বাবুসোনা সংস্কৃতি

আমরা বাঙালিরা তো প্রগতিশীল, তাই হয়ত আমাদের ছেলেটি কোরোনাকে “জানিস আমার মা কে” বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল

আশির দশকে বাবা-মায়ের সাথে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যেতাম। আমি তখনো প্রাথমিকে, সে কলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলের উঁচু ক্লাসে প্রথম সারির ছাত্র। তার ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বরের গর্বে তার বাবা-মা তো বটেই, প্রতিফলিত গৌরবে আমাদের অন্য আত্মীয়স্বজনদেরও মাটিতে পা পড়ে না। তাদের বাড়ি গেলে কিন্তু বোঝা যেত তার বাবা-মা গৌরবে বহুবচন চান না মোটেই। যত নিকটাত্মীয়ই আসুক, সে পড়ার টেবিল ছেড়ে নড়ত না। তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলেটিকে আমার মনে হত পঞ্চাশোর্ধ্বের মত রাশভারী। এমন নয় যে এই রুটিন কেবল পরীক্ষার আশেপাশে। বারো মাস সে এভাবেই চলত। স্বভাবতই আমার মত শৈশব পার না হওয়া আত্মীয়দের কাছে বড়রা ঐ ছেলেটিকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে হাজির করতেন। বড়রা বারবার শোনাতেন “ওর মত হওয়ার চেষ্টা করো। দেখেছ কেমন লেখাপড়ায় মন? বাড়িতে যে-ই আসুক, ঝড় উঠুক, বন্যা হয়ে যাক, ও কিন্তু পড়া ছেড়ে ওঠে না।”

বড় পরীক্ষাগুলোতে ভাল নম্বর এবং শিক্ষান্তে মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া যদি মানুষ হওয়ার মাপকাঠি হয় তাহলে বলা দরকার যে ছেলেটি সত্যিই মানুষ হয়েছে। আমি নিশ্চিত এই পথে হেঁটে এরকম মানুষ হওয়া মানুষ আমরা সকলেই কাঁড়ি কাঁড়ি দেখেছি গত ৩০-৪০ বছরে, এখনো দেখছি। প্রশ্ন হল সফল মানুষ আর ভাল মানুষ কি একই? ভাল মানুষ মানেই বা কী? যে মন দিয়ে রোজগার করে সংসার চালায় তার বাকি সমাজের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা না থাকলে, চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন হলেও কি তাকে ভাল মানুষ বলা যায়?

এই প্রশ্নগুলো কদিন আগে করলেও হাঁ হাঁ করে উঠতেন অনেক ভদ্রজন, বাকিরা পাত্তা দিতেন না। কিন্তু রোগ বড় বালাই, বিশেষত অতিমারী। গত দুদিন ধরে যেভাবে সকলে একটি অক্সফোর্ডের ছাত্র এবং তার বাবা-মাকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অভিযুক্ত করছেন তা দেখে অপ্রিয় প্রশ্নগুলো তোলার ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললাম।

নিজের কাছে সৎ থাকতে হলে মানতেই হবে এই প্রশ্নগুলো গত সাড়ে তিন দশক আমরা একেবারেই নিজেদের করিনি, অন্যদেরও করিনি। এগুলো অবান্তর হয়ে গেছে। ছোট থেকেই শিখে গেছি যে আমি মানুষ হয়েছি কিনা তার প্রমাণ হল আমি কোন পেশায় আছি এবং কত রোজগার করি। অতএব আমার ক্লাসের যে ফার্স্ট বয় পরে তত ভাল রেজাল্ট করতে না পেরে এখন সামান্য ব্যাঙ্ককর্মী, তার চেয়ে বেশি মানুষ হয়েছে থার্ড বয়। কারণ সে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে। এমন নয় যে কেবল অন্যরাই এভাবে ভাবে। ফার্স্ট বয় নিজেও ভাবে “আমার দ্বারা কিস্যু হল না। ও শালা স্কুলে কোনোদিন আমাকে ছুঁতে পারত না, কপাল জোরে কোথায় উঠে গেল!”

আমাদের প্রজন্ম এভাবেই ভাবতে শিখেছে এবং আমরা বাবা-মা হয়েও আমাদের নার্সারি স্কুলে যেতে শুরু করা ছেলেমেয়েদের এভাবেই ভাবতে শেখাচ্ছি। লক্ষ্য করুন, এই চিন্তার সমস্তটা জুড়েই আমি, কোথাও আমরা নেই। বন্ধুর সাফল্যে আনন্দ পাওয়া নেই, বন্ধুর ব্যর্থতায় কষ্ট পাওয়া নেই। দু-তিন প্রজন্ম ধরে এহেন স্বার্থপরতার কৃষিকাজ চালালে যেমন ফসল ফলে আমাদের বিলেত ফেরত বাবুসোনা ভাইটি তাই — তার বেশি কিচ্ছু নয়। আর তার বাবা-মা যে অপরাধ করেছেন তা শুরু হয়েছে তার ছোটবেলায়। সেই একই অপরাধ আমাদের অনেকের বাবা-মাই করেছেন। এমন করে গায়ে লাগেনি বলে সমাজ সেটাকে অপরাধ বলে চিহ্নিতই করেনি এতদিন। ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে কেবল শিখেছে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারলেই তার কাজ শেষ। দুনিয়ার কারোর প্রতি তার কোনো কর্তব্য নেই। ওই যে আমার আত্মীয় সম্পর্কে বড়রা বলতেন “বাড়িতে যে-ই আসুক, ঝড় উঠুক, বন্যা হয়ে যাক” ইত্যাদি। অর্থাৎ ঝড়ে তোমার প্রতিবেশীর ঘরের চাল উড়ে গিয়ে সে নিরাশ্রয় হয়ে যাক, তুমি বাবা-মায়ের বানিয়ে দেওয়া পড়ার ঘরে মোটা মাইনের চাকুরে হওয়ার প্রস্তুতি চালিয়ে যাও। বন্যায় তোমার আত্মীয়ের ঘর ভেসে যাক, তোমার দু ফোঁটা চোখের জল ফেলারও দরকার নেই, তুমি কেশব নাগের অঙ্কগুলো শেষ করো। ভাগ্যিস কেশবচন্দ্র নাগের অঙ্ক বইই কিনে দেওয়া হত আমাদের, তাঁর কষ্ট করে লেখাপড়া করার ইতিহাস পড়ানো হত না। অবশ্য হলেই বা কী হত? আমরা মুখস্থ করতাম আর পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে ভুলে যেতাম। যেমনটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে করেছি।

তা এইভাবে যে বাবুসোনাদের তৈরি করা হচ্ছে, কী করে আমরা আশা করছি যে তারা নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ ফুর্তির বাইরে কিছু ভাববে? গায়ে যখন জ্বর নেই, গলায় ব্যথা নেই, কাশি হচ্ছে না, তখন বাবুসোনা কেন মায়ের অফিসে কলার তুলে ঘুরতে যাবে না? কেন গিয়ে লাইন দেবে হাসপাতালে? তা-ও আবার সরকারি হাসপাতালে? ওসব হাসপাতাল তো তার বাড়ির কাজের মাসির জন্যে। আর মা-ই বা কেন ছেলেকে আদর করে অফিসে, মলে, ক্লাবে ঘোরাবেন না? কজনের ছেলে অক্সফোর্ডে পড়তে যায়? চুলোয় যাক জনস্বাস্থ্য, চুলোয় যাক সাবধানতা।

খুব খারাপ লাগছে তো কথাগুলো? বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে তো? তাহলে বলি। আমি যে স্কুলের ছাত্র, সেই স্কুলের আন্তঃক্লাস ফুটবল প্রতিযোগিতা হয় প্রয়াত মাস্টারমশাই পাঁচুগোপালবাবুর নামে। তাঁকে আমরা পাইনি। আমাদের ইংরিজির মাস্টারমশাই সোমনাথবাবু একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন “পাঁচুবাবু যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন, তখন হাসপাতালে রাত জেগেছিল আমাদের খারাপ ছাত্ররা, ভাল ছাত্ররা নয়।”

আমাদের সময় থেকেই এমন হয়। কারণ বাবা-মা শেখান পড়াশোনা করা এত বিশাল একটা কাজ যে ওটা করে আর কিচ্ছু করা যায় না। কারো জন্যে হাসপাতালে রাত জাগা যায় না, বাড়িতে কেউ এলে গল্পগুজব করা যায় না, এমনকি পাঠ্যের বাইরে ভাল বই-টই পড়াও যায় না। যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, বাংলা ক্লাসে আমাদের মাস্টারমশাই সুশান্ত বসু এক ভাল ছাত্র কোনো এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের নাম শোনেনি শুনে হতাশ হয়ে বলে ফেলেছিলেন “এত বয়স হয়ে গেল ওঁর কোন লেখা পড়নি? জীবনটা কাটাবে কী করে!” কী কুক্ষণেই বলেছিলেন! হোস্টেলে ফিরে অন্য এক ভাল ছাত্র নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিল, যার মূল উপজীব্য “সাহিত্য-ফাহিত্য পড়ে নষ্ট করার মত সময় নেই। এখন সামনে হায়ার সেকেন্ডারি, তারপর জয়েন্ট। এস্ট্যাবলিশড হয়ে নিই, তারপর বই ফই পড়া যাবে।”

আমার সেই সহপাঠীরও দোষ নেই। বাবুসোনা সংস্কৃতির ওই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু পড়ার কোনো দরকার নেই, যারা পড়ে তারা ফালতু। আমার এক মেধাবী বন্ধু উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ে সাড়া জাগানো ফল করেছিল। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফল বেরোবার পর তার বাড়ি গিয়ে আমার মনে হয়েছিল কেউ মারা গেছেন। কারণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তার হাজার তিনেক র‍্যাঙ্ক হয়েছে, বাবা বলেছেন “ওর লাইফ শেষ”। এই কারণে পিটার উইর পরিচালিত ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ ছবিটা দেখলেই মনে হয় এটা এই বাংলারই গল্প।

অবশ্য আমাদের বাবুসোনা সংস্কৃতি এমন জোরদার যে জন কিটিং (যে চরিত্রে রবিন উইলিয়ামস অভিনয় করেছিলেন)-এর তুলনায় অনেক নিরামিষ কথাবার্তা বলেই আমাদের সুশান্তবাবু ছাত্রদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

অথচ বাঙালি ছেলেরা এমন বাবুসোনা চিরকাল ছিল না কিন্তু। নইলে ক্ষুদিরামকে পাওয়া যেত না, বিনয় বাদল দীনেশ হত না, নকশালবাড়ি আন্দোলন বলেও কিছু ঘটত না। সেকথা থাক, বাবুসোনাদের বিদ্রোহী বিপ্লবী হওয়ার দরকার নেই (ক্ষুদিরাম তো কবেই আমাদের ঠাট্টার পাত্র হয়ে গেছেন), একটু মানুষের মত মানুষ হলেই যথেষ্ট হয়। কিন্তু কী করে হবে? মানুষ যেমন সমাজ তৈরি করে, সমাজও তো মানুষ তৈরি করে। আমাদের সমাজ তো ক্রমশ উন্নততর বাবুসোনার কারখানা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল দেখি পাড়ার বাচ্চারা মাঠে খেলার সময় মায়েরা বসে থাকেন পাশে। পড়ে গেলে দৌড়ে আসেন, খেলতে খেলতে ছোটদের মধ্যে ঝগড়া লাগলে প্রায়শই তা মায়েদের ঝগড়ায় পরিণত হয়। অর্থাৎ শিশু ছোট থেকেই শিখছে সে কখনো ভুল করে না, সে যা চায় সেটাই তার অধিকার।

বছর দুয়েক আগে আমাদের এক প্রতিবেশী মারা গেলেন। আমাদের পাড়া থেকে শ্মশান অনেক দূরে হওয়ায় কেউ মারা গেলে ম্যাটাডোরে করে নিয়ে যাওয়া হয় সাধারণত। শ্মশানযাত্রীতে ভরে যায় সে ম্যাটাডোর, অল্পবয়সীরা থাকে বেশি সংখ্যায় — এমনটাই কৈশোর থেকে দেখে আসছি। সেবার দেখলাম ম্যাটাডোরের উপর বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে। আরো যা বিস্ময়কর, একটি বছর কুড়ির ছেলেকে বাদ দিলে শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব আমিই সর্বকনিষ্ঠ। বাবুসোনারা বোধহয় টিউশনে ব্যস্ত ছিল। আমাদের মফস্বলেই এই অবস্থা, কলকাতার খবর জানি না।

এবার প্রবল আপত্তি উঠবে। যদি শ্মশানে, হাসপাতালেই ঘুরে বেড়ায় পড়ুয়ারা, তাহলে লেখাপড়া করবে কখন? এমন আপত্তি আমাদের বাবা-মায়েরা আর আমরাই করে থাকি। তার আগের লোকেরা করতেন না। বলা হয় আগে নাকি “কম্পিটিশনের যুগ” ছিল না, তাই অন্য সবে মন দেওয়া সম্ভব ছিল। অথচ আমরা এ ধরাকে ধন্য করে দেওয়ার অনেক আগেই দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, দেশ ভাগ হয়েছে। ভদ্রসন্তানদের পর্যন্ত দুমুঠো ভাতের জন্য করতে হয়নি এমন কাজ নেই। তার চেয়ে বেশি কম্পিটিশনে আমাদের পড়তে হয়েছে কি?

লেখাটা যদি এতদূর অব্দি পড়ে ফেলে থাকেন তাহলে হয়ত খেয়াল করেছেন আমি কেবল ছেলেদের কথাই বলে যাচ্ছি, ভদ্রলোকের মেয়েদের কথা বলছি না। তার মানে এই নয় যে ভদ্রজন মেয়েদের দারুণ সামাজিক জীব তৈরি করছেন। এ যুগের আলালদের ঘরে কেবল দুলাল তৈরি হয় না, বিলক্ষণ দুলালীও হয়। সেই সোনামণিরা বাবুসোনাদের চেয়ে যে মোটেই আলাদা নয় তা-ও দেখা যাচ্ছে কয়েকজন বিলেত ফেরতের খবরে। বিলেত না যাওয়া মেমদের কোরোনার কারণে স্কুল কলেজ না থাকার সুযোগে দলবদ্ধ ফুর্তি দেখেও টের পাওয়া যাচ্ছে। তবু একে বাবুসোনা সংস্কৃতিই বলছি কারণ এই ধারাটি বাঙালি তৈরি করেছিল পুত্রসন্তানদের কথা ভেবেই। তার প্রমাণ এক-দেড় দশক আগেও বিজ্ঞান শাখায় বাঙালি মেয়ের অভাব।

বাবা-মায়েরা বলতেন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হলে জীবন বৃথা। তারপর বেশ নিঃসঙ্কোচে বলতেন “মেয়ে হলে অত চিন্তা করতাম না। কিছু না হলে বিয়ে দিয়ে দেব, মিটে যাবে।” তাই সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ বানানোর তাগিদ মেয়েদের বেলায় কম দেখা যেত। ফলত আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র তারা দুঃখ করত “তোদের আর্টসের ক্লাসগুলোতে কত মেয়ে থাকে, আমরা তিরিশটা ছেলে আর দুটো মেয়ে। প্রেম করতেও কম্পিটিশন।” কথাটা মজা করে বলা হলেও একটা বড় সত্য বেরিয়ে আসে, তা হল ছেলেরা যা হলে মানুষ হয়েছে বলে বাবা-মায়েরা মনে করতেন মেয়েদের তা না হলেও চলত। মেয়ে মাস্টারি করলেও মানুষ, ছেলে মাস্টার হলে “ফেলিওর”।

বাবুসোনা সংস্কৃতি কী দিয়েছে বাঙালিকে? সমাজ সংসার ভুলে লেখাপড়া করে কজন বাঙালি প্রযুক্তিতে আলাদা করে বলার মত অবদান রেখেছে গত তিরিশ বছরে? গত চল্লিশ বছরে কজন বাঙালি ডাক্তারকে সারা ভারত এক ডাকে চিনেছে? নাহয় অত বড় না-ই হল, স্থানীয় মানুষ নাম শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত করে এমন ডাক্তারই বা কজন হয়েছে সারা পশ্চিমবঙ্গে? উত্তরে লবডঙ্কার বেশি কিছু পাওয়া শক্ত। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সাড়া জাগানো কটা কবিতা লেখা হয়েছে বাংলায় বা কটা ফিল্ম তৈরি হয়েছে এই সময়ে সে প্রশ্ন করার কোন মানেই হয় না, কারণ ওসব লাইন যে মেধাবীদের জন্যে নয় তা তো বাবুসোনা সংস্কৃতি বলেই দিয়েছে। একই সঙ্গে ভুলিয়ে দিয়েছে যে সংস্কৃতি মানে কেবল নাচ, গান, ছবি আঁকা, নাটক করা, সাহিত্য রচনা নয়। বিজ্ঞানচর্চা, রাজনীতি — এসবও সংস্কৃতির অঙ্গ।

আসলে বিজ্ঞানচর্চা হবে কী করে? বাবুসোনা সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান পড়ার উদ্দেশ্য তো বিজ্ঞান শেখা নয়, মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া। আমার আরেক মাস্টারমশাই শাশ্বত ভট্টাচার্য যেমন একবার ক্লাসে বলেছিলেন “তোমরা বিজ্ঞান পড়ো এই কারণে নয় যে তোমরা বিজ্ঞান শিখতে চাও বা তোমরা বিজ্ঞানমনস্ক। তোমরা বিজ্ঞান পড়ো কারণ ওটা পড়লে বেশি ভাল চাকরি পাওয়া যায় বলে প্রচার আছে। যদি প্রচার থাকত কুসংস্কারে অনার্স পড়লে বেশি ভাল চাকরি পাওয়া যায়, তাহলে তোমরা কুসংস্কারেই অনার্স পড়তে।” কথাটা যে নেহাত অন্যায় বলেননি তা সেদিনের যে বাবুসোনারা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন সোশাল মিডিয়ায় দক্ষিণপন্থী ভুয়ো খবরের সপক্ষে গলা ফাটায় তাদের দেখলেই পরিষ্কার হয়।

আর রাজনীতি? ওরে বাবা! লেখাপড়া করে হাসপাতালে অসুস্থ লোককে দেখতেই যাওয়া যায় না, আবার রাজনীতি করা যাবে কী করে? করা যে যায় তার কিন্তু অনেক প্রমাণ আছে।

উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (বাবুসোনাদের বাবা-মায়েদের প্রিয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র) সিপিআইএমএল লিবারেশনের সর্বক্ষণের কর্মী হয়েছেন, সর্বভারতীয় সম্পাদক হয়েছেন। সিপিএমের সর্বভারতীয় সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও সিবিএসইর সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। অবশ্য বাবুসোনাদের বাবা-মায়ের বিচারে দুজনেই “ফেলিওর”। টাকা, গাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি — কিছুই করে উঠতে পারেননি। তবে সে বিচারে মানুষ হওয়া লোকেদের মধ্যেও কিন্তু ছাত্রনেতা পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টে আইন ব্যবসা করে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী এবং পরবর্তীকালে দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়া প্রয়াত অরুণ জেটলি ছাত্র রাজনীতি করতেন।

মোদ্দাকথা, বাবুসোনা আর সোনামণিরা স্বার্থপর, দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে ওদের উপর রাগ করবেন না। আমাদের ছানাপোনাগুলোও তো অমনিই হবে। দিল্লীতে নাকি লোকে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছা করার যুক্তি হিসাবে বলে “জানতা হ্যায় মেরা বাপ কৌন হ্যায়?” আমরা বাঙালিরা তো প্রগতিশীল, তাই হয়ত আমাদের ছেলেটি কোরোনাকে “জানিস আমার মা কে” বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল।

অনধিকার চর্চা

অমর্ত্য সেন যেখানে অর্থনীতি জানেন না সেখানে ডাক্তাররা চিকিৎসা করতে জানে এ কি বিশ্বাসযোগ্য?

২০১৭ সালের নভেম্বরে আমার ডেঙ্গু হয়েছিল। সেবার চারিদিকে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। বেশকিছু মানুষ মারা যান। আমি নার্সিংহোমের যে ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলাম সেই ওয়ার্ডেই আরো দু তিনজন মশাবাহিত রোগে ভুগছিলেন। একজনকে আমার চোখের সামনেই আই সি ইউ তে নিয়ে যাওয়া হল, পরে শুনলাম মারা গেছেন। কিন্তু পরিষ্কার মনে আছে, আমার রোগ নির্ণয় করে ডাক্তারবাবু ডেঙ্গু লেখেননি, লিখেছিলেন অজানা জ্বর। ডাক্তার আমার এক ডাক্তার আত্মীয়ের বন্ধু হওয়াতে তাঁকে একান্তে জিজ্ঞেস করা গিয়েছিল মুখে ডেঙ্গু বললেও লিখলেন না কেন। উত্তর দেওয়ার সময়ে ডাক্তারবাবুর কাঁচুমাচু মুখটা আজও মনে পড়ে। ডেঙ্গু লিখলেই সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা। অগত্যা।
অর্থাৎ কী রোগ হয়েছে সেটা এম বি বি এস, এম ডি ইত্যাদি করা ডাক্তার বোঝেন না, বোঝে সরকার। একে একনায়কতন্ত্র না বললে কাকে বলে জানি না। যে কোন একনায়কতন্ত্র শেষ পর্যন্ত কী করে? নৈরাজ্যের জন্ম দেয়। সোজা বাংলায় “বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো।” এখন সেই গেরোতেই আমরা পড়েছি। পশ্চিমবঙ্গের সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেই বাম আমল থেকেই রুগ্ন, মৃতপ্রায়। এই আমলে যোগ হয়েছে নতুন উপসর্গ — অবহেলার অভিযোগে ডাক্তার পেটানো।
আসলে এমন সুন্দর ব্যবস্থা তৈরি করেছি আমরা যে আমাদেরই ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কোন প্রশ্ন করা চলে না। করলেই কেউ বলেন “মাওবাদী”, কেউ বলেন “দেশদ্রোহী”। অথচ ডাক্তারদের যথেচ্ছ প্রশ্ন করা চলে, কিচ্ছু না জেনে বিজ্ঞের মত তাঁদের সিদ্ধান্তকে অপ্রয়োজনীয় বলে দেগে দেওয়া চলে। এ বিষয়ে হিন্দু, মুসলমান, ধনী, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কেউ কম যায় না। যার হাতে স্মার্টফোন আছে, সে-ই ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কেনার আগে একবার গুগল করে নিচ্ছে, তারপর নিজের বিবেচনা অনুসারে অমুক ওষুধটা খাচ্ছে আর তমুকটা খাচ্ছে না। মানে ডাক্তার পরিশ্রম করে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পাশ করলেন, তারপর পাঁচ সাত বছর পড়াশোনা করে এম বি বি এস হলেন, আরো দু তিন বছর পড়ে এম ডি বা এম এস কিছু একটা হলেন, কেউ কেউ এরপর আরো পড়াশোনা করে, ট্যাঁকের পয়সা খরচা করে আরো নানা ডিগ্রি পেয়ে যে চিকিৎসা করলেন সেটা যে ফালতু তা বুঝতে একটা গুগল সার্চই যথেষ্ট। যার স্মার্টফোন নেই তার আছে পাড়ার ওষুধের দোকান অথবা সর্বজ্ঞ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। কোন অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক খেতেই হবে, কোন অন্তঃসত্ত্বার অস্ত্রোপচার করার কোন দরকার নেই এগুলো আজকাল হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তও জানে। এবং তারা এও জানে যে তাদের হিসাব অনুযায়ী “চিকিৎসায় গাফিলতি” হলেই হাসপাতালে দলবল নিয়ে চড়াও হয়ে ভাংচুর, মারপিট করাই যায়। কেউ কিচ্ছু বলবে না। বরং আলাপ পরিচয় থাকলে স্থানীয় কাউন্সিলর, এম এল এ বা এম পি স্বয়ং দক্ষযজ্ঞে নেতৃত্ব দেবেন।
তাছাড়া যেহেতু “অ্যালোপ্যাথিতে আসলে শরীরের ক্ষতি করে”, তাই সঙ্গে হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ইউনানি, বাবা রামদেব, আর্ট অফ লিভিং, গোমূত্র — এসব তো আছেই। খোদ কেন্দ্রীয় সরকার একখানা আয়ুশ মন্ত্রক খুলে বসেছেন। অতএব একথা জানতে কারো বাকি নেই যে লেখাপড়া করে এম বি বি এস ইত্যাদি হওয়া ডাক্তারগুলো নেহাত ফালতু। জুনিয়রগুলো তো তস্য ফালতু। অতএব দলবল নিয়ে যাও আর যত ইচ্ছে ঠ্যাঙাও।
অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ার তেমন কিছু নেই। অমর্ত্য সেন যেখানে অর্থনীতি জানেন না সেখানে ডাক্তাররা চিকিৎসা করতে জানে এ কি বিশ্বাসযোগ্য? বললেই মানতে হবে নাকি? এরপর তো বলবে মানুষ বাঁদর থেকে এসেছে, পৃথিবী বাসযোগ্য হতে কয়েক লক্ষ বছর সময় লেগেছে।
সরকারও বুঝেছে জনগণ কী চায়। জনগণ অধিকার চায়। নানারকম সব অধিকার, যার মধ্যে স্বাস্থ্যের অধিকারটাও আছে। তারা চায় নিজের সাধ্যের মধ্যেই উপযুক্ত চিকিৎসা। কিন্তু বাপু সবাইকে সব অধিকার দিয়ে দিলে বেচার জন্যে থাকবেটা কী? চিকিৎসার মত এমন একটা জিনিস যদি সরকারী হাসপাতালে গেলেই কম পয়সায় দিব্যি পাওয়া যায় তাহলে কত লোকের পোলাও মারা যাবে বলুন দেখি? যার পয়সা আছে সে যাক না ঝাঁ চকচকে বেসরকারী হাসপাতালে। যার সামর্থ্য নেই সে সরকারী হাসপাতালে আসুক, যেখানে সারাক্ষণ নেই রাজ্যের নৈরাজ্য চলে। বেড নেই, ওষুধ নেই, পরীক্ষা নিরীক্ষা করার যন্ত্রপাতি নেই, প্রয়োজন অনুসারে ডাক্তারও নেই। একজন ডাক্তার টানা চব্বিশ ঘন্টা, ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটি করেন। এখানেই লোকে আসুক। পরিষেবা পাবে না, হাতের কাছে ডাক্তার, নার্সগুলোকে তো পাবে। পেটাক, মেরে ফেলুক, যা ইচ্ছে করুক। আরে বাবা অন্তত মারপিট করার অধিকারটা তো দিতে হবে, নইলে সরকার চলবে কী করে? স্বাস্থ্যের অধিকারের চেয়ে এই অধিকার দিলে অনেক শস্তা হয় সরকারের। পুজো, কার্নিভাল, এ উৎসব সে উৎসবের বাজেটে টান পড়ে না।
কী মনে হচ্ছে? খামোকা বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গাল দেওয়া হচ্ছে? আচ্ছা মনে করে দেখুন তো, ২০১৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী কলকাতার টাউন হলে একটা মিটিং হয়েছিল না? সেখানে মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারী হাসপাতালের মালিকদের ডেকে খুব ধমকে দিয়েছিলেন। খামোকা পেশেন্টদের থেকে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে, স্বাস্থ্য নিয়ে বিজনেস করবেন না, মানুষকে ঠকাবেন না, সরকার কড়া ব্যবস্থা নেবে ইত্যাদি। আচ্ছা কার বিরুদ্ধে কটা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে আজ অব্দি? তার চেয়েও বড় কথা মুখ্যমন্ত্রী সারা রাজ্যের সরকারী হাসপাতালের সুপারদের নিয়ে টাউন হলে কবে বসেছেন? কবে জানতে চেয়েছেন কী কী সমস্যা আছে, কিভাবে মেটানো যায়? অর্থাৎ এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না। মাঝেমধ্যে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত যেখানে যায় সেখানকার ব্যাপারে একটু হম্বিতম্বি করলাম — এই যথেষ্ট।
সরকারী হাসপাতালেও কি আর কিছু করব না? করব। জবরদস্ত গেট লাগাব, আলো লাগাব, নীল সাদা রঙ করব, সেগুলো মাঝেরহাট ব্রিজের মত সুরক্ষিত হবে। এর বেশি করা যাবে না। বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খদ্দেররা সরকারী হাসপাতালের দিকে চলে না যায় সেটা তো নিশ্চিত করতে হবে। হ্যাঁ, উন্মত্ত জনতা কখনো কখনো ওখানেও গিয়ে পেটাবে বটে। সে মারও তো ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীরাই খাবে। সরকার আর মালিকপক্ষ মান্না দের মত গান গাইতেই পারে “তাতে তোমার কী? আর আমার কী?”
অতএব প্রিয় ডাক্তারকুল, আপনারা মানিয়ে নিন। এ দেশে ডাক্তারি করতে গেলে হয় কাফিল খান নয় পরিবহ মুখোপাধ্যায় হতেই হবে।
যাঁরা ডাক্তার নন তাঁরা খুব রাগ করছেন, তাই না? ভাবছেন “ডাক্তাররা যে কত বদমাইশি করে সেকথা তো একবারও বলল না? নার্সিংহোম আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা ফেঁদে লাল হয়ে যাচ্ছে কত ডাক্তার তা তো বলল না? এই যে সব চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে, এটা কি উচিৎ কাজ? কোন অধিকার নেই অসুস্থ মানুষের সাথে এরকম করার।”
ঠিক কথা। কোন কোন ডাক্তার অত্যন্ত অসৎ। নানারকম চক্র তৈরি করে দু নম্বরী পয়সা করেন, সরকারী টাকাও মেরে দেন। ইঞ্জিনিয়াররাও করেন। ব্যবসায়ীরা করেন, রাজনীতিবিদরা করেন, সাংবাদিকদের কথা আর নিজ মুখে কী বলব? আজকাল এমনকি মাস্টাররাও করেন এসব। কিন্তু বাংলা অভিধানে প্রসঙ্গ বলে একটা শব্দ আছে। ইংরিজিতে যাকে বলে context। এন আর এসের ঘটনার প্রসঙ্গে অসাধু ডাক্তারদের কথা আসে না। অবশ্য আজকাল আর প্রসঙ্গ টসঙ্গ কে মানে? ভারতের বেহাল অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুললে তো উত্তর আসে “পাকিস্তান কো ঘর মে ঘুসকে মারা।”
রইল ডাক্তারদের অধিকারের কথা। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার তাঁদের অবশ্যই আছে। গোটা দেশে এই মুহূর্তে একটা অধিকারই স্বীকৃত — উন্মত্ত জনতার যা ইচ্ছে করার অধিকার। সকলকেই মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে ওটাই একমাত্র অধিকার নয়। বস্তুত ওটা আদৌ কোন অধিকার নয়, ওটা বরং অন্যের অধিকার হরণ।
আর আমাদের অসুবিধা? দুঃখজনক। কিন্তু হাসপাতালে লুম্পেনতন্ত্র চালু হতে দিয়ে ডাক্তার আর রোগীকে যুযুধান দুই পক্ষে স্থাপন করেছেন যিনি, এই বিবাদ মেটানোর দায়িত্ব তো তাঁর উপরেই বর্তায়। তিনি তো মূর্তি আর পাঁচতারা হোটেল উদ্বোধনে ব্যস্ত।

বিশ্বসাথে যোগে

এত ভাল লেগেছে কবিতাটা, বলে “যে করে হোক আমায় একটা জাপানী অনুবাদ যোগাড় করে দাও”

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।”

গানটা ছোট থেকেই শুনছি। কতবার কত রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সুরে, বেসুরে; কত লং প্লেয়িং রেকর্ডে, ক্যাসেটে, সিডিতে যে শুনেছি তার হিসাব নেই। বেশিরভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীত যেরকম অন্যমনস্কভাবে শোনে সবাই, সেভাবেও শুনেছি আবার মন দিয়েও শুনে দেখেছি। কোন যোগ স্থাপন করতে পারিনি গানটার সাথে। এভাবেই স্কুল, কলেজ পেরিয়ে গেছি। বাবা-মায়ের ঠ্যালা খেয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অংশগ্রহণ করেছি একটা বয়স পর্যন্ত, তারপর যে বয়সে বাবা-মা আর জোর করতে পারে না সেই বয়স থেকে যতটা পেরেছি পাশ কাটিয়ে গেছি অনুষ্ঠানটাকে।

তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম। একদিন আশুতোষ বিল্ডিং এর ঠিক সামনে অর্ধচন্দ্রাকার জায়গাটায় বসে পা দুলিয়ে অমূল্য আড্ডা দিচ্ছি, আমার সহপাঠী বন্ধু এবং তৎকালীন কমরেড (পরে সহকর্মী) সুদীপ্ত এসে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। কোথায় যেতে হবে না হবে কিচ্ছু বলল না। যদ্দূর মনে পড়ে ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে বেরিয়েই রেলায় ট্যাক্সি ডেকে আমাকে নিয়ে উঠে পড়ল। কোথায় যাওয়ার তাড়া, কিসের তাড়া কিছুই বুঝলাম না। যেতে যেতে শোনা গেল সেটা।

আমরা দুজনে তখনো বিশ্বজুড়ে যৌথ খামারের স্বপ্নটপ্ন দেখি। তা জাপান থেকে এক কমরেড এসেছেন আমাদের এখানকার নির্বাচন কভার করতে। তাঁকে সাহায্য করতে হবে। ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য কমিটি নাকি সাংবাদিকতা বিভাগের কোন ছাত্রকে চেয়েছে সেই কাজে। আর আমার যোগ্যতা সম্পর্কে অকারণ উচ্চ ধারণা পোষণ করা বন্ধুটি অমনি আমার নাম বলে দিয়েছে। বলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি অবশ্য। আমাকে পাকড়াও করে পাড়ি দিয়েছে রাজ্য কমিটির অফিসে। শুনেই আমি ট্যাক্সির দরজা খুলে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলাম আর কি। জাপানীর জ জানি না, সুদীপ্ত আমায় এরকম ফাঁসাচ্ছে! শেষমেশ যে বান্ধবীটির প্রতি অনুরক্ত ছিলাম তার কথা ভেবে টেবে ঝাঁপটা দিলাম না।

জাপানীটি দেখা গেল অতীব ভদ্রলোক এবং সে জাপানী জানা লোক খুঁজছে না, খুঁজছে ইংরিজি এবং বাংলা জানা লোক। তা তার সাথে নির্বাচন কভার করা তো হল। বোধহয় নেহাত খারাপ সাহায্য করিনি। তাই সে পরেও আরেকবার কলকাতায় এসে আমাকেই খুঁজে বার করে কাজকম্ম করেছিল।

এর পরের বছর। ছাত্রজীবন একেবারে শেষ প্রান্তে। ছাত্র ফেডারেশনের সাথে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দিয়েছি, এম এ পাশ করে চাকরিবাকরি পাব কিনা তা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছি। এমন সময় খবর হল উগো শাভেজ কলকাতায় আসবেন। শাভেজ মানে ভেনেজুয়েলার সেই নেতা যিনি প্রায় একটা গোটা মহাদেশকে বিশ্বায়নের চাকার তলা থেকে সরিয়ে এনে অন্যরকমভাবে বাঁচার সাহস দিয়েছেন। শাভেজ মানে যিনি ভোটে জিতে এসে সমাজতান্ত্রিক কর্মকান্ড চালানোর ক্ষমতা ধরেন। শাভেজ মানে যিনি প্রায় কাস্ত্রোর মতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে বহুজাতিকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। সেই শাভেজ আসছেন কলকাতায়। যখন নেলসন ম্যান্ডেলা এসেছিলেন, বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন হাত ধরে। এবারে শোনামাত্র ভাবছি কী করে যাওয়া যায় রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে সেই দিনটায়। ছাত্র ফেডারেশনের সাথে আড়ি করেছি, যৌথ খামারের স্বপ্নের সাথে তো আড়ি করিনি। এত কাছে আসছেন শাভেজ, অন্তত কয়েকশো ফুট দূর থেকে তাঁকে দেখব না!

কোন ব্যবস্থা মাথায় আসার আগেই জাপানী কমরেড জুনিচির ফোন। “আমি কমরেড শাভেজের কলকাতা সফর কভার করতে আসছি। তোমার অন্য কোন কাজ না থাকলে আমাকে একটু সাহায্য করবে?” অন্য কাজ! সব কাজ ফেলে ঐ কাজ করব আমি।

জুনিচির সঙ্গী হওয়ার সুবাদে মঞ্চের একেবারে কাছাকাছি বসার সুযোগ পেয়ে গেলাম। খুব কাছ দিয়ে হেঁটে এসে মঞ্চে উঠলেন শাভেজ। তারপর উদাত্ত গলায় নিজের মাতৃভাষায় বক্তৃতা। স্টেডিয়ামে উপস্থিত বেশিরভাগ লোকের মতই আমিও স্প্যানিশ জানি না। জুনিচিও জানে না। আমার কাজ ছিল ঐ সভার সকলের বক্তৃতার ইংরিজি অনুবাদ লিখে দেওয়া। শাভেজের বক্তৃতা শুনছি আর প্যাডে লিখছি। আসলে তো তাঁর কথা শুনে লিখছি না, লিখছি স্প্যানিশ দূতাবাস আমারই বয়সী যে ছেলেটিকে শাভেজের বক্তৃতা বাংলা করে বলে দেওয়ার জন্যে নিযুক্ত করেছিল তার কথা শুনে। দু এক মিনিটের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে ভাগ্যবানটি স্প্যানিশ যেমনই জানুক, বাংলা মোটেই জানে না। হোঁচট খেতে খেতেও প্রায় মেরে এনেছিল ব্যাপারটা কিন্তু একেবারে গুবলেট হয়ে গেল শাভেজ বক্তৃতার উপসংহারে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা বলতে শুরু করতেই। লাইনদুয়েক বাংলা করতেই গোটা স্টেডিয়াম বুঝে গেল এটা কোন কবিতা। কিন্তু সেই হতভাগা বোধহয় জম্মে কবিতাটা পড়েনি। তাই সে ভ্যাবাচ্যাকা। আরো লাইনতিনেক চলার পর এমনকি শাভেজও বুঝলেন ঠিক বাংলা হচ্ছে না। ভুরু কুঁচকে থেমে গেলেন। অগত্যা মঞ্চে উপবিষ্ট পশ্চিমবাংলার তখনকার মুখ্যমন্ত্রী (তিনিও নাকি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মত কবিতা টবিতা লিখতেন) উঠে এসে সেই বঙ্গ মায়ের স্প্যানিশ সন্তানটিকে সরিয়ে দিয়ে গড়গড় করে বলে দিলেন “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য / উচ্চ যেথা শির…” ইত্যাদি। শাভেজ দেখলাম যারপরনাই খুশি হলেন। দুজনের আলিঙ্গন, স্টেডিয়ামসুদ্ধ লোকের স্লোগান দিয়ে মিটিং শেষ হল।

কথা ছিল বক্তৃতাগুলো আমি পরদিন দুপুরের মধ্যে ইমেল করব জুনিচিকে। তারপর বিকেলে ওর হোটেলে যাব আর কোন সাহায্য লাগলে সেটা করতে। পরদিন হোটেলে পৌঁছতেই ওর প্রথম প্রশ্ন “তুমি এত ভাল কবিতা লিখতে পার?রবীন্দ্রনাথের কবিতাটার কি সুন্দর ইংরিজি করেছ!” লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায় আর কি। ওকে বোঝালাম যে ইংরিজিটা মহাকবি নিজেই করে গেছেন। তাতে ও আরো মুগ্ধ। রবীন্দ্রনাথ নোবেলজয়ী কবি। জাপানেও গেছেন সেকথা ওর জানা। কিন্তু তিনি যে এত ভাল ইংরিজি জানতেন তা ও শোনেনি কখনো। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে রইল।

তারপরেই আমাকে ফেলল মহাবিপদে।

“আচ্ছা এই কবিতাটার জাপানী অনুবাদ পাওয়া যাবে?”

বোঝ! আমি ওকে বললাম যে রবীন্দ্রনাথ জাপানী ভাষা জানতেন বলে আমার জানা নেই। ওদের দেশের কোন কবি যদি করে থাকেন অনুবাদ তো থাকতে পারে কিন্তু সে তো ও-ই ভাল জানবে। জুনিচি নাছোড়বান্দা। এত ভাল লেগেছে কবিতাটা, বলে “যে করে হোক আমায় একটা জাপানী অনুবাদ যোগাড় করে দাও।” দিন দুয়েক সময় চেয়ে নিয়ে কেটে পড়লাম।

অকূলপাথারে পড়লে যা করা আমাদের জাতীয় অভ্যেস সেটাই করলাম। বাবার পরামর্শ চাইলাম। বাবাই বাতলে দিলেন। আমার এক মামা বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ছিলেন। সেই মামীকে ধরলাম। নিপ্পন ভবনের অধিকর্তার ইমেল আইডি যোগাড় হল। তাঁকেই জুনিচির ব্যাপারে জানিয়ে লিখলাম অন্তত বঞ্চিত করে যেন বাঁচিয়ে দেন। ভেবেছিলাম উত্তর টুত্তর পাব না। অবাক কান্ড! চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই উত্তর এল “আপনার অনুরোধ পেয়েছি। মিস্টার জুনিচি কোদামাকে আমরা কবিতাটা পাঠাচ্ছি।”

জুনিচির সেদিনই দিল্লীতে নিজের আস্তানায় ফিরে যাওয়ার কথা। আমি জানালাম কী বার্তা এসেছে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বেচারা একটু ব্যাজার মুখেই ফেরত গেল। বোধহয় ভেবেছিল মারাদোনার মত ডজ করে দিলাম। আমি আবার নিপ্পন ভবনের অধিকর্তা মারাদোনা কিনা তাই ভাবছিলাম। কে আমি অজ্ঞাতকুলশীল কলকাতার উপকণ্ঠের এক ছাত্র? আমার অনুরোধে কেনই বা এসব করতে যাবেন তিনি? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বুঝি ক্ষমতা অসীম। পরদিন বিকেলে দিল্লী থেকে ফোন করল জুনিচি। সে ইমেলে কবিতাটা পেয়েছে। এবং পড়ে আপ্লুত। “এমন আশ্চর্য কবিতা আমি আগে পড়িনি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

রবীন্দ্রনাথকে বললাম, একমাত্র তুমিই পারো। কোথায় সুদূর লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা! সেখানকার বিপ্লবী নেতার বুকে তুফান তোলে তোমার কবিতা আর সেই কবিতা নিজের ভাষায় পড়তে চায় এশিয়ার এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের সাংবাদিক! আব্দারটা করে তোমার দেশের, তোমার ভাষার এক অকিঞ্চিৎকর তরুণের কাছে আর সে আব্দারটা মেটাতে সমর্থ হয় কারণ একটা বিশ্বভারতী রেখে গেছ তুমি!
সেইদিন গানটা কানের ভিতর দিয়ে মরমে পৌঁছল। ফিরে রবীন্দ্রনাথকেই বললাম “নয়কো বনে, নয় বিজনে, / নয়কো আমার আপন মনে — / সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়, সেথায় আপন আমারও।।”

হোক সংযুক্তি

আপনি বলবেন সবাই যদি নিজেকে একা ভাবে তাহলে সেদিনকার মেট্রোর মত গণপিটুনির মানসিকতা তৈরি হচ্ছে কী করে? মানুষ হিংসা প্রদর্শন করার বেলায় ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে কী করে?

মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেল জোয়ান বনাম বুড়োতে। এরকমই একটা কিছু আশঙ্কা করছিলাম। কেন? সে কথায় পরে আসছি। আগে মেট্রো, বাস, ট্রেনে আমার গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার কিছুটা বলি। তাতে এই “বুড়ো মানেই বদ” স্টিরিওটাইপটার অন্তঃসারশূন্যতা কিছুটা বোঝা যাবে।
আমার মেয়ের বয়স ছয়। যখন একেবারে কোলের শিশু ছিল, তখন বেশ কয়েকবার মেট্রোয় উঠে ভিড়ের মধ্যে আমার স্ত্রী লেডিস সিটের সামনে দাঁড়িয়েছে। সেখানে বসা জেন ওয়াইয়ের সদস্যারা নিজেদের মোবাইল স্ক্রিনে ব্যস্ত থেকেছে বা হেড ফোনে সুরের জগতে মগ্ন থেকেছে। উঠে দাঁড়িয়ে বা পাশের জনকে সরে বসতে বলে আমার বউকে বসার জায়গা করে দিয়েছেন পাকা বা কাঁচাপাকা চুলের মহিলারা, অনেক সময় পুরুষরা। কেউ বলতেই পারেন যে এ থেকে প্রমাণ হয় না বুড়োবুড়িরা রক্ষণশীল নয়, moral policing করে না। ঠিক। কিন্তু এ থেকে এটা প্রমাণ হয় যে বয়স্কদের মধ্যে রক্ষণশীলতা যদি থেকে থাকে, তরুণদের মধ্যে আছে নিদারুণ হৃদয়হীনতা। সেটাও ঘটনাবিশেষে নিগ্রহ হয়ে উঠতে পারে এবং ওঠেও।
এটাকেও স্টিরিওটাইপ বলবেন তো? একদম ঠিক। এবং স্টিরিওটাইপ মাত্রেই ভুল। বয়স্ক মানুষ মাত্রেই সেদিনের মেট্রোর লোকগুলোর মত নয়, অল্পবয়সী মাত্রেই হৃদয়হীন নয়। তবু আরো দুটো ঘটনা শুনে নিন।
বছর পাঁচেক আগে বাসে করে অফিস যাচ্ছি। আমি শুরুর দিকের স্টপেজ থেকে উঠি বলে বসার জায়গা পেয়েছি কিন্তু কিছু পরেই বাসটায় ঠাসাঠাসি ভিড় হয়ে গেল। লক্ষ্য করলাম প্রায় আমারই বয়সী একটি মেয়ে ঐ ভিড়ের মধ্যে বিশাল একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে লোকের অভিশাপ এবং গুঁতো হজম করছে। ব্যাগটা নিতে চাইলাম, দিতে রাজি না হওয়ায় আন্দাজ করলাম মূল্যবান কিছু আছে। তখন আমার আসনটাই ছেড়ে দিলাম, মেয়েটি বসল। এটা বলার মত ঘটনা নয়। বলতে হচ্ছে আমি উঠে দাঁড়াতেই আমার সমবয়স্ক পুরুষ সহযাত্রীর প্রতিক্রিয়াটার জন্যে। বাঁকা হেসে সে আমায় বলল “বা দাদা, মেয়েছেলে বলে বসতে দিলেন? একটুআধটু আমাদেরও তো দিলে পারেন।” প্রথমে ইঙ্গিতটা বুঝিনি। বুঝতে পেরে বললাম “হ্যাঁ মেয়ে বলেই বসতে দিলাম। আপনি মেয়ে হয়ে আসুন, আপনাকেও বসতে দেব।” ছেলেটি এরপর আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু কয়েক মিনিট পরে দেখি ছেলেটি আর মেয়েটি অল্পস্বল্প কথা বলছে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বোঝা গেল ওরা সহকর্মী। এই হচ্ছে আমাদের প্রজন্ম, এই তার মহিলা সহকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধা, এই আমাদের প্রগতিশীলতা।
দ্বিতীয় ঘটনা মাসখানেক আগের। বলতে লজ্জা হয়, আমার জন্মস্থান, আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা নবগ্রামে স্টেশন রোডের উপর ঘটেছে ঘটনাটা। বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল নিতে গেছি ভর সন্ধ্যেবেলা। রাস্তা তখন জমজমাট। দেখি দোকানের সামনে আমার বয়সী একটি ছেলে তার সঙ্গের মহিলাকে কুৎসিত ভাষায় ধমকাচ্ছে। অনেকেই তাকিয়ে আছে, কেউ কিছু বলছে না। মেয়েটি, সম্ভবত ভয়ে, কাকুতিমিনতি করছে বাড়ি যাওয়ার জন্যে। একটু দেখে মনে হল ছেলেটি মত্ত। তাকে ধমকাব ভাবছি, এমন সময়ে ঠাস করে মেয়েটির গালে এক চড় কষিয়ে দিল। দ্বিতীয় চড় কষানোর আগেই তার হাতটা ধরে ফেলেছি এবং ধমকে বলেছি এটা ভদ্রলোকের জায়গা। এখানে এসব চলবে না। ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরে টলতে টলতে আমায় ধমকে গেল এই মর্মে যে এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি যেন নিজের চরকায় তেল দিই। আমি বলে গেলাম যা করার বাড়ি গিয়ে করতে হবে, এখানে এই ব্যবহার চলবে না। মিনিট পাঁচেক চলেছিল ব্যাপারটা। শেষ অব্দি মেয়েটি আমার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে টেনে হিঁচড়ে ইঞ্চি ছয়েক নড়াতে পারল ছেলেটিকে, আমায় চলে আসতে হল। কারণ আমাদের পাশ দিয়ে যেসব সুবেশী, শিক্ষিত তরুণ তরুণী হেঁটে যাচ্ছিলেন তাঁদের কেউ এগিয়ে এসে আমার সাথে গলা মেলালেন না। বরং ফুটপাথের মাঝবয়সী দোকানদার ভয়ে ভয়ে আমায় একটু সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পাশের মিষ্টির দোকান থেকে এক প্রবীণ তবু এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে আমায় বললেন “কী দরকার তোমার! এসব কি আর ভদ্র ঘরের ছেলেমেয়ে? কী করতে কী করে দেবে…”
দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে কাজ নেই। আসল কথা হচ্ছে মানুষ বদলে গেছে । আমার মা যখন যুবতী আর আমি মায়ের আঙুল ধরে চলা শিশু, সেই সময় আমাকে নিয়ে ট্রেনে বাসে উঠলে বসার জায়গা পেতে অসুবিধা হত না মনে আছে। তরুণরাই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতেন। আর তাই নিয়ে অন্য তরুণদের অশ্লীল ইঙ্গিত করতেও দেখিনি কখনো। আর আমাদের নবগ্রাম অজ পাড়াগাঁ ছিল তখন। সেখানে প্রকাশ্য রাস্তায় বউকে চড় মারার সাহস কারো ছিল না। অর্থাৎ বুড়োবুড়ি ছুঁড়োছুঁড়ি নির্বিশেষে আমরা পশ্চাৎপদ হয়ে পড়েছি। কেন?
এর এক শব্দে উত্তর বিযুক্তি (alienation)। গত দুই আড়াই দশকে আমাদের শেখানো হয়েছে “শুধু নিজেরটুকু নিয়ে ভাবো।” এর পোশাকি নাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদ (individualism)। জীবনের সবকিছুর কেন্দ্রেই আমি। আমার সুখ, আমার স্বাচ্ছন্দ্য, আমার ক্লেশ, আমার কষ্ট। বাকি দুনিয়া গোল্লায় যাক। এই মতবাদ সম্বল করেই আমাদের প্রজন্ম বড় হয়েছে, আমাদের বাবা-মায়েরা, মানে সেদিন মেট্রোয় ঐ যুগলকে যারা পিটিয়েছে তাদের পান্ডারা যে প্রজন্মের, বড় করেছেন। এই মতবাদই আমাদের সমাজকে, আমাদের রাজনীতিকে আজ নিয়ন্ত্রণ করছে। গোকুলে বেড়েছে সে, তারপর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এখন রাজত্ব করছে।
খেয়াল করে দেখুন — গত আড়াই দশক আপনি কাগজে পত্রে, সিনেমায়, সিরিয়ালে সর্বত্র এটাই জেনেছেন যে নিজের সমস্যা নিজে মিটিয়ে নেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে ভাল। এবং সেটাই আধুনিক মানুষের ধর্ম। যে কোন রকমের জোটবদ্ধতাই হচ্ছে দুর্বলতার লক্ষণ, সেকেলে মানসিকতার লক্ষণ, অফিস কাছারিতে ফাঁকিবাজির লক্ষণ। এইভাবে আপনাকে ক্রমশ বিযুক্ত করা হয়েছে অন্য মানুষের থেকে। আপনি এখন জানেন আপনি অফিসে একা, ট্রেনে একা, বাসে একা, অনেক ক্ষেত্রে বাড়িতেও একা।
এবার আপনি বলবেন সবাই যদি নিজেকে একা ভাবে তাহলে সেদিনকার মেট্রোর মত গণপিটুনির মানসিকতা তৈরি হচ্ছে কী করে? মানুষ হিংসা প্রদর্শন করার বেলায় ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে কী করে?
ব্যাপারটা খুব সোজা। মানুষ জোট বেঁধেছিল, সমাজবদ্ধ হয়েছিল কারণ শারীরিক, মানসিকভাবে তার একার পক্ষে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সেই ব্যাপারটা আজও বদলায়নি কারণ মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ জীব নয়। প্রযুক্তির এত উন্নতি সত্ত্বেও একা একজন মানুষ বাঁচতে পারে না, তাকে অন্য মানুষের উপর নির্ভর করতেই হয়, শারীরিক এবং মানসিক প্রয়োজনে। ফলে যতই কেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদ শেখাও না, মানুষ বিপদে পড়লে, এমনকি বিপন্ন বোধ করলেই, একজোট হতে চায়।
ঠিক এই কারণেই মানুষ কী কারণে একজোট হচ্ছে সেটা বুঝতে গেলে রাজনীতিটা বোঝা দরকার। সব মানুষই নিজের নিজের রাজনীতি অনুযায়ী একজোট হয়। আর কে কার সাথে জোট বাঁধবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে তার বিযুক্তি। কে কতটা বিযুক্ত সেটাই ঠিক করে সে তার চারপাশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিজেকে কোন পক্ষ ভাববে।
রাজনীতি মানে শুধু সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস নয়। এই পোস্টে যাঁরা লাইক দেবেন তাঁরা মনে করেন ছেলেমেয়েদুটোর প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন প্রকাশ্য জায়গায় প্রেমের অভিব্যক্তির অধিকার সকলের আছে, আবার কেউ মনে করেন ছেলেমেয়েদুটো বাড়াবাড়ি করেছিল কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। কেউ হয়ত আরো একটু ভিন্নমত তবে মোটের উপর এঁরা সকলেই মনে করেন ওদের মারা অন্যায় হয়েছে। এই ঘটনায় এই মতটাই তাঁদের রাজনীতি।
আবার যারা ছেলেমেয়েদুটোকে ধরে পেটাল আর যারা এখনো তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে, তারা মনে করে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়া এদেশের সংস্কৃতিবিরোধী বা মোটের উপর অশ্লীল। মারা হয়েছে বেশ হয়েছে। এটাই তাদের রাজনীতি।
এখন মুশকিল হচ্ছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদের যুগে আমরা আবার শিখেছি যে সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি টেনে আনা উচিৎ নয়। কোন ঘটনার রাজনীতি বুঝতে না চাওয়ার এই যে দীর্ঘদিনের অভ্যাস তৈরি হয়েছে তার ফলে আমরা পক্ষ চিনতে ভুল করি। যেমন যখন চাকরি পাই না, রোজগার হারাই, কষ্টের হকের রোজগারও ফুড়ুৎ করে পকেট থেকে উড়ে যায় তখন বুঝতে পারি না যে আমার শত্রু সেই অর্থনৈতিক নীতি যা উত্তুঙ্গ জিডিপি তৈরি করে অথচ কর্মসংস্থান কমায়। আমি ভাবতে শুরু করি আমার শত্রু তফসিলি জাতি উপজাতির লোকেরা, অথবা বিশেষ একটা ধর্মের লোকেরা। কখনো বা ভাবি মেয়েরা এত বেশি লেখাপড়া শিখছে বলেই যত গন্ডগোল, চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যেও ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। আমার বিযুক্তি আমাকে ভেতরে ভেতরে আক্রমণাত্মক করে তোলে আর আমি ঐ কাল্পনিক শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে হিসহিস করতে থাকি। আমার সামাজিক, অর্থনৈতিক, যৌন অবস্থান যা-ই হোক আমার চোখে আমিই হয়ে উঠি সবচেয়ে প্রতারিত, বঞ্চিত মানুষটা। অথচ যেহেতু আমি জানি যে আমি একা সেহেতু আমি সদা ভীত।
সুতরাং আমার সামনেই একটা মেয়ের কাপড় ধরে কেউ টানলে আমি না দেখার ভান করি কারণ ঐ মেয়েটা আমার কে? ওর চেয়ে আমি কি কম আক্রান্ত? ওর হয়ে বলতে গিয়ে কেন নিজেকে আরো বিপদে ফেলব? চোখের সামনে কেউ দুর্ঘটনায় মরে গেলেও আমি চোখ বন্ধ করে থাকি কারণ যে মরেছে সে আমার কেউ হয় না। আমার এমনিতেই হাজারটা সঙ্কট। আমার সঙ্কটের চেয়ে অন্য একটা মানুষের মৃত্যুও বড় সঙ্কট হতে পারে না।
তবে আমার চারপাশের সঙ্গে আমার যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব — সেটা কিন্তু মিথ্যে নয়। আমার উপর যে নানাবিধ অন্যায় চাপ তৈরি হচ্ছে সেটা কিন্তু আমার কল্পনা নয়। যদি মিথ্যে হত তাহলে মেট্রোয় ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ানোর জন্যে মার খেতে হত না। ফলত আমি যে কোন এক পক্ষে আর আমার যে বিপক্ষ আছে তাও সত্যি। আমি নিজের পক্ষের লোক খুঁজছি। একজোট হতে পারলেই আর আমার ভয়ের কারণ থাকে না। তখন গুছিয়ে ঠ্যাঙাতে পারি শত্রুপক্ষকে। কিন্তু আমি কোন পক্ষে আর কোন পক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই সেটা বুঝব কী করে? চোখের সামনে যাকে বা যাদের দেখছি তারা তো আমারই মত কয়েকজন ব্যক্তি মাত্র, তার বেশিকিছু নয় — এরকমটাই ভাবতে শিখেছি আমি। অতএব আমি সিদ্ধান্ত করলাম যে আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের যে বুড়োরা ধরে মারল, তারা শুধুই বুড়ো। কোন বিশেষ মতামতের, মানে রাজনীতির, প্রতিভূ নয়। অর্থাৎ এই লড়াইটায় আমার পক্ষ হল আমার মত তরুণরা আর বিপক্ষ হল বয়স্ক লোকেরা। সেদিন দলে ভারী ছিলাম না তাই মার খেয়েছি। সোশাল মিডিয়ায় আমার পক্ষের অনেককে পেয়ে গেছি অতএব মার ফিরিয়ে দিই যত বয়স্ক লোক আছে সকলকে গালাগালি দিয়ে।
যারা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আক্রমণ করেছিল তারাও একইরকম বিযুক্তির শিকার ছিল, যতক্ষণ না সংস্কৃতির শত্রু নামক কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে তারা এক হতে পেরেছে। শুধু এদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন এরকম কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধেই মানুষ বিযুক্তি কাটিয়ে এক হতে পারছে, আসল শত্রুরা বহাল তবিয়তে আছে। কলকাতার মেট্রো কোন বিচ্ছিন্ন জায়গা নয়।
তাই বলছি, হোক আলিঙ্গন। বয়স্কদের বিরুদ্ধে তরুণদের আলিঙ্গন নয়, রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীলদের আলিঙ্গন। বিযুক্তি কাটুক, মোবাইলের বাইরে এসে সত্যিকারের দুনিয়ায় সংযুক্তি হোক।
পক্ষ নেওয়ার আগে পক্ষ চিনুন।

সপ্তপদী: আমাদের অস্ত্র

একটা মুমূর্ষু গরীব ছেলেকে সারিয়ে তোলার পরে যখন তার বাবা আশীর্বাদ করেন “ভগবান আপনার ভাল কোরেন,” কৃষ্ণেন্দু উত্তরে বলে “ভগবান আর কোথায়, রামশরণ? তোমরাই তো আমার ভগবান।”

“এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো?
(মেয়েটা মাথা নেড়ে না বলে)
“কেন?”
“আমি বিধর্মী। এ সময়ে আমার তোমার কাছে আসা ঠিক হবে না।”
“এসো…….. (ধরাচূড়া পরা ছেলেটা মেয়েটাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসে) বোসো।”
“এ তুমি কী করলে?”
“কী করলাম!”
“এ অবস্থায় তুমি আমাকে স্পর্শ করলে!”
“অস্পৃশ্যতার কথা বলছ? আমার মাকে জানলে তুমি একথা বলতে পারতে না। আজ সারাদিন মনে হয়েছে মায়ের কথা। তখন আমি খুউব ছোট। মা গল্প করতেন ভবিষ্যতের। বলতেন ‘খোকা, তুই মস্তবড় ডাক্তার হবি। বিলেত যাবি।’ শুনে আমি অবাক হয়ে বলতাম ‘বিলেত যাব? বাবা যে বলেন বিলেত গেলে জাত যায়?’ মা হেসে ফেলতেন। বলতেন ‘তুই কি তোর বাবার মত জাত ধুয়ে জল খাবি? আর তোর বাবা যদি একান্তই রাগ করেন, আমি নাহয় তোর বাবাকে নিয়ে আলাদা হয়ে থাকব। তুই তো বড় হবি।”

আজকাল আর রোম্যান্টিকতা আসে না। অথচ কিছুদিন আগেও রোম্যান্টিক হিসাবে আমার দিব্যি নাম ছিল। রাস্তাঘাটে প্রেমিক- প্রেমিকা বা নবদম্পতি দেখলে বিক্ষুব্ধ মনও বেশ পেলব হয়ে আসত, বিভিন্ন সুখস্মৃতি ভিড় করত, জানা গান বা কবিতার লাইন মনে পড়ত। আজকাল আর তেমন হয় না। এখন জোড়া দেখলেই একটা আশঙ্কা কাজ করে এবং অনেক চেষ্টা করেও দেখেছি কিছু প্রশ্ন নিজেকে না করে থাকতে পারি না “দুজন একই ধর্মের তো? নইলে এদের কেউ আক্রমণ করবে না তো?”
এই আশঙ্কা একদিনে তৈরি হয়নি। বেশ মনে আছে বয়সে আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট এক মহিলা সহকর্মী — যাকে পোশাকআশাক, খাদ্যাভ্যাস, নামী স্কুলকলেজের ছাপ ইত্যাদি কারণে আধুনিকাই বলা উচিৎ — বছরদুয়েক আগে আমার সাথে দীর্ঘক্ষণ তর্ক করেছিল যে হিন্দু মেয়েদের ফুঁসলিয়ে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করাটা মুসলমান যুবকদের সুচিন্তিত সঙ্ঘবদ্ধ চক্রান্ত এবং হিন্দু মেয়ের সাথে মুসলমান ছেলের বিয়ে একমাত্র তখনই মেনে নেওয়া যেতে পারে যদি মেয়েটি নিজের ধর্ম পরিবর্তন না করে।
কাল ভ্যালেন্টাইনস ডে তে হৃদয়াকৃতি বেলুন আর চকোলেটের ফাঁক দিয়েও আমার আশঙ্কা আমাকে সারাদিন মুখ ভেংচে গেল, বারবার হাদিয়া আর অঙ্কিত সাক্সেনার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই থাকল আর কানে বাজতে থাকল সেই প্রাক্তন সহকর্মীর কথাগুলো। এই দৃশ্যশ্রাব্য আতঙ্ক থেকে বাঁচতে আমি আশ্রয় নিলাম বহুবার দেখা একটা পুরনো রোম্যান্টিক ছবিতে। সেখানে দুই ভিন্নধর্মী সহপাঠীর লাঠালাঠি শেষ হয়ে প্রেম শুরু হওয়ার অনুঘটক হিসাবে কাজ করছেন ছেলেটার সদ্যমৃতা মা, যিনি ছেলেকে ছোট থেকেই শিখিয়েছিলেন জাত ধুয়ে জল না খেতে। ভাগ্যিস! শিখিয়েছিলেন বলেই তো কৃষ্ণেন্দু মুখার্জি হাত ধরে নিজের হোস্টেলের ঘরে নিয়ে আসে রিনা ব্রাউনকে। নইলে যে তৈরিই হতে পারত না আমাদের অতিপ্রিয় প্রেমের ছবিটা, যা ১৯৬১ তে তৈরি, প্রাকস্বাধীনতা যুগের গল্প বলছে অথচ ২০১৮র আমরা যার চেয়ে পিছিয়ে পড়েছি।
কৃষ্ণেন্দুর মায়ের উদারতা (সময়ের গেরো দেখুন — মনুষ্যত্বকে উদারতা বলছি) যে নেহাত গালগল্প নয় তার প্রমাণ আমার পারিবারিক ইতিহাসেই আছে। আমার মায়ের দিদিমা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে এক ইসলাম ধর্মাবলম্বী স্বাধীনতা সংগ্রামীকে বাড়ির ঠাকুরঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন, হিন্দু দারোগা বাকি বাড়িটা তল্লাস করে তাকে পায়নি কারণ সে কল্পনাও করেনি ওখানে ঐ লোককে লুকনো যেতে পারে।
তবে তার মায়ের তুলনায় কৃষ্ণেন্দুর কাছে ধর্ম বা বিগ্রহের গুরুত্ব যে আরো কম, ‘সপ্তপদী’ দেখলে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। শুধু মেডিকাল কলেজ পর্বে তার সোচ্চার ঘোষণা থেকেই নয়, যে রিনার জন্য সে ধর্মান্তরিত হল তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরেও কৃষ্ণেন্দুর আচরণ বারবারই প্রমাণ করে মুখুজ্যে বামুন থেকে রেভারেন্ড হওয়ার পরেও তার বিশ্বাস মানবধর্মেই সবচেয়ে জোরালো। সেইজন্যেই একটা মুমূর্ষু গরীব ছেলেকে সারিয়ে তোলার পরে যখন তার বাবা আশীর্বাদ করেন “ভগবান আপনার ভাল কোরেন,” কৃষ্ণেন্দু উত্তরে বলে “ভগবান আর কোথায়, রামশরণ? তোমরাই তো আমার ভগবান।”
কাল কলকাতার রাজপথে যারা নাকি একটা পরিবারকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার অনুষ্ঠান করেছে, তারা রেভারেন্ড কৃষ্ণেন্দুর এই কথা শুনলে নির্ঘাত বলত “চালাকি করে রামশরণকে খ্রীষ্টান বানানোর চেষ্টা করছে।” সুবিধামত পেলে কৃষ্ণেন্দুর অবস্থা গ্রাহাম স্টেইনসের মতও করতে পারত। এরাই আবার এক হিন্দু সন্ন্যাসীকে নিজেদের লোক বলে দাবী করে যিনি লিখেছিলেন “বহুরূপে সম্মুখে তোমার/ ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/ জীবে প্রেম করে যেইজন/ সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।” শোনা যায় বিবেকানন্দ প্রথমে “জীবে দয়া” লিখেছিলেন। তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ শুনে বলেন “দয়া! দয়া করবার তুই কে রে? জীবে প্রেম বল।” কাকতালীয় নয় যে রিনার চোখ দিয়ে পরিচালক অজয় কর যখন রেভারেন্ডের ঘরটা আমাদের দেখান, সেখানে রিনা, যীশু ছাড়া আর যাঁদের ছবি দেখা যায় তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ। এবং রামকৃষ্ণ। এই কৃষ্ণেন্দুর কাছে যে ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে ভালবাসার মানুষের মূল্য বেশি হবে তা আশ্চর্যের নয়। আশ্চর্যের কথা এই যে কৃষ্ণেন্দুর বাবার গোঁড়ামি থেকে আমরা আজও বেরিয়ে আসতে পারলাম না অথচ তিনি নিজেও ছবির শেষপ্রান্তে সত্যদর্শন করতে পারলেন।
সেদিনের দর্শকের নিশ্চয়ই আপত্তিকর লাগেনি, এমনকি আলাদা করে লক্ষ্য করার মতই মনে হয়নি, যে কৃষ্ণেন্দুকে হারানো এবং নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানতে পারা, তারপর মাকে হারানোর মধ্যে দিয়ে রিনার নরকদর্শন আর কৃষ্ণেন্দুর বাবার ভুল স্বীকারের পরে রিনা আর কৃষ্ণেন্দুর মিলন কিন্তু সপ্তপদীতে হয়নি। ধর্মীয় এবং পারিবারিক পরিচয় খোয়ানো, কোমরের নীচে আঘাত পাওয়ায় চলচ্ছক্তি এবং যৌনক্ষমতা পর্যন্ত খোয়ানো রিনাকে কৃষ্ণেন্দু নিয়ে গেছে যীশুর কাছেই। গত ৫৭ বছর ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু দর্শক এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে চলেছেন, কারো মনে হয়নি খ্রীষ্টধর্ম জিতে গেল। আজ এ ছবি তৈরি হলে সুচিত্রা সেনের নাক কাটার দাবী উঠত বোধহয়। পূর্বসুরীদের সাথে আমাদের তুলনা করে দেখুন তো লজ্জায় নিজের নাক কাটতে ইচ্ছে করে কিনা?
তবে পূর্বসুরীরা বোধহয় এই ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। সেইজন্যে নিজেদের সৃষ্টিতে বারংবার সাবধান করেছেন। কেন বারংবার বলছি?
১৯৬১ তে মুক্তি পায় সপ্তপদী। এখানে তবু, অন্তত প্রাণ থাকতে কৃষ্ণেন্দু আর রিনা এক হতে পেরেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি কিভাবে দুটো জীবন নষ্ট করে দিতে পারে তার আরো নির্মম, আরো বিয়োগান্ত একটা ছবি কিন্তু মুক্তি পেয়েছে ঠিক তার আগের বছরই — সত্যজিৎ রায়ের দেবী। সেখানে উমাপ্রসাদ আর দয়াময়ী আর কখনো এক হতে পারেনি। দয়াময়ীকে শেষ দৃশ্যে আমরা হারিয়ে যেতে দেখি কুয়াশায়, উমাপ্রসাদ আর তাকে খুঁজে পায় না। তার মৃত্যু হল কিনা সত্যজিৎ দেখান না কিন্তু সে উন্মাদ হয়ে যায়। রিনা তবু কৃষ্ণেন্দুর কোল পায়, যীশুর শরণাগতি পায়। দয়াময়ী সেসব কিছুই পায় না। কৃষ্ণেন্দুর বাবার মত উমাপ্রসাদের বাবারও (কি আশ্চর্য! সেই ছবি বিশ্বাস!) গোঁড়ামি ভাঙে, তবে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয় তাঁকে।
সত্যজিতের মৃত্যুর পর এক বক্তৃতায় উৎপল দত্ত বলেছিলেন দেবী ছবিটা গ্রামেগঞ্জে সরকারী খরচে দেখানো উচিৎ। তবে সঠিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হবে। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কথা বাদ দিন। অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আজও দেবী আমাদের হাতিয়ার। আর অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে প্রেমের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে যারা, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সপ্তপদীও আমাদের অস্ত্র হতে পারে। হাদিয়ার জন্য লড়াইয়ে অস্ত্র, আর কেউ যেন অঙ্কিত না হয়, আর কোন তথাকথিত অনার কিলিং না হয় তার জন্য লড়াইয়েও অস্ত্র।
শোকের ঊর্ধ্বে উঠে বা শোকের মধ্যে দিয়েও যে সত্যদর্শন হয় তা যদি উমাপ্রসাদের বাবা কালীকিঙ্করকে দেখে বিশ্বাস না হয় তাহলে অঙ্কিতের বাবা যশপাল সাক্সেনাকে দেখুন, যিনি বললেন “যা হয়েছে তাতে আমি অত্যন্ত শোকগ্রস্ত। কিন্তু মুসলমানদের সাথে শত্রুতার পরিবেশ তৈরি করতে চাই না। আমার কোন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নেই।”

ফ্যাসিবাদের মানবজমিন

শাশ্বত ভারতীয় পরিবার এমন এক প্রতিষ্ঠান যেখানে একনায়কত্ব স্বীকৃত এবং প্রার্থিত। বাবা কি জেঠু কি দাদু — কেউ একজন যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই চূড়ান্ত। এই মডেলটা যৌথ পরিবারের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও ডোডোপাখি হয়ে গেছে বলে যদি কেউ ভাবেন তাহলে তিনি নিজের চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে দেখছেন না। শুধু পরিবার নয়, ক্রমশ ছোট হয়ে আসা অফিসগুলোর তস্য ছোট ডিপার্টমেন্টগুলোয় উঁকি মেরে দেখুন। যিনি মোটে তিনজনের বস তিনিও বাকি দুজনের শ্বাস প্রশ্বাসের উপর মালিকানা দাবী করেন

ভারতে ফ্যাসিবাদের জন্য জমি কেমন উর্বর এবং নরেন্দ্র মোদীর মত লোককে উপড়ে ফেলা কেন শক্ত সেটা বোঝা খুব সোজা। এর কারণটা হল এখানে ফ্যাসিবাদের অনেকগুলো মাথা। মোদী বা অমিত শাহ বা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে খবর করার জন্য সম্পাদকের চাকরি যাওয়া, সাংবাদিকদের খুন বা ধর্ষণের হুমকি পাওয়া, সাধারণ মানুষ বা বিখ্যাত কেউ সরকারের কোনরকম সমালোচনা করলেই অনলাইন বা অফলাইনে গালাগাল, তাকে ভাতে মারার চেষ্টা — এসব গত কয়েকবছরে জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে এটা যে ঘটছে তাও আপনি বলতে পারবেন না। বললেই “পাকিস্তান চলে যাও” ইত্যাদি। আজও কানহাইয়া কুমারকে এক জায়গায় মেরেধরে নীরব করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
কিন্তু সমস্যাটা যত ব্যাপক ভাবছেন তার চেয়েও অনেক বড় কারণ প্রাক-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মানিতে একটাই দল এভাবে বিরোধীদের গলা টিপে ধরত কিন্তু ভারতে শুধু সঙ্ঘ পরিবার এমন করছে তা নয়, ফলে এসব যে অন্যায় এটুকুই অনেক মানুষকে বোঝানো শক্ত। এমনিতেই শাশ্বত ভারতীয় পরিবার এমন এক প্রতিষ্ঠান যেখানে একনায়কত্ব স্বীকৃত এবং প্রার্থিত। বাবা কি জেঠু কি দাদু — কেউ একজন যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই চূড়ান্ত। এই মডেলটা যৌথ পরিবারের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও ডোডোপাখি হয়ে গেছে বলে যদি কেউ ভাবেন তাহলে তিনি নিজের চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে দেখছেন না। শুধু পরিবার নয়, ক্রমশ ছোট হয়ে আসা অফিসগুলোর তস্য ছোট ডিপার্টমেন্টগুলোয় উঁকি মেরে দেখুন। যিনি মোটে তিনজনের বস তিনিও বাকি দুজনের শ্বাস প্রশ্বাসের উপর মালিকানা দাবী করেন। সুতরাং যার ক্ষমতা কম বা নেই তাকে কথা বলতে না দেওয়া আমাদের সংস্কৃতি আর সেই সংস্কৃতির সবচেয়ে নির্লজ্জ ব্যবহার করেন আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। না, শুধু বিজেপি নয়।
কয়েকদিন আগেই তামিলনাডুর কার্টুনিস্ট জি বালাকে হাজতবাস করতে হল। তাঁর অপরাধ তিনি মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার আর ডিস্ট্রিক্ট কালেকটরকে নগ্ন দেখিয়েছেন তাঁর এক কার্টুনে। অতএব প্রশাসন ভীষণ সক্রিয় হয়ে ব্যবস্থা নিয়ে নিল ঝটপট।
মনে রাখবেন তামিলনাড়ু এমন রাজ্য যেখানে কিছুদিন আগে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রশাসনের টিকি পাওয়া যায়নি দীর্ঘদিন। জয়ললিতা মারা যাওয়ার পর থেকে কে কার পক্ষে, কে জয়ললিতার বড় ভক্ত তা নিয়ে ডামাডোলে বেশ কিছুদিন কোন মুখ্যমন্ত্রীই ছিল না। অথচ যেই কার্টুনিস্টকে গ্রেপ্তার করার কথা এল, প্রশাসন যন্ত্রের মত দ্রুত কাজ করল। দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতাশালীদের ল্যাংটো করে দেওয়াই যে কার্টুনিস্টের কাজ সেকথা আর শুনছে কে?
আরো ঘরের কাছে আসুন। ডেঙ্গু হয়েছে কি হয়নি তাই নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ আর সরকারের মধ্যে তর্কাতর্কি চলতে চলতে কতগুলো প্রাণ চলে গেল, প্রশাসন চলছিল গদাই লস্করী চালে এবং ডেঙ্গুর চেয়ে বড় শত্রু ঠাউরেছিল ডেঙ্গুর খবরকে। যেই না এক ডাক্তারবাবু ফেসবুকে পোস্ট করলেন ডেঙ্গু নিয়ে, অমনি দারুণ দ্রুততায় তিনি সাসপেন্ড হয়ে গেলেন। অম্বিকেশ, শিলাদিত্য ইত্যাদি পুরনো নামগুলো আর নাহয় না-ই বললাম।
আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে ডেঙ্গু নিয়ে একটা পোস্ট দেওয়ার পরে এক শুভাকাঙ্ক্ষী অগ্রজ সাংবাদিক ফোন করে সতর্ক করেছিলেন “খুব সাবধান। তুমি যা লিখেছ তার চেয়েও নিরীহ কথা লিখে কিন্তু এরাজ্যে লোকে গ্রেপ্তার হয়েছে।” ডাক্তার দত্তচৌধুরীর হাল থেকে স্পষ্ট যে সতর্কবার্তাটি অত্যন্ত সঙ্গত।
তা এই দেশে আর আপনি লোককে বোঝাবেন কী করে যে বিজেপি সরকার যা করছে তা এমার্জেন্সিরই নামান্তর! পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তর পর্যন্ত গণতন্ত্রকে গণধর্ষণ করার পরেও তো আজও অনেক শিক্ষিত লোক ইন্দিরাকে ভারতের সেরা প্রধানমন্ত্রী বলেন। স্বাভাবিকভাবেই মোদীবাবু তাঁকেও ছাড়িয়ে যাবেন। ওনার আমল নিয়ে হয়ত বইটই লেখা হবে। তবে মমতার সাথে যতই শত্রুতা করুন, একনায়কত্বের ইতিহাসে অন্তত কয়েকটা পাতা পাওয়ার থেকে আমাদের দিদিকে উনি বঞ্চিত করতে পারবেন না।

বড়লোকের খেলা

ছোটবেলা থেকে আমরা যে শুনে এসেছি ফুটবল হল গরীবলোকের খেলা সেটাকে এখন ছোটবেলার পরিত্যক্ত খেলনাগুলোর মত আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই ভাল। সারা পৃথিবীতেই ফুটবল এখন বড়লোকের খেলা — বড়লোকেরাই দ্যাখে, বড়লোকেরাই খেলে

saltlake

মাসখানেক আগে একদিন একটা ওয়েবসাইটের সাহায্যে হিসাব করে জানলাম আমি একবছরে যা রোজগার করি, প্যারিস সাঁ জা ফুটবল ক্লাবের ব্রাজিলীয় মহাতারকা নেমারের তা রোজগার করতে লাগে ছ ঘন্টার কিছু বেশি। মনে রাখতে হবে, মোদী সরকার যতই নানা ফন্দিফিকিরে আমার হকের টাকা থেকে আমায় বঞ্চিত করুক, আমি ভারতবর্ষের বেশিরভাগ লোকের চেয়ে সচ্ছল অবস্থাতেই আছি। অর্থাৎ আমার পরিবারের কাউকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হয় না, আমার নিজের বাসস্থান আছে, প্রয়োজন পড়লে এবং না পড়লেও জামাকাপড় কেনার সংস্থান আছে, সন্তানকে স্কুলে পড়ানোর জন্যে সরকারী অনুদানের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না, বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে এ রাজ্যের সেরা বেসরকারী চিকিৎসা তাকে দেওয়ার মত আর্থিক সঙ্গতি আছে এবং এতকিছুর পরেও ইচ্ছে হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, দরকার না হলেও বইপত্র কেনা এবং বছরে একবার সপরিবারে বেড়াতে যাওয়ার ক্ষমতা আছে। তা এই আমার বাৎসরিক রোজগারই যদি নেমার মোটে ছ ঘন্টায় আয় করে ফেলেন, তাহলে ভেবে দেখুন ভারতের মত একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশের মহানগরগুলোর বস্তিতে যারা থাকে তাদের জীবনযাত্রার সাথে নেমারের জীবনযাত্রার ফারাক কতটা। একজন বস্তিবাসী যদি পৃথিবী হন, নেমার তাহলে মহাবিশ্ব।
কয়েকমাস আগেই নেমারের প্রাক্তন টিমমেট লায়োনেল মেসি বাল্যবন্ধু আনতোনেলাকে বিয়ে করলেন আর্জেন্টিনায় নিজের যে শহরে জন্ম সেই রোজারিও এক বিলাসবহুল হোটেলে। সংবাদসংস্থাগুলো আকাশ থেকে তোলা একটা ছবি পাঠিয়েছিল হোটেলটার, অনেক কাগজে ছাপাও হয়েছিল। সেই ছবিতে দেখা যায় হোটেলটার ঠিক বাইরেই বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বস্তি। দেখতেই মনে পড়েছিল বিজন ভট্টাচার্য নামে এক পাগলের লেখা ‘নবান্ন’ বলে একটা নাটকের কথা। তার একটা দৃশ্য আমাদের পাঠ্য ছিল কোন এক সুদূর অতীতে। সেই দৃশ্যে এক বড়লোকের বাড়ির বিয়ে হচ্ছে। সেখানকার আসবাবপত্রের গা দিয়ে “আলো চুঁইয়ে পড়ছে” আর বিয়েবাড়ির বাইরে ময়লার ভ্যাটে একদল মানুষ কুকুরের সঙ্গে কামড়াকামড়ি করছে খাবারের জন্যে। আপনি বলবেন মেসি, নেমার তাঁদের জন্মগত প্রতিভা এবং অধ্যবসায়ের জোরে ঐ রোজগারে পৌঁছেছেন। কথাটা মিথ্যে নয়। একইসঙ্গে এটাও মিথ্যে নয় যে অনাহার ছাড়া অত্যাহার থাকতে পারে না।
যাই হোক, সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় ছোটবেলা থেকে আমরা যে শুনে এসেছি ফুটবল হল গরীবলোকের খেলা সেটাকে এখন ছোটবেলার পরিত্যক্ত খেলনাগুলোর মত আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই ভাল। সারা পৃথিবীতেই ফুটবল এখন বড়লোকের খেলা — বড়লোকেরাই দ্যাখে, বড়লোকেরাই খেলে। বিশ্বাস হচ্ছে না? ইন্টারনেটে খুঁজে দেখুন প্রিমিয়ার লিগের খেলাগুলোর টিকিটের দাম নিয়ে কত সমর্থক অসন্তুষ্ট। এন্ড্রু ফ্লিন্টফকে মনে পড়ে? তিনি তো নেহাত গরীব লোক নন, সিপিএম নন, বিজন ভট্টাচার্যের মত পাগলও নন। ইউটিউবে খুঁজে দেখুন, একটা রেডিও স্টেশনে বসে ফ্লিন্টফ প্রশ্ন তুলছেন আর্সেনালের খেলার টিকিটের দাম নিয়ে। বলছেন যে এওয়ে ম্যাচটা আর্সেনাল খেলতে যায় বিলাসবহুল প্লেনে করে, সে ম্যাচটা তো বাসে চড়েও খেলতে যাওয়া যায়। যে সমর্থক কষ্ট করে আয় করা পয়সা খরচ করে টিউবরেলে চড়ে খেলা দেখতে আসেন তিনি কুড়ি মিনিটের ফ্লাইটে যাতে সিনেমা দেখা যায়, ভিডিও গেম খেলা যায়, স্নানবিলাসী হওয়া যায় — তার জন্যে বেশি দামের টিকিট কিনতে বাধ্য হবেন কেন? গানাররা কেন বাসে করে খেলতে গিয়ে টিকিটের দাম কমানোর ব্যবস্থা করবে না?
তা এহেন ফুটবল খেলার ভবিষ্যতের তারকাদের আপনি দেখতে পাবেন আপনার দেশেই। আর কয়েকদিন পরেই আমাদের চিরচেনা (সাংবাদিক বন্ধুদের মুখে শুনছি আর চেনা যাচ্ছে না) সল্টলেক স্টেডিয়ামে তারা দাপিয়ে বেড়াবে। সেই স্টেডিয়ামের আশেপাশে কখনো বস্তি থাকতে দেওয়া যায়! ভাবলেন কী করে? পৃথিবীর সর্বত্রই তো দরিদ্র কুৎসিত, দারিদ্র্য নয়। অতএব বড়লোকেদের মোচ্ছবের জন্যে কিছু গরীবকে তো ঘরছাড়া হতেই হবে। আমাদের দেশটা কত সুজলাং সুফলাং সেটা দেখাতে হবে না দুনিয়াসুদ্ধু লোককে? হীরকরাজার মোচ্ছবের আগে লোকের ভিটেমাটি চাটি করার সেই দৃশ্য মনে নেই?
আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এতবড় খেলাধুলোর আয়োজন মানেই তো এই। ব্রাজিলে যখন ফুটবল বিশ্বকাপ হল তখনো এই একই ঘটনা ঘটেছিল তো। ব্রাজিল তো তবু ফুটবলের পীঠস্থান, আমাদের তো ফুটবলের বিশ্ব মানচিত্রের পিঠে স্থান খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। তবু আমরা এই মহাযজ্ঞ করছি। করার সুযোগ যে পেয়েছি সেও ফুটবল আর গরীবের খেলা নেই বলেই। মাঠের ভেতরে আমরা যা-ই করি না কেন, বাইরে আমাদের মত বড় বাজার আর কোথায় আছে? ফিফা আর তার স্পনসররা সেই বাজারে ব্যবসা করার এমন সুযোগ ছাড়বে কেন? আমাদের আম্বানি ইত্যাদিরাও সেই সুযোগে যারপরনাই কামিয়ে নেবেন না কেন? আর আমাদের শাসকরাই বা দুনিয়াকে দেখানোর এমন সুযোগ ছাড়বেন কেন যে আমাদের দেশে সবার পেটে ভাত না থাক, দারুণ দারুণ সব স্টেডিয়াম আছে, মোচ্ছব করতে আমরা ভারী ওস্তাদ। তাই অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপই শেষ নয়, প্রধানমন্ত্রীর সস্নেহ প্রশ্রয়ে অনূর্ধ্ব-২০ আয়োজন করার আব্দারও করে ফেলেছি আমরা। হরির লুট ভাল জমেছে বুঝলে ফিফা সে আব্দার রক্ষা করতেও পারে। চাই কি, ভবিষ্যতে সিনিয়র বিশ্বকাপও আমরা আয়োজন করতে চাইতে পারি। এক ফুয়েরারের বার্লিন অলিম্পিক দরকার হয়েছিল শক্তি প্রদর্শন করতে, আরেকজনের একটা ফুটবল বিশ্বকাপ তো লাগতেই পারে।
যাও বস্তির ছেলে, যাও। যেখানে পার পালিয়ে যাও, ফুটবল তোমার খেলা নয়। বস্তিতে ন্যাকড়া দিয়ে বল বানিয়ে খেলতে খেলতে ফুটবলের রাজা হয়ে ওঠা দিয়েগো মারাদোনা যখন তোমার শহরের আদরের প্রাক্তন ক্রিকেটারের সাথে বল লাথাবেন, তুমি তখন আসন্ন শীতে কোথায় মাথা গুঁজবে সেটা ভেবো। জগতের আনন্দযজ্ঞে তোমার নিমন্ত্রণ নেই, থাকতে পারে না।

পুনশ্চ: বন্ধুরা আমার ভন্ডামিতে ভুলবেন না যেন। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি এই খেলার বিপক্ষে নই। হতেই পারি না। আগামী একমাস সাজিয়ে গুছিয়ে ফলাও করে এই খেলারই খবর যারা আপনাদের সকালের কাগজে পরিবেশন করবে আমি তাদেরই একজন।

নির্বোধ আর বুদ্ধিমান

এই যারা হাসাহাসি করছে তাদের নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির উপরে আস্থা দেখে যে আমার হাসি পাচ্ছে। এরা অনেকেই তো কদিন আগে নিজেরাও বিশ্বাস করেছিল যে দু হাজার টাকার নোটের মধ্যে জিপিএস চিপ বসানো আছে, তাই মাটির নীচে পুঁতে রাখলেও আয়কর দপ্তর জানতে পারবে কোথায় আছে। এরাই তো গলা ফাটিয়ে বলে বেড়াচ্ছিল বিমুদ্রাকরণের ফলে নাকি আইএস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরাই তো হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডকে বেদবাক্য বলে মনে করে

রাজধানী কলকাতার অধিবাসীদের চেয়ে এ রাজ্যের গ্রাম বা মফঃস্বলের বাসিন্দারা যে নিকৃষ্টতর জীব, এ রকম একটা ধারণা অনেকদিন ধরে চালু আছে। বহুকাল শুনে এসেছি মাধ্যমিকে জেলার ছাত্রছাত্রীরা স্ট্যান্ড করে না, করিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এমন হতেই পারে না যে জেলার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় কলকাতার বাসিন্দাদের চেয়ে ভাল ফল করবে। ইদানীং কলকাতার অধিকাংশ ছেলেমেয়ে আইসিএসই বা সিবিএসই স্কুলে চলে গেছে বলেই বোধহয় এই অভিযোগটা আর তত শোনা যায় না।
বামফ্রন্ট যখন একের পর এক নির্বাচনে জিতত, যখন সেই জয়গুলোকে রিগিং এর ফল বলে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার জায়গাটা তৈরি হয়নি, তখনো দেখতাম শহুরে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তরা বলতেন “ও তো গ্রামের ভোটে জেতে।” মানে গ্রামের ভোটগুলো ফাউ। শহরের একেকটা ভোটের মূল্য গ্রামের ভোটের থেকে বেশি হওয়া উচিৎ ছিল, তাহলে এই অনর্থ ঘটতে পারত না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয় নিয়েও দেখেছি একই কথা বলা হয়। অথচ কলকাতা কর্পোরেশন, বিধাননগর পুরসভা তৃণমূলের দখলে; কলকাতার অধিকাংশ বিধায়ক মমতার পার্টির।
মজা হচ্ছে, কলকাতার লোকেদের মনেই থাকে না যে বাঙালি যাঁদের নিয়ে গর্ব করে, রামমোহন রায় থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত, তাঁদের অনেকেরই জন্ম, বেড়ে ওঠা কলকাতার বাইরে।
যাক গে। যেজন্যে এত কথা বলছি এবারে সেটা বলি। ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড বসানোর বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন চলছে। গত কয়েকদিনে যা জানা গেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে এলাকার মানুষের ক্ষোভ আসলে পাওয়ার গ্রিড নিয়ে ততটা নয় যতটা বলপূর্বক বা ঠকিয়ে জমি দখল করা নিয়ে। এই আন্দোলনের পেছনে নকশাল বা অন্য বিরোধীদের প্রেরণা (বা প্ররোচনা) থাকুক আর না-ই থাকুক, দিদির ভাইয়েরা যে শুধু আইনকানুন মেনেই জমি নিয়েছেন ওখানে তা নয় — এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। পাওয়ার গ্রিড ওখানে বসলে ঐ এলাকার মানুষের কী সুবিধা হবে, আদৌ কোন সুবিধা হবে কিনা এসব বোঝানোর জন্য সরকার সময় ব্যয় করেননি। অতএব এটা গা জোয়ারি, যেমন গা জোয়ারি সিঙ্গুরে করা হয়েছিল, নন্দীগ্রামে করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, সহকর্মী অনেকের কাছেই দেখছি ভাঙড় নিয়ে আলোচনায় মুখ্য বিষয় এগুলো নয়। মুখ্য হল এক স্থানীয় মহিলার বাইট, যেখানে তিনি বলেছেন ওখানে পাওয়ার গ্রিড হলে “আমাদের আর বাচ্চা হবে না।”
গ্রামের মানুষরা কত অজ্ঞ, কত অশিক্ষিত তা নিয়েই হাসাহাসি, রসালো আলোচনা ইত্যাদি চলছে। বিজ্ঞানে আমি বরাবরই অজ্ঞান। ইলেকট্রিক আর ইলেকট্রনিকের পার্থক্য বুঝিয়ে দেওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই সুতরাং ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড মানুষের শরীরে কী প্রভাব ফ্যালে বা আদৌ ফ্যালে কিনা তা নিয়ে আমার কোন ধারণা নেই। আমার পদার্থবিদ বন্ধুদের অনুরোধ করব আলোকপাত করতে।
কিন্তু এই যারা হাসাহাসি করছে তাদের নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির উপরে আস্থা দেখে যে আমার হাসি পাচ্ছে। এরা অনেকেই তো কদিন আগে নিজেরাও বিশ্বাস করেছিল যে দু হাজার টাকার নোটের মধ্যে জিপিএস চিপ বসানো আছে, তাই মাটির নীচে পুঁতে রাখলেও আয়কর দপ্তর জানতে পারবে কোথায় আছে। এরাই তো গলা ফাটিয়ে বলে বেড়াচ্ছিল বিমুদ্রাকরণের ফলে নাকি আইএস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরাই তো হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডকে বেদবাক্য বলে মনে করে। ঐ গ্রাম্য মহিলা, যিনি হয়ত শুধু নিজের নামটুকু সই করতে পারেন, তার সাথে এই ইংরিজি জানা, স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারা লোকেদের পার্থক্য কোথায়? শহরে বাস করে, ডিগ্রিধারী হয়ে কী তফাত হল? এবার থেকে শঙখ ঘোষকে মনে রাখবেন:

‘হাওড়া ব্রিজের চূড়োয় উঠুন,
নীচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান —
দুটোই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’

বয়স হচ্ছে

ইতিমধ্যে এক মনোযোগী ছাত্রী হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ পা পিছলে রাস্তার হাঁটুজলে ঝপাং । হাতের খাতা “ভেসে যায় অলকানন্দা জলে”। সে প্রথমে লজ্জিত পরে হর্ষিত । তারস্বরে সঙ্গী ছেলেটাকে ডাকছে ” অ্যাই, কোথায় গেলি ? শিগগির আয় ।” ছেলে অমনি দৌড়ে এসে হাত ধরে তুলতে গেছে । কিন্তু মেয়ের চিৎকৃত নির্দেশ “আগে খাতা আগে খাতা ।” রোগা প্যাংলাটি দেখলাম কোন শালপ্রাংশু মহাভুজ বলীর চেয়ে কোন অংশে কম নয় । একহাতে পৃথুলা সঙ্গিনী আর অন্য হাতে তার হৃদি, থুড়ি খাতা, সে দিব্যি তুলে নিল

বয়সটা যে চল্লিশের দিকে এগোচ্ছে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম গত পরশু বিকেলে । অফিস যাওয়ার পথে কলেজ স্ট্রিট গেছি গোটাদুয়েক বইয়ের খোঁজে । যেতে হবে ন্যাশনাল বুক এজেন্সিতে । আমার পরিষ্কার মনে পড়ল ওটা সূর্য সেন স্ট্রিটে । বীরবিক্রমে পুঁটিরাম পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন প্রায় রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছে গেছি তখন মনে হল এবার স্মৃতি ব্যর্থ হয়েছে এটা মেনে নেওয়া উচিৎ । নিজের স্মৃতির উপর গর্বটাকে লক্ষ্মী ছেলের মত পিঠের ব্যাগে লুকিয়ে ফেলে এক প্রবীণার কাছে পথনির্দেশ চাইলাম । তিনি জানালেন দোকানটা কফি হাউসের আশেপাশে । প্যারামাউন্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, তখনও দোকানটার চেহারা কিছুতেই মনে পড়ছে না । অগত্যা একজন নবীন দোকানকর্মীর সাহায্য চাইলাম । তিনি একেবারে কোন্ বাড়িটা তা-ও বলে দিলেন ।
আমি যখন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের সামনে তখন ঝুপ করে নেমে পড়ল বৃষ্টি । ব্যাগ থেকে লটঘটে ছাতাটা বার করে খুলতে খুলতেই একটু ভিজে গেলাম ।
এন বি এ তে ঢুকতে গিয়ে দেখি তার সামনে একগাদা তরুণ তরুণী ভিড় জমিয়েছে । আমার মত তাদের অফিস যাওয়ার তাড়া নেই । তাই বৃষ্টি থেকে বাঁচবার তাগিদও তাদের যৎসামান্য । কোন একটা ছাউনির নীচে দাঁড়ানো যতটা না প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি ঘন হয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে আড্ডা দেওয়ার জন্যে । ঐ ভাবনাহীন প্রাণগুলোকে এড়িয়ে ঢুকে পড়লাম দোকানে । সেখানে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন আগলে বসে আছেন কয়েকজন প্রায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক যাঁদের চোখ ঢেকে ফেলেছে সিঁড়িতে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েগুলো । বৃষ্টি দেখার আর উপায় নেই । আমার প্রবেশে ওঁরা একটু নড়েচড়ে বসেছিলেন কিন্তু আমি এমন একটা বই চেয়ে বসলাম যে হতাশ গলায় ওঁদের একজনকে বলতে হল “ও বই আর পাওয়া যায় না । অনেকদিন হল ।”
যা-ই হোক এক বন্ধুর জন্যে উপহার কেনার ছিল । সে বইটা শেলফের উপরেই রাখা ছিল । সেইটে কিনে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি আরো বেড়েছে, সেইসঙ্গে ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও । ভাবছি অনুজ অনির্বাণকে কফি হাউসে আসতে বলি, বহুবার প্রতিশ্রুত আড্ডাটা মারা যাবে । তারপর ভাবলাম এত বৃষ্টিতে আসবেই বা কী করে ? ভাবতে ভাবতে কফি হাউসের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি । বাইরের চেহারাটা দেখেই বুঝতে পারছি ভেতরে আমাকে আরো বেমানান, এমনকি হাস্যকর, দেখাবে । তাই বাইরেই কোনমতে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
বৃষ্টি কমার নাম নেই । রাস্তা দিয়ে বহু ছেলেমেয়ে ছাতা ছাড়াই দিব্য হেঁটে যাচ্ছে আমার কেজো জীবনকে মুখ ভেঙচিয়ে । কেউ কেউ ভিজতে ভিজতে হঠাৎ বৃষ্টি থেকে বাঁচার ভান করে ফুটপাথে এসে উঠছে । তাদের জায়গা ছাড়তে ছাড়তে আমি ক্রমশ কোণঠাসা । এমন সময়ে দেখি কফি হাউস থেকে একলাফে রাস্তায় নেমে পড়ে একটি মেয়ে তার প্রেমিকটিকে ভিজতে ডাকছে । ছোঁড়া এমন আহাম্মক (অথবা সাইনাসের রুগী) যে হাতের ছাতাখানা দেখিয়ে বলছে “তোর ছাতাটা বার কর না ।” দেখেই আমার মনে হল এ শালা শঙ্খবেলা দ্যাখেনি । শেষ অব্দি অবশ্য মেয়েটিরই জিৎ । সে বিজয়গর্বে গদগদ হয়ে প্রেমিককে বগলদাবা করে সংস্কৃত কলেজ পেরিয়ে উধাও হল ।
এইসব দেখতে দেখতে কখন এক ফুটপাথস্থ বই বিক্রেতার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি ! তিনি ঝাঁজিয়ে উঠলেন । আমি দেখলাম এখানে আমার না দাঁড়ানোই শ্রেয় । ময়ূরদের পাড়ায় দাঁড়কাকের দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অন্যায় । অতএব ঐ বৃষ্টিতেই রাস্তায় নেমে পড়লাম ।
জায়গা খুঁজতে খুঁজতে মনে হল হিন্দু স্কুলের সামনের পাঠ্য বইয়ের দোকানগুলো, যেগুলোকে বরাবর বইপাড়ার সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় দোকান বলে মনে হয় আমার, সেগুলোর ছাউনিই আমার উপযুক্ত আশ্রয় । কারণ সেখানে দেখি পড়াশোনা ছাড়া কিচ্ছু জানে না এমন ছেলেমেয়ে আর তাদের বাবা-মায়েদের ভিড় । আমার মত বা আরেকটু বড় মাপের ভুঁড়ি নিয়ে অনেকেই সেখানে আছে ।
সবে ওখানে দাঁড়িয়ে ছাতাটা বন্ধ করেছি, কোথা থেকে বেগুনী আর নীল শাড়ি পরা দুটো মেয়ে একটা ছাতায় আধাআধি ভিজতে ভিজতে এসে হাজির । একজন আরেকজনকে প্রচন্ড বকছে “তোকে বললাম শাড়ির ঝামেলা করিস না । এখন কী হবে ? হাঁটাও যাচ্ছে না ঠিক করে । কী ভারী হয়েছে শাড়িটা !”
অন্য বেচারির উত্তর “আমি কী করে জানব এরকম বৃষ্টি হবে ? সকাল থেকে রোদই ছিল ।”
এদের ঝগড়া উপভোগ করতে করতেই ভাবছি এত বৃষ্টিতে জল ঠেঙিয়ে অফিস যাব কী করে । হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সেই দুশ্চিন্তার কথা লিখেও ফেলেছি । ইতিমধ্যে এক মনোযোগী ছাত্রী হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ পা পিছলে রাস্তার হাঁটুজলে ঝপাং । হাতের খাতা “ভেসে যায় অলকানন্দা জলে”। সে প্রথমে লজ্জিত পরে হর্ষিত । তারস্বরে সঙ্গী ছেলেটাকে ডাকছে ” অ্যাই, কোথায় গেলি ? শিগগির আয় ।” ছেলে অমনি দৌড়ে এসে হাত ধরে তুলতে গেছে । কিন্তু মেয়ের চিৎকৃত নির্দেশ “আগে খাতা আগে খাতা ।” রোগা প্যাংলাটি দেখলাম কোন শালপ্রাংশু মহাভুজ বলীর চেয়ে কোন অংশে কম নয় । একহাতে পৃথুলা সঙ্গিনী আর অন্য হাতে তার হৃদি, থুড়ি খাতা, সে দিব্যি তুলে নিল ।
ততক্ষণে আমার নিজেকে আবার পাতিকাক মনে হচ্ছে । দুঃখে কা কা করে ডেকে উঠতে যাব, অমনি ফোনটা বেজে উঠল । সহকর্মী অর্ণবের ফোন “তুমি আমহার্স্ট স্ট্রিট ক্রসিং এ চলে আসতে পারবে ? আমি ওলাতে আছি । তোমায় তুলে নেব তাহলে ।” আমাকে তখন হেঁটে আন্দামান যেতে বললেও চলে যেতাম, আমহার্স্ট স্ট্রিট তো কোন্ ছার । Damsel না হলেও আমি তখন প্রবল distressed । সহকর্মীটি shining ওলায় আমাকে উদ্ধার করল ।

প্রতিবাদের অধিকার

আপনি সমর্থন করেন না এমন একটা বিষয় নিয়ে আন্দোলন হলেই আপনি বলবেন “আমার টাকায় এসব করা চলবে না। যে পাতে খাচ্ছ, সে পাতেই হাগছ” ইত্যাদি। তাহলে তো মশাই যে পাড়ার লোক সরকারী দলের প্রার্থীকে জেতায় না সে পাড়ায় রাস্তা না বানানোটাই সঠিক রাজনীতি। আপনি মমতার রাজ্যে থেকে বি জে পি, সি পি এম, কংগ্রেস এদের ভোট দেবেন আর দিদির ভাইয়েরা আপনার জন্য ক্যাটরিনার গালের মত রাস্তা বানিয়ে দেবে! আপনিও তো যে পাতে খাচ্ছেন সে পাতেই হাগছেন

JNUSU President Kanhaiya Kumar at JNU

হোক কলরব আন্দোলনের সময় দেখেছি, এখন আবার দেখছি যে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একটা যুক্তি দেওয়া হয় — আয়করদাতাদের টাকায় যেহেতু তারা ভর্তুকিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে অতএব তাদের প্রতিবাদ-টতিবাদ করার অধিকার নেই। এগুলো করা মানে আয়করদাতার টাকা নষ্ট করা। এই যুক্তি যুগপৎ বোকার যুক্তি এবং গা-জোয়ারি যুক্তি।
কেন এটা বোকার যুক্তি সেটা আগে বলি।

ভারতবর্ষে কয়েক কোটি আয়করদাতা। তারা সকলে প্রায় কোন বিষয়েই একমত নয়। হওয়ার দরকারও নেই। তাহলে কি করে ধরে নেওয়া হয় যে সব আয়করদাতাই মনে করে ছাত্রছাত্রীদের কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করা উচিৎ নয় বা আদৌ রাজনীতি করা উচিৎ নয়? যিনি এরকম ভাবেন তিনি ভাবুন কিন্তু আমার আয় বা ভাবনার মালিকানা আমি আপনাকে দিইনি। উপরন্তু যারা আন্দোলন করছে তাদের বাবা-মায়েরাও অনেকে আয়করদাতা। দেশগঠনে তাঁদের আয় কিছু কম পরিমাণে ব্যবহার হয় না। যাদবপুরের যেসব মাস্টারমশাই, দিদিমণি ছাত্রদের সমর্থন করেছিলেন এবং জে এন ইউ এর যাঁরা আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁরাও শুধু আয়করদাতার টাকায় মাইনে পান তা নয়, নিজেরাও আয়কর দেন। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, যাঁরা এদেশে থাকেন, তাঁরাও আয়করদাতা। স্পষ্টত, যে কোন ছাত্র আন্দোলনই বহু আয়করদাতার স্নেহধন্য।

এবার আপনি বলবেন, তাহলে যেসব আয়করদাতা আন্দোলনকারীরা তাদের টাকা নষ্ট করছে মনে করে তাদের মতামত কি মূল্যহীন? একেবারেই না। এখানেই আসছে গা-জোয়ারির প্রশ্নটা। আপনি সমর্থন করেন না এমন একটা বিষয় নিয়ে আন্দোলন হলেই আপনি বলবেন “আমার টাকায় এসব করা চলবে না। যে পাতে খাচ্ছ, সে পাতেই হাগছ” ইত্যাদি। তাহলে তো মশাই যে পাড়ার লোক সরকারী দলের প্রার্থীকে জেতায় না সে পাড়ায় রাস্তা না বানানোটাই সঠিক রাজনীতি। আপনি মমতার রাজ্যে থেকে বি জে পি, সি পি এম, কংগ্রেস এদের ভোট দেবেন আর দিদির ভাইয়েরা আপনার জন্য ক্যাটরিনার গালের মত রাস্তা বানিয়ে দেবে! আপনিও তো যে পাতে খাচ্ছেন সে পাতেই হাগছেন। আমি বামপন্থী। তা বলে আমি একথা বলতে পারি না যে আমি আয়কর দিই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু এস এফ আই আর এ আই এস এফ কে রাজনীতি করতে দিতে হবে। ছাত্র পরিষদ, টি এম সি পি, এ বি ভি পি সকলেরই অধিকার আছে। আমি এদের অপছন্দ করি বলেই এরা আন্দোলন করলে বলতে পারি না “আমার টাকায় এসব করা চলবে না। যে পাতে খাচ্ছ, সে পাতেই হাগছ”।

যদি বলি তাহলে আমি গুন্ডা। স্বাধীন দেশের নাগরিক-ফাগরিক কিস্যু নই। যে অন্যের স্বাধীনতা মানে না তার নিজের স্বাধীনতাও বাঁচে না।

পুনশ্চ — বিদেশবাসী প্রাক্তনীদের কথা এখানে বললাম না। কারণ তাঁদের মধ্যে যাঁরা ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে যান তাঁরা অত্যন্ত দেশভক্ত। নিশ্চয় এসব দেশদ্রোহী আন্দোলন কোন যুক্তিতেই সমর্থন করেন না। আর যাঁরা ঐসব অনুষ্ঠানে যান না তাঁরা তো একেবারে দেশদ্রোহী। তাঁরা কি ভাবেন সেই নিয়ে আলোচনা করলে যদি পুলিশে ধরে!

%d bloggers like this: