বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র

সিপিএমের

মিঠুদা (নাম পরিবর্তিত) পেশাদার ড্রাইভার। বাসচালক ছিলেন, এখন প্রাইভেট গাড়ি চালান। সম্প্রতি যে শতাধিক পৌরসভায় নির্বাচন হল, উনি তারই একটার বাসিন্দা। পার্টি সদস্য না হলেও, সক্রিয় সিপিএম সমর্থক। নির্বাচনের ফল বেরোবার আগের দিন দেখা হল, বললেন “দাদা, মনে হচ্ছে অন্তত আমাদের ওয়ার্ডটায় জিতে যাব। ওরা অনেক চেষ্টা করেছিল, ভয় দেখিয়েছিল, কিন্তু আমরা বুক দিয়ে বুথ আগলেছি।” মিঠুদার আশা পূর্ণ হয়নি। রাজ্যের অন্য অনেক পৌরসভার মত ওঁদের পৌরসভাও বিরোধীশূন্য হয়েছে। দিন সাতেক পরে আবার দেখা। দুঃখ করে বললেন “কাজকর্ম ফেলে, টিএমসির গালাগাল খেয়ে ভোটের আগে কদিন রাত জেগে পোস্টারিং করলাম। এখন ভোটের পরে পার্টি অফিসে গেলে নেতারা ভাব করছে যেন চেনেই না। আর ওদের কাছে যাবই না ভাবছি। আগেও দেখেছি, মিছিলে লোক দরকার হলে আমাকে ডাকে। আর এসডিও অফিসে ডেপুটেশন দিতে যাওয়ার সময়ে ফরসা দেখতে লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোকে ডাকে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, একবার বলেও না ‘মিঠু, তুইও যাস।’ কেন বলবে? আমার কালোকোলো চেহারা, লেখাপড়া জানি না অত, আমার আর কী দাম?”

পশ্চিমবঙ্গে বিধায়ক, সাংসদ নেই; ভোটও দু-আড়াই শতাংশে নেমে এসেছে সিপিএমের। তবু যে তারা এখনো কয়েক হাজার মানুষের মিছিল করতে পারে, আনিস খান হত্যার যথাযথ বিচার চেয়ে যে মাঝে কয়েকদিন রাজ্য তোলপাড় করে দিতে পেরেছিল, তা এই মিঠুদাদের জন্যই। মিঠুদার পেশায় মাস মাইনে নেই, ডি এ নেই, টি এ নেই, অবসরের পর পেনশন নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। গাড়ি চালালে রোজগার, না চালালে হাত খালি। সেই মানুষ ভোটের আগে গাড়ি না চালিয়ে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে বেড়িয়েছেন। একথা জানতে পারলে যে কোনো মানুষের মনে হতে বাধ্য, বর্তমান যেমনই হোক, সিপিএমের এখনো ভবিষ্যৎ আছে। কোনো পার্টির যদি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী সমর্থক থাকে, তাহলে তার কিসের অভাব?

অভাব আছে। মিঠুদাদের উপযুক্ত মর্যাদার অভাব। সিপিএমে বৃদ্ধতন্ত্র চলছে বলে প্রায়ই হইচই হয়। রাজ্য সম্মেলন চলাকালীন কয়েকজন বয়স্ক নেতা ঝিমোচ্ছেন — এই ছবি প্রকাশ হওয়ার পর আরও বেশি করে হচ্ছে। চাপা পড়ে যাচ্ছে যে কথা, তা হল বিমান বসু এখনো যে কোনো ২৫-৩০ বছরের ছেলের চেয়ে বেশি হাঁটতে পারেন মিছিলে, হান্নান মোল্লা দিল্লির রাস্তায় বসে এক বছরের বেশি কৃষক আন্দোলন করলেন সদ্য, তপন সেন এখনো গোটা ভারত চষে শ্রমিক সংগঠনের কাজ করেন। যা সত্যিই সিপিএমের সমস্যা, তাকে বলা চলে মধ্যবিত্ততন্ত্র। মিঠুদার অভিজ্ঞতা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। মূলত শ্রমিক-কৃষকের পার্টি হওয়ার কথা যে দলের, সেই দলের রাজ্য নেতৃত্বে দীর্ঘকাল ছাত্র, যুব নেতারা প্রাধান্য পাচ্ছেন। চক্রান্ত করে শ্রমিক নেতা, কৃষক নেতাদের সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে না এমন হয়ত নয়। আসলে পার্টিতে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। যাঁরা আসতে চাইছেন তাঁরা মিঠুদার মত ব্যবহার পাচ্ছেন। গুরুত্ব পাচ্ছেন লেখাপড়া জানা চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ীরা। মিঠুদার মত লোকেদের আদর দল ভারী করার সময়ে, অন্য সময়ে তারা অপ্রয়োজনীয়।

মিঠুদা মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন বা মায়াকভস্কি পড়েননি। তিনজনের সংসারের খাওয়া, পরা আর ছেলের লেখাপড়ার সংস্থান করতে উদয়াস্ত খেটে ওসব পড়াও যায় না। কিন্তু না পড়েই মার্কসবাদ যাকে শ্রেণিচরিত্র বলে, তার ধারণা ওঁর কাছে পরিষ্কার। বলেই দিলেন “চাকরি করা ফ্যামিলির ছেলেকে যতই তোল্লাই দিক, সে ভাল কেরিয়ার পেলেই চলে যাবে। পার্টির জন্যে আমরাই থাকব।” কিন্তু পার্টি এঁদের জন্য থাকবে কিনা এঁরা বুঝতে পারছেন না।  আশা করা যায় সিপিএমের নবনির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম জানেন, এই মুহূর্তে তাঁর পার্টির এ এক বড় সংকট। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ছিল মুসলমান, নিম্নবর্গীয় মানুষের হাতে। মুজফফর আহমেদ, আব্দুল হালিম, মহম্মদ ইসমাইলের মত নেতারা প্রবাদপ্রতিম। স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষত পার্টি ভাগ হওয়ার পর থেকে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সব কমিউনিস্ট পার্টিই ক্রমশ হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের দল। ভারতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে যার অর্থ গরীব, প্রান্তিক মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়া। এখন কি মাটির টানে ফিরতে পারবে সিপিএম?

তারুণ্য নেই এমন কথা আর বলা যাবে না। বিধানসভা নির্বাচনে এক ঝাঁক অল্পবয়সীকে প্রার্থী করা হয়েছিল, সদ্যগঠিত নতুন রাজ্য কমিটিতেও অনেক নতুন মুখ। আনিসের জন্য বিচার চেয়ে আন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি বহুকাল পরে মনে করিয়ে দিলেন সেই স্লোগান “পুলিসের লাঠি ঝাঁটার কাঠি/ভয় করে না কমিউনিস্ট পার্টি”। কিন্তু আশ্চর্য! তাঁকে এবং আরও একগুচ্ছ পার্টিকর্মীকে হাস্যকর অভিযোগে হপ্তা দুয়েক আটকে রাখা হল, উপরন্তু শারীরিক নির্যাতন চলল; সিপিএম আইনের উপর আস্থা রেখে নিরামিষ প্রতিবাদ ছাড়া কিছুই করল না!

আরও পড়ুন সেলিব্রিটি কাল্ট দরদী সিপিএমকে খোলা চিঠি

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির জন্যে ইস্যুর কিন্তু অভাব নেই। দেউচা পাঁচামিতে খনি করতে দেবেন না – এই দাবিতে স্থানীয় মানুষ আন্দোলনে, স্কুলের নিয়োগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, পুলিস আনিসের পর ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলরের হত্যাতেও প্রশ্নের মুখে, শাসক দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে যে নির্বাচিত কাউন্সিলর খুন হয়ে যাচ্ছেন, নেতৃত্ব মনোনীত চেয়ারম্যানকে বিজেপির সমর্থনে হারিয়ে দিয়ে পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়ে যাচ্ছেন অন্য একজন, ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ধরে সরকারে ফিরে মার্কামারা সাম্প্রদায়িক প্রাক্তন বিজেপিদের নির্বাচনে প্রার্থী করছে তৃণমূল। অথচ সিপিএম কিছুতেই মমতার কপালে ভাঁজ ফেলার মত বিরোধিতা করে উঠতে পারছে না। অন্য সবকিছু ভুলে সম্মেলন নিয়ে মেতে থাকা দেখে সন্দেহ হয়, পার্টির জন্য সম্মেলন নয়, সম্মেলনের জন্য পার্টি। বিপ্লবকেও ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখা যেতে পারে, সম্মেলনটা লগ্ন মেনে ষোড়শোপচারে করতে হয়।

বোধ করি কমিউনিস্ট পার্টিতে মধ্যবিত্ততন্ত্র চালু হয়ে গেলে এমনটাই ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন হয় না, এ অভিযোগ স্বয়ং হান্নান মোল্লা মাসখানেক আগে করেছেন। আসলে আন্দোলন হবে কি হবে না — তা ঠিক করছেন মাথায় ছোট বহরে বড় ভদ্রসন্তানরা, এবং অধিকাংশ সময়েই সিদ্ধান্ত হচ্ছে, হবে না। লড়াকু, গরীব কর্মী সমর্থকরা আছেন কেবল হুকুম তামিল করতে। অথচ মাস দশেক আগে নির্বাচনের প্রচারে টুম্পাসোনা গানের প্যারডি প্রকাশ করে বলা হয়েছিল সাধারণ মানুষের ভাষায় তাঁদের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা চলছে। সিপিএমের ভোটের ফলাফলে বোঝা গিয়েছিল, সাধারণ মানুষের ভাষা সিপিএম আদৌ বোঝেনি। লাভের লাভ এই, পার্টির শিল্পবোধও এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে শুভেন্দু মাইতির মত প্রবীণ গণশিল্পী তথা পার্টিকর্মীকে নেতৃত্ব মনে করছেন হুকুমের চাকর।

সিপিএমের ভবিষ্যৎ যদি এঁদের হাতেই থাকে, সে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার।

3 thoughts on “বৃদ্ধতন্ত্র নয়, সিপিএমের সমস্যা মধ্যবিত্ততন্ত্র”

Leave a Reply

%d bloggers like this: