ওয়কীল হাসানের গণতন্ত্র, না মুকেশ আম্বানির ধনতন্ত্র?

‘আমার মাথার উপরে যে সামান্য ছাদ ছিল সেটাও আমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমার বাচ্চারা পথে বসে আছে, স্যার। এখন আমি এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কোথায় কাটাব সারাজীবন? আজকাল মানুষের পক্ষে রোজগার করাই শক্ত। সেখানে আমি আবার ঘর কোথায় পাব, কী করে বানাব? ছেলেমেয়েদের মানুষ করব কী করে? মরে যাওয়া ছাড়া তো আর কোনো পথ নেই আমাদের সামনে… সরকারের সঙ্গে আমার কোনো কথাবার্তা হয়নি। আপনারা এসেছেন, আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। দেখা যাক, সরকারের কানে পৌঁছয় কিনা। জানি না সরকার আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি করবে না। আমি ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের কাছে কী আছে যার ভিত্তিতে আপনারা আমার বাড়ি ভাঙতে এসেছেন? আমাকে কিছুই দেখাতে পারেনি। স্রেফ আমাকে ধরে পুলিস স্টেশনে পাঠিয়ে দিল। আমার সঙ্গে আমার বন্ধু মুন্নাও (কুরেশি) ছিল, ওকেও পাঠিয়ে দিল। সেখানে আটটা পর্যন্ত আটকে রেখেছিল। আমার নাবালিকা মেয়ে, বউ আর ছেলেকেও ওখানেই রাখা হয়েছিল। আমার ছেলের চোট লেগেছে, মারধরও করা হয়েছে… স্যার, আমার তারিফ তো গোটা দুনিয়া করছে। উত্তরাখণ্ড সরকার আমাদের ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছিলও। কিন্তু আজকের দিনে ৫০ হাজার টাকায় কী হয়? আমাদের মাথার উপরে এত ধার যে বাচ্চাদের খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করব, বাড়ি বানাব, না ধার শোধ করব? অনেক কষ্ট করে অত ভাল একটা কাজ করলাম, সরকার আমাদের সাহায্য করলে আমাদেরও মেনস্ট্রিমে আসার সুযোগ হত। কিন্তু যেখানে ছিলাম আবার সেখানেই পৌঁছে গেলাম। আজ আমার বাড়িই ভেঙে দেওয়া হল, আমার বাচ্চারা দেখুন পথে বসে আছে।’

উপরের কথাগুলো কোনো সিনেমার সংলাপ নয়, নির্বাচনী বক্তৃতা নয়, পরাধীন দেশের মানুষের বিলাপও নয়। টিভি ক্যামেরার সামনে কথাগুলো বলেছেন ওয়কীল হাসান। মাত্র মাস তিনেক আগেই এই মানুষটি এবং তাঁর সঙ্গীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তরাখণ্ডের সিলকিয়ারা টানেল থেকে বার করে এনেছিলেন দুর্ঘটনায় আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিককে। ধন্য ধন্য করেছিলাম আপনি, আমি। পিঠ চাপড়াতে, মালা পরাতে ছুটে গিয়েছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর ধামি স্বয়ং। মনে হয়েছিল এই র‍্যাট হোল মাইনারদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়েছে গোটা দেশ। দেখা গিয়েছিল, উদ্ধারকারীদের একটা বড় অংশ মুসলমান। সেই মুসলমান যাঁদের পোশাক দেখেই দেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদী বলে চিনতে পারেন। যাঁদের কথা বা কার্যকলাপ অপছন্দ হলেই পাকিস্তান চলে যেতে বলা আজকাল স্কুলের শিশুদের মধ্যেও চালু হয়ে গেছে। এঁরা সেই সম্প্রদায়ের লোক যাঁরা সম্প্রদায়গত পরিচিতির কারণেই ট্রেনে যেতে যেতে খুন হয়ে যান কোনো উর্দিধারী পুলিসের গুলিতে, গণপিটুনিতে মারা যান স্রেফ ফ্রিজে গোমাংস রাখা আছে সন্দেহে। যে উত্তরাখণ্ডের টানেল থেকে জীবন বাজি রেখে শ্রমিকদের উদ্ধার করেছিলেন, সেই উত্তরাখণ্ডেই মুসলমানদের বহুদিনের বাসা খালি করে চলে যেতে হয় হুমকির মুখে।

এই সমস্ত কথা জানা সত্ত্বেও যখন সিলকিয়ারার উদ্ধারকার্যের পর অনেকে উল্লেখ করছিলেন যে উদ্ধারকারীরা অনেকেই মুসলমান, তখন অনেক উদারপন্থী এবং বামপন্থীও নাক সিঁটকে বলেছিলেন – আহা, সবেতে ধর্ম টেনে আনা কেন! দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি পাড়ার অন্য সমস্ত বাড়ি অক্ষত রেখে স্রেফ তাঁর বাড়িটাকেই বেআইনি জমিতে তৈরি বলে দেগে দিয়ে ভেঙে ফেলার পর ওয়কীল প্রশ্ন তুলেছেন তিনি মুসলমান বলেই কি এই কাণ্ড করা হল?

ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেলের সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই আর দিল্লির প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নজীব জঙ্গের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি বলেছেন, তাঁর বাড়ির গোটা এলাকা বহুকাল আগেই অনুমোদিত হয়ে গেছে। সেখানে স্কুল আছে, আইনি পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়েছিল এবং বাড়ি তৈরি করতে ব্যাঙ্ক ঋণও দিয়েছিল। ২০০৮ সালেই ওই এলাকাটিকে আইনি কলোনির শংসাপত্র দেওয়া হয় বলে ওয়কীল জানিয়েছেন।

তাহলে বেছে বেছে ওয়কীলের বাড়িই কেন ভাঙা হল? কেউ কৈফিয়ত দেয়নি। অমৃতকালের ভারতে কেউ কৈফিয়ত দেয় না। দিল্লির বিজেপি সাংসদ মনোজ তিওয়ারি বলেননি যে কী করে আইনি এলাকার মধ্যে হঠাৎ একটি বাড়ি বেআইনি হল। কিন্তু হইচই পড়ে যাওয়ায় জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার অধীনে ঝুপড়ির বাসিন্দাদের যে ঘর দেওয়া হয়, তেমনই একটা ঘর ওয়কীলের পরিবারকে দেওয়া হবে। ওয়কীল অবশ্য বলে দিয়েছেন, তিনি ঠিক ওখানেই তাঁর বাড়ি ফেরত চান। অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে সরকারের দাক্ষিণ্যে কোনো ঘরবাড়ি তিনি চান না। পথে বসে যাওয়া মানুষের পক্ষে জেদ ধরে রাখা শক্ত। বিশেষত যখন তিনি যুগপৎ গরিব এবং সংখ্যালঘু। তাই ওয়কীল নিরুপায় হয়ে কিছুদিন পরে সরকারের দেওয়া বাড়িতে সপরিবারে উঠে গেলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। হয়ত সেটাই অনিবার্য। কিন্তু ওয়কীলের প্রতি যে ব্যবহার করা হল তার আলোকে দেশের শাসনব্যবস্থা তথা গণতন্ত্র নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

ধরে নেওয়া যাক, ওয়কীল জীবনে একটিও নায়কোচিত কাজ করেননি। সিলকিয়ারা টানেলের উদ্ধারকার্যে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি কেবল একজন ছাপোষা ভারতীয়। তাহলেই কি দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির কাজটা বৈধ হয়ে গেল? নাজীব জঙ্গ কিন্তু বলেছেন কোনো অবৈধভাবে নির্মিত বাসস্থান ভেঙে দিতে হলে বসবাসকারীদের অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হয় – আইনে পরিষ্কার লেখা আছে।

মুশকিল হল, গত কয়েক বছরে আমরা এমন বুলডোজারপ্রেমী হয়ে উঠেছি, ক্ষমতাশালীকে অভ্রান্ত ভাবা এমন স্বভাবে পরিণত হয়েছে যে আইন মানা হয়েছে কি না হয়েছে তা নিয়ে আর আমরা ভাবি না। প্রকাশ্যে কারোর নামে একটা অভিযোগ করে দিলেই হল। সকলেই ধরে নিই, অভিযোগটা সত্যি। অর্থাৎ ডিডিএ যখন বলছে, সাংসদ যখন বলছেন, তখন ওয়কীলের বাড়িটা নিশ্চয়ই বেআইনি ছিল। অভিযুক্ত মাত্রেই অপরাধী বলে ধরে নেওয়ার এই মানসিকতার চাষ করা হয়েছে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে, সঙ্গত করেছে দেশের সংবাদমাধ্যম। ভুয়ো ভিডিও, ভুয়ো বলে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত ভিডিও, চালিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া হয়েছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতা চেয়ে স্লোগান দিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা।

সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ এক মামলায় বলেছে, এখন থেকে অভিযুক্তের সম্পর্কে আইনের চিরাচরিত মূল নীতি – ‘নিঃসংশয়ে অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’ – থেকে সরে আসতে হবে; যদি ট্রায়াল কোর্টে অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হয়। এনকাউন্টারে অভিযুক্তদের মেরে ফেলা এবং আন্দোলনকারীদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া তো নিয়মে পরিণত করা হয়েছে বহু রাজ্যে। উত্তরপ্রদেশ সরকার এর জন্যে সুপ্রিম কোর্টের কাছে বকুনি খাওয়ার পরেও বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে প্রতিবাদী স্বর স্তব্ধ করতে বুলডোজার চলছেই। এমনকি তৃণমূলশাসিত পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার চণ্ডীতলাতেও বুলডোজার দিয়ে বিরোধীদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল গতবছর। বুলডোজার ন্যায়কে বৈধতা দিতে মাঠে নেমেছেন বিচারপতিরাও। নিজের রায়ের থেকেও আক্রমণাত্মক বাণী দেওয়ার জন্যে বেশি বিখ্যাত কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি গতবছর এক বেআইনি নির্মাণ সংক্রান্ত মামলায় সগর্বে বলেছিলেন, ‘দরকার পড়লে যোগী আদিত্যনাথের থেকে কিছু বুলডোজার ভাড়া করুন।’

অর্থাৎ আইনের কাছে পুনর্বিবেচনার আবেদনের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, নাগরিকের মৌলিক অধিকার – কোনোকিছুই আর আজকের ভারতে ধ্রুব সত্য নয়। একবার প্রশাসনের কোপে পড়লে আমি নির্দোষ, একথা প্রমাণের দায়িত্ব যে অভিযুক্ত তারই উপরে এসে পড়ছে ক্রমশ।

ফলে ওয়কীলের যা হয়েছে, তাঁর নাবালক ছেলেমেয়েরা যা সহ্য করেছে, তা কাল যে কোনো কারণে আমাদের যে কাউকে সহ্য করতে হতে পারে। ওয়কীল তবু একটা নায়কোচিত কিছু করেছিলেন, তাই গোদি মিডিয়াকেও তাঁর খবর দেখাতে হচ্ছে। দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর বিনয় কুমার সাক্সেনা, সাংসদ মনোজ প্রমুখকে অন্তত মুখে বলতে হচ্ছে – ব্যাপারটা দুঃখজনক, ওঁকে ঘর দেওয়া হবে ইত্যাদি। আমার, আপনার বেলায় তাও হবে না। দেশের বহু মানুষের ইতিমধ্যেই সেই দশা হয়েছে।

যাঁরা ভাবছেন প্রতিবাদে, প্রতিরোধে থাকেন না বলে বেঁচে যাবেন অথবা মুসলমান নন বলে বেঁচে যাবেন, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার কানপুর দেহাতের এক ছোট গ্রামের বাসিন্দা প্রমীলা দীক্ষিত আর তাঁর মেয়ে নেহার কথা। তাঁদের বাড়িও অবৈধ বলে বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে গিয়েছিল প্রশাসন। এক পক্ষ বলে তাঁরা প্রতিবাদে গায়ে আগুন দেন, আরেক পক্ষের বক্তব্য, প্রমীলা আর নেহা বাড়ির ভিতরে থাকা অবস্থাতেই তাঁদের কুঁড়ে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় উচ্ছেদ করতে আসা প্রশাসন। সম্ভবত এঁরা ব্রাহ্মণ বলেই উত্তরপ্রদেশ পুলিস আধিকারিকদের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিল। কিন্তু তাতে তো আর মরা মানুষ বেঁচে ওঠে না। সুতরাং ওয়কীলের সহমর্মী না হওয়া মানে, বুলডোজার ন্যায়কে সমর্থন করা মানে ঘুঁটে পুড়তে দেখে গোবরের মত হাসা।

সম্প্রতি জনপ্রিয় ইউটিউবার ধ্রুব রাঠির একটি ভিডিও প্রচণ্ড ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ভারত ক্রমশ একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে কিনা। তিনি এমন কোনো তথ্য দেননি যা সচেতন ভারতীয়রা এতদিন জানতেন না। বরং অশনি সংকেতগুলোকে একত্র করাই এই ভিডিওতে ধ্রুবের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তবে তিনি একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন – দেশে ভোট হচ্ছে মানেই গণতন্ত্র আছে এমন মনে করা ভুল।

উত্তরপ্রদেশে, দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরী, খজুরি খাসে বা পশ্চিমবঙ্গের চণ্ডীতলায় – কোথাও নির্বিচারে বুলডোজার চলাই গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়। ওয়কীল, মুন্নারা পথে বসলে গণতন্ত্র টেকে না। মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়ে গণতন্ত্র ছাড়াও হতে পারে।

ধৈর্য থাকলে ভেবে দেখতে পারেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বদা গরিব মানুষের বাসস্থানই কেন বেআইনি গণ্য হয়? আর বড়লোকের ছেলের বিয়ের জন্যে কেন রাতারাতি ছোট বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অনুমোদন পেয়ে যায়?

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

স্রেফ কৃষকদের আটকাতে দুর্ভেদ্য দিল্লি!

গণতান্ত্রিক দেশের রাজধানীতে রবারের বুলেট চলতে দেখার অভ্যাস ভারতের নাগরিকদের নেই। সেটা আছে কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের। কাশ্মীরকে শান্ত করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন সম্রাট মোদী। দেখা যাচ্ছে, কাশ্মীরের মত ঘটনা খোদ দিল্লিতে ঘটছে।

দুর্গকে দুর্ভেদ্য করে তুলতে চারপাশে পরিখা কেটে দেওয়ার প্রথা সুপ্রাচীন। ইউরোপ, এশিয়া – সব জায়গার রাজারাই এই পন্থা অবলম্বন করতেন। বর্তমানে কেন্দ্রে সরকার চালাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের ঘোর অপছন্দের মোগল সম্রাটরাও একাজ করেছিলেন। লালকেল্লাকে বেষ্টন করে সেই পরিখা আজও আছে, যদিও এই শীতে সেই পরিখা শুকনো। লালকেল্লার প্রবেশদ্বারে আজ দাঁড়িয়ে আছেন নরেন্দ্র মোদী। সেলফি পয়েন্টে বসে, দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার জন্যে সময়ও ব্যয় করেন অনেক পর্যটক। মোদী ছবির মত, বা সম্রাটের মতই নীরব, এবং তাঁর রাজধানী দিল্লিকে দুর্ভেদ্য করতে এই মুহূর্তে দুর্গের মতই ঘিরে ফেলেছে দিল্লি পুলিস। পার্শ্ববর্তী হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ থেকে যাতে দিল্লিতে ঢোকা না যায় সেজন্য লম্বা লম্বা পেরেক, কংক্রিটের বাধা, কাঁটাতারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কে আসছে দিল্লি আক্রমণ করতে? সুদূর পারস্য থেকে নাদির শাহ? আফগানিস্তান থেকে আহমদ শাহ আবদালী? গজনীর সুলতান মামুদ? অ্যাটিলা দ্য হুন? অ্যালারিক দ্য গথ? না। আসছেন এই দেশের মাটিতে জন্মানো, বেড়ে ওঠা এবং এদেশেরই মাটিতে ফসল ফলানো কৃষকরা। কী জন্যে আবার দিল্লি অভিমুখে চলেছেন কৃষক সংগঠনের আন্দোলনকারীরা? সরকারকে উৎখাত করতে নয়, নিজেদের বহু পুরনো দাবি আদায় করতে। সেই দাবিগুলোর মধ্যে আছে এম এস স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার দাবি। এই সেই স্বামীনাথন, যাঁকে মাত্র কয়েকদিন আগে ভারতরত্ন বলে ঘোষণা করেছে মোদীরই সরকার। তাহলে কৃষকদের ট্র্যাক্টর নিয়ে দিল্লি শহরে ঢুকতে দিতে আপত্তি কিসের? এই কৃষকদের বন্দুক দেখিয়ে লাভ হয় না, ইডি, সিবিআই লেলিয়ে দিয়ে দল ভাঙানোর উপায় নেই, এঁরা পথে নেমে পড়লে দাবি আদায় করে তবেই বাড়ি ফেরেন – এই কি তবে আতঙ্কের কারণ?

মাত্র দুটো শীত কেটেছে, তারপরেই আবার পথে নেমেছেন দেশের কৃষকরা। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সংসদে পাস করা তিনটে নতুন কৃষি আইন বাতিল করার দাবিতে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা অগ্রাহ্য করে ২০২০ থেকে ২০২১ দিল্লির রাস্তায় বসেছিলেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। প্রবল প্রতাপান্বিত সরকার প্রথমে তাঁদের দাবিতে আমল দিতে চায়নি, তারপর আলোচনায় বসেছে, একইসঙ্গে বশংবদ প্রচারমাধ্যমকে দিয়ে দেশের বাকি মানুষের কাছে আন্দোলনকারীদের ভণ্ড, সন্ত্রাসবাদী, দেশবিরোধী ইত্যাদি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। বহু কৃষক সেই দীর্ঘ আন্দোলনে থাকতে থাকতে পথেই প্রাণ হারিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলের গাড়ি চারজন কৃষককে পিষে দিয়েছে। কিন্তু আন্দোলন থামেনি। কৃষকদের ঘিরে ফেলতে সরকারের ঝুলি থেকে ব্যারিকেড, কাঁটাতার বেরিয়েছে তখনই। কিন্তু কৃষকরা পিছু হটেননি, নিজেদের দাবিতে অনড় থেকেছেন এবং শেষপর্যন্ত বিরোধী দলের সাংসদরা সংখ্যার কারণে সংসদে যে আইনগুলো পাস হওয়া আটকাতে পারেননি, সেগুলোকে বাতিল করিয়ে তবেই দিল্লি ছেড়েছেন। আর ২-৩ মাসের মধ্যেই নির্বাচন। এই সময় কৃষকদের চাপের কাছে ফের মাথা নোয়াতে হলে সম্রাট মোদীর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষমতায় ফেরার পথে মাথা তুলে দাঁড়াবে কাঁটা – একথা ভেবেই কি কেন্দ্রীয় সরকার আক্রান্ত?

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, ১৪ ফেব্রুয়ারির দিল্লি অভিযানে হরিয়ানার কৃষকদের যোগ দেওয়া আটকাতে সে রাজ্যের বিজেপি সরকারের পুলিস এলাকায় এলাকায় হুমকি দিচ্ছে, যারা আন্দোলনে যাবে তাদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হবে। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে।

হরিয়ানা পুলিস ড্রোন থেকে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার মহড়া দিয়েছে। সে মহড়া কাজে লাগানো হয়েছে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে, শম্ভু সীমান্তে ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালেও। চালানো হয়েছে জলকামান, এমনকি রবারের বুলেটও।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

গণতান্ত্রিক দেশের রাজধানীতে রবারের বুলেট চলতে দেখার অভ্যাস ভারতের নাগরিকদের নেই। সেটা আছে কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের। কাশ্মীরকে শান্ত করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন সম্রাট মোদী। দেখা যাচ্ছে, কাশ্মীরের মত ঘটনা খোদ দিল্লিতে ঘটছে। আসলে সরকারের অপছন্দের কথা বললেই তার বিরুদ্ধে চলবে যাবতীয় অস্ত্র। জায়গাটা কাশ্মীর হোক, মণিপুর হোক আর দিল্লিই হোক। কাশ্মীরে না হয় ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিপদ আছে, মণিপুরে আছে মেইতেই বনাম কুকি সংঘর্ষ। দিল্লিতে তো কৃষকরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লড়তে আসছিলেন না। তাহলে এত বাধা তৈরি করা কেন? কার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলে সন্দেহ করছে সরকার? জানার কোনো উপায় নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন, হিংসায় কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। কৃষকদের আলাপ আলোচনা করা উচিত। সরকার আলোচনা করতে চায়, করছেও। তিনি অবশ্য বলেননি, আলোচনা করতে হলে দিল্লি শহরকে দুর্গম গিরি কান্তার মরু করে তুলতে হবে কেন? কেনই বা আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করতে হবে?

গত দুদিনের ঘটনাবলী থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যেও উঠে আসছে একগুচ্ছ প্রশ্ন। বিভিন্ন রাজ্যের, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতের, নানা আদর্শের কৃষকরা তাঁদের দাবির ভিত্তিতে একজোট হয়ে এত আক্রমণের সামনেও এক হয়ে হার-না-মানা আন্দোলন করতে পারেন। অথচ বিরোধী দলগুলো পারে না কেন? তাদের সরকারবিরোধিতা কেবল কিছু বক্তৃতা, যাত্রা আর নির্বাচনে আসন ভাগাভাগিতে সীমাবদ্ধ থেকে যায় কেন? দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষের অসন্তোষকে পুঞ্জীভূত করে গণআন্দোলনের রূপ দেওয়ার কাজে খামতি থেকে যাচ্ছে কেন? যে সরকার কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বহিঃশত্রুর মত ব্যবহার করে, পেশিশক্তির পূর্ণ ব্যবহার করে, তাকে স্রেফ নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি আর আসন সমঝোতা করে হারিয়ে দেওয়া যাবে – এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে কী করে দিন কাটাচ্ছেন ভারতের বিরোধী নেতৃবৃন্দ?

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

১৪৬ বছর ধরে ক্ষমতা দেখিয়ে চলেছে বুলডোজার

 “বুলডোজার, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?”

রাজধানী দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেরও তোয়াক্কা না করা বুলডোজারে বাড়িঘর, দোকানপাট গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল যাঁদের, তাঁরা এই প্রশ্ন করেছিলেন কিনা জানি না। তবে বৃন্দা কারাত নিশ্চিত জানতেন, বুলডোজার কখনো পথ হারায় না। যন্ত্র হলেও সে নিজের পক্ষ সম্পর্কে রীতিমত সচেতন। সেই ১৮৭৬ সাল থেকে সে ক্ষমতা প্রদর্শনের কাজ করে যাচ্ছে।

সে বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী রাদারফোর্ড বি হেস আর ডেমোক্র্যাট স্যামুয়েল টিলডেনের লড়াইতে বারবার এসে যেত বুলডোজারের কথা। বুলডোজ করা বলতে বোঝানো হত কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের উপর অত্যাচার করে, ভয় দেখিয়ে তাদের ভোটদানে বিরত করা। অবাক হচ্ছেন? ভেবেছিলেন চড়াম চড়াম ঢাকের বাদ্যি আমাদের নিজেদের আবিষ্কার? তা-ও কি হয়? আমরা না অহিংস জাতি? বরং বলা যায় আমেরিকা যেখানে, বুলডোজার সেখানে। ওসামা বিন লাদেনের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ও দিয়েই। আমেরিকা সমর্থিত ইজরায়েলের সেনাবাহিনীকেও গাজায় প্যালেস্তিনীয় যুবকের মৃতদেহ বুলডোজার দিয়ে পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। আবার আফগানিস্তানের প্রাক্তন সিআইএ এজেন্ট গুল আগা শেরজাই, যে এখন তালিবান সরকারের শরিক, তার নাঙ্গারহার প্রদেশের শাসক থাকার সময়ে (২০০৫-২০১৩) নামই হয়ে গিয়েছিল বুলডোজার। কারণ প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে গেলেই সাধারণ মানুষ তার কাছে অসমাপ্ত রাস্তা তৈরি করার আবেদন জানাত। শেরজাই নাকি পত্রপাঠ বুলডোজার চালিয়ে কাজ শুরু করে দিত।

আসলে চাষবাসের কাজে লাগবে বলে তৈরি বুলডোজারের ব্যবহার ক্রমশই শহুরে হয়ে উঠেছে। পালোয়ানরা পেশি ফোলায়, ক্ষমতাশালীরা বুলডোজার ফলায়। জরুরি অবস্থার সময়ে ভারতভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠা সঞ্জয় গান্ধীও পুরনো দিল্লির সৌন্দর্যায়নের নাম করে ওই যন্ত্র চালিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে এই এপ্রিল মাসেই সঞ্জয়ের ডান হাত আমলা জগমোহনের (সেই জগমোহন, যিনি ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যার সময়ে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল ছিলেন এবং পরে বিজেপিতে যোগ দেন) উদ্যোগে লালকেল্লা, জামা মসজিদ এবং এবং তুর্কমান গেট সংলগ্ন এলাকা চিহ্নিত করা হয় বস্তি উচ্ছেদ করে সৌন্দর্যায়নের জন্য। তা করতে গিয়ে অশান্তি দেখা দিলে ওই এলাকার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হয়, কিন্তু তুর্কমান গেটের বাসিন্দারা নাছোড়বান্দা। ১৮ এপ্রিল পুলিস প্রতিবাদীদের উপর গুলি চালায়, অনেকের মৃত্যুও হয়। বিবিসির মত বিদেশি সংবাদমাধ্যমের মতে, বেশকিছু প্রতিবাদীকে বুলডোজার দিয়ে পিষেও দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন শাহীনবাগ: কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে…

অতএব যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজার, মধ্যপ্রদেশের খারগোনে শিবরাজ সিং চৌহানের বুলডোজার বা দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীর — ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা মেনেই এগিয়েছে। তবে আরেকটা ব্যাপারেও ইতিহাস দারুণ ধারাবাহিক। তা হল গা-জোয়ারি শাসককে শেষপর্যন্ত বুলডোজ করে দেওয়া। এই বিধির বাঁধন কাটবার মত শক্তিমান বুলডোজার সম্ভবত এখনো তৈরি হয়নি।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত