আবার ফাইনালে হার, ফাটানো যাক দু-একটা বুদ্বুদ এবার

ভারতীয় ক্রিকেটের গোটা বাস্তুতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে সত্যকে অস্বীকার করে। বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের পর একাধিক ক্রিকেট ওয়েবসাইট এবং পরিসংখ্যানবিদ সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন একটা পরিসংখ্যান – ভারত গত তিনটে বিশ্বকাপে মাত্র চারটে ম্যাচ হেরেছে। এমন অনর্থক পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বা এদেশের অন্য কোনো খেলায় হয় না।

সপ্তাহের অর্ধেক কেটে গেল, বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের শোকপালন এখনো শেষ হল না। সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের খোঁজ নিয়েছেন কিনা জানি না, তবে ফাইনালের পর পরাজিত ভারতীয় দলের সদস্যদের পিঠ চাপড়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সাজঘরে গেছেন। দলের প্রত্যেককে আলাদা করে সান্ত্বনা দিয়েছেন, মহম্মদ শামির মাথাটাকে নিজেদের কাঁধে ঠেসে ধরেছেন, তারপর স্লো মোশনে আবেগাকুল আবহসঙ্গীত সহকারে বেরিয়ে এসেছেন – এই ভিডিও মুক্তি পেয়েছে। অতএব এই শোক পর্ব নির্ঘাত দীর্ঘায়িত হবে। আগে মানুষ শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যেত, আজকাল আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। শোকের জন্যে যাকে দায়ী করে তার মেয়ে, বউকে ধর্ষণের হুমকি দেয়। অন্তত সেইটা আশা করা যায় আজ সন্ধে থেকে বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কুড়ি বিশের সিরিজ শুরু হয়ে যাচ্ছে। সূর্যকুমার যাদবের নেতৃত্বাধীন দল যদি অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিতে পারে তাহলে তো কথাই নেই। গলার শির ফুলিয়ে সেই কথা বলা যাবে যা এখন বিনীতভাবে বলা হচ্ছে – আমাদের দলটাই সেরা, ওই দিনটা খারাপ গেছিল আর কি। মোদ্দাকথা, কেন আরও একবার একটা আইসিসি ট্রফি জিততে ব্যর্থ হলাম তার কোনো ক্রিকেটিয় বিশ্লেষণ হবে না।

কে-ই বা সেটা চায়? ভারতের কোনো প্রাক্তন ক্রিকেটার কোনো ত্রুটি তুলে ধরেছেন? গত কয়েকদিন বাংলা কাগজ-টাগজ ঘেঁটেও কোথাও রবিবারের হারের কোনো বিশ্লেষণ চোখে পড়ল না। কার চোখে কত জল কেবলই তা মাপা চলছে। সব সংবাদমাধ্যম ‘খলনায়ক’ খুঁজতে শুরু করেনি এটা যতখানি স্বস্তিদায়ক, ততটাই অস্বস্তির কারোর কোনো ক্রিকেটিয় ব্যাখ্যায় না যাওয়া। দল জেতে ক্রিকেটারদের মুনশিয়ানায় আর হারে কপালের দোষে – এই যদি ক্রিকেটভক্ত, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক এবং টিম ম্যানেজমেন্টের মিলিত সিদ্ধান্ত হয় তাহলে দশ বছর কেন; বিশ বছরেও ট্রফির খরা কাটা শক্ত।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি, বিশ্বকাপ – একটা করে প্রতিযোগিতার কোনো একটা স্তরে ভারতীয় দল মুখ থুবড়ে পড়ে আর ভারতের তাবড় প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার আর সাংবাদিকরা মূলত দুটো কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকেন – ১) একটা খারাপ দিন একটা ভাল দলকে রাতারাতি খারাপ করে দেয় না, ২) ভাগ্য খারাপ, তাই খারাপ দিনটা ফাইনালেই এল। কী আর করা যাবে?

সব দেশেই খেলা সম্পর্কে সাধারণ দর্শকের মতামত গঠনে প্রধান ভূমিকা নেন বিশেষজ্ঞ আর সাংবাদিকরা। তাঁরাই দিনের পর দিন এসব বলে চললে ক্রিকেটভক্তদের দোষ দেওয়া যায় না। সবাই তো আর দেখতে পান না অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তনরা নিজেদের দল হারলে (এমনকি জিতলেও) কীরকম চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, ছোট ছোট ত্রুটিকেও রেয়াত করেন না ধারাভাষ্যে। ভারতের বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিককুল বিসিসিআই প্রযোজিত টিভি সম্প্রচারের আমলে, কর্তাদের চটালে মাঠে ঢোকার অনুমোদন না পাওয়ার যুগে দেশসুদ্ধু লোককে শিখিয়ে দিয়েছেন যে জিতলে সমালোচনা করা হল ছিদ্রান্বেষণ আর হারলে সমালোচনা করতে নেই। দলের পাশে দাঁড়াতে হয়। মুশকিল হল, বারবার ব্যর্থতার ফলে ব্যাপারটা বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর মত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পরপর দশটা ম্যাচ জেতার পরে একটা ম্যাচ হেরেছে বলে একথা একটু বেশি কটু শোনাতে পারে। কিন্তু আসলে তো একটা ম্যাচ নয়, ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট জিততে পারেনি ভারত। দ্বিপাক্ষিক সিরিজের বাইরে জয় বলতে ২০২৩ এশিয়া কাপ। কিন্তু ক্রিকেট বহির্ভূত কারণে (ক্রিকেটিয় কারণ বাদই দিলাম) পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের যা অবস্থা তাতে ওটাও না জিতলে আর দল রাখার মানে কী?

আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের গোটা বাস্তুতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে সত্যকে অস্বীকার করে। বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের পর একাধিক ক্রিকেট ওয়েবসাইট এবং পরিসংখ্যানবিদ সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন একটা পরিসংখ্যান – ভারত গত তিনটে বিশ্বকাপে মাত্র চারটে ম্যাচ হেরেছে। এমন অনর্থক পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বা এদেশের অন্য কোনো খেলায় হয় না। প্রাথমিক স্তরের ম্যাচের সংখ্যা নক আউট পর্যায়ের চেয়ে কম তো হবেই। প্রাথমিক স্তরের বেশিরভাগ ম্যাচ না জিতলে নক আউটে ওঠা যায় না। সেমিফাইনাল তো দুটোই হয়, ফাইনাল একটা। জগতে যতদিন পাটিগণিত আছে, ততদিন এমনটাই হবে। পিভি সিন্ধু কোনো প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে বা ফাইনালে হারলে তাঁর পক্ষ নিয়ে কেউ বলে না, অধিকাংশ ম্যাচই তো জিতেছিল। অতএব চ্যাম্পিয়ন না হলেও ও-ই সেরা খেলোয়াড়। ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে পরাজিত দলের সমর্থকরা ঝরঝরিয়ে কাঁদেন, অনেকে ক্ষিপ্তও হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁরা বা তাঁদের দেশের প্রাক্তন ফুটবলাররা কখনো বলেন না, অধিকাংশ ম্যাচ জিতেছি। অতএব চ্যাম্পিয়ন না হলেও আমরাই সেরা দল। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে এই জাতীয় নির্বুদ্ধিতার প্রদর্শনী দশ বছর ধরে প্রত্যেক প্রতিযোগিতার পরেই হয়ে থাকে। মায়াবাদের দেশ ভারতবর্ষে কেউ একথা স্বীকার করতে রাজি নন, যে নক আউটে বারবার হার অঘটন হতে পারে না। নিজেদের মধ্যে গলদ আছে, সে গলদ খুঁজে বার করতে হবে এবং সংশোধন করতে হবে। আসলে স্বীকার করতে গেলেই একগাদা অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, অনেক সযত্নলালিত বুদ্বুদ দুম ফটাস হয়ে যাবে। তাতে এই যে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্রিকেট বাণিজ্য, তার সঙ্গে যুক্ত বিবিধ কায়েমি স্বার্থে ঘা লাগবে।

সেই বুদ্বুদগুলোর আলোচনায় যাওয়ার আগে বলে নেওয়া যাক, ক্রিকেট বাস্তুতন্ত্রের কেউ কেউ কখনো কখনো স্বীকার করেন যে বারবার আইসিসি টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হওয়া একটা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। কিন্তু তাঁরাও ব্যাপারটাকে স্রেফ মানসিক বলে আখ্যা দেন। যদি সেটাই ঠিক হয়, তাহলে খেলোয়াড়দের মানসিক সমস্যা দূর করার যেসব অত্যাধুনিক ব্যবস্থা আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানে আছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ডকে সেগুলো ব্যবহার করতে আটকাচ্ছে কে? নাকি সেসব করেও ফল একই থেকে যাচ্ছে? এসব প্রশ্ন ক্রিকেট বাস্তুতন্ত্রের লোকেরা তোলেন না।

এবার বুদ্বুদগুলোর দিকে তাকানো যাক।

১. বেশিরভাগ ম্যাচে জয়

এবারের মত বিশ্বকাপে পরপর দশটা ম্যাচ ভারত কখনো জেতেনি, তার চেয়েও বড় কথা এমন দাপটে জেতেনি। সেই কারণে এই দলের বাহবা প্রাপ্য, কিন্তু সেই সুবাদে ২০১৫ আর ২০১৯ সালের ভারতীয় দলগুলোকেও স্রেফ বেশিরভাগ ম্যাচ জেতার জন্য একইরকম ভাল বলে প্রমাণ করতে চাইলে কিছু অপ্রিয় প্রসঙ্গ না তুলে উপায় থাকে না।

২০০৭ সালে ভারত ভীষণ সহজ গ্রুপে ছিল (অন্য দলগুলো বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং বারমুডা)। তা সত্ত্বেও গ্রুপ স্তর থেকেই বিদায় নেয়। ভারত যেহেতু সবচেয়ে জনপ্রিয় দল, তাই তারা বিদায় নিলে মাঠ ভরে না। তার চেয়েও বড় কথা টিভি রেটিংয়ের বারোটা বেজে যায়। বিজ্ঞাপনদাতাদের বিপুল লোকসান হয়। আইসিসি সেবার বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে ভবিষ্যতে ভারতের দ্রুত বিদায়ের সম্ভাবনা নির্মূল করতেই হত। তাই ২০১১ বিশ্বকাপে ফরম্যাটই বদলে ফেলা হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে চালু হয়েছিল গ্রুপ লিগের পর সুপার সিক্স (২০০৭ সালে সুপার এইট) স্তর, তারপর সেমিফাইনাল, ফাইনাল। ২০১১ সালে ফিরে যাওয়া হল ১৯৯৬ সালের ফরম্যাটে। প্রথমে থাকল গ্রুপ স্তর (সাত দলের), তারপর কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল, ফাইনাল। অর্থাৎ একটা দল (পড়ুন ভারত) কমপক্ষে ছটা ম্যাচ খেলবেই গ্রুপ স্তরে, ফাইনাল পর্যন্ত গেলে নটা। ২০১৫ সালে ভারত ছিল পুল বি-তে। সেখানে বাকি ছটা দলের মধ্যে তিনটের নাম আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবোয়ে আর সংযুক্ত আরব আমীরশাহী। বাকি তিনটে দলের মধ্যে ছিল ক্ষয়িষ্ণু ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই পুলের সব ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার জন্যেও আলাদা হাততালি প্রাপ্য? কোয়ার্টার ফাইনালে আবার প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে কঠিন প্রতিপক্ষের সামনে পড়ামাত্রই মহেন্দ্র সিং ধোনির দল দুরমুশ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া জেতে ৯৫ রানে।

পরের বিশ্বকাপে ফের ফরম্যাট বদলে ফেলা হয়, অনিশ্চয়তা আরও কমিয়ে আনা হয়। বিশ্বকাপ ফুটবল জিততে হলে চার-চারটে নক আউট ম্যাচ জিততে হয়। কিন্তু ২০১৯ থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিততে হলে মোটে দুটো – সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। ২০০৭ সালের ১৬ দলের বিশ্বকাপকে ছোট করতে করতে করে দেওয়া হল দশ দলের। সবাই সবার বিরুদ্ধে খেলবে, অর্থাৎ কমপক্ষে নটা ম্যাচ খেলা নিশ্চিত হল। প্রথম চারে থাকলেই সোজা সেমিফাইনাল, সেখান থেকে দুটো ম্যাচ জিতলেই কেল্লা ফতে। এই ব্যবস্থায় ভারত আর নিউজিল্যান্ডের লিগের ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেস্তে যায়, ইংল্যান্ড বেশ সহজেই ভারতকে পরাস্ত করে। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড ভারতকে হারিয়ে দেয়।

আগের লেখাতেই লিখেছি, কীভাবে ত্রিদেব শুকিয়ে মারছে বাকি ক্রিকেট দুনিয়াকে। যাঁদের সত্যিই শুধু ক্রিকেটার নয়, ক্রিকেটের প্রতিও ভালবাসা আছে এবং দশ বছরেরও বেশি আগের ক্রিকেট সম্পর্কে জানা আছে, তাঁরা নিশ্চয়ই মানবেন যে ২০১১ সালের পর থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান যেখানে পৌঁছেছে তাতে বিশ্ব ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে তিন-চারটে দলের মধ্যে। এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখাল, কিন্তু ২০১৯ সালে তাদের অবস্থা ছিল টালমাটাল। ফলে আসলে বিশ্বকাপের দাবিদার ছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড। ভারত একমাত্র অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পেরেছিল। বাকি দুই দলের কাছেই হারে। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে গ্রুপের খেলায় হারতে হয়েছিল শ্রীলঙ্কার কাছে আর ফাইনালে শোচনীয় হার হয়েছিল পাকিস্তানের কাছে। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির আলোচনায় যাওয়া অর্থহীন, কারণ সেখানে ২০০৭ সালে খেতাব জয় বাদ দিলে ভারতের অবস্থা আরও করুণ।

সুতরাং বেশিরভাগ ম্যাচে জেতার তথ্যকে গলার মালা করে লাভ নেই। সমস্যাটাও মোটেই স্রেফ মানসিক নয়, দক্ষতাজনিত।

২. দক্ষতার দিক থেকে বিশ্বসেরা

বিশ্বসেরার শিরোপা যে নেই তা তো বলাই বাহুল্য, কিন্তু দক্ষতার দিক থেকে বিশ্বসেরা – এই ধারণাও দাঁড়িয়ে আছে নরম মাটির উপরে। ক্রিকেটে কোনোদিনই দক্ষতা মানে কেবল ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং করার পারদর্শিতা নয়। সঠিক পরিকল্পনার দক্ষতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। আজকের ভিডিও অ্যানালিসিস ইত্যাদি অতি উন্নত প্রযুক্তির যুগে সঠিক পরিকল্পনার গুরুত্ব ও ক্ষমতা আরও বেড়ে গেছে। ভারতীয় দল কি সেইখানে অন্য দলগুলোর সমতুল্য? স্মৃতিতে এখনো টাটকা এবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল দিয়েই দেখা যাক।

ফাইনালে

ম্যাচের প্রথম বল থেকেই পরিষ্কার হয় যে অস্ট্রেলিয়া একবার ভারতের সঙ্গে খেলা হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার খেলতে এসেছে অনুপুঙ্খ পরিকল্পনা নিয়ে। প্রত্যেক ভারতীয় ব্যাটারের জন্যে ছিল আলাদা আলাদা পরিকল্পনা।

রোহিত শর্মা প্রত্যেক ম্যাচে ঝোড়ো সূচনা করেছেন, তাঁর বেশিরভাগ চার ছয় হয়েছে অফ সাইডে পয়েন্টের পর থেকে মিড অফ পর্যন্ত এলাকা দিয়ে আর লেগ সাইডে স্কোয়্যার লেগ দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া ঠিক ওই দুই জায়গায় সীমানার ধারে ফিল্ডার রেখে বল করা শুরু করে। তার উপর আগের ম্যাচগুলো ভারত যেসব মাঠে খেলেছে তার তুলনায় নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের মাঠ বড়। অন্য ম্যাচে যেসব শটে চার বা ছয় হচ্ছিল, সেগুলোতে এক-দুই রান হতে শুরু করল। ফলে প্রথম দু-এক ওভার রোহিতকে কিছুটা হতাশ করে। তিনি অবশ্য একটু পরেই এই পরিকল্পনাকে পরাস্ত করে মারতে শুরু করেন। তখন আসে দ্বিতীয় পরিকল্পনা। পাওয়ার প্লে শেষ না হতেই গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে দিয়ে স্পিন করানো, যাতে জোরে বোলারের গতি রোহিতকে বড় শট নিতে সাহায্য না করে। তাঁকে যেন অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করতে হয়, ভুল করার সম্ভাবনা বাড়ে। ম্যাক্সওয়েল প্রথমে মার খেলেও শেষপর্যন্ত এই পরিকল্পনায় ফল হয়, রোহিত বড় শট নিতে গিয়ে আউট হয়ে যান।

শুভমান গিলের মূল শক্তি পয়েন্ট থেকে কভার পর্যন্ত অঞ্চল দিয়ে সামনের পায়ে ড্রাইভ করে বাউন্ডারি পাওয়া আর সামান্য খাটো লেংথের বলে একটুখানি হাত খোলার জায়গা পেলেই স্কোয়্যার কাট করা। তাঁকে কাট করার কোনো সুযোগই দেওয়া হল না এবং অফ সাইডে ফিল্ডারের ভিড় জমিয়ে দেওয়া হল। গিল নিজেও জানেন তাঁর ড্রাইভ কখনো কখনো কিছুটা পথ হাওয়ায় যাত্রা করে, তার উপর সেদিনের পিচটা ছিল মন্থর। ফলে তেমন হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি। সেই ভাবনায় বিব্রত রাখতে শর্ট কভার দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল মুখের সামনে। গিল রান করার জায়গা খুঁজে না পেয়ে হাঁসফাঁস করলেন, তারপর অফের বল জোর করে লেগে ঘুরিয়ে মারতে গিয়ে মিড অনে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন।

বিরাট কোহলিকে চটপট আউট করতে হলে ক্রিজে এসেই তিনি যে খুচরো রান নিতে শুরু করেন তা আটকাতে হয়। লখনৌতে পিচ ছিল আমেদাবাদের মতই মন্থর। সেখানে ইংল্যান্ড কভারে, মিড উইকেট, মিড অফ, মিড অনে লোক দাঁড় করিয়ে সফলভাবে আট বল কোনো রান করতে দেয়নি। নবম বলে তিনি ধৈর্য হারিয়ে জোরে ড্রাইভ করতে গিয়ে মিড অফে ক্যাচ দিয়ে আউট হন। অস্ট্রেলিয়াও তাঁকে মোটামুটি চুপ রাখছিল, কিন্তু মিচেল স্টার্ক একটা ওভারে নো বল করার পর খেই হারিয়ে ফেললেন। কোহলি পরপর তিনটে চার মেরে দিলেন। পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। তবু অস্ট্রেলিয়া কোনো সময়েই তাঁকে শট নেওয়ার জন্যে বেশি জায়গা দেয়নি, হাফভলি প্রায় পাননি। যে পিচে বল ব্যাটে আসছে না, সেখানে কোহলির পছন্দের খেলা – বলের গতিকে ব্যবহার করে ফিল্ডারদের ফাঁকে বল ঠেলে দিয়ে দৌড়ে রান নেওয়া – বেশ শক্ত। অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স সমেত সব জোরে বোলারই স্লোয়ারের উপর জোর দিচ্ছিলেন। মোটেই দরকার অনুযায়ী রান হচ্ছিল না। উলটো দিকে কে এল রাহুল তো সেদিন বিশ্বকাপের মন্থরতম অর্ধশতরান করেছেন। ফলে কোহলির উপর চাপ বাড়ছিল। যতই মনে হোক তিনি নিশ্চিত শতরানের দিকে এগোচ্ছিলেন আর কপাল দোষে কামিন্সের বলটা ব্যাটে লেগে উইকেটে পড়ল, আসলে কোহলি কখনোই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। ওই পিচে বারবার স্কোয়্যারে বল ঠেলে রান নিতে থাকলে গায়ের দিকে আসা খাটো লেংথের বলে ওভাবে প্লেড অন হওয়া মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।

রাহুলের জন্যে কোনো পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়েনি হয়ত। তিনি বেশ কিছুদিন হল একদিনের ক্রিকেট তো বটেই, কুড়ি বিশের ক্রিকেটেও এমনভাবে ব্যাট করেন যা দেখে মনে পড়ে কবীর সুমনের গান “ও গানওলা, আরেকটা গান গাও। আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই।” সেমিফাইনালে যেরকম নির্ভেজাল পাটা উইকেট পাওয়া গিয়েছিল এবং দেরিতে ব্যাট করতে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন, একমাত্র সেরকম ক্ষেত্রেই রাহুলকে চার ছয় মারতে ইচ্ছুক দেখা যায়। অন্যথায় তিনি ওরকম মন্থর ব্যাটিংই করেন, তারপর হয় স্টার্কের বলটার মত একটা দারুণ বলে আউট হয়ে যান, নয়ত উপায়ান্তর নেই দেখে মারতে গিয়ে আউট হন।

মধ্যে ছিলেন শ্রেয়স আয়ার। তাঁর জন্যেও স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। সাংবাদিক সম্মেলনে শর্ট বল নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি যতই রাগ করুন আর শ্রীলঙ্কা বা নিউজিল্যান্ডের বোলারদের বিরুদ্ধে যতই শতরান হাঁকান; কামিন্স, স্টার্ক, জশ হেজলউডের মত দীর্ঘদেহী জোরে বোলারদের বিরুদ্ধে তিনি যে সামনের পায়ে আসতে ইতস্তত করেন তা সাদা চোখেই দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক তাঁকে গুড লেংথে বল করলেন, তিনি সামনের পায়ে না এসে দোনামোনা করে খেলে খোঁচা দিয়ে ফেললেন।

সূর্যকুমার যাদবের শক্তি হল বোলারদের গতিকে কাজে লাগিয়ে মাঠের দুরূহ কোণে বল পাঠানো। আমেদাবাদের পিচে সে কাজটা এমনিতেই শক্ত ছিল। তার উপর অস্ট্রেলিয়া তাঁকে কোনো গতিই দেয়নি। যে বলে আউট হলেন সেটাও ছিল হেজলউডের মন্থর গতির খাটো লেংথের বল।

রবীন্দ্র জাদেজা টেস্টে ব্যাট হাতে দিব্যি ধারাবাহিক, একদিনের ক্রিকেটে মোটেই তা নন। তবু কেন তাঁকে সূর্যকুমারের আগে পাঠানো হয়েছিল তা রোহিত আর রাহুল দ্রাবিড়ই জানেন। কিন্তু তিনিও অলরাউন্ডারসুলভ কিছু করে উঠতে পারেননি। অনেকগুলো বল খেলে মোটে নয় রান করে অসহায়ের মত আউট হন।

এত পরিকল্পনার বিপরীতে ভারতের পরিকল্পনা কীরকম ছিল?

দুনিয়াসুদ্ধ লোক জানে ডানহাতি জোরে বোলার রাউন্ড দ্য উইকেট বল করলে ডেভিড ওয়ার্নার অস্বস্তি বোধ করেন। ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড সব ধরনের ক্রিকেটেই তাঁকে ওইভাবে বল করে বহুবার আউট করেছেন। অথচ মহম্মদ শামি শুরু করলেন যথারীতি ওভার দ্য উইকেট এবং চার হল। ওয়ার্নার ভাগ্যিস আত্মঘাতী শট খেলে আউট হয়ে গেলেন।

ট্রেভিস হেডের অস্বস্তি যে শরীর লক্ষ করে ধেয়ে আসা খাটো লেংথের বলে, তাও সুবিদিত। কিন্তু শামি আর যশপ্রীত বুমরা – দুজনেই তাঁকে অফস্টাম্পের বাইরে বল দিয়ে গেলেন, তিনিও বলের লেংথ অনুযায়ী কখনো সামনের পায়ে কখনো পিছনের পায়ে কভার, মিড অফ দিয়ে রান করে গেলেন। যতক্ষণে মহম্মদ সিরাজ তাঁকে শরীর লক্ষ করে বল করা শুরু করলেন ততক্ষণে ট্রেভিস হেড ক্রিজে জমে গেছেন।

মারনাস লাবুশেন আরেকটু হলে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দলে সুযোগই পেতেন না। কারণ তিনি বড় শট নিতে পারেন না বললেই হয়। তাই তাঁর কাজ একটা দিক ধরে থাকা, খুচরো রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখা। এটাও গোপন তথ্য নয়। খুচরো রান নিতে না পারলেই যে লাবুশেন হাঁকপাক করেন, বিশেষ করে স্পিনারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক শট নিতে গিয়ে বিপদে পড়েন তা চেন্নাইয়ের ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচেও দেখা গিয়েছিল। অথচ ফাইনালে তিনি ব্যাট করতে আসার পরে তাঁর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করার কোনো চেষ্টা হয়েছিল কি? এক প্রান্ত থেকে স্পিনার এনে মুখের সামনে ফিল্ডার দাঁড় করিয়েও অন্যরকম চেষ্টা করা যেত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে যে দল পরিকল্পনার দক্ষতায় প্রতিপক্ষের থেকে এতখানি পিছিয়ে থাকে, তাকে দক্ষতায় বিশ্বসেরা কী করে বলা যায়?

. এক দিনের ভুল

কেউ বলতেই পারেন, একটা ম্যাচ হারলেই এত কিছুকে ভুল বলে দেগে দেওয়া অন্যায়। ওই পরিকল্পনা নিয়েই তো টানা দশটা ম্যাচ জিতেছে। ঘটনা হল, ফাইনাল আর দশটা ম্যাচের মতই আরেকটা ম্যাচ – একথা মাইকের সামনে বলতে ভাল, শুনতে আরও ভাল। কিন্তু কোনো ভাল দল ওই কথা বিশ্বাস করে বসে থাকে না। ফাইনালে তো বটেই, যে কোনো নক আউট ম্যাচেই সকলে বেশি তৈরি হয়ে আসে। অস্ট্রেলিয়াই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। আর গত দশ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ভারত আলাদা প্রস্তুতি নেয় না। সেই কারণেই বারবার অপ্রস্তুত হয়।

এই প্রস্তুতিহীনতা অবশ্য কেবল নক আউটের ব্যাপার নয়, এই বিশ্বকাপের ব্যাপারও নয়। মহেন্দ্র সিং ধোনির আমল থেকেই স্টেজে মেরে দেওয়ার প্রবণতা আর কিছু গোঁড়ামি ভারতীয় দলের মজ্জাগত হয়ে গেছে। সেগুলো কী কী কারণে নক আউটের আগে ভারতকে অসুবিধায় ফেলে না তা যাঁরা এতদূর পড়ে ফেলেছেন তাঁরা বুঝে ফেলেছেন। এবার প্রবণতাগুলো কী তা দেখে নেওয়া যাক:

বিশ্বকাপের দল তৈরি করতে হয় চার বছর ধরে। কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপের পরের চার বছরেও ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট একজন চার নম্বর ব্যাটার ঠিক করতে পারেনি। ২০১৮ সালে অধিনায়ক কোহলি বলে দিয়েছিলেন, আম্বাতি রায়ুডুই হবেন বিশ্বকাপের চার নম্বর। শেষমেশ যখন বিশ্বকাপের দল ঘোষণা হল তখন দেখা গেল রায়ুডু আদৌ দলে নেই। বিজয়শঙ্কর বলে একজন হঠাৎ টিম ম্যানেজমেন্টের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিলেন। কেন তা আজও বোঝা যায়নি। প্রায় খেলা ছেড়ে দেওয়া দীনেশ কার্তিকও বিশ্বকাপ খেলতে চলে গেলেন, রায়ুডু বাদ। দলের অত গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা নিয়ে অমন ফাজলামি করে কোনো দল কোনোদিন বিশ্বকাপ জেতেনি। পরের চার বছরেও বিস্তর কাটা জোড়ার পরে শ্রেয়সে মনস্থির করতে পারল টিম ম্যানেজমেন্ট, কিন্তু হার্দিক পান্ডিয়া ছাড়া অলরাউন্ডার পাওয়া গেল না। তাঁর বদলে কাজ চালাতে পারেন ভেবে যাঁকে নেওয়া হয়েছিল, সেই শার্দূল ঠাকুরকে বল হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। ব্যাটেও তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেন না। সেই যে অস্ট্রেলিয়ায় একটা টেস্টে রান করে দিয়েছিলেন, সেই ভরসাতেই আজও তাঁকে অলরাউন্ডার বলে চালানো হচ্ছে। এ সমস্যার একটা সহজ সমাধান হতে পারত, যদি ভারতের ব্যাটাররা কেউ কেউ কাজ চালানোর মত বোলিং করতে পারতেন। এই বিশ্বকাপে যেখানে উইকেটে বল ঘুরেছে, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে কাজ চালানোর চেয়ে বেশি কাজই করেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল আর হেড। নিউজিল্যান্ডেরও ছিলেন গ্লেন ফিলিপস, ড্যারিল মিচেল, মিচেল স্যান্টনার, রচিন রবীন্দ্ররা। দক্ষিণ আফ্রিকার এইডেন মারক্রামের অফস্পিনও মন্দ নয়। কিন্তু রোহিতের হাতে ঠিক পাঁচজন বোলার। তাঁদের একজন মার খেয়ে গেলে সমূহ বিপদ। ওই পাঁচজন এতটাই ভাল বল করেছেন ফাইনাল পর্যন্ত, যে এই ফাঁকটা ধরা পড়েনি। কিন্তু একদিনের ক্রিকেটে এ ফাঁক বড় ফাঁকি। এ নিয়েই বিশ্বকাপ জিতে গেলে সেও এক ইতিহাস হত। ফাইনালে হেড আর লাবুশেন জমে যেতেই ফাঁকি ধরা পড়ে গেল, অধিনায়ক নিরুপায়।

আরও পড়ুন ভারতীয় ক্রিকেট মানে ফলাফল নিরপেক্ষ ব্যবসা

আমাদের ব্যাটাররা বল করতে পারেন না কেন? বোলারদের ব্যাটের হাতেরই বা কেন উন্নতি হচ্ছে না? এসব প্রশ্ন করলেই মহাতারকাদের মহা ইগোর কথা উঠে আসবে। রোহিত নিজে দীর্ঘকাল কাজ চালানোর মত অফস্পিন বল করতেন, অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছেন। কোহলিও মিডিয়াম পেস বল করতেন, তিনিও ছেড়ে দিয়েছেন। কেন ছাড়লেন? দলের প্রয়োজন থাকতেও কেন আবার শুরু করেননি? দেবা ন জানন্তি। এঁদের কি এমন কোনো চোট আছে যা বল করলে বেড়ে যেতে পারে? তেমন কোনো খবর নেই কিন্তু।

শচীন তেন্ডুলকরের (ম্যাচ ৪৭০, বল ৮০৫৪, ওভার পিছু রান ৫.১০, উইকেট ১৫৪, সেরা বোলিং ৫/৩২) টেনিস এলবো হয়েছিল, একসময় কোমরে বেল্ট পরে ব্যাট করতে নামতে হয়েছিল, তারপর সেই চোট মাস ছয়েকের জন্যে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তার আগে পরে বল করেছেন, ম্যাচ জিতিয়েছেন। বীরেন্দ্র সেওয়াগও (ম্যাচ ২৫১, বল ৪৩৯২, ওভার পিছু রান ৫.২৬, উইকেট ৯৬, সেরা বোলিং ৪/৬) চোটমুক্ত ছিলেন না, কিন্তু বল করতেন। সৌরভ গাঙ্গুলির (ম্যাচ ৩১১, বল ৪৫৬১, ওভার পিছু রান ৫.০৬, উইকেট ১০০, সেরা বোলিং ৫/১৬) ফিটনেস তো হাস্যকৌতুকের বিষয় ছিল। অথচ বল করে একাধিক স্মরণীয় জয় এনে দিয়েছেন।

সুরেশ রায়না (ম্যাচ ২২৬, বল ২১২৬, ওভার পিছু রান ৫.১১, উইকেট ৩৬, সেরা বোলিং ৩/৩৪) এঁদের মত অত উঁচু দরের ব্যাটার ছিলেন না, কিন্তু মিডল অর্ডারে ভরসা দিয়েছেন একসময়। দরকারে অফস্পিনটাও করে দিতেন।

এদিকে আজকের মহাতারকা ব্যাটারদের কেবল ফিটনেস নিয়েই কয়েকশো প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, রোজ লক্ষ লক্ষ গদগদ পোস্ট হয় সোশাল মিডিয়ায়। কিন্তু ওঁরা বল করতে পারেন না। কেদার যাদব বলে একজন ছিলেন। মারকুটে ব্যাট আর খুব নিচ থেকে বল ছেড়ে অফস্পিন করতেন, মারা সোজা ছিল না। বিরাটের সঙ্গে শতরান করে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটা স্মরণীয় ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। তিনি হঠাৎ কোনো অজ্ঞাত কারণে নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্টের বিষনজরে পড়ে বাদ চলে যান ২০২০ সালে।

২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফরে দেখা গিয়েছিল ভুবনেশ্বর কুমারের ব্যাটের হাত রীতিমত ভাল। ট্রেন্টব্রিজ টেস্টের দুই ইনিংসেই অর্ধশতরান করেছিলেন। আবার ২০১৭ সালে পাল্লেকেলেতে যখন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৩১ রানে সাত উইকেট পড়ে যায়, তখন অপরাজিত ৫৩ রান করে মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে জুটিতে ১০০ রান তুলে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। মাঝে বেশ কিছুদিন একদিনের দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলেন ভুবনেশ্বর। অথচ তাঁকে গড়েপিটে অলরাউন্ডার করে তুলতে পারেননি সর্বকালের সেরা ভারতীয় দল তৈরি করার কৃতিত্ব যিনি দিনরাত দাবি করেন, সেই রবি শাস্ত্রী, আর তাঁর আদরের দুই অধিনায়ক ধোনি, কোহলি।

এখনকার বোলারদের মধ্যে শামি আর বুমরা দুজনেই যে ব্যাটিং উপভোগ করেন তা টেস্ট ক্রিকেটে স্পষ্ট দেখা যায়। শামি দিব্যি কয়েকটা বড় শট নিয়ে ফেলতে পারেন। বুমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে। স্টুয়ার্ট ব্রডকে ঠেঙিয়ে টেস্টে এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়ার রেকর্ড করিয়ে নিয়েছেন তিনি।

এঁদের ব্যাটের হাতটা যত্ন করে আরেকটু ভাল করে দেওয়ার কাজটুকুও যদি না পারেন, তাহলে রাহুল দ্রাবিড় আর ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোর করেনটা কী? রোহিত, কোহলিকে তো আর হাতে ধরে ব্যাটিং শেখাতে হয় না।

আসলে এসব করতে গেলে নমনীয়তা দরকার। কিন্তু ভারতীয় দলের একদিনের ক্রিকেটের ব্যাটিং আর গোঁড়ামি সমার্থক। বেশিরভাগ পাঠক রে রে করে তেড়ে আসবেন জেনেও না বলে উপায় নেই, শচীন আর সেওয়াগের প্রস্থানের পর থেকে ভারত একদিনের ক্রিকেটে যে ব্যাটিংটা করছিল এতকাল, সেটা গত শতাব্দীর ব্যাটিং। রোহিত আর শিখর ধাওয়ান যেভাবে ইনিংস শুরু করতেন – একজন মারতেন, আরেকজন ধরে ধরে খেলতেন – সেটা করা হত ১৯৯৬ বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত। সনৎ জয়সূর্য আর রমেশ কালুভিথরনা সেই ধারা বদলে দেন। শচীন-সৌরভ, সৌরভ-সেওয়াগ, শচীন-সেওয়াগ মান্ধাতার আমলের ছকে ফেরত যাননি। ২০০০ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ওঠা, ২০০২ ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়, ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা, ২০১১ বিশ্বকাপ জয় – এসবের পিছনে ভারতের ওপেনিং জুটির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

এদিকে বিশ্বজয়ী অধিনায়ক ধোনি নিজে ‘ফিনিশার’, বিশ্বাস করতেন যে কোনো জায়গা থেকে ম্যাচ জিতিয়ে দেবেন। সম্ভবত সে কারণেই ২০১২ সালে শচীন আর ২০১৩ সালে সেওয়াগের প্রস্থানের পর উইকেট হাতে রেখে খেলার নীতি তিনি চালু করেন। রোহিতের যতদিন বয়স ছিল, ধৈর্য আর রিফ্লেক্স দুটোই ভাল ছিল, ততদিন লম্বা ইনিংস খেলে পরের দিকে স্ট্রাইক রেটের ঘাটতি পুষিয়ে দিতেন। কোহলির তখন স্বাভাবিক খেলাতেই অতি দ্রুত রান হত। ওই ক্ষমতাই তাঁকে রান তাড়া করার রাজায় পরিণত করেছিল। তার প্রমাণ ২০১২ সালে হোবার্টে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে, ২০১৩ সালে জয়পুরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বা ২০১৭ সালে পুনেতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা ইনিংসে রয়েছে। ধোনিও সত্যিই শেষ লগ্নে যে কোনো রান তুলে দিতে পারতেন। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে ধোনির বড় শট নেওয়ার ক্ষমতা ক্রমশ কমে আসে। তাঁর মত রিফ্লেক্স-নির্ভর, চোখ আর হাতের সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল ব্যাটারের ক্ষেত্রে ওই বয়সে সেটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি ততদিনে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বশক্তিমান তারকা। বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? মহিন্দর অমরনাথ ২০১১ সালের শেষদিকে টেস্ট ক্রিকেটে বাঁধতে চেয়েছিলেন, ধোনির গডফাদার এন শ্রীনিবাসন তাঁকে হেলিকপ্টার শট মেরে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেন।

যা-ই হোক, ঘটনা হল দুই প্রান্ত থেকে দুটো নতুন বল আর আগাগোড়া পাওয়ার প্লের যুগে বেশি ঝুঁকি নিয়ে অনেক বেশি রান করাটাই ব্যাটিং। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সে খেলাই খেলছে গত এক দশক। তারাই জিতেছে বিশ্বকাপ, ভারত ২০১৩ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতার পর থেকে জিতেছে শুধু কিছু অর্থহীন দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। ধোনির বয়স যত বেড়েছে তিনি সত্যকে অস্বীকার করে সেই পুরনো খেলাই খেলে গেছেন এবং যে ম্যাচেই অন্য কেউ বড় শট নিতে পারেনি, সেখানে ধোনি শেষ অবধি ক্রিজে থেকেও ‘ফিনিশ’ করতে পারেননি। ওই চক্করে ২০১৯ বিশ্বকাপটাই ফিনিশ করে দিয়ে গেছেন। ধোনিভক্তরা আজও বীরবিক্রমে বলেন, মার্টিন গাপ্টিলের ওই থ্রোটা উইকেটে না লাগলেই নাকি…। অথচ ওই বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ধোনি শেষ ওভার পর্যন্ত ক্রিজে ছিলেন (৩১ বলে অপরাজিত ৪২), ভারত দুই কি পাঁচ রানেও নয়, ৩১ রানে হেরেছিল। ওই ম্যাচের স্কোরকার্ডের দিকে তাকালেই দুই দলের ব্যাটিং ভাবনার তফাতটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায় এবং ওই ভাবনাই যে তফাত গড়ে দিচ্ছে তাও স্পষ্ট বোঝা যায়।

২০১৯ সালের পর থেকে কোহলি, রোহিতেরও বয়স বাড়ছে। পাওয়ার প্লের নিয়ম বদলাচ্ছে, আরও বেশি রান উঠছে। রোহিত তো ধোনির আমলে ইনিংস শুরু করার সময় থেকে বরাবরই প্রথমে রক্ষণ, পরে আক্রমণ নীতিতে খেলে এসেছেন। সেভাবেই তিনবার দ্বিশতরান করেছেন। তিনি বদলাবেন কেন? এদিকে কোহলিরও ক্ষমতা কমছে। যত কমছে তিনি তত সাবধানী হচ্ছেন। আজকের একদিনের ক্রিকেটে ঝুঁকি না নিলে কোহলির দরের ব্যাটার রোজ অর্ধশতরান করতে পারেন। তাও মাঝে তিন-চার বছর তাঁর সব ধরনের ক্রিকেটেই সময় খারাপ যাচ্ছিল। পঁচিশ ইনিংস পরে একদিনের ক্রিকেটে শতরান এল গত বছর ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। মনে রাখা ভাল, সিরিজটা ভারত আগেই হেরে গিয়েছিল। কোহলির শতরানটা আসে সিরিজ হেরে যাওয়ার পরের ম্যাচে। অতঃপর কোহলি ছন্দে ফিরেছেন, বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হলেন। কিন্তু দেখা গেল তিনি ধোনিসুলভ সাবধানী ব্যাটিং করছেন। ধোনির চেয়ে কোহলি অনেক উঁচু দরের ব্যাটার, তাছাড়া নামেনও অনেক আগে। তাই রান করছেন বেশি, কিন্তু দ্রুত রান তোলার দায়িত্ব অন্য কাউকে নিতে হচ্ছে। ফাইনালে সে দায়িত্ব রাহুল পালন করতে পারেননি। পরিসংখ্যান বলছে, ফাইনালে প্রথম দশ ওভারের পরে ভারত মাত্র চারটে চার মেরেছে। ২০০৫ সালের পর পুরুষদের একদিনের ম্যাচে এটা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এই ব্যাটিং কোনো ম্যাচ জেতাতে পারে না, বিশ্বকাপ ফাইনালে জেতা তো অসম্ভব। এমন ইনিংসে মহাতারকা পঞ্চাশ, একশো যা-ই করুন; কী এসে যায়?

সত্যিকারের বিশ্লেষণ করলে স্বীকার করতে হবে, ফাইনালে ভারতকে হারিয়েছে মিডল অর্ডার ব্যাটিং। বোলিং নয়। বস্তুত, গত চার-পাঁচ বছরে ভারতীয় বোলাররা টেস্টে এবং একদিনের ক্রিকেটে এত বেশি হারা ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছেন যে ব্যাটারদের এরকম মন্থর ব্যাটিং, সার্বিক ব্যর্থতা – সবই ঢেকে গেছে বারবার। এবারের ইংল্যান্ড ম্যাচও অমন হইহই করে জেতার কথা নয় ওই কটা রান নিয়ে। কিন্তু ঐন্দ্রজালিক জুটি শামি-বুমরা ফর্মে থাকলে সবই সম্ভব। তার উপর আছেন মহম্মদ সিরাজ আর রহস্যময় কুলদীপ যাদব, যাঁর কোনটা গুগলি আর কোনটা সাধারণ লেগ ব্রেক তা বুঝতে ফাইনালে ট্রেভিস হেড আর মারনাস লাবুশেনের আগে পর্যন্ত সব দলের ব্যাটাররা হিমশিম খেলেন। এঁদের সঙ্গে রবীন্দ্র জাদেজা। কিন্তু এঁরা কোনোদিন ব্যর্থ হবেন না এমন দাবি করা চলে না। তাই হাতে রান থাকা দরকার। কথাটা আর কেউ না বুঝুক, অধিনায়ক রোহিত বুঝেছিলেন। তাই বিশ্বকাপে এসে নিজের ব্যাটিং বদলে ফেললেন। কিন্তু দলের সবচেয়ে বড় তারকাকে বদলানোর সাধ্য তাঁরও নেই। কোহলি ঠিক তিনটে শতরান সমেত ৭৬৫ রান করলেন। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপের প্রথম দশজন রান সংগ্রাহকের মধ্যে একমাত্র তাঁর আর রাহুলের স্ট্রাইক রেটই একশোর নিচে

অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে জেতাল হেড আর লাবুশেনের চতুর্থ উইকেট জুটি, ভারতকে হারাল কোহলি আর রাহুলের শম্বুক গতির চতুর্থ উইকেট জুটি। অথচ ভারত এমন আজব দেশ, তারকা সাংবাদিক থেকে ফেসবুক পণ্ডিত – সকলে এখনো প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, রোহিত কেন ওই শটটা খেলতে গেল? ফাইনালে কেউ ওরকম খেলে? সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে ফাইনালে রোহিত ওই ব্যাটিং না করলে অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্যটা আরও কম হত, ম্যাচটা আরও আগে শেষ হত।

তারকা থেকে ক্রিকেটপ্রেমী – গোটা বাস্তুতন্ত্রের গোঁড়ামি না কাটলে ভারতীয় ক্রিকেট, দেশটার মতই, পিছন দিকে এগোতে থাকবে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

প্রিয় স্মৃতির ফাইনাল

ছলছলে চোখে যুবরাজ বললেন “আজ সত্যিই মনে হচ্ছে একটা বড় কিছু করেছি।” তখনো আমরা জানি না, তিনিও জানেন না, শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার।

যে কোনো নিরপেক্ষ বিচারে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ফাইনাল হিসাবে প্রথমেই উঠে আসে ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা। সর্বকালের সেরা একদিনের ম্যাচের তালিকাতেও ওই ম্যাচের স্থান হবে উপর দিকে। কিন্তু তাতে কী? প্রিয় ব্যাপারটা একান্ত ব্যক্তিগত। যে খেলছে না তার কাছে খেলা যেহেতু এক প্রদর্শনী, সেহেতু কোন খেলার কোন মুহূর্ত যে তার কাছে গোটা খেলাটাকে অবিস্মরণীয় করে তুলবে তা বলা মুশকিল। তার উপর আছে স্মৃতির ভূমিকা। যে খেলা দেখতে দেখতে মনে হয় জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না, সামান্য সময় পেরোলেই তা ফিকে হয়ে যায়। আবার যে খেলা দেখার সময়ে অসাধারণ মনে হয়নি, তা বহুকাল পরেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিনেমার মত। কেন এমন হয় জানি না। কখনো খেলার বাইরের কোনো ঘটনা প্রভাবিত করে স্মৃতিকে, কখনো বা খেলা দেখার সঙ্গীদের স্মৃতিও এমন কাণ্ড ঘটায়। এমনটা না ঘটলে কোনো প্রিয় খেলা থাকত না একা একা জাবর কাটার জন্যে। কোনো আড্ডায় বা লেখায় সেই খেলার গল্প করে আরও অনেকের যে ওই খেলাটা প্রিয়, তা আবিষ্কার করার আনন্দও মাটি হয়ে যেত।

আমার অনেক বেশি প্রিয় ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনাল

তখনো ভূগোল বলতে বুঝি জল থেকে কীভাবে মেঘ তৈরি হয় আর মেঘ থেকে কীভাবে বৃষ্টি হয় – এইসব। গ্লোব জিনিসটা দেখেছি কেবল বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে। ফলে বাবা রাতভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে টিভিতে খেলা দেখছেন – এ জিনিস দেখে বিস্মিত হওয়ার বয়স চলে যায়নি। আমার বয়সী অনেকেরই ওই বিশ্বকাপ নিয়ে মুগ্ধতা আজও কাটেনি, কাটবেও না। কারণ ক্রিকেট খেলায় অত রং আগে কখনো দেখিনি। ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সময়ে আমাদের বাড়িতে টিভি ছিল না, ’৯২ বিশ্বকাপের সময়ে হয়েছে সাদাকালো পোর্টেবল টিভি। বাড়ির উল্টোদিকের লাইব্রেরিতে স্পোর্টস্টারের পাতায় জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো অধিনায়কদের গ্রুপ ফটোতে দেখা জার্সির রংগুলো মনে রেখে দিয়েছিলাম। খেলা দেখার সময়ে সেই রং লাগিয়ে নিতাম খেলোয়াড়দের পোশাকে, মাঠে, আকাশে। কথা ছিল, মহম্মদ আজহারউদ্দিনের দল ফাইনালে উঠলে পাড়ায় যে দু-একজনের বাড়িতে রঙিন টিভি আছে সেখানে গিয়ে খেলা দেখব। কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়ে যায় ফাইনালের অনেক আগেই।

বাবার দ্বিতীয় পছন্দের দল ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তারাও সেবার সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি। তবে মেরুন জার্সির ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিন্তু দাপটে হারিয়েছিল কচি কলাপাতা জার্সির পাকিস্তানকে – একেবারে ১০ উইকেটে। দিনটা ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, জায়গাটা মেলবোর্ন। পরবর্তী এক মাসে ইমরান খান আর তাঁর দলবল যে রূপকথা রচনা করেন তা গল্পের বইয়ের বাইরে একমাত্র পাকিস্তানের ক্রিকেট দলই পারে। আজকের পাকিস্তানিরা তাকে বলেন ‘কুদরত কা নিজাম’, অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়ম। ২৭ ফেব্রুয়ারি নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে হোবার্টে দুর্বল জিম্বাবোয়েকে দাপটে হারানোর পর ১ মার্চ অ্যাডিলেড ওভালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাত্র ৭৪ রানে অল আউট হয়ে যান ইমরান, মিয়াঁদাদরা। সেদিন পাকিস্তানকে আক্ষরিক অর্থেই কুদরত বাঁচিয়ে দেয়। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ১৬ ওভারে ৬৩ রান করতে হত জেতার জন্যে। কিন্তু এত বৃষ্টি নামে যে খেলা ভেস্তে যায়, পাকিস্তান পেয়ে যায় একটা মহামূল্যবান পয়েন্ট। তারপর সিডনিতে ভারতের কাছে হার, ব্রিসবেনে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। পার্থে অস্ট্রেলিয়াকে হারাবার পরেও পাকিস্তানের সেমিফাইনালে যাওয়া অনিশ্চিত ছিল। পয়েন্ট টেবিলে এতটাই পিছিয়ে পড়েছিল যে শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পরেও রাউন্ড রবিন লিগের শেষ খেলায় নিউজিল্যান্ডকে না হারালে বিদায় নিতে হত।

বিশ্বকাপে তখন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডই সবচেয়ে নিখুঁত দল। সব ম্যাচ জিতে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে। শুধু তাই নয়, অধিনায়ক মার্টিন ক্রো ব্যাট করছেন রাজার মত। তাঁর দুটো অভিনব চালে কিস্তিমাত হচ্ছে প্রতিপক্ষ। এক, বোলিং শুরু করাচ্ছেন স্পিনার দীপক প্যাটেলকে দিয়ে। তাঁর বলে বিশেষ রান করা যাচ্ছে না। দুই, ব্যাটিং শুরু করাচ্ছেন প্রথম দুই ম্যাচে বেঞ্চে বসে থাকা মার্ক গ্রেটব্যাচকে দিয়ে। গ্রেটব্যাচ শুরু থেকেই ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে মারছেন। ১৯৯২ সালে ওই আক্রমণ অভূতপূর্ব। তার উপর পাকিস্তান দলে ইমরান আর মিয়াঁদাদের মধ্যে গণ্ডগোল। ইমরান নিজে পুরো সুস্থ নন। বোলার ইমরানের থেকে যতটা পাওয়া সম্ভব, তা পাচ্ছে না পাকিস্তান।

ক্রাইস্টচার্চের সেই ম্যাচে তারা অসাধ্য সাধন করল। লেগস্পিনার মুস্তাক আহমেদকে দিয়ে গ্রেটব্যাচকে শান্ত রাখলেন ইমরান। ফর্মে থাকা ক্রো ২০ বল খেলে তিন রানের বেশি করতে পারলেন না, আক্রম তাঁকে সুদ্ধ চারজনকে আউট করলেন। রামিজ রাজার শতরানে সহজেই জিতে গেল পাকিস্তান। অকল্যান্ডের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফের রোমাঞ্চকর জয়। ২৫ মার্চের ফাইনাল খেলতে সেই মেলবোর্নে ফেরত এল পাকিস্তান। সামনে আবার ইংল্যান্ড। জীবন সকলকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না, পাকিস্তানকে একসঙ্গে দুটো দিল।

ফাইনালেও ইংল্যান্ডেরই পাল্লা ভারি ছিল নিঃসন্দেহে। কারণ সেরা দল নিউজিল্যান্ড ছাড়া আর কেউ তাদের বেগ দিতে পারেনি। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে হার নেহাতই অঘটন। ব্যাটে বলে বিশ্বকাপ মাতাচ্ছিলেন বুড়ো ইয়ান বোথাম। গ্রেম হিক, অ্যালেক স্টুয়ার্ট, নিল ফেয়ারব্রাদাররা নিয়মিত রান করছিলেন। অলরাউন্ডার ক্রিস লুইস আর মিডিয়াম পেসার ডেরেক প্রিঙ্গলও ফর্মে।

কিন্তু ফাইনাল খেলল অন্য পাকিস্তান। একে অপরকে কোনোদিন পছন্দ না করা ইমরান আর মিয়াঁদাদ তৃতীয় উইকেটে ১৩৯ রান যোগ করলেন। তাও মিয়াঁদাদ সেদিন পুরো ফিট ছিলেন না, শেষদিকে রানার নিতে হয়েছিল। স্লগ ওভারে দারুণ মেরে দলের রান আড়াইশোর কাছে নিয়ে গেলেন ইনজামাম উল হক (৩৫ বলে ৪২) আর দুর্দম আক্রম (১৮ বলে ৩৩)। প্রিঙ্গল তিনটে উইকেট নিলেও বোথাম আর লুইস মার খেয়ে গেলেন।

আমার জ্যাঠতুতো, পিসতুতো দিদিদের মধ্যে তখন সুদর্শন ইমরানের প্রবল জনপ্রিয়তা, তবে দ্রুত তাঁর বাজার দখল করছেন আক্রম। আমাদের বাঙাল পাড়ায় সেই ২৫ মার্চ অনেকেই হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান সমর্থক; আমার বাবাও। সুতরাং আমিও। ইংল্যান্ডের প্রথম চারজন যখন ৬৯ রানের মধ্যে ফিরে গেলেন, তখন আমরা উল্লসিত। কিন্তু উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠলেন ফেয়ারব্রাদার আর অ্যালান ল্যাম্ব। বাবা একের পর এক বিড়ি শেষ করছেন, রান হয়ে যাচ্ছে, উইকেট পড়ছে না। শেষমেশ ইমরান ফেরত আনলেন আক্রমকে। তিনি রাউন্ড দ্য উইকেট দৌড়ে এসে পরপর দুবার ম্যাজিক করলেন। অ্যালান ল্যাম্ব আর ক্রিস লুইসের হতভম্ব স্টাম্পগুলো আমাদের উদ্বেগের অবসান ঘটাল।

ইংল্যান্ড আর বেগ দিতে পারেনি। ইমরান যখন ক্রিস্টালের ট্রফিটা হাতে নিয়ে দলের কথা ভুলে কেবল মা শওকত খানুমের নামে ক্যান্সার হাসপাতাল করার সংকল্প বর্ণনা করে চলেছেন, তখন আমি আর বাবা গিয়ে বসলাম পল্লী মঙ্গল সমিতির মাঠে। সেখানে আক্রমের স্তুতি চলছে, কোনো কাকু আবার বলছেন তাঁর মতে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ইনজামাম। একজন বললেন “বেল পাকলে কাকের কী?” অন্য এক কাকু রুখে উঠলেন “কেন? কাগজে তো দেখলাম গাভাসকার বলেছে ’৮৩ সালে যখন আমরা কাপ জিতলাম, ওরা খুব আনন্দ করেছিল। আমরা আনন্দ করব না? হাজার হোক এশিয়ার টিম।” এক জেঠুর মন্তব্য “হারাইছে তো ইংল্যান্ড রে। অগো ক্যান সাপোর্ট করুম? করতে অইলে পাকিস্তানরেই করা ভাল।”

আজকাল এই স্মৃতিকেও ছাপিয়ে যায় ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল

ততদিনে ক্রিকেটের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা স্রেফ দর্শক আর প্রদর্শনীর নয়। তিনটে খবরের কাগজের খেলার পাতায় কাজ করা হয়ে গেছে, চতুর্থ চাকরিতে সাংবাদিক হিসাবে বিশ্বকাপ কভারেজের সঙ্গে যুক্ত আছি। বাড়িতে রঙিন টিভি এসে গেছে, কিন্তু বাবার সঙ্গে বসে খেলা দেখা আর হয় না। যত বড় খেলা হয়, আমার তত বেশি কাজ থাকে। অফিসের হাই ডেফিনিশন টিভিতেই দেখি বেশিরভাগ খেলা।

সহকর্মীরা অনেকেই একমত হচ্ছিলেন না, কিন্তু আমি শুরু থেকে বলছিলাম, এবার ভারত চ্যাম্পিয়ন না হলে অবাক হব। কারণ আমাদের শচীন শুরু থেকেই ফর্মে। একা শচীনে রক্ষে নেই, বীরেন্দ্র সেওয়াগ দোসর। হেলায় ম্যাচ শুরু করছেন চার মেরে। জাহির খান বল হাতে নিলে উইকেট পড়া যেন সময়ের অপেক্ষা। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি রান পাচ্ছেন না, কিন্তু ইংল্যান্ডের সঙ্গে টাই হয়ে যাওয়া ম্যাচেও স্নায়ুর চাপে অধিনায়কত্বে ভুলচুক করেননি। মিডল অর্ডারে অভিজ্ঞ গৌতম গম্ভীর ধারাবাহিক। কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্পদ যুবরাজ সিং। হয় ব্যাটে নয় বলে তিনি ভরসার জায়গা হয়ে উঠছিলেন। আর কী লাগে বিশ্বকাপ জিততে? ’৯২ বিশ্বকাপে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করতাম বাবাকে, সেবার বাবার প্রশ্ন করার পালা। খেলার পাতায় কাজ করি, অতএব বাবার ধারণা আমি একটু বেশি জানি। আমি আমার এইসব যুক্তি বলি, বাবা নীরবে শোনেন। একমত হলেন কিনা জিজ্ঞেস করার সময়ও আমার থাকে না।

এমন চলতে চলতেই ভারত কোয়ার্টার ফাইনালে উঠল। আমাকে যেতে হল আমেদাবাদে। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, মানে ক্রিকেটের ব্রাজিল। যাদের বিশ্বকাপের যে কোনো স্তরে হারানো প্রায় বিশ্বকাপ জেতার মতই কঠিন। ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতীয় বোলিংকে ছিঁড়ে খাওয়া রিকি পন্টিং আবার শতরান করলেন। যুবরাজ মোক্ষম সময়ে ব্র্যাড হ্যাডিন আর মাইকেল ক্লার্কের উইকেট না নিলে লক্ষ্য আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারত। সেমিফাইনালে উঠতে দরকার ২৬১, সেওয়াগ বেশিক্ষণ টিকলেন না। শচীন সাবলীল ব্যাট করছেন দেখে শততম শতরানের আলাদা কপি লিখতে শুরু করেছি, এমন সময় শন টেটের বলে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে তিনি আউট। গম্ভীরের সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না বিরাট কোহলি। গম্ভীরও কাজ শেষ করে যেতে পারলেন না, ধোনি ফের ব্যর্থ। সিঁদুরে মেঘ দেখছি প্রেস বক্সে বসে, যুবরাজ খেলতে শুরু করলেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। সুরেশ রায়নাকে সঙ্গে নিয়ে শেষপর্যন্ত আড়াই ওভার আগেই খেলা শেষ করে দিলেন। ম্যাচের পর সাংবাদিক সম্মেলনের ঘরে এসে ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সম্মান জানালেন ভারতীয়, অভারতীয় সমস্ত সাংবাদিক। ছলছলে চোখে যুবরাজ বললেন “আজ সত্যিই মনে হচ্ছে একটা বড় কিছু করেছি।” তখনো আমরা জানি না, তিনিও জানেন না, শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার। বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর জানা যাবে, তিনি গোটা বিশ্বকাপ খেলেছেন শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা – এসব নিয়েই।

আরও পড়ুন দায়সারা বিশ্বকাপ, শেষ বিশ্বকাপ? 

বিশ্বকাপ যত এগোয়, জেতা তত কঠিন হয়। কিন্তু সেমিফাইনালে পাকিস্তান খুব দৃঢ় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারল না। ব্যাটে আর কেউ বেশি রান করতে না পারলেও শচীন আবার খেলে দিলেন, যুবরাজ ব্যাটে ব্যর্থ হলেও দুটো জরুরি উইকেট নিলেন। তবে আজ যে তরুণদের স্মৃতিতে ২০১১ নেই, তারা এখনকার শ্রীলঙ্কাকে দেখে কল্পনা করতে পারবে না সেই ফাইনাল কত কঠিন ছিল। শ্রীলঙ্কা গোটা বিশ্বকাপে হেরেছিল শুধু পাকিস্তানের কাছে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড আর সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে সহজে হারিয়েছিল। ফাইনালের দিন জাহির যথারীতি নতুন বলে উইকেট নিলেন, কিন্তু মুনাফ প্যাটেল ছাড়া সবাইকে মেরে দিলেন শ্রীলঙ্কার সর্বকালের সেরা ব্যাটারদের অন্যতম মাহেলা জয়বর্ধনে এবং অন্যরা। তবু তো কুমার সাঙ্গাকারাকে ৪৮ রানে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন যুবরাজ।

বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌনে তিনশো রান তাড়া করার চাপ অতুলনীয়, আর সেদিনই কিনা প্রথম ওভারে শূন্য রানে আউট হয়ে গেলেন সেওয়াগ। একটু পরেই শচীন। কোহলি তখনো চেজমাস্টার হয়ে ওঠেননি, গম্ভীরের সঙ্গে তাঁর জুটি সেদিন জমল না। এরপর নিজের অধিনায়কত্ব, নিজের কেরিয়ারের তোয়াক্কা না করে ব্যাট করতে নামলেন ধোনি। কোনো ক্রিকেটপ্রেমীকে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই পরের কয়েকটা ঘন্টা।

খবরের কাগজ তৈরি করে ছাপাখানায় পাঠানো যাদের চাকরি, তারা বাড়ি ফেরে গভীর রাতে। অমন দিনে দেরি হয় আরও বেশি। আমি বাড়ি ফিরলে সাধারণত ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলে দিতেন বাবা। সে রাতেও তিনিই খুলে দেন, তবে একেবারে সজাগ। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন “দারুণ দেখলাম, বুঝলি? একেবারে সাধ মিটিয়ে।” তখনো জানি না, বাবাও জানেন না, তাঁর ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার। তিনি দেখে ফেলেছেন শেষ বিশ্বকাপ ফাইনাল।

আরও অনেক ফাইনাল হবে, কোনোটা স্মৃতিতে এভাবে অক্ষয় হবে কিনা জানি না। স্মৃতিতেই তো সঞ্চিত থাকে আমাদের সত্তা, ভবিষ্যৎ।

সংবাদ প্রতিদিন কাগজের রোববার পত্রিকায় প্রকাশিত

কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন?

এ দেশের ক্রিকেটমহল এখন ভীষণ ব্যস্ত। ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আইপিএল চলছে। নিজ নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। লখনৌ সুপারজায়ান্টস অধিনায়ক কে এল রাহুল তো এতটাই নিবেদিতপ্রাণ যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে গুরুতর চোট পাওয়ার পরে হার নিশ্চিত জেনেও দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। অতঃপর চোটের প্রভাবে বাকি টুর্নামেন্টে আর খেলতে পারবেন না, সামনের মাসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলতে পারবেন না। এমন বীরত্বের জন্যই তো জাতীয় নায়কের মর্যাদা পান ক্রিকেটাররা। মুশকিল হল, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পদকজয়ী কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগত এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁর দাবি, মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন আক্রমণের অভিযোগে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, ক্রিকেটারদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।

গত ২৮ এপ্রিল ভিনেশ বলেন, ক্রিকেটারদের তো আমাদের দেশে পুজো করা হয়। তাঁরা আমাদের পক্ষ যদি না-ও নেন, অন্তত একটা নিরপেক্ষ বার্তা দিয়েও তো বলতে পারেন যে দোষীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কেবল ক্রিকেটার নয় অবশ্য, সব খেলার তারকাদের কাছেই আবেদন ছিল ভিনেশের। তারপর থেকে অভিনব বিন্দ্রা আর নীরজ চোপড়া – ভারতের ইতিহাসে যে দুজন অলিম্পিকে ব্যক্তিগত সোনা জিতেছেন, দুজনেই ওই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। সদ্যপ্রাক্তন টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাও দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের বিশেষ হেলদোল নেই। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র মহিলাদের জাতীয় দলের শিখা পাণ্ডে মুখ খুলেছেন। সদ্য চালু হওয়া মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে দামী ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধনার কোনো বক্তব্য নেই। জাতীয় দলের অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌরও চুপ। প্রাক্তনদের মধ্যে হরভজন সিং, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, ইরফান পাঠান সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। একমাত্র নভজ্যোৎ সিং সিধু সশরীরে ভিনেশ, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল কপিলদেব ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কবে ন্যায়বিচার পাবে?

স্পষ্ট বক্তা হওয়ার জন্য যাঁর বিপুল খ্যাতি, সেই বিরাট কোহলি স্পিকটি নট। যাবতীয় বাহাদুরি গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে খরচ করছেন। নারীবাদীরা প্রায়শই বিরাটকে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়েন তিনি জীবনে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার অবদান স্বীকার করেন বলে, তাঁর ব্যর্থতায় ট্রোলরা অনুষ্কাকে টার্গেট করলে বিরাট মুখ খোলেন বলে। দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে বিরাটই একমাত্র পুরুষ যিনি নিজের বউকে ভালবাসেন। তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেন একমাত্র অস্কার মঞ্চে বউকে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্রিস রককে ঘুঁষি মেরে দেওয়া উইল স্মিথ। দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি বিরাটের ভালবাসা আমাদের পাড়ার রানাদার পর্ণা বউদির প্রতি ভালবাসার চেয়ে মহত্তর কিছু মোটেই নয়। বরং হয়ত কিছুটা নিকৃষ্টতরই। কারণ রানাদা রাস্তাঘাটে অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে কাউকে বিশ্রীভাবে কথা বলতে দেখলে অন্তত একটু ধমকা-ধমকি করেন। কিন্তু দেশের লাঞ্ছিত মহিলা কুস্তিগীরদের নিয়ে বিরাটের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

মনে রাখা ভাল, অনুষ্কা নিজেও কম নারীবাদী নন। তিনি একদা সুনীল গাভস্করের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন, কারণ গাভস্কর বলেছিলেন অনুষ্কার বোলিংয়ে অনুশীলন করে বিরাটের লাভ হবে না। সেই অনুষ্কাও আজ চুপ। চুপ মানে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। দুটিতে কেমন জীবন উপভোগ করছেন তার তত্ত্বতাল্লাশ দিব্যি দিয়ে যাচ্ছেন টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে। তবে গাভস্করের বিরুদ্ধে লম্বা বিবৃতি দিয়েছিলেন, অলিম্পিয়ান মহিলাদের প্রতিবাদ নিয়ে এক লাইনও লেখেননি। অবশ্য পরীক্ষায় আনকমন প্রশ্ন এসে গেলে আমরাও সে প্রশ্ন ছেড়ে আসতাম।

গম্ভীর আবার দিল্লি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। সেই দিল্লির যন্তর মন্তরেই কুস্তিগীরদের অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। যদিও ওই এলাকা গম্ভীরের কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবু তিনি একজন জনপ্রতিনিধি তো বটেন। অবশ্য উনি সাংসদের দায়িত্ব খুব মন দিয়ে কোনোদিন পালন করেছেন বলে অভিযোগ নেই। উনি সারাবছর ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিয়ে বেড়ান, আইপিএলের সময়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকেন। কদিন পরে হয়ত ওই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সারাবছরই বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াবেন। কারণ লখনৌ সুপারজায়ান্টসে তাঁর পদটির নাম গ্লোবাল মেন্টর, আর ওই ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকরা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার টি টোয়েন্টি লিগে দল কিনে বসে আছেন। আর কোথায় কোথায় কিনবেন কে বলতে পারে? এমন বিশ্বনাগরিকের কি আর যন্তর মন্তরের অবস্থান বিক্ষোভ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কূপমণ্ডূকতা মানায়?

পিভি সিন্ধু, সায়না নেহওয়ালদেরও মুখে কুলুপ। ছবারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মেরি কম তো পিটি ঊষা গোত্রের, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির অতি ঘনিষ্ঠ, তাই নীরব। গত কয়েকদিন অবশ্য তাঁর রাজ্য মণিপুরে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। বিজেপি তাঁকে এত গুরুত্ব দেয় যে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজনাথ সিংকে ট্যাগ করে বলতে হচ্ছে “মাই স্টেট ইজ বার্নিং, কাইন্ডলি হেল্প”। যে নিখাত জারীনকে একসময় স্রেফ জ্যেষ্ঠত্বের অধিকারে অবজ্ঞা করতেন মেরি, সেই দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিখাত কিন্তু সরব হয়েছেন।

প্রাক্তন সাংসদ ভারতরত্ন ‘ভগবান’ শচীন তেন্ডুলকর মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ডাগআউটে নিদ্রা গিয়েছেন। তিনি অবশ্য কোনোদিনই গোলযোগ সইতে পারেন না, রাজ্যসভার গোলযোগ ছাড়া। বাঙালির গর্ব সৌরভ গাঙ্গুলিও দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়ে খুব ব্যস্ত। মহিলা কুস্তিগীরদের দুর্দশা নিয়ে ভাববেন কখন? তবু তো দয়া করে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে মুখ খুলেছেন। লর্ডসের ব্যালকনির চিরস্মরণীয় ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে ভারী বিনীতভাবে বলেছেন, ওদের লড়াই ওরা লড়ুক। আমি তো খবরের কাগজে পড়ছি, যা জানি না তা নিয়ে তো কথা বলা উচিত নয়।

এদিকে শচীন, সৌরভ দুজনেই কন্যাসন্তানের পিতা।

সত্যি কথা বলতে, ভারতীয় তারকা খেলোয়াড়দের যা ইতিহাস, তাতে এঁরা মহম্মদ আলি হয়ে উঠবেন বলে কেউ আশা করে না। সাম্প্রতিক অতীতে তাঁরা কিন্তু সাতে পাঁচে না থাকার নীতি অনেকটাই ত্যাগ করেছেন। ওঁরা এখন শচীন বা ঊষার মত শাসক দলের প্রসাদ গ্রহণ করে রাজ্যসভার সদস্য হচ্ছেন, এ পদ সে পদ গ্রহণ করছেন, গম্ভীরের মত ভোটে লড়ে সাংসদ বা বিধায়কও হচ্ছেন। যাঁদের অত এলেম নেই তাঁরাও কোহলির মত করে নোটবন্দি হওয়া মাত্রই তা কত বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ তা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলন চলাকালীন তার বিরোধিতা করে টুইট করেছিলেন। সেওয়াগের মত কেউ কেউ আরও এককাঠি সরেস। শহিদ হওয়া সৈনিকের মেয়েকে যুদ্ধবিরোধী কথা বলার জন্য ট্রোল করতেও ছাড়েননি। কেবল সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দরকার পড়লেই এঁরা কেউ নীরব হয়ে যান, কেউ এক-দু লাইনে কাজ সারেন। সেওয়াগ, কপিলদেব, হরভজন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মানুষ। কুস্তিগীরদের আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন হরিয়ানার কুস্তিগীররাই। তা না হলে এতেও ওই তিন প্রাক্তন মুখ খুলতেন কিনা সন্দেহ।

আরও পড়ুন ক্রিকেটার তুমি কার?

যে পদকজয়ী অলিম্পিয়ানরা আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপি-ঘনিষ্ঠই ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে বা জয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করতে এঁদেরও কামাই ছিল না। এখন চোখের জলে সেসবের দাম দিতে হচ্ছে। এখনো যে মহাতারকারা নীরব, তাঁদের দেখে একটাই ভয় হয়। জার্মান যাজক মার্টিন নিয়মোলারের অনুসরণে এঁদের না কোনোদিন আওড়াতে হয়, প্রথমে ওরা এসেছিল কুস্তিগীরদের জন্যে। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কুস্তিগীর নই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত