ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এবং একটি মৌলিক প্রশ্ন

এখনো তিরিশের নিচে বয়স এবং পৃথিবীর নানা বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ আছে যাদের, তাদের হয়ত তেমন আলোড়িত করছে না এই খবর যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা আর ছাপা হবে না। কারণ তাদের ন্যাট জিও যেমন ছিল তেমনই থাকছে। হাতের মোবাইল, ল্যাপটপ বা বাড়ির টিভিতে মহাবিশ্বের নানা বিস্ময় গোগ্রাসে গেলা যাবে যথারীতি। কিন্তু কলেজ লাইব্রেরিতে হলুদ বর্ডার দেওয়া মহার্ঘ পত্রিকাটি উল্টে পাল্টে দেখেই যাদের সুদূরের পিয়াসা মেটাতে হয়েছে আজ থেকে বছর বিশেক আগে পর্যন্ত, কিনে পড়ার সাধ হলেও সাধ্য হয়নি – তাদের মনে হতে বাধ্য যে একটা যুগের অবসান হল।

এই পত্রিকার যা ইতিহাস তাতে যুগের অবসান কথাটা অন্তত এক্ষেত্রে একেবারেই খবরের কাগজের অতিব্যবহৃত লব্জ হয়ে থাকছে না। ১৮৮৮ সালে স্রেফ স্কলারলি জার্নাল হিসাবে চালু হওয়া পত্রিকা, যা একসময় সারা বিশ্বে মাসে ৪০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে, তার ছাপা বন্ধ হয়ে যাওয়া যুগের অবসান তো বটেই। তবে এমন যুগাবসান প্রকাশনা এবং সাংবাদিকতার জগতে গত এক দশক ধরে হয়েই চলেছে। করোনা অতিমারীর পর থেকে গতি বেড়েছে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বিপুল জনপ্রিয় বহুজাতিক পত্রিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে এখনো প্রকাশিত হয়) দ্য উইক তাদের অস্ট্রেলিয় সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে সেই ২০১২ সালে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমোন্নতি এবং ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীতেই ছাপা পত্রিকা এবং খবরের কাগজের চাহিদা কমে যাচ্ছে বলে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মালিকদের মত। মার্কিন দেশের বিখ্যাত খবরের কাগজ দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট গত নভেম্বর মাসে রবিবারের কাগজের সঙ্গে যে পত্রিকাটি দিত তার প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছে।

ভারতে নয়ের দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর ‘মিডিয়া বুম’ হয়েছিল। সেইসময় বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় বহু নতুন খবরের কাগজ খোলা হয়, দিল্লি বা মুম্বাইয়ের শতবর্ষ প্রাচীন কাগজগুলো ভারতজুড়ে সংস্করণ চালু করে। ২০১৬ সালের পর থেকে এমন বহু কাগজ, কাগজের সংস্করণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে ২০২০-২২ সময়কালে, অতিমারীতে লোকে কাগজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছে – এই যুক্তিতে। সেই প্রক্রিয়া এখনো চলছে। পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে বসলে উত্তরবঙ্গ সংবাদের একটা গোটা পাতা ভরে যেতে পারে। কথা হল, স্মার্টফোন এবং ক্রমশ দ্রুততর ইন্টারনেট পরিষেবার ফলে অনেকেরই ছাপা পত্রিকা বা খবরের কাগজের প্রতি নির্ভরতা বা আকর্ষণ যে কমেছে তা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেই মালুম হয়। কিন্তু সেই সংখ্যাটা ঠিক কত? এর কোনো সর্বজনমান্য তথ্যপ্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না। আজ পর্যন্ত কোনো প্রকাশনা সংস্থা কোনো পত্রিকা, কাগজ বা ক্রোড়পত্র ছাপা বন্ধ করে দেওয়ার সময়ে প্রকাশ্যে জানাননি যে তার বিক্রি কতটা কমে গিয়েছিল। তাতে কোম্পানির কত টাকার ক্ষতি হচ্ছিল। বিদেশের কথা জানি না। এ দেশে যে বেশকিছু ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয় বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিচালিত মার্কেট রিসার্চ নয়, মালিকদের খামখেয়ালিপনার ভিত্তিতে – তার প্রমাণ আছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই পশ্চিমবঙ্গের এক বহুল প্রচারিত কাগজ তাদের দুটি ক্রোড়পত্র বিনা নোটিসে বন্ধ করে দেয়। কয়েকদিন আগে “আবার সে এসেছে ফিরিয়া” বলে রঙ্গমঞ্চে ফেরত এসেছে তার একটি। এই আচরণের ব্যাখ্যা একমাত্র পাগলা দাশু দিয়েই হতে পারে, অর্থনীতি দিয়ে নয়।

অবশ্য এসব বলে কোনো লাভ নেই। আজকাল সরকারই জবাবদিহি করতে চায় না, বিপুল পুঁজির অধিকারী ব্যবসায়ীরা জবাবদিহি করতে যাবেন কোন দুঃখে? পাঠক ভাবতে পারেন, জবাবদিহি করার প্রশ্ন আসছেই বা কেন? যুগ বদলায়, প্রযুক্তি বদলায় – এ তো চিরকালের নিয়ম। এমনি এমনি কি আর কবি বলেছেন “বৃদ্ধযুগের গলিত শবের পাশে/প্রাণকল্লোলে ঐ নবযুগ আসে”? মুশকিল হল, এই নবযুগ আসার উল্লাস সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যেই ক্রমশ কমে আসছে, কারণ দেখা যাচ্ছে যখনই নতুন প্রযুক্তি এসে পুরনো প্রযুক্তিকে বাতিল করে দেয়, তখনই বেশকিছু মানুষের রুটিরুজি নিয়ে টানাটানি পড়ে। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে তত সেরকম মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ছাপা পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ায় ১৯ জনের চাকরি গেছে বলে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে। এটি অবশ্য লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা। অসাংবাদিক কর্মচারীদের খবর কেউ রাখে না। যা-ই হোক, সাধারণভাবে কোনো প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে যত লোকের চাকরি যায় তার তুলনায় এই সংখ্যা নগণ্যই বলতে হবে। যা বেশি দুশ্চিন্তার তা হল শুধু যে মুদ্রণ প্রযুক্তিকে ওয়েব প্রযুক্তি টপকে যাওয়ায় পত্রপত্রিকা বন্ধ হচ্ছে আর কিছু মানুষের চাকরি যাচ্ছে তা তো নয়। গতবছর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন, যার সঙ্গে মুদ্রণ ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই, তারাও কয়েকশো কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। বাজফিড আর ভাইস, দুটোই সম্পূর্ণ ওয়েব মাধ্যম, তারাও সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে চারশো মানুষকে ছাঁটাই করেছে।

আরও পড়ুন টুইটার, বাইজু’স আঁধারে ছাঁটাই সম্পর্কে কয়েকটি কথা

কেবল সংবাদমাধ্যম নয়, অন্য সব ক্ষেত্রেই বিপুল কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। অ্যামাজন, গুগল, মেটার মত সংস্থার নাম সবাই জানে বলে তাদের ছাঁটাইয়ের খবর শিরোনাম হয়। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সামগ্রিক অবস্থাই আশঙ্কাজনক। এর উপর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার মত কথা হল, এ আই আসিছে চড়ে জুড়িগাড়ি। এই বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখছি বহুজাতিক এইচ আর কোম্পানি চ্যালেঞ্জার, গ্রে অ্যান্ড ক্রিসমাস দাবি করেছে এ বছরের মে মাসে ৪,০০০ মানুষ কাজ হারিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে। ওই প্রতিবেদনেই দেখলাম আইবিএমের সিইও অরবিন্দ কৃষ্ণ বলেছেন তাঁরা ধাপে ধাপে ৬,৮০০ কর্মীর জায়গায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আসবেন। এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই নাকি ৪,১৭,৫০০ চাকরি গেছে বিভিন্ন ক্ষেত্র মিলিয়ে। বছরের শুরুতেই এর চেয়ে বেশি চাকরি গিয়েছিল সেই ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে, সংখ্যাটা ছিল ৮,২০,০০০। মার্চ মাসে বিশ্ববিখ্যাত সংস্থা গোল্ডম্যান সাখস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সারা বিশ্বের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন পূর্ণ সময়ের চাকরি খাবে।

আসলে যন্ত্র তো আর চাকরি খায় না, মানুষের চাকরি খায় মানুষই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সাংবাদিকই বলুন আর তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী, তাঁর কাজটা যে যন্ত্রকে দিয়ে করালে আরও কম খরচে আরও দক্ষভাবে করানো যাবে – সে সিদ্ধান্ত কিন্তু নেয় কয়েকজন মানুষ। তা প্রযুক্তি যদি মানুষের চেয়ে ভাল কাজ করতে পারে, কেন তার ব্যবহার করব না? সিলিং ফ্যান কেনার সামর্থ থাকলে কি হাতপাখা ব্যবহার করি আমরা? নাকি এলপিজি কেনার সামর্থ থাকতেও কয়লার উনুনে রান্না করি? দুটো প্রশ্নেরই উত্তর না। কিন্তু এগুলো বোধহয় ভুল প্রশ্ন। ঠিক প্রশ্ন হল, প্রযুক্তি মানুষের জন্য, নাকি মানুষ প্রযুক্তির জন্য?

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

পঞ্চায়েত নির্বাচন: ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক

প্রত্যেকবার পঞ্চায়েত নির্বাচন এসে পড়লেই খবরের কাগজে এবং খবরের চ্যানেলে বেশকিছু খবর দেখে আমার বেজায় হাসি পায়। যখন কাগজে কাজ করতাম তখনও পেত, এখনও পায়। কারণ আজন্ম পঞ্চায়েত এলাকায় বসবাস করার কারণে খবরগুলো দেখেই বুঝতে পারি, এগুলোকে যাঁরা প্রকাশযোগ্য খবর বলে চিহ্নিত করেন তাঁদের পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম এবং পঞ্চায়েত ব্যাপারটা সম্পর্কে ধারণা শূন্যের কাছাকাছি। যতদিন কলকাতার কাগজে কাজ করেছি, বরাবরই খেলার পাতায় কাজ করতাম। ফলে ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। তার উপর সাংবাদিকরা কোনও বিষয়ে জানেন না বা ভুল জানেন, একথা মুখোমুখি বলার মত ভুল জগতে কমই আছে। তার চেয়ে জঙ্গলের মধ্যে বাঘের সামনে পড়ে গিয়ে দাঁত খিঁচানো বুদ্ধিমানের কাজ। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি যত কমই হোক, ওই ভুল বারবার করতে যাওয়ার মতো কম নয়। তাই গোদা বাংলায় যাকে বলে ‘চেপে যাওয়া’, সেটাই করে গেছি। এবারেও তেমনই করতাম, কিন্তু উস্কে দিলেন চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলী। বললেন পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে একটা লেখা চাই। বললে বিশ্বাস করবেন না, এড়িয়ে যাওয়ার একটা শেষ চেষ্টাও করেছিলাম। চার নম্বর থেকে যিনি ফোন করেছিলেন তাঁকে সাবধান করে দেওয়ার ঢঙে বলেছিলাম “লেখাটা হার্ডকোর পলিটিক্স হবে না কিন্তু”। তিনি “তা চাইছিও না” বলে বলটা রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ডেড ব্যাটে থামিয়ে দিলেন। তা ভাবলাম চাকরি যাওয়ার ভয় যখন আর নেই, তখন লিখেই ফেলি চেপে রাখা কথাগুলো।

পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন আমার কাছে রীতিমতো ব্যক্তিগত ব্যাপার, ফলে এই লেখাটাও অনেকখানি ব্যক্তিগত হবে। আজকাল তো বলাই হয় “The personal is political”, যা ব্যক্তিগত তা রাজনৈতিকই। এই যে প্রাক-নির্বাচনী হিংসার খবরের প্রাচুর্য সত্ত্বেও কিছু খবর পড়ে আমার হাসি পায়, সে তো পঞ্চায়েত এলাকায় জীবন কাটানো এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকার কারণেই। সে অভিজ্ঞতা ভুলে লিখলে শহুরে সাংবাদিকদের ভুলভুলাইয়াতেই আমাকেও ঘুরে মরতে হবে।

এবার আসল কথা বলি। কোন খবরে আমার হাসি পায়? দেখবেন সব কাগজেই এই মর্মে খবর বেরোয়, যে অমুক বাড়ির দুই জা দুই পার্টির প্রার্থী হয়েছেন। কাগজের তৎপর আলোকচিত্রী বা চ্যানেলের চিত্রগ্রহণকারী দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে (ক্ষেত্রবিশেষে দুজনের হাতে নিজ নিজ দলের পতাকা ধরিয়ে) ছবিও তোলেন। শহরের মানুষ এ ধরনের খবর যত বড় হাঁ করে গেলেন তার মধ্যে দিয়ে ভারতের সমস্ত বিরোধী দলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা বিজেপিতে গিয়ে শুদ্ধ হয়ে যেতে পারেন। এই খবরগুলোতে সূক্ষ্ম বা স্থূলভাবে ইঙ্গিত থাকে, যে আসলে দুই দলের তলায় তলায় আঁতাত হয়েছে। একই পরিবারের দুজনের দুই দলের হয়ে ভোটে দাঁড়ানো তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ। এ জাতীয় খবর দুই জা, দুই ভাই, কাকা-ভাইপো, মামা-ভাগ্নে— নানারকম সম্পর্কের প্রার্থীদের নিয়েই ছাপা হয়। সাংবাদিকতার ক্লাসে প্রথমেই শেখানো হয়, কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা খবর নয়। মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তবেই খবর। অস্যার্থ, যা ঘটেই থাকে তা খবর নয়। যা সচরাচর ঘটে না তা ঘটলেই খবর। স্রেফ সেই যুক্তিতেই এই খবরগুলোকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়ার কথা। কিন্তু যে সম্পাদকরা হাওড়া ব্রিজের ওপারটা কখনও স্বচক্ষে দেখেননি, তাঁরা ফেলেন না। বছরের পর বছর এইসব খবর দেখে শহুরে পাঠক/দর্শকেরও বিশ্বাস জন্মে যায়, অন্য কিছু নয়, এইটেই দুটো দলের আঁতাতের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

তাঁদের কে বোঝাবে যে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তৈরি করার উদ্দেশ্যই ছিল গ্রামের মানুষের শাসনভার তাদের হাতেই তুলে দেওয়া। নিজের বাড়ির সামনের রাস্তাটা খারাপ হলে সেটা সারানোর দায়িত্ব যেন মানুষ নিজেই নিতে পারেন— এমন ব্যবস্থা করাই পঞ্চায়েতি রাজের লক্ষ্য। কীভাবে তা করা যায় তা নিয়ে দুই ভাই, দুই জা, এমনকি বাপ-ছেলেরও মতভেদ থাকতে পারে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিধান হল, ভোটে দাঁড়িয়ে পড়ো। এলাকার লোক যাকে জেতাবে সে ঠিক করবে কীভাবে কী হবে। একই পরিবারের দুজন দুরকম পথ নিচ্ছেন, এটা নীতিহীনতার প্রমাণ হতেও পারে, না-ও হতে পারে। বরং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গণতান্ত্রিকতার নিদর্শন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মত ঘোর রাজনীতি সচেতন সমাজে এমনটা হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

১৯৭৮ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়, তখন আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু সেবার পঞ্চায়েত সমিতিতে সিপিএম প্রার্থী ছিলেন আমার বাবা। যে নিকটতম কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে তিনি নির্বাচিত হন, তিনি আমার বাবারই কাকিমার আপন ভাই। আমাদের নবগ্রাম বস্তুত পূর্ববাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর জঙ্গল সাফ করে গড়ে তোলা বসতি। সে কারণেই নাম— নতুন গ্রাম। আমাদের পরিবার এই লোকালয়ে এসেছে দেশভাগের অনেক পরে, কারণ আমার ঠাকুর্দা রেলের চাকুরে ছিলেন বলে গোটা পরিবার ছিল ভ্রাম্যমান। বাবাদের নয় ভাইবোনের একেকজনের জন্ম ভারতের একেক জায়গায়। তার কোনও কোনও জায়গা দেশভাগের পর আর ভারতে নেই। ঠাকুর্দা যতদিনে অবসর নিলেন ততদিনে তাঁর আদি বাড়ি হয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তান, সেখানে আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তাহলে অত বড় পরিবার নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাবেন কোথায়? যাঁকে আমার বাবা আটাত্তরের ভোটে হারালেন, বস্তুত তাঁদের পরিবারের ভরসাতেই ঠাকুর্দা এসে বাড়ি করেন হুগলি জেলার নবগ্রামে। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন আমাদের বাড়ি তৈরি তদারক করছেন বাবার সেই মামাটি, তখন কি আর জানতেন এ বাড়ির ছোট ছেলে হয়ে যাবে কমিউনিস্ট আর ভোটে দাঁড়াবে তাঁরই বিপরীতে? এসব গল্প হলেও সত্যি এবং শুধু আটাত্তর সালে সত্যি ছিল তা নয়, রাজ্যের যে কোনও পঞ্চায়েত এলাকায় আজও সত্যি। বাবার সেই মামাটি আজীবন কংগ্রেসিই ছিলেন, বাবাও আমৃত্যু সিপিএম। কেউ কারও সঙ্গে কথা বন্ধ করেননি, আবার একে অপরের দলেও যোগ দেননি। দুই পরিবারের আত্মীয়তাও এখনও অটুট। শহুরে সংবাদমাধ্যম আপনাকে বোঝাবে, এটা সেই সাতের দশক থেকেই কংগ্রেসের সিপিএমের বি টিম হওয়ার লক্ষণ। কিন্তু সত্যিটা জানতে হলে আপনাকে গ্রামে যেতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম আবার একরকম নয়। যেমন ধরুন আমাদের নবগ্রামে আজ এসে দাঁড়ালে আপনি বিশ্বাসই করবেন না এটা পঞ্চায়েত এলাকা। কারণ রেলস্টেশনের বাইরে দু পা বাড়াতেই আপনার চোখে পড়বে যানজট, যার মধ্যে আটকে আছে গোটা দুয়েক রীতিমত দামি গাড়ি। তাছাড়া গ্লো সাইন, বাহারি কনফেকশনারি, কাবাবের দোকান, বাতানুকূল কেক-পেস্ট্রির দোকান, অটো, টোটো, সাইকেল রিকশা। এমনকি স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে যত এগোবেন তত চোখে পড়বে ছোটবড় রেস্তোরাঁ, এদিকে ওদিকে সম্পূর্ণ এবং নির্মীয়মাণ বহুতল। একটি বহুতলের দোতলায় সুবিখ্যাত হাবিবসের বিউটি পার্লার। অলিগলি দিয়ে হাঁটলেই দেখা যাবে, শুধু ৫০-৬০ বছরের বাড়ি নয়, ভাঙা পড়ছে মাত্র বছর পনেরো আগে তৈরি হওয়া কারও সাধের বাড়িও। একের পর এক ফ্ল্যাটবাড়ি মাথা তুলছে। শান্ত জনপদ নবগ্রাম, যেখানে বছর দশেক আগেও রাত সাড়ে নটার পর রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত, সেখানে আলো চুঁইয়ে পড়ছে সর্বক্ষণ। ভিটেমাটি খোয়ানো বাঙালদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অবাঙালি মানুষের স্রোত, নয়ের দশকেও যা ছিল একশো শতাংশ হিন্দু এলাকা, সেখানে এখন তবু দু-চারটে মুসলমান পরিবার দেখা যায়। এই গ্রামের সঙ্গে কোনওভাবেই মিলবে না সুন্দরবন এলাকার কোনও গ্রাম অথবা আলিপুরদুয়ারের কোনও গ্রামের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, পঞ্চায়েত সদস্যদের কাছে দাবিদাওয়ার তালিকা।

২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আর শোনা যায় না, কিন্তু বামফ্রন্ট আমলের শেষদিকে প্রত্যেক পঞ্চায়েত নির্বাচনেই বাম দলের কর্মীরা প্রচারে বেরোলে ভোটাররা একটি প্রশ্ন অবশ্যই করতেন, “আমরা কবে মিউনিসিপ্যালিটি হব?” তাঁরা প্রতিবারই বলতেন “আগামীবার”। কিন্তু সে আগামীবার এসে পৌঁছবার আগেই বামফ্রন্ট সরকারের পতন হয়। এই প্রশ্ন নিশ্চিতভাবেই পূর্ব মেদিনীপুর বা দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের ভোটাররা করেন না। এই বৈচিত্র্য বুঝতে পারে এ রাজ্যের কটা সংবাদমাধ্যম? বোঝাতে পারেন কতজন শহুরে মানুষকে? জানি না। মুখরোচক হওয়ায় পঞ্চায়েত বলতেই তুলে ধরা হয় খুনোখুনি আর আঁতাতের গল্প।

প্রকাশ্য বা গোপন আঁতাতের গল্প একেবারেই মিথ্যে নয়। গোটা দেশের রাজনীতি থেকেই নীতি দৌড়ে পালাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে সে নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে না। কিন্তু যেসব ঘটনাকে আঁতাতের নিদর্শন বলে তুলে ধরা হয়, সেগুলো দেখে আমাদের মত পঞ্চায়েতবাসীর না হেসে উপায় থাকে না। আরও বেশি হাসি পায়, যখন অন্য দল করে বলে একই পরিবারের দুজন সদস্যের মধ্যে মারামারি, এমনকি খুনোখুনির খবর দেখিয়ে সুটবুট পরা অ্যাঙ্কররা মুখে বেদনা ফুটিয়ে বলেন “কোথায় চলেছি আমরা! সামান্য রাজনীতির জন্যে মানুষ নিজের আত্মীয়কে খুন করবে?” তারপর তুলে আনেন সংসদীয় রাজনীতির সৌজন্যের নানা দৃষ্টান্ত, সবই বিধানসভা বা লোকসভার গল্প। অর্থাৎ তখন আর মনে থাকে না, যে একই পরিবারের দুজন দুই দলের লোক হওয়ার অর্থ অশুভ আঁতাত।

আরও পড়ুন কর্ণাটক নির্বাচনের ফল: মিডিয়া, জিভ কাটো লজ্জায়

আসলে সেই ১৯৭৮ থেকে এ রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে চললেও গ্রামসভাকে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাঙালি আজও বিধানসভা, লোকসভার সমান বলে ভাবতে শেখেনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে বা টিভি চ্যানেলের আলোচনায় ‘local self-government’ কথাটা শুনতে চমৎকার লাগে। কিন্তু পঞ্চায়েতকে স্থানীয় সরকার বলে ভাবতে গেলেই মনে হয়, গাঁয়ের চাষাভুষো আবার সরকার চালাবে কী? তাই বিভিন্ন জেলার পৌরসভা নির্বাচনে বা কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে গোলাগুলি চললে যা শোনা যায় না, সে কথাই অনায়াসে বলা হয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের বেলায়— “এত খুনোখুনি হলে এরকম নির্বাচনের দরকার কী?” যে এলাকা যত নগরায়িত হচ্ছে, সেই এলাকার মানুষ এই বক্তব্যের সঙ্গে তত একমত হচ্ছেন। আমাদের নবগ্রামেও আজকাল অনেককে এরকম বলতে শোনা যায়। কারণ অধিকার যত সহজে পাওয়া যায়, তত তার গুরুত্ব ভুলে যাওয়াই বোধহয় আমাদের চরিত্র। তাই সেইসব পঞ্চায়েতেই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার অধিকার ফেরত পেতে, ভোট দেওয়ার অধিকার ফিরে পেতে রক্তাক্ত লড়াই হয় যেখানে গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতল শাসক দল এবং চক্ষুলজ্জা থাকলে অস্বীকার করা যায় না এমন হিংসার ছবি উঠে এল সমস্ত সংবাদমাধ্যমে। আমি তখনও একটি কাগজের চাকুরে সাংবাদিক। মনে আছে আমার হিন্দি বলয় থেকে আসা সহকর্মীরা কাণ্ড দেখে হাসাহাসি করতেন এবং বলতেন “আপনাদের এখানে সামান্য পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে এত মারামারি হয় কেন? আমাদের ওখানে তো এসব হয় না! আমরা তো আগে থেকেই ঠিক করে রাখি কে কী হবে না হবে। পঞ্চায়েতটা এমন কী ব্যাপার যে এর জন্যে এত লড়তে হবে?” সিনিয়র বাঙালি সাংবাদিকরা তাঁদের সঙ্গে একমত হয়ে স্বীকার করতেন যে ব্যাপারটা সত্যিই খুব লজ্জার। কাউকে দেখিনি বুঝিয়ে বলতে, যে আপনাদের ওখানে যেটা হয় সেটা গণতন্ত্র নয়। পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে নামেই, তাই মুখিয়ার ছেলেই মুখিয়া হয়। মতান্তর নেই, মনান্তরও নেই। কারণ পঞ্চায়েতের হাতে তেমন ক্ষমতাই নেই। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত এসেছে ভূমিসংস্কারের হাত ধরে। সে সংস্কার মধ্যচাষি পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে কিনা তা অন্য আলোচনার বিষয়, কিন্তু এ রাজ্যের পঞ্চায়েত সত্যিই গ্রামের চিরকালীন ক্ষমতার কাঠামো ভেঙে দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে হেলাশ্রদ্ধার পাত্রদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সেই অধিকার ছিনিয়ে নিতে এক দল সদা সচেষ্ট, অন্য দল অধিকার বজায় রাখতে মরিয়া। তাই লড়াই অবশ্যম্ভাবী। আপনাদের শান্তি শ্মশানের শান্তি, ওর চেয়ে অশান্তি ভাল। বোধহয় নিজেরা বোঝেন না বলেই বোঝাতে পারতেন না। এ বছরের নির্বাচনী সাংবাদিকতা দেখে বোধ হচ্ছে, আজও বোঝেন না।

শুরু করেছিলাম আমার জন্মের আগের এক পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘটনা দিয়ে। শেষ করি ১৯৯৮ সালের নির্বাচনের ঘটনা দিয়ে, যা পঞ্চায়েত নির্বাচন সম্পর্কে আমার প্রাচীনতম স্মৃতি।

আমাদের নবগ্রামের পাশের পঞ্চায়েতের নাম কানাইপুর। সেই কানাইপুরের বেশ খানিকটা এলাকা বিড়লাদের হিন্দমোটর কারখানার গায়ে। এখন সে কারখানা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে, কিন্তু তখন রমরমা ছিল। কারখানার সাইরেন শুনে ঘড়ি মেলানো চলত আমাদের এলাকায়। কারখানা সংলগ্ন আলোচ্য এলাকা দুটির নাম আদর্শনগর আর শাস্ত্রীনগর। সেখানকার বাসিন্দা মূলত কারখানার হিন্দি বলয় থেকে আসা শ্রমিকরা। পঞ্চায়েত সমিতিতে ১৯৯৩ সালে তাঁদের ভোটে জিতেছিলেন সিপিএম প্রার্থী। তিনি পরিশ্রমী এবং এলাকায় যারপরনাই জনপ্রিয়, অনর্গল হিন্দি বলতে পারতেন। শ্রমিকদের যে-কারও বাড়িতে পাত পেড়ে বসে যেতে পারতেন যে-কোনও সময়। কিন্তু ভোটের কিছুদিন আগে সেই যুবক একটি গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের কাজ করে ফেললেন। ফলে সিপিএম তাঁকে প্রার্থী না করার সিদ্ধান্ত নিল। ওই কেন্দ্রের প্রার্থীর নাম ঘোষণা হওয়ার আগেই ভোটাররা জেনে ফেললেন এই সিদ্ধান্ত, কারণ রুষ্ট পার্টিকর্মী ঘোষণা করে দিলেন তিনি নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াবেন। ভোটাররা কী করলেন? দলে দলে লোক একদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এক-দেড় কিলোমিটার হেঁটে হাজির হলেন স্থানীয় সিপিএমের যে নেতাকে তাঁরা সবচেয়ে বড় নেতা মনে করেন তাঁর বাড়িতে। বক্তব্য এক লাইনের— সেই শৃঙ্খলাভঙ্গকারী পার্টিকর্মীকেই প্রার্থী না করলে “আমরা সিপিএমকে ভোট দেব না।” সিপিএম তাঁদের দাবি মেনে নেয়নি। কিন্তু ওই নির্দল প্রার্থীকে হারাতে প্রার্থী করা হয়েছিল যাঁর কাছে ওই মানুষগুলো ফরিয়াদ নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকেই।

ভোটারদের এইভাবে সরাসরি নিজের বক্তব্য প্রকাশ করার সুযোগ দেয়, শাসক দলের দলীয় সিদ্ধান্তকেও চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেয় যে ব্যবস্থা, তারই নাম পঞ্চায়েত নির্বাচন। আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে প্রায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের স্বাদ দেয় এই নির্বাচন। যদি এই সুযোগ হারিয়ে যায়, সে ক্ষতি অপূরণীয়। লোকসভা, বিধানসভায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

কাশ্মীর আর মণিপুরের হাল দেখে বাঙালির শিউরে ওঠা উচিত

“আসলে কাশ্মীর আর কাশ্মীরীদের নেই। সমস্ত বড় বড় কনট্র্যাক্ট দেওয়া হচ্ছে বহিরাগতদের। গুজরাট, হরিয়ানার মত জায়গার ব্যবসাদারদের। আমাদের লোকেদের ব্যবসাগুলো ওদের সঙ্গে টাকায় পেরে উঠবে না। ফলে তারা এখন বাইরের লোকেদের সাব-কনট্র্যাক্টর।”

দুজন রাজনীতিবিদ। দুজনেই নিজের রাজ্যের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ – একজন হিন্দু, একজন মুসলমান। একজন মণিপুরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, অন্যজন অধুনালুপ্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের শেষ মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমজন বিজেপির নংথমবাম বীরেন সিং, দ্বিতীয়জন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা পিডিপির মহবুবা মুফতি। এই দুজন অতি সম্প্রতি দুই মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে এমন দুটো সাক্ষাৎকার দিয়েছেন যা পাশাপাশি রেখে দেখলে শুধু মণিপুরি বা কাশ্মীরী নয়, বাঙালিদেরও শিউরে উঠতে হবে। বস্তুত, বাঙালিদেরই শিউরে ওঠার কথা। কাশ্মীরী আর মণিপুরিদের তো সর্বনাশের মাথায় বাড়ি পড়েই গেছে। তাঁদের আর নতুন করে শিউরে ওঠার কী আছে?

২ জুলাই (রবিবার) মহবুবার এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ কাগজে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক সঙ্কর্ষণ ঠাকুর। সেই সাক্ষাৎকারের প্রায় প্রত্যেকটা কথাই উদ্ধৃতিযোগ্য, কিন্তু আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ের দেওয়ার মত কথাটা হল “আমি পাটনায় বিরোধী নেতাদের [সাম্প্রতিক বৈঠকে] বলেছি, মণিপুরে যা ঘটছে সেটাই ভারতের ভবিষ্যৎ চেহারা এবং কেউ কিছু করে উঠতে পারবে না। মণিপুর আমাদের আয়না দেখাচ্ছে।”

গোটা সাক্ষাৎকারে একটাও আশাব্যঞ্জক বাক্য বলেননি মহবুবা। অবশ্য ২০১৯ সালের ৫ অগাস্টের পর কোনো কাশ্মীরীর মুখ থেকে আশার বাণী শোনার আশা করা মানে হয় আপনি কাশ্মীরের ঘটনাবলী সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, নয় মুখে দরদ দেখাচ্ছেন আর মনে মনে ভাবছেন “ভাল টাইট হয়েছে ব্যাটারা”। এই টাইট হওয়ার ব্যাপারটাই ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মানুষের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মানুষের, ভাল করে বোঝা প্রয়োজন এবং বুঝতে গেলে বীরেনের সাক্ষাৎকারের কাছে যেতে হবে। প্রণয় ও রাধিকা রায়ের বিতাড়নের পর এনডিটিভিও যে রবীশ কুমার নামাঙ্কিত গোদি মিডিয়ার অংশ হয়ে গেছে তা সর্বজনবিদিত। সেই চ্যানেল সমেত অন্য অনেক চ্যানেলকেই বীরেন কেন ৩০ জুন (শুক্রবার) পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন এবং শেষপর্যন্ত করলেন না, তা নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সর্বত্র প্রায় একই কথা বলেছেন, এখানে এনডিটিভির সাক্ষাৎকার নিয়েই আলোচনা করব।

পদত্যাগ করতে চাওয়ার কারণ হিসাবে যা জানিয়েছেন তাতে চমকে ওঠার মত কিছু নেই। লোকে যতক্ষণ তাঁর খড়ের পুতুল পোড়াচ্ছিল ততক্ষণ ঠিক ছিল। তা বলে মোদীজির কুশপুত্তলিকা দাহ করবে! অহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা! ওই স্পর্ধা দেখে বীরেন আর স্থির থাকতে পারেননি। তিনি ব্যথিত হন এবং ভাবেন, লোকে যখন তাঁকে বিশ্বাসই করছে না, শ্রদ্ধাই করছে না, তখন চেয়ারে বসে থেকে কী হবে? এসব কথায় প্রশাসক হিসাবে বীরেনের যোগ্যতা বা অযোগ্যতা নয়, প্রকট হয় ফুয়রারের সেনাপতি হিসাবে তাঁর বিশ্বস্ততা। প্রায় ২৮ মিনিটের সাক্ষাৎকারে দেশের বাকি অংশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল শেষ মিনিট আষ্টেক।

প্রায় দুমাস ধরে চলা মণিপুরের দাঙ্গা কেন, কোন ঘটনা থেকে শুরু হল তা দুনিয়াসুদ্ধ লোক জেনে গেছে বহু আগেই। প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যম, এমনকি এই ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত হয়েছে, যে ঘটনার সূত্রপাত ৩ মে মণিপুরের সমস্ত উপজাতিদের এক সম্মিলিত পদযাত্রা থেকে। কী জন্যে আয়োজিত হয়েছিল সেই পদযাত্রা? মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় মেইতেইরা দাবি তুলেছে তাদের তফসিলি উপজাতি বলে ঘোষণা করতে হবে। ২০ এপ্রিল মণিপুর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে বলে, এই দাবি দশ বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। কালবিলম্ব না করে যেন রাজ্য সরকার চার সপ্তাহের মধ্যে এ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারকে তার সুপারিশ জানায়। আদালতের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়াতেই ওই পদযাত্রা বেরোয় এবং দাঙ্গা শুরু হয়। মূল সংঘর্ষ যে মূলত উপত্যকায় বসবাসকারী মেইতেইদের সঙ্গে পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী কুকি এবং নাগাদের, সেকথাও কারোর অজানা নেই। কোনো রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আর্থসামাজিকভাবে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা সম্প্রদায় সংরক্ষণ দাবি করছে, এমনটা ২০১৪ সালের আগে বিশেষ দেখা যেত না। উপরন্তু মুখ্যমন্ত্রী বীরেন নিজে মেইতেই। এসব কারণেই যে মণিপুরের উপজাতিদের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তাও এখন সবার জানা। কিন্তু বীরেন এনডিটিভির সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে এই দুমাসব্যাপী দাঙ্গার এক সম্পূর্ণ নতুন কারণ নির্দেশ করেছেন। বলেছেন মেইতেইদের তফসিলি উপজাতি তালিকাভুক্ত করার আইনি নির্দেশ নাকি আদৌ এসবের কারণ নয়। তাঁর বক্তব্য “সরকার তো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মেইতেইদের তফসিলি উপজাতি ঘোষণা করার সুপারিশ এখনো পাঠায়নি। তাহলে সেদিন পদযাত্রা বার করা হয়েছিল কিসের দাবিতে? যারা করেছিল তাদের জিজ্ঞাসা করুন।” তারপর নিজেই উত্তর দিয়েছেন এবং সেই উত্তরে আলোচনার অভিমুখই বদলে দিয়েছেন।

বলেছেন তাঁর সন্দেহ, এর পিছনে আসলে অনুপ্রবেশকারী এবং মাদক ব্যবসায়ীরা। বলেছেন মণিপুরের পার্বত্য এলাকায় নাকি জনবিন্যাসজনিত ভারসাম্য (“demographic balance”) নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেইতেই এবং নাগা এলাকায় সব ঠিক আছে, কিন্তু কুকি এলাকায় নাকি জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, রাজ্যের মায়ানমার সীমান্তবর্তী তিন জেলায় নাকি গত কয়েক বছরে প্রায় ১,০০০ নতুন গ্রাম গড়ে উঠেছে। একথা জানতে পারার পর তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে ওই এলাকার মানুষের বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র পরীক্ষা করতে বলেন। সেই উদ্দেশ্যে ক্যাবিনেট সাব-কমিটি গড়া হয়। তাঁর সাফাই “সেই কমিটির চেয়ারম্যান করি লেপাও হাওকিপকে, যে নিজেই একজন কুকি। আমার যদি কুকিদের সম্পর্কে খারাপ মনোভাব থাকত, তাহলে এটা করতাম কি?” তিনি এও বলেন যে মণিপুরের কুকিরা তাঁর ভাই, তাদের নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু যারা বাইরে থেকে আসছে তাদের বরদাস্ত করা যায় না। তা সেই সাব-কমিটি নাকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ২,১৭৪ জন অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে ফেলে। বীরেন ভারি নরম গলায় বলেন “আমি বললাম, এরা নিরীহ লোক। বিপদে পড়ে এখানে এসেছে, এদের উপযুক্ত পরিচয়পত্র দিয়ে শেল্টার হোম বানিয়ে রাখা হোক যাতে ভারতীয় নাগরিক না হতে পারে। মায়ানমারে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া যাবেখন। তা এসব করেছি বলে এই গণ্ডগোল করা হয়ে থাকতে পারে।” টানা দুমাস দাঙ্গা চলার পরে, বহু মানুষের মৃত্যুর পরে, বহু মানুষ ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নেওয়ার পরেও রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক সঠিক কারণ বলতে পারলেন না। হাওয়ায় কিছু অভিযোগ ভাসিয়ে দিলেন।

এরপরেই তিনি যোগ করলেন “তাছাড়া ২০১৯ সাল থেকে আমরা মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছি। তাতে দু হাজারের বেশি লোক গ্রেফতার হয়েছে জঙ্গলের এলাকা থেকে। তার মধ্যে একজন গ্রামপ্রধানও আছেন। সুতরাং এই সঙ্কট যারা আফিম চাষ করে সেই মাফিয়ারা আর যারা মায়ানমার থেকে অনুপ্রবেশে প্রশ্রয় দেয়, তারা মিলিতভাবে তৈরি করে থাকতে পারে।”

এই কয়েক মিনিটের কথায় জ্বলন্ত মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী কী কী করলেন একবার দেখে নেওয়া যাক:

১) গোটা অশান্তির দায় কুকিদের উপর চাপিয়ে দিলেন। মেইতেইদের কোনো দোষ নেই। অর্থাৎ একটা রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সুচতুরভাবে একটা সম্প্রদায়ের (তাঁর নিজের সম্প্রদায়) পক্ষ নিয়ে নিলেন।
২) কুকিদের মধ্যে অনেকেই আসলে অনুপ্রবেশকারী – এই সন্দেহ ছড়িয়ে দিলেন। অর্থাৎ কুকিদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন।
৩) কুকিরা পার্বত্য এলাকায়, অরণ্য এলাকায় গ্রামে গ্রামে আফিম চাষ করে। কুকি মানেই সন্দেহজনক, কুকি মানেই অপরাধী হতে পারে – এই ভাষ্য প্রচার করে দিলেন।

এই কায়দা কি নতুন? একেবারেই নয়। গোটা ভারতে মুসলমানদের সম্পর্কে ঠিক এই ভাষ্যই চালায় হিন্দুত্ববাদীরা। কুকির বদলে মুসলমান বসিয়ে নিন আর তৃতীয় ক্ষেত্রে পার্বত্য এলাকা, অরণ্য এলাকার বদলে মাদ্রাসা বসিয়ে নিন। আফিম চাষের বদলে সন্ত্রাসবাদী চাষ বসিয়ে নিন।

সুতরাং বীরেন যা বলেছেন তা বস্তুত বর্তমান ভারতে প্রচলিত সংখ্যাগুরুবাদী ভাষ্যের মণিপুরি রূপ। এবার আসা যাক, বাঙালিদের কেন সচকিত হওয়া উচিত সেই প্রসঙ্গে।

এই ভাষ্যের অসমিয়া রূপটা নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে। সেখানে সংখ্যাগুরু অসমিয়ারা, আর জনবিন্যাসজনিত ভারসাম্য নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগ বাঙালিদের বিরুদ্ধে। অতএব ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনআরসি)। সেই ব্যবস্থার প্রকোপে কত মানুষকে ডিটেনশন সেন্টারে কাটাতে হচ্ছে, কত মানুষের সেখানে মৃত্যু হয়েছে ইতিমধ্যেই, কতজন যে কোনো সময়ে অনুপ্রবেশকারী বলে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন – তার সঠিক সংখ্যা কারোর পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমরা শুধু একটা সংখ্যাই নির্দিষ্টভাবে জানি – ১৯ লক্ষ। ৩১ অগাস্ট ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ পড়ে এতগুলো মানুষের নাম। বলা হয়, এঁরা ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেননি। এঁদের সম্পর্কেও বলা হয়েছিল বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। বাংলাদেশ সে কথায় আমল দেয়নি, মায়ানমারও দেবে না, পৃথিবীর কোনো দেশই দিত বলে মনে হয় না। এদিকে অসমিয়া সংখ্যাগুরুবাদীরা কিন্তু এনআরসি থেকে ‘মাত্র’ ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ যাওয়ায় অখুশি। তারা আরও নিখুঁত (অর্থাৎ আরও বেশি মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার মত) এনআরসি চায়। কোনো মানুষকে বেআইনি বলাই যে অমানবিক, সে আলোচনায় না গিয়েও এনআরসি যে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রক্রিয়া তা বলাই যায়। নইলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যরা এ দেশের নাগরিক নয় – একথা এনআরসিতে প্রমাণিত হল কী করে?

নাগরিকত্বের ধারণাতেই যে মৌলিক গোলমাল আছে সে তর্কে এই আলোচনায় ঢুকব না, অন্য কথা বলি। এ দেশের নাগরিকদের হাতে একাধিক পরিচয়পত্র বহুকাল ধরে আছে। সেসবে এমনিতেই পাহাড়প্রমাণ ভুল থাকে যার জন্য নাগরিকরা নন, সরকারি ব্যবস্থা দায়ী। যে কোনোদিন দেশের যে কোনো মহকুমা আদালতে খানিকক্ষণ বসে থাকলেই দেখা যায় বহু মানুষ আসেন শুধু নাম এফিডেভিট করাবেন বলে। একেক নথিতে একেকরকম নাম ছাপা হয়েছে একেকরকম বানানে। সেইসব মানুষের অধিকাংশই হয় মুসলমান, নয় নিম্নবর্গীয় হিন্দু। কারণ পরিচয়পত্র তৈরির দায়িত্বে থাকা সরকারি আধিকারিকদের মধ্যে হিন্দু উচ্চবর্গীয়রা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা এঁদের নামগুলো জম্মে শোনেননি, শুনলেও বানান জানেন না। জেনে নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না। তাই ভুলের বেশিরভাগটা মুসলমান ও হিন্দু নিম্নবর্গীয়দের কাগজপত্রেই হয়ে থাকে। বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগে কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বাদই দিলাম। তা এই এনআরসি সারা দেশেই করার অভিপ্রায় ছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের। উদ্দেশ্য স্পষ্ট – যেসব সম্প্রদায় হিন্দুরাষ্ট্রে অবাঞ্ছিত, তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া। যেহেতু হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না এত কোটি মানুষ, তাই গণহত্যায় যদি না মরে তো থাকবে। কিন্তু শাসক সংখ্যাগুরুর অধীনস্থ প্রজা হিসাবে থাকবে। এত বড় দেশে ব্যাপারটা করা অসম্ভব, যদি না যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে তাদের মধ্যেই সমর্থন তৈরি করা যায়। তাই ঝোলানো হয়েছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নামক গাজর। ফলে এনআরসি বরাক উপত্যকার বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সমর্থন পেয়ে গেল, পশ্চিমবঙ্গেও ১৯৪৭ বা ১৯৭১ সালের পর এপারে আসা বাঙালদের উত্তরপুরুষের এনআরসি সম্পর্কে মতামত হয়ে গেল “সরকার একটা ভাল জিনিস করলে বিরোধিতা করব কেন?” সঙ্গে মিশে থাকল পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি হারানোর গল্প শুনে বড় হওয়া মস্তিষ্কের প্রতিশোধস্পৃহা। বরাবরের পশ্চিমবঙ্গীয়দের তো কথাই নেই। তাঁরা নিশ্চিন্ত – “আমি যে ছিলাম এই গ্রামেতেই”। যাঁরা এরকম মানসিকতার নন, তাঁরাও ভাবলেন সিএএবিরোধী আন্দোলন করার প্রয়োজন মুসলমানদের। নাগরিকত্ব গেলে তো তাদের যাবে, হিন্দুরা তো এনআরসিতে জায়গা না পেলেও ফের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। মতুয়ারা রীতিমত আশান্বিত হলেন বহু প্রতীক্ষিত নাগরিকত্ব এইবার পাওয়া যাবে ভেবে। নাগরিকত্ব পেতে গেলে যেসব অলীক শর্ত পূরণ করার কথা আইনে বলা আছে সেদিকে খুব বেশি লোকের চোখই পড়ল না।

দেশজুড়ে পথে পথে আন্দোলন এবং কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসের নিচে এনআরসি চাপা পড়ে গেল। সম্ভবত সেই কারণেই আন্দোলন বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকলেও সিএএ অনুযায়ী কাউকে নাগরিকত্ব দেওয়ার তাগিদ আর নরেন্দ্র মোদী সরকারের নেই। আসল উদ্দেশ্য তো অনেককে বাদ দেওয়া, কাউকে কাউকে যোগ করা নয়। যাঁরা ভেবেছিলেন আরএসএস-বিজেপি এনআরসির কথা ভুলে গেছে, তাঁদের বীরেনের কথা মন দিয়ে শোনা উচিত। তাঁর তৈরি ক্যাবিনেট সাব-কমিটি যা করছিল বলছেন, তা তো আসলে এনআরসির কাজই। কিছু মানুষকে অনাগরিক চিহ্নিত করে আলাদা জায়গায় রাখা। বীরেন খেলার মাঠের লোক ছিলেন বলে বোধহয় মনটা নরম, তাই ডিটেনশন সেন্টার না বলে শেল্টার হোম বলেছেন। লক্ষণীয় যে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করা হয়েছে বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র দিয়ে, অর্থাৎ আধার কার্ড। এই জিনিসটি যে একেবারে ফালতু, সেকথা এখন নেহাত নিরক্ষর মানুষও জেনে গেছেন। আধার জাল করা অত্যন্ত সহজ, নিত্যই আধার জাল করে লোকের টাকাপয়সা মেরে দেওয়ার কাহিনি কাগজে, টিভিতে, ওয়েবসাইটে দেখা যায়। আর বায়োমেট্রিক? প্রায়শই শোনা যায় অমুকের আঙুলের ছাপ আর মিলছে না, তমুকের চোখের মণি মিলছে না। ফলে অমুক সরকারি প্রকল্পের টাকা তোলা যাচ্ছে না, রেশন তোলা যাচ্ছে না। এই গোলযোগে ঝাড়খণ্ডে লুখি মুর্মু নামে এক মহিলা অনাহারে মারা গেছেন বলেও অভিযোগ আছে। সেই আধার কার্ড দিয়ে নাগরিক চিনে নিচ্ছে বীরেনের সরকার।

তবে এনআরসির চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে গেছে তাঁর ক্যাবিনেট কমিটি। কারণ গোটা রাজ্যের মানুষের নাগরিকত্বের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু সংখ্যালঘু কুকিদের। আগামীদিনে কি তাহলে এভাবেই অন্য নামে এনআরসি হবে সারা দেশে? যে যেখানে সংখ্যালঘু কেবল তাদেরই নাগরিকত্বের পরীক্ষায় বসানো হবে, যাতে আসামের এনআরসির চেয়ে অনেক সহজ, সুশৃঙ্খল হয় কাজটা, আরও বেছে বেছে অপছন্দের জনগোষ্ঠীর মানুষকে বাদ দেওয়া যায়? আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। যাঁরা জানেন না তাঁরা বলবেন, এ তো মেইতেই-নাগা জাতিগত রেষারেষির ব্যাপার। এর মধ্যে আরএসএস, হিন্দুত্ব, হিন্দুরাষ্ট্র আসছে কোথা থেকে? তাঁদের জন্য উল্লেখ থাক, মেইতেইরা প্রধানত হিন্দু। কুকিরা প্রধানত খ্রিস্টান। গত দুমাসে কয়েকশো গির্জা এবং মন্দির পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে মণিপুরে।

ভারতে তো আজকাল আর এসব পড়ে মানুষ হিসাবে খারাপ লাগে না অনেকের। ফলে শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য এনআরসি করার আশঙ্কাতেও শিউরে উঠবেন না অনেকেই, যদি তিনি যেখানে আছেন সেখানকার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ হন। তাই মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, ভারতবর্ষ এমন এক সাড়ে বত্রিশ ভাজা যে এদেশে সকলেই কোথাও না কোথাও সংখ্যালঘু। মারোয়াড়ি বা গুজরাটি নিজের রাজ্যে ধর্মীয় এবং জাতিগতভাবে সংখ্যাগুরু; কর্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গে এসে জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু। বাঙালি হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে সংখ্যাগুরু; বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ বা দিল্লিতে জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু। বাঙালি মুসলমান হিন্দি বলয়ে গেলে আবার জাতিগত ও ধর্মীয় – দুভাবেই সংখ্যালঘু। দেড়শো কোটি ভারতীয়ের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া খুব শক্ত যে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যেখানেই যাবে সেখানেই সবদিক থেকে সংখ্যাগুরুই থাকবে। অথচ করমণ্ডল এক্সপ্রেসের অসংরক্ষিত কামরায় যাত্রা করা দিনমজুর থেকে শুরু করে লোরেটো হাউসের প্রাক্তনী আই টি মজুর পর্যন্ত সকলকেই জীবিকার টানে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেতে হবে, সেখানে সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে হবে। যতই ফড়ফড়িয়ে ইংরিজি বলুন আর গড়গড়িয়ে হিন্দি, নাম দেখে বাঙালি বলে ঠিক চিনে ফেলা যাবে। ফলে নিশ্চিন্ত থাকার উপায় কারোরই নেই।

এই কারণেই মহবুবা যা বলেছেন তা অভ্রান্ত। আসামে এনআরসি নাম দিয়ে বা মণিপুরে ক্যাবিনেট সাব-কমিটির নাম দিয়ে যা করা হচ্ছিল তা আসলে ভারতের প্রতিটি রাজ্যের জন্য সযত্নে আলাদাভাবে তৈরি একেকটা হিন্দুত্ববাদী মডেল (যদিও উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে এনআরসির পথ করে দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী)। হিন্দুত্ববাদের লক্ষ্য অখণ্ড ভারত, কিন্তু আসলে যা করছে এবং এই কর্মপদ্ধতি একমাত্র যা করে উঠতে পারে, তা হল ভারতের বালকানায়ন (Balkanisation)। অর্থাৎ খণ্ড খণ্ড ভারত। যত এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক পুলিস, এক নির্বাচন, এক দেওয়ানি বিধি ইত্যাদি ধারণা গোটা ভারতের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাড়ছে, তার প্রতিক্রিয়ায় ভূমিপুত্রদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের মত রক্ষণশীল দাবিও বাড়ছে। দুই রাজ্যের পুলিসের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটছে। এভাবে চললে সব রাজ্যেই ‘ভিনরাজ্যের লোক হটাও’ অভিযান শুরু হবে। এর ট্রেলারও ইতিমধ্যেই কিছু কিছু জায়গায় দেখানো হয়ে গেছে। সোশাল মিডিয়ার যুগে কোনো রাজ্যকে এসব ইস্যুতে মণিপুর করে দেওয়া কয়েক মিনিটের ব্যাপার। সংরক্ষণের মত কোনো বড় ইস্যুর প্রয়োজনই পড়বে না।

আরো পড়ুন স্রেফ বলপ্রয়োগে মণিপুর সমস্যা আরো বাড়বে

তবে হিন্দুত্ববাদী মডেল যারা তৈরি করে তাদের আর যা-ই হোক, অবধানের এবং পরিশ্রমের খামতি নেই। একই মডেল যে সব রাজ্যে চলবে না তা তারা বিলক্ষণ জানে। তারা বোঝে যে কিছু রাজ্য আছে যেখানকার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে এভাবে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সরাসরি লড়িয়ে দেওয়া যাবে না। অন্য কৌশল দরকার হবে। আবার জম্মু ও কাশ্মীরের মত রাজ্যও ছিল, যেখানে হিন্দুত্বের সবচেয়ে বড় ঘোষিত শত্রু মুসলমানরাই সংখ্যাগুরু। সেক্ষেত্রে রাজ্যটাকেই ভেঙে দেওয়া দরকার। সে কাজ সম্পন্ন হয়েছে লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। কিন্তু আধিপত্য স্থায়ী করতে হলে দরকার রাজ্যটার চরিত্রই বদলে দেওয়া। জনবিন্যাসজনিত ভারসাম্য নষ্ট করার যে অভিযোগ কুকিদের বিরুদ্ধে বীরেন করেছেন, মহবুবা সঙ্কর্ষণকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন প্রায় সে জিনিসই ৫ অগাস্ট ২০১৯ তারিখের পর থেকে কাশ্মীরে করা হচ্ছে। “আসলে কাশ্মীর আর কাশ্মীরীদের নেই। সমস্ত বড় বড় কনট্র্যাক্ট দেওয়া হচ্ছে বহিরাগতদের। গুজরাট, হরিয়ানার মত জায়গার ব্যবসাদারদের। আমাদের লোকেদের ব্যবসাগুলো ওদের সঙ্গে টাকায় পেরে উঠবে না। ফলে তারা এখন বাইরের লোকেদের সাব-কনট্র্যাক্টর। বালি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের বিরাট আবিষ্কার লিথিয়াম – সবকিছু বাইরের লোকেদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তাও দুর্নীতি করে,” বলেছেন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।

তাহলে মোদ্দা কথা হল, যে রাজ্যের সংখ্যাগুরু (ধর্মীয় বা জাতিগত) হিন্দুত্বের পতাকা নিজেই তুলে নেবে না সে রাজ্যকে ভেঙে দেওয়া হবে। সেখানকার অর্থনীতির লাগাম তুলে দেওয়া হবে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী রাজ্যগুলোর ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে। বদলানোর চেষ্টা হবে জনবিন্যাস। ফলে যারা ছিল সংখ্যাগুরু, তারা হয়ে যেতে পারে ভীত সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘু। এ হল হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার আরেকটা মডেল। পশ্চিমবঙ্গবাসীর শিউরে ওঠা উচিত, কারণ পশ্চিমবঙ্গে একইসঙ্গে মণিপুর মডেল এবং কাশ্মীর মডেল প্রয়োগ করা সম্ভব।

ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির একেকজন নেতা উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য করা নিয়ে একেকরকম কথা বলে রেখেছেন। এমনকি কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান জীবন সিং এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ বছর জানুয়ারি মাসে দাবি করেছিলেন, আলাদা কামতাপুর রাজ্যের দাবি নিয়ে নাকি কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা চলছে। মধ্যস্থতা করছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। একথা সত্যি যে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো ভাবনাচিন্তা আছে বলে ঘোষণা করা হয়নি। তবে মনে রাখা ভাল, সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করা এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে আগের দিন সন্ধেবেলাও কিছু জানতেন না বলে দাবি করেছেন তৎকালীন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক। অবশ্য যিনি বলেন রাজভবনের ফ্যাক্স মেশিন খারাপ ছিল বলে মহবুবার সরকার গঠন করার দাবি জানতে পারেননি, তাঁকে বিশ্বাস করা চলে না। কিন্তু সঙ্কর্ষণের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মহবুবাও বলেছেন “হপ্তাখানেক ধরে গুজব শুনছিলাম…সেইজন্যেই আমি, ওমর আবদুল্লা এবং অন্যরা মিলে রাজ্যপালের কাছে যাই জানতে যে সত্যিই ৩৭০ রদ করা হবে কিনা। উনি আমাদের বলেন ‘আমি আপনাদের বলছি, সেরকম কিচ্ছু হবে না’। পরদিন সকালে কী হল সে তো জানেনই। আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল বটে, কিন্তু যতক্ষণ না পরেরদিন আমাদের মাথায় বাজ পড়ার মত করে ব্যাপারটা ঘটল, আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি।”

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির লাগাম এমনিতেই অনেকটা হিন্দিভাষীদের হাতে। রাজ্য ভাগ করলে বাঙালি হিন্দুরা উত্তরবঙ্গে নানা জাতি, উপজাতির মধ্যে হয়ে পড়বেন সংখ্যালঘু। কাশ্মীরী মুসলমানদের দুর্গতি দেখে ২০১৯ সালে যাঁরা উল্লসিত হয়েছিলেন তাঁরা সেদিন বিপুল অপরাধবোধে ভুগতে পারেন।

দক্ষিণবঙ্গে হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০২৪ সালের পর জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সারা দেশের লোকসভা, বিধানসভার আসনগুলোর ভোটার পুনর্বিন্যাস করার কথা। গোটা বা ভাঙা দক্ষিণবঙ্গে এমন হতেই পারে যে বেশকিছু আসনে বাঙালিরা নয়, হিন্দিভাষীরাই হয়ে গেলেন নির্ণায়ক শক্তি। অথচ মণিপুরের মতই পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে, অনুপ্রবেশকারীতে ভরে যাচ্ছে – এ অভিযোগ বিজেপির বহুকালের (সংসদে এ অভিযোগ প্রথম তোলেন অবশ্য মমতা ব্যানার্জি)। বীরেন যেমন সংখ্যালঘু কুকিদের মায়ানমার থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী বলে সন্দেহ ছড়াচ্ছেন, তেমনই বাঙালি মুসলমানরা আসলে বাংলাদেশি – এই সন্দেহ সারা ভারতে ইতিমধ্যেই ছড়ানো হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত তার ফল ভোগ করেছেন শুধুমাত্র ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়, ধর্ম বা শ্রেণি নির্বিশেষে বাঙালি মাত্রেই যে বাংলাদেশি (হ্যাঁ, হিন্দু উচ্চবর্গীয়রাও। কারণ দেশভাগের ফলে বিপুল সংখ্যক বাঙালি হিন্দুর এ পারে চলে আসার কথা আই টি সেলের প্রত্যেকটি কর্মী জানে) – এই ধারণার প্রচার পুরোদমে চলছে। রাজ্য ভেঙে গেলে চাটুজ্জে, বাঁড়ুজ্জে, ঘোষ, বোসদেরও অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত হতে সময় লাগবে না।

আরও পড়ুন প্রজাতন্ত্রসাধনা

কাশ্মীরীরা আজ কেমন আছে জিজ্ঞেস করায় মহবুবা যা বলেছেন তা একেবারে জর্জ অরওয়েলের ডিস্টোপিক উপন্যাস নাইন্টিন এইট্টি ফোর মনে পড়ায়। “কাশ্মীরীরা প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে বাস করছে। তারা ঘরের মধ্যেও মন খুলে কথা বলত পারে না, কারণ তারা ভীত, তাদের বেঁচে থাকার বোধটাকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আমরা বন্দুক আর বুটের নিচে বাস করছি।” যেসব জনগোষ্ঠীকে হিন্দুত্ব নিজেদের শত্রু বলে মনে করে, তাদের কিন্তু এভাবেই রাখতে পছন্দ করে। কেবল বাঙালি মুসলমান নয়, বাঙালি হিন্দুরাও যে মোটেই আরএসএসের পছন্দের জনগোষ্ঠী নয় তার বহু প্রমাণ আছে, খামোকা এ লেখার কলেবর বাড়িয়ে লাভ নেই। কিছুই খুঁজে না পেলে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারসভায় “ভারত মাতা কি জয়” স্লোগান খেয়াল করুন। নিদেন বাংলায় অনুবাদ করে নিয়ে “ভারতমাতার জয়” বলাও বিজেপি কর্মীদের না-পসন্দ।

কেউ অবশ্য বলতেই পারেন, পশ্চিমবঙ্গ অনেক বড় রাজ্য, বাঙালিরাও অনেক বড় জাতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গবাসী হিন্দু তো বটে। সুতরাং মণিপুর, কাশ্মীর নিয়ে আমাদের ভাবার দরকার কী? অমন ব্যবহার আমাদের প্রতি আরএসএস-বিজেপি করতে যাবে কেন? বড় রাজ্য, বড় জাতিকে ছোট করে নেওয়ার কায়দা যে হিন্দুত্ববাদীদের জানা আছে তা তো আগেই ব্যাখ্যা করেছি। ফলে বিরাটাকার নিয়ে ভরসা করে বোধহয় লাভ নেই। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যবাসীর হিন্দুরাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিক হয়ে ওঠার ক্ষমতার উপর হয়ত ভরসা রাখা যায়। যেভাবে চতুর্দিক হিন্দিভাষীতে ভরে যাওয়া নিয়ে নিচু গলায় অসন্তোষ প্রকাশ করতে করতে নিজের ছেলেমেয়েদের স্কুলের দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি করে দিচ্ছেন কলকাতা ও শহরতলির ভদ্রলোকেরা, বাঙালি হিন্দুর বহুকালের উৎসব রথযাত্রার চেয়ে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছেন গণেশপুজোয়, যেভাবে বারাণসীর ঢঙে কলকাতার ঘাটে গঙ্গারতি চালু করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, দীঘাকে করে তুলছেন পুরীর মত তীর্থস্থান, শাসক দল রামনবমীর মিছিল করছে বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, বজরংবলীর পুজো হচ্ছে ঘটা করে, বাংলা মেগাসিরিয়ালে বাজছে হিন্দি ছবির গান, বাংলা ছবির পোস্টার সারা ভারতে মুক্তির দোহাই দিয়ে লেখা হচ্ছে দেবনাগরী হরফে আর বাঘাযতীনের চেহারা হয়ে যাচ্ছে অক্ষয় কুমারের কেশরী ছবির পাঞ্জাবি যোদ্ধার মত – তাতে বিনাযুদ্ধে শুধু মেদিনীপুর নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গ হিন্দুরাষ্ট্রের সবচেয়ে লক্ষ্মীসোনা রাজ্য হয়ে গেলেও আশ্চর্য হওয়া যাবে না।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

বায়রন যদি ব্রুটাস হন, তৃণমূল কে?

২০২১ সালে যে তৃণমূল নেতাদের প্রতি মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন, যাঁরা বিজেপিতে গিয়ে বিপুল ভোটে হেরেছিলেন, তাঁদের নির্বাচনের ফল বেরোবার পর অনতিবিলম্বেই ফিরিয়েও নেওয়া হয়েছিল।

অবাক হওয়ার ক্ষমতা কমে আসাই সম্ভবত বার্ধক্যের সবচেয়ে নিশ্চিত লক্ষণ। বায়রন বিশ্বাস কংগ্রেসের টিকিটে, সিপিএমের সমর্থনে মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় খুব একটা অবাক হতে পারিনি। ফলে বুঝলাম, বুড়ো হচ্ছি। আমি যখন ছাত্র, তখন আমাদের কলেজের সেমিনারে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। পিঠে ভারি স্কুলব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাওয়া এক পরিচিত স্কুলছাত্রকে নাকি তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন “কেমন আছ?” সে উত্তর দিয়েছিল “ওই আছি আর কি। এবার গেলেই হয়।” তখনও এ-দেশে মোবাইল ফোন সহজলভ্য হয়নি। তখনই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এসে আমার মতো চালসে পড়া লোকের তো বুড়ো হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। চারপাশ অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। এত দ্রুত, যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে বদলানো প্রায় কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই বোধহয় সাহিত্য, সিনেমা, সোশাল মিডিয়া— সর্বত্র স্মৃতিমেদুরতার ছড়াছড়ি, একমাত্র নস্টালজিয়ার বাজারই সর্বদা সরগরম। বদল এমনিতে জীবনের লক্ষণ, তা মনোরঞ্জক এবং উত্তেজক। কিন্তু ঘনঘন বদল আবার একঘেয়ে হয়ে যায়। সর্বক্ষণ চার, ছয় হয় বলে যেমন আজকাল আর আইপিএল ম্যাচ দেখতে ভাল লাগে না। মনে হয়, এ তো জানা কথাই। খেলার মহান অনিশ্চয়তা বলে আর কিছু নেই। রাজনীতিও ক্রমশ মহান অনিশ্চয়তা হারাচ্ছে। এ রাজ্যের রাজনীতি তো বটেই।

অনেকেই চটে যাবেন। তবু না বলে পারছি না— পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলবদল ব্যাপারটা এতই জলভাত হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে, যে বায়রনের দলবদল নিয়ে কংগ্রেস ও বাম নেতৃত্বের আহত হওয়া এবং বহু সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া বা হতাশায় ভোগা আমার কাছে প্রাথমিকভাবে কৌতুককর। পরে অন্য কিছু। আগেই বলেছি, অতি দ্রুত সবকিছু বদলালে নিরুপায় মানুষ স্মৃতির কাছেই আশ্রয় নেয়। অনতি-অতীতে ফিরে গেলেই দেখতে পাই, এ রাজ্যের সর্বত্র একেকটা পাড়া বা পরিবার সম্পর্কে অন্যরা বলত “ওরা পাঁড় কংগ্রেসি” বা “ওরা কট্টর সিপিএম”। কোনও কোনও মানুষ সম্পর্কে বলা হত “প্রথমদিন থেকে তৃণমূলে আছে”। আজকাল আর সেসব বলা যায় না। এক যুগ আগে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেখা গেছে রেজ্জাক মোল্লার মতো “ঘামের গন্ধওলা কমরেড” তৃণমূলে চলে যেতে পারেন। উদয়ন গুহর মতো পারিবারিকভাবে বামপন্থী নেতা দল বদলাতে পারেন। হাত-পা নেড়ে মার্কসবাদ কপচানো, পকেটে মঁ ব্লাঁ পেন আর হাতে আই ওয়াচ পরা সিপিএমের রাজ্যসভার সদস্য ঋতব্রত ব্যানার্জি তৃণমূলের মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারেন নিঃসঙ্কোচে। এমনকি প্রবীণ সিপিএম নেতা তথা বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘদিনের মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের বিশ্বস্ত সৈনিক শঙ্কর ঘোষ বিজেপির নির্ভরযোগ্য ‘কারিয়াকার্তা’ হয়ে উঠতে পারেন। তালিকা দীর্ঘতর করা যেতেই পারে, কিন্তু বক্তব্য পরিষ্কার করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। যেসব মানুষ কখনও বামপন্থীদের ভোট দেন না, দেবেন না— তাঁদেরও কিন্তু বরাবর প্রত্যাশা থাকে, আর যে যা-ই করুক, বামপন্থীরা এমন নীতিহীনতায় জড়াবেন না। সেই বামপন্থীদেরই এসব করতে দেখে ফেলার পর ধনী ব্যবসায়ী কংগ্রেসি বায়রনের কাছে অন্যরকম প্রত্যাশা থাকবেই বা কেন? তিনি তো দেখলাম ঘোরপ্যাঁচহীন সরল মানুষ। বলেছেন, তৃণমূল প্রার্থী করেনি বলে কংগ্রেসে গিয়েছিলেন। এখন যখন বিধায়ক হয়েই গেছেন, তখন আর দলের উপর রাগ করে থাকার দরকার কী?

সাগরদীঘির ভোটাররা রাগ করতে পারেন এই লোকটির বিশ্বাসঘাতকতার জন্য, অধীর চৌধুরী রাগ করতে পারেন তাঁকে বোকা বানানো হয়েছে বলে। আমরা, বাকি রাজ্যের মানুষ, যদি রাগ করতে চাই তাহলে কয়েকটা কথা একটু স্মরণ করে নেওয়া দরকার।

এ রাজ্যের বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় দিনের পর দিন একাধিক বিধায়ককে বাইরে তৃণমূল, ভিতরে বিজেপি হয়ে থাকতে দিচ্ছেন। এঁদের মধ্যে মুকুল রায় বলে একজন আছেন, যিনি বিজেপির টিকিটে বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে পরে ঘটা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতিতে তৃণমূলে ফিরে এসেছেন বলে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। তারপর যখন তাঁকে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়, তখন বিরোধীরা সমালোচনা করেন। কারণ সংসদীয় প্রথা অনুযায়ী ওই পদটা প্রধান বিরোধী দলকে দেওয়া হয়ে থাকে। এই সমালোচনার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দেন, মুকুল তো বিজেপিরই বিধায়ক। কদিন আগেও মমতা একথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। বিধানসভার বাইরে প্রায় প্রতিদিন গরম গরম মন্তব্য করে বিজেপিকে সংবাদের শিরোনামে রাখেন যে বিরোধী দলনেতা, জনসভার অনুমতি আদায় করতে বারবার আদালতের দ্বারস্থ হতে যাঁর ক্লান্তি নেই, সেই শুভেন্দু অধিকারী কিন্তু এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার হুমকি-টুমকি দেননি কখনও। সুতরাং ধরে নিতে হয় মুকুল তৃণমূলেরও, বিজেপিরও। শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী সারদামণি যেমন বলতেন “আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।” তা এই ব্যবস্থায় যদি আমাদের রাগ না হয়, খামোকা বায়রনকে ব্রুটাসের সঙ্গে একাসনে বসানোর প্রয়োজন কী?

ওই লোকটি যে জনাদেশকে অসম্মান করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ রাজ্যের এক বড় অংশের মানুষ তো আবার তৃণমূল দল ভাঙালে তাতে জনাদেশের অসম্মান হয় বলে মনে করেন না। ঠিক যেভাবে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এবং সোশাল মিডিয়ায় বিজেপি কোনও রাজ্যের সরকার দল ভাঙিয়ে ভেঙে দিলে অমিত শাহকে চাণক্য বলা হয়, ব্যাপারটাকে মাস্টারস্ট্রোক বলা হয়, সেইভাবে এ রাজ্যেও তো অন্য দলের নেতা তৃণমূলে যোগ দিলে তা গণতন্ত্রের জয় বলেই ঘোষণা করেন বহু মানুষ। বিভিন্ন চ্যানেলের অ্যাঙ্কররাও গদগদ হয়ে বলেন, তৃণমূল দেখিয়ে দিল। বায়রনের দলবদলের পর যেমন বলা হচ্ছে, সাগরদীঘির পরাজয়ের জবাব দিল তৃণমূল। প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, জবাবটা কাকে দিল? ভোটারদের? যে ভোটাররা তৃণমূলকে দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন? তাহলে লড়াইটা কি শাসক দল বনাম ভোটারের? একেই তাহলে এখন গণতন্ত্র বলছি আমরা? পরপর হিমাচল প্রদেশ আর কর্নাটকে মুখ থুবড়ে পড়ার আগে বিজেপি সম্পর্কে সর্বভারতীয় স্তরে একটা কথা চালু হয়ে গিয়েছিল— ভোটে যে-ই জিতুক, সরকার গড়বে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কি আলাদা কিছু করছে?

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন যে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল তা তো ইদানীং অভিষেকও ঠারেঠোরে স্বীকার করেন। এ বছরে সময় অতিক্রান্ত হলেও পঞ্চায়েত নির্বাচন করানো নিয়ে সরকারের কোনও উৎসাহ নেই। রাজ্যপাল রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করছেন না, সরকারও তা নিয়ে সংঘাতে যাচ্ছে না। অথচ এমনিতে কত বিষয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে কত আকচা-আকচি চলে! ২০২১ সালে যে তৃণমূল নেতাদের প্রতি মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন, যাঁরা বিজেপিতে গিয়ে বিপুল ভোটে হেরেছিলেন, তাঁদের নির্বাচনের ফল বেরোবার পর অনতিবিলম্বেই ফিরিয়েও নেওয়া হয়েছিল। উপরন্তু বাবুল সুপ্রিয়র মতো দাঙ্গাবাজ বিজেপিফেরতকে উপনির্বাচনে প্রার্থী করে মন্ত্রীও বানানো হয়েছে। এগুলো জনাদেশকে সম্মান করার লক্ষণ? এই ধারাতেই তো কংগ্রেসের একমাত্র বিধায়ককে দলে টেনে নেওয়া হল। আবার মঞ্চে বসে অভিষেক জাঁক করে এও বললেন, যে বোতাম টিপলেই কংগ্রেসের চারজন সাংসদকে তৃণমূল নিয়ে নিতে পারে। একের পর এক দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় দল যখন টলমল করছে, দিদির দূত প্রকল্প ঘটা করে ঘোষণা করার পর জনরোষের চেহারা দেখে চুপিসাড়ে বন্ধ করে দিতে হয়েছে, নবজোয়ারে বেরিয়ে নিত্য ল্যাজেগোবরে হতে হচ্ছে— তখনও এভাবে বুক ফুলিয়ে দল ভাঙানোর হুমকি দেওয়া থেকে বোঝা যায় যে অভিষেক মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নীতি একটা বাতিল পণ্য হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন চাকরি চুরির চাঁইদের শেষ অব্দি কী গতি হয়?

তাঁর ধারণা যথার্থ। বিজেপির বিরুদ্ধে চাট্টি গরম গরম কথা বললেই (এমনকি আরএসএসের বিরুদ্ধেও বলতে হয় না। মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেন আরএসএস খারাপ নয়) সরকারি দলের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, গঙ্গারতি ও মন্দির নির্মাণ সত্ত্বেও বিজেপিকে আটকাতে তাদেরই ভোট দেওয়া আমাদের কর্তব্য— একথা যখন থেকে এ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনই নীতির ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয়ে গেছে। ২০২১ সালের নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল বিজেপিকে আটকানো, রাজ্যের সরকারের কাজের মূল্যায়ন নয়। তাতে ক্ষতি নেই। গণতন্ত্রে ভোটাররা নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিজেরাই তো ঠিক করবেন। কিন্তু আজ দুবছর পরে ভেবে দেখা দরকার, বিজেপিকে আটকানোর উদ্দেশ্যটুকুও সফল হয়েছে কি? বিজেপি তিনজন বিধায়ক নিয়ে এককোণে পড়ে থাকা দল থেকে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে তো বটেই, সরকারবিরোধী ভোটাররা যাতে বিজেপি ছাড়া আর কোনও দলের উপর ভরসা করতে না পারেন তার জন্যে শাসক দল আপ্রাণ চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় পক্ষের কাছে সামান্য একটা উপনির্বাচনে হারও তারা সহ্য করছে না। না হয় মেনে নেওয়া গেল, কংগ্রেস নিজেদের বিধায়ককে ধরে রাখতে পারে না বলে অপদার্থ। সিপিএম আরও অপদার্থ, কারণ তারা আদালতের মুখাপেক্ষী হয়ে আন্দোলন করে— এও না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপিই একমাত্র পদার্থ হিসাবে পড়ে থাক— এমন পরিস্থিতিই কি তৈরি করতে চেয়েছিলাম আমরা? বায়রনের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে চুটকি আর মিম বানানো বা ক্ষোভ প্রকাশ করার চেয়ে নিজেদের এই প্রশ্ন করা বেশি জরুরি। কারণ আবার নির্বাচন আসছে। গণতন্ত্রের ওইটুকু তলানিই তো পড়ে আছে আমাদের জন্যে— একটা ভোট দেওয়ার অধিকার।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

কর্ণাটক নির্বাচনের ফল: মিডিয়া, জিভ কাটো লজ্জায়

কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকতা আজ কদর্যতার নতুন শৃঙ্গে আরোহণ করল বিজেপি হেরে যাওয়ায়। এর বিপদ দীর্ঘমেয়াদি।

কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল রাজনৈতিকভাবে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেভাবে এই নির্বাচনের ফলাফল সম্প্রচারিত হতে দেখলাম টিভির পর্দায়, সাংবাদিক হিসাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করাও আমার অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। ব্যাপারটার শুরু নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকেই।

নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় এ দেশে চব্বিশ ঘন্টার খবরের চ্যানেলের ছড়াছড়ি হওয়ার পর থেকেই প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষা বা ওপিনিয়ন পোল এবং বুথফেরত সমীক্ষা বা এক্সিট পোলের বিপুল জনপ্রিয়তা। প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষা ভোটারদের প্রভাবিত করে কিনা বা এক দফা ভোটের পর টিভিতে বুথফেরত সমীক্ষা হলে পরের দফাগুলোয় যেখানে ভোটদান হবে সেখানকার ভোটদাতারা প্রভাবিত হন কিনা – এ নিয়ে একসময় বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। ফলে এখন নিয়ম হয়ে গেছে, যে কোনো স্তরের নির্বাচনের ৪৮ ঘন্টা আগে থেকে প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষার ফল প্রকাশ করা যাবে না, আর শেষ দফার ভোটদান সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বুথফেরত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা যাবে না। ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো গত কয়েক বছরে নিরপেক্ষতার ভান ত্যাগ করে ক্রমশ যত একচোখা হয়ে উঠেছে, তত এইসব সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তা সত্ত্বেও গত ডিসেম্বর মাসেই সংসদে মন্ত্রী কিরেন রিজিজু জানিয়ে দিয়েছেন, এইসব সমীক্ষা নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।

খুব ভাল কথা। গত দশ বছরে লোকসভা তো বটেই, বেশিরভাগ নির্বাচনের প্রাক্কালে মতামত সমীক্ষায় দেখা গেছে বিজেপি ভাল জায়গায় আছে, বুথফেরত সমীক্ষাতেও তাই। সবসময় যে সেইসব সমীক্ষার ফল মিলেছে তা নয়, সব নির্বাচনেও বিজেপি জেতেনি। কিন্তু ভুল কোন সমীক্ষায় না হয়? কোন দলই বা সব নির্বাচনে জেতে? ফলে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের এইসব সমীক্ষা নিষিদ্ধ করতে চাওয়ার কারণও ছিল না। কিন্তু এবারে কর্ণাটক নির্বাচনের আগে একটা অন্যরকম প্রবণতা লক্ষ করা গেল। যেই দেখা গেল প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষাগুলোতে ক্ষমতাসীন বিজেপির হাল ভাল নয় বলে দেখা যাচ্ছে, অমনি চ্যানেলগুলো ওইসব সমীক্ষা নিয়ে হইচই করা বন্ধ করে দিল। কোন চ্যানেলের সমীক্ষায় কী পাওয়া গেছে তা নিয়ে খবরের কাগজগুলোও বিশেষ জায়গা খরচ করল না। অথচ কাগজের রাশিফলের কলাম অনেকে যেভাবে গেলে, সেইভাবে ভোটে কী হতে চলেছে তা নিয়ে অনুষ্ঠান হলেও লোকে বিলক্ষণ গেলে। কারণ ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা কল্পনা করতে প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ ভালবাসে। অতএব টিআরপি আদায় করতে যে কোনো চ্যানেলের কাছে সমীক্ষাগুলো দারুণ লোভনীয়। তবু ঢাকঢোল পিটিয়ে সেগুলো নিয়ে প্রচার করতে দেখা গেল না। অথচ অতীতে খোদ বিজেপিকে দেখা গেছে বিজ্ঞাপন দিতে, যার বয়ান খানিকটা এইরকম – সমস্ত ওপিনিয়ন পোল বলছে আমরা জিতব। তাই আমাদেরই ভোট দিন। এবারে প্রায় কোনো প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষাকেই সেভাবে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না। তাই কি গোদা বাংলায় যাকে চেপে যাওয়া বলে, গোদী মিডিয়া তাই করতে শুরু করল?

এ সন্দেহ দৃঢ় হয় রায় দম্পতির হাত থেকে গৌতম আদানির করতলগত হওয়া এনডিটিভির কাণ্ড খেয়াল করলে। তারা ১০ মে ভোটদানের আগে দুদিন ধরে বিস্তারিত প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষার ফলাফল সম্প্রচার করল। তাতে ভোটাররা কোন ইস্যুকে প্রধান ইস্যু বলে ভাবছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ সম্পর্কে মতামত কী, রাজ্য সরকারের কাজ সম্পর্কে কী ভাবছেন – এইসব গভীর প্রশ্ন ছিল। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কত শতাংশ মানুষ কাকে দেখতে চান – এ প্রশ্নও ছিল। অথচ কে কত আসন পেতে পারে সেই হিসাবটাই দেখানো হল না।

আরও মজা হল গত বুধবার ভোটদানের পর সন্ধেবেলা। একমাত্র নিউজ নেশন-সিজিএস বুথফেরত সমীক্ষা নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে বলল, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে ১১৪ আসন নিয়ে, কংগ্রেস পাবে ৮৬, জেডিএস ২১ আর অন্যরা তিন। আর কোনো সর্বভারতীয় সমীক্ষাই নির্দিষ্ট সংখ্যা বলতে রাজি হল না। “এত আসন থেকে অত আসনের মধ্যে পাবে” – এটাই দেখা গেল সকলের পছন্দের নীতি। তাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস আর বিজেপি – দুই প্রধান পক্ষকে যে সংখ্যাগুলো দেওয়া হল, সেগুলোর কোনো সীমা পরিসীমা নেই। যেমন এবিপি নিউজ-সি ভোটার বলল বিজেপি পাবে ৬৬-৮৬ আসন আর কংগ্রেস ৮১-১০১। রিপাবলিক টিভি-পি মার্কের মতে বিজেপি ৮৫-১০০; কংগ্রেস ৯৪-১০৮। সুবর্ণ নিউজ-জন কি বাত বিজেপিকে দিল ৯৪-১১৭, কংগ্রেসকে ৯১-১০৬। টিভি ৯ ভারতবর্ষ-পোলস্ট্র্যাট বলল বিজেপি পাবে ৮৮-৯৮, কংগ্রেস ৯৯-১০৯।

সংখ্যাগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। একটা দল ৯৪ আসন পাওয়া মানে তার বিরোধী আসনে বসা প্রায় নিশ্চিত, অন্যদিকে ১১৭ আসন পাওয়া মানে নিশ্চিন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ছেলে পরীক্ষা দিয়ে এল, বাবা জিজ্ঞেস করলেন “কত পাবি?” ছেলে বলল “পাসও করতে পারি, ফেলও করতে পারি।” এ তো সেইরকম সমীক্ষা হয়ে গেল। একটা দল ৮৫ পেতে পারে, আবার একশোও পেতে পারে – একথা বলার জন্যে সমীক্ষা করার প্রয়োজন কী? এনডিটিভি নিজে কোনো সংস্থার সাহায্য নিয়ে এবারে বুথফেরত সমীক্ষা করেনি। এই সংখ্যাগুলো যখন বুধবার সন্ধ্যায় তাদের চ্যানেলে দেখানো হচ্ছিল, তখন বিজেপি মুখপাত্র দেশরতন নিগম সঙ্গত কারণেই বলেছিলেন “এবার দেখছি আমিও একটা পোল সার্ভে এজেন্সি খুলে ফেলতে পারি।”

চূড়ান্ত ফল এই সমস্ত সমীক্ষাকেই ভুল প্রমাণ করেছে। যখন এই লেখা লিখছি, তখন নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট বলছে কংগ্রেস ১১৭ আসনে জিতে গেছে, আরও ১৯ আসনে এগিয়ে। অর্থাৎ মোট ১৩৬। বিজেপি ৫৩ আসনে জয়ী, আরও ১১ আসনে এগিয়ে। অর্থাৎ মোট ৬৪। এছাড়া জেডিএস ১৮ আসনে জয়ী, আরও দুই আসনে এগিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে এই সমীক্ষাগুলোর ভুলের পরিমাণ কিন্তু লাগাতার কমছিল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মত হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনের ফলাফল কোনদিকে যাবে তা সঠিকভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন অনেক সংস্থার সমীক্ষকই, দু-একটা সংস্থা আসন সংখ্যাও প্রায় নিখুঁতভাবে বলে দিয়েছিল। তাহলে কর্ণাটকে গিয়ে কি তাঁরা সকলে রাতারাতি সব দক্ষতা হারিয়ে ফেললেন? নাকি সমীক্ষকদের দেওয়া সত্যিকারের সংখ্যাগুলো মিডিয়া আমাদের দেখতেই দিল না প্রলোভনে বা ভয়ে?

কোনো সন্দেহ নেই যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ সালের নির্বাচন জিততে চেয়েছিল। কিন্তু হারলেও তাদের পক্ষে ফলটা তো নেহাত খারাপ হয়নি। সেই প্রথম তারা এই রাজ্যে একক বিরোধী দল হিসাবে উঠে আসে। ২০১৬ বিধানসভার তুলনায় বিধায়কের সংখ্যা বেড়ে যায় ২৫ গুণেরও বেশি। ফলে হারলেও সেই ফলকে যে একাদশাবতার মোদীজির সাফল্য হিসাবে দেখানো সম্ভব হবে তা তো বিজেপির জানাই ছিল। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের এক বছরও যখন বাকি নেই, সেইসময় কর্ণাটকের মত বড় রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী দিনরাত প্রচার করার পরেও কেবল ক্ষমতা খোয়ানো নয়, গোটা ষাটেক আসনে নেমে আসাকে যে কোনোভাবেই সাফল্য বলে প্রমাণ করা যাবে না – তা বোধহয় অমিত শাহের মত পাকা মাথার লোকেদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই কি এত-থেকে-অত শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে বলা হয়েছিল বৃহৎ পুঁজির মালিকানায় থাকা সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোকে?

ইন্দিরা গান্ধী আরোপিত জরুরি অবস্থা সম্পর্কে লালকৃষ্ণ আদবানির একটা উক্তি বিজেপি নেতারা কয়েক বছর আগে পর্যন্তও খুব আওড়াতেন। আদবানি বলেছিলেন “শ্রীমতি গান্ধী মিডিয়াকে নত হতে বলেছিলেন, মিডিয়া হামাগুড়ি দিয়েছিল।” ২০১৪ সাল থেকে মূলধারার মিডিয়া যেভাবে চলছে সে সম্পর্কে অধুনা মার্গদর্শকমণ্ডলীর সদস্য আদবানির মতামত আমরা জানি না। কিন্তু আজ ফল প্রকাশের দিন সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো যা করল, তাকে বোধহয় একমাত্র দণ্ডি কাটার সঙ্গে তুলনা করে চলে।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল সকালের দিকেই। ইন্ডিয়া টুডের অ্যাঙ্কর রাহুল কাঁওয়াল কংগ্রেসের অফিসিয়াল হ্যান্ডেল থেকে টুইট করা একটা ভিডিও নিয়ে বেজায় আপত্তি করতে লাগলেন। কেন সেই ভিডিওতে রাহুল গান্ধীকে নায়কোচিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে? কেন লেখা হয়েছে “আমি অপরাজেয়। আমি আত্মবিশ্বাসী। হ্যাঁ, আজ আমি অপ্রতিরোধ্য।” ভিডিওটায় আপত্তিকর কী আছে তা কাঁওয়াল কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিলেন না, কিন্তু কী যেন খচখচ করে বিঁধছিল। সত্যি কথা বলতে, দেখে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। ক্লাসের কোনো একটা ছেলের দিকে একাধিক মেয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে আমরা বাকিরা যেনতেনপ্রকারেণ প্রমাণ করার চেষ্টা করতাম তার মধ্যে বিশেষ কিছুই নেই – না রূপের দিক থেকে, না গুণের দিক থেকে। এও যেন সেই ব্যাপার।

যদিও কাঁওয়াল মোটেই আমাদের মত যৌন ঈর্ষায় ভুগছিলেন না। পর্দার নিচের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছিল কংগ্রেস তখন ১২১, বিজেপি ৭৬। সংখ্যার উপর তো আর রাগ দেখানো চলে না, তাই গায়ের ঝালটা কংগ্রেস নেতাটির উপরেই ঝাড়ছিলেন তিনি। ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হল খানিক পরে যখন কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাতে অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এলেন। কংগ্রেস কেন এগিয়ে বা আরও এগিয়ে নেই কেন, সেসব প্রশ্নে না গিয়ে কাঁওয়ালবাবুর বর্ষীয়ান সহকর্মী রাজদীপ সরদেশাই প্রবল বিক্রমে প্রশ্ন করলেন, কংগ্রেস কর্মীরা কেন পোস্টাল ব্যালট গণনার সময় থেকেই ঢাকঢোল পিটিয়ে নাচ করছিলেন। যেন তাতে বিরাট কিছু হেরফের হয়ে যাবে বা কোনো নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করা হয়েছে। কাঁওয়ালও সঙ্গত করলেন। সুপ্রিয়া পাল্টা আক্রমণে গিয়ে যা বললেন তার নির্যাস হল, নেচেছে বেশ করেছে। আপনাদের স্টুডিওতে তো সকাল থেকে শোকপালন চলছে বলে মনে হচ্ছে। এহেন আক্রমণের মুখে দুজনকেই ব্যাকফুটে যেতে হল। কিন্তু তাতে অনুষ্ঠানের গুণগত পরিবর্তন কিছু হয়নি। সারাদিন ধরেই নানাবিধ গ্রাফিক্স তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা চলল যে বিজেপির এই হার তেমন বড় হার নয়। মাঝে মাঝে উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত, পৌরসভার নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য তুলে ধরার চেষ্টাও করা হল। উপরন্তু দিন দুয়েক আগে লাইভ অনুষ্ঠানে যোগেন্দ্র যাদবের খোঁচা উপেক্ষা করে আগাগোড়া ইন্ডিয়া টুডে মল্লিকার্জুন খড়গে আর জেপি নাড্ডার ছবি ব্যবহার করে গেল। কংগ্রেস হারলে আর বিজেপি জিতলে যেভাবে রাহুল আর মোদীর ছবি ব্যবহার করা হয় তা এ দিন করা হল না।

রাজদীপ অবশ্য নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে অত্যুৎসাহী হওয়ার ফল হাতেনাতে পেলেন কিছুক্ষণ পরেই, যখন বিজেপির আই টি সেলের সর্বেসর্বা অমিত মালব্য তাঁকে কুৎসিত ভাষায় অকারণে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেন।

কতটা বেহায়া এবং অসাংবাদিক হলে শাসক দলের মুখপাত্রের হাতে সহকর্মীর অমন অপমানে চুপ করে থাকা যায় কাঁওয়াল তা দেখিয়ে দিলেন। সেই তিনিই আবার বিকেলের দিকে সুপ্রিয়া যখন ফেরত এলেন, তখন পুরুষসিংহের মত গর্জন করে গেলেন “আজ কেন বলছেন না গণতন্ত্র মৃত? আজ কেন বলছেন না ইভিএমে গণ্ডগোল আছে?” অবশ্য ফ্যাক্ট চেকার মহম্মদ জুবেরের টুইট দেখে জানতে পারছি, বিজেপির পরাজয় থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আজ ওটাই গোদী মিডিয়ার বিশিষ্ট সাংবাদিকদের অন্তিম হাতিয়ার হিসাবে স্থির হয়েছিল।

এ তো গেল ইন্ডিয়া টুডের কথা। সাধারণত কোলাহল সবচেয়ে কম হয় বলে এখনো এনডিটিভি দেখে থাকি। প্রণয় রায়দের প্রস্থানের পর সেখানেও অন্য চ্যানেলের মত অত্যন্ত হাস্যকর কার্যকলাপ শুরু হয়েছে। আজ যেমন স্টুডিওর এক কোণে একজনকে কন্নড় খাবারদাবার তৈরি করতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরিচিত মুখ বিষ্ণু সোম এবং আদানি আমলে নতুন যোগ দেওয়া দুই অপেক্ষাকৃত তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ বলতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও কেবলই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন কেন এই হার বিজেপির পক্ষে রীতিমত সম্মানজনক। ব্যাপারটা একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে দুই তরুণ মুখের একজন ‘সিনিয়র জার্নালিস্ট’ শ্রীনিবাস রাজুকে বলেই ফেললেন “কংগ্রেস যখন হারে তখন তো আমাদের এক্সপার্টরা বলেন ‘ডেসিমেটেড’। আজ বিজেপি হারছে অথচ ‘তেমনভাবে হারছে না’ বলছেন কেন বলুন তো?” রাজু বলার চেষ্টা করলেন, তিনি কিছু বলছেন না। যা বলার ডেটাই বলছে। সামনে ল্যাপটপ নিয়ে বসা অ্যাঙ্কর বললেন “কই, ডেটা তা বলছে না তো!” বেচারির কাল সকাল পর্যন্ত চাকরিটা থাকলে হয়।

আরও পড়ুন রাজদীপের দ্বীপান্তর: নিরপেক্ষতার পুরস্কার?

এবং অর্ণব গোস্বামী। প্রিন্স অফ ডেনমার্ককে বাদ দিয়ে যেমন হ্যামলেট হয় না, ভারতীয় মিডিয়া আলোচনাও তেমনি এ গোঁসাইকে বাদ দিয়ে হয় না। তবে যে যা-ই মনে করুক, আমার মত স্বাধীন সাংবাদিকের বাড়িতে মাস গেলে কোনো রাজনৈতিক দলের দপ্তর থেকে মোটাসোটা প্যাকেট এসে তো পৌঁছয় না, ফলে কোন চ্যানেল রাখব আর কোনটা রাখব না সে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সারাক্ষণ গোঁসা করে থাকা গোঁসাইয়ের চ্যানেল পয়সা খরচ করে দেখার শখ আমার নেই। তাই রিপাবলিক নেটওয়ার্ক দেখি না। কিন্তু আজ অন্য সূত্র থেকে একটু-আধটু দেখতেই হল। দেখলাম তাঁর মেজাজ বরাবরের মতই সপ্তমে চড়ে যাচ্ছে যখন তখন, তবে সে চাপ বেশিক্ষণ নিলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে ভেবেই হয়ত কভারেজ কখনো জলন্ধর লোকসভার উপনির্বাচন, কখনো পাকিস্তানের সঙ্কটে চলে গেছে তাঁর গোটা নেটওয়ার্কেই।

বাংলা চ্যানেলগুলোর কথা আর কী বলব? বছরে ৩৬৪ দিন তারা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যকিছুর খবর রাখে না। সেই কূপমণ্ডূকতা একদিনে কাটিয়ে উঠে কি আর জাতীয় হয়ে ওঠা যায়? এবিপি আনন্দে দেখলাম নানা ছুতোয় তৃণমূল কংগ্রেস এরপর কী করবে আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কর্ণাটক থেকে কিছু শিখবে কিনা এই নিয়েই চিল চিৎকার চলছে। টিভি৯ বাংলা আরও এককাঠি সরেস। তারা বেশ বেলা পর্যন্ত পর্দায় সংখ্যাগুলো উপস্থাপন করা ছাড়া কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে কিছুই দেখাচ্ছিল না, ব্যস্ত ছিল অয়ন শীলকে নিয়ে। পরে দায়সারা সম্প্রচার শুরু হল। বাকি চ্যানেলগুলো দেখার আর প্রবৃত্তি হয়নি।

এত লম্বা লেখা পড়ে কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, আজ মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আলাদা করে লেখার কী দরকার ছিল?

উত্তরে বলি, সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা যে একটি সোনার পাথরবাটি তাতে সন্দেহ নেই। বড় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কারণগুলো বাদ দিলেও, সাংবাদিকরা মানুষ এবং কোনো মানুষ নিরপেক্ষ নয়। ফলে মানুষের সাংবাদিকতাও ১০০% নিরপেক্ষ হতে পারে না। সে কারণেই সমস্ত পেশার মত সাংবাদিকতাতেও কিছু নিয়মকানুন (যার পোশাকি নাম এথিক্স) মেনে চলা হয় চিরকাল। সেগুলোর সময়োচিত পরিবর্তনও ঘটে। কিন্তু অমৃতকালে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো ন্যূনতম এথিক্স বিসর্জন দিয়ে এতটাই পক্ষ নিয়ে ফেলেছে যে বিশ্বাসযোগ্যতা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। উল্টে সাংবাদিকতার অর্থটাই সাধারণ দর্শকের কাছে উল্টে গেছে। এখন তাঁরা মনে করেন একজন সাংবাদিক অমুক দলের কোনো কাজের সমালোচনা করেছেন মানেই তিনি ওই দলের বিরোধী। পরে আবার একই দলের কোনো কাজের প্রশংসা করলে মনে করেন পালটি খেল, বা এতদিনে আসল চেহারা বের করল। এই অভিজ্ঞতা রাজদীপের মত স্বনামধন্য সাংবাদিক থেকে শুরু করে আমার মত চুনোপুঁটি – সকলেরই। কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকতা আজ কদর্যতার নতুন শৃঙ্গে আরোহণ করল বিজেপি হেরে যাওয়ায়। এর বিপদ দীর্ঘমেয়াদি। বহুদিন পরে জয়ী হওয়া দলের সদস্য, সমর্থকরা আজ নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে মিডিয়া নামেই সাংবাদিকতা করে, এরা আসলে ক্ষমতাসীন দলের দালাল। অতএব কেন্দ্রীয় সরকারের জোয়াল ২০২৪ বা পরবর্তী যে সময়েই বিজেপি-আরএসএসের হাত থেকে বেরিয়ে যাক না কেন, নতুন যে দল ক্ষমতায় আসবে তারাও মিডিয়ার কাছ থেকে দালালিই দাবি করবে। একবার যে দালাল বলে প্রমাণিত হয়েছে তাকে তো আর সাংবাদিক বলে বিশ্বাস করা যায় না।

এই ক্ষতি সমস্ত সাংবাদিকের। তার চেয়েও বড় কথা, এই ক্ষতি গণতন্ত্রের।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

নয়া বার্তা ছাড়া পরিশ্রমের ফল পাবে না সিপিএম

তৃণমূলকে যত বড় ধাক্কা দেওয়া দরকার, বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে যতটা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দরকার – তার জন্যে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কি যথেষ্ট?

গত এক দশকে বাংলার রাজনীতিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলোর যদি একটা তালিকা তৈরি করা যায়, তাহলে প্রথম স্থান দখল করার লড়াইয়ে থাকবে ‘দুর্নীতি’ আর ‘সেটিং’। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে ‘এন আর সি’, ‘সি এ এ’, ‘এন পি আর’ শব্দগুলোর বহুল ব্যবহার সত্ত্বেও মনে হয় না ও দুটোকে টলানো যাবে। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সেই ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় মাপের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা শুরু হয়েছিল। তারপর সামনে আসে নারদ স্টিং অপারেশন, অতঃপর প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা কেলেঙ্কারি, গরু পাচার, অবৈধ বালি খাদান, কয়লা পাচার এবং সর্বোপরি নিয়োগ কেলেঙ্কারি। একের পর এক অভিযোগ উঠেই চলেছে। এগুলো ছাড়াও বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন ত্রিফলা আলো নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাইকেল নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, উমপুনের ত্রাণের চাল ও ত্রিপল বিতরণে দুর্নীতি হয়েছে। যদিও এই কটা অভিযোগ আইনি পথে খুব বেশি এগোয়নি, জনমনেও তেমন প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে সাধারণ মানুষের কথাবার্তা থেকে মনে হয় না। এর পাশাপাশি বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস বারবার দাবি করে এসেছে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে ‘সেটিং’, অর্থাৎ গোপন আঁতাত, আছে। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতির তদন্তগুলো শেষমেশ কোথাও পৌঁছয় না। অন্যদিকে ২০১১ পরবর্তী সময়ে যখনই তৃণমূল নিজেকে কোণঠাসা মনে করেছে, স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো বলেছেন সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি একসাথে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। কখনো বা বলেছেন সিপিএম বিজেপির হাত শক্ত করছে। এই করতে করতে বাংলার রাজনৈতিক বয়ানে যুক্ত হয়েছে দুটো শব্দ – বিজেমূল আর বিজেপিয়েম।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের নিচের তলা সচেতনভাবে বিজেপিতে ভোট নিয়ে গেছে বলে জোরদার অভিযোগ উঠেছিল। তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল জেলাস্তরের কিছু নেতার প্রকাশ্য উক্তি। আবার ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যেভাবে “দলে থেকে কাজ করতে পারছি না” অজুহাত দিয়ে দলে দলে তৃণমূল নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তার ফলে তৃণমূল আর বিজেপি একই দল – এই জাতীয় অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনের পর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মত করে বহু নেতা তৃণমূলে ফিরে আসেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নাম অবশ্যই মুকুল রায়, যিনি বিধানসভার খাতায় এখনো বিজেপি। অথচ রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ভাইপোর উপস্থিতিতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। এখন আবার তিনি তৃণমূল, না বিজেপি, নাকি অসুস্থ – তা নিয়ে তরজা চলছে। ফলে বিজেমূল তত্ত্বও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না আর।

কিন্তু সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে সেটিংকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে দুর্নীতি। লোকাল ট্রেনের ভেন্ডর কামরার আরোহী সবজি বা ছানার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মফস্বলে নতুন গজিয়ে ওঠা শীততাপনিয়ন্ত্রিত রিটেল চেনে বাজার করা গৃহবধূ – সকলেরই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। রাজ্য সরকারের পক্ষে যা বিশেষ উদ্বেগের, তা হল এই ইস্যু নিয়ে শাসক দল সম্পর্কে নরম মন্তব্য করতে প্রায় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সারদা কেলেঙ্কারি এ রাজ্যের মধ্যবিত্তকে প্রায় ছুঁতেই পারেনি, কারণ আমানতকারীরা অধিকাংশই ছিলেন গরিব মানুষ। তার উপর তখন ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের উপর তিতিবিরক্ত হয়ে নতুন শক্তিকে ক্ষমতায় আনা মানুষের তৃণমূল সম্পর্কে খানিকটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। নারদ কেলেঙ্কারির ঢেউ তো আরও অল্পেই ভেঙে গিয়েছিল। ততদিনে মন্ত্রীসান্ত্রীরা একটু-আধটু ঘুষ নেবেন – এ কথা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক জীবনে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। তাছাড়া যে টাকা ঘুষ হিসাবে দেওয়া হয়েছে তা আমার-আপনার টাকা কিনা তাও সন্দেহাতীত নয়। ফলে ও নিয়ে বেশি মানুষ ভাবেননি। কিন্তু এবার তাহলে জনমানসে এত অসন্তোষ কেন?

কারণ নানাবিধ, কিন্তু একটা কারণ অবশ্যই বিরোধী দলগুলোর সক্রিয়তার তফাত। ২০১১ সাল থেকে বছর খানেক আগে পর্যন্তও বিরোধী হিসাবে সিপিএম অবিশ্বাস্য নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে। নারদের ক্যামেরায় তৃণমূলের মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার দৃশ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরেও রাজ্যটা যেমন চলেছিল তেমনই চলেছে। বামফ্রন্টের মন্ত্রীরা এরকম কাণ্ডে জড়ালে আর বিরোধী নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলে সেদিন রাত থেকেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অবরুদ্ধ হয়ে যেত – একথা হলফ করে বলা যায়। তৎকালীন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ও তাঁর দলবল কিন্তু আলিমুদ্দিনে বসে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করেননি। মাঝেমধ্যে কলকাতার রাজপথে এক-আধটা মিছিল টিভির পর্দায় লাল পতাকার উপস্থিতি প্রমাণ করেছে, সরকারের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিগত রাজ্য সম্মেলনে নতুন রাজ্য কমিটি নির্মিত হওয়ার পর এবং মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির অনেকখানি পরিবর্তন ঘটেছে। কেবল কলকাতা নয়, জেলা সদরগুলোতে দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং আরও নানা দাবি নিয়ে বামেদের সরকারি অফিস অবরোধ করতে বা সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি করতে দেখা যাচ্ছে। যে লড়াকু মেজাজের জন্য বামপন্থী দলগুলোর কর্মীদের সুনাম বা দুর্নাম ছিল বরাবর, সেই মেজাজ আবার দেখা যাচ্ছে। কেবল নবান্ন নয়, উত্তরকন্যা অভিযান হচ্ছে নিয়মিত। কখনো ছাত্র-যুব সংগঠনের উদ্যোগে, কখনো বা শিক্ষক সংগঠনের উদ্যোগে। সেখানে ব্যারিকেড ভেঙে ফেলা হচ্ছে, আতঙ্কিত প্রশাসন জলকামান চালিয়ে দিচ্ছে। কলকাতায় চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সরকারের সোজা পথ, বাঁকা পথের নানা কৌশল সত্ত্বেও কিছুতেই ভাঙছে না। উল্টে ডিএ নিয়ে আন্দোলন করতে নেমে পড়েছেন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এবং অন্য রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা। একসঙ্গে এতগুলো আন্দোলনের প্রভাব পৃথিবীর যে কোনো দেশে যে কোনো কালে সরকারকে চাপে ফেলে। এখানেও ফেলেছে। মমতা সরকারের গোদের উপর বিষফোঁড়া আদালত।

দল এবং সরকার যে ঘূর্ণির মধ্যে পড়েছে তা আর কেউ মানুক না মানুক, পোড়খাওয়া নেত্রী মমতা নিশ্চয়ই মানেন। তাই একের পর এক জনসংযোগ কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের তারিখ নিয়েও উচ্চবাচ্য করছে না। যেসব এলাকায় পাঁচ বছর মানুষ খানাখন্দ পেরিয়ে যাতায়াত করেছেন, সেখানে এক বেলার মধ্যে নতুন রাস্তা তৈরি করা চলছে। মানুষের অসন্তোষের তীব্রতা টের পাওয়া যাচ্ছে এই দিয়েই যে তৃণমূল সাংসদ, বিধায়করা পর্যন্ত দিদির দূত হয়ে গিয়ে কোথাও তাড়া খেয়েছেন, কোথাও ভোটাররা মুখের উপর বলে দিয়েছেন ভোট দেওয়া হবে না। তাই এখন অভিষেক নতুন নাম দিয়ে ফের জনসংযোগের চেষ্টায় নেমেছেন।

মানুষের মধ্যে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, সেই ক্ষোভকে নালা কেটে ব্যালট বাক্সে বইয়ে দেওয়ার মত পরিশ্রম কি বামেরা করছেন? কোনো সন্দেহ নেই, রামনবমীর অজুহাতে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরি করে বিজেপি গত এক মাসে আবার এক ধরনের বাইনারি তৈরি করতে সফল হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। সে কাজে তাদের সাহায্য করছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। ঈদ উদযাপনে গিয়ে এন আর সি, সি এ এ নিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন সংখ্যালঘু মানুষকে। সাগরদীঘির হার এবং নওশাদ সিদ্দিকীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সামলাতে এবং একের পর এক তৃণমূল নেতার দুর্নীতির কেসে ফেঁসে যাওয়ার অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচতে হলে বিজেপি যে বামেদের চেয়ে প্রার্থিত প্রতিপক্ষ – তা মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কথা হল, এই কৌশল ভোঁতা করে দিতে বামেরা কী করতে পারেন? “বিজেপি-তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ভুলবেন না। দুর্নীতির মাধ্যমে রাজ্যটাকে কীভাবে ফোঁপরা করে দেওয়া হয়েছে খেয়াল রাখুন” – এই আবেদন আজকের বহুধাবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক বার্তা হিসাবে কি যথেষ্ট কার্যকরী? পশ্চিমবঙ্গ তো ভারতের বাইরে নয়। গোটা দেশে যা চলছে, তাতে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কেবল তৃণমূলের দুর্নীতির ইস্যুতে লড়ে কি সুবিধা করতে পারবেন বামেরা? তৃণমূলকে যত বড় ধাক্কা দেওয়া দরকার, বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে যতটা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দরকার – তার জন্যে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কি যথেষ্ট? নাকি মানুষের পালস বুঝতে আবার ভুল হচ্ছে সিপিএম তথা বাম নেতৃত্বের?

আরও পড়ুন বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র

সাম্প্রদায়িক বাইনারি তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক জমির সবটা দখলে রাখতে চাইছে তৃণমূল আর বিজেপি। তা ভাঙতে বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক বার্তা কি দিতে পারবেন সিপিএম ও তার শরিকরা? এখন পর্যন্ত দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় মিছিল করা ছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। শিগগির নতুন কোনো বার্তা দিতে না পারলে গত এক-দেড় বছরের পরিশ্রম কিন্তু জলে যেতে পারে। বুথ স্তরে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তৃণমূলের সঙ্গে লড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক খামতি তো আছেই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দু নাগরিকের পিঠ বাঁচানোর চিঠি

ওদের গুজরাটের মত, উত্তরপ্রদেশের মত শিক্ষা দেওয়া যাবে কী করে? সে আশাতেই তো বিরাট হিন্দু নেতাদের ভোট দেয়া। কিন্তু ওদের শিক্ষা দিতে দিতে আমাদের ছেলেপুলেগুলো অশিক্ষিত হয়ে যাবে না তো?

শুনুন ধর্মাবতার,

হিন্দুরাষ্ট্রের জন্মসূত্রে হিন্দু নাগরিক হিসাবে যা যা অপরাধ করে ফেলেছি সেসব স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে এই চিঠি লিখছি।

অ্যাঁ, কী বলছেন? ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো বটেই। সংবিধান নামে ওই যে মোটা বইটা আছে, যেটার নামে নেতা, মন্ত্রীরা শপথ নেন এবং ভুলেও মনে রাখেন না – সে বইতে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে লেখা আছে তো বটেই। স্কুল কলেজে পড়েছিলুম সেসব। এমনকি দরকারে পড়ে দেখব বলে আর ছেলেপুলেকে শেখাব বলে বাড়িতে এক কপি কিনেও রেখেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, বইতে তো কত কথাই লেখা থাকে। সব মেনে চললে তো বাঁচা যাবে না। যেমন ধরুন ‘সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা বলিলে পাপ হয়’। এরকম কথা ছোটবেলায় কত বইতে পড়েছি। তা বলে কি সবসময় সব জায়গায় সত্যি কথা বলে বেড়াই? সকলে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়ে গেলে আর আইন আদালত কোন কাজে লাগবে? কে সত্যি বলছে, কে মিথ্যে বলছে তার বিচার করতেই তো বিচারকরা আছেন। তা সংবিধানও একটা বই বৈ তো নয়। তার উপর আবার ইয়া মোটা। আজকাল তিন প্যারার বেশি ফেসবুক পোস্টই পড়ে ওঠা যায় না, অত মোটা বই কে পড়তে যাবে? ওসব জলাঞ্জলি দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, নয় কি? হোয়াটস্যাপেই এঁটে যাবে – দয়া করে এমন একটি সহজ ও ছোট সংবিধান বানিয়ে দিন না, মোটা ঝামেলাটি চিরতরে চুকে যাক। নতুন সংবিধানে ভারত যে হিন্দুরাষ্ট্র হবে তাতে তো সন্দেহ নেই, মানে চাদ্দিকে সবাই যখন বলছে দেশটা হিন্দুদের। তাই এখনই ক্ষমা-টমা চেয়ে পাপস্খালন করে রাখতে চাইছি আর কি, নইলে তখন যদি গদ্দার বলে শূলে চড়ানো হয়? মরণকালে হরিনাম করলে তো আর জীবন ফিরে পাওয়া যায় না, তাই প্রাণের মায়ায় কাজটা সেরে রাখছি।

প্রথম অপরাধটি করেছিলুম সেই ১৯৯২ সালে। আমার কোনো দোষ নেই, মাইরি বলছি। যত রাজ্যের হিন্দুবিরোধী খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেল দেখে বিশ্বাস করেছিলুম অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ভারি অন্যায় কাজ হয়েছে। ব্যাটা সেকুলার মিডিয়া আর পার্টিগুলো মিলে বুঝতেই দেয়নি যে বাল্মীকি, তুলসীদাস প্রমুখ রামায়ণ রচয়িতারা ভগবান শ্রীরামের জন্মস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ, মৌজা ও দাগ নম্বর লিখে না গিয়ে থাকলেও অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি, উমা ভারতী, মুরলী মনোহর যোশীর মত দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন নেতারা ঠিকই জানতেন যে একেবারে রামের ভূমিষ্ঠ হওয়ার জায়গাটিতেই পাপিষ্ঠ বাবর মসজিদ বানিয়ে ছেড়েছিল। আমার অজ্ঞানতা ক্ষমা করুন প্রভু।

সেই থেকে একের পর এক পাপ করেই চলেছি। এই ধরুন বাঙাল পরিবারের ছেলে হয়েও শিখে ফেলেছি দেশভাগের দায় হিন্দু, মুসলমান কোনো পক্ষের কম নয়। আরও শিখেছি ওপার থেকে যেমন ভিটেমাটি ছেড়ে অনেক হিন্দুকে এপারে চলে আসতে হয়েছিল, এপার থেকেও বিস্তর মুসলমান সব ফেলে ওপারে চলে গেছে। ওপারের লোক মোটেই সাধ করে চলে আসেনি, এপারের লোকও যে ড্যাং ড্যাং করে ওপারে পাড়ি দিয়েছে ঠিক তা নয়। এসব ঘোর বিজাতীয় কথাবার্তা যাঁরা শিখিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে দেহ রেখেছেন, ধর্মাবতার। ফলে আপনার কাজ কমেছে। যখন এক হোয়াটস্যাপ মেসেজ লম্বা সংবিধান অনুযায়ীও হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ শেষ হবে, তখন আর তেনাদের শাস্তি দেয়ার দরকার হবে না। আপনাদের হয়ে বরং আমিই তেনারা যা যা শিখিয়ে যেতে পারেননি তার জন্যে দু-চাট্টি গাল পেড়ে নিই।

যেখানে ইচ্ছে যত ইচ্ছে অন্যায় করে সবই বাবর ও তার চোদ্দ গুষ্টির পাপের শোধ তোলা হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করতে তাঁরা শিখিয়ে যাননি। মুসলমান মানেই মোগল আর মোগল মানেই রক্তপিশাচ বজ্জাত – এ কথাটি শিখিয়ে যাননি, মায় ওদের যে একটু শিক্ষা দিয়ে রাখা উচিত তা অবধি শিখিয়ে যাননি। কী ঝামেলা বলুন দেখি? অমৃতকালটি যে চেটেপুটে উপভোগ করব তার ব্যবস্থাই করে গেলেন না! তবে আর কী ছেলেপুলে মানুষ করলেন? ঘোর কলি। এখন দাড়িওলা, বন্দে ভারতে সওয়ার কল্কি অবতার যদি এর প্রতিকার করেন তবেই এ অধমের স্বর্গবাসের রাস্তা খোলে।

একটু ধৈর্য ধরুন, ধর্মাবতার। আমার পাপের এখানেই শেষ নয়। দ্বিগুণ পাপ করলুম ২০০২ সালে। ২৪ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরায় মহান করসেবকদের ট্রেনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর কয়েকদিন সামান্য একটু প্রতিক্রিয়া হল। অথচ ফের হিন্দুবিরোধী মিডিয়ার কথায়, ছবিতে বিশ্বাস করলুম ঘোর অন্যায় হচ্ছে। নারোদা পাটিয়া, নারোদা গাম, গুলবার্গ সোসাইটি – এসব জায়গার নাম মুখস্থ করে ফেললুম। আহসান জাফরিকে খুন করা হয়েছেবিলকিস বানোকে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে, পুলিস দেখেও কিছু দেখেনি, এমনকি মায়া কোদনানির মত মন্ত্রীসান্ত্রীরা দাঁড়িয়ে থেকে এসব করিয়েছেন – এমন গালগল্পে বিশ্বাস করে ফেললুম। একবারও ভেবে দেখলুম না, এক নিষ্ঠাবান হিন্দু মহিলা যাঁর নামেই রয়েছে মায়া, তিনি এমন মায়াদয়াহীন হতেই পারেন না। এসব হিন্দু সমাজকে বদনাম করার চক্রান্ত। গুজরাট মানে আসলে ভাইব্র্যান্ট গুজরাট, যেখানে মাঠে মাঠে ফসল আছে, গাছে গাছে পাখি আছে, ঘরে ঘরে চাকরি, থুড়ি ব্যবসা, আছে। যারা অন্য কথা বলে তাদের হিন্দু হৃদয়সম্রাটকে গাল পাড়া ছাড়া আর কাজ নেই – এই সহজ কথাটা বুঝে উঠতে পারিনি। চাকরি সূত্রে ও রাজ্যে থাকা আত্মীয়স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা অনেকবার বলেছে, তেমন কিছুই হয়নি ওখানে। কেবল মায়ের পেট থেকে পড়েই আরডিএক্স চিনে যায় যারা, তাদের একটু শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এমন শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে এখন গুজরাটের মত শান্ত রাজ্য আর নেই। কিন্তু সেকথা শুনে বিশ্বাস করিনি। কাউকে কাউকে মুখের উপর বলে দিয়েছি, ওটা শ্মশানের শান্তি।

ছ্যা ছ্যা! কী পাপ বলুন দেখি! একেবারেই উচিত হয়নি এসব বলা। এই তো কেমন ধীরে ধীরে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, কেবল নারোদা পাটিয়া বা নারোদা গাম কেন, ২০০২ সালে গুজরাটের কোথাও কেউ কাউকে খুন করেনি। ধর্ষণ যারা করেছিল তারাও সব নিপাট ভালমানুষ, বামুন বাড়ির ভদ্র ছেলেপুলে। তাই তাদের খামোকা সারাজীবন জেলের অন্ধকূপে আটকে রাখার মানে হয় না। তাদের এত সুখ আছে, এত সাধ আছে। সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে? না হয় তাদের দেখে কিছু লোক সাহস পেয়েছে, না হয় কাশ্মীরের কাঠুয়ায় বছর আষ্টেকের শিশুকেও ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে, না হয় ধর্ষকদের বাঁচাতে হিন্দুরা গোটা কতক মিছিল মিটিংই করেছে, মৃত শিশুর উকিলকে খুনের হুমকি দিয়েছে। সে আর তালিবান, আল কায়দা, আইসিস, বোকো হারামের অপরাধের তুলনায় কতটুকু? গেরুয়া পরে তো কেউ সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না, ওসব কংগ্রেসি প্রোপাগান্ডা। গেরুয়া পরে কেবল এমপি, এমএলএ, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়। কারণ তালিবানদের কেউ ভোট দেয় না, গেরুয়া পরে বোম ফিট করার অভিযোগ উঠলে দেয়। কারণ ওটি বীরত্ব।

আরও পড়ুন বিজেপি মুখপাত্র বিতাড়ন: হিন্দুত্বের টাইম আউট, খেলা শেষ নয়

দেশটা এখন বীরে বীরে বীরাক্কার। এদিকে আমার বীরেদের মর্যাদা দিতেও শেখা হয়নি। সেকুলাররা মাথাটা এমন খেয়েছে, কী বলব ধর্মাবতার, গোমাতাকে মাংস বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বা খাচ্ছে – এই অভিযোগে কাউকে উচিত শাস্তি দেয় যারা তাদের আমি ভেবেছি ‘লিঞ্চ মব’। এইসব সাহেবদের শেখানো কথাবার্তা, বুঝলেন কিনা? আমাদের দেশের কোনো ভাষায় ও কথাটা আছে? নেই, কারণ আমাদের দেশে ওরকম হয় না। আমাদের এখানে কেবল গোমাতার অসম্মান করলে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষা যারা দেয় তারা সব খোদ রাণাপ্রতাপের লোক, মানে সেই যিনি হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবরের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এই দেখুন, যত পাপই করে থাকি, আমার কিন্তু শুধরে নেওয়ার চেষ্টা আছে। যত রাজ্যের কমুনিস্টের লেখা ইতিহাস পড়ে শিখেছিলুম রাণাপ্রতাপ নাকি হেরে গেছিলেন। তা আবার হয় নাকি? ওই গরুখেকো মোগলদের কাছে আমাদের বিরাট হিন্দু রাজপুতরা কখনো হারতে পারে?

এত বছরের এত পাপ সব আপনার পায়ে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলুম। এবার থেকে একেবারে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে যাব, কথা দিচ্ছি। শুধু একটা ব্যাপারেই মনটা একটু খচখচ করছে, আপনি মাইবাপ, তাই আপনাকেই বলছি। হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া যে দরকার তাতে সন্দেহ নেই। নইলে ওদের গুজরাটের মত, উত্তরপ্রদেশের মত শিক্ষা দেওয়া যাবে কী করে? সে আশাতেই তো বিরাট হিন্দু নেতাদের ভোট দেয়া। কিন্তু ওদের শিক্ষা দিতে দিতে আমাদের ছেলেপুলেগুলো অশিক্ষিত হয়ে যাবে না তো? ডারউইন বলেছিলেন মানুষ বাঁদর ছিল। আমাদের মুনি ঋষিরা বলেননি, তাই বোধহয় ওসব বই থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারভিউতে “অমৃতস্য পুত্রাঃ” বলে-টলে আমাদের ছেলেপুলেগুলো চাকরি বাকরি পাবে তো, ধর্মাবতার? না, মানে বলছি চাকরি বাকরি তো এদেশে বিশেষ নেই, বিদেশেই খোঁজ করতে হবে। সেখানে এসব বললে আবার হাঁকড়ে দেবে না তো অশিক্ষিত লালমুখো সাহেবগুলো?

আর আপনার সময় নষ্ট করব না ধর্মাবতার। কেবল একখানা শেষ প্রশ্ন আছে। বলি বিলকিস বানোর ওই যে ভালমানুষ ধর্ষকগুলি, তাদের আবার মুসলমানদের শিক্ষা দেয়া হয়ে গেলে আমাদের মেয়েদের শিক্ষা দেয়ার প্ল্যান আছে নাকি? না, মানে হিন্দুরাষ্ট্রে কি মুসলমান থাকতে দেয়া হবে? না হলে এই লক্ষ লক্ষ বীরেরা করবেটা কী? শিক্ষা দেয়া ছাড়া আর কোনো বিদ্যে কি এদের আছে?

অপরাধ নেবেন না হুজুর। এসব প্রশ্ন করব কাকে? কল্কি অবতার তো আর প্রেস কনফারেন্স করেন না, তেনার এজলাসও নেই। অগত্যা আপনাকেই করলুম আর কি। তাছাড়া আমাদের সাধুসন্তরা বলেছেন, সবই মায়া। তাই ছোট মুখে বড় কথা বলে অপরাধ হয়ে থাকলে মায়া বলে মামলা ডিসমিস করে দেবেন, এই আশা রাখি।

বিনয়াবনত

হিন্দুরাষ্ট্রের এক হিন্দু নাগরিক

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

হিংসার রাজনীতির মোকাবিলায় বামপন্থীরা কোথায়?

ওরা আসে গেরুয়া ঝান্ডা নিয়ে, কমিউনিস্টরা লাল ঝান্ডা নিয়ে নামতে পারে। তাতে দুটো জিনিস হবে। এক, দাঙ্গাবাজরা একটু হলেও ভয় পাবে। জানবে, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকলেও দাঙ্গা আটকানোর লোক আছে। আর দুই, সাধারণ মানুষ দেখবেন কারা দাঙ্গা আটকাতে নেমেছে।

রামের নাম করে গত কয়েকদিন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যে রাবণসুলভ আচরণ চলেছে, খবর পেলাম, তার জেরে আমার দুই খুদে আত্মীয়ার স্কুলের পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। এতদ্বারা সময় জানান দিল যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আমরা কোনও উন্নততর ভারতবর্ষ তৈরি করতে পারিনি। কারণ, তিন দশক আগে একইভাবে আমার স্কুলের পরীক্ষাও পিছিয়ে গিয়েছিল। বস্তুত, আমার সময় এর চেয়ে ভালই ছিল বলতে হবে। কারণ, রিষড়া এলাকায় তখন যে অশান্তি দেখা দিয়েছিল তার কারণটা ছিল বিরাট— বাবরি মসজিদ ধ্বংস। সেই ঘটনা ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসকেই বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত, বদলে দিয়েছিলও। কিন্তু আজকের কচিকাঁচাদের পরীক্ষা বাতিল হল এক স্থানীয় গোলমালে, রামনবমী মিটে যাওয়ার পরেও মিছিল বার করে হিংসা ছড়ানোর প্রচেষ্টায়। অর্থাৎ এ রাজ্যে গত শতকের নয়ের দশকে যে অশান্তি সৃষ্টি করতে হলে জাতীয় স্তরে কোনও ঐতিহাসিক কাণ্ড ঘটাতে হত, এখন স্থানীয় স্তরে খানিকটা গুণ্ডামি করেই তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করা সম্ভব হচ্ছে।

প্রশ্ন হল, কেন সম্ভব হচ্ছে? কী বদলেছে গত ৩০ বছরে? হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক শক্তি বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে, তারা লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, সংসদকে নিজেদের বৈঠকখানায় পরিণত করেছে, প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে স্বয়ংসেবকদের বসিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি বিজেপির সদস্য, বিধায়ক এবং মন্ত্রী ছিলেন। উপরাষ্ট্রপতিরও আরএসএসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ইতিহাস রয়েছে। তা ছাড়া ভারতের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই যে নানা কৌশলে তাদের দখলে চলে গেছে— যেগুলো যায়নি সেগুলোকে দখলে আনার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে— তা বুঝতে এখন আর কারও বাকি নেই। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। আসল কথা হল, হিন্দুত্ববাদীরা দখল করতে পেরেছে মানুষের মস্তিষ্ক।

বাঙালি হিন্দুরা শ-দুয়েক বছর ধরেই মনে করে তারা দেশের আর সকলের চেয়ে প্রগতিশীল। ইতিহাসে অবশ্য এর কোনও নৈর্ব্যক্তিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। বাংলায় চিরকালই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন, রাধাকান্ত দেবও ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন। দুর্গাপুজো এসে পড়লেই বাঙালি হিন্দুরা ফেসবুকে লিখতে শুরু করে “পুজো যার যার, উৎসব সবার।” কিন্তু ঈদ-উল-ফিতর আর ঈদুজ্জোহার তফাত জানার সাধ নেই। বড়দিনে কেক খেতে না-পারলে ভাত হজম হয় না, পার্ক স্ট্রিটে সপরিবারে নেত্য করতে যেতে হয়। কিন্তু ঈদে কেউ বিরিয়ানি বা হালিম খাচ্ছে দেখলে ফ্যাক করে হেসে ফেলে “এ মা! তুই কি মুসলমান” বলে। জিভে জল আনা খাবারের সম্ভার থাকলেও জাকারিয়া স্ট্রিটে ঈদের মরসুমে এত ভিড় হয় না, যে টিভি চ্যানেলের রিপোর্টাররা মাথায় ফেজ পরে (বড়দিনের সময়ে যেমন স্যান্টা টুপি পরেন আর কি) ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন “কেমন লাগছে”। সংঘ বাঙালির এই বিভাজনরেখাটাই কাজে লাগিয়েছে। তাই এত স্থানীয় দাঙ্গা করা সম্ভব হচ্ছে।

এ দেশে যাঁরা হিন্দুত্ব রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘকাল চর্চা করছেন তাঁরা অনেকে মনে করেন, ২০০২ সালের গুজরাতের মতো রাজ্যব্যাপী দাঙ্গার পরিকল্পনা আরএসএস ত্যাগ করেছে। কারণ শিবপুর, ডালখোলা, রিষড়ার মতো এলাকায় ছোট-ছোট দাঙ্গা করতে পারলে লাভ অনেক দীর্ঘমেয়াদি। দাঙ্গার আগুন ঘরের কাছে চলে এলে মানুষ বেশি ভয় পায়। ফলে “হিন্দু খতরে মে হ্যায়”— এ কথা মনের গভীরে প্রোথিত করা সহজ হয়। যেমন রিষড়ায় দাঙ্গা হলে ঘটনার ল্যাজা-মুড়ো না-জেনেও শ্রীরামপুর, কোন্নগর, হিন্দমোটর, উত্তরপাড়ার সংখ্যাগুরু হিন্দুরা ভাবতে শুরু করেন, তাঁরা খুব বিপদের মধ্যে আছেন। এইসব এলাকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যেও নিরাপত্তার অভাববোধ বাড়তে থাকে। উভয় পক্ষই ভুলে যান, কয়েক প্রজন্ম ধরে গলাগলি না-হোক, অন্তত পাশাপাশি বাস করছেন তাঁরা। বহু রামনবমী, বহু মহরম গিয়েছে। শীত বসন্ত এসেছে চক্রাকারে, অথচ কারওই কোনও খতরা হয়নি। অর্থাৎ এইসব ছোট-ছোট অল্প তীব্রতার দাঙ্গা লাগানোর উদ্দেশ্য “আমাদেরি আন্তরিকতাতে / আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা/ খুঁজে আনা।”

সে কাজে সাহায্য করে নিষ্ক্রিয় প্রশাসন। অন্তর্যামী মুখ্যমন্ত্রী সাতদিন আগে থেকে একের পর এক প্রকাশ্য সভায় বলে যাচ্ছেন “ওরা রামনবমীতে ঝামেলা করবে”, অথচ তাঁরই অধীন পুলিস সে দাঙ্গা আটকাতে পারে না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী কখনও বলেন বিনা অনুমতিতে মিছিল বার করা হয়েছে, কখনও বলেন ওরা মিছিলের রুট বদলে ফেলেছে। যে মিছিলের অনুমতি ছিল না সে মিছিল পুলিস চলতে দিল কেন— দিদিকে এ প্রশ্ন করতে বিখ্যাত সাংবাদিক ভাইটি ভুলে যান। সর্বত্রই যাঁরা স্থানীয় মানুষ, সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে প্রদীপ জ্বালাবার আগে সলতে পাকাবার গল্পও শোনা যাচ্ছে এবং সে গল্পে হিন্দুত্ব ব্রিগেড খলনায়কের ভূমিকায় থাকলেও রাজ্যের শাসক দল নেহাত যাত্রার বিবেকের ভূমিকায় নেই। আশার কথা এটুকুই যে, রিষড়ায় ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা অশান্তির আগুন নিভে যাওয়ার আগেই কোন্নগর স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম— যা আশঙ্কা করেছিলাম কথাবার্তা সে পথে এগোল না। আগের দিন রাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে রিষড়ার গণ্ডগোলে ট্রেনে আটকে ছিলেন রাত দেড়টা-দুটো অবধি, এমন কয়েকজন আমার আর এক সাংবাদিক বন্ধুর আলোচনায় এসে যোগ দিলেন। আশঙ্কা করছিলাম দু-চার কথার পরেই কিছু অন্য ধর্মের মানুষকে দায়ী করে কিছু মন্তব্য ছুটে আসবে। তা কিন্তু হল না। যাঁরা কথা বলছিলেন তাঁরা পরস্পরের পরিচিত নন, নামধামও জানতে চাননি, ফলে ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু সকলেই দেখলাম দায়ী করলেন দুটো রাজনৈতিক দলকে, কোনও সম্প্রদায়কে নয়।

যদিও তারপর যে কথা উঠে এল তাতে অস্বস্তি বাড়ল বই কমল না। একজন বললেন “আজকাল তো আমাদের এখানে যা যা হচ্ছে সবই বিশেষ এক ধরনের লোকের জন্যে হচ্ছে। কী ধরনের লোক সেটা আর বলছি না, আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন। বিজেপি তো সারাক্ষণ হিন্দু হিন্দু করে। আমরাও তো হিন্দু, আমাদের রোজগারের কিছু সুবিধা হচ্ছে? বাঙালি হিন্দু তো কোনওমতে খেয়েপরে বাঁচছে। লালে লাল হচ্ছে কারা? তারাই তো দাঙ্গা করছে।” রিষড়ায় বরাবরই এক বড় অংশের মানুষ হিন্দিভাষী, হিন্দমোটরেও। বিশেষত যখন বিড়লাদের গাড়ি তৈরির কারখানা চালু ছিল। কিন্তু ইদানীংকালে কোন্নগর, শ্রীরামপুর ইত্যাদি এলাকাতেও দ্রুত হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সেই প্রেক্ষিতে এই ভদ্রলোকের কথা অশনি সঙ্কেত।

প্রথমত, এ কথায় অন্যের ঘাড়ে নিজের দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চিরাচরিত বাঙালি প্রবণতা প্রকট। যেদিন উনি ও কথা বললেন, সেদিনই বিহারের মুঙ্গের থেকে পুলিস গ্রেফতার করে আনল হাওড়ার সালকিয়ার ভেতো বাঙালি সুমিত সাউকে, যাকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইটে বন্দুক হাতে দেখা গিয়েছিল, যার মা সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় বলেছেন সে আগে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে কাজ করত। সুতরাং অবাঙালিরা দাঙ্গা করছে, বাঙালিরা শান্তিপ্রিয় জাত— এ কথায় সত্য ততটা নেই, যতটা আছে পরজাতিবিদ্বেষ।

দ্বিতীয়ত, বোঝাই যাচ্ছে এ তল্লাটে বাঙালি বনাম অবাঙালি সংঘাতের পটভূমি তৈরি হচ্ছে। যেভাবে ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দুকে বিশ্বাস করানো হয়েছে ২০-২২ শতাংশ মুসলমান তাদের জন্য বিপদ, প্রায় সেভাবেই হুগলি জেলার শহর-মফস্বলের সংখ্যাগুরু বাঙালি ক্রমশ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, তারা হিন্দিভাষীদের কারণে কোণঠাসা হচ্ছে। বিশেষত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের বিশ্রম্ভালাপে আজকাল অন্যতম জনপ্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কীভাবে “ওরা চারিদিকে ছেয়ে যাচ্ছে”। এর পিছনে স্থানীয় হিন্দিভাষীদের ব্যবহার যে একেবারেই দায়ী নয় তা-ও বলা যাবে না। শুধু এখানে কেন, পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গাতেই এমন অনেক আবাসন গড়ে উঠছে যেখানকার সংখ্যাগুরু হিন্দিভাষী ফ্ল্যাটমালিকরা নিয়ম করে দিচ্ছেন, আমিষাশী হলে তাকে ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া যাবে না। বাজারঘাটে বিক্রেতা বা অন্য লোকেদের হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য করা, না-বললে বাংলা না-বোঝার ভান করার মতো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। এ রাজ্যের বামপন্থীরা তো অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়া সব সমস্যাকেই মনে করেন নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাই যেমন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থামানোর কাজে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না, তেমন এইসব ক্রমবর্ধমান সামাজিক দ্বন্দ্বের নিরসনেও তাঁদের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঢুকে পড়ছে বাংলাপক্ষের মতো দক্ষিণপন্থী সংগঠন। এখন যেমন হিন্দু-মুসলমানে লাঠালাঠি লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টায় রয়েছে তৃণমূল, বিজেপি; আগামীদিনে নগরায়নে ভোল বদলে ফেলা এলাকাগুলোতে তেমনই বাঙালি বনাম অবাঙালি বাইনারি সৃষ্টি করে একই খেলা চলতে থাকবে বলে আশঙ্কা হয়। গত বিধানসভা নির্বাচনেই তার লক্ষণ দেখা গেছে। তৃণমূল বিজেপির হিন্দুত্বকে যতখানি আক্রমণ করেছিল তার চেয়ে বেশি করে বলেছিল বিজেপি বহিরাগতদের পার্টি। ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ স্লোগানেও প্রচ্ছন্ন ছিল এই ইঙ্গিত। এদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ছটপুজোয় সরকারি ছুটি দেয়, হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। পাশাপাশি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোকে লাটে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

কোনও না-কোনও কাল্পনিক বাইনারি তৈরি করে আমাদের নিয়ে শাটল ককের মতো খেলে চলেছে দুটো রাজনৈতিক শক্তি। এ জিনিস আটকাতে দরকার এমন এক তৃতীয় পক্ষ, যারা স্রেফ কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের কর্মসূচি এবং দুর্নীতিকে নয়, আক্রমণ করে আদর্শকে। অথচ এ রাজ্যের বামপন্থীরা কিছুতেই সিবিআই, ইডি, ডিএ, নিয়োগ দুর্নীতির বাইরে কোনওকিছু নিয়ে আক্রমণাত্মক হতে রাজি নন। দাঙ্গা কেন হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েই তাঁরা ক্ষান্ত। এমন নয় যে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কিন্তু সেখানেই তাঁদের কাজ শেষ হয় কী করে? কার্ল মার্কস তো বলেছিলেন, দার্শনিকরা পৃথিবীটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কাজ হল পৃথিবীটাকে বদলানো। কমরেডরা সে কথা ভুলে গেলেন নাকি? এ রাজ্যে যে বামপন্থী দলগুলোর উপস্থিতি আছে তাদের সদস্য-সমর্থকদের কথা শুনলে দুঃখে হাসি পায়।

সিপিএমের লোকেরা বারবার শুনিয়ে যান সরকারে থাকার সময়ে তাঁদের দল কীভাবে দাঙ্গা আটকাত আর তৃণমূল সরকার তার সাপেক্ষে কতখানি ব্যর্থ। মার্কসবাদে দেবতা নেই জানি, অপদেবতা আছে কিনা জানি না। এঁদের কথা শুনলে মনে হয় আশা করে আছেন জ্যোতি বসুর ভূত এসে দাঙ্গাবাজদের ঘাড় মটকে দিয়ে যাবে, এঁদের স্বহস্তে কিছু করার প্রয়োজন নেই। তাঁরা কী করছেন, এ প্রশ্ন তুললে আবার কেউ কেউ খাঁটি আমলাতান্ত্রিক ঢঙে বলেন “দাঙ্গা আটকানো সরকারের দায়িত্ব।” কেউ বা বলেন “পুলিশ মিছিল করার অনুমতি দিচ্ছে না। কী করব?” জ্যোতি বসু, মহম্মদ ইসমাইল, বিনয় চৌধুরীরা এত লক্ষ্মী ছেলে হলে সিপিএম কোনওদিন ক্ষমতায় আসত বলে মনে হয় না। এঁরাও সে আমলে কীভাবে দাঙ্গা আটকানো হত, তা নিয়ে জাঁক করার সুযোগ পেতেন না।

অন্যদিকে লিবারেশনের নেতা-কর্মীরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দাঙ্গার দায় যেন সবটাই বিজেপির ঘাড়ে চাপে। তৃণমূল সরকারের গায়ে ছিটেফোঁটা কাদা লাগলেও ফ্যাসিবিরোধী লড়াই দুর্বল হয়ে যাবে। অথচ তাঁদেরই পার্টির উত্তরপাড়া আঞ্চলিক কমিটির প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট রিষড়ার ঘটনা সম্পর্কে বলছে “যেখানে গত বছর মসজিদের সামনে দিয়ে মিছিল যাওয়ার সময়ে রীতিমতো রাস্তার ধারে ব্যারিকেড করে মিছিল পার করা হয়েছিল সেখানে এ-বছর তেমন কিছু ছিল না এবং অল্পসংখ্যক কয়েকজন পুলিশকর্মী মসজিদের সামনে মোতায়েন ছিলেন, যাদের অধিকাংশই গণ্ডগোলের সময়ে রীতিমত আহত হন।”

আরও বামদিকে যেসব দল আছে, যাদের কোনও নির্বাচনী স্বার্থ নেই, তারা ঠিক কী করছে জানি না। এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে কিন্তু তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। স্বীকার্য যে, তারপর থেকে তাদের উপরে রাষ্ট্রীয় আক্রমণ (রাজ্য সরকারের দিক থেকেও) বেড়েছে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জায়গায়, বিশেষত রিষড়া বা শিবপুরের মতো নগরায়িত এলাকায় তাদের ক্ষমতাও নগণ্য।

ভারতের কমিউনিস্টদের দাঙ্গার সময়ে রাস্তায় নেমে দাঙ্গা আটকানোর ইতিহাস আছে বলেই তাঁদের কাছে আশা করা। ক্ষমতাসর্বস্ব তৃণমূল আর পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চল থেকে উধাও কংগ্রেসের কাছে আশা করতে যাবে কোন আহাম্মক?

আরও পড়ুন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হলে ক্ষতি নেই বিজেপির

এসব নিয়ে এক মার্কসবাদী দলের কর্মী বন্ধুর কাছে দুঃখ করছিলাম। সে যা বলল সেটাই বোধহয় সার কথা। তার বক্তব্য, সংসদীয় এবং সংসদ-বহির্ভূত— সব ধরনের কমিউনিস্ট মিলিয়ে বিজেপি শাসনের আট বছরে হাজার খানেক সেমিনার ও সভা করে ফেলেছে, যার বিষয় ভারতে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং তাকে আটকানোর উপায়সমূহ। তারপরেও শিবপুর, ডালখোলা বা রিষড়া ঘটেই চলেছে। ঘটে যাওয়ার পর কমিউনিস্টরা কিছু শান্তি মিছিল, মিটিং, পোস্টারিং ইত্যাদি করছে। কিন্তু দাঙ্গা আটকাতে পারছে না। এর কারণ হল, হিন্দুত্ববাদীরা এবং তাদের স্যাঙাত দলগুলো দাঙ্গা লাগানোকে একটা রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে দেখে। তার জন্যে রীতিমত পরিকল্পনা করে, সেই পরিকল্পনাই রাস্তায় নেমে প্রয়োগ করে। কিন্তু কমিউনিস্টরা দাঙ্গা আটকানোকে প্রকল্প হিসেবে দেখছে না কিছুতেই। দাঙ্গাবাজদের বিরাট দল থাকতে পারে, কমিউনিস্টদের তো অন্তত ছোটখাটো দল আছে নানা জায়গাতেই। সেই কটা লোককে একত্র করেও তো পাল্টা রাস্তায় নামা যায়। ওরা আসে গেরুয়া ঝান্ডা নিয়ে, কমিউনিস্টরা লাল ঝান্ডা নিয়ে নামতে পারে। তাতে দুটো জিনিস হবে। এক, দাঙ্গাবাজরা একটু হলেও ভয় পাবে। জানবে, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকলেও দাঙ্গা আটকানোর লোক আছে। আর দুই, সাধারণ মানুষ দেখবেন কারা দাঙ্গা আটকাতে নেমেছে। ফলে বাইনারি যদি তৈরি হয়ও, তা ভেঙে যাবে।

নিশ্চয়ই আমার বন্ধুটি একমাত্র লোক নয় যে এভাবে ভাবছে। কিন্তু এরকম ভাবনার লোকেরা সম্ভবত সব দলেই সংখ্যালঘু। ফলে দোকানপাট পুড়লে, মাথা ফাটলে, হাত-পা ভাঙলে, পরীক্ষা পেছোলে আমরা এই ভেবে সান্ত্বনা পাব যে, কেউ মারা যায়নি, কেউ ধর্ষিত হয়নি। রামনবমীর পর হনুমান জয়ন্তী নিয়ে তটস্থ হয়ে থাকব। সেটা মিটলে ক্যালেন্ডারে খুঁজব, আবার কবে কোন পুজো আছে। সেদিন বাড়ি থেকে না-বেরোলে চলে কিনা।

সত্যিই, কী চমৎকার ভারতবর্ষ সাজিয়েছি ছোটদের জন্যে!

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

২০২৪ আসলে গণভোট, বহুত্ববাদী ভারতের মুখ রাহুল গান্ধী

প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী।

সেই কোন কালে চকোলেট কোম্পানি ক্যাডবেরি’জ অমিতাভ বচ্চনকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে একগুচ্ছ বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। তার একটায় তিনি পাপ্পু নামে একটি ছেলের বাবা, যার বয়স বেড়েই চলেছে কিন্তু সে স্কুলের গণ্ডি আর পেরোতে পারছেন না। তা পাপ্পুর হতাশ দোকানদার বাবাকে ছেলের বন্ধুরা এসে খবর দিল, পাপ্পু পাশ করে গেছে। অতএব তারা চকোলেট খাবে, পয়সা পাপ্পু দেবে। বাবা মহানন্দে সকলকে বিনিপয়সায় চকোলেট বিলোতে লাগলেন। এমন খুশির খবরে কি মিষ্টিমুখ না করে থাকা যায়? ওই সিরিজেরই আরেকটি বিজ্ঞাপনে অমিতাভ কলেজের অধ্যাপক। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখেন, ছেলেমেয়েরা সব ঊর্ধ্বশ্বাসে কোথায় যেন দৌড়চ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, পাপ্পুর নাকি পরীক্ষা, তাই তারা সবাই দৌড়চ্ছে। অবাক অধ্যাপক সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন পরীক্ষা মানে হল, একটি সুন্দরী মেয়ে (রাইমা সেন) কলেজে ঢুকছে আর মোটা কাচের চশমা পরা, সচরাচর যাদের ক্যাবলা বলা হয় তেমন ছেলে পাপ্পু প্রেম নিবেদন করবে বলে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি এল, দেখল এবং পাপ্পুকে জয়যুক্ত করল। ফলে সকলে মিলে পাপ্পু পাশ করে গেছে বলে ফের নাচানাচি শুরু করল। এ খবরেও মিষ্টিমুখ না-করে থাকা যায় না, অতএব ফের চকোলেট খাওয়া হল। এই পাপ্পু যে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে জায়গা করে নিতে চলেছে, তখন কে জানত!

আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র তুলনাহীন। আজ না হয় যাবতীয় টিভি চ্যানেল এবং অধিকাংশ সর্বভারতীয় খবরের কাগজের উপর আম্বানি-আদানির সহায়তায় তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির সর্বভারতীয় উত্থানের সময়ে তো এতখানি আধিপত্য ছিল না। তবু বিজেপি নেতারা বারবার আউড়ে এবং হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকের বিপুল ব্যবহারের মাধ্যমে জনমনে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পেরেছিলেন এই কথা যে, হার্ভার্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রাহুল গান্ধি হলেন ওই বিজ্ঞাপন সিরিজের অকর্মণ্য, অজস্রবার ফেল করা পাপ্পু। অন্যদিকে তথ্যের অধিকার আইন ব্যবহার করে যাঁর পাশ করার বছরের তথ্য জানতে চাইলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে মুখে কুলুপ আঁটে, সেই মোদি হলেন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, বিশ্বগুরু হওয়ার উপযুক্ত। যেহেতু মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতা সন্দেহজনক (গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত তাঁর মার্কশিটে অধ্যয়নের বিষয় লেখা ছিল “entire political science”), সেহেতু ডিগ্রি ব্যাপারটাই যে অপ্রয়োজনীয় তা প্রমাণ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র। বারো ক্লাসের গণ্ডি না-পেরনো স্মৃতি ইরানিকে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী করা হয়েছিল এবং ডিগ্রি যে কিছুই প্রমাণ করে না তা প্রমাণ করতে দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র মতো বিরাট কাগজ রীতিমত গ্রাফিক্স তৈরি করেছিল— যাতে দেখানো হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বেরই ডিগ্রির বালাই ছিল না। মনে রাখতে হবে, এই স্মৃতি সংসদে পৌঁছেছিলেন অমেঠি কেন্দ্রে রাহুলকে পরাজিত করে। অর্থাৎ স্মৃতিকে মাথায় তোলার পিছনেও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাহুলকে পাপ্পু প্রমাণ করা।

স্বীকার্য যে, প্রচুর লেখাপড়া জেনেও রাজনীতিতে কেউ অকর্মণ্য হতেই পারেন। আবার বেশিদূর লেখাপড়া না-করেও ক্ষুরধার বুদ্ধি, সাহস এবং পরিশ্রমের জোরে একজন রাজনীতিবিদ দারুণ সফল হতে পারেন। সাফল্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটা অবশ্য গুরুতর প্রশ্ন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেমন স্পষ্টতই মনে করেন, চা বিক্রেতার ছেলে হয়েও দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাই সাফল্য। কীভাবে সে চেয়ার অবধি পৌঁছনো হল এবং চেয়ারে বসে কী করা হচ্ছে তার তেমন গুরুত্ব নেই। তিনি যে গত আট বছরে এমনকি কাশ্মিরি পণ্ডিতদের জন্যও গঠনমূলক কিছু করে উঠতে পারেননি, তা তাঁর কাছে ব্যর্থতা বলে প্রতিভাত হয় বলে তো মনে হয় না। উলটে সারাক্ষণ নিজেই নিজেকে শংসাপত্র দিয়ে বেড়াচ্ছেন— “সব চঙ্গা সি”। এহেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের মানদণ্ডে রাহুল যা-ই করুন, প্রধানমন্ত্রী না-হতে পারলে পাপ্পুই থাকবেন। তাতে কিছু এসে যায় না। মুশকিল হল, পাপ্পু মিথ নির্মাণ এতই সফল হয়েছে যে, বিজেপিবিরোধী মানুষও কিছুতেই ওই মিথ ভুলে রাহুলকে দেখে উঠতে পারছেন না। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের এই ভুল না ভাঙলে বিপদ।

গত কয়েক দিনে যে চরম অন্যায় অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করে রাহুলকে লোকসভা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, বহু উদারপন্থী, এমনকি বামপন্থী মানুষও তাতে তেমন দোষ দেখছেন না। বিজেপি বাদে সব দলের নেতৃস্থানীয়রাই অবশ্য এর নিন্দা করেছেন, কিন্তু তার অনেকটাই “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” যুক্তিতে। কারণ, আজ এর প্রতিবাদ না-করলে কাল এত বড় দেশের কোনও এক নিম্ন আদালতে তাঁদের কারও কোনও প্রধানমন্ত্রীবিরোধী মন্তব্যকে হাতিয়ার করে কেউ যদি মানহানির মামলা ঠুকে দেয় আর আদালত তুরন্ত দুবছরের কারাদণ্ড দিয়ে দেয়, তাহলে তাঁদের সাংসদ বা বিধায়ক পদও নিমেষে খারিজ হয়ে যাবে। কিছু বলার মুখ থাকবে না। এই নেতা-নেত্রীদের কে কে ভারতের গণতন্ত্রের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সত্যিই চিন্তিত তা আরও কিছুদিন না কাটলে, তাঁদের দলের কার্যকলাপ না দেখলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। যেমন ধরুন, এর পরেও যদি আম আদমি পার্টি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী ধ্বজা উড়িয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটতে যায়, তা হলে বুঝতে হবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের লুকোবার মতো আরও অনেক কিছু আছে। সেসবের গুরুত্ব ভারতের গণতন্ত্র বাঁচানোর চেয়ে বেশি।

কিন্তু ইতিমধ্যেই দলগুলোর সাধারণ সদস্য, সমর্থকদের অনেকেরই দেখা যাচ্ছে রাহুল পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন এবং অনেকে তাঁর মধ্যে আশার আলো দেখছেন বলে প্রবল গাত্রদাহ। এর কারণ রাহুলের কার্যকলাপ তাঁরা এত বছর ধরে ভাল করে লক্ষই করেননি। নিজেদের অজান্তেই সরকারি প্রচারযন্ত্রের চোখ দিয়ে রাহুলকে দেখেছেন। তাই এখন চোখকান যা বলছে, মস্তিষ্ক কিছুতেই তা মানতে চাইছে না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভারত জোড়ো যাত্রার পরে রাহুল সর্বক্ষণের রাজনীতিবিদ নন— এই অভিযোগ আর করা যাচ্ছে না। লৌহমানব মোদির বিপরীতে তিনি যে ঠুনকো পুতুল নন, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছেন। কংগ্রেসেও যে নেতৃত্বের সঙ্কট দীর্ঘকাল ধরে চলছিল তার নিষ্পত্তি ঘটেছে। গুলাম নবি আজাদের মতো সুযোগসন্ধানীরা বিদায় হয়েছেন। কপিল সিব্বলের মতো অতিবৃদ্ধ, জনসংযোগহীন আইনজীবী নেতারা পথপার্শ্বে পড়ে আছেন। সুদর্শন, সাহেবদের মতো ইংরেজি বলায় দক্ষ শশী থারুর টিভি স্টুডিও আর টুইটার আলো করেই বসে আছেন। মল্লিকার্জুন খড়গেকে সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে ঝাড়া হাত-পা রাহুল জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে গেছেন।

কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। দেশ কীভাবে চালানো উচিত, ভারতের আগামীদিনের অর্থনীতি কেমন হওয়া উচিত, আজকের দুনিয়ায় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার পুনঃপ্রয়োগ কীভাবে করা সম্ভব— এসব নিয়ে গত কয়েক বছরে মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছেন রাহুল। কিন্তু গোদি মিডিয়া আর বিজেপি-র আইটি সেল সেসব দিকে আলো ফেলেনি। কেবলই পাপ্পু ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে এবং জওহরলাল নেহরুর চিন-নীতির ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির স্বৈরতান্ত্রিকতা— এগুলোকে রাহুল গান্ধীর সমার্থক করে দিয়েছে। দুঃখের বিষয়, বহু বিজেপি-বিরোধী, বিশেষত বামপন্থীরা, এই চশমা দিয়েই রাহুলকে দেখেছেন এবং এখনও দেখে চলেছেন। তাঁরা খেয়ালই করেন না, ২০১৯ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাহুল সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের যে প্রস্তাব রেখেছিলেন তা এই মুহূর্তে যে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির কবলে আমরা পড়েছি তার প্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক, এবং বলা বাহুল্য, বামপন্থী। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন ভারতে অমন একটা প্রকল্প দারুণ কাজে দেবে। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ অবশ্যই আছে। কিন্তু অন্তত এই শতকে ভারতের কোনও বামপন্থী দলের নেতাকে অর্থনীতি নিয়ে এরকম বিকল্প চিন্তা করতে দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের শেষ বামফ্রন্ট সরকার বরং অনেকাংশে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি নিয়ে চলছিল, কেরলের বাম সরকারও যে মৌলিকভাবে আলাদা কোনও পথ দেখাতে পারছে এমন নয়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যেমন (যাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে মোদি সরকার) তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে খুব আলাদা কোনও পথ নেওয়া হয়তো কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভবও নয়। কিন্তু প্রস্তাব হিসেবে, পরিকল্পনা হিসেবেও ডি রাজা, পিনারাই বিজয়ন বা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যরা কোনও মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির কথা বলেছেন কি? সরকারে এলে কী করবেন সে তো পরের কথা, রাহুল অন্তত অন্য কিছু ভাবার এবং বলার সাহস তো দেখিয়েছেন।

ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন রাহুল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিলেন। সেই আলোচনা শুনলে বোঝা যায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে রাহুল কীভাবে দেখেন এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্যকে কতটা গভীরভাবে জানেন। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের সাফল্য কীভাবে এল, ভারতে সেরকম কিছু করা সম্ভব কিনা জানতে চান এবং সেই প্রসঙ্গে জিএসটি ও নোটবন্দির ফলে কর্নাটকের বেল্লারির রমরমা জিনস শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতির কথা জানান। দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়েও সুনির্দিষ্ট আলোচনা করেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মির পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনকে কতটা গভীরভাবে দেখেছেন তা মিনিট পঁচিশেকের ওই ভিডিওতে বেশ বোঝা যায়। রঘুরাম কিন্তু ঘোর পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ। রাহুল আলোচনার এক জায়গায় প্রশ্ন করেন, “দেখতে পাচ্ছি স্টক এক্সচেঞ্জে টাকা লাগিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার কী মত?”

দিল্লির রাজনৈতিক মহলে সকলেই জানেন, রাহুলকে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের অপছন্দ হওয়ার অন্যতম কারণ তাঁর এই বামপন্থী প্রবণতা। তিনি যেভাবে নাম করে দেশের সবচেয়ে বড় দুই ধনী— মুকেশ আম্বানি আর গৌতম আদানিকে আক্রমণ করেন, তা অনেকেরই পছন্দ নয়। কারণ অর্থনীতির দিক থেকে কংগ্রেসের ক্রমশ ডাইনে সরে যাওয়া আরম্ভ হয়েছিল রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধীর আমলে, যা তুঙ্গে পৌঁছয় নরসিংহ-মনমোহন জুটির নেতৃত্বে। সেই কারণেই নরসিংহ বিজেপির বিশেষ পছন্দের লোক। শেখর গুপ্তার মত দক্ষিণপন্থী সাংবাদিকরা তাঁকে ‘ভারতের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী’ আখ্যাও দিয়ে থাকেন। সেই দলের নেতা হয়ে রাহুলের এভাবে বৃহৎ পুঁজিকে আক্রমণ, বারবার ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ নিয়ে কথা বলা অনেক কংগ্রেসিরই না-পসন্দ।

তা বলে রাহুল বিপ্লবী নন, লেনিন বা মাও জে দং নন। কিন্তু তাঁকে অমন হতে হবে— এমন প্রত্যাশা করবই বা কেন? এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও যখন বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে থেকে তেমন কেউ উঠে এলেন না, তখন বহুত্ববাদী ভারত থাকবে কি থাকবে না— এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে কমিউনিজমের দাঁড়িপাল্লায় রাহুলকে মাপার মূঢ়তা ক্ষমার অযোগ্য। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় একই সময়ে। একশো বছর পূর্ণ করার আগেই আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনায় চূড়ান্ত সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সেখানে ভারতীয় কমিউনিস্টরা দারুণ শুরু করেও ১৯৬৪ সালের পর থেকে নিজেদের ভাঙতে-ভাঙতে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে, অস্তিত্বেরই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ১৯৮৯ থেকে সংঘের শক্তি দ্রুত বেড়েছে, অথচ কমিউনিস্টরা সম্মুখসমরে যাওয়ার শক্তি ক্রমশ হারিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে তবু বিকল্প সরকার তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার শক্তি ছিল, ২০০৯ সালের পর থেকে তা-ও আর অবশিষ্ট নেই।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় রাজনীতির বাস্তুতন্ত্র মানে ছিল বামপন্থা বনাম মধ্যপন্থার লড়াই। সংঘ পরিবার সফলভাবে অটলবিহারী বাজপেয়ির আমল থেকে সেই বাস্তুতন্ত্রকে মধ্যপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থার লড়াইয়ে পরিণত করতে শুরু করে। ২০২৪ নির্বাচনে রাহুল তথা কংগ্রেসকে উড়িয়ে দিয়ে জিততে পারলে ব্যাপারটা পুরোপুরি দক্ষিণপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থা হয়ে দাঁড়াবে। কেবল মমতা ব্যানার্জি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, নবীন পট্টনায়করাই যদি বিরোধী দল হিসেবে টিঁকে থাকেন তা হলে বনাম শব্দটারও আর প্রয়োজন থাকবে কি না, সন্দেহ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যেমন শাসক-বিরোধী সংঘাত বলে কিছু হয় না। যা হয় সব বিধানসভার বাইরে টিভি ক্যামেরার সামনে। সুতরাং গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ভারতকে বাঁচাতে হলে ভারতের আরএসএসবিরোধী শক্তিগুলোর হাতে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। বামপন্থীদের সামনেও নেই। নেহরুর নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে অকারণে বরখাস্ত করা, ইন্দিরার জরুরি অবস্থা, মনমোহনের অপারেশন গ্রিন হান্ট ইত্যাদি কারণে কংগ্রেস সম্পর্কে যত বিতৃষ্ণাই থাক, রাজনীতিতে আশু বিপদের চেয়ে বড় কোনও বিপদ নেই, কোনওদিন ছিল না। সে কারণেই ইন্দিরা যখন দেশের গণতন্ত্রের জন্য মূর্তিমান বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন তখন জ্যোতি বসুর মতো প্রবাদপ্রতিম বাম নেতারা সংঘ-ঘেঁষা শক্তির উপস্থিতি সত্ত্বেও জয়প্রকাশ নারায়ণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

আরও পড়ুন কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?

রাহুল আরও একটা জায়গায় দেশের অন্য সব বিরোধী নেতার চেয়ে এগিয়ে আছেন, তা হল সরাসরি সংঘ-বিরোধিতা। অন্য সব দলের নেতাদেরই বিজেপির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। একমাত্র রাহুলই বারবার বলেন, লড়াইটা আরএসএসের বিরুদ্ধে। দেশের মাটিতে জনসভায় বলেন, সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন। আবার কেমব্রিজে বক্তৃতা দিতে গিয়েও বলেন। এ দেশের কমিউনিস্টদের চিরকালীন বদভ্যাস, তাঁরা অর্থনৈতিক বিভাজন ছাড়া আর কোনও বিভাজন স্বীকারই করতে চান না। গত শতকের তিনের দশকে এই কারণেই গিরনি কামগর ইউনিয়নের ধর্মঘটে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের নেতৃত্বাধীন শ্রমিকদের সঙ্গে বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকরের নেতৃত্বাধীন দলিত শ্রমিকদের ঐক্য হয়নি। একশো বছর হতে চলল, কমিউনিস্টরা নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাই রামমন্দির, হিজাব পরার জন্য মেয়েদের শিক্ষায়তনে ঢুকতে না-দেওয়া কিংবা গোমাংস ভক্ষণ বা পাচারের অভিযোগে মুসলমান হত্যার মতো ঘটনাগুলোকে বামপন্থীরা বলেন— আসল ইস্যু থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আসল ইস্যুগুলো কী? না বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। তাঁরা কিছুতেই মানবেন না, আরএসএস-বিজেপি মন্দির-মসজিদ, শিবাজি-মোগল ইত্যাদিকেই বৃহদংশের মানুষের কাছে আসল ইস্যু বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে। সে কারণেই উত্তরভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম সংসদ আয়োজিত হয়, যেখানে প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়। প্রশাসন যে কিছুই করে না সে তো প্রত্যাশিত, কিন্তু আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষই যে এইসব সংসদে যান তা সম্ভবই হত না তাঁদের কাছে বামপন্থীরা যেগুলোকে আসল ইস্যু বলেন সেগুলো নকল ইস্যু হয়ে না-গিয়ে থাকলে।

রাহুল কিন্তু এই কথাটা বোঝেন। তিনি জানেন, আসলে লড়াইটা সাংস্কৃতিক। সংঘ মানুষের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলেছে। ভারত জোড়ো যাত্রায় তিনি যে বারবার বলছিলেন “নফরত কে বাজার মে মহব্বত কা দুকান খোলনে আয়া হুঁ” (ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে এসেছি) তা স্রেফ কাব্যি নয়, সচেতন রাজনৈতিক স্লোগান। এই সময়ের প্রয়োজনীয় স্লোগান। সম্প্রতি এক আলোচনাসভায় নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবাস করে আসা লেখক মনীশ আজাদের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। শ্রোতাদের একজন প্রশ্ন করলেন, হাথরসের সেই ভয়ঙ্কর ধর্ষণ ও খুনের পরেও সেখানকার নির্বাচনে বিজেপি কেন জেতে? লখিমপুর খেড়িতে বিজেপি নেতার ছেলে গাড়ির চাকার তলায় কৃষকদের পিষে দেওয়ার পরেও সেখানে বিজেপি কী করে জেতে? মনীশ বললেন, ৪০-৫০ বছরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংঘ মানুষের মধ্যে এই ভাবনা প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, আসল ইস্যু হল ধর্ম, বর্ণ, জাতি— এইসব। অন্যান্য ইস্যুতে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারো, রেগেও যেতে পারো। কিন্তু ভোট দেওয়ার সময়ে সেসব ভুলে ধর্মের ভিত্তিতে দেবে। উদাহরণ দিয়ে বললেন, জিএসটি নিয়ে ক্ষুব্ধ গুজরাতের ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন প্রবল আন্দোলন করার পরেই একটা শহরের রাজপথের ফেস্টুন ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, “হম নারাজ হ্যাঁয়, গদ্দার নহি” (আমরা বিরক্ত, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নই)। তারপর গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যথারীতি জেতে। সুতরাং বিজেপিকে হারাতে হলে এই মানসিকতাকে হারাতে হবে। অর্থনৈতিক অভাব অনটনই আসল ইস্যু, বাকি সবই নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা— এই বালখিল্য রাজনীতি ফল দেবে না। কারণ, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে, বাজারটা ঘৃণার। রাহুল তাই ভালবাসার দোকান খোলার কথা বলেছেন। দোকানে কতজন খদ্দের আসবে, সে তো পরের কথা। কিন্তু যত বেশি দোকান খোলা হবে বাজারের পরিবেশ যে তত বদলাবে, তাতে তো সন্দেহ নেই। সত্যিকারের বিজেপি-বিরোধীরা এ কথা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন তত ভাল। রাহুল মহাপুরুষ নন, সাধুসন্ত নন, বিপ্লবী তো ননই। তিনি একা কতটুকু পারবেন? তাঁর ক্ষয়িষ্ণু পার্টিই বা কতটা পারবে?

২০২৪ সালের নির্বাচন বস্তুত গণভোটে পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী। কার সঙ্গে কার কোথায় নির্বাচনী আসন সমঝোতা হবে না-হবে সেসব পরের কথা, পাটিগাণিতিক আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক প্রশ্ন ওই একটাই। এ কথা অস্বীকার করলে আত্মপ্রতারণা হবে।

এমন বাইনারি নিঃসন্দেহে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু আমাদের সামনে আশু বিপদটা যে একদলীয় শাসন।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত

চাকরি চুরির চাঁইদের শেষ অব্দি কী গতি হয়?

অতগুলো চাকরি চুরি এবং রহস্য মৃত্যুর পরেও সিবিআই কয়েকশো চার্জশিট দাখিল করার বেশি কিছু এখনো করে উঠতে পারেনি। বিজেপিও ক্ষমতায় ফিরে এসেছে

“চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে–/ চোর চাই যে ক’রেই হোক, চোর চাই।” বাঙালির রবীন্দ্রনাথ পাঠ যত কমে আসছে, তাঁর বিভিন্ন পংক্তি বর্তমানের ব্যাখ্যায় যেন তত লাগসই হয়ে উঠছে। পাহাড়প্রমাণ চুরির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। শুরু হয়েছিল একটি ফ্ল্যাটে ৫০ কোটি টাকার পাহাড় দিয়ে, এখন ক্রমশ সেই পাহাড়কে নেহাতই শুশুনিয়া বলে মনে হচ্ছে। আমরা ঘাড় উঁচু করেই চলেছি, তবু এই চাকরি চুরির পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে না। সন্দেহ হয়, চূড়ায় পৌঁছনোর ইচ্ছাও হয়ত তদন্তকারী সংস্থাগুলোর নেই। কারণ সেই জ্যাক ও বীনগাছের গল্পের মত মেঘের উপরে এই দুর্নীতির পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলে হয়ত কোনো নরখাদক দৈত্যের দেখা মিলবে, যাকে সামলানোর ক্ষমতা সিবিআই, ইডির জাঁদরেল অফিসারদেরও নেই। ফলে যে করেই হোক মেজ, সেজ, রাঙা, ছোট চোরেদের ধরে আনা হচ্ছে। কদিন সংবাদমাধ্যমে তুমুল হইচই হচ্ছে, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কুনাট্য চলছে এইসব চোরেদের মধ্যে। ব্যাপারটা মুচমুচে করে তোলার জন্য নিয়মিত ব্যবধানে একজন করে মহিলার নাম ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘটনায় তাঁর অংশগ্রহণ কতটুকু, তদন্তকারী সংস্থা আদৌ তাঁকে অভিযুক্ত করছে কিনা – এ সবের খোঁজে না গিয়েই টিভি চ্যানেল এবং খবরের কাগজগুলো সোশাল মিডিয়া ঘেঁটে তাঁদের ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রকাশ করে দিচ্ছে। ফলে অভিযুক্তদের প্রেমিকা, প্রাক্তন প্রেমিকা, স্ত্রী, প্রাক্তন স্ত্রী – সকলেই বাজার ঘাটে মুখরোচক আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠছেন। এতে দুর্নীতির কূলকিনারা কতটা হচ্ছে জানি না, তবে নিঃসন্দেহে আমাদের অনেকের যৌন হতাশা প্রকাশিত হচ্ছে।

সত্যি কথা বলতে, কোনো অপরাধে অভিযুক্তদের শেষপর্যন্ত শাস্তি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সিবিআই বা ইডির সাফল্যের হার ঈর্ষণীয় নয়। সিবিআইয়ের দীর্ঘকালীন পরিচিতি বিরোধীদের জব্দ করার জন্যে ব্যবহার্য কেন্দ্রীয় সরকারের পেয়াদা হিসাবে। ২০১৩ সালে খোদ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এম লোধা বলেছিলেন সিবিআই হল “কেজড প্যারট”, অর্থাৎ খাঁচাবন্দি তোতাপাখি। গত এক দশকে সিবিআই এমন কিছু করেনি যাতে মনে করতে হবে তাদের ভূমিকার কোনো পরিবর্তন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চোখে তাই সিবিআই, ইডি নায়ক হয়ে উঠছে না। নায়ক হচ্ছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত বিচারপতিরা। ট্রেনে বাসে এক যাত্রী অন্য যাত্রীকে জিজ্ঞেস করছেন “অভিজিৎবাবুর রিটায়ারমেন্ট কবে? তার মধ্যে এদের পাকাপাকি ব্যবস্থা না করতে পারলে তো ঠিক বেরিয়ে যাবে।” ভারত অবতারবাদের দেশ। অধর্মের চূড়ান্ত হতে থাকলে যুগে যুগে আবির্ভূত হয়ে ভগবান দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করেন – এমনটাই বিপুল সংখ্যক মানুষের কয়েক হাজার বছরের বিশ্বাস। ফলে মানুষ যে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর উপর নয়, এমনকি বিচারব্যবস্থার উপরেও নয়, বিশেষ একজন বিচারপতির কাছে ন্যায় পাওয়ার আশা করছেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর কেটে গেলেও যে অবতারবাদ কাটিয়ে উঠে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরে এ দেশের মানুষের আস্থা তৈরি হল না, তার জন্য কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোই দায়ী।

উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যে নিয়োগ দুর্নীতির জালে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল এখন নিজেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে এবং বেরোবার প্রাণপণ চেষ্টায় বনলতা সেনগিরি (whataboutery) করতে গিয়ে হাস্যকর ‘চিরকুট’ প্রকাশ করছে, তেমনই এক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধেও উঠেছিল।

মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রমের প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার জন্যে ১৯৮২ সালে গঠিত হয় বৈষয়িক পরীক্ষা মন্ডল (ইংরেজি আদ্যক্ষর অনুযায়ী Vyapam)। পরে ২০০৮ সালে সরকারি চাকরি পাওয়ার পরীক্ষাও এই সংস্থার অধীনে নিয়ে আসা হয়। ২০০৯ সালে মেডিকাল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু হয় এবং সেবছর ডিসেম্বরে প্রচুর অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে একটা প্যানেল গঠন করেন। চার বছর পরে পুলিস এমন ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে যারা অন্যের হয়ে মেডিকালের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছিল বলে অভিযোগ। ১৬ জুলাই জগদীশ সাগর নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যে নাকি এই চক্রের মাথা। এরপর স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তদন্তের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় এবং পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতিতে যেমন হাজার হাজার চাকরি যাচ্ছে, ব্যাপম কেলেঙ্কারিতেও সেইসময় কয়েকশো প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে যাওয়া ডাক্তারি শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মা গ্রেপ্তারও হয়ে যান (পার্থ চ্যাটার্জির কথা মনে পড়ছে না?)। তারপর শুরু হয় রোমহর্ষক কাণ্ড। এই মামলার অভিযুক্ত এবং সাক্ষীদের পরপর মৃত্যু ঘটতে থাকে।

২০১৫ সালের জুন মাসে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমই বলেছিল মামলার সঙ্গে জড়িত ২৩ জন মারা গেছেন। জুলাই মাসের গোড়ায় এমনকি ব্যাপম নিয়ে প্রতিবেদন লিখছিলেন এমন এক সাংবাদিকেরও মৃত্যু হয়। অন্যতম অভিযুক্ত ডাক্তারির ছাত্রী নম্রতা ডামরোর কিছুদিন আগে রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছিলেন। সাংবাদিক অক্ষয় সিং নম্রতার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসার কিছুক্ষণ পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই এই তদন্তের দায়িত্ব হাতে নেয়। ঠিক পরেরদিন জব্বলপুরের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস মেডিকাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মাকে দিল্লিতে তাঁর হোটেলের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিবিআইকে তদন্ত করতে দিতে রাজি হন। অবশ্য তাতেও পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি। নম্রতার কেস ফাইল আবার খোলা হয়। কিন্তু যে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আগে বলেছিল শ্বাসরোধ করে হত্যা, দুমাস পরে তা বলে আত্মহত্যা। শিবরাজের পদত্যাগের দাবি উঠেছিল। কিন্তু তিনি সে দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেন তিনিই ব্যাপম কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছেন।

সকলেই জানেন ইতিমধ্যে মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ মুখ্যমন্ত্রী পদে ফিরে এসেছেন। সিবিআই ২০১৫ সালে তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে ৪০ জন তদন্তকারীর বিরাট দল তৈরি করেছিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেড়শো জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের কেসও ফাইল করেছিল। পরে সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কয়েক হাজারে পৌঁছয়। পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত যেমন স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে শুরু হয়ে এখন পৌরসভার মত অন্যান্য সরকারি চাকরির নিয়োগেও পৌঁছে গেছে, ব্যাপম তদন্তও সেভাবে ডাক্তারির পরীক্ষায় দুর্নীতি থেকে আরম্ভ হয়ে মধ্যপ্রদেশ সরকারের অন্যান্য দপ্তরের নিয়োগে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত হলটা কী?

আরও পড়ুন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়াই কি উদ্দেশ্য?

এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি, দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিবিআই আরও ১৬০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে। এই নিয়ে তদন্তের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ৬৫০ জনকে চার্জশিট দেওয়া হল। এর মধ্যে বিভিন্ন মেডিকাল কলেজের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মানিক ভট্টাচার্য বা সুবীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের মত। এছাড়া আধিকারিকদের ঘুষ দিয়ে অন্যকে দিয়ে নিজের পরীক্ষা দেওয়ানোয় অভিযুক্তরাও রয়েছে। অর্থাৎ সেই মেজ, সেজ, রাঙা, ছোট চোরেরা। লক্ষ্মীকান্ত শর্মা ছাড়া গুলাব সিং কিরার এবং প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্যপাল রাম নরেশ যাদব – এইটুকুই নাকি রাজনৈতিক যোগ। ঘটনার সময়কার মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজের পাঞ্জাবিতে কাদার ছিটে পর্যন্ত লাগেনি।

অতগুলো চাকরি চুরি এবং রহস্য মৃত্যুর পরেও সিবিআই কয়েকশো চার্জশিট দাখিল করার বেশি কিছু এখনো করে উঠতে পারেনি। বিজেপিও ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, সে যেভাবেই আসুক। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসেরও হয়ত আতঙ্কিত বা আশাহত হওয়ার কারণ নেই। সে যতই চাকরি চুরি যাওয়া ছাত্রছাত্রী, ইচ্ছুক শিক্ষকরা বছরের পরে বছর রাস্তায় বসে থাকুন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: