মাননীয় রাহুল গান্ধী,
মহাত্মা গান্ধীর শহিদ হওয়ার দিনে ভারত জোড়ো যাত্রার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে শ্রীনগরে আপনি যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে অন্তত একটি চমৎকার কাজ হয়েছে। যারা বলে ব্যক্তিগত জীবন আর রাজনীতিকে আলাদা আলাদা বাক্সে রাখা উচিত, রাজনৈতিক কারণে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি কাম্য নয়, তারা যে আসলে ব্যক্তিগত জীবনকে রাজনীতি কীভাবে প্রভাবিত করে তা বোঝে না অথবা কোনো উদ্দেশ্যে অন্যদের বুঝতে দিতে চায় না – তা আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেছে।
দুই দশকের সাংবাদিক জীবন বাদ দিন, প্রায় সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক বক্তৃতা শোনার জীবনে মনে করতে পারছি না আর কোনো ভারতীয় রাজনীতিবিদকে কোনো জনসভার প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আলাদা করে অথচ একত্রে কথা বলতে দেখেছি। কাশ্মীরের মানুষ এবং সেখানে মোতায়েন আধাসামরিক বাহিনী ও সেনাবাহিনীর জওয়ানদের যে এক পংক্তিতে দাঁড় করানো সম্ভব, একই বাক্যে তাঁদের সকলের যন্ত্রণা ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব তা নরেন্দ্র মোদীর ভারতে কেন, রাজীব গান্ধীর ভারতেও আমরা কোনোদিন কল্পনা করতে পারিনি। কারণ সৈনিক বা সাধারণ কাশ্মীরি – এই গোষ্ঠীনামের পিছনের ব্যক্তিগুলির বেদনা বা আনন্দ নিয়ে ভাবার কথা রাজনীতিবিদ দূরে থাক, আমাদেরও মনে আসেনি। আপনি ফোনে নিজের ঠাকুমা এবং বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার স্মৃতি উল্লেখ করে বললেন, এ যন্ত্রণা মোদী-অমিত শাহ বুঝবেন না। কাশ্মীরের মানুষ বুঝবেন; সিআরপিএফ, বিএসএফ, সেনাবাহিনীর জওয়ানদের আত্মীয়রা বুঝবেন। কারণ তাঁরা এরকম ফোন কল পেয়ে থাকেন। ভারত জোড়ো যাত্রার উদ্দেশ্য এই ফোন কলগুলো আসা বন্ধ করা।
এভাবে বড়জোর শিল্পী, সাহিত্যিকদের কেউ কেউ ভাবতে পেরেছেন। কথাগুলো শুনেই মনে পড়ে গেল আজাজ খান নির্দেশিত হামিদ ছায়াছবিটির কথা। একমাত্র সেখানেই দেখেছিলাম ভারতীয় সেনার হাতে গুম হয়ে যাওয়া বাবার সন্ধানে থাকা আট বছরের ছেলে আর জন্মের পর থেকে সন্তানের মুখ না দেখা জওয়ানের যন্ত্রণাকে পাশাপাশি রাখা হয়েছিল। মোদী-শাহের নিষ্ঠুর পরিহাসে ২০১৯ সালে ওই ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করা তালহা আর্শাদ রেশিকে নির্দেশক বেশ কিছুদিন জানাতেই পারেননি যে সে দেশের সেরা শিশুশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছে। কারণ তখন গোটা কাশ্মীরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে রেখেছিল ভারত সরকার, যা কাশ্মীরের মানুষেরও সরকার।
এই সংকট তো কেবল কাশ্মীরের মানুষের নয়। দেশের যেখানেই রাষ্ট্র অতিমাত্রায় শক্তিধর হয়ে উঠেছে, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সংঘাত রাষ্ট্রের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে, সেখানেই এই সংকট স্বাধীনতার পর থেকে বারবার ঘটেছে, আজও ঘটে চলেছে। ঠিক যেমন রাষ্ট্রের হাতে ধর্ষিত হওয়া অথবা ধর্ষিত হয়ে রাষ্ট্রশক্তির কাছ থেকে নৈর্ব্যক্তিক (একজন ধর্ষিতার পক্ষে যা অমানবিকের নামান্তর) ব্যবহার পাওয়া এ দেশের মেয়েদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ কোনো নেতাকে কখনো জনসভায় বলতে শুনিনি – “আপনারা হয়ত দেখেছেন আমি যখন হাঁটছিলাম, বেশকিছু মহিলা কাঁদছিলেন। জানেন ওঁরা কেন কাঁদছিলেন? কয়েকজন আমার সাথে দেখা করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে কাঁদছিলেন ঠিকই, কিন্তু এমন অনেকেও ছিলেন যাঁরা কাঁদছিলেন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে। কেউ কেউ বলছিলেন ওঁদের যৌন হয়রানি হয়েছে, কয়েকজনের আত্মীয়ই কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। শুনে আমি যখন বলতাম, আমি পুলিসকে বলি তাহলে? ওঁরা বলতেন, রাহুলজি, পুলিসকে বলবেন না। আমরা আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পুলিসকে বলবেন না। বললে আমাদের আরও ক্ষতি হবে। এই হল আমাদের দেশের বাস্তব।”
এ দেশ কত মহান তা নিয়ে কেবল সংঘ পরিবার তো নয়, আমাদের সকলেরই গর্বের শেষ নেই। সেই গর্বের আখ্যানে এই বাস্তব খাপ খায় না বলে আমরা এড়িয়ে যাই, রাজনৈতিক নেতারা তো এড়িয়ে যান বটেই। যে দলের যেখানে সরকার আছে সেখানে সে দলের নেতারা আরও বেশি করে এড়িয়ে যান, কারণ তাঁরা মনে মনে একে সমস্যা বলে জানলেও স্রেফ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলেই ভাবেন। ফলে এসব কথা তুললে নিজের দলের সরকারের ঘাড়ে দোষ এসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন। তার উপর পুলিসকে বললে সমস্যা বাড়বে – এ তো সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী কথা। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলও তো রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গ। ব্যবস্থার মধ্যে থেকে তার বিরুদ্ধে কথা বলা চলে কখনো? অথচ আপনি বললেন। এখনো ভারতের বেশ বড় বড় তিনটে রাজ্যে আপনার দলের সরকার, অর্থাৎ সেখানকার পুলিস আপনার দলেরই হাতে। তার উপর আপনি, আপনার মা এবং বোন সারাক্ষণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকেন। তবু যে আপনি এসব কথা বললেন, এ কথা চট করে ভোলা যাবে না। যেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললেন, সেখান থেকে কুনান পোশপোরা ঠিক কত কিলোমিটার দূরে তা জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, আপনার কথাগুলো কেবল ওই কাণ্ডের ধর্ষিতাদের নয়, স্পর্শ করবে মণিপুরের সেই মহিলাদেরও, যাঁরা ২০০৪ সালে একদা উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন ইম্ফলের রাস্তায়, সঙ্গে ছিল ফেস্টুন। তাতে লাল অক্ষরে লেখা ছিল – INDIAN ARMY RAPE US। কথাগুলো নিশ্চয়ই ছুঁয়ে ফেলবে ছত্তিসগড়ের সোনি সোরিকে, বেঁচে থাকলে ছুঁয়ে ফেলত অর্চনা গুহকেও। সংবাদমাধ্যম যাকে নির্ভয়া নাম দিয়েছিল সেই মেয়েটিকে তো বটেই। এইসব কুকীর্তির সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল আপনার দলই। তবু আপনি এসব কথা বলেছেন বলে, বা সেইজন্যেই আরও বেশি করে আপনি ধন্যবাদার্হ, রাহুল। মানহারা মানবীর দ্বারে এসে দাঁড়ানোর সাহস খুব কম পুরুষের হয়। তাকে মানবী হওয়ার সম্মানটুকু দেওয়ার ক্ষমতাও অনেক শাসকেরই হয় না, নিজে মহিলা হলেও। আমি যে রাজ্যের বাসিন্দা সে রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীই তো ধর্ষণ হলেই হয় ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, নয় প্রতিবাদী মহিলাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে যান, নতুবা ছেলেটি ও মেয়েটির মধ্যে প্রেম ছিল কিনা তার খোঁজ করেন। ভারতের রাজনীতিবিদদের থেকে এমন ব্যবহার পেয়েই ভারতীয় মেয়েরা অভ্যস্ত।
আরও পড়ুন রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন
আপনার বক্তৃতায় আপনি আরও অনেক কথা বলেছেন যেগুলো ভাল কথা, প্রয়োজনীয় কথা, বহুবার বলা কথা। তবু আবার বলা প্রয়োজন, কারণ কেউ বলছে না। যেমন আপনি ‘গঙ্গা-যমুনী তহজীব’-এর কথা, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সভ্যতার কথা বলেছেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত আপনার যাত্রার তুলনায় এনেছেন কাশ্মীর থেকে এলাহাবাদে নেহরু পরিবারের যাত্রার প্রসঙ্গ। সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কেমন একই সূত্রে গাঁথা তা দেখাতে ব্যক্তিগত ইতিহাসের এই ব্যবহার যে একজন পাকা বক্তার লক্ষণ। কিন্তু যা আপনার গোটা বক্তৃতায় সারাক্ষণ ছেয়ে থেকেছে তা হল সংবেদনশীলতা। আরও সহজ করে বললে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তের মানুষকে ছোঁয়ার ইচ্ছা। আপনি যেমন ধর্ষিত মহিলাদের কথা বলেছেন, তেমনই বলেছেন দুটি হতদরিদ্র ছেলের কথা, যাদের গায়ে জামা পর্যন্ত ছিল না, দেহ ছিল ধূলিমলিন। বলেছেন তাদের দেখেই মনে হয়েছিল উত্তর ভারতের শীতেও শুধু টি-শার্ট পরেই কাটিয়ে দেবেন। সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে কথাগুলো বানানো মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আপনার বক্তৃতার দিনেই নাগরিক ডট নেটে মনীষা ব্যানার্জি লিখেছেন “কথিত আছে চম্পারণে কস্তুরবা দেখেছিলেন, একটি ঝুপড়িতে দুই মহিলার মাত্র একটি কাপড়। একসঙ্গে দুজনে বাইরে বেরোতে পারেন না। এই কাহিনি গান্ধীকে কটিবস্ত্র ধারণে বাধ্য করে…”। ফলে সন্দেহ করা অমূলক নয়, যে এই কাহিনি আপনার জানা এবং আসলে তা থেকেই টি-শার্ট পরার সিদ্ধান্ত। যদি তাও হয়, তবু আজকের ভারতে একজন রাজনীতিবিদ সচেতনভাবে গান্ধীকে অনুকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং গান্ধীর এমন একটি কাজ অনুকরণ করছেন যা করতে গেলে নিজেকে শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে হয় – এ বড় কম কথা নয়। আমরা তো শুনে এসেছি আপনি ‘শাহজাদা’। আপনি নিজেও এই ভাষণে বলেছেন আজন্ম কোনো না কোনো সরকারি বাড়িতে থেকেছেন। শুধু সমালোচকের চোখ দিয়ে দেখলেও সেই লোকের এই ভূমিকার প্রশংসা না করে উপায় নেই। ঘৃণার ব্যাপারীদের কথা অবশ্য আলাদা।
ধূলিমলিন ছেলেদুটির কথা বলতে গিয়ে আপনি ফের তুলে এনেছেন আমাদের পালিশ করা ভারতবর্ষের কদাকার দিকটি। আপনারই এক সঙ্গী যে আপনাকে বলেছিলেন ওদের সাথে গলাগলি করা উচিত হয়নি, ওরা নোংরা – সেকথা বলে দিয়েছেন সর্বসমক্ষে। জানিয়েছেন, আপনার উত্তর ছিল “ওরা আমার এবং আপনার থেকে পরিষ্কার।” আবার বলি, একথা বানানো হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু বানানো হলেও দোষের নয়। প্রথমত, একজন নেতা জনসভায় না ভেবেচিন্তে যা খুশি বলবেনই বা কেন? দ্বিতীয়ত, অস্পৃশ্যতা আজও আমাদের দেশে ইতিহাস হয়ে যায়নি। যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁদের একথা যেভাবে ছোঁবে, আমার মত উচ্চবর্গীয় সাংবাদিককে সেভাবে স্পর্শ করবে না বলাই বাহুল্য। কয়েক হাজার বছর ধরে কোণঠাসা হয়ে থাকা সেইসব মানুষ ভারত জুড়ে গত আট বছরে আরও কোণঠাসা হয়েছেন, যতই একজন দলিতের পর একজন আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হয়ে থাকুন। যেসব গালাগালি স্বাধীন ভারতে অন্তত তাঁরা পিছন ফিরলে ছুঁড়ে দেওয়া হত, আজকাল প্রকাশ্যেই দেওয়া হয়। তাঁরা জানলেন, নিদেনপক্ষে একজন নেতা আছেন ভারতীয় রাজনীতিতে, যিনি ওই ভাবনার, ওই ব্যবহারের বিরুদ্ধে।
আজকের ভারত যেমন হয়েছে, তাতে সারাক্ষণ কথাবার্তা চলে নাগরিকত্ব নিয়ে। অনেকদিন পরে কাউকে ভারতীয়ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে শুনলাম। ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য” কথাটাকে আজ বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেই ঐক্য কীভাবে ভারতের সর্বত্র বিচিত্র ভাষায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চিন্তায় ধরা পড়েছে আপনি সেকথা বলেছেন। গুজরাটের গান্ধী, আসামের শঙ্করদেব, কর্ণাটকের বাসবেশ্বর বা বাসবান্না, কেরালার নারায়ণ গুরু, মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে – এঁদের সকলকেই আপনি ভারতীয়ত্বের নির্মাতা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটা শুনতে না পেয়ে রাগ করব ভাবছিলাম। কারণ এমনকি জওহরলাল নেহরুও তাঁর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া গ্রন্থে ভারতীয়ত্বের নির্মাণে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ বলে মতপ্রকাশ করেছেন, গান্ধীর সঙ্গে তাঁকে একাসনে বসিয়েছেন (“Tagore and Gandhi have undoubtedly been the two outstanding and dominating figures of India in the first half of the twentieth century… Tagore and Gandhi bring us to our present age.”)। সেই রবীন্দ্রনাথের নাম করলেন না দেখে সত্যিই রাগ করতে যাচ্ছিলাম। তারপর খেয়াল হল, রবীন্দ্রনাথের নাম তো বহু নেতার মুখে শুনেছি। এমনকি মোদীও শালগ্রাম শিলার মত করে তাঁর নাম নিয়ে নেন, অসহ্য উচ্চারণে তাঁর কবিতার পংক্তি আউড়ে বাঙালিদের মোহিত করার চেষ্টা করেন ভোটের মুখে। কিন্তু নারায়ণ গুরু আর ফুলের মত দুজন বর্ণবাদবিরোধী মানুষের নাম ভারতের কোনো উচ্চবর্গীয় শীর্ষস্থানীয় নেতার মুখে কোনোদিন শুনেছি কি? এমনকি আপনার পূর্বপুরুষ নেহরুর উপর্যুক্ত বইটিতেও বর্ণাশ্রম শুরুতে ভাল উদ্দেশ্যেই চালু করা হয়েছিল, পরে মন্দ হয়ে যায় – এই জাতীয় মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। গান্ধীও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ছিলেন, বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে নয়।
উপরন্তু আমরা যারা বিন্ধ্য পর্বতের এপাশে বাস করি এবং তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালির তফাত করতে পারি না; ওদিককার লোক হলেই দক্ষিণ ভারতীয় বলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই, তাদের অনেকের কাছে তো নামদুটোই নতুন। সে নাম আপনি করলেন ভারতের একেবারে উত্তর প্রান্তে দাঁড়িয়ে। এমনটি না করলে “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে” স্বপ্ন সত্যি হবে কী করে? স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আদানপ্রদান তো ঘটেনি, তাই তো সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে মঙ্গলঘট ভরা হয়নি। আপনি কি পারবেন সেই ঘট ভরতে?
সে বড় কঠিন কাজ, সম্ভবত অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ। আজকের ভারতে যখন সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে, তখন এ কাজ আরও শক্ত। সত্যি কথা বলতে কি, আপনি সে কাজের যোগ্য লোক কিনা তার পরীক্ষা আপনি ক্ষমতায় না পৌঁছলে শুরুই হবে না। আপনি যতই বলুন, ভারত জোড়ো যাত্রা কংগ্রেসের জন্য করেননি, কংগ্রেসকে বাদ দিয়েও আপনি যা করতে চান তা করতে পারবেন না। আর সেই দলে আজও গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে আছেন কমলনাথের মত লোক, যিনি এই সেদিন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণে কৃতিত্বের ভাগীদার হতে চেয়েছেন। যোগ করেছেন, আসল কৃতিত্ব আপনার বাবা রাজীব গান্ধীর, কারণ ১৯৮৫ সালে তিনিই বাবরির তালা খুলিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও আছেন শশী থারুর, যিনি কে জানে কোন অধিকারে কদিন আগে ঘোষণা করে দিলেন, ভারতের মুসলমানরা পর্যন্ত আর গুজরাট ২০০২ নিয়ে ভাবতে চান না।
এঁদের নিয়ে কী করে ভারত জুড়বেন সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ভার আপনার। নেহরু যে গণতন্ত্রের কথা বলতেন সেই গণতন্ত্রের রীতি মেনে আপনার উপর সাগ্রহ কিন্তু সন্দিগ্ধ নজর রাখব আমরা, যারা এখনো প্রশ্ন তোলা এবং সমালোচনা করা সংবাদমাধ্যমের কাজ বলে মনে করি। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে ভারতের আজ এমন এক নেতা দরকার যাঁর ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি না হলেও বুকের ভিতরে কিছুটা পাথর আছে। যে কোনো ভারতবাসী ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাবে। আপনার শ্রীনগরের বক্তৃতা শোনার পর মনে না করে পারছি না, আপনি তেমনই একজন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতিকে উপযুক্ত স্থান দিতে হবে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকলে কেউ এগোতে পারে না। কেবল রাজনীতি নয়, সাংবাদিকতাতেও তার ঊর্ধ্বে উঠতে হয়, তবেই সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের হারিয়ে যাওয়া বা কখনো খুঁজে না পাওয়া ভারতের সন্ধানও সেভাবেই পাওয়া যাবে সম্ভবত। দূরদর্শনে যখন নেহরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া অবলম্বনে শ্যাম বেনেগালের ভারত এক খোঁজ ধারাবাহিক শুরু হয়, তখন আমার বয়স ছয়। আপনার বোধহয় ১৮। তখন না হলেও, এখন নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে সুপণ্ডিত নেহরু বইয়ের নামে দাবি করেছেন তিনি ভারতকে ‘আবিষ্কার’ করেছেন। অন্যদিকে বেনেগাল ওই বইয়ের মধ্যে দিয়ে ভারত দেশটাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। এতদিন আমাদের অনেকেরই সন্দেহ ছিল, আপনি ক্রমঅপসৃয়মান ভারতকে আদৌ খুঁজতে চান কিনা। ভারত জোড়ো যাত্রায় প্রমাণ হল, চান। আশা করি এ খোঁজ শ্রীনগরে শেষ হয়নি, শুরু হল।
ধন্যবাদান্তে
জনৈক সাংবাদিক।
নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত
2 thoughts on “কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?”