অহৈতুকী পার্টিজানপ্রীতি

লক্ষ্য করুন বামপন্থী রাজনীতির কার্যকলাপের দায় নিতে হল মৃণাল সেনের ছবিকে। এটা আর কোন চলচ্চিত্র নির্মাতার ক্ষেত্রে হয় বলে মনে হয় না

মৃণাল সেন প্রতিভাবান, মৃণাল সেন এ দেশে নতুন ধারার চলচ্চিত্রের দিকপালদের একজন, মৃণাল সেনের লেখার হাত চমৎকার — এসব গুণ সত্ত্বেও তাঁর একটা বড় দোষ তিনি রাজনৈতিক। ছবিতে বা ছবির বাইরে তিনি কখনো পাঁচিলের উপর বসে সিগারেট হাতে পা দোলাননি। নিরপেক্ষ হতে তাঁর বয়ে গেছে।
শুধু রাজনৈতিক নয়, তিনি প্রায়শই পার্টিজান। তাঁর ছবির রঞ্জিত মল্লিক যে চাকরি স্যুটেড বুটেড হওয়াটাকেই যোগ্য হওয়ার প্রাথমিক শর্ত বলে মনে করে সেই চাকরি না পেয়ে স্যুট বুটের দোকানে আধলা ইঁট ছুঁড়ে মারে। তাঁর ছবিতে ফিল্ম ইউনিট নিজেদের শৌখিন মানবপ্রেমের অসারতা উপলব্ধি করে শুটিং বন্ধ করে ফিরে যায়। অতএব গত পরশু অব্দিও মৃণাল সেন আজকের ভদ্রলোকদের পাঞ্চিং ব্যাগও ছিলেন। প্রমাণ চাই? দিচ্ছি।
হয়ত আমার নিজের মুদ্রাদোষেই অদ্ভুত সব কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই রবিবাসরীয় কাগজে দেখলাম এক স্বনামধন্য প্রাক্তন আমলা নতুন বাঙালিদের নিয়ে লিখেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন আজকের বাঙালি যে বাংলার সংস্কৃতি ভুলে গেছে, হিন্দি, ইংরিজি, বাংলা মিশিয়ে আজব ভাষায় কথা বলছে তার দায় যে নির্দিষ্ট কোন সরকারের ঘাড়ে চাপানো উচিৎ তা নয় তবে এর জন্যে আসলে দায়ী ষাটের দশক থেকে শুরু হওয়া বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। তার ফলেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে পুঁজির পলায়ন, আর তারই দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল নাকি বাঙালির ক্রমশ অবাঙালি হয়ে ওঠা। অবশ্য এমন নয় যে এই অভিযোগ ইনিই প্রথম করলেন। জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর আউটলুক পত্রিকায় তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ও একই কথা লিখেছিলেন। কিন্তু যে কারণে সেই আমলার লেখাটার কথা এখানে উল্লেখ করছি সেটা হল তিনি এক জায়গায় লিখেছেন
“এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আগের প্রজন্মের মতো কেবল পাড়ার মোড়ে বা রকে বসে আড্ডা না দিয়ে, কিংবা সরকারি চাকরি হল না — এই ক্ষোভে নিজেদের নষ্ট না করে রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করে। স্থানীয় কাউন্সিলরের আশীর্বাদে ধন্য হলে তারা ছোট ছোট হকার স্টল খোলে কিংবা জ়োম্যাটো, সুইগি, ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজ়ন-এর মতো সংস্থার হয়ে মোটরবাইক চড়ে ডেলিভারি বয়ের কাজ করে। তারা কল সেন্টার বা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে, আন্দোলনের চাহিদা ছাড়াই। তারা ঘাম ঝরায়, কিন্তু ১২ জুলাই কমিটির নাম শোনেনি কোনও দিন। এরা ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ দুনিয়ায় ওতপ্রোত জড়িত, মোবাইল রিচার্জ বা ওটিপি ব্যবহারে চোস্ত, কিন্তু এরা কেউ কোনও দিন সাহিত্যপত্রিকা বা জীবনানন্দের কবিতা পড়েনি।
এরা দিনরাত্রি কাজ করে, মৃণাল সেনের ছবির সর্বহারাদের মতো মোটেই নয়।”
লেখাটা পড়া শেষ করে কাগজটা ভাঁজ করে রেখেছি সবে, এমন সময় হোয়াটস্যাপে এক সিনেমা অন্তপ্রাণ বন্ধু জানাল মৃণাল সেন প্রয়াত। লেখকের বক্তব্য সঙ্গত না অসঙ্গত তা বিচার করতে বসছি না এখন। শুধু বক্তব্য এই যে লক্ষ্য করুন বামপন্থী রাজনীতির কার্যকলাপের দায় নিতে হল মৃণাল সেনের ছবিকে। এটা আর কোন চলচ্চিত্র নির্মাতার ক্ষেত্রে হয় বলে মনে হয় না, সম্ভবত আরেক ঘোষিত মার্কসবাদী ঋত্বিককুমার ঘটকের ক্ষেত্রেও নয়।
মৃণাল সেনের একাধিক ছবিতে অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন এক অভিনেতা। প্রায় প্রতি সাক্ষাৎকারেই বলেন “মৃণালদার থেকে কত যে শিখেছি” ইত্যাদি। অধুনা নিজে ফিল্ম বানান। আমার মত অবসর যাপনের জন্যে ফিল্ম দেখা অশিক্ষিত লোকের সেসব ফিল্ম মুখে না রুচলেও ভদ্রসমাজে তাঁর ছবি যথেষ্ট জনপ্রিয়। তিনিও কয়েকবছর আগে নবীন পরিচালক আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তের ছবির সমালোচনায় এক জায়গায় লিখেছিলেন “আশির দশকের মৃণাল সেনের ছবির মত।“ কেন? না ছবিতে টানাটানির সংসার চালানো এক শ্রমিক দম্পতিকে দেখানো হয়েছিল যাদের জীবিকা অর্জনের লড়াই এত কঠোর যে ঠিক করে কথাও হয় না সারাদিন, দেখা হয় পলক পড়ার মত। আর ক্ষণিকের জন্যে ক্যামেরায় ধরা হয়েছিল একটি লাউডস্পিকারকে, যা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের আন্দোলনের সংবাদ বিসংবাদ। বারবার এসে পড়ছিল অর্থনৈতিক মন্দার নানা লক্ষণও।
অর্থাৎ মৃত্যুর পরে লোকের নিন্দা করতে নেই — এই সূত্র মেনে যত বিখ্যাত, অবিখ্যাত লোকের শ্রদ্ধাঞ্জলি আমরা এখন দেখছি, পড়ছি তার অনেকগুলোর আড়ালেই আছে এই অনুভব, এই মতামত যে মৃণাল সেনের ছবি আসলে বাতিল সময়ের বাতিল দলিল। বাতিল মতাদর্শের বাতিল বুলি ছাড়া ও থেকে আর কিচ্ছু পাওয়ার নেই। কিছু কিছু লোকের কাজ নিজ গুণে এমন উচ্চতায় পৌঁছে যায় যে সে কাজকে ভাল না বললে আবার রুচিশীল তকমা পাওয়া যায় না, উচ্চকোটির সদস্য হিসাবে পরিচয়টা নড়বড়ে হয়ে যায়। অগত্যা মৃণাল সেন সম্পর্কে গদগদ না হয়ে আজ অনেকেরই উপায় নেই। কিন্তু বাংলার ফিল্ম জগতের একজনেরও কাজ দেখলে কি মনে হয় যে কেউ “মৃণালদার” থেকে কিছু শিখেছেন?
সত্যি কথাটা স্বীকার করে ফেলা যাক। যাঁরা ছবি বানান আর আমরা যারা দেখি, কেউই বিশ্বাস করি না যে মৃণাল সেনের ছবিতে আর দেখার কিছু আছে। কেন করি না? কারণ স্রোতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করা — এসবের অভ্যেস আমরা ‘মহাপৃথিবী’ ছবির ভিক্টর ব্যানার্জির মায়ের ডায়রির পাতার মতই পুড়িয়ে দিয়েছি। ১৯৯১ সালের পর থেকে আমরা বাধ্য হতে শিখেছি। বাধ্য হলেই যাবতীয় আরাম, যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য, যাবতীয় ভোগ্যপণ্য আমাদের হাতের মুঠোয় তা আমরা বুঝে গেছি। পোষ্যকে দুভাবে বাধ্য করা যায়। এক, কলার পরিয়ে। দুই, লোভ দেখিয়ে। বস্তুত লোভ দেখিয়ে বাধ্য করে নিয়ে কলার পরানোই সবচেয়ে উত্তম উপায়। আমরা বাঙালি ভদ্দরলোকেরা সেভাবেই বাধ্য হয়েছি। আমরাই তো বাংলা ছবির দর্শক, আমাদেরই কেউ কেউ বাংলা ছবির নির্মাতা।
আমরা এতটাই বাধ্য যে শুধু যে নিজেরা প্রতিবাদ করি না তা নয়, অন্যকে প্রতিবাদ করতে দেখলেও যারপরনাই রুষ্ট হই। তাই কলকাতায় মিটিং, মিছিল হলে বাসে আলোচনা করি গাঁয়ের লোকেদের কাজকম্ম নেই তাই এই সুযোগে কলকাতায় বেড়াতে চলে আসে, ফ্রিতে বিরিয়ানি খেয়ে যায়। মাননীয় আমলা যাদের কথা লিখেছেন আর কি। “মৃণাল সেনের ছবির সর্বহারা।”
এই যে সাদা কলারের আমরা, আমাদের কী করেই বা মৃণাল সেনের ছবি ভাল লাগবে? কলকাতায় মিছিল বেরোয়, ট্যাক্সিচালকরা ইউনিয়ন করে তা নিয়ে বাংলার বাইরের লোকেদের কাছে আমাদের যে লজ্জার শেষ নেই। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন। বছরখানেক আগে দেশের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাইতে কৃষকদের বিশাল মিছিল হল। সেখানকার ভদ্রলোকেরা অনেকেই সেই মিছিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। কদিন আগে সারা দেশের কৃষকরা দিল্লীতে মিছিল করলেন। সেখানেও আমাদের মত ভদ্রলোকেরা খাবার নিয়ে, জল নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। এখানকার মত খবরও হল না কোন রাস্তায় কার গাড়ি আটকে পড়ে কার ফ্লাইট মিস হয়েছে। বাংলায় যখন কোন মিছিল, মিটিং হয় তখন আপনি তন্নতন্ন করে সংবাদের হাজারটা উৎস খুঁজেও একটা প্রশ্নের উত্তর কোথাও পাবেন না। সেটা হল “কেন?” মানে মিছিলটা হল কেন? কোন দাবীতে? খবরটা আমাদের কেউ দেয় না কারণ আমরা জানতে চাই না। কোন রাস্তা দিয়ে গেলে মিছিলটা এড়াতে পারব সেটুকু জানতে পারলেই আমরা খুশি। অতএব কী দরকার বাপু সিনেমার মধ্যে ওসব জিনিসের? রাজ্যটা অনেক দেরীতে উন্নয়নের রাস্তা ধরেছে, ওসব দেখলে বা দেখালে লোকে আবার যদি বিগড়ে যায়?
এভাবেই সত্যি সত্যি ভাল থাকা গেলে কোন কথা ছিল না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সাদা কলারের লোকেরা লক্ষ্মী হয়ে থেকেও মৃণাল সেনের সর্বহারাদের মত দুর্গতিগুলো এড়াতে পারছে না। কারখানার অস্থায়ী কর্মীদের মতই বহুজাতিকের এক্সিকিউটিভের হুটপাট চাকরি চলে যাচ্ছে, কর্মী হিসাবে যেসব অধিকার জন্মগত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল সে অধিকারগুলো কোম্পানি বলে কয়েই কেড়ে নিচ্ছে অথচ মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলা যাচ্ছে না। ছ ঘন্টার বদলে আট ঘন্টা, আট ঘন্টার বদলে দশ ঘন্টা কাজ করেই চলেছেন। বাড়িতে এসেও ল্যাপটপ খুলে মালিকের লাভের কড়ি বাড়িয়েই চলেছেন। বেসরকারী ক্ষেত্রের বসেদের কথা বাদ দিন, সরকারপোষিত স্কুল কলেজের সামান্য টিচার ইন চার্জরাও সাক্ষাৎ হিটলার হয়ে উঠেছেন। সেই যে সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা, যারা ১২ই জুলাই কমিটির নাম শোনেনি, আন্দোলনের নাম না করেই সোনা মুখ করে কাজ করে, তারা এত ভাল আছে যে বারো-পনেরো হাজার টাকার জন্যে বাইক নিয়ে দিন নেই রাত নেই ঝড় নেই জল নেই সুইগি, জোমাটোর হয়ে ডেলিভারি করছে। পিঠে খাবারের বোঝা তবু এ খাবার যাবে না ছোঁয়া। ছুঁয়ে ফেললেই ভিডিও ভাইরাল হবে, সামান্য মাইনের, বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা ও অধিকারবিহীন চাকরিটিও যাবে।
একজন লিখেছিলেন “খাওয়া না খাওয়ার খেলা যদি চলে সারা বেলা হঠাৎ কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না।” একেবারে যে কিছু ঘটছে না তাও নয়। কয়েক বছর আগেই উবের, ওলার আগমনে যারা সচ্ছলতার মুখ দেখেছিল ঐ দালালদ্বয় এখন তাদের টাকা পয়সা কমিয়ে শুধু নিজেদের পকেট ভর্তি করায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বাইপাসের উপর গাড়ি পেটাচ্ছে। আমি, আপনি তখনো জানতে চাইছি না দাবীগুলো কী কী?
আর কটা দিন সবুর করুন। এ আই আসিছে চড়ে জুড়ি গাড়ি। তখন আমার আপনার অবস্থাও অ্যামাজনের ডেলিভারি বয় বা উবেরের ড্রাইভারের মত হতে পারে। সেদিন মৃণাল সেনের কোরাস হয়ত খুব অলীক মনে হবে না। যে নায়ক আধলা ইঁট ছোঁড়ে তাকে যে স্রেফ নকশালই মনে হবে তাও ঠিক করে বলা যায় না। আজকের অর্থহীন তর্পণ বাদ দিন। মৃণাল সেনকে আসলে সেদিন আপনার দরকার হবে।
আজ যতই ফেসবুকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের বান ডাকুক না কেন, তথাকথিত শিক্ষিতদের মধ্যে না দেখেই মৃণাল সেনের ছবিকে আঁতেল আখ্যা দেওয়ার একটা প্রবণতা ছিল এবং আছে। কারণ ছবিগুলো পপকর্ন খেতে খেতে দেখা যায় না। অপমানে যেদিন সবার সমান হতে হবে, সেদিন বোঝা যাবে আসলে কোন ছবিগুলো আঁতেল, অর্থাৎ আমার আপনার কথা কোনদিন বলেনি, আমাদের চারপাশ দিয়ে বয়ে চলা, আমাদের টেনে নিয়ে চলা জীবনের কথা বলেনি, সম্পর্কের টানাপোড়েন আর গোয়েন্দা গল্পের গাড্ডায় ফেলে রেখেছিল।
মৃণাল সেন মার্কসবাদী ছিলেন আমৃত্যু। পরিবর্তনের হাওয়া গায়ে লেগে যখন এই বাংলায় অনেক আগমার্কা বামপন্থী কবি, অভিনেতা, গাইয়ে রাতারাতি আবিষ্কার করলেন তাঁরা এত বছর ভুল পথে ছিলেন, তখনো মৃণাল সেন অবস্থান বদলাননি। তা মার্কসবাদ ব্যাপারটাকেই যখন বাতিল করে দিয়েছিল সকলে তখন একজন মার্কসবাদীর চলচ্চিত্র ভাবনাকে বাতিল করে দেওয়া কিছু আশ্চর্যের নয়। কিন্তু যাঁরা খবর রাখেন তাঁরা জানেন হাওয়া বদলাচ্ছে। এতটাই বদলেছে যে ‘দি ইকনমিস্ট’ এর মত চরম দক্ষিণপন্থী পত্রিকা মার্কসের দ্বিশতবার্ষিকীতে লিখেছে পুঁজিবাদকে বর্তমান সঙ্কট থেকে বাঁচাতে হলেও মার্কস পড়তে হবে। অতএব কেউ যদি সচেতন হন, তাহলে এই নাম কা ওয়াস্তে তর্পণ শেষ হওয়ার পরেই মৃণাল সেনকে শিকেয় তুলে রাখার ভুল তিনি করবেন না। তবু এরকম বলার মানে হয় না যে বাংলা ছবির নির্মাতারা তাঁর মত সোচ্চার বামপন্থী ভাবধারার ছবি না বানালেই সেগুলো ফালতু। বলার কথাটা হল ছবিতে আটপৌরে জীবন, তার লড়াই, তার সঙ্কট না থাকাই ফাঁকিবাজি। সেই ফাঁকিবাজি করে, তাকে প্রশ্রয় দিয়ে মৃণাল সেনের প্রয়াণে গদগদ হওয়ার মানে হয় না।
সেই ফাঁকিবাজি না করার জন্যে মার্কসবাদী বা বামপন্থী ছবি বানাতে হয় না। অনেকেই তো বলেন পশ্চিমবাংলায় বাম শাসন ছিল অপশাসন। সেই অপশাসনের স্বরূপ নিয়ে কটা বাংলা ছবি হয়েছে? অথচ সারা পৃথিবীতেই তো অপশাসনের মধ্যে থেকেই দারুণ দারুণ ছবি হয়। ইরানের পরিচালকরা যেমন করেন। বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের রক্তাক্ত, অস্থির সময়গুলো নিয়েই তো অসামান্য সব ছবি হয়। সেগুলো সবই যে বামপন্থী ছবি তা তো নয়। আবার একটা কাকতালীয় ঘটনার কথা বলি।
মৃণাল সেন মারা যাওয়ার আগের রাতে নেটফ্লিক্সে আলফোনসো কুয়ারনের ‘রোমা’ দেখছিলাম। মেক্সিকোর ছাত্র আন্দোলন, গৃহযুদ্ধের পটভূমিকায় বানানো সাদাকালো, আবহসঙ্গীতবিহীন ছবিটা দেখতে দেখতে আমার মত ভেতো বাঙালি, ওয়ার্ল্ড সিনেমার সাথে ক্ষীণ সম্পর্কযুক্ত দর্শকের বারবারই ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেনের ছবিগুলোর কথা মনে পড়ছিল। এই ২০১৮তে তৈরি ছবিতে ১৯৭০-৭১ এর গল্প বলা হচ্ছে। এমনকি ১০ই জুন ১৯৭১ এ সংঘটিত কুখ্যাত কর্পাস ক্রিস্টি গণহত্যাও দেখানো হচ্ছে। মৃণাল সেন তো রাজনৈতিক হত্যাগুলোকে পর্দায় এনেছিলেন কেবল কাগজের শিরোনামগুলোর মাধ্যমে। এই বাংলার কেউ ‘রোমা’ বানালে বোদ্ধারা নির্ঘাত বলতেন “এ ছবি দিয়ে কী হবে? এ তো মৃণাল সেনের মত।“
‘রোমা’ ছবির যে সময়কাল তা এই বাংলাতেও অস্থিরতা, ছাত্র আন্দোলন, গণহত্যার সময়। ঠিক ১৯৭১ সালেই ঘটেছিল কাশীপুর গণহত্যা। এখন তো রাজ্যে কংগ্রেস সরকার নেই, সিদ্ধার্থশঙ্কর মৃত, সেই কান্ডের খলনায়করা সকলেই প্রায় ক্ষমতাহীন, নির্বিষ। কই হোক তো দেখি একটা ভাল ছবি সেই নিয়ে। বামফ্রন্ট আমলেও তো দুর্নীতি, রাজনৈতিক হিংসার অনেক ঘটনা। নাহয় তাই নিয়েই হোক। এ আমলে ওসব নিয়ে ছবি করলে তো পুলিশে ধরবে না, উলটে একটা ভূষণ টুষণ জুটে যেতে পারে।
হবে না। কারণ “মৃণালদার” থেকে যদি স্রেফ একটা জিনিস শেখার থাকে, সেটা হল বুকের পাটা। ওটা আবার কারো শেখা হয়নি। আর মেধা? থাক সে কথা। বরং স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গলা ধরে আসা চলুক। পার্টিজানদের ব্যাপারে অস্বস্তি কাটানোর সেরা উপায় তাদের কাল্ট ফিগার বানিয়ে দেওয়া। চিরকালই।

%d bloggers like this: