কাশ্মীরের ভ্যালেন্টাইন

কাশ্মীরে কি আর্চি’স গ্যালারি আছে? সেখানে লাল টুকটুকে হৃদপিণ্ড কিনতে পাওয়া যায়?

প্রমাণ নেই, তবে সাক্ষী আছে। আমি কাশ্মীর গিয়েছি। তখন ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ নয়। বাবা-মা কার থেকে যেন চেয়ে চিন্তে ক্যামেরাও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জম্মু থেকে বাসে চাপার পর খেয়াল হয় ফিল্ম কিনে নিয়ে যাওয়া হয়নি। দাম্পত্যের তারুণ্যে যেরকম ভুল হয়ে থাকে আর কি। তখন ভ্যালেন্টাইন্স ডে না থাকলেও প্রেম তো ছিলই।

গল্পটা শোনার পর থেকে কাশ্মীর বললে প্রথমেই প্রেম মনে হয়। তারপর সাদা কালো টিভিতে ‘কাশ্মীর কি কলি’ দেখলাম। বঙ্গললনা শর্মিলার লালিমা সে টিভিতে বিশেষ ধরা পড়েনি। তবু কাশ্মীর মানেই রোম্যান্স, কাশ্মীর মানেই প্রেম — এ একেবারে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে ঢুকেছি। যে মাস্টারমশাই জর্জ বার্নার্ড শ পড়াবেন তিনি অ্যান্টি রোম্যান্টিক নাটক পড়াবেন বলে ক্লাসে জিজ্ঞেস করলেন রোম্যান্টিক বললেই কী মনে আসে? সশব্দ চরণেই প্রেম এসে পড়ল। তখন জিজ্ঞেস করলেন রোম্যান্টিক ফিল্ম বলতে কার কোনটা মনে পড়ে? ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ এর মাঝখানে আমি বলে ফেললাম ‘কাশ্মীর কি কলি’। মাস্টারমশাই চোখ কপালে তুলে পরিষ্কার বাংলায় বললেন “এ তো ঠাকুরদাদার আমলের ছবি, বাবা। তুমি কি সেই যুগের লোক নাকি?” সেই গঞ্জনাও আমাকে দাবায়ে রাখতে পারেনি। তার আগে এবং পরেও যার প্রতিই মনটা দ্রব হয়েছে তাকেই বলার চেষ্টা করেছি “বরসোঁ সে খিজা কা মৌসম থা, উইরান বড়ি দুনিয়া থি মেরি।” বেশিরভাগ যে শুনতে পায়নি বা পেলেও আশা ভোঁসলের মত জবাব দিতে রাজি হয়নি সে কথা আলাদা।

ইতিমধ্যে আবার ‘রোজা’ এসে পড়েছে। তার পোস্টারে পর্যন্ত গোলাপ ফুল। তামিল দম্পতির “ইয়ে হসিঁ ওয়াদিয়াঁ ইয়ে খুলা আসমাঁ” তে দুষ্টু মিষ্টি মধুচন্দ্রিমার আত্মার উপর ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের নরকের দুঃস্বপ্ন। উফ! কি রোম্যান্টিক! এক শর্মিলায় রক্ষে নেই, মধু দোসর।
ঐ যে বলে বয়স বাড়া ভাল নয়? ঠিকই বলে। কাশ্মীর নিয়ে মাখো মাখো রোম্যান্স ভেঙে গেল বয়স বাড়তেই। সে-ও অবশ্য নারীঘটিত ব্যাপার। অরুন্ধতী রায়। কে যে ওঁকে কুনান পোশপোরা ইত্যাদি যাচ্ছেতাই ব্যাপার নিয়ে লিখতে বলে! তবু চলে যেত বলিউডে মগ্ন থাকলে, সব মাটি করলেন বিশাল ভরদ্বাজ। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট পড়ে যদি কেউ কাশ্মীরের কথা ভাবে, তাকে ঠেকানো শক্ত। কি যে বিপদ করেছেন ভরদ্বাজ বামুন আর বাশারাত পীর মিলে! এখন কাশ্মীর বললেই, প্রেম বললেই শর্মিলা নয়, মধুও নয়, শ্রদ্ধা কাপুরের কবর মনে পড়ে।

তা ভাবছিলাম কাশ্মীরে কি আর্চি’স গ্যালারি আছে? সেখানে লাল টুকটুকে হৃদপিণ্ড কিনতে পাওয়া যায়? ছ মাস আগের স্টকে ঝুল পড়ে যায়নি? পোকায় কাটেনি? আচ্ছা ওখানকার ছেলেমেয়েরা হোয়াটস্যাপে প্রেম করছে আবার? কাদের যেন হোয়াটস্যাপ অ্যাকাউন্ট নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গেছে শুনেছিলাম?

ও হ্যাঁ, ‘শিকারা’ নামে একটা ছবি বেরিয়েছে। সেটাও প্রেমের ছবি। না বললে লোকে বলবে “কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কথা তো বললেন না?” কী করে বোঝাই প্রেম আর উদ্বাস্তু একসাথে বললে আমার প্রথমেই সুপ্রিয়া দেবীর কথা মনে পড়ে!
আচ্ছা গত ছ মাসে কতজন কাশ্মীরি পণ্ডিত কাশ্মীরে ফেরত গেছে কেউ বলতে পারবেন? যারা গেছে তারা কি ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করছে? রবাবে বলিউডি গান দারুণ জমে কিন্তু। ধরুন আপনি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত মহিলা, ঝিলামের ধারে বসে চোখ বন্ধ করে শুনছেন একটি সুপুরুষ কাশ্মীরি ছেলে বাজাচ্ছে “এক থা গুল ঔর এক থি বুলবুল।”

আহা! চটছেন কেন? লাভ জিহাদে উস্কানি দিচ্ছি না। ও গানটায় শশী কাপুর আর নন্দা ছিলেন। দুজনের কেউই মুসলমান নন। শশীর দাদা শাম্মিও মুসলমান নন, শর্মিলা তো খোদ ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। অতএব ওসব ছবি দেখলে আজও দোষ নেই।

ভাবনা করা চলবে না

আপনার যদি গণতন্ত্র নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা থেকে থাকে এবং বিজেপির দেশপ্রেমের চশমা সরিয়ে আপনি যদি ফ্যাসিবাদ দেখতে পেয়ে থাকেন, তাহলে যতবড় বামবিরোধীই হোন না কেন, এই সত্য মেনে না নিয়ে আপনার উপায় নেই যে শুধু বামপন্থীরাই পড়ে আছেন

ফ্যাসিবাদের একটা মহৎ গুণ আছে — অতি উৎকৃষ্ট ছাঁকনির কাজ করে। কেন বলছি?
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন নানা দিক থেকেই অনন্য ছিল। যেমন ধরুন, বামপন্থী পরিবারে জন্মে, বরাবর বামপন্থী রাজনীতির কাছাকাছি থেকে যা দেখতে পাইনি, এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে পরে তেমন এক ঘটনা দেখলাম। শক্তি কমে আসা বামপন্থীরা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেলেন, নিজেদের মধ্যে কোন আদর্শগত মতানৈক্যে নয়, কোন অবাম দলকে সমর্থন করা উচিৎ, কাকে উচিৎ নয় তাই নিয়ে।
এক দল বললেন বিজেপি যেহেতু দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ, তাই ওদের হারাতে সকলের সাথে জোট করতে হবে। তবে কিনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর বিজেপির তফাত উনিশ বিশ। তাই ওঁকে বাদ দিয়েই করতে হবে এই জোট। কংগ্রেস অতীতে যা-ই করে থাক, ওদের সাথে থাকতেই হবে এই পরিস্থিতিতে। ওরা আর যা-ই হোক বিজেপি তো নয়। অস্যার্থ, একলা লড়তে ঠিক সাহস পাচ্ছি না। তাছাড়া সারা দেশে লড়ার শক্তিও নেই। অতএব ওরা লড়ুক, বাফারের কাজ করুক। আমরা তো রইলামই।
আরেক দল বামপন্থী উপর্যুক্ত বামেদের প্রবল আক্রমণ করলেন। বললেন ওঁরা ক্ষমতা হারানোর আক্রোশে, ক্ষুদ্র স্বার্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করছেন। বরং মমতার হাতই শক্ত করা উচিৎ। বাঁচালে উনিই পারেন বাঁচাতে। উনিই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে অগ্রণী সৈনিক। অস্যার্থ, আমাদের তো শক্তি নেই। উনি নেতৃত্ব দিন, আমরা লড়ে যাব।
নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর দু পক্ষই যে ভুল ছিলেন তা পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখা গেল প্রথম দল কংগ্রেসের লড়ার ক্ষমতায় আস্থা রাখলেও ভোটাররা রাখেননি। উলটে কংগ্রেস কী করবে আর কী করবে না তা নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে বিজেপি বা মমতার বিরোধী হিসাবে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে। যে ভোট নিজেদের ছিল সেগুলো ধরে রাখার কাজটাও ঠিক করে করা হয়নি।
দ্বিতীয় দলের ভোটের হিসাবে হারানোর মত কিছু ছিল না। সম্ভবত সেটাই তৃণমূলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের সবচেয়ে বড় কারণ। ভোটের ফলে দেখা গেল তাঁরা যে নেত্রীর উপর ভরসা করেছিলেন তাঁর উপর ভোটারদের যথেষ্ট ভরসা নেই।
ভোটের আগে বহু বাম এবং মধ্যপন্থী বন্ধুদের সাথে অনলাইন ও অফলাইনে ঝগড়া করেছি এই বলে যে বিজেপিকে আটকাতে হবে এই যুক্তিতে কোনরকম রামধনু জোট করলে কোন লাভ হবে না, বরং বিজেপির কাজ আরো সহজ হবে। এমনিতেই গত কয়েক বছরে ঘরে ঘরে যত্ন করে জমিয়ে তোলা ধর্মান্ধতা, মুসলমানবিদ্বেষের পরিমণ্ডলে অন্য সব ইস্যু যে পেছনে চলে যেতে পারে সেই আশঙ্কা করতে খুব বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। তার উপর বালাকোট যে মানুষকে অন্য সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে সে তো এতদিনে পরিষ্কার। কিন্তু রামধনু জোট কেন সারা দেশের কোথাও কাজ করল না তার অন্য কারণও তলিয়ে দেখা দরকার। সেটা করা খুব সহজ হয় বিজেপির জয়ের পর যারা এই নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী ছিল তাদের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে।
কংগ্রেসকে দিয়েই শুরু করা যাক। যে বামপন্থী দলগুলো কংগ্রেসকে ঢাল ভেবেছিলেন তাঁরা মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস সরকারের বিজেপিসুলভ কর্মসূচীকে পাত্তাই দেননি। গোশালা বানিয়ে দেব, রাম পথ বানিয়ে দেব — এসব বলে যারা বিধানসভা নির্বাচন জেতে, তাদের যদি ভোটাররা লোকসভায় ভোট না দেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি? যদি কেউ হিন্দুত্বের জন্যেই ভোট দেবে ঠিক করে, তাহলে আগমার্কা হিন্দুত্বকেই দেবে, নকল হিন্দুত্বকে কেন দেবে? বিধানসভায় নাহয় রাজ্য সরকারের কাজকর্মে রুষ্ট হয়ে কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া গেল, লোকসভায় আর কেন? শুধু মধ্যপ্রদেশ? গুজরাটের নির্বাচনের সময়ে বিজেপি প্রশ্ন তুলল “রাহুল গান্ধী কি হিন্দু?” কংগ্রেস উত্তর দিল “উনি শুধু হিন্দু নন, রীতিমত পৈতেওলা হিন্দু।” বামফ্রন্ট (ওটা কি আছে এখনো? বহরমপুর কেন্দ্রে সিপিএম কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করার পরেও?) নেতৃত্ব এই পার্টির হাত ধরে হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়বেন ভেবেছিলেন। এসব অবশ্য লোকসভা নির্বাচনের আগের কথা। তারপর থেকে কংগ্রেস কী কী করেছে?
ইউ এ পি এ আইন এবং এন আই এ আইনের সংশোধনী, যেগুলো ব্যক্তির নাগরিক অধিকারে শেষ পেরেক পুঁতেছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রাজ্য সরকারের যে অধিকার তাতে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিয়েছে, কংগ্রেস সেই সংশোধনগুলো নিয়ে বিতর্কে নানা গরম গরম কথা বলে শেষে রাজ্যসভায় পক্ষে ভোট দিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুতে সোনিয়া আর রাহুল গান্ধী সরকারের বিপক্ষে দাঁড়ালেও রোজ কোন না কোন কংগ্রেস নেতা সরকারকে সমর্থন করছেন। এমনকি পি চিদম্বরম গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে জয়রাম রমেশ, শশী থারুরের মত নেতা, যাঁরা সুললিত ইংরেজিতে গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি বলে গত কয়েক বছরে প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছেন, তাঁরা বলতে শুরু করেছেন মোদীর অবিমিশ্র সমালোচনা করা নাকি ঠিক নয়। সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজারা ভেবেছিলেন এদের হাত ধরে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন।
এবার তৃণমূল কংগ্রেসের কথায় আসা যাক। নকশাল, এস ইউ সি আই প্রভৃতি বামপন্থীরা এই দলটির সর্বোচ্চ নেত্রীকেই মুক্তিসূর্য ভেবেছিলেন, ২০১৬ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া সত্ত্বেও। তা তৃণমূল কী করেছে ভোটের পর থেকে?
এক কথায় বললে মহুয়া মৈত্র একটা মারকাটারি বক্তৃতা দিয়েছেন লোকসভায়। ব্যাস, আর কিচ্ছু না। ইউ এ পি এ আইনের সংশোধনী নিয়ে আলোচনায় বক্তৃতাটি দিয়ে ফেসবুক এবং ইউটিউবে কয়েক হাজার লাইক কুড়ানোর পর তৃণমূল সদলবলে ভোট দিয়েছে সরকারের পক্ষে। আর এন আই এ আইন নিয়ে ভোটাভুটিতে ওয়াক আউট করে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছে। এ তো গেল সংসদের ভেতরের কথা। বাইরে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার ঢল নেমেছে নির্বাচনের পর থেকে। তা আটকাতে অসমর্থ হয়ে শীর্ষ নেত্রীর বিজেপির থেকেও বেশি বিজেপি হওয়ার প্রয়াসও বেড়েছে। বিজেপি অযোধ্যায় রামমন্দির বানাবে, ইনি দীঘায় জগন্নাথ মন্দির বানাবেন বলছেন। একদিকে চা ওয়ালার সাফল্য দেখে চা ওয়ালীকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে বরাবরের রণং দেহি মূর্তি বিসর্জন দিয়ে কেন্দ্রের সাথে সংঘাতে যাবেন না বলছেন।
তারপর আসা যাক অখিলেশ আর মায়াবতীর কথায়। দুজনে সব অতীত বৈরিতা ভুলে উত্তরপ্রদেশে একজোট হয়ে লড়েছিলেন। সেই জোটের উপরে আমরা বিজেপিবিরোধীরা সকলেই অনেক আশা (নাকি দুরাশা?) করেছিলাম। পরাস্ত হওয়ার পর থেকে সংসদে আনা সমস্ত অগণতান্ত্রিক বিলে অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি আর মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি লক্ষ্মী হয়ে সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সংবিধানকে এবং গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে কাশ্মীরিদের প্রতি যা করা হল, আম্বেদকরের নামে শপথ নেওয়া মায়াবতীর পার্টি তাতেও বিনা বাক্য ব্যয়ে সমর্থন জানিয়েছে।
হিন্দুত্ববাদের সূতিকাগার, মোদী-শাহের ইন্দ্রপ্রস্থ যে গুজরাট, সেখানে তিন মহারথী এক হয়েছিলেন বিজেপিকে হারাবেন বলে। বামপন্থী, আম্বেদকরপন্থী জিগ্নেশ মেওয়ানি হাত মিলিয়েছিলেন চরম প্রতিক্রিয়াশীল উচ্চবর্ণের জন্যে সংরক্ষণ দাবী করা নেতা হার্দিক প্যাটেলের সাথে। এই বিপরীত মেরুর রাজনীতি কী করে মিলতে পারে তা নিয়ে যখন জিগ্নেশকে প্রশ্ন করা হয়েছিল নির্বাচনের আগে, তখন তিনি বলেছিলেন আগে তো বিজেপিকে হারাই, তারপর ওসব বুঝে নেব। বিজেপি বৃহত্তম বিপদ, আগে ওদের হারাতে হবে — এই যুক্তিতে তিনি আবার পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টদের পরামর্শ দিয়েছিলেন দিদির হাত শক্ত করতে। ফলাফলে দেখা গেল পরেরটা পরে হবে যুক্তি মানুষ বিশ্বাস করেননি। জিগ্নেশ আর হার্দিকের সঙ্গে জুড়েছিলেন কংগ্রেস নেতা অল্পেশ ঠাকোর। অল্পেশ এখন বিজেপিতে, হার্দিক নির্বাচন কমিশনের বদান্যতায় নির্বাচনে লড়তে না পারার পর থেকে চুপ, জিগ্নেশ একা পড়ে গেছেন।
আর কে বিজেপিবিরোধী ছিলেন? অরবিন্দ কেজরিওয়াল। অর্থাৎ আম আদমি পার্টি। ওঁদের কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। দিল্লীতে যে ওঁরা একটা আসনও জিততে পারেননি সেটা বড় কথা নয়। বিজেপির কয়েক হাজার কোটি টাকার নির্বাচনী প্রচার, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পার্টিজান কার্যকলাপের মধ্যে আপের মত একটা ছোট পার্টির না জিততে পারা দোষের নয়। কিন্তু বরাবরের লড়াকু কেজরিওয়াল কেমন যেন মিইয়ে গেছেন নির্বাচনের পর থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা নিয়ে তাঁর আর কোন বক্তব্য নেই। দিল্লীকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হোক এই দাবী তিনি কবে থেকে করে আসছেন। অথচ জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে তিন টুকরো করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া হল, তিনি সমর্থন করলেন।
দেবগৌড়ার দল নিজেদের বিধায়ক, সাংসদ বিক্রি হওয়া আটকাতে পারছেন না, ডি এম কে ও সরকারের বাধ্য সন্তান।
তাহলে বাকি রইল কারা? কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স আর হায়দরাবাদের আসাদুদ্দিন ওয়েসিকে (যিনি লম্বা দাড়ি রাখেন আর ফেজ পরেন বলে আমরা মৌলবাদী বলে ধরেই নিয়েছি, যদিও গেরুয়া পরা সাংসদদের দেখে মৌলবাদী মনে হয় না) বাদ দিলে, বাকি রইলেন বামপন্থীরা। আপনার যদি গণতন্ত্র নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা থেকে থাকে এবং বিজেপির দেশপ্রেমের চশমা সরিয়ে আপনি যদি ফ্যাসিবাদ দেখতে পেয়ে থাকেন, তাহলে যতবড় বামবিরোধীই হোন না কেন, এই সত্য মেনে না নিয়ে আপনার উপায় নেই যে শুধু বামপন্থীরাই পড়ে আছেন। বস্তুত, এন আই এ আইনে রাজ্য সরকারকে ঠুঁটো জগন্নাথ আর এন আই এ কে সর্বশক্তিমান করে দেওয়ার বিপক্ষে লোকসভায় ভোট দিয়েছিলেন ঠিক ছজন — চার বাম সাংসদ আর ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং ওয়েসি।
ফ্যাসিবাদ ছেঁকে দিয়েছে। এখন থেকে ভারতে তার যত বিরোধিতা হবে, যেটুকু বিরোধিতা হবে তার নেতৃত্ব বামপন্থীদেরই দিতে হবে। তাঁরা চান বা না চান, বিজেপিকে তাত্ত্বিকভাবে ফ্যাসিবাদী বলে মানুন বা না মানুন। কারণ বাফারগুলো আর নেই, আর থাকবে না। কেউ সি বি আই, ই ডি ওষুধে জব্দ, কেউ নিজের ক্ষমতাটুকু ধরে রাখতে পারলেই খুশি, কাউকে স্রেফ কিনে নেওয়া গেছে এবং যাবে। কিন্তু বামপন্থীদের দিকে সিবিআই, ই ডি লেলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ তাঁদের দুর্নীতি নেই। পশ্চিমবঙ্গের কিছু সেজ নেতা ছাড়া কাউকে কিনে ফেলাও যাচ্ছে না।
এই পর্যন্ত পড়ে আপনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন, কারণ চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে সিপিএমের দুর্নীতিগ্রস্ত এল সি এস, পঞ্চায়েত সদস্য, পঞ্চায়েত প্রধানের মুখ আপনার মনে পড়বে, পড়া সঙ্গত। কিন্তু মনে রাখবেন, ভারতে এ পর্যন্ত ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে যে দুটি বামপন্থী দল, তাদের আমলে সরকারী স্তরে দুর্নীতি ভারতের অন্য যে কোন রাজ্যের চেয়ে কম৷ আর কোন দলে আপনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা মানিক সরকার বা পিনারাই বিজয়নের মত জীবনযাত্রার মুখ্যমন্ত্রী দেখাতে পারবেন কি? ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মত সৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে কজন পাওয়া গেছে বাজার অর্থনীতির যুগে? সদ্যপ্রয়াত নকশাল নেতা এ কে রায় বা শঙ্কর গুহনিয়োগীর কথা নাহয় না-ই বললাম। না-ই আলোচনা করলাম যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রমমন্ত্রী এস ইউ সি আই নেতা সুবোধ ব্যানার্জির কথা। তাঁরা তো প্রাগৈতিহাসিক লোক বলে গণ্য হন আজকাল।
এখন প্রশ্ন, বামপন্থীরা লড়বেন কী করে? কতটুকু শক্তি তাঁদের? আর এস এস (বিজেপি তো ফ্রন্ট মাত্র) নামক কর্পোরেটপুষ্ট বেহেমথের সামনে তাঁরা কতটুকু? যদি বামপন্থী বলতে ক্রমহ্রাসমান সিপিএম বোঝেন তাহলে সত্যিই তাঁরা পারবেন না। যদি সীমিত সাংগঠনিক শক্তির সি পি আই বোঝেন তাহলে তাঁরাও পারবেন না। যদি আলাদা করে সি পি আই (এম-এল) লিবারেশন বোঝেন তাহলে নিঃসংশয়ে বলা যায় তাঁরাও পারবেন না। কিছু কিছু অঞ্চলে শক্তিশালী এস ইউ সি আই বা আর এস পি, ফরোয়ার্ড ব্লক — এঁরা কেউই পারবেন না। কিন্তু এঁরা সকলে যদি একত্র হন, তাহলে শক্তিটা উড়িয়ে দেওয়ার মত হয় না। এঁরা এক হলেই কি জিতে যাবেন? বা জনসমর্থন পাবেন? এক এক করে উত্তর ভাবা যাক।
কে যেন বলেছেন “I do not fight fascists because I will win. I fight fascists because they are fascists.” এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় কথা নেই। সমস্ত বামপন্থী শুধু নয়, সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় দেশপ্রেমিক মানুষেরই এই কথাটাই শিরোধার্য করা দরকার। বড় কথা হল সমস্ত বামপন্থী এক হতে পারবেন কিনা।
লোকসভা নির্বাচনের আগে ৩রা ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্টের ডাকা ব্রিগেড সমাবেশে লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের উপস্থিতিকে বৃহত্তর বাম ঐক্যের পূর্বাভাস বলে যাঁরা আশা করেছিলেন, অচিরেই তাঁদের ভুল ভেঙে যায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে সিপিএমের উদগ্রীব উন্মাদনায়। আজকের সঙ্কটেও, ভয় হয়, বাম ঐক্যের চেয়ে বৃহত্তম বামপন্থী দলটির নেতৃত্বের কাছে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের সখ্য বেশি প্রার্থনীয় না হয়। আরো আশঙ্কা এই যে ঐক্যের প্রচেষ্টা হলে হয়ত লিবারেশন কর্মীরা বলবেন “অমুক বছর যে আমাদের অমুক কমরেডকে ওরা মেরেছিল?” প্রত্যুত্তরে সিপিএম কর্মীরাও অনুরূপ হিংসার ইতিহাস তুলে ধরবেন। এস ইউ সি আই বলবেন “সিপিএম সংশোধনবাদী”, আর সিপিএম বলবেন “ওরা আবেগসর্বস্ব অতি বাম। বিপ্লবের পক্ষে ক্ষতিকর।”
এই যদি চলতে থাকে, তাহলে ভারতে বামপন্থী বলে আর কেউ তো থাকবেই না, বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা যায় ভারত ব্যাপারটাই আর থাকবে না।
এবার জনসমর্থনের প্রশ্ন। বামপন্থীরা সমর্থন পাবেন, কিন্তু পেতে গেলে ঠিক করতে হবে কাদের সমর্থন চাইছেন। সকলের সমর্থন কথাটার আজ আর কোন মানে নেই। ভারতে এখন ঔপনিবেশিক শাসন চলছে না। হিন্দু ফ্যাসিবাদ বাইরে থেকে আসা জিনিস নয়। তাই একে পরাস্ত করতে মহাত্মা গান্ধী যেরকম দল মত ধর্ম জাতি নির্বিশেষে সব ভারতবাসীকে এক করতে চেষ্টা করেছিলেন, সেরকম প্রচেষ্টার কোন মানে হয় না। স্পষ্টতই ভারতে যে সামাজিক ওলট পালট হয়নি অথচ হওয়া উচিৎ ছিল ইতিহাসের নিয়মে, এখন তারই সময়। অর্থাৎ এখন পক্ষ নেওয়ার সময়। বামপন্থীরা, যদি সত্যিই বামপন্থী হন, তাহলে আক্রান্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুর পক্ষ নেবেন। নিম্নবর্ণের মানুষের পক্ষ নেবেন। সারা পৃথিবীতে, আমাদের দেশে তো বটেই, জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণকে গ্রাস করতে উদ্যত পুঁজিবাদ। পুরো গ্রহটারই ধ্বংস সাধনে উদ্যত, সরকারপুষ্ট বৃহৎ পুঁজি। ধ্বংস থেকে বাঁচতে হলে অরণ্যের অধিকার অরণ্যবাসীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। তাই বামপন্থীদের আদিবাসীদের পক্ষেও অবশ্যই থাকতে হবে।
সব মিলিয়ে এঁরাই কিন্তু এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তবে এঁদের পক্ষে দাঁড়াতে হলে বামপন্থীদের দীর্ঘকাল সমর্থন করতেন এমন অনেক মানুষের সমর্থন হারানোর ঝুঁকিও কিন্তু নিতে হবে। গোড়াতেই বলেছি ফ্যাসিবাদ অতি উৎকৃষ্ট ছাঁকনি। সেকথা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে সত্যি তা নয়। চারপাশে তাকালেই দেখা যাচ্ছে, জীবনে কখনো বামপন্থীদের ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দেননি এমন বহু মানুষের সুপ্ত মুসলমানবিদ্বেষ কেমন বেরিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের ভোট এক লহমায় ২৩% থেকে ৭% এ নেমে আসার পেছনে এঁরা বড় কারণ। অবশিষ্ট সাত শতাংশের অনেকেও যে “কাশ্মীরকে বেশ টাইট দেওয়া গেছে” ভাবছেন না এমনটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদীরা আরো সূক্ষ্ম ছাঁকনি প্রয়োগ করতে চলেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং চাকরিতে বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে। তাতে যে বহু বাম সমর্থক উচ্চবর্ণের মানুষই উল্লসিত হবেন তা পরিষ্কার। বর্ণবাদকে আলাদা করে বোঝার প্রয়োজন নেই, শ্রেণীর লড়াই ছাড়া আর কোন লড়াই নেই — এই ভ্রান্তির ফল তখন বামপন্থীদের ভুগতে হবে। অর্থাৎ আরো অনেক সাবেকি সমর্থক সরে যাবেন। বামপন্থীরা সে ঝুঁকি নেবেন তো? এখন অবশ্য তাঁদের আর হারানোর কিছুই নেই। আর কবি তো বলেছেনই “তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে। তা বলে ভাবনা করা চলবে না।”

Where is the hosh?

আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ঐ মানুষগুলোকে এরকম জালনিবদ্ধ রোহিতের মত মরতে হয় কেন?

আমাদের এলাকায় পাড়ার লোকেরা মিলে অপেশাদার যাত্রা করেন বহুকাল থেকে। ছোটবেলায় চোখ বড় বড় করে দেখতাম মঞ্চের উপর যুদ্ধ হত, রাজা মন্ত্রী সৈনিক মরত, তারপর যেই আলো নিভে যেত অমনি তড়াক করে উঠে মঞ্চ থেকে চলে যেত। আমার বাবাও অভিনয় করতেন বলে যাত্রা শেষ হওয়ার পরে গ্রীনরুমে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। মৃত অভিনেতারা অন্ধকারের মধ্যে উঠে চলে যেতেন বলে শিশু বয়সে আমার কিন্তু সন্দেহ রয়েই যেত, লোকটা সত্যি বেঁচে আছে কিনা। গ্রীনরুমে গিয়ে পাড়াতুতো কাকু, জেঠু বা দাদুকে মেক আপ তুলতে দেখে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করা অব্দি আমার বুক দুরদুর করত। একটু বড় হওয়ার পর সেকথা মনে করে নিজের কাছেই বিস্তর লজ্জা পেয়েছি। তবে এখন বুঝতে পারি লজ্জা পাওয়ার কোন কারণ ছিল না। ধেড়ে ধেড়ে লোকেরা যখন সত্যিকারের যুদ্ধ, সত্যিকারের সৈনিকদের জীবনকে যাত্রার মতই নেহাত খেলা মনে করে, তখন বছর পাঁচেকের ছেলের যাত্রাকে সত্যি ভাবা কী আর এমন দোষের?
কাল পুলওয়ামায় বিয়াল্লিশ জনের মৃত্যুর পর থেকে অনলাইন এবং অফলাইনে লোকের যা প্রতিক্রিয়া দেখছি তাতে মনে হচ্ছে যুদ্ধ নেহাত যাত্রা বৈ তো নয়। তাও ভাল, উরির পরে পাকিস্তানে পরমাণু বোমা ফেলার প্রস্তাব দিচ্ছিল অনেকে, এবারে শুধু আরেকখানা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের আবদার করেই ক্ষান্ত আছে। চারিদিকে বেশ একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। বিজেপি মুখপাত্র রাম মাধব দেখলাম টিভিতে বলছেন পাকিস্তানকে এমন জবাব দেব, ওরা ভুলতে পারবে না ইত্যাদি। ডি ডি ইন্ডিয়াতে আবার দেখলাম এক পলিতকেশ ভদ্রলোক বলছেন পাকিস্তান এটা করেছে নির্বাচনে বিরোধীদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্যে। অর্থাৎ সম্ভবত, এখন থেকে ঘটনার তদন্ত এবং যাদের গাফিলতির ফলে এতগুলো মানুষের নিরুপায় মৃত্যু হল তাদের শাস্তিবিধানের চেয়ে সরকার যে ব্যাপারটায় গুরুত্ব দেবে সেটা হল যারা সরকারকে প্রশ্ন করবে তাদের দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া (কে জানে হয়ত জেলে দেওয়া বা গণপিটুনি দেওয়াও)। মাধববাবু যেমন বুম ধরা সাংবাদিকটিকে ধমকে বলেই দিলেন “আপনার কমিউনিটির যারা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে তাদের বিচ্ছিন্ন করার সময় এসে গেছে।“
কিছু করার নেই, মেনে নিতে হবে। দেশে এখন দেশপ্রেমিক সরকার। আই এস আই চিহ্নিত। পাকিস্তানের নয়, প্রশান্ত মহলানবীশের।
২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস যখন বাকি তখন এক দীর্ঘ ট্রেনযাত্রায় এক মিত্রকে বলছিলাম কেন আমি মোদী ক্ষমতায় আসুন চাই না। সে প্রায় সবটাই মেনে নিয়েও বলল “মোদী ক্ষমতায় এলে আর কিছু না হোক, পাকিস্তানকে একটু ঠুকে দেওয়া যাবে।“ যে দেশটাকে মোদীজির ঠুকে দেওয়ার কথা ছিল, হঠাৎ সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাতনির বিয়েতে গিয়ে কোলাকুলি করেছেন। ওটা নাকি স্টেটসম্যানসুলভ কাজ। তারপর হল পাঠানকোটে হামলা। অতঃপর পাকিস্তানের আই এস আইকে আদর করে ডেকে এনে (বিরিয়ানি খাওয়ানো হয়েছিল কিনা উজ্জ্বল নিকম জানতে পারেন) ভারতের সেনা ছাউনি পরিদর্শন করতে দেওয়া হল। ওটা বোধহয় নিউ ইয়র্ক টাইমসসুলভ ছিল। তারপর হল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এবং তা নিয়ে সিনেমা। এছাড়াও হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা ওয়ান র‍্যাঙ্ক ওয়ান পেনশন পাননি বলে দিল্লীর যন্তর মন্তরে অনশন করছিলেন, তাঁদের কলার ধরে স্থানচ্যুত করা হয়েছে। বি এস এফ, সি আর পি এফ জওয়ানরা ঠিকমত খেতে পান না, অফিসাররা অন্যায় ব্যবহার করেন — এই অভিযোগ করে সোশাল মিডিয়ায় ভিডিও আপলোড করেছিলেন। প্রতিকার পাননি, গলাধাক্কা পেয়েছেন। আর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ কিরকম কমে গেছে সে তো দেখাই যাচ্ছে পাঁচ বছর ধরে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ফলে নাকি সব তছনছ হয়ে গেছে শোনা যাচ্ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে সে গুড়েও বালি। নোটবন্দির ফলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ উঠে যাবে কথা ছিল, তাও হল না। এরপরেও এখনো দেখছি অনেকের অনেক আশা মোদীবাবুর উপরে। কোন কোন বাঙালির দেশপ্রেমের ভার বাংলা ভাষা বইতে পারছে না। তাই হিন্দিতে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন “মোদীজি সব কুছ রোক দো, বাস পাকিস্তান কো ঠোক দো।”
পাকিস্তান একটি সেনা আর মৌলবাদী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র, যার ভারতে অশান্তি সৃষ্টি করা ছাড়া প্রায় কোন কাজ নেই। তাদের সাহায্যপ্রাপ্ত সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপে এতজন সি আর পি এফ জওয়ানের প্রাণ গেল। ফলে রাগ, দুঃখ সবই বৈধ। কিন্তু এই যে প্রতিশোধ ইত্যাদি শব্দগুলো বুড়িমার চকলেট বোমের মত ব্যবহার করছি আমরা — এই প্রতিশোধ নিতে যাবেটা কে? আমি, আপনি তো নয়ই, রাম মাধব আর ভিকি কৌশল পর্যন্ত যাবেন না। যাবেন স্বাস্থ্যবান নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা, যাঁরা এই দেড়শো কোটির দেশের বিপুল কর্মসংস্থানের সমস্যার অন্যতম শিকার। তা এই প্রশ্ন কবে তুলবেন যে আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ঐ মানুষগুলোকে এরকম জালনিবদ্ধ রোহিতের মত মরতে হয় কেন? কাশ্মীরের মত বিপদসংকুল এলাকায় আটাত্তরটা গাড়ির বিরাট কনভয় আড়াই হাজার জওয়ানকে নিয়ে একত্রে চলাচল করে কোন দুঃখে? বিশেষত যেখানে গোয়েন্দা বিভাগ আগেই আক্রমণের সম্ভাবনা জানিয়েছিল? পাকিস্তানের সেনা, সরকার, সন্ত্রাসবাদী — কেউই তো আপনার হাতে নেই। যে সরকারটা আপনার হাতে তাকে এই প্রশ্নগুলো করবেন না?
অবশ্য এমনটা বললে অন্যায় হবে যে এই সরকারের আমলেই প্রথম এত কিছু ঘটল। কক্ষনো না। মহান লিবারাল নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে সন্ত্রাসবাদীরা ভারতের মাটি থেকে বিমান হাইজ্যাক করে আফগানিস্তানে চলে যায়নি? সে কি নরেন্দ্র মোদীর দোষ? কার্গিলে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে পড়েনি? সে কি মোদীর দোষে? মৃত সৈনিকদের কফিন নিয়ে কেলেঙ্কারি হয়নি? তার জন্যেও কি মোদী দায়ী? খোদ সংসদ ভবনে আক্রমণ হয়েছে। সেটাও কি বেচারা মোদীর ঘাড়ে চাপাব এখন?
আসলে আগমার্কা দেশপ্রেমিকদের আছে টনটনে মান আর বিপুল জোশ। কিন্তু রামকৃষ্ণ আবার বলেছিলেন “যার মান আর হুঁশ আছে সে-ই মানুষ।” মান আর জোশ তো অর্ধমানবেরও থাকে। সেটা একবার স্বয়ং বিবেকানন্দ টের পেয়েছিলেন।

বিঃ দ্রঃ দয়া করে “ছিঃ! সৈনিকের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করছেন?” জাতীয় মন্তব্য করবেন না। পৃথিবীর কোথাও সশস্ত্রবাহিনীর মানুষ অরাজনৈতিক কারণে নিহত হন না। মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লড়ানো একটি ঘোরতর রাজনৈতিক ক্রিয়া।