নাসার আর ব্রিজভূষণ: যৌন নির্যাতনের আমরা ওরা

নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

ইন্টারনেটের যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলিগলির খবর পর্যন্ত আমরা যেভাবে রাখি, আমেরিকানরাও ভারতের খবর সেভাবে রাখেন কিনা জানি না। মার্কিন জেলগুলোতে বন্দিদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার অধিকার আছে কিনা তাও জানি না। তবে যদি থেকে থাকে, তাহলে নির্ঘাত সেখানে বসে ল্যারি নাসার আফসোস করছে ভারতে তার জন্ম হয়নি বলে। নামটা অচেনা? সেটাই স্বাভাবিক। বাংলা খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলে খেলার খবর বলতে তো আইপিএল আর আইএসএল। আন্তর্জাতিক খেলা মানে বড়জোর ভারতীয় দলের ক্রিকেট আর ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল লিগ, চার বছরে একবার বিশ্বকাপ। ফলে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দেড়শোর বেশি জিমন্যাস্টের সাক্ষ্যদানের পর দুই দশক ধরে যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত নাসারের ৪০ থেকে ১৭৫ বছরের কারাদণ্ডের খবর হয়ত অনেকেরই চোখে পড়েনি বা স্মরণ নেই। নাসার ছিল ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্স, ইউ এস অলিম্পিক কমিটি এবং মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অগ্রগণ্য ডাক্তার। সেই মওকায় চিকিৎসার নাম করে সে মহিলা জিমন্যাস্টদের যথেচ্ছ যৌন নিপীড়ন করত।

এমনিতে একজন আমেরিকানের ভারতীয় হয়ে জন্মাতে চাওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং ভারতীয়রাই অনেকে আমেরিকান হয়ে জন্মাতে পারলে খুশি হত। কিন্তু নাসার মনে করতেই পারে, ভারতে জন্মালে সে স্রেফ ডাক্তার হয়ে না থেকে ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের শীর্ষ কর্তা হয়ে বসতে পারত। এমনিতেই তার বিকৃতির শিকার হওয়া মহিলাদের মুখ খুলতে বছর বিশেক সময় লেগেছে, কর্মকর্তা হলে নিশ্চয়ই তারা আরও ভয় পেত। ফলে আরও দেরিতে মুখ খুলত। খুললেও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত না গেলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা রাস্তায় বসে না পড়লে পুলিস এফআইআর পর্যন্ত নিত না। নিলেও নাসার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত, সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারত, যদি সে শাসক দলের টিকিটে নির্বাচিত সেনেটর হতে পারত। সেসব কিছুই হল না নাসার মার্কিন দেশে জন্মেছিল বলে। এসবের জন্যে যদি সে ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে হিংসা করে, তাকে দোষ দেওয়া চলে কি? বিশেষ করে যখন দুজন কুস্তিগির ব্রিজভূষণের সম্পর্কে পুলিসের কাছে যে অভিযোগগুলো করেছেন তার সঙ্গে নাসারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের স্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

এমন নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেয়েদের জন্যে একেবারে স্বর্গরাজ্য। ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের মার্কিন কলামনিস্ট ময়রা ডোনেগান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেন নাসার কাণ্ডে ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) অপদার্থতার কথা। হলিউডি থ্রিলার দেখার অভ্যাস যাঁদের আছে তাঁরা জানেন, এই এফবিআইকে প্রায়শই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে দেখানো হয়। ব্যতিক্রমী ছবি না হলে এফবিআইয়ের গোয়েন্দাদের এত তৎপর, এত সৎ বলে দেখানো হয় যেন তাঁদের চোখ এড়িয়ে মাছি গলতে পারে না। কিন্তু ডোনেগান লিখেছেন ২০১৫ সালে অলিম্পিয়ান ম্যাককেলা ম্যারোনি নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানানোর পরেও তারা নড়েচড়ে বসেনি। তারা তদন্ত শুরু করে ২০১৬ সালে যখন স্থানীয় পুলিস নাসারের একটা হার্ড ড্রাইভ থেকে ৩৭,০০০ শিশু নির্যাতনের ছবি বাজেয়াপ্ত করে। নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে জমা পড়া প্রথম অভিযোগ থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবস্থা নেওয়ার সময়টুকুতেও সে প্রায় ৭০ জন মহিলা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপরে নির্যাতন চালিয়েছে। নাসারের ঘটনা নিয়ে মার্কিন সেনেটে শুনানির সময়ে এফবিআই ডিরেক্টর ক্রিস রে স্বীকার করেন যে তাঁর সংস্থার গাফিলতি ছিল। কিন্তু তিনি দাবি করেন সেটা সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের ব্যক্তিগত গাফিলতি, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নয়। অথচ ডোনেগান লিখেছেন স্থানীয় পুলিস থেকে শুরু করে এফবিআই পর্যন্ত সর্বত্রই যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। গোটা আমেরিকা জুড়ে বহু মেয়ের অভিজ্ঞতাই তা বলে। সেদিক থেকে আমাদের মেয়েদের চেয়ে মার্কিন মেয়েদের অবস্থা বিশেষ উন্নত নয় বলতে হবে। কিন্তু তাহলেও তফাত বিস্তর। কোথায় তফাত?

এফবিআইয়ের গড়িমসির কথা প্রকাশ্যে এল কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ইনস্পেক্টর জেনারেল নাসার কাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে যে অন্তর্তদন্ত চালিয়েছিলেন তার নির্মম রিপোর্ট থেকে। উপরন্তু যে তিনটে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাসার যুক্ত ছিল, সেগুলোকেও ফল ভোগ করতে হয়েছে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে সংগঠনের প্রতিক্রিয়া সঠিক ছিল কিনা সে সম্পর্কে তদন্ত করায়। ইউ এস অলিম্পিক কমিটি একসময় ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের অনুমোদন বাতিল করে দেবে ঠিক করেছিল। অলিম্পিক কমিটির চাপে তাদের সিইও এবং প্রেসিডেন্ট কেরি পেরিকে পদত্যাগ করতে হয়। এমনকি তাঁর স্থলাভিষিক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সিইও এবং প্রেসিডেন্ট মেরি বনোকেও পদত্যাগ করতে হয় চারদিনের মাথায়, কারণ জিমন্যাস্টরা তাঁকে ওই পদে দেখতে চাননি। আসলে বনো এমন এক ল ফার্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যা নাসারকে সাহায্য করেছিল।

অর্থাৎ ও দেশে এক প্রতিষ্ঠানের দোষ দেখে অন্য প্রতিষ্ঠান শাক দিয়ে মাছ ঢাকেনি। অলিম্পিকে সোনা জয়ী সিমোন বাইলস, অ্যালি রাইসম্যান বা ম্যারোনি, ম্যাগি নিকলদের কথা সেনেট শুনেছে, আদালতও ধৈর্য ধরে শুনেছে। তার জন্যে তাঁদের ওয়াশিংটন ডিসি বা নিউইয়র্কের ফুটপাথে গিয়ে বসতে হয়নি। একথা সত্যি, যে ব্রিজভূষণ দোষী কি দোষী নন সেকথা বিচার করবে আদালত। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের সামনে হাজির করার দায়িত্বটুকু নিতেও তো এ দেশের পুলিস বা সরকার রাজি নয়। এমনকি ভারতীয় অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পিটি ঊষা কদিন আগে বলে বসেছিলেন, যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করে বিনেশ ফোগত, বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিকের মত কুস্তিগিররা নাকি দেশের বদনাম করছেন। নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

আরও পড়ুন হাসছি মোরা হাসছি দেখো: বীর দাসের বীরত্বে দুই ভারতের পর্দা ফাঁস

নাসার জেল খাটছেন, ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের সেই কর্তারাও বিতাড়িত, জিমন্যাস্টরা আছেন স্বমহিমায়। বাইলস আরও একটা অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, গোটা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে আবার কোন রুদ্ধশ্বাস দেহভঙ্গিমায় তিনি তাক লাগিয়ে দেবেন। এদিকে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে তিন সদস্যের অ্যাড হক কমিটির হাতে। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, এই অ্যাড হক কমিটি নাকি আসন্ন এশিয়ান গেমসের সংগঠকদের কাছে ভারত থেকে যে কুস্তিগিররা প্রতিযোগী হতে পারেন তার এক প্রাথমিক তালিকা পাঠিয়েছে। সেই তালিকায় প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের মধ্যে থেকে বজরং, ভিনেশ আছেন। তাছাড়াও আছেন রবি দাহিয়া, দীপক পুনিয়া, অংশু মালিক, সোনম মালিক। কিন্তু অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী সাক্ষী বাদ। কেন তিনিই বাদ? সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য স্মৃতি ইরানির জবাবদিহি দাবি করেছিলেন বলে কি?

দেখে শুনে মনে হয়, কদিন আগে রাতের অন্ধকারে দিল্লি পুলিসের গলাধাক্কা খাওয়ার পর ভিনেশ কাঁদতে কাঁদতে ক্যামেরার সামনে যা বলেছেন তার চেয়ে ন্যায্য কথা নেই – দেশের মেডেল জেতার পরেও যদি এত অপমান সহ্য করতে হয়, তাহলে আর কারোর কখনো মেডেল না জেতাই ভাল।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন?

এ দেশের ক্রিকেটমহল এখন ভীষণ ব্যস্ত। ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আইপিএল চলছে। নিজ নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। লখনৌ সুপারজায়ান্টস অধিনায়ক কে এল রাহুল তো এতটাই নিবেদিতপ্রাণ যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে গুরুতর চোট পাওয়ার পরে হার নিশ্চিত জেনেও দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। অতঃপর চোটের প্রভাবে বাকি টুর্নামেন্টে আর খেলতে পারবেন না, সামনের মাসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলতে পারবেন না। এমন বীরত্বের জন্যই তো জাতীয় নায়কের মর্যাদা পান ক্রিকেটাররা। মুশকিল হল, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পদকজয়ী কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগত এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁর দাবি, মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন আক্রমণের অভিযোগে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, ক্রিকেটারদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।

গত ২৮ এপ্রিল ভিনেশ বলেন, ক্রিকেটারদের তো আমাদের দেশে পুজো করা হয়। তাঁরা আমাদের পক্ষ যদি না-ও নেন, অন্তত একটা নিরপেক্ষ বার্তা দিয়েও তো বলতে পারেন যে দোষীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কেবল ক্রিকেটার নয় অবশ্য, সব খেলার তারকাদের কাছেই আবেদন ছিল ভিনেশের। তারপর থেকে অভিনব বিন্দ্রা আর নীরজ চোপড়া – ভারতের ইতিহাসে যে দুজন অলিম্পিকে ব্যক্তিগত সোনা জিতেছেন, দুজনেই ওই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। সদ্যপ্রাক্তন টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাও দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের বিশেষ হেলদোল নেই। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র মহিলাদের জাতীয় দলের শিখা পাণ্ডে মুখ খুলেছেন। সদ্য চালু হওয়া মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে দামী ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধনার কোনো বক্তব্য নেই। জাতীয় দলের অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌরও চুপ। প্রাক্তনদের মধ্যে হরভজন সিং, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ইরফান পাঠান সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। একমাত্র নভজ্যোৎ সিং সিধু সশরীরে ভিনেশ, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল কপিলদেব ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কবে ন্যায়বিচার পাবে?

স্পষ্ট বক্তা হওয়ার জন্য যাঁর বিপুল খ্যাতি, সেই বিরাট কোহলি স্পিকটি নট। যাবতীয় বাহাদুরি গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে খরচ করছেন। নারীবাদীরা প্রায়শই বিরাটকে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়েন তিনি জীবনে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার অবদান স্বীকার করেন বলে, তাঁর ব্যর্থতায় ট্রোলরা অনুষ্কাকে টার্গেট করলে বিরাট মুখ খোলেন বলে। দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে বিরাটই একমাত্র পুরুষ যিনি নিজের বউকে ভালবাসেন। তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেন একমাত্র অস্কার মঞ্চে বউকে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্রিস রককে ঘুঁষি মেরে দেওয়া উইল স্মিথ। দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি বিরাটের ভালবাসা আমাদের পাড়ার রানাদার পর্ণা বউদির প্রতি ভালবাসার চেয়ে মহত্তর কিছু মোটেই নয়। বরং হয়ত কিছুটা নিকৃষ্টতরই। কারণ রানাদা রাস্তাঘাটে অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে কাউকে বিশ্রীভাবে কথা বলতে দেখলে অন্তত একটু ধমকা-ধমকি করেন। কিন্তু দেশের লাঞ্ছিত মহিলা কুস্তিগীরদের নিয়ে বিরাটের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

মনে রাখা ভাল, অনুষ্কা নিজেও কম নারীবাদী নন। তিনি একদা সুনীল গাভস্করের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন, কারণ গাভস্কর বলেছিলেন অনুষ্কার বোলিংয়ে অনুশীলন করে বিরাটের লাভ হবে না। সেই অনুষ্কাও আজ চুপ। চুপ মানে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। দুটিতে কেমন জীবন উপভোগ করছেন তার তত্ত্বতাল্লাশ দিব্যি দিয়ে যাচ্ছেন টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে। তবে গাভস্করের বিরুদ্ধে লম্বা বিবৃতি দিয়েছিলেন, অলিম্পিয়ান মহিলাদের প্রতিবাদ নিয়ে এক লাইনও লেখেননি। অবশ্য পরীক্ষায় আনকমন প্রশ্ন এসে গেলে আমরাও সে প্রশ্ন ছেড়ে আসতাম।

গম্ভীর আবার দিল্লি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। সেই দিল্লির যন্তর মন্তরেই কুস্তিগীরদের অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। যদিও ওই এলাকা গম্ভীরের কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবু তিনি একজন জনপ্রতিনিধি তো বটেন। অবশ্য উনি সাংসদের দায়িত্ব খুব মন দিয়ে কোনোদিন পালন করেছেন বলে অভিযোগ নেই। উনি সারাবছর ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিয়ে বেড়ান, আইপিএলের সময়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকেন। কদিন পরে হয়ত ওই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সারাবছরই বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াবেন। কারণ লখনৌ সুপারজায়ান্টসে তাঁর পদটির নাম গ্লোবাল মেন্টর, আর ওই ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকরা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার টি টোয়েন্টি লিগে দল কিনে বসে আছেন। আর কোথায় কোথায় কিনবেন কে বলতে পারে? এমন বিশ্বনাগরিকের কি আর যন্তর মন্তরের অবস্থান বিক্ষোভ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কূপমণ্ডূকতা মানায়?

পিভি সিন্ধু, সায়না নেহওয়ালদেরও মুখে কুলুপ। ছবারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মেরি কম তো পিটি ঊষা গোত্রের, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির অতি ঘনিষ্ঠ, তাই নীরব। গত কয়েকদিন অবশ্য তাঁর রাজ্য মণিপুরে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। বিজেপি তাঁকে এত গুরুত্ব দেয় যে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজনাথ সিংকে ট্যাগ করে বলতে হচ্ছে “মাই স্টেট ইজ বার্নিং, কাইন্ডলি হেল্প”। যে নিখাত জারীনকে একসময় স্রেফ জ্যেষ্ঠত্বের অধিকারে অবজ্ঞা করতেন মেরি, সেই দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিখাত কিন্তু সরব হয়েছেন।

প্রাক্তন সাংসদ ভারতরত্ন ‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ডাগআউটে নিদ্রা গিয়েছেন। তিনি অবশ্য কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন? তবু তো দয়া করে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে মুখ খুলেছেন। লর্ডসের ব্যালকনির চিরস্মরণীয় ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে ভারী বিনীতভাবে বলেছেন, ওদের লড়াই ওরা লড়ুক। আমি তো খবরের কাগজে পড়ছি, যা জানি না তা নিয়ে তো কথা বলা উচিত নয়।

এদিকে শচীন, সৌরভ দুজনেই কন্যাসন্তানের পিতা।

সত্যি কথা বলতে, ভারতীয় তারকা খেলোয়াড়দের যা ইতিহাস, তাতে এঁরা মহম্মদ আলি হয়ে উঠবেন বলে কেউ আশা করে না। সাম্প্রতিক অতীতে তাঁরা কিন্তু সাতে পাঁচে না থাকার নীতি অনেকটাই ত্যাগ করেছেন। ওঁরা এখন শচীন বা ঊষার মত শাসক দলের প্রসাদ গ্রহণ করে রাজ্যসভার সদস্য হচ্ছেন, এ পদ সে পদ গ্রহণ করছেন, গম্ভীরের মত ভোটে লড়ে সাংসদ বা বিধায়কও হচ্ছেন। যাঁদের অত এলেম নেই তাঁরাও কোহলির মত করে নোটবন্দি হওয়া মাত্রই তা কত বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ তা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলন চলাকালীন তার বিরোধিতা করে টুইট করেছিলেন। সেওয়াগের মত কেউ কেউ আরও এককাঠি সরেস। শহিদ হওয়া সৈনিকের মেয়েকে যুদ্ধবিরোধী কথা বলার জন্য ট্রোল করতেও ছাড়েননি। কেবল সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দরকার পড়লেই এঁরা কেউ নীরব হয়ে যান, কেউ এক-দু লাইনে কাজ সারেন। সেওয়াগ, কপিলদেব, হরভজন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মানুষ। কুস্তিগীরদের আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন হরিয়ানার কুস্তিগীররাই। তা না হলে এতেও ওই তিন প্রাক্তন মুখ খুলতেন কিনা সন্দেহ।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

যে পদকজয়ী অলিম্পিয়ানরা আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপি-ঘনিষ্ঠই ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে বা জয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করতে এঁদেরও কামাই ছিল না। এখন চোখের জলে সেসবের দাম দিতে হচ্ছে। এখনো যে মহাতারকারা নীরব, তাঁদের দেখে একটাই ভয় হয়। জার্মান যাজক মার্টিন নিয়মোলারের অনুসরণে এঁদের না কোনোদিন আওড়াতে হয়, প্রথমে ওরা এসেছিল কুস্তিগীরদের জন্যে। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কুস্তিগীর নই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

নয়া বার্তা ছাড়া পরিশ্রমের ফল পাবে না সিপিএম

তৃণমূলকে যত বড় ধাক্কা দেওয়া দরকার, বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে যতটা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দরকার – তার জন্যে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কি যথেষ্ট?

গত এক দশকে বাংলার রাজনীতিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলোর যদি একটা তালিকা তৈরি করা যায়, তাহলে প্রথম স্থান দখল করার লড়াইয়ে থাকবে ‘দুর্নীতি’ আর ‘সেটিং’। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে ‘এন আর সি’, ‘সি এ এ’, ‘এন পি আর’ শব্দগুলোর বহুল ব্যবহার সত্ত্বেও মনে হয় না ও দুটোকে টলানো যাবে। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সেই ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় মাপের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা শুরু হয়েছিল। তারপর সামনে আসে নারদ স্টিং অপারেশন, অতঃপর প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা কেলেঙ্কারি, গরু পাচার, অবৈধ বালি খাদান, কয়লা পাচার এবং সর্বোপরি নিয়োগ কেলেঙ্কারি। একের পর এক অভিযোগ উঠেই চলেছে। এগুলো ছাড়াও বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন ত্রিফলা আলো নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাইকেল নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, উমপুনের ত্রাণের চাল ও ত্রিপল বিতরণে দুর্নীতি হয়েছে। যদিও এই কটা অভিযোগ আইনি পথে খুব বেশি এগোয়নি, জনমনেও তেমন প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে সাধারণ মানুষের কথাবার্তা থেকে মনে হয় না। এর পাশাপাশি বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস বারবার দাবি করে এসেছে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে ‘সেটিং’, অর্থাৎ গোপন আঁতাত, আছে। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতির তদন্তগুলো শেষমেশ কোথাও পৌঁছয় না। অন্যদিকে ২০১১ পরবর্তী সময়ে যখনই তৃণমূল নিজেকে কোণঠাসা মনে করেছে, স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো বলেছেন সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি একসাথে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। কখনো বা বলেছেন সিপিএম বিজেপির হাত শক্ত করছে। এই করতে করতে বাংলার রাজনৈতিক বয়ানে যুক্ত হয়েছে দুটো শব্দ – বিজেমূল আর বিজেপিয়েম।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের নিচের তলা সচেতনভাবে বিজেপিতে ভোট নিয়ে গেছে বলে জোরদার অভিযোগ উঠেছিল। তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল জেলাস্তরের কিছু নেতার প্রকাশ্য উক্তি। আবার ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যেভাবে “দলে থেকে কাজ করতে পারছি না” অজুহাত দিয়ে দলে দলে তৃণমূল নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তার ফলে তৃণমূল আর বিজেপি একই দল – এই জাতীয় অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনের পর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মত করে বহু নেতা তৃণমূলে ফিরে আসেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নাম অবশ্যই মুকুল রায়, যিনি বিধানসভার খাতায় এখনো বিজেপি। অথচ রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ভাইপোর উপস্থিতিতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। এখন আবার তিনি তৃণমূল, না বিজেপি, নাকি অসুস্থ – তা নিয়ে তরজা চলছে। ফলে বিজেমূল তত্ত্বও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না আর।

কিন্তু সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে সেটিংকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে দুর্নীতি। লোকাল ট্রেনের ভেন্ডর কামরার আরোহী সবজি বা ছানার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মফস্বলে নতুন গজিয়ে ওঠা শীততাপনিয়ন্ত্রিত রিটেল চেনে বাজার করা গৃহবধূ – সকলেরই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। রাজ্য সরকারের পক্ষে যা বিশেষ উদ্বেগের, তা হল এই ইস্যু নিয়ে শাসক দল সম্পর্কে নরম মন্তব্য করতে প্রায় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সারদা কেলেঙ্কারি এ রাজ্যের মধ্যবিত্তকে প্রায় ছুঁতেই পারেনি, কারণ আমানতকারীরা অধিকাংশই ছিলেন গরিব মানুষ। তার উপর তখন ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের উপর তিতিবিরক্ত হয়ে নতুন শক্তিকে ক্ষমতায় আনা মানুষের তৃণমূল সম্পর্কে খানিকটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। নারদ কেলেঙ্কারির ঢেউ তো আরও অল্পেই ভেঙে গিয়েছিল। ততদিনে মন্ত্রীসান্ত্রীরা একটু-আধটু ঘুষ নেবেন – এ কথা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক জীবনে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। তাছাড়া যে টাকা ঘুষ হিসাবে দেওয়া হয়েছে তা আমার-আপনার টাকা কিনা তাও সন্দেহাতীত নয়। ফলে ও নিয়ে বেশি মানুষ ভাবেননি। কিন্তু এবার তাহলে জনমানসে এত অসন্তোষ কেন?

কারণ নানাবিধ, কিন্তু একটা কারণ অবশ্যই বিরোধী দলগুলোর সক্রিয়তার তফাত। ২০১১ সাল থেকে বছর খানেক আগে পর্যন্তও বিরোধী হিসাবে সিপিএম অবিশ্বাস্য নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে। নারদের ক্যামেরায় তৃণমূলের মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার দৃশ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরেও রাজ্যটা যেমন চলেছিল তেমনই চলেছে। বামফ্রন্টের মন্ত্রীরা এরকম কাণ্ডে জড়ালে আর বিরোধী নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলে সেদিন রাত থেকেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অবরুদ্ধ হয়ে যেত – একথা হলফ করে বলা যায়। তৎকালীন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ও তাঁর দলবল কিন্তু আলিমুদ্দিনে বসে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করেননি। মাঝেমধ্যে কলকাতার রাজপথে এক-আধটা মিছিল টিভির পর্দায় লাল পতাকার উপস্থিতি প্রমাণ করেছে, সরকারের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিগত রাজ্য সম্মেলনে নতুন রাজ্য কমিটি নির্মিত হওয়ার পর এবং মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির অনেকখানি পরিবর্তন ঘটেছে। কেবল কলকাতা নয়, জেলা সদরগুলোতে দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং আরও নানা দাবি নিয়ে বামেদের সরকারি অফিস অবরোধ করতে বা সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি করতে দেখা যাচ্ছে। যে লড়াকু মেজাজের জন্য বামপন্থী দলগুলোর কর্মীদের সুনাম বা দুর্নাম ছিল বরাবর, সেই মেজাজ আবার দেখা যাচ্ছে। কেবল নবান্ন নয়, উত্তরকন্যা অভিযান হচ্ছে নিয়মিত। কখনো ছাত্র-যুব সংগঠনের উদ্যোগে, কখনো বা শিক্ষক সংগঠনের উদ্যোগে। সেখানে ব্যারিকেড ভেঙে ফেলা হচ্ছে, আতঙ্কিত প্রশাসন জলকামান চালিয়ে দিচ্ছে। কলকাতায় চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সরকারের সোজা পথ, বাঁকা পথের নানা কৌশল সত্ত্বেও কিছুতেই ভাঙছে না। উল্টে ডিএ নিয়ে আন্দোলন করতে নেমে পড়েছেন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এবং অন্য রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা। একসঙ্গে এতগুলো আন্দোলনের প্রভাব পৃথিবীর যে কোনো দেশে যে কোনো কালে সরকারকে চাপে ফেলে। এখানেও ফেলেছে। মমতা সরকারের গোদের উপর বিষফোঁড়া আদালত।

দল এবং সরকার যে ঘূর্ণির মধ্যে পড়েছে তা আর কেউ মানুক না মানুক, পোড়খাওয়া নেত্রী মমতা নিশ্চয়ই মানেন। তাই একের পর এক জনসংযোগ কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের তারিখ নিয়েও উচ্চবাচ্য করছে না। যেসব এলাকায় পাঁচ বছর মানুষ খানাখন্দ পেরিয়ে যাতায়াত করেছেন, সেখানে এক বেলার মধ্যে নতুন রাস্তা তৈরি করা চলছে। মানুষের অসন্তোষের তীব্রতা টের পাওয়া যাচ্ছে এই দিয়েই যে তৃণমূল সাংসদ, বিধায়করা পর্যন্ত দিদির দূত হয়ে গিয়ে কোথাও তাড়া খেয়েছেন, কোথাও ভোটাররা মুখের উপর বলে দিয়েছেন ভোট দেওয়া হবে না। তাই এখন অভিষেক নতুন নাম দিয়ে ফের জনসংযোগের চেষ্টায় নেমেছেন।

মানুষের মধ্যে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, সেই ক্ষোভকে নালা কেটে ব্যালট বাক্সে বইয়ে দেওয়ার মত পরিশ্রম কি বামেরা করছেন? কোনো সন্দেহ নেই, রামনবমীর অজুহাতে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরি করে বিজেপি গত এক মাসে আবার এক ধরনের বাইনারি তৈরি করতে সফল হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। সে কাজে তাদের সাহায্য করছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। ঈদ উদযাপনে গিয়ে এন আর সি, সি এ এ নিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন সংখ্যালঘু মানুষকে। সাগরদীঘির হার এবং নওশাদ সিদ্দিকীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সামলাতে এবং একের পর এক তৃণমূল নেতার দুর্নীতির কেসে ফেঁসে যাওয়ার অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচতে হলে বিজেপি যে বামেদের চেয়ে প্রার্থিত প্রতিপক্ষ – তা মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কথা হল, এই কৌশল ভোঁতা করে দিতে বামেরা কী করতে পারেন? “বিজেপি-তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ভুলবেন না। দুর্নীতির মাধ্যমে রাজ্যটাকে কীভাবে ফোঁপরা করে দেওয়া হয়েছে খেয়াল রাখুন” – এই আবেদন আজকের বহুধাবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক বার্তা হিসাবে কি যথেষ্ট কার্যকরী? পশ্চিমবঙ্গ তো ভারতের বাইরে নয়। গোটা দেশে যা চলছে, তাতে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কেবল তৃণমূলের দুর্নীতির ইস্যুতে লড়ে কি সুবিধা করতে পারবেন বামেরা? তৃণমূলকে যত বড় ধাক্কা দেওয়া দরকার, বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে যতটা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দরকার – তার জন্যে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কি যথেষ্ট? নাকি মানুষের পালস বুঝতে আবার ভুল হচ্ছে সিপিএম তথা বাম নেতৃত্বের?

আরও পড়ুন বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র

সাম্প্রদায়িক বাইনারি তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক জমির সবটা দখলে রাখতে চাইছে তৃণমূল আর বিজেপি। তা ভাঙতে বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক বার্তা কি দিতে পারবেন সিপিএম ও তার শরিকরা? এখন পর্যন্ত দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় মিছিল করা ছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। শিগগির নতুন কোনো বার্তা দিতে না পারলে গত এক-দেড় বছরের পরিশ্রম কিন্তু জলে যেতে পারে। বুথ স্তরে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তৃণমূলের সঙ্গে লড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক খামতি তো আছেই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দু নাগরিকের পিঠ বাঁচানোর চিঠি

ওদের গুজরাটের মত, উত্তরপ্রদেশের মত শিক্ষা দেওয়া যাবে কী করে? সে আশাতেই তো বিরাট হিন্দু নেতাদের ভোট দেয়া। কিন্তু ওদের শিক্ষা দিতে দিতে আমাদের ছেলেপুলেগুলো অশিক্ষিত হয়ে যাবে না তো?

শুনুন ধর্মাবতার,

হিন্দুরাষ্ট্রের জন্মসূত্রে হিন্দু নাগরিক হিসাবে যা যা অপরাধ করে ফেলেছি সেসব স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে এই চিঠি লিখছি।

অ্যাঁ, কী বলছেন? ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো বটেই। সংবিধান নামে ওই যে মোটা বইটা আছে, যেটার নামে নেতা, মন্ত্রীরা শপথ নেন এবং ভুলেও মনে রাখেন না – সে বইতে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে লেখা আছে তো বটেই। স্কুল কলেজে পড়েছিলুম সেসব। এমনকি দরকারে পড়ে দেখব বলে আর ছেলেপুলেকে শেখাব বলে বাড়িতে এক কপি কিনেও রেখেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, বইতে তো কত কথাই লেখা থাকে। সব মেনে চললে তো বাঁচা যাবে না। যেমন ধরুন ‘সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা বলিলে পাপ হয়’। এরকম কথা ছোটবেলায় কত বইতে পড়েছি। তা বলে কি সবসময় সব জায়গায় সত্যি কথা বলে বেড়াই? সকলে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়ে গেলে আর আইন আদালত কোন কাজে লাগবে? কে সত্যি বলছে, কে মিথ্যে বলছে তার বিচার করতেই তো বিচারকরা আছেন। তা সংবিধানও একটা বই বৈ তো নয়। তার উপর আবার ইয়া মোটা। আজকাল তিন প্যারার বেশি ফেসবুক পোস্টই পড়ে ওঠা যায় না, অত মোটা বই কে পড়তে যাবে? ওসব জলাঞ্জলি দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, নয় কি? হোয়াটস্যাপেই এঁটে যাবে – দয়া করে এমন একটি সহজ ও ছোট সংবিধান বানিয়ে দিন না, মোটা ঝামেলাটি চিরতরে চুকে যাক। নতুন সংবিধানে ভারত যে হিন্দুরাষ্ট্র হবে তাতে তো সন্দেহ নেই, মানে চাদ্দিকে সবাই যখন বলছে দেশটা হিন্দুদের। তাই এখনই ক্ষমা-টমা চেয়ে পাপস্খালন করে রাখতে চাইছি আর কি, নইলে তখন যদি গদ্দার বলে শূলে চড়ানো হয়? মরণকালে হরিনাম করলে তো আর জীবন ফিরে পাওয়া যায় না, তাই প্রাণের মায়ায় কাজটা সেরে রাখছি।

প্রথম অপরাধটি করেছিলুম সেই ১৯৯২ সালে। আমার কোনো দোষ নেই, মাইরি বলছি। যত রাজ্যের হিন্দুবিরোধী খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেল দেখে বিশ্বাস করেছিলুম অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ভারি অন্যায় কাজ হয়েছে। ব্যাটা সেকুলার মিডিয়া আর পার্টিগুলো মিলে বুঝতেই দেয়নি যে বাল্মীকি, তুলসীদাস প্রমুখ রামায়ণ রচয়িতারা ভগবান শ্রীরামের জন্মস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ, মৌজা ও দাগ নম্বর লিখে না গিয়ে থাকলেও অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি, উমা ভারতী, মুরলী মনোহর যোশীর মত দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন নেতারা ঠিকই জানতেন যে একেবারে রামের ভূমিষ্ঠ হওয়ার জায়গাটিতেই পাপিষ্ঠ বাবর মসজিদ বানিয়ে ছেড়েছিল। আমার অজ্ঞানতা ক্ষমা করুন প্রভু।

সেই থেকে একের পর এক পাপ করেই চলেছি। এই ধরুন বাঙাল পরিবারের ছেলে হয়েও শিখে ফেলেছি দেশভাগের দায় হিন্দু, মুসলমান কোনো পক্ষের কম নয়। আরও শিখেছি ওপার থেকে যেমন ভিটেমাটি ছেড়ে অনেক হিন্দুকে এপারে চলে আসতে হয়েছিল, এপার থেকেও বিস্তর মুসলমান সব ফেলে ওপারে চলে গেছে। ওপারের লোক মোটেই সাধ করে চলে আসেনি, এপারের লোকও যে ড্যাং ড্যাং করে ওপারে পাড়ি দিয়েছে ঠিক তা নয়। এসব ঘোর বিজাতীয় কথাবার্তা যাঁরা শিখিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে দেহ রেখেছেন, ধর্মাবতার। ফলে আপনার কাজ কমেছে। যখন এক হোয়াটস্যাপ মেসেজ লম্বা সংবিধান অনুযায়ীও হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ শেষ হবে, তখন আর তেনাদের শাস্তি দেয়ার দরকার হবে না। আপনাদের হয়ে বরং আমিই তেনারা যা যা শিখিয়ে যেতে পারেননি তার জন্যে দু-চাট্টি গাল পেড়ে নিই।

যেখানে ইচ্ছে যত ইচ্ছে অন্যায় করে সবই বাবর ও তার চোদ্দ গুষ্টির পাপের শোধ তোলা হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করতে তাঁরা শিখিয়ে যাননি। মুসলমান মানেই মোগল আর মোগল মানেই রক্তপিশাচ বজ্জাত – এ কথাটি শিখিয়ে যাননি, মায় ওদের যে একটু শিক্ষা দিয়ে রাখা উচিত তা অবধি শিখিয়ে যাননি। কী ঝামেলা বলুন দেখি? অমৃতকালটি যে চেটেপুটে উপভোগ করব তার ব্যবস্থাই করে গেলেন না! তবে আর কী ছেলেপুলে মানুষ করলেন? ঘোর কলি। এখন দাড়িওলা, বন্দে ভারতে সওয়ার কল্কি অবতার যদি এর প্রতিকার করেন তবেই এ অধমের স্বর্গবাসের রাস্তা খোলে।

একটু ধৈর্য ধরুন, ধর্মাবতার। আমার পাপের এখানেই শেষ নয়। দ্বিগুণ পাপ করলুম ২০০২ সালে। ২৪ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরায় মহান করসেবকদের ট্রেনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর কয়েকদিন সামান্য একটু প্রতিক্রিয়া হল। অথচ ফের হিন্দুবিরোধী মিডিয়ার কথায়, ছবিতে বিশ্বাস করলুম ঘোর অন্যায় হচ্ছে। নারোদা পাটিয়া, নারোদা গাম, গুলবার্গ সোসাইটি – এসব জায়গার নাম মুখস্থ করে ফেললুম। আহসান জাফরিকে খুন করা হয়েছেবিলকিস বানোকে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে, পুলিস দেখেও কিছু দেখেনি, এমনকি মায়া কোদনানির মত মন্ত্রীসান্ত্রীরা দাঁড়িয়ে থেকে এসব করিয়েছেন – এমন গালগল্পে বিশ্বাস করে ফেললুম। একবারও ভেবে দেখলুম না, এক নিষ্ঠাবান হিন্দু মহিলা যাঁর নামেই রয়েছে মায়া, তিনি এমন মায়াদয়াহীন হতেই পারেন না। এসব হিন্দু সমাজকে বদনাম করার চক্রান্ত। গুজরাট মানে আসলে ভাইব্র্যান্ট গুজরাট, যেখানে মাঠে মাঠে ফসল আছে, গাছে গাছে পাখি আছে, ঘরে ঘরে চাকরি, থুড়ি ব্যবসা, আছে। যারা অন্য কথা বলে তাদের হিন্দু হৃদয়সম্রাটকে গাল পাড়া ছাড়া আর কাজ নেই – এই সহজ কথাটা বুঝে উঠতে পারিনি। চাকরি সূত্রে ও রাজ্যে থাকা আত্মীয়স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা অনেকবার বলেছে, তেমন কিছুই হয়নি ওখানে। কেবল মায়ের পেট থেকে পড়েই আরডিএক্স চিনে যায় যারা, তাদের একটু শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এমন শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে এখন গুজরাটের মত শান্ত রাজ্য আর নেই। কিন্তু সেকথা শুনে বিশ্বাস করিনি। কাউকে কাউকে মুখের উপর বলে দিয়েছি, ওটা শ্মশানের শান্তি।

ছ্যা ছ্যা! কী পাপ বলুন দেখি! একেবারেই উচিত হয়নি এসব বলা। এই তো কেমন ধীরে ধীরে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, কেবল নারোদা পাটিয়া বা নারোদা গাম কেন, ২০০২ সালে গুজরাটের কোথাও কেউ কাউকে খুন করেনি। ধর্ষণ যারা করেছিল তারাও সব নিপাট ভালমানুষ, বামুন বাড়ির ভদ্র ছেলেপুলে। তাই তাদের খামোকা সারাজীবন জেলের অন্ধকূপে আটকে রাখার মানে হয় না। তাদের এত সুখ আছে, এত সাধ আছে। সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে? না হয় তাদের দেখে কিছু লোক সাহস পেয়েছে, না হয় কাশ্মীরের কাঠুয়ায় বছর আষ্টেকের শিশুকেও ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে, না হয় ধর্ষকদের বাঁচাতে হিন্দুরা গোটা কতক মিছিল মিটিংই করেছে, মৃত শিশুর উকিলকে খুনের হুমকি দিয়েছে। সে আর তালিবান, আল কায়দা, আইসিস, বোকো হারামের অপরাধের তুলনায় কতটুকু? গেরুয়া পরে তো কেউ সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না, ওসব কংগ্রেসি প্রোপাগান্ডা। গেরুয়া পরে কেবল এমপি, এমএলএ, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়। কারণ তালিবানদের কেউ ভোট দেয় না, গেরুয়া পরে বোম ফিট করার অভিযোগ উঠলে দেয়। কারণ ওটি বীরত্ব।

আরও পড়ুন বিজেপি মুখপাত্র বিতাড়ন: হিন্দুত্বের টাইম আউট, খেলা শেষ নয়

দেশটা এখন বীরে বীরে বীরাক্কার। এদিকে আমার বীরেদের মর্যাদা দিতেও শেখা হয়নি। সেকুলাররা মাথাটা এমন খেয়েছে, কী বলব ধর্মাবতার, গোমাতাকে মাংস বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বা খাচ্ছে – এই অভিযোগে কাউকে উচিত শাস্তি দেয় যারা তাদের আমি ভেবেছি ‘লিঞ্চ মব’। এইসব সাহেবদের শেখানো কথাবার্তা, বুঝলেন কিনা? আমাদের দেশের কোনো ভাষায় ও কথাটা আছে? নেই, কারণ আমাদের দেশে ওরকম হয় না। আমাদের এখানে কেবল গোমাতার অসম্মান করলে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষা যারা দেয় তারা সব খোদ রাণাপ্রতাপের লোক, মানে সেই যিনি হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবরের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এই দেখুন, যত পাপই করে থাকি, আমার কিন্তু শুধরে নেওয়ার চেষ্টা আছে। যত রাজ্যের কমুনিস্টের লেখা ইতিহাস পড়ে শিখেছিলুম রাণাপ্রতাপ নাকি হেরে গেছিলেন। তা আবার হয় নাকি? ওই গরুখেকো মোগলদের কাছে আমাদের বিরাট হিন্দু রাজপুতরা কখনো হারতে পারে?

এত বছরের এত পাপ সব আপনার পায়ে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলুম। এবার থেকে একেবারে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে যাব, কথা দিচ্ছি। শুধু একটা ব্যাপারেই মনটা একটু খচখচ করছে, আপনি মাইবাপ, তাই আপনাকেই বলছি। হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া যে দরকার তাতে সন্দেহ নেই। নইলে ওদের গুজরাটের মত, উত্তরপ্রদেশের মত শিক্ষা দেওয়া যাবে কী করে? সে আশাতেই তো বিরাট হিন্দু নেতাদের ভোট দেয়া। কিন্তু ওদের শিক্ষা দিতে দিতে আমাদের ছেলেপুলেগুলো অশিক্ষিত হয়ে যাবে না তো? ডারউইন বলেছিলেন মানুষ বাঁদর ছিল। আমাদের মুনি ঋষিরা বলেননি, তাই বোধহয় ওসব বই থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারভিউতে “অমৃতস্য পুত্রাঃ” বলে-টলে আমাদের ছেলেপুলেগুলো চাকরি বাকরি পাবে তো, ধর্মাবতার? না, মানে বলছি চাকরি বাকরি তো এদেশে বিশেষ নেই, বিদেশেই খোঁজ করতে হবে। সেখানে এসব বললে আবার হাঁকড়ে দেবে না তো অশিক্ষিত লালমুখো সাহেবগুলো?

আর আপনার সময় নষ্ট করব না ধর্মাবতার। কেবল একখানা শেষ প্রশ্ন আছে। বলি বিলকিস বানোর ওই যে ভালমানুষ ধর্ষকগুলি, তাদের আবার মুসলমানদের শিক্ষা দেয়া হয়ে গেলে আমাদের মেয়েদের শিক্ষা দেয়ার প্ল্যান আছে নাকি? না, মানে হিন্দুরাষ্ট্রে কি মুসলমান থাকতে দেয়া হবে? না হলে এই লক্ষ লক্ষ বীরেরা করবেটা কী? শিক্ষা দেয়া ছাড়া আর কোনো বিদ্যে কি এদের আছে?

অপরাধ নেবেন না হুজুর। এসব প্রশ্ন করব কাকে? কল্কি অবতার তো আর প্রেস কনফারেন্স করেন না, তেনার এজলাসও নেই। অগত্যা আপনাকেই করলুম আর কি। তাছাড়া আমাদের সাধুসন্তরা বলেছেন, সবই মায়া। তাই ছোট মুখে বড় কথা বলে অপরাধ হয়ে থাকলে মায়া বলে মামলা ডিসমিস করে দেবেন, এই আশা রাখি।

বিনয়াবনত

হিন্দুরাষ্ট্রের এক হিন্দু নাগরিক

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল: পুরনো কাহিনি, নতুন দিগন্ত

ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ভুজঙ্গের ভেদ এতটাই কম যে অজিত তার মধ্যে অপরাধীসুলভ ধূর্ততা আছে বলে সন্দেহ করায় ব্যোমকেশ বলে ফেলে “পরিচয় না থাকলে বোধহয় আমাকেও সেরকমই ভাবতে।”

“পৃথিবী বদলে গেছে/তাতে কি নতুন লাগে?/তুমি আমি একই আছি/দুজনে যা ছিলাম আগে”। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি দর্শক আর গোয়েন্দা গল্প নিয়ে ছবি বা ওয়েব সিরিজের সম্পর্কটা অনেকটা উত্তমকুমার অভিনীত আনন্দ আশ্রম ছবির এই গানটার মত। দুনিয়া জুড়ে এই ধরনের ছবিতে (এবং সাহিত্যে) আমূল পরিবর্তন এসে গেছে। অথচ এখানে আজও ধুতি পাঞ্জাবি পরা কলঙ্কহীন ব্যোমকেশ, নিখুঁত দক্ষিণ কলকাতার ভদ্রলোক ফেলুদা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মহাজনদের পথে গমন করেই এখানে ওখানে একটু-আধটু রং বদলে সোনাদা, মিতিন মাসি, একেনবাবুরা চালিয়ে যাচ্ছেন। দর্শককুলের কারোর যে একেবারেই ক্লান্তি আসে না তা নয়, কিন্তু বহুবার দেখা জিনিসই ফের দেখে ‘আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না’ বলার লোকও নেহাত কম পড়ে না। ফলে প্রযোজক, পরিচালকরাও চালিয়ে যাচ্ছেন একই মাল প্যাকেট বদলে। হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ব্যোমকেশ সিরিজও প্রথম সাতটা সিজনে এই ছকের বাইরে বেরোতে পারেনি। নতুনত্ব হিসাবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেক্সটে যা যা আমদানি করা হয়েছে, তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রস ঘনীভূত হওয়ার বদলে পিরিয়ড পিসের দফারফা হয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হয়েছে – period in pieces। সেই কারণে অষ্টম সিজন নিয়ে প্রত্যাশার পারদ খুব উঁচুতে রাখিনি। আগ্রহ ছিল শুধু দুটো কারণে – ১) এই নিয়ে চতুর্থবার চিড়িয়াখানা উপন্যাসটাকে পর্দায় নিয়ে আসা হচ্ছে। গল্পটা যারপরনাই রহস্যময় এবং গল্পে নানা পরত আছে। তা সত্ত্বেও, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের হাতেও তেমন উৎকৃষ্ট ছবি হয়ে উঠতে পারেনি। এবার কী হবে? ২) মন্দার ওয়েব সিরিজের নির্দেশক অনির্বাণ ভট্টাচার্য এই সিজনে কেবল ব্যোমকেশের ভূমিকায় ক্যামেরার সামনে নেই, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসাবে ক্যামেরার পিছনেও তাঁর বড় ভূমিকা থাকছে। পারবেন কি নতুন কিছু দেখাতে?

নূতনের কেতন দিব্যি উড়েছে, তাতে কালবোশেখীর ঝড় উঠল কিনা দর্শককুলের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাবে। কিন্তু যাবতীয় একঘেয়েমি এবং স্টিরিওটাইপকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবল চেষ্টা যে করা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

শরদিন্দুর গল্পের নাম চিড়িয়াখানা, সত্যজিতের ছবির নামও চিড়িয়াখানা, অঞ্জন দত্তের ছবির নাম ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা। কিন্তু পরিচালক সুদীপ্ত রায় ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর অনির্বাণ একই গল্প অবলম্বনে ছবি করলেও নামে নিয়ে এসেছেন পিঁজরাপোল শব্দটা। শরদিন্দু স্বয়ং গল্পে এই শব্দ ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু শব্দটাকে স্বতন্ত্র গুরুত্ব দান করেছে এই সিরিজের অকুস্থল নির্মাণ। শরদিন্দু লিখেছেন খোলামেলা গোলাপ কলোনীর কথা, যার আয়ের উৎস ফুলের ব্যবসা। সত্যজিৎ, অঞ্জনও তেমনই দেখিয়েছিলেন। সুদীপ্ত-অনির্বাণ ঘটনাবলীকে এনে স্থাপন করেছেন এক চকমেলানো ইংরেজ আমলের বাড়িতে, যার নাম রোজি ম্যানশন। এখানকার ব্যবসা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের। রোজি মেমসাহেবের প্রতি প্রেম অক্ষয় করে রাখতে থমাস সাহেবের তৈরি এই প্রাসাদোপম বাড়ির ঘরে বারান্দায় লিফটে চার পর্বের এই সিজনের অধিকাংশ দৃশ্যের অবতারণা। ফলে সমাজের মূলধারায় মিশতে না পারা এ বাড়ির বাসিন্দারা সকলেই পিঞ্জরাবদ্ধ, হয়ত দর্শক নিজেও – এই ধারণা ক্রমশ চেপে ধরে। অবশ্য এহ বাহ্য। পরিবর্তন এই একটা নয়, সব পরিবর্তনের কথা লিখবও না। কারণ তাতে সাহেবদের ভাষায় ‘স্পয়লার’ দেওয়া হয়ে যাবে।

অজিত চরিত্রের অভিনেতা বদলেছে এই সিজনে, এসেছেন ভাস্বর চ্যাটার্জি। তিনি একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা অজিত – মিতভাষী, মিষ্টভাষী। তিনি শুধু ব্যোমকেশ নয়, সত্যবতীরও (ঋদ্ধিমা ঘোষ) ভরসাস্থল। টিনে মুড়ি ভরে রাখা, বাজার থেকে কাঁচকলা নিয়ে আসা, আটা মেখে দেওয়া – সবেতেই অজিত পারদর্শী। সাইডকিক কথাটার নিকটতম বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভবত লেজুড়। শার্লক হোমসের ওয়াটসন বা আর্কুল পয়রোর হেস্টিংসকে সাইডকিক বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলা ভাষায় সাইডকিকের একেবারে সমার্থক শব্দ যে পাওয়া যায় না, তার কারণ সম্ভবত বিখ্যাত বাঙালিরাও বন্ধুদের নিজের চেয়ে ছোট করে ভাবতেন না একসময়। শরদিন্দু তাই অজিতকে সাইডকিক হিসাবে আঁকেননি, সত্যজিৎও লালমোহন গাঙ্গুলিকে সাইডকিক হিসাবে নির্মাণ করেননি। আজকের পরিচালক এবং অভিনেতারা বোধহয় অন্য ধারণার মানুষ। তাই তাঁদের অজিত, লালমোহনরা ভাঁড় হয়ে ওঠেন। এই কুৎসিত প্রবণতা পরিহার করার জন্য সুদীপ্ত-অনির্বাণের প্রশংসা প্রাপ্য। ভাস্বরের মাধ্যমে তাঁরা এমন এক অজিতকে তৈরি করেছেন যে শরদিন্দুর অজিতের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। সে নেপাল গুপ্তের চ্যালেঞ্জ কবুল করে দাবা খেলতে বসে যায় এবং তাকে হারিয়েও দেয়।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে অবশ্য ব্যোমকেশ চরিত্রে। গত সাতটা সিজনের মত এই সিজনেও অভিনেতা সেই অনির্বাণই, কিন্তু এই সত্যান্বেষী একেবারে নতুন। শরদিন্দু যে লিখেছেন ব্যোমকেশ নিজেকে গোয়েন্দা বলতে পছন্দ করত না, তা সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা গল্পগুলোর প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা, নাকি গোয়েন্দা চরিত্রের যে বহুমাত্রিকতা বিশ্বসাহিত্যে এবং সিনেমা/ওয়েব সিরিজে আজকাল দেখা যায় সেদিকে যাওয়ার নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা প্রচেষ্টা – তা বলা দুষ্কর। কিন্তু সন্দেহ নেই, শরদিন্দু সে লক্ষ্যে খুব বেশিদূর এগোননি। ‘কী হইতে কী হইয়া গেল’ কাহিনির সর্বশক্তিমান গোয়েন্দা না করে শরদিন্দু ব্যোমকেশকে আটপৌরে করেছেন ঠিকই, কিন্তু ব্যোমকেশ নিঃসন্দেহে সর্বগুণান্বিত। সে পাঁচজনের একজন নয়, একেবারে পঞ্চম। সে তার প্রতিপক্ষদের চেয়ে তীক্ষ্ণ তো বটেই, বেশি শক্তিশালী এবং বেশি সৎও বটে। এ ধরনের সত্যান্বেষী এই ২০২৩ সালে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কারণ অমন মানুষ আজ দুনিয়ায় বিরল, যাত্রার বিবেকের মতই অলীক। এই ওয়েব সিরিজে অনির্বাণ যে ব্যোমকেশের ভূমিকায় অবতীর্ণ, সে কিন্তু অন্য লোক।

সত্যজিতের উত্তমকুমার, বাসু চ্যাটার্জির রজিত কাপুর, অঞ্জনের আবীর চ্যাটার্জি বা যীশু সেনগুপ্ত, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুশান্ত সিং রাজপুত – সকলেই ব্যোমকেশের মূল পোশাক হিসাবে ধুতি পাঞ্জাবিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনির্বাণকেও এর আগের সিজনগুলোতে মূলত সেই পোশাকেই দেখা গেছে। এখানে অজিত ধুতি পাঞ্জাবিতে থাকলেও ব্যোমকেশ বাড়িতে পাঞ্জাবি পাজামায়, বাইরে আগাগোড়া শার্ট প্যান্টে। এই বহিরঙ্গের আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শরদিন্দুর ব্যোমকেশের মত এই ব্যোমকেশ নিশানাথ সেন ৫০ টাকার জায়গায় ভুল করে ৬০ টাকা দিয়ে গেছেন দেখে ফেরত দেওয়ার কথা চিন্তাও করে না। দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে অজিতকে বলে, ভেবে নেওয়া যাক পরিশ্রমের দাম হিসাব করতে জজসাহেব ভুল করেছেন। উপরন্তু আগাগোড়া ব্যোমকেশ একজন পেটরোগা লোক। বারবার শৌচালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন তার তদন্তেও ব্যাঘাত ঘটায়। বরং অজিত শক্তপোক্ত। পানুগোপালের মৃত্যুর খবরে দেখা যায় রেগে গেলে ব্যোমকেশের মাথার ঠিক থাকে না। জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে দেয়, চিৎকার করে, অজিতকে ওই মৃত্যুর জন্য দায়ী করে। এই নিজের উপর শারীরিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণহীন গোয়েন্দা (আচ্ছা, সত্যান্বেষীই হল) বাংলা ছবি, সিনেমায় প্রায় অপরিচিত। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি শবর সিরিজের শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে তবু কিছুটা মানবিক দোষ, মানসিক অসুখ – এসব দেখা যায়। কিন্তু সে পেশায় পুলিস অফিসার। পদমর্যাদা তার রক্ষাকবচের কাজ করে, এই ব্যোমকেশের তেমন কোনো রক্ষাকবচ নেই। উল্টে রহস্যের শেষ জটটা ছাড়াতে তাকে হাফপ্যান্ট পরা হাবিলদারের ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়।

অভিনয়ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এই নতুন ব্যোমকেশকে জীবন্ত করে তুলেছেন অনির্বাণ। প্রতীক দত্তের চিত্রনাট্য এবং সংলাপের গুণে আরও যা হয়েছে তা হল স্বাধীনতার সামান্য পরের যুগের এমন এক চিন্তাশীল যুবকের নির্মাণ, যার চিন্তাভাবনা এই ২০২৩ সালেও অনুরণন তোলে। হইচইয়ের এই সিরিজে অতীতে ব্যোমকেশকে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন আওড়াতে দেখা গেছে। কিন্তু তা নেহাতই প্রক্ষিপ্ত মনে হয়েছে। একে তো যে সময়কাল তুলে ধরা হয়েছে তখন জীবনানন্দ মোটেই যুবকদের মুখে মুখে ফিরতেন না, উপরন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে লাগসই না হলে কোনো দৃশ্যে অমন শক্তিশালী কবির পংক্তি স্রেফ জ্ঞান ফলানোর প্রচেষ্টা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এই সিজনে ব্যোমকেশ জীবনানন্দ আওড়ায় না, অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে পড়ে থাকা গাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখে তার প্রতিক্রিয়ায় সংবেদনশীল দর্শকের কেবল জীবনানন্দ নয়, টি এস এলিয়টও মনে পড়তে পারে। তবে এমন ব্যোমকেশ নিজের ডায়রিতে ‘বনলক্ষ্মী’ না লিখে ‘বনলক্ষী’ লিখলে মর্মাহত হতে হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-পূর্ব দাঙ্গা দেখে মনুষ্যত্ব সম্পর্কে আশাহীনতা ও বিষাদ এখানে কেবল ব্যোমকেশ নয়, নিশানাথেরও অভিজ্ঞান। তা অবশ্য শরদিন্দুর কলমেও এসেছিল, কিন্তু এই নিশানাথ (বাবু দত্তরায়) আরও বেশি কটু। তাঁর বয়স যত বাড়ছে তত জীবের চেয়ে জড়ের উপরেই নাকি টান বেড়ে চলেছে। এমনকি অজিতও তার গল্পে বড় বেশি নৃশংসতা এনে ফেলছে বলে সত্যবতী অভিযোগ করে। পিরিয়ড পিস মানে যে কেবল জামাকাপড়ের সাবেকিয়ানা আর সেপিয়া টোনের ছবি নয়, ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এখানে চরিত্রগুলো, দৃশ্যাবলী এবং শব্দ – সব মিলেই সময়কে ধারণ করেছে। রেডিওতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠ পর্যন্ত এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর নিয়ে। এসেছেন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। এ জন্যে সঙ্গীত ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত শুভদীপ গুহ প্রশংসার্হ। আবহে স্রেফ লাইন দুয়েক রবীন্দ্রনাথের গান দৃশ্যকে কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে, হিন্দি ছবির গান বাজানো বাংলা মেগাসিরিয়ালের যুগে দাঁড়িয়ে এই ওয়েব সিরিজ তাও দেখিয়ে দিল। সেতারের কথা আর না-ই বা বললাম।

শরদিন্দুর ডায়রি অনুযায়ী, চিড়িয়াখানা লেখা শেষ হয় ২০ জুলাই ১৯৫৩। এই সিজন শেষ হয়েছে ১৯৫২ সালের নির্বাচনে (তথ্যটা বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকার বাহুল্য না দেখালেই ভাল হত) ব্যোমকেশ, অজিত ও সত্যবতীর ভোটদান করে বেরিয়ে আসার দৃশ্য দিয়ে। যে নিশানাথ জাঁক করে বলেছিলেন “I deserve democracy, they don’t”, অর্থাৎ পিঁজরাপোলের অন্যরা গণতন্ত্রের যোগ্য নয়, সেই নিশানাথের ভোট দেওয়া হয়নি। ব্যোমকেশ তাঁর কথাকে ব্যঙ্গ করে স্ত্রী এবং বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে, ও কথার মানে কী? গণতন্ত্র সকলের জন্য না হলে যে কারোর জন্যই টেকে না, তা তিনি জীবন দিয়ে বুঝেছেন, এখন আমরা বুঝছি। নিশানাথকে শরদিন্দুর অজিত ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেনি, দময়ন্তীকেও নয়। তার মতে “… এ জগতে কর্মফলের হাত এড়ানো যায় না, বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না। নিশানাথ কঠিন মূল্য দিয়াছেন, দময়ন্তীও লজ্জা ভয় ও শোকের মাশুল দিয়া জীবনের ঋণ পরিশোধ করিতেছেন।” শরদিন্দুর এই সামাজিক রক্ষণশীলতাকে অতিক্রম করে গেছেন চিত্রনাট্যকার প্রতীক। এখানে ব্যোমকেশ নিশানাথের প্রতি সহানুভূতিহীন কারণ তিনি বিচারক হয়ে, অন্যের অসহায়তার সুযোগ নিয়েও নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচু ভাবতেন, অগণতান্ত্রিক ছিলেন। কিন্তু দময়ন্তীকে সমান দোষী ভাবা হয়নি, লাল সিংয়ের মৃত্যু সংবাদ জানার পর তাকে (মৈত্রী ব্যানার্জি) বৈধব্য পালন করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ তার অন্তরের পবিত্রতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। এতসব করা গেছে অতিনাটকীয় সংলাপ বা কান্নাকাটি ছাড়াই, স্রেফ কয়েকটা শটে। চিত্রনাট্যকারের এ প্রশংসনীয় সাফল্য।

আরও পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

তবে চিত্রনাট্যকার, নির্দেশক আর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের সবচেয়ে বড় সাফল্য বোধহয় শরদিন্দুর থেকে এতখানি সরে এসেও তাঁর সমস্ত ব্যোমকেশ কাহিনিতে উপস্থিত সেই উপাদানকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা – যা এই চিড়িয়াখানা গল্পে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও এর আগেকার চলচ্চিত্রকাররা হয় ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, অথবা সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে গেছেন। উপাদানটা হল যৌনতা। ব্যোমকেশের প্রায় সব গল্পেই আদিম রিপু কোনো না কোনো ভূমিকায় থাকে। প্রচ্ছন্ন অথচ তীব্র – এই হল শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনির যৌনতার বিশেষত্ব। এখানে পানুগোপাল চরিত্রে বুদ্ধদেব দাস, নজর বিবির চরিত্রে দীপান্বিতা সরকার, সর্বোপরি বনলক্ষ্মীর চরিত্রে অনুষ্কা চক্রবর্তী সে জিনিস জীবন্ত করে তুলেছেন। প্রথম দুজন তো প্রায় বিনা সংলাপে। তিনজনকেই যোগ্য সঙ্গত করেছে অয়ন শীলের ক্যামেরা। এমনকি সত্যবতীর চরিত্রে ক্রমশ উন্নতি করতে থাকা ঋদ্ধিমাও নীরবে যৌন ব্যাকুলতা ফুটিয়ে তোলেন আলো নেভানোর মন্থরতায়, পাশের খালি বালিশে হাত রাখায়। অকৃতদার অজিতের স্বপ্নে বনলক্ষ্মীর মুখ বদলে সত্যবতী হয়ে যাওয়াও অতুলনীয়।

তবে এতকিছুর সবই মাটি হতে পারত ভুজঙ্গ ডাক্তারের চরিত্রে দুর্বার শর্মা অমন দুর্দান্ত অভিনয় করতে না পারলে। ব্যোমকেশের প্রতিস্পর্ধী খলনায়ক রচনা করতে শরদিন্দু ভালবাসতেন। ‘সত্যান্বেষী’ গল্পের অনুকূল ডাক্তার থেকেই ম্যাড়মেড়ে খলনায়ক তাঁর অপছন্দ, ব্যোমকেশকে তার স্রষ্টা বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী জয় করতে দেননি। এখানেও শেষ সকালের আগে পর্যন্ত ভুজঙ্গ ব্যোমকেশের চেয়ে বেশি তৎপর, বেশি স্থিতধী, বেশি আত্মবিশ্বাসী। দুর্বার প্রত্যেকটা সংলাপ বলেন ভেবেচিন্তে, একটা তিরও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আবার ডাক্তারি করার সময়ে তাঁর মধ্যে সংবেদনশীলতার কোনো অভাব দেখা যায় না। ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ভুজঙ্গের ভেদ এতটাই কম যে অজিত তার মধ্যে অপরাধীসুলভ ধূর্ততা আছে বলে সন্দেহ করায় ব্যোমকেশ বলে ফেলে “পরিচয় না থাকলে বোধহয় আমাকেও সেরকমই ভাবতে।” দুর্বার যে দৃশ্যে ব্যোমকেশকে তার পেশা নিয়ে দুকথা শোনান, সেখানে তাঁর অভিনয় তলোয়ারের মত ঝলসে ওঠে। এই না হলে খলনায়ক! তাই বোধহয় শেষমেশ ব্যোমকেশেরও ভুজঙ্গকে একটা সুযোগ দিতে ইচ্ছা হয়। গল্পের ব্যোমকেশ কিন্তু ইচ্ছা করে সুযোগ দেয়নি। সে টেরই পায়নি ভুজঙ্গর মতলব।

এখানে ব্যোমকেশ সুযোগ তো দিল, তারপর কী হল? সেটা দেখে নেবেন। আমার দেখার আগ্রহ রইল, রহস্য গল্প নিয়ে তৈরি ছবি দেখার অভ্যাস বদলে দেওয়ার এত চেষ্টা সফল হয় কিনা।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

হিংসার রাজনীতির মোকাবিলায় বামপন্থীরা কোথায়?

ওরা আসে গেরুয়া ঝান্ডা নিয়ে, কমিউনিস্টরা লাল ঝান্ডা নিয়ে নামতে পারে। তাতে দুটো জিনিস হবে। এক, দাঙ্গাবাজরা একটু হলেও ভয় পাবে। জানবে, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকলেও দাঙ্গা আটকানোর লোক আছে। আর দুই, সাধারণ মানুষ দেখবেন কারা দাঙ্গা আটকাতে নেমেছে।

রামের নাম করে গত কয়েকদিন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যে রাবণসুলভ আচরণ চলেছে, খবর পেলাম, তার জেরে আমার দুই খুদে আত্মীয়ার স্কুলের পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। এতদ্বারা সময় জানান দিল যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আমরা কোনও উন্নততর ভারতবর্ষ তৈরি করতে পারিনি। কারণ, তিন দশক আগে একইভাবে আমার স্কুলের পরীক্ষাও পিছিয়ে গিয়েছিল। বস্তুত, আমার সময় এর চেয়ে ভালই ছিল বলতে হবে। কারণ, রিষড়া এলাকায় তখন যে অশান্তি দেখা দিয়েছিল তার কারণটা ছিল বিরাট— বাবরি মসজিদ ধ্বংস। সেই ঘটনা ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসকেই বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত, বদলে দিয়েছিলও। কিন্তু আজকের কচিকাঁচাদের পরীক্ষা বাতিল হল এক স্থানীয় গোলমালে, রামনবমী মিটে যাওয়ার পরেও মিছিল বার করে হিংসা ছড়ানোর প্রচেষ্টায়। অর্থাৎ এ রাজ্যে গত শতকের নয়ের দশকে যে অশান্তি সৃষ্টি করতে হলে জাতীয় স্তরে কোনও ঐতিহাসিক কাণ্ড ঘটাতে হত, এখন স্থানীয় স্তরে খানিকটা গুণ্ডামি করেই তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করা সম্ভব হচ্ছে।

প্রশ্ন হল, কেন সম্ভব হচ্ছে? কী বদলেছে গত ৩০ বছরে? হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক শক্তি বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে, তারা লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, সংসদকে নিজেদের বৈঠকখানায় পরিণত করেছে, প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে স্বয়ংসেবকদের বসিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি বিজেপির সদস্য, বিধায়ক এবং মন্ত্রী ছিলেন। উপরাষ্ট্রপতিরও আরএসএসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ইতিহাস রয়েছে। তা ছাড়া ভারতের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই যে নানা কৌশলে তাদের দখলে চলে গেছে— যেগুলো যায়নি সেগুলোকে দখলে আনার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে— তা বুঝতে এখন আর কারও বাকি নেই। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। আসল কথা হল, হিন্দুত্ববাদীরা দখল করতে পেরেছে মানুষের মস্তিষ্ক।

বাঙালি হিন্দুরা শ-দুয়েক বছর ধরেই মনে করে তারা দেশের আর সকলের চেয়ে প্রগতিশীল। ইতিহাসে অবশ্য এর কোনও নৈর্ব্যক্তিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। বাংলায় চিরকালই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন, রাধাকান্ত দেবও ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন। দুর্গাপুজো এসে পড়লেই বাঙালি হিন্দুরা ফেসবুকে লিখতে শুরু করে “পুজো যার যার, উৎসব সবার।” কিন্তু ঈদ-উল-ফিতর আর ঈদুজ্জোহার তফাত জানার সাধ নেই। বড়দিনে কেক খেতে না-পারলে ভাত হজম হয় না, পার্ক স্ট্রিটে সপরিবারে নেত্য করতে যেতে হয়। কিন্তু ঈদে কেউ বিরিয়ানি বা হালিম খাচ্ছে দেখলে ফ্যাক করে হেসে ফেলে “এ মা! তুই কি মুসলমান” বলে। জিভে জল আনা খাবারের সম্ভার থাকলেও জাকারিয়া স্ট্রিটে ঈদের মরসুমে এত ভিড় হয় না, যে টিভি চ্যানেলের রিপোর্টাররা মাথায় ফেজ পরে (বড়দিনের সময়ে যেমন স্যান্টা টুপি পরেন আর কি) ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন “কেমন লাগছে”। সংঘ বাঙালির এই বিভাজনরেখাটাই কাজে লাগিয়েছে। তাই এত স্থানীয় দাঙ্গা করা সম্ভব হচ্ছে।

এ দেশে যাঁরা হিন্দুত্ব রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘকাল চর্চা করছেন তাঁরা অনেকে মনে করেন, ২০০২ সালের গুজরাতের মতো রাজ্যব্যাপী দাঙ্গার পরিকল্পনা আরএসএস ত্যাগ করেছে। কারণ শিবপুর, ডালখোলা, রিষড়ার মতো এলাকায় ছোট-ছোট দাঙ্গা করতে পারলে লাভ অনেক দীর্ঘমেয়াদি। দাঙ্গার আগুন ঘরের কাছে চলে এলে মানুষ বেশি ভয় পায়। ফলে “হিন্দু খতরে মে হ্যায়”— এ কথা মনের গভীরে প্রোথিত করা সহজ হয়। যেমন রিষড়ায় দাঙ্গা হলে ঘটনার ল্যাজা-মুড়ো না-জেনেও শ্রীরামপুর, কোন্নগর, হিন্দমোটর, উত্তরপাড়ার সংখ্যাগুরু হিন্দুরা ভাবতে শুরু করেন, তাঁরা খুব বিপদের মধ্যে আছেন। এইসব এলাকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যেও নিরাপত্তার অভাববোধ বাড়তে থাকে। উভয় পক্ষই ভুলে যান, কয়েক প্রজন্ম ধরে গলাগলি না-হোক, অন্তত পাশাপাশি বাস করছেন তাঁরা। বহু রামনবমী, বহু মহরম গিয়েছে। শীত বসন্ত এসেছে চক্রাকারে, অথচ কারওই কোনও খতরা হয়নি। অর্থাৎ এইসব ছোট-ছোট অল্প তীব্রতার দাঙ্গা লাগানোর উদ্দেশ্য “আমাদেরি আন্তরিকতাতে / আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা/ খুঁজে আনা।”

সে কাজে সাহায্য করে নিষ্ক্রিয় প্রশাসন। অন্তর্যামী মুখ্যমন্ত্রী সাতদিন আগে থেকে একের পর এক প্রকাশ্য সভায় বলে যাচ্ছেন “ওরা রামনবমীতে ঝামেলা করবে”, অথচ তাঁরই অধীন পুলিস সে দাঙ্গা আটকাতে পারে না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী কখনও বলেন বিনা অনুমতিতে মিছিল বার করা হয়েছে, কখনও বলেন ওরা মিছিলের রুট বদলে ফেলেছে। যে মিছিলের অনুমতি ছিল না সে মিছিল পুলিস চলতে দিল কেন— দিদিকে এ প্রশ্ন করতে বিখ্যাত সাংবাদিক ভাইটি ভুলে যান। সর্বত্রই যাঁরা স্থানীয় মানুষ, সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে প্রদীপ জ্বালাবার আগে সলতে পাকাবার গল্পও শোনা যাচ্ছে এবং সে গল্পে হিন্দুত্ব ব্রিগেড খলনায়কের ভূমিকায় থাকলেও রাজ্যের শাসক দল নেহাত যাত্রার বিবেকের ভূমিকায় নেই। আশার কথা এটুকুই যে, রিষড়ায় ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা অশান্তির আগুন নিভে যাওয়ার আগেই কোন্নগর স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম— যা আশঙ্কা করেছিলাম কথাবার্তা সে পথে এগোল না। আগের দিন রাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে রিষড়ার গণ্ডগোলে ট্রেনে আটকে ছিলেন রাত দেড়টা-দুটো অবধি, এমন কয়েকজন আমার আর এক সাংবাদিক বন্ধুর আলোচনায় এসে যোগ দিলেন। আশঙ্কা করছিলাম দু-চার কথার পরেই কিছু অন্য ধর্মের মানুষকে দায়ী করে কিছু মন্তব্য ছুটে আসবে। তা কিন্তু হল না। যাঁরা কথা বলছিলেন তাঁরা পরস্পরের পরিচিত নন, নামধামও জানতে চাননি, ফলে ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু সকলেই দেখলাম দায়ী করলেন দুটো রাজনৈতিক দলকে, কোনও সম্প্রদায়কে নয়।

যদিও তারপর যে কথা উঠে এল তাতে অস্বস্তি বাড়ল বই কমল না। একজন বললেন “আজকাল তো আমাদের এখানে যা যা হচ্ছে সবই বিশেষ এক ধরনের লোকের জন্যে হচ্ছে। কী ধরনের লোক সেটা আর বলছি না, আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন। বিজেপি তো সারাক্ষণ হিন্দু হিন্দু করে। আমরাও তো হিন্দু, আমাদের রোজগারের কিছু সুবিধা হচ্ছে? বাঙালি হিন্দু তো কোনওমতে খেয়েপরে বাঁচছে। লালে লাল হচ্ছে কারা? তারাই তো দাঙ্গা করছে।” রিষড়ায় বরাবরই এক বড় অংশের মানুষ হিন্দিভাষী, হিন্দমোটরেও। বিশেষত যখন বিড়লাদের গাড়ি তৈরির কারখানা চালু ছিল। কিন্তু ইদানীংকালে কোন্নগর, শ্রীরামপুর ইত্যাদি এলাকাতেও দ্রুত হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সেই প্রেক্ষিতে এই ভদ্রলোকের কথা অশনি সঙ্কেত।

প্রথমত, এ কথায় অন্যের ঘাড়ে নিজের দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চিরাচরিত বাঙালি প্রবণতা প্রকট। যেদিন উনি ও কথা বললেন, সেদিনই বিহারের মুঙ্গের থেকে পুলিস গ্রেফতার করে আনল হাওড়ার সালকিয়ার ভেতো বাঙালি সুমিত সাউকে, যাকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইটে বন্দুক হাতে দেখা গিয়েছিল, যার মা সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় বলেছেন সে আগে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে কাজ করত। সুতরাং অবাঙালিরা দাঙ্গা করছে, বাঙালিরা শান্তিপ্রিয় জাত— এ কথায় সত্য ততটা নেই, যতটা আছে পরজাতিবিদ্বেষ।

দ্বিতীয়ত, বোঝাই যাচ্ছে এ তল্লাটে বাঙালি বনাম অবাঙালি সংঘাতের পটভূমি তৈরি হচ্ছে। যেভাবে ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দুকে বিশ্বাস করানো হয়েছে ২০-২২ শতাংশ মুসলমান তাদের জন্য বিপদ, প্রায় সেভাবেই হুগলি জেলার শহর-মফস্বলের সংখ্যাগুরু বাঙালি ক্রমশ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, তারা হিন্দিভাষীদের কারণে কোণঠাসা হচ্ছে। বিশেষত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের বিশ্রম্ভালাপে আজকাল অন্যতম জনপ্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কীভাবে “ওরা চারিদিকে ছেয়ে যাচ্ছে”। এর পিছনে স্থানীয় হিন্দিভাষীদের ব্যবহার যে একেবারেই দায়ী নয় তা-ও বলা যাবে না। শুধু এখানে কেন, পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গাতেই এমন অনেক আবাসন গড়ে উঠছে যেখানকার সংখ্যাগুরু হিন্দিভাষী ফ্ল্যাটমালিকরা নিয়ম করে দিচ্ছেন, আমিষাশী হলে তাকে ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া যাবে না। বাজারঘাটে বিক্রেতা বা অন্য লোকেদের হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য করা, না-বললে বাংলা না-বোঝার ভান করার মতো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। এ রাজ্যের বামপন্থীরা তো অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়া সব সমস্যাকেই মনে করেন নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাই যেমন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থামানোর কাজে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না, তেমন এইসব ক্রমবর্ধমান সামাজিক দ্বন্দ্বের নিরসনেও তাঁদের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঢুকে পড়ছে বাংলাপক্ষের মতো দক্ষিণপন্থী সংগঠন। এখন যেমন হিন্দু-মুসলমানে লাঠালাঠি লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টায় রয়েছে তৃণমূল, বিজেপি; আগামীদিনে নগরায়নে ভোল বদলে ফেলা এলাকাগুলোতে তেমনই বাঙালি বনাম অবাঙালি বাইনারি সৃষ্টি করে একই খেলা চলতে থাকবে বলে আশঙ্কা হয়। গত বিধানসভা নির্বাচনেই তার লক্ষণ দেখা গেছে। তৃণমূল বিজেপির হিন্দুত্বকে যতখানি আক্রমণ করেছিল তার চেয়ে বেশি করে বলেছিল বিজেপি বহিরাগতদের পার্টি। ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ স্লোগানেও প্রচ্ছন্ন ছিল এই ইঙ্গিত। এদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ছটপুজোয় সরকারি ছুটি দেয়, হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। পাশাপাশি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোকে লাটে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

কোনও না-কোনও কাল্পনিক বাইনারি তৈরি করে আমাদের নিয়ে শাটল ককের মতো খেলে চলেছে দুটো রাজনৈতিক শক্তি। এ জিনিস আটকাতে দরকার এমন এক তৃতীয় পক্ষ, যারা স্রেফ কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের কর্মসূচি এবং দুর্নীতিকে নয়, আক্রমণ করে আদর্শকে। অথচ এ রাজ্যের বামপন্থীরা কিছুতেই সিবিআই, ইডি, ডিএ, নিয়োগ দুর্নীতির বাইরে কোনওকিছু নিয়ে আক্রমণাত্মক হতে রাজি নন। দাঙ্গা কেন হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েই তাঁরা ক্ষান্ত। এমন নয় যে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কিন্তু সেখানেই তাঁদের কাজ শেষ হয় কী করে? কার্ল মার্কস তো বলেছিলেন, দার্শনিকরা পৃথিবীটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কাজ হল পৃথিবীটাকে বদলানো। কমরেডরা সে কথা ভুলে গেলেন নাকি? এ রাজ্যে যে বামপন্থী দলগুলোর উপস্থিতি আছে তাদের সদস্য-সমর্থকদের কথা শুনলে দুঃখে হাসি পায়।

সিপিএমের লোকেরা বারবার শুনিয়ে যান সরকারে থাকার সময়ে তাঁদের দল কীভাবে দাঙ্গা আটকাত আর তৃণমূল সরকার তার সাপেক্ষে কতখানি ব্যর্থ। মার্কসবাদে দেবতা নেই জানি, অপদেবতা আছে কিনা জানি না। এঁদের কথা শুনলে মনে হয় আশা করে আছেন জ্যোতি বসুর ভূত এসে দাঙ্গাবাজদের ঘাড় মটকে দিয়ে যাবে, এঁদের স্বহস্তে কিছু করার প্রয়োজন নেই। তাঁরা কী করছেন, এ প্রশ্ন তুললে আবার কেউ কেউ খাঁটি আমলাতান্ত্রিক ঢঙে বলেন “দাঙ্গা আটকানো সরকারের দায়িত্ব।” কেউ বা বলেন “পুলিশ মিছিল করার অনুমতি দিচ্ছে না। কী করব?” জ্যোতি বসু, মহম্মদ ইসমাইল, বিনয় চৌধুরীরা এত লক্ষ্মী ছেলে হলে সিপিএম কোনওদিন ক্ষমতায় আসত বলে মনে হয় না। এঁরাও সে আমলে কীভাবে দাঙ্গা আটকানো হত, তা নিয়ে জাঁক করার সুযোগ পেতেন না।

অন্যদিকে লিবারেশনের নেতা-কর্মীরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দাঙ্গার দায় যেন সবটাই বিজেপির ঘাড়ে চাপে। তৃণমূল সরকারের গায়ে ছিটেফোঁটা কাদা লাগলেও ফ্যাসিবিরোধী লড়াই দুর্বল হয়ে যাবে। অথচ তাঁদেরই পার্টির উত্তরপাড়া আঞ্চলিক কমিটির প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট রিষড়ার ঘটনা সম্পর্কে বলছে “যেখানে গত বছর মসজিদের সামনে দিয়ে মিছিল যাওয়ার সময়ে রীতিমতো রাস্তার ধারে ব্যারিকেড করে মিছিল পার করা হয়েছিল সেখানে এ-বছর তেমন কিছু ছিল না এবং অল্পসংখ্যক কয়েকজন পুলিশকর্মী মসজিদের সামনে মোতায়েন ছিলেন, যাদের অধিকাংশই গণ্ডগোলের সময়ে রীতিমত আহত হন।”

আরও বামদিকে যেসব দল আছে, যাদের কোনও নির্বাচনী স্বার্থ নেই, তারা ঠিক কী করছে জানি না। এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে কিন্তু তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। স্বীকার্য যে, তারপর থেকে তাদের উপরে রাষ্ট্রীয় আক্রমণ (রাজ্য সরকারের দিক থেকেও) বেড়েছে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জায়গায়, বিশেষত রিষড়া বা শিবপুরের মতো নগরায়িত এলাকায় তাদের ক্ষমতাও নগণ্য।

ভারতের কমিউনিস্টদের দাঙ্গার সময়ে রাস্তায় নেমে দাঙ্গা আটকানোর ইতিহাস আছে বলেই তাঁদের কাছে আশা করা। ক্ষমতাসর্বস্ব তৃণমূল আর পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চল থেকে উধাও কংগ্রেসের কাছে আশা করতে যাবে কোন আহাম্মক?

আরও পড়ুন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হলে ক্ষতি নেই বিজেপির

এসব নিয়ে এক মার্কসবাদী দলের কর্মী বন্ধুর কাছে দুঃখ করছিলাম। সে যা বলল সেটাই বোধহয় সার কথা। তার বক্তব্য, সংসদীয় এবং সংসদ-বহির্ভূত— সব ধরনের কমিউনিস্ট মিলিয়ে বিজেপি শাসনের আট বছরে হাজার খানেক সেমিনার ও সভা করে ফেলেছে, যার বিষয় ভারতে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং তাকে আটকানোর উপায়সমূহ। তারপরেও শিবপুর, ডালখোলা বা রিষড়া ঘটেই চলেছে। ঘটে যাওয়ার পর কমিউনিস্টরা কিছু শান্তি মিছিল, মিটিং, পোস্টারিং ইত্যাদি করছে। কিন্তু দাঙ্গা আটকাতে পারছে না। এর কারণ হল, হিন্দুত্ববাদীরা এবং তাদের স্যাঙাত দলগুলো দাঙ্গা লাগানোকে একটা রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে দেখে। তার জন্যে রীতিমত পরিকল্পনা করে, সেই পরিকল্পনাই রাস্তায় নেমে প্রয়োগ করে। কিন্তু কমিউনিস্টরা দাঙ্গা আটকানোকে প্রকল্প হিসেবে দেখছে না কিছুতেই। দাঙ্গাবাজদের বিরাট দল থাকতে পারে, কমিউনিস্টদের তো অন্তত ছোটখাটো দল আছে নানা জায়গাতেই। সেই কটা লোককে একত্র করেও তো পাল্টা রাস্তায় নামা যায়। ওরা আসে গেরুয়া ঝান্ডা নিয়ে, কমিউনিস্টরা লাল ঝান্ডা নিয়ে নামতে পারে। তাতে দুটো জিনিস হবে। এক, দাঙ্গাবাজরা একটু হলেও ভয় পাবে। জানবে, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকলেও দাঙ্গা আটকানোর লোক আছে। আর দুই, সাধারণ মানুষ দেখবেন কারা দাঙ্গা আটকাতে নেমেছে। ফলে বাইনারি যদি তৈরি হয়ও, তা ভেঙে যাবে।

নিশ্চয়ই আমার বন্ধুটি একমাত্র লোক নয় যে এভাবে ভাবছে। কিন্তু এরকম ভাবনার লোকেরা সম্ভবত সব দলেই সংখ্যালঘু। ফলে দোকানপাট পুড়লে, মাথা ফাটলে, হাত-পা ভাঙলে, পরীক্ষা পেছোলে আমরা এই ভেবে সান্ত্বনা পাব যে, কেউ মারা যায়নি, কেউ ধর্ষিত হয়নি। রামনবমীর পর হনুমান জয়ন্তী নিয়ে তটস্থ হয়ে থাকব। সেটা মিটলে ক্যালেন্ডারে খুঁজব, আবার কবে কোন পুজো আছে। সেদিন বাড়ি থেকে না-বেরোলে চলে কিনা।

সত্যিই, কী চমৎকার ভারতবর্ষ সাজিয়েছি ছোটদের জন্যে!

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

বিশ্বকাপে কী হবে ভুলে যান, আইপিএল দেখুন

রবীশ কুমার মোদীর দোষ দেখতে পায় না এমন মিডিয়ার নাম দিয়েছেন গোদি মিডিয়া, অর্থাৎ মোদীর কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়া। জানি না ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়ার কী নাম হওয়া উচিত।

‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কথাটা কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ভারতীয় অর্থনীতির আলোচনায় খুব ব্যবহার করা হত। কোনো বাঙালি অর্থনীতিবিদ এর বাংলা করেছেন কিনা জানি না। তবে এর মোটামুটি মানে হল, জনসংখ্যার এক বড় অংশ বয়সে নবীন হওয়ার সুবিধা। এখন আমাদের যতই ভাঁড়ে মা ভবানী হোক, নরেন্দ্র মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন সকলেই বলতেন ভারতীয়দের একটা বড় অংশ যেহেতু এখন কর্মক্ষম অবস্থায় আছেন সেহেতু এদের কর্মসংস্থান জুগিয়ে দিলেই দেশ ফুলে ফলে ভরে উঠবে। তা সে ডিভিডেন্ড গত ৮-১০ বছরে কতটা পাওয়া গেল তা নিয়ে এখন বিস্তর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নতুন চাকরি হওয়ার বদলে আমাদের দেশে বেকারত্ব ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে একথা ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমমন্ত্রকই বলেছিল। ছোট ব্যবসার অবস্থা কী তা পাড়ার দোকানে কথা বললেই টের পাওয়া যায়। ভারতীয় ক্রিকেট দলের অবস্থাও কেমন যেন আমাদের অর্থনীতির মতই হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তরুণ প্রতিভার অভাব নেই একথা আমরা সেই মহেন্দ্র সিং ধোনির আমল থেকে শুনে আসছি। যেটুকু সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাতে সেই প্রতিভারা যে নেহাত খারাপ ফল দিয়েছে তা-ও নয়, অথচ ঘুরে ফিরে একই মুখ খেলে চলেছে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে এবং একের পর এক বিশ্বকাপে ডোবানোর পর এখন দ্বিপাক্ষিক সিরিজেও ডোবাচ্ছে।

অর্থনীতির ফাঁক ঢাকতে জিডিপির মানদণ্ডই বদলে দেওয়া হয়েছিল প্রয়াত অরুণ জেটলি অর্থমন্ত্রী থাকার সময়ে। অনেক বিরোধী দল এবং অর্থনীতিবিদ সেই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এমন এক চমৎকার বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে সফল হয়েছে টাকার জোরে, যেখানে কোনো সমালোচক নেই। উল্টে যাদের সমালোচক হওয়ার কথা, সেই সংবাদমাধ্যম এবং প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বোর্ডকে সাফল্যের মানদণ্ডগুলো বদলে ফেলতে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে আর কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট জেতেনি ভারত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেমিফাইনালও পেরোতে পারেনি (২০১৪ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ২০২১ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল ব্যতিক্রম। শেষেরটায় অবশ্য সেমিফাইনাল বলে কিছু ছিল না)। ২০২১ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে তো সেমিফাইনালেরও আগে ঘরে ফেরার বিমান ধরতে হয়েছিল। অথচ কাগজে, টিভিতে, খেলা চলাকালীন ধারাভাষ্যে সারাক্ষণ প্রচার করা হয় আমাদের দল বিশ্বসেরা। সেখানেই থেমে না থেকে বলা হয় এই দল ভারতের সর্বকালের সেরা। কেন? না আমরা প্রচুর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতি। প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট থাকার কারণে গত এক দশকে দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোর গুরুত্ব যে প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে, সেকথা কেউ লেখেন না বা বলেন না। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চালু হওয়ার পরে পাঁচদিনের ক্রিকেটেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজের গুরুত্ব তো আসলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠা গেল কিনা, খেতাব জেতা গেল কিনা – তাতে। এসব বলা হয় না।

এ-ও বলা হয় না, যে সাদা বলের ক্রিকেটে ভারত আসলে গত শতাব্দীর ক্রিকেট খেলে চলেছে ২০১১ বিশ্বকাপের পর থেকেই। রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান, পরে রোহিত আর কে এল রাহুল যেভাবে ইনিংস শুরু করতেন সেভাবে একদিনের ক্রিকেট খেলা হত প্রাক-জয়সূর্য-কালুভিথর্না যুগে। ২০১১ বিশ্বকাপে শচীন তেন্ডুলকর আর বীরেন্দ্র সেওয়াগ যেভাবে ভারতের ইনিংস শুরু করতেন সেটা মনে থাকলেও কথাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাঁদের অবসরের পরে তো একদিনের ক্রিকেটটা আরও বদলেছে। দু প্রান্ত থেকে দুটো বল দিয়ে খেলা শুরু হয়েছে। ফলে স্পিনারদের প্রভাব কমেছে, রিভার্স সুইং প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ বল পুরনো না হলে ও দুটো হওয়া শক্ত। সঙ্গে আছে পাওয়ার প্লে, অর্থাৎ সারাক্ষণ বোলাররা নানারকম বিধিনিষেধের মধ্যে বল করছেন। ফলে রান করার কাজটা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে। সেই কারণে ইনিংসের শুরুতে আরও বেশি রান করার রাস্তা নিয়েছে ইংল্যান্ডের মত দল, যারা সব ধরনের ক্রিকেটে গত এক-দেড় দশকে আইসিসি টুর্নামেন্টগুলোতে সবচেয়ে বেশি সফল। অন্যদিকে মন্থরভাবে শুরু করব, উইকেট হাতে রেখে পরে মারব – এই নীতি অবলম্বন করে আমাদের বিরাট কোহলি আর রোহিত শর্মা ঝুড়ি ঝুড়ি শতরান আর দ্বিশতরান করেছেন দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোতে। গড় দেখলে চোখ কপালে উঠে যাবে, কিন্তু আসল জায়গায় চাপের ম্যাচে বারবার ব্যর্থ এবং দলও হেরেছে। রোহিত তবু ২০১৯ বিশ্বকাপে অসাধারণ ধারাবাহিকতা দেখিয়েছিলেন (৯ ম্যাচে ৬৪৮ রান, গড় ৮১; শতরান ৫), বিরাট তো বিশ্বকাপে অন্য মানুষ হয়ে যান। তিনটে বিশ্বকাপ খেলে এখন অবধি মোটে দুটো শতরান। তার কোনোটাই নক আউট ম্যাচে নয়, একটা আবার ২০১১ সালে দুর্বল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। কেরিয়ারে গড় ৫৭.৩২, অথচ বিশ্বকাপে গড় ৪৬.৮১।

রবীশ কুমার মোদীর দোষ দেখতে পায় না এমন মিডিয়ার নাম দিয়েছেন গোদি মিডিয়া, অর্থাৎ মোদীর কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়া। জানি না ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কোলে চড়ে বসে থাকা মিডিয়ার কী নাম হওয়া উচিত। গোদি মিডিয়ায় কর্মরত অনেক সাংবাদিক যেমন বিবেক দংশনে ভোগেন, ভারতীয় ক্রিকেট কভার করা অনেক সাংবাদিকেরও একই অবস্থা। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে শচীন তেন্ডুলকর চরম ব্যর্থ হওয়ার পরে এবং ভারত প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেওয়ার পরে অত বড় ক্রিকেটারেরও চরম সমালোচনা হয়েছিল। এক সর্বভারতীয় ইংরেজি কাগজে শিরোনাম হয়েছিল ENDULKAR। অথচ কোহলি বছর চারেক হয়ে গেল দলের হোমেও লাগেন না, যজ্ঞেও লাগেন না। কারোর সাধ্যি নেই সেকথা লেখে। বরং এতকাল পরে সাদা বলের ক্রিকেটে দুটো অর্থহীন ম্যাচে (১. এশিয়া কাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে, ২. বাংলাদেশের সঙ্গে একদিনের সিরিজ হেরে যাওয়ার পর তৃতীয় একদিনের ম্যাচে) শতরান করার পর রাজার প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি লিখতে হয়েছে। আমেদাবাদ টেস্টে ঢ্যাবঢেবে পিচে শতরান করে তাঁর টেস্টের রান খরাও সবে কেটেছে। গত কয়েক বছরে গড় নামতে নামতে ৪৮.৯৩ হয়ে গেছে। অথচ কথায় কথায় তাঁকে সর্বকালের সেরাদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসিয়ে দেওয়া কিন্তু থামেনি। যাঁদের সঙ্গে তাঁর নামোচ্চারণ করা হচ্ছে তাঁদের সকলের গড় পঞ্চাশের বেশি।

বলতে পারেন, এসব কথা লিখতে চাইলেই লেখা যায়? কেউ কি বারণ করেছে? তা করেনি বটে, তবে লিখে ফেললে সাংবাদিকের চাকরিটি নট হয়ে যেতে পারে। বিশ্বাস না হলে হর্ষ ভোগলেকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। তিনি কারোর সমালোচনাও করেননি। মহেন্দ্র সিং ধোনি অধিনায়ক থাকার সময়ে টুইটারে অমিতাভ বচ্চনের একটি অন্যায় সমালোচনা, যা আবার ধোনি সমর্থন জানিয়ে রিটুইট করেছিলেন, তার প্রতিবাদে ভদ্র ভাষায় জানিয়েছিলেন, সারাক্ষণ ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রশংসা করা একজন ধারাভাষ্যকারের কাজ নয়। সেবার ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে চুক্তি পুনর্নবীকরণের সময় এলে দেখা যায় হর্ষ বাদ পড়েছেন। রবীন্দ্র জাদেজাকে “বিটস অ্যান্ড পিসেজ ক্রিকেটার” বলার অপরাধে একই অবস্থা হয়েছিল সঞ্জয় মঞ্জরেকরের। তা অত নামকরা লোকেদেরই যদি ওই অবস্থা হয় তাহলে খবরের কাগজ, নিউজ এজেন্সি বা ওয়েবসাইটের একজন নগণ্য সাংবাদিকের কী অবস্থা হতে পারে ভেবে দেখুন। হর্ষ আর সঞ্জয় তবু কিছুদিন পরে, কে জানে কোন শর্তে, আবার বোর্ডের তালিকায় ফিরতে পেরেছেন। সাংবাদিকের তো একটি ফোনে চাকরি চলে যাবে এবং তারকাদের চটিয়ে চাকরি গেলে আর কোথাও চাকরি হবে না।

যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বলে রাখা যাক, ভারতের মাটিতে যত ক্রিকেট ম্যাচ হয় তার টিভি সম্প্রচারের প্রযোজক ভারতীয় বোর্ড। খেলা আপনি স্টার নেটওয়ার্কেই দেখুন আর সোনিতেই দেখুন। ফলে ধারাভাষ্যকাররা অধিকাংশই বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, সম্প্রচারকারীর সঙ্গে নয়। যাঁরা সম্প্রচারকারীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ তাঁরাও জানেন বোর্ডের অপছন্দের কথা বললে সম্প্রচারকারীও বিদায় করে দেবে, বোর্ডের সঙ্গে বিবাদ করে ব্যবসা গুবলেট করার ঝুঁকি নেবে না। এখানকার সম্প্রচার স্বত্ব পরম প্রার্থিত বস্তু। এই ব্যবস্থা ক্রিকেটবিশ্বের আর কোনো দেশে চালু নেই। সব দেশেই ক্রিকেট বোর্ড আলাদা, সম্প্রচারকারী এবং তার ধারাভাষ্যকাররা স্বাধীন। ফলে ইংল্যান্ডের খেলায় আপনি নাসের হুসেনকে জো রুট বা বেন স্টোকসের সমালোচনা করতে শুনবেন, কিন্তু ভারতীয় ব্যাটিং গোটা সিরিজে জঘন্যভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরেও বুধবার (২২ মার্চ ২০২৩) অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তৃতীয় একদিনের ম্যাচে দীনেশ কার্তিক বলেছেন এই সিরিজে ব্যাটারদের পারফরম্যান্স “প্রিটি অ্যাভারেজ”। প্রথম ম্যাচে ভারতের প্রথম চার উইকেট পড়ে গিয়েছিল ৩৯ রানে, মাত্র ১০.২ ওভারে। পঞ্চম উইকেট পড়ে যায় ৮৩ রানে, তখন মাত্র ১৯.২ ওভার খেলা হয়েছে। দ্বিতীয় ম্যাচে তো গোটা দল আউট হয়ে যায় ১১৭ রানে, ২৬ ওভারের মধ্যে। শেষ ম্যাচে যথেষ্ট ভাল শুরু করার পরেও শেষ সাত উইকেট পড়ে গেছে ১০২ রানে। এই ব্যাটিং যদি “প্রিটি অ্যাভারেজ” হয় তাহলে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, ওয়েবস্টার – সমস্ত প্রামাণ্য ইংরেজি অভিধানের সম্পাদকমণ্ডলীকে সত্বর জানানো দরকার যে ‘অ্যাভারেজ’ শব্দটার মানে বদলে গেছে। অবশ্য কার্তিক তো শিশু, প্রবাদপ্রতিম সুনীল গাভস্করকেও সারাক্ষণ অত্যুক্তি করে যেতে হয়। একবার আইপিএল চলাকালীন মুখ ফুটে বলেছিলেন, লকডাউনের সময়ে কোহলি যথেষ্ট অনুশীলন করতে পাননি। হালকা মেজাজে যোগ করেছিলেন, একটা ভিডিওতে দেখলাম অনুষ্কার সঙ্গে খেলছিল। ওই অনুশীলনে কোনো লাভ হবে না। অমনি এক রাগত ইন্সটাগ্রাম পোস্ট করে ট্রোলবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীমতি কোহলি

এসব কথা বলছি কারণ ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের মাত্র মাস ছয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সিরিজ হারের যথার্থ মূল্যায়ন করতে গেলে ভারতীয় ক্রিকেটের এই গোটা বাস্তুতন্ত্রকে বোঝা দরকার। টাকা এবং ট্রোলবাহিনীর জোরে ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রিকেটাররা সমস্ত সমালোচকের মুখ বন্ধ করে দিতে পারেন, একগাদা হোম সিরিজের আয়োজন করতে পারেন যাতে আমাদের ক্রিকেটারদের রেকর্ডগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে। কিন্তু রোহিত, কোহলি, রাহুল, রবীন্দ্র জাদেজাদের বয়স তো কমাতে পারেন না। প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁদের রিফ্লেক্স কমছে, লম্বা ইনিংস খেলার শারীরিক ক্ষমতা এবং মানসিক দক্ষতাও কমছে। ফলে আগে অন্তত দ্বিপাক্ষিক সিরিজে যে কৌশলে খেলে দলকে জয় এনে দিতে পারছিলেন, তা আর পেরে উঠছেন না। বুধবার যেমন ‘চেজমাস্টার’ বিরাট তাঁর চিরাচরিত রান তাড়া করার কায়দায় শুরু করেও শেষপর্যন্ত টানতে পারলেন না। রাহুল যে দ্রুত রান করতে পারেন না তা আর কতবার প্রমাণিত হলে কোচ রাহুল দ্রাবিড়, অধিনায়ক রোহিত এবং নির্বাচকরা তাঁকে অপরিহার্য ভাবা বন্ধ করবেন তাঁরাই জানেন। রাহুল এই সিরিজের প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৭৫ রান করে দলকে জিতিয়ে দেওয়ায় আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে শোনা গিয়েছিল তিনি নাকি সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল সে ম্যাচে জিততে হলে মাত্র ১৮৯ রান করতে হত, কোনো তাড়া ছিল না। ফলে রাহুল আপন মনে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বুধবারের খেলায় লক্ষ্য ছিল ২৭০, তবুও তিনি বিরাটের মত ১-২ রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখার তাগিদ দেখাননি। বত্রিশ রান করতে নিয়ে নিলেন ৫০ বল। এইভাবে নিজেই নিজের উপর চাপ বাড়াতে বাড়াতে একসময় হঠাৎ ‘পিটিয়ে ঠান্ডা করে দেব’ ভঙ্গিতে ব্যাট করতে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন। এহেন রাহুলকে আবার টিম ম্যানেজমেন্ট ঋষভ পন্থের অনুপস্থিতিতে বিশ্বকাপের পাকাপাকি উইকেটরক্ষক হিসাবেও ভাবছে। এখন উপায়?

এখানেই এসে পড়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড জলে যাওয়ার প্রশ্ন। হাতের কাছেই আছেন ঈশান কিষণ। যিনি এই সিরিজে অধিনায়ক রোহিত খেলেননি বলে মোটে একটা ম্যাচে খেলার সুযোগ পেলেন। তিনি এখন অবধি ১৪ একদিনের ম্যাচে ৪২.৫০ গড়ে রান করেছেন, একমাত্র শতরানটা আবার ২১০। অথচ তাঁকে মিডল অর্ডারে ভাবা যাচ্ছে না। ঈশানের বয়স তবু ২৪, তাঁর থেকে ডিভিডেন্ড পাওয়ার এখনো সময় আছে। এই সিরিজে দলের বাইরে ছিলেন আরেকজন উইকেটরক্ষক ব্যাটার, যিনি এখন অবধি ১১ একদিনের ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ৬৬ গড়ে রান করেছেন, স্ট্রাইক রেটও একশোর বেশি। অথচ কিছুতেই তাঁকে টানা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সেই সঞ্জু স্যামসনের বয়সে দেখতে দেখতে ২৯ হতে চলল। হয়ত এই বিশ্বকাপের দলেও তাঁকে রাখা হবে না। কারণ সাত বছর এবং একটা বিশ্বকাপ খেলে ফেলার পরেও যে ৩১ বছর বয়সীর ব্যাটিং অর্ডারই পাকা করা যাচ্ছে না, সেই রাহুল দলকে নতুন কিছু দিতে পারেন বলে বিশ্বাস করে টিম ম্যানেজমেন্ট।

পঁয়ত্রিশ হতে চলা বিরাট কোনোদিনই স্পিনের বিরুদ্ধে দারুণ ব্যাটার ছিলেন না। বছর তিনেক হল মাঝের ওভারগুলোতে কিছুতেই স্পিনারদের মেরে উঠতে পারেন না, মারতে গেলেই আউট হয়ে যান। ঠিক যেমন বুধবার হলেন। অথচ উপমহাদেশে বিশ্বকাপ, মাঝের ওভারগুলোতে স্পিনাররাই বেশি বল করবেন। বিশ্বকাপের আগেই ছত্রিশে পা দেবেন অধিনায়ক রোহিত। এই দলে একমাত্র তিনিই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে স্পিনারদের মারতে পারেন। কিন্তু তাঁর ধারাবাহিকতাও ক্রমশ কমছে। ইদানীং বল ঘুরলে বেশ অসুবিধায় পড়ছেন, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে প্রকট হয়েছে সমস্যাটা। এদিকে বল সুইং করলে তাঁকে চিরকালই কিঞ্চিৎ দিশাহারা দেখায়। সেই কারণেই টেস্ট ক্রিকেটে বিরাটের অর্ধেক সাফল্যও পাননি। এঁরা আমাদের ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ।

অবশ্য শুধু ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে দুশ্চিন্তার প্রতি অবিচার করা হবে। মনে রাখা ভাল, আমরা ডিসেম্বরে বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হেরেছি আর মার্চে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সিরিজ হারলাম স্রেফ ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে নয়। মাঝে যে সিরিজে শ্রীলঙ্কাকে ৩-০ হারিয়েছি সেখানেও প্রথম ম্যাচে তারা ৩৭৩ রানের জবাবে ৩০৬ তুলে ফেলেছিল। অধিনায়ক দাসুন শানাকা ৮৮ বলে ১০৮ রান করে অপরাজিত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সুইং সহায়ক পরিবেশে ভারতের ব্যাটিং শুয়ে পড়লেও অস্ট্রেলিয়ার ১২১ রান তুলতে লেগেছে মাত্র ১১ ওভার, একটাও উইকেট খোয়াতে হয়নি। সবচেয়ে সিনিয়র বোলার মহম্মদ শামির মধ্যেও ধারাবাহিকতার অভাব স্পষ্ট। আমাদের বিরাট ভরসা যশপ্রীত বুমরা বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন কিনা এখনো অনিশ্চিত, সাদা বলের ক্রিকেটে দীর্ঘদিন নির্ভরতা দেওয়া ভুবনেশ্বর কুমারও সাম্প্রতিক টি টোয়েন্টি ব্যর্থতার পর দলের বাইরে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের নির্বাচিত দলের দিকে তাকালে কতকগুলো আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করা যাবে।

এই দলে ছিলেন না ২৪ বছরের অর্শদীপ সিং, যিনি টি টোয়েন্টিতে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিণতির পরিচয় দিয়েছেন এবং মাত্র তিনটে একদিনের ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। অথচ ছিলেন ৩১ বছরের জয়দেব উনড়কত, যিনি দেশের জার্সিতে শেষ একদিনের ম্যাচ খেলেছেন ২০১৩ সালে। আমাদের সবেধন নীলমণি জোরে বোলার অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া সম্পূর্ণ ফিট এবং ব্যাটে, বলে চমৎকার খেললেন। তা সত্ত্বেও দলে ছিলেন মোটামুটি একই কাজের লোক শার্দূল ঠাকুর। তাঁর বয়স ৩১। প্রথম ম্যাচে দুজনেই একসঙ্গে খেলেও ফেললেন। শার্দূলকে মাত্র দু ওভার বল করতে দেওয়া হল আর ব্যাট করার কথা ছিল আট নম্বরে। তার দরকার পড়েনি। দ্বিতীয় ম্যাচে শার্দূলের জায়গায় এসে পড়লেন অক্ষর প্যাটেল, ভারত একসঙ্গে তিনজন বাঁহাতি স্পিনারকে খেলাল। এদিকে দেখা গেল পিচ জোরে বোলারদের উপযোগী। মিচেল স্টার্ক একাই পাঁচ উইকেট নিলেন, বাকিগুলো শন অ্যাবট আর নাথান এলিস। এসব দৃশ্য বেঞ্চে বসে দেখলেন ২৩ বছরের উমরান মালিক। তিনি আজকের ক্রিকেটে বিরল সেই প্রজাতির বোলার, যাঁর গড় গতি ঘন্টায় ১৪৫ কিলোমিটার বা ৯০ মাইলের বেশি। বিশাখাপত্তনমে তিন ওভারে ২৫ রান দেওয়া অক্ষরই চেন্নাইয়ের সিরিজ নির্ধারক ম্যাচেও খেললেন। দুটো উইকেট নিলেও আট ওভারে ৫৭ রান দিলেন আর বিশেষজ্ঞ ব্যাটার সূর্যকুমার যাদব তো বটেই, হার্দিকেরও আগে ব্যাট করতে এসে চার বলে দু রান করে রান আউট হয়ে গেলেন। তিন স্পিনারই খেলাতে হলে হাতে কিন্তু অফস্পিনার ওয়াশিংটন সুন্দরও ছিলেন। তাঁর আর অক্ষরের মধ্যে কে বেশি ভাল ব্যাট করেন তা তর্কসাপেক্ষ। লেগস্পিনার যজুবেন্দ্র চহলও ছিলেন, যিনি কিছুদিন আগেও ছিলেন টিম ম্যানেজমেন্টের নয়নমণি। হঠাৎ ২০২১ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে অকর্মণ্য প্রমাণিত হয়েছেন। সেবার দলেই ছিলেন না, পরের বছর অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে গিয়েও খেলানো হল না।

বুধবার চেন্নাইতে দেখা গেল ভারতের তিন স্পিনারের মধ্যে কুলদীপ যাদব ছাড়া বাকিরা অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারলেন না। অক্ষর মার খেলেন, জাদেজা উইকেট নিতে পারলেন না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জাম্পা আর অ্যাশটন অ্যাগারই আসলে ম্যাচটা জিতে নিলেন। তাঁদের দুজনের কুড়ি ওভারে মাত্র ৮৬ রান উঠল, চলে গেল ছটা উইকেট। ভারতের মাটিতে এমন ভেলকি দেখাতে স্বয়ং শেন ওয়ার্নও পারেননি। মানে এই সিরিজ হার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ভারতীয় ব্যাটাররা বল সুইং করলেও হাবুডুবু খান, স্পিন করলেও হাবুডুবু খান। মানতেই হবে দ্বিতীয়টা নতুন লাগছে। বিশেষত ভারতের এই দলকে যেহেতু সেই রবি শাস্ত্রী-কোহলির আমল থেকে সর্বকালের সেরা দল বলে দাবি করা হচ্ছে। শাস্ত্রী টিম ডিরেক্টর থাকার সময়ে স্বয়ং এই দাবি করেছিলেন, তারপর যথারীতি ভারতের সংবাদমাধ্যম বারবার লিখে এবং বলে ব্যাপারটা সকলকে বিশ্বাস করাতে উদ্যোগী হয়েছে। অথচ দেশের মাঠে ভারতকে হারানো চিরকালই শক্ত। স্টিভ ওয়র বিশ্বরেকর্ডধারী দলও পারেনি। কোহলি, রোহিতরা ইংল্যান্ড বা নিউজিল্যান্ডে সিরিজ জেতেননি, যার একাধিক নজির ভারতীয় ক্রিকেটে আছে। এমনকি তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল দক্ষিণ আফ্রিকা দলের কাছেও হেরে এসেছে। বস্তুত দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া বর্তমান প্রজন্ম এমন কিছুই করেনি যা ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তাও টেস্ট ক্রিকেটে। সাদা বলের ক্রিকেটে বলার মত একটা সাফল্যও গত দশ বছরে আসেনি। বরং ভিতরে ভিতরে যেসব বিপ্লব ঘটে গিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছিল, সেগুলোর টিকি পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমাদের নাকি অফুরন্ত জোরে বোলারের জোগান তৈরি হয়েছে। কোথায় তাঁরা? এক বুমরার অনুপস্থিতিতেই এত ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে কেন বোলিংকে? টেস্টে এখনো কেন খেলিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৩৬ বছর বয়সী অত্যন্ত মাঝারি মানের বোলার উমেশ যাদবকে? যা অবস্থা তাতে আইপিএলে ভাল বল করলে হয়ত ভুবনেশ্বরকেও বিশ্বকাপের জন্য ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁরও তো বয়স ৩৩। মাঝে মাঝে উদয় হন খলীল আহমেদ, নভদীপ সাইনি, দীপক চহর, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণর মত তরুণ বোলাররা। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষণ দেখেন তাঁদের মধ্যে এবং আমাদের দেখান। তারপর সেই বোলাররা বাদ পড়েন বা চোট পান, আর ফেরেন না। কোন কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যান?

এত চোটই বা হয় কেন? শুধু তো বোলার নয়, ব্যাটাররাও দেখা যাচ্ছে বসে বসেই চোট পেয়ে যান। যে শ্রেয়স আয়ার একদিনের ক্রিকেটে মিডল অর্ডারকে ভরসা দেবেন ভাবা হচ্ছিল, হঠাৎ আমেদাবাদ টেস্টে তিনি চোটের কারণে ব্যাট করতে নামলেন না। এখন জানা যাচ্ছে সে নাকি এমন চোট যে আইপিএল খেলাও অনিশ্চিত। এর আগে এমন অদ্ভুত চোট রাহুল পেয়েছেন, রোহিত পেয়েছেন। এর কারণ কি অতিরিক্ত ক্রিকেট? যদি তাই হয় তাহলে সুরাহা কী? বুধবারের হারের পর অধিনায়ক রোহিত সাঁইবাবাসুলভ দার্শনিকতায় বলে দিয়েছেন, খেলোয়াড়দের চোট সমস্যা তৈরি করছে ঠিকই, কিন্তু আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোই সব ক্রিকেটারের মালিক। তারাই ঠিক করবে কে কতগুলো ম্যাচ খেলবে না খেলবে।

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট: জাহান্নামের আগুনে পুষ্পের হাসি

তাহলে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের তরুণ প্রতিভারা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে ক্রমশ ডেমোগ্রাফিক লায়াবিলিটিতে পরিণত হচ্ছেন। যে সূর্যকুমার যাদব গত দুবছর টি টোয়েন্টিতে চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং করে একদিনের দলে জায়গা করে নিয়েছেন এবং যাঁকে দুটো ম্যাচে প্রথম বলে আউট হয়েছেন বলেই তৃতীয় ম্যাচে সাত নম্বরে ঠেলে দেওয়া হল, তিনিও কিন্তু দীর্ঘদিন ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করে যাওয়া সত্ত্বেও প্রথম সুযোগ পেয়েছেন ৩১ বছর বয়সে। কারণ তারকাদের বাদ দেওয়া বা ব্যাটিং অর্ডার বদলানো প্রায় অসম্ভব। অথচ অস্ট্রেলিয়াকে দেখুন। মিচেল মার্শ ওপেন করতে এসে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করছেন, তাই ডেভিড ওয়ার্নারের মত সিনিয়রকেও মিডল অর্ডারে খেলতে হল। বুমরা আর আয়ার ছিলেন না বলে অস্ট্রেলিয়ার এই জয়কে তুচ্ছ করাও বোকামি হবে। কারণ বুমরা অনেকদিন ধরেই নেই, আমরা তাঁর বিকল্প তৈরি করতে পারিনি। আর আয়ারের অনুপস্থিতিই যদি ঢাকতে না পারেন তাহলে আর রোহিত, বিরাটরা, রাহুলরা কিসের বড় ব্যাটার? বরং অস্ট্রেলিয়ার দলে ছিলেন না তাদের অন্যতম সেরা দুই পেসার – অধিনায়ক প্যাট কামিন্স (মায়ের মৃত্যুর ফলে) আর জশ হেজলউড (চোটের কারণে)। মিচেল স্টার্কের সঙ্গে মিডিয়াম পেসার মার্কাস স্তোইনিস আর অজিদের দ্বিতীয় সারির শন অ্যাবটকে সামলাতেই হিমসিম খেল তথাকথিত বিশ্বসেরা ভারতীয় ব্যাটিং। তাও তো অপরিণত ব্যাটিং করে প্রথম ম্যাচটা ভারতকে প্রায় উপহার দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটাররা, নইলে কী হত কে জানে?

আজকাল কোনো বিষয়েই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করার চল নেই। কিন্তু বিশ্বকাপের বছর বলেই হয়ত এসব নিয়ে অনেক ক্রিকেটভক্ত একটু চিন্তিত। তবে দেশের ক্রিকেটকর্তারা মোটেই চিন্তিত নন। একটা দেশের ক্রিকেট চালাতে গেলে ন্যূনতম যে কাঠামোগুলো দরকার হয় সেগুলোকে ঠিক রাখার প্রয়োজনও তাঁরা বোধ করেন না। নইলে নির্বাচন কমিটি নিয়ে এই ধাষ্টামো চলত নাকি?

২০২২ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির ব্যর্থতার জন্য চেতন শর্মার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিটিকে গত নভেম্বরে বরখাস্ত করা হল ঘটা করে। তারপর দুমাস কারা নির্বাচক ছিলেন কেউ জানে না। জানুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচন কমিটি হল, যার নেতৃত্বে সেই চেতনই। একমাস পরেই আরেক নাটক। এক টিভি চ্যানেলের স্টিং অপারেশনে চেতনকে বিরাটের নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়া নিয়ে কিছু ভিতরের খবর ফাঁস করতে দেখা গেল। অতঃপর ঘোষণা করা হল তিনি নাকি বোর্ড সভাপতি জয় শাহের কাছে স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তা না হয় দিলেন, কিন্তু তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন কে? কেউ না। বহুকাল হল নির্বাচন কমিটির প্রধান সশরীরে দল ঘোষণা করেন না, কাকে নেওয়া হল, কাকে নেওয়া হল না তা নিয়ে কোনো প্রশ্নোত্তরের সুযোগ থাকে না। এরপর হয়ত নির্বাচন কমিটিই থাকবে না। দরকারই বা কী? ক্রিকেটারদের মালিক যখন ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো, জাতীয় দল নির্বাচনটাও তারাই করে দিতে পারে তো। দেশের ব্যাঙ্ক, বিমা, বন্দর, বিমানবন্দর – সবই যখন গুটি কয়েক লোকের মালিকানায় চলে যাচ্ছে, ক্রিকেট দলটাও তাই যাক না। এমনিতেও যে দল দেশ চালায় সেই দলই তো ক্রিকেট বোর্ড চালাচ্ছে। ক্রিকেটাররা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সেই দলের নির্বাচনী পোস্টারে মুখও দেখাচ্ছেন। তাহলে এক যাত্রায় আর পৃথক ফল হবে কেন? বিশ্বকাপ ভুলে যান। আগামী শুক্রবার থেকে আইপিএল দেখুন মনের সুখে।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

২০২৪ আসলে গণভোট, বহুত্ববাদী ভারতের মুখ রাহুল গান্ধী

প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী।

সেই কোন কালে চকোলেট কোম্পানি ক্যাডবেরি’জ অমিতাভ বচ্চনকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে একগুচ্ছ বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। তার একটায় তিনি পাপ্পু নামে একটি ছেলের বাবা, যার বয়স বেড়েই চলেছে কিন্তু সে স্কুলের গণ্ডি আর পেরোতে পারছেন না। তা পাপ্পুর হতাশ দোকানদার বাবাকে ছেলের বন্ধুরা এসে খবর দিল, পাপ্পু পাশ করে গেছে। অতএব তারা চকোলেট খাবে, পয়সা পাপ্পু দেবে। বাবা মহানন্দে সকলকে বিনিপয়সায় চকোলেট বিলোতে লাগলেন। এমন খুশির খবরে কি মিষ্টিমুখ না করে থাকা যায়? ওই সিরিজেরই আরেকটি বিজ্ঞাপনে অমিতাভ কলেজের অধ্যাপক। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখেন, ছেলেমেয়েরা সব ঊর্ধ্বশ্বাসে কোথায় যেন দৌড়চ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, পাপ্পুর নাকি পরীক্ষা, তাই তারা সবাই দৌড়চ্ছে। অবাক অধ্যাপক সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন পরীক্ষা মানে হল, একটি সুন্দরী মেয়ে (রাইমা সেন) কলেজে ঢুকছে আর মোটা কাচের চশমা পরা, সচরাচর যাদের ক্যাবলা বলা হয় তেমন ছেলে পাপ্পু প্রেম নিবেদন করবে বলে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি এল, দেখল এবং পাপ্পুকে জয়যুক্ত করল। ফলে সকলে মিলে পাপ্পু পাশ করে গেছে বলে ফের নাচানাচি শুরু করল। এ খবরেও মিষ্টিমুখ না-করে থাকা যায় না, অতএব ফের চকোলেট খাওয়া হল। এই পাপ্পু যে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে জায়গা করে নিতে চলেছে, তখন কে জানত!

আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র তুলনাহীন। আজ না হয় যাবতীয় টিভি চ্যানেল এবং অধিকাংশ সর্বভারতীয় খবরের কাগজের উপর আম্বানি-আদানির সহায়তায় তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির সর্বভারতীয় উত্থানের সময়ে তো এতখানি আধিপত্য ছিল না। তবু বিজেপি নেতারা বারবার আউড়ে এবং হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকের বিপুল ব্যবহারের মাধ্যমে জনমনে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পেরেছিলেন এই কথা যে, হার্ভার্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রাহুল গান্ধি হলেন ওই বিজ্ঞাপন সিরিজের অকর্মণ্য, অজস্রবার ফেল করা পাপ্পু। অন্যদিকে তথ্যের অধিকার আইন ব্যবহার করে যাঁর পাশ করার বছরের তথ্য জানতে চাইলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে মুখে কুলুপ আঁটে, সেই মোদি হলেন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, বিশ্বগুরু হওয়ার উপযুক্ত। যেহেতু মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতা সন্দেহজনক (গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত তাঁর মার্কশিটে অধ্যয়নের বিষয় লেখা ছিল “entire political science”), সেহেতু ডিগ্রি ব্যাপারটাই যে অপ্রয়োজনীয় তা প্রমাণ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র। বারো ক্লাসের গণ্ডি না-পেরনো স্মৃতি ইরানিকে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী করা হয়েছিল এবং ডিগ্রি যে কিছুই প্রমাণ করে না তা প্রমাণ করতে দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র মতো বিরাট কাগজ রীতিমত গ্রাফিক্স তৈরি করেছিল— যাতে দেখানো হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বেরই ডিগ্রির বালাই ছিল না। মনে রাখতে হবে, এই স্মৃতি সংসদে পৌঁছেছিলেন অমেঠি কেন্দ্রে রাহুলকে পরাজিত করে। অর্থাৎ স্মৃতিকে মাথায় তোলার পিছনেও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাহুলকে পাপ্পু প্রমাণ করা।

স্বীকার্য যে, প্রচুর লেখাপড়া জেনেও রাজনীতিতে কেউ অকর্মণ্য হতেই পারেন। আবার বেশিদূর লেখাপড়া না-করেও ক্ষুরধার বুদ্ধি, সাহস এবং পরিশ্রমের জোরে একজন রাজনীতিবিদ দারুণ সফল হতে পারেন। সাফল্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটা অবশ্য গুরুতর প্রশ্ন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেমন স্পষ্টতই মনে করেন, চা বিক্রেতার ছেলে হয়েও দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাই সাফল্য। কীভাবে সে চেয়ার অবধি পৌঁছনো হল এবং চেয়ারে বসে কী করা হচ্ছে তার তেমন গুরুত্ব নেই। তিনি যে গত আট বছরে এমনকি কাশ্মিরি পণ্ডিতদের জন্যও গঠনমূলক কিছু করে উঠতে পারেননি, তা তাঁর কাছে ব্যর্থতা বলে প্রতিভাত হয় বলে তো মনে হয় না। উলটে সারাক্ষণ নিজেই নিজেকে শংসাপত্র দিয়ে বেড়াচ্ছেন— “সব চঙ্গা সি”। এহেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের মানদণ্ডে রাহুল যা-ই করুন, প্রধানমন্ত্রী না-হতে পারলে পাপ্পুই থাকবেন। তাতে কিছু এসে যায় না। মুশকিল হল, পাপ্পু মিথ নির্মাণ এতই সফল হয়েছে যে, বিজেপিবিরোধী মানুষও কিছুতেই ওই মিথ ভুলে রাহুলকে দেখে উঠতে পারছেন না। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের এই ভুল না ভাঙলে বিপদ।

গত কয়েক দিনে যে চরম অন্যায় অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করে রাহুলকে লোকসভা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, বহু উদারপন্থী, এমনকি বামপন্থী মানুষও তাতে তেমন দোষ দেখছেন না। বিজেপি বাদে সব দলের নেতৃস্থানীয়রাই অবশ্য এর নিন্দা করেছেন, কিন্তু তার অনেকটাই “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” যুক্তিতে। কারণ, আজ এর প্রতিবাদ না-করলে কাল এত বড় দেশের কোনও এক নিম্ন আদালতে তাঁদের কারও কোনও প্রধানমন্ত্রীবিরোধী মন্তব্যকে হাতিয়ার করে কেউ যদি মানহানির মামলা ঠুকে দেয় আর আদালত তুরন্ত দুবছরের কারাদণ্ড দিয়ে দেয়, তাহলে তাঁদের সাংসদ বা বিধায়ক পদও নিমেষে খারিজ হয়ে যাবে। কিছু বলার মুখ থাকবে না। এই নেতা-নেত্রীদের কে কে ভারতের গণতন্ত্রের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সত্যিই চিন্তিত তা আরও কিছুদিন না কাটলে, তাঁদের দলের কার্যকলাপ না দেখলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। যেমন ধরুন, এর পরেও যদি আম আদমি পার্টি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী ধ্বজা উড়িয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটতে যায়, তা হলে বুঝতে হবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের লুকোবার মতো আরও অনেক কিছু আছে। সেসবের গুরুত্ব ভারতের গণতন্ত্র বাঁচানোর চেয়ে বেশি।

কিন্তু ইতিমধ্যেই দলগুলোর সাধারণ সদস্য, সমর্থকদের অনেকেরই দেখা যাচ্ছে রাহুল পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন এবং অনেকে তাঁর মধ্যে আশার আলো দেখছেন বলে প্রবল গাত্রদাহ। এর কারণ রাহুলের কার্যকলাপ তাঁরা এত বছর ধরে ভাল করে লক্ষই করেননি। নিজেদের অজান্তেই সরকারি প্রচারযন্ত্রের চোখ দিয়ে রাহুলকে দেখেছেন। তাই এখন চোখকান যা বলছে, মস্তিষ্ক কিছুতেই তা মানতে চাইছে না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভারত জোড়ো যাত্রার পরে রাহুল সর্বক্ষণের রাজনীতিবিদ নন— এই অভিযোগ আর করা যাচ্ছে না। লৌহমানব মোদির বিপরীতে তিনি যে ঠুনকো পুতুল নন, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছেন। কংগ্রেসেও যে নেতৃত্বের সঙ্কট দীর্ঘকাল ধরে চলছিল তার নিষ্পত্তি ঘটেছে। গুলাম নবি আজাদের মতো সুযোগসন্ধানীরা বিদায় হয়েছেন। কপিল সিব্বলের মতো অতিবৃদ্ধ, জনসংযোগহীন আইনজীবী নেতারা পথপার্শ্বে পড়ে আছেন। সুদর্শন, সাহেবদের মতো ইংরেজি বলায় দক্ষ শশী থারুর টিভি স্টুডিও আর টুইটার আলো করেই বসে আছেন। মল্লিকার্জুন খড়গেকে সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে ঝাড়া হাত-পা রাহুল জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে গেছেন।

কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। দেশ কীভাবে চালানো উচিত, ভারতের আগামীদিনের অর্থনীতি কেমন হওয়া উচিত, আজকের দুনিয়ায় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার পুনঃপ্রয়োগ কীভাবে করা সম্ভব— এসব নিয়ে গত কয়েক বছরে মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছেন রাহুল। কিন্তু গোদি মিডিয়া আর বিজেপি-র আইটি সেল সেসব দিকে আলো ফেলেনি। কেবলই পাপ্পু ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে এবং জওহরলাল নেহরুর চিন-নীতির ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির স্বৈরতান্ত্রিকতা— এগুলোকে রাহুল গান্ধীর সমার্থক করে দিয়েছে। দুঃখের বিষয়, বহু বিজেপি-বিরোধী, বিশেষত বামপন্থীরা, এই চশমা দিয়েই রাহুলকে দেখেছেন এবং এখনও দেখে চলেছেন। তাঁরা খেয়ালই করেন না, ২০১৯ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাহুল সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের যে প্রস্তাব রেখেছিলেন তা এই মুহূর্তে যে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির কবলে আমরা পড়েছি তার প্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক, এবং বলা বাহুল্য, বামপন্থী। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন ভারতে অমন একটা প্রকল্প দারুণ কাজে দেবে। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ অবশ্যই আছে। কিন্তু অন্তত এই শতকে ভারতের কোনও বামপন্থী দলের নেতাকে অর্থনীতি নিয়ে এরকম বিকল্প চিন্তা করতে দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের শেষ বামফ্রন্ট সরকার বরং অনেকাংশে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি নিয়ে চলছিল, কেরলের বাম সরকারও যে মৌলিকভাবে আলাদা কোনও পথ দেখাতে পারছে এমন নয়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যেমন (যাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে মোদি সরকার) তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে খুব আলাদা কোনও পথ নেওয়া হয়তো কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভবও নয়। কিন্তু প্রস্তাব হিসেবে, পরিকল্পনা হিসেবেও ডি রাজা, পিনারাই বিজয়ন বা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যরা কোনও মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির কথা বলেছেন কি? সরকারে এলে কী করবেন সে তো পরের কথা, রাহুল অন্তত অন্য কিছু ভাবার এবং বলার সাহস তো দেখিয়েছেন।

ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন রাহুল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিলেন। সেই আলোচনা শুনলে বোঝা যায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে রাহুল কীভাবে দেখেন এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্যকে কতটা গভীরভাবে জানেন। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের সাফল্য কীভাবে এল, ভারতে সেরকম কিছু করা সম্ভব কিনা জানতে চান এবং সেই প্রসঙ্গে জিএসটি ও নোটবন্দির ফলে কর্নাটকের বেল্লারির রমরমা জিনস শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতির কথা জানান। দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়েও সুনির্দিষ্ট আলোচনা করেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মির পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনকে কতটা গভীরভাবে দেখেছেন তা মিনিট পঁচিশেকের ওই ভিডিওতে বেশ বোঝা যায়। রঘুরাম কিন্তু ঘোর পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ। রাহুল আলোচনার এক জায়গায় প্রশ্ন করেন, “দেখতে পাচ্ছি স্টক এক্সচেঞ্জে টাকা লাগিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার কী মত?”

দিল্লির রাজনৈতিক মহলে সকলেই জানেন, রাহুলকে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের অপছন্দ হওয়ার অন্যতম কারণ তাঁর এই বামপন্থী প্রবণতা। তিনি যেভাবে নাম করে দেশের সবচেয়ে বড় দুই ধনী— মুকেশ আম্বানি আর গৌতম আদানিকে আক্রমণ করেন, তা অনেকেরই পছন্দ নয়। কারণ অর্থনীতির দিক থেকে কংগ্রেসের ক্রমশ ডাইনে সরে যাওয়া আরম্ভ হয়েছিল রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধীর আমলে, যা তুঙ্গে পৌঁছয় নরসিংহ-মনমোহন জুটির নেতৃত্বে। সেই কারণেই নরসিংহ বিজেপির বিশেষ পছন্দের লোক। শেখর গুপ্তার মত দক্ষিণপন্থী সাংবাদিকরা তাঁকে ‘ভারতের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী’ আখ্যাও দিয়ে থাকেন। সেই দলের নেতা হয়ে রাহুলের এভাবে বৃহৎ পুঁজিকে আক্রমণ, বারবার ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ নিয়ে কথা বলা অনেক কংগ্রেসিরই না-পসন্দ।

তা বলে রাহুল বিপ্লবী নন, লেনিন বা মাও জে দং নন। কিন্তু তাঁকে অমন হতে হবে— এমন প্রত্যাশা করবই বা কেন? এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও যখন বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে থেকে তেমন কেউ উঠে এলেন না, তখন বহুত্ববাদী ভারত থাকবে কি থাকবে না— এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে কমিউনিজমের দাঁড়িপাল্লায় রাহুলকে মাপার মূঢ়তা ক্ষমার অযোগ্য। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় একই সময়ে। একশো বছর পূর্ণ করার আগেই আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনায় চূড়ান্ত সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সেখানে ভারতীয় কমিউনিস্টরা দারুণ শুরু করেও ১৯৬৪ সালের পর থেকে নিজেদের ভাঙতে-ভাঙতে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে, অস্তিত্বেরই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ১৯৮৯ থেকে সংঘের শক্তি দ্রুত বেড়েছে, অথচ কমিউনিস্টরা সম্মুখসমরে যাওয়ার শক্তি ক্রমশ হারিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে তবু বিকল্প সরকার তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার শক্তি ছিল, ২০০৯ সালের পর থেকে তা-ও আর অবশিষ্ট নেই।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় রাজনীতির বাস্তুতন্ত্র মানে ছিল বামপন্থা বনাম মধ্যপন্থার লড়াই। সংঘ পরিবার সফলভাবে অটলবিহারী বাজপেয়ির আমল থেকে সেই বাস্তুতন্ত্রকে মধ্যপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থার লড়াইয়ে পরিণত করতে শুরু করে। ২০২৪ নির্বাচনে রাহুল তথা কংগ্রেসকে উড়িয়ে দিয়ে জিততে পারলে ব্যাপারটা পুরোপুরি দক্ষিণপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থা হয়ে দাঁড়াবে। কেবল মমতা ব্যানার্জি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, নবীন পট্টনায়করাই যদি বিরোধী দল হিসেবে টিঁকে থাকেন তা হলে বনাম শব্দটারও আর প্রয়োজন থাকবে কি না, সন্দেহ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যেমন শাসক-বিরোধী সংঘাত বলে কিছু হয় না। যা হয় সব বিধানসভার বাইরে টিভি ক্যামেরার সামনে। সুতরাং গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ভারতকে বাঁচাতে হলে ভারতের আরএসএসবিরোধী শক্তিগুলোর হাতে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। বামপন্থীদের সামনেও নেই। নেহরুর নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে অকারণে বরখাস্ত করা, ইন্দিরার জরুরি অবস্থা, মনমোহনের অপারেশন গ্রিন হান্ট ইত্যাদি কারণে কংগ্রেস সম্পর্কে যত বিতৃষ্ণাই থাক, রাজনীতিতে আশু বিপদের চেয়ে বড় কোনও বিপদ নেই, কোনওদিন ছিল না। সে কারণেই ইন্দিরা যখন দেশের গণতন্ত্রের জন্য মূর্তিমান বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন তখন জ্যোতি বসুর মতো প্রবাদপ্রতিম বাম নেতারা সংঘ-ঘেঁষা শক্তির উপস্থিতি সত্ত্বেও জয়প্রকাশ নারায়ণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

আরও পড়ুন কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?

রাহুল আরও একটা জায়গায় দেশের অন্য সব বিরোধী নেতার চেয়ে এগিয়ে আছেন, তা হল সরাসরি সংঘ-বিরোধিতা। অন্য সব দলের নেতাদেরই বিজেপির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। একমাত্র রাহুলই বারবার বলেন, লড়াইটা আরএসএসের বিরুদ্ধে। দেশের মাটিতে জনসভায় বলেন, সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন। আবার কেমব্রিজে বক্তৃতা দিতে গিয়েও বলেন। এ দেশের কমিউনিস্টদের চিরকালীন বদভ্যাস, তাঁরা অর্থনৈতিক বিভাজন ছাড়া আর কোনও বিভাজন স্বীকারই করতে চান না। গত শতকের তিনের দশকে এই কারণেই গিরনি কামগর ইউনিয়নের ধর্মঘটে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের নেতৃত্বাধীন শ্রমিকদের সঙ্গে বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকরের নেতৃত্বাধীন দলিত শ্রমিকদের ঐক্য হয়নি। একশো বছর হতে চলল, কমিউনিস্টরা নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাই রামমন্দির, হিজাব পরার জন্য মেয়েদের শিক্ষায়তনে ঢুকতে না-দেওয়া কিংবা গোমাংস ভক্ষণ বা পাচারের অভিযোগে মুসলমান হত্যার মতো ঘটনাগুলোকে বামপন্থীরা বলেন— আসল ইস্যু থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আসল ইস্যুগুলো কী? না বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। তাঁরা কিছুতেই মানবেন না, আরএসএস-বিজেপি মন্দির-মসজিদ, শিবাজি-মোগল ইত্যাদিকেই বৃহদংশের মানুষের কাছে আসল ইস্যু বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে। সে কারণেই উত্তরভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম সংসদ আয়োজিত হয়, যেখানে প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়। প্রশাসন যে কিছুই করে না সে তো প্রত্যাশিত, কিন্তু আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষই যে এইসব সংসদে যান তা সম্ভবই হত না তাঁদের কাছে বামপন্থীরা যেগুলোকে আসল ইস্যু বলেন সেগুলো নকল ইস্যু হয়ে না-গিয়ে থাকলে।

রাহুল কিন্তু এই কথাটা বোঝেন। তিনি জানেন, আসলে লড়াইটা সাংস্কৃতিক। সংঘ মানুষের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলেছে। ভারত জোড়ো যাত্রায় তিনি যে বারবার বলছিলেন “নফরত কে বাজার মে মহব্বত কা দুকান খোলনে আয়া হুঁ” (ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে এসেছি) তা স্রেফ কাব্যি নয়, সচেতন রাজনৈতিক স্লোগান। এই সময়ের প্রয়োজনীয় স্লোগান। সম্প্রতি এক আলোচনাসভায় নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবাস করে আসা লেখক মনীশ আজাদের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। শ্রোতাদের একজন প্রশ্ন করলেন, হাথরসের সেই ভয়ঙ্কর ধর্ষণ ও খুনের পরেও সেখানকার নির্বাচনে বিজেপি কেন জেতে? লখিমপুর খেড়িতে বিজেপি নেতার ছেলে গাড়ির চাকার তলায় কৃষকদের পিষে দেওয়ার পরেও সেখানে বিজেপি কী করে জেতে? মনীশ বললেন, ৪০-৫০ বছরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংঘ মানুষের মধ্যে এই ভাবনা প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, আসল ইস্যু হল ধর্ম, বর্ণ, জাতি— এইসব। অন্যান্য ইস্যুতে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারো, রেগেও যেতে পারো। কিন্তু ভোট দেওয়ার সময়ে সেসব ভুলে ধর্মের ভিত্তিতে দেবে। উদাহরণ দিয়ে বললেন, জিএসটি নিয়ে ক্ষুব্ধ গুজরাতের ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন প্রবল আন্দোলন করার পরেই একটা শহরের রাজপথের ফেস্টুন ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, “হম নারাজ হ্যাঁয়, গদ্দার নহি” (আমরা বিরক্ত, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নই)। তারপর গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যথারীতি জেতে। সুতরাং বিজেপিকে হারাতে হলে এই মানসিকতাকে হারাতে হবে। অর্থনৈতিক অভাব অনটনই আসল ইস্যু, বাকি সবই নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা— এই বালখিল্য রাজনীতি ফল দেবে না। কারণ, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে, বাজারটা ঘৃণার। রাহুল তাই ভালবাসার দোকান খোলার কথা বলেছেন। দোকানে কতজন খদ্দের আসবে, সে তো পরের কথা। কিন্তু যত বেশি দোকান খোলা হবে বাজারের পরিবেশ যে তত বদলাবে, তাতে তো সন্দেহ নেই। সত্যিকারের বিজেপি-বিরোধীরা এ কথা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন তত ভাল। রাহুল মহাপুরুষ নন, সাধুসন্ত নন, বিপ্লবী তো ননই। তিনি একা কতটুকু পারবেন? তাঁর ক্ষয়িষ্ণু পার্টিই বা কতটা পারবে?

২০২৪ সালের নির্বাচন বস্তুত গণভোটে পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী। কার সঙ্গে কার কোথায় নির্বাচনী আসন সমঝোতা হবে না-হবে সেসব পরের কথা, পাটিগাণিতিক আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক প্রশ্ন ওই একটাই। এ কথা অস্বীকার করলে আত্মপ্রতারণা হবে।

এমন বাইনারি নিঃসন্দেহে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু আমাদের সামনে আশু বিপদটা যে একদলীয় শাসন।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত

হারানের নাতজামাই: স্মৃতিমেদুরতার নাটক

শিউরে ওঠার অনুভূতি কিন্তু হারানের নাতজামাই নাটকের শেষে হল না। যদিও শেষে মঞ্চে নির্মিত হল মাণিক লিখিত পুলিসকে ঘিরে ধরার দৃশ্য, যা দেখে মন্মথর মনে হয় “মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারাণের বাড়ীর লোকের জন্য চারদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে!”

ব্যর্থ বিপ্লব আর বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকার বলতে যা যা পড়ে থাকে তার মধ্যে প্রধান কি মধ্যবিত্ত স্মৃতিমেদুরতা? প্রশ্নটা আমার মত মাঝবয়সীর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ না দেখেছি তেলেঙ্গানার গণসংগ্রামের পার্টিকে, না দেখেছি ১৯৬৪ সালে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আগের পার্টিকে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর দ্বারা সংগঠিত তেভাগা আন্দোলনের মত কোনো বিদ্রোহ আমার জীবনে দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি। নকশাল আন্দোলনের মত কোনো বিপ্লব প্রচেষ্টাও দেখিনি। সবটাই আমার কাছে হয় ইতিহাস, নয় গল্পকথা। তেভাগা আন্দোলন বলতে ছোট থেকে শুনে আসা সলিল চৌধুরীর ‘ঘুমভাঙার গান’ ক্যাসেটটার কথাই প্রথমে মনে পড়ে। সে জিনিসও প্রযুক্তিগত কারণে এখন আর চলে না। মাঝে মাঝে রোদে দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টা করি না তা নয়, কিন্তু ক্যাসেট বাজাতে গেলে যে যন্ত্রটি দরকার তা বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে বহুকাল আগে। ঊর্ধ্বমুখী মধ্যবিত্ত অস্তিত্বে সপ্তাহান্তে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে হারানের নাতজামাই নাটকের মঞ্চায়ন দেখতে যাওয়া তাই অদেখা বিদ্রোহের ওম নেওয়ার চেষ্টা মাত্র।

গত ১৯ মার্চ (রবিবার) মধুসূদন মঞ্চে যাদবপুর রম্যাণীর নাটক দেখতে গিয়েছিলাম ওই ওমটুকু নিতেই। পর্দা ওঠার পরে যখন দেখি মঞ্চসজ্জায় চোখে পড়ার মত জায়গা করে নিয়েছেন চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ হোড় এবং নিভু নিভু আলোয় কৃষকদের বৈঠক চলছে, যা অবধারিতভাবে মনে পড়ায় সোমনাথ হোড়ের আঁকা একটি বিখ্যাত ছবিকে, তখনই আমার অদেখা বিদ্রোহের পরিবেশ তৈরি করতে সফল হয়ে যান মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পকে নাট্যরূপদানকারী অরুণ মুখোপাধ্যায়।

আমাদের যুগের শহুরে মধ্যবিত্ত বামপন্থার সঙ্গে লোকায়ত সংস্কৃতির ব্যবধান দুস্তর। লোকায়ত সংস্কৃতি আর আমরা বিপ্লবী সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি তা বিপ্রতীপ কোণে অবস্থান করে বললেও ভুল হয় না। আমাদের বামপন্থী গান, কবিতা, ছবি – সবকিছুরই মুখ পশ্চিম দিকে ঘোরানো। আমরা যতজন ‘বেলা চাও’ বা ‘জন হেনরি’ শুনেছি, ততজন যে ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য’ শুনিনি তা হলফ করে বলা যায়। এই নাটক দেখলে আঁচ পাওয়া যায়, এমনটি চিরকাল ছিল না। গোটা নাটক জুড়ে উদাত্ত কণ্ঠে গান গেয়ে চরণদাস (অভিজিৎ) চরিত্রটি বিদ্রোহকে কৃষক পরিবারের উঠোনে শক্ত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। গ্রামের যাত্রাদল এবং সে দলের অভিনেতাদের বিদ্রোহের সঙ্গে তলে তলে জড়িয়ে থাকাও বিপ্লবী সংস্কৃতি আর লোকায়ত সংস্কৃতির মেলবন্ধন তুলে ধরেছে। এর তুঙ্গ মুহূর্ত তৈরি হয় যখন হারানের (মাণিকের বানান অনুযায়ী হারাণ) বাড়ির দাওয়ায় কৃষকদের সঙ্গে মিলে চরণদাস শোনায় সদ্য বাঁধা গান ‘ন্যাংটার নেই বাটপাড়ে ভয়’। গানটি বাঁধা হয়েছে রামপ্রসাদী ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না’ গানের সুরে। গোটা নাটকে ওই একটি সময়েই মনে হল প্রেক্ষাগৃহের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি বড় বেশি সক্রিয়। আমার দেশের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবনধারণ করা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আমার অপরিচয়ের পরিমাণ শিরশিরানি ধরিয়ে দিল। কী হতে পারত আর কী হচ্ছে – সেকথা ভেবে বিষণ্ণ লাগল। হয়ত অপ্রাসঙ্গিক, তবু খেয়াল হল, যে মঙ্গলশঙ্খ ছাড়া হিন্দু বাড়ির পুজোআচ্চা চলে না সেই শাঁখ বাজিয়েই এককালে এ দেশে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিদ্রোহীদের সাবধান করে দেওয়া হত – পুলিস আসছে। আজ মন্দিরের মাইক থেকে জানান দেওয়া হয় – অমুক মুসলমানের বাড়ির ফ্রিজে হিন্দুদের পূজনীয় প্রাণির মাংস আছে। চলো বিহিত করে আসি।

মাণিক গল্পের নামে হারাণ চরিত্রটিকে রেখেছিলেন বটে, কিন্তু আখ্যানে সে চরিত্রের ভূমিকা নগণ্য। অরুণবাবুর নাট্যরূপে হারাণের অভিনয় করার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে এবং সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন প্রবীণ অভিনেতা শ্যামল চক্রবর্তী। গল্পের মতই এই নাটকেও অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ময়নার মা। মেক আপের দিক থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাজানো গোছানো মনে হলেও দেবলীনা চক্রবর্তী সব মিলিয়ে মন্দ নন। বিশেষত দারোগা মন্মথর (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়) মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভুবন মণ্ডলকে বাঁচানোর দৃশ্য, যা আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে তিনি চমৎকার। মন্ডলের চরিত্রে চন্দন সেন বা চণ্ডী ঘোষের চরিত্রে মেঘনাদ ভট্টাচার্যের অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাঁদের অভিনয় ক্ষমতা তো প্রমাণিত। তবে মথুর চরিত্রে সৌমিত্র মিত্র অতখানি মাতাল না হলেও হয়ত ক্ষতি ছিল না। হারানের নাতজামাই নাটক দেখতে গিয়ে কেষ্ট মুখার্জিকে মনে পড়া খুব সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।

দর্শককে টিকিটের দাম চুকিয়ে দেওয়ার তাগিদেই কিনা জানি না, এই নাটক হাস্যরস সৃষ্টির দিকে একটু বেশিই নজর দিয়েছে। উপরন্তু চণ্ডী ঘোষ আর সাতকড়ি (সৌমিত্র বসু) কতটা খারাপ লোক তা প্রমাণ করতে গিয়ে যেসব দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে সেগুলি বড় বেশি করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বেশি বয়সে যেসব উচ্চকিত বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেগুলির কথা মনে পড়ায়। কোনো সাহিত্যকর্মের নাট্যরূপ দেওয়ার অভিশাপই এই। যা যা সংযোজিত হল তা আখ্যানে নতুন মাত্রা যোগ করল কিনা সে প্রশ্ন দর্শকের মনে এসেই পড়ে। বাংলার জোতদাররা সব সাধুপুরুষ ছিল এমন দাবি নিশ্চয়ই কেউ করে না, মাণিক তো করতেন না বটেই। কিন্তু এখানে গ্রামের বিধবা হরিমতীর (সুজাতা সরকার) সঙ্গে চণ্ডী ঘোষের যে অবৈধ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে তা বিদ্রোহকে কতখানি ঘনীভূত করেছে তা অন্তত আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

অবশ্য মাণিকের গল্পের মূল সুর বিদ্রোহ হলেও এই নাটক সেখান থেকে বেশ খানিকটা সরে গেছে। ফলে হারানের নাতজামাই জগমোহনের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। মাণিকের জগমোহন ফিটফাট কড়া ধাতের লোক, পেলবতার লেশমাত্র নেই। অরুণবাবুর জগমোহন (শুভঙ্কর মুখার্জ্জী) তোতলা, বাপের সামনে কেঁচো হয়ে থাকে, রামায়ণ পালায় জটায়ুর চরিত্রে অভিনয় করে এবং এতটাই পেলব যে সীতার ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েলি স্বভাবের রসিক (গৌতম সেন) তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনাদায়ী রুপোর গয়নার জন্যে বউকে শ্বশুরবাড়িতে ফেলে রাখা নিয়ে মাণিকের জগমোহনের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে শ্বশুরবাড়ি যায় বউয়ের জন্যে মনটা হু হু করেছে বলে নয়, লোকমুখে বউয়ের ব্যভিচারিণী হওয়ার গল্প শুনে। ময়নাদের গ্রামের বিদ্রোহী মেজাজ যে তাকে আদৌ স্পর্শ করেছে এমন ইঙ্গিত মাণিক প্রায় শেষ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত দেন না। দারোগা মন্মথ ময়নার থুতনিতে হাত দিতে এলে সে যে “লাফিয়ে এসে ময়নাকে আড়াল করে গর্জে ওঠে”, তা কতটা বউয়ের প্রতি প্রেমে আর কতটা অধিকারবোধে সেকথা ভাবার ভার মাণিক পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন মায়ার জঞ্জাল: যে কলকাতা দেখতে পাই না, দেখতে চাই না

অরুণবাবুর জগমোহন কিন্তু ময়নার প্রেমে ডগমগ। এত প্রেম থাকতে সে আগে কেন বউকে নিতে ছুটে আসেনি সাতকড়ির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। এই নাটকে ময়না সত্যিই অন্য কারোর সঙ্গে রাত কাটিয়েছে কিনা সে প্রশ্ন করতে জগমোহন আসেও না, আসে তার বাবা সাতকড়ি। এসে বলে বউকে সে আর ঘরে নেবে না। জগমোহন বরং পরে এসে বাবার সিদ্ধান্ত নস্যাৎ করে এতদিন পরে বউয়ের সঙ্গে প্রেম করতে বসে। মাণিকের গল্পের সুস্পষ্ট রাজনীতি নাটকের এই শেষ দৃশ্যে এসে একেবারে ভেঙে পড়ে। গল্প পড়লে পরিষ্কার হয়, যে কেবল কৃষক নেতা মণ্ডল নয়, একটি গোটা পরিবার বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রামের মানুষের কাছে। জগমোহনও যে শেষপর্যন্ত বিদ্রোহের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, ময়নাকেও স্ত্রী হিসাবে পাশে নিয়েছে – এতগুলো কথা মাণিক বুঝিয়ে দেন একটিমাত্র বাক্যে – “ময়না তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়েই রক্ত মুছিয়ে দিতে আরম্ভ করে জগমোহনের।” শিউরে উঠে পাঠক বুঝতে পারে, জগমোহন মণ্ডল না হলেও, আগের রাতে পুলিসকে ধোঁকা দেওয়ায় যুক্ত না থাকলেও গ্রেপ্তার বরণ করেছে বিদ্রোহের দায় স্বীকার করে। আগের রাতে যে হারানের নাতজামাই ছিল সে বিদ্রোহী, আজ সকালে যে হারানের নাতজামাই সে-ও বিদ্রোহী। এ যেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই অমোঘ পংক্তি “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।”

এই শিউরে ওঠার অনুভূতি কিন্তু হারানের নাতজামাই নাটকের শেষে হল না। যদিও শেষে মঞ্চে নির্মিত হল মাণিক লিখিত পুলিসকে ঘিরে ধরার দৃশ্য, যা দেখে মন্মথর মনে হয় “মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারাণের বাড়ীর লোকের জন্য চারদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে!” কিন্তু তার আগেই অরাজনৈতিক হয়ে গেছে নাটকটি। ফলে জোতদার আর পুলিসকে যখন মঞ্চে ঘিরে ফেলে সশস্ত্র কৃষকরা, আর বেজে ওঠে “হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো”, তখন ছোটবেলা থেকে শুনে আসা গানের স্মৃতিমেদুরতাটুকু নিয়েই বেরিয়ে আসা যায় প্রেক্ষাগৃহ থেকে। তার বেশি কোনো সঞ্চয় থাকে না। সে অবশ্য আমার মুদ্রাদোষও হতে পারে। আমি তো কখনো রক্তে ধান বুনিনি, আমি পঞ্চাশ টাকা কিলো মিনিকিট চালের ভাত খাই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

চাকরি চুরির চাঁইদের শেষ অব্দি কী গতি হয়?

অতগুলো চাকরি চুরি এবং রহস্য মৃত্যুর পরেও সিবিআই কয়েকশো চার্জশিট দাখিল করার বেশি কিছু এখনো করে উঠতে পারেনি। বিজেপিও ক্ষমতায় ফিরে এসেছে

“চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে–/ চোর চাই যে ক’রেই হোক, চোর চাই।” বাঙালির রবীন্দ্রনাথ পাঠ যত কমে আসছে, তাঁর বিভিন্ন পংক্তি বর্তমানের ব্যাখ্যায় যেন তত লাগসই হয়ে উঠছে। পাহাড়প্রমাণ চুরির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। শুরু হয়েছিল একটি ফ্ল্যাটে ৫০ কোটি টাকার পাহাড় দিয়ে, এখন ক্রমশ সেই পাহাড়কে নেহাতই শুশুনিয়া বলে মনে হচ্ছে। আমরা ঘাড় উঁচু করেই চলেছি, তবু এই চাকরি চুরির পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে না। সন্দেহ হয়, চূড়ায় পৌঁছনোর ইচ্ছাও হয়ত তদন্তকারী সংস্থাগুলোর নেই। কারণ সেই জ্যাক ও বীনগাছের গল্পের মত মেঘের উপরে এই দুর্নীতির পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলে হয়ত কোনো নরখাদক দৈত্যের দেখা মিলবে, যাকে সামলানোর ক্ষমতা সিবিআই, ইডির জাঁদরেল অফিসারদেরও নেই। ফলে যে করেই হোক মেজ, সেজ, রাঙা, ছোট চোরেদের ধরে আনা হচ্ছে। কদিন সংবাদমাধ্যমে তুমুল হইচই হচ্ছে, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কুনাট্য চলছে এইসব চোরেদের মধ্যে। ব্যাপারটা মুচমুচে করে তোলার জন্য নিয়মিত ব্যবধানে একজন করে মহিলার নাম ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘটনায় তাঁর অংশগ্রহণ কতটুকু, তদন্তকারী সংস্থা আদৌ তাঁকে অভিযুক্ত করছে কিনা – এ সবের খোঁজে না গিয়েই টিভি চ্যানেল এবং খবরের কাগজগুলো সোশাল মিডিয়া ঘেঁটে তাঁদের ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রকাশ করে দিচ্ছে। ফলে অভিযুক্তদের প্রেমিকা, প্রাক্তন প্রেমিকা, স্ত্রী, প্রাক্তন স্ত্রী – সকলেই বাজার ঘাটে মুখরোচক আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠছেন। এতে দুর্নীতির কূলকিনারা কতটা হচ্ছে জানি না, তবে নিঃসন্দেহে আমাদের অনেকের যৌন হতাশা প্রকাশিত হচ্ছে।

সত্যি কথা বলতে, কোনো অপরাধে অভিযুক্তদের শেষপর্যন্ত শাস্তি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সিবিআই বা ইডির সাফল্যের হার ঈর্ষণীয় নয়। সিবিআইয়ের দীর্ঘকালীন পরিচিতি বিরোধীদের জব্দ করার জন্যে ব্যবহার্য কেন্দ্রীয় সরকারের পেয়াদা হিসাবে। ২০১৩ সালে খোদ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এম লোধা বলেছিলেন সিবিআই হল “কেজড প্যারট”, অর্থাৎ খাঁচাবন্দি তোতাপাখি। গত এক দশকে সিবিআই এমন কিছু করেনি যাতে মনে করতে হবে তাদের ভূমিকার কোনো পরিবর্তন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চোখে তাই সিবিআই, ইডি নায়ক হয়ে উঠছে না। নায়ক হচ্ছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত বিচারপতিরা। ট্রেনে বাসে এক যাত্রী অন্য যাত্রীকে জিজ্ঞেস করছেন “অভিজিৎবাবুর রিটায়ারমেন্ট কবে? তার মধ্যে এদের পাকাপাকি ব্যবস্থা না করতে পারলে তো ঠিক বেরিয়ে যাবে।” ভারত অবতারবাদের দেশ। অধর্মের চূড়ান্ত হতে থাকলে যুগে যুগে আবির্ভূত হয়ে ভগবান দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করেন – এমনটাই বিপুল সংখ্যক মানুষের কয়েক হাজার বছরের বিশ্বাস। ফলে মানুষ যে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর উপর নয়, এমনকি বিচারব্যবস্থার উপরেও নয়, বিশেষ একজন বিচারপতির কাছে ন্যায় পাওয়ার আশা করছেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর কেটে গেলেও যে অবতারবাদ কাটিয়ে উঠে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরে এ দেশের মানুষের আস্থা তৈরি হল না, তার জন্য কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোই দায়ী।

উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যে নিয়োগ দুর্নীতির জালে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল এখন নিজেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে এবং বেরোবার প্রাণপণ চেষ্টায় বনলতা সেনগিরি (whataboutery) করতে গিয়ে হাস্যকর ‘চিরকুট’ প্রকাশ করছে, তেমনই এক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধেও উঠেছিল।

মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রমের প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার জন্যে ১৯৮২ সালে গঠিত হয় বৈষয়িক পরীক্ষা মন্ডল (ইংরেজি আদ্যক্ষর অনুযায়ী Vyapam)। পরে ২০০৮ সালে সরকারি চাকরি পাওয়ার পরীক্ষাও এই সংস্থার অধীনে নিয়ে আসা হয়। ২০০৯ সালে মেডিকাল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু হয় এবং সেবছর ডিসেম্বরে প্রচুর অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে একটা প্যানেল গঠন করেন। চার বছর পরে পুলিস এমন ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে যারা অন্যের হয়ে মেডিকালের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছিল বলে অভিযোগ। ১৬ জুলাই জগদীশ সাগর নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যে নাকি এই চক্রের মাথা। এরপর স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তদন্তের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় এবং পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতিতে যেমন হাজার হাজার চাকরি যাচ্ছে, ব্যাপম কেলেঙ্কারিতেও সেইসময় কয়েকশো প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে যাওয়া ডাক্তারি শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মা গ্রেপ্তারও হয়ে যান (পার্থ চ্যাটার্জির কথা মনে পড়ছে না?)। তারপর শুরু হয় রোমহর্ষক কাণ্ড। এই মামলার অভিযুক্ত এবং সাক্ষীদের পরপর মৃত্যু ঘটতে থাকে।

২০১৫ সালের জুন মাসে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমই বলেছিল মামলার সঙ্গে জড়িত ২৩ জন মারা গেছেন। জুলাই মাসের গোড়ায় এমনকি ব্যাপম নিয়ে প্রতিবেদন লিখছিলেন এমন এক সাংবাদিকেরও মৃত্যু হয়। অন্যতম অভিযুক্ত ডাক্তারির ছাত্রী নম্রতা ডামরোর কিছুদিন আগে রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছিলেন। সাংবাদিক অক্ষয় সিং নম্রতার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসার কিছুক্ষণ পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই এই তদন্তের দায়িত্ব হাতে নেয়। ঠিক পরেরদিন জব্বলপুরের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস মেডিকাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মাকে দিল্লিতে তাঁর হোটেলের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিবিআইকে তদন্ত করতে দিতে রাজি হন। অবশ্য তাতেও পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি। নম্রতার কেস ফাইল আবার খোলা হয়। কিন্তু যে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আগে বলেছিল শ্বাসরোধ করে হত্যা, দুমাস পরে তা বলে আত্মহত্যা। শিবরাজের পদত্যাগের দাবি উঠেছিল। কিন্তু তিনি সে দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেন তিনিই ব্যাপম কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছেন।

সকলেই জানেন ইতিমধ্যে মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ মুখ্যমন্ত্রী পদে ফিরে এসেছেন। সিবিআই ২০১৫ সালে তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে ৪০ জন তদন্তকারীর বিরাট দল তৈরি করেছিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেড়শো জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের কেসও ফাইল করেছিল। পরে সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কয়েক হাজারে পৌঁছয়। পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত যেমন স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে শুরু হয়ে এখন পৌরসভার মত অন্যান্য সরকারি চাকরির নিয়োগেও পৌঁছে গেছে, ব্যাপম তদন্তও সেভাবে ডাক্তারির পরীক্ষায় দুর্নীতি থেকে আরম্ভ হয়ে মধ্যপ্রদেশ সরকারের অন্যান্য দপ্তরের নিয়োগে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত হলটা কী?

আরও পড়ুন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়াই কি উদ্দেশ্য?

এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি, দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিবিআই আরও ১৬০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে। এই নিয়ে তদন্তের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ৬৫০ জনকে চার্জশিট দেওয়া হল। এর মধ্যে বিভিন্ন মেডিকাল কলেজের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মানিক ভট্টাচার্য বা সুবীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের মত। এছাড়া আধিকারিকদের ঘুষ দিয়ে অন্যকে দিয়ে নিজের পরীক্ষা দেওয়ানোয় অভিযুক্তরাও রয়েছে। অর্থাৎ সেই মেজ, সেজ, রাঙা, ছোট চোরেরা। লক্ষ্মীকান্ত শর্মা ছাড়া গুলাব সিং কিরার এবং প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্যপাল রাম নরেশ যাদব – এইটুকুই নাকি রাজনৈতিক যোগ। ঘটনার সময়কার মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজের পাঞ্জাবিতে কাদার ছিটে পর্যন্ত লাগেনি।

অতগুলো চাকরি চুরি এবং রহস্য মৃত্যুর পরেও সিবিআই কয়েকশো চার্জশিট দাখিল করার বেশি কিছু এখনো করে উঠতে পারেনি। বিজেপিও ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, সে যেভাবেই আসুক। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসেরও হয়ত আতঙ্কিত বা আশাহত হওয়ার কারণ নেই। সে যতই চাকরি চুরি যাওয়া ছাত্রছাত্রী, ইচ্ছুক শিক্ষকরা বছরের পরে বছর রাস্তায় বসে থাকুন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: