লজ্জার ভাগ

ভিখারি দূরে থাক, হকারদের প্রবেশও নিষেধ। কেউ ফাঁকতালে গ্রীষ্মের দুপুরে ঢুকে পড়লে রক্ষীর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।

উসকোখুসকো, পরিচর্যার অভাবে লাল হয়ে যাওয়া দড়ির মত চুল, পরনে রং বোঝা যায় না এমন সালোয়ার কামিজ, কাঁধে একটা কাপড়ের পোঁটলা, সঙ্গে হাড় জিরজিরে ছেঁড়া ফ্রক পরা বছর দশেকের একটি মেয়ে। এভাবে আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন একজন বছর তিরিশের মহিলা। দিন পনেরো আগের কথা। কোনো ভণিতা নেই, দরজা খুলতেই বললেন “বাবু, দুটো কাপড় হবে? আমাদের পরার কাপড় নেই।” বাড়ির দরজায় এসে কেউ সরাসরি হাত পেতে দাঁড়ায়নি অনেককাল। তাই কিছুটা ধাক্কা লেগেছিল। নিজের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে, বউ মেয়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জাই হয়েছিল কিছুটা। গিন্নীর ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু পুরনো জামাকাপড় প্রার্থীর হাতে তুলে দেওয়া গেল। বাচ্চা মেয়েটির চোখ দিয়ে খিদে এমন দৃষ্টিকটুভাবে চেয়ে ছিল, যে তার হাতে দুটো বিস্কুটও দেওয়া গেল। তাতেই বোঝা গেল, এমন নয় যে ওদের বাড়িতে অন্নের তবু সংস্থান আছে, কেবল বস্ত্র ভিক্ষা করতে হচ্ছে। মহিলা বলে বসলেন “বাবু, চাল হবে?” আসলে ইনি ভিক্ষাজীবী নন একেবারেই। বললেন অধুনা প্রায় জঙ্গলে পরিণত হিন্দমোটর কারখানার পরিত্যক্ত কোয়ার্টারগুলোর একটাতে থাকেন। কী কাজ করতেন বললেন না, কিন্তু বললেন কাজ ঘুচে গেছে অতিমারীর কোপে। কাপড় দিয়েছি গোটা কয়েক, মেয়ের হাতে বিস্কুট দিয়েছি না চাইতেই, কিঞ্চিৎ নগদও দিয়েছি। বোধহয় সে জন্যেই ভরসা করে চাল চেয়েছিলেন। কেন কে জানে, ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “হবে না।” একটিও কথা না বাড়িয়ে, পোঁটলার মুখ বেঁধে ফেলে দুজনে বিদায় নিলেন।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার পর মনে হল, ফিরে ডাকি। কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেল। গিন্নী শুনে বললেন “হবে না বললে কেন? চাল তো ছিলই।” ভেবে দেখলাম, চাল আছে। অভাব তো নেই-ই, বরং উদ্বৃত্ত আছে। কিন্তু আমার দেবার মনটাই নেই। নিজের কাছে নানারকম যুক্তি খাড়া করে ফেললাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। যেমন, কাপড় দিলাম, টাকা দিলাম, আবার চালও দেব? বাড়াবাড়ি করা ভাল নয়। যদি চিনে রাখে, নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করে? প্রগতিশীল যুক্তিও খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রের মত লাগিয়ে দিলাম পিছনে — ভিক্ষা দেওয়া ভাল নয়। এর সমর্থনে দু-একজন মহাপুরুষের উক্তিও মনে করার চেষ্টা করলাম, মনে পড়ল না। শেষ পর্যন্ত দুটো কথা স্বীকার না করে উপায় রইল না। প্রথমত, যিনি এসেছিলেন তিনি সারা বছর ধরাচূড়ো পরে ট্রেনে বাসে ভিক্ষা করে নেশার টাকা তুলে বেড়ানোর লোক নন। লজ্জার মাথা খেয়ে মেয়ের হাত ধরে ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যদি বারবার ফিরেও আসেন, তাহলেও আমার যত আছে সবটা ভিক্ষা করে নিয়ে যাওয়ার শক্তি ওঁর নেই।

আসলে সংবেদনশীলতা বোধহয় একটা অভ্যাস। সে অভ্যাস আমার চলে গেছে, তাই কয়েক মিনিটের জন্যও আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে পারি না। ভয় হয়, দুর্বলতম মানুষটিও আমার সব কেড়ে নেবে। অথচ নেওয়ার মত কী-ই বা পড়ে আছে আমাদের? এক সময় কিন্তু ছিল। যখন এ তল্লাটে বাড়ি বাড়ি আসতেন তাঁরা, যাঁদের আমরা সবাই ভিখিরি বলতাম।

ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের যে জায়গাগুলো হুগলী শিল্পাঞ্চলের মধ্যে ধরা হত, তারই একটায় আজন্ম বসবাস করছি। আমার জন্মের আগে বা আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই এ অঞ্চলের বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সমরেশ বসুর গল্প, উপন্যাসে এই অঞ্চলের যে ব্যস্ত শ্রমিক মহল্লার ছবি পাওয়া যায়, সেসব বিরল হয়ে আসতে শুরু করেছে ক্রমশ। র‍্যালিস ইন্ডিয়াকে প্রথম থেকেই পোড়োবাড়ি বলে জেনেছি, রিলাক্সন কারখানায় ধর্মঘট, শ্রমিক-মালিকের টানাপোড়েন চলছে — এসব শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। কিন্তু কৈশোরের শেষ পর্যন্ত হিন্দমোটর আর রিষড়ার অ্যালকালির সাইরেন ভুলতে দেয়নি যে আমরা শিল্পাঞ্চলে বাস করি। পাড়ার কাকু, জেঠু, দাদারা সাইরেন বাজার খানিক আগে-পরে সাইকেল নিয়ে কারখানার দিকে রওনা হতেন বা ফিরতেন। ওসব সকাল-বিকেলের ব্যাপার। দুপুরের নৈঃশব্দ্য, গৃহিণীদের দু দণ্ড বিশ্রামের শান্তি ভঙ্গ হত ভিখারিদের আগমনে।

যাঁরা আসতেন তাঁদের রোজ দেখতে দেখতে মুখ চেনা হয়ে যেত। এক লোলচর্ম বৃদ্ধা আসতেন। পিঠ বেঁকে মাটির সাথে প্রায় সমান্তরাল হয়ে গেছে, দু পা হেঁটেই হাঁপিয়ে পড়েন, টানা কথা বলতেও পারেন না। পয়সা দিলে ক্ষুণ্ণই হতেন। তাঁর দরকার ছিল চাল, ডাল অথবা আলু। তখন ফ্ল্যাটে থাকতাম না। নিজেদের বাড়ি ছিল, সে বাড়ির চাল ছিল টিনের, বৃষ্টি হলে জলও পড়ত। কিন্তু ওই বৃদ্ধাকে মা কখনো বলেননি, চাল হবে না। এ কেবল আমার বাড়ির গল্প নয়। এলাকায় দোতলা বাড়ি তখন গোনা যেত, আর টিভি থাকতে একটা-দুটো বাড়িতে। বৃদ্ধা সব বাড়ি থেকেই কিছু না কিছু পেতেন, ঠা ঠা দুপুরে জিরিয়ে নিতেন কোনো বারান্দায় বসে। হাফপ্যান্টের বয়সে কৌতূহলের সীমা থাকে না। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম “দিদা, তুমি ভিক্ষা করো কেন? তোমার বাড়িতে কেউ নেই?” ছিল, সবই ছিল। স্বামী না থাকলেও ছেলে ছিল, বৌমা ছিল, নাতি-নাতনি ছিল। কিন্তু তারা দেখে না, দু মুঠো খেতেও দেয় না — এমনটাই বলেছিলেন তিনি। দিদার মৃত্যুসংবাদও যথাসময়ে পাওয়া গিয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের পাড়ার লোকেরাই চাঁদা তুলে তাঁর সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল।

এক কাকু ছিল, যে শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভিক্ষা করতে চাইত না। জন্মান্ধ, তার উপর টাকাপয়সার হিসাবও রাখতে পারত না ঠিক করে। তাই তার বাড়ি বাড়ি ধূপ বিক্রি করার ব্যবসা নামেই ব্যবসা। কোনো ক্রেতা তাকে সুযোগ পেয়ে ঠকিয়েছে কিনা জানি না, তবে যে ধূপ সে বিক্রি করতে আসত তার গন্ধ তেমন মনোমুগ্ধকর ছিল না। আদৌ কোনো গন্ধ ছিল কিনা সে-ও তর্কসাধ্য, অর্থাৎ পাইকারি বিক্রেতা তাকে বরাবরই ঠকিয়ে গেছে বলা যায়। সুতরাং কাকুর কোনোমতে গ্রাসাচ্ছাদন আসলে লোকের দয়ার উপরেই নির্ভরশীল ছিল। বয়স একটু বাড়তে মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণও দেখা দিয়েছিল, ফলে দুর্দশার শেষ ছিল না। তবু, কটু কথা শোনালেও, তাকে যৎসামান্য সাহায্য করার লোকের অভাব ছিল না আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর মফস্বলে।

মাঝে মাঝে দেখা মুখও ছিল কয়েকজন। সেই সময়কার আর সব মফস্বল স্টেশনের মত, আমাদের কোন্নগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও ভিখারিদের দেখা পাওয়া যেত। তাছাড়া কালীপুজোর দিন সন্ধেবেলা আমারই বয়সী কিছু শুকনো মুখ ঘুরে বেড়াত। তারা শিশু হলেও আত্মসম্মান যথেষ্ট, তাই কখনো কারোর কাছে বাজি চায়নি। কিন্তু তাদের মুখের অন্ধকার দেখেও নিজের ভাগের আলো থেকে একটুও দেবে না কোন পাষাণ?

আশির দশক পেরিয়ে নব্বইয়ের দশকে এসে কিন্তু অন্য মানুষের দয়ায় বাঁচতে বাধ্য মানুষের সংখ্যা কমে গেল বহুগুণ। এলাকায় বন্ধ কারখানার সংখ্যা বাড়লেও চোখের সামনে দেখতে পেলাম, কিছু না কিছু করছে সকলেই। নিতান্ত ভিক্ষা করে খাওয়ার লোক আমাদের এলাকায় আর নেই দেখে অদ্ভুত স্বস্তিবোধ হত। আজ যৌবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার বৃত্তের সমবয়স্ক এবং বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেদের সাথে কথা বলে দেখি, নিজ নিজ এলাকায় তাঁদের অভিজ্ঞতাও এরকমই। অন্যের অনুগ্রহের ভরসায় জীবনধারণ করার চেয়ে গ্লানিকর কিছু নেই। সে গ্লানি দেখাও গ্লানিকর। তা কাউকে অবসন্ন করে, কাউকে ক্ষিপ্ত করে। ওই গ্লানি থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি বলেই মনে হয়েছিল মাঝের কয়েক বছর।

এখন ভারতের যে প্রান্তের মানুষের সাথেই কথা বলছি, মন খারাপ করা গল্প বলছেন সবাই। আলোকচিত্রীদের ক্যামেরাতেও ধরা পড়ছে মানুষের অসীম দুর্দশার ছবি। পথ দিয়ে চলে যাওয়া দুধের গাড়ি থেকে গড়িয়ে পড়া দুধ রাস্তা থেকে চেটে খাচ্ছেন একজন — এমন ছবিও আমরা দেখে ফেলেছি গত বছর। তার আগেই অবশ্য আমার কল্পনাশক্তিকে অবশ করে দিয়ে হুগলী জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসী এক বন্ধু জানিয়েছে, এক দুপুরে তারা সবে খেয়ে উঠে ঢেঁকুর তুলছে যখন, এক পথিক এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছে “ভাত হবে?” বছর তিরিশেকের ছেলেটি নিজের জন্মস্থানে মানুষকে এভাবে অভুক্ত থাকতে কখনো দেখেনি। ভারতের রাজধানীতে জন্মানো, বেড়ে ওঠা সাংবাদিক বন্ধুও এই দেড় বছরে একাধিকবার বলেছেন, যারা খেটে খেত, তারাও হাত পাততে বাধ্য হচ্ছে।

জানি না, পাঠক, এসব অভিজ্ঞতা কতটা মিলছে আপনাদের অভিজ্ঞতার সাথে। আমাদের নবগ্রাম অনেক বদলে গেছে, আমরা সবাই বদলে গেছি। এখানে এখন অনবরত বাড়ি ভাঙছে, ফ্ল্যাট উঠছে। সেসব ফ্ল্যাটে আমরা সম্ভ্রান্ত লোকেরা থাকি। আমার ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা পেয়েই নিশ্চয়ই দোতলায় উঠে আসতে পেরেছিল ওই তরুণী মা আর তার মেয়ে। হয়ত আর কোনোদিন পারবে না। বহু ফ্ল্যাটে সজাগ রক্ষী আছে এসব বাজে লোককে আটকানোর জন্য। ভিখারি দূরে থাক, হকারদের প্রবেশও নিষেধ। কেউ ফাঁকতালে গ্রীষ্মের দুপুরে ঢুকে পড়লে রক্ষীর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে। আপনি যদি তেমন কোনো ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হন, তাহলে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতা, বমন উদ্রেককারী দৃশ্যের পসরা সাজাবার জন্য। এসব গালগল্প মনে হলে আমিই দায়ী।

আসলে অনুগ্রহ প্রার্থী মানুষ আমাকে বড় লজ্জায় ফেলেন। অতিমারীর সময় হঠাৎ লজ্জায় পড়তে হয়েছে তা নয়। এ লজ্জার শুরু এই সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে। তার আগে নেহাত বালক ছিলাম, লজ্জা ঘৃণা ভয় — সবই কম ছিল। প্রথম লজ্জা পেলাম যখন সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানার শ্রমিকরা আমাদের বাড়িতে পুরুষ-মহিলাদের প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি করতে এলেন। বাবার বয়সী লোক সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালে যে পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করে, সে অনুভূতি সেই প্রথম। আমরা যত বড় হয়েছি, বন্ধ কারখানার সংখ্যা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে মরিয়া শ্রমিকদের যাতায়াত। এক পাড়ায় কতজন এক মাসে কতগুলো ডিওডোর‍্যান্ট কিনতে পারে? উত্তর জেনেও তাঁদের দলে দলে, বারবার আসতে হয়েছে আমাদের দুয়ারে। বিপন্ন মানুষের জন্যে, রোজগারের রাস্তা খোঁজা মানুষের জন্যে এই পৃথিবী কী ভীষণ ছোট! যাঁরা আসেন, তাঁদের কখনো না কখনো ফেরাতেই হয়। মেজাজ ভাল থাকলে নরম সুরে “সেদিন যেটা দিয়ে গেলেন, এখনো ফুরোয়নি যে, কাকু।” তিরিক্ষে হলে “এই তো আপনাদের ফ্যাক্টরিরই একজনের থেকে একটা জিনিস কিনলাম। কজনের থেকে কিনতে হবে রে বাবা?” মাসে মাসে এলে কয়েক জনের মুখ চেনা হয়ে যায়। তখন অনুগ্রহ প্রার্থনা আরও লজ্জায় ফেলে। কেউ কেউ নিজের অবস্থায় এতই লজ্জিত, যে সামান্য নখপালিশ কেনার জন্য হাঁটুর বয়সী গৃহবধূকে বলে ফেলেন “আপনাদের অশেষ দয়া। আপনারা আছেন বলেই আমার মেয়েটা খেতে পরতে পাচ্ছে মা।” আসলে তিনি জানেন এই বেচা কেনা চাহিদা-যোগানের অর্থনৈতিক নীতি অনুযায়ী হচ্ছে না, হচ্ছে অনুগ্রহের ভিত্তিতে।

গত দেড়-দুই দশক ধরে তবু এই ভানটুকু আমাদের আব্রু বজায় রেখেছিল। অতিমারী এসে সেটুকুও বুঝি কেড়ে নিল। ভিখারি হওয়া ছাড়া আর পথ রইল না অনেক মানুষের। নিজেকে এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃশাসনীয় গল্পের নারীদের মত অসহায়, উলঙ্গ মনে হয়। দুঃখ ভাগ করলে কমে জানি, লজ্জা ভাগ করলে কমে কিনা জানি না। তাই খানিক আশায়, প্রিয় পাঠক, এই ঝুঁকি নিলাম।

https://aajkaal.in এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ

এখন কোথায় গেল কোলবালিশ আর কোথায় গেল প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, যা সবদিক থেকে পাশ্চাত্যের চেয়ে উন্নত? কোনটাই পারল না তো বাঁচাতে?

কাব্যি করবেন না। এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ, এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চের প্রত্যেকটা বাঁশ আমাদের নিজের হাতে পোঁতা। এখন চোখ বড় বড় করে বিস্ময় প্রকাশ করলে চলবে না। যখন বেসরকারিকরণকে সর্বসন্তাপহর বটিকা বলেছিলেন, যখন সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলেছিলেন “ফেলো কড়ি মাখো তেল”, তখন ভেবেছিলেন হাসপাতালে শয্যা খালি থাকলে তবে আপনার মেডিক্লেম কাজে লাগবে? মনে ছিল না অক্সিজেন কম পড়লে আপনি কোটিপতি হলেও লাভ হবে না?

ডাক্তার কাফিল খান নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে অক্সিজেন আনিয়ে শিশুদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়েছিলেন। সেই অপরাধে উত্তরপ্রদেশ সরকার তাঁকে হাজতবাস করাল দীর্ঘদিন। আজ সেই রাজ্যে শ্মশানে জায়গা নেই বলে ফুটপাথে পোড়ানো হচ্ছে মৃতদেহ।

A report by @lokeshRlive from Ghaziabad tearing into govt’s suppression of Covid casualties in UP.

pic.twitter.com/Elt9Rl9baZ

— Piyush Rai (@Benarasiyaa) April 18, 2021

অথচ সরকার বলছে এপ্রিল মাসে কোভিডে মৃতের সংখ্যা মাত্র দুই!

Story of Ghaziabad. pic.twitter.com/Q6JXjLHIJK

— Aditya Raj Kaul (@AdityaRajKaul) April 18, 2021

কে নির্বাচিত করেছিল এমন সরকারকে? ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং আর তার জাতভাইরা? এখন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেও কোভিডাক্রান্ত। কিন্তু গত বছর যখন প্রধানমন্ত্রীর বিধানে ভাইরাস তাড়াতে থালা বাজিয়েছিলেন, সে দৃশ্য যারা হাঁ করে টিভিতে দেখেছে, নিজেও সোৎসাহে থালা বাজিয়েছে — তারা তো এই দেশেরই মানুষ। পথে ঘাটে ঝগড়া করেছে, হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডকে বেদবাক্য বলে ধরে নিয়ে আওয়াজের চোটে করোনা ভাইরাস মরে যাবে, এই তত্ত্ব প্রচার করেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরা — তারা সবাই এ দেশের মানুষ। এর বিপরীতে করোনা অতিমারী আসলে এক পাহাড়প্রমাণ ফাঁকি, লড়াই আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারের তৈরি এক ধাপ্পা, করোনা সাধারণ সর্দিকাশি, ফ্লু-এর চেয়ে বেশি কিছু নয় — প্রবল আত্মবিশ্বাসে এসব বলে গেছে যারা, তারাও কেউ ভিনগ্রহের বাসিন্দা নয়।

ইন্ডিয়ান মেডিকাল অ্যাসোসিয়েশন জানাচ্ছে এখন অব্দি চলতি অতিমারীতে অন্তত ৭৩৯ জন এম বি বি এস ডাক্তার মারা গেছেন, এই দ্বিতীয় ঢেউতেই তিনজন। আই এম এ না বললেও আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় জানি — ডাক্তার, নার্সরা বারো ঘন্টা, ষোল ঘন্টা ডিউটি করছেন সেই গত বছরের মার্চ থেকে। খাওয়ার সময় নেই, বাথরুমে যাওয়ার সময় নেই, ঋতুমতী মহিলারা ন্যাপকিন বদলানোর সময় পর্যন্ত পাচ্ছেন না। তাঁদের ধন্যবাদ জানানোর জন্যই নাকি মহামতি নরেন্দ্র মোদী থালা বাসন বাজাতে বলেছিলেন দেশের সকলকে। এ দেশের অনুগত মানুষ তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ ঘটা করে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার কোভিড-১৯ ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। তাতে সাফাই কর্মচারী, ওয়ার্ড বয়, নার্স, আশা কর্মী, প্যারামেডিক, টেকনিশিয়ান, ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ প্রমুখের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বিমা প্রকল্প ছিল। ২৬শে মার্চ, ২০২০ তারিখে মন্ত্রী বলেছিলেন এতে নাকি প্রায় ২২ লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী উপকৃত হবেন। এ বছরের ২৪শে মার্চ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সার্কুলার জারি করে সেই বিমা প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। [১]

‘দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ জানাচ্ছে এই এক বছরে মাত্র ২৮৭ জন এই বিমার টাকা দাবি করেছেন। এই ধূর্ত, নির্দয় সরকারকে গদিতে বসিয়েছে কি পাকিস্তানের মানুষ? রাজ্যে রাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই) এদেরই ক্ষমতায় আনতে উদগ্রীব কি বাংলাদেশের মানুষ?

পশ্চিমবঙ্গে তো আবার আজকাল বাংলাদেশ বাদ দিয়ে কোন আলোচনা চলে না। ওটা যে আলাদা দেশ তা গুলিয়ে যায় অনেকসময়। ও দেশের ধর্ষিতাকে এ রাজ্যের নির্বাচনে ইস্যু করার চেষ্টা হয়। ও দেশের লোকে পশ্চিমবঙ্গ ভরে গেছে বলে যারা ভীষণ চিন্তিত, তাদের স্বভাবতই এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থা নিয়ে ভাবার সময় নেই। মুশকিল হল আমরা এ দেশে ভ্যাক্সিন পাঠাচ্ছি, সে দেশে ভ্যাক্সিন পাঠাচ্ছি বলে প্রধানমন্ত্রী আস্ফালন করছেন, এদিকে ওষুধের জন্য বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর কাছে হাত পাততে হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছেন। মোদী সরকারের কাছে বাংলাদেশ থেকে এই ওষুধ আমদানি করার অনুমতিও চেয়েছেন।

माननीय मुख्यमंत्री श्री हेमंत सोरेन जी ने रेमडेसिविर की कमी को पूरा करने के लिए बांग्लादेश की दवा कंपनियों से संपर्क साधा। केन्द्र सरकार से भी आयात की अनुमति मांगी।@HemantSorenJMM @JmmJharkhand @narendramodi @DVSadanandGowda @AmitShah @PMOIndia pic.twitter.com/ejhh40M05O

— JMM_पश्चिमी सिंहभूम (@WestsinghbhmJMM) April 18, 2021

অনুমতি পাবেন কিনা কে জানে? মোদীর অনুমতি দেওয়ার সময় হবে কি? উনি তো গোড়াতেই বলেছিলেন উনি প্রধানমন্ত্রী নন, প্রধান সেবক। ফলে ওঁর অনেক কাজ। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে নাকি অতিমারীর জরুরি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ফোন করে শুনেছেন তিনি পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে ব্যস্ত, ফিরলে উত্তর পাবেন। ইতিমধ্যে কত মানুষ আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরবেন না, সে খবরে প্রধানমন্ত্রীর দরকার নেই। এমন নয় যে তিনি এই প্রথম অযোগ্যতার বা নৃশংসতার পরিচয় দিচ্ছেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন। সেসব জেনেশুনে বিষ পান তো আমরাই করেছি। এখন বিষের জ্বালায় এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না বললে চলবে কেন?

পৃথিবীর সব দেশে কোভিডের প্রকোপে লকডাউন হয়েছে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষকে কয়েক শো মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করতে হয়নি, পথে ক্ষিদে তেষ্টায় মরতে হয়নি। এ দেশে হয়েছে। যখন তারা মরেছে, তখন আমরাই তো অসন্তোষ প্রকাশ করেছি, লকডাউন সত্ত্বেও এরা হাঁটছে কেন? অবৈজ্ঞানিক হলেও পোকামাকড় জ্ঞানে মানুষগুলোকে পথে বসিয়ে গায়ে স্প্রে করে স্যানিটাইজ করা হয়েছে। ওতেই নাকি কোভিড ছড়ানো বন্ধ হবে। তাতেই বা আমাদের কজনের আপত্তি হয়েছে? বিদেশ থেকে আসা বড়লোকেরা বেমালুম পরিচিতি বা টাকার জোরে কোয়ারান্টিনের বালাই না রেখে দেশের ভিতর সেঁধিয়ে গেছে আর আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছি বাড়ির কাজের লোক, ক্যাটারিং-এর কাজ করা লোক, রিকশাওয়ালা, পথের ভিখারি আর প্রবাসী শ্রমিকরাই ভাইরাস ছড়াচ্ছে। লেখাপড়া শিখে অবিজ্ঞানের চাষ করেছে যারা, অমুক পাঁপড় খেলে করোনা হয় না, তমুক আসন করলে করোনা হয় না, মাথায় গোমূত্র ছেটালে করোনা হয় না — এসব বিশ্বাস করেছে যারা, তারা কোন দেশের লোক?

কত না কালক্ষেপ করেছি গোটা পৃথিবীর দখল নেওয়ার জন্য ভাইরাসটা চীন গবেষণাগারে বানিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে কিনা সেই আলোচনায়। অথচ চীন যে কয়েক মাসের মধ্যে একগাদা নতুন হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছিল সেদিকে নজর দিইনি। না দেশ, না রাজ্য — কোন সরকারকে প্রশ্ন করিনি আমাদের একটাও নতুন হাসপাতাল হল না কেন? মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় নেমে গোল কেটেছেন কাকে কোথায় দাঁড়াতে হবে, আমরা হাততালি দিয়ে বলিনি “ওঃ, কি দারুণ লিডার! সামনে দাঁড়িয়ে লড়ছেন।” করোনাকে বালিশ করে শুয়ে পড়তে বলেছেন, আমরা বলেছি “বিজ্ঞানীরাও তো তা-ই বলছেন। এ ভাইরাস তো অনেকদিন থাকবে।” এখন কোথায় গেল কোলবালিশ আর কোথায় গেল প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, যা সবদিক থেকে পাশ্চাত্যের চেয়ে উন্নত? কোনটাই পারল না তো বাঁচাতে? এতদিন পরে গণেশের প্লাস্টিক সার্জারির প্রাচীন কৌশলে বিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রীর সরকার বলছে একশোটা হাসপাতালে নতুন অক্সিজেন প্ল্যান্ট বানানো হবে পিএম কেয়ারস ফান্ডের টাকায়।[২]

দেড়শো কোটি মানুষের দেশের মোটে একশোটা হাসপাতালে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করার টাকার খোঁজ এত দিনে পাওয়া গেল। এদিকে দুর্গাপুজোর টাকা জোগানো রাজ্য সরকার এখনো কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের চিকিৎসা বাবদ শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতালের প্রাপ্য আট কোটি টাকা দেয়নি।[৩]

আহা, নিজ রাজনৈতিক এজেন্ডার স্বার্থে আমরা কত কূট তর্কই না করেছি! কেউ পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা খারাপ বললে বলেছি “গুজরাটের অবস্থা কি ভাল? মধ্যপ্রদেশের অবস্থা কি ভাল?” যেন ঐ রাজ্যগুলোর চেয়ে কম লোক মরলেই এ রাজ্যের সরকারকে মেডেল দিতে হবে, এ রাজ্যের মানুষের জীবনের দাম নির্ভর করে ঐ রাজ্যগুলোর মানুষের জীবনের উপর। সারা দেশে কয়েকটা হাতে গোনা সংবাদমাধ্যম সাহস করে খবর করেছে যে কেন্দ্রীয় সরকার এবং অনেকগুলো রাজ্য সরকার রোগীর সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা লুকোচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে অকর্মণ্য সরকারগুলো দারুণ তৎপরতায় গর্জে উঠেছে, মামলা মোকদ্দমার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কোন পার্টির সরকার তা দেখে আমরা ঠিক করেছি খবরগুলো বিশ্বাস করব কিনা। যদি কেউ কখনো বলে ফেলে কেরালা করোনা ভাল সামলাচ্ছে, অমনি আমরা তক্কে তক্কে থেকেছি কেরালায় কেস বাড়ে কিনা, মৃত্যু বাড়ে কিনা। বাড়লেই সে কি উল্লাস! “বাঃ বাঃ! কেরালায় লোক মরেছে। হল তো? কেরালা মডেল?” এই শকুনবৃত্তি যে দেশের মানুষ করে, সে দেশই তো মৃত্যু উপত্যকা। এখন আমার দেশ না বলে এড়িয়ে গেলে হবে?

যখন সরকার বলেছিল করোনা তেমন চিন্তার ব্যাপার নয়, তখন আয়োজিত তবলিগী জামাতের মর্কজকে দেশের করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী করে কত না চেঁচিয়েছি। হিন্দু এলাকায় মুসলমান ফলওয়ালা, সব্জিওয়ালাকে ঢুকতে দিইনি কারণ নিশ্চিত খবর ছিল, কোভিড-১৯ ওদের বাধ্য ছেলে। ওদের শরীরে থেকে অসুস্থ করছে না, কিন্তু ওদের কথায় হিন্দুদের দেহে ঢুকে পড়ছে। এখন লক্ষ লক্ষ লোক কুম্ভমেলায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করলেও চিন্তা নেই, কারোর করোনা হবে না। এ কথা বলছে কোন দেশের মন্ত্রীসান্ত্রীরা?[৪]

তাদের মন্ত্রী বানিয়েছে কারা? টিমবাকটুর লোকেরা?

নেতা মন্ত্রীরা নাহয় সাধারণ মানুষের জীবনের তোয়াক্কা করেন না, ভোটের জন্য লালায়িত — তাই সমাবেশ করেই চলেছেন। সে সমাবেশ বন্ধ করার দাবি তুলছে না যে সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী — তারা কিসের জন্য লালায়িত? কোন দেশের লোক তারা?

এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ, কারণ কেবল মানুষ মরছে না। কয়েক কোটি জীবন্ত মানুষের বিবেক মরে গেছে, মরে যাচ্ছে প্রতিদিন। করোনায় এখনো দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও, যে অতিমারীতে মৃত্যু হয় বিবেকের, তাতে ভারত ইতিমধ্যেই পৃথিবীতে প্রথম স্থানে।

সূত্র:

[১] New Indian Express
[২] LiveMint
[৩] আনন্দবাজার পত্রিকা 
[৪] Firstpost

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

সাংবাদিক ছাঁটাই: আনন্দ সংবাদ নয়, বিপদ-সংকেত

বুঝে উঠতে পারেননি চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে ঠিকা শ্রমিকের চেয়ে বেশি অধিকার দাবি করা যায় না।

দুরাত্মার যেমন ছলের অভাব হয় না, ছাঁটাইয়ের কারণেরও অভাব হয় না। সে কারণ কখনো অতিমারী, যা কোভিড-১৯ এর প্রভাবে এখন চলছে; আবার কখনও আর্থিক মন্দা, যেমনটা ২০০৮-০৯ এ হয়েছিল। কখনও শুধুই “লোক বেশি ছিল”। অনেক সময় আবার কারণ দর্শানোর দরকারই পড়ে না, কারণ খবরটা বিশেষ কারো চোখেই পড়ে না। যেমন এই মুহূর্তে বি এস এন এলের মত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় স্থায়ী, অস্থায়ী কর্মীদের স্রেফ খেদিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ তা নিয়ে কর্মী এবং কর্মী ইউনিয়ন ছাড়া বিশেষ কারো মাথাব্যথা নেই। কারণ সংবাদমাধ্যমগুলো ইদানীং মানুষের কাজ হারানোকে আর খবর বলে মনে করে না। পথ অবরোধ, হাতাহাতি বা তারও বেশি কিছু ঘটলে দু একদিন খবরের চ্যানেলে নিউজফ্ল্যাশ হিসাবে এসে পড়ে, বিয়েবাড়িতে ঢুকে পড়া বুভুক্ষু ভিখারির মত খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় এক কোণে জায়গা হয়। সেটুকু জায়গাও অবশ্য ঘটনাটা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় হলে তবেই পাওয়া যায়। বেসরকারি সংস্থায় ছাঁটাই হওয়া পূর্ব দিকে সূর্য ওঠা আর পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার মতই স্বাভাবিক ঘটনা।

আপনি যদি নাম করা কোম্পানির ভাল মাইনের কর্মচারী হন, তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনার কাজ হারানোটা খবর নয়। আপনাকে যখন সুললিত ভাষায় জানানো হবে কোম্পানির আর আপনাকে প্রয়োজন নেই, তখন চুপচাপ বাড়ি চলে আসা ছাড়া আপনার আর কিচ্ছু করার নেই। আপনার বা আপনাদের কথা কোথাও এক লাইন লেখা হবে না। আপনাদের কেউ যদি ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েন, একমাত্র তাহলেই টিভি চ্যানেলগুলো দৌড়ে আসতে পারে বা কাগজওয়ালারা আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। কোভিডের প্রতাপে কাজ হারিয়ে এই মুহূর্তে আপনারা কেউ যদি নিজের এবং পরিবারের তেমন সর্বনাশ করবেন বলে ভেবে থাকেন, তাহলে তাঁদের যন্ত্রণার উপশমের জন্য একটা খবর আছে। আপনারা যে তিমিরে, সাংবাদিকরাও সেই তিমিরে। সেই মার্চ মাসের শেষ থেকে এই আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারা দেশে কয়েক হাজার সাংবাদিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আপনি যতগুলো কাগজের নাম জানেন, যতগুলো খবরের চ্যানেলের হদিশ আপনার জানা আছে, তার প্রায় সবকটাই কিছু সাংবাদিককে ছাঁটাই করেছে, বাকিদের মাইনে কেটেছে নানা মাত্রায়। তাঁরা মুখ বুজে সহ্য করছেন, আপনিই বা করবেন না কেন?

অনেকদিন অনেক সংখ্যাতাত্ত্বিক চালাকি চলল। এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া নিজেই বলছে অর্থনীতির অবস্থা মোটেও ভাল নয়, জি ডি পি ঋণাত্মকও হয়ে যেতে পারে। প্রবাসী শ্রমিকদের আমরা মাইলের পর মাইল হাঁটতে হাঁটতে মরে যেতে দেখে ফেলেছি। সমস্ত ক্ষেত্রেই বহু মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। এমতাবস্থায় হাজার পাঁচেক সাংবাদিকের চাকরি যাওয়া নিয়ে আলাদা করে বলবার কী আছে। সংখ্যার বিচারে হয়ত নেই, কিন্তু সাংবাদিকদের যদি প্রেস্টিটিউট আর শকুন — এই দুই স্টিরিওটাইপের বাইরে গিয়ে মানুষ বলে ভাবতে রাজি থাকেন, তাহলে সাংবাদিকদের কাজ হারানো আপনার কাজ হারানোর মতই বেদনাদায়ক। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এত সাংবাদিকের চাকরি যাওয়া এই দেশের গণ>তন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক দুঃসংবাদ। আর গণতন্ত্র বিপদে পড়া মানে শুধু আমার আপনার নয়, আমাদের সন্তানদেরও ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

আপনি বলবেন, কেন? সাংবাদিকদের চাকরি গেলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে কেন? আসলে হবে নয়, গণতন্ত্র ইতিমধ্যেই বিপন্ন। সেই কারণেই সাংবাদিকরা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশকে বিদায় দেওয়া হচ্ছে। অনস্বীকার্য যে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমই এখন “কলের গান, কুকুর মাথা”, তাদের কিনেছে বিজ্ঞাপনদাতা। আর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনদাতা হল সরকার (কেন্দ্র এবং রাজ্য)। বিজ্ঞাপনদাতাদের চটানো চলে না, অথচ সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহ করতে দিলেই চটবার মত খবর এসে হাজির হবে। মালিকপক্ষ তা চান না। তাঁরা ব্যবসা করতে নেমেছেন, জনসেবা করতে নয়। আপনি যদি সংবাদমাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপনী স্লোগানে মোহিত হয়ে থাকেন, সে আপনার দোষ। আসলে কাগজ তা-ই লেখে যা তাকে লিখতে বলা হয়। সে কাজ করতে তো আর সাংবাদিক লাগে না। তাই সাংবাদিকরা এখন উদ্বৃত্ত। এর প্রভাব আপনার উপর কীভাবে পড়বে বুঝলেন তো? আপনার সুখ দুঃখ বিপদ আপদের খবর ক্রমশই বিরলতর হবে কাগজের পাতায় আর টিভির পর্দায়। পাড়াসুদ্ধ লোকের চাকরি চলে গেলেও, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেলেও, করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যায় এবং মৃত্যুতে ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিলেও, কাগজ খুললে বা টিভি দেখলে মনে হবে অন্য দেশের খবর দেখছেন। কারণ সংবাদমাধ্যমগুলোকে তেমনটাই করতে বলা হয়েছে। কে বলেছে তা অনুমান করার জন্য স্বর্ণপদক চেয়ে বসবেন না যেন।

করোনার জন্য প্রায় সব পেশাতেই কর্মহানি হয়েছে প্রবল। বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ নিয়ে এ বিষয়ে দুটি সংখ্যা ভাবা হয়েছে। পরের সংখ্যায় থাকছে হকারদের নিয়ে বিশ্বেন্দু নন্দের, গৃহসহায়িকাদের নিয়ে মৌসুমী বিলকিসের প্রতিবেদন ও অর্থনীতির একটি মডেল নিয়ে অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ।

এত তেতো কথা পড়ে যে কেউ বলতেই পারেন, এ সমস্ত প্রোপাগান্ডা। সত্যিই তো অতিমারীর ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে, বেশিরভাগ ব্যবসা বাণিজ্যই ধুঁকছে। কাগজ বা চ্যানেলের মালিকরা কি পকেটের পয়সা দিয়ে ব্যবসা চালাবেন? তাঁদেরও নিশ্চয়ই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে ক্ষতি পূরণ করতে কর্মী সঙ্কোচন ছাড়া পথ ছিল না।

আচ্ছা, তাহলে অতিমারী নিয়েই কথা হোক। ভারতে করোনার পদার্পণ যেদিনই ঘটে থাক, চার ঘন্টার নোটিশে দেশ জুড়ে লকডাউন চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত অর্থনীতির চাকা তো পুরো দমে ঘুরছিল। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত লকডাউন শুরু হয় ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে, তার আগে ২২শে মার্চ ছিল জনতা কারফিউ। পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন শুরু হয়েছিল ২৩শে মার্চই; মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুর মত কয়েকটা রাজ্যও দেশব্যাপী লকডাউনের কয়েকদিন আগে থেকেই লকডাউন ঘোষণা করে। অর্থাৎ অর্থনীতির চাকা ঘুরতে ঘুরতে একেবারে বন্ধ হয়ে যায় মার্চের শেষ সপ্তাহে। আচ্ছা আর্থিক বর্ষ শেষ হয় কত তারিখে? ৩১শে মার্চ। তাহলে কোভিড-১৯ এর প্রভাব ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে কদিন পড়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যমের উপর? বড় জোর দশ দিন। এই দশ দিন এমনই কাঁপিয়ে দিল মহীরূহদের যে বাকি আর্থিক বর্ষের লাভ কমতে কমতে বিপুল ক্ষতিতে চলে গেল! তাই এপ্রিল-মে থেকেই মাইনে কাটা এবং ছাঁটাই শুরু করতে হল বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোতে? এ যদি সত্য হয়, তাহলে পি সি সরকারের এখনই প্রকাশ্যে নাক খত দিয়ে বলা উচিৎ তাঁর বংশের কেউ আর কোনওদিন ম্যাজিক দেখাবে না।

বলা যেতেই পারে যে এটা অতিসরলীকরণ হল। বিগত আর্থিক বর্ষের ক্ষতি নয়, এই বিপুল ছাঁটাই এবং মাইনে কাটার কারণ হল বর্তমান আর্থিক বর্ষের বিপুল ক্ষতির সম্ভাবনা। স্রেফ সম্ভাবনার কথা ভেবে মানুষের চাকরি খাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন তুলব না। কারণ কর্পোরেট দুনিয়া মানবিক যুক্তিতে চলে না, চলে লাভ ক্ষতির যুক্তিতে। সেখানে মানুষকে নিয়ে আলোচনা বামপন্থী সেন্টিমেন্টালিজম মাত্র। অন্য একটা প্রশ্ন আছে। কর্মীদের মাইনে দেওয়ার খরচ কমালে কতটা খরচ কমে? একটা উদাহরণই যথেষ্ট।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এক অতিকায় সর্বভারতীয় সংবাদপত্র তাদের উত্তর সম্পাদকীয় স্তম্ভে দাবি করেছিল কাগজ চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। যা যা কারণ বলা হয়েছিল, তার মধ্যে একটা ছিল কর্মচারীদের মাইনে দিতে বিপুল খরচ। তার দুদিন পরেই দিল্লি ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টস নামে সাংবাদিকদের এক সংগঠন পাবলিক রেকর্ড উদ্ধৃত করে বলেছিল, ঐ সংবাদপত্রের মোট আয়ের মাত্র ১১% খরচ হয় মাইনে দিতে। পরিসংখ্যানটা অবশ্য ২০১০-১১ আর্থিক বর্ষের। ধরা যাক সিংহহৃদয় মালিকপক্ষ এতদিনে সে খরচ দ্বিগুণ করে ফেলেছেন। তা এই বিপুল ক্ষতির মরসুমে কর্মী ছাঁটাই করে ঐ ২২% খরচের কতটা কমানো গেল? বাকি ৭৮% থেকে কিছু সাশ্রয় হল কি? এসব প্রশ্ন তুললেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ব্যবসার গোপনীয়তা, কোম্পানি আইনের রক্ষাকবচ ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসে যাবে। কোভিডের ক্ষতিপূরণে শ্রম আইন এলেবেলে হয়ে গেছে, আট ঘন্টা কাজের অধিকারের মত ন্যূনতম অধিকারও সরকার ইচ্ছামত স্থগিত রাখছেন। কেউ কিন্তু কোম্পানি আইন দেশমাতৃকার স্বার্থে বলি দিতে রাজি নয়। তাই বলছি, কোভিড নেহাত অজুহাত। এই বিপুল ক্ষতি নিয়ে তিন দিন ব্যাপী অশ্রু বিসর্জন সভা প্রতি বছরের মত এ বছরেও কোন কোম্পানি মরিশাসে কেউ বা মারাকেশে করবেন, নিদেন মুম্বাইয়ের সেভেন স্টার হোটেলে। এদিকে কাজ হারানো সাংবাদিকরা গৃহঋণের ই এম আই দিতে না পেরে ব্যাঙ্কের রিকভারি এজেন্টদের থেকে পালিয়ে বেড়াবেন।

কেউ কেউ হয়ত অগত্যা ধনী রাজনৈতিক দলের টোপ গিলে প্রকাশ্যে বা কৌশলে প্রোপাগান্ডার কাজে লাগবেন। কিন্তু সে সুযোগই বা কজন পাবেন? পশ্চিমবঙ্গে তো এক লহমায় সংবাদমাধ্যমের অনেকের কাজ হারানো অনতি অতীতেই ঘটেছে, যখন সুদীপ্ত সেনের পুঁজিতে পুষ্ট খবরের কাগজ এবং টিভি চ্যানেলগুলো উঠে গেল। অনেকেই আর কাজ পাননি। বাধ্য হয়ে মুদির দোকান, স্টেশনারি দোকান খুলে বসেছেন, কোনও মতে দিন গুজরান হয় — এমন মানুষও আছেন।

যাঁরা কোন পয়সাওয়ালা রাজনৈতিক দলের দাক্ষিণ্য পাবেন, তাঁরা যদি আপনার পছন্দের দলটির প্রোপাগান্ডা না করেন তাহলে বিলক্ষণ তেড়ে গাল দেবেন। কিন্তু, প্রিয় পাঠক, সাংবাদিকদের এই দুর্দশার কাহিনীতে আপনার ভাববার মত যে উপাদান আছে তা দয়া করে অগ্রাহ্য করবেন না। আজকাল সরকারী চাকরি অনেক কমে গেছে, বেশিরভাগ মানুষই কোন না কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। অতএব কর্পোরেটের কর্মচারী সাংবাদিকদের সাথে বিশেষ অবস্থাভেদ নেই।

সাংবাদিকদের এমন অবস্থা হল কেন? যাঁরা অমিতশক্তিধর, সরকার গড়তে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন বলে জনশ্রুতি, তাঁদের কাতারে কাতারে চাকরি যাচ্ছে আর কেউ টুঁ শব্দটি করছে না — এমন হল কেন? হল, কারণ নয়ের দশকে বিশ্বায়নের যুগে দিকপাল সাংবাদিকরা মালিকদের প্ররোচনায় রিমের পর রিম লিখে দেশসুদ্ধ লোককে বোঝালেন যে কর্মী ইউনিয়নের মত খারাপ জিনিস দুটি নেই। ওটি সর্বতোভাবে কর্মনাশা, শিল্পবিরোধী। এর ফলে সরকারি মদতে, মালিকদের ইচ্ছায় সব শিল্পেই ইউনিয়নগুলো দুর্বল হয়ে পড়ল, কোথাও নামমাত্রে পরিণত হল। সংবাদমাধ্যমে ইউনিয়ন কার্যত উঠে গেল। তারপর এল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। দিকপালরা ভাবলেন তাঁরা ঐতিহাসিক কাজ করলেন। ঠিকই ভাবলেন। তবে ভেবেছিলেন পানিপথের যুদ্ধ জয় করলেন, আজকের সাংবাদিকরা বুঝছেন (বুঝছেন কি? কে জানে!) আসলে ওটা ছিল পলাশীর পরাজয়। হাতে যন্ত্রপাতির বদলে কলম (এ যুগে ল্যাপটপ) থাকে বলে সাংবাদিকরা ভেবেছিলেন তাঁরা শ্রমিক নন। তাই বুঝে উঠতে পারেননি চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে ঠিকা শ্রমিকের চেয়ে বেশি অধিকার দাবি করা যায় না। আর জোট বেঁধে দাবি পেশ করার অধিকার না থাকলে কোন অধিকারই থাকে না, মালিকের খেয়ালে চলতে হয়।

খেয়াল মানে খিদে, লাভের খিদে। বাঘের ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে, কর্পোরেটের খিদে কখনও কমে না। এই একবিংশ শতকে লাভের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে। কর্পোরেট বয়ানে লাভের মানে হল গত বছরের চেয়ে বেশি লাভ। সেই নতুন টার্গেটে না পৌঁছাতে না পারলেই কোম্পানির ক্ষতি হয়, আর তখনই কর্মী ঘচাং ফু। সাংবাদিকও তেমনই এক কর্মী, তার বেশি কিছু নয়। সেই কারণেই আগেকার সম্পাদকরা রাজনৈতিক গুন্ডার হাতে প্রতিবেদক নিগৃহীত হলে বুক দিয়ে আগলাতেন এবং প্রশাসনের বাপান্ত করতেন। এখন খবর পর্যন্ত ছাপেন না অনেক সময়, এফ আই আর ও করতে দেন না। উলটে শাসক দলকে কুপিত করার অপরাধে ঐ প্রতিবেদককে বরখাস্তও করতে পারেন।

তাই আজ সহকর্মী কাজ হারিয়ে গলায় দড়ি দিলেও সাংবাদিকদের এক লাইন লেখার উপায় নেই, ফেসবুকে লিখতেও বুক কাঁপে। নির্জনে শোক পালন ছাড়া গতি নেই।

প্রিয় পাঠক, আপনি যে পেশাতেই থাকুন, কর্মস্থলে আপনার অবস্থা কি এর চেয়ে উন্নত? ভেবে দেখুন তো?

https://www.guruchandali.com/ এ প্রকাশিত

উল্টো রাজা উল্টো বুঝলি প্রজার দেশে

আমাদের সংবিধান যে নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মত একটা জিনিস সে সিদ্ধান্ত এ দেশে হয়েই গেছে

যে যা-ই বলুক, চোখ কান খোলা রাখলে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ মোটেই কোরোনা সামলাতে যা করা উচিৎ তা করছে না। বেশি কড়া কথা বলা হয়ে যাচ্ছে মনে হলে একটু নরম করে বলা যেতেই পারে করতে পারছে না। তা বলে কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে জেলায় কী হচ্ছে সে সম্বন্ধে ভাষণ দেবে আর খবরদারি করতে কেন্দ্রীয় দল পাঠাবে — তাও সমর্থনযোগ্য নয়।

লক্ষণীয়, গত দুদিনে কেন্দ্রীয় সরকার কতকগুলো জায়গা সম্বন্ধে আলাদা করে বলেছে সেখানে উদ্বেগজনক অবস্থা। প্রত্যেকটা জায়গাই অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে — কলকাতা, মুম্বাই, জয়পুর, ইন্দোর। কলকাতার (এবং হাওড়ার) অবস্থা আমরা আশেপাশের লোকেরা জানি, তাই বাদ দিন। কিন্তু বাকিগুলো ভাবুন।

শুরু থেকেই দেশে সবচেয়ে বেশি টেস্ট করছে কেরালা আর মহারাষ্ট্র। স্বভাবতই ও দুটো রাজ্যে কোরোনা আক্রান্ত রোগীও বেশি পাওয়া যাচ্ছে৷ মুম্বাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী। জয়পুর রাজস্থানে। যে রাজ্যের ভিলওয়ারাকে কদিন আগে মডেল বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই। সেখানে কোরোনা রোগীর সংখ্যাও কিছু অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ইন্দোর মধ্যপ্রদেশে। সে এমন এক রাজ্য যেখানে এখন অব্দি আস্ত ক্যাবিনেট নেই, স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। কংগ্রেস সরকারকে সরিয়ে সবে বিজেপি সরকার শপথ নিয়েছে, তখনই লকডাউন শুরু হল। সেখানে মাঝে কয়েকদিন প্রচুর কোরোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছিল, হঠাৎই কমতে শুরু করেছে। ভোজবাজির মত।

এর পাশাপাশি যদি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর দিকে চোখ রাখা যায়, দেখা যাবে উত্তরপ্রদেশে ঠিক কী হচ্ছে আমরা জানি না। তবলিগি জামাতের জমায়েত নিয়ে দিনরাত এত দুশ্চিন্তা আমাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে ওখান থেকে কতজনের কোরোনা হয়েছে, অথচ লকডাউন শুরু হওয়ার পর রামনবমীর দিন অযোধ্যার অনুষ্ঠান থেকে কতজনের কোরোনা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান আমরা পাচ্ছি না। উত্তরপ্রদেশে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ীই কিন্তু সহস্রাধিক আক্রান্ত। তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চিন্তিত নন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো সর্বদা দেশী বিদেশী পর্যটকে ভরে থাকে, অথচ ওদিকে একেকটা রাজ্যে দুজন, পাঁচ জন, দশ জন করে আক্রান্ত। অর্থাৎ ঐ রাজ্যগুলো বাকিদের জন্য অনুকরণীয়। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার বাকিদের ওদের থেকে শিখতে বলছেন না কেন, তাও পরিষ্কার নয়। ফলত কিছু রাজ্যের জন্য এই দুশ্চিন্তাকে লর্ড ডালহৌসির করদ রাজ্যগুলোর প্রজাদের জন্য দুশ্চিন্তার বেশি কিছু ভাবা শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আসলে রাজ্য সরকার মানে যে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ অফিস নয়, তা বর্তমান সরকার মোটেই মানতে চান না।সংবিধানকে মারো গুলি। কেনই বা মারবেন না? আমাদের সংবিধান যে নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মত একটা জিনিস সে সিদ্ধান্ত এ দেশে হয়েই গেছে। পাড়ার “আমি কিন্তু বিজেপি নই” দাদা বা দিদির সাথে কথা বললেই বুঝতে পারবেন।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রভু ভাবার অভ্যেসটা যারাই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার চালিয়েছে তাদেরই বিলক্ষণ ছিল। রাজ্যপালকে দিয়ে দিনরাত বিরোধী দলের রাজ্য সরকারের পিছনে লাগা, সরকার ভেঙে দেওয়া, কাজে বাধা সৃষ্টি — সবই শুরু হয়েছে সেই বাজপেয়ীর দুর্গা ইন্দিরার আমলে। বরাবর কেন্দ্রের দাদাগিরি নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন বামপন্থীরা। তাঁরা রাজ্যগুলোকে আরো ক্ষমতা দিতে এমনকি সংবিধান সংশোধন চাইতেন, ৩৫৬ ধারার বিলোপ চাইতেন। এ সবের জন্য বাঙালির দৈনিক বেদ যারপরনাই গালাগাল দিয়েছে বামেদের। বলেছে এরা কাজ করতে চায় না বলে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে আঙুল তোলে।

একবার তো এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমকিই দিয়েছিলেন যে তাঁর দল লোকসভায় ৩.৫৬% ভোট পেয়েছে, তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ জারি করিয়ে দেবেন। নামটা গুগল করলে পেয়ে যাবেন। শেষ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তিনিই আবার বলেছিলেন পি এম টু ডি এম কাজ হওয়া উচিৎ, রাজ্য সরকারকে মানব না।

এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু কোন দুষ্কর্মই আগে অন্য লোক করেছে বলে বৈধ হয়ে যায় না। ফলত কেন্দ্রীয় সরকারের এই “চালুনি বলে ছুঁচ, তোর পিছে কেন ছ্যাঁদা” মার্কা তৎপরতাকে কোন যুক্তিতেই মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। “এই সময়ে রাজনীতি করবেন না” কথাটাও নেহাত খিল্লি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বরাবর দেখা যায় রাজনীতিকে ভাইরাসের মত পরিহার করতে বলে তারাই যারা ক্ষমতাশালী, কারণ রাজনীতি বন্ধ করতে পারলে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। কেন্দ্র, রাজ্য উভয় সরকারের ব্যবহারই তা প্রমাণ করে। রাজ্যের ব্যবহার নিয়ে না হয় আরেকদিন কথা হবে। পিঠটাও তো বাঁচাতে হবে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ

যার মেডিক্লেম করার ক্ষমতা আছে, সে ভাল চিকিৎসা পাবে। যার নেই তার জন্য তো পূতিগন্ধময় সরকারী হাসপাতাল রইল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কখনো ঘটেনি এমন অন্তত দুটো ঘটনা কোভিড-১৯ ঘটিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। প্রথমত, অলিম্পিক এক বছর পিছিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, লন্ডনের অল ইংল্যান্ড ক্লাবের বার্ষিক টেনিস প্রতিযোগিতা, যা সবাই উইম্বলডন নামে চেনে, সেটাও এ বছরের মত বাতিল হয়ে গেছে। প্রাণহানির হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে থাকলেও ব্যাপ্তিতে নতুন কোরোনাভাইরাস দুটো বিশ্বযুদ্ধকেই ছাড়িয়ে গেছে। ওসেনিয়াও বাদ পড়েনি। ঠিক কত মানুষের জীবিকা কোরোনার বলি হবে তা এখনো অনিশ্চিত, তবে গরীব মানুষের ক্ষতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যা এবং আজ পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতির সাপেক্ষে হিসাব করলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ত এখনই আশি বছর আগেকার ক্ষতিকে অতিক্রম করেছে।

আমাদের দাদু-দিদিমাদের প্রজন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাপ অনুভব করেছিলেন। বোমাতঙ্কে এক সময় কলকাতা ছেড়ে দূর গ্রামে মফস্বলে পালিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভারত ভূখণ্ডে যুদ্ধ এসে না পৌঁছালেও পরাধীন দেশের শস্য উইনস্টন চার্চিলের বদান্যতায় ব্রিটিশ সৈন্যদের পেট ভরাতে চলে গিয়েছিল। কলকাতার রাস্তায় মানুষ ভাত নয়, ফ্যান চেয়ে বেড়িয়েছে, ভদ্র ঘরের মেয়ে বউদের ভাতের জন্য বেশ্যাবৃত্তি করতে হয়েছে (যৌনকর্মী শব্দটা তখনকার কোন লেখায় পাইনি, সম্ভবত যাদের কথা বলছি তারাও খুশি হত না এই শব্দ ব্যবহার করলে)। সেই সময় গ্রাম থেকে আসা অভুক্তদের মধ্যে সলিল চৌধুরীর চোখ রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলিকে দেখতে পেয়েছে। “দুটি শীর্ণ বাহু তুলে / ও সে ক্ষুধায় জ্বলে / অন্ন মেগে মেগে ফেরে প্রাসাদ পানে চেয়ে। / কে জানে হায় কোথায় বা ঘর / কী নাম কালো মেয়ে! হয়ত বা সেই ময়নাপাড়ার মাঠের কালো মেয়ে।”

সেই যুদ্ধের পর অনেক কিছু বদলেছিল। উপনিবেশ বজায় রাখা ধনী দেশগুলোর আর পড়তায় পোষাচ্ছিল না। তাই বিংশ শতাব্দী হয়ে গিয়েছিল মুক্তির দশক — সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্তির।

সাম্রাজ্য না হয় ছাড়া গেল, তা বলে কি রাশ ছেড়ে দেওয়া যায় পুরোপুরি? হরণ করতে না পারলে কি প্রাচুর্য বজায় রাখা যায়? তাছাড়া যাদের উপনিবেশ ছিল না তাদের বুঝি সাম্রাজ্যের সাধ হয় না, প্রাচুর্যের দরকার হয় না? সে প্রাচুর্য বজায় রাখতে মহাযুদ্ধের পরের প্রায় পঞ্চাশ বছর বেশ বেগ পেতে হয়েছিল পুরনো, নতুন দাদাদের। কারণ নতুন যে কায়দাটা, মানে কেনা আর বেচাই যে মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য ও মোক্ষ, তা অর্ধেক পৃথিবীকে বোঝানোই যাচ্ছিল না। কেবল ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কথা বলছি না। সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর অনেকেই তো তখন অর্থনীতিতে বাম দিক ঘেঁষে হাঁটছিল। ভারতের মত বিরাট দেশও। “যত খাই তত চাই বাপি চানাচুর” তত্ত্ব অর্ধেক বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি, মানুষকে ক্রেতাদাস বানিয়ে বিক্রেতারাজ কায়েম করা যায়নি। সেটা করা গেল গত শতকের শেষ দশকে এসে। ভোগবাদ শেষ অবধি বিশ্বায়িত হতে পারল আর বেলাগাম ভোগে আমরা পেলাম এই দুর্ভোগ — তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে এক পক্ষে প্রকৃতি, অন্য পক্ষে নিরস্ত্র সরকার। আর সাধারণ মানুষ? উলুখাগড়া।

এতদ্বারা কোরোনা কী থেকে হয় তা আবিষ্কার করে ফেলেছি বলে দাবী করছি না, যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বলছি মাত্র। যুদ্ধই যে চলছে তা নিয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই বলেছে “global pandemic” অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী অতিমারী। রোগটা কিভাবে হচ্ছে, কী কী উপায়ে ছড়াচ্ছে তাও শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত নয় প্রাদুর্ভাবের এতদিন পরেও, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার কবে হবে তাও এখনো অনিশ্চিত। তাই বলছি এ যুদ্ধে এক পক্ষে প্রকৃতি।

অন্য পক্ষে নিরস্ত্র সরকার কেন বলছি? কারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অস্ত্র হল শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি। সৈনিক হলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু মহাশক্তিধর দেশগুলোর অধিকাংশের আছে কেবল পরমাণু বোমা, মিসাইল, যুদ্ধজাহাজ, বিশাল স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী আর নৌবাহিনী। মশা মারতে কামান দাগলে কোন লাভ হয়? ম্যালেরিয়ার সময় যদি কামান দাগেন তাহলে রোগী মরবে, মশা নয়। কি চমৎকার ব্যাপার হত বলুন তো, যদি কোভিড-১৯ পাকিস্তান হত? এক্ষুণি মেঘে মেঘে গোটা কতক স্টেলদ বম্বার হানা দিলেই এই দিনের পর দিন ঘরবন্দী থাকার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। সারা পৃথিবীতে এখন যত পারমাণবিক অস্ত্র মজুত আছে তা একসঙ্গে বিস্ফোরিত হলেও কোরোনার ক থাকবে না। কারণ মানুষ দূরের কথা, গ্রহটাই থাকবে না হয়ত। মাথা না থাকলে আর কিসের মাথা ব্যথা? আমাদের সরকারগুলোর অস্ত্র যা আছে তা আসলে এইরকম। তাই নিরস্ত্র।

কিন্তু কেন নিরস্ত্র? কারণ সরকারগুলো এ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়নি। কেন নেয়নি? কারণ প্রয়োজন বোধ করেনি। কেন করেনি? কারণ ওটা সরকারের কাজ নয়। সরকারের কাজ তবে কোনটা? যুদ্ধ করা। তার প্রস্তুতি নিতেই সরকার ব্যস্ত ছিল। ভারতের সাথে তার প্রতিবেশীদের শেষ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১ এ। বাংলাদেশ, বার্মা, নেপালের মত অতি ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর সাথে সুদূর ভবিষ্যতেও যুদ্ধের কোন সম্ভাবনা নেই। উঠতে বসতে যার সাথে অশান্তি, সেই পাকিস্তান খেতে পায় না তো যুদ্ধ করবে কী? পারবে না জানে বলেই প্রক্সি ওয়ার চালায়। সেই প্রক্সি ওয়ারে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ কোন কাজে লাগে না, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানেরও সচরাচর প্রয়োজন পড়ে না। বাকি রইল চীন। ভারত তার পণ্যের বিরাট বাজার। যুদ্ধ লাগলে তার নিজেরই ব্যবসার ক্ষতি। এরকম প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, আর স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমেছে। ২০২০-২১ এর বাজেটে প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ হয়েছে ৩.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যের জন্য ৬৯,২৩৪ কোটি টাকা। তবু দেখবেন বিজ্ঞ ব্যক্তিরা লিখে এবং বলে হা হুতাশ করেন “আহা, অমুক প্লেনটা কেনা হল না! তমুক কামান মান্ধাতার আমলের হয়ে রয়েছে। অমুকে এগিয়ে গেল, তমুকে টেক্কা দিয়ে দিল।” শুধু বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই বা কেন? আমরাও তো করি। কাউকে শুনেছেন বলতে “আহা, কতদিন একটা নতুন সরকারী হাসপাতাল হয়নি! অমুক ওষুধটার দাম যে কেন সরকার কমাতে পারে না! তমুক যন্ত্রটা কলকাতার সব হাসপাতালে কেন নেই?” কেউ এসব বলে না, কারণ সবাই জানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের নয়। যুদ্ধ করার দায়িত্ব সরকারের।

চিকিৎসা করার দায়িত্ব তবে কার? আমরা সবাই জানি। ঝাঁ চকচকে বেসরকারী হাসপাতালের। ওষুধ বানানো এবং বেচার দায়িত্ব বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির। ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যবস্থা। যেমনটা “উন্নত” দেশে হয় আর কি। ওটাই তো সর্বোত্তম ব্যবস্থা, তাই না? আমরা তো তেমনটাই শিখেছি সেই নব্বইয়ের দশক থেকে। অন্য যে বিকল্প ছিল, মানে সরকার নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা — সেটা যে সেকেলে, সেটা যে ফালতু সে ব্যাপারে তো আমরা নিশ্চিত। সরকারী হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যবস্থাই হল সঠিক ব্যবস্থা। হাসপাতাল হবে পাঁচ তারা হোটেলের মত। সেখানকার কর্মচারীরা হবে সুবেশী হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়া রিসেপশনিস্টদের মত। আর ডাক্তারবাবু অনেক টাকা পারিশ্রমিক নেবেন। তবে না চিকিৎসা? যদি বলেন কড়ির ব্যবস্থা করবে কে? কেন, ইনসিওরেন্স কোম্পানি? বছর বছর কয়েক হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে গোটা পরিবারের মেডিক্লেম করিয়েছি তো। যার মেডিক্লেম করার ক্ষমতা আছে, সে ভাল চিকিৎসা পাবে। যার নেই তার জন্য তো পূতিগন্ধময় সরকারী হাসপাতাল রইল। উন্নত ব্যবস্থা মানেই তো এই বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, তাই না?
এতদিন চলছিল বেশ। শুধু আমাদের দেশে নয়, যে দেশগুলো আমাদের বিকল্প ভুলিয়ে এসব ধরিয়েছে সেখানেও দিব্যি চলছিল ব্যবস্থাটা। যার পকেটে মেডিক্লেম আছে সে খুশি, ডাক্তার খুশি, হাসপাতাল মালিকরা খুশি, ওষুধ কোম্পানি খুশি। আমাদের দেশে তবু যত নষ্টের গোড়া, সমাজবাদের প্রতি দুর্বলতা থাকা জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে তৈরি সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ অনেক গরীব মানুষের যেমন তেমন দেখভাল চালাচ্ছিল। অনেক উন্নত দেশে, যেমন আমাদের স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, রেস্ত না থাকলে অসুস্থ হওয়া মানা। মধ্যে বারাক ওবামা উল্টো গাইলেন, সে কথা বড় একটা পছন্দ হল না কারোর। কী করে হবে? সরকারী মানে ফালতু এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সরকারের কাজ নয় — এসব আমরা তো মোটে তিরিশ বছর হল শিখেছি, আমেরিকানরা সেই কবে থেকে শুনে আসছে। আর সকলকে শিখিয়েছেও। আজ হঠাৎ নতুন কথা শুনলে মনে হবে না ব্যাটা বুদ্ধির ঢেঁকি? ওবামার কথা শুনে যত লোক মুখ বেঁকিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি লোক বার্নি স্যান্ডার্সের কথা মন দিয়ে শুনছিল। তবু বার্নির গায়ে কেন কমুনিস্ট গন্ধ? এই প্রশ্নে দ্বিধায় ছিল। মানে সব দেশের পয়সাওয়ালা লোকই তো আমার আপনার মতই। যার পকেটে পয়সা নেই তাকে নিয়ে ভাবতে আমাদের বয়েই গেছে।

হেনকালে গগনেতে উঠিলেন কোরোনা।

ফল কী? ফেলো কড়ি মাখো তেলের দেশ যুক্তরাষ্ট্র এক কথায় ল্যাজে গোবরে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে পাত্তাই দেননি, বলেছিলেন ঐ দু চারটে হয়েছে আর কি, তাও চীনের চক্রান্তে। শিগগির শূন্যে নেমে আসবে। তারপর যখন রোগী বাড়তে থাকল তখনো বলছিলেন লকডাউন আবার কী? ওভাবে দেশ চলে? তারপর এখন, যখন চার লক্ষের বেশি আক্রান্ত নিয়ে তাঁর দেশ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দখল করে ফেলেছে, প্রায় তেরো হাজার মানুষ মৃত, তখন তিনি চীন আর হু কে দোষ দিচ্ছেন। ওদিকে ভেন্টিলেটর কোন রাজ্যে কতগুলো যাবে তা নিয়ে নিলাম চলছে। মানে বুঝলেন তো? আপনার স্বপ্নের দেশে, উন্নত ব্যবস্থায় মানুষের জীবন নিলামে কেনা বেচা হচ্ছে। এত অস্ত্র বানায় অত বড় দেশটা, সারা পৃথিবীতে বিক্রি করে, এত উন্নত মোবাইল কম্পিউটার ট্যাব নানাবিধ সফটওয়্যার আবিষ্কার করে, কে এফ সি, কোকা-কোলা, স্টারবাকস — উদ্ভাবনের স্বর্গরাজ্য একেবারে। অথচ যথেষ্ট ভেন্টিলেটর বানিয়ে উঠতে পারেনি। ভেন্টিলেটর তো অনেক বড় কথা, সামান্য অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া ড্রাগের জন্য পর্যন্ত ভারতকে ধমকাতে হচ্ছে। এই আপনাদের উন্নত দেশ, উন্নত ব্যবস্থা। কড়ি ফেললেও তেল দিতে পারছে না।

হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামে এই যে ওষুধ, যার জন্য ট্রাম্প মোদীকে দিলেন এক ধমক আর মোদী সুড়সুড় করে রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন, তেমন ওষুধ উৎপাদনের উপযুক্ত জায়গা হল ভারতের সরকারী ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলো। ভারতে ওষুধ তৈরির ৭০% কাঁচামাল আমদানি হয় চীন থেকে। ২০১৫ তে ভারত সরকার নিযুক্ত কাটোচ কমিটি বলেছিল সরকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে এই জায়গাটাতে ভারত অনায়াসেই স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ভারত সরকার, মানে মোদীর সরকার, কী করলেন? না ঐ সংস্থাগুলোকে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে কলকাতার বেঙ্গল কেমিক্যালও। যদিও কলকাতা হাইকোর্ট বেঙ্গল কেমিক্যাল বিক্রির সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিয়েছেন। তাহলে ভাবুন, যে সরকারী সংস্থা আমাদের জীবনদায়ী ওষুধ তৈরি করতে পারে তাকে বেচে দিতে সরকার উৎসাহী কেন? কারণ ঐ যে, ওষুধ যোগানো সরকারের কাজ নয়।

বিরক্ত হচ্ছেন? এক কথা বারবার পড়ে রেগে যাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করছেন কে ঠিক করল ওষুধ যোগানো সরকারের কাজ নয়, চিকিৎসা দেওয়া সরকারের কাজ নয়? আপনিই ঠিক করেছেন। যদি এতে খুব দাগা লাগে তাহলে বলা যায় আপনাকে দিয়ে ঠিক করানো হয়েছে। কে ঠিক করিয়েছে? সরকার নিজেই। একবার মনে করে দেখুন নব্বইয়ের দশক। মনমোহনী অর্থনীতি মনে আছে? তখন থেকেই তো কাগজে, টিভিতে, পত্রিকায় সর্বত্র জেনেছেন রাষ্ট্রের দিন শেষ। কেউ চীন বললে, কিউবা বললে, ভিয়েতনাম বললে বলেছেন “আরে ওসব রিজেক্টেড সিস্টেম। ওসব উঠে গেল দেখলেন না?” কারণ তার আগের কয়েক বছরে প্রণয় রায়ের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ এ বার্লিনের দেওয়াল ভাঙতে দেখেছেন, দ্যুমায় আগুন জ্বলতে দেখেছেন। আপনি ঠিক দেখেছেন এবং ভুল বুঝেছেন। আপনি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন দেখেছেন আর বাজার অর্থনীতির খুড়োর কল দেখেছেন। আপনি জানতে পারেননি যে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেবল ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ছিল না। আপনাকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর কথা বলা হয়নি, আপনাকে ব্রিটেনের এন এইচ এসের কথা বলা হয়নি, আপনাকে এখনো সিঙ্গাপুরের কথাও বড় একটা বলা হয়নি।

কেবল এভাবেই যে আপনাকে বোঝানো হয়েছে যা কেনা যায় তা-ই ভাল আর সরকারী মানেই ফালতু তা-ও নয়। সরকার নিজে আপনাকে সরকারী ব্যবস্থা থেকে দূরে ঠেলেছে। আমার জন্ম আশির দশকের গোড়ায়, আমার বোনের জন্ম ১৯৯০ তে। তখনো ভারত বাজার অর্থনীতির দেশ হয়নি, মেডিক্লেম কারোর অভিধানে ছিল না। আমার বাবা স্কুল শিক্ষক। আমার জন্মের সময়ে না হলেও, বোনের জন্মকালে মন্দ মাইনে পেতেন না। আমরা দুজনেই জন্মেছি সরকারী হাসপাতালে। তখনো সেগুলোর চেহারা আজকের আমরি, অ্যাপোলো বা ফর্টিসের মত ছিল না। কিন্তু সামর্থ্য থাকলে ওখানে যাব না এমন মনে হত না, হলে বাবা আমার মাকে নিয়ে যেতেন না। অথচ ২০১১ সালে আমার মেয়ের জন্ম হল বেসরকারী নার্সিংহোমে। কারণ আমি আমার স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ভার সরকারের উপর ছাড়তে ভরসা পেলাম না। ভরসার জায়গাটা সরকার নিজেই নষ্ট করে দিয়েছে তার আগের কুড়ি বছরে। সব দলের সরকারই। সরকার নিজেই ছিদ্র করেছে লৌহ বাসরে, আর সেই ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়েছে বেসরকারীকরণের কালনাগিনীকে। কারণ সরকার চায় না মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে।

কেন চায় না? সরকার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে না, শিক্ষার ব্যবস্থা করবে না, তাহলে করবে কী? দুটো কাজ করবে। এক, পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করবে। মানে রাস্তাঘাট, বিমানবন্দর ইত্যাদি। দুই, যুদ্ধ করবে। নব্বইয়ের দশকে নতুন চিন্তা ছিল এটাই। কেন চিন্তাবিদরা সরকারকে এই কাজ দুটোয় বেঁধে দিলেন?

ভেবে দেখুন, সরকার নিজে রাস্তাঘাট বানাতে পারে না। কোন ব্যবসায়ীকে বরাত দিতে হবে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিমানবন্দর — সবেতেই তাই। তাহলে বেশ কিছু বড়লোকের আরো বড়লোক হওয়ার ব্যবস্থা হল। যত বড়, যত গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো, তত বেশি মুনাফা, তত বড়লোক হওয়ার ব্যবস্থা। তাছাড়া কেবল স্বাস্থ্য বেসরকারী হলে ভাল তা তো নয়, সবই বেসরকারী হলে ভাল বলা হয়েছে। তাই পরিবহন বেসরকারী, শিক্ষা বেসরকারী, যা যা মানুষের জীবনে দরকারী তার সবই বেসরকারী। অর্থাৎ আসল কথা হল ব্যবসা। মানুষের জন্য অর্থনীতি নয়, ব্যবসার জন্য অর্থনীতি। আর যেহেতু অর্থনীতিই অন্য সব নীতিকে চালায় তাই তখন থেকে রাজনীতিও ব্যবসার জন্য, স্বাস্থ্য নীতিও ব্যবসার জন্য। আর সবচেয়ে অর্থকরী ব্যবসা হল অস্ত্র ব্যবসা। তাই যুদ্ধ করার অধিকারটা সরকারকে দেওয়া হল। যুদ্ধ হোক আর না-ই হোক, সরকারকে অস্ত্র কিনতেই হবে। না কিনলে ধনকুবেররা আরো ধনী হবে কী করে?

সুতরাং আপনার পকেটে কড়ি থাকায় যে ব্যবস্থাকে আপনি ভেবেছিলেন ফেলো কড়ি মাখো তেল, সেটার আসল নাম হল এলোমেলো করে দে মা লুটে পুটে খাই। মনে রাখবেন যে ধনীরা এই ব্যবস্থা চালায় সাক্ষীগোপাল সরকারগুলোকে দিয়ে, তাদের খাঁই অপরিসীম। আপনি যে ধার করে গাড়ি কিনে বা বিদেশ ঘুরে এসে ভাবেন “দেশের উন্নতি হয়েছে। আমার বাবা-মা তো এমন পারত না,” তাও ওদেরই বদান্যতায়। আপনি খরচ না করলে ওদের মুনাফা হয় না বলে। মুনাফাই মোক্ষ। আপনি যে কোম্পানির চাকুরে সে কোম্পানির মুনাফা গত বছরের চেয়ে এ বছর না বাড়লে আপনার চাকরিটি নট হয়ে যাবে, আপনি ফাঁকিবাজ না পরিশ্রমী তা অপ্রাসঙ্গিক। হাড়ে হাড়ে টের পাবেন বেসরকারী সংস্থা মানে মোটেই মেধাতন্ত্র (meritocracy) নয়, মুনাফাতন্ত্র (profitocracy)।

এখন কথা হচ্ছে এই মুনাফাতন্ত্রকে যদি ভাল বলেন, তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার মত হওয়াই ভাল। সরকার যদি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করে, তাহলে বেসরকারী হাসপাতালে যাবে কে? তাদের মুনাফা হবে কোথা থেকে? ভেন্টিলেটর নিলাম হওয়াও কিন্তু ভাল। ক্রয় বিক্রয়ের স্বাধীনতা। ফেলো কড়ি মাখো তেল। বুঝলেন কিনা?

মুনাফাতন্ত্র কিন্তু প্রকৃতির ধার ধারে না। বিশ্ব উষ্ণায়নকে বলে বামপন্থী কন্সপিরেসি থিওরি। কারণ উষ্ণায়ন হচ্ছে বলে মেনে নিলেই ফসিলজাত জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। তেল কোম্পানির লোকসান হবে না? পকেটে পয়সা থাকলেই আজকাল এ সি লাগিয়ে ফেলা যায়। সত্যি সত্যি ক্লোরোফ্লুওকার্বনের ব্যবহার কমাতে গেলে কী হবে এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবসার? প্লাস্টিক দুনিয়ার ক্ষতি করছে মানলে বিশ্বজোড়া প্লাস্টিক ব্যবসার বারোটা বাজবে। বাহুল্যকে প্রয়োজনে পরিণত করা গেছে কত দিনের চেষ্টায়, এখন উল্টো পথে হাঁটলে কী হবে মুনাফার গতি? অতএব যেমন চলছে চলুক। চালাতে গিয়ে হিমবাহগুলো তো বটেই, চিরতুষার (permafrost), মানে পৃথিবীর যেসব জায়গার বরফ সেই তুষার যুগ থেকে আজ পর্যন্ত গলেনি, তাও গলে যাচ্ছে। কত মহামারী অতিমারীর জীবাণু যে সেই বরফে জমেছিল কে-ই বা বলতে পারে? কাকলাস মেরুভালুকের ছবি মুনাফাবাদীদের মন গলাতে পারেনি, এখন দুনিয়াসুদ্ধ লোক থাকো ঘরে বন্দী। সব ব্যবসার সাড়ে সর্বনাশ, মুনাফাতন্ত্র ছাপিয়ে মন্দাতন্ত্র এসে পড়ল।

তাহলে বিশ্বযুদ্ধটা দাঁড়াল মুনাফাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকৃতির। ওয়ার্ল্ডোমিটার বলে যে সাইটটা গত কয়েক দিনে জনপ্রিয় হয়েছে, সেখানে গিয়ে কোরোনা আক্রান্ত দেশের নামগুলো ভাল করে দেখুন। যেসব দেশের সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মনোযোগ আছে, মানে মুনাফাতন্ত্র জোরালো নয়, সেসব দেশে রোগটার দাপট কম। ভিয়েতনাম খুঁজে দেখুন, কিউবা খুঁজে দেখুন। “রিজেক্টেড সিস্টেম” গুলোর অবস্থা একবার দেখলেনই না হয়। জার্মানি আবার রিজেক্টেড সিস্টেমেও চলে না, তবু সে সামলে নিয়েছে। কারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভাল। সামলে নিচ্ছে ফ্রান্সও। স্পেনের সরকার আবার কী করেছে দেখেছেন তো? বেসরকারী হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ করেছে। ভাবুন তো, আপনি ই এম বাইপাসের ধারে একটা ঝাঁ চকচকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, অথচ মেডিক্লেমে সবটা কভার হবে কিনা ভেবে রক্তচাপ বাড়ছে না!

এবার চীনা ফ্রন্টে একটা আক্রমণ হবে বুঝতে পারছি৷ প্রশ্ন উঠবে সবই যদি মুনাফাতন্ত্রের দোষ, তবে চীনে এমন কেলেঙ্কারির ব্যাখ্যা কী? উত্তরটা নেহাত সোজা। যতই চতুর্দিকে মাওয়ের ছবি থাক আর লাল পতাকায় ছেয়ে থাক পথ ঘাট, বর্তমান চীনের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক নেহরুর সমাজবাদের সাথে নরসিমা রাওয়ের কংগ্রেসের চেয়েও ক্ষীণ। কাস্তে হাতুড়ি চীনের শালগ্রাম শিলা মাত্র। সারা পৃথিবীতে ব্যবসা করতে চীনের আগ্রহ ট্রাম্পের দেশের চেয়ে কিছু কম নয়। ট্রাম্প যদি বলেন “মেরে পাস গেটস হ্যায়, জোবস হ্যায়, ব্রনসন হ্যায়। তুমহারে পাস কেয়া হ্যায়, কেয়া হ্যায় তুমহারে পাস?” জিনপিং সগর্বে বলবেন “মেরে পাস মা হ্যায়। জ্যাক মা।” চীনের মুনাফাতন্ত্র হয়ত আরো নির্মম কারণ সেখানে সরকারকে প্রকাশ্যে গাল দেওয়ার উপায় নেই। তাই এমন মহামারী হতে পারল। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, চীন তবুও বেশ তাড়াতাড়ি সামলে নিল। তার পেছনেও সেই সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবদান।

এই বিশ্বযুদ্ধে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে লড়ছেন, নিরস্ত্র অনন্যোপায় সেনাপ্রধানরা সেভাবেই লড়েন। একশো তিরিশ কোটি লোকের দেশে যথেষ্ট ডাক্তার নেই, নার্স নেই, হাসপাতাল নেই। তাহলে আপনি কী করবেন? প্রার্থনা করবেন। উনি বারবার ঠিক সেটাই করতে বলছেন আমাদের। ঈশ্বর যদি কোরোনাটা সামলে দিতে পারেন, তাহলে পাকিস্তানকে উনি একাই দেখে নেবেন। অতএব আপনারা তেড়ে প্রার্থনা করুন। মসজিদ ছাড়া সব জায়গায় প্রার্থনা করতে পারেন।

বাবুসোনা সংস্কৃতি

আমরা বাঙালিরা তো প্রগতিশীল, তাই হয়ত আমাদের ছেলেটি কোরোনাকে “জানিস আমার মা কে” বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল

আশির দশকে বাবা-মায়ের সাথে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যেতাম। আমি তখনো প্রাথমিকে, সে কলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলের উঁচু ক্লাসে প্রথম সারির ছাত্র। তার ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বরের গর্বে তার বাবা-মা তো বটেই, প্রতিফলিত গৌরবে আমাদের অন্য আত্মীয়স্বজনদেরও মাটিতে পা পড়ে না। তাদের বাড়ি গেলে কিন্তু বোঝা যেত তার বাবা-মা গৌরবে বহুবচন চান না মোটেই। যত নিকটাত্মীয়ই আসুক, সে পড়ার টেবিল ছেড়ে নড়ত না। তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলেটিকে আমার মনে হত পঞ্চাশোর্ধ্বের মত রাশভারী। এমন নয় যে এই রুটিন কেবল পরীক্ষার আশেপাশে। বারো মাস সে এভাবেই চলত। স্বভাবতই আমার মত শৈশব পার না হওয়া আত্মীয়দের কাছে বড়রা ঐ ছেলেটিকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে হাজির করতেন। বড়রা বারবার শোনাতেন “ওর মত হওয়ার চেষ্টা করো। দেখেছ কেমন লেখাপড়ায় মন? বাড়িতে যে-ই আসুক, ঝড় উঠুক, বন্যা হয়ে যাক, ও কিন্তু পড়া ছেড়ে ওঠে না।”

বড় পরীক্ষাগুলোতে ভাল নম্বর এবং শিক্ষান্তে মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া যদি মানুষ হওয়ার মাপকাঠি হয় তাহলে বলা দরকার যে ছেলেটি সত্যিই মানুষ হয়েছে। আমি নিশ্চিত এই পথে হেঁটে এরকম মানুষ হওয়া মানুষ আমরা সকলেই কাঁড়ি কাঁড়ি দেখেছি গত ৩০-৪০ বছরে, এখনো দেখছি। প্রশ্ন হল সফল মানুষ আর ভাল মানুষ কি একই? ভাল মানুষ মানেই বা কী? যে মন দিয়ে রোজগার করে সংসার চালায় তার বাকি সমাজের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা না থাকলে, চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন হলেও কি তাকে ভাল মানুষ বলা যায়?

এই প্রশ্নগুলো কদিন আগে করলেও হাঁ হাঁ করে উঠতেন অনেক ভদ্রজন, বাকিরা পাত্তা দিতেন না। কিন্তু রোগ বড় বালাই, বিশেষত অতিমারী। গত দুদিন ধরে যেভাবে সকলে একটি অক্সফোর্ডের ছাত্র এবং তার বাবা-মাকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অভিযুক্ত করছেন তা দেখে অপ্রিয় প্রশ্নগুলো তোলার ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললাম।

নিজের কাছে সৎ থাকতে হলে মানতেই হবে এই প্রশ্নগুলো গত সাড়ে তিন দশক আমরা একেবারেই নিজেদের করিনি, অন্যদেরও করিনি। এগুলো অবান্তর হয়ে গেছে। ছোট থেকেই শিখে গেছি যে আমি মানুষ হয়েছি কিনা তার প্রমাণ হল আমি কোন পেশায় আছি এবং কত রোজগার করি। অতএব আমার ক্লাসের যে ফার্স্ট বয় পরে তত ভাল রেজাল্ট করতে না পেরে এখন সামান্য ব্যাঙ্ককর্মী, তার চেয়ে বেশি মানুষ হয়েছে থার্ড বয়। কারণ সে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে। এমন নয় যে কেবল অন্যরাই এভাবে ভাবে। ফার্স্ট বয় নিজেও ভাবে “আমার দ্বারা কিস্যু হল না। ও শালা স্কুলে কোনোদিন আমাকে ছুঁতে পারত না, কপাল জোরে কোথায় উঠে গেল!”

আমাদের প্রজন্ম এভাবেই ভাবতে শিখেছে এবং আমরা বাবা-মা হয়েও আমাদের নার্সারি স্কুলে যেতে শুরু করা ছেলেমেয়েদের এভাবেই ভাবতে শেখাচ্ছি। লক্ষ্য করুন, এই চিন্তার সমস্তটা জুড়েই আমি, কোথাও আমরা নেই। বন্ধুর সাফল্যে আনন্দ পাওয়া নেই, বন্ধুর ব্যর্থতায় কষ্ট পাওয়া নেই। দু-তিন প্রজন্ম ধরে এহেন স্বার্থপরতার কৃষিকাজ চালালে যেমন ফসল ফলে আমাদের বিলেত ফেরত বাবুসোনা ভাইটি তাই — তার বেশি কিচ্ছু নয়। আর তার বাবা-মা যে অপরাধ করেছেন তা শুরু হয়েছে তার ছোটবেলায়। সেই একই অপরাধ আমাদের অনেকের বাবা-মাই করেছেন। এমন করে গায়ে লাগেনি বলে সমাজ সেটাকে অপরাধ বলে চিহ্নিতই করেনি এতদিন। ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে কেবল শিখেছে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারলেই তার কাজ শেষ। দুনিয়ার কারোর প্রতি তার কোনো কর্তব্য নেই। ওই যে আমার আত্মীয় সম্পর্কে বড়রা বলতেন “বাড়িতে যে-ই আসুক, ঝড় উঠুক, বন্যা হয়ে যাক” ইত্যাদি। অর্থাৎ ঝড়ে তোমার প্রতিবেশীর ঘরের চাল উড়ে গিয়ে সে নিরাশ্রয় হয়ে যাক, তুমি বাবা-মায়ের বানিয়ে দেওয়া পড়ার ঘরে মোটা মাইনের চাকুরে হওয়ার প্রস্তুতি চালিয়ে যাও। বন্যায় তোমার আত্মীয়ের ঘর ভেসে যাক, তোমার দু ফোঁটা চোখের জল ফেলারও দরকার নেই, তুমি কেশব নাগের অঙ্কগুলো শেষ করো। ভাগ্যিস কেশবচন্দ্র নাগের অঙ্ক বইই কিনে দেওয়া হত আমাদের, তাঁর কষ্ট করে লেখাপড়া করার ইতিহাস পড়ানো হত না। অবশ্য হলেই বা কী হত? আমরা মুখস্থ করতাম আর পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে ভুলে যেতাম। যেমনটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে করেছি।

তা এইভাবে যে বাবুসোনাদের তৈরি করা হচ্ছে, কী করে আমরা আশা করছি যে তারা নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ ফুর্তির বাইরে কিছু ভাববে? গায়ে যখন জ্বর নেই, গলায় ব্যথা নেই, কাশি হচ্ছে না, তখন বাবুসোনা কেন মায়ের অফিসে কলার তুলে ঘুরতে যাবে না? কেন গিয়ে লাইন দেবে হাসপাতালে? তা-ও আবার সরকারি হাসপাতালে? ওসব হাসপাতাল তো তার বাড়ির কাজের মাসির জন্যে। আর মা-ই বা কেন ছেলেকে আদর করে অফিসে, মলে, ক্লাবে ঘোরাবেন না? কজনের ছেলে অক্সফোর্ডে পড়তে যায়? চুলোয় যাক জনস্বাস্থ্য, চুলোয় যাক সাবধানতা।

খুব খারাপ লাগছে তো কথাগুলো? বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে তো? তাহলে বলি। আমি যে স্কুলের ছাত্র, সেই স্কুলের আন্তঃক্লাস ফুটবল প্রতিযোগিতা হয় প্রয়াত মাস্টারমশাই পাঁচুগোপালবাবুর নামে। তাঁকে আমরা পাইনি। আমাদের ইংরিজির মাস্টারমশাই সোমনাথবাবু একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন “পাঁচুবাবু যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন, তখন হাসপাতালে রাত জেগেছিল আমাদের খারাপ ছাত্ররা, ভাল ছাত্ররা নয়।”

আমাদের সময় থেকেই এমন হয়। কারণ বাবা-মা শেখান পড়াশোনা করা এত বিশাল একটা কাজ যে ওটা করে আর কিচ্ছু করা যায় না। কারো জন্যে হাসপাতালে রাত জাগা যায় না, বাড়িতে কেউ এলে গল্পগুজব করা যায় না, এমনকি পাঠ্যের বাইরে ভাল বই-টই পড়াও যায় না। যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, বাংলা ক্লাসে আমাদের মাস্টারমশাই সুশান্ত বসু এক ভাল ছাত্র কোনো এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের নাম শোনেনি শুনে হতাশ হয়ে বলে ফেলেছিলেন “এত বয়স হয়ে গেল ওঁর কোন লেখা পড়নি? জীবনটা কাটাবে কী করে!” কী কুক্ষণেই বলেছিলেন! হোস্টেলে ফিরে অন্য এক ভাল ছাত্র নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিল, যার মূল উপজীব্য “সাহিত্য-ফাহিত্য পড়ে নষ্ট করার মত সময় নেই। এখন সামনে হায়ার সেকেন্ডারি, তারপর জয়েন্ট। এস্ট্যাবলিশড হয়ে নিই, তারপর বই ফই পড়া যাবে।”

আমার সেই সহপাঠীরও দোষ নেই। বাবুসোনা সংস্কৃতির ওই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু পড়ার কোনো দরকার নেই, যারা পড়ে তারা ফালতু। আমার এক মেধাবী বন্ধু উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ে সাড়া জাগানো ফল করেছিল। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফল বেরোবার পর তার বাড়ি গিয়ে আমার মনে হয়েছিল কেউ মারা গেছেন। কারণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তার হাজার তিনেক র‍্যাঙ্ক হয়েছে, বাবা বলেছেন “ওর লাইফ শেষ”। এই কারণে পিটার উইর পরিচালিত ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ ছবিটা দেখলেই মনে হয় এটা এই বাংলারই গল্প।

অবশ্য আমাদের বাবুসোনা সংস্কৃতি এমন জোরদার যে জন কিটিং (যে চরিত্রে রবিন উইলিয়ামস অভিনয় করেছিলেন)-এর তুলনায় অনেক নিরামিষ কথাবার্তা বলেই আমাদের সুশান্তবাবু ছাত্রদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

অথচ বাঙালি ছেলেরা এমন বাবুসোনা চিরকাল ছিল না কিন্তু। নইলে ক্ষুদিরামকে পাওয়া যেত না, বিনয় বাদল দীনেশ হত না, নকশালবাড়ি আন্দোলন বলেও কিছু ঘটত না। সেকথা থাক, বাবুসোনাদের বিদ্রোহী বিপ্লবী হওয়ার দরকার নেই (ক্ষুদিরাম তো কবেই আমাদের ঠাট্টার পাত্র হয়ে গেছেন), একটু মানুষের মত মানুষ হলেই যথেষ্ট হয়। কিন্তু কী করে হবে? মানুষ যেমন সমাজ তৈরি করে, সমাজও তো মানুষ তৈরি করে। আমাদের সমাজ তো ক্রমশ উন্নততর বাবুসোনার কারখানা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল দেখি পাড়ার বাচ্চারা মাঠে খেলার সময় মায়েরা বসে থাকেন পাশে। পড়ে গেলে দৌড়ে আসেন, খেলতে খেলতে ছোটদের মধ্যে ঝগড়া লাগলে প্রায়শই তা মায়েদের ঝগড়ায় পরিণত হয়। অর্থাৎ শিশু ছোট থেকেই শিখছে সে কখনো ভুল করে না, সে যা চায় সেটাই তার অধিকার।

বছর দুয়েক আগে আমাদের এক প্রতিবেশী মারা গেলেন। আমাদের পাড়া থেকে শ্মশান অনেক দূরে হওয়ায় কেউ মারা গেলে ম্যাটাডোরে করে নিয়ে যাওয়া হয় সাধারণত। শ্মশানযাত্রীতে ভরে যায় সে ম্যাটাডোর, অল্পবয়সীরা থাকে বেশি সংখ্যায় — এমনটাই কৈশোর থেকে দেখে আসছি। সেবার দেখলাম ম্যাটাডোরের উপর বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে। আরো যা বিস্ময়কর, একটি বছর কুড়ির ছেলেকে বাদ দিলে শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব আমিই সর্বকনিষ্ঠ। বাবুসোনারা বোধহয় টিউশনে ব্যস্ত ছিল। আমাদের মফস্বলেই এই অবস্থা, কলকাতার খবর জানি না।

এবার প্রবল আপত্তি উঠবে। যদি শ্মশানে, হাসপাতালেই ঘুরে বেড়ায় পড়ুয়ারা, তাহলে লেখাপড়া করবে কখন? এমন আপত্তি আমাদের বাবা-মায়েরা আর আমরাই করে থাকি। তার আগের লোকেরা করতেন না। বলা হয় আগে নাকি “কম্পিটিশনের যুগ” ছিল না, তাই অন্য সবে মন দেওয়া সম্ভব ছিল। অথচ আমরা এ ধরাকে ধন্য করে দেওয়ার অনেক আগেই দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, দেশ ভাগ হয়েছে। ভদ্রসন্তানদের পর্যন্ত দুমুঠো ভাতের জন্য করতে হয়নি এমন কাজ নেই। তার চেয়ে বেশি কম্পিটিশনে আমাদের পড়তে হয়েছে কি?

লেখাটা যদি এতদূর অব্দি পড়ে ফেলে থাকেন তাহলে হয়ত খেয়াল করেছেন আমি কেবল ছেলেদের কথাই বলে যাচ্ছি, ভদ্রলোকের মেয়েদের কথা বলছি না। তার মানে এই নয় যে ভদ্রজন মেয়েদের দারুণ সামাজিক জীব তৈরি করছেন। এ যুগের আলালদের ঘরে কেবল দুলাল তৈরি হয় না, বিলক্ষণ দুলালীও হয়। সেই সোনামণিরা বাবুসোনাদের চেয়ে যে মোটেই আলাদা নয় তা-ও দেখা যাচ্ছে কয়েকজন বিলেত ফেরতের খবরে। বিলেত না যাওয়া মেমদের কোরোনার কারণে স্কুল কলেজ না থাকার সুযোগে দলবদ্ধ ফুর্তি দেখেও টের পাওয়া যাচ্ছে। তবু একে বাবুসোনা সংস্কৃতিই বলছি কারণ এই ধারাটি বাঙালি তৈরি করেছিল পুত্রসন্তানদের কথা ভেবেই। তার প্রমাণ এক-দেড় দশক আগেও বিজ্ঞান শাখায় বাঙালি মেয়ের অভাব।

বাবা-মায়েরা বলতেন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হলে জীবন বৃথা। তারপর বেশ নিঃসঙ্কোচে বলতেন “মেয়ে হলে অত চিন্তা করতাম না। কিছু না হলে বিয়ে দিয়ে দেব, মিটে যাবে।” তাই সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ বানানোর তাগিদ মেয়েদের বেলায় কম দেখা যেত। ফলত আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র তারা দুঃখ করত “তোদের আর্টসের ক্লাসগুলোতে কত মেয়ে থাকে, আমরা তিরিশটা ছেলে আর দুটো মেয়ে। প্রেম করতেও কম্পিটিশন।” কথাটা মজা করে বলা হলেও একটা বড় সত্য বেরিয়ে আসে, তা হল ছেলেরা যা হলে মানুষ হয়েছে বলে বাবা-মায়েরা মনে করতেন মেয়েদের তা না হলেও চলত। মেয়ে মাস্টারি করলেও মানুষ, ছেলে মাস্টার হলে “ফেলিওর”।

বাবুসোনা সংস্কৃতি কী দিয়েছে বাঙালিকে? সমাজ সংসার ভুলে লেখাপড়া করে কজন বাঙালি প্রযুক্তিতে আলাদা করে বলার মত অবদান রেখেছে গত তিরিশ বছরে? গত চল্লিশ বছরে কজন বাঙালি ডাক্তারকে সারা ভারত এক ডাকে চিনেছে? নাহয় অত বড় না-ই হল, স্থানীয় মানুষ নাম শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত করে এমন ডাক্তারই বা কজন হয়েছে সারা পশ্চিমবঙ্গে? উত্তরে লবডঙ্কার বেশি কিছু পাওয়া শক্ত। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সাড়া জাগানো কটা কবিতা লেখা হয়েছে বাংলায় বা কটা ফিল্ম তৈরি হয়েছে এই সময়ে সে প্রশ্ন করার কোন মানেই হয় না, কারণ ওসব লাইন যে মেধাবীদের জন্যে নয় তা তো বাবুসোনা সংস্কৃতি বলেই দিয়েছে। একই সঙ্গে ভুলিয়ে দিয়েছে যে সংস্কৃতি মানে কেবল নাচ, গান, ছবি আঁকা, নাটক করা, সাহিত্য রচনা নয়। বিজ্ঞানচর্চা, রাজনীতি — এসবও সংস্কৃতির অঙ্গ।

আসলে বিজ্ঞানচর্চা হবে কী করে? বাবুসোনা সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান পড়ার উদ্দেশ্য তো বিজ্ঞান শেখা নয়, মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া। আমার আরেক মাস্টারমশাই শাশ্বত ভট্টাচার্য যেমন একবার ক্লাসে বলেছিলেন “তোমরা বিজ্ঞান পড়ো এই কারণে নয় যে তোমরা বিজ্ঞান শিখতে চাও বা তোমরা বিজ্ঞানমনস্ক। তোমরা বিজ্ঞান পড়ো কারণ ওটা পড়লে বেশি ভাল চাকরি পাওয়া যায় বলে প্রচার আছে। যদি প্রচার থাকত কুসংস্কারে অনার্স পড়লে বেশি ভাল চাকরি পাওয়া যায়, তাহলে তোমরা কুসংস্কারেই অনার্স পড়তে।” কথাটা যে নেহাত অন্যায় বলেননি তা সেদিনের যে বাবুসোনারা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন সোশাল মিডিয়ায় দক্ষিণপন্থী ভুয়ো খবরের সপক্ষে গলা ফাটায় তাদের দেখলেই পরিষ্কার হয়।

আর রাজনীতি? ওরে বাবা! লেখাপড়া করে হাসপাতালে অসুস্থ লোককে দেখতেই যাওয়া যায় না, আবার রাজনীতি করা যাবে কী করে? করা যে যায় তার কিন্তু অনেক প্রমাণ আছে।

উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (বাবুসোনাদের বাবা-মায়েদের প্রিয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র) সিপিআইএমএল লিবারেশনের সর্বক্ষণের কর্মী হয়েছেন, সর্বভারতীয় সম্পাদক হয়েছেন। সিপিএমের সর্বভারতীয় সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও সিবিএসইর সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। অবশ্য বাবুসোনাদের বাবা-মায়ের বিচারে দুজনেই “ফেলিওর”। টাকা, গাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি — কিছুই করে উঠতে পারেননি। তবে সে বিচারে মানুষ হওয়া লোকেদের মধ্যেও কিন্তু ছাত্রনেতা পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টে আইন ব্যবসা করে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী এবং পরবর্তীকালে দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়া প্রয়াত অরুণ জেটলি ছাত্র রাজনীতি করতেন।

মোদ্দাকথা, বাবুসোনা আর সোনামণিরা স্বার্থপর, দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে ওদের উপর রাগ করবেন না। আমাদের ছানাপোনাগুলোও তো অমনিই হবে। দিল্লীতে নাকি লোকে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছা করার যুক্তি হিসাবে বলে “জানতা হ্যায় মেরা বাপ কৌন হ্যায়?” আমরা বাঙালিরা তো প্রগতিশীল, তাই হয়ত আমাদের ছেলেটি কোরোনাকে “জানিস আমার মা কে” বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল।

%d bloggers like this: