হে অভ্রান্ত চুল

ওয়েন্ডি ডোনিগার হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে লিখতে পারবেন না কারণ তিনি বিধর্মী এবং বিদেশী। অড্রে ট্রাশকের গবেষণাও আমরা জানতে চাই না একই কারণে। সুতরাং শামিম আহমেদই বা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখেন কোন সাহসে? কি ভাগ্যি ম্যাক্স মুলার সাহেব এ যুগে জন্মাননি!

প্রায় দেড় দশক হল খবরের কাগজে কাজ করছি। নয় নয় করে গোটা পাঁচেক কাগজে কাজ করা হয়ে গেল। এই কাগজগুলোর কোন কোনটার আবার এক বা একাধিক যমজ কাগজ আছে অন্য ভাষার। এছাড়াও অনেক কাগজ আছে যেগুলো পড়ি কিন্তু কখনো কাজ করিনি। এতগুলো কাগজ মিলিয়ে আজ অব্দি একটি কাগজও পাইনি যাতে কখনো কোন ভুল বেরোয় না। সমস্ত ভুলই অনভিপ্রেত এবং পরিহার্য। তবুও অনিবার্য। তার কারণ খবরের কাগজে লেখে এবং সম্পাদনা করে মানুষ। সাংবাদিকরা মানুষ, তাঁরা ভুল করেন। আবার সম্মানীয় অতিথি লেখক লেখিকারাও অনেক সময় ভুল করেন কারণ তাঁরাও মানুষ। সাংবাদিকতায় শিক্ষানবিশির দিনগুলোতে যাঁর কাছে হাতে কলমে কাজ শিখেছি, ভুল করলে তিনি প্রবল বকাঝকা করতেন সঙ্গত কারণেই। তবে পরে একটা কথা বলতেন, সেটা খুব দামী কথা। “কাজ করলেই ভুল হবে। একমাত্র যে কোন কাজ করে না, তারই ভুল হয় না।”

এই কথাটা কখনো ভুলতে পারি না বলেই অনুজ সাংবাদিকরা বা সংবাদজগতের বাইরের কেউ কোন সংবাদমাধ্যমের প্রমাদ নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় বা তার বাইরে রগড় করতে চাইলে প্রশ্রয় দিই না। আমারও তো কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়। ক্রিকেট মাঠে যেমন বলা হয় “যে ক্যাচ ফেলেছে তাকে ধমকিও না। পরের ক্যাচটা তোমার হাত থেকে পড়তে পারে।”

গত রবিবার বহুল প্রচারিত একটা কাগজে প্রকাশিত শামিম আহমেদের একটা লেখা নিয়ে যারা বাজার গরম করে চলেছে তাদের কান্ড দেখে এই কথাগুলো বলতেই হল। তবে এটুকু বলে ছেড়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তার কারণ লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যা চলছে সেটা শুধু একটা লেখার একটা ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা নয়, লেখাটার উৎকর্ষ বা উৎকর্ষের অভাব নিয়ে মতপ্রকাশ নয়, লেখকের মেধা নিয়ে ব্যঙ্গ (লেখক সম্বন্ধে কিছু না জেনেই), তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি, তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সরাসরি বা ঠারেঠোরে বলা “ও আর কী জানবে”। শুধু তাই নয়, এও বলার চেষ্টা হয়েছে যে জন্মাষ্টমীর দিন এই লেখা আসলে হিন্দুদের পূজ্য শ্রীকৃষ্ণকে কালিমালিপ্ত করার প্রচেষ্টা।

এগুলোকে এক কথায় বলে অসভ্যতা। এক দল লোক দেখলাম লিখছে সংশ্লিষ্ট কাগজের উচিৎ ছিল কোন সংস্কৃত পন্ডিতকে দিয়ে লেখাটা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া। স্পষ্টতই এখানে scholar অর্থে পন্ডিত বলা হচ্ছে না। কারণ যে লিখেছে সে জানে না শামিমবাবু সংস্কৃত জানেন কি জানেন না। শুধু লেখকের নাম থেকেই সে ধরে নিয়েছে এমন হতেই পারে না যে লোকটি সংস্কৃত জানে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী একজন হিন্দুদের পুরাণ আর কী জানবে?

এই জাতীয় সর্বজ্ঞ সমালোচকদের জ্ঞাতার্থে বলা যাক যে শামিমবাবু ইতিমধ্যেই মহাভারত নিয়ে পাঁচটি বইয়ের রচয়িতা। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের দর্শন বিভাগের এই অধ্যাপকের অধীনে ছজন মহাভারত নিয়ে এম ফিল স্তরের গবেষণা করেছে, আরো চারজন পি এইচ ডি ডিগ্রির জন্য গবেষণারত। পুরনো খবরের কাগজ (বা ইন্টারনেট) ঘাঁটলে এও জানা যাবে যে রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে শামিমবাবু প্রথম ইসলাম ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক যিনি স্নাতক স্তরে বেদান্ত দর্শন পড়িয়েছেন। এই সবই তিনি করে ফেললেন এতগুলো বছরে, সংস্কৃত না জেনেই — এতটা ভাবার মূর্খামি আশা করি সমালোচকরা করবেন না।

আরেক ধরণের সমালোচক দেখলাম সোজাসুজি লিখেই দিয়েছেন যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জন্মাষ্টমির দিনে বা অন্যান্য হিন্দু উৎসবের দিনগুলোতে হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে কুৎসা রটানো হয় শস্তা পাবলিসিটি পাওয়ার জন্যে। শামিমবাবুর লেখাটা বারবার পড়েও অবশ্য কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কুৎসা কোন জায়গাটায় করা হয়েছে বুঝে উঠতে পারলাম না। আসলে দোষ বোধহয় ব্যাসদেবেরই। তিনি মহাকাব্য লিখেছেন মনপ্রাণ দিয়ে। তাঁর কাব্যের চরিত্রেরা ভগবান হলেও দোষেগুণে মেশামিশি। সেইজন্যেই কয়েক হাজার বছর পরেও কাব্যটা সজীব। ব্যাসদেব তো আর জানতেন না এখনকার বিরাট হিন্দুদের নীতিবোধ চীনের পাঁচিলের মত উঁচু হবে, যা শ্রীকৃষ্ণের পক্ষেও অলঙ্ঘ্য হবে, সে যতই তিনি মূককে বাচাল এবং পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করার শক্তি দিন না কেন।

লেখার যে যে তথ্য নিয়ে সমালোচকদের আপত্তি সেগুলো নিয়ে আর আমি বাক্য ব্যয় করব না। লেখকের নিজের বক্তব্যই নীচে দেওয়া রইল। যা দুঃখের তা হল লেখার চেয়েও লেখকের পরিচয় আমাদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে আজকাল। ওয়েন্ডি ডোনিগার হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে লিখতে পারবেন না কারণ তিনি বিধর্মী এবং বিদেশী। অড্রে ট্রাশকের গবেষণাও আমরা জানতে চাই না একই কারণে। সুতরাং শামিম আহমেদই বা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখেন কোন সাহসে? কি ভাগ্যি ম্যাক্স মুলার সাহেব এ যুগে জন্মাননি! আর মাইকেল মধুসূদন! তিনি তো এ যুগে নির্ঘাত গণপিটুনিতে মারা যেতেন। তাঁর জীবন নিয়ে উৎপল দত্তের মঞ্চসফল নাটক ছিল ‘দাঁড়াও পথিকবর’। তখন আমার জন্ম হয়নি। পরে ঐ নাটকের উপর ভিত্তি করে তৈরি ছায়াছবিতে দেখেছিলাম একটি দৃশ্যে সুদূর গ্রামদেশ থেকে এক বৈষ্ণব কলকাতায় এসেছে শুধু ব্রজাঙ্গনা কাব্যের রচয়িতাকে দেখবে বলে। সুট বুট পরা মাইকেলকে দেখে তো সে তাজ্জব। সে বলে “তুমি নিশ্চয়ই শাপভ্রষ্ট, বাবা। এ কাব্য যে লিখেছে সে আসলে পরম বৈষ্ণব।” ঐ বৈষ্ণব ভদ্রলোকের সহিষ্ণুতা আমরা হারিয়েছি। তাই এখন অভ্রান্ত চুলেদের রাজত্ব। সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “টিকি মুণ্ডে চড়ি উঠি কহে ডগা নাড়ি, হাত-পা প্রত্যেক কাজে ভুল করে ভারি। হাত-পা কহিল হাসি, হে অভ্রান্ত চুল, কাজ করি আমরা যে, তাই করি ভুল।“

অভ্রান্ত চুলেদের বলি, এককভাবে বা দলবদ্ধ ট্রোলিং করে শামিমবাবুকে চুপ করানো যাবে না। কারণ তিনি একা নন, আমরা তাঁর সঙ্গে আছি এবং যতদিন আছি ততদিন তাঁকে একা হতেও দেব না।

বিঃ দ্রঃ যা দিনকাল তাতে প্রশ্ন উঠবেই যে আমি শামিম আহমেদ সম্পর্কে এত জানছি কী করে বা তাঁর হয়ে ওকালতি করছি কেন? উত্তরটা সোজাসুজি দিয়ে রাখি। প্রথমত, কার কী নিয়ে লেখা উচিৎ তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার গণতন্ত্রে একমাত্র লেখকের নিজের। কোন ভুল সে অধিকার কেড়ে নেওয়ার সপক্ষে কোন যুক্তি নয়। সেই অধিকারের সপক্ষে দরকার হলে এক হাজার বার ওকালতি করব। দ্বিতীয়ত, শামিমবাবুর সাথে দু দশক আগে ক্লাসঘরে আমার আলাপ হয়। এতদিনে ক্লাসঘর ছাড়িয়ে আমাদের অসমবয়সী বন্ধুত্ব এতটাই অগ্রসর যে তিনি আমার পরিবারভুক্ত, আমি তাঁর পরিবারের লোক। আমার পরিবারের দিকে তেড়ে এলে আমি তো চুপ করে বসে থাকব না।

shamim1shamim2

ক্রেতার স্বাধীনতা

গুলিটা তো আসলে খালিদকে নয়, করা হয়েছে আমাদের স্বাধীনতাকে

“আবার সে এসেছে ফিরিয়া।” ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে সেল, ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে বোনানজা, টিভিতে ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে স্পেশাল, শপিং মলে আজাদি ডিসকাউন্ট, খাসির মাংস, পিকনিক, মদ আর ডেসিবেল নিরপেক্ষ বক্স সহযোগে ছুটি কাটানো — সব ফিরে এসেছে। কিন্তু নাজিব ঘরে ফেরে নাই, রোহিত ঘরে ফেরে নাই, পেহলু ঘরে ফেরে নাই, রাকবর ঘরে ফেরে নাই।
মেয়ে স্কুলের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। সেই সংক্রান্ত কিছু কেনাকাটা করতে গতকাল সন্ধ্যায় দোকানে গেছি। দোকানের দোরগোড়ায় দুই প্রবীণ আমাদের মফঃস্বলের এলায়িত সন্ধ্যার সদ্ব্যবহার করছিলেন খোশগল্প করে। যখন দোকানে গিয়ে বসলাম তখন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল তরুণ প্রজন্মের অধঃপতন। বোধহয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রবীণেরা এই আলোচনা করে আসছেন। আর বছর কুড়ি বাঁচলে হয়ত আমিও করব। তাই কথাগুলোয় কান দিইনি। দিতে হল, যখন শুনলাম একজন বলছেন “এদের সব্বোনাশ করে দিল সিনেমা। সে সিনেমা করে কারা? এই খানগুলো। শাহরুখ খান, সলমন খান, আমির খান। পাকিস্তানের লোক পাকিস্তানের কালচার এখানে চালিয়ে দিল। দিয়ে কোটি কোটি টাকা করে ফেলল।”
আমার কান খাড়া।
“আর এদের নিয়ে কী করবে তুমি? তাড়াতেও তো পারবে না। তাড়াতে গেলে আবার এই ছেলেমেয়েরাই সব আপত্তি করবে।”
এরপর চুপ করে থাকা অসম্ভব, অনুচিতও। অতএব লোকটার দিকে ঘুরে সোজা প্রশ্ন করলাম “আপনি কি শাহরুখ খানকে পাকিস্তানি বললেন?”
“হ্যাঁ বললাম। তো?”
“আপনি জানেন শাহরুখের ঠাকুর্দা কে?”
“না। বয়ে গেছে।”
“শাহরুখের ঠাকুর্দা নেতাজির সাথে আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। সেই লোক পাকিস্তানি? তাহলে হিন্দুস্তানি কে? আপনি?”
বলার পর, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, লোকটা একেবারে থম মেরে গেল। আরো মিনিট পাঁচেক ছিলাম দোকানে। দুজনের একজনও আর একটা শব্দ বার করেনি মুখ থেকে। বেশ আনন্দই হল। কিন্তু মাথাটা ঠান্ডা হওয়ার পর আর সে আনন্দ থাকল না। ভেবে দেখুন, শাহরুখ খানের ঠাকুর্দা যে আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন সেটা তো নেহাতই ঘটনাচক্র। এদেশের কোটি কোটি মুসলমানের পরিবারের কেউ ওরকম নাম করা লোক ছিলেন না। পরাধীন ভারতের কোটি কোটি হিন্দু পরিবারের মতই তাঁরা নিতান্ত সাধারণ মানুষ, হয়ত স্বাধীনতা আন্দোলনে কণিকামাত্র অবদান ছিল অথবা ছিল না। তা বলে তাঁরা আমার চেয়ে কম ভারতীয় বলে ধরে নিতে হবে? দিবারাত্র তাঁদের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হবে?
কই, আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেস করে না আমি দেশপ্রেমিক কিনা? আমার ভারতীয়ত্ব নিয়ে তো কেউ প্রশ্ন তোলে না। পরিচিত যারা জানে আমার ঠাকুর্দা ইংরেজ আমলে ইংরেজদের অধীনে চাকরি করতেন, তারাও জাতীয় পতাকার প্রতি আমার আনুগত্য নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলে না। এই যে আমি শাহরুখ খানের সমর্থনে তাঁর পিতামহের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তুলে ধরলাম, এতে কি আমি মুসলমানবিদ্বেষী ছদ্ম জাতীয়তাবাদকেই এক ধরণের বৈধতা দিলাম?
দোকানে বসা বৃদ্ধের হয়ত সাহস বা সামর্থ্য কোনটাই নেই নিজের দেগে দেওয়া দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কিছু করার, কিন্তু ঐ লোকটার মত একজনই তো গতকাল গুলি করতে গিয়েছিল ছাত্রনেতা উমর খালিদকে। গুলিটা তো আসলে খালিদকে নয়, করা হয়েছে আমাদের স্বাধীনতাকে। যে দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষ সহনাগরিকদের নাগরিকতার, দেশের প্রতি আনুগত্যের শংসাপত্র দিতে সদাব্যস্ত, সে দেশে আসলে তো স্বাধীনতা নেই। যতই স্কুলে স্কুলে সাতসকালে পতাকা তোলা হোক।
শুধু ক্রেতা হওয়ার স্বাধীনতা কোন স্বাধীনতাই নয়।

উদ্বাস্তু

যে হালার পো অসমে বাঙালিরা খ্যাদানি খাওয়ায় দুইহাত তুইল্যা নাচতাছে, হেয়া য্যান নিজের এদেশীয় হওয়ার প্রমাণটা খুঁইজ্যা রাখে। নইলে বাংলায় এন আর সি হইলে হালার অবস্থা ডনের অমিতাভ বচ্চনের মত হইব গিয়া

আমার ঠাকুর্দা শচীন্দ্র কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় দ্যাশ ভাগ হইবার আগে থিকাই, জীবিকার প্রয়োজনে, উদ্বাস্তু। রেল কোম্পানিতে কাজ। টিটির চাকরি, মানে আমরা ডেলি প্যাসেঞ্জাররা যাদের “মামা” কই। ঢাকা বিক্রমপুরে তেনার পৈতৃক বাড়ি আছিল। কিন্তু মানুষ হইছেন আবার মামাবাড়িতে। আমার বাবা প্রশান্ত সে দুই বাড়ির কোনটাই দ্যাখেন নাই। কেন না তেনার জন্ম দ্যাশ ভাগের পরের বছর। তিনি সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। তবে আমার জ্যাঠা, পিসিরাও কেউ তেনাদের পৈতৃক বাড়ি দ্যাখেন নাই।
আমার বাবারে নিয়া ঠাকুর্দা শচীন্দ্র আর ঠাকুমা সুবর্ণলতার নয়টি সন্তান হয়। একটি মেয়ে অবশ্য ছোটবেলাতেই মইর‍্যা গেছিল। বাকি আটজনের কেউ তেনাদের পৈতৃক বাড়ি দ্যাখেন নাই। তাঁরা সকলে এক জায়গায় জন্মানও নাই। রেল কোম্পানির ঠ্যালায় আমার ঠাকুর্দা যহন যেহানে আছিলেন এনারা সেইহানেই হইছেন। জন্ম থিকাই উদ্বাস্তু আর কি।
কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর তো আর রেল কোয়ার্টারে থাকতে দিব না। নিজের বাড়ি লাগব। কোথায় যাওন যায়? ঠাকুর্দা, ঠাকুমা জানতেন দ্যাশ থিকা আত্মীয়স্বজনেরা আইস্যা হুগলী জিলায় রেললাইনের বাঁদিকে এক জায়গায় বসত করছে। এখনো সেহানে সন্ধ্যাবেলা শিয়াল ডাকে। স্টেশন থিকাও বহুদূর। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে আত্মীয়স্বজনের আশেপাশে থাকাই ভাল। নইলে বিপদে আপদে দেখব কেডা?
তাই রিটায়ার কইর‍্যা যৎসামান্য যা টাকাপয়সা পাইছিলেন ঠাকুর্দা, তাই দিয়া নবগ্রামে আমাগো বাড়ি হইল।
সে বাড়ির জমি ঠাকুর্দায় কার থিকা কিনছিল, সে এদেশীয় নাকি হেয়াও পূর্ববঙ্গ থিকা আইছিল, সেসব জানে এমন কেউ বোধহয় বাইচ্যা নাই।
যে হালার পো অসমে বাঙালিরা খ্যাদানি খাওয়ায় দুইহাত তুইল্যা নাচতাছে, হেয়া য্যান নিজের এদেশীয় হওয়ার প্রমাণটা খুঁইজ্যা রাখে। নইলে বাংলায় এন আর সি হইলে হালার অবস্থা ডনের অমিতাভ বচ্চনের মত হইব গিয়া। ডিটেনশন ক্যাম্পের বাইরে পুলিশে কিলাইব, ভিতরে আমরা।

বিঃ দ্রঃ এই পোস্টের ভাষা নিয়া যার আপত্তি আছে তারে আমি কাঁচকলা দ্যাখাই। বাঙাল আছিলাম, বাঙাল আছি, শ্যাষ নিঃশ্বাস ফেলা অব্দি বাঙালই থাকুম। মাইর‍্যাই ফেলাও আর কাইট্যাই ফেলাও।

প্রকল্প এখন প্রকাশ্যে

যেন একটা আলাদা আইন থাকলে গরুগুলোর চেয়ে রাকবরের প্রাণের মূল্য ঝাড়খন্ড পুলিশের কাছে বেশি হত

রাজস্থানে শুনেছি জল খুব সুলভ নয়। তবু পাছে পুলিশের গাড়ি নোংরা হয়, মৃতপ্রায় রাকবরকে ধুয়ে মুছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। তবে বেদম পিটুনির পর ধুয়ে দিলেই রক্তপাত বন্ধ হয় না। তাই সম্ভবত তার পরেও গোটা রাস্তায় রাকবরের রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে। ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতাল — এই দীর্ঘ ছ কিলোমিটার পথে নিশ্চয়ই তার রক্তের রেখা এখনো মিলিয়ে যায়নি। রাজস্থানে তো জল সুলভ নয়।
তা রাকবর খানের রক্তের রেখা মিলিয়ে যেতে না যেতেই উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে সাহিল মার খেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গেলেন। রাকবর আর সাহিলের মধ্যে চট করে কোন মিল চোখে পড়ে না। প্রথমজনের পেশা পশুপালন, দ্বিতীয়জন একটা চাকরি করেন। প্রথমজন গাঁয়ের লোক, দ্বিতীয়জন মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের বাসিন্দা। প্রথমজন বিবাহিত এবং ইতিমধ্যেই বাবা হয়েছিলেন, দ্বিতীয়জন গিয়েছিলেন পছন্দের মানুষের সাথে ঘর বাঁধতে। দুজনের মধ্যে বস্তুত একটাই মিল — দুজনেই মুসলমান। কতটা ধর্মপ্রাণ ওঁরা তাও আমরা জানি না, কিন্তু যাদের কাছে আসল হল ধর্মীয় পরিচিতি তারা আদার ব্যাপারী। জাহাজের খোঁজ তারা নিতে চায় না। গত কয়েকবছরে ঘটে চলা গণপ্রহারে মৃত্যুর মিছিলে চোখ রাখলে ধর্মান্ধ বদমাইশ ছাড়া সকলেই দেখতে পাবেন যে এই সংগঠিত খুনগুলোর লক্ষ্য ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আর খুনগুলোর করছে ক্ষমতাসীন সঙ্ঘ পরিবার, যারা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
একথা এতদিন পর্যন্ত আমার মত দেশদ্রোহী মাকু, সেকুরাই কেবল বলছিল। এখন আর তা নয়। গণপ্রহারের শিকার হওয়া অতিপরিচিত হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী অগ্নিবেশ গত সপ্তাহে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে একটা সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলেছেন “It was a lynch mob, except it was not a faceless lynch mob but one that was sponsored and supported by the powers that be in the state and central governments. I am not the first one to be attacked, many more have been lynched to death. Akhlaq Khan was killed in Dadri, so was Pehlu Khan and Junaid, and not a single murderer has been apprehended.”
রাকবরের খুন যা নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তা হল হিন্দুত্ববাদী প্রশাসনের প্রকল্পই হল মুসলমান নাগরিকদের খুন করা। এরপর রেজিস্ট্রি করে হিন্দু প্রেমিকাকে বিয়ে করতে গিয়ে সাহিলের মার খাওয়া প্রমাণ করে মুসলমানদের মারা তাদের মারার জন্যেই। গোরক্ষা, লাভ জিহাদ ইত্যাদি হল নতুন নতুন অজুহাত। আগে তবু মন্ত্রী সান্ত্রীদের চোখের চামড়া বজায় রাখার দায় ছিল। এখন আর সেসব নেই। অভিযুক্তরা জামিনে ছাড়া পেলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড্যাং ড্যাং করে মাল্যদান করতেও চলে যাচ্ছেন।
রাজধানী দিল্লীতে বসে অবশ্য এখনো একটু কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করতে হচ্ছে। সংবিধানটা এখনো বদলানো হয়নি কিনা। তাই আমাদের বিশুদ্ধ হিন্দি বলা নিপাট ভালমানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন “প্রয়োজনে সরকার গণপিটুনির বিরুদ্ধে আইন করতে প্রস্তুত।” যেন নতুন একখানা আইন করে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে। যেন এখনকার আইনে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা আইনসম্মত। যেন অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না শুধু উপযুক্ত আইন নেই বলে। যেন একটা আলাদা আইন থাকলে গরুগুলোর চেয়ে রাকবরের প্রাণের মূল্য ঝাড়খন্ড পুলিশের কাছে বেশি হত। “ও মন্ত্রীমশাই, ষড়যন্ত্রীমশাই… যত চালাকি তোমার, জানতে নাইকো বাকি আর।”
ধর্মীয় পরিচয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকা যেসব লোকেরা এখনো বেড়ার উপর বসে পা দোলাচ্ছেন আর “নিরপেক্ষতা”, “ডায়লগ” — এইসব ন্যাকা শব্দ কপচাচ্ছেন তাঁরা স্বামী অগ্নিবেশের সাবধানবাণীটা একবার পড়ে নেবেন “What they call hardline Hindutva is the greatest threat to Hindu culture, or sanatan dharam… The hardline approach of causing harm to whoever disagrees is a kind of nascent fascism.”
অবশ্য সাবধান হবে কে? অনেক লেখাপড়া জানা লোকের মতে তো আবার ফ্যাসিবাদ খুব ভাল জিনিস, দেশের ওটাই দরকার, হিটলার দারুণ লোক ছিল ইত্যাদি।

অনধিকার প্রবেশ

যেন কলেজ বা ইউনিভার্সিটি হল বারোয়ারী দুর্গাপুজো। পাড়ার কাউন্সিলর সবচেয়ে বেশি টাকা চাঁদা দেয় বলে সে চাইলে মুম্বাইয়ের মিস টিনাকে দিয়ে নবমীর দিন নাচের ব্যবস্থা করতেই হবে। যতই পাড়ার লোকে মনে করুক এটা অশ্লীল

যাদবপুরে প্রবেশিকা পরীক্ষা হওয়া উচিৎ না অনুচিত এই নিয়ে মতপার্থক্য আছে বিভিন্ন মহলে এবং থাকারই কথা। সরকারপোষিত একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংজ্ঞানুযায়ী আমার, আপনার মত করদাতাদের যৌথ সম্পত্তি। ফলে তার কার্যকলাপ নিয়ে নিশ্চয়ই আমাদের সকলের মতামত থাকবে। এটা আমাদের অধিকার। কর্পোরেটচালিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাঁকজমক দেখে যতই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন, তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি, ভর্তির প্রক্রিয়া, পাঠক্রম নিয়ে চেঁচামেচি করার অধিকার আমার আপনার নেই, এটা মনে রাখবেন।
যাদবপুরের প্রতি আমাদের সে অধিকার আছে বলেই যাদবপুরকে তথা সরকারপোষিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বুক দিয়ে আগলানো আমাদের কর্তব্য। এবং আমাদের সকলের অধিকার রক্ষা করার জন্যেই সরকারের কথায় যাদবপুর উঠবে বসবে, এমনটা হতে দেওয়া উচিৎ না।
সরকার মানেই নাগরিক নয়। সরকারের মতামত গণতন্ত্রের সবচেয়ে উন্নত অবস্থাতেও সব নাগরিকের মতামতের প্রমাণ নয়, বড়জোর সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের মতামতের প্রমাণ। সমস্ত ইস্যুতে তাও নয়। এমতাবস্থায় ঘরে বাইরে, কাগজে, চ্যানেলে, ফেসবুকে, হোয়াটস্যাপে বিতর্ক চলতে থাকুক কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কোন পথে চলবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধুমাত্র তার শিক্ষক শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীদের হাতেই থাকতে হবে।
কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী রাজ্য সরকার পোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে বলেছিলেন “সরকার টাকা দিচ্ছে আর সরকারের কথা মানবে না?” যেন কলেজ বা ইউনিভার্সিটি হল বারোয়ারী দুর্গাপুজো। পাড়ার কাউন্সিলর সবচেয়ে বেশি টাকা চাঁদা দেয় বলে সে চাইলে মুম্বাইয়ের মিস টিনাকে দিয়ে নবমীর দিন নাচের ব্যবস্থা করতেই হবে। যতই পাড়ার লোকে মনে করুক এটা অশ্লীল।
এভাবে তো লেখাপড়া হয় না।
উপরন্তু আজকের সরকার একরকম সিলেবাস ঠিক করবে, কাল অন্য সরকার এসে বলবে “এসব বাজে জিনিস পড়ানো হচ্ছে। কাল থেকে অন্য জিনিস পড়ানো হবে।“ আজকের সরকার বলছে “প্রবেশিকা পরীক্ষা তুলে দিতে হবে।“ কালকের সরকার বলবে “প্রবেশিকা পরীক্ষা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় চলে নাকি?” সরকার বদলের সাথে সাথে যদি লেখাপড়ার ধারা বদলায় তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি থিসিসগুলো যে টোকা নয় সে কথা কে-ই বা বিশ্বাস করবে?
অনেক বড় বড় মাথা দেখতে পাচ্ছি প্রবেশিকা পরীক্ষা কেন ভাল নয় তার পক্ষে অনেক যুক্তি দিচ্ছেন। আমার নিজেরও দু একটা যুক্তি আছে কিন্তু সে বিতর্কে যাবই না। যেতাম যদি বুঝতাম রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের পেছনে আছে যাদবপুরের শ্রীবৃদ্ধি। কিন্তু সরকারের যে ভাবের ঘরে দিনে ডাকাতি। যে সরকারের আমলে সারা রাজ্যে কলেজের আসন কেনাবেচা হয়, সেই সরকারের যাদবপুরের উন্নতির চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছে না একথা নিঃস্বার্থ কেউ কেন বিশ্বাস করবে? যাদবপুরের অনেক ছাত্রছাত্রী দেখছি প্রশ্ন তুলছেন যে সেন্ট জেভিয়ার্স বা রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরও তো প্রবেশিকা পরীক্ষা নেয়, তাদেরকে সরকার জোর করছে না কেন? শুধু যাদবপুরের উন্নতিই কি সরকারের লক্ষ্য?
খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। উত্তর একাধিক, তবে খুব সোজা। সেন্ট জেভিয়ার্সের ইউনিয়ন অরাজনৈতিক, সেখানে টি এম সি পির ঢোকার জায়গা নেই। আর বিদ্যামন্দিরের ছাত্র সংসদ বাতাসের মত। সবাই জানে আছে কিন্তু চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। অতএব সেখানেও টি এম সি পি কে ঢোকানো যাবে না। বিদ্যামন্দিরের উপরি সুবিধা এই যে তাদের চোখ রাঙালে, মুখ্যমন্ত্রী জানেন, বিজেপি “হিন্দু খতরে মে হ্যায়” বলে তেড়ে আসবে।
যাদবপুরের প্রতি এই অহৈতুকী কৃপার অনেক কারণের একটা, স্পষ্টতই, তাদের তোলাবাজির এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারার ব্যর্থতা। আরো একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করুন। এমন দুটো ঘটনা যুগপৎ ঘটছে — কলেজ ভর্তি নিয়ে প্রকাশ্য দুর্নীতি আর যাদবপুরে অচলাবস্থা — যার প্রভাব রিকশাচালকের পরিবার থেকে উচ্চপদস্থ সরকারী আমলার পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত, অথচ সাম্প্রতিক ভোটগুলোর ফলাফল অনুযায়ী রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি স্পিকটি নট। আসলে ক্ষমতাসীন দলের মত তারাও চায় এ রাজ্যের লেখাপড়া গোল্লায় যাক৷ বিশেষ করে যাদবপুর গোল্লায় গেলে তো নাগপুরে মিষ্টান্ন বিতরণ হবে। মুক্ত চিন্তা এবং বামপন্থী চিন্তার আখড়াগুলো সঙ্ঘ পরিবারের কাছে পরের ছেলে পরমানন্দ। যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষককুলের মধ্যে বিভিন্ন তীব্রতার লাল রঙের পোঁচ মমতাদেবী এবং মোদীবাবুর মধ্যে সমান বিবমিষার উদ্রেক করে। ২০০৮-০৯ থেকে শুরু করে বামফ্রন্টকে পছন্দ নয় বলে যে বামপন্থীরা মমতাকেই প্রকৃত বামপন্থী বলে নন্দিত করেছেন, এখনো করেন, তাঁরা এবার ভুলটা বুঝলে ভাল হয়।
এই অসহনীয় অবস্থাতেও, যে কোন আন্দোলন শুরু হলেই যা হয়, আন্দোলনের ধরণ নিয়ে সমালোচনা করতে কেউ ছাড়ছে না। লেখাপড়ার বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে সরকার, তবু যাদবপুরের সুবোধ বালক বালিকাদের উচিৎ ছিল ধর্নায় না বসে, অনশন না করে বই মুখে বসে থাকা — এই কথা অনেকেই বলছেন এবং লিখছেন। যেন ছেলেমেয়েরা রুখে না দাঁড়ালে তাঁরাই ব্যাপারটা নিয়ে সরকারের সাথে কথা বলে বিহিত করতেন। যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে, সেখানকার ছেলেমেয়েরা প্রতিবাদ করছে কেন তাই নিয়ে প্রাজ্ঞদের অপার বিস্ময় এবং বিপুল ক্রোধ।
আমার পরিচিত যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের এক প্রাক্তন ছাত্র দুঃখ করে বলল তুলনামূলক সাহিত্যের একজন নাকি অনশন করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাতে নাকি অনেকে বলছে ঐ বিভাগটাই ফালতু। ওটা তুলে দেওয়াই উচিৎ কারণ ওটা পড়ে কেউ চাকরি পায় না। ছেলেটি ভেবেছিল আমার সহানুভূতি পাবে কিন্তু আমি তাকে বললাম শুধু তুলনামূলক নয়, সবরকম সাহিত্য পড়ানোই বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ। তাতে আমার মত সাংবাদিকদের মস্ত সুবিধা। আমরা রোজ যে ছাইভস্ম লিখি সেগুলোকে ছাইভস্ম বলে চেনার মত আর কেউ থাকবে না। শুধু সাহিত্যও নয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগও তুলে দেওয়া উচিৎ। কারণ এদেশে বহু ইঞ্জিনিয়ার বেকার বসে আছে। যত ইঞ্জিনিয়ার আছে তত চাকরি নেই। ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না।
আমার কথা শুনে ছেলেটির মুখের যা চেহারা হল তাতে আমার এত অপরাধবোধ হল যে ভাবলাম ওকে সন্দেশ বিস্কুট খাওয়াই। খাওয়াতে খাওয়াতে বললাম যে কাল একটা না তৈরি হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেশের সরকার আই আই টি, আই আই এস সি র সমান মর্যাদা দিয়েছে। যাদবপুরের কী হবে?
বেচারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে আমাদের স্কুলের জহরবাবুর জ্যামিতি ক্লাস নেওয়ার ঢঙে বললাম “আসলে একটা সাদা কাগজের উপর কয়েকটা বিন্দু একে অপরের থেকে অনেক দূরে দূরে বসে আছে। কিন্তু এগুলোকে জুড়লে দেখবি আসলে এগুলো একটা চতুর্ভুজের চারটে শীর্ষবিন্দু। একটা হল শিক্ষা ব্যবসায় জাঁকিয়ে বসতে চাওয়া কর্পোরেট, একটা সেই কর্পোরেটের দাসানুদাস ফ্যাসিবাদী সরকার, আরেকটা উচ্চশিক্ষা পুরোপুরি বেসরকারী হাতে চলে গেলেই সর্বোচ্চ যোগ্যতা না থাকলেও পড়িয়ে বা বই লিখে দু পয়সা কামিয়ে নেবে বলে ওঁত পেতে থাকা বুদ্ধিজীবী এবং চতুর্থটা হল এক শ্রেণীর ভদ্রলোক, যারা বরাবর চেয়েছে শুধু তাদের ছেলেমেয়েরাই লেখাপড়া শিখুক। চাষাভুষোর পড়াশোনা শিখে কী হবে?”

সকলের রক্ত

সব হি কা খুন হ্যায় শামিল ইয়াহাঁ কি মিট্টি মে
কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়।।
— রাহাত ইন্দোরি

হা হা হা। আবার একটা লোককে মেরে ফেলেছে রে।
সে লোকটা কেবল গরু তাড়াচ্ছিল। হো হো হো।
কি হাসি পাচ্ছে রে ভাই! হি হি হি।
আবার দেখলাম মারতে মারতে যখন নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ তাদের এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল। হে হে হে।
এ তো পুরো হিন্দি সিনেমা রে ভাই। যারা মারছিল তারা পুরো অক্ষয় কুমার মাইরি। গুরু গুরু।
লোকটাকে রাস্তা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে যা স্টাইলে নিয়ে গেল না! দেখে আমার দিদি তো পুরো ফিদা। বলল এবার থেকে সল্লু না, এই অফিসারটার জন্মদিনেই বন্ধুদের খাওয়াব।
আবার লোকটা থেকে থেকে জল চাইছিল। হা হা হা।
কি গাধা মাইরি! ভেবেছে ওকে খতম করার আগে আবার জল খেতে দেবে!
এত নির্বোধও এদেশে ছিল! মরার সময়ও ভেবেছে লোকগুলোর মায়া দয়া আছে! আব্দারটা ভাব!
কী রে, ভাই? কাঁদছিস কেন? আরে ধুর! আমরা এই নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেই পারি। আমাদের কোন ভয় নেই। আমরা কি কাসিমের জাত নাকি? আমাদের গায়ে কে হাত দেবে?
কী বললি? ও, তাই বল। আর্জেন্টিনা হেরে গেছে বলে দুঃখ হচ্ছে। সত্যি রে ভাই, আমারও বড্ড কান্না পাচ্ছে। আয় গলা জড়িয়ে দু ভায়ে কাঁদি। ভেউ ভেউ ভেউ ভেউ…

আতঙ্ক

এ রাজ্যে এখন স্কুল কলেজের শিক্ষক, অধ্যাপকরা ভীষণ বিপজ্জনক

আমাদের পাড়ায় একজন আছে যে বহু বছর আগে ইডেন গার্ডেন্সে একটা মোহনবাগান – ইস্টবেঙ্গল খেলা দেখতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়েছিল। সেদিন ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল, আমার এই পাড়াতুতো কাকু জোর বেঁচে যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন সোজা হয়ে হাঁটতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এই সেদিনও বসে থাকতে থাকতে অকারণেই হঠাৎ চমকে উঠত — ট্রমা এমনই প্রবল। এত দীর্ঘ না হলেও, একটা স্বল্পমেয়াদী ট্রমা আমারও হয়ে যাচ্ছে বোধহয় — কিছু ছবি, কিছু শব্দ এমনভাবে গেঁথে যাচ্ছে মনে।
সর্বশেষ যে ছবিটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল সেটা হচ্ছে আজ সকালের কাগজে দেখা শ্রীরামপুর কলেজের এক অধ্যাপিকার ছবি। আতঙ্কে এভাবে কাঁদতে কোন দিদিমণিকে কখনো দেখিনি। মুহূর্তে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়কার দিদিমণিদের মুখগুলো ভিড় করতে শুরু করল। খবরে প্রকাশ “আন্দোলনকারী” ছাত্ররা দিদিমণিদের বাথরুমের দরজাও ভেঙে দিয়েছে। প্রাক্তন নয়, বর্তমানদের কীর্তি এটা। এর আগে অন্যত্র এক দিদিমণিকে জগ ছুঁড়ে মারার ঘটনাও সর্বজনবিদিত। কিন্তু সেখানে সান্ত্বনা ছিল এটুকু যে কান্ডটা ঘটিয়েছে এক নেতা, দিদিমণির কোন ছাত্র বা ছাত্রী নয়। এবারে আর সেকথা ভেবে নিজেকে শান্ত করা যাচ্ছে না। নির্ভয়াকান্ডের পর যখন সেই ধর্ষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ আমাদের সামনে আসছিল, তখন যেমন মধ্যে মধ্যে নিজেকেই ধর্ষক মনে হত, তেমনি আজ কেন যেন মনে হল আমিই আমার ছোটবেলার স্নেহময়ী দিদিমণিদের বাথরুমের দরজা ভেঙে দিয়েছি। শিউরে উঠলাম। কি ভয়ঙ্কর ছাত্রকুল তৈরি করেছি আমরা! অন্যায় দাবী আদায়ের জন্যে মাতৃসমা দিদিমণিদেরও চূড়ান্ত লাঞ্ছনা করতে বুক কাঁপে না এদের। শুনছি আজকাল নাকি মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের ভাগে খুন, ধর্ষণের হুমকিও বাদ যায় না।
পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র আন্দোলন, এমনকি উগ্র, হিংসাশ্রয়ী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। নকশাল আন্দোলনের সময়ে (যা ছাত্রদের নেতৃত্ব সত্ত্বেও ছাত্র আন্দোলনের পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না) হিট লিস্টে মাস্টারমশাইদের নাম উঠে যাওয়া, হত্যা — এসবের কথা শুনেছি। কিন্তু তখনো দিদিমণিদের উপর এ হেন আক্রমণ হয়েছে বলে জানি না। তাছাড়া অধ্যাপকদের কারো কারো বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা সত্ত্বেও সেইসব ছাত্ররা যখন পুলিশ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছে বা পঙ্গু হয়ে গেছে — মাস্টারমশাইদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। যার সবচেয়ে জ্বলজ্বলে প্রমাণ সম্ভবত খুন হওয়া ছাত্রের স্মৃতিতে অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত কবিতা

ময়দান ভারি হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির, তিমির।

কয়েকবছর আগে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হল হোক কলরব আন্দোলনে তখন আলোচিত হয়েছিল একদা উপাচার্য ত্রিগুণা সেনের কথা, যিনি নিজে কংগ্রেসি ছিলেন। কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় একবার তাঁকে ফোন করে বলেন “তোমার ক্যাম্পাসে দুটো কমিউনিস্ট লুকিয়ে আছে। পুলিশ যাচ্ছে, ওদের তুমি বের করে দাও।” উত্তরে উপাচার্য বলেন “আমি বেঁচে থাকতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পুলিশ আমার ছেলেদের গায়ে হাত দিতে পারবে না।” হোক কলরব আন্দোলনেও তো যাদবপুরের মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা ছাত্রছাত্রীদের সাথেই ছিলেন। ফলে বোঝা যায় যে যা ছাত্র আন্দোলন তা শিক্ষকবিরোধী হয় না। শিক্ষকবিরোধী হয় গুন্ডামি, যা কোন ইতিহাসের তোয়াক্কা করে না।
এ রাজ্যে এখন স্কুল কলেজের শিক্ষক, অধ্যাপকরা ভীষণ বিপজ্জনক। তাঁরা উন্নয়নবিরোধী, তাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা প্রচুর ছুটি পান (ঠিক সময়ে ইনক্রিমেন্ট, ডি এ ইত্যাদি যে পান না সেটা বলাও উন্নয়নবিরোধী), সবচেয়ে বড় কথা তাঁরা প্রতিবাদ করেন। অতএব এই বিপজ্জনক মানুষগুলোর হাত থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে গেলে যা যা করার সে তো করতেই হবে। খুন, জখম, মারধোর, শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনা যতটা সম্ভব। অতএব একদিকে তাঁরা খুন হচ্ছেন, খুনের সঠিক তদন্ত দাবী করে হাজতবাস করছেন। অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীদের হাতে মার খাচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন।
এই যে অবস্থার অবনতি এর জন্যে অনেকেই আবার শিক্ষককুলকেই দাবী করে থাকেন। শিক্ষকদের রাজনীতিই পশ্চিমবঙ্গের পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে এই কথাটা দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। সেই কারণে কিছু অভিজ্ঞতার কথা এই বেলা বলে ফেলি। আর কিছুদিন পরে এসব বললে হয় লোকে বলবে বানিয়ে বলছি, নয় মারতে আসবে।
আমি যে স্কুলে পড়েছি ক্লাস ফাইভ থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত, সেই স্কুল সেইসময় হুগলী জেলার অন্যতম সেরা স্কুল থেকে রাজ্যের অন্যতম সেরা হয়ে উঠছে। আগ্রহী যে কেউ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের থেকে মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ফলাফল যাচাই করে নিতে পারেন। শুধু পরীক্ষার রেজাল্টের দিক থেকেই নয়, আরো নানা দিক থেকেই আমাদের স্কুল ছিল ব্যতিক্রমী। সে নাহয় কোন সুসময়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে লেখা যাবে। এখন এর কৃতিত্ব কার? অবশ্যই একজনের নয়। কিন্তু আমাদের মাস্টারমশাইরা বলতেন “সুধীরবাবু না থাকলে স্কুল এই জায়গায় আসত না।”
সুধীরবাবু অর্থাৎ আমাদের হেডস্যার সুধীরকুমার মুখোপাধ্যায়। ভদ্রলোক ঘোর সিপিএম। আমি যখন ঐ স্কুলের ছাত্র তখন উনি নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি (ABTA) র জেলা সম্পাদক। সুধীরবাবুর সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছি আমার প্রিয় ইংরিজির মাস্টারমশাই সোমনাথবাবুর মুখে। স্যার একদিন বলেছিলেন “সুধীরবাবুর আগে কমিটি মেম্বাররা মিটিঙে চলে আসত লুঙ্গি পরে। উনি জলদগম্ভীর স্বরে বলেন ‘বাড়ি থেকে প্যান্ট পরে আসুন। সুধীরবাবুকে ছাড়া এমন হতেই পারত না।’” সোমনাথবাবু কোন শিক্ষক সংগঠনের সদস্য ছিলেন জানি না কিন্তু ঘোর গান্ধীবাদী লোক। বারবার বলেছেন “ঘরে দুটো লোকের ছবি রাখবি, আর কাউকে লাগবে না জীবনে — মহাত্মা গান্ধী আর রবীন্দ্রনাথ।”
আমাদের স্কুলের এসিস্ট্যান্ট হেডস্যার তখন পূর্ণবাবু। তিনি ইতিহাসের শিক্ষক, মার্কসবাদীদের ঘোর অপছন্দ করেন। একবার আমায় বলেছিলেন “সুধীরবাবুর সাথে আমার খুব তর্ক হয়। আমি বলেছি, আপনারা তো মুড়ি মিছরি এক দর করে দিতে চান।”
মার্কসবাদী সুধীরবাবু, গান্ধীবাদী সোমনাথবাবু আর দক্ষিণপন্থী পূর্ণবাবুর কখনো মতপার্থক্য হয়নি এমনটা নিশ্চয়ই নয়, কারণ সেটা অসম্ভব। কিন্তু তা বলে আমাদের স্কুলের উন্নতি থেমে থাকেনি, তরতরিয়ে এগিয়েছে। কেউ উলটো উদাহরণ দিতেই পারেন কিন্তু দুরকম উদাহরণেরই উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে সমস্যাটা শিক্ষকদের রাজনীতি করা নয়, খারাপ রাজনীতি করা। অবশ্য যারা অত্যাচারিত হচ্ছে তাদের রাজনীতিকেই দায়ী করা নেহাত গা জোয়ারি। সেখানে এতসব যুক্তি দিয়ে লাভই বা কী?
তপন সিংহের ছবিতে এক নিরীহ শিক্ষক রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত, সমাজবিরোধী হয়ে যাওয়া প্রাক্তন ছাত্রকে খুন করতে দেখে ফেলেন। ছাপোষা, যুবতী মেয়ের বাবা মাস্টারমশাইকে মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে মেনে নিতে হয় “আপনি কিন্তু কিছুই দ্যাখেননি, মাস্টারমশাই।” আমাদের মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের এবং আমাদেরও — এখন সেই অবস্থা। মানে মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে বেঁচে আছি। ছবিতে শিক্ষকের কন্যার মত আমাদের কতজনের যে মুখ পুড়বে আগামীদিনে কে জানে! তবে সেই মাস্টারমশাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বার্ধক্যের লাঠিটাকে স্কুলজীবনের মত আবার শাস্তি দেওয়ার লাঠি করে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন ভয় দেখাতে আসা মস্তানকে।
মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের হাতে মার যারা খেয়েছে তারাই জানে সে মারের জোর কত। হয়ত এখনো পিঠ পাতার সময় হয়নি।

ভো ভো ভদ্রসন্তান

কী হয় পঞ্চায়েত দিয়ে? যে ভদ্রসন্তান পেটে বোম মারলেও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের তিনটে স্তর কী কী বলতে পারবে না, সেও জানে পঞ্চায়েতের কোন কাজ নেই। বামফ্রন্ট সরকার এইটে বানিয়েছিল কেবল টাকা মারার জন্যে। কী দরকার এমন ভোটের? তুলে দিলেই হয়। এই যে ক্যানিং লোকালে ভদ্রসন্তানদের বাড়ি রান্না করতে আসা, বাসন মাজতে আসা ছোটলোকগুলো তিন চারদিন কামাই দেয় পঞ্চায়েতে ভোট দেবে বলে —- এর দরকারটা কী রে ভাই? এইসব ছোটলোক গণতন্ত্রের বোঝেটা কী? পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তো করার মধ্যে করেছে এই যে এদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে। ছোটলোকেরা অনেকে গ্রামের ভদ্রসন্তানদের টপকে প্রধান টধান হয়েছে। তা এ কি আর ভাল ব্যবস্থা রে বাপু?

শেষপর্যন্ত এক মাস্টারমশাইকে মরতে হল ভদ্রসন্তানদের “এসব আগেও হয়েছে” র এলায়িত ঔদাসীন্য থেকে জাগানোর জন্যে। হতভাগ্য প্রিসাইডিং অফিসার রাজকুমার রায় মরিয়া প্রমাণ করিলেন ভদ্রসন্তানগণের চেতনা মরে নাই। তাঁহারা আজিও নির্বাচনী হিংসার জন্যে সরকারকে দায়ী করিয়া গালাগাল করিতে সক্ষম।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়কার হিংসাটা নেহাত বিসদৃশ লাগায় একটু “উঃ আঃ” করতেই হচ্ছিল। তবু “এরা আসলে সিপিএমের মত সংগঠিত না তো, তাই একটু বেশি উগ্র” এসব বলে চালানো হচ্ছিল। মনোনয়ন জমা দেওয়া মিটে যেতেই ভদ্রসন্তানদের ভারী নিশ্চিন্দিভাব এসেছিল। কাগজে বেরিয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত বেশি আসন শাসক দল কখনো জেতেনি তাই খানিকটা নিন্দেমন্দ না করে উপায় ছিল না। শিক্ষিত লোক হিসাবে সমাজে একটা পরিচিতি আছে তো। এরপর তো নির্বাচন আর নির্বাচনে তো মারামারি, বোমাবাজি, খুন হয়েছে অনেক। অতএব ওতে সরকারের দোষ হয় না। নিন্দে করার দায়িত্বও নেই ভদ্রজনের।
তার চেয়ে বড় কথা যে মরল সে তো হয় এ পার্টির লোক, নয় ও পার্টির লোক। তারা তো আর কারো মা, বাপ, ভাই, বোন, ছেলেপুলে নয়। পার্টি তো করে অশিক্ষিতরা, যাদের শিক্ষিতদের মত স্বার্থপর হয়ে বাঁচার সুযোগ নেই। অতএব তারা মরলে ভদ্রসন্তানের কী-ই বা এসে যায়? ও তাপসী মালিকই বলুন আর দেবু দাস, ঊষা দাসই বলুন, ভদ্রসন্তান হলে কি আর রাজনীতির মধ্যে যেত? চেতন ভগতের কথামত নিজের কেরিয়ার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে জমাটি একখান চাকরি জুটিয়ে সক্কলের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত। অতএব পরিবর্তনের সরকার ভাল সরকার। যতই লোক মারুক আর গণতন্ত্রের মা-মাসি করুক, ভি আই পি রোডটা কংক্রিটে আর রেলিঙে মুড়ে দিয়েছে, এত আলো লাগিয়েছে যে ছেলেমেয়েরা চুমু খাওয়ার আড়াল পাচ্ছে না, স্কুলমাস্টারগুলো কোন কাজ করত না, তাদের ঘাড়ে কন্যাশ্রী থেকে দিদিশ্রী সব চাপিয়ে দিয়ে খুব টাইট দিয়েছে। আর কী চাই? একেই তো বলে উন্নয়ন। কেন হিংসার প্রতিবাদ করতে যাবে ভদ্রসন্তান? এত উন্নয়নের বদলে নাহয় এক ভাই এক কবিকে দিলই দুটো গাল। কবিকে কে বলেছিল পার্টির লোকের মত কবিতা লিখতে? তিনি যদি ভদ্রসন্তানোচিত কাজ কোনগুলো সেটা ভুলে মেরে দেন, সেটা বুড়ো বয়সের ভীমরতি। তার জন্যে সরকারকে কেন গাল দেবে? সর্বেসর্বা মুখ্যমন্ত্রীকেই বা কেন দোষ দেবে?
তবু নয় ভেবে দেখা যেত যদি ভোটটা লোকসভা কি বিধানসভার হত। কিসের ভোট? না পঞ্চায়েতের। কী হয় পঞ্চায়েত দিয়ে? যে ভদ্রসন্তান পেটে বোম মারলেও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের তিনটে স্তর কী কী বলতে পারবে না, সেও জানে পঞ্চায়েতের কোন কাজ নেই। বামফ্রন্ট সরকার এইটে বানিয়েছিল কেবল টাকা মারার জন্যে। কী দরকার এমন ভোটের? তুলে দিলেই হয়। এই যে ক্যানিং লোকালে ভদ্রসন্তানদের বাড়ি রান্না করতে আসা, বাসন মাজতে আসা ছোটলোকগুলো তিন চারদিন কামাই দেয় পঞ্চায়েতে ভোট দেবে বলে —- এর দরকারটা কী রে ভাই? এইসব ছোটলোক গণতন্ত্রের বোঝেটা কী? পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তো করার মধ্যে করেছে এই যে এদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে। ছোটলোকেরা অনেকে গ্রামের ভদ্রসন্তানদের টপকে প্রধান টধান হয়েছে। তা এ কি আর ভাল ব্যবস্থা রে বাপু? যেমন করেছিল পেছন পাকা কমিউনিস্টের দল, এখন ফল ভুগছে।
এ নিয়ে শহর, মফঃস্বল, গ্রাম সব জায়গার ভদ্রসন্তানেরাই একমত ছিলেন দুদিন আগে অব্দি। গোলমাল পাকালেন তাদেরই একজন। প্রিসাইডিং অফিসার হয়েছেন ভাল কথা, “আগেও হয়েছে” মন্ত্র জপে বুথে গিয়ে চোখকান বুঁজে থাকলেই চুকে যেত। কিন্তু এই চরম নীতিহীনতার যুগেও থাকে কিছু কিছু নীতিবাগীশ বোকার হদ্দ। এরা ভাবে ছাত্রদের সামনে অনুকরণীয় চরিত্র হয়ে ওঠাটা শিক্ষকের কাজের মধ্যে পড়ে। এই ভদ্রলোক সম্ভবত ঐ দলে। এই ধরণের লোকের সমস্যা হচ্ছে মেরুদণ্ড বলে জিনিসটা এখনো নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়নি আমাদের মত। ফলে সাহসটা অসম্ভব বেশি। লাঠিসোটা, টাঙ্গি, বন্দুক — যা-ই দেখাও না কেন, এদের ভয় পাওয়ানো মুশকিল। তা শক্ত মেরুদণ্ড তো অধুনা একটি রোগবিশেষ। সে রোগে শেষ অব্দি যা হয় তাই হয়েছে আর কি। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটি চমকপ্রদ। দৃশ্যত মার খেলেন এস ডি ও, তবে আসলে চড়চাপড়গুলো কার উদ্দেশে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এবং প্রত্যেকটি চড় তিনি অর্জন করেছেন।
মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যু অনেক ছাত্রকে জাগিয়ে তুলেছে দেখে ভাল লাগছে। এই দারুণ দুঃসময়ে আমরা এতই দ্বিধাবিভক্ত যে ডাক্তার মার খেলে শুধু ডাক্তাররা প্রতিবাদ করেন, রাজনৈতিক কর্মী মার খেলে শুধু তার দলের লোকেরাই প্রতিবাদ করে, শিক্ষক মার খেলে শুধু শিক্ষক সমিতি প্রতিবাদ করে, ছাত্ররা মার খেলেও সেটা শুধু তাদের সমস্যা, সাংবাদিক মার খেলে… যাকগে। কথা হচ্ছে এই ব্যাপারটা শাসকও বুঝে ফেলেছে। ফলে প্রতিবাদীদের গায়ে একটা লেবেল সেঁটে দেয়। জানে ঐটে করে দিলেই তারা আর কারো থেকে কোন সহানুভূতি, সমর্থন পাবে না। এবারে যেমন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সরকার লেবেল দিয়েছে “ওরা তো ভোটকর্মী নয়, শিক্ষকও নয়। ওরা এবিটিএ।” কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেমন বলে আর কি “ওরা তো ছাত্র নয়, ওরা বামপন্থী ছাত্র”, “ওরা তো কৃষক নয়, ওরা সিপিএমের কৃষক” বা এদের সব্বাইকে একেবারে থার্ড ব্র‍্যাকেটে পুরে “ওরা এন্টি ন্যাশনাল।” অস্যার্থ কেবল এটা নয় যে ঐ লেবেলের লোকেদের প্রতিবাদের অধিকার নেই। লেবেলটা আসলে চোখ মটকে বাকিদের বলা “এদের সাথে যোগ দিও না।” আমরা ভদ্রসন্তানেরাও এমন সুবোধ বালক যে সরকারী মতটা বুলির মত আউড়ে শুধু নিজে চেপে যাই তা নয়, অন্যকেও বোঝাই।
ভদ্রসন্তানদেরই আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি কিনা, তাই তেনারা যা মনে করেন সেই মতটাই প্রধান হয়ে ওঠে। ফলে জঘন্যতম কান্ডগুলো করেও সরকারগুলো দিব্য “আগেও হয়েছে” বলে চালিয়ে যাচ্ছে।
— নির্বাচনের জন্যে খুন? আগেও হয়েছে।
— ধর্ষণ? আগেও হয়েছে।
— ঘোড়া কেনাবেচা? আগেও হয়েছে।
— বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পুলিশের অত্যাচার? আগেও হয়েছে।
মোদীর আছে “কংগ্রেস কে সত্তর সাল” আর দিদির “বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছর”। যদ্দিন উনি আরো সত্তর বছর আর ইনি আরো চৌত্রিশ বছর শাসন না করছেন তদ্দিন চুপটি করে থাকতে হবে। ভদ্রসন্তানরা অবিশ্যি চুপ করে থাকতে ভারী ভালবাসেন। জেগে উঠে একেকজন যা সব সমাধান দিচ্ছেন তাতে মনে হয় এর চেয়ে ঘুমোলেই বুঝি ভাল ছিল। সেদিন ভোট দেব বলে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি (সকাল সকাল গেছিলাম বলে দিতে পেরেছি, ভাইসব। আমায় মেডেল দিও), কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর সাথে আমার পেছনের ভদ্রসন্তান দেশ, জাতি, পরিস্থিতি নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা শুরু করলেন এবং দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত করলেন “ভোট অনলাইন করে দেয়া উচিৎ।” আদ্ধেক লোক কী দিয়ে ভাত খাবে তার ঠিক নেই, উনি অনলাইনে ভোট করাচ্ছেন। এবং এতদ্দ্বারা শাসক দলের বদমাইশিকে বেমালুম অস্বীকার করছেন। আসলে সেই যে আগন্তুক ছবিতে ছিল — কূপমণ্ডূক। আজকাল ভদ্রসন্তানেরা স্মার্টফোনমণ্ডূক। নিজের প্রতি ছাড়া আর কারো প্রতি কোন দায়দায়িত্ব নেই। রাজকুমার রায়ের মৃত্যুটা বড় চমকে দিয়েছে, বড় কাছের লোক মনে হচ্ছে। তাই দুদিন একটু রাগারাগি করবেন আর কি। তারপর আবার মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগাবেন। তার উপরে লেখা থাকবে “আগেও হয়েছে”, এবং যেদিন সরকার দয়া করে ভোট দেয়ার সুযোগ দেবে সেদিন সুড়সুড় করে গিয়ে আবার ওদেরই ভোট দেবেন।
অবশ্য সব ভদ্রসন্তানই এমনধারা তা বললে অন্যায় হবে। অনেকে খুব প্রতিবাদী। তেনারা জেগে উঠেই ঠিক করে ফেলেছেন এদের আর ভোট নয়। কারণটি ভারী মজার। “এসব খুনোখুনি মারামারি করছে মুসলমানরা। বিজেপি এলেই এরা সিধে হয়ে যাবে। অতএব বাংলায় বিজেপিকেই চাই।” এদের জিজ্ঞেস করুন “হ্যাঁ দাদা, অনুব্রত মন্ডল কি মুসলমান? জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক কি পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়েন?” এনারা বুদ্ধিমানের মত জবাব দেবেন “আরে এরা তো আর মারামারিটা করছে না। যারা করছে তাদের নামগুলো দেখুন না। বেশিরভাগ মুসলমান। আরাবুলকে ভুলে যাচ্ছেন?” তখন যদি ধরিয়ে দেন যে যারা মার খেয়ে মরছে তাদের মধ্যেও অনেক মুসলমান, অমনি আপনি এন্টি ন্যাশনাল হয়ে যাবেন। আসল কথা সেই যে ব্রিগেডের মাঠে ২০১৪ সালে মোদীজি এসে বলেছিলেন “এখানে মমতা দিদি আছেন খুব ভাল কথা। দিল্লীতে আমায় বসান, আপনাদের দুই হাতে লাড্ডু হয়ে যাবে।” তা সেই লাড্ডু এখন গোগ্রাসে গিলছি আমরা। দু হাতের লাড্ডুতে মন ভরছে না, কোঁচড়েও চাই। তাই আবার নবান্নেও বিজেপিকে দরকার।
খান ভদ্রসন্তানগণ, পেট পুরে খান। পেটপুরে খান আর প্রাণভরে মলত্যাগ করুন। আপনারা তো আর ছোটলোক নন যে মাঠেঘাটে যেতে হবে। মোদীর স্বচ্ছ ভারত আর দিদির নির্মল বাংলার তো আপনারাই ব্র‍্যান্ড এম্বাসেডর।

বিঃ দ্রঃ তৃণমূল কংগ্রেসের কে এক অর্বাচীন এম এল এ কাল দাবী করেছেন তিনি নাকি এমন সন্ত্রাস বাম আমলেও দ্যাখেননি। ওসব গুজবে কান দেবেন না। লাড্ডু খেয়ে যান।

হোক সংযুক্তি

আপনি বলবেন সবাই যদি নিজেকে একা ভাবে তাহলে সেদিনকার মেট্রোর মত গণপিটুনির মানসিকতা তৈরি হচ্ছে কী করে? মানুষ হিংসা প্রদর্শন করার বেলায় ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে কী করে?

মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেল জোয়ান বনাম বুড়োতে। এরকমই একটা কিছু আশঙ্কা করছিলাম। কেন? সে কথায় পরে আসছি। আগে মেট্রো, বাস, ট্রেনে আমার গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার কিছুটা বলি। তাতে এই “বুড়ো মানেই বদ” স্টিরিওটাইপটার অন্তঃসারশূন্যতা কিছুটা বোঝা যাবে।
আমার মেয়ের বয়স ছয়। যখন একেবারে কোলের শিশু ছিল, তখন বেশ কয়েকবার মেট্রোয় উঠে ভিড়ের মধ্যে আমার স্ত্রী লেডিস সিটের সামনে দাঁড়িয়েছে। সেখানে বসা জেন ওয়াইয়ের সদস্যারা নিজেদের মোবাইল স্ক্রিনে ব্যস্ত থেকেছে বা হেড ফোনে সুরের জগতে মগ্ন থেকেছে। উঠে দাঁড়িয়ে বা পাশের জনকে সরে বসতে বলে আমার বউকে বসার জায়গা করে দিয়েছেন পাকা বা কাঁচাপাকা চুলের মহিলারা, অনেক সময় পুরুষরা। কেউ বলতেই পারেন যে এ থেকে প্রমাণ হয় না বুড়োবুড়িরা রক্ষণশীল নয়, moral policing করে না। ঠিক। কিন্তু এ থেকে এটা প্রমাণ হয় যে বয়স্কদের মধ্যে রক্ষণশীলতা যদি থেকে থাকে, তরুণদের মধ্যে আছে নিদারুণ হৃদয়হীনতা। সেটাও ঘটনাবিশেষে নিগ্রহ হয়ে উঠতে পারে এবং ওঠেও।
এটাকেও স্টিরিওটাইপ বলবেন তো? একদম ঠিক। এবং স্টিরিওটাইপ মাত্রেই ভুল। বয়স্ক মানুষ মাত্রেই সেদিনের মেট্রোর লোকগুলোর মত নয়, অল্পবয়সী মাত্রেই হৃদয়হীন নয়। তবু আরো দুটো ঘটনা শুনে নিন।
বছর পাঁচেক আগে বাসে করে অফিস যাচ্ছি। আমি শুরুর দিকের স্টপেজ থেকে উঠি বলে বসার জায়গা পেয়েছি কিন্তু কিছু পরেই বাসটায় ঠাসাঠাসি ভিড় হয়ে গেল। লক্ষ্য করলাম প্রায় আমারই বয়সী একটি মেয়ে ঐ ভিড়ের মধ্যে বিশাল একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে লোকের অভিশাপ এবং গুঁতো হজম করছে। ব্যাগটা নিতে চাইলাম, দিতে রাজি না হওয়ায় আন্দাজ করলাম মূল্যবান কিছু আছে। তখন আমার আসনটাই ছেড়ে দিলাম, মেয়েটি বসল। এটা বলার মত ঘটনা নয়। বলতে হচ্ছে আমি উঠে দাঁড়াতেই আমার সমবয়স্ক পুরুষ সহযাত্রীর প্রতিক্রিয়াটার জন্যে। বাঁকা হেসে সে আমায় বলল “বা দাদা, মেয়েছেলে বলে বসতে দিলেন? একটুআধটু আমাদেরও তো দিলে পারেন।” প্রথমে ইঙ্গিতটা বুঝিনি। বুঝতে পেরে বললাম “হ্যাঁ মেয়ে বলেই বসতে দিলাম। আপনি মেয়ে হয়ে আসুন, আপনাকেও বসতে দেব।” ছেলেটি এরপর আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু কয়েক মিনিট পরে দেখি ছেলেটি আর মেয়েটি অল্পস্বল্প কথা বলছে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বোঝা গেল ওরা সহকর্মী। এই হচ্ছে আমাদের প্রজন্ম, এই তার মহিলা সহকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধা, এই আমাদের প্রগতিশীলতা।
দ্বিতীয় ঘটনা মাসখানেক আগের। বলতে লজ্জা হয়, আমার জন্মস্থান, আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা নবগ্রামে স্টেশন রোডের উপর ঘটেছে ঘটনাটা। বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল নিতে গেছি ভর সন্ধ্যেবেলা। রাস্তা তখন জমজমাট। দেখি দোকানের সামনে আমার বয়সী একটি ছেলে তার সঙ্গের মহিলাকে কুৎসিত ভাষায় ধমকাচ্ছে। অনেকেই তাকিয়ে আছে, কেউ কিছু বলছে না। মেয়েটি, সম্ভবত ভয়ে, কাকুতিমিনতি করছে বাড়ি যাওয়ার জন্যে। একটু দেখে মনে হল ছেলেটি মত্ত। তাকে ধমকাব ভাবছি, এমন সময়ে ঠাস করে মেয়েটির গালে এক চড় কষিয়ে দিল। দ্বিতীয় চড় কষানোর আগেই তার হাতটা ধরে ফেলেছি এবং ধমকে বলেছি এটা ভদ্রলোকের জায়গা। এখানে এসব চলবে না। ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরে টলতে টলতে আমায় ধমকে গেল এই মর্মে যে এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি যেন নিজের চরকায় তেল দিই। আমি বলে গেলাম যা করার বাড়ি গিয়ে করতে হবে, এখানে এই ব্যবহার চলবে না। মিনিট পাঁচেক চলেছিল ব্যাপারটা। শেষ অব্দি মেয়েটি আমার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে টেনে হিঁচড়ে ইঞ্চি ছয়েক নড়াতে পারল ছেলেটিকে, আমায় চলে আসতে হল। কারণ আমাদের পাশ দিয়ে যেসব সুবেশী, শিক্ষিত তরুণ তরুণী হেঁটে যাচ্ছিলেন তাঁদের কেউ এগিয়ে এসে আমার সাথে গলা মেলালেন না। বরং ফুটপাথের মাঝবয়সী দোকানদার ভয়ে ভয়ে আমায় একটু সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পাশের মিষ্টির দোকান থেকে এক প্রবীণ তবু এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে আমায় বললেন “কী দরকার তোমার! এসব কি আর ভদ্র ঘরের ছেলেমেয়ে? কী করতে কী করে দেবে…”
দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে কাজ নেই। আসল কথা হচ্ছে মানুষ বদলে গেছে । আমার মা যখন যুবতী আর আমি মায়ের আঙুল ধরে চলা শিশু, সেই সময় আমাকে নিয়ে ট্রেনে বাসে উঠলে বসার জায়গা পেতে অসুবিধা হত না মনে আছে। তরুণরাই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতেন। আর তাই নিয়ে অন্য তরুণদের অশ্লীল ইঙ্গিত করতেও দেখিনি কখনো। আর আমাদের নবগ্রাম অজ পাড়াগাঁ ছিল তখন। সেখানে প্রকাশ্য রাস্তায় বউকে চড় মারার সাহস কারো ছিল না। অর্থাৎ বুড়োবুড়ি ছুঁড়োছুঁড়ি নির্বিশেষে আমরা পশ্চাৎপদ হয়ে পড়েছি। কেন?
এর এক শব্দে উত্তর বিযুক্তি (alienation)। গত দুই আড়াই দশকে আমাদের শেখানো হয়েছে “শুধু নিজেরটুকু নিয়ে ভাবো।” এর পোশাকি নাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদ (individualism)। জীবনের সবকিছুর কেন্দ্রেই আমি। আমার সুখ, আমার স্বাচ্ছন্দ্য, আমার ক্লেশ, আমার কষ্ট। বাকি দুনিয়া গোল্লায় যাক। এই মতবাদ সম্বল করেই আমাদের প্রজন্ম বড় হয়েছে, আমাদের বাবা-মায়েরা, মানে সেদিন মেট্রোয় ঐ যুগলকে যারা পিটিয়েছে তাদের পান্ডারা যে প্রজন্মের, বড় করেছেন। এই মতবাদই আমাদের সমাজকে, আমাদের রাজনীতিকে আজ নিয়ন্ত্রণ করছে। গোকুলে বেড়েছে সে, তারপর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এখন রাজত্ব করছে।
খেয়াল করে দেখুন — গত আড়াই দশক আপনি কাগজে পত্রে, সিনেমায়, সিরিয়ালে সর্বত্র এটাই জেনেছেন যে নিজের সমস্যা নিজে মিটিয়ে নেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে ভাল। এবং সেটাই আধুনিক মানুষের ধর্ম। যে কোন রকমের জোটবদ্ধতাই হচ্ছে দুর্বলতার লক্ষণ, সেকেলে মানসিকতার লক্ষণ, অফিস কাছারিতে ফাঁকিবাজির লক্ষণ। এইভাবে আপনাকে ক্রমশ বিযুক্ত করা হয়েছে অন্য মানুষের থেকে। আপনি এখন জানেন আপনি অফিসে একা, ট্রেনে একা, বাসে একা, অনেক ক্ষেত্রে বাড়িতেও একা।
এবার আপনি বলবেন সবাই যদি নিজেকে একা ভাবে তাহলে সেদিনকার মেট্রোর মত গণপিটুনির মানসিকতা তৈরি হচ্ছে কী করে? মানুষ হিংসা প্রদর্শন করার বেলায় ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে কী করে?
ব্যাপারটা খুব সোজা। মানুষ জোট বেঁধেছিল, সমাজবদ্ধ হয়েছিল কারণ শারীরিক, মানসিকভাবে তার একার পক্ষে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সেই ব্যাপারটা আজও বদলায়নি কারণ মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ জীব নয়। প্রযুক্তির এত উন্নতি সত্ত্বেও একা একজন মানুষ বাঁচতে পারে না, তাকে অন্য মানুষের উপর নির্ভর করতেই হয়, শারীরিক এবং মানসিক প্রয়োজনে। ফলে যতই কেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদ শেখাও না, মানুষ বিপদে পড়লে, এমনকি বিপন্ন বোধ করলেই, একজোট হতে চায়।
ঠিক এই কারণেই মানুষ কী কারণে একজোট হচ্ছে সেটা বুঝতে গেলে রাজনীতিটা বোঝা দরকার। সব মানুষই নিজের নিজের রাজনীতি অনুযায়ী একজোট হয়। আর কে কার সাথে জোট বাঁধবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে তার বিযুক্তি। কে কতটা বিযুক্ত সেটাই ঠিক করে সে তার চারপাশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিজেকে কোন পক্ষ ভাববে।
রাজনীতি মানে শুধু সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস নয়। এই পোস্টে যাঁরা লাইক দেবেন তাঁরা মনে করেন ছেলেমেয়েদুটোর প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন প্রকাশ্য জায়গায় প্রেমের অভিব্যক্তির অধিকার সকলের আছে, আবার কেউ মনে করেন ছেলেমেয়েদুটো বাড়াবাড়ি করেছিল কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। কেউ হয়ত আরো একটু ভিন্নমত তবে মোটের উপর এঁরা সকলেই মনে করেন ওদের মারা অন্যায় হয়েছে। এই ঘটনায় এই মতটাই তাঁদের রাজনীতি।
আবার যারা ছেলেমেয়েদুটোকে ধরে পেটাল আর যারা এখনো তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে, তারা মনে করে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়া এদেশের সংস্কৃতিবিরোধী বা মোটের উপর অশ্লীল। মারা হয়েছে বেশ হয়েছে। এটাই তাদের রাজনীতি।
এখন মুশকিল হচ্ছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদের যুগে আমরা আবার শিখেছি যে সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি টেনে আনা উচিৎ নয়। কোন ঘটনার রাজনীতি বুঝতে না চাওয়ার এই যে দীর্ঘদিনের অভ্যাস তৈরি হয়েছে তার ফলে আমরা পক্ষ চিনতে ভুল করি। যেমন যখন চাকরি পাই না, রোজগার হারাই, কষ্টের হকের রোজগারও ফুড়ুৎ করে পকেট থেকে উড়ে যায় তখন বুঝতে পারি না যে আমার শত্রু সেই অর্থনৈতিক নীতি যা উত্তুঙ্গ জিডিপি তৈরি করে অথচ কর্মসংস্থান কমায়। আমি ভাবতে শুরু করি আমার শত্রু তফসিলি জাতি উপজাতির লোকেরা, অথবা বিশেষ একটা ধর্মের লোকেরা। কখনো বা ভাবি মেয়েরা এত বেশি লেখাপড়া শিখছে বলেই যত গন্ডগোল, চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যেও ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। আমার বিযুক্তি আমাকে ভেতরে ভেতরে আক্রমণাত্মক করে তোলে আর আমি ঐ কাল্পনিক শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে হিসহিস করতে থাকি। আমার সামাজিক, অর্থনৈতিক, যৌন অবস্থান যা-ই হোক আমার চোখে আমিই হয়ে উঠি সবচেয়ে প্রতারিত, বঞ্চিত মানুষটা। অথচ যেহেতু আমি জানি যে আমি একা সেহেতু আমি সদা ভীত।
সুতরাং আমার সামনেই একটা মেয়ের কাপড় ধরে কেউ টানলে আমি না দেখার ভান করি কারণ ঐ মেয়েটা আমার কে? ওর চেয়ে আমি কি কম আক্রান্ত? ওর হয়ে বলতে গিয়ে কেন নিজেকে আরো বিপদে ফেলব? চোখের সামনে কেউ দুর্ঘটনায় মরে গেলেও আমি চোখ বন্ধ করে থাকি কারণ যে মরেছে সে আমার কেউ হয় না। আমার এমনিতেই হাজারটা সঙ্কট। আমার সঙ্কটের চেয়ে অন্য একটা মানুষের মৃত্যুও বড় সঙ্কট হতে পারে না।
তবে আমার চারপাশের সঙ্গে আমার যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব — সেটা কিন্তু মিথ্যে নয়। আমার উপর যে নানাবিধ অন্যায় চাপ তৈরি হচ্ছে সেটা কিন্তু আমার কল্পনা নয়। যদি মিথ্যে হত তাহলে মেট্রোয় ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ানোর জন্যে মার খেতে হত না। ফলত আমি যে কোন এক পক্ষে আর আমার যে বিপক্ষ আছে তাও সত্যি। আমি নিজের পক্ষের লোক খুঁজছি। একজোট হতে পারলেই আর আমার ভয়ের কারণ থাকে না। তখন গুছিয়ে ঠ্যাঙাতে পারি শত্রুপক্ষকে। কিন্তু আমি কোন পক্ষে আর কোন পক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই সেটা বুঝব কী করে? চোখের সামনে যাকে বা যাদের দেখছি তারা তো আমারই মত কয়েকজন ব্যক্তি মাত্র, তার বেশিকিছু নয় — এরকমটাই ভাবতে শিখেছি আমি। অতএব আমি সিদ্ধান্ত করলাম যে আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের যে বুড়োরা ধরে মারল, তারা শুধুই বুড়ো। কোন বিশেষ মতামতের, মানে রাজনীতির, প্রতিভূ নয়। অর্থাৎ এই লড়াইটায় আমার পক্ষ হল আমার মত তরুণরা আর বিপক্ষ হল বয়স্ক লোকেরা। সেদিন দলে ভারী ছিলাম না তাই মার খেয়েছি। সোশাল মিডিয়ায় আমার পক্ষের অনেককে পেয়ে গেছি অতএব মার ফিরিয়ে দিই যত বয়স্ক লোক আছে সকলকে গালাগালি দিয়ে।
যারা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আক্রমণ করেছিল তারাও একইরকম বিযুক্তির শিকার ছিল, যতক্ষণ না সংস্কৃতির শত্রু নামক কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে তারা এক হতে পেরেছে। শুধু এদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন এরকম কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধেই মানুষ বিযুক্তি কাটিয়ে এক হতে পারছে, আসল শত্রুরা বহাল তবিয়তে আছে। কলকাতার মেট্রো কোন বিচ্ছিন্ন জায়গা নয়।
তাই বলছি, হোক আলিঙ্গন। বয়স্কদের বিরুদ্ধে তরুণদের আলিঙ্গন নয়, রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীলদের আলিঙ্গন। বিযুক্তি কাটুক, মোবাইলের বাইরে এসে সত্যিকারের দুনিয়ায় সংযুক্তি হোক।
পক্ষ নেওয়ার আগে পক্ষ চিনুন।

এসব কী?

একদমই ভাল লাগছে না যখন দেখছি সিপিএম কর্মীরা মমতার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে বলে বিজেপির সাথে লড়াই নেই ধরে নিচ্ছেন

পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে যা হচ্ছে তাতে দেখছি অনেক বামবিরোধীও এখন স্বীকার করছেন এমনটা তাঁরা কখনো দ্যাখেননি। অনেকে এও বলছেন যে এমন পরিবর্তন তাঁরা চাননি। ব্যক্তিগতভাবে এসব দেখে আমি যেমন ক্রুদ্ধ, কষ্ট পাচ্ছি তেমনি একটা মৃদু ভাল লাগার জায়গা এইটা যে দেখতে পাচ্ছি বাম দলগুলোর মধ্যে, সিপিএমের মধ্যে এখনো বহু মানুষ আছেন যাঁরা প্রাণের মায়া, মান সম্মানের মায়া ত্যাগ করে প্রতিরোধ করছেন। রঙ বদলে ফ্যালেননি বা আমার মত ফেসবুকিশ বামপন্থী হয়ে যাননি।
সংবাদমাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ায় যা দেখছি তাতে এটা দেখেও অবাক হচ্ছি বলা যায় যে মার বেশি খাচ্ছেন বামেরাই, বিজেপি নয়। পার্টি অফিস বা ঘরবাড়ি ভাঙচুরও বামেদেরই বেশি হচ্ছে, যারা নাকি প্রধান বিরোধী নয়। বাম রাজনীতির দিক থেকে দেখলে এই মার খাওয়া, লড়ে যাওয়া প্রশংসনীয় নিঃসন্দেহে। ভোট হলে তেমন কিছু বেশি আসন পাব না জেনেও মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্যে এরকম দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যেতে পারে কটা পার্টি?
এসব ভাল লাগছে। কিন্তু একদমই ভাল লাগছে না যখন দেখছি সিপিএম কর্মীরা মমতার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে বলে বিজেপির সাথে লড়াই নেই বলে ধরে নিচ্ছেন। সত্যি কথা বলতে নেতৃত্বের দিক থেকে এমন সামান্যতম ইঙ্গিতও দেওয়া হয়নি। কোন কোন এলাকায় দেখতে পাচ্ছি বা শুনতে পাচ্ছি গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে “বাম-বিজেপি সমর্থিত”, এমনকি “বাম-তৃণমূল সমর্থিত” কাঁঠালের আমসত্ত্বের আবির্ভাব হয়েছে। সেরকমটা একেবারে স্থানীয় স্তরে, একজন বা কয়েকজনের স্বার্থের খাতিরে অতীতেও হয়েছে শুনেছি। এখন যখন পার্টি দুর্বল, ২০১১ র পর থেকে কেষ্টেতর প্রাণীদের অত্যাচারে অনেক জায়গায় প্রায় উধাও তখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কারো কারো এরকম কান্ড ঘটিয়ে ফেলা অন্যায় হলেও অবাক করার মত নয়। আদর্শগত দেউলিয়াপনা যে আছে সে তো আর আমরা নতুন জানছি না, তা বলে সকলেই ওরকম তা ভাবারও কারণ নেই। সেইজন্যেই ওরকম জোট করাটাই সামগ্রিকভাবে পার্টির অঘোষিত নীতি বলে মনে করার কারণ আছে, এমনটা নিখাদ তৃণমূলী ছাড়া কেউ বলবেন মনে হয় না। ফলত আমার আপত্তির জায়গা অন্য।
এখন গ্রাম, শহর সর্বত্রই হোয়াটস্যাপ আর ফেসবুকের দাপট। রাগ হচ্ছে, শঙ্কিত হচ্ছি তখন যখন দেখছি বিজেপি আই টি সেলের তৈরি ভুয়ো খবর সম্বলিত বার্তা সিপিএম সদস্য, সমর্থকরা দিব্যি ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছেন। ফেসবুকেও দেখছি অনেক সিপিএম সদস্য সরাসরি শেয়ার বাটন টিপে বিজেপি এবং তার বন্ধু যে দাঙ্গাবাজ সংগঠনগুলো, তাদের পোস্ট শেয়ার করছেন। সেসব পোস্টের মধ্যে সরাসরি মুসলমানবিদ্বেষী, বানানো তথ্যসম্বলিত যে পোস্টগুলো আমরা অনেকেই চিনি, সেগুলোও রয়েছে। মমতা কত খারাপ তা প্রমাণ করার জন্যে এসবও যাঁরা শেয়ার করছেন তাঁদের ধিক্কার জানাবার ভাষা নেই। মমতা কত খারাপ তা অনেকেই বুঝতে পারছে। আপনারা বিজেপির ভাষা ধার করে না বোঝালে লোকে বুঝবে না?
যেসব মানুষ বুক চিতিয়ে এখনো নিজেদের সিপিএম সমর্থক বলেন তাঁদের এহেন কার্যকলাপ দেখে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। এমনও সন্দেহ হচ্ছে যে তাঁদের সমর্থন বস্তুত একটাই চিহ্নে বরাবর ভোট দিয়ে আসার অভ্যাস, দলটার নীতি বা আদর্শের প্রতি (আদর্শ শব্দটায় আপত্তি থাকলে কথিত আদর্শ বলা যাক) সমর্থন নয়।
তবু সেটা সমর্থকদের ব্যাপার। একজন সমর্থকের সব কিছু তো আর একটা দল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দল অন্তত তার সদস্যদের শাসন করুক। সি পি আই (এম) এর কোন সোশাল মিডিয়া সেল আছে কিনা আমার জানা নেই। যদি নাও থাকে, এসব যে পার্টি সদস্যরা করছেন তাঁরা বুঝে করছেন, না না বুঝে করছেন সে দিকে নেতৃত্বের নজর দেওয়া উচিৎ নয় কি? নইলে তো ধরে নিতে হবে “মৌনং সম্মতি লক্ষণম।” বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইটাই যে বড় লড়াই সে কথা তো আপনাদের পার্টি কংগ্রেসও স্বীকার করল। তাহলে এসব কী?