গুরুর ধর্ষণ মাপ

ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা হুতোম প্যাঁচার নকশায় দেখছি খোদ বাংলায় হিন্দু বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হলে পরিবারের গুরু ফুলশয্যায় বসে থাকতেন। তিনি “প্রসাদ করে দিলে” তবে স্বামী-স্ত্রী মিলিত হতে পারত। হুতোম সকৌতুকে লিখেছেন কিভাবে এক পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত স্বামী খাটের তলায় লুকিয়ে থেকে যথাসময় বেরিয়ে এসে এক গুরুর মাথা ফাটিয়ে দেন, অতঃপর প্রাণভয়ে গুরুরা এই প্রসাদ করার অভ্যেস ত্যাগ করেন

মনে রাখবেন, ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যখন এক ধর্ষিতা আর তার সঙ্গী দিল্লীর ঠান্ডায় উলঙ্গ, রক্তাক্ত, মৃতপ্রায় অবস্থায় রাস্তায় পড়েছিল তখন তাদের সাহায্য করতে একটি মানুষও এগিয়ে আসেনি অথচ তা নিয়ে মোমবাতি মিছিল করতে লোকের অভাব হয়নি। আর ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট একজন ধর্ষকের শাস্তির প্রতিবাদে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায়। নিরস্ত্র, নিরীহ অবস্থায় নয়, রীতিমত খুনে মেজাজে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে বহু মহিলা এই ধর্ষকটির জন্যে কান্নাকাটি করছেন। মগজধোলাই কোন পর্যায়ে গেলে এটা সম্ভব একবার ভেবে দেখুন। মানলাম যে এই ভিড় সংগঠিত করা হয়েছে গোলমাল পাকানোর জন্য। কিন্তু একজন ধর্ষককে সমর্থন করার জন্যে এত লোককে সংগঠিত করা যে সম্ভব হচ্ছে (যে মূল্যেই হোক) তা মগজধোলাই ছাড়া একেবারেই অসম্ভব। সেই মগজধোলাইটা কী এবং কত প্রাচীন সেটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ।
ঘটনা হল যে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার গর্ব আমরা করে থাকি, এটা তার এক বিরাট উত্তরাধিকার। দেবদাসী এদেশের অতি প্রাচীন প্রথা তবে সেটা মন্দিরে সীমাবদ্ধ। কিন্তু শিষ্যদের বাড়ির মেয়েরা গুরুর ভোগ্য — এ বিশ্বাসটার ইতিহাসও কিন্তু আমাদের দেশে বেশ লম্বা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা হুতোম প্যাঁচার নকশায় দেখছি খোদ বাংলায় হিন্দু বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হলে পরিবারের গুরু ফুলশয্যায় বসে থাকতেন। তিনি “প্রসাদ করে দিলে” তবে স্বামী-স্ত্রী মিলিত হতে পারত। হুতোম সকৌতুকে লিখেছেন কিভাবে এক পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত স্বামী খাটের তলায় লুকিয়ে থেকে যথাসময় বেরিয়ে এসে এক গুরুর মাথা ফাটিয়ে দেন, অতঃপর প্রাণভয়ে গুরুরা এই প্রসাদ করার অভ্যেস ত্যাগ করেন। অতএব ঐ যে দেড় লক্ষ লোক মনে করেছে তাদের গুরু নির্দোষ, ঐ যে সাক্ষী মহারাজ বলে শাসকদলের এক গেরুয়া মাফিয়া ধর্ষণ প্রমাণিত হওয়ার পরেও গুরমিত নামক বরাহনন্দনটিকে পুণ্যাত্মা বলেছে, এরা কিন্তু সত্যিই মনে করে গুরুর অধিকার আছে শিষ্যাদের একটুআধটু ভোগটোগ করার। আমাদের এই ধর্মশাসিত দেশে ব্যাপারটা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। গুরুবাদী দেশ তো। “মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা।” ফলে এদেশের অধিকাংশ পুরুষই মনে করে ধর্ষণ তার জন্মগত অধিকার। যাদের পেটে বিদ্যে আছে, ঘটে বুদ্ধি আছে — তারা এই মনোভাব গোপন করতে জানে, বাকিরা জানে না। ঠিক এই কারণেই আইন marital rape বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে না, ধর্ষণের আইন অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর সাথে যৌন সংসর্গ ধর্ষণ বলে গণ্য হলেও অপকম্মটি মেয়েটির স্বামী করলে ধর্ষণ বলে ধরে না। এই আমাদের প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য, যা সমস্ত নারীকেই মা বলে ভাবতে শেখায় আর পুরুষকে শেখায় যে কোন নারীকেই সে ইচ্ছে হলেই মা বানিয়ে দিতে পারে, দোষ নেই। ভাগ্যিস সায়েবরা এসে আমাদের পাশ্চাত্যের আদবকায়দা শিখিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল, নইলে রামমোহন, বিদ্যাসাগরের লাশ পড়ে যেত তবু এদেশের মেয়েরা সতী হয়েই চলত, বালবিধবারা পাড়া প্রতিবেশীর সন্তানের মা হয়েই চলত। দেশের শিল্পোন্নত রাজ্যগুলো আবার এই পিছিয়ে পড়া বাংলার মত রামমোহন, বিদ্যাসাগর পায়নি কিনা তাই উনিশশো আশির দশকেও রূপ কানোয়ারকে সতী বানিয়েছে। শাহ বানোর নামটা মনে রাখা সোজা, এই মহিলার নামটা মনে পড়ে না সহজে।
নেহরু, আম্বেদকরদেরও বলিহারি। যে দেশ যা নয় তাকে তাই করে তোলার চেষ্টা! কতবড় সাহস! দেশের লোক গুরু ছাড়া বাঁচতে পারে না আর ওনারা বানাতে গেলেন সেকুলার দেশ। যত্তসব বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত মোগল আর সোনার চাঁদের দল। এতদিনে দেশটা ধর্মের পথে ফিরছে, গুরুদের হাতে ফিরছে

ধোঁকা ধোঁকা ধোঁকা

এখন অব্দি যা খবর তাতে সুপ্রিম কোর্ট একটি ছ মাসের জন্য ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। ছ মাসের জন্য কারণ মুসলমান মহিলাদের অধিকার রক্ষায় বিদ্যাসাগরের মত লড়ছেন যে ভদ্রলোক, তাঁর সরকার নাকি মুসলমানদের বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে কোন নতুন আইন টাইন করতে চান না। সেটা না করলে পরিস্থিতি ছ মাস পরে আবার পুনঃ তাৎক্ষণিক তালাক ভব হয়ে যাবে।
“আমরা” অবশ্য ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন ইত্যাদি জানিয়ে দিয়েছি এই রায়টার জন্যে। কারণ তাতে “আমাদের” এইটা ভাবতে সুবিধা হয় যে “আমাদের” নেতা “ওদের” মহিলাদের উদ্ধার করলেন। মামলাটা যে করেছিলেন মুসলমান মহিলারাই, এতদিন নিজেদের অধিকারের জন্য লড়লেন তাঁরাই সেটা ভুলে যেতে সুবিধা হয়। রায়টাও যে দিলেন বিচারপতিরা, মোদীবাবু নয় — সেটাও চেপে যাওয়াই ভাল কারণ আদালতের রায় বললে নেশাটা ঠিক জমে না। বিচারকদের তো আর দেখেশুনে, পছন্দ করে কপালে ভোটটি দিইনি। ফলে ওনাদের “আমাদের” লোক বলে ভাবতে এখনো একটু অসুবিধা হয়। তাছাড়া জহরকোট আর শ্বেতশুভ্র দাড়িতে যে মহারাণা প্রতাপসুলভ আবেদনটা আছে সেটা ঢলঢলে কালো কোটে কোথায়? অতএব যাঁর অবদান এই রায়ে গোটাকতক বক্তৃতা আর টুইট বৈ কিছু নয়, তাঁকেই কৃতিত্ব দিতে হবে।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। অত অজ্ঞ ভাববেন না। এখুনি বলবেন তো “রাজীব গান্ধী যখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলমান মহিলাদের অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিলেন না তখন কোথায় ছিলেন?” তখন আমি অ আ ক খ শিখছিলাম। তবে রাজীব গান্ধী যে অন্যায় করেছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজেকে রাজীব গান্ধীর চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ করতে শুধু আদালতে তাৎক্ষণিক তিনতালাকের (হ্যাঁ, তাৎক্ষণিক, মানে instant triple talaq কেই অসাংবিধানিক বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট। তিনতালাককে নয়) বিরুদ্ধে সরকারী উকিলকে দিয়ে সওয়াল করালে তো যথেষ্ট হবে না, দাদা। একটা নতুন আইন করে দেখান।
এইবার অভিন্ন দেওয়ানি আইনের কথা বলবেন তো? সেটা হলেই এটা হয়ে যায়, তাই না? আচ্ছা তাই হোক। মোদীজি আমাদের বলুন শুনি কী কী থাকবে সেই আইনে? নাহয় টুইট করেই বলুন। কী বললেন? ওটা এখনো তৈরি হয়নি? বুঝুন। দেশসুদ্ধ লোকের গোঁফে তেল মাখিয়ে দিলেন এদিকে কাঁঠাল গাছটা কোথায় সেটাই বলতে পারছেন না? তার মানে যদ্দিন অভিন্ন দেওয়ানী আইন না করতে পারছেন তদ্দিন তাৎক্ষণিক তিনতালাকের কোন প্রতিকার করতে পারবেন না? ও হরি! তাহলে আর কী উদ্ধার করলেন মুসলমান মহিলাদের? না মানে এটা ঠিকই যে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক, মহিলাদের উদ্ধার করতে না পারলে ঠিক নায়ক হওয়া যায় না। আর এদেশের বাস্তবটা হল সত্যিকারের ক্ষমতার জায়গায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষরাই বসে আছে, অতএব তারা অধিকার না দিলে মেয়েরা অধিকার পাবেও না। সুতরাং মোদীবাবুর দিকেই তো তাকিয়ে থাকতে হবে মুসলমান মহিলাদের অধিকার আদায়ের জন্যে। তিনিও যদি মুসলমান বোনেদের দুঃখে এরকম উদাসীন হন তাহলে চলে?

পুনশ্চ: এই স্ট্যাটাস যাঁরা পড়লেন তাঁদের মধ্যে যদি মোদীজির ঘনিষ্ঠ কেউ থাকেন, দয়া করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন মুসলমান বোনেদের উদ্ধারকার্য শেষ করতে বেশি দেরী না করতে কারণ হিন্দু বোনেরা অনেকে বড় কষ্টে আছেন। বিবাহবিচ্ছেদ তো ছেড়ে দিন, কাকে বিবাহ করবেন সেটা ঠিক করার অধিকারটুকু পাচ্ছেন না, বাপদাদার হাতে বেঘোরে খুন হচ্ছেন। অনেকে আবার সাহস করে বিয়েটা করে ফেলেও স্বামীর সাথে শান্তিতে থাকতে পারছেন না, স্বামীর নামে লাভ জিহাদ না কিসব অভিযোগ শুনছেন বাপের বাড়িতে ঘরবন্দী হয়ে। এঁরাই বা মোদীজি ছাড়া কার ভরসায় থাকবেন?

শুনুন ধর্মাবতার

কোটাল বলিলেন “ধর্মাবতার, আমরা গোমাতার সুরক্ষার চিন্তা ত্যাগ করিয়া পাদুকার শুকতলা ক্ষয় করিয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি যে ইহাই ঐ রাজ্যে এহেন একমাত্র ঘটনা নহে।”
বিচারকের রক্ত সাইক্লোনকালে ভারত মহাসাগরের ন্যায় উত্তাল হইয়া উঠিল। তিনি উত্তেজনার বশে দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিলেন “বল কি! আরো আছে!”
কোটাল উত্তর করিলেন “তবে আর বলিতেছি কি। আরো দুটি ঘটনার সন্ধান পাইয়াছি যেখানে পিতামাতার প্রতি রুষ্ট হইয়া অবোধ মেয়েটি ভিন্ন ধর্মের এক নরাধমকে বিবাহ করিয়াছে এবং ধর্মান্তরিত হইয়াছে।”
“দু-দুটি ঘটনা! তবে তো এ বড় ভয়ঙ্কর চক্রান্ত, কোটাল মহাশয়! আপনার বাহিনীকে বলুন মাতারক্ষা আপাতত স্থগিত রাখিয়া কন্যারক্ষায় মনোযোগ দিতে।”
এক্ষণে আলোচ্য কন্যার কৌঁসুলি আর্তনাদ করিলেন “ধর্মাবতার, আমার মক্কেল একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা। এ সম্বন্ধে তাঁহার মতামতটা একবার শুনিয়া দেখুন। তিনি বলিয়াছেন তিনি স্বেচ্ছায় এই বিবাহ করিয়াছেন এবং ধর্মান্তরিত হইয়াছেন।”
বিচারকের সহকারী তাঁর কানে কানে বলিলেন “বাইজোভ, ছোকরা বলে কি! মহিলার আবার স্বেচ্ছা! কোনদিন শুনিব দুগ্ধ দোহনের জন্য গোমাতার অনুমতি প্রয়োজন। তিনি স্বেচ্ছায় দিলে তবেই নেওয়া চলিবে।”
একথায় দুজনে খুব হাসিলেন। হাসির কারণ বুঝিতে না পারিয়া কন্যার কৌঁসুলিদ্বয় একে অপরের পানে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিলেন। অতঃপর বিচারপতি তাঁহাদের বলিলেন “প্রাপ্তবয়স্ক তো কী হইল? আপনারা দ্যাখেন নাই ইদানীং প্রাপ্তবয়স্করা কেমন শিশুদের মতন আহাম্মকি করিতেছেন? প্রবীণ প্রাক্তন ক্রিকেটার উদ্ভিন্নযৌবনা অনুষ্ঠান সঞ্চালিকাকে দেখিয়া নিজেকে ডিস্কো ড্যান্সার মনে করিতেছেন, সাংবাদিক নিজেকে বিচারক ভাবিতেছেন, অসংখ্য নরনারী মোবাইলকে জীবন আর জীবনকে মোবাইল ভাবিতেছেন, খেলা নিয়ে মেলা অনর্থ ঘটিতেছে এমনকি প্রাণ যাইতেছে। এসব কী করিয়া সম্ভব হইতেছে? না মগজধোলাই করিয়া। অতএব মগজধোলাই করিলেই যে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে দিয়া যা খুশি করাইয়া নেওয়া যায় ইহা বুঝিতে আপনাদের অসুবিধা হওয়া উচিৎ নহে।”
কন্যার কৌঁসুলি মাথা নাড়িয়া বলিলেন “যথার্থ, ধর্মাবতার। আপনি নির্ভুল। সত্যই আজকাল ভূমিকাগুলি বড্ড গুলাইয়া যাইতেছে। মন্ত্রীদের বিচারক মনে হইতেছে, বিচারককে প্রচারক মনে হইতেছে। তেনাদেরও মগজধোলাই হইয়াছে কিনা তাহাও তদন্ত করিয়া দেখা দরকার।”

*উপরের কথোপকথনটি কাল্পনিক। কোন বাস্তব ঘটনা বা চরিত্রের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া গেলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়

আমাদের কেউ নেই

এই মেরুকরণে বেশিরভাগ মুসলমান ভোট আর কিছু হিন্দু ভোট তাঁর দিকে পড়লেই তো কেল্লা ফতে। রামনবমীর মিছিলের পরে বোধহয় বুঝেছেন অঙ্ক মিলছে না, তাই এখন আবার নিজেকে বড় হিন্দু প্রমাণ করতে নেমে পড়েছেন। তাঁর পার্টি বজরংবলীর পুজো করছে। তিনি পুরীর মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছেন, উল্টোরথেও জ্বলজ্বল করছেন। কিন্তু যা হবার তা তো হয়ে গেছে। এখন দুই ধর্মের নেতাদের গরম গরম বাণী দিচ্ছেন। এতদিন যে ইদ্রিশ আলিদের পুষলেন, সে পাপ ভাগীরথীতে ধোয়া যাবে কি?

মমতা ব্যানার্জি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির — একথা ঘুমচোখে জিজ্ঞেস করলে বোধহয় পার্থ চ্যাটার্জিও বলবেন না। তবু রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যে অভিযোগ করেছেন সেটাকে অবিশ্বাস করার কারণ দেখছি না। তার কারণ দুটো। প্রথমত, কেশরীনাথ ত্রিপাঠী প্রাক্তন আর এস এস প্রচারক। আর এস এস দ্বারা শিক্ষিত একজন লোক ভারতীয় সংবিধানকে খুব সম্মান করে এবং নিজের সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘন না করার ব্যাপারে খুব সচেতন — এরকম দাবী করলে ভক্তরা যা-ই বলুন, প্রেতলোকে গোলওয়ালকর, হেড়গেওয়াররা খুব রেগে যাবেন। দ্বিতীয়ত, বিজেপি ব্লক সভাপতির মত কথা এই ভদ্রলোক বলেই থাকেন। কদিন আগে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারেও বলেছেন।
কিন্তু সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল ওভাবে কথা বলার সুযোগ ত্রিপাঠীমশাইকে কে করে দিল? উত্তর একটাই। মমতা ব্যানার্জি নিজে।
দেড়শো কোটির দেশে আজকাল মানুষ অপ্রতুল, কিন্তু গরুর কোন অভাব নেই। এক গরুর নিজের ভগবানের মহত্ত্বে এত ঠুনকো বিশ্বাস যে অন্যের ধর্মস্থানে তাঁকে না বসালে শরীরটা বেশ হিন্দু হিন্দু লাগে না। আরেকপাল গরুর আবার নিজের ধর্মের উপরে বিশ্বাস এত ঠুনকো যে সামান্য ফটোশপের ধাক্কাতেই তার অপমান হয় এবং ভাঙচুর, বাড়ি পোড়ানো, মারধর (গণপিটুনিরও দাবী ছিল) না করলে নিজেদের যথেষ্ট মুসলমান মনে হয় না।
কিন্তু কথা হচ্ছে মনে মনে তো অমন অনেকেই ভাবে। এই পরিমাণ হিংসা ছড়ানোর সাহস এদের হয় কখন? তখনই হয় যখন বিশ্বাস থাকে যে “আমার কিস্যু হবে না।” মমতা ব্যানার্জির সরকার সেই বিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল কোন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ছিল না। ২০১১ র পর থেকে, ২০১৬ র পরে বিশেষত, একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। সৌভাগ্যক্রমে এর জেরে এখন পর্যন্ত কোন প্রাণহানি হয়নি, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। নইলে আরো বড় আকার নিত। এই ঘটনাগুলোর সবকটাতেই পুলিশ পৌঁছেছে হিন্দী সিনেমার পুলিশের মত দেরীতে। মালদা, চন্দননগর, ধূলাগড়, খড়গপুর, নদীয়া, অধুনা বাদুড়িয়া — এই সংঘর্ষগুলো কেন আগে থাকতে আটকানো গেল না সেটাও বড় প্রশ্ন। প্ররোচনা যে যাকেই দিয়ে থাক, সে প্ররোচনায় আগুন জ্বলার আগেই জল ঢালা গেল না কেন? সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ তাহলে আছে কী করতে?
আসল কথা মমতা এক ভয়ঙ্কর খেলা শুরু করেছিলেন। এখন আর সামলাতে পারছেন না। বিজেপির হিন্দু মৌলবাদের মোকাবিলা করার বদলে মুসলমান মৌলবাদীদের তোল্লাই দিচ্ছিলেন। বস্তুত ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই দিচ্ছিলেন। মুসলমানদের উন্নয়নের জন্যে হাতেকলমে কিছু করার বদলে নজর ছিল মাথায় কাপড় দিয়ে নমাজ পড়ার ভঙ্গিতে ছবি তোলার দিকে। হাস্যকরভাবে সরকারী হোর্ডিং এ লেখা হচ্ছে “নমস্কার এবং সালাম।” যেন বাঙালি মুসলমান কখনো “নমস্কার” শব্দটা উচ্চারণ করে না। এতে কোন গরীব মুসলমানের কোন উপকার হয়নি। যা হয়েছে তা হল ইসলামিক মৌলবাদীদের বিশ্বাস তৈরি যে “দিদি আমাদের কিচ্ছু বলবে না” আর অন্যদিকে হিন্দু মৌলবাদীদের কাজ সহজ করা। তারা দিব্যি হিন্দুদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারছে “দিদি ওদের লোক। হিন্দুবিরোধী।” একইসঙ্গে মমতার আমলে গ্রামে, মফঃস্বলে গত কয়েকবছরে আর এস এস কিভাবে বেড়েছে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় সেটাও দিদির ইচ্ছা।
আদরের দিদি ভেবেছিলেন আর এস এস বাড়লে মুসলমানরা ভয় পাবে, তাঁকে রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে দেখবে আর ঢেলে ভোট দেবে। অন্যদিকে মুসলমান মৌলবাদীদের ভয়ে হিন্দুরা যদি বিজেপির দিকে ঢলে পড়ে তো পড়ুক। এই মেরুকরণে বেশিরভাগ মুসলমান ভোট আর কিছু হিন্দু ভোট তাঁর দিকে পড়লেই তো কেল্লা ফতে। রামনবমীর মিছিলের পরে বোধহয় বুঝেছেন অঙ্ক মিলছে না, তাই এখন আবার নিজেকে বড় হিন্দু প্রমাণ করতে নেমে পড়েছেন। তাঁর পার্টি বজরংবলীর পুজো করছে। তিনি পুরীর মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছেন, উল্টোরথেও জ্বলজ্বল করছেন। কিন্তু যা হবার তা তো হয়ে গেছে। এখন দুই ধর্মের নেতাদের গরম গরম বাণী দিচ্ছেন। এতদিন যে ইদ্রিশ আলিদের পুষলেন, সে পাপ ভাগীরথীতে ধোয়া যাবে কি?
এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে রাজ্যের প্রধান প্রশাসক কী বললেন? না তিনি রাজ্যপালের কথায় এতটাই অপমানিত যে পদত্যাগ করবেন ভেবেছিলেন। চমৎকার। বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, দাদু সুযোগ পেয়ে চেঁচামেচি করছেন আর মা ছেলেমেয়েদের কী করে বাঁচাব সেটা না ভেবে বললেন “আমি অত্যন্ত অপমানিত। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাব ভাবছিলাম। তারপর ভাবলাম আমি তো শ্বশুরমশাইয়ের মা নই, আমি ছেলেমেয়েদের মা। তাই গেলাম না। কিন্তু যেতে আমার দু মিনিট লাগবে।”
সঙ্কটমুহূর্তে পদত্যাগ যাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া, তিনি হচ্ছেন আমাদের মুখ্য প্রশাসক! আমাদের যে কে বাঁচাবে!
বিঃ দ্রঃ তৃণমূল, বিজেপি, জামাত ইত্যাদি ছাড়াও এ রাজ্যে আরেকটা রাজনৈতিক শক্তি নাকি আছে বলে খবর। তাদের নাম বামফ্রন্ট। তারা গরু নয়, কচ্ছপ। গতকাল কলকাতায় তারা একটা গনগনে মিছিল করেছে। কিসের বিরুদ্ধে? কলেজ স্কোয়ারে মিটিং, মিছিল নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে। নিষিদ্ধ করার ঘোষণাটা হয়েছিল প্রায় মাসখানেক আগে। অতএব ধৈর্য ধরতে হবে। আর মাসখানেক পরে ওঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে কিছু একটা করবেন আশা করা যায়।

বুদ্ধিজীবীর নিরপেক্ষতা : নিরপেক্ষতার ভন্ডামি

ভাবলে আরো অবাক লাগে যে হিটলারের বিরুদ্ধে শুধু ইহুদী বিজ্ঞানীরাই গিয়েছিলেন, খাঁটি জার্মান বিজ্ঞানীরা যাননি। ইতিহাস অবশ্য অন্যরকম বলছে। তবে সেক্ষেত্রেও ধরতে হবে ঐ জার্মানরা প্রশংসনীয় কিছু করেননি। আমি অবশ্য এত ভাবছি না। আমি মনে করছি কবি ইতিহাস পড়েন না। বড় কবি তো, শুধু কবিতাই পড়েন। অজস্র মধ্যমেধার বাঙালির মত সামান্য ‘বিশ্বাসঘাতক’ পড়াও তাঁর কাছে সময় নষ্ট।

রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন “যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি”। আজ সকালে শিখলাম বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এখন এত বুদ্ধি যে আইওয়া পৌঁছলে তবে ইসলামিক স্টেট সম্পর্কে জানতে পারেন। এই শিক্ষাটি আমার হল আনন্দবাজার পত্রিকার উত্তর সম্পাদকীয় স্তম্ভে নামকরা সাহিত্যিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটা পড়ে। ওঁর কবিতা কিছু কিছু পড়েছি। বেশ লাগে। বলতে কি, শ্রীজাতর চেয়ে বেশি ভাল লাগে। তার উপর আজকের লেখার শিরোনামটার সাথে একমত না হওয়ার কোন প্রশ্নই নেই: “সময় এসেছে ধর্ম না দেখে বিপন্নের পাশে দাঁড়ানোর”। অতএব লেখাটা গোগ্রাসে গিলতে গেলাম। আশা করেছিলাম লেখাটা ভাল হবে। এতটা শিক্ষামূলক হবে ধারণা করতে পারিনি।
কবি লিখছেন “গুজরাত দাঙ্গার পর দু’মাসের মাইনে দিয়েছিলাম। হেঁটেছিলাম বেশ অনেকগুলো মিছিলে। (তখনও জুকেরবার্গ ফুটেজ-বিপ্লবী হওয়ার সুযোগ করে দেননি)। তা সেই মিছিলের কয়েকটায় মহম্মদ সেলিম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কই সেলিম সাহেবকে কেউ মুসলিম সাম্প্রদায়িক বলেনি তো! আইনস্টাইন যখন রুজভেল্টকে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদিদের বাঁচাবার জন্য, কেউ কি তাঁকে ইহুদি-সাম্প্রদায়িক বলেছিলেন? মার্টিন লুথার কিং যে শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের মোকাবিলা করার জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের একে অপরের প্রতি “এক্সট্রিম ইন লাভ” হয়ে উঠতে বলতেন, তার জন্য কি কেউ বলেন যে উনি কৃষ্ণাঙ্গ সাম্প্রদায়িক?”
ইঙ্গিতটা বোঝা গেল? তিনটে উদাহরণ। একটাই মিল। মহম্মদ সেলিম জন্মসূত্রে মুসলমান, মিছিলটা ছিল ব্যাপক মুসলমান হত্যার বিরুদ্ধে। আইনস্টাইন জন্মসূত্রে ইহুদি, আবেদনটাও ছিল ইহুদিদের বাঁচানোর (যদিও এখানে কবি কোন চিঠির কথা বলছেন বুঝলাম না। কারোর জানা থাকলে জানাবেন। জানতে চাই। ম্যানহাটন প্রোজেক্ট নিয়ে চিঠিটা ঠিক ইহুদিদের বাঁচানোর জন্যে লেখা হয়েছিল বলে তো মনে হয় না)। মার্টিন লুথার কিং নিজে কৃষ্ণাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গদের এক হতে বলেছিলেন।
অর্থাৎ কবি ইঙ্গিত করছেন এঁদের কার্যকলাপ যে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো বলে প্রশংসনীয় তা নয়, এঁরা নিজ নিজ কৌমের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে প্রশংসনীয়। ভেবে অবাক লাগছে যে ২০০২ এ সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম একটা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যেখানে জন্মসূত্রে হিন্দু কোন সিপিএম নেতা যাননি। মানে বিনায়কবাবু তো তেমন কারো নাম করেননি দেখছি। কেউ গিয়ে থাকলে অবশ্য সেটা প্রশংসনীয় নয়। তাঁদের এখন বিবেকের দংশন হওয়া উচিৎ। যেমনটা বিনায়কবাবুর নিজের হচ্ছে। নিজের কৌমের পাশে না দাঁড়িয়ে অন্য কৌমের পাশে কেউ দাঁড়াতে যায়?
ভাবলে আরো অবাক লাগে যে হিটলারের বিরুদ্ধে শুধু ইহুদী বিজ্ঞানীরাই গিয়েছিলেন, খাঁটি জার্মান বিজ্ঞানীরা যাননি। ইতিহাস অবশ্য অন্যরকম বলছে। তবে সেক্ষেত্রেও ধরতে হবে ঐ জার্মানরা প্রশংসনীয় কিছু করেননি। আমি অবশ্য এত ভাবছি না। আমি মনে করছি কবি ইতিহাস পড়েন না। বড় কবি তো, শুধু কবিতাই পড়েন। অজস্র মধ্যমেধার বাঙালির মত সামান্য ‘বিশ্বাসঘাতক’ পড়াও তাঁর কাছে সময় নষ্ট।
ভাল হত কবি যদি এই “নিজের কৌমের পাশে দাঁড়ান” কথাটাই সোচ্চারে গোটা লেখাটা জুড়ে বলতেন। তত্ত্বটা মানতে না পারলেও অন্তত বুঝতাম লোকটার সাহস আছে। কিন্তু না, সে সৎসাহস তিনি দেখাতে পারেননি। এরপরেই শুরু করেছেন, যাকে আজকাল ইংরিজিতে অনেকে বলেন whataboutery।
“কে বলবে এগুলোর বিরুদ্ধে? আমি নিজেই কি বলেছি? বলিনি বলেই মাথা নিচু হয়ে গেল যখন মল্লারপুরের একটি ছেলে বইমেলায় আমাকে বলল, ‘দাদরির পর আপনি খবরের কাগজে লিখেছিলেন, কিন্তু কই আমাদের ইন্দ্রজিৎকে যখন পিটিয়ে মেরে দিল, তখন কিছু লিখলেন না তো?’
কে ইন্দ্রজিৎ? আখলাখের মতো তাকেও পিটিয়ে মারা হয়েছে? জানি না তো! কোথায় ধূলাগড়? উস্তি-ক্যানিং-কালিয়াচক-সমুদ্রগড়-দেগঙ্গা কোথায়? এই পৃথিবীতে? সেখানে যাদের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে তারা কারা? মানুষই তো?”
এই অংশটা পড়ে ইন্দ্রজিৎ কে সেটা আমারও মনে পড়েনি। তাই ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করতে হল। করে যা বেরোল তা হচ্ছে বীরভূম জেলার একটি ঘটনা। ‘দ্য হিন্দু’ র প্রতিবেদনে পেলাম ইন্দ্রজিৎ দত্ত বলে এক দোকানদারকে মহরম উপলক্ষে অনেক টাকা চাঁদা দিতে বলা হয়েছিল বলে অভিযোগ। দিতে আপত্তি করায় তাকে মারধোর করা হয় এবং সেই আঘাতের ফলেই কদিন পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক এবং প্রশাসনের অপদার্থতাজনিত মৃত্যু। কিন্তু আখলাক হত্যার সাথে তুলনাটা মেনে নেওয়া শক্ত। চাঁদার জুলুম আমাদের কারো অপরিচিত নয়, তার জেরে মৃত্যু বিরল হলেও। কিন্তু সেই মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করছেন একটি সংগঠিত হত্যার যার কারণ একজন মানুষের খাদ্যাভ্যাস! তার উপর তন্নতন্ন করে খুঁজেও এমন কোন খবর পেলাম না যে শাসকদলের কেউ ইন্দ্রজিতের হত্যাকারীর পক্ষে একটি কথা বলেছে। আখলাকের বেলায় কিন্তু এক অভিযুক্তের ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হওয়ার পর তাকে জাতীয় পতাকায় মোড়া হয়েছিল এবং এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছিলেন। একজন কবি তুলনা করছেন এই দুটো ঘটনার? কবিরা আত্মভোলা হন শুনেছি, কাণ্ডজ্ঞানশূন্যও হন নাকি? আরো হাসির কথা এই যে বিনায়কবাবু এই হত্যাকে ভারতে আইসিসের জিহাদের এক নিদর্শন বলে ধরেছেন। চাঁদা দেয়নি বলে পিটিয়ে মারা যদি আন্তর্জাতিক জিহাদ হয়, তাহলে বলতে হবে পাড়ার তোলাবাজের সাথে এল বাগদাদির পার্থক্য কেবল পরিমাপগত।
গত দুবছরে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি লেগেছে। মানুষের ঘরবাড়ি পুড়েছে। প্রশাসনের গড়িমসি বারবার প্রকট হয়েছে। সেজন্যে সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী, বিরোধী দল সকলেই সরকারের অপদার্থতার দিকে আঙুল তুলেছেন, সে বিনায়কবাবু যতই বলুন হিন্দুদের জন্য কেউ বলে না। তবু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে যদি এই কারণে তিনি বিষোদগার করতেন একটুও অন্যায় হত না। কিন্তু আশ্চর্যের কথা তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য মোটেও সরকার নয়। লেখার শেষ প্যারায় গিয়ে কবি বলছেন “বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো-সরস্বতীপুজো-বারের উপোস, নাতির পইতে, দাদুর শ্রাদ্ধ, সব কিছু করার পরে ফেসবুকে নিজেকে ‘নাস্তিক’ দাবি করার এলিটিস্ট ভণ্ডামি এক জন মুসলমান কল্পনাও করতে পারেন না। পারেন না বলেই, কোথাও কোনও মুসলমান অত্যাচারিত হলে তিনি বুক চিতিয়ে তার পাশে দাঁড়ান। দাঁড়ান এক জন মানুষের পাশে আর এক জন মানুষের যে-ভাবে দাঁড়ানো উচিত, সে-ভাবেই। প্রাজ্ঞ হিন্দুরা কবে এক জন অত্যাচারিত হিন্দুকেও মানুষ ভাবতে পারবেন? কবে বলতে পারবেন, সতেরো জন হিন্দু সন্ন্যাসীকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারা অন্যায় হয়েছিল? কবে আমি দেগঙ্গা কিংবা ক্যানিং-এর রাস্তায় দাঁড়িয়ে, চিৎকার করে বলতে পারব, ‘প্লিজ পানিশ মি অলসো। আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু কল মাইসেলফ, আ হিন্দু।'”
বুঝুন। হিন্দুদের প্রতি যত অত্যাচার, অনাচার, অবিচার হচ্ছে সবের জন্যে দায়ী হলেন সেইসব হিন্দুরা যাঁরা নিজেদের নাস্তিক বলে দাবী করেন। ধূলাগড়, দেগঙ্গা ইত্যাদির জন্যেও দায়ী হলেন নাস্তিকরা। কবিপ্রতিভা এখানে কি মারাত্মক বাইনারি নির্মাণ করল আসলে দেখুন, শিখুন।
বলা হল মুসলমানদের মধ্যে নাস্তিক-ফাস্তিক কেউ হয় না এবং মুসলমান সবসময় মুসলমানের পাশে দাঁড়ায়। অতএব আপনি যদি হিন্দু হন তাহলে ওসব নাস্তিক হওয়াটওয়া ত্যাগ করুন, হিন্দুর পাশে দাঁড়ান। লেখায় অনেক আগেই বলা হয়েছে যে ভারতে আইসিস ঠিক কত হাজার কোটি টাকা যে ঢোকাচ্ছে সেটা “সতর্ক করতে চাইলেও যাঁরা সতর্ক হন না, যাঁরা বিশ্বাস করেন অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকবে, সেই পণ্ডিতদের” জানা নেই (কবির যখন জানা আছে তখন তিনি কেন লিখলেন না সে-ও এক রহস্য)। অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ শিগগির শুরু হবে, আপনি যদি নাস্তিক হন বা সংখ্যালঘুর প্রতি সংবেদনশীল হন, তার মানে আপনি হিন্দু হয়ে হিন্দুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।
হিন্দু এদেশে কিরকম নিপীড়িত, কেমন কুকুর বেড়ালের মত তাদের রাখা হয়েছে সেকথা প্রমাণ করতে কবি বাংলাদেশী হিন্দু, কাশ্মীরি পন্ডিত সকলকেই টেনে এনেছেন। যখন আর কুলোয়নি তখন সেই আশির দশকের বিজন সেতু অব্দি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু এত চোখের জলেও বাঁকা হাসিটা লুকনো গেল না। “কাশ্মীরের যে পণ্ডিতগুলো দিল্লির রাস্তায় কাতরাচ্ছে গত পঁচিশ বছর, তাদের যন্ত্রণাতেও কারও বুকটা টনটন করে উঠলে সে তৎক্ষণাৎ বিজেপি বলে চিহ্নিত হয় কেন?” কে যে ওঁকে বিজেপি বলে চিহ্নিত করল উনিই জানেন। গোটা লেখায় যা যা বিজেপির বক্তব্য ঠিক তাই তাই বললেন, তারপর জানিয়ে দিলেন ওঁকে কিন্তু বিজেপি বলা চলবে না।
শিক্ষিত বিজেপি সমর্থকদের এই অভ্যেসটা অননুকরণীয়। সিপিএমের এই দুর্দিনেও কোন সমর্থককে আপনি বলতে শুনবেন না সে কোন পার্টির সমর্থক নয়। কংগ্রেস সমর্থকও তাই। এ রাজ্যে প্রবল প্রতাপান্বিত তৃণমূল সমর্থকরা তো সোচ্চার দিদিভক্ত। কিন্তু বিজেপিভক্ত নরেন্দ্র মোদীর ছবি বুকে আটকেও বলে “আমি কোন পার্টির সাপোর্টার নই।” ওদেরই সবার সমঝে চলা উচিৎ। ওরা কোথায় রেলা নেবে, তা নয়। আসলে সারাক্ষণ যারা ভয় বিক্রি করে তারাও ভীত হয়ে থাকে। বিনায়কবাবুর মত আপনার যদি সিরিয়া, তুরস্কের মুসলমানের আজানের সুর ভাল লাগে অথচ এদেশের কোটি কোটি মুসলমানের এক শতাংশেরও কম যুবকের আইসিসে যাওয়া দেখে মনে হয় ঘরে ঘরে জিহাদের প্রস্তুতি চলছে, তাহলে আর আপনি রেলায় থাকবেন কী করে?
এই রাজ্যে এখনো এক বোকা কবি আছেন যিনি বলেন সত্য বলা ছাড়া কবিতার আর কোন কাজ নেই। চতুর কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য তথ্যের বা বাস্তবের ধার না ধেরে দিব্যি ভয় ছড়ানোর কাজটা করেছেন। সত্য নয়, এখন যে উত্তরসত্যের যুগ।

না খেয়ে মরে চাষা, এবং গুলি খেয়ে

এই কিছুদিন আগে যখন তামিলনাড়ুর খরাক্লিষ্ট চাষীরা নিজেদের দুরবস্থা একদা চা বিক্রেতা প্রধানমন্ত্রীর কানে তোলবার আশায় নিজেদের পেচ্ছাপ পর্যন্ত খেলেন তখনো আমার আপনার মত ভদ্দরলোকেরা পায়ের উপর পা তুলে অর্ণব গোস্বামী নামক এক আপাতনির্বোধের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী গোগ্রাসে গিলছিল

ছোটবেলায় মা-জেঠিমার কাছে শোনা একটা গল্প: এক শাশুড়ি দিনরাত চিৎকার করে ছেলের বউকে গালমন্দ করত, তাই পাড়ার লোকে তার নিন্দে করত। শেষমেশ একদিন বুড়ির চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা বুড়িকে ধমকাবেন বলে সে বাড়ি চলেই গেলেন। গিয়ে দ্যাখেন বউ বুড়িকে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখে ঝাঁটাপেটা করছে, তাতেই বুড়ির চিৎকার এবং গালাগালি। বউয়ের কিন্তু মুখে রা টি নেই।
মধ্যপ্রদেশের কৃষক আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালানোর পরে যা হচ্ছে তা নিয়ে ভদ্দরলোকেদের প্রতিক্রিয়া দেখে গল্পটা মনে পড়ল। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশের চাষীদের অবস্থা বহু বছর ধরেই গল্পের শাশুড়ির চেয়েও শোচনীয়। তাদেরকে বউ, মানে আমাদের নির্বাচিত সরকারগুলো, আক্ষরিক অর্থেই না খাইয়ে মারছে। আর তারা যখন গলায় দড়ি দিয়েছে তখন নেশা, কেজরিওয়ালের প্ররোচনা, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি নানা কাল্পনিক কারণ দেখিয়ে তাদের পাত্তাই দেওয়া হয়নি।
এই কিছুদিন আগে যখন তামিলনাড়ুর খরাক্লিষ্ট চাষীরা নিজেদের দুরবস্থা একদা চা বিক্রেতা প্রধানমন্ত্রীর কানে তোলবার আশায় নিজেদের পেচ্ছাপ পর্যন্ত খেলেন তখনো আমার আপনার মত ভদ্দরলোকেরা পায়ের উপর পা তুলে অর্ণব গোস্বামী নামক এক আপাতনির্বোধের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী গোগ্রাসে গিলছিল। সীমান্তে সৈনিকরা মরছে আর চাষী ব্যাটারা নিজেদের দুর্দশাটাই বড় করে দেখছে! কতবড় আস্পর্ধা! এবার যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, চাষীরা রাস্তায় নেমেছে তখন এক দেশপ্রেমিক সরকারের পুলিশ তাদের গুলি করে চুপ করানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু যার পেট খালি তাকে চুপ করানো বড় শক্ত। ফেসবুক করা মায়েরা না জানলেও চাষী পরিবারের শিশুদের মায়েরা বিলক্ষণ সেটা জানেন। সরকার অবশ্য জানে না। তাই যা হবার তাই হয়েছে। ক্ষুধিত মানুষ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ঢিল ছুঁড়েছে, বাস পুড়িয়েছে। আর অমনি ভদ্দরলোকেদের ন্যাকা ন্যাকা মন্তব্য শুরু হয়েছে “কৃষকদের সমস্যার কথা সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন নিন্দনীয়।”
আরে মশাই, হিংসার আশ্রয় নিল বলে তবু আমার মত ধ্বজভঙ্গ সাংবাদিকরা ব্যাপারটা আপনাদের চোখের সামনে আনতে বাধ্য হল। নইলে ১২০ কোটি লোকের দেশে গোটাছয়েক চাষা মরে গেলে কি-ই বা এসে যায়? আর পুলিশ তো বলেছেই যে তারা গুলি চালায়নি। মধ্যপ্রদেশ তো প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে চলা একটা রাজ্য, তা হয়ত প্রাচীন ভারতে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টির মত পাপীদের বুকে গুলিবৃষ্টির প্রযুক্তিও চালু ছিল। হয়ত সেভাবেই ঐ চাষার বাচ্চাগুলো মরেছে। কে বলতে পারে?
তাছাড়া সরকার গুরুত্ব দিয়ে ভাববেটা কী? রিমের পর রিম লেখা হচ্ছে কৃষিঋণ মকুব করলে সরকারী তহবিলের কি বিপুল ক্ষতি হবে তাই নিয়ে। আমার আপনার মত ভদ্দরলোকেরাই তো বলে চাষীরা যখন কর দেয় না তখন তারা “ফ্রি লোডার”। এদের আবার ঋণ মকুব করা! বরং কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড় দেওয়া হোক। মুকেশ আম্বানির বাড়িতে আরো পাঁচটা সুইমিংপুল হোক, গৌতম আদানি আরো চারটে দেশে কয়লা তুলতে যাক। এতে হয়ত সরকারের টাকা একটু কম পড়বে কিন্তু এদের ব্যবসা বাড়লে তো এরা আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের চাকরি দেবে।
এই আশার পেছনের যুক্তিটা আজও বুঝলাম না। কোন কর্পোরেট আবার লাভের মুখ দেখলে নতুন চাকরি দেয়? সবাই বরং কর্মী কমিয়ে, কম লোক দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে মুনাফা বাড়ায়। বারো বছর হল একটা কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করছি। আজ অব্দি কতগুলো নতুন পদ তৈরি হতে দেখলাম অনেক কাগজপত্র ঘেঁটে, লাইব্রেরিতে দিনরাত পড়ে থেকে হয়ত বলতে পারব, অথচ আজ এই চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেল, কাল অমুক কাগজের ছটা সংস্করণ উঠে গেল, পরশু তমুক কাগজ ১৫০ লোককে ছাঁটাই করে দিল — এ তো লেগেই আছে। এসব খবর জানতে আজকাল সংবাদমাধ্যমের লোকও হতে হয় না, আবালবৃদ্ধবনিতা জানে। তবু কর্পোরেটকে আমাদের ফ্রি লোডার মনে হয় না, কৃষিঋণ মকুব তো দূরে থাক, কৃষককে ভর্তুকি দিলেও মনে হয় আমার ট্যাক্সের টাকার অপব্যবহার হচ্ছে। তা এই আমাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার চাষীদের দাবিদাওয়া মানতে যাবে কেন?
বড্ডবেশি পলিটিসাইজ করে ফেললাম, তাই না? যে ফসল ফলায় তার পরিবারই না খেয়ে থাকে — এই আশ্চর্য ঘটনাটা কোন অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ঘটানো সম্ভব হয় কেউ যদি আমায় বুঝিয়ে দিতে পারে, আমি জীবনে আর পলিটিক্সমুখো হব না। কী বললেন? এর পেছনে কংগ্রেস আছে? কংগ্রেস, সিপিএম, নকশাল, মাওবাদী, এন্টি ন্যাশনাল, লুটিয়েন্স এলিট — যারা যারা এই আন্দোলনের পেছনে আছে তাদের প্রতি আমার অকুণ্ঠ ভালবাসা রইল। আমার মত সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তর তোয়াক্কা না করে যদি তারা চাষীদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তো বেশ করেছে। কী? এসব ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে বলছেন? এই করে যদি কোন পার্টি ক্ষমতায় আসে তবে সে ক্ষমতায় আসার যোগ্য। তারপর লঙ্কায় এসে যদি সে-ও রাবণ হয় তখন রাবণবধের দায়িত্বও হাত বদলাবে নাহয়। ক্ষতি কি?

‘ওদের’ প্রতিবাদ

হিন্দু প্রতিরোধের যখন এত শক্তি যে অন্য ধর্মের ইমাম বদলে দিতে পারে তখন নিজের ধর্মে নিশ্চয়ই আরো বড় বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে? তাহলে খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে একটা হিন্দু প্রতিরোধ হোক না

সারা পৃথিবীর উগ্র দক্ষিণপন্থীদের তো বটেই, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষদের মধ্যে অনেকেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করেই থাকেন “ওরা নিজেদের ধর্মের মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে না।” যখন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তর্কবিতর্কে আর সব যুক্তি ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন এই যুক্তিটাকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে ভেসে ওঠার চেষ্টা করে অনেকে। সামগ্রিকভাবে এই অভিযোগটার সত্যতা বা অসত্যতা নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না। আপাতত একটা ঘটনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছি।
কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের শাহি ইমাম বরকতিবাবু একের পর এক ফতোয়া জারি করে ইদানীং বেশ নাম করেছিল। ধর্মের চেয়ে রাজনীতিতেই যে বাবুর আগ্রহ বেশি তা বুঝতে কারো বাকি ছিল না। এবং লোকটি নিজেকে এতই মাতব্বর ভাবতে শুরু করেছিল যে সরকারী নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গাড়িতে লাল বাতি নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। লোকটার বিরুদ্ধে আমার হিন্দু বন্ধুবান্ধবদের মতই মুসলমান বন্ধুদের মধ্যেও বেশ কিছুদিন ধরে অসন্তোষ লক্ষ্য করছি — শুধু ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নয়, তার বাইরেও। আমাকে রোজই টিপু সুলতান মসজিদের সামনে দিয়েই অফিস যেতে হয়। ফলে প্রায় একবছর আগে থেকে আমার চোখে পড়েছে বিভিন্ন বিষয়ে ঐ এলাকার প্রধানত মুসলমান ব্যবসায়ীদের ঝোলানো পোস্টার, যেগুলো বরকতিবাবুর ঠিক উলটো কথা বলেছে। শেষমেশ গত সপ্তাহে দেখলাম একটা পোস্টারে বলা হয়েছে রাজনীতিকে মসজিদের বাইরে রাখা হোক। তারপরেই জানা গেল কয়েকদিন আগে মসজিদে ঢোকার মুখে বরকতিবাবুকে কিছু মুসলমান যুবক কয়েক ঘা দিয়েছেন। তারপর জানা গেল তার ইমাম পদটি গেছে।
মজার কথা আমাদের দক্ষিণপন্থীরা এখন বলতে শুরু করেছেন এটার কৃতিত্ব হিন্দুদের। মুসলমানরা এই রাজ্যটা দখল করে নিচ্ছিল। হিন্দুরা প্রবল প্রতিরোধ করেছে। তাতেই ঘাবড়ে গিয়ে নাকি মমতা এটা করালেন।
অর্থাৎ ডানদিকের বাবুরা মনে করেন মুসলমানদের মসজিদ, তাদের ইমাম — এসব তারা পরিচালনা করে না, তাদের নিজস্ব কোন মতামত নেই। বেশ কথা। তাহলে এরপর থেকে মুসলমানরা কেন প্রতিবাদ করে না এই কথাটা আর কখনো বলবেন না। মুসলমানরা যখন এতই ঠুঁটো জগন্নাথ তখন তারা আর প্রতিবাদ করবে কী করে? আপনারাই বলরাম হয়ে ওদের কাজগুলো করে দিন।
আরো অনুরোধ করি, হিন্দু প্রতিরোধের যখন এত শক্তি যে অন্য ধর্মের ইমাম বদলে দিতে পারে তখন নিজের ধর্মে নিশ্চয়ই আরো বড় বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে? তাহলে খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে একটা হিন্দু প্রতিরোধ হোক না। সবর্ণ বিবাহের বিরুদ্ধে একটা হিন্দু প্রতিরোধ হোক। হিন্দুদের বাধ্য করুন পাত্র/পাত্রী চাই এর বিজ্ঞাপনে “caste no bar” লিখতে। রাজ্যে নাহয় আপনাদের ভাষায় মমতাজের সরকার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান — এসব রাজ্যে গোরক্ষকবাহিনীর মত একটা বাহিনী হোক না যারা দলিতদের কুয়োয় যারা কেরোসিন তেল ঢেলে দেয় তাদের বেদম পেটাবে। হিন্দু প্রতিরোধের শক্তিতেই তো এন্টি-রোমিও স্কোয়াড হয়েছে? তা ঐ শক্তি দিয়ে একটা এন্টি-হাঙ্গার স্কোয়াড করুন না। হিন্দু প্রতিরোধের এত শক্তি আর দেশের ৭৮% হিন্দুর একজনও যাতে খালি পেটে না ঘুমোয় তার ব্যবস্থা করতে পারবেন না? ২২% মুসলমানের কথা নাহয় না-ই ভাবলেন। তাদের তো এতবছর ধরে আমরা দেশদ্রোহীরা খাইয়েদাইয়ে মোটা করেছি। আপনাদের রাজত্বে নাহয় তারা না-ই খেল।

যারে কয় ব্যালান্স

মানে ব্যালান্স ব্যাপারটা কিরকম বুঝলেন তো? আইসিস অধ্যুষিত সিরিয়ায় দাঁড়িয়ে আমাকে বলতে হবে যে আমি ক্যাথলিক গোঁড়ামির তীব্র সমালোচক, নইলে ধরে নেওয়া হবে যে আমি আইসিসের নিন্দা করছি মুসলমান বিদ্বেষবশত। ওখানে তার শাস্তি কী জানেন তো? পিনারাই বিজয়ন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যা করলে এখানে কোটিপতি হওয়ার অফার দেওয়া হয় আর কি। সিরিয়া এই জায়গাটায় আমাদের থেকে এগিয়ে আছে এখনো। ওদের কথা কম, কাজ বেশি

বাজারে একটা জিনিসের এখন দারুণ কাটতি — ভারসাম্য, বাংলায় আজকাল যারে কয় ব্যালান্স। সবেতেই ব্যালান্স রাখতে হবে। হিন্দুর বাঁদরামির নিন্দা করলেই মুসলমানেরও কোন একটা দোষ নিয়ে যারপরনাই গাল দিতে হবে, কোথাও দলিতদের বাড়িতে উঁচু জাতের লোকেরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে জেনে আমি যদি রেগে চিৎকার করি তাহলে সিগারেটের প্যাকেটের বিধিসম্মত সতর্কীকরণের মত সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলতেই হবে যে দলিতরা যদি এরকম করত সেটাও অন্যায় হত। কোথাও কোন সাঁওতাল মেয়ের উপরে পুলিসী নির্যাতনের নিন্দা করলেই আমাকে বলতে হবে “যদিও আমি সাঁওতালদের দেশবিরোধী কার্যকলাপকে সমর্থন করি না” (মানে দেশটা আমার বাপের জমিদারী আর সাঁওতালরা আমার প্রজামাত্র এবং কোন সাঁওতাল সরকারবিরোধী কিছু করল মানেই মেয়ে-বউরা আমার বৈধ খাদ্য হয়ে গেল)। আমাকে আরো বলতে হবে যে আমি সবার সমানাধিকারের পক্ষে, কাউকে কোন বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিপক্ষে। অর্থাৎ শিক্ষায় এবং চাকরিতে তফসিলি জাতি উপজাতির জন্য (আর ট্রেনে বাসে মহিলা ও বয়স্কদের ব্যাপারটা কী হবে?) আসন সংরক্ষণের বিপক্ষে। এই ভারসাম্য রক্ষা যদি আমি না করতে পারি তাহলেই আমি হিন্দুবিদ্বেষী/দেশদ্রোহী/মাওবাদী/সিকুলার। মনে রাখতে হবে এগুলো সমার্থক শব্দ।
মানে ব্যালান্স ব্যাপারটা কিরকম বুঝলেন তো? আইসিস অধ্যুষিত সিরিয়ায় দাঁড়িয়ে আমাকে বলতে হবে যে আমি ক্যাথলিক গোঁড়ামির তীব্র সমালোচক, নইলে ধরে নেওয়া হবে যে আমি আইসিসের নিন্দা করছি মুসলমান বিদ্বেষবশত। ওখানে তার শাস্তি কী জানেন তো? পিনারাই বিজয়ন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যা করলে এখানে কোটিপতি হওয়ার অফার দেওয়া হয় আর কি। সিরিয়া এই জায়গাটায় আমাদের থেকে এগিয়ে আছে এখনো। ওদের কথা কম, কাজ বেশি।
তা এই যে জনগণ ব্যালান্স দাবি করছে আমার থেকে তা নিশ্চয়ই এই জন্যে যাতে আমাদের দেশের ব্যালান্স নষ্ট না হয়? তা দেখা যাক কিরকম ব্যালান্সের মধ্যে বাস করি আমরা।
দেশের ৭৫% এর বেশি যারা তাদের ধর্মীয় নেতারা গলা উঁচিয়ে বলবে অন্যদের যেন বাড়তে না দেওয়া হয়। “বড্ড বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ চারটে পাঁচটা করে বাচ্চার জন্ম দেওয়া যাতে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকতে পারি।” মানে জনসংখ্যায় ব্যালান্স এসে যাচ্ছে বলে ভয় দেখানো এবং যেন না আসে তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে বলা।
এরপরে আবার এদেশে ব্যালান্সের কথা বলা হয় কোন মুখে?
গেরুয়া পরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী জাগতিক দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে বসবে অনর্গল সাম্প্রদায়িক বিষ বমনের পর এবং তাকে বলা হবে জননেতা অথচ গৃহী মুসলমানকে বলা হবে “সাম্প্রদায়িক নেতা” যেহেতু তার গালে দাড়ি আর মাথায় ফেজ।
এই দেশে ব্যালান্স বজায় রাখতে হবে।
কারোর যথেষ্ট প্রমাণ না থাকতেও ফাঁসি হবে “সমবেত বিবেক” কে উপশম দিতে আর কেউ প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েও মন্ত্রী সান্ত্রী হবে, কোটি কোটি লোকের পূজনীয় হয়ে উঠবে। পঁচিশ বছর পর কাঠগড়ায় দাঁড়ালে লোকে এমন করবে যেন বেচারা ভগৎ সিং।
এই দেশে ব্যালান্স বজায় রাখতে হবে! আমরা কি নাগরিক না ট্রাপিজের খেলোয়াড়?
এক ভদ্দরলোক আবার সারাজীবন শীতকালে খোলামাঠে লাউডস্পিকারে গান গেয়ে পয়সা কামালেন, এখন লাউডস্পিকারে নামাজ শুনে ঘুমোতে পারছেন না। লোকে দ্বিচারিতাটা ধরে দিতেই ঝুলি থেকে ব্যালান্স বার করলেন — “গুরুদ্বার, মন্দির সবের কথাই বলছি। মসজিদে আপত্তি নেই, লাউডস্পিকারে আপত্তি।” মুম্বাই শহরে থেকে গণেশ চতুর্থীর হুজ্জত নিয়ে কিন্তু কোনদিন কিছু বলেছেন বলে অভিযোগ নেই। সেই সিরিয়ায় দাঁড়িয়ে ক্যাথলিকদের সমালোচনা আর কি। তবে এঁর চালাকিকে ব্যালান্স করার মত নির্বোধও তো আছে আমাগো দ্যাশে। তেমন একজনের কল্যাণে উনি এখন কামিয়ে কামানোর চেষ্টা করছেন। নাম কামাতে সফল হয়েছেন এর মধ্যেই, অনেকদিন পর। তবে পয়সা কামাতে হয়ত সফল হবেন না কারণ যে নির্বোধ দশ লাখ দেবে বলেছিল তার বোধহয় টাকা কম পড়েছে, তাই নতুন নতুন শর্ত দিচ্ছে। আসলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করতে হয় না তো (যাদের হয় তারা ফতোয়া দেয় না কারণ তাদের টাকার দাম আছে), তাই ব্যালান্স চেক করার অভ্যাসটা নেই।
একটা গোটা দেশের এহেন কেমিক্যাল ইমব্যালান্স নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।

নির্বাচিত ক্রোধ

অনেকদিন আগে একটা বই পড়েছিলাম — নির্বাচিত কলাম। সে বইয়ের লেখিকা তসলিমা নাসরিন দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অগ্রগণ্য নারীবাদী, প্রগতিশীল লেখিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। নিজের দেশ থেকে মুসলমান মৌলবাদীদের যাতনায় নির্বাসিত হয়ে দীর্ঘদিন এই বাংলায় ছিলেন। একই ধর্মের উগ্রবাদীদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ২০০৭ এ পশ্চিমবঙ্গের ধ্বজভঙ্গ সরকারের তাঁকে চলে যেতে বলা নিঃসন্দেহে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। মৌলবাদের যাতনায় মায়ের দেশ এবং মাসির দেশ (শিবনারায়ণ রায়ের ভাষায়) ছাড়তে বাধ্য হওয়া এই সাহিত্যিক শ্রীজাত, মন্দাক্রান্তার পাশে দাঁড়াবেন আশা করছিলাম। গতকাল দেখলাম দাঁড়িয়েছেন, তবে ছায়া এড়িয়ে। ভারতের অনেক জায়গায় এখনো উঁচু জাতের লোকেরা যেভাবে নীচু জাতের ছায়া এড়িয়ে দাঁড়ায়, সেভাবে

taslima

১৯৮০ সালে মুক্তি পায় ‘হীরক রাজার দেশে’। অনেকেই মনে করেন ছবিটা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিক্রিয়া। ওটা মুক্তি পাওয়ার সময়ে ভারতে “selective outrage” কথাটা চালু হয়নি। হয়নি বলেই কংগ্রেসিরা বা ইন্দিরা সমর্থকেরা প্রশ্ন তোলেনি “এমার্জেন্সির অত্যাচার নিয়ে ছবি করেছেন। ইংরেজের অত্যাচার নিয়ে ছবি করেননি কেন?”
“Selective” আর “outrage” দুটো শব্দই ইংরিজি ভাষায় থাকলেও পাশাপাশি বসিয়ে নতুন অর্থ দেওয়ার কথা সম্ভবত ১৯১৯ সালে ইংরেজদের মাথাতেও আসেনি। নইলে রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করার পরে সরকার বাহাদুর বলতেই পারতেন “Where were you when Mughals killed Sikhs in Sikh-Mughal wars? Why this selective outrage?”
ভারতীয় দক্ষিণপন্থীদের এক অনন্য অবদান এই “selective outrage”। কী বাংলা হওয়া উচিৎ এর? “নির্বাচিত ক্রোধ?” আচ্ছা উন্মাদ ছাড়া কেউ কি সবেতেই রেগে যায়? নাকি সকলে একই জিনিসে ক্রুদ্ধ হন? আপনি কখনো কোন দক্ষিণপন্থীকে দেখেছেন ভারতে বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে মুসলমান আর দলিতদের অস্বাভাবিক বেশি অনুপাত নিয়ে “outraged” হতে? পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মগুরুদের প্রভাব নিয়ে সরব হলেও গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীকে মুখ্যমন্ত্রী করায় “outraged” হননি এরকম লোকেরাই তো এদেশে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। একেও কি “selective outrage” বলা উচিৎ? যাঁরা জাকির নায়েককে উস্কানিমূলক কথাবার্তার জন্য হাতকড়া পরাতে চান কিন্তু যোগী আদিত্যনাথকে একটা সুযোগ দিতে চান তাঁদের রাগকে কি নির্বাচিত ক্রোধের দলে ফেললে খুব অন্যায় হবে?
আসলে “outrage” বা ক্রোধ একটি মানবিক অনুভূতি, যা নির্ভর করে কোন বিষয়ে একজন মানুষের “opinion” বা মতামতের উপর। দক্ষিণপন্থীদের মত হল ভারতীয় মুসলমান এবং দলিতরা মায়ের পেট থেকেই পড়েই অপরাধী হয়ে যায়। সুতরাং অন্যদের চেয়ে তারা বেশি কারারুদ্ধ হবে, এতে আর ক্রুদ্ধ হওয়ার কী আছে? পাকিস্তান, বাংলাদেশের ধর্মগুরুরা অত্যন্ত রক্ষণশীল কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ হাইটেক প্রগতিশীল অতএব তাঁর কথা আলাদা — এই হচ্ছে তাঁর সমর্থকদের মতামত। সেইজন্যেই এনার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া নিয়েও এঁদের কোন outrage নেই। জাকির নায়েক যে ধর্মের লোক সে ধর্মের লোকেরা সন্ত্রাসবাদী হয় তাই তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা দরকার কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ যতই প্রকাশ্য সভায় বলে থাকুন যে “একজন হিন্দু মরলে আমরা এফ আই আর করতে যাব না, কম করে দশজন মুসলমানকে মারব”, তাঁর প্রশাসক হিসাবে একটা সুযোগ প্রাপ্য যেহেতু হিন্দুরা সন্ত্রাসবাদী হয় না, আজমের বিস্ফোরণে দোষী সাব্যস্ত হলেও “activist” হয়।
এই মতামতগুলো ভাল কি মন্দ, ন্যায় কি অন্যায় সে আলোচনায় যাচ্ছি না, কিন্তু দক্ষিণপন্থীদের ক্রোধও যে নির্বাচিত সেটা কিন্তু এ থেকে বোঝা যাচ্ছে। এবং সেজন্যে তাঁদের গাল পাড়ছি না কারণ তাঁদের মতামতানুসারেই তাঁরা ক্রুদ্ধ হবেন। সেটাই স্বাভাবিক। গাল পাড়ব মতামতগুলোর জন্য, নির্বাচিত রাগের মত কোন কাঁঠালের আমসত্ত্বের জন্য নয়।
অনেকদিন আগে একটা বই পড়েছিলাম — নির্বাচিত কলাম। সে বইয়ের লেখিকা তসলিমা নাসরিন দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অগ্রগণ্য নারীবাদী, প্রগতিশীল লেখিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। নিজের দেশ থেকে মুসলমান মৌলবাদীদের যাতনায় নির্বাসিত হয়ে দীর্ঘদিন এই বাংলায় ছিলেন। একই ধর্মের উগ্রবাদীদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ২০০৭ এ পশ্চিমবঙ্গের ধ্বজভঙ্গ সরকারের তাঁকে চলে যেতে বলা নিঃসন্দেহে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। মৌলবাদের যাতনায় মায়ের দেশ এবং মাসির দেশ (শিবনারায়ণ রায়ের ভাষায়) ছাড়তে বাধ্য হওয়া এই সাহিত্যিক শ্রীজাত, মন্দাক্রান্তার পাশে দাঁড়াবেন আশা করছিলাম। গতকাল দেখলাম দাঁড়িয়েছেন, তবে ছায়া এড়িয়ে। ভারতের অনেক জায়গায় এখনো উঁচু জাতের লোকেরা যেভাবে নীচু জাতের ছায়া এড়িয়ে দাঁড়ায়, সেভাবে।
“শ্রীজাত, মন্দাক্রান্তার পাশে আছি কারণ আমি বাকস্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু….” সেই নির্বাচিত ক্রোধের তত্ত্ব। ওঁকে কলকাতা থেকে যখন চলে যেতে বলা হয় তখন কিছু বলেনি কেন? এরা কেবল হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলে। কোথায় ছিল এরা যখন তামিলনাডুর নাস্তিক এইচ ফারুককে হত্যা করা হল? খাগড়াগড় নিয়ে কবিতা লেখেনি কেন? ধূলাগড় নিয়ে লেখেনি কেন? রোজ কত মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়, তসলিমাকেই কত হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাই নিয়ে বলে না কেন?
“তখন বলেনি এখন বলছে কেন” যুক্তিটা কতটা খেলো সেটা আগেই বলেছি। দুরভিসন্ধিযুক্ত শাসক বা নিজের কুকীর্তি ঢাকতে ব্যস্ত কেউ ছাড়া অন্য লোক প্রতিবাদের বিরুদ্ধে এই যুক্তি খাড়া করে না। তসলিমা কেন করলেন সেটা ভাববার বিষয়। কিন্তু আর যা যা বলেছেন সেগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে।
এরা কেবল হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলে। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম কথাটা একশোভাগ সত্যি। এবার বলি, বেশ করে। এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে প্রথমেই মৌলবাদীরা যেটা করে সেটা হল তার ধর্মকে বিধর্মী আক্রমণ করেছে বলে চেঁচিয়ে মৌলবাদী নন এমন মানুষদেরও সহানুভূতি আদায় করা। তাই করেই মকবুল ফিদা হুসেনকে তাড়ানো হয়েছিল। তসলিমাও বেশ করেন কেবল মুসলমান মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। তিনিই বা কবে কালবুর্গি বা নরেন্দ্র দাভোলকারের হত্যার ব্যাপারে কড়া বিবৃতি দিলেন? উলটে বলেছিলেন কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় প্রমাণ হয় না ভারত অসহিষ্ণু।
এবার তর্কের খাতির দূর করে বাস্তবে আসি। তসলিমা যথেষ্ট না জেনেই অভিযোগটা করে বসেছেন। শ্রীজাত ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লিখছেন। বাংলাদেশে ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে তিনি এতটাই সরব ছিলেন যে কবীর সুমন তাঁকে মুসলমানবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে প্রায় গালিগালাজ করেছিলেন ফেসবুকেই।
খাগড়াগড় নিয়ে লেখেনি কেন? ধূলাগড় নিয়ে লেখেনি কেন? প্রশ্নগুলো এমন একজন করেছেন যিনি নাকি নিজে কবিতা লেখেন। অবাক লাগছে ভাবতে যে একজন কবি প্রায় রাজনৈতিক নেতার মত ভাষায় নির্ধারণ করতে চাইছেন কবিকে কোন কোন ঘটনা নিয়ে লিখতে হবে। কবি তা নিয়েই লিখবেন যা নিয়ে তাঁর লিখতে ইচ্ছা করে। কবি সাংবাদিক নন। এটা তসলিমা জানেন না? আর ধূলাগড়? একজনও মানুষ মারা গেছে ওখানে? একটিও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে? ঘরেদোরে আগুন ধরানো হয়েছিল। সেই সংক্রান্ত অপরাধে ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিলকে তাল কোন না কোন উদ্দেশ্য নিয়েই করা হয় বলে জানি। সোশাল মিডিয়ার গুন্ডাদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়। তসলিমাকে সেই দলে ফেলতে যে মন চায় না।
খাগড়াগড়? সে তো আরেক কান্ড। বিস্ফোরণের পর থেকে মৃত অভিযুক্তের নাম বদলাতে বদলাতে কোথা থেকে কোথায় যে গিয়ে পৌঁছেছে। হাজার হাজার ডক্টর হাজরা একেবারে। এন আই এ তদন্ত করছে, কয়েকজনকে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, এদিকে যে নাকি নাটের গুরু সে গত ২৮শে মার্চ সিলেটে নিহত হয়েছে। এটা নিয়ে কবির কী লেখার ছিল বুঝলাম না। আচ্ছা একটা প্রতিপ্রশ্ন করি? এই যে কদিন আগে আজমের ব্লাস্টে দুই আর এস এস কর্মীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হল, তসলিমার কি এই নিয়ে কিছু লেখা উচিৎ ছিল? যাক গে।
মন্দাক্রান্তাকে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে তসলিমা যা বলেছেন সেটা পড়ে হাসব না কাঁদব এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। এরকম হুমকি তো কত মেয়েই পায়। এখন মন্দাক্রান্তা পেয়েছে বলে লোকে হৈ হল্লা করছে — এই হল তসলিমার খেদ। ঠিকই তো। ভারতে রোজ কত মেয়ে ধর্ষিতা হচ্ছে, হঠাৎ নির্ভয়াকে নিয়ে সকলের অত চেগে ওঠার কী দরকার ছিল ভগবান জানে। বহু মেয়ে ধর্ষণের হুমকি পায় এবং ভয়ে কুঁকড়ে যায়, চুপ করে যায়, অনেকসময় হুমকিবাজরা দেখিয়ে দেয় তারা মুখেন মারিতং জগৎ নয়। ধর্ষণের পর মেয়েটি আরো নীরব হয়ে যায়। মন্দাক্রান্তা সেনেরও উচিৎ ছিল চুপচাপ হয়ে যাওয়া, প্রয়োজন হলে ফেসবুক ছেড়ে দেওয়া, অতঃপর দরজা জানালা এঁটে বাড়িতে বসে থাকা। এরকমটাই আপনার থেকে আশা করেছিলাম, তসলিমা দেবী। এই না হলে নারীবাদী?
আপনি চালিয়ে যান, ম্যাডাম। আপনি পুরো ব্যাপারটাকেই দাঁড় করালেন বুদ্ধিজীবী বনাম বুদ্ধিজীবী হিসাবে। আপনি শ্রীজাতর পাশে আছেন কিনা সেটা তো বড় কথা নয়, বড় কথা হল আপনি দাঙ্গাবাজের রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার পক্ষে না বিপক্ষে। সে ব্যাপারে আপনি একটা শব্দও খরচ করেননি। আপনার নীরবতা মুখর।

কয়েকটা প্রাসঙ্গিক লিঙ্ক

http://www.outlookindia.com/…/taslima-questions-sri…/1018138
http://m.economictimes.com/…/wont-…/articleshow/51564448.cms
http://twocircles.net/2014dec03/1417616083.html
http://www.timesnow.tv/…/mastermind-behind-2014-burdw…/58316

বিজ্ঞান, অপবিজ্ঞান ও কাঁচকলা

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের লোকেরা আজকে জে এন ইউ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মার খেতে দেখে যেন ভাববেন না আপনাদের উপরে কোন আক্রমণ আসবে না। যে উদাহরণটা দিলাম ওটা যে কোনদিন সত্যি হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রাচীন ভারতের বিমান প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। অমর্ত্য সেনকে যারা মূর্খ বলে তারা যে অশোক সেনকে বেশিদিন পন্ডিত বলে মানবে এমন মনে করা যুক্তিসঙ্গত নয়

১৯৮০র দশকে যখন প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডিও পেরোইনি তখন থেকেই আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম যে উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা না করে উপায় নেই। অর্থাৎ চাকরিবাকরি পাওয়া যাবে না। একটু বড় হতেই শুনলাম শুধু বিজ্ঞান পড়াও যথেষ্ট নয়, ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। নাহলে লেখাপড়া করার মানেই হয় না। ঘটনাচক্রে আমার বাবা শিক্ষক, একজন বাদে অন্য জ্যাঠারা শিক্ষক/অধ্যাপক, মামা মাসিরাও ঐ পেশায়, এমনকি মায়ের মামা মাসি, মেসোরাও অনেকে তাই। কিন্তু যা বুঝতাম সেটা হল ওঁদের সময়ে মাস্টার হওয়া ভাল ছিল কিন্তু আমার প্রজন্মের ভদ্রঘরের ছেলেকে (মেয়ে হলে অন্যরকম চলতে পারে, কারণ “সেই তো বিয়ে দিতে হবে”) ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে।
কতকটা নিকটাত্মীয়দের বেশিরভাগ শিক্ষকতায় থাকার ফলে, অনেকটাই বাবা-মায়ের ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনার সুবাদে আর খানিকটা বরাবর অতি সাধারণ ছাত্র হওয়ার ফলে আমার উপরে বিজ্ঞান পড়ার বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চাপ কখনো এসে পড়েনি। নিজের ইচ্ছামতই স্কুল ছাড়ার পরে কলা বিভাগের ছাত্র হতে পেরেছিলাম। তারপর ইংরিজি সাহিত্যের অযোগ্য ছাত্রও হতে পেরেছিলাম। কিন্তু অনেক যোগ্যতর সহপাঠীকে দেখেছি যারা এই স্বাধীনতাটা পায়নি। গান বাজনায় প্রবল আগ্রহ, নিচু ক্লাস থেকেই রাজনৈতিকভাবে খুব সচেতন, বইপাগল অনেক সহপাঠীকে দেখেই মনে হত, এখনো হয়, যে তারা সাহিত্য বা সমাজবিজ্ঞানে ভাল অবদান রাখতে পারত। যারা পারেনি তাদের অপরাধ তারা পরীক্ষায় চমৎকার নম্বর পেত। ভাল নম্বর পাওয়া ছেলেদের ইংরিজিতে যাকে humanities বলে তা নিয়ে পড়াশোনা করা একেবারে বারণ ছিল। ফলে তারা এদেশের লক্ষ লক্ষ ডাক্তারের একজন হয়েছে বা কোন বহুজাতিকের হয়ে সফটওয়্যার কোড লিখে দিন কাটাচ্ছে। যারা কোনভাবে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গিয়ে ধ্যাড়াতে পেরেছিল তারা তবু উপকৃত হয়েছে, সাহিত্যের বা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায়, শিক্ষকতায় সরে এসে নিজের বিষয়কে এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে। যারা অন্ততপক্ষে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ব্যর্থ হতে পেরেছিল তারাও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণায় বা মাস্টারিতে প্রাণ ঢেলে দিয়ে সুখী হয়েছে।
এ থেকে যা প্রমাণ হয় তা হল প্রায় চল্লিশ বছর আগে থেকেই আমাদের দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের মধ্যে চালু ধারণা হল সমাজবিজ্ঞান এবং সাহিত্য ফালতু বিষয়, বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে ব্যর্থ হলে বা মেধায় না কুলোলে তবেই ওগুলো পড়া যেতে পারে। ওগুলো এমনকি দ্বিতীয় পছন্দও নয় অনেকের কাছেই। শুধু মাড়োয়ারি নয়, অনেক বাঙালি পরিবারেও দেখেছি উচ্চ মাধ্যমিকে খারাপ নম্বর পেলে বি কমে ঢুকে পড়তে বলা হত। এর একটা কারণ এই যে কোন এক অজ্ঞাত কারণে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল কলাবিভাগে পড়লে অর্থকরী চাকরি পাওয়া যায় না। ততদিনে কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের ভদ্রস্থ মাইনে দিতে শুরু করেছে।
এই মানসিকতার পরিবর্তন তখনো হয়নি যখন অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রায় এক দশক পরে শিল্পে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের প্রভাবে চাকরিবাকরি কমতে শুরু করল। এই যে সকলকে ঠেলেঠুলে বিজ্ঞান প্রযুক্তি পড়ানো এই প্রবণতাকে কিছুটা সদর্থক বলা যেত যদি এর কারণটা শুধুই পেশাগত না হয়ে মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা হত। কিন্তু ঘটনা একেবারেই সেরকম ছিল না। আমাদের এক অধ্যাপক আবশ্যিক বাংলার ক্লাসে একবার বলেছিলেন “তোমরা এতজন যে বিজ্ঞানে অনার্স পড় তার কারণ এই নয় যে তোমরা সবাই বিজ্ঞানকে খুব জরুরী জিনিস মনে কর। তোমরা পড় কারণ একটা প্রচার আছে যে বিজ্ঞান পড়লে ভাল চাকরি পাওয়া যায়। যদি কুসংস্কারে অনার্স পড়লে ভাল চাকরি পাওয়া যেত তাহলে তোমরা কুসংস্কারেই অনার্স পড়তে।” কথাটা বলে তিনি অনেক ছাত্রের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, কিন্তু কথাটা সত্যি। সেসময়ে যারা লেখাপড়া করেছে তারা নিজের মনে জানে যে কথাটা সত্যি।
এতে কার ক্ষতি হয়েছে? বরাবর ভাবতাম যাদের জোর করে অপছন্দের বিষয় পড়ানো হয়েছে বুঝি শুধু তাদেরই ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি একটা বিরাট সামাজিক ক্ষতি হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যাদের ইতিহাসজ্ঞান বলে প্রায় কিচ্ছু নেই কারণ স্কুলে ইতিহাস পড়ার সময়ে এদের বলা হয়েছিল ওটা জরুরী বিষয় নয়, “মুখস্থ করে নম্বর পেয়ে গেলেই যথেষ্ট। মন দিয়ে অঙ্ক, বিজ্ঞান পড়”। ফলে আজকে আপনি এদের বলুন ভগৎ সিংকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, এরা পত্রপাঠ বিশ্বাস করে ফেলবে। এদের বলুন জওহরলাল নেহরু দেশের জন্য কিছুই করেননি, এরা বিশ্বাস করে ফেলবে। কারণ স্কুলের ইতিহাস বইতে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস যা পড়া হয়েছিল তার বিন্দুবিসর্গও এদের মনে নেই। মনে রাখার দরকার নেই ভেবে পড়লে মনে থাকার কথাও নয়। এদের বলুন নেহরুর বদলে সর্দার প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের চেহারা অন্যরকম হত। বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করে নেবে কারণ সন্দেহ হতে গেলে যে প্রাথমিক পড়াশোনা থাকতে হয় সেটাই নেই। থাকলে গুগল করেই জানতে পারত যে সর্দার নেহরুর চেয়ে ১৪ বছরের বড় এবং ১৯৪৭এ দেশ স্বাধীন হয় আর সর্দার মারা যান ১৯৫০এ। প্রধানমন্ত্রী হলেই বা তিনি দেশটা গড়ার সময় পেতেন কখন?
কিন্তু ক্ষতির শেষ শুধু ইতিহাসচেতনাহীনতায় নয়। আরো বড় ক্ষতি এই যে ভারতীয়দের বিরাট অংশ মনে করে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলোর কোন কার্যকারিতা নেই, এগুলো অধ্যয়ন করতে কোন মেধা লাগে না, যে কেউ এগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে। এই চিন্তার কারণেই সোশাল মিডিয়ায় এবং তার বাইরেও দেখবেন বলা হয় যাদবপুর, জেএনইউ, এফ টি আই আই তে যারা পড়ে তারা হল “ফ্রি লোডার”, তাদের কোন কাজ নেই, শুধু নেশা করে। চট করে কোন আই আই টি সম্পর্কে এরকম বলতে শুনবেন না। অথচ আই আই টির ছেলেমেয়েরাও সরকারী ভর্তুকি পায়, তাদের কেউ কেউও নেশা করে। কেউ বলছে “অমর্ত্য সেন অর্থনীতির কী বোঝেন? ওনার থেকে বড়বাজারে যে ব্যবসা চালায় সে ভাল বোঝে।” আবার কেউ হয়ত বলছে “ফলি নরিম্যান চিফ জাস্টিস ছিলেন বলেই কিসে সিডিশন হয় জানেন তা প্রমাণ হয় না। উকিলরা সব বদমাইশ।”
অথচ কখনো শুনবেন না কেউ বলছে “এ পি জে আব্দুল কালাম বিজ্ঞানের কী বুঝত?” শুনবেন না কারণ গড়পড়তা লোকের ধারণা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করে তারা মেধাবী এবং তাদের কাজ দেশের কাজে লাগে। সমাজবিজ্ঞানের আওতায় কী পড়ে, সেগুলো যে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে নির্ধারক ভূমিকা নেয়, বস্তুত একজন প্রযুক্তিবিদ বা পদার্থবিদের কাজের চেয়ে একজন অর্থনীতিবিদ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর কাজের প্রভাবই যে একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনে বেশি প্রত্যক্ষ সেকথা বোঝার শক্তি লেখাপড়া জানা ভারতবাসীর অধিকাংশেরই আজ নেই। অথচ যদি সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব কম হত তাহলে উমর খালিদকে বাস্তার নিয়ে সেমিনারে বক্তৃতা দিতে আটকানো হত না, আই আই এস সি র পদার্থবিদ্যার কোন গবেষককে আটকানো হত স্ট্রিং থিওরি নিয়ে কোন বক্তৃতা দেওয়া থেকে। বলা হত “এসব বলা যাবে না। এগুলো বেদবিরোধী।”
প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের লোকেরা আজকে জে এন ইউ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মার খেতে দেখে যেন ভাববেন না আপনাদের উপরে কোন আক্রমণ আসবে না। যে উদাহরণটা দিলাম ওটা যে কোনদিন সত্যি হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রাচীন ভারতের বিমান প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। অমর্ত্য সেনকে যারা মূর্খ বলে তারা যে অশোক সেনকে বেশিদিন পন্ডিত বলে মানবে এমন মনে করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
যে ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়েছে তার ফল এখন কতদিন ভোগ করতে হবে কে জানে? নতুন বাবা-মায়েরা যদি সন্তানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করেন তাহলে সুদূর ভবিষ্যৎটা ভাল হয়।
দায়িত্বটা অবশ্য শেষ অব্দি শিক্ষাব্যবস্থাকেই নিতে হবে। প্রেসিডেন্সির দুশো বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেছিলেন উচ্চশিক্ষায় কলাবিভাগের ছাত্রছাত্রীদেরও অঙ্ক শেখানো উচিৎ। পন্ডিত মানুষ, হয়ত ঠিকই বলেছেন, তবে দেশের এই দুঃসময়টা কেটে গেলে বোধহয় আগে দরকার স্কুলস্তর থেকে যত্ন করে ইতিহাস পড়ানোর সাথে সাথে একেবারে প্রাথমিক স্তরের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতি পড়ানো।