টেস্ট পরীক্ষায় আবার ফেল: একটি পূর্ণাঙ্গ প্রহসন

এই সময়কালে টেস্ট দল পরপর দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া বিদেশের কোথাও সিরিজ জেতেনি। বিদেশে খেলা হলেই রোহিত, চেতেশ্বর পূজারা, কোহলি, অজিঙ্ক রাহানে ধ্যাড়াবেন আর কখনো ঋষভ পন্থ, কখনো জাদেজা, কখনো শার্দূল, কখনো ওয়াশিংটন সুন্দর রান করে মুখরক্ষা করবেন – এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথম অঙ্ক: সব ব্যাটাকে ছেড়ে টস ব্যাটাকে ধর

ভারত কেন ওভালে হারল? টসে জিতে রোহিত শর্মা অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে ডাকলেন বলে। ধারাভাষ্যকার অথবা খবরের কাগজে কলাম লেখা বিশেষজ্ঞ প্রাক্তন ক্রিকেটার, ক্রিকেট সাংবাদিক এবং জনতা – সকলে মিলে এই উত্তরটা তৈরি করে ফেলেছিলেন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম দিনের খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। কারণ অস্ট্রেলিয়া দিনের শেষে তিন উইকেটে ৩২৭ রানে পৌঁছে গিয়েছিল। রানের অযোধ্যা পাহাড় যে পরদিন হিমালয়ে পরিণত হবে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। তবু তো শেষমেশ অস্ট্রেলিয়া এভারেস্টে উঠতে পারেনি, কারাকোরামে পৌঁছেই থেমে গিয়েছিল। অতএব স্রেফ প্রথম দিনের আবহাওয়া দেখেই কেন ফিল্ডিং নেবে – এ সমালোচনা করা ভারি সহজ হয়ে গেল। কেউ আসল কথাটাই বললেন না। টস করতে যাওয়ার সময়ে তো অধিনায়ককে হাতে যে ১১ জন খেলবেন তাদের তালিকাটা নিয়ে যেতে হয়। সেখানে বাঘা বাঘা চারজন জোরে বোলারের নাম লেখা হয়ে গেছে। তারপর টস জিতে আর ব্যাটিং নেওয়া যায় নাকি? যদি ইংল্যান্ডের মাঠে প্রথম দিনের তাজা পিচে বল করার সুযোগই না নেব, তাহলে আর চারজন জোরে বোলারকে নিলাম কেন? সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার মত আহাম্মকি আর আছে নাকি?

এমন নয় যে এই কথাটা একমাত্র আমিই বুঝেছি আর সুনীল গাভস্কর, রবি শাস্ত্রী, আকাশ চোপড়া প্রমুখ তাবড় প্রাক্তন ক্রিকেটার ধরতে পারেননি। কিন্তু তাঁরা সেকথা বলেননি। তাঁরা বলেছেন বটে, যে পৌনে পাঁচশো উইকেট নিয়ে ফেলা রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে খেলানো উচিত ছিল। কিন্তু কেন বিদেশের মাঠে একের পর এক টেস্টে একমাত্র স্পিনার হিসাবে তাঁর বদলে দলে থাকেন রবীন্দ্র জাদেজা – তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতেও তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। ব্যাখ্যাটা হল, জাদেজার ব্যাটিং অশ্বিনের চেয়ে ভাল। অথচ ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই প্রশ্নাতীত নয়।

এই ম্যাচে জাদেজা প্রথম ইনিংসে ৪৮ রান করেছেন, যা না করলে ভারতের হারের ব্যবধানটা আরও বড় হত। দ্বিতীয় ইনিংসে স্কট বোল্যান্ডের সামনে দু বলের বেশি টিকতেই পারেননি। স্কোরারদের কাজ না বাড়িয়ে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তার জন্যে তাঁকে উড়িয়ে দেব না। কোনো খেলোয়াড়ই সব ম্যাচে সফল হন না। ঘটনা হল অশ্বিন আর জাদেজার গোটা কেরিয়ারের ব্যাটিং পাশাপাশি রাখলে পরিষ্কার দেখা যায় অলরাউন্ডার হিসাবে অশ্বিন মোটেই খুব পিছিয়ে নেই। এখন পর্যন্ত ৬৫ টেস্টে ২৬৮ উইকেটের সঙ্গে জাদেজার রান ২৭০৬, গড় ৩৫.৬০, ১৮ অর্ধশতরানে সঙ্গে শতরান তিনটে। অশ্বিন ৯২ টেস্টে ৪৭৪ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ২৬.৯৭ গড়ে ৩১২৯ রানও করে ফেলেছেন। তেরোটা অর্ধশতরানের পাশাপাশি পাঁচ-পাঁচটা শতরানও আছে তাঁর। এর উপর আছে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে সিডনিতে সারাদিন ব্যাট করে ম্যাচ বাঁচানো ৩৯, যার দাম একটা দ্বিশতরানের চেয়েও বেশি। অতি বড় জাদেজাভক্তও ম্যাচের উপর ওর চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে এমন কোনো ইনিংসের কথা বলতে পারবেন না।

তাছাড়া জাদেজা দেশের মাঠের ঘূর্ণি পিচে যতখানি প্রভাবশালী বোলার, বিদেশে ততটাই নির্বিষ। তিনি ওভালে বিষাণ সিং বেদীকে টপকে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বাঁহাতি স্পিনার হয়ে গেছেন বটে, কিন্তু ২৬৮ উইকেটের মধ্যে ১৯৪ খানা উইকেটই এসেছে দেশের মাটিতে (৪০ টেস্টে), উইকেট পিছু মাত্র ২০.৪৫ রান খরচ করে। কিন্তু বিদেশে গেলেই জাদেজা অন্য বোলার। পঁচিশটা টেস্ট খেলে পেয়েছেন মাত্র ৭৪ খানা উইকেট। একেকটার জন্যে খরচ হয়েছে ৩৪.৩২ রান। ওভাল টেস্টেও দেখা গেল প্রথম ইনিংসে তিনি কোনো প্রভাবই ফেলতে পারলেন না। দ্বিতীয় ইনিংসে যখন বল রীতিমত ঘুরছে এবং লাফাচ্ছে তখন তিনটে উইকেট পেলেন বটে, কিন্তু স্টিভ স্মিথ আর ট্রেভিস হেডের দ্রুত রান তোলার তাড়া না থাকলে এবং ক্যামেরন গ্রীন স্কুল ক্রিকেটারের মত করে ডিফেন্স না করলে সেগুলো জুটত না। মহেন্দ্র সিং ধোনি অধিনায়ক থাকাকালীন একবার ইংল্যান্ডেই একটা টেস্টে জাদেজার স্পিন এতটাই পানসে হয়ে গিয়েছিল যে ধোনি উইকেট থেকে পিছিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে দিয়ে মিডিয়াম পেস বোলিং করিয়েছিলেন। তবু একমাত্র স্পিনার হিসাবে জাদেজাই খেলবেন, অশ্বিন নয়। তাঁরও বিদেশের রেকর্ড (৩৭ ম্যাচে ১৩৭ উইকেট, গড় ৩১.৪৫) দেশের তুলনায় সাধারণ, কিন্তু গত কয়েকটা বিদেশে সফরে অনেকখানি উন্নতি দেখা গিয়েছিল। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া সফরে এ যুগের সম্ভবত সেরা টেস্ট ব্যাটার স্মিথকে তিনি বোতলবন্দি করে ফেলেছিলেন।

এই অশ্বিনের চেয়ে শার্দূল ঠাকুর আর উমেশ যাদবকেও বেশি প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছে। উমেশ সেই ২০১১ সাল থেকে টেস্ট খেলছেন। সাতান্নটা টেস্ট খেলার পরেও তাঁর বোলিংয়ে অভিজ্ঞতার কোনো ছাপ দেখা যায় না। আজও গড় তিরিশের নিচে নামল না, ওভার পিছু সাড়ে তিনের বেশি রানও দিয়ে ফেলেন। কোনো ওভারে একটাও চার মারার বল না দিলে ধারাভাষ্যকাররা আপ্লুত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি নাকি দারুণ রিভার্স সুইং করান – এরকম একটা যুক্তি ওভালে তাঁর নির্বাচনের সপক্ষে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন শাস্ত্রীরা। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার কারণে সাধারণত বল এমনিই সারাদিন সুইং করে। সেখানে যে রিভার্স সুইং বিশেষজ্ঞের বিশেষ দরকার পড়বে না, তা কি ওই বোদ্ধারা জানেন না? আর দরকার পড়লেই বা। উমেশ তো ওয়াকার ইউনিসের মাপের বোলার নন। শার্দূলেরও না আছে গতি, না বিরাট সুইং। যতই নটা টেস্টে ২৯ খানা উইকেট পেয়ে থাকুন, দারুণ বোলিং সহায়ক পরিবেশ না পেলে তিনি নেহাত সাধারণ। ব্যাটেও এমন কিছু ধারাবাহিক নন, গড় মোটে ২০.৩৩। ত্রিশোর্ধ্ব এই ক্রিকেটারদের কাছ থেকে যে নতুন কিছু পাওয়ার থাকতে পারে না, সেকথা রোহিত আর সারাক্ষণ মনোযোগী ছাত্রের মত খাতায় নোট নেওয়া রাহুল দ্রাবিড় বোঝেন না কেন?

বোঝেন না যে সেকথা কিন্তু গাভস্কররা বলেন না। তাঁরা বরং টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তগুলোর সপক্ষে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেন। কারণ নুন খেলে গুণ গাইতেই হয়। নইলে নুন খাওয়া ছাড়তে হয়। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড শুধু পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বোর্ডই নয়, একমাত্র বোর্ড যারা জাতীয় দল এবং আইপিএলের সম্প্রচারের সুতোও নিজেদের হাতে রাখে। ধারাভাষ্যকাররা তার হাতের পুতুল। অপছন্দের কথা বলেছ কি চুক্তি বাতিল। অতএব বোর্ড যা করে সব ভাল, টিম ম্যানেজমেন্টও সবসময় ভালই করে, তবে মাঝেমধ্যে দু-একটা ভুল হয়ে যায় আর কি। যেমন টস জিতে ফিল্ডিং নিতে গিয়ে ব্যাটিং নেওয়া হয়ে যায়। তা বলে কি আর অচল ক্রিকেটার দলে নেওয়া হয়? মোটেই তা বলা যায় না।

দ্বিতীয় অঙ্ক: ভাঙব তবু মচকাব না

যাঁরা মন দিয়ে ওভাল টেস্ট দেখেছেন এবং পঞ্চম দিন সকাল সকাল ভারত হেরে যাওয়ার পরেও ভগ্ন হৃদয়ে অস্ট্রেলিয়ার ট্রফি হাতে নেওয়া পর্যন্ত সম্প্রচার দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই দুটো কথা ভাবছেন। প্রথমত, ডুবিয়েছে ভারতীয় দলের ক্রিকেটাররা। খামোকা প্রাক্তন ক্রিকেটারদের সমালোচনা করা কেন? দ্বিতীয়ত, অন্য সময়ে যা-ই করুন, ওভাল টেস্টের পরে তো আমাদের প্রাক্তনরা যারপরনাই সমালোচনা করেছেন। গাভস্কর তো এত রেগে গিয়েছিলেন যে স্টার স্পোর্টসের অ্যাঙ্কর ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হচ্ছিল পালাতে পারলে বাঁচেন। দ্রাবিড়ের দুই পুরনো বন্ধু সৌরভ গাঙ্গুলি আর হরভজন সিংও তাঁকে বিস্তর চোখা চোখা প্রশ্নে বিদ্ধ করেছেন। তাহলে এঁদের সমালোচনা করা কেন?

ঠিক কথা। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আসতে একটু সময় লাগবে। আগে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিই। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের চুক্তি যতই মহার্ঘ হোক, চোখের চামড়া তো কিনতে পারে না। ফলে ২০৯ রানে টেস্ট হারার পরে মিষ্টি কথা বলা কী করে সম্ভব? তাছাড়া হাজার হোক, গাভস্কর, সৌরভদের ক্রিকেট দুনিয়ায় তাঁদের খেলোয়াড় জীবনের অর্জনগুলোর জন্য বিশেষ সম্মান আছে। সে সম্মান তাঁরা বিসর্জন দেন কী করে? তাঁরা তো আর রাহুল কাঁওয়াল বা অর্ণব গোস্বামী নন যে বিজেপির গোহারা হারকে লাইভ টিভিতে ‘সম্মানজনক হার’ বলে চালানোর চেষ্টা করবেন অন্য দেশের লোকে কী ভাবল সেসবের তোয়াক্কা না করে। ক্রিকেটার গাভস্করের নামে গান বাঁধা হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে, অধিনায়ক সৌরভকে এখনো সমীহ করে সারা বিশ্বের ক্রিকেটমহল। সেগুলোর মূল্য ক্রিকেট বোর্ডের মহাত্মা গান্ধীর ছবিওয়ালা কাগজ এখনো পুরোপুরি ভুলিয়ে দিতে পারেনি। তার উপর ধৈর্যচ্যুতির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিদেশের মাঠে ভারত এই প্রথম হারল না, এর চেয়ে লজ্জাজনকভাবেও হেরেছে। কিন্তু একটা সাধারণ পিচে পাঁচদিন সবদিক থেকে পর্যুদস্ত হয়ে সেই সৌরভের আমল থেকে কতবার হেরেছে তা হাতে গুণে বলা যাবে। ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদানই হল বিদেশে জিততে শেখানো। গাভস্করও বিদেশে বহু যুদ্ধের নায়ক। ওই ওভালেই তাঁর মহাকাব্যিক ২২১ রান আছে চতুর্থ ইনিংসে। সেদিন চারশোর বেশি রান তাড়া করে ভারত আরেকটু হলে জিতেই যাচ্ছিল। ফলে এই হার তাঁদের হজম না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু…

এই কিন্তুর মধ্যেই আছে দ্বিতীয় উত্তর। রাগত প্রাক্তনরা কী বলেছেন তা কি খেয়াল করেছেন? বিরাট কোহলির আউট সম্পর্কে মতামত চাইলে ক্রুদ্ধ গাভস্কর বলেছেন, ওকেই জিজ্ঞেস করুন চতুর্থ-পঞ্চম স্টাম্পের বল কেন তাড়া করতে গেছিল। সৌরভ দ্রাবিড়কে প্রশ্ন করেছেন, প্রথমে ব্যাট করার কী যুক্তি ছিল? তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে ভারতের প্রথম পাঁচ ব্যাটার দীর্ঘদিন হল রান করতে পারছেন না। ব্যাটিংয়ে কি রদবদলের দরকার নেই? হরভজন জিজ্ঞেস করেন, ভারতীয় দলের মহাতারকারা বিদেশের পিচে কেন রান করতে পারেন না? বোলাররাই বা সুবিধা করতে পারেন না কেন?

প্রশ্নগুলো চোখা বটে, কিন্তু বেশি চোখা লাগছে এই কারণে যে ভারতের প্রাক্তনদের মুখ থেকে বর্তমান ক্রিকেটারদের স্তুতি শুনতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ব্যর্থ হলে সমালোচনা করা, প্রশ্ন করাই যে তাঁদের কাজ – একথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। এমনটা কিন্তু অন্য দেশে হয় না। ২০২১-২৩ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ড জঘন্য খেলছিল। অধিনায়ক জো রুট ছাড়া প্রায় কেউই রান করতে পারছিলেন না, বোলারদের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। রুটের অধিনায়কত্বও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছিল না। এমনকি দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেও শোচনীয় পরাজয় ঘটে ইংল্যান্ডের। সেইসময় নাসের হুসেন, মার্ক বুচারের মত প্রাক্তনরা কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টকে ছেড়ে কথা বলেননি। তাঁর ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে পরিষ্কার বলতেন রুটকে দিয়ে আর অধিনায়কত্ব হবে না। রুট শেষপর্যন্ত দায়িত্ব ছেড়ে দেন, ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে জাতীয় দল এবং আরও অনেককিছুর দায়িত্বে থাকা অ্যান্ড্রু স্ট্রস। তাঁর জায়গায় আসেন রবার্ট কী। তারপর টেস্ট দলের কোচ ক্রিস সিলভারউডকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে, অধিনায়ক হন বেন স্টোকস। দলেও বেশকিছু রদবদল করা হয়। তারপর থেকে ইংল্যান্ড যে ক্রিকেট খেলছে তাতে শুধু যে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাই নয়, তারা টেস্ট ক্রিকেটকে নতুন যুগে নিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাই এখন আলোচনার বিষয়। ম্যাককালামের আদরের নাম ব্যাজ। সেই থেকে তাদের খেলার ধরনের নামকরণ হয়েছে ব্যাজবল।

অথচ আমাদের প্রবাদপ্রতিম প্রাক্তনদের দেখুন। পৃথিবীর সেরা মানের পারিশ্রমিক, অনুশীলনের সুযোগসুবিধা ইত্যাদি পেয়েও সেই ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে আর কোনো আইসিসি ট্রফি জেতেনি ভারত। উপরন্তু এই সময়কালে টেস্ট দল পরপর দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া বিদেশের কোথাও সিরিজ জেতেনি। বিদেশে খেলা হলেই রোহিত, চেতেশ্বর পূজারা, কোহলি, অজিঙ্ক রাহানে ধ্যাড়াবেন আর কখনো ঋষভ পন্থ, কখনো জাদেজা, কখনো শার্দূল, কখনো ওয়াশিংটন সুন্দর রান করে মুখরক্ষা করবেন – এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দশ বছর ধরে এই ঘটনা বারবার ঘটে চললেও এখনো গাভস্কর, সৌরভরা নাম করে বলতে পারছেন না অমুককে বাদ দেওয়া উচিত। ২০১৩ সালে যখন ভারত বহুকাল পরে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের কাছে সিরিজ হারল, তখন জিওফ্রে বয়কট আর কপিলদেব কিন্তু রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন, শচীন তেন্ডুলকর উন্নতি করতে না পারলে অবসর নিন। আজ বিরাটের নাম মুখে আনতে পারছেন না আমাদের প্রাক্তনরা, বহু ভারতীয় গিন্নী যেমন কর্তার নাম মুখে আনেন না। অথচ একা কোহলিই যে কতখানি ডুবিয়ে দিচ্ছেন ভারতকে, তার স্পষ্ট পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন ক্রিকেট অ্যানালিটিক্স সংস্থা ক্রিকভিজের সিনিয়র ব্রডকাস্ট অ্যানালিস্ট সোহম সরখেল। নিচের এই টুইটসূত্রে চোখ রাখলেই দেখতে পাবেন, সদ্য শেষ হওয়া টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে অন্য ব্যাটারদের ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতের চার নম্বর ব্যাটার বাদে সব জায়গার ব্যাটাররাই বিপক্ষের ব্যাটারদের চেয়ে গড়ে ভাল রান করেছেন। কিন্তু একা কোহলির ব্যর্থতাই এত বিরাট যে তা অন্য সবার কাজে জল ঢেলে দিয়েছে। ২০২০ সালে তাঁর গড় ছিল ১৯, ২০২১ সালে ২৮ আর ২০২২ সালে ২৬। এ বছর এখন পর্যন্ত ৪৫, কিন্তু তার কারণ আমেদাবাদের ঢ্যাবঢেবে পিচে ১৮৬। ওই ইনিংস বাদে চলতি বছরেও তাঁর গড় ২৫।

তৃতীয় অঙ্ক: মানুষের তৃতীয় হাত

জিততে পারুন আর না-ই পারুন, ভারতীয় দলের ক্রিকেটার বা কোচের মুখে সবসময় খই ফোটে। এ জিনিসটা শিখিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই ধোনি আর শাস্ত্রীর। ধোনি ইংরেজি অভিধান থেকে একটি চমৎকার শব্দ চয়ন করেছিলেন – প্রোসেস। হেরে গেলেই বলতেন, আমরা হারজিত নিয়ে চিন্তিত নই। প্রোসেস ‘ফলো’ করা হয়েছে কিনা সেটাই বড় কথা। সেটা করা হলে ‘রেজাল্ট’ ঠিক এসে যাবে। কথাগুলো চমৎকার। বেশ একটা মহাত্মা গান্ধীসুলভ প্রশান্তি রয়েছে কথাগুলোর মধ্যে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ধোনি বাবা হয়ে গেলেন, চুল পেকে গেল, ভারতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে ফেললেন, ‘রেজাল্ট’ তো আজও এসে পৌঁছল না। তাঁর উত্তরসূরী কোহলি আর ভারতীয় দলের তৎকালীন কোচ শাস্ত্রী প্রোসেসের সঙ্গে যোগ করেছিলেন আরেকটি শব্দ – ইনটেন্ট। বারবার সাংবাদিক সম্মেলনে এসে দুজনেই বলতেন, ইনটেন্টই হচ্ছে আসল। ওটা যার আছে তার উপর টিম ম্যানেজমেন্টের ভরসা আছে। ইনটেন্ট দেখিয়ে হারলে কোনো দুঃখ নেই। এই ইনটেন্ট নেই বলে পূজারা যখন ধারাবাহিক ছিলেন তখনো বারবার বাদ পড়তে হয়েছে, ফর্মে থাকা রাহানেকে বসিয়ে রেখে নড়বড়ে রোহিতকে টেস্ট খেলানো হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়।

এইবার দ্বিতীয় অঙ্কে উত্থাপিত প্রথম প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে ফেলা যাক। ভারতীয় ক্রিকেট দলের ব্যর্থতায় প্রাক্তনদের সমালোচনা করছি কেন?

এই যে ইনটেন্ট নামক ধাষ্টামো, এর টেস্ট ক্রিকেটে কোনো মানেই হয় না জেনেও আমাদের প্রাক্তনরা কিন্তু সেসময় অধিনায়ক কোহলি আর কোচ শাস্ত্রীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন, দুহাত তুলে সমর্থন করেছিলেন। ২০১৫ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে প্রথম দুটো টেস্টে পূজারাকে বসিয়ে রাখা হয়, কারণ তার আগের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে তাঁর মধ্যে ইনটেন্ট দেখা যায়নি। তৃতীয় টেস্টে দুই ওপেনারের অভাব ঘটায় অগত্যা তাঁকে খেলানো হয় এবং তিনি ১৪৫ রানে অপরাজিত থাকেন। বস্তুত, দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য রানে আউট হলেও, কম রানের সেই ম্যাচে ওই ইনিংসই তফাত গড়ে দেয় এবং ভারত জেতে। পূজারা প্রথম ইনিংসে যখন পঞ্চাশ পেরোন, তখন ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মঞ্জরেকর গাভস্করকে জিজ্ঞেস করেন পূজারা কি দলে নিজের জায়গা পাকা করতে পারলেন, নাকি শতরান করলে জায়গা পাকা হবে? সানি উত্তর দেন, এই দলে যা প্রতিভার ছড়াছড়ি তাতে আলোচনায় থাকতে গেলে পূজারাকে দেড়শোর বেশি করতে হবে। বিরক্ত কলামনিস্ট মুকুল কেশবন দ্য টেলিগ্রাফ-এ লেখেন “A century and a half…what team of Titans was this, what bastion of Bradmans was Pujara trying to breach?” সেই ইনটেন্টের ভূত যে পূজারাকে আজও তাড়া করে বেড়াচ্ছে, তার প্রমাণ ওভালের দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর চরিত্রবিরোধী এবং খেলার পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় শট খেলতে গিয়ে আউট হওয়া। ক্রিজে জমে যাওয়া রোহিতের হঠাৎ নাথান লায়নের সোজা বলকে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হওয়া বা কোহলির কয়েকটা ডট বল হতেই বহুদূরের বল তাড়া করে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যাওয়ার পিছনেও ইনটেন্টের ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে।

ভারতীয় ক্রিকেটের একেবারে ভাবনার জায়গায় এই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগুলো যখন করা হয়েছে, তখন হাততালি দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ প্রাক্তনরা। কোহলির জিম-পাগল হওয়া এবং গোটা দলকে জিম-পাগল করে তোলাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন আমাদের প্রাক্তনরা, হর্ষ ভোগলেরা এবং প্রাতঃস্মরণীয় ক্রিকেট সাংবাদিকরা। অথচ মাইকেল হোল্ডিং, ওয়াসিম আক্রাম, কপিলদেবের মত নমস্য জোরে বোলাররা চিরকাল বলে এসেছেন, ক্রিকেটার মানে কুস্তিগীর নয়। তাদের পেশি ওরকম হওয়ার দরকার নেই। তাদের শরীর তৈরি করতে সেরা প্র্যাকটিস হল নেট প্র্যাকটিস। বিশেষ করে জোরে বোলারদের উচিত যত বেশি সম্ভব বোলিং করা। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এঁরা বারবার বলেছেন, এমনকি অফ সিজনেও কয়েকশো ওভার বল করতেন নেটে। সেভাবেই চোট-আঘাত মুক্ত অবস্থায় টানা প্রায় দুই দশক ভারতের হয়ে খেলে গেছেন কপিল। অথচ এখন আমাদের জিম করা ক্রিকেটারদের এমন অবস্থা যে ব্যাটাররাই অনেকে টানা দুটো সিরিজ খেলে উঠতে পারেন না। আর বোলাররা? যশপ্রীত বুমরা সেই যে আহত হয়েছেন, কিছুতেই মাঠে ফিরতে পারছেন না। বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন কিনা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, নভদীপ সাইনি – যাঁকেই ভবিষ্যৎ বলে ভাবা হয়, কিছুদিন পরেই দেখা যায় তিনি আহত। অতএব ঘুরে ফিরে বুড়িয়ে যাওয়া উমেশ আর মাঝারি মানের শার্দূলকেই খেলাতে হয়। অর্থাৎ গোলমালটা প্রথম একাদশ নির্বাচন থেকে শুরু হয়নি। দেশের কয়েকশো খেলোয়াড়ের মধ্যে থেকে ১৪-১৫ জন বেছে নেওয়ার সময়েই গোড়ায় গলদ হয়ে গেছে।

ব্যাটার বেছে নেওয়ায় গলদ তো আরও গভীর। কারণ টপ অর্ডার এবং মিডল অর্ডারের নিষ্কর্মাদের সরানো যাবে না। পূজারা, রাহানেদের তবু বাদ দেওয়া গেছে। তাঁদের কাউন্টি ক্রিকেটে বা ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করে ফিরতে হয়েছে। কিন্তু রোহিত আর কোহলির আছে বিপুল বিজ্ঞাপনী সমর্থন। অর্থাৎ তাঁদের উপর কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে রেখেছে বহু কোম্পানি। তার মধ্যে আছে ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে জুয়া খেলার কোম্পানিগুলোও। তাদের কেউ কেউ এমনকি জাতীয় দলের শার্ট স্পনসর, অমুক স্পনসর তমুক স্পনসর। তাদের আর্থিক ক্ষতি হয় এমন কাজ মোটেই করা চলে না। অতএব রান করতে না পারলেও শালগ্রাম শিলার মত এদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ তারকাদের দলে রাখতেই হবে। রঞ্জি ট্রফিতে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করা সরফরাজ খানরা যদ্দিন আইপিএলে রানের বন্যা বইয়ে শাঁসালো স্পনসর জোগাড় করতে না পারছেন তদ্দিন বাড়ির টিভিতে টেস্ট ম্যাচ দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না। এর ফলে দলের যে ক্রিকেটিয় ক্ষতি, তা পূরণ করতেই টেস্ট দল নির্বাচনের সময়ে বোলারদের বেলাতেও দেখা হয় ভাল ব্যাট করতে পারে কিনা, উইকেটরক্ষক বাছার সময়েও তাই।

অগ্রাধিকারের এই উলটপুরাণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ওভাল টেস্টে কে এল রাহুলকে উইকেটরক্ষক হিসাবে খেলানোর নিদান দিয়ে ফেলেছিলেন বহু বোর্ড ঘনিষ্ঠ ক্রিকেট সাংবাদিক। রাহুল ফিট থাকলে বোধহয় সেটাই ঘটত। যদিও সকলেই জানেন ইংল্যান্ডে উইকেটরক্ষা ভীষণ শক্ত কাজ কারণ বল ব্যাটারকে অতিক্রম করার পরেও সুইং করে অনেকসময়, পিচে অসমান বাউন্সও থাকতে পারে। সেখানে পাঁচদিনের খেলায় রাহুলের মত ঠেকনা দেওয়া উইকেটরক্ষক খেলানো আর খাদের ধারে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা একই কথা। ওভালে কোনা শ্রীকর ভরত প্রশংসনীয় উইকেটরক্ষা করেছেন। তারপরেও সোশাল মিডিয়ায় “ওকে দিয়ে হবে না” লিখে চলেছেন বহু বোদ্ধা সাংবাদিক। পন্থ থাকলে আলাদা কথা ছিল। তিনি অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বেচারা ভরত শান্তিতে খেলতে পারবেন না। ঋদ্ধিমান সাহাকে যখন দ্রাবিড় ডেকে বলে দিয়েছিলেন, তাঁর বয়স হয়েছে বলে আর টেস্ট দলে না নেওয়ার কথা ঠিক করেছে টিম ম্যানেজমেন্ট, তখন মনে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মত নতুন খেলোয়াড় তুলে আনার প্রগতিশীল পথে এগোচ্ছে ভারতীয় দল। এখন বোঝা যাচ্ছে, ওসব কিছু নয়। ঋদ্ধিমানের দরকার ছিল অমুক ডট কমের একটা এনডর্সমেন্ট চুক্তি। তাহলেই বয়সটা বাড়তি না হয়ে কমতি হয়ে যেত।

দল নির্বাচনে এইসব শর্তাবলী প্রযোজ্য বলেই বোধহয় বোর্ড পাঁচজনের নির্বাচন সমিতিতে চারজনকে রেখে, অস্থায়ী চেয়ারম্যান রেখে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে সেই ২০২০ সাল থেকে। তাঁদের আর গুরুত্ব কী? রাজ সিং দুঙ্গারপুরের মত বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো সাড়ে ষোলো বছরের ছেলেকে দলে ঢুকিয়ে দেওয়া বা যাঁকে ভবিষ্যতের অধিনায়ক বলে কেউ ভাবছেই না, তাকে গিয়ে “মিয়াঁ, ক্যাপ্টেন বনো গে?” বলার অধিকারই আজকের নির্বাচকদের নেই। তাঁরা স্রেফ দক্ষ বাজিকরের হাতের পুতুল।

সমস্ত ক্রিকেট ব্যবস্থাটাই যে অব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে সেকথা বলার কাজ তো বিশেষজ্ঞ, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিকদেরই। যিনি যত বড় নাম, তাঁর দায়িত্ব তত বেশি। অথচ সকলেই সুকুমার রায়ের ছড়ার মত “এই দুনিয়ার সকল ভাল, আসল ভাল নকল ভাল” বলে চালিয়ে যাচ্ছেন এক দশক যাবৎ। কারণ কেউ ধারাভাষ্য দেওয়ার চুক্তির লোভ সামলাতে পারছেন না, কারোর চাকরি বোর্ডের জো হুজুরি না করলে চলে যাবে। যেমন স্মৃতি ইরানিকে প্রশ্ন করায় এক সাংবাদিকের চাকরি গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাংবাদিকরা না হয় চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত, কিন্তু ভারতের হয়ে খেলা এবং এত বছর মোটা মাইনের ধারাভাষ্যের কাজ করা বিশেষজ্ঞরা এখনো জো হুজুরি করে যাবেন আর দুকথা শুনবেন না তা কি হয়?

আজ ভারতীয় ক্রিকেটে যে হারজিতের যে কোনো মূল্য নেই, রোহিত-কোহলিরা যে বারবার ব্যর্থতার পরেও কলার তুলে ‘গ্রেট’ অভিধা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং প্রত্যেকটা হারের পর নতুন নতুন অজুহাত খাড়া করতে পারেন তার জন্যে তো ভারতীয় ক্রিকেটের গোটা বাস্তুতন্ত্র দায়ী। এমন বাস্তুতন্ত্র তৈরি করায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন প্রাক্তনরা। ওভালের পরাজয়ের পরেও একগুচ্ছ অজুহাত খাড়া করেছেন অধিনায়ক রোহিত। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আইপিএল ফাইনালের পরে কেন হবে? জুনের বদলে মার্চে কেন হবে না? হলেই তো প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট সময় পাওয়া যেত। এত বড় প্রতিযোগিতার ফাইনাল তিন ম্যাচের হওয়া উচিত – এমন দাবিও করেছেন। হেরোদের ঘ্যানঘ্যান শুনতে কারই বা ভাল লাগে? অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স তাই বিদ্রুপ করেছেন “পঞ্চাশটা ম্যাচের সিরিজ হচ্ছে আদর্শ। কিন্তু অলিম্পিকে সোনার মেডেল জেতার জন্যে একটাই রেস হয়। এএফএল, এনআরএল সিরিজগুলোরও ফাইনাল থাকে। একেই খেলা বলে।”

চতুর্থ অঙ্ক: সাধের লাউ

পৃথিবীর সমস্ত খেলার নিয়ামক সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল সংস্থার নাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল, অর্থাৎ আইসিসি। তাদের টিকি বাঁধা আছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছে, কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি টাকার জোগান দেয় আইসিসিকে। বিনিময়ে সবচেয়ে বেশি লাভের গুড়ও নেয়। ফলে ভারতীয় বোর্ড চাইলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালও তিন ম্যাচের হতেই পারে, ইংল্যান্ডের বদলে আমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে হতে পারে। সেখানে এমন পিচ বানিয়ে দেওয়া হবে যে আমি-আপনি গিয়ে বল করলেও এক হাত ঘুরবে। কিন্তু কথা হল, ভারতীয় বোর্ড কি অতটা মাথা ঘামাবে?

তার সোনার ডিম পাড়া হাঁস হল আইপিএল। সেই আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব থেকে এত টাকা আয় হয় যে আগামী দিনে প্রতিযোগিতাটাকে টেনে আরও লম্বা করা হচ্ছে। আইসিসি তাতে মাথা নেড়ে সায়ও দিয়ে ফেলেছে। আইপিএল সম্পর্কে আমাদের সমস্ত বর্তমান ও প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার এবং প্রাতঃস্মরণীয় সাংবাদিকরা উচ্ছ্বসিত। তাঁদের কথাবার্তায়, লেখাপত্রে মনে হয় মানবজাতি এই প্রথম একটি জিনিস আবিষ্কার করতে পেরেছে যার কোনো নেতিবাচক দিক নেই। সমালোচনা করার মত একখানা বৈশিষ্ট্যও নেই। অথচ ওভাল টেস্টে হারের পর হঠাৎ সকলের মনে পড়েছে, যে আইপিএলটা না থাকলে এই ফাইনালের জন্যে যথেষ্ট প্রস্তুতির সময় পাওয়া যেত।

আরও পড়ুন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে মরে প্রমাণ করতে হবে সে মরেনি

অনেকে বলছেন এই হারের পর নাকি দ্রাবিড়ের চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে। হয়ত সেটা আন্দাজ করে মরিয়া হয়ে অথবা চাকরিটা যাবেই ধরে নিয়ে তিনি বলেছেন ক্রীড়াসূচি নিয়ে তিনি কখনোই খুশি হতে পারেন না। ফাইনালের দিন কুড়ি আগে যদি ইংল্যান্ডে পৌঁছনো যেত আর দু-তিনটে সাইড ম্যাচ পাওয়া যেত, তাহলে চমৎকার প্রস্তুতি হত। শুনলে মনে হয় ইনি রিপ ভ্যান দ্রাবিড়। নিজের খেলোয়াড় জীবন শেষ হওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এইমাত্র জেগে উঠেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যা ঠাসা ক্রীড়াসূচি তাতে সাইড ম্যাচ ব্যাপারটা তো বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। বিশেষ করে ভারতীয় দলের অফ সিজন বলে কিছু নেই দ্রাবিড় যখন ক্রিকেটার তখন থেকেই। তিনি যখন অবসর নেন আইপিএল তখনো চারাগাছ। এখন সে বটবৃক্ষ, দুর্জনে বলছে ছদ্মবেশী সেপ্টোপাস। তার খিদে ক্রমশ বাড়ছে, বিশ্বের অন্যত্র তার বীজ থেকে আরও নানা মাংসাশী লিগের জন্ম হচ্ছে যারা ক্রমশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে গিলে নেবে। এমন দিনে ভারত অধিনায়ক চাইছেন তিন ম্যাচের ফাইনাল, কোচ সাইড ম্যাচের কথা বলছেন। এসব কি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা রোজগার করার অপরাধবোধের প্রকাশ, নাকি আমাদের দেশের পরিচালকদের মত বৈদিক যুগে ফিরে যাওয়ার সাধ?

গত ইংল্যান্ড সফরে ভারতীয় দলের কোচ থাকা অবস্থায় যে শাস্ত্রী কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে সিরিজটা ভালয় ভালয় শেষ করার চেয়ে নিজের বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তিনি আবার জ্ঞান দিয়েছেন, আইপিএল বাদ দিয়ে টেস্টের জন্যে প্রস্তুতি নেওয়ার কাজটা খেলোয়াড়দের নিজ দায়িত্বেই করা উচিত। যোগ করেছেন, ভারতীয় বোর্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজদের সঙ্গে চুক্তিতে একটা শর্ত রাখা উচিত যাতে খেলোয়াড়রা ভবিষ্যতে এত বড় ম্যাচের জন্যে এরকম সুযোগ পায়। এত উত্তম প্রশাসনিক পরিকল্পনা তিনি জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়ে কোথায় ছিল কে জানে? তিনি দায়িত্বে থাকতেই ভারত প্রথমবার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠে। তখন এমন কোনো প্রয়াস তিনি করেননি, হার থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন কোনো পরামর্শই বোর্ডকে দিয়ে যাননি। এখন অসংখ্য ভাল ভাল ধারণা তাঁর মাথায় গিজগিজ করছে।

পঞ্চম অঙ্ক: যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ

ক্রিকেট এখন আগে অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা, পরে খেলা। সে ব্যবসার সবচেয়ে কম চাহিদার মালটির নাম টেস্ট ক্রিকেট। অতএব আপনি আরও একটা আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারত জিততে পারল না বলে যতই দুঃখ পান, জানবেন কর্তারা বা ক্রিকেটাররা আপনার দুঃখের ভাগী নয়। ভারতীয় ক্রিকেটারদের দুঃখে প্রাণ যাচ্ছে এমন মনে করার কারণ নেই, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররাও টেস্ট ক্রিকেটের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত বলে ভাববেন না। প্রমাণ চান? ওভাল টেস্টের একটা মিনিটও ইংল্যান্ডের বিখ্যাত বা কুখ্যাত খামখেয়ালি আবহাওয়ার জন্যে নষ্ট হয়নি। অথচ পাঁচদিন মিলিয়ে মোট ৪৪ ওভার কম খেলা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো দলেরই দিনে যতগুলো ওভার বল করা সম্ভব ততগুলো সম্পূর্ণ করার গরজ ছিল না।

সুতরাং যদি পাঁচদিনের খেলার প্রতি ভালবাসা থেকে থাকে, তাহলে বয়স্ক ঠাকুমার ফোকলা হাসি যেভাবে লোকে শেষ কয়েকদিন প্রাণভরে দেখে নেয়, সেইভাবে উপভোগ করে নিন। এ খেলা বাঁচুক তা কর্তারা চান না, সম্ভবত খেলোয়াড়রাও নয়। নইলে নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট, ইংল্যান্ডের জেসন রয়রা স্বেচ্ছায় দেশের বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতেন না ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খেলবেন বলে। কর্তারা ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খোলায় লাগাম দিতেন, টেস্ট ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় করে তুলতে গোলাপি বলের দিন-রাতের টেস্ট আয়োজন ক্রমশ বাড়াতেন। হচ্ছে ঠিক উল্টো – বোল্টরা দলে ভারি হচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর এবার সৌদি আরবেও বিপুল অর্থকরী ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ চালু হবে। আর দিন-রাতের টেস্টের কেউ নামোচ্চারণ করছে না।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

দল হারলেও গুহার চিচিং বনধ হতে দেবে না ক্রিকেট বোর্ড

এঁদের সময় শেষ। সেকথা এঁদের ভক্তরা মানবেন না, তার চেয়েও বড় কথা ক্রিকেট বোর্ড মানবে না। কারণ এই তারকাদের পিছনে টাকার থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একগুচ্ছ স্পনসর।

রবিচন্দ্রন অশ্বিন খেললেই কি ভারত ওভালের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল জিতে যেত? যশপ্রীত বুমরা যদি ফিট থাকতেন এবং খেলতেন, তাহলে কি ভারত জিতে যেত? ঋষভ পন্থ যদি প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে অন্যের এবং নিজের জীবন বিপন্ন করে শয্যাশায়ী না হতেন, তাহলে কি শেষ ইনিংসে ৪৪৪ রান তাড়া করার বিশ্বরেকর্ড করে জিতিয়ে দিতেন? এগুলোর কোনো ঠিক বা ভুল উত্তর হয় না, কারণ কী হলে কী হত কেউ বলতে পারে না। তবে তথ্য বলছে, ২০২১ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে এই তিনজনই খেলেছিলেন। তবু ভারত হেরেছিল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে এই তিনজনের উল্লেখযোগ্য অবদান সত্ত্বেও ভারত সেই ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পরে আর কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টেই খেতাব জেতেনি। শুধু টেস্ট ক্রিকেটের কথাই যদি বলি, গত দশ বছরে দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া ভারতের আর কোনো বলার মত সাফল্য নেই। দেশের মাঠে দাপটে যে কোনো দলকে হারিয়ে দেওয়ার রেকর্ড ভারতের টেস্ট ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। কিন্তু অতীতে একাধিক ভারতীয় দল ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ জিতেছে, নিউজিল্যান্ডে জিতেছে। এর একটাও রবি শাস্ত্রী-বিরাট কোহলি, রাহুল দ্রাবিড়-কোহলি বা দ্রাবিড়-রোহিত শর্মার দ্বারা হয়ে ওঠেনি। এমনকি গত দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভাঙাচোরা, নতুন মুখদের নিয়ে তৈরি দলটার কাছেও হেরে এসেছে এই দল। সুতরাং এই একটা ম্যাচে অমুক, অমুক আর অমুক থাকলেই ভারত জিতে যেত কিনা সে প্রশ্ন না তুলে বরং অন্য কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানা আছে কিনা দেখুন।

১) কোন টেস্ট খেলিয়ে দেশের নির্বাচন সমিতিতে যতজন নির্বাচক থাকার কথা ততজন নেই
২) কোন টেস্ট খেলিয়ে দেশের নির্বাচন সমিতিতে প্রধান নির্বাচক বলে কেউ নেই?
৩) কোন টেস্ট খেলিয়ে দেশের জাতীয় দল নির্বাচনের পর কোনো সাংবাদিক সম্মেলন হয় না?

জানেন কি, এই তিনটে প্রশ্নেরই উত্তর ভারত? যে কোনো খেলার আন্তর্জাতিক স্তরটাকে যাঁরা পেশাদার এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের ব্যাপার বলে মনে করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝবেন যে দিনের পর দিন এই ফাজলামি চালিয়ে গিয়ে বিশ্ব খেতাব কেন, কোনো সিরিজই জেতার আশা করা উচিত নয়।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী পাঁচজন নির্বাচক থাকার কথা। কিন্তু আছেন চারজন – শিবসুন্দর দাস, সুব্রত ব্যানার্জি, সলিল আঙ্কোলা আর শ্রীধরণ শরথ। এ বছর জানুয়ারি মাসে পাঁচ সদস্যের নির্বাচক কমিটিই ঘোষণা করা হয়েছিল, তার একজন চেয়ারম্যানও ছিলেন – চেতন শর্মা। কিন্তু পরের মাসেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হয় একটা স্টিং অপারেশনে নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার ফলে। তারপর চার মাস কেটে গেছে। ভারত দেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট ও একদিনের সিরিজ খেলল। প্রথম দুটো টেস্টের দল নির্বাচনের সময়ে চেতন ছিলেন। তারপর থেকে দল নির্বাচন করেছেন ওই ভাঙাচোরা নির্বাচন সমিতি এবং তার অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান শিবসুন্দর। মনে রাখা ভাল, এ বছর অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতে একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ। ফলে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একদিনের সিরিজটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার দল নির্বাচনও করে ওই ভাঙা নির্বাচন কমিটি। বলা বাহুল্য, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের দল নির্বাচনের সময়েও পঞ্চম নির্বাচককে নিয়োগ করার কথা ভাবেনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড। এভাবে বোধহয় পয়সা বাঁচানো হচ্ছে। বোর্ড সভাপতি জয় শাহের ক্রিকেটবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, গত কয়েক বছরে তাঁর সম্পত্তি যেভাবে কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে তাতে তাঁর ব্যবসাবুদ্ধি নিয়ে তো আর প্রশ্ন তোলা চলে না।

মজার কথা, নির্বাচন সমিতি নিয়ে এই ধাষ্টামোর সূচনা কিন্তু চেতনের পদত্যাগ থেকে শুরু হয়নি। গত নভেম্বরে কুড়ি বিশের বিশ্বকাপ থেকে ভারত বিদায় নেওয়ার পর এর আগের নির্বাচন সমিতিকে ঘটা করে বরখাস্ত করে বোর্ড। সেই নির্বাচন সমিতিতেও চারজন সদস্যই ছিলেন, এবং কী আশ্চর্য! তখনো চেয়ারম্যান ছিলেন চেতনই। অর্থাৎ যে ব্যর্থতার দায় ঘাড়ে চাপিয়ে অন্য তিন নির্বাচক সুনীল যোশী, দেবাশিস মোহান্তি আর হরবিন্দর সিংকে বিদায় করে দেওয়া হল; সেই ব্যর্থতার কাণ্ডারী চেতনকে আবার নির্বাচন সমিতির চেয়ারম্যান করে নিয়ে আসা হয়েছিল।

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, ক্রিকেট বোর্ড দল নির্বাচনকে তেমন জরুরি ব্যাপার বলে মনে করে না। সেটা দল ঘোষণার ভঙ্গিতেও পরিষ্কার। ভারতীয় ক্রিকেটে দস্তুর ছিল প্রধান নির্বাচক সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে দল ঘোষণা করেন। ক্রিকেটজীবনে অতি সাধারণ এমএসকে প্রসাদ, প্রশাসক হিসাবে বিশালকায় রাজ সিং দুঙ্গারপুর বা ক্রিকেটার হিসাবেও যথেষ্ট সফল দিলীপ ভেংসরকার – কেউ প্রধান নির্বাচক হয়ে এর অন্যথা করেননি। কিন্তু সেসব বন্ধ হয়ে গেছে জয় বোর্ড সভাপতি হওয়ার পর থেকে। এখন দিনের কোনো একটা সময়ে বোর্ড প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে খেলোয়াড় তালিকা জানিয়ে দেয়। তারপর কে বাদ পড়লেন আর কাকে বিশ্রাম দেওয়া হল তা নিয়ে গুজব পল্লবিত হয়।

সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার হল, ঘরোয়া ক্রিকেটে দিনের পর দিন ভাল খেলেও যে তরুণ ক্রিকেটাররা দলে সুযোগ পান না, তাঁদের কেন নেওয়া হল না তার জন্য জবাবদিহি করা হয় না। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের টপ অর্ডার ফর্মে নেই কোভিড অতিমারীর আগে থেকে। কালে ভদ্রে এক-আধটা অর্ধশতরান বা শতরান করে উদ্ধার করেন। অধিকাংশ ইনিংসে শেষদিকে পন্থ, রবীন্দ্র জাদেজা বা শার্দূল ঠাকুর সম্মানজনক স্কোরে পৌঁছে দেন দলকে। সেই কারণেই বোলার হিসাবে বিদেশের মাঠে কল্কে না পেলেও ওঁদেরই খেলানো হয় সেরা বোলার অশ্বিনকে বসিয়ে রেখে। যেদিন জাদেজা, শার্দূলরাও পেরে ওঠেন না, সেদিন মধ্যাহ্নভোজনের আগেই খেলা শেষ হয়ে যায়, যেমন রবিবার ওভালে হল। অথবা দল খটখটে রোদের দিনেও ৩৬ অল আউট হয়ে যায়, যেমনটা ঘটেছিল ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর অ্যাডিলেডে।

এভাবে সিরিজ বা বড় ম্যাচ জেতা সম্ভব নয় বলেই ভারত অধিকাংশ ক্ষেত্রে জেতে না। অথচ ঘুরে ফিরে সেই রোহিত, সেই চেতেশ্বর পূজারা, সেই অজিঙ্ক রাহানে, সেই কোহলি খেলেই চলেছেন। এদিকে মুম্বাইয়ের ২৫ বছরের ছেলে সরফরাজ খান ৩৭ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে সাড়ে তিন হাজার রান করে বসে আছেন প্রায় ৮০ গড়ে। তিনি কেন সুযোগ পান না জবাব দেওয়ার কেউ নেই। বাংলা দলের অভিমন্যু ঈশ্বরন (৮৭ ম্যাচে ৬৫৫৬ রান, গড় প্রায় ৪৮) পরপর বেশ কয়েকটা রঞ্জি ট্রফিতে ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন। তাঁরও মেঘে মেঘেই বেলা বাড়ছে। এরকম আরও নাম আছে।

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট বয়স ঢেকে ফেলছে বিজ্ঞাপনে

বাদ গিয়ে ফেরত আসা রাহানে ওভালে দুই ইনিংসেই ভারতের সেরা ব্যাটার ছিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে রোহিত আর কোহলিও বেশ ভাল ব্যাট করলেন। কিন্তু দেখা গেল, তাঁদের যথেষ্ট ভাল ফর্মও আর দলের জন্য যথেষ্ট নয়। ভারত দুশোর বেশি রানে হারল। ক্রিকেট জগতে একথার একটাই মানে হয়। এঁদের সময় শেষ। সেকথা এঁদের ভক্তরা মানবেন না, তার চেয়েও বড় কথা ক্রিকেট বোর্ড মানবে না। কারণ এই তারকাদের পিছনে টাকার থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একগুচ্ছ স্পনসর। খেলা সরাসরি সম্প্রচারকারীদের প্রাণ তাদের হাতে, আর সম্প্রচারই হল বোর্ডের ধনরত্নে ভরা গুহা। হারজিতের কথা ভেবে কি আর ও গুহার চিচিং বনধ হতে দেওয়া যায়? যায় না বলেই বয়সের যুক্তিতে ঋদ্ধিমান সাহাকে রাহুল দ্রাবিড় বলে দিতে পেরেছিলেন, এবার তুমি এসো। কিন্তু কোহলিদের বয়স চোখে দেখতে পান না।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

শুধু কুস্তির পদক নয়, দেবতার গ্রাসে আজ সবার সন্তান

যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি, তেমন এম সি মেরি কম আর পিটি ঊষা। তাঁরা নিজেদের পদক জেতার কষ্ট বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সহখেলোয়াড়দের কষ্ট যে বোঝেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে।

অলিম্পিক নয়, এশিয়ান গেমস নয়, কমনওয়েলথ গেমস নয়, এমনকি সাফ গেমসও নয়। স্রেফ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জেতা একখানা পদকের পিছনেও কত বছরের পরিশ্রম, কত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ত্যাগস্বীকার থাকে তা যে কোনো ক্রীড়াবিদকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। আরও বেশি করে টের পাওয়া যায় একটুর জন্য পদক জিততে পারেননি যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে। প্রয়াত মিলখা সিং জানতেন, কলকাতার ছেলে জয়দীপ কর্মকার জানেন, আগরতলার মেয়ে দীপা কর্মকারও জানেন সারাজীবনের পরিশ্রমের পর তীরে এসে তরী ডুবলে কেমন লাগে। অথচ গোটা দুনিয়ায় চতুর্থ হওয়াও সারাজীবনের সাধনা ছাড়া সম্ভব নয়।

সেই ১৮৯৬ সালে শুরু হয়েছিল আধুনিক অলিম্পিক। সোয়াশো বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। অথচ হকি দলের পদকগুলো বাদ দিলে কতজন ভারতীয় অলিম্পিক পদক জিতেছেন তা আজও এক হাতের কড়ে গুনে ফেলা যায়। এ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় যে ১৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে শ্যানন মিলার একটা অলিম্পিক থেকেই পাঁচটা পদক জিতে নেবেন বা একা মাইকেল ফেল্পসের আলমারিতেই থাকবে প্রায় আড়াই ডজন অলিম্পিক পদক। দেশটা চীনও নয় যে ছোটবেলা থেকে পদকজয়ী অলিম্পিয়ান তৈরি করতে যত্ন নেবে দেশের সরকার। এমন দেশের ক্রীড়াবিদরা যখন ঠিক করেন আন্তর্জাতিক স্তরে জেতা পদক জলে ফেলে দেবেন, তখন বুঝতে হবে পৃথিবীর সব রং মুছে গেছে তাঁদের চোখের সামনে থেকে। সূর্য নিভে গেছে।

‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় যে মা রাগের মাথায় সন্তানকে বলে ফেলেছিলেন “চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে”, নিজের কথা কানে যেতে যে অনুতাপবাণে তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠেছিল, একজন পদকজয়ী ক্রীড়াবিদের “মেডেল গঙ্গায় ফেলে দেব” বলার সময়ে তার চেয়ে কম যন্ত্রণা হয় না। কারণ একটা পদক জিততে হলে সন্তান পেটে ধরার মতই দীর্ঘ শারীরিক ও মানসিক বেদনা সহ্য করতে হয়। ভারতের কুস্তিগীররা, বিশেষ করে মহিলা কুস্তিগীররা, আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তা বুঝতে চাইলে আগে এই কথাটা স্পষ্ট বোঝা দরকার।

ক্রীড়াবিদরা সফল হওয়ার পরে সমস্ত আলো তাঁদের উপর এসে পড়ে। সাফল্যের পথটার উপরে আলো ফেলা হয় না সচরাচর। ফলে স্বীকার্য যে পদক জয়ের সলতে পাকানোর পর্ব খুব বেশি মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু যাঁরা মতি নন্দীর কাহিনি অবলম্বনে সরোজ দে পরিচালিত কোনি বা শিমিত আমীন পরিচালিত চক দে ইন্ডিয়া দেখেছেন, তাঁদের বলে দিতে হবে না যে স্রেফ প্রতিভায় চিঁড়ে ভেজে না। পেশাদার খেলোয়াড়ের জীবন বস্তুত ব্যথার পূজা। এমন ভয়ঙ্কর ব্যথা, যে খেলার জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা কিছু ফিল্ম সমালোচকের মনে হয়েছিল, গীতা ও ববিতা ফোগত এবং তাঁদের বাবা মহাবীর ফোগতের জীবন নিয়ে তৈরি দঙ্গল ছবিতে নারীত্বের অবমাননা দেখানো হয়েছে। মহাবীর মেয়েদের উপরে নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়েছেন, সেখানে ‘ফিমেল এজেন্সি’-র অভাব ইত্যাদি। এঁরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁশ নিয়ে তাড়া করার দৃশ্য সম্পর্কে কী ভাবেন কে জানে! যা-ই ভাবুন, পৃথিবীর সমস্ত ক্রীড়াবিদের সাফল্য ওই পথেই এসেছে। নির্মম মমতা ছাড়া সফল ক্রীড়াবিদ হওয়া যায় না।

তাহলে ভাবুন, পছন্দের খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে, নিজের বয়সী আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মত আনন্দ ফুর্তি বাদ দিয়ে, কোচের চোখরাঙানি হজম করে, খাটতে খাটতে আধমরা হয়ে গিয়ে যে পদক জেতেন একজন ক্রীড়াবিদ – সেই পদক বিসর্জন দিতে চান কোন অসহায়তায়।

ভিনেশ ফোগত, সঙ্গীতা ফোগত, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়ারা সেই অসহায়তায় পৌঁছেছেন। আপাতত হরিয়ানার কৃষক নেতাদের অনুরোধে গঙ্গায় পদক বিসর্জন দেওয়ার পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু কী হবে পাঁচদিন পরে?

হবে অশ্বডিম্ব – এই মনোভাব নিয়েই এই ইস্যুতে এখন পর্যন্ত চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তাই এই চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়েছে আমাদের কুস্তিগীরদের। সাধারণভাবে একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশের ক্রীড়াবিদদের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, ভারতের ক্রীড়াবিদদের ঘাড়ে সেসব তো আছেই। আছে একগাদা উপরি পাওনাও। বরাবরই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের মেজাজ মর্জি অনুযায়ী চলতে হয় তাঁদের। দেশের আর সবকিছুর মত খেলার জন্য বরাদ্দ টাকাও চলে যায় কর্মকর্তাদের পকেটে। আর কিছু মনে না থাকলেও কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি আর সুরেশ কালমাদির কথা কার না মনে আছে? ফলে অনেকেরই ধারণা ছিল, প্রাক্তন খেলোয়াড়দের খেলা চালানোর দায়িত্ব দিলে সব ম্যাজিকের মত বদলে যাবে। ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি, ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের দুর্নীতি – সবই আদালত পর্যন্ত গড়ানোর ফলে এসে পড়েছিল সেই সুযোগ। কিন্তু মোদী সরকারের আমলে দেখা গেল, রাজনীতিবিদদের বশংবদ প্রাক্তন খেলোয়াড়রা কিছু কম যান না। যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি, তেমন এম সি মেরি কম আর পিটি ঊষা। তাঁরা নিজেদের পদক জেতার কষ্ট বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সহখেলোয়াড়দের কষ্ট যে বোঝেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে।

ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে প্রথম যখন লাগাতার যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন ভিনেশ, সাক্ষীরা – তখন একটা ওভারসাইট কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছিল, যার কর্ণধার ছিলেন মেরি কম এবং আরেক অলিম্পিক পদকজয়ী কুস্তিগীর যোগেশ্বর দত্ত। সেই কমিটি অশ্বডিম্বই প্রসব করেছিল। নইলে যন্তর মন্তরে ধরনায় বসতেই হত না সাক্ষীদের।

মেরি কম, ঊষারা একে খেলোয়াড় তায় মহিলা। তবু তাঁরা যৌন হয়রানির অভিযোগকে পাত্তা দিচ্ছেন না, ভিনেশদের চোখের জলের দাম তাঁদের কাছে মিনারেল ওয়াটারের চেয়ে বেশি নয়। হয়ত ব্রিজভূষণের মত তাঁরাও মনে করেন ওসব পদকের দাম ১৫ টাকা। নতুন সংসদ ভবনের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন নির্বিঘ্ন করতে কুস্তিগীরদের উপর পুলিসি আক্রমণ সম্পর্কে তাঁদের নীরবতা, ব্রিজভূষণের প্রতি মৌন সমর্থন প্রমাণ করে ক্ষমতার মদের নেশা অন্য সব নেশার চেয়ে কড়া। হাজার হোক, মেরি কম মণিপুরের নির্বাচনে বিজেপির তারকা প্রচারক ছিলেন। যোগেশ্বর তো রীতিমত বিজেপি দলের সদস্য। অর্থাৎ ভারতের ক্রীড়াপ্রেমীদের অরাজনীতির সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।

কুস্তিগীরদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকেরও রাজনীতি ব্যাপারটা প্রবল অপছন্দ। তাঁরা কোমলমতি। শাসক দলের সাংসদ যৌন হয়রানির একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও গ্রেফতার হন না, সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ না করলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা ধরনায় না বসলে এফআইআর পর্যন্ত দায়ের হয় না। তবু বিরোধী দলের নেতারা কুস্তিগীরদের পাশে দাঁড়ালে কোমলমতি ক্রীড়াপ্রেমীরা নাক কোঁচকান। তাঁদের জন্য উল্লেখ থাক, আজকের অপমানিত কুস্তিগীররা কিন্তু কখনো অরাজনৈতিক ছিলেন না। ২০১৪ সালের পর থেকে চালু হওয়া ধারা অনুযায়ী তাঁরা সোশাল মিডিয়ায় মোদী সম্পর্কে এবং তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ছিলেন দীর্ঘকাল। হিন্দুত্বের রাজনীতিও তাঁদের অনেকেরই পছন্দের। মে মাসের গোড়ার দিকেও বজরং ইনস্টাগ্রামে বজরং দলকে সমর্থন করে পোস্ট করেছিলেন, পরে মুছে দেন।

তা বলে বজরংদের এই আন্দোলনকে বাঁকা চোখে দেখার কোনো কারণ নেই। হরিয়ানার রক্ষণশীল, খাপ পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রিত সমাজ থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের ফ্যাসিবাদের ক্রীড়নক হয়ে যাওয়া খুব আশ্চর্যের নয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের জাতিভুক্ত এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী সৌরভেরই যদি অমিত শাহের অনুগ্রহে আপত্তি না থাকে তো বজরংদের দোষ কী? কে লড়ছেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন দাবিতে লড়ছেন। যে দেশের মেয়েদের ছোট থেকে নিকটাত্মীয়ের হাতে যৌন হয়রানি অভ্যাস করে নিতে হয়, ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর অত্যাচারিত মেয়েটির পরিবার লোকলজ্জায় মুখ লুকোয় – সে দেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহিলা ক্রীড়াবিদরা তাঁদের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন; পাশে রয়েছেন পুরুষ ক্রীড়াবিদরা – একে ঐতিহাসিক বলে মানতেই হবে। কর্পোরেট পেশাদার মহিলারাও জানেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগুলো বহু জায়গাতেই এখনো দায়সারা। এই আন্দোলন তেমন অনেক কর্তৃপক্ষকেই তটস্থ করে তুলছে। ইতিমধ্যেই এসে পড়েছে কুস্তির আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থার হুঁশিয়ারি।

আরও পড়ুন কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

বিজেপির রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির চেয়ে এসব অনেক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। যদিও রাকেশ ও মহেশ টিকায়েতের মত খাপ পঞ্চায়েতের নেতার উপস্থিতি, বরাবরের বিজেপি সমর্থক ফোগত পরিবারের প্রধান মহাবীরের বিবৃতি এবং হরিয়ানার বিজেপি নেতাদের উল্টো গাওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এ ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে। মোদীর দেবতাপ্রতিম ভাবমূর্তি বিশেষ কাজে আসছে না।

অনির্বাচিত মনুবাদী সাধুসন্তরা ঢুকে পড়েছেন ভারতের সংসদে, অযোধ্যার মহন্তরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে যে আইন (Protection of Children from Sexual Offences Act, 2012) আছে তা বদলানোর দাবিতে সভা করতে চলেছেন ব্রিজভূষণের সমর্থনে। বলা বাহুল্য, তাঁদের কথার ওজন আজকের ভারত সরকারের কাছে অসীম। ফলে সরকার যে তাঁদের প্রণাম জানিয়ে অর্ডিন্যান্স এনে আইন বদলে ফেলবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ঘটলে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পারবে আমাদের সকলের সন্তানের ধর্ষকরা। সুতরাং ভিনেশ, সাক্ষী, বজরংদের লড়াই এখন শুধু পদকজয়ী ক্রীড়াবিদদের লড়াই নয়, সমস্ত ভারতীয়ের লড়াই। সব মেয়েকে, সব শিশুকে দেবতার গ্রাস থেকে বাঁচানোর লড়াই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

নাসার আর ব্রিজভূষণ: যৌন নির্যাতনের আমরা ওরা

নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

ইন্টারনেটের যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলিগলির খবর পর্যন্ত আমরা যেভাবে রাখি, আমেরিকানরাও ভারতের খবর সেভাবে রাখেন কিনা জানি না। মার্কিন জেলগুলোতে বন্দিদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার অধিকার আছে কিনা তাও জানি না। তবে যদি থেকে থাকে, তাহলে নির্ঘাত সেখানে বসে ল্যারি নাসার আফসোস করছে ভারতে তার জন্ম হয়নি বলে। নামটা অচেনা? সেটাই স্বাভাবিক। বাংলা খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলে খেলার খবর বলতে তো আইপিএল আর আইএসএল। আন্তর্জাতিক খেলা মানে বড়জোর ভারতীয় দলের ক্রিকেট আর ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল লিগ, চার বছরে একবার বিশ্বকাপ। ফলে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দেড়শোর বেশি জিমন্যাস্টের সাক্ষ্যদানের পর দুই দশক ধরে যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত নাসারের ৪০ থেকে ১৭৫ বছরের কারাদণ্ডের খবর হয়ত অনেকেরই চোখে পড়েনি বা স্মরণ নেই। নাসার ছিল ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্স, ইউ এস অলিম্পিক কমিটি এবং মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অগ্রগণ্য ডাক্তার। সেই মওকায় চিকিৎসার নাম করে সে মহিলা জিমন্যাস্টদের যথেচ্ছ যৌন নিপীড়ন করত।

এমনিতে একজন আমেরিকানের ভারতীয় হয়ে জন্মাতে চাওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং ভারতীয়রাই অনেকে আমেরিকান হয়ে জন্মাতে পারলে খুশি হত। কিন্তু নাসার মনে করতেই পারে, ভারতে জন্মালে সে স্রেফ ডাক্তার হয়ে না থেকে ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের শীর্ষ কর্তা হয়ে বসতে পারত। এমনিতেই তার বিকৃতির শিকার হওয়া মহিলাদের মুখ খুলতে বছর বিশেক সময় লেগেছে, কর্মকর্তা হলে নিশ্চয়ই তারা আরও ভয় পেত। ফলে আরও দেরিতে মুখ খুলত। খুললেও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত না গেলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা রাস্তায় বসে না পড়লে পুলিস এফআইআর পর্যন্ত নিত না। নিলেও নাসার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত, সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারত, যদি সে শাসক দলের টিকিটে নির্বাচিত সেনেটর হতে পারত। সেসব কিছুই হল না নাসার মার্কিন দেশে জন্মেছিল বলে। এসবের জন্যে যদি সে ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে হিংসা করে, তাকে দোষ দেওয়া চলে কি? বিশেষ করে যখন দুজন কুস্তিগির ব্রিজভূষণের সম্পর্কে পুলিসের কাছে যে অভিযোগগুলো করেছেন তার সঙ্গে নাসারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের স্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

এমন নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেয়েদের জন্যে একেবারে স্বর্গরাজ্য। ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের মার্কিন কলামনিস্ট ময়রা ডোনেগান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেন নাসার কাণ্ডে ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) অপদার্থতার কথা। হলিউডি থ্রিলার দেখার অভ্যাস যাঁদের আছে তাঁরা জানেন, এই এফবিআইকে প্রায়শই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে দেখানো হয়। ব্যতিক্রমী ছবি না হলে এফবিআইয়ের গোয়েন্দাদের এত তৎপর, এত সৎ বলে দেখানো হয় যেন তাঁদের চোখ এড়িয়ে মাছি গলতে পারে না। কিন্তু ডোনেগান লিখেছেন ২০১৫ সালে অলিম্পিয়ান ম্যাককেলা ম্যারোনি নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানানোর পরেও তারা নড়েচড়ে বসেনি। তারা তদন্ত শুরু করে ২০১৬ সালে যখন স্থানীয় পুলিস নাসারের একটা হার্ড ড্রাইভ থেকে ৩৭,০০০ শিশু নির্যাতনের ছবি বাজেয়াপ্ত করে। নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে জমা পড়া প্রথম অভিযোগ থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবস্থা নেওয়ার সময়টুকুতেও সে প্রায় ৭০ জন মহিলা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপরে নির্যাতন চালিয়েছে। নাসারের ঘটনা নিয়ে মার্কিন সেনেটে শুনানির সময়ে এফবিআই ডিরেক্টর ক্রিস রে স্বীকার করেন যে তাঁর সংস্থার গাফিলতি ছিল। কিন্তু তিনি দাবি করেন সেটা সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের ব্যক্তিগত গাফিলতি, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নয়। অথচ ডোনেগান লিখেছেন স্থানীয় পুলিস থেকে শুরু করে এফবিআই পর্যন্ত সর্বত্রই যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। গোটা আমেরিকা জুড়ে বহু মেয়ের অভিজ্ঞতাই তা বলে। সেদিক থেকে আমাদের মেয়েদের চেয়ে মার্কিন মেয়েদের অবস্থা বিশেষ উন্নত নয় বলতে হবে। কিন্তু তাহলেও তফাত বিস্তর। কোথায় তফাত?

এফবিআইয়ের গড়িমসির কথা প্রকাশ্যে এল কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ইনস্পেক্টর জেনারেল নাসার কাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে যে অন্তর্তদন্ত চালিয়েছিলেন তার নির্মম রিপোর্ট থেকে। উপরন্তু যে তিনটে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাসার যুক্ত ছিল, সেগুলোকেও ফল ভোগ করতে হয়েছে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে সংগঠনের প্রতিক্রিয়া সঠিক ছিল কিনা সে সম্পর্কে তদন্ত করায়। ইউ এস অলিম্পিক কমিটি একসময় ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের অনুমোদন বাতিল করে দেবে ঠিক করেছিল। অলিম্পিক কমিটির চাপে তাদের সিইও এবং প্রেসিডেন্ট কেরি পেরিকে পদত্যাগ করতে হয়। এমনকি তাঁর স্থলাভিষিক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সিইও এবং প্রেসিডেন্ট মেরি বনোকেও পদত্যাগ করতে হয় চারদিনের মাথায়, কারণ জিমন্যাস্টরা তাঁকে ওই পদে দেখতে চাননি। আসলে বনো এমন এক ল ফার্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যা নাসারকে সাহায্য করেছিল।

অর্থাৎ ও দেশে এক প্রতিষ্ঠানের দোষ দেখে অন্য প্রতিষ্ঠান শাক দিয়ে মাছ ঢাকেনি। অলিম্পিকে সোনা জয়ী সিমোন বাইলস, অ্যালি রাইসম্যান বা ম্যারোনি, ম্যাগি নিকলদের কথা সেনেট শুনেছে, আদালতও ধৈর্য ধরে শুনেছে। তার জন্যে তাঁদের ওয়াশিংটন ডিসি বা নিউইয়র্কের ফুটপাথে গিয়ে বসতে হয়নি। একথা সত্যি, যে ব্রিজভূষণ দোষী কি দোষী নন সেকথা বিচার করবে আদালত। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের সামনে হাজির করার দায়িত্বটুকু নিতেও তো এ দেশের পুলিস বা সরকার রাজি নয়। এমনকি ভারতীয় অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পিটি ঊষা কদিন আগে বলে বসেছিলেন, যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করে বিনেশ ফোগত, বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিকের মত কুস্তিগিররা নাকি দেশের বদনাম করছেন। নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

আরও পড়ুন হাসছি মোরা হাসছি দেখো: বীর দাসের বীরত্বে দুই ভারতের পর্দা ফাঁস

নাসার জেল খাটছেন, ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের সেই কর্তারাও বিতাড়িত, জিমন্যাস্টরা আছেন স্বমহিমায়। বাইলস আরও একটা অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, গোটা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে আবার কোন রুদ্ধশ্বাস দেহভঙ্গিমায় তিনি তাক লাগিয়ে দেবেন। এদিকে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে তিন সদস্যের অ্যাড হক কমিটির হাতে। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, এই অ্যাড হক কমিটি নাকি আসন্ন এশিয়ান গেমসের সংগঠকদের কাছে ভারত থেকে যে কুস্তিগিররা প্রতিযোগী হতে পারেন তার এক প্রাথমিক তালিকা পাঠিয়েছে। সেই তালিকায় প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের মধ্যে থেকে বজরং, ভিনেশ আছেন। তাছাড়াও আছেন রবি দাহিয়া, দীপক পুনিয়া, অংশু মালিক, সোনম মালিক। কিন্তু অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী সাক্ষী বাদ। কেন তিনিই বাদ? সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য স্মৃতি ইরানির জবাবদিহি দাবি করেছিলেন বলে কি?

দেখে শুনে মনে হয়, কদিন আগে রাতের অন্ধকারে দিল্লি পুলিসের গলাধাক্কা খাওয়ার পর ভিনেশ কাঁদতে কাঁদতে ক্যামেরার সামনে যা বলেছেন তার চেয়ে ন্যায্য কথা নেই – দেশের মেডেল জেতার পরেও যদি এত অপমান সহ্য করতে হয়, তাহলে আর কারোর কখনো মেডেল না জেতাই ভাল।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন?

এ দেশের ক্রিকেটমহল এখন ভীষণ ব্যস্ত। ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আইপিএল চলছে। নিজ নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। লখনৌ সুপারজায়ান্টস অধিনায়ক কে এল রাহুল তো এতটাই নিবেদিতপ্রাণ যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে গুরুতর চোট পাওয়ার পরে হার নিশ্চিত জেনেও দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। অতঃপর চোটের প্রভাবে বাকি টুর্নামেন্টে আর খেলতে পারবেন না, সামনের মাসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলতে পারবেন না। এমন বীরত্বের জন্যই তো জাতীয় নায়কের মর্যাদা পান ক্রিকেটাররা। মুশকিল হল, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পদকজয়ী কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগত এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁর দাবি, মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন আক্রমণের অভিযোগে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, ক্রিকেটারদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।

গত ২৮ এপ্রিল ভিনেশ বলেন, ক্রিকেটারদের তো আমাদের দেশে পুজো করা হয়। তাঁরা আমাদের পক্ষ যদি না-ও নেন, অন্তত একটা নিরপেক্ষ বার্তা দিয়েও তো বলতে পারেন যে দোষীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কেবল ক্রিকেটার নয় অবশ্য, সব খেলার তারকাদের কাছেই আবেদন ছিল ভিনেশের। তারপর থেকে অভিনব বিন্দ্রা আর নীরজ চোপড়া – ভারতের ইতিহাসে যে দুজন অলিম্পিকে ব্যক্তিগত সোনা জিতেছেন, দুজনেই ওই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। সদ্যপ্রাক্তন টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাও দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের বিশেষ হেলদোল নেই। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র মহিলাদের জাতীয় দলের শিখা পাণ্ডে মুখ খুলেছেন। সদ্য চালু হওয়া মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে দামী ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধনার কোনো বক্তব্য নেই। জাতীয় দলের অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌরও চুপ। প্রাক্তনদের মধ্যে হরভজন সিং, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ইরফান পাঠান সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। একমাত্র নভজ্যোৎ সিং সিধু সশরীরে ভিনেশ, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল কপিলদেব ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কবে ন্যায়বিচার পাবে?

স্পষ্ট বক্তা হওয়ার জন্য যাঁর বিপুল খ্যাতি, সেই বিরাট কোহলি স্পিকটি নট। যাবতীয় বাহাদুরি গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে খরচ করছেন। নারীবাদীরা প্রায়শই বিরাটকে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়েন তিনি জীবনে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার অবদান স্বীকার করেন বলে, তাঁর ব্যর্থতায় ট্রোলরা অনুষ্কাকে টার্গেট করলে বিরাট মুখ খোলেন বলে। দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে বিরাটই একমাত্র পুরুষ যিনি নিজের বউকে ভালবাসেন। তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেন একমাত্র অস্কার মঞ্চে বউকে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্রিস রককে ঘুঁষি মেরে দেওয়া উইল স্মিথ। দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি বিরাটের ভালবাসা আমাদের পাড়ার রানাদার পর্ণা বউদির প্রতি ভালবাসার চেয়ে মহত্তর কিছু মোটেই নয়। বরং হয়ত কিছুটা নিকৃষ্টতরই। কারণ রানাদা রাস্তাঘাটে অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে কাউকে বিশ্রীভাবে কথা বলতে দেখলে অন্তত একটু ধমকা-ধমকি করেন। কিন্তু দেশের লাঞ্ছিত মহিলা কুস্তিগীরদের নিয়ে বিরাটের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

মনে রাখা ভাল, অনুষ্কা নিজেও কম নারীবাদী নন। তিনি একদা সুনীল গাভস্করের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন, কারণ গাভস্কর বলেছিলেন অনুষ্কার বোলিংয়ে অনুশীলন করে বিরাটের লাভ হবে না। সেই অনুষ্কাও আজ চুপ। চুপ মানে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। দুটিতে কেমন জীবন উপভোগ করছেন তার তত্ত্বতাল্লাশ দিব্যি দিয়ে যাচ্ছেন টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে। তবে গাভস্করের বিরুদ্ধে লম্বা বিবৃতি দিয়েছিলেন, অলিম্পিয়ান মহিলাদের প্রতিবাদ নিয়ে এক লাইনও লেখেননি। অবশ্য পরীক্ষায় আনকমন প্রশ্ন এসে গেলে আমরাও সে প্রশ্ন ছেড়ে আসতাম।

গম্ভীর আবার দিল্লি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। সেই দিল্লির যন্তর মন্তরেই কুস্তিগীরদের অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। যদিও ওই এলাকা গম্ভীরের কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবু তিনি একজন জনপ্রতিনিধি তো বটেন। অবশ্য উনি সাংসদের দায়িত্ব খুব মন দিয়ে কোনোদিন পালন করেছেন বলে অভিযোগ নেই। উনি সারাবছর ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিয়ে বেড়ান, আইপিএলের সময়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকেন। কদিন পরে হয়ত ওই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সারাবছরই বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াবেন। কারণ লখনৌ সুপারজায়ান্টসে তাঁর পদটির নাম গ্লোবাল মেন্টর, আর ওই ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকরা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার টি টোয়েন্টি লিগে দল কিনে বসে আছেন। আর কোথায় কোথায় কিনবেন কে বলতে পারে? এমন বিশ্বনাগরিকের কি আর যন্তর মন্তরের অবস্থান বিক্ষোভ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কূপমণ্ডূকতা মানায়?

পিভি সিন্ধু, সায়না নেহওয়ালদেরও মুখে কুলুপ। ছবারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মেরি কম তো পিটি ঊষা গোত্রের, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির অতি ঘনিষ্ঠ, তাই নীরব। গত কয়েকদিন অবশ্য তাঁর রাজ্য মণিপুরে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। বিজেপি তাঁকে এত গুরুত্ব দেয় যে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজনাথ সিংকে ট্যাগ করে বলতে হচ্ছে “মাই স্টেট ইজ বার্নিং, কাইন্ডলি হেল্প”। যে নিখাত জারীনকে একসময় স্রেফ জ্যেষ্ঠত্বের অধিকারে অবজ্ঞা করতেন মেরি, সেই দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিখাত কিন্তু সরব হয়েছেন।

প্রাক্তন সাংসদ ভারতরত্ন ‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ডাগআউটে নিদ্রা গিয়েছেন। তিনি অবশ্য কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন? তবু তো দয়া করে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে মুখ খুলেছেন। লর্ডসের ব্যালকনির চিরস্মরণীয় ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে ভারী বিনীতভাবে বলেছেন, ওদের লড়াই ওরা লড়ুক। আমি তো খবরের কাগজে পড়ছি, যা জানি না তা নিয়ে তো কথা বলা উচিত নয়।

এদিকে শচীন, সৌরভ দুজনেই কন্যাসন্তানের পিতা।

সত্যি কথা বলতে, ভারতীয় তারকা খেলোয়াড়দের যা ইতিহাস, তাতে এঁরা মহম্মদ আলি হয়ে উঠবেন বলে কেউ আশা করে না। সাম্প্রতিক অতীতে তাঁরা কিন্তু সাতে পাঁচে না থাকার নীতি অনেকটাই ত্যাগ করেছেন। ওঁরা এখন শচীন বা ঊষার মত শাসক দলের প্রসাদ গ্রহণ করে রাজ্যসভার সদস্য হচ্ছেন, এ পদ সে পদ গ্রহণ করছেন, গম্ভীরের মত ভোটে লড়ে সাংসদ বা বিধায়কও হচ্ছেন। যাঁদের অত এলেম নেই তাঁরাও কোহলির মত করে নোটবন্দি হওয়া মাত্রই তা কত বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ তা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলন চলাকালীন তার বিরোধিতা করে টুইট করেছিলেন। সেওয়াগের মত কেউ কেউ আরও এককাঠি সরেস। শহিদ হওয়া সৈনিকের মেয়েকে যুদ্ধবিরোধী কথা বলার জন্য ট্রোল করতেও ছাড়েননি। কেবল সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দরকার পড়লেই এঁরা কেউ নীরব হয়ে যান, কেউ এক-দু লাইনে কাজ সারেন। সেওয়াগ, কপিলদেব, হরভজন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মানুষ। কুস্তিগীরদের আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন হরিয়ানার কুস্তিগীররাই। তা না হলে এতেও ওই তিন প্রাক্তন মুখ খুলতেন কিনা সন্দেহ।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

যে পদকজয়ী অলিম্পিয়ানরা আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপি-ঘনিষ্ঠই ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে বা জয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করতে এঁদেরও কামাই ছিল না। এখন চোখের জলে সেসবের দাম দিতে হচ্ছে। এখনো যে মহাতারকারা নীরব, তাঁদের দেখে একটাই ভয় হয়। জার্মান যাজক মার্টিন নিয়মোলারের অনুসরণে এঁদের না কোনোদিন আওড়াতে হয়, প্রথমে ওরা এসেছিল কুস্তিগীরদের জন্যে। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কুস্তিগীর নই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ক্রিকেট জেনেশুনে বিশ করেছে পান

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে।

শোয়েব আখতার যখন বল করতেন, মনে হত গোলাবর্ষণ করছেন। এখন বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার সময়েও প্রায় একই মেজাজে থাকেন। আজকাল প্রাক্তন ক্রিকেটাররা ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে কথা বলার সময়ে অতি মাত্রায় সাবধানী। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড চটে গেলে এ দেশে ধারাভাষ্যের মহার্ঘ সুযোগ পাওয়া যাবে না, কোনো একটা ভূমিকায় আইপিএলের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজে ঢুকে সারা বছরের রোজগার দু-আড়াই মাসে করার সুযোগও হাতছাড়া হবে। শোয়েব পাকিস্তানি হওয়ায় ও দুটো দরজাই তাঁর জন্যে বন্ধ। সম্ভবত সে কারণেই নিজের দেশের বাবর আজম সম্পর্কে যেরকম তীর্যক মন্তব্য করেন, বিরাট কোহলি সম্পর্কেও সেভাবেই কথা বলেন। কোহলিকে আক্রমণ করে কদিন আগে বলেছেন “আমি কোহলিকে অনুরোধ করব ও যেন ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত খেলে। তাহলে আরও ৮-৯ বছর সময় পাবে। ভারত ওকে হুইলচেয়ারে বসা অবস্থাতেও খেলাবে এবং একশোটা শতরান করা পর্যন্ত খেলতে দেবে। আমার মনে হয় ও অবসর পর্যন্ত অন্তত ১১০ খানা শতরান করে ফেলবে।”

কোনো সন্দেহ নেই ভারতীয় ক্রিকেটে ব্যক্তিপূজা এমন প্রবল, যে কপিলদেবকে রিচার্ড হেডলির টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড ভাঙার জন্য, আর শচীন তেন্ডুলকরকে শততম শতরান করতে দেওয়ার জন্য, খেলোয়াড় হিসাবে ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও খেলতে দেওয়া হয়েছিল। মহেন্দ্র সিং ধোনি অবশ্য রেকর্ড ভাঙার জন্য খেলে যাননি। তাঁর ফিনিশ করার ক্ষমতা ফিনিশ হয়ে গিয়ে থাকলেও বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের কোম্পানির ডিরেক্টরকে বাদ দেয় কোন নির্বাচকের সাধ্যি? বরং সেই ২০১১ সালে নির্বাচক কমিটির বৈঠকে ধোনিকে টেস্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ায় নির্বাচক মহিন্দর অমরনাথের চাকরিই নট হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং কোহলিও যদ্দিন ইচ্ছা খেলে যেতেই পারেন। কিন্তু শোয়েবের ভুল হয়েছে অন্য জায়গায়।

কোহলির এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতরানের সংখ্যা ৭৫ (টেস্ট ২৮, একদিনের ক্রিকেট ৪৬, আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ১)। যতদিন পর্যন্তই খেলুন, আরও ২৫ খানা শতরান কোথা থেকে আসতে পারে ভেবে দেখুন। পরপর দুটো ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে ব্যর্থ হওয়ার পর (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্মরণীয় ইনিংসটা বাদ দিলে) ৩৪ বছরের কোহলিকে আর ওই ফরম্যাটে খেলানো হবে কিনা দেবা ন জানন্তি। বয়স বাড়লে টেস্টে শতরান করা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে যায় তা তো কোহলির গত চার বছরের খেলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাহলে হাতে রইল পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট, যাতে কোহলিকে এখনো মাঝে মধ্যে স্বমহিমায় দেখা যায়। কিন্তু ওই ফরম্যাটটির নিজেরই যে বাঁচা দায়।

শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। মাত্র ছমাস পরেই পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ, তাও আবার ভারতে। যেখানে পঞ্চাশ গ্রাম ওজনের প্লাস্টিক বল দিয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হলেও খেলা দেখতে লোক জমে যায়। এই তো কদিন আগে ভারত-অস্ট্রেলিয়া একদিনের সিরিজ হয়ে গেল, তার আগে বাংলাদেশে সিরিজ হল। সেখানে গুরুত্বহীন ম্যাচে হলেও ঈশান কিষণ দ্বিশতরান করলেন, কোহলি শতরানের খরা কাটালেন। এমন সময়ে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট নিয়ে এমন কথা কেন? ঘটনা হল, যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে। সারা পৃথিবীতে টি টোয়েন্টি লিগগুলোর, মানে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের যত রমরমা হচ্ছে, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের দর্শক তত কমছে। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, যে কর্মকর্তারাও চান না ওটা বেঁচে বর্তে থাক। নইলে ১৩ নভেম্বর ২০২২ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি ফাইনালের পর ১৭, ১৯ আর ২২ তারিখ কেন তিনটে একদিনের ম্যাচ খেলবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড? মাত্র চারদিন আগে দাপটে কুড়ি ওভারের বিশ্ব খেতাব জয় করা ইংল্যান্ড তিনটে ম্যাচেই গোহারা হারে। সেই ফলাফলকে গুরুত্ব না দিলেও হয়ত চলে, ইংল্যান্ডের পর্যুদস্ত হওয়ার দায় ক্লান্তির উপর চাপানো তো একেবারেই চলে না, কারণ ইংল্যান্ডের একদিনের দলের অনেকেই ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলে ছিলেন না। কিন্তু আসল কথা হল অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ইংল্যান্ড খেলছে আর গ্যালারিতে মাছি তাড়ানোরও লোক নেই – এ জিনিস দুদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। খেলাগুলোর টিভি রেটিংয়ের অবস্থাও ছিল শোচনীয়।

এটা একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। ভারতেও যে কোনো দলের সঙ্গে খেলা থাকলেই মাঠ ভরে যাওয়ার দিন চলে গেছে। আইপিএলে টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে, সাংবাদিকরা সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে বাধ্য হন “দয়া করে কেউ টিকিট চাইবেন না।” কিন্তু পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে অন্তত কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর মত বড় শহরে সে সমস্যা হয় না। শুধু যে দর্শকদের আগ্রহ কমছে তা নয়, খেলোয়াড়দেরও আগ্রহ কমছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস ইতিমধ্যেই একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে বসে আছেন। মানে গত বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় এবার বিশ্বকাপে খেলবেন না। তাঁর বয়স কিন্তু মাত্র ৩১। গতবছর জুলাই মাসে অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর ডিসেম্বরে অবশ্য স্টোকস বলেছিলেন তিনি শুধু বিশ্বকাপটা খেলার কথা ভেবে দেখতেও পারেন। কিন্তু অবসর নেওয়ার যে কারণগুলো দেখিয়েছিলেন, সেগুলো লক্ষ করার মত। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, বড্ড বেশি ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। তিন ধরনের ক্রিকেটের ধকল তাঁর শরীর নিতে পারছে না।

এই সমস্যা একা স্টোকসের নয়। ইংল্যান্ডের জোরে বোলার জোফ্রা আর্চার চোট পেয়ে মাঠের বাইরে বসেছিলেন বেশ কয়েক বছর, চলতি আইপিএলে মাঠে ফিরলেন। ভারতের যশপ্রীত বুমরা কবে ফিরবেন এখনো পরিষ্কার নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায় সব দলের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররাই বারবার চোট পাচ্ছেন, বিরাম নিতে হচ্ছে। কারণ আইপিএল দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, সেই ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জয়যাত্রা এখন ম্যাগেলানের মত পৃথিবী পরিক্রমায় বেরিয়েছে। পাকিস্তান সুপার লিগ, লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশের সঙ্গে এ বছর থেকে যোগ হল দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টোয়েন্টি আর সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর আইএল টি টোয়েন্টি। শেষের দুটো আবার ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারে আইপিএলের ঠিক পরেই। দুটো লিগেই দল কিনেছেন চেন্নাই সুপার কিংস, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, কলকাতা নাইট রাইডার্স, দিল্লি ক্যাপিটালস, লখনৌ সুপার জায়ান্টস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, রাজস্থান রয়ালসের মত দলের মালিকরা। ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলো খেলোয়াড়দের যা পারিশ্রমিক দিচ্ছে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কোনো দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কম্ম নয়। ফলে ছাড়তে হলে একজন ক্রিকেটার জাতীয় দলের হয়ে খেলাই যে ছাড়বেন, ফ্র্যাঞ্চাইজের খেলা নয়, তা বলাই বাহুল্য। টেস্টের প্রতি স্টোকসের ভালবাসা আছে বলে একদিনের ক্রিকেট ছেড়েছেন, কেউ টেস্ট খেলাও ছাড়তে পারেন।

ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বোর্ড মিলে বিশ্ব ক্রিকেটকে যে ছাঁচে ঢেলেছে ২০১৪ সাল থেকে, তাতে অনেক ক্রিকেট বোর্ডেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ফলে ক্রিকেটারদের ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় নেই। এমনকি নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডও বাধ্য হয়েছে ফর্মের তুঙ্গে থাকা ট্রেন্ট বোল্টকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে অব্যাহতি দিতে। অর্থাৎ তিনি হয়ত টেস্ট ক্রিকেট আর খেলবেনই না, একদিনের ক্রিকেট কতটা খেলবেন তাতেও সন্দেহ আছে। আইপিএলের পারিশ্রমিকের সঙ্গে অবশ্য ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডও এঁটে উঠতে পারবে না অদূর ভবিষ্যতে। ইংল্যান্ডের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ কাগজের প্রতিবেদক টিম উইগমোর গত সপ্তাহেই লিখেছেন, আইপিএলের ক্রিকেটাররা যে পারিশ্রমিক পান তা আরও তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। কারণ এত বড় ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া লিগ পৃথিবীর অন্য যেসব খেলায় আছে, সেখানে দলগুলো মোট রাজস্বের অর্ধেক বা তারও বেশি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএ (বাস্কেটবল লিগ) এনএফএল (আমেরিকান ফুটবল লিগ) এবং এমএলএসে (বেসবল লিগ) অন্তত ৪৮% দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড ফুটবলের প্রিমিয়ার লিগ ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে রাজস্বের ৭১% খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের পিছনে ব্যয় করেছিল। সেখানে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো ব্যয় করে ১৮% বা তারও কম।

আরও পড়ুন বিশ্বকাপে কী হবে ভুলে যান, আইপিএল দেখুন

অতএব বুঝতেই পারছেন, শুধু পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট কেন, সারা বছর ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খেলে বেড়িয়ে ভবিষ্যতে টেস্ট ক্রিকেট খেলার উৎসাহও কজন ক্রিকেটারের থাকবে সন্দেহ। স্বভাবতই খেলার গুণমানের তফাত হবে, দর্শকদের আগ্রহেও ভাঁটা পড়বে। যেমন এই মুহূর্তে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে হচ্ছে। টেস্টের দর্শক ভারতেও কমে গেছে বেশ কিছুদিন হল। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে সপ্তাহান্তে কোহলির শতরান পূর্ণ করার দিনেও গ্যালারিতে মানুষের চেয়ে চেয়ার বেশি দেখা যাচ্ছিল। তবু কৌলীন্য আছে বলে কোহলি, স্টোকস, জো রুটের মত খেলোয়াড়রা এখনো ওই ক্রিকেটটা খেলতে চান। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের কিন্তু অবস্থা সঙ্গীন। বাঁচিয়ে রাখতে কী করা যায়? স্টোকস বলেছিলেন, সম্প্রতি রবি শাস্ত্রীও বলেছেন খেলাটাকে চল্লিশ ওভারে নামিয়ে আনার কথা। রোহিত বলেছেন নয়ের দশকের মত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট ফিরিয়ে আনা যায় কিনা ভেবে দেখা উচিত। কিন্তু খেলোয়াড়দের ম্যাচ খেলার সংখ্যা যদি না কমে, ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের পরিমাণ কমানোর দিকে যদি কর্তারা নজর না দেন, তাহলে চল্লিশ ওভারের ম্যাচ খেলতেই বা সেরা খেলোয়াড়দের কী করে পাওয়া যাবে?

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে। ওখানেই তো যত মধু। আইপিএলে দল বাড়িয়ে ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, কারণ মিডিয়া স্বত্ব বেচে পাওয়া টাকার পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০১৮-২২ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছিল ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকায়, আর ২০২৩-২৭ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৪৮,৩৯০ কোটি টাকায়। আইপিএল নামক এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসটির জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল নিজেদের সূচিতে প্রতি বছর আড়াই মাস খালি রেখেছে। কারণ আইপিএলে ম্যাচের সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। বাড়তে বাড়তে ২০২৭ সালে তা পৌঁছবে ৯৪-তে। সঙ্গে থাকবে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ। তারপর পঞ্চাশ (বা চল্লিশ ওভারের) খেলা খেলবেন কারা? সে বছর বিশ্বকাপেই বা কতজনকে ফিট অবস্থায় পাওয়া যাবে? তাই বলছিলাম, কোহলি যদি ২০৩১ অব্দি খেলেও ফেলেন, শতরানের সেঞ্চুরির জন্য সবচেয়ে লাগসই ফরম্যাটটার অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ।

এই সময় কাগজের অধুনালুপ্ত রাবিবারিক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত

বিশ্বকাপে কী হবে ভুলে যান, আইপিএল দেখুন

রবীশ কুমার মোদীর দোষ দেখতে পায় না এমন মিডিয়ার নাম দিয়েছেন গোদি মিডিয়া, অর্থাৎ মোদীর কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়া। জানি না ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়ার কী নাম হওয়া উচিত।

‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কথাটা কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ভারতীয় অর্থনীতির আলোচনায় খুব ব্যবহার করা হত। কোনো বাঙালি অর্থনীতিবিদ এর বাংলা করেছেন কিনা জানি না। তবে এর মোটামুটি মানে হল, জনসংখ্যার এক বড় অংশ বয়সে নবীন হওয়ার সুবিধা। এখন আমাদের যতই ভাঁড়ে মা ভবানী হোক, নরেন্দ্র মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন সকলেই বলতেন ভারতীয়দের একটা বড় অংশ যেহেতু এখন কর্মক্ষম অবস্থায় আছেন সেহেতু এদের কর্মসংস্থান জুগিয়ে দিলেই দেশ ফুলে ফলে ভরে উঠবে। তা সে ডিভিডেন্ড গত ৮-১০ বছরে কতটা পাওয়া গেল তা নিয়ে এখন বিস্তর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নতুন চাকরি হওয়ার বদলে আমাদের দেশে বেকারত্ব ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে একথা ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমমন্ত্রকই বলেছিল। ছোট ব্যবসার অবস্থা কী তা পাড়ার দোকানে কথা বললেই টের পাওয়া যায়। ভারতীয় ক্রিকেট দলের অবস্থাও কেমন যেন আমাদের অর্থনীতির মতই হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তরুণ প্রতিভার অভাব নেই একথা আমরা সেই মহেন্দ্র সিং ধোনির আমল থেকে শুনে আসছি। যেটুকু সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাতে সেই প্রতিভারা যে নেহাত খারাপ ফল দিয়েছে তা-ও নয়, অথচ ঘুরে ফিরে একই মুখ খেলে চলেছে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে এবং একের পর এক বিশ্বকাপে ডোবানোর পর এখন দ্বিপাক্ষিক সিরিজেও ডোবাচ্ছে।

অর্থনীতির ফাঁক ঢাকতে জিডিপির মানদণ্ডই বদলে দেওয়া হয়েছিল প্রয়াত অরুণ জেটলি অর্থমন্ত্রী থাকার সময়ে। অনেক বিরোধী দল এবং অর্থনীতিবিদ সেই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এমন এক চমৎকার বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে সফল হয়েছে টাকার জোরে, যেখানে কোনো সমালোচক নেই। উল্টে যাদের সমালোচক হওয়ার কথা, সেই সংবাদমাধ্যম এবং প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বোর্ডকে সাফল্যের মানদণ্ডগুলো বদলে ফেলতে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে আর কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট জেতেনি ভারত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেমিফাইনালও পেরোতে পারেনি (২০১৪ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ২০২১ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল ব্যতিক্রম। শেষেরটায় অবশ্য সেমিফাইনাল বলে কিছু ছিল না)। ২০২১ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে তো সেমিফাইনালেরও আগে ঘরে ফেরার বিমান ধরতে হয়েছিল। অথচ কাগজে, টিভিতে, খেলা চলাকালীন ধারাভাষ্যে সারাক্ষণ প্রচার করা হয় আমাদের দল বিশ্বসেরা। সেখানেই থেমে না থেকে বলা হয় এই দল ভারতের সর্বকালের সেরা। কেন? না আমরা প্রচুর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতি। প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট থাকার কারণে গত এক দশকে দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোর গুরুত্ব যে প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে, সেকথা কেউ লেখেন না বা বলেন না। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চালু হওয়ার পরে পাঁচদিনের ক্রিকেটেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজের গুরুত্ব তো আসলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠা গেল কিনা, খেতাব জেতা গেল কিনা – তাতে। এসব বলা হয় না।

এ-ও বলা হয় না, যে সাদা বলের ক্রিকেটে ভারত আসলে গত শতাব্দীর ক্রিকেট খেলে চলেছে ২০১১ বিশ্বকাপের পর থেকেই। রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান, পরে রোহিত আর কে এল রাহুল যেভাবে ইনিংস শুরু করতেন সেভাবে একদিনের ক্রিকেট খেলা হত প্রাক-জয়সূর্য-কালুভিথর্না যুগে। ২০১১ বিশ্বকাপে শচীন তেন্ডুলকর আর বীরেন্দ্র সেওয়াগ যেভাবে ভারতের ইনিংস শুরু করতেন সেটা মনে থাকলেও কথাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাঁদের অবসরের পরে তো একদিনের ক্রিকেটটা আরও বদলেছে। দু প্রান্ত থেকে দুটো বল দিয়ে খেলা শুরু হয়েছে। ফলে স্পিনারদের প্রভাব কমেছে, রিভার্স সুইং প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ বল পুরনো না হলে ও দুটো হওয়া শক্ত। সঙ্গে আছে পাওয়ার প্লে, অর্থাৎ সারাক্ষণ বোলাররা নানারকম বিধিনিষেধের মধ্যে বল করছেন। ফলে রান করার কাজটা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে। সেই কারণে ইনিংসের শুরুতে আরও বেশি রান করার রাস্তা নিয়েছে ইংল্যান্ডের মত দল, যারা সব ধরনের ক্রিকেটে গত এক-দেড় দশকে আইসিসি টুর্নামেন্টগুলোতে সবচেয়ে বেশি সফল। অন্যদিকে মন্থরভাবে শুরু করব, উইকেট হাতে রেখে পরে মারব – এই নীতি অবলম্বন করে আমাদের বিরাট কোহলি আর রোহিত শর্মা ঝুড়ি ঝুড়ি শতরান আর দ্বিশতরান করেছেন দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোতে। গড় দেখলে চোখ কপালে উঠে যাবে, কিন্তু আসল জায়গায় চাপের ম্যাচে বারবার ব্যর্থ এবং দলও হেরেছে। রোহিত তবু ২০১৯ বিশ্বকাপে অসাধারণ ধারাবাহিকতা দেখিয়েছিলেন (৯ ম্যাচে ৬৪৮ রান, গড় ৮১; শতরান ৫), বিরাট তো বিশ্বকাপে অন্য মানুষ হয়ে যান। তিনটে বিশ্বকাপ খেলে এখন অবধি মোটে দুটো শতরান। তার কোনোটাই নক আউট ম্যাচে নয়, একটা আবার ২০১১ সালে দুর্বল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। কেরিয়ারে গড় ৫৭.৩২, অথচ বিশ্বকাপে গড় ৪৬.৮১।

রবীশ কুমার মোদীর দোষ দেখতে পায় না এমন মিডিয়ার নাম দিয়েছেন গোদি মিডিয়া, অর্থাৎ মোদীর কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়া। জানি না ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়ার কী নাম হওয়া উচিত। গোদি মিডিয়ায় কর্মরত অনেক সাংবাদিক যেমন বিবেক দংশনে ভোগেন, ভারতীয় ক্রিকেট কভার করা অনেক সাংবাদিকেরও একই অবস্থা। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে শচীন তেন্ডুলকর চরম ব্যর্থ হওয়ার পরে এবং ভারত প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেওয়ার পরে অত বড় ক্রিকেটারেরও চরম সমালোচনা হয়েছিল। এক সর্বভারতীয় ইংরেজি কাগজে শিরোনাম হয়েছিল ENDULKAR। অথচ কোহলি বছর চারেক হয়ে গেল দলের হোমেও লাগেন না, যজ্ঞেও লাগেন না। কারোর সাধ্যি নেই সেকথা লেখে। বরং এতকাল পরে সাদা বলের ক্রিকেটে দুটো অর্থহীন ম্যাচে (১. এশিয়া কাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে, ২. বাংলাদেশের সঙ্গে একদিনের সিরিজ হেরে যাওয়ার পর তৃতীয় একদিনের ম্যাচে) শতরান করার পর রাজার প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি লিখতে হয়েছে। আমেদাবাদ টেস্টে ঢ্যাবঢেবে পিচে শতরান করে তাঁর টেস্টের রান খরাও সবে কেটেছে। গত কয়েক বছরে গড় নামতে নামতে ৪৮.৯৩ হয়ে গেছে। অথচ কথায় কথায় তাঁকে সর্বকালের সেরাদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসিয়ে দেওয়া কিন্তু থামেনি। যাঁদের সঙ্গে তাঁর নামোচ্চারণ করা হচ্ছে তাঁদের সকলের গড় পঞ্চাশের বেশি।

বলতে পারেন, এসব কথা লিখতে চাইলেই লেখা যায়? কেউ কি বারণ করেছে? তা করেনি বটে, তবে লিখে ফেললে সাংবাদিকের চাকরিটি নট হয়ে যেতে পারে। বিশ্বাস না হলে হর্ষ ভোগলেকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। তিনি কারোর সমালোচনাও করেননি। মহেন্দ্র সিং ধোনি অধিনায়ক থাকার সময়ে টুইটারে অমিতাভ বচ্চনের একটি অন্যায় সমালোচনা, যা আবার ধোনি সমর্থন জানিয়ে রিটুইট করেছিলেন, তার প্রতিবাদে ভদ্র ভাষায় জানিয়েছিলেন, সারাক্ষণ ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রশংসা করা একজন ধারাভাষ্যকারের কাজ নয়। সেবার ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে চুক্তি পুনর্নবীকরণের সময় এলে দেখা যায় হর্ষ বাদ পড়েছেন। রবীন্দ্র জাদেজাকে “বিটস অ্যান্ড পিসেজ ক্রিকেটার” বলার অপরাধে একই অবস্থা হয়েছিল সঞ্জয় মঞ্জরেকরের। তা অত নামকরা লোকেদেরই যদি ওই অবস্থা হয় তাহলে খবরের কাগজ, নিউজ এজেন্সি বা ওয়েবসাইটের একজন নগণ্য সাংবাদিকের কী অবস্থা হতে পারে ভেবে দেখুন। হর্ষ আর সঞ্জয় তবু কিছুদিন পরে, কে জানে কোন শর্তে, আবার বোর্ডের তালিকায় ফিরতে পেরেছেন। সাংবাদিকের তো একটি ফোনে চাকরি চলে যাবে এবং তারকাদের চটিয়ে চাকরি গেলে আর কোথাও চাকরি হবে না।

যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বলে রাখা যাক, ভারতের মাটিতে যত ক্রিকেট ম্যাচ হয় তার টিভি সম্প্রচারের প্রযোজক ভারতীয় বোর্ড। খেলা আপনি স্টার নেটওয়ার্কেই দেখুন আর সোনিতেই দেখুন। ফলে ধারাভাষ্যকাররা অধিকাংশই বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, সম্প্রচারকারীর সঙ্গে নয়। যাঁরা সম্প্রচারকারীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ তাঁরাও জানেন বোর্ডের অপছন্দের কথা বললে সম্প্রচারকারীও বিদায় করে দেবে, বোর্ডের সঙ্গে বিবাদ করে ব্যবসা গুবলেট করার ঝুঁকি নেবে না। এখানকার সম্প্রচার স্বত্ব পরম প্রার্থিত বস্তু। এই ব্যবস্থা ক্রিকেটবিশ্বের আর কোনো দেশে চালু নেই। সব দেশেই ক্রিকেট বোর্ড আলাদা, সম্প্রচারকারী এবং তার ধারাভাষ্যকাররা স্বাধীন। ফলে ইংল্যান্ডের খেলায় আপনি নাসের হুসেনকে জো রুট বা বেন স্টোকসের সমালোচনা করতে শুনবেন, কিন্তু ভারতীয় ব্যাটিং গোটা সিরিজে জঘন্যভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরেও বুধবার (২২ মার্চ ২০২৩) অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তৃতীয় একদিনের ম্যাচে দীনেশ কার্তিক বলেছেন এই সিরিজে ব্যাটারদের পারফরম্যান্স “প্রিটি অ্যাভারেজ”। প্রথম ম্যাচে ভারতের প্রথম চার উইকেট পড়ে গিয়েছিল ৩৯ রানে, মাত্র ১০.২ ওভারে। পঞ্চম উইকেট পড়ে যায় ৮৩ রানে, তখন মাত্র ১৯.২ ওভার খেলা হয়েছে। দ্বিতীয় ম্যাচে তো গোটা দল আউট হয়ে যায় ১১৭ রানে, ২৬ ওভারের মধ্যে। শেষ ম্যাচে যথেষ্ট ভাল শুরু করার পরেও শেষ সাত উইকেট পড়ে গেছে ১০২ রানে। এই ব্যাটিং যদি “প্রিটি অ্যাভারেজ” হয় তাহলে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, ওয়েবস্টার – সমস্ত প্রামাণ্য ইংরেজি অভিধানের সম্পাদকমণ্ডলীকে সত্বর জানানো দরকার যে ‘অ্যাভারেজ’ শব্দটার মানে বদলে গেছে। অবশ্য কার্তিক তো শিশু, প্রবাদপ্রতিম সুনীল গাভস্করকেও সারাক্ষণ অত্যুক্তি করে যেতে হয়। একবার আইপিএল চলাকালীন মুখ ফুটে বলেছিলেন, লকডাউনের সময়ে কোহলি যথেষ্ট অনুশীলন করতে পাননি। হালকা মেজাজে যোগ করেছিলেন, একটা ভিডিওতে দেখলাম অনুষ্কার সঙ্গে খেলছিল। ওই অনুশীলনে কোনো লাভ হবে না। অমনি এক রাগত ইন্সটাগ্রাম পোস্ট করে ট্রোলবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীমতি কোহলি

এসব কথা বলছি কারণ ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের মাত্র মাস ছয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সিরিজ হারের যথার্থ মূল্যায়ন করতে গেলে ভারতীয় ক্রিকেটের এই গোটা বাস্তুতন্ত্রকে বোঝা দরকার। টাকা এবং ট্রোলবাহিনীর জোরে ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রিকেটাররা সমস্ত সমালোচকের মুখ বন্ধ করে দিতে পারেন, একগাদা হোম সিরিজের আয়োজন করতে পারেন যাতে আমাদের ক্রিকেটারদের রেকর্ডগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে। কিন্তু রোহিত, কোহলি, রাহুল, রবীন্দ্র জাদেজাদের বয়স তো কমাতে পারেন না। প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁদের রিফ্লেক্স কমছে, লম্বা ইনিংস খেলার শারীরিক ক্ষমতা এবং মানসিক দক্ষতাও কমছে। ফলে আগে অন্তত দ্বিপাক্ষিক সিরিজে যে কৌশলে খেলে দলকে জয় এনে দিতে পারছিলেন, তা আর পেরে উঠছেন না। বুধবার যেমন ‘চেজমাস্টার’ বিরাট তাঁর চিরাচরিত রান তাড়া করার কায়দায় শুরু করেও শেষপর্যন্ত টানতে পারলেন না। রাহুল যে দ্রুত রান করতে পারেন না তা আর কতবার প্রমাণিত হলে কোচ রাহুল দ্রাবিড়, অধিনায়ক রোহিত এবং নির্বাচকরা তাঁকে অপরিহার্য ভাবা বন্ধ করবেন তাঁরাই জানেন। রাহুল এই সিরিজের প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৭৫ রান করে দলকে জিতিয়ে দেওয়ায় আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে শোনা গিয়েছিল তিনি নাকি সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল সে ম্যাচে জিততে হলে মাত্র ১৮৯ রান করতে হত, কোনো তাড়া ছিল না। ফলে রাহুল আপন মনে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বুধবারের খেলায় লক্ষ্য ছিল ২৭০, তবুও তিনি বিরাটের মত ১-২ রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখার তাগিদ দেখাননি। বত্রিশ রান করতে নিয়ে নিলেন ৫০ বল। এইভাবে নিজেই নিজের উপর চাপ বাড়াতে বাড়াতে একসময় হঠাৎ ‘পিটিয়ে ঠান্ডা করে দেব’ ভঙ্গিতে ব্যাট করতে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন। এহেন রাহুলকে আবার টিম ম্যানেজমেন্ট ঋষভ পন্থের অনুপস্থিতিতে বিশ্বকাপের পাকাপাকি উইকেটরক্ষক হিসাবেও ভাবছে। এখন উপায়?

এখানেই এসে পড়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড জলে যাওয়ার প্রশ্ন। হাতের কাছেই আছেন ঈশান কিষণ। যিনি এই সিরিজে অধিনায়ক রোহিত খেলেননি বলে মোটে একটা ম্যাচে খেলার সুযোগ পেলেন। তিনি এখন অবধি ১৪ একদিনের ম্যাচে ৪২.৫০ গড়ে রান করেছেন, একমাত্র শতরানটা আবার ২১০। অথচ তাঁকে মিডল অর্ডারে ভাবা যাচ্ছে না। ঈশানের বয়স তবু ২৪, তাঁর থেকে ডিভিডেন্ড পাওয়ার এখনো সময় আছে। এই সিরিজে দলের বাইরে ছিলেন আরেকজন উইকেটরক্ষক ব্যাটার, যিনি এখন অবধি ১১ একদিনের ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ৬৬ গড়ে রান করেছেন, স্ট্রাইক রেটও একশোর বেশি। অথচ কিছুতেই তাঁকে টানা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সেই সঞ্জু স্যামসনের বয়সে দেখতে দেখতে ২৯ হতে চলল। হয়ত এই বিশ্বকাপের দলেও তাঁকে রাখা হবে না। কারণ সাত বছর এবং একটা বিশ্বকাপ খেলে ফেলার পরেও যে ৩১ বছর বয়সীর ব্যাটিং অর্ডারই পাকা করা যাচ্ছে না, সেই রাহুল দলকে নতুন কিছু দিতে পারেন বলে বিশ্বাস করে টিম ম্যানেজমেন্ট।

পঁয়ত্রিশ হতে চলা বিরাট কোনোদিনই স্পিনের বিরুদ্ধে দারুণ ব্যাটার ছিলেন না। বছর তিনেক হল মাঝের ওভারগুলোতে কিছুতেই স্পিনারদের মেরে উঠতে পারেন না, মারতে গেলেই আউট হয়ে যান। ঠিক যেমন বুধবার হলেন। অথচ উপমহাদেশে বিশ্বকাপ, মাঝের ওভারগুলোতে স্পিনাররাই বেশি বল করবেন। বিশ্বকাপের আগেই ছত্রিশে পা দেবেন অধিনায়ক রোহিত। এই দলে একমাত্র তিনিই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে স্পিনারদের মারতে পারেন। কিন্তু তাঁর ধারাবাহিকতাও ক্রমশ কমছে। ইদানীং বল ঘুরলে বেশ অসুবিধায় পড়ছেন, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে প্রকট হয়েছে সমস্যাটা। এদিকে বল সুইং করলে তাঁকে চিরকালই কিঞ্চিৎ দিশাহারা দেখায়। সেই কারণেই টেস্ট ক্রিকেটে বিরাটের অর্ধেক সাফল্যও পাননি। এঁরা আমাদের ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ।

অবশ্য শুধু ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে দুশ্চিন্তার প্রতি অবিচার করা হবে। মনে রাখা ভাল, আমরা ডিসেম্বরে বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হেরেছি আর মার্চে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সিরিজ হারলাম স্রেফ ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে নয়। মাঝে যে সিরিজে শ্রীলঙ্কাকে ৩-০ হারিয়েছি সেখানেও প্রথম ম্যাচে তারা ৩৭৩ রানের জবাবে ৩০৬ তুলে ফেলেছিল। অধিনায়ক দাসুন শানাকা ৮৮ বলে ১০৮ রান করে অপরাজিত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সুইং সহায়ক পরিবেশে ভারতের ব্যাটিং শুয়ে পড়লেও অস্ট্রেলিয়ার ১২১ রান তুলতে লেগেছে মাত্র ১১ ওভার, একটাও উইকেট খোয়াতে হয়নি। সবচেয়ে সিনিয়র বোলার মহম্মদ শামির মধ্যেও ধারাবাহিকতার অভাব স্পষ্ট। আমাদের বিরাট ভরসা যশপ্রীত বুমরা বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন কিনা এখনো অনিশ্চিত, সাদা বলের ক্রিকেটে দীর্ঘদিন নির্ভরতা দেওয়া ভুবনেশ্বর কুমারও সাম্প্রতিক টি টোয়েন্টি ব্যর্থতার পর দলের বাইরে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের নির্বাচিত দলের দিকে তাকালে কতকগুলো আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করা যাবে।

এই দলে ছিলেন না ২৪ বছরের অর্শদীপ সিং, যিনি টি টোয়েন্টিতে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিণতির পরিচয় দিয়েছেন এবং মাত্র তিনটে একদিনের ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। অথচ ছিলেন ৩১ বছরের জয়দেব উনড়কত, যিনি দেশের জার্সিতে শেষ একদিনের ম্যাচ খেলেছেন ২০১৩ সালে। আমাদের সবেধন নীলমণি জোরে বোলার অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া সম্পূর্ণ ফিট এবং ব্যাটে, বলে চমৎকার খেললেন। তা সত্ত্বেও দলে ছিলেন মোটামুটি একই কাজের লোক শার্দূল ঠাকুর। তাঁর বয়স ৩১। প্রথম ম্যাচে দুজনেই একসঙ্গে খেলেও ফেললেন। শার্দূলকে মাত্র দু ওভার বল করতে দেওয়া হল আর ব্যাট করার কথা ছিল আট নম্বরে। তার দরকার পড়েনি। দ্বিতীয় ম্যাচে শার্দূলের জায়গায় এসে পড়লেন অক্ষর প্যাটেল, ভারত একসঙ্গে তিনজন বাঁহাতি স্পিনারকে খেলাল। এদিকে দেখা গেল পিচ জোরে বোলারদের উপযোগী। মিচেল স্টার্ক একাই পাঁচ উইকেট নিলেন, বাকিগুলো শন অ্যাবট আর নাথান এলিস। এসব দৃশ্য বেঞ্চে বসে দেখলেন ২৩ বছরের উমরান মালিক। তিনি আজকের ক্রিকেটে বিরল সেই প্রজাতির বোলার, যাঁর গড় গতি ঘন্টায় ১৪৫ কিলোমিটার বা ৯০ মাইলের বেশি। বিশাখাপত্তনমে তিন ওভারে ২৫ রান দেওয়া অক্ষরই চেন্নাইয়ের সিরিজ নির্ধারক ম্যাচেও খেললেন। দুটো উইকেট নিলেও আট ওভারে ৫৭ রান দিলেন আর বিশেষজ্ঞ ব্যাটার সূর্যকুমার যাদব তো বটেই, হার্দিকেরও আগে ব্যাট করতে এসে চার বলে দু রান করে রান আউট হয়ে গেলেন। তিন স্পিনারই খেলাতে হলে হাতে কিন্তু অফস্পিনার ওয়াশিংটন সুন্দরও ছিলেন। তাঁর আর অক্ষরের মধ্যে কে বেশি ভাল ব্যাট করেন তা তর্কসাপেক্ষ। লেগস্পিনার যজুবেন্দ্র চহলও ছিলেন, যিনি কিছুদিন আগেও ছিলেন টিম ম্যানেজমেন্টের নয়নমণি। হঠাৎ ২০২১ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে অকর্মণ্য প্রমাণিত হয়েছেন। সেবার দলেই ছিলেন না, পরের বছর অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে গিয়েও খেলানো হল না।

বুধবার চেন্নাইতে দেখা গেল ভারতের তিন স্পিনারের মধ্যে কুলদীপ যাদব ছাড়া বাকিরা অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারলেন না। অক্ষর মার খেলেন, জাদেজা উইকেট নিতে পারলেন না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জাম্পা আর অ্যাশটন অ্যাগারই আসলে ম্যাচটা জিতে নিলেন। তাঁদের দুজনের কুড়ি ওভারে মাত্র ৮৬ রান উঠল, চলে গেল ছটা উইকেট। ভারতের মাটিতে এমন ভেলকি দেখাতে স্বয়ং শেন ওয়ার্নও পারেননি। মানে এই সিরিজ হার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ভারতীয় ব্যাটাররা বল সুইং করলেও হাবুডুবু খান, স্পিন করলেও হাবুডুবু খান। মানতেই হবে দ্বিতীয়টা নতুন লাগছে। বিশেষত ভারতের এই দলকে যেহেতু সেই রবি শাস্ত্রী-কোহলির আমল থেকে সর্বকালের সেরা দল বলে দাবি করা হচ্ছে। শাস্ত্রী টিম ডিরেক্টর থাকার সময়ে স্বয়ং এই দাবি করেছিলেন, তারপর যথারীতি ভারতের সংবাদমাধ্যম বারবার লিখে এবং বলে ব্যাপারটা সকলকে বিশ্বাস করাতে উদ্যোগী হয়েছে। অথচ দেশের মাঠে ভারতকে হারানো চিরকালই শক্ত। স্টিভ ওয়র বিশ্বরেকর্ডধারী দলও পারেনি। কোহলি, রোহিতরা ইংল্যান্ড বা নিউজিল্যান্ডে সিরিজ জেতেননি, যার একাধিক নজির ভারতীয় ক্রিকেটে আছে। এমনকি তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল দক্ষিণ আফ্রিকা দলের কাছেও হেরে এসেছে। বস্তুত দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া বর্তমান প্রজন্ম এমন কিছুই করেনি যা ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তাও টেস্ট ক্রিকেটে। সাদা বলের ক্রিকেটে বলার মত একটা সাফল্যও গত দশ বছরে আসেনি। বরং ভিতরে ভিতরে যেসব বিপ্লব ঘটে গিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছিল, সেগুলোর টিকি পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমাদের নাকি অফুরন্ত জোরে বোলারের জোগান তৈরি হয়েছে। কোথায় তাঁরা? এক বুমরার অনুপস্থিতিতেই এত ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে কেন বোলিংকে? টেস্টে এখনো কেন খেলিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৩৬ বছর বয়সী অত্যন্ত মাঝারি মানের বোলার উমেশ যাদবকে? যা অবস্থা তাতে আইপিএলে ভাল বল করলে হয়ত ভুবনেশ্বরকেও বিশ্বকাপের জন্য ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁরও তো বয়স ৩৩। মাঝে মাঝে উদয় হন খলীল আহমেদ, নভদীপ সাইনি, দীপক চহর, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণর মত তরুণ বোলাররা। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষণ দেখেন তাঁদের মধ্যে এবং আমাদের দেখান। তারপর সেই বোলাররা বাদ পড়েন বা চোট পান, আর ফেরেন না। কোন কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যান?

এত চোটই বা হয় কেন? শুধু তো বোলার নয়, ব্যাটাররাও দেখা যাচ্ছে বসে বসেই চোট পেয়ে যান। যে শ্রেয়স আয়ার একদিনের ক্রিকেটে মিডল অর্ডারকে ভরসা দেবেন ভাবা হচ্ছিল, হঠাৎ আমেদাবাদ টেস্টে তিনি চোটের কারণে ব্যাট করতে নামলেন না। এখন জানা যাচ্ছে সে নাকি এমন চোট যে আইপিএল খেলাও অনিশ্চিত। এর আগে এমন অদ্ভুত চোট রাহুল পেয়েছেন, রোহিত পেয়েছেন। এর কারণ কি অতিরিক্ত ক্রিকেট? যদি তাই হয় তাহলে সুরাহা কী? বুধবারের হারের পর অধিনায়ক রোহিত সাঁইবাবাসুলভ দার্শনিকতায় বলে দিয়েছেন, খেলোয়াড়দের চোট সমস্যা তৈরি করছে ঠিকই, কিন্তু আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোই সব ক্রিকেটারের মালিক। তারাই ঠিক করবে কে কতগুলো ম্যাচ খেলবে না খেলবে।

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট: জাহান্নামের আগুনে পুষ্পের হাসি

তাহলে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের তরুণ প্রতিভারা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে ক্রমশ ডেমোগ্রাফিক লায়াবিলিটিতে পরিণত হচ্ছেন। যে সূর্যকুমার যাদব গত দুবছর টি টোয়েন্টিতে চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং করে একদিনের দলে জায়গা করে নিয়েছেন এবং যাঁকে দুটো ম্যাচে প্রথম বলে আউট হয়েছেন বলেই তৃতীয় ম্যাচে সাত নম্বরে ঠেলে দেওয়া হল, তিনিও কিন্তু দীর্ঘদিন ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করে যাওয়া সত্ত্বেও প্রথম সুযোগ পেয়েছেন ৩১ বছর বয়সে। কারণ তারকাদের বাদ দেওয়া বা ব্যাটিং অর্ডার বদলানো প্রায় অসম্ভব। অথচ অস্ট্রেলিয়াকে দেখুন। মিচেল মার্শ ওপেন করতে এসে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করছেন, তাই ডেভিড ওয়ার্নারের মত সিনিয়রকেও মিডল অর্ডারে খেলতে হল। বুমরা আর আয়ার ছিলেন না বলে অস্ট্রেলিয়ার এই জয়কে তুচ্ছ করাও বোকামি হবে। কারণ বুমরা অনেকদিন ধরেই নেই, আমরা তাঁর বিকল্প তৈরি করতে পারিনি। আর আয়ারের অনুপস্থিতিই যদি ঢাকতে না পারেন তাহলে আর রোহিত, বিরাটরা, রাহুলরা কিসের বড় ব্যাটার? বরং অস্ট্রেলিয়ার দলে ছিলেন না তাদের অন্যতম সেরা দুই পেসার – অধিনায়ক প্যাট কামিন্স (মায়ের মৃত্যুর ফলে) আর জশ হেজলউড (চোটের কারণে)। মিচেল স্টার্কের সঙ্গে মিডিয়াম পেসার মার্কাস স্তোইনিস আর অজিদের দ্বিতীয় সারির শন অ্যাবটকে সামলাতেই হিমসিম খেল তথাকথিত বিশ্বসেরা ভারতীয় ব্যাটিং। তাও তো অপরিণত ব্যাটিং করে প্রথম ম্যাচটা ভারতকে প্রায় উপহার দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটাররা, নইলে কী হত কে জানে?

আজকাল কোনো বিষয়েই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করার চল নেই। কিন্তু বিশ্বকাপের বছর বলেই হয়ত এসব নিয়ে অনেক ক্রিকেটভক্ত একটু চিন্তিত। তবে দেশের ক্রিকেটকর্তারা মোটেই চিন্তিত নন। একটা দেশের ক্রিকেট চালাতে গেলে ন্যূনতম যে কাঠামোগুলো দরকার হয় সেগুলোকে ঠিক রাখার প্রয়োজনও তাঁরা বোধ করেন না। নইলে নির্বাচন কমিটি নিয়ে এই ধাষ্টামো চলত নাকি?

২০২২ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির ব্যর্থতার জন্য চেতন শর্মার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিটিকে গত নভেম্বরে বরখাস্ত করা হল ঘটা করে। তারপর দুমাস কারা নির্বাচক ছিলেন কেউ জানে না। জানুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচন কমিটি হল, যার নেতৃত্বে সেই চেতনই। একমাস পরেই আরেক নাটক। এক টিভি চ্যানেলের স্টিং অপারেশনে চেতনকে বিরাটের নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়া নিয়ে কিছু ভিতরের খবর ফাঁস করতে দেখা গেল। অতঃপর ঘোষণা করা হল তিনি নাকি বোর্ড সভাপতি জয় শাহের কাছে স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তা না হয় দিলেন, কিন্তু তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন কে? কেউ না। বহুকাল হল নির্বাচন কমিটির প্রধান সশরীরে দল ঘোষণা করেন না, কাকে নেওয়া হল, কাকে নেওয়া হল না তা নিয়ে কোনো প্রশ্নোত্তরের সুযোগ থাকে না। এরপর হয়ত নির্বাচন কমিটিই থাকবে না। দরকারই বা কী? ক্রিকেটারদের মালিক যখন ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো, জাতীয় দল নির্বাচনটাও তারাই করে দিতে পারে তো। দেশের ব্যাঙ্ক, বিমা, বন্দর, বিমানবন্দর – সবই যখন গুটি কয়েক লোকের মালিকানায় চলে যাচ্ছে, ক্রিকেট দলটাও তাই যাক না। এমনিতেও যে দল দেশ চালায় সেই দলই তো ক্রিকেট বোর্ড চালাচ্ছে। ক্রিকেটাররা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সেই দলের নির্বাচনী পোস্টারে মুখও দেখাচ্ছেন। তাহলে এক যাত্রায় আর পৃথক ফল হবে কেন? বিশ্বকাপ ভুলে যান। আগামী শুক্রবার থেকে আইপিএল দেখুন মনের সুখে।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

অপমানে হতে হবে মহম্মদ শামির সমান

যথার্থ স্ট্রিট ফাইট করার সময়ে কোহলি কোথায় গেলেন, সে প্রশ্ন ধর্মনিরপেক্ষরা করবেন না? শামির হয়ে নিদেনপক্ষে একখানা টুইটও তো করতে পারতেন প্রাক্তন অধিনায়ক।

এমনকি অ্যাডলফ হিটলারের জন্যেও করুণা হয়। সে যাবতীয় কুকীর্তিকে ক্রীড়াধৌত করার জন্য পেয়েছিল মাত্র একটা অলিম্পিক, নরেন্দ্র মোদী পেয়েছেন আস্ত একটা ক্রিকেট বোর্ড। নিজের নামাঙ্কিত ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাশে অন্য এক রাষ্ট্রনেতাকে নিয়ে গেরুয়া রঙের গ্যালারির দিকে হাত নাড়তে নাড়তে গোটা মাঠ ঘুরছেন সর্বাধিনায়ক। এ দৃশ্য অমর করে রাখার জন্যে কোনো লেনি রিফেনশ্টল নেই – এই যা। কত বড় ইতিহাস তৈরি হল তা বোঝার মেধা বিবেক অগ্নিহোত্রীদের নেই, থাকলে ক্যামেরা নিয়ে ঠিক পৌঁছে যেতেন আমেদাবাদে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্টের প্রথম দিনে।

অবশ্য এ কথাও ঠিক, আজকাল দৃশ্যের জন্ম দিতে জিনিয়াসের দরকার হয় না। অসংখ্য ক্যামেরা সারাক্ষণ হাতে হাতে ঘুরছে আর কোটি কোটি দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। তাছাড়া স্টার স্পোর্টসের ক্যামেরা তো ছিলই। তার উপর ছিলেন অমিত শাহের সুপুত্রের অধীন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ধারাভাষ্যকাররা, যাঁদের চাটুকারিতার একমাত্র তুলনীয় উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার বাবুর মোসাহেবরা – “রাজা যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।” মুশকিল হল মোসাহেবি একটি প্রতিযোগিতামূলক পেশা, আলাপ আলোচনা করে এ কাজ করা যায় না। ফলে ধারাভাষ্যকাররা দর্শকসংখ্যা এদিক-ওদিক করে ফেলেছেন। বর্ষীয়ান সাংবাদিক শারদা উগ্রা লিখেছেন, খেলা শুরু হওয়ার আগেই সাতসকালে ম্যাথু হেডেন, সঞ্জয় মঞ্জরেকর আর স্টার স্পোর্টসের উপস্থাপক সুরেশ সুন্দরম বলে দিয়েছিলেন, মাঠে তিলধারণের জায়গা থাকবে না। কারণ শুধু ক্রিকেট নয়, লোকে আসবে তাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে। এক লক্ষ লোক নাকি এসে পড়বে। খেলা শুরুর মিনিট পঞ্চাশেক আগেই নাকি মাঠ প্রায় ভরে গিয়েছে। অথচ পরে রবি শাস্ত্রী, যাঁর পরম শত্রুও তাঁকে পৃথিবীর কোনো বিষয়ে কমিয়ে বলার অপবাদ দেবে না, ধারাভাষ্য দিতে দিতে প্রবল উৎসাহে বলেন ৫০ হাজারের বেশি লোক হয়েছে। কে জানে, হয়ত অর্ধেক লোক আসলে ক্রিকেট নয়, মোদীকে দেখতেই এসেছিল! পরে তিনি চলে যাওয়ায় তারাও চলে গেছে। উসমান খাজার শতরান দেখতে কি আর দেশপ্রেমিক দর্শকরা বসে থাকতে পারেন? পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হওয়ায় তাঁকে তো ভিসাই দেওয়া হয়েছে বাকি অস্ট্রেলিয়দের একদিন পরে

আসলে ক্রিকেট যে উপলক্ষ, মোদীর মহানতা প্রমাণই লক্ষ্য – তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। নইলে দেশের এত ক্রিকেটপাগল এবং ঐতিহ্যময় শহর থাকতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম আমেদাবাদেই বানানো হবে কেন? পতৌদি ট্রফি (ভারত-ইংল্যান্ড ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে জয়ী দলকে প্রদেয়) আর বর্ডার-গাভস্কর ট্রফি (ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে জয়ী দলকে প্রদেয়) – এই দুটো আজকের ক্রিকেটে সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজের মধ্যে পড়ে এবং কারো কারো দাবি অনুযায়ী খেলার উৎকর্ষে অ্যাশেজের চেয়েও এগিয়ে। সেক্ষেত্রে পরপর দুবার ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামই বা খেলা পায় কেন? ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে তো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টানা দুটো টেস্ট খেলা হয়েছিল ওই স্টেডিয়ামে। তখন অবশ্য যুক্তি হিসাবে কোভিড অতিমারী ছিল, এ বারে যুক্তি কী?

দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা প্রাণপণ চেষ্টাতেও চেপে রাখা যাচ্ছে না, যেখানেই ভোট হচ্ছে বিজেপির ভোট কমে যাচ্ছে, বিরোধী ভোট কাটাকাটিতে মানরক্ষা হচ্ছে। ওদিকে ব্রিটিশ চ্যানেল তথ্যচিত্র বানিয়ে বিশ্বগুরু বেলুনে পিন ফুটিয়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় মোদী অস্ট্রেলিয় প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করবেন, তার জন্য একটা মোচ্ছব করা দরকার, সেই দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ছবির মোচ্ছবটার মত। তাই বুঝি আমেদাবাদে এই আয়োজন। ওই শহরের গুজরাটি ভাষার কাগজ দিব্য ভাস্কর তো লিখেছে প্রথম দিনের খেলার ৮০,০০০ টিকিট নাকি বিজেপি দলই কিনে নিয়েছে। দ্য ওয়্যারের সাংবাদিকের কাছে কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক স্বীকারও করেছেন যে দল থেকে তাঁদের প্রথম দিনের খেলার বিপুল পরিমাণ টিকিট কিনতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ তো টি টোয়েন্টি নয়, খেলাটা যে পাঁচ দিনের। পৃথিবীর বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম যে শহরে, সেখানকার মানুষের ক্রিকেটপ্রেম এত প্রবল যে কাল চতুর্থ দিন দুপুরে বিরাট কোহলি যখন কোভিডোত্তর দুনিয়ায় প্রথম টেস্ট শতরান করলেন তখনো টিভির পর্দায় দেখা গেল মাঠের অর্ধেক ভরেনি। তিনি প্রায় দ্বিশতরান করে ফেললেও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। অথচ কাল ছিল রবিবার। এদিকে ২০০১ সালের সেই বিখ্যাত টেস্টের পর গত ২২ বছরে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার একটাও টেস্ট ম্যাচ হয়নি কলকাতায় ক্রিকেটের নন্দনকাননে।

অবশ্য কবি বলেছেন “ঘটে যা তা সব সত্য নয়”। আমেদাবাদে কেন তেমন দর্শক হয়নি, এ প্রশ্ন চারিদিক থেকে উঠতে শুরু করলেই হয়ত ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড রীতিমত পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেবে, মাঠ একেবারে উপচে পড়ছিল। ঠিক যেমনটা কদিন আগে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ সম্পর্কে লিগ কর্তৃপক্ষ বলেছে। ইদানীং ভারতে সমস্ত গোনাগুনিই হযবরল নিয়মে চলে। ইচ্ছামত বাড়ানো, কমানো যায়। একেবারেই এদিক-ওদিক করা না গেলেও বলে দিলেই চলবে “দর্শক কম হয়নি, স্টেডিয়াম বড় হয়ে গেছে।” নির্মলা সীতারামণ তো পথ দেখিয়েই রেখেছেন। ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই বোধহয় ঠিক কত দর্শক ধরে এই স্টেডিয়ামে তা নিয়ে দুরকম বয়ান সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন নিজেই স্টেডিয়ামের এক জায়গায় লিখে রেখেছে “১৩০,০০০”, আরেক জায়গায় “১১০,০০০”। এ যেন সেই ২০০২ নিয়ে কথা উঠলেই এক দলের “সব বাজে কথা, সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনচিট দিয়েছে” আর আরেক দলের “যা হয়েছিল বেশ হয়েছিল” বলার মত। হাজার হোক, জায়গাটা আমেদাবাদ, রাজ্যটা গুজরাট।

গুজরাট মডেলের চেয়ে ভাল মডেল ভূভারতে নেই। ওখানে ভারতের সবচেয়ে সিনিয়র বোলারকেও গ্যালারি থেকে ক্রিকেটপ্রেমীরা বুঝিয়ে দেন, বাপু, তুমি মুসলমান হও আর যা-ই হও, এখানে এলে “জয় শ্রীরাম” শুনতে হবে। ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিক সিএলআর জেমস বিয়ন্ড দ্য বাউন্ডারি নামে একটা বই লিখেছিলেন, আর সেখানে লিখেছিলেন, সে কী জানে যে শুধু ক্রিকেট জানে? ক্রিকেট যে সত্যিই সীমানার ওপারেও খেলা হয়, তার এমন চমৎকার উদাহরণ রোজ পাওয়া যায় না। স্রেফ কয়েকটা বাজে লোক এই কাণ্ড করেছে বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। ভারতীয় ক্রিকেট দলের গৈরিকীকরণ বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। তারই প্রতিফলন আমেদাবাদ টেস্টের প্রথম দিনের এই ঘটনা। যারা কাণ্ডটা ঘটিয়েছে তারা কেমন লোক তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু ওই ভিডিওতে মহম্মদ শামির সতীর্থদের আচরণ লক্ষ করার মত।

SHAMI KO JAI SHREE RAM 🚩 PIC.TWITTER.COM/RWVG1YMEAZ— Gems of Shorts (@Warlock_Shabby) March 9, 2023

প্রথমে সূর্যকুমার যাদবকে দেখে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীসুলভ উল্লাসে তাঁর নাম ধরে ডাকা হয়, তিনি সাড়া দিয়ে ডান হাত তোলেন। তারপর দুহাত জোড় করে দর্শকদের নমস্কার জানান। এরপর তাঁর পাশে মহম্মদ সিরাজকে দেখা যেতেই শুরু হয় “জয় শ্রীরাম” ধ্বনি। তারপর শামিকে দেখে উৎসাহ চরমে ওঠে। তাঁর নাম ধরে ডেকে ওই স্লোগান দেওয়া হয়, যাতে তিনি বোঝেন তাঁকেই শোনানো হচ্ছে। সেইসময় ওখানে উপস্থিত গুজরাটেরই বাসিন্দা এবং দলের অত্যন্ত সিনিয়র সদস্য চেতেশ্বর পূজারা, সৌরাষ্ট্র রঞ্জি দলের অধিনায়ক জয়দেব উনড়কত, আরেক সিনিয়র জোরে বোলার উমেশ যাদব এবং ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোর। সকলেরই হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা শুনতেই পাননি। একই দূরত্ব থেকে দুজনের নাম ধরে ডাকা হল, একজন শুনতে পেয়ে সাড়া দিলেন আর বাকিরা শুনতেই পাননি এমন তো হতে পারে না। তাহলে বুঝতে হবে হয় তাঁদের অবস্থা তপন সিংহের আতঙ্ক ছবির মাস্টারমশাইয়ের মত, নয় তো শামির প্রতি ধর্মীয় টিটকিরি তাঁরা দিব্যি উপভোগ করছিলেন। এই দল যদি চলতি সিরিজ জেতে, এমনকি যদি আসন্ন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে খেতাবও জেতে। তা কি ভারতের জয়?

সাংবাদিক মানস চক্রবর্তী বহুকাল আগে ব্রায়ান লারাকে নিয়ে একখানা কিশোরপাঠ্য বই লিখেছিলেন। সেখানে আছে, মানস লারার কথা প্রথম শোনেন অরুণলালের মুখে এবং সেটা লারার ব্যাটিং প্রতিভার কথা নয়। ১৯৮৯ সালে ভারত যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায়, অরুণ অন্যতম ব্যাটার হিসাবে সেই দলে ছিলেন। অরুণ বলেছিলেন, একটা টেস্টে দ্বাদশ ব্যক্তি ছিল ব্রায়ান লারা বলে একটা বাচ্চা ছেলে। প্রথম দিনের খেলার পর খবর এল ওর বাবা মারা গেছেন। অধিনায়ক ভিভিয়ান রিচার্ডস সমেত গোটা দল ওর বাড়ি চলে গেল। কথাটা বলে অরুণের মন্তব্য ছিল, বোঝা যায় কেন ওরা বছরের পর বছর টেস্ট হারে না। ২০০২ সালের ৫ ডিসেম্বরের ঘটনাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। সেদিন তৎকালীন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভ ওয়র সিডনির বাড়ির দিকে ধেয়ে এসেছিল এক দাবানল। স্টিভ তখন মেলবোর্নে, স্ত্রী লিনেট তিন সন্তান আর বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে বাড়িতে। লিনেটের ফোন পেয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রা পৌঁছে যান এবং আপ্রাণ লড়ে বাড়িটাকে আগুনের হাত থেকে বাঁচান। স্টিভ খবর পেয়ে বিমানে চেপে শেষপর্যন্ত বাড়ি পৌঁছন রাত এগারোটায়। ততক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণে। স্টিভ গিয়ে জানতে পারেন ম্যাকগ্রা ছ-সাত ঘন্টা ধরে আগুনের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন।

সহখেলোয়াড় মাঠের বাইরেও প্রাণাধিক প্রিয় – এই মূল্যবোধই খেলার মাঠের চিরকালীন শিক্ষা। সেই শিক্ষার পরিচয় কোথায় শামির সহখেলোয়াড়দের ব্যবহারে? ভারতে অবশ্য এখন অমৃত কাল। চিরকালীন সবকিছুই এখন বাতিল। কেউ কেউ বলবেন, কী করা উচিত ছিল পূজারাদের? শামির হয়ে লোকগুলোকে পাল্টা গালাগালি দিত, না হাতাহাতি করতে যেত? যে কোনো সভ্য দেশে এই প্রশ্নটাই অবান্তর। ভারতের গত অস্ট্রেলিয়া সফরে সিরাজকে বর্ণবিদ্বেষী গালাগালি দেওয়ার অভিযোগ উঠতেই কয়েকজন দর্শককে মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। যা অন্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড করতে পারে, তা যে এ দেশের বোর্ড করবে না — এমনটা তাহলে সূর্য, পূজারা, উনড়কত, উমেশ, বিক্রমরা জানেন? তাই তাঁরা প্রতিবাদ করেননি, বোর্ডের কাছে কোনো অভিযোগও জানাননি? এই ভিডিও যেভাবে ভাইরাল হয়েছে, বেশকিছু সংবাদমাধ্যম যেভাবে খবর প্রকাশ করেছে, তাতে অধিনায়ক রোহিত শর্মা বা কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের চোখে পড়েনি — এমনটা হওয়া অসম্ভব। তাঁরাই বা চুপ কেন? এর নাম নেতৃত্ব, নাকি হিন্দুত্ব?

ভারতীয় দলে আবার ভয়ানক লড়াকু কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন। তাঁদের সারা দেশের ক্রিকেট সাংবাদিকরা ‘স্ট্রিট ফাইটার’ বলে বিস্তর প্রশংসা করে থাকেন। এঁরা বিপক্ষ দলের ১১ নম্বর ব্যাটারকে বাউন্সারের পর বাউন্সার দিয়ে, স্লেজ করে বাহাদুরি দেখান। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বড় মুখ করে বলেন, আমাদের একজনকে আক্রমণ করলে আমরা ১১ জন মিলে প্রতিআক্রমণ করব।

এঁদের মধ্যে সবচেয়ে ওজনদার অবশ্যই ২৪ টেস্টে ৪২ খানা ইনিংস খেলার পরে ২৭ নম্বর থেকে ২৮ নম্বর শতরানে পৌঁছনো বিরাট। তিনি ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির সময়ে শামির ধর্ম তুলে যারা টুইট করেছিল তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীদের হৃদয়সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন। অধিনায়কত্ব যখন চলে গেল, তখন আপন মনের মাধুরী মিশায়ে ধর্মনিরপেক্ষরা গর্জন করেছিলেন, শামির পক্ষ নেওয়ার অপরাধেই নাকি বেচারা বিরাটকে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ক্রিকেট বোর্ড বরখাস্ত করেছে। এবার যথার্থ স্ট্রিট ফাইট করার সময়ে কোহলি কোথায় গেলেন, সে প্রশ্ন ধর্মনিরপেক্ষরা করবেন না? শামির হয়ে নিদেনপক্ষে একখানা টুইটও তো করতে পারতেন প্রাক্তন অধিনায়ক। তিনি যে এখনো ভারতীয় ক্রিকেটের এক নম্বর তারকা তাতে তো সন্দেহ নেই। তাঁকে তো যথেষ্ট মান্যিগণ্যি করেন ক্রিকেটভক্তরা, আর তাঁর ভক্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। টুইটারে বিরাটের সমালোচনা করলেই যেভাবে ট্রোলবাহিনী ধেয়ে আসে তাতেই তা টের পাওয়া যায়। এহেন বিরাটের জাভেদ মিয়াঁদাদসুলভ আগ্রাসন আমেদাবাদে শামির অপমান দেখেও মিইয়ে রইল? তাহলে বুঝতে হবে, বিরাট এবং তাঁর মত ডানপিটেদের যত হম্বিতম্বি সব ক্রিকেট বোর্ডের ছত্রছায়ায়, ক্রিকেট মাঠের ভিতরে। সিনেমার অ্যাকশন হিরোদের যেমন যত বীরত্ব সিনেমার সেটে, স্টান্টম্যানদের উপস্থিতিতে।

আরও পড়ুন সকলেই চুপ করে থাকবে, শামিকে মানিয়ে নিতে হবে

এমন নয় যে হিন্দুগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমান ক্রিকেটাররা ব্যর্থ হলে অতীতে কখনো কেউ তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে পাঁচটা কথা বলেনি। মহম্মদ আজহারউদ্দিন তো তেমন লোকেদের পোয়া বারো করে দিয়ে গেছেন ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে। কিন্তু সেসব মন্তব্য চলতে ঠারেঠোরে এবং ক্রিকেটারের কানে পৌঁছতে না দিয়ে। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগে টিটকিরি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। ফলে শুধু মুসলমান শামি কেন, শিখ অর্শদীপ সিংকেও পাকিস্তান ম্যাচে ক্যাচ ফেলার জন্য অনলাইন গালাগালি হজম করতে হয়েছে। কিন্তু আমেদাবাদে যা হল তা অভূতপূর্ব। শামির হাত থেকে ক্যাচ পড়েনি, তিনি অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের হাতে বেদম মারও খাননি। ম্যাচটাও পাকিস্তান ম্যাচ নয়। স্রেফ উত্যক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁকে সরাসরি আক্রমণ করেছে কিছু তথাকথিত ক্রিকেটপ্রেমী। অথচ গোটা দল চুপ, বোর্ডও চুপ। এ থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না দলটা আসলে কাদের। অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? এই দলেই তো খেলছেন রবীন্দ্র জাদেজা, যিনি গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রচারে জাতীয় দলের জার্সিকে ব্যবহার করেছেন। বোর্ড কোনো আপত্তি করেনি। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট দল এখন দেশের নয়, সরকারের দল। তাদের প্রধান কর্তব্য মোদীর যাবতীয় কীর্তিকে ক্রীড়াধৌত করা। তাই তাদের সমস্ত আচরণই এখন হিন্দুত্বানুসারী।

রবীন্দ্রনাথের কল্পনার ‘ভারততীর্থ’ কোথাও না থাকলেও, অন্তত আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল সেদিকে যাত্রা করছিল। স্বীকার করে নেওয়া ভাল, যে যাত্রা থেমে গেছে। অবশ্য ওই কবিতার ভাবনায় বেশকিছু আপত্তিকর দিক আছে বলে লিখেছিলেন অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য। তা সবিস্তারে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না। প্রাসঙ্গিক অংশটা হল

রবীন্দ্রনাথও ভক্তি-গদগদ হতেন। তাতে স্বদেশচেতনার উদ্দীপন ঘটত, সেটা আমাদের লাভ। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথ বেশিক্ষণ ওরকম ভক্তিগদগদ অভিভূত হয়ে থাকতে পারতেন না। গদগদচিত্তকে তিনিই আবার আঘাত করতেন…

‘ভারততীর্থ’ লেখার পর একটিমাত্র দিন গেল। তার পরেই রবীন্দ্রনাথ যা লিখলেন তা হল স্বদেশের প্রতি নিদারুণ ধিক্কার, অভিশাপ – “হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান/…বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে/ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।”

ভারততীর্থের পথে নয়, ভারতীয় ক্রিকেট এবং দেশটা এ পথেই চলেছে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

আজ জুটেছে, কাল কী হবে লাতিন আমেরিকার ফুটবলের?

জিদান প্রয়াত সক্রেটিসের মত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন না। মারাদোনার মত ফিদেল কাস্ত্রো বা কিউবাপ্রীতিও নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে জিদানের মনুষ্যত্বের কাছেই টাকার অঙ্কটা অশ্লীল বলে মনে হয়েছিল।

ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই নাকি বলেছিলেন, আমার পরেই আসবে প্লাবন। লিওনেল মেসি এখন পর্যন্ত তেমন কিছু বলেছেন বলে জানা যায়নি। তবে বিশ্বকাপ ফাইনালই যে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে তাঁর শেষ ম্যাচ ছিল সেকথা তো জানা গেছে। এখন প্রশ্ন হল, আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের ভবিষ্যৎ কী? দিয়েগো মারাদোনা ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ থেকে ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হন। পরে পাকাপাকিভাবে অবসর নেওয়ার সময়ে বলেন, আমার পরে অনেকদিন বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছবে না আর্জেন্টিনা। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। ১৯৯০ সালে রোমে তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার ২৪ বছর পরে আবার আর্জেন্টিনা ফাইনালে পৌঁছয় ২০১৪ সালে রিও দি জেনেইরোতে। মারাদোনার মত মেসির আমলেও আর্জেন্টিনা দুবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলল। আবার কবে ফাইনালে পৌঁছবে? প্রশ্নটার পরিসর আরেকটু বড় করে নেওয়া যাক? লাতিন আমেরিকার কোনও দল আবার কবে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবে? বা লাতিন আমেরিকার দলগুলোর ভবিষ্যৎ কী? প্রশ্নগুলো বৈধ, কারণ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিলও শেষবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে কুড়ি বছর হয়ে গেল। কেবল ফাইনালে পৌঁছনোকেই সাফল্যের প্রমাণ হিসাবে ধরে নিয়ে অবশ্য কোনও আলোচনা করা যায় না। কিন্তু ঘটনা হল গত তিন দশকে সামগ্রিকভাবেই লাতিন আমেরিকা বিশ্বকাপে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে ইউরোপের তুলনায়।

এমনিতেই চিলে, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা বা প্যারাগুয়ের মত দলে মাঝেমধ্যে কয়েকজন চোখ টানার মত ফুটবলার আসেন, তখন তাঁদের নিয়ে হইচই হয়। কিন্তু দল শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপে বেশিদূর এগোতে পারে না। উরুগুয়ে দুবার বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই গত শতকের প্রথমার্ধে, স্মরণকালে তাদের সেরা বিশ্বকাপ ২০১০। মূলত দিয়েগো ফোরলানের নৈপুণ্যে আর লুই সুয়ারেজের আক্ষরিক অর্থে হাতযশে সেমিফাইনালে উঠে তারা হেরে যায় এবং প্লে অফে জার্মানির কাছে হেরে চতুর্থ স্থান দখল করে। তাই বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকার ফুটবল মানে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাই। সেই ব্রাজিল পরপর তিনটে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয় দুই সহস্রাব্দের সন্ধিকালে। তারপর ২০১৪ সালের আগে আর সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি এবং ঘরের মাঠে মারাকানা স্টেডিয়ামের সেই সেমিফাইনাল ব্রাজিল সমর্থকদের পক্ষে বিভীষিকা হয়ে আছে। এবারের ব্রাজিলকে অনেক বেশি জমাট দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল নেইমার-নির্ভরতাও নেই। কিন্তু সেই ব্রাজিলও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিল। আর্জেন্টিনা ১৯৯০ আর ২০১৪— এই দুই ফাইনালের মাঝে একবারও শেষ চারে পৌঁছয়নি। স্বভাবতই আর্জেন্টিনার এবারের সাফল্যে ইউরোপের আধিপত্য খর্ব হল বলে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে অনেকের যে উল্লাস, তার স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়ার কারণ আছে। আধিপত্য আদৌ খর্ব হয়েছে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ আছে। আগামীবার থেকে বিশ্বকাপ ৪৮ দলের হয়ে গেলে ইউরোপের প্রাধান্য উল্টে বেড়েও যেতে পারে। প্রশ্ন হল, এমন হচ্ছে কেন? ২০০২ থেকে ২০২২— এই দুই দশকে এমন কী ঘটল যে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা ক্রোয়েশিয়ার চেয়েও কম ধারাবাহিক হয়ে পড়ল? ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড তো বটেই, গত ২০ বছরে বুলগেরিয়া, রোমানিয়ার মত বিশ্বকাপে অনিয়মিত দলের সামনে পড়লেও কেন হেরে যায় লাতিন আমেরিকার দানবরা? এইসব প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরও। সে উত্তর মাঠের ভিতরে খুঁজলে অগভীর জবাব পাওয়া যাবে।

বিশ্বকাপে ইউরোপের বাইরের যে দলগুলো খেলতে এসেছিল, তাদের সকলের খেলোয়াড় তালিকার দিকে তাকালেই একটা জিনিস চোখে পড়ে। প্রত্যেক দলেই ইউরোপে ক্লাব ফুটবল খেলা খেলোয়াড়দের সংখ্যা প্রচুর। বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ২৬ জনের দলে রিজার্ভ বেঞ্চের গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আর্মানি আর মাঝমাঠের খেলোয়াড় থিয়াগো আলমাদা ছাড়া সকলেই ইউরোপের কোনও না কোনও ক্লাবের খেলোয়াড়। একমাত্র আর্মানিই খেলেন নিজের দেশের ক্লাব রিভার প্লেটে। ব্রাজিল দলের ছবিটাও খুব আলাদা নয়। অতিরিক্ত গোলরক্ষক ওয়েভার্তন খেলেন সাও পাওলোর পালমেইরাসে আর মাঝমাঠের এভের্তোন রিবেইরো, আক্রমণভাগের পেদ্রো খেলেন রিও দি জেনেইরোর ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোতে। এছাড়া রক্ষণভাগের দানি আলভেস খেলেন মেক্সিকোর উনিভার্সিদাদ নাসিওনাল এসিতে। আর সবাই ইউরোপে খেলেন। আফ্রিকার দেশগুলোর দল ঘাঁটলেও একই ব্যাপার দেখা যাবে। এমনকি এবার চমকে দিল যে জাপান দল, তাদেরও ২৬ জনের মধ্যে শুধু জার্মানির লিগেই খেলেন আটজন। এর সরাসরি ফলাফল হল, ফুটবলে ঘরানা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আফ্রিকা বা এশিয়ার ক্ষেত্রে সেটা খুব বড় কথা নয়। কারণ বিশ্ব ফুটবলে এই দুই মহাদেশ এতটাই পিছিয়ে থেকে শুরু করেছে যে তাদের এখনও নিজস্ব ঘরানা বলে কিছু তৈরি হয়নি। ইউরোপে খেলতে খেলতে বরং তাদের লাভই হয়। কবি লিখেছিলেন “দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে”। এশিয়া, আফ্রিকার এখনও নেওয়ার পালা চলছে। অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে হয়ত দেওয়ার পালা আরম্ভ হবে। কিন্তু লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা নয়। লাতিন আমেরিকার নিজস্ব ঘরানা ছিল। সারা পৃথিবীর লাতিন আমেরিকান ফুটবলের ভক্তরা তাতেই মোহিত হয়েছিলেন। সেই ঘরানার প্রাণ হল ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, যা চোখের আরাম। সে খেলাকেই ‘জোগো বোনিতো’ অর্থাৎ ‘বিউটিফুল গেম’ বলা চলে। কিন্তু ফুটবল তো মানুষ খেলে। দেবতারা খেলে না, রোবটরাও নয়। ফলে সারা বছর যেভাবে খেলছেন একজন ফুটবলার, তিনি কালেভদ্রে জাতীয় দলের হয়ে একেবারে অন্য দর্শনে, অন্য কায়দায় খেলবেন কী করে? সেকথা জাতীয় দলের কোচকেও বুঝতে হয়, গা জোয়ারি চলে না। ফলে লাতিন আমেরিকান ফুটবলের রহস্য নষ্ট হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীই আসলে খেলে ইউরোপের খেলা। সে খেলায় ইউরোপকে হারাতে যে কালঘাম ছুটে যাবে আর সকলের তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু ক্ষতি শুধু ওটুকু নয়।

কিলিয়ান এমবাপের একটা মন্তব্যে নাকি বেজায় চটেছেন আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। সেই কারণেই দুর্ভেদ্য গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ ফাইনাল শেষ হওয়ার পর থেকে এমবাপেকে বিদ্রুপ করেই চলেছেন, একেকসময় তা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করছে। এমবাপে কিছুদিন আগে বলেছিলেন “ইউরোপে আমাদের সুবিধা হল সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে নেশনস লিগের মত উচ্চমানের ম্যাচ খেলি। ফলে আমরা যখন বিশ্বকাপে যাই তখন তৈরি হয়ে যাই। কিন্তু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকায় এইরকম সুযোগ পায় না। সেখানকার ফুটবল ইউরোপের মত উন্নত নয়। সেই কারণেই গত কয়েকটা বিশ্বকাপে ইউরোপিয়ানরাই জিতেছে।” এমিলিয়ানোর অসভ্যতাকে সমর্থন না করেও তাঁর আবেগকে ধরতে পারা সম্ভব। শুধু তো আর্জেন্টিনা নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার ফুটবল সম্পর্কেই একটা বড় কথা বলেছেন এমবাপে। খোদ ফ্রান্সকেই হারিয়ে দিয়ে মুখের মত জবাব দেওয়া হয়েছে বলে ভাবতেই পারেন এমিলিয়ানো। কিন্তু এমবাপের কথাটা ভেবে দেখার মত।

ইউরোপের চেয়ে লাতিন আমেরিকার ফুটবল যে পিছিয়ে পড়েছে তার পরিসংখ্যানগত প্রমাণ ইতিমধ্যেই দিয়েছি। তবে এমবাপে উদাহরণ দিতে গিয়ে একটু ভুল করেছেন। উয়েফা নেশনস লিগ চালু করেছে সদ্য। উদ্দেশ্য ক্লাব ফুটবলের দাপটে আন্তর্জাতিক ফুটবলের আকর্ষণ কমে যাওয়ার সমস্যা সামলানো। কিন্তু তাতে একটা বড় জিনিস স্বীকার করে নেওয়া হয়, সেটা হল ফুটবল খেলাটাকে চালায় আসলে ক্লাব ফুটবল। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইউরোপের ক্লাব ফুটবল। লাতিন আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে বছর বিশেক হল, আর নেশনস লিগের বয়স মাত্র তিন। লাতিন আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে কারণ তাদের ক্লাব ফুটবল পিছিয়ে পড়েছে। কেন পিছিয়ে পড়ল? কারণটা বিশুদ্ধ অর্থনীতি। ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, জার্মানির দ্বিতীয় সারির ক্লাবগুলোও যে পারিশ্রমিক দিতে পারে তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারে না আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় দুই ক্লাব চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিভার প্লেট আর বোকা জুনিয়র্সও। নেইমারকে খেলানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না ব্রাজিলের ফ্ল্যামেঙ্গো বা পালমেইরাস। আফ্রিকার ক্লাবগুলোর সঙ্গে তো আরও দুস্তর ব্যবধান।

এমন নয় যে লাতিন আমেরিকার খেলোয়াড়দের ইউরোপে চলে যাওয়া এই সহস্রাব্দেই শুরু হয়েছে। মারাদোনা, ক্যারেকা, রোমারিও, বেবেতো, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, রবার্তো কার্লোসরাও বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, নাপোলি, জুভেন্তাস বা এসি মিলানে খেলেছেন। কিন্তু তাঁদের সার, জল দিয়ে বড় করে তুলত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের ফুটবলব্যবস্থাই। তারপর তাঁদের খেলা দেখে চড়া দামে কিনে নিত ইউরোপের ক্লাবগুলো। মারাদোনার মারাদোনা হওয়া শুরু বোকা জুনিয়র্সে। কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে তিনি ফিরেও যান নিজের দেশে, তাঁর শেষ ক্লাব নেউয়েলস ওল্ড বয়েজ। কিন্তু ফুটবলের অর্থনীতি যেভাবে বদলে গেছে তাতে মেসি নিজের মাইনে কমাতে রাজি হয়েও বার্সেলোনাতেই থাকতে পারলেন না, আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়া তো দূরের কথা। অবশ্য মেসি আর্জেন্টিনা ছেড়েছেন অনেক ছোট বয়সে। চে গুয়েভারার জন্মস্থান রোজারিওর রুগ্ন শিশু মেসির প্রতিভা ছোটবেলাতেই চিনে নিয়ে বিশ্বখ্যাত লা মাসিয়ায় তুলে এনেছিলেন বার্সেলোনার স্পটাররা। মেসি ও তাঁর পরিবারের হয়ত কিছুটা কৃতিত্ব প্রাপ্য তিনি স্পেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ না করে আর্জেন্টিনার হয়েই সারাজীবন খেললেন বলে। কিন্তু ঘটনা হল পৃথিবী জুড়ে বেড়ে চলা অর্থনৈতিক বৈষম্যের সুযোগে কচি বয়সেই ইউরোপে চলে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার ফুটবল প্রতিভা। মেসির মত ছোট বয়সে না হলেও, কেরিয়ার শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই। তারপর আর কিসের ঘরানা? গোটা পৃথিবীকে এক অর্থনীতির ছাঁচে ঢালাই করার যে পরিকল্পনা বিশ্বায়ন বা নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতির, তারই ফলশ্রুতিতে গোটা পৃথিবীর ফুটবলই আসলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইউরোপের ফুটবল। জার্সির রংটুকুই যা আলাদা। মেসির মত জন্মগত প্রতিভা সকলের থাকে না, ফলে ফুটবলের সৌন্দর্য সিস্টেম ছাপিয়ে সকলের পায়ে জায়গা করে নিতেও পারে না। যে তরুণ আর্জেন্টাইন বা ব্রাজিলিয়ানের ফুটবল শিক্ষা হবে ইউরোপের কোচের হাতে, সারাবছর খেলবেন ইউরোপে, তিনি ড্রিবল করায় বিশ্বাস করবেন কম। এটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন বোর্ডের ঘরে যে ধন আছে, ক্রিকেটের ঘরে সে ধন আছে?

ফুটবলের আলোচনায় অর্থনীতি শব্দটা দেখেই যাঁরা নাক কুঁচকে ভাবছেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে রাজনীতি এনে ফেলা হচ্ছে বা ইউরোপ কেবল টাকার জোরে সবাইকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে বলায় যাঁরা রাগ করছেন তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই ২০১৩ সালের কথা। সে বছর ওয়েলশ ফুটবলার গ্যারেথ বেলকে ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো (১৩১.৮৬ মিলিয়ন ডলার) দাম দিয়ে কিনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। সেটা তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফার ফি। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন এবং সেইসময় রিয়ালে কার্লো আনচেলোত্তির সহকারী জিনেদিন জিদান বলেই ফেলেন “আমাকে দশ বছর আগে কেনা হয়েছিল ৭৫ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার) দিয়ে আর আমি বলেছিলাম আমি অত দাম পাওয়ার যোগ্য নই। এখন আমার মনে হয় কোনও খেলোয়াড়ই এত দাম পাওয়ার যোগ্য নয়। এটা স্রেফ ফুটবল। দুর্ভাগ্যজনক, দুর্বোধ্য যে এত টাকা কেন খরচ করা হচ্ছে।” জিদান প্রয়াত ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সক্রেটিসের মত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন বলে তো শোনা যায় না। মারাদোনার মত ফিদেল কাস্ত্রো বা কিউবাপ্রীতিরও খবর নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে আলজিরীয় অভিবাসীদের সন্তান জিদানের মনুষ্যত্বের কাছেই কোথাও টাকার অঙ্কটা অশ্লীল বলে মনে হয়েছিল। এখন ২০২২, সর্বকালের সবচেয়ে দামি ট্রান্সফারের তালিকায় প্রথম দশেরও বাইরে চলে গেছেন বেল।

পুরো তালিকাটা দেখুন এখানে। তারপর ভেবে দেখুন, মার্কিনি মদতে বারবার নির্বাচিত সরকার পড়ে যায়, অর্থনীতির দফারফা হয়ে যায় যে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, ভেনিজুয়েলা, পেরুতে— সেখানকার ফুটবল কী করে লড়বে ইউরোপের সঙ্গে? কুড়ি বছর পরে একবার একটা দলের বিশ্বকাপ জয় কি সত্যিই কিছু প্রমাণ করে? এ মাসেই আর্জেন্টিনায় মুদ্রাস্ফীতির হার ৯৯ শতাংশে পৌঁছবে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। বুয়েনস এয়ার্সের রাস্তা ভরিয়ে মেসির দলকে অভিবাদন জানিয়েছে যে হবু ফুটবলাররা, তাদের কজন ওই নীল-সাদা জার্সি গায়ে চাপানোর সঙ্কল্প বজায় রাখতে পারবে? প্রশ্নটা শুধু আবেগের নয়। মারাদোনার দল যখন বিশ্বকাপ জিতেছিল তখনও আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু দুনিয়াটা বদলে গেছে। বার্সেলোনা ছেড়ে কোনও নিঃস্ব নাপোলিকে ইতালি, ইউরোপের রাজা করতে যাননি মেসি। গেছেন কাতারি ধনকুবেরদের অর্থে পুষ্ট প্যারিসের ক্লাবে। যেখানে তাঁর পাশে খেলেন নেইমার আর এমবাপে— সবচেয়ে দামি ট্রান্সফারের তালিকায় যথাক্রমে এক আর দুই নম্বরে থাকা ফুটবলার।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত

মেসি বিশ্বকাপ জিতলেন, শিল্প বিশ্বজয়ী হল আবার

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই।

আলতামিরার গুহাবাসীরা কি প্লেনে চড়ে দেশ দেশান্তরে যেতে পারত? না। তারা কি কম্পিউটার ব্যবহার করত? না। তারা কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের কাজ যন্ত্রকে দিয়ে করাতে পারত? তাও নয়। তারা কি একটা বোতাম টিপে কয়েক হাজার মাইল দূরের জনপদ ধ্বংস করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছিল? মোটেই না। তারা কি ক্যান্সারাক্রান্ত মানুষের মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়ার উপায় জানত? একেবারেই না। কিন্তু তারা বাইসন আঁকতে পারত। সে বাইসন দেখতে অর্থ আর সামর্থ থাকলে আজও সারা পৃথিবীর মানুষ ছুটে যায়। মানুষের আর কিছুই থাকে না, শিল্পটুকুই থেকে যায়। যতদিন না আমাদের এই গ্রহটা মহাবিশ্বের অনিবার্যতায় জীবজগৎহীন জড়পিণ্ডে পরিণত হচ্ছে, ততদিন আর সব কিছু বদলে যাবে, ফুরিয়ে যাবে। থেকে যাবে আমাদের শিল্প।

সেইজন্যেই সাফল্যের চেয়েও শিল্প আমাদের চোখ টানে বেশি, স্মৃতির বেশি জায়গা অধিকার করে। দিয়েগো মারাদোনা তাই অনেকের চেয়ে কম গোল করে, অনেকের চেয়ে কম ট্রফি জিতেও বহু মানুষের হৃদয়সম্রাট হয়ে রয়েছেন। ক্লাবের হয়ে লিওনেল মেসির চেয়ে বেশি খেতাব ভবিষ্যতে জিততেই পারেন কোনো ফুটবলার, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোই তো খুব পিছিয়ে ছিলেন না। মেসির চেয়ে বেশি গোল হয়ত কিলিয়ান এমবাপেও করে ফেলবেন। কিন্তু যেসব দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন দেড় দশকের বেশি সময়, কাতারের ফুটবল মাঠে যেসব ছবি এঁকেছেন গত একমাস – সেগুলো দিয়েই স্মৃতির মণিকোঠায় মেসির জায়গা পাকা হয়ে গেছে, মারাদোনার মতই। আর কে না জানে স্মৃতির কোনো লেবেল লাগে না, শিল্পে কোনো GOAT হয় না, কোনো র‍্যাঙ্কিং চলে না। এমন কোনো সঙ্গীতরসিক আছেন কি যিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের গান শুনতে ভালবাসেন বলে পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গান শোনেন না, হিসাব করেন দুজনের মধ্যে কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ? আমাদের স্মৃতি তো নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগামী ভিড়ে গাদাগাদি ট্রেনের কামরা নয়, যেখানে উত্তমকুমারের চকিত চাহনির পাশে জায়গা হবে না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দীপ্তির।পথের পাঁচালী পড়ে কাঁদলে পুতুলনাচের ইতিকথা-র নির্লিপ্তিতে মুগ্ধ হওয়ার জায়গা থাকবে না – এত সীমিত নয় মানবিক আবেগ।

আর যদি শিল্প জয়যুক্ত হয়? কাল তেমন এক রাত ছিল।

বার্সেলোনার জার্সিতে তিনি যত ফুল ফুটিয়েছেন ইউরোপের মাঠে মাঠে, আর্জেন্টিনার নীল-সাদা জার্সিতে লাতিন আমেরিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকায়, রাশিয়ায় – সব সত্ত্বেও থেকে যাচ্ছিল অপূর্ণতা। রত্নখচিত মুকুটে যে কোহ-ই-নূর না থাকলে আর সবই বৃথা মনে হয়। শুধু আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মনে হয় তা নয়, মেসির মুখ দেখলে বোঝা যেত তাঁর নিজেরও মনে হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে হারের পর সর্বত্রগামী হয়েছিল মেসির অশ্রুসিক্ত ছবি।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

পৃথিবীর মানচিত্রে আর্জেন্টিনার একেবারে অন্য প্রান্তে থাকা ফুটবলে অনুন্নত দেশ ভারতের বাসিন্দা আমরা বিশ্বকাপ দেখি স্রেফ আনন্দের খোঁজে। আমরা প্রাক্তন উপনিবেশ, আমরা তৃতীয় বিশ্ব। স্বভাবতই এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন সফল ইউরোপের চেয়ে বেশি ঝুঁকে থাকে শিল্পী লাতিন আমেরিকার দিকে। ভারতে যখন থেকে বিশ্বকাপ লাইভ দেখা যায় তখন থেকেই নিখুঁত জার্মানি, ইতালি বা লড়াকু চেক রিপাবলিক, ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের আবেগকে বেশি উস্কে দেয় ক্যামেরুন বা নাইজেরিয়া। আজও কি বেশ কাছের মানুষ মনে হয় না রজার মিল্লাকে? এ দেশে যারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা স্পেনের সমর্থক তাদের মনও তো আসলে কেড়ে নিয়েছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম, জিনেদিন জিদান, ইনিয়েস্তার মত বল প্লেয়াররা – ছবি আঁকার নৈপুণ্যে। মানুষ হিংসুটে, মানুষ দাঙ্গাবাজ, মানুষ অকারণে মানুষকে অপমান করে। আইজ্যাক আসিমভ যথার্থই লক্ষ করেছিলেন, মানুষ একমাত্র জীব যারা অন্য জীবকে খাঁচায় পোরে। তবু তো মানুষ যে আনন্দ দেয় তার আনন্দ কামনা করে। খেলার মাঠে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেন শিল্পী ফুটবলাররা। তাই তাঁদের প্রতি পক্ষপাত থাকবেই। বহু মানুষ তাই চেয়েছিলেন, মেসির হাতে যেন একবার বিশ্বকাপটা ওঠে। য়োহান ক্রয়েফ কখনো বিশ্বকাপ ছুঁতে পারেননি, জর্জ বেস্টের সে সুযোগই ছিল না। সে দুর্ভাগ্য যেন মেসির না হয়।

হয়নি। কাল সেই উদ্দাম হাওয়ার রাত ছিল। অন্তত গত চল্লিশ বছরের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বকাপের ফাইনাল। যেখানে ৩৫ বছরের মেসি প্রথমার্ধেই পেনাল্টি থেকে গোল করলেন, মাঠজুড়ে খেললেন। মাঝমাঠে নিজেদের গোলের দিকে মুখ করে বল পেলেন মেসি, মেসি থেকে জুলিয়ান আলভারেজ, আলভারেজ থেকে ম্যাক অ্যালিস্টার, ম্যাক অ্যালিস্টার থেকে আংহেল দি মারিয়া – ছবির মত গোল হল। আশি মিনিট একতরফা খেলা হওয়ার পর মেসির এক হাত যখন বিশ্বকাপে, তখন ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটো গোল করে ফ্রান্সকে ম্যাচে ফেরালেন এরপর যিনি বিশ্বের অবিসংবাদী সেরা ফুটবলার হয়ে উঠবেন, সেই এমবাপে।

তারপর অতিরিক্ত সময়ের শেষ প্রান্তে ফের গোল দিয়ে মেসি যখন উচ্ছ্বাসে ভাসছেন, ভাবছেন সোনার পরী এবার তাঁর হাতের মুঠোয়, তখনই সামান্য ভুলে পেনাল্টি। হাওয়া ঘুরে গেল আবার। তারপর যদি বনস্পতির বিরাট ছায়া না দিতেন সোনার দস্তানার অধিকারী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, হয়ত প্যারিসেই উড়ে যেত সোনার পরী।

নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল, এ যুগের সেরা ফুটবল শিল্পীর মুকুটে কোহ-ই-নূর বসিয়ে দেওয়ার ফাইনাল।

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই। সেই তিনি, যিনি ২০১০ সালে মেসির দলের কোচ হয়েও এমন অস্থির পদচারণা করতেন সাইডলাইনে যে মনে হত নিজেই নেমে পড়বেন। যিনি গত বিশ্বকাপেও গ্যালারিতে ছেলেমানুষের মত হাসতেন, কাঁদতেন, চিৎকার করতেন আর্জেন্টিনার ম্যাচে। যিনি ভিআইপি, তবু ভিআইপি নন। যাঁর সঙ্গে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ফুটবল খেলতে না জানা একজন সাধারণ আর্জেন্টিনা সমর্থকের কোনো তফাত থাকত না, উদ্বিগ্ন সঙ্গীসাথীরা পিছন থেকে জামা ধরে টেনে রাখতেন – পাছে মানুষটা টাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। ১৯৮৬ সালে প্রায় একা দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর পর যিনি জীবদ্দশায় আর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখতে পেলেন না, আমূল বদলে যাওয়া ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্ব ফুটবলে ২০ বছর পর লাতিন আমেরিকার বিশ্বজয়ের রাতে সেই আকাশলীন দিয়েগোকে বলতে ইচ্ছে করছিল

ফিরে এসো মারাদোনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার…

মেসি
ছবি @ElDiegoPics টুইটার হ্যান্ডেল থেকে

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: