সরকারবিরোধী মানুষ এত অসহায় যে এই সময়কালে অনেকের মনে বিরোধী নেতাদের শূন্য আসনে শুধু বিজেপি নেতারাই নয়, বিচারকরাও বসে পড়েছেন।
সালটা ১৯৯৬। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করতে উদগ্রীব দেশের অকংগ্রেস, অবিজেপি দলগুলো। এই প্রস্তাবে সায় দেওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলছে সিপিএমের মধ্যে। সেইসময় আমাদের এলাকার সিপিএমের একেবারে নিচুতলার এক তরুণ কর্মী বলেছিলেন, ছোট থেকে শুনে আসছি আমাদের দলের নামে একটা ‘আই’ আছে। সেটার গুরুত্ব কী তা তো কোনোদিন টের পেলাম না। জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হলে গোটা দেশ টের পাবে। সেদিনের আড্ডায় অন্য এক কর্মী কংগ্রেসের সমর্থনে সরকারে যাওয়ার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, আজ কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়ব, তারপর বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে কোন মুখে ভোট চাইতে যাব লোকের কাছে? শেষপর্যন্ত যিনি ‘আই’-এর প্রভাব দেখার আশা করেছিলেন তাঁকে আশাহত হতে হয়েছিল। জ্যোতিবাবু স্বয়ং সেই নিচুতলার কমরেডের চেয়ে কিছু কম নিরাশ হননি। সরকারে না যাওয়ার পার্টিগত সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও বলেছিলেন, ঐতিহাসিক ভুল হল। জ্যোতিবাবুর জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির শরিক সেই কমরেড অতি সম্প্রতি প্রয়াত হলেন আর যিনি বিরোধিতা করেছিলেন তিনিও এখন বয়সের কারণে খানিকটা নিষ্প্রভ। ইতিমধ্যে সাতাশটা বছর কেটে গেছে, কিন্তু সিপিএমের ‘আই’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে পার্টির নিজেরই দ্বিধা এখনো কাটল না। ইন্ডিয়া জোটের ‘আই’-তে ‘আই’ মেলানো নিয়ে সাম্প্রতিক টানাপোড়েন তারই প্রমাণ।
সেইসময় সরকারে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পিছনে ঘোষিত যুক্তি ছিল, এমন কোনো সরকারে যাব না যে সরকার মার্কসবাদী কর্মসূচি লাগু করে উঠতে পারবে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের বহু নেতা সরকারে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন এবং তাঁরা মনে করেন ‘কেরালা লবি’ জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। কথাটা সত্যি হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গের সব নেতাও যে সরকারে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না তা সর্বজনবিদিত। এবারেও দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার পক্ষপাতী নয়। ইন্ডিয়া জোটে সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস – দুই দলই থাকলেও, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং অন্যতম নেতা সুজন চক্রবর্তী বারবারই বলছেন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আর তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও একই কথা বলছেন, কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে এক জোটে থাকা ঠিক হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সিপিএম নেতৃত্বের দ্বিধা স্পষ্ট হয়ে গেছে কো-অর্ডিনেশন কমিটিতে সদস্য না রাখার সিদ্ধান্তে। যদি গোড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হত তাহলে তবু বোঝা যেত। ইন্ডিয়া জোটের সব দল ওই কমিটিতে নেই। কিন্তু যখন কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা হয়, তখন সিপিএমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তাদের প্রতিনিধির নাম পরে জানানো হবে। পরবর্তীকালে হঠাৎ কমিটিতে না থাকার সিদ্ধান্ত হল কেন?
সিপিএম নেতৃত্বের এই দ্বিধার সমালোচনায় অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু অনস্বীকার্য যে বিজেপিবিরোধিতা আর তৃণমূলবিরোধিতার মধ্যে একটি বেছে নেওয়া আজকের সিপিএমের পক্ষে কঠিন। তাদের বিজেপিবিরোধিতার ইতিহাসে কোনো ছেদ নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের মত তারা কখনো বিজেপির সঙ্গে জোট সরকার গড়েনি, বিজেপির মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হননি কোনো সিপিএম নেতা। ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকারকে বিজেপি, সিপিএম দুই দলই সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সেবার নির্বাচনে ভোটাররা কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। উপরন্তু স্বল্প সময়ে ভিপি সিংয়ের সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু করা, একজন মুসলমানকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করার মত অভূতপূর্ব কাজ করেছিল। সেই সরকারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তি হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি বাবরি মসজিদ ভেঙে উঠতে পারেনি, বাধা পেয়েই সমর্থন প্রত্যাহার করে। অর্থাৎ বিজেপির কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে দেওয়া হয়নি, উল্টে হিন্দুত্ববাদের অতি অপছন্দের গোটা দুয়েক কাজ সেই সরকার করে ফেলেছিল। স্বভাবতই সিপিএম বিজেপিবিরোধী জোটের স্বাভাবিক সদস্য।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু মানুষ যে এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন তা বুঝতে বড় নেতা হতে হয় না। ট্রেনে বাসে বাজারে দোকানে খুচরো কথাবার্তায় গরিব, বড়লোক নির্বিশেষে মানুষের সরকারকে গাল দেওয়ার এরকম উৎসাহ শেষ দেখা গিয়েছিল বামফ্রন্ট আমলের শেষ পর্বে। এই অসন্তোষের কারণ যেমন ফ্ল্যাট থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়া অর্থাৎ যাবতীয় নিয়োগ দুর্নীতি, তেমনই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা নিয়ে দুর্নীতি, একশো দিনের কাজ না পাওয়ার মত বিষয়ও। পরের দুটি বিষয় সরাসরি গ্রামের গরিব মানুষের গায়ে লাগে। তা না হলে মনোনয়ন পর্ব থেকে শুরু করে গণনা পর্যন্ত পুকুর চুরির পরেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীরা এতগুলো আসনে জিততে পারত না, বাম-কংগ্রেসের ভোটও বাড়ত না। সংসদীয় রাজনীতিতে জনমতের এই স্রোতকে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের বিরোধী দল অগ্রাহ্য করতে পারে না।
এমতাবস্থায় সিপিএম কী করতে পারত? ইন্ডিয়া জোটে না গিয়ে বলতে পারত আমরা নিজেদের মত করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ব। সেক্ষেত্রে তৃণমূল তো বটেই, সব রঙের সমালোচক সিপিএমকে বিজেপির দালাল বলে দেগে দিত। ইন্ডিয়া জোটে থাকায় যেমন বিজেপি তৃণমূলের দালাল বলছে এবং নিজেদের সদস্য, সমর্থকরাও সন্দেহের চোখে দেখছে। কথা হল, সমালোচকরা কী বলবে তা ভেবে রাজনীতি করা দিশাহীনতার লক্ষণ। এতদিনের দিশাহীনতাই আজকের গাড্ডায় ফেলেছে সিপিএমকে। ইন্ডিয়া জোটে না গেলেই সিপিএমকে বিজেপির দালাল বলার সুযোগ পাওয়া যাবে কারণ ২০১১ সালের পর থেকে রাজ্যে সিপিএমের সক্রিয়তার অভাবে বিরোধী পরিসর দখল করতে শুরু করে বিজেপি। তৃণমূল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে গায়ের জোরে প্রহসনে পরিণত করার পর নিচের তলার হতাশ সদস্য, সমর্থকরা বিজেপির দিকে ভিড় জমান এবং ২০১৯ সালের লোকসভা আর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি তার ফায়দা তোলে। সিপিএম শূন্যে পৌঁছয়। ফলে ‘পার্টি লাইন’ যা-ই হোক, সিপিএমই বিজেপিকে পুষ্ট করছে – একথা পাটিগাণিতিক সত্য হয়ে যায়। সেই বদনামের ভারে সিপিএম এখন ন্যুব্জ।
এই পরিস্থিতি তৈরিই হত না, যদি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে নেতৃত্ব বাম রাজনীতির লড়াকু বিরোধিতার ঐতিহ্য বজায় রাখতেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর অনতিবিলম্বে সারদা কেলেঙ্কারির পর্দাফাঁস হয়। অথচ সিপিএম একদিনের জন্যও তা নিয়ে জনজীবন অচল করে দেওয়ার মত আন্দোলন করেনি। নারদের ক্যামেরায় শাসক দলের নেতাদের নগদ টাকা ঘুষ নিতে দেখা যায়। সেইসময় বিরোধী নেত্রীর নাম মমতা ব্যানার্জি হলে কলকাতা অচল হয়ে যেত, সূর্যকান্ত মিশ্ররা কেবল বিবৃতি দিয়ে গেছেন। গতবছর মার্চে সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে এবং মীনাক্ষী মুখার্জির উদ্যোগে সিপিএমের আন্দোলনে ঝাঁজ আসে। তার আগে পর্যন্ত রাস্তার চেয়ে টিভির পর্দায় এবং ফেসবুক লাইভেই বেশি দেখা যেত সিপিএম নেতাদের। সরকারবিরোধী মানুষ এত অসহায় যে এই সময়কালে অনেকের মনে বিরোধী নেতাদের শূন্য আসনে শুধু বিজেপি নেতারাই নয়, বিচারকরাও বসে পড়েছেন।
এই দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তার মূল্য হিসাবে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও শূন্য পাওয়া তেমন বড় কিছু নয়, যদি বিরোধী হিসাবে বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা হলেও ফেরত আনা যায়। সিপিএম নেতৃত্বের এবং বিজেপিবিরোধী সিপিএম সমালোচকদেরও ভেবে দেখা উচিত, সিপিএম ইন্ডিয়া জোট থেকে আলাদা হয়ে লড়লেই ভাল হয় কিনা। কারণ সিপিএম তৃণমূলবিরোধিতা না করলে আখেরে বিজেপিরই লাভ, তারা আরও বেশি করে তৃণমূলবিরোধী ভোট পাবে। মনে রাখা ভাল, ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপি হেরেছে মাত্র হাজার চারেক ভোটে। ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থীর (কংগ্রেস সমর্থিত) জামানত জব্দ হলেও তিনি পেয়েছেন তেরো হাজারের বেশি ভোট। এতগুলো তৃণমূলবিরোধী ভোট কিন্তু বিজেপির ঝুলিতে যেত তৃতীয় পক্ষ না থাকলে। এভাবে ভাবতে হলে অবশ্য সিপিএম নেতৃত্বকে ঠিক করতে হবে লোকসভা নির্বাচনে মূল লক্ষ্য কোনটা। জ্যোতি বসু, হরকিষেণ সিং সুরজিৎদের অন্তত সেই দ্বিধা ছিল না। তাঁরা বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকাতে ১৯৯৬ পর্যন্ত নরসিমা রাওয়ের সংখ্যালঘু সরকারকে চলতে দিয়েছিলেন।
মোহন ভাগবত বলেছিলেন ধর্ষণের মত অপরাধ ভারতে প্রায় ঘটেই না, ওসব হয় ইন্ডিয়ায়। কারণ ভারত প্রাচীন দিশি মূল্যবোধে চলে, ইন্ডিয়া চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুযায়ী। সেটাই ধর্ষণের কারণ। দেশের নাম ইংরিজিতেও ইন্ডিয়া থেকে ভারত করে দেওয়ার প্রয়াসকে এই আলোয় দেখতে হবে।
যা রটে তার কিছু
যেদিন বিজেপিবিরোধী জোটের নামকরণ হল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স, সংক্ষেপে ইন্ডিয়া, সেদিন সঙ্ঘ পরিবারের প্রবল বিরোধী এক অগ্রজ বন্ধু বলেছিলেন “সবই ভাল, কিন্তু সেই অ্যাংলোফাইল নামটাই ধরে থাকতে হল? ইন্ডিয়া না করে কোনোভাবে ভারত করা গেল না নামটা?” তিনিও অবশ্য স্বীকার করেছিলেন, গত এক দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে যেভাবে বিজেপিই ঠিক করে দিয়েছে ইস্যু কোনটা আর বিরোধীরা কেবল তার বিরোধিতা করে গেছে, সেই ধারা উলটে দিয়েছে ওই নাম। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, সরকারি দলের মুখপাত্র এবং তাদের কুখ্যাত আই টি সেল হিমশিম খাচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক আলোচনার যে মানদণ্ড তারাই তৈরি করেছে, তাতে ইন্ডিয়া নামধারী কাউকে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা চলে না। বললেই পালটা আক্রমণ হবে “তার মানে আপনি অ্যান্টি-ইন্ডিয়া?” নাম যে সবকিছু নয়, চরম দেশদ্রোহী কোনো দলও নিজের নামের সঙ্গে দেশের নাম জুড়তেই পারে – এই যুক্তির বাজার বিজেপি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে বহুকাল হল। বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদের নাম বদলে প্রয়াগরাজ রাখা হয়েছে, মোগলসরাই হয়ে গেছে দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর। এগুলো তো প্রাচীন জায়গা, সাম্প্রতিককালে ঝাঁ চকচকে শহর হয়ে ওঠা গুরগাঁওয়ের নাম পর্যন্ত বদলে গুরুগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির ঔরঙ্গজেব রোডেরও নাম বদলে গেছে। কারণ বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার মনে করে নাম ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্যাঁচে পড়ে শেক্সপিয়র সাহেবের মত নামে কী আসে যায় বললে নিজেদের সমর্থকরাই শুনবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখনিঃসৃত বাণী সমর্থকদের কাছে অমৃতসমান। তাই তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নামেও ইন্ডিয়া থাকে বলে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হল না দেখে শেষ চেষ্টা ছিল ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে ‘ঘমন্ডিয়া’ বলা। কিন্তু দেখা গেল, ওটা ‘মিত্রোঁ’ বা ‘ভাইয়োঁ ঔর বহনোঁ’-র অর্ধেক জনপ্রিয়তাও অর্জন করতে পারল না। ফলে নামের লড়াইটা তখনকার মত ইন্ডিয়া জোট জিতেই গিয়েছিল।
কিন্তু হার স্বীকার করে নেওয়া বিজেপির স্বভাব নয়। হলে একাধিক রাজ্যে ভোটে না জিতেও তারা সরকার গঠন করতে পারত না। তাছাড়া সত্যোত্তর পৃথিবীর বাস্তবতা বিজেপির মত করে কেউ বোঝে না। তারা জানে, আজকের দুনিয়ায় বাস্তবে কী ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে বড় কাজ হল মানুষ কী জানছে এবং জেনে কী ভাবছে তা নিয়ন্ত্রণ করা। অতএব যা ভাবলে আমার সুবিধা লোককে সেটাই ভাবাতে হবে, অন্য কথা ভাবার ফুরসত দেওয়া চলবে না। সুতরাং অবিলম্বে চলে এল জল্পনা কল্পনা চালানোর মত বিষয় – এক দেশ, এক নির্বাচন। আচমকা সংসদের বিশেষ অধিবেশন বসবে ঘোষণা করা হল এবং কী নিয়ে আলোচনা হবে তা সংসদীয় প্রথায় প্রকাশ না করে গোদি মিডিয়াকে দিয়ে সম্ভাবনা হিসাবে ভাসিয়ে দেওয়া হল এক দেশ, এক নির্বাচনের কথা। এতে বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল এই পরিকল্পনার বিরোধিতায়, নিজেদের সরকারবিরোধী বক্তব্যগুলো আর মানুষের সামনে তুলে ধরার সময় রইল না। জনপরিসর থেকে হারিয়ে গেল মণিপুর, হরিয়ানার দাঙ্গা, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, বিদেশের সংবাদমাধ্যমে আদানি গ্রুপের আর্থিক দুর্নীতির নতুন প্রমাণ সামনে আসায় তাদের বিরুদ্ধে ফের ওঠা যৌথ সংসদীয় তদন্তের দাবি। এক দেশ, এক নির্বাচন নিয়ে হইচই না কাটতেই সরকারপক্ষ নিয়ে এসেছে আরেক অনন্ত জল্পনার বিষয় – দেশের নাম ইংরেজিতেও ইন্ডিয়া থেকে বদলে ভারত করে দেওয়া হবে কি?
এমনিতে বিজেপির ভোটসর্বস্বতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্রেফ ভোটে জেতার জন্যে তারা করতে পারে না এমন কাজ নেই। ফলে এক দেশ, এক নির্বাচন চালু করা অথবা দেশের নাম বদলানোর দিকেও এগোতেই পারে। বিজেপির পুরনো বন্ধু এবং উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ইদানীং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া মায়াবতী যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন রাজনৈতিক সংগঠন বা জোটের নামে ইন্ডিয়া ও ভারত শব্দ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করার আবেদন নিয়ে, হাস্যকরভাবে ইন্ডিয়া জোটকে দায়ী করেছেন বিজেপিকে দেশের নাম বদলে দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য, তাতে এই সন্দেহ জোরদার হয়। কিন্তু এহ বাহ্য। আলোচনাটা আরেকটু গভীরে গিয়ে করা দরকার।
যেখানে বাঘের ভয়
লক্ষণীয় যে এক দেশ, এক নির্বাচন এখনো স্রেফ জল্পনার বিষয় হলেও (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটা কমিটি তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করা হয়নি) দেশের নাম সরকারিভাবে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত সরকারের তরফ থেকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপতিকে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’ লিখে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা স্রেফ কারোর স্বপ্নার্দ্র বিছানার জিনিস হয়ে নেই, সরকারি কাগজপত্রে লিখিত আকারে এসে পড়েছে। সুতরাং সাধারণ মানুষের এ নিয়ে আলোচনা না করে উপায় নেই। কারণ এতে আমার-আপনার – জনপ্রিয় লব্জে বললে করদাতার – টাকা জড়িয়ে আছে। মানে সমস্ত সরকারি কাগজপত্রে যদি কাল থেকে ‘গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ হয়ে দাঁড়ায় ‘গভমেন্ট অফ ভারত’, তাহলে স্রেফ লেটারহেড ছাপাতে কত কোটি টাকা খরচ হবে ভাবুন।
ইদানীং সরকার এবং তার ন্যাওটা সংবাদমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিখ্যাত ক্রিকেটার, চিত্রতারকা ইত্যাদি বিশেষ অজ্ঞরা সরকারের যে কোনো কার্যকলাপের উপকারিতা প্রমাণ করতে প্রথমেই বোঝায় কাজটা করলে করদাতাদের কত টাকা বাঁচবে। ১৯৯১ সালের পর থেকে যেমন সরকার এবং তার ন্যাওটারা অহোরাত্র বোঝাত ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে’, এ খানিকটা সেইরকম। যেমন ‘এক দেশ এক নির্বাচন ভাল, কারণ করদাতাদের অনেক টাকা বাঁচবে’, ‘ভর্তুকি তুলে দেওয়া ভাল, কারণ করদাতাদের অনেক টাকা বাঁচে’। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় ওটাই সরকারের কাজের ভালমন্দের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড, তাহলে কিন্তু সর্বত্র ‘ইন্ডিয়া’ বদলে ‘ভারত’ করার পরিকল্পনাকে কোনোভাবেই ভাল বলা যাবে না। কারণ এতে করদাতাদের টাকা তো বাঁচবেই না, উলটে একগাদা টাকা খরচ হবে। টাকার কথা যখন উঠলই, তখন খেয়াল করিয়ে দেওয়া যাক – শুধু গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া নেই, আছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াও। সেটাও কি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ভারত হবে? হলে টাকা কি নতুন করে ছাপা হবে? সেক্ষেত্রে পুরনো নোটগুলোকে কি চলতে দেবে সরকার? নাকি আরও একচোট নোটবন্দির খাঁড়া ঝুলছে আমাদের মাথার উপরে?
কথাটাকে সোশাল মিডিয়া জোক মনে হচ্ছে? মনে রাখবেন, দেশের বর্তমান সরকার জোকারের মত সব এলোমেলো করে দিতেই ভালবাসে। তাতে মানুষের প্রাণ গেলেও কুছ পরোয়া নেই। রাজ কাপুর অভিনীত জোকার নয়, হিথ লেজার বা জোয়াকিন ফিনিক্স অভিনীত জোকার। তার অন্তত দুটো প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে – নোটবন্দি আর চার ঘন্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন।
ভারত এক খোঁজ
অবশ্যই শুধু করদাতাদের টাকা খরচ হবে বলে ভারত নাম ব্যবহারে বিরোধিতা করা চলে না। ও রাস্তায় হাঁটলে শেষমেশ অনেক ভাল কাজেরই বিরোধিতায় গিয়ে পৌঁছতে হবে। ঠিক যে রাস্তায় মোদী সরকার হাঁটছে। দেশে এত ঘন ঘন নির্বাচন হয়, তাতে করদাতাদের বিপুল টাকা খরচ হয়। অতএব গোটা দেশে একসঙ্গে লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচন হোক – টাকা বাঁচবে। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিয়ে টাকা বাঁচানো যদি ঠিক হয়, তাহলে কিছুদিন পরে বলা যেতেই পারে, নির্বাচন ব্যাপারটারই দরকার নেই। একশো শতাংশ টাকা বেঁচে যাবে। পঞ্চায়েত, পৌরসভা, কর্পোরেশনগুলোর ব্যাপারে নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতেই তাই বলা হবে। সুতরাং অন্য যুক্তিতে আসি।
এতদিন যাঁরা জানতেন না, তাঁরাও গত কয়েকদিনের আলোচনায় নিশ্চয়ই জেনে গেছেন যে আমাদের দেশটার নাম সাংবিধানিকভাবেই ইন্ডিয়া এবং ভারত – দুটোই। সংবিধানের একেবারে প্রথম অনুচ্ছেদেই পরিষ্কার লেখা আছে “India, that is Bharat, shall be a Union of States.”
বস্তুত সংবিধান সভার বিতর্কে নাম নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল এবং সবাই যে ইন্ডিয়া শব্দটা ব্যবহার করা নিয়ে একমত ছিলেন তা নয়। শেষমেশ দুটো নামই থেকে যায়। এমন নয় যে ভারত নামটাকে ব্রাত্য করে দিয়ে স্রেফ বিদেশি লব্জের ইন্ডিয়াকেই দেশের সরকারি নাম করে দেওয়া হয়েছিল, যা এখন দক্ষিণপন্থীরা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আদৌ ইন্ডিয়া কেন? সব ভাষাতেই ভারত নয় কেন? আমার বন্ধু যা বলেছেন সেটা কি সত্যি? ইন্ডিয়া শব্দটা কেবল ভারতের অ্যাংলোফাইলরা, অর্থাৎ ইংরেজি ভাষাসর্বস্ব উচ্চকোটির লোকেরা ব্যবহার করেন? ও নাম আপামর ভারতবাসীর পছন্দের নাম নয়?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে মনে রাখা ভাল, বহু ভাষাভাষী এবং ভাষার ভিত্তিতে তৈরি প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত দেশ ভারতে এক রাজ্যের মানুষের সঙ্গে অন্য রাজ্যের মানুষের সংযোগের ভাষা কী হওয়া উচিত, সরকারি কাজের ভাষা কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে স্বাধীনতার আগে থেকেই বিতর্ক চলছে। এমনকি সংবিধানের ৩৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় লেখা আছে দেশের সরকারি ভাষা হবে দেবনাগরী লিপিতে লেখা হিন্দি।
তারপর ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ১ নম্বরে যা-ই লেখা থাক, এই সংবিধান চালু হওয়ার পরে ১৫ বছর দেশের সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরিজির ব্যবহার চলতে থাকবে। আবার ৩ নম্বর ধারাতেই বলা হয়েছে, বর্তমান অনুচ্ছেদে (অর্থাৎ ৩৪৩ নম্বরে) যা-ই বলা থাক, ওই ১৫ বছর কেটে গেলে ইংরিজি ভাষার ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে। ৩৪৩-৩৫১ অনুচ্ছেদগুলো পড়লে হিন্দি ভাষার প্রতি সংবিধানের পক্ষপাত দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়। ৩৫১ নম্বরে তো হিন্দি ভাষার প্রসারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই অনুচ্ছেদের শেষাংশে একেবারে হেডমাস্টারি কায়দায় বলা হচ্ছে শব্দভাণ্ডার প্রসারিত করার প্রয়োজনে প্রধানত সংস্কৃতের কাছে হাত পাততে হবে (“…for its vocabulary, primarily on Sanskrit and secondarily on other languages”)। ঘটনা হল, ভারত শব্দটা এসেছে সংস্কৃত থেকে এবং ব্যবহার হয় মূলত হিন্দি ও উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলোতে। ফলে বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের মানুষের সঙ্গত কারণেই এই শব্দটাকে দেশের নাম বলে মেনে নিতে আপত্তি আছে। প্রাচীন শাস্ত্র ও পৌরাণিক সাহিত্যে যে ভারতের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে কিন্তু দাক্ষিণাত্য পড়ে না। মহাভারতে কটা কথা আছে দক্ষিণ ভারত নিয়ে? বাঙালিদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, তামিল, মালয়ালমের সঙ্গে সংস্কৃতের অনেক মিল। অতএব ওগুলো সংস্কৃত থেকেই এসেছে। কিন্তু তামিলরা অনেকেই মনে করেন তাঁদের ভাষা সংস্কৃত থেকে আসেনি। বরং দাক্ষিণাত্যের সমস্ত ভাষার জন্ম তামিল থেকে। আর্য সভ্যতার থেকে দ্রাবিড় সভ্যতা একেবারেই পৃথক। সাম্প্রতিক অতীতে তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলায় ২৬০০ বছরের পুরনো এক সভ্যতার খোঁজ মেলার পর তাকে ‘ভারতম’ সভ্যতা বলা হবে, নাকি ‘দ্রাবিড়ম’ – এই নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছিল ওই রাজ্যের রাজনীতি।
অর্থাৎ আমরা বিন্ধ্য পর্বতের এপারে আছি বলেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতিতে ভারত শব্দটার প্রাঞ্জল উপস্থিতি। কিন্তু কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সমস্ত ভারতবাসী ভারত বলেই দেশটাকে চেনেন বা চিনতে পছন্দ করেন – এরকম ভাবনায় গলদ আছে। এমনকি বাঙালিরা সকলে ভারত শব্দটাই ভাবে – এমন ধারণাও প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে সাপ্তাহিক কালান্তর-এ প্রকাশিত দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিপোর্টাজ ‘আমি ইন্ডিয়া’ পড়লে
এই বয়েসে আবার উদ্বাস্তু। বন্যার তিনমাস পরেও একটা তাঁবু জোটাতে পারেন নি। সমর্থ মেয়ে-জামাই আর বছর দশেকের ছেলেটাকে নিয়ে চারদিক খোলা একটা ছাউনির তলায় খড় বিছিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। অথচ এখনও ওঁর মাথা ছুঁয়ে পূর্ণিমার চাঁদ।
‘পাকিস্তান ছেড়ে কবে এসেছিলেন?’ আশ্চর্য উত্তর দিলেন বুধেশ্বরী। ছাউনি থেকে হাত নামিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন ‘আমি ইন্ডিয়া। আমি পাকিস্তান না থাকিস।’
অমোঘ সেই অভিজ্ঞতা। পাটকাঠির চাল ছাড়িয়ে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে যে রমণী দাঁড়িয়ে, সে বলছে সে উদ্বাস্তু নয় – ভারতবাসী। সে বলছে সে ‘ইন্ডিয়া’।
আরও বড় কথা, ভারতের কেন্দ্রস্থলের যে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো সবচেয়ে জনবহুল, সেখানকার গরিব-গুরবো মানুষের মধ্যেও দেশের নাম হিসাবে ভারতের চেয়ে বেশি প্রচলিত এমন একটা শব্দ যা ভারত বনাম ইন্ডিয়া বিতর্কে বিজেপিবিরোধীদেরও উল্লেখ করতে দেখছি না – হিন্দুস্তান। স্বাধীনোত্তর দেশে আসমুদ্রহিমাচল সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছে (দক্ষিণ ভারতে কিছুটা কম, কিন্তু একেবারে পারেনি তা নয়) যে জিনিসটা তা যে মুম্বাইয়ে তৈরি হিন্দি ছবি – সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বাংলায় সে ছবির জনপ্রিয়তাও কোনোদিন কম ছিল না। ভেবে দেখুন তো, হিন্দি সিনেমার সংলাপে বা গানে কতবার শুনেছেন ভারত বা ভারতীয় শব্দটা? বরং বারবার শোনা যায় হিন্দুস্তান এবং হিন্দুস্তানি শব্দ দুটো। হম হিন্দুস্তানী ছবির ‘ছোড়ো কল কি বাতেঁ, কল কি বাত পুরানি/নয়ে দওর মে লিখেঙ্গে/দিল পর নয়ী কহানী/হম হিন্দুস্তানী’ গানটা একসময় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। সে গানে আবার আরএসএস-বিজেপির প্রবল অপছন্দের লোক জওহরলাল নেহরুকে দেখানো হয়েছিল।
বলিউডের সর্বকালের জনপ্রিয়তম শিল্পীদের একজন অমিতাভ বচ্চন। তাঁর প্রথম ছবির নাম সাত হিন্দুস্তানী (১৯৬৯)। তিনি বুড়ো বয়সে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে তৈরি বেশকিছু খাজা জাতীয়তাবাদী ছবির একটায় অভিনয় করেছিলেন। সেই ছবির নাম হিন্দুস্তান কি কসম (১৯৯৯)। ওই একই নামে ১৯৭৩ সালেও একটা ছবি হয়েছিল। চেতন আনন্দ সেই ছবি বানিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ নিয়ে। বর্তমানে যাঁকে বলিউডের বাদশা বলা হয়, সেই শাহরুখ খানের একটা ফ্লপ কিন্তু অন্যরকম ছবির নাম ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানী (২০০০)। আরও অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। হিন্দিভাষী সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে বলিউড হিন্দুস্তান শব্দটাকে এই প্রাধান্য দিত না। আরএসএস-বিজেপির প্রভাবে ইদানীং হয়ত বদল এসেছে, কিন্তু গত শতকের আট-নয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের যেসব শ্রমজীবী মানুষ বসবাস করতেন তাঁদের কদাচিৎ ভারত শব্দটা ব্যবহার করতে দেখা যেত। তাঁরা হিন্দুস্তানই বলতেন। যদিও হিন্দুস্তান শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হিন্দুদের ভূমি – হিন্দু, মুসলমান সকলেই কিন্তু দেশের নাম হিসাবে এই শব্দটাই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে এসেছেন। আজকাল কথাগুলো লেখার প্রয়োজন পড়ছে, পড়ে সন্দেহও হচ্ছে হয়ত, কিন্তু আমাদের শৈশবে স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস বা নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে যে গানটা পাড়ায় পাড়ায় মাইকে বাজতই, সেটা হল ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা/হিন্দুস্তান হমারা’। সেই গানের রচয়িতা মীর ইকবাল একসময় পাকিস্তানপন্থী হয়ে যান। সম্ভবত সেই অপরাধেই, আমাদের অখেয়ালে, ওই গানটাকে বিজেপি আমলে ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছে। ইকবালের লেখাপত্র পাঠ্য থেকে বাদ দেওয়াও শুরু হয়েছে, কিন্তু সে অন্য আলোচনা। এই আলোচনায় এটুকুই বলার যে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের বিরাট অংশের মানুষ দেশকে হিন্দুস্তান নামে চিনে এসেছেন অন্তত কয়েক হাজার বছর ধরে, ভারত নামে নয়, ইন্ডিয়া নামেও নয়। ফলে ইন্ডিয়া যদি অভিজাত ভারতের লব্জ হয়, ভারতও অভিজাত ভারতেরই অন্য এক অংশের লব্জ।
‘ভারত’ আর ‘ইন্ডিয়া’ বলে অনেক আরএসএসবিরোধীও আসলে যা বোঝাতে চান তা হল দুস্তর আর্থসামাজিক ব্যবধান। ওটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। তাঁরা বলতে চান এ দেশের মধ্যে আসলে দুটো দেশ আছে। ইন্ডিয়া অংশটা লেখাপড়া শেখা, শহুরে, পেট ভরে খাওয়া দেশ। ভারত মূলত গ্রামে বাস করে, লেখাপড়া শিখবে কী, অনশনে অর্ধাশনেই তার দিন কাটে। কথাটা ঠিক, আবার ভুলও। কারণ দুটো কেন? একটু ঘোরাফেরা করলেই স্পষ্ট দেখা যায় এ দেশের মধ্যে আসলে অনেকগুলো দেশ আছে। পেশাগত কারণে এক সময় বারবার ঝাড়খণ্ড যেতাম। রাঁচি আর কলকাতা যে একই দেশের দুটো রাজ্যের রাজধানী একথা বিশ্বাস হত না কিছুতেই। কারণ প্রচণ্ড অব্যবস্থা, প্রবল অনুন্নয়ন দেখেছি। আবার সিকিম আর কেরালা বেড়াতে গিয়ে অবাক হয়ে ভেবেছি, পশ্চিমবঙ্গ এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে একই দেশে আছে কেমন করে? এ তো গেল ভিনরাজ্যের কথা। সম্প্রতি জঙ্গলমহল ঘুরে এলাম। বুঝতে বাকি রইল না যে আমি আর কাঁকড়াঝোর বা আমলাশোলের বাসিন্দারা একই দেশে বাস করি না। কিন্তু তার সঙ্গে ইন্ডিয়া আর ভারত শব্দ দুটোর কী সম্পর্ক?
আরএসএস-বিজেপি কিন্তু ওই ফারাক বোঝাতে ইন্ডিয়া আর ভারত বলে না। তারা ওই দুটো শব্দ দিয়ে কী বোঝাতে চায় তা ২০১৩ সালে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত আসামের শিলচরে যা বলেছিলেন তা খেয়াল করলেই পরিষ্কার হবে। তিনি বলেছিলেন ধর্ষণের মত অপরাধ ভারতে প্রায় ঘটেই না, ওসব হয় ইন্ডিয়ায়। কারণ ভারত প্রাচীন দিশি মূল্যবোধে চলে, ইন্ডিয়া চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুযায়ী। সেটাই ধর্ষণের কারণ। দেশের নাম ইংরিজিতেও ইন্ডিয়া থেকে ভারত করে দেওয়ার প্রয়াসকে এই আলোয় দেখতে হবে। নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা জানেন ভাগবতের ওই মন্তব্য সর্বৈব মিথ্যা। আসল কথা হল গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বিরুদ্ধে ঘটানো অধিকাংশ অপরাধের অভিযোগই দায়ের হয় না। সুতরাং ইন্ডিয়াকে ভারত বানাতে চাওয়া মানে, হয় গোটা দেশটাকেই এমন করে ফেলা যেখানে পরম্পরাগত চিন্তায় ধর্ষিতারা আদৌ অভিযোগ দায়ের করবেন না, অথবা আরও সরল সমাধান – রাষ্ট্র বলবে ভারত প্রাচীন সংস্কার মেনে চলা দেশ। এখানে ধর্ষণ হয় না। এটা একটা উদাহরণ। আরও কী কী হওয়া সম্ভব ভারতে তার মাত্র একটা উদাহরণ।
আসল কথা
দেশকে মা বলে শুধু দক্ষিণপন্থীরাই কল্পনা করে তা তো নয়, ঋত্বিক ঘটকও করতেন। এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ করে থাকেন। কারণ দেশ আসলে একটা আবেগ, অর্থাৎ বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্র হল সেই বিমূর্ত ভিতের উপর গেঁথে তোলা মূর্ত ইমারত। নিজের মাকে যার যা ইচ্ছা সে তাই বলে ডাকে। ওটা বেঁধে দেওয়া অসম্ভব। বাঙালিরা মা বলে, তামিলরা আম্মা বলে, গুজরাটিরা আবার বা বলে। এমনকি বাঙালিদের মধ্যেও অনেকে মামণি বলে। এক পরিবারের কথা জানি, সেখানে দুই ছেলে তাদের মাকে বৌমা বলে ডাকত। কারণ কথা বলতে শেখার বয়সে ঠাকুমাকে শুনত তাদের মাকে বৌমা বলে ডাকছেন, সেই অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। তামিল বা গুজরাটি পরিবারগুলোর মধ্যেও খুঁজে দেখলে নির্ঘাত এরকম বিকল্প ডাকের সন্ধান পাওয়া যাবে। ও নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, কারণ ওটা আবেগের বিষয়। সন্তানের যা বলে ডাকতে ভাল লাগে, সে তাই বলবে। কেউ ভারত বলবে, কেউ হিন্দুস্তান বলবে, কেউ ইন্ডিয়া বললেও তেড়ে যাওয়ার কিছু নেই। সংবিধানপ্রণেতারা ইন্ডিয়া আর ভারত লিখেছিলেন, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন নাম হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুস্তান শব্দটা রাখেননি। হয়ত ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য ভাগ হওয়া এবং নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা দেশের সরকারি নাম হিন্দুস্তান হওয়া ভাল বার্তা দেবে না মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সে নামের ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ করার জন্যেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। ভারত রাষ্ট্র পরবর্তীকালেও সরকার ছাড়া অন্য কে কোন নাম ব্যবহার করছে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখন ঘামাতে চায় বলেই এত কাণ্ড করছে।
এমনিতে নাম বদলালে কী-ই বা এসে যায়? উপরে যে ব্যবহারিক অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছি সেটা ছাড়া? লক্ষ করে দেখছি, শেখানো বুলির মত কিছু কথা আওড়াচ্ছেন বিখ্যাতরা। সুনীল গাভস্কর প্রমুখ বলছেন, বর্মার নামও তো বদলে মায়ানমার হয়েছে। তাতে ক্ষতি কী? এর উত্তর খুঁজলেই আসল ক্ষতে চোখ পড়বে। বর্মার নাম বদলে মায়ানমার করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে এবং তা কোনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাজ ছিল না। কাজটা করেছিল জুন্টা সরকার। আসল আপত্তির জায়গাটা এইখানে। ভারত সরকার যদি সত্যিই মনে করে থাকে দেশের সরকারি নাম ইংরিজিতেও ভারত করার কোনো বিশেষ প্রয়োজন আছে, তাহলে সংসদে আলোচনা করে নিয়মকানুন মেনে সংবিধান সংশোধন করে বদলাতে পারত। কিন্তু সরকারি কাগজে চুপিসাড়ে বদল করে দেওয়া অগণতান্ত্রিক। কাজটা অবশ্য বিলক্ষণ চতুরতার। কারণ এখন সংসদের বাইরে বিজেপি মুখপাত্ররা যা-ই বলুন, সংসদে আলোচনা হলে হয়ত অমিত শাহ বলবেন, বদলাইনি তো! ভারত নামটা তো সংবিধানেই আছে।
আসলে সংগঠনের শতবর্ষে দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে গেল অথচ দুনিয়াসুদ্ধ লোক ইন্ডিয়া বলে ডাকছে – এ জিনিস আরএসএসের হজম হবে না। কারণ ‘ইন্ডিয়া’ নামটা এসেছে পারস্যের লোকেদের মুখের ‘হিন্দুস্তান’ ইউরোপিয় জবানে বদলে গিয়ে। ইংরেজদের এ দেশে আসতে তখনো কয়েক হাজার বছর দেরি, যীশুখ্রিস্টেরই জন্ম হয়নি। এ নাম কি সঙ্ঘ মেনে নিতে পারে? বস্তুত ‘হিন্দু’ শব্দটাও বেদ, বেদান্ত, রামায়ণ, মহাভারত – কোথাও নেই। বরং জরাথ্রুষ্টের ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ আবেস্তা-য় আছে। সঙ্ঘ তাই পারলেই তাদের বয়ানে ‘সনাতন ধর্ম’ কথাটা গুঁজে দেয়। এমনি তো আর দয়ানিধি স্ট্যালিন সনাতন ধর্মের বিনাশের ডাক দেওয়ায় বিজেপি নেতারা রণচণ্ডী হয়ে ওঠেননি। বস্তুত যে ভাষাটার প্রতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ পক্ষপাত, যা গত শতকের ছয়ের দশকে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং এখন বিজেপি ফের চাপিয়ে দেওয়ার তালে আছে, সেই ‘হিন্দি’ ভাষাও আদতে ছিল হিন্দুস্তানি (আমির খুসরো বলতেন হিন্দভি) ভাষা। সুলতানি আমল থেকে দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্য এশিয়া এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের ভাষা মিশে তা গড়ে উঠেছিল। এই ভাষা দেবনাগরী আর ফারসি – দুরকম লিপিতেই লেখা চলত। হিন্দি আর উর্দু – এই বিভাজন হয়েছে মাত্র শ দুয়েক বছর আগে এবং তার পিছনে ইংরেজদের ভূমিকা কম নয়।
অর্থাৎ সঙ্ঘ পরিবারের এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্রের স্লোগান – হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান – গোটাটাই বিদেশি লব্জ ধার করা। অবশ্য জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র ধারণাগুলোই ইউরোপিয়। কস্মিনকালে ভারতে ছিল না। আগাগোড়া ধার করা জিনিস নিয়ে চললে হীনমন্যতা আসাই স্বাভাবিক, ধারের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টাও প্রত্যাশিত।
শেষ নাহি যে
বুধেশ্বরী দীপেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘হামারলা মরিলে কি দ্যাশ বাঁচিবে?’ দেশের মানুষ না বাঁচলে দেশ বাঁচে না। এখন আশু লড়াইটা দেশ বাঁচানোর, নাম বাঁচানোর নয়। যেহেতু দেশের মানুষের জন্য বিজেপি সরকার কিছুই করেনি, তাই দেশের মানুষকে ঝুটো গর্ব দিয়ে এবং বিরোধীদের সে গর্ব সামলানোর কাজে ব্যস্ত রেখেই তারা উতরোবার চেষ্টা করছে। যুগপৎ নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত করছে। অর্থাৎ রথ দেখা এবং কলা বেচা। ২০২৪ নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদীরা পুনর্নির্বাচিত হলে দেশের নাম কেন, দেশের লোকেদের নামও বদলে দিতে পারে। কেউ আটকাতে পারবে না। ফলে এখন বিরোধীদের দায়িত্ব এক দেশ এক নির্বাচন বা নাম পরিবর্তনের মত কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থেকেও সরকারের অকর্মণ্যতা এবং বিপজ্জনক কাজগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো, বিকল্প হাজির করা। নইলে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির ঘূর্ণিতে ডুবে মরতে হবে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী অবশ্য নির্বাচন এবং নাম নিয়ে ডামাডোলের ঊর্ধ্বে উঠে আসন্ন বিশেষ অধিবেশনে সংসদে আলোচনার জন্য নটা বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু বিজেপি যে বিনা আলোচনায় সংসদ চালাতে এবং নিজেদের পছন্দের বিল পাস করাতে সিদ্ধহস্ত তা আমরা জেনে গেছি। ইন্ডিয়া জোট তাদের একতা বাইরের মত সংসদের ভিতরেও দেখাতে পারে কিনা, দেখিয়ে বিজেপির যা ইচ্ছা তাই করা আটকাতে পারে কিনা, তার উপরে নির্ভর করছে আমরা আগামী বছর কীরকম নির্বাচন দেখব। তার চেয়েও বড় কথা, দেশের ভিতটা থাকবে কিনা। ভিত না থাকলে ইমারত টেকে না।
পবন খেরা, সুপ্রিয়া শ্রীনাতেরা লাইভ টিভিতে গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ধমকাতে শুরু করলেন – বিজেপির দালালি করবেন না।
প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা আর বুথফেরত সমীক্ষার দৌলতে লোকনীতি-সিএসডিএস নামটা এখন ওয়াকিবহাল পাঠকদের কারোর অজানা নয়। কিন্তু এই সংস্থাটি আরও কিছু সমীক্ষা করে থাকে যেগুলো নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে শুধু যে হইচই হয় না তা নয়, আদৌ কোনো খবরই প্রকাশ করা হয় না। কারণ করলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে। তেমনই এক সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত সপ্তাহে। এই সমীক্ষার মজা হল, এখানে উত্তরদাতা সাংবাদিকরাই। যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের সমীক্ষাটির ফল দেখে আতঙ্কিত হওয়ার মত নানা বিষয় আছে, তবে এই লেখার পক্ষে যা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য তা হল, ৮২% সাংবাদিক বলেছেন তাঁরা মনে করেন তাঁদের নিয়োগকর্তা বিজেপিকে সমর্থন করেন।
এমনিতে স্বাধীন, সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে যে কোনো ব্যক্তিরই যে কোনো দলকে সমর্থন করার অধিকার আছে। উপরন্তু উদারনৈতিক গণতন্ত্রের গালভরা বাণীগুলোর গলদ বুঝে ফেলা যে কোনো মানুষই জানেন কোনো দেশেই কোনো সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে পারে না। বস্তুত, হওয়া উচিতও নয়। কারণ রাজনীতিহীন সাংবাদিকতা হল অর্থহীন তথ্যের সমাহার। ও জিনিস হোমেও লাগে না, যজ্ঞেও লাগে না। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া স্কুপ নামক ওয়েব সিরিজে একজন আদর্শবাদী সম্পাদকের একটি সংলাপ আছে। তিনি চাকরি ছাড়ার আগে মালিককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যখন কেউ বলে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর অন্য একজন বলে হচ্ছে না, তখন সাংবাদিকের কাজ দুজনকেই উদ্ধৃত করা নয়। জানলা খুলে দেখা কোনটা ঠিক এবং সেটাই লেখা। সাংবাদিকের কাজ কোনটা তা ঠিক করা কিন্তু শতকরা একশো ভাগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সুতরাং সাংবাদিকের এবং সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক প্রবণতা থাকতে বাধ্য। সেই প্রবণতা কোনদিকে থাকবে তা অনেককিছুর ভিত্তিতে ঠিক হয়, যার একটা অবশ্যই মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ। ফলে কোনো তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমই যে কোনোদিন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল না একথা বলাই বাহুল্য। যেমন কেউ বলে না দিলেও পশ্চিমবঙ্গে নেহাত বালক-বালিকারাও চিরকাল জানত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ওই সংস্থারই ইংরিজি কাগজ দ্য টেলিগ্রাফ কংগ্রেসপন্থী; বর্তমান, দ্য স্টেটসম্যান বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধী; আবার আজকাল বাম ঘেঁষা। তাহলে লোকনীতি-সিএসডিএস সমীক্ষার ফল আলাদা করে আলোচনা করার মত কেন? কারণ ভারতের মত এত বড় একটা দেশ, যেখানে এতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে, সেখানে চালানো সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক মনে করছেন তাঁদের সংস্থা একটা দলকেই সমর্থন করে। অর্থাৎ বিভিন্ন নাগরিক বিভিন্ন দলকে সমর্থন করার মত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন দলের দিকে ঢলে থাকলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ভারসাম্য বজায় থাকে তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এই সমীক্ষা থেকে।
২০১৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন খবরের চ্যানেল দেখার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা সমীক্ষার এই ফলাফলে অবিশ্বাস করবেন না। কেউ কেউ বলবেন বেশ হয়েছে, এমনটাই হওয়া উচিত কারণ বিজেপিই একমাত্র জাতীয়তাবাদী পার্টি। আর বিজেপিবিরোধী শঙ্কিত হবেন। এই যা তফাত। কিন্তু কে নিজের রাজনৈতিক পছন্দ অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের এই একপেশে হয়ে যাওয়াকে কীভাবে দেখবেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দেশের সংবাদমাধ্যমের এতখানি একচোখামির ফল কী হচ্ছে? অর্ণব গোস্বামী, রাহুল শিবশঙ্কর, রাহুল কাঁওয়াল, শিব অরুর, সুধীর চৌধুরী, রুবিকা লিয়াকত, দীপক চৌরাসিয়া, অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, সুরেশ চওনঙ্কে বা অমন চোপড়ারা যে পরিমাণ ঘৃণা ছড়িয়েছেন গত এক দশকে – তার ফল আর শুধু উত্তেজনা সৃষ্টি করে দাঙ্গা ছড়ানোয় সীমাবদ্ধ নেই। ও কাজ তো হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকও করে। ধর্মান্ধ টিভি অ্যাঙ্করদের অবদানে উঠে এসেছে চেতন সিংয়ের মত ভয়ঙ্কর অপরাধী, যে সরকারি উর্দি পরে সরকারি বন্দুক দিয়ে ট্রেনের কামরায় প্রথমে নিজের ঊর্ধ্বতন অফিসারকে খুন করে। তারপর এক কামরা থেকে আরেক কামরায় গিয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী যাত্রী খুঁজে বার করে খুন করে। অবশেষে সেখানে দাঁড়িয়ে বাকি যাত্রীদের হুমকি দেয়, ভারতের দুজনই আছে – মোদীজি আর যোগীজি। এখানে থাকতে হলে এদেরই ভোট দিতে হবে।
এতদ্বারা ২০২৪ লোকসভার নির্বাচনের জন্য বিজেপির প্রচার শুরু হয়ে গেল কি? রবীশ কুমার যাদের গোদি মিডিয়া বলেন, তারা যখন অমিত শাহকে বিধায়ক কেনাবেচা করার গুণে ‘মডার্ন চাণক্য’ আখ্যা দিতে পারে তখন এই প্রণালীকেও ব্যাপারটা থিতিয়ে গেলে যে বিজেপির ‘অ্যাগ্রেসিভ ক্যাম্পেনিং’ নাম দেবে না তার নিশ্চয়তা কী? আপাতত খাঁটি আমেরিকান কায়দায় চেতন সিংকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা চলছে। যদিও রেলমন্ত্রীকে কোনো সাংবাদিক প্রশ্ন করবে না, একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে বন্দুক হাতে ট্রেনযাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছি কেন? কারণ বিজেপি সরকারকে প্রশ্ন করা বারণ, করলে চাকরি যায়। লোকনীতি-সিএসডিএস সমীক্ষা যে সঠিক, এই তার হাতে গরম প্রমাণ।
নিজের বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আশপাশের লোকের সঙ্গে কথা বললেই টের পাওয়া যায় মূলধারার মিডিয়ার ছড়ানো ভুয়ো খবর এবং একচোখা খবর ইতিমধ্যেই কতখানি ক্ষতি করে ফেলেছে। দিন দুয়েক আগে একজন প্রাইভেট গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সেদিন কাগজে বেরিয়েছে বিজেপি মণিপুরের এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই এনআরসি করার কথা ঘোষণা করেছে। চালকের পাশে বসে কাগজ পড়তে গিয়ে সক্ষোভে আমার স্ত্রীকে বলতেই চালক বলে উঠলেন “ঠিক হয়েছে। এনআরসি তো করাই উচিত।” কেন করা উচিত জিজ্ঞাসা করায় তাঁর উত্তর “বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানগুলো এসেই তো মণিপুরে অশান্তিটা করছে।” তাঁকে বলা গেল যে মণিপুরে মুসলমান প্রায় নেই বললেই চলে এবং ওই রাজ্যের সীমান্ত মায়ানমারের সঙ্গে, বাংলাদেশের সঙ্গে নয়। তাঁর নাছোড়বান্দা উত্তর “মুসলমান সব জায়গাতেই আছে।” অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হল, মণিপুর সম্পর্কে তাঁর তথ্যের উৎস কী? উত্তর “খবরেই তো দেখাচ্ছে।” কোন চ্যানেলের খবরে দেখাচ্ছে সে প্রশ্ন করে আর সময় নষ্ট করিনি, কারণ কোন খবর মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ায় না সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বরং সহজ। তাই তাঁকে মণিপুরের ভূগোল, ইতিহাস এবং বর্তমান অশান্তি যে মেইতেই আর কুকিদের মধ্যে তা জানাতে খানিকটা সময় ব্যয় করলাম। এনআরসি যে এর প্রতিকার নয় তাও বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সফল হলাম কিনা জানি না, ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ মানুষ বহুবছর ধরে সারাদিন যা দেখে চলেছে তার প্রভাব কয়েক মিনিটের কথায় দূর হওয়া অসম্ভব।
ভারতীয় সমাজকে এই খাদের কিনারে নিয়ে আসার দোষ সবটাই টিআরপিখোর টিভি চ্যানেলগুলোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে অবশ্য অন্যায় হবে। খবরের কাগজগুলোও কোনো অংশে কম যায়নি। ‘পেইড নিউজ’ নিয়ে সাংবাদিক পি সাইনাথের যে কাজ আছে তা প্রমাণ করে টাকার জন্যে ভারতের বড় বড় কাগজগুলো সবকিছু করতে রাজি। ২০১৮ সালে কোবরাপোস্টের স্টিং অপারেশনেও তেমনই দেখা গিয়েছিল। কোবরাপোস্টের প্রতিনিধিরা একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধি সেজে ভারতের অনেকগুলো বড় বড় সংবাদমাধ্যমের কর্তাদের কাছে গিয়েছিলেন। প্রস্তাব ছিল, আমরা টাকা দেব, সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর করতে হবে এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা হয় এমন খবর করতে হবে, নানারকম ইভেন্টের আয়োজন করতে হবে। দুটো মাত্র সংবাদমাধ্যম রাজি হয়নি – পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ।
সংবাদমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থলোলুপতা এবং বিজেপি সরকারের ভয় দেখানো, সরকারবিরোধী খবর করলে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি নানা কৃৎকৌশলের ফল হল দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বিজেপি-আরএসএসের বয়ানের একাধিপত্য। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কখনো যা হয়নি ২০১৪ সালের পর থেকে ঠিক তাই হয়ে চলেছে। সংবাদমাধ্যম কেবলই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। যাদের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব তাদের প্রশ্ন করে না। অর্থাৎ কয়েকশো বছর ধরে সারা পৃথিবীতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার মূল কর্তব্য বলে যা স্থির হয়েছে – ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা – সেই কাজটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা অপরাধ, যে সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে না তারাই সঠিক কাজ করে – একথাই সারা দেশে সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সাংবাদিকরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে গদগদ সেলফি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। কে কত বড় সাংবাদিক তার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রশাসনিক বৈঠকে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন “পজিটিভ (ইতিবাচক) খবর করুন। বিজ্ঞাপন পাবেন।” এত বড় খবর সর্বাধিক বিক্রীত বাংলা দৈনিকের এক কোণে ১৭৮ শব্দে প্রকাশিত হয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের একজনও এর প্রতিবাদে একটি শব্দও লেখেননি বা বলেননি।
এভাবে চলছিল ভালই, কিছুদিন হল এই ধামাধরা মিডিয়া কিঞ্চিৎ ফাঁপরে পড়েছে। এমনিতে পৃথিবীর যে কোনো ব্যবসায় নিয়ম হল কাক কাকের মাংস খায় না। কিন্তু ভারতের সাংবাদিকতায় সেই নিয়ম বারবার ভেঙেছে গোদি মিডিয়া। অর্ণব গোস্বামী টাইমস নাওতে থাকার সময়েই বিজেপির পক্ষে বলে না এনডিটিভির মত যেসব চ্যানেল তার সাংবাদিকদের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা আরম্ভ করেছিলেন। একেবারে আরএসএসের তত্ত্ব অনুসরণ করে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, মুসলমান তো বটেই, যে কোনো ইস্যুতে সরকারের সামান্যতম বিরোধিতা করা ব্যক্তিদেরও দেশদ্রোহী বলা শুরু হয়ে গিয়েছিল ২০১৪ সাল থেকে। টিভি বিতর্কে বিরোধী দলের একজন মুখপাত্রকে ডেকে চিৎকার করে তাঁকে কথা বলতে না দেওয়া, অন্যদিকে নানা পরিচয়ে বিজেপি-আরএসএসপন্থী একাধিক লোককে প্যানেলে বসিয়ে একতরফা প্রচার চালিয়ে যাওয়া দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময়টুকু বাদ দিলে ভারতের সংবাদমাধ্যম এমন কখনো করেনি বলেই সম্ভবত বিরোধী দলগুলোর নেতারা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজিতে যাকে ‘ওয়াল টু ওয়াল কভারেজ’ বলে, সমস্ত নির্বাচনী প্রচারে এবং সারাবছরই বিজেপি তাই পেয়ে চলছিল আর বিরোধীদের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবার রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। এর পাল্টা কৌশল কারোর মাথায় আসেনি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য, সমর্থকরা ভেবে বসেছিলেন সোশাল মিডিয়া দিয়ে মাত করে দেবেন। কিন্তু বিপুল অর্থবলের কারণে সেখানেও বিজেপির সঙ্গে এঁটে ওঠা শক্ত। উপরন্তু আমাদের মত শহুরে মধ্যবিত্তদের নিজের চারপাশ দেখে যা-ই মনে হোক, ভারতের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এখনো স্মার্টফোন নেই, থাকলেও শস্তা ডেটা নেই, কানেক্টিভিটি নেই। ফলে ফেসবুক বা টুইটার দিয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছনো যায় না।
নেপথ্যে কে আছেন জানি না, কিন্তু বিজেপির এই সর্বগ্রাসী প্রচারের বিকল্প পথ প্রথম দেখালেন রাহুল গান্ধী – ভারত জোড়ো যাত্রা। শুধু যে সাবেকি ভারতীয় কায়দায় মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজের ভাবমূর্তি খানিকটা পুনরুদ্ধার করলেন এবং কংগ্রেসকে জাতীয় স্তরে ফের প্রাসঙ্গিক করে তুললেন তাই নয়, রাহুল ওই যাত্রায় এমন একটা জিনিস করলেন যা এমনকি বিজেপিও ভেবে উঠতে পারেনি। ভারত জোড়ো যাত্রাকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কোনো কভারেজ দেবে না বুঝে রাহুল ছোট বড় বিচার না করে বিকল্প সংবাদমাধ্যম, এমনকি ইউটিউবারদেরও সাক্ষাৎকার দেওয়া শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, বড় বড় কাগজে রাহুল নেই। টিভিতে রাহুল নেই। অথচ কর্ণাটকে চলা ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও আলোচনা করছেন। আসলে রাহুল (বা কংগ্রেস) যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা বড় অংশের মানুষ খবরের জন্য আর কাগজ বা টিভির উপর ভরসা করেন না। বিশেষত যাঁদের মস্তিষ্কের সবটাই এখনো হিন্দুত্ব গ্রাস করতে পারেনি, তাঁরা অনেকেই এখন ধ্রুব রাঠি বা আকাশ ব্যানার্জির মত ইউটিউবারের দিকে তাকিয়ে থাকেন খবর সংগ্রহের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের বিকল্প সংবাদমাধ্যম এখনো সঠিক অর্থে বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি বলেই হয়ত এই ধারা এখনো শীর্ণকায়। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মত বুলডোজারশাসিত রাজ্যেও হিন্দি ভাষার ইউটিউবাররা প্রবল জনপ্রিয়। যোগী সরকারকে বেগ দেওয়ার মত খবর, হাস্যকৌতুক, গান সবই তাঁরাই তৈরি করছেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বহু রাজ্যেই ঘটনা তাই। এই প্রবণতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হল ভারত জোড়ো যাত্রায়।
এর সঙ্গে কংগ্রেস আরও একটি কৌশল নিল, যা প্রথম চোটে যে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের আপত্তিকর মনে হবে। শাস্ত্রে বলা আছে, দূত অবধ্য। সাহেবরাও বলে থাকে “Don’t shoot the messenger”। কিন্তু রাহুল ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন একটি সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিককে সরাসরি বলে দিলেন, বিজেপির হয়ে কাজ করতে হলে বুকে বিজেপির লোগো লাগিয়ে আসুন। তাহলে ওদের যেভাবে উত্তর দিই আপনাদেরও সেভাবেই উত্তর দেব। সাংবাদিক হওয়ার ভান করবেন না। সাংবাদিক দমে যেতে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাওয়া বেরিয়ে গেল?
এরপর থেকে একই ঢঙে কথা বলা শুরু করলেন তাঁর দলের অন্য মুখপাত্ররাও। পবন খেরা, সুপ্রিয়া শ্রীনাতেরা লাইভ টিভিতে গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ধমকাতে শুরু করলেন – বিজেপির দালালি করবেন না। কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন ইন্ডিয়া টুডের শোতে সুপ্রিয়া সটান রাহুল কাঁওয়াল এবং রাজদীপ সরদেশাইকে বলে দিলেন, আপনাদের স্টুডিওতে তো সকাল থেকে শোকপালন চলছে বলে মনে হচ্ছে। এই আক্রমণাত্মক মেজাজ কংগ্রেসের মুখপাত্ররা বজায় রেখে চলেছেন। সম্প্রতি টাইমস নাওয়ের সাক্ষাৎকারে কপিল সিবাল নাভিকা কুমারকে ল্যাজেগোবরে করে ছেড়েছেন। ভারি মোলায়েম গলায় বলেছেন, আশা করি এখন পর্যন্ত নাভিকা প্রধানমন্ত্রীর মাউথপিস নয়?
How to destroy Navika Kumar, The Kapil Sibal Way {Thread)
ক্রমশ এই রণনীতি অন্য বিরোধী দলের নেতাদেরও নিতে দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সবকিছুই বাকি দেশের চেয়ে একটু দেরিতে হয় আজকাল। তাই হয়ত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অতি সম্প্রতি একেবারে পার্টিজান হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমকে কড়া ভাষায় প্রত্যুত্তর দেওয়া শুরু করেছেন। লাইভ অনুষ্ঠানে জি ২৪ ঘন্টার অ্যাঙ্কর মৌপিয়া নন্দীকে সটান বলে দিয়েছেন, দালালি করা চলবে না। ওই চ্যানেলের মালিক সুভাষ চন্দ্র যে রাজ্যসভার বিজেপি সমর্থিত সাংসদ, টেনে এনেছেন সেকথাও।
আত্মপক্ষ সমর্থনে মৌপিয়া প্রথমে ওই তথ্যটাই অস্বীকার করেছেন, তারপর সেটা সফল হবে না বুঝে জাঁক করে বলেছেন, সেলিম চাইলেও ২৪ ঘন্টা গণশক্তির মত রিপোর্টিং করবে না। তারপর, যেন হঠাৎ খেয়াল হওয়ায়, যোগ করেছেন, জাগো বাংলার মত রিপোর্টিংও করবে না।
স্বাভাবিক অবস্থায় রাজনৈতিক নেতাদের এইভাবে সাংবাদিকদের তথা সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ভারত যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং এই অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। বস্তুত অধিকাংশ তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম এখন এতটাই একচোখো হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তাদের খবর না দেখে বা না পড়ে কেউ যদি গণশক্তি আর জাগো বাংলা পড়ে নিজের মত করে ঠিক কী ঘটেছে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে হয়ত সত্যের বেশি কাছাকাছি পৌঁছবেন।
একথা পাঠক/দর্শক মাত্রেই আজকাল উপলব্ধি করেন। সেই কারণেই রবীশ কুমারের ইউটিউব চ্যানেলের গ্রাহক সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এমনকি কুণাল কামরার মত ঋজু বিদূষক, যাঁর মূল কাজ লোক হাসানো, তাঁর পডকাস্টও মানুষ আগ্রহ নিয়ে দ্যাখেন। সেদিক থেকে যে বাঙালি হিন্দি বা ইংরিজিতে স্বচ্ছন্দ নন তাঁদের দুর্ভাগা বলতে হবে। বাংলা ভাষায় ওই মানের কাজ এখনো হচ্ছে না।
যা-ই হোক, ধামাধরা মিডিয়ার সংকটের কথা ফেরত আসি। সম্প্রতি রিপাবলিক চ্যানেলের কর্ণধার অর্ণব মণিপুর নিয়ে মোদী সরকারের সমালোচনা করেছেন, রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিও তুলেছেন। তা নিয়ে বিজেপিবিরোধী মানুষ যুগপৎ হাসাহাসি করছেন এবং বিস্মিত হচ্ছেন। আসলে এতে বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই। বিজেপিকে তো বটেই, এমনকি বিজেপিবিরোধীদেরও বিস্মিত করে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও ২৬টি দলের ইন্ডিয়া জোট গড়ে উঠেছে। শেষপর্যন্ত সে জোট টিকবে কিনা সেটা পরের কথা, কিন্তু গোদি মিডিয়ার কাছে আশু সমস্যা হল এই দলগুলির অধীনে থাকা রাজ্য সরকারগুলো। গোটা দক্ষিণ ভারতে কোথাও বিজেপি সরকার নেই, অথচ ওই রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল, প্রচুর বিজ্ঞাপন পাওয়া যেতে পারে। বাড়াবাড়ি করলে বিজেপির দেখানো পথে ওই সরকারগুলো বিজ্ঞাপন দেবে না। গোবলয়ের রাজ্যগুলোর মধ্যেও বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থানের সরকার ইন্ডিয়া জোটের দলগুলোর হাতে। দিল্লি, পাঞ্জাবের সরকারও তাই। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের মত বড় রাজ্য, ছত্তিসগড়ের মত উন্নতি করতে থাকা রাজ্যও ইন্ডিয়ার হাতে। তাহলে গোদি মিডিয়ার হাতের পাঁচ বলতে রইল মডেলের হাড়গোড় বেরিয়ে পড়া গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ছোট্ট রাজ্য হরিয়ানা আর মধ্যপ্রদেশ। শেষেরটি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির হাতে থাকবে কিনা তা নিয়েও ঘোর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে তেমন ব্যবসা হয় না নয়ডাকেন্দ্রিক তথাকথিত সর্বভারতীয় মিডিয়ার। কারণ তারা ওই অঞ্চল এবং তার মানুষজনকে চেনেই না। স্বভাবতই তাঁরাও এদের পাত্তা দেন না। এমতাবস্থায় স্রেফ দাঙ্গাবাজি করে চলে কী করে অর্ণব, রুবিকাদের?
লাইভ টিভিতে বিরোধী দলের নেতাদের প্রতিআক্রমণের ফলে হিন্দুত্বে একান্ত দীক্ষিত দর্শক ছাড়া আর সকলের কাছেই বিশ্বাসযোগ্যতা যে তলানিতে ঠেকেছে একথা বুঝতে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর পাকা মাথাদের কারোর বুঝতে বাকি নেই। বিকল্প সংবাদমাধ্যম বিপুল সরকারি বাধা সত্ত্বেও যে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে তাতেও সন্দেহ নেই। অতএব মাঝেমধ্যে বিজেপিবিরোধী ভান করতে হবে বইকি। মুশকিল হল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন সম্ভবত বিজেপিও ভাবতে শুরু করেছে, এদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা করালে তা আর আগের মত প্রভাবশালী হবে না। তাই তারাও এখন ‘সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার’ ধরার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বিজেপিপন্থী লেখক, সাংবাদিক, এমনকি মন্ত্রীরাও বেশকিছু ইউটিউবারকে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেছেন। এমনটা বিজেপি আগে কখনো করেনি। এই ইউটিউবারদের অন্যতম beerbiceps বলে একজন। ইউটিউবে তার প্রায় ছয় মিলিয়ন ফলোয়ার। অতীতে সে ক্রিকেটার যজুবেন্দ্র চহল, সানি লিওন, সারা আলি খান জাতীয় মানুষের সাক্ষাৎকার নিত। এমনকি ডিমনেটাইজেশনকে ব্যঙ্গ করেও ভিডিওও বানিয়েছে একসময়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে সে পরম সাত্ত্বিক হয়ে উঠেছে। বারবার ভুয়ো খবর ছড়িয়ে ভ্রম সংশোধন করা এজেন্সি এএনআইয়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশ থেকে শুরু করে অমুক প্রভু, তমুক দক্ষিণপন্থী স্ট্র্যাটেজিস্ট – সকলেই বিয়ারবাইসেপসের শোতে উপস্থিত হচ্ছেন। বিজেপি যদি ২০২৪ নির্বাচন জিতেও যায়, রাহুল, সেলিমরা মূলধারার সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে তাঁদের তিরিক্ষে মেজাজ বজায় রাখলে হয়ত বিয়ারবাইসেপসদেরই পোয়া বারো হবে, কপাল পুড়বে অর্ণব, মৌপিয়াদের।
তবে আক্রমণের ধারাবাহিকতা থাকা চাই। সেলিম জি নেটওয়ার্কের অ্যাঙ্করকে হাঁকড়াবেন আর তাঁর দলের মুখপাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা রিপাবলিক টিভির মত আরও উগ্র দক্ষিণপন্থী চ্যানেলের বিতর্কে হাসিমুখে অংশগ্রহণ করবেন, অনুষ্ঠানের আগে পরে দিলদরিয়া হয়ে ছবিও তুলবেন – তা কী করে হয়?
২০২১ সালে যে তৃণমূল নেতাদের প্রতি মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন, যাঁরা বিজেপিতে গিয়ে বিপুল ভোটে হেরেছিলেন, তাঁদের নির্বাচনের ফল বেরোবার পর অনতিবিলম্বেই ফিরিয়েও নেওয়া হয়েছিল।
অবাক হওয়ার ক্ষমতা কমে আসাই সম্ভবত বার্ধক্যের সবচেয়ে নিশ্চিত লক্ষণ। বায়রন বিশ্বাস কংগ্রেসের টিকিটে, সিপিএমের সমর্থনে মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় খুব একটা অবাক হতে পারিনি। ফলে বুঝলাম, বুড়ো হচ্ছি। আমি যখন ছাত্র, তখন আমাদের কলেজের সেমিনারে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। পিঠে ভারি স্কুলব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাওয়া এক পরিচিত স্কুলছাত্রকে নাকি তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন “কেমন আছ?” সে উত্তর দিয়েছিল “ওই আছি আর কি। এবার গেলেই হয়।” তখনও এ-দেশে মোবাইল ফোন সহজলভ্য হয়নি। তখনই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এসে আমার মতো চালসে পড়া লোকের তো বুড়ো হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। চারপাশ অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। এত দ্রুত, যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে বদলানো প্রায় কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই বোধহয় সাহিত্য, সিনেমা, সোশাল মিডিয়া— সর্বত্র স্মৃতিমেদুরতার ছড়াছড়ি, একমাত্র নস্টালজিয়ার বাজারই সর্বদা সরগরম। বদল এমনিতে জীবনের লক্ষণ, তা মনোরঞ্জক এবং উত্তেজক। কিন্তু ঘনঘন বদল আবার একঘেয়ে হয়ে যায়। সর্বক্ষণ চার, ছয় হয় বলে যেমন আজকাল আর আইপিএল ম্যাচ দেখতে ভাল লাগে না। মনে হয়, এ তো জানা কথাই। খেলার মহান অনিশ্চয়তা বলে আর কিছু নেই। রাজনীতিও ক্রমশ মহান অনিশ্চয়তা হারাচ্ছে। এ রাজ্যের রাজনীতি তো বটেই।
অনেকেই চটে যাবেন। তবু না বলে পারছি না— পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলবদল ব্যাপারটা এতই জলভাত হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে, যে বায়রনের দলবদল নিয়ে কংগ্রেস ও বাম নেতৃত্বের আহত হওয়া এবং বহু সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া বা হতাশায় ভোগা আমার কাছে প্রাথমিকভাবে কৌতুককর। পরে অন্য কিছু। আগেই বলেছি, অতি দ্রুত সবকিছু বদলালে নিরুপায় মানুষ স্মৃতির কাছেই আশ্রয় নেয়। অনতি-অতীতে ফিরে গেলেই দেখতে পাই, এ রাজ্যের সর্বত্র একেকটা পাড়া বা পরিবার সম্পর্কে অন্যরা বলত “ওরা পাঁড় কংগ্রেসি” বা “ওরা কট্টর সিপিএম”। কোনও কোনও মানুষ সম্পর্কে বলা হত “প্রথমদিন থেকে তৃণমূলে আছে”। আজকাল আর সেসব বলা যায় না। এক যুগ আগে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেখা গেছে রেজ্জাক মোল্লার মতো “ঘামের গন্ধওলা কমরেড” তৃণমূলে চলে যেতে পারেন। উদয়ন গুহর মতো পারিবারিকভাবে বামপন্থী নেতা দল বদলাতে পারেন। হাত-পা নেড়ে মার্কসবাদ কপচানো, পকেটে মঁ ব্লাঁ পেন আর হাতে আই ওয়াচ পরা সিপিএমের রাজ্যসভার সদস্য ঋতব্রত ব্যানার্জি তৃণমূলের মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারেন নিঃসঙ্কোচে। এমনকি প্রবীণ সিপিএম নেতা তথা বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘদিনের মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের বিশ্বস্ত সৈনিক শঙ্কর ঘোষ বিজেপির নির্ভরযোগ্য ‘কারিয়াকার্তা’ হয়ে উঠতে পারেন। তালিকা দীর্ঘতর করা যেতেই পারে, কিন্তু বক্তব্য পরিষ্কার করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। যেসব মানুষ কখনও বামপন্থীদের ভোট দেন না, দেবেন না— তাঁদেরও কিন্তু বরাবর প্রত্যাশা থাকে, আর যে যা-ই করুক, বামপন্থীরা এমন নীতিহীনতায় জড়াবেন না। সেই বামপন্থীদেরই এসব করতে দেখে ফেলার পর ধনী ব্যবসায়ী কংগ্রেসি বায়রনের কাছে অন্যরকম প্রত্যাশা থাকবেই বা কেন? তিনি তো দেখলাম ঘোরপ্যাঁচহীন সরল মানুষ। বলেছেন, তৃণমূল প্রার্থী করেনি বলে কংগ্রেসে গিয়েছিলেন। এখন যখন বিধায়ক হয়েই গেছেন, তখন আর দলের উপর রাগ করে থাকার দরকার কী?
সাগরদীঘির ভোটাররা রাগ করতে পারেন এই লোকটির বিশ্বাসঘাতকতার জন্য, অধীর চৌধুরী রাগ করতে পারেন তাঁকে বোকা বানানো হয়েছে বলে। আমরা, বাকি রাজ্যের মানুষ, যদি রাগ করতে চাই তাহলে কয়েকটা কথা একটু স্মরণ করে নেওয়া দরকার।
এ রাজ্যের বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় দিনের পর দিন একাধিক বিধায়ককে বাইরে তৃণমূল, ভিতরে বিজেপি হয়ে থাকতে দিচ্ছেন। এঁদের মধ্যে মুকুল রায় বলে একজন আছেন, যিনি বিজেপির টিকিটে বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে পরে ঘটা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতিতে তৃণমূলে ফিরে এসেছেন বলে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। তারপর যখন তাঁকে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়, তখন বিরোধীরা সমালোচনা করেন। কারণ সংসদীয় প্রথা অনুযায়ী ওই পদটা প্রধান বিরোধী দলকে দেওয়া হয়ে থাকে। এই সমালোচনার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দেন, মুকুল তো বিজেপিরই বিধায়ক। কদিন আগেও মমতা একথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। বিধানসভার বাইরে প্রায় প্রতিদিন গরম গরম মন্তব্য করে বিজেপিকে সংবাদের শিরোনামে রাখেন যে বিরোধী দলনেতা, জনসভার অনুমতি আদায় করতে বারবার আদালতের দ্বারস্থ হতে যাঁর ক্লান্তি নেই, সেই শুভেন্দু অধিকারী কিন্তু এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার হুমকি-টুমকি দেননি কখনও। সুতরাং ধরে নিতে হয় মুকুল তৃণমূলেরও, বিজেপিরও। শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী সারদামণি যেমন বলতেন “আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।” তা এই ব্যবস্থায় যদি আমাদের রাগ না হয়, খামোকা বায়রনকে ব্রুটাসের সঙ্গে একাসনে বসানোর প্রয়োজন কী?
ওই লোকটি যে জনাদেশকে অসম্মান করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ রাজ্যের এক বড় অংশের মানুষ তো আবার তৃণমূল দল ভাঙালে তাতে জনাদেশের অসম্মান হয় বলে মনে করেন না। ঠিক যেভাবে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এবং সোশাল মিডিয়ায় বিজেপি কোনও রাজ্যের সরকার দল ভাঙিয়ে ভেঙে দিলে অমিত শাহকে চাণক্য বলা হয়, ব্যাপারটাকে মাস্টারস্ট্রোক বলা হয়, সেইভাবে এ রাজ্যেও তো অন্য দলের নেতা তৃণমূলে যোগ দিলে তা গণতন্ত্রের জয় বলেই ঘোষণা করেন বহু মানুষ। বিভিন্ন চ্যানেলের অ্যাঙ্কররাও গদগদ হয়ে বলেন, তৃণমূল দেখিয়ে দিল। বায়রনের দলবদলের পর যেমন বলা হচ্ছে, সাগরদীঘির পরাজয়ের জবাব দিল তৃণমূল। প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, জবাবটা কাকে দিল? ভোটারদের? যে ভোটাররা তৃণমূলকে দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন? তাহলে লড়াইটা কি শাসক দল বনাম ভোটারের? একেই তাহলে এখন গণতন্ত্র বলছি আমরা? পরপর হিমাচল প্রদেশ আর কর্নাটকে মুখ থুবড়ে পড়ার আগে বিজেপি সম্পর্কে সর্বভারতীয় স্তরে একটা কথা চালু হয়ে গিয়েছিল— ভোটে যে-ই জিতুক, সরকার গড়বে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কি আলাদা কিছু করছে?
২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন যে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল তা তো ইদানীং অভিষেকও ঠারেঠোরে স্বীকার করেন। এ বছরে সময় অতিক্রান্ত হলেও পঞ্চায়েত নির্বাচন করানো নিয়ে সরকারের কোনও উৎসাহ নেই। রাজ্যপাল রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করছেন না, সরকারও তা নিয়ে সংঘাতে যাচ্ছে না। অথচ এমনিতে কত বিষয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে কত আকচা-আকচি চলে! ২০২১ সালে যে তৃণমূল নেতাদের প্রতি মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন, যাঁরা বিজেপিতে গিয়ে বিপুল ভোটে হেরেছিলেন, তাঁদের নির্বাচনের ফল বেরোবার পর অনতিবিলম্বেই ফিরিয়েও নেওয়া হয়েছিল। উপরন্তু বাবুল সুপ্রিয়র মতো দাঙ্গাবাজ বিজেপিফেরতকে উপনির্বাচনে প্রার্থী করে মন্ত্রীও বানানো হয়েছে। এগুলো জনাদেশকে সম্মান করার লক্ষণ? এই ধারাতেই তো কংগ্রেসের একমাত্র বিধায়ককে দলে টেনে নেওয়া হল। আবার মঞ্চে বসে অভিষেক জাঁক করে এও বললেন, যে বোতাম টিপলেই কংগ্রেসের চারজন সাংসদকে তৃণমূল নিয়ে নিতে পারে। একের পর এক দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় দল যখন টলমল করছে, দিদির দূত প্রকল্প ঘটা করে ঘোষণা করার পর জনরোষের চেহারা দেখে চুপিসাড়ে বন্ধ করে দিতে হয়েছে, নবজোয়ারে বেরিয়ে নিত্য ল্যাজেগোবরে হতে হচ্ছে— তখনও এভাবে বুক ফুলিয়ে দল ভাঙানোর হুমকি দেওয়া থেকে বোঝা যায় যে অভিষেক মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নীতি একটা বাতিল পণ্য হয়ে গেছে।
তাঁর ধারণা যথার্থ। বিজেপির বিরুদ্ধে চাট্টি গরম গরম কথা বললেই (এমনকি আরএসএসের বিরুদ্ধেও বলতে হয় না। মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেন আরএসএস খারাপ নয়) সরকারি দলের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, গঙ্গারতি ও মন্দির নির্মাণ সত্ত্বেও বিজেপিকে আটকাতে তাদেরই ভোট দেওয়া আমাদের কর্তব্য— একথা যখন থেকে এ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনই নীতির ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয়ে গেছে। ২০২১ সালের নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল বিজেপিকে আটকানো, রাজ্যের সরকারের কাজের মূল্যায়ন নয়। তাতে ক্ষতি নেই। গণতন্ত্রে ভোটাররা নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিজেরাই তো ঠিক করবেন। কিন্তু আজ দুবছর পরে ভেবে দেখা দরকার, বিজেপিকে আটকানোর উদ্দেশ্যটুকুও সফল হয়েছে কি? বিজেপি তিনজন বিধায়ক নিয়ে এককোণে পড়ে থাকা দল থেকে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে তো বটেই, সরকারবিরোধী ভোটাররা যাতে বিজেপি ছাড়া আর কোনও দলের উপর ভরসা করতে না পারেন তার জন্যে শাসক দল আপ্রাণ চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় পক্ষের কাছে সামান্য একটা উপনির্বাচনে হারও তারা সহ্য করছে না। না হয় মেনে নেওয়া গেল, কংগ্রেস নিজেদের বিধায়ককে ধরে রাখতে পারে না বলে অপদার্থ। সিপিএম আরও অপদার্থ, কারণ তারা আদালতের মুখাপেক্ষী হয়ে আন্দোলন করে— এও না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপিই একমাত্র পদার্থ হিসাবে পড়ে থাক— এমন পরিস্থিতিই কি তৈরি করতে চেয়েছিলাম আমরা? বায়রনের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে চুটকি আর মিম বানানো বা ক্ষোভ প্রকাশ করার চেয়ে নিজেদের এই প্রশ্ন করা বেশি জরুরি। কারণ আবার নির্বাচন আসছে। গণতন্ত্রের ওইটুকু তলানিই তো পড়ে আছে আমাদের জন্যে— একটা ভোট দেওয়ার অধিকার।
কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকতা আজ কদর্যতার নতুন শৃঙ্গে আরোহণ করল বিজেপি হেরে যাওয়ায়। এর বিপদ দীর্ঘমেয়াদি।
কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল রাজনৈতিকভাবে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেভাবে এই নির্বাচনের ফলাফল সম্প্রচারিত হতে দেখলাম টিভির পর্দায়, সাংবাদিক হিসাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করাও আমার অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। ব্যাপারটার শুরু নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকেই।
নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় এ দেশে চব্বিশ ঘন্টার খবরের চ্যানেলের ছড়াছড়ি হওয়ার পর থেকেই প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষা বা ওপিনিয়ন পোল এবং বুথফেরত সমীক্ষা বা এক্সিট পোলের বিপুল জনপ্রিয়তা। প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষা ভোটারদের প্রভাবিত করে কিনা বা এক দফা ভোটের পর টিভিতে বুথফেরত সমীক্ষা হলে পরের দফাগুলোয় যেখানে ভোটদান হবে সেখানকার ভোটদাতারা প্রভাবিত হন কিনা – এ নিয়ে একসময় বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। ফলে এখন নিয়ম হয়ে গেছে, যে কোনো স্তরের নির্বাচনের ৪৮ ঘন্টা আগে থেকে প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষার ফল প্রকাশ করা যাবে না, আর শেষ দফার ভোটদান সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বুথফেরত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা যাবে না। ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো গত কয়েক বছরে নিরপেক্ষতার ভান ত্যাগ করে ক্রমশ যত একচোখা হয়ে উঠেছে, তত এইসব সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তা সত্ত্বেও গত ডিসেম্বর মাসেই সংসদে মন্ত্রী কিরেন রিজিজু জানিয়ে দিয়েছেন, এইসব সমীক্ষা নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
খুব ভাল কথা। গত দশ বছরে লোকসভা তো বটেই, বেশিরভাগ নির্বাচনের প্রাক্কালে মতামত সমীক্ষায় দেখা গেছে বিজেপি ভাল জায়গায় আছে, বুথফেরত সমীক্ষাতেও তাই। সবসময় যে সেইসব সমীক্ষার ফল মিলেছে তা নয়, সব নির্বাচনেও বিজেপি জেতেনি। কিন্তু ভুল কোন সমীক্ষায় না হয়? কোন দলই বা সব নির্বাচনে জেতে? ফলে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের এইসব সমীক্ষা নিষিদ্ধ করতে চাওয়ার কারণও ছিল না। কিন্তু এবারে কর্ণাটক নির্বাচনের আগে একটা অন্যরকম প্রবণতা লক্ষ করা গেল। যেই দেখা গেল প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষাগুলোতে ক্ষমতাসীন বিজেপির হাল ভাল নয় বলে দেখা যাচ্ছে, অমনি চ্যানেলগুলো ওইসব সমীক্ষা নিয়ে হইচই করা বন্ধ করে দিল। কোন চ্যানেলের সমীক্ষায় কী পাওয়া গেছে তা নিয়ে খবরের কাগজগুলোও বিশেষ জায়গা খরচ করল না। অথচ কাগজের রাশিফলের কলাম অনেকে যেভাবে গেলে, সেইভাবে ভোটে কী হতে চলেছে তা নিয়ে অনুষ্ঠান হলেও লোকে বিলক্ষণ গেলে। কারণ ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা কল্পনা করতে প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ ভালবাসে। অতএব টিআরপি আদায় করতে যে কোনো চ্যানেলের কাছে সমীক্ষাগুলো দারুণ লোভনীয়। তবু ঢাকঢোল পিটিয়ে সেগুলো নিয়ে প্রচার করতে দেখা গেল না। অথচ অতীতে খোদ বিজেপিকে দেখা গেছে বিজ্ঞাপন দিতে, যার বয়ান খানিকটা এইরকম – সমস্ত ওপিনিয়ন পোল বলছে আমরা জিতব। তাই আমাদেরই ভোট দিন। এবারে প্রায় কোনো প্রাক-নির্বাচনী মতামত সমীক্ষাকেই সেভাবে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না। তাই কি গোদা বাংলায় যাকে চেপে যাওয়া বলে, গোদী মিডিয়া তাই করতে শুরু করল?
এ সন্দেহ দৃঢ় হয় রায় দম্পতির হাত থেকে গৌতম আদানির করতলগত হওয়া এনডিটিভির কাণ্ড খেয়াল করলে। তারা ১০ মে ভোটদানের আগে দুদিন ধরে বিস্তারিত প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষার ফলাফল সম্প্রচার করল। তাতে ভোটাররা কোন ইস্যুকে প্রধান ইস্যু বলে ভাবছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ সম্পর্কে মতামত কী, রাজ্য সরকারের কাজ সম্পর্কে কী ভাবছেন – এইসব গভীর প্রশ্ন ছিল। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কত শতাংশ মানুষ কাকে দেখতে চান – এ প্রশ্নও ছিল। অথচ কে কত আসন পেতে পারে সেই হিসাবটাই দেখানো হল না।
আরও মজা হল গত বুধবার ভোটদানের পর সন্ধেবেলা। একমাত্র নিউজ নেশন-সিজিএস বুথফেরত সমীক্ষা নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে বলল, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে ১১৪ আসন নিয়ে, কংগ্রেস পাবে ৮৬, জেডিএস ২১ আর অন্যরা তিন। আর কোনো সর্বভারতীয় সমীক্ষাই নির্দিষ্ট সংখ্যা বলতে রাজি হল না। “এত আসন থেকে অত আসনের মধ্যে পাবে” – এটাই দেখা গেল সকলের পছন্দের নীতি। তাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস আর বিজেপি – দুই প্রধান পক্ষকে যে সংখ্যাগুলো দেওয়া হল, সেগুলোর কোনো সীমা পরিসীমা নেই। যেমন এবিপি নিউজ-সি ভোটার বলল বিজেপি পাবে ৬৬-৮৬ আসন আর কংগ্রেস ৮১-১০১। রিপাবলিক টিভি-পি মার্কের মতে বিজেপি ৮৫-১০০; কংগ্রেস ৯৪-১০৮। সুবর্ণ নিউজ-জন কি বাত বিজেপিকে দিল ৯৪-১১৭, কংগ্রেসকে ৯১-১০৬। টিভি ৯ ভারতবর্ষ-পোলস্ট্র্যাট বলল বিজেপি পাবে ৮৮-৯৮, কংগ্রেস ৯৯-১০৯।
সংখ্যাগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। একটা দল ৯৪ আসন পাওয়া মানে তার বিরোধী আসনে বসা প্রায় নিশ্চিত, অন্যদিকে ১১৭ আসন পাওয়া মানে নিশ্চিন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ছেলে পরীক্ষা দিয়ে এল, বাবা জিজ্ঞেস করলেন “কত পাবি?” ছেলে বলল “পাসও করতে পারি, ফেলও করতে পারি।” এ তো সেইরকম সমীক্ষা হয়ে গেল। একটা দল ৮৫ পেতে পারে, আবার একশোও পেতে পারে – একথা বলার জন্যে সমীক্ষা করার প্রয়োজন কী? এনডিটিভি নিজে কোনো সংস্থার সাহায্য নিয়ে এবারে বুথফেরত সমীক্ষা করেনি। এই সংখ্যাগুলো যখন বুধবার সন্ধ্যায় তাদের চ্যানেলে দেখানো হচ্ছিল, তখন বিজেপি মুখপাত্র দেশরতন নিগম সঙ্গত কারণেই বলেছিলেন “এবার দেখছি আমিও একটা পোল সার্ভে এজেন্সি খুলে ফেলতে পারি।”
চূড়ান্ত ফল এই সমস্ত সমীক্ষাকেই ভুল প্রমাণ করেছে। যখন এই লেখা লিখছি, তখন নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট বলছে কংগ্রেস ১১৭ আসনে জিতে গেছে, আরও ১৯ আসনে এগিয়ে। অর্থাৎ মোট ১৩৬। বিজেপি ৫৩ আসনে জয়ী, আরও ১১ আসনে এগিয়ে। অর্থাৎ মোট ৬৪। এছাড়া জেডিএস ১৮ আসনে জয়ী, আরও দুই আসনে এগিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে এই সমীক্ষাগুলোর ভুলের পরিমাণ কিন্তু লাগাতার কমছিল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মত হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনের ফলাফল কোনদিকে যাবে তা সঠিকভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন অনেক সংস্থার সমীক্ষকই, দু-একটা সংস্থা আসন সংখ্যাও প্রায় নিখুঁতভাবে বলে দিয়েছিল। তাহলে কর্ণাটকে গিয়ে কি তাঁরা সকলে রাতারাতি সব দক্ষতা হারিয়ে ফেললেন? নাকি সমীক্ষকদের দেওয়া সত্যিকারের সংখ্যাগুলো মিডিয়া আমাদের দেখতেই দিল না প্রলোভনে বা ভয়ে?
কোনো সন্দেহ নেই যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ সালের নির্বাচন জিততে চেয়েছিল। কিন্তু হারলেও তাদের পক্ষে ফলটা তো নেহাত খারাপ হয়নি। সেই প্রথম তারা এই রাজ্যে একক বিরোধী দল হিসাবে উঠে আসে। ২০১৬ বিধানসভার তুলনায় বিধায়কের সংখ্যা বেড়ে যায় ২৫ গুণেরও বেশি। ফলে হারলেও সেই ফলকে যে একাদশাবতার মোদীজির সাফল্য হিসাবে দেখানো সম্ভব হবে তা তো বিজেপির জানাই ছিল। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের এক বছরও যখন বাকি নেই, সেইসময় কর্ণাটকের মত বড় রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী দিনরাত প্রচার করার পরেও কেবল ক্ষমতা খোয়ানো নয়, গোটা ষাটেক আসনে নেমে আসাকে যে কোনোভাবেই সাফল্য বলে প্রমাণ করা যাবে না – তা বোধহয় অমিত শাহের মত পাকা মাথার লোকেদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই কি এত-থেকে-অত শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে বলা হয়েছিল বৃহৎ পুঁজির মালিকানায় থাকা সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোকে?
ইন্দিরা গান্ধী আরোপিত জরুরি অবস্থা সম্পর্কে লালকৃষ্ণ আদবানির একটা উক্তি বিজেপি নেতারা কয়েক বছর আগে পর্যন্তও খুব আওড়াতেন। আদবানি বলেছিলেন “শ্রীমতি গান্ধী মিডিয়াকে নত হতে বলেছিলেন, মিডিয়া হামাগুড়ি দিয়েছিল।” ২০১৪ সাল থেকে মূলধারার মিডিয়া যেভাবে চলছে সে সম্পর্কে অধুনা মার্গদর্শকমণ্ডলীর সদস্য আদবানির মতামত আমরা জানি না। কিন্তু আজ ফল প্রকাশের দিন সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো যা করল, তাকে বোধহয় একমাত্র দণ্ডি কাটার সঙ্গে তুলনা করে চলে।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল সকালের দিকেই। ইন্ডিয়া টুডের অ্যাঙ্কর রাহুল কাঁওয়াল কংগ্রেসের অফিসিয়াল হ্যান্ডেল থেকে টুইট করা একটা ভিডিও নিয়ে বেজায় আপত্তি করতে লাগলেন। কেন সেই ভিডিওতে রাহুল গান্ধীকে নায়কোচিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে? কেন লেখা হয়েছে “আমি অপরাজেয়। আমি আত্মবিশ্বাসী। হ্যাঁ, আজ আমি অপ্রতিরোধ্য।” ভিডিওটায় আপত্তিকর কী আছে তা কাঁওয়াল কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিলেন না, কিন্তু কী যেন খচখচ করে বিঁধছিল। সত্যি কথা বলতে, দেখে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। ক্লাসের কোনো একটা ছেলের দিকে একাধিক মেয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে আমরা বাকিরা যেনতেনপ্রকারেণ প্রমাণ করার চেষ্টা করতাম তার মধ্যে বিশেষ কিছুই নেই – না রূপের দিক থেকে, না গুণের দিক থেকে। এও যেন সেই ব্যাপার।
যদিও কাঁওয়াল মোটেই আমাদের মত যৌন ঈর্ষায় ভুগছিলেন না। পর্দার নিচের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছিল কংগ্রেস তখন ১২১, বিজেপি ৭৬। সংখ্যার উপর তো আর রাগ দেখানো চলে না, তাই গায়ের ঝালটা কংগ্রেস নেতাটির উপরেই ঝাড়ছিলেন তিনি। ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হল খানিক পরে যখন কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাতে অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এলেন। কংগ্রেস কেন এগিয়ে বা আরও এগিয়ে নেই কেন, সেসব প্রশ্নে না গিয়ে কাঁওয়ালবাবুর বর্ষীয়ান সহকর্মী রাজদীপ সরদেশাই প্রবল বিক্রমে প্রশ্ন করলেন, কংগ্রেস কর্মীরা কেন পোস্টাল ব্যালট গণনার সময় থেকেই ঢাকঢোল পিটিয়ে নাচ করছিলেন। যেন তাতে বিরাট কিছু হেরফের হয়ে যাবে বা কোনো নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করা হয়েছে। কাঁওয়ালও সঙ্গত করলেন। সুপ্রিয়া পাল্টা আক্রমণে গিয়ে যা বললেন তার নির্যাস হল, নেচেছে বেশ করেছে। আপনাদের স্টুডিওতে তো সকাল থেকে শোকপালন চলছে বলে মনে হচ্ছে। এহেন আক্রমণের মুখে দুজনকেই ব্যাকফুটে যেতে হল। কিন্তু তাতে অনুষ্ঠানের গুণগত পরিবর্তন কিছু হয়নি। সারাদিন ধরেই নানাবিধ গ্রাফিক্স তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা চলল যে বিজেপির এই হার তেমন বড় হার নয়। মাঝে মাঝে উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত, পৌরসভার নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য তুলে ধরার চেষ্টাও করা হল। উপরন্তু দিন দুয়েক আগে লাইভ অনুষ্ঠানে যোগেন্দ্র যাদবের খোঁচা উপেক্ষা করে আগাগোড়া ইন্ডিয়া টুডে মল্লিকার্জুন খড়গে আর জেপি নাড্ডার ছবি ব্যবহার করে গেল। কংগ্রেস হারলে আর বিজেপি জিতলে যেভাবে রাহুল আর মোদীর ছবি ব্যবহার করা হয় তা এ দিন করা হল না।
রাজদীপ অবশ্য নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে অত্যুৎসাহী হওয়ার ফল হাতেনাতে পেলেন কিছুক্ষণ পরেই, যখন বিজেপির আই টি সেলের সর্বেসর্বা অমিত মালব্য তাঁকে কুৎসিত ভাষায় অকারণে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেন।
কতটা বেহায়া এবং অসাংবাদিক হলে শাসক দলের মুখপাত্রের হাতে সহকর্মীর অমন অপমানে চুপ করে থাকা যায় কাঁওয়াল তা দেখিয়ে দিলেন। সেই তিনিই আবার বিকেলের দিকে সুপ্রিয়া যখন ফেরত এলেন, তখন পুরুষসিংহের মত গর্জন করে গেলেন “আজ কেন বলছেন না গণতন্ত্র মৃত? আজ কেন বলছেন না ইভিএমে গণ্ডগোল আছে?” অবশ্য ফ্যাক্ট চেকার মহম্মদ জুবেরের টুইট দেখে জানতে পারছি, বিজেপির পরাজয় থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আজ ওটাই গোদী মিডিয়ার বিশিষ্ট সাংবাদিকদের অন্তিম হাতিয়ার হিসাবে স্থির হয়েছিল।
এ তো গেল ইন্ডিয়া টুডের কথা। সাধারণত কোলাহল সবচেয়ে কম হয় বলে এখনো এনডিটিভি দেখে থাকি। প্রণয় রায়দের প্রস্থানের পর সেখানেও অন্য চ্যানেলের মত অত্যন্ত হাস্যকর কার্যকলাপ শুরু হয়েছে। আজ যেমন স্টুডিওর এক কোণে একজনকে কন্নড় খাবারদাবার তৈরি করতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরিচিত মুখ বিষ্ণু সোম এবং আদানি আমলে নতুন যোগ দেওয়া দুই অপেক্ষাকৃত তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ বলতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও কেবলই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন কেন এই হার বিজেপির পক্ষে রীতিমত সম্মানজনক। ব্যাপারটা একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে দুই তরুণ মুখের একজন ‘সিনিয়র জার্নালিস্ট’ শ্রীনিবাস রাজুকে বলেই ফেললেন “কংগ্রেস যখন হারে তখন তো আমাদের এক্সপার্টরা বলেন ‘ডেসিমেটেড’। আজ বিজেপি হারছে অথচ ‘তেমনভাবে হারছে না’ বলছেন কেন বলুন তো?” রাজু বলার চেষ্টা করলেন, তিনি কিছু বলছেন না। যা বলার ডেটাই বলছে। সামনে ল্যাপটপ নিয়ে বসা অ্যাঙ্কর বললেন “কই, ডেটা তা বলছে না তো!” বেচারির কাল সকাল পর্যন্ত চাকরিটা থাকলে হয়।
এবং অর্ণব গোস্বামী। প্রিন্স অফ ডেনমার্ককে বাদ দিয়ে যেমন হ্যামলেট হয় না, ভারতীয় মিডিয়া আলোচনাও তেমনি এ গোঁসাইকে বাদ দিয়ে হয় না। তবে যে যা-ই মনে করুক, আমার মত স্বাধীন সাংবাদিকের বাড়িতে মাস গেলে কোনো রাজনৈতিক দলের দপ্তর থেকে মোটাসোটা প্যাকেট এসে তো পৌঁছয় না, ফলে কোন চ্যানেল রাখব আর কোনটা রাখব না সে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সারাক্ষণ গোঁসা করে থাকা গোঁসাইয়ের চ্যানেল পয়সা খরচ করে দেখার শখ আমার নেই। তাই রিপাবলিক নেটওয়ার্ক দেখি না। কিন্তু আজ অন্য সূত্র থেকে একটু-আধটু দেখতেই হল। দেখলাম তাঁর মেজাজ বরাবরের মতই সপ্তমে চড়ে যাচ্ছে যখন তখন, তবে সে চাপ বেশিক্ষণ নিলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে ভেবেই হয়ত কভারেজ কখনো জলন্ধর লোকসভার উপনির্বাচন, কখনো পাকিস্তানের সঙ্কটে চলে গেছে তাঁর গোটা নেটওয়ার্কেই।
বাংলা চ্যানেলগুলোর কথা আর কী বলব? বছরে ৩৬৪ দিন তারা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যকিছুর খবর রাখে না। সেই কূপমণ্ডূকতা একদিনে কাটিয়ে উঠে কি আর জাতীয় হয়ে ওঠা যায়? এবিপি আনন্দে দেখলাম নানা ছুতোয় তৃণমূল কংগ্রেস এরপর কী করবে আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কর্ণাটক থেকে কিছু শিখবে কিনা এই নিয়েই চিল চিৎকার চলছে। টিভি৯ বাংলা আরও এককাঠি সরেস। তারা বেশ বেলা পর্যন্ত পর্দায় সংখ্যাগুলো উপস্থাপন করা ছাড়া কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে কিছুই দেখাচ্ছিল না, ব্যস্ত ছিল অয়ন শীলকে নিয়ে। পরে দায়সারা সম্প্রচার শুরু হল। বাকি চ্যানেলগুলো দেখার আর প্রবৃত্তি হয়নি।
এত লম্বা লেখা পড়ে কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, আজ মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আলাদা করে লেখার কী দরকার ছিল?
উত্তরে বলি, সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা যে একটি সোনার পাথরবাটি তাতে সন্দেহ নেই। বড় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কারণগুলো বাদ দিলেও, সাংবাদিকরা মানুষ এবং কোনো মানুষ নিরপেক্ষ নয়। ফলে মানুষের সাংবাদিকতাও ১০০% নিরপেক্ষ হতে পারে না। সে কারণেই সমস্ত পেশার মত সাংবাদিকতাতেও কিছু নিয়মকানুন (যার পোশাকি নাম এথিক্স) মেনে চলা হয় চিরকাল। সেগুলোর সময়োচিত পরিবর্তনও ঘটে। কিন্তু অমৃতকালে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো ন্যূনতম এথিক্স বিসর্জন দিয়ে এতটাই পক্ষ নিয়ে ফেলেছে যে বিশ্বাসযোগ্যতা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। উল্টে সাংবাদিকতার অর্থটাই সাধারণ দর্শকের কাছে উল্টে গেছে। এখন তাঁরা মনে করেন একজন সাংবাদিক অমুক দলের কোনো কাজের সমালোচনা করেছেন মানেই তিনি ওই দলের বিরোধী। পরে আবার একই দলের কোনো কাজের প্রশংসা করলে মনে করেন পালটি খেল, বা এতদিনে আসল চেহারা বের করল। এই অভিজ্ঞতা রাজদীপের মত স্বনামধন্য সাংবাদিক থেকে শুরু করে আমার মত চুনোপুঁটি – সকলেরই। কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকতা আজ কদর্যতার নতুন শৃঙ্গে আরোহণ করল বিজেপি হেরে যাওয়ায়। এর বিপদ দীর্ঘমেয়াদি। বহুদিন পরে জয়ী হওয়া দলের সদস্য, সমর্থকরা আজ নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে মিডিয়া নামেই সাংবাদিকতা করে, এরা আসলে ক্ষমতাসীন দলের দালাল। অতএব কেন্দ্রীয় সরকারের জোয়াল ২০২৪ বা পরবর্তী যে সময়েই বিজেপি-আরএসএসের হাত থেকে বেরিয়ে যাক না কেন, নতুন যে দল ক্ষমতায় আসবে তারাও মিডিয়ার কাছ থেকে দালালিই দাবি করবে। একবার যে দালাল বলে প্রমাণিত হয়েছে তাকে তো আর সাংবাদিক বলে বিশ্বাস করা যায় না।
এই ক্ষতি সমস্ত সাংবাদিকের। তার চেয়েও বড় কথা, এই ক্ষতি গণতন্ত্রের।
প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদী, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী।
সেই কোন কালে চকোলেট কোম্পানি ক্যাডবেরি’জ অমিতাভ বচ্চনকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে একগুচ্ছ বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। তার একটায় তিনি পাপ্পু নামে একটি ছেলের বাবা, যার বয়স বেড়েই চলেছে কিন্তু সে স্কুলের গণ্ডি আর পেরোতে পারছেন না। তা পাপ্পুর হতাশ দোকানদার বাবাকে ছেলের বন্ধুরা এসে খবর দিল, পাপ্পু পাশ করে গেছে। অতএব তারা চকোলেট খাবে, পয়সা পাপ্পু দেবে। বাবা মহানন্দে সকলকে বিনিপয়সায় চকোলেট বিলোতে লাগলেন। এমন খুশির খবরে কি মিষ্টিমুখ না করে থাকা যায়? ওই সিরিজেরই আরেকটি বিজ্ঞাপনে অমিতাভ কলেজের অধ্যাপক। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখেন, ছেলেমেয়েরা সব ঊর্ধ্বশ্বাসে কোথায় যেন দৌড়চ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, পাপ্পুর নাকি পরীক্ষা, তাই তারা সবাই দৌড়চ্ছে। অবাক অধ্যাপক সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন পরীক্ষা মানে হল, একটি সুন্দরী মেয়ে (রাইমা সেন) কলেজে ঢুকছে আর মোটা কাচের চশমা পরা, সচরাচর যাদের ক্যাবলা বলা হয় তেমন ছেলে পাপ্পু প্রেম নিবেদন করবে বলে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি এল, দেখল এবং পাপ্পুকে জয়যুক্ত করল। ফলে সকলে মিলে পাপ্পু পাশ করে গেছে বলে ফের নাচানাচি শুরু করল। এ খবরেও মিষ্টিমুখ না-করে থাকা যায় না, অতএব ফের চকোলেট খাওয়া হল। এই পাপ্পু যে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে জায়গা করে নিতে চলেছে, তখন কে জানত!
আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র তুলনাহীন। আজ না হয় যাবতীয় টিভি চ্যানেল এবং অধিকাংশ সর্বভারতীয় খবরের কাগজের উপর আম্বানি-আদানির সহায়তায় তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নরেন্দ্র মোদীর সর্বভারতীয় উত্থানের সময়ে তো এতখানি আধিপত্য ছিল না। তবু বিজেপি নেতারা বারবার আউড়ে এবং হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকের বিপুল ব্যবহারের মাধ্যমে জনমনে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পেরেছিলেন এই কথা যে, হার্ভার্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রাহুল গান্ধি হলেন ওই বিজ্ঞাপন সিরিজের অকর্মণ্য, অজস্রবার ফেল করা পাপ্পু। অন্যদিকে তথ্যের অধিকার আইন ব্যবহার করে যাঁর পাশ করার বছরের তথ্য জানতে চাইলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে মুখে কুলুপ আঁটে, সেই মোদী হলেন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, বিশ্বগুরু হওয়ার উপযুক্ত। যেহেতু মোদীর শিক্ষাগত যোগ্যতা সন্দেহজনক (গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত তাঁর মার্কশিটে অধ্যয়নের বিষয় লেখা ছিল “entire political science”), সেহেতু ডিগ্রি ব্যাপারটাই যে অপ্রয়োজনীয় তা প্রমাণ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে আরএসএস-বিজেপির প্রচারযন্ত্র। বারো ক্লাসের গণ্ডি না-পেরনো স্মৃতি ইরানিকে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী করা হয়েছিল এবং ডিগ্রি যে কিছুই প্রমাণ করে না তা প্রমাণ করতে দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র মতো বিরাট কাগজ রীতিমত গ্রাফিক্স তৈরি করেছিল— যাতে দেখানো হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বেরই ডিগ্রির বালাই ছিল না। মনে রাখতে হবে, এই স্মৃতি সংসদে পৌঁছেছিলেন অমেঠি কেন্দ্রে রাহুলকে পরাজিত করে। অর্থাৎ স্মৃতিকে মাথায় তোলার পিছনেও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাহুলকে পাপ্পু প্রমাণ করা।
স্বীকার্য যে, প্রচুর লেখাপড়া জেনেও রাজনীতিতে কেউ অকর্মণ্য হতেই পারেন। আবার বেশিদূর লেখাপড়া না-করেও ক্ষুরধার বুদ্ধি, সাহস এবং পরিশ্রমের জোরে একজন রাজনীতিবিদ দারুণ সফল হতে পারেন। সাফল্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটা অবশ্য গুরুতর প্রশ্ন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেমন স্পষ্টতই মনে করেন, চা বিক্রেতার ছেলে হয়েও দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাই সাফল্য। কীভাবে সে চেয়ার অবধি পৌঁছনো হল এবং চেয়ারে বসে কী করা হচ্ছে তার তেমন গুরুত্ব নেই। তিনি যে গত আট বছরে এমনকি কাশ্মিরি পণ্ডিতদের জন্যও গঠনমূলক কিছু করে উঠতে পারেননি, তা তাঁর কাছে ব্যর্থতা বলে প্রতিভাত হয় বলে তো মনে হয় না। উলটে সারাক্ষণ নিজেই নিজেকে শংসাপত্র দিয়ে বেড়াচ্ছেন— “সব চঙ্গা সি”। এহেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের মানদণ্ডে রাহুল যা-ই করুন, প্রধানমন্ত্রী না-হতে পারলে পাপ্পুই থাকবেন। তাতে কিছু এসে যায় না। মুশকিল হল, পাপ্পু মিথ নির্মাণ এতই সফল হয়েছে যে, বিজেপিবিরোধী মানুষও কিছুতেই ওই মিথ ভুলে রাহুলকে দেখে উঠতে পারছেন না। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের এই ভুল না ভাঙলে বিপদ।
গত কয়েক দিনে যে চরম অন্যায় অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করে রাহুলকে লোকসভা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, বহু উদারপন্থী, এমনকি বামপন্থী মানুষও তাতে তেমন দোষ দেখছেন না। বিজেপি বাদে সব দলের নেতৃস্থানীয়রাই অবশ্য এর নিন্দা করেছেন, কিন্তু তার অনেকটাই “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” যুক্তিতে। কারণ, আজ এর প্রতিবাদ না-করলে কাল এত বড় দেশের কোনও এক নিম্ন আদালতে তাঁদের কারও কোনও প্রধানমন্ত্রীবিরোধী মন্তব্যকে হাতিয়ার করে কেউ যদি মানহানির মামলা ঠুকে দেয় আর আদালত তুরন্ত দুবছরের কারাদণ্ড দিয়ে দেয়, তাহলে তাঁদের সাংসদ বা বিধায়ক পদও নিমেষে খারিজ হয়ে যাবে। কিছু বলার মুখ থাকবে না। এই নেতা-নেত্রীদের কে কে ভারতের গণতন্ত্রের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সত্যিই চিন্তিত তা আরও কিছুদিন না কাটলে, তাঁদের দলের কার্যকলাপ না দেখলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। যেমন ধরুন, এর পরেও যদি আম আদমি পার্টি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী ধ্বজা উড়িয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটতে যায়, তা হলে বুঝতে হবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের লুকোবার মতো আরও অনেক কিছু আছে। সেসবের গুরুত্ব ভারতের গণতন্ত্র বাঁচানোর চেয়ে বেশি।
কিন্তু ইতিমধ্যেই দলগুলোর সাধারণ সদস্য, সমর্থকদের অনেকেরই দেখা যাচ্ছে রাহুল পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন এবং অনেকে তাঁর মধ্যে আশার আলো দেখছেন বলে প্রবল গাত্রদাহ। এর কারণ রাহুলের কার্যকলাপ তাঁরা এত বছর ধরে ভাল করে লক্ষই করেননি। নিজেদের অজান্তেই সরকারি প্রচারযন্ত্রের চোখ দিয়ে রাহুলকে দেখেছেন। তাই এখন চোখকান যা বলছে, মস্তিষ্ক কিছুতেই তা মানতে চাইছে না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভারত জোড়ো যাত্রার পরে রাহুল সর্বক্ষণের রাজনীতিবিদ নন— এই অভিযোগ আর করা যাচ্ছে না। লৌহমানব মোদীর বিপরীতে তিনি যে ঠুনকো পুতুল নন, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছেন। কংগ্রেসেও যে নেতৃত্বের সঙ্কট দীর্ঘকাল ধরে চলছিল তার নিষ্পত্তি ঘটেছে। গুলাম নবি আজাদের মতো সুযোগসন্ধানীরা বিদায় হয়েছেন। কপিল সিব্বলের মতো অতিবৃদ্ধ, জনসংযোগহীন আইনজীবী নেতারা পথপার্শ্বে পড়ে আছেন। সুদর্শন, সাহেবদের মতো ইংরেজি বলায় দক্ষ শশী থারুর টিভি স্টুডিও আর টুইটার আলো করেই বসে আছেন। মল্লিকার্জুন খড়গেকে সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে ঝাড়া হাত-পা রাহুল জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে গেছেন।
কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। দেশ কীভাবে চালানো উচিত, ভারতের আগামীদিনের অর্থনীতি কেমন হওয়া উচিত, আজকের দুনিয়ায় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার পুনঃপ্রয়োগ কীভাবে করা সম্ভব— এসব নিয়ে গত কয়েক বছরে মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছেন রাহুল। কিন্তু গোদি মিডিয়া আর বিজেপি-র আইটি সেল সেসব দিকে আলো ফেলেনি। কেবলই পাপ্পু ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে এবং জওহরলাল নেহরুর চিন-নীতির ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির স্বৈরতান্ত্রিকতা— এগুলোকে রাহুল গান্ধীর সমার্থক করে দিয়েছে। দুঃখের বিষয়, বহু বিজেপি-বিরোধী, বিশেষত বামপন্থীরা, এই চশমা দিয়েই রাহুলকে দেখেছেন এবং এখনও দেখে চলেছেন। তাঁরা খেয়ালই করেন না, ২০১৯ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাহুল সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের যে প্রস্তাব রেখেছিলেন তা এই মুহূর্তে যে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির কবলে আমরা পড়েছি তার প্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক, এবং বলা বাহুল্য, বামপন্থী। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন ভারতে অমন একটা প্রকল্প দারুণ কাজে দেবে। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ অবশ্যই আছে। কিন্তু অন্তত এই শতকে ভারতের কোনও বামপন্থী দলের নেতাকে অর্থনীতি নিয়ে এরকম বিকল্প চিন্তা করতে দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের শেষ বামফ্রন্ট সরকার বরং অনেকাংশে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি নিয়ে চলছিল, কেরলের বাম সরকারও যে মৌলিকভাবে আলাদা কোনও পথ দেখাতে পারছে এমন নয়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যেমন (যাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে মোদী সরকার) তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে খুব আলাদা কোনও পথ নেওয়া হয়তো কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভবও নয়। কিন্তু প্রস্তাব হিসেবে, পরিকল্পনা হিসেবেও ডি রাজা, পিনারাই বিজয়ন বা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যরা কোনও মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির কথা বলেছেন কি? সরকারে এলে কী করবেন সে তো পরের কথা, রাহুল অন্তত অন্য কিছু ভাবার এবং বলার সাহস তো দেখিয়েছেন।
ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন রাহুল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিলেন। সেই আলোচনা শুনলে বোঝা যায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে রাহুল কীভাবে দেখেন এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্যকে কতটা গভীরভাবে জানেন। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের সাফল্য কীভাবে এল, ভারতে সেরকম কিছু করা সম্ভব কিনা জানতে চান এবং সেই প্রসঙ্গে জিএসটি ও নোটবন্দির ফলে কর্নাটকের বেল্লারির রমরমা জিনস শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতির কথা জানান। দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়েও সুনির্দিষ্ট আলোচনা করেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মির পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনকে কতটা গভীরভাবে দেখেছেন তা মিনিট পঁচিশেকের ওই ভিডিওতে বেশ বোঝা যায়। রঘুরাম কিন্তু ঘোর পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ। রাহুল আলোচনার এক জায়গায় প্রশ্ন করেন, “দেখতে পাচ্ছি স্টক এক্সচেঞ্জে টাকা লাগিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার কী মত?”
দিল্লির রাজনৈতিক মহলে সকলেই জানেন, রাহুলকে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের অপছন্দ হওয়ার অন্যতম কারণ তাঁর এই বামপন্থী প্রবণতা। তিনি যেভাবে নাম করে দেশের সবচেয়ে বড় দুই ধনী— মুকেশ আম্বানি আর গৌতম আদানিকে আক্রমণ করেন, তা অনেকেরই পছন্দ নয়। কারণ অর্থনীতির দিক থেকে কংগ্রেসের ক্রমশ ডাইনে সরে যাওয়া আরম্ভ হয়েছিল রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধীর আমলে, যা তুঙ্গে পৌঁছয় নরসিংহ-মনমোহন জুটির নেতৃত্বে। সেই কারণেই নরসিংহ বিজেপির বিশেষ পছন্দের লোক। শেখর গুপ্তার মত দক্ষিণপন্থী সাংবাদিকরা তাঁকে ‘ভারতের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী’ আখ্যাও দিয়ে থাকেন। সেই দলের নেতা হয়ে রাহুলের এভাবে বৃহৎ পুঁজিকে আক্রমণ, বারবার ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ নিয়ে কথা বলা অনেক কংগ্রেসিরই না-পসন্দ।
তা বলে রাহুল বিপ্লবী নন, লেনিন বা মাও জে দং নন। কিন্তু তাঁকে অমন হতে হবে— এমন প্রত্যাশা করবই বা কেন? এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও যখন বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে থেকে তেমন কেউ উঠে এলেন না, তখন বহুত্ববাদী ভারত থাকবে কি থাকবে না— এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে কমিউনিজমের দাঁড়িপাল্লায় রাহুলকে মাপার মূঢ়তা ক্ষমার অযোগ্য। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় একই সময়ে। একশো বছর পূর্ণ করার আগেই আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনায় চূড়ান্ত সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সেখানে ভারতীয় কমিউনিস্টরা দারুণ শুরু করেও ১৯৬৪ সালের পর থেকে নিজেদের ভাঙতে-ভাঙতে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে, অস্তিত্বেরই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ১৯৮৯ থেকে সংঘের শক্তি দ্রুত বেড়েছে, অথচ কমিউনিস্টরা সম্মুখসমরে যাওয়ার শক্তি ক্রমশ হারিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে তবু বিকল্প সরকার তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার শক্তি ছিল, ২০০৯ সালের পর থেকে তা-ও আর অবশিষ্ট নেই।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় রাজনীতির বাস্তুতন্ত্র মানে ছিল বামপন্থা বনাম মধ্যপন্থার লড়াই। সংঘ পরিবার সফলভাবে অটলবিহারী বাজপেয়ির আমল থেকে সেই বাস্তুতন্ত্রকে মধ্যপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থার লড়াইয়ে পরিণত করতে শুরু করে। ২০২৪ নির্বাচনে রাহুল তথা কংগ্রেসকে উড়িয়ে দিয়ে জিততে পারলে ব্যাপারটা পুরোপুরি দক্ষিণপন্থা বনাম দক্ষিণপন্থা হয়ে দাঁড়াবে। কেবল মমতা ব্যানার্জি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, নবীন পট্টনায়করাই যদি বিরোধী দল হিসেবে টিঁকে থাকেন তা হলে বনাম শব্দটারও আর প্রয়োজন থাকবে কি না, সন্দেহ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যেমন শাসক-বিরোধী সংঘাত বলে কিছু হয় না। যা হয় সব বিধানসভার বাইরে টিভি ক্যামেরার সামনে। সুতরাং গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ভারতকে বাঁচাতে হলে ভারতের আরএসএসবিরোধী শক্তিগুলোর হাতে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। বামপন্থীদের সামনেও নেই। নেহরুর নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে অকারণে বরখাস্ত করা, ইন্দিরার জরুরি অবস্থা, মনমোহনের অপারেশন গ্রিন হান্ট ইত্যাদি কারণে কংগ্রেস সম্পর্কে যত বিতৃষ্ণাই থাক, রাজনীতিতে আশু বিপদের চেয়ে বড় কোনও বিপদ নেই, কোনওদিন ছিল না। সে কারণেই ইন্দিরা যখন দেশের গণতন্ত্রের জন্য মূর্তিমান বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন তখন জ্যোতি বসুর মতো প্রবাদপ্রতিম বাম নেতারা সংঘ-ঘেঁষা শক্তির উপস্থিতি সত্ত্বেও জয়প্রকাশ নারায়ণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
রাহুল আরও একটা জায়গায় দেশের অন্য সব বিরোধী নেতার চেয়ে এগিয়ে আছেন, তা হল সরাসরি সংঘ-বিরোধিতা। অন্য সব দলের নেতাদেরই বিজেপির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। একমাত্র রাহুলই বারবার বলেন, লড়াইটা আরএসএসের বিরুদ্ধে। দেশের মাটিতে জনসভায় বলেন, সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন। আবার কেমব্রিজে বক্তৃতা দিতে গিয়েও বলেন। এ দেশের কমিউনিস্টদের চিরকালীন বদভ্যাস, তাঁরা অর্থনৈতিক বিভাজন ছাড়া আর কোনও বিভাজন স্বীকারই করতে চান না। গত শতকের তিনের দশকে এই কারণেই গিরনি কামগর ইউনিয়নের ধর্মঘটে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের নেতৃত্বাধীন শ্রমিকদের সঙ্গে বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকরের নেতৃত্বাধীন দলিত শ্রমিকদের ঐক্য হয়নি। একশো বছর হতে চলল, কমিউনিস্টরা নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাই রামমন্দির, হিজাব পরার জন্য মেয়েদের শিক্ষায়তনে ঢুকতে না-দেওয়া কিংবা গোমাংস ভক্ষণ বা পাচারের অভিযোগে মুসলমান হত্যার মতো ঘটনাগুলোকে বামপন্থীরা বলেন— আসল ইস্যু থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আসল ইস্যুগুলো কী? না বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। তাঁরা কিছুতেই মানবেন না, আরএসএস-বিজেপি মন্দির-মসজিদ, শিবাজি-মোগল ইত্যাদিকেই বৃহদংশের মানুষের কাছে আসল ইস্যু বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে। সে কারণেই উত্তরভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম সংসদ আয়োজিত হয়, যেখানে প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়। প্রশাসন যে কিছুই করে না সে তো প্রত্যাশিত, কিন্তু আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষই যে এইসব সংসদে যান তা সম্ভবই হত না তাঁদের কাছে বামপন্থীরা যেগুলোকে আসল ইস্যু বলেন সেগুলো নকল ইস্যু হয়ে না-গিয়ে থাকলে।
রাহুল কিন্তু এই কথাটা বোঝেন। তিনি জানেন, আসলে লড়াইটা সাংস্কৃতিক। সংঘ মানুষের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলেছে। ভারত জোড়ো যাত্রায় তিনি যে বারবার বলছিলেন “নফরত কে বাজার মে মহব্বত কা দুকান খোলনে আয়া হুঁ” (ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে এসেছি) তা স্রেফ কাব্যি নয়, সচেতন রাজনৈতিক স্লোগান। এই সময়ের প্রয়োজনীয় স্লোগান। সম্প্রতি এক আলোচনাসভায় নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবাস করে আসা লেখক মনীশ আজাদের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। শ্রোতাদের একজন প্রশ্ন করলেন, হাথরসের সেই ভয়ঙ্কর ধর্ষণ ও খুনের পরেও সেখানকার নির্বাচনে বিজেপি কেন জেতে? লখিমপুর খেড়িতে বিজেপি নেতার ছেলে গাড়ির চাকার তলায় কৃষকদের পিষে দেওয়ার পরেও সেখানে বিজেপি কী করে জেতে? মনীশ বললেন, ৪০-৫০ বছরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংঘ মানুষের মধ্যে এই ভাবনা প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, আসল ইস্যু হল ধর্ম, বর্ণ, জাতি— এইসব। অন্যান্য ইস্যুতে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারো, রেগেও যেতে পারো। কিন্তু ভোট দেওয়ার সময়ে সেসব ভুলে ধর্মের ভিত্তিতে দেবে। উদাহরণ দিয়ে বললেন, জিএসটি নিয়ে ক্ষুব্ধ গুজরাতের ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন প্রবল আন্দোলন করার পরেই একটা শহরের রাজপথের ফেস্টুন ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, “হম নারাজ হ্যাঁয়, গদ্দার নহি” (আমরা বিরক্ত, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নই)। তারপর গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যথারীতি জেতে। সুতরাং বিজেপিকে হারাতে হলে এই মানসিকতাকে হারাতে হবে। অর্থনৈতিক অভাব অনটনই আসল ইস্যু, বাকি সবই নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা— এই বালখিল্য রাজনীতি ফল দেবে না। কারণ, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে, বাজারটা ঘৃণার। রাহুল তাই ভালবাসার দোকান খোলার কথা বলেছেন। দোকানে কতজন খদ্দের আসবে, সে তো পরের কথা। কিন্তু যত বেশি দোকান খোলা হবে বাজারের পরিবেশ যে তত বদলাবে, তাতে তো সন্দেহ নেই। সত্যিকারের বিজেপি-বিরোধীরা এ কথা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন তত ভাল। রাহুল মহাপুরুষ নন, সাধুসন্ত নন, বিপ্লবী তো ননই। তিনি একা কতটুকু পারবেন? তাঁর ক্ষয়িষ্ণু পার্টিই বা কতটা পারবে?
২০২৪ সালের নির্বাচন বস্তুত গণভোটে পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন একটাই— ভারত এক ধর্ম এক ভাষার দেশ হবে, নাকি নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ থাকবে। প্রথমটার মুখ নরেন্দ্র মোদী, দ্বিতীয়টার রাহুল গান্ধী। কার সঙ্গে কার কোথায় নির্বাচনী আসন সমঝোতা হবে না-হবে সেসব পরের কথা, পাটিগাণিতিক আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক প্রশ্ন ওই একটাই। এ কথা অস্বীকার করলে আত্মপ্রতারণা হবে।
এমন বাইনারি নিঃসন্দেহে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু আমাদের সামনে আশু বিপদটা যে একদলীয় শাসন।
আমাদের অনেকেরই সন্দেহ ছিল, আপনি ক্রমঅপসৃয়মান ভারতকে আদৌ খুঁজতে চান কিনা। ভারত জোড়ো যাত্রায় প্রমাণ হল, চান।
মাননীয় রাহুল গান্ধী,
মহাত্মা গান্ধীর শহিদ হওয়ার দিনে ভারত জোড়ো যাত্রার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে শ্রীনগরে আপনি যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে অন্তত একটি চমৎকার কাজ হয়েছে। যারা বলে ব্যক্তিগত জীবন আর রাজনীতিকে আলাদা আলাদা বাক্সে রাখা উচিত, রাজনৈতিক কারণে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি কাম্য নয়, তারা যে আসলে ব্যক্তিগত জীবনকে রাজনীতি কীভাবে প্রভাবিত করে তা বোঝে না অথবা কোনো উদ্দেশ্যে অন্যদের বুঝতে দিতে চায় না – তা আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক আলোচনা মানেই তা নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে – এই সংস্কার উদারপন্থী ও বাম রাজনীতিতে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৈর্ব্যক্তিক, অর্থাৎ আবেগশূন্য। অথচ আবেগ বাদ দিয়ে মানুষ হয় না, মানুষ যা যা করে তার প্রায় কোনোটাই আবেগ বাদ দিয়ে করে না। রাজনীতি তো নয়ই। কিন্তু রাজনীতি তো বটেই, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা – সবই আবেগশূন্য হওয়াই যে অভিপ্রেত তা আমাদের জনজীবনে বহুকাল হল প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সম্ভবত সেই কারণেই দক্ষিণপন্থীদের পক্ষে সহজ হয়েছে একেবারে উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে আবেগসর্বস্বতা দিয়ে মানুষের মাথা খেয়ে দেশটার সর্বনাশ করা। আমরা সরকারি অফিসে, হাসপাতালে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেগশূন্য ব্যবহার পাই, নেতাদের কাছ থেকে এবং আদালতে আবেগশূন্য ব্যবহার পাই। কারণ গোটা ব্যবস্থাটা অনবরত শিখিয়ে চলেছে, মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবা অন্যায়। তাকে দেখতে হবে নৈর্ব্যক্তিকভাবে। সকলকে ৪৭ফ বা ৬৯ঙ হিসাবে দেখাই নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার। যে যেখানে ক্ষমতার বিন্যাসে উপরে থাকবে, সে ন্যায় করলেও মায়াদয়াহীনভাবেই করবে – এই আমাদের আজন্মলালিত সংস্কার। উল্টোদিকের মানুষটির সাথে মানুষ হিসাবে নয়, তার প্রাসঙ্গিক তকমার হিসাবে ব্যবহার করাই যেন ন্যায়। এভাবে চললে যা হওয়ার কথা আমাদের দেশে ঠিক তাই হয়েছে। ন্যায় আর হয় না, অধিকাংশ সময় অন্যায়ই হয় সাধারণ মানুষের প্রতি। তাই বোধহয় দক্ষিণপন্থীরা কাজের কথা বাদ দিয়ে কারোর হিন্দু আবেগ, কারোর অসমিয়া আবেগ, কারোর বাঙালি আবেগ, কারোর দলিত আবেগ, কারোর আদিবাসী আবেগে সুড়সুড়ি দিলে ভুল করে মনে হয় “এই তো আমাকে আমি হিসাবে দেখছে।” অতএব সমস্ত মনপ্রাণ তারই দিকে ধাবিত হয়। আপনার শ্রীনগরের বক্তৃতা শুনে মনে হল, আপনি এই কথাটা ধরে ফেলেছেন।
দুই দশকের সাংবাদিক জীবন বাদ দিন, প্রায় সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক বক্তৃতা শোনার জীবনে মনে করতে পারছি না আর কোনো ভারতীয় রাজনীতিবিদকে কোনো জনসভার প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আলাদা করে অথচ একত্রে কথা বলতে দেখেছি। কাশ্মীরের মানুষ এবং সেখানে মোতায়েন আধাসামরিক বাহিনী ও সেনাবাহিনীর জওয়ানদের যে এক পংক্তিতে দাঁড় করানো সম্ভব, একই বাক্যে তাঁদের সকলের যন্ত্রণা ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব তা নরেন্দ্র মোদীর ভারতে কেন, রাজীব গান্ধীর ভারতেও আমরা কোনোদিন কল্পনা করতে পারিনি। কারণ সৈনিক বা সাধারণ কাশ্মীরি – এই গোষ্ঠীনামের পিছনের ব্যক্তিগুলির বেদনা বা আনন্দ নিয়ে ভাবার কথা রাজনীতিবিদ দূরে থাক, আমাদেরও মনে আসেনি। আপনি ফোনে নিজের ঠাকুমা এবং বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার স্মৃতি উল্লেখ করে বললেন, এ যন্ত্রণা মোদী-অমিত শাহ বুঝবেন না। কাশ্মীরের মানুষ বুঝবেন; সিআরপিএফ, বিএসএফ, সেনাবাহিনীর জওয়ানদের আত্মীয়রা বুঝবেন। কারণ তাঁরা এরকম ফোন কল পেয়ে থাকেন। ভারত জোড়ো যাত্রার উদ্দেশ্য এই ফোন কলগুলো আসা বন্ধ করা।
এভাবে বড়জোর শিল্পী, সাহিত্যিকদের কেউ কেউ ভাবতে পেরেছেন। কথাগুলো শুনেই মনে পড়ে গেল আজাজ খান নির্দেশিত হামিদ ছায়াছবিটির কথা। একমাত্র সেখানেই দেখেছিলাম ভারতীয় সেনার হাতে গুম হয়ে যাওয়া বাবার সন্ধানে থাকা আট বছরের ছেলে আর জন্মের পর থেকে সন্তানের মুখ না দেখা জওয়ানের যন্ত্রণাকে পাশাপাশি রাখা হয়েছিল। মোদী-শাহের নিষ্ঠুর পরিহাসে ২০১৯ সালে ওই ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করা তালহা আর্শাদ রেশিকে নির্দেশক বেশ কিছুদিন জানাতেই পারেননি যে সে দেশের সেরা শিশুশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছে। কারণ তখন গোটা কাশ্মীরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে রেখেছিল ভারত সরকার, যা কাশ্মীরের মানুষেরও সরকার।
এই সংকট তো কেবল কাশ্মীরের মানুষের নয়। দেশের যেখানেই রাষ্ট্র অতিমাত্রায় শক্তিধর হয়ে উঠেছে, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সংঘাত রাষ্ট্রের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে, সেখানেই এই সংকট স্বাধীনতার পর থেকে বারবার ঘটেছে, আজও ঘটে চলেছে। ঠিক যেমন রাষ্ট্রের হাতে ধর্ষিত হওয়া অথবা ধর্ষিত হয়ে রাষ্ট্রশক্তির কাছ থেকে নৈর্ব্যক্তিক (একজন ধর্ষিতার পক্ষে যা অমানবিকের নামান্তর) ব্যবহার পাওয়া এ দেশের মেয়েদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ কোনো নেতাকে কখনো জনসভায় বলতে শুনিনি – “আপনারা হয়ত দেখেছেন আমি যখন হাঁটছিলাম, বেশকিছু মহিলা কাঁদছিলেন। জানেন ওঁরা কেন কাঁদছিলেন? কয়েকজন আমার সাথে দেখা করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে কাঁদছিলেন ঠিকই, কিন্তু এমন অনেকেও ছিলেন যাঁরা কাঁদছিলেন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে। কেউ কেউ বলছিলেন ওঁদের যৌন হয়রানি হয়েছে, কয়েকজনের আত্মীয়ই কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। শুনে আমি যখন বলতাম, আমি পুলিসকে বলি তাহলে? ওঁরা বলতেন, রাহুলজি, পুলিসকে বলবেন না। আমরা আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পুলিসকে বলবেন না। বললে আমাদের আরও ক্ষতি হবে। এই হল আমাদের দেশের বাস্তব।”
এ দেশ কত মহান তা নিয়ে কেবল সংঘ পরিবার তো নয়, আমাদের সকলেরই গর্বের শেষ নেই। সেই গর্বের আখ্যানে এই বাস্তব খাপ খায় না বলে আমরা এড়িয়ে যাই, রাজনৈতিক নেতারা তো এড়িয়ে যান বটেই। যে দলের যেখানে সরকার আছে সেখানে সে দলের নেতারা আরও বেশি করে এড়িয়ে যান, কারণ তাঁরা মনে মনে একে সমস্যা বলে জানলেও স্রেফ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলেই ভাবেন। ফলে এসব কথা তুললে নিজের দলের সরকারের ঘাড়ে দোষ এসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন। তার উপর পুলিসকে বললে সমস্যা বাড়বে – এ তো সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী কথা। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলও তো রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গ। ব্যবস্থার মধ্যে থেকে তার বিরুদ্ধে কথা বলা চলে কখনো? অথচ আপনি বললেন। এখনো ভারতের বেশ বড় বড় তিনটে রাজ্যে আপনার দলের সরকার, অর্থাৎ সেখানকার পুলিস আপনার দলেরই হাতে। তার উপর আপনি, আপনার মা এবং বোন সারাক্ষণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকেন। তবু যে আপনি এসব কথা বললেন, এ কথা চট করে ভোলা যাবে না। যেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললেন, সেখান থেকে কুনান পোশপোরা ঠিক কত কিলোমিটার দূরে তা জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, আপনার কথাগুলো কেবল ওই কাণ্ডের ধর্ষিতাদের নয়, স্পর্শ করবে মণিপুরের সেই মহিলাদেরও, যাঁরা ২০০৪ সালে একদা উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন ইম্ফলের রাস্তায়, সঙ্গে ছিল ফেস্টুন। তাতে লাল অক্ষরে লেখা ছিল – INDIAN ARMY RAPE US। কথাগুলো নিশ্চয়ই ছুঁয়ে ফেলবে ছত্তিসগড়ের সোনি সোরিকে, বেঁচে থাকলে ছুঁয়ে ফেলত অর্চনা গুহকেও। সংবাদমাধ্যম যাকে নির্ভয়া নাম দিয়েছিল সেই মেয়েটিকে তো বটেই। এইসব কুকীর্তির সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল আপনার দলই। তবু আপনি এসব কথা বলেছেন বলে, বা সেইজন্যেই আরও বেশি করে আপনি ধন্যবাদার্হ, রাহুল। মানহারা মানবীর দ্বারে এসে দাঁড়ানোর সাহস খুব কম পুরুষের হয়। তাকে মানবী হওয়ার সম্মানটুকু দেওয়ার ক্ষমতাও অনেক শাসকেরই হয় না, নিজে মহিলা হলেও। আমি যে রাজ্যের বাসিন্দা সে রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীই তো ধর্ষণ হলেই হয় ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, নয় প্রতিবাদী মহিলাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে যান, নতুবা ছেলেটি ও মেয়েটির মধ্যে প্রেম ছিল কিনা তার খোঁজ করেন। ভারতের রাজনীতিবিদদের থেকে এমন ব্যবহার পেয়েই ভারতীয় মেয়েরা অভ্যস্ত।
আপনার বক্তৃতায় আপনি আরও অনেক কথা বলেছেন যেগুলো ভাল কথা, প্রয়োজনীয় কথা, বহুবার বলা কথা। তবু আবার বলা প্রয়োজন, কারণ কেউ বলছে না। যেমন আপনি ‘গঙ্গা-যমুনী তহজীব’-এর কথা, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সভ্যতার কথা বলেছেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত আপনার যাত্রার তুলনায় এনেছেন কাশ্মীর থেকে এলাহাবাদে নেহরু পরিবারের যাত্রার প্রসঙ্গ। সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কেমন একই সূত্রে গাঁথা তা দেখাতে ব্যক্তিগত ইতিহাসের এই ব্যবহার যে একজন পাকা বক্তার লক্ষণ। কিন্তু যা আপনার গোটা বক্তৃতায় সারাক্ষণ ছেয়ে থেকেছে তা হল সংবেদনশীলতা। আরও সহজ করে বললে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তের মানুষকে ছোঁয়ার ইচ্ছা। আপনি যেমন ধর্ষিত মহিলাদের কথা বলেছেন, তেমনই বলেছেন দুটি হতদরিদ্র ছেলের কথা, যাদের গায়ে জামা পর্যন্ত ছিল না, দেহ ছিল ধূলিমলিন। বলেছেন তাদের দেখেই মনে হয়েছিল উত্তর ভারতের শীতেও শুধু টি-শার্ট পরেই কাটিয়ে দেবেন। সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে কথাগুলো বানানো মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আপনার বক্তৃতার দিনেই নাগরিক ডট নেটে মনীষা ব্যানার্জি লিখেছেন “কথিত আছে চম্পারণে কস্তুরবা দেখেছিলেন, একটি ঝুপড়িতে দুই মহিলার মাত্র একটি কাপড়। একসঙ্গে দুজনে বাইরে বেরোতে পারেন না। এই কাহিনি গান্ধীকে কটিবস্ত্র ধারণে বাধ্য করে…”। ফলে সন্দেহ করা অমূলক নয়, যে এই কাহিনি আপনার জানা এবং আসলে তা থেকেই টি-শার্ট পরার সিদ্ধান্ত। যদি তাও হয়, তবু আজকের ভারতে একজন রাজনীতিবিদ সচেতনভাবে গান্ধীকে অনুকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং গান্ধীর এমন একটি কাজ অনুকরণ করছেন যা করতে গেলে নিজেকে শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে হয় – এ বড় কম কথা নয়। আমরা তো শুনে এসেছি আপনি ‘শাহজাদা’। আপনি নিজেও এই ভাষণে বলেছেন আজন্ম কোনো না কোনো সরকারি বাড়িতে থেকেছেন। শুধু সমালোচকের চোখ দিয়ে দেখলেও সেই লোকের এই ভূমিকার প্রশংসা না করে উপায় নেই। ঘৃণার ব্যাপারীদের কথা অবশ্য আলাদা।
ধূলিমলিন ছেলেদুটির কথা বলতে গিয়ে আপনি ফের তুলে এনেছেন আমাদের পালিশ করা ভারতবর্ষের কদাকার দিকটি। আপনারই এক সঙ্গী যে আপনাকে বলেছিলেন ওদের সাথে গলাগলি করা উচিত হয়নি, ওরা নোংরা – সেকথা বলে দিয়েছেন সর্বসমক্ষে। জানিয়েছেন, আপনার উত্তর ছিল “ওরা আমার এবং আপনার থেকে পরিষ্কার।” আবার বলি, একথা বানানো হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু বানানো হলেও দোষের নয়। প্রথমত, একজন নেতা জনসভায় না ভেবেচিন্তে যা খুশি বলবেনই বা কেন? দ্বিতীয়ত, অস্পৃশ্যতা আজও আমাদের দেশে ইতিহাস হয়ে যায়নি। যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁদের একথা যেভাবে ছোঁবে, আমার মত উচ্চবর্গীয় সাংবাদিককে সেভাবে স্পর্শ করবে না বলাই বাহুল্য। কয়েক হাজার বছর ধরে কোণঠাসা হয়ে থাকা সেইসব মানুষ ভারত জুড়ে গত আট বছরে আরও কোণঠাসা হয়েছেন, যতই একজন দলিতের পর একজন আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হয়ে থাকুন। যেসব গালাগালি স্বাধীন ভারতে অন্তত তাঁরা পিছন ফিরলে ছুঁড়ে দেওয়া হত, আজকাল প্রকাশ্যেই দেওয়া হয়। তাঁরা জানলেন, নিদেনপক্ষে একজন নেতা আছেন ভারতীয় রাজনীতিতে, যিনি ওই ভাবনার, ওই ব্যবহারের বিরুদ্ধে।
আজকের ভারত যেমন হয়েছে, তাতে সারাক্ষণ কথাবার্তা চলে নাগরিকত্ব নিয়ে। অনেকদিন পরে কাউকে ভারতীয়ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে শুনলাম। ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য” কথাটাকে আজ বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেই ঐক্য কীভাবে ভারতের সর্বত্র বিচিত্র ভাষায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চিন্তায় ধরা পড়েছে আপনি সেকথা বলেছেন। গুজরাটের গান্ধী, আসামের শঙ্করদেব, কর্ণাটকের বাসবেশ্বর বা বাসবান্না, কেরালার নারায়ণ গুরু, মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে – এঁদের সকলকেই আপনি ভারতীয়ত্বের নির্মাতা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটা শুনতে না পেয়ে রাগ করব ভাবছিলাম। কারণ এমনকি জওহরলাল নেহরুও তাঁর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া গ্রন্থে ভারতীয়ত্বের নির্মাণে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ বলে মতপ্রকাশ করেছেন, গান্ধীর সঙ্গে তাঁকে একাসনে বসিয়েছেন (“Tagore and Gandhi have undoubtedly been the two outstanding and dominating figures of India in the first half of the twentieth century… Tagore and Gandhi bring us to our present age.”)। সেই রবীন্দ্রনাথের নাম করলেন না দেখে সত্যিই রাগ করতে যাচ্ছিলাম। তারপর খেয়াল হল, রবীন্দ্রনাথের নাম তো বহু নেতার মুখে শুনেছি। এমনকি মোদীও শালগ্রাম শিলার মত করে তাঁর নাম নিয়ে নেন, অসহ্য উচ্চারণে তাঁর কবিতার পংক্তি আউড়ে বাঙালিদের মোহিত করার চেষ্টা করেন ভোটের মুখে। কিন্তু নারায়ণ গুরু আর ফুলের মত দুজন বর্ণবাদবিরোধী মানুষের নাম ভারতের কোনো উচ্চবর্গীয় শীর্ষস্থানীয় নেতার মুখে কোনোদিন শুনেছি কি? এমনকি আপনার পূর্বপুরুষ নেহরুর উপর্যুক্ত বইটিতেও বর্ণাশ্রম শুরুতে ভাল উদ্দেশ্যেই চালু করা হয়েছিল, পরে মন্দ হয়ে যায় – এই জাতীয় মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। গান্ধীও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ছিলেন, বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে নয়।
উপরন্তু আমরা যারা বিন্ধ্য পর্বতের এপাশে বাস করি এবং তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালির তফাত করতে পারি না; ওদিককার লোক হলেই দক্ষিণ ভারতীয় বলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই, তাদের অনেকের কাছে তো নামদুটোই নতুন। সে নাম আপনি করলেন ভারতের একেবারে উত্তর প্রান্তে দাঁড়িয়ে। এমনটি না করলে “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে” স্বপ্ন সত্যি হবে কী করে? স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আদানপ্রদান তো ঘটেনি, তাই তো সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে মঙ্গলঘট ভরা হয়নি। আপনি কি পারবেন সেই ঘট ভরতে?
সে বড় কঠিন কাজ, সম্ভবত অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ। আজকের ভারতে যখন সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে, তখন এ কাজ আরও শক্ত। সত্যি কথা বলতে কি, আপনি সে কাজের যোগ্য লোক কিনা তার পরীক্ষা আপনি ক্ষমতায় না পৌঁছলে শুরুই হবে না। আপনি যতই বলুন, ভারত জোড়ো যাত্রা কংগ্রেসের জন্য করেননি, কংগ্রেসকে বাদ দিয়েও আপনি যা করতে চান তা করতে পারবেন না। আর সেই দলে আজও গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে আছেন কমলনাথের মত লোক, যিনি এই সেদিন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণে কৃতিত্বের ভাগীদার হতে চেয়েছেন। যোগ করেছেন, আসল কৃতিত্ব আপনার বাবা রাজীব গান্ধীর, কারণ ১৯৮৫ সালে তিনিই বাবরির তালা খুলিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও আছেন শশী থারুর, যিনি কে জানে কোন অধিকারে কদিন আগে ঘোষণা করে দিলেন, ভারতের মুসলমানরা পর্যন্ত আর গুজরাট ২০০২ নিয়ে ভাবতে চান না।
এঁদের নিয়ে কী করে ভারত জুড়বেন সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ভার আপনার। নেহরু যে গণতন্ত্রের কথা বলতেন সেই গণতন্ত্রের রীতি মেনে আপনার উপর সাগ্রহ কিন্তু সন্দিগ্ধ নজর রাখব আমরা, যারা এখনো প্রশ্ন তোলা এবং সমালোচনা করা সংবাদমাধ্যমের কাজ বলে মনে করি। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে ভারতের আজ এমন এক নেতা দরকার যাঁর ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি না হলেও বুকের ভিতরে কিছুটা পাথর আছে। যে কোনো ভারতবাসী ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাবে। আপনার শ্রীনগরের বক্তৃতা শোনার পর মনে না করে পারছি না, আপনি তেমনই একজন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতিকে উপযুক্ত স্থান দিতে হবে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকলে কেউ এগোতে পারে না। কেবল রাজনীতি নয়, সাংবাদিকতাতেও তার ঊর্ধ্বে উঠতে হয়, তবেই সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের হারিয়ে যাওয়া বা কখনো খুঁজে না পাওয়া ভারতের সন্ধানও সেভাবেই পাওয়া যাবে সম্ভবত। দূরদর্শনে যখন নেহরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া অবলম্বনে শ্যাম বেনেগালের ভারত এক খোঁজ ধারাবাহিক শুরু হয়, তখন আমার বয়স ছয়। আপনার বোধহয় ১৮। তখন না হলেও, এখন নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে সুপণ্ডিত নেহরু বইয়ের নামে দাবি করেছেন তিনি ভারতকে ‘আবিষ্কার’ করেছেন। অন্যদিকে বেনেগাল ওই বইয়ের মধ্যে দিয়ে ভারত দেশটাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। এতদিন আমাদের অনেকেরই সন্দেহ ছিল, আপনি ক্রমঅপসৃয়মান ভারতকে আদৌ খুঁজতে চান কিনা। ভারত জোড়ো যাত্রায় প্রমাণ হল, চান। আশা করি এ খোঁজ শ্রীনগরে শেষ হয়নি, শুরু হল।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেবল গুণী মানুষ নন, তাঁর প্রতিভা বহুমুখী। তিনি সাহিত্য রচনা করেন, ছবি আঁকেন, গান লেখেন। তার উপর রাজ্যের প্রশাসন চালাতে হয়। একজন মানুষকে এত কাজ করতে হলে কাগজ পড়ার সময়ের অভাব ঘটা খুবই স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই প্রতিদিন কাগজ পড়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী পান না। পেলে চোখে পড়ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ কাগজের একটা খবর, যার শিরোনাম ‘RSS yet to clear air on bombing claim affidavit’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের মিডিয়া বিভাগের প্রধান পবন খেরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) এক প্রাক্তন প্রচারকের মহারাষ্ট্রের নানদেড় জেলা ও সেশনস আদালতে জমা দেওয়া হলফনামা প্রকাশ্যে এনেছেন। সেই হলফনামায় যশবন্ত শিন্ডে নামক ওই লোকটি দাবি করেছে, সংঘ পরিবারের সদস্য সংগঠনগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সংবাদমাধ্যমের একাংশ এবং পুলিস প্রশাসনের সহযোগিতায় তার দোষ মুসলমান সম্প্রদায়ের ঘাড়ে চাপিয়েছে। ফলে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি লাভবান হয়েছে।
খবরটা মুখ্যমন্ত্রীর চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকতেই পারে, কারণ এ নিয়ে কোনো চ্যানেলে কোনো বিতর্কসভা বসেনি। কলকাতার অন্যান্য তথাকথিত উদার খবরের কাগজগুলোতেও আতসকাচ দিয়ে খুঁজে দেখতে হবে এই খবর। তাছাড়া কংগ্রেস তো বানিয়েও বলতে পারে। কারণ তারা তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপির প্রধান বিরোধী হয়ে উঠতে দিতে চায় না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর শক্তিশালী সোশাল মিডিয়া টিম আছে। টুইটারে তাঁর সাত মিলিয়ন ফলোয়ার, ফেসবুকে ৪.৯ মিলিয়ন। সেই সোশাল মিডিয়া টিমের সাহায্য নিলেই মুখ্যমন্ত্রী জানতে পারবেন যে ওই মর্মে হলফনামা সত্যিই ফাইল করা হয়েছে। চাইলে স্বয়ং যশবন্তের মুখ থেকেই হলফনামায় লিখিত অভিযোগগুলো সংক্ষেপে শুনে নিতেও পারবেন। মারাঠি যশবন্তের ভিডিও ইংরেজি সাবটাইটেল সমেত সোশাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
যশবন্তের হলফনামার কথা প্রকাশ্যে এল বৃহস্পতিবার, কলকাতার কাগজের প্রথম পাতায় সে খবর বেরোল শুক্রবার সকালে। সেদিনই সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বললেন “আরএসএস এত খারাপ ছিল না, এবং এত খারাপ বলে আমি বিশ্বাস করি না।” মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই খবরটা জানতে পারেননি বলেই ওরকম বলেছেন। স্বীকার্য যে যশবন্তের কথাগুলো অভিযোগ মাত্র। কিন্তু যে সংগঠনের একদা প্রচারকরা এই মুহূর্তে দেশের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বহু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী – তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ যে মারাত্মক, সে কথা না বোঝার মত রাজনীতিবিদ মমতা ব্যানার্জি নন। তাছাড়া তিনদিন হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত আরএসএস যশবন্তকে মিথ্যাবাদী বলে কোনো বিবৃতি দেয়নি। অবশ্য জবাবদিহি না চাইলে বিবৃতি দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ২০০৬ সালের নানদেড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে সরকারি সাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হতে চেয়ে আবেদন করেছিল যশবন্ত। আদালত সবেমাত্র সেই আবেদন গ্রহণ করেছে, আরএসএসকে জবাবদিহি করতে তো ডাকেনি। সাংবাদিকদেরই বা ঘাড়ে কটা মাথা, যে এ নিয়ে মোহন ভাগবতকে প্রশ্ন করবে? অতএব আরএসএসের বয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা বলে ঘোষণা করতে। কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। মুখ্যমন্ত্রী তো বিশ্বাসই করেন না আরএসএস খারাপ। ফলে যতক্ষণ তারা নিজেরা না বলছে “হ্যাঁ, আমরা খারাপ”, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চিন্ত। কিন্তু খটকা অন্যত্র।
“এত খারাপ ছিল না”। এত খারাপ মানে কত খারাপ? তার মানে মুখ্যমন্ত্রী জানেন যে আরএসএস একটু একটু খারাপ? সেই পরিমাণটা কি তাঁর পক্ষে সুবিধাজনক? খারাপ ছিল না মানেই বা কী? আগে যতটুকু খারাপ ছিল তাতে তাঁর আপত্তি ছিল না, এখন বেশি খারাপ হয়ে গেছে – এ কথাই কি বলতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী? তাঁর কাছে কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ তা অবশ্য আমাদের জানা নেই। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা কি খারাপ? সে হত্যায় আরএসএস যোগ প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ হয়নি বটে, তবে সেই ঘটনার পরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেছিলেন, আরএসএস নেতাদের ভাষণগুলো যে বিষ ছড়িয়েছে তারই পরিণতি গান্ধীহত্যা। তাই ভারত সরকার আরএসএসকে নিষিদ্ধ করে। কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন? সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। জওহরলাল নেহরুর বদলে যিনি প্রধানমন্ত্রী হলে ভারত সোনার দেশ হত বলে আরএসএস এখন দিনরাত ঘোষণা করে। মুখ্যমন্ত্রী নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই ধরে নিচ্ছি অতকাল আগের ব্যাপার তাঁর মনে নেই। তাই তার ভালমন্দ ভেবে দেখেননি। তবে যেহেতু তিনি একজন সাংবিধানিক পদাধিকারী এবং নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করেন, সেহেতু ধরে নিতে দোষ নেই যে যশবন্ত শিন্ডে তার হলফনামায় যে ধরনের কার্যকলাপের কথা লিখেছে সেগুলো আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর চোখে খারাপই। কারণ কাজগুলো বেআইনি এবং সাম্প্রদায়িক।
এখন কথা হল, যশবন্ত যে অভিযোগ করেছে আরএসএসের বিরুদ্ধে, সে অভিযোগও কিন্তু এই প্রথম উঠল তা নয়। মুখ্যমন্ত্রী কাগজ পড়ারই সময় পান না যখন, বই পড়ার সুযোগ না পাওয়ারই কথা। তবে তাঁর তো পড়ুয়া পারিষদের অভাব নেই। তাঁরা কেউ কেউ নির্ঘাত মহারাষ্ট্র পুলিসের প্রাক্তন ইন্সপেক্টর জেনারেল এস এম মুশরিফের লেখাপত্র পড়েছেন। তাঁর লেখা আরএসএস: দেশ কা সবসে বড়া আতঙ্কবাদী সংগঠনবইতে ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মোট ১৮টা বোমা বিস্ফোরণে আরএসএস, অভিনব ভারত, জয় বন্দেমাতরম, বজরং দল এবং সনাতন সংস্থা – এই পাঁচটা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে দায়ী করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পার্ষদরা কেন যে এসব কথা তাঁকে জানাননি! জানলে নিশ্চয়ই আরএসএস খারাপ “ছিল না” – একথা মুখ্যমন্ত্রী অতটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলতেন না। অবশ্য মুশরিফ যা লিখেছেন তার সমস্তই তো স্রেফ অভিযোগ। মালেগাঁও বিস্ফোরণের প্রধান অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞা যেভাবে ছাড়া পেয়ে সাংসদ হয়ে গেছেন, তাতে ওসব অভিযোগকে আর আমল দেওয়া চলে কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে আরএসএসের উপর অত্যন্ত জোরালো বিশ্বাস না থাকলে এসব জেনে সংঘ পরিবারের সদস্য নয় এমন এক রাজনৈতিক দলের সর্বময় নেত্রীর কিছুটা সন্দিহান হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিজের বিশ্বাসে অটল।
রাজনীতিতে দুজন ব্যক্তি, দুটো সংগঠন বা একজন ব্যক্তির সঙ্গে একটা সংগঠনের সম্পর্ক চোখ বন্ধ করে ভরসা করার মত পর্যায়ে পৌঁছনো চাট্টিখানি কথা নয়। বিপদের সময়ে পাশে দাঁড়ানোর ইতিহাস না থাকলে তেমনটা হওয়া শক্ত। সেদিক থেকে মমতার আরএসএসের প্রতি এই বিশ্বাস বুঝতে অসুবিধা হয় না। আজকের মুখ্যমন্ত্রী গত শতকের শেষ দশকে যখন ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন এককালের স্বয়ংসেবক অটলবিহারী বাজপেয়ী আর লালকৃষ্ণ আদবানির স্নেহ না পেলে মমতার পক্ষে আস্ত একখানা রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা সম্ভব হত কি? হলেও সদ্যোজাত দলটাই মধ্যগগনে থাকা সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বিরোধী হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে – এ বিশ্বাস কংগ্রেসের ভোটার তথা কর্মীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা যেত কি? মাত্র আটজন সাংসদ যে দলের, সেই দলের নেত্রীকে রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের প্রভাবিত করার মহার্ঘ সুযোগ দিয়েছিল বিজেপি। শুধু কি তাই? তেহেলকা কাণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পরেই সততার প্রতীক মমতা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এনডিএ ত্যাগ করেন। তা সত্ত্বেও ২০০৩ সালে তাঁকে দপ্তরহীন মন্ত্রী করে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। আরএসএস আর বিজেপি আলাদা – এই তত্ত্বে এখনো বিশ্বাস করেন যাঁরা, তাঁদের কথা আলাদা। বাকিরা নিশ্চয়ই মানবেন, এভাবে পাশে থাকার পরেও যদি মমতা আরএসএসকে বিশ্বাস না করতেন তাহলে ভারি অন্যায় হত।
আসলে মমতার আরএসএসে বিশ্বাস ততটা অসুবিধাজনক নয়। তাঁর বারংবার আরএসএস প্রীতি ঘোষণা সত্ত্বেও দেশসুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কেষ্টবিষ্টুদের মমতায় বিশ্বাস বরং বৃহত্তর বিপদের কারণ। গত বছর বিধানসভা নির্বাচনে যখন বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকানোই মূল এজেন্ডা হয়ে দাঁড়াল, তখন বামপন্থীদের মধ্যে লেগে গেল প্রবল ঝগড়া। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম দলগুলো বলতে শুরু করল বিজেপি আর তৃণমূল অভিন্ন, তাই তৃণমূলকে ভোট দেওয়া আর বিজেপিকে ভোট দেওয়া একই কথা। উঠে এল একটা নতুন শব্দ – বিজেমূল। অন্যদিকে নকশালপন্থীরা বলতে লাগল, যেখানে যে প্রার্থী বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী তাকে ভোট দিতে। বিজেমূল তত্ত্বের প্রমাণ হিসাবে সিপিএম “দলে থেকে কাজ করতে পারছি না” বলে লাইন দিয়ে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে চলে যাওয়া শীর্ষস্থানীয় নেতা, মন্ত্রীদের দেখাতে লাগল। আর যত না তৃণমূল, তার চেয়েও বেশি করে নকশালরা তার জবাবে তালিকা দিতে থাকল, কোন ব্লক স্তরের সিপিএম নেতা বিজেপিতে গেছে, কোন জেলা স্তরের নেত্রী বিজেপিতে যোগ দিলেন। অর্থাৎ দুপক্ষের কেউই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি কী, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে কেন আছে বা না থাকলে কেন নেই – সে আলোচনায় গেল না। অথচ ঠিক তখনই ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভে বসে লাইভ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন “আমি সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়ছি না। ওরা তো নির্বাচনে লড়ে না। ওরা বিজেপিকে সমর্থন করে। আমি লড়ছি বিজেপির সঙ্গে।” এই নেত্রীর দল জয়যুক্ত হল, একমাত্র বিরোধী দল হিসাবে উঠে এল বিজেপি। অর্থাৎ ঘোষিতভাবে আরএসএসের বন্ধু দুটো দলের হাতে চলে গেল বাংলার আইনসভা। অথচ পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিমানরা উল্লসিত হয়ে ঘোষণা করলেন, বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য জিতে গেল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ জিতে গেলেন, ইত্যাদি।
আরও মজার কথা, নির্বাচনে গোল্লা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিপিএমও পরিত্যাগ করল বিজেমূল তত্ত্ব। আরও এক ধাপ এগিয়ে এ বছর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেশের একমাত্র যে নেতা সর্বদা নাম করে আরএসএসকে আক্রমণ করেন, সেই রাহুল গান্ধীর দল কংগ্রেস থেকে শুরু করে সিপিএম, লিবারেশন সমেত সমস্ত বাম দল সমর্থন করে বসল মমতার পছন্দের প্রার্থীকে। সে আরেক যশবন্ত – বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছেন। এ থেকে যা প্রমাণিত হয় তা হল, মমতার মত আরএসএস-বান্ধব নয় যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো, তারাও ব্যাপারটাকে নির্বাচনী লড়াইয়ের বেশি কিছু ভাবে না।
আরএসএসের কাছে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলা মতাদর্শগত মরণপণ লড়াই। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে তারা সাংবিধানিক, অসাংবিধানিক – সবরকম পথই নিতে রাজি। প্রয়োজনে আদবানির মত আগুনে নেতাকে বঞ্চিত করে বাজপেয়ীর মত নরমপন্থীকে প্রধানমন্ত্রী করতে রাজি ছিল। জমি শক্ত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর মত কড়া হিন্দুত্ববাদীকে নেতা করেছে, ভবিষ্যতে তাঁকেও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে আরও গোঁড়া আদিত্যনাথকে সর্বোচ্চ নেতার আসনে বসাতে পারে। বিরোধীরা ওই বিস্তারে ভেবেই উঠতে পারেনি এখনো। এমনকি তথাকথিত কমিউনিস্ট দলগুলোও কেবল স্ট্র্যাটেজি সন্ধানে ব্যস্ত। কোথায় কাকে সমর্থন করলে বা কার সাথে নির্বাচনী জোট গড়লে বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকানো যাবে – এটুকুই তাদের চিন্তার গণ্ডি। সে কারণেই বিজেমূল শব্দটা নির্বাচনের আগে ভেসে ওঠে, পরাজয়ের পর মিলিয়ে যায়। যদি সিপিএমের পক্ষ থেকে সংঘমূল কথাটা বলা হত এবং শূন্য হয়ে যাওয়ার পরেও বলে যাওয়া হত, তাহলে জনমানসে সত্যি সত্যি প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হতে পারত। হিন্দুরাষ্ট্র কী, তা হওয়া আটকানো কেন দরকার, আটকানোর ক্ষেত্রে মমতাকে সত্যিই প্রয়োজন, নাকি তিনি হিন্দুত্বের ট্রোজান ঘোড়া – শতকরা ৮০-৯০ জন মানুষ এই মুহূর্তে এসব নিয়ে ভাবছেন না (সোশাল মিডিয়া দেখে যা-ই মনে হোক)। সংঘ পরিবারকে সরাসরি রাজনৈতিক ভাষণে, কর্মসূচিতে আক্রমণ করা হলে ভাবতে বাধ্য হতেন।
বিহারে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার সুযোগ আসা মাত্রই সমস্ত বাম দল একজোট হয়ে নীতীশকুমারকে সমর্থন করেছে। কেবল লিবারেশন নয়, সিপিএমও। সে জোটে কংগ্রেসও আছে। অথচ নীতীশও মমতার মতই বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছেন। শুধু তা-ই নয়, মমতার বিজেপির সাথে শেষ জোট ছিল ২০০৬ সালে। নীতীশ কিন্তু ২০১৬ বিধানসভা ভোটে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে লড়ে জিতেও বিশ্বাসঘাতকতা করে বিজেপির কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। কেন নীতীশ আরএসএস-বিরোধী বাম দল এবং কংগ্রেসের কাছে গ্রহণযোগ্য আর কেন মমতা নন, তা নিয়ে কোনো আলোচনাই শুনলাম না আমরা। আলোচনাটা হল না সম্ভবত এইজন্যে, যে বামেরা বা কংগ্রেস নিজেরাই ওসব নিয়ে ভাবে না। বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে পারলেই খুশি, শেষমেশ আরএসএসের প্রকল্পই সফল হয়ে যাবে কিনা তা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। অথবা ‘যখন হবে তখন দেখা যাবে’ নীতি নিয়ে চলছে।
আসলে কিন্তু মমতায় আর নীতীশে তফাত বড় কম নয়। নীতীশ সুযোগসন্ধানী, ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ। তারই অনিবার্য ফল হিসাবে ভূতপূর্ব জনতা দলের সঙ্গে, একদা সতীর্থ লালুপ্রসাদের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হয়েছিল। কিন্তু তাঁর রাজনীতির সূতিকাগার হল সমাজবাদী রাজনীতি, নিম্নবর্গীয় মানুষের রাজনীতি। সে কারণেই নীতীশ কখনো বিজেপিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি, বিজেপিও পারেনি। নীতীশ কখনো মমতার মত সোচ্চার আরএসএস বন্দনাও করেননি। কারণ আরএসএস হল ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিচালিত, হিন্দু সমাজের উপর ব্রাহ্মণ আধিপত্য বজায় রাখার জন্য গঠিত সংস্থা। নীতীশের দলের নিম্নবর্গীয় সদস্য, সমর্থকদের সঙ্গে আরএসএসের আড়চোখে দেখার সম্পর্কটুকুই হওয়া সম্ভব। তার বেশি নয়।
অন্যদিকে মমতা ব্রাহ্মণকন্যা। তাঁকে দুর্গা বলে সম্বোধন করতে আরএসএসের কোথাও বাধে না। মমতার রাজনীতির ইতিহাস অন্য দিক থেকেও নীতীশের সঙ্গে মেলে না। বস্তুত যুগপৎ কংগ্রেস বিরোধিতা এবং কমিউনিস্ট বিরোধিতার ইতিহাস সম্ভবত মমতা ছাড়া ভারতের কোনো আঞ্চলিক দলের নেই। তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় রাজনীতির ভিত্তিতে তৈরি দলগুলোর স্বভাবতই প্যাথোলজিকাল বাম বিরোধিতা নেই, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে কংগ্রেস বিরোধিতা ছিল। তেলুগু দেশম, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি, জগন্মোহন রেড্ডির দল বা ওড়িশার বিজু জনতা দলের জন্ম তৃণমূলের মতই কংগ্রেস ভেঙে। কিন্তু তাদেরও বামেদের সাথে ধুন্ধুমার সংঘাতের ইতিহাস নেই। তাদের এলাকায় বামেদের দুর্বলতা তার কারণ হতে পারে, কিন্তু এ কি নেহাত সমাপতন যে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর দিকে আরএসএস বাদ দিলে তৃণমূলই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি, কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেস, দু পক্ষই যাদের ঘোষিত শত্রু? লক্ষণীয়, ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল আর কংগ্রেসের জোট গড়তে দারুণ উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখা গেল, তিনি আরএসএসের বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন। সেই জোট বামফ্রন্টকে হারাতে পেরেছিল বটে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ভাঙনের গতিও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
তাহলে আরএসএসের সাথে সম্পর্ক মমতাকে কী কী দিয়েছে তা বোঝা গেল। এবার আরএসএস কী কী পেয়েছে সে আলোচনায় আসা যাক? রাজনীতিতে তো কেউ “আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি,/ তুমি অবসরমত বাসিয়ো” গায় না। আরএসএস যা যা পেয়েছে সবকটাই অমূল্য।
১) আরএসএসের দুই ঘোষিত শত্রু মুসলমান আর কমিউনিস্ট। তৃণমূলের উদ্যোগে কমিউনিস্টরা প্রথমে তাদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি থেকে ক্ষমতাচ্যুত, পরে ছত্রভঙ্গ হয়েছে। তার জন্যে আরএসএসের আগমার্কা কোম্পানি বিজেপিকে বিন্দুমাত্র কসরত করতে হয়নি। মুসলমানরা আগে প্রান্তিক ছিলেন, তৃণমূল আমলে বাংলার হিন্দুদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছেন। মমতা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ইমাম ভাতা চালু করলেন, বিজেপি প্রায় বিনা আয়াসেই হিন্দুদের বোঝাতে সক্ষম হল, মুসলমানরা মমতার দুধেল গাই। পরে মমতা নিজেই অনবধানবশত (নাকি সচেতনভাবেই?) সেকথা বললেনও। এখন পরিস্থিতি এমন, যে বাম আমলে মুসলমানরা বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া পেতেন না, এখন খোদ সল্টলেকে হোটেলের ঘর ভাড়া পান না।
২) মুসলমান তোষণ হচ্ছে – এই প্রোপাগান্ডা হিন্দুদের একটা বড় অংশের বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে তৃণমূল শাসনের ১১ বছরে। ইতিমধ্যে বেলাগাম হিন্দু তোষণ চলছে। বিজেপি আজগুবি অনলাইন প্রচার শুরু করল “পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো করতে দেওয়া হয় না”, তৃণমূল সরকার দুর্গাপুজোগুলোকে নগদ অনুদান দিতে শুরু করল। আরএসএস শুরু করল রামনবমীতে অস্ত্র মিছিল, তৃণমূল আরম্ভ করল বজরংবলী পুজো। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির পথ খুলে গেল, আরএসএসের প্রতিশ্রুতি পূরণ হল। এদিকে দিদি দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। রাজ্যে বিজেপির সরকার থাকলেও এভাবে হিন্দুত্বকে রাজনীতির এজেন্ডায় নিয়ে আসতে পারত কিনা সন্দেহ।
৩) ভারতের একেক রাজ্যের একেকটা বিশিষ্ট গুণ আছে, যা সেই রাজ্যের মানুষের মূলধন। গুজরাটের যেমন ব্যবসা, পাঞ্জাবের কৃষিকাজ। বাংলার ছিল লেখাপড়া, গানবাজনা, সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদি। অন্য রাজ্যের লোকেরা যাকে কটাক্ষ করে এককথায় বলে কালচার। এই কালচার আরএসএসের হিন্দুত্বের একেবারে বিপরীত মেরুর জিনিস। তৃণমূল আমলে সবচেয়ে নির্বিঘ্নে সাড়ে সর্বনাশ ঘটানো গেছে এই কালচারের। বাংলার ছেলেমেয়েরা ফড়ফড় করে ইংরেজি বলতে না পারলেও দেশে বিদেশে গবেষক, অধ্যাপক হিসাবে তাদের দাম ছিল। এখনো সর্বভারতীয় বিজ্ঞান পুরস্কারগুলোর প্রাপকদের তালিকা মাঝে মাঝে সেকথা জানান দেয়। সে দাম ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে স্কুল, কলেজের চাকরি বিক্রি করে লেখাপড়া লাটে তুলে দিয়ে। নায়ক, নায়িকা, গায়ক, গায়িকারা কাতারে কাতারে বিধায়ক আর সাংসদ হয়ে গেছেন। লেখকরা ব্যস্ত পুষ্পাঞ্জলি দিতে আর চরণামৃত পান করতে। সিনেমার কথা না বলাই ভাল। শৈল্পিক উৎকর্ষ বাদ দিন, পারিশ্রমিকের হাল এত খারাপ যে কলকাতার শিল্পীরা স্রেফ বাংলা ছবিতে, ওয়েব সিরিজে কাজ করে টিকে থাকতে পারবেন কিনা সন্দেহ। মন্ত্রীর বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়ার ছবি দেখে প্রথম সারির অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য হা-হুতাশ করছেন, ওই পরিমাণ টাকার অর্ধেক পেলেও বাংলা ছবিগুলো অনেক ভাল করে করা যেত।
কিন্তু এসব গোল্লায় যাওয়ার চেয়েও বড় ক্ষতি হয়েছে। লেখাপড়া, গানবাজনা, সাহিত্য, সিনেমা মিলিয়ে যে বাঙালি মনন ছিল সেটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আসল ক্ষতি সেটা। বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের অন্তত একটা ভান ছিল, যে সে ভারতের অন্য অনেক রাজ্যের লোকেদের মত ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না। দুর্গাপুজো এলে কদিন পাগলামি করে; নিজের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজো, সত্যনারায়ণের সিন্নি চলে। কিন্তু বাইরে সে একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। এখন সেসব গেছে। নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি হলে তার গায়ে খোদাই করা হচ্ছে গণেশের মুখ, শিবলিঙ্গ বা স্বস্তিকা। কলিং বেলে বেজে উঠছে “ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ”। অক্ষয় তৃতীয়ায় এখনো গণেশপুজো এবং হালখাতা হয় এমন দোকান খুঁজে পাওয়া দায়, অথচ গণেশ চতুর্থী এক দশকের মধ্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। শিগগির পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনন্ত ছুটির তালিকায় যোগ হবে নির্ঘাত। অল্পবয়সী বাঙালি কথা বলছে হিন্দি মিশিয়ে, ছোটরা স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শিখছে হিন্দি। বঙ্গভঙ্গের নাম করতেই লর্ড কার্জনের ঘুম কেড়ে নেওয়া বাঙালি নিজে নিজেই প্রায় উত্তর ভারতীয় হিন্দু হয়ে গেল তৃণমূল আমলে। এই সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ তামিলনাড়ুতে কিছুতেই হয়ে উঠছে না আরএসএসের দ্বারা। কেরালায় মার খেতে হচ্ছে, এমনকি নিজেদের হাতে থাকা কর্ণাটকেও করতে গিয়ে অনবরত সংঘাত হচ্ছে। বাংলায় কিন্তু ওসবের দরকারই হচ্ছে না। বিনা রক্তপাতে বাঙালি বাঙালিয়ানা বিসর্জন দিচ্ছে।
এর বেশি আর কী চাইতে পারত আরএসএস? মমতা হিন্দুরাষ্ট্রের জন্য রুক্ষ, পাথুরে বাংলার মাটিতে হাল চালিয়ে নরম তুলতুলে করে দিয়েছেন। বীজ বপনও সারা। ফসল তোলার কাজটা শুধু বাকি।
রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসে ডাঙ্গের দল থেকে যাওয়া কানহাইয়ার সাথে আম্বেদকরপন্থী জিগ্নেশেরও জায়গা হয়েছে। কানহাইয়া আবার প্রায় সব বক্তৃতাতেই আম্বেদকরের কথা বলে থাকেন।
পরলোক থাকলে সেখানে হয়ত শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে মুচকি হাসছেন। কারণ দীর্ঘকাল তিনি যে পার্টির প্রবাদপ্রতিম নেতা ছিলেন এবং যে পার্টি থেকে তাঁর বহিষ্কারের অন্যতম কারণ কংগ্রেসকে ভারতীয় গণতন্ত্রের কালো দিনগুলোতে সমর্থন করা, সেই পার্টির উদীয়মান নেতা দল বদলে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন।
এতদিনে সবাই জেনে গেছেন, কানহাইয়া জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের প্রথম প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নন, যিনি পরবর্তীকালে কংগ্রেসে যোগদান করলেন। কিন্তু কানহাইয়া আগের সকলের থেকে আলাদা। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোবার আগেই সারা দেশ তাঁকে চিনে গেছে। ইচ্ছামত এডিট করা ভিডিও ক্লিপকে হাতিয়ার করে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। হাজতবাস করে এসেই তিনি যে বক্তৃতা দেন, তা তাঁকে রাতারাতি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। অতঃপর সুবক্তা কানহাইয়া ভাইরাল হয়ে যান। ভাইরাল ভিডিওর প্রভাব এখন ভাইরাল অসুখের চেয়ে কম নয়। ফলত কানহাইয়াকে নিয়ে কেবল বামপন্থী নয়, সমস্ত বিজেপিবিরোধী মানুষেরই প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়েছিল। তিনি সিপিআই ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় স্বভাবতই নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তাছাড়াও বিষয়টিকে ভারতীয় বামপন্থার সাথে কংগ্রেসের সম্পর্কের নিরিখে দেখা প্রয়োজন।
স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে কমিউনিস্টরা কংগ্রেসকে কীভাবে দেখবেন তা নিয়ে বরাবর ধন্দে ভুগেছেন। তার অন্যতম কারণ জওহরলাল নেহরু। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কেবল সামাজিক চিন্তাধারার দিক দিয়ে প্রগতিশীল ছিলেন না, তাঁর অর্থনীতিও আধা-সমাজতান্ত্রিক। তার উপর তাঁর সোভিয়েত প্রীতি সর্বজনবিদিত। সোভিয়েত সরকার স্বাধীন ভারতের প্রথম দিককার উন্নয়নেও যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। ফলত ডাঙ্গের মত নেতারা কংগ্রেসকে শত্রু বলে ভাবতে চাননি। ১৯৫৯ সালে কেরালার নাম্বুদিরিপাদ সরকারকে নেহরু অন্যায়ভাবে ভেঙে দেওয়ার পরও নয়। অনতিকাল পরেই ভারত-চীন যুদ্ধ, কংগ্রেসের পক্ষাবলম্বন নিয়ে মতভেদ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে এমন পর্যায়ে পৌঁছল, যে প্রথমবার পার্টি ভাঙল। সেই ভাঙনের মাশুল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন আজও দিয়ে চলেছে। তারপর থেকে অন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সাথে কংগ্রেসের সম্পর্ক বেশিরভাগ সময়ে আদায় কাঁচকলায় হলেও, সিপিআইয়ের সাথে অম্লমধুর। সত্তরের দশকে কেরালায় একসঙ্গে সরকার চালিয়েছে কংগ্রেস, সিপিআই। জরুরি অবস্থার সময়ে বোধহয় অনেক কংগ্রেসির চেয়েও ইন্দিরার প্রতি সিপিআইয়ের সমর্থন বেশি সোচ্চার ছিল।
সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেস সরকারের আগ্রাসন সিপিএম ও নকশালদের সাথে কংগ্রেসের শত্রুতাকে চিরস্থায়ী করেছে বলে মনে হত অনেকদিন পর্যন্ত। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে সিপিএমের সাথেও কংগ্রেসের সম্পর্ক বদলেছে। দিল্লিতে কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীর সরকার চলছে সিপিএমের সমর্থনে — এ একসময় অকল্পনীয় ছিল। এমনকি ২০০৪-০৯ সেই সরকার চলার পরেও ভাবা যায়নি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় সিপিএম, কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়তে পারে। তা-ও সম্ভব হয়েছে। সিদ্ধার্থশঙ্করের দমননীতিতে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন নকশালরা। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংসদীয় নকশালপন্থী দলটি কিন্তু সিদ্ধার্থশঙ্করের স্নেহভাজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসাবে দেখে। মমতার দল কংগ্রেস থেকে বেরিয়েই তৈরি এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সর্বার্থে কংগ্রেসের জায়গাই অধিকার করেছে। অতএব ব্যক্তির নৈতিকতার প্রশ্নে কানহাইয়ার দলবদল নিন্দার্হ হতে পারে, রাজনৈতিক নীতির দিক থেকে তিনি কতটা বিচ্যুত, তা তর্কসাপেক্ষ।
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন যে একশো বছরেও সারা দেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারল না, তার কারণ হিসাবে অনেকেই আম্বেদকরপন্থীদের সঙ্গে ঐক্যের চেষ্টা না করাকে দায়ী করেন। ডাঙ্গে যখন মহারাষ্ট্রের গিরনি কামগর ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, তখন সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। কিন্তু আম্বেদকরের প্রস্তাব অনুযায়ী দলিত শ্রমিকদের বস্ত্রশিল্পের বয়ন বিভাগে কাজ করতে দেওয়ার দাবিকে ডাঙ্গে আন্দোলনের দাবিতে যুক্ত করতে রাজি হননি, ফলে ঐক্য হয়নি। মজার কথা, রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসে ডাঙ্গের দল থেকে যাওয়া কানহাইয়ার সাথে আম্বেদকরপন্থী জিগ্নেশেরও জায়গা হয়েছে। কানহাইয়া আবার প্রায় সব বক্তৃতাতেই আম্বেদকরের কথা বলে থাকেন। কংগ্রেসে বাম ঘেঁষা আর্থসামাজিক চিন্তার রাহুলই শেষ কথা হয়ে উঠবেন, নাকি কপিল সিবালের মত বৃদ্ধ সিংহেরা নিজেদের মত চাপিয়ে দিতে সমর্থ হবেন — কানহাইয়ার ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে অনেকটা তার উপরেও নির্ভর করবে। তবে অদূর ভবিষ্যতেই এমন দিন আসতে পারে, যখন আজ বিশ্বাসঘাতক মনে হওয়া কানহাইয়ার হয়ে তাঁর প্রাক্তন কমরেডদের প্রচারে বেরোতে হবে।
তরুণরা না জানলেও মাঝবয়সী বা প্রবীণদের নিশ্চয়ই মনে আছে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত ব্যাপারটা একেবারেই নতুন নয়।
“কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত বলতে তোর কী মনে পড়ে, তোপসে?”
“মোদী বনাম মমতা।”
জয়বাবা ফেলুনাথ ছবির সংলাপ অদল বদল করে নিয়ে আজকাল সোশাল মিডিয়ায় অনেক মিম ঘুরে বেড়ায়। এরকম একটা মিম তৈরি হওয়াও আশ্চর্য নয়। তবে তরুণরা না জানলেও মাঝবয়সী বা প্রবীণদের নিশ্চয়ই মনে আছে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত ব্যাপারটা একেবারেই নতুন নয়। সাংবিধানিকভাবেই রাজ্য সরকারগুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় পিগমি করে রাখা হয়েছে এবং এই সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস দরকার — এই দাবিতে সবচেয়ে সরব ছিলেন যে মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর নাম জ্যোতি বসু। বস্তুত, আশির দশকে অকংগ্রেসি রাজ্যগুলোর কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিত বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৭-এ তৈরি হওয়া বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র তাঁর আপিলা-চাপিলাগ্রন্থে সেকথা সবিস্তারে লিখেছেন। আজকের বাংলা সংবাদমাধ্যম এই সংঘাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু সেদিনের সরকারকে বিস্তর টিটকিরি সহ্য করতে হয়েছিল। বলা হত, কেন্দ্রের টাকা না পাওয়া নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে সরকার নিজের দায়িত্ব এড়াচ্ছে।
ব্যাপারটা যে তা ছিল না, বরং সমস্ত রাজ্যের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বাড়ানোর জন্য অতি প্রয়োজনীয় লড়াই ছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ১৯৮৩ সালে শ্রীনগরে রাজ্যগুলোর দাবি জোরদার করতে ফারুক আবদুল্লার ডাকা সম্মেলনে খসড়া দাবি সনদ তৈরি করার জন্য গঠিত উপসমিতির সঞ্চালক হিসাবে অশোকবাবুর উপস্থিতি। ঐ বছরই ডিসেম্বরে কলকাতায় জ্যোতিবাবুর আমন্ত্রণে ঐ মর্মে আরো একটি বৈঠক হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে যখন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল ন্যাশনাল কনফারেন্স সরকারকে পদচ্যুত করেন, তখন জ্যোতিবাবুর নির্দেশে অশোকবাবু দিল্লী গিয়ে কংগ্রেস বিরোধীদের সভায় যোগ দেন এবং পরদিন শ্রীনগরে রাজ্যপালের সাথে দেখা করে প্রতিবাদ করেন; কাশ্মীরের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদর দপ্তরের ব্যালকনি থেকে জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশে ভাষণও দেন।
১৯৮৩-তে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের জন্য গঠিত সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করতে হবে — এ ছিল সেইসময় জ্যোতিবাবু, অশোকবাবুদের জোরালো দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তা মানেনি। মানলে মমতা দেবীর জগদীপ ধনখড়কে সহ্য করতে হত না। তার চেয়েও বড় কথা, জম্মু ও কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া; দিল্লীর রাজ্য সরকারকে আইন বদলে ফেলে ঠুঁটো জগন্নাথ করে দেওয়া এবং মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার, মুখ্যসচিবকে নিয়ে টানাটানি করে পশ্চিমবঙ্গে অস্থিরতা তৈরি করা — যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর এই ধারাবাহিক আঘাত হানা বিজেপির পক্ষে শক্ত হত।
দুর্ভাগ্যজনক যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্যে পূর্বসুরীদের এই লড়াইয়ের ইতিহাস সিপিএমের বর্তমান নেতৃত্বের মনে আছে, এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে “তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে তীব্র মেরুকরণ হয়ে যায়। নির্বাচনী ফলাফলের এটিই সম্ভবত মূল কারণ।” নির্বাচনের প্রচারেও সিপিএমের (বা সংযুক্ত মোর্চার) পক্ষ থেকে এই বাইনারি ভাঙতে চাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। গত এক মাসের ঘটনাবলীকে সিপিএম নিজেই কিন্তু ওই বাইনারির ঊর্ধ্বে উঠে দেখতে পারছে না। ভোট পরবর্তী এই লড়াই যে কেবল বিজেপি বনাম তৃণমূল নয়, বরং কেন্দ্রীয় সরকার বনাম রাজ্য সরকার — তা তারা এখনো বুঝছে না। মন্ত্রীদের গ্রেপ্তারিকে সিপিএমের আইনজীবী নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য চটজলদি সমর্থন করেছিলেন। পার্টির মতামত তাঁর সঙ্গে মেলেনি, কিন্তু সে জন্যে বিকাশবাবুকে তিরস্কার করা হয়েছে বলেও খবর নেই। মুখ্যসচিবের ঘটনায় সুজন চক্রবর্তী যদিও বলেছেন এটা কেন্দ্রের প্রতিহিংসামূলক আচরণ, সাথে জুড়ে দিয়েছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের সমালোচনা।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিধানসভা, লোকসভায় অনুপস্থিত দলের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো-টাঠামো নিয়ে ভেবে লাভ কী? উত্তর হল, বাইনারি ভেঙে যে বিরোধী পরিসর পুনরায় দখল করা এখন সিপিএমের লক্ষ্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে গেলে সেই পরিসরই আর থাকবে না। কারণ কেন্দ্রের হাতে সমস্ত ক্ষমতা চলে যাওয়া একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ঠিক আগের ধাপ।