হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দু নাগরিকের পিঠ বাঁচানোর চিঠি

ওদের গুজরাটের মত, উত্তরপ্রদেশের মত শিক্ষা দেওয়া যাবে কী করে? সে আশাতেই তো বিরাট হিন্দু নেতাদের ভোট দেয়া। কিন্তু ওদের শিক্ষা দিতে দিতে আমাদের ছেলেপুলেগুলো অশিক্ষিত হয়ে যাবে না তো?

শুনুন ধর্মাবতার,

হিন্দুরাষ্ট্রের জন্মসূত্রে হিন্দু নাগরিক হিসাবে যা যা অপরাধ করে ফেলেছি সেসব স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে এই চিঠি লিখছি।

অ্যাঁ, কী বলছেন? ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো বটেই। সংবিধান নামে ওই যে মোটা বইটা আছে, যেটার নামে নেতা, মন্ত্রীরা শপথ নেন এবং ভুলেও মনে রাখেন না – সে বইতে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে লেখা আছে তো বটেই। স্কুল কলেজে পড়েছিলুম সেসব। এমনকি দরকারে পড়ে দেখব বলে আর ছেলেপুলেকে শেখাব বলে বাড়িতে এক কপি কিনেও রেখেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, বইতে তো কত কথাই লেখা থাকে। সব মেনে চললে তো বাঁচা যাবে না। যেমন ধরুন ‘সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা বলিলে পাপ হয়’। এরকম কথা ছোটবেলায় কত বইতে পড়েছি। তা বলে কি সবসময় সব জায়গায় সত্যি কথা বলে বেড়াই? সকলে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়ে গেলে আর আইন আদালত কোন কাজে লাগবে? কে সত্যি বলছে, কে মিথ্যে বলছে তার বিচার করতেই তো বিচারকরা আছেন। তা সংবিধানও একটা বই বৈ তো নয়। তার উপর আবার ইয়া মোটা। আজকাল তিন প্যারার বেশি ফেসবুক পোস্টই পড়ে ওঠা যায় না, অত মোটা বই কে পড়তে যাবে? ওসব জলাঞ্জলি দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, নয় কি? হোয়াটস্যাপেই এঁটে যাবে – দয়া করে এমন একটি সহজ ও ছোট সংবিধান বানিয়ে দিন না, মোটা ঝামেলাটি চিরতরে চুকে যাক। নতুন সংবিধানে ভারত যে হিন্দুরাষ্ট্র হবে তাতে তো সন্দেহ নেই, মানে চাদ্দিকে সবাই যখন বলছে দেশটা হিন্দুদের। তাই এখনই ক্ষমা-টমা চেয়ে পাপস্খালন করে রাখতে চাইছি আর কি, নইলে তখন যদি গদ্দার বলে শূলে চড়ানো হয়? মরণকালে হরিনাম করলে তো আর জীবন ফিরে পাওয়া যায় না, তাই প্রাণের মায়ায় কাজটা সেরে রাখছি।

প্রথম অপরাধটি করেছিলুম সেই ১৯৯২ সালে। আমার কোনো দোষ নেই, মাইরি বলছি। যত রাজ্যের হিন্দুবিরোধী খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেল দেখে বিশ্বাস করেছিলুম অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ভারি অন্যায় কাজ হয়েছে। ব্যাটা সেকুলার মিডিয়া আর পার্টিগুলো মিলে বুঝতেই দেয়নি যে বাল্মীকি, তুলসীদাস প্রমুখ রামায়ণ রচয়িতারা ভগবান শ্রীরামের জন্মস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ, মৌজা ও দাগ নম্বর লিখে না গিয়ে থাকলেও অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি, উমা ভারতী, মুরলী মনোহর যোশীর মত দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন নেতারা ঠিকই জানতেন যে একেবারে রামের ভূমিষ্ঠ হওয়ার জায়গাটিতেই পাপিষ্ঠ বাবর মসজিদ বানিয়ে ছেড়েছিল। আমার অজ্ঞানতা ক্ষমা করুন প্রভু।

সেই থেকে একের পর এক পাপ করেই চলেছি। এই ধরুন বাঙাল পরিবারের ছেলে হয়েও শিখে ফেলেছি দেশভাগের দায় হিন্দু, মুসলমান কোনো পক্ষের কম নয়। আরও শিখেছি ওপার থেকে যেমন ভিটেমাটি ছেড়ে অনেক হিন্দুকে এপারে চলে আসতে হয়েছিল, এপার থেকেও বিস্তর মুসলমান সব ফেলে ওপারে চলে গেছে। ওপারের লোক মোটেই সাধ করে চলে আসেনি, এপারের লোকও যে ড্যাং ড্যাং করে ওপারে পাড়ি দিয়েছে ঠিক তা নয়। এসব ঘোর বিজাতীয় কথাবার্তা যাঁরা শিখিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে দেহ রেখেছেন, ধর্মাবতার। ফলে আপনার কাজ কমেছে। যখন এক হোয়াটস্যাপ মেসেজ লম্বা সংবিধান অনুযায়ীও হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ শেষ হবে, তখন আর তেনাদের শাস্তি দেয়ার দরকার হবে না। আপনাদের হয়ে বরং আমিই তেনারা যা যা শিখিয়ে যেতে পারেননি তার জন্যে দু-চাট্টি গাল পেড়ে নিই।

যেখানে ইচ্ছে যত ইচ্ছে অন্যায় করে সবই বাবর ও তার চোদ্দ গুষ্টির পাপের শোধ তোলা হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করতে তাঁরা শিখিয়ে যাননি। মুসলমান মানেই মোগল আর মোগল মানেই রক্তপিশাচ বজ্জাত – এ কথাটি শিখিয়ে যাননি, মায় ওদের যে একটু শিক্ষা দিয়ে রাখা উচিত তা অবধি শিখিয়ে যাননি। কী ঝামেলা বলুন দেখি? অমৃতকালটি যে চেটেপুটে উপভোগ করব তার ব্যবস্থাই করে গেলেন না! তবে আর কী ছেলেপুলে মানুষ করলেন? ঘোর কলি। এখন দাড়িওলা, বন্দে ভারতে সওয়ার কল্কি অবতার যদি এর প্রতিকার করেন তবেই এ অধমের স্বর্গবাসের রাস্তা খোলে।

একটু ধৈর্য ধরুন, ধর্মাবতার। আমার পাপের এখানেই শেষ নয়। দ্বিগুণ পাপ করলুম ২০০২ সালে। ২৪ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরায় মহান করসেবকদের ট্রেনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর কয়েকদিন সামান্য একটু প্রতিক্রিয়া হল। অথচ ফের হিন্দুবিরোধী মিডিয়ার কথায়, ছবিতে বিশ্বাস করলুম ঘোর অন্যায় হচ্ছে। নারোদা পাটিয়া, নারোদা গাম, গুলবার্গ সোসাইটি – এসব জায়গার নাম মুখস্থ করে ফেললুম। আহসান জাফরিকে খুন করা হয়েছেবিলকিস বানোকে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে, পুলিস দেখেও কিছু দেখেনি, এমনকি মায়া কোদনানির মত মন্ত্রীসান্ত্রীরা দাঁড়িয়ে থেকে এসব করিয়েছেন – এমন গালগল্পে বিশ্বাস করে ফেললুম। একবারও ভেবে দেখলুম না, এক নিষ্ঠাবান হিন্দু মহিলা যাঁর নামেই রয়েছে মায়া, তিনি এমন মায়াদয়াহীন হতেই পারেন না। এসব হিন্দু সমাজকে বদনাম করার চক্রান্ত। গুজরাট মানে আসলে ভাইব্র্যান্ট গুজরাট, যেখানে মাঠে মাঠে ফসল আছে, গাছে গাছে পাখি আছে, ঘরে ঘরে চাকরি, থুড়ি ব্যবসা, আছে। যারা অন্য কথা বলে তাদের হিন্দু হৃদয়সম্রাটকে গাল পাড়া ছাড়া আর কাজ নেই – এই সহজ কথাটা বুঝে উঠতে পারিনি। চাকরি সূত্রে ও রাজ্যে থাকা আত্মীয়স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা অনেকবার বলেছে, তেমন কিছুই হয়নি ওখানে। কেবল মায়ের পেট থেকে পড়েই আরডিএক্স চিনে যায় যারা, তাদের একটু শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এমন শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে এখন গুজরাটের মত শান্ত রাজ্য আর নেই। কিন্তু সেকথা শুনে বিশ্বাস করিনি। কাউকে কাউকে মুখের উপর বলে দিয়েছি, ওটা শ্মশানের শান্তি।

ছ্যা ছ্যা! কী পাপ বলুন দেখি! একেবারেই উচিত হয়নি এসব বলা। এই তো কেমন ধীরে ধীরে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, কেবল নারোদা পাটিয়া বা নারোদা গাম কেন, ২০০২ সালে গুজরাটের কোথাও কেউ কাউকে খুন করেনি। ধর্ষণ যারা করেছিল তারাও সব নিপাট ভালমানুষ, বামুন বাড়ির ভদ্র ছেলেপুলে। তাই তাদের খামোকা সারাজীবন জেলের অন্ধকূপে আটকে রাখার মানে হয় না। তাদের এত সুখ আছে, এত সাধ আছে। সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে? না হয় তাদের দেখে কিছু লোক সাহস পেয়েছে, না হয় কাশ্মীরের কাঠুয়ায় বছর আষ্টেকের শিশুকেও ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে, না হয় ধর্ষকদের বাঁচাতে হিন্দুরা গোটা কতক মিছিল মিটিংই করেছে, মৃত শিশুর উকিলকে খুনের হুমকি দিয়েছে। সে আর তালিবান, আল কায়দা, আইসিস, বোকো হারামের অপরাধের তুলনায় কতটুকু? গেরুয়া পরে তো কেউ সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না, ওসব কংগ্রেসি প্রোপাগান্ডা। গেরুয়া পরে কেবল এমপি, এমএলএ, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়। কারণ তালিবানদের কেউ ভোট দেয় না, গেরুয়া পরে বোম ফিট করার অভিযোগ উঠলে দেয়। কারণ ওটি বীরত্ব।

আরও পড়ুন বিজেপি মুখপাত্র বিতাড়ন: হিন্দুত্বের টাইম আউট, খেলা শেষ নয়

দেশটা এখন বীরে বীরে বীরাক্কার। এদিকে আমার বীরেদের মর্যাদা দিতেও শেখা হয়নি। সেকুলাররা মাথাটা এমন খেয়েছে, কী বলব ধর্মাবতার, গোমাতাকে মাংস বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বা খাচ্ছে – এই অভিযোগে কাউকে উচিত শাস্তি দেয় যারা তাদের আমি ভেবেছি ‘লিঞ্চ মব’। এইসব সাহেবদের শেখানো কথাবার্তা, বুঝলেন কিনা? আমাদের দেশের কোনো ভাষায় ও কথাটা আছে? নেই, কারণ আমাদের দেশে ওরকম হয় না। আমাদের এখানে কেবল গোমাতার অসম্মান করলে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষা যারা দেয় তারা সব খোদ রাণাপ্রতাপের লোক, মানে সেই যিনি হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবরের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এই দেখুন, যত পাপই করে থাকি, আমার কিন্তু শুধরে নেওয়ার চেষ্টা আছে। যত রাজ্যের কমুনিস্টের লেখা ইতিহাস পড়ে শিখেছিলুম রাণাপ্রতাপ নাকি হেরে গেছিলেন। তা আবার হয় নাকি? ওই গরুখেকো মোগলদের কাছে আমাদের বিরাট হিন্দু রাজপুতরা কখনো হারতে পারে?

এত বছরের এত পাপ সব আপনার পায়ে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলুম। এবার থেকে একেবারে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে যাব, কথা দিচ্ছি। শুধু একটা ব্যাপারেই মনটা একটু খচখচ করছে, আপনি মাইবাপ, তাই আপনাকেই বলছি। হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া যে দরকার তাতে সন্দেহ নেই। নইলে ওদের গুজরাটের মত, উত্তরপ্রদেশের মত শিক্ষা দেওয়া যাবে কী করে? সে আশাতেই তো বিরাট হিন্দু নেতাদের ভোট দেয়া। কিন্তু ওদের শিক্ষা দিতে দিতে আমাদের ছেলেপুলেগুলো অশিক্ষিত হয়ে যাবে না তো? ডারউইন বলেছিলেন মানুষ বাঁদর ছিল। আমাদের মুনি ঋষিরা বলেননি, তাই বোধহয় ওসব বই থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারভিউতে “অমৃতস্য পুত্রাঃ” বলে-টলে আমাদের ছেলেপুলেগুলো চাকরি বাকরি পাবে তো, ধর্মাবতার? না, মানে বলছি চাকরি বাকরি তো এদেশে বিশেষ নেই, বিদেশেই খোঁজ করতে হবে। সেখানে এসব বললে আবার হাঁকড়ে দেবে না তো অশিক্ষিত লালমুখো সাহেবগুলো?

আর আপনার সময় নষ্ট করব না ধর্মাবতার। কেবল একখানা শেষ প্রশ্ন আছে। বলি বিলকিস বানোর ওই যে ভালমানুষ ধর্ষকগুলি, তাদের আবার মুসলমানদের শিক্ষা দেয়া হয়ে গেলে আমাদের মেয়েদের শিক্ষা দেয়ার প্ল্যান আছে নাকি? না, মানে হিন্দুরাষ্ট্রে কি মুসলমান থাকতে দেয়া হবে? না হলে এই লক্ষ লক্ষ বীরেরা করবেটা কী? শিক্ষা দেয়া ছাড়া আর কোনো বিদ্যে কি এদের আছে?

অপরাধ নেবেন না হুজুর। এসব প্রশ্ন করব কাকে? কল্কি অবতার তো আর প্রেস কনফারেন্স করেন না, তেনার এজলাসও নেই। অগত্যা আপনাকেই করলুম আর কি। তাছাড়া আমাদের সাধুসন্তরা বলেছেন, সবই মায়া। তাই ছোট মুখে বড় কথা বলে অপরাধ হয়ে থাকলে মায়া বলে মামলা ডিসমিস করে দেবেন, এই আশা রাখি।

বিনয়াবনত

হিন্দুরাষ্ট্রের এক হিন্দু নাগরিক

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত