বিবিসিকে বাদ দিয়ে বিশ্বগুরু থাকতে পারবেন মোদী?

বিবিসি যতখানি সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে চিরকাল, ততখানি আমাদের দূরদর্শন বা অল ইন্ডিয়া রেডিও কোনো দলের সরকারের আমলেই ভোগ করেনি

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন টানা তৃতীয় দিন ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের দিল্লি ও মুম্বাই অফিস জুড়ে বসে আছেন আয়কর আধিকারিকরা। বিবিসি কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের ইমেল পাঠিয়ে জানিয়েছেন আপাতত যেন দফতরে না এসে বাড়ি থেকেই তাঁরা কাজ চালিয়ে যান। এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া, ভারতের সম্পাদকদের একটি অগ্রগণ্য সংগঠন, এবং প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার মত সাংবাদিকদের সংগঠন একে সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা হিসাবে দেখছে জানিয়ে প্রথম দিনেই (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু সরকারপক্ষ কিন্তু বলেই যাচ্ছে, এটা বিবিসির দফতরে হানা নয়, সমীক্ষা (সার্ভে) মাত্র। এ এক আইনানুগ নিয়মিত প্রক্রিয়া। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আছে বলেই নাকি এই সার্ভে করা হচ্ছে।

বলা বাহুল্য, বিবিসি এ দেশের কোনো আইন ভেঙে থাকলে তদন্তের স্বার্থে তাদের দফতরে সার্ভে করা বা হানা দেওয়া এবং তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া ভারত সরকারের আয়কর বিভাগের অধিকার এবং কর্তব্য। কিন্তু মুশকিল হল, এরকম সার্ভে আয়কর বিভাগ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট গত কয়েক বছরে একাধিকবার দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমের দফতরে চালিয়েছে। অথচ একবারও কোনো সার্ভে বা হানা থেকে কোনো সংবাদমাধ্যমের অপরাধের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এডিটর্স গিল্ডের বিবৃতিতেই উল্লেখ করা হয়েছে নিউজক্লিক, নিউজলন্ড্রি, দৈনিক ভাস্কর এবং ভারত সমাচারের দফতরে আয়কর ও ইডি হানার কথা। তার বাইরেও বেশকিছু সংবাদমাধ্যমের দফতরে এমন ঘটনা ঘটেছে। কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের কাছে তো এসব জলভাত। তাঁরা কথায় কথায় কাগজ বন্ধ করে দেওয়া, নিগ্রহ, ইউএপিএ আইনে কারাবাস – এসবে অভ্যস্ত। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা টিভির অফিসেও ডিসেম্বর মাসে ইডি হানা দিয়েছিল। এই সবকটি সংবাদমাধ্যমই আবার কেন্দ্রীয় সরকারকে অসুবিধায় ফেলে এমন প্রতিবেদন বা বিরোধী মতামত প্রকাশ করার জন্য বিখ্যাত (বা সরকারের কাছে কুখ্যাত)। এ যদি নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার হয়, তাহলে বলতেই হবে এই কাক আর এই তাল একেবারে রাজযোটক। ফলে বিবিসির দফতরে যা চলছে তিনদিন ধরে, তাকে বাঁকা নজরে না দেখে উপায় নেই।

এডিটর্স গিল্ডের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০২ সালের গুজরাটের ঘটনাবলী এবং নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে দেশজুড়ে সংখ্যালঘু মানুষের উপর আক্রমণ নিয়ে বিবিসির দুই পর্বের তথ্যচিত্রের পরেই এই সার্ভে। সে তথ্যচিত্র দেশের মানুষকে দেখতে না দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল এই সরকার। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারকে দিয়ে ওই তথ্যচিত্রের সমস্ত লিঙ্ক ব্লকও করানো হয়েছিল। ফলে দুয়ে দুয়ে চার করতে কোনো অসুবিধা নেই।

তা বাদেও সরকার যে আসলে বিবিসির উপর ওই তথ্যচিত্রের শোধ তুলছে, আর্থিক অনিয়ম স্রেফ ছুতো – এমন মনে করার কারণ ঘটিয়ে দিচ্ছে নিজেই। কারণ বিবিসি দফতরে হানা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ‘সরকারি’ ভাষ্য নেই। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থার দফতরে এইরকম হানা (আচ্ছা সার্ভেই হল) আন্তর্জাতিক খবরে পরিণত হয়ে গেছে, অথচ আয়কর বিভাগের কোনো শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক বা অর্থমন্ত্রকের কোনো সচিব স্তরের আধিকারিক এ নিয়ে কোনো প্রেস বিবৃতি দেননি। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের দুটি টুইটার হ্যান্ডেলের একটিতেও এ নিয়ে একটি লাইন দেখলাম না। তাহলে প্রথম অনুচ্ছেদে লিখলাম কেন, সরকারপক্ষ বলেই যাচ্ছে…? সেখানেই মজা। ২০০২ সালে গুজরাটে ঠিক কী হয়েছিল, তা নিয়ে সঙ্ঘ পরিবার কখনো এক স্বরে কথা বলে না। একটি অংশ বলে, যা হয়েছিল বেশ হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদীদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন মোদী। আরেকটি অংশ বলে, খোদ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে মোদীজির কোনো দোষ ছিল না। এর উপর আর কথা হয় নাকি? সব বিরোধীদের অপপ্রচার।

আরো পড়ুন এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ

বিবিসির দফতরে আয়কর বিভাগের বিচরণ সম্পর্কেও একই পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে। এক দল সাংবাদিকের কাছে কিছু তথ্য পাঠিয়ে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে। একদা সরকারবিরোধী বলে পরিচিত, রায় দম্পতির প্রস্থানের পর সরকারি হয়ে ওঠা এনডিটিভির সাংবাদিক সংকেত উপাধ্যায়ই যেমন। তিনি টুইট করে এই অভিযোগের কথা জনসমক্ষে এনেছেন। অথচ এই তথ্যের সূত্র কী জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানিয়েছেন, সরকার প্রেস নোট হিসাবে ওই তথ্যগুলি জানিয়েছে। সরকার মানে কে? প্রেস নোটের উপর লেটারহেড কার ছিল? নিচের স্বাক্ষরটি কার? কোন মন্ত্রক থেকে পাঠানো হয়েছে এই নোট? এসবের কোনো উত্তর এই সাংবাদিকরা দিতে পারেননি। অন্যদিকে বিজেপির মুখপাত্ররা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময়ে বিবিসিকে তেড়ে গাল পাড়ছেন। বিবিসি দুর্নীতিগ্রস্ত, মিথ্যের ঝাঁপি খুলে বসেছে – এরকম নানা অভিযোগ করছেন। ঠিক যে অভিযোগগুলো ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’ তথ্যচিত্র মুক্তি পাওয়ার পরেও তাঁরা করেছিলেন। এই অভিযোগগুলো সত্যি হতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে আয়কর বিভাগের কী সম্পর্ক? এর কোনো উত্তর তাঁদের কাছে নেই। অর্থাৎ প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হচ্ছে, আর্থিক অনিয়ম নয়। আপত্তি বিবিসি কী দেখাচ্ছে তা নিয়ে।

স্বাভাবিকভাবেই ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলি এক সুরে সরকারকে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ থেকে শুরু করে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য পর্যন্ত সকলেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সরকারের নিন্দা করেছেন। কিন্তু তাতে মোদী সরকারের কী-ই বা এসে যায়? দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম হয় ভক্তিতে নয় ভয়ে সরকারকে প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছে। এনডিটিভির মত দু-একটি নাছোড়বান্দা সংবাদমাধ্যমকে মুকেশ আম্বানি বা গৌতম আদানি কিনে ফেলছেন – চুকে গেল ঝামেলা। কিন্তু বিবিসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তার কিছু অন্তত প্রমাণ করতে না পারলে অন্য ক্ষতির সম্ভাবনা। আজকের দুনিয়ায় নিজের দেশের সাড়ে বারোটা বাজিয়েও রাষ্ট্রনেতা হিসাবে বিদেশে নাম কুড়ানো অসম্ভব নয়। বিশেষ করে ভারতের মত দেশ, যার বিরাট বাজার বহুজাতিকদের দরকার এবং যে দেশ পরমাণু শক্তিধর – সে দেশের ভিতরে সংখ্যালঘুরা বাঁচল কি মরল, জনা দুয়েক পুঁজিপতি মিলে দেশের সমস্ত সম্পদের দখল নিয়ে নিল কিনা তা নিয়ে অন্য কোনো দেশ মাথা ঘামাতে যায় না। কিন্তু সেসব দেশের সংবাদমাধ্যমের গায়ে হাত পড়লে যা হয়, তা হল গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে পরিচিতির বারোটা বাজে। সে পরিচিতি নিয়ে কমিউনিস্ট চীনের রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষ মাথা ঘামান না। শি জিনপিং নিজের দেশের সকলকে নিজের ইচ্ছামত চালাতে পারলে খুশি, বিশ্বগুরু হতে চান না। কিন্তু মোদী তো চান। তাঁকে যদি ব্রিটেন, আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ভ্লাদিমির পুতিন আর জিনপিংয়ের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে একনায়ক বলে দেগে দেয় – তা কী পছন্দ হবে মোদীজির?

বিবিসি ব্রিটেনের রাজকীয় সনদের মাধ্যমে গঠিত সরকারের একটি মন্ত্রকের অধীন অথচ স্বায়ত্তশাসিত কর্পোরেশন। একে আমাদের প্রসার ভারতীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে। বিবিসি যতখানি সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে চিরকাল, ততখানি আমাদের দূরদর্শন বা অল ইন্ডিয়া রেডিও কোনো দলের সরকারের আমলেই ভোগ করেনি। ফলে ব্রিটেনে কনজারভেটিভ বা লেবার – যার সরকারই থাক, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মোদী যতই দহরম মহরম করুন, বিবিসি চটলে তারা আরও বেশি করে ভারত সরকার সম্পর্কে বিরূপ প্রচার করবে। বিবিসির দেখাদেখি অন্য বিদেশি সংবাদমাধ্যমও করবে। বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তিতে অনবরত আঁচড় পড়তে থাকলে কি খুশি হবেন মোদী? বিবিসি ধোয়া তুলসীপাতা নয়, তবে মনে রাখা ভাল, তারা কিন্তু নিজেদের দেশের ইতিহাসের বিশালকায় রাষ্ট্রনেতা উইনস্টন চার্চিলকেও ছেড়ে কথা বলে না। কথাটা বুঝতেন বলেই ইন্দিরা গান্ধী একসময়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি খড়্গহস্ত হয়েও পরে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ শুরু করেন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ফিফা থেকে নির্বাসন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা মাত্র

এমন কি হতে পারে যে ফিফা সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে (এআইএফএফ) নির্বাসন দেওয়ায় কোনো ভারতীয় খুশি হয়েছে? খেলোয়াড় বা ফুটবলপ্রেমীদের খুশি হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ক্লাবকর্তারাই বা খুশি হবেন কী কারণে? এমনিতেই তো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের বাইরের ক্লাবগুলো ধুঁকছে। তার উপর ফিফার নির্বাসন মানে ফিফা থেকে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) মারফত যা টাকাকড়ি এআইএফএফের কাছে আসত তা-ও বন্ধ থাকবে। ফলে ছিটেফোঁটা যা চুঁইয়ে পড়ত ক্লাবগুলোর দিকে, সে পথও বন্ধ হয়ে যাবে। স্পনসরদেরও খুশি হওয়ার কারণ নেই। স্পনসর মানে মোটের উপর আইএসএলের স্পনসরদের কথাই ধরতে হবে, কারণ তার বাইরে ভারতীয় ফুটবলে আগ্রহী স্পনসর পাওয়া বেশ কঠিন। নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতের আর সব ফুটবল প্রতিযোগিতার মত আইএসএলও হয়ে গেল ফিফার অনুমোদনহীন লিগ। অর্থাৎ আগামী জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোতে নতুন করে বিদেশি ফুটবলার আর নেওয়া যাবে না। বিদেশিরাই যে আইএসএলের জাঁকজমকের অর্ধেক, তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে এই নির্বাসনে খুশি হতে পারে কে?

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কেউ না। কিন্তু ভারত হল রামায়ণ-মহাভারতের দেশ। এখানে গল্পের মধ্যে গল্প, তার মধ্যে গল্প, সে গল্পের মধ্যেও আরেকখানা গল্প থাকে। এখানে আপাতদৃষ্টির ধোঁকা খাওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং হতেই পারে যে একদল ফুটবল প্রশাসক এই নির্বাসনে খুশিই হয়েছেন। দেশের ফুটবল এতে গোল্লায় গেলেও তাঁদের কিছু যায় আসে না। ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে পৈতৃক জমিদারি বানিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই জমিদারি হাতছাড়া হয়েছে মাত্র কয়েক মাস আগে। তখনই তাঁরা হুমকি দিয়েছিলেন, আদালত দেশের ফুটবল প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে ফিফা এ দেশের ফেডারেশনকে ব্যান করে দিতে পারে। সেই হুমকি ফলে যাওয়ায় আজ তাঁরা বাঁকা হাসতেই পারেন, মনে মনে বলতেই পারেন “দ্যাখ কেমন লাগে।” এই তাঁরা কারা? রহস্য করবার দরকার নেই, কারণ দেশের আপামর ফুটবলপ্রেমী জানেন প্রফুল প্যাটেল আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরাই আইনত মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও এআইএফএফ এক্সিকিউটিভ কমিটি আলো করে বসেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের গুঁতোয় আসনচ্যুত হওয়ার পর এবার যদি তিনি প্রফুল্ল অন্তরে এস্রাজ বাজান তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আদালতের নির্দেশে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি পদ হারালেও প্রফুল কিন্তু এখনো ফিফায় ভারতের প্রতিনিধি। ফলে কোনো কোনো মহল থেকে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে, যে ফিফার সিদ্ধান্তে তাঁর হাত আছে। কিন্তু ঘটনা হল, এর জন্য প্রফুলকে খুব একটা দায়ী করা চলে না। ফিফা আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সনদে স্বাক্ষরকারী। সেই সনদ অনুযায়ী বিশ্বের কোনো দেশের কোনো খেলার জাতীয় ফেডারেশনে সরকার বা কোনো তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ করলে সেই ফেডারেশনের অনুমোদন বাতিল করা হয়। সুতরাং যে মুহূর্তে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্স (সিওএ) গঠন করে ফেডারেশনের দায়িত্ব তাদের হাতে দিয়েছে, সেই মুহূর্তেই নির্বাসনের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

১৬ অগাস্ট সিওএ যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে ফিফার সিদ্ধান্ত তাদের অবাক করেছে। কারণ সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, ভারত সরকারের জাতীয় ক্রীড়া বিধি মেনে নতুন এক্সিকিউটিভ কমিটি গঠনের জন্য নির্বাচনের কাজ দ্রুত এগোচ্ছিল এবং এই প্রক্রিয়া নিয়ে অনবরত ফিফা, এএফসি সহ সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চলছিল। উপরন্তু, ২৫ জুলাই ফিফা-এএফসি এআইএফএফের অ্যাক্টিং সেক্রেটারি জেনারেলকে যে চিঠি দিয়েছিল প্রস্তাবিত স্ট্যাটিউট সম্পর্কে, সেই চিঠির সুপারিশ মেনে স্ট্যাটিউটে বদলও করা হয়েছে। কিন্তু ২৫ জুলাইয়ের চিঠিটি পড়লে সিওএ-র যুক্তি অসার বলে মনে হবে। কারণ ওই চিঠিতে প্রস্তাবিত স্ট্যাটিউট সম্পর্কে ফিফা-এএফসি কিছু আপত্তি প্রকাশ করেছিল। সেই আপত্তিগুলোতে বিশেষ আমল দেওয়া হয়নি, কোনো মতে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৫ অগাস্ট সাসপেনশনের চিঠিতে ফিফা সেকথাই উল্লেখ করেছে।

তবে এই নির্বাসন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফিফা কাউন্সিল নির্বাসনের সিদ্ধান্ত জানানোর পাশাপাশিই বলেছে, ভারত সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দপ্তরের সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখছে এবং আশাবাদী যে সমস্যা মিটে যাবে। আসলে এই সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক ফলগুলোর অন্যতম হল অক্টোবর মাসে এ দেশে যে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপ হওয়ার কথা, তা বাতিল হয়ে যাওয়া। সেটা হলে এ দেশের মেয়েদের ক্ষতি, ফিফাও তেমনটা চায় না। এমনকি ভারত সরকারও চায় না। সবেমাত্র স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নারী অধিকার নিয়ে একগাদা ভাল ভাল কথা বলেছেন, এখনই মহিলাদের বিশ্বকাপ ভারত থেকে সরে গেলে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেই হয়ত সরকারপক্ষের বিশ্বাস। নইলে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টের কাছে জরুরি ভিত্তিতে ১৭ তারিখই এ বিষয়ে শুনানির আর্জি জানাবেন কেন? সকাল সকাল শুনানি হওয়ার কথা এবং সর্বোচ্চ আদালত যদি সিওএকে ফিফার কথামত কাজ করার নির্দেশ দেন, তাহলে ভারতের নির্বাসন উঠে যেতে সপ্তাহ খানেকের বেশি লাগবে না।

কিন্তু নির্বাসন ক্ষণস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী – যা-ই হোক না কেন, দেশের ফুটবল এ অবস্থায় পৌঁছল কেন তা নিয়ে কিন্তু আলোচনা করতেই হবে। সুপ্রিম কোর্ট তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফুটবল প্রশাসনে নাক গলায়নি। দিল্লির আইনজীবী রাহুল মেহরাকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল কেন? সেসবের বিস্তারিত আলোচনা এখানে পাবেন।

প্রফুল প্যাটেল শুধু অগণতান্ত্রিক উপায়ে ফেডারেশনের মাথায় বসেছিলেন তা নয়, তাঁর আমলে কুকীর্তির তালিকা বেশ লম্বা। তাঁর আমলেই ফেডারেশনকে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করে দেশের ফুটবলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তায় পরিণত হয়েছে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ, যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো দেশের ফুটবল ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। আজ যে ফুটবলপ্রেমীরা গেল গেল রব তুলছেন, তাঁদের স্বীকার করে নেওয়ার সময় এসেছে, যে ফিফার সিদ্ধান্ত আসলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এমন নয় যে ভারতীয় ফুটবল দারুণ স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল, হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে প্রাণহানি হয়েছে। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল আইএসএল খেলছে – বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা এতেই খুশি হয়েছেন। দেশের আর কোথায় ফুটবল খেলাটার কী হল না হল তা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাতে রাজি হননি। তাঁরা খেয়ালই করেননি কলকাতা লিগটা পর্যন্ত ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছে। কখন হয়, কেমন করে হয় তার কোনো ঠিক নেই। দুই বড় ক্লাব নিজেদের মর্জি অনুসারে খেলে অথবা খেলে না। বছর ১০-১৫ আগে কলকাতায় তিন প্রধান ছাড়াও কিছু ক্লাব দেখা যেত যারা চমকে দেওয়ার মত ফুটবল খেলত। একসময় জাতীয় লিগে খেলা টালিগঞ্জ অগ্রগামী গেল কোথায়? নতুন দল গড়ে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের সাথে সমানে সমানে লড়ে যাওয়া ইউনাইটেড এসসি তো আইএসএল থেকে শত হস্ত দূরে। এমনকি মহমেডান স্পোর্টিংও অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে।

একই চিত্র জাতীয় স্তরে। মাহিন্দ্রা কোম্পানি দল তুলে দিয়েছে অনেকদিন হল। জেসিটির নাম আর শোনা যায় এখন? সবই আইএসএলের দোষে হয়েছে তা নয়, কিন্তু আইএসএল সব সংকটের শীর্ষবিন্দু। মুমূর্ষু ভারতীয় ফুটবলের চিকিৎসা করার বদলে প্রফুলের আমলে স্যালাইন, অক্সিজেন খুলে নিয়ে শেষ করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে আইএসএলের মাধ্যমে। গত দুই দশকে জাতীয় দলের সেরা খেলোয়াড়দের ধাত্রীভূমি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট ছোট ক্লাবগুলো। শিলং লাজং, আইজল এফসির মত ক্লাবের বহু বছরের পরিশ্রমকে পাত্তা না দিয়ে তাদের করে দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির (অর্থাৎ আই লিগের) নাগরিক। আর স্রেফ বিত্তের জোরে প্রথম সারির নাগরিক হয়েছে ইতিহাসবিহীন নর্থ ইস্ট ইউনাইটেড এফসি। ডেম্পো বা সালগাঁওকারের মত দল পড়ে রইল, গোয়া ফুটবলের ধারক ও বাহক হয়ে গেল এফসি গোয়া। বিজয়ন, সত্যেন, আনচেরি, পাপ্পাচানদের কেরল পুলিস কোথায় মিলিয়ে গেছে। টাইটেনিয়াম ক্লাবের কথা কজনেরই বা মনে আছে? সারা ভারত চিনছে কেরালা ব্লাস্টার্সকে।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

যে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলকে ফুটবল জগতের কেন্দ্রবিন্দু মনে করেন বাংলার ফুটবল পাগলরা, তাদের অবস্থাও তো কহতব্য নয়। প্রতি মরসুমের শুরুতেই মনে হয় এই বুঝি ইস্টবেঙ্গল দলটা উঠে গেল। তখন মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন আর একটি জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থা হয়। আর মোহনবাগান? তাদের নাম আদৌ মোহনবাগান কিনা তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয় মাঝেমধ্যে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি হিসাবে কলকাতা লিগ খেলে না দলটি, তারপর সেই প্রতিযোগিতায় হজম করে আসে আধ ডজন গোল।

এভাবে ভারতীয় ফুটবল কোনদিকে যাচ্ছিল? সুনীল ছেত্রী গোল করায় লায়োনেল মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর সঙ্গে পাল্লা দেন বটে, কিন্তু জাতীয় দলের ফলাফলে বিশেষ তারতম্য হয়নি। বাইচুং ভুটিয়া থেকে সুনীল হয়ে জেজে লালপেখলুয়া – জাতীয় দল ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে সেই একশোর আশপাশে ঘোরাফেরা করছে (২৩ জুন ২০২২ তারিখে সর্বশেষ আপডেটের সময়ে ১০৪)।

এই নির্বাসনে আশু ক্ষতি হল বরং মেয়েদের ফুটবলের। আমরা অনেকেই খবর রাখি না, মেয়েদের ফুটবলে ভারত অনেক এগিয়ে (৫ অগাস্ট ২০২২ তারিখে সর্বশেষ আপডেটের সময়ে র‍্যাঙ্কিং ৫৮)। সেই ফুটবল নিয়েও চরম ছেলেখেলা চলেছে প্রফুলের আমলে। শুধু যে অতি অযত্নে ইন্ডিয়ান উইমেন্স লিগ চালানো হয় তা-ই নয়, এ বছরের গোড়ায় দেশে এশিয়ান কাপের আয়োজন করতে গিয়ে চরম কেলেঙ্কারি হয়েছে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন ভারতীয় দলের ১২ জন কোভিডাক্রান্ত হওয়ার মেয়েদের আর সেই প্রতিযোগিতায় খেলাই হয়নি। অথচ তার জন্যে কে দায়ী তা নিয়ে ফেডারেশন মাথা ঘামায়নি, আজ অবধি কারোর শাস্তিও হয়নি। ভারতের ফুটবল মহল, সংবাদমাধ্যম – সকলেই এত সচেতন যে ওসব হওয়ার আশাও বোধহয় কেউ করেনি। শুধু কি তাই? অনূর্ধ্ব-১৭ মহিলাদের জাতীয় দলের সহকারী প্রশিক্ষক অ্যালেক্স অ্যামব্রোসের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে। সিওএ পত্রপাঠ তাঁকে বরখাস্ত করেছে। প্রফুলের আমল হলে কী হত কে জানে?

স্বভাবতই ফেডারেশনের নির্বাসনের খবরে যেরকম চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, কোমর ভেঙে যাওয়া ভারতীয় ফুটবলকে উঠে দাঁড়াতে গেলে কী করতে হবে তা নিয়ে সেরকম আলোচনা হবে না ধরে নেওয়া যায়। কারণ কোনো উপায়ে আইএসএল যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া নিশ্চিত করা গেলেই কোমর যে আদৌ ভাঙেনি তা বিশ্বাস করে নেবেন ফুটবলপ্রেমীরাও।

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত

ভারতীয় ক্রিকেট মানে ফলাফল নিরপেক্ষ ব্যবসা

জয় যা প্রকাশ করে তার চেয়ে বেশি লুকিয়ে ফেলে, পরাজয় যা ধামাচাপা রয়েছে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ভারতের সত্বর বিদায়ে মুহ্যমান ক্রিকেটপ্রেমীরা এভাবে ভেবে দেখতে পারেন। বিশ্বের সেরা টি টুয়েন্টি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বলে যে দেশ দাবি করে থাকে, ২০০৭ সালের পর থেকে তাদের একবারও চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা এবং ২০১৪ সালের পর আর ফাইনালের মুখ না দেখার পিছনে গভীরতর অসুখ খুঁজে দেখার এই তো সুযোগ। কোভিড যুগের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলগুলোর মত বুদ্বুদের মধ্যে বাঁচার ইচ্ছা প্রবল না হলে এ-ও ভেবে দেখা দরকার, সমস্যা কি কেবল দল নির্বাচন আর রণকৌশলে, নাকি গোটা ক্রিকেট কাঠামোটাই একদা জনপ্রিয় টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে দেখানো অসুস্থ মাড়ির মত “ভাল দেখায় বাইরে, পচে গেছে ভিতরে?”

এসব হিং টিং ছট প্রশ্ন যদি মাথার মধ্যে কামড়াতে শুরু করে, তাহলে বিশেষত বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমী বিপদে পড়বেন। কারণ সৎভাবে এগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই উঠে আসবে এক বঙ্গসন্তানের অনাচারের কথা। দেড়-দুশো বছর আগে মাইকেল মধুসূদন লিখেছিলেন “হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে বিবিধ রতন”। সেসব দিন চলে গেছে, এখন ভাঁড়ে মা ভবানী। সৌরভ গাঙ্গুলিই যে আমাদের সর্বশেষ রত্ন, তা কলকাতার কাগজ ও টিভি চ্যানেলের চিৎকৃত প্রচারে গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই আমরা মেনে নিয়েছি। তিনি শতরান করলে বাঙালি আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ, বাদ পড়লে কেন্দ্রের বঞ্চনা। স্টিভ ওয়কে ইডেন টেস্টে টসের জন্য অপেক্ষা করিয়ে রাখা আমাদের কাছে বিদ্যাসাগরের সাহেবের টেবিলে খড়ম পরিহিত পা তুলে বসার চেয়ে কম নয়। সে যুগে আমরা আরেকটু হলেই লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা খুলে মাথার উপর বনবন করে ঘোরানোর কীর্তিকে শিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতার পাশে বসিয়ে দিতাম। এহেন তেজস্বী বাঙালি আইকন কিনা ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি হওয়ার জন্য সমর্থন নিলেন এন শ্রীনিবাসনের। কে শ্রীনিবাসন? যাঁর অনাচার ভারতীয় ক্রিকেটে চূড়ান্ত অচলাবস্থার সূচনা করে। এমন অচলাবস্থা, যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বোর্ডের সংবিধানই নতুন করে লিখতে হয়েছিল। বোর্ডের দায়িত্ব দীর্ঘদিন ন্যস্ত ছিল সর্বোচ্চ আদালত নিযুক্ত অ্যাড-হক কমিটির হাতে। সেই অ্যাড-হক কমিটির প্রধান বিনোদ রাই, সব জেনেও, সৌরভের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে বিদায় নেওয়ার সময়ে বলেছিলেন, সৌরভের চেয়ে যোগ্যতর কোনো ব্যক্তি নেই এই পদের জন্য।

যোগ্যতম হলেও, নতুন সংবিধান অনুযায়ী এই ২০২১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সৌরভের বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদে থাকারই কথা নয়। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ওই চেয়ারে বসার আগেই ক্রিকেটে অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের কর্তা হিসাবে তিনি দু দফায় পাঁচ বছরের বেশি কাটিয়ে ফেলেছিলেন। তাই বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর মেয়াদ ছিল ন মাস। ছ বছর পদাধিকারী থাকার পর তিন বছরের কুলিং অফ পিরিয়ড, যখন সৌরভ কেবল বোর্ড নয়, বোর্ডের অধীন কোনো রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার পদাধিকারীও থাকতে পারেন না। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের মত সৌরভও বোধহয় মনে করেন দেশোদ্ধারের পথে আইনকে বাধা হতে দেওয়া চলে না। তাই তাঁর নেতৃত্বাধীন বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে সংশোধিত সংবিধান পুনরায় সংশোধনের আর্জি জানিয়ে বসল। অতঃপর “তারিখ পে তারিখ”।

তা-ও না হয় মানা গেল, কিন্তু যোগ্যতমের আমলে কেমন উদ্বর্তন হল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের? যে ঘরোয়া ক্রিকেটের শক্তিবৃদ্ধির জন্যই শাস্ত্রী-কোহলির দল গত কয়েক বছরে বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করতে পেরেছে বলে শোনা যায়, সেই ঘরোয়া ক্রিকেটারদের অতিমারীর আমলে হাঁড়ির হাল। ২০২০ সালের মে-জুন নাগাদ প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনেকেরই বোর্ডের কাছে এক নয়, দুই নয়, তিন বছরের টাকা পাওনা। আম্পায়ার, স্কোরার, কিউরেটার প্রমুখ খেলা চালানোর জন্য অপরিহার্য ব্যক্তিদেরও একই অবস্থা। সবে এ বছর সেপ্টেম্বরে বোর্ড বর্ধিত ফি এবং ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের প্রধানতম প্রতিযোগিতা রঞ্জি ট্রফি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও বন্ধ থাকেনি, আদৌ খেলা হয়নি ২০২০-২১ মরসুমে। বোর্ডের বক্তব্য ছিল, দু মাসের বায়ো বাবল তৈরি করে সংক্ষিপ্ত রঞ্জি ট্রফি আয়োজনও অসম্ভব। তার চেয়ে সাদা বলের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা ভাল। প্রেসিডেন্ট সৌরভ আর তাঁর যোগ্য সহকারী জয় শাহ কিন্তু ইতিমধ্যে আপ্রাণ চেষ্টায় আইপিএল সম্পূর্ণ করেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের সাথে যুক্ত কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ভাষ্যকার — সকলেই আইপিএলকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন। কারণ ওতেই নাকি বোর্ডের সংসার চলে, ওটি না বাঁচলে ঘরোয়া ক্রিকেট বাঁচবে না। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আইপিএল ফুলে ফেঁপে উঠছে, ঘরোয়া ক্রিকেটকে সতীনের সন্তানের মত দয়ার দানে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড অধুনা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বোর্ড; ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে বলে ইদানীং এক ধরনের জাতীয়তাবাদী গর্বও প্রচারিত হয়। কিন্তু সে গর্বে মহিলাদের কোনো ভাগ নেই। কন্যাসন্তানের পিতা সৌরভের আমলে অস্ট্রেলিয়ার মহিলাদের বিগ ব্যাশের আদলে মহিলাদের আইপিএল কিন্তু চালু হল না। অথচ ভারতের মহিলারা গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ায় টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিলেন। তবু, যে আইপিএল নাকি সর্বরোগহর বড়ি, মহিলাদের জন্য তার ব্যবস্থা করার সুযোগ হয় না পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বোর্ডের।

সব মিলিয়ে বলা চলে, গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া চলছে। আইনকানুনকে কাঁচকলা দেখানো বাহাদুরিতে পরিণত, কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বদ রসিকতায়। বোর্ড প্রেসিডেন্ট স্বয়ং এমন এক বাণিজ্যিক সংস্থার বিজ্ঞাপনে মুখ দেখান, যারা জাতীয় দলের শার্ট স্পনসরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আবার প্রেসিডেন্ট যুক্ত, এমন সংস্থা আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজ কিনে ফেলে। স্পষ্টতই সৌরভ শ্রীনিবাসনের পথেই হাঁটছেন। ইন্ডিয়া সিমেন্টসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ওই মালিক একইসঙ্গে বোর্ড প্রেসিডেন্ট এবং চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক ছিলেন। দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকে ইন্ডিয়া সিমেন্টসের ভাইস-প্রেসিডেন্টও করেছিলেন। সৌরভ সে তুলনায় আর এমন কী করেছেন?

আরও পড়ুন বোর্ডের ঘরে যে ধন আছে, ক্রিকেটের ঘরে সে ধন আছে?

নিয়ম ভাঙা ক্ষমতা প্রদর্শনের উপায় হয়ে দাঁড়ালে ভাল কাজও বাঁকা পথে করতে ভাল লাগে। ঠিক সেভাবেই ভারতীয় দলের কোচ হিসাবে নিয়োগ করা হল রাহুল দ্রাবিড়কে। আইনে যেমন বলা আছে সেভাবে ক্রিকেট অ্যাডভাইসরি কমিটি (সদস্য মদনলাল, রুদ্রপ্রতাপ সিং ও সুলক্ষণা নায়েক) বসিয়ে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে কোচ নির্বাচন করলেও দ্রাবিড় যোগ্যতম প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হতেই পারতেন। কিন্তু তাতে গুণময় বাগচীর মত পেশি ফোলানো যায় না। তাই প্রথমে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হল, দ্রাবিড় কোচ হতে পারেন। ফলত আর কেউ প্রার্থী হলেন না। অতঃপর ঘোষণা করা হল, আর কোনো প্রার্থী নেই, অতএব দ্রাবিড়ই কোচ হলেন। জনপ্রিয় প্রার্থীকে রিগিং করে জিতিয়ে দিলে তাঁর যোগ্যতাকে কতটা সম্মান দেওয়া হয় তা অশোক ভট্টাচার্যের একদা ঘনিষ্ঠ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদধন্য এবং অমিত শাহের পুত্রবন্ধু সৌরভ জানেন আশা করা যায়।

অবশ্য এত কথা তাঁর না ভাবলেও চলবে। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে জাতীয় দলের ব্যর্থতাতেও কিছু এসে যায় না। কদিন পরেই আইপিএলের খেলোয়াড় নিলাম হবে। আপামর ক্রিকেটভক্ত, সাংবাদিক, বিশ্লেষক টাকার অঙ্ক নিয়ে আলোচনা করবেন। তারপর আসবে বসন্ত — আইপিএলের আরও একটি মরসুম। দখিনা হাওয়ায় ভেসে যাবে আরও একটি আইসিসি টুর্নামেন্ট থেকে শূন্য হাতে ফেরার দুঃখ। ক্রিকেট খেলার ফলাফল নিরপেক্ষ ব্যবসায় পরিণত হতে আর বেশি দেরি নেই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: