বাধ্যতামূলক মহানতার একাকিত্বে ইমাম রশিদি

এক পুত্র আর এক পিতার গল্প বলি। প্রথম জনের বাবা খুন হয়েছিলেন গোরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের হাতে, দ্বিতীয় জনের ছেলে খুন হয়েছিল দাঙ্গাবাজদের হাতে। দ্বিতীয় জনকে আমরা সবাই চিনি — আসানসোলের নূরানী মসজিদের ইমাম ইমদাদুল রশিদি। প্রথম জনের নাম অভিষেক সিং। একবিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু এক বছরও নয়। অতএব মনে করিয়ে দেওয়া যাক, অভিষেকের বাবা সুবোধ কুমার সিং ছিলেন উত্তরপ্রদেশ পুলিসের ইন্সপেক্টর, একসময় দাদরির আখলাক আহমেদের খুনের ঘটনার তদন্ত করছিলেন। ইমামের ছেলে সিবগাতুল্লা খুন হয়েছিল ২০১৮ মার্চের দাঙ্গায়, ওই বছরেরই ৩ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের এক অঞ্চলে একটি গরুর মৃতদেহ নিয়ে গোহত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে জনতা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সুবোধ গুলিবিদ্ধ হন। ইমাম রশিদিকে আমরা মনে রেখেছি দাঙ্গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পুত্রশোক অগ্রাহ্য করে হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর বার্তা দেওয়ার জন্য। মুসলমানদের দিক থেকে বদলা নেওয়ার চেষ্টা হলে আসানসোল ত্যাগ করবেন বলার জন্য। সুবোধপুত্র অভিষেকও পিতৃশোকের মাঝেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন বাবা শিখিয়ে গেছেন হিন্দু মুসলমান আলাদা নয়। ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত। যেন এমন না হয় যে বহিঃশত্রুর দরকারই হল না, ভারতীয়রা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করে বসল।

কদিন হল ইমাম রশিদি আবার সংবাদের শিরোনামে এসেছেন পুত্র সিবগাতুল্লার খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করার জন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে এত বড় ত্যাগ দেখে প্রশংসার বন্যা বয়ে যাচ্ছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মনিরপেক্ষ আমরা আপ্লুত। এই তো আমাদের দেশ, ইমামের মত লোকেরাই তো আমাদের আশার আলো, ইত্যাদি বয়ানে সংবাদপত্রের প্রথম পাতা থেকে ফেসবুক ওয়াল পর্যন্ত সবই মুখরিত। একটি সংবাদপত্রে সরকারপক্ষের উকিলের বিবৃতিও বেরিয়েছে। তিনি বলেছেন চার দশকের বেশি ওকালতির অভিজ্ঞতায় কখনো কোনো মৃতের বাবাকে এমন অবস্থান নিতে দেখেননি। যদিও ইমাম সাহেবের এমন আচরণ মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। সিবগাতুল্লার হত্যার পরেই তিনি বলেছিলেন যে একজন হত্যাকারীকে ধরতে পেরেও ছেড়ে দিয়েছেন

সুবোধ কুমারের ছেলে অভিষেক এবং পরিবারের বাকি সদস্যরা কিন্তু এত মহান নন। আর পাঁচটা খুনের মামলার মত করেই সে মামলা এগোচ্ছে। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া কাগজের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, সুবোধের খুনে অভিযুক্ত ৪৪ জনের মধ্যে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে পুলিস দেশদ্রোহ আইনে মামলা করার অধিকার পেয়েছে এ বছরের ১৬ মার্চ। শোনামাত্রই কেউ কেউ সিদ্ধান্ত করতে পারেন, যোগীর রাজ্যে ন্যায়বিচার হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হল অভিযুক্তদের মধ্যে মাত্র ছজন জেলে আছে, বাকি সকলেই জামিনে বাইরে। প্রধান অভিযুক্ত বজরং দলের সদস্য যোগেশ রাজও শুরুতেই এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বাগড়া দেওয়ায় তার বেরিয়ে আসা হয়নি। বুলন্দশহরের পুলিস এফ আই আর করার সময়েই খুন, হিংসা এবং দেশদ্রোহিতার (সেকশন ১২৪এ) অভিযোগ এনেছিল। কিন্তু পরে আদালত শেষেরটি বাদ দেয়, কারণ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়া যায়নি। সে অনুমোদন পাওয়া যায় ২০১৯ সালের জুন মাসে। তারও প্রায় তিন বছর পরে বুলন্দশহর জেলা আদালত এই অভিযোগ অনুমোদন করেছে। অথচ সারা দেশে কয়েকশো মানুষ, যাঁদের একটা বড় অংশ মুসলমান, এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে কারাবাস করছেন। এদের মধ্যে সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান, ছাত্রনেতা উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম আছেন। অশীতিপর ফাদার স্ট্যান স্বামী তো শুনানি ছাড়াই জেলের মধ্যে মারা গেলেন। পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত মানুষটির জন্য তাঁর আইনজীবীরা সামান্য জল খাওয়ার স্ট্রয়ের আবেদন করেও সফল হননি।

অথচ ভারতের বিচারব্যবস্থা কিন্তু অমানবিক নয়। এই তো গতকাল দিল্লির এক আদালত ওঙ্কারেশ্বর ঠাকুরকে জামিন দিয়েছে মানবিকতার কারণে। ওঙ্কারেশ্বর সুল্লি ডিলস বলে একটি অ্যাপ তৈরি করায় অভিযুক্ত, যে অ্যাপে মুসলমান মহিলাদের কাল্পনিক নিলাম করা হয়েছিল। বিচারক ওঙ্কারেশ্বরকে জামিন দিয়ে বলেছেন, অভিযুক্তের এটা প্রথম অপরাধ। তাকে দীর্ঘদিন আটকে রাখলে তার শরীর স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।

এ তো পাতিয়ালা হাউস কোর্টের এক বিচারকের মন্তব্য। দেশের হাইকোর্টগুলো পর্যন্ত অত্যন্ত মানবিক। গত শনিবার দিল্লি হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর আর পরবেশ কুমারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার (হেট স্পিচ) অভিযোগে দায়ের হওয়া পিটিশনের উত্তরে বলেছে, কোনো কথা হেসে বললে অপরাধ হয় না। তাছাড়া ভোটের সময়ে বিদ্বেষমূলক কথা বললেও ক্ষতি নেই।

অর্থাৎ ক্ষেত্র বিশেষে বিচারকরা অত্যন্ত উদার, অত্যন্ত মানবিক। তবে সব ক্ষেত্রে অতটা হওয়া যায় না। ইমাম সাহেবের মত লোকেদের, ভারতের সংখ্যালঘুদের এই তারতম্য বুঝে না নিয়ে উপায় নেই। বিশেষত আজকের ভারতে মহান হওয়া সংখ্যাগুরুর কাছে একটি বিকল্প, সংখ্যালঘুর একমাত্র উপায়। আমাদের মধ্যে যাদের ইমাম সাহেবের প্রশংসা করতে গিয়ে আবেগে গলা বুজে আসে, তারা বুঝতে পারি না যে তিনি ছেলের খুনিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে, তাদের শাস্তি হলে মুহূর্তে সোশাল মিডিয়ার সাহায্যে কেবল আসানসোল কেন, গোটা দেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়তে পারে। দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর চেয়েও দ্রুত প্রতিক্রিয়া হবে। এ দেশ এখন নরকের দক্ষিণ দুয়ারে পৌঁছে গেছে। এখানে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেওয়া যায়, মুখে হাসিটি থাকলেই হল। এসব আমরা বুঝি না বলেই আসানসোল দাঙ্গার অগ্রণী নেতা বাবুল সুপ্রিয়র তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে ইমাম বিবৃতি দিলেন না বললে আমাদের গোঁসা হয়। আমরা কিছুতেই বোঝার চেষ্টা করি না, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের চোখের সামনে এখন এমন কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি নেই, যারা দাঙ্গার সময়ে তাঁদের ঢাল হয়ে উঠবে বলে ওঁরা আশা করতে পারেন। রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রীর উদ্দেশে “সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি” গাওয়া ছাড়া ইমাম সাহেবদের সামনে কোনো পথ খোলা নেই। ধর্মনিরপেক্ষ সংখ্যাগুরুর সামাজিক নিষ্ক্রিয়তা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তাই তাঁদের বাধ্যতামূলক মহানতার একাকিত্বে বন্দি করেছে।

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

অনুরূপ পোস্ট

রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

সত্যান্বেষী পাঠক জাগুন, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবর লিখতে হবে

সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ইতিবাচক না লিখলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে না — এই ঘোষণা প্রমাণ করে অগণতান্ত্রিকতা জয়যুক্ত হয়েছে। এই জয়ে বাংলার সংবাদমাধ্যমের অবদানও ফেলে দেওয়ার মত নয়।

ব্যোমকেশ জানালার দিক্ হইতে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল— “কিছুদিন থেকে কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে, লক্ষ্য করেছ?”

আমি বলিলাম— “না। বিজ্ঞাপন আমি পড়ি না।”

ভ্রূ তুলিয়া একটু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশ বলিল— “বিজ্ঞাপন পড় না? তবে পড় কি?”

“খবরের কাগজে সবাই যা পড়ে, তাই পড়ি— খবর।”

“অর্থাৎ মাঞ্চুরিয়ায় কার আঙুল কেটে গিয়ে রক্তপাত হয়েছে আর ব্রেজিলে কার একসঙ্গে তিনটে ছেলে হয়েছে, এই পড়! ওসব পড়ে লাভ কি? সত্যিকারের খাঁটি খবর যদি পেতে চাও, তাহলে বিজ্ঞাপন পড়।”

— পথের কাঁটা (ব্যোমকেশ সমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স; পঞ্চদশ মুদ্রণ, মে ২০১১)

বাংলার সংবাদমাধ্যমের যা অবস্থা হয়েছে, তাতে আজও সত্য জানার আগ্রহে যাঁরা খবরের কাগজ পড়েন তাঁরা সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের সাথে এই প্রশ্নে একমত না হয়ে পারবেন না। তা বলে কখনোই কোনো কাজের খবর ছাপা হয় না বললে নিদারুণ অবিচার হবে। যেমন কয়েকদিন আগেই সর্বাধিক বিক্রীত বাংলা সংবাদপত্রের সংক্ষিপ্ত খবরের স্তম্ভে একটি দারুণ কাজের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বয়ানটি এইরকম

‘পজিটিভ খবর’ ও সরকারি বিজ্ঞাপন

জেলার পত্র-পত্রিকা তথা সংবাদমাধ্যম উন্নয়নের খবর অনেক বেশি করে। তারা যাতে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত না হয়, প্রশাসনকে তা দেখার নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাওড়া শরৎ সদনে বৃহস্পতিবার জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “পজিটিভ (ইতিবাচক) খবর করুন। বিজ্ঞাপন পাবেন।” প্রশাসনিক বৈঠকে এ দিন জেলার সংবাদমাধ্যমের তরফে এক জন প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, তাঁদের আর্থিক অবস্থা সঙ্গিন। বারবার বলেও তাঁরা সরকারি বিজ্ঞাপন পাচ্ছেন না। বিষয়টি শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপন পাবেন। এলাকার উন্নয়নের খবর আপনারা ভাল করে করুন।” মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ছাপার পরে সেগুলি জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও স্থানীয় থানার আইসি-র কাছে পাঠাবেন। তাঁরা দেখে নেবেন, খবর ‘পজিটিভ’ না ‘নেগেটিভ’। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, বড় সংবাদমাধ্যম এক দিন অল্প করে খবর করে। অনেক সময় ‘নেগেটিভ’ ভাবে প্রচারও করে। কিন্তু জেলার ছোট কাগজ সরকারের কাজের কথা গ্রামে গ্রামে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। সেই জন্যই তাদের বিজ্ঞাপন পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, তা নজর রাখার জন্য প্রশাসনিক কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সিপিএম ও বিজেপি নেতাদের মতে, জরুরি অবস্থার সময়ে সংবাদ প্রকাশের আগে সরকারের অনুমোদন নিতে হত। এখন আবার ‘অন্য রকম জরুরি অবস্থা’ এসেছে, যখন বিজ্ঞাপনের জন্য সরকারের শংসাপত্র নিতে হবে।

এখন কী হয় জানি না, বছর দশেক আগেও খবরের কাগজে শিক্ষানবিশির সময়ে প্রথমেই শেখানো হত কী করে এরকম সংক্ষিপ্ত খবর লিখতে হয়। কারণ অনেকটা জায়গা জুড়ে হাজার-দেড় হাজার শব্দে প্রতিবেদন লেখা সহজ, এত অল্প পরিসরে সমস্ত কাজের কথা লিখে ফেলাই কঠিন। যেমন প্রতিবেদকের পক্ষে কঠিন, তেমনি প্রতিবেদন যে সম্পাদনা করে তার পক্ষেও কঠিন। ফলে এই কাজটা শিখে ফেললে বড় প্রতিবেদন লেখা বা সম্পাদনা করা জলভাত হয়ে যায়। সেদিক থেকে এই খবরটি (নিউজরুমের ভাষায় ‘ব্রিফ’) সাংবাদিকতার ক্লাসে পাঠ্য হওয়ার যোগ্য। মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যেকটি জরুরি বাক্য, রীতিমত ব্যাখ্যা সমেত ১৭৮ শব্দের মধ্যে ধরে দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেদকদের ছোট থেকে পই পই করে বলে দেওয়া হয়, নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য যে কোনো খবরে সব পক্ষের বক্তব্য দেওয়া আবশ্যক। এখানে তা-ও করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সম্বন্ধে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বক্তব্য তো লেখা হয়েছে বটেই, এমনকি শূন্য পাওয়া সিপিএমকেও বঞ্চিত করা হয়নি। রাজ্যের গণতন্ত্রের সামগ্রিক ছবি তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রতিবেদন গত দশ বছরের কাগজ ঘাঁটলেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

খবরটি থেকে কী কী জানা যাচ্ছে?

প্রথমত, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবরই করতে হবে। সরকারি আইন যা-ই বলুক, সরকারের সমালোচনা করলে, দোষত্রুটি ধরলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকৃতপক্ষে সরকারি আনুকূল্য। সে বাবদ যে টাকা পত্রপত্রিকাগুলি পেয়ে থাকে তা করদাতার টাকা নয়, সরকারের পৈতৃক সম্পত্তি। সরকারের নেকনজরে থাকলে পাওয়া যাবে, নচেৎ নয়। এককথায়, সংবাদমাধ্যমকে সরকারি প্রচারযন্ত্র হয়ে উঠতে হবে।

দ্বিতীয়ত, জেলার পত্রপত্রিকা, চ্যানেল ইত্যাদি সরকারের কাজের প্রচার অনেক বেশি করে। তার উপযুক্ত প্রতিদান যেন তারা পায়, তা দেখা সরকারি আধিকারিকদের কাজের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ জেলাশাসক যেমন খবর রাখেন জেলার কোথাও বন্যাদুর্গত মানুষ না খেয়ে আছেন কিনা, তেমনি তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে জেলার কোনো কাগজ বন্যাত্রাণে সরকারের কাজের ঢালাও প্রচার করেও সরকারি বিজ্ঞাপন না পেয়ে আছে কিনা।

তৃতীয়ত, সংবাদমাধ্যম মুখ্যমন্ত্রীকে একজন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসক মনে করছে না। প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়ে কেবল তাঁর কার্যকলাপের যথাযথ প্রতিবেদন তৈরি ও মূল্যায়ন তার কাজ নয়। মুখ্যমন্ত্রী মাইবাপ, তাই নিজেদের আর্জি পেশ করাও কাজ। বাঁচালে মুখ্যমন্ত্রীই বাঁচাবেন।

চতুর্থত, বড় সংবাদমাধ্যম সরকারের যথেষ্ট স্তুতি করছে না। এমনকি মাঝেমধ্যে নিন্দে-বান্দাও করছে। বাংলা যে সোনার বাংলা হয়ে উঠেছে, সে খবর গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে ছোট সংবাদমাধ্যমই। তারা সরকারকে দেখছে, অতএব তাদের দেখাও সরকারের কর্তব্য।

পঞ্চমত, সরকারের যথেষ্ট প্রশংসা করা হয়েছে কিনা তা ঠিক করবেন জেলাশাসক, পুলিস সুপার এবং স্থানীয় থানার আইসি। অর্থাৎ যাঁদের ফৌজদারি ক্ষমতা আছে। কিন্তু সরকারি যে দপ্তরগুলি আইনত বিজ্ঞাপন দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেগুলি এলেবেলে।

মোদ্দা কথা, পশ্চিমবঙ্গে এখন সরকারি বিজ্ঞাপন একটি ঘোষিত লাঠি, যা উঁচিয়ে সংবাদমাধ্যমকে সরকার নিজের ইচ্ছামত ওঠবোস করায়। ঘোষিত কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে তৈরি হওয়া দুটি প্রেস কমিশন দেশের সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন, সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার জন্য যা যা সুপারিশ করেছিল তার অনেককিছুই অনেক দলের সরকারই মানেনি। অনেক কথা সংবাদমাধ্যমও মানেনি। প্রেস কাউন্সিল নামে একটি ঠুঁটো জগন্নাথ আছে, তাদের কথাও দু পক্ষের কেউ শোনে না। এর উপর আছে সংবাদমাধ্যম চালানোর, বিশেষত খবরের কাগজ চালানোর, বিপুল খরচ। সেই সুবাদে গত ৭৫ বছর ধরে অনেক দলের অনেক সরকারই সরকারি বিজ্ঞাপনকে লাঠি হিসাবে ব্যবহার করেছে। যে কোনো গবেষক যে কোনো রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস আর সংবাদমাধ্যমগুলির সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার তথ্য পাশাপাশি রেখে পড়লেই তার অজস্র প্রমাণ পাবেন। কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত নরেন্দ্র মোদীর সরকারের আগে কোনো সরকার রীতিমত আইন প্রণয়ন করে সংবাদমাধ্যমকে তোতাপাখি করে ফেলার চেষ্টা করেনি। ঠিক তেমনি, অন ক্যামেরা সরকারি বৈঠকে বসে, ইতিবাচক খবর করলে তবে সরকারি বিজ্ঞাপন দেব — এ কথা ঘোষণা করার সাহসও পশ্চিমবঙ্গে অতীতে কোনো মুখ্যমন্ত্রীর হয়নি।

যে কোনো কাজ, যা বরাবর লুকিয়ে করা হত, তা প্রকাশ্যে করা বিরাট পরিবর্তনের প্রমাণ। অন্য সম্প্রদায়ের লোকেদের নিয়ে ভিত্তিহীন, কুৎসিত আলোচনা ভারতীয়রা চিরকাল করে থাকে। কিন্তু ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত ওই সম্প্রদায়ের মানুষের সামনে করা হত না, এখন হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয়, চক্ষুলজ্জাও দূরীভূত, কারণ পরজাতিবিদ্বেষ এখন ক্ষমতার আশীর্বাদধন্য। তেমনি সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ইতিবাচক না লিখলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে না — এই ঘোষণা প্রমাণ করে অগণতান্ত্রিকতা জয়যুক্ত হয়েছে। এই জয়ে বাংলার সংবাদমাধ্যমের অবদানও ফেলে দেওয়ার মত নয়। এতবড় খবর যে একটি বড় সংবাদপত্রের ব্রিফে জায়গা পেয়েছে এবং অন্যত্র আদৌ জায়গা পায়নি, তার একটিমাত্র ব্যাখ্যাই সম্ভব বলে মনে হয়। “মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষপাত জেলার ছোট সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতি। অতএব বেল পাকলে কাকের কী?” আরও নৈরাশ্যবাদী হলে অবশ্য আরেকটি ব্যাখ্যাও করা সম্ভব। “এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে যদি যা পাচ্ছি তা-ও বন্ধ করা হয়?”

গত এক দশকে ভারতীয় গণতন্ত্র, পিছু পিছু ভারতীয় সাংবাদিকতা, যে পথে গেছে তাতে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আয়ের যে পথ অবলম্বন করে এ দেশে সাংবাদিকতা এতকাল চলেছে তা বাতিল করতে হবে। নইলে সংবাদমাধ্যমের পক্ষে সত্য বলা, সত্য দেখানো অসম্ভব। সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং/অথবা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ এড়ানো না গেলে সংবাদমাধ্যমকে ক্ষমতার বশংবদ হয়েই থাকতে হবে। ফলত ইংরেজিতে এবং ভারতের অন্যান্য ভাষাতেও এখন গ্রাহকভিত্তিক সংবাদমাধ্যম চালু হয়েছে। নিউজলন্ড্রি, নিউজক্লিক, দ্য ওয়্যারের মত সংবাদমাধ্যমের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কেন তারা মূলধারার সংবাদমাধ্যমের চেয়ে সত্যের প্রতি অনেক বেশি বিশ্বস্ত থাকতে পারছে। আক্রান্ত হচ্ছে, তবু লড়ে যেতে পারছে। বাংলাতেও সেরকম প্রয়াস আশু প্রয়োজন। সেই প্রয়াস ফলপ্রসূ করতে হলে সত্যান্বেষী পাঠক, দর্শকদের এগিয়ে আসতে হবে। নইলে নাগরিক ডট নেট বা ইত্যাকার প্ল্যাটফর্মগুলিকেও অনতিবিলম্বে ক্ষমতার মালাই জপতে হবে।

তথ্যসূত্র

১। https://scroll.in/article/988105/explainer-how-indias-new-digital-media-rules-are-anti-democratic-and-unconstitutional

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আর এস এসের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন, তাঁদের অন্যতম হলেন রাহুল গান্ধী।

বিরোধী জোটে কংগ্রেসকে নিয়ে আপত্তি না থাকলেও রাহুলকে নিয়ে তৃণমূলের ‘অ্যালার্জি’ আগেও রাজনৈতিক মহলের নজরে এসেছে। এ বার সুদীপের ওই মন্তব্যে দলের তরফে কার্যত সিলমোহর দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাহুল গাঁধীকে মানুষ মোদীর বিকল্প হিসেবে দেখছে না। বারবার নির্বাচনী ব্যর্থতায় সুযোগ এবং সময় নষ্ট করা যাবে না। রাহুল সুযোগ পেয়েছেন। পারেননি।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জোটের বিকল্প হিসেবে জবরদস্ত বিশ্বাসযোগ্য মুখ সামনে রেখে প্রচারে যেতে হবে। আর তা হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’
— আনন্দবাজার পত্রিকা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১

সকালের কাগজে যাঁরা এই খবর পড়েছেন, তাঁরা অনেকেই যে প্রবীণ তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে একমত হবেন তা বলাই বাহুল্য। রাজীব-সোনিয়ার পুত্র রাহুল গান্ধী সত্যিই এমন একটা নির্বাচনও কংগ্রেসকে জেতাতে পারেননি, যা থেকে তাঁর সারা দেশের নেতা হওয়ার মত বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হতে পারে। উপরন্তু বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্কটের জন্য অনেকেই তাঁকে দায়ী করেছেন। রাজস্থানে অশোক গেহলত বনাম শচীন পাইলট লড়াইয়ে তিনি নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারেননি — এমন অভিযোগ আছে। মধ্যপ্রদেশে এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাধবরাও সিন্ধিয়ার পুত্র জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার দলত্যাগের পিছনেও রাহুল-প্রিয়াঙ্কার সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ ওঠে। বিহারের নির্বাচনে কংগ্রেস একগাদা আসন নিয়েও জোটকে ডুবিয়েছে, তা না হলে নীতীশ কুমারের প্রস্থান অনিবার্য ছিল। উত্তরপ্রদেশে এখনো কংগ্রেসের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। গান্ধী পরিবারের লোক হওয়া ছাড়া রাহুলের নেতাসুলভ কোনো গুণ খুঁজে পাওয়া এখনো মুশকিল। অন্য দিকে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একা হাতে পশ্চিমবঙ্গকে কমিউনিস্টশূন্য করেছেন, প্রবল প্রতাপান্বিত মোদী-অমিত শাহ জুটিকে রুখে দিয়েছেন। বিজেপি-বিরোধী জোটের নেতৃত্বে তিনিই যে সবচেয়ে “জবরদস্ত বিশ্বাসযোগ্য মুখ”, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী-ই বা হতে পারে? কেবল একটাই খটকা। ২০২৪ সালের জানুয়ারির আগে যে নির্বাচন শুরু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প মুখ ঘোষণা করার ব্যগ্রতা কেন?

এই খটকা না কাটতেই, বিকেল না গড়াতেই, এসে পড়েছে আরেকটি খবর। বাবুল সুপ্রিয় যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী (তাঁরই দলীয় মুখপত্র যা লিখেছে বলে খবরে প্রকাশ, তাতে এই তকমা দিলে নিশ্চয়ই দোষ হবে না) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র, মমতা প্রধানমন্ত্রী হলে যিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতেই পারেন, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং বাবুলকে পার্টিতে স্বাগত জানিয়েছেন।

এই দুটো খবর কয়েকদিন বা কয়েক মাসের ব্যবধানে এলে হয়ত এতটা খটকা লাগত না; দলবদল বাংলার রাজনীতিতে অভিনবত্ব হারিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। কিন্তু কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এসে পৌঁছনোয় কিঞ্চিৎ মুশকিল হয়েছে। কয়েকটি প্রশ্ন অনিবার্য বলে মনে হচ্ছে।

প্রথমত, গান্ধী পরিবারকে বাদ দিয়ে যে আজও কংগ্রেস হয় না, তা ভারতীয় রাজনীতির সাথে যে কোনো ভূমিকায় যুক্ত সকলেই জানেন। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তো জানেন বটেই। এ কথা ঠিক যে গত দশকেই টানা দশ বছর কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রে এমন একটি সরকার চলেছে যার নেতৃত্বে ছিলেন ওই পরিবারের বাইরের একজন। কিন্তু সে নিতান্ত ঠেকায় পড়ে। উপরন্তু সেই সরকারের কার্যকলাপে রাশ টানতে একটি পরামর্শদাতা সমিতি ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সোনিয়া গান্ধী। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বহু বিধানসভা এবং দুটি লোকসভা নির্বাচন হয়ে গেছে। কংগ্রেসের উপর্যুপরি ব্যর্থতা সত্ত্বেও দলের সর্বোচ্চ পদে সোনিয়া আর রাহুলের বদলে কেউ আসীন হননি। রাহুল নিজে থেকে পদ ছেড়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ সে পদে আসীন হতে চাননি। শশী থারুর, কপিল সিবাল, আনন্দ শর্মারা মধ্যে মধ্যে ঝড় তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাউল বাতাস সাতমহলা গান্ধীপুরীর হাজার বাতি নিভিয়ে দেওয়ার আগেই দিল্লির ট্র্যাফিকে হারিয়ে যায়। অতএব ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পরেও কংগ্রেস সাংসদদের গতিবিধি যে রাহুল গান্ধীই ঠিক করবেন, তা সুদীপ ও মমতা, দুজনেই বিলক্ষণ জানেন। তাহলে এত আগে থেকে প্রকাশ্যে রাহুলকে অনুপযুক্ত নেতা হিসাবে দেগে দিলেন কেন? রাহুলকে চটিয়ে কী লাভ?

দ্বিতীয়ত, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ যখন সাম্প্রদায়িকতা নিয়েই শানানো হয়, তখন মন্ত্রী পদের অপব্যবহার করে আসানসোল দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ আছে, মুসলমান বিদ্বেষ নিয়ে রাখঢাক করেন না — এমন একজনকে কেন নীল-সাদা কার্পেট পেতে দিল মুখ্যমন্ত্রীর দল?

প্রশ্নগুলো কারো কারো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। সাহেবরা বলে থাকে, সাফল্যের মত সফল আর কিছু নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন চূড়ান্ত সফল। এ রাজ্যের রাজনীতিতে তিনি এখন উসেন বোল্ট, অর্থাৎ দৌড়তে দৌড়তে এক-আধবার পিছনে তাকালেও হাত দুয়েক ব্যবধানে জিতবেন। অতএব তাঁর পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভাবার, সমালোচনা করার কোনো মানেই হয় না — এমনটা অনুরাগীরা বলতেই পারেন। কিন্তু ইতিহাসে যেমন বোল্ট আছেন, তেমন মিলখা সিংও আছেন। শোনা যায় রোম অলিম্পিকে তাঁর অবধারিত সোনা হাতছাড়া হয়েছিল অনেক এগিয়ে আছেন ভেবে গতি কমাতে গিয়ে। তাছাড়া স্লোগান হিসাবে যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, মমতাও জানেন, রাজনীতি খেলা নয়। অতএব ভেবে পা ফেলা এবং যে পা-টা ফেললাম, সেটারও পর্যালোচনা করা উচিত। সুতরাং প্রশ্নগুলো উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না।

বাংলা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট রাজ্যগুলো, তামিলনাড়ু, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ বাদ দিলে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মুখ্য প্রতিপক্ষ হিসাবে থাকবে কংগ্রেস অথবা কংগ্রেসের উপস্থিতি আছে এমন জোট। কংগ্রেস একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়, এমন লোকসভা আসনের সংখ্যা কিছুতেই শ দেড়েকের বেশি নয়। এর সাথে আছে কেরালার মত রাজ্য, যেখানে কংগ্রেস ভাল ফল করতে পারে, কিন্তু বিজেপিই অপ্রাসঙ্গিক। ফলে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বা কংগ্রেসের উপস্থিতি আছে এমন জোটকে ভাল ফল করতেই হবে। তৃণমূল কংগ্রেসের অতি বড় সমর্থকও নিশ্চয়ই এতটা স্বপ্নের জগতে বাস করেন না, যে মনে করবেন ২০২৪ সালের মধ্যে তৃণমূল প্রথমে ত্রিপুরা, তারপর গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। তারপর বাড়তে বাড়তে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত হাত চিহ্নের সমান বা তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে জোড়াফুল? যদি উদার চিত্তে ধরে নেওয়া যায় লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৪২-এ ৪২ পাবেন মমতা, ত্রিপুরার দুটো আসনেই জিতবেন, আসামের বাঙালিরাও তাঁকেই জয়যুক্ত করবেন, তাহলেও পঞ্চাশ পেরনো যাবে বড়জোর। বিজেপির ভারত জুড়ে বিপুল বিপর্যয় হলেও সরকার গড়তে কংগ্রেসের সমর্থন প্রয়োজন হবেই। নেতা হওয়ার অযোগ্য রাহুল গান্ধী তখন আজকের কথা মনে রেখে দিলে কী হবে? নাকি তাঁর কাছে সমর্থন চাওয়াই হবে না? ফ্যাসিবাদী সরকারের অপসারণ, নাকি মমতার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার? মূল লক্ষ্য কোনটি? হয় আমাদের সরকার হোক, নইলে যে যা পারে করুক, কিছু এসে যায় না — প্রকৃত এজেন্ডা এমন নয় তো?

বাবুলের তৃণমূলে যোগদানে এমন সন্দেহ প্রবল হয়। তার কারণ বাবুল আর যা-ই হোন, মুকুল নন। মুকুল রায়ের রাজনৈতিক দীক্ষা সঙ্ঘ পরিবারে নয়। তিনি বড়জোর রাজনৈতিক সুবিধাবাদী। বৃহত্তর ক্ষমতার স্বাদ পেতে কিম্বা ফৌজদারি অভিযোগের হাত থেকে বাঁচতে বিজেপিতে গিয়েছিলেন, সুযোগ বুঝে ফিরে এসেছেন। বাবুল কিন্তু কখনো তৃণমূলে ছিলেন না। অর্থাৎ এ প্রত্যাবর্তন নয়, পরিবর্তন। মুকুলের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ নেই। ভারতের রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রভাব ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে যত বেড়েছে, তত ভারতের উদারপন্থীদের কাছে কোনো দল বা নেতার গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হয়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িকতা। দ্বিতীয় ইউপিএ-র আমলে একের পর এক দুর্নীতি যখন প্রকাশ্যে আসছে, নির্ভয়া কান্ডে মানুষ ক্রমশ ধৈর্যহীন হয়ে পড়ছেন, তখন কংগ্রেসের পক্ষে শেষ যুক্তি হিসাবে খাড়া করা হত অসাম্প্রদায়িকতাকে। এই যুক্তি ২০১৪ সালের পর থেকে ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রায় সব রাজ্যে, কারণ বিজেপি-বিরোধী দলগুলির পাহাড়প্রমাণ ত্রুটি ঢাকা দেওয়ার উপায় নেই। অগত্যা বিজেপি-বিরোধী মানুষ ভেবে নিয়েছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত হোক, সাম্প্রদায়িক না হলেই হল। পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলও অনেকাংশে এই ভাবনার প্রতিফলন। বাবুল কিন্তু এই সামান্য পরীক্ষাতেও ফেল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অগ্রণী সৈনিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যদি বাবুলও গ্রহণযোগ্য হন, তাহলে মনে করা অনুচিত হবে না, যে নেত্রীর লড়াই আসলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নয়, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও নয়, স্রেফ বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে। যদি লোকসভা ত্রিশঙ্কু হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অবস্থায় না থাকেন, তখন আর কে সরকার গড়ল, না গড়ল — তা নিয়ে তাঁর আগ্রহ থাকবে না। তখন তাঁর কাছে রাহুল গান্ধীও যা, নরেন্দ্র মোদীও তাই।

ভারতে যাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সত্যিই লড়ছেন, আর যাঁরা লড়ছেন বলে ভাবছেন, সকলেই নির্দ্বিধায় বলে থাকেন — আসল শত্রু হল আর এস এস। আসলে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আর এস এসের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন, তাঁদের অন্যতম হলেন রাহুল গান্ধী। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করা হয়েছিল। বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরে গিয়ে তিনি যে নরম হিন্দুত্ব চালান, তা কংগ্রেসী ঘরানার পুরনো রাজনীতি। কিন্তু জওহরলাল নেহরুর পরে সম্ভবত আর কোনো কংগ্রেস নেতা এত সরাসরি আর এস এস-কে আক্রমণ করতেন না। এ হেন রাহুলকে সাত তাড়াতাড়ি নেতৃত্ব দিতে পারেন না বলে দেগে দেওয়া এবং স্পষ্টত সংখ্যালঘুবিদ্বেষী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিরোধী বাবুল সুপ্রিয়কে পার্টিতে জায়গা দেওয়া — এগুলো কি ধর্মনিরপেক্ষ জোটের নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করল? তাঁকে ভাবতে হবে। কারণ তিনি যাদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হবেন ভাবছেন, তারা ভাবতে পারে।

https://nagorik.net এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

নেমে আসুন ভোটারের সমতলে

ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না।

কিছুদিন পরে পরেই, বিশেষ করে কোন নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে, বিজেপি-বিরোধী মানুষজন সমাজ মাধ্যমে, একান্ত আলাপচারিতায় এবং লিখিত রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বিস্ময় প্রকাশ করেন “এত কিছুর পরেও লোকে ওদের সমর্থন করছে!” বা “এত কিছুর পরেও বিজেপি জিতে গেল!” এত কিছু, অর্থাৎ অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া; সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর পরিকল্পিত, রাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট হিংসা; আইনশৃঙ্খলার অবনতি; গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষের চরম আর্থিক দুর্দশার পাশাপাশি অতি ধনীদের আরো ফুলে ফেঁপে ওঠা; দুর্বার গতিতে একের পরে এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি হওয়া; দুর্নীতির বৈধতা পেয়ে যাওয়া; সাংবিধানিক অধিকারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। ২০২০-তে এর সাথে যোগ হল কোরোনাভাইরাসকে প্রথমে সরকারের পাত্তা না দেওয়া, পরে আচমকা লকডাউন, তার ফলে গরীব দিন আনি দিন খাই মানুষের অবর্ণনীয় জীবনযাপন ও মৃত্যু। তার সাথে যোগ হল চিকিৎসার অব্যবস্থা সম্বন্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থালা বাজানো, মোমবাতি জ্বালানোর মত গিমিক। কম পরীক্ষা করে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলেও অনেকের অভিযোগ।

এত কিছুর পরেও বিজেপি নির্বাচনে জেতে। অন্তত উড়ে যায় না। কেন হয় এরকম? দেখা যায় বিজেপির বিরুদ্ধে যাঁরা — রাজনৈতিক দল, চিন্তাবিদ, সাধারণ মানুষ — তাঁরা সকলেই এর কতকগুলো সাধারণ কারণ খুঁজে পান। সেগুলো মোটামুটি এরকম — ১) সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ, ২) বিজেপির অসম আর্থিক প্রতিপত্তি, ৩) বিজেপি আই টি সেলের প্রোপাগান্ডার তীব্রতা এবং ৪) নির্বাচন কমিশনের গান্ধারীবৃত্তি। কেউ কেউ মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের বৃহদংশের নির্লজ্জ চাটুকারিতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করাকেও সঙ্গে যোগ করেন।

সব সত্যি। কিন্তু কবির ভাষায় বললে “সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।”

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এন ডি এ সরকারের কর্মতৎপরতার যে তালিকা সকলের সামনে রয়েছে, তাতে গত কয়েক মাসে যোগ হয়েছে নতুন কৃষি আইন। এই আইন পাশ করা হয়েছে অভূতপূর্ব অগণতান্ত্রিক উপায়ে এবং এর বলে ভারতীয় কৃষকদের একেবারে কর্পোরেট গোলামে পরিণত করা যাবে। গরীব, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের ভাত ডাল আলুসেদ্ধটুকুর নিশ্চয়তাও উধাও হবে। এর পরেও কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তায় ধস নামতে দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকের আশঙ্কা। ফলে যাঁরা দক্ষিণপন্থার ঘোষিত বিরোধী — রাজনৈতিক দলের সদস্য বা পার্টি আনুগত্যহীন ব্যক্তি — যা-ই হোন না কেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিস্ময় ক্রমবর্ধমান। এমনকি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরাও বলে থাকেন “এত কিছুর পরেও…!” ফলত হতাশা। আর সেই হতাশার কারণে নির্বাচনের ফল বেরোবার পর বিজেপি-বিরোধীরা কিছু ভয়াবহ দক্ষিণপন্থী আচরণ শুরু করেন। যেমন অনেকে বলতে শুরু করেন “মুসলমানগুলো কেন অমুক পার্টিকে ভোট না দিয়ে তমুক পার্টিকে ভোট দিল?” কেউ আবার সমস্ত দোষ ইভিএমের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন (যদিও মনে করার কারণ নেই যে ইভিএম সম্পূর্ণ নির্দোষ)। এই আচরণ সাধারণ সমর্থক থেকে উচ্চস্তরের পার্টি নেতা পর্যন্ত সকলকেই করতে দেখা যায়। এই বিশ্লেষণে “সবাই বিজেপি হয়ে গেছে” — এই বিশ্বাস ক্রমশ ঘাড়ে চেপে বসে, বিজেপির লাভ হয়। কিন্তু এই বিশ্লেষণ একমাত্রিক। বিরোধী বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা ভেবে দেখবেন, নির্বাচনে (বিশেষ করে বিধানসভায়) যে মাইক্রো ইস্যুগুলো কাজ করে, সেগুলোকে এই বিশ্লেষণে অগ্রাহ্য করা হয়। সে কারণেই বিজেপিকে আটকানোর উদ্দেশ্যে বলা হয় “আর যাকে ইচ্ছা ভোট দিন, বিজেপিকে দেবেন না।”

একথা যাঁরা বলেন, বা বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের রামধনু জোটের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা সকলেই ন্যূনতম লেখাপড়া জানেন। শ্রেণীর দিক থেকে মধ্যবিত্ত বা তদূর্দ্ধ। প্রায় সকলেরই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে; নিদেন পক্ষে রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান এবং স্পষ্ট মতামত আছে। এঁরা জানেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতবাদ ও কার্যকলাপ কতটা ভয়ঙ্কর। ফলে তাঁদের কাছে সব নির্বাচনই হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে ভারতীয়ত্বের লড়াই। বিজেপি যেমন বাইনারি তৈরি করেছে সারা দেশে — দেশদ্রোহী আর দেশপ্রেমিক — অনেকটা একই আদলের আরেকটা বাইনারি এঁদের মনেও তৈরি হয়ে রয়েছে। ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি যে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না, দেওয়া সম্ভব নয় — একথা বুঝতে সারা দেশের বিজেপি-বিরোধীদের কেবলই ভুল হয়ে যাচ্ছে। এ ভুল না করলে কত দূর লড়া যায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিহারের নির্বাচনে।

কোন সন্দেহ নেই, যদি দেশের সর্বত্র সবকটা নির্বাচন ভারত ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে কি থাকবে না, গণতান্ত্রিক থাকবে নাকি একদলীয় একনায়কতন্ত্র হয়ে যাবে — কেবল এই ইস্যুতে লড়া যেত, তবে চমৎকার হত। দুঃখের বিষয়, তা সম্ভব নয়। তেমন দেশ তৈরি করার জন্য আমরা সঙ্ঘবিরোধীরা ৬৭ বছর (১৯৪৭-২০১৪) সময় পেয়েছিলাম। পারিনি। এখন রাতারাতি ভারতেরে সেই স্বর্গে জাগরিত করতে চেয়ে অ্যালার্ম ঘড়ি বাজিয়ে দিলেই রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে না। আপনি জানেন হিটলার কে, নাজি কারা, ফ্যাসিবাদ কী ক্ষতি করে। আপনার বাড়ির কাজের মেয়ে জানে না। এখন যদি ন্যুরেমবার্গ ল-এর সাথে সাদৃশ্য আছে বলে মোদী সরকারের পাশ করা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করতে বলেন, সাবধান করেন “আর যাকে ইচ্ছে ভোট দাও, বিজেপিকে দিও না”, তার বয়ে গেছে আপনার কথা শুনতে। কেবল গ্রামের গরীব মানুষ, শহরের বস্তিবাসী বা কাজের মেয়ের কথাই বা কেন? নিজেদের লেখাপড়া জানা আত্মীয়স্বজনদেরই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, ফ্যাসিবাদ কী কজন জানে? যে চেতনা তৈরিই হয়নি, সে চেতনার কাছে আবেদন করে কোন সাড়া পাওয়ার আশা করা কি উচিৎ?

সত্যি কথা বলতে, পৃথিবীর কোথাও কোন নির্বাচনই সম্পূর্ণত মতাদর্শের লড়াই হয় না। হওয়া উচিৎ কিনা তা-ও ভেবে দেখা দরকার। ধরা যাক, একটা দেশের সরকার রাস্তাঘাট সারায়নি পাঁচ বছর ধরে, রোজ দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ তারা দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি মাসে সংবর্ধনা দেয়। এই দলের কি ভোট পাওয়া উচিৎ? গণতন্ত্রে নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকারই শিরোধার্য, রাজনৈতিক দলের ভোট পাওয়ার অধিকার নয়। ভোটার ঠিক করবেন তিনি কোন কোন ইস্যুর ভিত্তিতে ভোট দেবেন। রাজনৈতিক শক্তিগুলো, সে কোন দল হোক বা ব্যক্তি, ভোটারের মত পাওয়ার জন্য অন্যদের চেয়ে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। “আমরা বিজেপি নই, অতএব আপনার ভোট পাওয়া আমাদের অধিকার” — কোন দল এমন বলতে পারে না। বললে সেটাই অগণতান্ত্রিক। যদি কেউ বলে “অমুক দল বিজেপি নয়, অতএব ওকে ভোট দেওয়া আপনার কর্তব্য”, তাহলে তা-ও অগণতান্ত্রিক। কারণ রাজনৈতিক দলের কর্তব্য ভোটারের চোখে নিজেকে অন্যদের চেয়ে উন্নত (অন্তত স্বতন্ত্র) হিসাবে প্রমাণ করা। তা করতে না পারলে, বিজেপির চেয়ে ভাল কোন বিকল্প দিতে না পারলে, ভোটার কেন ভোট দিতে যাবেন?

দেশের অধিকাংশ নির্বাচনেই কিন্তু বিজেপি-বিরোধীরা বিকল্পহীন হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন। ভোটারের সামনে বিজেপির অন্যায়গুলোর তালিকা প্রস্তুত করছেন কেবল। নিজেরা তার বদলে কী কী সদর্থক কাজ করবেন, তা বলছেন না। অনেক ক্ষেত্রে আবার বিজেপির রাজনীতিই অনুসরণ করে নির্বাচনে লড়ছেন। মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে যেমন কংগ্রেস গোশালা বানিয়ে দেওয়া, রাম পথ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতেছিল। সরকারটা স্বভাবতই বেশিদিন টেকেনি। আমরা যারা ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তারা কংগ্রেসের সেই জয়ে উল্লসিত (অন্তত আশ্বস্ত) হয়েছিলাম। গণ্ডগোলটা ওখানেই। বিজেপির নীতি কংগ্রেস নিলে যদি আমাদের আপত্তি না থাকে, কার্টুনিস্টকে তামিলনাড়ু সরকার গ্রেপ্তার করলে যদি আমরা হট্টগোল না করি, আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের উপর তৃণমূল কংগ্রেস সরকার জলকামান চালালেও যদি আমরা চুপ করে থাকি এবং বলি ওরা বিজেপি নয়, তাই ভোট ওদেরই প্রাপ্য, তাহলে বিজেপির হাতই শক্ত হয়। কথাটা আরো বেশি করে সত্যি পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে, যেখানে বিজেপি কখনো ক্ষমতায় আসেনি। জলকামানে ভিজে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলো বা তাদের পরিবার ফ্যাসিবাদ দ্যাখেনি, জলকামান দেখেছে। ত্রিপুরা রাজ্যের চাকরি চলে যাওয়ায় আত্মঘাতী শিক্ষক উত্তম ত্রিপুরার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তাদের বিজেপিকে ভোট দেওয়া থেকে নিরস্ত করা কি সম্ভব তখন আর?

এ রাজ্যে এখন পর্যন্ত লড়াইটা বিজেপির ইউটোপিয়া বনাম বিরোধীদের ইউটোপিয়া। বিজেপি সোনার বাংলার কথা বলছে। সে বাংলায় কর্মসংস্থান কী করে হবে বলছে না। আলটপকা ৭৫ লক্ষ চাকরির কথা বলেই ঢোঁক গিলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের সমস্যা জানতে এবং মেটাতে সরকারকে দুয়ারে দুয়ারে নিয়ে গেছে, অথচ কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে মুখে কুলুপ। বহুকাল ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে নিয়োগ নিয়ে চলতে থাকা অচলাবস্থার কোন স্থায়ী সমাধানের কথা সরকার বলছে না। কেবল এক প্রস্থ নিয়োগের ঘোষণা হয়েছে। তৃণমূল বরং বিজেপির ইউটোপিয়ার বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে এমন এক বাংলার ইউটোপিয়া, যার ইতিহাসে কেবল রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, নজরুল, লালন, ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদনরা আছেন। একে ইউটোপিয়া বলছি, কারণ বাংলায় এঁদের পাশাপাশি তারাও ছিল যারা রামমোহনের বিরোধিতা করেছিল, বিদ্যাসাগরকে খুনের চেষ্টা করেছিল, নজরুল সম্বন্ধে বলত “ফার্সি শব্দে কবিতা লেখে! সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।” ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল বাঙালিরাই। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির কথা তো সকলেই জানে। এই ইউটোপিয়ার লড়াইয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করা শক্ত। এমনিতেও এই ইউটোপিয়াগুলো অধিকাংশ মানুষকে ছুঁতে পারছে না।

তৃতীয় পক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট এসবের বাইরে গিয়ে বলবেন কি, কী হবে রাজ্যের ধুঁকতে থাকা স্কুলশিক্ষার? স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা কি আবার স্বমহিমায় ফেরত আসবে তাঁরা ক্ষমতায় এলে? রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের পাওনাগন্ডারই বা কী হবে? সারা দেশের কৃষকদের সাথে এদেশের কৃষকরাও তো স্বখাতসলিলে ডুবছেন। তাঁদের জন্যই বা কী পরিকল্পনা? শিল্পায়ন নিয়ে কী চিন্তা ভাবনা তাঁদের? ওটা না হলে গরীব মানুষের কর্মসংস্থানের কী হবে? কেন্দ্র যেভাবে রাজ্যের প্রায় সব ক্ষমতাই কেড়ে নিচ্ছে, সরকারে এলে কিভাবে লড়বেন তার বিরুদ্ধে?

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সর্বত্রই বিজেপি বিরোধীদের বিকল্প কর্মসূচী হাজির করতে হবে, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সরকারের অন্যায় তুলে ধরা, সমালোচনা করা বিরোধীদের একটা কাজ। একমাত্র কাজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ নিরাশ হয়ে পড়তে পারেন। বিরোধী রাজনীতি কিন্তু নৈরাশ্যবাদের জ্বালানিতে চলে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। ভোটারের চারপাশের বাস্তব পরিস্থিতি, তার কাছে জরুরী ইস্যুগুলো কী, সেসব না ভেবে যদি লাল, সবুজ, ধূসর সব রং মিলে গিয়ে এমন একটা ইস্যুতে লড়াই করে — যা অধিকাংশ ভোটারের কাছে কোন ইস্যুই নয়, তাহলে দক্ষিণপন্থা জিতেই চলবে। আমি ইউটোপিয়ায় প্রাণপণে যা-ই চাই না কেন।

প্রতিবাদ সংবাদে বাদ?

অনুপ্রেরণা ছাড়া এ রাজ্যে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করাও মানা

গত ২৭শে নভেম্বর পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা তিনটে কৃষি বিল বাতিলের দাবীতে এবং প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ বিলের বিরুদ্ধে দিল্লী অভিযান শুরু করেন। ইতিমধ্যে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশের মত রাজ্যগুলোর কৃষকরাও পথে নেমে পড়েছেন। মহারাষ্ট্রের কৃষকরা নামবেন বলে ঘোষণা করেছেন। কাউকে কেয়ার না করা মোদী সরকার বুঝেছে ঠ্যালার নাম বাবাজি। এ রীতিমত কৃষক বিদ্রোহ। তাই গায়ের জোর ভুলে অমিত শাহ ও সম্প্রদায় হঠাৎ আলোচনার জোরে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। চিড়ে কিন্তু ভিজছে না। একগুঁয়ে চাষাদের এক কথা — সংসদ ডাকো, আইন বাতিল করো। সারা দেশের বাম, মধ্য, দক্ষিণ — যে কোন পন্থার মানুষের কাছেই এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় কোন ঘটনা নেই, কোন ইস্যু নেই, থাকার কথাও নয়।

অথচ বাংলা মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে কিন্তু সেটা বোঝার উপায় নেই। গতকালই পি সাইনাথ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এই কৃষক বিদ্রোহ এক দিনে তৈরি হয়নি। গত কয়েক বছরে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশের কিষাণ লং মার্চের ধারাবাহিকতায় এই আন্দোলন এসেছে। সেই আন্দোলনগুলো যেমন বাংলার সর্বাধিক টি আর পি প্রাপ্ত দুটো খবরের চ্যানেলে প্রাধান্য পায়নি, এই আন্দোলনও পাচ্ছে না।

২৬শে নভেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ছিল। সেই ধর্মঘটকেও সমর্থন জানিয়েছিল কৃষক সংগঠনগুলো। সেদিন বহু জায়গায় ট্রেন চলেনি, বাস চলেনি, দোকানপাট বন্ধ ছিল। অথচ সেদিন দুপুরেও কূপমন্ডুক বাংলা চ্যানেলের প্রধান খবর ছিল মাঝেরহাট ব্রিজ খোলার দাবিতে বিজেপির দাপাদাপি। যে ব্রিজ আজ বিকেলে উদ্বোধন হওয়ার কথা আগেই ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল।

বাংলা খবরের কাগজগুলোতেও গত কয়েক দিন ধরে কৃষক বিদ্রোহ নয়, বেশি জায়গা অধিকার করে থাকছে শুভেন্দু অধিকারীর ধাষ্টামো বা মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর ভোটমুখী প্রকল্প ঘোষণা। গত দু-তিন দিনে তবু কৃষক বিদ্রোহের খবর বা ছবি বাড়ির কাগজটার প্রথম পাতায় ভাল করে দেখতে পাচ্ছি, তার আগে এ কোণে এক কলম বা ও কোণে দু কলমেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছিল। সে অবশ্য চব্বিশ ঘন্টার আনন্দময় চ্যানেলগুলোর তুলনায় মন্দের ভাল। কারণ ওগুলোতে খবর বলতে সারাদিন যা পাওয়া যায়, তা হল — অমুক জায়গায় তৃণমূলের লেখা দেওয়াল মুছে দিল বিজেপি। তমুক জায়গায় বিজেপির পার্টি অফিসে তৃণমূলের ভাঙচুর। বিজেপি নেতার মাচার লাউ কেটে নেওয়ার অভিযোগ তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতার অভিযোগ করলেন বিজেপি সদস্য — এইরকম আর কি।

অর্থাৎ যে খবরগুলো আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও নেহাত দেখানোর বা ছাপার মত কিছু না থাকলে জায়গা ভরাতে ব্রিফ হিসাবে ব্যবহার করা হত — সেগুলোই বাঙালিকে দিনরাত পড়ানো এবং দেখানো হচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেই হাস্যকর নয়। আসলে দিল্লী ভিত্তিক হিন্দ্রেজি সংবাদমাধ্যম যেমন দেশের আসল সমস্যাগুলোকে আড়াল করতে পাকিস্তানকে কেমন দিলাম, লাভ জিহাদ, সিভিল সার্ভিস জিহাদ ইত্যাদি আবর্জনা পরিবেশন করে, বাংলার সংবাদমাধ্যমও কৃষক বিদ্রোহ, শ্রমিকদের আন্দোলনকে আড়াল করতে আবর্জনা পরিবেশন করছে। হিন্দ্রেজি সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর থেকে মস্তিষ্কে বিষক্রিয়া হয়, বাংলার আবর্জনা কেবল দুর্গন্ধ ছড়ায় — তফাত এটুকুই।

কিন্তু কেন এমন করা হচ্ছে? কৃষক আন্দোলনকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিলে কী ক্ষতি? পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরা কি টিভি দ্যাখেন না, নাকি কৃষি আইন, শ্রম কোডের প্রভাব এ রাজ্যের শ্রমিক, কৃষকদের উপর পড়বে না?

আসলে প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও, যারা জানার তারা জানে, হিন্দ্রেজি সংবাদমাধ্যমের অধিকাংশ যেমন একচোখা, এ রাজ্যের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমও তাই। তাদের অনেকেই ফ্যাসিবিরোধী, কিন্তু কোনটাকে ফ্যাসিবাদ বলা হবে, তার কতটা বিরোধিতা করা হবে, আদৌ করা হবে কিনা — সেসব তারা ঠিক করে না। অনুপ্রেরণা ছাড়া এ রাজ্যে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করাও মানা।

অতএব শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি খুঁজছে যারা, তাদের আন্দোলনের কথা জানতে হলে আপনাকে ফেসবুকই খুলতে হবে। টিভির স্থানীয় সংবাদ লাউমাচা পুঁইমাচা নিয়েই চলবে। কৃষক বিদ্রোহের খবর জানতে চাইলেও হাতে গোনা হিন্দ্রেজি সংবাদমাধ্যম অথবা খবরের সাইটের শরণাপন্ন হতে হবে। টিভি আর কাগজ জুড়ে দলবদলের হট্টগোলই চলবে।

ছবিটা অবশ্য কাল থেকে বদলে যাবে বলে আশা করছি। কারণ আজ দিদি ঘোষণা করেছেন তিনি কৃষকদের পাশে আছেন, ঐ আইনগুলো খুব খারাপ, অবিলম্বে বাতিল করা উচিৎ এবং এই দাবিতে তাঁর দল কোমর বেঁধে আন্দোলনে নামছে। আশা করি এবার আর বাংলা সংবাদমাধ্যমের অনুপ্রেরণার অভাব হবে না।

উল্টো রাজা উল্টো বুঝলি প্রজার দেশে

আমাদের সংবিধান যে নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মত একটা জিনিস সে সিদ্ধান্ত এ দেশে হয়েই গেছে

যে যা-ই বলুক, চোখ কান খোলা রাখলে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ মোটেই কোরোনা সামলাতে যা করা উচিৎ তা করছে না। বেশি কড়া কথা বলা হয়ে যাচ্ছে মনে হলে একটু নরম করে বলা যেতেই পারে করতে পারছে না। তা বলে কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে জেলায় কী হচ্ছে সে সম্বন্ধে ভাষণ দেবে আর খবরদারি করতে কেন্দ্রীয় দল পাঠাবে — তাও সমর্থনযোগ্য নয়।

লক্ষণীয়, গত দুদিনে কেন্দ্রীয় সরকার কতকগুলো জায়গা সম্বন্ধে আলাদা করে বলেছে সেখানে উদ্বেগজনক অবস্থা। প্রত্যেকটা জায়গাই অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে — কলকাতা, মুম্বাই, জয়পুর, ইন্দোর। কলকাতার (এবং হাওড়ার) অবস্থা আমরা আশেপাশের লোকেরা জানি, তাই বাদ দিন। কিন্তু বাকিগুলো ভাবুন।

শুরু থেকেই দেশে সবচেয়ে বেশি টেস্ট করছে কেরালা আর মহারাষ্ট্র। স্বভাবতই ও দুটো রাজ্যে কোরোনা আক্রান্ত রোগীও বেশি পাওয়া যাচ্ছে৷ মুম্বাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী। জয়পুর রাজস্থানে। যে রাজ্যের ভিলওয়ারাকে কদিন আগে মডেল বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই। সেখানে কোরোনা রোগীর সংখ্যাও কিছু অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ইন্দোর মধ্যপ্রদেশে। সে এমন এক রাজ্য যেখানে এখন অব্দি আস্ত ক্যাবিনেট নেই, স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। কংগ্রেস সরকারকে সরিয়ে সবে বিজেপি সরকার শপথ নিয়েছে, তখনই লকডাউন শুরু হল। সেখানে মাঝে কয়েকদিন প্রচুর কোরোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছিল, হঠাৎই কমতে শুরু করেছে। ভোজবাজির মত।

এর পাশাপাশি যদি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর দিকে চোখ রাখা যায়, দেখা যাবে উত্তরপ্রদেশে ঠিক কী হচ্ছে আমরা জানি না। তবলিগি জামাতের জমায়েত নিয়ে দিনরাত এত দুশ্চিন্তা আমাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে ওখান থেকে কতজনের কোরোনা হয়েছে, অথচ লকডাউন শুরু হওয়ার পর রামনবমীর দিন অযোধ্যার অনুষ্ঠান থেকে কতজনের কোরোনা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান আমরা পাচ্ছি না। উত্তরপ্রদেশে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ীই কিন্তু সহস্রাধিক আক্রান্ত। তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চিন্তিত নন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো সর্বদা দেশী বিদেশী পর্যটকে ভরে থাকে, অথচ ওদিকে একেকটা রাজ্যে দুজন, পাঁচ জন, দশ জন করে আক্রান্ত। অর্থাৎ ঐ রাজ্যগুলো বাকিদের জন্য অনুকরণীয়। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার বাকিদের ওদের থেকে শিখতে বলছেন না কেন, তাও পরিষ্কার নয়। ফলত কিছু রাজ্যের জন্য এই দুশ্চিন্তাকে লর্ড ডালহৌসির করদ রাজ্যগুলোর প্রজাদের জন্য দুশ্চিন্তার বেশি কিছু ভাবা শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আসলে রাজ্য সরকার মানে যে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ অফিস নয়, তা বর্তমান সরকার মোটেই মানতে চান না।সংবিধানকে মারো গুলি। কেনই বা মারবেন না? আমাদের সংবিধান যে নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মত একটা জিনিস সে সিদ্ধান্ত এ দেশে হয়েই গেছে। পাড়ার “আমি কিন্তু বিজেপি নই” দাদা বা দিদির সাথে কথা বললেই বুঝতে পারবেন।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রভু ভাবার অভ্যেসটা যারাই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার চালিয়েছে তাদেরই বিলক্ষণ ছিল। রাজ্যপালকে দিয়ে দিনরাত বিরোধী দলের রাজ্য সরকারের পিছনে লাগা, সরকার ভেঙে দেওয়া, কাজে বাধা সৃষ্টি — সবই শুরু হয়েছে সেই বাজপেয়ীর দুর্গা ইন্দিরার আমলে। বরাবর কেন্দ্রের দাদাগিরি নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন বামপন্থীরা। তাঁরা রাজ্যগুলোকে আরো ক্ষমতা দিতে এমনকি সংবিধান সংশোধন চাইতেন, ৩৫৬ ধারার বিলোপ চাইতেন। এ সবের জন্য বাঙালির দৈনিক বেদ যারপরনাই গালাগাল দিয়েছে বামেদের। বলেছে এরা কাজ করতে চায় না বলে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে আঙুল তোলে।

একবার তো এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমকিই দিয়েছিলেন যে তাঁর দল লোকসভায় ৩.৫৬% ভোট পেয়েছে, তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ জারি করিয়ে দেবেন। নামটা গুগল করলে পেয়ে যাবেন। শেষ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তিনিই আবার বলেছিলেন পি এম টু ডি এম কাজ হওয়া উচিৎ, রাজ্য সরকারকে মানব না।

এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু কোন দুষ্কর্মই আগে অন্য লোক করেছে বলে বৈধ হয়ে যায় না। ফলত কেন্দ্রীয় সরকারের এই “চালুনি বলে ছুঁচ, তোর পিছে কেন ছ্যাঁদা” মার্কা তৎপরতাকে কোন যুক্তিতেই মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। “এই সময়ে রাজনীতি করবেন না” কথাটাও নেহাত খিল্লি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বরাবর দেখা যায় রাজনীতিকে ভাইরাসের মত পরিহার করতে বলে তারাই যারা ক্ষমতাশালী, কারণ রাজনীতি বন্ধ করতে পারলে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। কেন্দ্র, রাজ্য উভয় সরকারের ব্যবহারই তা প্রমাণ করে। রাজ্যের ব্যবহার নিয়ে না হয় আরেকদিন কথা হবে। পিঠটাও তো বাঁচাতে হবে।

সাত শতাংশের অধিকারে

তার চেয়েও বড় কথা “বুনিয়াদি লড়াইটা হল ভাতের লড়াই। বামপন্থীদের সেই লড়াই জারী রাখতে হবে” — এই জাতীয় যুক্তিতে সমকালের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া কি কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের উচিৎ?

যতই ক্ষমতাচ্যুত হোক, ক্ষমতাহীন হোক, বামপন্থীরা রাস্তায় নামলে ঢেউ উঠবে। আজও এর কোন ব্যতিক্রম পৃথিবীর কোথাও নেই। পার্টির নাম, সংগঠনের নাম যা-ই হোক। আর ন্যায্য দাবীতে রাস্তায় নামলে অকর্মণ্য শাসক মারবে, ধরবে, মাথা ফাটাবে — এরও কোন ব্যতিক্রম হয় না। ফলে গতকালের নবান্ন অভিযানে রাজপথে যেসব দৃশ্যের জন্ম হয়েছে সেগুলো অনভিপ্রেত হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। বুক চিতিয়ে পুলিশের সঙ্গে লড়ে গেলেন যে নূতন, সবুজ, কাঁচারা তাঁদেরও সাধুবাদ প্রাপ্য। ফেসবুক বিপ্লবের যুগে রাস্তাই যে একমাত্র রাস্তা সেকথা শিরোধার্য করে এইভাবে রক্তাক্ত হতে যাঁদের বাধে না তাঁদের কুর্নিশ না করে উপায় নেই। সমস্যা অন্যত্র।
কাল সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এস এফ আই আর যুব সংগঠন ডি ওয়াই এফ আই যে দাবীগুলোর ভিত্তিতে নবান্ন অভিযান করছিলেন — স্বল্প খরচে শিক্ষার দাবী এবং কাজের দাবী — সেগুলো যে ন্যায্য তা নিয়ে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের মনে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়, যদি না তিনি রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের অন্ধ সমর্থক হন বা মুখ্যমন্ত্রীকে দৈবী শক্তির অধিকারী, মানবিক ভুলচুকের অতীত বলে মনে করেন। কিন্তু রাজনীতি, বিশেষত বিরোধী রাজনীতি, শুধু দাবী সনদ পেশের ধারাবাহিকতার নাম নয়। উপরন্তু ছাত্র সংগঠনের বা যুব সংগঠনের কেবল তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থের কথাই বলা উচিৎ, বৃহত্তর রাজনীতি তাদের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিৎ নয় — এমনটা আর যে-ই ভাবুক, বামপন্থীরা নিশ্চয়ই ভাবেন না। সেদিক থেকে দেখলে প্রায় একইরকমের দাবী নিয়ে গত কয়েক বছরে কখনো সিপিএম দলের নবান্ন অভিযান, কখনো কৃষক সভার নবান্ন অভিযান, কখনো ছাত্র, যুব সংগঠনের নবান্ন অভিযান দেশের যে বর্তমান রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক সঙ্কট তার সাপেক্ষে কী অবস্থান নিচ্ছে? অভিযানগুলো বারবার নবান্নেই বা যাচ্ছে কেন?
শিক্ষা, স্বাস্থ্যকে পণ্য করে তোলার যে প্রক্রিয়া ১৯৯১ তে শুরু হয়েছিল, ২০১৪ থেকে বিজেপি শাসনে তা আরো প্রকাশ্য, আরো নির্লজ্জ। আম্বানিদের যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো চালুই হয়নি তাকে সেন্টার অফ এক্সেলেন্স তকমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অথচ টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের মত সরকারপোষিত প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের পুরো মাইনে দেওয়ার ক্ষমতা নাকি সরকারের নেই, ইসরোর গবেষকদের মাইনে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এ রাজ্যে কলেজে তোলাবাজি, হবু শিক্ষক, প্যারা টিচারদের পুলিশ দিয়ে পেটানো ইত্যাদি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের কোথাও শিক্ষাজগতের লোকেরা ভাল নেই। না ছাত্রছাত্রীরা, না গবেষক শিক্ষক শিক্ষিকারা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মৌলিক অধিকার বিপন্ন। তাহলে এসব নিয়ে সিপিএম বা তার গণসংঠনগুলোর সংসদ অভিযান হচ্ছে না কেন?
কাজের অধিকার সারা দেশে কিভাবে বিপন্ন তা তো আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক মাসে কয়েক হাজার মানুষের চাকরি গেছে, আরো বহু মানুষ আশঙ্কিত। যাদের চাকরি আছে তাঁরাও অনেকে মাইনে পাচ্ছেন না বি এস এন এল কর্মীদের মত। তা নিয়ে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলো (সিটু তো বটেই) আন্দোলনও করছে। অথচ দল হিসাবে এসব নিয়ে সিপিএমের রাস্তায় নেমে আন্দোলন সংসদ বা সাউথ ব্লকের দিকে যাচ্ছে না কেন? এস এফ আই বা ডি ওয়াই এফ আই এর অভিযানই বা দিল্লীমুখো নয় কেন? অন্য রাজ্যে সাংগঠনিক শক্তির অভাব আছে বলে দিল্লী আক্রমণ করছি না, একথা যদি কেউ বলেন, সেটাকে অজুহাত বলেই ধরতে হবে কারণ মহারাষ্ট্র, রাজস্থান বা হরিয়ানার মত যেসব রাজ্যে সিপিএমের সাংগঠনিক শক্তি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক কম, সেখানকার কৃষকদের পর্যন্ত সংগঠিত করে দিল্লী, মুম্বইয়ের বুকে সিপিএমের কৃষক সভার উদ্যোগে কিষাণ লং মার্চ সারা দেশ অল্প দিন আগেই দেখেছে। তাহলে?
তার চেয়েও বড় কথা “বুনিয়াদি লড়াইটা হল ভাতের লড়াই। বামপন্থীদের সেই লড়াই জারী রাখতে হবে” — এই জাতীয় যুক্তিতে সমকালের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া কি কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের উচিৎ? সারা দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিপদ হল হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্রের বিপদ। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র লুপ্ত হওয়ার বিপদ। সেই বিপদ কোন দিক থেকে এসেছে (এখনো আসছে ভাবার ভুল করবেন না) তা আমরা সবাই জানি। তার বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইকে কি সিপিএম কোন অদূর ভবিষ্যতের জন্যে স্থগিত রেখেছে? রাখতে পারে? রাজ্যের তৃণমূল সরকার তো ২০১১ থেকেই এখনকার মত চলছে। তা নিয়ে বারবার নবান্ন অভিযানে পার্টি সদস্য বা গণসংগঠনের সদস্যদের রক্ত ঝরছে অথচ মানুষের সমর্থন বাড়ার বদলে কমেই চলেছে। এর কারণ কী? আসলে কি মানুষের ইস্যু বুঝতেই ভুল হচ্ছে? নিজেদের পছন্দের ইস্যুকেই মানুষের ইস্যু বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে? নেতৃত্ব এগুলো ভাববেন না?
পশ্চিমবঙ্গের গরীব, বড়লোক, মধ্যবিত্ত সকলেই এই মুহূর্তে কোন ইস্যুটা নিয়ে উদ্বিগ্ন? বা নিদেন পক্ষে আগ্রহী? নিঃসন্দেহে এন আর সি। বিজেপি রোজ বলছে, বড় মেজ সেজ ছোট সব নেতা নেত্রী বলছেন বাংলায় এন আর সি হবেই। শুধু বাংলাই বা কেন? আসামে ডিটেনশন সেন্টার তৈরি হয়ে গেছে, অন্যত্রও হচ্ছে। তা নিয়ে সিপিএম নেতৃত্ব এখনো কিন্তু, যদি, তবে করছেন। কখনো শোনা যাচ্ছে আসামের বাইরে এন আর সি হলে ওঁরা বিরোধী, অর্থাৎ আসামে যা হয়েছে বেশ হয়েছে। কখনো বলছেন দেখতে হবে যেন সত্যিকারের নাগরিকরা বাদ না পড়ে যান। এসবের মানে কী? যে পার্টি অসহায় মানুষ, গরীব মানুষ, ছিন্নমূল মানুষের পাশে নির্দ্বিধায় দাঁড়ায় না, মানুষকে ছিন্নমূল করার প্রক্রিয়ার বিপক্ষে পিঠ সোজা করে দাঁড়ায় না — সে আবার কিরকম কমিউনিস্ট পার্টি?
ওদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এ নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। শেষ অব্দি সারদা, নারদের চোখ রাঙানি পেরিয়ে কদ্দূর কী করবেন সেটা পরের কথা, কিন্তু ছিন্নমূল হতে চলা মানুষ কিন্তু দেখছেন তিনি বলেছেন “দু কোটি লোককে বার করে দেবে? দুটো লোকের গায়ে হাত দিয়ে দেখাক।” এরকম কথা সিপিএম তথা বাম নেতাদের মুখে শোনা যাচ্ছে না কেন? তাঁরা কি ভাবছেন বাঙালদের পক্ষ নিলে এদেশীয় ভোটাররা ক্ষেপে যাবেন? উদ্বাস্তুদের জন্যে আন্দোলন কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতে তথা বাংলায় বামপন্থীদের শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়েছিল।
আচ্ছা, রাজ্য সরকারকেও কি সঠিক ইস্যুতে আক্রমণ করা হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রীর সাধের মেট্রো রেল প্রকল্প এমনই কল্পরাজ্যের জিনিস যে তাকে বাস্তবের মাটিতে নামাতে গিয়ে বহু লোকের ভিটেমাটি চাটি হওয়ার যোগাড় হয়েছে। তা নিয়েই বা বামেদের আন্দোলন কই? যে শহরে এই সরকারের আমলেই নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে, প্রকল্প শেষ করা সম্ভব নয় বলে ঘোষিত হয়েছে, সেই শহরে আবার এরকম সর্বনাশা প্রকল্প এগোল কী করে তা নিয়ে বামেরা সরকারকে প্রশ্নবাণে, আন্দোলনে জর্জরিত করলেন কই? নেতৃত্ব কি মনে করেন এগুলোতে কারোর কিছু এসে যায় না? নাকি ওখানেও হিসাব? বাড়ি ভেঙে পড়া লোকেদের চেয়ে মেট্রো হলে যারা চড়বে তাদের ভোটসংখ্যা বেশি হওয়ার হিসাব?
যদি তা-ই হয়, তাহলে এই যাঁরা লাল ঝান্ডার জন্যে এখনো প্রাণ বাজি রাখছেন তাঁরা কোন হিসাবে আছেন জানতে ইচ্ছা করে। তাঁদের ত্যাগ, তাঁদের রক্ত অপচয় হচ্ছে না তো? সাম্প্রতিককালে অনেকের মুখে কাছের শত্রু তৃণমূল, তারপর বিজেপির মোকাবিলা করা হবে ইত্যাদি শোনা যাচ্ছে। মনে পড়ল, ছেলেবেলা থেকে দেখি গণশক্তির সম্পাদকীয় স্তম্ভের উপরে কোন মার্কসবাদী ক্লাসিক সন্দর্ভ থেকে কয়েক লাইন উদ্ধৃত থাকে। যখন স্কুলে পড়ি তখন একটা উদ্ধৃতি প্রায়ই দেখতাম। স্মৃতি থেকে যতটুকু উদ্ধার করতে পারছি তাতে কথাটা ছিল খানিকটা এরকম: কমিউনিস্টদের লক্ষ্য, অন্য সব সর্বহারা পার্টির মতই, শ্রমিক শ্রেণীর আশু দাবীগুলি আদায় করা। কিন্তু তার মধ্যেও তারা বৃহত্তর লড়াইয়ের কথা ভোলে না এবং আসন্ন বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুতি নেয়।
আশা করি বাম নেতাদের স্মৃতিশক্তি আমার চেয়ে অনেক ভাল, তাঁরা আমার মত ক্লাসিকগুলো না পড়া লোক নন এবং ক্লাসিকগুলোর সময়োপযোগী ব্যাখ্যা করার শক্তিও তাঁদের অনেক বেশি।
কোন সিপিএম/বাম কর্মী বলতেই পারেন “তুমি কে হে, এত কথা বলছ? কোনদিন আমাদের কোন মিছিলে এক ঘা লাঠিও তো খাওনি। তোমার কী অধিকার এসব লেখার?” বললে তিনি ঠিকই বলবেন। তবে উত্তরে আমারও একটু বলার আছে।
আমি এই কথাগুলো লিখলাম সাত শতাংশের অধিকারে। অর্থাৎ আমি সেই সাত শতাংশের মধ্যে পড়ি যারা এখনো আপনাদের ভোট দেয়। অতএব আমার মতামতকে গুরুত্ব দিতে আপনারা বাধ্য। সংসদীয় গণতন্ত্রে কতিপয় লোকের এটুকু বাঁদরামি আপনাদের মেনে নিতেই হবে।

ন্যায় অন্যায়

রাষ্ট্র বলছে আপনি এদেশের নাগরিক কিনা তাতে আমার বয়ে গেছে। আপনি বলুন আপনার ঠাকুর্দা, দাদু, দিদিমা, বাবা, মা এঁরা এদেশের নাগরিক ছিলেন কিনা। একে যুক্তি বলে?

ঐতিহাসিক সঙ্কটের সময়ে অনেক বড় মানুষেরই ন্যায় অন্যায় গুলিয়ে যায়, আমাদের মত সাধারণ লোকের তো গুলিয়ে যেতেই পারে। তাই ৩১শে আগস্ট আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পর দেখছি উনিশ লক্ষ বাদ পড়েছে বলে যাঁরা দুঃখ বা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য ব্যাপারটা দুঃখজনক, কিন্তু ন্যায় কি অন্যায় তা জানি না। খসড়া তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পরে উদাসীন বা এন আর সি সমর্থক মানুষের সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি ছিল এই বাংলায়। সেদিক থেকে এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলতে হবে। কিন্তু তার একটা বড় কারণ, যা বিজেপির প্রতিক্রিয়া থেকেই পরিষ্কার, তালিকার বাইরে থাকা মানুষদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া।

আসামের অনেক হিন্দু বাঙালির মত পশ্চিমবঙ্গের বহু হিন্দু বাঙালিও বিজেপির প্রোপাগাণ্ডায় ভুলে বিশ্বাস করেছিল আসাম রাজ্যটাকে বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলমানরা একেবারে দখল করে নিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গও “ওদের” দখলে চলে যাচ্ছে। ফল আশানুরূপ না হওয়ায়, উপরন্তু হিন্দুরাই বেশি বাদ পড়ে যাওয়ায় এরা স্তম্ভিত, উৎকণ্ঠিত। ফলে উনিশ লক্ষ দেশহীন মানুষের জন্য হঠাৎ সমবেদনা তৈরি হয়েছে এবং রংচঙে ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা “বাংলায় এন আর সি চাই” বলে যে ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছিল, নিজেদের বিপদের আশঙ্কায় সেগুলো আর তত চোখে পড়ছে না। উলটে এই অধমের পোস্টে, যারা কাশ্মীরকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল, কাশ্মীরি মেয়েদের বিয়ে করতে পারবে বলে আহ্লাদে আটখানা হয়েছিল (চুয়াত্তর বছর ধরে তো নেহরু আটকে রেখেছিল), তারাও লাইক দিয়ে যাচ্ছে।

এদের নিয়ে ভাবি না। কিন্তু এরাই সব নয়। ব্যক্তিগতভাবে চিনি এমন অনেক হৃদয়বান মানুষকেও দেখছি বলছেন কোনটা ঠিক কোনটা ভুল জানি না। সেই জন্যই এই পোস্টের অবতারণা।

আসামে নাগরিকপঞ্জী নবায়ন করা বন্ধ করা উচিৎ এবং দেশের কোথাও এ জিনিস করা কেন উচিৎ নয় এসব বোঝাতে বহু মানুষ বহুদিন ধরে কাজ করছেন। ফেসবুকে NO NRC নামে একটা গ্রুপও আছে। সেসব দেখতে পারেন, দেখা প্রয়োজনও। কিন্তু সেসব ছাড়া নিজেই কতকগুলো কথা ভেবে দেখুন।

প্রথমত, পৃথিবীর সব রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নাগরিকত্বের কিছু প্রমাণপত্র দেয়। ভারত রাষ্ট্রও দেয়। যেমন ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট। এখন আবার সব কার্ডের বাড়া বলা হচ্ছে আধার কার্ডকে। এই প্রমাণপত্রগুলো কিসের প্রমাণ? আপনি যে ভারতের নাগরিক তার প্রমাণ। পৃথিবীর সব দেশই নাগরিকের থেকে তার সেই দেশের নাগরিক হওয়ার প্রমাণই দাবী করে। কিন্তু এন আর সি র কাছে এগুলো কোন প্রমাণই নয়। সেখানে রাষ্ট্র বলছে আপনি এদেশের নাগরিক কিনা তাতে আমার বয়ে গেছে। আপনি বলুন আপনার ঠাকুর্দা, দাদু, দিদিমা, বাবা, মা এঁরা এদেশের নাগরিক ছিলেন কিনা। একে যুক্তি বলে? কতটা পেছোব আমরা? ঠাকুর্দাতেই বা থামা কেন? ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এই বা থামার দরকার কী? ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ এ আমার পরিবারের যাঁরা জীবিত ছিলেন তাঁরা এ দেশের নাগরিক ছিলেন কিনা জানতে চাইলেই বা ঠেকাচ্ছে কে? ধরুন আগামী দিনে রাষ্ট্র আরো পেছোতে চাইল। বলল ১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোহ হল আমাদের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ। তার আগে আপনার পূর্বপুরুষ এ দেশে ছিলেন কিনা বলুন। না থাকলে আপনি নাগরিক নন। আজ লিগ্যাসি ডকুমেন্ট চাইলে না হয় বাড়ির দলিল, বাবার গ্র‍্যাজুয়েশন সার্টিফিকেট ইত্যাদি দেখাচ্ছেন। তখন পূর্বপুরুষের নামটা খুঁজে পাবেন তো?
জানি এর পালটা যুক্তি হিসাবে বলা হবে ভারতে এত দুর্নীতি যে সীমান্ত পেরিয়ে এসে ভোটার কার্ড ইত্যাদি করিয়ে ফেলা কোন ব্যাপারই নয়। অতএব ওগুলো কোন প্রমাণ নয়। ঠিক কথা। আচ্ছা দুর্নীতিটা কার? রাষ্ট্রেরই তো। ঘুষ নিয়ে সীমান্ত পার করিয়ে দেয় যে সীমান্ত রক্ষী সে রাষ্ট্রের যন্ত্র। রাষ্ট্রেরই অন্য কয়েকটা যন্ত্রের দুর্নীতি ছাড়া আপনি সত্যিকারের নাগরিক না হলে ভোটার, প্যান, পাসপোর্ট, আধার কিছুই বানিয়ে উঠতে পারবেন না। একথা ঠিক যে যে ঘুষ নেয় আর যে ঘুষ দেয় — দুজনেই দোষী। কিন্তু এন আর সি যদি যে ঘুষ দিয়ে নাগরিকত্ব কিনেছে তাকে চিহ্নিত করার এবং শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়, তাহলে যারা ঘুষ নিয়ে নাগরিকত্ব বিক্রি করেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থাটা কোথায়? নেই যখন তখন স্পষ্ট যে এই ব্যবস্থা তৈরিই হয়েছে এক পক্ষকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে, অর্থাৎ এ অন্যায় ব্যবস্থা।
দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর সমস্ত আইনের মূল মন্ত্র হল “Innocent till proved guilty.” অর্থাৎ আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হলে যতক্ষণ আপনি দোষী প্রমাণিত না হচ্ছেন ততক্ষণ আপনি নির্দোষ। এন আর সি কিন্তু উলটপুরাণ। রাষ্ট্র ধরেই নিচ্ছে তার কিছু নাগরিক আসলে নাগরিক নয়। তারপর সেই নাগরিককে বলছে “প্রমাণ করো তুমি নাগরিক।” কেন? রাষ্ট্র প্রমাণ করে দেখাক না যে অমুক আসলে অনুপ্রবেশকারী, নাগরিক নয়। “মারতে চাও তো ডাকাও নাকো জল্লাদ। গন্ধ শুঁকে মরতে হবে এ আবার কী আহ্লাদ?”

কিন্তু এ দুটো যুক্তির চেয়েও বড় কথা, এদেশে নাগরিকত্বের একাধিক প্রমাণপত্রের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও যদি আমরা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরি করা মেনে নিই, তাহলে রাষ্ট্রকে নাগরিকত্বের সংজ্ঞা ইচ্ছে মত বদলে নেওয়ার অধিকার দিয়ে দেওয়া হয়। ইংরিজিতে যাকে “shifting posts” বলে। এর বিপদটা ভেবে দেখুন। আজ রাষ্ট্র একটা তারিখ বেঁধে দিয়ে বলছে তার আগে যাদের পরিবার এ দেশে ছিল না তারা নাগরিক নয়। কাল বলতেই পারে সকলের ডি এন এ পরীক্ষা করব। যাদের মধ্যে উত্তরে হিমালয় আর দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের মাঝের এই ভূখণ্ডের বাইরের জিন পাওয়া যাবে, সে নাগরিক নয়। তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে। তখন রাষ্ট্রের সুবিধা মত এক একটা জনগোষ্ঠী ধরে অনাগরিক ঘোষণা করে দেওয়ার ভারী সুবিধা হবে। এবং সেটা কখন কোন জনগোষ্ঠী, তা কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছাধীন হবে। ফলে কোন জনগোষ্ঠীই নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন না। ভাবছেন নেহাত ভয়ের বেসাতি করছি? মনে রাখবেন, আধার কার্ডের মাধ্যমে আমার আপনার বায়োমেট্রিক তথ্য কিন্তু ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রের হাতে।

আসামের নাগরিকপঞ্জীর অবশ্যই একটা ইতিহাস আছে, যা দেশের অন্য কোন রাজ্যের সাথে মেলে না। অসমিয়া জাতি পরিচয়ের আক্রমণাত্মক রাজনীতিকে ধামাচাপা দিতে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সেই ইতিহাসটার অপব্যবহার করে ১৯৫১ র নাগরিকপঞ্জী নবায়নের এই গাজরটি ঝুলিয়েছিলেন। আজকের কেন্দ্রীয় সরকারকে এই নিয়ে কিছু বললেই তাঁরা হাত উলটে বলেন “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তো হচ্ছে। আমরা তো কিছু করিনি।” যেন সবসময় সব মামলায় সরকার সুপ্রিম কোর্টের বাধ্য ছেলেটি। যেন আইনি বিতর্কের মাধ্যমে আদালতের মত বদলের চেষ্টা করা সরকারের কাজ নয়। অথচ এই সেদিন আধার মামলার সময়ে সরকারী কৌঁসুলি বিচারপতিদের ধমক খেতে খেতেও আধারের জন্যে প্রাণপণ লড়ে গেছেন।
আর বিরোধী দলগুলো? তারা কে জানে কোন প্রণোদনায় কতকগুলো অর্থহীন কথা বলে চলেছে। কংগ্রেসের বিশেষ কিছু বলার মুখ নেই, যেহেতু তাদের নেতাই প্যান্ডোরার এই বাক্সটি খুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই তারা কেবল পদ্ধতিগত ত্রুটির প্রশ্ন তুলে বাদ পড়া মানুষের জন্যে অশ্রুপাত করছে। কিন্তু অন্য দলগুলোর ভূমিকাও কম ন্যক্কারজনক নয়। তৃণমূল আজ বাঙালি বাদ না গেলেই খুশি তো কাল গোর্খারা বাদ না গেলেই খুশি। বৃহত্তম বামপন্থী দল আবার প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক যেন বাদ না যায় সেদিকে নজর দিতে বলছেন। সরকার কেন খুলে বলছে না যাদের নাগরিকত্ব শেষ অব্দি প্রমাণ হবে না তাদের কী করা হবে — এই নিয়ে চেঁচামেচি করছেন। যেন তাঁরা জানেন না ইতিমধ্যেই আসামের ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে যাঁরা আছেন তাঁরা কেন আছেন, নির্মীয়মাণ ডিটেনশন ক্যাম্পগুলো কেন বানানো হচ্ছে।

হে মোর দুর্ভাগা দেশ!

ভাবনা করা চলবে না

আপনার যদি গণতন্ত্র নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা থেকে থাকে এবং বিজেপির দেশপ্রেমের চশমা সরিয়ে আপনি যদি ফ্যাসিবাদ দেখতে পেয়ে থাকেন, তাহলে যতবড় বামবিরোধীই হোন না কেন, এই সত্য মেনে না নিয়ে আপনার উপায় নেই যে শুধু বামপন্থীরাই পড়ে আছেন

ফ্যাসিবাদের একটা মহৎ গুণ আছে — অতি উৎকৃষ্ট ছাঁকনির কাজ করে। কেন বলছি?
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন নানা দিক থেকেই অনন্য ছিল। যেমন ধরুন, বামপন্থী পরিবারে জন্মে, বরাবর বামপন্থী রাজনীতির কাছাকাছি থেকে যা দেখতে পাইনি, এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে পরে তেমন এক ঘটনা দেখলাম। শক্তি কমে আসা বামপন্থীরা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেলেন, নিজেদের মধ্যে কোন আদর্শগত মতানৈক্যে নয়, কোন অবাম দলকে সমর্থন করা উচিৎ, কাকে উচিৎ নয় তাই নিয়ে।
এক দল বললেন বিজেপি যেহেতু দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ, তাই ওদের হারাতে সকলের সাথে জোট করতে হবে। তবে কিনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর বিজেপির তফাত উনিশ বিশ। তাই ওঁকে বাদ দিয়েই করতে হবে এই জোট। কংগ্রেস অতীতে যা-ই করে থাক, ওদের সাথে থাকতেই হবে এই পরিস্থিতিতে। ওরা আর যা-ই হোক বিজেপি তো নয়। অস্যার্থ, একলা লড়তে ঠিক সাহস পাচ্ছি না। তাছাড়া সারা দেশে লড়ার শক্তিও নেই। অতএব ওরা লড়ুক, বাফারের কাজ করুক। আমরা তো রইলামই।
আরেক দল বামপন্থী উপর্যুক্ত বামেদের প্রবল আক্রমণ করলেন। বললেন ওঁরা ক্ষমতা হারানোর আক্রোশে, ক্ষুদ্র স্বার্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করছেন। বরং মমতার হাতই শক্ত করা উচিৎ। বাঁচালে উনিই পারেন বাঁচাতে। উনিই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে অগ্রণী সৈনিক। অস্যার্থ, আমাদের তো শক্তি নেই। উনি নেতৃত্ব দিন, আমরা লড়ে যাব।
নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর দু পক্ষই যে ভুল ছিলেন তা পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখা গেল প্রথম দল কংগ্রেসের লড়ার ক্ষমতায় আস্থা রাখলেও ভোটাররা রাখেননি। উলটে কংগ্রেস কী করবে আর কী করবে না তা নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে বিজেপি বা মমতার বিরোধী হিসাবে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে। যে ভোট নিজেদের ছিল সেগুলো ধরে রাখার কাজটাও ঠিক করে করা হয়নি।
দ্বিতীয় দলের ভোটের হিসাবে হারানোর মত কিছু ছিল না। সম্ভবত সেটাই তৃণমূলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের সবচেয়ে বড় কারণ। ভোটের ফলে দেখা গেল তাঁরা যে নেত্রীর উপর ভরসা করেছিলেন তাঁর উপর ভোটারদের যথেষ্ট ভরসা নেই।
ভোটের আগে বহু বাম এবং মধ্যপন্থী বন্ধুদের সাথে অনলাইন ও অফলাইনে ঝগড়া করেছি এই বলে যে বিজেপিকে আটকাতে হবে এই যুক্তিতে কোনরকম রামধনু জোট করলে কোন লাভ হবে না, বরং বিজেপির কাজ আরো সহজ হবে। এমনিতেই গত কয়েক বছরে ঘরে ঘরে যত্ন করে জমিয়ে তোলা ধর্মান্ধতা, মুসলমানবিদ্বেষের পরিমণ্ডলে অন্য সব ইস্যু যে পেছনে চলে যেতে পারে সেই আশঙ্কা করতে খুব বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। তার উপর বালাকোট যে মানুষকে অন্য সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে সে তো এতদিনে পরিষ্কার। কিন্তু রামধনু জোট কেন সারা দেশের কোথাও কাজ করল না তার অন্য কারণও তলিয়ে দেখা দরকার। সেটা করা খুব সহজ হয় বিজেপির জয়ের পর যারা এই নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী ছিল তাদের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে।
কংগ্রেসকে দিয়েই শুরু করা যাক। যে বামপন্থী দলগুলো কংগ্রেসকে ঢাল ভেবেছিলেন তাঁরা মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস সরকারের বিজেপিসুলভ কর্মসূচীকে পাত্তাই দেননি। গোশালা বানিয়ে দেব, রাম পথ বানিয়ে দেব — এসব বলে যারা বিধানসভা নির্বাচন জেতে, তাদের যদি ভোটাররা লোকসভায় ভোট না দেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি? যদি কেউ হিন্দুত্বের জন্যেই ভোট দেবে ঠিক করে, তাহলে আগমার্কা হিন্দুত্বকেই দেবে, নকল হিন্দুত্বকে কেন দেবে? বিধানসভায় নাহয় রাজ্য সরকারের কাজকর্মে রুষ্ট হয়ে কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া গেল, লোকসভায় আর কেন? শুধু মধ্যপ্রদেশ? গুজরাটের নির্বাচনের সময়ে বিজেপি প্রশ্ন তুলল “রাহুল গান্ধী কি হিন্দু?” কংগ্রেস উত্তর দিল “উনি শুধু হিন্দু নন, রীতিমত পৈতেওলা হিন্দু।” বামফ্রন্ট (ওটা কি আছে এখনো? বহরমপুর কেন্দ্রে সিপিএম কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করার পরেও?) নেতৃত্ব এই পার্টির হাত ধরে হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়বেন ভেবেছিলেন। এসব অবশ্য লোকসভা নির্বাচনের আগের কথা। তারপর থেকে কংগ্রেস কী কী করেছে?
ইউ এ পি এ আইন এবং এন আই এ আইনের সংশোধনী, যেগুলো ব্যক্তির নাগরিক অধিকারে শেষ পেরেক পুঁতেছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রাজ্য সরকারের যে অধিকার তাতে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিয়েছে, কংগ্রেস সেই সংশোধনগুলো নিয়ে বিতর্কে নানা গরম গরম কথা বলে শেষে রাজ্যসভায় পক্ষে ভোট দিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুতে সোনিয়া আর রাহুল গান্ধী সরকারের বিপক্ষে দাঁড়ালেও রোজ কোন না কোন কংগ্রেস নেতা সরকারকে সমর্থন করছেন। এমনকি পি চিদম্বরম গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে জয়রাম রমেশ, শশী থারুরের মত নেতা, যাঁরা সুললিত ইংরেজিতে গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি বলে গত কয়েক বছরে প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছেন, তাঁরা বলতে শুরু করেছেন মোদীর অবিমিশ্র সমালোচনা করা নাকি ঠিক নয়। সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজারা ভেবেছিলেন এদের হাত ধরে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন।
এবার তৃণমূল কংগ্রেসের কথায় আসা যাক। নকশাল, এস ইউ সি আই প্রভৃতি বামপন্থীরা এই দলটির সর্বোচ্চ নেত্রীকেই মুক্তিসূর্য ভেবেছিলেন, ২০১৬ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া সত্ত্বেও। তা তৃণমূল কী করেছে ভোটের পর থেকে?
এক কথায় বললে মহুয়া মৈত্র একটা মারকাটারি বক্তৃতা দিয়েছেন লোকসভায়। ব্যাস, আর কিচ্ছু না। ইউ এ পি এ আইনের সংশোধনী নিয়ে আলোচনায় বক্তৃতাটি দিয়ে ফেসবুক এবং ইউটিউবে কয়েক হাজার লাইক কুড়ানোর পর তৃণমূল সদলবলে ভোট দিয়েছে সরকারের পক্ষে। আর এন আই এ আইন নিয়ে ভোটাভুটিতে ওয়াক আউট করে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছে। এ তো গেল সংসদের ভেতরের কথা। বাইরে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার ঢল নেমেছে নির্বাচনের পর থেকে। তা আটকাতে অসমর্থ হয়ে শীর্ষ নেত্রীর বিজেপির থেকেও বেশি বিজেপি হওয়ার প্রয়াসও বেড়েছে। বিজেপি অযোধ্যায় রামমন্দির বানাবে, ইনি দীঘায় জগন্নাথ মন্দির বানাবেন বলছেন। একদিকে চা ওয়ালার সাফল্য দেখে চা ওয়ালীকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে বরাবরের রণং দেহি মূর্তি বিসর্জন দিয়ে কেন্দ্রের সাথে সংঘাতে যাবেন না বলছেন।
তারপর আসা যাক অখিলেশ আর মায়াবতীর কথায়। দুজনে সব অতীত বৈরিতা ভুলে উত্তরপ্রদেশে একজোট হয়ে লড়েছিলেন। সেই জোটের উপরে আমরা বিজেপিবিরোধীরা সকলেই অনেক আশা (নাকি দুরাশা?) করেছিলাম। পরাস্ত হওয়ার পর থেকে সংসদে আনা সমস্ত অগণতান্ত্রিক বিলে অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি আর মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি লক্ষ্মী হয়ে সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সংবিধানকে এবং গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে কাশ্মীরিদের প্রতি যা করা হল, আম্বেদকরের নামে শপথ নেওয়া মায়াবতীর পার্টি তাতেও বিনা বাক্য ব্যয়ে সমর্থন জানিয়েছে।
হিন্দুত্ববাদের সূতিকাগার, মোদী-শাহের ইন্দ্রপ্রস্থ যে গুজরাট, সেখানে তিন মহারথী এক হয়েছিলেন বিজেপিকে হারাবেন বলে। বামপন্থী, আম্বেদকরপন্থী জিগ্নেশ মেওয়ানি হাত মিলিয়েছিলেন চরম প্রতিক্রিয়াশীল উচ্চবর্ণের জন্যে সংরক্ষণ দাবী করা নেতা হার্দিক প্যাটেলের সাথে। এই বিপরীত মেরুর রাজনীতি কী করে মিলতে পারে তা নিয়ে যখন জিগ্নেশকে প্রশ্ন করা হয়েছিল নির্বাচনের আগে, তখন তিনি বলেছিলেন আগে তো বিজেপিকে হারাই, তারপর ওসব বুঝে নেব। বিজেপি বৃহত্তম বিপদ, আগে ওদের হারাতে হবে — এই যুক্তিতে তিনি আবার পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টদের পরামর্শ দিয়েছিলেন দিদির হাত শক্ত করতে। ফলাফলে দেখা গেল পরেরটা পরে হবে যুক্তি মানুষ বিশ্বাস করেননি। জিগ্নেশ আর হার্দিকের সঙ্গে জুড়েছিলেন কংগ্রেস নেতা অল্পেশ ঠাকোর। অল্পেশ এখন বিজেপিতে, হার্দিক নির্বাচন কমিশনের বদান্যতায় নির্বাচনে লড়তে না পারার পর থেকে চুপ, জিগ্নেশ একা পড়ে গেছেন।
আর কে বিজেপিবিরোধী ছিলেন? অরবিন্দ কেজরিওয়াল। অর্থাৎ আম আদমি পার্টি। ওঁদের কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। দিল্লীতে যে ওঁরা একটা আসনও জিততে পারেননি সেটা বড় কথা নয়। বিজেপির কয়েক হাজার কোটি টাকার নির্বাচনী প্রচার, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পার্টিজান কার্যকলাপের মধ্যে আপের মত একটা ছোট পার্টির না জিততে পারা দোষের নয়। কিন্তু বরাবরের লড়াকু কেজরিওয়াল কেমন যেন মিইয়ে গেছেন নির্বাচনের পর থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা নিয়ে তাঁর আর কোন বক্তব্য নেই। দিল্লীকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হোক এই দাবী তিনি কবে থেকে করে আসছেন। অথচ জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে তিন টুকরো করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া হল, তিনি সমর্থন করলেন।
দেবগৌড়ার দল নিজেদের বিধায়ক, সাংসদ বিক্রি হওয়া আটকাতে পারছেন না, ডি এম কে ও সরকারের বাধ্য সন্তান।
তাহলে বাকি রইল কারা? কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স আর হায়দরাবাদের আসাদুদ্দিন ওয়েসিকে (যিনি লম্বা দাড়ি রাখেন আর ফেজ পরেন বলে আমরা মৌলবাদী বলে ধরেই নিয়েছি, যদিও গেরুয়া পরা সাংসদদের দেখে মৌলবাদী মনে হয় না) বাদ দিলে, বাকি রইলেন বামপন্থীরা। আপনার যদি গণতন্ত্র নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা থেকে থাকে এবং বিজেপির দেশপ্রেমের চশমা সরিয়ে আপনি যদি ফ্যাসিবাদ দেখতে পেয়ে থাকেন, তাহলে যতবড় বামবিরোধীই হোন না কেন, এই সত্য মেনে না নিয়ে আপনার উপায় নেই যে শুধু বামপন্থীরাই পড়ে আছেন। বস্তুত, এন আই এ আইনে রাজ্য সরকারকে ঠুঁটো জগন্নাথ আর এন আই এ কে সর্বশক্তিমান করে দেওয়ার বিপক্ষে লোকসভায় ভোট দিয়েছিলেন ঠিক ছজন — চার বাম সাংসদ আর ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং ওয়েসি।
ফ্যাসিবাদ ছেঁকে দিয়েছে। এখন থেকে ভারতে তার যত বিরোধিতা হবে, যেটুকু বিরোধিতা হবে তার নেতৃত্ব বামপন্থীদেরই দিতে হবে। তাঁরা চান বা না চান, বিজেপিকে তাত্ত্বিকভাবে ফ্যাসিবাদী বলে মানুন বা না মানুন। কারণ বাফারগুলো আর নেই, আর থাকবে না। কেউ সি বি আই, ই ডি ওষুধে জব্দ, কেউ নিজের ক্ষমতাটুকু ধরে রাখতে পারলেই খুশি, কাউকে স্রেফ কিনে নেওয়া গেছে এবং যাবে। কিন্তু বামপন্থীদের দিকে সিবিআই, ই ডি লেলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ তাঁদের দুর্নীতি নেই। পশ্চিমবঙ্গের কিছু সেজ নেতা ছাড়া কাউকে কিনে ফেলাও যাচ্ছে না।
এই পর্যন্ত পড়ে আপনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন, কারণ চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে সিপিএমের দুর্নীতিগ্রস্ত এল সি এস, পঞ্চায়েত সদস্য, পঞ্চায়েত প্রধানের মুখ আপনার মনে পড়বে, পড়া সঙ্গত। কিন্তু মনে রাখবেন, ভারতে এ পর্যন্ত ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে যে দুটি বামপন্থী দল, তাদের আমলে সরকারী স্তরে দুর্নীতি ভারতের অন্য যে কোন রাজ্যের চেয়ে কম৷ আর কোন দলে আপনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা মানিক সরকার বা পিনারাই বিজয়নের মত জীবনযাত্রার মুখ্যমন্ত্রী দেখাতে পারবেন কি? ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মত সৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে কজন পাওয়া গেছে বাজার অর্থনীতির যুগে? সদ্যপ্রয়াত নকশাল নেতা এ কে রায় বা শঙ্কর গুহনিয়োগীর কথা নাহয় না-ই বললাম। না-ই আলোচনা করলাম যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রমমন্ত্রী এস ইউ সি আই নেতা সুবোধ ব্যানার্জির কথা। তাঁরা তো প্রাগৈতিহাসিক লোক বলে গণ্য হন আজকাল।
এখন প্রশ্ন, বামপন্থীরা লড়বেন কী করে? কতটুকু শক্তি তাঁদের? আর এস এস (বিজেপি তো ফ্রন্ট মাত্র) নামক কর্পোরেটপুষ্ট বেহেমথের সামনে তাঁরা কতটুকু? যদি বামপন্থী বলতে ক্রমহ্রাসমান সিপিএম বোঝেন তাহলে সত্যিই তাঁরা পারবেন না। যদি সীমিত সাংগঠনিক শক্তির সি পি আই বোঝেন তাহলে তাঁরাও পারবেন না। যদি আলাদা করে সি পি আই (এম-এল) লিবারেশন বোঝেন তাহলে নিঃসংশয়ে বলা যায় তাঁরাও পারবেন না। কিছু কিছু অঞ্চলে শক্তিশালী এস ইউ সি আই বা আর এস পি, ফরোয়ার্ড ব্লক — এঁরা কেউই পারবেন না। কিন্তু এঁরা সকলে যদি একত্র হন, তাহলে শক্তিটা উড়িয়ে দেওয়ার মত হয় না। এঁরা এক হলেই কি জিতে যাবেন? বা জনসমর্থন পাবেন? এক এক করে উত্তর ভাবা যাক।
কে যেন বলেছেন “I do not fight fascists because I will win. I fight fascists because they are fascists.” এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় কথা নেই। সমস্ত বামপন্থী শুধু নয়, সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় দেশপ্রেমিক মানুষেরই এই কথাটাই শিরোধার্য করা দরকার। বড় কথা হল সমস্ত বামপন্থী এক হতে পারবেন কিনা।
লোকসভা নির্বাচনের আগে ৩রা ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্টের ডাকা ব্রিগেড সমাবেশে লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের উপস্থিতিকে বৃহত্তর বাম ঐক্যের পূর্বাভাস বলে যাঁরা আশা করেছিলেন, অচিরেই তাঁদের ভুল ভেঙে যায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে সিপিএমের উদগ্রীব উন্মাদনায়। আজকের সঙ্কটেও, ভয় হয়, বাম ঐক্যের চেয়ে বৃহত্তম বামপন্থী দলটির নেতৃত্বের কাছে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের সখ্য বেশি প্রার্থনীয় না হয়। আরো আশঙ্কা এই যে ঐক্যের প্রচেষ্টা হলে হয়ত লিবারেশন কর্মীরা বলবেন “অমুক বছর যে আমাদের অমুক কমরেডকে ওরা মেরেছিল?” প্রত্যুত্তরে সিপিএম কর্মীরাও অনুরূপ হিংসার ইতিহাস তুলে ধরবেন। এস ইউ সি আই বলবেন “সিপিএম সংশোধনবাদী”, আর সিপিএম বলবেন “ওরা আবেগসর্বস্ব অতি বাম। বিপ্লবের পক্ষে ক্ষতিকর।”
এই যদি চলতে থাকে, তাহলে ভারতে বামপন্থী বলে আর কেউ তো থাকবেই না, বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা যায় ভারত ব্যাপারটাই আর থাকবে না।
এবার জনসমর্থনের প্রশ্ন। বামপন্থীরা সমর্থন পাবেন, কিন্তু পেতে গেলে ঠিক করতে হবে কাদের সমর্থন চাইছেন। সকলের সমর্থন কথাটার আজ আর কোন মানে নেই। ভারতে এখন ঔপনিবেশিক শাসন চলছে না। হিন্দু ফ্যাসিবাদ বাইরে থেকে আসা জিনিস নয়। তাই একে পরাস্ত করতে মহাত্মা গান্ধী যেরকম দল মত ধর্ম জাতি নির্বিশেষে সব ভারতবাসীকে এক করতে চেষ্টা করেছিলেন, সেরকম প্রচেষ্টার কোন মানে হয় না। স্পষ্টতই ভারতে যে সামাজিক ওলট পালট হয়নি অথচ হওয়া উচিৎ ছিল ইতিহাসের নিয়মে, এখন তারই সময়। অর্থাৎ এখন পক্ষ নেওয়ার সময়। বামপন্থীরা, যদি সত্যিই বামপন্থী হন, তাহলে আক্রান্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুর পক্ষ নেবেন। নিম্নবর্ণের মানুষের পক্ষ নেবেন। সারা পৃথিবীতে, আমাদের দেশে তো বটেই, জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণকে গ্রাস করতে উদ্যত পুঁজিবাদ। পুরো গ্রহটারই ধ্বংস সাধনে উদ্যত, সরকারপুষ্ট বৃহৎ পুঁজি। ধ্বংস থেকে বাঁচতে হলে অরণ্যের অধিকার অরণ্যবাসীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। তাই বামপন্থীদের আদিবাসীদের পক্ষেও অবশ্যই থাকতে হবে।
সব মিলিয়ে এঁরাই কিন্তু এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তবে এঁদের পক্ষে দাঁড়াতে হলে বামপন্থীদের দীর্ঘকাল সমর্থন করতেন এমন অনেক মানুষের সমর্থন হারানোর ঝুঁকিও কিন্তু নিতে হবে। গোড়াতেই বলেছি ফ্যাসিবাদ অতি উৎকৃষ্ট ছাঁকনি। সেকথা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে সত্যি তা নয়। চারপাশে তাকালেই দেখা যাচ্ছে, জীবনে কখনো বামপন্থীদের ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দেননি এমন বহু মানুষের সুপ্ত মুসলমানবিদ্বেষ কেমন বেরিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের ভোট এক লহমায় ২৩% থেকে ৭% এ নেমে আসার পেছনে এঁরা বড় কারণ। অবশিষ্ট সাত শতাংশের অনেকেও যে “কাশ্মীরকে বেশ টাইট দেওয়া গেছে” ভাবছেন না এমনটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদীরা আরো সূক্ষ্ম ছাঁকনি প্রয়োগ করতে চলেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং চাকরিতে বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে। তাতে যে বহু বাম সমর্থক উচ্চবর্ণের মানুষই উল্লসিত হবেন তা পরিষ্কার। বর্ণবাদকে আলাদা করে বোঝার প্রয়োজন নেই, শ্রেণীর লড়াই ছাড়া আর কোন লড়াই নেই — এই ভ্রান্তির ফল তখন বামপন্থীদের ভুগতে হবে। অর্থাৎ আরো অনেক সাবেকি সমর্থক সরে যাবেন। বামপন্থীরা সে ঝুঁকি নেবেন তো? এখন অবশ্য তাঁদের আর হারানোর কিছুই নেই। আর কবি তো বলেছেনই “তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে। তা বলে ভাবনা করা চলবে না।”

কাটমানির স্বপ্নভঙ্গ?

যে শিল্পী একসময় আমাদের বলতেন “চল যাব তোকে নিয়ে, এই নরকের অনেক দূরে। এই মিথ্যে কথার মেকি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে”, তাঁর সবচেয়ে বড় মঞ্চ হয়ে দাঁড়াল একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ

বয়ঃসন্ধির প্রেম একতরফা হলেও বিশুদ্ধ। অন্তত আমাদের বয়ঃসন্ধির প্রেম তেমনই ছিল। কারণ আমাদের স্মার্টফোন ছিল না, তাতে সুলভ পর্নোগ্রাফি ছিল না, সম্ভবত সে জন্যেই অ্যাসিড দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করা ছাড়া আর কিছু করা যায় আমরা ভেবে উঠতে পারতাম না। তা সেই বয়ঃসন্ধির প্রেম নিয়ে সবচেয়ে জীবন্ত, হৃদপিণ্ড ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া গানটা লিখেছিলেন নচিকেতা। সে বয়সে তাঁর নীলাঞ্জনা আর আমাদের নীলাঞ্জনারা অভিন্ন ছিল।
শুধু প্রেম নয়, বয়ঃসন্ধির সবকিছুই মানুষের বহুকাল প্রিয় থাকে। হয়ত ওখানেই শৈশবের শেষ বলে। নচিকেতার জন্যেও তাই আমাদের প্রজন্মের অনেকের মনে একটা বিশেষ জায়গা আছে বা ছিল। শিল্পমূল্যে কবীর সুমন (সেযুগের সুমন চট্টোপাধ্যায়) অনেক এগিয়ে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে, মফঃস্বলে ছড়িয়ে থাকা মানুষের মনের কথা প্রায় তাঁদের ভাষায় গানের মাধ্যমে বলার ক্ষেত্রে নচিকেতার জুড়ি ছিল না। এবং সেটা বয়সের বাধা অতিক্রম করে। নচিকেতা আমাদের যেমন নীলাঞ্জনা দিয়েছিলেন, দাদু দিদাদের বৃদ্ধাশ্রম দিয়েছিলেন; শাপভ্রষ্ট বাবা, কাকাদের অনির্বাণ দিয়েছিলেন। অস্বীকার করবে কোন মূর্খ? আমরা সলিল চৌধুরীর যুগের লোক নই। আমাদের জন্যে কেউ ঘুমভাঙার গান লেখেনি। আলোর স্পর্শে দুঃখের কাল কেটে যাবে সেই স্বপ্ন আমরা দেখিনি, কারণ পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া ছাড়া আর কোন স্বপ্ন দেখতে শেখানোই হয়নি। প্রতিবাদের ভাষা বলতে আমরা তাই “শুনব না গান, গান শুনব না” বুঝেছি। সেই ভাষা নচিকেতাই যুগিয়েছিলেন।
সেই জায়গাটা নচিকেতা ধরে রাখতে পারতেন অনায়াসেই। কিন্তু ঐ যে অনেকে বলে, আপনি হয় যৌবনেই বিদ্রোহীর মৃত্যু বরণ করতে পারেন নয় দীর্ঘজীবী প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারেন। কথাটা নচিকেতার ক্ষেত্রে এমন নিদারুণ সত্যি হয়ে উঠবে ভাবতে পারিনি।
বেশ মনে আছে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার সময়ে আমাদের কোন্নগর রবীন্দ্রভবনে একবার গাইতে এসেছেন, এক প্রবীণ সিপিএম নেতাকে অনুষ্ঠান শেষে তরুণ পার্টিকর্মী উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন “যা পপুলারিটি, ভোটে দাঁড় করায় দিলে ড্যাং ড্যাং কইর‍্যা জিত্যা যাইব।” সুভাষ চক্রবর্তীর সাথে নচিকেতার ঘনিষ্ঠতা ততদিনে সুবিদিত। জানি না ইঙ্গিতটা সেদিকেই ছিল কিনা, তবে সি পি আই (এম) শেষ পর্যন্ত নচিকেতার জনপ্রিয়তাকে নির্বাচনী লড়াইয়ে ব্যবহার করেনি। রাজ্যে যখন পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করল তখন আরো অনেক ছোট বড় বিখ্যাত লোকের মতই নচিকেতাও পরিবর্তনপন্থী হয়ে উঠলেন। বামফ্রন্ট সমর্থক হিসাবে দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু সঙ্গে এও মনে হয়েছিল যে হয়ত তিনি বামফ্রন্টের দলগুলির বিচ্যুতিতে ব্যথিত, বিরক্ত একজন বামপন্থী। ভুল জায়গায় নিস্তার খুঁজছেন। ভুল তো আমি, আপনি সকলেই করি। তাছাড়া ২০০৮-০৯ থেকে মমতার প্রতি বামফ্রন্টের বাইরের বামেদের প্রকাশ্য ও গোপন সমর্থন তো ছিলই। আর তাঁর বিভিন্ন গান শুনে নকশালপন্থীদের প্রতি নচিকেতার সমর্থন বুঝে নিতেও খুব অসুবিধা হত না। তাই সান্ত্বনা ছিল।
সে সান্ত্বনা অবশ্য দ্রুত অন্তর্হিত শুরু করল যখন দেখা গেল নচিকেতার মনকাড়া গান কমে আসছে, বেড়ে যাচ্ছে রেল দপ্তরের বিভিন্ন জলসায় তাঁর অনুষ্ঠান। রেলমন্ত্রী তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবর্তনের সরকার আসার পরে মন ছুঁয়ে যাওয়া গান কমা আর অনুষ্ঠান বাড়া আরো ত্বরান্বিত হল। যে শিল্পী একসময় আমাদের বলতেন “চল যাব তোকে নিয়ে, এই নরকের অনেক দূরে। এই মিথ্যে কথার মেকি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে”, তাঁর সবচেয়ে বড় মঞ্চ হয়ে দাঁড়াল একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ। একজন শিল্পী, তিনি বাম ডান যা-ই হোন, যখন নিজের শিল্পকে অপ্রধান করে ফেলেন, যখন তাঁর রাজনীতি তাঁর শিল্পের মধ্যে দিয়ে নয়, অন্য পথে প্রকাশ খোঁজে তখন তাঁকে সন্দেহ করতেই হয়। ভাঁড়ার খালি হয়ে গেছে বলে গানের ভান করে আখের গোছাচ্ছেন — এই সন্দেহ আর অমূলক থাকে না তখন। সেই সন্দেহই ক্রমশ প্রবল হয়েছে গত কয়েক বছরে। আর এখন, যখন পশ্চিমবঙ্গে আরেক পালাবদলের কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে, তখন কাটমানি নিয়ে তাঁর গান সেই সন্দেহকে আরো বাড়িয়েই তুলল।
মানুষ ভুল করে, আবার মানুষই সেই ভুল সংশোধন করে। সে দিক থেকে মত পরিবর্তন করার অধিকার সব মানুষেরই আছে, একজন শিল্পীর তো আছে বটেই। সুতরাং নচিকেতা একবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করেছেন বলেই যে সারাজীবন করে যেতে হবে একথা বলার নিশ্চয়ই মানে হয় না। শিল্পীকে চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হতেই হবে এবং শেষ অব্দি নিজের বিবেকের বাণী শুনতেই হবে। কিন্তু মুশকিল হল যে সরকারঘনিষ্ঠ শিল্পীদের বিবেক একমাত্র উল্টোদিকে শক্তিশালী (সে যে উপায়েই শক্তিশালী হোক) বিরোধী দল থাকলে তবেই জাগ্রত হয়, তাদের বিবেককে যাত্রার বিবেকের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায় না।
আজ সকালের কাগজে দেখলাম নচিকেতা সাফাই দিয়েছেন, গানটা সারা দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা নেত্রীদেরই বিরুদ্ধে। এবারেও একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে তাঁকে দেখা যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলে বলেছেন দিদি ডাকলে তিনি নরকেও চলে যাবেন। কারণ ব্যক্তিগত সম্পর্কই তাঁর কাছে আসল, পার্টি কোন ব্যাপার না। কথাটা কেমন সিগারেটের প্যাকেটের বিধিসম্মত সতর্কীকরণের মত শোনাল না? কাল সুভাষদার সাথে সম্পর্ক ভাল ছিল বলে উনি সিপিএমের ছিলেন, আজ দিদির জন্যে উনি তৃণমূলের, কাল অন্য কোন দাদার জন্যে বিজেপির হয়ে যেতেই পারেন — এমনটাই কি বলতে চাইলেন জীবনমুখী শিল্পী?

পুনশ্চ: সেদিন দেখি আমার নীলাঞ্জনা বাজার করছে। মাছ, মাংস, সবজি বিক্রেতাদের সাথে তার কথা বলার ধরণ দেখে অবাক হয়ে ভাবলাম “একে নিয়ে কবিতা লিখতাম!”

%d bloggers like this: