আজ জুটেছে, কাল কী হবে লাতিন আমেরিকার ফুটবলের?

জিদান প্রয়াত সক্রেটিসের মত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন না। মারাদোনার মত ফিদেল কাস্ত্রো বা কিউবাপ্রীতিও নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে জিদানের মনুষ্যত্বের কাছেই টাকার অঙ্কটা অশ্লীল বলে মনে হয়েছিল।

ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই নাকি বলেছিলেন, আমার পরেই আসবে প্লাবন। লিওনেল মেসি এখন পর্যন্ত তেমন কিছু বলেছেন বলে জানা যায়নি। তবে বিশ্বকাপ ফাইনালই যে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে তাঁর শেষ ম্যাচ ছিল সেকথা তো জানা গেছে। এখন প্রশ্ন হল, আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের ভবিষ্যৎ কী? দিয়েগো মারাদোনা ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ থেকে ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হন। পরে পাকাপাকিভাবে অবসর নেওয়ার সময়ে বলেন, আমার পরে অনেকদিন বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছবে না আর্জেন্টিনা। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। ১৯৯০ সালে রোমে তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার ২৪ বছর পরে আবার আর্জেন্টিনা ফাইনালে পৌঁছয় ২০১৪ সালে রিও দি জেনেইরোতে। মারাদোনার মত মেসির আমলেও আর্জেন্টিনা দুবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলল। আবার কবে ফাইনালে পৌঁছবে? প্রশ্নটার পরিসর আরেকটু বড় করে নেওয়া যাক? লাতিন আমেরিকার কোনও দল আবার কবে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবে? বা লাতিন আমেরিকার দলগুলোর ভবিষ্যৎ কী? প্রশ্নগুলো বৈধ, কারণ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিলও শেষবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে কুড়ি বছর হয়ে গেল। কেবল ফাইনালে পৌঁছনোকেই সাফল্যের প্রমাণ হিসাবে ধরে নিয়ে অবশ্য কোনও আলোচনা করা যায় না। কিন্তু ঘটনা হল গত তিন দশকে সামগ্রিকভাবেই লাতিন আমেরিকা বিশ্বকাপে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে ইউরোপের তুলনায়।

এমনিতেই চিলে, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা বা প্যারাগুয়ের মত দলে মাঝেমধ্যে কয়েকজন চোখ টানার মত ফুটবলার আসেন, তখন তাঁদের নিয়ে হইচই হয়। কিন্তু দল শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপে বেশিদূর এগোতে পারে না। উরুগুয়ে দুবার বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই গত শতকের প্রথমার্ধে, স্মরণকালে তাদের সেরা বিশ্বকাপ ২০১০। মূলত দিয়েগো ফোরলানের নৈপুণ্যে আর লুই সুয়ারেজের আক্ষরিক অর্থে হাতযশে সেমিফাইনালে উঠে তারা হেরে যায় এবং প্লে অফে জার্মানির কাছে হেরে চতুর্থ স্থান দখল করে। তাই বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকার ফুটবল মানে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাই। সেই ব্রাজিল পরপর তিনটে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয় দুই সহস্রাব্দের সন্ধিকালে। তারপর ২০১৪ সালের আগে আর সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি এবং ঘরের মাঠে মারাকানা স্টেডিয়ামের সেই সেমিফাইনাল ব্রাজিল সমর্থকদের পক্ষে বিভীষিকা হয়ে আছে। এবারের ব্রাজিলকে অনেক বেশি জমাট দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল নেইমার-নির্ভরতাও নেই। কিন্তু সেই ব্রাজিলও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিল। আর্জেন্টিনা ১৯৯০ আর ২০১৪— এই দুই ফাইনালের মাঝে একবারও শেষ চারে পৌঁছয়নি। স্বভাবতই আর্জেন্টিনার এবারের সাফল্যে ইউরোপের আধিপত্য খর্ব হল বলে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে অনেকের যে উল্লাস, তার স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়ার কারণ আছে। আধিপত্য আদৌ খর্ব হয়েছে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ আছে। আগামীবার থেকে বিশ্বকাপ ৪৮ দলের হয়ে গেলে ইউরোপের প্রাধান্য উল্টে বেড়েও যেতে পারে। প্রশ্ন হল, এমন হচ্ছে কেন? ২০০২ থেকে ২০২২— এই দুই দশকে এমন কী ঘটল যে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা ক্রোয়েশিয়ার চেয়েও কম ধারাবাহিক হয়ে পড়ল? ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড তো বটেই, গত ২০ বছরে বুলগেরিয়া, রোমানিয়ার মত বিশ্বকাপে অনিয়মিত দলের সামনে পড়লেও কেন হেরে যায় লাতিন আমেরিকার দানবরা? এইসব প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরও। সে উত্তর মাঠের ভিতরে খুঁজলে অগভীর জবাব পাওয়া যাবে।

বিশ্বকাপে ইউরোপের বাইরের যে দলগুলো খেলতে এসেছিল, তাদের সকলের খেলোয়াড় তালিকার দিকে তাকালেই একটা জিনিস চোখে পড়ে। প্রত্যেক দলেই ইউরোপে ক্লাব ফুটবল খেলা খেলোয়াড়দের সংখ্যা প্রচুর। বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ২৬ জনের দলে রিজার্ভ বেঞ্চের গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আর্মানি আর মাঝমাঠের খেলোয়াড় থিয়াগো আলমাদা ছাড়া সকলেই ইউরোপের কোনও না কোনও ক্লাবের খেলোয়াড়। একমাত্র আর্মানিই খেলেন নিজের দেশের ক্লাব রিভার প্লেটে। ব্রাজিল দলের ছবিটাও খুব আলাদা নয়। অতিরিক্ত গোলরক্ষক ওয়েভার্তন খেলেন সাও পাওলোর পালমেইরাসে আর মাঝমাঠের এভের্তোন রিবেইরো, আক্রমণভাগের পেদ্রো খেলেন রিও দি জেনেইরোর ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোতে। এছাড়া রক্ষণভাগের দানি আলভেস খেলেন মেক্সিকোর উনিভার্সিদাদ নাসিওনাল এসিতে। আর সবাই ইউরোপে খেলেন। আফ্রিকার দেশগুলোর দল ঘাঁটলেও একই ব্যাপার দেখা যাবে। এমনকি এবার চমকে দিল যে জাপান দল, তাদেরও ২৬ জনের মধ্যে শুধু জার্মানির লিগেই খেলেন আটজন। এর সরাসরি ফলাফল হল, ফুটবলে ঘরানা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আফ্রিকা বা এশিয়ার ক্ষেত্রে সেটা খুব বড় কথা নয়। কারণ বিশ্ব ফুটবলে এই দুই মহাদেশ এতটাই পিছিয়ে থেকে শুরু করেছে যে তাদের এখনও নিজস্ব ঘরানা বলে কিছু তৈরি হয়নি। ইউরোপে খেলতে খেলতে বরং তাদের লাভই হয়। কবি লিখেছিলেন “দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে”। এশিয়া, আফ্রিকার এখনও নেওয়ার পালা চলছে। অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে হয়ত দেওয়ার পালা আরম্ভ হবে। কিন্তু লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা নয়। লাতিন আমেরিকার নিজস্ব ঘরানা ছিল। সারা পৃথিবীর লাতিন আমেরিকান ফুটবলের ভক্তরা তাতেই মোহিত হয়েছিলেন। সেই ঘরানার প্রাণ হল ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, যা চোখের আরাম। সে খেলাকেই ‘জোগো বোনিতো’ অর্থাৎ ‘বিউটিফুল গেম’ বলা চলে। কিন্তু ফুটবল তো মানুষ খেলে। দেবতারা খেলে না, রোবটরাও নয়। ফলে সারা বছর যেভাবে খেলছেন একজন ফুটবলার, তিনি কালেভদ্রে জাতীয় দলের হয়ে একেবারে অন্য দর্শনে, অন্য কায়দায় খেলবেন কী করে? সেকথা জাতীয় দলের কোচকেও বুঝতে হয়, গা জোয়ারি চলে না। ফলে লাতিন আমেরিকান ফুটবলের রহস্য নষ্ট হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীই আসলে খেলে ইউরোপের খেলা। সে খেলায় ইউরোপকে হারাতে যে কালঘাম ছুটে যাবে আর সকলের তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু ক্ষতি শুধু ওটুকু নয়।

কিলিয়ান এমবাপের একটা মন্তব্যে নাকি বেজায় চটেছেন আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। সেই কারণেই দুর্ভেদ্য গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ ফাইনাল শেষ হওয়ার পর থেকে এমবাপেকে বিদ্রুপ করেই চলেছেন, একেকসময় তা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করছে। এমবাপে কিছুদিন আগে বলেছিলেন “ইউরোপে আমাদের সুবিধা হল সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে নেশনস লিগের মত উচ্চমানের ম্যাচ খেলি। ফলে আমরা যখন বিশ্বকাপে যাই তখন তৈরি হয়ে যাই। কিন্তু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকায় এইরকম সুযোগ পায় না। সেখানকার ফুটবল ইউরোপের মত উন্নত নয়। সেই কারণেই গত কয়েকটা বিশ্বকাপে ইউরোপিয়ানরাই জিতেছে।” এমিলিয়ানোর অসভ্যতাকে সমর্থন না করেও তাঁর আবেগকে ধরতে পারা সম্ভব। শুধু তো আর্জেন্টিনা নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার ফুটবল সম্পর্কেই একটা বড় কথা বলেছেন এমবাপে। খোদ ফ্রান্সকেই হারিয়ে দিয়ে মুখের মত জবাব দেওয়া হয়েছে বলে ভাবতেই পারেন এমিলিয়ানো। কিন্তু এমবাপের কথাটা ভেবে দেখার মত।

ইউরোপের চেয়ে লাতিন আমেরিকার ফুটবল যে পিছিয়ে পড়েছে তার পরিসংখ্যানগত প্রমাণ ইতিমধ্যেই দিয়েছি। তবে এমবাপে উদাহরণ দিতে গিয়ে একটু ভুল করেছেন। উয়েফা নেশনস লিগ চালু করেছে সদ্য। উদ্দেশ্য ক্লাব ফুটবলের দাপটে আন্তর্জাতিক ফুটবলের আকর্ষণ কমে যাওয়ার সমস্যা সামলানো। কিন্তু তাতে একটা বড় জিনিস স্বীকার করে নেওয়া হয়, সেটা হল ফুটবল খেলাটাকে চালায় আসলে ক্লাব ফুটবল। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইউরোপের ক্লাব ফুটবল। লাতিন আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে বছর বিশেক হল, আর নেশনস লিগের বয়স মাত্র তিন। লাতিন আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে কারণ তাদের ক্লাব ফুটবল পিছিয়ে পড়েছে। কেন পিছিয়ে পড়ল? কারণটা বিশুদ্ধ অর্থনীতি। ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, জার্মানির দ্বিতীয় সারির ক্লাবগুলোও যে পারিশ্রমিক দিতে পারে তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারে না আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় দুই ক্লাব চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিভার প্লেট আর বোকা জুনিয়র্সও। নেইমারকে খেলানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না ব্রাজিলের ফ্ল্যামেঙ্গো বা পালমেইরাস। আফ্রিকার ক্লাবগুলোর সঙ্গে তো আরও দুস্তর ব্যবধান।

এমন নয় যে লাতিন আমেরিকার খেলোয়াড়দের ইউরোপে চলে যাওয়া এই সহস্রাব্দেই শুরু হয়েছে। মারাদোনা, ক্যারেকা, রোমারিও, বেবেতো, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, রবার্তো কার্লোসরাও বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, নাপোলি, জুভেন্তাস বা এসি মিলানে খেলেছেন। কিন্তু তাঁদের সার, জল দিয়ে বড় করে তুলত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের ফুটবলব্যবস্থাই। তারপর তাঁদের খেলা দেখে চড়া দামে কিনে নিত ইউরোপের ক্লাবগুলো। মারাদোনার মারাদোনা হওয়া শুরু বোকা জুনিয়র্সে। কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে তিনি ফিরেও যান নিজের দেশে, তাঁর শেষ ক্লাব নেউয়েলস ওল্ড বয়েজ। কিন্তু ফুটবলের অর্থনীতি যেভাবে বদলে গেছে তাতে মেসি নিজের মাইনে কমাতে রাজি হয়েও বার্সেলোনাতেই থাকতে পারলেন না, আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়া তো দূরের কথা। অবশ্য মেসি আর্জেন্টিনা ছেড়েছেন অনেক ছোট বয়সে। চে গুয়েভারার জন্মস্থান রোজারিওর রুগ্ন শিশু মেসির প্রতিভা ছোটবেলাতেই চিনে নিয়ে বিশ্বখ্যাত লা মাসিয়ায় তুলে এনেছিলেন বার্সেলোনার স্পটাররা। মেসি ও তাঁর পরিবারের হয়ত কিছুটা কৃতিত্ব প্রাপ্য তিনি স্পেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ না করে আর্জেন্টিনার হয়েই সারাজীবন খেললেন বলে। কিন্তু ঘটনা হল পৃথিবী জুড়ে বেড়ে চলা অর্থনৈতিক বৈষম্যের সুযোগে কচি বয়সেই ইউরোপে চলে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার ফুটবল প্রতিভা। মেসির মত ছোট বয়সে না হলেও, কেরিয়ার শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই। তারপর আর কিসের ঘরানা? গোটা পৃথিবীকে এক অর্থনীতির ছাঁচে ঢালাই করার যে পরিকল্পনা বিশ্বায়ন বা নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতির, তারই ফলশ্রুতিতে গোটা পৃথিবীর ফুটবলই আসলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইউরোপের ফুটবল। জার্সির রংটুকুই যা আলাদা। মেসির মত জন্মগত প্রতিভা সকলের থাকে না, ফলে ফুটবলের সৌন্দর্য সিস্টেম ছাপিয়ে সকলের পায়ে জায়গা করে নিতেও পারে না। যে তরুণ আর্জেন্টাইন বা ব্রাজিলিয়ানের ফুটবল শিক্ষা হবে ইউরোপের কোচের হাতে, সারাবছর খেলবেন ইউরোপে, তিনি ড্রিবল করায় বিশ্বাস করবেন কম। এটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন বোর্ডের ঘরে যে ধন আছে, ক্রিকেটের ঘরে সে ধন আছে?

ফুটবলের আলোচনায় অর্থনীতি শব্দটা দেখেই যাঁরা নাক কুঁচকে ভাবছেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে রাজনীতি এনে ফেলা হচ্ছে বা ইউরোপ কেবল টাকার জোরে সবাইকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে বলায় যাঁরা রাগ করছেন তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই ২০১৩ সালের কথা। সে বছর ওয়েলশ ফুটবলার গ্যারেথ বেলকে ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো (১৩১.৮৬ মিলিয়ন ডলার) দাম দিয়ে কিনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। সেটা তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফার ফি। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন এবং সেইসময় রিয়ালে কার্লো আনচেলোত্তির সহকারী জিনেদিন জিদান বলেই ফেলেন “আমাকে দশ বছর আগে কেনা হয়েছিল ৭৫ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার) দিয়ে আর আমি বলেছিলাম আমি অত দাম পাওয়ার যোগ্য নই। এখন আমার মনে হয় কোনও খেলোয়াড়ই এত দাম পাওয়ার যোগ্য নয়। এটা স্রেফ ফুটবল। দুর্ভাগ্যজনক, দুর্বোধ্য যে এত টাকা কেন খরচ করা হচ্ছে।” জিদান প্রয়াত ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সক্রেটিসের মত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন বলে তো শোনা যায় না। মারাদোনার মত ফিদেল কাস্ত্রো বা কিউবাপ্রীতিরও খবর নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে আলজিরীয় অভিবাসীদের সন্তান জিদানের মনুষ্যত্বের কাছেই কোথাও টাকার অঙ্কটা অশ্লীল বলে মনে হয়েছিল। এখন ২০২২, সর্বকালের সবচেয়ে দামি ট্রান্সফারের তালিকায় প্রথম দশেরও বাইরে চলে গেছেন বেল।

পুরো তালিকাটা দেখুন এখানে। তারপর ভেবে দেখুন, মার্কিনি মদতে বারবার নির্বাচিত সরকার পড়ে যায়, অর্থনীতির দফারফা হয়ে যায় যে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, ভেনিজুয়েলা, পেরুতে— সেখানকার ফুটবল কী করে লড়বে ইউরোপের সঙ্গে? কুড়ি বছর পরে একবার একটা দলের বিশ্বকাপ জয় কি সত্যিই কিছু প্রমাণ করে? এ মাসেই আর্জেন্টিনায় মুদ্রাস্ফীতির হার ৯৯ শতাংশে পৌঁছবে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। বুয়েনস এয়ার্সের রাস্তা ভরিয়ে মেসির দলকে অভিবাদন জানিয়েছে যে হবু ফুটবলাররা, তাদের কজন ওই নীল-সাদা জার্সি গায়ে চাপানোর সঙ্কল্প বজায় রাখতে পারবে? প্রশ্নটা শুধু আবেগের নয়। মারাদোনার দল যখন বিশ্বকাপ জিতেছিল তখনও আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু দুনিয়াটা বদলে গেছে। বার্সেলোনা ছেড়ে কোনও নিঃস্ব নাপোলিকে ইতালি, ইউরোপের রাজা করতে যাননি মেসি। গেছেন কাতারি ধনকুবেরদের অর্থে পুষ্ট প্যারিসের ক্লাবে। যেখানে তাঁর পাশে খেলেন নেইমার আর এমবাপে— সবচেয়ে দামি ট্রান্সফারের তালিকায় যথাক্রমে এক আর দুই নম্বরে থাকা ফুটবলার।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত

মেসি বিশ্বকাপ জিতলেন, শিল্প বিশ্বজয়ী হল আবার

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই।

আলতামিরার গুহাবাসীরা কি প্লেনে চড়ে দেশ দেশান্তরে যেতে পারত? না। তারা কি কম্পিউটার ব্যবহার করত? না। তারা কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের কাজ যন্ত্রকে দিয়ে করাতে পারত? তাও নয়। তারা কি একটা বোতাম টিপে কয়েক হাজার মাইল দূরের জনপদ ধ্বংস করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছিল? মোটেই না। তারা কি ক্যান্সারাক্রান্ত মানুষের মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়ার উপায় জানত? একেবারেই না। কিন্তু তারা বাইসন আঁকতে পারত। সে বাইসন দেখতে অর্থ আর সামর্থ থাকলে আজও সারা পৃথিবীর মানুষ ছুটে যায়। মানুষের আর কিছুই থাকে না, শিল্পটুকুই থেকে যায়। যতদিন না আমাদের এই গ্রহটা মহাবিশ্বের অনিবার্যতায় জীবজগৎহীন জড়পিণ্ডে পরিণত হচ্ছে, ততদিন আর সব কিছু বদলে যাবে, ফুরিয়ে যাবে। থেকে যাবে আমাদের শিল্প।

সেইজন্যেই সাফল্যের চেয়েও শিল্প আমাদের চোখ টানে বেশি, স্মৃতির বেশি জায়গা অধিকার করে। দিয়েগো মারাদোনা তাই অনেকের চেয়ে কম গোল করে, অনেকের চেয়ে কম ট্রফি জিতেও বহু মানুষের হৃদয়সম্রাট হয়ে রয়েছেন। ক্লাবের হয়ে লিওনেল মেসির চেয়ে বেশি খেতাব ভবিষ্যতে জিততেই পারেন কোনো ফুটবলার, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোই তো খুব পিছিয়ে ছিলেন না। মেসির চেয়ে বেশি গোল হয়ত কিলিয়ান এমবাপেও করে ফেলবেন। কিন্তু যেসব দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন দেড় দশকের বেশি সময়, কাতারের ফুটবল মাঠে যেসব ছবি এঁকেছেন গত একমাস – সেগুলো দিয়েই স্মৃতির মণিকোঠায় মেসির জায়গা পাকা হয়ে গেছে, মারাদোনার মতই। আর কে না জানে স্মৃতির কোনো লেবেল লাগে না, শিল্পে কোনো GOAT হয় না, কোনো র‍্যাঙ্কিং চলে না। এমন কোনো সঙ্গীতরসিক আছেন কি যিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের গান শুনতে ভালবাসেন বলে পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গান শোনেন না, হিসাব করেন দুজনের মধ্যে কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ? আমাদের স্মৃতি তো নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগামী ভিড়ে গাদাগাদি ট্রেনের কামরা নয়, যেখানে উত্তমকুমারের চকিত চাহনির পাশে জায়গা হবে না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দীপ্তির।পথের পাঁচালী পড়ে কাঁদলে পুতুলনাচের ইতিকথা-র নির্লিপ্তিতে মুগ্ধ হওয়ার জায়গা থাকবে না – এত সীমিত নয় মানবিক আবেগ।

আর যদি শিল্প জয়যুক্ত হয়? কাল তেমন এক রাত ছিল।

বার্সেলোনার জার্সিতে তিনি যত ফুল ফুটিয়েছেন ইউরোপের মাঠে মাঠে, আর্জেন্টিনার নীল-সাদা জার্সিতে লাতিন আমেরিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকায়, রাশিয়ায় – সব সত্ত্বেও থেকে যাচ্ছিল অপূর্ণতা। রত্নখচিত মুকুটে যে কোহ-ই-নূর না থাকলে আর সবই বৃথা মনে হয়। শুধু আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মনে হয় তা নয়, মেসির মুখ দেখলে বোঝা যেত তাঁর নিজেরও মনে হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে হারের পর সর্বত্রগামী হয়েছিল মেসির অশ্রুসিক্ত ছবি।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

পৃথিবীর মানচিত্রে আর্জেন্টিনার একেবারে অন্য প্রান্তে থাকা ফুটবলে অনুন্নত দেশ ভারতের বাসিন্দা আমরা বিশ্বকাপ দেখি স্রেফ আনন্দের খোঁজে। আমরা প্রাক্তন উপনিবেশ, আমরা তৃতীয় বিশ্ব। স্বভাবতই এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন সফল ইউরোপের চেয়ে বেশি ঝুঁকে থাকে শিল্পী লাতিন আমেরিকার দিকে। ভারতে যখন থেকে বিশ্বকাপ লাইভ দেখা যায় তখন থেকেই নিখুঁত জার্মানি, ইতালি বা লড়াকু চেক রিপাবলিক, ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের আবেগকে বেশি উস্কে দেয় ক্যামেরুন বা নাইজেরিয়া। আজও কি বেশ কাছের মানুষ মনে হয় না রজার মিল্লাকে? এ দেশে যারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা স্পেনের সমর্থক তাদের মনও তো আসলে কেড়ে নিয়েছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম, জিনেদিন জিদান, ইনিয়েস্তার মত বল প্লেয়াররা – ছবি আঁকার নৈপুণ্যে। মানুষ হিংসুটে, মানুষ দাঙ্গাবাজ, মানুষ অকারণে মানুষকে অপমান করে। আইজ্যাক আসিমভ যথার্থই লক্ষ করেছিলেন, মানুষ একমাত্র জীব যারা অন্য জীবকে খাঁচায় পোরে। তবু তো মানুষ যে আনন্দ দেয় তার আনন্দ কামনা করে। খেলার মাঠে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেন শিল্পী ফুটবলাররা। তাই তাঁদের প্রতি পক্ষপাত থাকবেই। বহু মানুষ তাই চেয়েছিলেন, মেসির হাতে যেন একবার বিশ্বকাপটা ওঠে। য়োহান ক্রয়েফ কখনো বিশ্বকাপ ছুঁতে পারেননি, জর্জ বেস্টের সে সুযোগই ছিল না। সে দুর্ভাগ্য যেন মেসির না হয়।

হয়নি। কাল সেই উদ্দাম হাওয়ার রাত ছিল। অন্তত গত চল্লিশ বছরের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বকাপের ফাইনাল। যেখানে ৩৫ বছরের মেসি প্রথমার্ধেই পেনাল্টি থেকে গোল করলেন, মাঠজুড়ে খেললেন। মাঝমাঠে নিজেদের গোলের দিকে মুখ করে বল পেলেন মেসি, মেসি থেকে জুলিয়ান আলভারেজ, আলভারেজ থেকে ম্যাক অ্যালিস্টার, ম্যাক অ্যালিস্টার থেকে আংহেল দি মারিয়া – ছবির মত গোল হল। আশি মিনিট একতরফা খেলা হওয়ার পর মেসির এক হাত যখন বিশ্বকাপে, তখন ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটো গোল করে ফ্রান্সকে ম্যাচে ফেরালেন এরপর যিনি বিশ্বের অবিসংবাদী সেরা ফুটবলার হয়ে উঠবেন, সেই এমবাপে।

তারপর অতিরিক্ত সময়ের শেষ প্রান্তে ফের গোল দিয়ে মেসি যখন উচ্ছ্বাসে ভাসছেন, ভাবছেন সোনার পরী এবার তাঁর হাতের মুঠোয়, তখনই সামান্য ভুলে পেনাল্টি। হাওয়া ঘুরে গেল আবার। তারপর যদি বনস্পতির বিরাট ছায়া না দিতেন সোনার দস্তানার অধিকারী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, হয়ত প্যারিসেই উড়ে যেত সোনার পরী।

নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল, এ যুগের সেরা ফুটবল শিল্পীর মুকুটে কোহ-ই-নূর বসিয়ে দেওয়ার ফাইনাল।

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই। সেই তিনি, যিনি ২০১০ সালে মেসির দলের কোচ হয়েও এমন অস্থির পদচারণা করতেন সাইডলাইনে যে মনে হত নিজেই নেমে পড়বেন। যিনি গত বিশ্বকাপেও গ্যালারিতে ছেলেমানুষের মত হাসতেন, কাঁদতেন, চিৎকার করতেন আর্জেন্টিনার ম্যাচে। যিনি ভিআইপি, তবু ভিআইপি নন। যাঁর সঙ্গে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ফুটবল খেলতে না জানা একজন সাধারণ আর্জেন্টিনা সমর্থকের কোনো তফাত থাকত না, উদ্বিগ্ন সঙ্গীসাথীরা পিছন থেকে জামা ধরে টেনে রাখতেন – পাছে মানুষটা টাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। ১৯৮৬ সালে প্রায় একা দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর পর যিনি জীবদ্দশায় আর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখতে পেলেন না, আমূল বদলে যাওয়া ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্ব ফুটবলে ২০ বছর পর লাতিন আমেরিকার বিশ্বজয়ের রাতে সেই আকাশলীন দিয়েগোকে বলতে ইচ্ছে করছিল

ফিরে এসো মারাদোনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার…

মেসি
ছবি @ElDiegoPics টুইটার হ্যান্ডেল থেকে

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

বিশ্বকাপ ফুটবলে মাঠ ও মাঠের বাইরে সেরা ১০ দিগন্ত

বিশ্বকাপ ফিফার সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ২০২৬ সালে তাকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা করা হবে আরও বেশি ডিমের আশায় – দলের সংখ্যা বাড়বে। চার বছর অন্তর হয় বলেই বিশ্বকাপ বহু অবিস্মরণীয় মুহূর্তের জন্ম দেয়, অনেক নতুন জিনিস দেখা যায়। মাঠে ও মাঠের বাইরে কী কী নতুন দেখলাম এবার? একটি অসম্পূর্ণ তালিকা:

মাঠে

১। এই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবল মরসুমের শেষে নয়, বিশ্বকাপ হল মাঝপথে। দামি খেলোয়াড়দের গত কয়েকটা বিশ্বকাপের তুলনায় অনেক তরতাজা দেখাল।

২। নয়ের দশক থেকে ক্রমোন্নতির পর আফ্রিকার ফুটবল ফের পিছিয়ে পড়ছে – এমন আশঙ্কার মেঘ সরিয়ে ক্যামেরুন, ঘানার মত অতীতে সাফল্য পাওয়া দেশ ব্যর্থ হলেও প্রথম আফ্রিকান দল হিসাবে সেমিফাইনালে পৌঁছল মরক্কো।

৩। অতদূর যেতে না পারলেও গতিময় ফুটবল খেলে মুগ্ধ করল জাপান। প্রথম রাউন্ডে জার্মানিকে হারানোর পর দ্বিতীয় রাউন্ডেও আগেরবারের ফাইনালিস্ট লুকা মদ্রিচের ক্রোয়েশিয়াকে টেনে নিয়ে গেল পেনাল্টি শুটআউট অবধি। এশিয়ার অন্য প্রতিযোগীদের মধ্যে সৌদি আরবও চমকে দিল আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়ে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের কাছে শোচনীয়ভাবে হারলেও এশিয়ার অন্য দেশ দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম রাউন্ডে হারিয়ে দেয় পর্তুগালের মত ভারি দলকে।

৪। রেফারিংয়ের মান খুশি করতে পারল না কাউকেই। প্রথম রাউন্ড থেকেই ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির অফসাইড দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন দলের সমর্থকরা অখুশি ছিলেন। কোনো দল সহজেই পেনাল্টি পেয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ ন্যায্য পেনাল্টি পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠছিল। অসন্তোষ মাত্রা ছাড়িয়ে গেল আর্জেন্টিনা বনাম নেদারল্যান্ডস ম্যাচে। দু দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হল, ১৮ জনকে হলুদ, একজনকে লাল কার্ড দেখালেন স্প্যানিশ রেফারি আন্তোনিও মাতেউ লাহোস। ম্যাচের পর প্রকাশ্যে তাঁর নিন্দা করলেন মেসি।

৫। স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বকাপ। এমনকি তৃতীয় স্থান দখলের ম্যাচেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।

আরো পড়ুন কাতারে বিশ্বকাপ: নিরোর অতিথি আমরা সবাই

মাঠের বাইরে

১। ফিফা বিশ্বকাপে রাজনীতি পছন্দ করে না, কিন্তু প্রতিবাদ আটকাতে স্বয়ং ফিফা সভাপতি রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতেও পিছপা নন। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই সাংবাদিক সম্মেলনে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

২। ইউরোপের দেশগুলো নিরাপদ প্রতিবাদে বিশ্বাসী। ফিফা হলুদ কার্ডের ভয় দেখাতেই ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেন ‘ওয়ান লাভ’ আর্মব্যান্ড পরার পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন। জার্মানিও শুধু ম্যাচের আগে টিম ফটো তোলার সময়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে প্রতিবাদ সারল।

৩। হাজার চেষ্টাতেও বিশ্বকাপকে অরাজনৈতিক করে ফেলা যায় না। মরক্কোর ফুটবলাররা স্পেনকে হারিয়ে আনন্দ উদযাপন করলেন প্যালেস্তাইনের পতাকা হাতে

৪। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সমেত অনেকে আবার হাস্যকরভাবে দাবি করলেন, এ জয় মুসলিম দুনিয়ার জয়। যেন বিশ্বকাপের আর কোনো দলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ফুটবলার নেই।

৫। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন জাতিরাষ্ট্র ব্যাপারটা কৃত্রিম, কার্ল মার্কস চাইতেন সীমান্তহীন পৃথিবী। কাতারে দেখা গেল সীমান্তগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বত্রিশ দলের ৮৩০ জন ফুটবলারের মধ্যে ১৩৭ জন যে দেশে জন্মেছেন সে দেশের হয়ে খেলেননি। নিকো উইলিয়ামস আর তাঁর ভাই ইনাকি খেলেছেন যথাক্রমে স্পেন ও ঘানার হয়ে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ভারতীয় দলের জার্সি এখন বিজেপির সম্পত্তি

সেওয়াগের মত কেউ কেউ এতই উগ্র যে অভব্য ট্রোলিংয়েও পিছপা হন না। কিন্তু বিজেপির পতাকা তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় না। ফ্যাসিবাদী কৌশল হিসাবে এটি বেশি কার্যকরী, কারণ এতে অনেক বেশি মানুষ প্রভাবিত হন। ওর গায়ে জার্সি নেই, অতএব ও নিরপেক্ষ – অধিকাংশ মানুষ এরকম সরলরেখাতেই ভাবতে পছন্দ করেন।

“দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না।” অরাজনৈতিক হওয়ার ভান করা সুখী বিত্তশালীদের ব্যঙ্গ করে লেখা এই ছড়া ২০২০ সালে রীতিমত ভাইরাল হয়েছিল। আজীবন অভিনয়ের পেশায় যুক্ত থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান হয়ে যাওয়া রুদ্রনীল ঘোষের তীব্র শ্লেষ কতজনকে বিঁধেছিল তার হিসাব নেই, কিন্তু ছড়াকার হিসাবে রুদ্রনীলের সততাকে সন্দেহ করা যাবে না। অচিরেই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি সাতেও থাকেন, পাঁচেও থাকেন। তৃণমূল কংগ্রেসে থেকে সরকারি আধিকারিক হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেও ঠিক সময়ে জার্সি বদলে বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু অরাজনৈতিক হয়ে থাকেননি। এ রাজ্যে সেই ২০১১ সাল থেকে আপনি অভিনেতা বা খেলোয়াড় – যা-ই হোন না কেন, বিখ্যাত হলেই জার্সি পরা বাধ্যতামূলক। যারা কিছুতেই কোনো জার্সি পরেনি তাদের কার্যকলাপ দেখে অন্তর্বাসের রং আন্দাজ করার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। অবস্থা এমন যে যাদের জার্সির চাহিদা নেই তারা কদিন আগেই যাদের অন্তর্বাস “নির্ঘাত সবুজ” বলে গাল দিয়েছে, তাদেরই “ওরটা লাল না হয়ে যায় না” বলে গলা জড়িয়ে ধরছে।

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। জনপ্রিয় মুখগুলোকে নিজের জার্সি না পরালে ফ্যাসিবাদের চলে না, কারণ তা ফ্যাসিবাদী শক্তিকে বৃহত্তর সামাজিক স্বীকৃতি দেয়। ভোটবাক্সেও তার প্রভাব পড়ে। যে দু-একজন পরতে চায় না তাদের গায়ে বিপক্ষের জার্সি চাপিয়ে না দিলেও চলে না। কারণ তারা ফ্যাসিবাদের সামাজিক স্বীকৃতিকে বিপন্ন করে। কেবল রাজনীতিকে নয়, গোটা সমাজটাকেই এ হেন বাইনারিতে ফেলতে না পারলে ফ্যাসিবাদ বাঁচতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা, নাটক ও খেলার জগতের পরিচিত মুখগুলোকে (সরলমতি মিডিয়া যাদের একদা নাম দিয়েছিল সুশীল সমাজ, এখন নাম রেখেছে বুদ্ধিজীবী) সফলভাবে দলে টেনে অথবা শত্রুপক্ষে ঠেলে দিয়ে ফ্যাসিবাদ অভিপ্রেত সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করতে শতকরা একশো ভাগ সফল হয়েছে। রূপোলি পর্দার দেব অধিকারী, নুসরত জাহান, মিমি চক্রবর্তী থেকে শুরু করে ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারি, লক্ষ্মীরতন শুক্লা – সকলেই শাসক দলের জার্সি পরেছেন। আবার রুদ্রনীল, অনিন্দ্যদের মত অতি বুদ্ধিমানরা প্রতি মরসুমে জার্সি বদলে বেড়াচ্ছেন। এসবই ফ্যাসিবাদের সামান্য লক্ষণ। সে প্রসঙ্গে সেটিং আছে না নেই, থাকলে কাদের মধ্যে আছে – তা নিয়ে আলোচনা করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলকে ফ্যাসিবাদী শক্তি বললে অনেকে রে রে করে ওঠেন অথবা নানা সূক্ষ্ম তর্কের অবতারণা হয়। সে তর্কে যাব না। কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দল যে ফ্যাসিবাদী তা সব বিরোধীই মোটামুটি মেনে নিয়েছেন। সেই সুবাদে কিছু কথা বলতেই এই নিবন্ধের অবতারণা। পশ্চিমবঙ্গে যেমন বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিচিত মুখগুলোকে দলে টেনে বৃহত্তর সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করা হয়েছে, ফ্যাসিবাদ সারা দেশেই সেই পন্থা নিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। কাজটা যে করা হচ্ছে তা কিন্তু এখনো অনেকেই মানতে পারেন না, কারণ ভারতীয় জনতা পার্টি এই কাজ তৃণমূল কংগ্রেসের মত গোদা পথে করেনি এতদিন। উদাহরণস্বরূপ, বলিউড এবং ক্রিকেট জগতের জনপ্রিয় মুখগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে বিজেপির পক্ষ নিয়ে টুইট করলে বা বক্তৃতা দিলেও তাদের সাংসদ বা বিধায়ক করা হয়নি। মন্ত্রী তো নয়ই। অনুপম খের, কঙ্গনা রানাওয়াত, অক্ষয় কুমাররা এখনো বিজেপির পার্টি সদস্য নন। বিরাট কোহলি, শচীন তেন্ডুলকর, অনিল কুম্বলে, বীরেন্দ্র সেওয়াগরা যে কোনো ইস্যুতে বিজেপি সরকারের পক্ষ নিয়ে প্রয়োজন পড়লেই টুইট করে দেন (অনেক সময় দেখা যায় বয়ানটা দাঁড়ি, কমা সুদ্ধ এক)। সেওয়াগের মত কেউ কেউ এতই উগ্র যে অভব্য ট্রোলিংয়েও পিছপা হন না। কিন্তু বিজেপির পতাকা তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় না। ফ্যাসিবাদী কৌশল হিসাবে এটি বেশি কার্যকরী, কারণ এতে অনেক বেশি মানুষ প্রভাবিত হন। ওর গায়ে জার্সি নেই, অতএব ও নিরপেক্ষ – অধিকাংশ মানুষ এরকম সরলরেখাতেই ভাবতে পছন্দ করেন। ফলে একই কথা গৌতম গম্ভীর বা ভোজপুরি সিনেমার নায়ক মনোজ তিওয়ারি বললে বিজেপি সমর্থক বাদে অন্যরা মানতে চাইবেন না, সন্দেহ করবেন। কারণ ওঁরা বিজেপির সাংসদ। কিন্তু কোহলি বা অক্ষয় বললে অনেক বেশি মানুষ মেনে নেবেন। বিজেপি একথা জানে বলেই ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখগুলোকে ভোটে দাঁড় করানোর জন্য বা নির্বাচনী প্রচারে হাজির করানোর জন্য আদেখলেপনা নেই। গম্ভীর বা তিওয়ারির জনপ্রিয়তা বিরাট বা অক্ষয়ের মত দেশব্যাপী নয়, বিভিন্ন মতের মানুষের মধ্যেও নয়। ফলে তাঁদের কাজে লাগানো হয় সূক্ষ্মতর উপায়ে লোকের মাথা খেতে।

এই প্রক্রিয়ার সাফল্য কতদূর সে আলোচনায় আসব। তার আগে বলে নিই, আসন্ন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে এমন একটা কাণ্ড ঘটেছে যাতে ফ্যাসিবাদ যে সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য জনপ্রিয় মুখগুলোকে ব্যবহার করার স্তর অতিক্রম করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে তা প্রমাণ হয়ে গেছে। এ জিনিসও আসলে আগেই শুরু হয়েছে, কিন্তু প্রায় কেউই বিশ্বাস করছিলেন না। আমি নিজেই অন্তত গোটা তিনেক লেখায় এ বিষয়ে লিখেছি এবং ঘোর বামপন্থীরাও হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। এবার আর উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ চোটের কারণে এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বাইরে থাকা অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজা গত মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) বিজেপির হয়ে জামনগর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রচারে নেমেছিলেন। রীতিমত রোড শো করেছেন। এমনিতে ব্যক্তি জাদেজা এমনটা করতেই পারেন। আইনত কোনো বাধা তো নেই বটেই, নীতিগতভাবেও আপত্তি করা চলে না, সমালোচনা করা চলে। আমেরিকার মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়িকা মেগান র‍্যাপিনো যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে সমর্থন করতে পারেন, জাদেজাই বা কেন তাঁর পছন্দসই দলের হয়ে প্রচার করতে পারবেন না? কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। বিজেপি এই রোড শোয়ের প্রচার করতে যে পোস্টার তৈরি করেছে তাতে জাদেজার গায়ে ভারতীয় দলের জার্সি। অর্থাৎ ওই কেন্দ্রের বাসিন্দা ক্রিকেটার জাদেজা বিজেপিকে ভোট দিতে বলছেন – শুধু এটুকু বক্তব্য নয়। ভারতীয় দল, যা আমার আপনার প্রতিনিধি হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে, তাদের একজন প্রতিনিধি বলছেন বিজেপিকে ভোট দিতে।

বিজেপি অবশ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করে থাকে সাবলীলভাবে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে পুলওয়ামায় বোমা বিস্ফোরণে যে সিআরপিএফ জওয়ানরা শহিদ হয়েছিলেন তার জন্য কারা দোষী তা উদ্ঘাটন করার উদ্যোগ আজ অবধি দেখা গেল না। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দল সেবার প্রায় গোটা নির্বাচনটাই লড়ল শহিদদের নাম করে। কেউ তদন্তের দাবি করলেই তাদের দেশদ্রোহী বলা হয়েছিল, আজও হয়। প্রয়াত সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত যে ভাষায় কথা বলতেন তাতে প্রায়শই বোঝা শক্ত হত তিনি সেনাবাহিনীর লোক না শাসক দলের লোক। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা নিজেদের হতশ্রী অবস্থার কথা প্রকাশ করলে কিন্তু উন্নতির প্রয়াস হয় না, উল্টে জওয়ানদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত সেনানীরা ‘ওয়ান র‍্যাঙ্ক ওয়ান পেনশন’ দাবি করতে গিয়ে যে অমিত শাহের অধীন পুলিসের গলাধাক্কা খেয়েছিলেন সেকথা অগ্নিবীর প্রকল্পের যুগে আর কে-ই বা মনে রেখেছে? কিন্তু সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণ যতখানি বিপজ্জনক, তার চেয়ে কম বিপজ্জনক নয় সরকারের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আত্মসাৎ করে নেওয়া।

ভাল হোক মন্দ হোক, আবালবৃদ্ধবনিতার ভোটাধিকারসম্পন্ন ভারতে গণতন্ত্রের অনুশীলন চলেছে সাড়ে সাত দশক। তার কিছু দীর্ঘমেয়াদি লাভ রয়েছে। যেমন এখনো দেশের আধিপত্যবাদী সরকারকে কিছু জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালিয়ে যেতে হচ্ছে এবং নির্বাচনের প্রাক্কালে ঘোষণা করতে হচ্ছে, জিতলে এই দেব বা ওই দেব। কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভোটাররা জেনে এসেছেন গণতন্ত্রে তাঁদের কিছু প্রাপ্য আছে। এই ধারণা বদল করার প্রক্রিয়া স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শুরু করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর নিজের দলকেও “রেউড়ি কালচার” মানতেই হচ্ছে। এটুকুই ভারতীয় গণতন্ত্রের অর্জন। তেমনই এক অর্জন এই ধারণা, যে ভারতের হয়ে খেলে যে দল, সে দল সব ভারতীয়ের। কংগ্রেসের নয়, বিজেপির নয়, সিপিএমের নয়, তৃণমূলের নয়, এমনকি সরকারেরও নয়। আবার এই তালিকার সকলেরই। এমন নয় যে স্বাধীনতার আগে বা পরে ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্যান্য খেলার প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো রাজনৈতিক দল নাক গলায়নি বা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেনি। এনকেপি সালভে, মাধবরাও সিন্ধিয়া, শরদ পাওয়ারের মত কংগ্রেস, এনসিপি নেতারা ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হয়েছেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, প্রফুল প্যাটেল সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সর্বোচ্চ পদে আসীন থেকেছেন দীর্ঘকাল। ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থার শীর্ষ পদে কংগ্রেসি সুরেশ কালমাদির কার্যকলাপ নিয়ে তো যত কম বলা যায় তত ভাল। রাজ্য স্তরে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের মাথায় পুলিস কর্তা প্রসূন মুখার্জিকে বসানোর জন্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অতিসক্রিয়তাও ভোলার নয়। কিন্তু কোনো নেতা, কোনো রাজনৈতিক দলই কখনো ভারতীয় দলকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেননি।

চলতি ফুটবল বিশ্বকাপ রাজতান্ত্রিক কাতারে হওয়ায় অতীতের ফ্যাসিবাদী বা জুন্টা সরকার চালিত রাষ্ট্রগুলোতে বিশ্বকাপ, অলিম্পিকের মত প্রতিযোগিতা বা জাতীয় দলকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর ইতিহাস নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। মনে রাখা ভাল, তেমন ঘটনা কিন্তু ভারতের কোনো সরকার কখনো ঘটায়নি। জাদেজার ঘটনা স্পষ্ট দেখিয়ে দিল, এবার আমরা ইতিহাসের সেই বিপজ্জনক অধ্যায়ে ঢুকে পড়েছি যখন শুধু রাজনীতি নয়, দেশের সবকিছুর উপরেই সরকার নিজের মালিকানা কায়েম করে, সাধারণ মানুষের আবেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতীয় দলের উপরেও।

কেন করে? ঠিক যে কারণে সেনাবাহিনী আর নিজেদের দলকে এক করে দেখায়, সেই কারণেই। অর্থাৎ দেশের জন্যে প্রাণ দিতে উদ্যত সৈনিকরা, দেশের প্রতিনিধি খেলোয়াড়রা আমাদের লোক। তারা মনে করে আমরাই সেরা – এই ধারণা সাধারণ মানুষের মনে প্রতিষ্ঠা করতে। যে কোনো একনায়ক বা একনায়ক হয়ে উঠতে চাওয়া শাসকের এটিই অভিজ্ঞান। সম্প্রতি ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে অপসারিত হওয়া জেয়ার বলসোনারোও একই চেষ্টা করেছিলেন। সারা বিশ্বের ব্রাজিল ভক্তদের প্রিয় হলুদ-সবুজ জার্সিকে নিজের প্রচারে এমনভাবে ব্যবহার করেছিলেন বলসোনারো, যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগেই বিশ্বকাপ দলের কোচ তিতে বলে রেখেছেন, খেতাব জিতলেও ১৯৫০ সাল থেকে চলে আসা প্রথা ভেঙে তিনি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করতে যাবেন না। ১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময়ে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেটাই হবে ভারতের প্রথম এবং শেষ নির্বাচন। তাঁদের মুখে ছাই দিয়ে আমাদের দেশে পাকিস্তানের মত জুন্টা সরকার বা সেনাবাহিনীর অঙ্গুলিহেলনে চালিত নড়বড়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই জাতীয় দলের জার্সি নিয়ে ওরকম নোংরা রাজনীতি কখনো হয়নি। সি কে নাইডু থেকে শচীন তেন্ডুলকর পর্যন্ত সব ক্রিকেট তারকাই আমাদের সকলের হয়েছেন। ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথম সিরিজ জয় বা ১৯৮৩, ২০০৭, ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয়ে দলমত নির্বিশেষে সব ভারতীয়ই গর্বিত হতে পেরেছে। সে সুদিন ফুরোতে চলল।

সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকাদের কাজে লাগানোর ছক ব্রাজিলেও দেখা গেছে। নির্বাচনের কদিন আগে নেইমার বলসোনারোকে সরাসরি সমর্থন করেন। কিন্তু বিজেপির অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। ফলে বলসোনারো বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এসব ব্যাপারে বিজেপি সূক্ষ্মতর, সুতরাং সফলতর। এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব বিরাট ডিমনেটাইজেশনের পরেই সাংবাদিক সম্মেলনে বলে দেন, ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে ওই সিদ্ধান্ত সর্বশ্রেষ্ঠ। একেবারে আরএসএসের সুরেই ২০১৮ সালে এক ক্রিকেটভক্তকে বলেন অন্য দেশের ক্রিকেটারদের পছন্দ করলে অন্য দেশেই চলে যেতে। অথচ আজও ভারতের উদারবাদী, প্রগতিশীলরা বিরাট বলতে অজ্ঞান। তাঁর ব্যাটিং নিয়ে অভিভূত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিরাটকে দক্ষিণপন্থী বললে প্রবল বামপন্থীরাও বেজায় রেগে যান। এমনকি বিরাটের হাত থেকে অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে মহম্মদ শামির পক্ষ নিয়ে কথা বলার ফলে – এমন কষ্টকল্পনাও তাঁরা করে ফেলতে পারেন। অথচ বিরাট তাঁর টিমমেটের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু সোশাল মিডিয়া ট্রোলকে জবাব দিয়েছিলেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মোটেই দাঁড়াননি। তাঁর নিজের শহর দিল্লিতে যখন গরীব মুসলমানদের বাড়ি, দোকান বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় তখন তাঁকে বলতে শোনা যায়নি “ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এই সিদ্ধান্ত সবচেয়ে লজ্জাজনক।”

বিরাটকে নিয়ে ভারতের অনেক নারীবাদীও উচ্ছ্বসিত, কারণ নিজের সাফল্যের মুহূর্তে তিনি সবসময় স্ত্রী অনুষ্কাকে কৃতিত্ব দেন, নিজের ব্যর্থতায় অনুষ্কা ট্রোলড হলে সোচ্চারে পাশে দাঁড়ান। কী নিষ্পাপ মুগ্ধতায় এই নারীবাদীরা গ্রাহ্যই করেন না, বক্সার বিজেন্দর সিং, প্রাক্তন ক্রিকেটার আশিস নেহরা, বর্তমান ক্রিকেটার শিখর ধাওয়ানের মত বিরাটও গুরমীত রাম রহিম সিং ইনসানের আশীর্বাদধন্য। এই গুরুদেব যে সে লোক নন, ইনি ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের বক্তব্য পড়লে শিউরে উঠতে হয়। বলা যেতেই পারে, বিরাট বহু বছর আগে যখন গুরমীতের কাছে গিয়েছিলেন তখন এসব জানতেন না বা তখনো হয়ত ওসব ঘটেনি। কিন্তু বিরাট অর্থনীতি জানেন, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস জানেন, কেবল অস্বস্তিকর তথ্যগুলো জানেন না – এ কেমন করে সম্ভব? গুরমীতের কীর্তিকলাপ পরে প্রকাশ্যে এসেছে, এমনটা অবশ্য খুবই সম্ভব। কিন্তু বিরাট কি তখন দুঃখপ্রকাশ করেছেন অতীতে ওই লোকের আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন বলে? ২০১৭ সালে একবারই তিনি গুরমীত সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তাতে কিন্তু বলেননি যে গুরমীতের কাছে কখনো যাননি। শুধু রসিকতা করে বলেছিলেন “Funniest part was him calling Jagdish Nehra and Jousuf Pathan??”

গেরুয়া জার্সিটি না পরে বিরাট এসব কাণ্ড করে বেড়ান বলে গেরুয়া রাজনীতির বিরোধীদের চোখে তিনি একইরকম প্রিয় থেকে যান এবং তাঁদের অজান্তেই তাঁদের মধ্যে বিভাজনের বিষ ঢুকে পড়ে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় দুই বন্ধু বিরাট বড় না রোহিত শর্মা বড় তা নিয়ে ঝগড়া করতে করতে খুন করে ফেলায়। ওই খুনের জন্য বিরাট দায়ী নন, দায়ী যে বিভাজনের রাজনীতির প্রচারে তিনি নিজের খ্যাতিকে ব্যবহার করেন সেই রাজনীতি। এমন বিদ্বেষে দীর্ণ সমাজই ফ্যাসিবাদের প্রার্থিত।

ভারতীয় ক্রিকেট দলের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মুখপাত্র হয়ে ওঠার কাজটা কিন্তু আজ শুরু হয়নি। হয়েছিল ২০১৯ সালের ৮ মার্চ, যখন পুলওয়ামায় নিহত জওয়ানদের শ্রদ্ধা জানাতে ভারতীয় দল সেনাবাহিনীর মত ক্যামোফ্লাজ ক্যাপ পরে মাঠে নেমেছিল রাঁচিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একদিনের ম্যাচে। সেখানে রাজনীতিকরণকে ক্যামোফ্লাজ করা হয়েছিল শহিদদের নাম করে। কিন্তু ক্রিকেট দলের সামরিকীকরণও যে অন্যায় সেকথা ভারতে কেউ বলেনি, উদারপন্থী বা বামপন্থী ক্রিকেটভক্তরাও বলেননি। কারণ তাঁরা খেলা রাজনীতির বাইরের বিষয় বলে মনে করেন। এই বালখিল্য মানসিকতার সুযোগ নিয়েই ভারতীয় ফ্যাসিবাদ সামাজিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। লক্ষণীয়, ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যশালী ক্রিকেট মাঠ ফিরোজ শাহ কোটলার নামকরণ করা হয়েছে অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মত বড় দলের ভারত সফরের সূচিতে জায়গা পাচ্ছে না ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন গার্ডেন্স বা মুম্বাইয়ের ঐতিহ্যশালী ওয়াংখেড়ে আর ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়াম। তালিকায় থাকছে জীবিত প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত আমেদাবাদের স্টেডিয়ামটি।

আরও পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

আজ ভারতীয় দলের জার্সি বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে কাজে লাগানো হচ্ছে, কাল খেলোয়াড়দের জয়-পরাজয় বিজেপিরই জয়-পরাজয় বলে গণ্য হবে। ইতিমধ্যেই সে অভিজ্ঞতা ভারতের অলিম্পিক খেলার ক্রীড়াবিদদের হয়ে গেছে। কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমস বা অলিম্পিকের প্রোমো ভিডিও জুড়ে থেকেছেন ক্রীড়ামন্ত্রীরা। পদকজয়ীদের সংবর্ধনা সভায় প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এভাবেই চলবে, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে খেলাধুলো এভাবেই চলে। মুশকিল হল, জুন্টা সরকার বা এ ধরনের আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে যতক্ষণ মাঠে জয় আসে ততক্ষণ সব ঠিক থাকে। পরাজয়ের ফল হয় ভয়ংকর। যে ক্রীড়াবিদরা আজ জল্লাদের উল্লাসমঞ্চে উঠছেন এবং যে ক্রীড়াপ্রেমীরা হাততালি দিচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু সেদিন কেঁদে কূল পাবেন না।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

কোরোকোরো কোমিক্কু কমিক্স এবং বিশ্বকাপে এশিয়া

আইএসএলের কথা ভেবে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে? জাপান কিন্তু স্রেফ জে-লিগ চালু করে ক্ষান্ত হয়নি। গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া তাদের স্বভাব নয়। জাপানে স্কুল ফুটবলকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়।

“চীন, ব্রহ্মদেশ, অসভ্য জাপান,/তারাও স্বাধীন, তারাও প্রধান” কিন্তু ভারত ঘুমিয়ে আছে – এমন বিলাপ করেছিলেন কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সে শ দেড়েক বছর আগেকার কথা। আজকের বাঙালি চীন, জাপানকে অসভ্য দেশ ভাবার ভুল করে না। কিন্তু চারবারের বিশ্বকাপ জয়ী জার্মানিকে জাপান এক গোলে পিছিয়ে পড়েও হারিয়ে দিল দেখে ভারতের ঘুমিয়ে থাকা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস যে পড়ে না – এমন কথা হলফ করে বলা যায় না।

অবশ্য এবারের বিশ্বকাপ যেভাবে আরম্ভ হয়েছে, তাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করলে আর থামা শক্ত হবে। আয়োজক কাতার বাদে এশিয়া মহাদেশের সব দেশই রীতিমত সাড়া জাগিয়ে শুরু করেছে। শুক্রবার রাতে নেদারল্যান্ডস আর ইকুয়েডরের খেলা ড্র হওয়া মাত্রই কাতারের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু তার কিছুক্ষণ আগেই বিশ্বখ্যাত গ্যারেথ বেলের ওয়েলসের বিরুদ্ধে রোমহর্ষক জয় হাসিল করেছে ইরান।

ইরান কিন্তু প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আধ ডজন গোল হজম করেছিল। খেলা নয়, প্রশংসিত হয়েছিল ইরান দলের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করা। মাহসা আমীনীর রাষ্ট্রীয় হত্যার পর ইরান এখন আন্দোলনে উত্তাল। কেবল মহিলারা নন, বহু পুরুষও গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ইরান যখন একের পর এক গোল খাচ্ছিল গ্যারেথ সাউথগেটের দলের কাছে, তখন বহু শহরে উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন মানুষ। কারণ জাতীয় দল, স্বভাবতই, তাঁদের কাছে দেশের সরকারের প্রতীক। তৎসত্ত্বেও ম্যাচের পর ইরান অধিনায়ক এহসান হজসফি জানান, তাঁরা সরকার নয়, দেশের মানুষেরই পাশে আছেন। এই দুঃসাহসের কী ফল হজসফি ও তাঁর সতীর্থরা পরিবার সমেত ভোগ করবেন তা দেশে ফিরলে হয়ত টের পাওয়া যাবে। বলা বাহুল্য, ইরান সরকার পিঠ চাপড়ে দেওয়ার জন্য বসে নেই।

ইতিমধ্যেই খানিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে নিশ্চয়ই, ফলে ওয়েলসের বিরুদ্ধে ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মিলিয়েছেন হজসফিরা। কিন্তু সেসব চাপ সামলেও ‘খেলতে পারে না, শুধু প্রতিবাদ করতে পারে’ এই বিদ্রূপ কড়ায় গণ্ডায় চুকিয়ে দিয়ে নব্বই মিনিট আপ্রাণ লড়াই করার পর শেষ মুহূর্তে দুটো গোল দিয়ে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। ইংল্যান্ড বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হওয়ায় ইরানের সামনে এখনো পরের রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০১৪ আর ২০১৮ বিশ্বকাপেও যথাক্রমে আর্জেন্টিনা এবং স্পেনের মত দলের সঙ্গে জোরদার লড়াই করেছিল তারা, হেরেছিল ১-০ গোলে। সুতরাং এবার দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছলে তা হবে দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল।

ইতালিয়া ৯০-এর ক্যামেরুন থেকে শুরু হয়েছিল আফ্রিকার দলগুলোর বিশ্বকাপ মাতিয়ে দেওয়া খেলা। কোনোবার নাইজেরিয়া, কোনোবার সেনেগাল চমকে দিয়েছে। ২০১০ বিশ্বকাপে শেষ মুহূর্তে লুই সুয়ারেজ হাত দিয়ে গোল আটকে না দিলে হয়ত প্রথম আফ্রিকান দল হিসাবে ঘানা সেমিফাইনালেও পৌঁছে যেত। সেই আফ্রিকা এবারে এখনো নিষ্প্রভ, বরং এশিয়া চমকে দিচ্ছে।

এমনিতে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপে এশিয়ার সবচেয়ে ধারাবাহিক দল। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন আর জার্মানি ছাড়া তারাই একমাত্র দল যারা গত দশটা বিশ্বকাপেই খেলেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। একমাত্র ২০০২ সালে ঘরের মাঠে সেমিফাইনালে পৌঁছনো ছাড়া তাদের বলার মত কোনো সাফল্য নেই। এবারে যথেষ্ট শক্তিশালী উরুগুয়ের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র দিয়ে শুরু করা আশাব্যঞ্জক। যদিও গ্রুপ এইচ বেশ কঠিন।

কোচ হার্ভে রেনার্ড ছাড়া সৌদি আরব আর সকলকেই চমকে দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে। চমক আরও বাকি আছে কিনা সময় বলবে, তবে সৌদির সাফল্যে তাদের কোচের অবদান কিন্তু অনেকখানি। রেনার্ড কোনো কুলীন ইউরোপিয় ক্লাবের কোচ ছিলেন না কখনো, কিন্তু আফ্রিকা, এশিয়ার খেলোয়াড়দের মনমেজাজ, শক্তি-দুর্বলতা তাঁর নখদর্পনে। জাম্বিয়া আর আইভরি কোস্টকে আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস খেতাব জিতিয়েছিলেন। সে কারণেই তৈল ধনে ধনী সৌদি কর্তারা তাঁকে জাতীয় দলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

জাপানের চমক কিন্তু এক ম্যাচে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তাদের এই সাফল্যের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে তৎকালীন লিগের খোলনলচে বদলে ফেলে জে-লিগ চালু করার মাধ্যমে। বয়স্ক বাঙালি ফুটবলপ্রেমীদের বিলক্ষণ মনে আছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ব্রাজিলিয় ট্র‍্যাজিক নায়ক জিকোর জাপানের লিগে খেলতে আসার কথা। আরও বহু ফুটবলোন্নত দেশের তারকাই সেসময় জাপানে খেলতে আসেন। তবু জাপান এশিয় ফুটবলে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠলেও বিশ্ব স্তরে তেমন ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি তখনই। আজকের অবস্থায় পৌঁছতে সময় লেগেছে।

আইএসএলের কথা ভেবে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে? জাপান কিন্তু স্রেফ জে-লিগ চালু করে ক্ষান্ত হয়নি। গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া তাদের স্বভাব নয়। জাপানে স্কুল ফুটবলকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশু বয়স থেকে শুরু হয় স্কাউটিং। ‘নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ কাগজের এক প্রতিবেদন বলছে, জাপানি শিশুদের মধ্যে ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ ৩৫ বছর ধরে করে চলেছেন টম বায়ার বলে এক আমেরিকান। আটের দশকে অবসর নেওয়ার পর তিনি জাপানেরই বাসিন্দা হয়ে যান। ছোটদের জন্য একগুচ্ছ ফুটবল স্কুল খোলেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আরও মজার কথা, সে যুগে ছোটদের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় কমিক্সে ‘কোরোকোরো কোমিক্কু’-তে ফুটবল শেখার কায়দাকানুন শিশুপাঠ্য করে লিখতে থাকেন। সেদিন জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিল যে জাপান দল, তাদের তিনজন ফুটবলার – মিনামিনো, দোয়ান আর এন্দো – বায়ারের সেই স্কুলগুলোর ছাত্র ছিলেন।

আরও পড়ুন জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত

এত কাঠখড় পুড়িয়ে জাপানি ফুটবল এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে বিশ্বকাপের ২৬ জনের দলের সাতজন খেলেন বুন্দেশলিগায় আর একজন জার্মানির দ্বিতীয় ধাপের লিগে। এঁদের মধ্যে জার্মান লিগে সবচেয়ে বেশি সমীহ করা হয় মাঝমাঠের খেলোয়াড় দাইচি কামাদাকে। তিনি খেলেন এইন্ট্রাখট ফ্র‍্যাঙ্কফুর্টে। জার্মানির বিখ্যাত ক্লাব ভিএফবি স্টুটগার্টের স্কাউটরা কদিন আগেই জাপানের শোশি হাইস্কুলের ছাত্র আনরি চেইসুকে সই করিয়েছে। সে ইতিমধ্যেই জাপানের অনূর্ধ্ব-১৭ ও ২৩ দলে খেলে ফেলেছে।

অর্থাৎ জাপান ফুটবলে সূর্যোদয় সবে শুরু হয়েছে। চলতি বিশ্বকাপেই তারা সাফল্যে দক্ষিণ কোরিয়াকে টপকে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবার বাকি তিনটে ম্যাচে তেমন কিছু করতে না পারলেও আগামীদিনে বিশ্ব ফুটবলে সমীহ করার মত এশিয় শক্তি হয়ে ওঠার পথে তারাই সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

জাতীয় সঙ্গীত এবং নেশন: ইরান যা ভাবায়

নেশন যে একটা বানিয়ে তোলা ধারণা – রবীন্দ্রনাথের এই মতের চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হলে। একই কবির একই ভাষায় লেখা দুটো গান গায় দুই আলাদা নেশনের মানুষ।

জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়ার কী কী ফল হতে পারে? ইসলামিক আইনে চালিত, এই মুহূর্তে গনগনে বিদ্রোহের আগুনে ঝলসাতে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে কী হতে পারে জানি না, তবে সাংবিধানিকভাবে এখনো ধর্মনিরপেক্ষ এবং তথাকথিত আধুনিক আইনকানুন মেনে চলা দেশ ভারতে কী হতে পারে তার বেশকিছু দৃষ্টান্ত আছে।

২০১৮ সালের দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন নিজেদের দেশের সবচেয়ে সংস্কৃতিবান এবং প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী বলে দাবি করা কলকাতার বাসিন্দারা স্টার থিয়েটারে ন জন দর্শকের দিকে তেড়ে যান সিনেমা শুরু হওয়ার আগে ‘জনগণমন’ চলার সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে গান না করার অপরাধে। অথচ সে বছরের জানুয়ারিতেই সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টেরই জারি করা সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র বাজানো বাধ্যতামূলক করার আদেশ বাতিল করে দিয়ে বলেছিল, “The interim order passed on November 30, 2016 is modified that playing of national anthem prior to screening of a film is not mandatory or directory”। কিন্তু দেশের অবস্থা তখনই এমন, যে ওই আদেশ পুরোপুরি বাতিল করার সাহস সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরও হয়নি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় সে সময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বটে “should we wear our patriotism on our sleeves”? কিন্তু আদালত এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্কোয়্যার পাস দিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে।

সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর ৯ জানুয়ারি দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া কলকাতার বিভিন্ন সিনেমা হলের মালিকদের মতামত প্রকাশ করেছিল এক প্রতিবেদনে। সেই প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায়, ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাতিরাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যে মনোভাবই থেকে থাকুক, কলকাতার হলমালিকরা ব্যবসার মত জাতীয়তাবাদের প্রতিযোগিতাতেও হারতে রাজি নন।

প্রিয়া সিনেমার মালিক অরিজিৎ দত্ত বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশে আমার এখানে কোনো তফাত হবে না। আমি জাতীয় সঙ্গীতের বদলে বন্দে মাতরম বাজাব। আশা করব দর্শকরা উঠে দাঁড়াবেন। তবে আমি কাউকে জোর করব না।” মিনার, বিজলী, ছবিঘরের মালিক সুরঞ্জন পাল বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্টের নতুন অর্ডার জাতীয় স্তোত্র বাজানো বাধ্যতামূলক নয় বললেও আমি বাজাতেই থাকব। আমি এ-ও আশা করব যে গান চলার সময়ে দর্শকরা উঠে দাঁড়াবেন।” নবীনার মালিক নবীন চৌখানি আবার একটা নতুন কথা বলেছিলেন। “আগের অর্ডারটা বৈষম্যমূলক ছিল। কেবল সিনেমা হলগুলোকে জাতীয় স্তোত্র বাজানোর জন্যে বেছে নেওয়া হল কেন? রেস্তোরাঁ, খেলার মাঠ – এসব জায়গায় তো বাজাতে বলা হয়নি।”

অর্থাৎ দিনের যে কোনো সময়ে যে কোনো উদ্দেশ্যে আপনি যেখানেই যান না কেন, রাষ্ট্রের ইচ্ছা হলেই আপনাকে সাবধান পজিশনে দাঁড় করিয়ে জাতীয় স্তোত্র বাজিয়ে দেওয়া হবে আর আপনাকেও সুবোধ বালক/বালিকা হয়ে গাইতে হবে। এই ব্যবস্থায় বিশেষ কারোর আপত্তি নেই। শুধু তাই নয়, কেউ ভিন্নমত হলে তাকেও মেরে ধরে দাঁড় করিয়ে গাওয়ানোর উদ্যোগ নেবে লোকে।

চেন্নাই, বেঙ্গালুরুতেও সেসময় সিনেমা হলে এ নিয়ে বিস্তর গোলমাল, হাতাহাতি হয়েছিল, গৌহাটিতে হুইলচেয়ারে বসা এক শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকেও জাতীয়তাবাদী দর্শকরা উঠে না দাঁড়ানোর জন্য গালাগালি করেছিলেন। উল্লেখ্য, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার অবমাননা আইনত অপরাধ বলে গণ্য হলেও আইনে কোথাও বলা নেই উঠে না দাঁড়ানো মানে অবমাননা করা। যা-ই হোক, আজও রমরমিয়ে সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র বেজে চলেছে, অধিকাংশ নাগরিক উঠে দাঁড়িয়ে গান গেয়েও থাকেন। ইদানীং অবশ্য যারা উঠে দাঁড়ায় না তাদের দিকে তেড়ে যাওয়ার ঘটনা তত শোনা যায় না। অনেকে ওসব ঝামেলা এড়াতে গান বেজে যাওয়ার পরে হলে ঢোকেন। তার মানে ঝামেলা যে হতে পারে সে আতঙ্ক সফলভাবে সকলের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে। সিনেমা হলে জাতীয়তাবাদ প্রদর্শন কর্তব্য বলে স্বীকৃত হয়েছে। সে কর্তব্য পালন না করলে গারদে পুরে দেওয়ার আইন এখনো পাস হয়নি বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কদিন আগে বলে দিয়েছেন, শুধু বন্দুকধারী নয়, কলমধারী নকশালদেরও সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। তেমন কিছুদিন পরে বলতেই পারেন, শুধু রাজনীতি করা অ্যান্টি-ন্যাশনাল নয়, জাতীয় স্তোত্র না গাওয়া অ্যান্টি-ন্যাশনালদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে। কে না জানে, প্রধানমন্ত্রী যে সে লোক নন? তিনি বিষ্ণুর একাদশ অবতার। অতএব তাঁর কথাই আইন। তিনি বললেই জাতীয় স্তোত্র গাইতে যারা উঠে দাঁড়ায় না তাদের হাজতবাস করানোর জন্য সিনেমা হলে কাতারে কাতারে পুলিস মোতায়েন হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

তবু না মেনে উপায় নেই, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আয়াতোল্লা খোমেইনি হয়ে উঠতে বাকি আছে। অনুসিদ্ধান্ত – ভারতের ইরান হয়ে উঠতে বাকি আছে। তাই ভাবছিলাম, ভারতেই যদি সাধারণ নাগরিক সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র না গাইলে এত কাণ্ড হতে পারে, তাহলে কাতারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে ইরানের যে ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না, তাঁদের কী অবস্থা হবে। ম্যাচের পর সাংবাদিক সম্মেলনে ইরান অধিনায়ক এহসান হজসফি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন কেন তাঁরা জাতীয় সঙ্গীত গাননি। জানিয়েছেন দেশে যা চলছে তা যে ভাল হচ্ছে না তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই এবং তাঁর দল দেশের মানুষের পাশেই আছে। তাদের জন্যেই ভাল খেলার চেষ্টা, গোল করার চেষ্টা।

⚡️ BREAKING: #IRAN FOOTBALL TEAM CAPTAIN DEFIES REGIME, BACKS PROTESTS: “WE HAVE TO ACCEPT THAT CONDITIONS IN OUR COUNTRY ARE NOT RIGHT & OUR PEOPLE ARE NOT HAPPY. THEY SHOULD KNOW THAT WE ARE WITH THEM. AND WE SUPPORT THEM. AND WE SYMPATHIZE WITH THEM REGARDING THE CONDITIONS.” PIC.TWITTER.COM/SX4KENXITZ— Hillel Neuer (@HillelNeuer) November 21, 2022

কী চলছে তাঁর দেশে? কারোর জানতে বাকি নেই। ১৬ সেপ্টেম্বর মাহসা আমীনী রাষ্ট্রের হাতে খুন হওয়ার পর থেকে ইরানের মহিলাদের হিজাববিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। তাঁরা প্রকাশ্যে আসছেন ইসলামিক রাষ্ট্রের হিজাব, বোরখা পরার আইন অমান্য করে। পুড়িয়ে দিচ্ছেন সেসব, চুল কেটে ফেলছেন। মিছিলে মিছিলে ছয়লাপ গোটা দেশ। পাল্লা দিয়ে চলছে সরকারি দমননীতি – মারধোর, হত্যা, পুলিসি হেফাজতে যৌন নির্যাতন। ইরানের পুরুষদের একটা বড় অংশ যে এই আন্দোলনের পাশে এসে গেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল বিশ্বকাপের মঞ্চে ফুটবল দলের প্রতিবাদে।

পৃথিবীর কোথাও কোনো নারী আন্দোলনের পাশে এভাবে পুরুষদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা দাঁড়িয়েছেন কিনা জানি না, নারীবাদ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা বলতে পারবেন। কিন্তু হজসফি ও তাঁর দল একইসঙ্গে অন্য একটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন যা আজকের পৃথিবীতে, ভারতে তো বটেই, প্রাসঙ্গিক। ভারতের জাতীয় স্তোত্রের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ নেশন (বাংলাতেও এই শব্দই লিখেছেন) ব্যাপারটাকেই ভাল চোখে দেখতেন না। স্বাধীন দেশে কী করলে নেশনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় তার কিছু মানদণ্ড আমরা ঠিক করেছি, সব দেশই করে থাকে। তার অন্যতম জাতীয় সঙ্গীত। ইরানের ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না, বললেন দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ দেশ মানে মানুষ, কতকগুলো প্রতীক নয়। তাহলে কি প্রতীকের প্রয়োজন শুধু দেশের উপর নেশনের আধিপত্য বজায় রাখতে?

১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে রবীন্দ্রনাথ ইরানে যান শাসক রেজা শাহ পহলভির আমন্ত্রণে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক হজসফিদের জানার কথা নয়। তবু তাঁদের আচরণে যেন উঠে এসেছে নেশন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথেরই অনাস্থা।

আরও পড়ুন ‘ন্যাশনাল আর্কাইভের অবলুপ্তি দেশটাকে শপিং মল বানানোর চক্রান্ত’

১৯১৬ সালের মে মাস থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল – এই সময়ের মধ্যে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দেন। যেসব কথাবার্তা তিনি বলেন তা জাতীয়তাবাদীদের (বা নেশনবাদীদের) সেদিনও পছন্দ হয়নি, আজও হয় না। যেমন জাপান সম্পর্কে তিনি বলেন “জাপানে দেখেছি গোটা দেশের মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের মস্তিষ্ক এবং স্বাধীনতা সরকারের হাতে খর্ব হতে দিয়েছে। আর সরকার নানারকম শিক্ষার ব্যবস্থার দ্বারা মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের অনুভূতি নির্মাণ করছে, মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিলে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে নজরদারি চালাচ্ছে। এক সংকীর্ণ পথ দিয়ে সত্যের দিকে নয়, মানুষকে সেই দিকে চালিত করছে যেদিকে নিয়ে গেলে মানুষকে একেবারে ভেঙে গড়ে নিজের ইচ্ছানুযায়ী এক সমসত্ত্ব জড়পিণ্ডে পরিণত করা যাবে। মানুষ এই সর্বগ্রাসী মানসিক দাসত্ব সানন্দে এবং সগর্বে মেনে নেয় কারণ তাদের মধ্যে নেশন নামক ক্ষমতার যন্ত্রে পরিণত হওয়ার উত্তেজক অভিলাষ কাজ করে…”। [ভাষান্তর আমার]

(I have seen in Japan the voluntary submission of the whole people to the trimming of their minds and clipping of their freedom by their government, which through various educational agencies regulates their thoughts, manufactures their feelings, becomes suspiciously watchful when they show signs of inclining toward the spiritual, leading them through a narrow path not toward what is true but what is necessary for the complete welding of them into one unform mass according to its own recipe. The people accept this all-pervading mental slavery with cheerfulness and pride because of their nervous desire to turn themselves into a machine of power, called the Nation…)

পড়লে মনে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়েই রবীন্দ্রনাথ ইসলামিক বিপ্লব পরবর্তী ইরানের মত নেশন বা একবিংশ শতাব্দীর বিরাট ডিসটোপিয়াসুলভ নেশনগুলোর চেহারা দেখতে পাচ্ছিলেন, যা তাঁর অন্তত দেড় দশক পরে ইউরোপের টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে দেখে কল্পনা করবেন অলডাস হাক্সলি (Brave New World; প্রকাশকাল ১৯৩২), তিন দশক পরে জর্জ অরওয়েল (1984; প্রকাশকাল ১৯৪৯)।

নেশন যে একটা বানিয়ে তোলা ধারণা – রবীন্দ্রনাথের এই মতের চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হলে। একই কবির একই ভাষায় লেখা দুটো গান গায় দুই আলাদা নেশনের মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে এ জিনিস দেখতে হয়নি। ১৯১৬-১৭ সালের সেই বক্তৃতামালায় ভারত সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “যদিও শৈশবকাল থেকে আমাকে শেখানো হয়েছিল যে নেশনকে পুজো করা প্রায় ঈশ্বরকে এবং মানবতাকে শ্রদ্ধা করার চেয়েও ভাল, আমার মনে হয় আমি সেই শিক্ষার প্রভাব কাটিয়ে উঠেছি। আমার বিশ্বাস আমার দেশের মানুষ তাঁদের সত্যিকারের ভারত লাভ করতে পারবেন সেই শিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করলে, যা শেখায় একটা দেশ মানবতার আদর্শের চেয়ে বড়।”

(Even though from childhood I had been taught that idolatry of the Nation is almost better than reverence for God and humanity, I believe I have outgrown that teaching, and it is my conviction that my countrymen will truly gain their India by fighting against the education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity.) [ভাষান্তর আমার]

রবীন্দ্রনাথ যে লড়াই করতে বলেছিলেন আমরা তাতে ব্যর্থ হওয়ার ফলেই দেশভাগ হয়, উপরন্তু খণ্ডিত ভারতবর্ষ আজও ভাগ হয়ে চলেছে। ইরানের ফুটবল দল নেশন নির্ধারিত প্রতীককে অস্বীকার করে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা যত দিন যাচ্ছে তত নেশনের বশংবদ হয়ে পড়ছেন। আগে সাতে পাঁচে থাকতেন না, ইদানীং সবার আগে রাষ্ট্রের পক্ষ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সোশাল মিডিয়ায়। এসব বললেই একটা কথা বলা হয় – আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের থেকে ওসব আশা করা উচিত নয়, কারণ আমাদের সমাজ ইউরোপ বা আমেরিকার মত গণতান্ত্রিক নয়। আমাদের খেলোয়াড়রা রাজনৈতিক প্রতিবাদ করলে নাকি নানাবিধ চাপের মুখে পড়বেন। ইরানের ফুটবলারদের দেখার পর এ কথায় আর কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই বোধহয়। কারণ আমরা তো ইরানের চেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক দেশ বলেই নিজেদের দাবি করে থাকি। তাহলে তাদের ফুটবলাররা এবং তাঁদের পরিজন যে সংকটের কল্পনায় ম্রিয়মান না হয়ে এমন প্রতিবাদ করেছেন তার চেয়ে বড় কোন বিপদে আমাদের খেলোয়াড়রা পড়তে পারেন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে?

পুনশ্চ: বিশ্বকাপ জ্বরে আমাদের অনেকেরই হয়ত চোখ এড়িয়ে গেছে একটা খবর। বিজেপির আইনজীবী নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় দিল্লি হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করে দাবি করেছেন ‘জনগণমন’ আর ‘বন্দে মাতরম’-কে সমান মর্যাদা দিতে হবে। তার উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, দুটো গান একই স্তরের এবং দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দুটোকেই সমান শ্রদ্ধা জানানো উচিত। উপাধ্যায় নিজের পিটিশনে দাবি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলোকে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুটো গানই প্রত্যেক কাজের দিনে বাজানো নিশ্চিত করতে হবে।

দেশ যত দুর্বল হয় নেশনকে তত শক্তিশালী করার দরকার হয়। যে গানে নেশন কম জনগণমন বেশি, সে গান ঠেকায় পড়ে সহ্য করে নিতে হয়। কিন্তু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে অবশ্যই সেই গান বেশি শ্রেয়, যেখানে মাতৃমূর্তির সাহায্যে জনমনে অভিন্ন নেশন প্রতিভাত হয়। 

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

কাতারে বিশ্বকাপ: নিরোর অতিথি আমরা সবাই

এমন নয় যে কেবল একখানা জমকালো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হবে বলেই তারা হঠাৎ শ্রমিকদের এভাবে নিংড়ে নেওয়া শুরু করেছে। দুনিয়াসুদ্ধ লোকের জানা ছিল কাতারে নিয়মকানুন সর্বনেশে।

রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন – এ কথা খুবই প্রচলিত। উইলিয়ম শেক্সপিয়র অবশ্য অন্য আরেকটা বাজনার কথা লিখেছেন। কিন্তু সে বিতর্ক থাক। কথা হল, বাজনদার হওয়া ছাড়াও নিরোর নানারকম গুণ ছিল। যেমন তিনি নিজের বাগানে অতিথিদের জন্যে এলাহি নৈশ পার্টির আয়োজন করতেন। সে পার্টির আলোর ব্যবস্থা করা হত অভিনব কায়দায়। কিছু অসহায় লোককে আলকাতরায় চুবিয়ে কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হত, তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হত। জ্যান্ত মানুষগুলো পুড়ত আর আলোয় আলো হয়ে উঠত নিরোর বাগান। সেসব কয়েক হাজার বছর আগেকার কথা। তখনকার মানুষ এখনকার তুলনায় অসভ্য ছিল – এই বলে নিরোর অতিথিদের মাফ করে দেওয়া যেতে পারে হয়ত। কিন্তু আমাদের মাফ করা হবে কোন অজুহাতে? আমাদের যুগেও তো আনন্দের আয়োজনগুলো, বিশেষ করে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ আখ্যা দেওয়া হয় যে মোচ্ছবগুলোকে, সেগুলো নিরোর পার্টির মতই বহু মানুষের জীবন, জীবিকা, স্বাধীনতার বিনিময়ে আয়োজিত হচ্ছে। কলকাতায় অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপ হলে বস্তি উচ্ছেদ হয়, আমেদাবাদে ডোনাল্ড ট্রাম্প এলে গরীব মানুষগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে উঁচু পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়। কাতারে আজ থেকে যে বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে তার আয়োজন করতে যা যা করা হয়েছে সেসবও তো গোপন নেই। তবু তো আমরা মেতে উঠব, তাই না?

কী হয়েছে জানেন না বলছেন? তা না জানতেও পারেন। কারণ এ যুগের নিরোরা সভ্য মানুষ। তাঁরা অমন বুক ফুলিয়ে অতিথিদের দেখিয়ে দেখিয়ে ওসব করেন না। অতিথিদের নজর যাতে কেবল ভাল ভাল জিনিসে পড়ে তার বন্দোবস্ত করার জন্য গাদাগুচ্ছের সংবাদমাধ্যমও আছে। তারা আর কতটুকু জানতে দেয় এসব? তবে বিদেশি সংবাদমাধ্যম এসে পড়লে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যায় অনেক সময়। তাই একবার বলে দিই যতটুকু জানা গেছে।

কাতারের রাজপরিবার এবং ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেছেন ২০১০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত নির্মাণকাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন মোটে তিনজন শ্রমিক। কিন্তু ফেয়ার স্কোয়ার নামের মানবাধিকার সংগঠন বলেছে ওই সংখ্যাটা নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাদের সুপ্রিম কমিটির বক্তব্য, আরও ৩৬ জন বিভিন্ন নির্মাণস্থলে দিনের কাজ শেষ করার খানিকক্ষণ পরেই মারা গেছেন। কিন্তু কাতার সরকার এবং ফিফা তাঁদের হিসাবের মধ্যে রাখেনি, বলে দিয়েছে ওগুলো “প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু”। অবশ্য এ-ও হিমশৈলের চূড়া। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামে যে বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা আছে, তাদের বিশ্বাস করলে বলতে হয় আসলে কয়েক হাজার শ্রমিক মারা গেছেন গত ১২ বছরে।

বিশ্বকাপ আরম্ভের দিন সকালে মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো, এমবাপে, লেওয়ানডস্কিদের নিয়ে সুস্বাদু লেখা উপহার দেওয়ার বদলে তেতো সত্যের ঝাঁপি খুলে বসার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। মৃত শ্রমিকদের কথা না তুলে পারলাম না। তার কারণ ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের তদন্তমূলক প্রতিবেদনে বছর খানেক আগেই উঠে এসেছে এই তথ্য, যে স্রেফ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কারই ৬,৫০০ প্রবাসী শ্রমিক মারা গেছেন কাতারের আনন্দযজ্ঞে। সবে বছর দুয়েক হল, নিজের দেশের রাজপথ দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের হাজার হাজার মাইল হেঁটে যেতে দেখেছি নিরম্বু উপবাসে। হাঁটতে হাঁটতে মরে যেতে দেখেছি, ক্লান্ত হয়ে রেললাইনের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ট্রেনের চাকায় পিষে যেতে দেখেছি। সে স্মৃতি টাটকা থাকতেও বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার উত্তেজনায় প্রবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা কী করে ভুলে যাই বলুন?

তবে হ্যাঁ, যত শ্রমিকেরই মৃত্যু হয়ে থাক আর যত শ্রমিকই কাতারের অতি দুর্বল শ্রম আইনের সুযোগে চরম শোষিত হয়ে থাকুন (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে সংখ্যাটা এক লক্ষের বেশি), দেখার মত একটা জিনিস যে দেখা যাবে আগামী একমাস, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক শ্রমিক বলেছেন তাঁদের দিয়ে দিনে ১৪-১৮ ঘন্টা কাজ করানো হয়েছে। এত পরিশ্রম কি আর বৃথা যাবে? শুধু কাতারকে দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। এমন নয় যে কেবল একখানা জমকালো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হবে বলেই তারা হঠাৎ শ্রমিকদের এভাবে নিংড়ে নেওয়া শুরু করেছে। দুনিয়াসুদ্ধ লোকের জানা ছিল কাতারে নিয়মকানুন সর্বনেশে। ফিফার সদস্যরা সব জেনেশুনেই তাদের বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। কিসের বিনিময়ে তাঁদের এহেন বদান্যতা সে আবার আরেক কাহিনি।

আপনি বলতেই পারেন, এসব রাজনীতির কথা, ফুটবল কোথায়? কিন্তু মনে রাখবেন, এবারের বিশ্বকাপ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে ইউক্রেন আক্রমণ করার জন্যে। সুতরাং আর ফুটবল অরাজনৈতিক, বিশ্বকাপ অরাজনৈতিক – এসব বলার অধিকার ফিফা বা কাতারের নেই। ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নতুন কাতারে নতুন শ্রম আইন বলবৎ করা এবং মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স সেন্টার তৈরি করানোর জন্য ফিফাকে চাপ দেবে বলে ঘোষণা করেছে। আটটা দলের অধিনায়ক মাঠে নামবেন সমপ্রেমী, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি বিবিধ লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের সমর্থনে রামধনু রংয়ের ‘ওয়ানলাভ’ আর্মব্যান্ড পরে। বেশকিছু দল কাতারের সমপ্রেমবিরোধী দমনমূলক আইনের প্রতিবাদে ফ্যান জোন করবে না ঠিক করেছে। এছাড়াও বেশ কয়েকজন ফুটবলার ও কোচ বলেছেন কাতারে বিশ্বকাপের আয়োজন করাই উচিত হয়নি। সুতরাং অন্তত এবারের বিশ্বকাপের আর অরাজনৈতিক হয়ে থাকার উপায় নেই। সেকথা বুঝেই বোধহয় ইনফান্তিনো হঠাৎ দারুণ কাতারি, আরব, আফ্রিকান, সমপ্রেমী, প্রতিবন্ধী, প্রবাসী শ্রমিক হয়ে উঠেছেন। এমনকি বলেছেন কাতারের নিন্দে করার আগে ইউরোপের নিজেদের তিন হাজার বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। আহা, এমন ভাল ভাল কথা যদি সারা বছর বিশ্বের বড় বড় পুঁজির অধিকারীরা ভাবতেন!

তবে একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে যে এই প্রথম এত বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এতখানি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একনায়কতান্ত্রিক যে কোনো সরকার চিরকাল এরকম প্রতিযোগিতাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের কাজে লাগায়। রুশ একনায়ক ভ্লাদিমির পুতিন ২০১৮ বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছিলেন, আর্জেন্টিনার একনায়ক হর্হে রাফালে ভিদেলা একইভাবে ব্যবহার করেছিলেন ১৯৭৮ বিশ্বকাপকে, বেনিতো মুসোলিনি ১৯৩৪ বিশ্বকাপকে। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে আর্য রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে অ্যাডলফ হিটলারকে যেভাবে ল্যাজে গোবরে হতে হয়েছিল জেসি ওয়েন্সের দাপটে, সে ইতিহাস মনে রাখেন না। রাখার দরকার নেই। কারণ মুসোলিনি আর ভিদেলার আমলে যথাক্রমে ইতালি আর আর্জেন্টিনায় ঠিক কী কী ঘটেছিল ইতিহাসে তা স্পষ্ট লেখা থাকলেও ওই দুই বিশ্বকাপে যে ফুটবলাররা খেলেছিলেন, তাঁরা সকলেই যে অংশগ্রহণের জন্য লজ্জিত বা তাঁদের জয় রক্তলাঞ্ছিত মনে করেন তা কিন্তু নয়। কারোর মতে তাঁরা খেলেছিলেন দেশের মানুষের জন্য, দেশের শাসকের জন্য তো নয়। কেউ আবার বলেন মাঠের বাইরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা ছিল না। কিছু ফুটবলার সৎভাবে স্বীকার করেন সবকিছুই জানা ছিল, কিন্তু তাঁরা কী-ই বা করতে পারতেন? এই তিন দলের কেউই যে সম্পূর্ণ ভুল তা বলা চলে না। কারণ খেলোয়াড়দের ক্ষমতার সীমা আছে। বল পায়ে অতিমানবিক দেখতে লাগে বলেই তাঁরা কেউ সত্যি সত্যি অতিমানব নন।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

সত্যি কথা বলতে মুসোলিনি আর ভিদেলা আয়োজিত বিশ্বকাপে যা যা ঘটেছিল, তার তুলনায় কাতারে যা হতে চলেছে সেটা বড়জোর নোংরামি। কাতারে অন্তত কোনো স্টেডিয়াম থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে ডিটেনশন ক্যাম্প নেই, আর্জেন্টিনায় কিন্তু ছিল। উপরন্তু মুসোলিনি যেভাবে ফাইনালের রেফারিকে পর্যন্ত চোখ রাঙিয়ে ইতালির বিশ্বকাপ জয় নিশ্চিত করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে, কাতারের রাজার পক্ষে তা করা প্রায় অসম্ভব। কাতার যদি গ্রুপ এ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছয় তাহলেই যথেষ্ট। কারণ তাদের গ্রুপে আছে নেদারল্যান্ডস আর আফ্রিকান সিংহ সেনেগাল। সাদিও মানে শেষ মুহূর্তে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেও তারা যথেষ্ট শক্তিশালী দল।

গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ডের পক্ষে গ্রুপ বি মোটেই কঠিন হওয়ার কথা নয়। হ্যারি কেন ও তাঁর দলবল ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা দলগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে, কারণ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে (২০১৮) পৌঁছবার পরের ইউরোতেই (২০২০) ফাইনাল খেলার বিরল কৃতিত্ব এই দল অর্জন করেছে। তবে ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড দলের বিশ্বজয়ের কৃতিত্ব এখনো অধরা। এফ এ-র সঙ্গে সাউথগেটের চুক্তির মেয়াদ ২০২৪ পর্যন্ত। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, যে জানা আছে এবার ট্রফি জিততে না পারলে ওই চুক্তি কাজে আসবে না। গত কয়েক বছরে ক্রমাগত উন্নতি করে চলা এই দলটা কেনই বা গ্যারেথ বেলের ওয়েলস, নড়বড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইরানকে নিয়ে চিন্তিত হতে যাবে?

একই কথা প্রযোজ্য গ্রুপ সি-র আর্জেন্টিনার জন্য। এমনকি দিয়েগো মারাদোনার খেলোয়াড় জীবনেও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযান শুরু হত অস্থিরভাবে। এই প্রথম ওই বিরল প্রতিভার মানুষটি না থাকবেন ড্রেসিংরুমে, না থাকবেন শিশুসুলভ উদ্দীপনা নিয়ে সমর্থক হিসাবে গ্যালারিতে। অনেকদিন পরে এবার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ খেলতে নামছে ফেভারিটদের মধ্যেও ফেভারিট হিসাবে, যদিও লায়োনেল মেসি সেকথা মানতে চাইছেন না এখনো। কদিন আগেই তিনি দাবি করেছেন আর্জেন্টিনা মোটেই ফেভারিট নয়। কথাটা নিঃসন্দেহে দলের উপর চাপ তৈরি হতে না দেওয়ার জন্য বলা। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত একটা দল যদি ফেভারিট না হয় তাহলে শব্দটার মানে কী? এবারের বিশ্বকাপ মেসির জন্যে শেষ সুযোগ। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে যতরকম খেতাব জেতা সম্ভব প্রায় সবই জিতে ফেলেছেন একাধিকবার, বিশ্বের সর্বকালের সেরাদের মধ্যেও তাঁর নাম লিখে ফেলেছেন অগণিত মানুষ। তবুও মারাদোনা নামক একটা দেওয়ালের সামনে এসে বারবার থমকে দাঁড়াতে হয়েছে মেসিকে। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা এবং সারা পৃথিবীর সমালোচকরা বারবার বলে এসেছেন, বার্সেলোনার মেসি আর আর্জেন্টিনার মেসি এক নয়। তিনি নীল-সাদা জার্সিতে তো কিছুই জেতেননি। মারাদোনা প্রয়াত হলেন ২০২০ সালে, আর পরের বছরই মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জিতে ফেললেন। এবার তাঁর সামনে মারাদোনার ১৯৮৬ সালের কীর্তি ছুঁয়ে ফেলার সুযোগ। মারাদোনা অবশ্য প্রায় একা হাতে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ভরা যৌবনে, মেসি এখনই ৩৫। ইতিমধ্যেই বার্সেলোনা ছেড়ে তাঁকে প্যারিস সাঁ জা-য় সরে যেতে হয়েছে, ২০২৬ সালে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকোর বিশ্বকাপে মেসি মাঠে নামার অবস্থায় থাকেন, তাহলেও বিশ্বকাপ জেতার অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাছাড়া এত শক্তিশালী দলই বা প্রতি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা পাবে কোথায়? সাধারণত আর্জেন্টিনা গোল করেও নিশ্চিন্ত হতে পারে না। কিন্তু এবার লায়োনেল স্ক্যালোনির দলে অন্তত একজন ক্রিস্টিয়ান রোমেরো আছেন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায়।

গ্রুপ ডি-র প্রথম স্থানের লড়াইটা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স আর বিপজ্জনক ডেনমার্কের মধ্যেই থাকার কথা, যদি না অস্ট্রেলিয়া কোনো চমক দেয়। এই নিয়ে পরপর পাঁচটা বিশ্বকাপ খেলবে তারা, কিন্তু এবারের বিশ্বকাপটা আরেকটু হলেই ফসকে যাচ্ছিল। শেষমেশ আন্তঃমহাদেশিয় প্লে অফে পেরুকে হারিয়ে কাতারে পৌঁছতে হয়েছে। ইউরো ২০২০-তে ডেনমার্ক সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল। সেইসময় মাঠেই অসুস্থ হয়ে পড়া ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন নিজের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন, সম্প্রতি ফ্রান্সকে ডেনমার্ক দুবার হারিয়েছেও বটে। তবু দিদিয়ের দেশঁর ছেলেরা বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল। পল পোগবা আর এনগোলো কান্তে অবশ্য মাঝমাঠে থাকছেন না, কিন্তু গত বিশ্বকাপের বিস্ময়বালক কিলিয়ান এমবাপে এখন ২৩ বছরের ভয়ঙ্কর গোলশিকারী। সঙ্গে থাকার কথা ছিল করিম বেনজেমার। কিন্তু তিনি আবার উরুর চোটে ছিটকে গেলেন গতকাল। ফ্রান্সের গোলে অবশ্য নির্ভরযোগ্য উগো লরিস থাকছেন।

গ্রুপ ই থেকে যে দুই দলের দ্বিতীয় রাউন্ডে না ওঠাই অঘটন হবে, সেই স্পেন আর জার্মানির বেশ মিল আছে। দুটো দলই প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, কিন্তু বেশ কিছুদিন কোনো ট্রফি জিততে পারেনি। জার্মান ফুটবল ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ সময় গত চারটে বছর। রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ থেকেই তাদের বিদায় সকলকে চমকে দিয়েছিল। তারপর ইউরো ২০২০-তেও তারা দ্বিতীয় রাউন্ডের গন্ডি টপকাতে পারেনি। কিন্তু হান্সি ফ্লিকের দলে আবার একগুচ্ছ পৃথিবীর প্রথম সারির ফুটবলার এসে গেছেন। গোল করার জন্য সার্জিও ন্যাব্রি, লেরয় সেন, কাই হ্যাভের্তজ, টিমো ওয়ার্নারের পরেও আছেন ৩৩ বছরের থমাস মুলার। পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। ম্যানুয়েল নয়ারকেও ভুলে গেলে চলবে না, তিনি তো শুধুই গোলরক্ষক নন।

লুই এনরিকের স্পেনেও প্রতিভাবান আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের ছড়াছড়ি। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা এই মুহূর্তে পেদ্রি, যাঁর বয়স মাত্র ১৯, বিশ্বকাপ চলাকালীন কুড়িতে পা দেবেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই বার্সেলোনার জার্সি গায়ে প্রায় ১০০ ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। বার্সেলোনার আরেক তরুণ আনসু ফাতিকে নিয়েও অনেকের বিরাট আশা। ফিট থাকলে তিনি একাই বিশ্বকাপ মাতিয়ে দিতে পারেন বলে কারো কারো ধারণা। ইউরো ২০২০-তে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া স্পেন বিশ্বকাপের যোগ্যতার্জন পর্ব পেরিয়ে এসেছে বেশ অনায়াসেই। তবে পেদ্রি, ফাতিদের করা গোল এনরিকের রক্ষণ ধরে রাখতে পারবে কিনা সেটাই বড় কথা। বটবৃক্ষের মত সার্জিও বুস্কেৎস অবশ্য থাকবেন ওই তরুণদের পিছনে।

গত বিশ্বকাপের রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়ার জন্য গ্রুপ এফ সহজ হওয়ার কথা। কারণ এই গ্রুপে তাদের চ্যালেঞ্জ করার মত দল একমাত্র বেলজিয়াম, যাদের কেবলই শক্তিক্ষয় হয়েছে গত চার বছরে। অন্যদিকে জ্লাটকো ডেলিচের অধীন ক্রোয়েশিয়ার ক্রমোন্নতি হয়েছে। ২০১৮ বিশ্বকাপের বেলজিয়াম দলকে বলা হয়েছিল সোনালি প্রজন্ম। সেই প্রজন্ম প্রায় শেষ। ভিনসেন্ট কম্পানি অবসর নিয়েছেন, রোমেলু লুকাকু আগের মত বিপজ্জনক নেই আর ইডেন হ্যাজার্ডের চোটে জর্জরিত সময় কেটেছে রিয়াল মাদ্রিদে। এখনো প্রথম দলে নিয়মিত নন। একমাত্র কেভিন ডি ব্রুইন আর গোলরক্ষক থিবাউ কুতোয়া আগের বিশ্বকাপের ফর্মেই আছেন বলা যায়।

গ্রুপ জি-র ক্যামেরুন উচ্চাকাঙ্ক্ষী দল। রিগোবার্ট সংয়ের ছেলেরা যখন মার্চ মাসে আলজেরিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ছাড়পত্র আদায় করলেন, তখন ক্যামেরুনের কিংবদন্তি প্রাক্তন ফুটবলার স্যামুয়েল এটোয়ো দলকে বলেছিলেন “আমরা কাতারে যাব বিশ্বকাপ জিততে।” স্বপ্ন সবসময় বড় করে দেখাই ভাল। কিন্তু এটোয়োর স্বপ্ন সফল করতে ক্যামেরুনকে প্রথম রাউন্ডেই সার্বিয়া আর সুইটজারল্যান্ডের মত শক্ত বাধা ডিঙোতে হবে। দ্রাগান স্তোইকোভিচের অধীনে সার্বিয়া শুধু জিততে চায় না, অনেক গোল করতে চায়। তাদের হারানো মোটেই সহজ নয়। কিন্তু দল হিসাবে আরও জমাট মুরাত ইয়াকিনের সুইটজারল্যান্ড, যাদের প্রাণভোমরা গ্রানিৎ ঝাকা। এই দল ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সকে ১-৩ পিছিয়ে পড়েও শুটআউটে হারিয়েছিল, কোয়ার্টার ফাইনালেও স্পেনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পেনাল্টি শুটআউট অব্দি।

এমন একটা গ্রুপ হয়ত তিতের ব্রাজিলের পক্ষেও নেহাত সহজ হবে না, যদিও পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এই গ্রুপ থেকে প্রথম হয়ে উঠবে বলেই সকলে আশা করবে। মেসির মত নেইমারও এবার যে দলে খেলবেন তাঁর খেলোয়াড় জীবনে সেটাই সম্ভবত ব্রাজিলের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। রাফিনিয়া, রিচার্লিসন, লুকাস পাকেতা – নেইমার ছাড়াও তিতের হাতে গোল করার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এতজন হাজির। তার উপর মাঝমাঠে আছেন ক্যাসেমিরো আর রক্ষণভাগে বর্ষীয়ান থিয়াগো সিলভা। কার তাতে কী, তিতে যদি ষষ্ঠ খেতাবের স্বপ্ন দেখেন?

ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোরও এটাই শেষ বিশ্বকাপ। পিয়ার্স মর্গানের সঙ্গে যে সাক্ষাৎকারের জন্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাঁকে ক্লাব থেকে তাড়াতে চলেছে বলে খবর, সেখানেই তিনি জানিয়েছেন আর ২-৩ বছর খেলে চল্লিশে অবসর নিতে চান। সেক্ষেত্রে বিশ্বকাপের মুখে অমন একখানা সাক্ষাৎকার কেন দিতে গেলেন তা বিস্ময়কর। এমনিতেই পর্তুগাল পড়েছে শক্ত গ্রুপে। গ্রুপ এইচে তাদের প্রতিপক্ষ ঘানা, উরুগুয়ে আর দক্ষিণ কোরিয়া। ঘানা অবশ্য শেষ ১২ ম্যাচের মাত্র দুটো জিতেছে, কিন্তু হেড কোচ ওটো অ্যাডো যথার্থই বলেছেন, ঘানা হল বড় প্রতিযোগিতার দল। তারা ২০১০ সালে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের স্বাদ পেয়ে গেছে। ফলে তাদের হালকাভাবে নেওয়া যায় না। আবার উরুগুয়ে শুধু যে দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (যদিও বহুকাল আগে – ১৯৩০, ১৯৫০) তা নয়, এবারে তাদের দল যথেষ্ট শক্তিশালী। লুই সুয়ারেজ আর এডিনসন কাভানি তো আছেন বটেই, আছেন দিয়েগো গোদিন। এঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে থাকবে রিয়াল মাদ্রিদের ফেদেরিকো ভ্যালভের্দের তারুণ্যের দীপ্তি। কোচ দিয়েগো আলোনসোর বিশ্বাস এই দল তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে পারে। সে বিশ্বাসের শক্ত পরীক্ষা গ্রুপেই হয়ে যাবে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত এই গ্রুপে আছে দক্ষিণ কোরিয়া – এশিয়ার সবচেয়ে ধারাবাহিক দল। এমনকি ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনা আর স্পেনকে বাদ দিলে একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়াই টানা দশটা বিশ্বকাপ খেলতে চলেছে। তাদেরও বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। টটেনহ্যামের সন হিউং-মিন সুস্থ থাকলে এবং ফিট থাকলে কোরিয়াও বেগ দিতে পারে।

এমতাবস্থায় রোনাল্ডো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফর্ম হারিয়ে বসলেন, একটা ম্যাচের মধ্যেই মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন, বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে বললেন ইউনাইটেড ম্যানেজার এরিক টেন হ্যাগকে মোটেই শ্রদ্ধা করেন না। ওই ক্লাব এবং ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার ওয়েন রুনিকে অকারণেই ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলেন। পর্তুগালের আর যে ফুটবলার যেমনই খেলুন না কেন, বলাই বাহুল্য রোনাল্ডো স্বমহিমায় না থাকলে ২০১৬ ইউরো জয় আর ২০১৯ উয়েফা নেশনস লিগ জয় সম্ভব হত না।

পাঠক, আপনি যদি পর্তুগালের ভক্ত হন, তাহলে রোনাল্ডোর জন্য প্রার্থনা করুন। যদি অন্য কোনো দলের সমর্থক হন তাহলে তাদের জন্য প্রার্থনা করুন। কিন্তু বিনীত অনুরোধ, সঙ্গে কাতারের মৃত এবং অত্যাচারিত মানুষের জন্যও প্রার্থনা করুন। প্রার্থনায় কিছু হয় না, কিন্তু এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারবেন? আমরা সকলেই তো নিরোর অতিথি হয়ে গেছি, কেউ বাদ নেই। কারণ আজ বিশ্বজুড়ে অনেক নিরো।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

ভারতীয় ক্রিকেট: জাহান্নামের আগুনে পুষ্পের হাসি

কেবল টি টোয়েন্টি নয়। রোহিত, শিখর ধাওয়ান, কোহলিরা একদিনের ক্রিকেটে যে ব্যাটিংটা করেন সেটাও প্রায় প্রাক-জয়সূর্য-কালু যুগের ব্যাটিং।

হে (ক্রিকেট) অতীত, তুমি হৃদয়ে আমার…

রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা সোশাল মিডিয়া প্রজন্মের ক্রিকেটার। তাঁরা খুব ইতিহাসের তোয়াক্কা করবেন এমন ভাবা অন্যায়। কিন্তু ভারতীয় দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের খেলোয়াড় জীবন থেকেই একটা ব্যাপারে দারুণ সুনাম। তিনি নাকি নিজের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে পড়ুয়া। যে কোনো সফরে তিনি কিছু না কিছু পড়েন। সেসব বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে ক্রিকেটের ইতিহাস। বিভিন্ন ক্রিকেট সাংবাদিক একাধিকবার এসব কথা লিখেছেন, তাই বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। উপরন্তু দ্রাবিড় যে সুবক্তা তা আমরা সকলেই জানি। শুধু ইংরেজিটা চমৎকার বলেন তা নয়, বক্তব্যও থাকে জোরালো। দ্রাবিড়ের ২০১১ সালের ‘স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান ওরেশন’ এত উৎকৃষ্ট ছিল যে তা নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হয়েছিল। যে লোক বই পড়ে না তার পক্ষে অত সুন্দর কথা বলা সম্ভব নয়।

এহেন পড়ুয়া এবং ক্রিকেট ইতিহাস সচেতন দ্রাবিড় কি জানেন না যে অস্ট্রেলিয়া যেমন গ্লেন ম্যাকগ্রা, ডেনিস লিলি, জেফ থমসন, ব্রেট লি-র দেশ তেমনই রিচি বেনো আর শেন ওয়ার্নেরও দেশ? বল ঘোরাতে জানেন এমন লেগস্পিনাররা বরাবরই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সফল হন, কারণ সে দেশের পিচের অতিরিক্ত বাউন্স তাঁদের ঘূর্ণিকে আরও বিষাক্ত করে তোলে। এই মুহূর্তে পায়ে গুলি খেয়ে হুইলচেয়ারে বন্দি ইমরান খান জানেন, ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ে কত বড় ভূমিকা ছিল লেগস্পিনার মুস্তাক আহমেদের। নটা ম্যাচে ১৬ খানা উইকেট নিয়েছিলেন ১৯.৪৩ গড়ে, ওভার পিছু রান দিয়েছিলেন চারেরও কম। সেরা বোলিং করেছিলেন একেবারে ফাইনালে। মেলবোর্নের বিশাল মাঠে ইংল্যান্ড অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ আর অলরাউন্ডার ডারমট রিভ মুস্তাককে মারতে গিয়ে আউটফিল্ডে ক্যাচ তুলে আউট হন। গ্রেম হিক ঠকে যান মুস্তাকের গুগলিতে।

লেগস্পিনারদের কথা বলে আলোচনা শুরু করলাম কেন? ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি ফাইনালে ১৯৯২ সালের মতই আবার পাকিস্তান আর ইংল্যান্ড মুখোমুখি বলে? না। ভাগবত চন্দ্রশেখর আর অনিল কুম্বলের দেশ ভারত একজন পরীক্ষিত ও সফল লেগস্পিনারকে ডাগআউটেই বসিয়ে রেখে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিল বলে। যজুবেন্দ্র চহলের অস্ট্রেলিয়া সফর বেঞ্চে বসে শেষ হয়ে যাওয়াই ভারতের এবারের অভিযানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট যে আগাগোড়া ভুল পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ব খেতাব জিততে গিয়েছিল, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ নেই। মাঠে নেমে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে সেসবের আলোচনা তো হবেই। কিন্তু পরিকল্পনাতেই ভুল থাকলে মাঠে নেমে আর ঠিক কাজটা করা হবে কী করে?

ভারতের মত দেশে ক্রিকেট বোঝে না এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম। ফলে অগণিত ক্রিকেটবোদ্ধাদের মধ্যে কেউ বলে বসতেই পারেন, ১৯৯২ সালের বস্তাপচা ৫০ ওভারের ক্রিকেটের ধারণা দিয়ে আজকের টি টোয়েন্টি ক্রিকেটকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া বোকামি। আচ্ছা, ইতিহাস চুলোয় যাক। এবারে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে লেগস্পিনাররা কী করেছেন সেটাই না হয় দেখা যাক।

সুপার ১২ স্তর থেকে ফাইনালের আগে পর্যন্ত মোট নজন লেগস্পিনার খেলেছেন (ইংল্যান্ডের দুজন; আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবোয়ের একজন করে)। এঁরা মোট ১৩১ ওভার বল করে তুলে নিয়েছেন ৪১টা উইকেট। উইকেট পিছু খরচ করতে হয়েছে মাত্র ২২.২৯ রান, ওভার পিছু রান দিয়েছেন সাতেরও কম। একজনও লেগস্পিনারকে খেলায়নি ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস আর বাংলাদেশ – ঠিক যে চারটে দেশ সেমিফাইনালে পৌঁছতে পারেনি।

যা শত্রু পরে পরে

এই আলোচনা শুরুতেই সেরে নেওয়ার আরেকটা কারণ হল, ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা সেমিফাইনালে গোহারা হারার পর সটান দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন বোলারদের ঘাড়ে। স্বয়ং অধিনায়ক সমেত ব্যাটাররা কী করেছেন সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে তাই বলে নেওয়া দরকার যে ঠিকঠাক বোলারদের খেলানোই হয়নি। অস্ট্রেলিয়ায় খেলা হলেই সমস্ত আলোচনা জোরে বোলারদের নিয়ে হয়ে থাকে। কারণ সবাই জানে সে দেশের পিচ অন্য দেশের তুলনায় গতিময় হয়, বাউন্স বেশি থাকে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে অস্ট্রেলিয়ায় জিততে হলে দলে ভাল স্পিনার থাকা একইরকম জরুরি, বিশেষ করে সীমিত ওভারের খেলায়। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রিকেটমাঠগুলো অস্ট্রেলিয়াতেই। যাঁরা নিয়মিত টি টোয়েন্টি ক্রিকেট দেখে অভ্যস্ত তাঁরা জানেন, এই ফরম্যাটে সর্বত্রই বাউন্ডারি ছোট করে ফেলা হয়। ফলে দৌড়ে তিন রান নেওয়ার ঘটনা প্রায় দেখাই যায় না ভারত বা সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর মাঠে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাঠগুলো এতটাই বড় যে বাউন্ডারি কমিয়ে আনার পরেও এবারের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে প্রচুর তিন রান হতে দেখা গেছে। ভারতের সঙ্গে সেমিফাইনালে মহম্মদ শামির অবিমৃশ্যকারিতায় জস বাটলার একবার দৌড়ে চার রান পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছেন। তা এত বড় বড় মাঠে স্পিনারকে চার, ছয় মারতে গেলে আউট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই টি টোয়েন্টি যুগের আগেও যে দলে ভাল স্পিনার আছে তারা অস্ট্রেলিয়ায় ভাল ফল করেছে।

১৯৯২ সালে কেবল পাকিস্তানের মুস্তাক নয়, নিউজিল্যান্ডের অফস্পিনার দীপক প্যাটেলও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন এই কারণে। স্পিনার যে বোলিং ওপেন করতে পারে তার আগে কেউ কখনো ভাবেনি। প্রয়াত মার্টিন ক্রোয়ের ওই চাল প্রতিপক্ষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছিল। প্যাটেল বেশি উইকেট নিতে পারেননি, কিন্তু ওভার পিছু রান দিয়েছিলেন ৩.১০। আরও আগে ১৯৮৫ সালে ভারত যখন অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জেতে, সেই জয়েরও অন্যতম স্থপতি ছিলেন লেগস্পিনার লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ।

অথচ এবার চহলের বদলে খেলে গেলেন অক্ষর প্যাটেল। যিনি উচ্চতার কারণে পিচ থেকে বাউন্স আদায় করতে পারেন বটে, কিন্তু বল ঘোরাতে হলে তাঁর দরকার স্লো টার্নার। অস্ট্রেলিয়ায় অমন পিচ পাওয়া যায় না, বরং সমান বাউন্সের পিচ হওয়ায় অক্ষরের মত বোলারকে মনের সুখে প্রহারেণ ধনঞ্জয় করা যায়। হয়েছেও তাই। অক্ষর প্রায় ৪০ গড়ে পাঁচ ম্যাচে মোটে তিনটে উইকেট নিয়েছেন, ওভার পিছু সাড়ে আটের বেশি রান দিয়েছেন। কিন্তু বোলিং আক্রমণের একমাত্র সমস্যা তিনি নন। দীর্ঘদিন সাদা বলের ক্রিকেটে টিম ম্যানেজমেন্টের অপছন্দের বোলার হয়ে থাকার পর রোহিত-দ্রাবিড়ের আমলে অশ্বিন হঠাৎই প্রিয় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি প্রায় কোনো ম্যাচেই কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি। অথচ পিচে স্পিনারদের জন্য যথেষ্ট সাহায্য ছিল। সেমিফাইনালের অ্যাডিলেডে তো ছিলই। চহলের চেয়ে অক্ষরের ব্যাটিং ক্ষমতা বেশি, তাই তাঁকে খেলানোই সমীচীন – এমন একটা যুক্তি টিম ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ দেখা গেল প্রায়ই তাঁর আগে ব্যাট করতে নামছেন অশ্বিন। তাহলে আর চহল খেললে কী ক্ষতি ছিল?

পেস বোলিং বিভাগে আবার গোড়ায় গলদ। তড়িঘড়ি আহত যশপ্রীত বুমরাকে ফেরানোর চেষ্টা হয়েছিল, সে চেষ্টা সফল হয়নি। শামি অতীতে টি টোয়েন্টিতে ভাল করেননি, তা সত্ত্বেও তাঁকেই বুমরার জায়গায় নেওয়া হল। সুপার ১২-তে তবু ঠিকঠাক চলছিল, সেমিফাইনালে যখন তাঁরই বোলিং আক্রমণকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, তখনই শামি ব্যর্থ হলেন। তরুণ অর্শদীপ (১০ উইকেট, ওভার পিছু ৭.৮০ রান) আর অভিজ্ঞ ভুবনেশ্বর কুমার (মাত্র চার উইকেট, কিন্তু ওভার পিছু ৬.১৬) গোটা প্রতিযোগিতায় নেহাত খারাপ বল করেননি। কিন্তু সমস্যা হল তাঁরা একইরকম গতির সুইং বোলার। যেদিন বল তত সুইং করে না, সেদিন দু প্রান্ত থেকে দুজনকে খেলতে হলে ব্যাটারদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। শামির গতি এঁদের চেয়ে বেশি, কিন্তু সুইং না হলেও ব্যাটারকে ঘামিয়ে তোলার মত নয়; যা পাকিস্তানের হ্যারিস রউফ, ইংল্যান্ডের মার্ক উড বা দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যানরিখ নর্খ্যে পারেন। ফলে ভারতের বোলিং হয়ে গেল বৈচিত্র্যহীন। ভারতের দ্রুততম বোলার হয়ে গেলেন অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া, যিনি আবার বিশেষ ফর্মে ছিলেন না। আসলে বিশেষ করে বুমরা অনুপস্থিত বলেই দরকার ছিল একজন এক্সপ্রেস গতির পেসার। কিন্তু ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বল করতে পারা উমরান মালিক বা মহসীন খানকে তো স্কোয়াডেই রাখা হয়নি।

শশী তারকায় তপনে

নির্বাচক এবং টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনার অভাব বোলারদের ঘাড়ে চাপিয়ে রোহিত আসলে যাদের আড়াল করেছেন, এবার তাদের আলোচনায় আসা যাক। ক্রিকেটের যে ফরম্যাটে মাত্র ১২০টা বল খেলার জন্য হাতে দশখানা উইকেট থাকে, সেখানে বোলারদের ভূমিকা যে স্রেফ সহায়কের – একথা বোঝার জন্য ক্রিকেট বোদ্ধা হওয়ার দরকার পড়ে না। টি টোয়েন্টি জেতানোর দায়িত্ব সর্বদা মূলত ব্যাটারদের কাঁধে। যে দলের ব্যাটিং লাইন আপ বাংলাদেশ, জিম্বাবোয়ে, নেদারল্যান্ডসের মত দলের সঙ্গেও ২০০ রান করতে পারে না; পার্থের সবচেয়ে গতিময় পিচে ১৪০ পর্যন্তও পৌঁছতে পারে না – সেই দলের অধিনায়ক যখন স্রেফ সেমিফাইনাল ম্যাচটা দশ উইকেটে হারার জন্য বোলারদের দিকে আঙুল তোলেন তখন হেসে ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না।

অধিনায়ক নিজে ছটা ম্যাচে মাত্র ১১৬ রান করেছেন, গড় ১৯.৩৩। তাঁর নির্ভরযোগ্য ওপেনিং পার্টনার কে এল রাহুলের গড় ২১.৩৩। দুটো অর্ধশতরান করেছেন জিম্বাবোয়ে আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাসকিন আহমেদকে খেলতে গিয়েই তাঁর গলদঘর্ম অবস্থা। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, রোহিত আর রাহুলের স্ট্রাইক রেট যথাক্রমে ১০৬.৪২ আর ১২০.৭৫। এই দুই বীরপুঙ্গবের কল্যাণে ওপেনিং জুটির ওভার পিছু রান করার দিক থেকে ভারত সুপার ১২-তে খেলা দলগুলোর মধ্যে সবার নিচে, সবার পিছে (৪.৯৮, অর্থাৎ ১০৬ বল খেলে ৮৮ রান)।

যোগ্যতার্জন পর্ব পেরিয়ে সুপার ১২-তে উঠতে পারেনি যারা, তাদের মধ্যেও একমাত্র নামিবিয়া এক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে (৪.৪৪)।

এবার সবচেয়ে অপ্রিয় প্রসঙ্গে আসা যাক – বিরাট কোহলি। তিনি প্রতিযোগিতা শেষ করেছেন ব্র্যাডম্যানোচিত ৯৮.৬৬ গড়ে, স্ট্রাইক রেট ১৩৬.৪০। অতএব কোহলির ভক্তরা এবং তিনি যে শুধু ভারতের নয় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ব্যাটার তা প্রমাণ করতে ব্যস্ত বিশেষজ্ঞরা, বলে চলেছেন – আর কী করবে লোকটা? ঘটনা হল সূর্যকুমার যাদব গোটা প্রতিযোগিতায় অবিশ্বাস্য স্ট্রাইক রেটে (১৮৯.৬৮) ব্যাট না করলে এবং সেমিফাইনালে হার্দিক একই কাজ (১৯০.৯০) না করলে কোহলির ওই অর্ধশতরানগুলো সত্ত্বেও ভারত সম্ভবত আরও আগেই প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিত। কারণ মোট রান জেতার মত হত না। একমাত্র ব্যতিক্রম পাকিস্তান ম্যাচ। সত্যিই ওই হারা ম্যাচটা কোহলি একা হাতে জিতিয়েছেন। একথাও সত্যি যে শেষ দু ওভারে কোনোদিন ভুলতে না পারার মত দুটো ছক্কা মারার প্রতিভা এই মুহূর্তে বিশ্বের আর কোনো ব্যাটারের নেই। কিন্তু প্রথম ওভারে ব্যাট করতে নেমে ১৬০ রান তুলতে তাঁকে শেষ ওভার অবধি খেলতে হয়েছে এবং শেষ ওভারেও ম্যাচের লাগাম নিজের হাতে রাখতে পারেননি। শেষ বল খেলে উইনিং স্ট্রোক নিতে হয়েছে টেল এন্ডার অশ্বিনকে। সেদিন যা ঘটেছিল তা এককথায় কামাল। কিন্তু কামাল একবারই ঘটে। কামাল ভুল প্রণালীকে সঠিক বলে প্রমাণ করে না। শেষ দু ওভারে গোটা তিরিশেক রান বারবার তোলা যায় না। সুতরাং ‘আগে ধরে খেলব, পরে মেরে পুষিয়ে দেব’ নীতি অচল। ইংল্যান্ড ম্যাচই তা প্রমাণ করে দিয়েছে। পঞ্চাশ করতে ৪০ বল খরচ করে ফেলার পর কোহলি ১৮তম ওভারে আউট হয়ে গেলেন, দলের রান তখন মাত্র ১৩৬।

কোহলির এই নীতির সপক্ষে যুক্তি হল – ওপেনাররা ডুবিয়েছে, তিনে নেমে খেলাটা ধরতে হবে না? নইলে তো ইনিংস আগেই শেষ হয়ে যেত। পাটীগণিত কিন্তু এই ধরাধরি সমর্থন করে না। হিসাবটা একেবারে সোজা। টি টোয়েন্টিতে একটা দলের জন্য বরাদ্দ ১২০টা বল, হাতে দশটা উইকেট। মানে উইকেট পিছু মাত্র ১২টা বল। একজন ব্যাটার ওর চেয়ে বেশি বল না খেললে কিচ্ছু এসে যায় না, বরং সেক্ষেত্রে পরের ব্যাটার বেশি সুযোগ পেয়ে যাবেন রান করতে। সুতরাং বারোটা বলে যত বেশি সম্ভব রান করার চেষ্টা করা উচিত, তার চেয়ে বেশি বল খেললে আরও বেশি রান করার চেষ্টা করা দরকার। তা না করে ১৩৬.৪০ স্ট্রাইক রেটে পুরো ইনিংস ব্যাট করা মানে পরের ব্যাটারদের কাজ কঠিন করে দেওয়া, হাতে থাকা উইকেটের অপচয়। মনে রাখা ভাল, এই প্রতিযোগিতায় পাওয়ার প্লে-তে ওভার পিছু রান করায় শেষ থেকে দ্বিতীয় হয়েছে ভারত (৫.৯৭; প্রথম স্থানে নেদারল্যান্ডস)।

পাওয়ার প্লে-তে অত কম রান করে টি টোয়েন্টি খেতাব জেতা যায় না। এতে কোহলির দায় কিন্তু কম নয়। কারণ তিনি প্রায়শই পাওয়ার প্লে চলাকালীনই ব্যাট করতে নেমেছেন। টি টোয়েন্টি একেবারেই স্ট্রাইক রেটের খেলা। কোহলির কেরিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৩৭.৯৬। মোট রান আর গড়ে যত উপরেই থাকুন, এতে তিনি পৃথিবীর প্রথম ৭০ জনের মধ্যেও নেই। নিজে অধিনায়ক থাকার সময়ে কোহলি টেস্ট ম্যাচের ব্যাটিং নিয়ে বলতে গিয়েও ‘ইনটেন্ট’ শব্দটা বারবার ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ পিচ যেমনই হোক, পরিস্থিতি যা-ই হোক, প্রতিপক্ষের বোলিং সবল না দুর্বল সেসব দেখা চলবে না। সারাক্ষণ রান করার চেষ্টা করে যেতে হবে, মন্থর গতিতে রান করা মানেই নাকি নিজের দলের উপর চাপ তৈরি করা। কথাটা অবশ্য চালু করেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। এই ইনটেন্টের অভাবেই তো অজিঙ্ক রাহানের সাদা বলের কেরিয়ার বলে কিছু হল না। চেতেশ্বর পূজারাকে বহুবার শতরান করেও শুনতে হয়েছে তাঁর ইনটেন্টের অভাব আছে। আশ্চর্যের কথা, ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে কোহলির নিজের ইনটেন্টের দেখা পাওয়া যায় না। সুনীল গাভস্কর, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, শচীন তেন্ডুলকর, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, ভিভিএস লক্ষ্মণের দেশের কোহলি অ্যাডাম জাম্পা, লিয়াম লিভিংস্টোন, আদিল রশিদের মত স্পিনারকেও পিটিয়ে উঠতে পারেন না।

ঘটনা হল, এসব দোষ এবারের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে প্রথম জানা গেল এমন নয়। গত বছর সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে এইসব দোষেই ভারত সেমিফাইনালেও পৌঁছতে পারেনি। এ বছর এশিয়া কাপেও এইসব কারণেই আফগানিস্তান ছাড়া কারোর সঙ্গেই পরাক্রম দেখানো সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও কেন এই তারকাদের বাদ দেওয়া যায় না, কীভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে আইপিএল – সেসব নিয়ে এই ওয়েবসাইটেই আগে লিখেছি, পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। বরং অন্য কয়েকটা প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক।

কচি তারা, কথা ফোটে নাই

২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পরে ভারত আর কোনো খেতাব জেতেনি। আজ দ্রাবিড়-রোহিতের ব্যর্থতায় শাস্ত্রী-কোহলির যে ভক্তরা উল্লসিত, তাঁরাও নিশ্চয়ই এ তথ্য ভুলে যাননি। সর্বগ্রাসী মিডিয়া হাইপ আর মনভোলানো বিজ্ঞাপনী চাকচিক্য এতদিন সব ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল, ইংল্যান্ড একেবারে দশ উইকেটে জিতল বলেই সম্ভবত আর সামলাতে পারা যাচ্ছে না। বহু চাটুকারেরও মুখ খুলে গেছে। তবু এই চূড়ান্ত পণ্যায়নের যুগে যেহেতু ক্রিকেট তারকাদের একেকজনের উপর কোটি কোটি টাকা লগ্নি হয়ে আছে, সেহেতু এঁদের ঢাল হয়ে এখনো কিছু সংবাদমাধ্যম, ক্রিকেট লেখক এবং অতশত না বোঝা নিষ্পাপ ভক্ত দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। নরেন্দ্র মোদীর সরকারের একটা ব্যর্থতাও অস্বীকার করতে না পেরে যেমন এক শ্রেণির মানুষ বলেন “ইফ নট মোদী, দেন হু”, তেমনি এঁরাও বলতে শুরু করেছেন, এদের বাদ দিলে খেলবে কারা?

ঘটনা হল, এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেটে এর চেয়ে অবান্তর প্রশ্ন নেই। মুম্বাইয়ের পৃথ্বী শ দেশের হয়ে এখন পর্যন্ত একটাই টি টোয়েন্টি খেলেছেন এবং কোনো রান করতে পারেননি। কিন্তু আইপিএল এবং ঘরোয়া টি টোয়েন্টিতে ৯২ ম্যাচে তিনি করে ফেলেছেন ২৪০১ রান; স্ট্রাইক রেট ১৫১.৬৭; সর্বোচ্চ ১৩৪। ওই ১৩৪ রান তিনি করেছেন মাত্র ৬১ বলে, গত মাসে আসামের বিরুদ্ধে সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে। ওই প্রতিযোগিতাটি হল ভারতের ঘরোয়া টি টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা। তাহলে আইপিএল কী? এ প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া লজ্জা দিবেন না।

ভারতীয় দলের তারকারা ইদানীং যত খেলেন তার সমান বা হয়ত তার চেয়েও বেশি বিশ্রাম নেন। সেই সুবাদে ঝাড়খণ্ডের উইকেটকিপার ব্যাটার ঈশান কিষণকে তো অনেকেই চিনে গেছেন। ভারতের হয়ে যে কটা টি টোয়েন্টি আর একদিনের ম্যাচ তিনি এখন অব্দি খেলেছেন তাতে ধোনির মত অভাবনীয় কিছু না করলেও প্রমাণ হয়েছে তাঁর আরও সুযোগ প্রাপ্য। স্রেফ ওপেনিং ব্যাটার হিসাবেও তিনি খেলেছেন এবং খেলতে পারেন।

কিন্তু কাব্যে সবচেয়ে উপেক্ষিত কেরালার সঞ্জু স্যামসন। তিনি যে সিরিজে দলে সুযোগ পান সেখানে একটা-দুটো ম্যাচে খেলেন, সেখানে সফল বা ব্যর্থ যা-ই হোন, পরের সিরিজে বাদ পড়ে যান। আবার হয়ত তার পরের সিরিজে ফেরত আসেন। তারকাদের ট্র্যাফিক জ্যামে মাথা গলাতে পারেন না আর কি। এ পর্যন্ত ভারতের হয়ে ১৬টা টি টোয়েন্টিতে ১৩৫.১৫ স্ট্রাইক রেটে ২৯৬ রান করেছেন। উইকেটের পিছনে সাতটা ক্যাচ নিয়েছেন, দুটো স্টাম্পিং করেছেন। সঞ্জুর বয়স ইতিমধ্যেই ২৮, ঈশান ২৪, পৃথ্বী ২৩। এছাড়াও আছেন শ্রেয়স আয়ার, শুভমান গিলরা। আছেন আইপিএলে সাফল্য পাওয়া ঋতুরাজ গায়কোয়াড় (২৫), রাহুল ত্রিপাঠী (৩১), ফিনিশার হিসাবে একাধিকবার চমকে দেওয়া রাহুল টেওয়াটিয়া (২৯)। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মত বহু দেশ টি টোয়েন্টিতে এমন অনেককে খেলায় যাঁরা অন্য কোনো ফরম্যাটে সুযোগ পান না। ভারতও চাইলে তেমন করতেই পারে। টি টোয়েন্টি অন্যরকম, তার চাহিদাও অন্যরকম।

মাঝখানে নদী ওই

উপরের নামগুলো গত কয়েক মাসে তারকাদের অনুপস্থিতিতে যেটুকু সুযোগ পাওয়া গেছে তার সদ্ব্যবহার করা ক্রিকেটারদের। কিন্তু ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে শুকনো মুখে ফেরা দলের মধ্যেই এমন দুজন আছেন যাঁরা উপর্যুপরি ব্যর্থ হওয়া তারকাদের জায়গা নিতে পারেন। একজন ঋষভ পন্থ। টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ৩১ ম্যাচের কেরিয়ারেই যেসব ইনিংস তিনি খেলে ফেলেছেন তাতে তাঁর প্রতিভাকে সন্দেহ করার আর উপায় নেই। কিন্তু তার সঙ্গে মানানসই সাফল্য সাদা বলের কেরিয়ারে এখনো দেখা যায়নি। তার অনেকখানি দায় শাস্ত্রী-কোহলি এবং দ্রাবিড়-রোহিতের। পাঁচ বছর হয়ে গেল, ব্যাটিং অর্ডারে ঋষভের জায়গা কোথায় তা এখনো স্থির হল না। অথচ সাদা চোখেই দেখা যায়, তাঁর মত আক্রমণাত্মক ব্যাটার যত বেশি বল খেলার সুযোগ পায় দলের পক্ষে তত ভাল। ইংল্যান্ডে একটা ম্যাচে ওপেনার হিসাবে খেলিয়েই সে পরীক্ষায় দাঁড়ি টেনে দিলেন দ্রাবিড়-রোহিত; আগের কোচ, অধিনায়ক তো সে চেষ্টাও করেননি। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়, শচীন একদিনের ক্রিকেটে কত নম্বরে ব্যাট করবেন তা নিয়ে অজিত ওয়াড়েকর-আজহার ১৯৯৪ সালে অকল্যান্ডের সেই ইনিংসের পরেও এমন টালবাহানা করলে কী হত।

অন্যজন দীপক হুড়া। বরোদার এই ২৭ বছর বয়সী ব্যাটার ভারতের হয়ে ১৩টা টি টোয়েন্টিতে ১৫৩.৪০ স্ট্রাইক রেটে শ তিনেক রান করে ফেলেছেন। জুন মাসে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৫৭ বলে ১০৪ করেছেন। তবু তাঁর জায়গা পাকা নয়, কারণ ওই ট্র্যাফিক জ্যাম। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে মাত্র একটা ম্যাচ খেলতে পেলেন পার্থে সবচেয়ে কঠিন উইকেটে।

বলে রাখা ভাল, কেবল টি টোয়েন্টি নয়। রোহিত, শিখর ধাওয়ান, কোহলিরা একদিনের ক্রিকেটে যে ব্যাটিংটা করেন সেটাও প্রায় প্রাক-জয়সূর্য-কালু যুগের ব্যাটিং। বিশেষত ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে ও ব্যাটিং সব দল বাতিল করে দিয়েছে। সে কারণেই ভারত ৫০ ওভারের ক্রিকেটেও ঝুড়ি ঝুড়ি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতেছে গত ন বছরে, কিন্তু বড় প্রতিযোগিতা এলেই ব্যর্থ। কারণ কোনো বড় দল, বিশেষ করে নক আউট স্তরের ম্যাচে, শেষের দিকের ওভারে এত লুজ বল ফেলে না বা ফিল্ডিংয়ে এত ভুলভ্রান্তি করে না যে পাওয়ার প্লে-তে কম রান করার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া যাবে। বরং সে সময় আসার আগেই আউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ২০১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যেমন নতুন বলেই রোহিত, রাহুল, কোহলি আউট হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে শুধু খেলোয়াড় পরিবর্তন নয়, পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন না আনলে সামনের বছর ঘরের মাঠে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপেও একইরকম বিপর্যয় ঘটবে।

আরও পড়ুন বিরাট, রোহিত, রাহুলদের সত্য রচনা চলছে চলবে

একই প্রণালী বারবার প্রয়োগ করে যদি ভারতীয় বোর্ড ভিন্ন ফলের আশা করে তাহলে বলতে হয় জেতা হারায় তাদের কিছু এসে যায় না। তেমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কারণ আইপিএল আর ভারতীয় ক্রিকেট দলের ম্যাচের সম্প্রচার সত্ত্ব থেকে এত বিপুল অর্থ আয় হয় যে দলের জয় পরাজয়ে কেবল ক্রিকেটপ্রেমীদেরই উত্তেজিত হওয়া সাজে। বোর্ডকর্তারা অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স দেখে নিয়ে সুখে নিদ্রা যেতে পারেন।

এতক্ষণে অরিন্দম…

কারা যেন ভারতের টি টোয়েন্টি ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিষম চিন্তিত হয়ে দ্রাবিড়কে প্রশ্ন করে ফেলেছিল, ভারতীয় ক্রিকেটারদের কি অন্য দেশের টি টোয়েন্টি লিগে খেলতে দেওয়া উচিত? ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা তো অনেকেই অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগে খেলেন। হয়ত তারই সুবিধা পেয়ে গেলেন। দ্রাবিড়, ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট ক্রিকেটারদের একজন, মহা উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছেন, সে তো ভারি মুশকিলের ব্যাপার হবে। অন্য দেশের লিগগুলোর সময়ে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট চলে যে! ভারতীয়রা ওখানে খেলতে গেলে আমাদের রঞ্জি ট্রফিটা উঠে যাবে যে! শুনে মাইকেল মধুসূদন মনে পড়ে: “এতক্ষণে” –অরিন্দম কহিলা বিষাদে / “জানিনা কেমনে আসি লক্ষণ পশিল/রক্ষঃপুরে!…”

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আর্থিক পেশির জোরে যখন আইপিএলের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ফিউচার টুরস প্রোগ্রামে জায়গা খালি করিয়েছে তখন আর পাঁচজন অনুগত প্রাক্তন ক্রিকেটারের মতই দ্রাবিড় চুপচাপ ছিলেন। ইতিমধ্যে বোর্ড আইপিএলে আরও দুটো দল যোগ করেছে, সম্প্রচার সত্ত্বের দাম যত বাড়ানো হচ্ছে তত টাকা পাওয়া যাচ্ছে দেখে আগামী কয়েক বছরে ম্যাচের সংখ্যাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এখন সারা পৃথিবীতে একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ গজাচ্ছে। সেসব দেশের ক্রিকেট বোর্ড নিজেদের খেলোয়াড়দের এতকাল আইপিএলের জন্য ছেড়ে এসেছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ রেখে আইপিএল চলবে – এ ব্যবস্থাও মেনে নিয়েছে। এখন যদি বিস্মিত দ্রাবিড় বলেন – হায়, তাত, উচিত কি তব/একাজ – তাতে তো চিড়ে ভিজবে না। উচিত-অনুচিতের সীমা তো ক্রিকেট কবেই পেরিয়ে এসেছে।

ইনস্ক্রিপ্ট-এ প্রকাশিত

বাঙালি কাহারে কয়, সে কি কেবলি সৌরভময়?

ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল।
সেই ভুলটুকু বেঁচে থাক
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।

অন্নদাশঙ্কর রায় এসব লিখেছেন বহুকাল হয়ে গেল। কিন্তু আজও কলকাতা ও তার শহরতলির ভদ্রজন বলে থাকেন “বাঙালি আর মুসলমান”। বোঝা শক্ত নয় যে বাঙালি বলতে তাঁরা বোঝেন হিন্দু বাংলাভাষীদের। মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গের কাগজ, টিভি, এমনকি সরকারও চালান মূলত কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের ভদ্রজনই। কোনটা বাঙালি ভাবাবেগকে আহত করে (ইদানীং আবার ভাবাবেগ না লিখে অস্মিতা লেখা চালু হয়েছে), কোনটা করে না তাও ঠিক করে দেন ওঁরাই। ফলে শেষমেশ দেখা যায় বাঙালি বলতে সব বাঙালি হিন্দুও নয়, কেবল তাঁদেরই বোঝাচ্ছে। সুতরাং দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের সময়ে মাল নদীতে হড়পা বান এসে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি হলে বাঙালির ভাবাবেগ আহত হয় না, কলকাতায় ড্যাং ড্যাং করে কার্নিভাল চলে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নামক এক লাভজনক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদ বেহালার গাঙ্গুলিবাড়ির ছোট ছেলেটির হাতছাড়া হলে বাঙালির ভাবাবেগ এতদূর আহত হয়, যে মুখ্যমন্ত্রীকে ময়দানে নামতে হয়। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে বলতে হয়, মহারাজকে সম্মান দিতে চাইলে শাহরুখ খানকে সরিয়ে তাঁকেই রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করুন না। বামপন্থীরাও বলেন, এসব হল দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে বিজেপির কুক্ষিগত করার চক্রান্ত। কেন সব রাজনৈতিক দলকেই কিছু না কিছু বলতেই হয়? কারণ নজরুল-টজরুল আজকাল আর কে পড়ে? এখন বাঙালি বলতে একজন আছে – সৌরভ গাঙ্গুলি।

অর্থাৎ বাঙালি মানে দাঁড়াল কলকাতা ঘেঁষা ভদ্রজন। তাঁদের আবেগ জড়িত বলেই তো ইস্টবেঙ্গল আইএসএলে দল নামাতে পারল কিনা তা মুখ্যমন্ত্রীকে তদারক করতে হয়, কিন্তু মহমেডান স্পোর্টিং থাকল কি উঠে গেল তা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা থাকে না। দু-একদিন হইচইয়ের পরেই সংবাদমাধ্যম এবং ক্রীড়াপ্রেমীদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যান জাতীয় গেমসে ফুটবলে সোনা জয়ী বাংলা দলের ফুটবলাররা। দুদিন দুরাত ট্রেনে করে ফিরতে না হলে আদৌ তাঁদের নিয়ে কেউ আলোচনা করত কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। একই কারণে জাতীয় গেমসে বাংলা কোথায় শেষ করল, কেন করল – সেসব নিয়ে রাজ্যের সর্বাধিক প্রচারিত খবরের কাগজগুলোতে কয়েক সেন্টিমিটার জায়গাও খরচ করা হয় না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অমিত শাহের প্রসাদে ক্রিকেট বোর্ডের সর্বোচ্চ পদে বসে থাকা সৌরভ কত বড় বঞ্চনার শিকার হলেন তা নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয় একেবারে প্রথম পাতায়।

ঘটনাচক্রে সৌরভ যে বছর ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হলেন সে বছরই অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বাঙালি বলে দাবি করতে উৎসাহের খামতি হয়নি জনমত গঠনকারী বাবুদের। সে তবু একরকম, কিন্তু বাঙালি ভাবাবেগ এত সহজপাচ্য যে কলকাতার ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে অভিজিৎ আর সৌরভকে বাঙালির গর্ব হিসাবে পাশাপাশি রেখে হোর্ডিং টাঙিয়েছিল কে বা কারা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সমাজবিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদত্ত পৃথিবীর সেরা পুরস্কার অর্জনের কৃতিত্ব কী করে এক ব্যবসায়িক সংস্থার আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ছক্কা পাঞ্জায় সফল হয়ে পাওয়া চেয়ারের সমান হয়, তা বাঙালিই জানে। কিন্তু কী আর করা যাবে? মহাজনেরা দেগে দিয়েছেন, বাঙালি বলতে একজনই আছে।

দাগানোর কাজটা আজ হয়নি, হয়েছে সৌরভের খেলোয়াড় জীবনেই। লর্ডসে টেস্ট অভিষেকের পর থেকে কোনো ম্যাচে প্রথম একাদশ থেকে সৌরভ বাদ গেলেই বাংলায় বসে মনে হত নেতাজি সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হওয়ার পরে এত বড় অন্যায় আর কোনো বাঙালির সঙ্গে করা হয়নি। আজকের মুখ্যমন্ত্রী সৌরভকে পদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান, আগের সরকারও কিছু কম যেত না। ১৯৯৭ সালে ঢাকায় ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ফাইনালে সৌরভ একটি অবিস্মরণীয় ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর প্রকাশ্য সংবর্ধনার আয়োজন করে। অবাক কাণ্ড! জিতিয়েছেন একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল, বিশ্বকাপ ফাইনাল নয়। তার জন্যে সরকারি সংবর্ধনা পাওয়ার সৌভাগ্য পৃথিবীর কজন ক্রিকেটারের হয়েছে বলা মুশকিল। অন্তত শচীন তেন্ডুলকরের যে হয়নি তা হলফ করে বলা যায়। তিনি পরের বছরেই শারজায় প্রায় একক কৃতিত্বে একই সপ্তাহে দুবার স্টিভ ওয়র অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ভারতকে খেতাব জেতান। এমন ব্যাট করেছিলেন যে ওয় বলেন ডন ব্র্যাডম্যানের পরে শচীনই সেরা। তবু কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার তাঁর বর্ণাঢ্য সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেনি।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

বাঙালি ক্রীড়াবিদকে বাংলার সরকার সম্মান জানিয়েছে – এর নিন্দা করলে আবার অনেকে রেগে যেতে পারেন। পক্ষ সমর্থনে এমনও বলা যেতে পারে, যে বাঙালিদের মধ্যে থেকে তো আর মুম্বাইয়ের মত কাঁড়ি কাঁড়ি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার বেরোয় না, আমাদের সবেধন নীলমণি সৌরভই আছেন। তাই আমরা, আমাদের সরকার একটু বাড়াবাড়ি করলে ক্ষতি কী? কথা হল, ক্ষতি কিছু হত না, যদি সব বাঙালি ক্রীড়াবিদ সম্পর্কেই এমন মহৎ চিন্তা গোটা বাংলার মানুষের এবং মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকারগুলোর থাকত। বাংলার রঞ্জি ট্রফি দলের সুলুকসন্ধান কজন বাঙালি রাখেন তার ঠিক নেই, কিন্তু কলকাতা নাইট রাইডার্স আইপিএল জিতলে ঘটা করে ইডেন উদ্যানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংবর্ধনার ব্যবস্থা হয়। সৌরভকে দল থেকে বাদ দিলে গেল গেল রব উঠত, এখন প্রশাসনিক পদে থাকতে না দিলেও বাঙালির জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ কলকাতার বৃত্তের বাইরের লোক, শিলিগুড়ির ছেলে ঋদ্ধিমান সাহা ফর্ম না হারিয়েও স্রেফ আহত হয়ে দলের বাইরে যাওয়ার জন্যেই যখন ভারতীয় দলে তাঁর জায়গা খোয়ালেন, তখন তেমন আলোড়ন উঠল না। উঠল তখন যখন ঋদ্ধিমানের স্থলাভিষিক্ত তরুণ ঋষভ পন্থ দুরন্ত ব্যাটিংয়ে তাঁর জায়গা পাকা করে ফেলেছেন, স্বভাবতই কোচ রাহুল দ্রাবিড় ঋদ্ধিমানের দীর্ঘ কেরিয়ারকে সম্মান করে আলাদা করে ডেকে বলে দিয়েছেন তাঁকে আর টেস্ট দলের জন্য ভাবা হবে না। হপ্তাখানেক কলকাতার সংবাদমাধ্যম ঋদ্ধিমানের প্রতি অবিচারের জন্য দ্রাবিড়কে খলনায়ক বানিয়ে অশ্রুপাত করল। আগে উচ্চবাচ্য করা হয়নি। সম্ভবত তার কারণ তখন খলনায়ক খুঁজতে হলে প্রথমেই স্বয়ং সৌরভের দিকে আঙুল তুলতে হত। কারণ তিনি তখন বোর্ড সভাপতি তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা ঋষভ আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালসের ক্রিকেটার আর সৌরভ সেই দলেরই পরামর্শদাতা ছিলেন বোর্ডকর্তা হওয়ার আগে পর্যন্ত।

ক্রিকেটিয় কারণে ঋদ্ধিমানের ভারতীয় দলের জন্য আর বিবেচিত না হওয়া তবু মেনে নেওয়া যায়, বোর্ড সভাপতি সৌরভ যে দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না সে কথাও না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু ঋদ্ধিমানের মত বর্ষীয়ান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড় তো বাংলার তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে অমূল্য সম্পদ হতে পারতেন। তাঁকে কেন ত্রিপুরায় চলে যেতে হল বাংলার ক্রিকেটকর্তাদের অপমানজনক ব্যবহারে? এ নিয়ে সরাসরি আঙুল ওঠা উচিত ছিল সৌরভের দিকে। তিনি বোর্ড সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের প্রতিনিধি হিসাবেই। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁর হস্তক্ষেপ করা বেআইনিও হত না। কিন্তু এসব পশ্চিমবঙ্গে কোনো আলোচনার বিষয়ই নয়। কারণ সম্ভবত সৌরভ যতটা বাঙালি, ঋদ্ধিমান ততটা বাঙালি নন।

এশিয়ান গেমসে হেপ্টাথলনে সোনা জয়ী স্বপ্না বর্মনও সৌরভের মত বাঙালি নন নিশ্চয়ই। নইলে স্বপ্নার মধ্যপ্রদেশে চলে যাওয়া আটকাতে মুখ্যমন্ত্রী নিজে আসরে নামলেন না কেন? কোথায় গেল বাঙালির ভাবাবেগ?

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

বিপুল ক্ষমতা ভোগ করেও মিস্টার বেচারা বাংলার সৌরভ?

সুযোগ পেলে যা ইচ্ছে তাই করতে প্রাক্তন খেলোয়াড়রা যে কম যান না তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফরাসি ফুটবলের কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনি।

পি সতশিবম আর রঞ্জন গোগোইয়ের বেশ নিন্দা হয়েছিল। কারণ তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে অবসর নেওয়ার পর যথাক্রমে কেরালার রাজ্যপাল আর রাজ্যসভার মনোনীত সদস্যের পদ গ্রহণ করেছিলেন। নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলই করি অপমান – এ কথার এমন জলজ্যান্ত উদাহরণ আমাদের দেশেও বিরল। সব পেশাতেই কিছু কাজ আছে যা বেআইনি না হলেও অশোভন বলে সাধারণত কেউ করেন না। যেমন মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর পাঞ্জাব বা অসমের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের টিকিটে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে যাননি। কাল মুখ্যমন্ত্রিত্ব চলে গেলে মমতা ব্যানার্জিও কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে তৃণমূলের মেয়র পদপ্রার্থী হবেন না সম্ভবত। কিন্তু সতশিবম আর গোগোই শোভনতার ধার ধারেননি। তাঁদের সিদ্ধান্তে ভারতের বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে প্রশ্ন আলাদা, কিন্তু ক্ষমতার জন্য তাঁরা কতখানি লালায়িত তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। স্বেচ্ছায় পদাবনতিও যে কারোর অভীষ্ট হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত হত। বিশ্বাস করা আরও সহজ করে দিলেন আমাদের ঘরের ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলি। আরও ছোট পরিসরে আরও ছোট একটা পদের জন্য তিনি ঝাঁপিয়েছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী তথা শক্তিশালী ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পদে প্রায় তিন বছর কাটানোর পর এখন তিনি ঘোষণা করেছেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের সভাপতি পদের প্রার্থী হবেন।

সৌরভ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে পৌঁছেছিলেন সিএবি হয়েই। কিন্তু সিএবির মসনদে তাঁকে বসিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। দীর্ঘদেহী সৌরভ খর্বকায় মুখ্যমন্ত্রীর পিছনে লক্ষ্মী ছেলের মত দাঁড়িয়ে আছেন আর মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বিশাল ছায়া দিয়ে সৌরভকে আড়াল করে সিএবি সভাপতি হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণা করছেন – এ দৃশ্য অনেকেরই এখনো মনে আছে। দুর্জনে বলে মুখ্যমন্ত্রী ওভাবে হাতে ধরে চেয়ারে বসিয়ে না দিলে সৌরভের পক্ষে সিএবি সভাপতি হওয়া শক্ত ছিল। কারণ খেলার মাঠে অধিনায়ক হিসাবে তিনি দলের মধ্যে যতটা জনপ্রিয় ছিলেন, মাঠের বাইরে বাংলার ক্রিকেট প্রশাসকদের মধ্যে ততটাই অপ্রিয়। কারণটাও সহজবোধ্য। সৎ বা দুর্নীতিগ্রস্ত যা-ই হোন, ময়দানে যাঁরা ক্লাব চালান তাঁরা বছরের পর বছর বহু সময় ব্যয় করে নিজেদের ব্যবসা বা চাকরির খানিকটা ক্ষতি করেই কাজটা করেন। সেই কাজের মধ্যে দিয়ে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে অ্যাসোসিয়েশনের রাজনীতিতে সফল হয়ে সিএবির পদাধিকারী হতে হয়। কথাটা বিশ্বনাথ দত্ত বা জগমোহন ডালমিয়ার মত প্রবাদপ্রতিম প্রশাসকদের ক্ষেত্রে যতটা সত্যি, একদা সিএবির যুগ্ম সচিব প্রয়াত শরদিন্দু পাল বা গৌতম দাশগুপ্তের ক্ষেত্রেও ততটাই সত্যি। তাঁরা যথাক্রমে কুমোরটুলি আর শ্যামবাজার ক্লাব চালিয়েছেন কয়েক দশক। অথচ সৌরভ সেসব কিছুই করলেন না। খেলা ছাড়ার পরের কয়েক বছর ধারাভাষ্য, বিজ্ঞাপনে মুখ দেখানো, টিভির পর্দায় দাদাগিরি করতে করতেই সিএবির যুগ্ম সচিব হয়ে গেলেন। তারপর স্রেফ মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদে ডালমিয়ার মৃত্যুর পর সিএবি সভাপতি হয়ে বসলেন।

সৌরভভক্তরা স্বভাবতই রেগে যাবেন, বলবেন খেলাটা যখন ক্রিকেট, তখন সৌরভ কত বড় ক্রিকেটার সেটাই তো আসল কথা। মাঠে অত বড় বড় কীর্তি যার, তাকেও প্রশাসনে আসতে হলে আগে ক্লাবের হেঁশেল ঠেলতে হবে – এ অন্যায় দাবি। শরদিন্দু, গৌতমরা ক্রিকেটের কী জানেন? কত হাজার রান আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে? তাঁদের মত দীর্ঘকাল লড়তে হবে কেন সৌরভকে? এই মনোভাব কেবল ভক্তদের নয়। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্সের প্রধান বিনোদ রাইও নবগঠিত বোর্ডের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার সময়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন সৌরভের মত মানুষ বোর্ড সভাপতি হলেন বলে। রাই বলেছিলেন সৌরভই ওই পদের পক্ষে যোগ্যতম। স্বাধীনতার আগে থেকে মূলত অক্রিকেটার লোকেদের দ্বারা চালিত ভারতীয় বোর্ডে যে পরিমাণ অব্যবস্থা এবং দুর্নীতি চলেছে, যার ফলে সুপ্রিম কোর্ট এন শ্রীনিবাসনকে পদচ্যুত করে বোর্ডের আমূল সংস্কার করার নির্দেশ দিয়েছিল, তাতে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের উপরে অত্যধিক ভরসা করা হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রাক্তন খেলোয়াড়রা প্রশাসনে এলেই প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হবে, স্বেচ্ছাচার চলবে না – এমনটা পৃথিবীর কোথাও প্রমাণিত হয়নি। সুযোগ পেলে যা ইচ্ছে তাই করতে প্রাক্তন খেলোয়াড়রা যে কম যান না তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফরাসি ফুটবলের কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনি। যদিও তিনি কোনো মুখ্যমন্ত্রীর প্রসাদে ফরাসি ফুটবল ফেডারেশনের সর্বোচ্চ পদে আসীন হননি, দস্তুরমত ফুটবল রাজনীতি করেই অতদূর উঠতে হয়েছিল। আসলে ফিফা প্রাক্তন খেলোয়াড় মানেই ঈশ্বরপ্রেরিত প্রশাসক – এমনটা বিশ্বাস করে না। প্রাক্তন ফুটবলারদের জন্য আলাদা করে জায়গা সংরক্ষণও ফিফার নীতিবিরুদ্ধ। সম্প্রতি যে যে কারণে ফিফা সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে নির্বাসন দিয়েছিল, তার অন্যতম হল সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্সের প্রস্তাবিত সংবিধানে প্রাক্তন ফুটবলারদের জন্য আলাদা করে পদের ব্যবস্থা। ফিফার সাফ কথা – প্রাক্তন ফুটবলার প্রশাসনে স্বাগত, কিন্তু তাকে আসতে হবে রাজ্য অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমেই। অর্থাৎ ফুটবলারকে প্রশাসক হয়ে উঠতে হবে, প্রাক্তন বলে প্রশাসনকে বাইপাস করা চলবে না।

সৌরভ যেরকম মসৃণভাবে অফ সাইডে ফিল্ডিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাউন্ডারি খুঁজে ফেলতেন, সেরকমভাবেই ক্ষমতায় পৌঁছনোর বাইপাস খুঁজে নেন। নবান্নে ধরনা দিয়ে সিএবি সভাপতি হয়েছিলেন, বোর্ড সভাপতি হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রসাদে। তাঁকে ওই পদে থাকতে দেওয়া হল না বলে এই মুহূর্তে ডান, বাম নির্বিশেষে বাঙালি ক্ষুব্ধ। সেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরে আর কোনো ঘটনায় বোধহয় বাঙালিকে এতখানি ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কার, যাঁর প্রসাদে বোর্ডের সভাপতি হওয়া গিয়েছিল, তাঁর বিরক্তিতেই পদ হাতছাড়া হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে তো সবিস্তারে লেখা হয়েছে, ৬ অক্টোবর গভীর রাতে অমিত শাহের বাড়িতে এক বৈঠকে ঠিক হয় সৌরভকে এবার সরিয়ে দেওয়া হবে। মজার কথা, সেখানে সৌরভের কার্যকলাপ নিয়ে নানা আপত্তি তোলেন শ্রীনিবাসন এবং উপস্থিত অন্য বোর্ডকর্তারা তাঁর কথায় সায় দেন। কোন শ্রীনিবাসন? যাঁর কুকীর্তির ফলে বোর্ডে ওলোট-পালট হয়ে সর্বোচ্চ আদালতের নজরদারিতে সংস্কার হয়েছিল। সেই শ্রীনিবাসন দেখা যাচ্ছে আজও যথেষ্ট ক্ষমতাশালী। কে বোর্ড সভাপতি হবে তা তিনি এখনো নির্ধারণ করতে পারেন। বস্তুত ২০১৯ সালে সৌরভের সভাপতি হওয়ার পিছনেও তাঁর সম্মতি ছিল। তাহলে কী লাভ হল লোধা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংস্কার করে? কী লাভ হল সৌরভের মত প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটার বোর্ড সভাপতি হয়ে?

সংবাদমাধ্যমে জোর জল্পনা, সৌরভকে নাকি অমিত শাহ সরিয়ে দিলেন তিনি বিজেপিতে যোগ দিতে রাজি হননি বলে। একথা পাতে পড়তে না পড়তেই ভারতের বিজেপিবিরোধী, উদারপন্থী মানুষ একেবারে টপ করে গিলে নিয়েছেন। সৌরভের কেমন শক্ত মেরুদণ্ড তা গ্রেগ চ্যাপেলের পর অমিত শাহও টের পেয়ে গেলেন ইত্যাদি মর্মে সোশাল মিডিয়া বিদীর্ণ করছেন অনেকেই। এরপর ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যদি সৌরভের দিদি তাঁকে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে প্রার্থী করে ফেলেন তাহলে ‘লিবারেল’ হিসাবে সৌরভের দর আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে। সকলে ইতিমধ্যেই ভুলে গেছেন, সৌরভ এতদিন চেয়ারে বসেছিলেন দেশের দু নম্বর বিজেপি নেতা অমিত শাহ ও তদীয় পুত্র জয় শাহের সৌজন্যেই। শুধু তা-ই নয়, বোর্ডের নতুন সংবিধান অনুযায়ী সৌরভের কার্যকাল সভাপতি হওয়ার দশ মাস পরেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বর্তমান কর্মকর্তাদের মেয়াদ বাড়ানো হোক – সুপ্রিম কোর্টে এই সংবিধানবিরোধী আর্জি জানিয়ে ফেভিকলের বিজ্ঞাপনের নেতার মত নিজ নিজ চেয়ারে এতদিন বসেছিলেন সৌরভ, জয়রা। সুপ্রিম কোর্ট এত ব্যস্ত যে সে আর্জির শুনানির দিন কেবলই পিছিয়েছে। আড়াই বছর পর গত মাসে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় (যিনি আগামী মাসে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করবেন) ও হিমা কোহলি রায় দিলেন, তিন বছর নয়, বোর্ড সভাপতি, যুগ্ম সচিব ও অন্যরা একটানা ছ বছর বহাল থাকতে পারবেন। অর্থাৎ ২০১৮ সালের রায়ের একেবারে উল্টো পথে হেঁটে নতুন সংবিধান বদলে অনেকাংশে পুরনো জায়গায় ফিরে যাওয়া হল। এ হেন ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়া সৌরভ আজ বাংলার চোখে মিস্টার বেচারা। এতটাই বেচারা যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলবেন, সৌরভকে যেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের পদের জন্য লড়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সৌরভের পদচ্যুতি বাঙালির জাতীয় সংকট। মুখ্যমন্ত্রী কি চুপ করে থাকতে পারেন?

তবে রবীন্দ্রনাথের পরে বাঙালিকে সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন যিনি, সেই সৌরভ দেখা যাচ্ছে কম রাবীন্দ্রিক নন। বিপদে মোরে রক্ষা করো, দিদির কাছে এ নহে তাঁর প্রার্থনা। তিনি চন্দ্রচূড়-কোহলির রায় নির্ঘাত খুঁটিয়ে দেখেছেন, আইনের ফাঁক খুঁজে ক্ষমতা ধরে রাখার বুদ্ধিতে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দুই প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সতশিবম আর গোগোইয়ের উপর দিয়ে যান। রায়ে বলা আছে, ক্রিকেট প্রশাসনের একেক স্তরে ছ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে কুলিং অফ পিরিয়ড থাকবে, স্তর বদলে গেলে নয়। ফলে সিএবি সভাপতি হয়ে তিনি আরও কিছুদিন নিশ্চিন্তে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন; বোর্ড সভাপতি হওয়ার পরে রাজ্য সংস্থার সভাপতি হওয়া দু-চারজনের যতই দৃষ্টিকটু মনে হোক।

এতে বাংলার ক্রিকেটের কী লাভ হবে সে প্রশ্ন অবান্তর। সৌরভ এর আগেও সিএবি সভাপতি ছিলেন, তাতে বাংলার ক্রিকেট কতটা উন্নত হয়েছে সে হিসাব কেউ দেন না। বোর্ড সভাপতি হয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের কেমন ছন্নছাড়া অবস্থা করে ছেড়েছেন তা তো চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। সাফল্য বলতে অতিমারীর মধ্যেও আইপিএল আয়োজন। অবশ্য আইপিএল চালানো ছাড়া অন্য কাজ আছে বলে হয়ত সৌরভ-জয় মনেই করেননি। তাই আইপিএল চালু ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চালু থাকা রঞ্জি ট্রফি বন্ধ ছিল। ওদিকে জাতীয় দলে বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত। বিরাট কোহলির অধিনায়কত্ব যাওয়া নিয়ে নাটক; বিরাট প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মা, সভাপতি সৌরভসুদ্ধ গোটা বোর্ডকে সাংবাদিকদের সামনে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলেন, কিন্তু কোনো শাস্তি হল না। সমস্ত ক্রিকেট খেলিয়ে দেশে জাতীয় দল ঘোষণা হলে তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন নির্বাচকরা। কে আহত, কাকে বাদ দেওয়া হল তা নিয়ে পরিষ্কার বিবৃতি দেন। ভারতেও বরাবর এমন ব্যবস্থাই চালু ছিল। সৌরভের আমলে সেসব উঠে গেছে। কে যে কখন বিশ্রাম নিচ্ছেন আর কে চোটের জন্য বাইরে থাকছেন তা বোঝা দুষ্কর। নানারকম খবর সংবাদমাধ্যমে ভাসতে থাকে আর যে ক্রিকেটপ্রেমীর যা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে তিনি তা-ই মেনে নেন।

আরও পড়ুন নিশীথিনী-সম

সৌরভের নিজের আচরণও প্রশ্নের ঊর্দ্ধে নয়। বোর্ড সভাপতির বিজ্ঞাপনী মডেল হওয়া ক্রিকেট-পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য। তাও আবার বোর্ডের সাথে স্পনসরশিপ চুক্তিতে আবদ্ধ সংস্থার প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার বিজ্ঞাপনে। এসব প্রশ্ন গত তিন বছরে বোর্ডের সভায় উঠেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ সৌরভের ঢাল ছিলেন জয় শাহ। তাছাড়া যে দেশে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং অমুক কোম্পানি, তমুক কোম্পানির বিজ্ঞাপন আলো করে খবরের কাগজগুলোর প্রথম পাতায় বসতে পারেন, সেখানে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতিকে আটকাবে কে?

এইভাবে দুহাতে কামানো সৌরভ বাংলার আপামর মানুষ ও মুখ্যমন্ত্রীর চোখে আজ বঞ্চিত, নিপীড়িত। সেই নিপীড়নের অবসান হবে কী হলে? সৌরভকে বিশ্বক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থার প্রধানের নির্বাচনে প্রার্থী হতে দিলে। তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে সৌরভের হয়ে আর্জি জানিয়েছেন। ক্রিকেটের এহেন গণতন্ত্রীকরণ গভীর আশাব্যঞ্জক। বোর্ডটা তুলে দিয়ে সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের হাতে দিয়ে দিলে হয় না? সংসদে তো আজকাল রাজনৈতিক বিতর্ক বিশেষ হয় না। না হয় ক্রিকেট দল নির্বাচনটা ওখানে হবে।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

%d bloggers like this: