দায়সারা বিশ্বকাপ, শেষ বিশ্বকাপ?

কর্তারা যে ৫০ ওভারের খেলাটাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন তা সবচেয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির প্রাক্তন অধিনায়ক এবং সদ্য পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব এমসিসির সভাপতি হওয়া মার্ক নিকোলাস।

বিশ্বকাপ

১৯৮৭ সালে যখন প্রথমবার এদেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপ হয় তখন দুনিয়াটাই অন্যরকম ছিল। তাই সেকথা থাক, বরং ১৯৯৬ সালের কথা ভাবা যাক। আজ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের খেলা আর আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করে যে টাকার হিমালয়ে চড়েছে তা টেথিস সাগরের মত উঁচু হতে শুরু করেছিল ওই সময় থেকেই। প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া বুঝতে পেরেছিলেন ভারতের ক্রিকেটপাগল জনতার বাজার কত লোভনীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে। সেই বাজারে তাদের প্রবেশাধিকার দিয়ে এত টাকা কামাতে পারে ভারতীয় বোর্ড, যে গোটা ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করা যাবে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার চোখরাঙানি সহ্য করার বদলে তাদেরই চোখ রাঙানো যাবে। তবে ডালমিয়া ছিলেন খাঁটি ব্যবসায়ী। কামানোর জন্য খরচ করতে তাঁর আপত্তি ছিল না। বিশেষত টাকা যখন বোর্ডের, নিজের পকেটের নয়। ফলে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা মিলিয়ে হওয়া সেবারের বিশ্বকাপে জাঁকজমকের খামতি ছিল না। সেই বিশ্বকাপ থেকে বিস্তর আয় হয়েছিল এবং তার অনেকটা ডালমিয়া পকেটে পুরেছেন – এমন অভিযোগ পরে উঠেছিল। সেসব মামলা মোকদ্দমার জেরেই একসময় তাঁকে বোর্ডছাড়া হতে হয়, পরে আবার ফিরেও আসেন। কিন্তু বিশ্বকাপের আয়োজন যে জবরদস্ত হয়েছিল তা কেউ অস্বীকার করে না। ইডেন উদ্যানে বহু অর্থ খরচ করে বিরাট উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল, গঙ্গার হাওয়া এসে অদৃষ্টপূর্ব লেজার শোকে অভূতপূর্ব বিপর্যয়ে পরিণত করেছিল। ভারত সেমিফাইনালে শোচনীয়ভাবে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে যাওয়ার পরে লেখালিখি হয়েছিল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি মঞ্চটাই নাকি যত নষ্টের গোড়া। ওটা তৈরি করতে গিয়েই নাকি পিচের বারোটা বেজে গিয়েছিল, ফলে সেমিফাইনালের দিন অরবিন্দ ডি সিলভা আর মুথাইয়া মুরলীধরন এক জাতের বোলার হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১১ সালে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় হওয়া বিশ্বকাপেও জাঁকজমক কম ছিল না। সেবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল। তদ্দিনে ভারত হিমালয়ে উঠে পড়েছে, বোর্ডের টাকার অভাব নেই। ফলে বাকি বিশ্বকাপটাও হয়েছিল বিশ্বকাপের মত। আর এবার?

আজ গতবারের দুই ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ শুরু করবে। কিন্তু তার আগে কোনো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে না, কারণ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড খুবই মিতব্যয়ী। চোখধাঁধানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করে শুধু আইপিএল শুরুর দিনে। ১৯৯৬ সালে বোর্ড সভাপতি ছিলেন শিল্পপতি ডালমিয়া, এখন শিল্পপতি জয় শাহ। ও না! ভুল হল। বোর্ড সভাপতি ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রজার বিনি, জয় হলেন সচিব। আসলে বিনিকে দেখা যায় কম, শোনা যায় আরও কম। তাই খেয়াল থাকে না। মানে তাঁর অবস্থা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর মত। তিনি সাংবিধানিক প্রধান বটে, সবেতেই তাঁর স্বাক্ষর লাগে বটে, কিন্তু নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে তাঁকে ডাকাই হয় না। রাজদণ্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন মোদীজি। ক্রিকেট বোর্ডের সর্বেসর্বাও এখন শাহজি, বিনিজি অন্তঃপুরবাসী। যাঁর নাম জয় আর পদবি শাহ, তিনি সর্বেসর্বা হবেন না তো হবে কে? সে যতই তিনি এশিয়ান গেমসে মহিলাদের ক্রিকেটে স্মৃতি মান্ধনা একাই সোনা জিতেছেন মনে করুন না কেন।

কথা হল, জগমোহনের বিশ্বকাপ আয়োজন করা নিয়ে যা উৎসাহ ছিল, জয়ের তার অর্ধেকও দেখা যাচ্ছে না। তাই এবারের বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণা হয়েছে মাত্র ১০০ দিন আগে, যেখানে পৃথিবীর যে কোনো খেলায় বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণা হয়ে যায় বছরখানেক আগে। আগামী বছর জুন মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির সূচি যেমন প্রকাশিত হয়েছে গত মাসে। কারণ বিভিন্ন দেশের মানুষকে খেলা দেখতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা দেশে পৌঁছতে হবে। যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে, থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সেসব প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যত কম সময় পাওয়া যাবে খরচ বেড়ে যাবে ততই। অব্যবস্থা দেখা দেবে, যে দেশে খেলা সেই দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু ওসব ভাবনা রাজা বাদশাহরা কবেই বা করলেন? তাঁরা চলেন নিজের নিয়মে, বাকি সকলকে মানিয়ে নিতে হয়। বিশ্বকাপ এমনিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রতিযোগিতা, ফলে সূচি ঘোষণা করার কথা তাদের। কিন্তু আয়োজক দেশকেই ঠিক করতে হয় সূচিটা। একথাও কারোর জানতে বাকি নেই যে ফুটবল দুনিয়াকে ফিফা যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, আইসিসির মুরোদ নেই তা করার। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অর্থবল এত বেশি যে আইসিসি এখন ঠুঁটো জগন্নাথ। অনতি অতীতে আইসিসির ফিউচার টুরস প্রোগ্রামে (অর্থাৎ পরবর্তী কয়েক বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নির্ধারিত সূচিতে) আইপিএলের জন্য যে আরও বেশি ফাঁক রাখা হবে তা ঘোষণা করে দিয়েছেন শাহজিই, আইসিসি নয়। তা নিয়ে আইসিসি ট্যাঁ ফোঁ করতে পারেনি। ফলে এত দেরিতে বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণার দায় আইসিসির ঘাড়ে চাপানো চলে না।

তবে অস্বাভাবিক দেরিতে সূচি ঘোষণাতেই অব্যবস্থার শেষ নয়, বরং সূচনা। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেল বিভিন্ন আয়োজক রাজ্য সংস্থা তাদের স্টেডিয়ামে যেদিন ম্যাচ দেওয়া হয়েছে সেদিন আয়োজন সম্ভব নয় বলছে। খোদ কলকাতাতেই যেমন কালীপুজোর দিন ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান ম্যাচ রাখা হয়েছিল। ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের অভিজ্ঞতা না থাকা মানুষও বোঝেন যে সেদিন ম্যাচ আয়োজন করা অসম্ভব, কিন্তু দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র বোঝেন না। ক্রীড়াসূচি তৈরি করার সময়ে যে যেখানে খেলা সেখানকার আয়োজকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়, সম্ভবত তাও তিনি বোঝেন না। নইলে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের আয়োজকরা নিশ্চয়ই এত বোকা নন যে কালীপুজোর দিন ম্যাচ করতে রাজি হবেন? জয় শাহীর মজা হল, হিন্দুত্ববাদী দলের নেতা অমিত শাহের পুত্র সর্বেসর্বা হলেও বিশ্বকাপের সূচি বানানোর সময়ে বোর্ডের খেয়ালই ছিল না যে ১৫ অক্টোবর নবরাত্রি উৎসবের সূচনা, সেদিন আমেদাবাদ শহরে ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচ করা সম্ভব নয়। এহেন প্রশাসনিক নৈপুণ্যের কারণে অনেক দেরিতে সূচি ঘোষণা করার পরেও সব মিলিয়ে গোটা দশেক ম্যাচের দিনক্ষণ বদল করতে হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। বিশ্বকাপের টিকিট বিক্রি নিয়ে যা চলছে তা প্রাক-২০১৪ ভারতে সম্ভবত তদন্তযোগ্য কেলেঙ্কারি বলে গণ্য হত এবং সমস্ত খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলে দিনরাত এ নিয়েই তর্কাতর্কি চলত। একে তো টিকিটের আকাশছোঁয়া দাম, তার উপর বিশ্বকাপের টিকিট অনলাইনে কিনতে গিয়ে অনেকেই তাজ্জব বনে গেছেন। ঘন্টা চারেক ‘কিউ’-তে পড়ে থেকেও টিকিট পাননি অনেকে। আইসিসি এখন পর্যন্ত বলেনি কত টিকিট বিক্রি হওয়ার কথা ছিল আর কত টিকিট বিক্রি হয়েছে। বিক্রির দায়িত্বে থাকা বুকমাইশো সোশাল মিডিয়ায় জানিয়েছে, তাদের হাতে নাকি সীমিত সংখ্যক টিকিটই আছে। এত টিকিট গেল কোথায়? এসব নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যত লেখালিখি হয়েছে, ভারতের সংবাদমাধ্যমে তত হয়নি। ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমে তবু খানিকটা হয়েছে, বাংলার কথা না বলাই ভাল। একদিকে টিকিটের আকাল, অন্যদিকে একাধিক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, আজকে উদ্বোধনী ম্যাচে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে নাকি ৪০,০০০ মহিলাকে দর্শক হিসাবে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে গুজরাট বিজেপি। আমেদাবাদের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে হোয়াটস্যাপে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে নাকি এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাহলে কি বিশ্বকাপের টিকিট পেতে গেলে বিজেপির সদস্য বা সমর্থক হতে হবে? সেকথা যদি ঠিক না-ও হয়, এই বিশ্বকাপে হক যে অন্য সব রাজ্যের চেয়ে গুজরাটের বেশি, তাতে কিন্তু সন্দেহ নেই। ভারতে এর আগে অনুষ্ঠিত তিনটে বিশ্বকাপে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম, কলকাতার ইডেন উদ্যান, দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা বা চেন্নাইয়ের চিদম্বরম স্টেডিয়ামের মত ঐতিহ্যশালী মাঠের যে সৌভাগ্য হয়নি সেই সৌভাগ্যই এবার হয়েছে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ ওখানে, ফাইনাল ওখানে, আবার ক্রিকেটবিশ্বের সকলের চোখ থাকে যে ম্যাচের দিকে – সেই ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচও ওই মাঠেই।

কেন ঘটছে এসব? জলের মত সরল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন বহুদিনের ক্রীড়া সাংবাদিক শারদা উগ্রা, সম্প্রতি দ্য ক্যারাভ্যান পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর দীর্ঘ প্রতিবেদনে, যার শিরোনাম Shah’s playground: BJP’s Control of Cricket in India। সেই প্রতিবেদনে বোর্ডের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, অমিতপুত্র বোর্ড চালান একেবারেই একনায়কত্বের ঢঙে। মিনমিনে বিনির সময় থেকে নয়, সৌরভ গাঙ্গুলি বোর্ড সভাপতি থাকার সময় থেকেই। অনেকসময় তিনি বোর্ডের অন্যদের সৌরভের ফোন ধরতে বারণ করতেন। যদি সৌরভ বলতেন অমুক ম্যাচটা ওইদিন হতে হবে, অবধারিতভাবে অন্য কোনোদিন ধার্য করা হত। জয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজের সভাপতি পদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া সৌরভ এসব মেনে নিয়েই পদ আঁকড়ে পড়েছিলেন। বোঝা শক্ত নয়, কেন বিশ্বকাপ আয়োজনে এত ডামাডোল। যাঁর কোনো প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই, তিনি যদি একনায়কের কায়দায় এত বড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন তাহলে এর চেয়ে উন্নত আর কী হওয়া সম্ভব?

আরও পড়ুন ক্রিকেট জেনেশুনে বিশ করেছে পান

যোগ্যতার অভাবের পাশাপাশি সদিচ্ছার অভাবটাও অবশ্য উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ১৯৯৬ সালে একদিনের ক্রিকেটের রমরমা ছিল, এখন বিশ্বজুড়েই ৫০ ওভারের খেলা অবাঞ্ছিত। ১৯৭০-এর দশকে একদিনের ক্রিকেটের দরকার হয়েছিল টেস্টের একঘেয়েমি কাটিয়ে মাঠে দর্শক ফেরাতে। সেই চেষ্টা সফল হয়। পরে খেলায় আরও বিনোদন আনতে কেরি প্যাকার চালু করেন রঙিন জামা, সাদা বলে দিনরাতের একদিনের ম্যাচ। প্রথম দিকে তিনি বিদ্রোহী তকমা পেলেও শেষপর্যন্ত কর্তারা বোঝেন এতে বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা। প্যাকারের ক্রিকেটই হয়ে দাঁড়ায় মান্য একদিনের ক্রিকেট। এখন আর সে দিন নেই। বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট। ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তিরা তাকে যথেচ্ছ বাড়তেও দিচ্ছেন, কারণ ওতেই পকেট ভরে যাচ্ছে। যদি একদিনের ক্রিকেটের প্রতি মমতা থাকত, তাহলে ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলোতে লাগাম দিতেন। টি টোয়েন্টির মত একদিনের ক্রিকেটেও দুই প্রান্ত থেকে দুটো বলে খেলা চালু করে, মাঠের সীমানা দৃষ্টিকটুভাবে ছোট করে এনে, ইনিংসের সবকটা ওভারকেই ফিল্ডিং সাজানোর নানাবিধ নিষেধের আওতায় নিয়ে এসে ব্যাট-বলের লড়াইকে দুদলের ব্যাটারদের চার, ছয় মারার প্রতিযোগিতায় পরিণত করতেন না। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। কথায় কথায় সাড়ে তিনশো-চারশো রান হচ্ছে, দ্বিশতরান হচ্ছে মুহুর্মুহু। পুরুষদের একদিনের ক্রিকেটে ২০১০ সালে শচীন তেন্ডুলকার প্রথম দ্বিশতরান করার পর থেকে গত ১৩ বছরে আরও নখানা দ্বিশতরান হয়ে গেছে, একা রোহিত শর্মার ঝুলিতেই তিনখানা। অথচ একদিনের ক্রিকেটের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ কমে গেছে পৃথিবীর সর্বত্র। ঘন্টা তিনেক লাগাতার চার-ছক্কা দেখতে ভাল লাগে, ছ-সাত ঘন্টা ধরে ও জিনিস দেখা সাধারণত ক্লান্তিকর। শেষের দিকের ওভারগুলোতে পুরনো বলে রিভার্স সুইং করিয়ে ব্যাটারদের কাজ কঠিন করে দেওয়া বোলারদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে গেছে। স্পিনারদেরও চকচকে নতুন বলে চার, ছয় না খাওয়ার দিকেই মনোযোগ দিতে হচ্ছে। ওয়াসিম আক্রাম, শেন ওয়ার্নরা এখন খেললে কোনো তফাত গড়ে দিতে পারতেন কিনা বলা মুশকিল।

খেলোয়াড়রাও ইদানীং ৫০ ওভারের ক্রিকেট খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেক কম পরিশ্রমে অনেক বেশি টাকা রোজগার করা যাচ্ছে কুড়ি বিশের ক্রিকেট খেলে। ফলে ওটাকেই তাঁরা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। টেস্ট ক্রিকেট আর ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট খেলে শরীরেও আর এত তাগদ থাকছে না যে একদিনের ক্রিকেট খেলবেন। গত বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার বেন স্টোকস তো গতবছর একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসরই নিয়ে ফেলেছিলেন। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটকর্তারা অনেক বলে কয়ে তাঁকে শুধুমাত্র ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলতে রাজি করিয়েছেন। বিশ্বকাপের পর কী হবে কেউ জানে না। নিউজিল্যান্ডের সেরা বোলার ট্রেন্ট বোল্টও নিজের দেশের বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। অর্থাৎ দেশের হয়ে খেলার আগ্রহ কমে গেছে, ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকছেন। ভারতের সাদা বলের অধিনায়ক রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলিও সাম্প্রতিককালে একদিনের ম্যাচের সিরিজে একটা ম্যাচ খেলেন তো দুটো ম্যাচে বিশ্রাম নেন। বিশ্বকাপের আগে শেষ দুটো সিরিজ ছিল এশিয়া কাপ আর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। তারও সব ম্যাচ খেললেন না।

কর্তারা যে ৫০ ওভারের খেলাটাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন তা সবচেয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির প্রাক্তন অধিনায়ক এবং সদ্য পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব এমসিসির সভাপতি হওয়া মার্ক নিকোলাস। ইএসপিএন ক্রিকইনফো ওয়েবসাইটকে তিনি বলেছেন, একদিনের ক্রিকেট আগামীদিনে বিশ্বকাপের বাইরে আর হওয়ার মানে হয় না। এমসিসি এখন আর ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা নয়, কিন্তু ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে এখনো তাদের মতামতের বিস্তর গুরুত্ব আছে আর ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বোর্ডগুলোই জয় শাহের বোর্ডের পরে সবচেয়ে ধনী বোর্ড। বস্তুত তারা ভারতীয় বোর্ডের নন্দী, ভৃঙ্গী। অনেকের ধারণা ভারতই ৫০ ওভারের খেলাটাকে ধরে রেখেছে এবং এবারের বিশ্বকাপটা জমজমাট হলে খেলাটা বেঁচে যাবে। এককথায়, ভারতই পারে বাঁচাতে। পারে হয়ত, কিন্তু বিশ্বকাপ আয়োজনে যে অযত্ন প্রকট তাতে বাঁচানোর ইচ্ছা আছে বলে তো মনে হয় না। আগামী কয়েক মরসুমে আইপিএলকে আরও লম্বা করার যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছে সেটাও একদিনের ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসার লক্ষণ নয়। অতএব ২০২৭ সালে আর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ না হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এতখানি অনিশ্চয়তা নিয়ে সম্ভবত কোনো খেলার বিশ্বকাপ শুরু হয়নি এর আগে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার।

Leave a Reply

%d bloggers like this: