ইন্দিরা হতে অর্ধশতক পরে মোদীর হাত ধরে ফিরেছে জরুরি অবস্থা

এই আবহে যে নির্বাচন হবে তা যদি অবাধ হয়, তাহলে ফড়িংও পাখি, জলহস্তীও হাতি, দেবও মহানায়ক।

আগামী ৪ জুন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষিত হবে। তার ঠিক ২১ দিন পরেই জরুরি অবস্থা ৪৯ পেরিয়ে পঞ্চাশে পা দেবে। নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ওই দিনটা কাউকে ভুলতে দেয় না। প্রতিবছরই ষোড়শোপচারে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, ওই ২১ মাস ভারতের ইতিহাসে অন্ধকার সময়। এবার যদি মোদী ক্ষমতায় ফিরতে পারেন, হয়ত গোটা বছর ধরেই বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হবে ইন্দিরা গান্ধী কী মারাত্মক স্বৈরতন্ত্রী ছিলেন, কংগ্রেস দেশের কত ক্ষতি করেছে ইত্যাদি। সুখের কথা, তার জন্যে আলাদা করে আয়োজন না করলেও চলবে। কারণ মনে করিয়ে দেওয়ার কাজটা ইতিমধ্যেই আরম্ভ হয়ে গেছে। ইনস্টা রিল প্রজন্মের অনেকেই জানত না কীভাবে সারা ভারতে বিরোধী দলের নেতা, কর্মীদের উপর অত্যাচার চালানো হয়েছিল, গ্রেফতার করা হয়েছিল, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল, সাংবাদিকদেরও কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। দশ বছরের মোদী রাজত্বে সেসব দেখানো হয়েছে। তবে ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী স্বকণ্ঠে নতুন কালের সূচনা ঘোষণা করার পরে তাও ঘটেছে যা জরুরি অবস্থার সময়ে ঘটেনি – দুটো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্রীয় এজেন্সি গ্রেফতার করেছে।

তথ্যের খাতিরে অবশ্য বলতে হবে যে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী জেএমএম নেতা হেমন্ত সোরেন গ্রেফতার হবেন বুঝতে পেরে আগেভাগেই মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার চম্পাই সোরেনকে সঁপে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনা হল, মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করে দিল্লির আম আদমি পার্টি সরকারের মত ঝাড়খণ্ডের জোট সরকারকেও ভেঙে ফেলাই ছিল বিজেপির লক্ষ্য। হেমন্ত আর অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই কৌশলের বিরুদ্ধে লড়াই করার দুটো আলাদা পথ বেছে নিয়েছেন। হেমন্ত ক্ষমতা হস্তান্তর করে কারাবরণ করার পর, বিধানসভায় আস্থা ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন জোট সরকার ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়। কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কেজরিওয়াল ঠিক করেছেন পদত্যাগ করবেন না, কারারুদ্ধ থেকেই প্রশাসন চালিয়ে যাবেন। হয়ত এমনটা করবেন ঠিক করে রেখেছিলেন বলেই তিনি গতমাসে দিল্লি বিধানসভায় নিজেই আস্থা প্রস্তাব এনে আরও একবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করেছেন। ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতারি অভূতপূর্ব ঘটনা। ফলে সম্ভব-অসম্ভবের কথা আলাদা, আইনত এমনটা করা যায় কিনা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও দ্বিধায়। অমৃতকালে বোধহয় এমনই হয়ে থাকে।

কেবল দুই মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতারিই অবশ্য একমাত্র অভূতপূর্ব ঘটনা নয়। দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়েছে আয়কর বিভাগ। বিশ বছর আগের কর নাকি বকেয়া আছে, এই যুক্তিতে জরিমানা হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। সিবিআই, ইডি, আয়কর বিভাগকে ব্যবহার করে কীভাবে নিজেদের তহবিলে পাহাড়প্রমাণ টাকা জড়ো করেছে বিজেপি, তা তো সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নির্বাচনী বন্ডের প্রথম দফার তথ্য প্রকাশ্যে আসার পরেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ২১ মার্চ বন্ডের নম্বরগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বিকল্প সংবাদমাধ্যম এবং বিশ্লেষকদের তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে আরও নানা তথ্য। তার অন্যতম হল দিল্লি সরকারের আবগারি নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত এক কাহিনি।

এই সেই নীতি, যা দিয়ে দুর্নীতি করা হয়েছে অভিযোগ তুলে দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়াকে দীর্ঘদিন বন্দি রাখা হয়েছে, আপের রাজ্যসভার সাংসদ সঞ্জয় সিংকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এখন কেজরিওয়ালকেও গ্রেফতার করা হল। একই মামলায় এছাড়াও গ্রেফতার হয়েছেন তেলেঙ্গানার সদ্যপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মেয়ে কে কবিতা। এঁদের সকলের গ্রেফতারির পিছনেই রাজসাক্ষী পি শরৎ চন্দ্র রেড্ডির বয়ান। ইনি হায়দরাবাদের অরবিন্দ ফার্মা লিমিটেডের অন্যতম ডিরেক্টর। স্ক্রোল ওয়েবসাইটের তদন্ত বলছে, ২০২২ সালে গ্রেফতার হওয়ার পাঁচদিন পরে শরৎ বিজেপিকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে পাঁচ কোটি টাকা দেন। এর কিছুদিন পরে তিনি জামিনের আবেদন করেন এবং কী আশ্চর্য! ইডি জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করেনি! তারপরেই তিনি দিল্লির আবগারি নীতি নিয়ে মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে যান।

অতঃপর শরৎ বিজেপিকে আরও ২৫ কোটি টাকা দেন। এর সঙ্গে কেজরিওয়ালদের গ্রেফতারির সম্পর্ক বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই, পাঠক বুদ্ধিমান।

হেমন্তের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন আছে। দেশজুড়ে যতজন বিরোধী নেতাকে ইডি গ্রেফতার করেছে, তাঁদের কারোর বিরুদ্ধেই মামলা কিন্তু কোথাও পৌঁছচ্ছে না। প্রায়শই এ আদালত সে আদালতের বিচারক ইডিকে ধমকে জিজ্ঞেস করছেন, আপনারা কি সত্যিই মামলার নিষ্পত্তি চান? শিবসেনার সঞ্জয় রাউতকে জামিন দেওয়ার সময়ে মুম্বাই হাইকোর্টের বিচারক জিজ্ঞেস করেছিলেন, মুখ্য অভিযুক্তদের গ্রেফতার না করে সঞ্জয়ের জামিন আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? ইডির আচরণ কোথাও প্রশ্নাতীত নয়। ফলে কয়েকদিন আগেই সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দেয়, ইডি কাউকে গ্রেফতার করলে লিখিতভাবে জানাতে হবে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করে। ২০ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট সরকারের আবেদন খারিজ করে দেয়।

অর্থাৎ দেশের সরকার কোনোরকম কার্যকারণ না দেখিয়েই মানুষকে গ্রেফতার করার অধিকার দাবি করেছিল। প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২ আইনটার অবশ্য বদনামই আছে অযৌক্তিক দমনমূলক আইন হিসাবে। কিন্তু সে অন্য আলোচনার বিষয়। আমরা বরং দেখি, জরুরি অবস্থার ইন্দিরা-সঞ্জয়কেও লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মত কী কী কাজ হয়ে চলেছে লোকসভা নির্বাচনের মুখে।

বিদায়ী সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে দুই কক্ষ মিলিয়ে বিরোধী পক্ষের ১৪৬ জন সাংসদকে নানা ছুতোয় সাসপেন্ড করে একতরফা পাস করিয়ে নেওয়া হল নতুন টেলিকম আইন আর পুরনো ফৌজদারি আইন বাতিল করা তিনটে নতুন আইন, যেগুলো মারাত্মক দমনমূলক বলে অভিযোগ উঠেছে।

সামান্য চণ্ডীগড়ের কর্পোরেশনও যাতে বিরোধী জোটের হাতে না যায় তার জন্যে অনিল মাসি নামক এক নির্লজ্জ আধিকারিককে দিয়ে মেয়র নির্বাচনের দিন ব্যালট বিকৃতি ঘটিয়ে আপের প্রার্থীকে হারিয়ে জিতিয়ে দেওয়া হল বিজেপি প্রার্থীকে। সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করা মাত্রই দেখা গেল কয়েকজন আপ কাউন্সিলর দলবদল করে ফেলেছেন। মোদীজির নেতৃত্বে হঠাৎ আস্থা জেগে উঠেছে। শেষপর্যন্ত অবশ্য সর্বোচ্চ আদালত কড়া অবস্থান নেওয়ায় চণ্ডীগড় কর্পোরেশনে ভোটারদের রায়ই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনকেও ছাড়া হচ্ছে না। সেখানেও রাত দুটোর সময়ে এক প্রার্থীকে বাতিল করে দিয়েছে প্রশাসন।

হিমাচল প্রদেশে রাজ্যসভা নির্বাচনের ভোটাভুটির আগে কংগ্রেসের কয়েকজন বিধায়ক উধাও হয়ে গেলেন। সেই ছজন কংগ্রেস বিধায়ক বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায় ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের প্রার্থীর সঙ্গে ভোট ‘টাই’ হয়ে যায়। টসে জিতে যান বিজেপি প্রার্থী। ওই বিধায়কদের স্পিকার পরে সাসপেন্ড করেন। একই দিনে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যসভা নির্বাচনেও ক্রস ভোটিংয়ের ফলে বিজেপির একজন অতিরিক্ত প্রার্থী জিতে যান। সবই অবশ্য বিবেকের সহসা জাগরণ, মোদীজির নেতৃত্বে ভারতের দুর্বার অগ্রগতিতে আস্থা তৈরি হওয়ার ফল।

মহারাষ্ট্রে শিবসেনাকে দ্বিখণ্ডিত করে একনাথ শিন্ডেকে সমর্থন দিয়ে সরকার গড়েছিল বিজেপি। অতঃপর নির্বাচন কমিশন দল ভেঙে বেরিয়ে আসা শিন্ডে গোষ্ঠীকেই আসল শিবসেনা বলে রায় দিয়ে শিবসেনার প্রতীক তাদেরই দিয়ে দিয়েছে। একই ঘটনা ঘটানো হয়েছে রাজ্যের আরেক দল ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির প্রতিও। শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিরাট অভিযোগ ছিল। তিনি বিজেপিতে যোগ দিতেই হয়ে গেলেন ধপধপে সাদা। তারপর নির্বাচন কমিশন তাঁর গোষ্ঠীকেই আসল এনসিপি গণ্য করে দলীয় প্রতীক দিয়ে দিল। দলের প্রতিষ্ঠাতা এবং মহারাষ্ট্রের প্রবীণ নেতা শরদের দলকে এখন লড়তে হবে অন্য প্রতীকে।

বুঝতে অসুবিধা হয় না যে লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর ৪০০ পার করার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করারই অঙ্গ এসব। রাজ্যসভা, লোকসভা – দুই কক্ষেই দু-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা চাই বিজেপির। নইলে সংবিধানের ল্যাজা মুড়ো বদলে দেওয়া যাবে না, ২০২৫ সালের মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করাও স্বপ্নই থেকে যাবে। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত চেয়েছিলেন। অনেকেরই মনে হয়েছিল তা অসম্ভব। কীভাবে সম্ভব করতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর দল। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের চূড়ান্ত সাফল্যের পর বিজেপি বা এনডিএর পক্ষে আসন আরও বাড়ানোও অনেকের অসম্ভব মনে হচ্ছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির হাতে ছিল কেবল দলীয় কর্মীবাহিনী আর রাজ্য প্রশাসন। মোদীর হাতে আছে যাবতীয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি।

নির্বাচন কমিশনটাকেও করতলগত করার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করার জন্যে গঠিত কমিটিতে আগে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা আর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। মোদী সরকার নতুন আইন করে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে ঢুকিয়েছে মন্ত্রিসভার এক সদস্যকে, অর্থাৎ বিরোধী দলনেতার ভূমিকা হয়ে গেল দর্শকের। নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক বলে দাবি করে যেমন সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল, তেমন এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করেও মামলা হয়েছে। সে মামলার শুনানি হওয়ার আগেই সাত তাড়াতাড়ি সভা ডেকে দুজন নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেছে সরকার। বিরোধী দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী অভিযোগ করেছেন, মাত্র ২৪ ঘন্টা সময় দিয়ে শ দুয়েক নামের তালিকা হাতে ধরিয়ে বেছে নিতে বলা হয়েছিল। মামলা গ্রহণ করে বিচারপতিরা বলেছেন, নির্বাচন এসে যাওয়ায় ওই আইনে স্থগিতাদেশ দিতে চান না। কিন্তু আর যা যা বলেছেন, তাতে আইনটি সম্পর্কে তাঁরা খুব সদয় বলে মনে হচ্ছে না। সরকারের এত তাড়া কিসের – সে প্রশ্ন তুলেছেন।

কিন্তু তাতে কী? যতদিনে এ মামলার রায় বেরোবে, ততদিনে হয়ত নির্বাচন মিটে যাবে। ঠিক যেমন নির্বাচনী বন্ড নিয়ে মামলা হয়েছিল ২০১৮ সালে, রায় বেরোল ২০২৪ সালে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া আবার চেয়েছিল নির্বাচন পর্ব চুকলে নির্বাচনী বন্ডের তথ্য প্রকাশ করতে। তারপর সুপ্রিম কোর্টের ধমকের জোর যত বাড়ল, তথ্য প্রকাশের গতিও তত বাড়ল। এখন দেখা যাচ্ছে, গত নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট বন্ডের মামলায় নিজেদের রায় রিজার্ভ করার পরেও বিজেপি সরকার বন্ড ছাপা বন্ধ করেনি। ২০২৪ সালের তৃতীয় মাস এখনো শেষ হয়নি, এর মধ্যেই ৮,৩৫০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড ছাপা হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বিজেপি ২০১৮ সাল থেকে বন্ডে মোট ৮,২৫১ কোটি টাকা পেয়েছে। আর যে যে দল বন্ডে টাকা নিয়েছে তারা সকলে মিলেও এত টাকা পায়নি। এর পাশে রাখুন দেশের প্রধান বিরোধী দলের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া, টাকা কেড়ে নেওয়া। কোনো সন্দেহ নেই, এরপর কংগ্রেস অনেক আসনে প্রার্থী দিতেই খাবি খাবে। ইতিমধ্যেই গুজরাটের এক আসনে নাম ঘোষণা হয়ে যাওয়া প্রার্থী প্রথমে বাবা অসুস্থ – এই কারণ দেখিয়ে নিজের নাম তুলে নেন, তারপর পার্টি থেকেই পদত্যাগ করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন, দুই প্রজন্ম ধরে তাঁকে আর তাঁর বাবাকে নাকি কংগ্রেস নেতৃত্ব চরম অসম্মান করে এসেছেন। তাই এই সিদ্ধান্ত। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন, কংগ্রেস নেতারা সনাতন ধর্মকে সম্মান করেন না।

এরপর কী হতে যাচ্ছে, কোন বিরোধী নেতা গ্রেফতার হতে যাচ্ছেন আমরা জানি না। শনিবার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মহুয়া মৈত্রের বাড়িতেও সিবিআই হানা দেয় এবং শূন্য হাতে ফিরে যায়। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে সরকারবিরোধী দল এবং ব্যক্তিদের একমাত্র আশার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। চাতক পাখির মত আদালতের দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই – যদি এমন কোনো রায় দেওয়া হয় যাতে সরকার কোণঠাসা হয়। এমনটা যে দেশে হয়, বুঝতে হবে সে দেশের গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। পার্শ্ববর্তী পাকিস্তানেই এমন হতে দেখা যায়। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত লোকেরা আবার অবাধ নির্বাচন বলতে বোঝেন রক্তপাতহীন নির্বাচন। সেই সরলমতি মানুষগুলোর উদ্দেশে বলা যাক, এই আবহে যে নির্বাচন হবে তা যদি অবাধ হয়, তাহলে ফড়িংও পাখি, জলহস্তীও হাতি, দেবও মহানায়ক। এমনিতেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন আছে যার সন্তোষজনক উত্তর দিতে নির্বাচন কমিশনের ভারি অনীহা। উত্তর দিয়ে দিলে কথা ছিল না, কিন্তু আলোচনাই করতে না চাওয়া যে প্রবণতার দিকে নির্দেশ করে তাকে গোদা বাংলায় বলে ‘ঠাকুরঘরে কে রে?’, ‘আমি তো কলা খাইনি।’ আলোচনা দীর্ঘায়িত করতে চাই না, তাই কেবল একটা তথ্য উল্লেখ করা যাক। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর দ্য কুইন্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, একটা-দুটো নয়, মোট ৩৭৩ আসনে নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী প্রদত্ত ভোটের সঙ্গে গোনা ভোটের বিস্তর তফাত ছিল। এই তফাতের কোনো ব্যাখ্যা কমিশন আজ পর্যন্ত দেয়নি।

তাহলে করণীয় কী? আমার-আপনার মত সাধারণ নাগরিকের কী করা উচিত জানি না, বিরোধী দলগুলোর অবশ্যই সর্বশক্তি দিয়ে পথেঘাটে আন্দোলনে নামা উচিত এই সরকারের বিরুদ্ধে। কারণ নির্বাচনে তারা যাতে নিজেদের শক্তি অনুযায়ীও লড়তে না পারে সরকারের তরফে তার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। হয়ত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হবে যে বিরোধীপক্ষের সেরা বক্তারা প্রায় সবাই কারান্তরালে থাকবেন প্রচার পর্বে। সুতরাং এখন আর আলাদা করে প্রচার, আসন সমঝোতা – এসব নিয়ে ভেবে লাভ কী? পথে নামা ছাড়া বিরোধীদের সামনে প্রচারেরই বা আর কোন পথ খোলা আছে? প্রায় কোনো মূলধারার সংবাদমাধ্যমই তো বিরোধীদের জায়গা দেবে না। টাকাপয়সার বিপুল অসাম্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিজেপির সঙ্গে এঁটে ওঠাও তৃণমূল কংগ্রেসের মত দু-একটা দল ছাড়া বাকিদের পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং রাস্তাই একমাত্র রাস্তা নয় কি?

অথচ আমরা কী দেখছি? কংগ্রেসের তিন প্রধান নেতা রাহুল গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়্গেকে সাংবাদিক সম্মেলন করতে দেখছি। ইন্ডিয়া জোটের নেতাদের কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন নিবেদন করতে দেখছি। দিল্লির রাজপথে লাগাতার আন্দোলনে সব দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে কবে দেখব? কেরালায় কংগ্রেস, সিপিএম দুই দলই পথে নেমেছে। কিন্তু দেশজুড়ে বিরোধীদের পাড়ায় পাড়ায় আন্দোলন কবে দেখব? এদেশের বিরোধীরা কি তেমন আন্দোলন করতে ভুলে গেছেন? ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পরে দিল্লির চেহারা এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? আম আদমি পার্টির উত্থানই তো রামলীলা ময়দান আঁকড়ে পড়ে থাকা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। সে আন্দোলনে যিনি কেজরিওয়ালের গুরু ছিলেন, সেই আন্না হাজারে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে অনন্ত শয্যায় শায়িত ছিলেন। কেজরিওয়াল গ্রেফতার হওয়ার পর জেগে উঠে সংবাদসংস্থা এএনআইকে বিবৃতি দিয়ে গ্রেফতার সমর্থন করেছেন। সমর্থন করার কারণটি জব্বর।

ওসব কথা থাক। প্রশ্ন হল, নিজেরা ক্ষমতায় থাকার সময়ে আন্দোলন, রাজনীতি সম্পর্কে যে বিতৃষ্ণা তৈরি করিয়েছিলেন সাধারণ নাগরিকদের মনে, বিজেপিবিরোধীরা কি এখন তারই ফাঁদে পড়েছেন? ১৯৯১ সালের উদারীকরণের পর থেকেই তো কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস, উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, বিচারপতি, এমনকি এই শতাব্দীর গোড়া থেকে এ রাজ্যের কমিউনিস্ট শাসকদেরও আমরা বলতে দেখেছি – মিছিল মানুষকে অসুবিধায় ফেলে, বনধ কর্মনাশা ইত্যাদি। তাই বোধহয় এখন আন্দোলনের বদলে আদালতে ভরসা রাখতে হচ্ছে। যেসব দলের নির্বাচনে আসন পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য থেকে মাইনাসে, তারাও গণতন্ত্র বাঁচানোর চেয়ে কে কোন আসনে লড়বে তা নিয়ে দরাদরি করতে ব্যস্ত। কেউ বলছে ‘অমুক আসন আমাদের সেন্টিমেন্ট’, ‘কেউ বলছে তমুক আসনে আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী’। যেন দাঁড়ালেই ‘এলেম, দেখলেম, জয় করলেম’ হয়ে যাবে।

এদেশের বিপন্ন মানুষ কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ভরসায় না থেকে নিজের মত করে লড়াই করে যাচ্ছেন। দেশের কৃষকরা আবার পথে। মোদী সরকার তাঁদের পথে আক্ষরিক অর্থে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা পিছু হটছেন না। যদিও সরকারের বদান্যতায় মূলধারার সংবাদমাধ্যম তো বটেই, সোশাল মিডিয়া থেকেও কৃষক আন্দোলনের খবর উধাও।

লাদাখের মানুষও গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে রোজ রাস্তায় নামছেন, পরিবেশ ধ্বংসের প্রতিবাদে সুবিখ্যাত সোনম ওয়াংচুক অনশনে বসেছেন।

ভারতের মত বিরাট দেশের অমিত ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের আন্দোলন যে একেবারেই সফল হতে পারে না তা নয়। ২০২০-২১ সালের কৃষক আন্দোলনই দেখিয়ে দিয়েছে গণআন্দোলনের ক্ষমতা কতখানি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নেতৃত্ব দিচ্ছে না এমন আন্দোলনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও আছে। ২০১৯-২০ সালের এনআরসি, সিএএবিরোধী আন্দোলনেরও সেই সীমাবদ্ধতা ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সেই আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েনি, আন্দোলনকে এবং তার দাবিগুলোকে পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে দেয়নি। ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণা হয়ে যায় – এটা মুসলমানদের সমস্যা, তাই ওরা আন্দোলন করছে। একইভাবে এখনো বহু মানুষ ভাবছেন কৃষি আইনগুলো কৃষকদের সমস্যা, লাদাখের ব্যাপারটা লাদাখের মানুষের সমস্যা আর মণিপুর তো বিস্মৃত, কাশ্মীর মুসলমানপ্রধান হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্পনাতেও নেই। এককথায় দেশের বিরোধী রাজনীতি সময়ের চেয়ে, পরিস্থিতির চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। যতদিন পিছিয়ে থাকবে তত দ্রুত ভারত ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া বা রচপ তায়িপ এরদোগানের তুরস্ক হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবে। এখন জরুরি অবস্থা।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

ভীরুদের হাতে ভারতের গণতন্ত্র রক্ষার ভার, তাই বিরোধী জোট নড়বড়ে

রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করেও যে বিজেপি চারশো আসন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নয় তা পরিষ্কার। বিরোধী নেতাদের ভীরুতাকে তারা হাতিয়ার করতে চাইছে। ইডি, সিবিআইয়ের খাতায় কেবল নীতীশ কুমার বা মমতার দলের নেতা মন্ত্রীদের নামেই অভিযোগ আছে তা তো নয়। কেরালায় সিপিএম নেতা, মন্ত্রীদের গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে নেতাদের বিরুদ্ধেও কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল।

জার্মানিতে নাজি পার্টির উত্থান ও পতন নিয়ে মার্কিন সাংবাদিক উইলিয়াম শাইরারের লেখা একখানা বই সারা বিশ্বে সমাদৃত। দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য থার্ড রাইখ নামে এই বইতে শাইরার লিখেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হোহেনজোলার্ন রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল একটা দুর্ঘটনা (“proclaimed by accident!”)। কারণ যুদ্ধে পরাজয়ের পর কাইজার (জার্মান সম্রাট) সিংহাসন ছেড়ে দেন, ওদিকে বার্লিনে তখন জোরদার সাধারণ ধর্মঘট চলছে। রোজা লুক্সেমবার্গ আর কার্ল লিবনেখটের নেতৃত্বে বামপন্থী সমাজতন্ত্রীরা রাশিয়ার মত বিপ্লব করে ফেলতে পারে – এই ভয় চেপে ধরে সোশাল ডেমোক্র্যাট নেতা ফ্রেডরিশ এবার্ট আর ফিলিপ শাইডেমানকে, যাঁরা চ্যান্সেলর প্রিন্স ম্যাক্স অফ ব্যাডেনও পদত্যাগ করে দেওয়ায়, সেই মুহূর্তে দেশের দায়িত্বে ছিলেন। শাইরারের মতে, ওঁরা চেয়েছিলেন যেনতেনপ্রকারেণ রাজতন্ত্র বজায় থাকুক। তা হচ্ছে না দেখে বিপ্লবের আতঙ্কেই ১৯১৮ সালের ৯ নভেম্বর তড়িঘড়ি কোনিগসপ্লাৎজের সামনে জড়ো হওয়ার জনতার সামনে শাইডেমান ঘোষণা করে দেন – জার্মানি এখন থেকে ‘রিপাবলিক’। সেই রিপাবলিকের সংবিধান ঘোষণা হয় আরও একবছর পরে ওয়াইমার বলে একটা শহরে আয়োজিত অ্যাসেম্বলি থেকে। তাই তাকে ওয়াইমার রিপাবলিক বলা হয়ে থাকে। বিপ্লবের সম্ভাবনা দমন করতে যে ওয়াইমার রিপাবলিক দারুণ সফল হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। এমনকি রোজা আর কার্লকেও একেবারে প্রাণে মেরে দেওয়া হয়েছিল জানুয়ারি মাসেই। কিন্তু এসব করতে গিয়ে গণতন্ত্র যেমন হওয়া উচিত তেমন করে জার্মানিকে গড়ে তোলার দিকে মোটে নজর দেওয়া হয়নি। সামন্তপ্রভু, উচ্চবর্গীয় জার্মান এবং সেনাবাহিনীর লোকজন – যাদের গণতন্ত্র ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ ছিল না, তাদের পোষ মানানোর নরম বা গরম – কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। ফলে তৈরি হয় এক জগাখিচুড়ি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে সেনাবাহিনীর যতটা প্রভাব প্রতিপত্তি থাকা উচিত তার চেয়ে বেশিই ছিল। সঙ্গে ছিল ক্ষমতাশালী শ্রেণিগুলোর দুর্নীতি। সব মিলিয়ে কেমন অবস্থা হয় সাধারণ জার্মানদের? ভাষান্তরে শাইরার বর্ণিত সেই অসহনীয় পরিস্থিতি এইরকম:

… তবে জনতা বুঝতে পারেনি যে জার্মান মুদ্রার বিপর্যয়ে বৃহৎ শিল্পপতি, সেনাবাহিনী আর রাষ্ট্র কেমন লাভবান হচ্ছিল। তারা শুধু দেখতে পাচ্ছিল যে ব্যাঙ্কে অনেক টাকা থাকলেও খানিকটা গাজর, কিছুটা আলু, কয়েক আউন্স চিনি, এক পাউন্ড ময়দা কেনা যাচ্ছিল না। প্রত্যেকটি ব্যক্তি জানত যে সে দেউলিয়া আর প্রতিদিন খিদের জ্বালা টের পেত। এই যন্ত্রণা আর আশাহীনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা যা কিছু হয়েছে তার জন্য গণতন্ত্রকে দায়ী করত।

এমন একটা সময় অ্যাডলফ হিটলারের জন্যে ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত।

গত সোমবার কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে ভুবনেশ্বরে এক সভায় বলেছেন, কিছু নেতা এবং সাধারণ মানুষ যদি ভীরুতা অবলম্বন করেন তাহলে সংবিধান ও গণতন্ত্রের বাঁচা শক্ত। তার আগেরদিনই নীতীশ কুমার কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং বাম দলগুলোর সমর্থন ছেড়ে বেরিয়ে ফের বিজেপির সঙ্গে জোট করে আরও একবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে ফেলেছেন। ফলে বোঝা শক্ত নয়, খড়্গের আঙুল কার দিকে ছিল। খড়্গে অবশ্য রাখঢাক করেননি, শুধু নীতীশের দিকে আঙুল তুলেও থামেননি। নীতীশ চলে যাওয়ায় ইন্ডিয়া জোট দুর্বল হবে না বলেছেন, একইসঙ্গে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কেরও নিন্দা করেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোর জন্যে। দেশের সংকট মুহূর্তে কিছু রাজনীতিবিদের ভীরুতার কী দাম একটা দেশকে দিতে হয় তা শাইরারের বইয়ের যে অংশ নিয়ে আলোচনা করলাম তা পড়লেই বোঝা যায়। তবে খড়্গে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন যে বিজেপির বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একা নীতীশই ভীরু নন।

বস্তুত, ভীরুদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করলে ইন্ডিয়া জোট আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, আখেরে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই ক্ষতি হবে – এই আশঙ্কাতেই সম্ভবত খড়্গে আর কারোর নাম করেননি। নইলে নিঃসন্দেহে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নামও করতে হত। তিনি ইন্ডিয়া জোটে আছেন, অথচ তাঁর দলের শাসনে থাকা পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন – পাঞ্জাবে তাঁরা একাই লড়বেন, কংগ্রেসকে কোনো আসন ছাড়বেন না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও করতে হত। তাঁর দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল – কংগ্রেস দাদাগিরি করে, কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করার ব্যাপারে আন্তরিক নয়। কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটে এল, তাঁকে জোটের মিটিংয়ে একেবারে রাহুল গান্ধীর পাশে জায়গাও দেওয়া হল। অথচ কোনো মিটিংয়ে তিনি নিজে যান না, কখনো কোনো প্রতিনিধিকেও পাঠান না, কখনো আবার সংযুক্ত ঘোষণাপত্রে তাঁর দলের স্বাক্ষর থাকে না। গত কয়েকদিনে আবার সটান বলে দিয়েছেন, ইন্ডিয়া জোটে আছেন দেশে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে একাই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন। ত্রিপুরা, মেঘালয়, গোয়া ইত্যাদি নির্বাচনে লড়তে গিয়ে আদৌ সুবিধা করতে না পারার পরেও তিনি রাজ্যের বাইরে নিজের শক্তি সম্পর্কে কী করে আত্মবিশ্বাসী হচ্ছেন তা বোঝা শক্ত। রাহুলের ভারত ন্যায় যাত্রা মমতার রাজ্যে ঢুকে পড়েছে, অথচ তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে তাতে সঙ্গত করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উলটে কংগ্রেস অভিযোগ করছে তৃণমূলই নাকি ন্যায় যাত্রার পতাকা ছিঁড়ে দিচ্ছে, রাহুলকে সরকারি গেস্ট হাউসে মধ্যাহ্নভোজন করতে দেওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখানো হচ্ছে না। এর পিছনে ইডি, সিবিআই আতঙ্ক ছাড়া অন্য কিছু কি থাকা সম্ভব? এ যদি ভীরুতা না হয়, তাহলে তো ভাবতে হবে সিপিএম নেতারা যে তৃণমূল-বিজেপি সেটিংয়ের তত্ত্ব খাড়া করেন সেটাই সত্যি। নইলে বিজেপি যে দেশের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু সেকথা তো খড়্গের মত মমতাও বলে থাকেন। তাহলে মিলেমিশে লড়তে আপত্তি থাকবে কেন? ইন্ডিয়া জোটে তাঁর চেয়ে বেশি সিপিএমকে গুরুত্ব দেওয়া হয় – এ তো অভিমানের কথা। এই কি মান-অভিমানের সময়? তাও যদি অভিমানের ভিত্তি থাকত। সিপিএমের সাংসদ সংখ্যা তৃণমূলের ধারেকাছে নয়। তাদের নেতা সীতারাম ইয়েচুরি মিটিংয়ে গুরুত্ব পেলেন কি পেলেন না তাতে কী-ই বা এসে যায়?

আরও পড়ুন মুখ্যমন্ত্রীর আরএসএস: বিশ্বাসে মিলায় বস্তু 

রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করেও যে বিজেপি চারশো আসন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নয় তা পরিষ্কার। বিরোধী নেতাদের ভীরুতাকে তারা হাতিয়ার করতে চাইছে। ইডি, সিবিআইয়ের খাতায় কেবল নীতীশ কুমার বা মমতার দলের নেতা মন্ত্রীদের নামেই অভিযোগ আছে তা তো নয়। কেরালায় সিপিএম নেতা, মন্ত্রীদের গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে নেতাদের বিরুদ্ধেও কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল। সম্ভবত স্ট্যালিনের সরকার পালটা এক ইডি অফিসারকে গ্রেফতার করায়, মাদুরাইয়ের ইডি দফতরে হানা দেওয়ায় উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। নীতীশ এনডিএতে ফিরে যাওয়া মাত্রই তেজস্বী যাদবকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকেও এক মামলায় গ্রেফতার করা হতে পারে বলে হাওয়ায় খবর ভাসছে। ইন্ডিয়া জোটের আরেক শরিক শিবসেনা। তাদের ডাকাবুকো নেতা সঞ্জয় রাউত। তাঁর নামেও মামলা আছে ইডির হাতে, ইতিপূর্বে তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। দরকার পড়লে শিবসেনার ভীরুতার পরীক্ষাও নিশ্চয়ই নেওয়া হবে।

এবার্ট আর শাইডেমানের ভূমিকা ভারতে কারা পালন করলেন তা তো এখনই বোঝা যাবে না, স্পষ্ট হবে আজকের ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন। কিন্তু কৌতূহল হয়, বিরোধী দলগুলো দুর্নীতিমুক্ত হলে বিজেপিবিরোধী জোটের এমন নড়বড়ে অবস্থা হত কিনা। কোনো সন্দেহ নেই, যেসব মামলায় বিভিন্ন দলের নেতাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তার অনেকগুলোরই ভিত্তি নেই। রাউতকে জামিন দেওয়ার সময়ে যেমন বিচারপতি বলেছিলেন, ওই গ্রেফতারি বেআইনি। যে কোনো দেওয়ানি গোলমালকে আর্থিক দুর্নীতির তকমা দেওয়া চলে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল, গত কয়েক দশকে ভারতের প্রায় সব দলের নেতাদের এত আর্থিক কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়েছে, যে কোন ক্ষেত্রে পালে সত্যিই বাঘ পড়েছে আর কোথায় স্রেফ বিরোধী শক্তিকে গ্রাস করে নিতে কেন্দ্রীয় এজেন্সি ‘চোর চোর’ বলে চেঁচাচ্ছে – তা বোঝা শক্ত। এই ধোঁয়াশার সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলগুলোকে ভোটারদের চোখে আরও ছোট করে দেওয়া এবং সম্ভব হলে দলে টেনে আনা চলছে।

হিটলারের অবশ্য ইডি, সিবিআই ছিল না।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজেরে অপমান করছে সিপিএম

সরকারবিরোধী মানুষ এত অসহায় যে এই সময়কালে অনেকের মনে বিরোধী নেতাদের শূন্য আসনে শুধু বিজেপি নেতারাই নয়, বিচারকরাও বসে পড়েছেন।

সালটা ১৯৯৬। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করতে উদগ্রীব দেশের অকংগ্রেস, অবিজেপি দলগুলো। এই প্রস্তাবে সায় দেওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলছে সিপিএমের মধ্যে। সেইসময় আমাদের এলাকার সিপিএমের একেবারে নিচুতলার এক তরুণ কর্মী বলেছিলেন, ছোট থেকে শুনে আসছি আমাদের দলের নামে একটা ‘আই’ আছে। সেটার গুরুত্ব কী তা তো কোনোদিন টের পেলাম না। জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হলে গোটা দেশ টের পাবে। সেদিনের আড্ডায় অন্য এক কর্মী কংগ্রেসের সমর্থনে সরকারে যাওয়ার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, আজ কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়ব, তারপর বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে কোন মুখে ভোট চাইতে যাব লোকের কাছে? শেষপর্যন্ত যিনি ‘আই’-এর প্রভাব দেখার আশা করেছিলেন তাঁকে আশাহত হতে হয়েছিল। জ্যোতিবাবু স্বয়ং সেই নিচুতলার কমরেডের চেয়ে কিছু কম নিরাশ হননি। সরকারে না যাওয়ার পার্টিগত সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও বলেছিলেন, ঐতিহাসিক ভুল হল। জ্যোতিবাবুর জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির শরিক সেই কমরেড অতি সম্প্রতি প্রয়াত হলেন আর যিনি বিরোধিতা করেছিলেন তিনিও এখন বয়সের কারণে খানিকটা নিষ্প্রভ। ইতিমধ্যে সাতাশটা বছর কেটে গেছে, কিন্তু সিপিএমের ‘আই’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে পার্টির নিজেরই দ্বিধা এখনো কাটল না। ইন্ডিয়া জোটের ‘আই’-তে ‘আই’ মেলানো নিয়ে সাম্প্রতিক টানাপোড়েন তারই প্রমাণ।

সেইসময় সরকারে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পিছনে ঘোষিত যুক্তি ছিল, এমন কোনো সরকারে যাব না যে সরকার মার্কসবাদী কর্মসূচি লাগু করে উঠতে পারবে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের বহু নেতা সরকারে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন এবং তাঁরা মনে করেন ‘কেরালা লবি’ জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। কথাটা সত্যি হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গের সব নেতাও যে সরকারে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না তা সর্বজনবিদিত। এবারেও দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার পক্ষপাতী নয়। ইন্ডিয়া জোটে সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস – দুই দলই থাকলেও, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং অন্যতম নেতা সুজন চক্রবর্তী বারবারই বলছেন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আর তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও একই কথা বলছেন, কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে এক জোটে থাকা ঠিক হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সিপিএম নেতৃত্বের দ্বিধা স্পষ্ট হয়ে গেছে কো-অর্ডিনেশন কমিটিতে সদস্য না রাখার সিদ্ধান্তে। যদি গোড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হত তাহলে তবু বোঝা যেত। ইন্ডিয়া জোটের সব দল ওই কমিটিতে নেই। কিন্তু যখন কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা হয়, তখন সিপিএমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তাদের প্রতিনিধির নাম পরে জানানো হবে। পরবর্তীকালে হঠাৎ কমিটিতে না থাকার সিদ্ধান্ত হল কেন?

সিপিএম নেতৃত্বের এই দ্বিধার সমালোচনায় অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু অনস্বীকার্য যে বিজেপিবিরোধিতা আর তৃণমূলবিরোধিতার মধ্যে একটি বেছে নেওয়া আজকের সিপিএমের পক্ষে কঠিন। তাদের বিজেপিবিরোধিতার ইতিহাসে কোনো ছেদ নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের মত তারা কখনো বিজেপির সঙ্গে জোট সরকার গড়েনি, বিজেপির মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হননি কোনো সিপিএম নেতা। ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকারকে বিজেপি, সিপিএম দুই দলই সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সেবার নির্বাচনে ভোটাররা কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। উপরন্তু স্বল্প সময়ে ভিপি সিংয়ের সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু করা, একজন মুসলমানকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করার মত অভূতপূর্ব কাজ করেছিল। সেই সরকারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তি হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি বাবরি মসজিদ ভেঙে উঠতে পারেনি, বাধা পেয়েই সমর্থন প্রত্যাহার করে। অর্থাৎ বিজেপির কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে দেওয়া হয়নি, উল্টে হিন্দুত্ববাদের অতি অপছন্দের গোটা দুয়েক কাজ সেই সরকার করে ফেলেছিল। স্বভাবতই সিপিএম বিজেপিবিরোধী জোটের স্বাভাবিক সদস্য।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু মানুষ যে এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন তা বুঝতে বড় নেতা হতে হয় না। ট্রেনে বাসে বাজারে দোকানে খুচরো কথাবার্তায় গরিব, বড়লোক নির্বিশেষে মানুষের সরকারকে গাল দেওয়ার এরকম উৎসাহ শেষ দেখা গিয়েছিল বামফ্রন্ট আমলের শেষ পর্বে। এই অসন্তোষের কারণ যেমন ফ্ল্যাট থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়া অর্থাৎ যাবতীয় নিয়োগ দুর্নীতি, তেমনই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা নিয়ে দুর্নীতি, একশো দিনের কাজ না পাওয়ার মত বিষয়ও। পরের দুটি বিষয় সরাসরি গ্রামের গরিব মানুষের গায়ে লাগে। তা না হলে মনোনয়ন পর্ব থেকে শুরু করে গণনা পর্যন্ত পুকুর চুরির পরেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীরা এতগুলো আসনে জিততে পারত না, বাম-কংগ্রেসের ভোটও বাড়ত না। সংসদীয় রাজনীতিতে জনমতের এই স্রোতকে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের বিরোধী দল অগ্রাহ্য করতে পারে না।

এমতাবস্থায় সিপিএম কী করতে পারত? ইন্ডিয়া জোটে না গিয়ে বলতে পারত আমরা নিজেদের মত করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ব। সেক্ষেত্রে তৃণমূল তো বটেই, সব রঙের সমালোচক সিপিএমকে বিজেপির দালাল বলে দেগে দিত। ইন্ডিয়া জোটে থাকায় যেমন বিজেপি তৃণমূলের দালাল বলছে এবং নিজেদের সদস্য, সমর্থকরাও সন্দেহের চোখে দেখছে। কথা হল, সমালোচকরা কী বলবে তা ভেবে রাজনীতি করা দিশাহীনতার লক্ষণ। এতদিনের দিশাহীনতাই আজকের গাড্ডায় ফেলেছে সিপিএমকে। ইন্ডিয়া জোটে না গেলেই সিপিএমকে বিজেপির দালাল বলার সুযোগ পাওয়া যাবে কারণ ২০১১ সালের পর থেকে রাজ্যে সিপিএমের সক্রিয়তার অভাবে বিরোধী পরিসর দখল করতে শুরু করে বিজেপি। তৃণমূল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে গায়ের জোরে প্রহসনে পরিণত করার পর নিচের তলার হতাশ সদস্য, সমর্থকরা বিজেপির দিকে ভিড় জমান এবং ২০১৯ সালের লোকসভা আর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি তার ফায়দা তোলে। সিপিএম শূন্যে পৌঁছয়। ফলে ‘পার্টি লাইন’ যা-ই হোক, সিপিএমই বিজেপিকে পুষ্ট করছে – একথা পাটিগাণিতিক সত্য হয়ে যায়। সেই বদনামের ভারে সিপিএম এখন ন্যুব্জ।

আরও পড়ুন নয়া বার্তা ছাড়া পরিশ্রমের ফল পাবে না সিপিএম

এই পরিস্থিতি তৈরিই হত না, যদি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে নেতৃত্ব বাম রাজনীতির লড়াকু বিরোধিতার ঐতিহ্য বজায় রাখতেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর অনতিবিলম্বে সারদা কেলেঙ্কারির পর্দাফাঁস হয়। অথচ সিপিএম একদিনের জন্যও তা নিয়ে জনজীবন অচল করে দেওয়ার মত আন্দোলন করেনি। নারদের ক্যামেরায় শাসক দলের নেতাদের নগদ টাকা ঘুষ নিতে দেখা যায়। সেইসময় বিরোধী নেত্রীর নাম মমতা ব্যানার্জি হলে কলকাতা অচল হয়ে যেত, সূর্যকান্ত মিশ্ররা কেবল বিবৃতি দিয়ে গেছেন। গতবছর মার্চে সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে এবং মীনাক্ষী মুখার্জির উদ্যোগে সিপিএমের আন্দোলনে ঝাঁজ আসে। তার আগে পর্যন্ত রাস্তার চেয়ে টিভির পর্দায় এবং ফেসবুক লাইভেই বেশি দেখা যেত সিপিএম নেতাদের। সরকারবিরোধী মানুষ এত অসহায় যে এই সময়কালে অনেকের মনে বিরোধী নেতাদের শূন্য আসনে শুধু বিজেপি নেতারাই নয়, বিচারকরাও বসে পড়েছেন।

এই দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তার মূল্য হিসাবে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও শূন্য পাওয়া তেমন বড় কিছু নয়, যদি বিরোধী হিসাবে বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা হলেও ফেরত আনা যায়। সিপিএম নেতৃত্বের এবং বিজেপিবিরোধী সিপিএম সমালোচকদেরও ভেবে দেখা উচিত, সিপিএম ইন্ডিয়া জোট থেকে আলাদা হয়ে লড়লেই ভাল হয় কিনা। কারণ সিপিএম তৃণমূলবিরোধিতা না করলে আখেরে বিজেপিরই লাভ, তারা আরও বেশি করে তৃণমূলবিরোধী ভোট পাবে। মনে রাখা ভাল, ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপি হেরেছে মাত্র হাজার চারেক ভোটে। ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থীর (কংগ্রেস সমর্থিত) জামানত জব্দ হলেও তিনি পেয়েছেন তেরো হাজারের বেশি ভোট। এতগুলো তৃণমূলবিরোধী ভোট কিন্তু বিজেপির ঝুলিতে যেত তৃতীয় পক্ষ না থাকলে। এভাবে ভাবতে হলে অবশ্য সিপিএম নেতৃত্বকে ঠিক করতে হবে লোকসভা নির্বাচনে মূল লক্ষ্য কোনটা। জ্যোতি বসু, হরকিষেণ সিং সুরজিৎদের অন্তত সেই দ্বিধা ছিল না। তাঁরা বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকাতে ১৯৯৬ পর্যন্ত নরসিমা রাওয়ের সংখ্যালঘু সরকারকে চলতে দিয়েছিলেন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ব্যাকফুটে গোদি মিডিয়া

পবন খেরা, সুপ্রিয়া শ্রীনাতেরা লাইভ টিভিতে গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ধমকাতে শুরু করলেন – বিজেপির দালালি করবেন না।

প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা আর বুথফেরত সমীক্ষার দৌলতে লোকনীতি-সিএসডিএস নামটা এখন ওয়াকিবহাল পাঠকদের কারোর অজানা নয়। কিন্তু এই সংস্থাটি আরও কিছু সমীক্ষা করে থাকে যেগুলো নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে শুধু যে হইচই হয় না তা নয়, আদৌ কোনো খবরই প্রকাশ করা হয় না। কারণ করলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে। তেমনই এক সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত সপ্তাহে। এই সমীক্ষার মজা হল, এখানে উত্তরদাতা সাংবাদিকরাই। যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের সমীক্ষাটির ফল দেখে আতঙ্কিত হওয়ার মত নানা বিষয় আছে, তবে এই লেখার পক্ষে যা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য তা হল, ৮২% সাংবাদিক বলেছেন তাঁরা মনে করেন তাঁদের নিয়োগকর্তা বিজেপিকে সমর্থন করেন।

এমনিতে স্বাধীন, সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে যে কোনো ব্যক্তিরই যে কোনো দলকে সমর্থন করার অধিকার আছে। উপরন্তু উদারনৈতিক গণতন্ত্রের গালভরা বাণীগুলোর গলদ বুঝে ফেলা যে কোনো মানুষই জানেন কোনো দেশেই কোনো সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে পারে না। বস্তুত, হওয়া উচিতও নয়। কারণ রাজনীতিহীন সাংবাদিকতা হল অর্থহীন তথ্যের সমাহার। ও জিনিস হোমেও লাগে না, যজ্ঞেও লাগে না। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া স্কুপ নামক ওয়েব সিরিজে একজন আদর্শবাদী সম্পাদকের একটি সংলাপ আছে। তিনি চাকরি ছাড়ার আগে মালিককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যখন কেউ বলে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর অন্য একজন বলে হচ্ছে না, তখন সাংবাদিকের কাজ দুজনকেই উদ্ধৃত করা নয়। জানলা খুলে দেখা কোনটা ঠিক এবং সেটাই লেখা। সাংবাদিকের কাজ কোনটা তা ঠিক করা কিন্তু শতকরা একশো ভাগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সুতরাং সাংবাদিকের এবং সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক প্রবণতা থাকতে বাধ্য। সেই প্রবণতা কোনদিকে থাকবে তা অনেককিছুর ভিত্তিতে ঠিক হয়, যার একটা অবশ্যই মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ। ফলে কোনো তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমই যে কোনোদিন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল না একথা বলাই বাহুল্য। যেমন কেউ বলে না দিলেও পশ্চিমবঙ্গে নেহাত বালক-বালিকারাও চিরকাল জানত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ওই সংস্থারই ইংরিজি কাগজ দ্য টেলিগ্রাফ কংগ্রেসপন্থী; বর্তমান, দ্য স্টেটসম্যান বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধী; আবার আজকাল বাম ঘেঁষা। তাহলে লোকনীতি-সিএসডিএস সমীক্ষার ফল আলাদা করে আলোচনা করার মত কেন? কারণ ভারতের মত এত বড় একটা দেশ, যেখানে এতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে, সেখানে চালানো সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক মনে করছেন তাঁদের সংস্থা একটা দলকেই সমর্থন করে। অর্থাৎ বিভিন্ন নাগরিক বিভিন্ন দলকে সমর্থন করার মত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন দলের দিকে ঢলে থাকলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ভারসাম্য বজায় থাকে তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এই সমীক্ষা থেকে।

২০১৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন খবরের চ্যানেল দেখার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা সমীক্ষার এই ফলাফলে অবিশ্বাস করবেন না। কেউ কেউ বলবেন বেশ হয়েছে, এমনটাই হওয়া উচিত কারণ বিজেপিই একমাত্র জাতীয়তাবাদী পার্টি। আর বিজেপিবিরোধী শঙ্কিত হবেন। এই যা তফাত। কিন্তু কে নিজের রাজনৈতিক পছন্দ অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের এই একপেশে হয়ে যাওয়াকে কীভাবে দেখবেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দেশের সংবাদমাধ্যমের এতখানি একচোখামির ফল কী হচ্ছে? অর্ণব গোস্বামী, রাহুল শিবশঙ্কর, রাহুল কাঁওয়াল, শিব অরুর, সুধীর চৌধুরী, রুবিকা লিয়াকত, দীপক চৌরাসিয়া, অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, সুরেশ চওনঙ্কে বা অমন চোপড়ারা যে পরিমাণ ঘৃণা ছড়িয়েছেন গত এক দশকে – তার ফল আর শুধু উত্তেজনা সৃষ্টি করে দাঙ্গা ছড়ানোয় সীমাবদ্ধ নেই। ও কাজ তো হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকও করে। ধর্মান্ধ টিভি অ্যাঙ্করদের অবদানে উঠে এসেছে চেতন সিংয়ের মত ভয়ঙ্কর অপরাধী, যে সরকারি উর্দি পরে সরকারি বন্দুক দিয়ে ট্রেনের কামরায় প্রথমে নিজের ঊর্ধ্বতন অফিসারকে খুন করে। তারপর এক কামরা থেকে আরেক কামরায় গিয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী যাত্রী খুঁজে বার করে খুন করে। অবশেষে সেখানে দাঁড়িয়ে বাকি যাত্রীদের হুমকি দেয়, ভারতের দুজনই আছে – মোদীজি আর যোগীজি। এখানে থাকতে হলে এদেরই ভোট দিতে হবে।

এতদ্বারা ২০২৪ লোকসভার নির্বাচনের জন্য বিজেপির প্রচার শুরু হয়ে গেল কি? রবীশ কুমার যাদের গোদি মিডিয়া বলেন, তারা যখন অমিত শাহকে বিধায়ক কেনাবেচা করার গুণে ‘মডার্ন চাণক্য’ আখ্যা দিতে পারে তখন এই প্রণালীকেও ব্যাপারটা থিতিয়ে গেলে যে বিজেপির ‘অ্যাগ্রেসিভ ক্যাম্পেনিং’ নাম দেবে না তার নিশ্চয়তা কী? আপাতত খাঁটি আমেরিকান কায়দায় চেতন সিংকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা চলছে। যদিও রেলমন্ত্রীকে কোনো সাংবাদিক প্রশ্ন করবে না, একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে বন্দুক হাতে ট্রেনযাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছি কেন? কারণ বিজেপি সরকারকে প্রশ্ন করা বারণ, করলে চাকরি যায়। লোকনীতি-সিএসডিএস সমীক্ষা যে সঠিক, এই তার হাতে গরম প্রমাণ।

নিজের বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আশপাশের লোকের সঙ্গে কথা বললেই টের পাওয়া যায় মূলধারার মিডিয়ার ছড়ানো ভুয়ো খবর এবং একচোখা খবর ইতিমধ্যেই কতখানি ক্ষতি করে ফেলেছে। দিন দুয়েক আগে একজন প্রাইভেট গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সেদিন কাগজে বেরিয়েছে বিজেপি মণিপুরের এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই এনআরসি করার কথা ঘোষণা করেছে। চালকের পাশে বসে কাগজ পড়তে গিয়ে সক্ষোভে আমার স্ত্রীকে বলতেই চালক বলে উঠলেন “ঠিক হয়েছে। এনআরসি তো করাই উচিত।” কেন করা উচিত জিজ্ঞাসা করায় তাঁর উত্তর “বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানগুলো এসেই তো মণিপুরে অশান্তিটা করছে।” তাঁকে বলা গেল যে মণিপুরে মুসলমান প্রায় নেই বললেই চলে এবং ওই রাজ্যের সীমান্ত মায়ানমারের সঙ্গে, বাংলাদেশের সঙ্গে নয়। তাঁর নাছোড়বান্দা উত্তর “মুসলমান সব জায়গাতেই আছে।” অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হল, মণিপুর সম্পর্কে তাঁর তথ্যের উৎস কী? উত্তর “খবরেই তো দেখাচ্ছে।” কোন চ্যানেলের খবরে দেখাচ্ছে সে প্রশ্ন করে আর সময় নষ্ট করিনি, কারণ কোন খবর মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ায় না সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বরং সহজ। তাই তাঁকে মণিপুরের ভূগোল, ইতিহাস এবং বর্তমান অশান্তি যে মেইতেই আর কুকিদের মধ্যে তা জানাতে খানিকটা সময় ব্যয় করলাম। এনআরসি যে এর প্রতিকার নয় তাও বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সফল হলাম কিনা জানি না, ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ মানুষ বহুবছর ধরে সারাদিন যা দেখে চলেছে তার প্রভাব কয়েক মিনিটের কথায় দূর হওয়া অসম্ভব।

ভারতীয় সমাজকে এই খাদের কিনারে নিয়ে আসার দোষ সবটাই টিআরপিখোর টিভি চ্যানেলগুলোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে অবশ্য অন্যায় হবে। খবরের কাগজগুলোও কোনো অংশে কম যায়নি। ‘পেইড নিউজ’ নিয়ে সাংবাদিক পি সাইনাথের যে কাজ আছে তা প্রমাণ করে টাকার জন্যে ভারতের বড় বড় কাগজগুলো সবকিছু করতে রাজি। ২০১৮ সালে কোবরাপোস্টের স্টিং অপারেশনেও তেমনই দেখা গিয়েছিল। কোবরাপোস্টের প্রতিনিধিরা একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধি সেজে ভারতের অনেকগুলো বড় বড় সংবাদমাধ্যমের কর্তাদের কাছে গিয়েছিলেন। প্রস্তাব ছিল, আমরা টাকা দেব, সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর করতে হবে এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা হয় এমন খবর করতে হবে, নানারকম ইভেন্টের আয়োজন করতে হবে। দুটো মাত্র সংবাদমাধ্যম রাজি হয়নি – পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ।

সংবাদমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থলোলুপতা এবং বিজেপি সরকারের ভয় দেখানো, সরকারবিরোধী খবর করলে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি নানা কৃৎকৌশলের ফল হল দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বিজেপি-আরএসএসের বয়ানের একাধিপত্য। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কখনো যা হয়নি ২০১৪ সালের পর থেকে ঠিক তাই হয়ে চলেছে। সংবাদমাধ্যম কেবলই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। যাদের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব তাদের প্রশ্ন করে না। অর্থাৎ কয়েকশো বছর ধরে সারা পৃথিবীতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার মূল কর্তব্য বলে যা স্থির হয়েছে – ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা – সেই কাজটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা অপরাধ, যে সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে না তারাই সঠিক কাজ করে – একথাই সারা দেশে সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সাংবাদিকরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে গদগদ সেলফি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। কে কত বড় সাংবাদিক তার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রশাসনিক বৈঠকে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন “পজিটিভ (ইতিবাচক) খবর করুন। বিজ্ঞাপন পাবেন।” এত বড় খবর সর্বাধিক বিক্রীত বাংলা দৈনিকের এক কোণে ১৭৮ শব্দে প্রকাশিত হয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের একজনও এর প্রতিবাদে একটি শব্দও লেখেননি বা বলেননি।

এভাবে চলছিল ভালই, কিছুদিন হল এই ধামাধরা মিডিয়া কিঞ্চিৎ ফাঁপরে পড়েছে। এমনিতে পৃথিবীর যে কোনো ব্যবসায় নিয়ম হল কাক কাকের মাংস খায় না। কিন্তু ভারতের সাংবাদিকতায় সেই নিয়ম বারবার ভেঙেছে গোদি মিডিয়া। অর্ণব গোস্বামী টাইমস নাওতে থাকার সময়েই বিজেপির পক্ষে বলে না এনডিটিভির মত যেসব চ্যানেল তার সাংবাদিকদের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা আরম্ভ করেছিলেন। একেবারে আরএসএসের তত্ত্ব অনুসরণ করে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, মুসলমান তো বটেই, যে কোনো ইস্যুতে সরকারের সামান্যতম বিরোধিতা করা ব্যক্তিদেরও দেশদ্রোহী বলা শুরু হয়ে গিয়েছিল ২০১৪ সাল থেকে। টিভি বিতর্কে বিরোধী দলের একজন মুখপাত্রকে ডেকে চিৎকার করে তাঁকে কথা বলতে না দেওয়া, অন্যদিকে নানা পরিচয়ে বিজেপি-আরএসএসপন্থী একাধিক লোককে প্যানেলে বসিয়ে একতরফা প্রচার চালিয়ে যাওয়া দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময়টুকু বাদ দিলে ভারতের সংবাদমাধ্যম এমন কখনো করেনি বলেই সম্ভবত বিরোধী দলগুলোর নেতারা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজিতে যাকে ‘ওয়াল টু ওয়াল কভারেজ’ বলে, সমস্ত নির্বাচনী প্রচারে এবং সারাবছরই বিজেপি তাই পেয়ে চলছিল আর বিরোধীদের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবার রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। এর পাল্টা কৌশল কারোর মাথায় আসেনি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য, সমর্থকরা ভেবে বসেছিলেন সোশাল মিডিয়া দিয়ে মাত করে দেবেন। কিন্তু বিপুল অর্থবলের কারণে সেখানেও বিজেপির সঙ্গে এঁটে ওঠা শক্ত। উপরন্তু আমাদের মত শহুরে মধ্যবিত্তদের নিজের চারপাশ দেখে যা-ই মনে হোক, ভারতের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এখনো স্মার্টফোন নেই, থাকলেও শস্তা ডেটা নেই, কানেক্টিভিটি নেই। ফলে ফেসবুক বা টুইটার দিয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছনো যায় না।

নেপথ্যে কে আছেন জানি না, কিন্তু বিজেপির এই সর্বগ্রাসী প্রচারের বিকল্প পথ প্রথম দেখালেন রাহুল গান্ধী – ভারত জোড়ো যাত্রা। শুধু যে সাবেকি ভারতীয় কায়দায় মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজের ভাবমূর্তি খানিকটা পুনরুদ্ধার করলেন এবং কংগ্রেসকে জাতীয় স্তরে ফের প্রাসঙ্গিক করে তুললেন তাই নয়, রাহুল ওই যাত্রায় এমন একটা জিনিস করলেন যা এমনকি বিজেপিও ভেবে উঠতে পারেনি। ভারত জোড়ো যাত্রাকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কোনো কভারেজ দেবে না বুঝে রাহুল ছোট বড় বিচার না করে বিকল্প সংবাদমাধ্যম, এমনকি ইউটিউবারদেরও সাক্ষাৎকার দেওয়া শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, বড় বড় কাগজে রাহুল নেই। টিভিতে রাহুল নেই। অথচ কর্ণাটকে চলা ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও আলোচনা করছেন। আসলে রাহুল (বা কংগ্রেস) যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা বড় অংশের মানুষ খবরের জন্য আর কাগজ বা টিভির উপর ভরসা করেন না। বিশেষত যাঁদের মস্তিষ্কের সবটাই এখনো হিন্দুত্ব গ্রাস করতে পারেনি, তাঁরা অনেকেই এখন ধ্রুব রাঠি বা আকাশ ব্যানার্জির মত ইউটিউবারের দিকে তাকিয়ে থাকেন খবর সংগ্রহের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের বিকল্প সংবাদমাধ্যম এখনো সঠিক অর্থে বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি বলেই হয়ত এই ধারা এখনো শীর্ণকায়। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মত বুলডোজারশাসিত রাজ্যেও হিন্দি ভাষার ইউটিউবাররা প্রবল জনপ্রিয়। যোগী সরকারকে বেগ দেওয়ার মত খবর, হাস্যকৌতুক, গান সবই তাঁরাই তৈরি করছেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বহু রাজ্যেই ঘটনা তাই। এই প্রবণতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হল ভারত জোড়ো যাত্রায়।

এর সঙ্গে কংগ্রেস আরও একটি কৌশল নিল, যা প্রথম চোটে যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের আপত্তিকর মনে হবে। শাস্ত্রে বলা আছে, দূত অবধ্য। সাহেবরাও বলে থাকে “Don’t shoot the messenger”। কিন্তু রাহুল ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন একটি সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিককে সরাসরি বলে দিলেন, বিজেপির হয়ে কাজ করতে হলে বুকে বিজেপির লোগো লাগিয়ে আসুন। তাহলে ওদের যেভাবে উত্তর দিই আপনাদেরও সেভাবেই উত্তর দেব। সাংবাদিক হওয়ার ভান করবেন না। সাংবাদিক দমে যেতে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাওয়া বেরিয়ে গেল?

এরপর থেকে একই ঢঙে কথা বলা শুরু করলেন তাঁর দলের অন্য মুখপাত্ররাও। পবন খেরা, সুপ্রিয়া শ্রীনাতেরা লাইভ টিভিতে গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ধমকাতে শুরু করলেন – বিজেপির দালালি করবেন না। কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন ইন্ডিয়া টুডের শোতে সুপ্রিয়া সটান রাহুল কাঁওয়াল এবং রাজদীপ সরদেশাইকে বলে দিলেন, আপনাদের স্টুডিওতে তো সকাল থেকে শোকপালন চলছে বলে মনে হচ্ছে। এই আক্রমণাত্মক মেজাজ কংগ্রেসের মুখপাত্ররা বজায় রেখে চলেছেন। সম্প্রতি টাইমস নাওয়ের সাক্ষাৎকারে কপিল সিবাল নাভিকা কুমারকে ল্যাজেগোবরে করে ছেড়েছেন। ভারি মোলায়েম গলায় বলেছেন, আশা করি এখন পর্যন্ত নাভিকা প্রধানমন্ত্রীর মাউথপিস নয়?

ক্রমশ এই রণনীতি অন্য বিরোধী দলের নেতাদেরও নিতে দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সবকিছুই বাকি দেশের চেয়ে একটু দেরিতে হয় আজকাল। তাই হয়ত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অতি সম্প্রতি একেবারে পার্টিজান হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমকে কড়া ভাষায় প্রত্যুত্তর দেওয়া শুরু করেছেন। লাইভ অনুষ্ঠানে জি ২৪ ঘন্টার অ্যাঙ্কর মৌপিয়া নন্দীকে সটান বলে দিয়েছেন, দালালি করা চলবে না। ওই চ্যানেলের মালিক সুভাষ চন্দ্র যে রাজ্যসভার বিজেপি সমর্থিত সাংসদ, টেনে এনেছেন সেকথাও।

আত্মপক্ষ সমর্থনে মৌপিয়া প্রথমে ওই তথ্যটাই অস্বীকার করেছেন, তারপর সেটা সফল হবে না বুঝে জাঁক করে বলেছেন, সেলিম চাইলেও ২৪ ঘন্টা গণশক্তির মত রিপোর্টিং করবে না। তারপর, যেন হঠাৎ খেয়াল হওয়ায়, যোগ করেছেন, জাগো বাংলার মত রিপোর্টিংও করবে না।

স্বাভাবিক অবস্থায় রাজনৈতিক নেতাদের এইভাবে সাংবাদিকদের তথা সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ভারত যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং এই অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। বস্তুত অধিকাংশ তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম এখন এতটাই একচোখো হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তাদের খবর না দেখে বা না পড়ে কেউ যদি গণশক্তি আর জাগো বাংলা পড়ে নিজের মত করে ঠিক কী ঘটেছে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে হয়ত সত্যের বেশি কাছাকাছি পৌঁছবেন।

একথা পাঠক/দর্শক মাত্রেই আজকাল উপলব্ধি করেন। সেই কারণেই রবীশ কুমারের ইউটিউব চ্যানেলের গ্রাহক সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এমনকি কুণাল কামরার মত ঋজু বিদূষক, যাঁর মূল কাজ লোক হাসানো, তাঁর পডকাস্টও মানুষ আগ্রহ নিয়ে দ্যাখেন। সেদিক থেকে যে বাঙালি হিন্দি বা ইংরিজিতে স্বচ্ছন্দ নন তাঁদের দুর্ভাগা বলতে হবে। বাংলা ভাষায় ওই মানের কাজ এখনো হচ্ছে না।

যা-ই হোক, ধামাধরা মিডিয়ার সংকটের কথা ফেরত আসি। সম্প্রতি রিপাবলিক চ্যানেলের কর্ণধার অর্ণব মণিপুর নিয়ে মোদী সরকারের সমালোচনা করেছেন, রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিও তুলেছেন। তা নিয়ে বিজেপিবিরোধী মানুষ যুগপৎ হাসাহাসি করছেন এবং বিস্মিত হচ্ছেন। আসলে এতে বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই। বিজেপিকে তো বটেই, এমনকি বিজেপিবিরোধীদেরও বিস্মিত করে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও ২৬টি দলের ইন্ডিয়া জোট গড়ে উঠেছে। শেষপর্যন্ত সে জোট টিকবে কিনা সেটা পরের কথা, কিন্তু গোদি মিডিয়ার কাছে আশু সমস্যা হল এই দলগুলির অধীনে থাকা রাজ্য সরকারগুলো। গোটা দক্ষিণ ভারতে কোথাও বিজেপি সরকার নেই, অথচ ওই রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল, প্রচুর বিজ্ঞাপন পাওয়া যেতে পারে। বাড়াবাড়ি করলে বিজেপির দেখানো পথে ওই সরকারগুলো বিজ্ঞাপন দেবে না। গোবলয়ের রাজ্যগুলোর মধ্যেও বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থানের সরকার ইন্ডিয়া জোটের দলগুলোর হাতে। দিল্লি, পাঞ্জাবের সরকারও তাই। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের মত বড় রাজ্য, ছত্তিসগড়ের মত উন্নতি করতে থাকা রাজ্যও ইন্ডিয়ার হাতে। তাহলে গোদি মিডিয়ার হাতের পাঁচ বলতে রইল মডেলের হাড়গোড় বেরিয়ে পড়া গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ছোট্ট রাজ্য হরিয়ানা আর মধ্যপ্রদেশ। শেষেরটি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির হাতে থাকবে কিনা তা নিয়েও ঘোর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে তেমন ব্যবসা হয় না নয়ডাকেন্দ্রিক তথাকথিত সর্বভারতীয় মিডিয়ার। কারণ তারা ওই অঞ্চল এবং তার মানুষজনকে চেনেই না। স্বভাবতই তাঁরাও এদের পাত্তা দেন না। এমতাবস্থায় স্রেফ দাঙ্গাবাজি করে চলে কী করে অর্ণব, রুবিকাদের?

লাইভ টিভিতে বিরোধী দলের নেতাদের প্রতিআক্রমণের ফলে হিন্দুত্বে একান্ত দীক্ষিত দর্শক ছাড়া আর সকলের কাছেই বিশ্বাসযোগ্যতা যে তলানিতে ঠেকেছে একথা বুঝতে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর পাকা মাথাদের কারোর বুঝতে বাকি নেই। বিকল্প সংবাদমাধ্যম বিপুল সরকারি বাধা সত্ত্বেও যে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে তাতেও সন্দেহ নেই। অতএব মাঝেমধ্যে বিজেপিবিরোধী ভান করতে হবে বইকি। মুশকিল হল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন সম্ভবত বিজেপিও ভাবতে শুরু করেছে, এদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা করালে তা আর আগের মত প্রভাবশালী হবে না। তাই তারাও এখন ‘সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার’ ধরার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বিজেপিপন্থী লেখক, সাংবাদিক, এমনকি মন্ত্রীরাও বেশকিছু ইউটিউবারকে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেছেন। এমনটা বিজেপি আগে কখনো করেনি। এই ইউটিউবারদের অন্যতম beerbiceps বলে একজন। ইউটিউবে তার প্রায় ছয় মিলিয়ন ফলোয়ার। অতীতে সে ক্রিকেটার যজুবেন্দ্র চহল, সানি লিওন, সারা আলি খান জাতীয় মানুষের সাক্ষাৎকার নিত। এমনকি ডিমনেটাইজেশনকে ব্যঙ্গ করেও ভিডিওও বানিয়েছে একসময়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে সে পরম সাত্ত্বিক হয়ে উঠেছে। বারবার ভুয়ো খবর ছড়িয়ে ভ্রম সংশোধন করা এজেন্সি এএনআইয়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশ থেকে শুরু করে অমুক প্রভু, তমুক দক্ষিণপন্থী স্ট্র্যাটেজিস্ট – সকলেই বিয়ারবাইসেপসের শোতে উপস্থিত হচ্ছেন। বিজেপি যদি ২০২৪ নির্বাচন জিতেও যায়, রাহুল, সেলিমরা মূলধারার সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে তাঁদের তিরিক্ষে মেজাজ বজায় রাখলে হয়ত বিয়ারবাইসেপসদেরই পোয়া বারো হবে, কপাল পুড়বে অর্ণব, মৌপিয়াদের।

তবে আক্রমণের ধারাবাহিকতা থাকা চাই। সেলিম জি নেটওয়ার্কের অ্যাঙ্করকে হাঁকড়াবেন আর তাঁর দলের মুখপাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা রিপাবলিক টিভির মত আরও উগ্র দক্ষিণপন্থী চ্যানেলের বিতর্কে হাসিমুখে অংশগ্রহণ করবেন, অনুষ্ঠানের আগে পরে দিলদরিয়া হয়ে ছবিও তুলবেন – তা কী করে হয়?

পিপলস রিপোর্টার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

বায়রন যদি ব্রুটাস হন, তৃণমূল কে?

২০২১ সালে যে তৃণমূল নেতাদের প্রতি মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন, যাঁরা বিজেপিতে গিয়ে বিপুল ভোটে হেরেছিলেন, তাঁদের নির্বাচনের ফল বেরোবার পর অনতিবিলম্বেই ফিরিয়েও নেওয়া হয়েছিল।

অবাক হওয়ার ক্ষমতা কমে আসাই সম্ভবত বার্ধক্যের সবচেয়ে নিশ্চিত লক্ষণ। বায়রন বিশ্বাস কংগ্রেসের টিকিটে, সিপিএমের সমর্থনে মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় খুব একটা অবাক হতে পারিনি। ফলে বুঝলাম, বুড়ো হচ্ছি। আমি যখন ছাত্র, তখন আমাদের কলেজের সেমিনারে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। পিঠে ভারি স্কুলব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাওয়া এক পরিচিত স্কুলছাত্রকে নাকি তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন “কেমন আছ?” সে উত্তর দিয়েছিল “ওই আছি আর কি। এবার গেলেই হয়।” তখনও এ-দেশে মোবাইল ফোন সহজলভ্য হয়নি। তখনই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এসে আমার মতো চালসে পড়া লোকের তো বুড়ো হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। চারপাশ অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। এত দ্রুত, যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে বদলানো প্রায় কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই বোধহয় সাহিত্য, সিনেমা, সোশাল মিডিয়া— সর্বত্র স্মৃতিমেদুরতার ছড়াছড়ি, একমাত্র নস্টালজিয়ার বাজারই সর্বদা সরগরম। বদল এমনিতে জীবনের লক্ষণ, তা মনোরঞ্জক এবং উত্তেজক। কিন্তু ঘনঘন বদল আবার একঘেয়ে হয়ে যায়। সর্বক্ষণ চার, ছয় হয় বলে যেমন আজকাল আর আইপিএল ম্যাচ দেখতে ভাল লাগে না। মনে হয়, এ তো জানা কথাই। খেলার মহান অনিশ্চয়তা বলে আর কিছু নেই। রাজনীতিও ক্রমশ মহান অনিশ্চয়তা হারাচ্ছে। এ রাজ্যের রাজনীতি তো বটেই।

অনেকেই চটে যাবেন। তবু না বলে পারছি না— পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলবদল ব্যাপারটা এতই জলভাত হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে, যে বায়রনের দলবদল নিয়ে কংগ্রেস ও বাম নেতৃত্বের আহত হওয়া এবং বহু সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া বা হতাশায় ভোগা আমার কাছে প্রাথমিকভাবে কৌতুককর। পরে অন্য কিছু। আগেই বলেছি, অতি দ্রুত সবকিছু বদলালে নিরুপায় মানুষ স্মৃতির কাছেই আশ্রয় নেয়। অনতি-অতীতে ফিরে গেলেই দেখতে পাই, এ রাজ্যের সর্বত্র একেকটা পাড়া বা পরিবার সম্পর্কে অন্যরা বলত “ওরা পাঁড় কংগ্রেসি” বা “ওরা কট্টর সিপিএম”। কোনও কোনও মানুষ সম্পর্কে বলা হত “প্রথমদিন থেকে তৃণমূলে আছে”। আজকাল আর সেসব বলা যায় না। এক যুগ আগে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেখা গেছে রেজ্জাক মোল্লার মতো “ঘামের গন্ধওলা কমরেড” তৃণমূলে চলে যেতে পারেন। উদয়ন গুহর মতো পারিবারিকভাবে বামপন্থী নেতা দল বদলাতে পারেন। হাত-পা নেড়ে মার্কসবাদ কপচানো, পকেটে মঁ ব্লাঁ পেন আর হাতে আই ওয়াচ পরা সিপিএমের রাজ্যসভার সদস্য ঋতব্রত ব্যানার্জি তৃণমূলের মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারেন নিঃসঙ্কোচে। এমনকি প্রবীণ সিপিএম নেতা তথা বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘদিনের মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের বিশ্বস্ত সৈনিক শঙ্কর ঘোষ বিজেপির নির্ভরযোগ্য ‘কারিয়াকার্তা’ হয়ে উঠতে পারেন। তালিকা দীর্ঘতর করা যেতেই পারে, কিন্তু বক্তব্য পরিষ্কার করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। যেসব মানুষ কখনও বামপন্থীদের ভোট দেন না, দেবেন না— তাঁদেরও কিন্তু বরাবর প্রত্যাশা থাকে, আর যে যা-ই করুক, বামপন্থীরা এমন নীতিহীনতায় জড়াবেন না। সেই বামপন্থীদেরই এসব করতে দেখে ফেলার পর ধনী ব্যবসায়ী কংগ্রেসি বায়রনের কাছে অন্যরকম প্রত্যাশা থাকবেই বা কেন? তিনি তো দেখলাম ঘোরপ্যাঁচহীন সরল মানুষ। বলেছেন, তৃণমূল প্রার্থী করেনি বলে কংগ্রেসে গিয়েছিলেন। এখন যখন বিধায়ক হয়েই গেছেন, তখন আর দলের উপর রাগ করে থাকার দরকার কী?

সাগরদীঘির ভোটাররা রাগ করতে পারেন এই লোকটির বিশ্বাসঘাতকতার জন্য, অধীর চৌধুরী রাগ করতে পারেন তাঁকে বোকা বানানো হয়েছে বলে। আমরা, বাকি রাজ্যের মানুষ, যদি রাগ করতে চাই তাহলে কয়েকটা কথা একটু স্মরণ করে নেওয়া দরকার।

এ রাজ্যের বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় দিনের পর দিন একাধিক বিধায়ককে বাইরে তৃণমূল, ভিতরে বিজেপি হয়ে থাকতে দিচ্ছেন। এঁদের মধ্যে মুকুল রায় বলে একজন আছেন, যিনি বিজেপির টিকিটে বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে পরে ঘটা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতিতে তৃণমূলে ফিরে এসেছেন বলে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। তারপর যখন তাঁকে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়, তখন বিরোধীরা সমালোচনা করেন। কারণ সংসদীয় প্রথা অনুযায়ী ওই পদটা প্রধান বিরোধী দলকে দেওয়া হয়ে থাকে। এই সমালোচনার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দেন, মুকুল তো বিজেপিরই বিধায়ক। কদিন আগেও মমতা একথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। বিধানসভার বাইরে প্রায় প্রতিদিন গরম গরম মন্তব্য করে বিজেপিকে সংবাদের শিরোনামে রাখেন যে বিরোধী দলনেতা, জনসভার অনুমতি আদায় করতে বারবার আদালতের দ্বারস্থ হতে যাঁর ক্লান্তি নেই, সেই শুভেন্দু অধিকারী কিন্তু এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার হুমকি-টুমকি দেননি কখনও। সুতরাং ধরে নিতে হয় মুকুল তৃণমূলেরও, বিজেপিরও। শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী সারদামণি যেমন বলতেন “আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।” তা এই ব্যবস্থায় যদি আমাদের রাগ না হয়, খামোকা বায়রনকে ব্রুটাসের সঙ্গে একাসনে বসানোর প্রয়োজন কী?

ওই লোকটি যে জনাদেশকে অসম্মান করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ রাজ্যের এক বড় অংশের মানুষ তো আবার তৃণমূল দল ভাঙালে তাতে জনাদেশের অসম্মান হয় বলে মনে করেন না। ঠিক যেভাবে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এবং সোশাল মিডিয়ায় বিজেপি কোনও রাজ্যের সরকার দল ভাঙিয়ে ভেঙে দিলে অমিত শাহকে চাণক্য বলা হয়, ব্যাপারটাকে মাস্টারস্ট্রোক বলা হয়, সেইভাবে এ রাজ্যেও তো অন্য দলের নেতা তৃণমূলে যোগ দিলে তা গণতন্ত্রের জয় বলেই ঘোষণা করেন বহু মানুষ। বিভিন্ন চ্যানেলের অ্যাঙ্কররাও গদগদ হয়ে বলেন, তৃণমূল দেখিয়ে দিল। বায়রনের দলবদলের পর যেমন বলা হচ্ছে, সাগরদীঘির পরাজয়ের জবাব দিল তৃণমূল। প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, জবাবটা কাকে দিল? ভোটারদের? যে ভোটাররা তৃণমূলকে দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন? তাহলে লড়াইটা কি শাসক দল বনাম ভোটারের? একেই তাহলে এখন গণতন্ত্র বলছি আমরা? পরপর হিমাচল প্রদেশ আর কর্নাটকে মুখ থুবড়ে পড়ার আগে বিজেপি সম্পর্কে সর্বভারতীয় স্তরে একটা কথা চালু হয়ে গিয়েছিল— ভোটে যে-ই জিতুক, সরকার গড়বে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কি আলাদা কিছু করছে?

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন যে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল তা তো ইদানীং অভিষেকও ঠারেঠোরে স্বীকার করেন। এ বছরে সময় অতিক্রান্ত হলেও পঞ্চায়েত নির্বাচন করানো নিয়ে সরকারের কোনও উৎসাহ নেই। রাজ্যপাল রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করছেন না, সরকারও তা নিয়ে সংঘাতে যাচ্ছে না। অথচ এমনিতে কত বিষয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে কত আকচা-আকচি চলে! ২০২১ সালে যে তৃণমূল নেতাদের প্রতি মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন, যাঁরা বিজেপিতে গিয়ে বিপুল ভোটে হেরেছিলেন, তাঁদের নির্বাচনের ফল বেরোবার পর অনতিবিলম্বেই ফিরিয়েও নেওয়া হয়েছিল। উপরন্তু বাবুল সুপ্রিয়র মতো দাঙ্গাবাজ বিজেপিফেরতকে উপনির্বাচনে প্রার্থী করে মন্ত্রীও বানানো হয়েছে। এগুলো জনাদেশকে সম্মান করার লক্ষণ? এই ধারাতেই তো কংগ্রেসের একমাত্র বিধায়ককে দলে টেনে নেওয়া হল। আবার মঞ্চে বসে অভিষেক জাঁক করে এও বললেন, যে বোতাম টিপলেই কংগ্রেসের চারজন সাংসদকে তৃণমূল নিয়ে নিতে পারে। একের পর এক দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় দল যখন টলমল করছে, দিদির দূত প্রকল্প ঘটা করে ঘোষণা করার পর জনরোষের চেহারা দেখে চুপিসাড়ে বন্ধ করে দিতে হয়েছে, নবজোয়ারে বেরিয়ে নিত্য ল্যাজেগোবরে হতে হচ্ছে— তখনও এভাবে বুক ফুলিয়ে দল ভাঙানোর হুমকি দেওয়া থেকে বোঝা যায় যে অভিষেক মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নীতি একটা বাতিল পণ্য হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন চাকরি চুরির চাঁইদের শেষ অব্দি কী গতি হয়?

তাঁর ধারণা যথার্থ। বিজেপির বিরুদ্ধে চাট্টি গরম গরম কথা বললেই (এমনকি আরএসএসের বিরুদ্ধেও বলতে হয় না। মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেন আরএসএস খারাপ নয়) সরকারি দলের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, গঙ্গারতি ও মন্দির নির্মাণ সত্ত্বেও বিজেপিকে আটকাতে তাদেরই ভোট দেওয়া আমাদের কর্তব্য— একথা যখন থেকে এ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনই নীতির ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয়ে গেছে। ২০২১ সালের নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল বিজেপিকে আটকানো, রাজ্যের সরকারের কাজের মূল্যায়ন নয়। তাতে ক্ষতি নেই। গণতন্ত্রে ভোটাররা নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিজেরাই তো ঠিক করবেন। কিন্তু আজ দুবছর পরে ভেবে দেখা দরকার, বিজেপিকে আটকানোর উদ্দেশ্যটুকুও সফল হয়েছে কি? বিজেপি তিনজন বিধায়ক নিয়ে এককোণে পড়ে থাকা দল থেকে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে তো বটেই, সরকারবিরোধী ভোটাররা যাতে বিজেপি ছাড়া আর কোনও দলের উপর ভরসা করতে না পারেন তার জন্যে শাসক দল আপ্রাণ চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় পক্ষের কাছে সামান্য একটা উপনির্বাচনে হারও তারা সহ্য করছে না। না হয় মেনে নেওয়া গেল, কংগ্রেস নিজেদের বিধায়ককে ধরে রাখতে পারে না বলে অপদার্থ। সিপিএম আরও অপদার্থ, কারণ তারা আদালতের মুখাপেক্ষী হয়ে আন্দোলন করে— এও না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপিই একমাত্র পদার্থ হিসাবে পড়ে থাক— এমন পরিস্থিতিই কি তৈরি করতে চেয়েছিলাম আমরা? বায়রনের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে চুটকি আর মিম বানানো বা ক্ষোভ প্রকাশ করার চেয়ে নিজেদের এই প্রশ্ন করা বেশি জরুরি। কারণ আবার নির্বাচন আসছে। গণতন্ত্রের ওইটুকু তলানিই তো পড়ে আছে আমাদের জন্যে— একটা ভোট দেওয়ার অধিকার।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

নয়া বার্তা ছাড়া পরিশ্রমের ফল পাবে না সিপিএম

তৃণমূলকে যত বড় ধাক্কা দেওয়া দরকার, বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে যতটা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দরকার – তার জন্যে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কি যথেষ্ট?

গত এক দশকে বাংলার রাজনীতিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলোর যদি একটা তালিকা তৈরি করা যায়, তাহলে প্রথম স্থান দখল করার লড়াইয়ে থাকবে ‘দুর্নীতি’ আর ‘সেটিং’। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে ‘এন আর সি’, ‘সি এ এ’, ‘এন পি আর’ শব্দগুলোর বহুল ব্যবহার সত্ত্বেও মনে হয় না ও দুটোকে টলানো যাবে। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সেই ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় মাপের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা শুরু হয়েছিল। তারপর সামনে আসে নারদ স্টিং অপারেশন, অতঃপর প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা কেলেঙ্কারি, গরু পাচার, অবৈধ বালি খাদান, কয়লা পাচার এবং সর্বোপরি নিয়োগ কেলেঙ্কারি। একের পর এক অভিযোগ উঠেই চলেছে। এগুলো ছাড়াও বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন ত্রিফলা আলো নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাইকেল নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, উমপুনের ত্রাণের চাল ও ত্রিপল বিতরণে দুর্নীতি হয়েছে। যদিও এই কটা অভিযোগ আইনি পথে খুব বেশি এগোয়নি, জনমনেও তেমন প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে সাধারণ মানুষের কথাবার্তা থেকে মনে হয় না। এর পাশাপাশি বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস বারবার দাবি করে এসেছে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে ‘সেটিং’, অর্থাৎ গোপন আঁতাত, আছে। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতির তদন্তগুলো শেষমেশ কোথাও পৌঁছয় না। অন্যদিকে ২০১১ পরবর্তী সময়ে যখনই তৃণমূল নিজেকে কোণঠাসা মনে করেছে, স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো বলেছেন সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি একসাথে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। কখনো বা বলেছেন সিপিএম বিজেপির হাত শক্ত করছে। এই করতে করতে বাংলার রাজনৈতিক বয়ানে যুক্ত হয়েছে দুটো শব্দ – বিজেমূল আর বিজেপিয়েম।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের নিচের তলা সচেতনভাবে বিজেপিতে ভোট নিয়ে গেছে বলে জোরদার অভিযোগ উঠেছিল। তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল জেলাস্তরের কিছু নেতার প্রকাশ্য উক্তি। আবার ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যেভাবে “দলে থেকে কাজ করতে পারছি না” অজুহাত দিয়ে দলে দলে তৃণমূল নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তার ফলে তৃণমূল আর বিজেপি একই দল – এই জাতীয় অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনের পর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মত করে বহু নেতা তৃণমূলে ফিরে আসেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নাম অবশ্যই মুকুল রায়, যিনি বিধানসভার খাতায় এখনো বিজেপি। অথচ রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ভাইপোর উপস্থিতিতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। এখন আবার তিনি তৃণমূল, না বিজেপি, নাকি অসুস্থ – তা নিয়ে তরজা চলছে। ফলে বিজেমূল তত্ত্বও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না আর।

কিন্তু সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে সেটিংকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে দুর্নীতি। লোকাল ট্রেনের ভেন্ডর কামরার আরোহী সবজি বা ছানার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মফস্বলে নতুন গজিয়ে ওঠা শীততাপনিয়ন্ত্রিত রিটেল চেনে বাজার করা গৃহবধূ – সকলেরই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। রাজ্য সরকারের পক্ষে যা বিশেষ উদ্বেগের, তা হল এই ইস্যু নিয়ে শাসক দল সম্পর্কে নরম মন্তব্য করতে প্রায় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সারদা কেলেঙ্কারি এ রাজ্যের মধ্যবিত্তকে প্রায় ছুঁতেই পারেনি, কারণ আমানতকারীরা অধিকাংশই ছিলেন গরিব মানুষ। তার উপর তখন ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের উপর তিতিবিরক্ত হয়ে নতুন শক্তিকে ক্ষমতায় আনা মানুষের তৃণমূল সম্পর্কে খানিকটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। নারদ কেলেঙ্কারির ঢেউ তো আরও অল্পেই ভেঙে গিয়েছিল। ততদিনে মন্ত্রীসান্ত্রীরা একটু-আধটু ঘুষ নেবেন – এ কথা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক জীবনে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। তাছাড়া যে টাকা ঘুষ হিসাবে দেওয়া হয়েছে তা আমার-আপনার টাকা কিনা তাও সন্দেহাতীত নয়। ফলে ও নিয়ে বেশি মানুষ ভাবেননি। কিন্তু এবার তাহলে জনমানসে এত অসন্তোষ কেন?

কারণ নানাবিধ, কিন্তু একটা কারণ অবশ্যই বিরোধী দলগুলোর সক্রিয়তার তফাত। ২০১১ সাল থেকে বছর খানেক আগে পর্যন্তও বিরোধী হিসাবে সিপিএম অবিশ্বাস্য নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে। নারদের ক্যামেরায় তৃণমূলের মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার দৃশ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরেও রাজ্যটা যেমন চলেছিল তেমনই চলেছে। বামফ্রন্টের মন্ত্রীরা এরকম কাণ্ডে জড়ালে আর বিরোধী নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলে সেদিন রাত থেকেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অবরুদ্ধ হয়ে যেত – একথা হলফ করে বলা যায়। তৎকালীন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ও তাঁর দলবল কিন্তু আলিমুদ্দিনে বসে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করেননি। মাঝেমধ্যে কলকাতার রাজপথে এক-আধটা মিছিল টিভির পর্দায় লাল পতাকার উপস্থিতি প্রমাণ করেছে, সরকারের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিগত রাজ্য সম্মেলনে নতুন রাজ্য কমিটি নির্মিত হওয়ার পর এবং মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির অনেকখানি পরিবর্তন ঘটেছে। কেবল কলকাতা নয়, জেলা সদরগুলোতে দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং আরও নানা দাবি নিয়ে বামেদের সরকারি অফিস অবরোধ করতে বা সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি করতে দেখা যাচ্ছে। যে লড়াকু মেজাজের জন্য বামপন্থী দলগুলোর কর্মীদের সুনাম বা দুর্নাম ছিল বরাবর, সেই মেজাজ আবার দেখা যাচ্ছে। কেবল নবান্ন নয়, উত্তরকন্যা অভিযান হচ্ছে নিয়মিত। কখনো ছাত্র-যুব সংগঠনের উদ্যোগে, কখনো বা শিক্ষক সংগঠনের উদ্যোগে। সেখানে ব্যারিকেড ভেঙে ফেলা হচ্ছে, আতঙ্কিত প্রশাসন জলকামান চালিয়ে দিচ্ছে। কলকাতায় চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সরকারের সোজা পথ, বাঁকা পথের নানা কৌশল সত্ত্বেও কিছুতেই ভাঙছে না। উল্টে ডিএ নিয়ে আন্দোলন করতে নেমে পড়েছেন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এবং অন্য রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা। একসঙ্গে এতগুলো আন্দোলনের প্রভাব পৃথিবীর যে কোনো দেশে যে কোনো কালে সরকারকে চাপে ফেলে। এখানেও ফেলেছে। মমতা সরকারের গোদের উপর বিষফোঁড়া আদালত।

দল এবং সরকার যে ঘূর্ণির মধ্যে পড়েছে তা আর কেউ মানুক না মানুক, পোড়খাওয়া নেত্রী মমতা নিশ্চয়ই মানেন। তাই একের পর এক জনসংযোগ কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের তারিখ নিয়েও উচ্চবাচ্য করছে না। যেসব এলাকায় পাঁচ বছর মানুষ খানাখন্দ পেরিয়ে যাতায়াত করেছেন, সেখানে এক বেলার মধ্যে নতুন রাস্তা তৈরি করা চলছে। মানুষের অসন্তোষের তীব্রতা টের পাওয়া যাচ্ছে এই দিয়েই যে তৃণমূল সাংসদ, বিধায়করা পর্যন্ত দিদির দূত হয়ে গিয়ে কোথাও তাড়া খেয়েছেন, কোথাও ভোটাররা মুখের উপর বলে দিয়েছেন ভোট দেওয়া হবে না। তাই এখন অভিষেক নতুন নাম দিয়ে ফের জনসংযোগের চেষ্টায় নেমেছেন।

মানুষের মধ্যে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, সেই ক্ষোভকে নালা কেটে ব্যালট বাক্সে বইয়ে দেওয়ার মত পরিশ্রম কি বামেরা করছেন? কোনো সন্দেহ নেই, রামনবমীর অজুহাতে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরি করে বিজেপি গত এক মাসে আবার এক ধরনের বাইনারি তৈরি করতে সফল হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। সে কাজে তাদের সাহায্য করছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। ঈদ উদযাপনে গিয়ে এন আর সি, সি এ এ নিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন সংখ্যালঘু মানুষকে। সাগরদীঘির হার এবং নওশাদ সিদ্দিকীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সামলাতে এবং একের পর এক তৃণমূল নেতার দুর্নীতির কেসে ফেঁসে যাওয়ার অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচতে হলে বিজেপি যে বামেদের চেয়ে প্রার্থিত প্রতিপক্ষ – তা মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কথা হল, এই কৌশল ভোঁতা করে দিতে বামেরা কী করতে পারেন? “বিজেপি-তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ভুলবেন না। দুর্নীতির মাধ্যমে রাজ্যটাকে কীভাবে ফোঁপরা করে দেওয়া হয়েছে খেয়াল রাখুন” – এই আবেদন আজকের বহুধাবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক বার্তা হিসাবে কি যথেষ্ট কার্যকরী? পশ্চিমবঙ্গ তো ভারতের বাইরে নয়। গোটা দেশে যা চলছে, তাতে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কেবল তৃণমূলের দুর্নীতির ইস্যুতে লড়ে কি সুবিধা করতে পারবেন বামেরা? তৃণমূলকে যত বড় ধাক্কা দেওয়া দরকার, বিজেপিকে রাজ্য রাজনীতিতে যতটা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দরকার – তার জন্যে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কি যথেষ্ট? নাকি মানুষের পালস বুঝতে আবার ভুল হচ্ছে সিপিএম তথা বাম নেতৃত্বের?

আরও পড়ুন বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র

সাম্প্রদায়িক বাইনারি তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক জমির সবটা দখলে রাখতে চাইছে তৃণমূল আর বিজেপি। তা ভাঙতে বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক বার্তা কি দিতে পারবেন সিপিএম ও তার শরিকরা? এখন পর্যন্ত দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় মিছিল করা ছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। শিগগির নতুন কোনো বার্তা দিতে না পারলে গত এক-দেড় বছরের পরিশ্রম কিন্তু জলে যেতে পারে। বুথ স্তরে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তৃণমূলের সঙ্গে লড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক খামতি তো আছেই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

সিপিএম পথে ফিরেছে, কিন্তু ব্যালটে ফিরবে কি?

আইএসএফের সঙ্গে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের এখন ঠিক কী সম্পর্ক? কংগ্রেসের সঙ্গে কি আবার জোট করা হবে?

খবরে প্রকাশ, সিপিএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি শিলিগুড়িতে এক সভায় বলেছেন, শিলিগুড়ি পৌর নিগম বামেদের হাতছাড়া হয়েছে সবে কয়েক মাস। কিন্তু এর মধ্যেই তা দুর্বৃত্তদের হাতে চলে গেছে। সিপিএম তথা বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত প্রশাসনিক কার্যকলাপ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ধুতি পাঞ্জাবির মত শ্বেতশুভ্র ছিল, কোথাও দুর্নীতির লেশমাত্র ছিল না – এমনটা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, দুর্নীতির যে পরিমাণ এবং দুর্নীতি করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর যে নির্লজ্জা এ রাজ্যে দেখা যাচ্ছে তা একান্তই তৃণমূল কংগ্রেসের দান। তার মধ্যে কংগ্রেসের উত্তরাধিকার খুঁজতে যাওয়াও বৃথা। আবু বরকত আলি গনিখান চৌধুরীরা সেকালের জমিদারদের কায়দায় রাজনীতি করতেন, অধীর চৌধুরীর মত লোকেরা তার সঙ্গে মিশিয়েছিলেন পেশিশক্তির ব্যবহার। কিন্তু সেখানেও পরিমাণ মত দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করে রবিন হুড মার্কা ভাবমূর্তি তৈরি করার প্রয়াস থাকত। বাম আমলেও রাজনৈতিক মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীরা অন্তত নিজের এলাকায় গরীবের মেয়ের বিয়ে দেওয়া, অমুক বড়লোককে ‘চমকে’ দিয়ে তমুক গরীবকে একটু স্বস্তি দেওয়া – এসব করত।

কিন্তু মাত্র এগারো বছরের শাসনেই দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের ফ্ল্যাট থেকে নগদ কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে, তদন্ত এগোলে অগাধ গোপন সম্পত্তির হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। অনুব্রত মন্ডলের মত বাহুবলীরা নিজেরাই নেতা হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তো বটেই, এমনকি দেশের বাইরেও নেতাদের সম্পত্তি রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এতৎসত্ত্বেও স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্যে অনুব্রতর মত নেতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন, ববি হাকিম বাঘ বেরিয়ে এলেই শেয়ালরা পালাবে ইত্যাদি আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছেন। সাধারণ মানুষ টিভির পর্দায় পাহাড়প্রমাণ টাকা দেখে ফেলায় কদিন নিচু হয়ে থাকা শাসকের গলা আবার সপ্তমে চড়েছে। সুতরাং সাধারণ মানুষ যদি ভেবে নেন, শীর্ষ নেতৃত্বের আশীর্বাদেই এত দুর্নীতি চলছে রাজ্যে, তাহলে দোষ দেওয়া যাবে না। উপরন্তু মহারাষ্ট্র বা তামিলনাড়ুর মত পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী অর্থনীতির রাজ্যে দুর্নীতি সাধারণ মানুষের যতটা চোখে লাগে, কর্মসংস্থানের হাহাকার পড়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের নেতাদের বিপুল সম্পত্তি এবং তা নিয়ে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধের অভাব অনেক বেশি গায়ে লাগাই স্বাভাবিক।

ফলে মীনাক্ষীর কথা বেশকিছু শ্রোতাকে স্পর্শ করতে পারলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সম্ভবত পারছেও। সেই কারণেই ইদানীং সিপিএমের মিছিল, মিটিংয়ে আবার ভিড় হতে দেখা যাচ্ছে। স্রেফ কৌতূহলী জনতার ভিড় নয়, মধ্যবয়স্ক বা পাকা চুলের মানুষের ভিড় নয় – তরুণ তরুণীদের ভিড়। স্কুল নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে বছর দশেক হতে চলল, কিন্তু গত এক বছরে যে তীব্রতা এসেছে আন্দোলনে – তাও আগে দেখা যায়নি। এর পিছনেও যে সিপিএমের সক্রিয়তা বৃদ্ধি অন্যতম কারণ, তা এই আন্দোলনকে নিয়মিত নজরে রাখা সাংবাদিকরা সকলেই জানেন। মীনাক্ষী, ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, কলতান দাশগুপ্তের মত সিপিএমের ছাত্র, যুব সংগঠনের নেতারা যে এই আন্দোলন নিয়ে পথে নেমে পড়েছেন, কম্পাস ঠিক করতে সাহায্য করছেন তা তো কারোর কাছেই অবিদিত নেই। যে রাত্রে করুণাময়ী থেকে আন্দোলনকারীদের বলপূর্বক তুলে দেওয়া হল কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশকে সাক্ষী গোপাল করে, সে রাত্রেও এঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন উচ্ছেদ আটকাতে। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সম্পর্কে সিপিএমের হাবভাব বদল চোখে পড়ার মত। পূর্বতন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের আমলে এই আন্দোলন চলছিল নিজের মত করে। কলকাতার মাঝখানে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে চাকরিপ্রার্থীরা যখন অনশন করছিলেন, তখন পথচারীরা পর্যন্ত উঁকি মেরে দেখতেন না এরা কারা, কেন এখানে বসে আছে। সিপিএম বলত তারা আন্দোলনটাকে হাইজ্যাক করতে চায় না বলে ওর মধ্যে প্রবেশ করছে না, কিন্তু আন্দোলনকারীদের পাশে আছে। পাশে থাকা মানে কোনোদিন বিমান বসু, কোনোদিন অন্য কোনো নেতার মেয়ো রোড গমনের ফেসবুক লাইভ। মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর থেকে স্বয়ং বেশ কয়েকবার আন্দোলনকারীদের কাছে গেছেন, এই ইস্যু নিয়ে পার্টির পতাকা নিয়ে অথবা নাগরিক মিছিলের নাম দিয়ে একাধিক কর্মসূচি পালন হয়েছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কড়া রায় তৃণমূল সরকারকে বিপদে ফেলেছে আদালতের ভিতরে। কিন্তু আদালতের লড়াইকে রাস্তায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব অবশ্যই সিপিএমের।

কিন্তু রাজ্যের পরিস্থিতির সাপেক্ষে যে প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ, তা হল পথে ঘাটে সিপিএমের প্রতি সমর্থন ফেরত এলেও, ব্যালট বাক্সে আসবে কি? কোনো সন্দেহ নেই, কলকাতার ধর্মতলায় সারা রাজ্যের ছাত্র, যুবদের একত্র করে শক্তি প্রদর্শন আর ভোট আদায় এক জিনিস নয়। ২০২৪ এখনো ঢের দেরি, সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। সে নির্বাচনে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন কতটা প্রভাব ফেলবে বলা মুশকিল। হয়ত বেশি প্রভাবশালী হবে সিপিএমের হেল্পলাইন, যেখানে মানুষ ফোন করে স্থানীয় দুর্নীতির কথা বলতে পারেন। সিপিএম নেতাদের দাবি দারুণ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া রাজ্যের প্রত্যেক পঞ্চায়েত এলাকায় গোটা নভেম্বর মাস জুড়ে পদযাত্রা এবং ডেপুটেশনের কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে, যা শুভেন্দু-অভিষেক কাদা ছোড়াছুড়ি এবং রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব পেরিয়ে কলকাতার সংবাদমাধ্যমে এখনো জায়গা করে নিতে পারেনি।

রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে, তৃণমূলের স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজ্য নেতাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ক্ষোভ জমেছে। কিন্তু তেমন ক্ষোভ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগেও ছিল। সে নির্বাচন অনেকটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্পর্কে গণভোটে পরিণত হওয়ায় এবং দুয়ারে সরকার আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কল্যাণে তৃণমূল শেষপর্যন্ত হইহই করে জিতেছিল। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট অন্য ব্যাপার। ইতিমধ্যে দুয়ারে সরকার নিয়েও দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। তৃণমূলেরই একাধিক গোষ্ঠীকে কারা কী পেল, কারা পেল না তা নিয়ে প্রকাশ্যে ঝগড়া করতে দেখা যাচ্ছে। বিজেপি এখন পর্যন্ত নিষ্প্রভ। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে কি পারবে সিপিএম?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে উঠে আসবে আরেকটি জরুরি প্রশ্ন। বামফ্রন্ট, তুমি আজিও আছ কি? কারণ সিপিএম যখন মধ্যগগনে, তখনো বহু জায়গায় তাদের চেয়ে ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপির মত ফ্রন্টের অন্য দলগুলোরই আধিপত্য বেশি ছিল। তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি যেমন হয়েছে, তেমনি নির্বাচনের সময়ে এই সমীকরণ বামফ্রন্টের হাত শক্তও করেছে। মুর্শিদাবাদে কী অবস্থা আরএসপির? কোচবিহারে উদয়ন গুহর প্রস্থানের পর কেমন আছে ফরোয়ার্ড ব্লক? প্রবাদপ্রতিম চিত্ত বসুর পার্টির উত্তর ২৪ পরগণাতেই বা কী হাল? বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে যে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি হয়েছিল তাতে ছিল কংগ্রেস আর ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টও। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মুসলমান এবং হিন্দু নিম্নবর্গীয় মানুষের হাত ধরার জন্যই নাকি শেষোক্ত দলটিকে নেওয়া হয়েছিল। তাদের সঙ্গেই বা সিপিএম তথা বামফ্রন্টের এখন ঠিক কী সম্পর্ক? কংগ্রেসের সঙ্গে কি আবার জোট করা হবে?

আরও পড়ুন সেলিব্রিটি কাল্ট দরদী সিপিএমকে খোলা চিঠি

এইসব প্রশ্নেই লুকিয়ে আছে বামেরা এ রাজ্যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা তার উত্তর। কারণ এ রাজ্যে যেভাবে ভোট হয়, তাতে সবকিছু ঠিকঠাক করেও নির্বাচনের দিন খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নের মোকাবিলা করতে না পারলে ভোটে জেতা যায় না। গোটা রাজ্যে একা তার মোকাবিলা করার মত সংগঠন সিপিএমের এখন নেই, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে হবেও না।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়াই কি উদ্দেশ্য?

পশ্চিমবঙ্গের কাগজ, টিভি চ্যানেলের মালিক, সম্পাদক, উত্তর সম্পাদকীয় লেখক, বিশেষজ্ঞ ও বিখ্যাতদের ছেলেপুলেরা প্রায় কেউই সরকারি স্কুলে পড়ে না। ফলে দিব্যি ওসব স্কুলের রোগবালাইকে অগ্রাহ্য করে থাকা গিয়েছিল।

ঘটনাচক্রে আমার পিতৃকুল, মাতৃকুলের অধিকাংশ আত্মীয় পেশায় শিক্ষক। তাঁরা অনেকেই আজ প্রয়াত। রাজনৈতিকভাবে সরকারি, বিরোধী, দুয়ের মাঝামাঝি— নানারকম দলের সদস্য, সমর্থক হলেও গত শতকের নয়ের দশকের শেষদিকে দেখতাম সকলেই একটি ব্যাপারে একমত— পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলগুলো ক্রমশ উঠে যাবে। কারণ ওই স্কুলগুলো ভরে থাকত মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েতে, যাদের বাবা-মায়েরা ক্রমশ তাদের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। আমার শিক্ষক আত্মীয়রা বলতেন এই প্রবণতা বাড়তে বাড়তে একসময় সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলগুলোতে পড়ে থাকবে কেবল তারা, যাদের বাবা-মায়েরা বেসরকারি স্কুলের খরচ পোষাতে পারবেন না। তাদের পড়াশোনা হল কি হল না তা নিয়ে শিক্ষকদেরও বিশেষ মাথাব্যথা থাকবে না, সরকারও দায়সারা স্কুল চালাবে। তখন কথাগুলো বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আজ পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষার অবস্থা দেখে সেই আত্মীয়দের বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ দর্শনের পারদর্শিতা স্বীকার না করে উপায় নেই।

আমাদের ছাত্রাবস্থাতেই সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলো ধুঁকতে শুরু করেছিল। তার জন্যে দায়ী করা হয় বামফ্রন্ট সরকারের প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে। কিন্তু এই শতকে কী কারণে মধ্যবিত্ত বাবা-মায়েরা সরকারি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলোকে ত্যাগ করলেন তা অত সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। একটা কারণ অবশ্যই কোন মাধ্যমে পড়ানো হচ্ছে তা নিয়ে বাঙালির অত্যধিক মাথাব্যথা। শিক্ষার গুণমান নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে অনেক বাবা-মাই ছেলেমেয়ের ইংরেজিতে গড়গড়িয়ে কথা বলতে পারা নিশ্চিত করতে চান। অর্থাৎ স্কুল তাঁদের কাছে প্রকৃতপক্ষে সারাদিনব্যাপী স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস। সঙ্গে অন্য বিষয়গুলো পড়িয়ে দিলেই হল। ফলে সাধ্যাতীত এবং বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা নেই এমন মাইনে দিয়েও বেসরকারি স্কুলেই তাঁরা ছেলেমেয়েকে পাঠান। সে ধরনের অনেক স্কুলেরই শিক্ষকদের যোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়, ফলে অনেকসময় ওই অভিভাবকরাই পড়াশোনার মান নিয়ে একান্ত আলোচনায় সন্দেহ প্রকাশ করেন। অথচ পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলগুলোতে যাঁরা পড়ান, তাঁরা অন্তত ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে একটা প্রতিযোগিতামূলক লিখিত পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউতে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে নিযুক্ত হচ্ছিলেন। তা সত্ত্বেও মধ্যবিত্তের বেসরকারি স্কুলে ছোটার পিছনে কি ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে’ কুসংস্কার? নাকি বাজার অর্থনীতির ‘যা পয়সা দিয়ে কিনতে হয় না তা ভাল নয়’ আদর্শে আস্থা? উত্তর যা-ই হোক, মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েরা সরে যাওয়ায় স্কুলের প্রতি শিক্ষকদের এবং সরকারের আগ্রহ যে কমে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিছুদিন আগেই তো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ স্কুল। বহু জায়গায় স্কুল চালু রাখতে শিক্ষকরা এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রী ধরে আনছেন।

শিক্ষকসমাজ অবশ্যই কোনও মনোলিথ নয়। পশ্চিমবঙ্গের সব শিক্ষক একইরকম ভাবেন বা সকলেই ফাঁকিবাজ, বসে বসে মাইনে পান— এমন একটা মত ইদানীং রীতিমত জনপ্রিয় হয়েছে। সে মতে সায় দিচ্ছি না। কারণ ফাঁকিবাজ সব পেশাতেই ছিল, আছে এবং থাকবে। তা বলে একটা গোটা পেশার সকলেই অলস, অনিচ্ছুক কর্মী হয়ে যান না। কিন্তু যা বলার, তা হল স্কুলের পঠনপাঠন নিয়ে শিক্ষকদের নিরুৎসাহ করার সবরকম চেষ্টা সরকারি তরফে করা হয়েছে। মন দিয়ে পড়াতে চান এমন অনেক শিক্ষকই সখেদে বলেন, সিলেবাস শেষ করানো অতিমারির আগেও রীতিমত কঠিন ছিল। কারণ তাঁদের অনেকখানি সময় চলে যায় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের জন্য ছেলেমেয়েদের তথ্যাবলি সংগ্রহ ও নথিবদ্ধ করতে, জিনিসপত্র বিলি করতে। স্কুলগুলো প্রায় রেশন দোকানের চেহারা নেয়, ক্লাস কাটছাঁট করতে হয়। তার উপর বর্তমান সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ছুটি কত বেড়েছে তা নিয়েও আলাদা গবেষণা হতে পারে। পুজোর ছুটি ফুরোতেই চায় না, গরমের ছুটি প্রায়শই নির্ধারিত দিনের আগেই শুরু হয়ে যায়, তারপর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আগে ছুটির তালিকার বেশিরভাগটা ঠিক করতেন স্কুল কর্তৃপক্ষ, এখন চলে অঘোষিত এক-রাজ্য-এক-ছুটি নীতি। ফলে দক্ষিণবঙ্গ গরমে পুড়লে শীতল উত্তরবঙ্গেও স্কুল বন্ধ থাকে। কোনও স্কুল কর্তৃপক্ষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকারি ছুটি অগ্রাহ্য করে পঠনপাঠন চালু রাখতে চাইলে শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়। এর উপর আছে শূন্য পদের বিপদ। বহু স্কুলে অশিক্ষক কর্মীদের পদ ফাঁকা পড়ে আছে। সে কাজও শিক্ষকদেরই করতে হয়। এতসব করে আর কতটুকু পড়ানো সম্ভব?

এসব অভিভাবকদেরও বিলক্ষণ চোখে পড়ে। ছেলেমেয়েকে সরকারি স্কুলমুখো না করার পিছনে এসব কারণও কাজ করে এবং সেজন্য তাঁদের দোষ দেওয়া চলে না। উপর্যুক্ত বিপত্তিগুলোর চেয়েও শিক্ষকদের কাজকর্মে বেশি প্রভাব ফেলছে শিক্ষকের অভাব। যেসব স্কুলে এখনও ছাত্রছাত্রীর অভাব নেই, সেখানেও শিক্ষকের অভাব প্রকট। স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের যে স্বচ্ছ ও নিয়মিত ব্যবস্থা তৃণমূল সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল তাকে লাটে তুলে দেওয়ার ফলে বহু স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। উপরন্তু ইচ্ছামত বদলির ব্যবস্থায় কোথাও একই বিষয়ের শিক্ষক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি, অথচ অন্য কোনও বিষয়ের একজন শিক্ষকও নেই।

অর্থাৎ শুধু যে রাস্তায় বসে থাকা (এবং মধ্যরাতে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া) হবু শিক্ষকরাই অবিচারের শিকার, তা নয়। যাঁরা স্কুলে পড়াচ্ছেন তাঁরাও ভাল নেই। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে সেইসব ছাত্রছাত্রীদের, যাদের বাবা-মা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্কুলের মাইনে জোগাতে পারেন না। অতিমারির সময়ে সরকার স্কুল খোলার নামই করছিল না, যেনতেনপ্রকারেণ বন্ধ রাখছিল দেখে অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন স্কুলগুলোকে লাটে তুলে দেওয়াই উদ্দেশ্য। সে কাজে অতিমারিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাঁদের আশঙ্কা যথার্থ। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, নিয়োগের পরীক্ষা নিয়ে বেলাগাম দুর্নীতি এবং চালু চাকরির পরীক্ষাটাকে অকেজো করে দেওয়া যে কেবল কর্মসংস্থান সংক্রান্ত ইস্যু নয়, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা লাটে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনারও অংশ সেকথা গত এগারো বছরে কারও মনে হয়নি। সেই ২০১৩ সালেই যখন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু পরিষ্কার বলেছিলেন, এসএসসি কি দুর্গাপুজো যে প্রতি বছর করতে হবে? একথা যে স্কুলশিক্ষার উপরে কুঠারাঘাত সেকথা রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীরা ছাড়া কেউ তখন বলেননি। পরবর্তীকালে যখন তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন এসএসসি, টেট ইত্যাদি পরীক্ষার মেধাতালিকা প্রকাশ করা হবে না, পাশ করলে প্রার্থীর কাছে এসএমএস যাবে কেবল, তখনও রাজ্যের লেখাপড়া জানা মানুষ কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হবে সরকারি উদ্যোগে অথচ তার মেধাতালিকা প্রকাশ করা হবে না— এ যে দুর্নীতির পথ প্রস্তুত করা, তা তখন কোন সাংবাদিক লিখেছিলেন? কোন শিক্ষাবিদ একটি উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছিলেন? আজকের দুর্নীতির নিন্দা করতে গিয়ে অনেকেই বাম আমলের নিয়োগ দুর্নীতি টেনে আনছেন। এতে হয়ত নিরপেক্ষতা প্রমাণ হয়, কিন্তু অস্বীকার করা হয় যে এসএসসি, টেট দুর্নীতির সঙ্গে প্রাক-এসএসসি যুগে টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার তুলনা বস্তুত আলুর সঙ্গে আপেলের তুলনা। কারণ সেখানে স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি হত, যা বন্ধ করতে সরকার কেন্দ্রীয় পরীক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিল। এখানে সরকার সচেতনভাবে একটি চালু ব্যবস্থা ধাপে ধাপে তুলে দিয়েছে যাতে কেন্দ্রীয়ভাবে দুর্নীতি করা সম্ভব হয়। যাঁরা বলেন পাঁচ টাকার দুর্নীতিও দুর্নীতি আর পাঁচ কোটি টাকার দুর্নীতিও দুর্নীতি, তাঁদের দেখলে সশরীরে ঈশ্বর দর্শনের মত অনুভূতি হতে পারে। কিন্তু তাতে একথা অপ্রমাণ হয় না যে তাঁরা যে কোনও কারণেই হোক স্থিতাবস্থার সমর্থক। পরিস্থিতির চাপে বর্তমান সরকারকে খানিকটা গাল দিচ্ছেন মাত্র। হয়ত কিছুটা বিবেকের দায়ে, কিছুটা নইলে লোকে খারাপ বলবে বলে।

আরও পড়ুন শিক্ষক দিবসের প্রশ্ন: শিক্ষকদের বাঁচাবে কে?

তৃণমূল সরকারের বরাবরের সমর্থক কেউ কেউ যেমন রাতের অন্ধকারে মহিলাসুদ্ধ আন্দোলনকারীদের পুলিসের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার দৃশ্যে আর স্থির থাকতে পারেননি। বলেছেন বলপ্রয়োগ কাম্য নয়, আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা মিটিয়ে ফেলা হোক। এসব বিবৃতি দিলে হয়ত বিবেকের ডাকে সাড়া দেওয়া হয় বা সাধারণ মানুষের কাছে নিজের ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল করা যায়। কিন্তু এগুলির বক্তব্য দুর্বোধ্য। ভাবখানা এমন যেন সরকার বাহাদুর এ দুর্নীতিতে যুক্তই নন। তৃতীয় পক্ষ টাকা নিয়ে চাকরি দিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করেছে। এখন সরকার এদের অভিভাবকের আসনে বসে বুঝিয়েসুঝিয়ে মিটিয়ে দিলেই সব মিটে যায়। যেন সরকার মেধাতালিকা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেয়নি, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এই মামলায় হাজতবাস করছেন না, যেন আদালত কান ধরার আগে সরকার নিজেই দোষীদের খুঁজে খুঁজে শাস্তি দেওয়া শুরু করেছিল।

হিন্দিভাষীরা বলে থাকেন “দাল মে কুছ কালা নেহি হ্যায়, পুরা দাল হি কালা হ্যায়।” পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির ব্যাপারটাও যে তাই তা এখনও অনেকেই বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না। কারণ এই সত্য তাঁদের রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। কিন্তু চুপ করে থাকতেও পারছেন না, কারণ যে ছেলেমেয়েগুলোকে লাঞ্ছিত হতে দেখা গেছে তারা মোটের উপর নিজের শ্রেণির। এরা মইদুল ইসলাম মিদ্যার মত বিরোধী দলের মিছিলে আসা বা আনিস খানের মত দলীয় রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া গেঁয়ো মুসলমান নয় যে তাদের মৃত্যুতে চোখ ফিরিয়ে থাকা যাবে। পশ্চিমবঙ্গের কাগজ, টিভি চ্যানেলের মালিক, সম্পাদক, উত্তর সম্পাদকীয় লেখক, বিশেষজ্ঞ ও বিখ্যাতদের ছেলেপুলেরা প্রায় কেউই সরকারি স্কুলে পড়ে না। ফলে দিব্যি ওসব স্কুলের রোগবালাইকে অগ্রাহ্য করে থাকা গিয়েছিল। কিন্তু এখন যারা মার খাচ্ছে তাদের মুখের ভাষা শুনে, বেশভূষা দেখে পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ ভেবে আর থাকা যাচ্ছে না। এতদিনে সত্যিই গা শিরশির করছে— এরপর কোনও ইস্যুতে যদি আমাদের ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গেই সরকার এরকম ব্যবহার করে! এতদিন যারা মার খেয়েছে, নানাভাবে অত্যাচারিত হয়েছে তাদের অবস্থা এবং অবস্থানকে নানা যুক্তিতে আমল না দেওয়া এই মানুষদের জন্যই বোধহয় কবি লিখেছিলেন “যাদের করেছ অপমান/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।”

চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন হয়ত শেষ অবধি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে সরকারি প্রতাপে বা কৌশলে, হয়ত সব যেমন চলছিল তেমনই চলবে। কিন্তু তারা অন্তত সাতে পাঁচে না থাকা বাঙালির হাড়ে ঠকঠকানি ধরানোর কাজটুকু করতে পেরেছে বলে ধন্যবাদার্হ।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

মমতা ও পশ্চিমবঙ্গ: মাঝির হাতেই নৌকাডুবি?

মঙ্গলবার দুপুরে যখন সরকার নির্ধারিত স্থান উপচে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে গিয়ে পড়েছে সিপিএমের ছাত্র ও যুব সংগঠনের মিটিং, সেইসময় একটি জনপ্রিয় বাংলা খবরের চ্যানেল সে মিটিং না দেখিয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্যের গ্রেপ্তারের খবর দেখাচ্ছিল। অ্যাঙ্কর, নিউজরুমে দাঁড়ানো এক সাংবাদিক এবং আরও এক প্রতিবেদকের মধ্যে এসএসসি দুর্নীতির চর্বিতচর্বণ চলছিল। অনিবার্যভাবে এসে পড়ছিল অর্পিতা-পার্থ সম্পর্কের আলোচনা। তার খানিকক্ষণ আগেই ওই চ্যানেলে ফ্লোরা সাইনি বলে কোনো এক মডেলের চেহারা ফটোশুটের আগে কীভাবে বদলে যায় তা-ও দেখানো হচ্ছিল বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। কোন চ্যানেলে ‘ইনসাফ’ আন্দোলন কীভাবে দেখানো হচ্ছে দেখতে গিয়ে ওই চ্যানেলটিতে গিয়েই বারবার হতাশ হতে হচ্ছিল। এমনকি মাঝে মাঝে প্রধান খবর বলে পরপর যে খবরগুলোর ঝলক দেখানো হয়, সেখানেও ইনসাফ সভার সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হচ্ছিল, সাক্ষাৎকারে ধর্মাবতার অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কেমন তিনমাস জেলের ভয় দেখিয়েছেন অভিষেক ব্যানার্জিকে।

হঠাৎই সেই চ্যানেলেও লাইভ হয়ে গেল সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তৃতা। সমস্তটাই লাইভ হল। শুধু ওই একটি চ্যানেল নয়, কোনো চ্যানেলেই কমিউনিস্টরা আবার সেকালের মত কলকাতাকে অচল করে দিয়েছে, নৈরাজ্যের দিন ফিরিয়ে আনছে, পুলিসের কথা না শুনে ঘোর অন্যায় করছে – এরকম অভিযোগ উঠতে দেখলাম না। ওই জমায়েতের জন্য কোন রাস্তায় কত বড় যানজট তৈরি হয়েছে, কার প্লেন মিস হয়ে যাচ্ছে, কে ইন্টারভিউতে পৌঁছতে পারল না – এই নিয়ে অশ্রু বিসর্জনও চোখে পড়ল না। বরং বিজেপি মনোনীত প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদের চ্যানেলের স্টুডিও যেভাবে সাজানো হয়েছিল এবং অ্যাঙ্কররা যেরকম উদ্দীপ্ত ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল গণশক্তি নতুন চ্যানেল খুলেছে। কলকাতার যে খবরের কাগজটি মিটিং মিছিলে সাধারণ নাগরিকের অসুবিধা নিয়ে সাধারণত সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকে, তাদের বুধবার সকালের সংস্করণেও ইনসাফ সভার প্রতিবেদনে ওসব নিয়ে একটি শব্দ নেই।

কলকাতার সংবাদমাধ্যম দারুণ বিরোধী-বান্ধব – এমন অভিযোগ মমতা ব্যানার্জিও করবেন না। তাহলে এ হেন আচরণের কারণ কী? একটা কারণ নির্ঘাত প্রস্তুতির অভাব। জনতা যে আসলে চিড়িয়াখানা দেখতে এসেছিল, সে স্টোরির প্রস্তুতি থাকে ব্রিগেডে মিটিং হলে। যানজট ইত্যাদিও খেয়াল রাখা হয় সেইসব দিনে। কিন্তু ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে হওয়ার কথা যে জমায়েত, তা যে গোটা ধর্মতলা দখল করে নেবে তা বোধহয় কোনো প্রথিতযশা চ্যানেল সম্পাদক আন্দাজ করতে পারেননি। কিন্তু প্রস্তুতি না থাকলে খুঁত ধরতে অসুবিধা হতে পারে, প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে হবে কেন? মাসখানেক আগে ওই ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে থেকেই চাকরির দাবিতে ৫০০ দিন ধরে মেয়ো রোডে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের কাছ পর্যন্ত একটি নাগরিক মিছিলের ডাক দিয়েছিল বামেরা। লেখার প্রয়োজনে এবং কিছুটা নিজের প্রতিবাদ জানানোর তাগিদে সেদিন গিয়েছিলাম। সেই মিছিলে নেতারা এবং বিখ্যাতরা ছিলেন, কিন্তু প্রাণ ছিল না। লাভ বলতে এক প্রাক্তন সহকর্মীর সঙ্গে অনেকদিন পরে সাক্ষাৎ। সে গিয়েছিল নিজের কাগজ থেকে মিছিল কভার করতে। বলেছিল, কলকাতার সংবাদমাধ্যম নাকি এখন বামেদের প্রতি কিছুটা নরম হয়েছে। চাইছে বামেদের হাল ফিরুক। সেদিন কথাটা খুব একটা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু মঙ্গলবারের পর বিশ্বাস না করে উপায় নেই।

কথা হল, সংবাদমাধ্যমের নরম হওয়ার প্রয়োজন কী? বিজ্ঞাপনের রাশ তো এখনো নবান্নের হাতেই। সিবিআই আর ইডি যতই জ্বালাতন করুক, সাংবাদিকদের প্রয়োজনে টাইট দেওয়ার জন্য কেস দিতে রাজ্য পুলিস তো আছেই। আসলে হাজার হোক, চ্যানেলের টিআরপি চাই। কাগজেরও পাঠকের মর্জি কিছুটা খেয়াল রাখতেই হয়। বহু দর্শক/পাঠকেরই মর্জি যে গত কয়েক মাসে সরকারবিরোধী হয়ে উঠেছে তা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে চড়া, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাজারে আলু পটল ঝিঙে মাছ মাংস কিনতে যাওয়া সম্পাদকরাও দিব্যি টের পাচ্ছেন।

বিধানসভার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যে বিশ্লেষণ এ রাজ্যে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল, তা হল কোনো সরকারবিরোধী হাওয়া আদপেই ছিল না। সবটাই বিরোধীদের কল্পনা। বিজেপির ভোট ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচন থেকে এক লাফে ২৮.১৩% বাড়ল। মুখ্যমন্ত্রী নিজে হেরে গেছেন কিন্তু তাঁর পার্টি জিতেছে – এমন ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। ঠিক তাই ঘটল, অথচ প্রাজ্ঞ সম্পাদক এবং তৃণমূল সমর্থকরা ঘোষণা করলেন সরকারের বিরুদ্ধে কোনো হাওয়া ছিল না। কেউ কেউ বললেন মমতা হেরেছেন শুভেন্দু অধিকারীর ধর্মীয় মেরুকরণমূলক প্রচারের কারণে, তার সঙ্গে সরকারের প্রতি অসন্তোষের কোনো সম্পর্ক নেই। আশ্চর্য! জ্যোতি বসুর পরে বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা নাকি স্রেফ ধর্মীয় মেরুকরণের কারণে হেরে গেছেন। এসব বলে আসলে যা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে, তা হল সরকারবিরোধী হাওয়া টেনে নিয়েছিল বিজেপি। সাধারণ ভোটার তৃণমূল নেতা, মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়ে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট ছিলেন। বিজেপির পরাজিত প্রার্থীদের তালিকায় তৃণমূলাগতদের বিরাট উপস্থিতিই তার প্রমাণ। কিন্তু মমতার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল অটুট। দলীয় রাজনীতির বাইরের মানুষের সাথে কথা বললেই শোনা যেত, তাঁরা মনে করেন অমুক নেতাটা বদমাইশ কিন্তু দিদি ভাল। তমুক মন্ত্রী চোর কিন্তু দিদি ভাল। অনেকের মতেই ভাইপোও সুবিধের লোক নয়, কিন্তু মমতা ভাল। তাঁর দুর্ভাগ্য, এইসব আজেবাজে লোককে নিয়ে চলতে হয়। ফলে দুর্নীতিগ্রস্তরা “দলে থেকে কাজ করতে পারছি না” বলে বিজেপিতে চলে যাওয়ায় মমতার জনপ্রিয়তা বরং বেড়েই গিয়েছিল। তিনি নন্দীগ্রামে হারলেন স্থানীয় বটগাছ শুভেন্দুর কাছে, অন্য কেউ প্রার্থী হলেই হয়ত জিতে জেতেন। কিন্তু এ কথা তো সত্যি, যে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকেই মমতা আসলে ২৯৪ আসনেই প্রার্থী। ভোটাররা যাদের অপছন্দ করছিলেন তারা দল ছেড়ে চলে যাওয়ায় প্রসন্ন চিত্তে আবার মমতাকেই ভোট দিয়েছিলেন। এই গগনচুম্বী ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও কিন্তু আজ টলমল করছে।

ইনসাফ সভায় লোক টানতে মীনাক্ষী মুখার্জি, কলতান দাশগুপ্তরা স্থানীয় স্তরে অসংখ্য ছোট ছোট সভা করেছেন বলে জানা যাচ্ছে। অর্থাৎ সংগঠনের একেবারে নিচের স্তর থেকে ইমারত গড়ে তোলার চেষ্টা। এ মাসে সিপিএম রাজ্যের প্রত্যেকটা পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন দেওয়ার কর্মসূচিও নিয়েছে। সেই ডেপুটেশনের প্রস্তুতি হিসাবে আবার প্রত্যেক পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যেক পাড়ায় স্ট্রিট কর্নার হচ্ছে। এর আগে হয়েছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনসংযোগ অভিযান। এই সক্রিয়তা শুধু যে গত ১১ বছরে দেখা যায়নি তা-ই নয়, শ্বেতশুভ্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে জনসংযোগে এমনই ভাঁটা পড়েছিল যে লেখাপড়া জানা শহুরে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ছাড়া অধিকাংশ মানুষেরই মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলকে দূর গ্রহের বাসিন্দা বলে মনে হত। তার বিপরীতে মমতা কাছের লোক। যে ভাষা বিভ্রাটের জন্য মমতা নাক উঁচু সিপিএম কর্মী সমর্থকদের হাসির পাত্র, সে ভাষা একজন রিকশাচালক বা পরিচারিকাকে মনে করাত তিনি কাছের মানুষ। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে মমতার দেবীপ্রতিম জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল এভাবেই। সেই জনপ্রিয়তা তাঁর দলকে নিঃসন্দেহে ২০২১ উতরে দিতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু ইদানীং সব ধরনের মানুষের বিশ্বাসেই চিড় ধরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কেন?

একসময় হিট বাংলা ছবির রিমেক হত বলিউডে এবং সে ছবিও হিট হত। সেভাবেই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের নিশি পদ্ম শক্তি সামন্তের হাতে হয়েছিল অমর প্রেম। সে ছবির গান তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। গীতিকার আনন্দ বক্সী একটি গানে তুলেছিলেন মোক্ষম প্রশ্ন – মাঝনদীতে নৌকো দুললে তো মাঝি সামলে-সুমলে পারে নৌকো ভেড়ায়, কিন্তু মাঝি নিজেই নৌকো ডুবিয়ে দেবে ঠিক করলে সে নৌকোকে বাঁচাবে কে (মজধার মে নইয়া ডোলে/তো মাঝি পার লগায়ে।/মাঝি জো নাও ডুবোয়ে/উসে কৌন বচায়ে)? অতি সাম্প্রতিককালে সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এই জাতীয় সংশয় তৈরি হয়েছে মানুষের মনে। এসএসসি দুর্নীতি অবধি তবু ঠিক ছিল। মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ সমর্থন করতে যাননি, বরং ঝটপট মন্ত্রিসভা থেকে পার্থকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। ফলে ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি দিদি সমর্থন করেন – এমন ভাবার অবকাশ তৈরি হয়নি। কিন্তু অনুব্রত মণ্ডলের বেলায় দিদির একেবারে অন্য রূপ। কেষ্টবাবুর ঘরে নোটের পাহাড় দেখা যায়নি বটে, কিন্তু রোজই তাঁর বিপুল পরিমাণ ফিক্সড ডিপোজিট, জমিজমা, সাদা-কালো ব্যবসার কাহিনি প্রকাশিত হচ্ছে। দিদি কিন্তু বরাভয় নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন যেদিন ফিরে আসবে, সেদিন বীরের সম্মান দিয়ে নিয়ে আসতে হবে। যে মানুষ নিশ্চিন্তে ছিলেন এই ভেবে, যে আশেপাশে চোর ডাকাত থাকলেও নৌকার হাল দিদির হাতে, তিনি এরপর কী ভাবছেন কে জানে? একথা ঠিক যে নারদ কেলেঙ্কারির অভিযুক্তদেরও মমতা একইভাবে সমর্থন করেছিলেন, তাতে জনপ্রিয়তা কমেনি। কিন্তু মানুষের ধৈর্যেরও সীমা থাকে, আর সে সীমা কখন লঙ্ঘিত হয় কেউ জানে না। হয়ত বিরোধীদের সক্রিয়তার মাত্রাও সেই সীমা নিয়ন্ত্রণ করে। নারদ কেলেঙ্কারির পর পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীরা সাংবাদিক সম্মেলন ছাড়া আর কী করেছিলেন মনে করতে বেশ কষ্ট হবে।

কারণ যা-ই থাক, গত কয়েক মাসে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে। দোকানে বাজারে মানুষ মমতার সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। একজন রিকশাচালক এমনকি তাঁর হাওয়াই চটি, নীল পাড় সাদা শাড়িতেও দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন। সেসবের দাম সম্পর্কে এমন সব কথা উড়ে বেড়াচ্ছে যেগুলো নিঃসন্দেহে হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির অবদান। নতুনত্ব এইখানে, যে হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি এর আগে মমতাকে মমতাজ বলত, আরও নানা অশ্লীল ব্যক্তিগত আক্রমণ করত। কিন্তু মমতা দুর্নীতিগ্রস্ত বললে ভাইরাল হওয়া যাবে না – ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকদের কাছে বোধহয় এরকমই তথ্য ছিল। সে তথ্য কি বদলে গেল?

একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর। রাজ্যে চাকরি-বাকরি নেই; চাকরি সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির তদন্তেই সিবিআই, ইডির রমরমা। ওদিকে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জড়িয়ে পড়লেন ভুয়ো চাকরি বিলোবার কাণ্ডে। ঘটা করে সভা ডেকে চাকরির নিয়োগপত্র বলে যা বিলোলেন তা প্রথমত বেসরকারি চাকরির। তারপর জানা গেল ওগুলো সঠিক অর্থে চাকরিও নয়, শিক্ষানবিশির সুযোগ মাত্র। পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থানের যা অবস্থা তাতে অসহায় যুবকরা ওই মোটা অফারই মাথায় তুলে নিতেন নিশ্চয়ই, কিন্তু অতঃপর ঝুলি থেকে বেরোল প্রফেসর শঙ্কুর ‘মরুরহস্য’ গল্পের বিজ্ঞানী ডিমেট্রিয়াসের পোষ্যের আকারের একটি বেড়াল। যে সংস্থার অফার লেটার দেওয়া হয়েছে সেই সংস্থা আদৌ ওগুলি ইস্যু করেনি। চিঠিতে যাঁর সই রয়েছে সেই বেদপ্রকাশ সিং সটান বলে দিলেন চিঠিগুলি ভুয়ো। ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম গান্ধীজির তিন বাঁদর হয়ে বসেছিল। তারপর থেকে মন্ত্রী, আমলা যাকেই এ নিয়ে প্রশ্ন করেছে তিনিই বলেছেন তিনি কিছু জানেন না। জানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ফলে মাঝির নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার ভয় ঢুকে পড়ল এখানেও।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এমন মানুষও আছেন যাঁরা তৃণমূলে দুর্নীতি আছে, শঠতা আছে জেনে, তৃণমূল নেতারা সন্ত্রাস চালান মেনে, মমতাকে ভক্তি না করেও তাঁর মুখ চেয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন। কারণ তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করেন। অধুনা তাঁরাও মাঝির হাতে নৌকাডুবির ভয় পাচ্ছেন, পেতে বাধ্য। গত বছর এ রাজ্যের নির্বাচনী প্রচার রাজ্য সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে হয়নি বলা যায়। যদি বলা হয় ভোটটাকে করে তোলা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে গণভোট, তাহলে ভুল হবে না। সেই ভোটে জিতলেন মমতা। তারপর থেকে গত এক বছরে তিনি কী কী করেছেন? বিজেপির দুই নেতাকে দলে নিয়ে একজনকে সাংসদ, আরেকজনকে বিধায়ক তথা মন্ত্রী করেছেন। আরেকজন প্রবীণ বিজেপি নেতাকে দলে নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁকে প্রার্থী করে সারা ভারতের বিরোধীদের সমর্থন জোগাড় করেছেন। তারপর শেষ মুহূর্তে বলেছেন আগে জানলে বিজেপি মনোনীত প্রার্থীকেই সমর্থন করতেন। তারপর উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধীদের সম্মিলিতভাবে মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন করেননি। সেখানেই শেষ নয়। কদিন আগে বলেছেন বিজেপি খারাপ, আরএসএস খারাপ নয়। শেষমেশ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভাল, অন্য বিজেপি নেতারা ইডি, সিবিআইকে কাজে লাগাচ্ছেন। ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তো মাঝির হাতে নৌকাডুবির ভয় করবেনই।

আরও পড়ুন রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

এমন হতেই পারে যে এরপরেও মমতা তথা তাঁর দল হইহই করে নির্বাচনে জিতবে। তবে মনে রাখা ভাল, রাজনীতিতে অমর প্রেম বলে কিছু হয় না।

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত

মুখ্যমন্ত্রীর আরএসএস: বিশ্বাসে মিলায় বস্তু

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেবল গুণী মানুষ নন, তাঁর প্রতিভা বহুমুখী। তিনি সাহিত্য রচনা করেন, ছবি আঁকেন, গান লেখেন। তার উপর রাজ্যের প্রশাসন চালাতে হয়। একজন মানুষকে এত কাজ করতে হলে কাগজ পড়ার সময়ের অভাব ঘটা খুবই স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই প্রতিদিন কাগজ পড়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী পান না। পেলে চোখে পড়ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ কাগজের একটা খবর, যার শিরোনাম ‘RSS yet to clear air on bombing claim affidavit’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের মিডিয়া বিভাগের প্রধান পবন খেরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) এক প্রাক্তন প্রচারকের মহারাষ্ট্রের নানদেড় জেলা ও সেশনস আদালতে জমা দেওয়া হলফনামা প্রকাশ্যে এনেছেন। সেই হলফনামায় যশবন্ত শিন্ডে নামক ওই লোকটি দাবি করেছে, সংঘ পরিবারের সদস্য সংগঠনগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সংবাদমাধ্যমের একাংশ এবং পুলিস প্রশাসনের সহযোগিতায় তার দোষ মুসলমান সম্প্রদায়ের ঘাড়ে চাপিয়েছে। ফলে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি লাভবান হয়েছে।

খবরটা মুখ্যমন্ত্রীর চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকতেই পারে, কারণ এ নিয়ে কোনো চ্যানেলে কোনো বিতর্কসভা বসেনি। কলকাতার অন্যান্য তথাকথিত উদার খবরের কাগজগুলোতেও আতসকাচ দিয়ে খুঁজে দেখতে হবে এই খবর। তাছাড়া কংগ্রেস তো বানিয়েও বলতে পারে। কারণ তারা তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপির প্রধান বিরোধী হয়ে উঠতে দিতে চায় না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর শক্তিশালী সোশাল মিডিয়া টিম আছে। টুইটারে তাঁর সাত মিলিয়ন ফলোয়ার, ফেসবুকে ৪.৯ মিলিয়ন। সেই সোশাল মিডিয়া টিমের সাহায্য নিলেই মুখ্যমন্ত্রী জানতে পারবেন যে ওই মর্মে হলফনামা সত্যিই ফাইল করা হয়েছে। চাইলে স্বয়ং যশবন্তের মুখ থেকেই হলফনামায় লিখিত অভিযোগগুলো সংক্ষেপে শুনে নিতেও পারবেন। মারাঠি যশবন্তের ভিডিও ইংরেজি সাবটাইটেল সমেত সোশাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

যশবন্তের হলফনামার কথা প্রকাশ্যে এল বৃহস্পতিবার, কলকাতার কাগজের প্রথম পাতায় সে খবর বেরোল শুক্রবার সকালে। সেদিনই সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বললেন “আরএসএস এত খারাপ ছিল না, এবং এত খারাপ বলে আমি বিশ্বাস করি না।” মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই খবরটা জানতে পারেননি বলেই ওরকম বলেছেন। স্বীকার্য যে যশবন্তের কথাগুলো অভিযোগ মাত্র। কিন্তু যে সংগঠনের একদা প্রচারকরা এই মুহূর্তে দেশের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বহু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী – তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ যে মারাত্মক, সে কথা না বোঝার মত রাজনীতিবিদ মমতা ব্যানার্জি নন। তাছাড়া তিনদিন হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত আরএসএস যশবন্তকে মিথ্যাবাদী বলে কোনো বিবৃতি দেয়নি। অবশ্য জবাবদিহি না চাইলে বিবৃতি দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ২০০৬ সালের নানদেড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে সরকারি সাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হতে চেয়ে আবেদন করেছিল যশবন্ত। আদালত সবেমাত্র সেই আবেদন গ্রহণ করেছে, আরএসএসকে জবাবদিহি করতে তো ডাকেনি। সাংবাদিকদেরই বা ঘাড়ে কটা মাথা, যে এ নিয়ে মোহন ভাগবতকে প্রশ্ন করবে? অতএব আরএসএসের বয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা বলে ঘোষণা করতে। কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। মুখ্যমন্ত্রী তো বিশ্বাসই করেন না আরএসএস খারাপ। ফলে যতক্ষণ তারা নিজেরা না বলছে “হ্যাঁ, আমরা খারাপ”, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চিন্ত। কিন্তু খটকা অন্যত্র।

“এত খারাপ ছিল না”। এত খারাপ মানে কত খারাপ? তার মানে মুখ্যমন্ত্রী জানেন যে আরএসএস একটু একটু খারাপ? সেই পরিমাণটা কি তাঁর পক্ষে সুবিধাজনক? খারাপ ছিল না মানেই বা কী? আগে যতটুকু খারাপ ছিল তাতে তাঁর আপত্তি ছিল না, এখন বেশি খারাপ হয়ে গেছে – এ কথাই কি বলতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী? তাঁর কাছে কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ তা অবশ্য আমাদের জানা নেই। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা কি খারাপ? সে হত্যায় আরএসএস যোগ প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ হয়নি বটে, তবে সেই ঘটনার পরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেছিলেন, আরএসএস নেতাদের ভাষণগুলো যে বিষ ছড়িয়েছে তারই পরিণতি গান্ধীহত্যা। তাই ভারত সরকার আরএসএসকে নিষিদ্ধ করে। কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন? সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। জওহরলাল নেহরুর বদলে যিনি প্রধানমন্ত্রী হলে ভারত সোনার দেশ হত বলে আরএসএস এখন দিনরাত ঘোষণা করে। মুখ্যমন্ত্রী নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই ধরে নিচ্ছি অতকাল আগের ব্যাপার তাঁর মনে নেই। তাই তার ভালমন্দ ভেবে দেখেননি। তবে যেহেতু তিনি একজন সাংবিধানিক পদাধিকারী এবং নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করেন, সেহেতু ধরে নিতে দোষ নেই যে যশবন্ত শিন্ডে তার হলফনামায় যে ধরনের কার্যকলাপের কথা লিখেছে সেগুলো আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর চোখে খারাপই। কারণ কাজগুলো বেআইনি এবং সাম্প্রদায়িক।

এখন কথা হল, যশবন্ত যে অভিযোগ করেছে আরএসএসের বিরুদ্ধে, সে অভিযোগও কিন্তু এই প্রথম উঠল তা নয়। মুখ্যমন্ত্রী কাগজ পড়ারই সময় পান না যখন, বই পড়ার সুযোগ না পাওয়ারই কথা। তবে তাঁর তো পড়ুয়া পারিষদের অভাব নেই। তাঁরা কেউ কেউ নির্ঘাত মহারাষ্ট্র পুলিসের প্রাক্তন ইন্সপেক্টর জেনারেল এস এম মুশরিফের লেখাপত্র পড়েছেন। তাঁর লেখা আরএসএস: দেশ কা সবসে বড়া আতঙ্কবাদী সংগঠন বইতে ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মোট ১৮টা বোমা বিস্ফোরণে আরএসএস, অভিনব ভারত, জয় বন্দেমাতরম, বজরং দল এবং সনাতন সংস্থা – এই পাঁচটা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে দায়ী করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পার্ষদরা কেন যে এসব কথা তাঁকে জানাননি! জানলে নিশ্চয়ই আরএসএস খারাপ “ছিল না” – একথা মুখ্যমন্ত্রী অতটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলতেন না। অবশ্য মুশরিফ যা লিখেছেন তার সমস্তই তো স্রেফ অভিযোগ। মালেগাঁও বিস্ফোরণের প্রধান অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞা যেভাবে ছাড়া পেয়ে সাংসদ হয়ে গেছেন, তাতে ওসব অভিযোগকে আর আমল দেওয়া চলে কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে আরএসএসের উপর অত্যন্ত জোরালো বিশ্বাস না থাকলে এসব জেনে সংঘ পরিবারের সদস্য নয় এমন এক রাজনৈতিক দলের সর্বময় নেত্রীর কিছুটা সন্দিহান হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিজের বিশ্বাসে অটল।

রাজনীতিতে দুজন ব্যক্তি, দুটো সংগঠন বা একজন ব্যক্তির সঙ্গে একটা সংগঠনের সম্পর্ক চোখ বন্ধ করে ভরসা করার মত পর্যায়ে পৌঁছনো চাট্টিখানি কথা নয়। বিপদের সময়ে পাশে দাঁড়ানোর ইতিহাস না থাকলে তেমনটা হওয়া শক্ত। সেদিক থেকে মমতার আরএসএসের প্রতি এই বিশ্বাস বুঝতে অসুবিধা হয় না। আজকের মুখ্যমন্ত্রী গত শতকের শেষ দশকে যখন ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন এককালের স্বয়ংসেবক অটলবিহারী বাজপেয়ী আর লালকৃষ্ণ আদবানির স্নেহ না পেলে মমতার পক্ষে আস্ত একখানা রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা সম্ভব হত কি? হলেও সদ্যোজাত দলটাই মধ্যগগনে থাকা সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বিরোধী হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে – এ বিশ্বাস কংগ্রেসের ভোটার তথা কর্মীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা যেত কি? মাত্র আটজন সাংসদ যে দলের, সেই দলের নেত্রীকে রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের প্রভাবিত করার মহার্ঘ সুযোগ দিয়েছিল বিজেপি। শুধু কি তাই? তেহেলকা কাণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পরেই সততার প্রতীক মমতা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এনডিএ ত্যাগ করেন। তা সত্ত্বেও ২০০৩ সালে তাঁকে দপ্তরহীন মন্ত্রী করে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। আরএসএস আর বিজেপি আলাদা – এই তত্ত্বে এখনো বিশ্বাস করেন যাঁরা, তাঁদের কথা আলাদা। বাকিরা নিশ্চয়ই মানবেন, এভাবে পাশে থাকার পরেও যদি মমতা আরএসএসকে বিশ্বাস না করতেন তাহলে ভারি অন্যায় হত।

আসলে মমতার আরএসএসে বিশ্বাস ততটা অসুবিধাজনক নয়। তাঁর বারংবার আরএসএস প্রীতি ঘোষণা সত্ত্বেও দেশসুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কেষ্টবিষ্টুদের মমতায় বিশ্বাস বরং বৃহত্তর বিপদের কারণ। গত বছর বিধানসভা নির্বাচনে যখন বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকানোই মূল এজেন্ডা হয়ে দাঁড়াল, তখন বামপন্থীদের মধ্যে লেগে গেল প্রবল ঝগড়া। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম দলগুলো বলতে শুরু করল বিজেপি আর তৃণমূল অভিন্ন, তাই তৃণমূলকে ভোট দেওয়া আর বিজেপিকে ভোট দেওয়া একই কথা। উঠে এল একটা নতুন শব্দ – বিজেমূল। অন্যদিকে নকশালপন্থীরা বলতে লাগল, যেখানে যে প্রার্থী বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী তাকে ভোট দিতে। বিজেমূল তত্ত্বের প্রমাণ হিসাবে সিপিএম “দলে থেকে কাজ করতে পারছি না” বলে লাইন দিয়ে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে চলে যাওয়া শীর্ষস্থানীয় নেতা, মন্ত্রীদের দেখাতে লাগল। আর যত না তৃণমূল, তার চেয়েও বেশি করে নকশালরা তার জবাবে তালিকা দিতে থাকল, কোন ব্লক স্তরের সিপিএম নেতা বিজেপিতে গেছে, কোন জেলা স্তরের নেত্রী বিজেপিতে যোগ দিলেন। অর্থাৎ দুপক্ষের কেউই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি কী, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে কেন আছে বা না থাকলে কেন নেই – সে আলোচনায় গেল না। অথচ ঠিক তখনই ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভে বসে লাইভ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন “আমি সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়ছি না। ওরা তো নির্বাচনে লড়ে না। ওরা বিজেপিকে সমর্থন করে। আমি লড়ছি বিজেপির সঙ্গে।” এই নেত্রীর দল জয়যুক্ত হল, একমাত্র বিরোধী দল হিসাবে উঠে এল বিজেপি। অর্থাৎ ঘোষিতভাবে আরএসএসের বন্ধু দুটো দলের হাতে চলে গেল বাংলার আইনসভা। অথচ পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিমানরা উল্লসিত হয়ে ঘোষণা করলেন, বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য জিতে গেল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ জিতে গেলেন, ইত্যাদি।

আরও মজার কথা, নির্বাচনে গোল্লা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিপিএমও পরিত্যাগ করল বিজেমূল তত্ত্ব। আরও এক ধাপ এগিয়ে এ বছর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেশের একমাত্র যে নেতা সর্বদা নাম করে আরএসএসকে আক্রমণ করেন, সেই রাহুল গান্ধীর দল কংগ্রেস থেকে শুরু করে সিপিএম, লিবারেশন সমেত সমস্ত বাম দল সমর্থন করে বসল মমতার পছন্দের প্রার্থীকে। সে আরেক যশবন্ত – বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছেন। এ থেকে যা প্রমাণিত হয় তা হল, মমতার মত আরএসএস-বান্ধব নয় যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো, তারাও ব্যাপারটাকে নির্বাচনী লড়াইয়ের বেশি কিছু ভাবে না।

আরএসএসের কাছে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলা মতাদর্শগত মরণপণ লড়াই। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে তারা সাংবিধানিক, অসাংবিধানিক – সবরকম পথই নিতে রাজি। প্রয়োজনে আদবানির মত আগুনে নেতাকে বঞ্চিত করে বাজপেয়ীর মত নরমপন্থীকে প্রধানমন্ত্রী করতে রাজি ছিল। জমি শক্ত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর মত কড়া হিন্দুত্ববাদীকে নেতা করেছে, ভবিষ্যতে তাঁকেও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে আরও গোঁড়া আদিত্যনাথকে সর্বোচ্চ নেতার আসনে বসাতে পারে। বিরোধীরা ওই বিস্তারে ভেবেই উঠতে পারেনি এখনো। এমনকি তথাকথিত কমিউনিস্ট দলগুলোও কেবল স্ট্র্যাটেজি সন্ধানে ব্যস্ত। কোথায় কাকে সমর্থন করলে বা কার সাথে নির্বাচনী জোট গড়লে বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকানো যাবে – এটুকুই তাদের চিন্তার গণ্ডি। সে কারণেই বিজেমূল শব্দটা নির্বাচনের আগে ভেসে ওঠে, পরাজয়ের পর মিলিয়ে যায়। যদি সিপিএমের পক্ষ থেকে সংঘমূল কথাটা বলা হত এবং শূন্য হয়ে যাওয়ার পরেও বলে যাওয়া হত, তাহলে জনমানসে সত্যি সত্যি প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হতে পারত। হিন্দুরাষ্ট্র কী, তা হওয়া আটকানো কেন দরকার, আটকানোর ক্ষেত্রে মমতাকে সত্যিই প্রয়োজন, নাকি তিনি হিন্দুত্বের ট্রোজান ঘোড়া – শতকরা ৮০-৯০ জন মানুষ এই মুহূর্তে এসব নিয়ে ভাবছেন না (সোশাল মিডিয়া দেখে যা-ই মনে হোক)। সংঘ পরিবারকে সরাসরি রাজনৈতিক ভাষণে, কর্মসূচিতে আক্রমণ করা হলে ভাবতে বাধ্য হতেন।

বিহারে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার সুযোগ আসা মাত্রই সমস্ত বাম দল একজোট হয়ে নীতীশকুমারকে সমর্থন করেছে। কেবল লিবারেশন নয়, সিপিএমও। সে জোটে কংগ্রেসও আছে। অথচ নীতীশও মমতার মতই বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছেন। শুধু তা-ই নয়, মমতার বিজেপির সাথে শেষ জোট ছিল ২০০৬ সালে। নীতীশ কিন্তু ২০১৬ বিধানসভা ভোটে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে লড়ে জিতেও বিশ্বাসঘাতকতা করে বিজেপির কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। কেন নীতীশ আরএসএস-বিরোধী বাম দল এবং কংগ্রেসের কাছে গ্রহণযোগ্য আর কেন মমতা নন, তা নিয়ে কোনো আলোচনাই শুনলাম না আমরা। আলোচনাটা হল না সম্ভবত এইজন্যে, যে বামেরা বা কংগ্রেস নিজেরাই ওসব নিয়ে ভাবে না। বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে পারলেই খুশি, শেষমেশ আরএসএসের প্রকল্পই সফল হয়ে যাবে কিনা তা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। অথবা ‘যখন হবে তখন দেখা যাবে’ নীতি নিয়ে চলছে।

আসলে কিন্তু মমতায় আর নীতীশে তফাত বড় কম নয়। নীতীশ সুযোগসন্ধানী, ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ। তারই অনিবার্য ফল হিসাবে ভূতপূর্ব জনতা দলের সঙ্গে, একদা সতীর্থ লালুপ্রসাদের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হয়েছিল। কিন্তু তাঁর রাজনীতির সূতিকাগার হল সমাজবাদী রাজনীতি, নিম্নবর্গীয় মানুষের রাজনীতি। সে কারণেই নীতীশ কখনো বিজেপিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি, বিজেপিও পারেনি। নীতীশ কখনো মমতার মত সোচ্চার আরএসএস বন্দনাও করেননি। কারণ আরএসএস হল ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিচালিত, হিন্দু সমাজের উপর ব্রাহ্মণ আধিপত্য বজায় রাখার জন্য গঠিত সংস্থা। নীতীশের দলের নিম্নবর্গীয় সদস্য, সমর্থকদের সঙ্গে আরএসএসের আড়চোখে দেখার সম্পর্কটুকুই হওয়া সম্ভব। তার বেশি নয়।

অন্যদিকে মমতা ব্রাহ্মণকন্যা। তাঁকে দুর্গা বলে সম্বোধন করতে আরএসএসের কোথাও বাধে না। মমতার রাজনীতির ইতিহাস অন্য দিক থেকেও নীতীশের সঙ্গে মেলে না। বস্তুত যুগপৎ কংগ্রেস বিরোধিতা এবং কমিউনিস্ট বিরোধিতার ইতিহাস সম্ভবত মমতা ছাড়া ভারতের কোনো আঞ্চলিক দলের নেই। তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় রাজনীতির ভিত্তিতে তৈরি দলগুলোর স্বভাবতই প্যাথোলজিকাল বাম বিরোধিতা নেই, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে কংগ্রেস বিরোধিতা ছিল। তেলুগু দেশম, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি, জগন্মোহন রেড্ডির দল বা ওড়িশার বিজু জনতা দলের জন্ম তৃণমূলের মতই কংগ্রেস ভেঙে। কিন্তু তাদেরও বামেদের সাথে ধুন্ধুমার সংঘাতের ইতিহাস নেই। তাদের এলাকায় বামেদের দুর্বলতা তার কারণ হতে পারে, কিন্তু এ কি নেহাত সমাপতন যে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর দিকে আরএসএস বাদ দিলে তৃণমূলই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি, কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেস, দু পক্ষই যাদের ঘোষিত শত্রু? লক্ষণীয়, ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল আর কংগ্রেসের জোট গড়তে দারুণ উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখা গেল, তিনি আরএসএসের বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন। সেই জোট বামফ্রন্টকে হারাতে পেরেছিল বটে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ভাঙনের গতিও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

তাহলে আরএসএসের সাথে সম্পর্ক মমতাকে কী কী দিয়েছে তা বোঝা গেল। এবার আরএসএস কী কী পেয়েছে সে আলোচনায় আসা যাক? রাজনীতিতে তো কেউ “আমি   নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি,/ তুমি   অবসরমত বাসিয়ো” গায় না। আরএসএস যা যা পেয়েছে সবকটাই অমূল্য।

১) আরএসএসের দুই ঘোষিত শত্রু মুসলমান আর কমিউনিস্ট। তৃণমূলের উদ্যোগে কমিউনিস্টরা প্রথমে তাদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি থেকে ক্ষমতাচ্যুত, পরে ছত্রভঙ্গ হয়েছে। তার জন্যে আরএসএসের আগমার্কা কোম্পানি বিজেপিকে বিন্দুমাত্র কসরত করতে হয়নি। মুসলমানরা আগে প্রান্তিক ছিলেন, তৃণমূল আমলে বাংলার হিন্দুদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছেন। মমতা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ইমাম ভাতা চালু করলেন, বিজেপি প্রায় বিনা আয়াসেই হিন্দুদের বোঝাতে সক্ষম হল, মুসলমানরা মমতার দুধেল গাই। পরে মমতা নিজেই অনবধানবশত (নাকি সচেতনভাবেই?) সেকথা বললেনও। এখন পরিস্থিতি এমন, যে বাম আমলে মুসলমানরা বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া পেতেন না, এখন খোদ সল্টলেকে হোটেলের ঘর ভাড়া পান না।

২) মুসলমান তোষণ হচ্ছে – এই প্রোপাগান্ডা হিন্দুদের একটা বড় অংশের বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে তৃণমূল শাসনের ১১ বছরে। ইতিমধ্যে বেলাগাম হিন্দু তোষণ চলছে। বিজেপি আজগুবি অনলাইন প্রচার শুরু করল “পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো করতে দেওয়া হয় না”, তৃণমূল সরকার দুর্গাপুজোগুলোকে নগদ অনুদান দিতে শুরু করল। আরএসএস শুরু করল রামনবমীতে অস্ত্র মিছিল, তৃণমূল আরম্ভ করল বজরংবলী পুজো। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির পথ খুলে গেল, আরএসএসের প্রতিশ্রুতি পূরণ হল। এদিকে দিদি দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। রাজ্যে বিজেপির সরকার থাকলেও এভাবে হিন্দুত্বকে রাজনীতির এজেন্ডায় নিয়ে আসতে পারত কিনা সন্দেহ।

৩) ভারতের একেক রাজ্যের একেকটা বিশিষ্ট গুণ আছে, যা সেই রাজ্যের মানুষের মূলধন। গুজরাটের যেমন ব্যবসা, পাঞ্জাবের কৃষিকাজ। বাংলার ছিল লেখাপড়া, গানবাজনা, সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদি। অন্য রাজ্যের লোকেরা যাকে কটাক্ষ করে এককথায় বলে কালচার। এই কালচার আরএসএসের হিন্দুত্বের একেবারে বিপরীত মেরুর জিনিস। তৃণমূল আমলে সবচেয়ে নির্বিঘ্নে সাড়ে সর্বনাশ ঘটানো গেছে এই কালচারের। বাংলার ছেলেমেয়েরা ফড়ফড় করে ইংরেজি বলতে না পারলেও দেশে বিদেশে গবেষক, অধ্যাপক হিসাবে তাদের দাম ছিল। এখনো সর্বভারতীয় বিজ্ঞান পুরস্কারগুলোর প্রাপকদের তালিকা মাঝে মাঝে সেকথা জানান দেয়। সে দাম ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে স্কুল, কলেজের চাকরি বিক্রি করে লেখাপড়া লাটে তুলে দিয়ে। নায়ক, নায়িকা, গায়ক, গায়িকারা কাতারে কাতারে বিধায়ক আর সাংসদ হয়ে গেছেন। লেখকরা ব্যস্ত পুষ্পাঞ্জলি দিতে আর চরণামৃত পান করতে। সিনেমার কথা না বলাই ভাল। শৈল্পিক উৎকর্ষ বাদ দিন, পারিশ্রমিকের হাল এত খারাপ যে কলকাতার শিল্পীরা স্রেফ বাংলা ছবিতে, ওয়েব সিরিজে কাজ করে টিকে থাকতে পারবেন কিনা সন্দেহ। মন্ত্রীর বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়ার ছবি দেখে প্রথম সারির অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য হা-হুতাশ করছেন, ওই পরিমাণ টাকার অর্ধেক পেলেও বাংলা ছবিগুলো অনেক ভাল করে করা যেত।

কিন্তু এসব গোল্লায় যাওয়ার চেয়েও বড় ক্ষতি হয়েছে। লেখাপড়া, গানবাজনা, সাহিত্য, সিনেমা মিলিয়ে যে বাঙালি মনন ছিল সেটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আসল ক্ষতি সেটা। বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের অন্তত একটা ভান ছিল, যে সে ভারতের অন্য অনেক রাজ্যের লোকেদের মত ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না। দুর্গাপুজো এলে কদিন পাগলামি করে; নিজের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজো, সত্যনারায়ণের সিন্নি চলে। কিন্তু বাইরে সে একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। এখন সেসব গেছে। নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি হলে তার গায়ে খোদাই করা হচ্ছে গণেশের মুখ, শিবলিঙ্গ বা স্বস্তিকা। কলিং বেলে বেজে উঠছে “ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ”। অক্ষয় তৃতীয়ায় এখনো গণেশপুজো এবং হালখাতা হয় এমন দোকান খুঁজে পাওয়া দায়, অথচ গণেশ চতুর্থী এক দশকের মধ্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। শিগগির পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনন্ত ছুটির তালিকায় যোগ হবে নির্ঘাত। অল্পবয়সী বাঙালি কথা বলছে হিন্দি মিশিয়ে, ছোটরা স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শিখছে হিন্দি। বঙ্গভঙ্গের নাম করতেই লর্ড কার্জনের ঘুম কেড়ে নেওয়া বাঙালি নিজে নিজেই প্রায় উত্তর ভারতীয় হিন্দু হয়ে গেল তৃণমূল আমলে। এই সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ তামিলনাড়ুতে কিছুতেই হয়ে উঠছে না আরএসএসের দ্বারা। কেরালায় মার খেতে হচ্ছে, এমনকি নিজেদের হাতে থাকা কর্ণাটকেও করতে গিয়ে অনবরত সংঘাত হচ্ছে। বাংলায় কিন্তু ওসবের দরকারই হচ্ছে না। বিনা রক্তপাতে বাঙালি বাঙালিয়ানা বিসর্জন দিচ্ছে।

আরও পড়ুন শাহেনশাহ ও ফ্যাসিবিরোধী ইশতেহার

এর বেশি আর কী চাইতে পারত আরএসএস? মমতা হিন্দুরাষ্ট্রের জন্য রুক্ষ, পাথুরে বাংলার মাটিতে হাল চালিয়ে নরম তুলতুলে করে দিয়েছেন। বীজ বপনও সারা। ফসল তোলার কাজটা শুধু বাকি।