হিন্দির হাতে বাংলা বিপন্ন: বাঙালি কি নির্দোষ?

এত দিনে মাথায় ঢুকেছে যে শক্তিশালী জাতিবিদ্বেষী যখন মারতে আসে তখন স্রেফ নামটা দেখেই মারে।

প্রত্যেকটা নির্বাচন কিছু ইস্যু নিয়ে প্রবল আলাপ আলোচনা বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি করে আর কিছু ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচন সেইভাবেই একটা উত্তেজনার বিষয় আড়চোখে লক্ষ্য করে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই এবারের নির্বাচন এত কিছু নিয়ে এত বেশি উত্তাপ, কদর্যতা, হিংসার উদ্রেক করেছে যে এই বিষয়টা যদি অষ্টম দফা পর্যন্তও নির্বাচনী ইস্যু না হয়ে ওঠে, তাহলে হয়ত আপাতত ভালই হয়। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ইস্যুটাকে আর পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

বিষয় বাঙালির উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। আর সেখানেই কিনা সরকারি ফতোয়া জারি হয়েছে কাজকর্মে যতদূর সম্ভব হিন্দি ব্যবহার করতে হবে। উচ্চশিক্ষায় যুক্ত বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন। বাঙালিকে নিজ দেশে পরবাসী করে দেওয়ার চক্রান্ত; বাংলার ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পিত আক্রমণ — এইসব অভিযোগ উঠেছে। সংস্থার গবেষকরা তাঁদের মত করে প্রতিবাদ করেছেন। সংস্থা বেগতিক দেখে নিজেদের আদেশের অন্যরকম ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।১ এদিকে আবার শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রতিবাদের মুখে ফেরত আনা হয়েছে। নির্বাচনের পরেই আবার রবীন্দ্রনাথ উধাও হবেন কিনা তা সময় বলবে। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে তো এখন নিশ্চিন্তে বলা চলে “সে মন্দিরে দেব নাই”। বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে পাঁচিল তুলে বসুধাকে খণ্ড ক্ষুদ্র করেই উপাচার্য সন্তুষ্ট নন, তিনি নাকি বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে যাবেন।২

এই ঘটনাগুলো দীর্ঘ মেয়াদে পশ্চিমবঙ্গের বা সারা পৃথিবীর বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে যতই ক্ষতিকর হোক, শতকরা নব্বই জন বাঙালির ভাবিত না হলেও চলত। আজকাল মহেন্দ্রলাল সরকার নামটা শুনলে কেউ কেউ আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মালিকদের আত্মীয় বলে সন্দেহ করে, আর রবীন্দ্রনাথের পদবি বহুকাল হল তাঁর নামকে অতিক্রম করে গেছে। ফলে ঘরে একখানা ছবি ঝুলিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু এসবের পাশাপাশি এমন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, যেগুলো উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণা বা শিল্প সাহিত্যের সাথে দৈনন্দিন সম্পর্কহীন ছা পোষা মধ্যবিত্তেরও ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঘটনাগুলো সংখ্যায় এখনো বেশ কম, হয়ত সোশাল মিডিয়ার যুগ না হলে খুব বেশি লোক জানতেও পারত না। কিন্তু লক্ষণ হিসাবে ভাল নয়। কদিন আগেই ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে রোহিত মজুমদার নামে এক বাঙালি যুবক অভিযোগ করলেন, বড়বাজার অঞ্চলে ব্যবসার কাজে এসে বেশ কিছু হিন্দিভাষী লোকের হাতে তিনি হেনস্থা হন এবং হিন্দি বোঝেন না বলে তাঁদের বাংলায় কথা বলতে অনুরোধ করায় তাঁকে বলা হয় বাংলা বলতে হলে বাংলাদেশে চলে যেতে হবে।৩ প্রায় একই সময়ে এক যুবক ফেসবুকেই ভিডিও পোস্ট করে অভিযোগ করেন হুগলী জেলার হিন্দমোটরে এক হিন্দিভাষী নাকি তাঁকে বাড়ি ভাড়া দেননি আমিষাশী হওয়ার অপরাধে। এ পর্যন্ত প্রকাশ পাওয়া সবচেয়ে কুৎসিত অভিযোগ উঠেছে কোন্নগরে। হোলির দিন অবাঙালি যুবকরা জোর করে ঘরে ঢুকে বাঙালি মহিলাকে নাকি রঙ মাখিয়েছে। প্রতিবাদ করায় এবং হোলি বাঙালিদের উৎসব নয়, বাঙালিরা দোল খেলে বলায় নাকি উত্তর এসেছে নেমপ্লেটে লিখে রাখা উচিৎ যে বাঙালি। এবং ২ তারিখের পর মজা দেখানো হবে।৪

কোন্নগরের ঘটনায় এফ আই আর দায়ের করা হয়েছে। হুমকির কথাটা সত্য হোক আর না হোক, সোশাল মিডিয়ায় কিন্তু সত্যিই এমন ভিডিও ঘুরছে, যেখানে হিন্দিভাষী কয়েকজন লোক আঙুল নেড়ে চোখ রাঙিয়ে বলছে ২ তারিখের পর বাঙালিদের দেখে নেওয়া হবে, কারণ “পশ্চিমবঙ্গে এবার আমাদের সরকার হচ্ছে।” এখানে আমরা কারা — সে ভারী কঠিন প্রশ্ন। এখন অব্দি দেশে যেটুকু সাংবিধানিক নিয়মকানুন অবশিষ্ট আছে, তাতে সরকার কোন দলের বা জোটের হয়। বাঙালির সরকার বা অবাঙালির সরকার হয় বলে তো জানি না। তবে রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা। সব কি আর জানি? সত্যি কথাটা এই, যে অতীতে যে জায়গাটা হুগলী শিল্পাঞ্চল ছিল সেখানে বা কলকাতার বেশকিছু অঞ্চলে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় প্রায়শই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে শিগগির এমন একদিন আসবে যখন হিন্দিভাষীরা তাঁদের উপর ছড়ি ঘোরাবেন। বাঙালি বাংলাতেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে যাবে, সংস্কৃতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এই আতঙ্কই চলতি নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বহিরাগত তত্ত্বে উঁকি মেরেছিল। কিন্তু সম্ভবত হিন্দিভাষী ভোটারদের সংখ্যা ফেলে দেওয়ার মত নয় বলে ও তত্ত্ব নিয়ে বেশি কাটাছেঁড়া করা হল না।

রাজনৈতিক দলগুলো উপর্যুক্ত ঘটনাবলী নিয়ে মাথা না ঘামালেও, বাংলা পক্ষের মত সংগঠন কিন্তু বীর বিক্রমে মাঠে নেমে পড়েছে। “গুটখাখোর” জাতীয় কিছু সগর্ব জাতিবিদ্বেষী শব্দাবলী তাদের হাতিয়ার। যেন বাঙালিরা কেউ গুটখার ধারে কাছে যায় না, অথবা গুটখা খেলেই যে কোন মানুষ আক্রমণাত্মক, বাঙালি বিদ্বেষী, ধর্ষণোদ্যত পুরুষে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয়, এদের ফেসবুক লাইভগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ঠিক যেভাবে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের একগাদা সন্তান, তাই তাদের রাজনৈতিক দলগুলো তোষণ করে বলে বক্তৃতা দিয়ে থাকে; বাংলাপক্ষের নেতৃবৃন্দও সুযোগ পেলেই হিন্দিভাষীদের সন্তানের সংখ্যা বাঙালিদের চেয়ে বেশি, তাই তাদের রাজনৈতিক দলগুলো তোষণ করে — এসব বলে থাকেন। বেশিক্ষণ সেসব বক্তৃতা শুনলে মনে হয় ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ নামক হিন্দি ছবির বাংলায় ডাব করা প্রিন্ট দেখছি, যার নাম ‘বাঙালি বিপন্ন’।

বাঙালি যে বিপন্ন তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ নেই। যা রটে তার কিছু তো বটে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থা বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেবল বাংলায় হচ্ছে তা নয়, সারা ভারতে চলছে। কিন্তু কোন পক্ষের উগ্রতাকে শিরোধার্য না করে এই বিপন্নতার কারণ খুঁজতে গেলে বাঙালির পক্ষে একগাদা অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠে আসে।

পৃথিবীতে এমন কোন ভাষা সংস্কৃতি নেই যাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব অন্য ভাষার লোকেরা নিয়েছে। কেনই বা নেবে? এমন ভাষাও পাওয়া যাবে না, যা বিপুল সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করেন অথচ অনেকেই ব্যবহার যে করেন তা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বোধ করেন। এই অনন্য গুণটি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি গত দুই-তিন দশকে আয়ত্ত করেছে। শহর ও মফস্বলের সম্পন্ন বাঙালি এখন ছেলেমেয়েকে কেবল ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে সন্তুষ্ট নয়, দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে রাখে হিন্দি। বাংলা নৈব নৈব চ। দুনিয়া অনেক বদলে গেছে, ভাল করে ইংরেজি জানা না থাকলে চাকরি বাকরি পাওয়া যাবে না — এ যুক্তি অনস্বীকার্য। কিন্তু হিন্দি লিখতে পড়তে শেখা বঙ্গসন্তানদের কী করে কোটিপতি হতে সাহায্য করবে তা বোঝা দুষ্কর। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতে কর্মসংস্থানের অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় খারাপ বৈ ভাল নয়; দিল্লী, মুম্বইতে থেকে কাজকর্ম করতে হলে হিন্দি বলতে পারাই যথেষ্ট। সেটুকু আমাদের সোনার ছেলেমেয়েরা হিন্দি সিনেমার দৌলতে যথেষ্ট ভাল আয়ত্ত করে ফেলে। তবু ২০১৭ সালে যখন তৃণমূল সরকার ঘোষণা করল প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা পড়াতেই হবে, সম্ভ্রান্ত বাঙালি বাবা-মায়েদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। দার্জিলিঙের গোর্খা, নেপালি, ভুটিয়া, লেপচা বা দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসীরা এর প্রতিবাদ করলে কারণ বোঝা যায়। হিন্দি বা ইংরেজির মত বাংলাও তাঁদের মাতৃভাষা নয়। তাঁদের কেন এই ভাষা শিখতেই হবে? কিন্তু কলকাতা ও তার আশপাশের বাঙালির যে উষ্মা প্রকাশ, তা হিন্দিভাষী হয়ে ওঠার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব কি? তা এই যখন ইচ্ছা, তখন আর “ওরা আমাদের টিকতে দেবে না” — এই চিন্তা করা কেন? দোল কথাটা তো এমনিও ভুলেই গেছেন, হোয়াটস্যাপ করেন ‘হ্যাপি হোলি’। তা এবার থেকে না হয় হোলিই খেলবেন।

সম্প্রতি চেন্নাইয়ের এক অনুষ্ঠানে ঘোষিকা হিন্দিতে কথা বলায় ভারত বিখ্যাত এ আর রহমান৫ মুচকি হেসে আপত্তি জানিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেছেন। ভিডিওটা দেখে মনে পড়ল, বছর দুয়েক আগে হংস মধ্যে বক যথা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এক বৈঠকে হাজির হয়েছিলাম। সেখানে তাঁরা আলোচনা করছিলেন হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বাংলাকে কী করে বাঁচানো যায়। সকলেই একমত হলেন যে ওঁদের কিছু করার নেই। রাজনৈতিক কর্মীদের সরকারে এসে বাংলার অর্থনীতির হাল ফেরাতে হবে, তাহলেই সংস্কৃতি বাঁচবে। বাংলায় লিখে পুরস্কারপ্রাপ্ত এক সাহিত্যিক জোর দিয়ে বললেন, প্রয়োজন না থাকলে নিজের সন্তানকে তিনি বাংলা পড়াবেন না। আরেক বিপ্লবী সাহিত্যিকও তাঁকে সমর্থন করলেন। এই কারণেই তামিলনাড়ুর তামিলরা বিপন্ন নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বিপন্ন। মনে রাখা ভাল, রহমান মোটেই তামিলপক্ষের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নন। ভারতের বেশিরভাগ লোক বরং তাঁকে চিনেছে তিনি হিন্দি ছবিতে কাজ করেছেন বলেই। কিন্তু তিনি বোঝেন কোথায় সীমারেখা টানতে হয়। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের ভাষা সংস্কৃতির প্রতি শিল্পী হিসাবে তাঁর যে দায়িত্ব তা তিনি রাজনৈতিক কর্মীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন না।

অনেককাল আগে থেকেই বাঙালি ভদ্রসমাজ ইংরেজি ভাল করে শিখলেই হবে, বাংলা এলেবেলে — এই তত্ত্ব চালু করে বিরাট অংশের বাঙালির থেকে নিজেদের আলাদা করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বড় সাধ ছিল বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা হবে। সে প্রয়াসে বহুকাল আগেই জল ঢালা হয়ে গেছে, কারণ বাঙালি বিদ্বানরা নিজে শিখতে পারলেই যথেষ্ট হল মনে করেন। বিদ্বানের সংখ্যা বাড়িয়ে কী লাভ? এইভাবে বাংলা ক্রমশ কেবল শিল্প, সাহিত্যের ভাষায় পরিণত হয়েছে। এখন উল্টে তারই বিরুদ্ধে অভিযোগ “কোন কাজে লাগে না তো।” যেন যুগ বদলের সাথে সাথে কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পরিবর্তন করা, নতুন পরিভাষা, নতুন শব্দ তৈরি করা অন্য ভাষার লোকেদের কাজ ছিল। সে যা-ই হোক, কথা হচ্ছে কাজে লাগে না বলে সাধারণ চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত যখন নিজের সংস্কৃতিকে বাতিলই করে দিয়েছেন তখন আর ভয় কী? ছেলেমেয়েকে বাংলা বই পড়ানো দূরে থাক, বাংলা টিভি চ্যানেল পর্যন্ত দেখতে বারণ করেছেন। তা কেন্দ্রীয় সরকার আর আপনার হিন্দিভাষী প্রতিবেশীরা যদি বাংলা বলাটুকুও বন্ধ করে দেন, সে তো ভালই, তাই না?
আসলে এত দিনে মাথায় ঢুকেছে যে শক্তিশালী জাতিবিদ্বেষী যখন মারতে আসে তখন স্রেফ নামটা দেখেই মারে। “জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না” বললে তখন রেহাই পাওয়া যাবে না। তাই আপ্রাণ জাতি পরিচয় তুলে ধরে পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা। তবে বাঙালির সে চেষ্টাতেও ফাঁকিবাজির ছাপ স্পষ্ট। আক্রমণের লক্ষ্য বড়বাজারের বিহারী ঠেলাওয়ালা থেকে কোটিপতি ভুজিয়াওয়ালা পর্যন্ত সকলেই। অথচ নিজের ভুলে যাওয়া ভাষা সংস্কৃতিকে নতুন করে জানার চেষ্টা নেই। ক্রমশ শক্তি বাড়িয়ে চলা হিন্দুরাষ্ট্র আগামী দিনে হয়ত আইন করে সমস্ত সরকারি কাজে হিন্দি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাগুলোকে ব্রাত্য করে দেবে। তখন নির্ঘাত বাঙালির প্রতিরোধ হবে বিহারী গোয়ালার থেকে দুধ না কেনা, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা সবজিওয়ালাকে বয়কট করা ইত্যাদি। আমরা পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোকেরা জানি, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে “কম্পিটিশনে” পিছিয়ে পড়তে হয়। বরাক উপত্যকা বা বাংলাদেশের বাঙালিদের মত বোকা হাঁদা নই যে ভাষার জন্যে প্রাণ দিতে যাব।

বাংলা ছবির টাইটেল কার্ড, যা আজকাল বাংলা হরফের চেয়ে রোমানে বেশি লেখা হয়, অনতিবিলম্বেই দেবনাগরীতেও লেখা হবে। কারণ বাঙালি শিল্পীর মত সুবোধ প্রজাতি ভূভারতে নেই। ওঁরা ছটপুজোয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছুটি দেয় কেন সে প্রশ্ন করেননি, এ রাজ্যে হঠাৎ হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের কী প্রয়োজন তাও জিজ্ঞেস করেননি। রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রদের পাশে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কোন সংস্কৃতির লক্ষণ, সে নিয়েও তাঁরা ভাবেননি। সুতরাং আশা করা যায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে কেবল ভক্তিমূলক আর পুরাণাশ্রয়ী হিন্দি ছবি দেখানো হলেও তাঁরা আপত্তি করবেন না। এমনিতেও আজকের চিত্রতারকাদের অনেকেই বাংলা বলেন শেক্সপিয়রের মত।

পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং বিপ্লবী সাহিত্যিকরাও নিশ্চয়ই হিন্দিতে লেখা শিখে নেবেন। বাংলার আর মার্কেট কই? হিন্দি লেখার মার্কেট গোটা ভারত।

তথ্যসূত্র
১। https://www.telegraphindia.com/west-bengal/calcutta/indian-association-for-the-cultivation-of-sciences-climbdown-on-hindi-after-protest/cid/1810549
২। https://thewire.in/education/visva-bharati-vice-chancellor-in-fresh-row-over-leaked-audio-clip
৩। https://www.facebook.com/100000786783881/posts/3841532379216284/?d=n
৪। https://www.facebook.com/BanglaPokkhoHooghly/videos/813827019481916
৫। https://www.instagram.com/p/CM3_bzEFc6R/?utm_source=ig_web_button_share_sheet

https://guruchandali.com/ এ প্রকাশিত

বং কারেকশন

জন্মদিনে ছোটদের উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিৎ দিতে ভয় হয়। যদি আদৌ ছুঁয়েই না দ্যাখে স্নেহভাজনটি?

জ্যাঠতুতো, পিসতুতো মিলিয়ে আমার এগারোজন জামাইবাবু। সর্বকনিষ্ঠ শ্যালক হওয়ার কারণে তাঁদের অনেকের বিয়ের সময়ে আমি যুক্তাক্ষর পর্যন্ত জানতাম না। কিন্তু শালা শালীদের সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে আমাকে তাঁরা বঞ্চিত করেননি। আমার কাছে এবং আমার তুতো ভাইবোনদের কাছে তাই জামাইবাবুরা বড় আব্দারের জায়গা। আজকাল কিন্তু তাঁরা বিরল। জিজু নামের এক নতুন প্রজাতি তাঁদের জায়গা দখল করেছে।

পাশের বাড়ির ছেলেটা আমাকে কাকু বলে না, বলে আঙ্কল। আমার স্ত্রীকে আমার মেয়ে বন্ধুদের ছেলেমেয়েরা মামী বলা শিখল না, শিখল আন্টি। ট্রেনে বাসে অচেনা বয়স্ক মহিলারাও আর মাসিমা নেই, আন্টি হয়ে উঠেছেন। সম্পূর্ণ অচেনা লোককে আন্তরিক ভদ্রতায় “দাদা, একটু সরবেন?” বলার দিন গেছে। কেঠো “এক্সকিউজ মি” না বললে অভদ্র বলেই মনে করা হয় আজকাল।
ঘরোয়া আইবুড়ো ভাতকে কনুইয়ের গুঁতোয় এক কোণে সরিয়ে দিয়েছে মেহেন্দির জাঁকজমক। জন্মদিনে ছোটদের উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিৎ দিতে ভয় হয়। যদি আদৌ ছুঁয়েই না দ্যাখে স্নেহভাজনটি?
প্রাণের বন্ধু এখন আর ভাইয়ের মত নয়। সে হল ব্রো। মেয়েদের পাতানো ভায়েরা সব “ভাইয়া”। যে বন্ধুর মা চমৎকার রাঁধেন, তাঁর রান্না “সুপার সে ভি উপর”।

অনেক শিক্ষিত পাড়ায় গ্রীষ্মে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা বন্ধ বহুকাল, যেমন নবমীতে পাড়ার মণ্ডপে ছোটদের জন্যে ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতাও উঠে গেছে। কোথাও কোথাও এসে গেছে টিভির রিয়্যালিটি শোয়ের অনুকরণে নাচ গানের প্রতিযোগিতা, যেখানে পাঁচ ছয় সাত আট বছরের শিশুরা হিন্দি ছবির আইটেম সঙে নেচে গেয়ে হাততালি পায়।
প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কাঁধ ঝুলে পড়া ছেলেকে তার বন্ধুরা “দেবদাস দেবদাস ভাব করলে প্যাঁদাব কিন্তু” বলে না, বলে “কাম অন ইয়ার।” ইংরিজি শব্দ বাদ দিয়ে বাংলা ছবির নামকরণ হওয়াই শক্ত হয়ে গেছে, হলেও তা লেখা হয় রোমান হরফে। ছবির নায়ক নায়িকা প্রেম সম্বোধন করে “সোড়িঁয়ে”, “সাইয়াঁ”, “জানু”, “জানেমন” বলে। প্রিয়ার কী রূপ সে-ও জানে না, যে কখনো ভালবাসে।

অমিত শাহ এসব জানেন। তিনি জানেন হিন্দি চাপাতে গেলে তামিল, তেলুগু, মালয়ালিরা ক্ষেপে উঠতে পারে, বাঙালিদের ক্ষেপে ওঠার সম্ভাবনা কম। কারণ বাঙালি সুদূর অতীতে ব্যতিক্রমী ছিল বটে, এখন সে শুধু “হটকে”।

বাধাই হো

ডেভেলাপমেন্টের ভাষা এমোন আচ্ছা সে সিখাবো যে নকরির গঙ্গা মাইয়া এসে যাবেন ওয়েস্ট বেঙ্গালে

পাশ্চিমবাঙ্গালের জানাগাণকে আনেক আনেক বাধাই। উয়ো তেইস তারিখ সে ভাবছি বাধাই দেবো, কিন্তু একটু দেরী হোয়ে গেলো। আমাকে শামা কারিয়ে দেবেন। এখোন তো আপনাদের সোনার সোমোয়, দোনো হাথ মে লাড্ডু। এখোন আপনারা এইটুকু গালতি মাফ কারিয়ে দিতে পারবেন।
আপনাদের ভালোবাষায় আমাদের ভোটবাক্সা একদম ভরে গেছে। আমরা আপনাদের এই ভালোবাষার বদলা বিলকুল সুদসামেত চুকতা কারিয়ে দেব। আপনাদের ছেলেমেয়েরা আনেক দিন ধরে এন্টি ডেভেলাপমেন্ট ভাষা সিখে বিলকুল বাকোয়াস তৈরি হোচ্ছে। আভি ওদের সব্বাইকে আমরা ডেভেলাপমেন্টের ভাষা এমোন আচ্ছা সে সিখাবো যে নকরির গঙ্গা মাইয়া এসে যাবেন ওয়েস্ট বেঙ্গালে।
হাঁ, ইয়ে সাচ বাত আছে কি দেশ মে বেকারি বহুত বেড়ে গেছে। পিছলে পঁয়তাল্লিশ সাল মে ইতনি বেকারি ছিলো না। লেকিন ওটা নিয়ে আপনারা একদম ভাববেন না। সব জায়গায় কিছু এন্টি নেসনাল আদমি থাকে, বেঙ্গালে থোড়া জিয়াদা আছে। ওরাই ইয়ে সব নিয়ে কথা বলছে। আপনারা ওদেরকে এই ভোটে যা থাপ্পাড় দিয়েছেন তার রিওয়ার্ড তো পাবেনই। জালদি আমরা বেঙ্গাল থেকে এন্টি নেসনালদের আউট কারিয়ে দেব। সাব উয়িদেশ থেকে ঘুসপেটি হয়ে ঢুকে আছে আর ওদেরই জন্যে আপনাদের নকরি হচ্ছে না।
বাই দা ওয়ে, আপনারা সাউথ ইন্ডিয়ার এন্টি নেসনালদের কোথায় একদম ভুলবেন না। ওরা ডেভেলাপমেন্ট চায় না। ইসি লিয়ে ওদের নেসনাল লেঙ্গুয়েজ নিয়ে বহুত প্রবলেম আছে। ওরা একদম বেকওয়ার্ড স্টেটস আছে। আপনাদের বেঙ্গালের যে একটা এন্টি নেসনাল ইকনমিস্ট আছে কি সেন? ওনার তৈরি কি সব আনাপ শানাপ ইনডেক্সে ওরা উপর দিকে আছে, লেকিন ভেদিক ইকনমিক্সে ওরা একদম ফেল আছে। রামায়ণ, মাহাভারাত কিচ্ছু ওরা মানে না। রাভাণ, মাহিষাসুরের মত ভিলেনদের ওরা পুজা করে। ওদেরকে ফালো করবেন তো কিচ্ছু ডেভেলাপমেন্ট হোবে না।
পার আমাদের বেঙ্গালিদের উপর ভিশোয়াস আছে। বেঙ্গালিরা সুইসাইড কোরবে না, তাদের মোদ্দে আনেক ইনটেলিজেন্ট মাইন্ডস আছে। আমাদের গালতি ভি সোশাল মিডিয়ায় ওরা এমোন ডিফেন্ড করে দেয় যে আমরা ভাবি “আরে ইয়ে তো গালতি থা হি নহি।“
উপার সে ইতনে সাল বাদ আমরা আপনাদের পার্টিশানের বদলা নেয়ার চান্স দিচ্ছি। আপনারা ছেড়ে দিবেন? রাভিন্দ্রনাথ টেগোর বোলেন, বাঙ্কিমচান্দ্র চাট্টোপাধ্যায় বোলেন, সোকোলেই বেঙ্গালিদের সাওধান করেছেন টার্মাইটদের বিরুদ্ধে। গদ্দার কমনিস্ট আর মমতাজ বেগম আপনাদের কাছে উয়ো সব লুকিয়ে রেখেছিল। এখোন আমরা ইতিহাস নয়া তারিকে সে লিখব তো দেখতে পাবেন।
বেঙ্গালি হিস্ট্রিতে লেকিন আনেক গদ্দার ভি আছে। ওদের এলমিনেট কোরতে হোবে। রামমোহান রয় আছে, ভিদিয়াসাগর আছে। হিন্দুধার্মের এরা যা শাতি কোরেছেন সব আমাদের রিভার্স কোরতে হোবে। তারপর মাইকেল মাদসুদান আছে। ক্রিশ্চান মিশনারিদের টাকায় রামজির বহুত বেইজতি কোরেছে। উসকা ভি উইচার আমরা কোরব। আর কোন কোন বেঙ্গালি এন্টি হিন্দুস্তান কাম করেছে উয়ো দেখার কাম আমরা কানভার্টেড বুদ্ধিজীউয়ীদের দিয়েছি। ওনাদের আর্ডিনারি বুদ্ধি নহি, এক্সট্রা আর্ডিনারি বুদ্ধি। সেগুলোর ইউজ কোরে নিতে হোবে। বাদ মে ওদের জন্যে ভি ডিটেনশন কেম্প হোবে। আমরা কোন বেঙ্গালির সাথে আন্যায় হোতে দিবো না, আপনারা দেখে নিবেন।
মনে রাখবেন, যারা দুর্গা মায়ের পূজা কোরে, রাষ্ট্রভাষা বোলে, তাদের কোন ভয় নাই। ভয় পাবে সির্ফ ভারত মাতার শত্রুরা।
ফির একবার সব বেঙ্গালিকে বহুত বহুত বাধাই।

%d bloggers like this: