আরএসএসের পছন্দসই অগভীর বিরোধিতার মুখ বাবুল, শত্রুঘ্ন

বাবুল সুপ্রিয় ও শত্রুঘ্ন সিনহা
(ছবি ইন্টারনেট থেকে)

নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক, বামফ্রন্ট সরকার মধ্যগগনে। আমার এক পিসতুতো দিদির ছেলে একবার কোনো ক্লাসে উঠলে সেখানেই ঘাঁটি গেড়ে ফেলছে। তা নিয়ে তার বাবা, মা, মামা সকলেই চিন্তিত। আমার সিপিএম কর্মী বাবা সেই দিদির মামা হন, তার উপর পেশায় শিক্ষক। ফলে সে ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে পরামর্শ চাইল। কোনো জবাব দেওয়ার আগেই দিদির ভাইটি আমার বাবাকে বলল “দোষ তো আমার ভাগনার নয়, দোষ তো তোদের (বয়সের তফাত কম হওয়ায় ‘তুই’ সম্বোধনই চালু ছিল)। তোরা মুড়ি মিছরি এক দর কইরা দিছস। এমন ব্যবস্থা করছস যে রিকশাআলার পোলায় আমার ভাগনার পাশে বইস্যা ক্লাস করে। তাতে তার তো কোনো উন্নতি হয় না, কারণ তার ল্যাখাপড়ার কালচার নাই। উল্টা আমাদের ভদ্দরলোকের পোলাগুলার সব্বোনাশ হয়্যা যাইতাছে।” আমার বাবা ভাগ্নে-ভাগ্নী বলতে অজ্ঞান ছিলেন, তাই কোনো কড়া উত্তর দেননি। হেসে বলেছিলেন “অ, নাচতে শেখো নাই বইলা উঠানের দোষ দিতাছ।” বাড়ি ফিরে আমাকে বলেছিলেন “এদের কীরকম মানসিকতা দেখেছিস? রিকশাওলার ছেলে ওর ভাগ্নের সাথে এক ক্লাসে পড়ছে বলে ওর গায়ে ফোসকা পড়ছে। তার জন্যে নাকি ওর ভাগ্নের পড়াশোনা হচ্ছে না।”

এর কৃতিত্ব বা দোষ কতটা বামফ্রন্ট সরকারের জানি না। দেশের অনেক জায়গাতেই সেইসময় পর্যন্ত রিকশাচালকের ছেলেমেয়ে আর চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়ে এক স্কুলেই পড়ত, একসাথে খেলাধুলোও করত। একই পাড়ায় বিত্তশালীর প্রাসাদপ্রমাণ বাগানওলা বাড়ি থাকত, মধ্যবিত্তের একতলা বাড়ি থাকত, নিম্নবিত্তের টালির চালের বাড়িও থাকত। সেসব বাড়ির মধ্যে বাটি চালাচালির সম্পর্কও থাকত কখনো কখনো। এ কোনো সোনালি অতীতের আষাঢ়ে গপ্প নয়। তখনো বিলক্ষণ শ্রেণি বিভাজন ছিল, তিনতলা বাড়ির মেয়ের সাথে টালির বাড়ির ছেলের প্রেম হত না সিনেমার মত, বিয়েও নয়। কিন্তু এ বাড়ির দাদুর শ্রাদ্ধে ও বাড়ি থেকে চিঁড়ে-দই খাওয়ার লোক থাকত, ও বাড়ির ছেলের বিয়েতে এ বাড়ি থেকে অন্তত একজনের নেমন্তন্ন থাকত। ১৯৯১ সালের পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে বদলাতে এখন সব অলীক। এখন হয় ফ্ল্যাট, নয় ঝুপড়ি। হয় গেটেড কমিউনিটি, নয় বস্তি। যেখানে পাড়া অবশিষ্ট আছে, সেখানেও বাবা-মা কেবল নিজেদের দরের পরিবারের বাচ্চাদের সাথেই মেলামেশা করতে দেন নিজের ছেলেমেয়েকে। চাকুরিজীবীর ছেলের স্কুল আর রিকশাওলার ছেলের স্কুল আলাদা হবে — আমার পিসতুতো দাদার এই ফ্যান্টাসি এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। রিকশাচালক, বাড়ির কাজের দিদি, জনমজুরের ছেলেমেয়েরা পড়ছে টিমটিমে সরকারপোষিত স্কুলে, কারণ তাদের বাবা-মায়েদের ওটুকুই সাধ্য। আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়ছে ঝাঁ চকচকে প্রাইভেট স্কুলে। অর্থাৎ মনমোহনী অর্থনীতির তিরিশ বছরে অভূতপূর্ব বৈচিত্র্যহীন ঐক্য তৈরি হয়েছে এ দেশে। ইংরেজিতে যাকে ঘেটো বলে, গোটা দেশটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমন ঘেটোর সমাহার।

কেন এসব কথা লিখলাম? কারণ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের দেশ ভারতবর্ষ বিপন্ন বলে আমরা সকলেই খুব চিন্তিত। একটা করে নির্বাচনের ফল বেরোয়, বিজেপি জেতে, আর আমরা নানা রঙের বিজেপিবিরোধীরা, হতাশ হয়ে বা ক্রুদ্ধ হয়ে বলি “এ দেশটার কিস্যু হবে না। লোকে কেবল হিন্দু-মুসলমান বোঝে। আর কোনো ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামায় না।” এত বড় দেশে প্রত্যেক নির্বাচনেরই যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে সেগুলোর কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, ধর্মীয় বিভাজনকে প্রধান ইস্যু করে তোলার চেষ্টা নিঃসন্দেহে অনেকটাই সফল হয়েছে। নির্বাচনগুলোর ফলাফলে তার প্রভাব উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। কিন্তু সে বিভাজন দূর করার পথ খোঁজার সময়ে আমরা ভেবে দেখছি না, ধর্মীয় বিভাজনের ইমারত দাঁড়িয়ে আছে অন্য গভীরতর বিভাজনের উপর। আমি আপনার থেকে আলাদা। আমি আপনার চেয়ে বেশি রোজগার করি, আপনার চেয়ে দামি পোশাক পরি, আমার গাড়ি আছে আপনার নেই, অতএব আপনার সাথে আমার মেশা উচিত নয়। আমাকে মিশতে হবে আমার মত লোকেদের সাথে। এই ব্যাপারটা যদি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে আপনি আমার জানাশোনার বাইরে চলে যাবেন। ক্রমশ আপনার ভালমন্দে আগ্রহ হারাব, তারপর একসময় স্থির বিশ্বাস হবে যে আপনি বাঁচলেন কি মরলেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমি কেবল আমার মত লোকেদের সাথে মিশি, আপনি মেশেন আপনার মত লোকেদের সাথে — সমাজ যে এমনভাবে বিভক্ত হওয়াই উচিত, এই ধারণা একবার মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে অন্য যে কোনোরকম বিভাজন তৈরি করা জলভাত। যে অপর, সে অপ্রয়োজনীয়, এমনকি খারাপ — আগে একথা প্রতিষ্ঠা করুন। তারপর অপরের সংজ্ঞাটা দরকার মত বদলাতে থাকুন। সোজা হিসাব।

আমাদের দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় (নাকি সর্বত্রই?) এমনিতেই এক ধরনের অপরায়নের ভিত্তিতে পৃথকীকরণ কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে — বর্ণবাদ। তার সাথে বিশ্বায়নের যুগে যোগ হয়েছে শ্রেণিভিত্তিক পৃথকীকরণ, যা এতক্ষণ ব্যাখ্যা করলাম। এই দো-ফসলি জমিতে ধর্মীয় বিভাজনের ফসল ফলানো মোটেই কঠিন নয়। যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নিয়ে আমাদের গুমোর, সেই বৈচিত্র্য স্থানীয় স্তরে হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তৈরি জমিতেই বীজ বুনে ফসল তুলেছে। ভেবে দেখুন, ভারতের বাজার খুলে দেওয়া হল ১৯৯১ সালে, আমরা ‘আপওয়ার্ডলি মোবাইল’ হতে শিখে গেলাম। আর ১৯৮৯ সাল থেকে রক্তক্ষয়ী রথযাত্রার মাধ্যমে লালকৃষ্ণ আদবানি সঙ্ঘের যে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা সারা ভারতে ছড়িয়ে দিতে নেমেছিলেন, তার প্রথম বড়সড় সাফল্য এল ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্যে দিয়ে। ভারতে বহুজাতিকের পায়ের তলার মাটি যত মজবুত হয়েছে, তত মজবুত হয়েছে আরএসএসের মাটি। ১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া আরএসএস বরাবর সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে অবিচল থেকে কাজ করে গেছে। কিন্তু দেশভাগ, গান্ধীহত্যার মত ঘটনার পরেও প্রান্তিক শক্তি হয়েই থাকতে হয়েছিল। অথচ কম্পিউটারের ভারতে, উদারীকরণের ভারতে কিনা এই প্রাচীনপন্থী, ধর্মান্ধ সংগঠন ক্রমশ নিজের শক্তি বাড়িয়ে আজকের অপরাজেয় স্থানে পৌঁছতে পারল। একথা বললে ভুল হবে না, যে ভোগ্যপণ্যের বৈচিত্র্য আর বেসরকারিকরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে ও সমাজে আরএসএসের প্রভাব বেড়েছে। অটলবিহারী বাজপেয়ী আর মোদীর সরকারের রাজনীতি যতটা রক্ষণশীল, তাঁদের অর্থনীতি ততই উদারপন্থী। তথাকথিত খোলা হাওয়ার খোঁজ দিয়েছিল কংগ্রেস, সে হাওয়ায় পাল তুলে দেশকে মাঝসমুদ্রে নিয়ে গেছে আরএসএস। কারণ নব্বইয়ের দশক থেকে যে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি সারা পৃথিবীতে চালু হয়েছে নানা চেহারায়, তাতে যে বৈষম্য বাড়ে তা এখন বিশ্বব্যাঙ্কও স্বীকার করে। আর আগেই বলেছি, মূল বৈষম্যটা বাড়লে আর সবরকম বৈষম্য তৈরি করা যায়। অতএব ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করতে হলে ওটাই পথ।

বারবার আরএসএস কেন বলছি? বিজেপি বলছি না কেন? কারণ হিন্দুরাষ্ট্র বিজেপির এজেন্ডা নয়। বিজেপির কোনো দায়িত্বশীল নেতা ওই শব্দটি পারতপক্ষে উচ্চারণ করেন না, কাগজে কলমে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি সহস্রবার দেওয়া হলেও, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় না। ভীষণদর্শন সাধুসন্ন্যাসী বা হিন্দি বলয়ের কোনো কোনো নেতা ২০২৩ সালের মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে বলে কয়েকবার ঘোষণা করেছেন বটে, কিন্তু মোদী বা অমিত শাহের মত কেউ কখনো ওসব বলেন না। বুদ্ধিমান সাংবাদিক, বিশ্লেষকরা যারা ওসব বলে তাদের “ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট” (প্রান্তিক ব্যক্তি) বলে দাগিয়ে দেন। হিন্দি ভাষায় জনপ্রিয় প্রবাদ হল “হাথি কে দাঁত। খানে কে ঔর, দিখানে কে ঔর।” অর্থাৎ হাতি যে দাঁত দিয়ে খায়, সে দাঁত দেখায় না। আরএসএস অত্যন্ত বলশালী হাতি বৈ তো নয়। বিজেপিবিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী, বিশ্লেষক, আমরা চুনোপুঁটিরা — সকলেই বিস্তর আলাপ-আলোচনা করছি, ফন্দি আঁটছি, বিজেপিকে কী করে নির্বাচনে হারানো যায় তা নিয়ে। আর অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করছি, বিচার বিভাগ থেকে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিসবাহিনী — সবই “ওদের” লোকে ভর্তি। এই “ওরা” যে বিজেপি নয়, আরএসএস, তা বুঝতে পারলে এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না।

আরএসএস নিজেকে বলে সামাজিক সংগঠন, অর্থাৎ বর্তমান ভারতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুধু দলীয় রাজনীতির নয়, স্রেফ নির্বাচনী রাজনীতির তো নয়ই। লড়াইটা সামাজিক। আরএসএস নিজে সেভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে একশো বছর ধরে লড়ে এসেছে, দলীয় রাজনীতিকে সেই লড়াইয়ের একটা ফ্রন্টে পরিণত করেছে। আর আমরা ভাবছি, যেনতেনপ্রকারেণ আরএসএসের রাজনৈতিক শাখাকে ভোটে হারিয়ে দিলেই ঝামেলা চুকে যাবে।

আরএসএসের সমান বয়সী একটি রাজনৈতিক দল ছিল ভারতে — ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। সে দল ভাঙতে ভাঙতে শতধা বিভক্ত। প্রাচীন সংগঠনে এরকম ভাঙাগড়া হয়েই থাকে। কিন্তু মজার কথা, আরএসএসের মধ্যেও নানা দ্বিধা দ্বন্দ্ব আছে। তবু তারা এখনো ‘সঙ্ঘ পরিবার’। সর্বত্র বজরং দলের সাথে বিজেপির মতে মেলে না; বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রবীণ তোগাড়িয়াও প্রকাশ্যে মোদীর নিন্দা করেছেন। মাঝেমধ্যে খোদ আরএসএস বেসুরো গায়। অথচ মূল লক্ষ্য থেকে এরা কেউ কখনো সরে না। মুসলমান বিদ্বেষে সবাই এককাট্টা, রামমন্দির নিয়ে সবাই এককাট্টা। বিরোধীদের আঁচড়াতে, কামড়াতে, খুন করতে সবাই সমান উদ্যোগী। কমিউনিস্টরা কে বেশি কমিউনিস্ট তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে প্রচুর শক্তিক্ষয় করেন, করতে করতে শুধু ল্যাজের ডগা পড়ে আছে। সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যদের ওসব বদভ্যাস নেই।

আরও যা গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে রাখতে, হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন সার্থক করতে আরএসএস শুধু বিজেপির উপর দায়িত্ব দিয়ে বসে নেই। তারা জানে, সমস্ত প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত হওয়া সত্ত্বেও, ইলেকটোরাল বন্ডের কল্যাণে টাকার অঢেল জোগান থাকা সত্ত্বেও এত বড় দেশে সব নির্বাচন জেতা অসম্ভব। বিজেপি হেরে গেলেই হিন্দুরাষ্ট্র ফসকে যাবে? তা হতে দেওয়া যায় না। তাই “সেটিং” থাক আর না-ই থাক, অন্তত আরএসএসের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নয়, শক্তিশালী বিরোধী হিসাবে তেমন কিছু দলের উপস্থিতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কীভাবে করা হল তা হয়ত অতিদূর ভবিষ্যতে কোনো পরিশ্রমী গবেষক উদ্ঘাটন করবেন, কিন্তু আপাতত দেখাই যাচ্ছে, যিনি রথযাত্রায় আদবানির পাশে ছিলেন, আনন্দ পট্টবর্ধনের বিখ্যাত তথ্যচিত্র রাম কে নাম-এ যাঁকে আদবানির মঞ্চে মাইক হাতে দেখা যায়, সেই শত্রুঘ্ন সিনহা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। যে বাবুল সুপ্রিয় দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন বলে বহু মানুষ অভিযোগ করেন, সোশাল মিডিয়ায় বাঙালি মুসলমানদের বিদেশি বলেছেন একাধিকবার, তিনি বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসে প্রথম এগারোয় জায়গা পাচ্ছেন। প্রার্থী হচ্ছেন এমন আসনে, যেখানে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট। অবশ্য তৃণমূলের সর্বময় কর্ত্রী বহু আগেই রাখঢাক না করে বলেছিলেন তাঁর সমস্যা বিজেপিকে নিয়ে, আরএসএসকে নিয়ে নয়। গান্ধীজির বাঁদরদের মত মুখ, চোখ, কান বন্ধ করে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ এবং বিপ্লবী মানুষ সে কথা শুনতে বা দেখতে পাননি, তাঁর দল সম্পর্কে মানুষকে সাবধানও করেননি। নিশ্চয়ই সে কারণেই মমতা আত্মবিশ্বাসী, যে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের সংখ্যালঘু মানুষ বাবুলকে ভোট দিন আর না-ই দিন, ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা নিশ্চয়ই দেবেন। আসানসোলের সংখ্যালঘু মানুষ শত্রুঘ্নকে ভোট না দিলেও ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা নিশ্চয়ই দেবেন। কারণ বিজেপিকে ভোট না দিলেই যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত বেঁচে যাবে — এ বিশ্বাস বহু মানুষের। তাঁরা আরএসএসকে দেখতে পান না। যাঁদের দেখিয়ে দেওয়া দায়িত্ব তাঁরা দেখতে দেন না।

শুধু তৃণমূল কংগ্রেস নয়। বিলীয়মান কংগ্রেসের জায়গা নেবে বলে যে দলটার উপর গত কয়েকদিন বহু বিজেপিবিরোধী মানুষ ভরসা করতে শুরু করেছেন দেখছি, সেই আম আদমি পার্টি দুটোর জায়গায় দশটা রাজ্যে ক্ষমতায় এলেও আরএসএসের ক্ষতি নেই। বহু কমিউনিস্টও দেখছি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিল্লি সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম দেখে আপ্লুত। মনমোহনী অর্থনীতির আমলে বামপন্থীদেরও যে নিজেদের রাজনীতি গুলিয়ে গেছে তার এর চেয়ে ভাল প্রমাণ সম্ভবত নেই। তাঁরা ভেবেও দেখছেন না, কেজরিওয়াল যা করছেন তা আসলে রাজীব গান্ধীর আমলের কংগ্রেসসুলভ কাজ। তফাতের মধ্যে কংগ্রেসের মত দুর্নীতি আপ দলে নেই। কেজরিওয়াল একাধিকবার বলেছেন, তিনি বামপন্থী নন, দক্ষিণপন্থীও নন। কার্যক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তিনি হয় কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নেন না, নয় আরএসএসের পছন্দের অবস্থান নেন। দিল্লি দাঙ্গায় তাঁর দল কোনো সক্রিয়তা দেখায়নি। উপরন্তু নিজের দলের মুসলমান কাউন্সিলর তাহির হুসেনের পাশেও দাঁড়ায়নি। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার সমর্থন করেছিল। অর্থাৎ আপ আপনাকে ভাল রাস্তা দিতে পারে, ভাল স্কুল ও হাসপাতাল দিতে পারে, শস্তায় জল ও বিদ্যুৎ দিতে পারে। তবে তাদের শাসিত রাজ্যে গণহত্যা হয়ে গেলে তারা মাথা ঘামাবে না। অর্থাৎ আপ হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার পথে বাধা নয়।

যেমন বাধা নন ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক। মমতা, কেজরিওয়াল, নবীন — এঁরা কেবল ‘গোদি মিডিয়া’ নয়, ভারতের সব মিডিয়ার মতেই দারুণ ভাল। কারণ এঁরা “গুড গভর্ন্যান্স” (সুশাসন) নামক একটি জিনিস সরবরাহ করেন। সেটি দুলালের তালমিছরির মত এক অরাজনৈতিক অমৃত। এঁদের দেখিয়ে মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে — সুশাসন মানে হল রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল ও ভর্তুকি। কর্মসংস্থান নয়, আইনশৃঙ্খলা নয়, জাতীয় রাজনীতির ইস্যুতে সঠিক অবস্থান নেওয়াও নয়। এই মানদণ্ড মেনে নিতে অসুবিধা না থাকলে কিন্তু মানুষ যোগী আদিত্যনাথকে আবার ভোট দিল বলে রাগ করা চলে না। কারণ রাস্তাঘাট নিয়ে ওই রাজ্যের মানুষের বিশেষ অভিযোগ নেই। স্কুল, হাসপাতাল না দিতে পারলেও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার বিনামূল্যে রেশন দিয়েছে। কোভিডে মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণও দিয়েছে।

ভারতে একজন বিরোধী নেতা আছেন, যিনি মানেন লড়াইটা আসলে সামাজিক এবং বলেন যে লড়াই আসলে আরএসএসের বিরুদ্ধে। তিনি রাহুল গান্ধী। কিন্তু সমস্যা হল, তিনি সোশাল মিডিয়ার নেতা। ইদানীং দিব্য বাগ্মী হয়ে উঠেছেন, কিন্তু রাস্তায় নামেন কালেভদ্রে। ইউটিউব, ফেসবুক আর টুইটারে লাইকের মূল্য যে রাজনীতির ময়দানে শূন্য — তা তিনি বোঝেন বলে মনে হয় না। বহু বিজেপিবিরোধীর একটি পাহাড়প্রমাণ ভ্রান্তি আছে। তা হল, বিজেপি শাসনের ভিত্তি সোশাল মিডিয়া। একশো বছর ধরে আরএসএসের তৃণমূল স্তরে গিয়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে কাজ করার ব্যাপারে কোনো ধারণা না থাকাই এই ভ্রান্তির মূলে। সম্ভবত রাহুলও এতেই ভোগেন। গত কয়েক বছরে রাহুলের কথাবার্তা থেকে বোধ হয়, তিনি বোঝেন মৌলিক বিভাজনগুলোর সাথে লড়াই না করে উপরিতলের ধর্মীয় বিভাজন দূর করা যাবে না। আরএসএসকে হারানোও যাবে না। কিন্তু সে ক্ষমতা তাঁর তো নেই বটেই, তাঁর দলেরও নেই। প্রাক-স্বাধীনতা যুগের কংগ্রেস বা লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সময়কার কংগ্রেসেও দেশের ধনীদের যথেষ্ট উপস্থিতি থাকলেও সাধারণ, গরীব মানুষের সাথে কিছু সংযোগ ছিল। ইন্দিরার সময় থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছে, যার শীর্ষবিন্দু ছিল জরুরি অবস্থা। কিন্তু সে আমলেও অর্থনৈতিকভাবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের রাস্তায় থাকার প্রচেষ্টা ছিল। রাজীবের সময় থেকে তা-ও কমতে শুরু করে, নরসিমা-মনমোহনে এসে কংগ্রেসের সর্বার্থে উচ্চকোটির দক্ষিণপন্থী পার্টি হওয়া শুরু হয়। আবার নরসিমার এক সময়কার মিডিয়া উপদেষ্টা পিভিআরকে প্রসাদ লিখেছেন, নরসিমার নাকি ইচ্ছে ছিল বিজেপির আগেই অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করা। সেই উদারপন্থী অর্থনীতি আর হিন্দুত্বের সহাবস্থানের গল্প। এমনি এমনি তো তাঁকে ভারতের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী বলেন না কেউ কেউ। কংগ্রেস এখনো সেই পথেই চলেছে, রাহুল একা চাকা উল্টোদিকে ঘোরাবেন কী করে?

তাহলে আরএসএসের বিরুদ্ধে সামাজিক লড়াই লড়বে কারা? লালুপ্রসাদ, মুলায়ম সিং, মায়াবতীদের রাজনীতি নির্বাচনী লড়াইয়ে আর ফল দিচ্ছে না মানে তো এই নয়, যে দেশের নিম্নবর্গীয় মানুষ এখন খুব ভাল আছেন। জাতপাতের বৈষম্য বরং গভীরতর হয়েছে, শ্রেণিবৈষম্যের কথা আগেই বলেছি, আর ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য তো ভয়াবহ স্তরে পৌঁছেছে। এইসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে একযোগে লড়ার নতুন রাজনীতি করবে কারা?

কেবল ভোটের পাটিগণিতে কিন্তু এ আঁধার থেকে মুক্তির পথ পাওয়া যাবে না।

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

সত্যান্বেষী পাঠক জাগুন, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবর লিখতে হবে

সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ইতিবাচক না লিখলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে না — এই ঘোষণা প্রমাণ করে অগণতান্ত্রিকতা জয়যুক্ত হয়েছে। এই জয়ে বাংলার সংবাদমাধ্যমের অবদানও ফেলে দেওয়ার মত নয়।

ব্যোমকেশ জানালার দিক্ হইতে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল— “কিছুদিন থেকে কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে, লক্ষ্য করেছ?”

আমি বলিলাম— “না। বিজ্ঞাপন আমি পড়ি না।”

ভ্রূ তুলিয়া একটু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশ বলিল— “বিজ্ঞাপন পড় না? তবে পড় কি?”

“খবরের কাগজে সবাই যা পড়ে, তাই পড়ি— খবর।”

“অর্থাৎ মাঞ্চুরিয়ায় কার আঙুল কেটে গিয়ে রক্তপাত হয়েছে আর ব্রেজিলে কার একসঙ্গে তিনটে ছেলে হয়েছে, এই পড়! ওসব পড়ে লাভ কি? সত্যিকারের খাঁটি খবর যদি পেতে চাও, তাহলে বিজ্ঞাপন পড়।”

— পথের কাঁটা (ব্যোমকেশ সমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স; পঞ্চদশ মুদ্রণ, মে ২০১১)

বাংলার সংবাদমাধ্যমের যা অবস্থা হয়েছে, তাতে আজও সত্য জানার আগ্রহে যাঁরা খবরের কাগজ পড়েন তাঁরা সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের সাথে এই প্রশ্নে একমত না হয়ে পারবেন না। তা বলে কখনোই কোনো কাজের খবর ছাপা হয় না বললে নিদারুণ অবিচার হবে। যেমন কয়েকদিন আগেই সর্বাধিক বিক্রীত বাংলা সংবাদপত্রের সংক্ষিপ্ত খবরের স্তম্ভে একটি দারুণ কাজের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বয়ানটি এইরকম

‘পজিটিভ খবর’ ও সরকারি বিজ্ঞাপন

জেলার পত্র-পত্রিকা তথা সংবাদমাধ্যম উন্নয়নের খবর অনেক বেশি করে। তারা যাতে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত না হয়, প্রশাসনকে তা দেখার নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাওড়া শরৎ সদনে বৃহস্পতিবার জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “পজিটিভ (ইতিবাচক) খবর করুন। বিজ্ঞাপন পাবেন।” প্রশাসনিক বৈঠকে এ দিন জেলার সংবাদমাধ্যমের তরফে এক জন প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, তাঁদের আর্থিক অবস্থা সঙ্গিন। বারবার বলেও তাঁরা সরকারি বিজ্ঞাপন পাচ্ছেন না। বিষয়টি শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপন পাবেন। এলাকার উন্নয়নের খবর আপনারা ভাল করে করুন।” মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ছাপার পরে সেগুলি জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও স্থানীয় থানার আইসি-র কাছে পাঠাবেন। তাঁরা দেখে নেবেন, খবর ‘পজিটিভ’ না ‘নেগেটিভ’। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, বড় সংবাদমাধ্যম এক দিন অল্প করে খবর করে। অনেক সময় ‘নেগেটিভ’ ভাবে প্রচারও করে। কিন্তু জেলার ছোট কাগজ সরকারের কাজের কথা গ্রামে গ্রামে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। সেই জন্যই তাদের বিজ্ঞাপন পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, তা নজর রাখার জন্য প্রশাসনিক কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সিপিএম ও বিজেপি নেতাদের মতে, জরুরি অবস্থার সময়ে সংবাদ প্রকাশের আগে সরকারের অনুমোদন নিতে হত। এখন আবার ‘অন্য রকম জরুরি অবস্থা’ এসেছে, যখন বিজ্ঞাপনের জন্য সরকারের শংসাপত্র নিতে হবে।

এখন কী হয় জানি না, বছর দশেক আগেও খবরের কাগজে শিক্ষানবিশির সময়ে প্রথমেই শেখানো হত কী করে এরকম সংক্ষিপ্ত খবর লিখতে হয়। কারণ অনেকটা জায়গা জুড়ে হাজার-দেড় হাজার শব্দে প্রতিবেদন লেখা সহজ, এত অল্প পরিসরে সমস্ত কাজের কথা লিখে ফেলাই কঠিন। যেমন প্রতিবেদকের পক্ষে কঠিন, তেমনি প্রতিবেদন যে সম্পাদনা করে তার পক্ষেও কঠিন। ফলে এই কাজটা শিখে ফেললে বড় প্রতিবেদন লেখা বা সম্পাদনা করা জলভাত হয়ে যায়। সেদিক থেকে এই খবরটি (নিউজরুমের ভাষায় ‘ব্রিফ’) সাংবাদিকতার ক্লাসে পাঠ্য হওয়ার যোগ্য। মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যেকটি জরুরি বাক্য, রীতিমত ব্যাখ্যা সমেত ১৭৮ শব্দের মধ্যে ধরে দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেদকদের ছোট থেকে পই পই করে বলে দেওয়া হয়, নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য যে কোনো খবরে সব পক্ষের বক্তব্য দেওয়া আবশ্যক। এখানে তা-ও করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সম্বন্ধে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বক্তব্য তো লেখা হয়েছে বটেই, এমনকি শূন্য পাওয়া সিপিএমকেও বঞ্চিত করা হয়নি। রাজ্যের গণতন্ত্রের সামগ্রিক ছবি তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রতিবেদন গত দশ বছরের কাগজ ঘাঁটলেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

খবরটি থেকে কী কী জানা যাচ্ছে?

প্রথমত, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবরই করতে হবে। সরকারি আইন যা-ই বলুক, সরকারের সমালোচনা করলে, দোষত্রুটি ধরলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকৃতপক্ষে সরকারি আনুকূল্য। সে বাবদ যে টাকা পত্রপত্রিকাগুলি পেয়ে থাকে তা করদাতার টাকা নয়, সরকারের পৈতৃক সম্পত্তি। সরকারের নেকনজরে থাকলে পাওয়া যাবে, নচেৎ নয়। এককথায়, সংবাদমাধ্যমকে সরকারি প্রচারযন্ত্র হয়ে উঠতে হবে।

দ্বিতীয়ত, জেলার পত্রপত্রিকা, চ্যানেল ইত্যাদি সরকারের কাজের প্রচার অনেক বেশি করে। তার উপযুক্ত প্রতিদান যেন তারা পায়, তা দেখা সরকারি আধিকারিকদের কাজের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ জেলাশাসক যেমন খবর রাখেন জেলার কোথাও বন্যাদুর্গত মানুষ না খেয়ে আছেন কিনা, তেমনি তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে জেলার কোনো কাগজ বন্যাত্রাণে সরকারের কাজের ঢালাও প্রচার করেও সরকারি বিজ্ঞাপন না পেয়ে আছে কিনা।

তৃতীয়ত, সংবাদমাধ্যম মুখ্যমন্ত্রীকে একজন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসক মনে করছে না। প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়ে কেবল তাঁর কার্যকলাপের যথাযথ প্রতিবেদন তৈরি ও মূল্যায়ন তার কাজ নয়। মুখ্যমন্ত্রী মাইবাপ, তাই নিজেদের আর্জি পেশ করাও কাজ। বাঁচালে মুখ্যমন্ত্রীই বাঁচাবেন।

চতুর্থত, বড় সংবাদমাধ্যম সরকারের যথেষ্ট স্তুতি করছে না। এমনকি মাঝেমধ্যে নিন্দে-বান্দাও করছে। বাংলা যে সোনার বাংলা হয়ে উঠেছে, সে খবর গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে ছোট সংবাদমাধ্যমই। তারা সরকারকে দেখছে, অতএব তাদের দেখাও সরকারের কর্তব্য।

পঞ্চমত, সরকারের যথেষ্ট প্রশংসা করা হয়েছে কিনা তা ঠিক করবেন জেলাশাসক, পুলিস সুপার এবং স্থানীয় থানার আইসি। অর্থাৎ যাঁদের ফৌজদারি ক্ষমতা আছে। কিন্তু সরকারি যে দপ্তরগুলি আইনত বিজ্ঞাপন দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেগুলি এলেবেলে।

মোদ্দা কথা, পশ্চিমবঙ্গে এখন সরকারি বিজ্ঞাপন একটি ঘোষিত লাঠি, যা উঁচিয়ে সংবাদমাধ্যমকে সরকার নিজের ইচ্ছামত ওঠবোস করায়। ঘোষিত কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে তৈরি হওয়া দুটি প্রেস কমিশন দেশের সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন, সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার জন্য যা যা সুপারিশ করেছিল তার অনেককিছুই অনেক দলের সরকারই মানেনি। অনেক কথা সংবাদমাধ্যমও মানেনি। প্রেস কাউন্সিল নামে একটি ঠুঁটো জগন্নাথ আছে, তাদের কথাও দু পক্ষের কেউ শোনে না। এর উপর আছে সংবাদমাধ্যম চালানোর, বিশেষত খবরের কাগজ চালানোর, বিপুল খরচ। সেই সুবাদে গত ৭৫ বছর ধরে অনেক দলের অনেক সরকারই সরকারি বিজ্ঞাপনকে লাঠি হিসাবে ব্যবহার করেছে। যে কোনো গবেষক যে কোনো রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস আর সংবাদমাধ্যমগুলির সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার তথ্য পাশাপাশি রেখে পড়লেই তার অজস্র প্রমাণ পাবেন। কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত নরেন্দ্র মোদীর সরকারের আগে কোনো সরকার রীতিমত আইন প্রণয়ন করে সংবাদমাধ্যমকে তোতাপাখি করে ফেলার চেষ্টা করেনি। ঠিক তেমনি, অন ক্যামেরা সরকারি বৈঠকে বসে, ইতিবাচক খবর করলে তবে সরকারি বিজ্ঞাপন দেব — এ কথা ঘোষণা করার সাহসও পশ্চিমবঙ্গে অতীতে কোনো মুখ্যমন্ত্রীর হয়নি।

যে কোনো কাজ, যা বরাবর লুকিয়ে করা হত, তা প্রকাশ্যে করা বিরাট পরিবর্তনের প্রমাণ। অন্য সম্প্রদায়ের লোকেদের নিয়ে ভিত্তিহীন, কুৎসিত আলোচনা ভারতীয়রা চিরকাল করে থাকে। কিন্তু ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত ওই সম্প্রদায়ের মানুষের সামনে করা হত না, এখন হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয়, চক্ষুলজ্জাও দূরীভূত, কারণ পরজাতিবিদ্বেষ এখন ক্ষমতার আশীর্বাদধন্য। তেমনি সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ইতিবাচক না লিখলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে না — এই ঘোষণা প্রমাণ করে অগণতান্ত্রিকতা জয়যুক্ত হয়েছে। এই জয়ে বাংলার সংবাদমাধ্যমের অবদানও ফেলে দেওয়ার মত নয়। এতবড় খবর যে একটি বড় সংবাদপত্রের ব্রিফে জায়গা পেয়েছে এবং অন্যত্র আদৌ জায়গা পায়নি, তার একটিমাত্র ব্যাখ্যাই সম্ভব বলে মনে হয়। “মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষপাত জেলার ছোট সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতি। অতএব বেল পাকলে কাকের কী?” আরও নৈরাশ্যবাদী হলে অবশ্য আরেকটি ব্যাখ্যাও করা সম্ভব। “এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে যদি যা পাচ্ছি তা-ও বন্ধ করা হয়?”

গত এক দশকে ভারতীয় গণতন্ত্র, পিছু পিছু ভারতীয় সাংবাদিকতা, যে পথে গেছে তাতে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আয়ের যে পথ অবলম্বন করে এ দেশে সাংবাদিকতা এতকাল চলেছে তা বাতিল করতে হবে। নইলে সংবাদমাধ্যমের পক্ষে সত্য বলা, সত্য দেখানো অসম্ভব। সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং/অথবা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ এড়ানো না গেলে সংবাদমাধ্যমকে ক্ষমতার বশংবদ হয়েই থাকতে হবে। ফলত ইংরেজিতে এবং ভারতের অন্যান্য ভাষাতেও এখন গ্রাহকভিত্তিক সংবাদমাধ্যম চালু হয়েছে। নিউজলন্ড্রি, নিউজক্লিক, দ্য ওয়্যারের মত সংবাদমাধ্যমের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কেন তারা মূলধারার সংবাদমাধ্যমের চেয়ে সত্যের প্রতি অনেক বেশি বিশ্বস্ত থাকতে পারছে। আক্রান্ত হচ্ছে, তবু লড়ে যেতে পারছে। বাংলাতেও সেরকম প্রয়াস আশু প্রয়োজন। সেই প্রয়াস ফলপ্রসূ করতে হলে সত্যান্বেষী পাঠক, দর্শকদের এগিয়ে আসতে হবে। নইলে নাগরিক ডট নেট বা ইত্যাকার প্ল্যাটফর্মগুলিকেও অনতিবিলম্বে ক্ষমতার মালাই জপতে হবে।

তথ্যসূত্র

১। https://scroll.in/article/988105/explainer-how-indias-new-digital-media-rules-are-anti-democratic-and-unconstitutional

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

হাসছি মোরা হাসছি দেখো: বীর দাসের বীরত্বে দুই ভারতের পর্দা ফাঁস

বীর দাস যে কথাগুলো সহজ ভাষায় বলেছেন, সেগুলো দেশের কোনো বিরোধী নেতা এখন পর্যন্ত বলেননি।

কিসে আমাদের হাসি পায়? এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমরা কারা — সে প্রশ্নের উত্তর। হাসি যে এভাবে মানুষ চেনায় তা ২০১৪ পরবর্তী ‘স্বাধীন’ ভারতে বাস না করলে বোধহয় বোঝা হত না। এখন হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক, টুইটারে অনবরত হাসির উপাদান আসে। চাইলেই এমন ব্যবস্থা করা সম্ভব যাতে সারাদিন মোবাইলে কেবল চুটকিই আসতে থাকবে। কদিন পরে গুগল যখন বুঝবে আপনি হাসবেন বলেই বাঁচেন, তখন আপনাকে খবর হিসাবেও নানারকম চুটকি, মিম আর হাস্যকর ভিডিও পাঠাতে থাকবে।

আমরা সবাই হাসছি, গোটা দেশ হাসছে। সবাই, সবকিছুই হাসির পাত্র। একজন নিরস্ত্র লোককে গুলি করে মেরে ফেলেছে পুলিস, এক উল্লসিত মানুষ লাফিয়ে উঠে তার বুকে লাথি মারছে। তেমন হোয়াটস্যাপ গ্রুপে থাকলে এ নিয়েও একাধিক চুটকি পড়তে পারবেন। একটা মিছিলের লোকেদের পিছন থেকে এসে পিষে দিয়ে চলে গেছে একটা গাড়ি। পিষে যাওয়া লোকগুলোকে নিয়েও কৌতুক করা সম্ভব। তাছাড়া মহিলারা কত বোকা তা নিয়ে, একইসঙ্গে তারা পুরুষদের কেমন দাঁতের উপর রাখে তা নিয়েও অজস্র কৌতুক বিতরণ হয় আজকাল। মুসলমানদের রক্ষণশীলতা, পুরুষদের দাড়ি আর মহিলাদের বোরখা নিয়েও দারুণ বুদ্ধিমান এবং প্রবল শিক্ষিত লোকেরা মাথা খাটিয়ে হাজার হাজার জোক ও মিম তৈরি করছেন। আজকাল হাসির প্রয়োজনীয়তা এত প্রবল, যে নাচগানের অনুষ্ঠানেও লোক না হাসালে টিআরপি পাওয়া যায় না। আর হাসাতে হলে যে জাতিবিদ্বেষপূর্ণ বিদ্রুপ করতেই হবে তা স্বতঃসিদ্ধ। কদিন আগেই নাচের অনুষ্ঠানের এক সঞ্চালক গৌহাটির এক শিশুশিল্পীকে দর্শকদের সামনে হাজির করেছেন “চাইনিজ”, “মোমো”, “চিং চং” বলে।১ এসব দেখেও আমাদের হাসি পায়। রসিকতাটাকে জাতিবিদ্বেষপূর্ণ বললে আরও বেশি হাসি পায়। কারণ জাতিবিদ্বেষও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত, যতক্ষণ না বিদ্বেষটা আমাদের জাতির প্রতি ধেয়ে আসে।

কিসে আমাদের হাসি পায় না? এর উত্তরও বলে দেবে আমরা কারা। পেট্রোল, ডিজেলের লাগামছাড়া দাম নিয়ে রসিকতা করলে আমাদের হাসি পায় না। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে রসিকতা করলে আমাদের হাসি পায় না। দেবদেবীদের নিয়ে, পৌরাণিক চরিত্রদের নিয়ে রসিকতা করলেও আমাদের হাসি পায় না। দেশের দোষত্রুটি, দুর্নীতি নিয়ে রসিকতা করলে আমাদের হাসি পায় না। শুধু হাসি পায় না তা-ই নয়, ওসব নিয়ে রসিকতা করলে আমরা বেজায় চটে যাই। চটে গিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা আর মনে থাকে না। তখুনি আমরা তেড়ে গাল পাড়ি, রসিকতা করা বিদূষক বা কার্টুনিস্টকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলি। আমাদের মধ্যে যারা উদ্যোগী, তারা এফ আই আর পর্যন্ত করি। কিন্তু এই আমরাই সব নই। আমাদের আরেক দল আছে।

এই আমাদেরও হাসি পায়। আমরা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হাসাহাসি করি। ভারত ১৯৪৭ সালে নয়, ২০১৪ সালে স্বাধীন হয়েছে শুনে হাসাহাসি করি। যারা এসব বলে তাদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামীর সংখ্যা যে শূন্য, তা নিয়ে হাসাহাসি করি। প্রধানমন্ত্রীর দাড়ি আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভুঁড়ি নিয়ে রসিকতায় হাসি। আমরা লক্ষ্মণের শক্তিশেল পড়ে হাসি, যানে ভি দো ইয়ারোঁ ছবির শেষ দৃশ্য দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ি। আর কিসে আমাদের হাসি পায়? প্রধানমন্ত্রী সমেত দেশের সবচেয়ে দায়িত্বপূর্ণ লোকেদের কার্যকলাপ এবং অবলীলাক্রমে দিন কে রাত, রাতকে দিন করার ক্ষমতা দেখে হাসি পায়। পেঁয়াজের দাম এত বাড়ছে কেন জিজ্ঞেস করলে অর্থমন্ত্রী যখন বলেন “আমি পেঁয়াজ খাই না”, তখন আমাদের হাসি পায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আলেকজান্ডারকে না হওয়া যুদ্ধে হারিয়েছিলেন শুনে আমাদের হাসি পায়। গুজরাটে পথের ধারে আমিষ খাবার বিক্রি করতে দেওয়া হবে না শুনেও হাসি পায়, কারণ আমরা নিরুপায়। আমরা কেবল হাসতে পারি, আর কিছুই করতে পারি না। মানুষ তো কেবল মজা পেয়ে হাসে না, চরম দুর্দশাতেও হাসে। আমাদের এখন সেই অবস্থা। দেশের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা যখন বলেন নাগরিক সমাজের সাথেও লড়তে হবে, তখনো আমাদের হাসি পায়। কিন্তু ভয়ে হেসে উঠতে পারি না। যখন দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান গণপিটুনিকে বৈধ ঘোষণা করেন, তখনো হাসতে পারলে আমরা খুশি হতাম। কিন্তু সাহস হয় না, কারণ আমাদের গায়ে ‘দেশদ্রোহী’ ছাপ দিনরাত পড়ে। ‘সন্ত্রাসবাদী’ ছাপ পড়তে কতক্ষণ?

এই দুই আমরা — ভারতের বাসিন্দা। দুটো ভারত। এই দুটো ভারতের কথাই বিদূষক বীর দাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি সেন্টারে দাঁড়িয়ে হলভর্তি দর্শকের সামনে বলেছেন। বস্তুত, তিনি কোনো রসিকতা করেননি। কোনো চুটকি বলেননি। কেবল ভারতে ঘটে যাওয়া কতকগুলো ঘটনা পরপর আউড়ে গেছেন। তাতেই এক ভারত এফআইআর করে ফেলেছে, অন্য ভারত উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। কারণ বীর দাস যে কথাগুলো সহজ ভাষায় বলেছেন, সেগুলো দেশের কোনো বিরোধী নেতা এখন পর্যন্ত বলেননি। প্রথিতযশা সাংবাদিকদের অধিকাংশ হয় মিথ্যে বলার শিল্পে দড় হয়ে উঠেছেন, নয় নিরপেক্ষতার অজুহাতকে ঢাল করে ফেলেছেন। এখনো সত্য খোঁজার, সত্য লেখার, সত্য দেখানোর সাহস যাঁদের আছে তাঁরা সিদ্দিক কাপ্পানের মত কারাগারে পচছেন। অবিনাশ ঝায়ের মত খুন হচ্ছেন। সমৃদ্ধি সকুনিয়া আর স্বর্ণা ঝায়ের মত আটক হচ্ছেন।

হয়ত বীরও কোনোদিন আটক হবেন অথবা তাঁর পেশার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হবে, যেমনটা মুনাওয়ার ফারুকির ক্ষেত্রে করা হল। হয়ত বীর, কুণাল কামরা, বরুণ গ্রোভাররা মুসলমান নন বলেই কিছুটা বেশি সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বীর বুঝিয়ে দিলেন তিনি কোন ভারতের সঙ্গে আছেন। তিনি সার্থকনামা।

আমাদের বাংলায় হবে সেই ছেলে কবে? এখানে আপাতত পদ্মলোচন নামের কানা ছেলেদের ছড়াছড়ি। কেবল অরাজনৈতিক, মোটা দাগের যৌন রসিকতার উদযাপন চলছে। যে দেশের সাংবাদিকরা বিকিয়ে যায় সে দেশ নিশ্চয়ই দুর্ভাগা, কিন্তু যে জাতির বিদূষকরা সুবিধাবাদী — তাদের দুর্দশা আরও বেশি। বাঙালি এখন সেই জাতি। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই হিন্দি বলয়ের অনেকের ভিডিও দেখা যায়, যাঁরা বীরদের মত বিখ্যাত না হলেও যোগী আদিত্যনাথের মত ভয়ঙ্কর লোককে নিয়েও রসিকতা করতে ভয় পান না। বাংলায় তেমন কেউ কই? ভাবলে অবাক লাগে, এই ভাষারই একজন কবি লিখেছিলেন সেই পংক্তিগুলো, যা বীরকে ভুল প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগা ভারতীয়দের মনের ভাব প্রকাশ করেছে নিখুঁতভাবে

অভয় দিচ্ছি, শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?

বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!

আমি আছি, গিন্নি আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে —

সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।

তথ্যসূত্র

১। https://www.republicworld.com/entertainment-news/television-news/kiren-rijiju-condemns-raghav-juyals-remarks-says-such-comments-harm-national-integrity.html

২। https://www.bignewsnetwork.com/news/271724114/journalist-killed-in-bihar-protest-erupts-in-madhubani

৩। https://www.ndtv.com/india-news/2-women-journalists-detained-after-they-accused-tripura-police-of-intimidation-granted-bail-2611637

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

বামেদের মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিকতার সংকট কিংবা দ্বিমেরু-বঙ্গের এক নিশ্চিন্ত নাগরিকের প্রলাপ

বিজেপির রামনবমীর বিপরীতে তৃণমূলের হনুমানপুজো, অযোধ্যার রামমন্দিরের বিপরীতে দীঘার জগন্নাথ মন্দির… এগুলোই বাংলার রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের অন্তিম লগ্নে ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের সাংবাদিক সম্মেলন দেখছিলাম। ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিরাট আশা জাগিয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেহারাটা অনেকেরই মনে আছে। জয়ের জন্য প্রাণপণ লড়াই করার পর পরাজিত হলে কোনও নেতা বা নেত্রীর প্রতিক্রিয়া ওরকমই হওয়ার কথা। অথচ, জয়প্রকাশবাবু দেখলাম বেশ স্থিতধী। তিন থেকে ৭৭-এ পৌঁছনোতেই তিনি সাফল্য (নাকি সান্ত্বনা?) খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে শতাধিক বিধানসভা আসনে এগিয়ে থাকার কথা সুবিধামত ভুলেই গেলেন বোধহয়। কিংবা হয়তো ওটা কর্মীদের মনোবল ভাঙতে না-দেওয়ার কৌশল। তবে যে-কথা বলতে গিয়ে তাঁর মাস্ক-পরা মুখও মনে হল উদ্ভাসিত, কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট তৃপ্তি— তা হল তৃতীয় শক্তির অবলুপ্তি। বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ যে রাজ্যের রাজনীতিতে কোনও সাড়াই ফেলতে পারেনি এবং আগামী দিনে এই রাজ্যের রাজনীতি যে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে— এই ঘোষণায় রীতিমত জয়ের প্রকাশ দেখলাম। বোঝা গেল, রাজ্য জয়ের স্বপ্ন সফল না-হলেও পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিমেরু রাজনীতির দিকে নিয়ে যাওয়াও বিজেপির পক্ষে যথেষ্ট সন্তোষজনক ফলাফল।

২০১৪-র পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়তনের কোনও রাজ্যে বিজেপি-কে এরকম বিশ্রী হারের মুখ দেখতে হয়নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা, দেশভাগের ইতিহাস ইত্যাদি নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের খেলা শুরু হয়েছিল। আরও নানাবিধ মেরুকরণের আশঙ্কাও প্রকট হয়ে উঠেছিল। উপরন্তু, বিজেপি এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে গেলে ২০২৪-এ তাদের লোকসভায় জেতার পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে, এরকমও অনেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন। তা ছাড়াও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোর যা সার্বিক অবস্থা, সেসব দেখে পশ্চিমবঙ্গবাসীর শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। সর্বোপরি অন্য রাজ্যের মানুষও উদগ্রীব ছিলেন দেখার জন্য যে, বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দুত্বের কাছে হার মানে কি না। সেটা ঘটলে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুরাষ্ট্রের বৌদ্ধিক জয় হত। ফলে, তৃণমূল কংগ্রেসের জয় অনেকের কাছেই উল্লাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের বাইরের মানুষের এই উল্লাস শতকরা একশো ভাগ সঙ্গত, কারণ যে কোনও মূল্যে বিজেপির পরাজয়ই তাঁদের প্রয়োজন ছিল। এই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে দেশব্যাপী তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তই। যেমন, এই মুহূর্তে করোনা সামলানোয় গাফিলতি এবং অনিচ্ছা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রবল চাপে পড়েছে বলেই দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের করোনার দোহাই দিয়ে তুলে দিতে পারছে না— যা গত বছর শাহিনবাগের সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের বেলায় করতে পেরেছিল। পশ্চিমবঙ্গে জিতে গেলে মোদি-অমিত শাহ জুটি কৃষকদের ওপর বলপ্রয়োগ করতেও পিছপা হতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু সেসব সংক্রান্ত স্বস্তি ও উল্লাস পেরিয়েও, এই রাজ্যের মানুষের ভবিষ্যতের স্বার্থে কিছু কথা ভেবে দেখা প্রয়োজন বই কী!

প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি। এর সবটাই সরকারবিরোধী ভোট তো বটেই, কিন্তু কী কারণে এই ভোটাররা সরকারের বিরোধী? যদি জনপ্রিয় যুক্তি অনুযায়ী ধরে নিই এদের বিজেপিকে ভোট দেওয়ার একটাই কারণ— মুসলমান বিদ্বেষ, তা হলে বিশেষ উদ্বেগের কারণ রয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিজেপির ক্রমবর্ধমান শক্তিতে আসানসোল, ধূলাগড়, বসিরহাট, তেলেনিপাড়ার মতো নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি হতে দেখা গিয়েছে। এর কোনওটাই তৃণমূলের সংগঠন আটকাতে পারেনি। বহু জায়গাতেই মানুষের অভিযোগ, প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়াও পর্যাপ্ত ছিল না। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে। ২০১৬-তে ১০.১৬ শতাংশ ভোট পাওয়া সাকুল্যে তিন বিধায়কের বিজেপিই যখন এত অশান্তি পাকাতে পেরেছে, তখন প্রায় চার গুণ বেশি ভোট পাওয়া ৭৭ জন বিধায়কের বিজেপি লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে থাকবে কি? মনে রাখতে হবে, এখন তাদের ১৮ জন সাংসদও আছেন, কেন্দ্রে তাদের সরকার। পান থেকে চুন খসলে তা নিয়ে একটা বড়সড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার রসদ তাদের আছে। গত কয়েক বছরে বাংলার সমাজে যে গভীর সাম্প্রদায়িক ক্ষত তৈরি হয়েছে তা যে বিজেপির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মিলিয়ে যাবে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল সমর্থন নিয়ে প্রত্যাবর্তনে প্রমাণিত হল যে, ইমাম ভাতা দিলে অন্যায় হয় না, পুরোহিত ভাতা দেওয়াও ভালো। যেহেতু বিজেপির প্রচার ছিল পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো করতে দেওয়া হয় না, সেই প্রচারকে মিথ্যা প্রমাণ করতে সরকারের ক্লাবগুলোকে পুজোর খরচ দেওয়াও অন্যায় নয়। অতএব আগামী পাঁচ বছর বিজেপির প্ররোচনা দেওয়ার মতো ইস্যুর অভাব হবে না, আর তৃণমূল সরকার সে সব প্ররোচনার রাজনৈতিক মোকাবিলা না-করে দড়ির উপর ব্যালান্সের খেলা খেলে যাবেন— এমন সম্ভাবনা তাই প্রবল।

যা গত দশ বছরে হয়নি, আগামী পাঁচ বছরে হবে— এমন আশা করা যুক্তিযুক্ত নয়। তাই ২০১১ থেকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়া আরএসএস-এর সংগঠনের বিরুদ্ধে শাসক দল সত্যিকারের কোনও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে— এমন ভাবা, অতএব, বাতুলতা হবে। অবশ্য সরকারি দল প্রতিরোধ করতে যাবেই বা কেন? মুখ্যমন্ত্রী তো এই সেদিন ইন্ডিয়া টুডে-র সাংবাদিক রাহুল কাঁওয়ালকে বলেছেন, আরএসএস-কে নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা নেই, কারণ তারা ভোটে লড়ে না তাঁর সমস্যা বিজেপিকে নিয়ে। বিজেপিকে হারানো হয়ে গেছে, অতএব আরএসএস এবং তৃণমূলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলতেই পারে বোধহয়। আগামী পাঁচ বছর, বা জয়প্রকাশবাবুর কথা ঠিক হলে, অতিদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিজেপির রামনবমীর বিপরীতে তৃণমূলের হনুমানপুজো, অযোধ্যার রামমন্দিরের বিপরীতে দীঘার জগন্নাথ মন্দির… এগুলোই বাংলার রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে।

দুর্নীতির অভিযোগ, সে আম্ফানের ত্রাণেই হোক কিংবা এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক, বাংলার নির্বাচনে সে সব যে কোনও ইস্যু নয় তা এবারের নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলত কর্মসংস্থানও ইস্যু নয়, হয়তো আগামীদিনেও হবে না। শিল্প হবে কি হবে না, শিক্ষিত বেকাররা চাকরি পাবে কি পাবে না— প্রচারে অনবরত সে সব কথা বলে এবং ইশতেহারে লিখে বিরাট গোল্লা পেয়েছে বাম দলগুলো এবং কংগ্রেস, আইএসএফ একটার বেশি আসনে জিততে পারেনি। সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের সম্বন্ধে প্রশ্ন আসতে মুখ্যমন্ত্রী একটাও শব্দ খরচ করতে চাইলেন না, করার কথাও নয়। তারা যে ইস্যুগুলো তুলে ধরেছিল, সেগুলো তাঁর মাথায় থাকলেই নাগরিকদের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দিক থেকে ভাবলে মানতেই হয়, তাঁর সে সব মনে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। যারা মনে রেখেছিল, তাদের সব মিলিয়ে সাড়ে আট শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। অত কম মানুষের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে একজন মুখ্যমন্ত্রীর মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। আর বিজেপি যে ওসব নিয়ে ভাবতে রাজি নয় তা কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের দখলে থাকা অন্য রাজ্য সরকারগুলোর কার্যকলাপ দেখলেই বোঝা যায়। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন থেকে ইস্যুকেন্দ্রিক না-হয়ে চিহ্নকেন্দ্রিক হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী কালীঘাট মন্দিরে গেলেন কি না, মহরমের দিন প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি দেওয়া হল কি না— এই সব।

সাধারণ নাগরিকের স্বস্তি এইখানে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালু করা একগুচ্ছ জনমুখী প্রকল্প, যার সুবিধা গরিব প্রান্তিক মানুষ পেয়ে থাকেন, সেগুলো অন্তত চালু রইল। বিজেপি যেখানে যেখানে ক্ষমতায় আছে, সেখানে এরকম প্রকল্পের কোনও স্থান নেই। আয়ুষ্মান ভারত[3] বা ফসল বিমা যোজনার[4] মতো দু-একটা কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প যা-ও বা আছে, সেগুলো সবই প্রকৃতপক্ষে ধোঁকার টাটি বলে অভিযোগ।

স্পষ্টত, আর একটা আশা নিয়ে মানুষ তৃণমূলকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেছেন, তা হল, বাংলায় এনআরসি হবে না। আইনত এনআরসি করা বা না-করা কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে মানুষ নিশ্চয়ই আশা করেন দিদি এই রাজ্যে এই প্রক্রিয়া প্রাণপণে আটকাবেন। গত বছর যখন বিভিন্ন ধারার বামপন্থীরা, নানা বয়সের মহিলারা সিএএ-এনআরসি-এনপিআর আটকাতে আন্দোলন করছিলেন তখন দেখা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই নিয়ে মিছিল-মিটিং করলেও অন্যদের আন্দোলনের প্রতি রাজ্য প্রশাসন বিশেষ সদয় নয়। আশা করা যায়, এখন আর সে সমস্যা হবে না। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তো আর এ নিয়ে আন্দোলন করতে যাবে না, শক্তিহীন বামফ্রন্টই বা কী এমন আন্দোলন করবে? হাতে রইলেন বিকল্প বামেরা, যাঁরা এরপর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও তীব্র করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তাঁরা তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবেক। তৃণমূলের এই বিপুল জয়ে তাঁদের ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনের যথেষ্ট অবদান— এই দাবিতে রবিবাসরীয় আকাশ-বাতাস তাঁরা মুখর করে তুলেছিলেন। সুতরাং তাঁরা আন্দোলন করলে মমতা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। আশা করা যায়, দিদি আগামী পাঁচ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এঁদের সংগ্রামকে মমতাময়ী পক্ষিমাতার মতো দুই ডানা দিয়ে আগলাবেন। ২০১৮ সালে যেমন চেয়েছিলেন পঞ্চায়েতে শুধু তাঁর দলই থাকুক, এখন তেমন দাবি আশা করা যায় করবেন না যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও শুধু তাঁর দলই লড়ুক।

শূন্যে পৌঁছে যাওয়া কংগ্রেসের এ-রাজ্যে ভবিষ্যৎ কী, বলা দুষ্কর। একা কুম্ভ অধীর চৌধুরীর গড় মাটিতে মিশে গেছে, প্রবীণ জনপ্রিয় নেতা আব্দুল মান্নান ধরাশায়ী। বৃদ্ধতান্ত্রিক সিপিএমেও একগুচ্ছ নতুন মুখ দেখা গেছে, কিন্তু কংগ্রেসে? সিপিএমের কচিকাঁচারা যদি ‘একলা চলো রে’ নীতিতে ফিরে যেতে চান তা হলে কংগ্রেসের কী হবে, দেবা ন জানন্তি।

অবশ্য ফলপ্রকাশের পর আটচল্লিশ ঘন্টা কেটে গিয়ে থাকলেও রাজ্য সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের কেউ দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন, এমন খবর নেই। একটি তথাকথিত বিপ্লবী পার্টির শান্ত হ্রদের মতো অন্দরমহলে একমাত্র ঢেউ বলতে টিভির পর্দায় পরাজিত সিপিআইএম প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অকস্মাৎ বিষোদ্গার। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীর বাইরে এ-ভাবে কথা বলা শৃঙ্খলাভঙ্গ কি না, সে বিতর্কে না-গিয়েও বলা যায়, তাঁর সমালোচনায় গঠনমূলক কিছু ছিল না। এই ফলের জন্য “পলিটব্যুরোর দু-একজন নেতা” ছাড়া তিনি দুটো কারণ দেখিয়েছেন। সর্বক্ষণের কর্মীদের যথেষ্ট ভাতা না-পাওয়া আর আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করা। দ্বিতীয়টার ব্যাখ্যা দেননি, আর প্রথমটা ঠিক থাকলে কীভাবে শূন্যের বদলে খাতায় পাঁচটা বা দশটা আসন জমা পড়ত, তা বুঝতে চেষ্টা করার চেয়ে বাইফোকাল চশমা হারানো মানুষের পক্ষে সূচে সুতো পরানো সহজ। উপরন্তু তন্ময়বাবু যে ভাষায় বামপন্থীদের রাস্তার রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখাকে কটাক্ষ করেছেন, তাতে তাঁর মার্কস্‌বাদে আস্থাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করা নিয়ে আপত্তি আর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা নিয়ে প্রবল আবেগ দেখে মনে হয়নি, আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করার মতো কোনও পথ তিনি নিজের দলকে দেখাতে চান। বোধহয় তাঁর মনে হয়েছে স্রেফ আইএসএফ-কে জোটের বাইরে রাখলেই মানুষ তাঁদের ঢেলে ভোট দিতেন। মীনাক্ষী, ঐশী, দীপ্সিতা, সৃজন, প্রতীকুরদেরও তা-ই ধারণা কি না, কে জানে! যদি তা-ই হয়, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে বামেদের বাংলায় ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা শূন্য।

আসলে সিপিএমের রাজনীতিতে শ্রেণির প্রশ্ন বহুদিন ধরেই অবহেলিত। তা না-হলে ওঁরা আগেই বুঝতে পারতেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে নির্ণায়ক ভোট দেন গরিব মানুষ, যাঁরা তাঁর বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে উপকৃত। আমাদের দেশে যে কোনও নির্বাচনেই নির্ণায়ক ভোট আসলে গরিব মানুষের, কারণ তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গত কয়েক বছরে সিপিআইএম-এর সোশাল মিডিয়া নির্ভরতা, এবং কারা সোশাল মিডিয়ায় ওই পার্টির জয়পতাকা ওড়ান তা দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় সিপিআইএম-এর মূল ভোটার হয়ে দাঁড়িয়েছেন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষ। এঁদের অনেকেই আসলে অভ্যাসে সিপিআইএম। পরিবার সিপিআইএম সমর্থক বলে এঁরা সিপিআইএম সমর্থক, অথবা অল্প বয়সে কোনও বাম গণসংগঠনের সদস্য ছিলেন, সেই আবেগ রয়ে গেছে। গরিব মানুষ কোনও পার্টির দ্বারা, সরকারের দ্বারা উপকৃত হলে তা তাঁর ভোটকে প্রভাবিত করে। কিন্তু উপর্যুক্ত শ্রেণির মানুষের সেভাবে উপকৃত হওয়ার ব্যাপার নেই, তাঁরা চলতি হাওয়ার পন্থী। এ বারের ভোটে হাওয়া ছিল বামেরা জিতবে না, অতএব ভোট দিয়ে লাভ নেই। উপরন্তু দাড়ি-টুপি পরা মুসলমান ধর্মগুরুর সঙ্গে জোট বাঁধাও এঁদের পছন্দ হয়নি। তাই লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া সাত শতাংশের মধ্যে থেকেও এই দুই বা তিন শতাংশ বেরিয়ে গিয়ে বিজেপি-বিরোধিতার কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছেন, এখন সোশাল মিডিয়া ভরিয়ে তুলছেন স্বীকারোক্তিতে। এরই মধ্যে হঠাৎ দ্বিমেরু রাজনীতির বিপদগুলো খেয়াল হওয়ায় কেউ কেউ লম্বা পোস্ট লিখে তৃণমূল কংগ্রেসকে খেয়াল করাচ্ছেন, তাঁদের ভোট দেওয়া হয়েছে স্রেফ বিজেপিকে আটকাতে। পার্টিটাকে পছন্দ হয়েছে বা সরকারের কাজ পছন্দ হয়েছে বলে নয়।

শ্রেণি সচেতনতার অভাবে, সমাজবিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ জ্ঞানের অভাবে এই শ্রেণির চিন্তাভাবনাই কিন্তু বর্তমান বাম নেতা এবং প্রার্থীদের বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তাই মমতার জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোকে সিপিআইএম কর্মীরা প্রায়ই হেয় করেন। “মানুষ আপনার দান/ ভিক্ষা চায় না, মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা করুন”— এই চরম নব্য উদারনীতিবাদী কথাটা মিটিং-এ বা সোশাল মিডিয়ায় সিপিআইএম-এর লোকেদের প্রায়শই বলতে দেখা যায়। ওঁরা জানেন না অথবা উপলব্ধি করেন না যে, সরকারের টাকা আসলে করদাতাদের টাকা এবং সে কর একজন ধনী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে একজন রিকশাচালক পর্যন্ত সকলেই দেন। সুতরাং নাগরিকের জন্য চালু করা কোনও সরকারি প্রকল্প আদতে দান নয়। কন্যাশ্রীর সাইকেল যেমন দান নয়, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের প্রিমিয়ামও দান নয়। শুধু তা-ই নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য এগুলো করা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বহু পুরনো কৌশল। বামফ্রন্ট সরকারও এমন প্রকল্প চালাত। কথাগুলো কিন্তু বিস্তর প্রশংসা কুড়োয় মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সমর্থকদের থেকে। ফলে, ওঁরা ভাবেন, একেবারে ঠিক কথাই বলা হয়েছে এবং বাস্তবে গরিব মানুষের থেকে আরও দূরে সরে যান।

এই মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিকতা না-কাটলে সিপিআইএম-এর আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

অতএব দ্বিমেরু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে রুজিরোজগারের প্রশ্ন জিইয়ে রাখার দায়িত্ব এখন পড়ল বিকল্প বামেদের কাঁধে। তাঁদের অনেককালের অভিযোগ, সিপিআইএম বামপন্থার বদনাম করছে। একটিবার সুযোগ পেলেই তাঁরা দেখিয়ে দিতে পারেন আসল বামপন্থা কী, কিন্তু সিপিআইএম তাঁদের জায়গা ছাড়ে না। সিপিআইএম ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরের দশ বছরেও সে সুযোগ ওঁরা পাননি। অনেকটা ওই ‘আনফিট’ বর্ষীয়ান ক্রিকেটার যেমন অতীতের পারফরম্যান্সের জোরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খেলেই যান, আর বেচারা তরুণ প্রতিভাবানদের রিজার্ভ বেঞ্চে বসেই জীবন কাটাতে হয়। নির্বাচকদের অসীম কৃপা, এবার তাঁরা দলের সেই বোঝাগুলিকে বিদেয় করার বন্দোবস্ত পাকা করে দিলেন। আশা করা যাক, তরুণরা সেঞ্চুরি, ডবল সেঞ্চুরির ফুলঝুরি ছোটাতে পারবেন শিগগিরই।

https://4numberplatform.com/ এ প্রকাশিত

নেমে আসুন ভোটারের সমতলে

ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না।

কিছুদিন পরে পরেই, বিশেষ করে কোন নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে, বিজেপি-বিরোধী মানুষজন সমাজ মাধ্যমে, একান্ত আলাপচারিতায় এবং লিখিত রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বিস্ময় প্রকাশ করেন “এত কিছুর পরেও লোকে ওদের সমর্থন করছে!” বা “এত কিছুর পরেও বিজেপি জিতে গেল!” এত কিছু, অর্থাৎ অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া; সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর পরিকল্পিত, রাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট হিংসা; আইনশৃঙ্খলার অবনতি; গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষের চরম আর্থিক দুর্দশার পাশাপাশি অতি ধনীদের আরো ফুলে ফেঁপে ওঠা; দুর্বার গতিতে একের পরে এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি হওয়া; দুর্নীতির বৈধতা পেয়ে যাওয়া; সাংবিধানিক অধিকারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। ২০২০-তে এর সাথে যোগ হল কোরোনাভাইরাসকে প্রথমে সরকারের পাত্তা না দেওয়া, পরে আচমকা লকডাউন, তার ফলে গরীব দিন আনি দিন খাই মানুষের অবর্ণনীয় জীবনযাপন ও মৃত্যু। তার সাথে যোগ হল চিকিৎসার অব্যবস্থা সম্বন্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থালা বাজানো, মোমবাতি জ্বালানোর মত গিমিক। কম পরীক্ষা করে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলেও অনেকের অভিযোগ।

এত কিছুর পরেও বিজেপি নির্বাচনে জেতে। অন্তত উড়ে যায় না। কেন হয় এরকম? দেখা যায় বিজেপির বিরুদ্ধে যাঁরা — রাজনৈতিক দল, চিন্তাবিদ, সাধারণ মানুষ — তাঁরা সকলেই এর কতকগুলো সাধারণ কারণ খুঁজে পান। সেগুলো মোটামুটি এরকম — ১) সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ, ২) বিজেপির অসম আর্থিক প্রতিপত্তি, ৩) বিজেপি আই টি সেলের প্রোপাগান্ডার তীব্রতা এবং ৪) নির্বাচন কমিশনের গান্ধারীবৃত্তি। কেউ কেউ মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের বৃহদংশের নির্লজ্জ চাটুকারিতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করাকেও সঙ্গে যোগ করেন।

সব সত্যি। কিন্তু কবির ভাষায় বললে “সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।”

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এন ডি এ সরকারের কর্মতৎপরতার যে তালিকা সকলের সামনে রয়েছে, তাতে গত কয়েক মাসে যোগ হয়েছে নতুন কৃষি আইন। এই আইন পাশ করা হয়েছে অভূতপূর্ব অগণতান্ত্রিক উপায়ে এবং এর বলে ভারতীয় কৃষকদের একেবারে কর্পোরেট গোলামে পরিণত করা যাবে। গরীব, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের ভাত ডাল আলুসেদ্ধটুকুর নিশ্চয়তাও উধাও হবে। এর পরেও কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তায় ধস নামতে দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকের আশঙ্কা। ফলে যাঁরা দক্ষিণপন্থার ঘোষিত বিরোধী — রাজনৈতিক দলের সদস্য বা পার্টি আনুগত্যহীন ব্যক্তি — যা-ই হোন না কেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিস্ময় ক্রমবর্ধমান। এমনকি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরাও বলে থাকেন “এত কিছুর পরেও…!” ফলত হতাশা। আর সেই হতাশার কারণে নির্বাচনের ফল বেরোবার পর বিজেপি-বিরোধীরা কিছু ভয়াবহ দক্ষিণপন্থী আচরণ শুরু করেন। যেমন অনেকে বলতে শুরু করেন “মুসলমানগুলো কেন অমুক পার্টিকে ভোট না দিয়ে তমুক পার্টিকে ভোট দিল?” কেউ আবার সমস্ত দোষ ইভিএমের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন (যদিও মনে করার কারণ নেই যে ইভিএম সম্পূর্ণ নির্দোষ)। এই আচরণ সাধারণ সমর্থক থেকে উচ্চস্তরের পার্টি নেতা পর্যন্ত সকলকেই করতে দেখা যায়। এই বিশ্লেষণে “সবাই বিজেপি হয়ে গেছে” — এই বিশ্বাস ক্রমশ ঘাড়ে চেপে বসে, বিজেপির লাভ হয়। কিন্তু এই বিশ্লেষণ একমাত্রিক। বিরোধী বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা ভেবে দেখবেন, নির্বাচনে (বিশেষ করে বিধানসভায়) যে মাইক্রো ইস্যুগুলো কাজ করে, সেগুলোকে এই বিশ্লেষণে অগ্রাহ্য করা হয়। সে কারণেই বিজেপিকে আটকানোর উদ্দেশ্যে বলা হয় “আর যাকে ইচ্ছা ভোট দিন, বিজেপিকে দেবেন না।”

একথা যাঁরা বলেন, বা বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের রামধনু জোটের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা সকলেই ন্যূনতম লেখাপড়া জানেন। শ্রেণীর দিক থেকে মধ্যবিত্ত বা তদূর্দ্ধ। প্রায় সকলেরই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে; নিদেন পক্ষে রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান এবং স্পষ্ট মতামত আছে। এঁরা জানেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতবাদ ও কার্যকলাপ কতটা ভয়ঙ্কর। ফলে তাঁদের কাছে সব নির্বাচনই হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে ভারতীয়ত্বের লড়াই। বিজেপি যেমন বাইনারি তৈরি করেছে সারা দেশে — দেশদ্রোহী আর দেশপ্রেমিক — অনেকটা একই আদলের আরেকটা বাইনারি এঁদের মনেও তৈরি হয়ে রয়েছে। ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি যে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না, দেওয়া সম্ভব নয় — একথা বুঝতে সারা দেশের বিজেপি-বিরোধীদের কেবলই ভুল হয়ে যাচ্ছে। এ ভুল না করলে কত দূর লড়া যায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিহারের নির্বাচনে।

কোন সন্দেহ নেই, যদি দেশের সর্বত্র সবকটা নির্বাচন ভারত ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে কি থাকবে না, গণতান্ত্রিক থাকবে নাকি একদলীয় একনায়কতন্ত্র হয়ে যাবে — কেবল এই ইস্যুতে লড়া যেত, তবে চমৎকার হত। দুঃখের বিষয়, তা সম্ভব নয়। তেমন দেশ তৈরি করার জন্য আমরা সঙ্ঘবিরোধীরা ৬৭ বছর (১৯৪৭-২০১৪) সময় পেয়েছিলাম। পারিনি। এখন রাতারাতি ভারতেরে সেই স্বর্গে জাগরিত করতে চেয়ে অ্যালার্ম ঘড়ি বাজিয়ে দিলেই রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে না। আপনি জানেন হিটলার কে, নাজি কারা, ফ্যাসিবাদ কী ক্ষতি করে। আপনার বাড়ির কাজের মেয়ে জানে না। এখন যদি ন্যুরেমবার্গ ল-এর সাথে সাদৃশ্য আছে বলে মোদী সরকারের পাশ করা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করতে বলেন, সাবধান করেন “আর যাকে ইচ্ছে ভোট দাও, বিজেপিকে দিও না”, তার বয়ে গেছে আপনার কথা শুনতে। কেবল গ্রামের গরীব মানুষ, শহরের বস্তিবাসী বা কাজের মেয়ের কথাই বা কেন? নিজেদের লেখাপড়া জানা আত্মীয়স্বজনদেরই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, ফ্যাসিবাদ কী কজন জানে? যে চেতনা তৈরিই হয়নি, সে চেতনার কাছে আবেদন করে কোন সাড়া পাওয়ার আশা করা কি উচিৎ?

সত্যি কথা বলতে, পৃথিবীর কোথাও কোন নির্বাচনই সম্পূর্ণত মতাদর্শের লড়াই হয় না। হওয়া উচিৎ কিনা তা-ও ভেবে দেখা দরকার। ধরা যাক, একটা দেশের সরকার রাস্তাঘাট সারায়নি পাঁচ বছর ধরে, রোজ দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ তারা দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি মাসে সংবর্ধনা দেয়। এই দলের কি ভোট পাওয়া উচিৎ? গণতন্ত্রে নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকারই শিরোধার্য, রাজনৈতিক দলের ভোট পাওয়ার অধিকার নয়। ভোটার ঠিক করবেন তিনি কোন কোন ইস্যুর ভিত্তিতে ভোট দেবেন। রাজনৈতিক শক্তিগুলো, সে কোন দল হোক বা ব্যক্তি, ভোটারের মত পাওয়ার জন্য অন্যদের চেয়ে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। “আমরা বিজেপি নই, অতএব আপনার ভোট পাওয়া আমাদের অধিকার” — কোন দল এমন বলতে পারে না। বললে সেটাই অগণতান্ত্রিক। যদি কেউ বলে “অমুক দল বিজেপি নয়, অতএব ওকে ভোট দেওয়া আপনার কর্তব্য”, তাহলে তা-ও অগণতান্ত্রিক। কারণ রাজনৈতিক দলের কর্তব্য ভোটারের চোখে নিজেকে অন্যদের চেয়ে উন্নত (অন্তত স্বতন্ত্র) হিসাবে প্রমাণ করা। তা করতে না পারলে, বিজেপির চেয়ে ভাল কোন বিকল্প দিতে না পারলে, ভোটার কেন ভোট দিতে যাবেন?

দেশের অধিকাংশ নির্বাচনেই কিন্তু বিজেপি-বিরোধীরা বিকল্পহীন হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন। ভোটারের সামনে বিজেপির অন্যায়গুলোর তালিকা প্রস্তুত করছেন কেবল। নিজেরা তার বদলে কী কী সদর্থক কাজ করবেন, তা বলছেন না। অনেক ক্ষেত্রে আবার বিজেপির রাজনীতিই অনুসরণ করে নির্বাচনে লড়ছেন। মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে যেমন কংগ্রেস গোশালা বানিয়ে দেওয়া, রাম পথ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতেছিল। সরকারটা স্বভাবতই বেশিদিন টেকেনি। আমরা যারা ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তারা কংগ্রেসের সেই জয়ে উল্লসিত (অন্তত আশ্বস্ত) হয়েছিলাম। গণ্ডগোলটা ওখানেই। বিজেপির নীতি কংগ্রেস নিলে যদি আমাদের আপত্তি না থাকে, কার্টুনিস্টকে তামিলনাড়ু সরকার গ্রেপ্তার করলে যদি আমরা হট্টগোল না করি, আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের উপর তৃণমূল কংগ্রেস সরকার জলকামান চালালেও যদি আমরা চুপ করে থাকি এবং বলি ওরা বিজেপি নয়, তাই ভোট ওদেরই প্রাপ্য, তাহলে বিজেপির হাতই শক্ত হয়। কথাটা আরো বেশি করে সত্যি পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে, যেখানে বিজেপি কখনো ক্ষমতায় আসেনি। জলকামানে ভিজে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলো বা তাদের পরিবার ফ্যাসিবাদ দ্যাখেনি, জলকামান দেখেছে। ত্রিপুরা রাজ্যের চাকরি চলে যাওয়ায় আত্মঘাতী শিক্ষক উত্তম ত্রিপুরার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তাদের বিজেপিকে ভোট দেওয়া থেকে নিরস্ত করা কি সম্ভব তখন আর?

এ রাজ্যে এখন পর্যন্ত লড়াইটা বিজেপির ইউটোপিয়া বনাম বিরোধীদের ইউটোপিয়া। বিজেপি সোনার বাংলার কথা বলছে। সে বাংলায় কর্মসংস্থান কী করে হবে বলছে না। আলটপকা ৭৫ লক্ষ চাকরির কথা বলেই ঢোঁক গিলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের সমস্যা জানতে এবং মেটাতে সরকারকে দুয়ারে দুয়ারে নিয়ে গেছে, অথচ কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে মুখে কুলুপ। বহুকাল ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে নিয়োগ নিয়ে চলতে থাকা অচলাবস্থার কোন স্থায়ী সমাধানের কথা সরকার বলছে না। কেবল এক প্রস্থ নিয়োগের ঘোষণা হয়েছে। তৃণমূল বরং বিজেপির ইউটোপিয়ার বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে এমন এক বাংলার ইউটোপিয়া, যার ইতিহাসে কেবল রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, নজরুল, লালন, ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদনরা আছেন। একে ইউটোপিয়া বলছি, কারণ বাংলায় এঁদের পাশাপাশি তারাও ছিল যারা রামমোহনের বিরোধিতা করেছিল, বিদ্যাসাগরকে খুনের চেষ্টা করেছিল, নজরুল সম্বন্ধে বলত “ফার্সি শব্দে কবিতা লেখে! সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।” ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল বাঙালিরাই। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির কথা তো সকলেই জানে। এই ইউটোপিয়ার লড়াইয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করা শক্ত। এমনিতেও এই ইউটোপিয়াগুলো অধিকাংশ মানুষকে ছুঁতে পারছে না।

তৃতীয় পক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট এসবের বাইরে গিয়ে বলবেন কি, কী হবে রাজ্যের ধুঁকতে থাকা স্কুলশিক্ষার? স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা কি আবার স্বমহিমায় ফেরত আসবে তাঁরা ক্ষমতায় এলে? রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের পাওনাগন্ডারই বা কী হবে? সারা দেশের কৃষকদের সাথে এদেশের কৃষকরাও তো স্বখাতসলিলে ডুবছেন। তাঁদের জন্যই বা কী পরিকল্পনা? শিল্পায়ন নিয়ে কী চিন্তা ভাবনা তাঁদের? ওটা না হলে গরীব মানুষের কর্মসংস্থানের কী হবে? কেন্দ্র যেভাবে রাজ্যের প্রায় সব ক্ষমতাই কেড়ে নিচ্ছে, সরকারে এলে কিভাবে লড়বেন তার বিরুদ্ধে?

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সর্বত্রই বিজেপি বিরোধীদের বিকল্প কর্মসূচী হাজির করতে হবে, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সরকারের অন্যায় তুলে ধরা, সমালোচনা করা বিরোধীদের একটা কাজ। একমাত্র কাজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ নিরাশ হয়ে পড়তে পারেন। বিরোধী রাজনীতি কিন্তু নৈরাশ্যবাদের জ্বালানিতে চলে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। ভোটারের চারপাশের বাস্তব পরিস্থিতি, তার কাছে জরুরী ইস্যুগুলো কী, সেসব না ভেবে যদি লাল, সবুজ, ধূসর সব রং মিলে গিয়ে এমন একটা ইস্যুতে লড়াই করে — যা অধিকাংশ ভোটারের কাছে কোন ইস্যুই নয়, তাহলে দক্ষিণপন্থা জিতেই চলবে। আমি ইউটোপিয়ায় প্রাণপণে যা-ই চাই না কেন।

প্রতিবাদ সংবাদে বাদ?

অনুপ্রেরণা ছাড়া এ রাজ্যে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করাও মানা

গত ২৭শে নভেম্বর পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা তিনটে কৃষি বিল বাতিলের দাবীতে এবং প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ বিলের বিরুদ্ধে দিল্লী অভিযান শুরু করেন। ইতিমধ্যে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশের মত রাজ্যগুলোর কৃষকরাও পথে নেমে পড়েছেন। মহারাষ্ট্রের কৃষকরা নামবেন বলে ঘোষণা করেছেন। কাউকে কেয়ার না করা মোদী সরকার বুঝেছে ঠ্যালার নাম বাবাজি। এ রীতিমত কৃষক বিদ্রোহ। তাই গায়ের জোর ভুলে অমিত শাহ ও সম্প্রদায় হঠাৎ আলোচনার জোরে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। চিড়ে কিন্তু ভিজছে না। একগুঁয়ে চাষাদের এক কথা — সংসদ ডাকো, আইন বাতিল করো। সারা দেশের বাম, মধ্য, দক্ষিণ — যে কোন পন্থার মানুষের কাছেই এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় কোন ঘটনা নেই, কোন ইস্যু নেই, থাকার কথাও নয়।

অথচ বাংলা মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে কিন্তু সেটা বোঝার উপায় নেই। গতকালই পি সাইনাথ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এই কৃষক বিদ্রোহ এক দিনে তৈরি হয়নি। গত কয়েক বছরে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশের কিষাণ লং মার্চের ধারাবাহিকতায় এই আন্দোলন এসেছে। সেই আন্দোলনগুলো যেমন বাংলার সর্বাধিক টি আর পি প্রাপ্ত দুটো খবরের চ্যানেলে প্রাধান্য পায়নি, এই আন্দোলনও পাচ্ছে না।

২৬শে নভেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ছিল। সেই ধর্মঘটকেও সমর্থন জানিয়েছিল কৃষক সংগঠনগুলো। সেদিন বহু জায়গায় ট্রেন চলেনি, বাস চলেনি, দোকানপাট বন্ধ ছিল। অথচ সেদিন দুপুরেও কূপমন্ডুক বাংলা চ্যানেলের প্রধান খবর ছিল মাঝেরহাট ব্রিজ খোলার দাবিতে বিজেপির দাপাদাপি। যে ব্রিজ আজ বিকেলে উদ্বোধন হওয়ার কথা আগেই ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল।

বাংলা খবরের কাগজগুলোতেও গত কয়েক দিন ধরে কৃষক বিদ্রোহ নয়, বেশি জায়গা অধিকার করে থাকছে শুভেন্দু অধিকারীর ধাষ্টামো বা মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর ভোটমুখী প্রকল্প ঘোষণা। গত দু-তিন দিনে তবু কৃষক বিদ্রোহের খবর বা ছবি বাড়ির কাগজটার প্রথম পাতায় ভাল করে দেখতে পাচ্ছি, তার আগে এ কোণে এক কলম বা ও কোণে দু কলমেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছিল। সে অবশ্য চব্বিশ ঘন্টার আনন্দময় চ্যানেলগুলোর তুলনায় মন্দের ভাল। কারণ ওগুলোতে খবর বলতে সারাদিন যা পাওয়া যায়, তা হল — অমুক জায়গায় তৃণমূলের লেখা দেওয়াল মুছে দিল বিজেপি। তমুক জায়গায় বিজেপির পার্টি অফিসে তৃণমূলের ভাঙচুর। বিজেপি নেতার মাচার লাউ কেটে নেওয়ার অভিযোগ তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতার অভিযোগ করলেন বিজেপি সদস্য — এইরকম আর কি।

অর্থাৎ যে খবরগুলো আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও নেহাত দেখানোর বা ছাপার মত কিছু না থাকলে জায়গা ভরাতে ব্রিফ হিসাবে ব্যবহার করা হত — সেগুলোই বাঙালিকে দিনরাত পড়ানো এবং দেখানো হচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেই হাস্যকর নয়। আসলে দিল্লী ভিত্তিক হিন্দ্রেজি সংবাদমাধ্যম যেমন দেশের আসল সমস্যাগুলোকে আড়াল করতে পাকিস্তানকে কেমন দিলাম, লাভ জিহাদ, সিভিল সার্ভিস জিহাদ ইত্যাদি আবর্জনা পরিবেশন করে, বাংলার সংবাদমাধ্যমও কৃষক বিদ্রোহ, শ্রমিকদের আন্দোলনকে আড়াল করতে আবর্জনা পরিবেশন করছে। হিন্দ্রেজি সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর থেকে মস্তিষ্কে বিষক্রিয়া হয়, বাংলার আবর্জনা কেবল দুর্গন্ধ ছড়ায় — তফাত এটুকুই।

কিন্তু কেন এমন করা হচ্ছে? কৃষক আন্দোলনকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিলে কী ক্ষতি? পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরা কি টিভি দ্যাখেন না, নাকি কৃষি আইন, শ্রম কোডের প্রভাব এ রাজ্যের শ্রমিক, কৃষকদের উপর পড়বে না?

আসলে প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও, যারা জানার তারা জানে, হিন্দ্রেজি সংবাদমাধ্যমের অধিকাংশ যেমন একচোখা, এ রাজ্যের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমও তাই। তাদের অনেকেই ফ্যাসিবিরোধী, কিন্তু কোনটাকে ফ্যাসিবাদ বলা হবে, তার কতটা বিরোধিতা করা হবে, আদৌ করা হবে কিনা — সেসব তারা ঠিক করে না। অনুপ্রেরণা ছাড়া এ রাজ্যে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করাও মানা।

অতএব শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি খুঁজছে যারা, তাদের আন্দোলনের কথা জানতে হলে আপনাকে ফেসবুকই খুলতে হবে। টিভির স্থানীয় সংবাদ লাউমাচা পুঁইমাচা নিয়েই চলবে। কৃষক বিদ্রোহের খবর জানতে চাইলেও হাতে গোনা হিন্দ্রেজি সংবাদমাধ্যম অথবা খবরের সাইটের শরণাপন্ন হতে হবে। টিভি আর কাগজ জুড়ে দলবদলের হট্টগোলই চলবে।

ছবিটা অবশ্য কাল থেকে বদলে যাবে বলে আশা করছি। কারণ আজ দিদি ঘোষণা করেছেন তিনি কৃষকদের পাশে আছেন, ঐ আইনগুলো খুব খারাপ, অবিলম্বে বাতিল করা উচিৎ এবং এই দাবিতে তাঁর দল কোমর বেঁধে আন্দোলনে নামছে। আশা করি এবার আর বাংলা সংবাদমাধ্যমের অনুপ্রেরণার অভাব হবে না।

উল্টো রাজা উল্টো বুঝলি প্রজার দেশে

আমাদের সংবিধান যে নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মত একটা জিনিস সে সিদ্ধান্ত এ দেশে হয়েই গেছে

যে যা-ই বলুক, চোখ কান খোলা রাখলে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ মোটেই কোরোনা সামলাতে যা করা উচিৎ তা করছে না। বেশি কড়া কথা বলা হয়ে যাচ্ছে মনে হলে একটু নরম করে বলা যেতেই পারে করতে পারছে না। তা বলে কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে জেলায় কী হচ্ছে সে সম্বন্ধে ভাষণ দেবে আর খবরদারি করতে কেন্দ্রীয় দল পাঠাবে — তাও সমর্থনযোগ্য নয়।

লক্ষণীয়, গত দুদিনে কেন্দ্রীয় সরকার কতকগুলো জায়গা সম্বন্ধে আলাদা করে বলেছে সেখানে উদ্বেগজনক অবস্থা। প্রত্যেকটা জায়গাই অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে — কলকাতা, মুম্বাই, জয়পুর, ইন্দোর। কলকাতার (এবং হাওড়ার) অবস্থা আমরা আশেপাশের লোকেরা জানি, তাই বাদ দিন। কিন্তু বাকিগুলো ভাবুন।

শুরু থেকেই দেশে সবচেয়ে বেশি টেস্ট করছে কেরালা আর মহারাষ্ট্র। স্বভাবতই ও দুটো রাজ্যে কোরোনা আক্রান্ত রোগীও বেশি পাওয়া যাচ্ছে৷ মুম্বাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী। জয়পুর রাজস্থানে। যে রাজ্যের ভিলওয়ারাকে কদিন আগে মডেল বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই। সেখানে কোরোনা রোগীর সংখ্যাও কিছু অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ইন্দোর মধ্যপ্রদেশে। সে এমন এক রাজ্য যেখানে এখন অব্দি আস্ত ক্যাবিনেট নেই, স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। কংগ্রেস সরকারকে সরিয়ে সবে বিজেপি সরকার শপথ নিয়েছে, তখনই লকডাউন শুরু হল। সেখানে মাঝে কয়েকদিন প্রচুর কোরোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছিল, হঠাৎই কমতে শুরু করেছে। ভোজবাজির মত।

এর পাশাপাশি যদি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর দিকে চোখ রাখা যায়, দেখা যাবে উত্তরপ্রদেশে ঠিক কী হচ্ছে আমরা জানি না। তবলিগি জামাতের জমায়েত নিয়ে দিনরাত এত দুশ্চিন্তা আমাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে ওখান থেকে কতজনের কোরোনা হয়েছে, অথচ লকডাউন শুরু হওয়ার পর রামনবমীর দিন অযোধ্যার অনুষ্ঠান থেকে কতজনের কোরোনা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান আমরা পাচ্ছি না। উত্তরপ্রদেশে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ীই কিন্তু সহস্রাধিক আক্রান্ত। তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চিন্তিত নন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো সর্বদা দেশী বিদেশী পর্যটকে ভরে থাকে, অথচ ওদিকে একেকটা রাজ্যে দুজন, পাঁচ জন, দশ জন করে আক্রান্ত। অর্থাৎ ঐ রাজ্যগুলো বাকিদের জন্য অনুকরণীয়। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার বাকিদের ওদের থেকে শিখতে বলছেন না কেন, তাও পরিষ্কার নয়। ফলত কিছু রাজ্যের জন্য এই দুশ্চিন্তাকে লর্ড ডালহৌসির করদ রাজ্যগুলোর প্রজাদের জন্য দুশ্চিন্তার বেশি কিছু ভাবা শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আসলে রাজ্য সরকার মানে যে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ অফিস নয়, তা বর্তমান সরকার মোটেই মানতে চান না।সংবিধানকে মারো গুলি। কেনই বা মারবেন না? আমাদের সংবিধান যে নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মত একটা জিনিস সে সিদ্ধান্ত এ দেশে হয়েই গেছে। পাড়ার “আমি কিন্তু বিজেপি নই” দাদা বা দিদির সাথে কথা বললেই বুঝতে পারবেন।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রভু ভাবার অভ্যেসটা যারাই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার চালিয়েছে তাদেরই বিলক্ষণ ছিল। রাজ্যপালকে দিয়ে দিনরাত বিরোধী দলের রাজ্য সরকারের পিছনে লাগা, সরকার ভেঙে দেওয়া, কাজে বাধা সৃষ্টি — সবই শুরু হয়েছে সেই বাজপেয়ীর দুর্গা ইন্দিরার আমলে। বরাবর কেন্দ্রের দাদাগিরি নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন বামপন্থীরা। তাঁরা রাজ্যগুলোকে আরো ক্ষমতা দিতে এমনকি সংবিধান সংশোধন চাইতেন, ৩৫৬ ধারার বিলোপ চাইতেন। এ সবের জন্য বাঙালির দৈনিক বেদ যারপরনাই গালাগাল দিয়েছে বামেদের। বলেছে এরা কাজ করতে চায় না বলে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে আঙুল তোলে।

একবার তো এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমকিই দিয়েছিলেন যে তাঁর দল লোকসভায় ৩.৫৬% ভোট পেয়েছে, তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ জারি করিয়ে দেবেন। নামটা গুগল করলে পেয়ে যাবেন। শেষ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তিনিই আবার বলেছিলেন পি এম টু ডি এম কাজ হওয়া উচিৎ, রাজ্য সরকারকে মানব না।

এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু কোন দুষ্কর্মই আগে অন্য লোক করেছে বলে বৈধ হয়ে যায় না। ফলত কেন্দ্রীয় সরকারের এই “চালুনি বলে ছুঁচ, তোর পিছে কেন ছ্যাঁদা” মার্কা তৎপরতাকে কোন যুক্তিতেই মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। “এই সময়ে রাজনীতি করবেন না” কথাটাও নেহাত খিল্লি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বরাবর দেখা যায় রাজনীতিকে ভাইরাসের মত পরিহার করতে বলে তারাই যারা ক্ষমতাশালী, কারণ রাজনীতি বন্ধ করতে পারলে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। কেন্দ্র, রাজ্য উভয় সরকারের ব্যবহারই তা প্রমাণ করে। রাজ্যের ব্যবহার নিয়ে না হয় আরেকদিন কথা হবে। পিঠটাও তো বাঁচাতে হবে।

সাত তাড়াতাড়ি

রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ বা প্যারডি এমন কিছু অভূতপূর্ব ব্যাপার নয় যা রোদ্দুর রায়ের ক্ষণজন্মা প্রতিভার দৌলতে এই সোনার বাংলায় ঘটতে পারল

ঠিক সাতটা অনুচ্ছেদ। কারণ এই ঘটনা এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়।

১) শরীর, নারী শরীর তো বটেই, অবশ্যই বিদ্রোহের হাতিয়ার হতে পারে। মণিপুরের মায়েরা এক সময় রাষ্ট্রীয় ধর্ষণের প্রতিবাদে উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। হাতের ব্যানারে লেখা ছিল “INDIAN ARMY RAPE US.” এরকম বিস্ফোরক রাজনৈতিক বক্তব্য নিজের শরীরকে ব্যবহার করে প্রকাশ করা যায়। আবার সাধারণভাবে ধর্ষণ, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে মহিলারা slut walk ও করে থাকেন। সুতরাং শুধু বুকে বা পিঠে কেন, হাতে পায়ে মাথায় পশ্চাদ্দেশে — যেখানে ইচ্ছা হয় আপনি কিছু লিখে ছবি তুলতেই পারেন। কিন্তু সেটা যদি বিদ্রোহ বলে গ্রাহ্য হতে হয় তাহলে লেখাটার সারবত্তা থাকতে হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে খিস্তি বসিয়ে দিলেই বিদ্রোহ হয় না। মণিপুরের মায়েদের মত বা যাঁরা slut walk করেন তাঁদের মত বিদ্রোহী হতে গেলে কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার —- সকলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। তাতে নানাবিধ ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। সেজেগুজে একটি জনপ্রিয় উৎসবে যোগ দেওয়ায় কোন ঝুঁকি নেই। ভাইরাল হতে চাওয়া বিদ্রোহ নয়।

২) রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ বা প্যারডি এমন কিছু অভূতপূর্ব ব্যাপার নয় যা রোদ্দুর রায়ের ক্ষণজন্মা প্রতিভার দৌলতে এই সোনার বাংলায় ঘটতে পারল। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই ওসব হয়েছে, স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় করেছেন। বিশিষ্ট সমালোচক জ্যোতি ভটাচার্য দেখিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর একটা কবিতায় ‘ভারততীর্থ’ কবিতার কিছু পংক্তি নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। কিন্তু তাঁরা আনতাবড়ি খিস্তি যোগ করে কাজ সারেননি। “উনি ব্যঙ্গ করেছেন অতএব আমি করলে দোষ নেই” — এটা অশিক্ষিতের যুক্তি। কী করেছেন তা দিয়ে আপনার বিচার হবে, স্রেফ করেছেন বলেই বাহবা দাবী করতে পারেন না কেউ। সে আপনি মেঘ বা রৌদ্র যা-ই হন।

৩) অনেক বুদ্ধিমান লোক ‘শেষের কবিতা’ র বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই এই অসভ্যতার ওকালতি করাতে চাইছেন। প্রচুর লাইকও পাচ্ছেন, কারণ উপন্যাস পড়ার সময় আজকাল কারোর নেই। যাঁরা আগ্রহী তাঁরা উপন্যাসটা পড়লে দেখবেন যে অংশগুলো উদ্ধৃত হচ্ছে সেগুলো অমিত রায় এবং সে যে ছদ্মনামে রবিবাবুর বিরোধিতা করত, সেই নিবারণ চক্রবর্তীর বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য নয়। আর অমিত চরিত্রটি কী এবং কেন সেটা উপন্যাসের শেষ পাতা অব্দি পৌঁছাতে পারলে বেশ বোঝা যায়। কথাটা যদি গোলমেলে মনে হয় তাহলে গুগল করে দেখে নিন negative capability মানে কী।

৪) সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে এক শ্রেণীর লেখক আছেন যাঁরা মনে করেন চাট্টি খিস্তি লিখলেই নবারুণ ভট্টাচার্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ব্যাপারটার প্রবল সমর্থন দেখতে পাচ্ছি। অবাক হচ্ছি না। যাঁরা কিংবদন্তির রাজহংসের জল বাদ দিয়ে দুধ খাওয়ার মত করে নবারুণের সাহিত্য থেকে তুলে নিয়েছেন কেবল খিস্তিটুকু, তাঁরা এই ধাষ্টামো সমর্থন করবেন না তো করবে কারা?

৫) ভারতের ফ্যাসিবাদীদের একটি প্রিয় খেলা আছে। ইংরেজিতে তার নাম whataboutery, আমি বাংলায় বলি বনলতা সেনগিরি। অর্থাৎ “এতদিন কোথায় ছিলেন?” এই কাণ্ডে দেখছি ফ্যাসিবিরোধীরা প্রবল বনলতা সেনগিরি করছেন। “দিল্লীতে জোর করে রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে খুন করে ফেলা হল। সেটা অশ্লীল মনে হয়নি?” “বিজেপি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিকৃত করে পোস্টার বানিয়েছে। সেটা অশ্লীল মনে হয়নি?” এ কি অদ্ভুত গা জোয়ারি রে বাবা! যারা রবীন্দ্রভারতীর কাণ্ডটার নিন্দা করছি তারা অনেকেই তো সোচ্চার বিজেপিবিরোধী, দিল্লীর দাঙ্গা নিয়েও সোচ্চার থেকেছি। এই অসভ্যতা বিজেপি করেনি বলেই নিন্দা করা যাবে না? বা বিজেপিও নিন্দা করছে বলেই আমাদের প্রশংসা করা কর্তব্য? এ তো বিজেপির মতই অনর্থক বাইনারি তৈরি করা। তাও আবার বাংলার সংস্কৃতির পায়ুমৈথুন করে — ঠিক যেটা বিজেপি করতে চায়।

৬) বাড়াবাড়ি করা আমাদের জাতীয় স্বভাবে পরিণত হয়েছে। যেমন ক্রিয়ায় তেমনি প্রতিক্রিয়ায়। কিছু ছেলেমেয়ে অসভ্যতা করেছে, তাদের নিন্দা শুনতেই হবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পারলে কিছু শাস্তিও দিতে পারেন। এদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করার দরকার কী? এরা কি চুরি ডাকাতি করেছে না খুন জখম করেছে? আর উপাচার্যই বা কিসের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করতে চাইছিলেন?

৭) গত দশ-বারো বছরে রাস্তাঘাটে খিস্তি দিয়ে কথা বলা যে দ্রুততায় ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, একই দ্রুততায় ভারতীয় পুরুষদের ধর্ষণ করার ইচ্ছাও বেড়েছে। কিছু মেয়ের পিঠ দেখা যেতেই সেই ইচ্ছা বেরিয়ে আসছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! মেয়েদের পিঠ দেখা গেছে! আবার সে পিঠে কিসব লেখা! এ উত্তেজনা সামলানো যায়? যাদের মেয়েদের হাতের তালু দেখলেও গা শিরশির করে, তারা যে পিঠ দেখে মত্ত হাতীর মত আচরণ করবে তাতে আর আশ্চর্য কী?

হে বাঙাল, ভুলিও না

এই মহাকাব্যিক ট্র‍্যাজেডিকে ১৯৮৯ এ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিপদের সাথে এক যোগে ব্যবহার করে যারা, তারা যে আসলে বাঙালদের যন্ত্রণারই লঘুকরণ করে

স্বাধীনতার আগে পূর্ববঙ্গে (অধুনা বাংলাদেশ) বসত ছিল এমন হিন্দু — চলতি কথায় বাঙাল। আমি এবং আমার বাবা আর মায়ের পরিবারগুলো যেমন। আমার স্ত্রীর বাবা, মায়ের পরিবারও। ভারতে হিন্দুত্ববাদের রমরমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিয়ে আলাদা করে চর্চা অনেক বেড়ে গেছে। নতুন নাগরিকত্ব আইন এবং এন আর সি র আবহেও এদের নিয়ে ক্রমবর্ধমান চর্চা।

“হিন্দু খতরে মে হ্যায়” প্রমাণ করতে কিছুদিন হল কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সাথে এক নিঃশ্বাসে আমাদের কথা বলা হচ্ছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা ও উচ্ছেদ ঘটেছিল স্বাধীন দেশের একটি প্রদেশের একটি অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসনের মদতে। আর বাঙালদের দুর্দশার কারণ ছিল একটা পরাধীন দেশের দু টুকরো হওয়া। কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এত বিপুল সংখ্যার মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। এই মহাকাব্যিক ট্র‍্যাজেডিকে ১৯৮৯ এ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিপদের সাথে এক যোগে ব্যবহার করে যারা, তারা যে আসলে বাঙালদের যন্ত্রণারই লঘুকরণ করে সেই চেতনা আজকের বাঙালদের মধ্যে দেখতে পাই না। আরো যা দেখতে পাই না, তা হল দেশভাগের ফলে বহু মুসলমানকেও যে ভিটে ছাড়া হয়ে এ পার থেকে ও পারে যেতে হয়েছিল সেই স্বীকৃতি। স্বাধীনতার আগে পরে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় সম্পত্তিহানি, প্রাণহানি, মেয়ে বউদের সম্মানহানির ইতিহাস যে তাদেরও আছে — সেই চেতনা। বোঝা যায় হিন্দুত্বের অপরবিদ্বেষী রাজনীতি আমাদের মস্তিষ্কে জাঁকিয়ে বসেছে।

আজকের বাঙাল, অর্থাৎ আমার মত ১৯৪৬-৪৭ না দেখা বাঙাল, এমনকি বাংলা ভাষার জন্যে লড়াই করে একটা আলাদা দেশ তৈরি হল যে যুদ্ধে, সেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধও নিজের চোখে না দেখা বাঙাল। তার কাছে গুরুজনদের মুখে শোনা “অরা আমাদের তাড়ায় দিছিল” কথাটুকুই কেবল আছে। তৎসহ ইতিহাস না পড়ার এবং ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ পড়ার অভ্যাস আছে। ফলত আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া খুব শক্ত হয় না যে ধর্মীয় নিপীড়নের বদলে পাল্টা নিপীড়নই উচিৎ কাজ। তাই সি এ এ, এন আর সি মিলিয়ে এ দেশের মুসলমানদের যদি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেওয়া হয় তো হোক, যদি দেশ থেকে তাড়ানো হয় তাতেও ক্ষতি নেই। “ওরাই তো আমাদের তাড়িয়েছিল” একটি যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করার সপক্ষে সাক্ষীগোপাল করা হয় ঋত্বিক ঘটককে, যিনি মানুষকে উদ্বাস্তু বানানোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ করেছেন তাঁর ছবিতে।

যাক সেকথা। ইদানীং তো দেখতে পাই মানবতা কোন যুক্তি নয়। তাই যদি কেউ বলে, আমার বাপ-ঠাকুর্দা উদ্বাস্তু ছিল বলেই আমি চাই না অমন দশা আর কারো হোক — তাকে দল বেঁধে ন্যাকা বলা হয়। সৎ উদ্দেশ্য, অসৎ উদ্দেশ্যের সংজ্ঞাও আমূল বদলে গেছে। নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষের উপর প্রতিশোধ নেওয়াই সৎ উদ্দেশ্য আজকাল। আমার এক আত্মীয় যেমন এন আর সি নিয়ে আলোচনায় বললেন “আমি বিজেপির সাপোর্টার নই। কিন্তু কোন কাজের উদ্দেশ্য যদি সৎ হয়, কেন সমর্থন করব না? এরা বাংলাদেশ থেকে এসে দেশের কাজকর্ম সব দখল করে নিচ্ছে। কেন অ্যালাউ করব?”

এ হেন বাঙালের কাছে মানবতার যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই। তাই একটা অন্য কথা বলি। আজকের বাঙালরা ভেবে দেখুন, যদি দেশভাগের সময় এ পারের মানুষরা (নেতারা তো বটেই) এই “কেন অ্যালাউ করব” কথাটা বলতেন, তাহলে কী অবস্থা হত আমাদের পূর্বপুরুষদের? আমরা এতদিনে জমিয়ে বসেছি বলে এখন যারা উদ্বাস্তু তারা চুলোয় যাক — আসামের বাঙালরা সেখানকার পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান (ওখানে যাদের মিঞা বলা হয়) সম্পর্কে এই মনোভাব পোষণ করেই এন আর সি হয়ে বিপদে পড়লেন। একথা বললেই আমার সেই আত্মীয়ের মত অনেক বাঙালই বলেন “আমার সব ডকুমেন্ট আছে। এখানে এন আর সি হলে আমার ভয় নেই।” আপনি যদি এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন, তাহলে আপনি নিজের চারপাশ সম্বন্ধে অদ্ভুত উদাসীন। শেষ পর্যন্ত এন আর সি হোক বা না হোক, আপনার বাপ-ঠাকুর্দাকে যে “অ্যালাউ” করা হয়েছিল সেকথা বলা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। সোশাল মিডিয়ায় দেখুন, রাস্তাঘাটে কান পাতুন। প্রকাশ্যেই অবাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা বলতে শুরু করেছে “এরা সব ওপার থেকে এসেছিল। এদের আমরা খেতে দিলাম পরতে দিলাম থাকতে দিলাম। আর এরা এখন নিজেদের ইতিহাস ভুলে মুসলমানদের জন্যে মিছিল মিটিং করছে!”

কিভাবে ইতিহাস বিকৃত করে আপনাকে আপনার পূর্বসুরীদের মতই উদ্বাস্তু বানানোর চক্রান্ত হচ্ছে বুঝুন। তাঁরা নাকি ওপার থেকে এসেছিলেন, ওরা খেতে পরতে থাকতে দিয়েছিল। অর্থাৎ দেশটা যে এক ছিল, ঐ পারের মত এই পারটাও যে আপনার বাপ-ঠাকুর্দার দেশই ছিল সেকথা অস্বীকার করা হচ্ছে। ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন সুচতুরভাবে পশ্চিমবঙ্গীয়দেরও (চলতি কথায় এদেশী) বোঝানো হচ্ছে পূর্ববঙ্গীয়রা তাদের জায়গায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এরকম যে স্বাধীনতার পরে বাঙালদের “অ্যালাউ” করা হয়েছিল এ দেশে থাকতে। এখন আপনাকে আবার নতুন করে নিজের জন্যে অ্যালাউয়েন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।

এদের কথায় ভুলে দেশভাগের প্রতিশোধ নেওয়ার ঝোঁকে যদি সি এ এ, এন আর সি মেনে নেন, তাহলে সারাজীবন আপনাকে ঐ অ্যালাউয়েন্সেরই বন্দোবস্ত করে যেতে হবে। বারবার প্রমাণ করতে হবে আপনি ভারতীয়, কারণ কোন প্রমাণই সকলের চোখে যথেষ্ট হবে না।

পুনশ্চ: কোন এদেশী যদি ভেবে থাকেন তিনি তোফা থাকবেন তাহলে তিনিও মূর্খ। কারণ বাঙাল আর এদেশীর তফাত কেবল বাঙালিরাই বোঝে। অন্যদের কাছে সবাই বাঙালি, এবং হিন্দুত্ববাদ শেখাচ্ছে “বাঙালি দেখলেই জানবে অনুপ্রবেশ।” আপাতত তার ফলে মার খাচ্ছেন গরীব গুরবো মানুষ। তা বলে হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, দিল্লী, মুম্বাইয়ের উচ্চবংশীয় বহুজাতিকের কর্মী বঙ্গসন্তানরা চিরকাল সুখে থাকতে পারবেন ভাবার কারণ নেই।

সাত শতাংশের অধিকারে

তার চেয়েও বড় কথা “বুনিয়াদি লড়াইটা হল ভাতের লড়াই। বামপন্থীদের সেই লড়াই জারী রাখতে হবে” — এই জাতীয় যুক্তিতে সমকালের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া কি কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের উচিৎ?

যতই ক্ষমতাচ্যুত হোক, ক্ষমতাহীন হোক, বামপন্থীরা রাস্তায় নামলে ঢেউ উঠবে। আজও এর কোন ব্যতিক্রম পৃথিবীর কোথাও নেই। পার্টির নাম, সংগঠনের নাম যা-ই হোক। আর ন্যায্য দাবীতে রাস্তায় নামলে অকর্মণ্য শাসক মারবে, ধরবে, মাথা ফাটাবে — এরও কোন ব্যতিক্রম হয় না। ফলে গতকালের নবান্ন অভিযানে রাজপথে যেসব দৃশ্যের জন্ম হয়েছে সেগুলো অনভিপ্রেত হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। বুক চিতিয়ে পুলিশের সঙ্গে লড়ে গেলেন যে নূতন, সবুজ, কাঁচারা তাঁদেরও সাধুবাদ প্রাপ্য। ফেসবুক বিপ্লবের যুগে রাস্তাই যে একমাত্র রাস্তা সেকথা শিরোধার্য করে এইভাবে রক্তাক্ত হতে যাঁদের বাধে না তাঁদের কুর্নিশ না করে উপায় নেই। সমস্যা অন্যত্র।
কাল সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এস এফ আই আর যুব সংগঠন ডি ওয়াই এফ আই যে দাবীগুলোর ভিত্তিতে নবান্ন অভিযান করছিলেন — স্বল্প খরচে শিক্ষার দাবী এবং কাজের দাবী — সেগুলো যে ন্যায্য তা নিয়ে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের মনে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়, যদি না তিনি রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের অন্ধ সমর্থক হন বা মুখ্যমন্ত্রীকে দৈবী শক্তির অধিকারী, মানবিক ভুলচুকের অতীত বলে মনে করেন। কিন্তু রাজনীতি, বিশেষত বিরোধী রাজনীতি, শুধু দাবী সনদ পেশের ধারাবাহিকতার নাম নয়। উপরন্তু ছাত্র সংগঠনের বা যুব সংগঠনের কেবল তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থের কথাই বলা উচিৎ, বৃহত্তর রাজনীতি তাদের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিৎ নয় — এমনটা আর যে-ই ভাবুক, বামপন্থীরা নিশ্চয়ই ভাবেন না। সেদিক থেকে দেখলে প্রায় একইরকমের দাবী নিয়ে গত কয়েক বছরে কখনো সিপিএম দলের নবান্ন অভিযান, কখনো কৃষক সভার নবান্ন অভিযান, কখনো ছাত্র, যুব সংগঠনের নবান্ন অভিযান দেশের যে বর্তমান রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক সঙ্কট তার সাপেক্ষে কী অবস্থান নিচ্ছে? অভিযানগুলো বারবার নবান্নেই বা যাচ্ছে কেন?
শিক্ষা, স্বাস্থ্যকে পণ্য করে তোলার যে প্রক্রিয়া ১৯৯১ তে শুরু হয়েছিল, ২০১৪ থেকে বিজেপি শাসনে তা আরো প্রকাশ্য, আরো নির্লজ্জ। আম্বানিদের যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো চালুই হয়নি তাকে সেন্টার অফ এক্সেলেন্স তকমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অথচ টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের মত সরকারপোষিত প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের পুরো মাইনে দেওয়ার ক্ষমতা নাকি সরকারের নেই, ইসরোর গবেষকদের মাইনে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এ রাজ্যে কলেজে তোলাবাজি, হবু শিক্ষক, প্যারা টিচারদের পুলিশ দিয়ে পেটানো ইত্যাদি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের কোথাও শিক্ষাজগতের লোকেরা ভাল নেই। না ছাত্রছাত্রীরা, না গবেষক শিক্ষক শিক্ষিকারা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মৌলিক অধিকার বিপন্ন। তাহলে এসব নিয়ে সিপিএম বা তার গণসংঠনগুলোর সংসদ অভিযান হচ্ছে না কেন?
কাজের অধিকার সারা দেশে কিভাবে বিপন্ন তা তো আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক মাসে কয়েক হাজার মানুষের চাকরি গেছে, আরো বহু মানুষ আশঙ্কিত। যাদের চাকরি আছে তাঁরাও অনেকে মাইনে পাচ্ছেন না বি এস এন এল কর্মীদের মত। তা নিয়ে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলো (সিটু তো বটেই) আন্দোলনও করছে। অথচ দল হিসাবে এসব নিয়ে সিপিএমের রাস্তায় নেমে আন্দোলন সংসদ বা সাউথ ব্লকের দিকে যাচ্ছে না কেন? এস এফ আই বা ডি ওয়াই এফ আই এর অভিযানই বা দিল্লীমুখো নয় কেন? অন্য রাজ্যে সাংগঠনিক শক্তির অভাব আছে বলে দিল্লী আক্রমণ করছি না, একথা যদি কেউ বলেন, সেটাকে অজুহাত বলেই ধরতে হবে কারণ মহারাষ্ট্র, রাজস্থান বা হরিয়ানার মত যেসব রাজ্যে সিপিএমের সাংগঠনিক শক্তি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক কম, সেখানকার কৃষকদের পর্যন্ত সংগঠিত করে দিল্লী, মুম্বইয়ের বুকে সিপিএমের কৃষক সভার উদ্যোগে কিষাণ লং মার্চ সারা দেশ অল্প দিন আগেই দেখেছে। তাহলে?
তার চেয়েও বড় কথা “বুনিয়াদি লড়াইটা হল ভাতের লড়াই। বামপন্থীদের সেই লড়াই জারী রাখতে হবে” — এই জাতীয় যুক্তিতে সমকালের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া কি কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের উচিৎ? সারা দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিপদ হল হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্রের বিপদ। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র লুপ্ত হওয়ার বিপদ। সেই বিপদ কোন দিক থেকে এসেছে (এখনো আসছে ভাবার ভুল করবেন না) তা আমরা সবাই জানি। তার বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইকে কি সিপিএম কোন অদূর ভবিষ্যতের জন্যে স্থগিত রেখেছে? রাখতে পারে? রাজ্যের তৃণমূল সরকার তো ২০১১ থেকেই এখনকার মত চলছে। তা নিয়ে বারবার নবান্ন অভিযানে পার্টি সদস্য বা গণসংগঠনের সদস্যদের রক্ত ঝরছে অথচ মানুষের সমর্থন বাড়ার বদলে কমেই চলেছে। এর কারণ কী? আসলে কি মানুষের ইস্যু বুঝতেই ভুল হচ্ছে? নিজেদের পছন্দের ইস্যুকেই মানুষের ইস্যু বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে? নেতৃত্ব এগুলো ভাববেন না?
পশ্চিমবঙ্গের গরীব, বড়লোক, মধ্যবিত্ত সকলেই এই মুহূর্তে কোন ইস্যুটা নিয়ে উদ্বিগ্ন? বা নিদেন পক্ষে আগ্রহী? নিঃসন্দেহে এন আর সি। বিজেপি রোজ বলছে, বড় মেজ সেজ ছোট সব নেতা নেত্রী বলছেন বাংলায় এন আর সি হবেই। শুধু বাংলাই বা কেন? আসামে ডিটেনশন সেন্টার তৈরি হয়ে গেছে, অন্যত্রও হচ্ছে। তা নিয়ে সিপিএম নেতৃত্ব এখনো কিন্তু, যদি, তবে করছেন। কখনো শোনা যাচ্ছে আসামের বাইরে এন আর সি হলে ওঁরা বিরোধী, অর্থাৎ আসামে যা হয়েছে বেশ হয়েছে। কখনো বলছেন দেখতে হবে যেন সত্যিকারের নাগরিকরা বাদ না পড়ে যান। এসবের মানে কী? যে পার্টি অসহায় মানুষ, গরীব মানুষ, ছিন্নমূল মানুষের পাশে নির্দ্বিধায় দাঁড়ায় না, মানুষকে ছিন্নমূল করার প্রক্রিয়ার বিপক্ষে পিঠ সোজা করে দাঁড়ায় না — সে আবার কিরকম কমিউনিস্ট পার্টি?
ওদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এ নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। শেষ অব্দি সারদা, নারদের চোখ রাঙানি পেরিয়ে কদ্দূর কী করবেন সেটা পরের কথা, কিন্তু ছিন্নমূল হতে চলা মানুষ কিন্তু দেখছেন তিনি বলেছেন “দু কোটি লোককে বার করে দেবে? দুটো লোকের গায়ে হাত দিয়ে দেখাক।” এরকম কথা সিপিএম তথা বাম নেতাদের মুখে শোনা যাচ্ছে না কেন? তাঁরা কি ভাবছেন বাঙালদের পক্ষ নিলে এদেশীয় ভোটাররা ক্ষেপে যাবেন? উদ্বাস্তুদের জন্যে আন্দোলন কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতে তথা বাংলায় বামপন্থীদের শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়েছিল।
আচ্ছা, রাজ্য সরকারকেও কি সঠিক ইস্যুতে আক্রমণ করা হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রীর সাধের মেট্রো রেল প্রকল্প এমনই কল্পরাজ্যের জিনিস যে তাকে বাস্তবের মাটিতে নামাতে গিয়ে বহু লোকের ভিটেমাটি চাটি হওয়ার যোগাড় হয়েছে। তা নিয়েই বা বামেদের আন্দোলন কই? যে শহরে এই সরকারের আমলেই নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে, প্রকল্প শেষ করা সম্ভব নয় বলে ঘোষিত হয়েছে, সেই শহরে আবার এরকম সর্বনাশা প্রকল্প এগোল কী করে তা নিয়ে বামেরা সরকারকে প্রশ্নবাণে, আন্দোলনে জর্জরিত করলেন কই? নেতৃত্ব কি মনে করেন এগুলোতে কারোর কিছু এসে যায় না? নাকি ওখানেও হিসাব? বাড়ি ভেঙে পড়া লোকেদের চেয়ে মেট্রো হলে যারা চড়বে তাদের ভোটসংখ্যা বেশি হওয়ার হিসাব?
যদি তা-ই হয়, তাহলে এই যাঁরা লাল ঝান্ডার জন্যে এখনো প্রাণ বাজি রাখছেন তাঁরা কোন হিসাবে আছেন জানতে ইচ্ছা করে। তাঁদের ত্যাগ, তাঁদের রক্ত অপচয় হচ্ছে না তো? সাম্প্রতিককালে অনেকের মুখে কাছের শত্রু তৃণমূল, তারপর বিজেপির মোকাবিলা করা হবে ইত্যাদি শোনা যাচ্ছে। মনে পড়ল, ছেলেবেলা থেকে দেখি গণশক্তির সম্পাদকীয় স্তম্ভের উপরে কোন মার্কসবাদী ক্লাসিক সন্দর্ভ থেকে কয়েক লাইন উদ্ধৃত থাকে। যখন স্কুলে পড়ি তখন একটা উদ্ধৃতি প্রায়ই দেখতাম। স্মৃতি থেকে যতটুকু উদ্ধার করতে পারছি তাতে কথাটা ছিল খানিকটা এরকম: কমিউনিস্টদের লক্ষ্য, অন্য সব সর্বহারা পার্টির মতই, শ্রমিক শ্রেণীর আশু দাবীগুলি আদায় করা। কিন্তু তার মধ্যেও তারা বৃহত্তর লড়াইয়ের কথা ভোলে না এবং আসন্ন বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুতি নেয়।
আশা করি বাম নেতাদের স্মৃতিশক্তি আমার চেয়ে অনেক ভাল, তাঁরা আমার মত ক্লাসিকগুলো না পড়া লোক নন এবং ক্লাসিকগুলোর সময়োপযোগী ব্যাখ্যা করার শক্তিও তাঁদের অনেক বেশি।
কোন সিপিএম/বাম কর্মী বলতেই পারেন “তুমি কে হে, এত কথা বলছ? কোনদিন আমাদের কোন মিছিলে এক ঘা লাঠিও তো খাওনি। তোমার কী অধিকার এসব লেখার?” বললে তিনি ঠিকই বলবেন। তবে উত্তরে আমারও একটু বলার আছে।
আমি এই কথাগুলো লিখলাম সাত শতাংশের অধিকারে। অর্থাৎ আমি সেই সাত শতাংশের মধ্যে পড়ি যারা এখনো আপনাদের ভোট দেয়। অতএব আমার মতামতকে গুরুত্ব দিতে আপনারা বাধ্য। সংসদীয় গণতন্ত্রে কতিপয় লোকের এটুকু বাঁদরামি আপনাদের মেনে নিতেই হবে।

%d bloggers like this: