আরএসএসের পছন্দসই অগভীর বিরোধিতার মুখ বাবুল, শত্রুঘ্ন

বাবুল সুপ্রিয় ও শত্রুঘ্ন সিনহা
(ছবি ইন্টারনেট থেকে)

নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক, বামফ্রন্ট সরকার মধ্যগগনে। আমার এক পিসতুতো দিদির ছেলে একবার কোনো ক্লাসে উঠলে সেখানেই ঘাঁটি গেড়ে ফেলছে। তা নিয়ে তার বাবা, মা, মামা সকলেই চিন্তিত। আমার সিপিএম কর্মী বাবা সেই দিদির মামা হন, তার উপর পেশায় শিক্ষক। ফলে সে ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে পরামর্শ চাইল। কোনো জবাব দেওয়ার আগেই দিদির ভাইটি আমার বাবাকে বলল “দোষ তো আমার ভাগনার নয়, দোষ তো তোদের (বয়সের তফাত কম হওয়ায় ‘তুই’ সম্বোধনই চালু ছিল)। তোরা মুড়ি মিছরি এক দর কইরা দিছস। এমন ব্যবস্থা করছস যে রিকশাআলার পোলায় আমার ভাগনার পাশে বইস্যা ক্লাস করে। তাতে তার তো কোনো উন্নতি হয় না, কারণ তার ল্যাখাপড়ার কালচার নাই। উল্টা আমাদের ভদ্দরলোকের পোলাগুলার সব্বোনাশ হয়্যা যাইতাছে।” আমার বাবা ভাগ্নে-ভাগ্নী বলতে অজ্ঞান ছিলেন, তাই কোনো কড়া উত্তর দেননি। হেসে বলেছিলেন “অ, নাচতে শেখো নাই বইলা উঠানের দোষ দিতাছ।” বাড়ি ফিরে আমাকে বলেছিলেন “এদের কীরকম মানসিকতা দেখেছিস? রিকশাওলার ছেলে ওর ভাগ্নের সাথে এক ক্লাসে পড়ছে বলে ওর গায়ে ফোসকা পড়ছে। তার জন্যে নাকি ওর ভাগ্নের পড়াশোনা হচ্ছে না।”

এর কৃতিত্ব বা দোষ কতটা বামফ্রন্ট সরকারের জানি না। দেশের অনেক জায়গাতেই সেইসময় পর্যন্ত রিকশাচালকের ছেলেমেয়ে আর চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়ে এক স্কুলেই পড়ত, একসাথে খেলাধুলোও করত। একই পাড়ায় বিত্তশালীর প্রাসাদপ্রমাণ বাগানওলা বাড়ি থাকত, মধ্যবিত্তের একতলা বাড়ি থাকত, নিম্নবিত্তের টালির চালের বাড়িও থাকত। সেসব বাড়ির মধ্যে বাটি চালাচালির সম্পর্কও থাকত কখনো কখনো। এ কোনো সোনালি অতীতের আষাঢ়ে গপ্প নয়। তখনো বিলক্ষণ শ্রেণি বিভাজন ছিল, তিনতলা বাড়ির মেয়ের সাথে টালির বাড়ির ছেলের প্রেম হত না সিনেমার মত, বিয়েও নয়। কিন্তু এ বাড়ির দাদুর শ্রাদ্ধে ও বাড়ি থেকে চিঁড়ে-দই খাওয়ার লোক থাকত, ও বাড়ির ছেলের বিয়েতে এ বাড়ি থেকে অন্তত একজনের নেমন্তন্ন থাকত। ১৯৯১ সালের পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে বদলাতে এখন সব অলীক। এখন হয় ফ্ল্যাট, নয় ঝুপড়ি। হয় গেটেড কমিউনিটি, নয় বস্তি। যেখানে পাড়া অবশিষ্ট আছে, সেখানেও বাবা-মা কেবল নিজেদের দরের পরিবারের বাচ্চাদের সাথেই মেলামেশা করতে দেন নিজের ছেলেমেয়েকে। চাকুরিজীবীর ছেলের স্কুল আর রিকশাওলার ছেলের স্কুল আলাদা হবে — আমার পিসতুতো দাদার এই ফ্যান্টাসি এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। রিকশাচালক, বাড়ির কাজের দিদি, জনমজুরের ছেলেমেয়েরা পড়ছে টিমটিমে সরকারপোষিত স্কুলে, কারণ তাদের বাবা-মায়েদের ওটুকুই সাধ্য। আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়ছে ঝাঁ চকচকে প্রাইভেট স্কুলে। অর্থাৎ মনমোহনী অর্থনীতির তিরিশ বছরে অভূতপূর্ব বৈচিত্র্যহীন ঐক্য তৈরি হয়েছে এ দেশে। ইংরেজিতে যাকে ঘেটো বলে, গোটা দেশটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমন ঘেটোর সমাহার।

কেন এসব কথা লিখলাম? কারণ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের দেশ ভারতবর্ষ বিপন্ন বলে আমরা সকলেই খুব চিন্তিত। একটা করে নির্বাচনের ফল বেরোয়, বিজেপি জেতে, আর আমরা নানা রঙের বিজেপিবিরোধীরা, হতাশ হয়ে বা ক্রুদ্ধ হয়ে বলি “এ দেশটার কিস্যু হবে না। লোকে কেবল হিন্দু-মুসলমান বোঝে। আর কোনো ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামায় না।” এত বড় দেশে প্রত্যেক নির্বাচনেরই যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে সেগুলোর কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, ধর্মীয় বিভাজনকে প্রধান ইস্যু করে তোলার চেষ্টা নিঃসন্দেহে অনেকটাই সফল হয়েছে। নির্বাচনগুলোর ফলাফলে তার প্রভাব উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। কিন্তু সে বিভাজন দূর করার পথ খোঁজার সময়ে আমরা ভেবে দেখছি না, ধর্মীয় বিভাজনের ইমারত দাঁড়িয়ে আছে অন্য গভীরতর বিভাজনের উপর। আমি আপনার থেকে আলাদা। আমি আপনার চেয়ে বেশি রোজগার করি, আপনার চেয়ে দামি পোশাক পরি, আমার গাড়ি আছে আপনার নেই, অতএব আপনার সাথে আমার মেশা উচিত নয়। আমাকে মিশতে হবে আমার মত লোকেদের সাথে। এই ব্যাপারটা যদি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে আপনি আমার জানাশোনার বাইরে চলে যাবেন। ক্রমশ আপনার ভালমন্দে আগ্রহ হারাব, তারপর একসময় স্থির বিশ্বাস হবে যে আপনি বাঁচলেন কি মরলেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমি কেবল আমার মত লোকেদের সাথে মিশি, আপনি মেশেন আপনার মত লোকেদের সাথে — সমাজ যে এমনভাবে বিভক্ত হওয়াই উচিত, এই ধারণা একবার মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে অন্য যে কোনোরকম বিভাজন তৈরি করা জলভাত। যে অপর, সে অপ্রয়োজনীয়, এমনকি খারাপ — আগে একথা প্রতিষ্ঠা করুন। তারপর অপরের সংজ্ঞাটা দরকার মত বদলাতে থাকুন। সোজা হিসাব।

আমাদের দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় (নাকি সর্বত্রই?) এমনিতেই এক ধরনের অপরায়নের ভিত্তিতে পৃথকীকরণ কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে — বর্ণবাদ। তার সাথে বিশ্বায়নের যুগে যোগ হয়েছে শ্রেণিভিত্তিক পৃথকীকরণ, যা এতক্ষণ ব্যাখ্যা করলাম। এই দো-ফসলি জমিতে ধর্মীয় বিভাজনের ফসল ফলানো মোটেই কঠিন নয়। যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নিয়ে আমাদের গুমোর, সেই বৈচিত্র্য স্থানীয় স্তরে হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তৈরি জমিতেই বীজ বুনে ফসল তুলেছে। ভেবে দেখুন, ভারতের বাজার খুলে দেওয়া হল ১৯৯১ সালে, আমরা ‘আপওয়ার্ডলি মোবাইল’ হতে শিখে গেলাম। আর ১৯৮৯ সাল থেকে রক্তক্ষয়ী রথযাত্রার মাধ্যমে লালকৃষ্ণ আদবানি সঙ্ঘের যে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা সারা ভারতে ছড়িয়ে দিতে নেমেছিলেন, তার প্রথম বড়সড় সাফল্য এল ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্যে দিয়ে। ভারতে বহুজাতিকের পায়ের তলার মাটি যত মজবুত হয়েছে, তত মজবুত হয়েছে আরএসএসের মাটি। ১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া আরএসএস বরাবর সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে অবিচল থেকে কাজ করে গেছে। কিন্তু দেশভাগ, গান্ধীহত্যার মত ঘটনার পরেও প্রান্তিক শক্তি হয়েই থাকতে হয়েছিল। অথচ কম্পিউটারের ভারতে, উদারীকরণের ভারতে কিনা এই প্রাচীনপন্থী, ধর্মান্ধ সংগঠন ক্রমশ নিজের শক্তি বাড়িয়ে আজকের অপরাজেয় স্থানে পৌঁছতে পারল। একথা বললে ভুল হবে না, যে ভোগ্যপণ্যের বৈচিত্র্য আর বেসরকারিকরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে ও সমাজে আরএসএসের প্রভাব বেড়েছে। অটলবিহারী বাজপেয়ী আর মোদীর সরকারের রাজনীতি যতটা রক্ষণশীল, তাঁদের অর্থনীতি ততই উদারপন্থী। তথাকথিত খোলা হাওয়ার খোঁজ দিয়েছিল কংগ্রেস, সে হাওয়ায় পাল তুলে দেশকে মাঝসমুদ্রে নিয়ে গেছে আরএসএস। কারণ নব্বইয়ের দশক থেকে যে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি সারা পৃথিবীতে চালু হয়েছে নানা চেহারায়, তাতে যে বৈষম্য বাড়ে তা এখন বিশ্বব্যাঙ্কও স্বীকার করে। আর আগেই বলেছি, মূল বৈষম্যটা বাড়লে আর সবরকম বৈষম্য তৈরি করা যায়। অতএব ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করতে হলে ওটাই পথ।

বারবার আরএসএস কেন বলছি? বিজেপি বলছি না কেন? কারণ হিন্দুরাষ্ট্র বিজেপির এজেন্ডা নয়। বিজেপির কোনো দায়িত্বশীল নেতা ওই শব্দটি পারতপক্ষে উচ্চারণ করেন না, কাগজে কলমে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি সহস্রবার দেওয়া হলেও, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় না। ভীষণদর্শন সাধুসন্ন্যাসী বা হিন্দি বলয়ের কোনো কোনো নেতা ২০২৩ সালের মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে বলে কয়েকবার ঘোষণা করেছেন বটে, কিন্তু মোদী বা অমিত শাহের মত কেউ কখনো ওসব বলেন না। বুদ্ধিমান সাংবাদিক, বিশ্লেষকরা যারা ওসব বলে তাদের “ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট” (প্রান্তিক ব্যক্তি) বলে দাগিয়ে দেন। হিন্দি ভাষায় জনপ্রিয় প্রবাদ হল “হাথি কে দাঁত। খানে কে ঔর, দিখানে কে ঔর।” অর্থাৎ হাতি যে দাঁত দিয়ে খায়, সে দাঁত দেখায় না। আরএসএস অত্যন্ত বলশালী হাতি বৈ তো নয়। বিজেপিবিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী, বিশ্লেষক, আমরা চুনোপুঁটিরা — সকলেই বিস্তর আলাপ-আলোচনা করছি, ফন্দি আঁটছি, বিজেপিকে কী করে নির্বাচনে হারানো যায় তা নিয়ে। আর অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করছি, বিচার বিভাগ থেকে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিসবাহিনী — সবই “ওদের” লোকে ভর্তি। এই “ওরা” যে বিজেপি নয়, আরএসএস, তা বুঝতে পারলে এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না।

আরএসএস নিজেকে বলে সামাজিক সংগঠন, অর্থাৎ বর্তমান ভারতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুধু দলীয় রাজনীতির নয়, স্রেফ নির্বাচনী রাজনীতির তো নয়ই। লড়াইটা সামাজিক। আরএসএস নিজে সেভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে একশো বছর ধরে লড়ে এসেছে, দলীয় রাজনীতিকে সেই লড়াইয়ের একটা ফ্রন্টে পরিণত করেছে। আর আমরা ভাবছি, যেনতেনপ্রকারেণ আরএসএসের রাজনৈতিক শাখাকে ভোটে হারিয়ে দিলেই ঝামেলা চুকে যাবে।

আরএসএসের সমান বয়সী একটি রাজনৈতিক দল ছিল ভারতে — ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। সে দল ভাঙতে ভাঙতে শতধা বিভক্ত। প্রাচীন সংগঠনে এরকম ভাঙাগড়া হয়েই থাকে। কিন্তু মজার কথা, আরএসএসের মধ্যেও নানা দ্বিধা দ্বন্দ্ব আছে। তবু তারা এখনো ‘সঙ্ঘ পরিবার’। সর্বত্র বজরং দলের সাথে বিজেপির মতে মেলে না; বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রবীণ তোগাড়িয়াও প্রকাশ্যে মোদীর নিন্দা করেছেন। মাঝেমধ্যে খোদ আরএসএস বেসুরো গায়। অথচ মূল লক্ষ্য থেকে এরা কেউ কখনো সরে না। মুসলমান বিদ্বেষে সবাই এককাট্টা, রামমন্দির নিয়ে সবাই এককাট্টা। বিরোধীদের আঁচড়াতে, কামড়াতে, খুন করতে সবাই সমান উদ্যোগী। কমিউনিস্টরা কে বেশি কমিউনিস্ট তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে প্রচুর শক্তিক্ষয় করেন, করতে করতে শুধু ল্যাজের ডগা পড়ে আছে। সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যদের ওসব বদভ্যাস নেই।

আরও যা গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে রাখতে, হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন সার্থক করতে আরএসএস শুধু বিজেপির উপর দায়িত্ব দিয়ে বসে নেই। তারা জানে, সমস্ত প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত হওয়া সত্ত্বেও, ইলেকটোরাল বন্ডের কল্যাণে টাকার অঢেল জোগান থাকা সত্ত্বেও এত বড় দেশে সব নির্বাচন জেতা অসম্ভব। বিজেপি হেরে গেলেই হিন্দুরাষ্ট্র ফসকে যাবে? তা হতে দেওয়া যায় না। তাই “সেটিং” থাক আর না-ই থাক, অন্তত আরএসএসের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নয়, শক্তিশালী বিরোধী হিসাবে তেমন কিছু দলের উপস্থিতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কীভাবে করা হল তা হয়ত অতিদূর ভবিষ্যতে কোনো পরিশ্রমী গবেষক উদ্ঘাটন করবেন, কিন্তু আপাতত দেখাই যাচ্ছে, যিনি রথযাত্রায় আদবানির পাশে ছিলেন, আনন্দ পট্টবর্ধনের বিখ্যাত তথ্যচিত্র রাম কে নাম-এ যাঁকে আদবানির মঞ্চে মাইক হাতে দেখা যায়, সেই শত্রুঘ্ন সিনহা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। যে বাবুল সুপ্রিয় দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন বলে বহু মানুষ অভিযোগ করেন, সোশাল মিডিয়ায় বাঙালি মুসলমানদের বিদেশি বলেছেন একাধিকবার, তিনি বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসে প্রথম এগারোয় জায়গা পাচ্ছেন। প্রার্থী হচ্ছেন এমন আসনে, যেখানে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট। অবশ্য তৃণমূলের সর্বময় কর্ত্রী বহু আগেই রাখঢাক না করে বলেছিলেন তাঁর সমস্যা বিজেপিকে নিয়ে, আরএসএসকে নিয়ে নয়। গান্ধীজির বাঁদরদের মত মুখ, চোখ, কান বন্ধ করে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ এবং বিপ্লবী মানুষ সে কথা শুনতে বা দেখতে পাননি, তাঁর দল সম্পর্কে মানুষকে সাবধানও করেননি। নিশ্চয়ই সে কারণেই মমতা আত্মবিশ্বাসী, যে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের সংখ্যালঘু মানুষ বাবুলকে ভোট দিন আর না-ই দিন, ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা নিশ্চয়ই দেবেন। আসানসোলের সংখ্যালঘু মানুষ শত্রুঘ্নকে ভোট না দিলেও ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা নিশ্চয়ই দেবেন। কারণ বিজেপিকে ভোট না দিলেই যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত বেঁচে যাবে — এ বিশ্বাস বহু মানুষের। তাঁরা আরএসএসকে দেখতে পান না। যাঁদের দেখিয়ে দেওয়া দায়িত্ব তাঁরা দেখতে দেন না।

শুধু তৃণমূল কংগ্রেস নয়। বিলীয়মান কংগ্রেসের জায়গা নেবে বলে যে দলটার উপর গত কয়েকদিন বহু বিজেপিবিরোধী মানুষ ভরসা করতে শুরু করেছেন দেখছি, সেই আম আদমি পার্টি দুটোর জায়গায় দশটা রাজ্যে ক্ষমতায় এলেও আরএসএসের ক্ষতি নেই। বহু কমিউনিস্টও দেখছি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিল্লি সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম দেখে আপ্লুত। মনমোহনী অর্থনীতির আমলে বামপন্থীদেরও যে নিজেদের রাজনীতি গুলিয়ে গেছে তার এর চেয়ে ভাল প্রমাণ সম্ভবত নেই। তাঁরা ভেবেও দেখছেন না, কেজরিওয়াল যা করছেন তা আসলে রাজীব গান্ধীর আমলের কংগ্রেসসুলভ কাজ। তফাতের মধ্যে কংগ্রেসের মত দুর্নীতি আপ দলে নেই। কেজরিওয়াল একাধিকবার বলেছেন, তিনি বামপন্থী নন, দক্ষিণপন্থীও নন। কার্যক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তিনি হয় কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নেন না, নয় আরএসএসের পছন্দের অবস্থান নেন। দিল্লি দাঙ্গায় তাঁর দল কোনো সক্রিয়তা দেখায়নি। উপরন্তু নিজের দলের মুসলমান কাউন্সিলর তাহির হুসেনের পাশেও দাঁড়ায়নি। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার সমর্থন করেছিল। অর্থাৎ আপ আপনাকে ভাল রাস্তা দিতে পারে, ভাল স্কুল ও হাসপাতাল দিতে পারে, শস্তায় জল ও বিদ্যুৎ দিতে পারে। তবে তাদের শাসিত রাজ্যে গণহত্যা হয়ে গেলে তারা মাথা ঘামাবে না। অর্থাৎ আপ হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার পথে বাধা নয়।

যেমন বাধা নন ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক। মমতা, কেজরিওয়াল, নবীন — এঁরা কেবল ‘গোদি মিডিয়া’ নয়, ভারতের সব মিডিয়ার মতেই দারুণ ভাল। কারণ এঁরা “গুড গভর্ন্যান্স” (সুশাসন) নামক একটি জিনিস সরবরাহ করেন। সেটি দুলালের তালমিছরির মত এক অরাজনৈতিক অমৃত। এঁদের দেখিয়ে মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে — সুশাসন মানে হল রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল ও ভর্তুকি। কর্মসংস্থান নয়, আইনশৃঙ্খলা নয়, জাতীয় রাজনীতির ইস্যুতে সঠিক অবস্থান নেওয়াও নয়। এই মানদণ্ড মেনে নিতে অসুবিধা না থাকলে কিন্তু মানুষ যোগী আদিত্যনাথকে আবার ভোট দিল বলে রাগ করা চলে না। কারণ রাস্তাঘাট নিয়ে ওই রাজ্যের মানুষের বিশেষ অভিযোগ নেই। স্কুল, হাসপাতাল না দিতে পারলেও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার বিনামূল্যে রেশন দিয়েছে। কোভিডে মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণও দিয়েছে।

ভারতে একজন বিরোধী নেতা আছেন, যিনি মানেন লড়াইটা আসলে সামাজিক এবং বলেন যে লড়াই আসলে আরএসএসের বিরুদ্ধে। তিনি রাহুল গান্ধী। কিন্তু সমস্যা হল, তিনি সোশাল মিডিয়ার নেতা। ইদানীং দিব্য বাগ্মী হয়ে উঠেছেন, কিন্তু রাস্তায় নামেন কালেভদ্রে। ইউটিউব, ফেসবুক আর টুইটারে লাইকের মূল্য যে রাজনীতির ময়দানে শূন্য — তা তিনি বোঝেন বলে মনে হয় না। বহু বিজেপিবিরোধীর একটি পাহাড়প্রমাণ ভ্রান্তি আছে। তা হল, বিজেপি শাসনের ভিত্তি সোশাল মিডিয়া। একশো বছর ধরে আরএসএসের তৃণমূল স্তরে গিয়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে কাজ করার ব্যাপারে কোনো ধারণা না থাকাই এই ভ্রান্তির মূলে। সম্ভবত রাহুলও এতেই ভোগেন। গত কয়েক বছরে রাহুলের কথাবার্তা থেকে বোধ হয়, তিনি বোঝেন মৌলিক বিভাজনগুলোর সাথে লড়াই না করে উপরিতলের ধর্মীয় বিভাজন দূর করা যাবে না। আরএসএসকে হারানোও যাবে না। কিন্তু সে ক্ষমতা তাঁর তো নেই বটেই, তাঁর দলেরও নেই। প্রাক-স্বাধীনতা যুগের কংগ্রেস বা লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সময়কার কংগ্রেসেও দেশের ধনীদের যথেষ্ট উপস্থিতি থাকলেও সাধারণ, গরীব মানুষের সাথে কিছু সংযোগ ছিল। ইন্দিরার সময় থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছে, যার শীর্ষবিন্দু ছিল জরুরি অবস্থা। কিন্তু সে আমলেও অর্থনৈতিকভাবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের রাস্তায় থাকার প্রচেষ্টা ছিল। রাজীবের সময় থেকে তা-ও কমতে শুরু করে, নরসিমা-মনমোহনে এসে কংগ্রেসের সর্বার্থে উচ্চকোটির দক্ষিণপন্থী পার্টি হওয়া শুরু হয়। আবার নরসিমার এক সময়কার মিডিয়া উপদেষ্টা পিভিআরকে প্রসাদ লিখেছেন, নরসিমার নাকি ইচ্ছে ছিল বিজেপির আগেই অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করা। সেই উদারপন্থী অর্থনীতি আর হিন্দুত্বের সহাবস্থানের গল্প। এমনি এমনি তো তাঁকে ভারতের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী বলেন না কেউ কেউ। কংগ্রেস এখনো সেই পথেই চলেছে, রাহুল একা চাকা উল্টোদিকে ঘোরাবেন কী করে?

তাহলে আরএসএসের বিরুদ্ধে সামাজিক লড়াই লড়বে কারা? লালুপ্রসাদ, মুলায়ম সিং, মায়াবতীদের রাজনীতি নির্বাচনী লড়াইয়ে আর ফল দিচ্ছে না মানে তো এই নয়, যে দেশের নিম্নবর্গীয় মানুষ এখন খুব ভাল আছেন। জাতপাতের বৈষম্য বরং গভীরতর হয়েছে, শ্রেণিবৈষম্যের কথা আগেই বলেছি, আর ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য তো ভয়াবহ স্তরে পৌঁছেছে। এইসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে একযোগে লড়ার নতুন রাজনীতি করবে কারা?

কেবল ভোটের পাটিগণিতে কিন্তু এ আঁধার থেকে মুক্তির পথ পাওয়া যাবে না।

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

প্রজাতন্ত্রসাধনা

বেহুলা লখিন্দরের বাসরে একটা মাত্র ছিদ্র ছিল। সেখান দিয়েই প্রবেশ করেছিল কালনাগিনী। আমাদের প্রজাতন্ত্রের বাসরে শুরু থেকেই অজস্র ছিদ্র

কী শিখেছ স্কুলে আজ
বলো দেখি বাছা?

শিখেছি স্বাধীন সব মানুষ ধরায়
স্কুলেতে তো আমাদের তেমনই পড়ায়।

What did you learn in school today
Dear little boy of mine?

I learnt that everybody’s free
That’s what the teachers said to me.
—Tom Paxton

তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। স্কুলে বেশ নামডাক হয়েছে বক্তা হিসাবে। অতএব মাস্টারমশাইদের একজন বললেন প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে হবে ছাত্রদের পক্ষ থেকে। বক্তৃতা তৈরি করে সহকারী প্রধান শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র মণ্ডলকে শুনিয়ে আসতে হবে আগেই। পূর্ণবাবুকে শোনাতে যেতেই তিনি মৃদু হেসে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন “আর যা-ই বল বাবা, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় বলে দিস না। তুই তো আবার কমিউনিস্ট লোকের ছেলে…”

তখন অবশ্য আমার আজাদিকে মোটেই ঝুটো মনে হত না, আর বাবা আমাকে শিখিয়ে পড়িয়েও দিতেন না। সুতরাং ২৬শে জানুয়ারি হেড স্যারের ঘরের সামনে বসানো মাইকে যে ভাল ভাল কথাগুলো বললাম সেগুলো বিশ্বাস করেই বললাম। মাস্টারমশাইরা বিস্তর পিঠ চাপড়ে দিলেন, বন্ধুরা কেউ কেউ চোখ গোল গোল করে বলল “কী করে তুই এরকম বলতে পারিস!” আমি মহা খুশি। আহা! আমার স্বাধীনতা, আমার প্রজাতন্ত্র।

ক্রিকেট খেলায় ব্লাইন্ড স্পট বলে একটা ব্যাপার আছে, যেখানে বল পড়লে ব্যাটসম্যানের প্রতিক্রিয়ার বিকল্প অত্যন্ত সীমিত। বলটাকে আক্রমণ করা প্রায় অসম্ভব। অধিকাংশ ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে সেটা লেগ স্টাম্পের বাইরের এলাকা। তাই আইন অনুযায়ী সেখানে পিচ পড়া বলে লেগ বিফোর উইকেট আউট দেওয়া যায় না। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ব্লাইন্ড স্পটগুলো সম্পর্কে তখনো কিছুই জানতাম না।

দেশমাতৃকা কী বিলক্ষণ জানতাম। কিন্তু মণিপুরের মায়েদের কথা জানতাম না। আমার সেই অপাপবিদ্ধ প্রজাতন্ত্র দিবসের বছর দশেক পরে তাঁরা উলঙ্গ হয়ে রাজপথে দাঁড়াবেন, হাতের ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকবে “INDIAN ARMY RAPE US”। ততদিনে ইরম শর্মিলার অনশনের চার বছর অতিক্রান্ত।

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মে বিলাসিতা যেমন জানি না তখনো, তেমনি খিদে কাকে বলে তা-ও সম্যক জানি না। রোজ রাতে যারা জল খেয়ে ঘুমোয় তারাও যে প্রজাতন্ত্রের ব্লাইন্ড স্পট সে কথাও আমার বোঝা হয়নি।

আমার কাছে জম্মু-কাশ্মীর মানে তখন শর্মিলা ঠাকুর আর শাম্মি কাপুর। AFSPA যে কত বড় chutzpah সেকথা জানারও প্রশ্নই ছিল না সেই প্রজাতন্ত্র দিবসে।

যতদূর মনে পড়ে, আদিবাসীদের জীবন আর জল জঙ্গল থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়া আটকাতে যুগ যুগ ধরে তাদের অনন্ত লড়াই যে ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারিতেও থামতে পারেনি সে কথাও তখন জানা ছিল না আমার।

বয়স আন্দাজে সে হয়ত আশ্চর্য নয়, যা আশ্চর্য তা হল আমি জানতাম সংবিধান প্রণেতা হলেন বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর। যেন ঐ একটি লোক একা একা দক্ষিণের জানলা খুলে বসে বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে লিখে ফেলেছিলেন কয়েকশো পাতার একখানা নিয়মাবলী, যা পুঙখানুপুঙখ অনুসরণ করে এত বড় দেশটা চলবে। সুতরাং সংবিধানটা ভাল হলে সব কৃতিত্ব আম্বেদকরের, মন্দ হলেও ঐ একজনকে গালাগাল দিলেই যথেষ্ট। সংবিধান সভা ব্যাপারটার কোন অস্তিত্ব আমার চেতনায় বহুকাল ছিল না। এমনকি ক্লাস নাইন টেন পর্যন্ত পাঠ্য ইতিহাস বইতেও সেটা নামমাত্র।

আম্বেদকর সম্পর্কেই বা কী জানতাম? একটা চশমা পরা টাক মাথা গোল মুখো লোক, যিনি সংবিধান প্রণেতা। ব্যাস! এটুকুই। ইতিহাস বইতে গান্ধীজির জন্যে অনেকগুলো পাতা বরাদ্দ। নেতাজীর জন্যেও কম নয়। নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতা সংগ্রামী — তাও পড়েছি। মৌলানা আবুল কালাম আজাদও স্বাধীনতা সংগ্রামী, সুপণ্ডিত, কংগ্রেস সভাপতি ইত্যাদি। হয়ত বাম শাসিত রাজ্য বলেই স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে মাস্টারদা সূর্য সেন বা ভগৎ সিংও তখন ব্রাত্য ছিলেন না। এমনকি মহারাষ্ট্রের চাপেকর ভ্রাতৃদ্বয়ের সশস্ত্র আন্দোলন প্রসঙ্গে বিনায়ক দামোদর সাভারকরও ছিলেন (গভর্নর জেনারেলকে অজস্র মার্সি পিটিশন লেখা এবং মুক্তি পাওয়ার পর ভোল পাল্টে ফেলার ইতিহাস ছিল না অবশ্য)। আম্বেদকর সম্বন্ধে কিন্তু ঐ এক লাইন।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাঁর আজীবন সংগ্রামের কথা পড়তে পাইনি আমরা। গান্ধীর সাথে তাঁর পুনা চুক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি মাইল ফলক বলে লেখা হয়েছিল। কিন্তু চুক্তিটা কী এবং কেন সেসব আমাদের জানা হয়নি। সাবালক হতে হতে আমরা জেনেছি নেহরুর লেখা বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘The Discovery of India’, গান্ধীর আত্মকথা ‘My experiments with truth’। কিন্তু আম্বেদকর যে সংবিধান ছাড়া জীবনে আর কিছু লিখেছেন তার কোন লক্ষণ দেখিনি আমরা। ‘Annihilation of caste’ নামক অদ্বিতীয় বইটা (আদপে বক্তৃতা) পড়তে আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেল।

অবশ্য আম্বেদকর সম্বন্ধে আরেকটা জিনিস স্কুল ছাড়ার পরে পরেই জেনে ফেলেছিলাম আমরা। “লোকটা কাস্টের ভিত্তিতে রিজার্ভেশন করে দেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।“ অর্থাৎ ঐ সিদ্ধান্তটার দায়ও একা ঐ লোকটার ঘাড়েই চাপে। আমার বাবা বলতেন “সব ব্যাটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর”। এও সেই ব্যাপার। কাস্ট কোথা থেকে এল, কেন এল, কত হাজার বছর ধরে তার অন্যায় সুবিধা কে ভোগ করল, কারা এখনো ভোগ করছে — সেসব কিছুই জানা হল না। সংবিধান সভা কী, তার সদস্য কারা ছিলেন, কিভাবে সেখানে প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংবিধান প্রণয়ন হয়েছে — তাও জানার দরকার পড়ল না। ফলে কাস্ট তৈরি করার দোষ মনুর ঘাড়ে চাপল না, চাপল আম্বেদকরের ঘাড়ে।

কত কী যে জানা হয়নি! পাঠ্য যে কত কিছু অপাঠ্য করে রেখেছিল! প্রজাতন্ত্রেও যে কত দেওয়াল তুলে রেখেছি আমরা! হিন্দুরা সর্বক্ষণ আলোচনা করে যে মুসলমানরা ঘেটো বানিয়ে বাস করে, ওদের আরো খোলামেলা হওয়া উচিৎ। অথচ হিন্দু বন্ধুরা মিলে একসাথে জমি কিনে কো-অপারেটিভ আবাসন তৈরি করার পরিকল্পনা করে মুসলমান বন্ধুর সামনেই, তাকে কখনো বলে না “তুইও আমাদের সাথে ফ্ল্যাট কেন।” মহানগরগুলোতেও নিরামিষাশীদের হাউজিঙে আমিষাশীর জায়গা হয় না।

বেহুলা লখিন্দরের বাসরে একটা মাত্র ছিদ্র ছিল। সেখান দিয়েই প্রবেশ করেছিল কালনাগিনী। আমাদের প্রজাতন্ত্রের বাসরে শুরু থেকেই অজস্র ছিদ্র। সেসব ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়েছে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের শত সহস্র সাপ। ছিদ্রগুলো আম্বেদকর গোড়াতেই দেখতে পেয়েছিলেন। তাই সংবিধান সভায় তাঁর শেষ বক্তৃতায় ভারতে গণতন্ত্র টিকবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। টিকিয়ে রাখতে হলে তিনটি পদক্ষেপ জরুরী বলে উল্লেখ করেছিলেন। তৃতীয়টি নিয়ে গড়িমসি আমাদের আজকের দুর্দিন ঘনিয়ে তুলেছে বলে মনে হয়:

তৃতীয় যে কাজটা আমাদের করতেই হবে তা হল রাজনৈতিক গণতন্ত্র হয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। আমাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে সামাজিক গণতন্ত্রে পরিণত করতে হবে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র স্থায়ী হতে পারে না যদি তার ভিত সামাজিক গণতন্ত্র দিয়ে তৈরি না হয়। সামাজিক গণতন্ত্র মানে কী? মানে এমন এক জীবনচর্যা, যা স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীকে জীবনধারণের মূল নীতি বলে মনে করে। এই তিনটে নীতিকে আলাদা করে দেখলে চলবে না। এদের একত্রে ভাবতে হবে কারণ কোন একটা অনুসরণ না করা হলেই গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়…। ২৬শে জানুয়ারি ১৯৫০ আমরা এক স্ববিরোধী জীবন শুরু করতে চলেছি। রাজনৈতিক জীবনে সাম্য থাকবে, অর্থনৈতিক আর সামাজিক জীবনে থাকবে অসাম্য…। কতদিন আমরা এই স্ববিরোধ চালিয়ে যাব? কতদিন সমাজে, অর্থনীতিতে মানুষকে সাম্য থেকে বঞ্চিত করব? যদি বেশিদিন তা করি তাহলে তা আমাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবে।

আম্বেদকরের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়ার মুখে। ব্লাইন্ড স্পটগুলো চওড়া হতে হতে ব্ল্যাকহোলে পরিণত। সবচেয়ে বড়টার নাম কাশ্মীর, পিছু পিছু উত্তরপ্রদেশ।

আশার কথা এই যে সংবিধানের প্রস্তাবনায় যাদের “We, the people of India” বলা হয়েছে তারা এই প্রথম বিপুল সংখ্যায় সংবিধান কী এবং কেন, প্রজাতন্ত্র ব্যাপারটাই বা কী — এসব জিজ্ঞেস করছে। যারা এই সংবিধানের বিনাশ চায় তারাও এমন তেড়ে গাল দেয়নি আগে। তার ফলে সংবিধান সম্বন্ধে আগ্রহ বাড়ছে। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ একত্রে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়ছেন, সংবিধান বাঁচাতে হবে বলে মিছিল করছেন — এমন প্রজাতন্ত্র আমরা আগে দেখিনি।

স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে জায়গা না পাওয়া আম্বেদকর এখন মিছিলে। জামা মসজিদের সিঁড়িতে দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ রাবণের হাতে, ধর্মতলার ধরনায় বর্ণহিন্দু ছাত্রীর হাতে। এমন প্রজাতন্ত্র দিবস আমাদের ইতিহাসে সম্ভবত আগে আসেনি। রাস্তায় অতন্দ্র মায়েরা বলছেন “বালাই ষাট”।

*ভাষান্তর আমার

আমার সন্ততি

ভেবে দেখলাম যে অক্ষয় ধন আমার সন্তানকে দিয়ে যেতে পারি তা হল সমাজ, সংসারের সঙ্গে, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোধ

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

— শঙ্খ ঘোষ (বাবরের প্রার্থনা)

যেদিন বাবা হয়েছি সেদিন থেকে ভেবে চলেছি, মানুষ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় সন্তানকে যা যা দিয়ে যেতে পারে তার মধ্যে কোনটা সবচেয়ে মূল্যবান?
অনেকে টাকাপয়সা, ধনসম্পদ দিয়ে যান। টাকার দাম মুদ্রাস্ফীতির কারণে দিন দিন কমে, সম্পত্তির মূল্যও নানা কারণে বাড়ে কমে। কথায় বলে কুবেরের ধনও ফুরিয়ে যায়। ফলে সন্তানকে যত ধনসম্পত্তিই দিয়ে যান না কেন, তার মূল্য অবিকৃত থাকবে না।
সফল, কৃতি মানুষেরা তাঁদের সন্তানদের খ্যাতি দিয়ে যান। কিন্তু সেই খ্যাতি বজায় রাখতে হলে সন্তানকেও বিখ্যাত বাবা কি মায়ের মত প্রতিভাবান এবং সফল হতে হয়, যা প্রায়শই হয় না। উপরন্তু বাবা-মায়ের খ্যাতির অপব্যবহার করে সন্তান তাঁদের দুর্নামের কারণ হচ্ছে — এমন দৃষ্টান্তই চোখে পড়ে বেশি। উপেন্দ্রকিশোরের পরে সুকুমার, সুকুমারের পর সত্যজিৎ নেহাতই ব্যতিক্রম। সে জন্যেই মনে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্রের পরে নারায়ণচন্দ্রই বরং বেশি দেখা যায়।
আমরা সাধারণ মানুষ। এ যুগে সন্তানের ভোগ করার মত যথেষ্ট সম্পত্তি রেখে যাওয়ার সুযোগ আমাদের অনেকেরই হবে না। মৃত্যুর পরেও সন্তান “অমুকের ছেলে” বা “তমুকের মেয়ে” হিসাবে সমাজে অতিরিক্ত সম্মান, সুযোগসুবিধা বা খ্যাতি ভোগ করবে তেমন সম্ভাবনাও নেই। তবে কি এমন কিছুই নেই যা আমাদের মৃত্যুর পরেও সন্তানদের সম্পদ না হোক, অন্তত ছাতা হিসাবে কাজ করতে পারে? আমার সন্তানের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সীমা তবে আমার শরীর? সেই শরীর অবলুপ্ত হওয়ার পর আমার সাথে সম্পর্কের কোন মূল্যবান অর্জন তার কাছে থাকবে না? তাহলে কেন দেশ কাল নির্বিশেষে বাবা-মায়েরা নিজের জীবনের চেয়েও সন্তানের মঙ্গলকে ঊর্ধ্বে স্থান দেন? আমাদের অষ্টাদশ শতকের কবির কেন মনে হল ঈশ্বরীর দেখা পেলে বাংলার নিরক্ষর পাটনী প্রার্থনা করবে “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”? প্রায় তিনশো বছর পরের কবির কেন মনে হল ভাগ্যান্বেষী উজবেক যোদ্ধা বাবর, যার সাথে সেই বাঙালি পাটনীর কোন দিক থেকে কোন মিল নেই, তিনিও নিজের ঈশ্বরের কাছে বলতেন, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার সন্তানের জীবন দাও? কবির কল্পনা তো আকাশ থেকে পড়েনি, এমনই আকুতি বিভিন্ন ভাষায় কত বাবা-মাকে তো আজও উচ্চারণ করতে দেখি আমরা। সেই বাবা মায়েরা তাহলে জীবন ফুরোলেই ফুরিয়ে যাবেন সন্তানের কাছেও?
কেউ কেউ বলবেন বাবা-মা শিক্ষা দেন, জীবনে নিজের পায়ে দাঁড় করান। সেটাই তো সারাজীবন সঙ্গে থাকে। সেকথা ঠিক, কিন্তু সে অবদান বাবা-মায়ের অনন্য অবদান নয়। মানুষ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের থেকেও শিক্ষা পায়, সর্বোপরি শিক্ষক শিক্ষিকাদের থেকে পায়। এবং যে শিক্ষা সে পায় তার বেশিরভাগটাই স্বোপার্জিত। বাবা-মা বড় জোর সুযোগ তৈরি করে দেন।
ভেবে দেখলাম যে অক্ষয় ধন আমার সন্তানকে দিয়ে যেতে পারি তা হল সমাজ, সংসারের সঙ্গে, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোধ। সুসময়ে, এবং দারুণ দুঃসময়ে, সেই বোধ তাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের প্রত্যেককে আমাদের বাবা-মায়েরাও জেনে বা না জেনে ঐ বোধই দিয়ে গেছেন, দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাসের কোন মুহূর্তে ঠিক কোন জায়গাটায় আমি দাঁড়িয়ে আছি এবং তার সাপেক্ষে বর্তমানে আর ভবিষ্যতে আমার কোথায় দাঁড়ানো উচিৎ সেই বোধ সচেতন বাবা-মায়েরা আমাদের দিয়ে যান জেনে বুঝে। আর যে বাবা-মায়েরা তত সচেতন নন আসলে তাঁরাও স্থান নির্দেশ করে দিয়ে যান তাঁদের কথাবার্তায়, জীবনচর্যায়।
কথাটা নতুন করে উপলব্ধি করলাম টিভিতে তথাকথিত গোরক্ষকদের হাতে নিহত পুলিশকর্মী সুবোধ কুমার সিং এর ছেলে অভিষেকের কথা শুনতে শুনতে।
সুবোধ কুমার খুন হওয়ার পর যত সময় যাচ্ছে তত পরিষ্কার হচ্ছে যে খুন হওয়ার দিনের ঘটনাবলী সুপরিকল্পিত, হঠাৎ উত্তেজিত জনতা তাঁকে হত্যা করেনি। তিনি সাম্প্রতিক অতীতে গোহত্যার “অপরাধে” প্রথম যে খুনটা হয়েছিল দাদরিতে, সেই খুনের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। সেই খুনের অপরাধীদের হাজতবাস করার পেছনে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। বদলি হয়ে বুলন্দশহরে এসে পড়ার পরেও আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে আপোষ না করে তিনি হিন্দুত্ববাদীদের যথেষ্ট বিরাগভাজন হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী বলেছেন সুবোধ কুমারকে প্রায়শই খুনের হুমকি দেওয়া হত। খবরে প্রকাশ বিজেপি নেতারা বুলন্দশহর থেকে তাঁর বদলি দাবী করেছিলেন অতি সম্প্রতি। বিপদের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন জেনেও সুবোধ কুমার ঘটনার দিন পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসাবে যা কর্তব্য ঠিক তাই করছিলেন। কোন সাহস তাঁকে প্রণোদিত করেছিল তা বলার জন্যে তিনি নেই, তা দেশ হিসাবে আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু বাবা হিসাবে তাঁর সাফল্য এই অন্ধকারে আমাদের ক্ষীণ আলো দেখাচ্ছে।
সকালের কাগজে মুন্ডিতমস্তক যে ছেলেদুটির ছবি কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বসা আমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলছিল, সেই বাবা হারা কিশোর যখন টিভির পর্দায় বলে “শুধু মুখ্যমন্ত্রীকে নয়, সারা ভারতের লোকের কাছে আমার আবেদন, হিন্দু মুসলমান নিয়ে দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হিংসা দয়া করে বন্ধ করুন,” তখন বোঝা যায় সুবোধকুমার ছেলেটির সঙ্গেই আছেন।
আরো পরিষ্কার হয় যখন অভিষেক বলেন “আমার বাবা একটা কথাই বলতেন ‘আর কিছু হতে পার না পার, সুনাগরিক হও। সব ধর্ম, সব জাতির লোকই এক। তুমি কারো চেয়ে বড় নও, কারো চেয়ে ছোটও নও।”
বাবা খুন হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে এই ভাষায় এই কথাগুলো বলতে পারা মুখস্থ বিদ্যায় সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যে বিদ্যার বলে মধ্যে মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর বন্দনা করেন সে বিদ্যার কর্ম নয় এসব। অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে শুধু ক্রিয়া, বিশেষণের জোরে এসব কথা বেরোয় না। অভিষেক যখন আমাদের সবাইকে সাবধান করেন এই বলে যে আমরা আত্মহননের পথে এগোচ্ছি; পাকিস্তান, চীনের দরকার নেই, আমরাই একে অপরের অনেক বড় শত্রু হয়ে উঠছি; তখন বোঝা যায় অভিষেকের প্রয়াত বাবা, এবং অবশ্যই মা, এই যুগসন্ধিক্ষণে তার যে স্থান নির্দেশ করেছেন সে সেই স্থানের যোগ্য হয়ে উঠছে। এইখানে মৃত সুবোধ কুমারের জিত, হত্যাকারীদের হার। হত্যাকারীদের সরকার তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ করুক আর না-ই করুক, সুবোধ কুমার সন্তানের মধ্যে বেঁচে রইলেন। আমাদেরও বাঁচার রাস্তার সন্ধান দিলেন।
এত কথা বলার পরে একটা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। সন্তান কি সবসময় বাবা-মায়ের দেখানো অবস্থান মেনে নেয়? নেয় না। প্রকৃতপক্ষে সর্বদা মেনে নেওয়া উচিৎও নয়। কারণ অনেক বাবা-মা এমন অবস্থানও ঠিক করেন যা সমাজের পক্ষে, সন্তানের চারপাশের মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, পশ্চাৎমুখী। সেইসব বাবা-মায়েদের অবাধ্য সন্তানেরাই যুগে যুগে সমাজকে বদলে দেন, এগিয়ে নিয়ে যান। সেই জন্যেই আমাদেরও বারবার ভাবতে হবে সন্তানকে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে বলছি। কার পক্ষে, কার বিপক্ষে? তাকে যে অবস্থান নিতে শেখাচ্ছি তা শুধু তার জন্যে ভাল, না আর পাঁচজনের জন্যেও ভাল — সেকথাও ভাবতে হবে। এমনি এমনি তো আর ঠাকুমা, দিদিমারা বলতেন না “প্রসব করলেই হয় না মাতা।”

কাঁটাতারের এপার ওপার

বেশ তো চলছিল। গোমাংস খেয়েছে, পিটিয়ে মার। গরু চুরি করছিল, পিটিয়ে মার। কী খাচ্ছিস? টিফিন বক্সে কী আছে? মার শালাকে। হাতে গরম কোন কারণ থাক আর না-ই থাক। পিটিয়ে মার, কারণ এরা বেঁচে থাকলেই সন্ত্রাসবাদী হবে। হয় গণপিটুনিতে মার, নইলে পুলিশ দিয়ে এনকাউন্টারে মার। আইন, আদালত এসবের কোন দরকার নেই। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা সব দেবনিযুক্ত

স্ত্রী এলসা, পুত্র ব্রুনো আর কন্যা গ্রেটেলকে নিয়ে র‍্যালফের সুখের সংসার। কর্মক্ষেত্রে সফল লোকেদের যেমন হয় আর কি। সুখ আরো বেড়ে গেল যখন তার পদোন্নতি তথা বদলি হল। কোথায়? পোল্যান্ডে।
কী করে র‍্যালফ? সে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ, সৎ নাজি। ফুয়েরারের প্রতি আনুগত্যে তার এক বিন্দু গাফিলতি নেই। সে জন্যে সে নিজের মা-কেও অপছন্দ করে। কারণ তিনি প্রকাশ্যেই বেসুরো গেয়ে ওঠেন অনেক সময়। ছেলের উন্নতিতে আর সকলে খুশি হলেও তিনি খুশি হন না।
সে যা-ই হোক, নতুন জায়গায় গিয়ে ব্রুনো কিন্তু একেবারেই খুশি হয় না কারণ সেখানে তার সাথে খেলার মত কেউ নেই। এটা বারণ, সেটা বারণ। এমনকি বাড়ি সংলগ্ন বাগানের বাইরে যাওয়াও বারণ। গৃহশিক্ষকের কাছে ইহুদীবিদ্বেষ শিক্ষা চলে ব্রুনো আর তার দিদির। সেসব কিছুই ব্রুনোর কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে না। বাড়িতে চাকর হিসাবে যে ইহুদীকে সে দেখতে পায় তার সাথে গৃহশিক্ষকের বর্ণনার ইহুদীর কোন মিলই নেই যে। ২০০৮ এ মুক্তি পাওয়া ছবি ‘The Boy in the Striped Pajamas’ এর বাকি গল্পটা সংক্ষেপে বলা যাক।
বাড়ির সকলের নজর এড়িয়ে, আধখোলা গেটের সুযোগ নিয়ে ব্রুনো একদিন চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্যহীন পদক্ষেপে সে পৌঁছে যায় একটা কাঁটাতারে ঘেরা এলাকার বাইরে। নাজি, ফুয়েরার, ইহুদী — এই শব্দগুলো এক জায়গায় ব্যবহৃত হওয়ার পর কাঁটাতার শব্দটা এসে পড়লে আজ আর কাউকে বলে দেওয়ার দরকার হয় না যে জায়গাটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। কিন্তু ব্রুনো নাজি জার্মানিতে জন্মানো এক নিষ্পাপ শিশু। সে জানত না কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কী জিনিস। সে এও জানত না যে ঐ ক্যাম্পের কম্যান্ড্যান্ট স্বয়ং তার বাবা। সে বরং খুশি হয় তারের ওপারে ডোরাকাটা ঢলঢলে শার্ট আর পাজামা পরা এক সমবয়স্ক বন্ধুকে পেয়ে। সকলের অলক্ষ্যে এই বন্ধুত্ব বেড়ে চলে, যতদিন না ব্রুনোর মা এলসা স্বামীর কাজটা আসলে কী সেটা টের পেয়ে ছেলেমেয়েকে এই কুপ্রভাব থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে। ব্রুনোর বন্ধু শ্মুয়েল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বাস করেও বোঝেনি ওখানে কী ঘটে আসলে। তাই তার বাবার অন্তর্ধানে সে যারপরনাই বিস্মিত এবং বাবাকে খুঁজে বার করবে ঠিক করেছে। ব্রুনো তাকে সাহায্য করতে চায়। তাই শ্মুয়েল খুঁজে পেতে আরেক জোড়া পোশাক নিয়ে আসে। ব্রুনো সেই পোশাক পরে ঢুকে পড়ে ক্যাম্পে। যতক্ষণে তাকে বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে কম্যান্ড্যান্ট র‍্যালফ সদলবলে তার খোঁজ করতে করতে যথাস্থানে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে গ্যাস চেম্বারে একদল অপরিচিত ইহুদীর সাথে বিশুদ্ধ আর্য রক্তের ব্রুনো প্রাণ ত্যাগ করেছে। চিমনির কালো ধোঁয়া সে কথা জানান দিচ্ছে। বিবেকের মৃত্যু হয়েছে।
বিবেক তিওয়ারির মৃত্যু হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী, নিঃসন্দেহে হিন্দু, উচ্চবর্ণ বিবেক তিওয়ারির মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু হয়নি, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী শাসকের রাজত্বে পুলিশ বিনা কারণে একজন উচ্চবর্ণের হিন্দুকে গুলি করে মেরেছে। বিবেকের স্বজনরা স্তম্ভিত। টিভি ক্যামেরার সামনে তাঁর সহধর্মিনী বলেছেন তিনি ভাবতেই পারছেন না যে বিজেপিকে তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, যে যোগীজিকে অনেক আশা নিয়ে তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, সেই যোগীজির পুলিশ তাঁর স্বামীকে এভাবে মেরে ফেলল। তিনি তো সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না!
তবে কেন? তবে কেন? সারা দেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষ প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছেন। বেশ তো চলছিল। গোমাংস খেয়েছে, পিটিয়ে মার। গরু চুরি করছিল, পিটিয়ে মার। কী খাচ্ছিস? টিফিন বক্সে কী আছে? মার শালাকে। হাতে গরম কোন কারণ থাক আর না-ই থাক। পিটিয়ে মার, কারণ এরা বেঁচে থাকলেই সন্ত্রাসবাদী হবে। হয় গণপিটুনিতে মার, নইলে পুলিশ দিয়ে এনকাউন্টারে মার। আইন, আদালত এসবের কোন দরকার নেই। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা সব দেবনিযুক্ত। তাঁরা যা বলেন সেটাই তো আইন। অতএব উত্তরপ্রদেশে এনকাউন্টারে আশির উপর মানুষের মৃত্যুতে অনেক মানুষই অবাক হননি, প্রশ্ন তোলেননি। এরকম কড়া হাতেই তো দেশ শাসন করা উচিৎ। আমার রাজ্যে কবে এমন হবে? অধীর আগ্রহে ঘুম হচ্ছে না অনেকের।
কিন্তু সব হিসাব ভেস্তে গেল। বিবেকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তিনি মুসলমান মহিলা সহকর্মীকে সূর্যাস্তের পর বাড়িতে ছাড়তে গেলেন। আর পুলিশের ডাকে থামলেন না পর্যন্ত। কে জানে কেন? তিনি কী ভেবেছিলেন আমরা আর কোনদিন জানতে পারব না। জানব না সঙ্গের ভদ্রমহিলা ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে তাঁরা দুজনে কোন হেনস্থার শিকার হতে পারেন বলে বিবেকের আশঙ্কা ছিল কিনা। হাজার হোক, যোগীজির রামরাজ্যে অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড আছে, লাভ জিহাদ আছে। নাকি তিনি ভেবেছিলেন ট্রিগারমোদী উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আর্বান নকশালদের বানানো একটি চরিত্র?
আসলে তিনি বোধহয় জানতেন না, যেমন তাঁর পরিবার জানে না, যে শুরুটা হয়েছিল ইহুদীদের দিয়ে, শেষটা নয়। আখলাক, আফরাজুল, পেহলুর মত অনেকের মৃত্যুতে, কাফিল খানের হয়রানিতে যে ভারতীয়রা প্রকাশ্যে বা জনান্তিকে উল্লাস করেন তাঁরা এই বেলা জেনে রাখুন।

ছবি: The Boy in the Striped Pajamas ছবির একটি দৃশ্য

প্রকল্প এখন প্রকাশ্যে

যেন একটা আলাদা আইন থাকলে গরুগুলোর চেয়ে রাকবরের প্রাণের মূল্য ঝাড়খন্ড পুলিশের কাছে বেশি হত

রাজস্থানে শুনেছি জল খুব সুলভ নয়। তবু পাছে পুলিশের গাড়ি নোংরা হয়, মৃতপ্রায় রাকবরকে ধুয়ে মুছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। তবে বেদম পিটুনির পর ধুয়ে দিলেই রক্তপাত বন্ধ হয় না। তাই সম্ভবত তার পরেও গোটা রাস্তায় রাকবরের রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে। ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতাল — এই দীর্ঘ ছ কিলোমিটার পথে নিশ্চয়ই তার রক্তের রেখা এখনো মিলিয়ে যায়নি। রাজস্থানে তো জল সুলভ নয়।
তা রাকবর খানের রক্তের রেখা মিলিয়ে যেতে না যেতেই উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে সাহিল মার খেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গেলেন। রাকবর আর সাহিলের মধ্যে চট করে কোন মিল চোখে পড়ে না। প্রথমজনের পেশা পশুপালন, দ্বিতীয়জন একটা চাকরি করেন। প্রথমজন গাঁয়ের লোক, দ্বিতীয়জন মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের বাসিন্দা। প্রথমজন বিবাহিত এবং ইতিমধ্যেই বাবা হয়েছিলেন, দ্বিতীয়জন গিয়েছিলেন পছন্দের মানুষের সাথে ঘর বাঁধতে। দুজনের মধ্যে বস্তুত একটাই মিল — দুজনেই মুসলমান। কতটা ধর্মপ্রাণ ওঁরা তাও আমরা জানি না, কিন্তু যাদের কাছে আসল হল ধর্মীয় পরিচিতি তারা আদার ব্যাপারী। জাহাজের খোঁজ তারা নিতে চায় না। গত কয়েকবছরে ঘটে চলা গণপ্রহারে মৃত্যুর মিছিলে চোখ রাখলে ধর্মান্ধ বদমাইশ ছাড়া সকলেই দেখতে পাবেন যে এই সংগঠিত খুনগুলোর লক্ষ্য ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আর খুনগুলোর করছে ক্ষমতাসীন সঙ্ঘ পরিবার, যারা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
একথা এতদিন পর্যন্ত আমার মত দেশদ্রোহী মাকু, সেকুরাই কেবল বলছিল। এখন আর তা নয়। গণপ্রহারের শিকার হওয়া অতিপরিচিত হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী অগ্নিবেশ গত সপ্তাহে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে একটা সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলেছেন “It was a lynch mob, except it was not a faceless lynch mob but one that was sponsored and supported by the powers that be in the state and central governments. I am not the first one to be attacked, many more have been lynched to death. Akhlaq Khan was killed in Dadri, so was Pehlu Khan and Junaid, and not a single murderer has been apprehended.”
রাকবরের খুন যা নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তা হল হিন্দুত্ববাদী প্রশাসনের প্রকল্পই হল মুসলমান নাগরিকদের খুন করা। এরপর রেজিস্ট্রি করে হিন্দু প্রেমিকাকে বিয়ে করতে গিয়ে সাহিলের মার খাওয়া প্রমাণ করে মুসলমানদের মারা তাদের মারার জন্যেই। গোরক্ষা, লাভ জিহাদ ইত্যাদি হল নতুন নতুন অজুহাত। আগে তবু মন্ত্রী সান্ত্রীদের চোখের চামড়া বজায় রাখার দায় ছিল। এখন আর সেসব নেই। অভিযুক্তরা জামিনে ছাড়া পেলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড্যাং ড্যাং করে মাল্যদান করতেও চলে যাচ্ছেন।
রাজধানী দিল্লীতে বসে অবশ্য এখনো একটু কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করতে হচ্ছে। সংবিধানটা এখনো বদলানো হয়নি কিনা। তাই আমাদের বিশুদ্ধ হিন্দি বলা নিপাট ভালমানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন “প্রয়োজনে সরকার গণপিটুনির বিরুদ্ধে আইন করতে প্রস্তুত।” যেন নতুন একখানা আইন করে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে। যেন এখনকার আইনে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা আইনসম্মত। যেন অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না শুধু উপযুক্ত আইন নেই বলে। যেন একটা আলাদা আইন থাকলে গরুগুলোর চেয়ে রাকবরের প্রাণের মূল্য ঝাড়খন্ড পুলিশের কাছে বেশি হত। “ও মন্ত্রীমশাই, ষড়যন্ত্রীমশাই… যত চালাকি তোমার, জানতে নাইকো বাকি আর।”
ধর্মীয় পরিচয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকা যেসব লোকেরা এখনো বেড়ার উপর বসে পা দোলাচ্ছেন আর “নিরপেক্ষতা”, “ডায়লগ” — এইসব ন্যাকা শব্দ কপচাচ্ছেন তাঁরা স্বামী অগ্নিবেশের সাবধানবাণীটা একবার পড়ে নেবেন “What they call hardline Hindutva is the greatest threat to Hindu culture, or sanatan dharam… The hardline approach of causing harm to whoever disagrees is a kind of nascent fascism.”
অবশ্য সাবধান হবে কে? অনেক লেখাপড়া জানা লোকের মতে তো আবার ফ্যাসিবাদ খুব ভাল জিনিস, দেশের ওটাই দরকার, হিটলার দারুণ লোক ছিল ইত্যাদি।

সকলের রক্ত

সব হি কা খুন হ্যায় শামিল ইয়াহাঁ কি মিট্টি মে
কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়।।
— রাহাত ইন্দোরি

হা হা হা। আবার একটা লোককে মেরে ফেলেছে রে।
সে লোকটা কেবল গরু তাড়াচ্ছিল। হো হো হো।
কি হাসি পাচ্ছে রে ভাই! হি হি হি।
আবার দেখলাম মারতে মারতে যখন নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ তাদের এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল। হে হে হে।
এ তো পুরো হিন্দি সিনেমা রে ভাই। যারা মারছিল তারা পুরো অক্ষয় কুমার মাইরি। গুরু গুরু।
লোকটাকে রাস্তা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে যা স্টাইলে নিয়ে গেল না! দেখে আমার দিদি তো পুরো ফিদা। বলল এবার থেকে সল্লু না, এই অফিসারটার জন্মদিনেই বন্ধুদের খাওয়াব।
আবার লোকটা থেকে থেকে জল চাইছিল। হা হা হা।
কি গাধা মাইরি! ভেবেছে ওকে খতম করার আগে আবার জল খেতে দেবে!
এত নির্বোধও এদেশে ছিল! মরার সময়ও ভেবেছে লোকগুলোর মায়া দয়া আছে! আব্দারটা ভাব!
কী রে, ভাই? কাঁদছিস কেন? আরে ধুর! আমরা এই নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেই পারি। আমাদের কোন ভয় নেই। আমরা কি কাসিমের জাত নাকি? আমাদের গায়ে কে হাত দেবে?
কী বললি? ও, তাই বল। আর্জেন্টিনা হেরে গেছে বলে দুঃখ হচ্ছে। সত্যি রে ভাই, আমারও বড্ড কান্না পাচ্ছে। আয় গলা জড়িয়ে দু ভায়ে কাঁদি। ভেউ ভেউ ভেউ ভেউ…

নিজের দিকে আঙুল তুলুন

আমাকে ছোট থেকে যাঁরা ঠেগুয়া খাইয়েছেন তাঁরা তো কখনো দাবী করেননি ছটপুজোয় ছুটি দিতে হবে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেন দিলেন সে প্রশ্ন তাঁকে করুন। এ রাজ্যের হিন্দিভাষীরা নিজেদের মত করে রামনবমী পালনও তো করে আসছেন বরাবর, অস্ত্রমিছিল করেননি তো। রাজনৈতিক দল কেন রাম আর হনুমানের পুজো করবে সে প্রশ্ন দিলীপ ঘোষ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে করুন, হিন্দিভাষীরা এর জবাব কেন দেবেন? এ তো আইসিসের অপরাধের জবাব এদেশের সাধারণ মুসলমানের কাছে চাওয়ার মত হয়ে গেল

যেহেতু প্রাসঙ্গিক সেহেতু একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করা যাক।
আমার বাড়ির খুব কাছে অধুনালুপ্ত হিন্দমোটর কারখানা, তৎসহ শ্রমিকদের কোয়ার্টার। ঐ এলাকার বাইরেও কিছুটা জায়গা জুড়ে যাঁদের কোয়ার্টারে জায়গা হয়নি বা নিজের সামর্থ্য আছে তাঁদের বাসস্থান। আমার যখন সদ্য অক্ষর পরিচয় হয়েছে তখন কারখানাটা রমরমিয়ে চলছে। আমার বাবা সেইসময় সক্রিয় রাজনীতিবিদ, তার উপরে প্রশাসক। ফলে রোজ সকালে ঐ কারখানার শ্রমিকরা, যাঁরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছেন এবং মূলত হিন্দিভাষী, বাবার কাছে বিভিন্ন দরকারে আসতেন। বাবা বাড়ি ফিরত অনেক রাত করে, ফলে খুব ভোর ভোর উঠতে পারত না। যতক্ষণ না উঠত, ওঁদের সাথে গল্পগুজব করতাম আমি। অন্য ভাষা আমার কাছে ভীষণ কৌতূহলোদ্দীপক ছিল আর ওঁদের দিক থেকে দেখলে, ছোটদের সাথে সময় কাটাতে কার না ভাল লাগে? তা এই রোজ সকালে হিন্দি বলার ফলে বাংলার সাথে সাথে হিন্দিটাও তখন আমি দিব্যি বলতে পারি।
যখন হাইস্কুলে পৌঁছেছি তখন ঐ কারখানারই এক শিখ শ্রমিক পরিবার আমাদের প্রায় আত্মীয় হয়ে গিয়েছিল। ওঁরা সপরিবারে আমাদের বাড়ি এসেছেন, ওঁদের ছেলেমেয়েদের বিয়েতে আমরা নেমন্তন্ন খেয়েছি। সেই ঘনিষ্ঠতা বেশিদিন টেকেনি, নইলে গুরুমুখীটাও কিছুটা শিখে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।
বরাবর, এমনকি হিন্দমোটর কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও, এলাকার হিন্দিভাষী মানুষদের সাথে আমাদের সম্পর্ক একই রকম থেকেছে। খুব ছোটবেলা থেকেই তাই ছটপুজোর ঠেগুয়ার স্বাদ কিরকম সেটা জানি। আমার বাবার যখন ক্যান্সার হয়, তখন যাঁরা নিয়মিত খবর নিতেন, যে কোনরকমভাবে আমাদের সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন তাঁদের মধ্যে অনেকেও বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার হিন্দিভাষী শ্রমিক। বাবা মারা যাওয়ার পর ভেবেছিলাম স্বাভাবিক কারণেই ওঁদের সাথে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। আমাকে অবাক করে, আমাকে খুব ছোটবেলায় দেখেছেন এমন একজন তাঁর মেয়ের গ্র‍্যাজুয়েশনের পরে কী পড়া উচিৎ তার পরামর্শ করতে আমার কাছে এসেছিলেন বছর দুয়েক আগে। “তুমহারে পিতাজি তো রহে নহি। অব কাঁহা যায়েঁ, কিসসে পুছেঁ? সোচা তুমসে হি পুছ লেতে হ্যাঁয়” বললেন এসে। এই যে জীবিকার তাগিদে, জীবনরক্ষার তাগিদে পশ্চিমবঙ্গে আসা ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ এখানে থাকতে থাকতে এই রাজ্যের মানুষকে ভরসাস্থল মনে করেন — এর চেয়ে গর্বের আর কিছু নেই বলে আমার মনে হয়।
আমি নিজে একসময় হায়দরাবাদের একটা খবরের কাগজে কাজ করতাম। তখন সেই নিউজরুমে বাঙালিরা প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, তেলুগুদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি তো বটেই। একদিন এক তেলুগু সহকর্মী হঠাৎ দাবী করে বসল আমাকে ফোনে ইংরিজিতে কথা বলতে হবে কারণ কানের কাছে অজানা ভাষায় কেউ কথা বললে তার কাজের অসুবিধা হচ্ছে। এই অন্যায় দাবী মেনে নেওয়ার ছেলে আমি নই। ফলে তার সাথে জোর ঝগড়া হল। সে বলল “তাহলে তেলুগু শেখো। এখানে এসে থাকবে, কাজ করবে আর এখানকার ভাষা শিখবে না?” আমি সপাটে জবাব দিয়েছিলাম “শিখতেই পারি। কিন্তু তুমি কলকাতায় এসো, আমরা তোমায় বাংলা শিখতে জোর করব না। আমরা করি না।” সে আর রা কাড়েনি।
বাঙালি হিসাবে অত গর্বিত আমার কখনো লাগেনি। আর সশস্ত্র রামনবমী মিছিল, তজ্জনিত হিংসা, আবুল কালাম আজাদের মূর্তি ভাঙা দেখে বাঙালি হিসাবে এত লজ্জিতও কখনো হইনি। সেই লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে সেই বাঙালিরা যারা এখন আমাদের জাতিগত অধঃপতনের দোষ চাপাচ্ছে অবাঙালিদের ঘাড়ে। ভারত এখন বিবিধ আমরা ওরায় বিভক্ত। তার মধ্যে আবার একটা নতুন আমরা-ওরা যোগ করছে এই বাঙালিরা।
নিজের অযোগ্যতা, অপদার্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানো ভীতু, ওপরচালাক এবং অলস লোকের লক্ষণ। এই বাঙালিরাও আমাদের সেরকম বলেই প্রমাণ করছে। হাস্যকর কিছু কথা বলা হচ্ছে। “এত বেশি সহিষ্ণু হওয়াই আমাদের অন্যায় হয়েছে”, “আমাদের কালচারটার এরা সব্বোনাশ করে দিল”, “রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের বাংলা। সেই বাংলায় অবাঙালিগুলো এসে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ঢোকাল”, “ওরা যেখানে যেখানে থাকে সেখানেই কিন্তু হিন্দুত্ববাদের রমরমা” — এইসব কথা দেখছি বিজেপিবিরোধীরা তো বটেই, নিজেকে বামপন্থী বলে দাবী করা অনেকেও বেশ বুক ফুলিয়ে বলছেন, সোশাল মিডিয়ায় লিখছেনও। মোটের উপর ঐ তিনটেই বক্তব্য এঁদের। কথাগুলো কতটা অন্যায়, কেন অন্যায় সেটা এবার দেখা যাক।

“এত বেশি সহিষ্ণু হওয়াই আমাদের অন্যায় হয়েছে”
কিরকম হওয়া উচিৎ ছিল তাহলে? মুম্বাইয়ের শিবসেনার মত? বিহার বা উত্তরপ্রদেশের লোক দেখলেই ঠ্যাঙানো উচিৎ ছিল? নাকি সব্বাইকে বাংলা শিখতে হবে, নইলে এর লাইসেন্স দেব না, তার লাইসেন্স দেব না — এসব বলা উচিৎ ছিল? প্রথমত, মুম্বাইতে এটা করে কী ফল হয়েছে? মুম্বাই বলতেই বিশ্বসুদ্ধ লোক কী বোঝে? বলিউড। কোন ভাষায় ছবি হয় সেখানে? হিন্দি। চেনা পরিচিত বাঙালি যারা মহারাষ্ট্রে থাকেন তাঁদের কজন মারাঠি জানেন একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন তো। বুঝতে পারবেন ঠ্যাঙাড়ে পদ্ধতি ব্যর্থ। তাছাড়া এই কথা যদি বলেন তাহলে হিন্দুত্ববাদীরা যখন পাকিস্তানের উদাহরণ দেখিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়া সমর্থন করে তখন কিন্তু বলা চলবে না “দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চাও তাহলে?”

“আমাদের কালচারটার এরা সব্বোনাশ করে দিল”
এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর নেই। কিসের কালচার? কালচার বলতে আজকের বাঙালি কী বোঝে? কালচারের বাংলা প্রতিশব্দ কী? সঠিক বানানে সেটা লিখতে পারবে চল্লিশের নীচে বয়স এমন কজন আছে? তামিল, তেলুগু ছবি ঝেড়ে বলিউডে ছবি হয় আবার সেই ছবি ঝেড়ে বাংলা ছবি হয়। প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই চলছে। এর নাম কালচার? ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে তো বাঙালি দেড়শো বছর ধরে পড়ছে কিন্তু আগে তো বাপ-মা গর্ব করে বলত না “জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না”? এই অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে বিহারী, মাড়োয়ারিরা? একই স্কুলে পড়া মাড়োয়ারি ছেলেমেয়ের বাবা-মাকে তো বলতে শুনি না গদগদ হয়ে “মেরে বেটে কো না হিন্দি ঠিক সে আতা নহি”? সন্ধ্যের পর তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি যে সিরিয়ালগুলো দ্যাখে সেগুলোর নাম কালচার? ওসবে তো হিন্দি ছবির গানও চলে। তার মানে যারা বানায় তারা নিজেরা লিখতে তো পারেই না, লাগসই বাংলা গান খুঁজে বের করার মুরোদও তাদের নেই। স্বাভাবিক। কারণ এদের সাক্ষাৎকার যা এদিকওদিক পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় এরা বাংলা বলে গ্রীকদের মত। তা এরকমটা এদের শেখাল কে? হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালা? গলায় পা দিয়ে? বাঙালি হিন্দু মেয়ের বিয়েতে মেহেন্দি চালু করল কে? কোন বিহারী এসে এ কে ৪৭ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল? যে ছেলে সব শাস্ত্রীয় আচার মেনে বিয়ে করে, প্রেমের বিয়েতেও পণ নিতে ছাড়ে না, সে বৌভাতের দিন প্রথাগত ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে শেরওয়ানি পরে কোন মাড়োয়ারির ভয়ে? ছেলেমেয়েকে ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে এমনকি দ্বিতীয় ভাষার জায়গা থেকেও বাংলাকে সরিয়ে হিন্দি ঢোকান যে বাঙালি বাবা-মায়েরা তাদের কোন হিন্দিভাষী ব্ল্যাকমেল করেছে এটা করতে?
তাছাড়া কালচার মানে তো শুধু এসব নয়। ট্রেনে বাসে তরুণ বাঙালিদের ভাষা শুনে দেখেছেন? এমনিতে পাঁচ লাইন কথা বললে দু লাইন ইংরিজি আর আড়াই লাইন হিন্দি থাকে। খিস্তি দেওয়ার সময় কিন্তু এরা পরম বাঙালি। এবং জনসমক্ষে খিস্তিসহ কথা বলাটা বেশ গর্বের ব্যাপার এদের কাছে। বছর কুড়ি আগেও বড়দের সামনে শালা বলে ফেললে যে বাঙালি কানমলা খেয়েছে তারই ছেলেমেয়ে ট্রেনে বসে হেডফোনে বন্ধুকে মহানন্দে কাঁচা খিস্তি দিয়ে যায়, সে কামরাভর্তি যতই বাপ-পিতেমোর বয়সী লোক থাক, মহিলারা থাকুন বা বাচ্চাকাচ্চা থাক।
এই জাতির কালচার শেষ করে দিয়েছে অন্য রাজ্য থেকে আসা দশ বারো শতাংশ লোক? শুনলেই হাসি পায়।

“এ বাংলা রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগরের বাংলা। সেই বাংলায় অবাঙালিগুলো এই সাম্প্রদায়িক, পশ্চাৎপদ রাজনীতি ঢোকাল”
ঐ তিন চারটে নাম মুখস্থ বুলির মত আউড়ে যাওয়া বহুকাল হল বাঙালির বদভ্যেস। কাঁঠালি কলার চেয়েও বেশি ঘটে ব্যবহার করা হয় এই নামগুলো। অথচ এই লোকগুলো কেন বিশিষ্ট তা ছেলেমেয়েকে শেখানোর দায়িত্ব অনেকদিন বাবা-মায়েরা ছেড়ে দিয়েছেন। কি ভাগ্যিস দ্বিতীয় জন কিছু গান, কবিতা লিখে গেছেন। তাই স্ট্যাটাস বজায় রাখতে বাড়িতে রচনাবলী সাজিয়ে রাখা, ছেলেমেয়েকে আবৃত্তি স্কুলে পাঠিয়ে “ভগবান তুমি…” বলতে শেখানো, ঘুরেফিরে গুটিকয়েক গান আর নাচ শেখানো — এসব আছে। বাকিরা তো আক্ষরিক অর্থেই ছবি হয়ে গেছেন। প্রথমজনেরটা থাকে ঠাকুরঘরে। অতএব কী বলেছেন ওসব আর কে পড়তে যাবে? পড়লেও ভাবতে যাবে কেন? গুরুবচন। মুখস্থ করাই কর্তব্য, ভাবতে নেই।
রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন অথচ সঙ্গীতে এবং কাব্যে একেবারে স্বতন্ত্র নজরুলের প্রতি আমরা পশ্চিমবঙ্গীয়রা সযত্নলালিত অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিয়েছি। আজকাল আর নজরুলগীতি শেখা ঠিক কেতাদুরস্ত নয়। আমাদের ছোটবেলার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যাগুলোও প্রায় অবলুপ্ত। অন্নদাশঙ্করেরই বোধহয় ভুল হয়েছিল। নজরুলকে আমরা বিলকুল ভাগ করে দিয়েছি। আশঙ্কা হয় সেটাও হয়ত তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যেই।
চতুর্থজনের অবস্থা তো আরো করুণ। এই ভদ্রলোকের নাম আজকাল আর খুব বেশি বাঙালি জানে কিনা আমার সন্দেহ হয়। ছোটদের তো জানার উপায়ও নেই। তারা তো জলি প্রাইমার, এলিমেন্টারি ম্যাথসে ডুবে আছে। তার মধ্যে কি আর বর্ণপরিচয়ের জায়গা আছে? আর বড়রা তো বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে বরাবরই জানত দুটো শব্দ —- বিধবাবিবাহ আর বাল্য বিবাহ। আরেকজনকে তো বাঙালি ভুলেই গেছে। তিনি রামমোহন রায়। সেটা অবশ্য একদিকে ভাল। পপকর্ন খেতে খেতে পদ্মাবতী দেখার সময়ে ঐ ভদ্রলোককে মনে পড়লে পুরো আমেজটাই নষ্ট হবে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে এই লোকগুলোকে শালগ্রাম শিলা বানিয়ে ফেলেছি আমরা অনেক আগেই। সুতরাং আমাদের বাংলাটা আর এদের বাংলা নেই। এর জন্যে বিহারী, মাড়োয়ারিদের গাল পাড়ার কোন যুক্তি নেই। তা বাদেও বাংলাকে এদের বাংলা বলা নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে অর্ধসত্য বলার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
রামকৃষ্ণের কথা আলাদা। তিনি শত হলেও ধর্মগুরু। তাছাড়া তাঁর এক নম্বর শিষ্য একটা আস্ত প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গেছেন। তাই তিনি নিজের সময়ও পূজিত, এখনো পূজিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে গালাগাল দেওয়ার লোক তাঁর সময়েও নেহাত কম ছিল না। যেমন তাঁর যশে দ্বিজেন্দ্রলালের কম গা জ্বলেনি। আর নোবেল টোবেল পাওয়ার পরেও, বাণী বসুর ‘অষ্টম গর্ভ’ পড়লে বোঝা যায়, শিক্ষিত বাঙালিরা অনেকেই মনে করত উনি শুধু একজন বড়লোকের ছেলে যে শান্তিনিকেতনে সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে। এসব যারা মনে করত এ বাংলা তাদেরও। নিজেদের রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি ভাবতে গেলে মনে রাখা উচিৎ আমরা ঐ লোকগুলোরও জাতভাই।
আর বিদ্যাসাগর? এ বাংলা কোনদিনই তাঁর ছিল না। তিনি যেমন আমাদের পূর্বপুরুষ তেমন যারা বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার অপরাধে তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছিল, তাঁকে খিস্তি করে গান লিখেছিল, জুতো ছুঁড়েছিল, টাকার লোভে তাঁকে ঠকিয়েছিল তারাও এই আমাদেরই পূর্বপুরুষ। এবং তারা নেহাত এলেবেলে লোকও নয়, অনেকেই তখনকার সমাজের মাথা। এই বাংলা এমনই বিদ্যাসাগরের যে তিনি শেষ বয়সে এই জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে দন্ডকারণ্যে সাঁওতালদের সঙ্গে গিয়ে বাস করতেন।
যে নবজাগরণ বা আলোকপ্রাপ্তি নিয়ে আমরা জাঁক করি সেই আলো যাঁরা নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন এক ইউরোপীয় অধ্যাপকও। মনে রাখা ভাল যে সেই হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওকে আমাদেরই গণ্যমান্য পূর্বপুরুষরা বিদেশী এবং বিধর্মী বলে অপমানের একশেষ করেছিল। আমাদের সমাজের কুপ্রথাগুলোর দিকে আঙুল তোলার তাঁর অধিকার নেই বলেছিল। ঠিক যেমন আজকের দক্ষিণপন্থীরা বলছে লেনিন তো বিদেশী, এদেশে তার মূর্তি থাকবে কেন? আমাদের সেই পূর্বপুরুষেরা ডিরোজিওকে ভাতেও মেরে এমন অবস্থা করে যে তাঁর অকালমৃত্যু হয়।
আর সাম্প্রদায়িকতা হিন্দিভাষীরা এ রাজ্যে নিয়ে এসেছে, কেবল তাদের এলাকাগুলোতেই হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটছে এমনটা যদি আপনার মনে হয় তাহলে বলতে হয় আপনি বুদবুদের মধ্যে বাস করছেন বহুকাল ধরেই। ভাল করে তাকিয়ে দেখলে চারপাশে অজস্র আত্মীয়স্বজন পাবেন যারা গাদা ডিগ্রিধারী হয়েও চরম অশিক্ষিতের মত বলে “অমুকের মুসলমানদের সাথে এত কিসের দহরম বুঝি না। বাঙালি ছেলে বাঙালিদের সাথে বন্ধুত্ব কর না।” বাংলা ভাষার জন্যে আজ অব্দি যারা প্রাণ দিয়েছে সীমান্তের দুই পারে, তাদের বেশিরভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী অথচ আমাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, অধ্যাপক, সাংবাদিক ইত্যাদি পেশাধারী মূর্খরা বলে তারাই বাঙালি, মুসলমানরা মুসলমান। বিজেপির প্রোপাগান্ডা আর মমতার নিজেকে মুসলমানদের ত্রাতা হিসাবে তুলে ধরার অপচেষ্টা শুরু হওয়ার পর থেকে আশপাশের লেখাপড়া জানা মানুষদের ভেতরের ঘৃণা কিভাবে বেরিয়ে আসছে, কি অনায়াসে তারা ভিত্তিহীন গুজবকে ধ্রুব সত্য হিসাবে বিশ্বাস করছে এবং অন্যকে বিশ্বাস করাচ্ছে তা যদি আপনার চোখে না পড়ে থাকে, একমাত্র তাহলেই আপনি ভাববেন হিন্দুত্ববাদীরা শুধু হিন্দিভাষীদের এলাকায় শক্তিশালী হচ্ছে।
তবে এই সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসও আমাদের সুপ্রাচীন। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের অনন্য প্রতিভা যেমন তাঁর ইহুদীবিদ্বেষকে অতিক্রম করতে পারেনি, আমাদের গদ্যের আদিপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভাও তেমনি তাঁর মুসলমানবিদ্বেষকে অতিক্রম করতে পারেনি। মুসলমান শাসকরা এদেশে হানাদার এবং সমস্ত অধঃপতনের মূলে, তারা আসার আগে এদেশ স্বর্গরাজ্য ছিল — এই যে অতিসরলীকৃত ইতিহাস আর এস এস আমাদের গেলাচ্ছে, বঙ্কিম যে তার চেয়ে খুব আলাদা কিছু ভাবতেন তা ভাবা শক্ত। রাজসিংহ উপন্যাসের শেষে তবু একটা কৈফিয়ত গোছের লেখা আছে, যেখানে বঙ্কিম লিখেছেন সব হিন্দুই ভাল আর সব মুসলমানই খারাপ এমনটা বলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। আনন্দমঠ উপন্যাসের শেষে তাও নেই।
বিবেকানন্দ একবার বৈদান্তিক মস্তিষ্কের সঙ্গে ঐস্লামিক দেহের সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর ইতিহাস পাঠেও “সবই ব্যাদে আছে” এবং সে যুগের পর থেকে ভারতে আর ভাল কিছু হয়নি — এই মনোভাবটা বড় জ্বলজ্বল করে। আর সত্যি বলতে কি, ঐ উক্তি থেকেও এটাই মনে হয় যে বিবেকানন্দ মুসলমানদের একটা বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষ হিসাবে না দেখে একটা বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর লোক হিসাবে দেখতেন। নইলে ঐস্লামিক দেহ কথাটার কোন মানে দাঁড়ায় কি? সব মুসলমানের দেহের গঠন কি একরকম? আমার মাছ ভাত খাওয়া বাঙালি মুসলমান মাস্টারমশাই সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার রোগাসোগা লোক। আবার আমাদের পেস বোলার মহম্মদ শামি। দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ চেহারার উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা মুসলমান। এদের মধ্যে কার দেহের সঙ্গে বৈদান্তিক মস্তিষ্কের সমন্বয় চাইছিলেন বিবেকানন্দ?
অত তত্ত্বকথারও দরকার নেই, বাস্তব উদাহরণ দেখি। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দাঙ্গা করতে আমরা বাঙালিরা কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকিনি। ১৯৪৬ এর ১৬ই আগস্টের দাঙ্গাও বাইরে থেকে কেউ এসে করে দিয়ে যায়নি।
অতএব শুরু হয়ে যাওয়া ঝড় এবং আসন্ন প্রলয় আটকাতে হলে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে বাঙালি সংস্কৃতিমান, বাঙালি শান্তিপ্রিয়, বাঙালি দাঙ্গাবাজি করে না — এই একমাত্রিক পরিচিতিটা আপন মনের মাধুরী মিশায়ে আমাদেরই তৈরি করা। আসলে বাঙালিদের মধ্যে অন্য কোন জাতের লোকেদের চেয়ে পরধর্মবিদ্বেষী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দাঙ্গাবাজ লোক কম নেই। কোনদিন ছিলও না। বাঙালির বাংলাকে এক রাখতে রাখীবন্ধন করা রবীন্দ্রনাথ আছেন আবার হিন্দু, মুসলমান এক দেশের নাগরিক হতে পারে না — এই মনোভাবের শ্যামাপ্রসাদও আছেন। আমাদের “একই বৃন্তে দুটি কুসুম” লেখা, অসামান্য শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা নজরুল আছেন আবার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস লেলিয়ে দেওয়া সুরাবর্দিও আছেন। আপনি এদের মধ্যে কার উত্তরসূরি সেটা প্রমাণ হয় আপনার কথায় এবং কাজে।
অতএব আঙুলটা এবার নিজের দিকে তোলা যাক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভেতরের দৈত্যটার মুখোমুখি হওয়া যাক। এমনিতেও যে রাজ্যে আমরা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে অন্য রাজ্যের অন্য ভাষাভাষী মানুষ এসে সবকিছু বদলে দিচ্ছেন — এটা যদি সত্যি বলে মানতে হয় তাহলে এটাও মানতে হয় যে আমরা সব নিরেট মাথার লোক। গোটা ভারতকে ভাগ করা হচ্ছে, বাঙালিকেও ভাগ করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সেটা ভুলে আরো নতুন ভাগাভাগি তৈরি করবেন না দয়া করে। আদি অনন্তকাল ধরে মানুষ জীবিকার সন্ধানে এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাচ্ছে। এই ধারার বিরুদ্ধে কথা বলা যেমন অনৈতিহাসিক তেমনই অমানবিক। পৃথিবীর কোন প্রগতিশীল মানবগোষ্ঠী এর জন্যে কারো সাথে শত্রুতা করে না। এবং করতে ইচ্ছে করলে মনে রাখবেন, সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া থাকে এবং বহু বাঙালি পেশাগত কারণে সারা ভারতে ছড়িয়ে আছেন।
কী বললেন? হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ? সে তো সঙ্ঘ পরিবার, ভারত সরকার আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার করছে। তার জন্যে আপনার হিন্দিভাষী, রাম আর হনুমানের পূজারী প্রতিবেশী দায়ী হবেন কেন? আমাকে ছোট থেকে যাঁরা ঠেগুয়া খাইয়েছেন তাঁরা তো কখনো দাবী করেননি ছটপুজোয় ছুটি দিতে হবে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেন দিলেন সে প্রশ্ন তাঁকে করুন। এ রাজ্যের হিন্দিভাষীরা নিজেদের মত করে রামনবমী পালনও তো করে আসছেন বরাবর, অস্ত্রমিছিল করেননি তো। রাজনৈতিক দল কেন রাম আর হনুমানের পুজো করবে সে প্রশ্ন দিলীপ ঘোষ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে করুন, হিন্দিভাষীরা এর জবাব কেন দেবেন? এ তো আইসিসের অপরাধের জবাব এদেশের সাধারণ মুসলমানের কাছে চাওয়ার মত হয়ে গেল।
সত্যি কথা বলতে, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদকে মালার মত গলায় পরে নিচ্ছি আমরা নিজে — বাংলার চর্চা ক্রমশ কমিয়ে দিয়ে এবং ভাষাটার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে। কয়েক মাস আগে এক টেলিকম কোম্পানি তাদের ইংরিজি বিজ্ঞাপনের বাংলা তর্জমা খবরের কাগজে ছেপেছিল শুধু গুগল ট্রান্সলেটরের ভরসায়। ফলে সেটার হরফটাই যা বাংলা ছিল, ভাষাটা কী তা বোঝা ভগবানেরও অসাধ্য। এই সাহস ওরা তামিলনাড়ু, কর্ণাটক কি কেরালায় পায় না। এখানে যে পায় তার জন্যে দায়ী আমরাই, এ রাজ্যের হিন্দিভাষীরা নন। অন্য ভাষা শিখতে গেলে যে বাংলা ভুলতে হয় না সেটা নিজে বুঝলে এবং ছেলেমেয়েকে বোঝালে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ এমনিই ট্যাঁ ফোঁ করার জায়গা পাবে না।

%d bloggers like this: