একজিট পোল: অঙ্কে কাঁচার সমীক্ষা

ভোটদান হয়ে যাওয়া মাত্রই সমীক্ষক, সাংবাদিক তো বটেই; এমনকি ভোটারদেরও বোধহয় আর ইস্যু নিয়ে আগ্রহ থাকে না। সংখ্যাই তখন শেষ কথা।

অঙ্কে ভাল হতে না পারলে জীবন বৃথা — কথাটা বাবা বলতেন। অঙ্কের থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে, কোনমতে মাধ্যমিক পাস করার পরে আর অঙ্কের ছায়া না মাড়িয়ে দিব্যি চাকরি বাকরি পেয়ে গিয়ে বাবার দিকে সগর্বে তাকাতাম, ভাবখানা “হুঁ হুঁ, কেমন দিলাম?” বাবা বুঝতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। এখন জীবিত থাকলে নির্ঘাত পাল্টা বলতেন “কেমন দিলাম?” বুথফেরত সমীক্ষা বা এক্সিট পোলের ফলাফল এসে পড়েছে। সেগুলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হৈ হৈ করে প্রত্যাবর্তন[১] (পি মার্কসের সমীক্ষা) থেকে শুরু করে বিজেপির নিরঙ্কুশ পরিবর্তন[২] (ইন্ডিয়া টিভি-পিপলস পালসের সমীক্ষা) পর্যন্ত সবকটা সম্ভাবনাই দেখা গেছে। যেন এক্সিট পোলের ঈশ্বর রাবীন্দ্রিক দাড়িওয়ালা রবি শাস্ত্রী। বলছেন “মিত্রোঁ, অল থ্রি রেজাল্টস পসিবল।” একই নির্বাচনের এক্সিট পোলের ফলাফল কেন এমন আকাশ পাতাল হয় তা নিয়ে মাথা চুলকানো ছাড়া আর উপায় নেই। কারণ খেলা যখন ছিল অঙ্কের সনে, তখন লুকোচুরি খেলেছি। যা নয়ে হয় না, তা কি আর নব্বইতে হয়?

একা এক্সিট পোলে রক্ষে নেই, অতিমারী দোসর। টিভির পর্দা জুড়ে সম্ভাব্য আসন সংখ্যা, ভোট শতাংশ — এসবের সাথেই নেচে বেড়াচ্ছে করোনায় আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। কাল তিন লাখ আক্রান্ত হলে আজ চার লাখ, কাল আড়াই হাজার মানুষ মরে থাকলে আজ সাড়ে তিন হাজার। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে খবর নয়, লোটোর ফলাফল দেখছি। যাদের সংখ্যা মিলে যাচ্ছে তারা হয়ত আনন্দে আত্মহারা। যাদের মিলছে না তারা হয়ত কলসী দড়ি খুঁজছে। বা হয়ত দু পক্ষই কলসী দড়ি খুঁজে রাখছে, কারণ চাইলেই তো নিজের পছন্দসই একখানা সমীক্ষার ফল হাতের কাছে পাওয়া যায়। অপছন্দের ফলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে ভোরবেলা গঙ্গার পাড়ে প্রাতঃকৃত্য করতে বসা লোকেদের মত নিজের চোখ ঢেকে ফেললেই আরো দুটো দিন নিজস্ব বুদ্বুদে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। সে বুদ্বুদ সময় হলে আপনি ফাটবে, আঙুল দিয়ে ফাটানোর প্রয়োজন হবে না। তৃণমূল, বিজেপির বাইরে বাম, কংগ্রেস বা আই এস এফের সমর্থকদেরও উৎকণ্ঠ হয়ে থাকার কারণ আছে। তাঁদেরও শূন্য (ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়ার সমীক্ষা) থেকে ২৫ (এবিপি-সি ভোটারের সমীক্ষা) পর্যন্ত সবরকম সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে।

এমন বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইতে চাইতে মনে হয় আমরা সকলেই সংখ্যা হয়ে গেছি। ৪৭ফ, ৬৯ঙ ইত্যাদি। নইলে আমার মত অঙ্কে কাঁচা লোকের সাথে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোন তফাতই থাকে না! তাঁরাও অঙ্কের সাথে লুকোচুরি খেলেন! টিভি ক্যামেরা দেখাচ্ছে, মানুষ নিজে টুইট করছে, ফেসবুকে পোস্ট করছে অক্সিজেনের অভাবের কথা, হাসপাতালে শয্যার অপ্রতুলতার কথা। অথচ ঐ মহামান্য জনসেবকরা সগর্বে বলে চলেছেন কোথাও কোন অভাব নেই। ফুটপাথে সার বেঁধে মড়া পোড়ানোর দৃশ্য সবাই দেখতে পাচ্ছে, অথচ তাঁদের খাতায় মৃতের সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছাতেই চাইছে না। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর আরো সোজাসাপ্টা লোক। তিনি বলে দিয়েছেন চেঁচামেচি করলে মৃতেরা ফিরে আসবে না। অতএব সংখ্যা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। অনেকের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গেও নাকি সংখ্যা কমিয়ে বলা চলছে, তবে ওসব বলতে নেই। বিজেপি এসে যাবে। তাই আমিও বলছি না।

এখন কথা হচ্ছে সংখ্যা কি কথা বলে? আমাদের কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে? কোভিড জনিত সংখ্যার ভাষা তো মন্ত্রীসান্ত্রীরা বুঝছেন না দেখাই যাচ্ছে। আমরা কি বুঝছি? বুথফেরত সমীক্ষা থেকে তার কোন আঁচ পেলাম না। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের শেষ তিন দফা ভোটের সময় দেশের কোভিড পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়েছে, রাজ্যেরও। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানার পথে এবং পার্কে মড়া পোড়ানোর ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও কি সোনার বাংলার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করলাম আমরা? সমীক্ষায় তার কোন উত্তর পেলাম না। অবশ্য প্রশ্নটা করা হয়েছিল কিনা তা জানি না। দেড় বছর ধরে যে অতিমারী চলছে, তার মোকাবিলায় রাজ্যের তৃণমূল সরকার আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মধ্যে কোন তফাত দেখলেন কি ভোটাররা? তারও উত্তর রবিবার নির্বাচনের ফলে থাকবে হয়ত। নাকি থাকবে না? সিপিএমের কমিউনিটি ক্যান্টিন কি ভোটারদের প্রভাবিত করেছে? নাকি বিপদের সময়ে ত্রাণমূলক কাজ করার সঙ্গে সরকার চালানোর যোগ্যতার কোন সম্পর্ক নেই — এমনটাই ভোটারদের রায়? সে প্রশ্নের জবাবও খুঁজছিলাম। টিভিতে জনমত সমীক্ষা দেখানোর সময় যেভাবে ইস্যুভিত্তিক মত দেখানো হত, বুথফেরত সমীক্ষায় তেমন দেখলাম না। ফলে এ প্রশ্নের উত্তরও পেলাম না।

আসলে ভোটদান হয়ে যাওয়া মাত্রই সমীক্ষক, সাংবাদিক তো বটেই; এমনকি ভোটারদেরও বোধহয় আর ইস্যু নিয়ে আগ্রহ থাকে না। সংখ্যাই তখন শেষ কথা। খুব সম্ভবত ভোটের ফল বেরোবার সময়েও একই ঘটনা ঘটবে। “খেলা হবে” না “সোনার বাংলা” — কোন স্লোগান জিতল তা নিয়েই সরগরম থাকবে টিভি স্টুডিও। আমরাও বাহারী গ্রাফিক্স দেখে বোঝার চেষ্টা করব কোন এলাকা সবুজ ছিল, গেরুয়া হল; কোথায় গেরুয়া হয়ে গেল সবুজ। কারণ খোঁজার পরিশ্রম কে আর করতে চায়? শীতলকুচির আগে পরে ভোটদানে কোন পরিবর্তন লক্ষ করা গেল কিনা এ নিয়ে কোন আলোচনা হবে কি? একসময় হত। আজকাল এসব দুরাশা মনে হয়, কারণ যুগ বদলে গেছে, রোজ আরো বদলাচ্ছে। কদিন আগে অব্দিও জানতাম দলবদল হয় ভোটের পর। উত্তর-পূর্ব ভারতে হয়েছে, কর্ণাটকে হয়েছে, মধ্যপ্রদেশে হয়েছে, মহারাষ্ট্রে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে দেখা গেল ভোটের আগেই দলবদল। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের চেয়ে প্রচারে অনেক বেশি আলোচিত হল দলবদল। বুথফেরত সমীক্ষা নিয়ে আলোচনাতেও একটি চ্যানেলে বিজেপির মুখপাত্র একটুও লজ্জা না পেয়ে বলে দিলেন, মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন ওঁরা দুশো আসন না পেলে গদ্দাররা চলে যাবে। সুতরাং ফল যা-ই হোক, সরকার তো আমাদেরই হবে। আশঙ্কা হয়, ফল প্রকাশের দিনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে কে কে দল বদল করছেন। করলে বিধানসভার চেহারাটা কেমন হবে? মুহুর্মুহু রং বদলানো একটা গ্রাফিক হয়ত অনবরত আসবে আমাদের টিভির পর্দায়। জয়ী দলের মুখপাত্র গেয়ে উঠতেও পারেন “যদি আমাকে অসৎ বলো, আমি বলব অঙ্কে কাঁচা।”

তথ্যসূত্র:
[১]। https://www.anandabazar.com/elections/west-bengal-assembly-election/west-bengal-exit-poll-result-2021-tmc-may-win-this-election-with-a-tough-fight-with-bjp-maximum-exit-poll-shows-dgtl/cid/1278553

[২]। https://www.indiatvnews.com/elections/news-west-bengal-election-exit-poll-2021-with-india-tv-tmc-mamata-banerjee-bjp-congress-left-live-updates-701359

https://guruchandali.com/ এ প্রকাশিত

শীতলকুচির প্রতি ঈষদুষ্ণ ব্যবহার: সঙ্কোচের বিহ্বলতায় বাম রাজনীতি ম্রিয়মান

বামপন্থীরা কি কেবল বুলিতেই আটকে থাকবেন? বরাবর তো তাঁদের শক্তি ছিল দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় পথে নেমে আন্দোলন।

“এই নির্বাচন গুলি দিয়ে নয়, বুলি দিয়ে হওয়া উচিৎ”, বললেন সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম। মনে পড়ে গেল সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে রাম বিভীষণকে খোঁড়াতে দেখে বলছেন “যত তেজ বুঝি তোমার মুখেই।” জাম্বুবান পাশ থেকে টোন কাটছে “আজ্ঞে হ্যাঁ, মুখেন মারিতং জগৎ”। আসলে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এবং সিপিএম দলের ইতিহাস সম্বন্ধে ন্যূনতম, লোকের মুখে শোনা ধারণা থাকলেও বিশ্বাস করা শক্ত হবে যে গণতন্ত্রের চরম সঙ্কটের মুহূর্তে একজন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা লড়াই আন্দোলনের কথা বলছেন না, রাজ্য অচল করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন না। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এক কবি একদা লিখেছিলেন “রাস্তাই একমাত্র রাস্তা”, আর সেলিম বললেন বাকযুদ্ধই একমাত্র রাস্তা!

রাষ্ট্রের বন্দুকের গুলিতে চারজন মানুষের প্রাণ চলে যাওয়ার পর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। দোষীদের শাস্তি হয়নি, হবেও না। কারণ নির্বাচনকালীন প্রশাসন অজস্র অস্বস্তিকর প্রশ্ন না শোনার ভান করে আত্মরক্ষার স্বার্থে জওয়ানরা গুলি চালিয়েছিল বলে রায় দিয়ে ফেলেছে। ব্যবস্থা নেওয়া বলতে নির্বাচন কমিশন ৭২ ঘন্টা রাজনৈতিক নেতাদের ঐ এলাকায় ঢুকতে বারণ করেছে আর বাকি চার দফা নির্বাচনের প্রচার এক দিন করে কমিয়ে দিয়েছে। স্পষ্টতই, যে চারজনের প্রাণ গিয়েছে, সেই মনিরুজ্জামান, ছামিউল, হামিদুল আর নুর সম্বন্ধে নির্বাচন কমিশনের মনোভাব — পরের ছেলে পরমানন্দ। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির নেতা দিলীপ ঘোষ বলেই দিয়েছেন দরকার পড়লে আরো শীতলকুচি হতে পারে। ফলত নির্বাচন কমিশন স্বয়ংশাসিত সংস্থা — এ কথা এখন কলেজের ছাত্রদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষার উত্তর মাত্র। এমতাবস্থায় লক্ষ্মী ছেলের সংসদীয় রাজনীতি যে ভোটারদের সমর্থন আদায় করা আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্কটের মোকাবিলা করা — দুটোর কোনটার জন্যেই যথেষ্ট নয়, তা বিজেপি বিরোধী যে কোন রাজনৈতিক নেতার বুঝতে পারা উচিৎ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিলক্ষণ বুঝেছেন। তাই ঘটনার দিনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি করেছেন, শীতলকুচিতে তাঁর যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মৃতদের পরিবার পরিজনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছেন, প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছেন। আর বামপন্থীরা ইতিমধ্যে কী করলেন?

তাঁরাও প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। জেলায় জেলায় প্রতিবাদ হবে। যেমন প্রতিবাদ দলীয় বৃত্তের বাইরে থাকা কোন কোন সংগঠনও করছে। শীতলকুচির ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেই সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, সেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর আচরণের নিন্দা ছিল। বলেছিলেন যে দলের লোকই মারা গিয়ে থাক, নিন্দার ভাষা নেই। সঙ্গে ছিল এই বক্তব্য, যে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার প্রস্তাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী কেন ঘেরাও করার কথা বলেছিলেন, তার আগের ঘটনাবলী কী, সেসব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার সময় সম্ভবত সিপিএম নেতৃত্ব পাননি।

কোন সন্দেহ নেই তৃতীয় দফা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যে মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ভোটদান হয়েছে, বহু জায়গায় মানুষ দশ বছর পর নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছেন, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের আতঙ্ক কেটেছে, তাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বড় ভূমিকা রয়েছে। যাঁরা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বাদ দিয়ে ভোট করানো হোক দাবি তুলছেন এখন, তাঁদের চোখে হঠাৎ রাজ্য পুলিস ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেছে। রাজ্যের বহু মানুষ তাঁদের সাথে একমত হবেন না। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীও চুপচাপ ভোটারদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে তা নয়। রাজ্যের একাধিক জায়গা থেকে তাদের আচার আচরণ নিয়ে মানুষ প্রথম দফা থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন। কেউ বলছিলেন তারা বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, কেউ বলছিলেন তারাই উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আরো গুরুতর কিছু অভিযোগ উঠেছে, ভোটের ডিউটি করে এসে প্রিসাইডিং অফিসাররা সেসব সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ উঠেছিল হুগলী জেলা থেকে। সেখানে ৫ই এপ্রিল রাতে একটি দশম শ্রেণির ছাত্রীকে স্কুলবাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জওয়ান শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। সেই জওয়ানকে পুলিস গ্রেপ্তার করেনি। [১]

এই বাহিনীকে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘেরাও করার কথা বলে থাকেন, তার নিন্দা করা যেতে পারে বড় জোর এই মর্মে, যে এতে উত্তেজনা ছাড়বে, ভোটের মরসুমে তা কাম্য নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মানুষের মৃত্যুর পর মমতার ঐ উক্তিকেও উস্কানিমূলক আখ্যা দিয়ে সমানভাবে দায়ী করলে মনে হয়, মৃতেরা বা স্থানীয় মানুষ সত্যি সত্যিই জওয়ানদের আক্রমণ করেছিলেন, তাই তারা গুলি চালিয়েছে। অথচ তেমন কোন ভিডিও ফুটেজ বা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দুদিন পেরিয়ে গেলেও পাওয়া যায়নি। সাত তাড়াতাড়ি পুলিসের বক্তব্য বিশ্বাস করে ঐ বিবৃতি সুজনবাবু দিলেন কেন? ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কাগজের আজকের সংস্করণ পড়লে সুজনবাবু আরো ধন্দে পড়বেন। কারণ মঈনুদ্দিন চিস্তির প্রতিবেদন বলছে, যে মৃণাল হক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে নাকি জওয়ানরা তাকে সাহায্য করতে যায় এবং গুজব রটে তাকে মারধর করা হয়েছে, তা থেকে অশান্তি শুরু হয়, সেই মৃণাল হকের বাবা-মা বলছেন সে বাজারে গিয়েছিল, তাকে জওয়ানরা অকারণে মারধর করে। সত্য যা-ই হোক, নির্বাচন কমিশনে জমা পড়া রিপোর্টের সাথে এই বয়ান যে মিলছে না। [২] সংযুক্ত মোর্চার নেতৃবৃন্দের চোখেও এইসব অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। আজ কলকাতায় নির্বাচন আধিকারিকের সাথে দেখা করে বেরিয়ে তাঁরা যে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন তাতে তা-ই বোঝা গেল। তাহলে অন্য নেতার মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করার অত তাড়া ছিল কেন, সে প্রশ্ন রয়ে গেল। [৩]

তবু তো সুজনবাবুর বিবৃতিতে ঘটনার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিন্দার ভাগ বেশি ছিল। যত সময় গড়িয়েছে, বাম নেতা কর্মীদের ভাষ্যে নিক্তিতে মেপে বিজেপি আর তৃণমূলকে সমান দায়ী করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে সেলিমবাবুর সাংবাদিক সম্মেলন। শেষকালে তিনি অমিত শাহ আর মমতা — দুজনেরই পদত্যাগ দাবি করে বসলেন। অমিত শাহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে এই ঘটনা ঘটেছে — এমন অভিযোগ অনেকেই করছেন। ফলে সেলিম তাঁর পদত্যাগ দাবি করতেই পারেন। কিন্তু কেবল কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করতে বলেছেন বলে মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে, এ যুক্তি হাস্যকর। অবশ্য সেলিমের পক্ষ সমর্থনে বলা যেতে পারে যে তিনি ঐ দুজনের পদত্যাগ করা উচিৎ বলেই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে দেন, ফলে মমতার কেন পদত্যাগ করা উচিৎ তার যুক্তি ব্যাখ্যা করার সময় পাওয়া যায়নি। মনে কী দ্বিধা রেখে তিনি চলে গেলেন!

কোন যুক্তি যদি থেকেও থাকে, তা দুর্বোধ্য। কেউ বুঝেছেন বলে মনে হয় না। সাধারণ ভোটারের কাছে বরং এ কথাই প্রতিভাত হল, যে মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্যই যে এই গুলি চালনা, বিজেপি-বিরোধী ভোটারদের বার্তা দেওয়ার জন্যই যে এই নৃশংসতা — বামপন্থীরা তা বুঝলেন না বা বুঝতে চাইলেন না। আমরা তৃতীয় পক্ষ, আমাদের অন্য দুই পক্ষকেই আক্রমণ করতে হবে — এই রাজনৈতিক হীনমন্যতা তাঁদের বিজেপি-বিরোধী ভোটারদের নিজেদের দিকে টেনে আনার প্রয়োজন ভুলিয়ে দিল। বরং এই ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা কেবল সংখ্যালঘু নয়, সবরকম বিজেপি-বিরোধী মানুষ, যাঁরা তৃণমূলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মোর্চাকে ভোট দেবেন ভাবছিলেন, তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিল। অন্য দিকে এই নির্বাচন পর্বে সম্ভবত প্রথমবার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শক্তিশালী মনে হল। কারণটা আর কিছুই নয়। বিরোধিতাই তাঁর শক্তি, প্রশাসন চালানো নয়। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী হিসাবে তাঁকে আগাগোড়াই রক্ষণ সামলাতে হচ্ছিল। শীতলকুচির ঘটনা তাঁকে আবার বিরোধী নেত্রীর মত আক্রমণে যাওয়ার সুযোগ এনে দিল।

এ তো গেল বুলি নিয়ে কথাবার্তা। কিন্তু বামপন্থীরা কি কেবল বুলিতেই আটকে থাকবেন? বরাবর তো তাঁদের শক্তি ছিল দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় পথে নেমে আন্দোলন। এ বারের নির্বাচনে যে তাঁরা প্রবলভাবে আলোচনার মধ্যে চলে এলেন, তা-ও তো ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযানের পর। এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা দ্বিতীয় তো হলেনই, উপরন্তু সকালবেলায় শীতলকুচিতে গুলি চলার পরে সারাদিনে কোথাও নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষকদের বা বিজেপি নেতাদের ঘেরাও করার মত কোন ঘটনা ঘটল না। শুধু বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করা হল, ঘটনার দুদিন পরে নির্বাচন আধিকারিকের সাথে দেখা করে মোর্চার আপত্তিগুলো জানানো হল কেবল। এই ঈষদুষ্ণ ব্যবহার কি মৃতেরা তৃণমূলের লোক বলে? তাহলে এ-ও তো হীনমন্যতা।

প্রথম দুটো বেঞ্চের মধ্যে মারামারি হচ্ছে, আমি শেষ বেঞ্চের ছেলে, আমার কী আসে যায়? এই মানসিকতা নিয়ে কি বিরোধী রাজনীতি হয়? সমর্থন বাড়ানো যায়? সময় বলবে। তবে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সিপিএম বলে একটা পার্টি ছিল, যারা কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী খুন হওয়ার পর তাঁর নিজের পার্টি বনধ ডাকার আগেই বনধ ডেকে দিয়েছিল। যুক্তি ছিল, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন হত্যা করা আসলে ভারতের গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা। তারই প্রতিবাদে বনধ। জানি না ভোট দানের সময় অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আসা বাহিনীর গুলিতে সাধারণ ভোটারের হত্যা গণতন্ত্রকে হত্যা করার চেষ্টা কিনা, সে দিনের নেতারা থাকলে তৎক্ষণাৎ পরদিন বাংলা বনধ ডাকতেন কিনা। কোন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিরোধী আসনে থাকা দল, যদি প্রমাণ করতে চায় তার কাছে মানুষের জীবনের দাম আছে, তাহলে শুধু বুলিতে কি কাজ হয়? জাম্বুবানের ভাষায় “ঢাল নেই তলোয়ার নেই খামচা মারেঙ্গা”?

সূত্র :
১. NDTV
২. Telegraph India
৩. CPIM West Bengal Facebook Page

https://nagorik.net এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

‘পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেধার বহির্গমন বন্ধ করতে হবে’

দেখলে অবাক হবেন না, যদি মেদিনীপুরে কোন মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয় “তৃণমূলের শুভেন্দু অধিকারীর হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিপুল ভোটে জয়ী করুন”।

সিপিএম প্রার্থীদের মধ্যে এবার এক ঝাঁক নতুন মুখ। তাদের অন্যতম পৃথা তা। বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্রের প্রার্থী পৃথা সিপিএমের যুব ফ্রন্টের কর্মী হিসাবে গত কয়েক বছর দারুণ সক্রিয় থেকেছেন। তাঁর আরেকটা পরিচয়, তিনি প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক প্রদীপ তা-র কন্যা। পৃথার বাবা ২০১২ সালে বর্ধমান শহরে সিপিএমের একটি মিছিল চলাকালীন খুন হন। সেই সঙ্কট, যা যুগপৎ ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক, তা পেরিয়ে এসে পৃথা আজ বিধানসভায় প্রার্থী। এই যাত্রা এবং জরুরী রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো নিয়ে তাঁর সঙ্গে nagorik.net-এর পক্ষে কথা বললেন প্রতীক

প্রতীক: পৃথা, আপনি যে প্রজন্মের মানুষ তার দু-তিন প্রজন্ম আগে থেকেই বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েকে শেখাচ্ছেন “রাজনীতি খুব খারাপ জিনিস। রাজনীতির ধারে কাছে যাবে না।” এরকম বলার অনেক কারণের মধ্যে একটা অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার দীর্ঘ ইতিহাস। সেই হিংসা আপনাকে সরাসরি স্পর্শ করেছে। তারপরেও আপনি রাজনীতিতে এসেছেন। যারা রাজনীতিতে আসতে চায় তাদের কী বার্তা দিতে চাইবেন?

পৃথা: হিংসার বাতাবরণের কারণে বাবা-মায়েরা ভয় পান ঠিকই। কিন্তু যে কোন কাজেরই কিছু ইতিবাচক, কিছু নেতিবাচক দিক থাকে। রাজনীতিরও তাই। যারা রাজনীতি করতে আসবে, তাদের এগুলো মাথায় রেখেই আসতে হবে। আর সত্যি সত্যি রাজনীতিতে আসতে চাইলে বারণ করে কাউকে বেশিদিন আটকে রাখা যায় না।

প্রতীক: আপনার বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বেশ জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে। অল্পবয়সী ভোটারদের মধ্যে বিজেপি বেশ জনপ্রিয়। যারা সক্রিয়ভাবে বিজেপি করে না, তাদের কথাবার্তা বা সোশাল মিডিয়া পোস্টেও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা, প্রাচীনপন্থী মতামতের প্রাবল্য। এমন কেন হচ্ছে বলে মনে হয়? চিরকাল তো অল্পবয়সীরা বামপন্থীদের দিকেই আকৃষ্ট হত বেশি। বামপন্থীরা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না বলেই কি এরকম হচ্ছে?

পৃথা: এটা একেবারেই ভুল ধারণা। আমি গ্রামাঞ্চলে ঘোরা এবং কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অল্পবয়সীদের দক্ষিণপন্থার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ব্যাপারটা কলকাতাকেন্দ্রিক। সেই জন্যে চোখে পড়ে বেশি এবং এটাই প্রচার করা হয়। বাস্তব চিত্র একদমই অতটা খারাপ নয়। বরং বিরাট সংখ্যক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে মার খাওয়া দেখে, বিপদের সম্ভাবনা মেনে নিয়ে বাম রাজনীতি করতে আসছে। এটা কেমন জানেন তো? এই যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ছেলেমেয়েরা বাংলা বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে? এটাও কিন্তু শহরকেন্দ্রিক ধারণা। আমরা তো দেখি প্রচুর ছেলেমেয়ে বাংলা বই পড়ে। এগুলো আসলে তৈরি করা মিথ।

প্রতীক: আচ্ছা, বর্ধমানকে তো একসময় বাম দুর্গ বলা হত। সেখান থেকে পিছু হটতে হটতে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে ঐ জেলায় বামফ্রন্ট ২৫-এ পাঁচ আর লোকসভা নির্বাচনে তো শূন্যই। এটা কেন হল?

পৃথা: সব জায়গাতেই আমাদের শক্তি যে কমেছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্ধমানেও তাই হয়েছে। আবার সংগঠন নিজেদের মত করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, নতুন ক্যাডার বাহিনী তৈরি করার চেষ্টা করছে। আগেকার নানা কার্যকলাপে মানুষ অসন্তুষ্ট হয়েছেন, নানা কারণে মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মেছিল। সেগুলো স্বীকার করে নিয়ে সেইসব অভিযোগ মেটানো, হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।

প্রতীক: বিধায়ক হলে বর্ধমানের জন্য আলাদা করে কোন পরিকল্পনা আছে?

পৃথা: অবশ্যই, একগুচ্ছ পরিকল্পনা আছে। বর্ধমানের পৌরসভার সমস্যার কথা তো আগেই বললাম। তাছাড়া বড় নীলপুর মোড়ে একটা গেট তৈরি হল, তারপর সেটাকে ভেঙে দেওয়া হল, তাতে একগাদা টাকা তছরুপ হল। এই দুর্নীতির প্রতিকার করতে হবে। সবথেকে বড় কথা এটা নিরুপম সেনের কেন্দ্র। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বেকারদের জন্য স্বপ্ন বুনেছিলেন। আপনি যদি গড়িয়া থেকে করুণাময়ীর দিকে যান, দেখবেন রাস্তার দু পাশে ইনফোসিসের জন্য বরাদ্দ করা জমিতে একের পর এক বিলাসবহুল হোটেল উঠেছে। বড়লোক বাবুদের বাড়ির ছেলেরা সেখানে গিয়ে ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দেন, আর আমার আপনার বাড়ির ছেলেকে যেতে হয় বেঙ্গালুরুতে কাজ করতে। লকডাউন জুড়ে আমাদের কাছে অজস্র ফোন আসত “দিদি, মায়ের প্রেশার নেমে গেছে। একটু ওষুধটা কিনে বাড়িতে দিয়ে আসবে?” বা “বাবা বাজারে বেরোতে পারছে না, একটা ব্যবস্থা করে দেবে?” মানে প্রচুর মানুষ আছেন, যাঁদের ছেলেমেয়েরা কাজের জন্যে রাজ্যের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে থেকে মেধার এই বহির্গমন বন্ধ করতে হবে। অন্তত নিরুপম সেনের কেন্দ্রে তো বন্ধ করতেই হবে। নিরুপম সেন যেদিন বর্ধমানে হেরেছিলেন, তিনি হারেননি। আসলে পশ্চিমবঙ্গের বেকাররা হেরে গিয়েছিল। তাঁর স্বপ্নকে সত্যি করার লক্ষ্যে যত দূর করা সম্ভব আমি করব।

প্রতীক: আপনার বাবা খুন হওয়ার পরে শুনেছি খুবই কঠিন সময় কেটেছে আপনার পরিবারের। এখন আপনি ওখান থেকেই ভোটে দাঁড়িয়েছেন। কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

পৃথা: বাবা খুন হওয়ার পর আমার মা মাটি কামড়ে ওখানে পড়ে থেকেছেন, একদিনও বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। দুর্বিষহ অবস্থায় মা প্রায় একা লড়াই করেছেন, আমি উচ্চশিক্ষার কারণে কলকাতায় চলে যাই। আমাদের এলাকা ছাড়া করার সবরকম চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু মা-কে নড়াতে পারেনি কেউ। বর্ধমান শহর আমার নিজের শহর। এখানে হাজারো সমস্যা রয়েছে। বহু বছর ধরে পৌর বোর্ড নেই, নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল। তাছাড়া যে সমস্যাগুলো সব জায়গায় আছে, যেমন বেকারত্ব, কৃষক আত্মহত্যার মতই বেকারদের আত্মহত্যাও আজকের জ্বলন্ত সমস্যা। প্রচণ্ড দুর্নীতি সরকারের সব ক্ষেত্রে, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও। ফসলের দাম, নারীর নিরাপত্তা — এরকম যে ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে আমরা লড়ছি সেগুলোও আর সব জায়গার মতই বর্ধমানেরও ইস্যু। সেগুলো নিয়ে মানুষের কাছে যখন যাচ্ছি, খুব ভাল সাড়া পাচ্ছি। কেবল ভোটের অঙ্কের কথা নয়। লাল ঝান্ডা কাঁধে ভোট আমার কাছে মাইলস্টোন। শেখার সুযোগ, বাড়ি বাড়ি যাওয়ার একটা সুযোগ পার্টি আমাকে এনে দিয়েছে। সেই সুযোগটা সৎভাবে কাজে লাগাতে চাই। কিন্তু ভোট হয়ে যাওয়ার পরেও আমাকে লম্বা পথ হাঁটতে হবে। আমি নির্বাচনকে শেখার ধাপ বলে মনে করি। তাই খুব ভাল লাগছে যে বহু মানুষ এসে মন খুলে কথা বলছেন, কোন জড়তা নেই।

প্রতীক: একটা অভিযোগ বা প্রচার আছে যে লোকসভা নির্বাচনে বামেরা বিজেপিকে ভোট হস্তান্তর করেছিল। যদি প্রচারটা ভুলও হয়, এ কথা তো সত্যি যে বামেদের ভোট কমেছিল এবং বিজেপির ভোট বেড়েছিল। এবার কি সেই প্রবণতা বদলাবে?

পৃথা: এটা সত্যি যে কিছু মানুষ একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, তৃণমূলের যে চোর ডাকাত বদমাইশদের জন্য নাভিশ্বাস উঠছে সকলের, বিজেপি এসে তাদের শায়েস্তা করবে। আলাদা করা বামেদের দেগে দেওয়া উচিৎ নয়, অনেক মানুষই এমনটা মনে করেছিল। কিন্তু প্রথমত বিজেপির মনুবাদী এজেন্ডা, তাকে কায়দা করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া, দেশের সম্পদ এক এক করে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া, কৃষকদের উপর অকথ্য অত্যাচার… এতগুলো মানুষ দিল্লীর রাস্তায় বসে বসে মরে গেল অথচ প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে পাঁচ মিনিটের জন্য গিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না… এগুলো মানুষ দেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তারা খেয়োখেয়ি, দলাদলির যে আবহ তৈরি করেছে সেটা মানুষের মনে প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি এখনো ঠিক করে প্রার্থী তালিকাই প্রকাশ উঠতে পারল না, কারণ বিজেপি মাছের ভেড়ির মত হয়ে গেছে। বাজারে মাংস কাটার পর যেমন উদ্বৃত্ত নাড়ি ভুঁড়ি মাছের খাবার হিসাবে ভেড়ির লোকেরা নিয়ে যায়, তেমনি যার যা অপচয়, সব বিজেপি নেবে বলে বসে আছে। দেখলে অবাক হবেন না, যদি মেদিনীপুরে কোন মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয় “তৃণমূলের শুভেন্দু অধিকারীর হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিপুল ভোটে জয়ী করুন”। এই পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সোনালি, রুপালি সবাই বিজেপিতে যাচ্ছেন। অতএব বিজেপি আর তৃণমূল যে একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ তা বুঝতে মানুষের আর অসুবিধা হচ্ছে না। এর পাশে আমরা আমাদের মতাদর্শ, কাজকর্ম নিয়ে দাঁড়াচ্ছি। সব মিলিয়ে আমাদের এবারের ফল নিশ্চয়ই ভাল হবে।

প্রতীক: বিজেপি সরকারের কথা যখন তুললেন তখন বলি, আপনাদের ইশতেহারে বলা হয়েছে সংযুক্ত মোর্চার সরকার হলে এ রাজ্যে এন আর সি, সি এ এ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু একটা সমালোচনা হচ্ছে যে এই ইস্যু নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে যতটা সোচ্চার হওয়া উচিৎ আপনারা তা হচ্ছেন না। কী বলবেন?

পৃথা: এটা সঠিক সমালোচনা নয়। আমি নিজেই তো প্রচারে এ নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছি। অন্য প্রার্থীরাও বলছেন। এন আর সি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত যে অঞ্চলগুলোতে উদ্বাস্তুরা এসে বসত করেছেন সেখানে তো কথাই নেই। যাদবপুরে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি মানুষের মধ্যে কি সাংঘাতিক আতঙ্ক। যাঁরা সকালবেলায় ক্যানিং, গোসাবা ইত্যাদি এলাকা থেকে পরিচারিকার কাজ করতে আসেন বা দিনমজুরি করতে আসেন, তাঁরা ভয়ের চোটে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ‘এই কার্ড নেই, সেই কার্ড নেই’ আতঙ্কে। সেই কারণে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এন আর সি – সি এ এ নিয়ে আমরা প্রচার করেছি। এখনো ভোটের প্রচারে সেই প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি আমরা এ-ও দেখলাম যে মোদীর এত বিরোধী দিদি, তাঁর দলের সাংসদ, যাদবপুরের মত উদ্বাস্তু আন্দোলনের ইতিহাস থাকা এলাকার সাংসদ নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভোট দিতে উপস্থিত থাকলেন না সংসদে।

প্রতীক: বিশেষ করে আপনি মহিলা বলে একটা প্রশ্ন অবশ্যই করা দরকার। বামেদের সাথে আই এস এফ-এর জোট অনেকের পছন্দ হয়নি। আপনাদের অনেক সমর্থকেরও ব্যাপারটা ভাল লাগেনি, কারণ অনেকের মতে আই এস এফ সাম্প্রদায়িক দল। আরেকটা বড় কারণ আব্বাস সিদ্দিকির বেশ কিছু নারীবিদ্বেষী মন্তব্য, যার ভিডিও সুলভ। বিশেষত নুসরত জাহানের পেশা এবং অন্য ধর্মের লোককে বিয়ে করা নিয়ে আব্বাস যা বলেছেন। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?

পৃথা: দেখুন, যে দলগুলো মিলে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করেছে তারা যদি সব ব্যাপারে একমত হত, তাহলে তো একটাই দল হত। অনেক বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য তো আছেই। এই মুহূর্তে ধর্ম দিয়ে মানুষকে ভাগ করার যে খেলা এ দেশে বিজেপি – আর এস এস চালু করেছে, তার বিরুদ্ধে যে আছে তাকেই আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। সে কংগ্রেসই হোক আর আই এস এফ-ই হোক। আব্বাসের ঐ মন্তব্যগুলো একদমই অনুচিত, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে উনি ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে উনি দলিতদের অধিকারের কথা বলেছেন; জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের অধিকারের সপক্ষে বলেছেন। আই এস এফ যে সংগঠনগুলোকে নিয়ে তৈরি হয়েছে, তাদের দিকেও যদি তাকান, দেখবেন তারাও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের অধিকারের কথা বলছে। আমি যে পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি তার মধ্যে থেকে বামপন্থী রাজনীতিতে আসা স্বাভাবিক, কিন্তু যে একেবারে অন্য আবহে অন্যরকম ভাবনা চিন্তায় বেড়ে উঠেছে, তাকে আমি আমার রাজনীতি দিয়ে প্রভাবিত করতে পারছি। সে-ও আমার মতাদর্শের সবটা না মানলেও দু-চারটে কথা বলছে। আমার মনে হয় এটা বড় সাফল্য। আগের সব কথাবার্তা সত্ত্বেও আব্বাস এখন যে রাজনীতির কথা বলছেন, ব্রিগেডে যার কিছুটা দেখা গেছে, তা আশাব্যঞ্জক। সাধুবাদ না দিয়ে পারা যায় না। ভারতের সংবিধান রক্ষা করার লড়াইয়ে আমাদের সকলকে প্রয়োজন, তাই সবাইকে নিয়েই লড়ছি।

ছবি ঋণ : ফেসবুক । পৃথার অঙ্কনচিত্রের শিল্পী তৌসিফ হক। শিল্পীর অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি ঋণ cpimwb.org.in

নেমে আসুন ভোটারের সমতলে

ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না।

কিছুদিন পরে পরেই, বিশেষ করে কোন নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে, বিজেপি-বিরোধী মানুষজন সমাজ মাধ্যমে, একান্ত আলাপচারিতায় এবং লিখিত রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বিস্ময় প্রকাশ করেন “এত কিছুর পরেও লোকে ওদের সমর্থন করছে!” বা “এত কিছুর পরেও বিজেপি জিতে গেল!” এত কিছু, অর্থাৎ অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া; সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর পরিকল্পিত, রাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট হিংসা; আইনশৃঙ্খলার অবনতি; গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষের চরম আর্থিক দুর্দশার পাশাপাশি অতি ধনীদের আরো ফুলে ফেঁপে ওঠা; দুর্বার গতিতে একের পরে এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি হওয়া; দুর্নীতির বৈধতা পেয়ে যাওয়া; সাংবিধানিক অধিকারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। ২০২০-তে এর সাথে যোগ হল কোরোনাভাইরাসকে প্রথমে সরকারের পাত্তা না দেওয়া, পরে আচমকা লকডাউন, তার ফলে গরীব দিন আনি দিন খাই মানুষের অবর্ণনীয় জীবনযাপন ও মৃত্যু। তার সাথে যোগ হল চিকিৎসার অব্যবস্থা সম্বন্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থালা বাজানো, মোমবাতি জ্বালানোর মত গিমিক। কম পরীক্ষা করে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলেও অনেকের অভিযোগ।

এত কিছুর পরেও বিজেপি নির্বাচনে জেতে। অন্তত উড়ে যায় না। কেন হয় এরকম? দেখা যায় বিজেপির বিরুদ্ধে যাঁরা — রাজনৈতিক দল, চিন্তাবিদ, সাধারণ মানুষ — তাঁরা সকলেই এর কতকগুলো সাধারণ কারণ খুঁজে পান। সেগুলো মোটামুটি এরকম — ১) সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ, ২) বিজেপির অসম আর্থিক প্রতিপত্তি, ৩) বিজেপি আই টি সেলের প্রোপাগান্ডার তীব্রতা এবং ৪) নির্বাচন কমিশনের গান্ধারীবৃত্তি। কেউ কেউ মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের বৃহদংশের নির্লজ্জ চাটুকারিতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করাকেও সঙ্গে যোগ করেন।

সব সত্যি। কিন্তু কবির ভাষায় বললে “সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।”

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এন ডি এ সরকারের কর্মতৎপরতার যে তালিকা সকলের সামনে রয়েছে, তাতে গত কয়েক মাসে যোগ হয়েছে নতুন কৃষি আইন। এই আইন পাশ করা হয়েছে অভূতপূর্ব অগণতান্ত্রিক উপায়ে এবং এর বলে ভারতীয় কৃষকদের একেবারে কর্পোরেট গোলামে পরিণত করা যাবে। গরীব, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের ভাত ডাল আলুসেদ্ধটুকুর নিশ্চয়তাও উধাও হবে। এর পরেও কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তায় ধস নামতে দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকের আশঙ্কা। ফলে যাঁরা দক্ষিণপন্থার ঘোষিত বিরোধী — রাজনৈতিক দলের সদস্য বা পার্টি আনুগত্যহীন ব্যক্তি — যা-ই হোন না কেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিস্ময় ক্রমবর্ধমান। এমনকি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরাও বলে থাকেন “এত কিছুর পরেও…!” ফলত হতাশা। আর সেই হতাশার কারণে নির্বাচনের ফল বেরোবার পর বিজেপি-বিরোধীরা কিছু ভয়াবহ দক্ষিণপন্থী আচরণ শুরু করেন। যেমন অনেকে বলতে শুরু করেন “মুসলমানগুলো কেন অমুক পার্টিকে ভোট না দিয়ে তমুক পার্টিকে ভোট দিল?” কেউ আবার সমস্ত দোষ ইভিএমের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন (যদিও মনে করার কারণ নেই যে ইভিএম সম্পূর্ণ নির্দোষ)। এই আচরণ সাধারণ সমর্থক থেকে উচ্চস্তরের পার্টি নেতা পর্যন্ত সকলকেই করতে দেখা যায়। এই বিশ্লেষণে “সবাই বিজেপি হয়ে গেছে” — এই বিশ্বাস ক্রমশ ঘাড়ে চেপে বসে, বিজেপির লাভ হয়। কিন্তু এই বিশ্লেষণ একমাত্রিক। বিরোধী বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা ভেবে দেখবেন, নির্বাচনে (বিশেষ করে বিধানসভায়) যে মাইক্রো ইস্যুগুলো কাজ করে, সেগুলোকে এই বিশ্লেষণে অগ্রাহ্য করা হয়। সে কারণেই বিজেপিকে আটকানোর উদ্দেশ্যে বলা হয় “আর যাকে ইচ্ছা ভোট দিন, বিজেপিকে দেবেন না।”

একথা যাঁরা বলেন, বা বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের রামধনু জোটের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা সকলেই ন্যূনতম লেখাপড়া জানেন। শ্রেণীর দিক থেকে মধ্যবিত্ত বা তদূর্দ্ধ। প্রায় সকলেরই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে; নিদেন পক্ষে রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান এবং স্পষ্ট মতামত আছে। এঁরা জানেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতবাদ ও কার্যকলাপ কতটা ভয়ঙ্কর। ফলে তাঁদের কাছে সব নির্বাচনই হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে ভারতীয়ত্বের লড়াই। বিজেপি যেমন বাইনারি তৈরি করেছে সারা দেশে — দেশদ্রোহী আর দেশপ্রেমিক — অনেকটা একই আদলের আরেকটা বাইনারি এঁদের মনেও তৈরি হয়ে রয়েছে। ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি যে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না, দেওয়া সম্ভব নয় — একথা বুঝতে সারা দেশের বিজেপি-বিরোধীদের কেবলই ভুল হয়ে যাচ্ছে। এ ভুল না করলে কত দূর লড়া যায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিহারের নির্বাচনে।

কোন সন্দেহ নেই, যদি দেশের সর্বত্র সবকটা নির্বাচন ভারত ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে কি থাকবে না, গণতান্ত্রিক থাকবে নাকি একদলীয় একনায়কতন্ত্র হয়ে যাবে — কেবল এই ইস্যুতে লড়া যেত, তবে চমৎকার হত। দুঃখের বিষয়, তা সম্ভব নয়। তেমন দেশ তৈরি করার জন্য আমরা সঙ্ঘবিরোধীরা ৬৭ বছর (১৯৪৭-২০১৪) সময় পেয়েছিলাম। পারিনি। এখন রাতারাতি ভারতেরে সেই স্বর্গে জাগরিত করতে চেয়ে অ্যালার্ম ঘড়ি বাজিয়ে দিলেই রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে না। আপনি জানেন হিটলার কে, নাজি কারা, ফ্যাসিবাদ কী ক্ষতি করে। আপনার বাড়ির কাজের মেয়ে জানে না। এখন যদি ন্যুরেমবার্গ ল-এর সাথে সাদৃশ্য আছে বলে মোদী সরকারের পাশ করা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করতে বলেন, সাবধান করেন “আর যাকে ইচ্ছে ভোট দাও, বিজেপিকে দিও না”, তার বয়ে গেছে আপনার কথা শুনতে। কেবল গ্রামের গরীব মানুষ, শহরের বস্তিবাসী বা কাজের মেয়ের কথাই বা কেন? নিজেদের লেখাপড়া জানা আত্মীয়স্বজনদেরই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, ফ্যাসিবাদ কী কজন জানে? যে চেতনা তৈরিই হয়নি, সে চেতনার কাছে আবেদন করে কোন সাড়া পাওয়ার আশা করা কি উচিৎ?

সত্যি কথা বলতে, পৃথিবীর কোথাও কোন নির্বাচনই সম্পূর্ণত মতাদর্শের লড়াই হয় না। হওয়া উচিৎ কিনা তা-ও ভেবে দেখা দরকার। ধরা যাক, একটা দেশের সরকার রাস্তাঘাট সারায়নি পাঁচ বছর ধরে, রোজ দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ তারা দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি মাসে সংবর্ধনা দেয়। এই দলের কি ভোট পাওয়া উচিৎ? গণতন্ত্রে নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকারই শিরোধার্য, রাজনৈতিক দলের ভোট পাওয়ার অধিকার নয়। ভোটার ঠিক করবেন তিনি কোন কোন ইস্যুর ভিত্তিতে ভোট দেবেন। রাজনৈতিক শক্তিগুলো, সে কোন দল হোক বা ব্যক্তি, ভোটারের মত পাওয়ার জন্য অন্যদের চেয়ে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। “আমরা বিজেপি নই, অতএব আপনার ভোট পাওয়া আমাদের অধিকার” — কোন দল এমন বলতে পারে না। বললে সেটাই অগণতান্ত্রিক। যদি কেউ বলে “অমুক দল বিজেপি নয়, অতএব ওকে ভোট দেওয়া আপনার কর্তব্য”, তাহলে তা-ও অগণতান্ত্রিক। কারণ রাজনৈতিক দলের কর্তব্য ভোটারের চোখে নিজেকে অন্যদের চেয়ে উন্নত (অন্তত স্বতন্ত্র) হিসাবে প্রমাণ করা। তা করতে না পারলে, বিজেপির চেয়ে ভাল কোন বিকল্প দিতে না পারলে, ভোটার কেন ভোট দিতে যাবেন?

দেশের অধিকাংশ নির্বাচনেই কিন্তু বিজেপি-বিরোধীরা বিকল্পহীন হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন। ভোটারের সামনে বিজেপির অন্যায়গুলোর তালিকা প্রস্তুত করছেন কেবল। নিজেরা তার বদলে কী কী সদর্থক কাজ করবেন, তা বলছেন না। অনেক ক্ষেত্রে আবার বিজেপির রাজনীতিই অনুসরণ করে নির্বাচনে লড়ছেন। মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে যেমন কংগ্রেস গোশালা বানিয়ে দেওয়া, রাম পথ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতেছিল। সরকারটা স্বভাবতই বেশিদিন টেকেনি। আমরা যারা ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তারা কংগ্রেসের সেই জয়ে উল্লসিত (অন্তত আশ্বস্ত) হয়েছিলাম। গণ্ডগোলটা ওখানেই। বিজেপির নীতি কংগ্রেস নিলে যদি আমাদের আপত্তি না থাকে, কার্টুনিস্টকে তামিলনাড়ু সরকার গ্রেপ্তার করলে যদি আমরা হট্টগোল না করি, আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের উপর তৃণমূল কংগ্রেস সরকার জলকামান চালালেও যদি আমরা চুপ করে থাকি এবং বলি ওরা বিজেপি নয়, তাই ভোট ওদেরই প্রাপ্য, তাহলে বিজেপির হাতই শক্ত হয়। কথাটা আরো বেশি করে সত্যি পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে, যেখানে বিজেপি কখনো ক্ষমতায় আসেনি। জলকামানে ভিজে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলো বা তাদের পরিবার ফ্যাসিবাদ দ্যাখেনি, জলকামান দেখেছে। ত্রিপুরা রাজ্যের চাকরি চলে যাওয়ায় আত্মঘাতী শিক্ষক উত্তম ত্রিপুরার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তাদের বিজেপিকে ভোট দেওয়া থেকে নিরস্ত করা কি সম্ভব তখন আর?

এ রাজ্যে এখন পর্যন্ত লড়াইটা বিজেপির ইউটোপিয়া বনাম বিরোধীদের ইউটোপিয়া। বিজেপি সোনার বাংলার কথা বলছে। সে বাংলায় কর্মসংস্থান কী করে হবে বলছে না। আলটপকা ৭৫ লক্ষ চাকরির কথা বলেই ঢোঁক গিলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের সমস্যা জানতে এবং মেটাতে সরকারকে দুয়ারে দুয়ারে নিয়ে গেছে, অথচ কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে মুখে কুলুপ। বহুকাল ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে নিয়োগ নিয়ে চলতে থাকা অচলাবস্থার কোন স্থায়ী সমাধানের কথা সরকার বলছে না। কেবল এক প্রস্থ নিয়োগের ঘোষণা হয়েছে। তৃণমূল বরং বিজেপির ইউটোপিয়ার বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে এমন এক বাংলার ইউটোপিয়া, যার ইতিহাসে কেবল রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, নজরুল, লালন, ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদনরা আছেন। একে ইউটোপিয়া বলছি, কারণ বাংলায় এঁদের পাশাপাশি তারাও ছিল যারা রামমোহনের বিরোধিতা করেছিল, বিদ্যাসাগরকে খুনের চেষ্টা করেছিল, নজরুল সম্বন্ধে বলত “ফার্সি শব্দে কবিতা লেখে! সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।” ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল বাঙালিরাই। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির কথা তো সকলেই জানে। এই ইউটোপিয়ার লড়াইয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করা শক্ত। এমনিতেও এই ইউটোপিয়াগুলো অধিকাংশ মানুষকে ছুঁতে পারছে না।

তৃতীয় পক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট এসবের বাইরে গিয়ে বলবেন কি, কী হবে রাজ্যের ধুঁকতে থাকা স্কুলশিক্ষার? স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা কি আবার স্বমহিমায় ফেরত আসবে তাঁরা ক্ষমতায় এলে? রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের পাওনাগন্ডারই বা কী হবে? সারা দেশের কৃষকদের সাথে এদেশের কৃষকরাও তো স্বখাতসলিলে ডুবছেন। তাঁদের জন্যই বা কী পরিকল্পনা? শিল্পায়ন নিয়ে কী চিন্তা ভাবনা তাঁদের? ওটা না হলে গরীব মানুষের কর্মসংস্থানের কী হবে? কেন্দ্র যেভাবে রাজ্যের প্রায় সব ক্ষমতাই কেড়ে নিচ্ছে, সরকারে এলে কিভাবে লড়বেন তার বিরুদ্ধে?

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সর্বত্রই বিজেপি বিরোধীদের বিকল্প কর্মসূচী হাজির করতে হবে, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সরকারের অন্যায় তুলে ধরা, সমালোচনা করা বিরোধীদের একটা কাজ। একমাত্র কাজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ নিরাশ হয়ে পড়তে পারেন। বিরোধী রাজনীতি কিন্তু নৈরাশ্যবাদের জ্বালানিতে চলে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। ভোটারের চারপাশের বাস্তব পরিস্থিতি, তার কাছে জরুরী ইস্যুগুলো কী, সেসব না ভেবে যদি লাল, সবুজ, ধূসর সব রং মিলে গিয়ে এমন একটা ইস্যুতে লড়াই করে — যা অধিকাংশ ভোটারের কাছে কোন ইস্যুই নয়, তাহলে দক্ষিণপন্থা জিতেই চলবে। আমি ইউটোপিয়ায় প্রাণপণে যা-ই চাই না কেন।

%d bloggers like this: