সত্যান্বেষী পাঠক জাগুন, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবর লিখতে হবে

সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ইতিবাচক না লিখলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে না — এই ঘোষণা প্রমাণ করে অগণতান্ত্রিকতা জয়যুক্ত হয়েছে। এই জয়ে বাংলার সংবাদমাধ্যমের অবদানও ফেলে দেওয়ার মত নয়।

ব্যোমকেশ জানালার দিক্ হইতে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল— “কিছুদিন থেকে কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে, লক্ষ্য করেছ?”

আমি বলিলাম— “না। বিজ্ঞাপন আমি পড়ি না।”

ভ্রূ তুলিয়া একটু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশ বলিল— “বিজ্ঞাপন পড় না? তবে পড় কি?”

“খবরের কাগজে সবাই যা পড়ে, তাই পড়ি— খবর।”

“অর্থাৎ মাঞ্চুরিয়ায় কার আঙুল কেটে গিয়ে রক্তপাত হয়েছে আর ব্রেজিলে কার একসঙ্গে তিনটে ছেলে হয়েছে, এই পড়! ওসব পড়ে লাভ কি? সত্যিকারের খাঁটি খবর যদি পেতে চাও, তাহলে বিজ্ঞাপন পড়।”

— পথের কাঁটা (ব্যোমকেশ সমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স; পঞ্চদশ মুদ্রণ, মে ২০১১)

বাংলার সংবাদমাধ্যমের যা অবস্থা হয়েছে, তাতে আজও সত্য জানার আগ্রহে যাঁরা খবরের কাগজ পড়েন তাঁরা সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের সাথে এই প্রশ্নে একমত না হয়ে পারবেন না। তা বলে কখনোই কোনো কাজের খবর ছাপা হয় না বললে নিদারুণ অবিচার হবে। যেমন কয়েকদিন আগেই সর্বাধিক বিক্রীত বাংলা সংবাদপত্রের সংক্ষিপ্ত খবরের স্তম্ভে একটি দারুণ কাজের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বয়ানটি এইরকম

‘পজিটিভ খবর’ ও সরকারি বিজ্ঞাপন

জেলার পত্র-পত্রিকা তথা সংবাদমাধ্যম উন্নয়নের খবর অনেক বেশি করে। তারা যাতে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত না হয়, প্রশাসনকে তা দেখার নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাওড়া শরৎ সদনে বৃহস্পতিবার জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “পজিটিভ (ইতিবাচক) খবর করুন। বিজ্ঞাপন পাবেন।” প্রশাসনিক বৈঠকে এ দিন জেলার সংবাদমাধ্যমের তরফে এক জন প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, তাঁদের আর্থিক অবস্থা সঙ্গিন। বারবার বলেও তাঁরা সরকারি বিজ্ঞাপন পাচ্ছেন না। বিষয়টি শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপন পাবেন। এলাকার উন্নয়নের খবর আপনারা ভাল করে করুন।” মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ছাপার পরে সেগুলি জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও স্থানীয় থানার আইসি-র কাছে পাঠাবেন। তাঁরা দেখে নেবেন, খবর ‘পজিটিভ’ না ‘নেগেটিভ’। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, বড় সংবাদমাধ্যম এক দিন অল্প করে খবর করে। অনেক সময় ‘নেগেটিভ’ ভাবে প্রচারও করে। কিন্তু জেলার ছোট কাগজ সরকারের কাজের কথা গ্রামে গ্রামে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। সেই জন্যই তাদের বিজ্ঞাপন পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, তা নজর রাখার জন্য প্রশাসনিক কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সিপিএম ও বিজেপি নেতাদের মতে, জরুরি অবস্থার সময়ে সংবাদ প্রকাশের আগে সরকারের অনুমোদন নিতে হত। এখন আবার ‘অন্য রকম জরুরি অবস্থা’ এসেছে, যখন বিজ্ঞাপনের জন্য সরকারের শংসাপত্র নিতে হবে।

এখন কী হয় জানি না, বছর দশেক আগেও খবরের কাগজে শিক্ষানবিশির সময়ে প্রথমেই শেখানো হত কী করে এরকম সংক্ষিপ্ত খবর লিখতে হয়। কারণ অনেকটা জায়গা জুড়ে হাজার-দেড় হাজার শব্দে প্রতিবেদন লেখা সহজ, এত অল্প পরিসরে সমস্ত কাজের কথা লিখে ফেলাই কঠিন। যেমন প্রতিবেদকের পক্ষে কঠিন, তেমনি প্রতিবেদন যে সম্পাদনা করে তার পক্ষেও কঠিন। ফলে এই কাজটা শিখে ফেললে বড় প্রতিবেদন লেখা বা সম্পাদনা করা জলভাত হয়ে যায়। সেদিক থেকে এই খবরটি (নিউজরুমের ভাষায় ‘ব্রিফ’) সাংবাদিকতার ক্লাসে পাঠ্য হওয়ার যোগ্য। মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যেকটি জরুরি বাক্য, রীতিমত ব্যাখ্যা সমেত ১৭৮ শব্দের মধ্যে ধরে দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেদকদের ছোট থেকে পই পই করে বলে দেওয়া হয়, নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য যে কোনো খবরে সব পক্ষের বক্তব্য দেওয়া আবশ্যক। এখানে তা-ও করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সম্বন্ধে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বক্তব্য তো লেখা হয়েছে বটেই, এমনকি শূন্য পাওয়া সিপিএমকেও বঞ্চিত করা হয়নি। রাজ্যের গণতন্ত্রের সামগ্রিক ছবি তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রতিবেদন গত দশ বছরের কাগজ ঘাঁটলেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

খবরটি থেকে কী কী জানা যাচ্ছে?

প্রথমত, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবরই করতে হবে। সরকারি আইন যা-ই বলুক, সরকারের সমালোচনা করলে, দোষত্রুটি ধরলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকৃতপক্ষে সরকারি আনুকূল্য। সে বাবদ যে টাকা পত্রপত্রিকাগুলি পেয়ে থাকে তা করদাতার টাকা নয়, সরকারের পৈতৃক সম্পত্তি। সরকারের নেকনজরে থাকলে পাওয়া যাবে, নচেৎ নয়। এককথায়, সংবাদমাধ্যমকে সরকারি প্রচারযন্ত্র হয়ে উঠতে হবে।

দ্বিতীয়ত, জেলার পত্রপত্রিকা, চ্যানেল ইত্যাদি সরকারের কাজের প্রচার অনেক বেশি করে। তার উপযুক্ত প্রতিদান যেন তারা পায়, তা দেখা সরকারি আধিকারিকদের কাজের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ জেলাশাসক যেমন খবর রাখেন জেলার কোথাও বন্যাদুর্গত মানুষ না খেয়ে আছেন কিনা, তেমনি তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে জেলার কোনো কাগজ বন্যাত্রাণে সরকারের কাজের ঢালাও প্রচার করেও সরকারি বিজ্ঞাপন না পেয়ে আছে কিনা।

তৃতীয়ত, সংবাদমাধ্যম মুখ্যমন্ত্রীকে একজন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসক মনে করছে না। প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়ে কেবল তাঁর কার্যকলাপের যথাযথ প্রতিবেদন তৈরি ও মূল্যায়ন তার কাজ নয়। মুখ্যমন্ত্রী মাইবাপ, তাই নিজেদের আর্জি পেশ করাও কাজ। বাঁচালে মুখ্যমন্ত্রীই বাঁচাবেন।

চতুর্থত, বড় সংবাদমাধ্যম সরকারের যথেষ্ট স্তুতি করছে না। এমনকি মাঝেমধ্যে নিন্দে-বান্দাও করছে। বাংলা যে সোনার বাংলা হয়ে উঠেছে, সে খবর গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে ছোট সংবাদমাধ্যমই। তারা সরকারকে দেখছে, অতএব তাদের দেখাও সরকারের কর্তব্য।

পঞ্চমত, সরকারের যথেষ্ট প্রশংসা করা হয়েছে কিনা তা ঠিক করবেন জেলাশাসক, পুলিস সুপার এবং স্থানীয় থানার আইসি। অর্থাৎ যাঁদের ফৌজদারি ক্ষমতা আছে। কিন্তু সরকারি যে দপ্তরগুলি আইনত বিজ্ঞাপন দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেগুলি এলেবেলে।

মোদ্দা কথা, পশ্চিমবঙ্গে এখন সরকারি বিজ্ঞাপন একটি ঘোষিত লাঠি, যা উঁচিয়ে সংবাদমাধ্যমকে সরকার নিজের ইচ্ছামত ওঠবোস করায়। ঘোষিত কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে তৈরি হওয়া দুটি প্রেস কমিশন দেশের সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন, সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার জন্য যা যা সুপারিশ করেছিল তার অনেককিছুই অনেক দলের সরকারই মানেনি। অনেক কথা সংবাদমাধ্যমও মানেনি। প্রেস কাউন্সিল নামে একটি ঠুঁটো জগন্নাথ আছে, তাদের কথাও দু পক্ষের কেউ শোনে না। এর উপর আছে সংবাদমাধ্যম চালানোর, বিশেষত খবরের কাগজ চালানোর, বিপুল খরচ। সেই সুবাদে গত ৭৫ বছর ধরে অনেক দলের অনেক সরকারই সরকারি বিজ্ঞাপনকে লাঠি হিসাবে ব্যবহার করেছে। যে কোনো গবেষক যে কোনো রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস আর সংবাদমাধ্যমগুলির সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার তথ্য পাশাপাশি রেখে পড়লেই তার অজস্র প্রমাণ পাবেন। কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত নরেন্দ্র মোদীর সরকারের আগে কোনো সরকার রীতিমত আইন প্রণয়ন করে সংবাদমাধ্যমকে তোতাপাখি করে ফেলার চেষ্টা করেনি। ঠিক তেমনি, অন ক্যামেরা সরকারি বৈঠকে বসে, ইতিবাচক খবর করলে তবে সরকারি বিজ্ঞাপন দেব — এ কথা ঘোষণা করার সাহসও পশ্চিমবঙ্গে অতীতে কোনো মুখ্যমন্ত্রীর হয়নি।

যে কোনো কাজ, যা বরাবর লুকিয়ে করা হত, তা প্রকাশ্যে করা বিরাট পরিবর্তনের প্রমাণ। অন্য সম্প্রদায়ের লোকেদের নিয়ে ভিত্তিহীন, কুৎসিত আলোচনা ভারতীয়রা চিরকাল করে থাকে। কিন্তু ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত ওই সম্প্রদায়ের মানুষের সামনে করা হত না, এখন হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয়, চক্ষুলজ্জাও দূরীভূত, কারণ পরজাতিবিদ্বেষ এখন ক্ষমতার আশীর্বাদধন্য। তেমনি সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ইতিবাচক না লিখলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে না — এই ঘোষণা প্রমাণ করে অগণতান্ত্রিকতা জয়যুক্ত হয়েছে। এই জয়ে বাংলার সংবাদমাধ্যমের অবদানও ফেলে দেওয়ার মত নয়। এতবড় খবর যে একটি বড় সংবাদপত্রের ব্রিফে জায়গা পেয়েছে এবং অন্যত্র আদৌ জায়গা পায়নি, তার একটিমাত্র ব্যাখ্যাই সম্ভব বলে মনে হয়। “মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষপাত জেলার ছোট সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতি। অতএব বেল পাকলে কাকের কী?” আরও নৈরাশ্যবাদী হলে অবশ্য আরেকটি ব্যাখ্যাও করা সম্ভব। “এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে যদি যা পাচ্ছি তা-ও বন্ধ করা হয়?”

গত এক দশকে ভারতীয় গণতন্ত্র, পিছু পিছু ভারতীয় সাংবাদিকতা, যে পথে গেছে তাতে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আয়ের যে পথ অবলম্বন করে এ দেশে সাংবাদিকতা এতকাল চলেছে তা বাতিল করতে হবে। নইলে সংবাদমাধ্যমের পক্ষে সত্য বলা, সত্য দেখানো অসম্ভব। সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং/অথবা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ এড়ানো না গেলে সংবাদমাধ্যমকে ক্ষমতার বশংবদ হয়েই থাকতে হবে। ফলত ইংরেজিতে এবং ভারতের অন্যান্য ভাষাতেও এখন গ্রাহকভিত্তিক সংবাদমাধ্যম চালু হয়েছে। নিউজলন্ড্রি, নিউজক্লিক, দ্য ওয়্যারের মত সংবাদমাধ্যমের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কেন তারা মূলধারার সংবাদমাধ্যমের চেয়ে সত্যের প্রতি অনেক বেশি বিশ্বস্ত থাকতে পারছে। আক্রান্ত হচ্ছে, তবু লড়ে যেতে পারছে। বাংলাতেও সেরকম প্রয়াস আশু প্রয়োজন। সেই প্রয়াস ফলপ্রসূ করতে হলে সত্যান্বেষী পাঠক, দর্শকদের এগিয়ে আসতে হবে। নইলে নাগরিক ডট নেট বা ইত্যাকার প্ল্যাটফর্মগুলিকেও অনতিবিলম্বে ক্ষমতার মালাই জপতে হবে।

তথ্যসূত্র

১। https://scroll.in/article/988105/explainer-how-indias-new-digital-media-rules-are-anti-democratic-and-unconstitutional

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

সেলিব্রিটি কাল্ট দরদী সিপিএমকে খোলা চিঠি

শিখেছিলাম যে কমিউনিস্ট শহিদের বেদিতে মালা দিতে গেলেও যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। পার্টি সদস্যের সে যোগ্যতা আছে, আমার নেই।

আমার খ্যাতি নেই, ইউটিউব চ্যানেল নেই, পোষ্য জীবজন্তুও নেই। পাড়ার কুকুরকে মাঝে মধ্যে উচ্ছিষ্ট খেতে দেওয়া ছাড়া পশুপ্রেমিক হিসাবে আমার কোনো কীর্তি নেই। আমি রেড ভলান্টিয়ার নই, সিপিএম দলের সদস্য নই, কোনোদিন ছিলাম না, ভবিষ্যতেও হব বলে মনে হয় না। অতএব যা লিখছি তা না লিখলেও কিছু এসে যেত না। তবু লিখছি একেবারে ব্যক্তিগত মন্দ লাগার কারণে। সব পক্ষকে সমান চোখে দেখার দায় এ লেখায় আমি নিচ্ছি না, নিতে চাইছি না। সেই কারণেই নাগরিক ডট নেটে এ লেখা লিখব না ভেবেছিলাম। ফেসবুক দেয়ালে লেখাই সমীচীন হবে মনে করছিলাম। কিন্তু সম্পাদকমণ্ডলীর অন্য সদস্যরা বললেন, আমরা ব্যক্তিগত অনুভূতিকে আগেও জায়গা দিয়েছি এই মঞ্চে, এবারেও দেব।

২০০০ সালে ভোটাধিকার পেয়েছি, তারপর থেকে সিপিএমকেই ভোট দিয়ে আসছি। সেই দল জেলেপাড়ার সঙেদের দলে পরিণত হলে খারাপ লাগে। সেই খারাপ লাগার কারণেই কিছু অপ্রিয় কথা এখানে বলব।

পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোক পরিসরে বরাবর দেখেছি, রাজনৈতিক পরিবার বলে একটা কথা খুব চালু। অরাজনৈতিক পরিবার বলে কিছু হয় কিনা জানি না, তবে দেখেছি সাধারণভাবে ওই শব্দবন্ধ দিয়ে বোঝানো হয় এমন পরিবারকে, যাদের একাধিক সদস্য এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের সদস্য। ধরেই নেওয়া হয়, ওই পরিবারের লোকেরা অন্যদের চেয়ে রাজনীতিটা বেশি বোঝে। অন্যদের চেয়ে রাজনৈতিক ব্যাপারে মতামত দেওয়ার অধিকার একটু বেশি, সে নিজে রাজনীতির ধারে কাছে না গেলেও। এই ধারণার পিছনে আদৌ কোনো যুক্তি নেই, আছে পরিবারতন্ত্রের প্রতি সুপ্ত ভালবাসা। ভারতে এই ভালবাসা সকলেরই অল্পবিস্তর আছে, বদনাম শুধু গান্ধীরা কুড়োয়। সেই কারণে স্বাধীনতার পর থেকে কমিউনিস্ট দলগুলো ছাড়া প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বই কোনো না কোনো পরিবার কুক্ষিগত করেছে। কমিউনিস্টদের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটেনি মানে বুঝতে হবে, ব্যক্তিগতভাবে যে যা-ই মনে করুক, অমুকের ছেলে বা তমুকের মেয়ে পরিচয়কে নেতা হওয়ার যোগ্যতা বলে স্বীকৃতি দেয়নি এই দলগুলো। এখনো দেয় না, কিন্তু আমার মতে সিপিএমের সাম্প্রতিক খিল্লিযোগ্য কার্যকলাপগুলোর কারণ হল পার্টির শুভানুধ্যায়ীদের পারিবারিক অতীতকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া।

ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরের দশ বছরে সিপিএমের সমস্ত স্তরে এটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সিপিএমের সেলিব্রিটি সমর্থকরা বলে থাকেন “আমার বাবা-মাকে ছোট থেকে দেখেছি লাল পতাকা নিয়ে…” ইত্যাদি। কেউ বলেন লাল পতাকার সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান, তাই তিনি সিপিএম সমর্থক। এসব খুবই পবিত্র আবেগ সন্দেহ নেই। কিন্তু মুশকিল হল, সাধারণত এই উচ্চমধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পার্টি দরদিরা মনে করেন, তাঁর বাবা জেল খেটেছিলেন বলে তিনি নিজেই একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার ক্ষমতা ধরেন। রাজনীতি ব্যাপারটা যে অত সহজ নয়, উপরন্তু কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি, সেটা এঁদের অনেকেরই বোধগম্য হয় না। অথচ গত দশ বছরে সিপিএম দল এঁদের বিপুল গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে। বিখ্যাত মানুষদের বাম প্রীতি অন্যায় তো নয়ই, অভিনবও নয়। পৃথিবীর সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকে শিল্পী, সাহিত্যিকদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অনেকে একেবারে সদস্য হয়েছেন, অনেকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছেন। অনিল চ্যাটার্জির মত জনপ্রিয় অভিনেতা তো সিপিএমের হয়ে নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেখছি শ্রীলেখা, বাদশা, রাহুল, কমলেশ্বররা সিপিএমের মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অনিল চ্যাটার্জির সময়েও কিন্তু জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরাই মুখ ছিলেন। এখন পার্টি কলেবরে কমেছে, আর নেতারা পার্টি দরদি আর পার্টি সদস্যের তফাত করতে ভুলে গেছেন। নিজেদের মুখগুলো মানুষের পছন্দ নয় বুঝেই কিনা কে জানে, বিখ্যাত দরদি পেলেই প্রবল আগ্রহে জড়িয়ে ধরছেন, তাঁর জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। ফলে কেরিয়ারের মধ্যগগনেও সঠিক অর্থে তারকা হতে ব্যর্থ অভিনেত্রী সিপিএমের স্টার ক্যাম্পেনার হয়ে রাজ্য চষে বেড়াচ্ছেন। টিভি চ্যানেলের বিতর্কে সিপিএমের হয়ে বলতে যাচ্ছেন বাদশা মৈত্র বা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। ব্রিগেডের মঞ্চেও তাঁরা যারপরনাই গুরুত্ব পাচ্ছেন। এত গুরুত্ব পেলে আমার আপনারও মনে হতে বাধ্য, আমি একজন দারুণ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং দলটা আমার পৈতৃক সম্পত্তি। দলের কর্মীদের চেয়ে আমি কোনো অংশে কম নই, তাদের সাথে আমি যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারি।

শুধু সেলিব্রিটি নয়। মূলত পারিবারিক ইতিহাসের কারণে সিপিএম সমর্থক বা একদা পার্টির কোনো সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাই ভালবেসে এখনো মোটা টাকা চাঁদা দেন — এরকম অনেক দরদিকেই সিপিএম নেতৃত্ব প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। সিপিএমের যেসব সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে পার্টির নথিতে পর্যন্ত স্বীকার করা হয়েছে, সেগুলোও ঠিক ছিল বলে এঁরা ফেসবুকে ঝগড়া করে বেড়ান, শোনা যায় সোশাল মিডিয়া স্ট্র‍্যাটেজি ইত্যাদিও এঁরা ঠিক করেন। টুম্পা প্যারডি নিয়ে যখন পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা হচ্ছে, এক সিপিএম বন্ধুকে আমার মন্দ লাগা জানাতে ফোন করেছিলাম। তার কাছে শুনলাম “ওটা তো পার্টি বানায়নি, বানিয়েছে পার্টিকে ভালবাসে এরকম কিছু ছেলেপুলে।” তারপর দেখলাম মহম্মদ সেলিম, শতরূপ ঘোষের মত নেতারা ওই প্যারডির সপক্ষে অনেককিছু বলেছেন। প্যারডিটা ভাল ছিল কি মন্দ ছিল সে প্রশ্ন আর নতুন করে তুলছি না। বলছি এটা যা প্রমাণ করে, তা হল হয় পার্টি নিজের কাজ দরদিদের আউটসোর্স করে দিয়েছে, অথবা দরদিরা ভালমন্দ যা-ই করুক, পার্টি তার পক্ষ নিচ্ছে। এত বিরাট হৃদয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের হওয়া উচিত কিনা সেটা বোধহয় ভেবে দেখা প্রয়োজন।

দরদিরা নিশ্চয়ই রেগে যাচ্ছেন। একটু বিস্তারিত বলি। দরদ খারাপ নয়, যদি তা দাবিহীন হয়। কমিউনিস্ট পার্টির নানারকমের দরদি থাকে। আমি যাদের কথা বলছি, তাদের কতকগুলো সামান্য লক্ষণ আছে। ১) পরিবারের কেউ অবিভক্ত সিপিআই বা সিপিএম করতেন, ২) অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচ্ছল, পার্টিকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন নিয়মিত বা মাঝে মাঝে, ৩) সিপিএমের সমালোচনাও করেন, কিন্তু যেগুলো পার্টির দোষ বলে উল্লেখ করেন, সেগুলো শোধরালে সিপিএম উন্নততর কংগ্রেস বা তৃণমূল হবে। উন্নততর কমিউনিস্ট পার্টি নয়। ৪) সোশাল মিডিয়ায় সিপিএমের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই তাকে বিজেপি বা তৃণমূল বলে দেগে দিতে দেরি করেন না। হয়ত যার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তার পার্টির জন্যে আত্মত্যাগ বেশি। কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় পার্টির বিরুদ্ধ মত প্রচার আটকানোর পবিত্র দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার পর অত আগুপিছু দেখার সময় থাকে না।

এই ধরনের দরদিরা মনে করেন যেহেতু এঁরা সিপিএমকে ভালবাসেন এবং সাধ্যমত সাহায্য করেন, অতএব এঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং পরামর্শ অনুযায়ী চলা সিপিএমের কর্তব্য। অর্থাৎ সিপিএম একটি কোম্পানি আর এঁরা তার শেয়ার হোল্ডার। এই দরদিদের ভুল অচিরেই ভেঙে যেত, যদি পার্টির আচরণ তেমন হত। কিন্তু পার্টিও বোধহয় নিজেকে কোম্পানি হিসাবেই দ্যাখে। তাই দরদিদের সঙ্গে কর্মীদের বিবাদে চুপ করে থাকে, নয়ত বিপ্লবী নেতা তন্ময় ভট্টাচার্যের মত দরদিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তুমিও একটা ভুল করেছ… আমাকে জানাতে পারতে….” ইত্যাদি।

তবে এই দোষে কেবল রাজ্য স্তরের নেতারা দুষ্ট এমন বললে মিথ্যে বলা হয়। সিপিএম পার্টিটা ভাল, জ্যোতিবাবু লোকটা ভাল নয়। বুদ্ধবাবু মানুষটা ভাল, কিন্তু পার্টি ওঁকে কাজ করতে দিল না। এই বাক্য দুটো শুধু বাজারি প্রোপাগান্ডা নয়, ব্যাখ্যা হিসাবে অমার্কসিয়ও বটে। সিপিএমের উপর, নীচ সর্বত্রই কর্মীর গুরুত্ব কমিয়ে দরদির গুরুত্ব বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। উদাহরণ দিই।

সাতই নভেম্বর সকালে বাজারে যাচ্ছি। পার্টির এক শহিদের বেদির সামনে নভেম্বর বিপ্লব দিবস উদযাপন হচ্ছে, জনা পাঁচেক পার্টি সদস্য রয়েছেন। আমাকে দেখে এক তরুণ পার্টিকর্মী যোগ দিতে বললেন। দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামান্য বক্তৃতা হল, তারপর শহিদবেদিতে মাল্যদান। পার্টি সদস্যরা দিচ্ছেন, হতবুদ্ধি করে দিয়ে আমার হাতেও তুলে দেওয়া হল মালা। পথচারীদের মধ্যে থেকে আমাকেই যে ডাকা হয়েছিল তার একমাত্র কারণ এই এলাকায় সিপিএম দলকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছিলেন যাঁরা, তার মধ্যে আমার প্রয়াত পিতা একজন। আমি তাঁর কাছে শিখেছিলাম যে কমিউনিস্ট শহিদের বেদিতে মালা দিতে গেলেও যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। পার্টি সদস্যের সে যোগ্যতা আছে, আমার নেই। বুঝলাম এই তরুণ কর্মীটিকে তা শেখানো হয়নি। আশপাশে যে প্রবীণরা ছিলেন তাঁদের কাকু, জেঠু বলি। তাঁরাও চাইছেন আমি দিই।

মনে শহিদের প্রতি অশ্রদ্ধা নেই বলে দিয়েই ফেললাম। কিন্তু তাতে রাজনীতির ফাঁকিবাজিটা আড়াল হয় না। আসলে সারা বছর ধরে পাড়ার রিকশা চালকদের বোঝানো হয়নি নভেম্বর বিপ্লব কী এবং কেন? দরকারের সময় একজন পরিচিত দরদিকে ডেকে নেওয়া হল। অর্থাৎ পার্টিকে ব্রাহ্মসমাজে পরিণত করা হয়েছে। আদর্শ প্রগতিশীল, উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু তা নিয়ে সভা-সমিতি, উপাসনা করব আমরা ভদ্রলোকেরা। ওরা ওসবের কী বুঝবে?

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এখনো গরীব মানুষ সিপিএম করেন জানি। কিন্তু সব মিলিয়ে সিপিএম হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যবিত্তের, মধ্যবিত্তের জন্য, মধ্যবিত্তের দ্বারা চালিত পার্টি। ফলে এখন পার্টিকর্মীকে কুকুরের উপর হিংস্রতার অজুহাতে কেউ দল বেঁধে পিটিয়ে গেলেও কমিউনিস্টদের বিখ্যাত (এবং কুখ্যাত) পার্টিজানশিপ বোতাম আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান। সংগঠন বাড়ানোর কী হবে তা কেউ ভাবছে না। ভাবছে কী করে সেলিব্রিটি দরদি বাড়ানো যায়। বিজেপি ফেরত হলেও চলবে।

দরদির উপরে কর্মীকে স্থান না দিলে সিপিএমের নিস্তার নেই।

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

Has the CPI(M) forgotten its strong federal roots?

Then state finance minister Ashok Mitra was his mainstay in this fight. It was as much a demand for more administrative rights as economic independence

Photos from internet

On May 30, the West Bengal state committee of the Communist Party of India (Marxist) came up with its assessment of the assembly election results, in which the party won no seats. The document explaining this disaster states that most of the 32 seats won by the Left Front in 2016 have gone to Trinamool Congress (TMC) – 23, to be precise.

At one point, the document says, in Bengali, “Because of the Bharatiya Janata Party’s (BJP’s) aggressive words, Trinamool’s election rigging, corruption, anarchy in every sector, absence of democracy etc. could not become electoral issues. People chose Trinamool Congress as the main opposition to the BJP. In addition, Trinamool was able to use the welfare schemes to garner support. There was extreme polarisation between Trinamool Congress and BJP. That is probably the main reason behind this result.”

This is as candid an admission of being wrong as you would get from the CPI(M). The West Bengal leadership has been maintaining since 2011 that the BJP and TMC are two sides of the same coin, so they have often dismissed governor Jagdeep Dhankhar’s attempts to overstep his jurisdiction and Mamata Banerjee’s sharp reaction to these moves as ‘drama’. This document shows that the CPI(M) is ready to rethink the political line that regards both TMC and BJP equally harmful. The fact that the welfare schemes CPI(M) leaders called “doles” during the election campaign have been marked as reasons for TMC’s popular support is a significant shift.

One may have expected this document to impact the party’s behaviour, but this doesn’t seem to be happening at the moment. Case in point is the ongoing battle between Banerjee’s and Narendra Modi’s governments.

Senior CPI(M) leader Sujan Chakraborty has termed the Centre’s decision to unilaterally transfer chief secretary Alapan Bandyopadhyay as “vindictive”, but added that the chief secretary’s role has been reduced to that of a “ghatak (matchmaker)” under the TMC government. Earlier in May, ministers of the state were arrested by the Central Bureau of Investigation (CBI) in a case where the chargesheet had already been submitted. CPI(M)’s Rajya Sabha MP Bikash Bhattacharya, a lawyer, wasted no time in saying the arrests were fair. The Calcutta high court’s subsequent interim bail order, however, made it clear that it is not as straightforward as Bhattacharya made it sound. Even the CPI(M)’s official stance differed from his, but he has neither been censured for his comments nor asked to explain them.

This proves there is still no consensus in the party ranks about the ways to deal with the TMC, and the CPI(M) does not regard the BJP’s repeated attempts to destabilise the West Bengal government as a threat to federalism but as a usual political tussle between TMC and BJP. During the election campaign, the Left-Congress-Indian Secular Front combine had talked about the need to break the TMC-BJP binary. It looks like the CPI(M) itself is still stuck in that binary, and does not recognise the greater issues at play. It would not be out of context to delve into history at this point.

The party at the Centre trying to destabilise an opposition party’s state government is not new. The first party at the receiving end was the undivided Communist Party of India (CPI). The Kerala government led by its legendary leader E.M.S. Namboodiripad was toppled in 1959, and finding out how many times Indira Gandhi’s government used Article 356 of the Constitution could exhaust a seasoned statistician. But the BJP’s consistency and determination in breaking the back of federalism is unparalleled.

What is happening in Bengal is basically the logical progression of what began with the dilution of Article 370 and bifurcation of Jammu and Kashmir. It continued with passing a law that makes the Arvind Kejriwal government subservient to the Lieutenant Governor. The arrests and the fight over the chief secretary are not attacks on the chief minister or the TMC. These are attacks on the rights of state governments and the political courtesies governing Centre-state relationship. This is about showing who’s boss.

This is exactly what the Jyoti Basu-led Left front government fought against in the 1980s. Basu maintained all along that the Centre was not in charge, and states should be on equal footing. His cry was not just for a bigger share of the Centre’s revenue; his was a principled stand for all states. Then state finance minister Ashok Mitra was his mainstay in this fight. It was as much a demand for more administrative rights as economic independence; that’s why they found other non-Congress chief ministers like Ramakrishna Hegde, M.G. Ramachandran, N.T. Rama Rao and Farooq Abdullah by their side. They held two meetings in 1983, in Srinagar and Kolkata, and a sub-committee was formed to draft a list of demands. Mitra led that sub-committee. Their commitment to the cause is best proved by the case of Jammu and Kashmir.

On July 2, 1984, governor Jagmohan dismissed the National Conference government led by Farooq. The then Karnataka chief minister, Hegde, chaired a meeting with non-Congress leaders at Karnataka Bhavan in New Delhi. The resolution release afterwards criticised the Centre for murdering democracy in Kashmir. A delegation reached Srinagar the next day to express solidarity with Abdullah and the people of J&K. Mitra recalls in his memoirs that Basu directed him to be present at the meeting in New Delhi and join the delegation to Srinagar. Delivering a speech to the public gathered in front of the National Conference office, he writes, was one of his fondest memories.

But senior CPI(M) leader Mohammad Salim, while speaking to this writer, confirmed that his party views the ongoing conflict purely as a partisan issue. “There’s no question of federalism here,” he declared. “This is just the governments using their agencies against each other. Only the leftists think about federalism. Our party has fought for it in the past, we wanted Sarkaria Commission’s recommendations implemented. Neither the TMC nor BJP has ever thought about federalism. The bickering over the Narada accused or the chief secretary is nothing but the failed state’s attempt to divert the headlines. Mamata has failed to provide relief to people after Cyclone Yaas, the Centre hasn’t done anything either. That’s why the chief secretary is being made an issue. Similarly, when people needed vaccines and they couldn’t provide it, they fought over the Narada-accused leaders.”

In reality, though, the fight for federalism was put on the back burner while the CPI(M) was still in power. Mitra writes in Apila Chapila (translation by the author), “After I left Writers’ Buildings [he resigned in 1987 for reasons not relevant to this article], I found the West Bengal government has suddenly become a good boy. There’s no overdraft, spending is well within the scope of earnings, so the budget is zero deficit. My unequivocal opinion is, this complete change of stance is highly incompatible with the state government’s approach. Fat overdraft indicated the states are struggling because of the one-sided relationship with the Centre. Doing away with it means announcing to the world that all problems have been solved, there’s no financial constraint. Now we can sleep peacefully.”

Mitra wrote this in the early 2000s. The Goods and Services Tax (GST) was not yet in existence. There is hardly any dispute today that the GST has further tilted the scales in favour of the Central government. And the chairman of the GST council that is credited with planning everything was Asim Dasgupta, Mitra’s successor in Basu’s cabinet. He resigned from the council in 2011, but by his own admission, 80% of the job had already been done. Dasgupta’s contribution was even acknowledged by then Union finance minister Arun Jaitley when the GST was launched in 2017.

The decay of the Left as an opposition has had huge implications for West Bengal, and the job of turning this seems to be getting harder by the day. A strong right-wing party has now become the only opposition in a state famous for its secular, socialist ethos. The CPI(M), still the biggest leftist party in terms of number of members, has no time to waste if they are to stay relevant. State Congress president Adhir Ranjan Chowdhury has already said he does not want to put up a candidate against Mamata Banerjee in the by-election at Bhowanipore. If Chowdhury’s party agrees with his proposal, it may mean curtains on the Left-Congress combine. In that case, comrades have a long fight ahead. What are they doing to ensure it is not a lonely one?

The state committee’s statement mentioned at the beginning of this article had said, “To turn this primary review into a comprehensive one, discussions will have to be held and opinions sought at the booth and branch level.” At the moment, the CP(M) is distributing a questionnaire among its workers and supporters via the district committees to do that. It has two sets of questions, under the heads ‘political’ and ‘organisational’. The first three questions in the first set are all about the party’s policy regarding the TMC:

  1. Is it really true that there was strong anti-incumbency against the TMC before the elections? Did we overestimate that sentiment? Did we underestimate Trinamool Congress?
  2. Did people reject our campaign about the understanding between the TMC and BJP? Which party was our main target across the election campaign? TMC or BJP? Or did we maintain equidistance?
  3. How have the welfare schemes and subsidies from the TMC government impacted the recipients? Have we assessed that?

The answers, and whether the leadership is willing to make changes according to them, could hold the key to the CPI(M)’s future in West Bengal.

A section of the party, however, feels where they stand vis-à-vis Banerjee or the BJP is irrelevant. What matters is whether they can still identify with the poor and have the stomach to fight for issues that affect them. This view is best articulated in an article written in Bengali by young trade union leader and Darjeeling district committee member Sudip Dutta, for party mouthpiece Ganashakti: “We have to go to the rural and urban poor, and get the strength for class struggle from them. The most promising strategy for modern revolution is hidden amongst this socio-economic populace divided into innumerable groups.”

Originally published here

https://thewire.in/politics/west-bengal-cpim-tmc-federalism

দ্যাট লিডার, দিস ম্যান: মহাশূন্যের দুটি বিন্দু

‘দিস ম্যান’ (অবশ্যই উওম্যানও) যারপরনাই পরিশ্রম করল স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় আর ‘দ্যাট লিডার’ পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অঙ্ক কষে গেলেন।

২০০৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বের রিপোর্টিং করতে জাপানের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র আকাহাতা তাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেদক জুনিচি কোদামাকে পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। আমার তখন সেই বয়স যে বয়সে মনে হয় কাল বাদে পরশুই বিপ্লবটা করে ফেলব। ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হওয়ার সুবাদে এবং এক বন্ধুর সক্রিয়তায় জুনিচির সহকারী হওয়ার সৌভাগ্য হল। পার্টি মুখপত্রের সাংবাদিক হলেও, পার্টির বিরোধীদের বক্তব্য জানায় তার সমান উৎসাহ। সম্ভবত ধনী দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র বলেই আকাহাতা খরচ করার ব্যাপারেও অকৃপণ। তাই জুনিচি ভাড়া করা গাড়িতে চেপে যে কোন এলাকায় চলে যেত। বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে হাতে টানা রিকশার চালক পর্যন্ত সকলের সাথে কথা বলাই তার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞান। আমার কাজ মূলত জুনিচির আপাত দুর্বোধ্য ইংরেজি আর স্থানীয় লোকের বাংলা, হিন্দির সংযোগ স্থাপন এবং গাড়ির চালককে পথনির্দেশ দিয়ে জুনিচি আর তার স্ত্রী, ছায়াসঙ্গিনী রিয়েকোকে অচেনা জায়গাগুলোতে নিয়ে যাওয়া। দিন সাতেকের সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিখলাম যে বিপ্লবটা পরশু হচ্ছে না, অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।

ঐ সাতদিনের একদিন সকালে আমরা গিয়েছিলাম বারাসত চাঁপাডালি মোড়ের কাছে সিপিএমের পার্টি অফিসে। সে অফিসের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটি ঘরে জুনিচির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তখনকার এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। ভদ্রলোকের ধোপদুরস্ত সাদা পাঞ্জাবি পাজামা আর মুখের কর্পোরেট হাসিটি মনোমুগ্ধকর। টেবিলের উপর দেখলাম তিনটি মোবাইল ফোন। অমন অত্যাধুনিক হ্যান্ডসেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসের ধনীর দুলাল-দুলালিদের হাতেও দেখিনি। বেরিয়ে আসার পর দেখলাম জাপানি কমরেডরাও বেশ অবাক। জুনিচি নিজে তখনো নোকিয়ার সেই ছুঁড়ে মানুষ মারা যায় এমন একখানা হ্যান্ডসেট ব্যবহার করে, তার স্ত্রীর নিজস্ব মোবাইল নেই।

সেখান থেকে আমরা গেলাম ছোট জাগুলিয়া। কমরেড দোর্দণ্ডপ্রতাপ বলে দিয়েছিলেন কার খোঁজ করতে হবে। খুঁজতে খুঁজতে আমরা পৌঁছলাম একটা ছোট্ট পার্টি অফিসে। বারাসতে যদি প্রাসাদে ঢুকে থাকি, এ তাহলে কুঁড়েঘর। দোর্দণ্ডপ্রতাপ যত রাজকীয়, ইনি তত সাদাসিধে। একমাথা পাকা চুল, চোখে ঘোলাটে চশমা, মুখভর্তি পাকা দাড়ি, পরনে সাধারণ লুঙ্গি, গায়ে ফুটো হয়ে যাওয়া গেঞ্জি। কানেও কম শোনেন। কিন্তু যেই মাত্র শুনলেন সুদূর জাপানের কমিউনিস্ট পার্টির দুই কমরেড এসেছেন, মনে হল বয়স দশ বছর কমে গেল ভদ্রলোকের। বলা বাহুল্য এ অফিসে এসি ঘর নেই। একতলায় গোটা দুয়েক ঘর, দোতলায় একখানা। ইনি আমাদের বেঞ্চে বসালেন। দোর্দণ্ডবাবু ঠান্ডা পানীয় খাইয়েছিলেন, ইনি হাঁক পেড়ে রাস্তার দোকান থেকে আনালেন লাল চা। জুনিচি গিয়েছিল নির্বাচন সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে, কিন্তু এই ব্যক্তিটি সম্বন্ধে তার অসীম আগ্রহ তৈরি হল। তার হয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করতে হল কবে থেকে পার্টি করছেন (পঞ্চাশের দশক থেকে), এখন পার্টিতে কোন পদে আছেন (লোকাল কমিটির সদস্য), কী করেন (পার্টিই করেন, সারাজীবন তা-ই করেছেন), কোথায় থাকেন (ঐ অফিসেই থাকেন)। ছোট জাগুলিয়ায় গরীব মানুষ কতজন, ধনী কারা, কোথায় কেমন ভোট হয় — এসব প্রশ্নের জবাবও বৃদ্ধ যেভাবে দিলেন, তাতে বোঝা যায় এলাকাটা তাঁর হাতের তালুর মত চেনা।

কমিউনিস্ট পার্টির এরকম দু-একজন সদস্যকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার ছেলেবেলাতেই হয়েছে, আরো অনেকের গল্প শুনেছি। কিন্তু জুনিচি আর রিয়েকোর এমন অভিজ্ঞতা ছিল না। তারা আপ্লুত। আর সবচেয়ে মোক্ষম কথাটি জুনিচি বলল গাড়িতে উঠে। “হোয়াট ডিফারেন্স! দ্যাট লিডার, দিস ম্যান!” সত্যিই জগতের বিশ্লেষণে কার্ল মার্কস অভ্রান্ত। কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরেও এমন শ্রেণি বিভাজন!

সতেরো বছর আগের সেই দিনটা বারবার মনে পড়ছে দোসরা মে-র পর থেকে। বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক দশক পূর্ণ হল। সেটা বড় কথা নয়। নির্বাচনে কোন দল হারে, কোন দল জেতে। একটানা ৩৪ বছর একই পার্টির নেতৃত্ব একই ফ্রন্টের সরকার ছিল, সেটাই বরং বিরল। কিন্তু একটা রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দশ বছরের মধ্যে একটা দল লোকসভায় শূন্য, বিধানসভায় শূন্য — এরকম ঘটতে দেখা যায় না চট করে। উদাহরণস্বরূপ কংগ্রেসকেই দেখা যাক। তারা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় নেই ১৯৭৭ সাল থেকে। কিন্তু দীর্ঘদিন প্রধান বিরোধী দল ছিল। নব্বইয়ের দশকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দল ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার পর দ্রুত ক্ষমতা কমতে থাকলেও ২০১১-র পালাবদলেও কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তারা এতদিন পরে বিধানসভায় শূন্য হয়েছে, লোকসভায় এখনো এ রাজ্য থেকে তাদের দুইজন প্রতিনিধি। পাশাপাশি বামফ্রন্টের বড় শরিক এই অল্প সময়েই ব্রিগেড ময়দান ছাড়া সর্বত্র শূন্য। এমতাবস্থায় যে কোন দলে রাজ্য স্তরের নেতাদের জবাবদিহি করতে হয়, জায়গা ছাড়তে হয়। গত কুড়ি বছরে কতবার প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি বদলেছে গুনে দেখতে হবে। কিন্তু সিপিএমে ওসব হবার নয়। তারা মার্কসবাদী, লেনিনের আদর্শে চলে, তাদের আছে রেজিমেন্টেশন। সবই নাকি যৌথ দায়িত্বের ব্যাপার। রেজিমেন্টেশন ভাল না মন্দ তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। সেটুকু বাদ দিলে বাকিটা কিন্তু দিব্য শুনতে লাগে। বিশেষত কর্পোরেট দুনিয়ায় যেন তেন প্রকারেণ অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার যে ধারা আছে, তার তুলনায় এ তো স্বর্গ। কিন্তু সিপিএমের ক্ষেত্রে যৌথ দায়িত্ব কথাটার অর্থ দাঁড়িয়েছে যৌথভাবে দায়িত্ব এড়ানো। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বে যখন রাস্তায় দাঁড়ানো উন্নয়ন খড়গ হাতে বাম কর্মীদের তাড়া করল, খুন করল, মহিলাদের কাপড় খুলে নিল — তখন রাজ্যের কোথাও নেতাদের যৌথ দায়িত্ব নিয়ে ধরনায় বসতে দেখা যায়নি, কোথাও কোন অবরোধ হয়নি। যে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁদের এত অভিযোগ, তিনি নিশ্চিন্তে হরিশ চ‍্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে রোজ নবান্নে গেছেন, এসেছেন। কোন লাল ঝান্ডা তাঁর পথ আটকায়নি।

অর্থাৎ “দিস ম্যান” মার খেয়েছে আর “দ্যাট লিডার” আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বিবৃতি দিয়েছেন। কেউ কেউ ফেসবুক বিদীর্ণ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। কবে কোন জেলার কোন প্রত্যন্ত এলাকায় কোন পার্টি অফিস ভাঙা হয়েছে তা সারা রাজ্যের বাম কর্মী সমর্থকরা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নেতারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, কজন পার্টিকর্মীর সাথে গিয়ে দেখা করেছেন, কটা থানা ঘেরাও করেছেন — সেসব প্রচারিত হয়নি। ফলত বিরাট সংখ্যক নীচুতলার কর্মী সমর্থকের বিজেপির দিকে সরে যাওয়া, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ৩৭% থেকে ৭% হয়ে যাওয়া। তৃণমূল ও সম্প্রদায় স্বভাবতই বললেন বাম রাম হয়েছে। এতদূরও রটে গেল যে জেলার বাম নেতারা সচেতনভাবে ভোট ট্রান্সফার করিয়েছেন বিজেপির বাক্সে। সচেতন, অবচেতনের বিতর্কে না গিয়েও অনস্বীকার্য যে বামেদের ভোট সে সময় বিজেপির খাতায় জমা পড়েছে। অর্থাৎ একেবারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করা কর্মীরা মারও খেলেন, বদনামের ভাগীও হলেন।

অতঃপর নেতারা কী ব্যবস্থা নিলেন? কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ২০১৬ নির্বাচনের সময় থেকেই সূর্যবাবু, বিমানবাবুদের সঙ্গে অধীরবাবু, মান্নানবাবুদের যা ভাব তা দেখে অমর আকবর অ্যান্টনি বা ইয়াদোঁ কি বারাত ছবির শৈশবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভাইয়েদের কথা মনে পড়ে। ভাগ্যিস মার্কসবাদে ভূত জিনিসটা নেই। থাকলে শহিদদের ভূতেরা যে কী করত ভাবলে গা শিরশির করে। তবে অন্ধের মত অতীত আঁকড়ে রাজনীতি হয় না। তাই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা ভেবে বাম কর্মী সমর্থকরা হয়ত ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন (ভোটের অঙ্ক দেখলে কংগ্রেস কর্মী সমর্থকরা মন থেকে মেনেছিলেন কিনা নিশ্চিত হওয়া শক্ত), কিন্তু ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে সে জোটও হল না। তার দু বছরের মাথায় বিধানসভা নির্বাচন। মে মাসের নির্বাচনের জন্যে বামেদের নতুন উদ্যম দেখা গেল ফেব্রুয়ারিতে, যখন জোয়ানরা নবান্ন অভিযান করলেন। প্রচণ্ড মার খেলেন, মইদুল ইসলাম মিদ্যা প্রাণ হারালেন। কিন্তু ততদিনে রাজ্যে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসাবে নিজেদের জায়গা পাকা করে ফেলেছে। এস এফ আই নেতা সৃজন ভট্টাচার্য নাগরিক ডট নেটকে নবান্ন অভিযানের আগের দিন বলেছিলেন, বাইনারি ভাঙতেই নবান্নে যাচ্ছি। অর্থাৎ তদ্দিনে তৃণমূল-বিজেপি বাইনারি প্রতিষ্ঠিত।

এই বাইনারি তৈরি হল কেন? কোন সন্দেহ নেই তৃণমূল তেমনটাই চেয়েছিল। কারণ প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্ব চালানো বা মুখরোচক কুৎসার দৌড়ে জেতা কর্মসংস্থানের প্রশ্ন, দুর্নীতির প্রশ্নের সুরাহা করার চেয়ে সহজ। কিন্তু সঙ্গত দাবি নিয়েও কেবল বিবৃতি দিলে আর মামলা ঠুকলে কি আর বিরোধী রাজনীতি হয়? সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্রেফ মামলা ঠুকে ঠুকেই তৃণমূলকে নাজেহাল করে দেবেন — এমন একটা দাবি সিপিএমের আইনজীবী নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে করতেন (“মারব কম, দৌড় করাব বেশি”)। আদতে প্রসব হল অশ্বডিম্ব। যাদবপুর কেন্দ্রে আনকোরা অভিনেত্রীর কাছে হারলেন। রাজ্যের কোথায় তাঁর মামলার ভয়ে শাসক দল বাম কর্মী সমর্থকদের মারা বন্ধ করে দিয়েছে তা তিনিই জানেন। তবে কেবল বিকাশবাবুকে দোষ দেওয়া অন্যায়। বামেদের বরাবরের বদনাম তাঁরা কথায় কথায় আন্দোলন করেন; মিছিল, ধর্মঘট কিছুই বাদ যায় না। ক্ষমতায় থাকাকালীনও এ স্বভাব যায়নি। এই করেই পশ্চিমবঙ্গের শিল্প টিল্প সব তাঁরা তাড়িয়েছেন বলে এখনো অভিযোগ করা হয়। ২০১১-র পরের বঙ্গ সিপিএম সম্বন্ধে কিন্তু এমন অভিযোগ করার উপায় নেই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বনধ ডাকলে আলাদা কথা, নিজেরা ওসবের মধ্যে যাননি। রাজ্যের মন্ত্রীদের হাসিমুখে টাকা নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসার পরেও আন্দোলনের ঠ্যালায় জনজীবন বিপর্যস্ত করেননি। আদালত যেদিন রায় দিলেন এস এস সি পরীক্ষায় দুর্নীতি হয়েছে; সেদিনও সূর্যবাবু, সেলিমবাবু, সুজনবাবু বা বিমানবাবু সরকারের গদি নাড়িয়ে দেওয়ার মত কোন কাজ করেননি। সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী আসনে থাকলে কী ঘটত তা বামপন্থীরাও বিলক্ষণ বোঝেন। অশোক মিত্র নাকি একবার বলেছিলেন “আমি ভদ্রলোক নই, কমিউনিস্ট।” সিপিএমের বর্তমান নেতৃত্ব কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক। তাঁদের ভদ্রতার সুযোগেই মমতাকে মমতাজ বেগম আখ্যা দিয়ে, অনবরত অকথা কুকথা বলে, রামনবমী বনাম বজরংবলীর বাইনারি ব্যবহার করে বিজেপি রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হয়ে গেল।

অন্য দিকে বিজেপি শক্তিশালী হওয়ার পর থেকেই বাম নেতৃত্বের বক্তব্য, তৃণমূল আর বিজেপি সমান বিপজ্জনক। এখনো বলি, কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। যাঁরা অন্যরকম বলেন তাঁদের একটা বড় যুক্তি হল তৃণমূল খুব খারাপ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দল হতে পারে, কিন্তু বিজেপি এমন একটা দল যারা গণতান্ত্রিক কাঠামোটার পক্ষেই বিপজ্জনক। আমার প্রশ্ন, মেরে ধরে বিরোধীদের মনোনয়নই জমা দিতে না দিলে আর কোন গণতান্ত্রিক কাঠামো অবশিষ্ট থাকে? উত্তরে অবধারিতভাবে বলা হবে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসা তৃণমূল শুরু করেনি, ইত্যাদি। এসব বলার সময় তৃণমূলপন্থী এবং উদারপন্থীরা মনে রাখেন না বা ইচ্ছা করেই ভুলে যান যে ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচন চালু হওয়ার পর থেকে ২০১৮-র মত এত বেশি আসনে কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক পক্ষ জেতেনি। এই রইল প্রমাণ [১]। কিন্তু কথা হল, দুটো দল যদি সমান বিপজ্জনক হয়, তাহলে বড় দলটিকে সর্বশক্তি দিয়ে হারালেই তো ছোট দলকে হারানো সহজ হওয়ার কথা। উল্টোটা কী করে সম্ভব? তৃণমূলকে হারাতে পারলেও বিজেপির বিপদ তো থেকেই যেত। এই সোজা কথাটা বাম নেতারা বুঝলেন না। ফলে বিজেপি বিরোধী হিসাবে একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারলেন না। শ্যাম পেলেন না, কুলও হারালেন।

মোদ্দা কথা এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতা অচল করে দেওয়ার জন্য খ্যাত (আচ্ছা, কুখ্যাতই হল) বামপন্থীরা কোনরকম দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্যে গেলেন না। ধর্মতলায় টেট পরীক্ষার অবিচারের প্রতিবাদে অনশনরত ছেলেমেয়েদের আন্দোলনে বিমানবাবু অতিথি শিল্পীর মত গিয়ে বসলেন। সুজনবাবু রাজভবনের গেটে অপেক্ষারত টিভি সাংবাদিকদের নিয়মিত বাইট দিলেন। সেলিমবাবু হিন্দি বাংলা মিশিয়ে সকৌতুক সাংবাদিক সম্মেলন আর ফেসবুক লাইভ করে গেলেন। মানুষের আশীর্বাদ কুড়োবার দায়িত্ব পড়ল নীচের তলার কর্মীদের উপর — কমিউনিটি ক্যান্টিন আর রেড ভলান্টিয়ার্সের মাধ্যমে। ‘দিস ম্যান’ (অবশ্যই উওম্যানও) যারপরনাই পরিশ্রম করল স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় আর ‘দ্যাট লিডার’ পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অঙ্ক কষে গেলেন। কংগ্রেসের সাথে জোট করা যথেষ্ট হবে না, অতএব নতুন জোটসঙ্গী চাই। আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে? খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল ফুরফুরা শরীফে। ভদ্রলোক ভোটাররা চটবেন জেনেও নেতারা যে উদ্যমে আব্বাস সিদ্দিকিকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে শমীক লাহিড়ী যেরকম সন্দর্ভ রচনা করেছিলেন পার্টি মুখপত্রে — তাতে ভাবা গিয়েছিল সিপিএম সত্যিই কৌম পরিচয়ের রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়ার যে ঐতিহাসিক ভুল, তা সংশোধন করতে চায়। কিন্তু পরীক্ষায় শূন্য পাওয়ার পর যেভাবে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সাথে জোটকে দায়ী করা হচ্ছে, তাতে স্পষ্ট তাঁরা কর্মী সমর্থকদের যা-ই বলে থাকুন, আই এস এফের সাথে জোট করা শর্টকাটে জিতে যাওয়ার কৌশলের বেশি কিছু ছিল না।

অশোক ভট্টাচার্য আর শিলিগুড়ি নাকি সমার্থক। সেই শিলিগুড়িতে তাঁর এক বিশ্বস্ত অনুচর বিজেপিতে চলে যাওয়াতেই ভটচায্যিমশাই একেবারে তৃতীয় হয়ে গেলেন! তাহলে প্রশ্ন ওঠা উচিৎ তাঁর এতদিনের দাপট কি তাঁর ছিল, না অনুচরের? তিনি কি টের পাননি যে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন? যে কিসের ভিত্তিতে একটা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী দলে চলে যাওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন শঙ্কর ঘোষ তাঁর ডান হাত হয়ে উঠেছিলেন? কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসাবে এ প্রশ্নের জবাবও দিতে হবে। অথচ প্রবীন ভটচায্যিমশাই অত গভীরে না গিয়ে নিজের পরাজয়কে স্রেফ বাকি রাজ্যের প্রবণতার অংশ বলেই ক্ষান্ত হলেন।

দক্ষিণবঙ্গের ভটচায্যিমশাই আরো এক কাঠি সরেস। তিনি যে কেবল আই এস এফের সাথে জোটে দোষ দেখেছেন তা নয়, কংগ্রেসকে অবহেলা, অবজ্ঞা, অপমান — আরো কী কী সব করা হয়েছে বলে তিনি বেজায় আহত। বলেছেন সে অপমানের জবাব নাকি কংগ্রেসের সদস্য সমর্থকরা দিয়ে দিয়েছেন। যে দল নিজের লড়া ৯১টা আসনেই পেয়েছে ২০১৯ লোকসভার চেয়ে ২.০৬% কম ভোট, তাদের সদস্য সমর্থকরা কি আকাশের চাঁদ এনে দেবে ভেবে ভটচাযমশাই তন্ময় হয়ে ছিলেন? চক্ষুশূল আই এস এফ কিন্তু ২৮টা আসনে ২০১৯ সালে প্রাপ্ত বাম ভোটের চেয়ে ৬.৬০% বেশি ভোট পেয়েছে। এমনকি বাম, কংগ্রেস যোগ করলে যা হয় তার চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছে। অতএব তারাই ডুবিয়ে দিল, এ তত্ত্ব দাঁড়াচ্ছে না। তাদের নেওয়া হল বলে অনেক বাম ভোটার বিমুখ হলেন — এই যদি বক্তব্য হয়, তাহলে সে আশঙ্কা আগে কেন প্রকাশ্যে বলেননি? ফল বেরোবার পরে শৃঙ্খলাকে আর গুরুত্ব দিচ্ছেন না, কারণ গোটা সিস্টেমটাই উলঙ্গ হয়ে গেছে। আগেই শৃঙ্খলাভঙ্গ করে উলঙ্গ হওয়া বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন তো। তাহলে কি আশা করছিলেন আর যা-ই হোক নিজের আসনটি জিতে যাবেন? এবং জিতে গেলে আর বিদ্রোহী হওয়ার দরকার বোধ করতেন না? অবশ্য এই ভটচায্যির সবচেয়ে চমকপ্রদ মন্তব্য জোট নিয়ে নয়, বাটি নিয়ে। কমিউনিস্টদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি করাকে তিনি যে ভাষায় কটাক্ষ করেছেন, স্বয়ং তথাগত রায়কেও তা করতে দেখিনি কখনো। নেতাদের বাটি হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ার পরামর্শ শুনে মনে পড়ল, ছোটবেলা থেকে যে কমিউনিস্টদের দেখেছি, তাঁরা এ রাজ্যের বন্যা থেকে শুরু করে কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধে মানুষের পাশে দাঁড়াতে আক্ষরিক অর্থেই ভিক্ষার বাটি নিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি যেতেন, স্টেশনে এবং বাসস্টপে দাঁড়াতেন। নির্বাচনের খরচও এখনো বাড়ি বাড়ি ঘুরে জোগাড় করেন ভটচাযমশায়ের কমরেডরা। এ ভিক্ষা যদি ভটচায্যিমশায়ের কাছে লজ্জার বিষয় হয়, তাহলে তাঁর শ্রেণিচরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ। “আমি মার্কসবাদী, আজীবন তা-ই থাকব” বলেছেন বলেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা চলে না।

মিলে মিশে লড়া এমনই সর্বরোগহর বটিকা হিসাবে সিপিএম মহলে নন্দিত যে সুন্দরবনের লড়াকু নেতা কান্তি গাঙ্গুলি পর্যন্ত ভবিষ্যতে তৃণমূলের সাথে হাত মেলানোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এদিকে ভোটের ফল বেরোবার পর থেকে যত্রতত্র বাম কর্মী সমর্থকরা তৃণমূলের হাতে মার খাচ্ছেন, ঘরছাড়া হচ্ছেন। এমনকি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রাণের মায়া অগ্রাহ্য করে যে রেড ভলান্টিয়াররা কাজ করছেন, তাঁরাও খুনের হুমকি, ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন। বেশ মনে আছে, নির্বাচনের কিছুদিন আগে ফেসবুকে মহম্মদ সেলিমের বিজেপির প্রতি নরম মনোভাবের সমালোচনা করে লিখেছিলাম, বিজেপি ক্ষমতায় এলে নীচের তলার কর্মীরা মার খাবেন, সেলিমবাবুরা পাশে দাঁড়াবেন না। এর প্রতিক্রিয়ায় বহু সিপিএম কর্মী আমার দিকে ধেয়ে এসেছিলেন। অনেকে বলেছিলেন তাঁদের পার্টিতে কোন উপরতলা-নীচতলা নেই। কথাটা সত্যি হলে সত্যিই ভাল লাগত। কিন্তু গত এক সপ্তাহে দেখা যাচ্ছে ‘দিস ম্যান’ মার খাচ্ছে, ‘দ্যাট লিডার’ কী যে করছে কেউ জানে না। ক্ষুব্ধ পার্টিকর্মীরা সোশাল মিডিয়ায় বিষোদ্গার করছেন। বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর বা ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত এলাকার কথা বাদ দিন। কর্মীদের অভিযোগ খোদ দমদমে পার্টি অফিস বেদখল হয়ে যাচ্ছে, তবু নেতৃত্ব সংঘাতে যেতে চাইছেন না। নিরপেক্ষরা নিশ্চয়ই বলবেন নির্বাচনের পরে পশ্চিমবঙ্গে এসব ঘটনা চিরকাল ঘটে। কিন্তু যে দলের কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা যে এরকম মুহূর্তে দলাই লামাকে নেতা হিসাবে চাইবেন না তা বলাই বাহুল্য। তাঁরা চাইবেন নেতারা এসবের প্রতিবাদে রাস্তায় নামুন। তাঁরা আশা করবেন নেতারা বোঝেন যে একটাও আসন না পাওয়ার পর শাসক দলের অত্যাচার নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে চাইলে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক পাওয়াও মুশকিল হবে। ফলে সংবাদমাধ্যম দেখে সাধারণ মানুষ ভাববেন কেবল বিজেপির লোকেরাই নির্যাতিত হচ্ছে।

এতদিন পরে নন্দীগ্রামে একটা মিছিলের ব্যবস্থা হয়েছে। সীমিত শক্তির অজুহাতে বামেদের শীর্ষ নেতৃত্ব কতদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন আর কতজন নিরুপায় কর্মী সমর্থককে বিজেপির কাছে আশ্রয় নিতে হবে — তার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে বামেদের ভোট শতাংশও শূন্যের দিকে হাঁটবে কিনা। পরাজিত, আক্রান্ত মানুষ কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা দিল্লি থেকে জেলায় চলে আসতে পারেন দলের আক্রান্ত লোককে দেখতে। সূর্যকান্ত মিশ্ররা কলকাতা থেকে গিয়ে উঠতে পারেন না।

তথ্যসূত্র

[১] দ্য হিন্দু পত্রিকা

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

বামেদের মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিকতার সংকট কিংবা দ্বিমেরু-বঙ্গের এক নিশ্চিন্ত নাগরিকের প্রলাপ

বিজেপির রামনবমীর বিপরীতে তৃণমূলের হনুমানপুজো, অযোধ্যার রামমন্দিরের বিপরীতে দীঘার জগন্নাথ মন্দির… এগুলোই বাংলার রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের অন্তিম লগ্নে ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের সাংবাদিক সম্মেলন দেখছিলাম। ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিরাট আশা জাগিয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেহারাটা অনেকেরই মনে আছে। জয়ের জন্য প্রাণপণ লড়াই করার পর পরাজিত হলে কোনও নেতা বা নেত্রীর প্রতিক্রিয়া ওরকমই হওয়ার কথা। অথচ, জয়প্রকাশবাবু দেখলাম বেশ স্থিতধী। তিন থেকে ৭৭-এ পৌঁছনোতেই তিনি সাফল্য (নাকি সান্ত্বনা?) খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে শতাধিক বিধানসভা আসনে এগিয়ে থাকার কথা সুবিধামত ভুলেই গেলেন বোধহয়। কিংবা হয়তো ওটা কর্মীদের মনোবল ভাঙতে না-দেওয়ার কৌশল। তবে যে-কথা বলতে গিয়ে তাঁর মাস্ক-পরা মুখও মনে হল উদ্ভাসিত, কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট তৃপ্তি— তা হল তৃতীয় শক্তির অবলুপ্তি। বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ যে রাজ্যের রাজনীতিতে কোনও সাড়াই ফেলতে পারেনি এবং আগামী দিনে এই রাজ্যের রাজনীতি যে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে— এই ঘোষণায় রীতিমত জয়ের প্রকাশ দেখলাম। বোঝা গেল, রাজ্য জয়ের স্বপ্ন সফল না-হলেও পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিমেরু রাজনীতির দিকে নিয়ে যাওয়াও বিজেপির পক্ষে যথেষ্ট সন্তোষজনক ফলাফল।

২০১৪-র পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়তনের কোনও রাজ্যে বিজেপি-কে এরকম বিশ্রী হারের মুখ দেখতে হয়নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা, দেশভাগের ইতিহাস ইত্যাদি নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের খেলা শুরু হয়েছিল। আরও নানাবিধ মেরুকরণের আশঙ্কাও প্রকট হয়ে উঠেছিল। উপরন্তু, বিজেপি এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে গেলে ২০২৪-এ তাদের লোকসভায় জেতার পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে, এরকমও অনেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন। তা ছাড়াও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোর যা সার্বিক অবস্থা, সেসব দেখে পশ্চিমবঙ্গবাসীর শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। সর্বোপরি অন্য রাজ্যের মানুষও উদগ্রীব ছিলেন দেখার জন্য যে, বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দুত্বের কাছে হার মানে কি না। সেটা ঘটলে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুরাষ্ট্রের বৌদ্ধিক জয় হত। ফলে, তৃণমূল কংগ্রেসের জয় অনেকের কাছেই উল্লাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের বাইরের মানুষের এই উল্লাস শতকরা একশো ভাগ সঙ্গত, কারণ যে কোনও মূল্যে বিজেপির পরাজয়ই তাঁদের প্রয়োজন ছিল। এই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে দেশব্যাপী তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তই। যেমন, এই মুহূর্তে করোনা সামলানোয় গাফিলতি এবং অনিচ্ছা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রবল চাপে পড়েছে বলেই দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের করোনার দোহাই দিয়ে তুলে দিতে পারছে না— যা গত বছর শাহিনবাগের সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের বেলায় করতে পেরেছিল। পশ্চিমবঙ্গে জিতে গেলে মোদি-অমিত শাহ জুটি কৃষকদের ওপর বলপ্রয়োগ করতেও পিছপা হতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু সেসব সংক্রান্ত স্বস্তি ও উল্লাস পেরিয়েও, এই রাজ্যের মানুষের ভবিষ্যতের স্বার্থে কিছু কথা ভেবে দেখা প্রয়োজন বই কী!

প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি। এর সবটাই সরকারবিরোধী ভোট তো বটেই, কিন্তু কী কারণে এই ভোটাররা সরকারের বিরোধী? যদি জনপ্রিয় যুক্তি অনুযায়ী ধরে নিই এদের বিজেপিকে ভোট দেওয়ার একটাই কারণ— মুসলমান বিদ্বেষ, তা হলে বিশেষ উদ্বেগের কারণ রয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিজেপির ক্রমবর্ধমান শক্তিতে আসানসোল, ধূলাগড়, বসিরহাট, তেলেনিপাড়ার মতো নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি হতে দেখা গিয়েছে। এর কোনওটাই তৃণমূলের সংগঠন আটকাতে পারেনি। বহু জায়গাতেই মানুষের অভিযোগ, প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়াও পর্যাপ্ত ছিল না। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে। ২০১৬-তে ১০.১৬ শতাংশ ভোট পাওয়া সাকুল্যে তিন বিধায়কের বিজেপিই যখন এত অশান্তি পাকাতে পেরেছে, তখন প্রায় চার গুণ বেশি ভোট পাওয়া ৭৭ জন বিধায়কের বিজেপি লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে থাকবে কি? মনে রাখতে হবে, এখন তাদের ১৮ জন সাংসদও আছেন, কেন্দ্রে তাদের সরকার। পান থেকে চুন খসলে তা নিয়ে একটা বড়সড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার রসদ তাদের আছে। গত কয়েক বছরে বাংলার সমাজে যে গভীর সাম্প্রদায়িক ক্ষত তৈরি হয়েছে তা যে বিজেপির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মিলিয়ে যাবে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল সমর্থন নিয়ে প্রত্যাবর্তনে প্রমাণিত হল যে, ইমাম ভাতা দিলে অন্যায় হয় না, পুরোহিত ভাতা দেওয়াও ভালো। যেহেতু বিজেপির প্রচার ছিল পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো করতে দেওয়া হয় না, সেই প্রচারকে মিথ্যা প্রমাণ করতে সরকারের ক্লাবগুলোকে পুজোর খরচ দেওয়াও অন্যায় নয়। অতএব আগামী পাঁচ বছর বিজেপির প্ররোচনা দেওয়ার মতো ইস্যুর অভাব হবে না, আর তৃণমূল সরকার সে সব প্ররোচনার রাজনৈতিক মোকাবিলা না-করে দড়ির উপর ব্যালান্সের খেলা খেলে যাবেন— এমন সম্ভাবনা তাই প্রবল।

যা গত দশ বছরে হয়নি, আগামী পাঁচ বছরে হবে— এমন আশা করা যুক্তিযুক্ত নয়। তাই ২০১১ থেকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়া আরএসএস-এর সংগঠনের বিরুদ্ধে শাসক দল সত্যিকারের কোনও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে— এমন ভাবা, অতএব, বাতুলতা হবে। অবশ্য সরকারি দল প্রতিরোধ করতে যাবেই বা কেন? মুখ্যমন্ত্রী তো এই সেদিন ইন্ডিয়া টুডে-র সাংবাদিক রাহুল কাঁওয়ালকে বলেছেন, আরএসএস-কে নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা নেই, কারণ তারা ভোটে লড়ে না তাঁর সমস্যা বিজেপিকে নিয়ে। বিজেপিকে হারানো হয়ে গেছে, অতএব আরএসএস এবং তৃণমূলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলতেই পারে বোধহয়। আগামী পাঁচ বছর, বা জয়প্রকাশবাবুর কথা ঠিক হলে, অতিদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিজেপির রামনবমীর বিপরীতে তৃণমূলের হনুমানপুজো, অযোধ্যার রামমন্দিরের বিপরীতে দীঘার জগন্নাথ মন্দির… এগুলোই বাংলার রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে।

দুর্নীতির অভিযোগ, সে আম্ফানের ত্রাণেই হোক কিংবা এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক, বাংলার নির্বাচনে সে সব যে কোনও ইস্যু নয় তা এবারের নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলত কর্মসংস্থানও ইস্যু নয়, হয়তো আগামীদিনেও হবে না। শিল্প হবে কি হবে না, শিক্ষিত বেকাররা চাকরি পাবে কি পাবে না— প্রচারে অনবরত সে সব কথা বলে এবং ইশতেহারে লিখে বিরাট গোল্লা পেয়েছে বাম দলগুলো এবং কংগ্রেস, আইএসএফ একটার বেশি আসনে জিততে পারেনি। সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের সম্বন্ধে প্রশ্ন আসতে মুখ্যমন্ত্রী একটাও শব্দ খরচ করতে চাইলেন না, করার কথাও নয়। তারা যে ইস্যুগুলো তুলে ধরেছিল, সেগুলো তাঁর মাথায় থাকলেই নাগরিকদের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দিক থেকে ভাবলে মানতেই হয়, তাঁর সে সব মনে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। যারা মনে রেখেছিল, তাদের সব মিলিয়ে সাড়ে আট শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। অত কম মানুষের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে একজন মুখ্যমন্ত্রীর মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। আর বিজেপি যে ওসব নিয়ে ভাবতে রাজি নয় তা কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের দখলে থাকা অন্য রাজ্য সরকারগুলোর কার্যকলাপ দেখলেই বোঝা যায়। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন থেকে ইস্যুকেন্দ্রিক না-হয়ে চিহ্নকেন্দ্রিক হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী কালীঘাট মন্দিরে গেলেন কি না, মহরমের দিন প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি দেওয়া হল কি না— এই সব।

সাধারণ নাগরিকের স্বস্তি এইখানে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালু করা একগুচ্ছ জনমুখী প্রকল্প, যার সুবিধা গরিব প্রান্তিক মানুষ পেয়ে থাকেন, সেগুলো অন্তত চালু রইল। বিজেপি যেখানে যেখানে ক্ষমতায় আছে, সেখানে এরকম প্রকল্পের কোনও স্থান নেই। আয়ুষ্মান ভারত[3] বা ফসল বিমা যোজনার[4] মতো দু-একটা কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প যা-ও বা আছে, সেগুলো সবই প্রকৃতপক্ষে ধোঁকার টাটি বলে অভিযোগ।

স্পষ্টত, আর একটা আশা নিয়ে মানুষ তৃণমূলকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেছেন, তা হল, বাংলায় এনআরসি হবে না। আইনত এনআরসি করা বা না-করা কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে মানুষ নিশ্চয়ই আশা করেন দিদি এই রাজ্যে এই প্রক্রিয়া প্রাণপণে আটকাবেন। গত বছর যখন বিভিন্ন ধারার বামপন্থীরা, নানা বয়সের মহিলারা সিএএ-এনআরসি-এনপিআর আটকাতে আন্দোলন করছিলেন তখন দেখা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই নিয়ে মিছিল-মিটিং করলেও অন্যদের আন্দোলনের প্রতি রাজ্য প্রশাসন বিশেষ সদয় নয়। আশা করা যায়, এখন আর সে সমস্যা হবে না। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তো আর এ নিয়ে আন্দোলন করতে যাবে না, শক্তিহীন বামফ্রন্টই বা কী এমন আন্দোলন করবে? হাতে রইলেন বিকল্প বামেরা, যাঁরা এরপর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও তীব্র করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তাঁরা তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবেক। তৃণমূলের এই বিপুল জয়ে তাঁদের ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনের যথেষ্ট অবদান— এই দাবিতে রবিবাসরীয় আকাশ-বাতাস তাঁরা মুখর করে তুলেছিলেন। সুতরাং তাঁরা আন্দোলন করলে মমতা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। আশা করা যায়, দিদি আগামী পাঁচ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এঁদের সংগ্রামকে মমতাময়ী পক্ষিমাতার মতো দুই ডানা দিয়ে আগলাবেন। ২০১৮ সালে যেমন চেয়েছিলেন পঞ্চায়েতে শুধু তাঁর দলই থাকুক, এখন তেমন দাবি আশা করা যায় করবেন না যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও শুধু তাঁর দলই লড়ুক।

শূন্যে পৌঁছে যাওয়া কংগ্রেসের এ-রাজ্যে ভবিষ্যৎ কী, বলা দুষ্কর। একা কুম্ভ অধীর চৌধুরীর গড় মাটিতে মিশে গেছে, প্রবীণ জনপ্রিয় নেতা আব্দুল মান্নান ধরাশায়ী। বৃদ্ধতান্ত্রিক সিপিএমেও একগুচ্ছ নতুন মুখ দেখা গেছে, কিন্তু কংগ্রেসে? সিপিএমের কচিকাঁচারা যদি ‘একলা চলো রে’ নীতিতে ফিরে যেতে চান তা হলে কংগ্রেসের কী হবে, দেবা ন জানন্তি।

অবশ্য ফলপ্রকাশের পর আটচল্লিশ ঘন্টা কেটে গিয়ে থাকলেও রাজ্য সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের কেউ দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন, এমন খবর নেই। একটি তথাকথিত বিপ্লবী পার্টির শান্ত হ্রদের মতো অন্দরমহলে একমাত্র ঢেউ বলতে টিভির পর্দায় পরাজিত সিপিআইএম প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অকস্মাৎ বিষোদ্গার। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীর বাইরে এ-ভাবে কথা বলা শৃঙ্খলাভঙ্গ কি না, সে বিতর্কে না-গিয়েও বলা যায়, তাঁর সমালোচনায় গঠনমূলক কিছু ছিল না। এই ফলের জন্য “পলিটব্যুরোর দু-একজন নেতা” ছাড়া তিনি দুটো কারণ দেখিয়েছেন। সর্বক্ষণের কর্মীদের যথেষ্ট ভাতা না-পাওয়া আর আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করা। দ্বিতীয়টার ব্যাখ্যা দেননি, আর প্রথমটা ঠিক থাকলে কীভাবে শূন্যের বদলে খাতায় পাঁচটা বা দশটা আসন জমা পড়ত, তা বুঝতে চেষ্টা করার চেয়ে বাইফোকাল চশমা হারানো মানুষের পক্ষে সূচে সুতো পরানো সহজ। উপরন্তু তন্ময়বাবু যে ভাষায় বামপন্থীদের রাস্তার রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখাকে কটাক্ষ করেছেন, তাতে তাঁর মার্কস্‌বাদে আস্থাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করা নিয়ে আপত্তি আর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা নিয়ে প্রবল আবেগ দেখে মনে হয়নি, আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করার মতো কোনও পথ তিনি নিজের দলকে দেখাতে চান। বোধহয় তাঁর মনে হয়েছে স্রেফ আইএসএফ-কে জোটের বাইরে রাখলেই মানুষ তাঁদের ঢেলে ভোট দিতেন। মীনাক্ষী, ঐশী, দীপ্সিতা, সৃজন, প্রতীকুরদেরও তা-ই ধারণা কি না, কে জানে! যদি তা-ই হয়, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে বামেদের বাংলায় ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা শূন্য।

আসলে সিপিএমের রাজনীতিতে শ্রেণির প্রশ্ন বহুদিন ধরেই অবহেলিত। তা না-হলে ওঁরা আগেই বুঝতে পারতেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে নির্ণায়ক ভোট দেন গরিব মানুষ, যাঁরা তাঁর বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে উপকৃত। আমাদের দেশে যে কোনও নির্বাচনেই নির্ণায়ক ভোট আসলে গরিব মানুষের, কারণ তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গত কয়েক বছরে সিপিআইএম-এর সোশাল মিডিয়া নির্ভরতা, এবং কারা সোশাল মিডিয়ায় ওই পার্টির জয়পতাকা ওড়ান তা দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় সিপিআইএম-এর মূল ভোটার হয়ে দাঁড়িয়েছেন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষ। এঁদের অনেকেই আসলে অভ্যাসে সিপিআইএম। পরিবার সিপিআইএম সমর্থক বলে এঁরা সিপিআইএম সমর্থক, অথবা অল্প বয়সে কোনও বাম গণসংগঠনের সদস্য ছিলেন, সেই আবেগ রয়ে গেছে। গরিব মানুষ কোনও পার্টির দ্বারা, সরকারের দ্বারা উপকৃত হলে তা তাঁর ভোটকে প্রভাবিত করে। কিন্তু উপর্যুক্ত শ্রেণির মানুষের সেভাবে উপকৃত হওয়ার ব্যাপার নেই, তাঁরা চলতি হাওয়ার পন্থী। এ বারের ভোটে হাওয়া ছিল বামেরা জিতবে না, অতএব ভোট দিয়ে লাভ নেই। উপরন্তু দাড়ি-টুপি পরা মুসলমান ধর্মগুরুর সঙ্গে জোট বাঁধাও এঁদের পছন্দ হয়নি। তাই লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া সাত শতাংশের মধ্যে থেকেও এই দুই বা তিন শতাংশ বেরিয়ে গিয়ে বিজেপি-বিরোধিতার কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছেন, এখন সোশাল মিডিয়া ভরিয়ে তুলছেন স্বীকারোক্তিতে। এরই মধ্যে হঠাৎ দ্বিমেরু রাজনীতির বিপদগুলো খেয়াল হওয়ায় কেউ কেউ লম্বা পোস্ট লিখে তৃণমূল কংগ্রেসকে খেয়াল করাচ্ছেন, তাঁদের ভোট দেওয়া হয়েছে স্রেফ বিজেপিকে আটকাতে। পার্টিটাকে পছন্দ হয়েছে বা সরকারের কাজ পছন্দ হয়েছে বলে নয়।

শ্রেণি সচেতনতার অভাবে, সমাজবিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ জ্ঞানের অভাবে এই শ্রেণির চিন্তাভাবনাই কিন্তু বর্তমান বাম নেতা এবং প্রার্থীদের বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তাই মমতার জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোকে সিপিআইএম কর্মীরা প্রায়ই হেয় করেন। “মানুষ আপনার দান/ ভিক্ষা চায় না, মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা করুন”— এই চরম নব্য উদারনীতিবাদী কথাটা মিটিং-এ বা সোশাল মিডিয়ায় সিপিআইএম-এর লোকেদের প্রায়শই বলতে দেখা যায়। ওঁরা জানেন না অথবা উপলব্ধি করেন না যে, সরকারের টাকা আসলে করদাতাদের টাকা এবং সে কর একজন ধনী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে একজন রিকশাচালক পর্যন্ত সকলেই দেন। সুতরাং নাগরিকের জন্য চালু করা কোনও সরকারি প্রকল্প আদতে দান নয়। কন্যাশ্রীর সাইকেল যেমন দান নয়, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের প্রিমিয়ামও দান নয়। শুধু তা-ই নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য এগুলো করা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বহু পুরনো কৌশল। বামফ্রন্ট সরকারও এমন প্রকল্প চালাত। কথাগুলো কিন্তু বিস্তর প্রশংসা কুড়োয় মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সমর্থকদের থেকে। ফলে, ওঁরা ভাবেন, একেবারে ঠিক কথাই বলা হয়েছে এবং বাস্তবে গরিব মানুষের থেকে আরও দূরে সরে যান।

এই মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিকতা না-কাটলে সিপিআইএম-এর আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

অতএব দ্বিমেরু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে রুজিরোজগারের প্রশ্ন জিইয়ে রাখার দায়িত্ব এখন পড়ল বিকল্প বামেদের কাঁধে। তাঁদের অনেককালের অভিযোগ, সিপিআইএম বামপন্থার বদনাম করছে। একটিবার সুযোগ পেলেই তাঁরা দেখিয়ে দিতে পারেন আসল বামপন্থা কী, কিন্তু সিপিআইএম তাঁদের জায়গা ছাড়ে না। সিপিআইএম ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরের দশ বছরেও সে সুযোগ ওঁরা পাননি। অনেকটা ওই ‘আনফিট’ বর্ষীয়ান ক্রিকেটার যেমন অতীতের পারফরম্যান্সের জোরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খেলেই যান, আর বেচারা তরুণ প্রতিভাবানদের রিজার্ভ বেঞ্চে বসেই জীবন কাটাতে হয়। নির্বাচকদের অসীম কৃপা, এবার তাঁরা দলের সেই বোঝাগুলিকে বিদেয় করার বন্দোবস্ত পাকা করে দিলেন। আশা করা যাক, তরুণরা সেঞ্চুরি, ডবল সেঞ্চুরির ফুলঝুরি ছোটাতে পারবেন শিগগিরই।

https://4numberplatform.com/ এ প্রকাশিত

‘পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেধার বহির্গমন বন্ধ করতে হবে’

দেখলে অবাক হবেন না, যদি মেদিনীপুরে কোন মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয় “তৃণমূলের শুভেন্দু অধিকারীর হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিপুল ভোটে জয়ী করুন”।

সিপিএম প্রার্থীদের মধ্যে এবার এক ঝাঁক নতুন মুখ। তাদের অন্যতম পৃথা তা। বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্রের প্রার্থী পৃথা সিপিএমের যুব ফ্রন্টের কর্মী হিসাবে গত কয়েক বছর দারুণ সক্রিয় থেকেছেন। তাঁর আরেকটা পরিচয়, তিনি প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক প্রদীপ তা-র কন্যা। পৃথার বাবা ২০১২ সালে বর্ধমান শহরে সিপিএমের একটি মিছিল চলাকালীন খুন হন। সেই সঙ্কট, যা যুগপৎ ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক, তা পেরিয়ে এসে পৃথা আজ বিধানসভায় প্রার্থী। এই যাত্রা এবং জরুরী রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো নিয়ে তাঁর সঙ্গে nagorik.net-এর পক্ষে কথা বললেন প্রতীক

প্রতীক: পৃথা, আপনি যে প্রজন্মের মানুষ তার দু-তিন প্রজন্ম আগে থেকেই বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েকে শেখাচ্ছেন “রাজনীতি খুব খারাপ জিনিস। রাজনীতির ধারে কাছে যাবে না।” এরকম বলার অনেক কারণের মধ্যে একটা অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার দীর্ঘ ইতিহাস। সেই হিংসা আপনাকে সরাসরি স্পর্শ করেছে। তারপরেও আপনি রাজনীতিতে এসেছেন। যারা রাজনীতিতে আসতে চায় তাদের কী বার্তা দিতে চাইবেন?

পৃথা: হিংসার বাতাবরণের কারণে বাবা-মায়েরা ভয় পান ঠিকই। কিন্তু যে কোন কাজেরই কিছু ইতিবাচক, কিছু নেতিবাচক দিক থাকে। রাজনীতিরও তাই। যারা রাজনীতি করতে আসবে, তাদের এগুলো মাথায় রেখেই আসতে হবে। আর সত্যি সত্যি রাজনীতিতে আসতে চাইলে বারণ করে কাউকে বেশিদিন আটকে রাখা যায় না।

প্রতীক: আপনার বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বেশ জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে। অল্পবয়সী ভোটারদের মধ্যে বিজেপি বেশ জনপ্রিয়। যারা সক্রিয়ভাবে বিজেপি করে না, তাদের কথাবার্তা বা সোশাল মিডিয়া পোস্টেও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা, প্রাচীনপন্থী মতামতের প্রাবল্য। এমন কেন হচ্ছে বলে মনে হয়? চিরকাল তো অল্পবয়সীরা বামপন্থীদের দিকেই আকৃষ্ট হত বেশি। বামপন্থীরা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না বলেই কি এরকম হচ্ছে?

পৃথা: এটা একেবারেই ভুল ধারণা। আমি গ্রামাঞ্চলে ঘোরা এবং কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অল্পবয়সীদের দক্ষিণপন্থার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ব্যাপারটা কলকাতাকেন্দ্রিক। সেই জন্যে চোখে পড়ে বেশি এবং এটাই প্রচার করা হয়। বাস্তব চিত্র একদমই অতটা খারাপ নয়। বরং বিরাট সংখ্যক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে মার খাওয়া দেখে, বিপদের সম্ভাবনা মেনে নিয়ে বাম রাজনীতি করতে আসছে। এটা কেমন জানেন তো? এই যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ছেলেমেয়েরা বাংলা বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে? এটাও কিন্তু শহরকেন্দ্রিক ধারণা। আমরা তো দেখি প্রচুর ছেলেমেয়ে বাংলা বই পড়ে। এগুলো আসলে তৈরি করা মিথ।

প্রতীক: আচ্ছা, বর্ধমানকে তো একসময় বাম দুর্গ বলা হত। সেখান থেকে পিছু হটতে হটতে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে ঐ জেলায় বামফ্রন্ট ২৫-এ পাঁচ আর লোকসভা নির্বাচনে তো শূন্যই। এটা কেন হল?

পৃথা: সব জায়গাতেই আমাদের শক্তি যে কমেছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্ধমানেও তাই হয়েছে। আবার সংগঠন নিজেদের মত করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, নতুন ক্যাডার বাহিনী তৈরি করার চেষ্টা করছে। আগেকার নানা কার্যকলাপে মানুষ অসন্তুষ্ট হয়েছেন, নানা কারণে মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মেছিল। সেগুলো স্বীকার করে নিয়ে সেইসব অভিযোগ মেটানো, হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।

প্রতীক: বিধায়ক হলে বর্ধমানের জন্য আলাদা করে কোন পরিকল্পনা আছে?

পৃথা: অবশ্যই, একগুচ্ছ পরিকল্পনা আছে। বর্ধমানের পৌরসভার সমস্যার কথা তো আগেই বললাম। তাছাড়া বড় নীলপুর মোড়ে একটা গেট তৈরি হল, তারপর সেটাকে ভেঙে দেওয়া হল, তাতে একগাদা টাকা তছরুপ হল। এই দুর্নীতির প্রতিকার করতে হবে। সবথেকে বড় কথা এটা নিরুপম সেনের কেন্দ্র। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বেকারদের জন্য স্বপ্ন বুনেছিলেন। আপনি যদি গড়িয়া থেকে করুণাময়ীর দিকে যান, দেখবেন রাস্তার দু পাশে ইনফোসিসের জন্য বরাদ্দ করা জমিতে একের পর এক বিলাসবহুল হোটেল উঠেছে। বড়লোক বাবুদের বাড়ির ছেলেরা সেখানে গিয়ে ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দেন, আর আমার আপনার বাড়ির ছেলেকে যেতে হয় বেঙ্গালুরুতে কাজ করতে। লকডাউন জুড়ে আমাদের কাছে অজস্র ফোন আসত “দিদি, মায়ের প্রেশার নেমে গেছে। একটু ওষুধটা কিনে বাড়িতে দিয়ে আসবে?” বা “বাবা বাজারে বেরোতে পারছে না, একটা ব্যবস্থা করে দেবে?” মানে প্রচুর মানুষ আছেন, যাঁদের ছেলেমেয়েরা কাজের জন্যে রাজ্যের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে থেকে মেধার এই বহির্গমন বন্ধ করতে হবে। অন্তত নিরুপম সেনের কেন্দ্রে তো বন্ধ করতেই হবে। নিরুপম সেন যেদিন বর্ধমানে হেরেছিলেন, তিনি হারেননি। আসলে পশ্চিমবঙ্গের বেকাররা হেরে গিয়েছিল। তাঁর স্বপ্নকে সত্যি করার লক্ষ্যে যত দূর করা সম্ভব আমি করব।

প্রতীক: আপনার বাবা খুন হওয়ার পরে শুনেছি খুবই কঠিন সময় কেটেছে আপনার পরিবারের। এখন আপনি ওখান থেকেই ভোটে দাঁড়িয়েছেন। কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

পৃথা: বাবা খুন হওয়ার পর আমার মা মাটি কামড়ে ওখানে পড়ে থেকেছেন, একদিনও বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। দুর্বিষহ অবস্থায় মা প্রায় একা লড়াই করেছেন, আমি উচ্চশিক্ষার কারণে কলকাতায় চলে যাই। আমাদের এলাকা ছাড়া করার সবরকম চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু মা-কে নড়াতে পারেনি কেউ। বর্ধমান শহর আমার নিজের শহর। এখানে হাজারো সমস্যা রয়েছে। বহু বছর ধরে পৌর বোর্ড নেই, নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল। তাছাড়া যে সমস্যাগুলো সব জায়গায় আছে, যেমন বেকারত্ব, কৃষক আত্মহত্যার মতই বেকারদের আত্মহত্যাও আজকের জ্বলন্ত সমস্যা। প্রচণ্ড দুর্নীতি সরকারের সব ক্ষেত্রে, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও। ফসলের দাম, নারীর নিরাপত্তা — এরকম যে ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে আমরা লড়ছি সেগুলোও আর সব জায়গার মতই বর্ধমানেরও ইস্যু। সেগুলো নিয়ে মানুষের কাছে যখন যাচ্ছি, খুব ভাল সাড়া পাচ্ছি। কেবল ভোটের অঙ্কের কথা নয়। লাল ঝান্ডা কাঁধে ভোট আমার কাছে মাইলস্টোন। শেখার সুযোগ, বাড়ি বাড়ি যাওয়ার একটা সুযোগ পার্টি আমাকে এনে দিয়েছে। সেই সুযোগটা সৎভাবে কাজে লাগাতে চাই। কিন্তু ভোট হয়ে যাওয়ার পরেও আমাকে লম্বা পথ হাঁটতে হবে। আমি নির্বাচনকে শেখার ধাপ বলে মনে করি। তাই খুব ভাল লাগছে যে বহু মানুষ এসে মন খুলে কথা বলছেন, কোন জড়তা নেই।

প্রতীক: একটা অভিযোগ বা প্রচার আছে যে লোকসভা নির্বাচনে বামেরা বিজেপিকে ভোট হস্তান্তর করেছিল। যদি প্রচারটা ভুলও হয়, এ কথা তো সত্যি যে বামেদের ভোট কমেছিল এবং বিজেপির ভোট বেড়েছিল। এবার কি সেই প্রবণতা বদলাবে?

পৃথা: এটা সত্যি যে কিছু মানুষ একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, তৃণমূলের যে চোর ডাকাত বদমাইশদের জন্য নাভিশ্বাস উঠছে সকলের, বিজেপি এসে তাদের শায়েস্তা করবে। আলাদা করা বামেদের দেগে দেওয়া উচিৎ নয়, অনেক মানুষই এমনটা মনে করেছিল। কিন্তু প্রথমত বিজেপির মনুবাদী এজেন্ডা, তাকে কায়দা করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া, দেশের সম্পদ এক এক করে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া, কৃষকদের উপর অকথ্য অত্যাচার… এতগুলো মানুষ দিল্লীর রাস্তায় বসে বসে মরে গেল অথচ প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে পাঁচ মিনিটের জন্য গিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না… এগুলো মানুষ দেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তারা খেয়োখেয়ি, দলাদলির যে আবহ তৈরি করেছে সেটা মানুষের মনে প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি এখনো ঠিক করে প্রার্থী তালিকাই প্রকাশ উঠতে পারল না, কারণ বিজেপি মাছের ভেড়ির মত হয়ে গেছে। বাজারে মাংস কাটার পর যেমন উদ্বৃত্ত নাড়ি ভুঁড়ি মাছের খাবার হিসাবে ভেড়ির লোকেরা নিয়ে যায়, তেমনি যার যা অপচয়, সব বিজেপি নেবে বলে বসে আছে। দেখলে অবাক হবেন না, যদি মেদিনীপুরে কোন মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয় “তৃণমূলের শুভেন্দু অধিকারীর হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিপুল ভোটে জয়ী করুন”। এই পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সোনালি, রুপালি সবাই বিজেপিতে যাচ্ছেন। অতএব বিজেপি আর তৃণমূল যে একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ তা বুঝতে মানুষের আর অসুবিধা হচ্ছে না। এর পাশে আমরা আমাদের মতাদর্শ, কাজকর্ম নিয়ে দাঁড়াচ্ছি। সব মিলিয়ে আমাদের এবারের ফল নিশ্চয়ই ভাল হবে।

প্রতীক: বিজেপি সরকারের কথা যখন তুললেন তখন বলি, আপনাদের ইশতেহারে বলা হয়েছে সংযুক্ত মোর্চার সরকার হলে এ রাজ্যে এন আর সি, সি এ এ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু একটা সমালোচনা হচ্ছে যে এই ইস্যু নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে যতটা সোচ্চার হওয়া উচিৎ আপনারা তা হচ্ছেন না। কী বলবেন?

পৃথা: এটা সঠিক সমালোচনা নয়। আমি নিজেই তো প্রচারে এ নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছি। অন্য প্রার্থীরাও বলছেন। এন আর সি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত যে অঞ্চলগুলোতে উদ্বাস্তুরা এসে বসত করেছেন সেখানে তো কথাই নেই। যাদবপুরে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি মানুষের মধ্যে কি সাংঘাতিক আতঙ্ক। যাঁরা সকালবেলায় ক্যানিং, গোসাবা ইত্যাদি এলাকা থেকে পরিচারিকার কাজ করতে আসেন বা দিনমজুরি করতে আসেন, তাঁরা ভয়ের চোটে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ‘এই কার্ড নেই, সেই কার্ড নেই’ আতঙ্কে। সেই কারণে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এন আর সি – সি এ এ নিয়ে আমরা প্রচার করেছি। এখনো ভোটের প্রচারে সেই প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি আমরা এ-ও দেখলাম যে মোদীর এত বিরোধী দিদি, তাঁর দলের সাংসদ, যাদবপুরের মত উদ্বাস্তু আন্দোলনের ইতিহাস থাকা এলাকার সাংসদ নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভোট দিতে উপস্থিত থাকলেন না সংসদে।

প্রতীক: বিশেষ করে আপনি মহিলা বলে একটা প্রশ্ন অবশ্যই করা দরকার। বামেদের সাথে আই এস এফ-এর জোট অনেকের পছন্দ হয়নি। আপনাদের অনেক সমর্থকেরও ব্যাপারটা ভাল লাগেনি, কারণ অনেকের মতে আই এস এফ সাম্প্রদায়িক দল। আরেকটা বড় কারণ আব্বাস সিদ্দিকির বেশ কিছু নারীবিদ্বেষী মন্তব্য, যার ভিডিও সুলভ। বিশেষত নুসরত জাহানের পেশা এবং অন্য ধর্মের লোককে বিয়ে করা নিয়ে আব্বাস যা বলেছেন। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?

পৃথা: দেখুন, যে দলগুলো মিলে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করেছে তারা যদি সব ব্যাপারে একমত হত, তাহলে তো একটাই দল হত। অনেক বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য তো আছেই। এই মুহূর্তে ধর্ম দিয়ে মানুষকে ভাগ করার যে খেলা এ দেশে বিজেপি – আর এস এস চালু করেছে, তার বিরুদ্ধে যে আছে তাকেই আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। সে কংগ্রেসই হোক আর আই এস এফ-ই হোক। আব্বাসের ঐ মন্তব্যগুলো একদমই অনুচিত, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে উনি ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে উনি দলিতদের অধিকারের কথা বলেছেন; জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের অধিকারের সপক্ষে বলেছেন। আই এস এফ যে সংগঠনগুলোকে নিয়ে তৈরি হয়েছে, তাদের দিকেও যদি তাকান, দেখবেন তারাও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের অধিকারের কথা বলছে। আমি যে পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি তার মধ্যে থেকে বামপন্থী রাজনীতিতে আসা স্বাভাবিক, কিন্তু যে একেবারে অন্য আবহে অন্যরকম ভাবনা চিন্তায় বেড়ে উঠেছে, তাকে আমি আমার রাজনীতি দিয়ে প্রভাবিত করতে পারছি। সে-ও আমার মতাদর্শের সবটা না মানলেও দু-চারটে কথা বলছে। আমার মনে হয় এটা বড় সাফল্য। আগের সব কথাবার্তা সত্ত্বেও আব্বাস এখন যে রাজনীতির কথা বলছেন, ব্রিগেডে যার কিছুটা দেখা গেছে, তা আশাব্যঞ্জক। সাধুবাদ না দিয়ে পারা যায় না। ভারতের সংবিধান রক্ষা করার লড়াইয়ে আমাদের সকলকে প্রয়োজন, তাই সবাইকে নিয়েই লড়ছি।

ছবি ঋণ : ফেসবুক । পৃথার অঙ্কনচিত্রের শিল্পী তৌসিফ হক। শিল্পীর অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি ঋণ cpimwb.org.in

নেমে আসুন ভোটারের সমতলে

ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না।

কিছুদিন পরে পরেই, বিশেষ করে কোন নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে, বিজেপি-বিরোধী মানুষজন সমাজ মাধ্যমে, একান্ত আলাপচারিতায় এবং লিখিত রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বিস্ময় প্রকাশ করেন “এত কিছুর পরেও লোকে ওদের সমর্থন করছে!” বা “এত কিছুর পরেও বিজেপি জিতে গেল!” এত কিছু, অর্থাৎ অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া; সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর পরিকল্পিত, রাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট হিংসা; আইনশৃঙ্খলার অবনতি; গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষের চরম আর্থিক দুর্দশার পাশাপাশি অতি ধনীদের আরো ফুলে ফেঁপে ওঠা; দুর্বার গতিতে একের পরে এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি হওয়া; দুর্নীতির বৈধতা পেয়ে যাওয়া; সাংবিধানিক অধিকারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। ২০২০-তে এর সাথে যোগ হল কোরোনাভাইরাসকে প্রথমে সরকারের পাত্তা না দেওয়া, পরে আচমকা লকডাউন, তার ফলে গরীব দিন আনি দিন খাই মানুষের অবর্ণনীয় জীবনযাপন ও মৃত্যু। তার সাথে যোগ হল চিকিৎসার অব্যবস্থা সম্বন্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থালা বাজানো, মোমবাতি জ্বালানোর মত গিমিক। কম পরীক্ষা করে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলেও অনেকের অভিযোগ।

এত কিছুর পরেও বিজেপি নির্বাচনে জেতে। অন্তত উড়ে যায় না। কেন হয় এরকম? দেখা যায় বিজেপির বিরুদ্ধে যাঁরা — রাজনৈতিক দল, চিন্তাবিদ, সাধারণ মানুষ — তাঁরা সকলেই এর কতকগুলো সাধারণ কারণ খুঁজে পান। সেগুলো মোটামুটি এরকম — ১) সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ, ২) বিজেপির অসম আর্থিক প্রতিপত্তি, ৩) বিজেপি আই টি সেলের প্রোপাগান্ডার তীব্রতা এবং ৪) নির্বাচন কমিশনের গান্ধারীবৃত্তি। কেউ কেউ মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের বৃহদংশের নির্লজ্জ চাটুকারিতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করাকেও সঙ্গে যোগ করেন।

সব সত্যি। কিন্তু কবির ভাষায় বললে “সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।”

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এন ডি এ সরকারের কর্মতৎপরতার যে তালিকা সকলের সামনে রয়েছে, তাতে গত কয়েক মাসে যোগ হয়েছে নতুন কৃষি আইন। এই আইন পাশ করা হয়েছে অভূতপূর্ব অগণতান্ত্রিক উপায়ে এবং এর বলে ভারতীয় কৃষকদের একেবারে কর্পোরেট গোলামে পরিণত করা যাবে। গরীব, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের ভাত ডাল আলুসেদ্ধটুকুর নিশ্চয়তাও উধাও হবে। এর পরেও কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তায় ধস নামতে দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকের আশঙ্কা। ফলে যাঁরা দক্ষিণপন্থার ঘোষিত বিরোধী — রাজনৈতিক দলের সদস্য বা পার্টি আনুগত্যহীন ব্যক্তি — যা-ই হোন না কেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিস্ময় ক্রমবর্ধমান। এমনকি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরাও বলে থাকেন “এত কিছুর পরেও…!” ফলত হতাশা। আর সেই হতাশার কারণে নির্বাচনের ফল বেরোবার পর বিজেপি-বিরোধীরা কিছু ভয়াবহ দক্ষিণপন্থী আচরণ শুরু করেন। যেমন অনেকে বলতে শুরু করেন “মুসলমানগুলো কেন অমুক পার্টিকে ভোট না দিয়ে তমুক পার্টিকে ভোট দিল?” কেউ আবার সমস্ত দোষ ইভিএমের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন (যদিও মনে করার কারণ নেই যে ইভিএম সম্পূর্ণ নির্দোষ)। এই আচরণ সাধারণ সমর্থক থেকে উচ্চস্তরের পার্টি নেতা পর্যন্ত সকলকেই করতে দেখা যায়। এই বিশ্লেষণে “সবাই বিজেপি হয়ে গেছে” — এই বিশ্বাস ক্রমশ ঘাড়ে চেপে বসে, বিজেপির লাভ হয়। কিন্তু এই বিশ্লেষণ একমাত্রিক। বিরোধী বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা ভেবে দেখবেন, নির্বাচনে (বিশেষ করে বিধানসভায়) যে মাইক্রো ইস্যুগুলো কাজ করে, সেগুলোকে এই বিশ্লেষণে অগ্রাহ্য করা হয়। সে কারণেই বিজেপিকে আটকানোর উদ্দেশ্যে বলা হয় “আর যাকে ইচ্ছা ভোট দিন, বিজেপিকে দেবেন না।”

একথা যাঁরা বলেন, বা বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের রামধনু জোটের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা সকলেই ন্যূনতম লেখাপড়া জানেন। শ্রেণীর দিক থেকে মধ্যবিত্ত বা তদূর্দ্ধ। প্রায় সকলেরই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে; নিদেন পক্ষে রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান এবং স্পষ্ট মতামত আছে। এঁরা জানেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতবাদ ও কার্যকলাপ কতটা ভয়ঙ্কর। ফলে তাঁদের কাছে সব নির্বাচনই হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে ভারতীয়ত্বের লড়াই। বিজেপি যেমন বাইনারি তৈরি করেছে সারা দেশে — দেশদ্রোহী আর দেশপ্রেমিক — অনেকটা একই আদলের আরেকটা বাইনারি এঁদের মনেও তৈরি হয়ে রয়েছে। ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন একজন মানুষ ভোট দিচ্ছেন বা কলকাতার কোন বস্তিবাসী যখন ভোট দিচ্ছেন, তিনি যে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বা বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছেন না, দেওয়া সম্ভব নয় — একথা বুঝতে সারা দেশের বিজেপি-বিরোধীদের কেবলই ভুল হয়ে যাচ্ছে। এ ভুল না করলে কত দূর লড়া যায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিহারের নির্বাচনে।

কোন সন্দেহ নেই, যদি দেশের সর্বত্র সবকটা নির্বাচন ভারত ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে কি থাকবে না, গণতান্ত্রিক থাকবে নাকি একদলীয় একনায়কতন্ত্র হয়ে যাবে — কেবল এই ইস্যুতে লড়া যেত, তবে চমৎকার হত। দুঃখের বিষয়, তা সম্ভব নয়। তেমন দেশ তৈরি করার জন্য আমরা সঙ্ঘবিরোধীরা ৬৭ বছর (১৯৪৭-২০১৪) সময় পেয়েছিলাম। পারিনি। এখন রাতারাতি ভারতেরে সেই স্বর্গে জাগরিত করতে চেয়ে অ্যালার্ম ঘড়ি বাজিয়ে দিলেই রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে না। আপনি জানেন হিটলার কে, নাজি কারা, ফ্যাসিবাদ কী ক্ষতি করে। আপনার বাড়ির কাজের মেয়ে জানে না। এখন যদি ন্যুরেমবার্গ ল-এর সাথে সাদৃশ্য আছে বলে মোদী সরকারের পাশ করা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করতে বলেন, সাবধান করেন “আর যাকে ইচ্ছে ভোট দাও, বিজেপিকে দিও না”, তার বয়ে গেছে আপনার কথা শুনতে। কেবল গ্রামের গরীব মানুষ, শহরের বস্তিবাসী বা কাজের মেয়ের কথাই বা কেন? নিজেদের লেখাপড়া জানা আত্মীয়স্বজনদেরই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, ফ্যাসিবাদ কী কজন জানে? যে চেতনা তৈরিই হয়নি, সে চেতনার কাছে আবেদন করে কোন সাড়া পাওয়ার আশা করা কি উচিৎ?

সত্যি কথা বলতে, পৃথিবীর কোথাও কোন নির্বাচনই সম্পূর্ণত মতাদর্শের লড়াই হয় না। হওয়া উচিৎ কিনা তা-ও ভেবে দেখা দরকার। ধরা যাক, একটা দেশের সরকার রাস্তাঘাট সারায়নি পাঁচ বছর ধরে, রোজ দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ তারা দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি মাসে সংবর্ধনা দেয়। এই দলের কি ভোট পাওয়া উচিৎ? গণতন্ত্রে নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকারই শিরোধার্য, রাজনৈতিক দলের ভোট পাওয়ার অধিকার নয়। ভোটার ঠিক করবেন তিনি কোন কোন ইস্যুর ভিত্তিতে ভোট দেবেন। রাজনৈতিক শক্তিগুলো, সে কোন দল হোক বা ব্যক্তি, ভোটারের মত পাওয়ার জন্য অন্যদের চেয়ে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। “আমরা বিজেপি নই, অতএব আপনার ভোট পাওয়া আমাদের অধিকার” — কোন দল এমন বলতে পারে না। বললে সেটাই অগণতান্ত্রিক। যদি কেউ বলে “অমুক দল বিজেপি নয়, অতএব ওকে ভোট দেওয়া আপনার কর্তব্য”, তাহলে তা-ও অগণতান্ত্রিক। কারণ রাজনৈতিক দলের কর্তব্য ভোটারের চোখে নিজেকে অন্যদের চেয়ে উন্নত (অন্তত স্বতন্ত্র) হিসাবে প্রমাণ করা। তা করতে না পারলে, বিজেপির চেয়ে ভাল কোন বিকল্প দিতে না পারলে, ভোটার কেন ভোট দিতে যাবেন?

দেশের অধিকাংশ নির্বাচনেই কিন্তু বিজেপি-বিরোধীরা বিকল্পহীন হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন। ভোটারের সামনে বিজেপির অন্যায়গুলোর তালিকা প্রস্তুত করছেন কেবল। নিজেরা তার বদলে কী কী সদর্থক কাজ করবেন, তা বলছেন না। অনেক ক্ষেত্রে আবার বিজেপির রাজনীতিই অনুসরণ করে নির্বাচনে লড়ছেন। মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে যেমন কংগ্রেস গোশালা বানিয়ে দেওয়া, রাম পথ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতেছিল। সরকারটা স্বভাবতই বেশিদিন টেকেনি। আমরা যারা ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তারা কংগ্রেসের সেই জয়ে উল্লসিত (অন্তত আশ্বস্ত) হয়েছিলাম। গণ্ডগোলটা ওখানেই। বিজেপির নীতি কংগ্রেস নিলে যদি আমাদের আপত্তি না থাকে, কার্টুনিস্টকে তামিলনাড়ু সরকার গ্রেপ্তার করলে যদি আমরা হট্টগোল না করি, আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের উপর তৃণমূল কংগ্রেস সরকার জলকামান চালালেও যদি আমরা চুপ করে থাকি এবং বলি ওরা বিজেপি নয়, তাই ভোট ওদেরই প্রাপ্য, তাহলে বিজেপির হাতই শক্ত হয়। কথাটা আরো বেশি করে সত্যি পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে, যেখানে বিজেপি কখনো ক্ষমতায় আসেনি। জলকামানে ভিজে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলো বা তাদের পরিবার ফ্যাসিবাদ দ্যাখেনি, জলকামান দেখেছে। ত্রিপুরা রাজ্যের চাকরি চলে যাওয়ায় আত্মঘাতী শিক্ষক উত্তম ত্রিপুরার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তাদের বিজেপিকে ভোট দেওয়া থেকে নিরস্ত করা কি সম্ভব তখন আর?

এ রাজ্যে এখন পর্যন্ত লড়াইটা বিজেপির ইউটোপিয়া বনাম বিরোধীদের ইউটোপিয়া। বিজেপি সোনার বাংলার কথা বলছে। সে বাংলায় কর্মসংস্থান কী করে হবে বলছে না। আলটপকা ৭৫ লক্ষ চাকরির কথা বলেই ঢোঁক গিলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের সমস্যা জানতে এবং মেটাতে সরকারকে দুয়ারে দুয়ারে নিয়ে গেছে, অথচ কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে মুখে কুলুপ। বহুকাল ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে নিয়োগ নিয়ে চলতে থাকা অচলাবস্থার কোন স্থায়ী সমাধানের কথা সরকার বলছে না। কেবল এক প্রস্থ নিয়োগের ঘোষণা হয়েছে। তৃণমূল বরং বিজেপির ইউটোপিয়ার বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে এমন এক বাংলার ইউটোপিয়া, যার ইতিহাসে কেবল রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, নজরুল, লালন, ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদনরা আছেন। একে ইউটোপিয়া বলছি, কারণ বাংলায় এঁদের পাশাপাশি তারাও ছিল যারা রামমোহনের বিরোধিতা করেছিল, বিদ্যাসাগরকে খুনের চেষ্টা করেছিল, নজরুল সম্বন্ধে বলত “ফার্সি শব্দে কবিতা লেখে! সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।” ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল বাঙালিরাই। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির কথা তো সকলেই জানে। এই ইউটোপিয়ার লড়াইয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করা শক্ত। এমনিতেও এই ইউটোপিয়াগুলো অধিকাংশ মানুষকে ছুঁতে পারছে না।

তৃতীয় পক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট এসবের বাইরে গিয়ে বলবেন কি, কী হবে রাজ্যের ধুঁকতে থাকা স্কুলশিক্ষার? স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা কি আবার স্বমহিমায় ফেরত আসবে তাঁরা ক্ষমতায় এলে? রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের পাওনাগন্ডারই বা কী হবে? সারা দেশের কৃষকদের সাথে এদেশের কৃষকরাও তো স্বখাতসলিলে ডুবছেন। তাঁদের জন্যই বা কী পরিকল্পনা? শিল্পায়ন নিয়ে কী চিন্তা ভাবনা তাঁদের? ওটা না হলে গরীব মানুষের কর্মসংস্থানের কী হবে? কেন্দ্র যেভাবে রাজ্যের প্রায় সব ক্ষমতাই কেড়ে নিচ্ছে, সরকারে এলে কিভাবে লড়বেন তার বিরুদ্ধে?

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সর্বত্রই বিজেপি বিরোধীদের বিকল্প কর্মসূচী হাজির করতে হবে, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সরকারের অন্যায় তুলে ধরা, সমালোচনা করা বিরোধীদের একটা কাজ। একমাত্র কাজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ নিরাশ হয়ে পড়তে পারেন। বিরোধী রাজনীতি কিন্তু নৈরাশ্যবাদের জ্বালানিতে চলে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। ভোটারের চারপাশের বাস্তব পরিস্থিতি, তার কাছে জরুরী ইস্যুগুলো কী, সেসব না ভেবে যদি লাল, সবুজ, ধূসর সব রং মিলে গিয়ে এমন একটা ইস্যুতে লড়াই করে — যা অধিকাংশ ভোটারের কাছে কোন ইস্যুই নয়, তাহলে দক্ষিণপন্থা জিতেই চলবে। আমি ইউটোপিয়ায় প্রাণপণে যা-ই চাই না কেন।

এসব কী?

একদমই ভাল লাগছে না যখন দেখছি সিপিএম কর্মীরা মমতার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে বলে বিজেপির সাথে লড়াই নেই ধরে নিচ্ছেন

পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে যা হচ্ছে তাতে দেখছি অনেক বামবিরোধীও এখন স্বীকার করছেন এমনটা তাঁরা কখনো দ্যাখেননি। অনেকে এও বলছেন যে এমন পরিবর্তন তাঁরা চাননি। ব্যক্তিগতভাবে এসব দেখে আমি যেমন ক্রুদ্ধ, কষ্ট পাচ্ছি তেমনি একটা মৃদু ভাল লাগার জায়গা এইটা যে দেখতে পাচ্ছি বাম দলগুলোর মধ্যে, সিপিএমের মধ্যে এখনো বহু মানুষ আছেন যাঁরা প্রাণের মায়া, মান সম্মানের মায়া ত্যাগ করে প্রতিরোধ করছেন। রঙ বদলে ফ্যালেননি বা আমার মত ফেসবুকিশ বামপন্থী হয়ে যাননি।
সংবাদমাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ায় যা দেখছি তাতে এটা দেখেও অবাক হচ্ছি বলা যায় যে মার বেশি খাচ্ছেন বামেরাই, বিজেপি নয়। পার্টি অফিস বা ঘরবাড়ি ভাঙচুরও বামেদেরই বেশি হচ্ছে, যারা নাকি প্রধান বিরোধী নয়। বাম রাজনীতির দিক থেকে দেখলে এই মার খাওয়া, লড়ে যাওয়া প্রশংসনীয় নিঃসন্দেহে। ভোট হলে তেমন কিছু বেশি আসন পাব না জেনেও মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্যে এরকম দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যেতে পারে কটা পার্টি?
এসব ভাল লাগছে। কিন্তু একদমই ভাল লাগছে না যখন দেখছি সিপিএম কর্মীরা মমতার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে বলে বিজেপির সাথে লড়াই নেই বলে ধরে নিচ্ছেন। সত্যি কথা বলতে নেতৃত্বের দিক থেকে এমন সামান্যতম ইঙ্গিতও দেওয়া হয়নি। কোন কোন এলাকায় দেখতে পাচ্ছি বা শুনতে পাচ্ছি গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে “বাম-বিজেপি সমর্থিত”, এমনকি “বাম-তৃণমূল সমর্থিত” কাঁঠালের আমসত্ত্বের আবির্ভাব হয়েছে। সেরকমটা একেবারে স্থানীয় স্তরে, একজন বা কয়েকজনের স্বার্থের খাতিরে অতীতেও হয়েছে শুনেছি। এখন যখন পার্টি দুর্বল, ২০১১ র পর থেকে কেষ্টেতর প্রাণীদের অত্যাচারে অনেক জায়গায় প্রায় উধাও তখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কারো কারো এরকম কান্ড ঘটিয়ে ফেলা অন্যায় হলেও অবাক করার মত নয়। আদর্শগত দেউলিয়াপনা যে আছে সে তো আর আমরা নতুন জানছি না, তা বলে সকলেই ওরকম তা ভাবারও কারণ নেই। সেইজন্যেই ওরকম জোট করাটাই সামগ্রিকভাবে পার্টির অঘোষিত নীতি বলে মনে করার কারণ আছে, এমনটা নিখাদ তৃণমূলী ছাড়া কেউ বলবেন মনে হয় না। ফলত আমার আপত্তির জায়গা অন্য।
এখন গ্রাম, শহর সর্বত্রই হোয়াটস্যাপ আর ফেসবুকের দাপট। রাগ হচ্ছে, শঙ্কিত হচ্ছি তখন যখন দেখছি বিজেপি আই টি সেলের তৈরি ভুয়ো খবর সম্বলিত বার্তা সিপিএম সদস্য, সমর্থকরা দিব্যি ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছেন। ফেসবুকেও দেখছি অনেক সিপিএম সদস্য সরাসরি শেয়ার বাটন টিপে বিজেপি এবং তার বন্ধু যে দাঙ্গাবাজ সংগঠনগুলো, তাদের পোস্ট শেয়ার করছেন। সেসব পোস্টের মধ্যে সরাসরি মুসলমানবিদ্বেষী, বানানো তথ্যসম্বলিত যে পোস্টগুলো আমরা অনেকেই চিনি, সেগুলোও রয়েছে। মমতা কত খারাপ তা প্রমাণ করার জন্যে এসবও যাঁরা শেয়ার করছেন তাঁদের ধিক্কার জানাবার ভাষা নেই। মমতা কত খারাপ তা অনেকেই বুঝতে পারছে। আপনারা বিজেপির ভাষা ধার করে না বোঝালে লোকে বুঝবে না?
যেসব মানুষ বুক চিতিয়ে এখনো নিজেদের সিপিএম সমর্থক বলেন তাঁদের এহেন কার্যকলাপ দেখে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। এমনও সন্দেহ হচ্ছে যে তাঁদের সমর্থন বস্তুত একটাই চিহ্নে বরাবর ভোট দিয়ে আসার অভ্যাস, দলটার নীতি বা আদর্শের প্রতি (আদর্শ শব্দটায় আপত্তি থাকলে কথিত আদর্শ বলা যাক) সমর্থন নয়।
তবু সেটা সমর্থকদের ব্যাপার। একজন সমর্থকের সব কিছু তো আর একটা দল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দল অন্তত তার সদস্যদের শাসন করুক। সি পি আই (এম) এর কোন সোশাল মিডিয়া সেল আছে কিনা আমার জানা নেই। যদি নাও থাকে, এসব যে পার্টি সদস্যরা করছেন তাঁরা বুঝে করছেন, না না বুঝে করছেন সে দিকে নেতৃত্বের নজর দেওয়া উচিৎ নয় কি? নইলে তো ধরে নিতে হবে “মৌনং সম্মতি লক্ষণম।” বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইটাই যে বড় লড়াই সে কথা তো আপনাদের পার্টি কংগ্রেসও স্বীকার করল। তাহলে এসব কী?

খরচের খাতা

গ্রামে লোকজন চৌত্রিশ বছর ধরে খেতে পেত না, পরতে পেত না, পড়তেও পেত না। কারণ স্কুল কলেজ কিছু ছিলই না। এখন ইস্কুলে ইস্কুলে ছয়লাপ। সেসব সহ্য হচ্ছে না বলে হিংসুটে সিপিএম কাগজগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে রটাচ্ছে যে সরকারী ইস্কুলগুলো নাকি উঠে যাচ্ছে

যারা পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দিতে না দেওয়ার জন্যে গুন্ডামি হচ্ছে বলে চেঁচামেচি করছে তারা বুঝছে না এর মাধ্যমে কত পয়সা বাঁচছে। একটা এতবড় নির্বাচন করতে কত খরচা হয় বোঝেন? বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেশিরভাগ আসনে নির্বাচন হয়ে গেলে কত টাকা বেঁচে যাবে সে খেয়াল আছে? চৌত্রিশ বছরে বামফ্রন্ট তো কোষাগার খালি করে রেখে গেছিল। তা সত্ত্বেও বাংলায় যে উন্নয়নের জোয়ার এসেছে এরা কি সেটা দেখতে পাচ্ছে না?
ক্লাবগুলো সব ঝিনচ্যাক নীল সাদা হয়েছে, রাস্তায় এত আলো যে পাখিরা রাতে দিন ভেবে কলকাকলিতে ভরিয়ে দিচ্ছে, ভি আই পি রোড, যশোর রোড সব কালীঘাট মন্দিরের চাতালের মত চওড়া হয়ে গেছে, গাছফাছ উড়িয়ে দিয়ে রেলিং বসিয়ে লন্ডন না হোক, কলকাতাকে হনলুলুর মত তো দেখাচ্ছেই। নইলে বিদেশ কিম্বা ব্যাঙ্গালোর থেকে অনেকবছর পর এসে বিশ্ব বাঙালিরা আনন্দে কেঁদে ফেলছে কি এমনি এমনি? গ্রামে লোকজন চৌত্রিশ বছর ধরে খেতে পেত না, পরতে পেত না, পড়তেও পেত না। কারণ স্কুল কলেজ কিছু ছিলই না। এখন ইস্কুলে ইস্কুলে ছয়লাপ। সেসব সহ্য হচ্ছে না বলে হিংসুটে সিপিএম কাগজগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে রটাচ্ছে যে সরকারী ইস্কুলগুলো নাকি উঠে যাচ্ছে। তা সে রটাক। নিন্দুকের রাবণের মত দশটা মাথা হয়। কিন্তু এটা তো বুঝতে হবে এত উন্নয়ন করতে টাকা লাগে। সে টাকা কি আকাশ থেকে পড়বে? বছর বছর ভোটও হবে আবার উন্নয়নও হবে? এ যে খেতে পেলে শুতে চাওয়া দেখছি।
আর ভোট দিতে গেলেই বা দিতেন কাকে? লালেদের তো আর দিতেন না এই বাজারে। আর আছেটা কে? জয় শ্রীরাম পার্টি? আরে জয় শ্রীরাম তো তরোয়াল হাতে নিয়ে যারা মনোনয়ন জমা দেয়া আটকাচ্ছে তারাও বলছে। তবে আর তফাত কী? তাহলে দাঁড়াল কী? দাঁড়াল এই যে ভোট হলেও যাকে দিতেন ভোট না হলেও সে-ই জিতবে। তাহলে আবার অসুবিধেটা কী? খামোকা এক কাঁড়ি টাকা খরচা করার থেকে এইটেই ভাল না? ভাত, ডাল আর ডিমের ঝোলের উপর দিয়ে মিটে যাবে।
কী বললেন? হিংসা? রক্তপাত? ধুর মশাই! ও তো বাম আমল থেকে চলে আসছে। এতটা দ্যাখেননি বলছেন? ওসব চক্রান্ত। চুপিচুপি করেছে, ক্যামেরায় উঠতে দেয়নি। এখনকার সরকার অনেক খোলামেলা, গণতান্ত্রিক। তাই সব দেখতে পাচ্ছেন আর ভয় পাচ্ছেন। এই যে ভয় পাওয়ার স্বাধীনতা — এইটাই তো আগে ছিল না। এটাই তো সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। তাছাড়া হিংসা হচ্ছে হিংসা। পাঁচ কোটি চুরি কল্লেই চুরি আর পাঁচ টাকা চুরি কল্লে চুরি না? যত্তসব মাওবাদীর দল! সিপিএম এর ম, মাও এর ও আর বিজেপির পি র কা মিলে হল মওকা। এরা ভেবেছে এই মওকা ক্ষমতা দখল করে উন্নয়নের গতি স্তব্ধ করে দেয়ার। সে গুড়ে বালি। উন্নয়ন চলছে, চলবে।

বিঃ দ্রঃ বিজেপিতে কা নেই সেটা আমরা জানি। বাম বুদ্ধিজীবীদের ভাষার উপর প্রভুত্ব করার স্বভাবটা আর গেল না। ভাষাটা এখন আর রবীন্দ্র সদনের আঁতেলদের নয়, ওটা এখন সবার। অতএব আমরা যখন বলেছি কা আছে তখন আছে। ও নিয়ে দাঁড়কাকের মত কা কা করবেন না বলে দিচ্ছি।

কংগ্রেস-সিপিএম জোট নিয়ে সীতারামায়ণ

“মিত্রোঁ, আপনারা দেখুন, আমি দলিত বাবা-মার চা ওয়ালা ছেলে, আপনাদের আশীর্বাদে ক্ষমতায় এসেছি। আমাকে সরানোর জন্যে সবাই একজোট হয়েছে। এদের কোন নীতি নেই, কোন আদর্শ নেই, শুধু একটাই উদ্দেশ্য — মোদীকে হারানো। কারণ মোদী গরীব মানুষের জন্যে কাজ করে, কারণ মোদীর আমলে হিন্দুদের জাগরণ হয়েছে” ইত্যাদি

মার্কসবাদ মানে কী, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি যা বলছেন সেটাই কিনা, প্রকাশ কারাত ঠিক না ভুল — এসব তত্ত্বকথা না হয় থাক। তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করার বৈদগ্ধ্য আমার নেই, যতদূর জানি বেশিরভাগ লোকেরই আমার মতই অবস্থা। অতএব ওসব ভুলে গিয়ে একটা কান্ডজ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্ন করি। কান্ডজ্ঞান ব্যাপারটা সংসদীয় রাজনীতিতে প্রায়শই গাণিতিক। অতএব প্রশ্নটাকে অঙ্কের প্রশ্নও বলা যায়। প্রশ্নটা এই — যে অঙ্কটা একবার ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে সেটাই আবার করতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ কিনা।

পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের জোট নিদারুণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। আসন সংখ্যাটা যেসব সিপিএম কর্মীর মনে আছে তাঁরা নিশ্চয় মানেন একা লড়লে ৩৪ বছরের শাসন বা অপশাসন সত্ত্বেও এত খারাপ অবস্থা হত না। অর্থাৎ ইয়েচুরি, কারাত, বেঙ্গল লাইন, কেরালা লাইন যা-ই হোক না কেন হাতে কাস্তে হাতুড়ি উঠে আসা ভোটাররা মোটেই পছন্দ করেননি। সীতারামের একমাথা চুল বলেই তিনি আবার বেলতলায় যাবেন এটা কী ধরণের কান্ডজ্ঞান ভগবান কিম্বা মার্কস কেউই জানেন না বোধহয়।

আজকের টাইমস অফ ইন্ডিয়া পড়ে বুঝলাম ভদ্রলোকের আবার পার্টির উপর অভিমান হয়েছে। “আমায় প্রো-কংগ্রেস বললে আমিও প্রো-বিজেপি বলতে পারি” জাতীয় ছেলেমানুষি কথাবার্তা বলেছেন ধেড়ে সাধারণ সম্পাদক। সে বলুন গে। উনি বুঝবেন আর ওঁর পার্টি বুঝবে। কিন্তু উনি মার্কসবাদের মানে যা বলেছেন সেটা মেনে নিলেও যে কংগ্রেসের সাথে জোট সমর্থনযোগ্য হচ্ছে না! উনি বলেছেন যে বদলাতে পারে না সে কমিউনিস্ট নয়। মেনে নেওয়া গেল। তাহলে উনি নিজে কংগ্রেসের সাথে জোটের চূড়ান্ত ব্যর্থতা দেখার পরেও বদলাচ্ছেন না কেন?

ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে তাড়ানো যে আশু কর্তব্য তা নিয়ে শুধু সিপিএম বা বামপন্থী কেন, বিরোধী রাজনৈতিক দল বা দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকা নাগরিকদের কারোরই দ্বিধা আছে বলে মনে হয় না। সীতারাম নিজেও বলেছেন মতপার্থক্য শুধু কিভাবে সেটা নিয়ে। তাহলে কেন মনে হচ্ছে যে বিরোধী ঐক্যটা নির্বাচনী জোট করেই হতে হবে? ভোটের পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী তো সিদ্ধান্ত নেওয়াই যায়। সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই তো নির্বাচন দিয়েই শেষ হবে না।

তেলে আর জলে মিশ খাওয়াতে গেলে যে যাকে হারাতে চাইছি তারই সুবিধা হয় সেই শিক্ষাটা ২০১৬ সালের ফল থেকে নেওয়া কি এতই শক্ত? আমরা কেউ কি ভুলে গেছি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে মমতা কী বলে গেলেন সমানে? কংগ্রেস সমর্থকদের বললেন “দেখুন, বরাবর বলেছি কংগ্রেস সিপিএমের বি টিম। দেখলেন তো? ওরা সাঁইবাড়ির শহীদদের কেমন ভুলে গেল দেখুন।” আর সিপিএম সমর্থকদের ছুঁয়ে গেল তাঁর টিটকিরি “বাহাত্তরের সন্ত্রাস ভুলে গেলেন কমরেড?” এর ফলে যেটা হল সেটা হচ্ছে গোটা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঁচ বছর কী কাজ করলেন তার কোন হিসাবই দিতে হল না। বিরোধীরা নিজেদের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ সামাল দিতেই ব্যস্ত থাকলেন, সরকারকে প্রশ্নটা করবেন কখন?

আরও পড়ুন ঢেউ উঠছে…

এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়, রামধনু জোট হলে নরেন্দ্র মোদীর কাজটাও একইরকম সহজ হয়ে যাবে। অর্থনীতির বেহাল অবস্থার জন্যে জবাবদিহি করতে হবে না, সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার পুঁজিবাদের জন্যে কৈফিয়ত দিতে হবে না, কর্নিসেনাদের তোল্লাই দেওয়া, মুসলমান, দলিতদের উপর অত্যাচারের প্রশ্ন উঠবেই না। তিনি শুধু কেঁদেকেটে মিটিঙে মিটিঙে সেই ফাটা রেকর্ড বাজাবেন “মিত্রোঁ, আপনারা দেখুন, আমি দলিত বাবা-মার চা ওয়ালা ছেলে, আপনাদের আশীর্বাদে ক্ষমতায় এসেছি। আমাকে সরানোর জন্যে সবাই একজোট হয়েছে। এদের কোন নীতি নেই, কোন আদর্শ নেই, শুধু একটাই উদ্দেশ্য — মোদীকে হারানো। কারণ মোদী গরীব মানুষের জন্যে কাজ করে, কারণ মোদীর আমলে হিন্দুদের জাগরণ হয়েছে” ইত্যাদি। এর সাথে মোদীর ইশারায় সাঙ্গোপাঙ্গদের তৈরি কিছু বাইনারি তো থাকবেই, সেগুলো তো জোট হলেও হবে, না হলেও হবে। অর্থাৎ বিরোধীরা যথারীতি নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকবেন। বরং মোদীর পক্ষে তুলনায় শক্ত হবে যে রাজ্যে যে শক্তিশালী সেখানে তার মোকাবিলা করা। কারণ ২০১৪ র হাওয়া আর নেই। সব প্রশ্নপত্রের একই উত্তর দিয়ে তখন ড্যাংড্যাং করে পাশ করা গেছিল, এবারে অত সোজা হবে না। অতএব আমি যদি মোদী হতাম, আমি চাইতাম শুধু কংগ্রেস-বাম নয়, যত বিরোধী দল আছে সব্বাই মিলে একটা জোট হোক। তাহলে বলতে পারব সারদা, নারদা, ভাদরা, কাস্তে হাতুড়ি সবাই এক। এরা এক হয়ে দেশের মানুষকে লুটতে চায়। এটা অ্যান্টি-ন্যাশনালদের জোট। অর্ণব গোস্বামীকে লেলিয়ে দেব, সে জিওর্জিও আরমানির স্যুট আর জিমি চুর জুতো পরে বলবে “এটা দেশের গরীব মানুষের ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় ফিরতে হাত নিশপিশ করা লুটিয়েন্স এলিট আর জেএনইউ এর অ্যান্টি-ন্যাশনাল বামেদের জোট। এতদিন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ছিল, এবার ভোটে হয়েছে।” আহা! ভারী মজা হবে।

অনেক বাজে বকলাম। একটা মজার স্মৃতি দিয়ে শেষ করি।

জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে যখন সিপিএম পার্টিতে বিতর্ক হয় তখন সীতারাম ইয়েচুরি ছিলেন সরকারে না যাওয়ার পক্ষে। সেবারে তাঁরাই জয়যুক্ত হয়েছিলেন। তারপর আজকালে একটা ছবি বেরিয়েছিল। ছবি মানে এখন যাকে মিম (meme) বলা হয়। ছবিতে কার্ল মার্কসের মূর্তির সামনে বসে সীতারাম বোঝাচ্ছেন “মার্কসবাদ মানে হল…”। আর মার্কসের মূর্তিটা বলছে “এটা আবার কে?”

%d bloggers like this: