কেন আমি আইপিএল নাস্তিক?

প্রতিবছর ঘটা করে নিলাম হয়, বাবুরা দাসী বাঁদি কেনার মত পছন্দের ক্রিকেটার কেনেন। খেলার সময়েও কেবল খেলা হয় না। গ্যালারিতে এবং আফটার পার্টিতে বলিউড সুন্দরীরা আসেন, মাঠের ধারে চিয়ারলিডার নাম দিয়ে স্বল্পবাস মেম নাচানো হয়।

সদ্য দ্বিতীয়বার বাবা হওয়া বিরাট কোহলি মাঠে নামার জন্যে মুখিয়ে আছেন। মহেন্দ্র সিং ধোনির নাকি ব্র্যাড পিট অভিনীত বেঞ্জামিন বাটনের মত বয়স বাড়ার বদলে কমছে। হার্দিক পান্ডিয়ার কাছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়কত্ব হারানোয় রোহিত শর্মা কি রেগে আছেন, নাকি হালকা বোধ করছেন?

খবরের কাগজের খেলার পাতা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া– সর্বত্র ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন এসব নিয়েই আলোচনা করছেন। কারণ শীত চলে যেতেই এসে পড়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের বৃহত্তম রিয়েলিটি শো। পেশাগত বাধ্যবাধকতা সরে যাওয়ার পর থেকে আইপিএল দেখি টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে কখনও চোখে পড়ে গেলে দু-এক ওভার। উপরন্তু কাগজে, টিভিতে বা হাতের মোবাইলে শিরোনাম পেরিয়ে আইপিএলের খবরেও ঢুকি না। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রিকেটপ্রেমিক হয়েও আইপিএল দেখতে যাই না কেন? যুক্তিগুলো সাজানো যাক।

ক্রিকেটের কাঠিন্য নেইআছে আমোদ 

২০০৮ সালের প্রথম আইপিএলের সময়ে যে কাগজের ক্রীড়া সাংবাদিক ছিলাম, সেই কাগজের মালিক আইপিএলের একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিরও মালিক ছিলেন। প্রথম খেলার দিনই মাঠে গিয়ে দেখি– অবাক কাণ্ড! বাউন্ডারির দড়ির বাইরে যতটা জায়গা পড়ে, তা একত্র করলে আরেকটা ছোটখাটো মাঠ হয়ে যায়। খেলা শুরু হতেই দেখা গেল, রোহিত শর্মা স্পিনারের বল চামচের মত করে পিছন দিকে তুলে দিলেও মাত্র একবার ড্রপ খেয়ে মাঠের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমাদের উপর কিন্তু কাগজের কর্তাদের কড়া নির্দেশ ছিল, বাউন্ডারি যে ছোট করে দেওয়া হয়েছে সেকথা কোনও কারণেই লেখা যাবে না।

গত দেড় দশকে অবশ্য এসব লুকোচুরি আর নেই। এখন সবাই জানে, ৫০ ওভারের খেলাতেও বাউন্ডারি ছোট করে ফেলা হয় চার-ছয়ের সংখ্যা বাড়াতে। স্বীকার্য যে, আজকাল এমন বড় বড় ছয় মারা হয় যে বল গিয়ে পড়ে গ্যালারিতে। তার কারণ ব্যাটগুলোর গঠন এবং ওজন, বাউন্ডারির দৈর্ঘ্য নয়। কিন্তু একইসঙ্গে লক্ষ করে দেখবেন, সীমানার ধারে রোমাঞ্চকর ক্যাচের সংখ্যা কত বেড়ে গিয়েছে। পৃথিবীর যে কোনও দেশে কুড়ি ওভারের লিগ চললেই প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে একজন ফিল্ডার অপূর্ব কায়দায় শূন্যে শরীর ছুড়ে দিয়ে বা অন্য একজন ফিল্ডারের সাহায্যে সীমানার বাইরে থেকে ফিরে ক্যাচ নিচ্ছেন। এমনটা সম্ভব হয় সীমানার বাইরে অনেকখানি জায়গা থাকে বলেই।

ইউটিউবে প্রাক-আইপিএল যুগের সাদা বলের ক্রিকেটই দেখুন– সীমানার পরে মাঠ শেষ। সেখানে এসব করতে গেলে ভারতীয় স্টেডিয়ামগুলোর গ্রিলে ধাক্কা খেতে হত। আরও লক্ষ করুন, বাউন্ডারি ছোট করে দেওয়ায় রানিং বিটুইন দ্য উইকেটসে কত কম শক্তি খরচ হচ্ছে ব্যাটারের। তিন রান প্রায় হয়ই না, কারণ ফিল্ডারের বল তাড়া করে চার আটকে বল ফেরত পাঠানোর অবকাশ কম। তার আগেই বল সীমানা পেরিয়ে যাবে।

সাধারণভাবে পরিশ্রমের দিক থেকে দেখলেও যে আইপিএল বা টি২০ ক্রিকেট একজন ক্রিকেটারের পক্ষে তুলনায় আরামদায়ক তা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার নেই। বোলারকে চার ওভারের বেশি বল করতে হয় না, একজন ব্যাটার প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত খেলে শতরান করলেও বড়জোর ৬০-৭০ বল খেলবেন। টেস্ট ক্রিকেটের কথা বাদ দিন, ৪২ বছর বয়সে পঞ্চাশ ওভারের খেলা খেলতে হলেও টের পাওয়া যেত ধোনির বয়স কমছে না বাড়ছে। জেমস অ্যান্ডারসন একজনই হয়, তিনিও বেছে বেছে ম্যাচ খেলেন।

বড়লোকের বেড়ালের বিয়ে

সদ্য প্রকাশিত এক সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে, ভারতের উপরতলার ১% লোকের হাতে দেশের ২২.৬% আয় আর ৪০% সম্পদ রয়েছে। তা এমন এক দেশে বাবুরা বেড়ালের বিয়ে দেবেন না মোচ্ছব করে? প্রতিবছর ঘটা করে নিলাম হয়, বাবুরা দাসী বাঁদি কেনার মত পছন্দের ক্রিকেটার কেনেন। খেলার সময়েও কেবল খেলা হয় না। গ্যালারিতে এবং আফটার পার্টিতে বলিউড সুন্দরীরা আসেন, মাঠের ধারে চিয়ারলিডার নাম দিয়ে স্বল্পবাস মেম নাচানো হয়। কোন কোন বছর কোন ক্রিকেটার কোন চিয়ারলিডারের সঙ্গে কী ধরনের যৌনতায় লিপ্ত হয়েছিলেন তা নিয়ে রসালো কাহিনীও প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে।

একবার যেমন প্রাক্তন দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক গ্রেম স্মিথের কীর্তিকলাপ মুখরোচক হয়েছিল, আরেকবার ক্রিস গেল আর শেরলিন চোপড়ার নাচানাচি কলকাতার কাগজের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল। আজ থেকে ঠিক এক যুগ আগে পুনে ওয়ারিয়র্স দলের ক্রিকেটাররা রেভ পার্টিতে গিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ে ক্যাচ কট কটও হয়েছিলেন। নেহাত তাঁরা শাহরুখ খানের ছেলে নন, তাই বেশি হয়রানি হয়নি।

কবি বলেছেন, শীত এসে পড়লে বসন্ত খুব পিছিয়ে থাকতে পারে না। তেমনই ফুর্তির উপাদান হিসাবে মদ, মেয়েমানুষ এসে পড়লে জুয়াও পিছিয়ে থাকে না। তবে ভারতের সরকার, সাংবাদিক, ভাষ্যকার, সর্বোপরি ক্রিকেটপ্রেমী জনতা অত্যন্ত ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন। তাই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ঘটনা ধরা পড়ে গেলে শান্তাকুমারণ শ্রীসান্ত, অজিত চান্ডিলার মত কয়েকজনকে শাস্তি দিয়ে মিটিয়ে ফেলা হয়। চেন্নাই সুপার কিংস দল সাসপেন্ড হয়ে যায় তাদের মালিকদের অন্যতম গুরুনাথ মেইয়াপ্পন অবৈধ বাজি ধরায় যুক্ত ছিলেন বলে, অথচ তৎকালীন অধিনায়ক ধোনি নাকি কিছুই জানতেন না। এক ফ্রেমে একাধিক ছবি থাকলেও তিনি নাকি এন শ্রীনিবাসনের জামাইকে আদৌ চিনতেন না। অথচ ধোনি নিজে শ্রীনিবাসনের স্নেহভাজন, তাঁর কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্টও নিযুক্ত হয়েছিলেন।

আইপিএলের উদ্গাতা ললিত মোদি বিস্তর আর্থিক কেলেঙ্কারি করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে ২০১০ সালে। নিজের লোকদের কম পয়সায় ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা পাইয়ে দেওয়া, আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রির টাকা থেকে কাটমানি নেওয়া, বিদেশে গোপন অ্যাকাউন্টে টাকা সরানো– কী ছিল না তার মধ্যে? প্যান্ডোরার বাক্স খুলেছিলেন ললিত নিজেই। যখন তিনি অভিযোগ করেন যে, তৎকালীন মন্ত্রী শশী থারুর নিজের প্রভাব খাটিয়ে সুনন্দা পুষ্করকে কোচি টাস্কার্স ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনিয়ে দিয়েছেন। তা থেকে আরও নানা অভিযোগ উঠেছিল– আইপিএলের সব ফ্র্যাঞ্চাইজিতেই নাকি বেনামে অনেকের টাকা খাটে। অন্য কোনও দেশে হয়তো এত কাণ্ডের পর এই লিগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু যারা দেশ চালায়, তাদের মোচ্ছব থামায় কার সাধ্যি? ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগসত্যি?

কবি বলেছেন নামে কী আসে যায়? আইপিএলের বেলায় সেকথা মনে রাখা খুব জরুরি। এ এমনই ভারতীয় লিগ যে, ২০০৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময়ে ম্যাচের আয়োজন করা যাবে না বলে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলা হয়েছিল। পরেও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে খেলা হয়েছে। অতএব দরকার পড়লে উত্তর মেরুতে বা চাঁদেও খেলা যেতে পারে। কিন্তু খেলা হওয়া চাই, কারণ সম্প্রচার স্বত্ব বেচে পকেট ভারী হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের। সেটাই লক্ষ্য, ক্রিকেট উপলক্ষ্য।

বোর্ড ধনী হলে তা কি ভারতীয় ক্রিকেটের লাভ নয়? এর উত্তর দেওয়া বেজায় শক্ত। ভারতীয় ক্রিকেটারদের, এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেটারদেরও যে আইপিএল যুগে পারিশ্রমিক অনেক বেড়েছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু মুশকিল হল, কর্তা এবং ক্রিকেটারদের লক্ষ্য, মোক্ষ সবই হয়ে গিয়েছে আইপিএল। অতিমারির সময়ে আইপিএলটা যেন হতে পারে তার সযত্ন ব্যবস্থা করেছিল সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন বোর্ড। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চালু ছিল যে রনজি ট্রফি, তা চালু রাখার উদ্যোগ নেয়নি। ঘরোয়া ক্রিকেটারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থাও হয় অনেক পরে।

আরো পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট মানে ফলাফল নিরপেক্ষ ব্যবসা

দেওধর ট্রফি, চ্যালেঞ্জার ট্রফির মত গুরুত্বপূর্ণ ঘরোয়া প্রতিযোগিতা প্রায় তুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু টি২০ নয়, পঞ্চাশ ওভারের জাতীয় দল বা টেস্ট দল বাছার সময়েও যে আইপিএলের পারফরমেন্সকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তা এখন সুনীল গাভাসকারের মত শান্তশিষ্ট লোকও বলতে শুরু করেছেন। কেএল রাহুলের মত প্রতিষ্ঠিত তারকা তো বটেই, ঈশান কিষান বা শ্রেয়স আয়ারের মত তরুণ তুর্কিরাও এখন আইপিএল ছাড়া অন্য কিছুকে পাত্তা দিচ্ছেন না। কেউ মানসিক সমস্যার দোহাই দিয়ে আইপিএলের আগের টেস্ট সিরিজ থেকেও পালাচ্ছেন, কেউ চোট আছে বলে রনজি না খেলে বসে থাকছেন।

তাহলে আইপিএল থেকে ভারতীয় ক্রিকেট টাকা ছাড়া পেল কী? মনে রাখা ভাল, পৃথিবীর সেরা টি ২০ লিগের আয়োজক হওয়া নিয়ে গুমর থাকলেও ভারত সেই ২০০৭ সালের পরে আর ওয়ার্ল্ড টি২০ও জেতেনি। এই লিগ কেন দেখব? হাতে নষ্ট করার মত সময় থাকলে না হয় কোনও ওয়েব সিরিজ দেখা যাবে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

বাংলার ক্রিকেটের রূপ খুঁজিতে যাই না আর

কলকাতা নাইট রাইডার্স আইপিএল জেতায় রাজ্যের রাজধানীতে এ রাজ্যের করদাতাদের টাকায় ঘটা করে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছিল। তাতে বাংলার ক্রিকেটের কী উপকার হয়েছে?

শিল্পপতি সৌরভ গাঙ্গুলির শালবনির প্রস্তাবিত ইস্পাত কারখানা সফল হবে কিনা তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল কর্তা সৌরভের ভিশন ২০-২০ প্রোজেক্ট যে মুখ থুবড়ে পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিএবি প্রধান হয়েই ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট অধিনায়কদের অন্যতম সৌরভ বাংলার ক্রিকেটকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতির জোরে ব্যাটারদের জন্যে ভাঙ্গিপুরাপ্পু ভেঙ্কটসাই লক্ষ্মণ, জোরে বোলারদের জন্যে ওয়াকার ইউনিস, স্পিনারদের জন্যে মুথাইয়া মুরলীথরন বাংলা দলের নেট আলো করে ছিলেন বেশ কিছুদিন। কিন্তু সেসবই ক্ষণিকের হাসিকান্না। তাতে বাংলার ক্রিকেট দলের বা রাজ্যের ক্রিকেটের কোনো দীর্ঘমেয়াদি লাভ হয়েছে বলে এই ২০২৪ সালের শেষ শীতে এসে তো দেখা যাচ্ছে না। এই বাক্য এমন একটা সময়ে লিখতে হচ্ছে যখন ভারতীয় দলে একসঙ্গে দুজন বাংলা দলের বোলার রয়েছেন, রাঁচি টেস্টে আকাশ দীপের অভিষেকও মন্দ হয়নি। মহম্মদ শামি এই মুহূর্তে চোটের জন্যে বিশ্রামে থাকলেও দীর্ঘকাল ধরে তিনি ভারতীয় বোলিংয়ের স্তম্ভ। ফিরে এলে অদূর ভবিষ্যতে যশপ্রীত বুমরার বিশ্রামের ম্যাচে যদি বাংলার তিন পেসারকে একসঙ্গে খেলতে দেখা যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অভিমন্যু ঈশ্বরণ যে হারে রান করে চলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং ভারত এ দলের হয়ে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে তাঁকেও ভারতীয় দলে খেলতে দেখা যেতেই পারে। তাহলে বাংলার ক্রিকেটের কোনো লাভ হয়নি বলছি কেন? কারণ একাধিক।

এগুলো ব্যক্তিগত সাফল্য মাত্র। শামি, মুকেশ কুমার আর আকাশকে রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার হয়ে একসঙ্গে খেলতে দেখা যাবে – এমন সম্ভাবনা কম। ভারতীয় দল এত বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে যে একবার জাতীয় দলে থিতু হয়ে গেলে রঞ্জি ম্যাচ খেলার আর অবকাশ থাকে না। তার উপর সময়, সুযোগ থাকলেও ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার আগ্রহ এখন ক্রিকেটারদের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান। আইপিএলে নিয়মিত হয়ে যেতে পারলে তো কথাই নেই। বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের ঈশান কিষণ তো টেস্টও খেলতে চাইছেন না। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাঝপথ থেকে পলাতক ছবির অনুপকুমার হয়ে গেলেন। ঝাড়খণ্ড দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও তাঁকে খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে রাজ্য থেকে কোনো ক্রিকেটার জাতীয় দলে সুযোগ পেলে এখন বেল পাকলে কাকের কী বলাই সমীচীন। দেখা দরকার, রাজ্য দল সাফল্য পাচ্ছে কি? সে প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক।

শীত শেষ হওয়ার আগেই বাংলার রঞ্জি দলের অভিযান শেষ হয়ে গেছে এবারে। এলিট গ্রুপ বি-তে তৃতীয় স্থানে শেষ করেছে বাংলা। ফলে নক আউট পর্যায়ে পৌঁছনো হয়নি। গত মরসুমে ফাইনালে পৌঁছে থাকলেও সৌরাষ্ট্রের কাছে শোচনীয় হার হয়েছিল। তার আগেরবার সেমিফাইনালে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধেও একই ঘটনা ঘটে। অতিমারীর আগের শেষ রঞ্জি ট্রফিতেও ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের কাছেই ইনিংসে হার হয়েছিল বাংলার। অর্থাৎ ঘরোয়া ক্রিকেটে যে দলগুলো ধারাবাহিকভাবে সফল, তাদের সামনে পড়লেই ব্যবধান অনেকখানি হয়ে যাচ্ছে। মুম্বাইয়ের মত ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা দল দূর অস্ত, কর্ণাটক বা তামিলনাড়ুর স্তরেও পৌঁছয়নি বাংলা। সাফল্যের লেখচিত্র ঊর্ধ্বগামী হওয়ার বদলে নিম্নগামী বললেও ভুল হয় না। পঞ্চাশ ওভারের প্রতিযোগিতা বিজয় হাজারে ট্রফিতেও সাম্প্রতিককালে বলার মত সাফল্য নেই। কুড়ি ওভারের মুস্তাক আলি ট্রফি নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন, কারণ ওটা বস্তুত আইপিএলের প্রতিভা অন্বেষণ পরীক্ষা। সেখান থেকে আকাশ দীপ, শাহবাজ আহমেদদের ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো খুঁজে নিচ্ছে।

বাংলার ক্রিকেটের আরেকটা দিকও আলোচনার যোগ্য। শামি, মুকেশ, আকাশরা নিজেদের রাজ্যে ক্রিকেট খেলার পরিবেশ না পেয়ে কলকাতায় এসে পরিশ্রম করে জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা অর্জন করছেন। অথচ সৌরভের পর ঋদ্ধিমান সাহা ছাড়া কোনো স্থানীয় ক্রিকেটার কিন্তু ভারতীয় দলে নিয়মিত হয়ে উঠতে পারেননি। তাহলে নয়ের দশক থেকে সৌরভের দৃষ্টান্তে পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলো কী অবদান রাখল? না, বাংলা পক্ষ মার্কা বাঙালির প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ তুলছি না। বলছি ছেলের কিটব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাঙালি বাবা-মায়েরা ভিনরাজ্য থেকে আসা ছেলেগুলোকে দেখে শিখতে পারেন – সাফল্যের খিদে আসলে কী জিনিস এবং পরিশ্রম কাকে বলে।

পরিশ্রমী বাঙালিকে অবশ্য বাঙালিরাও যে প্রাপ্য সম্মান দেন তা নয়। নইলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে মনোজ তিওয়ারির চেয়ে অনেক বেশি সফল ঋদ্ধিমান সাহাকে বাংলা ছেড়ে ত্রিপুরায় চলে যেতে হত না। তাঁর অপরাধ কী ছিল? অনেক ভেবেও সৌরভ-ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিককে চটিয়ে ফেলা ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যাবে না। অথচ মনোজ গত মরসুমের শেষে আর খেলব না বলায় কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিল। শেষমেশ সিএবি সচিব স্নেহাশিস গাঙ্গুলির অনুরোধে তিনি এ মরসুমেও খেলতে রাজি হয়ে যান। তরুণ ক্রিকেটারদের উঠে আসার সুযোগ দিতে হবে ইত্যাদি যুক্তি কারোর মাথায় আসেনি। এবারে বিহারের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচ খেলে চূড়ান্ত অবসর ঘোষণা করার পর মনোজকে রীতিমত সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছে। অবশ্য ঋদ্ধিমান এমন ব্যবহার আশা করতে পারেন না। তাঁর চোদ্দ পুরুষে কেউ কখনো সিএবি কর্তা ছিলেন না। তার উপর তিনি কলকাতার অভিজাত পরিবারের সন্তান নন। তিনি হলেন শিলিগুড়ির ছেলে, যেখান দিয়ে কলকাতার বাবু বিবিরা দার্জিলিং, কালিম্পং, গ্যাংটক বেড়াতে যান। খেলতে খেলতেই রাজনীতিতে নেমে পড়ে কেউকেটা হতে পারলে অন্য কথা ছিল। অন্যথায় ঋদ্ধিমান বাংলার ক্রিকেটের কতটা সেবা করেছেন না করেছেন তার হিসাব করা বৃথা।

আরও পড়ুন কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

আরও একটা কথা ভেবে দেখার মত। শাহরুখ খান ধুতি পাঞ্জাবি পরে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা দিয়ে, ভুল বাংলায় থিম সং গেয়ে ইডেন উদ্যানে যে দলটার তাঁবু ফেলেছেন, সেই কলকাতা নাইট রাইডার্সকে দিয়ে বাংলার ক্রিকেটের কী উপকার হচ্ছে? ওটা কাল রাজকোট নাইট রাইডার্স বা অযোধ্যা নাইট রাইডার্স হয়ে গেলেই বা কী ক্ষতি হবে? সে দল আইপিএল জেতায় রাজ্যের রাজধানীতে এ রাজ্যের করদাতাদের টাকায় ঘটা করে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছিল। তাতে বাংলার ক্রিকেটের কী উপকার হয়েছে? আইপিএল যখন চালু হয়, তখন বলা হয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো যে এলাকায়, সেই এলাকার ক্রিকেটের উন্নতিকল্পে তারা কাজ করবে। সে কাজের কোনো হিসাব আছে? রাজ্য সরকারের এ রাজ্যের সমস্ত খেলায় যেরকম কড়া নজর, তাতে কলকাতা নাইট রাইডার্সের জবাবদিহি চাইতে পারে কিন্তু।

মনোজ নিজেই মন্ত্রিসভার সদস্য। সুতরাং চাইলে স্বয়ং এ কাজ করতে পারেন। কিন্তু বাংলার ক্রিকেটের যে আর গুরুত্ব নেই তা তো তিনি ভালই বুঝে ফেলেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দশ হাজারের বেশি রানের মালিক মনোজ বিদায়কালে বলেছেন, তরুণ খেলোয়াড়রা আইপিএলকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে হতাশ হয়ে এক্সে পোস্ট করে ফেলেছিলেন যে পরের মরসুম থেকে রঞ্জি ট্রফি বন্ধই করে দেওয়া উচিত। তার জন্যে বোর্ডকে জরিমানাও দিতে হয়েছে। কিন্তু কথাটা তো ভুল বলেননি। আগামী দিনে বাংলার ক্রিকেট বলে আদৌ কিছু থাকবে কিনা কে জানে? সুতরাং আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজকে চটিয়ে কী লাভ? তাদের বিরুদ্ধে কিছু করে, লড়েই জেতার আশা নেই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

আবার ফাইনালে হার, ফাটানো যাক দু-একটা বুদ্বুদ এবার

ভারতীয় ক্রিকেটের গোটা বাস্তুতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে সত্যকে অস্বীকার করে। বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের পর একাধিক ক্রিকেট ওয়েবসাইট এবং পরিসংখ্যানবিদ সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন একটা পরিসংখ্যান – ভারত গত তিনটে বিশ্বকাপে মাত্র চারটে ম্যাচ হেরেছে। এমন অনর্থক পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বা এদেশের অন্য কোনো খেলায় হয় না।

সপ্তাহের অর্ধেক কেটে গেল, বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের শোকপালন এখনো শেষ হল না। সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের খোঁজ নিয়েছেন কিনা জানি না, তবে ফাইনালের পর পরাজিত ভারতীয় দলের সদস্যদের পিঠ চাপড়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সাজঘরে গেছেন। দলের প্রত্যেককে আলাদা করে সান্ত্বনা দিয়েছেন, মহম্মদ শামির মাথাটাকে নিজেদের কাঁধে ঠেসে ধরেছেন, তারপর স্লো মোশনে আবেগাকুল আবহসঙ্গীত সহকারে বেরিয়ে এসেছেন – এই ভিডিও মুক্তি পেয়েছে। অতএব এই শোক পর্ব নির্ঘাত দীর্ঘায়িত হবে। আগে মানুষ শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যেত, আজকাল আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। শোকের জন্যে যাকে দায়ী করে তার মেয়ে, বউকে ধর্ষণের হুমকি দেয়। অন্তত সেইটা আশা করা যায় আজ সন্ধে থেকে বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কুড়ি বিশের সিরিজ শুরু হয়ে যাচ্ছে। সূর্যকুমার যাদবের নেতৃত্বাধীন দল যদি অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিতে পারে তাহলে তো কথাই নেই। গলার শির ফুলিয়ে সেই কথা বলা যাবে যা এখন বিনীতভাবে বলা হচ্ছে – আমাদের দলটাই সেরা, ওই দিনটা খারাপ গেছিল আর কি। মোদ্দাকথা, কেন আরও একবার একটা আইসিসি ট্রফি জিততে ব্যর্থ হলাম তার কোনো ক্রিকেটিয় বিশ্লেষণ হবে না।

কে-ই বা সেটা চায়? ভারতের কোনো প্রাক্তন ক্রিকেটার কোনো ত্রুটি তুলে ধরেছেন? গত কয়েকদিন বাংলা কাগজ-টাগজ ঘেঁটেও কোথাও রবিবারের হারের কোনো বিশ্লেষণ চোখে পড়ল না। কার চোখে কত জল কেবলই তা মাপা চলছে। সব সংবাদমাধ্যম ‘খলনায়ক’ খুঁজতে শুরু করেনি এটা যতখানি স্বস্তিদায়ক, ততটাই অস্বস্তির কারোর কোনো ক্রিকেটিয় ব্যাখ্যায় না যাওয়া। দল জেতে ক্রিকেটারদের মুনশিয়ানায় আর হারে কপালের দোষে – এই যদি ক্রিকেটভক্ত, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক এবং টিম ম্যানেজমেন্টের মিলিত সিদ্ধান্ত হয় তাহলে দশ বছর কেন; বিশ বছরেও ট্রফির খরা কাটা শক্ত।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি, বিশ্বকাপ – একটা করে প্রতিযোগিতার কোনো একটা স্তরে ভারতীয় দল মুখ থুবড়ে পড়ে আর ভারতের তাবড় প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার আর সাংবাদিকরা মূলত দুটো কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকেন – ১) একটা খারাপ দিন একটা ভাল দলকে রাতারাতি খারাপ করে দেয় না, ২) ভাগ্য খারাপ, তাই খারাপ দিনটা ফাইনালেই এল। কী আর করা যাবে?

সব দেশেই খেলা সম্পর্কে সাধারণ দর্শকের মতামত গঠনে প্রধান ভূমিকা নেন বিশেষজ্ঞ আর সাংবাদিকরা। তাঁরাই দিনের পর দিন এসব বলে চললে ক্রিকেটভক্তদের দোষ দেওয়া যায় না। সবাই তো আর দেখতে পান না অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তনরা নিজেদের দল হারলে (এমনকি জিতলেও) কীরকম চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, ছোট ছোট ত্রুটিকেও রেয়াত করেন না ধারাভাষ্যে। ভারতের বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিককুল বিসিসিআই প্রযোজিত টিভি সম্প্রচারের আমলে, কর্তাদের চটালে মাঠে ঢোকার অনুমোদন না পাওয়ার যুগে দেশসুদ্ধু লোককে শিখিয়ে দিয়েছেন যে জিতলে সমালোচনা করা হল ছিদ্রান্বেষণ আর হারলে সমালোচনা করতে নেই। দলের পাশে দাঁড়াতে হয়। মুশকিল হল, বারবার ব্যর্থতার ফলে ব্যাপারটা বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর মত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পরপর দশটা ম্যাচ জেতার পরে একটা ম্যাচ হেরেছে বলে একথা একটু বেশি কটু শোনাতে পারে। কিন্তু আসলে তো একটা ম্যাচ নয়, ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট জিততে পারেনি ভারত। দ্বিপাক্ষিক সিরিজের বাইরে জয় বলতে ২০২৩ এশিয়া কাপ। কিন্তু ক্রিকেট বহির্ভূত কারণে (ক্রিকেটিয় কারণ বাদই দিলাম) পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের যা অবস্থা তাতে ওটাও না জিতলে আর দল রাখার মানে কী?

আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের গোটা বাস্তুতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে সত্যকে অস্বীকার করে। বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের পর একাধিক ক্রিকেট ওয়েবসাইট এবং পরিসংখ্যানবিদ সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন একটা পরিসংখ্যান – ভারত গত তিনটে বিশ্বকাপে মাত্র চারটে ম্যাচ হেরেছে। এমন অনর্থক পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বা এদেশের অন্য কোনো খেলায় হয় না। প্রাথমিক স্তরের ম্যাচের সংখ্যা নক আউট পর্যায়ের চেয়ে কম তো হবেই। প্রাথমিক স্তরের বেশিরভাগ ম্যাচ না জিতলে নক আউটে ওঠা যায় না। সেমিফাইনাল তো দুটোই হয়, ফাইনাল একটা। জগতে যতদিন পাটিগণিত আছে, ততদিন এমনটাই হবে। পিভি সিন্ধু কোনো প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে বা ফাইনালে হারলে তাঁর পক্ষ নিয়ে কেউ বলে না, অধিকাংশ ম্যাচই তো জিতেছিল। অতএব চ্যাম্পিয়ন না হলেও ও-ই সেরা খেলোয়াড়। ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে পরাজিত দলের সমর্থকরা ঝরঝরিয়ে কাঁদেন, অনেকে ক্ষিপ্তও হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁরা বা তাঁদের দেশের প্রাক্তন ফুটবলাররা কখনো বলেন না, অধিকাংশ ম্যাচ জিতেছি। অতএব চ্যাম্পিয়ন না হলেও আমরাই সেরা দল। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে এই জাতীয় নির্বুদ্ধিতার প্রদর্শনী দশ বছর ধরে প্রত্যেক প্রতিযোগিতার পরেই হয়ে থাকে। মায়াবাদের দেশ ভারতবর্ষে কেউ একথা স্বীকার করতে রাজি নন, যে নক আউটে বারবার হার অঘটন হতে পারে না। নিজেদের মধ্যে গলদ আছে, সে গলদ খুঁজে বার করতে হবে এবং সংশোধন করতে হবে। আসলে স্বীকার করতে গেলেই একগাদা অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, অনেক সযত্নলালিত বুদ্বুদ দুম ফটাস হয়ে যাবে। তাতে এই যে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্রিকেট বাণিজ্য, তার সঙ্গে যুক্ত বিবিধ কায়েমি স্বার্থে ঘা লাগবে।

সেই বুদ্বুদগুলোর আলোচনায় যাওয়ার আগে বলে নেওয়া যাক, ক্রিকেট বাস্তুতন্ত্রের কেউ কেউ কখনো কখনো স্বীকার করেন যে বারবার আইসিসি টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হওয়া একটা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। কিন্তু তাঁরাও ব্যাপারটাকে স্রেফ মানসিক বলে আখ্যা দেন। যদি সেটাই ঠিক হয়, তাহলে খেলোয়াড়দের মানসিক সমস্যা দূর করার যেসব অত্যাধুনিক ব্যবস্থা আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানে আছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ডকে সেগুলো ব্যবহার করতে আটকাচ্ছে কে? নাকি সেসব করেও ফল একই থেকে যাচ্ছে? এসব প্রশ্ন ক্রিকেট বাস্তুতন্ত্রের লোকেরা তোলেন না।

এবার বুদ্বুদগুলোর দিকে তাকানো যাক।

১. বেশিরভাগ ম্যাচে জয়

এবারের মত বিশ্বকাপে পরপর দশটা ম্যাচ ভারত কখনো জেতেনি, তার চেয়েও বড় কথা এমন দাপটে জেতেনি। সেই কারণে এই দলের বাহবা প্রাপ্য, কিন্তু সেই সুবাদে ২০১৫ আর ২০১৯ সালের ভারতীয় দলগুলোকেও স্রেফ বেশিরভাগ ম্যাচ জেতার জন্য একইরকম ভাল বলে প্রমাণ করতে চাইলে কিছু অপ্রিয় প্রসঙ্গ না তুলে উপায় থাকে না।

২০০৭ সালে ভারত ভীষণ সহজ গ্রুপে ছিল (অন্য দলগুলো বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং বারমুডা)। তা সত্ত্বেও গ্রুপ স্তর থেকেই বিদায় নেয়। ভারত যেহেতু সবচেয়ে জনপ্রিয় দল, তাই তারা বিদায় নিলে মাঠ ভরে না। তার চেয়েও বড় কথা টিভি রেটিংয়ের বারোটা বেজে যায়। বিজ্ঞাপনদাতাদের বিপুল লোকসান হয়। আইসিসি সেবার বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে ভবিষ্যতে ভারতের দ্রুত বিদায়ের সম্ভাবনা নির্মূল করতেই হত। তাই ২০১১ বিশ্বকাপে ফরম্যাটই বদলে ফেলা হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে চালু হয়েছিল গ্রুপ লিগের পর সুপার সিক্স (২০০৭ সালে সুপার এইট) স্তর, তারপর সেমিফাইনাল, ফাইনাল। ২০১১ সালে ফিরে যাওয়া হল ১৯৯৬ সালের ফরম্যাটে। প্রথমে থাকল গ্রুপ স্তর (সাত দলের), তারপর কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল, ফাইনাল। অর্থাৎ একটা দল (পড়ুন ভারত) কমপক্ষে ছটা ম্যাচ খেলবেই গ্রুপ স্তরে, ফাইনাল পর্যন্ত গেলে নটা। ২০১৫ সালে ভারত ছিল পুল বি-তে। সেখানে বাকি ছটা দলের মধ্যে তিনটের নাম আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবোয়ে আর সংযুক্ত আরব আমীরশাহী। বাকি তিনটে দলের মধ্যে ছিল ক্ষয়িষ্ণু ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই পুলের সব ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার জন্যেও আলাদা হাততালি প্রাপ্য? কোয়ার্টার ফাইনালে আবার প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে কঠিন প্রতিপক্ষের সামনে পড়ামাত্রই মহেন্দ্র সিং ধোনির দল দুরমুশ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া জেতে ৯৫ রানে।

পরের বিশ্বকাপে ফের ফরম্যাট বদলে ফেলা হয়, অনিশ্চয়তা আরও কমিয়ে আনা হয়। বিশ্বকাপ ফুটবল জিততে হলে চার-চারটে নক আউট ম্যাচ জিততে হয়। কিন্তু ২০১৯ থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিততে হলে মোটে দুটো – সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। ২০০৭ সালের ১৬ দলের বিশ্বকাপকে ছোট করতে করতে করে দেওয়া হল দশ দলের। সবাই সবার বিরুদ্ধে খেলবে, অর্থাৎ কমপক্ষে নটা ম্যাচ খেলা নিশ্চিত হল। প্রথম চারে থাকলেই সোজা সেমিফাইনাল, সেখান থেকে দুটো ম্যাচ জিতলেই কেল্লা ফতে। এই ব্যবস্থায় ভারত আর নিউজিল্যান্ডের লিগের ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেস্তে যায়, ইংল্যান্ড বেশ সহজেই ভারতকে পরাস্ত করে। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড ভারতকে হারিয়ে দেয়।

আগের লেখাতেই লিখেছি, কীভাবে ত্রিদেব শুকিয়ে মারছে বাকি ক্রিকেট দুনিয়াকে। যাঁদের সত্যিই শুধু ক্রিকেটার নয়, ক্রিকেটের প্রতিও ভালবাসা আছে এবং দশ বছরেরও বেশি আগের ক্রিকেট সম্পর্কে জানা আছে, তাঁরা নিশ্চয়ই মানবেন যে ২০১১ সালের পর থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান যেখানে পৌঁছেছে তাতে বিশ্ব ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে তিন-চারটে দলের মধ্যে। এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখাল, কিন্তু ২০১৯ সালে তাদের অবস্থা ছিল টালমাটাল। ফলে আসলে বিশ্বকাপের দাবিদার ছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড। ভারত একমাত্র অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পেরেছিল। বাকি দুই দলের কাছেই হারে। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে গ্রুপের খেলায় হারতে হয়েছিল শ্রীলঙ্কার কাছে আর ফাইনালে শোচনীয় হার হয়েছিল পাকিস্তানের কাছে। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির আলোচনায় যাওয়া অর্থহীন, কারণ সেখানে ২০০৭ সালে খেতাব জয় বাদ দিলে ভারতের অবস্থা আরও করুণ।

সুতরাং বেশিরভাগ ম্যাচে জেতার তথ্যকে গলার মালা করে লাভ নেই। সমস্যাটাও মোটেই স্রেফ মানসিক নয়, দক্ষতাজনিত।

২. দক্ষতার দিক থেকে বিশ্বসেরা

বিশ্বসেরার শিরোপা যে নেই তা তো বলাই বাহুল্য, কিন্তু দক্ষতার দিক থেকে বিশ্বসেরা – এই ধারণাও দাঁড়িয়ে আছে নরম মাটির উপরে। ক্রিকেটে কোনোদিনই দক্ষতা মানে কেবল ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং করার পারদর্শিতা নয়। সঠিক পরিকল্পনার দক্ষতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। আজকের ভিডিও অ্যানালিসিস ইত্যাদি অতি উন্নত প্রযুক্তির যুগে সঠিক পরিকল্পনার গুরুত্ব ও ক্ষমতা আরও বেড়ে গেছে। ভারতীয় দল কি সেইখানে অন্য দলগুলোর সমতুল্য? স্মৃতিতে এখনো টাটকা এবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল দিয়েই দেখা যাক।

ফাইনালে

ম্যাচের প্রথম বল থেকেই পরিষ্কার হয় যে অস্ট্রেলিয়া একবার ভারতের সঙ্গে খেলা হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার খেলতে এসেছে অনুপুঙ্খ পরিকল্পনা নিয়ে। প্রত্যেক ভারতীয় ব্যাটারের জন্যে ছিল আলাদা আলাদা পরিকল্পনা।

রোহিত শর্মা প্রত্যেক ম্যাচে ঝোড়ো সূচনা করেছেন, তাঁর বেশিরভাগ চার ছয় হয়েছে অফ সাইডে পয়েন্টের পর থেকে মিড অফ পর্যন্ত এলাকা দিয়ে আর লেগ সাইডে স্কোয়্যার লেগ দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া ঠিক ওই দুই জায়গায় সীমানার ধারে ফিল্ডার রেখে বল করা শুরু করে। তার উপর আগের ম্যাচগুলো ভারত যেসব মাঠে খেলেছে তার তুলনায় নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের মাঠ বড়। অন্য ম্যাচে যেসব শটে চার বা ছয় হচ্ছিল, সেগুলোতে এক-দুই রান হতে শুরু করল। ফলে প্রথম দু-এক ওভার রোহিতকে কিছুটা হতাশ করে। তিনি অবশ্য একটু পরেই এই পরিকল্পনাকে পরাস্ত করে মারতে শুরু করেন। তখন আসে দ্বিতীয় পরিকল্পনা। পাওয়ার প্লে শেষ না হতেই গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে দিয়ে স্পিন করানো, যাতে জোরে বোলারের গতি রোহিতকে বড় শট নিতে সাহায্য না করে। তাঁকে যেন অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করতে হয়, ভুল করার সম্ভাবনা বাড়ে। ম্যাক্সওয়েল প্রথমে মার খেলেও শেষপর্যন্ত এই পরিকল্পনায় ফল হয়, রোহিত বড় শট নিতে গিয়ে আউট হয়ে যান।

শুভমান গিলের মূল শক্তি পয়েন্ট থেকে কভার পর্যন্ত অঞ্চল দিয়ে সামনের পায়ে ড্রাইভ করে বাউন্ডারি পাওয়া আর সামান্য খাটো লেংথের বলে একটুখানি হাত খোলার জায়গা পেলেই স্কোয়্যার কাট করা। তাঁকে কাট করার কোনো সুযোগই দেওয়া হল না এবং অফ সাইডে ফিল্ডারের ভিড় জমিয়ে দেওয়া হল। গিল নিজেও জানেন তাঁর ড্রাইভ কখনো কখনো কিছুটা পথ হাওয়ায় যাত্রা করে, তার উপর সেদিনের পিচটা ছিল মন্থর। ফলে তেমন হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি। সেই ভাবনায় বিব্রত রাখতে শর্ট কভার দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল মুখের সামনে। গিল রান করার জায়গা খুঁজে না পেয়ে হাঁসফাঁস করলেন, তারপর অফের বল জোর করে লেগে ঘুরিয়ে মারতে গিয়ে মিড অনে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন।

বিরাট কোহলিকে চটপট আউট করতে হলে ক্রিজে এসেই তিনি যে খুচরো রান নিতে শুরু করেন তা আটকাতে হয়। লখনৌতে পিচ ছিল আমেদাবাদের মতই মন্থর। সেখানে ইংল্যান্ড কভারে, মিড উইকেট, মিড অফ, মিড অনে লোক দাঁড় করিয়ে সফলভাবে আট বল কোনো রান করতে দেয়নি। নবম বলে তিনি ধৈর্য হারিয়ে জোরে ড্রাইভ করতে গিয়ে মিড অফে ক্যাচ দিয়ে আউট হন। অস্ট্রেলিয়াও তাঁকে মোটামুটি চুপ রাখছিল, কিন্তু মিচেল স্টার্ক একটা ওভারে নো বল করার পর খেই হারিয়ে ফেললেন। কোহলি পরপর তিনটে চার মেরে দিলেন। পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। তবু অস্ট্রেলিয়া কোনো সময়েই তাঁকে শট নেওয়ার জন্যে বেশি জায়গা দেয়নি, হাফভলি প্রায় পাননি। যে পিচে বল ব্যাটে আসছে না, সেখানে কোহলির পছন্দের খেলা – বলের গতিকে ব্যবহার করে ফিল্ডারদের ফাঁকে বল ঠেলে দিয়ে দৌড়ে রান নেওয়া – বেশ শক্ত। অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স সমেত সব জোরে বোলারই স্লোয়ারের উপর জোর দিচ্ছিলেন। মোটেই দরকার অনুযায়ী রান হচ্ছিল না। উলটো দিকে কে এল রাহুল তো সেদিন বিশ্বকাপের মন্থরতম অর্ধশতরান করেছেন। ফলে কোহলির উপর চাপ বাড়ছিল। যতই মনে হোক তিনি নিশ্চিত শতরানের দিকে এগোচ্ছিলেন আর কপাল দোষে কামিন্সের বলটা ব্যাটে লেগে উইকেটে পড়ল, আসলে কোহলি কখনোই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। ওই পিচে বারবার স্কোয়্যারে বল ঠেলে রান নিতে থাকলে গায়ের দিকে আসা খাটো লেংথের বলে ওভাবে প্লেড অন হওয়া মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।

রাহুলের জন্যে কোনো পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়েনি হয়ত। তিনি বেশ কিছুদিন হল একদিনের ক্রিকেট তো বটেই, কুড়ি বিশের ক্রিকেটেও এমনভাবে ব্যাট করেন যা দেখে মনে পড়ে কবীর সুমনের গান “ও গানওলা, আরেকটা গান গাও। আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই।” সেমিফাইনালে যেরকম নির্ভেজাল পাটা উইকেট পাওয়া গিয়েছিল এবং দেরিতে ব্যাট করতে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন, একমাত্র সেরকম ক্ষেত্রেই রাহুলকে চার ছয় মারতে ইচ্ছুক দেখা যায়। অন্যথায় তিনি ওরকম মন্থর ব্যাটিংই করেন, তারপর হয় স্টার্কের বলটার মত একটা দারুণ বলে আউট হয়ে যান, নয়ত উপায়ান্তর নেই দেখে মারতে গিয়ে আউট হন।

মধ্যে ছিলেন শ্রেয়স আয়ার। তাঁর জন্যেও স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। সাংবাদিক সম্মেলনে শর্ট বল নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি যতই রাগ করুন আর শ্রীলঙ্কা বা নিউজিল্যান্ডের বোলারদের বিরুদ্ধে যতই শতরান হাঁকান; কামিন্স, স্টার্ক, জশ হেজলউডের মত দীর্ঘদেহী জোরে বোলারদের বিরুদ্ধে তিনি যে সামনের পায়ে আসতে ইতস্তত করেন তা সাদা চোখেই দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক তাঁকে গুড লেংথে বল করলেন, তিনি সামনের পায়ে না এসে দোনামোনা করে খেলে খোঁচা দিয়ে ফেললেন।

সূর্যকুমার যাদবের শক্তি হল বোলারদের গতিকে কাজে লাগিয়ে মাঠের দুরূহ কোণে বল পাঠানো। আমেদাবাদের পিচে সে কাজটা এমনিতেই শক্ত ছিল। তার উপর অস্ট্রেলিয়া তাঁকে কোনো গতিই দেয়নি। যে বলে আউট হলেন সেটাও ছিল হেজলউডের মন্থর গতির খাটো লেংথের বল।

রবীন্দ্র জাদেজা টেস্টে ব্যাট হাতে দিব্যি ধারাবাহিক, একদিনের ক্রিকেটে মোটেই তা নন। তবু কেন তাঁকে সূর্যকুমারের আগে পাঠানো হয়েছিল তা রোহিত আর রাহুল দ্রাবিড়ই জানেন। কিন্তু তিনিও অলরাউন্ডারসুলভ কিছু করে উঠতে পারেননি। অনেকগুলো বল খেলে মোটে নয় রান করে অসহায়ের মত আউট হন।

এত পরিকল্পনার বিপরীতে ভারতের পরিকল্পনা কীরকম ছিল?

দুনিয়াসুদ্ধ লোক জানে ডানহাতি জোরে বোলার রাউন্ড দ্য উইকেট বল করলে ডেভিড ওয়ার্নার অস্বস্তি বোধ করেন। ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড সব ধরনের ক্রিকেটেই তাঁকে ওইভাবে বল করে বহুবার আউট করেছেন। অথচ মহম্মদ শামি শুরু করলেন যথারীতি ওভার দ্য উইকেট এবং চার হল। ওয়ার্নার ভাগ্যিস আত্মঘাতী শট খেলে আউট হয়ে গেলেন।

ট্রেভিস হেডের অস্বস্তি যে শরীর লক্ষ করে ধেয়ে আসা খাটো লেংথের বলে, তাও সুবিদিত। কিন্তু শামি আর যশপ্রীত বুমরা – দুজনেই তাঁকে অফস্টাম্পের বাইরে বল দিয়ে গেলেন, তিনিও বলের লেংথ অনুযায়ী কখনো সামনের পায়ে কখনো পিছনের পায়ে কভার, মিড অফ দিয়ে রান করে গেলেন। যতক্ষণে মহম্মদ সিরাজ তাঁকে শরীর লক্ষ করে বল করা শুরু করলেন ততক্ষণে ট্রেভিস হেড ক্রিজে জমে গেছেন।

মারনাস লাবুশেন আরেকটু হলে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দলে সুযোগই পেতেন না। কারণ তিনি বড় শট নিতে পারেন না বললেই হয়। তাই তাঁর কাজ একটা দিক ধরে থাকা, খুচরো রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখা। এটাও গোপন তথ্য নয়। খুচরো রান নিতে না পারলেই যে লাবুশেন হাঁকপাক করেন, বিশেষ করে স্পিনারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক শট নিতে গিয়ে বিপদে পড়েন তা চেন্নাইয়ের ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচেও দেখা গিয়েছিল। অথচ ফাইনালে তিনি ব্যাট করতে আসার পরে তাঁর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করার কোনো চেষ্টা হয়েছিল কি? এক প্রান্ত থেকে স্পিনার এনে মুখের সামনে ফিল্ডার দাঁড় করিয়েও অন্যরকম চেষ্টা করা যেত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে যে দল পরিকল্পনার দক্ষতায় প্রতিপক্ষের থেকে এতখানি পিছিয়ে থাকে, তাকে দক্ষতায় বিশ্বসেরা কী করে বলা যায়?

. এক দিনের ভুল

কেউ বলতেই পারেন, একটা ম্যাচ হারলেই এত কিছুকে ভুল বলে দেগে দেওয়া অন্যায়। ওই পরিকল্পনা নিয়েই তো টানা দশটা ম্যাচ জিতেছে। ঘটনা হল, ফাইনাল আর দশটা ম্যাচের মতই আরেকটা ম্যাচ – একথা মাইকের সামনে বলতে ভাল, শুনতে আরও ভাল। কিন্তু কোনো ভাল দল ওই কথা বিশ্বাস করে বসে থাকে না। ফাইনালে তো বটেই, যে কোনো নক আউট ম্যাচেই সকলে বেশি তৈরি হয়ে আসে। অস্ট্রেলিয়াই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। আর গত দশ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ভারত আলাদা প্রস্তুতি নেয় না। সেই কারণেই বারবার অপ্রস্তুত হয়।

এই প্রস্তুতিহীনতা অবশ্য কেবল নক আউটের ব্যাপার নয়, এই বিশ্বকাপের ব্যাপারও নয়। মহেন্দ্র সিং ধোনির আমল থেকেই স্টেজে মেরে দেওয়ার প্রবণতা আর কিছু গোঁড়ামি ভারতীয় দলের মজ্জাগত হয়ে গেছে। সেগুলো কী কী কারণে নক আউটের আগে ভারতকে অসুবিধায় ফেলে না তা যাঁরা এতদূর পড়ে ফেলেছেন তাঁরা বুঝে ফেলেছেন। এবার প্রবণতাগুলো কী তা দেখে নেওয়া যাক:

বিশ্বকাপের দল তৈরি করতে হয় চার বছর ধরে। কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপের পরের চার বছরেও ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট একজন চার নম্বর ব্যাটার ঠিক করতে পারেনি। ২০১৮ সালে অধিনায়ক কোহলি বলে দিয়েছিলেন, আম্বাতি রায়ুডুই হবেন বিশ্বকাপের চার নম্বর। শেষমেশ যখন বিশ্বকাপের দল ঘোষণা হল তখন দেখা গেল রায়ুডু আদৌ দলে নেই। বিজয়শঙ্কর বলে একজন হঠাৎ টিম ম্যানেজমেন্টের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিলেন। কেন তা আজও বোঝা যায়নি। প্রায় খেলা ছেড়ে দেওয়া দীনেশ কার্তিকও বিশ্বকাপ খেলতে চলে গেলেন, রায়ুডু বাদ। দলের অত গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা নিয়ে অমন ফাজলামি করে কোনো দল কোনোদিন বিশ্বকাপ জেতেনি। পরের চার বছরেও বিস্তর কাটা জোড়ার পরে শ্রেয়সে মনস্থির করতে পারল টিম ম্যানেজমেন্ট, কিন্তু হার্দিক পান্ডিয়া ছাড়া অলরাউন্ডার পাওয়া গেল না। তাঁর বদলে কাজ চালাতে পারেন ভেবে যাঁকে নেওয়া হয়েছিল, সেই শার্দূল ঠাকুরকে বল হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। ব্যাটেও তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেন না। সেই যে অস্ট্রেলিয়ায় একটা টেস্টে রান করে দিয়েছিলেন, সেই ভরসাতেই আজও তাঁকে অলরাউন্ডার বলে চালানো হচ্ছে। এ সমস্যার একটা সহজ সমাধান হতে পারত, যদি ভারতের ব্যাটাররা কেউ কেউ কাজ চালানোর মত বোলিং করতে পারতেন। এই বিশ্বকাপে যেখানে উইকেটে বল ঘুরেছে, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে কাজ চালানোর চেয়ে বেশি কাজই করেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল আর হেড। নিউজিল্যান্ডেরও ছিলেন গ্লেন ফিলিপস, ড্যারিল মিচেল, মিচেল স্যান্টনার, রচিন রবীন্দ্ররা। দক্ষিণ আফ্রিকার এইডেন মারক্রামের অফস্পিনও মন্দ নয়। কিন্তু রোহিতের হাতে ঠিক পাঁচজন বোলার। তাঁদের একজন মার খেয়ে গেলে সমূহ বিপদ। ওই পাঁচজন এতটাই ভাল বল করেছেন ফাইনাল পর্যন্ত, যে এই ফাঁকটা ধরা পড়েনি। কিন্তু একদিনের ক্রিকেটে এ ফাঁক বড় ফাঁকি। এ নিয়েই বিশ্বকাপ জিতে গেলে সেও এক ইতিহাস হত। ফাইনালে হেড আর লাবুশেন জমে যেতেই ফাঁকি ধরা পড়ে গেল, অধিনায়ক নিরুপায়।

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট মানে ফলাফল নিরপেক্ষ ব্যবসা

আমাদের ব্যাটাররা বল করতে পারেন না কেন? বোলারদের ব্যাটের হাতেরই বা কেন উন্নতি হচ্ছে না? এসব প্রশ্ন করলেই মহাতারকাদের মহা ইগোর কথা উঠে আসবে। রোহিত নিজে দীর্ঘকাল কাজ চালানোর মত অফস্পিন বল করতেন, অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছেন। কোহলিও মিডিয়াম পেস বল করতেন, তিনিও ছেড়ে দিয়েছেন। কেন ছাড়লেন? দলের প্রয়োজন থাকতেও কেন আবার শুরু করেননি? দেবা ন জানন্তি। এঁদের কি এমন কোনো চোট আছে যা বল করলে বেড়ে যেতে পারে? তেমন কোনো খবর নেই কিন্তু।

শচীন তেন্ডুলকরের (ম্যাচ ৪৭০, বল ৮০৫৪, ওভার পিছু রান ৫.১০, উইকেট ১৫৪, সেরা বোলিং ৫/৩২) টেনিস এলবো হয়েছিল, একসময় কোমরে বেল্ট পরে ব্যাট করতে নামতে হয়েছিল, তারপর সেই চোট মাস ছয়েকের জন্যে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তার আগে পরে বল করেছেন, ম্যাচ জিতিয়েছেন। বীরেন্দ্র সেওয়াগও (ম্যাচ ২৫১, বল ৪৩৯২, ওভার পিছু রান ৫.২৬, উইকেট ৯৬, সেরা বোলিং ৪/৬) চোটমুক্ত ছিলেন না, কিন্তু বল করতেন। সৌরভ গাঙ্গুলির (ম্যাচ ৩১১, বল ৪৫৬১, ওভার পিছু রান ৫.০৬, উইকেট ১০০, সেরা বোলিং ৫/১৬) ফিটনেস তো হাস্যকৌতুকের বিষয় ছিল। অথচ বল করে একাধিক স্মরণীয় জয় এনে দিয়েছেন।

সুরেশ রায়না (ম্যাচ ২২৬, বল ২১২৬, ওভার পিছু রান ৫.১১, উইকেট ৩৬, সেরা বোলিং ৩/৩৪) এঁদের মত অত উঁচু দরের ব্যাটার ছিলেন না, কিন্তু মিডল অর্ডারে ভরসা দিয়েছেন একসময়। দরকারে অফস্পিনটাও করে দিতেন।

এদিকে আজকের মহাতারকা ব্যাটারদের কেবল ফিটনেস নিয়েই কয়েকশো প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, রোজ লক্ষ লক্ষ গদগদ পোস্ট হয় সোশাল মিডিয়ায়। কিন্তু ওঁরা বল করতে পারেন না। কেদার যাদব বলে একজন ছিলেন। মারকুটে ব্যাট আর খুব নিচ থেকে বল ছেড়ে অফস্পিন করতেন, মারা সোজা ছিল না। বিরাটের সঙ্গে শতরান করে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটা স্মরণীয় ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। তিনি হঠাৎ কোনো অজ্ঞাত কারণে নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্টের বিষনজরে পড়ে বাদ চলে যান ২০২০ সালে।

২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফরে দেখা গিয়েছিল ভুবনেশ্বর কুমারের ব্যাটের হাত রীতিমত ভাল। ট্রেন্টব্রিজ টেস্টের দুই ইনিংসেই অর্ধশতরান করেছিলেন। আবার ২০১৭ সালে পাল্লেকেলেতে যখন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৩১ রানে সাত উইকেট পড়ে যায়, তখন অপরাজিত ৫৩ রান করে মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে জুটিতে ১০০ রান তুলে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। মাঝে বেশ কিছুদিন একদিনের দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলেন ভুবনেশ্বর। অথচ তাঁকে গড়েপিটে অলরাউন্ডার করে তুলতে পারেননি সর্বকালের সেরা ভারতীয় দল তৈরি করার কৃতিত্ব যিনি দিনরাত দাবি করেন, সেই রবি শাস্ত্রী, আর তাঁর আদরের দুই অধিনায়ক ধোনি, কোহলি।

এখনকার বোলারদের মধ্যে শামি আর বুমরা দুজনেই যে ব্যাটিং উপভোগ করেন তা টেস্ট ক্রিকেটে স্পষ্ট দেখা যায়। শামি দিব্যি কয়েকটা বড় শট নিয়ে ফেলতে পারেন। বুমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে। স্টুয়ার্ট ব্রডকে ঠেঙিয়ে টেস্টে এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়ার রেকর্ড করিয়ে নিয়েছেন তিনি।

এঁদের ব্যাটের হাতটা যত্ন করে আরেকটু ভাল করে দেওয়ার কাজটুকুও যদি না পারেন, তাহলে রাহুল দ্রাবিড় আর ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোর করেনটা কী? রোহিত, কোহলিকে তো আর হাতে ধরে ব্যাটিং শেখাতে হয় না।

আসলে এসব করতে গেলে নমনীয়তা দরকার। কিন্তু ভারতীয় দলের একদিনের ক্রিকেটের ব্যাটিং আর গোঁড়ামি সমার্থক। বেশিরভাগ পাঠক রে রে করে তেড়ে আসবেন জেনেও না বলে উপায় নেই, শচীন আর সেওয়াগের প্রস্থানের পর থেকে ভারত একদিনের ক্রিকেটে যে ব্যাটিংটা করছিল এতকাল, সেটা গত শতাব্দীর ব্যাটিং। রোহিত আর শিখর ধাওয়ান যেভাবে ইনিংস শুরু করতেন – একজন মারতেন, আরেকজন ধরে ধরে খেলতেন – সেটা করা হত ১৯৯৬ বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত। সনৎ জয়সূর্য আর রমেশ কালুভিথরনা সেই ধারা বদলে দেন। শচীন-সৌরভ, সৌরভ-সেওয়াগ, শচীন-সেওয়াগ মান্ধাতার আমলের ছকে ফেরত যাননি। ২০০০ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ওঠা, ২০০২ ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়, ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা, ২০১১ বিশ্বকাপ জয় – এসবের পিছনে ভারতের ওপেনিং জুটির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

এদিকে বিশ্বজয়ী অধিনায়ক ধোনি নিজে ‘ফিনিশার’, বিশ্বাস করতেন যে কোনো জায়গা থেকে ম্যাচ জিতিয়ে দেবেন। সম্ভবত সে কারণেই ২০১২ সালে শচীন আর ২০১৩ সালে সেওয়াগের প্রস্থানের পর উইকেট হাতে রেখে খেলার নীতি তিনি চালু করেন। রোহিতের যতদিন বয়স ছিল, ধৈর্য আর রিফ্লেক্স দুটোই ভাল ছিল, ততদিন লম্বা ইনিংস খেলে পরের দিকে স্ট্রাইক রেটের ঘাটতি পুষিয়ে দিতেন। কোহলির তখন স্বাভাবিক খেলাতেই অতি দ্রুত রান হত। ওই ক্ষমতাই তাঁকে রান তাড়া করার রাজায় পরিণত করেছিল। তার প্রমাণ ২০১২ সালে হোবার্টে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে, ২০১৩ সালে জয়পুরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বা ২০১৭ সালে পুনেতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা ইনিংসে রয়েছে। ধোনিও সত্যিই শেষ লগ্নে যে কোনো রান তুলে দিতে পারতেন। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে ধোনির বড় শট নেওয়ার ক্ষমতা ক্রমশ কমে আসে। তাঁর মত রিফ্লেক্স-নির্ভর, চোখ আর হাতের সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল ব্যাটারের ক্ষেত্রে ওই বয়সে সেটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি ততদিনে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বশক্তিমান তারকা। বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? মহিন্দর অমরনাথ ২০১১ সালের শেষদিকে টেস্ট ক্রিকেটে বাঁধতে চেয়েছিলেন, ধোনির গডফাদার এন শ্রীনিবাসন তাঁকে হেলিকপ্টার শট মেরে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেন।

যা-ই হোক, ঘটনা হল দুই প্রান্ত থেকে দুটো নতুন বল আর আগাগোড়া পাওয়ার প্লের যুগে বেশি ঝুঁকি নিয়ে অনেক বেশি রান করাটাই ব্যাটিং। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সে খেলাই খেলছে গত এক দশক। তারাই জিতেছে বিশ্বকাপ, ভারত ২০১৩ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতার পর থেকে জিতেছে শুধু কিছু অর্থহীন দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। ধোনির বয়স যত বেড়েছে তিনি সত্যকে অস্বীকার করে সেই পুরনো খেলাই খেলে গেছেন এবং যে ম্যাচেই অন্য কেউ বড় শট নিতে পারেনি, সেখানে ধোনি শেষ অবধি ক্রিজে থেকেও ‘ফিনিশ’ করতে পারেননি। ওই চক্করে ২০১৯ বিশ্বকাপটাই ফিনিশ করে দিয়ে গেছেন। ধোনিভক্তরা আজও বীরবিক্রমে বলেন, মার্টিন গাপ্টিলের ওই থ্রোটা উইকেটে না লাগলেই নাকি…। অথচ ওই বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ধোনি শেষ ওভার পর্যন্ত ক্রিজে ছিলেন (৩১ বলে অপরাজিত ৪২), ভারত দুই কি পাঁচ রানেও নয়, ৩১ রানে হেরেছিল। ওই ম্যাচের স্কোরকার্ডের দিকে তাকালেই দুই দলের ব্যাটিং ভাবনার তফাতটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায় এবং ওই ভাবনাই যে তফাত গড়ে দিচ্ছে তাও স্পষ্ট বোঝা যায়।

২০১৯ সালের পর থেকে কোহলি, রোহিতেরও বয়স বাড়ছে। পাওয়ার প্লের নিয়ম বদলাচ্ছে, আরও বেশি রান উঠছে। রোহিত তো ধোনির আমলে ইনিংস শুরু করার সময় থেকে বরাবরই প্রথমে রক্ষণ, পরে আক্রমণ নীতিতে খেলে এসেছেন। সেভাবেই তিনবার দ্বিশতরান করেছেন। তিনি বদলাবেন কেন? এদিকে কোহলিরও ক্ষমতা কমছে। যত কমছে তিনি তত সাবধানী হচ্ছেন। আজকের একদিনের ক্রিকেটে ঝুঁকি না নিলে কোহলির দরের ব্যাটার রোজ অর্ধশতরান করতে পারেন। তাও মাঝে তিন-চার বছর তাঁর সব ধরনের ক্রিকেটেই সময় খারাপ যাচ্ছিল। পঁচিশ ইনিংস পরে একদিনের ক্রিকেটে শতরান এল গত বছর ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। মনে রাখা ভাল, সিরিজটা ভারত আগেই হেরে গিয়েছিল। কোহলির শতরানটা আসে সিরিজ হেরে যাওয়ার পরের ম্যাচে। অতঃপর কোহলি ছন্দে ফিরেছেন, বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হলেন। কিন্তু দেখা গেল তিনি ধোনিসুলভ সাবধানী ব্যাটিং করছেন। ধোনির চেয়ে কোহলি অনেক উঁচু দরের ব্যাটার, তাছাড়া নামেনও অনেক আগে। তাই রান করছেন বেশি, কিন্তু দ্রুত রান তোলার দায়িত্ব অন্য কাউকে নিতে হচ্ছে। ফাইনালে সে দায়িত্ব রাহুল পালন করতে পারেননি। পরিসংখ্যান বলছে, ফাইনালে প্রথম দশ ওভারের পরে ভারত মাত্র চারটে চার মেরেছে। ২০০৫ সালের পর পুরুষদের একদিনের ম্যাচে এটা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এই ব্যাটিং কোনো ম্যাচ জেতাতে পারে না, বিশ্বকাপ ফাইনালে জেতা তো অসম্ভব। এমন ইনিংসে মহাতারকা পঞ্চাশ, একশো যা-ই করুন; কী এসে যায়?

সত্যিকারের বিশ্লেষণ করলে স্বীকার করতে হবে, ফাইনালে ভারতকে হারিয়েছে মিডল অর্ডার ব্যাটিং। বোলিং নয়। বস্তুত, গত চার-পাঁচ বছরে ভারতীয় বোলাররা টেস্টে এবং একদিনের ক্রিকেটে এত বেশি হারা ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছেন যে ব্যাটারদের এরকম মন্থর ব্যাটিং, সার্বিক ব্যর্থতা – সবই ঢেকে গেছে বারবার। এবারের ইংল্যান্ড ম্যাচও অমন হইহই করে জেতার কথা নয় ওই কটা রান নিয়ে। কিন্তু ঐন্দ্রজালিক জুটি শামি-বুমরা ফর্মে থাকলে সবই সম্ভব। তার উপর আছেন মহম্মদ সিরাজ আর রহস্যময় কুলদীপ যাদব, যাঁর কোনটা গুগলি আর কোনটা সাধারণ লেগ ব্রেক তা বুঝতে ফাইনালে ট্রেভিস হেড আর মারনাস লাবুশেনের আগে পর্যন্ত সব দলের ব্যাটাররা হিমশিম খেলেন। এঁদের সঙ্গে রবীন্দ্র জাদেজা। কিন্তু এঁরা কোনোদিন ব্যর্থ হবেন না এমন দাবি করা চলে না। তাই হাতে রান থাকা দরকার। কথাটা আর কেউ না বুঝুক, অধিনায়ক রোহিত বুঝেছিলেন। তাই বিশ্বকাপে এসে নিজের ব্যাটিং বদলে ফেললেন। কিন্তু দলের সবচেয়ে বড় তারকাকে বদলানোর সাধ্য তাঁরও নেই। কোহলি ঠিক তিনটে শতরান সমেত ৭৬৫ রান করলেন। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপের প্রথম দশজন রান সংগ্রাহকের মধ্যে একমাত্র তাঁর আর রাহুলের স্ট্রাইক রেটই একশোর নিচে

অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে জেতাল হেড আর লাবুশেনের চতুর্থ উইকেট জুটি, ভারতকে হারাল কোহলি আর রাহুলের শম্বুক গতির চতুর্থ উইকেট জুটি। অথচ ভারত এমন আজব দেশ, তারকা সাংবাদিক থেকে ফেসবুক পণ্ডিত – সকলে এখনো প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, রোহিত কেন ওই শটটা খেলতে গেল? ফাইনালে কেউ ওরকম খেলে? সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে ফাইনালে রোহিত ওই ব্যাটিং না করলে অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্যটা আরও কম হত, ম্যাচটা আরও আগে শেষ হত।

তারকা থেকে ক্রিকেটপ্রেমী – গোটা বাস্তুতন্ত্রের গোঁড়ামি না কাটলে ভারতীয় ক্রিকেট, দেশটার মতই, পিছন দিকে এগোতে থাকবে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

শুধু কুস্তির পদক নয়, দেবতার গ্রাসে আজ সবার সন্তান

যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি, তেমন এম সি মেরি কম আর পিটি ঊষা। তাঁরা নিজেদের পদক জেতার কষ্ট বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সহখেলোয়াড়দের কষ্ট যে বোঝেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে।

অলিম্পিক নয়, এশিয়ান গেমস নয়, কমনওয়েলথ গেমস নয়, এমনকি সাফ গেমসও নয়। স্রেফ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জেতা একখানা পদকের পিছনেও কত বছরের পরিশ্রম, কত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ত্যাগস্বীকার থাকে তা যে কোনো ক্রীড়াবিদকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। আরও বেশি করে টের পাওয়া যায় একটুর জন্য পদক জিততে পারেননি যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে। প্রয়াত মিলখা সিং জানতেন, কলকাতার ছেলে জয়দীপ কর্মকার জানেন, আগরতলার মেয়ে দীপা কর্মকারও জানেন সারাজীবনের পরিশ্রমের পর তীরে এসে তরী ডুবলে কেমন লাগে। অথচ গোটা দুনিয়ায় চতুর্থ হওয়াও সারাজীবনের সাধনা ছাড়া সম্ভব নয়।

সেই ১৮৯৬ সালে শুরু হয়েছিল আধুনিক অলিম্পিক। সোয়াশো বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। অথচ হকি দলের পদকগুলো বাদ দিলে কতজন ভারতীয় অলিম্পিক পদক জিতেছেন তা আজও এক হাতের কড়ে গুনে ফেলা যায়। এ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় যে ১৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে শ্যানন মিলার একটা অলিম্পিক থেকেই পাঁচটা পদক জিতে নেবেন বা একা মাইকেল ফেল্পসের আলমারিতেই থাকবে প্রায় আড়াই ডজন অলিম্পিক পদক। দেশটা চীনও নয় যে ছোটবেলা থেকে পদকজয়ী অলিম্পিয়ান তৈরি করতে যত্ন নেবে দেশের সরকার। এমন দেশের ক্রীড়াবিদরা যখন ঠিক করেন আন্তর্জাতিক স্তরে জেতা পদক জলে ফেলে দেবেন, তখন বুঝতে হবে পৃথিবীর সব রং মুছে গেছে তাঁদের চোখের সামনে থেকে। সূর্য নিভে গেছে।

‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় যে মা রাগের মাথায় সন্তানকে বলে ফেলেছিলেন “চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে”, নিজের কথা কানে যেতে যে অনুতাপবাণে তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠেছিল, একজন পদকজয়ী ক্রীড়াবিদের “মেডেল গঙ্গায় ফেলে দেব” বলার সময়ে তার চেয়ে কম যন্ত্রণা হয় না। কারণ একটা পদক জিততে হলে সন্তান পেটে ধরার মতই দীর্ঘ শারীরিক ও মানসিক বেদনা সহ্য করতে হয়। ভারতের কুস্তিগীররা, বিশেষ করে মহিলা কুস্তিগীররা, আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তা বুঝতে চাইলে আগে এই কথাটা স্পষ্ট বোঝা দরকার।

ক্রীড়াবিদরা সফল হওয়ার পরে সমস্ত আলো তাঁদের উপর এসে পড়ে। সাফল্যের পথটার উপরে আলো ফেলা হয় না সচরাচর। ফলে স্বীকার্য যে পদক জয়ের সলতে পাকানোর পর্ব খুব বেশি মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু যাঁরা মতি নন্দীর কাহিনি অবলম্বনে সরোজ দে পরিচালিত কোনি বা শিমিত আমীন পরিচালিত চক দে ইন্ডিয়া দেখেছেন, তাঁদের বলে দিতে হবে না যে স্রেফ প্রতিভায় চিঁড়ে ভেজে না। পেশাদার খেলোয়াড়ের জীবন বস্তুত ব্যথার পূজা। এমন ভয়ঙ্কর ব্যথা, যে খেলার জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা কিছু ফিল্ম সমালোচকের মনে হয়েছিল, গীতা ও ববিতা ফোগত এবং তাঁদের বাবা মহাবীর ফোগতের জীবন নিয়ে তৈরি দঙ্গল ছবিতে নারীত্বের অবমাননা দেখানো হয়েছে। মহাবীর মেয়েদের উপরে নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়েছেন, সেখানে ‘ফিমেল এজেন্সি’-র অভাব ইত্যাদি। এঁরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁশ নিয়ে তাড়া করার দৃশ্য সম্পর্কে কী ভাবেন কে জানে! যা-ই ভাবুন, পৃথিবীর সমস্ত ক্রীড়াবিদের সাফল্য ওই পথেই এসেছে। নির্মম মমতা ছাড়া সফল ক্রীড়াবিদ হওয়া যায় না।

তাহলে ভাবুন, পছন্দের খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে, নিজের বয়সী আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মত আনন্দ ফুর্তি বাদ দিয়ে, কোচের চোখরাঙানি হজম করে, খাটতে খাটতে আধমরা হয়ে গিয়ে যে পদক জেতেন একজন ক্রীড়াবিদ – সেই পদক বিসর্জন দিতে চান কোন অসহায়তায়।

ভিনেশ ফোগত, সঙ্গীতা ফোগত, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়ারা সেই অসহায়তায় পৌঁছেছেন। আপাতত হরিয়ানার কৃষক নেতাদের অনুরোধে গঙ্গায় পদক বিসর্জন দেওয়ার পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু কী হবে পাঁচদিন পরে?

হবে অশ্বডিম্ব – এই মনোভাব নিয়েই এই ইস্যুতে এখন পর্যন্ত চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তাই এই চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়েছে আমাদের কুস্তিগীরদের। সাধারণভাবে একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশের ক্রীড়াবিদদের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, ভারতের ক্রীড়াবিদদের ঘাড়ে সেসব তো আছেই। আছে একগাদা উপরি পাওনাও। বরাবরই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের মেজাজ মর্জি অনুযায়ী চলতে হয় তাঁদের। দেশের আর সবকিছুর মত খেলার জন্য বরাদ্দ টাকাও চলে যায় কর্মকর্তাদের পকেটে। আর কিছু মনে না থাকলেও কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি আর সুরেশ কালমাদির কথা কার না মনে আছে? ফলে অনেকেরই ধারণা ছিল, প্রাক্তন খেলোয়াড়দের খেলা চালানোর দায়িত্ব দিলে সব ম্যাজিকের মত বদলে যাবে। ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি, ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের দুর্নীতি – সবই আদালত পর্যন্ত গড়ানোর ফলে এসে পড়েছিল সেই সুযোগ। কিন্তু মোদী সরকারের আমলে দেখা গেল, রাজনীতিবিদদের বশংবদ প্রাক্তন খেলোয়াড়রা কিছু কম যান না। যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি, তেমন এম সি মেরি কম আর পিটি ঊষা। তাঁরা নিজেদের পদক জেতার কষ্ট বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সহখেলোয়াড়দের কষ্ট যে বোঝেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে।

ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে প্রথম যখন লাগাতার যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন ভিনেশ, সাক্ষীরা – তখন একটা ওভারসাইট কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছিল, যার কর্ণধার ছিলেন মেরি কম এবং আরেক অলিম্পিক পদকজয়ী কুস্তিগীর যোগেশ্বর দত্ত। সেই কমিটি অশ্বডিম্বই প্রসব করেছিল। নইলে যন্তর মন্তরে ধরনায় বসতেই হত না সাক্ষীদের।

মেরি কম, ঊষারা একে খেলোয়াড় তায় মহিলা। তবু তাঁরা যৌন হয়রানির অভিযোগকে পাত্তা দিচ্ছেন না, ভিনেশদের চোখের জলের দাম তাঁদের কাছে মিনারেল ওয়াটারের চেয়ে বেশি নয়। হয়ত ব্রিজভূষণের মত তাঁরাও মনে করেন ওসব পদকের দাম ১৫ টাকা। নতুন সংসদ ভবনের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন নির্বিঘ্ন করতে কুস্তিগীরদের উপর পুলিসি আক্রমণ সম্পর্কে তাঁদের নীরবতা, ব্রিজভূষণের প্রতি মৌন সমর্থন প্রমাণ করে ক্ষমতার মদের নেশা অন্য সব নেশার চেয়ে কড়া। হাজার হোক, মেরি কম মণিপুরের নির্বাচনে বিজেপির তারকা প্রচারক ছিলেন। যোগেশ্বর তো রীতিমত বিজেপি দলের সদস্য। অর্থাৎ ভারতের ক্রীড়াপ্রেমীদের অরাজনীতির সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।

কুস্তিগীরদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকেরও রাজনীতি ব্যাপারটা প্রবল অপছন্দ। তাঁরা কোমলমতি। শাসক দলের সাংসদ যৌন হয়রানির একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও গ্রেফতার হন না, সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ না করলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা ধরনায় না বসলে এফআইআর পর্যন্ত দায়ের হয় না। তবু বিরোধী দলের নেতারা কুস্তিগীরদের পাশে দাঁড়ালে কোমলমতি ক্রীড়াপ্রেমীরা নাক কোঁচকান। তাঁদের জন্য উল্লেখ থাক, আজকের অপমানিত কুস্তিগীররা কিন্তু কখনো অরাজনৈতিক ছিলেন না। ২০১৪ সালের পর থেকে চালু হওয়া ধারা অনুযায়ী তাঁরা সোশাল মিডিয়ায় মোদী সম্পর্কে এবং তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ছিলেন দীর্ঘকাল। হিন্দুত্বের রাজনীতিও তাঁদের অনেকেরই পছন্দের। মে মাসের গোড়ার দিকেও বজরং ইনস্টাগ্রামে বজরং দলকে সমর্থন করে পোস্ট করেছিলেন, পরে মুছে দেন।

তা বলে বজরংদের এই আন্দোলনকে বাঁকা চোখে দেখার কোনো কারণ নেই। হরিয়ানার রক্ষণশীল, খাপ পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রিত সমাজ থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের ফ্যাসিবাদের ক্রীড়নক হয়ে যাওয়া খুব আশ্চর্যের নয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের জাতিভুক্ত এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী সৌরভেরই যদি অমিত শাহের অনুগ্রহে আপত্তি না থাকে তো বজরংদের দোষ কী? কে লড়ছেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন দাবিতে লড়ছেন। যে দেশের মেয়েদের ছোট থেকে নিকটাত্মীয়ের হাতে যৌন হয়রানি অভ্যাস করে নিতে হয়, ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর অত্যাচারিত মেয়েটির পরিবার লোকলজ্জায় মুখ লুকোয় – সে দেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহিলা ক্রীড়াবিদরা তাঁদের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন; পাশে রয়েছেন পুরুষ ক্রীড়াবিদরা – একে ঐতিহাসিক বলে মানতেই হবে। কর্পোরেট পেশাদার মহিলারাও জানেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগুলো বহু জায়গাতেই এখনো দায়সারা। এই আন্দোলন তেমন অনেক কর্তৃপক্ষকেই তটস্থ করে তুলছে। ইতিমধ্যেই এসে পড়েছে কুস্তির আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থার হুঁশিয়ারি।

আরও পড়ুন কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

বিজেপির রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির চেয়ে এসব অনেক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। যদিও রাকেশ ও মহেশ টিকায়েতের মত খাপ পঞ্চায়েতের নেতার উপস্থিতি, বরাবরের বিজেপি সমর্থক ফোগত পরিবারের প্রধান মহাবীরের বিবৃতি এবং হরিয়ানার বিজেপি নেতাদের উল্টো গাওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এ ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে। মোদীর দেবতাপ্রতিম ভাবমূর্তি বিশেষ কাজে আসছে না।

অনির্বাচিত মনুবাদী সাধুসন্তরা ঢুকে পড়েছেন ভারতের সংসদে, অযোধ্যার মহন্তরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে যে আইন (Protection of Children from Sexual Offences Act, 2012) আছে তা বদলানোর দাবিতে সভা করতে চলেছেন ব্রিজভূষণের সমর্থনে। বলা বাহুল্য, তাঁদের কথার ওজন আজকের ভারত সরকারের কাছে অসীম। ফলে সরকার যে তাঁদের প্রণাম জানিয়ে অর্ডিন্যান্স এনে আইন বদলে ফেলবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ঘটলে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পারবে আমাদের সকলের সন্তানের ধর্ষকরা। সুতরাং ভিনেশ, সাক্ষী, বজরংদের লড়াই এখন শুধু পদকজয়ী ক্রীড়াবিদদের লড়াই নয়, সমস্ত ভারতীয়ের লড়াই। সব মেয়েকে, সব শিশুকে দেবতার গ্রাস থেকে বাঁচানোর লড়াই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন?

এ দেশের ক্রিকেটমহল এখন ভীষণ ব্যস্ত। ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আইপিএল চলছে। নিজ নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। লখনৌ সুপারজায়ান্টস অধিনায়ক কে এল রাহুল তো এতটাই নিবেদিতপ্রাণ যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে গুরুতর চোট পাওয়ার পরে হার নিশ্চিত জেনেও দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। অতঃপর চোটের প্রভাবে বাকি টুর্নামেন্টে আর খেলতে পারবেন না, সামনের মাসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলতে পারবেন না। এমন বীরত্বের জন্যই তো জাতীয় নায়কের মর্যাদা পান ক্রিকেটাররা। মুশকিল হল, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পদকজয়ী কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগত এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁর দাবি, মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন আক্রমণের অভিযোগে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, ক্রিকেটারদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।

গত ২৮ এপ্রিল ভিনেশ বলেন, ক্রিকেটারদের তো আমাদের দেশে পুজো করা হয়। তাঁরা আমাদের পক্ষ যদি না-ও নেন, অন্তত একটা নিরপেক্ষ বার্তা দিয়েও তো বলতে পারেন যে দোষীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কেবল ক্রিকেটার নয় অবশ্য, সব খেলার তারকাদের কাছেই আবেদন ছিল ভিনেশের। তারপর থেকে অভিনব বিন্দ্রা আর নীরজ চোপড়া – ভারতের ইতিহাসে যে দুজন অলিম্পিকে ব্যক্তিগত সোনা জিতেছেন, দুজনেই ওই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। সদ্যপ্রাক্তন টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাও দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের বিশেষ হেলদোল নেই। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র মহিলাদের জাতীয় দলের শিখা পাণ্ডে মুখ খুলেছেন। সদ্য চালু হওয়া মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে দামী ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধনার কোনো বক্তব্য নেই। জাতীয় দলের অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌরও চুপ। প্রাক্তনদের মধ্যে হরভজন সিং, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ইরফান পাঠান সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। একমাত্র নভজ্যোৎ সিং সিধু সশরীরে ভিনেশ, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল কপিলদেব ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কবে ন্যায়বিচার পাবে?

স্পষ্ট বক্তা হওয়ার জন্য যাঁর বিপুল খ্যাতি, সেই বিরাট কোহলি স্পিকটি নট। যাবতীয় বাহাদুরি গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে খরচ করছেন। নারীবাদীরা প্রায়শই বিরাটকে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়েন তিনি জীবনে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার অবদান স্বীকার করেন বলে, তাঁর ব্যর্থতায় ট্রোলরা অনুষ্কাকে টার্গেট করলে বিরাট মুখ খোলেন বলে। দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে বিরাটই একমাত্র পুরুষ যিনি নিজের বউকে ভালবাসেন। তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেন একমাত্র অস্কার মঞ্চে বউকে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্রিস রককে ঘুঁষি মেরে দেওয়া উইল স্মিথ। দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি বিরাটের ভালবাসা আমাদের পাড়ার রানাদার পর্ণা বউদির প্রতি ভালবাসার চেয়ে মহত্তর কিছু মোটেই নয়। বরং হয়ত কিছুটা নিকৃষ্টতরই। কারণ রানাদা রাস্তাঘাটে অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে কাউকে বিশ্রীভাবে কথা বলতে দেখলে অন্তত একটু ধমকা-ধমকি করেন। কিন্তু দেশের লাঞ্ছিত মহিলা কুস্তিগীরদের নিয়ে বিরাটের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

মনে রাখা ভাল, অনুষ্কা নিজেও কম নারীবাদী নন। তিনি একদা সুনীল গাভস্করের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন, কারণ গাভস্কর বলেছিলেন অনুষ্কার বোলিংয়ে অনুশীলন করে বিরাটের লাভ হবে না। সেই অনুষ্কাও আজ চুপ। চুপ মানে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। দুটিতে কেমন জীবন উপভোগ করছেন তার তত্ত্বতাল্লাশ দিব্যি দিয়ে যাচ্ছেন টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে। তবে গাভস্করের বিরুদ্ধে লম্বা বিবৃতি দিয়েছিলেন, অলিম্পিয়ান মহিলাদের প্রতিবাদ নিয়ে এক লাইনও লেখেননি। অবশ্য পরীক্ষায় আনকমন প্রশ্ন এসে গেলে আমরাও সে প্রশ্ন ছেড়ে আসতাম।

গম্ভীর আবার দিল্লি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। সেই দিল্লির যন্তর মন্তরেই কুস্তিগীরদের অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। যদিও ওই এলাকা গম্ভীরের কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবু তিনি একজন জনপ্রতিনিধি তো বটেন। অবশ্য উনি সাংসদের দায়িত্ব খুব মন দিয়ে কোনোদিন পালন করেছেন বলে অভিযোগ নেই। উনি সারাবছর ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিয়ে বেড়ান, আইপিএলের সময়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকেন। কদিন পরে হয়ত ওই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সারাবছরই বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াবেন। কারণ লখনৌ সুপারজায়ান্টসে তাঁর পদটির নাম গ্লোবাল মেন্টর, আর ওই ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকরা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার টি টোয়েন্টি লিগে দল কিনে বসে আছেন। আর কোথায় কোথায় কিনবেন কে বলতে পারে? এমন বিশ্বনাগরিকের কি আর যন্তর মন্তরের অবস্থান বিক্ষোভ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কূপমণ্ডূকতা মানায়?

পিভি সিন্ধু, সায়না নেহওয়ালদেরও মুখে কুলুপ। ছবারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মেরি কম তো পিটি ঊষা গোত্রের, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির অতি ঘনিষ্ঠ, তাই নীরব। গত কয়েকদিন অবশ্য তাঁর রাজ্য মণিপুরে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। বিজেপি তাঁকে এত গুরুত্ব দেয় যে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজনাথ সিংকে ট্যাগ করে বলতে হচ্ছে “মাই স্টেট ইজ বার্নিং, কাইন্ডলি হেল্প”। যে নিখাত জারীনকে একসময় স্রেফ জ্যেষ্ঠত্বের অধিকারে অবজ্ঞা করতেন মেরি, সেই দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিখাত কিন্তু সরব হয়েছেন।

প্রাক্তন সাংসদ ভারতরত্ন ‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ডাগআউটে নিদ্রা গিয়েছেন। তিনি অবশ্য কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন? তবু তো দয়া করে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে মুখ খুলেছেন। লর্ডসের ব্যালকনির চিরস্মরণীয় ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে ভারী বিনীতভাবে বলেছেন, ওদের লড়াই ওরা লড়ুক। আমি তো খবরের কাগজে পড়ছি, যা জানি না তা নিয়ে তো কথা বলা উচিত নয়।

এদিকে শচীন, সৌরভ দুজনেই কন্যাসন্তানের পিতা।

সত্যি কথা বলতে, ভারতীয় তারকা খেলোয়াড়দের যা ইতিহাস, তাতে এঁরা মহম্মদ আলি হয়ে উঠবেন বলে কেউ আশা করে না। সাম্প্রতিক অতীতে তাঁরা কিন্তু সাতে পাঁচে না থাকার নীতি অনেকটাই ত্যাগ করেছেন। ওঁরা এখন শচীন বা ঊষার মত শাসক দলের প্রসাদ গ্রহণ করে রাজ্যসভার সদস্য হচ্ছেন, এ পদ সে পদ গ্রহণ করছেন, গম্ভীরের মত ভোটে লড়ে সাংসদ বা বিধায়কও হচ্ছেন। যাঁদের অত এলেম নেই তাঁরাও কোহলির মত করে নোটবন্দি হওয়া মাত্রই তা কত বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ তা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলন চলাকালীন তার বিরোধিতা করে টুইট করেছিলেন। সেওয়াগের মত কেউ কেউ আরও এককাঠি সরেস। শহিদ হওয়া সৈনিকের মেয়েকে যুদ্ধবিরোধী কথা বলার জন্য ট্রোল করতেও ছাড়েননি। কেবল সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দরকার পড়লেই এঁরা কেউ নীরব হয়ে যান, কেউ এক-দু লাইনে কাজ সারেন। সেওয়াগ, কপিলদেব, হরভজন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মানুষ। কুস্তিগীরদের আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন হরিয়ানার কুস্তিগীররাই। তা না হলে এতেও ওই তিন প্রাক্তন মুখ খুলতেন কিনা সন্দেহ।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

যে পদকজয়ী অলিম্পিয়ানরা আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপি-ঘনিষ্ঠই ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে বা জয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করতে এঁদেরও কামাই ছিল না। এখন চোখের জলে সেসবের দাম দিতে হচ্ছে। এখনো যে মহাতারকারা নীরব, তাঁদের দেখে একটাই ভয় হয়। জার্মান যাজক মার্টিন নিয়মোলারের অনুসরণে এঁদের না কোনোদিন আওড়াতে হয়, প্রথমে ওরা এসেছিল কুস্তিগীরদের জন্যে। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কুস্তিগীর নই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

বাঙালি কাহারে কয়, সে কি কেবলি সৌরভময়?

ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল।
সেই ভুলটুকু বেঁচে থাক
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।

অন্নদাশঙ্কর রায় এসব লিখেছেন বহুকাল হয়ে গেল। কিন্তু আজও কলকাতা ও তার শহরতলির ভদ্রজন বলে থাকেন “বাঙালি আর মুসলমান”। বোঝা শক্ত নয় যে বাঙালি বলতে তাঁরা বোঝেন হিন্দু বাংলাভাষীদের। মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গের কাগজ, টিভি, এমনকি সরকারও চালান মূলত কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের ভদ্রজনই। কোনটা বাঙালি ভাবাবেগকে আহত করে (ইদানীং আবার ভাবাবেগ না লিখে অস্মিতা লেখা চালু হয়েছে), কোনটা করে না তাও ঠিক করে দেন ওঁরাই। ফলে শেষমেশ দেখা যায় বাঙালি বলতে সব বাঙালি হিন্দুও নয়, কেবল তাঁদেরই বোঝাচ্ছে। সুতরাং দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের সময়ে মাল নদীতে হড়পা বান এসে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি হলে বাঙালির ভাবাবেগ আহত হয় না, কলকাতায় ড্যাং ড্যাং করে কার্নিভাল চলে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নামক এক লাভজনক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদ বেহালার গাঙ্গুলিবাড়ির ছোট ছেলেটির হাতছাড়া হলে বাঙালির ভাবাবেগ এতদূর আহত হয়, যে মুখ্যমন্ত্রীকে ময়দানে নামতে হয়। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে বলতে হয়, মহারাজকে সম্মান দিতে চাইলে শাহরুখ খানকে সরিয়ে তাঁকেই রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করুন না। বামপন্থীরাও বলেন, এসব হল দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে বিজেপির কুক্ষিগত করার চক্রান্ত। কেন সব রাজনৈতিক দলকেই কিছু না কিছু বলতেই হয়? কারণ নজরুল-টজরুল আজকাল আর কে পড়ে? এখন বাঙালি বলতে একজন আছে – সৌরভ গাঙ্গুলি।

অর্থাৎ বাঙালি মানে দাঁড়াল কলকাতা ঘেঁষা ভদ্রজন। তাঁদের আবেগ জড়িত বলেই তো ইস্টবেঙ্গল আইএসএলে দল নামাতে পারল কিনা তা মুখ্যমন্ত্রীকে তদারক করতে হয়, কিন্তু মহমেডান স্পোর্টিং থাকল কি উঠে গেল তা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা থাকে না। দু-একদিন হইচইয়ের পরেই সংবাদমাধ্যম এবং ক্রীড়াপ্রেমীদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যান জাতীয় গেমসে ফুটবলে সোনা জয়ী বাংলা দলের ফুটবলাররা। দুদিন দুরাত ট্রেনে করে ফিরতে না হলে আদৌ তাঁদের নিয়ে কেউ আলোচনা করত কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। একই কারণে জাতীয় গেমসে বাংলা কোথায় শেষ করল, কেন করল – সেসব নিয়ে রাজ্যের সর্বাধিক প্রচারিত খবরের কাগজগুলোতে কয়েক সেন্টিমিটার জায়গাও খরচ করা হয় না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অমিত শাহের প্রসাদে ক্রিকেট বোর্ডের সর্বোচ্চ পদে বসে থাকা সৌরভ কত বড় বঞ্চনার শিকার হলেন তা নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয় একেবারে প্রথম পাতায়।

ঘটনাচক্রে সৌরভ যে বছর ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হলেন সে বছরই অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বাঙালি বলে দাবি করতে উৎসাহের খামতি হয়নি জনমত গঠনকারী বাবুদের। সে তবু একরকম, কিন্তু বাঙালি ভাবাবেগ এত সহজপাচ্য যে কলকাতার ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে অভিজিৎ আর সৌরভকে বাঙালির গর্ব হিসাবে পাশাপাশি রেখে হোর্ডিং টাঙিয়েছিল কে বা কারা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সমাজবিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদত্ত পৃথিবীর সেরা পুরস্কার অর্জনের কৃতিত্ব কী করে এক ব্যবসায়িক সংস্থার আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ছক্কা পাঞ্জায় সফল হয়ে পাওয়া চেয়ারের সমান হয়, তা বাঙালিই জানে। কিন্তু কী আর করা যাবে? মহাজনেরা দেগে দিয়েছেন, বাঙালি বলতে একজনই আছে।

দাগানোর কাজটা আজ হয়নি, হয়েছে সৌরভের খেলোয়াড় জীবনেই। লর্ডসে টেস্ট অভিষেকের পর থেকে কোনো ম্যাচে প্রথম একাদশ থেকে সৌরভ বাদ গেলেই বাংলায় বসে মনে হত নেতাজি সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হওয়ার পরে এত বড় অন্যায় আর কোনো বাঙালির সঙ্গে করা হয়নি। আজকের মুখ্যমন্ত্রী সৌরভকে পদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান, আগের সরকারও কিছু কম যেত না। ১৯৯৭ সালে ঢাকায় ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ফাইনালে সৌরভ একটি অবিস্মরণীয় ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর প্রকাশ্য সংবর্ধনার আয়োজন করে। অবাক কাণ্ড! জিতিয়েছেন একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল, বিশ্বকাপ ফাইনাল নয়। তার জন্যে সরকারি সংবর্ধনা পাওয়ার সৌভাগ্য পৃথিবীর কজন ক্রিকেটারের হয়েছে বলা মুশকিল। অন্তত শচীন তেন্ডুলকরের যে হয়নি তা হলফ করে বলা যায়। তিনি পরের বছরেই শারজায় প্রায় একক কৃতিত্বে একই সপ্তাহে দুবার স্টিভ ওয়র অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ভারতকে খেতাব জেতান। এমন ব্যাট করেছিলেন যে ওয় বলেন ডন ব্র্যাডম্যানের পরে শচীনই সেরা। তবু কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার তাঁর বর্ণাঢ্য সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেনি।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

বাঙালি ক্রীড়াবিদকে বাংলার সরকার সম্মান জানিয়েছে – এর নিন্দা করলে আবার অনেকে রেগে যেতে পারেন। পক্ষ সমর্থনে এমনও বলা যেতে পারে, যে বাঙালিদের মধ্যে থেকে তো আর মুম্বাইয়ের মত কাঁড়ি কাঁড়ি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার বেরোয় না, আমাদের সবেধন নীলমণি সৌরভই আছেন। তাই আমরা, আমাদের সরকার একটু বাড়াবাড়ি করলে ক্ষতি কী? কথা হল, ক্ষতি কিছু হত না, যদি সব বাঙালি ক্রীড়াবিদ সম্পর্কেই এমন মহৎ চিন্তা গোটা বাংলার মানুষের এবং মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকারগুলোর থাকত। বাংলার রঞ্জি ট্রফি দলের সুলুকসন্ধান কজন বাঙালি রাখেন তার ঠিক নেই, কিন্তু কলকাতা নাইট রাইডার্স আইপিএল জিতলে ঘটা করে ইডেন উদ্যানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংবর্ধনার ব্যবস্থা হয়। সৌরভকে দল থেকে বাদ দিলে গেল গেল রব উঠত, এখন প্রশাসনিক পদে থাকতে না দিলেও বাঙালির জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ কলকাতার বৃত্তের বাইরের লোক, শিলিগুড়ির ছেলে ঋদ্ধিমান সাহা ফর্ম না হারিয়েও স্রেফ আহত হয়ে দলের বাইরে যাওয়ার জন্যেই যখন ভারতীয় দলে তাঁর জায়গা খোয়ালেন, তখন তেমন আলোড়ন উঠল না। উঠল তখন যখন ঋদ্ধিমানের স্থলাভিষিক্ত তরুণ ঋষভ পন্থ দুরন্ত ব্যাটিংয়ে তাঁর জায়গা পাকা করে ফেলেছেন, স্বভাবতই কোচ রাহুল দ্রাবিড় ঋদ্ধিমানের দীর্ঘ কেরিয়ারকে সম্মান করে আলাদা করে ডেকে বলে দিয়েছেন তাঁকে আর টেস্ট দলের জন্য ভাবা হবে না। হপ্তাখানেক কলকাতার সংবাদমাধ্যম ঋদ্ধিমানের প্রতি অবিচারের জন্য দ্রাবিড়কে খলনায়ক বানিয়ে অশ্রুপাত করল। আগে উচ্চবাচ্য করা হয়নি। সম্ভবত তার কারণ তখন খলনায়ক খুঁজতে হলে প্রথমেই স্বয়ং সৌরভের দিকে আঙুল তুলতে হত। কারণ তিনি তখন বোর্ড সভাপতি তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা ঋষভ আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালসের ক্রিকেটার আর সৌরভ সেই দলেরই পরামর্শদাতা ছিলেন বোর্ডকর্তা হওয়ার আগে পর্যন্ত।

ক্রিকেটিয় কারণে ঋদ্ধিমানের ভারতীয় দলের জন্য আর বিবেচিত না হওয়া তবু মেনে নেওয়া যায়, বোর্ড সভাপতি সৌরভ যে দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না সে কথাও না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু ঋদ্ধিমানের মত বর্ষীয়ান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড় তো বাংলার তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে অমূল্য সম্পদ হতে পারতেন। তাঁকে কেন ত্রিপুরায় চলে যেতে হল বাংলার ক্রিকেটকর্তাদের অপমানজনক ব্যবহারে? এ নিয়ে সরাসরি আঙুল ওঠা উচিত ছিল সৌরভের দিকে। তিনি বোর্ড সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের প্রতিনিধি হিসাবেই। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁর হস্তক্ষেপ করা বেআইনিও হত না। কিন্তু এসব পশ্চিমবঙ্গে কোনো আলোচনার বিষয়ই নয়। কারণ সম্ভবত সৌরভ যতটা বাঙালি, ঋদ্ধিমান ততটা বাঙালি নন।

এশিয়ান গেমসে হেপ্টাথলনে সোনা জয়ী স্বপ্না বর্মনও সৌরভের মত বাঙালি নন নিশ্চয়ই। নইলে স্বপ্নার মধ্যপ্রদেশে চলে যাওয়া আটকাতে মুখ্যমন্ত্রী নিজে আসরে নামলেন না কেন? কোথায় গেল বাঙালির ভাবাবেগ?

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

বিপুল ক্ষমতা ভোগ করেও মিস্টার বেচারা বাংলার সৌরভ?

সুযোগ পেলে যা ইচ্ছে তাই করতে প্রাক্তন খেলোয়াড়রা যে কম যান না তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফরাসি ফুটবলের কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনি।

পি সতশিবম আর রঞ্জন গোগোইয়ের বেশ নিন্দা হয়েছিল। কারণ তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে অবসর নেওয়ার পর যথাক্রমে কেরালার রাজ্যপাল আর রাজ্যসভার মনোনীত সদস্যের পদ গ্রহণ করেছিলেন। নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলই করি অপমান – এ কথার এমন জলজ্যান্ত উদাহরণ আমাদের দেশেও বিরল। সব পেশাতেই কিছু কাজ আছে যা বেআইনি না হলেও অশোভন বলে সাধারণত কেউ করেন না। যেমন মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর পাঞ্জাব বা অসমের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের টিকিটে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে যাননি। কাল মুখ্যমন্ত্রিত্ব চলে গেলে মমতা ব্যানার্জিও কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে তৃণমূলের মেয়র পদপ্রার্থী হবেন না সম্ভবত। কিন্তু সতশিবম আর গোগোই শোভনতার ধার ধারেননি। তাঁদের সিদ্ধান্তে ভারতের বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে প্রশ্ন আলাদা, কিন্তু ক্ষমতার জন্য তাঁরা কতখানি লালায়িত তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। স্বেচ্ছায় পদাবনতিও যে কারোর অভীষ্ট হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত হত। বিশ্বাস করা আরও সহজ করে দিলেন আমাদের ঘরের ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলি। আরও ছোট পরিসরে আরও ছোট একটা পদের জন্য তিনি ঝাঁপিয়েছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী তথা শক্তিশালী ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পদে প্রায় তিন বছর কাটানোর পর এখন তিনি ঘোষণা করেছেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের সভাপতি পদের প্রার্থী হবেন।

সৌরভ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে পৌঁছেছিলেন সিএবি হয়েই। কিন্তু সিএবির মসনদে তাঁকে বসিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। দীর্ঘদেহী সৌরভ খর্বকায় মুখ্যমন্ত্রীর পিছনে লক্ষ্মী ছেলের মত দাঁড়িয়ে আছেন আর মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বিশাল ছায়া দিয়ে সৌরভকে আড়াল করে সিএবি সভাপতি হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণা করছেন – এ দৃশ্য অনেকেরই এখনো মনে আছে। দুর্জনে বলে মুখ্যমন্ত্রী ওভাবে হাতে ধরে চেয়ারে বসিয়ে না দিলে সৌরভের পক্ষে সিএবি সভাপতি হওয়া শক্ত ছিল। কারণ খেলার মাঠে অধিনায়ক হিসাবে তিনি দলের মধ্যে যতটা জনপ্রিয় ছিলেন, মাঠের বাইরে বাংলার ক্রিকেট প্রশাসকদের মধ্যে ততটাই অপ্রিয়। কারণটাও সহজবোধ্য। সৎ বা দুর্নীতিগ্রস্ত যা-ই হোন, ময়দানে যাঁরা ক্লাব চালান তাঁরা বছরের পর বছর বহু সময় ব্যয় করে নিজেদের ব্যবসা বা চাকরির খানিকটা ক্ষতি করেই কাজটা করেন। সেই কাজের মধ্যে দিয়ে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে অ্যাসোসিয়েশনের রাজনীতিতে সফল হয়ে সিএবির পদাধিকারী হতে হয়। কথাটা বিশ্বনাথ দত্ত বা জগমোহন ডালমিয়ার মত প্রবাদপ্রতিম প্রশাসকদের ক্ষেত্রে যতটা সত্যি, একদা সিএবির যুগ্ম সচিব প্রয়াত শরদিন্দু পাল বা গৌতম দাশগুপ্তের ক্ষেত্রেও ততটাই সত্যি। তাঁরা যথাক্রমে কুমোরটুলি আর শ্যামবাজার ক্লাব চালিয়েছেন কয়েক দশক। অথচ সৌরভ সেসব কিছুই করলেন না। খেলা ছাড়ার পরের কয়েক বছর ধারাভাষ্য, বিজ্ঞাপনে মুখ দেখানো, টিভির পর্দায় দাদাগিরি করতে করতেই সিএবির যুগ্ম সচিব হয়ে গেলেন। তারপর স্রেফ মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদে ডালমিয়ার মৃত্যুর পর সিএবি সভাপতি হয়ে বসলেন।

সৌরভভক্তরা স্বভাবতই রেগে যাবেন, বলবেন খেলাটা যখন ক্রিকেট, তখন সৌরভ কত বড় ক্রিকেটার সেটাই তো আসল কথা। মাঠে অত বড় বড় কীর্তি যার, তাকেও প্রশাসনে আসতে হলে আগে ক্লাবের হেঁশেল ঠেলতে হবে – এ অন্যায় দাবি। শরদিন্দু, গৌতমরা ক্রিকেটের কী জানেন? কত হাজার রান আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে? তাঁদের মত দীর্ঘকাল লড়তে হবে কেন সৌরভকে? এই মনোভাব কেবল ভক্তদের নয়। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্সের প্রধান বিনোদ রাইও নবগঠিত বোর্ডের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার সময়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন সৌরভের মত মানুষ বোর্ড সভাপতি হলেন বলে। রাই বলেছিলেন সৌরভই ওই পদের পক্ষে যোগ্যতম। স্বাধীনতার আগে থেকে মূলত অক্রিকেটার লোকেদের দ্বারা চালিত ভারতীয় বোর্ডে যে পরিমাণ অব্যবস্থা এবং দুর্নীতি চলেছে, যার ফলে সুপ্রিম কোর্ট এন শ্রীনিবাসনকে পদচ্যুত করে বোর্ডের আমূল সংস্কার করার নির্দেশ দিয়েছিল, তাতে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের উপরে অত্যধিক ভরসা করা হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রাক্তন খেলোয়াড়রা প্রশাসনে এলেই প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হবে, স্বেচ্ছাচার চলবে না – এমনটা পৃথিবীর কোথাও প্রমাণিত হয়নি। সুযোগ পেলে যা ইচ্ছে তাই করতে প্রাক্তন খেলোয়াড়রা যে কম যান না তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফরাসি ফুটবলের কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনি। যদিও তিনি কোনো মুখ্যমন্ত্রীর প্রসাদে ফরাসি ফুটবল ফেডারেশনের সর্বোচ্চ পদে আসীন হননি, দস্তুরমত ফুটবল রাজনীতি করেই অতদূর উঠতে হয়েছিল। আসলে ফিফা প্রাক্তন খেলোয়াড় মানেই ঈশ্বরপ্রেরিত প্রশাসক – এমনটা বিশ্বাস করে না। প্রাক্তন ফুটবলারদের জন্য আলাদা করে জায়গা সংরক্ষণও ফিফার নীতিবিরুদ্ধ। সম্প্রতি যে যে কারণে ফিফা সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে নির্বাসন দিয়েছিল, তার অন্যতম হল সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্সের প্রস্তাবিত সংবিধানে প্রাক্তন ফুটবলারদের জন্য আলাদা করে পদের ব্যবস্থা। ফিফার সাফ কথা – প্রাক্তন ফুটবলার প্রশাসনে স্বাগত, কিন্তু তাকে আসতে হবে রাজ্য অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমেই। অর্থাৎ ফুটবলারকে প্রশাসক হয়ে উঠতে হবে, প্রাক্তন বলে প্রশাসনকে বাইপাস করা চলবে না।

সৌরভ যেরকম মসৃণভাবে অফ সাইডে ফিল্ডিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাউন্ডারি খুঁজে ফেলতেন, সেরকমভাবেই ক্ষমতায় পৌঁছনোর বাইপাস খুঁজে নেন। নবান্নে ধরনা দিয়ে সিএবি সভাপতি হয়েছিলেন, বোর্ড সভাপতি হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রসাদে। তাঁকে ওই পদে থাকতে দেওয়া হল না বলে এই মুহূর্তে ডান, বাম নির্বিশেষে বাঙালি ক্ষুব্ধ। সেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরে আর কোনো ঘটনায় বোধহয় বাঙালিকে এতখানি ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কার, যাঁর প্রসাদে বোর্ডের সভাপতি হওয়া গিয়েছিল, তাঁর বিরক্তিতেই পদ হাতছাড়া হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে তো সবিস্তারে লেখা হয়েছে, ৬ অক্টোবর গভীর রাতে অমিত শাহের বাড়িতে এক বৈঠকে ঠিক হয় সৌরভকে এবার সরিয়ে দেওয়া হবে। মজার কথা, সেখানে সৌরভের কার্যকলাপ নিয়ে নানা আপত্তি তোলেন শ্রীনিবাসন এবং উপস্থিত অন্য বোর্ডকর্তারা তাঁর কথায় সায় দেন। কোন শ্রীনিবাসন? যাঁর কুকীর্তির ফলে বোর্ডে ওলোট-পালট হয়ে সর্বোচ্চ আদালতের নজরদারিতে সংস্কার হয়েছিল। সেই শ্রীনিবাসন দেখা যাচ্ছে আজও যথেষ্ট ক্ষমতাশালী। কে বোর্ড সভাপতি হবে তা তিনি এখনো নির্ধারণ করতে পারেন। বস্তুত ২০১৯ সালে সৌরভের সভাপতি হওয়ার পিছনেও তাঁর সম্মতি ছিল। তাহলে কী লাভ হল লোধা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংস্কার করে? কী লাভ হল সৌরভের মত প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটার বোর্ড সভাপতি হয়ে?

সংবাদমাধ্যমে জোর জল্পনা, সৌরভকে নাকি অমিত শাহ সরিয়ে দিলেন তিনি বিজেপিতে যোগ দিতে রাজি হননি বলে। একথা পাতে পড়তে না পড়তেই ভারতের বিজেপিবিরোধী, উদারপন্থী মানুষ একেবারে টপ করে গিলে নিয়েছেন। সৌরভের কেমন শক্ত মেরুদণ্ড তা গ্রেগ চ্যাপেলের পর অমিত শাহও টের পেয়ে গেলেন ইত্যাদি মর্মে সোশাল মিডিয়া বিদীর্ণ করছেন অনেকেই। এরপর ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যদি সৌরভের দিদি তাঁকে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে প্রার্থী করে ফেলেন তাহলে ‘লিবারেল’ হিসাবে সৌরভের দর আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে। সকলে ইতিমধ্যেই ভুলে গেছেন, সৌরভ এতদিন চেয়ারে বসেছিলেন দেশের দু নম্বর বিজেপি নেতা অমিত শাহ ও তদীয় পুত্র জয় শাহের সৌজন্যেই। শুধু তা-ই নয়, বোর্ডের নতুন সংবিধান অনুযায়ী সৌরভের কার্যকাল সভাপতি হওয়ার দশ মাস পরেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বর্তমান কর্মকর্তাদের মেয়াদ বাড়ানো হোক – সুপ্রিম কোর্টে এই সংবিধানবিরোধী আর্জি জানিয়ে ফেভিকলের বিজ্ঞাপনের নেতার মত নিজ নিজ চেয়ারে এতদিন বসেছিলেন সৌরভ, জয়রা। সুপ্রিম কোর্ট এত ব্যস্ত যে সে আর্জির শুনানির দিন কেবলই পিছিয়েছে। আড়াই বছর পর গত মাসে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় (যিনি আগামী মাসে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করবেন) ও হিমা কোহলি রায় দিলেন, তিন বছর নয়, বোর্ড সভাপতি, যুগ্ম সচিব ও অন্যরা একটানা ছ বছর বহাল থাকতে পারবেন। অর্থাৎ ২০১৮ সালের রায়ের একেবারে উল্টো পথে হেঁটে নতুন সংবিধান বদলে অনেকাংশে পুরনো জায়গায় ফিরে যাওয়া হল। এ হেন ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়া সৌরভ আজ বাংলার চোখে মিস্টার বেচারা। এতটাই বেচারা যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলবেন, সৌরভকে যেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের পদের জন্য লড়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সৌরভের পদচ্যুতি বাঙালির জাতীয় সংকট। মুখ্যমন্ত্রী কি চুপ করে থাকতে পারেন?

তবে রবীন্দ্রনাথের পরে বাঙালিকে সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন যিনি, সেই সৌরভ দেখা যাচ্ছে কম রাবীন্দ্রিক নন। বিপদে মোরে রক্ষা করো, দিদির কাছে এ নহে তাঁর প্রার্থনা। তিনি চন্দ্রচূড়-কোহলির রায় নির্ঘাত খুঁটিয়ে দেখেছেন, আইনের ফাঁক খুঁজে ক্ষমতা ধরে রাখার বুদ্ধিতে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দুই প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সতশিবম আর গোগোইয়ের উপর দিয়ে যান। রায়ে বলা আছে, ক্রিকেট প্রশাসনের একেক স্তরে ছ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে কুলিং অফ পিরিয়ড থাকবে, স্তর বদলে গেলে নয়। ফলে সিএবি সভাপতি হয়ে তিনি আরও কিছুদিন নিশ্চিন্তে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন; বোর্ড সভাপতি হওয়ার পরে রাজ্য সংস্থার সভাপতি হওয়া দু-চারজনের যতই দৃষ্টিকটু মনে হোক।

এতে বাংলার ক্রিকেটের কী লাভ হবে সে প্রশ্ন অবান্তর। সৌরভ এর আগেও সিএবি সভাপতি ছিলেন, তাতে বাংলার ক্রিকেট কতটা উন্নত হয়েছে সে হিসাব কেউ দেন না। বোর্ড সভাপতি হয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের কেমন ছন্নছাড়া অবস্থা করে ছেড়েছেন তা তো চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। সাফল্য বলতে অতিমারীর মধ্যেও আইপিএল আয়োজন। অবশ্য আইপিএল চালানো ছাড়া অন্য কাজ আছে বলে হয়ত সৌরভ-জয় মনেই করেননি। তাই আইপিএল চালু ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চালু থাকা রঞ্জি ট্রফি বন্ধ ছিল। ওদিকে জাতীয় দলে বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত। বিরাট কোহলির অধিনায়কত্ব যাওয়া নিয়ে নাটক; বিরাট প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মা, সভাপতি সৌরভসুদ্ধ গোটা বোর্ডকে সাংবাদিকদের সামনে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলেন, কিন্তু কোনো শাস্তি হল না। সমস্ত ক্রিকেট খেলিয়ে দেশে জাতীয় দল ঘোষণা হলে তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন নির্বাচকরা। কে আহত, কাকে বাদ দেওয়া হল তা নিয়ে পরিষ্কার বিবৃতি দেন। ভারতেও বরাবর এমন ব্যবস্থাই চালু ছিল। সৌরভের আমলে সেসব উঠে গেছে। কে যে কখন বিশ্রাম নিচ্ছেন আর কে চোটের জন্য বাইরে থাকছেন তা বোঝা দুষ্কর। নানারকম খবর সংবাদমাধ্যমে ভাসতে থাকে আর যে ক্রিকেটপ্রেমীর যা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে তিনি তা-ই মেনে নেন।

আরও পড়ুন নিশীথিনী-সম

সৌরভের নিজের আচরণও প্রশ্নের ঊর্দ্ধে নয়। বোর্ড সভাপতির বিজ্ঞাপনী মডেল হওয়া ক্রিকেট-পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য। তাও আবার বোর্ডের সাথে স্পনসরশিপ চুক্তিতে আবদ্ধ সংস্থার প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার বিজ্ঞাপনে। এসব প্রশ্ন গত তিন বছরে বোর্ডের সভায় উঠেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ সৌরভের ঢাল ছিলেন জয় শাহ। তাছাড়া যে দেশে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং অমুক কোম্পানি, তমুক কোম্পানির বিজ্ঞাপন আলো করে খবরের কাগজগুলোর প্রথম পাতায় বসতে পারেন, সেখানে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতিকে আটকাবে কে?

এইভাবে দুহাতে কামানো সৌরভ বাংলার আপামর মানুষ ও মুখ্যমন্ত্রীর চোখে আজ বঞ্চিত, নিপীড়িত। সেই নিপীড়নের অবসান হবে কী হলে? সৌরভকে বিশ্বক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থার প্রধানের নির্বাচনে প্রার্থী হতে দিলে। তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে সৌরভের হয়ে আর্জি জানিয়েছেন। ক্রিকেটের এহেন গণতন্ত্রীকরণ গভীর আশাব্যঞ্জক। বোর্ডটা তুলে দিয়ে সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের হাতে দিয়ে দিলে হয় না? সংসদে তো আজকাল রাজনৈতিক বিতর্ক বিশেষ হয় না। না হয় ক্রিকেট দল নির্বাচনটা ওখানে হবে।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

বিরাট, রোহিত, রাহুলদের সত্য রচনা চলছে চলবে

টি টোয়েন্টিতে যে সেট হওয়ার সময় নেওয়া চলে না, সেকথা এঁদের বলবে কে? বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলি, সেক্রেটারি জয় শাহ, নির্বাচক কমিটির প্রধান চেতন শর্মা বা কোচ রাহুল দ্রাবিড় – কারোরই ঘাড়ে অতগুলো মাথা নেই।

এশিয়া কাপ থেকে ভারতের বিদায়

প্রতিক্রিয়া ১

কিচ্ছু ভাববেন না। আমাদের সেরা দল তো খেলেনি। সেরা বোলার যশপ্রীত বুমরা চোটের জন্য বিশ্রামে ছিল, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে তো খেলবে। সঙ্গে থাকছে টি টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট হর্ষল প্যাটেল। সে-ও চোটের কারণে এশিয়া কাপ খেলেনি। তার উপর টুর্নামেন্টের মাঝখানেই আমাদের ভরসা অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজা চোট পেয়ে বেরিয়ে গেল। এভাবে জেতা যায়?

প্রতিক্রিয়া ২

বিরাট কোহলি শেষমেশ ৭১ নম্বর সেঞ্চুরিটা করে ফেলেছে। আর চিন্তা নেই। এবার তো রানের বন্যা বইবে। বিরাট যেমন খেলছে খেলে যাক, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি আমরা ঠিক জিতে যাব। এশিয়া কাপ জিতিনি তো হয়েছে কী? বিরাট তো সেঞ্চুরি করেছে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাউন্সিলের র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্বের এক নম্বর টি টোয়েন্টি দল ভারত এশিয়ার ছটা দলের মধ্যে তিন বা চারে শেষ করায় মোটামুটি এই দুরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আজকাল এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞে আর ভক্তে বিশেষ তফাত হয় না। নগদ নারায়ণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও ভক্তি সঞ্চার করেছেন। যেসব বিশেষজ্ঞ এখনো ভক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, তাঁদেরও সোশাল মিডিয়ার ভক্তকুলকে ভয় করে চলতে হয়। ট্রোলরা খাঁটি সাম্যবাদী, কাউকে ছাড়ে না। এই লেখায় আমরা উপরের দুই প্রতিক্রিয়াকেই পাশ কাটিয়ে এশিয়া কাপে ভারতের ব্যর্থতার কারণ এবং ফলাফলকে তৃতীয় রকমে দেখার চেষ্টা করব।

প্রথমত, বুমরা যে এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা দু-তিনজন বোলারের মধ্যে পড়েন তা নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই। ফলে এশিয়া কাপে তাঁর অনুপস্থিতি এবং আসন্ন ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে উপস্থিতিতে যে অনেকখানি তফাত ঘটবে সেকথা ঠিকই। কিন্তু মুশকিল হল, তিনি এত তাড়াতাড়ি নিজের সেরা ফর্ম ফিরে পাবেন কিনা তা বলা শক্ত। যে কোনো চোট সারিয়ে ফেরার পরেই প্রথম কিছুদিন বোলারদের মধ্যে একই জায়গায় আবার চোট পাওয়ার আশঙ্কা কাজ করে। সে আশঙ্কা কাটে বেশকিছু ওভার বল করা হলে। নেটে বল করে স্বচ্ছন্দ হয়ে গেলেও ম্যাচ খেলার চাপ অন্য। সেই চাপ অনেকসময় সদ্য সেরে ওঠা শরীর নিতে পারে না। ফলে ম্যাচ প্র্যাকটিস দরকার। কিন্তু ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির আগে আর মাত্র ছটা টি টোয়েন্টি খেলবে ভারত। সঙ্গে তিনটে একদিনের ম্যাচ। সবকটা ম্যাচেই কি খেলবেন বুমরা? সেটাও কি যথেষ্ট? কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। সুতরাং বুমরা এসে পড়েছেন বলেই সব জাদুর মত ঠিক হয়ে যাবে ভেবে নিলে তাঁর প্রতিই অবিচার করা হবে।

দ্বিতীয়ত, হর্ষল প্যাটেল। তাঁর উপর হঠাৎই দেখা যাচ্ছে অনেকের প্রবল ভরসা। সে ভরসার কারণ অবশ্যই গত দুই বছরের আইপিএলে তাঁর বোলিং। হর্ষল ভারত বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর পিচে নিঃসন্দেহে একজন গুরুত্বপূর্ণ বোলার তাঁর গতির হেরফের, নিখুঁত লাইন লেংথ এবং বৈচিত্র্যের জন্য। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার পিচ নব্বইয়ের দশকের তুলনায় মন্থর হয়ে এলেও দু-আড়াই মাসব্যাপী আইপিএলে শেষের দিকে পিচগুলো যতটা ‘ক্লান্ত’ হয়ে পড়ে, সেরকম হবে না। অস্ট্রেলিয়ায় সাধারণত সমান বাউন্সের পিচ হয়, বল নির্বিঘ্নে ব্যাটে আসে। ঘন্টায় ১৩০-৩৫ কিলোমিটার গতিতে বল করা হর্ষল সেখানে প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের কতটা সমস্যায় ফেলতে পারবেন তা বলা মুশকিল। ওরকম পিচে ভুবনেশ্বর কুমার আর হর্ষল একই ধরনের বোলার হয়ে পড়তে পারেন। পরপর দুটো ম্যাচে ১৯তম ওভারে একগাদা রান দিয়ে ফেলায় এখন ভুবনেশ্বর অনেকেরই চক্ষুশূল, কিন্তু আসলে টি টোয়েন্টিতে তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ফর্ম্যাটে সারা পৃথিবীতে খুব বেশি বোলার নেই যাদের গোটা কেরিয়ারে ইকোনমি রেট, অর্থাৎ ওভার পিছু রান দেওয়ার হার, সাতের নিচে। সহজাত সুইং বোলার ভুবনেশ্বরের আরেকটা গুণ, তিনি নিয়মিত উইকেট নেন। সাতাত্তর ম্যাচে তাঁর ঝুলিতে ৮৪টা উইকেট, গড় মাত্র ২১.৭৩।

আসলে এশিয়া কাপ দেখিয়ে দিল, পেস ব্যাটারি নিয়ে গত কয়েক বছরে বিরাট আর রবি শাস্ত্রী যতই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে থাকুন, আমাদের হাতে এখনো খুব বেশি বিকল্প নেই। আবেশ খানকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তিনি মোটেই সুবিধা করতে পারেননি। আশা জাগিয়েছেন বাঁ হাতি অর্শদীপ সিং, তাই ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলেও জায়গা পেয়েছেন। কিন্তু তাঁরও মূল অস্ত্র স্লোয়ার এবং ইয়র্কার। বুমরা বাদে আমাদের সত্যিকারের গতিময় বোলার নেই। এবারের আইপিএলে দ্রুততম বোলারদের অন্যতম ছিলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের উমরান মালিক। অথচ তাঁর উপর নির্বাচকদের বা ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের বিশেষ ভরসা নেই। তাই জুন-জুলাই মাসে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুটো (প্রথম ম্যাচে মাত্র এক ওভার বল করার সুযোগ পেয়েছিলেন), ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচ খেলানোর পর আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। বেগতিক দেখে বিশেষজ্ঞরা হঠাৎ মহম্মদ শামির নাম জপতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শামির গতি আর সুইং দুটোই থাকলেও তিনি টি টোয়েন্টিতে মোটেই নির্ভরযোগ্য নন। সতেরোটা টি টোয়েন্টি ম্যাচে তাঁর উইকেট সংখ্যা মাত্র ১৮। উইকেট পিছু ৩১.৫৫ রান খরচ করেন আর ওভার পিছু প্রায় দশ (৯.৫৪) রান দিয়ে ফেলেন। সেই কারণেই বোধহয় শেষমেশ তাঁকে স্ট্যান্ডবাই হিসাবে রাখা হয়েছে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির জন্য। মূলত সুইং বোলার দীপক চহরের উপরেও তার চেয়ে বেশি ভরসা নির্বাচক বা টিম ম্যানেজমেন্টের নেই দেখা গেল।

স্পিন বোলিংয়ের অবস্থা তুলনায় ভাল। জাদেজা চোটের কারণে আপাতত হারিয়ে গেলেও আমাদের সাদা বলের সেরা স্পিনার যজুবেন্দ্র চহল আছেন, রবিচন্দ্রন অশ্বিনও মন্দ ফর্মে নেই দেখা গেল। আর আছেন অক্ষর প্যাটেল। ব্যাটের হাতটাও ভাল হওয়ার কারণে হয়ত শেষপর্যন্ত চহলের পাশে দ্বিতীয় স্পিনারের জায়গাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনিই নেবেন। কিন্তু ভুবনেশ্বরের উনিশ-বিশ আর ঋষভ পন্থের রান আউট করতে না পারার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে যে সত্য ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা হল এশিয়া কাপে ভারতের ব্যর্থতার আসল কারণ ব্যাটিং। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি নিয়ে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণও ব্যাটিংই।

আফগানিস্তান ম্যাচের বাহাদুরি দেখে না ভোলাই ভাল। আগের দিন টুর্নামেন্টে টিকে থাকার ম্যাচে প্রচণ্ড স্নায়ুর চাপ নিয়ে শেষ বল পর্যন্ত লড়েছিলেন আফগান ক্রিকেটাররা। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড শারজায় আইপিএল ম্যাচের আয়োজন হলে আপত্তি করে না, কিন্তু জাতীয় দলকে সেখানে খেলতে দেবে না। তাই চালচুলোহীন আফগানদের পরপর দুদিন দুটো আলাদা জায়গায় খেলতে হল। আগের দিন শারজায়, পরের দিন দুবাইতে। স্বভাবতই তাঁরা শারীরিক বা মানসিকভাবে ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার অবস্থাতেই ছিলেন না। অন্যদিকে গুরুত্বহীন ম্যাচে ভারতীয়দের উপর প্রত্যাশা বা স্নায়ু – কারোর চাপই ছিল না। ফলে ওই ম্যাচের ২১২ রান দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না।

বাকি সব ম্যাচেই কিন্তু ব্যাটিং একগাদা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সুপার ফোরের পাকিস্তান ম্যাচে প্রথম ছ ওভারে ৬০ পেরিয়ে যাওয়ার পরে এবং প্রথম তিন ব্যাটারের একজন (বিরাট) শেষ ওভার পর্যন্ত খেলে যাওয়া সত্ত্বেও ভারত দুশো পেরোতে পারেনি। একবার শক্ত ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছেন বলেই হার্দিক পান্ডিয়া রোজ জেতাবেন তা হতে পারে না। সুপার ফোরের ম্যাচের দিন তিনি পাঁচ বলের বেশি টেকেননি। যিনি শেষ কয়েক ওভারে ব্যাটিংয়ের বিশেষজ্ঞ হিসাবে দলে জায়গা পেয়েছেন, সেই দীনেশ কার্তিক গ্রুপের পাকিস্তান ম্যাচে খেলতে পেয়েছিলেন একটা বল, হংকংয়ের বিরুদ্ধে ব্যাট করার সুযোগই পাননি। অথচ এই ম্যাচে তাঁকে খেলানো হল না। খেললেন ঋষভ পন্থ, যিনি টেস্টে অসাধারণ, একদিনের ক্রিকেটেও অসাধারণ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ৫৮টা টি টোয়েন্টি খেলা হয়ে গেল, এখনো পায়ের নিচে মাটি পাননি। দল তাঁকে দিয়ে ঠিক কী করাতে চায় তা-ও পরিষ্কার নয়। ইংল্যান্ড সফরে মাত্র একবার তাঁকে দিয়ে ইনিংস শুরু করানো হল, তারপর আবার মিডল অর্ডারে ঠেলে দেওয়া হল। তরুণ দীপক হুড়া আদ্যন্ত টপ অর্ডার ব্যাটার। এ পর্যন্ত মোটে বারোটা ম্যাচ খেলেছেন, তার মধ্যেই শতরান করে বসে আছেন। গড় ৪১.৮৫, স্ট্রাইক রেট – যা টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – দেড়শোরও বেশি। তাঁকে গোটা টুর্নামেন্টে খেলানো হল নিচের দিকে। ইদানীং যিনি মাঠে নামলেই প্রতিভার বিচ্ছুরণে হাঁ হয়ে যেতে হয়, সেই সূর্যকুমার যাদবও সুপার ফোরের পাকিস্তান ম্যাচে সফল হননি। সে অবস্থায় বিরাট করেছেন ৪৪ বলে ৬০ রান, স্ট্রাইক রেট ১৩৬.৩৬। সংখ্যাগুলো যে যথেষ্ট ভাল, তার প্রধান কারণ বিরাটের চোখধাঁধানো রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস। কিন্তু মনে রাখা ভাল, সপ্তম ওভারে ব্যাট করতে নেমে শেষ ওভারের চতুর্থ বল অবধি ব্যাট করেও বিরাট মেরেছেন মাত্র চারটে চার আর একটা ছয়।

শ্রীলঙ্কা ম্যাচের ব্যাটিং সম্পর্কে তো যত কম কথা বলা যায় তত ভাল। অধিনায়ক রোহিত আর কিছুটা সূর্যকুমার ছাড়া বাকি সবাই ব্যর্থ। রানটা যে যথেষ্ট হয়নি তা তো ফলেই প্রমাণিত। এমনকি হংকং ম্যাচেও সূর্যকুমার ২৬ বলে ৬৮ রান না করলে বিরাটের ৫৯ (মাত্র একটা চার, তিনটে ছয়) সত্ত্বেও ভারতের রান ১৫০-৬০ অবধি গিয়ে আটকে যেত। ম্যাচের স্কোরবোর্ড প্রমাণ করছে, ব্যাপারটা মোটেই স্বস্তিদায়ক হত না।

অর্থাৎ গত বছরের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে ঠিক যে যে রোগ ভারতীয় দলকে ভুগিয়েছিল, এখনো সেসবের ওষুধ পাওয়া যায়নি। এই এক বছরে ভারত বেশকিছু টি টোয়েন্টি খেলেছে। তাতে চোট, বিশ্রাম ইত্যাদি নানা কারণে এশিয়া কাপ এবং ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলে জায়গা না পাওয়া অনেক ক্রিকেটার খেলেছেন। ঈশান কিষণ, সঞ্জু স্যামসন, ঋতুরাজ সিংরা যে সেই সুযোগগুলোর একেবারেই সদ্ব্যবহার করতে পারেননি তা-ও নয়। তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হল না কেন? না হওয়ার কারণটা খুব সহজ। আপনার অসুখ করল, ডাক্তার এলেন, কী কী ওষুধ খেতে হবে লিখে দিয়ে গেলেন। তারপর দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনা হলে যদি আপনি শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের অভাগীর মত ওষুধগুলো মাথায় ঠেকিয়ে এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দেন, তাহলে রোগ সারবে? ভারতীয় দলেরও একই অবস্থা।

কে এল রাহুল ইনিংস শুরু করতে যাবেন রোহিতের সঙ্গে এবং টেস্ট ওপেনারদের মত লম্বা ইনিংস খেলার দিকে মনোযোগ দেবেন। রোহিত তো পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটেও পাওয়ার প্লের বিষম ঝড়ের বায়ে মারের সাগর পাড়ি দিতে নারাজ। বেশ কয়েক ওভার নেন সেট হয়ে নিতে, তারপর ভয়ভাঙা নায়ে ওঠেন। কুড়ি ওভারের খেলাতেও একই পথে চলেছেন এতদিন। ইংল্যান্ড সফরে টি টোয়েন্টি সিরিজে অন্যরকম পথ ধরেছিলেন, কিন্তু এশিয়া কাপের প্রথম দুই ম্যাচে পুনর্মূষিক ভব। তৃতীয় ম্যাচ থেকে অবশ্য পরিবর্তন দেখা গেছে। আবার পুরনো গলিতে ফেরত যাবেন কিনা সেটা এ মাসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজেই টের পাওয়া যাবে। আর আছেন বিরাট। তিনি পঞ্চাশ ওভারের ব্যাটিংয়ের রাজা। সেখানে যে কায়দায় ইনিংস গড়েন, তা বদলাতে রাজি নন। এক-দুই রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখবেন, সেট হয়ে গেলে তবেই চার-ছয় মারার কথা ভাববেন।

টি টোয়েন্টিতে যে সেট হওয়ার সময় নেওয়া চলে না, সেকথা এঁদের বলবে কে? বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলি, সেক্রেটারি জয় শাহ, নির্বাচক কমিটির প্রধান চেতন শর্মা বা কোচ রাহুল দ্রাবিড় – কারোরই ঘাড়ে অতগুলো মাথা নেই। কেন নেই?

বিরাট তো কেবল বড় ক্রিকেটার নন, তিনি গোটা ক্রিকেট দুনিয়ার বৃহত্তম ব্র্যান্ড। তাঁর উপর বিপুল পরিমাণ টাকা লগ্নি হয়ে আছে। জিততে হবে বলে লগ্নিকারীদের হতাশ করা চলে না। বিরাট আর রোহিত যে বয়সে পৌঁছেছেন তাতে নিজেদের খেলার ধরন পাল্টে ফেলা হয়ত কঠিন। সেক্ষেত্রে ওষুধ হল তাঁদের জায়গায় অন্যদের সুযোগ দেওয়া। কিন্তু দুজনেই বড় ব্র্যান্ড। অতএব ওষুধ জানা থাকলেও সে ওষুধ প্রয়োগ করা চলবে না। আর রাহুল? তিনি নিজে অতবড় ব্র্যান্ড নন বটে, কিন্তু তিনি আইপিএলে লখনৌ সুপার জায়ান্টসের অধিনায়ক। অন্তত আইপিএল ব্র্যান্ডকে তো গুরুত্ব দিতে হবে। ব্র্যান্ডের যুক্তিতেই কার্তিককে খেলানোর চেয়ে পন্থকে খেলানো বেশি জরুরি। তিনিও এক আইপিএল দলের (দিল্লি ক্যাপিটালস) অধিনায়ক। হার্দিক আবার গুজরাট লায়ন্সের অধিনায়ক। এখন ফর্মে আছেন, যখন থাকবেন না তখন তিনিও ব্র্যান্ডের সুবিধা নিশ্চয়ই পাবেন।

নব্বইয়ের দশকে জাতীয় দলের নির্বাচকদের প্রায় সব সভার আগে-পরেই খবরের কাগজে লেখা হত আঞ্চলিক কোটার কথা। অমুকের ঘরোয়া ক্রিকেটে তেমন পারফরম্যান্স নেই, কিন্তু পূর্বাঞ্চলের কোটায় সুযোগ পেয়ে গেল। অথবা তমুকের বাদ পড়া অনিবার্য ছিল, শেষমেশ পশ্চিমাঞ্চলের কোটায় টিকে গেল। এখনকার সংবাদমাধ্যম তখনকার মত বোর্ডের প্রভাবমুক্ত হলে নির্ঘাত অমুক ব্র্যান্ডের কোটা, তমুক ফ্র্যাঞ্চাইজের কোটার কথা জানা যেত।

রোহিত-রাহুল-বিরাট-ঋষভদের গুণমুগ্ধরা বলতেই পারেন, এসব একেবারেই মনগড়া কথাবার্তা। ওঁরা নিজেদের যোগ্যতাতেই দলে আছেন। ব্র্যান্ড ভ্যালুর ভারে দলে ঢোকার কোনো প্রয়োজনই নেই। তাছাড়া ব্র্যান্ড ভ্যালু কি বোলারদের থাকে না? তাহলে বোলারদের সম্পর্কে এরকম মূল্যায়ন করছি না কেন?

আসলে ভারতে বোলাররা কোনোদিনই ব্যাটারদের মত জনপ্রিয় হন না। ফলে ব্র্যান্ড ভ্যালুতেও ব্যাটারদের ধারে কাছে পৌঁছতে পারেন না। শচীন তেন্ডুলকরের এক শতাংশ বিজ্ঞাপন চুক্তিও কোনোদিন অনিল কুম্বলে পাননি। যুবরাজ সিংয়ের চেয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে জাহির খানের অবদান খুব কম নয়। কটা বিজ্ঞাপনে দেখেছেন তাঁকে? গত কয়েক বছরে ভারত তিন ধরনের ক্রিকেটেই যত ম্যাচ জিতেছে তাতে বিরাট, রোহিতের চেয়ে বুমরার অবদান নেহাত কম নয়। তবু তিনি এনডর্সমেন্টের দিক থেকে এখনো বেশ কয়েক মাইল পিছিয়ে।

অতএব ব্যাটারদের আলোচনায় ফেরা যাক। ঋষভ এখন পর্যন্ত এমন কিছু করেননি টি টোয়েন্টিতে, যা দিয়ে তাঁকে যেনতেনপ্রকারেণ দলে রাখা যুক্তিযুক্ত বলে প্রমাণ করা যায়। তিনি যদি বাঁহাতি ব্যাটার বলে অপরিহার্য হন, তাহলে তো বিশেষজ্ঞ ব্যাটার হিসাবেই খেলানো উচিত। হয় কার্তিক খেলবেন, নয় ঋষভ খেলবেন – এমন ব্যবস্থা কেন? অবশ্য ঋষভের এখনো বয়স কম, তাই আরও সুযোগ প্রাপ্য – এই যুক্তি দেওয়া চলে। কিন্তু রোহিত-রাহুল-কোহলি সমস্যা বিশদে আলোচনা করা প্রয়োজন। তাঁরা কাঁচা বয়স পেরিয়ে এসেছেন।

রাহুল ৬১ বার ভারতের হয়ে টি টোয়েন্টি খেলতে নেমে ইতিমধ্যেই হাজার দুয়েক রান করে ফেলেছেন। কেরিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৪০-এর বেশি, অর্থাৎ পর্যাপ্ত। কিন্তু বছর দুয়েক হল তিনি ওই টেস্টসুলভ ব্যাটিং শুরু করেছেন। কেবল ভারতের হয়ে নয়, এ বছরের আইপিএলেও তিনি ওভাবেই ব্যাট করেছেন। ঝুঁকি কমিয়ে ফেলায় ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু যে স্ট্রাইক রেটে করছেন তা দলের কাজে আসে না প্রায়শই। ফলে নিজের যোগ্যতাতেই দলে থাকায় দলের কী লাভ হচ্ছে সে প্রশ্ন ওঠা উচিত।

রাহুল যে রোহিত আর বিরাটের স্তরের ব্যাটার নন তা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। শেষ দুজন বিস্তর রান করেছেন টি টোয়েন্টিতে। গড়ের দিক থেকে বিরাট বিশ্বের এক নম্বর (৫১.৯৪)। মোট রানে রোহিত এক (৩৬২০), বিরাট দুই (৩৫৮৪)। অথচ রোহিতের টি টোয়েন্টি অভিষেকের পর থেকে ভারত ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি জিতেছে মাত্র একবার (২০০৭)। সেবার তিনি মিডল অর্ডারে ব্যাট করেছিলেন। বিরাটের অভিষেকের পর থেকে একবারও নয়। এমনকি সেমিফাইনালে পৌঁছতেও হিমসিম খেতে হয়েছে, ফাইনাল খেলা হয়েছে শুধু ২০১৪ সালে। কী করে হয় এমনটা? ফর্ম্যাটটা তো ব্যাটার নির্ভর। বিশ্বের সেরা দুজন ব্যাটার ভারতের, অথচ ভারত কেন সুবিধা করতে পারে না? এর খানিকটা উত্তর পাওয়া যাবে স্ট্রাইক রেটের তালিকার দিকে তাকালে।

শুনতে অবিশ্বাস্য লাগবে, প্রথম তিনটে জায়গা দখল করে আছেন যথাক্রমে রোমানিয়া, হাঙ্গেরি আর বেলজিয়ামের তিন ব্যাটার। টেস্ট খেলিয়ে দেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে উপরে নাম আছে সূর্যকুমারের (১৭৩.২৯)। প্রথম পনেরো জনের মধ্যে টেস্ট খেলিয়ে দেশের প্রতিনিধি আর মাত্র তিনজন – নিউজিল্যান্ডের জেমস নিশাম (১৬৫.৮৪), তাঁর দেশেরই কলিন মানরো (১৫৬.৪৪) আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের আন্দ্রে রাসেল (১৫৬.০০)। তারপর বারবার নাম আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের। ২০০৭ সালের পরের ছটা ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির চারটেই এই তিন দেশের কেউ না কেউ জিতেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বেশ কয়েকজন ব্যাটারের নামও পাওয়া যায়। সূর্যকুমারের পর ভারতীয় নাম খুঁজতে খুঁজতে চলে যেতে হবে অনেক নিচে ৩৪ নম্বরে, যেখানে আছেন বীরেন্দ্র সেওয়াগ (১৪৫.৩৮)। আরও কয়েক ধাপ নামলে পাওয়া যাবে হার্দিকের নাম (১৪৪.৬৮)। রোহিত বা কোহলি – কেউই প্রথম পঞ্চাশেও নেই। এই তালিকাটা ব্যাটারদের ‘ক্লাস’ প্রমাণ করে না একেবারেই। যা প্রমাণ করে তা হল টি টোয়েন্টি ক্লাস ব্যাটিংয়ের জায়গা নয়, কম বলে যত বেশি সম্ভব রান করার জায়গা। সেটা করলে তবেই দল জেতার মত পরিস্থিতিতে পৌঁছয়, আর সেখানেই ভারতীয় ব্যাটাররা অনেক পিছিয়ে। রোহিত আর বিরাট তো বটেই।

এই দুজনের পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে আরও একটা দিক ধরা পড়ে। এমনিতে কোহলির কেরিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৩৮.৩৭। কিন্তু পাঁচের বেশি দল খেলেছে এমন টুর্নামেন্টে (অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি এবং এশিয়া কাপ) তাঁর গড় প্রায় আশি হলেও স্ট্রাইক রেট নেমে আসে ১৩০.৩৯-এ। রোহিতের গড় ৩২ থেকে ৩৬-এ পৌঁছে যায়, কিন্তু স্ট্রাইক রেট ১৪০.৬৩ থেকে নেমে আসে ১৩৩.৭৩-এ। অর্থাৎ দুজনেরই নৈপুণ্য দ্বিপাক্ষিক সিরিজে বেশি। অথচ টি টোয়েন্টিতে দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোর আসলে কোনো গুরুত্ব নেই। সব দলই ওগুলোকে ব্যবহার করে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির প্রস্তুতি হিসাবে। প্রমাণ চান? টাটকা প্রমাণ আছে। গত ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে একটা সিরিজ খেলেছিল। সেই সিরিজ অস্ট্রেলিয়া শোচনীয়ভাবে হারে (৪-১)। এমনকি শেষ ম্যাচে মাত্র ৬২ রানে অল আউট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে কী এসে গেল? ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি খেতাব জেতে অস্ট্রেলিয়াই, বাংলাদেশ গ্রুপ স্তরই পেরোতে পারেনি। এই কারণেই র‍্যাঙ্কিংয়ে কোন দল এক নম্বর তাতেও কিছু এসে যায় না।

এখন কথা হল, ভারতীয় দলের দুই সেরা ব্যাটার, যাঁরা ব্যাট করেন একেবারে উপরের দিকে, তাঁদের স্ট্রাইক রেট যদি এত মাঝারি মানের হয়, তাহলে দল মোক্ষম ম্যাচে জেতে কী করে? জেতে না। ঠিক যে কারণে পাকিস্তানও বারবার এশিয়া কাপ ফাইনাল বা ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি সেমিফাইনালের মত বড় ম্যাচে বারবার ব্যর্থ হয়। রোহিত-রাহুল-কোহলি বা পাকিস্তানের বাবর-রিজওয়ান যে ব্যাটিং করেন, তাতে আসলে যা হয়, তা হল সূর্যকুমারের মত ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটিংয়ে সিদ্ধহস্ত খেলোয়াড়দের উপর বেশি চাপ পড়ে। কার্তিকের মত ফিনিশাররা এক-দু বলের বেশি খেলারই সুযোগ পান না। অথচ টি টোয়েন্টিতে ঝুঁকি বর্জন করে লম্বা ইনিংস খেলার কোনো প্রয়োজনই নেই। কারণ এখানে ব্যাটিং দলকে পঞ্চাশ ওভারের খেলার অর্ধেকের চেয়েও কম বল খেলতে হয়, অথচ হাতে থাকে একই সংখ্যক উইকেট। ঝুঁকি না নিলে রান করে ব্যক্তিগতভাবে ধারাবাহিক হওয়া খুব কঠিনও নয়। কারণ ফিল্ডিং দলের অধিনায়ককে সারাক্ষণই রক্ষ্মণাত্মক থাকতে হয়, ক্যাচ নেওয়ার মত জায়গায় বেশি ফিল্ডার রাখা যায় না। বোলারদেরও ব্যাটারকে আউট করার চেয়ে চার-ছয় মারতে না দেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়।

আফগানিস্তান ম্যাচে দুশো স্ট্রাইক রেটে বিরাটের শতরান দেখার পরে এসব কথা অনেকেরই অবান্তর মনে হতে পারে। কেউ আশা করতেই পারেন, এতদিন ফর্মে ছিলেন না (বিরাট নিজে অবশ্য বলেন তিনি কোনোদিনই ফর্ম হারাননি, নিন্দুকে নিন্দে রটিয়েছে) বলে বিরাটের দ্রুত রান করতে সমস্যা হচ্ছিল। এশিয়া কাপে ফর্মে এসে গেছেন, এবার আফগানিস্তান ম্যাচের মত স্ট্রাইক রেটেই তিনি খেলবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়ে যেতে পারে ক্রিকেট বোর্ডের ওয়েবসাইটের জন্য বিরাট রোহিতকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তা দেখলে। সেখানে বিরাট বলেছেন তিনি কোচেদের বলেই দিয়েছেন, ১০-১৫ বল খেলে নেওয়ার পর বাউন্ডারি মারার দিকে যাবেন। নিজের স্বাভাবিক খেলাই তিনি খেলবেন। সেই ছকের বাইরে যেতে গিয়েই সমস্যা হচ্ছিল। কবে যে তিনি বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তা অবশ্য ম্যাচের পর ম্যাচ স্ট্রাইক রেট দেখলে টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যা-ই হোক, তিনি বলেছেন এশিয়া কাপে তিনি যেভাবে ব্যাট করতে চান টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁকে সেভাবেই ব্যাট করতে দিয়েছে এবং তিনি নিজের পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট। যোগ করেছেন, কেবল তিনি নয়, রাহুলকেও তিনি যেভাবে খেলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সেভাবে খেলতে দিলেই দলের পক্ষে ভাল হবে। রোহিতকেও বলেছেন, তুমি-আমি এতদিন খেলে ফেলেছি যে আমরা নিজেদের মত খেলতে পারলেই দলের পক্ষে ভাল। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতেও লম্বা ইনিংস খেলার দিকেই তাঁদের নজর থাকবে। শয়ে শয়ে ব্র্যান্ড এবং লক্ষ লক্ষ ভক্ত পকেটে আছে, অতএব “সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ঘটে যা তা সব সত্য নহে।”

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট বয়স ঢেকে ফেলছে বিজ্ঞাপনে

মুশকিল হল, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে আফগানদের ক্লান্ত বোলিং পাওয়া যাবে না। ফলে লম্বা ইনিংস দুশো স্ট্রাইক রেটে খেলা একটু কঠিন হতে পারে। আরেকটি ঐতিহাসিক সত্য হল, অস্ট্রেলিয়া বড় শক্ত ঠাঁই। এশিয়ার উইকেটে দ্রুত রান করতে যে ব্যাটারের অসুবিধা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তার রান করা সহজ হয়ে গেছে – এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি পাওয়া যায় না। ফলে ব্যাটিং নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। দলের জেতা-হারার চেয়ে বিরাট, রোহিতদের ব্যক্তিগত গৌরব যদি আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

 

বোর্ডের ঘরে যে ধন আছে, ক্রিকেটের ঘরে সে ধন আছে?

রাজা বাদশারা বিশেষ আনন্দের দিনে দাঁড়িপাল্লার এক দিকে বসতেন আর অন্যদিকে চাপানো হত সোনাদানা। হুজুরের ওজনের সমান সম্পদ গরীবগুরবোদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হত। সবকিছুকেই কতটা ধন পাওয়া যাবে তার সাপেক্ষে মাপার সেই কি শুরু? কে জানে! তবে আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন সাফল্য-ব্যর্থতা তো বটেই, উৎকর্ষ-অপকর্ষ, উচিত-অনুচিতও টাকা দিয়েই মাপা হয়। তাই খেলার খবরেও ঢুকে পড়ে টাকার হিসাব; খেলোয়াড়দের রান, উইকেট, ক্যাচের চেয়েও বড় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের নিলামে তাঁদের দর। স্বভাবতই ক্রিকেট দলের সাফল্য দিয়ে ক্রিকেট বোর্ডের সাফল্য মাপার দিনও শেষ, দলের ব্যর্থতায় বোর্ডের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার যুগও গত হয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের মতই ক্রিকেট বোর্ডও আমাদের নয়নের মণি, কারণ বোর্ড সফল। তাই আমরা প্রশ্ন তুলি না, বোর্ড সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি আর সচিব জয় শাহের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁরা কেন চেয়ার ছাড়ছেন না। কেন তুলব? বোর্ড তো সফল। বহু বছর হল ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী বোর্ডের নাম বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া। এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী আছে? যদি কোনোদিন দেখা যায় ভারতীয় বোর্ডের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, আয়ের দিক থেকে এক নম্বর জায়গাটা অন্য কোনো দেশের হাতে চলে গেছে, তখন কাঠগড়ায় তোলা হবে সৌরভ-জয়কে।

তা সম্প্রতি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আরও একটা বড়সড় সাফল্য পেয়েছে। এ যুগের বিচারে বিখ্যাত সৌরভ-শচীন জুটির সব সাফল্যের দাম এর চেয়ে কম। কারণ তাঁরা গোটা কয়েক ম্যাচ জিতিয়েছেন ভারতকে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ এবং টুর্নামেন্ট জিতিয়েছেন। সেসবের স্মারক মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বোর্ডের সদর দপ্তরে গেলে দেখা যায়। কিন্তু সৌরভ-জয় জুটি বোর্ডকে সদ্য এনে দিয়েছে ৪৮,৩৯০ কোটি টাকা। এ একেবারে নগদ লাভ। এ জিনিস কেবল ব্যাঙ্কে গেলে দেখা যায় তা নয়, এর উপস্থিতি প্রতি মুহূর্তে টের পাওয়া যায়। পাঁচ বছরের জন্য আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব বেচে এই রোজগার হয়েছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মহামতি জয় শাহ সংবাদসংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের পরের ফিউচার টুরস প্রোগ্রামে, অর্থাৎ কোন দেশ কবে কার বিরুদ্ধে কোথায় খেলবে তার যে বিস্তারিত সূচি তৈরি হয় তাতে, আলাদা করে আইপিএলের জন্য আলাদা করে আড়াই মাস সময় দেওয়া থাকবে। মানে সেইসময় পৃথিবীর কোথাও কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হবে না, যাতে সব দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররা শুধু আইপিএল খেলতে পারেন। লক্ষ করুন, এই ঘোষণা করে দিলেন বিসিসিআইয়ের সচিব, আইসিসির কোনো কর্মকর্তা নয়। জয় বলেছেন এ নিয়ে আইসিসি এবং বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা হয়ে গেছে। তা হতেই পারে। কিন্তু ফিউচার টুরস প্রোগ্রাম তো তৈরি করে আইসিসি। তাহলে কোন এক্তিয়ারে জয় এই ঘোষণা করতে পারেন? উত্তর ওই ৪৮,৩৯০ কোটি। এই মূল্যে সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি হওয়ায় ম্যাচ পিছু সম্প্রচার মূল্যের বিচারে আইপিএল সারা বিশ্বে জনপ্রিয় ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের চেয়েও এগিয়ে গেল।

স্রেফ অর্থের জোরে যেমন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ, আইসিসি তেমন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অনুগত। বিশ্ব রাজনীতিতে তবু অবাধ্য চীন আছে, দুর্বিনীত রাশিয়া আছে। ফলে নিজের স্বার্থরক্ষায় যা খুশি করতে পারলেও পৃথিবীর সর্বত্র সর্বদা আমেরিকার কথাই শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু ক্রিকেট দুনিয়ায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিস্পর্ধী কোনো শক্তি নেই। যে কটা দেশ দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট খেলে, যাদের দেশে ক্রিকেটের উল্লেখযোগ্য বাজার আছে, তাদের মধ্যে ভারত সবচেয়ে জনবহুল এবং ক্রিকেটের জন্য পাগল দেশ। ফলে এখানকার বাজার সবচেয়ে বড়। বিশ্বায়নের আগে, ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণের আগের যুগে যে বোর্ডগুলো ক্রিকেটের উপর ছড়ি ঘোরাত, সেই ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার একাধিপত্যের জবাব দিচ্ছে বিসিসিআই – এমন একটা কথা ভেবে অনেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক আনন্দ পান। বিসিসিআইয়ের যে কোনো অন্যায়কে এই যুক্তিতে ভারতের ক্রিকেটবোদ্ধারা বৈধ বলে ঘোষণা করে থাকেন বলেই সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীর মনে অমন ধারণা তৈরি হয়। কিন্তু ঘটনা হল, বিসিসিআই মোটেই কোনো বৈপ্লবিক কায়দায় আইসিসির উপর আধিপত্য কায়েম করেনি। ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) আর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) সাথে সমঝোতা করেই এই ছড়ি ঘোরানো চলছে।

২০১৪ সালে এন শ্রীনিবাসন আইসিসি চেয়ারম্যান থাকার সময়ে রীতিমত আইন করে তৈরি হয় আইসিসির নতুন রাজস্ব বন্টন পদ্ধতি, যাকে সাধারণত ‘বিগ থ্রি মডেল’ বলা হয়ে থাকে। এই মডেল অনুযায়ী ২০১৫-২০২৩ সালে আইসিসির আয় থেকে ৪৪০ মিলিয়ন ডলার পেতে পারত বিসিসিআই, প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার পেত ইসিবি আর প্রায় ১৩২ মিলিয়ন ডলার পেত সিএ। যা পড়ে থাকত তা বাকিদের মধ্যে নানা পরিমাণে ভাগ হত। কিন্তু পরে শ্রীনিবাসনের স্থলাভিষিক্ত হন আরেক ভারতীয় – শশাঙ্ক মনোহর। তিনি নিজে ভারতীয় হয়েও তেলা মাথায় তেল দেওয়া বিগ থ্রি মডেলের বিরোধিতা করেন এবং শেষপর্যন্ত ২০১৭ সালে বিগ থ্রি মডেল বাতিল করে ১৪-১ ভোটে পাস হয় নতুন মডেল। সেখানে আইসিসির রাজস্ব থেকে ভারতীয় বোর্ডের প্রাপ্য হয় ২৯৩ মিলিয়ন ডলার, ইংল্যান্ডের বোর্ডের ১৪৩ মিলিয়ন ডলার, বাকি সাত (অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ) পূর্ণ সদস্য বোর্ডের ১৩২ মিলিয়ন ডলার করে আর জিম্বাবোয়ের প্রাপ্য হয় ৯৪ মিলিয়ন ডলার। বিসিসিআই এই নতুন ব্যবস্থায় যারপরনাই রুষ্ট হয়; ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডও খুশি হয়নি। বিগ থ্রি মডেলের পক্ষে তাদের সোজাসাপ্টা যুক্তি – আমরা সবচেয়ে বেশি টাকা এনে দিই, অতএব আমরাই সবচেয়ে বেশি টাকা নেব। এমন নির্ভেজাল বৈষম্যবাদী যুক্তি প্রকাশ্যে বলতে জেফ বেজোস বা ইলন মাস্কের মত ধনকুবেরও লজ্জা পেতেন। মনে করুন, কোনো পরিবারে দশ ভাই। যে তিন ভাই সবচেয়ে বেশি রোজগার করে, তারা যদি খেতে বসে বলে খাবারের বেশিরভাগ অংশ তাদের দিয়ে দিতে হবে – তাহলে যেমন হয় আর কি। ব্যাপারটা যে শুধু দৃষ্টিকটু তা নয়। এই ব্যবস্থা চলতে দিলে যা হবে, তা হল ওই তিন ভাই ক্রমশ মোটা হবে আর বাকিরা অপুষ্টিতে ভুগবে, হয়ত শুকিয়ে মরবে।

পুঁজিবাদ এমনিতে তেলা মাথায় তেল দেওয়ারই ব্যবস্থা; মানুষের সাধ্যমত অবদান গ্রহণ করে তার প্রয়োজন মত ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নয়। কিন্তু পুঁজিবাদকেও বাঁচতে হলে খেয়াল রাখতে হয়, যেন শোষণ করার উপযুক্ত শোষিত থাকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন ও লুইগি জিঙ্গেলসের একটা বইয়ের নামই হল সেভিং ক্যাপিটালিজম ফ্রম দ্য ক্যাপিটালিস্টস ক্রিকেটের বাজার তো এমনিতেই ছোট, কারণ নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ডজনখানেক দেশ। মনোপলি কায়েম করতে গিয়ে ছোট ছোট দেশগুলোকে শুকিয়ে মারলে যে ব্যবসার ভাল হবে না – তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু একে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির যুগ, তার উপর বিসিসিআই হল সর্বশক্তিমান। তাই গোঁসাঘরে মিলিত হয়ে তিন ক্রিকেট বোর্ড নতুন ফিকির বার করল। আইসিসি তো বন্টন করে আইসিসি আয়োজিত প্রতিযোগিতাগুলোর রাজস্ব, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বেশিটাই তো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। সেই সিরিজের আয় পুরোটাই ভাগ হয় দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের মধ্যে। তাই এই তিন দেশ নিজেদের মধ্যে ঘুরে ফিরে বেশি খেলা আরম্ভ করল। আইসিসির ফিউচার টুরস প্রোগ্রামকে ফেলে দেওয়া যায় না। কারণ প্রথমত, তা করলে আইসিসি ভেঙে বেরিয়ে আসতে হয়। ব্যবসার মুনাফা বাড়ানো উদ্দেশ্য, বিদ্রোহ করা তো নয়। দ্বিতীয়ত, ২০১৯ থেকে চালু হয়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। সবার সাথে সবাইকে খেলতে হবে (যদিও রাজনৈতিক কারণে ভারত-পাকিস্তান সিরিজ হয় না), পয়েন্টের প্রশ্ন আছে। তাই ত্রিদেব করলেন কী, নিজেদের মধ্যে চার-পাঁচ টেস্টের সিরিজ খেলা শুরু করলেন। ওদিকে নিউজিল্যান্ডের মত ভাল দলের সঙ্গে ভারত দুটো টেস্টের বেশি খেলে না। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে কটা ম্যাচ খেলা হবে; একই সফরে একদিনের ম্যাচ, টি টোয়েন্টি খেলা হবে কিনা তা নিয়ে দরাদরি চলে। ওই যে বলেছি, খেলার উৎকর্ষ বিচার্য নয়। বিচার্য হল কোন সিরিজ বেচে বেশি টাকা আসবে। এই কারণেই অস্ট্রেলিয়ায় করোনা পরিস্থিতি যখন বেশ খারাপ, তখনো ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফর দিব্যি চালু ছিল। অথচ করোনার কারণেই অস্ট্রেলিয়া ২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে তিন টেস্টের সিরিজ বাতিল করে দিয়েছিল।

বিসিসিআই আইসিসিকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে ফেলতে পেরেছে এবং ইসিবি আর সিএকে লেজুড় বানিয়ে ফেলতে পেরেছে। এর একমাত্র কারণ টাকা। আর সেই টাকার সবচেয়ে বড় উৎস হল আইপিএল। এই প্রতিযোগিতা কতটা এগিয়ে দেয় বিসিসিআইকে? উদাহরণ হিসাবে এই ৪৮,৩৯০ কোটি টাকাকেই ব্যবহার করা যাক। আগেই বলেছি, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে পাস হওয়া আইসিসির নতুন রাজস্ব বন্টন মডেল অনুযায়ী আট বছরের জন্য বিসিসিআইয়ের প্রাপ্য ২৯৩ মিলিয়ন ডলার। মানে আজকের বিনিময় মূল্যে প্রায় ২,২৯৫ কোটি টাকা। যখন এই সিদ্ধান্ত হয় তখন ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম আরও বেশি ছিল, ফলে বিসিসিআইয়ের প্রাপ্য ছিল আরও কম। এই টাকা পাওয়া যায় কিস্তিতে। আগামী দিনে শেষ কিস্তি পাওয়ার সময়ে টাকার দাম পড়তে থাকলে হয়ত আরেকটু বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত যা-ই পাওয়া যাক, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শুধু আইপিএলের পাঁচ বছরের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করেই বিসিসিআই তার ২৩-২৪ গুণ বেশি টাকা আয় করতে পারে। এর আগের বছরগুলোর (২০১৫-২২) স্বত্ব বিক্রি করে বোর্ড পেয়েছিল ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকা। আইসিসির দেয় টাকা তো তার কাছেও নস্যি। সুতরাং বিসিসিআইয়ের যদি আর কোনো আয়ের উৎস না-ও থাকে, কেবল আইপিএলই ক্রিকেট জগতে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট।

এই আধিপত্য খাটিয়ে যা যা করা হচ্ছে তা নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নানারকম আপত্তি উঠছে, দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা হচ্ছে। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া আজব দেশ। সেখানকার প্রাক্তন ক্রিকেটাররা, বড় বড় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা নিজেদের ক্রিকেট বোর্ডের দোষ ধরেন। ফলে বিসিসিআইয়ের সাথে হাত মিলিয়ে তারা বিলক্ষণ লাভ করছে জেনেও তাঁরা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলেন। অস্ট্রেলিয়ার ‘দি এজ’ পত্রিকার ক্রিকেট লিখিয়ে ড্যানিয়েল ব্রেটিগ যেমন লিখেছেন, আইপিএলের আয় আকাশ ছোঁয়ার ফলে টেস্ট ক্রিকেট ক্রমশ মাইনর লিগে পরিণত হতে পারে। তাঁর আশঙ্কা যে অমূলক নয় তার ইঙ্গিত জয়ের সাক্ষাৎকারে রয়েছে।

এমনিতেই আইসিসির উপর প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম মরসুমে (২০১৯-২১) এক অত্যাশ্চর্য পয়েন্ট সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। সব ম্যাচের পয়েন্ট মূল্য সমান ছিল না, কিন্তু সব সিরিজের পয়েন্ট মূল্য সমান ছিল। কারণটা সহজবোধ্য – ত্রিদেব তো নিজেদের মধ্যে যতগুলো টেস্ট খেলবেন, অন্যদের সাথে ততগুলো খেলবেন না। ফলে পাঁচ টেস্টের অ্যাশেজ সিরিজেও সব ম্যাচ জিতলে পাওয়া যাচ্ছিল ১২০ (২৪x৫) পয়েন্ট, আবার ভারত-নিউজিল্যান্ডের দুই টেস্টের সিরিজেও সব ম্যাচ জিতলে সেই ১২০ (৬০x২)। এত বায়নাক্কা বজায় রেখেও অবশ্য খেতাবটা জিততে পারেনি তিন প্রধানের কেউ। বর্তমান মরসুমে এই বায়না আর মানা হয়নি, কিন্তু জয়ের বয়ান অনুযায়ী, আগামী দিনে বছরে আড়াই মাস আইপিএলকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়েছে। এদিকে পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এখন ফ্যাঞ্চাইজ লিগ চালু হয়েছে। ইংল্যান্ডে চালু হয়েছে ১০০ বলের খেলার ফ্যাঞ্চাইজ লিগ – দ্য হান্ড্রেড। সেগুলো অত টাকার খনি নয় বলে আইসিসির আনুকূল্য পাবে না, কিন্তু উপার্জনের প্রয়োজনে বেশকিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার সেগুলোতেও খেলেন এবং খেলবেন। নয় নয় করে সারা বিশ্বে কেবল ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগই খেলে বেড়ানো ক্রিকেটারের সংখ্যা এখন কম নয়। তাঁদের দর ক্রমশ বাড়ছে, ফলে আরও বেশি সংখ্যক ক্রিকেটার যে আগামী দিনে ওই পথ বেছে নেবেন তাতে সন্দেহ নেই, শীর্ষস্থানীয়রা তো থাকবেনই। তাহলে জাতীয় দলের হয়ে ক্রিকেট খেলবেন কোন ক্রিকেটাররা এবং কখন?

এদিকে বিসিসিআই ছাড়া অন্য বোর্ডগুলোর পক্ষে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক সেভাবে বাড়ানো কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। ব্রেটিগ লিখেছেন, আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব থেকে আয় করা অর্থের ২৫ শতাংশও যদি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোর স্যালারি ক্যাপ বাড়াতে ব্যবহার করা হয়, তাহলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়ে দাঁড়াবে “ফাইন্যানশিয়াল আফটারথট”। অর্থাৎ “ওটা সময় পেলে খেলা যাবে এখন”। কারণ আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব যখন ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিল, তখন তার ১৪ শতাংশ ছিল স্যালারি ক্যাপ। আগামী নিলামে সেই অনুপাত বজায় রাখলেই স্যালারি ক্যাপ হয়ে যাবে এখনকার তিন গুণ। তখন কেমন পারিশ্রমিক হবে শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারদের? ব্রেটিগ প্যাট কামিন্সের উদাহরণ দিয়েছেন। কামিন্স এখন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার থেকে পান মরসুম পিছু ২ মিলিয়ন ডলার, যা আইপিএলে খেলার জন্য সর্বোচ্চ যা পাওয়া যায় তার তুল্য। নতুন সম্প্রচার স্বত্বের পরিমাণ অনুসারে পারিশ্রমিক বাড়লে আইপিএলের সবচেয়ে দামি ক্রিকেটারের পারিশ্রমিক কিন্তু ১০ মিলিয়ন ডলারেও পৌঁছে যেতে পারে।

এখানেই শেষ নয়। যে প্রিমিয়ার লিগকে আইপিএল ছাপিয়ে গেছে বলে এত হইচই, সেই লিগের সম্প্রচার স্বত্বের অর্ধেকেরও বেশি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া হয়। আইপিএল যদি সেই মডেল অনুসরণ করে তাহলে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক কত হবে ভাবুন। তখন পাঁচদিনের ক্রিকেট খেলার উৎসাহ কজনের থাকবে? অন্য ফর্ম্যাটেই বা দেশের জার্সি গায়ে খেলার কতটুকু গুরুত্ব থাকবে? স্রেফ আইপিএল ফ্যাঞ্চাইজগুলোর চোখে পড়ার মঞ্চ হয়ে উঠবে কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ময়দান?

কেউ বলতেই পারেন, তেমন হলে ক্ষতিটা কোথায়? আন্তর্জাতিক ফুটবল তো কবে থেকেই ওভাবে চলছে। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, আফ্রিকান নেশনস কাপ থেকে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো ফুটবলার পছন্দ করে। তারপর তারা ইউরোপের লিগগুলোতে খেলতে এসে আকাশছোঁয়া পারিশ্রমিক পান। দেশের হয়ে খেলার জন্যে তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না – এমন অভিযোগে মাঝেমধ্যে বিবাদ বিসম্বাদও হয়। তাই সেসবের জন্য বিশ্ব নিয়ামক সংস্থা ফিফাকে আলাদা নিয়মও তৈরি করতে হয়েছে। না হয় আইসিসিও তেমন কিছু করবে। ক্রিকেটারদের রোজগার বাড়লে ক্ষতি কী? ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের রোজগার বাড়লে, প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়লেই বা অসুবিধা কোথায়?

ঠিক কথা। খেলা তো আসলে ব্যবসা। যে ফর্ম্যাট বেশি বিক্রি হবে সে ফর্ম্যাটই টিকে থাকবে। ফলে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য চোখের জল ফেলে লাভ নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বদলে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটই আসল খেলা হয়ে দাঁড়ালেও কালের গতি হিসাবেই মেনে নিতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল, ইউরোপের ফুটবল মাঠে খেলা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আর ভারতের ক্রিকেট মাঠে খেলা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় এখনো আকাশ-পাতাল তফাত। বিশ্বের ধনী ফুটবল ক্লাবগুলো অর্জিত অর্থের বেশ খানিকটা ব্যয় করে দর্শক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে। অথচ ভারতের বহু ক্রিকেট মাঠে সাধারণ দর্শকদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে পূতিগন্ধময় বাথরুম। কোথাও তিনতলায় খেলা দেখতে বসলে পানীয় জলের জন্য নামতে হয় একতলায়।

ইউরোপে নিয়মানুযায়ী ক্লাবগুলোর নিজস্ব অ্যাকাডেমি থাকে, সেখানে শিশু বয়স থেকে ফুটবলার তৈরি করা হয়। আইপিএলে ওসব তো নেই বটেই, শুরু হওয়ার সময়ে ‘ক্যাচমেন্ট এরিয়া’-র ক্রিকেটের উন্নতিকল্পে ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো কীসব করবে শোনা গিয়েছিল। এখন ক্যাচমেন্ট এরিয়া ব্যাপারটারই আর নামগন্ধ নেই। কলকাতা নাইট রাইডার্সে বাংলার ক্রিকেটার দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়, গুজরাট টাইটান্সে খুঁজতে হয় গুজরাটের খেলোয়াড়। উপরন্তু ফুটবলে উন্নত দেশে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামগুলোর মালিক ক্লাবগুলোই। সেই পরিকাঠামো আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্য ব্যবহৃত হয়। ক্রিকেটে কিন্তু ব্যাপারটা উল্টো। দেশের ক্রিকেট বোর্ডের অর্থে তৈরি পরিকাঠামোই ব্যবহার করছে ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো। মানে খেলাটার থেকে তারা নিচ্ছে সবকিছু, কী ফিরিয়ে দিচ্ছে তার হদিশ নেই।

আর বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী ক্রিকেট বোর্ডের কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। আইপিএলের বিন্দুমাত্র সমালোচনা করলেই বিসিসিআই ও তার অনুগত প্রাক্তন ক্রিকেটার, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিকরা বলতে শুরু করেন ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি হয়েছে আইপিএল থেকে আসা অর্থের জন্যই। ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক, প্রাক্তনদের পেনশন বেড়েছে সে কথা সত্যি। কিন্তু সেগুলো তো যে কোনো পেশাতেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাড়ার কথা। গত দুই দশকে দেশে যে হারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, সে অনুপাতে কিন্তু ওই টাকার অঙ্কগুলো বাড়েনি। আর ওটুকুই তো একটা খেলার উন্নতির সব নয়। বাকি চেহারাটা কেমন?

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

কোভিড পর্বে বোর্ড প্রবল উৎসাহে আইপিএল আয়োজন করেছে (প্রয়োজন পড়লে বিদেশে), জাতীয় দলের বিদেশ সফরের ব্যবস্থা করেছে। অথচ রঞ্জি ট্রফি খেলা ক্রিকেটারদের টাকা দেওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল। আম্পায়ার, স্কোরার, মাঠ পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরাও বিস্মৃত হয়েছিলেন। মুম্বাই আর মধ্যপ্রদেশের মধ্যে এবারের রঞ্জি ট্রফি ফাইনালে ডিসিশন রিভিউ সিস্টেমের ব্যবস্থা নেই, কারণ খরচে কুলোবে না। উত্তরাখণ্ডের রঞ্জি দলের ক্রিকেটারদের দুর্দশার কথা জানলে অবশ্য মনে হবে এসব কিছুই নয়। এ মাসের গোড়ায় সাংবাদিক জেমি অল্টারের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ওই ক্রিকেটাররা এক বছর ধরে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন দিনে মাত্র ১০০ টাকা। সে টাকাও মাসের পর মাস বকেয়া থাকে। অধিনায়ক জয় বিস্তা বিসিসিআইকে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ মরসুমের বকেয়ার ব্যাপারে চিঠি লিখে কোনো জবাব পাননি।

মেয়েদের ক্রিকেট বিসিসিআই কীভাবে চালাচ্ছে তা নিয়ে লিখতে বসলে আরও হাজার দুয়েক শব্দ লিখতে হবে। এটুকু বলা যাক, যে চলতি ভারত-শ্রীলঙ্কা সিরিজ ভারতে বসে টিভিতে সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। বহু টালবাহানার পর আগামী বছর অবশ্য মেয়েদের আইপিএল শুরু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ বিসিসিআই নিঃসন্দেহে একটি সফল কোম্পানি, কিন্তু সে সাফল্যে ক্রিকেটের কী লাভ হচ্ছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একসময় সারা পৃথিবীতে অর্থনীতির আলোচনায় ‘ট্রিকল ডাউন’ কথাটা বেশ জনপ্রিয় ছিল। বলা হত সচ্ছলতা চুঁইয়ে পড়বে নীচের দিকে, তাতেই নীচের তলার মানুষের হাল ফিরবে। বাস্তবে তা কতটা ঘটে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা তর্ক করবেন, কিন্তু অন্তত ভারতীয় ক্রিকেটে বিসিসিআইয়ের সচ্ছলতা চুঁইয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে না। টেস্ট ক্রিকেটের জন্য চোখের জল না হয় না-ই ফেললাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চুলোয় যাওয়াও না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু বিসিসিআইয়ের সমান ওজনের সমৃদ্ধি যে দেশীয় ক্রিকেটে দেখা যাচ্ছে না।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

ঝুলন সেরা বাঙালি ক্রিকেটার? মোটেই না

ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস বাংলাকে বাদ দিয়ে লেখা অসম্ভব। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বাংলাকে বাদ দিয়ে অনায়াসে লেখা যেত। রেকর্ড বইয়ে সর্বোচ্চ রানের ওপেনিং জুটির তালিকার একেবারে শীর্ষে পঙ্কজ রায়ের নাম ছিল ঠিকই, কিন্তু রেকর্ড বই ইতিহাস নয়। একবিংশ শতাব্দীতে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলার পাকাপাকি জায়গা তৈরি করেছেন দুজন। একজন অবসর নেওয়ার দেড় দশক পরেও সারাক্ষণ সংবাদের শিরোনামে, বাঙালির নয়নের মণি। অর্থাৎ সৌরভ গাঙ্গুলি। অন্যজন কে, বাজি রেখে বলতে পারি, আপনি ভুরু কুঁচকে ভাবছেন।

এই শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরে ফিক্সিং কেলেঙ্কারির বিপর্যয় কাটিয়ে অধিনায়ক হিসাবে সৌরভ যখন ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বদলে দিচ্ছিলেন, সেই সময়েই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেন্নাইতে একটি একদিনের ম্যাচে ভারতের হয়ে খেলতে শুরু করেন ঝুলন গোস্বামী। সে বছরই টেস্ট অভিষেক। ঝুলনের শুরুটা সৌরভের মত সাড়া জাগানো হয়নি। প্রথম টেস্টে এই ডানহাতি জোরে বোলার কোনো উইকেট পাননি। কিন্তু গত কুড়ি বছর ধরে ভারতের মহিলা দলের প্রায় সমস্ত স্মরণীয় জয়ে ঝুলনের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ২০০৬ সালে ভারতীয় মহিলারা ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতেন। প্রথম টেস্টে লেস্টারে নৈশপ্রহরী হিসাবে ঝুলন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতরান করেন। আর টনটনের দ্বিতীয় টেস্টে তিনি একাই একশো। প্রথম ইনিংসে ৩৩ রানে পাঁচ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ রানে পাঁচ উইকেট। একদিনের ক্রিকেটে ঝুলন প্রকৃতপক্ষে একজন কিংবদন্তি। চলতি বিশ্বকাপে তিনি মহিলাদের বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হলেন, তারপরেই মেয়েদের একদিনের ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসাবে ২৫০ উইকেটের মালিক হলেন।

যাঁরা মেয়েদের ক্রিকেটের খবর রাখেন তাঁরা জানেন, ভারতের মহিলাদের দলে এই মুহূর্তে দুজন আছেন যাঁরা সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়েন। কীর্তির দিক থেকে অধিনায়ক মিতালী রাজ যদি মেয়েদের ক্রিকেটের শচীন তেন্ডুলকর হন, ঝুলন অবশ্যই কপিলদেব। দুটো দশক জুড়ে ভারতীয় বোলিংকে নেতৃত্ব দেওয়া কত শক্ত, তা কপিলদেবের চেয়ে ভাল কে-ই বা জানে? ঝুলনের নামটা মাথায় আসেনি বলে জিভ কাটছেন নাকি? কাটবেন না, কারণ দোষ আপনার নয়। শুধু যে মহিলাদের ক্রিকেট টিভিতে অনেক কম দেখানো হয় আর কাগজে অনেক কম লেখা হয় তা-ই নয়, কপিলদেব ১৬ বছরে খেলেছেন ১৩১টা টেস্ট আর ২২৫টা একদিনের ম্যাচ। ঝুলন কুড়ি বছরে ২০১ খানা একদিনের ম্যাচ (২২ মার্চ, ২০২২ তারিখে ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচ পর্যন্ত) খেললেও টেস্ট খেলেছেন মাত্র বারোটা। একদিনের ম্যাচের সংখ্যাটাও আসলে কপিলের সাথে তুলনীয় নয়, কারণ কপিলের কেরিয়ারের বেশ খানিকটা সময়ে একদিনের ক্রিকেট ছিল লম্বা টেস্ট সিরিজের শেষ পাতে মিষ্টির মত। কিন্তু ঝুলনের দু বছর আগে অভিষেক হওয়া জাহির খান বারো বছরেই দুশো একদিনের ম্যাচ খেলে ফেলেছিলেন।

ভারতীয় পুরুষদের ক্রিকেটের মহীরুহ যাঁরা, তাঁদের ঝুলিতে একটা জিনিস আছে যা বাংলার গৌরব সৌরভের ঝুলিতে নেই। ২০০৩ সালের ২৩ মার্চ রিকি পন্টিংয়ের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া সৌরভের হাতে বিশ্বকাপ ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা দুরমুশ করে চতুর্থবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। কিন্তু কপিলদেব বিশ্বকাপ জিতেছেন, সুনীল গাভস্করও সেই দলে ছিলেন। বিশ্বসেরার মেডেল গলায় ঝুলিয়েছে শচীন তেন্ডুলকর আর মহেন্দ্র সিং ধোনিও। ব্যক্তিগত কৃতিত্বে ঝলমলে কেরিয়ারে ঝুলন আর মিতালীর ও জিনিসটার স্বাদ এখনো পাওয়া হয়নি। পেতে গেলে চলতি বিশ্বকাপে দুজনকেই নিজেদের সেরা ফর্মের কাছাকাছি থাকতে হবে। প্রথম চারটে ম্যাচে নীরব থাকার পর পঞ্চম ম্যাচে মিতালীর ব্যাট কথা বললেও পার্থক্য গড়ে দিতে পারেনি। বাংলাদেশ ম্যাচে দল জিতে গেলেও মিতালী আবার ব্যর্থ। ঝুলন মন্দ খেলছিলেন না, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে একেবারেই ফ্লপ, সহজ বাংলাদেশ ম্যাচে ছিলেন স্বমহিমায়। গতবার ফাইনালে উঠেও ইংল্যান্ডের কাছে হারতে হয়েছিল। বাকি রইল দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। সেটা জিততে পারলে এখনো ভারতের সেমিফাইনালে পৌঁছবার সম্ভাবনা আছে। যদি শেষপর্যন্ত স্মৃতি মান্ধনা, পূজা বস্ত্রকর, শেফালি বর্মার মত তরুণদের সাথে মিতালী, ঝুলন, হরমনপ্রীতদের সুর মিলে যায় তাহলে ৩ এপ্রিল ক্রাইস্টচার্চে প্রথম বাঙালি হিসাবে ঝুলন ছুঁয়ে ফেলবেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সঙ্গে থাকবেন শিলিগুড়ির রিচা ঘোষ।

চিন্তা করবেন না। এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকতা দেখাতে না পারা ভারতীয় দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত ঘটনা ঘটে গেলেও ঝুলনকে আমরা কেউ সেরা বাঙালি ক্রিকেটার বলার ধৃষ্টতা দেখাব না। মহিলাদের ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাক আর না-ই থাক, শিগগির জেনে যাব যে মেয়েদের ক্রিকেটের বোলারদের গড় গতি ছেলেদের চেয়ে কম। আরও নানা তথ্য থেকে প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে না যে মেয়েদের বিশ্বকাপ জয় আর ছেলেদের বিশ্বকাপ জয় এক নয়। সেরেনা উইলিয়ামসকে ও দেশে কেউ রাফায়েল নাদাল, রজার ফেডেরার বা নোভাক জোকোভিচের চেয়ে কম বড় খেলোয়াড় ভাবে না। তা বলে আমাদেরও যে ওভাবে ভাবতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি।

আরও পড়ুন কালোর জন্যে কাঁদা, অথচ সাদা মনে কাদা

তাছাড়া সৌরভের বায়োপিক হওয়ার আগেই যে বলিউড ঝুলনের বায়োপিক বানিয়ে ফেলছে, সে কি কম স্বীকৃতি? তাতে আবার ঝুলনের চরিত্রে অভিনয় করছেন ছেলেদের ক্রিকেট দলের অধিনায়কের অভিনেত্রী স্ত্রী। এর চেয়ে বেশি কী-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে ঝুলনের মত একজন শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারের? ঢ্যাঙা, কালো মেয়ে মাঠে উইকেট তুলতে পারে, রান করতে পারে। কিন্তু পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে যখন তার জীবন নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখতে যাব, তখন পর্দায় একটা টুকটুকে মেয়ে না থাকলে চলবে কেন? আমরা মণিপুরি মেরি কমকে পর্দায় দেখি পাঞ্জাবি অভিনেত্রীর অবয়বে, বাংলার ঝুলনকেও সেভাবেই দেখব। দেখে পপকর্ন খেতে খেতে হাততালিও দেব। দেশের ক্রিকেট বোর্ডই যখন মহিলা ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক পুরুষদের ধারেকাছে হওয়া উচিত বলে মনে করে না, দলটার নিয়মিত খেলতে পাওয়া উচিত বলেও মনে করে না, তখন আমরা সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরা সব সমান করে ভাবতে যাব কেন? আমাদের কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখার জন্য কেন ছটফট করব?

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত