ঘটনা ১
রাজস্থানের বাসিন্দা নাফিসা আত্তারি গত মঙ্গলবার তাঁর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, বুধবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। কারণ তিনি সোশাল মিডিয়ায় রবিবারের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তান জিতে যাওয়ার পর আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন।
ঘটনা ২
কাশ্মীরের শ্রীনগরের শের-এ-কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অফ মেডিকাল সাইন্সেস আর গভমেন্ট মেডিকাল কলেজের ছাত্রছাত্রী, ওয়ার্ডেন ও ম্যানেজমেন্টের লোকেদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত ইউএপিএ আইনে মামলা দায়ের করেছে পুলিস। অভিযোগ পাকিস্তানের জয়ে উল্লাস করা, বাজি পোড়ানো ইত্যাদি। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়নি, তবে পুলিস বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। ক্যাম্পাসে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
ঘটনা ৩
রবিবার ভারত-পাক ম্যাচের পর একটি দক্ষিণপন্থী ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করা হয় যে মুসলমান পাড়ায় পাকিস্তান জেতার পর বাজি পোড়ানো হয়েছে। পুলিস তদন্ত করে দেখে যে ওই পাড়ায় সেদিন বিয়ে ছিল এবং বাজি আসলে সেখানেই পোড়ানো হচ্ছিল। যারা ফেসবুক পোস্টটি করেছিল, তারা দোষ স্বীকার করে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। পুলিস তাদের প্রত্যেককে দিয়ে ২৫ হাজার টাকার বন্ড জমা করিয়েছে।
ঘটনা ৪
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছেন পাকিস্তানের জয় যারা উদযাপন করেছে তাদের বিরুদ্ধে সিডিশন ল, অর্থাৎ দেশদ্রোহবিরোধী আইন প্রয়োগ করা হবে। আগ্রাতে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ইতিমধ্যেই ।
সব ঘটনা উল্লেখ করা গেল না, নিশ্চিতভাবেই অনেক ঘটনা বাদ পড়ে গেল। পাঠকরা নিজেদের জানা ঘটনা এই তালিকায় জুড়ে নিতে পারবেন। এমন ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা সম্ভব হলে তা কুড়ি বিশের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের একমাত্র মুসলমান ক্রিকেটার মহম্মদ শামির কাছে পাঠানো যেতে পারে। তাতে তাঁর মানসিক যন্ত্রণার কিছু উপশম হলেও হতে পারে। কারণ এই ঘটনাগুলো জানলে তিনি বুঝতে পারবেন, পাকিস্তানের কাছে ভারত হেরে যাওয়ার পর থেকে তাঁকে যা সহ্য করতে হয়েছে তা ভারতের সাধারণ মুসলমানদের দুর্গতির তুলনায় কিছুই নয়। তাঁকে নাহক অনলাইন গালাগালি সহ্য করতে হয়েছে, জামিন অযোগ্য ধারায় পুলিশ কেস তো আর হয়নি। চাকরিও খোয়াতে হয়নি। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ উঠেছে মাত্র, সে অভিযোগের ভিত্তিতে অন্তত গ্রেপ্তার করা হয়নি। শামির নিয়োগকর্তা যে ক্রিকেট বোর্ড, সে বোর্ডের সেক্রেটারি যখন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র, তখন দেশে ফিরলেও যে শামিকে ৩.৫ ওভারে ৪৩ রান দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করা হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সে নিশ্চয়তা এ মুহূর্তে ভারতের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বীর নেই।
ফুটবলপ্রেমীরা জানেন ১৯৬৯ সালে একটা ফুটবল ম্যাচের জন্য হন্ডুরাস আর এল সালভাদোরের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। মানে খেলার জন্য যুদ্ধ হওয়ার ইতিহাস আছে। কিন্তু ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হল যুদ্ধের জন্য খেলা — গত পাঁচ দিনের ঘটনাবলী তা প্রমাণ করে দিয়েছে। পাকিস্তানের গণতন্ত্র নিয়ে অতি বড় পাকিস্তানিও গলা তুলে কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করেন। আর ভারত এখন এত মহান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যে ক্রিকেট ম্যাচে অন্য দেশের দলকে সমর্থন করলে চাকরি হারাতে হয়, গ্রেপ্তার হতে হয়, এমনকি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে হয়। কিন্তু সে কথা বললে অর্ধেক বলা হয়। কোনো ভারতীয় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এমনকি ইংল্যান্ডকেও সমর্থন করতে পারেন। জেলে যেতে হবে না। যত দোষ পাকিস্তানকে সমর্থন করলেই। কেবল অন্ধ ক্রিকেটভক্তরা নয়, ক্রিকেটাররা পর্যন্ত তা-ই মনে করেন। প্রাক্তন ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীর রবিবারই টুইট করেছিলেন, যারা ভারতের জয়ে বাজি পোড়াচ্ছে তারা ভারতীয় হতে পারে না। তিনি অবশ্য এখন বিজেপি সাংসদ, তাই এমন মন্তব্য তাঁর থেকে অপ্রত্যাশিত নয়, কিন্তু বীরেন্দ্র সেওয়াগও তীর্যক টুইট করতে ছাড়েননি। তাঁর বক্তব্য দীপাবলিতে ভারতের বেশকিছু এলাকায় বাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, অথচ পাকিস্তান জেতার পরে লোকে বাজি পোড়াচ্ছে। তারা বোধহয় ক্রিকেটের জয় উদযাপন করছে। তাহলে দীপাবলিতেই বা বাজি পোড়ালে দোষ কী? এই ভণ্ডামির কী প্রয়োজন? সব জ্ঞান দীপাবলির বেলাতেই কেন? সীমান্তের ওপারের ওঁরাও কিছু কম যান না। এক মন্ত্রী বলেছেন এই জয় ইসলামের জয়। প্রাক্তন ক্রিকেটার ওয়াকার ইউনিস লাইভ টিভিতে বলেছেন, রিজওয়ানের ব্যাটিংয়ের চেয়েও তৃপ্তিদায়ক ব্যাপার হল হিন্দুদের মধ্যে গিয়ে নমাজ পড়া। অর্থাৎ এতগুলো লোক তক্কে তক্কে ছিল যুদ্ধ করবে বলে — ধর্মযুদ্ধ।
আরও পড়ুন এটা যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট; ওঁরা গ্ল্যাডিয়েটর নন, ক্রিকেটার
কিন্তু এতেও সবটা বলা হল না। কারণ পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত বিরাট কোহলি চার-ছয় মারার সময়ে উল্লাস করার জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে খবর নেই। ওয়াকারকেও তাঁর মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে টুইট করতে হয়েছে । কিন্তু সেওয়াগ, গম্ভীররা ওসবের ধারে কাছে যাননি। কারণ পাকিস্তানি মন্ত্রী, প্রাক্তন ক্রিকেটাররা যেমন শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করেছেন, এঁরা মনে করেন এঁরাও তেমনই শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করেছেন। কে সেই শত্রু? উত্তরটা খুব সোজা। কানে বাজির আওয়াজ এলেই যাদের সম্বন্ধে মনে হয় নির্ঘাত ওরাই পোড়াচ্ছে এবং পাকিস্তান জিতেছে বলেই পোড়াচ্ছে, তারাই শত্রু, তারাই দেশদ্রোহী। অর্থাৎ আপনি ভারতীয় হয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন করেও বেঁচে যেতে পারেন, যদি মুসলমান না হন।
নেহাত গা জোয়ারি মন্তব্য করা হল? মুসলমানদের দিকে ঝোল টেনে কথা বলা হল মনে হচ্ছে? মহম্মদ শামিকে রাম, শ্যাম, যদু, মধুর ‘গদ্দার’ ইত্যাদি বলা দেখেই সে সন্দেহ দূর হয়ে যাওয়ার কথা। যদি তারপরেও সন্দেহ থাকে, তাহলে শামির সমর্থনে ভারতীয় প্রাক্তন ক্রিকেটারদের টুইটগুলো লক্ষ করবেন। গম্ভীর, সেওয়াগ তো বটেই; অনিল কুম্বলে, ভারতীয় ক্রিকেটের মৌনীবাবা শচীন তেন্ডুলকর — সকলেই শামি যে নির্দোষ সেই মর্মে টুইট করেছেন। সকলেরই বক্তব্য মোটামুটি এক। শামি চ্যাম্পিয়ন বোলার; খেলার মাঠে একটা খারাপ দিন যে কোনো খেলোয়াড়ের যেতে পারে; শামি, আমরা তোমাকে ভালবাসি, ইত্যাদি। একজনও কিন্তু বলেননি, শামি ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলে, আমরাও ভারতের হয়ে খেলেছি। ওকে সন্দেহ করা আর আমাদের সন্দেহ করা একই কথা। যারা তা করে তাদের মত ফ্যান আমাদের দরকার নেই। ইংল্যান্ডের ফুটবল দলের অধিনায়ক হ্যারি কেন কিন্তু পেনাল্টি শুট আউটে গোল করতে ব্যর্থ কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের সমর্থনে ঠিক এই কথাই বলেছিলেন। শচীনরা বলেননি, কারণ ওঁরা খুব ভাল করে জানেন শামি মুসলমান বলেই সে সন্দেহের পাত্র। উইকেট না পেলেও, মার খেলেও যশপ্রীত বুমরা, ভুবনেশ্বর কুমার, রবীন্দ্র জাদেজা সন্দেহের পাত্র নয়। পাকিস্তান ম্যাচে হিন্দুরা খারাপ পারফরম্যান্স করলে সন্দেহ করার কিছু নেই, মুসলমানকে সন্দেহ করতে হবে — এই মানসিকতার বিরুদ্ধে কুম্বলে, শচীনরা একটাও কথা বলেননি। তাঁরা তবু মুখ খুলেছেন, অধিনায়ক ডাকাবুকো কোহলির থেকে পাওয়া গেছে বিরাট নীরবতা। সমালোচকদের বিরুদ্ধে কথার ফুলঝুরি ছোটানো কোচ রবি শাস্ত্রীরও মুখে কুলুপ। এমনকি টিমের বড়দা (মেন্টরের বাংলা প্রতিশব্দ পরামর্শদাতা। ধোনির জন্য সেটা বড্ড ম্যাড়মেড়ে নয়?) মহেন্দ্র সিং ধোনিও চুপ।
কেনই বা চুপ থাকবেন না? ওঁরাও তো আমার, আপনার মত কাগজ পড়েন, টিভি দেখেন, সোশাল মিডিয়া ঘাঁটেন। ফলে ওঁরা দেশের অবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ওঁরা হয়ত জানেন গুজরাটের আনন্দ (আমুল খ্যাত) শহরের মঙ্গলবারের ঘটনা। সেখানে একটি নতুন হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ব্যাঙ্কোয়েট হলের উদ্বোধন আটকাতে বিরাট জনতা হাজির হয় গত পরশু। তারা গঙ্গাজল দিয়ে এলাকা শুদ্ধিকরণের প্রয়াস করেছে। স্লোগান দিয়েছে, ভারতে থাকতে হলে জয় শ্রীরাম বলতে হবে। হিন্দু এলাকায় মুসলমান মালিকের হোটেল থাকবে, এ অনাচার তারা মানতে রাজি নয়। খবরে প্রকাশ, হোটেলটির তিন মালিকের একজন হিন্দু। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
ধোনি ঝাড়খন্ডের মানুষ, দিব্যি বাংলা বলতে পারেন। রাঁচিতে তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজনদের মধ্যেও বাঙালি আছেন। তাঁর প্রতিভা প্রথম চিনেছিলেন কেশব ব্যানার্জি নামের এক বাঙালি মাস্টারমশাই। ফলে ধোনি হয়ত ত্রিপুরার খবরও রাখেন। হয়ত ভাল করেই জানেন, ওই রাজ্যে কীভাবে মুসলমান খ্যাদানো চলছে কদিন ধরে আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মালিকানায় চলা সংবাদমাধ্যম চোখ বুজে আছে। এই পরিবেশের মধ্যে ধোনির কী দায় পড়েছে মুসলমান সতীর্থের হয়ে মুখ খোলার?
এত ঘটনা না জানলেও আইপিএল খেলা তারকা ক্রিকেটাররা বিলক্ষণ জানেন, এক গ্রাম মাদক উদ্ধার না হওয়া সত্ত্বেও শাহরুখ খানের ছেলেকে তিন সপ্তাহ কারাবাস করতে হল। ইতিমধ্যে তদন্তকারী অফিসারের বিরুদ্ধে নানা কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠে এসেছে। যে দেশে অর্ণব গোস্বামীর জামিনের জন্য মধ্যরাতে আদালত বসতে পারে, সে দেশে আদালতের সময়ই হয় না মাসের পর মাস, বছরের পর বছর উমর খালিদের জামিনের আবেদন শোনার। শার্জিল ইমাম যে কথা বলেননি তার জন্য, সিদ্দিক কাপ্পান যে প্রতিবেদন লেখেননি তার জন্য, মুনাওয়ার ফারুকি যে কৌতুক করেননি তার জন্য এবং আরিয়ান খান যে মাদক নেননি তার জন্য — কারাবাস করতে পারেন। একজন আদানির বন্দরে কয়েক হাজার গ্রামের মাদক পাওয়া গেলেও তেমন হেলদোল হয় না আইনের রক্ষকদের, একজন খানকে রেভ পার্টিতে পাওয়া গেলেই সে কেবল মাদকাসক্ত নয়, মাদক ব্যবসায়ী হয়ে যায় সারা দেশের চোখে — এ কথা আমাদের মত ক্রিকেট তারকারাও জানেন। তাই তাঁরা চুপ করেই থাকবেন।
শামি, আপনি মানিয়ে নিন। আপনার চেয়ে অনেক দূরে, অনেক নীচে থাকা ভারতীয় মুসলমানরা প্রতিনিয়ত যেমন মানিয়ে নিচ্ছেন।
2 thoughts on “সবাই চুপ করে থাকবে, মানিয়ে নিন শামি”