তালিবান শাসন: ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

এ দেশের শাসকরা তালিবান নন। কারণ তাঁরা অনেকেই গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতে পারেন। উচ্চশিক্ষিত বলেই পাঠ্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি।

খুব আতঙ্কে কাটছে আমাদের। পাশেই আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। ভীষণদর্শন বন্দুকধারীদের ছবি, মানুষের প্রাণপণ পালানোর ছবি আমরা টিভি, খবরের কাগজ অথবা সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখছি। আফগান মানেই বর্বর, অথবা মুসলমানরা ওরকমই হয় — এরকম ভাবনার লোকেরা একরকম শান্তি পাচ্ছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ মনে পড়লে অশান্তি দ্বিগুণ। আফগানিস্তানের মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের কথা ভেবে ঘুম উড়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবল ‘কাবুলিওয়ালা’ লেখেননি। লিখেছিলেন “বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/ দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।” এই লাইনগুলো স্মরণ থাকলে আতঙ্কিত হওয়ার জন্য আফগানিস্তান দেখার প্রয়োজন নেই। তালিবান যা যা করে থাকে তার প্রায় কোনোটাই এ দেশে ঘটতে বাকি নেই।

তারা যখন নব্বইয়ের দশকে প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন থেকেই এ কথা বলে অনেকে প্রবল নিন্দার মুখে পড়েছেন। বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে ফেলা গর্হিত কাজ, কিন্তু বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার — এমন ব্যাখ্যাই চিৎকৃত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কারণ তালিবান কাজটা করেছিল ক্ষমতায় এসে, বাবরি ভেঙেছিল ‘স্বতঃস্ফূর্ত জনতা’। এখন সেই স্বতঃস্ফূর্ত জনতাই দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা। নেশন কী চায় তারাই জানে। সেই চাহিদা অনুযায়ী এডিট করা ভিডিও ক্লিপ জুগিয়ে দেয় ক্ষমতাসীন দলের আই টি সেল, পুলিস তার ভিত্তিতেই সত্য মিথ্যা যাচাই না করে মানুষকে হাজতে পুরে দেয়, সে পচতে থাকে ইউএপিএ আইনে। শরিয়তি আইনের অবিচার এর চেয়ে আর কত বেশি?

তবু এ দেশের শাসকরা তালিবান নন। কারণ তাঁরা অনেকেই গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতে পারেন। উচ্চশিক্ষিত বলেই পাঠ্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি। তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর গল্প বাতিল করেন, দলিত লেখক বামা এবং সুখরথারিনিও বাতিল হন। এঁরা গান নিষিদ্ধ করে লোকসঙ্গীত গায়ককে হত্যা করেন না, অপছন্দের লেখা সরিয়ে দেন। সে কালের জার্মানির মত বই পোড়ানোও শুরু হয়ে গেছে। আমেদাবাদের বইয়ের দোকানে ঢুকে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ পুড়িয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে, আবার এসব বই পাওয়া গেলে দোকানই জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। আফগানিস্তানে তালিবরা যেটাকে ইসলাম বলে সেটাই ইসলাম। ভারতেও এখন সঙ্ঘ যাকে হিন্দুধর্ম বলে সেটাই হিন্দুধর্ম। তাই বাৎস্যায়নও হিন্দু সংস্কৃতি বিরুদ্ধ।

আরও পড়ুন সাহিত্য ও সাংবাদিকতা অপ্রিয় সত্য ছাড়া বৃথা

তালিবান নেতারা সগর্বে বলে, মেয়েদের কাজকর্ম, লেখাপড়া করতে হলে ইসলামের নির্দেশ মেনে বোরখা পরে বাইরে বেরোতে হবে। ইসলামে ঠিক কী বলা আছে তা তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু তালিবানি শাসনে তাদের মুখের কথাই আইন। এ দেশে এখনো ১৯৫০ সালের সংবিধান চালু আছে বটে, কিন্তু মহিলাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচন, জামাকাপড়ের মাপ, মোবাইল ফোন ব্যবহার, এমনকি চাউমিন খাওয়ার অভ্যাসেও যে সংস্কৃতির বারোটা বাজছে — তা বহুবার পরিষ্কার করে দিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। স্বয়ং মোহন ভাগবত প্রকাশ্যেই বলে থাকেন, মেয়েদের কাজ ঘর সামলানো। উত্তরপ্রদেশের দাসনার মন্দিরের মহন্ত যতি নরসিংহানন্দের ছাপার অযোগ্য ভাইরাল বিষোদ্গারে মহিলাদের সম্পর্কে ভাবনায় তালিবান-সঙ্ঘ ঐকমত্য পরিষ্কার। এখন বিজেপি এই ঘোর মুসলমান বিদ্বেষী লোকটিকে জিহাদি আখ্যা দিচ্ছে, কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন ধরে কপিল মিশ্রর মত গুরুত্বপূর্ণ নেতার ঘনিষ্ঠ।

আর হত্যা? গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশদের কথা আমাদের মনে নেই। আরও অদরকারি আখলাক আহমেদ, পেহলু খানের মত অসংখ্য গণপিটুনির শিকারদের স্মৃতি। কারণ তাঁরা গরুর অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত। গত পরশু এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক বিচারপতি তো বলেই দিয়েছেন, গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করে তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইন দরকার। গরুর কল্যাণ হলেই দেশের কল্যাণ হবে।

আশা করা যায় তালিবান সরকার শুয়োরের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার আগেই ভারত সরকার বিচারপতির স্বপ্ন সত্যি করবেন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত