ভালবাসার শক্তি

তারা খেলতে বেরিয়ে খুন হয়ে যাচ্ছে, পোষা জন্তুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষিত হয়ে গুমখুন হচ্ছে, অকারণে যখন তখন পিতৃহারা হচ্ছে, এমনকি শিশুদের শব ভেসে উঠছে আমাদের সমুদ্রতীরে

রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’ ছবিটা অসংখ্যবার দেখেছি। ছোটবেলার দোসরা অক্টোবরগুলোয় দেখতাম আর কিছু দেখার ছিল না বলে। পরে স্বেচ্ছায় দেখেছি বেশ কয়েকবার। যে দৃশ্যটা কিছুতেই ভুলতে পারি না সেটা হল বেলেঘাটায় গান্ধীজির অনশনের দৃশ্য।
অসুস্থ তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন, ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না থামলে অনশন ভাঙবেন না। কলকাতার দাঙ্গার হোতা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দিকে পাশে নিয়ে জনগণের কাছে নেহরু দাঙ্গা বন্ধ করার আবেদন করলেন, বললেন “আমাদের পাগলামির জন্যে গান্ধীজির জীবন বিপন্ন।“ তার পরের দৃশ্যে দাঙ্গাবাজরা গান্ধীজির পায়ের কাছে অস্ত্র ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তাদের মধ্যে থেকে এক ক্ষিপ্ত হিন্দু যুবক এসে কোন শিশুর পায়ের একপাটি জুতো ছুঁড়ে মারল তাঁর বুকের উপর।
“খাও এটা। খাও। আমি তো নরকে যাবই। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পাপ নিয়ে যাব না।“
“সে তো শুধু ঈশ্বর জানেন কে নরকে যাবে,” গান্ধীজির উত্তর।
“খুন করেছি আমি। একটা ছোট বাচ্চাকে। মাথাটা দেয়ালে ঠুকে মেরে ফেলেছি।“
“কেন?”
“কেটে ফেলেছে… আমার এইটুকু বাচ্চাটাকে… মুসলমানরা মেরে ফেলেছে।“
“এই শোক কাটিয়ে ওঠার একটা রাস্তা আছে। এমন একটা বাচ্চাকে খুঁজে বার কর যার বাবা-মা খুন হয়ে গেছে। তাকে মানুষ কর। বাচ্চাটা যেন মুসলমান হয়। আর সেভাবেই তাকে মানুষ কোর।“
বিস্ফারিত নেত্রে একথা শোনার পর চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসে গান্ধীর পায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ে সেই সন্তানহারা, শিশুহন্তা পিতা। ক্ষমা প্রার্থনা করে।
যতবার দেখেছি ছবিটা, এই জায়গাটায় এসে মন বিদ্রোহ করেছে। মনে হয়েছে এমনটাই হওয়া উচিৎ বটে কিন্তু একমাত্র গান্ধীর উচ্চতার মানুষই ওভাবে ভাবতে পারেন। একজন সাধারণ মানুষ কি পারে? অসম্ভব, এ অসম্ভব।
একেবারে অসম্ভব যে নয় তার প্রমাণ পেতে অপেক্ষা করতে হল এই অবিশ্বাসী মধ্যবয়স অবধি। যখন রামনবমীর মিছিল নিয়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে আততায়ীরা আসানসোলের এক মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমদাদুল রশিদির কিশোর সন্তানকে খুন করল, আর তিনি বললেন যদি কেউ এর প্রতিক্রিয়ায় কোনরকম হিংসার আশ্রয় নেয় তাহলে তিনি মসজিদ ছেড়ে, আসানসোল ছেড়ে চলে যাবেন।
সেটা এবছর মার্চ মাসের ঘটনা। ঠিক তার আগের মাসে অঙ্কিত সাক্সেনা বলে এক হিন্দু যুবককে খুন করা হয় মুসলমান মেয়েকে ভালবাসার অপরাধে। তার বাবা যশপাল সাক্সেনাও একগলা পুত্রশোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলেন “হ্যাঁ আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে তারা মুসলমান। কিন্তু তা বলে সব মুসলমানকে খুনী বলে দেগে দেওয়া যায় না। সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর কাজে আমাকে ব্যবহার করবেন না। ব্যাপারটাকে ধর্মের সঙ্গে জড়াবেন না, পরিবেশ বিষিয়ে দেবেন না।“
কিন্তু কে শুনছে তাঁর কথা, তাঁদের কথা? অপরবিদ্বেষ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। যার চামড়ার রং আমার মত নয় তার প্রতি বিদ্বেষ, যে আমার ভাষায় কথা বলে না তার প্রতি বিদ্বেষ, যে মূলত আমার রাজ্যের বা দেশের বাসিন্দা নয় তার প্রতি বিদ্বেষ, যার খাদ্যাভ্যাস আমার মত নয় তার প্রতি বিদ্বেষ, সর্বোপরি যে অন্য ধর্মের লোক তার প্রতি বিদ্বেষ।
এই সর্বব্যাপী বিদ্বেষ দিয়ে আমরা আমাদের শিশুদের জন্যে এক ভয়াবহ পৃথিবী তৈরি করেছি। তারা খেলতে বেরিয়ে খুন হয়ে যাচ্ছে, পোষা জন্তুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষিত হয়ে গুমখুন হচ্ছে, অকারণে যখন তখন পিতৃহারা হচ্ছে, এমনকি শিশুদের শব ভেসে উঠছে আমাদের সমুদ্রতীরে।
নব্বইয়ের দশক থেকে সৌদি আরবপুষ্ট যে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ পৃথিবীজুড়ে থাবা ছড়িয়েছিল তার কার্যক্রম ছিল জনবহুল জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ বা কয়েকজন সন্ত্রাসবাদীকে দিয়ে কোন জনবহুল জায়গায় মানুষকে বন্দী করে গণহত্যা। দীর্ঘদিন সাধারণ মানুষের মাঝখানে নিতান্ত সাধারণ হয়ে ঘোরাফেরা করত সেই সন্ত্রাসীরা। যাদের পারিভাষিক নাম স্লিপার সেল। একদিন অতর্কিতে হানা দিত তারা, প্রায়শই আত্মহনন যার অঙ্গ। আল কায়দা থেকে আইসিসের হাত ঘুরে অধুনা সেই সন্ত্রাসবাদ অনেকাংশে স্তিমিত। এখন পৃথিবীর সর্বত্র দেখছি স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাস আরো নির্দিষ্ট, আরো ব্যক্তিগত। কোথাও গোপন শিবির করার দরকার হচ্ছে না, মৌলবাদী ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ মস্তিষ্কে গুঁজে দেওয়ার জন্যে প্রয়োজন পড়ছে না কোন দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের। হাতের স্মার্টফোনেই চলে আসছে উশকানিমূলক প্রোপাগান্ডা, চতুর ভুয়ো খবর। এখানে আলাদা করে কোন স্লিপার সেল নেই কারণ আমি, আপনি, আমরা সবাই একেকজন স্লিপার সেল। হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, অর্ণব গোস্বামী ও সম্প্রদায় প্রকাশ্যেই আমাদের মধ্যে অহোরাত্র বুনে যাচ্ছে ঘৃণার বীজ। আমাদের কোষে কোষে ঘুমিয়ে থাকা সেই ঘৃণা মুহূর্তে আমাদের করে তুলছে সন্ত্রাসবাদী। যে মুহূর্তে কেউ ছড়িয়ে দিল অমুকের ফ্রিজে গরুর মাংস রাখা আছে, এই আমি, এই আপনি দৌড়লাম তাকে পেটাতে। কেউ চিৎকার করে বলল অমুক গরু চুরি করে পালাচ্ছে। সবাই মিলে পেটাতে গেলাম তাকে। মারতে পাশবিক সুখ হচ্ছে। মারতে মারতে মরে গেলে আরো সুখ।
আমি, আপনি মানুষ মারছি আর আমাদের দেখে ছোটরাও শিখছে মানুষ খুন করা নেহাত জলভাত। আফরাজুলকে খুন করে পুড়িয়ে দিয়েছিল যারা তাদের মধ্যে ছিল কয়েকজন চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলে। আট বছরের আসিফার ক্রমাগত ধর্ষণ এবং খুনেও যুক্ত ছিল এক অপ্রাপ্তবয়স্ক। মাদ্রাসার ছাত্র আজিমকে খুন করে ফেলল অপ্রাপ্তবয়স্করাই। শুধু গ্রীনহাউস গ্যাস নয়, ঘৃণার বিষবাষ্পে পরিপূর্ণ এক বায়ুমন্ডলে বেড়ে উঠছে আমার, আপনার সন্তান। শুধু বড়দের কাছে নয়, সমবয়স্কদের সাথেও সে নিরাপদ নয়। আজকাল মনে হয় শিশুরা জন্মাচ্ছে হয় খুন হতে নয় খুনী হতে। নিরন্তর শক্তিক্ষয় হচ্ছে — ভালবাসার শক্তি। যে শক্তি একটুও অবশিষ্ট থাকলে শেষ পর্যন্ত খুন করা থামিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া যায়।
হিন্দুরা যাকে নরক বলেন, মুসলমানরা বলেন দোজখ, খ্রীষ্টানরা Hell, তা বোধহয় এমন পৃথিবীর চেয়ে ভয়ঙ্কর নয়।

%d bloggers like this: