নিজের দিকে আঙুল তুলুন

আমাকে ছোট থেকে যাঁরা ঠেগুয়া খাইয়েছেন তাঁরা তো কখনো দাবী করেননি ছটপুজোয় ছুটি দিতে হবে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেন দিলেন সে প্রশ্ন তাঁকে করুন। এ রাজ্যের হিন্দিভাষীরা নিজেদের মত করে রামনবমী পালনও তো করে আসছেন বরাবর, অস্ত্রমিছিল করেননি তো। রাজনৈতিক দল কেন রাম আর হনুমানের পুজো করবে সে প্রশ্ন দিলীপ ঘোষ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে করুন, হিন্দিভাষীরা এর জবাব কেন দেবেন? এ তো আইসিসের অপরাধের জবাব এদেশের সাধারণ মুসলমানের কাছে চাওয়ার মত হয়ে গেল

যেহেতু প্রাসঙ্গিক সেহেতু একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করা যাক।
আমার বাড়ির খুব কাছে অধুনালুপ্ত হিন্দমোটর কারখানা, তৎসহ শ্রমিকদের কোয়ার্টার। ঐ এলাকার বাইরেও কিছুটা জায়গা জুড়ে যাঁদের কোয়ার্টারে জায়গা হয়নি বা নিজের সামর্থ্য আছে তাঁদের বাসস্থান। আমার যখন সদ্য অক্ষর পরিচয় হয়েছে তখন কারখানাটা রমরমিয়ে চলছে। আমার বাবা সেইসময় সক্রিয় রাজনীতিবিদ, তার উপরে প্রশাসক। ফলে রোজ সকালে ঐ কারখানার শ্রমিকরা, যাঁরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছেন এবং মূলত হিন্দিভাষী, বাবার কাছে বিভিন্ন দরকারে আসতেন। বাবা বাড়ি ফিরত অনেক রাত করে, ফলে খুব ভোর ভোর উঠতে পারত না। যতক্ষণ না উঠত, ওঁদের সাথে গল্পগুজব করতাম আমি। অন্য ভাষা আমার কাছে ভীষণ কৌতূহলোদ্দীপক ছিল আর ওঁদের দিক থেকে দেখলে, ছোটদের সাথে সময় কাটাতে কার না ভাল লাগে? তা এই রোজ সকালে হিন্দি বলার ফলে বাংলার সাথে সাথে হিন্দিটাও তখন আমি দিব্যি বলতে পারি।
যখন হাইস্কুলে পৌঁছেছি তখন ঐ কারখানারই এক শিখ শ্রমিক পরিবার আমাদের প্রায় আত্মীয় হয়ে গিয়েছিল। ওঁরা সপরিবারে আমাদের বাড়ি এসেছেন, ওঁদের ছেলেমেয়েদের বিয়েতে আমরা নেমন্তন্ন খেয়েছি। সেই ঘনিষ্ঠতা বেশিদিন টেকেনি, নইলে গুরুমুখীটাও কিছুটা শিখে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।
বরাবর, এমনকি হিন্দমোটর কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও, এলাকার হিন্দিভাষী মানুষদের সাথে আমাদের সম্পর্ক একই রকম থেকেছে। খুব ছোটবেলা থেকেই তাই ছটপুজোর ঠেগুয়ার স্বাদ কিরকম সেটা জানি। আমার বাবার যখন ক্যান্সার হয়, তখন যাঁরা নিয়মিত খবর নিতেন, যে কোনরকমভাবে আমাদের সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন তাঁদের মধ্যে অনেকেও বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার হিন্দিভাষী শ্রমিক। বাবা মারা যাওয়ার পর ভেবেছিলাম স্বাভাবিক কারণেই ওঁদের সাথে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। আমাকে অবাক করে, আমাকে খুব ছোটবেলায় দেখেছেন এমন একজন তাঁর মেয়ের গ্র‍্যাজুয়েশনের পরে কী পড়া উচিৎ তার পরামর্শ করতে আমার কাছে এসেছিলেন বছর দুয়েক আগে। “তুমহারে পিতাজি তো রহে নহি। অব কাঁহা যায়েঁ, কিসসে পুছেঁ? সোচা তুমসে হি পুছ লেতে হ্যাঁয়” বললেন এসে। এই যে জীবিকার তাগিদে, জীবনরক্ষার তাগিদে পশ্চিমবঙ্গে আসা ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ এখানে থাকতে থাকতে এই রাজ্যের মানুষকে ভরসাস্থল মনে করেন — এর চেয়ে গর্বের আর কিছু নেই বলে আমার মনে হয়।
আমি নিজে একসময় হায়দরাবাদের একটা খবরের কাগজে কাজ করতাম। তখন সেই নিউজরুমে বাঙালিরা প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, তেলুগুদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি তো বটেই। একদিন এক তেলুগু সহকর্মী হঠাৎ দাবী করে বসল আমাকে ফোনে ইংরিজিতে কথা বলতে হবে কারণ কানের কাছে অজানা ভাষায় কেউ কথা বললে তার কাজের অসুবিধা হচ্ছে। এই অন্যায় দাবী মেনে নেওয়ার ছেলে আমি নই। ফলে তার সাথে জোর ঝগড়া হল। সে বলল “তাহলে তেলুগু শেখো। এখানে এসে থাকবে, কাজ করবে আর এখানকার ভাষা শিখবে না?” আমি সপাটে জবাব দিয়েছিলাম “শিখতেই পারি। কিন্তু তুমি কলকাতায় এসো, আমরা তোমায় বাংলা শিখতে জোর করব না। আমরা করি না।” সে আর রা কাড়েনি।
বাঙালি হিসাবে অত গর্বিত আমার কখনো লাগেনি। আর সশস্ত্র রামনবমী মিছিল, তজ্জনিত হিংসা, আবুল কালাম আজাদের মূর্তি ভাঙা দেখে বাঙালি হিসাবে এত লজ্জিতও কখনো হইনি। সেই লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে সেই বাঙালিরা যারা এখন আমাদের জাতিগত অধঃপতনের দোষ চাপাচ্ছে অবাঙালিদের ঘাড়ে। ভারত এখন বিবিধ আমরা ওরায় বিভক্ত। তার মধ্যে আবার একটা নতুন আমরা-ওরা যোগ করছে এই বাঙালিরা।
নিজের অযোগ্যতা, অপদার্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানো ভীতু, ওপরচালাক এবং অলস লোকের লক্ষণ। এই বাঙালিরাও আমাদের সেরকম বলেই প্রমাণ করছে। হাস্যকর কিছু কথা বলা হচ্ছে। “এত বেশি সহিষ্ণু হওয়াই আমাদের অন্যায় হয়েছে”, “আমাদের কালচারটার এরা সব্বোনাশ করে দিল”, “রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের বাংলা। সেই বাংলায় অবাঙালিগুলো এসে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ঢোকাল”, “ওরা যেখানে যেখানে থাকে সেখানেই কিন্তু হিন্দুত্ববাদের রমরমা” — এইসব কথা দেখছি বিজেপিবিরোধীরা তো বটেই, নিজেকে বামপন্থী বলে দাবী করা অনেকেও বেশ বুক ফুলিয়ে বলছেন, সোশাল মিডিয়ায় লিখছেনও। মোটের উপর ঐ তিনটেই বক্তব্য এঁদের। কথাগুলো কতটা অন্যায়, কেন অন্যায় সেটা এবার দেখা যাক।

“এত বেশি সহিষ্ণু হওয়াই আমাদের অন্যায় হয়েছে”
কিরকম হওয়া উচিৎ ছিল তাহলে? মুম্বাইয়ের শিবসেনার মত? বিহার বা উত্তরপ্রদেশের লোক দেখলেই ঠ্যাঙানো উচিৎ ছিল? নাকি সব্বাইকে বাংলা শিখতে হবে, নইলে এর লাইসেন্স দেব না, তার লাইসেন্স দেব না — এসব বলা উচিৎ ছিল? প্রথমত, মুম্বাইতে এটা করে কী ফল হয়েছে? মুম্বাই বলতেই বিশ্বসুদ্ধ লোক কী বোঝে? বলিউড। কোন ভাষায় ছবি হয় সেখানে? হিন্দি। চেনা পরিচিত বাঙালি যারা মহারাষ্ট্রে থাকেন তাঁদের কজন মারাঠি জানেন একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন তো। বুঝতে পারবেন ঠ্যাঙাড়ে পদ্ধতি ব্যর্থ। তাছাড়া এই কথা যদি বলেন তাহলে হিন্দুত্ববাদীরা যখন পাকিস্তানের উদাহরণ দেখিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়া সমর্থন করে তখন কিন্তু বলা চলবে না “দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চাও তাহলে?”

“আমাদের কালচারটার এরা সব্বোনাশ করে দিল”
এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর নেই। কিসের কালচার? কালচার বলতে আজকের বাঙালি কী বোঝে? কালচারের বাংলা প্রতিশব্দ কী? সঠিক বানানে সেটা লিখতে পারবে চল্লিশের নীচে বয়স এমন কজন আছে? তামিল, তেলুগু ছবি ঝেড়ে বলিউডে ছবি হয় আবার সেই ছবি ঝেড়ে বাংলা ছবি হয়। প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই চলছে। এর নাম কালচার? ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে তো বাঙালি দেড়শো বছর ধরে পড়ছে কিন্তু আগে তো বাপ-মা গর্ব করে বলত না “জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না”? এই অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে বিহারী, মাড়োয়ারিরা? একই স্কুলে পড়া মাড়োয়ারি ছেলেমেয়ের বাবা-মাকে তো বলতে শুনি না গদগদ হয়ে “মেরে বেটে কো না হিন্দি ঠিক সে আতা নহি”? সন্ধ্যের পর তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি যে সিরিয়ালগুলো দ্যাখে সেগুলোর নাম কালচার? ওসবে তো হিন্দি ছবির গানও চলে। তার মানে যারা বানায় তারা নিজেরা লিখতে তো পারেই না, লাগসই বাংলা গান খুঁজে বের করার মুরোদও তাদের নেই। স্বাভাবিক। কারণ এদের সাক্ষাৎকার যা এদিকওদিক পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় এরা বাংলা বলে গ্রীকদের মত। তা এরকমটা এদের শেখাল কে? হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালা? গলায় পা দিয়ে? বাঙালি হিন্দু মেয়ের বিয়েতে মেহেন্দি চালু করল কে? কোন বিহারী এসে এ কে ৪৭ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল? যে ছেলে সব শাস্ত্রীয় আচার মেনে বিয়ে করে, প্রেমের বিয়েতেও পণ নিতে ছাড়ে না, সে বৌভাতের দিন প্রথাগত ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে শেরওয়ানি পরে কোন মাড়োয়ারির ভয়ে? ছেলেমেয়েকে ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে এমনকি দ্বিতীয় ভাষার জায়গা থেকেও বাংলাকে সরিয়ে হিন্দি ঢোকান যে বাঙালি বাবা-মায়েরা তাদের কোন হিন্দিভাষী ব্ল্যাকমেল করেছে এটা করতে?
তাছাড়া কালচার মানে তো শুধু এসব নয়। ট্রেনে বাসে তরুণ বাঙালিদের ভাষা শুনে দেখেছেন? এমনিতে পাঁচ লাইন কথা বললে দু লাইন ইংরিজি আর আড়াই লাইন হিন্দি থাকে। খিস্তি দেওয়ার সময় কিন্তু এরা পরম বাঙালি। এবং জনসমক্ষে খিস্তিসহ কথা বলাটা বেশ গর্বের ব্যাপার এদের কাছে। বছর কুড়ি আগেও বড়দের সামনে শালা বলে ফেললে যে বাঙালি কানমলা খেয়েছে তারই ছেলেমেয়ে ট্রেনে বসে হেডফোনে বন্ধুকে মহানন্দে কাঁচা খিস্তি দিয়ে যায়, সে কামরাভর্তি যতই বাপ-পিতেমোর বয়সী লোক থাক, মহিলারা থাকুন বা বাচ্চাকাচ্চা থাক।
এই জাতির কালচার শেষ করে দিয়েছে অন্য রাজ্য থেকে আসা দশ বারো শতাংশ লোক? শুনলেই হাসি পায়।

“এ বাংলা রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগরের বাংলা। সেই বাংলায় অবাঙালিগুলো এই সাম্প্রদায়িক, পশ্চাৎপদ রাজনীতি ঢোকাল”
ঐ তিন চারটে নাম মুখস্থ বুলির মত আউড়ে যাওয়া বহুকাল হল বাঙালির বদভ্যেস। কাঁঠালি কলার চেয়েও বেশি ঘটে ব্যবহার করা হয় এই নামগুলো। অথচ এই লোকগুলো কেন বিশিষ্ট তা ছেলেমেয়েকে শেখানোর দায়িত্ব অনেকদিন বাবা-মায়েরা ছেড়ে দিয়েছেন। কি ভাগ্যিস দ্বিতীয় জন কিছু গান, কবিতা লিখে গেছেন। তাই স্ট্যাটাস বজায় রাখতে বাড়িতে রচনাবলী সাজিয়ে রাখা, ছেলেমেয়েকে আবৃত্তি স্কুলে পাঠিয়ে “ভগবান তুমি…” বলতে শেখানো, ঘুরেফিরে গুটিকয়েক গান আর নাচ শেখানো — এসব আছে। বাকিরা তো আক্ষরিক অর্থেই ছবি হয়ে গেছেন। প্রথমজনেরটা থাকে ঠাকুরঘরে। অতএব কী বলেছেন ওসব আর কে পড়তে যাবে? পড়লেও ভাবতে যাবে কেন? গুরুবচন। মুখস্থ করাই কর্তব্য, ভাবতে নেই।
রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন অথচ সঙ্গীতে এবং কাব্যে একেবারে স্বতন্ত্র নজরুলের প্রতি আমরা পশ্চিমবঙ্গীয়রা সযত্নলালিত অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিয়েছি। আজকাল আর নজরুলগীতি শেখা ঠিক কেতাদুরস্ত নয়। আমাদের ছোটবেলার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যাগুলোও প্রায় অবলুপ্ত। অন্নদাশঙ্করেরই বোধহয় ভুল হয়েছিল। নজরুলকে আমরা বিলকুল ভাগ করে দিয়েছি। আশঙ্কা হয় সেটাও হয়ত তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যেই।
চতুর্থজনের অবস্থা তো আরো করুণ। এই ভদ্রলোকের নাম আজকাল আর খুব বেশি বাঙালি জানে কিনা আমার সন্দেহ হয়। ছোটদের তো জানার উপায়ও নেই। তারা তো জলি প্রাইমার, এলিমেন্টারি ম্যাথসে ডুবে আছে। তার মধ্যে কি আর বর্ণপরিচয়ের জায়গা আছে? আর বড়রা তো বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে বরাবরই জানত দুটো শব্দ —- বিধবাবিবাহ আর বাল্য বিবাহ। আরেকজনকে তো বাঙালি ভুলেই গেছে। তিনি রামমোহন রায়। সেটা অবশ্য একদিকে ভাল। পপকর্ন খেতে খেতে পদ্মাবতী দেখার সময়ে ঐ ভদ্রলোককে মনে পড়লে পুরো আমেজটাই নষ্ট হবে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে এই লোকগুলোকে শালগ্রাম শিলা বানিয়ে ফেলেছি আমরা অনেক আগেই। সুতরাং আমাদের বাংলাটা আর এদের বাংলা নেই। এর জন্যে বিহারী, মাড়োয়ারিদের গাল পাড়ার কোন যুক্তি নেই। তা বাদেও বাংলাকে এদের বাংলা বলা নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে অর্ধসত্য বলার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
রামকৃষ্ণের কথা আলাদা। তিনি শত হলেও ধর্মগুরু। তাছাড়া তাঁর এক নম্বর শিষ্য একটা আস্ত প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গেছেন। তাই তিনি নিজের সময়ও পূজিত, এখনো পূজিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে গালাগাল দেওয়ার লোক তাঁর সময়েও নেহাত কম ছিল না। যেমন তাঁর যশে দ্বিজেন্দ্রলালের কম গা জ্বলেনি। আর নোবেল টোবেল পাওয়ার পরেও, বাণী বসুর ‘অষ্টম গর্ভ’ পড়লে বোঝা যায়, শিক্ষিত বাঙালিরা অনেকেই মনে করত উনি শুধু একজন বড়লোকের ছেলে যে শান্তিনিকেতনে সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে। এসব যারা মনে করত এ বাংলা তাদেরও। নিজেদের রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি ভাবতে গেলে মনে রাখা উচিৎ আমরা ঐ লোকগুলোরও জাতভাই।
আর বিদ্যাসাগর? এ বাংলা কোনদিনই তাঁর ছিল না। তিনি যেমন আমাদের পূর্বপুরুষ তেমন যারা বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার অপরাধে তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছিল, তাঁকে খিস্তি করে গান লিখেছিল, জুতো ছুঁড়েছিল, টাকার লোভে তাঁকে ঠকিয়েছিল তারাও এই আমাদেরই পূর্বপুরুষ। এবং তারা নেহাত এলেবেলে লোকও নয়, অনেকেই তখনকার সমাজের মাথা। এই বাংলা এমনই বিদ্যাসাগরের যে তিনি শেষ বয়সে এই জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে দন্ডকারণ্যে সাঁওতালদের সঙ্গে গিয়ে বাস করতেন।
যে নবজাগরণ বা আলোকপ্রাপ্তি নিয়ে আমরা জাঁক করি সেই আলো যাঁরা নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন এক ইউরোপীয় অধ্যাপকও। মনে রাখা ভাল যে সেই হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওকে আমাদেরই গণ্যমান্য পূর্বপুরুষরা বিদেশী এবং বিধর্মী বলে অপমানের একশেষ করেছিল। আমাদের সমাজের কুপ্রথাগুলোর দিকে আঙুল তোলার তাঁর অধিকার নেই বলেছিল। ঠিক যেমন আজকের দক্ষিণপন্থীরা বলছে লেনিন তো বিদেশী, এদেশে তার মূর্তি থাকবে কেন? আমাদের সেই পূর্বপুরুষেরা ডিরোজিওকে ভাতেও মেরে এমন অবস্থা করে যে তাঁর অকালমৃত্যু হয়।
আর সাম্প্রদায়িকতা হিন্দিভাষীরা এ রাজ্যে নিয়ে এসেছে, কেবল তাদের এলাকাগুলোতেই হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটছে এমনটা যদি আপনার মনে হয় তাহলে বলতে হয় আপনি বুদবুদের মধ্যে বাস করছেন বহুকাল ধরেই। ভাল করে তাকিয়ে দেখলে চারপাশে অজস্র আত্মীয়স্বজন পাবেন যারা গাদা ডিগ্রিধারী হয়েও চরম অশিক্ষিতের মত বলে “অমুকের মুসলমানদের সাথে এত কিসের দহরম বুঝি না। বাঙালি ছেলে বাঙালিদের সাথে বন্ধুত্ব কর না।” বাংলা ভাষার জন্যে আজ অব্দি যারা প্রাণ দিয়েছে সীমান্তের দুই পারে, তাদের বেশিরভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী অথচ আমাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, অধ্যাপক, সাংবাদিক ইত্যাদি পেশাধারী মূর্খরা বলে তারাই বাঙালি, মুসলমানরা মুসলমান। বিজেপির প্রোপাগান্ডা আর মমতার নিজেকে মুসলমানদের ত্রাতা হিসাবে তুলে ধরার অপচেষ্টা শুরু হওয়ার পর থেকে আশপাশের লেখাপড়া জানা মানুষদের ভেতরের ঘৃণা কিভাবে বেরিয়ে আসছে, কি অনায়াসে তারা ভিত্তিহীন গুজবকে ধ্রুব সত্য হিসাবে বিশ্বাস করছে এবং অন্যকে বিশ্বাস করাচ্ছে তা যদি আপনার চোখে না পড়ে থাকে, একমাত্র তাহলেই আপনি ভাববেন হিন্দুত্ববাদীরা শুধু হিন্দিভাষীদের এলাকায় শক্তিশালী হচ্ছে।
তবে এই সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসও আমাদের সুপ্রাচীন। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের অনন্য প্রতিভা যেমন তাঁর ইহুদীবিদ্বেষকে অতিক্রম করতে পারেনি, আমাদের গদ্যের আদিপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভাও তেমনি তাঁর মুসলমানবিদ্বেষকে অতিক্রম করতে পারেনি। মুসলমান শাসকরা এদেশে হানাদার এবং সমস্ত অধঃপতনের মূলে, তারা আসার আগে এদেশ স্বর্গরাজ্য ছিল — এই যে অতিসরলীকৃত ইতিহাস আর এস এস আমাদের গেলাচ্ছে, বঙ্কিম যে তার চেয়ে খুব আলাদা কিছু ভাবতেন তা ভাবা শক্ত। রাজসিংহ উপন্যাসের শেষে তবু একটা কৈফিয়ত গোছের লেখা আছে, যেখানে বঙ্কিম লিখেছেন সব হিন্দুই ভাল আর সব মুসলমানই খারাপ এমনটা বলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। আনন্দমঠ উপন্যাসের শেষে তাও নেই।
বিবেকানন্দ একবার বৈদান্তিক মস্তিষ্কের সঙ্গে ঐস্লামিক দেহের সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর ইতিহাস পাঠেও “সবই ব্যাদে আছে” এবং সে যুগের পর থেকে ভারতে আর ভাল কিছু হয়নি — এই মনোভাবটা বড় জ্বলজ্বল করে। আর সত্যি বলতে কি, ঐ উক্তি থেকেও এটাই মনে হয় যে বিবেকানন্দ মুসলমানদের একটা বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষ হিসাবে না দেখে একটা বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর লোক হিসাবে দেখতেন। নইলে ঐস্লামিক দেহ কথাটার কোন মানে দাঁড়ায় কি? সব মুসলমানের দেহের গঠন কি একরকম? আমার মাছ ভাত খাওয়া বাঙালি মুসলমান মাস্টারমশাই সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার রোগাসোগা লোক। আবার আমাদের পেস বোলার মহম্মদ শামি। দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ চেহারার উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা মুসলমান। এদের মধ্যে কার দেহের সঙ্গে বৈদান্তিক মস্তিষ্কের সমন্বয় চাইছিলেন বিবেকানন্দ?
অত তত্ত্বকথারও দরকার নেই, বাস্তব উদাহরণ দেখি। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দাঙ্গা করতে আমরা বাঙালিরা কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকিনি। ১৯৪৬ এর ১৬ই আগস্টের দাঙ্গাও বাইরে থেকে কেউ এসে করে দিয়ে যায়নি।
অতএব শুরু হয়ে যাওয়া ঝড় এবং আসন্ন প্রলয় আটকাতে হলে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে বাঙালি সংস্কৃতিমান, বাঙালি শান্তিপ্রিয়, বাঙালি দাঙ্গাবাজি করে না — এই একমাত্রিক পরিচিতিটা আপন মনের মাধুরী মিশায়ে আমাদেরই তৈরি করা। আসলে বাঙালিদের মধ্যে অন্য কোন জাতের লোকেদের চেয়ে পরধর্মবিদ্বেষী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দাঙ্গাবাজ লোক কম নেই। কোনদিন ছিলও না। বাঙালির বাংলাকে এক রাখতে রাখীবন্ধন করা রবীন্দ্রনাথ আছেন আবার হিন্দু, মুসলমান এক দেশের নাগরিক হতে পারে না — এই মনোভাবের শ্যামাপ্রসাদও আছেন। আমাদের “একই বৃন্তে দুটি কুসুম” লেখা, অসামান্য শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা নজরুল আছেন আবার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস লেলিয়ে দেওয়া সুরাবর্দিও আছেন। আপনি এদের মধ্যে কার উত্তরসূরি সেটা প্রমাণ হয় আপনার কথায় এবং কাজে।
অতএব আঙুলটা এবার নিজের দিকে তোলা যাক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভেতরের দৈত্যটার মুখোমুখি হওয়া যাক। এমনিতেও যে রাজ্যে আমরা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে অন্য রাজ্যের অন্য ভাষাভাষী মানুষ এসে সবকিছু বদলে দিচ্ছেন — এটা যদি সত্যি বলে মানতে হয় তাহলে এটাও মানতে হয় যে আমরা সব নিরেট মাথার লোক। গোটা ভারতকে ভাগ করা হচ্ছে, বাঙালিকেও ভাগ করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সেটা ভুলে আরো নতুন ভাগাভাগি তৈরি করবেন না দয়া করে। আদি অনন্তকাল ধরে মানুষ জীবিকার সন্ধানে এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাচ্ছে। এই ধারার বিরুদ্ধে কথা বলা যেমন অনৈতিহাসিক তেমনই অমানবিক। পৃথিবীর কোন প্রগতিশীল মানবগোষ্ঠী এর জন্যে কারো সাথে শত্রুতা করে না। এবং করতে ইচ্ছে করলে মনে রাখবেন, সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া থাকে এবং বহু বাঙালি পেশাগত কারণে সারা ভারতে ছড়িয়ে আছেন।
কী বললেন? হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ? সে তো সঙ্ঘ পরিবার, ভারত সরকার আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার করছে। তার জন্যে আপনার হিন্দিভাষী, রাম আর হনুমানের পূজারী প্রতিবেশী দায়ী হবেন কেন? আমাকে ছোট থেকে যাঁরা ঠেগুয়া খাইয়েছেন তাঁরা তো কখনো দাবী করেননি ছটপুজোয় ছুটি দিতে হবে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেন দিলেন সে প্রশ্ন তাঁকে করুন। এ রাজ্যের হিন্দিভাষীরা নিজেদের মত করে রামনবমী পালনও তো করে আসছেন বরাবর, অস্ত্রমিছিল করেননি তো। রাজনৈতিক দল কেন রাম আর হনুমানের পুজো করবে সে প্রশ্ন দিলীপ ঘোষ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে করুন, হিন্দিভাষীরা এর জবাব কেন দেবেন? এ তো আইসিসের অপরাধের জবাব এদেশের সাধারণ মুসলমানের কাছে চাওয়ার মত হয়ে গেল।
সত্যি কথা বলতে, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদকে মালার মত গলায় পরে নিচ্ছি আমরা নিজে — বাংলার চর্চা ক্রমশ কমিয়ে দিয়ে এবং ভাষাটার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে। কয়েক মাস আগে এক টেলিকম কোম্পানি তাদের ইংরিজি বিজ্ঞাপনের বাংলা তর্জমা খবরের কাগজে ছেপেছিল শুধু গুগল ট্রান্সলেটরের ভরসায়। ফলে সেটার হরফটাই যা বাংলা ছিল, ভাষাটা কী তা বোঝা ভগবানেরও অসাধ্য। এই সাহস ওরা তামিলনাড়ু, কর্ণাটক কি কেরালায় পায় না। এখানে যে পায় তার জন্যে দায়ী আমরাই, এ রাজ্যের হিন্দিভাষীরা নন। অন্য ভাষা শিখতে গেলে যে বাংলা ভুলতে হয় না সেটা নিজে বুঝলে এবং ছেলেমেয়েকে বোঝালে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ এমনিই ট্যাঁ ফোঁ করার জায়গা পাবে না।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading