কী ঢাকছে সরকারি চোলি? কেনই বা ঢাকছে?

আজ বিবিসির তথ্যচিত্র মুছে দেওয়া হচ্ছে, কাল ২০০২ সালে গুজরাটে আদৌ কোনো দাঙ্গা হয়েছিল বলে পোস্ট করলেই তা মুছে দেওয়া হবে। আহসান জাফরি খুন হননি – ওটি ভুয়ো খবর। বিলকিস ধর্ষিত হননি – ওটিও ভুয়ো খবর।

চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়
চোলি কে পিছে?
চুনরী কে নীচে কেয়া হ্যায়
চুনরী কে নীচে?

আমাদের তখন সবে গোঁফের রেখা উঠছে। সন্ধেবেলা দূরদর্শনের ‘সুপারহিট মুকাবলা’ অনুষ্ঠানে খলনায়ক ছবির এই গান পরপর কয়েক সপ্তাহ বেজেছিল এবং আমাদের উদ্বেল করেছিল। তখনো বাঙালি ছেলেমেয়েরা ভূমিষ্ঠ হয়েই হিন্দিতে পণ্ডিত হয়ে যেত না, ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়েরাও দলে দলে হিন্দিকে তাদের দ্বিতীয় ভাষা করে তুলতে উদগ্রীব হতেন না। ফলে চোলি আর চুনরী শব্দদুটির অর্থ জানতে আমাদের কিঞ্চিৎ সময় লেগেছিল। জানার পর আমাদের রোমাঞ্চ কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল তা আজকের স্মার্টফোন প্রজন্ম কল্পনা করতে পারবে না। কিছুদিন পরে সে রোমাঞ্চে জল ঢেলে দিতে কেউ বা কারা আদালতে মামলা ঠুকে দিল। গানটি শ্লীল না অশ্লীল তা নিয়ে প্রবল তর্কাতর্কি লেগে গেল, কিছুদিন পরে দেখা গেল জনপ্রিয়তায় একসময় এক নম্বরে উঠে যাওয়া ওই গান আর ‘সুপারহিট মুকাবলা’ অনুষ্ঠানে বাজানো হচ্ছে না। ইলা অরুণের গাওয়া ওই চারটি লাইন মোটেই অশালীন নয় – এই যুক্তির পক্ষে যারা, তাদের হাতিয়ার ছিল অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া পরের কয়েক লাইন

চোলি মে দিল হ্যায় মেরা
চুনরী মে দিল হ্যায় মেরা
ইয়ে দিল ম্যায় দুঙ্গি মেরে ইয়ার কো, পেয়ার কো।

অকাট্য যুক্তি। ছবিতে দেখা যেত এক নাচাগানার আসরে নীনা গুপ্তা গানের প্রথম চার লাইনের প্রশ্নটি তুলছেন, আর লাস্যময়ী মাধুরী দীক্ষিত স্পষ্ট উত্তর দিয়ে দিচ্ছেন। অতএব অন্য কিছু ভাবার তো কোনো কারণ নেই। যতদূর মনে পড়ে আদালতে গানটির অশ্লীলতা প্রমাণ হয়নি, তাই প্রায় একই যুগের খুদ্দার ছবির অন্য একটি গান ‘সেক্সি সেক্সি সেক্সি মুঝে লোগ বোলে’-র মত আদালতের নির্দেশে গানের কথা বদল করে নতুন করে প্রকাশ করতে হয়নি। কিন্তু ঘটনা হল, চোলির পিছনে আর চুনরীর নিচে যা আছে তা নিয়ে আমাদের রোমাঞ্চে জল ঢালা সম্ভব হয়নি। আমরা যে যার মত করে বুঝে নিয়েছিলাম কী আছে – দিল না অন্য কিছু।

২০০২ সালে গুজরাটে গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের পর কী ঘটেছিল, তাতে নরেন্দ্র মোদীর কতখানি দায় ছিল, আদৌ ছিল কি ছিল না – এ প্রশ্ন উঠলেই আমার ওই গানটির কথাই মনে পড়ে। হৃদয় তো অনেক গভীরে গেলে পাওয়া যায়। বয়ঃসন্ধির ছেলেপুলেদের অতদূর যাওয়ার ধৈর্য থাকে না। আমরা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্কিন ডিপ’, ওই গানের সে অর্থটুকু ভেবেই আহ্লাদিত হতাম। দূরবর্তী কোনো মাইক থেকে গানটি ভেসে এলে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে চোখ মারামারি চলত, ঠোঁটে থাকত দুষ্টু হাসি। তা বলে কি আমাদের মধ্যে একটিও সুবোধ বালক ছিল না? তারা আমাদের অসভ্য উল্লাস দেখে যারপরনাই বিরক্ত হত। দু-একজন খাঁটি সাত্ত্বিক মানসিকতায় আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করত, আমরা গানটির একেবারে ভুল অর্থ ভেবে নিচ্ছি। একই গানের কথার যে একাধিক অর্থ হওয়া সম্ভব সে শিক্ষা আমরা তখনই পাই – রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীরতা বা ভারতচন্দ্রের ব্যাজস্তুতিকে স্পর্শ করার আগেই।

বিলিতি কবিতার রোম্যান্টিক যুগের কবিরা মনে করতেন মানুষ অমৃতের সন্তান। জন্মের পরেও বেশ কিছুদিন সে নিষ্পাপ থাকে, তারপর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তার মধ্যে পাপ প্রবেশ করে, পবিত্রতা বিদায় নেয়। কবি উইলিয়াম ব্লেক Songs of Innocence আর Songs of Experience নামে দুটি পরিপূরক কবিতার বই লিখে ফেলেছিলেন, আর উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখেছিলেন এ জগৎ হল কারাগার। একটি ছেলে যত বড় হয় তত তার চতুর্দিকে ঘনিয়ে আসে সে কারাগারের গরাদ (“Shades of the prison-house begin to close/Upon the growing Boy”)। ২০০২ সালের মত ঘটনা যখন ঘটে তখন মানুষ অমৃতের সন্তান না মৃত্যুর সওদাগর তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ দেখা দেয়। তবে এখন পিছন ফিরে মনে হয় মাধুরীর চোলি যেমন আমাদের নিষ্পাপ নাবালকত্ব থেকে অভিজ্ঞ সাবালকত্বে পৌঁছে দিয়েছিল, তেমনই গুজরাট ২০০২ ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে রাম জন্মভূমি নিয়ে গণহিস্টিরিয়া তৈরি করা আর মসজিদ ভাঙার রাজনীতির নাবালকত্ব থেকে শাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণের সাবালকত্বে পৌঁছে দিয়েছিল।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত একাধিক মামলায় রায় দিয়েছে – কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু, ধর্ষণ, বাস্তুচ্যুতির পিছনে কোনো বৃহত্তর অপরাধমূলক চক্রান্ত ছিল না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদীরও কোনো প্রত্যক্ষ দায় ছিল না। এর উপরে আর কথা কী? কে না জানে, ভারতের বিচারব্যবস্থার মত নিখুঁত ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই? সেই কারণেই তো বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে বাতিল করার দাবিতে উঠেপড়ে লেগেছে মোদী সরকার। তাদের অভিযোগ – ব্যবস্থাটি অগণতান্ত্রিক। আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু আর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় প্রায় বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন প্রতিদিন। কী কাণ্ড! যে ব্যবস্থা মোদীর বিরুদ্ধে যাবতীয় রাজনৈতিক চক্রান্ত নস্যাৎ করে তাঁকে পদ্মফুলের মত নিষ্পাপ প্রমাণ করেছে, সেই ব্যবস্থাকে কিনা তাঁর সরকারই মনে করে অগণতান্ত্রিক!

এমন সময়, হাঁউ মাউ খাঁউ, গণহত্যার গন্ধ পাঁউ বলে এসে পড়ল বিবিসির তথ্যচিত্র ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন। নতুন করে উঠে পড়ল চোলির পিছনে কী আছে সেই প্রশ্ন। এইবেলা পরিষ্কার করে দেওয়া যাক, উদাহরণ হিসাবে শুধুমাত্র বিপরীতকামী পুরুষদের মধ্যে চালু থাকা নারীদেহ সম্পর্কে একটি রগরগে আলোচনাকে কেন টেনে এনেছি। কারণটি খুব সোজা। ওই যে বললাম, আমরা যে যার মত করে বুঝে নিয়েছিলাম? লক্ষ করলে দেখা যাবে, গুজরাটে ঠিক কী হয়েছিল বিজেপির ভোটাররাও ঠিক একইভাবে যে যার মত করে বুঝে নিয়েছে। ওই যে বললাম, গানটি ভেসে এলেই আমাদের মধ্যে চোখ মারামারি চলত? ঠিক একই ব্যাপার বিজেপি ও তার ভোটারদের মধ্যে চলে। বিবিসির তথ্যচিত্রে যা যা দেখানো হয়েছে তার কিছুই কিন্তু নতুন নয়। নতুন খবর বলতে এটুকুই, যে ব্রিটিশ সরকার এক নিজস্ব তদন্ত চালিয়েছিল, যার সিদ্ধান্ত হল মোদী স্বয়ং দায়ী। যে সমস্ত প্রমাণ, যেসব সাক্ষীকে এই তথ্যচিত্রের দর্শকরা দেখছেন তাঁদের কথা ভারতের বহু ছোটবড় সংবাদমাধ্যমে গত দুই দশকে প্রকাশিত হয়েছে। রাকেশ শর্মার তথ্যচিত্র ফাইনাল সলিউশন দেখলে বিবিসির তথ্যচিত্রের চেয়েও বেশি ঠান্ডা স্রোত নামবে শিরদাঁড়া বেয়ে। সেই তথ্যচিত্রটি যখন ইউটিউবে প্রথম আপলোড করা হয়, তখন সরকারের হাতে তা ব্লক করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু দলে দলে লোক বারবার রিপোর্ট করে ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’-কে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে সাময়িকভাবে ব্লক করিয়ে দিয়েছিল।

ফলে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। উঠলেই প্রত্যেকবার বিজেপি নেতা ও সমর্থকদের থেকে দুরকম উত্তর পাওয়া যায়। এক দল বলে, সব বানানো গল্প। সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনচিট দিয়েছে। আরেক দল বলে, যা করেছে বেশ করেছে। মুসলমানদের বেশি বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। অমিত শাহ স্বয়ং যেমন সংবাদসংস্থা এএনআইকে বলেছিলেন, মোদীজির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত অভিযোগ করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সেই অভিযোগকারীদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আবার সম্প্রতি হিমাচল প্রদেশে নির্বাচনী প্রচারে বলেছেন, ২০০২ সালে মোদীজি যারা হিংসা ছড়ায় তাদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন। ফলে গুজরাটে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার যা পছন্দ সে তাই বুঝে নেবে।

আমরাও ঠিক এমনই করতাম। এক দল মাধুরীর হৃদয় নিয়ে ভাবত, আরেক দল মাংসপিণ্ড নিয়ে। এমন চোলিকেন্দ্রিক পৌরুষই যে গুজরাট ২০০২-এর অভিজ্ঞান তা আর কেউ না জানলেও বিলকিস বানো বিলক্ষণ জানেন।

ভারত সরকার ইউটিউবে বিবিসির তথ্যচিত্রের যত লিঙ্ক আছে সব ব্লক করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। বিবিসির তথ্যচিত্রের লিঙ্ক শেয়ার করায় বেশকিছু টুইটও মুছে দিতে বলেছে। যদি বলি এই সাবালক জীবনের চেয়ে সেই নাবালক জীবন ভাল ছিল, তাহলে স্রেফ স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছি বলা যাবে কি? তখন ভারত রাষ্ট্র স্রেফ যৌনতাকেই অশ্লীল বলে বিবেচনা করত, ঢেকেঢুকে রেখে, গানের কথা বদলে দিয়ে বা কোনো ফিল্মের গোটা দু-চার চুম্বন দৃশ্য বাদ দিয়েই নিজের ক্ষমতা জানান দিত। তাও কেউ আদালতে দৌড়লে তবে। এখন তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করে নিজের অপছন্দের কিছু দেখলেই তাকে অসত্য বলে দেগে দিয়ে ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ঠিক সেই কাজটিই করা হয়েছে এক্ষেত্রে। কদিন আগেই, গত মঙ্গলবার, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে আপলোড হওয়া সংশোধনীর এক খসড়ায় দেখা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো যে খবরকে ভুয়ো খবর বলে ঘোষণা করবে সে খবর কোনো সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করা যাবে না। শেয়ার হলে তার দায়িত্ব বর্তাবে সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটির উপর।

অর্থাৎ আজ বিবিসির তথ্যচিত্র মুছে দেওয়া হচ্ছে, কাল ২০০২ সালে গুজরাটে আদৌ কোনো দাঙ্গা হয়েছিল বলে পোস্ট করলেই তা মুছে দেওয়া হবে। আহসান জাফরি খুন হননি – ওটি ভুয়ো খবর। বিলকিস ধর্ষিত হননি – ওটিও ভুয়ো খবর। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো হয়ত এমনই বলবে। তা সরকার বা সরকারি সংস্থাগুলি বলতেই পারে। কিন্তু যত বলবে ততই চোলির পিছনে কী আছে সে প্রশ্ন জোরালো হবে। সরকারের এখনো চোলি কেন প্রয়োজন – সে প্রশ্নও উঠবে নির্ঘাত। কারণ গুজরাট দাঙ্গায় অভিযুক্ত, এমনকি শাস্তিপ্রাপ্তরাও তো এখন মুক্ত। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যের সত্যতা প্রমাণ করে গারদ ঘনিয়ে এসেছে কেবল উমর খালিদ, শার্জিল ইমামদের মত নাবালকদের উপর – যারা গালভর্তি দাড়ি গজিয়ে যাওয়ার পরেও মানুষকে মৃত্যুর সওদাগর ভাবার সাবালকত্বে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

আরও পড়ুন অসংসদীয় শব্দ: মুখ বুজে বাঁচা অভ্যাস করতে হবে

সামান্য আশাবাদী অবশ্য হওয়া যায় একথা ভেবে, যে সরকারের এখনো খানিক লজ্জাশরম আছে বলেই চোলির প্রয়োজন পড়ছে। তবে ইন্টারনেটের যুগে চোলি যথাস্থানে রাখা লৌহকঠিন সরকারের পক্ষেও কষ্টসাধ্য। শীত বড়জোর আর এক মাস। তারপর বসন্ত সমীরণে ভোরের দিকে হাওড়ার ফেরিঘাট থেকে যদি বাগবাজার অভিমুখে নৌকাবিহারে বেরিয়ে পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন ভাগীরথীর পাড়ে প্রাতঃকৃত্য করতে বসেছেন অনেকে। তাঁরা বসেন নদীর দিকে পিছন ফিরে। তাতে সুবিধা হল, আপনি তাঁদের উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পেলেও তাঁরা আপনাকে দেখতে পান না। ফলে ভেবে নেওয়া সহজ হয় যে আপনিও তাঁদের দেখতে পাচ্ছেন না। ইন্টারনেটে একটি দেশের মধ্যে তথ্য ও তথ্যচিত্র ব্লক করা এমনই ব্যাপার। অবশ্য আত্মপ্রতারণা ছাড়া একনায়কত্ব বাঁচে কেমন করে?

পুনশ্চ: বিবিসির তথ্যচিত্রের নামে পার্ট ওয়ান কথাটি রয়েছে। কঙ্গনা রানাওয়াতের হিট ছবির সংলাপের ভাষায় “অভি তো হমে ঔর জলীল হোনা হ্যায়।”

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

সেতু ভাঙলেও টাল খায় না গুজরাট মডেল

সারা দেশের ভদ্রলোক শ্রেণি গুজরাট বলতে অজ্ঞান। কি চমৎকার রাস্তা! সবরমতীর ধারটা কি দারুণ করেছে! লোকের কত টাকা! দিল্লি থেকে কন্যাকুমারী – সর্বত্রই মুগ্ধতার কারণগুলো মোটামুটি এক। বাঙালি ভদ্রজনের মুগ্ধতার দুটো অতিরিক্ত কারণ আছে – ১) ওখানে কত ইন্ডাস্ট্রি, ২) ওখানে কেউ চাকরি বাকরি নিয়ে মাথায় ঘামায় না, সবাই ব্যবসা করে। এই মুগ্ধ জনতার সাথে খানিকক্ষণ কথা বললেই টের পাওয়া যায় এঁরা গুজরাট বলতে বোঝেন আমেদাবাদ, বড়জোর ভদোদরা। তলিয়ে জিজ্ঞেস করলে বেরিয়ে পড়ে বেড়াতে গিয়ে আমেদাবাদের বাইরে কেবল গির অরণ্যের সিংহ দেখেছেন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ বলতেও এঁরা কলকাতাই বোঝেন, মহারাষ্ট্র বলতে মুম্বাই। ফলে বামপন্থী বা ডানপন্থী যা-ই হোন, গুজরাট মডেলে এঁদের অগাধ আস্থা। তবে স্বপ্নের গুজরাটে বেমক্কা সেতু ভেঙে পড়লে কিঞ্চিৎ ফাঁপরে পড়েন।

মোরবিতে মেরামতির জন্য সাত মাস বন্ধ থাকা সেতু দিন পাঁচেক হল খোলা হয়েছিল, রবিবার ভর সন্ধেবেলা ভেঙে পড়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে খুলে দেওয়ার আগে নাকি সুরক্ষা শংসাপত্রও নেওয়া হয়নি। উন্নয়নের গুজরাট বলে কথা, উন্নয়ন কি আর লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রাখা যায়? কর্মবীর নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য। কয়েক হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি ডুবে যাবে জেনেও যেখানে সর্দার সরোবর বাঁধ তৈরি করা হয় বহু বছরের আন্দোলন দুরমুশ করে দিয়ে।

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন পর্যন্ত শ দেড়েক মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। তাতে কী-ই বা এসে গেল? গুজরাটে অনেক কাজ হয়, তার মধ্যে খানিকটা দুর্নীতি তো হবেই। আমাদের এখানে তো কাজই হয় না – এমন ধারণা দিয়েই অনেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা করবেন সন্দেহ নেই। আসলে উন্নয়ন মানে যে শহরের উন্নয়ন; অর্থাৎ ফ্লাইওভার, রাস্তা, সেতু, পার্ক, রেলিং, ফুটপাথ নির্মাণ – একথাই আমরা শিখেছি। অমর্ত্য সেন বাঙালি বলে আমাদের দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু তিনি উন্নয়নের যে অন্যতর সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে আমাদের আগ্রহ নেই। তাঁর কাজের ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদ মহবুব উল হকের তৈরি হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে গুজরাট সচরাচর মাঝের সারির উপরে উঠতে পারে না। ২০২১ সালেও অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ সমেত ১৯ রাজ্যের সঙ্গে গুজরাট মিডিয়াম এইচডিআই ক্যাটেগরিতেই ছিল। সে রাজ্যের অনেক জায়গায় যে ছেলেমেয়েরা সাঁতরে নদী পেরিয়ে স্কুলে যায়, শিক্ষার হাল ভাল নয়, স্বাস্থ্যের হাল ভাল নয় – এসব খবরও বাসি। কিন্তু ওসবে আমরা আমল দেব কেন? পেল্লাই কারখানা হলেই যে প্রচুর কর্মসংস্থান হয় না, উন্নয়ন হয় না সেসব আমরা এখনো টের পাইনি যে। তাই তো পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর এখনো রাজনৈতিক চাপান উতোরের বিষয়।

আরও পড়ুন কী ঢাকছে সরকারি চোলি? কেনই বা ঢাকছে?

সংবাদসংস্থা আইএএনএস জুন মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, গুজরাটে বেকার সমস্যা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে গ্রাম পঞ্চায়েতের এক্সিকিউটিভ প্রধানের ৩৪০০ শূন্য পদে চাকরির জন্য ১৭ লক্ষ আবেদন পত্র জমা পড়েছিল। কিন্তু গুজরাট বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনের প্রচারের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায় ওসব কোনো ইস্যু নয়। ইস্যু হল হিন্দুত্ব। অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলছেন টাকায় লক্ষ্মী, গণেশের ছবি ছাপানো উচিত আর বিজেপির বিদায়ী মন্ত্রিসভা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার জন্য কমিটি গঠন করছে। সেতু ভেঙে পড়া এমন কী ব্যাপার? জীবন মৃত্যু তো ভগবানের হাতে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: