পাঠশালা বন্ধ?

আমার জন্য, আমার ছেলেমেয়ের জন্য তো নতুন শিক্ষানীতি অনেক দ্বার খুলে দিল। সত্যি কি তাই? নতুন ব্যবস্থায় আপনারাও ফালতু লোকেদের দলে পড়ে যাবেন না তো?

অন্তত একজন মাস্টারমশাইকে চিনি যিনি খুব ছোটবেলায় পিতৃহীন হন, বাবা খুব সামান্য কাজ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর মা লোকের বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচার কাজ করে ছেলেকে বড় করেন। আমার বছর কুড়ির ছাত্রজীবনে অন্তত পাঁচ জন সহপাঠীকে পেয়েছি যারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, কিন্তু মেধা এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতায় অন্য সকলের চেয়ে দু তিন গুণ এগিয়ে। নিজেদের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে তারা সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছে। প্রাথমিক স্তরে একটা স্কুলে দু দফায় দু তিন বছর পড়েছিলাম, যেখানে প্রত্যেক ক্লাসে প্রায় নব্বই শতাংশ পড়ুয়াই প্রথম প্রজন্মের। আমার বাবা যে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সেই স্কুলেরও অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুল শেষ করতে পারত না। লেখাপড়ার চেয়ে, পরীক্ষা পাশ করার চেয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদ তাদের এবং তাদের পরিবারের অনেক বেশি। বাবার মুখে শুনতাম, এখন গঞ্জ এলাকার স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর কাছেও শুনি, অনেক ছাত্রীর মেধা থাকা সত্ত্বেও বিয়ে হয়ে যায় মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই। বেশি লেখাপড়া শিখলে পাত্র পাওয়া মুশকিল হবে, বরপণের অঙ্কটা তখন নাগালের বাইরে চলে যাবে। অনেক ছাত্রী স্কুলে এসে থেকে কেবল জানতে চায় কখন মিড ডে মিল পাওয়া যাবে, কারণ বাড়ি থেকে ভরপেট ভাত খেয়ে আসার সৌভাগ্য তাদের হয় না।

এই আমাদের দেশ। এ দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে আমরা কথা বলছি।

এটা মার্ক জুকরবার্গের দেশ নয়। আমরা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি যে সুন্দর পিচাই, সত্য নাডেলারা এখানে ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। আর তাদের গুগল, মাইক্রোসফটের সি ই ও হয়ে বসায় এ দেশের একটি মানুষেরও এক কণা লাভ হয়নি। ওগুলো কোন ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, কারণ ওতে ওঁদের দুজনের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ফুলে ফেঁপে ওঠা ছাড়া পৃথিবীর আর কারো কোন লাভ বা ক্ষতি হয়নি। প্রথম অনুচ্ছেদে যাদের কথা লিখেছি, তারাই এ দেশের মানুষ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। আমার পরিচিত মাস্টারমশাই যে শেষ পর্যন্ত মাস্টারমশাই হতে পেরেছেন, আমার ঐ সহপাঠীরা কেউ কেউ বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে, অধ্যাপনা করে তাক লাগিয়ে দিতে পেরেছে, তার কারণ অনেক দূর পর্যন্ত তাদের পড়াশোনার খরচের সিংহভাগ বহন করেছিল সরকার। তখনো বিপুল মাইনের বেসরকারী স্কুলে দিগ্বিদিক ভরে যায়নি (বিশেষত যারা অভিভাবকদের বলতে পারে দরকার হলে বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করে মাইনে দিন, নয়ত স্টুডেন্টকে নিয়ে যান), টাকা থাকলেই ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়ার ঢালাও সুযোগ ছিল না। কিন্তু মেধা থাকলে পড়া আটকাত না। কারণ পড়তে পুঁজির দরকার হত না, সরকারই ছিল মধ্যবিত্ত এবং গরীব বাবা-মায়ের পুঁজি। “লম্পট”, “দুশ্চরিত্র”, “দুর্বল” প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর তাঁর বিরোধীদের আসনে থাকা “গোঁড়া”, “সেকেলে”, “শিল্পবিরোধী”, “দেশদ্রোহী” বামপন্থীরা এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত জানত দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে বড় সুযোগ লেখাপড়া করা। এমন নয় যে তখন পাশ করলেই টপাটপ চাকরি জুটে যেত, দেশে বেকারত্ব ছিলই না। কিন্তু মেধা আছে, পুঁজি নেই বলে লেখাপড়া শেষ হবে না — এমনটা ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছিল।

সে ধারা গতিপথ বদলাতে শুরু করেছিল আজকের উচ্চবিত্তদের পরম পূজ্য মনমোহন সিং আর নরসিমা রাওয়ের আমল থেকে। আমাদের ছাত্রজীবনের শেষদিকেই দেখেছি অনেকে উষ্মা প্রকাশ করছে “ব্যাঙ্গালোর ট্যাঙ্গালোরে কত অপশন। একটু টাকা খরচ করলেই ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া যায়। এখানে লেফটিস্টগুলো না ইন্ডাস্ট্রি রেখেছে, না কলেজ খুলতে দিচ্ছে।” কোয়ান্টিটি-কোয়ালিটির ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের কথা তখন কেউ শুনতে চায়নি। বামফ্রন্ট সরকারও, শেষ অবধি, ঢালাও কলেজ খোলার অনুমতি দিলেন। ক্যাপিটেশন ফি কথাটা আমাদের অভিধানে জাঁকিয়ে বসল। সেই সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের রমরমা হল। তাদের সোম, বুধ, শুক্র একরকম ইউনিফর্ম; মঙ্গল, বৃহস্পতি অন্যরকম। সেখানে না পড়লে মনুষ্য জন্ম বৃথা বলে জানা গেল। ভদ্রসন্তানদের ইংরেজি শিখতে না দেওয়ার বামপন্থী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সে এক যুগান্তকারী আন্দোলন। কোন মাধ্যমে পড়াশোনা হচ্ছে সেটাই হয়ে দাঁড়াল মুখ্য। কী পড়ানো হচ্ছে, কত ভাল পড়ানো হচ্ছে, কারা পড়াচ্ছেন — সেসব ছেঁদো ব্যাপার হয়ে গেল। সরকারী স্কুলগুলো হয়ে পড়ল প্রান্তিক। কারণ ভদ্রসন্তানরা আর ওমুখো হলেন না, ফলে মাস্টারমশাই দিদিমণিদের পড়ানোর উৎসাহ তলানিতে পোঁছাল। ঝাঁ চকচকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নেই যে গ্রামাঞ্চলে তার কথা আলাদা। শহর বা মফস্বলে যারা লোকের বাড়িতে কাজ করে বা রিকশা চালায় বা ভাগচাষী, তাদের ছেলেমেয়েদের আবার কিসের মেধা? কী হবে তাদের লেখাপড়া শিখে? পথে দেখা হতে আমাদের এলাকার নামকরা ছেলেদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক একদিন হতাশ গলায় বললেন “আগে আমাদের স্কুলে পড়ত ডাক্তার, মাস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসারদের ছেলেরা। এখন কারা পড়ে জানিসই তো। এদের নিয়ে আর কী লেখাপড়া হবে?”

সেই কারণেই সরকারী স্কুল সরকারের নিজেরও দুয়োরানি হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারী স্কুলের ফি নিয়ে গণ্ডগোল মেটাতে নিজে আসরে নামেন, কিন্তু সরকারী স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়, নামমাত্র মাইনেয় কাজ করে যান প্যারা টিচাররা। অনশন করতে গিয়ে পথের পাশে মারা যান, কাগজের ভিতরের পাতায় খবর হয় আর মহামান্য আদালত নির্দেশ দেন এমন জায়গায় আন্দোলন করতে হবে যেখানে কারোর অসুবিধা হবে না।

এইসব ভাবনাতেই শিলমোহর দিল নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। যাদের বাবা-মায়ের সঙ্গতি আছে সেই ভদ্রসন্তানরা দামী স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। যত যাবেন তত গরীব, সংখ্যালঘু, নিম্নবর্গীয়, জাতি উপজাতির মানুষই কেবল পড়ে থাকবেন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর তাঁদের লেখাপড়া করা যে তেমন জরুরী নয় সে সিদ্ধান্ত সমাজ এবং সরকার তো নিয়েই রেখেছে। তাছাড়া সরকারী প্রতিষ্ঠানের আর কী দাম থাকবে? সরকারী পক্ষপাত তো রিলায়েন্স ইউনিভার্সিটির মত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিই। তাছাড়া নতুন শিক্ষানীতি বলেই দিয়েছে “চরে খাও।” রামকৃষ্ণ মিশন বা সেন্ট জেভিয়ার্সের মত হাতে গোনা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কে আর চরে খেতে পারবে? মাইনে বাড়বে। মধ্যবিত্ত ঋণ নেবে, নিম্নবিত্ত পড়া ছেড়ে দেবে। এ হেন বেসরকারীকরণে ভদ্রলোকদের খুশি হওয়ার মত আরেকটা ব্যাপার ঘটবে। যাদের তাঁরা “সোনার চাঁদ, সোনার টুকরো” বলেন, তাদের লেখাপড়া করা কমে যাবে। এমনিতেই বহু জায়গায় সংরক্ষিত আসনগুলো পূরণ হয় না (তথাপি জেনারেল ক্যাটেগরি ‘বঞ্চিত’), এরপর যেমন-খুশি-ফি-বাড়াও ব্যবস্থায় আরো কম ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে। কারণ ভদ্রলোকদের মস্তিষ্কের গভীরে প্রবিষ্ট প্রোপাগান্ডা যা-ই বলুক, ভারতের গরীব মানুষদের মধ্যে বামুন, কায়েতদের চেয়ে তফসিলি জাতি উপজাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।

আপনি ফোনে, ট্যাবে, ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে এতদূর পড়ে ভাবছেন বাজে সময় নষ্ট হল। ফালতু লোকেদের জন্য এত অশ্রুপাত কিসের? আমার জন্য, আমার ছেলেমেয়ের জন্য তো নতুন শিক্ষানীতি অনেক দ্বার খুলে দিল। সত্যি কি তাই? নতুন ব্যবস্থায় আপনারাও ফালতু লোকেদের দলে পড়ে যাবেন না তো? মনে রাখবেন, এখন থেকে কিন্তু ডিগ্রির দাম আর আগের মত থাকবে না। ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ছেড়ে দিলে সার্টিফিকেট, সেকেন্ড ইয়ারে ছাড়লে ডিপ্লোমা, শেষ অব্দি পড়লে ডিগ্রি। অধ্যবসায়ের বিশেষ দাম থাকল কি? চাকরির বাজারে এমন ডিগ্রির দাম থাকবে তো? ফিজিক্সের সাথে ইতিহাস পড়া যাবে শুনতে রোমহর্ষক। কিন্তু অঙ্ক আর কেমিস্ট্রি না পড়ে ইতিহাস পড়লে ফিজিক্স শেখা যাবে তো? অন্তত চাকরি বাকরি পাওয়ার মত শেখা সম্ভব হবে তো? যে সরকার এই শিক্ষানীতি বানিয়েছেন তাঁরা আবার মেকলের শিক্ষাব্যবস্থার বড় সমালোচক, কারণ ওটা ছিল ইংরেজ সরকারের কেরানি তৈরি করার ব্যবস্থা। তার বদলে এঁরা এনেছেন বহুজাতিকের বাধ্য কর্মী তৈরির ব্যবস্থা, তাই স্কুলস্তর থেকেই স্থানীয় ব্যবসায় ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা। কিন্তু সেটাও সুচারুভাবে সম্পন্ন হবে তো? তাছাড়া শিক্ষক শিক্ষিকাদের মেধাও তো এবার থেকে বাজারের পণ্য হয়ে গেল, তারও দরাদরি হবে। ইতিমধ্যেই উচ্চশিক্ষায় পার্ট টাইমার দিয়ে কাজ চালানো দস্তুর হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে তার যোগ্যতার উপযুক্ত দাম পাবে তো?

পাঠ্যক্রম কী হবে সে আলোচনায় কালক্ষেপ করা উচিৎ হবে না। যে যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এসে গেছে সেখানকার খবর রাখলেই সহজে আন্দাজ করা যায় নজরুল, সুকান্ত বাদ যাবেন। রবীন্দ্রনাথ টিকে গেলেও যেতে পারেন, তবে ‘ভারততীর্থ’, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ ইত্যাদি কবিতাগুলো ছেলেমেয়েদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেওয়া হবে না। বাংলার ইতিহাস ব্যাপারটা বাদ দেওয়াই ভাল হবে, কারণ সেই পাল যুগ থেকে শুরু করে পলাশীর যুদ্ধ অব্দি কেবল বিধর্মীদের রমরমা তো। আর উনবিংশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলন ব্যাপারটা একদম পড়ানো যাবে না। ঐ সময়েই তো বাঙালিরা সব অহিন্দু ম্লেচ্ছ হয়ে গেল। রামমোহন বলে একটা লোক গভর্নর জেনারেলকে চিঠি লিখল (ডিসেম্বর ১৮২৩), এ দেশের যুবকদের সংস্কৃত পড়ানোয় অত মন না দিলেও চলবে। ইংরেজি পড়ান, আধুনিক দর্শন পড়ান। মানে লোকটা কেবল পবিত্র সতীদাহ প্রথা তুলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। ও আপদ বিদেয় হতে না হতেই আবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলে আরেকজন হাজির। সে আরো বড় বিপদ। কেবল বিধবাদের বিয়ে দিয়েছে, মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছে তা নয়; পণ্ডিতদের সাথে, ব্যালান্টাইন সাহেবের সাথে ঝগড়া করে বেদ, বেদান্ত, সংস্কৃতকে পাশে সরিয়ে দিয়ে ইংরেজি আর পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার পাকা ব্যবস্থা করেছে। ওসব পড়েই তো দেশটা উচ্ছন্নে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র — এসব বুদ্ধি তো ঐ পশ্চিমের জানলা গলেই ঢুকে পড়েছে।

অবশ্য বাংলা ভাষাটাই তো থাকবে না, বাংলার ইতিহাসের কথা আসছে কোথা থেকে? ইংরেজি মাধ্যমে তো পড়াতে দেবেন না বলছেন সরকার। তা আপনারা যারা ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চেয়েছিলেন, তারা কি আর বাংলা মাধ্যমে পড়াবেন এখন? তা তো হয় না। সরকার জানেন সে কথা। তাই বলবেন হিন্দি মাধ্যমে পড়াতে। বোকা তামিলদের তাতে আপত্তি থাকতে পারে, আপনাদের তো নেই। এমনিতেই তো ছেলেমেয়ের সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি করে রেখেছেন অনেকে।

নয়া শিক্ষানীতি কি জয়, হিন্দি মিডিয়াম কি জয়।

ধারাবাহিক উপন্যাস কাল থেকে

একজন রাজনৈতিক কর্মী। হালে সাফল্য বলতে যা বোঝায় সে অর্থে ব্যর্থ। তার চেয়েও বড় কথা, তার নিজের বিচারে ব্যর্থ। আর তার সফল ছেলে। সময়ের চোখে সফল কিন্তু নিজের সাফল্য খতিয়ে দেখতে গেলেই সে বিভ্রান্ত হয়। এই দুটো মানুষের ঠোকাঠুকি আর ভালবাসা নিয়ে আড়াই বছরের চেষ্টায় একখানা উপন্যাস লিখেছিলাম। গত পুজোয় একটি পত্রিকায় প্রকাশ হব হব করেও সম্ভব হল না অনিবার্য কারণে।

অন্য কোন পত্রিকা আমার নাগালের বাইরে, বই হিসাবে প্রকাশ করা খরচ সাপেক্ষ এবং স্বখরচায় দুটো বই প্রকাশ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, উপার্জন দূরের কথা, ছাপার খরচটুকু তুলে আনাও দুঃসাধ্য। অথচ মানুষের গল্প পড়ার ক্ষিদে কমে গেছে এমন তো মনে হয় না। তাই এই অতিমারীর মাঝখানে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।

উপন্যাসটা ধারাবাহিকভাবে আমার ব্লগে প্রকাশ করব।

আপনাদের কল্যাণে ২০১৭ র নভেম্বরে চালু করা আমার বাংলা ব্লগ ১৬,০০০ হিট পেরিয়ে গেছে। নিয়মিত অনেক নতুন মানুষ আমার লেখা পড়েন। ফলত নিজের লেখা অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ওর চেয়ে ভাল জায়গা আমার জানা নেই।

তবে আমার অন্য পোস্টের সাথে একটু তফাত হবে। ব্লগটা চালু করার সময়ে আমি চাকুরে ছিলাম, এখন বেকার। উপরন্তু উপন্যাস লিখতে সবচেয়ে ওঁচা লেখকেরও বিলক্ষণ পরিশ্রম হয়, আমারও হয়েছে। পড়তে হলে সেই পরিশ্রমের দাম দিয়েই পড়া উচিৎ বলে আমি বিশ্বাস করি। অতএব একটা করে অধ্যায় যখন পোস্ট করব, তখন পোস্টের নীচে দাম দেওয়ার জায়গা থাকবে। যাঁরা দাম দিতে চান তাঁরা দিতে পারবেন। কতবার দেবেন বা আদৌ দেবেন কিনা তা পাঠকের ইচ্ছাধীন থাকবে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকে বলেছেন এমনটা করে লাভ নেই, বিনামূল্যে পড়া গেলে কেউ দাম দিয়ে পড়বে না। আমি কিন্তু দুরারোগ্য আশাবাদী। তাই পাঠকের উপর বিশ্বাস রাখতে চাই। আমার দিক থেকে অঙ্গীকার — কারোর মনে হবে না পয়সা দিয়ে ভুষি কিনছি।

অতএব আগামীকাল (৫ই জুলাই) থেকে প্রতি রবিবার আমার ব্লগে পোস্ট হবে উপন্যাস ‘নাম তার ছিল’ থেকে একটা করে অধ্যায় আর সেই লিঙ্ক পোস্ট করব আমার ফেসবুক দেয়ালে এবং টুইটার হ্যান্ডলে।

পড়বেন, মন্তব্য করবেন এবং অবশ্যই প্রয়োজন বুঝলে সমালোচনা করবেন। অন্যদের কথা জানি না, আমাকে সমালোচনাই সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করে আরো লিখতে।

যত পূজা হল না সারা

কার্ল সেগান টেগান ভেবে আনন্দ পেলে পাক, কিন্তু সেসব হয়ে ওঠার বদলে যদি আত্মহত্যা করে বসে তাতে ব্যথিত হওয়ার কিচ্ছু নেই


সুপ্রভাত,

তোমরা যখন এই চিঠি পড়বে তখন আর আমি থাকব না। আমার উপর রাগ কোর না। আমি জানি তোমরা অনেকে সত্যিই আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে, আমাকে ভালবাসতে এবং আমার সাথে ভাল ব্যবহারও করতে। আমার কারো প্রতি কোন অভিযোগ নেই। চিরকাল আমি নিজেই আমার সমস্যা। আমার আত্মা আর শরীরের ব্যবধান ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, ফলে আমি একটা দানবে পরিণত হয়েছি। আমি বরাবর লেখক হতে চাইতাম। বিজ্ঞান লেখক — কার্ল সেগানের মত। শেষ অব্দি এই চিঠিটা ছাড়া আমার আর কিছু লেখা হয়ে উঠল না।

আমি বিজ্ঞান, নক্ষত্র এবং প্রকৃতিকে ভালবাসতাম। কিন্তু মানুষকে ভালবেসেছিলাম একথা না বুঝেই, যে মানুষ বহুকাল হল প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। আমাদের অনুভূতি ধার করা, আমাদের ভালবাসা বানানো, আমাদের স্বকীয়তা কৃত্রিম শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আঘাত না পেয়ে ভালবাসা সত্যিই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একটা মানুষের দাম কমাতে কমাতে তার পরিচিতির সমান করে দেওয়া হয়েছে। একটা ভোটের সমান, একটা নম্বরের সমান, কোন একটা জড় পদার্থের সমান। কিছুতেই একটা মানুষকে একটা মস্তিষ্ক হিসাবে গণ্য করা হয় না, নক্ষত্রচূর্ণে তৈরি এক মহিমাময় বস্তু বলে তাকে ভাবা হয় না। কোন ক্ষেত্রেই হয় না। না লেখাপড়ায়, না রাস্তাঘাটে, না মৃত্যুতে, না জীবনে।

আমার জন্ম এক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। আমার শৈশবের একাকিত্ব কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ল না। আমি সেই কল্কে না পাওয়া শিশুটিই রয়ে গেলাম।

চলে যাওয়ার পর লোকে আমায় ভীতু বলতে পারে, স্বার্থপর বলতে পারে বা বোকা বলতে পারে। আমার তাতে বয়ে গেছে। আমি মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাস করি না, ভূত প্রেতেও বিশ্বাস করি না। আমি একমাত্র যা বিশ্বাস করি তা হল আমি তারায় তারায় ভ্রমণ করতে পারি আর অন্য বিশ্ব সম্বন্ধে জানতে পারি।

না, এটা সুশান্ত সিং রাজপুতের সুইসাইড নোটের বাংলা ভাষান্তর নয়। তিনি ভাল ছাত্র ছিলেন, জাতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষায় খুব উপরের দিকে র‍্যাঙ্ক করে দিল্লী কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তিও হয়েছিলেন। আর দুটো সেমিস্টার পড়লে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারও হয়ে যেতেন। পড়েননি সে তাঁর ইচ্ছা। অভিনয় করলে বেশি ভাল করবেন বিবেচনা করে ওখানেই লেখাপড়া সাঙ্গ করেন। সিদ্ধান্তটা যে খুব ভুল ছিল তা-ও নয়। আসলে ইংরেজিতে লেখা এই সুইসাইড নোট যে ছাত্রের তিনি কিন্তু লেখাপড়াই করতে চেয়েছিলেন। তিনি হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি গবেষক ছিলেন। সুশান্তের মত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেননি, এসেছিলেন দারিদ্র্য সীমার নীচের এক পরিবার থেকে। দোষের মধ্যে ছাত্র আন্দোলন করতেন, তার উপর জাতে ছোটলোক (মৃত্যুর পরে অবশ্য সকলে মিলে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল তিনি আদৌ তফসিলি জাতির মানুষ নন)। তাই তাঁর স্টাইপেন্ড বন্ধ করে দিয়ে, সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছিল।

যাঁরা এখনো বোঝেননি বা বেমালুম ভুলে গেছেন, তাঁদের জন্য বলা যাক — ছাত্রটির নাম রোহিত ভেমুলা। মানসিক স্বাস্থ্য, অবসাদ, depression মানে কেবল বাঙালি কবি কথিত মনখারাপ আর নিম্নচাপই কিনা — এসব নিয়ে আলোচনা দেখছি আর শুনছি। অবাক হয়ে ভাবছি এই গণ বেদনা, গণ উদ্বেগ, গণ হাহাকার কেন রোহিতের কপালে জোটেনি? একটা কারণ অবশ্যই সুশান্তের পেশা। অমন সুদর্শন একজন মানুষ, যিনি এগারোটা ছবির ছোট্ট কেরিয়ারে অনেককে মোহিত করেছিলেন, তাঁর এভাবে চলে যাওয়া ভারতের কয়েকশো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটার একজন অখ্যাত গবেষকের আত্মহত্যার চেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিক্রিয়াগুলো বোঝার চেষ্টা করছি।

রোহিতের আত্মহত্যায় সোশাল মিডিয়া এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভিতরে বাইরে বহু মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল “গেছে আপদ গেছে। লেখাপড়া না করে যারা রাজনীতি করে তাদের মায়া দয়া দেখানোর মানে হয় না।” অনেকের, বিশেষত রাষ্ট্রের, প্রতিক্রিয়া ছিল “ও তো দলিতই নয়, আবার দলিত দলিত করে নাচার কী আছে?” অস্যার্থ দলিত হলে না হয় কিছুটা কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করা যেত। ভয়, পাছে ভোট নষ্ট হয়। এ ছাড়াও কারো কারো প্রতিক্রিয়া ছিল “আমি ব্যাপারটা ঠিক জানি না। না জেনে কিছু বলা উচিৎ হবে না।” এর বাইরে ছিলেন তাঁরা, যাঁরা রোহিতের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলতে নারাজ। বলছিলেন ক্ষমতার কাঠামো তাকে ষড় করে জবাই করেছে আসলে।

এই শেষ দলের মানুষদের কথা বাদ দিন। তাঁরা স্পষ্টতই অ্যান্টি ন্যাশনাল। কিন্তু বাকিদের কারো কেন মনে হয়নি ছেলেটা বড় একা হয়ে গিয়েছিল, ওর পাশে কেউ কেন দাঁড়াল না? ছেলেটার হয়ত অনেক কিছু বলার ছিল, শোনার কেউ থাকলে এভাবে ওকে চলে যেতে হত না? ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমে রোহিতের সুইসাইড নোট পড়ে কারো তো মনে হয়নি “ইশ! ছেলেটার মহাবিশ্ব নিয়ে কি অদম্য আগ্রহ ছিল! যদি সেগানের মত লেখক হয়ে উঠতে পারত কি ভালই না হত!” আজ সুশান্তের অ্যাস্ট্রোফিজিক্স প্রীতি নিয়ে এই গণ হা হুতাশ ক্রমশ ক্লান্ত, ক্লান্ত করে। যে যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করুন, আসলে স্বীকার না করে উপায় নেই যে মনোযোগের এই পার্থক্যের আসল কারণটা রোহিতই তার সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন।

সুশান্ত যদি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির জয় লোবোর মত প্রত্যাশার চাপে গলায় দড়ি দিতেন, তাহলেও সে মৃত্যু রোহিতের মৃত্যুর চেয়ে আমাদের বেশি নাড়া দিত। প্রথমত তিনি মধ্যবিত্ত বলে, বাংলায় যাকে বলে ভদ্রলোকের ছেলে। দ্বিতীয়ত, সুশান্ত সিং রাজপুত বলে। অন্ধ্রপ্রদেশের মালা জাতের হতদরিদ্র একটি ছেলের ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে করতে আত্মহত্যা করা কোন দুর্ঘটনা নয় আমাদের কাছে। “ওরা তো রিজার্ভেশন না থাকলে চান্সই পেত না”। কিন্তু ভদ্রলোকের ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার বদলে আত্মহত্যা করবে — এ কিন্তু অকল্পনীয়। আঁতকে ওঠার মত। ২০১৬ সালে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সামনে সুশান্তর বক্তৃতা শুনলাম। সেখানে তিনি বলছেন ছোট থেকেই পরিবার ঠিক করে দিয়েছিল তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে, আর দিদিদের ডাক্তার হতে হবে। সুশান্তর পরিবার যেমন, ভারতীয় সমাজও তেমন। ঠিক করে দিয়েছে রোহিত যদি একে গরীব তায় ভেমুলা হয়, তাহলে তাকে মুচি মেথর না হোক, পিওন টিওনই হতে হবে। কার্ল সেগান টেগান ভেবে আনন্দ পেলে পাক, কিন্তু সেসব হয়ে ওঠার বদলে যদি আত্মহত্যা করে বসে তাতে ব্যথিত হওয়ার কিচ্ছু নেই। তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার কিচ্ছু নেই। বরং অর্থনৈতিক জোরে এই নিয়ম ভেঙে যদি টিনা দাবির মত কেউ আই এ এস পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে যায়, তখন তার মেধার প্রশংসা করার বদলে সবাই মিলে বলতে হবে “দেখেছ, কারা সব রিজার্ভেশন নিয়ে বসে আছে?”

তাই ভাবছিলাম, নিত্য সোনার চাঁদ সোনার টুকরো বলে ডাকা হয় যাদের, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কে ভাবে? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর এই প্রথম কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন একজন আদিবাসী — সোনাঝরিয়া মিঞ্জ। যাঁরা হতে পারেননি, কেবল গায়ের রঙ, মুখের ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে ইচ্ছাকৃত এবং অন্যমনস্ক টিটকিরি শুনতে শুনতে জীবন কাটালেন বা না পেরে পড়াশোনার জায়গা থেকে, চাকরি থেকে, কখনো বা জীবন থেকেই বিদায় নিলেন চুনী কোটালের মত, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কে ভাবে?

কে ভাবে সেইসব সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে, যারা কেবল মুসলমান বলে বা আমিষাশী বলে অন্য শহরে পড়তে গিয়ে, চাকরি করতে গিয়ে বাড়ি ভাড়া পায় না? ঘরে বাইরে অনলাইনে অফলাইনে গত দুদিন ধরে এই যে সকলের কথা মন দিয়ে শোনার, কোন বন্ধুকে একা হতে না দেওয়ার কোটি কোটি শপথ এর মধ্যে কোথাও এসবের প্রতিকারের কোন প্রত্যয় রয়েছে কি?

অলস কল্পনায় কোন শিল্পীর হয়ত ভাবতে ইচ্ছা করবে সুশান্ত আর রোহিতের স্বর্গবাস হয়েছে। সেখানে রোহিতের বায়োপিক হচ্ছে, রোহিতের ভূমিকায় অভিনয় করছেন সুশান্ত। আমার মত বেরসিক লোকেরা এসব ভেবে উঠতে পারে না। আমরা গল্পের গরুকে একেবারে চাঁদে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। মানে রোহিতের ভূমিকায় আলি ফজল।

মা হওয়া কি মুখের কথা?

হাতি মা এমনকি গোমাতাও নন। হলে না হয় একটা মন্দির টন্দির করে দেওয়ার কথা ভাবা যেত। তা যখন সম্ভব নয় তখন মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিবাদ করাই কি উচিৎ কাজ নয়?

আমাদের ভাবনায় মায়েরা অতিমানবিক। তাঁরা পারেন না এমন কিছু নেই। দশ মাস দশ দিন পেটে ধরতে পারেন, অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে প্রসব করতে পারেন, বাড়ির সব কাজ একাই করতে পারেন শুধু নয়, নিখুঁতভাবে পারেন। মায়েদের নেহাত মানুষ হয়ে বাঁচা খুবই লজ্জার। অতএব আমাদেরই দায়িত্ব যন্ত্রণা অকল্পনীয় স্তরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের অতিমানবিক হতে সাহায্য করা। এই দায়িত্ব আমরা একনিষ্ঠ নিয়মানুবর্তিতায় বরাবর পালন করে এসেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা দাঁড়ান।

একেবারে পুরাণ থেকে শুরু করুন। সীতা অন্তঃসত্ত্বা, রামচন্দ্র বাবা হবেন। যাকে বলে হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার। একজন রানীর প্রসবে কোন সমস্যা হওয়ারই কথা নয়। সর্বদা যত্নে থাকবেন, ভালমন্দ খাবেন, সময় মত রাজবৈদ্যের উপস্থিতিতে তাঁর সন্তান হবে। কিন্তু তা আর হল কোথায়? দস্যু মোহনের গল্পের মত “কী হইতে কী হইয়া গেল”, সীতার চরিত্র সম্বন্ধে সর্বজ্ঞ রাম পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। প্রজাদের কানাকানি তাঁর কানে জ্বালা ধরাল, তিনি সীতাকে নির্বাসন দিলেন। লব কুশের জন্ম হল জঙ্গলের মাঝখানে বাল্মীকির আশ্রমে।

তারপর দেবকী। তিনিও রাজনন্দিনী, যথারীতি আরেক রাজার সাথে বিয়েও হল। এঁরও যথা সময়ে নির্বিঘ্নে মা হতে পারার কথা। কিন্তু পাষণ্ড ভ্রাতা কংস ইতিমধ্যে খবর পেয়েছে বোনের অষ্টম গর্ভই তার মৃত্যুর কারণ হবে। তাই স্বামী স্ত্রী দুজনকেই ঢোকাও কাস্টডিতে। আর কি নিখুঁত ব্যবস্থা! অষ্টম গর্ভ অব্দি অপেক্ষা করার ব্যাপার নেই। একটি করে সন্তান হয় আর পত্র পাঠ তাদের শেষ করে দেওয়া হয়। এত কষ্ট সহ্য করেও কিন্তু দেবকী ঠিক শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দিয়েই ফেললেন। আবার স্বামী-স্ত্রী ষড় করে দৈব সহায়তায় সন্তানটিকে বাঁচিয়েও ফেললেন। ভাবুন, দেবকী অতিমানবিক নন?

কলি যুগ বলে আজকাল সতীত্ব টতীত্ব নিয়ে লোকে অত মাথা ঘামায় না। বিজ্ঞান সে যুগের মত উন্নত নেই। ফলে অমুকের গর্ভ তমুকের মৃত্যুর কারণ হবে — এসবও জানতে পারা যায় না। তবে অতিমানবিক মা কিন্তু কম পড়েনি। এই ধরুন ‘মাদার ইন্ডিয়া’। ছবিটা নাকি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। ভাবুন, একজন মহিলা স্বামী পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর চরম দারিদ্র্য সামলে ছেলেদের মানুষ করলেন। শেষে আবার বিগড়ে যাওয়া ছেলেকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে নিজেই তাকে হত্যা করলেন। এ যুগের কোন বাবা পারবেন? ক্ষমতাবান, স্নেহান্ধ বাবাদের আমলে ছেলেদের সম্পত্তি কেমন লাফিয়ে বাড়ছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
সে যা-ই হোক, সিনেমার মাদার ইন্ডিয়াকে অন্তত গর্ভাবস্থায় রাজার তাড়নায় জঙ্গলে বা জেলে কাটাতে হয়নি। বাস্তবের গুজরাটে বিলকিস বানোর তিন বছরের মেয়ে সালেহাকে তাঁর চোখের সামনেই পাথরে আছড়ে মেরে ফেলা হয় বলে অভিযোগ। আসলে ধর্ষণ করার তাড়া ছিল আর কি। তারপর এতগুলো বছর কেটে গেছে, বিলকিস এখনো আইন আদালত করে চলেছেন। অতিমানবিক নয়? মা বলেই তো পারেন।

তারপর সফুরা জারগর। ভাল ছাত্রী, পি এইচ ডি করছেন জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজের এবং আসন্ন সন্তানের নাগরিকত্ব লোপাট করে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে মিছিল, মিটিং, ধরনা সংগঠিত করার অপরাধে গত ১২ই এপ্রিল গ্রেপ্তার হয়েছেন। কোন দোকানে আগুন লাগাননি, কাউকে গাঁট্টা পর্যন্ত মারেননি। অন্যকে ওসব করতে প্ররোচিত করেছেন এমন প্রমাণও আদালতে দাখিল করা হয়নি পুলিশের পক্ষ থেকে। তবু এই অন্তঃসত্ত্বা তরুণী গতকালও জামিন পেলেন না। বিচারক বললেন অন্তত চাক্কা জ্যাম করার প্রাথমিক প্রমাণ তো পাওয়া গেছে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে। অতএব জামিন দেওয়া যাবে না। এ নিয়ে অনেকে রাগ করছেন। তাঁরা মহৎ উদ্দেশ্যটা বুঝতেই পারছেন না। সফুরাকে এমন যন্ত্রণার মধ্যে না রাখলে তিনি পৌরাণিক মহত্ত্বে উত্তীর্ণ হবেন কী করে? পুরাণগুলো কি কেবল হিন্দুদের সম্পত্তি নাকি? ওগুলো হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সব ভারতীয়ের। সে যুগে ইসলাম ছিল না বলে দুঃখ কষ্ট সহ্য করে মহত্ত্ব অর্জনে মুসলমান মহিলারা অনেক পিছিয়ে আছেন। তাঁদের সমান হওয়ার সুযোগ দিতে হবে না?

এখন আপনারা বলবেন হাতি মায়ের জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভুলভাল তথ্য দিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছেন, মানুষ মায়ের জন্য কেন দরদ নেই? ধুর মশাই! হাতি কি মানুষ? তার কি পুরাণ আছে? তার মহৎ হওয়ার কোন দরকার আছে? সে একটা নিরীহ জীব। তাকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখাই কর্তব্য। বিশেষত বাকি ভারতে শিল্পের জন্য, খনিজের জন্য, বুলেট ট্রেনের জন্য জঙ্গল সাফ করে দেওয়ার ফলে হাতিদের যখন ক্ষতি হচ্ছে তখন কেরালায় অন্তত তাদের বাঁচাতেই হবে। তাই এই তৎপরতা। ভাল করে ভেবে দেখুন, হাতি মা এমনকি গোমাতাও নন। হলে না হয় একটা মন্দির টন্দির করে দেওয়ার কথা ভাবা যেত। তা যখন সম্ভব নয় তখন মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিবাদ করাই কি উচিৎ কাজ নয়?

মাথা ঠান্ডা করে শবাসন করুন। করলেই বুঝতে পারবেন, সব ঠিক আছে। মায়েদের প্রতি আমাদের ব্যবহার একেবারে সনাতন ঐতিহ্য মেনে চলছে। অসুবিধা অন্যত্র। মায়েরা তো মহান হয়ে যান, এবারও হবেন হয়ত। বিষ্ণুর অবতার রামকে কিন্তু শেষ অব্দি নিতান্ত ছাপোষা গেরস্থের মত অবসাদে ভুগে সরযূ নদীর জলে ঝাঁপ দিতে হয়েছিল। কংসের অবস্থা আরো শোচনীয়। জনসমক্ষে হাঁটুর বয়সী ছেলের কাছে বেদম পেটানি খেয়ে মৃত্যু। পুরাণ কিন্তু ভারতীয়দের যৌথ উত্তরাধিকার, কেবল হিন্দুদের সম্পত্তি নয়।

ভারতমাতা কি জয়!

নতুন করে পাব বলে

কেবল ঠেলে খনির গভীরে পাঠানো তো নয়, আরেক রকম ব্যবস্থাও আছে

20200508_164038-COLLAGE.jpg

প্রিয় কবি,

আপনার সাথে আমার সংলাপে বিপত্তির অন্ত নেই। এক দিকে খবরদারি, অন্য দিকে দেখনদারি। আপনাকে নিজের করে পাবার জো নেই।

এক দল টিকি নেড়ে বলবে “রবীন্দ্রনাথকে যেখানে সেখানে যেভাবে ইচ্ছে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলেই হল? নিয়ম কানুন নেই? আজ প্রত্যুষে শুকতারাটি অমুক কোণে স্থির হয়ে ছিল কি? না হয়ে থাকলে কোন আক্কেলে গুনগুনিয়ে ‘ধীরে ধীরে ধীরে বও’ গাইছিলে? বলি ভোরের বেলার তারা তুমি পেলে কোথায়?”

আবার বিপক্ষ দল বলবে “কিসব ন্যাকা ন্যাকা ব্যাপার! রবীন্দ্রনাথ কারো বাপের সম্পত্তি নাকি? রবীন্দ্রনাথকে বুকে রেখেচি। বুকে। শালা হৃদয় আমার নাচে রে, পাগল কুত্তার মত নাচে রে।”
প্রথম দলের মত আসলে এরাও মনে করে আপনি এদের পৈতৃক সম্পত্তি। আপনার লেখা নিয়ে যা ইচ্ছে করলেই হল। অন্য কারো লেখা চটকালে তো সহজে বিখ্যাত হওয়া যায় না।

আমাকে তাই বারবার আপনাকে নিয়ে পালাতে হয়। কোলাহল বারণ হলে মন্দ হয় না, আপনার আমার কথা কানে কানে হওয়াই ভাল। গত পঁচিশে বৈশাখের পর থেকে আজ অব্দি যা যা হয়েছে, তাতে আপনার সাথে কিছু নতুন সংলাপের প্রয়োজন হয়েছে। সে কথাই বলি।

কহো মোরে তুমি কে গো মাতঃ!

মহাসঙ্কট উপস্থিত। দেশের রাজার (হ্যাঁ, রাজাই। স্বাধীনতার এত বছর পরে দেশটা একেবারে যক্ষপুরী হয়ে উঠেছে। সে কথায় পরে আসছি) আদেশ, দেশকে মা বলে ভাবতে হবে। কেবল ভাবলে হবে না, আবার চিৎকার করে ডাকতেও হবে। যারা ছাগল ছানাদের মত দিবারাত্র গলা ছেড়ে ডাকবে না, তাদের দেশের শত্রু দেগে দেওয়া হয়েছে। গারদে ভরার ব্যবস্থাও হয়েছে। দেশকে মা বলে ডাকতে হুকুম হয়েছে, এদিকে দেশের লোককে সন্তান ভাবার হুকুম হল না। তারা কেবল প্রজা। রাজা হুকুম করবেন, তারা তামিল করবে। অন্যথা হলেই রাজার পাইক, বরকন্দাজ লাঠিপেটা করবে, গারদে ভরবে। আবার সকলে প্রজা নয়, কেউ কেউ প্রজা। রাজা যাকে প্রজা বলবেন, কেবল সে-ই প্রজা। বাকি সব অনুপ্রবেশকারী শয়তান।

তা দেশ মানে কী? দেশ মানে কে? আপনাকে সে প্রশ্ন করতে গিয়ে কোন মায়ের ছবি তো পেলাম না। পেলাম কেবল মানুষ। ক্লাসঘরে আর ঠাকুরঘরে আপনাকে দেখতে অভ্যস্ত চোখে দেখলাম আমার সাথে প্রতিবাদ মিছিলে। যে মহামানবের সাগরতীর বলে ভারতকে চিনিয়েছেন, দেখলাম সেই মানবসাগরই আপনাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আপনার বিশ্বভারতী অভ্রভেদী দেবালয় হয়ে গেছে অনেকদিন, তা থেকে আপনার বিগ্রহটুকুও উধাও করে দেওয়া হবে অদূর ভবিষ্যতে। তাতে অবশ্য কিছু এসে যায় না। শিবরাম কবেই সাবধান করেছিলেন, “সঙ্ঘ মানেই সাংঘাতিক।” চুলোয় যাক সেই সঙ্ঘ, তার সাথে আর যত সঙ্ঘ আছে। আপনি তো আমাদেরই লোক। আমরা আমাদের মত করে পেলেই হল। কিন্তু গোলমালের এখানেই শেষ নয়।

দেশকে দিনরাত মা বলে প্রণাম ঠুকতে হবে, অথচ মায়েদের জন্য দেশটা বড় শক্ত ঠাঁই হয়ে উঠেছে। যারা প্রজা হয়ে থাকতে রাজি নয়, যারা আপনার গান শুনে বা না শুনে দাবী করেছে আমরা সবাই রাজা, তাদের মধ্যে মায়েরা বড় কম ছিলেন না। সেই মায়েদের উপর রাজার আঘাত নেমে এসেছে। সাতাশ বছরের সফুরা জারগরের সন্তানের জন্মের প্রথম ক্ষণ শুভ হবে না, হতে দেওয়া হবে না। কারাগারের অন্ধকূপে তাকে মা হতে হবে রাজার আদেশে। পুরাণকে ইতিহাস বলে গেলানো কংস রাজার অনুগত অসুরকুল অবশ্য তাতেও খুশি নয়। তারা প্রশ্ন তুলেছে সফুরা কি বিবাহিতা, নাকি সফুরা কুমারী? মুসলমানবিদ্বেষী, বিকৃত কামনায় হিলহিলে অসুরকুল মায়ের অগ্নিপরীক্ষা চায়। সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলেছে।

সফুরা কুন্তীর মত কুমারী না হলেও তার সন্তান যেন কর্ণের মতই পাণ্ডব বর্জিত হয় তা নিশ্চিত করতে রাজা রাতে মাত্র চার ঘন্টা ঘুমিয়ে নতুন ভারত গড়েছেন। এ ভারতে সংখ্যালঘুকে গর্ভে থাকতেই নিষ্ফলের, হতাশের দলে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়। কবি, এ দেশে কি আর কেউ অনাথ বিধর্মী শিশুকে নিজের সন্তান বলে মানবে? আর কি কোন সন্তান বলবে “আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকল জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন”?
আপনি কি পিছিয়ে পড়লেন, কবি?

৪৭ফ, ৬৯ঙ

“একদিনের পর দুদিন, দুদিনের পর তিনদিন; সুড়ঙ্গ কেটেই চলেছি, এক হাতের পর দু হাত, দু হাতের পর তিন হাত। তাল তাল সোনা তুলে আনছি, এক তালের পর দু তাল, দু তালের পর তিন তাল। যক্ষপুরে অঙ্কের পর অঙ্ক সার বেঁধে চলেছে, কোন অর্থে পৌঁছয় না। তাই ওদের কাছে আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা।”

আমাদের কালের কথাই লিখেছেন আপনি। এতখানি বয়সে এসে এই উপলব্ধি হল। যক্ষপুরীর কথা বলছিলাম। শুধু দেশটা কেন? গোটা পৃথিবীটাই যে রক্তকরবীর যক্ষপুরীতে পরিণত। নবীন কোরোনাভাইরাস এসে কদিন খনির দরজা এঁটে দিয়েছে৷ তাই এ কদিনের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে ৪৭ফ আর ৬৯ঙ দের এবার মুখের রক্ত তুলে মরতে হবে। যক্ষপুরীর কবলের মধ্যে ঢুকলে তার হাঁ বন্ধ হয়ে যায়, এখন তার জঠরের মধ্যে যাবার একটি পথ ছাড়া আর পথ নেই। তাই বিল্ডারদের সাথে মিটিং করে সরকার রেলকে বলে “এদের বাড়ি যাবার ট্রেন বাতিল করো হে।” যদিও বিস্তর চেঁচামেচি হওয়ায় ঢোঁক গিলে বলতে হয়েছে “আচ্ছা বাতিল করতে হবে না। এরা যাবেখন।”
কেবল ঠেলে খনির গভীরে পাঠানো তো নয়, আরেক রকম ব্যবস্থাও আছে। বিশেষত আমাদের মত পুঁথি পড়ে চোখ খোয়াতে বসা, সর্দারদের চর বিশু পাগলদের জন্য। চাকরি থেকে ছুটি। ওরা বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছে, কেমনে দিই ফাঁকি?

উত্তর খুঁজছি, পাচ্ছি না। রচনাবলী, গীতবিতান, ছিন্নপত্রাবলী, ইংরেজি বক্তৃতামালা — সর্বত্র খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে আপনার উপর বেজায় রেগে যাচ্ছি কখনো, কখনো আনন্দে কাঁদছি, আত্মগ্লানিতে হাসছি, বিষাদে চুপ করে থাকছি। সংলাপ চলছে, চলবে। আপনাকে এ জানা আমার ফুরাবে না।

যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে

“কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, মেয়েটা হায়ার সেকেন্ডারি দিচ্ছে… কিছু একটা তো করতে হবে… ভাই একটা ডিও নেবে? লেডিস, জেন্টস দুরকমই আছে…”


আজ মে দিবস। সকালে ফ্ল্যাটের নীচে নেমে মাছ কিনছি, এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালেন কিছুটা কুচো চিংড়ি কিনবেন বলে। টাকা হাতেই রাখা এবং বেশভূষা দেখে বোঝা যায় কারোর বাড়িতে কাজ করেন। কথায় কথায় বললেন “কোরোনা হবার হলে হবেই। আমাদের পাড়ায় তিন বাড়িতে তিনজনের। কেউ কারো বাড়ি যাচ্ছে না। কিন্তু হল তো?”

লকডাউন শুরু হয়েছে এক মাসের বেশি হয়ে গেল। আমার ওয়ার্ক ফ্রম হোম, আমার মত ফ্ল্যাটবাসীদের অনেকেরই তাই। যাঁরা বাসন মাজেন, কাপড় কাচেন জীবিকা নির্বাহের জন্য, তাঁদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম বলে কিছু হয় না। আর যাদের হয় না তাদের মধ্যে আমার স্ত্রী, আমার অনেক প্রতিবেশীও পড়েন। লকডাউনে আমাদের কারো তেমন অসুবিধা নেই। ঘরে বসেও মাস গেলে মাইনে পাচ্ছি, কারণে অকারণে কর্তৃপক্ষ খানিকটা কেটে নিলেও। কিন্তু ঐ ভদ্রমহিলার মত যাঁরা, তাঁদের কাজে বেরোতেই হচ্ছে। লকডাউন মানলে তাঁরা মাইনে পাবেন না, ভাত খেতে পাবেন না, কেবল গালি খাবেন। বাড়ির কাজের দিদিদের ছুটি দেওয়ার কারণে প্রতিবেশীদের রক্তচক্ষু সহ্য করতে হয়েছে পাড়ার কোন কোন পরিবারকে। অনেকে আবার ছুটি দিয়েছেন নিজের পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে, কিন্তু “কাজ করছে না যখন মাইনে পাবে কেন?” এই যুক্তি প্রয়োগ করছেন। ফলত ভদ্রমহিলাকে আর বললাম না যে “হবার হলে হবেই” কথাটার কোন মানে হয় না, সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। স্পষ্টত আমার কাছে যে কথার যা মানে ওঁর জীবনে তা নয়। আমার কাছে মে দিবস একটা ঐতিহাসিক দিন, ওঁর কাছে একটা অর্থহীন শব্দবন্ধ।


মার্চ মাসের শেষ দিক থেকেই অফিসে, পাড়ায় তুমুল আলোচনা — কোথায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাওয়া যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে না। কারো কারো অভিযোগ লিকুইড হ্যান্ড ওয়াশ অ্যামাজনে পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না, ডেটল কিনতেও ঘুরতে হচ্ছে তিন চারটে দোকান। ভদ্রলোকেদের মহাসঙ্কট। আমার বাড়িতে কিন্তু এখনো লিকুইড হ্যান্ড ওয়াশ পর্যাপ্ত। কী করে? সে কথাই বলি।

হুগলী শিল্পাঞ্চল বলতে একসময় যা বোঝাত, আমার বাড়ি সেই এলাকায়। তবে একে একে নিভিয়াছে দেউটি। রেললাইনের ওপারে জি টি রোডের ধারে র‍্যালিস ইন্ডিয়াকে আমি বরাবর অশ্বত্থবেষ্টিত দেখেছি। গদি তৈরির রিলাক্সন কারখানা অনেক দড়ি টানাটানির পর বন্ধ হয়ে গেছে আমি কলেজে ঢোকার আগেই। ন্যালকোর রমরমা রং তৈরির কারখানা, যার পাশ দিয়ে স্কুলে যেতাম, স্থানীয় লব্জে যা অ্যালকালি, তাও প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা হয়ে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘকাল। পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করতে পাঁচিলের ইঁট সরিয়ে কিছু লোককে তেলেনাপোতায় ঢুকতে দেখতাম স্কুলজীবনের শেষদিকেই। জে কে স্টিল প্রেতপুরী, পূর্ণিমা রাতে ভাঙা দোলনা দিব্যি মেরামত হয়ে যায় আর মধুবালা দোল খেতে খেতে গান করেন “আয়েগা আয়েগা আয়েগা। আয়েগা যো আনেওয়ালা”। শেষ পর্যন্ত একা দাঁড়িয়ে ছিল বিড়লাদের হিন্দমোটর কারখানা। তার ভিতর দিয়ে গেলে এখন মন খারাপ হয়ে যায়। আরো মন খারাপ হয় ট্রেন কোন্নগর স্টেশন ছাড়লে ডানদিকে তাকিয়ে যখন দেখি বন্ধ কারখানার চৌহদ্দিতে আদিগন্ত ঝিলের অনেকটা বুজিয়ে গগনচুম্বী আবাসন তৈরি হচ্ছে। এ শুধু আমার বাড়ির আশপাশের বন্ধ কারখানার ফিরিস্তি। গোটা হুগলী জেলায় ছোট বড় এমন অজস্র কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তা এত সব বন্ধ কারখানার শ্রমিকরা কী করেন? তাঁরা বাড়ি বাড়ি আসেন।

কেউ আমার কাকাদের বয়সী, অপমানে মাটিতে মিশে যেতে যেতে বলেন “কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, মেয়েটা হায়ার সেকেন্ডারি দিচ্ছে… কিছু একটা তো করতে হবে… ভাই একটা ডিও নেবে? লেডিস, জেন্টস দুরকমই আছে…”

কেউ আমার চেয়ে বয়সে সামান্য ছোট, চমৎকার কথা বলে, বোঝা যায় লেখাপড়ায় নেহাত খারাপ ছিল না। কিন্তু বোধহয় কোম্পানির মালিকের পাতে মাছের পিস ছোট হয়ে যাচ্ছিল তাকে মাইনে দিতে গিয়ে। তাই সে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের দরজায়। রবিবার সকালে এসে আমার স্ত্রীকে বলছে “বৌদি, এই সেন্টটা দেখুন, দারুণ গন্ধ… আচ্ছা ফিনাইল লাগবে? বেশি দাম নয়…”

একটা ছেলে প্রতি মাসেই আসে। বয়স খুব বেশি নয় অথচ মাথায় টাক পড়ে গেছে, চোখ দুটো ঢুকে গেছে কোটরে, শীতের দুপুরেও দেখে মনে হয় বৈশাখের কড়া রোদে কয়েক মাইল হেঁটে এসে ধুঁকছে। নামটা যতবার জিজ্ঞেস করি, ততবার ভুলে যাই। “জীবনের ইতর শ্রেণীর মানুষ তো এরা সব”। এদের নাম মনে রাখার অবসর কোথায় আমার মনের? তা সেই ছেলেটার থেকে কী-ই বা কিনব প্রতি মাসে? হ্যান্ড ওয়াশই কিনি। কতটুকুই বা খরচ হয় প্রতি মাসে! রান্নাঘরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঝকঝকে হ্যান্ড ওয়াশের বোতল, আমার স্ত্রী বলেন “তুমিই এবার হ্যান্ড ওয়াশের দোকান খুলবে।” তা সেই বোতলগুলোই কোরোনার আমলে আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এপ্রিল মাস কেটে গেছে, মে মাসের আজ প্রথম দিন। এই ফ্ল্যাটে এসেছি ২০১৬ র দোলের পরদিন। এই প্রথম ছেলেটা এতদিন হয়ে গেল আসেনি। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম “কোথায় বাড়ি তোমার?” আমাদের এখান থেকে অনেক দূরে। লোকাল ট্রেন চালু না হলে সে আসতে পারবে না। জানি না তার মে দিবস কেমন কাটছে। দুর্বল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন তাও জানি না, আশা করি কোভিড-১৯ ধরলেও বয়সের কারণে সে প্রাণে বেঁচে যাবে। আমারই বয়সী ছেলে। কে জানে কবে আমার দন্ডমুন্ডের কর্তার গেলাসে সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি কম পড়বে, আমাকেও হ্যান্ড ওয়াশ নিয়ে দাঁড়াতে হবে আপনাদের দরজায়?

উল্টো রাজা উল্টো বুঝলি প্রজার দেশে

আমাদের সংবিধান যে নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মত একটা জিনিস সে সিদ্ধান্ত এ দেশে হয়েই গেছে

যে যা-ই বলুক, চোখ কান খোলা রাখলে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ মোটেই কোরোনা সামলাতে যা করা উচিৎ তা করছে না। বেশি কড়া কথা বলা হয়ে যাচ্ছে মনে হলে একটু নরম করে বলা যেতেই পারে করতে পারছে না। তা বলে কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে জেলায় কী হচ্ছে সে সম্বন্ধে ভাষণ দেবে আর খবরদারি করতে কেন্দ্রীয় দল পাঠাবে — তাও সমর্থনযোগ্য নয়।

লক্ষণীয়, গত দুদিনে কেন্দ্রীয় সরকার কতকগুলো জায়গা সম্বন্ধে আলাদা করে বলেছে সেখানে উদ্বেগজনক অবস্থা। প্রত্যেকটা জায়গাই অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে — কলকাতা, মুম্বাই, জয়পুর, ইন্দোর। কলকাতার (এবং হাওড়ার) অবস্থা আমরা আশেপাশের লোকেরা জানি, তাই বাদ দিন। কিন্তু বাকিগুলো ভাবুন।

শুরু থেকেই দেশে সবচেয়ে বেশি টেস্ট করছে কেরালা আর মহারাষ্ট্র। স্বভাবতই ও দুটো রাজ্যে কোরোনা আক্রান্ত রোগীও বেশি পাওয়া যাচ্ছে৷ মুম্বাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী। জয়পুর রাজস্থানে। যে রাজ্যের ভিলওয়ারাকে কদিন আগে মডেল বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই। সেখানে কোরোনা রোগীর সংখ্যাও কিছু অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ইন্দোর মধ্যপ্রদেশে। সে এমন এক রাজ্য যেখানে এখন অব্দি আস্ত ক্যাবিনেট নেই, স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। কংগ্রেস সরকারকে সরিয়ে সবে বিজেপি সরকার শপথ নিয়েছে, তখনই লকডাউন শুরু হল। সেখানে মাঝে কয়েকদিন প্রচুর কোরোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছিল, হঠাৎই কমতে শুরু করেছে। ভোজবাজির মত।

এর পাশাপাশি যদি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর দিকে চোখ রাখা যায়, দেখা যাবে উত্তরপ্রদেশে ঠিক কী হচ্ছে আমরা জানি না। তবলিগি জামাতের জমায়েত নিয়ে দিনরাত এত দুশ্চিন্তা আমাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে ওখান থেকে কতজনের কোরোনা হয়েছে, অথচ লকডাউন শুরু হওয়ার পর রামনবমীর দিন অযোধ্যার অনুষ্ঠান থেকে কতজনের কোরোনা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান আমরা পাচ্ছি না। উত্তরপ্রদেশে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ীই কিন্তু সহস্রাধিক আক্রান্ত। তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চিন্তিত নন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো সর্বদা দেশী বিদেশী পর্যটকে ভরে থাকে, অথচ ওদিকে একেকটা রাজ্যে দুজন, পাঁচ জন, দশ জন করে আক্রান্ত। অর্থাৎ ঐ রাজ্যগুলো বাকিদের জন্য অনুকরণীয়। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার বাকিদের ওদের থেকে শিখতে বলছেন না কেন, তাও পরিষ্কার নয়। ফলত কিছু রাজ্যের জন্য এই দুশ্চিন্তাকে লর্ড ডালহৌসির করদ রাজ্যগুলোর প্রজাদের জন্য দুশ্চিন্তার বেশি কিছু ভাবা শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আসলে রাজ্য সরকার মানে যে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ অফিস নয়, তা বর্তমান সরকার মোটেই মানতে চান না।সংবিধানকে মারো গুলি। কেনই বা মারবেন না? আমাদের সংবিধান যে নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মত একটা জিনিস সে সিদ্ধান্ত এ দেশে হয়েই গেছে। পাড়ার “আমি কিন্তু বিজেপি নই” দাদা বা দিদির সাথে কথা বললেই বুঝতে পারবেন।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রভু ভাবার অভ্যেসটা যারাই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার চালিয়েছে তাদেরই বিলক্ষণ ছিল। রাজ্যপালকে দিয়ে দিনরাত বিরোধী দলের রাজ্য সরকারের পিছনে লাগা, সরকার ভেঙে দেওয়া, কাজে বাধা সৃষ্টি — সবই শুরু হয়েছে সেই বাজপেয়ীর দুর্গা ইন্দিরার আমলে। বরাবর কেন্দ্রের দাদাগিরি নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন বামপন্থীরা। তাঁরা রাজ্যগুলোকে আরো ক্ষমতা দিতে এমনকি সংবিধান সংশোধন চাইতেন, ৩৫৬ ধারার বিলোপ চাইতেন। এ সবের জন্য বাঙালির দৈনিক বেদ যারপরনাই গালাগাল দিয়েছে বামেদের। বলেছে এরা কাজ করতে চায় না বলে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে আঙুল তোলে।

একবার তো এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমকিই দিয়েছিলেন যে তাঁর দল লোকসভায় ৩.৫৬% ভোট পেয়েছে, তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ জারি করিয়ে দেবেন। নামটা গুগল করলে পেয়ে যাবেন। শেষ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তিনিই আবার বলেছিলেন পি এম টু ডি এম কাজ হওয়া উচিৎ, রাজ্য সরকারকে মানব না।

এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু কোন দুষ্কর্মই আগে অন্য লোক করেছে বলে বৈধ হয়ে যায় না। ফলত কেন্দ্রীয় সরকারের এই “চালুনি বলে ছুঁচ, তোর পিছে কেন ছ্যাঁদা” মার্কা তৎপরতাকে কোন যুক্তিতেই মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। “এই সময়ে রাজনীতি করবেন না” কথাটাও নেহাত খিল্লি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বরাবর দেখা যায় রাজনীতিকে ভাইরাসের মত পরিহার করতে বলে তারাই যারা ক্ষমতাশালী, কারণ রাজনীতি বন্ধ করতে পারলে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। কেন্দ্র, রাজ্য উভয় সরকারের ব্যবহারই তা প্রমাণ করে। রাজ্যের ব্যবহার নিয়ে না হয় আরেকদিন কথা হবে। পিঠটাও তো বাঁচাতে হবে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ

যার মেডিক্লেম করার ক্ষমতা আছে, সে ভাল চিকিৎসা পাবে। যার নেই তার জন্য তো পূতিগন্ধময় সরকারী হাসপাতাল রইল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কখনো ঘটেনি এমন অন্তত দুটো ঘটনা কোভিড-১৯ ঘটিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। প্রথমত, অলিম্পিক এক বছর পিছিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, লন্ডনের অল ইংল্যান্ড ক্লাবের বার্ষিক টেনিস প্রতিযোগিতা, যা সবাই উইম্বলডন নামে চেনে, সেটাও এ বছরের মত বাতিল হয়ে গেছে। প্রাণহানির হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে থাকলেও ব্যাপ্তিতে নতুন কোরোনাভাইরাস দুটো বিশ্বযুদ্ধকেই ছাড়িয়ে গেছে। ওসেনিয়াও বাদ পড়েনি। ঠিক কত মানুষের জীবিকা কোরোনার বলি হবে তা এখনো অনিশ্চিত, তবে গরীব মানুষের ক্ষতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যা এবং আজ পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতির সাপেক্ষে হিসাব করলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ত এখনই আশি বছর আগেকার ক্ষতিকে অতিক্রম করেছে।

আমাদের দাদু-দিদিমাদের প্রজন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাপ অনুভব করেছিলেন। বোমাতঙ্কে এক সময় কলকাতা ছেড়ে দূর গ্রামে মফস্বলে পালিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভারত ভূখণ্ডে যুদ্ধ এসে না পৌঁছালেও পরাধীন দেশের শস্য উইনস্টন চার্চিলের বদান্যতায় ব্রিটিশ সৈন্যদের পেট ভরাতে চলে গিয়েছিল। কলকাতার রাস্তায় মানুষ ভাত নয়, ফ্যান চেয়ে বেড়িয়েছে, ভদ্র ঘরের মেয়ে বউদের ভাতের জন্য বেশ্যাবৃত্তি করতে হয়েছে (যৌনকর্মী শব্দটা তখনকার কোন লেখায় পাইনি, সম্ভবত যাদের কথা বলছি তারাও খুশি হত না এই শব্দ ব্যবহার করলে)। সেই সময় গ্রাম থেকে আসা অভুক্তদের মধ্যে সলিল চৌধুরীর চোখ রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলিকে দেখতে পেয়েছে। “দুটি শীর্ণ বাহু তুলে / ও সে ক্ষুধায় জ্বলে / অন্ন মেগে মেগে ফেরে প্রাসাদ পানে চেয়ে। / কে জানে হায় কোথায় বা ঘর / কী নাম কালো মেয়ে! হয়ত বা সেই ময়নাপাড়ার মাঠের কালো মেয়ে।”

সেই যুদ্ধের পর অনেক কিছু বদলেছিল। উপনিবেশ বজায় রাখা ধনী দেশগুলোর আর পড়তায় পোষাচ্ছিল না। তাই বিংশ শতাব্দী হয়ে গিয়েছিল মুক্তির দশক — সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্তির।

সাম্রাজ্য না হয় ছাড়া গেল, তা বলে কি রাশ ছেড়ে দেওয়া যায় পুরোপুরি? হরণ করতে না পারলে কি প্রাচুর্য বজায় রাখা যায়? তাছাড়া যাদের উপনিবেশ ছিল না তাদের বুঝি সাম্রাজ্যের সাধ হয় না, প্রাচুর্যের দরকার হয় না? সে প্রাচুর্য বজায় রাখতে মহাযুদ্ধের পরের প্রায় পঞ্চাশ বছর বেশ বেগ পেতে হয়েছিল পুরনো, নতুন দাদাদের। কারণ নতুন যে কায়দাটা, মানে কেনা আর বেচাই যে মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য ও মোক্ষ, তা অর্ধেক পৃথিবীকে বোঝানোই যাচ্ছিল না। কেবল ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কথা বলছি না। সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর অনেকেই তো তখন অর্থনীতিতে বাম দিক ঘেঁষে হাঁটছিল। ভারতের মত বিরাট দেশও। “যত খাই তত চাই বাপি চানাচুর” তত্ত্ব অর্ধেক বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি, মানুষকে ক্রেতাদাস বানিয়ে বিক্রেতারাজ কায়েম করা যায়নি। সেটা করা গেল গত শতকের শেষ দশকে এসে। ভোগবাদ শেষ অবধি বিশ্বায়িত হতে পারল আর বেলাগাম ভোগে আমরা পেলাম এই দুর্ভোগ — তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে এক পক্ষে প্রকৃতি, অন্য পক্ষে নিরস্ত্র সরকার। আর সাধারণ মানুষ? উলুখাগড়া।

এতদ্বারা কোরোনা কী থেকে হয় তা আবিষ্কার করে ফেলেছি বলে দাবী করছি না, যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বলছি মাত্র। যুদ্ধই যে চলছে তা নিয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই বলেছে “global pandemic” অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী অতিমারী। রোগটা কিভাবে হচ্ছে, কী কী উপায়ে ছড়াচ্ছে তাও শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত নয় প্রাদুর্ভাবের এতদিন পরেও, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার কবে হবে তাও এখনো অনিশ্চিত। তাই বলছি এ যুদ্ধে এক পক্ষে প্রকৃতি।

অন্য পক্ষে নিরস্ত্র সরকার কেন বলছি? কারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অস্ত্র হল শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি। সৈনিক হলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু মহাশক্তিধর দেশগুলোর অধিকাংশের আছে কেবল পরমাণু বোমা, মিসাইল, যুদ্ধজাহাজ, বিশাল স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী আর নৌবাহিনী। মশা মারতে কামান দাগলে কোন লাভ হয়? ম্যালেরিয়ার সময় যদি কামান দাগেন তাহলে রোগী মরবে, মশা নয়। কি চমৎকার ব্যাপার হত বলুন তো, যদি কোভিড-১৯ পাকিস্তান হত? এক্ষুণি মেঘে মেঘে গোটা কতক স্টেলদ বম্বার হানা দিলেই এই দিনের পর দিন ঘরবন্দী থাকার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। সারা পৃথিবীতে এখন যত পারমাণবিক অস্ত্র মজুত আছে তা একসঙ্গে বিস্ফোরিত হলেও কোরোনার ক থাকবে না। কারণ মানুষ দূরের কথা, গ্রহটাই থাকবে না হয়ত। মাথা না থাকলে আর কিসের মাথা ব্যথা? আমাদের সরকারগুলোর অস্ত্র যা আছে তা আসলে এইরকম। তাই নিরস্ত্র।

কিন্তু কেন নিরস্ত্র? কারণ সরকারগুলো এ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়নি। কেন নেয়নি? কারণ প্রয়োজন বোধ করেনি। কেন করেনি? কারণ ওটা সরকারের কাজ নয়। সরকারের কাজ তবে কোনটা? যুদ্ধ করা। তার প্রস্তুতি নিতেই সরকার ব্যস্ত ছিল। ভারতের সাথে তার প্রতিবেশীদের শেষ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১ এ। বাংলাদেশ, বার্মা, নেপালের মত অতি ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর সাথে সুদূর ভবিষ্যতেও যুদ্ধের কোন সম্ভাবনা নেই। উঠতে বসতে যার সাথে অশান্তি, সেই পাকিস্তান খেতে পায় না তো যুদ্ধ করবে কী? পারবে না জানে বলেই প্রক্সি ওয়ার চালায়। সেই প্রক্সি ওয়ারে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ কোন কাজে লাগে না, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানেরও সচরাচর প্রয়োজন পড়ে না। বাকি রইল চীন। ভারত তার পণ্যের বিরাট বাজার। যুদ্ধ লাগলে তার নিজেরই ব্যবসার ক্ষতি। এরকম প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, আর স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমেছে। ২০২০-২১ এর বাজেটে প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ হয়েছে ৩.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যের জন্য ৬৯,২৩৪ কোটি টাকা। তবু দেখবেন বিজ্ঞ ব্যক্তিরা লিখে এবং বলে হা হুতাশ করেন “আহা, অমুক প্লেনটা কেনা হল না! তমুক কামান মান্ধাতার আমলের হয়ে রয়েছে। অমুকে এগিয়ে গেল, তমুকে টেক্কা দিয়ে দিল।” শুধু বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই বা কেন? আমরাও তো করি। কাউকে শুনেছেন বলতে “আহা, কতদিন একটা নতুন সরকারী হাসপাতাল হয়নি! অমুক ওষুধটার দাম যে কেন সরকার কমাতে পারে না! তমুক যন্ত্রটা কলকাতার সব হাসপাতালে কেন নেই?” কেউ এসব বলে না, কারণ সবাই জানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের নয়। যুদ্ধ করার দায়িত্ব সরকারের।

চিকিৎসা করার দায়িত্ব তবে কার? আমরা সবাই জানি। ঝাঁ চকচকে বেসরকারী হাসপাতালের। ওষুধ বানানো এবং বেচার দায়িত্ব বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির। ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যবস্থা। যেমনটা “উন্নত” দেশে হয় আর কি। ওটাই তো সর্বোত্তম ব্যবস্থা, তাই না? আমরা তো তেমনটাই শিখেছি সেই নব্বইয়ের দশক থেকে। অন্য যে বিকল্প ছিল, মানে সরকার নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা — সেটা যে সেকেলে, সেটা যে ফালতু সে ব্যাপারে তো আমরা নিশ্চিত। সরকারী হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যবস্থাই হল সঠিক ব্যবস্থা। হাসপাতাল হবে পাঁচ তারা হোটেলের মত। সেখানকার কর্মচারীরা হবে সুবেশী হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়া রিসেপশনিস্টদের মত। আর ডাক্তারবাবু অনেক টাকা পারিশ্রমিক নেবেন। তবে না চিকিৎসা? যদি বলেন কড়ির ব্যবস্থা করবে কে? কেন, ইনসিওরেন্স কোম্পানি? বছর বছর কয়েক হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে গোটা পরিবারের মেডিক্লেম করিয়েছি তো। যার মেডিক্লেম করার ক্ষমতা আছে, সে ভাল চিকিৎসা পাবে। যার নেই তার জন্য তো পূতিগন্ধময় সরকারী হাসপাতাল রইল। উন্নত ব্যবস্থা মানেই তো এই বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, তাই না?
এতদিন চলছিল বেশ। শুধু আমাদের দেশে নয়, যে দেশগুলো আমাদের বিকল্প ভুলিয়ে এসব ধরিয়েছে সেখানেও দিব্যি চলছিল ব্যবস্থাটা। যার পকেটে মেডিক্লেম আছে সে খুশি, ডাক্তার খুশি, হাসপাতাল মালিকরা খুশি, ওষুধ কোম্পানি খুশি। আমাদের দেশে তবু যত নষ্টের গোড়া, সমাজবাদের প্রতি দুর্বলতা থাকা জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে তৈরি সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ অনেক গরীব মানুষের যেমন তেমন দেখভাল চালাচ্ছিল। অনেক উন্নত দেশে, যেমন আমাদের স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, রেস্ত না থাকলে অসুস্থ হওয়া মানা। মধ্যে বারাক ওবামা উল্টো গাইলেন, সে কথা বড় একটা পছন্দ হল না কারোর। কী করে হবে? সরকারী মানে ফালতু এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সরকারের কাজ নয় — এসব আমরা তো মোটে তিরিশ বছর হল শিখেছি, আমেরিকানরা সেই কবে থেকে শুনে আসছে। আর সকলকে শিখিয়েছেও। আজ হঠাৎ নতুন কথা শুনলে মনে হবে না ব্যাটা বুদ্ধির ঢেঁকি? ওবামার কথা শুনে যত লোক মুখ বেঁকিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি লোক বার্নি স্যান্ডার্সের কথা মন দিয়ে শুনছিল। তবু বার্নির গায়ে কেন কমুনিস্ট গন্ধ? এই প্রশ্নে দ্বিধায় ছিল। মানে সব দেশের পয়সাওয়ালা লোকই তো আমার আপনার মতই। যার পকেটে পয়সা নেই তাকে নিয়ে ভাবতে আমাদের বয়েই গেছে।

হেনকালে গগনেতে উঠিলেন কোরোনা।

ফল কী? ফেলো কড়ি মাখো তেলের দেশ যুক্তরাষ্ট্র এক কথায় ল্যাজে গোবরে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে পাত্তাই দেননি, বলেছিলেন ঐ দু চারটে হয়েছে আর কি, তাও চীনের চক্রান্তে। শিগগির শূন্যে নেমে আসবে। তারপর যখন রোগী বাড়তে থাকল তখনো বলছিলেন লকডাউন আবার কী? ওভাবে দেশ চলে? তারপর এখন, যখন চার লক্ষের বেশি আক্রান্ত নিয়ে তাঁর দেশ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দখল করে ফেলেছে, প্রায় তেরো হাজার মানুষ মৃত, তখন তিনি চীন আর হু কে দোষ দিচ্ছেন। ওদিকে ভেন্টিলেটর কোন রাজ্যে কতগুলো যাবে তা নিয়ে নিলাম চলছে। মানে বুঝলেন তো? আপনার স্বপ্নের দেশে, উন্নত ব্যবস্থায় মানুষের জীবন নিলামে কেনা বেচা হচ্ছে। এত অস্ত্র বানায় অত বড় দেশটা, সারা পৃথিবীতে বিক্রি করে, এত উন্নত মোবাইল কম্পিউটার ট্যাব নানাবিধ সফটওয়্যার আবিষ্কার করে, কে এফ সি, কোকা-কোলা, স্টারবাকস — উদ্ভাবনের স্বর্গরাজ্য একেবারে। অথচ যথেষ্ট ভেন্টিলেটর বানিয়ে উঠতে পারেনি। ভেন্টিলেটর তো অনেক বড় কথা, সামান্য অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া ড্রাগের জন্য পর্যন্ত ভারতকে ধমকাতে হচ্ছে। এই আপনাদের উন্নত দেশ, উন্নত ব্যবস্থা। কড়ি ফেললেও তেল দিতে পারছে না।

হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামে এই যে ওষুধ, যার জন্য ট্রাম্প মোদীকে দিলেন এক ধমক আর মোদী সুড়সুড় করে রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন, তেমন ওষুধ উৎপাদনের উপযুক্ত জায়গা হল ভারতের সরকারী ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলো। ভারতে ওষুধ তৈরির ৭০% কাঁচামাল আমদানি হয় চীন থেকে। ২০১৫ তে ভারত সরকার নিযুক্ত কাটোচ কমিটি বলেছিল সরকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে এই জায়গাটাতে ভারত অনায়াসেই স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ভারত সরকার, মানে মোদীর সরকার, কী করলেন? না ঐ সংস্থাগুলোকে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে কলকাতার বেঙ্গল কেমিক্যালও। যদিও কলকাতা হাইকোর্ট বেঙ্গল কেমিক্যাল বিক্রির সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিয়েছেন। তাহলে ভাবুন, যে সরকারী সংস্থা আমাদের জীবনদায়ী ওষুধ তৈরি করতে পারে তাকে বেচে দিতে সরকার উৎসাহী কেন? কারণ ঐ যে, ওষুধ যোগানো সরকারের কাজ নয়।

বিরক্ত হচ্ছেন? এক কথা বারবার পড়ে রেগে যাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করছেন কে ঠিক করল ওষুধ যোগানো সরকারের কাজ নয়, চিকিৎসা দেওয়া সরকারের কাজ নয়? আপনিই ঠিক করেছেন। যদি এতে খুব দাগা লাগে তাহলে বলা যায় আপনাকে দিয়ে ঠিক করানো হয়েছে। কে ঠিক করিয়েছে? সরকার নিজেই। একবার মনে করে দেখুন নব্বইয়ের দশক। মনমোহনী অর্থনীতি মনে আছে? তখন থেকেই তো কাগজে, টিভিতে, পত্রিকায় সর্বত্র জেনেছেন রাষ্ট্রের দিন শেষ। কেউ চীন বললে, কিউবা বললে, ভিয়েতনাম বললে বলেছেন “আরে ওসব রিজেক্টেড সিস্টেম। ওসব উঠে গেল দেখলেন না?” কারণ তার আগের কয়েক বছরে প্রণয় রায়ের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ এ বার্লিনের দেওয়াল ভাঙতে দেখেছেন, দ্যুমায় আগুন জ্বলতে দেখেছেন। আপনি ঠিক দেখেছেন এবং ভুল বুঝেছেন। আপনি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন দেখেছেন আর বাজার অর্থনীতির খুড়োর কল দেখেছেন। আপনি জানতে পারেননি যে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেবল ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ছিল না। আপনাকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর কথা বলা হয়নি, আপনাকে ব্রিটেনের এন এইচ এসের কথা বলা হয়নি, আপনাকে এখনো সিঙ্গাপুরের কথাও বড় একটা বলা হয়নি।

কেবল এভাবেই যে আপনাকে বোঝানো হয়েছে যা কেনা যায় তা-ই ভাল আর সরকারী মানেই ফালতু তা-ও নয়। সরকার নিজে আপনাকে সরকারী ব্যবস্থা থেকে দূরে ঠেলেছে। আমার জন্ম আশির দশকের গোড়ায়, আমার বোনের জন্ম ১৯৯০ তে। তখনো ভারত বাজার অর্থনীতির দেশ হয়নি, মেডিক্লেম কারোর অভিধানে ছিল না। আমার বাবা স্কুল শিক্ষক। আমার জন্মের সময়ে না হলেও, বোনের জন্মকালে মন্দ মাইনে পেতেন না। আমরা দুজনেই জন্মেছি সরকারী হাসপাতালে। তখনো সেগুলোর চেহারা আজকের আমরি, অ্যাপোলো বা ফর্টিসের মত ছিল না। কিন্তু সামর্থ্য থাকলে ওখানে যাব না এমন মনে হত না, হলে বাবা আমার মাকে নিয়ে যেতেন না। অথচ ২০১১ সালে আমার মেয়ের জন্ম হল বেসরকারী নার্সিংহোমে। কারণ আমি আমার স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ভার সরকারের উপর ছাড়তে ভরসা পেলাম না। ভরসার জায়গাটা সরকার নিজেই নষ্ট করে দিয়েছে তার আগের কুড়ি বছরে। সব দলের সরকারই। সরকার নিজেই ছিদ্র করেছে লৌহ বাসরে, আর সেই ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়েছে বেসরকারীকরণের কালনাগিনীকে। কারণ সরকার চায় না মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে।

কেন চায় না? সরকার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে না, শিক্ষার ব্যবস্থা করবে না, তাহলে করবে কী? দুটো কাজ করবে। এক, পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করবে। মানে রাস্তাঘাট, বিমানবন্দর ইত্যাদি। দুই, যুদ্ধ করবে। নব্বইয়ের দশকে নতুন চিন্তা ছিল এটাই। কেন চিন্তাবিদরা সরকারকে এই কাজ দুটোয় বেঁধে দিলেন?

ভেবে দেখুন, সরকার নিজে রাস্তাঘাট বানাতে পারে না। কোন ব্যবসায়ীকে বরাত দিতে হবে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিমানবন্দর — সবেতেই তাই। তাহলে বেশ কিছু বড়লোকের আরো বড়লোক হওয়ার ব্যবস্থা হল। যত বড়, যত গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো, তত বেশি মুনাফা, তত বড়লোক হওয়ার ব্যবস্থা। তাছাড়া কেবল স্বাস্থ্য বেসরকারী হলে ভাল তা তো নয়, সবই বেসরকারী হলে ভাল বলা হয়েছে। তাই পরিবহন বেসরকারী, শিক্ষা বেসরকারী, যা যা মানুষের জীবনে দরকারী তার সবই বেসরকারী। অর্থাৎ আসল কথা হল ব্যবসা। মানুষের জন্য অর্থনীতি নয়, ব্যবসার জন্য অর্থনীতি। আর যেহেতু অর্থনীতিই অন্য সব নীতিকে চালায় তাই তখন থেকে রাজনীতিও ব্যবসার জন্য, স্বাস্থ্য নীতিও ব্যবসার জন্য। আর সবচেয়ে অর্থকরী ব্যবসা হল অস্ত্র ব্যবসা। তাই যুদ্ধ করার অধিকারটা সরকারকে দেওয়া হল। যুদ্ধ হোক আর না-ই হোক, সরকারকে অস্ত্র কিনতেই হবে। না কিনলে ধনকুবেররা আরো ধনী হবে কী করে?

সুতরাং আপনার পকেটে কড়ি থাকায় যে ব্যবস্থাকে আপনি ভেবেছিলেন ফেলো কড়ি মাখো তেল, সেটার আসল নাম হল এলোমেলো করে দে মা লুটে পুটে খাই। মনে রাখবেন যে ধনীরা এই ব্যবস্থা চালায় সাক্ষীগোপাল সরকারগুলোকে দিয়ে, তাদের খাঁই অপরিসীম। আপনি যে ধার করে গাড়ি কিনে বা বিদেশ ঘুরে এসে ভাবেন “দেশের উন্নতি হয়েছে। আমার বাবা-মা তো এমন পারত না,” তাও ওদেরই বদান্যতায়। আপনি খরচ না করলে ওদের মুনাফা হয় না বলে। মুনাফাই মোক্ষ। আপনি যে কোম্পানির চাকুরে সে কোম্পানির মুনাফা গত বছরের চেয়ে এ বছর না বাড়লে আপনার চাকরিটি নট হয়ে যাবে, আপনি ফাঁকিবাজ না পরিশ্রমী তা অপ্রাসঙ্গিক। হাড়ে হাড়ে টের পাবেন বেসরকারী সংস্থা মানে মোটেই মেধাতন্ত্র (meritocracy) নয়, মুনাফাতন্ত্র (profitocracy)।

এখন কথা হচ্ছে এই মুনাফাতন্ত্রকে যদি ভাল বলেন, তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার মত হওয়াই ভাল। সরকার যদি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করে, তাহলে বেসরকারী হাসপাতালে যাবে কে? তাদের মুনাফা হবে কোথা থেকে? ভেন্টিলেটর নিলাম হওয়াও কিন্তু ভাল। ক্রয় বিক্রয়ের স্বাধীনতা। ফেলো কড়ি মাখো তেল। বুঝলেন কিনা?

মুনাফাতন্ত্র কিন্তু প্রকৃতির ধার ধারে না। বিশ্ব উষ্ণায়নকে বলে বামপন্থী কন্সপিরেসি থিওরি। কারণ উষ্ণায়ন হচ্ছে বলে মেনে নিলেই ফসিলজাত জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। তেল কোম্পানির লোকসান হবে না? পকেটে পয়সা থাকলেই আজকাল এ সি লাগিয়ে ফেলা যায়। সত্যি সত্যি ক্লোরোফ্লুওকার্বনের ব্যবহার কমাতে গেলে কী হবে এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবসার? প্লাস্টিক দুনিয়ার ক্ষতি করছে মানলে বিশ্বজোড়া প্লাস্টিক ব্যবসার বারোটা বাজবে। বাহুল্যকে প্রয়োজনে পরিণত করা গেছে কত দিনের চেষ্টায়, এখন উল্টো পথে হাঁটলে কী হবে মুনাফার গতি? অতএব যেমন চলছে চলুক। চালাতে গিয়ে হিমবাহগুলো তো বটেই, চিরতুষার (permafrost), মানে পৃথিবীর যেসব জায়গার বরফ সেই তুষার যুগ থেকে আজ পর্যন্ত গলেনি, তাও গলে যাচ্ছে। কত মহামারী অতিমারীর জীবাণু যে সেই বরফে জমেছিল কে-ই বা বলতে পারে? কাকলাস মেরুভালুকের ছবি মুনাফাবাদীদের মন গলাতে পারেনি, এখন দুনিয়াসুদ্ধ লোক থাকো ঘরে বন্দী। সব ব্যবসার সাড়ে সর্বনাশ, মুনাফাতন্ত্র ছাপিয়ে মন্দাতন্ত্র এসে পড়ল।

তাহলে বিশ্বযুদ্ধটা দাঁড়াল মুনাফাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকৃতির। ওয়ার্ল্ডোমিটার বলে যে সাইটটা গত কয়েক দিনে জনপ্রিয় হয়েছে, সেখানে গিয়ে কোরোনা আক্রান্ত দেশের নামগুলো ভাল করে দেখুন। যেসব দেশের সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মনোযোগ আছে, মানে মুনাফাতন্ত্র জোরালো নয়, সেসব দেশে রোগটার দাপট কম। ভিয়েতনাম খুঁজে দেখুন, কিউবা খুঁজে দেখুন। “রিজেক্টেড সিস্টেম” গুলোর অবস্থা একবার দেখলেনই না হয়। জার্মানি আবার রিজেক্টেড সিস্টেমেও চলে না, তবু সে সামলে নিয়েছে। কারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভাল। সামলে নিচ্ছে ফ্রান্সও। স্পেনের সরকার আবার কী করেছে দেখেছেন তো? বেসরকারী হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ করেছে। ভাবুন তো, আপনি ই এম বাইপাসের ধারে একটা ঝাঁ চকচকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, অথচ মেডিক্লেমে সবটা কভার হবে কিনা ভেবে রক্তচাপ বাড়ছে না!

এবার চীনা ফ্রন্টে একটা আক্রমণ হবে বুঝতে পারছি৷ প্রশ্ন উঠবে সবই যদি মুনাফাতন্ত্রের দোষ, তবে চীনে এমন কেলেঙ্কারির ব্যাখ্যা কী? উত্তরটা নেহাত সোজা। যতই চতুর্দিকে মাওয়ের ছবি থাক আর লাল পতাকায় ছেয়ে থাক পথ ঘাট, বর্তমান চীনের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক নেহরুর সমাজবাদের সাথে নরসিমা রাওয়ের কংগ্রেসের চেয়েও ক্ষীণ। কাস্তে হাতুড়ি চীনের শালগ্রাম শিলা মাত্র। সারা পৃথিবীতে ব্যবসা করতে চীনের আগ্রহ ট্রাম্পের দেশের চেয়ে কিছু কম নয়। ট্রাম্প যদি বলেন “মেরে পাস গেটস হ্যায়, জোবস হ্যায়, ব্রনসন হ্যায়। তুমহারে পাস কেয়া হ্যায়, কেয়া হ্যায় তুমহারে পাস?” জিনপিং সগর্বে বলবেন “মেরে পাস মা হ্যায়। জ্যাক মা।” চীনের মুনাফাতন্ত্র হয়ত আরো নির্মম কারণ সেখানে সরকারকে প্রকাশ্যে গাল দেওয়ার উপায় নেই। তাই এমন মহামারী হতে পারল। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, চীন তবুও বেশ তাড়াতাড়ি সামলে নিল। তার পেছনেও সেই সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবদান।

এই বিশ্বযুদ্ধে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে লড়ছেন, নিরস্ত্র অনন্যোপায় সেনাপ্রধানরা সেভাবেই লড়েন। একশো তিরিশ কোটি লোকের দেশে যথেষ্ট ডাক্তার নেই, নার্স নেই, হাসপাতাল নেই। তাহলে আপনি কী করবেন? প্রার্থনা করবেন। উনি বারবার ঠিক সেটাই করতে বলছেন আমাদের। ঈশ্বর যদি কোরোনাটা সামলে দিতে পারেন, তাহলে পাকিস্তানকে উনি একাই দেখে নেবেন। অতএব আপনারা তেড়ে প্রার্থনা করুন। মসজিদ ছাড়া সব জায়গায় প্রার্থনা করতে পারেন।

বাবুসোনা সংস্কৃতি

আমরা বাঙালিরা তো প্রগতিশীল, তাই হয়ত আমাদের ছেলেটি কোরোনাকে “জানিস আমার মা কে” বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল

আশির দশকে বাবা-মায়ের সাথে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যেতাম। আমি তখনো প্রাথমিকে, সে কলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলের উঁচু ক্লাসে প্রথম সারির ছাত্র। তার ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বরের গর্বে তার বাবা-মা তো বটেই, প্রতিফলিত গৌরবে আমাদের অন্য আত্মীয়স্বজনদেরও মাটিতে পা পড়ে না। তাদের বাড়ি গেলে কিন্তু বোঝা যেত তার বাবা-মা গৌরবে বহুবচন চান না মোটেই। যত নিকটাত্মীয়ই আসুক, সে পড়ার টেবিল ছেড়ে নড়ত না। তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলেটিকে আমার মনে হত পঞ্চাশোর্ধ্বের মত রাশভারী। এমন নয় যে এই রুটিন কেবল পরীক্ষার আশেপাশে। বারো মাস সে এভাবেই চলত। স্বভাবতই আমার মত শৈশব পার না হওয়া আত্মীয়দের কাছে বড়রা ঐ ছেলেটিকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে হাজির করতেন। বড়রা বারবার শোনাতেন “ওর মত হওয়ার চেষ্টা করো। দেখেছ কেমন লেখাপড়ায় মন? বাড়িতে যে-ই আসুক, ঝড় উঠুক, বন্যা হয়ে যাক, ও কিন্তু পড়া ছেড়ে ওঠে না।”

বড় পরীক্ষাগুলোতে ভাল নম্বর এবং শিক্ষান্তে মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া যদি মানুষ হওয়ার মাপকাঠি হয় তাহলে বলা দরকার যে ছেলেটি সত্যিই মানুষ হয়েছে। আমি নিশ্চিত এই পথে হেঁটে এরকম মানুষ হওয়া মানুষ আমরা সকলেই কাঁড়ি কাঁড়ি দেখেছি গত ৩০-৪০ বছরে, এখনো দেখছি। প্রশ্ন হল সফল মানুষ আর ভাল মানুষ কি একই? ভাল মানুষ মানেই বা কী? যে মন দিয়ে রোজগার করে সংসার চালায় তার বাকি সমাজের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা না থাকলে, চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন হলেও কি তাকে ভাল মানুষ বলা যায়?

এই প্রশ্নগুলো কদিন আগে করলেও হাঁ হাঁ করে উঠতেন অনেক ভদ্রজন, বাকিরা পাত্তা দিতেন না। কিন্তু রোগ বড় বালাই, বিশেষত অতিমারী। গত দুদিন ধরে যেভাবে সকলে একটি অক্সফোর্ডের ছাত্র এবং তার বাবা-মাকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অভিযুক্ত করছেন তা দেখে অপ্রিয় প্রশ্নগুলো তোলার ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললাম।

নিজের কাছে সৎ থাকতে হলে মানতেই হবে এই প্রশ্নগুলো গত সাড়ে তিন দশক আমরা একেবারেই নিজেদের করিনি, অন্যদেরও করিনি। এগুলো অবান্তর হয়ে গেছে। ছোট থেকেই শিখে গেছি যে আমি মানুষ হয়েছি কিনা তার প্রমাণ হল আমি কোন পেশায় আছি এবং কত রোজগার করি। অতএব আমার ক্লাসের যে ফার্স্ট বয় পরে তত ভাল রেজাল্ট করতে না পেরে এখন সামান্য ব্যাঙ্ককর্মী, তার চেয়ে বেশি মানুষ হয়েছে থার্ড বয়। কারণ সে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে। এমন নয় যে কেবল অন্যরাই এভাবে ভাবে। ফার্স্ট বয় নিজেও ভাবে “আমার দ্বারা কিস্যু হল না। ও শালা স্কুলে কোনোদিন আমাকে ছুঁতে পারত না, কপাল জোরে কোথায় উঠে গেল!”

আমাদের প্রজন্ম এভাবেই ভাবতে শিখেছে এবং আমরা বাবা-মা হয়েও আমাদের নার্সারি স্কুলে যেতে শুরু করা ছেলেমেয়েদের এভাবেই ভাবতে শেখাচ্ছি। লক্ষ্য করুন, এই চিন্তার সমস্তটা জুড়েই আমি, কোথাও আমরা নেই। বন্ধুর সাফল্যে আনন্দ পাওয়া নেই, বন্ধুর ব্যর্থতায় কষ্ট পাওয়া নেই। দু-তিন প্রজন্ম ধরে এহেন স্বার্থপরতার কৃষিকাজ চালালে যেমন ফসল ফলে আমাদের বিলেত ফেরত বাবুসোনা ভাইটি তাই — তার বেশি কিচ্ছু নয়। আর তার বাবা-মা যে অপরাধ করেছেন তা শুরু হয়েছে তার ছোটবেলায়। সেই একই অপরাধ আমাদের অনেকের বাবা-মাই করেছেন। এমন করে গায়ে লাগেনি বলে সমাজ সেটাকে অপরাধ বলে চিহ্নিতই করেনি এতদিন। ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে কেবল শিখেছে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারলেই তার কাজ শেষ। দুনিয়ার কারোর প্রতি তার কোনো কর্তব্য নেই। ওই যে আমার আত্মীয় সম্পর্কে বড়রা বলতেন “বাড়িতে যে-ই আসুক, ঝড় উঠুক, বন্যা হয়ে যাক” ইত্যাদি। অর্থাৎ ঝড়ে তোমার প্রতিবেশীর ঘরের চাল উড়ে গিয়ে সে নিরাশ্রয় হয়ে যাক, তুমি বাবা-মায়ের বানিয়ে দেওয়া পড়ার ঘরে মোটা মাইনের চাকুরে হওয়ার প্রস্তুতি চালিয়ে যাও। বন্যায় তোমার আত্মীয়ের ঘর ভেসে যাক, তোমার দু ফোঁটা চোখের জল ফেলারও দরকার নেই, তুমি কেশব নাগের অঙ্কগুলো শেষ করো। ভাগ্যিস কেশবচন্দ্র নাগের অঙ্ক বইই কিনে দেওয়া হত আমাদের, তাঁর কষ্ট করে লেখাপড়া করার ইতিহাস পড়ানো হত না। অবশ্য হলেই বা কী হত? আমরা মুখস্থ করতাম আর পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে ভুলে যেতাম। যেমনটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে করেছি।

তা এইভাবে যে বাবুসোনাদের তৈরি করা হচ্ছে, কী করে আমরা আশা করছি যে তারা নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ ফুর্তির বাইরে কিছু ভাববে? গায়ে যখন জ্বর নেই, গলায় ব্যথা নেই, কাশি হচ্ছে না, তখন বাবুসোনা কেন মায়ের অফিসে কলার তুলে ঘুরতে যাবে না? কেন গিয়ে লাইন দেবে হাসপাতালে? তা-ও আবার সরকারি হাসপাতালে? ওসব হাসপাতাল তো তার বাড়ির কাজের মাসির জন্যে। আর মা-ই বা কেন ছেলেকে আদর করে অফিসে, মলে, ক্লাবে ঘোরাবেন না? কজনের ছেলে অক্সফোর্ডে পড়তে যায়? চুলোয় যাক জনস্বাস্থ্য, চুলোয় যাক সাবধানতা।

খুব খারাপ লাগছে তো কথাগুলো? বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে তো? তাহলে বলি। আমি যে স্কুলের ছাত্র, সেই স্কুলের আন্তঃক্লাস ফুটবল প্রতিযোগিতা হয় প্রয়াত মাস্টারমশাই পাঁচুগোপালবাবুর নামে। তাঁকে আমরা পাইনি। আমাদের ইংরিজির মাস্টারমশাই সোমনাথবাবু একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন “পাঁচুবাবু যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন, তখন হাসপাতালে রাত জেগেছিল আমাদের খারাপ ছাত্ররা, ভাল ছাত্ররা নয়।”

আমাদের সময় থেকেই এমন হয়। কারণ বাবা-মা শেখান পড়াশোনা করা এত বিশাল একটা কাজ যে ওটা করে আর কিচ্ছু করা যায় না। কারো জন্যে হাসপাতালে রাত জাগা যায় না, বাড়িতে কেউ এলে গল্পগুজব করা যায় না, এমনকি পাঠ্যের বাইরে ভাল বই-টই পড়াও যায় না। যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, বাংলা ক্লাসে আমাদের মাস্টারমশাই সুশান্ত বসু এক ভাল ছাত্র কোনো এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের নাম শোনেনি শুনে হতাশ হয়ে বলে ফেলেছিলেন “এত বয়স হয়ে গেল ওঁর কোন লেখা পড়নি? জীবনটা কাটাবে কী করে!” কী কুক্ষণেই বলেছিলেন! হোস্টেলে ফিরে অন্য এক ভাল ছাত্র নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিল, যার মূল উপজীব্য “সাহিত্য-ফাহিত্য পড়ে নষ্ট করার মত সময় নেই। এখন সামনে হায়ার সেকেন্ডারি, তারপর জয়েন্ট। এস্ট্যাবলিশড হয়ে নিই, তারপর বই ফই পড়া যাবে।”

আমার সেই সহপাঠীরও দোষ নেই। বাবুসোনা সংস্কৃতির ওই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু পড়ার কোনো দরকার নেই, যারা পড়ে তারা ফালতু। আমার এক মেধাবী বন্ধু উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ে সাড়া জাগানো ফল করেছিল। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফল বেরোবার পর তার বাড়ি গিয়ে আমার মনে হয়েছিল কেউ মারা গেছেন। কারণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তার হাজার তিনেক র‍্যাঙ্ক হয়েছে, বাবা বলেছেন “ওর লাইফ শেষ”। এই কারণে পিটার উইর পরিচালিত ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ ছবিটা দেখলেই মনে হয় এটা এই বাংলারই গল্প।

অবশ্য আমাদের বাবুসোনা সংস্কৃতি এমন জোরদার যে জন কিটিং (যে চরিত্রে রবিন উইলিয়ামস অভিনয় করেছিলেন)-এর তুলনায় অনেক নিরামিষ কথাবার্তা বলেই আমাদের সুশান্তবাবু ছাত্রদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

অথচ বাঙালি ছেলেরা এমন বাবুসোনা চিরকাল ছিল না কিন্তু। নইলে ক্ষুদিরামকে পাওয়া যেত না, বিনয় বাদল দীনেশ হত না, নকশালবাড়ি আন্দোলন বলেও কিছু ঘটত না। সেকথা থাক, বাবুসোনাদের বিদ্রোহী বিপ্লবী হওয়ার দরকার নেই (ক্ষুদিরাম তো কবেই আমাদের ঠাট্টার পাত্র হয়ে গেছেন), একটু মানুষের মত মানুষ হলেই যথেষ্ট হয়। কিন্তু কী করে হবে? মানুষ যেমন সমাজ তৈরি করে, সমাজও তো মানুষ তৈরি করে। আমাদের সমাজ তো ক্রমশ উন্নততর বাবুসোনার কারখানা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল দেখি পাড়ার বাচ্চারা মাঠে খেলার সময় মায়েরা বসে থাকেন পাশে। পড়ে গেলে দৌড়ে আসেন, খেলতে খেলতে ছোটদের মধ্যে ঝগড়া লাগলে প্রায়শই তা মায়েদের ঝগড়ায় পরিণত হয়। অর্থাৎ শিশু ছোট থেকেই শিখছে সে কখনো ভুল করে না, সে যা চায় সেটাই তার অধিকার।

বছর দুয়েক আগে আমাদের এক প্রতিবেশী মারা গেলেন। আমাদের পাড়া থেকে শ্মশান অনেক দূরে হওয়ায় কেউ মারা গেলে ম্যাটাডোরে করে নিয়ে যাওয়া হয় সাধারণত। শ্মশানযাত্রীতে ভরে যায় সে ম্যাটাডোর, অল্পবয়সীরা থাকে বেশি সংখ্যায় — এমনটাই কৈশোর থেকে দেখে আসছি। সেবার দেখলাম ম্যাটাডোরের উপর বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে। আরো যা বিস্ময়কর, একটি বছর কুড়ির ছেলেকে বাদ দিলে শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব আমিই সর্বকনিষ্ঠ। বাবুসোনারা বোধহয় টিউশনে ব্যস্ত ছিল। আমাদের মফস্বলেই এই অবস্থা, কলকাতার খবর জানি না।

এবার প্রবল আপত্তি উঠবে। যদি শ্মশানে, হাসপাতালেই ঘুরে বেড়ায় পড়ুয়ারা, তাহলে লেখাপড়া করবে কখন? এমন আপত্তি আমাদের বাবা-মায়েরা আর আমরাই করে থাকি। তার আগের লোকেরা করতেন না। বলা হয় আগে নাকি “কম্পিটিশনের যুগ” ছিল না, তাই অন্য সবে মন দেওয়া সম্ভব ছিল। অথচ আমরা এ ধরাকে ধন্য করে দেওয়ার অনেক আগেই দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, দেশ ভাগ হয়েছে। ভদ্রসন্তানদের পর্যন্ত দুমুঠো ভাতের জন্য করতে হয়নি এমন কাজ নেই। তার চেয়ে বেশি কম্পিটিশনে আমাদের পড়তে হয়েছে কি?

লেখাটা যদি এতদূর অব্দি পড়ে ফেলে থাকেন তাহলে হয়ত খেয়াল করেছেন আমি কেবল ছেলেদের কথাই বলে যাচ্ছি, ভদ্রলোকের মেয়েদের কথা বলছি না। তার মানে এই নয় যে ভদ্রজন মেয়েদের দারুণ সামাজিক জীব তৈরি করছেন। এ যুগের আলালদের ঘরে কেবল দুলাল তৈরি হয় না, বিলক্ষণ দুলালীও হয়। সেই সোনামণিরা বাবুসোনাদের চেয়ে যে মোটেই আলাদা নয় তা-ও দেখা যাচ্ছে কয়েকজন বিলেত ফেরতের খবরে। বিলেত না যাওয়া মেমদের কোরোনার কারণে স্কুল কলেজ না থাকার সুযোগে দলবদ্ধ ফুর্তি দেখেও টের পাওয়া যাচ্ছে। তবু একে বাবুসোনা সংস্কৃতিই বলছি কারণ এই ধারাটি বাঙালি তৈরি করেছিল পুত্রসন্তানদের কথা ভেবেই। তার প্রমাণ এক-দেড় দশক আগেও বিজ্ঞান শাখায় বাঙালি মেয়ের অভাব।

বাবা-মায়েরা বলতেন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হলে জীবন বৃথা। তারপর বেশ নিঃসঙ্কোচে বলতেন “মেয়ে হলে অত চিন্তা করতাম না। কিছু না হলে বিয়ে দিয়ে দেব, মিটে যাবে।” তাই সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ বানানোর তাগিদ মেয়েদের বেলায় কম দেখা যেত। ফলত আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র তারা দুঃখ করত “তোদের আর্টসের ক্লাসগুলোতে কত মেয়ে থাকে, আমরা তিরিশটা ছেলে আর দুটো মেয়ে। প্রেম করতেও কম্পিটিশন।” কথাটা মজা করে বলা হলেও একটা বড় সত্য বেরিয়ে আসে, তা হল ছেলেরা যা হলে মানুষ হয়েছে বলে বাবা-মায়েরা মনে করতেন মেয়েদের তা না হলেও চলত। মেয়ে মাস্টারি করলেও মানুষ, ছেলে মাস্টার হলে “ফেলিওর”।

বাবুসোনা সংস্কৃতি কী দিয়েছে বাঙালিকে? সমাজ সংসার ভুলে লেখাপড়া করে কজন বাঙালি প্রযুক্তিতে আলাদা করে বলার মত অবদান রেখেছে গত তিরিশ বছরে? গত চল্লিশ বছরে কজন বাঙালি ডাক্তারকে সারা ভারত এক ডাকে চিনেছে? নাহয় অত বড় না-ই হল, স্থানীয় মানুষ নাম শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত করে এমন ডাক্তারই বা কজন হয়েছে সারা পশ্চিমবঙ্গে? উত্তরে লবডঙ্কার বেশি কিছু পাওয়া শক্ত। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সাড়া জাগানো কটা কবিতা লেখা হয়েছে বাংলায় বা কটা ফিল্ম তৈরি হয়েছে এই সময়ে সে প্রশ্ন করার কোন মানেই হয় না, কারণ ওসব লাইন যে মেধাবীদের জন্যে নয় তা তো বাবুসোনা সংস্কৃতি বলেই দিয়েছে। একই সঙ্গে ভুলিয়ে দিয়েছে যে সংস্কৃতি মানে কেবল নাচ, গান, ছবি আঁকা, নাটক করা, সাহিত্য রচনা নয়। বিজ্ঞানচর্চা, রাজনীতি — এসবও সংস্কৃতির অঙ্গ।

আসলে বিজ্ঞানচর্চা হবে কী করে? বাবুসোনা সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান পড়ার উদ্দেশ্য তো বিজ্ঞান শেখা নয়, মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া। আমার আরেক মাস্টারমশাই শাশ্বত ভট্টাচার্য যেমন একবার ক্লাসে বলেছিলেন “তোমরা বিজ্ঞান পড়ো এই কারণে নয় যে তোমরা বিজ্ঞান শিখতে চাও বা তোমরা বিজ্ঞানমনস্ক। তোমরা বিজ্ঞান পড়ো কারণ ওটা পড়লে বেশি ভাল চাকরি পাওয়া যায় বলে প্রচার আছে। যদি প্রচার থাকত কুসংস্কারে অনার্স পড়লে বেশি ভাল চাকরি পাওয়া যায়, তাহলে তোমরা কুসংস্কারেই অনার্স পড়তে।” কথাটা যে নেহাত অন্যায় বলেননি তা সেদিনের যে বাবুসোনারা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন সোশাল মিডিয়ায় দক্ষিণপন্থী ভুয়ো খবরের সপক্ষে গলা ফাটায় তাদের দেখলেই পরিষ্কার হয়।

আর রাজনীতি? ওরে বাবা! লেখাপড়া করে হাসপাতালে অসুস্থ লোককে দেখতেই যাওয়া যায় না, আবার রাজনীতি করা যাবে কী করে? করা যে যায় তার কিন্তু অনেক প্রমাণ আছে।

উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (বাবুসোনাদের বাবা-মায়েদের প্রিয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র) সিপিআইএমএল লিবারেশনের সর্বক্ষণের কর্মী হয়েছেন, সর্বভারতীয় সম্পাদক হয়েছেন। সিপিএমের সর্বভারতীয় সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও সিবিএসইর সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। অবশ্য বাবুসোনাদের বাবা-মায়ের বিচারে দুজনেই “ফেলিওর”। টাকা, গাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি — কিছুই করে উঠতে পারেননি। তবে সে বিচারে মানুষ হওয়া লোকেদের মধ্যেও কিন্তু ছাত্রনেতা পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টে আইন ব্যবসা করে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী এবং পরবর্তীকালে দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়া প্রয়াত অরুণ জেটলি ছাত্র রাজনীতি করতেন।

মোদ্দাকথা, বাবুসোনা আর সোনামণিরা স্বার্থপর, দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে ওদের উপর রাগ করবেন না। আমাদের ছানাপোনাগুলোও তো অমনিই হবে। দিল্লীতে নাকি লোকে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছা করার যুক্তি হিসাবে বলে “জানতা হ্যায় মেরা বাপ কৌন হ্যায়?” আমরা বাঙালিরা তো প্রগতিশীল, তাই হয়ত আমাদের ছেলেটি কোরোনাকে “জানিস আমার মা কে” বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল।

সাত তাড়াতাড়ি

রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ বা প্যারডি এমন কিছু অভূতপূর্ব ব্যাপার নয় যা রোদ্দুর রায়ের ক্ষণজন্মা প্রতিভার দৌলতে এই সোনার বাংলায় ঘটতে পারল

ঠিক সাতটা অনুচ্ছেদ। কারণ এই ঘটনা এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়।

১) শরীর, নারী শরীর তো বটেই, অবশ্যই বিদ্রোহের হাতিয়ার হতে পারে। মণিপুরের মায়েরা এক সময় রাষ্ট্রীয় ধর্ষণের প্রতিবাদে উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। হাতের ব্যানারে লেখা ছিল “INDIAN ARMY RAPE US.” এরকম বিস্ফোরক রাজনৈতিক বক্তব্য নিজের শরীরকে ব্যবহার করে প্রকাশ করা যায়। আবার সাধারণভাবে ধর্ষণ, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে মহিলারা slut walk ও করে থাকেন। সুতরাং শুধু বুকে বা পিঠে কেন, হাতে পায়ে মাথায় পশ্চাদ্দেশে — যেখানে ইচ্ছা হয় আপনি কিছু লিখে ছবি তুলতেই পারেন। কিন্তু সেটা যদি বিদ্রোহ বলে গ্রাহ্য হতে হয় তাহলে লেখাটার সারবত্তা থাকতে হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে খিস্তি বসিয়ে দিলেই বিদ্রোহ হয় না। মণিপুরের মায়েদের মত বা যাঁরা slut walk করেন তাঁদের মত বিদ্রোহী হতে গেলে কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার —- সকলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। তাতে নানাবিধ ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। সেজেগুজে একটি জনপ্রিয় উৎসবে যোগ দেওয়ায় কোন ঝুঁকি নেই। ভাইরাল হতে চাওয়া বিদ্রোহ নয়।

২) রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ বা প্যারডি এমন কিছু অভূতপূর্ব ব্যাপার নয় যা রোদ্দুর রায়ের ক্ষণজন্মা প্রতিভার দৌলতে এই সোনার বাংলায় ঘটতে পারল। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই ওসব হয়েছে, স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় করেছেন। বিশিষ্ট সমালোচক জ্যোতি ভটাচার্য দেখিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর একটা কবিতায় ‘ভারততীর্থ’ কবিতার কিছু পংক্তি নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। কিন্তু তাঁরা আনতাবড়ি খিস্তি যোগ করে কাজ সারেননি। “উনি ব্যঙ্গ করেছেন অতএব আমি করলে দোষ নেই” — এটা অশিক্ষিতের যুক্তি। কী করেছেন তা দিয়ে আপনার বিচার হবে, স্রেফ করেছেন বলেই বাহবা দাবী করতে পারেন না কেউ। সে আপনি মেঘ বা রৌদ্র যা-ই হন।

৩) অনেক বুদ্ধিমান লোক ‘শেষের কবিতা’ র বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই এই অসভ্যতার ওকালতি করাতে চাইছেন। প্রচুর লাইকও পাচ্ছেন, কারণ উপন্যাস পড়ার সময় আজকাল কারোর নেই। যাঁরা আগ্রহী তাঁরা উপন্যাসটা পড়লে দেখবেন যে অংশগুলো উদ্ধৃত হচ্ছে সেগুলো অমিত রায় এবং সে যে ছদ্মনামে রবিবাবুর বিরোধিতা করত, সেই নিবারণ চক্রবর্তীর বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য নয়। আর অমিত চরিত্রটি কী এবং কেন সেটা উপন্যাসের শেষ পাতা অব্দি পৌঁছাতে পারলে বেশ বোঝা যায়। কথাটা যদি গোলমেলে মনে হয় তাহলে গুগল করে দেখে নিন negative capability মানে কী।

৪) সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে এক শ্রেণীর লেখক আছেন যাঁরা মনে করেন চাট্টি খিস্তি লিখলেই নবারুণ ভট্টাচার্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ব্যাপারটার প্রবল সমর্থন দেখতে পাচ্ছি। অবাক হচ্ছি না। যাঁরা কিংবদন্তির রাজহংসের জল বাদ দিয়ে দুধ খাওয়ার মত করে নবারুণের সাহিত্য থেকে তুলে নিয়েছেন কেবল খিস্তিটুকু, তাঁরা এই ধাষ্টামো সমর্থন করবেন না তো করবে কারা?

৫) ভারতের ফ্যাসিবাদীদের একটি প্রিয় খেলা আছে। ইংরেজিতে তার নাম whataboutery, আমি বাংলায় বলি বনলতা সেনগিরি। অর্থাৎ “এতদিন কোথায় ছিলেন?” এই কাণ্ডে দেখছি ফ্যাসিবিরোধীরা প্রবল বনলতা সেনগিরি করছেন। “দিল্লীতে জোর করে রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে খুন করে ফেলা হল। সেটা অশ্লীল মনে হয়নি?” “বিজেপি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিকৃত করে পোস্টার বানিয়েছে। সেটা অশ্লীল মনে হয়নি?” এ কি অদ্ভুত গা জোয়ারি রে বাবা! যারা রবীন্দ্রভারতীর কাণ্ডটার নিন্দা করছি তারা অনেকেই তো সোচ্চার বিজেপিবিরোধী, দিল্লীর দাঙ্গা নিয়েও সোচ্চার থেকেছি। এই অসভ্যতা বিজেপি করেনি বলেই নিন্দা করা যাবে না? বা বিজেপিও নিন্দা করছে বলেই আমাদের প্রশংসা করা কর্তব্য? এ তো বিজেপির মতই অনর্থক বাইনারি তৈরি করা। তাও আবার বাংলার সংস্কৃতির পায়ুমৈথুন করে — ঠিক যেটা বিজেপি করতে চায়।

৬) বাড়াবাড়ি করা আমাদের জাতীয় স্বভাবে পরিণত হয়েছে। যেমন ক্রিয়ায় তেমনি প্রতিক্রিয়ায়। কিছু ছেলেমেয়ে অসভ্যতা করেছে, তাদের নিন্দা শুনতেই হবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পারলে কিছু শাস্তিও দিতে পারেন। এদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করার দরকার কী? এরা কি চুরি ডাকাতি করেছে না খুন জখম করেছে? আর উপাচার্যই বা কিসের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করতে চাইছিলেন?

৭) গত দশ-বারো বছরে রাস্তাঘাটে খিস্তি দিয়ে কথা বলা যে দ্রুততায় ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, একই দ্রুততায় ভারতীয় পুরুষদের ধর্ষণ করার ইচ্ছাও বেড়েছে। কিছু মেয়ের পিঠ দেখা যেতেই সেই ইচ্ছা বেরিয়ে আসছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! মেয়েদের পিঠ দেখা গেছে! আবার সে পিঠে কিসব লেখা! এ উত্তেজনা সামলানো যায়? যাদের মেয়েদের হাতের তালু দেখলেও গা শিরশির করে, তারা যে পিঠ দেখে মত্ত হাতীর মত আচরণ করবে তাতে আর আশ্চর্য কী?