পাঠশালা বন্ধ?

আমার জন্য, আমার ছেলেমেয়ের জন্য তো নতুন শিক্ষানীতি অনেক দ্বার খুলে দিল। সত্যি কি তাই? নতুন ব্যবস্থায় আপনারাও ফালতু লোকেদের দলে পড়ে যাবেন না তো?

অন্তত একজন মাস্টারমশাইকে চিনি যিনি খুব ছোটবেলায় পিতৃহীন হন, বাবা খুব সামান্য কাজ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর মা লোকের বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচার কাজ করে ছেলেকে বড় করেন। আমার বছর কুড়ির ছাত্রজীবনে অন্তত পাঁচ জন সহপাঠীকে পেয়েছি যারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, কিন্তু মেধা এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতায় অন্য সকলের চেয়ে দু তিন গুণ এগিয়ে। নিজেদের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে তারা সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছে। প্রাথমিক স্তরে একটা স্কুলে দু দফায় দু তিন বছর পড়েছিলাম, যেখানে প্রত্যেক ক্লাসে প্রায় নব্বই শতাংশ পড়ুয়াই প্রথম প্রজন্মের। আমার বাবা যে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সেই স্কুলেরও অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুল শেষ করতে পারত না। লেখাপড়ার চেয়ে, পরীক্ষা পাশ করার চেয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদ তাদের এবং তাদের পরিবারের অনেক বেশি। বাবার মুখে শুনতাম, এখন গঞ্জ এলাকার স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর কাছেও শুনি, অনেক ছাত্রীর মেধা থাকা সত্ত্বেও বিয়ে হয়ে যায় মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই। বেশি লেখাপড়া শিখলে পাত্র পাওয়া মুশকিল হবে, বরপণের অঙ্কটা তখন নাগালের বাইরে চলে যাবে। অনেক ছাত্রী স্কুলে এসে থেকে কেবল জানতে চায় কখন মিড ডে মিল পাওয়া যাবে, কারণ বাড়ি থেকে ভরপেট ভাত খেয়ে আসার সৌভাগ্য তাদের হয় না।

এই আমাদের দেশ। এ দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে আমরা কথা বলছি।

এটা মার্ক জুকরবার্গের দেশ নয়। আমরা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি যে সুন্দর পিচাই, সত্য নাডেলারা এখানে ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। আর তাদের গুগল, মাইক্রোসফটের সি ই ও হয়ে বসায় এ দেশের একটি মানুষেরও এক কণা লাভ হয়নি। ওগুলো কোন ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, কারণ ওতে ওঁদের দুজনের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ফুলে ফেঁপে ওঠা ছাড়া পৃথিবীর আর কারো কোন লাভ বা ক্ষতি হয়নি। প্রথম অনুচ্ছেদে যাদের কথা লিখেছি, তারাই এ দেশের মানুষ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। আমার পরিচিত মাস্টারমশাই যে শেষ পর্যন্ত মাস্টারমশাই হতে পেরেছেন, আমার ঐ সহপাঠীরা কেউ কেউ বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে, অধ্যাপনা করে তাক লাগিয়ে দিতে পেরেছে, তার কারণ অনেক দূর পর্যন্ত তাদের পড়াশোনার খরচের সিংহভাগ বহন করেছিল সরকার। তখনো বিপুল মাইনের বেসরকারী স্কুলে দিগ্বিদিক ভরে যায়নি (বিশেষত যারা অভিভাবকদের বলতে পারে দরকার হলে বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করে মাইনে দিন, নয়ত স্টুডেন্টকে নিয়ে যান), টাকা থাকলেই ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়ার ঢালাও সুযোগ ছিল না। কিন্তু মেধা থাকলে পড়া আটকাত না। কারণ পড়তে পুঁজির দরকার হত না, সরকারই ছিল মধ্যবিত্ত এবং গরীব বাবা-মায়ের পুঁজি। “লম্পট”, “দুশ্চরিত্র”, “দুর্বল” প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর তাঁর বিরোধীদের আসনে থাকা “গোঁড়া”, “সেকেলে”, “শিল্পবিরোধী”, “দেশদ্রোহী” বামপন্থীরা এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত জানত দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে বড় সুযোগ লেখাপড়া করা। এমন নয় যে তখন পাশ করলেই টপাটপ চাকরি জুটে যেত, দেশে বেকারত্ব ছিলই না। কিন্তু মেধা আছে, পুঁজি নেই বলে লেখাপড়া শেষ হবে না — এমনটা ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছিল।

সে ধারা গতিপথ বদলাতে শুরু করেছিল আজকের উচ্চবিত্তদের পরম পূজ্য মনমোহন সিং আর নরসিমা রাওয়ের আমল থেকে। আমাদের ছাত্রজীবনের শেষদিকেই দেখেছি অনেকে উষ্মা প্রকাশ করছে “ব্যাঙ্গালোর ট্যাঙ্গালোরে কত অপশন। একটু টাকা খরচ করলেই ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া যায়। এখানে লেফটিস্টগুলো না ইন্ডাস্ট্রি রেখেছে, না কলেজ খুলতে দিচ্ছে।” কোয়ান্টিটি-কোয়ালিটির ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের কথা তখন কেউ শুনতে চায়নি। বামফ্রন্ট সরকারও, শেষ অবধি, ঢালাও কলেজ খোলার অনুমতি দিলেন। ক্যাপিটেশন ফি কথাটা আমাদের অভিধানে জাঁকিয়ে বসল। সেই সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের রমরমা হল। তাদের সোম, বুধ, শুক্র একরকম ইউনিফর্ম; মঙ্গল, বৃহস্পতি অন্যরকম। সেখানে না পড়লে মনুষ্য জন্ম বৃথা বলে জানা গেল। ভদ্রসন্তানদের ইংরেজি শিখতে না দেওয়ার বামপন্থী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সে এক যুগান্তকারী আন্দোলন। কোন মাধ্যমে পড়াশোনা হচ্ছে সেটাই হয়ে দাঁড়াল মুখ্য। কী পড়ানো হচ্ছে, কত ভাল পড়ানো হচ্ছে, কারা পড়াচ্ছেন — সেসব ছেঁদো ব্যাপার হয়ে গেল। সরকারী স্কুলগুলো হয়ে পড়ল প্রান্তিক। কারণ ভদ্রসন্তানরা আর ওমুখো হলেন না, ফলে মাস্টারমশাই দিদিমণিদের পড়ানোর উৎসাহ তলানিতে পোঁছাল। ঝাঁ চকচকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নেই যে গ্রামাঞ্চলে তার কথা আলাদা। শহর বা মফস্বলে যারা লোকের বাড়িতে কাজ করে বা রিকশা চালায় বা ভাগচাষী, তাদের ছেলেমেয়েদের আবার কিসের মেধা? কী হবে তাদের লেখাপড়া শিখে? পথে দেখা হতে আমাদের এলাকার নামকরা ছেলেদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক একদিন হতাশ গলায় বললেন “আগে আমাদের স্কুলে পড়ত ডাক্তার, মাস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসারদের ছেলেরা। এখন কারা পড়ে জানিসই তো। এদের নিয়ে আর কী লেখাপড়া হবে?”

সেই কারণেই সরকারী স্কুল সরকারের নিজেরও দুয়োরানি হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারী স্কুলের ফি নিয়ে গণ্ডগোল মেটাতে নিজে আসরে নামেন, কিন্তু সরকারী স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়, নামমাত্র মাইনেয় কাজ করে যান প্যারা টিচাররা। অনশন করতে গিয়ে পথের পাশে মারা যান, কাগজের ভিতরের পাতায় খবর হয় আর মহামান্য আদালত নির্দেশ দেন এমন জায়গায় আন্দোলন করতে হবে যেখানে কারোর অসুবিধা হবে না।

এইসব ভাবনাতেই শিলমোহর দিল নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। যাদের বাবা-মায়ের সঙ্গতি আছে সেই ভদ্রসন্তানরা দামী স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। যত যাবেন তত গরীব, সংখ্যালঘু, নিম্নবর্গীয়, জাতি উপজাতির মানুষই কেবল পড়ে থাকবেন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর তাঁদের লেখাপড়া করা যে তেমন জরুরী নয় সে সিদ্ধান্ত সমাজ এবং সরকার তো নিয়েই রেখেছে। তাছাড়া সরকারী প্রতিষ্ঠানের আর কী দাম থাকবে? সরকারী পক্ষপাত তো রিলায়েন্স ইউনিভার্সিটির মত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিই। তাছাড়া নতুন শিক্ষানীতি বলেই দিয়েছে “চরে খাও।” রামকৃষ্ণ মিশন বা সেন্ট জেভিয়ার্সের মত হাতে গোনা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কে আর চরে খেতে পারবে? মাইনে বাড়বে। মধ্যবিত্ত ঋণ নেবে, নিম্নবিত্ত পড়া ছেড়ে দেবে। এ হেন বেসরকারীকরণে ভদ্রলোকদের খুশি হওয়ার মত আরেকটা ব্যাপার ঘটবে। যাদের তাঁরা “সোনার চাঁদ, সোনার টুকরো” বলেন, তাদের লেখাপড়া করা কমে যাবে। এমনিতেই বহু জায়গায় সংরক্ষিত আসনগুলো পূরণ হয় না (তথাপি জেনারেল ক্যাটেগরি ‘বঞ্চিত’), এরপর যেমন-খুশি-ফি-বাড়াও ব্যবস্থায় আরো কম ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে। কারণ ভদ্রলোকদের মস্তিষ্কের গভীরে প্রবিষ্ট প্রোপাগান্ডা যা-ই বলুক, ভারতের গরীব মানুষদের মধ্যে বামুন, কায়েতদের চেয়ে তফসিলি জাতি উপজাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।

আপনি ফোনে, ট্যাবে, ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে এতদূর পড়ে ভাবছেন বাজে সময় নষ্ট হল। ফালতু লোকেদের জন্য এত অশ্রুপাত কিসের? আমার জন্য, আমার ছেলেমেয়ের জন্য তো নতুন শিক্ষানীতি অনেক দ্বার খুলে দিল। সত্যি কি তাই? নতুন ব্যবস্থায় আপনারাও ফালতু লোকেদের দলে পড়ে যাবেন না তো? মনে রাখবেন, এখন থেকে কিন্তু ডিগ্রির দাম আর আগের মত থাকবে না। ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ছেড়ে দিলে সার্টিফিকেট, সেকেন্ড ইয়ারে ছাড়লে ডিপ্লোমা, শেষ অব্দি পড়লে ডিগ্রি। অধ্যবসায়ের বিশেষ দাম থাকল কি? চাকরির বাজারে এমন ডিগ্রির দাম থাকবে তো? ফিজিক্সের সাথে ইতিহাস পড়া যাবে শুনতে রোমহর্ষক। কিন্তু অঙ্ক আর কেমিস্ট্রি না পড়ে ইতিহাস পড়লে ফিজিক্স শেখা যাবে তো? অন্তত চাকরি বাকরি পাওয়ার মত শেখা সম্ভব হবে তো? যে সরকার এই শিক্ষানীতি বানিয়েছেন তাঁরা আবার মেকলের শিক্ষাব্যবস্থার বড় সমালোচক, কারণ ওটা ছিল ইংরেজ সরকারের কেরানি তৈরি করার ব্যবস্থা। তার বদলে এঁরা এনেছেন বহুজাতিকের বাধ্য কর্মী তৈরির ব্যবস্থা, তাই স্কুলস্তর থেকেই স্থানীয় ব্যবসায় ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা। কিন্তু সেটাও সুচারুভাবে সম্পন্ন হবে তো? তাছাড়া শিক্ষক শিক্ষিকাদের মেধাও তো এবার থেকে বাজারের পণ্য হয়ে গেল, তারও দরাদরি হবে। ইতিমধ্যেই উচ্চশিক্ষায় পার্ট টাইমার দিয়ে কাজ চালানো দস্তুর হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে তার যোগ্যতার উপযুক্ত দাম পাবে তো?

পাঠ্যক্রম কী হবে সে আলোচনায় কালক্ষেপ করা উচিৎ হবে না। যে যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এসে গেছে সেখানকার খবর রাখলেই সহজে আন্দাজ করা যায় নজরুল, সুকান্ত বাদ যাবেন। রবীন্দ্রনাথ টিকে গেলেও যেতে পারেন, তবে ‘ভারততীর্থ’, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ ইত্যাদি কবিতাগুলো ছেলেমেয়েদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেওয়া হবে না। বাংলার ইতিহাস ব্যাপারটা বাদ দেওয়াই ভাল হবে, কারণ সেই পাল যুগ থেকে শুরু করে পলাশীর যুদ্ধ অব্দি কেবল বিধর্মীদের রমরমা তো। আর উনবিংশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলন ব্যাপারটা একদম পড়ানো যাবে না। ঐ সময়েই তো বাঙালিরা সব অহিন্দু ম্লেচ্ছ হয়ে গেল। রামমোহন বলে একটা লোক গভর্নর জেনারেলকে চিঠি লিখল (ডিসেম্বর ১৮২৩), এ দেশের যুবকদের সংস্কৃত পড়ানোয় অত মন না দিলেও চলবে। ইংরেজি পড়ান, আধুনিক দর্শন পড়ান। মানে লোকটা কেবল পবিত্র সতীদাহ প্রথা তুলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। ও আপদ বিদেয় হতে না হতেই আবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলে আরেকজন হাজির। সে আরো বড় বিপদ। কেবল বিধবাদের বিয়ে দিয়েছে, মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছে তা নয়; পণ্ডিতদের সাথে, ব্যালান্টাইন সাহেবের সাথে ঝগড়া করে বেদ, বেদান্ত, সংস্কৃতকে পাশে সরিয়ে দিয়ে ইংরেজি আর পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার পাকা ব্যবস্থা করেছে। ওসব পড়েই তো দেশটা উচ্ছন্নে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র — এসব বুদ্ধি তো ঐ পশ্চিমের জানলা গলেই ঢুকে পড়েছে।

অবশ্য বাংলা ভাষাটাই তো থাকবে না, বাংলার ইতিহাসের কথা আসছে কোথা থেকে? ইংরেজি মাধ্যমে তো পড়াতে দেবেন না বলছেন সরকার। তা আপনারা যারা ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চেয়েছিলেন, তারা কি আর বাংলা মাধ্যমে পড়াবেন এখন? তা তো হয় না। সরকার জানেন সে কথা। তাই বলবেন হিন্দি মাধ্যমে পড়াতে। বোকা তামিলদের তাতে আপত্তি থাকতে পারে, আপনাদের তো নেই। এমনিতেই তো ছেলেমেয়ের সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি করে রেখেছেন অনেকে।

নয়া শিক্ষানীতি কি জয়, হিন্দি মিডিয়াম কি জয়।

ব্যর্থ নমস্কার

বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতিরও কম অসম্মান কলকাতার বুকে মূর্তি ভাঙার আগে থেকেই হয়নি। লুকিয়ে চুরিয়ে হয়নি, আমার আপনার চোখের সামনেই হয়েছে

প্রথমে ভেবেছিলাম এই বিষয়ে একটা লাইনও লিখব না। প্রবৃত্তি হচ্ছিল না। বাস্তবিক যা ঘটেছে এবং ঘটছে তা দেখে বমি পাচ্ছিল। কিন্তু শেষ অব্দি ভেবে দেখলাম ইতরামির স্বর্ণযুগে প্রবৃত্তির দোহাই দিয়ে চুপ করে থাকা অপরাধমূলক কাজ। যারা ভালবাসো, অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো ইত্যাদি ভাল ভাল কথা বলেছিলেন, দুর্দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের কবীন্দ্র স্বয়ং তাঁদের ব্যর্থ নমস্কারে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি কোন হরিদাস পাল? তাই সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বমি করার মত করেই উগরে দিই।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি কেন ভাঙা হয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। অত বিশালকায় বাঙালি আর কে-ই বা আছেন? ওঁকে না ভাঙলে বাংলাকে কী করে ভাঙা যাবে? আমার নিজের অন্তত কারা ভেঙেছে তা নিয়েও কোন সন্দেহ নেই, যতক্ষণ না তদন্ত অন্যরকম প্রমাণ করছে। কিন্তু বলার কথা এই যে বাঙালির ভণ্ডামি যারা মূর্তি ভেঙেছে তাদেরই হাত শক্ত করছে।
যত লোক ফেসবুকে বিদ্যাসাগরকে ডিপি বানিয়েছে তার অর্ধেকও যদি ফেসবুকে বাংলায় পোস্ট করার অভ্যাস রাখত, হোয়াটস্যাপে বাংলায় চ্যাট করত তাহলে বাংলার রাজধানীতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার সাহস কারো হত না। কলকাতা জুড়ে কয়েকশো ইংরিজি মাধ্যম স্কুল। সেই স্কুলে পাঠরত লক্ষ লক্ষ বাঙালি ছেলেমেয়ে যদি অন্তত দ্বিতীয় ভাষা হিসাবেও বাংলা পড়ত, তাহলে আমাদের বিদ্যাসাগরকে নিয়ে গদগদ হওয়ার একটা মানে থাকত। কিন্তু তারা পড়ে হিন্দি। বাবা-মায়েরা গর্ব করেন “জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।“ এদিকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে বলে লোকে কেঁদে ভাসাচ্ছে।
রাজ্যের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো শিক্ষক শিক্ষিকার অভাবে ধুঁকছে, ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বেশিদিন আগের কথা নয়, স্বয়ং বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠা করা স্কুল বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। আমাদের মধ্যে যাঁদের কথা কম, কাজ বেশি তাঁরা আপাতত বাঁচিয়েছেন। আমরা কেউ সেসব নিয়ে ভাবি? বিদ্যাসাগর অবিভক্ত বাংলায় ঘুরে ঘুরে স্কুল স্থাপন করেছিলেন। কেন? যাতে শিক্ষার আলো সবচেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে, সবচেয়ে গরীব মানুষটার ঘরেও পৌঁছায়। এবং সেটা সম্ভব একমাত্র জোরালো সরকারপোষিত শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে তবেই। অথচ আমাদের এখানে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থার মুমূর্ষু অবস্থা নিয়ে আমাদের কারোর মাথা ব্যথা আছে? বেসরকারী স্কুলগুলোর বেশি ফি এর জন্যে মুখ্যমন্ত্রী একদিন মালিকদের ডেকে ধমকালেই তো আমরা খুশি। বিদ্যাসাগরের শিক্ষা গোল্লায় যাক, যতক্ষণ হাতে কলমে মূর্তি না ভাঙা হচ্ছে ততক্ষণ সব ঠিক আছে। মাস দুয়েক আগে কলকাতা শহরের বুকে শিক্ষক পদপ্রার্থীরা রোদ বৃষ্টি মাথায় করে না খেয়ে রাস্তায় বসেছিলেন। একদিন দুদিন নয়, আঠাশ দিন। কজন গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আর কটা ফেসবুক পোস্ট দেখেছি পরিষ্কার মনে আছে। শিক্ষকের দুঃখে যার প্রাণ কাঁদে না সে কিরকম বিদ্যাসাগরপ্রেমী?
আরো মোটা দাগে বলব? বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতিরও কম অসম্মান কলকাতার বুকে মূর্তি ভাঙার আগে থেকেই হয়নি। লুকিয়ে চুরিয়ে হয়নি, আমার আপনার চোখের সামনেই হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করিনি, আমাদের অগ্রগামী শিল্পী, সাহিত্যিক, অধ্যাপকরাও করেননি। গোটা শহর ছেয়ে গেছে বিভিন্ন মনীষীদের উক্তি সম্বলিত হোর্ডিংয়ে, যার মধ্যে বিদ্যাসাগরও আছেন। সঙ্গের ছবিটি কিন্তু সেই মনীষীদের নয়, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর। আরেক ধরণের হোর্ডিংয়ে বাংলার মনীষীদের সঙ্গে এক সারিতে বসানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। সেই হোর্ডিংও আলো (বা অন্ধকার) করে রেখেছে শহরের আকাশ। কারো মনে হয়নি ব্যাপারটা অন্যায়, অশ্লীল? বাঙালি সংস্কৃতির উপর আঘাত? আমরা কি অপেক্ষা করছিলাম কবে বিদাসাগরের মুন্ডুটা আছড়ে মাটিতে ফেলা হবে তার জন্যে?
আর একটা কথা বলার আছে। বাংলার সংস্কৃতি আক্রান্ত সন্দেহ নেই। কিন্তু চট করে ব্যাপারটা যেরকম বাঙালি বনাম অবাঙালি করে ফেলা হয়েছে তা শুধু সঙ্কটটাকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। লড়াইটা আসলে ভাল বনাম মন্দের, বাঙালি বনাম অবাঙালির নয়। বাঙালিকে নিজভূমে পরবাসী হতে কেউ জোর করেনি।
অফিসে কাজ করতে করতে ক্ষিদে পেলে সুইগি অ্যাপের মাধ্যমে খাবার আনাই। গত এক দেড় মাসে দুবার দুজন ডেলিভারি বয় খাবার নিয়ে এসে আমাকে ফোন করে হিন্দিতে কথা বলেছে। একজনের পদবী হালদার, অন্যজনের সাহা। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিলাম “ভাই, আপনি বাঙালি তো?” সদর্থক উত্তর পেয়ে জানতে চেয়েছিলাম আমার পদবি বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেও কেন হিন্দিতে কথা বললেন। দুজনেই জানালেন আজকাল বাঙালি খদ্দেররা নাকি বাংলায় কথা বললে বুঝতেই পারেন না। এ জিনিস বাঙালিকে বড়বাজারের গদির কোন মারোয়াড়ি শেখাননি, ভবানীপুরের পাঞ্জাবীরাও শেখাননি। ঠিক যেমন বাঙালি মেয়ের বিয়েতে সঙ্গীত করতে হবে এমনটা কোন অবাঙালি মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দাবী করেননি, বাঙালি বর বৌভাতে শেরওয়ানি না পরলে ভোটার লিস্ট থেকে নাম কেটে দেওয়া হবে, এমনটাও কোন অবাঙালি রাজনীতিবিদ হুমকি দেননি। হিন্দিকে বাংলার মাথায় চাপিয়েছে বাঙালি নিজেই। যে কারণে শহুরে, লেখাপড়া জানা বাঙালির বিদ্যাসাগরের জন্যে এই হঠাৎ আবেগকে মড়াকান্নার বেশি কিছু বলা শক্ত।
বাঙালি সংস্কৃতির উপর আঘাত করা শুরু হয়েছে তখন থেকে যখন বাংলার অধিকাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও যেখানে সেখানে রাজনৈতিক হোর্ডিং লেখা শুরু হয়েছে উর্দুতে। প্রবল আঘাত করা হয়েছে তখন যখন হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বিরাট আঘাত নেমে এসেছে তখন যখন কলকাতার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রাঙ্গণে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় কর, নিদেনপক্ষে উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেনের বদলে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন নেত্রীর ঢাউস প্রতিকৃতি টাঙানো হয়েছে। পঞ্চধাতুর বা দুশো ফুটের বিদ্যাসাগর মূর্তি বানিয়ে এই ক্ষতি পূরণীয় নয়। এবং এ ক্ষতি অবাঙালিরা কেউ করেনি।
বিদ্যাসাগরকে রাধাকান্ত দেব, রসময় দত্তর মত বাঙালিদের বিরুদ্ধেই লড়তে হয়েছিল। তাই অনেকে যে বলছেন “বাঙালিকে সব বিভেদ ভুলে এক হতে হবে”, সেকথা একেবারে ভুল। বরং বাঙালিকে পক্ষ নিতে হবে। ঠিক করতে হবে সে বিদ্যাসাগরের পক্ষে না রাধাকান্তদের পক্ষে। কথায় এবং কাজে আমাদের রামমোহন, বিদ্যাসাগরের আত্মীয় ছিলেন মহারাষ্ট্রের আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ, জ্যোতিরাও ফুলেরা। ঠিক তেমনি সেদিন যাঁরা বিদ্যাসাগরকে অকথা কুকথা বলেছেন, প্রাণ নাশের চেষ্টা করেছেন তাঁদের উত্তরসূরী আজকের মোদী, অমিত শাহরা। অতএব হিন্দি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অতিসরলীকরণ দিয়ে এ লড়াই লড়া যাবে না। ওভাবে লড়লে বড়জোর কারো নির্বাচনী লড়াইয়ে সুবিধা হতে পারে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আড়ালে নিজেদের অপসংস্কৃতি লুকিয়ে ফেলার সুবিধা হতে পারে।
পুনশ্চ: অধুনা যে হাওয়া তাতে এই লেখাটাকে বামের রাম হয়ে যাওয়ার প্রমাণ হিসাবে চালানো হবে হয়ত। হলে আমি নিরুপায় কারণ আমি ছোট থেকে অঙ্কে কাঁচা। বাইনারি বুঝি না।

জল পড়ে। পাতা নড়ে

এরপরে যা খেয়াল হওয়ায় চমকে উঠলাম তা হল বিশ্ববরেণ্য হয়ে ওঠার পরেও নিজের মানবিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সচেতনতা

vidyasagar

দুটো অতিপরিচিত লাইন সেদিন ঘোল খাইয়ে দিল ।
সন্ধ্যেবেলা এক অগ্রজ সাংবাদিকের ফোন “জল পড়ে । পাতা নড়ে । কার লেখা রে ?” অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পত্রপাঠ জবাব দিলাম “বিদ্যাসাগর । বর্ণপরিচয়ে আছে ।”
প্রতিপ্রশ্ন “ঠিক তো ? রবীন্দ্রনাথ নয় তো ?”
বাঙালির ছেলে । যে কোন বিষয়েই রবীন্দ্রনাথের নামটা চলে এলে একটু বেশি সতর্ক হতেই হয় । আমি তাই বললাম “আচ্ছা চেক করে জানাচ্ছি ।” সহকর্মীদের দু’একজনকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি দুটো নামই উঠে আসছে । অগত্যা বিপদে পড়লে সমস্ত বুদ্ধিমান পুরুষের যা করা উচিৎ ঠিক তাই করলাম । গিন্নীর শরণ নিলাম । তিনি কন্যার বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ ঘেঁটে জানালেন “জল পড়ে । পাতা নড়ে ” কোথ্থাও নেই । প্রথম ভাগের তৃতীয় পাঠে আছে “জল পড়ে । মেঘ ডাকে ।” আর অষ্টম পাঠে আছে “জল পড়িতেছে । পাতা নড়িতেছে ।”
রহস্য ঘনীভূত হল দেখে এক অধ্যাপক বন্ধুকে ফোন করলাম । সে একবাক্যে “রবীন্দ্রনাথ” বলল । কিন্তু কোন্ বইতে আছে মনে করতে পারল না । আমারই মনে হল হয়ত সহজ পাঠ হবে । নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আবার সহধর্মিনীর সাহায্য নিতে হল । তিনি জানালেন রবীন্দ্রনাথ রচিত সহজ পাঠের প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ তো বটেই এমনকি বিশ্বভারতী সংকলিত তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগেও জল পড়েনি, পাতা নড়েনি ।
রহস্যের সমাধান যে দূর অস্ত সেকথা সেই অগ্রজকে জানাতেই তিনি মনে করিয়ে দিলেন জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষারম্ভ’ অধ্যায়ে লিখেছেন
“আমরা তিনটি বালক একসঙ্গে মানুষ হইতেছিলাম । আমার সঙ্গীদুটি আমার চেয়ে দুই বছরের বড়ো । তাঁহারা যখন গুরুমশায়ের কাছে পড়া আরম্ভ করিলেন আমারও শিক্ষা সেই সময়ে শুরু হইল । কিন্তু সে-কথা আমার মনেও নাই ।
কেবল মনে পড়ে, “জল পড়ে পাতা নড়ে ।’ আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা ।”
অতএব লাইনদুটো রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা হতেই পারে না ।
অকাট্য যুক্তি । কিন্তু তাহলে রহস্য উদ্ঘাটন হবে কী করে ? কবিগুরুর আদিকবিটি তাহলে কে ? বিদ্যাসাগর না হলেও অন্য কেউ তো বটে ? নাকি জীবনস্মৃতি লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করায় নিত্য বর্তমান ঘটমান বর্তমানের চেহারা নিয়েছে ? এই সেদিন পর্যন্তও তো বঙ্গসন্তানদের লেখাপড়া বর্ণপরিচয় দিয়েই শুরু হত । আর রবীন্দ্রনাথের তো শিক্ষারম্ভ বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই ।
কোথায় পাব উত্তর ? গুগল জ্যাঠাকে জিজ্ঞেস করে দেখলাম বিন্দুবিসর্গ জানে না এব্যাপারে । আমার সিধুজ্যাঠা নেই বলে আফশোস করতে করতে বাড়ি পৌঁছলাম । তারপর হঠাৎ ক্যাপ্টেন স্পার্কের মত মস্তিষ্কে একটা স্পার্ক হল । মনে পড়ল প্রশান্ত পাল রচিত রবিজীবনীর কথা । কী যেন পড়েছিলাম এই ব্যাপারে ! খুলে বসলাম ।
দেখি প্রথম খন্ডের চতুর্থ অধ্যায়ে (রবীন্দ্রজীবনের চতুর্থ বৎসর) আছে
“যদিও রবীন্দ্রনাথের জন্য বিশেষ করে বর্ণপরিচয় — প্রথম ভাগ কেনার উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবু এই বইটিও তাঁর প্রথম শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেই মনে হয় ।” এরপর জীবনস্মৃতির উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে প্রশান্ত পাল লিখছেন “এই বর্ণনা বর্ণপরিচয় — প্রথম ভাগকেই মনে করিয়ে দেয় । অবশ্য সে ক্ষেত্রেও আমাদের দ্বিধা সম্পূর্ণ কাটে না । কারণ উক্ত গ্রন্থের তৃতীয় পাঠে ‘জল পড়ে’ বাক্যটি থাকলেও ‘পাতা নড়ে’ বাক্যটি নেই এবং অষ্টম পাঠে বাক্যদুটিকে পাওয়া যায় একেবারে গদ্যাত্মক চেহারায় — ‘জল পড়িতেছে । পাতা নড়িতেছে ‘ — যাকে আদিকবির প্রথম কবিতা বলা শক্ত ।”
এরপর আছে আরেকটা বইয়ের আলোচনা যে বইতে রবীন্দ্রনাথ পড়েন “হিরণ্যকশিপুর পেট চিরছে নৃসিংহ অবতার” । অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন সিদ্ধান্ত করেছেন এইটা শিশুবোধক নামে একটা বই এবং এটাকেই তিনি রবীন্দ্রনাথের পড়া প্রথম বইয়ের মর্যাদা দিয়েছেন । কিন্তু প্রশান্ত পাল ভিন্নমত । তিনি ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবই দিয়ে প্রমাণ করেছেন ওটা রবীন্দ্রনাথের পড়া প্রথম বই নয় । তিনি লিখছেন “এই পর্বে দু-দফায় যে বই কেনা হয়েছে, তাতে আমরা ‘প্রথম ভাগ’ [দাম দেখে বর্ণপরিচয় — প্রথম ভাগ হওয়াই সম্ভব বলে মনে হয়], বর্ণপরিচয় ও শিশুশিক্ষা-র কথাই জানতে পেরেছি, শিশুবোধক কেনা হয়েছে এমন কোন ইঙ্গিত মেলেনি ।”
এর কিছু পরে প্রশান্ত পাল লিখছেন
“রবীন্দ্রনাথের শিক্ষারম্ভ হয়েছিল শিশুশিক্ষা দিয়ে এবং তার পরে সম্ভবতঃ বর্ণপরিচয়ের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটেছিল । তারও পরে পড়েছিলেন শিশুবোধক, আর এই শিশুবোধকেই পেয়েছিলেন মূলপাঠসহ চাণক্যশ্লোকের বাংলা পদ্যানুবাদ । আর এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পুরো ইতিহাসটিকে গুছিয়ে আনতে পারি এইভাবে : বর্ণপরিচয় — প্রথম ভাগ দিয়ে সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ যখন ভাদ্র [Sep 1864] থেকে শিক্ষারম্ভ করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁদের সঙ্গী ছিলেন না ; তিনি পাঠশালায় যেতে শুরু করলেন পৌষ মাস [Jan 1865] থেকে, শিশুশিক্ষা অবলম্বনেই তাঁর অক্ষর পরিচয় হয়, কিন্তু বর্ণযোজনা শেখেন বর্ণপরিচয় থেকে — ‘কর খল’ এবং ‘জল পড়িতেছে । পাতা নড়িতেছে” পাঠই তিনি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ভাবী মহাকবির সমস্ত চৈতন্য গদ্যের সেই সাদাসিধে রূপের অন্তরে নিহিত ছন্দটুকু আবিষ্কার করে গদ্যের ঘটমান বর্তমানকে কবিতার নিত্য বর্তমানে পরিণত করেছে ।”
রহস্যের সমাধান হল । আমাদের সকলের পরিচিত লাইনদুটো বিদ্যাসাগরের রচনা নয়, রবীন্দ্রনাথের রচনাও নয় ; একটা ভুল উদ্ধৃতিমাত্র ।
কিন্তু এরপরে যা খেয়াল হওয়ায় চমকে উঠলাম তা হল বিশ্ববরেণ্য হয়ে ওঠার পরেও নিজের মানবিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সচেতনতা । জীবনস্মৃতির মুখবন্ধে তিনি স্পষ্ট লিখেছেন
“জীবনের স্মৃতি জীবনের ইতিহাস নহে — তাহা কোন্-এক অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তের রচনা । তাহাতে নানা জায়গায় যে নানা রং পড়িয়াছে তাহা বাহিরের প্রতিবিম্ব নহে — সে-রঙ তাহার নিজের ভান্ডারের, সে-রঙ তাহাকে নিজের রসে গুলিয়া লইতে হইয়াছে ; সুতরাং পটের উপর যে ছাপ পড়িয়াছে তাহা আদালতে সাক্ষ্য দিবার কাজে লাগিবে না ।”
আমরা ওঁকে ঠাকুর বানিয়েছি কিন্তু উনি কখনোই আমাদের পাল্লায় পড়ে ভুলে যাননি যে আর পাঁচজনের মত ওঁরও ভুল হওয়া স্বাভাবিক এবং অনিবার্য।

%d bloggers like this: