আমার সন্ততি

ভেবে দেখলাম যে অক্ষয় ধন আমার সন্তানকে দিয়ে যেতে পারি তা হল সমাজ, সংসারের সঙ্গে, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোধ

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

— শঙ্খ ঘোষ (বাবরের প্রার্থনা)

যেদিন বাবা হয়েছি সেদিন থেকে ভেবে চলেছি, মানুষ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় সন্তানকে যা যা দিয়ে যেতে পারে তার মধ্যে কোনটা সবচেয়ে মূল্যবান?
অনেকে টাকাপয়সা, ধনসম্পদ দিয়ে যান। টাকার দাম মুদ্রাস্ফীতির কারণে দিন দিন কমে, সম্পত্তির মূল্যও নানা কারণে বাড়ে কমে। কথায় বলে কুবেরের ধনও ফুরিয়ে যায়। ফলে সন্তানকে যত ধনসম্পত্তিই দিয়ে যান না কেন, তার মূল্য অবিকৃত থাকবে না।
সফল, কৃতি মানুষেরা তাঁদের সন্তানদের খ্যাতি দিয়ে যান। কিন্তু সেই খ্যাতি বজায় রাখতে হলে সন্তানকেও বিখ্যাত বাবা কি মায়ের মত প্রতিভাবান এবং সফল হতে হয়, যা প্রায়শই হয় না। উপরন্তু বাবা-মায়ের খ্যাতির অপব্যবহার করে সন্তান তাঁদের দুর্নামের কারণ হচ্ছে — এমন দৃষ্টান্তই চোখে পড়ে বেশি। উপেন্দ্রকিশোরের পরে সুকুমার, সুকুমারের পর সত্যজিৎ নেহাতই ব্যতিক্রম। সে জন্যেই মনে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্রের পরে নারায়ণচন্দ্রই বরং বেশি দেখা যায়।
আমরা সাধারণ মানুষ। এ যুগে সন্তানের ভোগ করার মত যথেষ্ট সম্পত্তি রেখে যাওয়ার সুযোগ আমাদের অনেকেরই হবে না। মৃত্যুর পরেও সন্তান “অমুকের ছেলে” বা “তমুকের মেয়ে” হিসাবে সমাজে অতিরিক্ত সম্মান, সুযোগসুবিধা বা খ্যাতি ভোগ করবে তেমন সম্ভাবনাও নেই। তবে কি এমন কিছুই নেই যা আমাদের মৃত্যুর পরেও সন্তানদের সম্পদ না হোক, অন্তত ছাতা হিসাবে কাজ করতে পারে? আমার সন্তানের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সীমা তবে আমার শরীর? সেই শরীর অবলুপ্ত হওয়ার পর আমার সাথে সম্পর্কের কোন মূল্যবান অর্জন তার কাছে থাকবে না? তাহলে কেন দেশ কাল নির্বিশেষে বাবা-মায়েরা নিজের জীবনের চেয়েও সন্তানের মঙ্গলকে ঊর্ধ্বে স্থান দেন? আমাদের অষ্টাদশ শতকের কবির কেন মনে হল ঈশ্বরীর দেখা পেলে বাংলার নিরক্ষর পাটনী প্রার্থনা করবে “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”? প্রায় তিনশো বছর পরের কবির কেন মনে হল ভাগ্যান্বেষী উজবেক যোদ্ধা বাবর, যার সাথে সেই বাঙালি পাটনীর কোন দিক থেকে কোন মিল নেই, তিনিও নিজের ঈশ্বরের কাছে বলতেন, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার সন্তানের জীবন দাও? কবির কল্পনা তো আকাশ থেকে পড়েনি, এমনই আকুতি বিভিন্ন ভাষায় কত বাবা-মাকে তো আজও উচ্চারণ করতে দেখি আমরা। সেই বাবা মায়েরা তাহলে জীবন ফুরোলেই ফুরিয়ে যাবেন সন্তানের কাছেও?
কেউ কেউ বলবেন বাবা-মা শিক্ষা দেন, জীবনে নিজের পায়ে দাঁড় করান। সেটাই তো সারাজীবন সঙ্গে থাকে। সেকথা ঠিক, কিন্তু সে অবদান বাবা-মায়ের অনন্য অবদান নয়। মানুষ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের থেকেও শিক্ষা পায়, সর্বোপরি শিক্ষক শিক্ষিকাদের থেকে পায়। এবং যে শিক্ষা সে পায় তার বেশিরভাগটাই স্বোপার্জিত। বাবা-মা বড় জোর সুযোগ তৈরি করে দেন।
ভেবে দেখলাম যে অক্ষয় ধন আমার সন্তানকে দিয়ে যেতে পারি তা হল সমাজ, সংসারের সঙ্গে, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোধ। সুসময়ে, এবং দারুণ দুঃসময়ে, সেই বোধ তাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের প্রত্যেককে আমাদের বাবা-মায়েরাও জেনে বা না জেনে ঐ বোধই দিয়ে গেছেন, দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাসের কোন মুহূর্তে ঠিক কোন জায়গাটায় আমি দাঁড়িয়ে আছি এবং তার সাপেক্ষে বর্তমানে আর ভবিষ্যতে আমার কোথায় দাঁড়ানো উচিৎ সেই বোধ সচেতন বাবা-মায়েরা আমাদের দিয়ে যান জেনে বুঝে। আর যে বাবা-মায়েরা তত সচেতন নন আসলে তাঁরাও স্থান নির্দেশ করে দিয়ে যান তাঁদের কথাবার্তায়, জীবনচর্যায়।
কথাটা নতুন করে উপলব্ধি করলাম টিভিতে তথাকথিত গোরক্ষকদের হাতে নিহত পুলিশকর্মী সুবোধ কুমার সিং এর ছেলে অভিষেকের কথা শুনতে শুনতে।
সুবোধ কুমার খুন হওয়ার পর যত সময় যাচ্ছে তত পরিষ্কার হচ্ছে যে খুন হওয়ার দিনের ঘটনাবলী সুপরিকল্পিত, হঠাৎ উত্তেজিত জনতা তাঁকে হত্যা করেনি। তিনি সাম্প্রতিক অতীতে গোহত্যার “অপরাধে” প্রথম যে খুনটা হয়েছিল দাদরিতে, সেই খুনের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। সেই খুনের অপরাধীদের হাজতবাস করার পেছনে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। বদলি হয়ে বুলন্দশহরে এসে পড়ার পরেও আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে আপোষ না করে তিনি হিন্দুত্ববাদীদের যথেষ্ট বিরাগভাজন হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী বলেছেন সুবোধ কুমারকে প্রায়শই খুনের হুমকি দেওয়া হত। খবরে প্রকাশ বিজেপি নেতারা বুলন্দশহর থেকে তাঁর বদলি দাবী করেছিলেন অতি সম্প্রতি। বিপদের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন জেনেও সুবোধ কুমার ঘটনার দিন পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসাবে যা কর্তব্য ঠিক তাই করছিলেন। কোন সাহস তাঁকে প্রণোদিত করেছিল তা বলার জন্যে তিনি নেই, তা দেশ হিসাবে আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু বাবা হিসাবে তাঁর সাফল্য এই অন্ধকারে আমাদের ক্ষীণ আলো দেখাচ্ছে।
সকালের কাগজে মুন্ডিতমস্তক যে ছেলেদুটির ছবি কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বসা আমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলছিল, সেই বাবা হারা কিশোর যখন টিভির পর্দায় বলে “শুধু মুখ্যমন্ত্রীকে নয়, সারা ভারতের লোকের কাছে আমার আবেদন, হিন্দু মুসলমান নিয়ে দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হিংসা দয়া করে বন্ধ করুন,” তখন বোঝা যায় সুবোধকুমার ছেলেটির সঙ্গেই আছেন।
আরো পরিষ্কার হয় যখন অভিষেক বলেন “আমার বাবা একটা কথাই বলতেন ‘আর কিছু হতে পার না পার, সুনাগরিক হও। সব ধর্ম, সব জাতির লোকই এক। তুমি কারো চেয়ে বড় নও, কারো চেয়ে ছোটও নও।”
বাবা খুন হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে এই ভাষায় এই কথাগুলো বলতে পারা মুখস্থ বিদ্যায় সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যে বিদ্যার বলে মধ্যে মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর বন্দনা করেন সে বিদ্যার কর্ম নয় এসব। অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে শুধু ক্রিয়া, বিশেষণের জোরে এসব কথা বেরোয় না। অভিষেক যখন আমাদের সবাইকে সাবধান করেন এই বলে যে আমরা আত্মহননের পথে এগোচ্ছি; পাকিস্তান, চীনের দরকার নেই, আমরাই একে অপরের অনেক বড় শত্রু হয়ে উঠছি; তখন বোঝা যায় অভিষেকের প্রয়াত বাবা, এবং অবশ্যই মা, এই যুগসন্ধিক্ষণে তার যে স্থান নির্দেশ করেছেন সে সেই স্থানের যোগ্য হয়ে উঠছে। এইখানে মৃত সুবোধ কুমারের জিত, হত্যাকারীদের হার। হত্যাকারীদের সরকার তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ করুক আর না-ই করুক, সুবোধ কুমার সন্তানের মধ্যে বেঁচে রইলেন। আমাদেরও বাঁচার রাস্তার সন্ধান দিলেন।
এত কথা বলার পরে একটা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। সন্তান কি সবসময় বাবা-মায়ের দেখানো অবস্থান মেনে নেয়? নেয় না। প্রকৃতপক্ষে সর্বদা মেনে নেওয়া উচিৎও নয়। কারণ অনেক বাবা-মা এমন অবস্থানও ঠিক করেন যা সমাজের পক্ষে, সন্তানের চারপাশের মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, পশ্চাৎমুখী। সেইসব বাবা-মায়েদের অবাধ্য সন্তানেরাই যুগে যুগে সমাজকে বদলে দেন, এগিয়ে নিয়ে যান। সেই জন্যেই আমাদেরও বারবার ভাবতে হবে সন্তানকে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে বলছি। কার পক্ষে, কার বিপক্ষে? তাকে যে অবস্থান নিতে শেখাচ্ছি তা শুধু তার জন্যে ভাল, না আর পাঁচজনের জন্যেও ভাল — সেকথাও ভাবতে হবে। এমনি এমনি তো আর ঠাকুমা, দিদিমারা বলতেন না “প্রসব করলেই হয় না মাতা।”

ভালবাসার শক্তি

তারা খেলতে বেরিয়ে খুন হয়ে যাচ্ছে, পোষা জন্তুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষিত হয়ে গুমখুন হচ্ছে, অকারণে যখন তখন পিতৃহারা হচ্ছে, এমনকি শিশুদের শব ভেসে উঠছে আমাদের সমুদ্রতীরে

রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’ ছবিটা অসংখ্যবার দেখেছি। ছোটবেলার দোসরা অক্টোবরগুলোয় দেখতাম আর কিছু দেখার ছিল না বলে। পরে স্বেচ্ছায় দেখেছি বেশ কয়েকবার। যে দৃশ্যটা কিছুতেই ভুলতে পারি না সেটা হল বেলেঘাটায় গান্ধীজির অনশনের দৃশ্য।
অসুস্থ তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন, ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না থামলে অনশন ভাঙবেন না। কলকাতার দাঙ্গার হোতা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দিকে পাশে নিয়ে জনগণের কাছে নেহরু দাঙ্গা বন্ধ করার আবেদন করলেন, বললেন “আমাদের পাগলামির জন্যে গান্ধীজির জীবন বিপন্ন।“ তার পরের দৃশ্যে দাঙ্গাবাজরা গান্ধীজির পায়ের কাছে অস্ত্র ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তাদের মধ্যে থেকে এক ক্ষিপ্ত হিন্দু যুবক এসে কোন শিশুর পায়ের একপাটি জুতো ছুঁড়ে মারল তাঁর বুকের উপর।
“খাও এটা। খাও। আমি তো নরকে যাবই। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পাপ নিয়ে যাব না।“
“সে তো শুধু ঈশ্বর জানেন কে নরকে যাবে,” গান্ধীজির উত্তর।
“খুন করেছি আমি। একটা ছোট বাচ্চাকে। মাথাটা দেয়ালে ঠুকে মেরে ফেলেছি।“
“কেন?”
“কেটে ফেলেছে… আমার এইটুকু বাচ্চাটাকে… মুসলমানরা মেরে ফেলেছে।“
“এই শোক কাটিয়ে ওঠার একটা রাস্তা আছে। এমন একটা বাচ্চাকে খুঁজে বার কর যার বাবা-মা খুন হয়ে গেছে। তাকে মানুষ কর। বাচ্চাটা যেন মুসলমান হয়। আর সেভাবেই তাকে মানুষ কোর।“
বিস্ফারিত নেত্রে একথা শোনার পর চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসে গান্ধীর পায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ে সেই সন্তানহারা, শিশুহন্তা পিতা। ক্ষমা প্রার্থনা করে।
যতবার দেখেছি ছবিটা, এই জায়গাটায় এসে মন বিদ্রোহ করেছে। মনে হয়েছে এমনটাই হওয়া উচিৎ বটে কিন্তু একমাত্র গান্ধীর উচ্চতার মানুষই ওভাবে ভাবতে পারেন। একজন সাধারণ মানুষ কি পারে? অসম্ভব, এ অসম্ভব।
একেবারে অসম্ভব যে নয় তার প্রমাণ পেতে অপেক্ষা করতে হল এই অবিশ্বাসী মধ্যবয়স অবধি। যখন রামনবমীর মিছিল নিয়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে আততায়ীরা আসানসোলের এক মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমদাদুল রশিদির কিশোর সন্তানকে খুন করল, আর তিনি বললেন যদি কেউ এর প্রতিক্রিয়ায় কোনরকম হিংসার আশ্রয় নেয় তাহলে তিনি মসজিদ ছেড়ে, আসানসোল ছেড়ে চলে যাবেন।
সেটা এবছর মার্চ মাসের ঘটনা। ঠিক তার আগের মাসে অঙ্কিত সাক্সেনা বলে এক হিন্দু যুবককে খুন করা হয় মুসলমান মেয়েকে ভালবাসার অপরাধে। তার বাবা যশপাল সাক্সেনাও একগলা পুত্রশোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলেন “হ্যাঁ আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে তারা মুসলমান। কিন্তু তা বলে সব মুসলমানকে খুনী বলে দেগে দেওয়া যায় না। সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর কাজে আমাকে ব্যবহার করবেন না। ব্যাপারটাকে ধর্মের সঙ্গে জড়াবেন না, পরিবেশ বিষিয়ে দেবেন না।“
কিন্তু কে শুনছে তাঁর কথা, তাঁদের কথা? অপরবিদ্বেষ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। যার চামড়ার রং আমার মত নয় তার প্রতি বিদ্বেষ, যে আমার ভাষায় কথা বলে না তার প্রতি বিদ্বেষ, যে মূলত আমার রাজ্যের বা দেশের বাসিন্দা নয় তার প্রতি বিদ্বেষ, যার খাদ্যাভ্যাস আমার মত নয় তার প্রতি বিদ্বেষ, সর্বোপরি যে অন্য ধর্মের লোক তার প্রতি বিদ্বেষ।
এই সর্বব্যাপী বিদ্বেষ দিয়ে আমরা আমাদের শিশুদের জন্যে এক ভয়াবহ পৃথিবী তৈরি করেছি। তারা খেলতে বেরিয়ে খুন হয়ে যাচ্ছে, পোষা জন্তুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষিত হয়ে গুমখুন হচ্ছে, অকারণে যখন তখন পিতৃহারা হচ্ছে, এমনকি শিশুদের শব ভেসে উঠছে আমাদের সমুদ্রতীরে।
নব্বইয়ের দশক থেকে সৌদি আরবপুষ্ট যে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ পৃথিবীজুড়ে থাবা ছড়িয়েছিল তার কার্যক্রম ছিল জনবহুল জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ বা কয়েকজন সন্ত্রাসবাদীকে দিয়ে কোন জনবহুল জায়গায় মানুষকে বন্দী করে গণহত্যা। দীর্ঘদিন সাধারণ মানুষের মাঝখানে নিতান্ত সাধারণ হয়ে ঘোরাফেরা করত সেই সন্ত্রাসীরা। যাদের পারিভাষিক নাম স্লিপার সেল। একদিন অতর্কিতে হানা দিত তারা, প্রায়শই আত্মহনন যার অঙ্গ। আল কায়দা থেকে আইসিসের হাত ঘুরে অধুনা সেই সন্ত্রাসবাদ অনেকাংশে স্তিমিত। এখন পৃথিবীর সর্বত্র দেখছি স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাস আরো নির্দিষ্ট, আরো ব্যক্তিগত। কোথাও গোপন শিবির করার দরকার হচ্ছে না, মৌলবাদী ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ মস্তিষ্কে গুঁজে দেওয়ার জন্যে প্রয়োজন পড়ছে না কোন দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের। হাতের স্মার্টফোনেই চলে আসছে উশকানিমূলক প্রোপাগান্ডা, চতুর ভুয়ো খবর। এখানে আলাদা করে কোন স্লিপার সেল নেই কারণ আমি, আপনি, আমরা সবাই একেকজন স্লিপার সেল। হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, অর্ণব গোস্বামী ও সম্প্রদায় প্রকাশ্যেই আমাদের মধ্যে অহোরাত্র বুনে যাচ্ছে ঘৃণার বীজ। আমাদের কোষে কোষে ঘুমিয়ে থাকা সেই ঘৃণা মুহূর্তে আমাদের করে তুলছে সন্ত্রাসবাদী। যে মুহূর্তে কেউ ছড়িয়ে দিল অমুকের ফ্রিজে গরুর মাংস রাখা আছে, এই আমি, এই আপনি দৌড়লাম তাকে পেটাতে। কেউ চিৎকার করে বলল অমুক গরু চুরি করে পালাচ্ছে। সবাই মিলে পেটাতে গেলাম তাকে। মারতে পাশবিক সুখ হচ্ছে। মারতে মারতে মরে গেলে আরো সুখ।
আমি, আপনি মানুষ মারছি আর আমাদের দেখে ছোটরাও শিখছে মানুষ খুন করা নেহাত জলভাত। আফরাজুলকে খুন করে পুড়িয়ে দিয়েছিল যারা তাদের মধ্যে ছিল কয়েকজন চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলে। আট বছরের আসিফার ক্রমাগত ধর্ষণ এবং খুনেও যুক্ত ছিল এক অপ্রাপ্তবয়স্ক। মাদ্রাসার ছাত্র আজিমকে খুন করে ফেলল অপ্রাপ্তবয়স্করাই। শুধু গ্রীনহাউস গ্যাস নয়, ঘৃণার বিষবাষ্পে পরিপূর্ণ এক বায়ুমন্ডলে বেড়ে উঠছে আমার, আপনার সন্তান। শুধু বড়দের কাছে নয়, সমবয়স্কদের সাথেও সে নিরাপদ নয়। আজকাল মনে হয় শিশুরা জন্মাচ্ছে হয় খুন হতে নয় খুনী হতে। নিরন্তর শক্তিক্ষয় হচ্ছে — ভালবাসার শক্তি। যে শক্তি একটুও অবশিষ্ট থাকলে শেষ পর্যন্ত খুন করা থামিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া যায়।
হিন্দুরা যাকে নরক বলেন, মুসলমানরা বলেন দোজখ, খ্রীষ্টানরা Hell, তা বোধহয় এমন পৃথিবীর চেয়ে ভয়ঙ্কর নয়।

প্রকল্প এখন প্রকাশ্যে

যেন একটা আলাদা আইন থাকলে গরুগুলোর চেয়ে রাকবরের প্রাণের মূল্য ঝাড়খন্ড পুলিশের কাছে বেশি হত

রাজস্থানে শুনেছি জল খুব সুলভ নয়। তবু পাছে পুলিশের গাড়ি নোংরা হয়, মৃতপ্রায় রাকবরকে ধুয়ে মুছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। তবে বেদম পিটুনির পর ধুয়ে দিলেই রক্তপাত বন্ধ হয় না। তাই সম্ভবত তার পরেও গোটা রাস্তায় রাকবরের রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে। ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতাল — এই দীর্ঘ ছ কিলোমিটার পথে নিশ্চয়ই তার রক্তের রেখা এখনো মিলিয়ে যায়নি। রাজস্থানে তো জল সুলভ নয়।
তা রাকবর খানের রক্তের রেখা মিলিয়ে যেতে না যেতেই উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে সাহিল মার খেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গেলেন। রাকবর আর সাহিলের মধ্যে চট করে কোন মিল চোখে পড়ে না। প্রথমজনের পেশা পশুপালন, দ্বিতীয়জন একটা চাকরি করেন। প্রথমজন গাঁয়ের লোক, দ্বিতীয়জন মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের বাসিন্দা। প্রথমজন বিবাহিত এবং ইতিমধ্যেই বাবা হয়েছিলেন, দ্বিতীয়জন গিয়েছিলেন পছন্দের মানুষের সাথে ঘর বাঁধতে। দুজনের মধ্যে বস্তুত একটাই মিল — দুজনেই মুসলমান। কতটা ধর্মপ্রাণ ওঁরা তাও আমরা জানি না, কিন্তু যাদের কাছে আসল হল ধর্মীয় পরিচিতি তারা আদার ব্যাপারী। জাহাজের খোঁজ তারা নিতে চায় না। গত কয়েকবছরে ঘটে চলা গণপ্রহারে মৃত্যুর মিছিলে চোখ রাখলে ধর্মান্ধ বদমাইশ ছাড়া সকলেই দেখতে পাবেন যে এই সংগঠিত খুনগুলোর লক্ষ্য ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আর খুনগুলোর করছে ক্ষমতাসীন সঙ্ঘ পরিবার, যারা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
একথা এতদিন পর্যন্ত আমার মত দেশদ্রোহী মাকু, সেকুরাই কেবল বলছিল। এখন আর তা নয়। গণপ্রহারের শিকার হওয়া অতিপরিচিত হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী অগ্নিবেশ গত সপ্তাহে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে একটা সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলেছেন “It was a lynch mob, except it was not a faceless lynch mob but one that was sponsored and supported by the powers that be in the state and central governments. I am not the first one to be attacked, many more have been lynched to death. Akhlaq Khan was killed in Dadri, so was Pehlu Khan and Junaid, and not a single murderer has been apprehended.”
রাকবরের খুন যা নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তা হল হিন্দুত্ববাদী প্রশাসনের প্রকল্পই হল মুসলমান নাগরিকদের খুন করা। এরপর রেজিস্ট্রি করে হিন্দু প্রেমিকাকে বিয়ে করতে গিয়ে সাহিলের মার খাওয়া প্রমাণ করে মুসলমানদের মারা তাদের মারার জন্যেই। গোরক্ষা, লাভ জিহাদ ইত্যাদি হল নতুন নতুন অজুহাত। আগে তবু মন্ত্রী সান্ত্রীদের চোখের চামড়া বজায় রাখার দায় ছিল। এখন আর সেসব নেই। অভিযুক্তরা জামিনে ছাড়া পেলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড্যাং ড্যাং করে মাল্যদান করতেও চলে যাচ্ছেন।
রাজধানী দিল্লীতে বসে অবশ্য এখনো একটু কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করতে হচ্ছে। সংবিধানটা এখনো বদলানো হয়নি কিনা। তাই আমাদের বিশুদ্ধ হিন্দি বলা নিপাট ভালমানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন “প্রয়োজনে সরকার গণপিটুনির বিরুদ্ধে আইন করতে প্রস্তুত।” যেন নতুন একখানা আইন করে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে। যেন এখনকার আইনে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা আইনসম্মত। যেন অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না শুধু উপযুক্ত আইন নেই বলে। যেন একটা আলাদা আইন থাকলে গরুগুলোর চেয়ে রাকবরের প্রাণের মূল্য ঝাড়খন্ড পুলিশের কাছে বেশি হত। “ও মন্ত্রীমশাই, ষড়যন্ত্রীমশাই… যত চালাকি তোমার, জানতে নাইকো বাকি আর।”
ধর্মীয় পরিচয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকা যেসব লোকেরা এখনো বেড়ার উপর বসে পা দোলাচ্ছেন আর “নিরপেক্ষতা”, “ডায়লগ” — এইসব ন্যাকা শব্দ কপচাচ্ছেন তাঁরা স্বামী অগ্নিবেশের সাবধানবাণীটা একবার পড়ে নেবেন “What they call hardline Hindutva is the greatest threat to Hindu culture, or sanatan dharam… The hardline approach of causing harm to whoever disagrees is a kind of nascent fascism.”
অবশ্য সাবধান হবে কে? অনেক লেখাপড়া জানা লোকের মতে তো আবার ফ্যাসিবাদ খুব ভাল জিনিস, দেশের ওটাই দরকার, হিটলার দারুণ লোক ছিল ইত্যাদি।

সকলের রক্ত

সব হি কা খুন হ্যায় শামিল ইয়াহাঁ কি মিট্টি মে
কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়।।
— রাহাত ইন্দোরি

হা হা হা। আবার একটা লোককে মেরে ফেলেছে রে।
সে লোকটা কেবল গরু তাড়াচ্ছিল। হো হো হো।
কি হাসি পাচ্ছে রে ভাই! হি হি হি।
আবার দেখলাম মারতে মারতে যখন নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ তাদের এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল। হে হে হে।
এ তো পুরো হিন্দি সিনেমা রে ভাই। যারা মারছিল তারা পুরো অক্ষয় কুমার মাইরি। গুরু গুরু।
লোকটাকে রাস্তা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে যা স্টাইলে নিয়ে গেল না! দেখে আমার দিদি তো পুরো ফিদা। বলল এবার থেকে সল্লু না, এই অফিসারটার জন্মদিনেই বন্ধুদের খাওয়াব।
আবার লোকটা থেকে থেকে জল চাইছিল। হা হা হা।
কি গাধা মাইরি! ভেবেছে ওকে খতম করার আগে আবার জল খেতে দেবে!
এত নির্বোধও এদেশে ছিল! মরার সময়ও ভেবেছে লোকগুলোর মায়া দয়া আছে! আব্দারটা ভাব!
কী রে, ভাই? কাঁদছিস কেন? আরে ধুর! আমরা এই নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেই পারি। আমাদের কোন ভয় নেই। আমরা কি কাসিমের জাত নাকি? আমাদের গায়ে কে হাত দেবে?
কী বললি? ও, তাই বল। আর্জেন্টিনা হেরে গেছে বলে দুঃখ হচ্ছে। সত্যি রে ভাই, আমারও বড্ড কান্না পাচ্ছে। আয় গলা জড়িয়ে দু ভায়ে কাঁদি। ভেউ ভেউ ভেউ ভেউ…

%d bloggers like this: