লজ্জার ভাগ

ভিখারি দূরে থাক, হকারদের প্রবেশও নিষেধ। কেউ ফাঁকতালে গ্রীষ্মের দুপুরে ঢুকে পড়লে রক্ষীর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।

উসকোখুসকো, পরিচর্যার অভাবে লাল হয়ে যাওয়া দড়ির মত চুল, পরনে রং বোঝা যায় না এমন সালোয়ার কামিজ, কাঁধে একটা কাপড়ের পোঁটলা, সঙ্গে হাড় জিরজিরে ছেঁড়া ফ্রক পরা বছর দশেকের একটি মেয়ে। এভাবে আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন একজন বছর তিরিশের মহিলা। দিন পনেরো আগের কথা। কোনো ভণিতা নেই, দরজা খুলতেই বললেন “বাবু, দুটো কাপড় হবে? আমাদের পরার কাপড় নেই।” বাড়ির দরজায় এসে কেউ সরাসরি হাত পেতে দাঁড়ায়নি অনেককাল। তাই কিছুটা ধাক্কা লেগেছিল। নিজের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে, বউ মেয়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জাই হয়েছিল কিছুটা। গিন্নীর ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু পুরনো জামাকাপড় প্রার্থীর হাতে তুলে দেওয়া গেল। বাচ্চা মেয়েটির চোখ দিয়ে খিদে এমন দৃষ্টিকটুভাবে চেয়ে ছিল, যে তার হাতে দুটো বিস্কুটও দেওয়া গেল। তাতেই বোঝা গেল, এমন নয় যে ওদের বাড়িতে অন্নের তবু সংস্থান আছে, কেবল বস্ত্র ভিক্ষা করতে হচ্ছে। মহিলা বলে বসলেন “বাবু, চাল হবে?” আসলে ইনি ভিক্ষাজীবী নন একেবারেই। বললেন অধুনা প্রায় জঙ্গলে পরিণত হিন্দমোটর কারখানার পরিত্যক্ত কোয়ার্টারগুলোর একটাতে থাকেন। কী কাজ করতেন বললেন না, কিন্তু বললেন কাজ ঘুচে গেছে অতিমারীর কোপে। কাপড় দিয়েছি গোটা কয়েক, মেয়ের হাতে বিস্কুট দিয়েছি না চাইতেই, কিঞ্চিৎ নগদও দিয়েছি। বোধহয় সে জন্যেই ভরসা করে চাল চেয়েছিলেন। কেন কে জানে, ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “হবে না।” একটিও কথা না বাড়িয়ে, পোঁটলার মুখ বেঁধে ফেলে দুজনে বিদায় নিলেন।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার পর মনে হল, ফিরে ডাকি। কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেল। গিন্নী শুনে বললেন “হবে না বললে কেন? চাল তো ছিলই।” ভেবে দেখলাম, চাল আছে। অভাব তো নেই-ই, বরং উদ্বৃত্ত আছে। কিন্তু আমার দেবার মনটাই নেই। নিজের কাছে নানারকম যুক্তি খাড়া করে ফেললাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। যেমন, কাপড় দিলাম, টাকা দিলাম, আবার চালও দেব? বাড়াবাড়ি করা ভাল নয়। যদি চিনে রাখে, নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করে? প্রগতিশীল যুক্তিও খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রের মত লাগিয়ে দিলাম পিছনে — ভিক্ষা দেওয়া ভাল নয়। এর সমর্থনে দু-একজন মহাপুরুষের উক্তিও মনে করার চেষ্টা করলাম, মনে পড়ল না। শেষ পর্যন্ত দুটো কথা স্বীকার না করে উপায় রইল না। প্রথমত, যিনি এসেছিলেন তিনি সারা বছর ধরাচূড়ো পরে ট্রেনে বাসে ভিক্ষা করে নেশার টাকা তুলে বেড়ানোর লোক নন। লজ্জার মাথা খেয়ে মেয়ের হাত ধরে ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যদি বারবার ফিরেও আসেন, তাহলেও আমার যত আছে সবটা ভিক্ষা করে নিয়ে যাওয়ার শক্তি ওঁর নেই।

আসলে সংবেদনশীলতা বোধহয় একটা অভ্যাস। সে অভ্যাস আমার চলে গেছে, তাই কয়েক মিনিটের জন্যও আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে পারি না। ভয় হয়, দুর্বলতম মানুষটিও আমার সব কেড়ে নেবে। অথচ নেওয়ার মত কী-ই বা পড়ে আছে আমাদের? এক সময় কিন্তু ছিল। যখন এ তল্লাটে বাড়ি বাড়ি আসতেন তাঁরা, যাঁদের আমরা সবাই ভিখিরি বলতাম।

ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের যে জায়গাগুলো হুগলী শিল্পাঞ্চলের মধ্যে ধরা হত, তারই একটায় আজন্ম বসবাস করছি। আমার জন্মের আগে বা আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই এ অঞ্চলের বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সমরেশ বসুর গল্প, উপন্যাসে এই অঞ্চলের যে ব্যস্ত শ্রমিক মহল্লার ছবি পাওয়া যায়, সেসব বিরল হয়ে আসতে শুরু করেছে ক্রমশ। র‍্যালিস ইন্ডিয়াকে প্রথম থেকেই পোড়োবাড়ি বলে জেনেছি, রিলাক্সন কারখানায় ধর্মঘট, শ্রমিক-মালিকের টানাপোড়েন চলছে — এসব শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। কিন্তু কৈশোরের শেষ পর্যন্ত হিন্দমোটর আর রিষড়ার অ্যালকালির সাইরেন ভুলতে দেয়নি যে আমরা শিল্পাঞ্চলে বাস করি। পাড়ার কাকু, জেঠু, দাদারা সাইরেন বাজার খানিক আগে-পরে সাইকেল নিয়ে কারখানার দিকে রওনা হতেন বা ফিরতেন। ওসব সকাল-বিকেলের ব্যাপার। দুপুরের নৈঃশব্দ্য, গৃহিণীদের দু দণ্ড বিশ্রামের শান্তি ভঙ্গ হত ভিখারিদের আগমনে।

যাঁরা আসতেন তাঁদের রোজ দেখতে দেখতে মুখ চেনা হয়ে যেত। এক লোলচর্ম বৃদ্ধা আসতেন। পিঠ বেঁকে মাটির সাথে প্রায় সমান্তরাল হয়ে গেছে, দু পা হেঁটেই হাঁপিয়ে পড়েন, টানা কথা বলতেও পারেন না। পয়সা দিলে ক্ষুণ্ণই হতেন। তাঁর দরকার ছিল চাল, ডাল অথবা আলু। তখন ফ্ল্যাটে থাকতাম না। নিজেদের বাড়ি ছিল, সে বাড়ির চাল ছিল টিনের, বৃষ্টি হলে জলও পড়ত। কিন্তু ওই বৃদ্ধাকে মা কখনো বলেননি, চাল হবে না। এ কেবল আমার বাড়ির গল্প নয়। এলাকায় দোতলা বাড়ি তখন গোনা যেত, আর টিভি থাকতে একটা-দুটো বাড়িতে। বৃদ্ধা সব বাড়ি থেকেই কিছু না কিছু পেতেন, ঠা ঠা দুপুরে জিরিয়ে নিতেন কোনো বারান্দায় বসে। হাফপ্যান্টের বয়সে কৌতূহলের সীমা থাকে না। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম “দিদা, তুমি ভিক্ষা করো কেন? তোমার বাড়িতে কেউ নেই?” ছিল, সবই ছিল। স্বামী না থাকলেও ছেলে ছিল, বৌমা ছিল, নাতি-নাতনি ছিল। কিন্তু তারা দেখে না, দু মুঠো খেতেও দেয় না — এমনটাই বলেছিলেন তিনি। দিদার মৃত্যুসংবাদও যথাসময়ে পাওয়া গিয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের পাড়ার লোকেরাই চাঁদা তুলে তাঁর সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল।

এক কাকু ছিল, যে শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভিক্ষা করতে চাইত না। জন্মান্ধ, তার উপর টাকাপয়সার হিসাবও রাখতে পারত না ঠিক করে। তাই তার বাড়ি বাড়ি ধূপ বিক্রি করার ব্যবসা নামেই ব্যবসা। কোনো ক্রেতা তাকে সুযোগ পেয়ে ঠকিয়েছে কিনা জানি না, তবে যে ধূপ সে বিক্রি করতে আসত তার গন্ধ তেমন মনোমুগ্ধকর ছিল না। আদৌ কোনো গন্ধ ছিল কিনা সে-ও তর্কসাধ্য, অর্থাৎ পাইকারি বিক্রেতা তাকে বরাবরই ঠকিয়ে গেছে বলা যায়। সুতরাং কাকুর কোনোমতে গ্রাসাচ্ছাদন আসলে লোকের দয়ার উপরেই নির্ভরশীল ছিল। বয়স একটু বাড়তে মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণও দেখা দিয়েছিল, ফলে দুর্দশার শেষ ছিল না। তবু, কটু কথা শোনালেও, তাকে যৎসামান্য সাহায্য করার লোকের অভাব ছিল না আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর মফস্বলে।

মাঝে মাঝে দেখা মুখও ছিল কয়েকজন। সেই সময়কার আর সব মফস্বল স্টেশনের মত, আমাদের কোন্নগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও ভিখারিদের দেখা পাওয়া যেত। তাছাড়া কালীপুজোর দিন সন্ধেবেলা আমারই বয়সী কিছু শুকনো মুখ ঘুরে বেড়াত। তারা শিশু হলেও আত্মসম্মান যথেষ্ট, তাই কখনো কারোর কাছে বাজি চায়নি। কিন্তু তাদের মুখের অন্ধকার দেখেও নিজের ভাগের আলো থেকে একটুও দেবে না কোন পাষাণ?

আশির দশক পেরিয়ে নব্বইয়ের দশকে এসে কিন্তু অন্য মানুষের দয়ায় বাঁচতে বাধ্য মানুষের সংখ্যা কমে গেল বহুগুণ। এলাকায় বন্ধ কারখানার সংখ্যা বাড়লেও চোখের সামনে দেখতে পেলাম, কিছু না কিছু করছে সকলেই। নিতান্ত ভিক্ষা করে খাওয়ার লোক আমাদের এলাকায় আর নেই দেখে অদ্ভুত স্বস্তিবোধ হত। আজ যৌবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার বৃত্তের সমবয়স্ক এবং বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেদের সাথে কথা বলে দেখি, নিজ নিজ এলাকায় তাঁদের অভিজ্ঞতাও এরকমই। অন্যের অনুগ্রহের ভরসায় জীবনধারণ করার চেয়ে গ্লানিকর কিছু নেই। সে গ্লানি দেখাও গ্লানিকর। তা কাউকে অবসন্ন করে, কাউকে ক্ষিপ্ত করে। ওই গ্লানি থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি বলেই মনে হয়েছিল মাঝের কয়েক বছর।

এখন ভারতের যে প্রান্তের মানুষের সাথেই কথা বলছি, মন খারাপ করা গল্প বলছেন সবাই। আলোকচিত্রীদের ক্যামেরাতেও ধরা পড়ছে মানুষের অসীম দুর্দশার ছবি। পথ দিয়ে চলে যাওয়া দুধের গাড়ি থেকে গড়িয়ে পড়া দুধ রাস্তা থেকে চেটে খাচ্ছেন একজন — এমন ছবিও আমরা দেখে ফেলেছি গত বছর। তার আগেই অবশ্য আমার কল্পনাশক্তিকে অবশ করে দিয়ে হুগলী জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসী এক বন্ধু জানিয়েছে, এক দুপুরে তারা সবে খেয়ে উঠে ঢেঁকুর তুলছে যখন, এক পথিক এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছে “ভাত হবে?” বছর তিরিশেকের ছেলেটি নিজের জন্মস্থানে মানুষকে এভাবে অভুক্ত থাকতে কখনো দেখেনি। ভারতের রাজধানীতে জন্মানো, বেড়ে ওঠা সাংবাদিক বন্ধুও এই দেড় বছরে একাধিকবার বলেছেন, যারা খেটে খেত, তারাও হাত পাততে বাধ্য হচ্ছে।

জানি না, পাঠক, এসব অভিজ্ঞতা কতটা মিলছে আপনাদের অভিজ্ঞতার সাথে। আমাদের নবগ্রাম অনেক বদলে গেছে, আমরা সবাই বদলে গেছি। এখানে এখন অনবরত বাড়ি ভাঙছে, ফ্ল্যাট উঠছে। সেসব ফ্ল্যাটে আমরা সম্ভ্রান্ত লোকেরা থাকি। আমার ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা পেয়েই নিশ্চয়ই দোতলায় উঠে আসতে পেরেছিল ওই তরুণী মা আর তার মেয়ে। হয়ত আর কোনোদিন পারবে না। বহু ফ্ল্যাটে সজাগ রক্ষী আছে এসব বাজে লোককে আটকানোর জন্য। ভিখারি দূরে থাক, হকারদের প্রবেশও নিষেধ। কেউ ফাঁকতালে গ্রীষ্মের দুপুরে ঢুকে পড়লে রক্ষীর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে। আপনি যদি তেমন কোনো ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হন, তাহলে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতা, বমন উদ্রেককারী দৃশ্যের পসরা সাজাবার জন্য। এসব গালগল্প মনে হলে আমিই দায়ী।

আসলে অনুগ্রহ প্রার্থী মানুষ আমাকে বড় লজ্জায় ফেলেন। অতিমারীর সময় হঠাৎ লজ্জায় পড়তে হয়েছে তা নয়। এ লজ্জার শুরু এই সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে। তার আগে নেহাত বালক ছিলাম, লজ্জা ঘৃণা ভয় — সবই কম ছিল। প্রথম লজ্জা পেলাম যখন সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানার শ্রমিকরা আমাদের বাড়িতে পুরুষ-মহিলাদের প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি করতে এলেন। বাবার বয়সী লোক সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালে যে পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করে, সে অনুভূতি সেই প্রথম। আমরা যত বড় হয়েছি, বন্ধ কারখানার সংখ্যা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে মরিয়া শ্রমিকদের যাতায়াত। এক পাড়ায় কতজন এক মাসে কতগুলো ডিওডোর‍্যান্ট কিনতে পারে? উত্তর জেনেও তাঁদের দলে দলে, বারবার আসতে হয়েছে আমাদের দুয়ারে। বিপন্ন মানুষের জন্যে, রোজগারের রাস্তা খোঁজা মানুষের জন্যে এই পৃথিবী কী ভীষণ ছোট! যাঁরা আসেন, তাঁদের কখনো না কখনো ফেরাতেই হয়। মেজাজ ভাল থাকলে নরম সুরে “সেদিন যেটা দিয়ে গেলেন, এখনো ফুরোয়নি যে, কাকু।” তিরিক্ষে হলে “এই তো আপনাদের ফ্যাক্টরিরই একজনের থেকে একটা জিনিস কিনলাম। কজনের থেকে কিনতে হবে রে বাবা?” মাসে মাসে এলে কয়েক জনের মুখ চেনা হয়ে যায়। তখন অনুগ্রহ প্রার্থনা আরও লজ্জায় ফেলে। কেউ কেউ নিজের অবস্থায় এতই লজ্জিত, যে সামান্য নখপালিশ কেনার জন্য হাঁটুর বয়সী গৃহবধূকে বলে ফেলেন “আপনাদের অশেষ দয়া। আপনারা আছেন বলেই আমার মেয়েটা খেতে পরতে পাচ্ছে মা।” আসলে তিনি জানেন এই বেচা কেনা চাহিদা-যোগানের অর্থনৈতিক নীতি অনুযায়ী হচ্ছে না, হচ্ছে অনুগ্রহের ভিত্তিতে।

গত দেড়-দুই দশক ধরে তবু এই ভানটুকু আমাদের আব্রু বজায় রেখেছিল। অতিমারী এসে সেটুকুও বুঝি কেড়ে নিল। ভিখারি হওয়া ছাড়া আর পথ রইল না অনেক মানুষের। নিজেকে এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃশাসনীয় গল্পের নারীদের মত অসহায়, উলঙ্গ মনে হয়। দুঃখ ভাগ করলে কমে জানি, লজ্জা ভাগ করলে কমে কিনা জানি না। তাই খানিক আশায়, প্রিয় পাঠক, এই ঝুঁকি নিলাম।

https://aajkaal.in এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

শিক্ষক দিবসের প্রশ্ন: শিক্ষকদের বাঁচাবে কে?

কাকিমার এখন লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে মাসে এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলের উপর যে আশা ছিল, সে আশা পূরণ হল না।

কালের গতি রোধ করা যমেরও অসাধ্য। তাই আজ পশ্চিমবঙ্গেও শিক্ষক দিবস। নইলে যেখানে শিক্ষিকারা বিষ খেতে বাধ্য হন, সেখানে শিক্ষক দিবস বলে কিছু থাকতে পারে না। অণিমা নাথ, ছবি দাস, শিখা দাস, পুতুল মন্ডল, জোশুয়া টুডু, মন্দিরা সর্দারদের বিষ খাওয়া আসলে একটা ষড়যন্ত্র, অশান্তি সৃষ্টি করাই আসল উদ্দেশ্য ছিল — এমন অভিযোগ অবশ্য উঠেছে। [১] ওঠাই স্বাভাবিক। কৃষকরা আত্মহত্যা করলে যেমন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং তাদের অনুরাগীরা বলে থাকে “ক্ষতিপূরণের লোভে করেছে।” কবি এমনি এমনি লেখেননি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি। এ দেশে না জন্মালে আত্মহত্যা যে মরণোত্তর কিছু পাওয়ার লোভে করা সম্ভব এ তথ্য আপনি জানতে পারতেন? তেমনি প্রাথমিক স্কুলের কয়েকজন নগণ্য শিক্ষিকা যে একটা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে অস্থির করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মানববোমার মত কাজ করতে পারেন — এ-ও অন্য কোথাও থাকলে জানা কঠিন হত। তাও আবার বিস্ফোরকবিহীন মানববোমা। মানে চারপাশে আর কেউ মরবে না, কারোর কোনো ক্ষতি হবে না। কেবল শিক্ষিকা নিজে মরবেন, আর তাতেই সরকার কেঁপে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি আমাদের এত শ্রদ্ধা অবশিষ্ট আছে?

নেই। থাকলে ২০১৫ সালের মাদ্রাসা শিক্ষকদের অনশন আন্দোলনের কথা, ২০১৯ সালের প্যারাটিচারদের অনশনের কথা এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরির প্রত্যাশায় থাকা হবু শিক্ষকদের অনশনের কথা মনে থাকত। কয়েকশো শিক্ষক বা হবু শিক্ষক ওই আন্দোলনগুলোতে অনশন করেছেন, খবরের কাগজের তিনের পাতায়, বা পাঁচের পাতায়, কি সাতের পাতায় খবর বেরিয়েছে। আমরা পাতা উল্টাতে গিয়ে হয়ত খেয়ালও করিনি। ছন্দা সাহার মৃত্যু (২০১৫) [২], রেবতী রাউতের মৃত্যু এবং তাপস বরের ব্রেন স্ট্রোক নিয়ে বিতর্ক (২০১৯) [৩] তৈরি হলে কখনো সখনো একটু হৈ চৈ হয়েছে। তারপর যে কে সেই। গত দশ বছরে এ রাজ্যে যে কোন আন্দোলনের প্রতি সরকারি উদাসীনতা এবং সামাজিক উদাসীনতার কারণে (শুধু সরকার কেন? আন্দোলনের ‘আ’ শুনলেই কারণ জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে আমরাও কি অভিসম্পাত দিই না?) সব ধরনের আন্দোলনকারী ভেবে নিতে বাধ্য হয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি না নিলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে না। তাই কেবল শিক্ষক, হবু শিক্ষকরা নয়, ডাক্তাররাও এই পর্বে অনশনের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। বিষ খাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এক দিনে পৌঁছানো হয়নি।

এ রাজ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেমন আছেন খোঁজ নিতে গেলে প্রথমেই বিরাট অর্থনৈতিক বিভেদ চোখে পড়ে। স্কুলশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত স্থায়ী চাকরি করা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছল, অভিযোগের অবকাশ বলতে মহার্ঘ ভাতা নিয়ে রাজ্য সরকারের নিয়ে টালবাহানা। কিন্তু সেই অভিযোগ সমস্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারীরই রয়েছে, কেবল তাঁদের নয়। চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করা প্যারাটিচারদের অবস্থা এর বিপরীত। তাঁরা মাস গেলে তেরো হাজার টাকার আশেপাশে মাইনে পান। প্রভিডেন্ট ফান্ড, প্রফেশনাল ট্যাক্স ইত্যাদি কেটে এগারো হাজার টাকার মত হাতে আসে, যোগ্যতা যা-ই হোক, অভিজ্ঞতা যত বছরেরই হোক। নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব ছিল ক্লাসের পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের যত্ন নেওয়া, স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। অথচ স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ যেহেতু বন্ধ, তাই স্কুলগুলোতে শূন্য পদের অভাব নেই, ফলত কাজের চাপ যথেষ্ট। অতএব স্কুল কর্তৃপক্ষ অনন্যোপায়। প্যারাটিচাররা পুরো সময়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমান ক্লাস নিচ্ছেন, সমানে সমানে পরীক্ষার খাতাও দেখছেন। এমনকি, গোড়ায় কথা ছিল সপ্তাহে তিনদিন তাঁরা কাজ করবেন। তা অবস্থা বিশেষে ছদিনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ কাজ বেশি, মাইনে কম — প্যারাটিচারদের জন্য এটাই নিয়ম।

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একইরকম বিভাজন তৈরি হয়েছে। পুরো সময়ের অধ্যাপনা শুরু করেই যেখানে হাজার পঞ্চাশেক টাকা মাইনে পাওয়া যাচ্ছে, বছরের পর বছর আংশিক সময়ের অধ্যাপক (যাঁদের এখন বলা হয় State Aided College Teacher — SACT) হয়ে থাকা নেট/স্লেট পাশ করা পিএইচডি অধ্যাপক, অধ্যাপিকারাও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় আটকে আছেন। কলেজের মর্জি মাফিক কোথাও কোথাও আরও কম। কলেজ সার্ভিস কমিশনের নিয়োগও অনিয়মিত। ফলে কলেজ চালানোর ক্ষেত্রে কিন্তু বড় ভূমিকা পালন করেন SACT-রা। অথচ ওঁদের পদগুলো, পরিভাষায়, নোশনাল। মানে কোনো SACT কোনো কারণে বিদায় নিলে তাঁর জায়গায় নতুন লোক পাওয়া যাবে না।

পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নেই বহু বছর, কর্মসংস্থানের অভাব বর্তমান সরকারের আমলেই তৈরি হয়েছে এমন বললে নিতান্ত অন্যায় হবে। কলেজ সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ নিয়ে বামফ্রন্ট আমলেও বিস্তর ডামাডোল ছিল। কিন্তু দীর্ঘ অভাবের তালিকার পাশে যা ছিল, তা হল লেখাপড়া শিখতে পারলে এবং এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করলে শিক্ষকতার চাকরির নিশ্চয়তা। বাম আমলেই একসময় স্কুলের চাকরির নিয়োগে স্থানীয় স্তরে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ উঠত। টাকা নিয়েই হোক অথবা নেতার সাথে পরিচিতি বা আত্মীয়তার সুবাদে যোগ্য প্রার্থীর বদলে অযোগ্য শিক্ষক, শিক্ষিকা নিয়োগ করা হচ্ছে — এমনটা কান পাতলেই শোনা যেত। স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু হওয়ার পর ছবিটা বদলে গিয়েছিল। কতটা বদলেছিল? আমার পাড়ায় চপ ভাজেন এক কাকিমা; কাকুর ছোট দোকান ছিল। তাঁদের বড় ছেলে এম এ পড়ছিল। বছর কয়েক আগে একবার চপ কিনতে গিয়েছি, কাকিমা বড় মুখ করে বললেন “এরপর এসএসসিটা পাস করলে মাস্টারি পাবে। আমাদের সংসারটা দাঁড়িয়ে যাবে।” সেই এসএসসি আর তার দেওয়া হয়নি, কারণ পরীক্ষাটাই হয়নি। কাকিমার এখন লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে মাসে এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলের উপর যে আশা ছিল, সে আশা পূরণ হল না। ছেলে এখন কাকিমাকে ব্যবসায় সাহায্য করে। এইভাবেই কি ভবিষ্যতের শিক্ষক, শিক্ষিকা পাব আমরা?

এমন মনে করার কারণ নেই, যে পুরো সময়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা খুব ভাল আছেন। মাস গেলে মাইনেটা পেলেই মাস্টাররা খুশি, আর কিছু নিয়ে তারা ভাবে না। এমনিতেই একগাদা ছুটি পায়, অতিমারির ফলে তো আরও মজা হয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সম্বন্ধে এমন ভাবনা সাম্প্রতিককালে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। ফাঁকিবাজ পৃথিবীর সব পেশায়, সব কালে, সব দেশে থাকে। কিন্তু নিজের ধারণা নিয়ে বসে না থেকে শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সাথে কথা বললে বোঝা যায় তাঁরা সুখে নেই।

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এক শিক্ষকের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, পরীক্ষা বাতিল হয়ে যাওয়া খুবই দুঃখের। কিন্তু লেখাপড়াটা ঠিক করে হয়েছিল কি? অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষক অপ্রতুল, এদিকে পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাজারটা কাজ চেপেছে তাঁদের ঘাড়ে। সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্পের কাজকর্ম অনেকটাই তাঁদের করতে হয়। করতে গিয়ে পড়ানোর সময় কাটছাঁট হয়। আরও বললেন, পশ্চিমবঙ্গে গত দশ বছরে যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে, সে হারে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বাড়েনি। কাগজে, টিভিতে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়া নিয়ে উল্লাস হয়, কিন্তু ছাত্রের সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে সে কথা কেউ বলে না। এই ছাত্ররা যাচ্ছে কোথায়? তাঁর মতে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জীবিকার সন্ধানে চলে যাচ্ছে। তাঁর আশঙ্কা, এই প্রবণতা অতিমারীর প্রকোপে আরও বেড়ে গেল। একেই দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া এবং বছর দুয়েক স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে আসছে। ওই শিক্ষকের আশঙ্কা, এরপর যখন স্কুল খুলবে তখন দেখা যাবে স্কুলছুট ছাত্রের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে।

উনি যা বলেননি, তা হল সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা গত দশ-পনেরো বছর ধরেই কমছে। গ্রামাঞ্চলের কথা জানি না, শহর ও শহরতলি এলাকায় তার একটা বড় কারণ বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাবা-মায়েদের পক্ষপাত। এর প্রভাবে কোথাও কোথাও ছাত্রসংখ্যা এমনভাবে কমছে, যে স্বয়ং বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত স্কুলও উঠে যেতে বসেছিল বছর দুয়েক আগে। ইংরেজি মাধ্যম করে দিয়ে বাঁচানো হয়েছে। [৪] বাংলা মাধ্যম অনেক স্কুলকেই ইংরেজি মাধ্যম করে বাঁচানোর চেষ্টা রাজ্য সরকার করছেন। বাঁচছে কিনা বুঝতে আরও কয়েক বছর লাগবে, কিন্তু ওই রুগ্ন স্কুলগুলোর মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের নিশ্চিন্ত থাকার দিন গিয়েছে। কারণ ১৯৯১-এর পর থেকে শিক্ষার বেসরকারিকরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ কথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে শিক্ষা (স্বাস্থ্যের মতই) আরও একটা ব্যবসা। আর রুগ্ন ব্যবসা যে রাখতে নেই তা কেন্দ্র বা রাজ্য, কোনো সরকারই অস্বীকার করে না। ফলে আজকের পাকা চাকরি মানেই আর কালকের পাকা চাকরি নয়।

মুশকিল হল, পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার, এমনকি এক-দেড় লাখ টাকা খরচ করে যেসব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের ভর্তি করছেন, সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেকেই ভদ্রজনোচিত মাইনে পান না। স্কুল মালিক কোটিপতি হচ্ছেন, অথচ মাস্টাররা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা বেসরকারি কলেজগুলোতে যাঁরা পড়ান, তাঁদের অবস্থাও তথৈবচ। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজের আংশিক সময়ের শিক্ষকদের কথা উপরে বলেছি। একই যোগ্যতার অনেকে মাসে পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা বেতনে বেসরকারি কলেজগুলোতে পড়িয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার ক্লাস পিছু টাকা পান। কত পাবেন, কেমনভাবে পাবেন তা অনেক ক্ষেত্রেই কলেজ কর্তৃপক্ষের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করে। বেসরকারি স্কুল এবং হাসপাতালের খরচ আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে হইচই হয়। মুখ্যমন্ত্রী বরাভয় নিয়ে আবির্ভূত হন, কাউকে ধমকে, কাউকে বাবা বাছা করে বুঝিয়ে অভিভাবকদের উপর চাপ কমাতে বলেন। কিন্তু মাস্টারদের মাইনে কোনো আলোচনার বিষয় হয় না। অবশ্য সরকারের বেতনভুক যে মাস্টাররা, তাঁদের আর্থিক দাবিদাওয়াই যখন কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন বেসরকারি স্কুল, কলেজের শিক্ষকরা কার কাছে কী আশা করবেন?

২০১৮ সালে জগদ্বিখ্যাত টাইম পত্রিকা আমেরিকার পাবলিক স্কুলগুলোর মাস্টারদের পারিশ্রমিক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওঁদের অবস্থা এত সঙ্গীন, যে একজন বলেছেন তিনি দিন গুজরান করার জন্য একসাথে তিনটে কাজ করেন, উপরন্তু ব্লাড প্লাজমা দান করেন।[৫] পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্তটা দেখিয়ে নিজেদের তার চেয়ে উন্নত প্রমাণ করায় আমরা ভারতীয়রা ওস্তাদ। অতএব সে প্রতিবেদন তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা বলতেই পারেন, “আমরা অনেক ভাল রেখেছি।” সত্যিই তো। মাস্টারদের নিয়ে সরকারের তো বিশেষ মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কী পড়ানো হবে, কেন পড়ানো হবে — সেসব কর্পোরেট জগত ইতিমধ্যেই ঠিক করতে শুরু করেছে, আগামী দিনে আরও করবে। যে শিক্ষা কর্পোরেটের কাজে লাগে না, তা যে শিক্ষাই নয় — সে ব্যাপারে ঐকমত্য শিগগির তৈরি হয়ে যাবে। কদিন পর আপনি নিজেই বলবেন, আপনার সন্তানের ছবি আঁকা, খেলাধুলো করা, গান গাওয়া, সাহিত্য পড়া বা ভাল করে অঙ্ক শেখাও তত জরুরি নয়, যত জরুরি কোডিং শেখা। আর সেটা করতে কড়া বা স্নেহময় মাস্টারমশাই, দিদিমণি লাগে না। লাগে একটা অ্যাপ। যাদের অ্যাপ নেই তারা শিখবে না। মিটে গেল।

শিক্ষক দিবসে দাঁড়িয়ে ভয় হচ্ছে, শেরনি ছবিতে যেমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মানুষের কুকর্মের ফলে একসময় বাঘ দেখতে মিউজিয়ামে যেতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও না সেই অবস্থা হয়।

তথ্যসূত্র:

১) হিন্দুস্তান টাইমস
২) ওল্ড ইন্ডিয়া টুমোরো
৩) সংবাদ প্রতিদিন
৪) আনন্দবাজার পত্রিকা
৫) টাইম ডট কম

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

Has the CPI(M) forgotten its strong federal roots?

Then state finance minister Ashok Mitra was his mainstay in this fight. It was as much a demand for more administrative rights as economic independence

Photos from internet

On May 30, the West Bengal state committee of the Communist Party of India (Marxist) came up with its assessment of the assembly election results, in which the party won no seats. The document explaining this disaster states that most of the 32 seats won by the Left Front in 2016 have gone to Trinamool Congress (TMC) – 23, to be precise.

At one point, the document says, in Bengali, “Because of the Bharatiya Janata Party’s (BJP’s) aggressive words, Trinamool’s election rigging, corruption, anarchy in every sector, absence of democracy etc. could not become electoral issues. People chose Trinamool Congress as the main opposition to the BJP. In addition, Trinamool was able to use the welfare schemes to garner support. There was extreme polarisation between Trinamool Congress and BJP. That is probably the main reason behind this result.”

This is as candid an admission of being wrong as you would get from the CPI(M). The West Bengal leadership has been maintaining since 2011 that the BJP and TMC are two sides of the same coin, so they have often dismissed governor Jagdeep Dhankhar’s attempts to overstep his jurisdiction and Mamata Banerjee’s sharp reaction to these moves as ‘drama’. This document shows that the CPI(M) is ready to rethink the political line that regards both TMC and BJP equally harmful. The fact that the welfare schemes CPI(M) leaders called “doles” during the election campaign have been marked as reasons for TMC’s popular support is a significant shift.

One may have expected this document to impact the party’s behaviour, but this doesn’t seem to be happening at the moment. Case in point is the ongoing battle between Banerjee’s and Narendra Modi’s governments.

Senior CPI(M) leader Sujan Chakraborty has termed the Centre’s decision to unilaterally transfer chief secretary Alapan Bandyopadhyay as “vindictive”, but added that the chief secretary’s role has been reduced to that of a “ghatak (matchmaker)” under the TMC government. Earlier in May, ministers of the state were arrested by the Central Bureau of Investigation (CBI) in a case where the chargesheet had already been submitted. CPI(M)’s Rajya Sabha MP Bikash Bhattacharya, a lawyer, wasted no time in saying the arrests were fair. The Calcutta high court’s subsequent interim bail order, however, made it clear that it is not as straightforward as Bhattacharya made it sound. Even the CPI(M)’s official stance differed from his, but he has neither been censured for his comments nor asked to explain them.

This proves there is still no consensus in the party ranks about the ways to deal with the TMC, and the CPI(M) does not regard the BJP’s repeated attempts to destabilise the West Bengal government as a threat to federalism but as a usual political tussle between TMC and BJP. During the election campaign, the Left-Congress-Indian Secular Front combine had talked about the need to break the TMC-BJP binary. It looks like the CPI(M) itself is still stuck in that binary, and does not recognise the greater issues at play. It would not be out of context to delve into history at this point.

The party at the Centre trying to destabilise an opposition party’s state government is not new. The first party at the receiving end was the undivided Communist Party of India (CPI). The Kerala government led by its legendary leader E.M.S. Namboodiripad was toppled in 1959, and finding out how many times Indira Gandhi’s government used Article 356 of the Constitution could exhaust a seasoned statistician. But the BJP’s consistency and determination in breaking the back of federalism is unparalleled.

What is happening in Bengal is basically the logical progression of what began with the dilution of Article 370 and bifurcation of Jammu and Kashmir. It continued with passing a law that makes the Arvind Kejriwal government subservient to the Lieutenant Governor. The arrests and the fight over the chief secretary are not attacks on the chief minister or the TMC. These are attacks on the rights of state governments and the political courtesies governing Centre-state relationship. This is about showing who’s boss.

This is exactly what the Jyoti Basu-led Left front government fought against in the 1980s. Basu maintained all along that the Centre was not in charge, and states should be on equal footing. His cry was not just for a bigger share of the Centre’s revenue; his was a principled stand for all states. Then state finance minister Ashok Mitra was his mainstay in this fight. It was as much a demand for more administrative rights as economic independence; that’s why they found other non-Congress chief ministers like Ramakrishna Hegde, M.G. Ramachandran, N.T. Rama Rao and Farooq Abdullah by their side. They held two meetings in 1983, in Srinagar and Kolkata, and a sub-committee was formed to draft a list of demands. Mitra led that sub-committee. Their commitment to the cause is best proved by the case of Jammu and Kashmir.

On July 2, 1984, governor Jagmohan dismissed the National Conference government led by Farooq. The then Karnataka chief minister, Hegde, chaired a meeting with non-Congress leaders at Karnataka Bhavan in New Delhi. The resolution release afterwards criticised the Centre for murdering democracy in Kashmir. A delegation reached Srinagar the next day to express solidarity with Abdullah and the people of J&K. Mitra recalls in his memoirs that Basu directed him to be present at the meeting in New Delhi and join the delegation to Srinagar. Delivering a speech to the public gathered in front of the National Conference office, he writes, was one of his fondest memories.

But senior CPI(M) leader Mohammad Salim, while speaking to this writer, confirmed that his party views the ongoing conflict purely as a partisan issue. “There’s no question of federalism here,” he declared. “This is just the governments using their agencies against each other. Only the leftists think about federalism. Our party has fought for it in the past, we wanted Sarkaria Commission’s recommendations implemented. Neither the TMC nor BJP has ever thought about federalism. The bickering over the Narada accused or the chief secretary is nothing but the failed state’s attempt to divert the headlines. Mamata has failed to provide relief to people after Cyclone Yaas, the Centre hasn’t done anything either. That’s why the chief secretary is being made an issue. Similarly, when people needed vaccines and they couldn’t provide it, they fought over the Narada-accused leaders.”

In reality, though, the fight for federalism was put on the back burner while the CPI(M) was still in power. Mitra writes in Apila Chapila (translation by the author), “After I left Writers’ Buildings [he resigned in 1987 for reasons not relevant to this article], I found the West Bengal government has suddenly become a good boy. There’s no overdraft, spending is well within the scope of earnings, so the budget is zero deficit. My unequivocal opinion is, this complete change of stance is highly incompatible with the state government’s approach. Fat overdraft indicated the states are struggling because of the one-sided relationship with the Centre. Doing away with it means announcing to the world that all problems have been solved, there’s no financial constraint. Now we can sleep peacefully.”

Mitra wrote this in the early 2000s. The Goods and Services Tax (GST) was not yet in existence. There is hardly any dispute today that the GST has further tilted the scales in favour of the Central government. And the chairman of the GST council that is credited with planning everything was Asim Dasgupta, Mitra’s successor in Basu’s cabinet. He resigned from the council in 2011, but by his own admission, 80% of the job had already been done. Dasgupta’s contribution was even acknowledged by then Union finance minister Arun Jaitley when the GST was launched in 2017.

The decay of the Left as an opposition has had huge implications for West Bengal, and the job of turning this seems to be getting harder by the day. A strong right-wing party has now become the only opposition in a state famous for its secular, socialist ethos. The CPI(M), still the biggest leftist party in terms of number of members, has no time to waste if they are to stay relevant. State Congress president Adhir Ranjan Chowdhury has already said he does not want to put up a candidate against Mamata Banerjee in the by-election at Bhowanipore. If Chowdhury’s party agrees with his proposal, it may mean curtains on the Left-Congress combine. In that case, comrades have a long fight ahead. What are they doing to ensure it is not a lonely one?

The state committee’s statement mentioned at the beginning of this article had said, “To turn this primary review into a comprehensive one, discussions will have to be held and opinions sought at the booth and branch level.” At the moment, the CP(M) is distributing a questionnaire among its workers and supporters via the district committees to do that. It has two sets of questions, under the heads ‘political’ and ‘organisational’. The first three questions in the first set are all about the party’s policy regarding the TMC:

  1. Is it really true that there was strong anti-incumbency against the TMC before the elections? Did we overestimate that sentiment? Did we underestimate Trinamool Congress?
  2. Did people reject our campaign about the understanding between the TMC and BJP? Which party was our main target across the election campaign? TMC or BJP? Or did we maintain equidistance?
  3. How have the welfare schemes and subsidies from the TMC government impacted the recipients? Have we assessed that?

The answers, and whether the leadership is willing to make changes according to them, could hold the key to the CPI(M)’s future in West Bengal.

A section of the party, however, feels where they stand vis-à-vis Banerjee or the BJP is irrelevant. What matters is whether they can still identify with the poor and have the stomach to fight for issues that affect them. This view is best articulated in an article written in Bengali by young trade union leader and Darjeeling district committee member Sudip Dutta, for party mouthpiece Ganashakti: “We have to go to the rural and urban poor, and get the strength for class struggle from them. The most promising strategy for modern revolution is hidden amongst this socio-economic populace divided into innumerable groups.”

Originally published here

https://thewire.in/politics/west-bengal-cpim-tmc-federalism

দ্যাট লিডার, দিস ম্যান: মহাশূন্যের দুটি বিন্দু

‘দিস ম্যান’ (অবশ্যই উওম্যানও) যারপরনাই পরিশ্রম করল স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় আর ‘দ্যাট লিডার’ পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অঙ্ক কষে গেলেন।

২০০৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বের রিপোর্টিং করতে জাপানের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র আকাহাতা তাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেদক জুনিচি কোদামাকে পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। আমার তখন সেই বয়স যে বয়সে মনে হয় কাল বাদে পরশুই বিপ্লবটা করে ফেলব। ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হওয়ার সুবাদে এবং এক বন্ধুর সক্রিয়তায় জুনিচির সহকারী হওয়ার সৌভাগ্য হল। পার্টি মুখপত্রের সাংবাদিক হলেও, পার্টির বিরোধীদের বক্তব্য জানায় তার সমান উৎসাহ। সম্ভবত ধনী দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র বলেই আকাহাতা খরচ করার ব্যাপারেও অকৃপণ। তাই জুনিচি ভাড়া করা গাড়িতে চেপে যে কোন এলাকায় চলে যেত। বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে হাতে টানা রিকশার চালক পর্যন্ত সকলের সাথে কথা বলাই তার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞান। আমার কাজ মূলত জুনিচির আপাত দুর্বোধ্য ইংরেজি আর স্থানীয় লোকের বাংলা, হিন্দির সংযোগ স্থাপন এবং গাড়ির চালককে পথনির্দেশ দিয়ে জুনিচি আর তার স্ত্রী, ছায়াসঙ্গিনী রিয়েকোকে অচেনা জায়গাগুলোতে নিয়ে যাওয়া। দিন সাতেকের সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিখলাম যে বিপ্লবটা পরশু হচ্ছে না, অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।

ঐ সাতদিনের একদিন সকালে আমরা গিয়েছিলাম বারাসত চাঁপাডালি মোড়ের কাছে সিপিএমের পার্টি অফিসে। সে অফিসের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটি ঘরে জুনিচির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তখনকার এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। ভদ্রলোকের ধোপদুরস্ত সাদা পাঞ্জাবি পাজামা আর মুখের কর্পোরেট হাসিটি মনোমুগ্ধকর। টেবিলের উপর দেখলাম তিনটি মোবাইল ফোন। অমন অত্যাধুনিক হ্যান্ডসেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসের ধনীর দুলাল-দুলালিদের হাতেও দেখিনি। বেরিয়ে আসার পর দেখলাম জাপানি কমরেডরাও বেশ অবাক। জুনিচি নিজে তখনো নোকিয়ার সেই ছুঁড়ে মানুষ মারা যায় এমন একখানা হ্যান্ডসেট ব্যবহার করে, তার স্ত্রীর নিজস্ব মোবাইল নেই।

সেখান থেকে আমরা গেলাম ছোট জাগুলিয়া। কমরেড দোর্দণ্ডপ্রতাপ বলে দিয়েছিলেন কার খোঁজ করতে হবে। খুঁজতে খুঁজতে আমরা পৌঁছলাম একটা ছোট্ট পার্টি অফিসে। বারাসতে যদি প্রাসাদে ঢুকে থাকি, এ তাহলে কুঁড়েঘর। দোর্দণ্ডপ্রতাপ যত রাজকীয়, ইনি তত সাদাসিধে। একমাথা পাকা চুল, চোখে ঘোলাটে চশমা, মুখভর্তি পাকা দাড়ি, পরনে সাধারণ লুঙ্গি, গায়ে ফুটো হয়ে যাওয়া গেঞ্জি। কানেও কম শোনেন। কিন্তু যেই মাত্র শুনলেন সুদূর জাপানের কমিউনিস্ট পার্টির দুই কমরেড এসেছেন, মনে হল বয়স দশ বছর কমে গেল ভদ্রলোকের। বলা বাহুল্য এ অফিসে এসি ঘর নেই। একতলায় গোটা দুয়েক ঘর, দোতলায় একখানা। ইনি আমাদের বেঞ্চে বসালেন। দোর্দণ্ডবাবু ঠান্ডা পানীয় খাইয়েছিলেন, ইনি হাঁক পেড়ে রাস্তার দোকান থেকে আনালেন লাল চা। জুনিচি গিয়েছিল নির্বাচন সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে, কিন্তু এই ব্যক্তিটি সম্বন্ধে তার অসীম আগ্রহ তৈরি হল। তার হয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করতে হল কবে থেকে পার্টি করছেন (পঞ্চাশের দশক থেকে), এখন পার্টিতে কোন পদে আছেন (লোকাল কমিটির সদস্য), কী করেন (পার্টিই করেন, সারাজীবন তা-ই করেছেন), কোথায় থাকেন (ঐ অফিসেই থাকেন)। ছোট জাগুলিয়ায় গরীব মানুষ কতজন, ধনী কারা, কোথায় কেমন ভোট হয় — এসব প্রশ্নের জবাবও বৃদ্ধ যেভাবে দিলেন, তাতে বোঝা যায় এলাকাটা তাঁর হাতের তালুর মত চেনা।

কমিউনিস্ট পার্টির এরকম দু-একজন সদস্যকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার ছেলেবেলাতেই হয়েছে, আরো অনেকের গল্প শুনেছি। কিন্তু জুনিচি আর রিয়েকোর এমন অভিজ্ঞতা ছিল না। তারা আপ্লুত। আর সবচেয়ে মোক্ষম কথাটি জুনিচি বলল গাড়িতে উঠে। “হোয়াট ডিফারেন্স! দ্যাট লিডার, দিস ম্যান!” সত্যিই জগতের বিশ্লেষণে কার্ল মার্কস অভ্রান্ত। কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরেও এমন শ্রেণি বিভাজন!

সতেরো বছর আগের সেই দিনটা বারবার মনে পড়ছে দোসরা মে-র পর থেকে। বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক দশক পূর্ণ হল। সেটা বড় কথা নয়। নির্বাচনে কোন দল হারে, কোন দল জেতে। একটানা ৩৪ বছর একই পার্টির নেতৃত্ব একই ফ্রন্টের সরকার ছিল, সেটাই বরং বিরল। কিন্তু একটা রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দশ বছরের মধ্যে একটা দল লোকসভায় শূন্য, বিধানসভায় শূন্য — এরকম ঘটতে দেখা যায় না চট করে। উদাহরণস্বরূপ কংগ্রেসকেই দেখা যাক। তারা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় নেই ১৯৭৭ সাল থেকে। কিন্তু দীর্ঘদিন প্রধান বিরোধী দল ছিল। নব্বইয়ের দশকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দল ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার পর দ্রুত ক্ষমতা কমতে থাকলেও ২০১১-র পালাবদলেও কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তারা এতদিন পরে বিধানসভায় শূন্য হয়েছে, লোকসভায় এখনো এ রাজ্য থেকে তাদের দুইজন প্রতিনিধি। পাশাপাশি বামফ্রন্টের বড় শরিক এই অল্প সময়েই ব্রিগেড ময়দান ছাড়া সর্বত্র শূন্য। এমতাবস্থায় যে কোন দলে রাজ্য স্তরের নেতাদের জবাবদিহি করতে হয়, জায়গা ছাড়তে হয়। গত কুড়ি বছরে কতবার প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি বদলেছে গুনে দেখতে হবে। কিন্তু সিপিএমে ওসব হবার নয়। তারা মার্কসবাদী, লেনিনের আদর্শে চলে, তাদের আছে রেজিমেন্টেশন। সবই নাকি যৌথ দায়িত্বের ব্যাপার। রেজিমেন্টেশন ভাল না মন্দ তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। সেটুকু বাদ দিলে বাকিটা কিন্তু দিব্য শুনতে লাগে। বিশেষত কর্পোরেট দুনিয়ায় যেন তেন প্রকারেণ অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার যে ধারা আছে, তার তুলনায় এ তো স্বর্গ। কিন্তু সিপিএমের ক্ষেত্রে যৌথ দায়িত্ব কথাটার অর্থ দাঁড়িয়েছে যৌথভাবে দায়িত্ব এড়ানো। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বে যখন রাস্তায় দাঁড়ানো উন্নয়ন খড়গ হাতে বাম কর্মীদের তাড়া করল, খুন করল, মহিলাদের কাপড় খুলে নিল — তখন রাজ্যের কোথাও নেতাদের যৌথ দায়িত্ব নিয়ে ধরনায় বসতে দেখা যায়নি, কোথাও কোন অবরোধ হয়নি। যে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁদের এত অভিযোগ, তিনি নিশ্চিন্তে হরিশ চ‍্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে রোজ নবান্নে গেছেন, এসেছেন। কোন লাল ঝান্ডা তাঁর পথ আটকায়নি।

অর্থাৎ “দিস ম্যান” মার খেয়েছে আর “দ্যাট লিডার” আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বিবৃতি দিয়েছেন। কেউ কেউ ফেসবুক বিদীর্ণ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। কবে কোন জেলার কোন প্রত্যন্ত এলাকায় কোন পার্টি অফিস ভাঙা হয়েছে তা সারা রাজ্যের বাম কর্মী সমর্থকরা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নেতারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, কজন পার্টিকর্মীর সাথে গিয়ে দেখা করেছেন, কটা থানা ঘেরাও করেছেন — সেসব প্রচারিত হয়নি। ফলত বিরাট সংখ্যক নীচুতলার কর্মী সমর্থকের বিজেপির দিকে সরে যাওয়া, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ৩৭% থেকে ৭% হয়ে যাওয়া। তৃণমূল ও সম্প্রদায় স্বভাবতই বললেন বাম রাম হয়েছে। এতদূরও রটে গেল যে জেলার বাম নেতারা সচেতনভাবে ভোট ট্রান্সফার করিয়েছেন বিজেপির বাক্সে। সচেতন, অবচেতনের বিতর্কে না গিয়েও অনস্বীকার্য যে বামেদের ভোট সে সময় বিজেপির খাতায় জমা পড়েছে। অর্থাৎ একেবারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করা কর্মীরা মারও খেলেন, বদনামের ভাগীও হলেন।

অতঃপর নেতারা কী ব্যবস্থা নিলেন? কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ২০১৬ নির্বাচনের সময় থেকেই সূর্যবাবু, বিমানবাবুদের সঙ্গে অধীরবাবু, মান্নানবাবুদের যা ভাব তা দেখে অমর আকবর অ্যান্টনি বা ইয়াদোঁ কি বারাত ছবির শৈশবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভাইয়েদের কথা মনে পড়ে। ভাগ্যিস মার্কসবাদে ভূত জিনিসটা নেই। থাকলে শহিদদের ভূতেরা যে কী করত ভাবলে গা শিরশির করে। তবে অন্ধের মত অতীত আঁকড়ে রাজনীতি হয় না। তাই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা ভেবে বাম কর্মী সমর্থকরা হয়ত ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন (ভোটের অঙ্ক দেখলে কংগ্রেস কর্মী সমর্থকরা মন থেকে মেনেছিলেন কিনা নিশ্চিত হওয়া শক্ত), কিন্তু ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে সে জোটও হল না। তার দু বছরের মাথায় বিধানসভা নির্বাচন। মে মাসের নির্বাচনের জন্যে বামেদের নতুন উদ্যম দেখা গেল ফেব্রুয়ারিতে, যখন জোয়ানরা নবান্ন অভিযান করলেন। প্রচণ্ড মার খেলেন, মইদুল ইসলাম মিদ্যা প্রাণ হারালেন। কিন্তু ততদিনে রাজ্যে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসাবে নিজেদের জায়গা পাকা করে ফেলেছে। এস এফ আই নেতা সৃজন ভট্টাচার্য নাগরিক ডট নেটকে নবান্ন অভিযানের আগের দিন বলেছিলেন, বাইনারি ভাঙতেই নবান্নে যাচ্ছি। অর্থাৎ তদ্দিনে তৃণমূল-বিজেপি বাইনারি প্রতিষ্ঠিত।

এই বাইনারি তৈরি হল কেন? কোন সন্দেহ নেই তৃণমূল তেমনটাই চেয়েছিল। কারণ প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্ব চালানো বা মুখরোচক কুৎসার দৌড়ে জেতা কর্মসংস্থানের প্রশ্ন, দুর্নীতির প্রশ্নের সুরাহা করার চেয়ে সহজ। কিন্তু সঙ্গত দাবি নিয়েও কেবল বিবৃতি দিলে আর মামলা ঠুকলে কি আর বিরোধী রাজনীতি হয়? সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্রেফ মামলা ঠুকে ঠুকেই তৃণমূলকে নাজেহাল করে দেবেন — এমন একটা দাবি সিপিএমের আইনজীবী নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে করতেন (“মারব কম, দৌড় করাব বেশি”)। আদতে প্রসব হল অশ্বডিম্ব। যাদবপুর কেন্দ্রে আনকোরা অভিনেত্রীর কাছে হারলেন। রাজ্যের কোথায় তাঁর মামলার ভয়ে শাসক দল বাম কর্মী সমর্থকদের মারা বন্ধ করে দিয়েছে তা তিনিই জানেন। তবে কেবল বিকাশবাবুকে দোষ দেওয়া অন্যায়। বামেদের বরাবরের বদনাম তাঁরা কথায় কথায় আন্দোলন করেন; মিছিল, ধর্মঘট কিছুই বাদ যায় না। ক্ষমতায় থাকাকালীনও এ স্বভাব যায়নি। এই করেই পশ্চিমবঙ্গের শিল্প টিল্প সব তাঁরা তাড়িয়েছেন বলে এখনো অভিযোগ করা হয়। ২০১১-র পরের বঙ্গ সিপিএম সম্বন্ধে কিন্তু এমন অভিযোগ করার উপায় নেই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বনধ ডাকলে আলাদা কথা, নিজেরা ওসবের মধ্যে যাননি। রাজ্যের মন্ত্রীদের হাসিমুখে টাকা নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসার পরেও আন্দোলনের ঠ্যালায় জনজীবন বিপর্যস্ত করেননি। আদালত যেদিন রায় দিলেন এস এস সি পরীক্ষায় দুর্নীতি হয়েছে; সেদিনও সূর্যবাবু, সেলিমবাবু, সুজনবাবু বা বিমানবাবু সরকারের গদি নাড়িয়ে দেওয়ার মত কোন কাজ করেননি। সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী আসনে থাকলে কী ঘটত তা বামপন্থীরাও বিলক্ষণ বোঝেন। অশোক মিত্র নাকি একবার বলেছিলেন “আমি ভদ্রলোক নই, কমিউনিস্ট।” সিপিএমের বর্তমান নেতৃত্ব কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক। তাঁদের ভদ্রতার সুযোগেই মমতাকে মমতাজ বেগম আখ্যা দিয়ে, অনবরত অকথা কুকথা বলে, রামনবমী বনাম বজরংবলীর বাইনারি ব্যবহার করে বিজেপি রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হয়ে গেল।

অন্য দিকে বিজেপি শক্তিশালী হওয়ার পর থেকেই বাম নেতৃত্বের বক্তব্য, তৃণমূল আর বিজেপি সমান বিপজ্জনক। এখনো বলি, কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। যাঁরা অন্যরকম বলেন তাঁদের একটা বড় যুক্তি হল তৃণমূল খুব খারাপ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দল হতে পারে, কিন্তু বিজেপি এমন একটা দল যারা গণতান্ত্রিক কাঠামোটার পক্ষেই বিপজ্জনক। আমার প্রশ্ন, মেরে ধরে বিরোধীদের মনোনয়নই জমা দিতে না দিলে আর কোন গণতান্ত্রিক কাঠামো অবশিষ্ট থাকে? উত্তরে অবধারিতভাবে বলা হবে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসা তৃণমূল শুরু করেনি, ইত্যাদি। এসব বলার সময় তৃণমূলপন্থী এবং উদারপন্থীরা মনে রাখেন না বা ইচ্ছা করেই ভুলে যান যে ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচন চালু হওয়ার পর থেকে ২০১৮-র মত এত বেশি আসনে কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক পক্ষ জেতেনি। এই রইল প্রমাণ [১]। কিন্তু কথা হল, দুটো দল যদি সমান বিপজ্জনক হয়, তাহলে বড় দলটিকে সর্বশক্তি দিয়ে হারালেই তো ছোট দলকে হারানো সহজ হওয়ার কথা। উল্টোটা কী করে সম্ভব? তৃণমূলকে হারাতে পারলেও বিজেপির বিপদ তো থেকেই যেত। এই সোজা কথাটা বাম নেতারা বুঝলেন না। ফলে বিজেপি বিরোধী হিসাবে একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারলেন না। শ্যাম পেলেন না, কুলও হারালেন।

মোদ্দা কথা এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতা অচল করে দেওয়ার জন্য খ্যাত (আচ্ছা, কুখ্যাতই হল) বামপন্থীরা কোনরকম দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্যে গেলেন না। ধর্মতলায় টেট পরীক্ষার অবিচারের প্রতিবাদে অনশনরত ছেলেমেয়েদের আন্দোলনে বিমানবাবু অতিথি শিল্পীর মত গিয়ে বসলেন। সুজনবাবু রাজভবনের গেটে অপেক্ষারত টিভি সাংবাদিকদের নিয়মিত বাইট দিলেন। সেলিমবাবু হিন্দি বাংলা মিশিয়ে সকৌতুক সাংবাদিক সম্মেলন আর ফেসবুক লাইভ করে গেলেন। মানুষের আশীর্বাদ কুড়োবার দায়িত্ব পড়ল নীচের তলার কর্মীদের উপর — কমিউনিটি ক্যান্টিন আর রেড ভলান্টিয়ার্সের মাধ্যমে। ‘দিস ম্যান’ (অবশ্যই উওম্যানও) যারপরনাই পরিশ্রম করল স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় আর ‘দ্যাট লিডার’ পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অঙ্ক কষে গেলেন। কংগ্রেসের সাথে জোট করা যথেষ্ট হবে না, অতএব নতুন জোটসঙ্গী চাই। আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে? খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল ফুরফুরা শরীফে। ভদ্রলোক ভোটাররা চটবেন জেনেও নেতারা যে উদ্যমে আব্বাস সিদ্দিকিকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে শমীক লাহিড়ী যেরকম সন্দর্ভ রচনা করেছিলেন পার্টি মুখপত্রে — তাতে ভাবা গিয়েছিল সিপিএম সত্যিই কৌম পরিচয়ের রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়ার যে ঐতিহাসিক ভুল, তা সংশোধন করতে চায়। কিন্তু পরীক্ষায় শূন্য পাওয়ার পর যেভাবে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সাথে জোটকে দায়ী করা হচ্ছে, তাতে স্পষ্ট তাঁরা কর্মী সমর্থকদের যা-ই বলে থাকুন, আই এস এফের সাথে জোট করা শর্টকাটে জিতে যাওয়ার কৌশলের বেশি কিছু ছিল না।

অশোক ভট্টাচার্য আর শিলিগুড়ি নাকি সমার্থক। সেই শিলিগুড়িতে তাঁর এক বিশ্বস্ত অনুচর বিজেপিতে চলে যাওয়াতেই ভটচায্যিমশাই একেবারে তৃতীয় হয়ে গেলেন! তাহলে প্রশ্ন ওঠা উচিৎ তাঁর এতদিনের দাপট কি তাঁর ছিল, না অনুচরের? তিনি কি টের পাননি যে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন? যে কিসের ভিত্তিতে একটা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী দলে চলে যাওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন শঙ্কর ঘোষ তাঁর ডান হাত হয়ে উঠেছিলেন? কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসাবে এ প্রশ্নের জবাবও দিতে হবে। অথচ প্রবীন ভটচায্যিমশাই অত গভীরে না গিয়ে নিজের পরাজয়কে স্রেফ বাকি রাজ্যের প্রবণতার অংশ বলেই ক্ষান্ত হলেন।

দক্ষিণবঙ্গের ভটচায্যিমশাই আরো এক কাঠি সরেস। তিনি যে কেবল আই এস এফের সাথে জোটে দোষ দেখেছেন তা নয়, কংগ্রেসকে অবহেলা, অবজ্ঞা, অপমান — আরো কী কী সব করা হয়েছে বলে তিনি বেজায় আহত। বলেছেন সে অপমানের জবাব নাকি কংগ্রেসের সদস্য সমর্থকরা দিয়ে দিয়েছেন। যে দল নিজের লড়া ৯১টা আসনেই পেয়েছে ২০১৯ লোকসভার চেয়ে ২.০৬% কম ভোট, তাদের সদস্য সমর্থকরা কি আকাশের চাঁদ এনে দেবে ভেবে ভটচাযমশাই তন্ময় হয়ে ছিলেন? চক্ষুশূল আই এস এফ কিন্তু ২৮টা আসনে ২০১৯ সালে প্রাপ্ত বাম ভোটের চেয়ে ৬.৬০% বেশি ভোট পেয়েছে। এমনকি বাম, কংগ্রেস যোগ করলে যা হয় তার চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছে। অতএব তারাই ডুবিয়ে দিল, এ তত্ত্ব দাঁড়াচ্ছে না। তাদের নেওয়া হল বলে অনেক বাম ভোটার বিমুখ হলেন — এই যদি বক্তব্য হয়, তাহলে সে আশঙ্কা আগে কেন প্রকাশ্যে বলেননি? ফল বেরোবার পরে শৃঙ্খলাকে আর গুরুত্ব দিচ্ছেন না, কারণ গোটা সিস্টেমটাই উলঙ্গ হয়ে গেছে। আগেই শৃঙ্খলাভঙ্গ করে উলঙ্গ হওয়া বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন তো। তাহলে কি আশা করছিলেন আর যা-ই হোক নিজের আসনটি জিতে যাবেন? এবং জিতে গেলে আর বিদ্রোহী হওয়ার দরকার বোধ করতেন না? অবশ্য এই ভটচায্যির সবচেয়ে চমকপ্রদ মন্তব্য জোট নিয়ে নয়, বাটি নিয়ে। কমিউনিস্টদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি করাকে তিনি যে ভাষায় কটাক্ষ করেছেন, স্বয়ং তথাগত রায়কেও তা করতে দেখিনি কখনো। নেতাদের বাটি হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ার পরামর্শ শুনে মনে পড়ল, ছোটবেলা থেকে যে কমিউনিস্টদের দেখেছি, তাঁরা এ রাজ্যের বন্যা থেকে শুরু করে কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধে মানুষের পাশে দাঁড়াতে আক্ষরিক অর্থেই ভিক্ষার বাটি নিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি যেতেন, স্টেশনে এবং বাসস্টপে দাঁড়াতেন। নির্বাচনের খরচও এখনো বাড়ি বাড়ি ঘুরে জোগাড় করেন ভটচাযমশায়ের কমরেডরা। এ ভিক্ষা যদি ভটচায্যিমশায়ের কাছে লজ্জার বিষয় হয়, তাহলে তাঁর শ্রেণিচরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ। “আমি মার্কসবাদী, আজীবন তা-ই থাকব” বলেছেন বলেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা চলে না।

মিলে মিশে লড়া এমনই সর্বরোগহর বটিকা হিসাবে সিপিএম মহলে নন্দিত যে সুন্দরবনের লড়াকু নেতা কান্তি গাঙ্গুলি পর্যন্ত ভবিষ্যতে তৃণমূলের সাথে হাত মেলানোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এদিকে ভোটের ফল বেরোবার পর থেকে যত্রতত্র বাম কর্মী সমর্থকরা তৃণমূলের হাতে মার খাচ্ছেন, ঘরছাড়া হচ্ছেন। এমনকি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রাণের মায়া অগ্রাহ্য করে যে রেড ভলান্টিয়াররা কাজ করছেন, তাঁরাও খুনের হুমকি, ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন। বেশ মনে আছে, নির্বাচনের কিছুদিন আগে ফেসবুকে মহম্মদ সেলিমের বিজেপির প্রতি নরম মনোভাবের সমালোচনা করে লিখেছিলাম, বিজেপি ক্ষমতায় এলে নীচের তলার কর্মীরা মার খাবেন, সেলিমবাবুরা পাশে দাঁড়াবেন না। এর প্রতিক্রিয়ায় বহু সিপিএম কর্মী আমার দিকে ধেয়ে এসেছিলেন। অনেকে বলেছিলেন তাঁদের পার্টিতে কোন উপরতলা-নীচতলা নেই। কথাটা সত্যি হলে সত্যিই ভাল লাগত। কিন্তু গত এক সপ্তাহে দেখা যাচ্ছে ‘দিস ম্যান’ মার খাচ্ছে, ‘দ্যাট লিডার’ কী যে করছে কেউ জানে না। ক্ষুব্ধ পার্টিকর্মীরা সোশাল মিডিয়ায় বিষোদ্গার করছেন। বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর বা ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত এলাকার কথা বাদ দিন। কর্মীদের অভিযোগ খোদ দমদমে পার্টি অফিস বেদখল হয়ে যাচ্ছে, তবু নেতৃত্ব সংঘাতে যেতে চাইছেন না। নিরপেক্ষরা নিশ্চয়ই বলবেন নির্বাচনের পরে পশ্চিমবঙ্গে এসব ঘটনা চিরকাল ঘটে। কিন্তু যে দলের কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা যে এরকম মুহূর্তে দলাই লামাকে নেতা হিসাবে চাইবেন না তা বলাই বাহুল্য। তাঁরা চাইবেন নেতারা এসবের প্রতিবাদে রাস্তায় নামুন। তাঁরা আশা করবেন নেতারা বোঝেন যে একটাও আসন না পাওয়ার পর শাসক দলের অত্যাচার নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে চাইলে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক পাওয়াও মুশকিল হবে। ফলে সংবাদমাধ্যম দেখে সাধারণ মানুষ ভাববেন কেবল বিজেপির লোকেরাই নির্যাতিত হচ্ছে।

এতদিন পরে নন্দীগ্রামে একটা মিছিলের ব্যবস্থা হয়েছে। সীমিত শক্তির অজুহাতে বামেদের শীর্ষ নেতৃত্ব কতদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন আর কতজন নিরুপায় কর্মী সমর্থককে বিজেপির কাছে আশ্রয় নিতে হবে — তার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে বামেদের ভোট শতাংশও শূন্যের দিকে হাঁটবে কিনা। পরাজিত, আক্রান্ত মানুষ কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা দিল্লি থেকে জেলায় চলে আসতে পারেন দলের আক্রান্ত লোককে দেখতে। সূর্যকান্ত মিশ্ররা কলকাতা থেকে গিয়ে উঠতে পারেন না।

তথ্যসূত্র

[১] দ্য হিন্দু পত্রিকা

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

ইভিএমে তিনবার কারচুপি করার সুযোগ আছে: জহর সরকার

এই প্রথম একজন নির্বাচন কমিশনার হলেন, যাঁর পক্ষপাতিত্ব সম্বন্ধে গোটা ভারতবর্ষ একমত। সেটাই সমস্যা বাড়িয়েছে।

দু দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোটগ্রহণ চলছে। শুরু থেকেই এই মেশিনগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কেউ না কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে বিশেষত বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বারবার নানারকম অভিযোগ করেছে। রাজনৈতিক নেতার বাড়ি থেকে ইভিএম উদ্ধার হওয়া বা ইভিএমের হিসাব না মেলার মত ঘটনা সন্দেহ আরো বাড়িয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কাছে এসে পড়লে দলগুলো যতখানি উৎসাহ নিয়ে ইভিএমের দোষ ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করে, ভোটপর্ব মিটে গেলে আর সে উৎসাহ থাকে না, বিশেষত যদি ফলাফল বিজেপির বিপক্ষে যায়। তাহলে ইভিএম নিয়ে আপত্তি কি স্রেফ রাজনৈতিক স্টান্ট, নাকি সত্যিই আপত্তি করার মত কিছু আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নাগরিক ডট নেট কথা বলল প্রবীণ আই এ এস জহর সরকারের সঙ্গে।

১৯৯৯ সালে যখন প্রথমবার ইভিএম ব্যবহার করা হয়, তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের চিফ ইলেক্টোরাল অফিসার ছিলেন। বর্তমানে জহরবাবু দ্য সিটিজেন্স কমিশন অন ইলেকশনস (CCE) নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, যার সদস্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সরকারি আমলা, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকরা। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে ইভিএম কারচুপি নিয়ে এ বছরের শুরুতে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয় এবং নির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্রপতি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে পাঠানো হয়।

আপনারা জানুয়ারি মাসে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করেন, তাতে বলেন যে ইভিএমে কারচুপি করা যায় না এমন কোন প্রমাণ নেই। তাই একমাত্র সমাধান হল যত বেশি সম্ভব ভিভিপ্যাট গণনা করা। এই নিয়ে আপনারা যে রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন এবং বিভিন্ন মহলে পাঠিয়েছিলেন, তাতে কোন প্রতিক্রিয়া হয়েছে কি?

নাগরিকরা জবাব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন কোন জবাব দেয়নি, সরকারও কোন জবাব দেয়নি।

২০১৮ সালের ইকনমিক টাইমসের একটা প্রতিবেদন দেখছিলাম। বৎসোয়ানায় আমাদের এখান থেকে ইভিএম রপ্তানি করা হয়েছিল এবং সেখানকার বিরোধী দল অভিযোগ করে যে ওগুলো এমনভাবে তৈরি যাতে ভোটে ক্ষমতাসীন দল জেতে। আপনারাও বলছেন কারচুপি সম্ভব। তাহলে কি বলছেন একেবারে মেশিন বানানোর স্তরেই এই ধরনের কারচুপি সম্ভব?

না, ওটা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রে অতটা কারচুপি করা যায় না, কারণ সমস্ত প্রক্রিয়াটা একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যায়। ভারতে আমি প্রথম যখন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার শুরু করেছিলাম ১৯৯৯-তে, তখন যন্ত্রটার উপর যথেষ্ট ভরসা ছিল। আমরা যথেষ্ট নিশ্চিত ছিলাম, কারণ তখন হ্যাকিং কী জিনিস সেটা বিশেষ কেউ জানত না, প্রযুক্তি তখনো অনেক পিছিয়ে। কিন্তু ১৫-২০ বছর পরে প্রযুক্তি এমন জায়গায় চলে এসেছে, যে স্কোপ অফ ইন্টারভেনশন থাকলেই কারচুপি করা সম্ভব।

তাহলে আপনি কী ধরনের কারচুপির কথা বলছেন যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।

ইভিএমে তিনবার স্কোপ অফ ইন্টারভেনশন আছে। প্রথম সুযোগ যখন পরীক্ষা করার জন্যে ইভিএম বার করে নিয়ে যাওয়া হয়। বাইরের আউটসোর্সড এজেন্টরা ভারত ইলেকট্রনিক্স (BEL) বা অন্য সরকারি ম্যানুফ্যাকচারারদের হয়ে টেস্টিং-এ নিয়ে যায়। সেখানে একটা বড় ঘরে বসে তারা টেস্টিং করে, দেখার কেউ থাকে না। আমরা জানতাম যে BEL নিজেই কাজটা করে। স্বভাবতই সরকারি সংস্থা কাজটা করলে সন্দেহ কম থাকে, কারণ সরকারি কর্মচারীদের চাকরি বা পেনশনের ব্যাপার আছে। তারা চট করে গন্ডগোল করতে সাহস পাবে না। কিন্তু পরে জানা গেল এই কাজটা আউটসোর্স করে দেওয়া হয় বিভিন্ন এজেন্সিকে। এই আউটসোর্সিং একটা দুর্বলতার জায়গা।

দ্বিতীয় সুযোগ যখন সেট বার করে রিটার্নিং অফিসারের অফিসে নিয়ে আসা হয়। প্রার্থী ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর মেশিনগুলোকে রিসেট করতে হয়। সেটটা একটা কোড দিয়ে রিসেট করা হয়। প্রত্যেকটা নির্বাচন কেন্দ্রে এই কাজটা করা হয়, কারণ আগে থেকে তো আর জানা থাকে না কোন বোতামে কোন প্রার্থী থাকবে। প্রার্থীদের নাম ঠিক হলে তবেই এই কাজটা করা সম্ভব। এই রিসেটের সময়ে কারচুপির সুযোগ থাকে। কারণ রিসেটও যে সরকারি আধিকারিক বসে করেন তা নয়। এই কাজটাও আউটসোর্সড লোককে দিয়ে করানো হয়। তাদের দুরভিসন্ধি থাকলে ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব। ব্যাপারটা অনেকটা বাড়ির টিভি সারানোর মত। যার টিভি সারানো হচ্ছে সে তো আর বুঝতে পারে না যে সারাচ্ছে সে কী করছে। ঐ সময়টায় কোন সফটওয়্যার নিয়ে এসে এমন ব্যবস্থা করা সম্ভব যাতে বেশ কয়েকটা ভোট, যাকেই দেওয়া হোক, একজন প্রার্থীর কাছেই যাবে।

তৃতীয় সুযোগ যখন মেশিনটাকে পোলিং বুথে নিয়ে গিয়ে আবার খোলা হয়। তবে এই সময়টায় কারচুপির সম্ভাবনা কম, কারণ তখন সব দলের পোলিং এজেন্ট ভোট দিয়ে মেশিন পরীক্ষা করেন। যে যেমন ইচ্ছা ভোট দেন এবং কাগজে লিখে নেন কে কটা ভোট দিলেন। তারপর ফলাফল দেখাতে বলেন। সেই ফলাফল মিললে বোঝা যায় সব ঠিক আছে। একে আমরা বলি মক রান। এরপর যখন মেশিন সেট করা হয় তখন কারচুপির সুযোগ থাকে। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা লক্ষ্য করার লোক থাকে বলেই বলছি সম্ভাবনা কম।

কিন্তু বুঝতেই পারছেন যে তিনবার মেশিন খোলা হয়, তার মধ্যে দুবার গোপনে খোলা হয় এবং প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন এই সময়গুলোতে কারচুপি করা সম্ভব। ভারত এবং আরো ষাটটা দেশের প্রযুক্তিবিদরা বলেছেন যখন কারচুপি সম্ভব, তখন আমরা ইভিএম ব্যবহার করব না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটা রাজ্য এখনো ইভিএম ব্যবহার করে, কিন্তু সাথে ব্যালট পেপারও রাখে। আর লাতিন আমেরিকার দুটো দেশ ইভিএম ব্যবহার করে। পৃথিবীর ১৮০টা গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে আর কেউ এই যন্ত্র ব্যবহার করে না।

এত উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও এতগুলো দেশ ব্যবহার করে না কেন? এটা ঠিকই যে কিছু দেশ করে না পুরনো সংস্কারবশত। কিন্তু জার্মানি বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্য উন্নত দেশগুলোতে এই নিয়ে প্রচুর বিচার বিশ্লেষণ হয়েছে। ই ইউ-এর জাজ বলে দিয়েছেন এই মেশিন আমরা ব্যবহার করতে দেব না, এক শতাংশ সন্দেহ থাকলেও নয়। তাই গোটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে কোথাও ইভিএম ব্যবহার হয় না। ব্রিটেনেও হয় না। তাহলে এতগুলো উন্নত দেশ কি নেহাত বোকা, যে উন্নত প্রযুক্তি থাকতেও ব্যবহার করছে না?

অনেক ভোটকর্মীর সাথে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা খুব জোর দিয়ে বলেন যে কারচুপি অসম্ভব এবং নিজের কথা প্রমাণ করার জন্যে ইভিএম হাতে পাওয়া থেকে শুরু করে ভোটকেন্দ্র থেকে ফিরে মেশিন জমা দেওয়া পর্যন্ত যে লম্বা প্রক্রিয়া, সেটার ফিরিস্তি দিয়ে বলেন এর মধ্যে কোনরকম কারচুপি করার সুযোগই নেই। এই ধারণাটা ভোটকর্মীদের মধ্যে কেন তৈরি হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?

আসলে ভোটকর্মীরা গোটা প্রক্রিয়ার মাঝের একটা ছোট অংশ দেখতে পান। আমি বৃহত্তর ছবিটা বললাম। ওঁদের বক্তব্য একদম সঠিক। অর্থাৎ বুথে যাওয়া আর বুথ থেকে ফেরত আসা — এর মধ্যে ট্যাম্পারিং অসম্ভব। কারণ ভোটকর্মীদের যে পার্টি তৈরি করা হয় সেটা কম্পিউটারে র‍্যান্ডম সিলেকশনের মাধ্যমে হয়, যাতে কেউ কারোর পরিচিত না হয়। প্রথম দিকে এটা কেরানিদের উপর ছেড়ে দেওয়া হত। তখন প্রায়ই চার বন্ধু বলত, আমাদের একসাথে দিয়ে দিন। কোন বদ মতলব আছে বলে নয়, চেনা জানা লোক হলে সুবিধা হবে ভেবে। আবার পার্টির লোকেরাও দাবি করত প্রতি পোলিং পার্টিতে তাদের একজনকে রাখতে হবে। কিন্তু এখন পুরো ব্যাপারটাই কম্পিউটারের মর্জিতে চলে। ফলে একই পোলিং পার্টির সবার সবাইকে চেনার সম্ভাবনা দশ লাখে এক। অতএব পাঁচজন অচেনা লোক, যারা একে অপরের রাজনীতি জানে না, তারা তো আর দলবদ্ধভাবে কারচুপি করতে পারে না। সুতরাং ভোটকর্মীদের স্তরে কারচুপির সম্ভাবনা শূন্য।

আচ্ছা অনেক ভোটেই যে একটা অভিযোগ ওঠে, পশ্চিমবঙ্গে এবারের ভোটেও উঠেছিল, যে ভোটার বলছেন আমি এক দলের বোতাম টিপলাম, অন্য দলের বোতামের পাশে আলো জ্বলল। এটা কি সম্ভব?

না, এটা একেবারেই সম্ভব নয়। এই ধন্দ এড়াতেই তো ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেল)-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আমাদের যে অভিযোগ সেটা হল এত কোটি টাকা দিয়ে ভিভিপ্যাট মেশিনগুলো কেনা হয়েছে, অথচ ওঁরা স্লিপগুলো গুনতে রাজি নন। আমরা যারা সমস্ত ভিভিপ্যাট গোনার দাবি করেছি, তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলাম। আমরা বলছি ওঁরা যে বলছেন ভিভিপ্যাট গুনতে পাঁচদিন লাগবে, এটা একেবারে বাজে কথা। ভিভিপ্যাটের স্লিপগুলো তাসের মত গুছিয়ে নিতে হবে। একজন ব্যাঙ্ককর্মী রাখতে হবে, যিনি নোট গোনার মত ওগুলো গুনে যাবেন আর আলাদা আলাদা বাক্সে ফেলবেন। তারপর রাজনৈতিক দলের এজেন্টদের বলবেন, নিজের নিজের বাক্স তুলে দেখে নিন আপনাদের প্রাপ্ত ভোটের সাথে মিলল কিনা। এতে কতক্ষণ লাগে? এইটুকু করতে না চেয়ে নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা যে আচরণ করেছেন তা থেকে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে ভিভিপ্যাটের সাথে ইভিএম না-ও মিলতে পারে। আমরা যদি এটার প্রমাণ পাই, তখন দুটো মেশিনের কেন সমন্বয় হচ্ছে না সেটা নিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। সেটা পরের পদক্ষেপ।

অনেকদিন আগে আপনার একটা বক্তৃতায়শুনেছিলাম, তাতে আপনি বলেছিলেন একটা যন্ত্র হয়, যাতে বিভিন্ন বুথ থেকে আসা ইভিএমগুলোর ভোট মিশিয়ে ফেলা যায়। সেই যন্ত্র কিনতে কেন্দ্রীয় সরকার আপত্তি করেছিল। তাহলে কি ধরে নিতে পারি যে শুধু কারচুপি করা যায় তা-ই নয়, ইভিএমে আমার ভোটের গোপনতাও সুরক্ষিত নয়?

যন্ত্রটার নাম টোটালাইজার। ওটা অবশ্যই ব্যবহার করা উচিৎ, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলই টোটালাইজার চায় না। কারণ তারা বুথভিত্তিক ফলাফল চায়, নিজেদের এলাকাভিত্তিক সাফল্য বা ব্যর্থতা বোঝার জন্যে। কিন্তু রিটার্নিং অফিসার হিসাবে আমি মনে করি বুথভিত্তিক ফলাফল অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এই ফল জেনে নিয়ে কোন দল যারা তাদের ভোট দেয়নি, তাদের উপর চড়াও হতে পারে। টোটালাইজার যেটা করে সেটা হল পাঁচটা ইভিএমকে একসাথে যুক্ত করে দেয়, তারপর মোট ভোটটা পাওয়া যায়। এই মোট ভোট থেকে আর ধরা যায় না কোন পাড়ার লোক কোথায় ভোট দিয়েছে।

ইভিএমের পক্ষে যাঁরা সওয়াল করেন, তাঁদের বক্তব্য যখন ব্যালটে ভোট হত তখন গণনায় তো বেশি সময় লাগতই, তার চেয়েও বড় কথা ভোট লুঠ করা বা ছাপ্পা ভোট দেওয়া অনেক সহজ ছিল। এটা কি আপনি মানবেন?

শেষের দিকে ছাপ্পা ভোটকে নিয়ন্ত্রণ করারও নানা কৃৎকৌশল বার করা হয়েছিল। এমন উপায় বার করা হয়েছিল যে গণনার সময়েও ছাপ্পা ভোট আমরা ধরে ফেলতাম। তাছাড়া সেইভাবে তো ইভিএম-ও দখল করা যায়। সেই ভয়ে ইভিএম ব্যবহার করার কোন যুক্তি নেই। তবে ইভিএম যে সুবিধাজনক তাতে ভুল নেই। কিন্তু প্রক্রিয়াটা সম্বন্ধে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। আমি ব্যালটেই ফেরত যেতে বলছি তা নয়। আমার বক্তব্য হল ইভিএমের সাথে ভিভিপ্যাটও গুনে নেওয়া হোক। কিন্তু সুনীল অরোরা গোঁ ধরে বসে রইলেন, গুনব না। তাতেই সন্দেহ আরো বেড়ে গেল।

মনে রাখতে হবে টি এন শেষনের পর থেকে কোনদিন নির্বাচন কমিশনকে আমরা এত নীচু চোখে দেখিনি। সব নির্বাচন কমিশনারই কম বেশি সমালোচিত হয়েছেন, কিন্তু এস ওয়াই কুরেশি, ওমপ্রকাশ রাওয়াত বা এন গোপালস্বামীকে তো আমরা কোনদিন সন্দেহ করিনি। শেষন একটা মানদণ্ড তৈরি করে গিয়েছিলেন। তারপর এই প্রথম একজন নির্বাচন কমিশনার হলেন, যাঁর পক্ষপাতিত্ব সম্বন্ধে গোটা ভারতবর্ষ একমত। সেটাই সমস্যা বাড়িয়েছে।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি টুইটার থেকে।

বামেদের মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিকতার সংকট কিংবা দ্বিমেরু-বঙ্গের এক নিশ্চিন্ত নাগরিকের প্রলাপ

বিজেপির রামনবমীর বিপরীতে তৃণমূলের হনুমানপুজো, অযোধ্যার রামমন্দিরের বিপরীতে দীঘার জগন্নাথ মন্দির… এগুলোই বাংলার রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের অন্তিম লগ্নে ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের সাংবাদিক সম্মেলন দেখছিলাম। ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিরাট আশা জাগিয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেহারাটা অনেকেরই মনে আছে। জয়ের জন্য প্রাণপণ লড়াই করার পর পরাজিত হলে কোনও নেতা বা নেত্রীর প্রতিক্রিয়া ওরকমই হওয়ার কথা। অথচ, জয়প্রকাশবাবু দেখলাম বেশ স্থিতধী। তিন থেকে ৭৭-এ পৌঁছনোতেই তিনি সাফল্য (নাকি সান্ত্বনা?) খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে শতাধিক বিধানসভা আসনে এগিয়ে থাকার কথা সুবিধামত ভুলেই গেলেন বোধহয়। কিংবা হয়তো ওটা কর্মীদের মনোবল ভাঙতে না-দেওয়ার কৌশল। তবে যে-কথা বলতে গিয়ে তাঁর মাস্ক-পরা মুখও মনে হল উদ্ভাসিত, কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট তৃপ্তি— তা হল তৃতীয় শক্তির অবলুপ্তি। বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ যে রাজ্যের রাজনীতিতে কোনও সাড়াই ফেলতে পারেনি এবং আগামী দিনে এই রাজ্যের রাজনীতি যে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে— এই ঘোষণায় রীতিমত জয়ের প্রকাশ দেখলাম। বোঝা গেল, রাজ্য জয়ের স্বপ্ন সফল না-হলেও পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিমেরু রাজনীতির দিকে নিয়ে যাওয়াও বিজেপির পক্ষে যথেষ্ট সন্তোষজনক ফলাফল।

২০১৪-র পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়তনের কোনও রাজ্যে বিজেপি-কে এরকম বিশ্রী হারের মুখ দেখতে হয়নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা, দেশভাগের ইতিহাস ইত্যাদি নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের খেলা শুরু হয়েছিল। আরও নানাবিধ মেরুকরণের আশঙ্কাও প্রকট হয়ে উঠেছিল। উপরন্তু, বিজেপি এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে গেলে ২০২৪-এ তাদের লোকসভায় জেতার পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে, এরকমও অনেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন। তা ছাড়াও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোর যা সার্বিক অবস্থা, সেসব দেখে পশ্চিমবঙ্গবাসীর শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। সর্বোপরি অন্য রাজ্যের মানুষও উদগ্রীব ছিলেন দেখার জন্য যে, বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দুত্বের কাছে হার মানে কি না। সেটা ঘটলে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুরাষ্ট্রের বৌদ্ধিক জয় হত। ফলে, তৃণমূল কংগ্রেসের জয় অনেকের কাছেই উল্লাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের বাইরের মানুষের এই উল্লাস শতকরা একশো ভাগ সঙ্গত, কারণ যে কোনও মূল্যে বিজেপির পরাজয়ই তাঁদের প্রয়োজন ছিল। এই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে দেশব্যাপী তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তই। যেমন, এই মুহূর্তে করোনা সামলানোয় গাফিলতি এবং অনিচ্ছা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রবল চাপে পড়েছে বলেই দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের করোনার দোহাই দিয়ে তুলে দিতে পারছে না— যা গত বছর শাহিনবাগের সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের বেলায় করতে পেরেছিল। পশ্চিমবঙ্গে জিতে গেলে মোদি-অমিত শাহ জুটি কৃষকদের ওপর বলপ্রয়োগ করতেও পিছপা হতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু সেসব সংক্রান্ত স্বস্তি ও উল্লাস পেরিয়েও, এই রাজ্যের মানুষের ভবিষ্যতের স্বার্থে কিছু কথা ভেবে দেখা প্রয়োজন বই কী!

প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি। এর সবটাই সরকারবিরোধী ভোট তো বটেই, কিন্তু কী কারণে এই ভোটাররা সরকারের বিরোধী? যদি জনপ্রিয় যুক্তি অনুযায়ী ধরে নিই এদের বিজেপিকে ভোট দেওয়ার একটাই কারণ— মুসলমান বিদ্বেষ, তা হলে বিশেষ উদ্বেগের কারণ রয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিজেপির ক্রমবর্ধমান শক্তিতে আসানসোল, ধূলাগড়, বসিরহাট, তেলেনিপাড়ার মতো নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি হতে দেখা গিয়েছে। এর কোনওটাই তৃণমূলের সংগঠন আটকাতে পারেনি। বহু জায়গাতেই মানুষের অভিযোগ, প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়াও পর্যাপ্ত ছিল না। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে। ২০১৬-তে ১০.১৬ শতাংশ ভোট পাওয়া সাকুল্যে তিন বিধায়কের বিজেপিই যখন এত অশান্তি পাকাতে পেরেছে, তখন প্রায় চার গুণ বেশি ভোট পাওয়া ৭৭ জন বিধায়কের বিজেপি লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে থাকবে কি? মনে রাখতে হবে, এখন তাদের ১৮ জন সাংসদও আছেন, কেন্দ্রে তাদের সরকার। পান থেকে চুন খসলে তা নিয়ে একটা বড়সড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার রসদ তাদের আছে। গত কয়েক বছরে বাংলার সমাজে যে গভীর সাম্প্রদায়িক ক্ষত তৈরি হয়েছে তা যে বিজেপির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মিলিয়ে যাবে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল সমর্থন নিয়ে প্রত্যাবর্তনে প্রমাণিত হল যে, ইমাম ভাতা দিলে অন্যায় হয় না, পুরোহিত ভাতা দেওয়াও ভালো। যেহেতু বিজেপির প্রচার ছিল পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো করতে দেওয়া হয় না, সেই প্রচারকে মিথ্যা প্রমাণ করতে সরকারের ক্লাবগুলোকে পুজোর খরচ দেওয়াও অন্যায় নয়। অতএব আগামী পাঁচ বছর বিজেপির প্ররোচনা দেওয়ার মতো ইস্যুর অভাব হবে না, আর তৃণমূল সরকার সে সব প্ররোচনার রাজনৈতিক মোকাবিলা না-করে দড়ির উপর ব্যালান্সের খেলা খেলে যাবেন— এমন সম্ভাবনা তাই প্রবল।

যা গত দশ বছরে হয়নি, আগামী পাঁচ বছরে হবে— এমন আশা করা যুক্তিযুক্ত নয়। তাই ২০১১ থেকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়া আরএসএস-এর সংগঠনের বিরুদ্ধে শাসক দল সত্যিকারের কোনও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে— এমন ভাবা, অতএব, বাতুলতা হবে। অবশ্য সরকারি দল প্রতিরোধ করতে যাবেই বা কেন? মুখ্যমন্ত্রী তো এই সেদিন ইন্ডিয়া টুডে-র সাংবাদিক রাহুল কাঁওয়ালকে বলেছেন, আরএসএস-কে নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা নেই, কারণ তারা ভোটে লড়ে না তাঁর সমস্যা বিজেপিকে নিয়ে। বিজেপিকে হারানো হয়ে গেছে, অতএব আরএসএস এবং তৃণমূলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলতেই পারে বোধহয়। আগামী পাঁচ বছর, বা জয়প্রকাশবাবুর কথা ঠিক হলে, অতিদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিজেপির রামনবমীর বিপরীতে তৃণমূলের হনুমানপুজো, অযোধ্যার রামমন্দিরের বিপরীতে দীঘার জগন্নাথ মন্দির… এগুলোই বাংলার রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে।

দুর্নীতির অভিযোগ, সে আম্ফানের ত্রাণেই হোক কিংবা এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক, বাংলার নির্বাচনে সে সব যে কোনও ইস্যু নয় তা এবারের নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলত কর্মসংস্থানও ইস্যু নয়, হয়তো আগামীদিনেও হবে না। শিল্প হবে কি হবে না, শিক্ষিত বেকাররা চাকরি পাবে কি পাবে না— প্রচারে অনবরত সে সব কথা বলে এবং ইশতেহারে লিখে বিরাট গোল্লা পেয়েছে বাম দলগুলো এবং কংগ্রেস, আইএসএফ একটার বেশি আসনে জিততে পারেনি। সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের সম্বন্ধে প্রশ্ন আসতে মুখ্যমন্ত্রী একটাও শব্দ খরচ করতে চাইলেন না, করার কথাও নয়। তারা যে ইস্যুগুলো তুলে ধরেছিল, সেগুলো তাঁর মাথায় থাকলেই নাগরিকদের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দিক থেকে ভাবলে মানতেই হয়, তাঁর সে সব মনে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। যারা মনে রেখেছিল, তাদের সব মিলিয়ে সাড়ে আট শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। অত কম মানুষের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে একজন মুখ্যমন্ত্রীর মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। আর বিজেপি যে ওসব নিয়ে ভাবতে রাজি নয় তা কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের দখলে থাকা অন্য রাজ্য সরকারগুলোর কার্যকলাপ দেখলেই বোঝা যায়। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন থেকে ইস্যুকেন্দ্রিক না-হয়ে চিহ্নকেন্দ্রিক হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী কালীঘাট মন্দিরে গেলেন কি না, মহরমের দিন প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি দেওয়া হল কি না— এই সব।

সাধারণ নাগরিকের স্বস্তি এইখানে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালু করা একগুচ্ছ জনমুখী প্রকল্প, যার সুবিধা গরিব প্রান্তিক মানুষ পেয়ে থাকেন, সেগুলো অন্তত চালু রইল। বিজেপি যেখানে যেখানে ক্ষমতায় আছে, সেখানে এরকম প্রকল্পের কোনও স্থান নেই। আয়ুষ্মান ভারত[3] বা ফসল বিমা যোজনার[4] মতো দু-একটা কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প যা-ও বা আছে, সেগুলো সবই প্রকৃতপক্ষে ধোঁকার টাটি বলে অভিযোগ।

স্পষ্টত, আর একটা আশা নিয়ে মানুষ তৃণমূলকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেছেন, তা হল, বাংলায় এনআরসি হবে না। আইনত এনআরসি করা বা না-করা কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে মানুষ নিশ্চয়ই আশা করেন দিদি এই রাজ্যে এই প্রক্রিয়া প্রাণপণে আটকাবেন। গত বছর যখন বিভিন্ন ধারার বামপন্থীরা, নানা বয়সের মহিলারা সিএএ-এনআরসি-এনপিআর আটকাতে আন্দোলন করছিলেন তখন দেখা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই নিয়ে মিছিল-মিটিং করলেও অন্যদের আন্দোলনের প্রতি রাজ্য প্রশাসন বিশেষ সদয় নয়। আশা করা যায়, এখন আর সে সমস্যা হবে না। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তো আর এ নিয়ে আন্দোলন করতে যাবে না, শক্তিহীন বামফ্রন্টই বা কী এমন আন্দোলন করবে? হাতে রইলেন বিকল্প বামেরা, যাঁরা এরপর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও তীব্র করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তাঁরা তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবেক। তৃণমূলের এই বিপুল জয়ে তাঁদের ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনের যথেষ্ট অবদান— এই দাবিতে রবিবাসরীয় আকাশ-বাতাস তাঁরা মুখর করে তুলেছিলেন। সুতরাং তাঁরা আন্দোলন করলে মমতা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। আশা করা যায়, দিদি আগামী পাঁচ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এঁদের সংগ্রামকে মমতাময়ী পক্ষিমাতার মতো দুই ডানা দিয়ে আগলাবেন। ২০১৮ সালে যেমন চেয়েছিলেন পঞ্চায়েতে শুধু তাঁর দলই থাকুক, এখন তেমন দাবি আশা করা যায় করবেন না যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও শুধু তাঁর দলই লড়ুক।

শূন্যে পৌঁছে যাওয়া কংগ্রেসের এ-রাজ্যে ভবিষ্যৎ কী, বলা দুষ্কর। একা কুম্ভ অধীর চৌধুরীর গড় মাটিতে মিশে গেছে, প্রবীণ জনপ্রিয় নেতা আব্দুল মান্নান ধরাশায়ী। বৃদ্ধতান্ত্রিক সিপিএমেও একগুচ্ছ নতুন মুখ দেখা গেছে, কিন্তু কংগ্রেসে? সিপিএমের কচিকাঁচারা যদি ‘একলা চলো রে’ নীতিতে ফিরে যেতে চান তা হলে কংগ্রেসের কী হবে, দেবা ন জানন্তি।

অবশ্য ফলপ্রকাশের পর আটচল্লিশ ঘন্টা কেটে গিয়ে থাকলেও রাজ্য সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের কেউ দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন, এমন খবর নেই। একটি তথাকথিত বিপ্লবী পার্টির শান্ত হ্রদের মতো অন্দরমহলে একমাত্র ঢেউ বলতে টিভির পর্দায় পরাজিত সিপিআইএম প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অকস্মাৎ বিষোদ্গার। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীর বাইরে এ-ভাবে কথা বলা শৃঙ্খলাভঙ্গ কি না, সে বিতর্কে না-গিয়েও বলা যায়, তাঁর সমালোচনায় গঠনমূলক কিছু ছিল না। এই ফলের জন্য “পলিটব্যুরোর দু-একজন নেতা” ছাড়া তিনি দুটো কারণ দেখিয়েছেন। সর্বক্ষণের কর্মীদের যথেষ্ট ভাতা না-পাওয়া আর আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করা। দ্বিতীয়টার ব্যাখ্যা দেননি, আর প্রথমটা ঠিক থাকলে কীভাবে শূন্যের বদলে খাতায় পাঁচটা বা দশটা আসন জমা পড়ত, তা বুঝতে চেষ্টা করার চেয়ে বাইফোকাল চশমা হারানো মানুষের পক্ষে সূচে সুতো পরানো সহজ। উপরন্তু তন্ময়বাবু যে ভাষায় বামপন্থীদের রাস্তার রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখাকে কটাক্ষ করেছেন, তাতে তাঁর মার্কস্‌বাদে আস্থাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করা নিয়ে আপত্তি আর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা নিয়ে প্রবল আবেগ দেখে মনে হয়নি, আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করার মতো কোনও পথ তিনি নিজের দলকে দেখাতে চান। বোধহয় তাঁর মনে হয়েছে স্রেফ আইএসএফ-কে জোটের বাইরে রাখলেই মানুষ তাঁদের ঢেলে ভোট দিতেন। মীনাক্ষী, ঐশী, দীপ্সিতা, সৃজন, প্রতীকুরদেরও তা-ই ধারণা কি না, কে জানে! যদি তা-ই হয়, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে বামেদের বাংলায় ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা শূন্য।

আসলে সিপিএমের রাজনীতিতে শ্রেণির প্রশ্ন বহুদিন ধরেই অবহেলিত। তা না-হলে ওঁরা আগেই বুঝতে পারতেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে নির্ণায়ক ভোট দেন গরিব মানুষ, যাঁরা তাঁর বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে উপকৃত। আমাদের দেশে যে কোনও নির্বাচনেই নির্ণায়ক ভোট আসলে গরিব মানুষের, কারণ তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গত কয়েক বছরে সিপিআইএম-এর সোশাল মিডিয়া নির্ভরতা, এবং কারা সোশাল মিডিয়ায় ওই পার্টির জয়পতাকা ওড়ান তা দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় সিপিআইএম-এর মূল ভোটার হয়ে দাঁড়িয়েছেন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষ। এঁদের অনেকেই আসলে অভ্যাসে সিপিআইএম। পরিবার সিপিআইএম সমর্থক বলে এঁরা সিপিআইএম সমর্থক, অথবা অল্প বয়সে কোনও বাম গণসংগঠনের সদস্য ছিলেন, সেই আবেগ রয়ে গেছে। গরিব মানুষ কোনও পার্টির দ্বারা, সরকারের দ্বারা উপকৃত হলে তা তাঁর ভোটকে প্রভাবিত করে। কিন্তু উপর্যুক্ত শ্রেণির মানুষের সেভাবে উপকৃত হওয়ার ব্যাপার নেই, তাঁরা চলতি হাওয়ার পন্থী। এ বারের ভোটে হাওয়া ছিল বামেরা জিতবে না, অতএব ভোট দিয়ে লাভ নেই। উপরন্তু দাড়ি-টুপি পরা মুসলমান ধর্মগুরুর সঙ্গে জোট বাঁধাও এঁদের পছন্দ হয়নি। তাই লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া সাত শতাংশের মধ্যে থেকেও এই দুই বা তিন শতাংশ বেরিয়ে গিয়ে বিজেপি-বিরোধিতার কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছেন, এখন সোশাল মিডিয়া ভরিয়ে তুলছেন স্বীকারোক্তিতে। এরই মধ্যে হঠাৎ দ্বিমেরু রাজনীতির বিপদগুলো খেয়াল হওয়ায় কেউ কেউ লম্বা পোস্ট লিখে তৃণমূল কংগ্রেসকে খেয়াল করাচ্ছেন, তাঁদের ভোট দেওয়া হয়েছে স্রেফ বিজেপিকে আটকাতে। পার্টিটাকে পছন্দ হয়েছে বা সরকারের কাজ পছন্দ হয়েছে বলে নয়।

শ্রেণি সচেতনতার অভাবে, সমাজবিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ জ্ঞানের অভাবে এই শ্রেণির চিন্তাভাবনাই কিন্তু বর্তমান বাম নেতা এবং প্রার্থীদের বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তাই মমতার জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোকে সিপিআইএম কর্মীরা প্রায়ই হেয় করেন। “মানুষ আপনার দান/ ভিক্ষা চায় না, মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা করুন”— এই চরম নব্য উদারনীতিবাদী কথাটা মিটিং-এ বা সোশাল মিডিয়ায় সিপিআইএম-এর লোকেদের প্রায়শই বলতে দেখা যায়। ওঁরা জানেন না অথবা উপলব্ধি করেন না যে, সরকারের টাকা আসলে করদাতাদের টাকা এবং সে কর একজন ধনী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে একজন রিকশাচালক পর্যন্ত সকলেই দেন। সুতরাং নাগরিকের জন্য চালু করা কোনও সরকারি প্রকল্প আদতে দান নয়। কন্যাশ্রীর সাইকেল যেমন দান নয়, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের প্রিমিয়ামও দান নয়। শুধু তা-ই নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য এগুলো করা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বহু পুরনো কৌশল। বামফ্রন্ট সরকারও এমন প্রকল্প চালাত। কথাগুলো কিন্তু বিস্তর প্রশংসা কুড়োয় মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সমর্থকদের থেকে। ফলে, ওঁরা ভাবেন, একেবারে ঠিক কথাই বলা হয়েছে এবং বাস্তবে গরিব মানুষের থেকে আরও দূরে সরে যান।

এই মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিকতা না-কাটলে সিপিআইএম-এর আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

অতএব দ্বিমেরু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে রুজিরোজগারের প্রশ্ন জিইয়ে রাখার দায়িত্ব এখন পড়ল বিকল্প বামেদের কাঁধে। তাঁদের অনেককালের অভিযোগ, সিপিআইএম বামপন্থার বদনাম করছে। একটিবার সুযোগ পেলেই তাঁরা দেখিয়ে দিতে পারেন আসল বামপন্থা কী, কিন্তু সিপিআইএম তাঁদের জায়গা ছাড়ে না। সিপিআইএম ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরের দশ বছরেও সে সুযোগ ওঁরা পাননি। অনেকটা ওই ‘আনফিট’ বর্ষীয়ান ক্রিকেটার যেমন অতীতের পারফরম্যান্সের জোরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খেলেই যান, আর বেচারা তরুণ প্রতিভাবানদের রিজার্ভ বেঞ্চে বসেই জীবন কাটাতে হয়। নির্বাচকদের অসীম কৃপা, এবার তাঁরা দলের সেই বোঝাগুলিকে বিদেয় করার বন্দোবস্ত পাকা করে দিলেন। আশা করা যাক, তরুণরা সেঞ্চুরি, ডবল সেঞ্চুরির ফুলঝুরি ছোটাতে পারবেন শিগগিরই।

https://4numberplatform.com/ এ প্রকাশিত

একজিট পোল: অঙ্কে কাঁচার সমীক্ষা

ভোটদান হয়ে যাওয়া মাত্রই সমীক্ষক, সাংবাদিক তো বটেই; এমনকি ভোটারদেরও বোধহয় আর ইস্যু নিয়ে আগ্রহ থাকে না। সংখ্যাই তখন শেষ কথা।

অঙ্কে ভাল হতে না পারলে জীবন বৃথা — কথাটা বাবা বলতেন। অঙ্কের থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে, কোনমতে মাধ্যমিক পাস করার পরে আর অঙ্কের ছায়া না মাড়িয়ে দিব্যি চাকরি বাকরি পেয়ে গিয়ে বাবার দিকে সগর্বে তাকাতাম, ভাবখানা “হুঁ হুঁ, কেমন দিলাম?” বাবা বুঝতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। এখন জীবিত থাকলে নির্ঘাত পাল্টা বলতেন “কেমন দিলাম?” বুথফেরত সমীক্ষা বা এক্সিট পোলের ফলাফল এসে পড়েছে। সেগুলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হৈ হৈ করে প্রত্যাবর্তন[১] (পি মার্কসের সমীক্ষা) থেকে শুরু করে বিজেপির নিরঙ্কুশ পরিবর্তন[২] (ইন্ডিয়া টিভি-পিপলস পালসের সমীক্ষা) পর্যন্ত সবকটা সম্ভাবনাই দেখা গেছে। যেন এক্সিট পোলের ঈশ্বর রাবীন্দ্রিক দাড়িওয়ালা রবি শাস্ত্রী। বলছেন “মিত্রোঁ, অল থ্রি রেজাল্টস পসিবল।” একই নির্বাচনের এক্সিট পোলের ফলাফল কেন এমন আকাশ পাতাল হয় তা নিয়ে মাথা চুলকানো ছাড়া আর উপায় নেই। কারণ খেলা যখন ছিল অঙ্কের সনে, তখন লুকোচুরি খেলেছি। যা নয়ে হয় না, তা কি আর নব্বইতে হয়?

একা এক্সিট পোলে রক্ষে নেই, অতিমারী দোসর। টিভির পর্দা জুড়ে সম্ভাব্য আসন সংখ্যা, ভোট শতাংশ — এসবের সাথেই নেচে বেড়াচ্ছে করোনায় আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। কাল তিন লাখ আক্রান্ত হলে আজ চার লাখ, কাল আড়াই হাজার মানুষ মরে থাকলে আজ সাড়ে তিন হাজার। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে খবর নয়, লোটোর ফলাফল দেখছি। যাদের সংখ্যা মিলে যাচ্ছে তারা হয়ত আনন্দে আত্মহারা। যাদের মিলছে না তারা হয়ত কলসী দড়ি খুঁজছে। বা হয়ত দু পক্ষই কলসী দড়ি খুঁজে রাখছে, কারণ চাইলেই তো নিজের পছন্দসই একখানা সমীক্ষার ফল হাতের কাছে পাওয়া যায়। অপছন্দের ফলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে ভোরবেলা গঙ্গার পাড়ে প্রাতঃকৃত্য করতে বসা লোকেদের মত নিজের চোখ ঢেকে ফেললেই আরো দুটো দিন নিজস্ব বুদ্বুদে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। সে বুদ্বুদ সময় হলে আপনি ফাটবে, আঙুল দিয়ে ফাটানোর প্রয়োজন হবে না। তৃণমূল, বিজেপির বাইরে বাম, কংগ্রেস বা আই এস এফের সমর্থকদেরও উৎকণ্ঠ হয়ে থাকার কারণ আছে। তাঁদেরও শূন্য (ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়ার সমীক্ষা) থেকে ২৫ (এবিপি-সি ভোটারের সমীক্ষা) পর্যন্ত সবরকম সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে।

এমন বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইতে চাইতে মনে হয় আমরা সকলেই সংখ্যা হয়ে গেছি। ৪৭ফ, ৬৯ঙ ইত্যাদি। নইলে আমার মত অঙ্কে কাঁচা লোকের সাথে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোন তফাতই থাকে না! তাঁরাও অঙ্কের সাথে লুকোচুরি খেলেন! টিভি ক্যামেরা দেখাচ্ছে, মানুষ নিজে টুইট করছে, ফেসবুকে পোস্ট করছে অক্সিজেনের অভাবের কথা, হাসপাতালে শয্যার অপ্রতুলতার কথা। অথচ ঐ মহামান্য জনসেবকরা সগর্বে বলে চলেছেন কোথাও কোন অভাব নেই। ফুটপাথে সার বেঁধে মড়া পোড়ানোর দৃশ্য সবাই দেখতে পাচ্ছে, অথচ তাঁদের খাতায় মৃতের সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছাতেই চাইছে না। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর আরো সোজাসাপ্টা লোক। তিনি বলে দিয়েছেন চেঁচামেচি করলে মৃতেরা ফিরে আসবে না। অতএব সংখ্যা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। অনেকের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গেও নাকি সংখ্যা কমিয়ে বলা চলছে, তবে ওসব বলতে নেই। বিজেপি এসে যাবে। তাই আমিও বলছি না।

এখন কথা হচ্ছে সংখ্যা কি কথা বলে? আমাদের কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে? কোভিড জনিত সংখ্যার ভাষা তো মন্ত্রীসান্ত্রীরা বুঝছেন না দেখাই যাচ্ছে। আমরা কি বুঝছি? বুথফেরত সমীক্ষা থেকে তার কোন আঁচ পেলাম না। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের শেষ তিন দফা ভোটের সময় দেশের কোভিড পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়েছে, রাজ্যেরও। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানার পথে এবং পার্কে মড়া পোড়ানোর ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও কি সোনার বাংলার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করলাম আমরা? সমীক্ষায় তার কোন উত্তর পেলাম না। অবশ্য প্রশ্নটা করা হয়েছিল কিনা তা জানি না। দেড় বছর ধরে যে অতিমারী চলছে, তার মোকাবিলায় রাজ্যের তৃণমূল সরকার আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মধ্যে কোন তফাত দেখলেন কি ভোটাররা? তারও উত্তর রবিবার নির্বাচনের ফলে থাকবে হয়ত। নাকি থাকবে না? সিপিএমের কমিউনিটি ক্যান্টিন কি ভোটারদের প্রভাবিত করেছে? নাকি বিপদের সময়ে ত্রাণমূলক কাজ করার সঙ্গে সরকার চালানোর যোগ্যতার কোন সম্পর্ক নেই — এমনটাই ভোটারদের রায়? সে প্রশ্নের জবাবও খুঁজছিলাম। টিভিতে জনমত সমীক্ষা দেখানোর সময় যেভাবে ইস্যুভিত্তিক মত দেখানো হত, বুথফেরত সমীক্ষায় তেমন দেখলাম না। ফলে এ প্রশ্নের উত্তরও পেলাম না।

আসলে ভোটদান হয়ে যাওয়া মাত্রই সমীক্ষক, সাংবাদিক তো বটেই; এমনকি ভোটারদেরও বোধহয় আর ইস্যু নিয়ে আগ্রহ থাকে না। সংখ্যাই তখন শেষ কথা। খুব সম্ভবত ভোটের ফল বেরোবার সময়েও একই ঘটনা ঘটবে। “খেলা হবে” না “সোনার বাংলা” — কোন স্লোগান জিতল তা নিয়েই সরগরম থাকবে টিভি স্টুডিও। আমরাও বাহারী গ্রাফিক্স দেখে বোঝার চেষ্টা করব কোন এলাকা সবুজ ছিল, গেরুয়া হল; কোথায় গেরুয়া হয়ে গেল সবুজ। কারণ খোঁজার পরিশ্রম কে আর করতে চায়? শীতলকুচির আগে পরে ভোটদানে কোন পরিবর্তন লক্ষ করা গেল কিনা এ নিয়ে কোন আলোচনা হবে কি? একসময় হত। আজকাল এসব দুরাশা মনে হয়, কারণ যুগ বদলে গেছে, রোজ আরো বদলাচ্ছে। কদিন আগে অব্দিও জানতাম দলবদল হয় ভোটের পর। উত্তর-পূর্ব ভারতে হয়েছে, কর্ণাটকে হয়েছে, মধ্যপ্রদেশে হয়েছে, মহারাষ্ট্রে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে দেখা গেল ভোটের আগেই দলবদল। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের চেয়ে প্রচারে অনেক বেশি আলোচিত হল দলবদল। বুথফেরত সমীক্ষা নিয়ে আলোচনাতেও একটি চ্যানেলে বিজেপির মুখপাত্র একটুও লজ্জা না পেয়ে বলে দিলেন, মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন ওঁরা দুশো আসন না পেলে গদ্দাররা চলে যাবে। সুতরাং ফল যা-ই হোক, সরকার তো আমাদেরই হবে। আশঙ্কা হয়, ফল প্রকাশের দিনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে কে কে দল বদল করছেন। করলে বিধানসভার চেহারাটা কেমন হবে? মুহুর্মুহু রং বদলানো একটা গ্রাফিক হয়ত অনবরত আসবে আমাদের টিভির পর্দায়। জয়ী দলের মুখপাত্র গেয়ে উঠতেও পারেন “যদি আমাকে অসৎ বলো, আমি বলব অঙ্কে কাঁচা।”

তথ্যসূত্র:
[১]। https://www.anandabazar.com/elections/west-bengal-assembly-election/west-bengal-exit-poll-result-2021-tmc-may-win-this-election-with-a-tough-fight-with-bjp-maximum-exit-poll-shows-dgtl/cid/1278553

[২]। https://www.indiatvnews.com/elections/news-west-bengal-election-exit-poll-2021-with-india-tv-tmc-mamata-banerjee-bjp-congress-left-live-updates-701359

https://guruchandali.com/ এ প্রকাশিত

হিন্দির হাতে বাংলা বিপন্ন: বাঙালি কি নির্দোষ?

এত দিনে মাথায় ঢুকেছে যে শক্তিশালী জাতিবিদ্বেষী যখন মারতে আসে তখন স্রেফ নামটা দেখেই মারে।

প্রত্যেকটা নির্বাচন কিছু ইস্যু নিয়ে প্রবল আলাপ আলোচনা বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি করে আর কিছু ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচন সেইভাবেই একটা উত্তেজনার বিষয় আড়চোখে লক্ষ্য করে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই এবারের নির্বাচন এত কিছু নিয়ে এত বেশি উত্তাপ, কদর্যতা, হিংসার উদ্রেক করেছে যে এই বিষয়টা যদি অষ্টম দফা পর্যন্তও নির্বাচনী ইস্যু না হয়ে ওঠে, তাহলে হয়ত আপাতত ভালই হয়। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ইস্যুটাকে আর পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

বিষয় বাঙালির উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। আর সেখানেই কিনা সরকারি ফতোয়া জারি হয়েছে কাজকর্মে যতদূর সম্ভব হিন্দি ব্যবহার করতে হবে। উচ্চশিক্ষায় যুক্ত বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন। বাঙালিকে নিজ দেশে পরবাসী করে দেওয়ার চক্রান্ত; বাংলার ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পিত আক্রমণ — এইসব অভিযোগ উঠেছে। সংস্থার গবেষকরা তাঁদের মত করে প্রতিবাদ করেছেন। সংস্থা বেগতিক দেখে নিজেদের আদেশের অন্যরকম ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।১ এদিকে আবার শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রতিবাদের মুখে ফেরত আনা হয়েছে। নির্বাচনের পরেই আবার রবীন্দ্রনাথ উধাও হবেন কিনা তা সময় বলবে। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে তো এখন নিশ্চিন্তে বলা চলে “সে মন্দিরে দেব নাই”। বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে পাঁচিল তুলে বসুধাকে খণ্ড ক্ষুদ্র করেই উপাচার্য সন্তুষ্ট নন, তিনি নাকি বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে যাবেন।২

এই ঘটনাগুলো দীর্ঘ মেয়াদে পশ্চিমবঙ্গের বা সারা পৃথিবীর বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে যতই ক্ষতিকর হোক, শতকরা নব্বই জন বাঙালির ভাবিত না হলেও চলত। আজকাল মহেন্দ্রলাল সরকার নামটা শুনলে কেউ কেউ আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মালিকদের আত্মীয় বলে সন্দেহ করে, আর রবীন্দ্রনাথের পদবি বহুকাল হল তাঁর নামকে অতিক্রম করে গেছে। ফলে ঘরে একখানা ছবি ঝুলিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু এসবের পাশাপাশি এমন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, যেগুলো উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণা বা শিল্প সাহিত্যের সাথে দৈনন্দিন সম্পর্কহীন ছা পোষা মধ্যবিত্তেরও ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঘটনাগুলো সংখ্যায় এখনো বেশ কম, হয়ত সোশাল মিডিয়ার যুগ না হলে খুব বেশি লোক জানতেও পারত না। কিন্তু লক্ষণ হিসাবে ভাল নয়। কদিন আগেই ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে রোহিত মজুমদার নামে এক বাঙালি যুবক অভিযোগ করলেন, বড়বাজার অঞ্চলে ব্যবসার কাজে এসে বেশ কিছু হিন্দিভাষী লোকের হাতে তিনি হেনস্থা হন এবং হিন্দি বোঝেন না বলে তাঁদের বাংলায় কথা বলতে অনুরোধ করায় তাঁকে বলা হয় বাংলা বলতে হলে বাংলাদেশে চলে যেতে হবে।৩ প্রায় একই সময়ে এক যুবক ফেসবুকেই ভিডিও পোস্ট করে অভিযোগ করেন হুগলী জেলার হিন্দমোটরে এক হিন্দিভাষী নাকি তাঁকে বাড়ি ভাড়া দেননি আমিষাশী হওয়ার অপরাধে। এ পর্যন্ত প্রকাশ পাওয়া সবচেয়ে কুৎসিত অভিযোগ উঠেছে কোন্নগরে। হোলির দিন অবাঙালি যুবকরা জোর করে ঘরে ঢুকে বাঙালি মহিলাকে নাকি রঙ মাখিয়েছে। প্রতিবাদ করায় এবং হোলি বাঙালিদের উৎসব নয়, বাঙালিরা দোল খেলে বলায় নাকি উত্তর এসেছে নেমপ্লেটে লিখে রাখা উচিৎ যে বাঙালি। এবং ২ তারিখের পর মজা দেখানো হবে।৪

কোন্নগরের ঘটনায় এফ আই আর দায়ের করা হয়েছে। হুমকির কথাটা সত্য হোক আর না হোক, সোশাল মিডিয়ায় কিন্তু সত্যিই এমন ভিডিও ঘুরছে, যেখানে হিন্দিভাষী কয়েকজন লোক আঙুল নেড়ে চোখ রাঙিয়ে বলছে ২ তারিখের পর বাঙালিদের দেখে নেওয়া হবে, কারণ “পশ্চিমবঙ্গে এবার আমাদের সরকার হচ্ছে।” এখানে আমরা কারা — সে ভারী কঠিন প্রশ্ন। এখন অব্দি দেশে যেটুকু সাংবিধানিক নিয়মকানুন অবশিষ্ট আছে, তাতে সরকার কোন দলের বা জোটের হয়। বাঙালির সরকার বা অবাঙালির সরকার হয় বলে তো জানি না। তবে রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা। সব কি আর জানি? সত্যি কথাটা এই, যে অতীতে যে জায়গাটা হুগলী শিল্পাঞ্চল ছিল সেখানে বা কলকাতার বেশকিছু অঞ্চলে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় প্রায়শই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে শিগগির এমন একদিন আসবে যখন হিন্দিভাষীরা তাঁদের উপর ছড়ি ঘোরাবেন। বাঙালি বাংলাতেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে যাবে, সংস্কৃতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এই আতঙ্কই চলতি নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বহিরাগত তত্ত্বে উঁকি মেরেছিল। কিন্তু সম্ভবত হিন্দিভাষী ভোটারদের সংখ্যা ফেলে দেওয়ার মত নয় বলে ও তত্ত্ব নিয়ে বেশি কাটাছেঁড়া করা হল না।

রাজনৈতিক দলগুলো উপর্যুক্ত ঘটনাবলী নিয়ে মাথা না ঘামালেও, বাংলা পক্ষের মত সংগঠন কিন্তু বীর বিক্রমে মাঠে নেমে পড়েছে। “গুটখাখোর” জাতীয় কিছু সগর্ব জাতিবিদ্বেষী শব্দাবলী তাদের হাতিয়ার। যেন বাঙালিরা কেউ গুটখার ধারে কাছে যায় না, অথবা গুটখা খেলেই যে কোন মানুষ আক্রমণাত্মক, বাঙালি বিদ্বেষী, ধর্ষণোদ্যত পুরুষে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয়, এদের ফেসবুক লাইভগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ঠিক যেভাবে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের একগাদা সন্তান, তাই তাদের রাজনৈতিক দলগুলো তোষণ করে বলে বক্তৃতা দিয়ে থাকে; বাংলাপক্ষের নেতৃবৃন্দও সুযোগ পেলেই হিন্দিভাষীদের সন্তানের সংখ্যা বাঙালিদের চেয়ে বেশি, তাই তাদের রাজনৈতিক দলগুলো তোষণ করে — এসব বলে থাকেন। বেশিক্ষণ সেসব বক্তৃতা শুনলে মনে হয় ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ নামক হিন্দি ছবির বাংলায় ডাব করা প্রিন্ট দেখছি, যার নাম ‘বাঙালি বিপন্ন’।

বাঙালি যে বিপন্ন তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ নেই। যা রটে তার কিছু তো বটে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থা বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেবল বাংলায় হচ্ছে তা নয়, সারা ভারতে চলছে। কিন্তু কোন পক্ষের উগ্রতাকে শিরোধার্য না করে এই বিপন্নতার কারণ খুঁজতে গেলে বাঙালির পক্ষে একগাদা অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠে আসে।

পৃথিবীতে এমন কোন ভাষা সংস্কৃতি নেই যাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব অন্য ভাষার লোকেরা নিয়েছে। কেনই বা নেবে? এমন ভাষাও পাওয়া যাবে না, যা বিপুল সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করেন অথচ অনেকেই ব্যবহার যে করেন তা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বোধ করেন। এই অনন্য গুণটি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি গত দুই-তিন দশকে আয়ত্ত করেছে। শহর ও মফস্বলের সম্পন্ন বাঙালি এখন ছেলেমেয়েকে কেবল ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে সন্তুষ্ট নয়, দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে রাখে হিন্দি। বাংলা নৈব নৈব চ। দুনিয়া অনেক বদলে গেছে, ভাল করে ইংরেজি জানা না থাকলে চাকরি বাকরি পাওয়া যাবে না — এ যুক্তি অনস্বীকার্য। কিন্তু হিন্দি লিখতে পড়তে শেখা বঙ্গসন্তানদের কী করে কোটিপতি হতে সাহায্য করবে তা বোঝা দুষ্কর। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতে কর্মসংস্থানের অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় খারাপ বৈ ভাল নয়; দিল্লী, মুম্বইতে থেকে কাজকর্ম করতে হলে হিন্দি বলতে পারাই যথেষ্ট। সেটুকু আমাদের সোনার ছেলেমেয়েরা হিন্দি সিনেমার দৌলতে যথেষ্ট ভাল আয়ত্ত করে ফেলে। তবু ২০১৭ সালে যখন তৃণমূল সরকার ঘোষণা করল প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা পড়াতেই হবে, সম্ভ্রান্ত বাঙালি বাবা-মায়েদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। দার্জিলিঙের গোর্খা, নেপালি, ভুটিয়া, লেপচা বা দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসীরা এর প্রতিবাদ করলে কারণ বোঝা যায়। হিন্দি বা ইংরেজির মত বাংলাও তাঁদের মাতৃভাষা নয়। তাঁদের কেন এই ভাষা শিখতেই হবে? কিন্তু কলকাতা ও তার আশপাশের বাঙালির যে উষ্মা প্রকাশ, তা হিন্দিভাষী হয়ে ওঠার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব কি? তা এই যখন ইচ্ছা, তখন আর “ওরা আমাদের টিকতে দেবে না” — এই চিন্তা করা কেন? দোল কথাটা তো এমনিও ভুলেই গেছেন, হোয়াটস্যাপ করেন ‘হ্যাপি হোলি’। তা এবার থেকে না হয় হোলিই খেলবেন।

সম্প্রতি চেন্নাইয়ের এক অনুষ্ঠানে ঘোষিকা হিন্দিতে কথা বলায় ভারত বিখ্যাত এ আর রহমান৫ মুচকি হেসে আপত্তি জানিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেছেন। ভিডিওটা দেখে মনে পড়ল, বছর দুয়েক আগে হংস মধ্যে বক যথা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এক বৈঠকে হাজির হয়েছিলাম। সেখানে তাঁরা আলোচনা করছিলেন হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বাংলাকে কী করে বাঁচানো যায়। সকলেই একমত হলেন যে ওঁদের কিছু করার নেই। রাজনৈতিক কর্মীদের সরকারে এসে বাংলার অর্থনীতির হাল ফেরাতে হবে, তাহলেই সংস্কৃতি বাঁচবে। বাংলায় লিখে পুরস্কারপ্রাপ্ত এক সাহিত্যিক জোর দিয়ে বললেন, প্রয়োজন না থাকলে নিজের সন্তানকে তিনি বাংলা পড়াবেন না। আরেক বিপ্লবী সাহিত্যিকও তাঁকে সমর্থন করলেন। এই কারণেই তামিলনাড়ুর তামিলরা বিপন্ন নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বিপন্ন। মনে রাখা ভাল, রহমান মোটেই তামিলপক্ষের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নন। ভারতের বেশিরভাগ লোক বরং তাঁকে চিনেছে তিনি হিন্দি ছবিতে কাজ করেছেন বলেই। কিন্তু তিনি বোঝেন কোথায় সীমারেখা টানতে হয়। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের ভাষা সংস্কৃতির প্রতি শিল্পী হিসাবে তাঁর যে দায়িত্ব তা তিনি রাজনৈতিক কর্মীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন না।

অনেককাল আগে থেকেই বাঙালি ভদ্রসমাজ ইংরেজি ভাল করে শিখলেই হবে, বাংলা এলেবেলে — এই তত্ত্ব চালু করে বিরাট অংশের বাঙালির থেকে নিজেদের আলাদা করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বড় সাধ ছিল বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা হবে। সে প্রয়াসে বহুকাল আগেই জল ঢালা হয়ে গেছে, কারণ বাঙালি বিদ্বানরা নিজে শিখতে পারলেই যথেষ্ট হল মনে করেন। বিদ্বানের সংখ্যা বাড়িয়ে কী লাভ? এইভাবে বাংলা ক্রমশ কেবল শিল্প, সাহিত্যের ভাষায় পরিণত হয়েছে। এখন উল্টে তারই বিরুদ্ধে অভিযোগ “কোন কাজে লাগে না তো।” যেন যুগ বদলের সাথে সাথে কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পরিবর্তন করা, নতুন পরিভাষা, নতুন শব্দ তৈরি করা অন্য ভাষার লোকেদের কাজ ছিল। সে যা-ই হোক, কথা হচ্ছে কাজে লাগে না বলে সাধারণ চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত যখন নিজের সংস্কৃতিকে বাতিলই করে দিয়েছেন তখন আর ভয় কী? ছেলেমেয়েকে বাংলা বই পড়ানো দূরে থাক, বাংলা টিভি চ্যানেল পর্যন্ত দেখতে বারণ করেছেন। তা কেন্দ্রীয় সরকার আর আপনার হিন্দিভাষী প্রতিবেশীরা যদি বাংলা বলাটুকুও বন্ধ করে দেন, সে তো ভালই, তাই না?
আসলে এত দিনে মাথায় ঢুকেছে যে শক্তিশালী জাতিবিদ্বেষী যখন মারতে আসে তখন স্রেফ নামটা দেখেই মারে। “জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না” বললে তখন রেহাই পাওয়া যাবে না। তাই আপ্রাণ জাতি পরিচয় তুলে ধরে পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা। তবে বাঙালির সে চেষ্টাতেও ফাঁকিবাজির ছাপ স্পষ্ট। আক্রমণের লক্ষ্য বড়বাজারের বিহারী ঠেলাওয়ালা থেকে কোটিপতি ভুজিয়াওয়ালা পর্যন্ত সকলেই। অথচ নিজের ভুলে যাওয়া ভাষা সংস্কৃতিকে নতুন করে জানার চেষ্টা নেই। ক্রমশ শক্তি বাড়িয়ে চলা হিন্দুরাষ্ট্র আগামী দিনে হয়ত আইন করে সমস্ত সরকারি কাজে হিন্দি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাগুলোকে ব্রাত্য করে দেবে। তখন নির্ঘাত বাঙালির প্রতিরোধ হবে বিহারী গোয়ালার থেকে দুধ না কেনা, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা সবজিওয়ালাকে বয়কট করা ইত্যাদি। আমরা পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোকেরা জানি, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে “কম্পিটিশনে” পিছিয়ে পড়তে হয়। বরাক উপত্যকা বা বাংলাদেশের বাঙালিদের মত বোকা হাঁদা নই যে ভাষার জন্যে প্রাণ দিতে যাব।

বাংলা ছবির টাইটেল কার্ড, যা আজকাল বাংলা হরফের চেয়ে রোমানে বেশি লেখা হয়, অনতিবিলম্বেই দেবনাগরীতেও লেখা হবে। কারণ বাঙালি শিল্পীর মত সুবোধ প্রজাতি ভূভারতে নেই। ওঁরা ছটপুজোয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছুটি দেয় কেন সে প্রশ্ন করেননি, এ রাজ্যে হঠাৎ হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের কী প্রয়োজন তাও জিজ্ঞেস করেননি। রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রদের পাশে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কোন সংস্কৃতির লক্ষণ, সে নিয়েও তাঁরা ভাবেননি। সুতরাং আশা করা যায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে কেবল ভক্তিমূলক আর পুরাণাশ্রয়ী হিন্দি ছবি দেখানো হলেও তাঁরা আপত্তি করবেন না। এমনিতেও আজকের চিত্রতারকাদের অনেকেই বাংলা বলেন শেক্সপিয়রের মত।

পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং বিপ্লবী সাহিত্যিকরাও নিশ্চয়ই হিন্দিতে লেখা শিখে নেবেন। বাংলার আর মার্কেট কই? হিন্দি লেখার মার্কেট গোটা ভারত।

তথ্যসূত্র
১। https://www.telegraphindia.com/west-bengal/calcutta/indian-association-for-the-cultivation-of-sciences-climbdown-on-hindi-after-protest/cid/1810549
২। https://thewire.in/education/visva-bharati-vice-chancellor-in-fresh-row-over-leaked-audio-clip
৩। https://www.facebook.com/100000786783881/posts/3841532379216284/?d=n
৪। https://www.facebook.com/BanglaPokkhoHooghly/videos/813827019481916
৫। https://www.instagram.com/p/CM3_bzEFc6R/?utm_source=ig_web_button_share_sheet

https://guruchandali.com/ এ প্রকাশিত

‘পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেধার বহির্গমন বন্ধ করতে হবে’

দেখলে অবাক হবেন না, যদি মেদিনীপুরে কোন মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয় “তৃণমূলের শুভেন্দু অধিকারীর হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিপুল ভোটে জয়ী করুন”।

সিপিএম প্রার্থীদের মধ্যে এবার এক ঝাঁক নতুন মুখ। তাদের অন্যতম পৃথা তা। বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্রের প্রার্থী পৃথা সিপিএমের যুব ফ্রন্টের কর্মী হিসাবে গত কয়েক বছর দারুণ সক্রিয় থেকেছেন। তাঁর আরেকটা পরিচয়, তিনি প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক প্রদীপ তা-র কন্যা। পৃথার বাবা ২০১২ সালে বর্ধমান শহরে সিপিএমের একটি মিছিল চলাকালীন খুন হন। সেই সঙ্কট, যা যুগপৎ ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক, তা পেরিয়ে এসে পৃথা আজ বিধানসভায় প্রার্থী। এই যাত্রা এবং জরুরী রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো নিয়ে তাঁর সঙ্গে nagorik.net-এর পক্ষে কথা বললেন প্রতীক

প্রতীক: পৃথা, আপনি যে প্রজন্মের মানুষ তার দু-তিন প্রজন্ম আগে থেকেই বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েকে শেখাচ্ছেন “রাজনীতি খুব খারাপ জিনিস। রাজনীতির ধারে কাছে যাবে না।” এরকম বলার অনেক কারণের মধ্যে একটা অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার দীর্ঘ ইতিহাস। সেই হিংসা আপনাকে সরাসরি স্পর্শ করেছে। তারপরেও আপনি রাজনীতিতে এসেছেন। যারা রাজনীতিতে আসতে চায় তাদের কী বার্তা দিতে চাইবেন?

পৃথা: হিংসার বাতাবরণের কারণে বাবা-মায়েরা ভয় পান ঠিকই। কিন্তু যে কোন কাজেরই কিছু ইতিবাচক, কিছু নেতিবাচক দিক থাকে। রাজনীতিরও তাই। যারা রাজনীতি করতে আসবে, তাদের এগুলো মাথায় রেখেই আসতে হবে। আর সত্যি সত্যি রাজনীতিতে আসতে চাইলে বারণ করে কাউকে বেশিদিন আটকে রাখা যায় না।

প্রতীক: আপনার বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বেশ জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে। অল্পবয়সী ভোটারদের মধ্যে বিজেপি বেশ জনপ্রিয়। যারা সক্রিয়ভাবে বিজেপি করে না, তাদের কথাবার্তা বা সোশাল মিডিয়া পোস্টেও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা, প্রাচীনপন্থী মতামতের প্রাবল্য। এমন কেন হচ্ছে বলে মনে হয়? চিরকাল তো অল্পবয়সীরা বামপন্থীদের দিকেই আকৃষ্ট হত বেশি। বামপন্থীরা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না বলেই কি এরকম হচ্ছে?

পৃথা: এটা একেবারেই ভুল ধারণা। আমি গ্রামাঞ্চলে ঘোরা এবং কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অল্পবয়সীদের দক্ষিণপন্থার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ব্যাপারটা কলকাতাকেন্দ্রিক। সেই জন্যে চোখে পড়ে বেশি এবং এটাই প্রচার করা হয়। বাস্তব চিত্র একদমই অতটা খারাপ নয়। বরং বিরাট সংখ্যক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে মার খাওয়া দেখে, বিপদের সম্ভাবনা মেনে নিয়ে বাম রাজনীতি করতে আসছে। এটা কেমন জানেন তো? এই যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ছেলেমেয়েরা বাংলা বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে? এটাও কিন্তু শহরকেন্দ্রিক ধারণা। আমরা তো দেখি প্রচুর ছেলেমেয়ে বাংলা বই পড়ে। এগুলো আসলে তৈরি করা মিথ।

প্রতীক: আচ্ছা, বর্ধমানকে তো একসময় বাম দুর্গ বলা হত। সেখান থেকে পিছু হটতে হটতে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে ঐ জেলায় বামফ্রন্ট ২৫-এ পাঁচ আর লোকসভা নির্বাচনে তো শূন্যই। এটা কেন হল?

পৃথা: সব জায়গাতেই আমাদের শক্তি যে কমেছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্ধমানেও তাই হয়েছে। আবার সংগঠন নিজেদের মত করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, নতুন ক্যাডার বাহিনী তৈরি করার চেষ্টা করছে। আগেকার নানা কার্যকলাপে মানুষ অসন্তুষ্ট হয়েছেন, নানা কারণে মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মেছিল। সেগুলো স্বীকার করে নিয়ে সেইসব অভিযোগ মেটানো, হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।

প্রতীক: বিধায়ক হলে বর্ধমানের জন্য আলাদা করে কোন পরিকল্পনা আছে?

পৃথা: অবশ্যই, একগুচ্ছ পরিকল্পনা আছে। বর্ধমানের পৌরসভার সমস্যার কথা তো আগেই বললাম। তাছাড়া বড় নীলপুর মোড়ে একটা গেট তৈরি হল, তারপর সেটাকে ভেঙে দেওয়া হল, তাতে একগাদা টাকা তছরুপ হল। এই দুর্নীতির প্রতিকার করতে হবে। সবথেকে বড় কথা এটা নিরুপম সেনের কেন্দ্র। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বেকারদের জন্য স্বপ্ন বুনেছিলেন। আপনি যদি গড়িয়া থেকে করুণাময়ীর দিকে যান, দেখবেন রাস্তার দু পাশে ইনফোসিসের জন্য বরাদ্দ করা জমিতে একের পর এক বিলাসবহুল হোটেল উঠেছে। বড়লোক বাবুদের বাড়ির ছেলেরা সেখানে গিয়ে ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দেন, আর আমার আপনার বাড়ির ছেলেকে যেতে হয় বেঙ্গালুরুতে কাজ করতে। লকডাউন জুড়ে আমাদের কাছে অজস্র ফোন আসত “দিদি, মায়ের প্রেশার নেমে গেছে। একটু ওষুধটা কিনে বাড়িতে দিয়ে আসবে?” বা “বাবা বাজারে বেরোতে পারছে না, একটা ব্যবস্থা করে দেবে?” মানে প্রচুর মানুষ আছেন, যাঁদের ছেলেমেয়েরা কাজের জন্যে রাজ্যের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে থেকে মেধার এই বহির্গমন বন্ধ করতে হবে। অন্তত নিরুপম সেনের কেন্দ্রে তো বন্ধ করতেই হবে। নিরুপম সেন যেদিন বর্ধমানে হেরেছিলেন, তিনি হারেননি। আসলে পশ্চিমবঙ্গের বেকাররা হেরে গিয়েছিল। তাঁর স্বপ্নকে সত্যি করার লক্ষ্যে যত দূর করা সম্ভব আমি করব।

প্রতীক: আপনার বাবা খুন হওয়ার পরে শুনেছি খুবই কঠিন সময় কেটেছে আপনার পরিবারের। এখন আপনি ওখান থেকেই ভোটে দাঁড়িয়েছেন। কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

পৃথা: বাবা খুন হওয়ার পর আমার মা মাটি কামড়ে ওখানে পড়ে থেকেছেন, একদিনও বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। দুর্বিষহ অবস্থায় মা প্রায় একা লড়াই করেছেন, আমি উচ্চশিক্ষার কারণে কলকাতায় চলে যাই। আমাদের এলাকা ছাড়া করার সবরকম চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু মা-কে নড়াতে পারেনি কেউ। বর্ধমান শহর আমার নিজের শহর। এখানে হাজারো সমস্যা রয়েছে। বহু বছর ধরে পৌর বোর্ড নেই, নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল। তাছাড়া যে সমস্যাগুলো সব জায়গায় আছে, যেমন বেকারত্ব, কৃষক আত্মহত্যার মতই বেকারদের আত্মহত্যাও আজকের জ্বলন্ত সমস্যা। প্রচণ্ড দুর্নীতি সরকারের সব ক্ষেত্রে, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও। ফসলের দাম, নারীর নিরাপত্তা — এরকম যে ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে আমরা লড়ছি সেগুলোও আর সব জায়গার মতই বর্ধমানেরও ইস্যু। সেগুলো নিয়ে মানুষের কাছে যখন যাচ্ছি, খুব ভাল সাড়া পাচ্ছি। কেবল ভোটের অঙ্কের কথা নয়। লাল ঝান্ডা কাঁধে ভোট আমার কাছে মাইলস্টোন। শেখার সুযোগ, বাড়ি বাড়ি যাওয়ার একটা সুযোগ পার্টি আমাকে এনে দিয়েছে। সেই সুযোগটা সৎভাবে কাজে লাগাতে চাই। কিন্তু ভোট হয়ে যাওয়ার পরেও আমাকে লম্বা পথ হাঁটতে হবে। আমি নির্বাচনকে শেখার ধাপ বলে মনে করি। তাই খুব ভাল লাগছে যে বহু মানুষ এসে মন খুলে কথা বলছেন, কোন জড়তা নেই।

প্রতীক: একটা অভিযোগ বা প্রচার আছে যে লোকসভা নির্বাচনে বামেরা বিজেপিকে ভোট হস্তান্তর করেছিল। যদি প্রচারটা ভুলও হয়, এ কথা তো সত্যি যে বামেদের ভোট কমেছিল এবং বিজেপির ভোট বেড়েছিল। এবার কি সেই প্রবণতা বদলাবে?

পৃথা: এটা সত্যি যে কিছু মানুষ একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, তৃণমূলের যে চোর ডাকাত বদমাইশদের জন্য নাভিশ্বাস উঠছে সকলের, বিজেপি এসে তাদের শায়েস্তা করবে। আলাদা করা বামেদের দেগে দেওয়া উচিৎ নয়, অনেক মানুষই এমনটা মনে করেছিল। কিন্তু প্রথমত বিজেপির মনুবাদী এজেন্ডা, তাকে কায়দা করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া, দেশের সম্পদ এক এক করে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া, কৃষকদের উপর অকথ্য অত্যাচার… এতগুলো মানুষ দিল্লীর রাস্তায় বসে বসে মরে গেল অথচ প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে পাঁচ মিনিটের জন্য গিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না… এগুলো মানুষ দেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তারা খেয়োখেয়ি, দলাদলির যে আবহ তৈরি করেছে সেটা মানুষের মনে প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি এখনো ঠিক করে প্রার্থী তালিকাই প্রকাশ উঠতে পারল না, কারণ বিজেপি মাছের ভেড়ির মত হয়ে গেছে। বাজারে মাংস কাটার পর যেমন উদ্বৃত্ত নাড়ি ভুঁড়ি মাছের খাবার হিসাবে ভেড়ির লোকেরা নিয়ে যায়, তেমনি যার যা অপচয়, সব বিজেপি নেবে বলে বসে আছে। দেখলে অবাক হবেন না, যদি মেদিনীপুরে কোন মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয় “তৃণমূলের শুভেন্দু অধিকারীর হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিপুল ভোটে জয়ী করুন”। এই পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সোনালি, রুপালি সবাই বিজেপিতে যাচ্ছেন। অতএব বিজেপি আর তৃণমূল যে একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ তা বুঝতে মানুষের আর অসুবিধা হচ্ছে না। এর পাশে আমরা আমাদের মতাদর্শ, কাজকর্ম নিয়ে দাঁড়াচ্ছি। সব মিলিয়ে আমাদের এবারের ফল নিশ্চয়ই ভাল হবে।

প্রতীক: বিজেপি সরকারের কথা যখন তুললেন তখন বলি, আপনাদের ইশতেহারে বলা হয়েছে সংযুক্ত মোর্চার সরকার হলে এ রাজ্যে এন আর সি, সি এ এ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু একটা সমালোচনা হচ্ছে যে এই ইস্যু নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে যতটা সোচ্চার হওয়া উচিৎ আপনারা তা হচ্ছেন না। কী বলবেন?

পৃথা: এটা সঠিক সমালোচনা নয়। আমি নিজেই তো প্রচারে এ নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছি। অন্য প্রার্থীরাও বলছেন। এন আর সি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত যে অঞ্চলগুলোতে উদ্বাস্তুরা এসে বসত করেছেন সেখানে তো কথাই নেই। যাদবপুরে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি মানুষের মধ্যে কি সাংঘাতিক আতঙ্ক। যাঁরা সকালবেলায় ক্যানিং, গোসাবা ইত্যাদি এলাকা থেকে পরিচারিকার কাজ করতে আসেন বা দিনমজুরি করতে আসেন, তাঁরা ভয়ের চোটে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ‘এই কার্ড নেই, সেই কার্ড নেই’ আতঙ্কে। সেই কারণে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এন আর সি – সি এ এ নিয়ে আমরা প্রচার করেছি। এখনো ভোটের প্রচারে সেই প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি আমরা এ-ও দেখলাম যে মোদীর এত বিরোধী দিদি, তাঁর দলের সাংসদ, যাদবপুরের মত উদ্বাস্তু আন্দোলনের ইতিহাস থাকা এলাকার সাংসদ নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভোট দিতে উপস্থিত থাকলেন না সংসদে।

প্রতীক: বিশেষ করে আপনি মহিলা বলে একটা প্রশ্ন অবশ্যই করা দরকার। বামেদের সাথে আই এস এফ-এর জোট অনেকের পছন্দ হয়নি। আপনাদের অনেক সমর্থকেরও ব্যাপারটা ভাল লাগেনি, কারণ অনেকের মতে আই এস এফ সাম্প্রদায়িক দল। আরেকটা বড় কারণ আব্বাস সিদ্দিকির বেশ কিছু নারীবিদ্বেষী মন্তব্য, যার ভিডিও সুলভ। বিশেষত নুসরত জাহানের পেশা এবং অন্য ধর্মের লোককে বিয়ে করা নিয়ে আব্বাস যা বলেছেন। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?

পৃথা: দেখুন, যে দলগুলো মিলে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করেছে তারা যদি সব ব্যাপারে একমত হত, তাহলে তো একটাই দল হত। অনেক বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য তো আছেই। এই মুহূর্তে ধর্ম দিয়ে মানুষকে ভাগ করার যে খেলা এ দেশে বিজেপি – আর এস এস চালু করেছে, তার বিরুদ্ধে যে আছে তাকেই আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। সে কংগ্রেসই হোক আর আই এস এফ-ই হোক। আব্বাসের ঐ মন্তব্যগুলো একদমই অনুচিত, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে উনি ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে উনি দলিতদের অধিকারের কথা বলেছেন; জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের অধিকারের সপক্ষে বলেছেন। আই এস এফ যে সংগঠনগুলোকে নিয়ে তৈরি হয়েছে, তাদের দিকেও যদি তাকান, দেখবেন তারাও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের অধিকারের কথা বলছে। আমি যে পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি তার মধ্যে থেকে বামপন্থী রাজনীতিতে আসা স্বাভাবিক, কিন্তু যে একেবারে অন্য আবহে অন্যরকম ভাবনা চিন্তায় বেড়ে উঠেছে, তাকে আমি আমার রাজনীতি দিয়ে প্রভাবিত করতে পারছি। সে-ও আমার মতাদর্শের সবটা না মানলেও দু-চারটে কথা বলছে। আমার মনে হয় এটা বড় সাফল্য। আগের সব কথাবার্তা সত্ত্বেও আব্বাস এখন যে রাজনীতির কথা বলছেন, ব্রিগেডে যার কিছুটা দেখা গেছে, তা আশাব্যঞ্জক। সাধুবাদ না দিয়ে পারা যায় না। ভারতের সংবিধান রক্ষা করার লড়াইয়ে আমাদের সকলকে প্রয়োজন, তাই সবাইকে নিয়েই লড়ছি।

ছবি ঋণ : ফেসবুক । পৃথার অঙ্কনচিত্রের শিল্পী তৌসিফ হক। শিল্পীর অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি ঋণ cpimwb.org.in

নেমে আসুন ভোটারের সমতলে

ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না।

কিছুদিন পরে পরেই, বিশেষ করে কোন নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে, বিজেপি-বিরোধী মানুষজন সমাজ মাধ্যমে, একান্ত আলাপচারিতায় এবং লিখিত রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বিস্ময় প্রকাশ করেন “এত কিছুর পরেও লোকে ওদের সমর্থন করছে!” বা “এত কিছুর পরেও বিজেপি জিতে গেল!” এত কিছু, অর্থাৎ অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া; সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর পরিকল্পিত, রাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট হিংসা; আইনশৃঙ্খলার অবনতি; গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষের চরম আর্থিক দুর্দশার পাশাপাশি অতি ধনীদের আরো ফুলে ফেঁপে ওঠা; দুর্বার গতিতে একের পরে এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি হওয়া; দুর্নীতির বৈধতা পেয়ে যাওয়া; সাংবিধানিক অধিকারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। ২০২০-তে এর সাথে যোগ হল কোরোনাভাইরাসকে প্রথমে সরকারের পাত্তা না দেওয়া, পরে আচমকা লকডাউন, তার ফলে গরীব দিন আনি দিন খাই মানুষের অবর্ণনীয় জীবনযাপন ও মৃত্যু। তার সাথে যোগ হল চিকিৎসার অব্যবস্থা সম্বন্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থালা বাজানো, মোমবাতি জ্বালানোর মত গিমিক। কম পরীক্ষা করে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলেও অনেকের অভিযোগ।

এত কিছুর পরেও বিজেপি নির্বাচনে জেতে। অন্তত উড়ে যায় না। কেন হয় এরকম? দেখা যায় বিজেপির বিরুদ্ধে যাঁরা — রাজনৈতিক দল, চিন্তাবিদ, সাধারণ মানুষ — তাঁরা সকলেই এর কতকগুলো সাধারণ কারণ খুঁজে পান। সেগুলো মোটামুটি এরকম — ১) সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ, ২) বিজেপির অসম আর্থিক প্রতিপত্তি, ৩) বিজেপি আই টি সেলের প্রোপাগান্ডার তীব্রতা এবং ৪) নির্বাচন কমিশনের গান্ধারীবৃত্তি। কেউ কেউ মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের বৃহদংশের নির্লজ্জ চাটুকারিতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করাকেও সঙ্গে যোগ করেন।

সব সত্যি। কিন্তু কবির ভাষায় বললে “সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।”

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এন ডি এ সরকারের কর্মতৎপরতার যে তালিকা সকলের সামনে রয়েছে, তাতে গত কয়েক মাসে যোগ হয়েছে নতুন কৃষি আইন। এই আইন পাশ করা হয়েছে অভূতপূর্ব অগণতান্ত্রিক উপায়ে এবং এর বলে ভারতীয় কৃষকদের একেবারে কর্পোরেট গোলামে পরিণত করা যাবে। গরীব, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের ভাত ডাল আলুসেদ্ধটুকুর নিশ্চয়তাও উধাও হবে। এর পরেও কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তায় ধস নামতে দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকের আশঙ্কা। ফলে যাঁরা দক্ষিণপন্থার ঘোষিত বিরোধী — রাজনৈতিক দলের সদস্য বা পার্টি আনুগত্যহীন ব্যক্তি — যা-ই হোন না কেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিস্ময় ক্রমবর্ধমান। এমনকি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরাও বলে থাকেন “এত কিছুর পরেও…!” ফলত হতাশা। আর সেই হতাশার কারণে নির্বাচনের ফল বেরোবার পর বিজেপি-বিরোধীরা কিছু ভয়াবহ দক্ষিণপন্থী আচরণ শুরু করেন। যেমন অনেকে বলতে শুরু করেন “মুসলমানগুলো কেন অমুক পার্টিকে ভোট না দিয়ে তমুক পার্টিকে ভোট দিল?” কেউ আবার সমস্ত দোষ ইভিএমের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন (যদিও মনে করার কারণ নেই যে ইভিএম সম্পূর্ণ নির্দোষ)। এই আচরণ সাধারণ সমর্থক থেকে উচ্চস্তরের পার্টি নেতা পর্যন্ত সকলকেই করতে দেখা যায়। এই বিশ্লেষণে “সবাই বিজেপি হয়ে গেছে” — এই বিশ্বাস ক্রমশ ঘাড়ে চেপে বসে, বিজেপির লাভ হয়। কিন্তু এই বিশ্লেষণ একমাত্রিক। বিরোধী বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা ভেবে দেখবেন, নির্বাচনে (বিশেষ করে বিধানসভায়) যে মাইক্রো ইস্যুগুলো কাজ করে, সেগুলোকে এই বিশ্লেষণে অগ্রাহ্য করা হয়। সে কারণেই বিজেপিকে আটকানোর উদ্দেশ্যে বলা হয় “আর যাকে ইচ্ছা ভোট দিন, বিজেপিকে দেবেন না।”

একথা যাঁরা বলেন, বা বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের রামধনু জোটের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা সকলেই ন্যূনতম লেখাপড়া জানেন। শ্রেণীর দিক থেকে মধ্যবিত্ত বা তদূর্দ্ধ। প্রায় সকলেরই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে; নিদেন পক্ষে রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান এবং স্পষ্ট মতামত আছে। এঁরা জানেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতবাদ ও কার্যকলাপ কতটা ভয়ঙ্কর। ফলে তাঁদের কাছে সব নির্বাচনই হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে ভারতীয়ত্বের লড়াই। বিজেপি যেমন বাইনারি তৈরি করেছে সারা দেশে — দেশদ্রোহী আর দেশপ্রেমিক — অনেকটা একই আদলের আরেকটা বাইনারি এঁদের মনেও তৈরি হয়ে রয়েছে। ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি যে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না, দেওয়া সম্ভব নয় — একথা বুঝতে সারা দেশের বিজেপি-বিরোধীদের কেবলই ভুল হয়ে যাচ্ছে। এ ভুল না করলে কত দূর লড়া যায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিহারের নির্বাচনে।

কোন সন্দেহ নেই, যদি দেশের সর্বত্র সবকটা নির্বাচন ভারত ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে কি থাকবে না, গণতান্ত্রিক থাকবে নাকি একদলীয় একনায়কতন্ত্র হয়ে যাবে — কেবল এই ইস্যুতে লড়া যেত, তবে চমৎকার হত। দুঃখের বিষয়, তা সম্ভব নয়। তেমন দেশ তৈরি করার জন্য আমরা সঙ্ঘবিরোধীরা ৬৭ বছর (১৯৪৭-২০১৪) সময় পেয়েছিলাম। পারিনি। এখন রাতারাতি ভারতেরে সেই স্বর্গে জাগরিত করতে চেয়ে অ্যালার্ম ঘড়ি বাজিয়ে দিলেই রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে না। আপনি জানেন হিটলার কে, নাজি কারা, ফ্যাসিবাদ কী ক্ষতি করে। আপনার বাড়ির কাজের মেয়ে জানে না। এখন যদি ন্যুরেমবার্গ ল-এর সাথে সাদৃশ্য আছে বলে মোদী সরকারের পাশ করা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করতে বলেন, সাবধান করেন “আর যাকে ইচ্ছে ভোট দাও, বিজেপিকে দিও না”, তার বয়ে গেছে আপনার কথা শুনতে। কেবল গ্রামের গরীব মানুষ, শহরের বস্তিবাসী বা কাজের মেয়ের কথাই বা কেন? নিজেদের লেখাপড়া জানা আত্মীয়স্বজনদেরই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, ফ্যাসিবাদ কী কজন জানে? যে চেতনা তৈরিই হয়নি, সে চেতনার কাছে আবেদন করে কোন সাড়া পাওয়ার আশা করা কি উচিৎ?

সত্যি কথা বলতে, পৃথিবীর কোথাও কোন নির্বাচনই সম্পূর্ণত মতাদর্শের লড়াই হয় না। হওয়া উচিৎ কিনা তা-ও ভেবে দেখা দরকার। ধরা যাক, একটা দেশের সরকার রাস্তাঘাট সারায়নি পাঁচ বছর ধরে, রোজ দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ তারা দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি মাসে সংবর্ধনা দেয়। এই দলের কি ভোট পাওয়া উচিৎ? গণতন্ত্রে নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকারই শিরোধার্য, রাজনৈতিক দলের ভোট পাওয়ার অধিকার নয়। ভোটার ঠিক করবেন তিনি কোন কোন ইস্যুর ভিত্তিতে ভোট দেবেন। রাজনৈতিক শক্তিগুলো, সে কোন দল হোক বা ব্যক্তি, ভোটারের মত পাওয়ার জন্য অন্যদের চেয়ে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। “আমরা বিজেপি নই, অতএব আপনার ভোট পাওয়া আমাদের অধিকার” — কোন দল এমন বলতে পারে না। বললে সেটাই অগণতান্ত্রিক। যদি কেউ বলে “অমুক দল বিজেপি নয়, অতএব ওকে ভোট দেওয়া আপনার কর্তব্য”, তাহলে তা-ও অগণতান্ত্রিক। কারণ রাজনৈতিক দলের কর্তব্য ভোটারের চোখে নিজেকে অন্যদের চেয়ে উন্নত (অন্তত স্বতন্ত্র) হিসাবে প্রমাণ করা। তা করতে না পারলে, বিজেপির চেয়ে ভাল কোন বিকল্প দিতে না পারলে, ভোটার কেন ভোট দিতে যাবেন?

দেশের অধিকাংশ নির্বাচনেই কিন্তু বিজেপি-বিরোধীরা বিকল্পহীন হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন। ভোটারের সামনে বিজেপির অন্যায়গুলোর তালিকা প্রস্তুত করছেন কেবল। নিজেরা তার বদলে কী কী সদর্থক কাজ করবেন, তা বলছেন না। অনেক ক্ষেত্রে আবার বিজেপির রাজনীতিই অনুসরণ করে নির্বাচনে লড়ছেন। মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে যেমন কংগ্রেস গোশালা বানিয়ে দেওয়া, রাম পথ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতেছিল। সরকারটা স্বভাবতই বেশিদিন টেকেনি। আমরা যারা ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তারা কংগ্রেসের সেই জয়ে উল্লসিত (অন্তত আশ্বস্ত) হয়েছিলাম। গণ্ডগোলটা ওখানেই। বিজেপির নীতি কংগ্রেস নিলে যদি আমাদের আপত্তি না থাকে, কার্টুনিস্টকে তামিলনাড়ু সরকার গ্রেপ্তার করলে যদি আমরা হট্টগোল না করি, আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের উপর তৃণমূল কংগ্রেস সরকার জলকামান চালালেও যদি আমরা চুপ করে থাকি এবং বলি ওরা বিজেপি নয়, তাই ভোট ওদেরই প্রাপ্য, তাহলে বিজেপির হাতই শক্ত হয়। কথাটা আরো বেশি করে সত্যি পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে, যেখানে বিজেপি কখনো ক্ষমতায় আসেনি। জলকামানে ভিজে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলো বা তাদের পরিবার ফ্যাসিবাদ দ্যাখেনি, জলকামান দেখেছে। ত্রিপুরা রাজ্যের চাকরি চলে যাওয়ায় আত্মঘাতী শিক্ষক উত্তম ত্রিপুরার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তাদের বিজেপিকে ভোট দেওয়া থেকে নিরস্ত করা কি সম্ভব তখন আর?

এ রাজ্যে এখন পর্যন্ত লড়াইটা বিজেপির ইউটোপিয়া বনাম বিরোধীদের ইউটোপিয়া। বিজেপি সোনার বাংলার কথা বলছে। সে বাংলায় কর্মসংস্থান কী করে হবে বলছে না। আলটপকা ৭৫ লক্ষ চাকরির কথা বলেই ঢোঁক গিলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের সমস্যা জানতে এবং মেটাতে সরকারকে দুয়ারে দুয়ারে নিয়ে গেছে, অথচ কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে মুখে কুলুপ। বহুকাল ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে নিয়োগ নিয়ে চলতে থাকা অচলাবস্থার কোন স্থায়ী সমাধানের কথা সরকার বলছে না। কেবল এক প্রস্থ নিয়োগের ঘোষণা হয়েছে। তৃণমূল বরং বিজেপির ইউটোপিয়ার বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে এমন এক বাংলার ইউটোপিয়া, যার ইতিহাসে কেবল রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, নজরুল, লালন, ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদনরা আছেন। একে ইউটোপিয়া বলছি, কারণ বাংলায় এঁদের পাশাপাশি তারাও ছিল যারা রামমোহনের বিরোধিতা করেছিল, বিদ্যাসাগরকে খুনের চেষ্টা করেছিল, নজরুল সম্বন্ধে বলত “ফার্সি শব্দে কবিতা লেখে! সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।” ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল বাঙালিরাই। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির কথা তো সকলেই জানে। এই ইউটোপিয়ার লড়াইয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করা শক্ত। এমনিতেও এই ইউটোপিয়াগুলো অধিকাংশ মানুষকে ছুঁতে পারছে না।

তৃতীয় পক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট এসবের বাইরে গিয়ে বলবেন কি, কী হবে রাজ্যের ধুঁকতে থাকা স্কুলশিক্ষার? স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা কি আবার স্বমহিমায় ফেরত আসবে তাঁরা ক্ষমতায় এলে? রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের পাওনাগন্ডারই বা কী হবে? সারা দেশের কৃষকদের সাথে এদেশের কৃষকরাও তো স্বখাতসলিলে ডুবছেন। তাঁদের জন্যই বা কী পরিকল্পনা? শিল্পায়ন নিয়ে কী চিন্তা ভাবনা তাঁদের? ওটা না হলে গরীব মানুষের কর্মসংস্থানের কী হবে? কেন্দ্র যেভাবে রাজ্যের প্রায় সব ক্ষমতাই কেড়ে নিচ্ছে, সরকারে এলে কিভাবে লড়বেন তার বিরুদ্ধে?

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সর্বত্রই বিজেপি বিরোধীদের বিকল্প কর্মসূচী হাজির করতে হবে, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সরকারের অন্যায় তুলে ধরা, সমালোচনা করা বিরোধীদের একটা কাজ। একমাত্র কাজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ নিরাশ হয়ে পড়তে পারেন। বিরোধী রাজনীতি কিন্তু নৈরাশ্যবাদের জ্বালানিতে চলে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। ভোটারের চারপাশের বাস্তব পরিস্থিতি, তার কাছে জরুরী ইস্যুগুলো কী, সেসব না ভেবে যদি লাল, সবুজ, ধূসর সব রং মিলে গিয়ে এমন একটা ইস্যুতে লড়াই করে — যা অধিকাংশ ভোটারের কাছে কোন ইস্যুই নয়, তাহলে দক্ষিণপন্থা জিতেই চলবে। আমি ইউটোপিয়ায় প্রাণপণে যা-ই চাই না কেন।