তোমার পথের থেকে অনেক দূরে

বুঝে নেওয়া জরুরী যে বিবেকানন্দ যতই এক খণ্ড জমিতে কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করে থাকুন, আজকের মিশন একটি অতিকায় এন জি ও

কিছুদিন আগেই সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আমি যে কলেজে পড়েছি তার নাম জ্বলজ্বল করছিল। কারণ বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে যেখানে একজন মুসলমান অধ্যাপককে সংস্কৃত বিভাগে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পড়াতে দেওয়া হল না, সেখানে আমাদের কলেজের সংস্কৃত বিভাগে একজন মুসলমান অধ্যাপক পড়াচ্ছেন। খবরটা বেরোতে আমার বহু সহপাঠী, বহু সিনিয়র, জুনিয়র তা নিয়ে গর্ব করে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে। কোন কোন মাস্টারমশাইও করেছেন। আমি করিনি। যাঁরা করেছেন তাঁরা ভুল করেছেন মনে করি না। আজকের আবহে দাঁড়িয়ে তাঁরা সঙ্গত কারণেই মনে করেছেন আমাদের কলেজ সঠিক অবস্থানে আছে। তাই গর্বিত হয়েছেন।

কিন্তু আমি, হয়ত নিজের মুদ্রাদোষে, মনে করেছিলাম কোন ধর্মের লোক কোন বিষয় পড়াচ্ছে এটা খবর হয়ে দাঁড়ানোই দুর্ভাগ্যজনক। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির থেকে বি এ পাশ করে যখন সাংবাদিকতায় এম এ পড়তে ঢুকেছিলাম, একেবারে প্রথম দিকের ক্লাসেই আমরা শিখেছিলাম কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা খবর নয়। মানুষ কুকুরকে কামড়ালে খবর। সেই শিক্ষা আজও ভুলতে পারিনি বলে আমার মনে হয়েছিল মুসলমান শিক্ষকের সংস্কৃত পড়ানো খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে — এ ভারতীয় হিসাবে আমার লজ্জা, বিদ্যামন্দিরের ছাত্র হিসাবে আমার যতই গর্ব হোক। উপরন্তু প্রতিষ্ঠান হিসাবে, যৌবনের উপবন হিসাবে আমার কলেজের প্রতি আমার যত টানই থাক না কেন, কলেজটাকে পরিচালনা করে যে প্রতিষ্ঠান, সেই রামকৃষ্ণ মিশনকে আমি কোনদিন বিশ্বাস করিনি।

বেলুড় বিদ্যামন্দিরের ছাত্র হওয়ার আগেই আমার জানা ছিল ভগিনী নিবেদিতাকে রামকৃষ্ণ মিশনের সংস্রব ত্যাগ করতে বলা হয়েছিল তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করতেন বলে। যুক্তি ছিল মিশন রাজনীতি নিরপেক্ষ থাকতে চায়। তা ভাল কি মন্দ সে নাহয় তর্কসাধ্য। বিশেষত ধর্মীয় সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের রাজনীতিতে জড়ানোর বিষময় ফল যখন আমরা একশো বছর ধরে দেখছি। কিন্তু এন ডি এ ১ এর আমলে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের ছাত্র থাকার সুবাদে দেখেছি, কিভাবে হাওড়া থেকে বেলুড় মঠ অব্দি ট্রেন চালু হওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে গেল মসৃণভাবে। পরে যখন সে ট্রেন চালু হল তখন আমি কোন্নগর-হাওড়া নিত্যযাত্রী। দেখতাম রামকৃষ্ণের জন্মতিথির মত দু একটা দিন বাদে সেই ট্রেনে যাতায়াত করতেন মূলত দুজন — ট্রেনের চালক আর গার্ড। অথচ শিয়ালদা-ডানকুনি পথে ট্রেন বাড়ে না বহুকাল, যদিও মানুষ বাদুড়ঝোলা হয়ে যাতায়াত করেন রোজ। সারা দেশে খুঁজলে অমন কয়েকশো রুট পাওয়া যেত।

আরো দেখেছি হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রতি মহারাজদের প্রসন্নতা। ধর্মীয় ঐতিহ্যের বাধ্যতামূলক ক্লাসে অধ্যক্ষের সাথে একবার আমার আর কয়েকজন সহপাঠীর ধুন্ধুমার বেধে গেল। তিনি বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর অত্যাচারের দোহাই দিয়ে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছিলেন। ঠিক সেই কথাগুলোই বলছিলেন যেগুলো আর এস এস তথা বিজেপি সেই সময় অল্প স্বল্প বলত, আজকাল সোচ্চারে, আরো আক্রমণাত্মক ভাষায় বলে।

লক্ষ্য করে দেখবেন, বাংলার সংস্কার আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়রা আজকের বিজেপি-আর এস এসের অতি অপছন্দের লোক৷ বিশেষত বিদ্যাসাগর আর রামমোহন। সোশাল মিডিয়ায় তাঁদের গালাগালি দেওয়া হয়, অশ্লীল মিম বানানো হয়। কোন বাঙালির চোখে যে ঐ দুজন মানুষ খলনায়ক হতে পারেন বিদ্যামন্দিরে না পড়লে আমার জানাই হত না। এক মহারাজ একবার বলেছিলেন ঐ দুজন হিন্দুধর্মের ক্ষতি করেছেন খ্রীষ্টান সরকারের সাহায্য নিয়ে। সতীদাহ প্রথার সপক্ষে আর বিধবা বিবাহের বিপক্ষে এমন ঋজু বক্তৃতা বিজেপির ট্রোলদের মুখে ইদানীং শোনা যায়। বাজপেয়ী বা আদবানি দূরের কথা, নরেন্দ্র মোদীরও আজ অবধি সাহস হয়নি এমনটা প্রকাশ্যে বলার। স্বামী সুবীরানন্দদের মত সাধুদের সমর্থনে যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারে তখন আদিত্যনাথ হয়ত এসব বলবে।

তা এসব অভিজ্ঞতার কারণে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধানমন্ত্রীর জন্যে গেরুয়া কার্পেট বিছিয়ে দেওয়ায় আমি একটুও অবাক হইনি। আর মিশনে ফোন করে ধিক্কার দেওয়ার কর্মসূচীতেও সামিল হইনি। বুঝে নেওয়া জরুরী যে বিবেকানন্দ যতই এক খণ্ড জমিতে কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করে থাকুন, আজকের মিশন একটি অতিকায় এন জি ও, যার দেশী ও বৈদেশিক স্বার্থ রামকৃষ্ণের দরিদ্রতম ভক্তের সাথে না-ও মিলতে পারে, হিন্দুত্ববাদী শাসকের সাথে মিলবেই। কেউ যদি ভাবে রামকৃষ্ণ “যত মত তত পথ” বলেছিলেন বলে, সত্যান্বেষীর আগ্রহে সবরকম সাধনপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন বলে আজকের মহারাজরা হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সদর্পে দাঁড়াবেন, তাহলে সে দিবাস্বপ্ন দেখছে।

বিবেকানন্দ বলেছিলেন ভারতে ইসলামিক শরীরে বৈদান্তিক আত্মার সমন্বয় করতে — এসব জ্ঞানগর্ভ কথা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে কোন লাভ নেই। কাজের কথা হল বাংলায় যত বাড়িতে রামমোহন, বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথের ছবি আছে তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়িতে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, সারদার ছবি আছে। তার অধিকাংশই আবার রামকৃষ্ণ মিশনের কোন বিপণি থেকে কেনা। এই কথাটা নরেন্দ্র মোদী জানেন। তিনি জানেন রামকৃষ্ণ মিশন এমন এক বিক্রেতা যাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে হিন্দুত্ব কোম্পানির পণ্য বেচলে বাংলায় সবচেয়ে বেশি ক্রেতা পাওয়া যাবে। এমনকি যারা সচরাচর কোম্পানিটাকে ভাল চোখে দেখে না, তারাও এবার এই কোম্পানির মাল কিনে ফেলতে পারে। আর যে মালটা বাজারে একদম চলছে না, বরং বেচতে গিয়ে লোকের গালাগাল শুনতে হচ্ছে, সেই সি এ এ-এন আর সি-এন পি আরও এই প্ল্যাটফর্ম থেকে বিক্রি করলে বিক্রি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

এখন ব্যথিত প্রাণেরা বলবেন রামকৃষ্ণ মিশন তাদের প্ল্যাটফর্ম মোদীকে ব্যবহার করতে দিল কেন? এ প্রশ্নের কোন অর্থ নেই। ছুরি দিয়ে মানুষ খুন করা যায়। আপনি কি প্রশ্ন করেন অ্যামাজন তাদের প্ল্যাটফর্মে ছুরি বিক্রি করতে দেয় কেন?
আসল কথা গোটা দেশের মত বাংলাও একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এক হাতে কার্ল মার্কস, অন্য হাতে মা কালী; একদিকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গদগদ হওয়া আর অন্যদিকে বাংলা পরীক্ষায় রচনায় বিবেকানন্দের পুনরুত্থানবাদ (সহজ কথায় “সবই ব্যাদে আছে”) কোট করে বাঙালিদের এতকাল চলেছে। আর চলবে না। আপনাকে পক্ষ নিতে হবে। এতদিন অনেকেরই বিশ্বাস ছিল রামকৃষ্ণ মিশন যে হিন্দুধর্মের কথা বলে তা আর এস এসের হিন্দুত্ব নয়। এই ধারণার মূলে রামকৃষ্ণ স্বয়ং। আজ তাঁর ইচ্ছানুসারে প্রতিষ্ঠিত মিশন বুঝিয়ে দিল তারা দুটোকে বিশেষ আলাদা বলে মনে করে না। এবার আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি রামকৃষ্ণকে নিজের মত করে বুঝে নেবেন, নাকি তাঁর সঙ্ঘের সাধুরা যেভাবে তাঁকে দেখাচ্ছেন সেটাই শিরোধার্য করবেন।

এবার তর্ক উঠবে, রামকৃষ্ণ মিশন আবার কখন হিন্দুত্বকে (সি এ এ-এন আর সি-এন পি আর) মান্যতা দিল? বরংস্বামী সুবীরানন্দ তো বলেছেন “আমরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে”। বলেছেন বটে, কিন্তু ওটা সিগারেটের প্যাকেটে বিধিসম্মত সতর্কীকরণের মত। আমরা যারা রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেছি তারা বিলক্ষণ জানি কতটা মেধাবী হলে তবে ঐ সংগঠনের উচ্চপদে ওঠা যায়। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টির সমসংখ্যক বা তার বেশি পি এইচ ডি, আই আই টি পাশ ইঞ্জিনিয়ার, বিলেত ফেরত ডাক্তার, গবেষক ইত্যাদি পাওয়া যাবে রামকৃষ্ণ মিশনের উচ্চকোটিতে। সেইসব লোকেরা বোঝেননি মোদীর বেলুড় মঠে এসে থাকতে চাওয়া, বিবেকানন্দের জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য কী — এ যিনি বিশ্বাস করবেন তাঁকে একথা বিশ্বাস করানোও শক্ত নয় যে দু হাজার টাকার নোটে মাইক্রোচিপ আছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে প্রধানমন্ত্রীকে না বলা কি সম্ভব? মিশন কী বলে নিরস্ত করতে পারত মোদীকে? অনেক ভাবলাম এবং ভেবে দেখলাম, উত্তরটা কিন্তু খুব সোজা। মহারাজরা বলতেই পারতেন, আমরা সন্ন্যাসী, আপনি এসে থাকলে গাদা নিরাপত্তাকর্মী আসবেন, সংবাদমাধ্যম হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এসবে আশ্রমের শান্তিভঙ্গ হবে, আমাদের সাধন ভজনের অসুবিধা হবে। অবশ্য একথা রামকৃষ্ণ মিশন বলতে পারত কিনা তার চেয়েও বড় কথা প্রশ্রয় পাওয়ার প্রত্যয় না থাকলে নরেন্দ্র মোদী এমন আব্দার করতেন না। তিনি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে গিয়ে থাকার আব্দার তো করেননি আজ অব্দি? অতএব মেনে নেওয়া যাক যে সুবীরানন্দরা সন্ত লাল সিং নন, যিনি হিন্দু হয়ে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং অযোধ্যার রামমন্দির আন্দোলনের বিরোধিতা করার অপরাধে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আনন্দ পট্টবর্ধনের ‘রাম কে নাম’ তথ্যচিত্রে অবশ্য তিনি অমর হয়ে আছেন।

মোদ্দা কথা হল, রামকৃষ্ণ মিশনের জন্য অশ্রুপাত করা বৃথা। যদি আপনি বিপদটা বুঝে থাকেন, যদি আপনি দেশটাকে বাঁচাতে চান, তাহলে রামের সেতু বন্ধনে কাঠবিড়ালী যেটুকু করেছিল সেটুকুই উদ্যোগ নিয়ে করুন। মিছিলে আসুন, মিটিঙে আসুন। যতটা পারেন।

পুনশ্চ: আমার মত যারা বিদ্যামন্দির, নরেন্দ্রপুর বা মিশনের অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনী, তাদের বলি, আমার কাছে কিন্তু কলেজ মানে মাস্টারমশাইরা আর ছাত্ররা। এসব বিষয়ে যে তাঁদের মতামত নেওয়া হয় না তা আমরা প্রত্যেকেই জানি। ফলে আমার তাঁদের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য নেই। তাছাড়া অ্যামাজন ক্ষতিকারক জিনিসপত্র বিক্রি করায় বলে কি আমি তার কর্মচারীদের দোষী ঠাওরাই? তবে যেহেতু আইনত কলেজ বলতে কর্তৃপক্ষকে মানতেই হয় এবং সেই কর্তৃপক্ষ হলেন মিশনের সন্ন্যাসীরা, সেহেতু কেবল ওখানে পড়তাম, এই আবেগে আর কখনো ঐ চত্বরে পা দেব না। প্রিয় মাস্টারমশাইদের সাথে বাইরে দেখা করব, বন্ধুদের সাথেও তাই। বর্তমান ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক হলে তাদের জন্যেও একই ব্যবস্থা।

হে বাঙাল, ভুলিও না

এই মহাকাব্যিক ট্র‍্যাজেডিকে ১৯৮৯ এ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিপদের সাথে এক যোগে ব্যবহার করে যারা, তারা যে আসলে বাঙালদের যন্ত্রণারই লঘুকরণ করে

স্বাধীনতার আগে পূর্ববঙ্গে (অধুনা বাংলাদেশ) বসত ছিল এমন হিন্দু — চলতি কথায় বাঙাল। আমি এবং আমার বাবা আর মায়ের পরিবারগুলো যেমন। আমার স্ত্রীর বাবা, মায়ের পরিবারও। ভারতে হিন্দুত্ববাদের রমরমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিয়ে আলাদা করে চর্চা অনেক বেড়ে গেছে। নতুন নাগরিকত্ব আইন এবং এন আর সি র আবহেও এদের নিয়ে ক্রমবর্ধমান চর্চা।

“হিন্দু খতরে মে হ্যায়” প্রমাণ করতে কিছুদিন হল কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সাথে এক নিঃশ্বাসে আমাদের কথা বলা হচ্ছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা ও উচ্ছেদ ঘটেছিল স্বাধীন দেশের একটি প্রদেশের একটি অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসনের মদতে। আর বাঙালদের দুর্দশার কারণ ছিল একটা পরাধীন দেশের দু টুকরো হওয়া। কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এত বিপুল সংখ্যার মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। এই মহাকাব্যিক ট্র‍্যাজেডিকে ১৯৮৯ এ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিপদের সাথে এক যোগে ব্যবহার করে যারা, তারা যে আসলে বাঙালদের যন্ত্রণারই লঘুকরণ করে সেই চেতনা আজকের বাঙালদের মধ্যে দেখতে পাই না। আরো যা দেখতে পাই না, তা হল দেশভাগের ফলে বহু মুসলমানকেও যে ভিটে ছাড়া হয়ে এ পার থেকে ও পারে যেতে হয়েছিল সেই স্বীকৃতি। স্বাধীনতার আগে পরে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় সম্পত্তিহানি, প্রাণহানি, মেয়ে বউদের সম্মানহানির ইতিহাস যে তাদেরও আছে — সেই চেতনা। বোঝা যায় হিন্দুত্বের অপরবিদ্বেষী রাজনীতি আমাদের মস্তিষ্কে জাঁকিয়ে বসেছে।

আজকের বাঙাল, অর্থাৎ আমার মত ১৯৪৬-৪৭ না দেখা বাঙাল, এমনকি বাংলা ভাষার জন্যে লড়াই করে একটা আলাদা দেশ তৈরি হল যে যুদ্ধে, সেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধও নিজের চোখে না দেখা বাঙাল। তার কাছে গুরুজনদের মুখে শোনা “অরা আমাদের তাড়ায় দিছিল” কথাটুকুই কেবল আছে। তৎসহ ইতিহাস না পড়ার এবং ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ পড়ার অভ্যাস আছে। ফলত আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া খুব শক্ত হয় না যে ধর্মীয় নিপীড়নের বদলে পাল্টা নিপীড়নই উচিৎ কাজ। তাই সি এ এ, এন আর সি মিলিয়ে এ দেশের মুসলমানদের যদি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেওয়া হয় তো হোক, যদি দেশ থেকে তাড়ানো হয় তাতেও ক্ষতি নেই। “ওরাই তো আমাদের তাড়িয়েছিল” একটি যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করার সপক্ষে সাক্ষীগোপাল করা হয় ঋত্বিক ঘটককে, যিনি মানুষকে উদ্বাস্তু বানানোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ করেছেন তাঁর ছবিতে।

যাক সেকথা। ইদানীং তো দেখতে পাই মানবতা কোন যুক্তি নয়। তাই যদি কেউ বলে, আমার বাপ-ঠাকুর্দা উদ্বাস্তু ছিল বলেই আমি চাই না অমন দশা আর কারো হোক — তাকে দল বেঁধে ন্যাকা বলা হয়। সৎ উদ্দেশ্য, অসৎ উদ্দেশ্যের সংজ্ঞাও আমূল বদলে গেছে। নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষের উপর প্রতিশোধ নেওয়াই সৎ উদ্দেশ্য আজকাল। আমার এক আত্মীয় যেমন এন আর সি নিয়ে আলোচনায় বললেন “আমি বিজেপির সাপোর্টার নই। কিন্তু কোন কাজের উদ্দেশ্য যদি সৎ হয়, কেন সমর্থন করব না? এরা বাংলাদেশ থেকে এসে দেশের কাজকর্ম সব দখল করে নিচ্ছে। কেন অ্যালাউ করব?”

এ হেন বাঙালের কাছে মানবতার যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই। তাই একটা অন্য কথা বলি। আজকের বাঙালরা ভেবে দেখুন, যদি দেশভাগের সময় এ পারের মানুষরা (নেতারা তো বটেই) এই “কেন অ্যালাউ করব” কথাটা বলতেন, তাহলে কী অবস্থা হত আমাদের পূর্বপুরুষদের? আমরা এতদিনে জমিয়ে বসেছি বলে এখন যারা উদ্বাস্তু তারা চুলোয় যাক — আসামের বাঙালরা সেখানকার পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান (ওখানে যাদের মিঞা বলা হয়) সম্পর্কে এই মনোভাব পোষণ করেই এন আর সি হয়ে বিপদে পড়লেন। একথা বললেই আমার সেই আত্মীয়ের মত অনেক বাঙালই বলেন “আমার সব ডকুমেন্ট আছে। এখানে এন আর সি হলে আমার ভয় নেই।” আপনি যদি এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন, তাহলে আপনি নিজের চারপাশ সম্বন্ধে অদ্ভুত উদাসীন। শেষ পর্যন্ত এন আর সি হোক বা না হোক, আপনার বাপ-ঠাকুর্দাকে যে “অ্যালাউ” করা হয়েছিল সেকথা বলা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। সোশাল মিডিয়ায় দেখুন, রাস্তাঘাটে কান পাতুন। প্রকাশ্যেই অবাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা বলতে শুরু করেছে “এরা সব ওপার থেকে এসেছিল। এদের আমরা খেতে দিলাম পরতে দিলাম থাকতে দিলাম। আর এরা এখন নিজেদের ইতিহাস ভুলে মুসলমানদের জন্যে মিছিল মিটিং করছে!”

কিভাবে ইতিহাস বিকৃত করে আপনাকে আপনার পূর্বসুরীদের মতই উদ্বাস্তু বানানোর চক্রান্ত হচ্ছে বুঝুন। তাঁরা নাকি ওপার থেকে এসেছিলেন, ওরা খেতে পরতে থাকতে দিয়েছিল। অর্থাৎ দেশটা যে এক ছিল, ঐ পারের মত এই পারটাও যে আপনার বাপ-ঠাকুর্দার দেশই ছিল সেকথা অস্বীকার করা হচ্ছে। ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন সুচতুরভাবে পশ্চিমবঙ্গীয়দেরও (চলতি কথায় এদেশী) বোঝানো হচ্ছে পূর্ববঙ্গীয়রা তাদের জায়গায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এরকম যে স্বাধীনতার পরে বাঙালদের “অ্যালাউ” করা হয়েছিল এ দেশে থাকতে। এখন আপনাকে আবার নতুন করে নিজের জন্যে অ্যালাউয়েন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।

এদের কথায় ভুলে দেশভাগের প্রতিশোধ নেওয়ার ঝোঁকে যদি সি এ এ, এন আর সি মেনে নেন, তাহলে সারাজীবন আপনাকে ঐ অ্যালাউয়েন্সেরই বন্দোবস্ত করে যেতে হবে। বারবার প্রমাণ করতে হবে আপনি ভারতীয়, কারণ কোন প্রমাণই সকলের চোখে যথেষ্ট হবে না।

পুনশ্চ: কোন এদেশী যদি ভেবে থাকেন তিনি তোফা থাকবেন তাহলে তিনিও মূর্খ। কারণ বাঙাল আর এদেশীর তফাত কেবল বাঙালিরাই বোঝে। অন্যদের কাছে সবাই বাঙালি, এবং হিন্দুত্ববাদ শেখাচ্ছে “বাঙালি দেখলেই জানবে অনুপ্রবেশ।” আপাতত তার ফলে মার খাচ্ছেন গরীব গুরবো মানুষ। তা বলে হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, দিল্লী, মুম্বাইয়ের উচ্চবংশীয় বহুজাতিকের কর্মী বঙ্গসন্তানরা চিরকাল সুখে থাকতে পারবেন ভাবার কারণ নেই।

সত্য; তবু শেষ সত্য নয়

যদি না আসেন তাহলে দেশের শত্রুদের পক্ষে সহজ হবে বলে দেওয়া যে এই আন্দোলনে মুসলমান ছাড়া কারো কিছু এসে যায় না। রেল অবরোধে, উত্তেজনায় সাম্প্রদায়িক হিংসার তকমা সেঁটে দেওয়া জলভাত হয়ে দাঁড়াবে, দাঙ্গা বাধানো সহজ হয়ে যাবে। তাতে শুধু আপনি নয়, ডাহা ফেল করবে ভারতবর্ষ

আসাম জ্বলছে। অসমিয়াদের বক্তব্য ওঁদের ভাষা, সংস্কৃতি সব বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালিরা ধ্বংস করে দিচ্ছে। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে সেই অনসমিয়াদের নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ওঁরা রাস্তায়। যারা নাগরিকত্ব আইনের এই নব কলেবরের বিরুদ্ধে কারণ এতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাদ রাখা হচ্ছে — তারাও ক্রমশ রাস্তায়, ক্রমশ একজোট।

লড়াইটা লম্বা। লড়াইটা কেবল নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে নয়, জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর বিরুদ্ধেও। এবং স্পষ্ট করে বলা যাক, নাগরিকত্ব সংবিধানের কেন্দ্রীয় তালিকার বিষয়। ফলে যে যে রাজ্য সরকার এই আইন প্রয়োগ করব না বলছেন তাঁরা আদর্শগত অবস্থান জানাচ্ছেন মাত্র। তাঁরা কাউকে নাগরিকত্ব দিতে পারেন না, অতএব না দেওয়ারও প্রশ্ন নেই। কিন্তু রাজ্য সরকারগুলো অবশ্যই জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) আটকাতে পারেন। কারণ ব্যবহারিক কারণেই রাজ্য সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কাজটা করা মুশকিল। সত্যিই যদি কোন রাজ্য সরকার অসহযোগ করতে চান তাহলে সেটা NPR থেকেই শুরু করতে হবে। আশাব্যঞ্জক যে বহু মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই বলেছেন NRC করতে দেবেন না। তবে সেই কথাকে কজন কাজে পরিণত করবেন সেটাই আসল কথা।
পরিষ্কার করে এটাও বলা দরকার যে নতুন আইনের বিরোধিতাকে যে হিন্দুবিরোধিতা বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে সেটাও বিশুদ্ধ বদমাইশি। একজন বিরোধীও বলেননি “হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া অন্যায়।” বরং সকলেই বলেছেন “বেছে বেছে মুসলমানদের বাদ দেওয়া অন্যায়।” উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঙালিবিদ্বেষী প্রতিবাদ ছাড়া কোন প্রতিবাদ শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিবাদ নয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে রাজ্যসভায় বললেন এই আইন নিয়ে যারা ইতিমধ্যেই নাগরিক তাদের দুশ্চিন্তা করার কিচ্ছু নেই — সেটা ধূর্ততা। সত্যিই তো। সংশোধিত আইন তো যারা আগে থেকেই নাগরিক তাদের সম্বন্ধে নতুন কিছু বলছে না, বলছে যারা নাগরিক ছিল না তাদের সম্বন্ধে। খবরের কাগজের পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনে যে লেখা হয় চোদ্দ হাজার টাকার জিনিস চোদ্দশো টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, তা যতটা সত্যি, অমিত শাহ যা বলেছেন তাও ততটাই সত্যি। পাতার একেবারে তলায় প্রায় আণুবীক্ষণিক হরফে লেখা থাকে “শর্তাবলী প্রযোজ্য”। ওটা দেখতে না পেয়েছেন কি মরেছেন। এই নাগরিকত্ব আইনের “শর্তাবলী প্রযোজ্য” মানে হল “এরপর নাগরিকপঞ্জী তৈরি করা হবে। তখন বুঝে নেব কে কে কবে কোথা থেকে এসেছ। পছন্দ না হলেই নাগরিকত্ব বাতিল।”

কাদের পছন্দ হবে না তা বুঝতে ফেলুদা বা ব্যোমকেশ হওয়ার দরকার নেই। নতুন নাগরিকত্ব আইনেই বলা আছে। তার পরেও যদি ঘেঁটু ফুলের মত নিষ্পাপ কেউ থেকে থাকেন তার জন্যে অমিত শাহ রাজ্যসভায় পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, আপনাদের দাবীটা কী রে বাপু? দুনিয়ার যেখান থেকে যত মুসলমান আসবে সবাইকে নাগরিকত্ব দিতে হবে নাকি? এর জবাবে বাংলার সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন চমৎকার বক্তৃতা দিলেন, এমনকি আমাদের ঠাকুর মানে রবীন্দ্রনাথ — সেকথাও বললেন। ভাল হত ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় ভারতীয় কারা তার যে সংজ্ঞা আছে সেটাও শুনিয়ে দিলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ অব্দি একটা ভাল বই পড়েননি বলে সারা জীবন অশিক্ষিত হয়ে থাকবেন এ কি ভাল কথা? যাকগে।

কথা হচ্ছে ইতিহাস না পড়লে বা ভুলে মেরে দিলে (আমাদের উচ্চশিক্ষিত লোকেদের অনেকেই যা করেছে বলে আজকাল দেখতে পাচ্ছি) যা হয় সঙ্ঘ পরিবার তথা আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও তা-ই হয়েছে। এত বয়সে ফের ইতিহাস পড়তে যাওয়া কষ্টসাধ্য, তাই ঐ পাতা দুয়েকের কবিতাটার কথা বলছিলাম। পড়লে বোঝা যায় ভারত এমন এক দেশ যেখানে “সবারে হবে মিলিবারে আনতশিরে।” মিলতে হবে, মেলা যাবেও। কিন্তু মাথা নীচু করে সবার সমান হয়ে। আঙুল উঁচিয়ে সবাইকে এক করতে গেলে যা হয়, বিজেপি আমলে তা-ই হচ্ছে।

সবাইকে হিন্দু হতে হবে, সবাইকে হিন্দি বলতে হবে আমাদের হিন্দুস্তানে। এই আর এস এস প্রকল্প লাগু করতে গিয়ে কাশ্মীরকে বন্দুক আর ট্যাঙ্ক দিয়ে শান্ত রাখতে হয়েছে। এখন আবার আসামকে বন্দুক দেখাতে কাশ্মীর থেকে সেনা ডেকে আনতে হচ্ছে। সম্পর্কটা খেয়াল করুন। এক দেশ দুই আইন নাকি অন্যায় — এই যুক্তিতে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হল। এদিকে নতুন নাগরিকত্ব আইনের আওতার বাইরে রাখা হল উত্তর পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য, কিছু অঞ্চলকে। কেন? কারণ ভারতের সব রাজ্যের ইতিহাস এক নয়, আশা আকাঙ্ক্ষা এক নয়। ঐ রাজ্যগুলোর আদি নিবাসীদের দীর্ঘকালীন আশঙ্কা বাইরে থেকে লোক এলে তাঁদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে যাবে, সে তারা যে ধর্মের লোকই হোক। বিজেপি যদি বলে কেউ অন্য দেশ থেকে ঐ রাজ্যগুলোতে এলেই নাগরিকত্ব পাবে, তাহলে যাকে গোদা বাংলায় বলে “এক ঘাও মাটিতে পড়বে না।” কত সেনা আছে তোমার? কোথায় কোথায় দাঁড় করাবে?

এই বাস্তব ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা, মানে যাঁদের আজকাল লম্পট, চামার, মুসলমানদের এজেন্ট, ব্রিটিশ এজেন্ট ইত্যাদি বলা হয়, তাঁরা জানতেন। সেই কারণেই হাতুড়ি পিটিয়ে এক দেশ, এক আইনের নির্বোধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে যাননি। অমিত শক্তিধর শাহকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে বাইরে রাখার জন্যেও সেই লম্পট দুশ্চরিত্র লোকগুলোর তৈরি সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলেরই দোহাই দিতে হয়েছে।

কিন্তু আসামকেও তাহলে ছাড় দেওয়া হল না কেন? হয়েছে। উপজাতি এলাকাগুলোকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, কারণ ষষ্ঠ তফসিল সেই এলাকাগুলোর কথাই বলে। বাকি আসামের জন্যে সরকার অমন ব্যবস্থা করল না কেন? করলেই তো অসমিয়ারা আর আপত্তি করতেন না, তাই না? করতে যে পারল না সেখানেই ভারতবর্ষ নামক সাড়ে বত্রিশ ভাজার মজা। আসামে কোটি খানেক বাঙালি, তার অনেকেই আবার হিন্দু। NRC তে তাদের অনেকেই বাদ পড়েছে। প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গে দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ তাড়া খেয়েছেন, দুষ্টু লোকে বলে চড় থাপ্পড়ও খেয়েছেন। খেতে খেতে নাগরিকত্ব আইনের খুড়োর কল দেখিয়েছেন। এখন যদি অসমিয়া হিন্দুদের না বাঁচান তাহলে পশ্চিমবঙ্গে… ঐ যে… এক ঘা…।

এই গল্পের নীতিবাক্যগুলো কী তাহলে?

১) ভারত এক ধর্মের দেশ নয়, এক ভাষার দেশ নয়, এক আইন সর্বত্র প্রয়োগ করাও যাবে না এখানে। এ এমন এক দেশ যেখানে এক কোণে যে সংখ্যাগুরু, অন্য কোণে সে-ই সংখ্যালঘু।

২) সকলেই যে গেরুয়া দেশপ্রেমিকদের মত নিজের ধর্মীয় পরিচিতিকেই সবচেয়ে উপরে স্থান দেয় তা-ও নয়। অমর্ত্য সেন বলে এক অ্যান্টিন্যাশনাল একটা বইতে লিখেছে একজন মানুষের অনেকগুলো পরিচয় থাকে। এ দেশের বহু লোক বইটা না পড়েও ব্যাপারটা নিজের জীবনে পালন করে। এখানে একটা পরিচিতির উপর ভর দিয়ে ভেদাভেদ তৈরি করতে গেলে অন্য একটা পরিচিতি সব গুবলেট করে দিতে পারে। (উফ! আবার বইয়ের কথা বলে ফেললাম। এত পড়লে মন্ত্রীরা কাজ করবেন কখন?)

যারা মনে করে ভারত সকলের জন্য তাদের বছর আষ্টেক খুব খারাপ কেটেছে। এমন নয় যে তার আগে ভারতে সাম্প্রদায়িক রেষারেষি, হানাহানি ছিল না। কিন্তু সেগুলো ছিল আইনত নিষিদ্ধ, সামাজিকভাবে অস্বীকৃত। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের রমরমায় গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িকতা প্রথমে সামাজিক স্বীকৃতি পেল, তারপর আইনগত বৈধতা পেল। তারপর অর্থনীতি যখন তলানিতে, গণতান্ত্রিক অধিকার যখন ভূলুণ্ঠিত — এরকম একটা সময়ে নাগরিকত্ব আইনের এই সংশোধন সাম্প্রদায়িকতাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিল

সবটাই হতে পারল কারণ আমাদের চারপাশের মানুষেরা হয় পরধর্মবিদ্বেষী, পরজাতিবিদ্বেষী হয়ে উঠলেন, নয় যাবতীয় অন্যায়ের প্রতি উদাসীন হয়ে রইলেন। মৌনং সম্মতি লক্ষণম।

সেদিক থেকে গত কয়েক দিনের ঘটনাবলী কিন্তু নতুন আশার সঞ্চার করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ দ্রুত জড়ো হচ্ছেন, প্রতিবাদ করছেন। দীর্ঘ বিশ তিরিশ বছর ধরে লালিত আন্দোলনবিরোধী, প্রতিবাদবিরোধী সংস্কৃতির জাল ছিঁড়ে এমন মানুষ মিছিলে নেমে পড়ছেন যাঁরা চিরকাল এসবের থেকে সযত্নে দূরে থেকেছেন। তার মানে তাঁরা বিপদটা বুঝছেন। অনেকে নিজে নিজেই বুঝে নিচ্ছেন, কেউ বা সাগ্রহে জেনে নিচ্ছেন। প্রশ্ন করলেই আক্রান্ত হওয়ার কালে দাঁড়িয়ে এ কি কম কথা?

তবে এই আশাবাদে লাগাম পরানো দরকার। গত দুদিনের প্রতিবাদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরই প্রধানত অংশগ্রহণ দেখে অনেকেই নাক সিঁটকোচ্ছেন। “ওটা তো ওদের প্রতিবাদ”। তা বন্দুকের নলের ঠিক সামনে যখন “ওরা” আছে তখন প্রতিবাদ করার তাগিদ “ওদের” থাকবে বই কি। কিন্তু আপনি যদি বুঝে থাকেন বিপদটা কোনখানে, যদি বুঝে থাকেন আসলে CAB, NRC ভারতের বিরুদ্ধেই অন্তর্ঘাত তাহলে আপনিও এসে দাঁড়ান। ভারত তো আপনারও। এবং ভুলেও মনে করবেন না মুসলমান না হলেই আপনি নিরাপদ। আসামের বাঙালি হিন্দুদের দেখে শিখুন। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। আসলে আপনিও হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের উদ্যত থাবার আওতায় থাকা বাঙালি। আর যদি না আসেন তাহলে দেশের শত্রুদের পক্ষে সহজ হবে বলে দেওয়া যে এই আন্দোলনে মুসলমান ছাড়া কারো কিছু এসে যায় না। রেল অবরোধে, উত্তেজনায় সাম্প্রদায়িক হিংসার তকমা সেঁটে দেওয়া জলভাত হয়ে দাঁড়াবে, দাঙ্গা বাধানো সহজ হয়ে যাবে। তাতে শুধু আপনি নয়, ডাহা ফেল করবে ভারতবর্ষ।

আন্দোলনের ফলে রাতারাতি কিন্তু কিছু হবে না। রাত সবে শুরু। আরো গভীর হবে। আন্দোলন জোরদার হলে কাশ্মীর বা আসামের মত বাংলারও কণ্ঠরোধ হতেই পারে। খুব বেশি রাজ্যে প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়লে NRC করতে বদ্ধপরিকর সরকার কতটা দমন পীড়নের পথে যাবে কেউ বলতে পারে না। সরকারের পুলিশ আছে, সেনাবাহিনী আছে, না জানি আরো কত কী আছে! আমরা অবয়বহীন দেড়শো কোটি। আমাদের আমরা ছাড়া আর কিছু নেই। সে নেহাত ফেলে দেওয়ার মত শক্তি নয়, উপস্থিত নানাবিধ বিদ্বেষে শতধাবিভক্ত হলেও।
তাই অন্ধকারের আজকের সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

সৃষ্টির মনের কথা

“ভালবাসা কী করে প্রমাণ করা যায় বল তো? ভালবেসেই তো? আজ যখন আদালতে আমাকে বলা হল ‘প্রমাণ করুন আপনি দেশকে ভালবাসেন’, আমি ভাবলাম কী করে করি? কেমন করে প্রমাণ করা যায় যে আমি আমার দেশকে ভালবাসি?”

দুঃসময়। বড় দুঃসময়ে বেঁচে আছি। সকালের কাগজ ১৯৯২ এর স্মৃতি উশকে দিয়ে লিখছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ হুমকি দিয়েছে রাত পোহালেই দু লক্ষ লোক ঢুকে পড়বে অযোধ্যায়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮৯ মনে করানো রথযাত্রার প্রস্তুতি। রাজ্য সরকার শীর্ষস্থানীয় আমলাকে পাঠিয়েছে বিজেপির সাথে যাত্রাপথ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে। আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
ওদিকে আসামে ডিটেনশন ক্যাম্পে ভিড় বাড়ছে, বহু পরিবার ছিন্নভিন্ন, আত্মহত্যার পর আত্মহত্যা। সংসদে পাশ হওয়ার অপেক্ষায় নতুন নাগরিকত্ব আইন। যে আইন পাশ হলে অহিন্দু মানুষের ভারতের নাগরিক হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে” শুধু কবিতার পংক্তি হয়ে যাবে।
এসব ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি। আর বিরোধীদের রাজনীতিটা কিরকম?
দিন দুয়েক আগে কংগ্রেস নেতা সি পি যোশী বললেন একমাত্র একজন কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রীই পারেন রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। মনে করিয়ে দিলেন যে রাজীব গান্ধীই বাবরি মসজিদের তালা খুলিয়ে পুজো আচ্চার ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। যোশী আরো বলেছেন হিন্দু ধর্মটা একমাত্র ব্রাক্ষ্মণরাই বোঝে। নরেন্দ্র মোদী, উমা ভারতী এরা আর কী জানবে? নীচু জাতের লোকেদের হিন্দু ধর্ম নিয়ে কথা বলার কোন অধিকারই নেই। যোশীজিকে যিনি ধমকে দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ, সেই রাহুল গান্ধী কেবল মন্দির থেকে মন্দিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর সম্পর্কে তাই হিন্দুত্বের ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বিজেপি প্রশ্ন তুলেছিল তিনি কি হিন্দু? উত্তরে কংগ্রেস মুখপাত্র বলেছিলেন রাহুল যে শুধু হিন্দু তাই নয়, তিনি রীতিমত পৈতেওয়ালা হিন্দু।
বাংলার অগ্নিকন্যা তথা কর্ণধার বিজেপিকে আটকাতে দীর্ঘদিন অব্দি সাধারণ মুসলমানকে ভুলে ইমাম, মোয়াজ্জেমদের সমর্থনে ভর দিয়ে চলছিলেন। বছরখানেক হল সেসব চাপা দিতে আবার ব্রাক্ষ্মণ সম্মেলন, বজরংবলী পুজো, জনসভায় গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ, দুর্গা বিসর্জনের বিষণ্ণতাকে আমুদে কার্নিভালে পরিণত করায় মেতেছেন। তাতেও যথেষ্ট হচ্ছে না মনে করে শেষমেশ আয়করদাতাদের টাকা পুজো কমিটিগুলোকে বিলিয়েছেন। এন আর সি নিয়ে দিনকতক লোকলস্কর নিয়ে বিস্তর চেঁচামেচি করার পর এখন স্পিকটি নট। অবশ্য ওটা নিয়ে বেশি পরিশ্রম কেনই বা করতে যাবেন? তিনিই তো প্রথম সাংসদ যিনি সীমান্তবর্তী এলাকায় সিপিএম বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকাচ্ছে, এদের বার করে দেওয়া হোক — এই দাবী করে লোকসভার স্পিকারের দিকে কাগজ ছুঁড়েছিলেন।
আর বামপন্থীরা? সর্ববৃহৎ পার্টির নেতাদের একাংশ তো মনে করছেন বিজেপিকে হারাতে উপর্যুক্ত কংগ্রেসেরই হাত ধরা দরকার এক্ষুণি। নিজেদের লড়ার ক্ষমতার উপর এমন আস্থা আর কাদের আছে? এন আর সি, নাগরিকত্ব বিল নিয়ে বামেদের যে কী মতামত কে জানে! শীর্ষ নেতৃত্ব একবার বলেছিলেন দেখতে হবে নিরপরাধ লোকের যেন হয়রানি না হয়। মানে মানুষের নাগরিকত্ব নির্ধারণে তার বংশপরিচয়কে মানদণ্ড ধরায় বোধহয় তাঁদের আপত্তি নেই। যাহা লিগ্যাসি তাহাই লিগাল।
অর্থাৎ দেশের সর্বত্র তাঁদের ভারতীয়তা, তাঁদের দেশপ্রেমের প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে মানুষের কাছে। এই প্রমাণ দীর্ঘকাল ঠারেঠোরে চাওয়া হত এদেশের মুসলমানদের কাছে। এখন ঘাড় ধরে চাওয়া হচ্ছে। আসামের অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরাও সেই আওতায়। সংখ্যালঘুদের প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁরা অপ্রিয়, অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক। তাঁদের খুন করলে শাস্তি হয় না চাকরি হয়, ধর্মস্থান ভেঙে দিলে অপরাধ হয় না মন্ত্রিত্ব হয়, গালাগালি দিলে বাহাদুরি হয়।
এমতাবস্থায় প্রায়শই “সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় — দ্বেষ।” মনটা এমন কোন সৃষ্টি খুঁজতে থাকে যার মনের কথা ভালবাসা। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম অনুভব সিনহার ছবি ‘মুল্ক’ (দেশ)। হিন্দু, মুসলমানের ইতিহাসের সঙ্গমস্থল বেনারসের পুরনো বাসিন্দা বৃদ্ধ আইনজীবী মুরাদ আলি মহম্মদকে কাঠগড়ায় উঠতে হল এবং প্রমাণ করতে বলা হল তিনি তাঁর মুল্ক অর্থাৎ দেশকে ভালবাসেন। তিনি নিয়মিত আয়কর দেন, পুলিশের খাতায় কখনো তাঁর নাম ওঠেনি, এমনকি গাড়ি চালানোর সময়ও কখনো ট্র‍্যাফিক আইন ভাঙেননি। কিন্তু ওসব যথেষ্ট নয় একথা প্রমাণের জন্যে যে তিনি দেশপ্রেমিক। সন্ত্রাসবাদী নন।
ধর্মীয় মৌলবাদ আমাদের উঠোন পেরিয়ে চলে আসছে আমাদের সবার শোবার ঘর অব্দি। তফাৎ শুধু এই যে সংখ্যালঘুর মৌলবাদকে ঢুকতে হচ্ছে লুকিয়ে চুরিয়ে, সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ আসছে সামনের দরজা দিয়ে। আলি মহম্মদের ভোলেভালা ক্লাস টেন পাশ ভাই বিলালের ছেলে শাহিদ, যাকে ছোটবেলায় ধরে বেঁধে কোরান পড়িয়ে ওঠা যায়নি, সে কাশ্মীরের বন্যাত্রাণে অর্থসাহায্য করছে ভাবতে ভাবতে হয়ে গেল জেহাদি নেটওয়ার্কের সদস্য। আর বাড়ির উল্টোদিকের পান বিক্রেতা চৌবে, যে আলি সাহেবের প্রাণের বন্ধু, তার অকর্মণ্য ছেলে বুক ফুলিয়ে “দেশের কাজে” নেমে পড়ল বাইকের সামনে পতাকা লাগিয়ে। কী সেই কাজ? লোকলস্কর ডেকে এনে আলি সাহেবের গ্যারেজ ভেঙে দেওয়া, হিন্দু উৎসবের আগে লাউডস্পিকারের মুখটা মুসলমানদের বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যাতে তারা টের পায় “গোটা দেশ তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ”, রাতে আলি সাহেবের বাড়িতে পাথর ছোঁড়ার আয়োজন, দেয়ালে এবং দরজায় লিখে দেওয়া “TERRORIST”, “GO TO PAK”।
এই ছবিতে অনুভব সিনহার সবচেয়ে বড় কাজ সম্ভবত আমাদের অনেকের মনে তৈরি হওয়া চড়া একরঙা ছবিগুলো মুছে দেওয়া। এ ছবির হিন্দুরা নানারকম, মুসলমানরাও তাই।
ধর্মপ্রাণ অথচ গোঁড়ামিহীন আলি মহম্মদ আছেন, কোরান ঠিকমত না পড়েও জেহাদী হওয়া ভাইপো শাহিদ আছে, অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াডের ভুয়ো এনকাউন্টারবাদী অফিসার দানিশ জাভেদও আছেন। তিনি মনে করেন সন্ত্রাসবাদীদের গ্রেপ্তার না করে শেষ করে দেওয়া উচিৎ কারণ তারা মুসলমানদের বদনামের কারণ।
হিন্দুদের মধ্যে চৌবে আছেন, যিনি স্ত্রীকে লুকিয়ে বন্ধু আলির বাড়িতে কোরমা, কালিয়া খেতেন অথচ শাহিদের অপরাধ প্রকাশ হতেই বিরাট হিন্দু হয়ে উঠলেন এবং নিঃসংশয়ে বুঝে নিলেন “আমার ছেলে ঠিকই বলে। ওরা ঐরকমই।“ কিন্তু আলি সাহেবের আরেক বন্ধু সোনকর আছেন, যিনি ১৯৯২ এর ৬ই ডিসেম্বরের অভিশপ্ত রাতে চৌবেকে সঙ্গে নিয়ে আলি সাহেবের পরিবারকে দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিলেন। যিনি গোটা মহল্লার বিরুদ্ধে গিয়ে আলি সাহেবের পুরো পরিবারকে সন্ত্রাসবাদী প্রমাণ করার চেষ্টা চলার সময়ে পাশে থাকলেন। আলির প্রবাসী ছেলে এসে যখন বলল এ বাড়ি ছেড়ে তার সাথে ইংল্যান্ড চলে যাওয়াই ভাল, তখন সোনকরকে দেখিয়েই আলি সাহেব বললেন “আমরা চলে যাব? আমি নিজেকে কী জবাব দেব? যে আমি দেশদ্রোহী? পাড়ার লোককে সোনকর কী জবাব দেবে? ও বলবে ও দেশদ্রোহীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল?”
সর্বোপরি আছেন আরতি মহম্মদ — আলি সাহেবের হিন্দু পুত্রবধূ। একজন বেপথু হয়েছে বলে পুরো পরিবারটাকে সন্ত্রাসবাদী প্রমাণ করার প্রচেষ্টাকে বিফল করার দায়িত্ব শেষ অবধি যার ঘাড়ে পড়ে। মুসলমানদের ঝামেলা মুসলমানরাই সামলাক, কোর্ট তো বলে দিয়েছে ওরা টেররিস্ট — বাবা-মায়ের এইসব আবোলতাবোল কথাবার্তা উড়িয়ে দিয়ে ঘাড় সোজা করে লড়ে যায় মেয়েটি। অথচ বেনারসে আসার আগে স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের মুখে দাঁড়িয়েছিল সে, কারণ আলি সাহেবের ছেলে আফতাব চাইছিল সন্তানের জন্মের আগেই যেন তার ধর্মটা ঠিক করে রাখা হয়। শুনানিতে যাওয়ার সময় কিন্তু সে মন্দিরের প্রসাদী ফুল মাথায় ছুঁইয়ে যায়।
আরো এক দল মানুষ আছেন আলি সাহেবের মুল্কে, যাদের কথা না বললেই নয়। কিছু লোক যারা মসজিদে নমাজ পড়তে এসে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় শাহিদ আর বিলালের শাহাদাত উদযাপন করতে আসার জন্যে এবং প্রবল ধমক খায়। আলি সাহেব তাদের জানিয়ে দেন শাহিদ যা করেছে তা শাহাদাত নয়, সন্ত্রাস। যারা তাঁর বাড়িতে পাথর ছুঁড়েছে তারাও যে সন্ত্রাসীই সেকথা তিনি বলে এসেছেন এফ আই আর নিতে অনিচ্ছুক দারোগাকে।
মসজিদে ফিসফিসিয়ে কথা বলা লোকগুলোর দলেই পড়েন সরকারপক্ষের উকিল সন্তোষ আনন্দ। সাক্ষ্যপ্রমাণ না-ই থাক, মুসলমানবিদ্বেষের কোন অভাব নেই তাঁর মধ্যে। তিনি জানেন এখন কেস জিততে হলে বিচারবিভাগকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে হয়; হোয়াটস্যাপ, ফেসবুককে হাতিয়ার করতে হয়।
ছায়াছবি হিসাবে অনায়াসেই আরো ভাল হতে পারত ‘মুল্ক’। তাপসী পান্নু আরো জোরালো আরতি হতে পারতেন, আদালতে তাঁর অতি মূল্যবান closing argument চিত্রনাট্যের সাহায্য পেলে আরো কম বক্তৃতা হতে পারত। বিচারকের শেষ কথাগুলোও, যদিও অত্যন্ত জরুরী, অতটা বক্তৃতার মত না শোনালে নিঃসন্দেহে আরো ভাল হত। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় কথা এই সময়ে এই ছবিটার প্রয়োজন ছিল। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আলি সাহেবরূপী ঋষি কাপুর যখন সন্তোষ আনন্দরূপী আশুতোষ রানাকে প্রশ্ন করেন “আমার দেশে আমাকে স্বাগত জানানোর অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?” তখন প্রশ্নটা তাঁর একার থাকে না, কোটি কোটি ভারতবাসীর হয়ে দাঁড়ায়। সেইসব ভারতবাসীর যাঁদের পান থেকে চুন খসলে পাকিস্তানি বলে সম্বোধন করা হয়, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের সময়ে যাদের দিকে আড়চোখে, বাঁকা হেসে তাকানো হয়।
তবে সবচেয়ে মনে রাখার মত মুহূর্ত তৈরি হয় আদালতে নয়, বাড়ির ছাদে। ভাই বিলালের উকিল থেকে কেসে অন্যতম অভিযুক্ত হয়ে যাওয়ার পর শব্দহীন বিনিদ্র রাতে পুত্রবধূকে আলি সাহেব বলেন “তবসসুম যখন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এল, তখন আমার সাথে খুব ঝগড়া করত, বলত ‘তুমি আমায় ভালবাস না।’ আমি বলতাম ‘বাসি তো। খুব ভালবাসি।’ ভালবাসা কী করে প্রমাণ করা যায় বল তো? ভালবেসেই তো? আজ যখন আদালতে আমাকে বলা হল ‘প্রমাণ করুন আপনি দেশকে ভালবাসেন’, আমি ভাবলাম কী করে করি? কেমন করে প্রমাণ করা যায় যে আমি আমার দেশকে ভালবাসি?”
দেশকে ভালবাসার প্রশ্ন উঠতে তাঁর মনে পড়ল প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা, মায়ের কথা নয়। “ভারত মাতা কি জয়” স্লোগানের পরাভবে পূর্ণিমার তাজমহলের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুরাদ আলি মহম্মদের দেশপ্রেম।

উদ্বাস্তু

যে হালার পো অসমে বাঙালিরা খ্যাদানি খাওয়ায় দুইহাত তুইল্যা নাচতাছে, হেয়া য্যান নিজের এদেশীয় হওয়ার প্রমাণটা খুঁইজ্যা রাখে। নইলে বাংলায় এন আর সি হইলে হালার অবস্থা ডনের অমিতাভ বচ্চনের মত হইব গিয়া

আমার ঠাকুর্দা শচীন্দ্র কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় দ্যাশ ভাগ হইবার আগে থিকাই, জীবিকার প্রয়োজনে, উদ্বাস্তু। রেল কোম্পানিতে কাজ। টিটির চাকরি, মানে আমরা ডেলি প্যাসেঞ্জাররা যাদের “মামা” কই। ঢাকা বিক্রমপুরে তেনার পৈতৃক বাড়ি আছিল। কিন্তু মানুষ হইছেন আবার মামাবাড়িতে। আমার বাবা প্রশান্ত সে দুই বাড়ির কোনটাই দ্যাখেন নাই। কেন না তেনার জন্ম দ্যাশ ভাগের পরের বছর। তিনি সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। তবে আমার জ্যাঠা, পিসিরাও কেউ তেনাদের পৈতৃক বাড়ি দ্যাখেন নাই।
আমার বাবারে নিয়া ঠাকুর্দা শচীন্দ্র আর ঠাকুমা সুবর্ণলতার নয়টি সন্তান হয়। একটি মেয়ে অবশ্য ছোটবেলাতেই মইর‍্যা গেছিল। বাকি আটজনের কেউ তেনাদের পৈতৃক বাড়ি দ্যাখেন নাই। তাঁরা সকলে এক জায়গায় জন্মানও নাই। রেল কোম্পানির ঠ্যালায় আমার ঠাকুর্দা যহন যেহানে আছিলেন এনারা সেইহানেই হইছেন। জন্ম থিকাই উদ্বাস্তু আর কি।
কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর তো আর রেল কোয়ার্টারে থাকতে দিব না। নিজের বাড়ি লাগব। কোথায় যাওন যায়? ঠাকুর্দা, ঠাকুমা জানতেন দ্যাশ থিকা আত্মীয়স্বজনেরা আইস্যা হুগলী জিলায় রেললাইনের বাঁদিকে এক জায়গায় বসত করছে। এখনো সেহানে সন্ধ্যাবেলা শিয়াল ডাকে। স্টেশন থিকাও বহুদূর। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে আত্মীয়স্বজনের আশেপাশে থাকাই ভাল। নইলে বিপদে আপদে দেখব কেডা?
তাই রিটায়ার কইর‍্যা যৎসামান্য যা টাকাপয়সা পাইছিলেন ঠাকুর্দা, তাই দিয়া নবগ্রামে আমাগো বাড়ি হইল।
সে বাড়ির জমি ঠাকুর্দায় কার থিকা কিনছিল, সে এদেশীয় নাকি হেয়াও পূর্ববঙ্গ থিকা আইছিল, সেসব জানে এমন কেউ বোধহয় বাইচ্যা নাই।
যে হালার পো অসমে বাঙালিরা খ্যাদানি খাওয়ায় দুইহাত তুইল্যা নাচতাছে, হেয়া য্যান নিজের এদেশীয় হওয়ার প্রমাণটা খুঁইজ্যা রাখে। নইলে বাংলায় এন আর সি হইলে হালার অবস্থা ডনের অমিতাভ বচ্চনের মত হইব গিয়া। ডিটেনশন ক্যাম্পের বাইরে পুলিশে কিলাইব, ভিতরে আমরা।

বিঃ দ্রঃ এই পোস্টের ভাষা নিয়া যার আপত্তি আছে তারে আমি কাঁচকলা দ্যাখাই। বাঙাল আছিলাম, বাঙাল আছি, শ্যাষ নিঃশ্বাস ফেলা অব্দি বাঙালই থাকুম। মাইর‍্যাই ফেলাও আর কাইট্যাই ফেলাও।

আমি আজ উদ্বাস্তু বটে

নির্ঘাৎ আসামের অনেক হিন্দু বাঙালিও “বিজেপি এলে মুসলমানদের তাড়াবে” এই আনন্দে তাদের ভোট দিয়েছিলেন, এখন দেখছেন ভটচায্যি বামুনের ছেলে তপোধীর, তারও নাগরিকত্ব এরা কেড়ে নিচ্ছে

আসামে বিনাগরিকীকরণ (disenfranchisement) প্রক্রিয়া হৈ হৈ করে শুরু হয়ে গেছে। শুনছি বাতিলের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্যও আছেন। ব্যাপারটা মোটামুটি বাঙালি খেদাও হয়ে দাঁড়াচ্ছে আবার। “মুসলমান হলে বাঙালি নয়”, “বাঙালিরা কিসের ভারতীয়” এসব কথাবার্তা সঙ্ঘচালিত ভারতে প্রায়ই শুনছি। অনেক হিন্দু বাঙালিরও প্রথম বাক্যটা খুব পছন্দের। নির্ঘাৎ আসামের অনেক হিন্দু বাঙালিও “বিজেপি এলে মুসলমানদের তাড়াবে” এই আনন্দে তাদের ভোট দিয়েছিলেন, এখন দেখছেন ভটচায্যি বামুনের ছেলে তপোধীর, তারও নাগরিকত্ব এরা কেড়ে নিচ্ছে। ফেসবুকে অনেকদিন ধরেই দেখতে পাই ‘বাংলায় বিজেপিকেই চাই’ ইত্যাদি নামে অনেকগুলো গ্রুপ বেশ সক্রিয়। আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউও তাদের পোস্ট সহর্ষে শেয়ার করে। আশা করি এরা কেউ আমার মত বাঙাল পরিবারের ছেলে নয়। কারণ আমি আজ সকালেই ভেবে দেখলাম আমার পৈতৃক বাড়িটা যে ১৯৭১ এর অনেক আগে তৈরি সেটা প্রমাণ করা বেশ দুঃসাধ্য হবে। দাদুর আমলের দলিল কোথায় আছে, আদৌ আছে না উইয়ের পেটে গেছে সে খুব শক্ত প্রশ্ন। আবার থাকলেও দিলীপ ঘোষের সরকার সেটাকে প্রমাণ বলে মানবে কিনা তা-ই বা কে জানে?

কাল আবার আসামের মুখ্যমন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন যাদের ১৯৭১ এর আগে আসামে বাস ছিল বলে প্রমাণ হবে না তাদের কোন নাগরিক অধিকার থাকবে না। উদ্বাস্তুর যেটুকু মানবাধিকার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ স্বীকার করে সেটুকুই থাকবে। এখন কথা হচ্ছে, একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে কে অধিকার দিয়েছে কে দেশের নাগরিকই নয় সেটা নির্ধারণ করার? ১৯৭১ এর আগে আসামে থাকত না মানেই ভারতে থাকত না তা তো না-ও হতে পারে। কিন্তু এসব যুক্তির কথা। যুক্তিফুক্তি হিন্দুরাষ্ট্রে চলে না। অতএব যারা যারা বাঙাল এবং বাংলায় বিজেপিকে চাও, সবাই এখন থেকে প্রমাণ যোগাড় করতে লাগ নইলে আমার মত পাপিষ্ঠ বামপন্থীর সাথে একসাথে রিফিউজি হয়ে যেতে হবে কিন্তু। আর সে রিফিউজি মানে অভিষেক বচ্চন নয়, মেঘে ঢাকা তারার বিজন ভট্টাচার্য। মনে থাকে যেন। মনে না পড়লে ইউটিউবে একবার দেখে নাও, বাবারা।
পুনশ্চ: বামফ্রন্ট সরকারের যতরকম সমালোচনা হওয়া সম্ভব এবং হয়, তারমধ্যে মরিচঝাঁপি থাকেই। অন্য বামপন্থীদের সমালোচনাতেও থাকে, বিজেপির মত দক্ষিণপন্থীদের সমালোচনাতেও থাকে। মরিচঝাঁপিতে যারা নিহত, ধর্ষিত, বিতাড়িত হয়েছিল তারা মুসলমান ছিল না, বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। নমঃশূদ্র। বিজেপি তাহলে এতদ্বারা স্বীকার করে নিক যে মরিচঝাঁপিতে যা করা হয়েছিল ঠিকই করা হয়েছিল। অনাগরিকের আবার কিসের নাগরিক অধিকার? আর মানবাধিকার? সে তো রোহিঙ্গাদেরও আছে। তা বলে কি তাদের এদেশের মাটিতে মানুষের মত বাঁচতে দিতে হবে নাকি? অবশ্য মুসলমানদের মানবাধিকার ব্যাপারটা বিজেপির কাছে সোনার পাথরবাটি। 

%d bloggers like this: