২০২৪ আসলে গণভোট, বহুত্ববাদী ভারতের মুখ রাহুল গান্ধী

প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী।

সেই কোন কালে চকোলেট কোম্পানি ক্যাডবেরি’জ অমিতাভ বচ্চনকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে একগুচ্ছ বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। তার একটায় তিনি পাপ্পু নামে একটি ছেলের বাবা, যার বয়স বেড়েই চলেছে কিন্তু সে স্কুলের গণ্ডি আর পেরোতে পারছেন না। তা পাপ্পুর হতাশ দোকানদার বাবাকে ছেলের বন্ধুরা এসে খবর দিল, পাপ্পু পাশ করে গেছে। অতএব তারা চকোলেট খাবে, পয়সা পাপ্পু দেবে। বাবা মহানন্দে সকলকে বিনিপয়সায় চকোলেট বিলোতে লাগলেন। এমন খুশির খবরে কি মিষ্টিমুখ না করে থাকা যায়? ওই সিরিজেরই আরেকটি বিজ্ঞাপনে অমিতাভ কলেজের অধ্যাপক। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখেন, ছেলেমেয়েরা সব ঊর্ধ্বশ্বাসে কোথায় যেন দৌড়চ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, পাপ্পুর নাকি পরীক্ষা, তাই তারা সবাই দৌড়চ্ছে। অবাক অধ্যাপক সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন পরীক্ষা মানে হল, একটি সুন্দরী মেয়ে (রাইমা সেন) কলেজে ঢুকছে আর মোটা কাচের চশমা পরা, সচরাচর যাদের ক্যাবলা বলা হয় তেমন ছেলে পাপ্পু প্রেম নিবেদন করবে বলে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি এল, দেখল এবং পাপ্পুকে জয়যুক্ত করল। ফলে সকলে মিলে পাপ্পু পাশ করে গেছে বলে ফের নাচানাচি শুরু করল। এ খবরেও মিষ্টিমুখ না-করে থাকা যায় না, অতএব ফের চকোলেট খাওয়া হল। এই পাপ্পু যে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে জায়গা করে নিতে চলেছে, তখন কে জানত!

আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র তুলনাহীন। আজ না হয় যাবতীয় টিভি চ্যানেল এবং অধিকাংশ সর্বভারতীয় খবরের কাগজের উপর আম্বানি-আদানির সহায়তায় তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির সর্বভারতীয় উত্থানের সময়ে তো এতখানি আধিপত্য ছিল না। তবু বিজেপি নেতারা বারবার আউড়ে এবং হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকের বিপুল ব্যবহারের মাধ্যমে জনমনে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পেরেছিলেন এই কথা যে, হার্ভার্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রাহুল গান্ধি হলেন ওই বিজ্ঞাপন সিরিজের অকর্মণ্য, অজস্রবার ফেল করা পাপ্পু। অন্যদিকে তথ্যের অধিকার আইন ব্যবহার করে যাঁর পাশ করার বছরের তথ্য জানতে চাইলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে মুখে কুলুপ আঁটে, সেই মোদি হলেন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, বিশ্বগুরু হওয়ার উপযুক্ত। যেহেতু মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতা সন্দেহজনক (গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত তাঁর মার্কশিটে অধ্যয়নের বিষয় লেখা ছিল “entire political science”), সেহেতু ডিগ্রি ব্যাপারটাই যে অপ্রয়োজনীয় তা প্রমাণ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র। বারো ক্লাসের গণ্ডি না-পেরনো স্মৃতি ইরানিকে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী করা হয়েছিল এবং ডিগ্রি যে কিছুই প্রমাণ করে না তা প্রমাণ করতে দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র মতো বিরাট কাগজ রীতিমত গ্রাফিক্স তৈরি করেছিল— যাতে দেখানো হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বেরই ডিগ্রির বালাই ছিল না। মনে রাখতে হবে, এই স্মৃতি সংসদে পৌঁছেছিলেন অমেঠি কেন্দ্রে রাহুলকে পরাজিত করে। অর্থাৎ স্মৃতিকে মাথায় তোলার পিছনেও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাহুলকে পাপ্পু প্রমাণ করা।

স্বীকার্য যে, প্রচুর লেখাপড়া জেনেও রাজনীতিতে কেউ অকর্মণ্য হতেই পারেন। আবার বেশিদূর লেখাপড়া না-করেও ক্ষুরধার বুদ্ধি, সাহস এবং পরিশ্রমের জোরে একজন রাজনীতিবিদ দারুণ সফল হতে পারেন। সাফল্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটা অবশ্য গুরুতর প্রশ্ন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেমন স্পষ্টতই মনে করেন, চা বিক্রেতার ছেলে হয়েও দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাই সাফল্য। কীভাবে সে চেয়ার অবধি পৌঁছনো হল এবং চেয়ারে বসে কী করা হচ্ছে তার তেমন গুরুত্ব নেই। তিনি যে গত আট বছরে এমনকি কাশ্মিরি পণ্ডিতদের জন্যও গঠনমূলক কিছু করে উঠতে পারেননি, তা তাঁর কাছে ব্যর্থতা বলে প্রতিভাত হয় বলে তো মনে হয় না। উলটে সারাক্ষণ নিজেই নিজেকে শংসাপত্র দিয়ে বেড়াচ্ছেন— “সব চঙ্গা সি”। এহেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের মানদণ্ডে রাহুল যা-ই করুন, প্রধানমন্ত্রী না-হতে পারলে পাপ্পুই থাকবেন। তাতে কিছু এসে যায় না। মুশকিল হল, পাপ্পু মিথ নির্মাণ এতই সফল হয়েছে যে, বিজেপিবিরোধী মানুষও কিছুতেই ওই মিথ ভুলে রাহুলকে দেখে উঠতে পারছেন না। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের এই ভুল না ভাঙলে বিপদ।

গত কয়েক দিনে যে চরম অন্যায় অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করে রাহুলকে লোকসভা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, বহু উদারপন্থী, এমনকি বামপন্থী মানুষও তাতে তেমন দোষ দেখছেন না। বিজেপি বাদে সব দলের নেতৃস্থানীয়রাই অবশ্য এর নিন্দা করেছেন, কিন্তু তার অনেকটাই “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” যুক্তিতে। কারণ, আজ এর প্রতিবাদ না-করলে কাল এত বড় দেশের কোনও এক নিম্ন আদালতে তাঁদের কারও কোনও প্রধানমন্ত্রীবিরোধী মন্তব্যকে হাতিয়ার করে কেউ যদি মানহানির মামলা ঠুকে দেয় আর আদালত তুরন্ত দুবছরের কারাদণ্ড দিয়ে দেয়, তাহলে তাঁদের সাংসদ বা বিধায়ক পদও নিমেষে খারিজ হয়ে যাবে। কিছু বলার মুখ থাকবে না। এই নেতা-নেত্রীদের কে কে ভারতের গণতন্ত্রের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সত্যিই চিন্তিত তা আরও কিছুদিন না কাটলে, তাঁদের দলের কার্যকলাপ না দেখলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। যেমন ধরুন, এর পরেও যদি আম আদমি পার্টি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী ধ্বজা উড়িয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটতে যায়, তা হলে বুঝতে হবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের লুকোবার মতো আরও অনেক কিছু আছে। সেসবের গুরুত্ব ভারতের গণতন্ত্র বাঁচানোর চেয়ে বেশি।

কিন্তু ইতিমধ্যেই দলগুলোর সাধারণ সদস্য, সমর্থকদের অনেকেরই দেখা যাচ্ছে রাহুল পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন এবং অনেকে তাঁর মধ্যে আশার আলো দেখছেন বলে প্রবল গাত্রদাহ। এর কারণ রাহুলের কার্যকলাপ তাঁরা এত বছর ধরে ভাল করে লক্ষই করেননি। নিজেদের অজান্তেই সরকারি প্রচারযন্ত্রের চোখ দিয়ে রাহুলকে দেখেছেন। তাই এখন চোখকান যা বলছে, মস্তিষ্ক কিছুতেই তা মানতে চাইছে না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভারত জোড়ো যাত্রার পরে রাহুল সর্বক্ষণের রাজনীতিবিদ নন— এই অভিযোগ আর করা যাচ্ছে না। লৌহমানব মোদির বিপরীতে তিনি যে ঠুনকো পুতুল নন, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছেন। কংগ্রেসেও যে নেতৃত্বের সঙ্কট দীর্ঘকাল ধরে চলছিল তার নিষ্পত্তি ঘটেছে। গুলাম নবি আজাদের মতো সুযোগসন্ধানীরা বিদায় হয়েছেন। কপিল সিব্বলের মতো অতিবৃদ্ধ, জনসংযোগহীন আইনজীবী নেতারা পথপার্শ্বে পড়ে আছেন। সুদর্শন, সাহেবদের মতো ইংরেজি বলায় দক্ষ শশী থারুর টিভি স্টুডিও আর টুইটার আলো করেই বসে আছেন। মল্লিকার্জুন খড়গেকে সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে ঝাড়া হাত-পা রাহুল জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে গেছেন।

কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। দেশ কীভাবে চালানো উচিত, ভারতের আগামীদিনের অর্থনীতি কেমন হওয়া উচিত, আজকের দুনিয়ায় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার পুনঃপ্রয়োগ কীভাবে করা সম্ভব— এসব নিয়ে গত কয়েক বছরে মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছেন রাহুল। কিন্তু গোদি মিডিয়া আর বিজেপি-র আইটি সেল সেসব দিকে আলো ফেলেনি। কেবলই পাপ্পু ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে এবং জওহরলাল নেহরুর চিন-নীতির ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির স্বৈরতান্ত্রিকতা— এগুলোকে রাহুল গান্ধীর সমার্থক করে দিয়েছে। দুঃখের বিষয়, বহু বিজেপি-বিরোধী, বিশেষত বামপন্থীরা, এই চশমা দিয়েই রাহুলকে দেখেছেন এবং এখনও দেখে চলেছেন। তাঁরা খেয়ালই করেন না, ২০১৯ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাহুল সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের যে প্রস্তাব রেখেছিলেন তা এই মুহূর্তে যে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির কবলে আমরা পড়েছি তার প্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক, এবং বলা বাহুল্য, বামপন্থী। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন ভারতে অমন একটা প্রকল্প দারুণ কাজে দেবে। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ অবশ্যই আছে। কিন্তু অন্তত এই শতকে ভারতের কোনও বামপন্থী দলের নেতাকে অর্থনীতি নিয়ে এরকম বিকল্প চিন্তা করতে দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের শেষ বামফ্রন্ট সরকার বরং অনেকাংশে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি নিয়ে চলছিল, কেরলের বাম সরকারও যে মৌলিকভাবে আলাদা কোনও পথ দেখাতে পারছে এমন নয়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যেমন (যাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে মোদি সরকার) তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে খুব আলাদা কোনও পথ নেওয়া হয়তো কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভবও নয়। কিন্তু প্রস্তাব হিসেবে, পরিকল্পনা হিসেবেও ডি রাজা, পিনারাই বিজয়ন বা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যরা কোনও মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির কথা বলেছেন কি? সরকারে এলে কী করবেন সে তো পরের কথা, রাহুল অন্তত অন্য কিছু ভাবার এবং বলার সাহস তো দেখিয়েছেন।

ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন রাহুল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিলেন। সেই আলোচনা শুনলে বোঝা যায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে রাহুল কীভাবে দেখেন এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্যকে কতটা গভীরভাবে জানেন। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের সাফল্য কীভাবে এল, ভারতে সেরকম কিছু করা সম্ভব কিনা জানতে চান এবং সেই প্রসঙ্গে জিএসটি ও নোটবন্দির ফলে কর্নাটকের বেল্লারির রমরমা জিনস শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতির কথা জানান। দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়েও সুনির্দিষ্ট আলোচনা করেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মির পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনকে কতটা গভীরভাবে দেখেছেন তা মিনিট পঁচিশেকের ওই ভিডিওতে বেশ বোঝা যায়। রঘুরাম কিন্তু ঘোর পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ। রাহুল আলোচনার এক জায়গায় প্রশ্ন করেন, “দেখতে পাচ্ছি স্টক এক্সচেঞ্জে টাকা লাগিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার কী মত?”

দিল্লির রাজনৈতিক মহলে সকলেই জানেন, রাহুলকে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের অপছন্দ হওয়ার অন্যতম কারণ তাঁর এই বামপন্থী প্রবণতা। তিনি যেভাবে নাম করে দেশের সবচেয়ে বড় দুই ধনী— মুকেশ আম্বানি আর গৌতম আদানিকে আক্রমণ করেন, তা অনেকেরই পছন্দ নয়। কারণ অর্থনীতির দিক থেকে কংগ্রেসের ক্রমশ ডাইনে সরে যাওয়া আরম্ভ হয়েছিল রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধীর আমলে, যা তুঙ্গে পৌঁছয় নরসিংহ-মনমোহন জুটির নেতৃত্বে। সেই কারণেই নরসিংহ বিজেপির বিশেষ পছন্দের লোক। শেখর গুপ্তার মত দক্ষিণপন্থী সাংবাদিকরা তাঁকে ‘ভারতের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী’ আখ্যাও দিয়ে থাকেন। সেই দলের নেতা হয়ে রাহুলের এভাবে বৃহৎ পুঁজিকে আক্রমণ, বারবার ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ নিয়ে কথা বলা অনেক কংগ্রেসিরই না-পসন্দ।

তা বলে রাহুল বিপ্লবী নন, লেনিন বা মাও জে দং নন। কিন্তু তাঁকে অমন হতে হবে— এমন প্রত্যাশা করবই বা কেন? এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও যখন বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে থেকে তেমন কেউ উঠে এলেন না, তখন বহুত্ববাদী ভারত থাকবে কি থাকবে না— এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে কমিউনিজমের দাঁড়িপাল্লায় রাহুলকে মাপার মূঢ়তা ক্ষমার অযোগ্য। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় একই সময়ে। একশো বছর পূর্ণ করার আগেই আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনায় চূড়ান্ত সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সেখানে ভারতীয় কমিউনিস্টরা দারুণ শুরু করেও ১৯৬৪ সালের পর থেকে নিজেদের ভাঙতে-ভাঙতে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে, অস্তিত্বেরই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ১৯৮৯ থেকে সংঘের শক্তি দ্রুত বেড়েছে, অথচ কমিউনিস্টরা সম্মুখসমরে যাওয়ার শক্তি ক্রমশ হারিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে তবু বিকল্প সরকার তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার শক্তি ছিল, ২০০৯ সালের পর থেকে তা-ও আর অবশিষ্ট নেই।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় রাজনীতির বাস্তুতন্ত্র মানে ছিল বামপন্থা বনাম মধ্যপন্থার লড়াই। সংঘ পরিবার সফলভাবে অটলবিহারী বাজপেয়ির আমল থেকে সেই বাস্তুতন্ত্রকে মধ্যপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থার লড়াইয়ে পরিণত করতে শুরু করে। ২০২৪ নির্বাচনে রাহুল তথা কংগ্রেসকে উড়িয়ে দিয়ে জিততে পারলে ব্যাপারটা পুরোপুরি দক্ষিণপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থা হয়ে দাঁড়াবে। কেবল মমতা ব্যানার্জি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, নবীন পট্টনায়করাই যদি বিরোধী দল হিসেবে টিঁকে থাকেন তা হলে বনাম শব্দটারও আর প্রয়োজন থাকবে কি না, সন্দেহ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যেমন শাসক-বিরোধী সংঘাত বলে কিছু হয় না। যা হয় সব বিধানসভার বাইরে টিভি ক্যামেরার সামনে। সুতরাং গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ভারতকে বাঁচাতে হলে ভারতের আরএসএসবিরোধী শক্তিগুলোর হাতে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। বামপন্থীদের সামনেও নেই। নেহরুর নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে অকারণে বরখাস্ত করা, ইন্দিরার জরুরি অবস্থা, মনমোহনের অপারেশন গ্রিন হান্ট ইত্যাদি কারণে কংগ্রেস সম্পর্কে যত বিতৃষ্ণাই থাক, রাজনীতিতে আশু বিপদের চেয়ে বড় কোনও বিপদ নেই, কোনওদিন ছিল না। সে কারণেই ইন্দিরা যখন দেশের গণতন্ত্রের জন্য মূর্তিমান বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন তখন জ্যোতি বসুর মতো প্রবাদপ্রতিম বাম নেতারা সংঘ-ঘেঁষা শক্তির উপস্থিতি সত্ত্বেও জয়প্রকাশ নারায়ণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

আরও পড়ুন কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?

রাহুল আরও একটা জায়গায় দেশের অন্য সব বিরোধী নেতার চেয়ে এগিয়ে আছেন, তা হল সরাসরি সংঘ-বিরোধিতা। অন্য সব দলের নেতাদেরই বিজেপির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। একমাত্র রাহুলই বারবার বলেন, লড়াইটা আরএসএসের বিরুদ্ধে। দেশের মাটিতে জনসভায় বলেন, সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন। আবার কেমব্রিজে বক্তৃতা দিতে গিয়েও বলেন। এ দেশের কমিউনিস্টদের চিরকালীন বদভ্যাস, তাঁরা অর্থনৈতিক বিভাজন ছাড়া আর কোনও বিভাজন স্বীকারই করতে চান না। গত শতকের তিনের দশকে এই কারণেই গিরনি কামগর ইউনিয়নের ধর্মঘটে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের নেতৃত্বাধীন শ্রমিকদের সঙ্গে বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকরের নেতৃত্বাধীন দলিত শ্রমিকদের ঐক্য হয়নি। একশো বছর হতে চলল, কমিউনিস্টরা নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাই রামমন্দির, হিজাব পরার জন্য মেয়েদের শিক্ষায়তনে ঢুকতে না-দেওয়া কিংবা গোমাংস ভক্ষণ বা পাচারের অভিযোগে মুসলমান হত্যার মতো ঘটনাগুলোকে বামপন্থীরা বলেন— আসল ইস্যু থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আসল ইস্যুগুলো কী? না বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। তাঁরা কিছুতেই মানবেন না, আরএসএস-বিজেপি মন্দির-মসজিদ, শিবাজি-মোগল ইত্যাদিকেই বৃহদংশের মানুষের কাছে আসল ইস্যু বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে। সে কারণেই উত্তরভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম সংসদ আয়োজিত হয়, যেখানে প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়। প্রশাসন যে কিছুই করে না সে তো প্রত্যাশিত, কিন্তু আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষই যে এইসব সংসদে যান তা সম্ভবই হত না তাঁদের কাছে বামপন্থীরা যেগুলোকে আসল ইস্যু বলেন সেগুলো নকল ইস্যু হয়ে না-গিয়ে থাকলে।

রাহুল কিন্তু এই কথাটা বোঝেন। তিনি জানেন, আসলে লড়াইটা সাংস্কৃতিক। সংঘ মানুষের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলেছে। ভারত জোড়ো যাত্রায় তিনি যে বারবার বলছিলেন “নফরত কে বাজার মে মহব্বত কা দুকান খোলনে আয়া হুঁ” (ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে এসেছি) তা স্রেফ কাব্যি নয়, সচেতন রাজনৈতিক স্লোগান। এই সময়ের প্রয়োজনীয় স্লোগান। সম্প্রতি এক আলোচনাসভায় নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবাস করে আসা লেখক মনীশ আজাদের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। শ্রোতাদের একজন প্রশ্ন করলেন, হাথরসের সেই ভয়ঙ্কর ধর্ষণ ও খুনের পরেও সেখানকার নির্বাচনে বিজেপি কেন জেতে? লখিমপুর খেড়িতে বিজেপি নেতার ছেলে গাড়ির চাকার তলায় কৃষকদের পিষে দেওয়ার পরেও সেখানে বিজেপি কী করে জেতে? মনীশ বললেন, ৪০-৫০ বছরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংঘ মানুষের মধ্যে এই ভাবনা প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, আসল ইস্যু হল ধর্ম, বর্ণ, জাতি— এইসব। অন্যান্য ইস্যুতে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারো, রেগেও যেতে পারো। কিন্তু ভোট দেওয়ার সময়ে সেসব ভুলে ধর্মের ভিত্তিতে দেবে। উদাহরণ দিয়ে বললেন, জিএসটি নিয়ে ক্ষুব্ধ গুজরাতের ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন প্রবল আন্দোলন করার পরেই একটা শহরের রাজপথের ফেস্টুন ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, “হম নারাজ হ্যাঁয়, গদ্দার নহি” (আমরা বিরক্ত, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নই)। তারপর গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যথারীতি জেতে। সুতরাং বিজেপিকে হারাতে হলে এই মানসিকতাকে হারাতে হবে। অর্থনৈতিক অভাব অনটনই আসল ইস্যু, বাকি সবই নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা— এই বালখিল্য রাজনীতি ফল দেবে না। কারণ, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে, বাজারটা ঘৃণার। রাহুল তাই ভালবাসার দোকান খোলার কথা বলেছেন। দোকানে কতজন খদ্দের আসবে, সে তো পরের কথা। কিন্তু যত বেশি দোকান খোলা হবে বাজারের পরিবেশ যে তত বদলাবে, তাতে তো সন্দেহ নেই। সত্যিকারের বিজেপি-বিরোধীরা এ কথা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন তত ভাল। রাহুল মহাপুরুষ নন, সাধুসন্ত নন, বিপ্লবী তো ননই। তিনি একা কতটুকু পারবেন? তাঁর ক্ষয়িষ্ণু পার্টিই বা কতটা পারবে?

২০২৪ সালের নির্বাচন বস্তুত গণভোটে পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী। কার সঙ্গে কার কোথায় নির্বাচনী আসন সমঝোতা হবে না-হবে সেসব পরের কথা, পাটিগাণিতিক আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক প্রশ্ন ওই একটাই। এ কথা অস্বীকার করলে আত্মপ্রতারণা হবে।

এমন বাইনারি নিঃসন্দেহে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু আমাদের সামনে আশু বিপদটা যে একদলীয় শাসন।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত

কতদিন রামের চেয়ে পিছিয়ে থাকবেন কৃষ্ণ?

কোভিডে যখন আমরা ঘরবন্দি, তখন দূরদর্শন তাদের জনপ্রিয় হিন্দি ধারাবাহিকের অনেকগুলোই পুনঃপ্রচার করছিল। বাসু চ্যাটার্জির ব্যোমকেশ বক্সীর প্রায় সবকটা পর্বই ফের গোগ্রাসে গিললাম। বি আর চোপড়ার মহাভারত দেখার তেমন উৎসাহ ছিল না, তবে কিছু পর্ব চোখে পড়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটা ছিল কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম এবং ঝড়ের রাতে বসুদেবের কৃষ্ণকে মাথায় নিয়ে গোকুলযাত্রা। দেখতে দেখতে মনে পড়ল নীতীশ ভরদ্বাজের কথা। দূরদর্শনে সম্প্রচারিত রামানন্দ সাগরের রামায়ণ কীভাবে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে তা নিয়ে বইপত্র লেখা হয়েছে। কিন্তু সেই রামায়ণের রাম অরুণ গোভিলও পাননি, এমন এক সম্মান পেয়েছিলেন চোপড়ার মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রাভিনেতা নীতীশ। তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই জয়ে তাঁর কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয়ই একমাত্র কারণ ছিল না নিশ্চয়ই, কিন্তু ভারতের দর্শক যে অভিনয় আর বাস্তবে প্রায়শই তফাত করতে পারেন না তার অজস্র প্রমাণ আছে। হেমেন গুপ্তের ‘বিয়াল্লিশ’ ছবিতে অত্যাচারী পুলিস অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করার পর বিকাশ রায়ের বাড়িতে ঢিল পড়ার কিংবদন্তিও সে কথাই প্রমাণ করে।

কিন্তু পর্দার কৃষ্ণের রাজনৈতিক লাভ হলেও বিষ্ণুর দুই অবতারের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণই কিন্তু হিন্দুত্ব রাজনীতিতে উপেক্ষিত। রামজন্মভূমি আন্দোলন গোটা ভারতের ইতিহাসই বদলে দিয়েছে। গত কয়েক বছরে রামনবমী হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক বিবৃতির মঞ্চ। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সশস্ত্র মিছিল করবে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু এলাকায় এমন আচরণ করবে যেন বানরসেনার মত তারাও রাবণবধে বেরিয়েছে – এ যেন নিয়ম হয়ে গেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মত বিজেপিবিরোধীরা এর উত্তরে প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্ব করতে নেমে পাল্টা রামনবমী মিছিল, বজরংবলী পুজো ইত্যাদি করবে – এটাই নিয়ম হয়ে গেছে। সেই তুলনায় জন্মাষ্টমী এখনো শান্তিপূর্ণ উৎসব। ‘অ্যাংগ্রি রাম’, ‘অ্যাংগ্রি হনুমান’-এর মত ‘অ্যাংগ্রি কৃষ্ণ’ স্টিকারও দেখা যায় না পথচলতি গাড়ির গায়ে। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আস্ত বক্তৃতা দিয়ে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণের বাঁশরী আর শিখীর পাখা এখনো সুদর্শনকে ঢাকা দিয়ে রেখেছে।

অবশ্য তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কারণ নেই। হিন্দুত্ব প্রকল্পে অযোধ্যার পরে যে কাশী এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরার জায়গা – তা তো হিন্দুত্ববাদীদের স্লোগানেই বলা আছে। গত ১৩ অগাস্ট দিল্লিতে কয়েকজন সাধুসন্ত হিন্দুরাষ্ট্রের ৩২ পাতার খসড়া সংবিধান প্রকাশ করেছেন। তাতে উল্লেখ না থাকলেও, হিন্দুত্বের পিতা সাভারকরের কৃষ্ণ তথা গীতাপ্রীতি মাথায় রাখলে হিন্দুরাষ্ট্রের পতাকায় অশোক চক্রের জায়গা নেবে সুদর্শন চক্র – এমন কল্পনা অন্যায় হবে না।

আরও পড়ুন লাঠালাঠি নয়, গলাগলি

দেবতোষ দাশের বিন্দুবিসর্গ উপন্যাস পড়তে গিয়ে জানলাম, কার্ল মার্কস জগদ্বিখ্যাত দাস কাপিটাল বইতে বিষ্ণুকে উল্লেখ করেছেন পুঁজিবাদী বলে (‘Enough, that the world still jogs on, solely through the self chastisement of this modern penitent, of Vishnu, the capitalist.’)। সে অর্থে বর্তমানে গোটা দুনিয়াটাই বিষ্ণুর দখলে, ভারত তো বটেই। সেই বিষ্ণুর লোকপ্রিয় অবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিকে কি বেশিদিন নরেন্দ্র মোদীরা স্রেফ একটা ছুটির দিন হয়ে থাকতে দেবেন? তুলসীদাসের প্রজারঞ্জক রামকে দিয়ে তাঁদের কাজ চলে না। যশোদার আদরের বালগোপাল বা রাধার প্রেমিক শ্যামকে দিয়ে কি চলবে?

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র

মিঠুদা (নাম পরিবর্তিত) পেশাদার ড্রাইভার। বাসচালক ছিলেন, এখন প্রাইভেট গাড়ি চালান। সম্প্রতি যে শতাধিক পৌরসভায় নির্বাচন হল, উনি তারই একটার বাসিন্দা। পার্টি সদস্য না হলেও, সক্রিয় সিপিএম সমর্থক। নির্বাচনের ফল বেরোবার আগের দিন দেখা হল, বললেন “দাদা, মনে হচ্ছে অন্তত আমাদের ওয়ার্ডটায় জিতে যাব। ওরা অনেক চেষ্টা করেছিল, ভয় দেখিয়েছিল, কিন্তু আমরা বুক দিয়ে বুথ আগলেছি।” মিঠুদার আশা পূর্ণ হয়নি। রাজ্যের অন্য অনেক পৌরসভার মত ওঁদের পৌরসভাও বিরোধীশূন্য হয়েছে। দিন সাতেক পরে আবার দেখা। দুঃখ করে বললেন “কাজকর্ম ফেলে, টিএমসির গালাগাল খেয়ে ভোটের আগে কদিন রাত জেগে পোস্টারিং করলাম। এখন ভোটের পরে পার্টি অফিসে গেলে নেতারা ভাব করছে যেন চেনেই না। আর ওদের কাছে যাবই না ভাবছি। আগেও দেখেছি, মিছিলে লোক দরকার হলে আমাকে ডাকে। আর এসডিও অফিসে ডেপুটেশন দিতে যাওয়ার সময়ে ফরসা দেখতে লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোকে ডাকে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, একবার বলেও না ‘মিঠু, তুইও যাস।’ কেন বলবে? আমার কালোকোলো চেহারা, লেখাপড়া জানি না অত, আমার আর কী দাম?”

পশ্চিমবঙ্গে বিধায়ক, সাংসদ নেই; ভোটও দু-আড়াই শতাংশে নেমে এসেছে সিপিএমের। তবু যে তারা এখনো কয়েক হাজার মানুষের মিছিল করতে পারে, আনিস খান হত্যার যথাযথ বিচার চেয়ে যে মাঝে কয়েকদিন রাজ্য তোলপাড় করে দিতে পেরেছিল, তা এই মিঠুদাদের জন্যই। মিঠুদার পেশায় মাস মাইনে নেই, ডি এ নেই, টি এ নেই, অবসরের পর পেনশন নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। গাড়ি চালালে রোজগার, না চালালে হাত খালি। সেই মানুষ ভোটের আগে গাড়ি না চালিয়ে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে বেড়িয়েছেন। একথা জানতে পারলে যে কোনো মানুষের মনে হতে বাধ্য, বর্তমান যেমনই হোক, সিপিএমের এখনো ভবিষ্যৎ আছে। কোনো পার্টির যদি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী সমর্থক থাকে, তাহলে তার কিসের অভাব?

অভাব আছে। মিঠুদাদের উপযুক্ত মর্যাদার অভাব। সিপিএমে বৃদ্ধতন্ত্র চলছে বলে প্রায়ই হইচই হয়। রাজ্য সম্মেলন চলাকালীন কয়েকজন বয়স্ক নেতা ঝিমোচ্ছেন — এই ছবি প্রকাশ হওয়ার পর আরও বেশি করে হচ্ছে। চাপা পড়ে যাচ্ছে যে কথা, তা হল বিমান বসু এখনো যে কোনো ২৫-৩০ বছরের ছেলের চেয়ে বেশি হাঁটতে পারেন মিছিলে, হান্নান মোল্লা দিল্লির রাস্তায় বসে এক বছরের বেশি কৃষক আন্দোলন করলেন সদ্য, তপন সেন এখনো গোটা ভারত চষে শ্রমিক সংগঠনের কাজ করেন। যা সত্যিই সিপিএমের সমস্যা, তাকে বলা চলে মধ্যবিত্ততন্ত্র। মিঠুদার অভিজ্ঞতা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। মূলত শ্রমিক-কৃষকের পার্টি হওয়ার কথা যে দলের, সেই দলের রাজ্য নেতৃত্বে দীর্ঘকাল ছাত্র, যুব নেতারা প্রাধান্য পাচ্ছেন। চক্রান্ত করে শ্রমিক নেতা, কৃষক নেতাদের সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে না এমন হয়ত নয়। আসলে পার্টিতে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। যাঁরা আসতে চাইছেন তাঁরা মিঠুদার মত ব্যবহার পাচ্ছেন। গুরুত্ব পাচ্ছেন লেখাপড়া জানা চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ীরা। মিঠুদার মত লোকেদের আদর দল ভারী করার সময়ে, অন্য সময়ে তারা অপ্রয়োজনীয়।

মিঠুদা মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন বা মায়াকভস্কি পড়েননি। তিনজনের সংসারের খাওয়া, পরা আর ছেলের লেখাপড়ার সংস্থান করতে উদয়াস্ত খেটে ওসব পড়াও যায় না। কিন্তু না পড়েই মার্কসবাদ যাকে শ্রেণিচরিত্র বলে, তার ধারণা ওঁর কাছে পরিষ্কার। বলেই দিলেন “চাকরি করা ফ্যামিলির ছেলেকে যতই তোল্লাই দিক, সে ভাল কেরিয়ার পেলেই চলে যাবে। পার্টির জন্যে আমরাই থাকব।” কিন্তু পার্টি এঁদের জন্য থাকবে কিনা এঁরা বুঝতে পারছেন না।  আশা করা যায় সিপিএমের নবনির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম জানেন, এই মুহূর্তে তাঁর পার্টির এ এক বড় সংকট। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ছিল মুসলমান, নিম্নবর্গীয় মানুষের হাতে। মুজফফর আহমেদ, আব্দুল হালিম, মহম্মদ ইসমাইলের মত নেতারা প্রবাদপ্রতিম। স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষত পার্টি ভাগ হওয়ার পর থেকে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সব কমিউনিস্ট পার্টিই ক্রমশ হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের দল। ভারতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে যার অর্থ গরীব, প্রান্তিক মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়া। এখন কি মাটির টানে ফিরতে পারবে সিপিএম?

তারুণ্য নেই এমন কথা আর বলা যাবে না। বিধানসভা নির্বাচনে এক ঝাঁক অল্পবয়সীকে প্রার্থী করা হয়েছিল, সদ্যগঠিত নতুন রাজ্য কমিটিতেও অনেক নতুন মুখ। আনিসের জন্য বিচার চেয়ে আন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি বহুকাল পরে মনে করিয়ে দিলেন সেই স্লোগান “পুলিসের লাঠি ঝাঁটার কাঠি/ভয় করে না কমিউনিস্ট পার্টি”। কিন্তু আশ্চর্য! তাঁকে এবং আরও একগুচ্ছ পার্টিকর্মীকে হাস্যকর অভিযোগে হপ্তা দুয়েক আটকে রাখা হল, উপরন্তু শারীরিক নির্যাতন চলল; সিপিএম আইনের উপর আস্থা রেখে নিরামিষ প্রতিবাদ ছাড়া কিছুই করল না!

আরও পড়ুন সেলিব্রিটি কাল্ট দরদী সিপিএমকে খোলা চিঠি

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির জন্যে ইস্যুর কিন্তু অভাব নেই। দেউচা পাঁচামিতে খনি করতে দেবেন না – এই দাবিতে স্থানীয় মানুষ আন্দোলনে, স্কুলের নিয়োগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, পুলিস আনিসের পর ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলরের হত্যাতেও প্রশ্নের মুখে, শাসক দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে যে নির্বাচিত কাউন্সিলর খুন হয়ে যাচ্ছেন, নেতৃত্ব মনোনীত চেয়ারম্যানকে বিজেপির সমর্থনে হারিয়ে দিয়ে পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়ে যাচ্ছেন অন্য একজন, ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ধরে সরকারে ফিরে মার্কামারা সাম্প্রদায়িক প্রাক্তন বিজেপিদের নির্বাচনে প্রার্থী করছে তৃণমূল। অথচ সিপিএম কিছুতেই মমতার কপালে ভাঁজ ফেলার মত বিরোধিতা করে উঠতে পারছে না। অন্য সবকিছু ভুলে সম্মেলন নিয়ে মেতে থাকা দেখে সন্দেহ হয়, পার্টির জন্য সম্মেলন নয়, সম্মেলনের জন্য পার্টি। বিপ্লবকেও ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখা যেতে পারে, সম্মেলনটা লগ্ন মেনে ষোড়শোপচারে করতে হয়।

বোধ করি কমিউনিস্ট পার্টিতে মধ্যবিত্ততন্ত্র চালু হয়ে গেলে এমনটাই ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন হয় না, এ অভিযোগ স্বয়ং হান্নান মোল্লা মাসখানেক আগে করেছেন। আসলে আন্দোলন হবে কি হবে না — তা ঠিক করছেন মাথায় ছোট বহরে বড় ভদ্রসন্তানরা, এবং অধিকাংশ সময়েই সিদ্ধান্ত হচ্ছে, হবে না। লড়াকু, গরীব কর্মী সমর্থকরা আছেন কেবল হুকুম তামিল করতে। অথচ মাস দশেক আগে নির্বাচনের প্রচারে টুম্পাসোনা গানের প্যারডি প্রকাশ করে বলা হয়েছিল সাধারণ মানুষের ভাষায় তাঁদের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা চলছে। সিপিএমের ভোটের ফলাফলে বোঝা গিয়েছিল, সাধারণ মানুষের ভাষা সিপিএম আদৌ বোঝেনি। লাভের লাভ এই, পার্টির শিল্পবোধও এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে শুভেন্দু মাইতির মত প্রবীণ গণশিল্পী তথা পার্টিকর্মীকে নেতৃত্ব মনে করছেন হুকুমের চাকর।

সিপিএমের ভবিষ্যৎ যদি এঁদের হাতেই থাকে, সে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: