নাসার আর ব্রিজভূষণ: যৌন নির্যাতনের আমরা ওরা

নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

ইন্টারনেটের যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলিগলির খবর পর্যন্ত আমরা যেভাবে রাখি, আমেরিকানরাও ভারতের খবর সেভাবে রাখেন কিনা জানি না। মার্কিন জেলগুলোতে বন্দিদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার অধিকার আছে কিনা তাও জানি না। তবে যদি থেকে থাকে, তাহলে নির্ঘাত সেখানে বসে ল্যারি নাসার আফসোস করছে ভারতে তার জন্ম হয়নি বলে। নামটা অচেনা? সেটাই স্বাভাবিক। বাংলা খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলে খেলার খবর বলতে তো আইপিএল আর আইএসএল। আন্তর্জাতিক খেলা মানে বড়জোর ভারতীয় দলের ক্রিকেট আর ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল লিগ, চার বছরে একবার বিশ্বকাপ। ফলে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দেড়শোর বেশি জিমন্যাস্টের সাক্ষ্যদানের পর দুই দশক ধরে যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত নাসারের ৪০ থেকে ১৭৫ বছরের কারাদণ্ডের খবর হয়ত অনেকেরই চোখে পড়েনি বা স্মরণ নেই। নাসার ছিল ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্স, ইউ এস অলিম্পিক কমিটি এবং মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অগ্রগণ্য ডাক্তার। সেই মওকায় চিকিৎসার নাম করে সে মহিলা জিমন্যাস্টদের যথেচ্ছ যৌন নিপীড়ন করত।

এমনিতে একজন আমেরিকানের ভারতীয় হয়ে জন্মাতে চাওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং ভারতীয়রাই অনেকে আমেরিকান হয়ে জন্মাতে পারলে খুশি হত। কিন্তু নাসার মনে করতেই পারে, ভারতে জন্মালে সে স্রেফ ডাক্তার হয়ে না থেকে ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের শীর্ষ কর্তা হয়ে বসতে পারত। এমনিতেই তার বিকৃতির শিকার হওয়া মহিলাদের মুখ খুলতে বছর বিশেক সময় লেগেছে, কর্মকর্তা হলে নিশ্চয়ই তারা আরও ভয় পেত। ফলে আরও দেরিতে মুখ খুলত। খুললেও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত না গেলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা রাস্তায় বসে না পড়লে পুলিস এফআইআর পর্যন্ত নিত না। নিলেও নাসার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত, সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারত, যদি সে শাসক দলের টিকিটে নির্বাচিত সেনেটর হতে পারত। সেসব কিছুই হল না নাসার মার্কিন দেশে জন্মেছিল বলে। এসবের জন্যে যদি সে ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে হিংসা করে, তাকে দোষ দেওয়া চলে কি? বিশেষ করে যখন দুজন কুস্তিগির ব্রিজভূষণের সম্পর্কে পুলিসের কাছে যে অভিযোগগুলো করেছেন তার সঙ্গে নাসারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের স্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

এমন নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেয়েদের জন্যে একেবারে স্বর্গরাজ্য। ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের মার্কিন কলামনিস্ট ময়রা ডোনেগান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেন নাসার কাণ্ডে ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) অপদার্থতার কথা। হলিউডি থ্রিলার দেখার অভ্যাস যাঁদের আছে তাঁরা জানেন, এই এফবিআইকে প্রায়শই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে দেখানো হয়। ব্যতিক্রমী ছবি না হলে এফবিআইয়ের গোয়েন্দাদের এত তৎপর, এত সৎ বলে দেখানো হয় যেন তাঁদের চোখ এড়িয়ে মাছি গলতে পারে না। কিন্তু ডোনেগান লিখেছেন ২০১৫ সালে অলিম্পিয়ান ম্যাককেলা ম্যারোনি নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানানোর পরেও তারা নড়েচড়ে বসেনি। তারা তদন্ত শুরু করে ২০১৬ সালে যখন স্থানীয় পুলিস নাসারের একটা হার্ড ড্রাইভ থেকে ৩৭,০০০ শিশু নির্যাতনের ছবি বাজেয়াপ্ত করে। নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে জমা পড়া প্রথম অভিযোগ থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবস্থা নেওয়ার সময়টুকুতেও সে প্রায় ৭০ জন মহিলা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপরে নির্যাতন চালিয়েছে। নাসারের ঘটনা নিয়ে মার্কিন সেনেটে শুনানির সময়ে এফবিআই ডিরেক্টর ক্রিস রে স্বীকার করেন যে তাঁর সংস্থার গাফিলতি ছিল। কিন্তু তিনি দাবি করেন সেটা সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের ব্যক্তিগত গাফিলতি, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নয়। অথচ ডোনেগান লিখেছেন স্থানীয় পুলিস থেকে শুরু করে এফবিআই পর্যন্ত সর্বত্রই যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। গোটা আমেরিকা জুড়ে বহু মেয়ের অভিজ্ঞতাই তা বলে। সেদিক থেকে আমাদের মেয়েদের চেয়ে মার্কিন মেয়েদের অবস্থা বিশেষ উন্নত নয় বলতে হবে। কিন্তু তাহলেও তফাত বিস্তর। কোথায় তফাত?

এফবিআইয়ের গড়িমসির কথা প্রকাশ্যে এল কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ইনস্পেক্টর জেনারেল নাসার কাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে যে অন্তর্তদন্ত চালিয়েছিলেন তার নির্মম রিপোর্ট থেকে। উপরন্তু যে তিনটে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাসার যুক্ত ছিল, সেগুলোকেও ফল ভোগ করতে হয়েছে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে সংগঠনের প্রতিক্রিয়া সঠিক ছিল কিনা সে সম্পর্কে তদন্ত করায়। ইউ এস অলিম্পিক কমিটি একসময় ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের অনুমোদন বাতিল করে দেবে ঠিক করেছিল। অলিম্পিক কমিটির চাপে তাদের সিইও এবং প্রেসিডেন্ট কেরি পেরিকে পদত্যাগ করতে হয়। এমনকি তাঁর স্থলাভিষিক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সিইও এবং প্রেসিডেন্ট মেরি বনোকেও পদত্যাগ করতে হয় চারদিনের মাথায়, কারণ জিমন্যাস্টরা তাঁকে ওই পদে দেখতে চাননি। আসলে বনো এমন এক ল ফার্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যা নাসারকে সাহায্য করেছিল।

অর্থাৎ ও দেশে এক প্রতিষ্ঠানের দোষ দেখে অন্য প্রতিষ্ঠান শাক দিয়ে মাছ ঢাকেনি। অলিম্পিকে সোনা জয়ী সিমোন বাইলস, অ্যালি রাইসম্যান বা ম্যারোনি, ম্যাগি নিকলদের কথা সেনেট শুনেছে, আদালতও ধৈর্য ধরে শুনেছে। তার জন্যে তাঁদের ওয়াশিংটন ডিসি বা নিউইয়র্কের ফুটপাথে গিয়ে বসতে হয়নি। একথা সত্যি, যে ব্রিজভূষণ দোষী কি দোষী নন সেকথা বিচার করবে আদালত। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের সামনে হাজির করার দায়িত্বটুকু নিতেও তো এ দেশের পুলিস বা সরকার রাজি নয়। এমনকি ভারতীয় অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পিটি ঊষা কদিন আগে বলে বসেছিলেন, যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করে বিনেশ ফোগত, বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিকের মত কুস্তিগিররা নাকি দেশের বদনাম করছেন। নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

আরও পড়ুন হাসছি মোরা হাসছি দেখো: বীর দাসের বীরত্বে দুই ভারতের পর্দা ফাঁস

নাসার জেল খাটছেন, ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের সেই কর্তারাও বিতাড়িত, জিমন্যাস্টরা আছেন স্বমহিমায়। বাইলস আরও একটা অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, গোটা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে আবার কোন রুদ্ধশ্বাস দেহভঙ্গিমায় তিনি তাক লাগিয়ে দেবেন। এদিকে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে তিন সদস্যের অ্যাড হক কমিটির হাতে। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, এই অ্যাড হক কমিটি নাকি আসন্ন এশিয়ান গেমসের সংগঠকদের কাছে ভারত থেকে যে কুস্তিগিররা প্রতিযোগী হতে পারেন তার এক প্রাথমিক তালিকা পাঠিয়েছে। সেই তালিকায় প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের মধ্যে থেকে বজরং, ভিনেশ আছেন। তাছাড়াও আছেন রবি দাহিয়া, দীপক পুনিয়া, অংশু মালিক, সোনম মালিক। কিন্তু অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী সাক্ষী বাদ। কেন তিনিই বাদ? সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য স্মৃতি ইরানির জবাবদিহি দাবি করেছিলেন বলে কি?

দেখে শুনে মনে হয়, কদিন আগে রাতের অন্ধকারে দিল্লি পুলিসের গলাধাক্কা খাওয়ার পর ভিনেশ কাঁদতে কাঁদতে ক্যামেরার সামনে যা বলেছেন তার চেয়ে ন্যায্য কথা নেই – দেশের মেডেল জেতার পরেও যদি এত অপমান সহ্য করতে হয়, তাহলে আর কারোর কখনো মেডেল না জেতাই ভাল।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

নয়া বার্তা ছাড়া পরিশ্রমের ফল পাবে না সিপিএম

তৃণমূলকে যত বড় ধাক্কা দেওয়া দরকার, বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে যতটা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দরকার – তার জন্যে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কি যথেষ্ট?

গত এক দশকে বাংলার রাজনীতিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলোর যদি একটা তালিকা তৈরি করা যায়, তাহলে প্রথম স্থান দখল করার লড়াইয়ে থাকবে ‘দুর্নীতি’ আর ‘সেটিং’। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে ‘এন আর সি’, ‘সি এ এ’, ‘এন পি আর’ শব্দগুলোর বহুল ব্যবহার সত্ত্বেও মনে হয় না ও দুটোকে টলানো যাবে। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সেই ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় মাপের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা শুরু হয়েছিল। তারপর সামনে আসে নারদ স্টিং অপারেশন, অতঃপর প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা কেলেঙ্কারি, গরু পাচার, অবৈধ বালি খাদান, কয়লা পাচার এবং সর্বোপরি নিয়োগ কেলেঙ্কারি। একের পর এক অভিযোগ উঠেই চলেছে। এগুলো ছাড়াও বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন ত্রিফলা আলো নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাইকেল নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, উমপুনের ত্রাণের চাল ও ত্রিপল বিতরণে দুর্নীতি হয়েছে। যদিও এই কটা অভিযোগ আইনি পথে খুব বেশি এগোয়নি, জনমনেও তেমন প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে সাধারণ মানুষের কথাবার্তা থেকে মনে হয় না। এর পাশাপাশি বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস বারবার দাবি করে এসেছে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে ‘সেটিং’, অর্থাৎ গোপন আঁতাত, আছে। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতির তদন্তগুলো শেষমেশ কোথাও পৌঁছয় না। অন্যদিকে ২০১১ পরবর্তী সময়ে যখনই তৃণমূল নিজেকে কোণঠাসা মনে করেছে, স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো বলেছেন সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি একসাথে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। কখনো বা বলেছেন সিপিএম বিজেপির হাত শক্ত করছে। এই করতে করতে বাংলার রাজনৈতিক বয়ানে যুক্ত হয়েছে দুটো শব্দ – বিজেমূল আর বিজেপিয়েম।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের নিচের তলা সচেতনভাবে বিজেপিতে ভোট নিয়ে গেছে বলে জোরদার অভিযোগ উঠেছিল। তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল জেলাস্তরের কিছু নেতার প্রকাশ্য উক্তি। আবার ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যেভাবে “দলে থেকে কাজ করতে পারছি না” অজুহাত দিয়ে দলে দলে তৃণমূল নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তার ফলে তৃণমূল আর বিজেপি একই দল – এই জাতীয় অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনের পর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মত করে বহু নেতা তৃণমূলে ফিরে আসেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নাম অবশ্যই মুকুল রায়, যিনি বিধানসভার খাতায় এখনো বিজেপি। অথচ রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ভাইপোর উপস্থিতিতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। এখন আবার তিনি তৃণমূল, না বিজেপি, নাকি অসুস্থ – তা নিয়ে তরজা চলছে। ফলে বিজেমূল তত্ত্বও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না আর।

কিন্তু সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে সেটিংকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে দুর্নীতি। লোকাল ট্রেনের ভেন্ডর কামরার আরোহী সবজি বা ছানার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মফস্বলে নতুন গজিয়ে ওঠা শীততাপনিয়ন্ত্রিত রিটেল চেনে বাজার করা গৃহবধূ – সকলেরই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। রাজ্য সরকারের পক্ষে যা বিশেষ উদ্বেগের, তা হল এই ইস্যু নিয়ে শাসক দল সম্পর্কে নরম মন্তব্য করতে প্রায় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সারদা কেলেঙ্কারি এ রাজ্যের মধ্যবিত্তকে প্রায় ছুঁতেই পারেনি, কারণ আমানতকারীরা অধিকাংশই ছিলেন গরিব মানুষ। তার উপর তখন ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের উপর তিতিবিরক্ত হয়ে নতুন শক্তিকে ক্ষমতায় আনা মানুষের তৃণমূল সম্পর্কে খানিকটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। নারদ কেলেঙ্কারির ঢেউ তো আরও অল্পেই ভেঙে গিয়েছিল। ততদিনে মন্ত্রীসান্ত্রীরা একটু-আধটু ঘুষ নেবেন – এ কথা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক জীবনে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। তাছাড়া যে টাকা ঘুষ হিসাবে দেওয়া হয়েছে তা আমার-আপনার টাকা কিনা তাও সন্দেহাতীত নয়। ফলে ও নিয়ে বেশি মানুষ ভাবেননি। কিন্তু এবার তাহলে জনমানসে এত অসন্তোষ কেন?

কারণ নানাবিধ, কিন্তু একটা কারণ অবশ্যই বিরোধী দলগুলোর সক্রিয়তার তফাত। ২০১১ সাল থেকে বছর খানেক আগে পর্যন্তও বিরোধী হিসাবে সিপিএম অবিশ্বাস্য নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে। নারদের ক্যামেরায় তৃণমূলের মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার দৃশ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরেও রাজ্যটা যেমন চলেছিল তেমনই চলেছে। বামফ্রন্টের মন্ত্রীরা এরকম কাণ্ডে জড়ালে আর বিরোধী নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলে সেদিন রাত থেকেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অবরুদ্ধ হয়ে যেত – একথা হলফ করে বলা যায়। তৎকালীন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ও তাঁর দলবল কিন্তু আলিমুদ্দিনে বসে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করেননি। মাঝেমধ্যে কলকাতার রাজপথে এক-আধটা মিছিল টিভির পর্দায় লাল পতাকার উপস্থিতি প্রমাণ করেছে, সরকারের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিগত রাজ্য সম্মেলনে নতুন রাজ্য কমিটি নির্মিত হওয়ার পর এবং মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির অনেকখানি পরিবর্তন ঘটেছে। কেবল কলকাতা নয়, জেলা সদরগুলোতে দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং আরও নানা দাবি নিয়ে বামেদের সরকারি অফিস অবরোধ করতে বা সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি করতে দেখা যাচ্ছে। যে লড়াকু মেজাজের জন্য বামপন্থী দলগুলোর কর্মীদের সুনাম বা দুর্নাম ছিল বরাবর, সেই মেজাজ আবার দেখা যাচ্ছে। কেবল নবান্ন নয়, উত্তরকন্যা অভিযান হচ্ছে নিয়মিত। কখনো ছাত্র-যুব সংগঠনের উদ্যোগে, কখনো বা শিক্ষক সংগঠনের উদ্যোগে। সেখানে ব্যারিকেড ভেঙে ফেলা হচ্ছে, আতঙ্কিত প্রশাসন জলকামান চালিয়ে দিচ্ছে। কলকাতায় চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সরকারের সোজা পথ, বাঁকা পথের নানা কৌশল সত্ত্বেও কিছুতেই ভাঙছে না। উল্টে ডিএ নিয়ে আন্দোলন করতে নেমে পড়েছেন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এবং অন্য রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা। একসঙ্গে এতগুলো আন্দোলনের প্রভাব পৃথিবীর যে কোনো দেশে যে কোনো কালে সরকারকে চাপে ফেলে। এখানেও ফেলেছে। মমতা সরকারের গোদের উপর বিষফোঁড়া আদালত।

দল এবং সরকার যে ঘূর্ণির মধ্যে পড়েছে তা আর কেউ মানুক না মানুক, পোড়খাওয়া নেত্রী মমতা নিশ্চয়ই মানেন। তাই একের পর এক জনসংযোগ কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের তারিখ নিয়েও উচ্চবাচ্য করছে না। যেসব এলাকায় পাঁচ বছর মানুষ খানাখন্দ পেরিয়ে যাতায়াত করেছেন, সেখানে এক বেলার মধ্যে নতুন রাস্তা তৈরি করা চলছে। মানুষের অসন্তোষের তীব্রতা টের পাওয়া যাচ্ছে এই দিয়েই যে তৃণমূল সাংসদ, বিধায়করা পর্যন্ত দিদির দূত হয়ে গিয়ে কোথাও তাড়া খেয়েছেন, কোথাও ভোটাররা মুখের উপর বলে দিয়েছেন ভোট দেওয়া হবে না। তাই এখন অভিষেক নতুন নাম দিয়ে ফের জনসংযোগের চেষ্টায় নেমেছেন।

মানুষের মধ্যে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, সেই ক্ষোভকে নালা কেটে ব্যালট বাক্সে বইয়ে দেওয়ার মত পরিশ্রম কি বামেরা করছেন? কোনো সন্দেহ নেই, রামনবমীর অজুহাতে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরি করে বিজেপি গত এক মাসে আবার এক ধরনের বাইনারি তৈরি করতে সফল হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। সে কাজে তাদের সাহায্য করছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। ঈদ উদযাপনে গিয়ে এন আর সি, সি এ এ নিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন সংখ্যালঘু মানুষকে। সাগরদীঘির হার এবং নওশাদ সিদ্দিকীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সামলাতে এবং একের পর এক তৃণমূল নেতার দুর্নীতির কেসে ফেঁসে যাওয়ার অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচতে হলে বিজেপি যে বামেদের চেয়ে প্রার্থিত প্রতিপক্ষ – তা মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কথা হল, এই কৌশল ভোঁতা করে দিতে বামেরা কী করতে পারেন? “বিজেপি-তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ভুলবেন না। দুর্নীতির মাধ্যমে রাজ্যটাকে কীভাবে ফোঁপরা করে দেওয়া হয়েছে খেয়াল রাখুন” – এই আবেদন আজকের বহুধাবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক বার্তা হিসাবে কি যথেষ্ট কার্যকরী? পশ্চিমবঙ্গ তো ভারতের বাইরে নয়। গোটা দেশে যা চলছে, তাতে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কেবল তৃণমূলের দুর্নীতির ইস্যুতে লড়ে কি সুবিধা করতে পারবেন বামেরা? তৃণমূলকে যত বড় ধাক্কা দেওয়া দরকার, বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে যতটা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দরকার – তার জন্যে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কি যথেষ্ট? নাকি মানুষের পালস বুঝতে আবার ভুল হচ্ছে সিপিএম তথা বাম নেতৃত্বের?

আরও পড়ুন বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র

সাম্প্রদায়িক বাইনারি তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক জমির সবটা দখলে রাখতে চাইছে তৃণমূল আর বিজেপি। তা ভাঙতে বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক বার্তা কি দিতে পারবেন সিপিএম ও তার শরিকরা? এখন পর্যন্ত দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় মিছিল করা ছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। শিগগির নতুন কোনো বার্তা দিতে না পারলে গত এক-দেড় বছরের পরিশ্রম কিন্তু জলে যেতে পারে। বুথ স্তরে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তৃণমূলের সঙ্গে লড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক খামতি তো আছেই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দু নাগরিকের পিঠ বাঁচানোর চিঠি

ওদের গুজরাটের মত, উত্তরপ্রদেশের মত শিক্ষা দেওয়া যাবে কী করে? সে আশাতেই তো বিরাট হিন্দু নেতাদের ভোট দেয়া। কিন্তু ওদের শিক্ষা দিতে দিতে আমাদের ছেলেপুলেগুলো অশিক্ষিত হয়ে যাবে না তো?

শুনুন ধর্মাবতার,

হিন্দুরাষ্ট্রের জন্মসূত্রে হিন্দু নাগরিক হিসাবে যা যা অপরাধ করে ফেলেছি সেসব স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে এই চিঠি লিখছি।

অ্যাঁ, কী বলছেন? ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো বটেই। সংবিধান নামে ওই যে মোটা বইটা আছে, যেটার নামে নেতা, মন্ত্রীরা শপথ নেন এবং ভুলেও মনে রাখেন না – সে বইতে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে লেখা আছে তো বটেই। স্কুল কলেজে পড়েছিলুম সেসব। এমনকি দরকারে পড়ে দেখব বলে আর ছেলেপুলেকে শেখাব বলে বাড়িতে এক কপি কিনেও রেখেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, বইতে তো কত কথাই লেখা থাকে। সব মেনে চললে তো বাঁচা যাবে না। যেমন ধরুন ‘সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা বলিলে পাপ হয়’। এরকম কথা ছোটবেলায় কত বইতে পড়েছি। তা বলে কি সবসময় সব জায়গায় সত্যি কথা বলে বেড়াই? সকলে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়ে গেলে আর আইন আদালত কোন কাজে লাগবে? কে সত্যি বলছে, কে মিথ্যে বলছে তার বিচার করতেই তো বিচারকরা আছেন। তা সংবিধানও একটা বই বৈ তো নয়। তার উপর আবার ইয়া মোটা। আজকাল তিন প্যারার বেশি ফেসবুক পোস্টই পড়ে ওঠা যায় না, অত মোটা বই কে পড়তে যাবে? ওসব জলাঞ্জলি দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, নয় কি? হোয়াটস্যাপেই এঁটে যাবে – দয়া করে এমন একটি সহজ ও ছোট সংবিধান বানিয়ে দিন না, মোটা ঝামেলাটি চিরতরে চুকে যাক। নতুন সংবিধানে ভারত যে হিন্দুরাষ্ট্র হবে তাতে তো সন্দেহ নেই, মানে চাদ্দিকে সবাই যখন বলছে দেশটা হিন্দুদের। তাই এখনই ক্ষমা-টমা চেয়ে পাপস্খালন করে রাখতে চাইছি আর কি, নইলে তখন যদি গদ্দার বলে শূলে চড়ানো হয়? মরণকালে হরিনাম করলে তো আর জীবন ফিরে পাওয়া যায় না, তাই প্রাণের মায়ায় কাজটা সেরে রাখছি।

প্রথম অপরাধটি করেছিলুম সেই ১৯৯২ সালে। আমার কোনো দোষ নেই, মাইরি বলছি। যত রাজ্যের হিন্দুবিরোধী খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেল দেখে বিশ্বাস করেছিলুম অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ভারি অন্যায় কাজ হয়েছে। ব্যাটা সেকুলার মিডিয়া আর পার্টিগুলো মিলে বুঝতেই দেয়নি যে বাল্মীকি, তুলসীদাস প্রমুখ রামায়ণ রচয়িতারা ভগবান শ্রীরামের জন্মস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ, মৌজা ও দাগ নম্বর লিখে না গিয়ে থাকলেও অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি, উমা ভারতী, মুরলী মনোহর যোশীর মত দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন নেতারা ঠিকই জানতেন যে একেবারে রামের ভূমিষ্ঠ হওয়ার জায়গাটিতেই পাপিষ্ঠ বাবর মসজিদ বানিয়ে ছেড়েছিল। আমার অজ্ঞানতা ক্ষমা করুন প্রভু।

সেই থেকে একের পর এক পাপ করেই চলেছি। এই ধরুন বাঙাল পরিবারের ছেলে হয়েও শিখে ফেলেছি দেশভাগের দায় হিন্দু, মুসলমান কোনো পক্ষের কম নয়। আরও শিখেছি ওপার থেকে যেমন ভিটেমাটি ছেড়ে অনেক হিন্দুকে এপারে চলে আসতে হয়েছিল, এপার থেকেও বিস্তর মুসলমান সব ফেলে ওপারে চলে গেছে। ওপারের লোক মোটেই সাধ করে চলে আসেনি, এপারের লোকও যে ড্যাং ড্যাং করে ওপারে পাড়ি দিয়েছে ঠিক তা নয়। এসব ঘোর বিজাতীয় কথাবার্তা যাঁরা শিখিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে দেহ রেখেছেন, ধর্মাবতার। ফলে আপনার কাজ কমেছে। যখন এক হোয়াটস্যাপ মেসেজ লম্বা সংবিধান অনুযায়ীও হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ শেষ হবে, তখন আর তেনাদের শাস্তি দেয়ার দরকার হবে না। আপনাদের হয়ে বরং আমিই তেনারা যা যা শিখিয়ে যেতে পারেননি তার জন্যে দু-চাট্টি গাল পেড়ে নিই।

যেখানে ইচ্ছে যত ইচ্ছে অন্যায় করে সবই বাবর ও তার চোদ্দ গুষ্টির পাপের শোধ তোলা হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করতে তাঁরা শিখিয়ে যাননি। মুসলমান মানেই মোগল আর মোগল মানেই রক্তপিশাচ বজ্জাত – এ কথাটি শিখিয়ে যাননি, মায় ওদের যে একটু শিক্ষা দিয়ে রাখা উচিত তা অবধি শিখিয়ে যাননি। কী ঝামেলা বলুন দেখি? অমৃতকালটি যে চেটেপুটে উপভোগ করব তার ব্যবস্থাই করে গেলেন না! তবে আর কী ছেলেপুলে মানুষ করলেন? ঘোর কলি। এখন দাড়িওলা, বন্দে ভারতে সওয়ার কল্কি অবতার যদি এর প্রতিকার করেন তবেই এ অধমের স্বর্গবাসের রাস্তা খোলে।

একটু ধৈর্য ধরুন, ধর্মাবতার। আমার পাপের এখানেই শেষ নয়। দ্বিগুণ পাপ করলুম ২০০২ সালে। ২৪ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরায় মহান করসেবকদের ট্রেনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর কয়েকদিন সামান্য একটু প্রতিক্রিয়া হল। অথচ ফের হিন্দুবিরোধী মিডিয়ার কথায়, ছবিতে বিশ্বাস করলুম ঘোর অন্যায় হচ্ছে। নারোদা পাটিয়া, নারোদা গাম, গুলবার্গ সোসাইটি – এসব জায়গার নাম মুখস্থ করে ফেললুম। আহসান জাফরিকে খুন করা হয়েছেবিলকিস বানোকে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে, পুলিস দেখেও কিছু দেখেনি, এমনকি মায়া কোদনানির মত মন্ত্রীসান্ত্রীরা দাঁড়িয়ে থেকে এসব করিয়েছেন – এমন গালগল্পে বিশ্বাস করে ফেললুম। একবারও ভেবে দেখলুম না, এক নিষ্ঠাবান হিন্দু মহিলা যাঁর নামেই রয়েছে মায়া, তিনি এমন মায়াদয়াহীন হতেই পারেন না। এসব হিন্দু সমাজকে বদনাম করার চক্রান্ত। গুজরাট মানে আসলে ভাইব্র্যান্ট গুজরাট, যেখানে মাঠে মাঠে ফসল আছে, গাছে গাছে পাখি আছে, ঘরে ঘরে চাকরি, থুড়ি ব্যবসা, আছে। যারা অন্য কথা বলে তাদের হিন্দু হৃদয়সম্রাটকে গাল পাড়া ছাড়া আর কাজ নেই – এই সহজ কথাটা বুঝে উঠতে পারিনি। চাকরি সূত্রে ও রাজ্যে থাকা আত্মীয়স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা অনেকবার বলেছে, তেমন কিছুই হয়নি ওখানে। কেবল মায়ের পেট থেকে পড়েই আরডিএক্স চিনে যায় যারা, তাদের একটু শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এমন শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে এখন গুজরাটের মত শান্ত রাজ্য আর নেই। কিন্তু সেকথা শুনে বিশ্বাস করিনি। কাউকে কাউকে মুখের উপর বলে দিয়েছি, ওটা শ্মশানের শান্তি।

ছ্যা ছ্যা! কী পাপ বলুন দেখি! একেবারেই উচিত হয়নি এসব বলা। এই তো কেমন ধীরে ধীরে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, কেবল নারোদা পাটিয়া বা নারোদা গাম কেন, ২০০২ সালে গুজরাটের কোথাও কেউ কাউকে খুন করেনি। ধর্ষণ যারা করেছিল তারাও সব নিপাট ভালমানুষ, বামুন বাড়ির ভদ্র ছেলেপুলে। তাই তাদের খামোকা সারাজীবন জেলের অন্ধকূপে আটকে রাখার মানে হয় না। তাদের এত সুখ আছে, এত সাধ আছে। সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে? না হয় তাদের দেখে কিছু লোক সাহস পেয়েছে, না হয় কাশ্মীরের কাঠুয়ায় বছর আষ্টেকের শিশুকেও ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে, না হয় ধর্ষকদের বাঁচাতে হিন্দুরা গোটা কতক মিছিল মিটিংই করেছে, মৃত শিশুর উকিলকে খুনের হুমকি দিয়েছে। সে আর তালিবান, আল কায়দা, আইসিস, বোকো হারামের অপরাধের তুলনায় কতটুকু? গেরুয়া পরে তো কেউ সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না, ওসব কংগ্রেসি প্রোপাগান্ডা। গেরুয়া পরে কেবল এমপি, এমএলএ, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়। কারণ তালিবানদের কেউ ভোট দেয় না, গেরুয়া পরে বোম ফিট করার অভিযোগ উঠলে দেয়। কারণ ওটি বীরত্ব।

আরও পড়ুন বিজেপি মুখপাত্র বিতাড়ন: হিন্দুত্বের টাইম আউট, খেলা শেষ নয়

দেশটা এখন বীরে বীরে বীরাক্কার। এদিকে আমার বীরেদের মর্যাদা দিতেও শেখা হয়নি। সেকুলাররা মাথাটা এমন খেয়েছে, কী বলব ধর্মাবতার, গোমাতাকে মাংস বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বা খাচ্ছে – এই অভিযোগে কাউকে উচিত শাস্তি দেয় যারা তাদের আমি ভেবেছি ‘লিঞ্চ মব’। এইসব সাহেবদের শেখানো কথাবার্তা, বুঝলেন কিনা? আমাদের দেশের কোনো ভাষায় ও কথাটা আছে? নেই, কারণ আমাদের দেশে ওরকম হয় না। আমাদের এখানে কেবল গোমাতার অসম্মান করলে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষা যারা দেয় তারা সব খোদ রাণাপ্রতাপের লোক, মানে সেই যিনি হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবরের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এই দেখুন, যত পাপই করে থাকি, আমার কিন্তু শুধরে নেওয়ার চেষ্টা আছে। যত রাজ্যের কমুনিস্টের লেখা ইতিহাস পড়ে শিখেছিলুম রাণাপ্রতাপ নাকি হেরে গেছিলেন। তা আবার হয় নাকি? ওই গরুখেকো মোগলদের কাছে আমাদের বিরাট হিন্দু রাজপুতরা কখনো হারতে পারে?

এত বছরের এত পাপ সব আপনার পায়ে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলুম। এবার থেকে একেবারে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে যাব, কথা দিচ্ছি। শুধু একটা ব্যাপারেই মনটা একটু খচখচ করছে, আপনি মাইবাপ, তাই আপনাকেই বলছি। হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া যে দরকার তাতে সন্দেহ নেই। নইলে ওদের গুজরাটের মত, উত্তরপ্রদেশের মত শিক্ষা দেওয়া যাবে কী করে? সে আশাতেই তো বিরাট হিন্দু নেতাদের ভোট দেয়া। কিন্তু ওদের শিক্ষা দিতে দিতে আমাদের ছেলেপুলেগুলো অশিক্ষিত হয়ে যাবে না তো? ডারউইন বলেছিলেন মানুষ বাঁদর ছিল। আমাদের মুনি ঋষিরা বলেননি, তাই বোধহয় ওসব বই থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারভিউতে “অমৃতস্য পুত্রাঃ” বলে-টলে আমাদের ছেলেপুলেগুলো চাকরি বাকরি পাবে তো, ধর্মাবতার? না, মানে বলছি চাকরি বাকরি তো এদেশে বিশেষ নেই, বিদেশেই খোঁজ করতে হবে। সেখানে এসব বললে আবার হাঁকড়ে দেবে না তো অশিক্ষিত লালমুখো সাহেবগুলো?

আর আপনার সময় নষ্ট করব না ধর্মাবতার। কেবল একখানা শেষ প্রশ্ন আছে। বলি বিলকিস বানোর ওই যে ভালমানুষ ধর্ষকগুলি, তাদের আবার মুসলমানদের শিক্ষা দেয়া হয়ে গেলে আমাদের মেয়েদের শিক্ষা দেয়ার প্ল্যান আছে নাকি? না, মানে হিন্দুরাষ্ট্রে কি মুসলমান থাকতে দেয়া হবে? না হলে এই লক্ষ লক্ষ বীরেরা করবেটা কী? শিক্ষা দেয়া ছাড়া আর কোনো বিদ্যে কি এদের আছে?

অপরাধ নেবেন না হুজুর। এসব প্রশ্ন করব কাকে? কল্কি অবতার তো আর প্রেস কনফারেন্স করেন না, তেনার এজলাসও নেই। অগত্যা আপনাকেই করলুম আর কি। তাছাড়া আমাদের সাধুসন্তরা বলেছেন, সবই মায়া। তাই ছোট মুখে বড় কথা বলে অপরাধ হয়ে থাকলে মায়া বলে মামলা ডিসমিস করে দেবেন, এই আশা রাখি।

বিনয়াবনত

হিন্দুরাষ্ট্রের এক হিন্দু নাগরিক

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

হিংসার রাজনীতির মোকাবিলায় বামপন্থীরা কোথায়?

ওরা আসে গেরুয়া ঝান্ডা নিয়ে, কমিউনিস্টরা লাল ঝান্ডা নিয়ে নামতে পারে। তাতে দুটো জিনিস হবে। এক, দাঙ্গাবাজরা একটু হলেও ভয় পাবে। জানবে, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকলেও দাঙ্গা আটকানোর লোক আছে। আর দুই, সাধারণ মানুষ দেখবেন কারা দাঙ্গা আটকাতে নেমেছে।

রামের নাম করে গত কয়েকদিন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যে রাবণসুলভ আচরণ চলেছে, খবর পেলাম, তার জেরে আমার দুই খুদে আত্মীয়ার স্কুলের পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। এতদ্বারা সময় জানান দিল যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আমরা কোনও উন্নততর ভারতবর্ষ তৈরি করতে পারিনি। কারণ, তিন দশক আগে একইভাবে আমার স্কুলের পরীক্ষাও পিছিয়ে গিয়েছিল। বস্তুত, আমার সময় এর চেয়ে ভালই ছিল বলতে হবে। কারণ, রিষড়া এলাকায় তখন যে অশান্তি দেখা দিয়েছিল তার কারণটা ছিল বিরাট— বাবরি মসজিদ ধ্বংস। সেই ঘটনা ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসকেই বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত, বদলে দিয়েছিলও। কিন্তু আজকের কচিকাঁচাদের পরীক্ষা বাতিল হল এক স্থানীয় গোলমালে, রামনবমী মিটে যাওয়ার পরেও মিছিল বার করে হিংসা ছড়ানোর প্রচেষ্টায়। অর্থাৎ এ রাজ্যে গত শতকের নয়ের দশকে যে অশান্তি সৃষ্টি করতে হলে জাতীয় স্তরে কোনও ঐতিহাসিক কাণ্ড ঘটাতে হত, এখন স্থানীয় স্তরে খানিকটা গুণ্ডামি করেই তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করা সম্ভব হচ্ছে।

প্রশ্ন হল, কেন সম্ভব হচ্ছে? কী বদলেছে গত ৩০ বছরে? হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক শক্তি বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে, তারা লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, সংসদকে নিজেদের বৈঠকখানায় পরিণত করেছে, প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে স্বয়ংসেবকদের বসিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি বিজেপির সদস্য, বিধায়ক এবং মন্ত্রী ছিলেন। উপরাষ্ট্রপতিরও আরএসএসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ইতিহাস রয়েছে। তা ছাড়া ভারতের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই যে নানা কৌশলে তাদের দখলে চলে গেছে— যেগুলো যায়নি সেগুলোকে দখলে আনার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে— তা বুঝতে এখন আর কারও বাকি নেই। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। আসল কথা হল, হিন্দুত্ববাদীরা দখল করতে পেরেছে মানুষের মস্তিষ্ক।

বাঙালি হিন্দুরা শ-দুয়েক বছর ধরেই মনে করে তারা দেশের আর সকলের চেয়ে প্রগতিশীল। ইতিহাসে অবশ্য এর কোনও নৈর্ব্যক্তিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। বাংলায় চিরকালই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন, রাধাকান্ত দেবও ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন। দুর্গাপুজো এসে পড়লেই বাঙালি হিন্দুরা ফেসবুকে লিখতে শুরু করে “পুজো যার যার, উৎসব সবার।” কিন্তু ঈদ-উল-ফিতর আর ঈদুজ্জোহার তফাত জানার সাধ নেই। বড়দিনে কেক খেতে না-পারলে ভাত হজম হয় না, পার্ক স্ট্রিটে সপরিবারে নেত্য করতে যেতে হয়। কিন্তু ঈদে কেউ বিরিয়ানি বা হালিম খাচ্ছে দেখলে ফ্যাক করে হেসে ফেলে “এ মা! তুই কি মুসলমান” বলে। জিভে জল আনা খাবারের সম্ভার থাকলেও জাকারিয়া স্ট্রিটে ঈদের মরসুমে এত ভিড় হয় না, যে টিভি চ্যানেলের রিপোর্টাররা মাথায় ফেজ পরে (বড়দিনের সময়ে যেমন স্যান্টা টুপি পরেন আর কি) ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন “কেমন লাগছে”। সংঘ বাঙালির এই বিভাজনরেখাটাই কাজে লাগিয়েছে। তাই এত স্থানীয় দাঙ্গা করা সম্ভব হচ্ছে।

এ দেশে যাঁরা হিন্দুত্ব রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘকাল চর্চা করছেন তাঁরা অনেকে মনে করেন, ২০০২ সালের গুজরাতের মতো রাজ্যব্যাপী দাঙ্গার পরিকল্পনা আরএসএস ত্যাগ করেছে। কারণ শিবপুর, ডালখোলা, রিষড়ার মতো এলাকায় ছোট-ছোট দাঙ্গা করতে পারলে লাভ অনেক দীর্ঘমেয়াদি। দাঙ্গার আগুন ঘরের কাছে চলে এলে মানুষ বেশি ভয় পায়। ফলে “হিন্দু খতরে মে হ্যায়”— এ কথা মনের গভীরে প্রোথিত করা সহজ হয়। যেমন রিষড়ায় দাঙ্গা হলে ঘটনার ল্যাজা-মুড়ো না-জেনেও শ্রীরামপুর, কোন্নগর, হিন্দমোটর, উত্তরপাড়ার সংখ্যাগুরু হিন্দুরা ভাবতে শুরু করেন, তাঁরা খুব বিপদের মধ্যে আছেন। এইসব এলাকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যেও নিরাপত্তার অভাববোধ বাড়তে থাকে। উভয় পক্ষই ভুলে যান, কয়েক প্রজন্ম ধরে গলাগলি না-হোক, অন্তত পাশাপাশি বাস করছেন তাঁরা। বহু রামনবমী, বহু মহরম গিয়েছে। শীত বসন্ত এসেছে চক্রাকারে, অথচ কারওই কোনও খতরা হয়নি। অর্থাৎ এইসব ছোট-ছোট অল্প তীব্রতার দাঙ্গা লাগানোর উদ্দেশ্য “আমাদেরি আন্তরিকতাতে / আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা/ খুঁজে আনা।”

সে কাজে সাহায্য করে নিষ্ক্রিয় প্রশাসন। অন্তর্যামী মুখ্যমন্ত্রী সাতদিন আগে থেকে একের পর এক প্রকাশ্য সভায় বলে যাচ্ছেন “ওরা রামনবমীতে ঝামেলা করবে”, অথচ তাঁরই অধীন পুলিস সে দাঙ্গা আটকাতে পারে না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী কখনও বলেন বিনা অনুমতিতে মিছিল বার করা হয়েছে, কখনও বলেন ওরা মিছিলের রুট বদলে ফেলেছে। যে মিছিলের অনুমতি ছিল না সে মিছিল পুলিস চলতে দিল কেন— দিদিকে এ প্রশ্ন করতে বিখ্যাত সাংবাদিক ভাইটি ভুলে যান। সর্বত্রই যাঁরা স্থানীয় মানুষ, সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে প্রদীপ জ্বালাবার আগে সলতে পাকাবার গল্পও শোনা যাচ্ছে এবং সে গল্পে হিন্দুত্ব ব্রিগেড খলনায়কের ভূমিকায় থাকলেও রাজ্যের শাসক দল নেহাত যাত্রার বিবেকের ভূমিকায় নেই। আশার কথা এটুকুই যে, রিষড়ায় ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা অশান্তির আগুন নিভে যাওয়ার আগেই কোন্নগর স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম— যা আশঙ্কা করেছিলাম কথাবার্তা সে পথে এগোল না। আগের দিন রাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে রিষড়ার গণ্ডগোলে ট্রেনে আটকে ছিলেন রাত দেড়টা-দুটো অবধি, এমন কয়েকজন আমার আর এক সাংবাদিক বন্ধুর আলোচনায় এসে যোগ দিলেন। আশঙ্কা করছিলাম দু-চার কথার পরেই কিছু অন্য ধর্মের মানুষকে দায়ী করে কিছু মন্তব্য ছুটে আসবে। তা কিন্তু হল না। যাঁরা কথা বলছিলেন তাঁরা পরস্পরের পরিচিত নন, নামধামও জানতে চাননি, ফলে ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু সকলেই দেখলাম দায়ী করলেন দুটো রাজনৈতিক দলকে, কোনও সম্প্রদায়কে নয়।

যদিও তারপর যে কথা উঠে এল তাতে অস্বস্তি বাড়ল বই কমল না। একজন বললেন “আজকাল তো আমাদের এখানে যা যা হচ্ছে সবই বিশেষ এক ধরনের লোকের জন্যে হচ্ছে। কী ধরনের লোক সেটা আর বলছি না, আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন। বিজেপি তো সারাক্ষণ হিন্দু হিন্দু করে। আমরাও তো হিন্দু, আমাদের রোজগারের কিছু সুবিধা হচ্ছে? বাঙালি হিন্দু তো কোনওমতে খেয়েপরে বাঁচছে। লালে লাল হচ্ছে কারা? তারাই তো দাঙ্গা করছে।” রিষড়ায় বরাবরই এক বড় অংশের মানুষ হিন্দিভাষী, হিন্দমোটরেও। বিশেষত যখন বিড়লাদের গাড়ি তৈরির কারখানা চালু ছিল। কিন্তু ইদানীংকালে কোন্নগর, শ্রীরামপুর ইত্যাদি এলাকাতেও দ্রুত হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সেই প্রেক্ষিতে এই ভদ্রলোকের কথা অশনি সঙ্কেত।

প্রথমত, এ কথায় অন্যের ঘাড়ে নিজের দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চিরাচরিত বাঙালি প্রবণতা প্রকট। যেদিন উনি ও কথা বললেন, সেদিনই বিহারের মুঙ্গের থেকে পুলিস গ্রেফতার করে আনল হাওড়ার সালকিয়ার ভেতো বাঙালি সুমিত সাউকে, যাকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইটে বন্দুক হাতে দেখা গিয়েছিল, যার মা সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় বলেছেন সে আগে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে কাজ করত। সুতরাং অবাঙালিরা দাঙ্গা করছে, বাঙালিরা শান্তিপ্রিয় জাত— এ কথায় সত্য ততটা নেই, যতটা আছে পরজাতিবিদ্বেষ।

দ্বিতীয়ত, বোঝাই যাচ্ছে এ তল্লাটে বাঙালি বনাম অবাঙালি সংঘাতের পটভূমি তৈরি হচ্ছে। যেভাবে ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দুকে বিশ্বাস করানো হয়েছে ২০-২২ শতাংশ মুসলমান তাদের জন্য বিপদ, প্রায় সেভাবেই হুগলি জেলার শহর-মফস্বলের সংখ্যাগুরু বাঙালি ক্রমশ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, তারা হিন্দিভাষীদের কারণে কোণঠাসা হচ্ছে। বিশেষত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের বিশ্রম্ভালাপে আজকাল অন্যতম জনপ্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কীভাবে “ওরা চারিদিকে ছেয়ে যাচ্ছে”। এর পিছনে স্থানীয় হিন্দিভাষীদের ব্যবহার যে একেবারেই দায়ী নয় তা-ও বলা যাবে না। শুধু এখানে কেন, পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গাতেই এমন অনেক আবাসন গড়ে উঠছে যেখানকার সংখ্যাগুরু হিন্দিভাষী ফ্ল্যাটমালিকরা নিয়ম করে দিচ্ছেন, আমিষাশী হলে তাকে ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া যাবে না। বাজারঘাটে বিক্রেতা বা অন্য লোকেদের হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য করা, না-বললে বাংলা না-বোঝার ভান করার মতো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। এ রাজ্যের বামপন্থীরা তো অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়া সব সমস্যাকেই মনে করেন নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাই যেমন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থামানোর কাজে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না, তেমন এইসব ক্রমবর্ধমান সামাজিক দ্বন্দ্বের নিরসনেও তাঁদের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঢুকে পড়ছে বাংলাপক্ষের মতো দক্ষিণপন্থী সংগঠন। এখন যেমন হিন্দু-মুসলমানে লাঠালাঠি লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টায় রয়েছে তৃণমূল, বিজেপি; আগামীদিনে নগরায়নে ভোল বদলে ফেলা এলাকাগুলোতে তেমনই বাঙালি বনাম অবাঙালি বাইনারি সৃষ্টি করে একই খেলা চলতে থাকবে বলে আশঙ্কা হয়। গত বিধানসভা নির্বাচনেই তার লক্ষণ দেখা গেছে। তৃণমূল বিজেপির হিন্দুত্বকে যতখানি আক্রমণ করেছিল তার চেয়ে বেশি করে বলেছিল বিজেপি বহিরাগতদের পার্টি। ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ স্লোগানেও প্রচ্ছন্ন ছিল এই ইঙ্গিত। এদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ছটপুজোয় সরকারি ছুটি দেয়, হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। পাশাপাশি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোকে লাটে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

কোনও না-কোনও কাল্পনিক বাইনারি তৈরি করে আমাদের নিয়ে শাটল ককের মতো খেলে চলেছে দুটো রাজনৈতিক শক্তি। এ জিনিস আটকাতে দরকার এমন এক তৃতীয় পক্ষ, যারা স্রেফ কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের কর্মসূচি এবং দুর্নীতিকে নয়, আক্রমণ করে আদর্শকে। অথচ এ রাজ্যের বামপন্থীরা কিছুতেই সিবিআই, ইডি, ডিএ, নিয়োগ দুর্নীতির বাইরে কোনওকিছু নিয়ে আক্রমণাত্মক হতে রাজি নন। দাঙ্গা কেন হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েই তাঁরা ক্ষান্ত। এমন নয় যে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কিন্তু সেখানেই তাঁদের কাজ শেষ হয় কী করে? কার্ল মার্কস তো বলেছিলেন, দার্শনিকরা পৃথিবীটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কাজ হল পৃথিবীটাকে বদলানো। কমরেডরা সে কথা ভুলে গেলেন নাকি? এ রাজ্যে যে বামপন্থী দলগুলোর উপস্থিতি আছে তাদের সদস্য-সমর্থকদের কথা শুনলে দুঃখে হাসি পায়।

সিপিএমের লোকেরা বারবার শুনিয়ে যান সরকারে থাকার সময়ে তাঁদের দল কীভাবে দাঙ্গা আটকাত আর তৃণমূল সরকার তার সাপেক্ষে কতখানি ব্যর্থ। মার্কসবাদে দেবতা নেই জানি, অপদেবতা আছে কিনা জানি না। এঁদের কথা শুনলে মনে হয় আশা করে আছেন জ্যোতি বসুর ভূত এসে দাঙ্গাবাজদের ঘাড় মটকে দিয়ে যাবে, এঁদের স্বহস্তে কিছু করার প্রয়োজন নেই। তাঁরা কী করছেন, এ প্রশ্ন তুললে আবার কেউ কেউ খাঁটি আমলাতান্ত্রিক ঢঙে বলেন “দাঙ্গা আটকানো সরকারের দায়িত্ব।” কেউ বা বলেন “পুলিশ মিছিল করার অনুমতি দিচ্ছে না। কী করব?” জ্যোতি বসু, মহম্মদ ইসমাইল, বিনয় চৌধুরীরা এত লক্ষ্মী ছেলে হলে সিপিএম কোনওদিন ক্ষমতায় আসত বলে মনে হয় না। এঁরাও সে আমলে কীভাবে দাঙ্গা আটকানো হত, তা নিয়ে জাঁক করার সুযোগ পেতেন না।

অন্যদিকে লিবারেশনের নেতা-কর্মীরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দাঙ্গার দায় যেন সবটাই বিজেপির ঘাড়ে চাপে। তৃণমূল সরকারের গায়ে ছিটেফোঁটা কাদা লাগলেও ফ্যাসিবিরোধী লড়াই দুর্বল হয়ে যাবে। অথচ তাঁদেরই পার্টির উত্তরপাড়া আঞ্চলিক কমিটির প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট রিষড়ার ঘটনা সম্পর্কে বলছে “যেখানে গত বছর মসজিদের সামনে দিয়ে মিছিল যাওয়ার সময়ে রীতিমতো রাস্তার ধারে ব্যারিকেড করে মিছিল পার করা হয়েছিল সেখানে এ-বছর তেমন কিছু ছিল না এবং অল্পসংখ্যক কয়েকজন পুলিশকর্মী মসজিদের সামনে মোতায়েন ছিলেন, যাদের অধিকাংশই গণ্ডগোলের সময়ে রীতিমত আহত হন।”

আরও বামদিকে যেসব দল আছে, যাদের কোনও নির্বাচনী স্বার্থ নেই, তারা ঠিক কী করছে জানি না। এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে কিন্তু তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। স্বীকার্য যে, তারপর থেকে তাদের উপরে রাষ্ট্রীয় আক্রমণ (রাজ্য সরকারের দিক থেকেও) বেড়েছে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জায়গায়, বিশেষত রিষড়া বা শিবপুরের মতো নগরায়িত এলাকায় তাদের ক্ষমতাও নগণ্য।

ভারতের কমিউনিস্টদের দাঙ্গার সময়ে রাস্তায় নেমে দাঙ্গা আটকানোর ইতিহাস আছে বলেই তাঁদের কাছে আশা করা। ক্ষমতাসর্বস্ব তৃণমূল আর পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চল থেকে উধাও কংগ্রেসের কাছে আশা করতে যাবে কোন আহাম্মক?

আরও পড়ুন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হলে ক্ষতি নেই বিজেপির

এসব নিয়ে এক মার্কসবাদী দলের কর্মী বন্ধুর কাছে দুঃখ করছিলাম। সে যা বলল সেটাই বোধহয় সার কথা। তার বক্তব্য, সংসদীয় এবং সংসদ-বহির্ভূত— সব ধরনের কমিউনিস্ট মিলিয়ে বিজেপি শাসনের আট বছরে হাজার খানেক সেমিনার ও সভা করে ফেলেছে, যার বিষয় ভারতে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং তাকে আটকানোর উপায়সমূহ। তারপরেও শিবপুর, ডালখোলা বা রিষড়া ঘটেই চলেছে। ঘটে যাওয়ার পর কমিউনিস্টরা কিছু শান্তি মিছিল, মিটিং, পোস্টারিং ইত্যাদি করছে। কিন্তু দাঙ্গা আটকাতে পারছে না। এর কারণ হল, হিন্দুত্ববাদীরা এবং তাদের স্যাঙাত দলগুলো দাঙ্গা লাগানোকে একটা রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে দেখে। তার জন্যে রীতিমত পরিকল্পনা করে, সেই পরিকল্পনাই রাস্তায় নেমে প্রয়োগ করে। কিন্তু কমিউনিস্টরা দাঙ্গা আটকানোকে প্রকল্প হিসেবে দেখছে না কিছুতেই। দাঙ্গাবাজদের বিরাট দল থাকতে পারে, কমিউনিস্টদের তো অন্তত ছোটখাটো দল আছে নানা জায়গাতেই। সেই কটা লোককে একত্র করেও তো পাল্টা রাস্তায় নামা যায়। ওরা আসে গেরুয়া ঝান্ডা নিয়ে, কমিউনিস্টরা লাল ঝান্ডা নিয়ে নামতে পারে। তাতে দুটো জিনিস হবে। এক, দাঙ্গাবাজরা একটু হলেও ভয় পাবে। জানবে, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকলেও দাঙ্গা আটকানোর লোক আছে। আর দুই, সাধারণ মানুষ দেখবেন কারা দাঙ্গা আটকাতে নেমেছে। ফলে বাইনারি যদি তৈরি হয়ও, তা ভেঙে যাবে।

নিশ্চয়ই আমার বন্ধুটি একমাত্র লোক নয় যে এভাবে ভাবছে। কিন্তু এরকম ভাবনার লোকেরা সম্ভবত সব দলেই সংখ্যালঘু। ফলে দোকানপাট পুড়লে, মাথা ফাটলে, হাত-পা ভাঙলে, পরীক্ষা পেছোলে আমরা এই ভেবে সান্ত্বনা পাব যে, কেউ মারা যায়নি, কেউ ধর্ষিত হয়নি। রামনবমীর পর হনুমান জয়ন্তী নিয়ে তটস্থ হয়ে থাকব। সেটা মিটলে ক্যালেন্ডারে খুঁজব, আবার কবে কোন পুজো আছে। সেদিন বাড়ি থেকে না-বেরোলে চলে কিনা।

সত্যিই, কী চমৎকার ভারতবর্ষ সাজিয়েছি ছোটদের জন্যে!

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

২০২৪ আসলে গণভোট, বহুত্ববাদী ভারতের মুখ রাহুল গান্ধী

প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী।

সেই কোন কালে চকোলেট কোম্পানি ক্যাডবেরি’জ অমিতাভ বচ্চনকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে একগুচ্ছ বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। তার একটায় তিনি পাপ্পু নামে একটি ছেলের বাবা, যার বয়স বেড়েই চলেছে কিন্তু সে স্কুলের গণ্ডি আর পেরোতে পারছেন না। তা পাপ্পুর হতাশ দোকানদার বাবাকে ছেলের বন্ধুরা এসে খবর দিল, পাপ্পু পাশ করে গেছে। অতএব তারা চকোলেট খাবে, পয়সা পাপ্পু দেবে। বাবা মহানন্দে সকলকে বিনিপয়সায় চকোলেট বিলোতে লাগলেন। এমন খুশির খবরে কি মিষ্টিমুখ না করে থাকা যায়? ওই সিরিজেরই আরেকটি বিজ্ঞাপনে অমিতাভ কলেজের অধ্যাপক। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখেন, ছেলেমেয়েরা সব ঊর্ধ্বশ্বাসে কোথায় যেন দৌড়চ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, পাপ্পুর নাকি পরীক্ষা, তাই তারা সবাই দৌড়চ্ছে। অবাক অধ্যাপক সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন পরীক্ষা মানে হল, একটি সুন্দরী মেয়ে (রাইমা সেন) কলেজে ঢুকছে আর মোটা কাচের চশমা পরা, সচরাচর যাদের ক্যাবলা বলা হয় তেমন ছেলে পাপ্পু প্রেম নিবেদন করবে বলে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি এল, দেখল এবং পাপ্পুকে জয়যুক্ত করল। ফলে সকলে মিলে পাপ্পু পাশ করে গেছে বলে ফের নাচানাচি শুরু করল। এ খবরেও মিষ্টিমুখ না-করে থাকা যায় না, অতএব ফের চকোলেট খাওয়া হল। এই পাপ্পু যে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে জায়গা করে নিতে চলেছে, তখন কে জানত!

আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র তুলনাহীন। আজ না হয় যাবতীয় টিভি চ্যানেল এবং অধিকাংশ সর্বভারতীয় খবরের কাগজের উপর আম্বানি-আদানির সহায়তায় তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির সর্বভারতীয় উত্থানের সময়ে তো এতখানি আধিপত্য ছিল না। তবু বিজেপি নেতারা বারবার আউড়ে এবং হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকের বিপুল ব্যবহারের মাধ্যমে জনমনে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পেরেছিলেন এই কথা যে, হার্ভার্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রাহুল গান্ধি হলেন ওই বিজ্ঞাপন সিরিজের অকর্মণ্য, অজস্রবার ফেল করা পাপ্পু। অন্যদিকে তথ্যের অধিকার আইন ব্যবহার করে যাঁর পাশ করার বছরের তথ্য জানতে চাইলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে মুখে কুলুপ আঁটে, সেই মোদি হলেন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, বিশ্বগুরু হওয়ার উপযুক্ত। যেহেতু মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতা সন্দেহজনক (গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত তাঁর মার্কশিটে অধ্যয়নের বিষয় লেখা ছিল “entire political science”), সেহেতু ডিগ্রি ব্যাপারটাই যে অপ্রয়োজনীয় তা প্রমাণ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র। বারো ক্লাসের গণ্ডি না-পেরনো স্মৃতি ইরানিকে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী করা হয়েছিল এবং ডিগ্রি যে কিছুই প্রমাণ করে না তা প্রমাণ করতে দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র মতো বিরাট কাগজ রীতিমত গ্রাফিক্স তৈরি করেছিল— যাতে দেখানো হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বেরই ডিগ্রির বালাই ছিল না। মনে রাখতে হবে, এই স্মৃতি সংসদে পৌঁছেছিলেন অমেঠি কেন্দ্রে রাহুলকে পরাজিত করে। অর্থাৎ স্মৃতিকে মাথায় তোলার পিছনেও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাহুলকে পাপ্পু প্রমাণ করা।

স্বীকার্য যে, প্রচুর লেখাপড়া জেনেও রাজনীতিতে কেউ অকর্মণ্য হতেই পারেন। আবার বেশিদূর লেখাপড়া না-করেও ক্ষুরধার বুদ্ধি, সাহস এবং পরিশ্রমের জোরে একজন রাজনীতিবিদ দারুণ সফল হতে পারেন। সাফল্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটা অবশ্য গুরুতর প্রশ্ন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেমন স্পষ্টতই মনে করেন, চা বিক্রেতার ছেলে হয়েও দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাই সাফল্য। কীভাবে সে চেয়ার অবধি পৌঁছনো হল এবং চেয়ারে বসে কী করা হচ্ছে তার তেমন গুরুত্ব নেই। তিনি যে গত আট বছরে এমনকি কাশ্মিরি পণ্ডিতদের জন্যও গঠনমূলক কিছু করে উঠতে পারেননি, তা তাঁর কাছে ব্যর্থতা বলে প্রতিভাত হয় বলে তো মনে হয় না। উলটে সারাক্ষণ নিজেই নিজেকে শংসাপত্র দিয়ে বেড়াচ্ছেন— “সব চঙ্গা সি”। এহেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের মানদণ্ডে রাহুল যা-ই করুন, প্রধানমন্ত্রী না-হতে পারলে পাপ্পুই থাকবেন। তাতে কিছু এসে যায় না। মুশকিল হল, পাপ্পু মিথ নির্মাণ এতই সফল হয়েছে যে, বিজেপিবিরোধী মানুষও কিছুতেই ওই মিথ ভুলে রাহুলকে দেখে উঠতে পারছেন না। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের এই ভুল না ভাঙলে বিপদ।

গত কয়েক দিনে যে চরম অন্যায় অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করে রাহুলকে লোকসভা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, বহু উদারপন্থী, এমনকি বামপন্থী মানুষও তাতে তেমন দোষ দেখছেন না। বিজেপি বাদে সব দলের নেতৃস্থানীয়রাই অবশ্য এর নিন্দা করেছেন, কিন্তু তার অনেকটাই “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” যুক্তিতে। কারণ, আজ এর প্রতিবাদ না-করলে কাল এত বড় দেশের কোনও এক নিম্ন আদালতে তাঁদের কারও কোনও প্রধানমন্ত্রীবিরোধী মন্তব্যকে হাতিয়ার করে কেউ যদি মানহানির মামলা ঠুকে দেয় আর আদালত তুরন্ত দুবছরের কারাদণ্ড দিয়ে দেয়, তাহলে তাঁদের সাংসদ বা বিধায়ক পদও নিমেষে খারিজ হয়ে যাবে। কিছু বলার মুখ থাকবে না। এই নেতা-নেত্রীদের কে কে ভারতের গণতন্ত্রের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সত্যিই চিন্তিত তা আরও কিছুদিন না কাটলে, তাঁদের দলের কার্যকলাপ না দেখলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। যেমন ধরুন, এর পরেও যদি আম আদমি পার্টি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী ধ্বজা উড়িয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটতে যায়, তা হলে বুঝতে হবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের লুকোবার মতো আরও অনেক কিছু আছে। সেসবের গুরুত্ব ভারতের গণতন্ত্র বাঁচানোর চেয়ে বেশি।

কিন্তু ইতিমধ্যেই দলগুলোর সাধারণ সদস্য, সমর্থকদের অনেকেরই দেখা যাচ্ছে রাহুল পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন এবং অনেকে তাঁর মধ্যে আশার আলো দেখছেন বলে প্রবল গাত্রদাহ। এর কারণ রাহুলের কার্যকলাপ তাঁরা এত বছর ধরে ভাল করে লক্ষই করেননি। নিজেদের অজান্তেই সরকারি প্রচারযন্ত্রের চোখ দিয়ে রাহুলকে দেখেছেন। তাই এখন চোখকান যা বলছে, মস্তিষ্ক কিছুতেই তা মানতে চাইছে না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভারত জোড়ো যাত্রার পরে রাহুল সর্বক্ষণের রাজনীতিবিদ নন— এই অভিযোগ আর করা যাচ্ছে না। লৌহমানব মোদির বিপরীতে তিনি যে ঠুনকো পুতুল নন, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছেন। কংগ্রেসেও যে নেতৃত্বের সঙ্কট দীর্ঘকাল ধরে চলছিল তার নিষ্পত্তি ঘটেছে। গুলাম নবি আজাদের মতো সুযোগসন্ধানীরা বিদায় হয়েছেন। কপিল সিব্বলের মতো অতিবৃদ্ধ, জনসংযোগহীন আইনজীবী নেতারা পথপার্শ্বে পড়ে আছেন। সুদর্শন, সাহেবদের মতো ইংরেজি বলায় দক্ষ শশী থারুর টিভি স্টুডিও আর টুইটার আলো করেই বসে আছেন। মল্লিকার্জুন খড়গেকে সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে ঝাড়া হাত-পা রাহুল জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে গেছেন।

কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। দেশ কীভাবে চালানো উচিত, ভারতের আগামীদিনের অর্থনীতি কেমন হওয়া উচিত, আজকের দুনিয়ায় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার পুনঃপ্রয়োগ কীভাবে করা সম্ভব— এসব নিয়ে গত কয়েক বছরে মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছেন রাহুল। কিন্তু গোদি মিডিয়া আর বিজেপি-র আইটি সেল সেসব দিকে আলো ফেলেনি। কেবলই পাপ্পু ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে এবং জওহরলাল নেহরুর চিন-নীতির ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির স্বৈরতান্ত্রিকতা— এগুলোকে রাহুল গান্ধীর সমার্থক করে দিয়েছে। দুঃখের বিষয়, বহু বিজেপি-বিরোধী, বিশেষত বামপন্থীরা, এই চশমা দিয়েই রাহুলকে দেখেছেন এবং এখনও দেখে চলেছেন। তাঁরা খেয়ালই করেন না, ২০১৯ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাহুল সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের যে প্রস্তাব রেখেছিলেন তা এই মুহূর্তে যে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির কবলে আমরা পড়েছি তার প্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক, এবং বলা বাহুল্য, বামপন্থী। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন ভারতে অমন একটা প্রকল্প দারুণ কাজে দেবে। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ অবশ্যই আছে। কিন্তু অন্তত এই শতকে ভারতের কোনও বামপন্থী দলের নেতাকে অর্থনীতি নিয়ে এরকম বিকল্প চিন্তা করতে দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের শেষ বামফ্রন্ট সরকার বরং অনেকাংশে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি নিয়ে চলছিল, কেরলের বাম সরকারও যে মৌলিকভাবে আলাদা কোনও পথ দেখাতে পারছে এমন নয়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যেমন (যাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে মোদি সরকার) তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে খুব আলাদা কোনও পথ নেওয়া হয়তো কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভবও নয়। কিন্তু প্রস্তাব হিসেবে, পরিকল্পনা হিসেবেও ডি রাজা, পিনারাই বিজয়ন বা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যরা কোনও মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির কথা বলেছেন কি? সরকারে এলে কী করবেন সে তো পরের কথা, রাহুল অন্তত অন্য কিছু ভাবার এবং বলার সাহস তো দেখিয়েছেন।

ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন রাহুল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিলেন। সেই আলোচনা শুনলে বোঝা যায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে রাহুল কীভাবে দেখেন এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্যকে কতটা গভীরভাবে জানেন। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের সাফল্য কীভাবে এল, ভারতে সেরকম কিছু করা সম্ভব কিনা জানতে চান এবং সেই প্রসঙ্গে জিএসটি ও নোটবন্দির ফলে কর্নাটকের বেল্লারির রমরমা জিনস শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতির কথা জানান। দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়েও সুনির্দিষ্ট আলোচনা করেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মির পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনকে কতটা গভীরভাবে দেখেছেন তা মিনিট পঁচিশেকের ওই ভিডিওতে বেশ বোঝা যায়। রঘুরাম কিন্তু ঘোর পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ। রাহুল আলোচনার এক জায়গায় প্রশ্ন করেন, “দেখতে পাচ্ছি স্টক এক্সচেঞ্জে টাকা লাগিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার কী মত?”

দিল্লির রাজনৈতিক মহলে সকলেই জানেন, রাহুলকে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের অপছন্দ হওয়ার অন্যতম কারণ তাঁর এই বামপন্থী প্রবণতা। তিনি যেভাবে নাম করে দেশের সবচেয়ে বড় দুই ধনী— মুকেশ আম্বানি আর গৌতম আদানিকে আক্রমণ করেন, তা অনেকেরই পছন্দ নয়। কারণ অর্থনীতির দিক থেকে কংগ্রেসের ক্রমশ ডাইনে সরে যাওয়া আরম্ভ হয়েছিল রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধীর আমলে, যা তুঙ্গে পৌঁছয় নরসিংহ-মনমোহন জুটির নেতৃত্বে। সেই কারণেই নরসিংহ বিজেপির বিশেষ পছন্দের লোক। শেখর গুপ্তার মত দক্ষিণপন্থী সাংবাদিকরা তাঁকে ‘ভারতের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী’ আখ্যাও দিয়ে থাকেন। সেই দলের নেতা হয়ে রাহুলের এভাবে বৃহৎ পুঁজিকে আক্রমণ, বারবার ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ নিয়ে কথা বলা অনেক কংগ্রেসিরই না-পসন্দ।

তা বলে রাহুল বিপ্লবী নন, লেনিন বা মাও জে দং নন। কিন্তু তাঁকে অমন হতে হবে— এমন প্রত্যাশা করবই বা কেন? এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও যখন বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে থেকে তেমন কেউ উঠে এলেন না, তখন বহুত্ববাদী ভারত থাকবে কি থাকবে না— এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে কমিউনিজমের দাঁড়িপাল্লায় রাহুলকে মাপার মূঢ়তা ক্ষমার অযোগ্য। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় একই সময়ে। একশো বছর পূর্ণ করার আগেই আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনায় চূড়ান্ত সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সেখানে ভারতীয় কমিউনিস্টরা দারুণ শুরু করেও ১৯৬৪ সালের পর থেকে নিজেদের ভাঙতে-ভাঙতে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে, অস্তিত্বেরই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ১৯৮৯ থেকে সংঘের শক্তি দ্রুত বেড়েছে, অথচ কমিউনিস্টরা সম্মুখসমরে যাওয়ার শক্তি ক্রমশ হারিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে তবু বিকল্প সরকার তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার শক্তি ছিল, ২০০৯ সালের পর থেকে তা-ও আর অবশিষ্ট নেই।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় রাজনীতির বাস্তুতন্ত্র মানে ছিল বামপন্থা বনাম মধ্যপন্থার লড়াই। সংঘ পরিবার সফলভাবে অটলবিহারী বাজপেয়ির আমল থেকে সেই বাস্তুতন্ত্রকে মধ্যপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থার লড়াইয়ে পরিণত করতে শুরু করে। ২০২৪ নির্বাচনে রাহুল তথা কংগ্রেসকে উড়িয়ে দিয়ে জিততে পারলে ব্যাপারটা পুরোপুরি দক্ষিণপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থা হয়ে দাঁড়াবে। কেবল মমতা ব্যানার্জি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, নবীন পট্টনায়করাই যদি বিরোধী দল হিসেবে টিঁকে থাকেন তা হলে বনাম শব্দটারও আর প্রয়োজন থাকবে কি না, সন্দেহ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যেমন শাসক-বিরোধী সংঘাত বলে কিছু হয় না। যা হয় সব বিধানসভার বাইরে টিভি ক্যামেরার সামনে। সুতরাং গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ভারতকে বাঁচাতে হলে ভারতের আরএসএসবিরোধী শক্তিগুলোর হাতে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। বামপন্থীদের সামনেও নেই। নেহরুর নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে অকারণে বরখাস্ত করা, ইন্দিরার জরুরি অবস্থা, মনমোহনের অপারেশন গ্রিন হান্ট ইত্যাদি কারণে কংগ্রেস সম্পর্কে যত বিতৃষ্ণাই থাক, রাজনীতিতে আশু বিপদের চেয়ে বড় কোনও বিপদ নেই, কোনওদিন ছিল না। সে কারণেই ইন্দিরা যখন দেশের গণতন্ত্রের জন্য মূর্তিমান বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন তখন জ্যোতি বসুর মতো প্রবাদপ্রতিম বাম নেতারা সংঘ-ঘেঁষা শক্তির উপস্থিতি সত্ত্বেও জয়প্রকাশ নারায়ণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

আরও পড়ুন কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?

রাহুল আরও একটা জায়গায় দেশের অন্য সব বিরোধী নেতার চেয়ে এগিয়ে আছেন, তা হল সরাসরি সংঘ-বিরোধিতা। অন্য সব দলের নেতাদেরই বিজেপির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। একমাত্র রাহুলই বারবার বলেন, লড়াইটা আরএসএসের বিরুদ্ধে। দেশের মাটিতে জনসভায় বলেন, সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন। আবার কেমব্রিজে বক্তৃতা দিতে গিয়েও বলেন। এ দেশের কমিউনিস্টদের চিরকালীন বদভ্যাস, তাঁরা অর্থনৈতিক বিভাজন ছাড়া আর কোনও বিভাজন স্বীকারই করতে চান না। গত শতকের তিনের দশকে এই কারণেই গিরনি কামগর ইউনিয়নের ধর্মঘটে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের নেতৃত্বাধীন শ্রমিকদের সঙ্গে বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকরের নেতৃত্বাধীন দলিত শ্রমিকদের ঐক্য হয়নি। একশো বছর হতে চলল, কমিউনিস্টরা নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাই রামমন্দির, হিজাব পরার জন্য মেয়েদের শিক্ষায়তনে ঢুকতে না-দেওয়া কিংবা গোমাংস ভক্ষণ বা পাচারের অভিযোগে মুসলমান হত্যার মতো ঘটনাগুলোকে বামপন্থীরা বলেন— আসল ইস্যু থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আসল ইস্যুগুলো কী? না বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। তাঁরা কিছুতেই মানবেন না, আরএসএস-বিজেপি মন্দির-মসজিদ, শিবাজি-মোগল ইত্যাদিকেই বৃহদংশের মানুষের কাছে আসল ইস্যু বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে। সে কারণেই উত্তরভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম সংসদ আয়োজিত হয়, যেখানে প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়। প্রশাসন যে কিছুই করে না সে তো প্রত্যাশিত, কিন্তু আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষই যে এইসব সংসদে যান তা সম্ভবই হত না তাঁদের কাছে বামপন্থীরা যেগুলোকে আসল ইস্যু বলেন সেগুলো নকল ইস্যু হয়ে না-গিয়ে থাকলে।

রাহুল কিন্তু এই কথাটা বোঝেন। তিনি জানেন, আসলে লড়াইটা সাংস্কৃতিক। সংঘ মানুষের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলেছে। ভারত জোড়ো যাত্রায় তিনি যে বারবার বলছিলেন “নফরত কে বাজার মে মহব্বত কা দুকান খোলনে আয়া হুঁ” (ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে এসেছি) তা স্রেফ কাব্যি নয়, সচেতন রাজনৈতিক স্লোগান। এই সময়ের প্রয়োজনীয় স্লোগান। সম্প্রতি এক আলোচনাসভায় নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবাস করে আসা লেখক মনীশ আজাদের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। শ্রোতাদের একজন প্রশ্ন করলেন, হাথরসের সেই ভয়ঙ্কর ধর্ষণ ও খুনের পরেও সেখানকার নির্বাচনে বিজেপি কেন জেতে? লখিমপুর খেড়িতে বিজেপি নেতার ছেলে গাড়ির চাকার তলায় কৃষকদের পিষে দেওয়ার পরেও সেখানে বিজেপি কী করে জেতে? মনীশ বললেন, ৪০-৫০ বছরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংঘ মানুষের মধ্যে এই ভাবনা প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, আসল ইস্যু হল ধর্ম, বর্ণ, জাতি— এইসব। অন্যান্য ইস্যুতে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারো, রেগেও যেতে পারো। কিন্তু ভোট দেওয়ার সময়ে সেসব ভুলে ধর্মের ভিত্তিতে দেবে। উদাহরণ দিয়ে বললেন, জিএসটি নিয়ে ক্ষুব্ধ গুজরাতের ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন প্রবল আন্দোলন করার পরেই একটা শহরের রাজপথের ফেস্টুন ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, “হম নারাজ হ্যাঁয়, গদ্দার নহি” (আমরা বিরক্ত, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নই)। তারপর গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যথারীতি জেতে। সুতরাং বিজেপিকে হারাতে হলে এই মানসিকতাকে হারাতে হবে। অর্থনৈতিক অভাব অনটনই আসল ইস্যু, বাকি সবই নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা— এই বালখিল্য রাজনীতি ফল দেবে না। কারণ, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে, বাজারটা ঘৃণার। রাহুল তাই ভালবাসার দোকান খোলার কথা বলেছেন। দোকানে কতজন খদ্দের আসবে, সে তো পরের কথা। কিন্তু যত বেশি দোকান খোলা হবে বাজারের পরিবেশ যে তত বদলাবে, তাতে তো সন্দেহ নেই। সত্যিকারের বিজেপি-বিরোধীরা এ কথা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন তত ভাল। রাহুল মহাপুরুষ নন, সাধুসন্ত নন, বিপ্লবী তো ননই। তিনি একা কতটুকু পারবেন? তাঁর ক্ষয়িষ্ণু পার্টিই বা কতটা পারবে?

২০২৪ সালের নির্বাচন বস্তুত গণভোটে পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী। কার সঙ্গে কার কোথায় নির্বাচনী আসন সমঝোতা হবে না-হবে সেসব পরের কথা, পাটিগাণিতিক আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক প্রশ্ন ওই একটাই। এ কথা অস্বীকার করলে আত্মপ্রতারণা হবে।

এমন বাইনারি নিঃসন্দেহে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু আমাদের সামনে আশু বিপদটা যে একদলীয় শাসন।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত

চাকরি চুরির চাঁইদের শেষ অব্দি কী গতি হয়?

অতগুলো চাকরি চুরি এবং রহস্য মৃত্যুর পরেও সিবিআই কয়েকশো চার্জশিট দাখিল করার বেশি কিছু এখনো করে উঠতে পারেনি। বিজেপিও ক্ষমতায় ফিরে এসেছে

“চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে–/ চোর চাই যে ক’রেই হোক, চোর চাই।” বাঙালির রবীন্দ্রনাথ পাঠ যত কমে আসছে, তাঁর বিভিন্ন পংক্তি বর্তমানের ব্যাখ্যায় যেন তত লাগসই হয়ে উঠছে। পাহাড়প্রমাণ চুরির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। শুরু হয়েছিল একটি ফ্ল্যাটে ৫০ কোটি টাকার পাহাড় দিয়ে, এখন ক্রমশ সেই পাহাড়কে নেহাতই শুশুনিয়া বলে মনে হচ্ছে। আমরা ঘাড় উঁচু করেই চলেছি, তবু এই চাকরি চুরির পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে না। সন্দেহ হয়, চূড়ায় পৌঁছনোর ইচ্ছাও হয়ত তদন্তকারী সংস্থাগুলোর নেই। কারণ সেই জ্যাক ও বীনগাছের গল্পের মত মেঘের উপরে এই দুর্নীতির পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলে হয়ত কোনো নরখাদক দৈত্যের দেখা মিলবে, যাকে সামলানোর ক্ষমতা সিবিআই, ইডির জাঁদরেল অফিসারদেরও নেই। ফলে যে করেই হোক মেজ, সেজ, রাঙা, ছোট চোরেদের ধরে আনা হচ্ছে। কদিন সংবাদমাধ্যমে তুমুল হইচই হচ্ছে, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কুনাট্য চলছে এইসব চোরেদের মধ্যে। ব্যাপারটা মুচমুচে করে তোলার জন্য নিয়মিত ব্যবধানে একজন করে মহিলার নাম ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘটনায় তাঁর অংশগ্রহণ কতটুকু, তদন্তকারী সংস্থা আদৌ তাঁকে অভিযুক্ত করছে কিনা – এ সবের খোঁজে না গিয়েই টিভি চ্যানেল এবং খবরের কাগজগুলো সোশাল মিডিয়া ঘেঁটে তাঁদের ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রকাশ করে দিচ্ছে। ফলে অভিযুক্তদের প্রেমিকা, প্রাক্তন প্রেমিকা, স্ত্রী, প্রাক্তন স্ত্রী – সকলেই বাজার ঘাটে মুখরোচক আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠছেন। এতে দুর্নীতির কূলকিনারা কতটা হচ্ছে জানি না, তবে নিঃসন্দেহে আমাদের অনেকের যৌন হতাশা প্রকাশিত হচ্ছে।

সত্যি কথা বলতে, কোনো অপরাধে অভিযুক্তদের শেষপর্যন্ত শাস্তি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সিবিআই বা ইডির সাফল্যের হার ঈর্ষণীয় নয়। সিবিআইয়ের দীর্ঘকালীন পরিচিতি বিরোধীদের জব্দ করার জন্যে ব্যবহার্য কেন্দ্রীয় সরকারের পেয়াদা হিসাবে। ২০১৩ সালে খোদ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এম লোধা বলেছিলেন সিবিআই হল “কেজড প্যারট”, অর্থাৎ খাঁচাবন্দি তোতাপাখি। গত এক দশকে সিবিআই এমন কিছু করেনি যাতে মনে করতে হবে তাদের ভূমিকার কোনো পরিবর্তন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চোখে তাই সিবিআই, ইডি নায়ক হয়ে উঠছে না। নায়ক হচ্ছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত বিচারপতিরা। ট্রেনে বাসে এক যাত্রী অন্য যাত্রীকে জিজ্ঞেস করছেন “অভিজিৎবাবুর রিটায়ারমেন্ট কবে? তার মধ্যে এদের পাকাপাকি ব্যবস্থা না করতে পারলে তো ঠিক বেরিয়ে যাবে।” ভারত অবতারবাদের দেশ। অধর্মের চূড়ান্ত হতে থাকলে যুগে যুগে আবির্ভূত হয়ে ভগবান দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করেন – এমনটাই বিপুল সংখ্যক মানুষের কয়েক হাজার বছরের বিশ্বাস। ফলে মানুষ যে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর উপর নয়, এমনকি বিচারব্যবস্থার উপরেও নয়, বিশেষ একজন বিচারপতির কাছে ন্যায় পাওয়ার আশা করছেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর কেটে গেলেও যে অবতারবাদ কাটিয়ে উঠে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরে এ দেশের মানুষের আস্থা তৈরি হল না, তার জন্য কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোই দায়ী।

উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যে নিয়োগ দুর্নীতির জালে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল এখন নিজেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে এবং বেরোবার প্রাণপণ চেষ্টায় বনলতা সেনগিরি (whataboutery) করতে গিয়ে হাস্যকর ‘চিরকুট’ প্রকাশ করছে, তেমনই এক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধেও উঠেছিল।

মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রমের প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার জন্যে ১৯৮২ সালে গঠিত হয় বৈষয়িক পরীক্ষা মন্ডল (ইংরেজি আদ্যক্ষর অনুযায়ী Vyapam)। পরে ২০০৮ সালে সরকারি চাকরি পাওয়ার পরীক্ষাও এই সংস্থার অধীনে নিয়ে আসা হয়। ২০০৯ সালে মেডিকাল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু হয় এবং সেবছর ডিসেম্বরে প্রচুর অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে একটা প্যানেল গঠন করেন। চার বছর পরে পুলিস এমন ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে যারা অন্যের হয়ে মেডিকালের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছিল বলে অভিযোগ। ১৬ জুলাই জগদীশ সাগর নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যে নাকি এই চক্রের মাথা। এরপর স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তদন্তের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় এবং পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতিতে যেমন হাজার হাজার চাকরি যাচ্ছে, ব্যাপম কেলেঙ্কারিতেও সেইসময় কয়েকশো প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে যাওয়া ডাক্তারি শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মা গ্রেপ্তারও হয়ে যান (পার্থ চ্যাটার্জির কথা মনে পড়ছে না?)। তারপর শুরু হয় রোমহর্ষক কাণ্ড। এই মামলার অভিযুক্ত এবং সাক্ষীদের পরপর মৃত্যু ঘটতে থাকে।

২০১৫ সালের জুন মাসে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমই বলেছিল মামলার সঙ্গে জড়িত ২৩ জন মারা গেছেন। জুলাই মাসের গোড়ায় এমনকি ব্যাপম নিয়ে প্রতিবেদন লিখছিলেন এমন এক সাংবাদিকেরও মৃত্যু হয়। অন্যতম অভিযুক্ত ডাক্তারির ছাত্রী নম্রতা ডামরোর কিছুদিন আগে রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছিলেন। সাংবাদিক অক্ষয় সিং নম্রতার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসার কিছুক্ষণ পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই এই তদন্তের দায়িত্ব হাতে নেয়। ঠিক পরেরদিন জব্বলপুরের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস মেডিকাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মাকে দিল্লিতে তাঁর হোটেলের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিবিআইকে তদন্ত করতে দিতে রাজি হন। অবশ্য তাতেও পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি। নম্রতার কেস ফাইল আবার খোলা হয়। কিন্তু যে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আগে বলেছিল শ্বাসরোধ করে হত্যা, দুমাস পরে তা বলে আত্মহত্যা। শিবরাজের পদত্যাগের দাবি উঠেছিল। কিন্তু তিনি সে দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেন তিনিই ব্যাপম কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছেন।

সকলেই জানেন ইতিমধ্যে মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ মুখ্যমন্ত্রী পদে ফিরে এসেছেন। সিবিআই ২০১৫ সালে তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে ৪০ জন তদন্তকারীর বিরাট দল তৈরি করেছিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেড়শো জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের কেসও ফাইল করেছিল। পরে সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কয়েক হাজারে পৌঁছয়। পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত যেমন স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে শুরু হয়ে এখন পৌরসভার মত অন্যান্য সরকারি চাকরির নিয়োগেও পৌঁছে গেছে, ব্যাপম তদন্তও সেভাবে ডাক্তারির পরীক্ষায় দুর্নীতি থেকে আরম্ভ হয়ে মধ্যপ্রদেশ সরকারের অন্যান্য দপ্তরের নিয়োগে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত হলটা কী?

আরও পড়ুন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়াই কি উদ্দেশ্য?

এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি, দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিবিআই আরও ১৬০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে। এই নিয়ে তদন্তের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ৬৫০ জনকে চার্জশিট দেওয়া হল। এর মধ্যে বিভিন্ন মেডিকাল কলেজের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মানিক ভট্টাচার্য বা সুবীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের মত। এছাড়া আধিকারিকদের ঘুষ দিয়ে অন্যকে দিয়ে নিজের পরীক্ষা দেওয়ানোয় অভিযুক্তরাও রয়েছে। অর্থাৎ সেই মেজ, সেজ, রাঙা, ছোট চোরেরা। লক্ষ্মীকান্ত শর্মা ছাড়া গুলাব সিং কিরার এবং প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্যপাল রাম নরেশ যাদব – এইটুকুই নাকি রাজনৈতিক যোগ। ঘটনার সময়কার মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজের পাঞ্জাবিতে কাদার ছিটে পর্যন্ত লাগেনি।

অতগুলো চাকরি চুরি এবং রহস্য মৃত্যুর পরেও সিবিআই কয়েকশো চার্জশিট দাখিল করার বেশি কিছু এখনো করে উঠতে পারেনি। বিজেপিও ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, সে যেভাবেই আসুক। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসেরও হয়ত আতঙ্কিত বা আশাহত হওয়ার কারণ নেই। সে যতই চাকরি চুরি যাওয়া ছাত্রছাত্রী, ইচ্ছুক শিক্ষকরা বছরের পরে বছর রাস্তায় বসে থাকুন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

অপমানে হতে হবে মহম্মদ শামির সমান

যথার্থ স্ট্রিট ফাইট করার সময়ে কোহলি কোথায় গেলেন, সে প্রশ্ন ধর্মনিরপেক্ষরা করবেন না? শামির হয়ে নিদেনপক্ষে একখানা টুইটও তো করতে পারতেন প্রাক্তন অধিনায়ক।

এমনকি অ্যাডলফ হিটলারের জন্যেও করুণা হয়। সে যাবতীয় কুকীর্তিকে ক্রীড়াধৌত করার জন্য পেয়েছিল মাত্র একটা অলিম্পিক, নরেন্দ্র মোদী পেয়েছেন আস্ত একটা ক্রিকেট বোর্ড। নিজের নামাঙ্কিত ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাশে অন্য এক রাষ্ট্রনেতাকে নিয়ে গেরুয়া রঙের গ্যালারির দিকে হাত নাড়তে নাড়তে গোটা মাঠ ঘুরছেন সর্বাধিনায়ক। এ দৃশ্য অমর করে রাখার জন্যে কোনো লেনি রিফেনশ্টল নেই – এই যা। কত বড় ইতিহাস তৈরি হল তা বোঝার মেধা বিবেক অগ্নিহোত্রীদের নেই, থাকলে ক্যামেরা নিয়ে ঠিক পৌঁছে যেতেন আমেদাবাদে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্টের প্রথম দিনে।

অবশ্য এ কথাও ঠিক, আজকাল দৃশ্যের জন্ম দিতে জিনিয়াসের দরকার হয় না। অসংখ্য ক্যামেরা সারাক্ষণ হাতে হাতে ঘুরছে আর কোটি কোটি দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। তাছাড়া স্টার স্পোর্টসের ক্যামেরা তো ছিলই। তার উপর ছিলেন অমিত শাহের সুপুত্রের অধীন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ধারাভাষ্যকাররা, যাঁদের চাটুকারিতার একমাত্র তুলনীয় উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার বাবুর মোসাহেবরা – “রাজা যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।” মুশকিল হল মোসাহেবি একটি প্রতিযোগিতামূলক পেশা, আলাপ আলোচনা করে এ কাজ করা যায় না। ফলে ধারাভাষ্যকাররা দর্শকসংখ্যা এদিক-ওদিক করে ফেলেছেন। বর্ষীয়ান সাংবাদিক শারদা উগ্রা লিখেছেন, খেলা শুরু হওয়ার আগেই সাতসকালে ম্যাথু হেডেন, সঞ্জয় মঞ্জরেকর আর স্টার স্পোর্টসের উপস্থাপক সুরেশ সুন্দরম বলে দিয়েছিলেন, মাঠে তিলধারণের জায়গা থাকবে না। কারণ শুধু ক্রিকেট নয়, লোকে আসবে তাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে। এক লক্ষ লোক নাকি এসে পড়বে। খেলা শুরুর মিনিট পঞ্চাশেক আগেই নাকি মাঠ প্রায় ভরে গিয়েছে। অথচ পরে রবি শাস্ত্রী, যাঁর পরম শত্রুও তাঁকে পৃথিবীর কোনো বিষয়ে কমিয়ে বলার অপবাদ দেবে না, ধারাভাষ্য দিতে দিতে প্রবল উৎসাহে বলেন ৫০ হাজারের বেশি লোক হয়েছে। কে জানে, হয়ত অর্ধেক লোক আসলে ক্রিকেট নয়, মোদীকে দেখতেই এসেছিল! পরে তিনি চলে যাওয়ায় তারাও চলে গেছে। উসমান খাজার শতরান দেখতে কি আর দেশপ্রেমিক দর্শকরা বসে থাকতে পারেন? পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হওয়ায় তাঁকে তো ভিসাই দেওয়া হয়েছে বাকি অস্ট্রেলিয়দের একদিন পরে

আসলে ক্রিকেট যে উপলক্ষ, মোদীর মহানতা প্রমাণই লক্ষ্য – তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। নইলে দেশের এত ক্রিকেটপাগল এবং ঐতিহ্যময় শহর থাকতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম আমেদাবাদেই বানানো হবে কেন? পতৌদি ট্রফি (ভারত-ইংল্যান্ড ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে জয়ী দলকে প্রদেয়) আর বর্ডার-গাভস্কর ট্রফি (ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে জয়ী দলকে প্রদেয়) – এই দুটো আজকের ক্রিকেটে সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজের মধ্যে পড়ে এবং কারো কারো দাবি অনুযায়ী খেলার উৎকর্ষে অ্যাশেজের চেয়েও এগিয়ে। সেক্ষেত্রে পরপর দুবার ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামই বা খেলা পায় কেন? ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে তো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টানা দুটো টেস্ট খেলা হয়েছিল ওই স্টেডিয়ামে। তখন অবশ্য যুক্তি হিসাবে কোভিড অতিমারী ছিল, এ বারে যুক্তি কী?

দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা প্রাণপণ চেষ্টাতেও চেপে রাখা যাচ্ছে না, যেখানেই ভোট হচ্ছে বিজেপির ভোট কমে যাচ্ছে, বিরোধী ভোট কাটাকাটিতে মানরক্ষা হচ্ছে। ওদিকে ব্রিটিশ চ্যানেল তথ্যচিত্র বানিয়ে বিশ্বগুরু বেলুনে পিন ফুটিয়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় মোদী অস্ট্রেলিয় প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করবেন, তার জন্য একটা মোচ্ছব করা দরকার, সেই দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ছবির মোচ্ছবটার মত। তাই বুঝি আমেদাবাদে এই আয়োজন। ওই শহরের গুজরাটি ভাষার কাগজ দিব্য ভাস্কর তো লিখেছে প্রথম দিনের খেলার ৮০,০০০ টিকিট নাকি বিজেপি দলই কিনে নিয়েছে। দ্য ওয়্যারের সাংবাদিকের কাছে কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক স্বীকারও করেছেন যে দল থেকে তাঁদের প্রথম দিনের খেলার বিপুল পরিমাণ টিকিট কিনতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ তো টি টোয়েন্টি নয়, খেলাটা যে পাঁচ দিনের। পৃথিবীর বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম যে শহরে, সেখানকার মানুষের ক্রিকেটপ্রেম এত প্রবল যে কাল চতুর্থ দিন দুপুরে বিরাট কোহলি যখন কোভিডোত্তর দুনিয়ায় প্রথম টেস্ট শতরান করলেন তখনো টিভির পর্দায় দেখা গেল মাঠের অর্ধেক ভরেনি। তিনি প্রায় দ্বিশতরান করে ফেললেও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। অথচ কাল ছিল রবিবার। এদিকে ২০০১ সালের সেই বিখ্যাত টেস্টের পর গত ২২ বছরে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার একটাও টেস্ট ম্যাচ হয়নি কলকাতায় ক্রিকেটের নন্দনকাননে।

অবশ্য কবি বলেছেন “ঘটে যা তা সব সত্য নয়”। আমেদাবাদে কেন তেমন দর্শক হয়নি, এ প্রশ্ন চারিদিক থেকে উঠতে শুরু করলেই হয়ত ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড রীতিমত পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেবে, মাঠ একেবারে উপচে পড়ছিল। ঠিক যেমনটা কদিন আগে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ সম্পর্কে লিগ কর্তৃপক্ষ বলেছে। ইদানীং ভারতে সমস্ত গোনাগুনিই হযবরল নিয়মে চলে। ইচ্ছামত বাড়ানো, কমানো যায়। একেবারেই এদিক-ওদিক করা না গেলেও বলে দিলেই চলবে “দর্শক কম হয়নি, স্টেডিয়াম বড় হয়ে গেছে।” নির্মলা সীতারামণ তো পথ দেখিয়েই রেখেছেন। ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই বোধহয় ঠিক কত দর্শক ধরে এই স্টেডিয়ামে তা নিয়ে দুরকম বয়ান সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন নিজেই স্টেডিয়ামের এক জায়গায় লিখে রেখেছে “১৩০,০০০”, আরেক জায়গায় “১১০,০০০”। এ যেন সেই ২০০২ নিয়ে কথা উঠলেই এক দলের “সব বাজে কথা, সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনচিট দিয়েছে” আর আরেক দলের “যা হয়েছিল বেশ হয়েছিল” বলার মত। হাজার হোক, জায়গাটা আমেদাবাদ, রাজ্যটা গুজরাট।

গুজরাট মডেলের চেয়ে ভাল মডেল ভূভারতে নেই। ওখানে ভারতের সবচেয়ে সিনিয়র বোলারকেও গ্যালারি থেকে ক্রিকেটপ্রেমীরা বুঝিয়ে দেন, বাপু, তুমি মুসলমান হও আর যা-ই হও, এখানে এলে “জয় শ্রীরাম” শুনতে হবে। ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিক সিএলআর জেমস বিয়ন্ড দ্য বাউন্ডারি নামে একটা বই লিখেছিলেন, আর সেখানে লিখেছিলেন, সে কী জানে যে শুধু ক্রিকেট জানে? ক্রিকেট যে সত্যিই সীমানার ওপারেও খেলা হয়, তার এমন চমৎকার উদাহরণ রোজ পাওয়া যায় না। স্রেফ কয়েকটা বাজে লোক এই কাণ্ড করেছে বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। ভারতীয় ক্রিকেট দলের গৈরিকীকরণ বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। তারই প্রতিফলন আমেদাবাদ টেস্টের প্রথম দিনের এই ঘটনা। যারা কাণ্ডটা ঘটিয়েছে তারা কেমন লোক তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু ওই ভিডিওতে মহম্মদ শামির সতীর্থদের আচরণ লক্ষ করার মত।

SHAMI KO JAI SHREE RAM 🚩 PIC.TWITTER.COM/RWVG1YMEAZ— Gems of Shorts (@Warlock_Shabby) March 9, 2023

প্রথমে সূর্যকুমার যাদবকে দেখে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীসুলভ উল্লাসে তাঁর নাম ধরে ডাকা হয়, তিনি সাড়া দিয়ে ডান হাত তোলেন। তারপর দুহাত জোড় করে দর্শকদের নমস্কার জানান। এরপর তাঁর পাশে মহম্মদ সিরাজকে দেখা যেতেই শুরু হয় “জয় শ্রীরাম” ধ্বনি। তারপর শামিকে দেখে উৎসাহ চরমে ওঠে। তাঁর নাম ধরে ডেকে ওই স্লোগান দেওয়া হয়, যাতে তিনি বোঝেন তাঁকেই শোনানো হচ্ছে। সেইসময় ওখানে উপস্থিত গুজরাটেরই বাসিন্দা এবং দলের অত্যন্ত সিনিয়র সদস্য চেতেশ্বর পূজারা, সৌরাষ্ট্র রঞ্জি দলের অধিনায়ক জয়দেব উনড়কত, আরেক সিনিয়র জোরে বোলার উমেশ যাদব এবং ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোর। সকলেরই হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা শুনতেই পাননি। একই দূরত্ব থেকে দুজনের নাম ধরে ডাকা হল, একজন শুনতে পেয়ে সাড়া দিলেন আর বাকিরা শুনতেই পাননি এমন তো হতে পারে না। তাহলে বুঝতে হবে হয় তাঁদের অবস্থা তপন সিংহের আতঙ্ক ছবির মাস্টারমশাইয়ের মত, নয় তো শামির প্রতি ধর্মীয় টিটকিরি তাঁরা দিব্যি উপভোগ করছিলেন। এই দল যদি চলতি সিরিজ জেতে, এমনকি যদি আসন্ন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে খেতাবও জেতে। তা কি ভারতের জয়?

সাংবাদিক মানস চক্রবর্তী বহুকাল আগে ব্রায়ান লারাকে নিয়ে একখানা কিশোরপাঠ্য বই লিখেছিলেন। সেখানে আছে, মানস লারার কথা প্রথম শোনেন অরুণলালের মুখে এবং সেটা লারার ব্যাটিং প্রতিভার কথা নয়। ১৯৮৯ সালে ভারত যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায়, অরুণ অন্যতম ব্যাটার হিসাবে সেই দলে ছিলেন। অরুণ বলেছিলেন, একটা টেস্টে দ্বাদশ ব্যক্তি ছিল ব্রায়ান লারা বলে একটা বাচ্চা ছেলে। প্রথম দিনের খেলার পর খবর এল ওর বাবা মারা গেছেন। অধিনায়ক ভিভিয়ান রিচার্ডস সমেত গোটা দল ওর বাড়ি চলে গেল। কথাটা বলে অরুণের মন্তব্য ছিল, বোঝা যায় কেন ওরা বছরের পর বছর টেস্ট হারে না। ২০০২ সালের ৫ ডিসেম্বরের ঘটনাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। সেদিন তৎকালীন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভ ওয়র সিডনির বাড়ির দিকে ধেয়ে এসেছিল এক দাবানল। স্টিভ তখন মেলবোর্নে, স্ত্রী লিনেট তিন সন্তান আর বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে বাড়িতে। লিনেটের ফোন পেয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রা পৌঁছে যান এবং আপ্রাণ লড়ে বাড়িটাকে আগুনের হাত থেকে বাঁচান। স্টিভ খবর পেয়ে বিমানে চেপে শেষপর্যন্ত বাড়ি পৌঁছন রাত এগারোটায়। ততক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণে। স্টিভ গিয়ে জানতে পারেন ম্যাকগ্রা ছ-সাত ঘন্টা ধরে আগুনের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন।

সহখেলোয়াড় মাঠের বাইরেও প্রাণাধিক প্রিয় – এই মূল্যবোধই খেলার মাঠের চিরকালীন শিক্ষা। সেই শিক্ষার পরিচয় কোথায় শামির সহখেলোয়াড়দের ব্যবহারে? ভারতে অবশ্য এখন অমৃত কাল। চিরকালীন সবকিছুই এখন বাতিল। কেউ কেউ বলবেন, কী করা উচিত ছিল পূজারাদের? শামির হয়ে লোকগুলোকে পাল্টা গালাগালি দিত, না হাতাহাতি করতে যেত? যে কোনো সভ্য দেশে এই প্রশ্নটাই অবান্তর। ভারতের গত অস্ট্রেলিয়া সফরে সিরাজকে বর্ণবিদ্বেষী গালাগালি দেওয়ার অভিযোগ উঠতেই কয়েকজন দর্শককে মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। যা অন্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড করতে পারে, তা যে এ দেশের বোর্ড করবে না — এমনটা তাহলে সূর্য, পূজারা, উনড়কত, উমেশ, বিক্রমরা জানেন? তাই তাঁরা প্রতিবাদ করেননি, বোর্ডের কাছে কোনো অভিযোগও জানাননি? এই ভিডিও যেভাবে ভাইরাল হয়েছে, বেশকিছু সংবাদমাধ্যম যেভাবে খবর প্রকাশ করেছে, তাতে অধিনায়ক রোহিত শর্মা বা কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের চোখে পড়েনি — এমনটা হওয়া অসম্ভব। তাঁরাই বা চুপ কেন? এর নাম নেতৃত্ব, নাকি হিন্দুত্ব?

ভারতীয় দলে আবার ভয়ানক লড়াকু কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন। তাঁদের সারা দেশের ক্রিকেট সাংবাদিকরা ‘স্ট্রিট ফাইটার’ বলে বিস্তর প্রশংসা করে থাকেন। এঁরা বিপক্ষ দলের ১১ নম্বর ব্যাটারকে বাউন্সারের পর বাউন্সার দিয়ে, স্লেজ করে বাহাদুরি দেখান। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বড় মুখ করে বলেন, আমাদের একজনকে আক্রমণ করলে আমরা ১১ জন মিলে প্রতিআক্রমণ করব।

এঁদের মধ্যে সবচেয়ে ওজনদার অবশ্যই ২৪ টেস্টে ৪২ খানা ইনিংস খেলার পরে ২৭ নম্বর থেকে ২৮ নম্বর শতরানে পৌঁছনো বিরাট। তিনি ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির সময়ে শামির ধর্ম তুলে যারা টুইট করেছিল তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীদের হৃদয়সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন। অধিনায়কত্ব যখন চলে গেল, তখন আপন মনের মাধুরী মিশায়ে ধর্মনিরপেক্ষরা গর্জন করেছিলেন, শামির পক্ষ নেওয়ার অপরাধেই নাকি বেচারা বিরাটকে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ক্রিকেট বোর্ড বরখাস্ত করেছে। এবার যথার্থ স্ট্রিট ফাইট করার সময়ে কোহলি কোথায় গেলেন, সে প্রশ্ন ধর্মনিরপেক্ষরা করবেন না? শামির হয়ে নিদেনপক্ষে একখানা টুইটও তো করতে পারতেন প্রাক্তন অধিনায়ক। তিনি যে এখনো ভারতীয় ক্রিকেটের এক নম্বর তারকা তাতে তো সন্দেহ নেই। তাঁকে তো যথেষ্ট মান্যিগণ্যি করেন ক্রিকেটভক্তরা, আর তাঁর ভক্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। টুইটারে বিরাটের সমালোচনা করলেই যেভাবে ট্রোলবাহিনী ধেয়ে আসে তাতেই তা টের পাওয়া যায়। এহেন বিরাটের জাভেদ মিয়াঁদাদসুলভ আগ্রাসন আমেদাবাদে শামির অপমান দেখেও মিইয়ে রইল? তাহলে বুঝতে হবে, বিরাট এবং তাঁর মত ডানপিটেদের যত হম্বিতম্বি সব ক্রিকেট বোর্ডের ছত্রছায়ায়, ক্রিকেট মাঠের ভিতরে। সিনেমার অ্যাকশন হিরোদের যেমন যত বীরত্ব সিনেমার সেটে, স্টান্টম্যানদের উপস্থিতিতে।

আরও পড়ুন সকলেই চুপ করে থাকবে, শামিকে মানিয়ে নিতে হবে

এমন নয় যে হিন্দুগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমান ক্রিকেটাররা ব্যর্থ হলে অতীতে কখনো কেউ তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে পাঁচটা কথা বলেনি। মহম্মদ আজহারউদ্দিন তো তেমন লোকেদের পোয়া বারো করে দিয়ে গেছেন ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে। কিন্তু সেসব মন্তব্য চলতে ঠারেঠোরে এবং ক্রিকেটারের কানে পৌঁছতে না দিয়ে। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগে টিটকিরি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। ফলে শুধু মুসলমান শামি কেন, শিখ অর্শদীপ সিংকেও পাকিস্তান ম্যাচে ক্যাচ ফেলার জন্য অনলাইন গালাগালি হজম করতে হয়েছে। কিন্তু আমেদাবাদে যা হল তা অভূতপূর্ব। শামির হাত থেকে ক্যাচ পড়েনি, তিনি অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের হাতে বেদম মারও খাননি। ম্যাচটাও পাকিস্তান ম্যাচ নয়। স্রেফ উত্যক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁকে সরাসরি আক্রমণ করেছে কিছু তথাকথিত ক্রিকেটপ্রেমী। অথচ গোটা দল চুপ, বোর্ডও চুপ। এ থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না দলটা আসলে কাদের। অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? এই দলেই তো খেলছেন রবীন্দ্র জাদেজা, যিনি গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রচারে জাতীয় দলের জার্সিকে ব্যবহার করেছেন। বোর্ড কোনো আপত্তি করেনি। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট দল এখন দেশের নয়, সরকারের দল। তাদের প্রধান কর্তব্য মোদীর যাবতীয় কীর্তিকে ক্রীড়াধৌত করা। তাই তাদের সমস্ত আচরণই এখন হিন্দুত্বানুসারী।

রবীন্দ্রনাথের কল্পনার ‘ভারততীর্থ’ কোথাও না থাকলেও, অন্তত আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল সেদিকে যাত্রা করছিল। স্বীকার করে নেওয়া ভাল, যে যাত্রা থেমে গেছে। অবশ্য ওই কবিতার ভাবনায় বেশকিছু আপত্তিকর দিক আছে বলে লিখেছিলেন অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য। তা সবিস্তারে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না। প্রাসঙ্গিক অংশটা হল

রবীন্দ্রনাথও ভক্তি-গদগদ হতেন। তাতে স্বদেশচেতনার উদ্দীপন ঘটত, সেটা আমাদের লাভ। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথ বেশিক্ষণ ওরকম ভক্তিগদগদ অভিভূত হয়ে থাকতে পারতেন না। গদগদচিত্তকে তিনিই আবার আঘাত করতেন…

‘ভারততীর্থ’ লেখার পর একটিমাত্র দিন গেল। তার পরেই রবীন্দ্রনাথ যা লিখলেন তা হল স্বদেশের প্রতি নিদারুণ ধিক্কার, অভিশাপ – “হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান/…বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে/ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।”

ভারততীর্থের পথে নয়, ভারতীয় ক্রিকেট এবং দেশটা এ পথেই চলেছে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

কেচ্ছা নয়, মনে রাখা দরকার গণতন্ত্রের মলিন মুখ

যে বইটি নিয়ে কথা হচ্ছে, কয়েক বছর আগে পিডিএফ আকারে সেটি হাতে এসে পৌঁছেছিল। কয়েক পাতার বেশি এগোবার প্রবৃত্তি হয়নি। কোনো রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিরই হবে বলে মনে হয় না।

নামকরা লোকেদের কেচ্ছাকাহিনিতে রুচি আছে এমন মানুষের সংখ্যা কোনো দেশে কোনোকালেই দুর্লভ নয়। তথাগত রায়ের যেমন কর্মহীন অবসরজীবনের দুটি ব্রত – মুসলমানদের গাল পাড়া আর লেনিন সিফিলিসে মারা গিয়েছিলেন – একথা প্রচার করা। সারা পৃথিবীতেই কার্ল মার্কস পরিচারিকার সন্তানের পিতা হয়েছিলেন কিনা, জন এফ কেনেডি আর মেরিলিন মনরোর যৌনতা কতটা গনগনে ছিল, মাও সে তুং সমকামী ছিলেন কিনা (যেন সমকামী হওয়া ভীষণ অন্যায়) – এসব পড়তে বেশকিছু লোক মুখিয়ে থাকে। ফলে কেচ্ছার পাত্রপাত্রীরা মরে ভূত হয়ে গিয়ে থাকলেও এ নিয়ে আজও বইপত্র লেখা হয়ে চলেছে। বাঙালিদেরও কেচ্ছাকাহিনিতে বিলক্ষণ রুচি আছে এবং তার মধ্যে প্রিয়তম হল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক নিয়ে কেচ্ছা। খবরের কাগজে তিন-সাড়ে তিন দশক যাবৎ বিখ্যাত মানুষদের কেচ্ছা লিখেই এক সাংবাদিক রীতিমত প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছেন। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী নিয়ে একখানা উপন্যাসও ‘নামিয়ে দিয়েছেন’। সে উপন্যাসের যে শুধু বিস্তর কাটতি তা নয়, কিছুদিন আগে শুনলাম এক গবেষককে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক অধ্যাপক জিজ্ঞেস করেছিলেন “আচ্ছা, ওই সুইসাইড নোটটা কোন বইতে পাব বলুন তো?” সোশাল মিডিয়ার যুগে এই কেচ্ছাপ্রীতি যে আরও বেড়েছে তা বলাই বাহুল্য। মুশকিল হল, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের ফালতু আড্ডার গণ্ডি পেরিয়ে এখন এসব রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গা দখল করে ফেলছে।

সিপিএমের বিরুদ্ধে তর্কে যুক্তি না পেলেই কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপির লোকেরা বলতে শুরু করে জ্যোতি বসু অতি বদ লোক। কারণ তিনি বউ মারা যাওয়ার পর শালিকে বিয়ে করেছিলেন। যেন এর মত পাপ আর দ্বিতীয় নেই এবং জ্যোতিবাবু পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি এ পাপ করেছেন।

রাহুল গান্ধী মাঝেমধ্যে বিদেশ গেলেই বিজেপি এবং তাদের বশংবদ সংবাদমাধ্যম জল্পনা শুরু করে – ইউরোপের কোনো দেশে নির্ঘাত তাঁর কোনো বান্ধবী আছে, তিনি তার কাছেই যান। রাহুলের মা সোনিয়া ইতালিতে রেস্তোরাঁয় ‘ওয়েট্রেস’ ছিলেন এমনও বলা হয়েছে বিজেপির পক্ষ থেকে (যেন অমন নোংরা কাজ আর হয় না) এবং কয়েক বছর আগে সে কাজের অনুষঙ্গে নানা অশালীন ইঙ্গিতও করা হত নিয়মিত।

নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে যোগ দিয়ে ঘর ছাড়ার আগে বালক বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। তাই তিনি এখনো বিবাহিত না অবিবাহিত – তা নিয়েও বিস্তর কটুকাটব্য হয়ে থাকে।

তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে একবার বলেছিলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সন্ধেবেলা নন্দনে যেতেন নারী সংসর্গ করতে।

কদিন আগে কুণাল ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে যৌন কেচ্ছা উস্কে দিতে তাঁকে সমকামী বলে টিটকিরি দিয়েছিলেন (এর চেয়ে বড় টিটকিরি কি আর আমাদের সংবেদনশীল নেতারা খুঁজে পান?)।

তারপর সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থীর হাতে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের রাগ সামলাতে না পেরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হুমকি দিয়ে বসলেন, তাঁর মুখ খোলালে ভাল হবে না। তিনি কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীর গাড়ির চালক এবং কন্যা সংক্রান্ত অনেককিছু জানেন। সেসব ফাঁস করে দেবেন।

এর প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস মুখপাত্র কৌস্তভ বাগচী ঠিক করলেন আরও নিচে নামবেন। তাই টিভি স্টুডিওতে বসে টেনে বার করলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা দীপক ঘোষের লেখা কেচ্ছাকাহিনি।

কেচ্ছা নিয়ে মেতে থাকার সুবিধা হল, কোনো মানুষের সমালোচনা করার জন্য ন্যূনতম পড়াশোনা বা ভাবনাচিন্তা করতে হয় না। রবীন্দ্রনাথ বা মার্কসের লেখা এক লাইনও না পড়ে, লেনিন বা মাওয়ের কাজ সম্পর্কে কিছুই না জেনেও মনের সুখে গাল পাড়া যায়। তেমনই মমতার রাজনীতি, তাঁর প্রশাসন চালানোর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি, দুর্নীতি, আধিপত্যবাদ – কোনোকিছুর বিরুদ্ধেই কোনো লড়াই না করে স্রেফ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কেচ্ছা নিয়ে চেঁচামেচি করে দিব্য আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। কোনো পরিশ্রম হয় না।

যে বইটি নিয়ে কথা হচ্ছে, কয়েক বছর আগে পিডিএফ আকারে সেটি হাতে এসে পৌঁছেছিল। কয়েক পাতার বেশি এগোবার প্রবৃত্তি হয়নি। কোনো রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিরই হবে বলে মনে হয় না। কেচ্ছাকাহিনির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, তা মুখরোচক, কিন্তু যে পড়ে তার কল্যাণ-অকল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কহীন। সেই কারণেই যারা পড়ে তারা তারিয়ে তারিয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, প্রমাণযোগ্যতার অভাব। এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটিই, বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললে, কেচ্ছার ইউএসপি। যে কেচ্ছা সত্য বা মিথ্যা বলে প্রমাণ করা সম্ভব, তার নিষিদ্ধ মজাটিই নষ্ট হয়ে যায়। ঘোষমশায়ের বইতে এই দুটি বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। ফলে ভোররাত্তিরে গ্রেপ্তার হওয়া কৌস্তভ এবং দারুণ গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন বলে মনে করা যেসব ব্যক্তি পিডিএফটি পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন, তাঁরা কিছু লোককে ক্ষণিক উত্তেজনার উপাদান জোগানো ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারবেন না। ওতে মমতা আইনত শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ বা প্রমাণ নেই। ঘোষমশাই যেসব ব্যাপারকে নৈতিক অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছেন সেসবও তাঁর মতে অনৈতিক। পশ্চিমবঙ্গের আপামর জনগণের অনৈতিক না-ও মনে হতে পারে। বিশেষত বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএম দলের কর্মী, সমর্থকদের যদি ওর সবকটিই অনৈতিক বলে মনে হয় তাহলে খুবই চিন্তার বিষয়। পার্টি আর কত শতাংশ বামপন্থী আছে তা নিয়েই নেতৃবৃন্দকে চিন্তা করতে হবে সেক্ষেত্রে।

এতগুলি কথা বলে নিতে হল, কারণ কৌস্তভের গ্রেপ্তারি আমাদের এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যার ভয়ঙ্করতা উপলব্ধি এবং প্রতিবাদ এই মুহূর্তের রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রে এসে পড়েছে ঘোষমশাই লিখিত কেচ্ছাকাহিনি।

কৌস্তভ যা-ই বলুন, ওই বই ছেপে বা পিডিএফ আকারে হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া আদৌ কোনো রাজনৈতিক কাজ নয়। কারণ ওটি কোনো নিষিদ্ধ ইশতেহার নয়, যা ছড়িয়ে দিলে রাষ্ট্রকে জোর ধাক্কা দেওয়া যাবে। কিন্তু ওই কেচ্ছাকাহিনির গুণাগুণ বিচার নিষ্প্রয়োজন। যা নিন্দাযোগ্য তা হল কৌস্তভের গ্রেপ্তারি। কোনো মানুষের, বিশেষত কোনো মহিলার, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা কুরুচিকর। তা করার জন্য কৌস্তভ এবং বইয়ের লেখক ঘোষমশায়েরও চরম নিন্দা করা যেতে পারে। কিন্তু একজন ক্ষমতাশালীর নামে কেউ কেচ্ছা লিখেছে, আর সেই কেচ্ছা একজন প্রকাশ্যে বলেছে বলে তাকে গ্রেপ্তার করার মত অগণতান্ত্রিকতা আর নেই। গণতান্ত্রিক অধিকার মূলত অপ্রিয় কথা বলার অধিকার। তার ভাষা, আঙ্গিক সবসময় ভদ্র সভ্য হয় না। কোনটি সভ্য আর কোনটি নয়, তাও নিতান্ত তর্কাতীত ব্যাপার নয়। একজন মহিলার বিরুদ্ধে কুৎসা করা হয়েছে, রাজ্যের প্রধানকে অসম্মান করা হয়েছে – এইসব যুক্তিতে যদি এই গ্রেপ্তারিকে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে যে কোনোদিন আমি বা আপনি বাজারে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করার জন্য গ্রেপ্তার হতে পারি। সোশাল মিডিয়া পোস্ট করার জন্যও গ্রেপ্তার হতে পারি, যেমনটা অম্বিকেশ মহাপাত্র বা রোদ্দূর রায়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। কোনটা আইনি, কোনটা বেআইনি, কোনটা শালীন ভাষা, কোনটা অশালীন – সে বিচার তো পরে আদালতে হবে। কিন্তু রাজ্যের প্রধান পদাধিকারীর সমালোচনা করা বা তাঁকে গালি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারির মধ্যেই যে ক্ষমতার আস্ফালন এবং সাধারণ নাগরিকের হয়রানি জড়িয়ে আছে, যা শিলাদিত্য চৌধুরীকে ভোগ করতে হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে একনায়কতন্ত্রের লক্ষণ।

সপ্তাহ দুয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে কটূক্তি করার অভিযোগে কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরাকে প্লেন থেকে নামিয়ে আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করে গ্রেপ্তার করেছিল আসাম পুলিস। উক্তিটি আদৌ কটূক্তি ছিল কিনা নিজের চোখে দেখে বিচার করুন।

তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, এটি কটূক্তিই। কিন্তু যে দেশে প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করলেই গ্রেপ্তার হতে হয় সে আবার গণতান্ত্রিক দেশ হয় কী করে? পবন বা কৌস্তভ নামকরা লোক, তাই গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জামিন পেয়েছেন। পবনের ক্ষেত্রে স্বয়ং দেশের প্রধান বিচারপতি শুনানি করে জামিন দিয়েছেন। আমি, আপনি গ্রেপ্তার হলে তো এমন হবে না। দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে রাজধানীর বুকে মিটিং, মিছিল করার ‘অপরাধে’ ৪১ দিন হাজতবাস করে সবেমাত্র জামিন পেলেন নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি ও তাঁর দলের সদস্যরা। এর আগে একইরকম ঘটনা ঘটেছিল সিপিএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জিসহ অনেকের বেলায়। সেক্ষেত্রে আমার, আপনার পচে মরা ছাড়া কোনো পথ আছে কি? গ্রেপ্তার করার নিয়মকানুন কী, গ্রেপ্তার হওয়া মানুষের অধিকারগুলিই বা কী – তাও তো আমরা আইনজীবী কৌস্তভের মত করে জানি না। তাহলে কি আমি লেখা বন্ধ করে দেব, আপনারা পড়া এবং শেয়ার করা বন্ধ করে দেবেন? এই আমাদের গণতান্ত্রিক রাজ্য? এই আমাদের বিজেপিকে রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে না দেওয়ার প্রতিদান?

স্বীকার্য যে আমাদের সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে প্রকাশ্য আলোচনায় মহিলাদের সম্বন্ধে কথা বলার সময়ে আমাদের শব্দচয়ন এবং বিষয় নির্বাচন কিছুটা বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশের আইনও কতকটা তাই বলে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, মুখ্যমন্ত্রী যে কোনো মহিলা নন। তিনি রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তাঁর হাতে যতখানি ক্ষমতা আছে তা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো মহিলা দূরের কথা, কোনো পুরুষের হাতেও নেই। রোজ এ রাজ্যের যতজন মহিলা রাস্তাঘাটে কটূক্তি এবং তার চেয়ে অনেক বেশি – যৌন হয়রানি – হজম করেন, তাঁরা কিন্তু এত ক্ষমতার অধিকারী নন। কৌস্তভের ক্ষেত্রে যে তৎপরতা দেখিয়েছে রাজ্য পুলিস, সে তৎপরতা তাঁরা তো আশা করতেই পারেন না, এমনকি অনেকসময় ধর্ষণের অভিযোগেও পুলিসকে নড়ে বসতে দেখা যায় না। উপরন্তু এ রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী সেই ২০১১ সাল থেকে যে কোনো ধর্ষণের ঘটনাতেই হয় ধর্ষিত মহিলার দোষ দেখতে পান, নয় বিরোধীদের চক্রান্ত দেখতে পান। পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, হাঁসখালি – কোথাও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অর্থাৎ ক্ষমতার ভাষা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তিনি পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি। টিভি স্টুডিও থেকে কেচ্ছা ছড়ানোর কারণে কৌস্তভের গ্রেপ্তারি দেখে সুজেট জর্ডান বোধহয় কবরে পাশ ফিরে শুলেন। একটি হতকুচ্ছিত বইয়ের পিডিএফ শেয়ার করা তাঁর কবরকে আরও কণ্টকাকীর্ণ করবে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

বিবিসিকে বাদ দিয়ে বিশ্বগুরু থাকতে পারবেন মোদী?

বিবিসি যতখানি সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে চিরকাল, ততখানি আমাদের দূরদর্শন বা অল ইন্ডিয়া রেডিও কোনো দলের সরকারের আমলেই ভোগ করেনি

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন টানা তৃতীয় দিন ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের দিল্লি ও মুম্বাই অফিস জুড়ে বসে আছেন আয়কর আধিকারিকরা। বিবিসি কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের ইমেল পাঠিয়ে জানিয়েছেন আপাতত যেন দফতরে না এসে বাড়ি থেকেই তাঁরা কাজ চালিয়ে যান। এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া, ভারতের সম্পাদকদের একটি অগ্রগণ্য সংগঠন, এবং প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার মত সাংবাদিকদের সংগঠন একে সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা হিসাবে দেখছে জানিয়ে প্রথম দিনেই (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু সরকারপক্ষ কিন্তু বলেই যাচ্ছে, এটা বিবিসির দফতরে হানা নয়, সমীক্ষা (সার্ভে) মাত্র। এ এক আইনানুগ নিয়মিত প্রক্রিয়া। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আছে বলেই নাকি এই সার্ভে করা হচ্ছে।

বলা বাহুল্য, বিবিসি এ দেশের কোনো আইন ভেঙে থাকলে তদন্তের স্বার্থে তাদের দফতরে সার্ভে করা বা হানা দেওয়া এবং তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া ভারত সরকারের আয়কর বিভাগের অধিকার এবং কর্তব্য। কিন্তু মুশকিল হল, এরকম সার্ভে আয়কর বিভাগ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট গত কয়েক বছরে একাধিকবার দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমের দফতরে চালিয়েছে। অথচ একবারও কোনো সার্ভে বা হানা থেকে কোনো সংবাদমাধ্যমের অপরাধের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এডিটর্স গিল্ডের বিবৃতিতেই উল্লেখ করা হয়েছে নিউজক্লিক, নিউজলন্ড্রি, দৈনিক ভাস্কর এবং ভারত সমাচারের দফতরে আয়কর ও ইডি হানার কথা। তার বাইরেও বেশকিছু সংবাদমাধ্যমের দফতরে এমন ঘটনা ঘটেছে। কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের কাছে তো এসব জলভাত। তাঁরা কথায় কথায় কাগজ বন্ধ করে দেওয়া, নিগ্রহ, ইউএপিএ আইনে কারাবাস – এসবে অভ্যস্ত। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা টিভির অফিসেও ডিসেম্বর মাসে ইডি হানা দিয়েছিল। এই সবকটি সংবাদমাধ্যমই আবার কেন্দ্রীয় সরকারকে অসুবিধায় ফেলে এমন প্রতিবেদন বা বিরোধী মতামত প্রকাশ করার জন্য বিখ্যাত (বা সরকারের কাছে কুখ্যাত)। এ যদি নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার হয়, তাহলে বলতেই হবে এই কাক আর এই তাল একেবারে রাজযোটক। ফলে বিবিসির দফতরে যা চলছে তিনদিন ধরে, তাকে বাঁকা নজরে না দেখে উপায় নেই।

এডিটর্স গিল্ডের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০২ সালের গুজরাটের ঘটনাবলী এবং নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে দেশজুড়ে সংখ্যালঘু মানুষের উপর আক্রমণ নিয়ে বিবিসির দুই পর্বের তথ্যচিত্রের পরেই এই সার্ভে। সে তথ্যচিত্র দেশের মানুষকে দেখতে না দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল এই সরকার। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারকে দিয়ে ওই তথ্যচিত্রের সমস্ত লিঙ্ক ব্লকও করানো হয়েছিল। ফলে দুয়ে দুয়ে চার করতে কোনো অসুবিধা নেই।

তা বাদেও সরকার যে আসলে বিবিসির উপর ওই তথ্যচিত্রের শোধ তুলছে, আর্থিক অনিয়ম স্রেফ ছুতো – এমন মনে করার কারণ ঘটিয়ে দিচ্ছে নিজেই। কারণ বিবিসি দফতরে হানা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ‘সরকারি’ ভাষ্য নেই। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থার দফতরে এইরকম হানা (আচ্ছা সার্ভেই হল) আন্তর্জাতিক খবরে পরিণত হয়ে গেছে, অথচ আয়কর বিভাগের কোনো শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক বা অর্থমন্ত্রকের কোনো সচিব স্তরের আধিকারিক এ নিয়ে কোনো প্রেস বিবৃতি দেননি। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের দুটি টুইটার হ্যান্ডেলের একটিতেও এ নিয়ে একটি লাইন দেখলাম না। তাহলে প্রথম অনুচ্ছেদে লিখলাম কেন, সরকারপক্ষ বলেই যাচ্ছে…? সেখানেই মজা। ২০০২ সালে গুজরাটে ঠিক কী হয়েছিল, তা নিয়ে সঙ্ঘ পরিবার কখনো এক স্বরে কথা বলে না। একটি অংশ বলে, যা হয়েছিল বেশ হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদীদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন মোদী। আরেকটি অংশ বলে, খোদ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে মোদীজির কোনো দোষ ছিল না। এর উপর আর কথা হয় নাকি? সব বিরোধীদের অপপ্রচার।

আরো পড়ুন এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ

বিবিসির দফতরে আয়কর বিভাগের বিচরণ সম্পর্কেও একই পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে। এক দল সাংবাদিকের কাছে কিছু তথ্য পাঠিয়ে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে। একদা সরকারবিরোধী বলে পরিচিত, রায় দম্পতির প্রস্থানের পর সরকারি হয়ে ওঠা এনডিটিভির সাংবাদিক সংকেত উপাধ্যায়ই যেমন। তিনি টুইট করে এই অভিযোগের কথা জনসমক্ষে এনেছেন। অথচ এই তথ্যের সূত্র কী জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানিয়েছেন, সরকার প্রেস নোট হিসাবে ওই তথ্যগুলি জানিয়েছে। সরকার মানে কে? প্রেস নোটের উপর লেটারহেড কার ছিল? নিচের স্বাক্ষরটি কার? কোন মন্ত্রক থেকে পাঠানো হয়েছে এই নোট? এসবের কোনো উত্তর এই সাংবাদিকরা দিতে পারেননি। অন্যদিকে বিজেপির মুখপাত্ররা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময়ে বিবিসিকে তেড়ে গাল পাড়ছেন। বিবিসি দুর্নীতিগ্রস্ত, মিথ্যের ঝাঁপি খুলে বসেছে – এরকম নানা অভিযোগ করছেন। ঠিক যে অভিযোগগুলো ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’ তথ্যচিত্র মুক্তি পাওয়ার পরেও তাঁরা করেছিলেন। এই অভিযোগগুলো সত্যি হতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে আয়কর বিভাগের কী সম্পর্ক? এর কোনো উত্তর তাঁদের কাছে নেই। অর্থাৎ প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হচ্ছে, আর্থিক অনিয়ম নয়। আপত্তি বিবিসি কী দেখাচ্ছে তা নিয়ে।

স্বাভাবিকভাবেই ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলি এক সুরে সরকারকে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ থেকে শুরু করে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য পর্যন্ত সকলেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সরকারের নিন্দা করেছেন। কিন্তু তাতে মোদী সরকারের কী-ই বা এসে যায়? দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম হয় ভক্তিতে নয় ভয়ে সরকারকে প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছে। এনডিটিভির মত দু-একটি নাছোড়বান্দা সংবাদমাধ্যমকে মুকেশ আম্বানি বা গৌতম আদানি কিনে ফেলছেন – চুকে গেল ঝামেলা। কিন্তু বিবিসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তার কিছু অন্তত প্রমাণ করতে না পারলে অন্য ক্ষতির সম্ভাবনা। আজকের দুনিয়ায় নিজের দেশের সাড়ে বারোটা বাজিয়েও রাষ্ট্রনেতা হিসাবে বিদেশে নাম কুড়ানো অসম্ভব নয়। বিশেষ করে ভারতের মত দেশ, যার বিরাট বাজার বহুজাতিকদের দরকার এবং যে দেশ পরমাণু শক্তিধর – সে দেশের ভিতরে সংখ্যালঘুরা বাঁচল কি মরল, জনা দুয়েক পুঁজিপতি মিলে দেশের সমস্ত সম্পদের দখল নিয়ে নিল কিনা তা নিয়ে অন্য কোনো দেশ মাথা ঘামাতে যায় না। কিন্তু সেসব দেশের সংবাদমাধ্যমের গায়ে হাত পড়লে যা হয়, তা হল গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে পরিচিতির বারোটা বাজে। সে পরিচিতি নিয়ে কমিউনিস্ট চীনের রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষ মাথা ঘামান না। শি জিনপিং নিজের দেশের সকলকে নিজের ইচ্ছামত চালাতে পারলে খুশি, বিশ্বগুরু হতে চান না। কিন্তু মোদী তো চান। তাঁকে যদি ব্রিটেন, আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ভ্লাদিমির পুতিন আর জিনপিংয়ের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে একনায়ক বলে দেগে দেয় – তা কী পছন্দ হবে মোদীজির?

বিবিসি ব্রিটেনের রাজকীয় সনদের মাধ্যমে গঠিত সরকারের একটি মন্ত্রকের অধীন অথচ স্বায়ত্তশাসিত কর্পোরেশন। একে আমাদের প্রসার ভারতীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে। বিবিসি যতখানি সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে চিরকাল, ততখানি আমাদের দূরদর্শন বা অল ইন্ডিয়া রেডিও কোনো দলের সরকারের আমলেই ভোগ করেনি। ফলে ব্রিটেনে কনজারভেটিভ বা লেবার – যার সরকারই থাক, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মোদী যতই দহরম মহরম করুন, বিবিসি চটলে তারা আরও বেশি করে ভারত সরকার সম্পর্কে বিরূপ প্রচার করবে। বিবিসির দেখাদেখি অন্য বিদেশি সংবাদমাধ্যমও করবে। বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তিতে অনবরত আঁচড় পড়তে থাকলে কি খুশি হবেন মোদী? বিবিসি ধোয়া তুলসীপাতা নয়, তবে মনে রাখা ভাল, তারা কিন্তু নিজেদের দেশের ইতিহাসের বিশালকায় রাষ্ট্রনেতা উইনস্টন চার্চিলকেও ছেড়ে কথা বলে না। কথাটা বুঝতেন বলেই ইন্দিরা গান্ধী একসময়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি খড়্গহস্ত হয়েও পরে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ শুরু করেন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?

আমাদের অনেকেরই সন্দেহ ছিল, আপনি ক্রমঅপসৃয়মান ভারতকে আদৌ খুঁজতে চান কিনা। ভারত জোড়ো যাত্রায় প্রমাণ হল, চান।

মাননীয় রাহুল গান্ধী,

মহাত্মা গান্ধীর শহিদ হওয়ার দিনে ভারত জোড়ো যাত্রার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে শ্রীনগরে আপনি যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে অন্তত একটি চমৎকার কাজ হয়েছে। যারা বলে ব্যক্তিগত জীবন আর রাজনীতিকে আলাদা আলাদা বাক্সে রাখা উচিত, রাজনৈতিক কারণে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি কাম্য নয়, তারা যে আসলে ব্যক্তিগত জীবনকে রাজনীতি কীভাবে প্রভাবিত করে তা বোঝে না অথবা কোনো উদ্দেশ্যে অন্যদের বুঝতে দিতে চায় না – তা আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেছে।

রাজনৈতিক আলোচনা মানেই তা নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে – এই সংস্কার উদারপন্থী ও বাম রাজনীতিতে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৈর্ব্যক্তিক, অর্থাৎ আবেগশূন্য। অথচ আবেগ বাদ দিয়ে মানুষ হয় না, মানুষ যা যা করে তার প্রায় কোনোটাই আবেগ বাদ দিয়ে করে না। রাজনীতি তো নয়ই। কিন্তু রাজনীতি তো বটেই, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা – সবই আবেগশূন্য হওয়াই যে অভিপ্রেত তা আমাদের জনজীবনে বহুকাল হল প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সম্ভবত সেই কারণেই দক্ষিণপন্থীদের পক্ষে সহজ হয়েছে একেবারে উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে আবেগসর্বস্বতা দিয়ে মানুষের মাথা খেয়ে দেশটার সর্বনাশ করা। আমরা সরকারি অফিসে, হাসপাতালে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেগশূন্য ব্যবহার পাই, নেতাদের কাছ থেকে এবং আদালতে আবেগশূন্য ব্যবহার পাই। কারণ গোটা ব্যবস্থাটা অনবরত শিখিয়ে চলেছে, মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবা অন্যায়। তাকে দেখতে হবে নৈর্ব্যক্তিকভাবে। সকলকে ৪৭ফ বা ৬৯ঙ হিসাবে দেখাই নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার। যে যেখানে ক্ষমতার বিন্যাসে উপরে থাকবে, সে ন্যায় করলেও মায়াদয়াহীনভাবেই করবে – এই আমাদের আজন্মলালিত সংস্কার। উল্টোদিকের মানুষটির সাথে মানুষ হিসাবে নয়, তার প্রাসঙ্গিক তকমার হিসাবে ব্যবহার করাই যেন ন্যায়। এভাবে চললে যা হওয়ার কথা আমাদের দেশে ঠিক তাই হয়েছে। ন্যায় আর হয় না, অধিকাংশ সময় অন্যায়ই হয় সাধারণ মানুষের প্রতি। তাই বোধহয় দক্ষিণপন্থীরা কাজের কথা বাদ দিয়ে কারোর হিন্দু আবেগ, কারোর অসমিয়া আবেগ, কারোর বাঙালি আবেগ, কারোর দলিত আবেগ, কারোর আদিবাসী আবেগে সুড়সুড়ি দিলে ভুল করে মনে হয় “এই তো আমাকে আমি হিসাবে দেখছে।” অতএব সমস্ত মনপ্রাণ তারই দিকে ধাবিত হয়। আপনার শ্রীনগরের বক্তৃতা শুনে মনে হল, আপনি এই কথাটা ধরে ফেলেছেন।

দুই দশকের সাংবাদিক জীবন বাদ দিন, প্রায় সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক বক্তৃতা শোনার জীবনে মনে করতে পারছি না আর কোনো ভারতীয় রাজনীতিবিদকে কোনো জনসভার প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আলাদা করে অথচ একত্রে কথা বলতে দেখেছি। কাশ্মীরের মানুষ এবং সেখানে মোতায়েন আধাসামরিক বাহিনী ও সেনাবাহিনীর জওয়ানদের যে এক পংক্তিতে দাঁড় করানো সম্ভব, একই বাক্যে তাঁদের সকলের যন্ত্রণা ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব তা নরেন্দ্র মোদীর ভারতে কেন, রাজীব গান্ধীর ভারতেও আমরা কোনোদিন কল্পনা করতে পারিনি। কারণ সৈনিক বা সাধারণ কাশ্মীরি – এই গোষ্ঠীনামের পিছনের ব্যক্তিগুলির বেদনা বা আনন্দ নিয়ে ভাবার কথা রাজনীতিবিদ দূরে থাক, আমাদেরও মনে আসেনি। আপনি ফোনে নিজের ঠাকুমা এবং বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার স্মৃতি উল্লেখ করে বললেন, এ যন্ত্রণা মোদী-অমিত শাহ বুঝবেন না। কাশ্মীরের মানুষ বুঝবেন; সিআরপিএফ, বিএসএফ, সেনাবাহিনীর জওয়ানদের আত্মীয়রা বুঝবেন। কারণ তাঁরা এরকম ফোন কল পেয়ে থাকেন। ভারত জোড়ো যাত্রার উদ্দেশ্য এই ফোন কলগুলো আসা বন্ধ করা।

এভাবে বড়জোর শিল্পী, সাহিত্যিকদের কেউ কেউ ভাবতে পেরেছেন। কথাগুলো শুনেই মনে পড়ে গেল আজাজ খান নির্দেশিত হামিদ ছায়াছবিটির কথা। একমাত্র সেখানেই দেখেছিলাম ভারতীয় সেনার হাতে গুম হয়ে যাওয়া বাবার সন্ধানে থাকা আট বছরের ছেলে আর জন্মের পর থেকে সন্তানের মুখ না দেখা জওয়ানের যন্ত্রণাকে পাশাপাশি রাখা হয়েছিল। মোদী-শাহের নিষ্ঠুর পরিহাসে ২০১৯ সালে ওই ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করা তালহা আর্শাদ রেশিকে নির্দেশক বেশ কিছুদিন জানাতেই পারেননি যে সে দেশের সেরা শিশুশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছে। কারণ তখন গোটা কাশ্মীরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে রেখেছিল ভারত সরকার, যা কাশ্মীরের মানুষেরও সরকার।

এই সংকট তো কেবল কাশ্মীরের মানুষের নয়। দেশের যেখানেই রাষ্ট্র অতিমাত্রায় শক্তিধর হয়ে উঠেছে, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সংঘাত রাষ্ট্রের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে, সেখানেই এই সংকট স্বাধীনতার পর থেকে বারবার ঘটেছে, আজও ঘটে চলেছে। ঠিক যেমন রাষ্ট্রের হাতে ধর্ষিত হওয়া অথবা ধর্ষিত হয়ে রাষ্ট্রশক্তির কাছ থেকে নৈর্ব্যক্তিক (একজন ধর্ষিতার পক্ষে যা অমানবিকের নামান্তর) ব্যবহার পাওয়া এ দেশের মেয়েদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ কোনো নেতাকে কখনো জনসভায় বলতে শুনিনি – “আপনারা হয়ত দেখেছেন আমি যখন হাঁটছিলাম, বেশকিছু মহিলা কাঁদছিলেন। জানেন ওঁরা কেন কাঁদছিলেন? কয়েকজন আমার সাথে দেখা করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে কাঁদছিলেন ঠিকই, কিন্তু এমন অনেকেও ছিলেন যাঁরা কাঁদছিলেন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে। কেউ কেউ বলছিলেন ওঁদের যৌন হয়রানি হয়েছে, কয়েকজনের আত্মীয়ই কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। শুনে আমি যখন বলতাম, আমি পুলিসকে বলি তাহলে? ওঁরা বলতেন, রাহুলজি, পুলিসকে বলবেন না। আমরা আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পুলিসকে বলবেন না। বললে আমাদের আরও ক্ষতি হবে। এই হল আমাদের দেশের বাস্তব।”

এ দেশ কত মহান তা নিয়ে কেবল সংঘ পরিবার তো নয়, আমাদের সকলেরই গর্বের শেষ নেই। সেই গর্বের আখ্যানে এই বাস্তব খাপ খায় না বলে আমরা এড়িয়ে যাই, রাজনৈতিক নেতারা তো এড়িয়ে যান বটেই। যে দলের যেখানে সরকার আছে সেখানে সে দলের নেতারা আরও বেশি করে এড়িয়ে যান, কারণ তাঁরা মনে মনে একে সমস্যা বলে জানলেও স্রেফ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলেই ভাবেন। ফলে এসব কথা তুললে নিজের দলের সরকারের ঘাড়ে দোষ এসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন। তার উপর পুলিসকে বললে সমস্যা বাড়বে – এ তো সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী কথা। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলও তো রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গ। ব্যবস্থার মধ্যে থেকে তার বিরুদ্ধে কথা বলা চলে কখনো? অথচ আপনি বললেন। এখনো ভারতের বেশ বড় বড় তিনটে রাজ্যে আপনার দলের সরকার, অর্থাৎ সেখানকার পুলিস আপনার দলেরই হাতে। তার উপর আপনি, আপনার মা এবং বোন সারাক্ষণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকেন। তবু যে আপনি এসব কথা বললেন, এ কথা চট করে ভোলা যাবে না। যেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললেন, সেখান থেকে কুনান পোশপোরা ঠিক কত কিলোমিটার দূরে তা জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, আপনার কথাগুলো কেবল ওই কাণ্ডের ধর্ষিতাদের নয়, স্পর্শ করবে মণিপুরের সেই মহিলাদেরও, যাঁরা ২০০৪ সালে একদা উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন ইম্ফলের রাস্তায়, সঙ্গে ছিল ফেস্টুন। তাতে লাল অক্ষরে লেখা ছিল – INDIAN ARMY RAPE US। কথাগুলো নিশ্চয়ই ছুঁয়ে ফেলবে ছত্তিসগড়ের সোনি সোরিকে, বেঁচে থাকলে ছুঁয়ে ফেলত অর্চনা গুহকেও। সংবাদমাধ্যম যাকে নির্ভয়া নাম দিয়েছিল সেই মেয়েটিকে তো বটেই। এইসব কুকীর্তির সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল আপনার দলই। তবু আপনি এসব কথা বলেছেন বলে, বা সেইজন্যেই আরও বেশি করে আপনি ধন্যবাদার্হ, রাহুল। মানহারা মানবীর দ্বারে এসে দাঁড়ানোর সাহস খুব কম পুরুষের হয়। তাকে মানবী হওয়ার সম্মানটুকু দেওয়ার ক্ষমতাও অনেক শাসকেরই হয় না, নিজে মহিলা হলেও। আমি যে রাজ্যের বাসিন্দা সে রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীই তো ধর্ষণ হলেই হয় ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, নয় প্রতিবাদী মহিলাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে যান, নতুবা ছেলেটি ও মেয়েটির মধ্যে প্রেম ছিল কিনা তার খোঁজ করেন। ভারতের রাজনীতিবিদদের থেকে এমন ব্যবহার পেয়েই ভারতীয় মেয়েরা অভ্যস্ত।

আরও পড়ুন রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

আপনার বক্তৃতায় আপনি আরও অনেক কথা বলেছেন যেগুলো ভাল কথা, প্রয়োজনীয় কথা, বহুবার বলা কথা। তবু আবার বলা প্রয়োজন, কারণ কেউ বলছে না। যেমন আপনি ‘গঙ্গা-যমুনী তহজীব’-এর কথা, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সভ্যতার কথা বলেছেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত আপনার যাত্রার তুলনায় এনেছেন কাশ্মীর থেকে এলাহাবাদে নেহরু পরিবারের যাত্রার প্রসঙ্গ। সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কেমন একই সূত্রে গাঁথা তা দেখাতে ব্যক্তিগত ইতিহাসের এই ব্যবহার যে একজন পাকা বক্তার লক্ষণ। কিন্তু যা আপনার গোটা বক্তৃতায় সারাক্ষণ ছেয়ে থেকেছে তা হল সংবেদনশীলতা। আরও সহজ করে বললে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তের মানুষকে ছোঁয়ার ইচ্ছা। আপনি যেমন ধর্ষিত মহিলাদের কথা বলেছেন, তেমনই বলেছেন দুটি হতদরিদ্র ছেলের কথা, যাদের গায়ে জামা পর্যন্ত ছিল না, দেহ ছিল ধূলিমলিন। বলেছেন তাদের দেখেই মনে হয়েছিল উত্তর ভারতের শীতেও শুধু টি-শার্ট পরেই কাটিয়ে দেবেন। সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে কথাগুলো বানানো মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আপনার বক্তৃতার দিনেই নাগরিক ডট নেটে মনীষা ব্যানার্জি লিখেছেন “কথিত আছে চম্পারণে কস্তুরবা দেখেছিলেন, একটি ঝুপড়িতে দুই মহিলার মাত্র একটি কাপড়। একসঙ্গে দুজনে বাইরে বেরোতে পারেন না। এই কাহিনি গান্ধীকে কটিবস্ত্র ধারণে বাধ্য করে…”। ফলে সন্দেহ করা অমূলক নয়, যে এই কাহিনি আপনার জানা এবং আসলে তা থেকেই টি-শার্ট পরার সিদ্ধান্ত। যদি তাও হয়, তবু আজকের ভারতে একজন রাজনীতিবিদ সচেতনভাবে গান্ধীকে অনুকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং গান্ধীর এমন একটি কাজ অনুকরণ করছেন যা করতে গেলে নিজেকে শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে হয় – এ বড় কম কথা নয়। আমরা তো শুনে এসেছি আপনি ‘শাহজাদা’। আপনি নিজেও এই ভাষণে বলেছেন আজন্ম কোনো না কোনো সরকারি বাড়িতে থেকেছেন। শুধু সমালোচকের চোখ দিয়ে দেখলেও সেই লোকের এই ভূমিকার প্রশংসা না করে উপায় নেই। ঘৃণার ব্যাপারীদের কথা অবশ্য আলাদা।

ধূলিমলিন ছেলেদুটির কথা বলতে গিয়ে আপনি ফের তুলে এনেছেন আমাদের পালিশ করা ভারতবর্ষের কদাকার দিকটি। আপনারই এক সঙ্গী যে আপনাকে বলেছিলেন ওদের সাথে গলাগলি করা উচিত হয়নি, ওরা নোংরা – সেকথা বলে দিয়েছেন সর্বসমক্ষে। জানিয়েছেন, আপনার উত্তর ছিল “ওরা আমার এবং আপনার থেকে পরিষ্কার।” আবার বলি, একথা বানানো হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু বানানো হলেও দোষের নয়। প্রথমত, একজন নেতা জনসভায় না ভেবেচিন্তে যা খুশি বলবেনই বা কেন? দ্বিতীয়ত, অস্পৃশ্যতা আজও আমাদের দেশে ইতিহাস হয়ে যায়নি। যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁদের একথা যেভাবে ছোঁবে, আমার মত উচ্চবর্গীয় সাংবাদিককে সেভাবে স্পর্শ করবে না বলাই বাহুল্য। কয়েক হাজার বছর ধরে কোণঠাসা হয়ে থাকা সেইসব মানুষ ভারত জুড়ে গত আট বছরে আরও কোণঠাসা হয়েছেন, যতই একজন দলিতের পর একজন আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হয়ে থাকুন। যেসব গালাগালি স্বাধীন ভারতে অন্তত তাঁরা পিছন ফিরলে ছুঁড়ে দেওয়া হত, আজকাল প্রকাশ্যেই দেওয়া হয়। তাঁরা জানলেন, নিদেনপক্ষে একজন নেতা আছেন ভারতীয় রাজনীতিতে, যিনি ওই ভাবনার, ওই ব্যবহারের বিরুদ্ধে।

আজকের ভারত যেমন হয়েছে, তাতে সারাক্ষণ কথাবার্তা চলে নাগরিকত্ব নিয়ে। অনেকদিন পরে কাউকে ভারতীয়ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে শুনলাম। ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য” কথাটাকে আজ বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেই ঐক্য কীভাবে ভারতের সর্বত্র বিচিত্র ভাষায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চিন্তায় ধরা পড়েছে আপনি সেকথা বলেছেন। গুজরাটের গান্ধী, আসামের শঙ্করদেব, কর্ণাটকের বাসবেশ্বর বা বাসবান্না, কেরালার নারায়ণ গুরু, মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে – এঁদের সকলকেই আপনি ভারতীয়ত্বের নির্মাতা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটা শুনতে না পেয়ে রাগ করব ভাবছিলাম। কারণ এমনকি জওহরলাল নেহরুও তাঁর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া গ্রন্থে ভারতীয়ত্বের নির্মাণে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ বলে মতপ্রকাশ করেছেন, গান্ধীর সঙ্গে তাঁকে একাসনে বসিয়েছেন (“Tagore and Gandhi have undoubtedly been the two outstanding and dominating figures of India in the first half of the twentieth century… Tagore and Gandhi bring us to our present age.”)। সেই রবীন্দ্রনাথের নাম করলেন না দেখে সত্যিই রাগ করতে যাচ্ছিলাম। তারপর খেয়াল হল, রবীন্দ্রনাথের নাম তো বহু নেতার মুখে শুনেছি। এমনকি মোদীও শালগ্রাম শিলার মত করে তাঁর নাম নিয়ে নেন, অসহ্য উচ্চারণে তাঁর কবিতার পংক্তি আউড়ে বাঙালিদের মোহিত করার চেষ্টা করেন ভোটের মুখে। কিন্তু নারায়ণ গুরু আর ফুলের মত দুজন বর্ণবাদবিরোধী মানুষের নাম ভারতের কোনো উচ্চবর্গীয় শীর্ষস্থানীয় নেতার মুখে কোনোদিন শুনেছি কি? এমনকি আপনার পূর্বপুরুষ নেহরুর উপর্যুক্ত বইটিতেও বর্ণাশ্রম শুরুতে ভাল উদ্দেশ্যেই চালু করা হয়েছিল, পরে মন্দ হয়ে যায় – এই জাতীয় মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। গান্ধীও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ছিলেন, বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে নয়।

উপরন্তু আমরা যারা বিন্ধ্য পর্বতের এপাশে বাস করি এবং তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালির তফাত করতে পারি না; ওদিককার লোক হলেই দক্ষিণ ভারতীয় বলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই, তাদের অনেকের কাছে তো নামদুটোই নতুন। সে নাম আপনি করলেন ভারতের একেবারে উত্তর প্রান্তে দাঁড়িয়ে। এমনটি না করলে “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে” স্বপ্ন সত্যি হবে কী করে? স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আদানপ্রদান তো ঘটেনি, তাই তো সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে মঙ্গলঘট ভরা হয়নি। আপনি কি পারবেন সেই ঘট ভরতে?

সে বড় কঠিন কাজ, সম্ভবত অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ। আজকের ভারতে যখন সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে, তখন এ কাজ আরও শক্ত। সত্যি কথা বলতে কি, আপনি সে কাজের যোগ্য লোক কিনা তার পরীক্ষা আপনি ক্ষমতায় না পৌঁছলে শুরুই হবে না। আপনি যতই বলুন, ভারত জোড়ো যাত্রা কংগ্রেসের জন্য করেননি, কংগ্রেসকে বাদ দিয়েও আপনি যা করতে চান তা করতে পারবেন না। আর সেই দলে আজও গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে আছেন কমলনাথের মত লোক, যিনি এই সেদিন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণে কৃতিত্বের ভাগীদার হতে চেয়েছেন। যোগ করেছেন, আসল কৃতিত্ব আপনার বাবা রাজীব গান্ধীর, কারণ ১৯৮৫ সালে তিনিই বাবরির তালা খুলিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও আছেন শশী থারুর, যিনি কে জানে কোন অধিকারে কদিন আগে ঘোষণা করে দিলেন, ভারতের মুসলমানরা পর্যন্ত আর গুজরাট ২০০২ নিয়ে ভাবতে চান না

এঁদের নিয়ে কী করে ভারত জুড়বেন সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ভার আপনার। নেহরু যে গণতন্ত্রের কথা বলতেন সেই গণতন্ত্রের রীতি মেনে আপনার উপর সাগ্রহ কিন্তু সন্দিগ্ধ নজর রাখব আমরা, যারা এখনো প্রশ্ন তোলা এবং সমালোচনা করা সংবাদমাধ্যমের কাজ বলে মনে করি। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে ভারতের আজ এমন এক নেতা দরকার যাঁর ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি না হলেও বুকের ভিতরে কিছুটা পাথর আছে। যে কোনো ভারতবাসী ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাবে। আপনার শ্রীনগরের বক্তৃতা শোনার পর মনে না করে পারছি না, আপনি তেমনই একজন।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতিকে উপযুক্ত স্থান দিতে হবে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকলে কেউ এগোতে পারে না। কেবল রাজনীতি নয়, সাংবাদিকতাতেও তার ঊর্ধ্বে উঠতে হয়, তবেই সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের হারিয়ে যাওয়া বা কখনো খুঁজে না পাওয়া ভারতের সন্ধানও সেভাবেই পাওয়া যাবে সম্ভবত। দূরদর্শনে যখন নেহরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া অবলম্বনে শ্যাম বেনেগালের ভারত এক খোঁজ ধারাবাহিক শুরু হয়, তখন আমার বয়স ছয়। আপনার বোধহয় ১৮। তখন না হলেও, এখন নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে সুপণ্ডিত নেহরু বইয়ের নামে দাবি করেছেন তিনি ভারতকে ‘আবিষ্কার’ করেছেন। অন্যদিকে বেনেগাল ওই বইয়ের মধ্যে দিয়ে ভারত দেশটাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। এতদিন আমাদের অনেকেরই সন্দেহ ছিল, আপনি ক্রমঅপসৃয়মান ভারতকে আদৌ খুঁজতে চান কিনা। ভারত জোড়ো যাত্রায় প্রমাণ হল, চান। আশা করি এ খোঁজ শ্রীনগরে শেষ হয়নি, শুরু হল।

ধন্যবাদান্তে

জনৈক সাংবাদিক।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: