কাঁটাতারের এপার ওপার

বেশ তো চলছিল। গোমাংস খেয়েছে, পিটিয়ে মার। গরু চুরি করছিল, পিটিয়ে মার। কী খাচ্ছিস? টিফিন বক্সে কী আছে? মার শালাকে। হাতে গরম কোন কারণ থাক আর না-ই থাক। পিটিয়ে মার, কারণ এরা বেঁচে থাকলেই সন্ত্রাসবাদী হবে। হয় গণপিটুনিতে মার, নইলে পুলিশ দিয়ে এনকাউন্টারে মার। আইন, আদালত এসবের কোন দরকার নেই। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা সব দেবনিযুক্ত

স্ত্রী এলসা, পুত্র ব্রুনো আর কন্যা গ্রেটেলকে নিয়ে র‍্যালফের সুখের সংসার। কর্মক্ষেত্রে সফল লোকেদের যেমন হয় আর কি। সুখ আরো বেড়ে গেল যখন তার পদোন্নতি তথা বদলি হল। কোথায়? পোল্যান্ডে।
কী করে র‍্যালফ? সে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ, সৎ নাজি। ফুয়েরারের প্রতি আনুগত্যে তার এক বিন্দু গাফিলতি নেই। সে জন্যে সে নিজের মা-কেও অপছন্দ করে। কারণ তিনি প্রকাশ্যেই বেসুরো গেয়ে ওঠেন অনেক সময়। ছেলের উন্নতিতে আর সকলে খুশি হলেও তিনি খুশি হন না।
সে যা-ই হোক, নতুন জায়গায় গিয়ে ব্রুনো কিন্তু একেবারেই খুশি হয় না কারণ সেখানে তার সাথে খেলার মত কেউ নেই। এটা বারণ, সেটা বারণ। এমনকি বাড়ি সংলগ্ন বাগানের বাইরে যাওয়াও বারণ। গৃহশিক্ষকের কাছে ইহুদীবিদ্বেষ শিক্ষা চলে ব্রুনো আর তার দিদির। সেসব কিছুই ব্রুনোর কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে না। বাড়িতে চাকর হিসাবে যে ইহুদীকে সে দেখতে পায় তার সাথে গৃহশিক্ষকের বর্ণনার ইহুদীর কোন মিলই নেই যে। ২০০৮ এ মুক্তি পাওয়া ছবি ‘The Boy in the Striped Pajamas’ এর বাকি গল্পটা সংক্ষেপে বলা যাক।
বাড়ির সকলের নজর এড়িয়ে, আধখোলা গেটের সুযোগ নিয়ে ব্রুনো একদিন চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্যহীন পদক্ষেপে সে পৌঁছে যায় একটা কাঁটাতারে ঘেরা এলাকার বাইরে। নাজি, ফুয়েরার, ইহুদী — এই শব্দগুলো এক জায়গায় ব্যবহৃত হওয়ার পর কাঁটাতার শব্দটা এসে পড়লে আজ আর কাউকে বলে দেওয়ার দরকার হয় না যে জায়গাটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। কিন্তু ব্রুনো নাজি জার্মানিতে জন্মানো এক নিষ্পাপ শিশু। সে জানত না কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কী জিনিস। সে এও জানত না যে ঐ ক্যাম্পের কম্যান্ড্যান্ট স্বয়ং তার বাবা। সে বরং খুশি হয় তারের ওপারে ডোরাকাটা ঢলঢলে শার্ট আর পাজামা পরা এক সমবয়স্ক বন্ধুকে পেয়ে। সকলের অলক্ষ্যে এই বন্ধুত্ব বেড়ে চলে, যতদিন না ব্রুনোর মা এলসা স্বামীর কাজটা আসলে কী সেটা টের পেয়ে ছেলেমেয়েকে এই কুপ্রভাব থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে। ব্রুনোর বন্ধু শ্মুয়েল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বাস করেও বোঝেনি ওখানে কী ঘটে আসলে। তাই তার বাবার অন্তর্ধানে সে যারপরনাই বিস্মিত এবং বাবাকে খুঁজে বার করবে ঠিক করেছে। ব্রুনো তাকে সাহায্য করতে চায়। তাই শ্মুয়েল খুঁজে পেতে আরেক জোড়া পোশাক নিয়ে আসে। ব্রুনো সেই পোশাক পরে ঢুকে পড়ে ক্যাম্পে। যতক্ষণে তাকে বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে কম্যান্ড্যান্ট র‍্যালফ সদলবলে তার খোঁজ করতে করতে যথাস্থানে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে গ্যাস চেম্বারে একদল অপরিচিত ইহুদীর সাথে বিশুদ্ধ আর্য রক্তের ব্রুনো প্রাণ ত্যাগ করেছে। চিমনির কালো ধোঁয়া সে কথা জানান দিচ্ছে। বিবেকের মৃত্যু হয়েছে।
বিবেক তিওয়ারির মৃত্যু হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী, নিঃসন্দেহে হিন্দু, উচ্চবর্ণ বিবেক তিওয়ারির মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু হয়নি, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী শাসকের রাজত্বে পুলিশ বিনা কারণে একজন উচ্চবর্ণের হিন্দুকে গুলি করে মেরেছে। বিবেকের স্বজনরা স্তম্ভিত। টিভি ক্যামেরার সামনে তাঁর সহধর্মিনী বলেছেন তিনি ভাবতেই পারছেন না যে বিজেপিকে তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, যে যোগীজিকে অনেক আশা নিয়ে তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, সেই যোগীজির পুলিশ তাঁর স্বামীকে এভাবে মেরে ফেলল। তিনি তো সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না!
তবে কেন? তবে কেন? সারা দেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষ প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছেন। বেশ তো চলছিল। গোমাংস খেয়েছে, পিটিয়ে মার। গরু চুরি করছিল, পিটিয়ে মার। কী খাচ্ছিস? টিফিন বক্সে কী আছে? মার শালাকে। হাতে গরম কোন কারণ থাক আর না-ই থাক। পিটিয়ে মার, কারণ এরা বেঁচে থাকলেই সন্ত্রাসবাদী হবে। হয় গণপিটুনিতে মার, নইলে পুলিশ দিয়ে এনকাউন্টারে মার। আইন, আদালত এসবের কোন দরকার নেই। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা সব দেবনিযুক্ত। তাঁরা যা বলেন সেটাই তো আইন। অতএব উত্তরপ্রদেশে এনকাউন্টারে আশির উপর মানুষের মৃত্যুতে অনেক মানুষই অবাক হননি, প্রশ্ন তোলেননি। এরকম কড়া হাতেই তো দেশ শাসন করা উচিৎ। আমার রাজ্যে কবে এমন হবে? অধীর আগ্রহে ঘুম হচ্ছে না অনেকের।
কিন্তু সব হিসাব ভেস্তে গেল। বিবেকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তিনি মুসলমান মহিলা সহকর্মীকে সূর্যাস্তের পর বাড়িতে ছাড়তে গেলেন। আর পুলিশের ডাকে থামলেন না পর্যন্ত। কে জানে কেন? তিনি কী ভেবেছিলেন আমরা আর কোনদিন জানতে পারব না। জানব না সঙ্গের ভদ্রমহিলা ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে তাঁরা দুজনে কোন হেনস্থার শিকার হতে পারেন বলে বিবেকের আশঙ্কা ছিল কিনা। হাজার হোক, যোগীজির রামরাজ্যে অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড আছে, লাভ জিহাদ আছে। নাকি তিনি ভেবেছিলেন ট্রিগারমোদী উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আর্বান নকশালদের বানানো একটি চরিত্র?
আসলে তিনি বোধহয় জানতেন না, যেমন তাঁর পরিবার জানে না, যে শুরুটা হয়েছিল ইহুদীদের দিয়ে, শেষটা নয়। আখলাক, আফরাজুল, পেহলুর মত অনেকের মৃত্যুতে, কাফিল খানের হয়রানিতে যে ভারতীয়রা প্রকাশ্যে বা জনান্তিকে উল্লাস করেন তাঁরা এই বেলা জেনে রাখুন।

ছবি: The Boy in the Striped Pajamas ছবির একটি দৃশ্য

রক্তপিপাসু বাঙালি

আফরাজুল মুসলমান অর্থাৎ বাঙালি নয় — এই কথাও দেখলাম লোকে বেশ রেলা নিয়ে বলে বেড়াচ্ছে। অবশ্য মাইকেল মধুসূদন আর কাজী নজরুল বাঙালি নন যারা বলতে পারে তাদের কাছে আফরাজুলের আর কী দাম?

afrazul

আখলাক আহমেদ খুন হওয়ার কয়েকদিন পরে আমি একটা খেলার প্রতিবেদন লিখতে একটা বিজেপিশাসিত রাজ্যে গেছি। সেই রাজ্যের সবচেয়ে শিল্পোন্নত শহরের অভিজাত এলাকায় তৈরি স্টেডিয়ামের অস্থায়ী প্রেস বক্সে গিয়ে রোজ বসি। ওখানকার পয়সাওয়ালা, ক্ষমতাবান লোকেরা আশেপাশেই এসে বসেন, খানিকক্ষণ ক্রিকেটমাঠের উত্তাপ নিয়ে যান, নিজেদের মধ্যে আবহাওয়া, হজমের গণ্ডগোল, ক্রিকেটটা আশির দশকে কেমন ছিল আর এখন কেমন হয়েছে, শহরের কোথায় এখন জমির দাম সবচেয়ে বেশি আর কোথায় সবচেয়ে কম — এইসব নিয়ে গভীর আলোচনা করেন। সেই আলোচনায় একদিন দেখলাম সকলেই একমত হয়ে বলছেন যে একটা মুসলমান মরেছে তাতে দেশসুদ্ধু লোক মিলে যে লাফালাফিটা করছে সেটা অত্যন্ত অন্যায়। উত্তরপ্রদেশ সরকার আবার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে! হিন্দু মরলে দিত?
কিছুটা তফাতে বসে আমার গা চিড়বিড় করছে, নিজেকে শান্ত রাখছি এই বুঝিয়ে যে এই ধর্মান্ধগুলোর সাথে তখন তর্কে জড়ালে আমার কাজের বারোটা বাজবে। আরো যে ভাবনাটা শান্ত থাকতে সাহায্য করেছিল সেটা এই যে ওটা একে গোবলয়ের রাজ্য তায় বিজেপিশাসিত। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত লোকেরা এইভাবে ভাবে না। অন্য ব্যাপারে যতই মতের অমিল থাক, এই ধরণের হত্যার পক্ষ নিয়ে কেউ গলা ফাটায় না, যে খুন হল সরকার তার পরিবারের পাশে দাঁড়ালেও কেউ নোংরা মন্তব্য করে না। আফরাজুলের হত্যার পরের দিনগুলো আমার এই আত্মশ্লাঘাকে ইডেন থেকে ছয় মেরে বাংলার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
রামনবমীতে সশস্ত্র মিছিল দেখে আন্দাজ করেছিলাম, এবারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে বাঙালিদের মধ্যে গোমাতার সন্তানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আফরাজুল সম্পর্কে লাভ জিহাদের গপ্পটা বাজারে পড়তে না পড়তে বাঙালি চৈত্র সেলের শাড়ির মত ঝাঁপিয়ে তুলে নিল এবং সেটাকে মানুষ খুনের যুক্তি হিসাবে রোজকার কথাবার্তায় এবং অবশ্যই সোশাল মিডিয়ায় চালিয়ে দিল। আফরাজুলের বিরুদ্ধে লাভ জিহাদের অভিযোগ যে আদৌ প্রমাণ হল না সেকথা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু যে দেশে ধর্ষণ করে ড্যাংড্যাং করে মন্ত্রী হওয়া যায় সে দেশে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড, তাও আবার দন্ড দিতে আইন আদালত লাগবে না; রাম, শ্যাম, যদু, শম্ভু যে কেউ দন্ড দিতে পারে — একে যুক্তি বলে স্বীকার করে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করল কারা? রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, বেগম রোকেয়ার দেশের লোকেরা। আবার আফরাজুল মুসলমান অর্থাৎ বাঙালি নয় — এই কথাও দেখলাম লোকে বেশ রেলা নিয়ে বলে বেড়াচ্ছে। অবশ্য মাইকেল মধুসূদন আর কাজী নজরুল বাঙালি নন যারা বলতে পারে তাদের কাছে আফরাজুলের আর কী দাম? অপেক্ষায় ছিলাম কবে কোন ঘটনা নিয়ে বনলতা সেনগিরি শুরু হবে। বিরাট হিন্দু বাঙালি সেই সুযোগটা পেল হেমন্ত রায়ের মৃত্যুতে। কে হত্যা করেছে, কেন হত্যা করেছে কিছু জানতে পারার আগেই তারা যত ধর্মনিরপেক্ষ লোক সবার মা-মাসি উদ্ধার করে বলতে শুরু করল “এই হত্যার প্রতিবাদ হবে না কেন? একে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না কেন?”
আচ্ছা প্রতিবাদটা কার বিরুদ্ধে হবে? দুনিয়ার যেখানে যত খুন হচ্ছে নানা কারণে, সবকটারই প্রতিবাদ করতে হবে? সবকটাই নিন্দনীয় বললে মোটের উপর আপত্তি করার কিছু থাকে না কিন্তু সবকটারই নিন্দা করতেই হবে, নয়ত কোনটারই নিন্দা করা চলবে না, একথা যারা বলে তারা যে আসলে এক বিশেষ ধরণের খুনীর সমর্থক — একথা পরিষ্কার করে বলার সময় এসেছে। কী ধরণের খুনী তা নিয়ে যদি আপনার সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে একবার কালকের খবরে চোখ রাখুন। রাজস্থানে শম্ভুলালের সমর্থনে আদালত আক্রমণ করে যেটা করা হয়েছে সেটাকে সন্ত্রাসবাদ ছাড়া অন্য কোন নাম দেওয়া যায় না। মাথার তেরঙ্গাটাকে টেনে নামিয়ে তার জায়গায় গেরুয়া পতাকা তোলা হয়েছে। আইসিসের আছে কালো পতাকা, এদের আছে গেরুয়া পতাকা। যে ভারত সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০ ফুট উঁচু জাতীয় পতাকা লাগাতে চায়, পর্নো ছায়াছবির আগেও জাতীয় সঙ্গীত চালাতে চায় সেই সরকার কিন্তু এ নিয়ে চুপচাপ। অর্ণব গোস্বামী কী বললেন এ নিয়ে? কেউ শুনেছেন?
ও হ্যাঁ, ক্ষতিপূরণের কথা হচ্ছিল। ওটা তো রাজস্থান সরকারেরই দেওয়া উচিৎ ছিল। তাদের রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার এমন অবস্থা যে লোকে জানে একটা মুসলমানকে খুন করলে কিচ্ছু এসে যাবে না — এর জন্যেই তো প্রাণ গেল একটা নিরস্ত্র লোকের। এর দায় কোন না কোন সরকারকে তো নিতেই হবে। অতঃপর খুনী গ্রেপ্তার হল কিনা সেটা বড় কথা নয় কারণ অপরাধটা যেভাবে করা হয়েছে তাতে গ্রেপ্তার করার কাজটুকুই তো সরকারের ভাগে পড়ে ছিল। সেটুকু করার জন্যে তো আর বিরাট হিন্দুরা দাবী করতে পারেন না যে সকলে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেবে।
রাজস্থান সরকার অবশ্য আফরাজুলের খুনী, তার প্রতি সহানুভূতিশীল লোকেদের দায় নেবেন না সেটাই স্বাভাবিক কারণ মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে জননেত্রী নন, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে আগ্রহী প্রশাসক নন। উনি উন্মত্ত জনতার নেত্রী। প্রমাণ চাই? গত ১৩ই ডিসেম্বর দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারটা পড়ে নিন। নেত্রীর সোজাসাপ্টা কথা “একটা কাস্টের লোকের ভাবাবেগে যখন আঘাত লেগেছে তখন পদ্মাবতী মুক্তি পাওয়ার দরকারটা কী?” আরো অনেক মণিমুক্তো পাবেন ঐ সাক্ষাৎকারে যা বুঝিয়ে দেয় ক্ষ্যাপা জনতা যা চায় তাই-ই হবে রাজস্থানে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও সেই জনতারই একজন।
যাক সে কথা। এই বীভৎসতা দেখে কিন্তু এক শ্রেণীর বাঙালি যারপরনাই উল্লসিত। বসিরহাটের গন্ডগোলেই যারা ৩৫৬ ইত্যাদির দাবী করে ফেলেছিল তাদের রাজস্থানে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে এমনটা বলতে কিন্তু শোনা যাবে না। বাঙালির মোদীপ্রীতি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। নিত্যযাত্রী হওয়ার সুবাদে আজকাল প্রায়ই দেখি বাংলার বাসিন্দা বিহারী, মারোয়াড়িরা মোদীকে গাল পাড়ছেন। অথচ বাঙালিদের কি অচলা ভক্তি!
সক্রেটিসের ছাত্র আর এরিস্টটলের মাস্টারমশাই প্লেটো মনে করতেন গণতন্ত্র একটা ফালতু ব্যাপার কারণ এটা খুব ভাল চললে হয়ে দাঁড়ায় অভিজাততন্ত্র (plutocracy) আর খুব খারাপ চললে ক্ষ্যাপা জনতাতন্ত্র (mobocracy)। তা ভারতীয় গণতন্ত্র এখন একাধারে plutocracy এবং mobocracy। একদিকে দেশের সরকার থেকে ফুটবল পর্যন্ত সবকিছু চালাচ্ছে হাতেগোনা কয়েকজন পয়সাওয়ালা লোক, যাদের আরো বড়লোক করার জন্যে আগামীদিনে আমার, আপনার সাদা পথে অর্জিত টাকাও কেড়ে নেওয়ার আইন তৈরি হচ্ছে; অন্যদিকে আপনি কার পুজো করবেন, কী খাবেন, কী পরবেন, কী দেখবেন, কাকে বিয়ে করবেন, কার সাথে শোবেন সেটা ঠিক করে দেবে পাগলা কুকুরের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক জনতা আর সরকার সেই জনতারই পক্ষ নিয়ে কখনো আপনার লাঞ্ছনা দেখে চুপটি করে থাকবে, আর কখনো আইনের অপব্যবহার করে বা নতুন আইন বানিয়ে আপনার অত্যাচার বাড়িয়ে তুলবে। যদি সংখ্যালঘু হন তো আপনি বাঁচবেন না মরবেন সেটাও ঠিক করবে ঐ জনতাই। সরকার বলবে “জনতাকে ক্ষেপানো কেন বাপু? জনতা যেমনটি চায় তেমনটি করে থাকতে পারলে থাক, নইলে পাকিস্তান চলে যাও।”
তা বাঙালি ঐ plutocracy র দিকটায় প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না কারণ বাঙালির অভিজাত নেই গুজরাতি আর মারোয়াড়িদের মত, তাই mobocracy র দিকটায় সমানে সমানে লড়ে যাচ্ছে। ফাইট, মণি ফাইট।

%d bloggers like this: