তোমার পথের থেকে অনেক দূরে

বুঝে নেওয়া জরুরী যে বিবেকানন্দ যতই এক খণ্ড জমিতে কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করে থাকুন, আজকের মিশন একটি অতিকায় এন জি ও

কিছুদিন আগেই সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আমি যে কলেজে পড়েছি তার নাম জ্বলজ্বল করছিল। কারণ বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে যেখানে একজন মুসলমান অধ্যাপককে সংস্কৃত বিভাগে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পড়াতে দেওয়া হল না, সেখানে আমাদের কলেজের সংস্কৃত বিভাগে একজন মুসলমান অধ্যাপক পড়াচ্ছেন। খবরটা বেরোতে আমার বহু সহপাঠী, বহু সিনিয়র, জুনিয়র তা নিয়ে গর্ব করে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে। কোন কোন মাস্টারমশাইও করেছেন। আমি করিনি। যাঁরা করেছেন তাঁরা ভুল করেছেন মনে করি না। আজকের আবহে দাঁড়িয়ে তাঁরা সঙ্গত কারণেই মনে করেছেন আমাদের কলেজ সঠিক অবস্থানে আছে। তাই গর্বিত হয়েছেন।

কিন্তু আমি, হয়ত নিজের মুদ্রাদোষে, মনে করেছিলাম কোন ধর্মের লোক কোন বিষয় পড়াচ্ছে এটা খবর হয়ে দাঁড়ানোই দুর্ভাগ্যজনক। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির থেকে বি এ পাশ করে যখন সাংবাদিকতায় এম এ পড়তে ঢুকেছিলাম, একেবারে প্রথম দিকের ক্লাসেই আমরা শিখেছিলাম কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা খবর নয়। মানুষ কুকুরকে কামড়ালে খবর। সেই শিক্ষা আজও ভুলতে পারিনি বলে আমার মনে হয়েছিল মুসলমান শিক্ষকের সংস্কৃত পড়ানো খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে — এ ভারতীয় হিসাবে আমার লজ্জা, বিদ্যামন্দিরের ছাত্র হিসাবে আমার যতই গর্ব হোক। উপরন্তু প্রতিষ্ঠান হিসাবে, যৌবনের উপবন হিসাবে আমার কলেজের প্রতি আমার যত টানই থাক না কেন, কলেজটাকে পরিচালনা করে যে প্রতিষ্ঠান, সেই রামকৃষ্ণ মিশনকে আমি কোনদিন বিশ্বাস করিনি।

বেলুড় বিদ্যামন্দিরের ছাত্র হওয়ার আগেই আমার জানা ছিল ভগিনী নিবেদিতাকে রামকৃষ্ণ মিশনের সংস্রব ত্যাগ করতে বলা হয়েছিল তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করতেন বলে। যুক্তি ছিল মিশন রাজনীতি নিরপেক্ষ থাকতে চায়। তা ভাল কি মন্দ সে নাহয় তর্কসাধ্য। বিশেষত ধর্মীয় সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের রাজনীতিতে জড়ানোর বিষময় ফল যখন আমরা একশো বছর ধরে দেখছি। কিন্তু এন ডি এ ১ এর আমলে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের ছাত্র থাকার সুবাদে দেখেছি, কিভাবে হাওড়া থেকে বেলুড় মঠ অব্দি ট্রেন চালু হওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে গেল মসৃণভাবে। পরে যখন সে ট্রেন চালু হল তখন আমি কোন্নগর-হাওড়া নিত্যযাত্রী। দেখতাম রামকৃষ্ণের জন্মতিথির মত দু একটা দিন বাদে সেই ট্রেনে যাতায়াত করতেন মূলত দুজন — ট্রেনের চালক আর গার্ড। অথচ শিয়ালদা-ডানকুনি পথে ট্রেন বাড়ে না বহুকাল, যদিও মানুষ বাদুড়ঝোলা হয়ে যাতায়াত করেন রোজ। সারা দেশে খুঁজলে অমন কয়েকশো রুট পাওয়া যেত।

আরো দেখেছি হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রতি মহারাজদের প্রসন্নতা। ধর্মীয় ঐতিহ্যের বাধ্যতামূলক ক্লাসে অধ্যক্ষের সাথে একবার আমার আর কয়েকজন সহপাঠীর ধুন্ধুমার বেধে গেল। তিনি বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর অত্যাচারের দোহাই দিয়ে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছিলেন। ঠিক সেই কথাগুলোই বলছিলেন যেগুলো আর এস এস তথা বিজেপি সেই সময় অল্প স্বল্প বলত, আজকাল সোচ্চারে, আরো আক্রমণাত্মক ভাষায় বলে।

লক্ষ্য করে দেখবেন, বাংলার সংস্কার আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়রা আজকের বিজেপি-আর এস এসের অতি অপছন্দের লোক৷ বিশেষত বিদ্যাসাগর আর রামমোহন। সোশাল মিডিয়ায় তাঁদের গালাগালি দেওয়া হয়, অশ্লীল মিম বানানো হয়। কোন বাঙালির চোখে যে ঐ দুজন মানুষ খলনায়ক হতে পারেন বিদ্যামন্দিরে না পড়লে আমার জানাই হত না। এক মহারাজ একবার বলেছিলেন ঐ দুজন হিন্দুধর্মের ক্ষতি করেছেন খ্রীষ্টান সরকারের সাহায্য নিয়ে। সতীদাহ প্রথার সপক্ষে আর বিধবা বিবাহের বিপক্ষে এমন ঋজু বক্তৃতা বিজেপির ট্রোলদের মুখে ইদানীং শোনা যায়। বাজপেয়ী বা আদবানি দূরের কথা, নরেন্দ্র মোদীরও আজ অবধি সাহস হয়নি এমনটা প্রকাশ্যে বলার। স্বামী সুবীরানন্দদের মত সাধুদের সমর্থনে যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারে তখন আদিত্যনাথ হয়ত এসব বলবে।

তা এসব অভিজ্ঞতার কারণে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধানমন্ত্রীর জন্যে গেরুয়া কার্পেট বিছিয়ে দেওয়ায় আমি একটুও অবাক হইনি। আর মিশনে ফোন করে ধিক্কার দেওয়ার কর্মসূচীতেও সামিল হইনি। বুঝে নেওয়া জরুরী যে বিবেকানন্দ যতই এক খণ্ড জমিতে কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করে থাকুন, আজকের মিশন একটি অতিকায় এন জি ও, যার দেশী ও বৈদেশিক স্বার্থ রামকৃষ্ণের দরিদ্রতম ভক্তের সাথে না-ও মিলতে পারে, হিন্দুত্ববাদী শাসকের সাথে মিলবেই। কেউ যদি ভাবে রামকৃষ্ণ “যত মত তত পথ” বলেছিলেন বলে, সত্যান্বেষীর আগ্রহে সবরকম সাধনপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন বলে আজকের মহারাজরা হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সদর্পে দাঁড়াবেন, তাহলে সে দিবাস্বপ্ন দেখছে।

বিবেকানন্দ বলেছিলেন ভারতে ইসলামিক শরীরে বৈদান্তিক আত্মার সমন্বয় করতে — এসব জ্ঞানগর্ভ কথা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে কোন লাভ নেই। কাজের কথা হল বাংলায় যত বাড়িতে রামমোহন, বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথের ছবি আছে তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়িতে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, সারদার ছবি আছে। তার অধিকাংশই আবার রামকৃষ্ণ মিশনের কোন বিপণি থেকে কেনা। এই কথাটা নরেন্দ্র মোদী জানেন। তিনি জানেন রামকৃষ্ণ মিশন এমন এক বিক্রেতা যাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে হিন্দুত্ব কোম্পানির পণ্য বেচলে বাংলায় সবচেয়ে বেশি ক্রেতা পাওয়া যাবে। এমনকি যারা সচরাচর কোম্পানিটাকে ভাল চোখে দেখে না, তারাও এবার এই কোম্পানির মাল কিনে ফেলতে পারে। আর যে মালটা বাজারে একদম চলছে না, বরং বেচতে গিয়ে লোকের গালাগাল শুনতে হচ্ছে, সেই সি এ এ-এন আর সি-এন পি আরও এই প্ল্যাটফর্ম থেকে বিক্রি করলে বিক্রি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

এখন ব্যথিত প্রাণেরা বলবেন রামকৃষ্ণ মিশন তাদের প্ল্যাটফর্ম মোদীকে ব্যবহার করতে দিল কেন? এ প্রশ্নের কোন অর্থ নেই। ছুরি দিয়ে মানুষ খুন করা যায়। আপনি কি প্রশ্ন করেন অ্যামাজন তাদের প্ল্যাটফর্মে ছুরি বিক্রি করতে দেয় কেন?
আসল কথা গোটা দেশের মত বাংলাও একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এক হাতে কার্ল মার্কস, অন্য হাতে মা কালী; একদিকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গদগদ হওয়া আর অন্যদিকে বাংলা পরীক্ষায় রচনায় বিবেকানন্দের পুনরুত্থানবাদ (সহজ কথায় “সবই ব্যাদে আছে”) কোট করে বাঙালিদের এতকাল চলেছে। আর চলবে না। আপনাকে পক্ষ নিতে হবে। এতদিন অনেকেরই বিশ্বাস ছিল রামকৃষ্ণ মিশন যে হিন্দুধর্মের কথা বলে তা আর এস এসের হিন্দুত্ব নয়। এই ধারণার মূলে রামকৃষ্ণ স্বয়ং। আজ তাঁর ইচ্ছানুসারে প্রতিষ্ঠিত মিশন বুঝিয়ে দিল তারা দুটোকে বিশেষ আলাদা বলে মনে করে না। এবার আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি রামকৃষ্ণকে নিজের মত করে বুঝে নেবেন, নাকি তাঁর সঙ্ঘের সাধুরা যেভাবে তাঁকে দেখাচ্ছেন সেটাই শিরোধার্য করবেন।

এবার তর্ক উঠবে, রামকৃষ্ণ মিশন আবার কখন হিন্দুত্বকে (সি এ এ-এন আর সি-এন পি আর) মান্যতা দিল? বরংস্বামী সুবীরানন্দ তো বলেছেন “আমরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে”। বলেছেন বটে, কিন্তু ওটা সিগারেটের প্যাকেটে বিধিসম্মত সতর্কীকরণের মত। আমরা যারা রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেছি তারা বিলক্ষণ জানি কতটা মেধাবী হলে তবে ঐ সংগঠনের উচ্চপদে ওঠা যায়। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টির সমসংখ্যক বা তার বেশি পি এইচ ডি, আই আই টি পাশ ইঞ্জিনিয়ার, বিলেত ফেরত ডাক্তার, গবেষক ইত্যাদি পাওয়া যাবে রামকৃষ্ণ মিশনের উচ্চকোটিতে। সেইসব লোকেরা বোঝেননি মোদীর বেলুড় মঠে এসে থাকতে চাওয়া, বিবেকানন্দের জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য কী — এ যিনি বিশ্বাস করবেন তাঁকে একথা বিশ্বাস করানোও শক্ত নয় যে দু হাজার টাকার নোটে মাইক্রোচিপ আছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে প্রধানমন্ত্রীকে না বলা কি সম্ভব? মিশন কী বলে নিরস্ত করতে পারত মোদীকে? অনেক ভাবলাম এবং ভেবে দেখলাম, উত্তরটা কিন্তু খুব সোজা। মহারাজরা বলতেই পারতেন, আমরা সন্ন্যাসী, আপনি এসে থাকলে গাদা নিরাপত্তাকর্মী আসবেন, সংবাদমাধ্যম হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এসবে আশ্রমের শান্তিভঙ্গ হবে, আমাদের সাধন ভজনের অসুবিধা হবে। অবশ্য একথা রামকৃষ্ণ মিশন বলতে পারত কিনা তার চেয়েও বড় কথা প্রশ্রয় পাওয়ার প্রত্যয় না থাকলে নরেন্দ্র মোদী এমন আব্দার করতেন না। তিনি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে গিয়ে থাকার আব্দার তো করেননি আজ অব্দি? অতএব মেনে নেওয়া যাক যে সুবীরানন্দরা সন্ত লাল সিং নন, যিনি হিন্দু হয়ে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং অযোধ্যার রামমন্দির আন্দোলনের বিরোধিতা করার অপরাধে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আনন্দ পট্টবর্ধনের ‘রাম কে নাম’ তথ্যচিত্রে অবশ্য তিনি অমর হয়ে আছেন।

মোদ্দা কথা হল, রামকৃষ্ণ মিশনের জন্য অশ্রুপাত করা বৃথা। যদি আপনি বিপদটা বুঝে থাকেন, যদি আপনি দেশটাকে বাঁচাতে চান, তাহলে রামের সেতু বন্ধনে কাঠবিড়ালী যেটুকু করেছিল সেটুকুই উদ্যোগ নিয়ে করুন। মিছিলে আসুন, মিটিঙে আসুন। যতটা পারেন।

পুনশ্চ: আমার মত যারা বিদ্যামন্দির, নরেন্দ্রপুর বা মিশনের অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনী, তাদের বলি, আমার কাছে কিন্তু কলেজ মানে মাস্টারমশাইরা আর ছাত্ররা। এসব বিষয়ে যে তাঁদের মতামত নেওয়া হয় না তা আমরা প্রত্যেকেই জানি। ফলে আমার তাঁদের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য নেই। তাছাড়া অ্যামাজন ক্ষতিকারক জিনিসপত্র বিক্রি করায় বলে কি আমি তার কর্মচারীদের দোষী ঠাওরাই? তবে যেহেতু আইনত কলেজ বলতে কর্তৃপক্ষকে মানতেই হয় এবং সেই কর্তৃপক্ষ হলেন মিশনের সন্ন্যাসীরা, সেহেতু কেবল ওখানে পড়তাম, এই আবেগে আর কখনো ঐ চত্বরে পা দেব না। প্রিয় মাস্টারমশাইদের সাথে বাইরে দেখা করব, বন্ধুদের সাথেও তাই। বর্তমান ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক হলে তাদের জন্যেও একই ব্যবস্থা।

হে বাঙাল, ভুলিও না

এই মহাকাব্যিক ট্র‍্যাজেডিকে ১৯৮৯ এ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিপদের সাথে এক যোগে ব্যবহার করে যারা, তারা যে আসলে বাঙালদের যন্ত্রণারই লঘুকরণ করে

স্বাধীনতার আগে পূর্ববঙ্গে (অধুনা বাংলাদেশ) বসত ছিল এমন হিন্দু — চলতি কথায় বাঙাল। আমি এবং আমার বাবা আর মায়ের পরিবারগুলো যেমন। আমার স্ত্রীর বাবা, মায়ের পরিবারও। ভারতে হিন্দুত্ববাদের রমরমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিয়ে আলাদা করে চর্চা অনেক বেড়ে গেছে। নতুন নাগরিকত্ব আইন এবং এন আর সি র আবহেও এদের নিয়ে ক্রমবর্ধমান চর্চা।

“হিন্দু খতরে মে হ্যায়” প্রমাণ করতে কিছুদিন হল কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সাথে এক নিঃশ্বাসে আমাদের কথা বলা হচ্ছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা ও উচ্ছেদ ঘটেছিল স্বাধীন দেশের একটি প্রদেশের একটি অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসনের মদতে। আর বাঙালদের দুর্দশার কারণ ছিল একটা পরাধীন দেশের দু টুকরো হওয়া। কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এত বিপুল সংখ্যার মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। এই মহাকাব্যিক ট্র‍্যাজেডিকে ১৯৮৯ এ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিপদের সাথে এক যোগে ব্যবহার করে যারা, তারা যে আসলে বাঙালদের যন্ত্রণারই লঘুকরণ করে সেই চেতনা আজকের বাঙালদের মধ্যে দেখতে পাই না। আরো যা দেখতে পাই না, তা হল দেশভাগের ফলে বহু মুসলমানকেও যে ভিটে ছাড়া হয়ে এ পার থেকে ও পারে যেতে হয়েছিল সেই স্বীকৃতি। স্বাধীনতার আগে পরে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় সম্পত্তিহানি, প্রাণহানি, মেয়ে বউদের সম্মানহানির ইতিহাস যে তাদেরও আছে — সেই চেতনা। বোঝা যায় হিন্দুত্বের অপরবিদ্বেষী রাজনীতি আমাদের মস্তিষ্কে জাঁকিয়ে বসেছে।

আজকের বাঙাল, অর্থাৎ আমার মত ১৯৪৬-৪৭ না দেখা বাঙাল, এমনকি বাংলা ভাষার জন্যে লড়াই করে একটা আলাদা দেশ তৈরি হল যে যুদ্ধে, সেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধও নিজের চোখে না দেখা বাঙাল। তার কাছে গুরুজনদের মুখে শোনা “অরা আমাদের তাড়ায় দিছিল” কথাটুকুই কেবল আছে। তৎসহ ইতিহাস না পড়ার এবং ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ পড়ার অভ্যাস আছে। ফলত আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া খুব শক্ত হয় না যে ধর্মীয় নিপীড়নের বদলে পাল্টা নিপীড়নই উচিৎ কাজ। তাই সি এ এ, এন আর সি মিলিয়ে এ দেশের মুসলমানদের যদি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেওয়া হয় তো হোক, যদি দেশ থেকে তাড়ানো হয় তাতেও ক্ষতি নেই। “ওরাই তো আমাদের তাড়িয়েছিল” একটি যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করার সপক্ষে সাক্ষীগোপাল করা হয় ঋত্বিক ঘটককে, যিনি মানুষকে উদ্বাস্তু বানানোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ করেছেন তাঁর ছবিতে।

যাক সেকথা। ইদানীং তো দেখতে পাই মানবতা কোন যুক্তি নয়। তাই যদি কেউ বলে, আমার বাপ-ঠাকুর্দা উদ্বাস্তু ছিল বলেই আমি চাই না অমন দশা আর কারো হোক — তাকে দল বেঁধে ন্যাকা বলা হয়। সৎ উদ্দেশ্য, অসৎ উদ্দেশ্যের সংজ্ঞাও আমূল বদলে গেছে। নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষের উপর প্রতিশোধ নেওয়াই সৎ উদ্দেশ্য আজকাল। আমার এক আত্মীয় যেমন এন আর সি নিয়ে আলোচনায় বললেন “আমি বিজেপির সাপোর্টার নই। কিন্তু কোন কাজের উদ্দেশ্য যদি সৎ হয়, কেন সমর্থন করব না? এরা বাংলাদেশ থেকে এসে দেশের কাজকর্ম সব দখল করে নিচ্ছে। কেন অ্যালাউ করব?”

এ হেন বাঙালের কাছে মানবতার যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই। তাই একটা অন্য কথা বলি। আজকের বাঙালরা ভেবে দেখুন, যদি দেশভাগের সময় এ পারের মানুষরা (নেতারা তো বটেই) এই “কেন অ্যালাউ করব” কথাটা বলতেন, তাহলে কী অবস্থা হত আমাদের পূর্বপুরুষদের? আমরা এতদিনে জমিয়ে বসেছি বলে এখন যারা উদ্বাস্তু তারা চুলোয় যাক — আসামের বাঙালরা সেখানকার পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান (ওখানে যাদের মিঞা বলা হয়) সম্পর্কে এই মনোভাব পোষণ করেই এন আর সি হয়ে বিপদে পড়লেন। একথা বললেই আমার সেই আত্মীয়ের মত অনেক বাঙালই বলেন “আমার সব ডকুমেন্ট আছে। এখানে এন আর সি হলে আমার ভয় নেই।” আপনি যদি এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন, তাহলে আপনি নিজের চারপাশ সম্বন্ধে অদ্ভুত উদাসীন। শেষ পর্যন্ত এন আর সি হোক বা না হোক, আপনার বাপ-ঠাকুর্দাকে যে “অ্যালাউ” করা হয়েছিল সেকথা বলা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। সোশাল মিডিয়ায় দেখুন, রাস্তাঘাটে কান পাতুন। প্রকাশ্যেই অবাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা বলতে শুরু করেছে “এরা সব ওপার থেকে এসেছিল। এদের আমরা খেতে দিলাম পরতে দিলাম থাকতে দিলাম। আর এরা এখন নিজেদের ইতিহাস ভুলে মুসলমানদের জন্যে মিছিল মিটিং করছে!”

কিভাবে ইতিহাস বিকৃত করে আপনাকে আপনার পূর্বসুরীদের মতই উদ্বাস্তু বানানোর চক্রান্ত হচ্ছে বুঝুন। তাঁরা নাকি ওপার থেকে এসেছিলেন, ওরা খেতে পরতে থাকতে দিয়েছিল। অর্থাৎ দেশটা যে এক ছিল, ঐ পারের মত এই পারটাও যে আপনার বাপ-ঠাকুর্দার দেশই ছিল সেকথা অস্বীকার করা হচ্ছে। ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন সুচতুরভাবে পশ্চিমবঙ্গীয়দেরও (চলতি কথায় এদেশী) বোঝানো হচ্ছে পূর্ববঙ্গীয়রা তাদের জায়গায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এরকম যে স্বাধীনতার পরে বাঙালদের “অ্যালাউ” করা হয়েছিল এ দেশে থাকতে। এখন আপনাকে আবার নতুন করে নিজের জন্যে অ্যালাউয়েন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।

এদের কথায় ভুলে দেশভাগের প্রতিশোধ নেওয়ার ঝোঁকে যদি সি এ এ, এন আর সি মেনে নেন, তাহলে সারাজীবন আপনাকে ঐ অ্যালাউয়েন্সেরই বন্দোবস্ত করে যেতে হবে। বারবার প্রমাণ করতে হবে আপনি ভারতীয়, কারণ কোন প্রমাণই সকলের চোখে যথেষ্ট হবে না।

পুনশ্চ: কোন এদেশী যদি ভেবে থাকেন তিনি তোফা থাকবেন তাহলে তিনিও মূর্খ। কারণ বাঙাল আর এদেশীর তফাত কেবল বাঙালিরাই বোঝে। অন্যদের কাছে সবাই বাঙালি, এবং হিন্দুত্ববাদ শেখাচ্ছে “বাঙালি দেখলেই জানবে অনুপ্রবেশ।” আপাতত তার ফলে মার খাচ্ছেন গরীব গুরবো মানুষ। তা বলে হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, দিল্লী, মুম্বাইয়ের উচ্চবংশীয় বহুজাতিকের কর্মী বঙ্গসন্তানরা চিরকাল সুখে থাকতে পারবেন ভাবার কারণ নেই।

%d bloggers like this: