আমার সন্ততি

ভেবে দেখলাম যে অক্ষয় ধন আমার সন্তানকে দিয়ে যেতে পারি তা হল সমাজ, সংসারের সঙ্গে, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোধ

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

— শঙ্খ ঘোষ (বাবরের প্রার্থনা)

যেদিন বাবা হয়েছি সেদিন থেকে ভেবে চলেছি, মানুষ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় সন্তানকে যা যা দিয়ে যেতে পারে তার মধ্যে কোনটা সবচেয়ে মূল্যবান?
অনেকে টাকাপয়সা, ধনসম্পদ দিয়ে যান। টাকার দাম মুদ্রাস্ফীতির কারণে দিন দিন কমে, সম্পত্তির মূল্যও নানা কারণে বাড়ে কমে। কথায় বলে কুবেরের ধনও ফুরিয়ে যায়। ফলে সন্তানকে যত ধনসম্পত্তিই দিয়ে যান না কেন, তার মূল্য অবিকৃত থাকবে না।
সফল, কৃতি মানুষেরা তাঁদের সন্তানদের খ্যাতি দিয়ে যান। কিন্তু সেই খ্যাতি বজায় রাখতে হলে সন্তানকেও বিখ্যাত বাবা কি মায়ের মত প্রতিভাবান এবং সফল হতে হয়, যা প্রায়শই হয় না। উপরন্তু বাবা-মায়ের খ্যাতির অপব্যবহার করে সন্তান তাঁদের দুর্নামের কারণ হচ্ছে — এমন দৃষ্টান্তই চোখে পড়ে বেশি। উপেন্দ্রকিশোরের পরে সুকুমার, সুকুমারের পর সত্যজিৎ নেহাতই ব্যতিক্রম। সে জন্যেই মনে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্রের পরে নারায়ণচন্দ্রই বরং বেশি দেখা যায়।
আমরা সাধারণ মানুষ। এ যুগে সন্তানের ভোগ করার মত যথেষ্ট সম্পত্তি রেখে যাওয়ার সুযোগ আমাদের অনেকেরই হবে না। মৃত্যুর পরেও সন্তান “অমুকের ছেলে” বা “তমুকের মেয়ে” হিসাবে সমাজে অতিরিক্ত সম্মান, সুযোগসুবিধা বা খ্যাতি ভোগ করবে তেমন সম্ভাবনাও নেই। তবে কি এমন কিছুই নেই যা আমাদের মৃত্যুর পরেও সন্তানদের সম্পদ না হোক, অন্তত ছাতা হিসাবে কাজ করতে পারে? আমার সন্তানের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সীমা তবে আমার শরীর? সেই শরীর অবলুপ্ত হওয়ার পর আমার সাথে সম্পর্কের কোন মূল্যবান অর্জন তার কাছে থাকবে না? তাহলে কেন দেশ কাল নির্বিশেষে বাবা-মায়েরা নিজের জীবনের চেয়েও সন্তানের মঙ্গলকে ঊর্ধ্বে স্থান দেন? আমাদের অষ্টাদশ শতকের কবির কেন মনে হল ঈশ্বরীর দেখা পেলে বাংলার নিরক্ষর পাটনী প্রার্থনা করবে “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”? প্রায় তিনশো বছর পরের কবির কেন মনে হল ভাগ্যান্বেষী উজবেক যোদ্ধা বাবর, যার সাথে সেই বাঙালি পাটনীর কোন দিক থেকে কোন মিল নেই, তিনিও নিজের ঈশ্বরের কাছে বলতেন, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার সন্তানের জীবন দাও? কবির কল্পনা তো আকাশ থেকে পড়েনি, এমনই আকুতি বিভিন্ন ভাষায় কত বাবা-মাকে তো আজও উচ্চারণ করতে দেখি আমরা। সেই বাবা মায়েরা তাহলে জীবন ফুরোলেই ফুরিয়ে যাবেন সন্তানের কাছেও?
কেউ কেউ বলবেন বাবা-মা শিক্ষা দেন, জীবনে নিজের পায়ে দাঁড় করান। সেটাই তো সারাজীবন সঙ্গে থাকে। সেকথা ঠিক, কিন্তু সে অবদান বাবা-মায়ের অনন্য অবদান নয়। মানুষ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের থেকেও শিক্ষা পায়, সর্বোপরি শিক্ষক শিক্ষিকাদের থেকে পায়। এবং যে শিক্ষা সে পায় তার বেশিরভাগটাই স্বোপার্জিত। বাবা-মা বড় জোর সুযোগ তৈরি করে দেন।
ভেবে দেখলাম যে অক্ষয় ধন আমার সন্তানকে দিয়ে যেতে পারি তা হল সমাজ, সংসারের সঙ্গে, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোধ। সুসময়ে, এবং দারুণ দুঃসময়ে, সেই বোধ তাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের প্রত্যেককে আমাদের বাবা-মায়েরাও জেনে বা না জেনে ঐ বোধই দিয়ে গেছেন, দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাসের কোন মুহূর্তে ঠিক কোন জায়গাটায় আমি দাঁড়িয়ে আছি এবং তার সাপেক্ষে বর্তমানে আর ভবিষ্যতে আমার কোথায় দাঁড়ানো উচিৎ সেই বোধ সচেতন বাবা-মায়েরা আমাদের দিয়ে যান জেনে বুঝে। আর যে বাবা-মায়েরা তত সচেতন নন আসলে তাঁরাও স্থান নির্দেশ করে দিয়ে যান তাঁদের কথাবার্তায়, জীবনচর্যায়।
কথাটা নতুন করে উপলব্ধি করলাম টিভিতে তথাকথিত গোরক্ষকদের হাতে নিহত পুলিশকর্মী সুবোধ কুমার সিং এর ছেলে অভিষেকের কথা শুনতে শুনতে।
সুবোধ কুমার খুন হওয়ার পর যত সময় যাচ্ছে তত পরিষ্কার হচ্ছে যে খুন হওয়ার দিনের ঘটনাবলী সুপরিকল্পিত, হঠাৎ উত্তেজিত জনতা তাঁকে হত্যা করেনি। তিনি সাম্প্রতিক অতীতে গোহত্যার “অপরাধে” প্রথম যে খুনটা হয়েছিল দাদরিতে, সেই খুনের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। সেই খুনের অপরাধীদের হাজতবাস করার পেছনে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। বদলি হয়ে বুলন্দশহরে এসে পড়ার পরেও আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে আপোষ না করে তিনি হিন্দুত্ববাদীদের যথেষ্ট বিরাগভাজন হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী বলেছেন সুবোধ কুমারকে প্রায়শই খুনের হুমকি দেওয়া হত। খবরে প্রকাশ বিজেপি নেতারা বুলন্দশহর থেকে তাঁর বদলি দাবী করেছিলেন অতি সম্প্রতি। বিপদের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন জেনেও সুবোধ কুমার ঘটনার দিন পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসাবে যা কর্তব্য ঠিক তাই করছিলেন। কোন সাহস তাঁকে প্রণোদিত করেছিল তা বলার জন্যে তিনি নেই, তা দেশ হিসাবে আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু বাবা হিসাবে তাঁর সাফল্য এই অন্ধকারে আমাদের ক্ষীণ আলো দেখাচ্ছে।
সকালের কাগজে মুন্ডিতমস্তক যে ছেলেদুটির ছবি কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বসা আমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলছিল, সেই বাবা হারা কিশোর যখন টিভির পর্দায় বলে “শুধু মুখ্যমন্ত্রীকে নয়, সারা ভারতের লোকের কাছে আমার আবেদন, হিন্দু মুসলমান নিয়ে দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হিংসা দয়া করে বন্ধ করুন,” তখন বোঝা যায় সুবোধকুমার ছেলেটির সঙ্গেই আছেন।
আরো পরিষ্কার হয় যখন অভিষেক বলেন “আমার বাবা একটা কথাই বলতেন ‘আর কিছু হতে পার না পার, সুনাগরিক হও। সব ধর্ম, সব জাতির লোকই এক। তুমি কারো চেয়ে বড় নও, কারো চেয়ে ছোটও নও।”
বাবা খুন হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে এই ভাষায় এই কথাগুলো বলতে পারা মুখস্থ বিদ্যায় সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যে বিদ্যার বলে মধ্যে মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর বন্দনা করেন সে বিদ্যার কর্ম নয় এসব। অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে শুধু ক্রিয়া, বিশেষণের জোরে এসব কথা বেরোয় না। অভিষেক যখন আমাদের সবাইকে সাবধান করেন এই বলে যে আমরা আত্মহননের পথে এগোচ্ছি; পাকিস্তান, চীনের দরকার নেই, আমরাই একে অপরের অনেক বড় শত্রু হয়ে উঠছি; তখন বোঝা যায় অভিষেকের প্রয়াত বাবা, এবং অবশ্যই মা, এই যুগসন্ধিক্ষণে তার যে স্থান নির্দেশ করেছেন সে সেই স্থানের যোগ্য হয়ে উঠছে। এইখানে মৃত সুবোধ কুমারের জিত, হত্যাকারীদের হার। হত্যাকারীদের সরকার তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ করুক আর না-ই করুক, সুবোধ কুমার সন্তানের মধ্যে বেঁচে রইলেন। আমাদেরও বাঁচার রাস্তার সন্ধান দিলেন।
এত কথা বলার পরে একটা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। সন্তান কি সবসময় বাবা-মায়ের দেখানো অবস্থান মেনে নেয়? নেয় না। প্রকৃতপক্ষে সর্বদা মেনে নেওয়া উচিৎও নয়। কারণ অনেক বাবা-মা এমন অবস্থানও ঠিক করেন যা সমাজের পক্ষে, সন্তানের চারপাশের মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, পশ্চাৎমুখী। সেইসব বাবা-মায়েদের অবাধ্য সন্তানেরাই যুগে যুগে সমাজকে বদলে দেন, এগিয়ে নিয়ে যান। সেই জন্যেই আমাদেরও বারবার ভাবতে হবে সন্তানকে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে বলছি। কার পক্ষে, কার বিপক্ষে? তাকে যে অবস্থান নিতে শেখাচ্ছি তা শুধু তার জন্যে ভাল, না আর পাঁচজনের জন্যেও ভাল — সেকথাও ভাবতে হবে। এমনি এমনি তো আর ঠাকুমা, দিদিমারা বলতেন না “প্রসব করলেই হয় না মাতা।”

কাঁটাতারের এপার ওপার

বেশ তো চলছিল। গোমাংস খেয়েছে, পিটিয়ে মার। গরু চুরি করছিল, পিটিয়ে মার। কী খাচ্ছিস? টিফিন বক্সে কী আছে? মার শালাকে। হাতে গরম কোন কারণ থাক আর না-ই থাক। পিটিয়ে মার, কারণ এরা বেঁচে থাকলেই সন্ত্রাসবাদী হবে। হয় গণপিটুনিতে মার, নইলে পুলিশ দিয়ে এনকাউন্টারে মার। আইন, আদালত এসবের কোন দরকার নেই। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা সব দেবনিযুক্ত

স্ত্রী এলসা, পুত্র ব্রুনো আর কন্যা গ্রেটেলকে নিয়ে র‍্যালফের সুখের সংসার। কর্মক্ষেত্রে সফল লোকেদের যেমন হয় আর কি। সুখ আরো বেড়ে গেল যখন তার পদোন্নতি তথা বদলি হল। কোথায়? পোল্যান্ডে।
কী করে র‍্যালফ? সে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ, সৎ নাজি। ফুয়েরারের প্রতি আনুগত্যে তার এক বিন্দু গাফিলতি নেই। সে জন্যে সে নিজের মা-কেও অপছন্দ করে। কারণ তিনি প্রকাশ্যেই বেসুরো গেয়ে ওঠেন অনেক সময়। ছেলের উন্নতিতে আর সকলে খুশি হলেও তিনি খুশি হন না।
সে যা-ই হোক, নতুন জায়গায় গিয়ে ব্রুনো কিন্তু একেবারেই খুশি হয় না কারণ সেখানে তার সাথে খেলার মত কেউ নেই। এটা বারণ, সেটা বারণ। এমনকি বাড়ি সংলগ্ন বাগানের বাইরে যাওয়াও বারণ। গৃহশিক্ষকের কাছে ইহুদীবিদ্বেষ শিক্ষা চলে ব্রুনো আর তার দিদির। সেসব কিছুই ব্রুনোর কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে না। বাড়িতে চাকর হিসাবে যে ইহুদীকে সে দেখতে পায় তার সাথে গৃহশিক্ষকের বর্ণনার ইহুদীর কোন মিলই নেই যে। ২০০৮ এ মুক্তি পাওয়া ছবি ‘The Boy in the Striped Pajamas’ এর বাকি গল্পটা সংক্ষেপে বলা যাক।
বাড়ির সকলের নজর এড়িয়ে, আধখোলা গেটের সুযোগ নিয়ে ব্রুনো একদিন চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্যহীন পদক্ষেপে সে পৌঁছে যায় একটা কাঁটাতারে ঘেরা এলাকার বাইরে। নাজি, ফুয়েরার, ইহুদী — এই শব্দগুলো এক জায়গায় ব্যবহৃত হওয়ার পর কাঁটাতার শব্দটা এসে পড়লে আজ আর কাউকে বলে দেওয়ার দরকার হয় না যে জায়গাটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। কিন্তু ব্রুনো নাজি জার্মানিতে জন্মানো এক নিষ্পাপ শিশু। সে জানত না কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কী জিনিস। সে এও জানত না যে ঐ ক্যাম্পের কম্যান্ড্যান্ট স্বয়ং তার বাবা। সে বরং খুশি হয় তারের ওপারে ডোরাকাটা ঢলঢলে শার্ট আর পাজামা পরা এক সমবয়স্ক বন্ধুকে পেয়ে। সকলের অলক্ষ্যে এই বন্ধুত্ব বেড়ে চলে, যতদিন না ব্রুনোর মা এলসা স্বামীর কাজটা আসলে কী সেটা টের পেয়ে ছেলেমেয়েকে এই কুপ্রভাব থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে। ব্রুনোর বন্ধু শ্মুয়েল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বাস করেও বোঝেনি ওখানে কী ঘটে আসলে। তাই তার বাবার অন্তর্ধানে সে যারপরনাই বিস্মিত এবং বাবাকে খুঁজে বার করবে ঠিক করেছে। ব্রুনো তাকে সাহায্য করতে চায়। তাই শ্মুয়েল খুঁজে পেতে আরেক জোড়া পোশাক নিয়ে আসে। ব্রুনো সেই পোশাক পরে ঢুকে পড়ে ক্যাম্পে। যতক্ষণে তাকে বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে কম্যান্ড্যান্ট র‍্যালফ সদলবলে তার খোঁজ করতে করতে যথাস্থানে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে গ্যাস চেম্বারে একদল অপরিচিত ইহুদীর সাথে বিশুদ্ধ আর্য রক্তের ব্রুনো প্রাণ ত্যাগ করেছে। চিমনির কালো ধোঁয়া সে কথা জানান দিচ্ছে। বিবেকের মৃত্যু হয়েছে।
বিবেক তিওয়ারির মৃত্যু হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী, নিঃসন্দেহে হিন্দু, উচ্চবর্ণ বিবেক তিওয়ারির মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু হয়নি, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী শাসকের রাজত্বে পুলিশ বিনা কারণে একজন উচ্চবর্ণের হিন্দুকে গুলি করে মেরেছে। বিবেকের স্বজনরা স্তম্ভিত। টিভি ক্যামেরার সামনে তাঁর সহধর্মিনী বলেছেন তিনি ভাবতেই পারছেন না যে বিজেপিকে তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, যে যোগীজিকে অনেক আশা নিয়ে তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, সেই যোগীজির পুলিশ তাঁর স্বামীকে এভাবে মেরে ফেলল। তিনি তো সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না!
তবে কেন? তবে কেন? সারা দেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষ প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছেন। বেশ তো চলছিল। গোমাংস খেয়েছে, পিটিয়ে মার। গরু চুরি করছিল, পিটিয়ে মার। কী খাচ্ছিস? টিফিন বক্সে কী আছে? মার শালাকে। হাতে গরম কোন কারণ থাক আর না-ই থাক। পিটিয়ে মার, কারণ এরা বেঁচে থাকলেই সন্ত্রাসবাদী হবে। হয় গণপিটুনিতে মার, নইলে পুলিশ দিয়ে এনকাউন্টারে মার। আইন, আদালত এসবের কোন দরকার নেই। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা সব দেবনিযুক্ত। তাঁরা যা বলেন সেটাই তো আইন। অতএব উত্তরপ্রদেশে এনকাউন্টারে আশির উপর মানুষের মৃত্যুতে অনেক মানুষই অবাক হননি, প্রশ্ন তোলেননি। এরকম কড়া হাতেই তো দেশ শাসন করা উচিৎ। আমার রাজ্যে কবে এমন হবে? অধীর আগ্রহে ঘুম হচ্ছে না অনেকের।
কিন্তু সব হিসাব ভেস্তে গেল। বিবেকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তিনি মুসলমান মহিলা সহকর্মীকে সূর্যাস্তের পর বাড়িতে ছাড়তে গেলেন। আর পুলিশের ডাকে থামলেন না পর্যন্ত। কে জানে কেন? তিনি কী ভেবেছিলেন আমরা আর কোনদিন জানতে পারব না। জানব না সঙ্গের ভদ্রমহিলা ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে তাঁরা দুজনে কোন হেনস্থার শিকার হতে পারেন বলে বিবেকের আশঙ্কা ছিল কিনা। হাজার হোক, যোগীজির রামরাজ্যে অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড আছে, লাভ জিহাদ আছে। নাকি তিনি ভেবেছিলেন ট্রিগারমোদী উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আর্বান নকশালদের বানানো একটি চরিত্র?
আসলে তিনি বোধহয় জানতেন না, যেমন তাঁর পরিবার জানে না, যে শুরুটা হয়েছিল ইহুদীদের দিয়ে, শেষটা নয়। আখলাক, আফরাজুল, পেহলুর মত অনেকের মৃত্যুতে, কাফিল খানের হয়রানিতে যে ভারতীয়রা প্রকাশ্যে বা জনান্তিকে উল্লাস করেন তাঁরা এই বেলা জেনে রাখুন।

ছবি: The Boy in the Striped Pajamas ছবির একটি দৃশ্য