দায়সারা বিশ্বকাপ, শেষ বিশ্বকাপ?

কর্তারা যে ৫০ ওভারের খেলাটাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন তা সবচেয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির প্রাক্তন অধিনায়ক এবং সদ্য পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব এমসিসির সভাপতি হওয়া মার্ক নিকোলাস।

১৯৮৭ সালে যখন প্রথমবার এদেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপ হয় তখন দুনিয়াটাই অন্যরকম ছিল। তাই সেকথা থাক, বরং ১৯৯৬ সালের কথা ভাবা যাক। আজ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের খেলা আর আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করে যে টাকার হিমালয়ে চড়েছে তা টেথিস সাগরের মত উঁচু হতে শুরু করেছিল ওই সময় থেকেই। প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া বুঝতে পেরেছিলেন ভারতের ক্রিকেটপাগল জনতার বাজার কত লোভনীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে। সেই বাজারে তাদের প্রবেশাধিকার দিয়ে এত টাকা কামাতে পারে ভারতীয় বোর্ড, যে গোটা ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করা যাবে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার চোখরাঙানি সহ্য করার বদলে তাদেরই চোখ রাঙানো যাবে। তবে ডালমিয়া ছিলেন খাঁটি ব্যবসায়ী। কামানোর জন্য খরচ করতে তাঁর আপত্তি ছিল না। বিশেষত টাকা যখন বোর্ডের, নিজের পকেটের নয়। ফলে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা মিলিয়ে হওয়া সেবারের বিশ্বকাপে জাঁকজমকের খামতি ছিল না। সেই বিশ্বকাপ থেকে বিস্তর আয় হয়েছিল এবং তার অনেকটা ডালমিয়া পকেটে পুরেছেন – এমন অভিযোগ পরে উঠেছিল। সেসব মামলা মোকদ্দমার জেরেই একসময় তাঁকে বোর্ডছাড়া হতে হয়, পরে আবার ফিরেও আসেন। কিন্তু বিশ্বকাপের আয়োজন যে জবরদস্ত হয়েছিল তা কেউ অস্বীকার করে না। ইডেন উদ্যানে বহু অর্থ খরচ করে বিরাট উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল, গঙ্গার হাওয়া এসে অদৃষ্টপূর্ব লেজার শোকে অভূতপূর্ব বিপর্যয়ে পরিণত করেছিল। ভারত সেমিফাইনালে শোচনীয়ভাবে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে যাওয়ার পরে লেখালিখি হয়েছিল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি মঞ্চটাই নাকি যত নষ্টের গোড়া। ওটা তৈরি করতে গিয়েই নাকি পিচের বারোটা বেজে গিয়েছিল, ফলে সেমিফাইনালের দিন অরবিন্দ ডি সিলভা আর মুথাইয়া মুরলীধরন এক জাতের বোলার হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১১ সালে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় হওয়া বিশ্বকাপেও জাঁকজমক কম ছিল না। সেবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল। তদ্দিনে ভারত হিমালয়ে উঠে পড়েছে, বোর্ডের টাকার অভাব নেই। ফলে বাকি বিশ্বকাপটাও হয়েছিল বিশ্বকাপের মত। আর এবার?

আজ গতবারের দুই ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ শুরু করবে। কিন্তু তার আগে কোনো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে না, কারণ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড খুবই মিতব্যয়ী। চোখধাঁধানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করে শুধু আইপিএল শুরুর দিনে। ১৯৯৬ সালে বোর্ড সভাপতি ছিলেন শিল্পপতি ডালমিয়া, এখন শিল্পপতি জয় শাহ। ও না! ভুল হল। বোর্ড সভাপতি ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রজার বিনি, জয় হলেন সচিব। আসলে বিনিকে দেখা যায় কম, শোনা যায় আরও কম। তাই খেয়াল থাকে না। মানে তাঁর অবস্থা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর মত। তিনি সাংবিধানিক প্রধান বটে, সবেতেই তাঁর স্বাক্ষর লাগে বটে, কিন্তু নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে তাঁকে ডাকাই হয় না। রাজদণ্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন মোদীজি। ক্রিকেট বোর্ডের সর্বেসর্বাও এখন শাহজি, বিনিজি অন্তঃপুরবাসী। যাঁর নাম জয় আর পদবি শাহ, তিনি সর্বেসর্বা হবেন না তো হবে কে? সে যতই তিনি এশিয়ান গেমসে মহিলাদের ক্রিকেটে স্মৃতি মান্ধনা একাই সোনা জিতেছেন মনে করুন না কেন।

কথা হল, জগমোহনের বিশ্বকাপ আয়োজন করা নিয়ে যা উৎসাহ ছিল, জয়ের তার অর্ধেকও দেখা যাচ্ছে না। তাই এবারের বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণা হয়েছে মাত্র ১০০ দিন আগে, যেখানে পৃথিবীর যে কোনো খেলায় বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণা হয়ে যায় বছরখানেক আগে। আগামী বছর জুন মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির সূচি যেমন প্রকাশিত হয়েছে গত মাসে। কারণ বিভিন্ন দেশের মানুষকে খেলা দেখতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা দেশে পৌঁছতে হবে। যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে, থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সেসব প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যত কম সময় পাওয়া যাবে খরচ বেড়ে যাবে ততই। অব্যবস্থা দেখা দেবে, যে দেশে খেলা সেই দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু ওসব ভাবনা রাজা বাদশাহরা কবেই বা করলেন? তাঁরা চলেন নিজের নিয়মে, বাকি সকলকে মানিয়ে নিতে হয়। বিশ্বকাপ এমনিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রতিযোগিতা, ফলে সূচি ঘোষণা করার কথা তাদের। কিন্তু আয়োজক দেশকেই ঠিক করতে হয় সূচিটা। একথাও কারোর জানতে বাকি নেই যে ফুটবল দুনিয়াকে ফিফা যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, আইসিসির মুরোদ নেই তা করার। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অর্থবল এত বেশি যে আইসিসি এখন ঠুঁটো জগন্নাথ। অনতি অতীতে আইসিসির ফিউচার টুরস প্রোগ্রামে (অর্থাৎ পরবর্তী কয়েক বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নির্ধারিত সূচিতে) আইপিএলের জন্য যে আরও বেশি ফাঁক রাখা হবে তা ঘোষণা করে দিয়েছেন শাহজিই, আইসিসি নয়। তা নিয়ে আইসিসি ট্যাঁ ফোঁ করতে পারেনি। ফলে এত দেরিতে বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণার দায় আইসিসির ঘাড়ে চাপানো চলে না।

তবে অস্বাভাবিক দেরিতে সূচি ঘোষণাতেই অব্যবস্থার শেষ নয়, বরং সূচনা। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেল বিভিন্ন আয়োজক রাজ্য সংস্থা তাদের স্টেডিয়ামে যেদিন ম্যাচ দেওয়া হয়েছে সেদিন আয়োজন সম্ভব নয় বলছে। খোদ কলকাতাতেই যেমন কালীপুজোর দিন ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান ম্যাচ রাখা হয়েছিল। ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের অভিজ্ঞতা না থাকা মানুষও বোঝেন যে সেদিন ম্যাচ আয়োজন করা অসম্ভব, কিন্তু দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র বোঝেন না। ক্রীড়াসূচি তৈরি করার সময়ে যে যেখানে খেলা সেখানকার আয়োজকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়, সম্ভবত তাও তিনি বোঝেন না। নইলে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের আয়োজকরা নিশ্চয়ই এত বোকা নন যে কালীপুজোর দিন ম্যাচ করতে রাজি হবেন? জয় শাহীর মজা হল, হিন্দুত্ববাদী দলের নেতা অমিত শাহের পুত্র সর্বেসর্বা হলেও বিশ্বকাপের সূচি বানানোর সময়ে বোর্ডের খেয়ালই ছিল না যে ১৫ অক্টোবর নবরাত্রি উৎসবের সূচনা, সেদিন আমেদাবাদ শহরে ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচ করা সম্ভব নয়। এহেন প্রশাসনিক নৈপুণ্যের কারণে অনেক দেরিতে সূচি ঘোষণা করার পরেও সব মিলিয়ে গোটা দশেক ম্যাচের দিনক্ষণ বদল করতে হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। বিশ্বকাপের টিকিট বিক্রি নিয়ে যা চলছে তা প্রাক-২০১৪ ভারতে সম্ভবত তদন্তযোগ্য কেলেঙ্কারি বলে গণ্য হত এবং সমস্ত খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলে দিনরাত এ নিয়েই তর্কাতর্কি চলত। একে তো টিকিটের আকাশছোঁয়া দাম, তার উপর বিশ্বকাপের টিকিট অনলাইনে কিনতে গিয়ে অনেকেই তাজ্জব বনে গেছেন। ঘন্টা চারেক ‘কিউ’-তে পড়ে থেকেও টিকিট পাননি অনেকে। আইসিসি এখন পর্যন্ত বলেনি কত টিকিট বিক্রি হওয়ার কথা ছিল আর কত টিকিট বিক্রি হয়েছে। বিক্রির দায়িত্বে থাকা বুকমাইশো সোশাল মিডিয়ায় জানিয়েছে, তাদের হাতে নাকি সীমিত সংখ্যক টিকিটই আছে। এত টিকিট গেল কোথায়? এসব নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যত লেখালিখি হয়েছে, ভারতের সংবাদমাধ্যমে তত হয়নি। ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমে তবু খানিকটা হয়েছে, বাংলার কথা না বলাই ভাল। একদিকে টিকিটের আকাল, অন্যদিকে একাধিক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, আজকে উদ্বোধনী ম্যাচে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে নাকি ৪০,০০০ মহিলাকে দর্শক হিসাবে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে গুজরাট বিজেপি। আমেদাবাদের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে হোয়াটস্যাপে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে নাকি এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাহলে কি বিশ্বকাপের টিকিট পেতে গেলে বিজেপির সদস্য বা সমর্থক হতে হবে? সেকথা যদি ঠিক না-ও হয়, এই বিশ্বকাপে হক যে অন্য সব রাজ্যের চেয়ে গুজরাটের বেশি, তাতে কিন্তু সন্দেহ নেই। ভারতে এর আগে অনুষ্ঠিত তিনটে বিশ্বকাপে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম, কলকাতার ইডেন উদ্যান, দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা বা চেন্নাইয়ের চিদম্বরম স্টেডিয়ামের মত ঐতিহ্যশালী মাঠের যে সৌভাগ্য হয়নি সেই সৌভাগ্যই এবার হয়েছে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ ওখানে, ফাইনাল ওখানে, আবার ক্রিকেটবিশ্বের সকলের চোখ থাকে যে ম্যাচের দিকে – সেই ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচও ওই মাঠেই।

কেন ঘটছে এসব? জলের মত সরল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন বহুদিনের ক্রীড়া সাংবাদিক শারদা উগ্রা, সম্প্রতি দ্য ক্যারাভ্যান পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর দীর্ঘ প্রতিবেদনে, যার শিরোনাম Shah’s playground: BJP’s Control of Cricket in India। সেই প্রতিবেদনে বোর্ডের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, অমিতপুত্র বোর্ড চালান একেবারেই একনায়কত্বের ঢঙে। মিনমিনে বিনির সময় থেকে নয়, সৌরভ গাঙ্গুলি বোর্ড সভাপতি থাকার সময় থেকেই। অনেকসময় তিনি বোর্ডের অন্যদের সৌরভের ফোন ধরতে বারণ করতেন। যদি সৌরভ বলতেন অমুক ম্যাচটা ওইদিন হতে হবে, অবধারিতভাবে অন্য কোনোদিন ধার্য করা হত। জয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজের সভাপতি পদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া সৌরভ এসব মেনে নিয়েই পদ আঁকড়ে পড়েছিলেন। বোঝা শক্ত নয়, কেন বিশ্বকাপ আয়োজনে এত ডামাডোল। যাঁর কোনো প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই, তিনি যদি একনায়কের কায়দায় এত বড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন তাহলে এর চেয়ে উন্নত আর কী হওয়া সম্ভব?

আরও পড়ুন ক্রিকেট জেনেশুনে বিশ করেছে পান

যোগ্যতার অভাবের পাশাপাশি সদিচ্ছার অভাবটাও অবশ্য উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ১৯৯৬ সালে একদিনের ক্রিকেটের রমরমা ছিল, এখন বিশ্বজুড়েই ৫০ ওভারের খেলা অবাঞ্ছিত। ১৯৭০-এর দশকে একদিনের ক্রিকেটের দরকার হয়েছিল টেস্টের একঘেয়েমি কাটিয়ে মাঠে দর্শক ফেরাতে। সেই চেষ্টা সফল হয়। পরে খেলায় আরও বিনোদন আনতে কেরি প্যাকার চালু করেন রঙিন জামা, সাদা বলে দিনরাতের একদিনের ম্যাচ। প্রথম দিকে তিনি বিদ্রোহী তকমা পেলেও শেষপর্যন্ত কর্তারা বোঝেন এতে বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা। প্যাকারের ক্রিকেটই হয়ে দাঁড়ায় মান্য একদিনের ক্রিকেট। এখন আর সে দিন নেই। বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট। ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তিরা তাকে যথেচ্ছ বাড়তেও দিচ্ছেন, কারণ ওতেই পকেট ভরে যাচ্ছে। যদি একদিনের ক্রিকেটের প্রতি মমতা থাকত, তাহলে ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলোতে লাগাম দিতেন। টি টোয়েন্টির মত একদিনের ক্রিকেটেও দুই প্রান্ত থেকে দুটো বলে খেলা চালু করে, মাঠের সীমানা দৃষ্টিকটুভাবে ছোট করে এনে, ইনিংসের সবকটা ওভারকেই ফিল্ডিং সাজানোর নানাবিধ নিষেধের আওতায় নিয়ে এসে ব্যাট-বলের লড়াইকে দুদলের ব্যাটারদের চার, ছয় মারার প্রতিযোগিতায় পরিণত করতেন না। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। কথায় কথায় সাড়ে তিনশো-চারশো রান হচ্ছে, দ্বিশতরান হচ্ছে মুহুর্মুহু। পুরুষদের একদিনের ক্রিকেটে ২০১০ সালে শচীন তেন্ডুলকার প্রথম দ্বিশতরান করার পর থেকে গত ১৩ বছরে আরও নখানা দ্বিশতরান হয়ে গেছে, একা রোহিত শর্মার ঝুলিতেই তিনখানা। অথচ একদিনের ক্রিকেটের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ কমে গেছে পৃথিবীর সর্বত্র। ঘন্টা তিনেক লাগাতার চার-ছক্কা দেখতে ভাল লাগে, ছ-সাত ঘন্টা ধরে ও জিনিস দেখা সাধারণত ক্লান্তিকর। শেষের দিকের ওভারগুলোতে পুরনো বলে রিভার্স সুইং করিয়ে ব্যাটারদের কাজ কঠিন করে দেওয়া বোলারদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে গেছে। স্পিনারদেরও চকচকে নতুন বলে চার, ছয় না খাওয়ার দিকেই মনোযোগ দিতে হচ্ছে। ওয়াসিম আক্রাম, শেন ওয়ার্নরা এখন খেললে কোনো তফাত গড়ে দিতে পারতেন কিনা বলা মুশকিল।

খেলোয়াড়রাও ইদানীং ৫০ ওভারের ক্রিকেট খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেক কম পরিশ্রমে অনেক বেশি টাকা রোজগার করা যাচ্ছে কুড়ি বিশের ক্রিকেট খেলে। ফলে ওটাকেই তাঁরা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। টেস্ট ক্রিকেট আর ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট খেলে শরীরেও আর এত তাগদ থাকছে না যে একদিনের ক্রিকেট খেলবেন। গত বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার বেন স্টোকস তো গতবছর একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসরই নিয়ে ফেলেছিলেন। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটকর্তারা অনেক বলে কয়ে তাঁকে শুধুমাত্র ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলতে রাজি করিয়েছেন। বিশ্বকাপের পর কী হবে কেউ জানে না। নিউজিল্যান্ডের সেরা বোলার ট্রেন্ট বোল্টও নিজের দেশের বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। অর্থাৎ দেশের হয়ে খেলার আগ্রহ কমে গেছে, ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকছেন। ভারতের সাদা বলের অধিনায়ক রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলিও সাম্প্রতিককালে একদিনের ম্যাচের সিরিজে একটা ম্যাচ খেলেন তো দুটো ম্যাচে বিশ্রাম নেন। বিশ্বকাপের আগে শেষ দুটো সিরিজ ছিল এশিয়া কাপ আর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। তারও সব ম্যাচ খেললেন না।

কর্তারা যে ৫০ ওভারের খেলাটাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন তা সবচেয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির প্রাক্তন অধিনায়ক এবং সদ্য পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব এমসিসির সভাপতি হওয়া মার্ক নিকোলাস। ইএসপিএন ক্রিকইনফো ওয়েবসাইটকে তিনি বলেছেন, একদিনের ক্রিকেট আগামীদিনে বিশ্বকাপের বাইরে আর হওয়ার মানে হয় না। এমসিসি এখন আর ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা নয়, কিন্তু ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে এখনো তাদের মতামতের বিস্তর গুরুত্ব আছে আর ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বোর্ডগুলোই জয় শাহের বোর্ডের পরে সবচেয়ে ধনী বোর্ড। বস্তুত তারা ভারতীয় বোর্ডের নন্দী, ভৃঙ্গী। অনেকের ধারণা ভারতই ৫০ ওভারের খেলাটাকে ধরে রেখেছে এবং এবারের বিশ্বকাপটা জমজমাট হলে খেলাটা বেঁচে যাবে। এককথায়, ভারতই পারে বাঁচাতে। পারে হয়ত, কিন্তু বিশ্বকাপ আয়োজনে যে অযত্ন প্রকট তাতে বাঁচানোর ইচ্ছা আছে বলে তো মনে হয় না। আগামী কয়েক মরসুমে আইপিএলকে আরও লম্বা করার যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছে সেটাও একদিনের ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসার লক্ষণ নয়। অতএব ২০২৭ সালে আর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ না হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এতখানি অনিশ্চয়তা নিয়ে সম্ভবত কোনো খেলার বিশ্বকাপ শুরু হয়নি এর আগে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

টেস্ট পরীক্ষায় আবার ফেল: একটি পূর্ণাঙ্গ প্রহসন

এই সময়কালে টেস্ট দল পরপর দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া বিদেশের কোথাও সিরিজ জেতেনি। বিদেশে খেলা হলেই রোহিত, চেতেশ্বর পূজারা, কোহলি, অজিঙ্ক রাহানে ধ্যাড়াবেন আর কখনো ঋষভ পন্থ, কখনো জাদেজা, কখনো শার্দূল, কখনো ওয়াশিংটন সুন্দর রান করে মুখরক্ষা করবেন – এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথম অঙ্ক: সব ব্যাটাকে ছেড়ে টস ব্যাটাকে ধর

ভারত কেন ওভালে হারল? টসে জিতে রোহিত শর্মা অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে ডাকলেন বলে। ধারাভাষ্যকার অথবা খবরের কাগজে কলাম লেখা বিশেষজ্ঞ প্রাক্তন ক্রিকেটার, ক্রিকেট সাংবাদিক এবং জনতা – সকলে মিলে এই উত্তরটা তৈরি করে ফেলেছিলেন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম দিনের খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। কারণ অস্ট্রেলিয়া দিনের শেষে তিন উইকেটে ৩২৭ রানে পৌঁছে গিয়েছিল। রানের অযোধ্যা পাহাড় যে পরদিন হিমালয়ে পরিণত হবে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। তবু তো শেষমেশ অস্ট্রেলিয়া এভারেস্টে উঠতে পারেনি, কারাকোরামে পৌঁছেই থেমে গিয়েছিল। অতএব স্রেফ প্রথম দিনের আবহাওয়া দেখেই কেন ফিল্ডিং নেবে – এ সমালোচনা করা ভারি সহজ হয়ে গেল। কেউ আসল কথাটাই বললেন না। টস করতে যাওয়ার সময়ে তো অধিনায়ককে হাতে যে ১১ জন খেলবেন তাদের তালিকাটা নিয়ে যেতে হয়। সেখানে বাঘা বাঘা চারজন জোরে বোলারের নাম লেখা হয়ে গেছে। তারপর টস জিতে আর ব্যাটিং নেওয়া যায় নাকি? যদি ইংল্যান্ডের মাঠে প্রথম দিনের তাজা পিচে বল করার সুযোগই না নেব, তাহলে আর চারজন জোরে বোলারকে নিলাম কেন? সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার মত আহাম্মকি আর আছে নাকি?

এমন নয় যে এই কথাটা একমাত্র আমিই বুঝেছি আর সুনীল গাভস্কর, রবি শাস্ত্রী, আকাশ চোপড়া প্রমুখ তাবড় প্রাক্তন ক্রিকেটার ধরতে পারেননি। কিন্তু তাঁরা সেকথা বলেননি। তাঁরা বলেছেন বটে, যে পৌনে পাঁচশো উইকেট নিয়ে ফেলা রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে খেলানো উচিত ছিল। কিন্তু কেন বিদেশের মাঠে একের পর এক টেস্টে একমাত্র স্পিনার হিসাবে তাঁর বদলে দলে থাকেন রবীন্দ্র জাদেজা – তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতেও তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। ব্যাখ্যাটা হল, জাদেজার ব্যাটিং অশ্বিনের চেয়ে ভাল। অথচ ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই প্রশ্নাতীত নয়।

এই ম্যাচে জাদেজা প্রথম ইনিংসে ৪৮ রান করেছেন, যা না করলে ভারতের হারের ব্যবধানটা আরও বড় হত। দ্বিতীয় ইনিংসে স্কট বোল্যান্ডের সামনে দু বলের বেশি টিকতেই পারেননি। স্কোরারদের কাজ না বাড়িয়ে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তার জন্যে তাঁকে উড়িয়ে দেব না। কোনো খেলোয়াড়ই সব ম্যাচে সফল হন না। ঘটনা হল অশ্বিন আর জাদেজার গোটা কেরিয়ারের ব্যাটিং পাশাপাশি রাখলে পরিষ্কার দেখা যায় অলরাউন্ডার হিসাবে অশ্বিন মোটেই খুব পিছিয়ে নেই। এখন পর্যন্ত ৬৫ টেস্টে ২৬৮ উইকেটের সঙ্গে জাদেজার রান ২৭০৬, গড় ৩৫.৬০, ১৮ অর্ধশতরানে সঙ্গে শতরান তিনটে। অশ্বিন ৯২ টেস্টে ৪৭৪ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ২৬.৯৭ গড়ে ৩১২৯ রানও করে ফেলেছেন। তেরোটা অর্ধশতরানের পাশাপাশি পাঁচ-পাঁচটা শতরানও আছে তাঁর। এর উপর আছে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে সিডনিতে সারাদিন ব্যাট করে ম্যাচ বাঁচানো ৩৯, যার দাম একটা দ্বিশতরানের চেয়েও বেশি। অতি বড় জাদেজাভক্তও ম্যাচের উপর ওর চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে এমন কোনো ইনিংসের কথা বলতে পারবেন না।

তাছাড়া জাদেজা দেশের মাঠের ঘূর্ণি পিচে যতখানি প্রভাবশালী বোলার, বিদেশে ততটাই নির্বিষ। তিনি ওভালে বিষাণ সিং বেদীকে টপকে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বাঁহাতি স্পিনার হয়ে গেছেন বটে, কিন্তু ২৬৮ উইকেটের মধ্যে ১৯৪ খানা উইকেটই এসেছে দেশের মাটিতে (৪০ টেস্টে), উইকেট পিছু মাত্র ২০.৪৫ রান খরচ করে। কিন্তু বিদেশে গেলেই জাদেজা অন্য বোলার। পঁচিশটা টেস্ট খেলে পেয়েছেন মাত্র ৭৪ খানা উইকেট। একেকটার জন্যে খরচ হয়েছে ৩৪.৩২ রান। ওভাল টেস্টেও দেখা গেল প্রথম ইনিংসে তিনি কোনো প্রভাবই ফেলতে পারলেন না। দ্বিতীয় ইনিংসে যখন বল রীতিমত ঘুরছে এবং লাফাচ্ছে তখন তিনটে উইকেট পেলেন বটে, কিন্তু স্টিভ স্মিথ আর ট্রেভিস হেডের দ্রুত রান তোলার তাড়া না থাকলে এবং ক্যামেরন গ্রীন স্কুল ক্রিকেটারের মত করে ডিফেন্স না করলে সেগুলো জুটত না। মহেন্দ্র সিং ধোনি অধিনায়ক থাকাকালীন একবার ইংল্যান্ডেই একটা টেস্টে জাদেজার স্পিন এতটাই পানসে হয়ে গিয়েছিল যে ধোনি উইকেট থেকে পিছিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে দিয়ে মিডিয়াম পেস বোলিং করিয়েছিলেন। তবু একমাত্র স্পিনার হিসাবে জাদেজাই খেলবেন, অশ্বিন নয়। তাঁরও বিদেশের রেকর্ড (৩৭ ম্যাচে ১৩৭ উইকেট, গড় ৩১.৪৫) দেশের তুলনায় সাধারণ, কিন্তু গত কয়েকটা বিদেশে সফরে অনেকখানি উন্নতি দেখা গিয়েছিল। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া সফরে এ যুগের সম্ভবত সেরা টেস্ট ব্যাটার স্মিথকে তিনি বোতলবন্দি করে ফেলেছিলেন।

এই অশ্বিনের চেয়ে শার্দূল ঠাকুর আর উমেশ যাদবকেও বেশি প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছে। উমেশ সেই ২০১১ সাল থেকে টেস্ট খেলছেন। সাতান্নটা টেস্ট খেলার পরেও তাঁর বোলিংয়ে অভিজ্ঞতার কোনো ছাপ দেখা যায় না। আজও গড় তিরিশের নিচে নামল না, ওভার পিছু সাড়ে তিনের বেশি রানও দিয়ে ফেলেন। কোনো ওভারে একটাও চার মারার বল না দিলে ধারাভাষ্যকাররা আপ্লুত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি নাকি দারুণ রিভার্স সুইং করান – এরকম একটা যুক্তি ওভালে তাঁর নির্বাচনের সপক্ষে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন শাস্ত্রীরা। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার কারণে সাধারণত বল এমনিই সারাদিন সুইং করে। সেখানে যে রিভার্স সুইং বিশেষজ্ঞের বিশেষ দরকার পড়বে না, তা কি ওই বোদ্ধারা জানেন না? আর দরকার পড়লেই বা। উমেশ তো ওয়াকার ইউনিসের মাপের বোলার নন। শার্দূলেরও না আছে গতি, না বিরাট সুইং। যতই নটা টেস্টে ২৯ খানা উইকেট পেয়ে থাকুন, দারুণ বোলিং সহায়ক পরিবেশ না পেলে তিনি নেহাত সাধারণ। ব্যাটেও এমন কিছু ধারাবাহিক নন, গড় মোটে ২০.৩৩। ত্রিশোর্ধ্ব এই ক্রিকেটারদের কাছ থেকে যে নতুন কিছু পাওয়ার থাকতে পারে না, সেকথা রোহিত আর সারাক্ষণ মনোযোগী ছাত্রের মত খাতায় নোট নেওয়া রাহুল দ্রাবিড় বোঝেন না কেন?

বোঝেন না যে সেকথা কিন্তু গাভস্কররা বলেন না। তাঁরা বরং টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তগুলোর সপক্ষে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেন। কারণ নুন খেলে গুণ গাইতেই হয়। নইলে নুন খাওয়া ছাড়তে হয়। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড শুধু পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বোর্ডই নয়, একমাত্র বোর্ড যারা জাতীয় দল এবং আইপিএলের সম্প্রচারের সুতোও নিজেদের হাতে রাখে। ধারাভাষ্যকাররা তার হাতের পুতুল। অপছন্দের কথা বলেছ কি চুক্তি বাতিল। অতএব বোর্ড যা করে সব ভাল, টিম ম্যানেজমেন্টও সবসময় ভালই করে, তবে মাঝেমধ্যে দু-একটা ভুল হয়ে যায় আর কি। যেমন টস জিতে ফিল্ডিং নিতে গিয়ে ব্যাটিং নেওয়া হয়ে যায়। তা বলে কি আর অচল ক্রিকেটার দলে নেওয়া হয়? মোটেই তা বলা যায় না।

দ্বিতীয় অঙ্ক: ভাঙব তবু মচকাব না

যাঁরা মন দিয়ে ওভাল টেস্ট দেখেছেন এবং পঞ্চম দিন সকাল সকাল ভারত হেরে যাওয়ার পরেও ভগ্ন হৃদয়ে অস্ট্রেলিয়ার ট্রফি হাতে নেওয়া পর্যন্ত সম্প্রচার দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই দুটো কথা ভাবছেন। প্রথমত, ডুবিয়েছে ভারতীয় দলের ক্রিকেটাররা। খামোকা প্রাক্তন ক্রিকেটারদের সমালোচনা করা কেন? দ্বিতীয়ত, অন্য সময়ে যা-ই করুন, ওভাল টেস্টের পরে তো আমাদের প্রাক্তনরা যারপরনাই সমালোচনা করেছেন। গাভস্কর তো এত রেগে গিয়েছিলেন যে স্টার স্পোর্টসের অ্যাঙ্কর ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হচ্ছিল পালাতে পারলে বাঁচেন। দ্রাবিড়ের দুই পুরনো বন্ধু সৌরভ গাঙ্গুলি আর হরভজন সিংও তাঁকে বিস্তর চোখা চোখা প্রশ্নে বিদ্ধ করেছেন। তাহলে এঁদের সমালোচনা করা কেন?

ঠিক কথা। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আসতে একটু সময় লাগবে। আগে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিই। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের চুক্তি যতই মহার্ঘ হোক, চোখের চামড়া তো কিনতে পারে না। ফলে ২০৯ রানে টেস্ট হারার পরে মিষ্টি কথা বলা কী করে সম্ভব? তাছাড়া হাজার হোক, গাভস্কর, সৌরভদের ক্রিকেট দুনিয়ায় তাঁদের খেলোয়াড় জীবনের অর্জনগুলোর জন্য বিশেষ সম্মান আছে। সে সম্মান তাঁরা বিসর্জন দেন কী করে? তাঁরা তো আর রাহুল কাঁওয়াল বা অর্ণব গোস্বামী নন যে বিজেপির গোহারা হারকে লাইভ টিভিতে ‘সম্মানজনক হার’ বলে চালানোর চেষ্টা করবেন অন্য দেশের লোকে কী ভাবল সেসবের তোয়াক্কা না করে। ক্রিকেটার গাভস্করের নামে গান বাঁধা হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে, অধিনায়ক সৌরভকে এখনো সমীহ করে সারা বিশ্বের ক্রিকেটমহল। সেগুলোর মূল্য ক্রিকেট বোর্ডের মহাত্মা গান্ধীর ছবিওয়ালা কাগজ এখনো পুরোপুরি ভুলিয়ে দিতে পারেনি। তার উপর ধৈর্যচ্যুতির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিদেশের মাঠে ভারত এই প্রথম হারল না, এর চেয়ে লজ্জাজনকভাবেও হেরেছে। কিন্তু একটা সাধারণ পিচে পাঁচদিন সবদিক থেকে পর্যুদস্ত হয়ে সেই সৌরভের আমল থেকে কতবার হেরেছে তা হাতে গুণে বলা যাবে। ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদানই হল বিদেশে জিততে শেখানো। গাভস্করও বিদেশে বহু যুদ্ধের নায়ক। ওই ওভালেই তাঁর মহাকাব্যিক ২২১ রান আছে চতুর্থ ইনিংসে। সেদিন চারশোর বেশি রান তাড়া করে ভারত আরেকটু হলে জিতেই যাচ্ছিল। ফলে এই হার তাঁদের হজম না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু…

এই কিন্তুর মধ্যেই আছে দ্বিতীয় উত্তর। রাগত প্রাক্তনরা কী বলেছেন তা কি খেয়াল করেছেন? বিরাট কোহলির আউট সম্পর্কে মতামত চাইলে ক্রুদ্ধ গাভস্কর বলেছেন, ওকেই জিজ্ঞেস করুন চতুর্থ-পঞ্চম স্টাম্পের বল কেন তাড়া করতে গেছিল। সৌরভ দ্রাবিড়কে প্রশ্ন করেছেন, প্রথমে ব্যাট করার কী যুক্তি ছিল? তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে ভারতের প্রথম পাঁচ ব্যাটার দীর্ঘদিন হল রান করতে পারছেন না। ব্যাটিংয়ে কি রদবদলের দরকার নেই? হরভজন জিজ্ঞেস করেন, ভারতীয় দলের মহাতারকারা বিদেশের পিচে কেন রান করতে পারেন না? বোলাররাই বা সুবিধা করতে পারেন না কেন?

প্রশ্নগুলো চোখা বটে, কিন্তু বেশি চোখা লাগছে এই কারণে যে ভারতের প্রাক্তনদের মুখ থেকে বর্তমান ক্রিকেটারদের স্তুতি শুনতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ব্যর্থ হলে সমালোচনা করা, প্রশ্ন করাই যে তাঁদের কাজ – একথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। এমনটা কিন্তু অন্য দেশে হয় না। ২০২১-২৩ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ড জঘন্য খেলছিল। অধিনায়ক জো রুট ছাড়া প্রায় কেউই রান করতে পারছিলেন না, বোলারদের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। রুটের অধিনায়কত্বও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছিল না। এমনকি দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেও শোচনীয় পরাজয় ঘটে ইংল্যান্ডের। সেইসময় নাসের হুসেন, মার্ক বুচারের মত প্রাক্তনরা কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টকে ছেড়ে কথা বলেননি। তাঁর ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে পরিষ্কার বলতেন রুটকে দিয়ে আর অধিনায়কত্ব হবে না। রুট শেষপর্যন্ত দায়িত্ব ছেড়ে দেন, ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে জাতীয় দল এবং আরও অনেককিছুর দায়িত্বে থাকা অ্যান্ড্রু স্ট্রস। তাঁর জায়গায় আসেন রবার্ট কী। তারপর টেস্ট দলের কোচ ক্রিস সিলভারউডকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে, অধিনায়ক হন বেন স্টোকস। দলেও বেশকিছু রদবদল করা হয়। তারপর থেকে ইংল্যান্ড যে ক্রিকেট খেলছে তাতে শুধু যে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাই নয়, তারা টেস্ট ক্রিকেটকে নতুন যুগে নিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাই এখন আলোচনার বিষয়। ম্যাককালামের আদরের নাম ব্যাজ। সেই থেকে তাদের খেলার ধরনের নামকরণ হয়েছে ব্যাজবল।

অথচ আমাদের প্রবাদপ্রতিম প্রাক্তনদের দেখুন। পৃথিবীর সেরা মানের পারিশ্রমিক, অনুশীলনের সুযোগসুবিধা ইত্যাদি পেয়েও সেই ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে আর কোনো আইসিসি ট্রফি জেতেনি ভারত। উপরন্তু এই সময়কালে টেস্ট দল পরপর দুবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জেতা ছাড়া বিদেশের কোথাও সিরিজ জেতেনি। বিদেশে খেলা হলেই রোহিত, চেতেশ্বর পূজারা, কোহলি, অজিঙ্ক রাহানে ধ্যাড়াবেন আর কখনো ঋষভ পন্থ, কখনো জাদেজা, কখনো শার্দূল, কখনো ওয়াশিংটন সুন্দর রান করে মুখরক্ষা করবেন – এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দশ বছর ধরে এই ঘটনা বারবার ঘটে চললেও এখনো গাভস্কর, সৌরভরা নাম করে বলতে পারছেন না অমুককে বাদ দেওয়া উচিত। ২০১৩ সালে যখন ভারত বহুকাল পরে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের কাছে সিরিজ হারল, তখন জিওফ্রে বয়কট আর কপিলদেব কিন্তু রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন, শচীন তেন্ডুলকর উন্নতি করতে না পারলে অবসর নিন। আজ বিরাটের নাম মুখে আনতে পারছেন না আমাদের প্রাক্তনরা, বহু ভারতীয় গিন্নী যেমন কর্তার নাম মুখে আনেন না। অথচ একা কোহলিই যে কতখানি ডুবিয়ে দিচ্ছেন ভারতকে, তার স্পষ্ট পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন ক্রিকেট অ্যানালিটিক্স সংস্থা ক্রিকভিজের সিনিয়র ব্রডকাস্ট অ্যানালিস্ট সোহম সরখেল। নিচের এই টুইটসূত্রে চোখ রাখলেই দেখতে পাবেন, সদ্য শেষ হওয়া টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে অন্য ব্যাটারদের ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতের চার নম্বর ব্যাটার বাদে সব জায়গার ব্যাটাররাই বিপক্ষের ব্যাটারদের চেয়ে গড়ে ভাল রান করেছেন। কিন্তু একা কোহলির ব্যর্থতাই এত বিরাট যে তা অন্য সবার কাজে জল ঢেলে দিয়েছে। ২০২০ সালে তাঁর গড় ছিল ১৯, ২০২১ সালে ২৮ আর ২০২২ সালে ২৬। এ বছর এখন পর্যন্ত ৪৫, কিন্তু তার কারণ আমেদাবাদের ঢ্যাবঢেবে পিচে ১৮৬। ওই ইনিংস বাদে চলতি বছরেও তাঁর গড় ২৫।

তৃতীয় অঙ্ক: মানুষের তৃতীয় হাত

জিততে পারুন আর না-ই পারুন, ভারতীয় দলের ক্রিকেটার বা কোচের মুখে সবসময় খই ফোটে। এ জিনিসটা শিখিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই ধোনি আর শাস্ত্রীর। ধোনি ইংরেজি অভিধান থেকে একটি চমৎকার শব্দ চয়ন করেছিলেন – প্রোসেস। হেরে গেলেই বলতেন, আমরা হারজিত নিয়ে চিন্তিত নই। প্রোসেস ‘ফলো’ করা হয়েছে কিনা সেটাই বড় কথা। সেটা করা হলে ‘রেজাল্ট’ ঠিক এসে যাবে। কথাগুলো চমৎকার। বেশ একটা মহাত্মা গান্ধীসুলভ প্রশান্তি রয়েছে কথাগুলোর মধ্যে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ধোনি বাবা হয়ে গেলেন, চুল পেকে গেল, ভারতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে ফেললেন, ‘রেজাল্ট’ তো আজও এসে পৌঁছল না। তাঁর উত্তরসূরী কোহলি আর ভারতীয় দলের তৎকালীন কোচ শাস্ত্রী প্রোসেসের সঙ্গে যোগ করেছিলেন আরেকটি শব্দ – ইনটেন্ট। বারবার সাংবাদিক সম্মেলনে এসে দুজনেই বলতেন, ইনটেন্টই হচ্ছে আসল। ওটা যার আছে তার উপর টিম ম্যানেজমেন্টের ভরসা আছে। ইনটেন্ট দেখিয়ে হারলে কোনো দুঃখ নেই। এই ইনটেন্ট নেই বলে পূজারা যখন ধারাবাহিক ছিলেন তখনো বারবার বাদ পড়তে হয়েছে, ফর্মে থাকা রাহানেকে বসিয়ে রেখে নড়বড়ে রোহিতকে টেস্ট খেলানো হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়।

এইবার দ্বিতীয় অঙ্কে উত্থাপিত প্রথম প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে ফেলা যাক। ভারতীয় ক্রিকেট দলের ব্যর্থতায় প্রাক্তনদের সমালোচনা করছি কেন?

এই যে ইনটেন্ট নামক ধাষ্টামো, এর টেস্ট ক্রিকেটে কোনো মানেই হয় না জেনেও আমাদের প্রাক্তনরা কিন্তু সেসময় অধিনায়ক কোহলি আর কোচ শাস্ত্রীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন, দুহাত তুলে সমর্থন করেছিলেন। ২০১৫ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে প্রথম দুটো টেস্টে পূজারাকে বসিয়ে রাখা হয়, কারণ তার আগের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে তাঁর মধ্যে ইনটেন্ট দেখা যায়নি। তৃতীয় টেস্টে দুই ওপেনারের অভাব ঘটায় অগত্যা তাঁকে খেলানো হয় এবং তিনি ১৪৫ রানে অপরাজিত থাকেন। বস্তুত, দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য রানে আউট হলেও, কম রানের সেই ম্যাচে ওই ইনিংসই তফাত গড়ে দেয় এবং ভারত জেতে। পূজারা প্রথম ইনিংসে যখন পঞ্চাশ পেরোন, তখন ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মঞ্জরেকর গাভস্করকে জিজ্ঞেস করেন পূজারা কি দলে নিজের জায়গা পাকা করতে পারলেন, নাকি শতরান করলে জায়গা পাকা হবে? সানি উত্তর দেন, এই দলে যা প্রতিভার ছড়াছড়ি তাতে আলোচনায় থাকতে গেলে পূজারাকে দেড়শোর বেশি করতে হবে। বিরক্ত কলামনিস্ট মুকুল কেশবন দ্য টেলিগ্রাফ-এ লেখেন “A century and a half…what team of Titans was this, what bastion of Bradmans was Pujara trying to breach?” সেই ইনটেন্টের ভূত যে পূজারাকে আজও তাড়া করে বেড়াচ্ছে, তার প্রমাণ ওভালের দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর চরিত্রবিরোধী এবং খেলার পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় শট খেলতে গিয়ে আউট হওয়া। ক্রিজে জমে যাওয়া রোহিতের হঠাৎ নাথান লায়নের সোজা বলকে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হওয়া বা কোহলির কয়েকটা ডট বল হতেই বহুদূরের বল তাড়া করে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যাওয়ার পিছনেও ইনটেন্টের ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে।

ভারতীয় ক্রিকেটের একেবারে ভাবনার জায়গায় এই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগুলো যখন করা হয়েছে, তখন হাততালি দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ প্রাক্তনরা। কোহলির জিম-পাগল হওয়া এবং গোটা দলকে জিম-পাগল করে তোলাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন আমাদের প্রাক্তনরা, হর্ষ ভোগলেরা এবং প্রাতঃস্মরণীয় ক্রিকেট সাংবাদিকরা। অথচ মাইকেল হোল্ডিং, ওয়াসিম আক্রাম, কপিলদেবের মত নমস্য জোরে বোলাররা চিরকাল বলে এসেছেন, ক্রিকেটার মানে কুস্তিগীর নয়। তাদের পেশি ওরকম হওয়ার দরকার নেই। তাদের শরীর তৈরি করতে সেরা প্র্যাকটিস হল নেট প্র্যাকটিস। বিশেষ করে জোরে বোলারদের উচিত যত বেশি সম্ভব বোলিং করা। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এঁরা বারবার বলেছেন, এমনকি অফ সিজনেও কয়েকশো ওভার বল করতেন নেটে। সেভাবেই চোট-আঘাত মুক্ত অবস্থায় টানা প্রায় দুই দশক ভারতের হয়ে খেলে গেছেন কপিল। অথচ এখন আমাদের জিম করা ক্রিকেটারদের এমন অবস্থা যে ব্যাটাররাই অনেকে টানা দুটো সিরিজ খেলে উঠতে পারেন না। আর বোলাররা? যশপ্রীত বুমরা সেই যে আহত হয়েছেন, কিছুতেই মাঠে ফিরতে পারছেন না। বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন কিনা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, নভদীপ সাইনি – যাঁকেই ভবিষ্যৎ বলে ভাবা হয়, কিছুদিন পরেই দেখা যায় তিনি আহত। অতএব ঘুরে ফিরে বুড়িয়ে যাওয়া উমেশ আর মাঝারি মানের শার্দূলকেই খেলাতে হয়। অর্থাৎ গোলমালটা প্রথম একাদশ নির্বাচন থেকে শুরু হয়নি। দেশের কয়েকশো খেলোয়াড়ের মধ্যে থেকে ১৪-১৫ জন বেছে নেওয়ার সময়েই গোড়ায় গলদ হয়ে গেছে।

ব্যাটার বেছে নেওয়ায় গলদ তো আরও গভীর। কারণ টপ অর্ডার এবং মিডল অর্ডারের নিষ্কর্মাদের সরানো যাবে না। পূজারা, রাহানেদের তবু বাদ দেওয়া গেছে। তাঁদের কাউন্টি ক্রিকেটে বা ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করে ফিরতে হয়েছে। কিন্তু রোহিত আর কোহলির আছে বিপুল বিজ্ঞাপনী সমর্থন। অর্থাৎ তাঁদের উপর কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে রেখেছে বহু কোম্পানি। তার মধ্যে আছে ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে জুয়া খেলার কোম্পানিগুলোও। তাদের কেউ কেউ এমনকি জাতীয় দলের শার্ট স্পনসর, অমুক স্পনসর তমুক স্পনসর। তাদের আর্থিক ক্ষতি হয় এমন কাজ মোটেই করা চলে না। অতএব রান করতে না পারলেও শালগ্রাম শিলার মত এদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ তারকাদের দলে রাখতেই হবে। রঞ্জি ট্রফিতে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করা সরফরাজ খানরা যদ্দিন আইপিএলে রানের বন্যা বইয়ে শাঁসালো স্পনসর জোগাড় করতে না পারছেন তদ্দিন বাড়ির টিভিতে টেস্ট ম্যাচ দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না। এর ফলে দলের যে ক্রিকেটিয় ক্ষতি, তা পূরণ করতেই টেস্ট দল নির্বাচনের সময়ে বোলারদের বেলাতেও দেখা হয় ভাল ব্যাট করতে পারে কিনা, উইকেটরক্ষক বাছার সময়েও তাই।

অগ্রাধিকারের এই উলটপুরাণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ওভাল টেস্টে কে এল রাহুলকে উইকেটরক্ষক হিসাবে খেলানোর নিদান দিয়ে ফেলেছিলেন বহু বোর্ড ঘনিষ্ঠ ক্রিকেট সাংবাদিক। রাহুল ফিট থাকলে বোধহয় সেটাই ঘটত। যদিও সকলেই জানেন ইংল্যান্ডে উইকেটরক্ষা ভীষণ শক্ত কাজ কারণ বল ব্যাটারকে অতিক্রম করার পরেও সুইং করে অনেকসময়, পিচে অসমান বাউন্সও থাকতে পারে। সেখানে পাঁচদিনের খেলায় রাহুলের মত ঠেকনা দেওয়া উইকেটরক্ষক খেলানো আর খাদের ধারে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা একই কথা। ওভালে কোনা শ্রীকর ভরত প্রশংসনীয় উইকেটরক্ষা করেছেন। তারপরেও সোশাল মিডিয়ায় “ওকে দিয়ে হবে না” লিখে চলেছেন বহু বোদ্ধা সাংবাদিক। পন্থ থাকলে আলাদা কথা ছিল। তিনি অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বেচারা ভরত শান্তিতে খেলতে পারবেন না। ঋদ্ধিমান সাহাকে যখন দ্রাবিড় ডেকে বলে দিয়েছিলেন, তাঁর বয়স হয়েছে বলে আর টেস্ট দলে না নেওয়ার কথা ঠিক করেছে টিম ম্যানেজমেন্ট, তখন মনে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মত নতুন খেলোয়াড় তুলে আনার প্রগতিশীল পথে এগোচ্ছে ভারতীয় দল। এখন বোঝা যাচ্ছে, ওসব কিছু নয়। ঋদ্ধিমানের দরকার ছিল অমুক ডট কমের একটা এনডর্সমেন্ট চুক্তি। তাহলেই বয়সটা বাড়তি না হয়ে কমতি হয়ে যেত।

দল নির্বাচনে এইসব শর্তাবলী প্রযোজ্য বলেই বোধহয় বোর্ড পাঁচজনের নির্বাচন সমিতিতে চারজনকে রেখে, অস্থায়ী চেয়ারম্যান রেখে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে সেই ২০২০ সাল থেকে। তাঁদের আর গুরুত্ব কী? রাজ সিং দুঙ্গারপুরের মত বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো সাড়ে ষোলো বছরের ছেলেকে দলে ঢুকিয়ে দেওয়া বা যাঁকে ভবিষ্যতের অধিনায়ক বলে কেউ ভাবছেই না, তাকে গিয়ে “মিয়াঁ, ক্যাপ্টেন বনো গে?” বলার অধিকারই আজকের নির্বাচকদের নেই। তাঁরা স্রেফ দক্ষ বাজিকরের হাতের পুতুল।

সমস্ত ক্রিকেট ব্যবস্থাটাই যে অব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে সেকথা বলার কাজ তো বিশেষজ্ঞ, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিকদেরই। যিনি যত বড় নাম, তাঁর দায়িত্ব তত বেশি। অথচ সকলেই সুকুমার রায়ের ছড়ার মত “এই দুনিয়ার সকল ভাল, আসল ভাল নকল ভাল” বলে চালিয়ে যাচ্ছেন এক দশক যাবৎ। কারণ কেউ ধারাভাষ্য দেওয়ার চুক্তির লোভ সামলাতে পারছেন না, কারোর চাকরি বোর্ডের জো হুজুরি না করলে চলে যাবে। যেমন স্মৃতি ইরানিকে প্রশ্ন করায় এক সাংবাদিকের চাকরি গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাংবাদিকরা না হয় চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত, কিন্তু ভারতের হয়ে খেলা এবং এত বছর মোটা মাইনের ধারাভাষ্যের কাজ করা বিশেষজ্ঞরা এখনো জো হুজুরি করে যাবেন আর দুকথা শুনবেন না তা কি হয়?

আজ ভারতীয় ক্রিকেটে যে হারজিতের যে কোনো মূল্য নেই, রোহিত-কোহলিরা যে বারবার ব্যর্থতার পরেও কলার তুলে ‘গ্রেট’ অভিধা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং প্রত্যেকটা হারের পর নতুন নতুন অজুহাত খাড়া করতে পারেন তার জন্যে তো ভারতীয় ক্রিকেটের গোটা বাস্তুতন্ত্র দায়ী। এমন বাস্তুতন্ত্র তৈরি করায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন প্রাক্তনরা। ওভালের পরাজয়ের পরেও একগুচ্ছ অজুহাত খাড়া করেছেন অধিনায়ক রোহিত। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আইপিএল ফাইনালের পরে কেন হবে? জুনের বদলে মার্চে কেন হবে না? হলেই তো প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট সময় পাওয়া যেত। এত বড় প্রতিযোগিতার ফাইনাল তিন ম্যাচের হওয়া উচিত – এমন দাবিও করেছেন। হেরোদের ঘ্যানঘ্যান শুনতে কারই বা ভাল লাগে? অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স তাই বিদ্রুপ করেছেন “পঞ্চাশটা ম্যাচের সিরিজ হচ্ছে আদর্শ। কিন্তু অলিম্পিকে সোনার মেডেল জেতার জন্যে একটাই রেস হয়। এএফএল, এনআরএল সিরিজগুলোরও ফাইনাল থাকে। একেই খেলা বলে।”

চতুর্থ অঙ্ক: সাধের লাউ

পৃথিবীর সমস্ত খেলার নিয়ামক সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল সংস্থার নাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল, অর্থাৎ আইসিসি। তাদের টিকি বাঁধা আছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছে, কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি টাকার জোগান দেয় আইসিসিকে। বিনিময়ে সবচেয়ে বেশি লাভের গুড়ও নেয়। ফলে ভারতীয় বোর্ড চাইলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালও তিন ম্যাচের হতেই পারে, ইংল্যান্ডের বদলে আমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে হতে পারে। সেখানে এমন পিচ বানিয়ে দেওয়া হবে যে আমি-আপনি গিয়ে বল করলেও এক হাত ঘুরবে। কিন্তু কথা হল, ভারতীয় বোর্ড কি অতটা মাথা ঘামাবে?

তার সোনার ডিম পাড়া হাঁস হল আইপিএল। সেই আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব থেকে এত টাকা আয় হয় যে আগামী দিনে প্রতিযোগিতাটাকে টেনে আরও লম্বা করা হচ্ছে। আইসিসি তাতে মাথা নেড়ে সায়ও দিয়ে ফেলেছে। আইপিএল সম্পর্কে আমাদের সমস্ত বর্তমান ও প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার এবং প্রাতঃস্মরণীয় সাংবাদিকরা উচ্ছ্বসিত। তাঁদের কথাবার্তায়, লেখাপত্রে মনে হয় মানবজাতি এই প্রথম একটি জিনিস আবিষ্কার করতে পেরেছে যার কোনো নেতিবাচক দিক নেই। সমালোচনা করার মত একখানা বৈশিষ্ট্যও নেই। অথচ ওভাল টেস্টে হারের পর হঠাৎ সকলের মনে পড়েছে, যে আইপিএলটা না থাকলে এই ফাইনালের জন্যে যথেষ্ট প্রস্তুতির সময় পাওয়া যেত।

আরও পড়ুন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে মরে প্রমাণ করতে হবে সে মরেনি

অনেকে বলছেন এই হারের পর নাকি দ্রাবিড়ের চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে। হয়ত সেটা আন্দাজ করে মরিয়া হয়ে অথবা চাকরিটা যাবেই ধরে নিয়ে তিনি বলেছেন ক্রীড়াসূচি নিয়ে তিনি কখনোই খুশি হতে পারেন না। ফাইনালের দিন কুড়ি আগে যদি ইংল্যান্ডে পৌঁছনো যেত আর দু-তিনটে সাইড ম্যাচ পাওয়া যেত, তাহলে চমৎকার প্রস্তুতি হত। শুনলে মনে হয় ইনি রিপ ভ্যান দ্রাবিড়। নিজের খেলোয়াড় জীবন শেষ হওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এইমাত্র জেগে উঠেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যা ঠাসা ক্রীড়াসূচি তাতে সাইড ম্যাচ ব্যাপারটা তো বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। বিশেষ করে ভারতীয় দলের অফ সিজন বলে কিছু নেই দ্রাবিড় যখন ক্রিকেটার তখন থেকেই। তিনি যখন অবসর নেন আইপিএল তখনো চারাগাছ। এখন সে বটবৃক্ষ, দুর্জনে বলছে ছদ্মবেশী সেপ্টোপাস। তার খিদে ক্রমশ বাড়ছে, বিশ্বের অন্যত্র তার বীজ থেকে আরও নানা মাংসাশী লিগের জন্ম হচ্ছে যারা ক্রমশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে গিলে নেবে। এমন দিনে ভারত অধিনায়ক চাইছেন তিন ম্যাচের ফাইনাল, কোচ সাইড ম্যাচের কথা বলছেন। এসব কি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা রোজগার করার অপরাধবোধের প্রকাশ, নাকি আমাদের দেশের পরিচালকদের মত বৈদিক যুগে ফিরে যাওয়ার সাধ?

গত ইংল্যান্ড সফরে ভারতীয় দলের কোচ থাকা অবস্থায় যে শাস্ত্রী কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে সিরিজটা ভালয় ভালয় শেষ করার চেয়ে নিজের বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তিনি আবার জ্ঞান দিয়েছেন, আইপিএল বাদ দিয়ে টেস্টের জন্যে প্রস্তুতি নেওয়ার কাজটা খেলোয়াড়দের নিজ দায়িত্বেই করা উচিত। যোগ করেছেন, ভারতীয় বোর্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজদের সঙ্গে চুক্তিতে একটা শর্ত রাখা উচিত যাতে খেলোয়াড়রা ভবিষ্যতে এত বড় ম্যাচের জন্যে এরকম সুযোগ পায়। এত উত্তম প্রশাসনিক পরিকল্পনা তিনি জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়ে কোথায় ছিল কে জানে? তিনি দায়িত্বে থাকতেই ভারত প্রথমবার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠে। তখন এমন কোনো প্রয়াস তিনি করেননি, হার থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন কোনো পরামর্শই বোর্ডকে দিয়ে যাননি। এখন অসংখ্য ভাল ভাল ধারণা তাঁর মাথায় গিজগিজ করছে।

পঞ্চম অঙ্ক: যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ

ক্রিকেট এখন আগে অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা, পরে খেলা। সে ব্যবসার সবচেয়ে কম চাহিদার মালটির নাম টেস্ট ক্রিকেট। অতএব আপনি আরও একটা আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারত জিততে পারল না বলে যতই দুঃখ পান, জানবেন কর্তারা বা ক্রিকেটাররা আপনার দুঃখের ভাগী নয়। ভারতীয় ক্রিকেটারদের দুঃখে প্রাণ যাচ্ছে এমন মনে করার কারণ নেই, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররাও টেস্ট ক্রিকেটের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত বলে ভাববেন না। প্রমাণ চান? ওভাল টেস্টের একটা মিনিটও ইংল্যান্ডের বিখ্যাত বা কুখ্যাত খামখেয়ালি আবহাওয়ার জন্যে নষ্ট হয়নি। অথচ পাঁচদিন মিলিয়ে মোট ৪৪ ওভার কম খেলা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো দলেরই দিনে যতগুলো ওভার বল করা সম্ভব ততগুলো সম্পূর্ণ করার গরজ ছিল না।

সুতরাং যদি পাঁচদিনের খেলার প্রতি ভালবাসা থেকে থাকে, তাহলে বয়স্ক ঠাকুমার ফোকলা হাসি যেভাবে লোকে শেষ কয়েকদিন প্রাণভরে দেখে নেয়, সেইভাবে উপভোগ করে নিন। এ খেলা বাঁচুক তা কর্তারা চান না, সম্ভবত খেলোয়াড়রাও নয়। নইলে নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট, ইংল্যান্ডের জেসন রয়রা স্বেচ্ছায় দেশের বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতেন না ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খেলবেন বলে। কর্তারা ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খোলায় লাগাম দিতেন, টেস্ট ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় করে তুলতে গোলাপি বলের দিন-রাতের টেস্ট আয়োজন ক্রমশ বাড়াতেন। হচ্ছে ঠিক উল্টো – বোল্টরা দলে ভারি হচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর এবার সৌদি আরবেও বিপুল অর্থকরী ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ চালু হবে। আর দিন-রাতের টেস্টের কেউ নামোচ্চারণ করছে না।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

ক্রিকেট জেনেশুনে বিশ করেছে পান

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে।

শোয়েব আখতার যখন বল করতেন, মনে হত গোলাবর্ষণ করছেন। এখন বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার সময়েও প্রায় একই মেজাজে থাকেন। আজকাল প্রাক্তন ক্রিকেটাররা ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে কথা বলার সময়ে অতি মাত্রায় সাবধানী। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড চটে গেলে এ দেশে ধারাভাষ্যের মহার্ঘ সুযোগ পাওয়া যাবে না, কোনো একটা ভূমিকায় আইপিএলের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজে ঢুকে সারা বছরের রোজগার দু-আড়াই মাসে করার সুযোগও হাতছাড়া হবে। শোয়েব পাকিস্তানি হওয়ায় ও দুটো দরজাই তাঁর জন্যে বন্ধ। সম্ভবত সে কারণেই নিজের দেশের বাবর আজম সম্পর্কে যেরকম তীর্যক মন্তব্য করেন, বিরাট কোহলি সম্পর্কেও সেভাবেই কথা বলেন। কোহলিকে আক্রমণ করে কদিন আগে বলেছেন “আমি কোহলিকে অনুরোধ করব ও যেন ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত খেলে। তাহলে আরও ৮-৯ বছর সময় পাবে। ভারত ওকে হুইলচেয়ারে বসা অবস্থাতেও খেলাবে এবং একশোটা শতরান করা পর্যন্ত খেলতে দেবে। আমার মনে হয় ও অবসর পর্যন্ত অন্তত ১১০ খানা শতরান করে ফেলবে।”

কোনো সন্দেহ নেই ভারতীয় ক্রিকেটে ব্যক্তিপূজা এমন প্রবল, যে কপিলদেবকে রিচার্ড হেডলির টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড ভাঙার জন্য, আর শচীন তেন্ডুলকরকে শততম শতরান করতে দেওয়ার জন্য, খেলোয়াড় হিসাবে ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও খেলতে দেওয়া হয়েছিল। মহেন্দ্র সিং ধোনি অবশ্য রেকর্ড ভাঙার জন্য খেলে যাননি। তাঁর ফিনিশ করার ক্ষমতা ফিনিশ হয়ে গিয়ে থাকলেও বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের কোম্পানির ডিরেক্টরকে বাদ দেয় কোন নির্বাচকের সাধ্যি? বরং সেই ২০১১ সালে নির্বাচক কমিটির বৈঠকে ধোনিকে টেস্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ায় নির্বাচক মহিন্দর অমরনাথের চাকরিই নট হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং কোহলিও যদ্দিন ইচ্ছা খেলে যেতেই পারেন। কিন্তু শোয়েবের ভুল হয়েছে অন্য জায়গায়।

কোহলির এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতরানের সংখ্যা ৭৫ (টেস্ট ২৮, একদিনের ক্রিকেট ৪৬, আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ১)। যতদিন পর্যন্তই খেলুন, আরও ২৫ খানা শতরান কোথা থেকে আসতে পারে ভেবে দেখুন। পরপর দুটো ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে ব্যর্থ হওয়ার পর (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্মরণীয় ইনিংসটা বাদ দিলে) ৩৪ বছরের কোহলিকে আর ওই ফরম্যাটে খেলানো হবে কিনা দেবা ন জানন্তি। বয়স বাড়লে টেস্টে শতরান করা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে যায় তা তো কোহলির গত চার বছরের খেলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাহলে হাতে রইল পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট, যাতে কোহলিকে এখনো মাঝে মধ্যে স্বমহিমায় দেখা যায়। কিন্তু ওই ফরম্যাটটির নিজেরই যে বাঁচা দায়।

শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। মাত্র ছমাস পরেই পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ, তাও আবার ভারতে। যেখানে পঞ্চাশ গ্রাম ওজনের প্লাস্টিক বল দিয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হলেও খেলা দেখতে লোক জমে যায়। এই তো কদিন আগে ভারত-অস্ট্রেলিয়া একদিনের সিরিজ হয়ে গেল, তার আগে বাংলাদেশে সিরিজ হল। সেখানে গুরুত্বহীন ম্যাচে হলেও ঈশান কিষণ দ্বিশতরান করলেন, কোহলি শতরানের খরা কাটালেন। এমন সময়ে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট নিয়ে এমন কথা কেন? ঘটনা হল, যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে। সারা পৃথিবীতে টি টোয়েন্টি লিগগুলোর, মানে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের যত রমরমা হচ্ছে, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের দর্শক তত কমছে। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, যে কর্মকর্তারাও চান না ওটা বেঁচে বর্তে থাক। নইলে ১৩ নভেম্বর ২০২২ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি ফাইনালের পর ১৭, ১৯ আর ২২ তারিখ কেন তিনটে একদিনের ম্যাচ খেলবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড? মাত্র চারদিন আগে দাপটে কুড়ি ওভারের বিশ্ব খেতাব জয় করা ইংল্যান্ড তিনটে ম্যাচেই গোহারা হারে। সেই ফলাফলকে গুরুত্ব না দিলেও হয়ত চলে, ইংল্যান্ডের পর্যুদস্ত হওয়ার দায় ক্লান্তির উপর চাপানো তো একেবারেই চলে না, কারণ ইংল্যান্ডের একদিনের দলের অনেকেই ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলে ছিলেন না। কিন্তু আসল কথা হল অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ইংল্যান্ড খেলছে আর গ্যালারিতে মাছি তাড়ানোরও লোক নেই – এ জিনিস দুদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। খেলাগুলোর টিভি রেটিংয়ের অবস্থাও ছিল শোচনীয়।

এটা একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। ভারতেও যে কোনো দলের সঙ্গে খেলা থাকলেই মাঠ ভরে যাওয়ার দিন চলে গেছে। আইপিএলে টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে, সাংবাদিকরা সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে বাধ্য হন “দয়া করে কেউ টিকিট চাইবেন না।” কিন্তু পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে অন্তত কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর মত বড় শহরে সে সমস্যা হয় না। শুধু যে দর্শকদের আগ্রহ কমছে তা নয়, খেলোয়াড়দেরও আগ্রহ কমছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস ইতিমধ্যেই একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে বসে আছেন। মানে গত বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় এবার বিশ্বকাপে খেলবেন না। তাঁর বয়স কিন্তু মাত্র ৩১। গতবছর জুলাই মাসে অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর ডিসেম্বরে অবশ্য স্টোকস বলেছিলেন তিনি শুধু বিশ্বকাপটা খেলার কথা ভেবে দেখতেও পারেন। কিন্তু অবসর নেওয়ার যে কারণগুলো দেখিয়েছিলেন, সেগুলো লক্ষ করার মত। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, বড্ড বেশি ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। তিন ধরনের ক্রিকেটের ধকল তাঁর শরীর নিতে পারছে না।

এই সমস্যা একা স্টোকসের নয়। ইংল্যান্ডের জোরে বোলার জোফ্রা আর্চার চোট পেয়ে মাঠের বাইরে বসেছিলেন বেশ কয়েক বছর, চলতি আইপিএলে মাঠে ফিরলেন। ভারতের যশপ্রীত বুমরা কবে ফিরবেন এখনো পরিষ্কার নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায় সব দলের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররাই বারবার চোট পাচ্ছেন, বিরাম নিতে হচ্ছে। কারণ আইপিএল দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, সেই ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জয়যাত্রা এখন ম্যাগেলানের মত পৃথিবী পরিক্রমায় বেরিয়েছে। পাকিস্তান সুপার লিগ, লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশের সঙ্গে এ বছর থেকে যোগ হল দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টোয়েন্টি আর সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর আইএল টি টোয়েন্টি। শেষের দুটো আবার ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারে আইপিএলের ঠিক পরেই। দুটো লিগেই দল কিনেছেন চেন্নাই সুপার কিংস, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, কলকাতা নাইট রাইডার্স, দিল্লি ক্যাপিটালস, লখনৌ সুপার জায়ান্টস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, রাজস্থান রয়ালসের মত দলের মালিকরা। ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলো খেলোয়াড়দের যা পারিশ্রমিক দিচ্ছে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কোনো দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কম্ম নয়। ফলে ছাড়তে হলে একজন ক্রিকেটার জাতীয় দলের হয়ে খেলাই যে ছাড়বেন, ফ্র্যাঞ্চাইজের খেলা নয়, তা বলাই বাহুল্য। টেস্টের প্রতি স্টোকসের ভালবাসা আছে বলে একদিনের ক্রিকেট ছেড়েছেন, কেউ টেস্ট খেলাও ছাড়তে পারেন।

ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বোর্ড মিলে বিশ্ব ক্রিকেটকে যে ছাঁচে ঢেলেছে ২০১৪ সাল থেকে, তাতে অনেক ক্রিকেট বোর্ডেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ফলে ক্রিকেটারদের ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় নেই। এমনকি নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডও বাধ্য হয়েছে ফর্মের তুঙ্গে থাকা ট্রেন্ট বোল্টকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে অব্যাহতি দিতে। অর্থাৎ তিনি হয়ত টেস্ট ক্রিকেট আর খেলবেনই না, একদিনের ক্রিকেট কতটা খেলবেন তাতেও সন্দেহ আছে। আইপিএলের পারিশ্রমিকের সঙ্গে অবশ্য ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডও এঁটে উঠতে পারবে না অদূর ভবিষ্যতে। ইংল্যান্ডের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ কাগজের প্রতিবেদক টিম উইগমোর গত সপ্তাহেই লিখেছেন, আইপিএলের ক্রিকেটাররা যে পারিশ্রমিক পান তা আরও তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। কারণ এত বড় ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া লিগ পৃথিবীর অন্য যেসব খেলায় আছে, সেখানে দলগুলো মোট রাজস্বের অর্ধেক বা তারও বেশি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএ (বাস্কেটবল লিগ) এনএফএল (আমেরিকান ফুটবল লিগ) এবং এমএলএসে (বেসবল লিগ) অন্তত ৪৮% দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড ফুটবলের প্রিমিয়ার লিগ ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে রাজস্বের ৭১% খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের পিছনে ব্যয় করেছিল। সেখানে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো ব্যয় করে ১৮% বা তারও কম।

আরও পড়ুন বিশ্বকাপে কী হবে ভুলে যান, আইপিএল দেখুন

অতএব বুঝতেই পারছেন, শুধু পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট কেন, সারা বছর ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খেলে বেড়িয়ে ভবিষ্যতে টেস্ট ক্রিকেট খেলার উৎসাহও কজন ক্রিকেটারের থাকবে সন্দেহ। স্বভাবতই খেলার গুণমানের তফাত হবে, দর্শকদের আগ্রহেও ভাঁটা পড়বে। যেমন এই মুহূর্তে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে হচ্ছে। টেস্টের দর্শক ভারতেও কমে গেছে বেশ কিছুদিন হল। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে সপ্তাহান্তে কোহলির শতরান পূর্ণ করার দিনেও গ্যালারিতে মানুষের চেয়ে চেয়ার বেশি দেখা যাচ্ছিল। তবু কৌলীন্য আছে বলে কোহলি, স্টোকস, জো রুটের মত খেলোয়াড়রা এখনো ওই ক্রিকেটটা খেলতে চান। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের কিন্তু অবস্থা সঙ্গীন। বাঁচিয়ে রাখতে কী করা যায়? স্টোকস বলেছিলেন, সম্প্রতি রবি শাস্ত্রীও বলেছেন খেলাটাকে চল্লিশ ওভারে নামিয়ে আনার কথা। রোহিত বলেছেন নয়ের দশকের মত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট ফিরিয়ে আনা যায় কিনা ভেবে দেখা উচিত। কিন্তু খেলোয়াড়দের ম্যাচ খেলার সংখ্যা যদি না কমে, ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের পরিমাণ কমানোর দিকে যদি কর্তারা নজর না দেন, তাহলে চল্লিশ ওভারের ম্যাচ খেলতেই বা সেরা খেলোয়াড়দের কী করে পাওয়া যাবে?

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে। ওখানেই তো যত মধু। আইপিএলে দল বাড়িয়ে ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, কারণ মিডিয়া স্বত্ব বেচে পাওয়া টাকার পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০১৮-২২ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছিল ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকায়, আর ২০২৩-২৭ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৪৮,৩৯০ কোটি টাকায়। আইপিএল নামক এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসটির জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল নিজেদের সূচিতে প্রতি বছর আড়াই মাস খালি রেখেছে। কারণ আইপিএলে ম্যাচের সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। বাড়তে বাড়তে ২০২৭ সালে তা পৌঁছবে ৯৪-তে। সঙ্গে থাকবে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ। তারপর পঞ্চাশ (বা চল্লিশ ওভারের) খেলা খেলবেন কারা? সে বছর বিশ্বকাপেই বা কতজনকে ফিট অবস্থায় পাওয়া যাবে? তাই বলছিলাম, কোহলি যদি ২০৩১ অব্দি খেলেও ফেলেন, শতরানের সেঞ্চুরির জন্য সবচেয়ে লাগসই ফরম্যাটটার অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ।

এই সময় কাগজের অধুনালুপ্ত রাবিবারিক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত

বোর্ডের ঘরে যে ধন আছে, ক্রিকেটের ঘরে সে ধন আছে?

রাজা বাদশারা বিশেষ আনন্দের দিনে দাঁড়িপাল্লার এক দিকে বসতেন আর অন্যদিকে চাপানো হত সোনাদানা। হুজুরের ওজনের সমান সম্পদ গরীবগুরবোদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হত। সবকিছুকেই কতটা ধন পাওয়া যাবে তার সাপেক্ষে মাপার সেই কি শুরু? কে জানে! তবে আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন সাফল্য-ব্যর্থতা তো বটেই, উৎকর্ষ-অপকর্ষ, উচিত-অনুচিতও টাকা দিয়েই মাপা হয়। তাই খেলার খবরেও ঢুকে পড়ে টাকার হিসাব; খেলোয়াড়দের রান, উইকেট, ক্যাচের চেয়েও বড় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের নিলামে তাঁদের দর। স্বভাবতই ক্রিকেট দলের সাফল্য দিয়ে ক্রিকেট বোর্ডের সাফল্য মাপার দিনও শেষ, দলের ব্যর্থতায় বোর্ডের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার যুগও গত হয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের মতই ক্রিকেট বোর্ডও আমাদের নয়নের মণি, কারণ বোর্ড সফল। তাই আমরা প্রশ্ন তুলি না, বোর্ড সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি আর সচিব জয় শাহের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁরা কেন চেয়ার ছাড়ছেন না। কেন তুলব? বোর্ড তো সফল। বহু বছর হল ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী বোর্ডের নাম বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া। এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী আছে? যদি কোনোদিন দেখা যায় ভারতীয় বোর্ডের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, আয়ের দিক থেকে এক নম্বর জায়গাটা অন্য কোনো দেশের হাতে চলে গেছে, তখন কাঠগড়ায় তোলা হবে সৌরভ-জয়কে।

তা সম্প্রতি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আরও একটা বড়সড় সাফল্য পেয়েছে। এ যুগের বিচারে বিখ্যাত সৌরভ-শচীন জুটির সব সাফল্যের দাম এর চেয়ে কম। কারণ তাঁরা গোটা কয়েক ম্যাচ জিতিয়েছেন ভারতকে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ এবং টুর্নামেন্ট জিতিয়েছেন। সেসবের স্মারক মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বোর্ডের সদর দপ্তরে গেলে দেখা যায়। কিন্তু সৌরভ-জয় জুটি বোর্ডকে সদ্য এনে দিয়েছে ৪৮,৩৯০ কোটি টাকা। এ একেবারে নগদ লাভ। এ জিনিস কেবল ব্যাঙ্কে গেলে দেখা যায় তা নয়, এর উপস্থিতি প্রতি মুহূর্তে টের পাওয়া যায়। পাঁচ বছরের জন্য আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব বেচে এই রোজগার হয়েছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মহামতি জয় শাহ সংবাদসংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের পরের ফিউচার টুরস প্রোগ্রামে, অর্থাৎ কোন দেশ কবে কার বিরুদ্ধে কোথায় খেলবে তার যে বিস্তারিত সূচি তৈরি হয় তাতে, আলাদা করে আইপিএলের জন্য আলাদা করে আড়াই মাস সময় দেওয়া থাকবে। মানে সেইসময় পৃথিবীর কোথাও কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হবে না, যাতে সব দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররা শুধু আইপিএল খেলতে পারেন। লক্ষ করুন, এই ঘোষণা করে দিলেন বিসিসিআইয়ের সচিব, আইসিসির কোনো কর্মকর্তা নয়। জয় বলেছেন এ নিয়ে আইসিসি এবং বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা হয়ে গেছে। তা হতেই পারে। কিন্তু ফিউচার টুরস প্রোগ্রাম তো তৈরি করে আইসিসি। তাহলে কোন এক্তিয়ারে জয় এই ঘোষণা করতে পারেন? উত্তর ওই ৪৮,৩৯০ কোটি। এই মূল্যে সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি হওয়ায় ম্যাচ পিছু সম্প্রচার মূল্যের বিচারে আইপিএল সারা বিশ্বে জনপ্রিয় ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের চেয়েও এগিয়ে গেল।

স্রেফ অর্থের জোরে যেমন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ, আইসিসি তেমন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অনুগত। বিশ্ব রাজনীতিতে তবু অবাধ্য চীন আছে, দুর্বিনীত রাশিয়া আছে। ফলে নিজের স্বার্থরক্ষায় যা খুশি করতে পারলেও পৃথিবীর সর্বত্র সর্বদা আমেরিকার কথাই শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু ক্রিকেট দুনিয়ায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিস্পর্ধী কোনো শক্তি নেই। যে কটা দেশ দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট খেলে, যাদের দেশে ক্রিকেটের উল্লেখযোগ্য বাজার আছে, তাদের মধ্যে ভারত সবচেয়ে জনবহুল এবং ক্রিকেটের জন্য পাগল দেশ। ফলে এখানকার বাজার সবচেয়ে বড়। বিশ্বায়নের আগে, ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণের আগের যুগে যে বোর্ডগুলো ক্রিকেটের উপর ছড়ি ঘোরাত, সেই ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার একাধিপত্যের জবাব দিচ্ছে বিসিসিআই – এমন একটা কথা ভেবে অনেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক আনন্দ পান। বিসিসিআইয়ের যে কোনো অন্যায়কে এই যুক্তিতে ভারতের ক্রিকেটবোদ্ধারা বৈধ বলে ঘোষণা করে থাকেন বলেই সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীর মনে অমন ধারণা তৈরি হয়। কিন্তু ঘটনা হল, বিসিসিআই মোটেই কোনো বৈপ্লবিক কায়দায় আইসিসির উপর আধিপত্য কায়েম করেনি। ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) আর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) সাথে সমঝোতা করেই এই ছড়ি ঘোরানো চলছে।

২০১৪ সালে এন শ্রীনিবাসন আইসিসি চেয়ারম্যান থাকার সময়ে রীতিমত আইন করে তৈরি হয় আইসিসির নতুন রাজস্ব বন্টন পদ্ধতি, যাকে সাধারণত ‘বিগ থ্রি মডেল’ বলা হয়ে থাকে। এই মডেল অনুযায়ী ২০১৫-২০২৩ সালে আইসিসির আয় থেকে ৪৪০ মিলিয়ন ডলার পেতে পারত বিসিসিআই, প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার পেত ইসিবি আর প্রায় ১৩২ মিলিয়ন ডলার পেত সিএ। যা পড়ে থাকত তা বাকিদের মধ্যে নানা পরিমাণে ভাগ হত। কিন্তু পরে শ্রীনিবাসনের স্থলাভিষিক্ত হন আরেক ভারতীয় – শশাঙ্ক মনোহর। তিনি নিজে ভারতীয় হয়েও তেলা মাথায় তেল দেওয়া বিগ থ্রি মডেলের বিরোধিতা করেন এবং শেষপর্যন্ত ২০১৭ সালে বিগ থ্রি মডেল বাতিল করে ১৪-১ ভোটে পাস হয় নতুন মডেল। সেখানে আইসিসির রাজস্ব থেকে ভারতীয় বোর্ডের প্রাপ্য হয় ২৯৩ মিলিয়ন ডলার, ইংল্যান্ডের বোর্ডের ১৪৩ মিলিয়ন ডলার, বাকি সাত (অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ) পূর্ণ সদস্য বোর্ডের ১৩২ মিলিয়ন ডলার করে আর জিম্বাবোয়ের প্রাপ্য হয় ৯৪ মিলিয়ন ডলার। বিসিসিআই এই নতুন ব্যবস্থায় যারপরনাই রুষ্ট হয়; ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডও খুশি হয়নি। বিগ থ্রি মডেলের পক্ষে তাদের সোজাসাপ্টা যুক্তি – আমরা সবচেয়ে বেশি টাকা এনে দিই, অতএব আমরাই সবচেয়ে বেশি টাকা নেব। এমন নির্ভেজাল বৈষম্যবাদী যুক্তি প্রকাশ্যে বলতে জেফ বেজোস বা ইলন মাস্কের মত ধনকুবেরও লজ্জা পেতেন। মনে করুন, কোনো পরিবারে দশ ভাই। যে তিন ভাই সবচেয়ে বেশি রোজগার করে, তারা যদি খেতে বসে বলে খাবারের বেশিরভাগ অংশ তাদের দিয়ে দিতে হবে – তাহলে যেমন হয় আর কি। ব্যাপারটা যে শুধু দৃষ্টিকটু তা নয়। এই ব্যবস্থা চলতে দিলে যা হবে, তা হল ওই তিন ভাই ক্রমশ মোটা হবে আর বাকিরা অপুষ্টিতে ভুগবে, হয়ত শুকিয়ে মরবে।

পুঁজিবাদ এমনিতে তেলা মাথায় তেল দেওয়ারই ব্যবস্থা; মানুষের সাধ্যমত অবদান গ্রহণ করে তার প্রয়োজন মত ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নয়। কিন্তু পুঁজিবাদকেও বাঁচতে হলে খেয়াল রাখতে হয়, যেন শোষণ করার উপযুক্ত শোষিত থাকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন ও লুইগি জিঙ্গেলসের একটা বইয়ের নামই হল সেভিং ক্যাপিটালিজম ফ্রম দ্য ক্যাপিটালিস্টস ক্রিকেটের বাজার তো এমনিতেই ছোট, কারণ নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ডজনখানেক দেশ। মনোপলি কায়েম করতে গিয়ে ছোট ছোট দেশগুলোকে শুকিয়ে মারলে যে ব্যবসার ভাল হবে না – তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু একে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির যুগ, তার উপর বিসিসিআই হল সর্বশক্তিমান। তাই গোঁসাঘরে মিলিত হয়ে তিন ক্রিকেট বোর্ড নতুন ফিকির বার করল। আইসিসি তো বন্টন করে আইসিসি আয়োজিত প্রতিযোগিতাগুলোর রাজস্ব, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বেশিটাই তো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। সেই সিরিজের আয় পুরোটাই ভাগ হয় দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের মধ্যে। তাই এই তিন দেশ নিজেদের মধ্যে ঘুরে ফিরে বেশি খেলা আরম্ভ করল। আইসিসির ফিউচার টুরস প্রোগ্রামকে ফেলে দেওয়া যায় না। কারণ প্রথমত, তা করলে আইসিসি ভেঙে বেরিয়ে আসতে হয়। ব্যবসার মুনাফা বাড়ানো উদ্দেশ্য, বিদ্রোহ করা তো নয়। দ্বিতীয়ত, ২০১৯ থেকে চালু হয়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। সবার সাথে সবাইকে খেলতে হবে (যদিও রাজনৈতিক কারণে ভারত-পাকিস্তান সিরিজ হয় না), পয়েন্টের প্রশ্ন আছে। তাই ত্রিদেব করলেন কী, নিজেদের মধ্যে চার-পাঁচ টেস্টের সিরিজ খেলা শুরু করলেন। ওদিকে নিউজিল্যান্ডের মত ভাল দলের সঙ্গে ভারত দুটো টেস্টের বেশি খেলে না। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে কটা ম্যাচ খেলা হবে; একই সফরে একদিনের ম্যাচ, টি টোয়েন্টি খেলা হবে কিনা তা নিয়ে দরাদরি চলে। ওই যে বলেছি, খেলার উৎকর্ষ বিচার্য নয়। বিচার্য হল কোন সিরিজ বেচে বেশি টাকা আসবে। এই কারণেই অস্ট্রেলিয়ায় করোনা পরিস্থিতি যখন বেশ খারাপ, তখনো ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফর দিব্যি চালু ছিল। অথচ করোনার কারণেই অস্ট্রেলিয়া ২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে তিন টেস্টের সিরিজ বাতিল করে দিয়েছিল।

বিসিসিআই আইসিসিকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে ফেলতে পেরেছে এবং ইসিবি আর সিএকে লেজুড় বানিয়ে ফেলতে পেরেছে। এর একমাত্র কারণ টাকা। আর সেই টাকার সবচেয়ে বড় উৎস হল আইপিএল। এই প্রতিযোগিতা কতটা এগিয়ে দেয় বিসিসিআইকে? উদাহরণ হিসাবে এই ৪৮,৩৯০ কোটি টাকাকেই ব্যবহার করা যাক। আগেই বলেছি, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে পাস হওয়া আইসিসির নতুন রাজস্ব বন্টন মডেল অনুযায়ী আট বছরের জন্য বিসিসিআইয়ের প্রাপ্য ২৯৩ মিলিয়ন ডলার। মানে আজকের বিনিময় মূল্যে প্রায় ২,২৯৫ কোটি টাকা। যখন এই সিদ্ধান্ত হয় তখন ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম আরও বেশি ছিল, ফলে বিসিসিআইয়ের প্রাপ্য ছিল আরও কম। এই টাকা পাওয়া যায় কিস্তিতে। আগামী দিনে শেষ কিস্তি পাওয়ার সময়ে টাকার দাম পড়তে থাকলে হয়ত আরেকটু বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত যা-ই পাওয়া যাক, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শুধু আইপিএলের পাঁচ বছরের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করেই বিসিসিআই তার ২৩-২৪ গুণ বেশি টাকা আয় করতে পারে। এর আগের বছরগুলোর (২০১৫-২২) স্বত্ব বিক্রি করে বোর্ড পেয়েছিল ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকা। আইসিসির দেয় টাকা তো তার কাছেও নস্যি। সুতরাং বিসিসিআইয়ের যদি আর কোনো আয়ের উৎস না-ও থাকে, কেবল আইপিএলই ক্রিকেট জগতে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট।

এই আধিপত্য খাটিয়ে যা যা করা হচ্ছে তা নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নানারকম আপত্তি উঠছে, দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা হচ্ছে। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া আজব দেশ। সেখানকার প্রাক্তন ক্রিকেটাররা, বড় বড় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা নিজেদের ক্রিকেট বোর্ডের দোষ ধরেন। ফলে বিসিসিআইয়ের সাথে হাত মিলিয়ে তারা বিলক্ষণ লাভ করছে জেনেও তাঁরা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলেন। অস্ট্রেলিয়ার ‘দি এজ’ পত্রিকার ক্রিকেট লিখিয়ে ড্যানিয়েল ব্রেটিগ যেমন লিখেছেন, আইপিএলের আয় আকাশ ছোঁয়ার ফলে টেস্ট ক্রিকেট ক্রমশ মাইনর লিগে পরিণত হতে পারে। তাঁর আশঙ্কা যে অমূলক নয় তার ইঙ্গিত জয়ের সাক্ষাৎকারে রয়েছে।

এমনিতেই আইসিসির উপর প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম মরসুমে (২০১৯-২১) এক অত্যাশ্চর্য পয়েন্ট সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। সব ম্যাচের পয়েন্ট মূল্য সমান ছিল না, কিন্তু সব সিরিজের পয়েন্ট মূল্য সমান ছিল। কারণটা সহজবোধ্য – ত্রিদেব তো নিজেদের মধ্যে যতগুলো টেস্ট খেলবেন, অন্যদের সাথে ততগুলো খেলবেন না। ফলে পাঁচ টেস্টের অ্যাশেজ সিরিজেও সব ম্যাচ জিতলে পাওয়া যাচ্ছিল ১২০ (২৪x৫) পয়েন্ট, আবার ভারত-নিউজিল্যান্ডের দুই টেস্টের সিরিজেও সব ম্যাচ জিতলে সেই ১২০ (৬০x২)। এত বায়নাক্কা বজায় রেখেও অবশ্য খেতাবটা জিততে পারেনি তিন প্রধানের কেউ। বর্তমান মরসুমে এই বায়না আর মানা হয়নি, কিন্তু জয়ের বয়ান অনুযায়ী, আগামী দিনে বছরে আড়াই মাস আইপিএলকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়েছে। এদিকে পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এখন ফ্যাঞ্চাইজ লিগ চালু হয়েছে। ইংল্যান্ডে চালু হয়েছে ১০০ বলের খেলার ফ্যাঞ্চাইজ লিগ – দ্য হান্ড্রেড। সেগুলো অত টাকার খনি নয় বলে আইসিসির আনুকূল্য পাবে না, কিন্তু উপার্জনের প্রয়োজনে বেশকিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার সেগুলোতেও খেলেন এবং খেলবেন। নয় নয় করে সারা বিশ্বে কেবল ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগই খেলে বেড়ানো ক্রিকেটারের সংখ্যা এখন কম নয়। তাঁদের দর ক্রমশ বাড়ছে, ফলে আরও বেশি সংখ্যক ক্রিকেটার যে আগামী দিনে ওই পথ বেছে নেবেন তাতে সন্দেহ নেই, শীর্ষস্থানীয়রা তো থাকবেনই। তাহলে জাতীয় দলের হয়ে ক্রিকেট খেলবেন কোন ক্রিকেটাররা এবং কখন?

এদিকে বিসিসিআই ছাড়া অন্য বোর্ডগুলোর পক্ষে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক সেভাবে বাড়ানো কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। ব্রেটিগ লিখেছেন, আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব থেকে আয় করা অর্থের ২৫ শতাংশও যদি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোর স্যালারি ক্যাপ বাড়াতে ব্যবহার করা হয়, তাহলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়ে দাঁড়াবে “ফাইন্যানশিয়াল আফটারথট”। অর্থাৎ “ওটা সময় পেলে খেলা যাবে এখন”। কারণ আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব যখন ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিল, তখন তার ১৪ শতাংশ ছিল স্যালারি ক্যাপ। আগামী নিলামে সেই অনুপাত বজায় রাখলেই স্যালারি ক্যাপ হয়ে যাবে এখনকার তিন গুণ। তখন কেমন পারিশ্রমিক হবে শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারদের? ব্রেটিগ প্যাট কামিন্সের উদাহরণ দিয়েছেন। কামিন্স এখন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার থেকে পান মরসুম পিছু ২ মিলিয়ন ডলার, যা আইপিএলে খেলার জন্য সর্বোচ্চ যা পাওয়া যায় তার তুল্য। নতুন সম্প্রচার স্বত্বের পরিমাণ অনুসারে পারিশ্রমিক বাড়লে আইপিএলের সবচেয়ে দামি ক্রিকেটারের পারিশ্রমিক কিন্তু ১০ মিলিয়ন ডলারেও পৌঁছে যেতে পারে।

এখানেই শেষ নয়। যে প্রিমিয়ার লিগকে আইপিএল ছাপিয়ে গেছে বলে এত হইচই, সেই লিগের সম্প্রচার স্বত্বের অর্ধেকেরও বেশি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া হয়। আইপিএল যদি সেই মডেল অনুসরণ করে তাহলে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক কত হবে ভাবুন। তখন পাঁচদিনের ক্রিকেট খেলার উৎসাহ কজনের থাকবে? অন্য ফর্ম্যাটেই বা দেশের জার্সি গায়ে খেলার কতটুকু গুরুত্ব থাকবে? স্রেফ আইপিএল ফ্যাঞ্চাইজগুলোর চোখে পড়ার মঞ্চ হয়ে উঠবে কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ময়দান?

কেউ বলতেই পারেন, তেমন হলে ক্ষতিটা কোথায়? আন্তর্জাতিক ফুটবল তো কবে থেকেই ওভাবে চলছে। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, আফ্রিকান নেশনস কাপ থেকে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো ফুটবলার পছন্দ করে। তারপর তারা ইউরোপের লিগগুলোতে খেলতে এসে আকাশছোঁয়া পারিশ্রমিক পান। দেশের হয়ে খেলার জন্যে তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না – এমন অভিযোগে মাঝেমধ্যে বিবাদ বিসম্বাদও হয়। তাই সেসবের জন্য বিশ্ব নিয়ামক সংস্থা ফিফাকে আলাদা নিয়মও তৈরি করতে হয়েছে। না হয় আইসিসিও তেমন কিছু করবে। ক্রিকেটারদের রোজগার বাড়লে ক্ষতি কী? ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের রোজগার বাড়লে, প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়লেই বা অসুবিধা কোথায়?

ঠিক কথা। খেলা তো আসলে ব্যবসা। যে ফর্ম্যাট বেশি বিক্রি হবে সে ফর্ম্যাটই টিকে থাকবে। ফলে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য চোখের জল ফেলে লাভ নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বদলে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটই আসল খেলা হয়ে দাঁড়ালেও কালের গতি হিসাবেই মেনে নিতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল, ইউরোপের ফুটবল মাঠে খেলা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আর ভারতের ক্রিকেট মাঠে খেলা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় এখনো আকাশ-পাতাল তফাত। বিশ্বের ধনী ফুটবল ক্লাবগুলো অর্জিত অর্থের বেশ খানিকটা ব্যয় করে দর্শক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে। অথচ ভারতের বহু ক্রিকেট মাঠে সাধারণ দর্শকদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে পূতিগন্ধময় বাথরুম। কোথাও তিনতলায় খেলা দেখতে বসলে পানীয় জলের জন্য নামতে হয় একতলায়।

ইউরোপে নিয়মানুযায়ী ক্লাবগুলোর নিজস্ব অ্যাকাডেমি থাকে, সেখানে শিশু বয়স থেকে ফুটবলার তৈরি করা হয়। আইপিএলে ওসব তো নেই বটেই, শুরু হওয়ার সময়ে ‘ক্যাচমেন্ট এরিয়া’-র ক্রিকেটের উন্নতিকল্পে ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো কীসব করবে শোনা গিয়েছিল। এখন ক্যাচমেন্ট এরিয়া ব্যাপারটারই আর নামগন্ধ নেই। কলকাতা নাইট রাইডার্সে বাংলার ক্রিকেটার দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়, গুজরাট টাইটান্সে খুঁজতে হয় গুজরাটের খেলোয়াড়। উপরন্তু ফুটবলে উন্নত দেশে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামগুলোর মালিক ক্লাবগুলোই। সেই পরিকাঠামো আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্য ব্যবহৃত হয়। ক্রিকেটে কিন্তু ব্যাপারটা উল্টো। দেশের ক্রিকেট বোর্ডের অর্থে তৈরি পরিকাঠামোই ব্যবহার করছে ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো। মানে খেলাটার থেকে তারা নিচ্ছে সবকিছু, কী ফিরিয়ে দিচ্ছে তার হদিশ নেই।

আর বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী ক্রিকেট বোর্ডের কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। আইপিএলের বিন্দুমাত্র সমালোচনা করলেই বিসিসিআই ও তার অনুগত প্রাক্তন ক্রিকেটার, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিকরা বলতে শুরু করেন ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি হয়েছে আইপিএল থেকে আসা অর্থের জন্যই। ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক, প্রাক্তনদের পেনশন বেড়েছে সে কথা সত্যি। কিন্তু সেগুলো তো যে কোনো পেশাতেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাড়ার কথা। গত দুই দশকে দেশে যে হারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, সে অনুপাতে কিন্তু ওই টাকার অঙ্কগুলো বাড়েনি। আর ওটুকুই তো একটা খেলার উন্নতির সব নয়। বাকি চেহারাটা কেমন?

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

কোভিড পর্বে বোর্ড প্রবল উৎসাহে আইপিএল আয়োজন করেছে (প্রয়োজন পড়লে বিদেশে), জাতীয় দলের বিদেশ সফরের ব্যবস্থা করেছে। অথচ রঞ্জি ট্রফি খেলা ক্রিকেটারদের টাকা দেওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল। আম্পায়ার, স্কোরার, মাঠ পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরাও বিস্মৃত হয়েছিলেন। মুম্বাই আর মধ্যপ্রদেশের মধ্যে এবারের রঞ্জি ট্রফি ফাইনালে ডিসিশন রিভিউ সিস্টেমের ব্যবস্থা নেই, কারণ খরচে কুলোবে না। উত্তরাখণ্ডের রঞ্জি দলের ক্রিকেটারদের দুর্দশার কথা জানলে অবশ্য মনে হবে এসব কিছুই নয়। এ মাসের গোড়ায় সাংবাদিক জেমি অল্টারের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ওই ক্রিকেটাররা এক বছর ধরে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন দিনে মাত্র ১০০ টাকা। সে টাকাও মাসের পর মাস বকেয়া থাকে। অধিনায়ক জয় বিস্তা বিসিসিআইকে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ মরসুমের বকেয়ার ব্যাপারে চিঠি লিখে কোনো জবাব পাননি।

মেয়েদের ক্রিকেট বিসিসিআই কীভাবে চালাচ্ছে তা নিয়ে লিখতে বসলে আরও হাজার দুয়েক শব্দ লিখতে হবে। এটুকু বলা যাক, যে চলতি ভারত-শ্রীলঙ্কা সিরিজ ভারতে বসে টিভিতে সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। বহু টালবাহানার পর আগামী বছর অবশ্য মেয়েদের আইপিএল শুরু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ বিসিসিআই নিঃসন্দেহে একটি সফল কোম্পানি, কিন্তু সে সাফল্যে ক্রিকেটের কী লাভ হচ্ছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একসময় সারা পৃথিবীতে অর্থনীতির আলোচনায় ‘ট্রিকল ডাউন’ কথাটা বেশ জনপ্রিয় ছিল। বলা হত সচ্ছলতা চুঁইয়ে পড়বে নীচের দিকে, তাতেই নীচের তলার মানুষের হাল ফিরবে। বাস্তবে তা কতটা ঘটে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা তর্ক করবেন, কিন্তু অন্তত ভারতীয় ক্রিকেটে বিসিসিআইয়ের সচ্ছলতা চুঁইয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে না। টেস্ট ক্রিকেটের জন্য চোখের জল না হয় না-ই ফেললাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চুলোয় যাওয়াও না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু বিসিসিআইয়ের সমান ওজনের সমৃদ্ধি যে দেশীয় ক্রিকেটে দেখা যাচ্ছে না।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

ভারতীয় ক্রিকেট মানে ফলাফল নিরপেক্ষ ব্যবসা

জয় যা প্রকাশ করে তার চেয়ে বেশি লুকিয়ে ফেলে, পরাজয় যা ধামাচাপা রয়েছে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ভারতের সত্বর বিদায়ে মুহ্যমান ক্রিকেটপ্রেমীরা এভাবে ভেবে দেখতে পারেন। বিশ্বের সেরা টি টুয়েন্টি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বলে যে দেশ দাবি করে থাকে, ২০০৭ সালের পর থেকে তাদের একবারও চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা এবং ২০১৪ সালের পর আর ফাইনালের মুখ না দেখার পিছনে গভীরতর অসুখ খুঁজে দেখার এই তো সুযোগ। কোভিড যুগের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলগুলোর মত বুদ্বুদের মধ্যে বাঁচার ইচ্ছা প্রবল না হলে এ-ও ভেবে দেখা দরকার, সমস্যা কি কেবল দল নির্বাচন আর রণকৌশলে, নাকি গোটা ক্রিকেট কাঠামোটাই একদা জনপ্রিয় টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে দেখানো অসুস্থ মাড়ির মত “ভাল দেখায় বাইরে, পচে গেছে ভিতরে?”

এসব হিং টিং ছট প্রশ্ন যদি মাথার মধ্যে কামড়াতে শুরু করে, তাহলে বিশেষত বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমী বিপদে পড়বেন। কারণ সৎভাবে এগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই উঠে আসবে এক বঙ্গসন্তানের অনাচারের কথা। দেড়-দুশো বছর আগে মাইকেল মধুসূদন লিখেছিলেন “হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে বিবিধ রতন”। সেসব দিন চলে গেছে, এখন ভাঁড়ে মা ভবানী। সৌরভ গাঙ্গুলিই যে আমাদের সর্বশেষ রত্ন, তা কলকাতার কাগজ ও টিভি চ্যানেলের চিৎকৃত প্রচারে গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই আমরা মেনে নিয়েছি। তিনি শতরান করলে বাঙালি আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ, বাদ পড়লে কেন্দ্রের বঞ্চনা। স্টিভ ওয়কে ইডেন টেস্টে টসের জন্য অপেক্ষা করিয়ে রাখা আমাদের কাছে বিদ্যাসাগরের সাহেবের টেবিলে খড়ম পরিহিত পা তুলে বসার চেয়ে কম নয়। সে যুগে আমরা আরেকটু হলেই লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা খুলে মাথার উপর বনবন করে ঘোরানোর কীর্তিকে শিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতার পাশে বসিয়ে দিতাম। এহেন তেজস্বী বাঙালি আইকন কিনা ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি হওয়ার জন্য সমর্থন নিলেন এন শ্রীনিবাসনের। কে শ্রীনিবাসন? যাঁর অনাচার ভারতীয় ক্রিকেটে চূড়ান্ত অচলাবস্থার সূচনা করে। এমন অচলাবস্থা, যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বোর্ডের সংবিধানই নতুন করে লিখতে হয়েছিল। বোর্ডের দায়িত্ব দীর্ঘদিন ন্যস্ত ছিল সর্বোচ্চ আদালত নিযুক্ত অ্যাড-হক কমিটির হাতে। সেই অ্যাড-হক কমিটির প্রধান বিনোদ রাই, সব জেনেও, সৌরভের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে বিদায় নেওয়ার সময়ে বলেছিলেন, সৌরভের চেয়ে যোগ্যতর কোনো ব্যক্তি নেই এই পদের জন্য।

যোগ্যতম হলেও, নতুন সংবিধান অনুযায়ী এই ২০২১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সৌরভের বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদে থাকারই কথা নয়। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ওই চেয়ারে বসার আগেই ক্রিকেটে অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের কর্তা হিসাবে তিনি দু দফায় পাঁচ বছরের বেশি কাটিয়ে ফেলেছিলেন। তাই বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর মেয়াদ ছিল ন মাস। ছ বছর পদাধিকারী থাকার পর তিন বছরের কুলিং অফ পিরিয়ড, যখন সৌরভ কেবল বোর্ড নয়, বোর্ডের অধীন কোনো রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার পদাধিকারীও থাকতে পারেন না। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের মত সৌরভও বোধহয় মনে করেন দেশোদ্ধারের পথে আইনকে বাধা হতে দেওয়া চলে না। তাই তাঁর নেতৃত্বাধীন বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে সংশোধিত সংবিধান পুনরায় সংশোধনের আর্জি জানিয়ে বসল। অতঃপর “তারিখ পে তারিখ”।

তা-ও না হয় মানা গেল, কিন্তু যোগ্যতমের আমলে কেমন উদ্বর্তন হল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের? যে ঘরোয়া ক্রিকেটের শক্তিবৃদ্ধির জন্যই শাস্ত্রী-কোহলির দল গত কয়েক বছরে বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করতে পেরেছে বলে শোনা যায়, সেই ঘরোয়া ক্রিকেটারদের অতিমারীর আমলে হাঁড়ির হাল। ২০২০ সালের মে-জুন নাগাদ প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনেকেরই বোর্ডের কাছে এক নয়, দুই নয়, তিন বছরের টাকা পাওনা। আম্পায়ার, স্কোরার, কিউরেটার প্রমুখ খেলা চালানোর জন্য অপরিহার্য ব্যক্তিদেরও একই অবস্থা। সবে এ বছর সেপ্টেম্বরে বোর্ড বর্ধিত ফি এবং ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের প্রধানতম প্রতিযোগিতা রঞ্জি ট্রফি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও বন্ধ থাকেনি, আদৌ খেলা হয়নি ২০২০-২১ মরসুমে। বোর্ডের বক্তব্য ছিল, দু মাসের বায়ো বাবল তৈরি করে সংক্ষিপ্ত রঞ্জি ট্রফি আয়োজনও অসম্ভব। তার চেয়ে সাদা বলের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা ভাল। প্রেসিডেন্ট সৌরভ আর তাঁর যোগ্য সহকারী জয় শাহ কিন্তু ইতিমধ্যে আপ্রাণ চেষ্টায় আইপিএল সম্পূর্ণ করেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের সাথে যুক্ত কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ভাষ্যকার — সকলেই আইপিএলকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন। কারণ ওতেই নাকি বোর্ডের সংসার চলে, ওটি না বাঁচলে ঘরোয়া ক্রিকেট বাঁচবে না। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আইপিএল ফুলে ফেঁপে উঠছে, ঘরোয়া ক্রিকেটকে সতীনের সন্তানের মত দয়ার দানে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড অধুনা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বোর্ড; ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে বলে ইদানীং এক ধরনের জাতীয়তাবাদী গর্বও প্রচারিত হয়। কিন্তু সে গর্বে মহিলাদের কোনো ভাগ নেই। কন্যাসন্তানের পিতা সৌরভের আমলে অস্ট্রেলিয়ার মহিলাদের বিগ ব্যাশের আদলে মহিলাদের আইপিএল কিন্তু চালু হল না। অথচ ভারতের মহিলারা গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ায় টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিলেন। তবু, যে আইপিএল নাকি সর্বরোগহর বড়ি, মহিলাদের জন্য তার ব্যবস্থা করার সুযোগ হয় না পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বোর্ডের।

সব মিলিয়ে বলা চলে, গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া চলছে। আইনকানুনকে কাঁচকলা দেখানো বাহাদুরিতে পরিণত, কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বদ রসিকতায়। বোর্ড প্রেসিডেন্ট স্বয়ং এমন এক বাণিজ্যিক সংস্থার বিজ্ঞাপনে মুখ দেখান, যারা জাতীয় দলের শার্ট স্পনসরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আবার প্রেসিডেন্ট যুক্ত, এমন সংস্থা আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজ কিনে ফেলে। স্পষ্টতই সৌরভ শ্রীনিবাসনের পথেই হাঁটছেন। ইন্ডিয়া সিমেন্টসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ওই মালিক একইসঙ্গে বোর্ড প্রেসিডেন্ট এবং চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক ছিলেন। দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকে ইন্ডিয়া সিমেন্টসের ভাইস-প্রেসিডেন্টও করেছিলেন। সৌরভ সে তুলনায় আর এমন কী করেছেন?

আরও পড়ুন বোর্ডের ঘরে যে ধন আছে, ক্রিকেটের ঘরে সে ধন আছে?

নিয়ম ভাঙা ক্ষমতা প্রদর্শনের উপায় হয়ে দাঁড়ালে ভাল কাজও বাঁকা পথে করতে ভাল লাগে। ঠিক সেভাবেই ভারতীয় দলের কোচ হিসাবে নিয়োগ করা হল রাহুল দ্রাবিড়কে। আইনে যেমন বলা আছে সেভাবে ক্রিকেট অ্যাডভাইসরি কমিটি (সদস্য মদনলাল, রুদ্রপ্রতাপ সিং ও সুলক্ষণা নায়েক) বসিয়ে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে কোচ নির্বাচন করলেও দ্রাবিড় যোগ্যতম প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হতেই পারতেন। কিন্তু তাতে গুণময় বাগচীর মত পেশি ফোলানো যায় না। তাই প্রথমে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হল, দ্রাবিড় কোচ হতে পারেন। ফলত আর কেউ প্রার্থী হলেন না। অতঃপর ঘোষণা করা হল, আর কোনো প্রার্থী নেই, অতএব দ্রাবিড়ই কোচ হলেন। জনপ্রিয় প্রার্থীকে রিগিং করে জিতিয়ে দিলে তাঁর যোগ্যতাকে কতটা সম্মান দেওয়া হয় তা অশোক ভট্টাচার্যের একদা ঘনিষ্ঠ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদধন্য এবং অমিত শাহের পুত্রবন্ধু সৌরভ জানেন আশা করা যায়।

অবশ্য এত কথা তাঁর না ভাবলেও চলবে। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে জাতীয় দলের ব্যর্থতাতেও কিছু এসে যায় না। কদিন পরেই আইপিএলের খেলোয়াড় নিলাম হবে। আপামর ক্রিকেটভক্ত, সাংবাদিক, বিশ্লেষক টাকার অঙ্ক নিয়ে আলোচনা করবেন। তারপর আসবে বসন্ত — আইপিএলের আরও একটি মরসুম। দখিনা হাওয়ায় ভেসে যাবে আরও একটি আইসিসি টুর্নামেন্ট থেকে শূন্য হাতে ফেরার দুঃখ। ক্রিকেট খেলার ফলাফল নিরপেক্ষ ব্যবসায় পরিণত হতে আর বেশি দেরি নেই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ভারত-পাক না হলে যাদের লাভ, হলে তাদের বেশি লাভ

তবে কি রাজনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসায়িক লাভ করার রাস্তা তৈরি করা হয় ভারত-পাক ম্যাচে? মোটেই না।

১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধে যখন সীমান্তে আমাদের জওয়ানরা লড়ছিল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

সুনীল গাভস্করকে যদি কেউ এই প্রশ্নটা করে বসে, তাহলে ভদ্রলোকের দেশপ্রেম বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রমাণ করা মুশকিল হবে। কারণ তিনি তখন অস্ট্রেলিয়ায় অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেই দলে গাভস্কর, বিষাণ সিং বেদি আর ফারোখ ইঞ্জিনিয়ার যেমন ছিলেন, তেমনি পাকিস্তানের ইন্তিখাব আলম, আসিফ মাসুদ, জাহির আব্বাসরাও ছিলেন। এমনকি যুদ্ধ নিয়ে সেই দলে রসিকতাও হত। যেমন সহখেলোয়াড় রিচার্ড হাটন (ইংল্যান্ড) বলেছিলেন যুদ্ধ করতে করতে ফারোখ যদি ইন্তিখাবের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেন, তাহলেও ইন্তিখাব মরবেন না। ওঁর পেটে চর্বি এতই বেশি, যে বেয়নেট ওখানেই আটকে যাবে। এসব কথা গাভস্কর ‘সানি ডেজ’ নামে তাঁর বইতে সকৌতুকে লিখেছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি বহু স্মরণীয় ইনিংস খেলেছেন, এমনকি শেষ টেস্ট ইনিংসেও অসম্ভব কঠিন পিচে প্রায় শতরান করে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ ব্যাটসম্যান গাভস্কর পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের যারপরনাই জ্বালাতন করেছেন। তবু, সত্যিকারের যুদ্ধ চলাকালীনও পাক ক্রিকেটারদের সাথে কী ধরনের বন্ধুত্ব বজায় ছিল তা এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়। আরও বোঝা যায়, ভারত বা পাকিস্তানের সরকারও এই ক্রিকেটারদের একসাথে খেলা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাঁদের কাজ তখন যুদ্ধ পরিচালনা করা। তা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ক্রিকেটারদের কাজ ক্রিকেট খেলা, তাঁরাও সেটাই করছিলেন। যে দেশের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে সে দেশের ক্রিকেটারদের সাথে খেললে মহাভারত অশুদ্ধ হবে — এমন ভাবার ফুরসত ছিল না কারোর।

কিন্তু যুগ বদলেছে। ১৯৯৯ সালের পর থেকে ভারত-পাক যুদ্ধ আর হয়নি (প্রক্সি ওয়ার ১৯৪৭ থেকে কখনো থেমেছে কিনা সন্দেহ)। তবু পাকিস্তানের সাথে ক্রিকেটীয় সম্পর্ক রাখলে সীমান্তের জওয়ানদের অসম্মান করা হবে — এমন বলা হয়। পাকিস্তানের ছায়া মাড়ানোও বারণ। তাই আইপিএলে পর্যন্ত পাকিস্তানের ক্রিকেটার বা কোচ নেই বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। দু দেশের মধ্যে শেষবার সাদা বলের সিরিজ খেলা হয়েছিল ২০১২-১৩ মরসুমে আর শেষ টেস্ট সিরিজ ২০০৭ সালে। যখন কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে, তখন কিন্তু জওয়ানদের অসম্মান করা হল বলে ভারত সরকার মনে করেন না। ফলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বা বিশ্বকাপে ম্যাচটা হয়। এই ম্যাচে আইসিসির লক্ষ্মীর ভান্ডার উপচে পড়ে। পৃথিবীর যেখানেই খেলা হোক, অনাবাসী ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা মাঠ ভরিয়ে দেন। সরাসরি টিভি সম্প্রচারের সেদিন মোচ্ছব। যে প্রবল দেশপ্রেমিকরা এমনিতে দু দেশের মধ্যে খেলাধুলোর তীব্র বিরোধী, তাঁরা কেউ ম্যাচটা বয়কট করার ডাক দেন না। টুইটারে টিভি বন্ধ রাখার কোনো হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেনও চলে না।

আসলে সবার উপরে ব্যবসা সত্য, তাহার উপরে নাই। খেলা না হলে রাজনৈতিক লাভ, কিন্তু নিয়মিত খেলা হয় না বলেই আইসিসি টুর্নামেন্টে খেলা হলে ব্যবসায়িক লাভ দ্বিগুণ। আর সে লাভে হস্তক্ষেপ করলে মহাশক্তিধর নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহও অসুবিধায় পড়বেন। তাই রাত পোহালে ওয়ার্ল্ড টি২০-তে যে ভারত-পাক ম্যাচ, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হানার প্রতিবাদে সেই ম্যাচে খেলা উচিত নয় — এমন বিবৃতি দেন গিরিরাজ সিংয়ের মত কম গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতারা। অনুরাগ ঠাকুর বা অমিত শাহ নন। অমিতবাবুর সুপুত্র নিজেই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের হর্তাকর্তা, চাইলেই তো ম্যাচ বয়কট করাতে পারতেন। বিরাট কোহলিদের মাত্র কয়েকটা পয়েন্টের লোকসান হত। কিন্তু পিতা পুত্রকে অমন করতে বলবেন না, কারণ আসল লোকসান হত কয়েকশো কোটি টাকার। কেবল বোর্ড নয়, সরকার-বান্ধব বহু ব্যবসায়ীর।

আরো পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

তবে কি রাজনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসায়িক লাভ করার রাস্তা তৈরি করা হয় ভারত-পাক ম্যাচে? মোটেই না। জর্জ অরওয়েল খেলাধুলো সম্পর্কে বলেছিলেন, এ হল গুলিবর্ষণ না করে যুদ্ধ। কালেভদ্রে হওয়া ভারত-পাক ম্যাচে দু দেশের ক্রিকেটমোদীদের মধ্যে ঘৃণার বান ডাকে, সোশাল মিডিয়ায় খিস্তির ঢল নামে। দু দেশের সরকার তো তেমনটাই চান। বরং অন্য সময় এই ঘৃণা জিইয়ে রাখতে বাড়তি প্রয়াসের দরকার হয়, এই ম্যাচের আগে, পরে পায়ের উপর পা তুলে মজা দেখা যায়।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: