কতদিন রামের চেয়ে পিছিয়ে থাকবেন কৃষ্ণ?

কৃষ্ণ

কোভিডে যখন আমরা ঘরবন্দি, তখন দূরদর্শন তাদের জনপ্রিয় হিন্দি ধারাবাহিকের অনেকগুলোই পুনঃপ্রচার করছিল। বাসু চ্যাটার্জির ব্যোমকেশ বক্সীর প্রায় সবকটা পর্বই ফের গোগ্রাসে গিললাম। বি আর চোপড়ার মহাভারত দেখার তেমন উৎসাহ ছিল না, তবে কিছু পর্ব চোখে পড়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটা ছিল কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম এবং ঝড়ের রাতে বসুদেবের কৃষ্ণকে মাথায় নিয়ে গোকুলযাত্রা। দেখতে দেখতে মনে পড়ল নীতীশ ভরদ্বাজের কথা। দূরদর্শনে সম্প্রচারিত রামানন্দ সাগরের রামায়ণ কীভাবে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে তা নিয়ে বইপত্র লেখা হয়েছে। কিন্তু সেই রামায়ণের রাম অরুণ গোভিলও পাননি, এমন এক সম্মান পেয়েছিলেন চোপড়ার মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রাভিনেতা নীতীশ। তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই জয়ে তাঁর কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয়ই একমাত্র কারণ ছিল না নিশ্চয়ই, কিন্তু ভারতের দর্শক যে অভিনয় আর বাস্তবে প্রায়শই তফাত করতে পারেন না তার অজস্র প্রমাণ আছে। হেমেন গুপ্তের ‘বিয়াল্লিশ’ ছবিতে অত্যাচারী পুলিস অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করার পর বিকাশ রায়ের বাড়িতে ঢিল পড়ার কিংবদন্তিও সে কথাই প্রমাণ করে।

কিন্তু পর্দার কৃষ্ণের রাজনৈতিক লাভ হলেও বিষ্ণুর দুই অবতারের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণই কিন্তু হিন্দুত্ব রাজনীতিতে উপেক্ষিত। রামজন্মভূমি আন্দোলন গোটা ভারতের ইতিহাসই বদলে দিয়েছে। গত কয়েক বছরে রামনবমী হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক বিবৃতির মঞ্চ। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সশস্ত্র মিছিল করবে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু এলাকায় এমন আচরণ করবে যেন বানরসেনার মত তারাও রাবণবধে বেরিয়েছে – এ যেন নিয়ম হয়ে গেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মত বিজেপিবিরোধীরা এর উত্তরে প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্ব করতে নেমে পাল্টা রামনবমী মিছিল, বজরংবলী পুজো ইত্যাদি করবে – এটাই নিয়ম হয়ে গেছে। সেই তুলনায় জন্মাষ্টমী এখনো শান্তিপূর্ণ উৎসব। ‘অ্যাংগ্রি রাম’, ‘অ্যাংগ্রি হনুমান’-এর মত ‘অ্যাংগ্রি কৃষ্ণ’ স্টিকারও দেখা যায় না পথচলতি গাড়ির গায়ে। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আস্ত বক্তৃতা দিয়ে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণের বাঁশরী আর শিখীর পাখা এখনো সুদর্শনকে ঢাকা দিয়ে রেখেছে।

অবশ্য তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কারণ নেই। হিন্দুত্ব প্রকল্পে অযোধ্যার পরে যে কাশী এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরার জায়গা – তা তো হিন্দুত্ববাদীদের স্লোগানেই বলা আছে। গত ১৩ অগাস্ট দিল্লিতে কয়েকজন সাধুসন্ত হিন্দুরাষ্ট্রের ৩২ পাতার খসড়া সংবিধান প্রকাশ করেছেন। তাতে উল্লেখ না থাকলেও, হিন্দুত্বের পিতা সাভারকরের কৃষ্ণ তথা গীতাপ্রীতি মাথায় রাখলে হিন্দুরাষ্ট্রের পতাকায় অশোক চক্রের জায়গা নেবে সুদর্শন চক্র – এমন কল্পনা অন্যায় হবে না।

আরও পড়ুন লাঠালাঠি নয়, গলাগলি

দেবতোষ দাশের বিন্দুবিসর্গ উপন্যাস পড়তে গিয়ে জানলাম, কার্ল মার্কস জগদ্বিখ্যাত দাস কাপিটাল বইতে বিষ্ণুকে উল্লেখ করেছেন পুঁজিবাদী বলে (‘Enough, that the world still jogs on, solely through the self chastisement of this modern penitent, of Vishnu, the capitalist.’)। সে অর্থে বর্তমানে গোটা দুনিয়াটাই বিষ্ণুর দখলে, ভারত তো বটেই। সেই বিষ্ণুর লোকপ্রিয় অবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিকে কি বেশিদিন নরেন্দ্র মোদীরা স্রেফ একটা ছুটির দিন হয়ে থাকতে দেবেন? তুলসীদাসের প্রজারঞ্জক রামকে দিয়ে তাঁদের কাজ চলে না। যশোদার আদরের বালগোপাল বা রাধার প্রেমিক শ্যামকে দিয়ে কি চলবে?

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন।

Leave a Reply

%d bloggers like this: