একজন স্রষ্টা কিভাবে আরেক স্রষ্টার সৃষ্টি আত্তীকরণ করে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান, বোধহয় এই গান তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন
“ও আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে / ঢ্যাং কুড়কুড় ঢ্যাং কুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে…” গানটা বেশ জনপ্রিয়। পুজোর মরসুমে বিশেষত ছোটদের নাচ-গানের অনুষ্ঠানে প্রায় সর্বত্র শোনা যায়। ১৯৭৭ সালের পুজোয় সলিল চৌধুরীর এই সৃষ্টি তাঁর কন্যা অন্তরার গলায় প্রথম শোনা গিয়েছিল। গানটার সঞ্চারী এরকম “কাঁদছ কেন আজ ময়নাপাড়ার মেয়ে? / নতুন জামা ফ্রক পাওনি বুঝি চেয়ে? / আমার কাছে যা আছে সব তোমায় দেব দিয়ে / আজ হাসিখুশি মিথ্যে হবে তোমাকে বাদ দিয়ে।”
আনন্দ যে ভাগ করলে বাড়ে, সে কথা আজকাল আর ছোটদের বোঝানোর সময় পাই না আমরা। সলিল চৌধুরীর প্রজন্মের মানুষ প্রাণপণে শেখাতেন। এই স্তবকটা সেদিক থেকে চমকপ্রদ কিছু নয়। কিন্তু বহুবার শোনা এই গানটা কদিন আগে নিজের মেয়ের গলায় শুনে যে কারণে কানটা বেশি খাড়া করতে হল, তা হল দুটো শব্দ — “ময়নাপাড়ার মেয়ে”।
ঐ দুটো শব্দে ঘুমন্ত স্মৃতি সজাগ হয়ে উঠল। আমাদের বাড়িতে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি প্রথম টেপ রেকর্ডার (বা ক্যাসেট প্লেয়ার) আসার পর গোড়ার দিকে কেনা ক্যাসেটগুলোর একটার নাম ছিল ‘হিটস অফ সলিল চৌধুরী’। সেই ক্যাসেটের অধিকাংশ গান সকলের চেনা, সেই বারো-তেরো বছর বয়সে আমারও চেনা। কিন্তু সেই প্রথম শুনেছিলাম এক আশ্চর্য গান — সুচিত্রা মিত্রের গলায় ‘সেই মেয়ে’।
১৯৫০ এ প্রকাশিত সেই গানের শরীরে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বাংলার গ্রামের মানুষের দুর্দশা আর তেভাগা আন্দোলন। কলকাতায় এসে পড়া অগণিত অভুক্ত, অর্ধভুক্ত মানুষের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখে গীতিকার লিখেছেন “হয়ত তাকে কৃষ্ণকলি বলে, কবিগুরু, তুমিই চিনেছিলে।” শীর্ণ বাহু তুলে ক্ষুধায় জ্বলতে দেখে শুরুতেই ভেবেছেন “কে জানে হায়, কোথায় বা ঘর কী নাম কালো মেয়ে?” তারপরই চিহ্নিত করেছেন “হয়ত বা সেই ময়নাপাড়ার মাঠের কালো মেয়ে।” একজন স্রষ্টা কিভাবে আরেক স্রষ্টার সৃষ্টি আত্তীকরণ করে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান, বোধহয় এই গান তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
চৌঠা আষাঢ় ১৩০৭ এ রচিত রবীন্দ্রনাথের “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি” সুচিত্রা মিত্র বা শান্তিদেব ঘোষের গলায় কে না শুনেছে? সেই উৎকৃষ্ট প্রেমের (যদিও ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থের এই কবিতা গীতবিতানের প্রেম পর্যায় নয়, বিচিত্র পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত) গানের নায়িকা সলিল চৌধুরীর কলমে ফিরে এল অভুক্ত পল্লীবালা হিসাবে। তেভাগা আন্দোলনে উদ্দীপ্ত গীতিকার নিজের গানের শেষে কবিগুরুকে বললেন “আবার কোনদিন যদি তারে দেখো পথে / বোলো তারে বোলো তারই তরে / ময়নাপাড়া থেকে খবর আসে তারি তরে রে / সে যেন ফিরে যায় রে।”
জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে দুই স্রষ্টার এই সংলাপ কৈশোর থেকেই জানা ছিল। মধ্যবয়সের মুখে এসে খেয়াল করে শিহরিত হলাম যে সেই ময়নাপাড়ার মেয়ে সলিল চৌধুরীকে ১৯৭৭ এও ছেড়ে যায়নি। ১৯৫০ এ তিনি বছর আঠাশের যুবক, সাতাশ বছর পরে প্রায় বৃদ্ধ। তাঁর কল্পনায় রবীন্দ্রনাথের গানের যুবতী ততদিনে ছোট্ট মেয়ে হয়ে গেছে। তেভাগার তাপ এ গানে নেই, সময় বদলেছে বলে, হয়ত শিশুদের জন্য গান বলেও। কিন্তু গানটা যে সচ্ছল পরিবারের শিশুর জবানিতে রচিত, সে নিজে যা উপহার পেয়েছে তার সবই ময়নাপাড়ার মেয়েকে দিয়ে দেবে বলছে, নইলে হাসিখুশি মিথ্যে হয়ে যাবে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর সলিল চৌধুরীর সংলাপ বোধহয় এই গানে কেবল ময়নাপাড়ার মেয়েতে শেষ নয়, কারণ সচ্ছল মেয়ের প্রত্যয়ে প্রতিধ্বনি পাচ্ছি ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূজার সাজ’ কবিতার। দরিদ্র কৃষক বাবার দুই ছেলে — বিধু আর মধু। বাবার কিনে আনা সামান্য ছিটের জামা বিধুর পছন্দ হয়েছে, মধু কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সে ধনী রায়বাবুর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে। রায়বাবু নিজের ছেলেকে ডেকে বলেন “ওরে গুপি, তোর জামা দে তুই মধুকে।” কবিতার মূল প্রতিপাদ্য অবশ্য আত্মসম্মান, তাই বিধু-মধুর মা মধুর ধার করা জামা দেখে দুঃখ পান, বিধুকে বলেন “দরিদ্র ছেলের দেহে দরিদ্র বাপের স্নেহে / ছিটের জামাটি করে আলো।” কিন্তু লক্ষণীয় যে, রায়বাবুও আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার পক্ষপাতী।
যার মেডিক্লেম করার ক্ষমতা আছে, সে ভাল চিকিৎসা পাবে। যার নেই তার জন্য তো পূতিগন্ধময় সরকারী হাসপাতাল রইল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কখনো ঘটেনি এমন অন্তত দুটো ঘটনা কোভিড-১৯ ঘটিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। প্রথমত, অলিম্পিক এক বছর পিছিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, লন্ডনের অল ইংল্যান্ড ক্লাবের বার্ষিক টেনিস প্রতিযোগিতা, যা সবাই উইম্বলডন নামে চেনে, সেটাও এ বছরের মত বাতিল হয়ে গেছে। প্রাণহানির হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে থাকলেও ব্যাপ্তিতে নতুন কোরোনাভাইরাস দুটো বিশ্বযুদ্ধকেই ছাড়িয়ে গেছে। ওসেনিয়াও বাদ পড়েনি। ঠিক কত মানুষের জীবিকা কোরোনার বলি হবে তা এখনো অনিশ্চিত, তবে গরীব মানুষের ক্ষতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যা এবং আজ পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতির সাপেক্ষে হিসাব করলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ত এখনই আশি বছর আগেকার ক্ষতিকে অতিক্রম করেছে।
আমাদের দাদু-দিদিমাদের প্রজন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাপ অনুভব করেছিলেন। বোমাতঙ্কে এক সময় কলকাতা ছেড়ে দূর গ্রামে মফস্বলে পালিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভারত ভূখণ্ডে যুদ্ধ এসে না পৌঁছালেও পরাধীন দেশের শস্য উইনস্টন চার্চিলের বদান্যতায় ব্রিটিশ সৈন্যদের পেট ভরাতে চলে গিয়েছিল। কলকাতার রাস্তায় মানুষ ভাত নয়, ফ্যান চেয়ে বেড়িয়েছে, ভদ্র ঘরের মেয়ে বউদের ভাতের জন্য বেশ্যাবৃত্তি করতে হয়েছে (যৌনকর্মী শব্দটা তখনকার কোন লেখায় পাইনি, সম্ভবত যাদের কথা বলছি তারাও খুশি হত না এই শব্দ ব্যবহার করলে)। সেই সময় গ্রাম থেকে আসা অভুক্তদের মধ্যে সলিল চৌধুরীর চোখ রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলিকে দেখতে পেয়েছে। “দুটি শীর্ণ বাহু তুলে / ও সে ক্ষুধায় জ্বলে / অন্ন মেগে মেগে ফেরে প্রাসাদ পানে চেয়ে। / কে জানে হায় কোথায় বা ঘর / কী নাম কালো মেয়ে! হয়ত বা সেই ময়নাপাড়ার মাঠের কালো মেয়ে।”
সেই যুদ্ধের পর অনেক কিছু বদলেছিল। উপনিবেশ বজায় রাখা ধনী দেশগুলোর আর পড়তায় পোষাচ্ছিল না। তাই বিংশ শতাব্দী হয়ে গিয়েছিল মুক্তির দশক — সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্তির।
সাম্রাজ্য না হয় ছাড়া গেল, তা বলে কি রাশ ছেড়ে দেওয়া যায় পুরোপুরি? হরণ করতে না পারলে কি প্রাচুর্য বজায় রাখা যায়? তাছাড়া যাদের উপনিবেশ ছিল না তাদের বুঝি সাম্রাজ্যের সাধ হয় না, প্রাচুর্যের দরকার হয় না? সে প্রাচুর্য বজায় রাখতে মহাযুদ্ধের পরের প্রায় পঞ্চাশ বছর বেশ বেগ পেতে হয়েছিল পুরনো, নতুন দাদাদের। কারণ নতুন যে কায়দাটা, মানে কেনা আর বেচাই যে মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য ও মোক্ষ, তা অর্ধেক পৃথিবীকে বোঝানোই যাচ্ছিল না। কেবল ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কথা বলছি না। সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর অনেকেই তো তখন অর্থনীতিতে বাম দিক ঘেঁষে হাঁটছিল। ভারতের মত বিরাট দেশও। “যত খাই তত চাই বাপি চানাচুর” তত্ত্ব অর্ধেক বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি, মানুষকে ক্রেতাদাস বানিয়ে বিক্রেতারাজ কায়েম করা যায়নি। সেটা করা গেল গত শতকের শেষ দশকে এসে। ভোগবাদ শেষ অবধি বিশ্বায়িত হতে পারল আর বেলাগাম ভোগে আমরা পেলাম এই দুর্ভোগ — তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে এক পক্ষে প্রকৃতি, অন্য পক্ষে নিরস্ত্র সরকার। আর সাধারণ মানুষ? উলুখাগড়া।
এতদ্বারা কোরোনা কী থেকে হয় তা আবিষ্কার করে ফেলেছি বলে দাবী করছি না, যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বলছি মাত্র। যুদ্ধই যে চলছে তা নিয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই বলেছে “global pandemic” অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী অতিমারী। রোগটা কিভাবে হচ্ছে, কী কী উপায়ে ছড়াচ্ছে তাও শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত নয় প্রাদুর্ভাবের এতদিন পরেও, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার কবে হবে তাও এখনো অনিশ্চিত। তাই বলছি এ যুদ্ধে এক পক্ষে প্রকৃতি।
অন্য পক্ষে নিরস্ত্র সরকার কেন বলছি? কারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অস্ত্র হল শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি। সৈনিক হলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু মহাশক্তিধর দেশগুলোর অধিকাংশের আছে কেবল পরমাণু বোমা, মিসাইল, যুদ্ধজাহাজ, বিশাল স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী আর নৌবাহিনী। মশা মারতে কামান দাগলে কোন লাভ হয়? ম্যালেরিয়ার সময় যদি কামান দাগেন তাহলে রোগী মরবে, মশা নয়। কি চমৎকার ব্যাপার হত বলুন তো, যদি কোভিড-১৯ পাকিস্তান হত? এক্ষুণি মেঘে মেঘে গোটা কতক স্টেলদ বম্বার হানা দিলেই এই দিনের পর দিন ঘরবন্দী থাকার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। সারা পৃথিবীতে এখন যত পারমাণবিক অস্ত্র মজুত আছে তা একসঙ্গে বিস্ফোরিত হলেও কোরোনার ক থাকবে না। কারণ মানুষ দূরের কথা, গ্রহটাই থাকবে না হয়ত। মাথা না থাকলে আর কিসের মাথা ব্যথা? আমাদের সরকারগুলোর অস্ত্র যা আছে তা আসলে এইরকম। তাই নিরস্ত্র।
কিন্তু কেন নিরস্ত্র? কারণ সরকারগুলো এ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়নি। কেন নেয়নি? কারণ প্রয়োজন বোধ করেনি। কেন করেনি? কারণ ওটা সরকারের কাজ নয়। সরকারের কাজ তবে কোনটা? যুদ্ধ করা। তার প্রস্তুতি নিতেই সরকার ব্যস্ত ছিল। ভারতের সাথে তার প্রতিবেশীদের শেষ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১ এ। বাংলাদেশ, বার্মা, নেপালের মত অতি ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর সাথে সুদূর ভবিষ্যতেও যুদ্ধের কোন সম্ভাবনা নেই। উঠতে বসতে যার সাথে অশান্তি, সেই পাকিস্তান খেতে পায় না তো যুদ্ধ করবে কী? পারবে না জানে বলেই প্রক্সি ওয়ার চালায়। সেই প্রক্সি ওয়ারে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ কোন কাজে লাগে না, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানেরও সচরাচর প্রয়োজন পড়ে না। বাকি রইল চীন। ভারত তার পণ্যের বিরাট বাজার। যুদ্ধ লাগলে তার নিজেরই ব্যবসার ক্ষতি। এরকম প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, আর স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমেছে। ২০২০-২১ এর বাজেটে প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ হয়েছে ৩.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যের জন্য ৬৯,২৩৪ কোটি টাকা। তবু দেখবেন বিজ্ঞ ব্যক্তিরা লিখে এবং বলে হা হুতাশ করেন “আহা, অমুক প্লেনটা কেনা হল না! তমুক কামান মান্ধাতার আমলের হয়ে রয়েছে। অমুকে এগিয়ে গেল, তমুকে টেক্কা দিয়ে দিল।” শুধু বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই বা কেন? আমরাও তো করি। কাউকে শুনেছেন বলতে “আহা, কতদিন একটা নতুন সরকারী হাসপাতাল হয়নি! অমুক ওষুধটার দাম যে কেন সরকার কমাতে পারে না! তমুক যন্ত্রটা কলকাতার সব হাসপাতালে কেন নেই?” কেউ এসব বলে না, কারণ সবাই জানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের নয়। যুদ্ধ করার দায়িত্ব সরকারের।
চিকিৎসা করার দায়িত্ব তবে কার? আমরা সবাই জানি। ঝাঁ চকচকে বেসরকারী হাসপাতালের। ওষুধ বানানো এবং বেচার দায়িত্ব বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির। ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যবস্থা। যেমনটা “উন্নত” দেশে হয় আর কি। ওটাই তো সর্বোত্তম ব্যবস্থা, তাই না? আমরা তো তেমনটাই শিখেছি সেই নব্বইয়ের দশক থেকে। অন্য যে বিকল্প ছিল, মানে সরকার নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা — সেটা যে সেকেলে, সেটা যে ফালতু সে ব্যাপারে তো আমরা নিশ্চিত। সরকারী হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যবস্থাই হল সঠিক ব্যবস্থা। হাসপাতাল হবে পাঁচ তারা হোটেলের মত। সেখানকার কর্মচারীরা হবে সুবেশী হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়া রিসেপশনিস্টদের মত। আর ডাক্তারবাবু অনেক টাকা পারিশ্রমিক নেবেন। তবে না চিকিৎসা? যদি বলেন কড়ির ব্যবস্থা করবে কে? কেন, ইনসিওরেন্স কোম্পানি? বছর বছর কয়েক হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে গোটা পরিবারের মেডিক্লেম করিয়েছি তো। যার মেডিক্লেম করার ক্ষমতা আছে, সে ভাল চিকিৎসা পাবে। যার নেই তার জন্য তো পূতিগন্ধময় সরকারী হাসপাতাল রইল। উন্নত ব্যবস্থা মানেই তো এই বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, তাই না?
এতদিন চলছিল বেশ। শুধু আমাদের দেশে নয়, যে দেশগুলো আমাদের বিকল্প ভুলিয়ে এসব ধরিয়েছে সেখানেও দিব্যি চলছিল ব্যবস্থাটা। যার পকেটে মেডিক্লেম আছে সে খুশি, ডাক্তার খুশি, হাসপাতাল মালিকরা খুশি, ওষুধ কোম্পানি খুশি। আমাদের দেশে তবু যত নষ্টের গোড়া, সমাজবাদের প্রতি দুর্বলতা থাকা জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে তৈরি সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ অনেক গরীব মানুষের যেমন তেমন দেখভাল চালাচ্ছিল। অনেক উন্নত দেশে, যেমন আমাদের স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, রেস্ত না থাকলে অসুস্থ হওয়া মানা। মধ্যে বারাক ওবামা উল্টো গাইলেন, সে কথা বড় একটা পছন্দ হল না কারোর। কী করে হবে? সরকারী মানে ফালতু এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সরকারের কাজ নয় — এসব আমরা তো মোটে তিরিশ বছর হল শিখেছি, আমেরিকানরা সেই কবে থেকে শুনে আসছে। আর সকলকে শিখিয়েছেও। আজ হঠাৎ নতুন কথা শুনলে মনে হবে না ব্যাটা বুদ্ধির ঢেঁকি? ওবামার কথা শুনে যত লোক মুখ বেঁকিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি লোক বার্নি স্যান্ডার্সের কথা মন দিয়ে শুনছিল। তবু বার্নির গায়ে কেন কমুনিস্ট গন্ধ? এই প্রশ্নে দ্বিধায় ছিল। মানে সব দেশের পয়সাওয়ালা লোকই তো আমার আপনার মতই। যার পকেটে পয়সা নেই তাকে নিয়ে ভাবতে আমাদের বয়েই গেছে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন কোরোনা।
ফল কী? ফেলো কড়ি মাখো তেলের দেশ যুক্তরাষ্ট্র এক কথায় ল্যাজে গোবরে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে পাত্তাই দেননি, বলেছিলেন ঐ দু চারটে হয়েছে আর কি, তাও চীনের চক্রান্তে। শিগগির শূন্যে নেমে আসবে। তারপর যখন রোগী বাড়তে থাকল তখনো বলছিলেন লকডাউন আবার কী? ওভাবে দেশ চলে? তারপর এখন, যখন চার লক্ষের বেশি আক্রান্ত নিয়ে তাঁর দেশ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দখল করে ফেলেছে, প্রায় তেরো হাজার মানুষ মৃত, তখন তিনি চীন আর হু কে দোষ দিচ্ছেন। ওদিকে ভেন্টিলেটর কোন রাজ্যে কতগুলো যাবে তা নিয়ে নিলাম চলছে। মানে বুঝলেন তো? আপনার স্বপ্নের দেশে, উন্নত ব্যবস্থায় মানুষের জীবন নিলামে কেনা বেচা হচ্ছে। এত অস্ত্র বানায় অত বড় দেশটা, সারা পৃথিবীতে বিক্রি করে, এত উন্নত মোবাইল কম্পিউটার ট্যাব নানাবিধ সফটওয়্যার আবিষ্কার করে, কে এফ সি, কোকা-কোলা, স্টারবাকস — উদ্ভাবনের স্বর্গরাজ্য একেবারে। অথচ যথেষ্ট ভেন্টিলেটর বানিয়ে উঠতে পারেনি। ভেন্টিলেটর তো অনেক বড় কথা, সামান্য অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া ড্রাগের জন্য পর্যন্ত ভারতকে ধমকাতে হচ্ছে। এই আপনাদের উন্নত দেশ, উন্নত ব্যবস্থা। কড়ি ফেললেও তেল দিতে পারছে না।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামে এই যে ওষুধ, যার জন্য ট্রাম্প মোদীকে দিলেন এক ধমক আর মোদী সুড়সুড় করে রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন, তেমন ওষুধ উৎপাদনের উপযুক্ত জায়গা হল ভারতের সরকারী ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলো। ভারতে ওষুধ তৈরির ৭০% কাঁচামাল আমদানি হয় চীন থেকে। ২০১৫ তে ভারত সরকার নিযুক্ত কাটোচ কমিটি বলেছিল সরকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে এই জায়গাটাতে ভারত অনায়াসেই স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ভারত সরকার, মানে মোদীর সরকার, কী করলেন? না ঐ সংস্থাগুলোকে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে কলকাতার বেঙ্গল কেমিক্যালও। যদিও কলকাতা হাইকোর্ট বেঙ্গল কেমিক্যাল বিক্রির সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিয়েছেন। তাহলে ভাবুন, যে সরকারী সংস্থা আমাদের জীবনদায়ী ওষুধ তৈরি করতে পারে তাকে বেচে দিতে সরকার উৎসাহী কেন? কারণ ঐ যে, ওষুধ যোগানো সরকারের কাজ নয়।
বিরক্ত হচ্ছেন? এক কথা বারবার পড়ে রেগে যাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করছেন কে ঠিক করল ওষুধ যোগানো সরকারের কাজ নয়, চিকিৎসা দেওয়া সরকারের কাজ নয়? আপনিই ঠিক করেছেন। যদি এতে খুব দাগা লাগে তাহলে বলা যায় আপনাকে দিয়ে ঠিক করানো হয়েছে। কে ঠিক করিয়েছে? সরকার নিজেই। একবার মনে করে দেখুন নব্বইয়ের দশক। মনমোহনী অর্থনীতি মনে আছে? তখন থেকেই তো কাগজে, টিভিতে, পত্রিকায় সর্বত্র জেনেছেন রাষ্ট্রের দিন শেষ। কেউ চীন বললে, কিউবা বললে, ভিয়েতনাম বললে বলেছেন “আরে ওসব রিজেক্টেড সিস্টেম। ওসব উঠে গেল দেখলেন না?” কারণ তার আগের কয়েক বছরে প্রণয় রায়ের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ এ বার্লিনের দেওয়াল ভাঙতে দেখেছেন, দ্যুমায় আগুন জ্বলতে দেখেছেন। আপনি ঠিক দেখেছেন এবং ভুল বুঝেছেন। আপনি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন দেখেছেন আর বাজার অর্থনীতির খুড়োর কল দেখেছেন। আপনি জানতে পারেননি যে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেবল ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ছিল না। আপনাকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর কথা বলা হয়নি, আপনাকে ব্রিটেনের এন এইচ এসের কথা বলা হয়নি, আপনাকে এখনো সিঙ্গাপুরের কথাও বড় একটা বলা হয়নি।
কেবল এভাবেই যে আপনাকে বোঝানো হয়েছে যা কেনা যায় তা-ই ভাল আর সরকারী মানেই ফালতু তা-ও নয়। সরকার নিজে আপনাকে সরকারী ব্যবস্থা থেকে দূরে ঠেলেছে। আমার জন্ম আশির দশকের গোড়ায়, আমার বোনের জন্ম ১৯৯০ তে। তখনো ভারত বাজার অর্থনীতির দেশ হয়নি, মেডিক্লেম কারোর অভিধানে ছিল না। আমার বাবা স্কুল শিক্ষক। আমার জন্মের সময়ে না হলেও, বোনের জন্মকালে মন্দ মাইনে পেতেন না। আমরা দুজনেই জন্মেছি সরকারী হাসপাতালে। তখনো সেগুলোর চেহারা আজকের আমরি, অ্যাপোলো বা ফর্টিসের মত ছিল না। কিন্তু সামর্থ্য থাকলে ওখানে যাব না এমন মনে হত না, হলে বাবা আমার মাকে নিয়ে যেতেন না। অথচ ২০১১ সালে আমার মেয়ের জন্ম হল বেসরকারী নার্সিংহোমে। কারণ আমি আমার স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ভার সরকারের উপর ছাড়তে ভরসা পেলাম না। ভরসার জায়গাটা সরকার নিজেই নষ্ট করে দিয়েছে তার আগের কুড়ি বছরে। সব দলের সরকারই। সরকার নিজেই ছিদ্র করেছে লৌহ বাসরে, আর সেই ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়েছে বেসরকারীকরণের কালনাগিনীকে। কারণ সরকার চায় না মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে।
কেন চায় না? সরকার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে না, শিক্ষার ব্যবস্থা করবে না, তাহলে করবে কী? দুটো কাজ করবে। এক, পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করবে। মানে রাস্তাঘাট, বিমানবন্দর ইত্যাদি। দুই, যুদ্ধ করবে। নব্বইয়ের দশকে নতুন চিন্তা ছিল এটাই। কেন চিন্তাবিদরা সরকারকে এই কাজ দুটোয় বেঁধে দিলেন?
ভেবে দেখুন, সরকার নিজে রাস্তাঘাট বানাতে পারে না। কোন ব্যবসায়ীকে বরাত দিতে হবে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিমানবন্দর — সবেতেই তাই। তাহলে বেশ কিছু বড়লোকের আরো বড়লোক হওয়ার ব্যবস্থা হল। যত বড়, যত গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো, তত বেশি মুনাফা, তত বড়লোক হওয়ার ব্যবস্থা। তাছাড়া কেবল স্বাস্থ্য বেসরকারী হলে ভাল তা তো নয়, সবই বেসরকারী হলে ভাল বলা হয়েছে। তাই পরিবহন বেসরকারী, শিক্ষা বেসরকারী, যা যা মানুষের জীবনে দরকারী তার সবই বেসরকারী। অর্থাৎ আসল কথা হল ব্যবসা। মানুষের জন্য অর্থনীতি নয়, ব্যবসার জন্য অর্থনীতি। আর যেহেতু অর্থনীতিই অন্য সব নীতিকে চালায় তাই তখন থেকে রাজনীতিও ব্যবসার জন্য, স্বাস্থ্য নীতিও ব্যবসার জন্য। আর সবচেয়ে অর্থকরী ব্যবসা হল অস্ত্র ব্যবসা। তাই যুদ্ধ করার অধিকারটা সরকারকে দেওয়া হল। যুদ্ধ হোক আর না-ই হোক, সরকারকে অস্ত্র কিনতেই হবে। না কিনলে ধনকুবেররা আরো ধনী হবে কী করে?
সুতরাং আপনার পকেটে কড়ি থাকায় যে ব্যবস্থাকে আপনি ভেবেছিলেন ফেলো কড়ি মাখো তেল, সেটার আসল নাম হল এলোমেলো করে দে মা লুটে পুটে খাই। মনে রাখবেন যে ধনীরা এই ব্যবস্থা চালায় সাক্ষীগোপাল সরকারগুলোকে দিয়ে, তাদের খাঁই অপরিসীম। আপনি যে ধার করে গাড়ি কিনে বা বিদেশ ঘুরে এসে ভাবেন “দেশের উন্নতি হয়েছে। আমার বাবা-মা তো এমন পারত না,” তাও ওদেরই বদান্যতায়। আপনি খরচ না করলে ওদের মুনাফা হয় না বলে। মুনাফাই মোক্ষ। আপনি যে কোম্পানির চাকুরে সে কোম্পানির মুনাফা গত বছরের চেয়ে এ বছর না বাড়লে আপনার চাকরিটি নট হয়ে যাবে, আপনি ফাঁকিবাজ না পরিশ্রমী তা অপ্রাসঙ্গিক। হাড়ে হাড়ে টের পাবেন বেসরকারী সংস্থা মানে মোটেই মেধাতন্ত্র (meritocracy) নয়, মুনাফাতন্ত্র (profitocracy)।
এখন কথা হচ্ছে এই মুনাফাতন্ত্রকে যদি ভাল বলেন, তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার মত হওয়াই ভাল। সরকার যদি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করে, তাহলে বেসরকারী হাসপাতালে যাবে কে? তাদের মুনাফা হবে কোথা থেকে? ভেন্টিলেটর নিলাম হওয়াও কিন্তু ভাল। ক্রয় বিক্রয়ের স্বাধীনতা। ফেলো কড়ি মাখো তেল। বুঝলেন কিনা?
মুনাফাতন্ত্র কিন্তু প্রকৃতির ধার ধারে না। বিশ্ব উষ্ণায়নকে বলে বামপন্থী কন্সপিরেসি থিওরি। কারণ উষ্ণায়ন হচ্ছে বলে মেনে নিলেই ফসিলজাত জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। তেল কোম্পানির লোকসান হবে না? পকেটে পয়সা থাকলেই আজকাল এ সি লাগিয়ে ফেলা যায়। সত্যি সত্যি ক্লোরোফ্লুওকার্বনের ব্যবহার কমাতে গেলে কী হবে এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবসার? প্লাস্টিক দুনিয়ার ক্ষতি করছে মানলে বিশ্বজোড়া প্লাস্টিক ব্যবসার বারোটা বাজবে। বাহুল্যকে প্রয়োজনে পরিণত করা গেছে কত দিনের চেষ্টায়, এখন উল্টো পথে হাঁটলে কী হবে মুনাফার গতি? অতএব যেমন চলছে চলুক। চালাতে গিয়ে হিমবাহগুলো তো বটেই, চিরতুষার (permafrost), মানে পৃথিবীর যেসব জায়গার বরফ সেই তুষার যুগ থেকে আজ পর্যন্ত গলেনি, তাও গলে যাচ্ছে। কত মহামারী অতিমারীর জীবাণু যে সেই বরফে জমেছিল কে-ই বা বলতে পারে? কাকলাস মেরুভালুকের ছবি মুনাফাবাদীদের মন গলাতে পারেনি, এখন দুনিয়াসুদ্ধ লোক থাকো ঘরে বন্দী। সব ব্যবসার সাড়ে সর্বনাশ, মুনাফাতন্ত্র ছাপিয়ে মন্দাতন্ত্র এসে পড়ল।
তাহলে বিশ্বযুদ্ধটা দাঁড়াল মুনাফাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকৃতির। ওয়ার্ল্ডোমিটার বলে যে সাইটটা গত কয়েক দিনে জনপ্রিয় হয়েছে, সেখানে গিয়ে কোরোনা আক্রান্ত দেশের নামগুলো ভাল করে দেখুন। যেসব দেশের সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মনোযোগ আছে, মানে মুনাফাতন্ত্র জোরালো নয়, সেসব দেশে রোগটার দাপট কম। ভিয়েতনাম খুঁজে দেখুন, কিউবা খুঁজে দেখুন। “রিজেক্টেড সিস্টেম” গুলোর অবস্থা একবার দেখলেনই না হয়। জার্মানি আবার রিজেক্টেড সিস্টেমেও চলে না, তবু সে সামলে নিয়েছে। কারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভাল। সামলে নিচ্ছে ফ্রান্সও। স্পেনের সরকার আবার কী করেছে দেখেছেন তো? বেসরকারী হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ করেছে। ভাবুন তো, আপনি ই এম বাইপাসের ধারে একটা ঝাঁ চকচকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, অথচ মেডিক্লেমে সবটা কভার হবে কিনা ভেবে রক্তচাপ বাড়ছে না!
এবার চীনা ফ্রন্টে একটা আক্রমণ হবে বুঝতে পারছি৷ প্রশ্ন উঠবে সবই যদি মুনাফাতন্ত্রের দোষ, তবে চীনে এমন কেলেঙ্কারির ব্যাখ্যা কী? উত্তরটা নেহাত সোজা। যতই চতুর্দিকে মাওয়ের ছবি থাক আর লাল পতাকায় ছেয়ে থাক পথ ঘাট, বর্তমান চীনের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক নেহরুর সমাজবাদের সাথে নরসিমা রাওয়ের কংগ্রেসের চেয়েও ক্ষীণ। কাস্তে হাতুড়ি চীনের শালগ্রাম শিলা মাত্র। সারা পৃথিবীতে ব্যবসা করতে চীনের আগ্রহ ট্রাম্পের দেশের চেয়ে কিছু কম নয়। ট্রাম্প যদি বলেন “মেরে পাস গেটস হ্যায়, জোবস হ্যায়, ব্রনসন হ্যায়। তুমহারে পাস কেয়া হ্যায়, কেয়া হ্যায় তুমহারে পাস?” জিনপিং সগর্বে বলবেন “মেরে পাস মা হ্যায়। জ্যাক মা।” চীনের মুনাফাতন্ত্র হয়ত আরো নির্মম কারণ সেখানে সরকারকে প্রকাশ্যে গাল দেওয়ার উপায় নেই। তাই এমন মহামারী হতে পারল। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, চীন তবুও বেশ তাড়াতাড়ি সামলে নিল। তার পেছনেও সেই সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবদান।
এই বিশ্বযুদ্ধে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে লড়ছেন, নিরস্ত্র অনন্যোপায় সেনাপ্রধানরা সেভাবেই লড়েন। একশো তিরিশ কোটি লোকের দেশে যথেষ্ট ডাক্তার নেই, নার্স নেই, হাসপাতাল নেই। তাহলে আপনি কী করবেন? প্রার্থনা করবেন। উনি বারবার ঠিক সেটাই করতে বলছেন আমাদের। ঈশ্বর যদি কোরোনাটা সামলে দিতে পারেন, তাহলে পাকিস্তানকে উনি একাই দেখে নেবেন। অতএব আপনারা তেড়ে প্রার্থনা করুন। মসজিদ ছাড়া সব জায়গায় প্রার্থনা করতে পারেন।