ক্রিকেটার তুমি কার?

এই দল আর ভারতের কৃষকদের হয়ে খেলে না। প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় গত এক বছরে যারা চাকরি খুইয়েছে, এ দল তাদেরও নয়।

১৯৯৯-এর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কলকাতার আশেপাশে এ বারের মত হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ছিল না। চেন্নাইতে অবশ্য বছরের কোন সময়েই ঠান্ডা বলে কিছু থাকে কিনা তা বিতর্কের বিষয়। সেখানকার চিপকে চলছিল ভারত বনাম পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ। ৩০শে জানুয়ারি, অর্থাৎ ম্যাচের তৃতীয় দিন, বিকেলে যখন খেলা শেষ হল তখন চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য ২৭১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ভারতের দুই ওপেনার আউট, ক্রিজে রাহুল দ্রাবিড়। এবং আমাদের নয়নের মণি শচীন তেণ্ডুলকার। “জেতালে ও-ই জেতাবে” — সকলের এমনটাই ধারণা। ওয়াসিম আক্রাম, ওয়াকার ইউনিস, সাকলেন মুস্তাককে সামলে আর কে জেতাতে পারে? রাহুল বড়জোর ম্যাচ বাঁচাতে পারেন। আজহার পারেন না, এমনকি সৌরভ পারেন বলেও আমরা কেউ ভাবছিলাম না। পরদিন দেখা গিয়েছিল, আমরা ভুল ভাবছিলাম না।

আমরা মানে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের ছাত্ররা। বেলুড় মঠের ঠিক পাশেই আমাদের আবাসিক কলেজ; স্বামী বিবেকানন্দের নাকি স্বপ্ন ছিল এই কলেজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আমাদের স্বভাব চরিত্র মোটেই অপাপবিদ্ধ ব্রহ্মচারীসুলভ ছিল না। আমরা বিলক্ষণ ক্লাস পালাতাম, স্টাডি আওয়ারে পাঁচিল টপকাতাম নানা কারণে। ক্রিকেট দেখা তার মধ্যে অবশ্যই একটা। ৩১শে জানুয়ারি ম্যাচের ফয়সালা হবে। সেদিন অবশ্য ক্লাস পালাবার দরকার ছিল না। কারণ দিনটা রবিবার। আমরা এক দঙ্গল সেদিন সকালেই হোস্টেল থেকে পলাতক। বেলুড় বাজারের আশেপাশে একগাদা ক্লাব। কোনটা সদ্যনির্মিত তৃণমূল কংগ্রেস প্রভাবিত, কোনটার বাইরে ঝোলে কাস্তে হাতুড়ি আঁকা লাল পতাকা। কোনটা অমুক গ্রামরক্ষী বাহিনী, কোনটা তমুক সংঘ। আমাদের মত হোস্টেল পালানো ক্রীড়ামোদীদের জন্য সকলেরই অবারিত দ্বার। কারণ পার্টি যার যার, ক্রিকেট সবার। ভারতীয় ক্রিকেটাররাও সবার।

সেদিন সকাল থেকে আবার বেলুড়ের সর্বত্র প্রবল বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বামপন্থী আমি, আমার এক বিজেপি সমর্থক বন্ধু আর মোটের উপর অরাজনৈতিক জনা দুয়েক — এই চারজন টিভির খোঁজে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে চলেছি। এই এখানে বসে শচীনের স্কোয়ার কাট দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, পরক্ষণেই দৌড়তে হচ্ছে অন্য কোথাও, কারণ কারেন্ট চলে গেছে। শুধু আমরা চারজন নয়, একযোগে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের কলেজের বিভিন্ন ব্যাচের জনা পঞ্চাশেক। কেউ এ ক্লাবে অন্ধ ভি কে রামস্বামীর দুবার ড্রপ পড়া বলে সৌরভকে আউট দেওয়া দেখেছে, কেউ ও ক্লাবে দেখে বুঝেছে আজহারের এল বি ডব্লিউ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।

এইভাবে সারা দুপুর অক্লান্ত দৌড়াদৌড়ি করে আমরা শচীন আর নয়ন মোঙ্গিয়ার জুটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি। ধর্মসঙ্কট উপস্থিত হল শচীন নব্বইয়ের ঘরে ঢুকে পড়ার পর। দেখা গেল গোটা এলাকা একসাথে বিদ্যুৎহীন। আমরা আক্ষরিক অর্থে পথে বসে পড়েছি। তারপর কোন একজন সিনিয়র ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, ঐ মোড়ে কংগ্রেসের পার্টি অফিসে টিভি চলছে। সে রাস্তা থেকে দেখেছে। কিন্তু ওরা কি যাকে তাকে ঢুকতে দেবে? দল বেঁধে দৌড়নো হল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অফিসের দিকে। একজন বুক ঠুকে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকু, একটু খেলা দেখা যাবে? মাথা দোলানোর অপেক্ষা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সদলবলে কংগ্রেস ত্যাগ করার পর অতগুলো ছেলে একত্রে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের কোন কংগ্রেস অফিসে ঢোকেনি। কিন্তু আমি আর আমার বিজেপি বন্ধু ইতস্তত করছি। তখনো বামেদের সমর্থনে কেন্দ্রে ইউ পি এ সরকার হয়নি, বরং কয়েক বছর আগেই সিপিএমের তাত্ত্বিক নেতারা কংগ্রেসের সমর্থনে সরকারে যাবেন না জেদ করে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকে দিয়েছেন। সেই কংগ্রেস অফিসে ঢুকব? আমার বিজেপি বন্ধু আবার দাবি করে সে আসলে গুজরাটি, মাত্র কয়েক পুরুষ আগেই তার পূর্বপুরুষ গুজরাট থেকে বাংলায় এসেছিলেন। সবচেয়ে বিখ্যাত গুজরাটি মহাত্মা থেকে সোনিয়া পর্যন্ত সব গান্ধীকেই সে ঘৃণা করে। তাদের ছবিওলা পার্টি অফিসে সে ঢোকে কী করে? শেষ পর্যন্ত দুজনেই অবশ্য বুক ঠুকে ঢুকে পড়লাম। শচীন জিতে গেলেন, পতাকাগুলো হেরে গেল। কারণ ওগুলো বিভিন্ন দলের পতাকা, শচীনের হাতে যে ভারতের পতাকা।

ম্যাচটা অবশ্য শচীন জেতাতে পারেননি। শেষের দিকে পিঠের ব্যথায় কাবু হয়ে চটজলদি খেলা শেষ করার চেষ্টায় বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উইকেট দিয়ে আসেন। তাঁর চারজন টিমমেট মিলে বাকি এক মুঠো রান করে উঠতে পারেননি। সেই হারের ধাক্কা এত প্রবল ছিল যে আমরা অনেকেই সেদিন সন্ধ্যায় পড়াশোনা করতে পারিনি। কেউ কেউ রাতে খেতেও যায়নি ডাইনিং হলে। এই বিষাদ কেন? কারণ ভারতীয় ক্রিকেট দল সবার হয়ে খেলে। শচীন যখন ব্যাট করতেন, আমাদের সবার হয়ে ব্যাট করতেন। বিরাট কোহলি, অজিঙ্ক রাহানে, চেতেশ্বর পুজারা, ঋষভ পন্থ — সকলেই সব ভারতীয়ের প্রতিনিধি। এমনটাই আমরা জানতাম। এবার বোধহয় মেনে নিতে হবে, ভুল জানতাম। ওঁরা আসলে বি সি সি আই নামে এক প্রাইভেট কোম্পানির কর্মচারী। সে কোম্পানির মালিকানা এখন বিজেপি নেতা তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সুপুত্র জয় শাহের হাতে। অতএব ক্রিকেটাররা এবং ক্রিকেট এখন কেবল বিজেপি আর তার সমর্থকদের। তা নাহলে ব্যতিক্রমহীনভাবে সকলে কৃষক আন্দোলন নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে টুইট করতে যাবেন কেন? শুভমান গিল বাদে সকলেই তো এতদিন চুপ করে ছিলেন। এমনিতে তো এঁরা দেশের কোন ব্যাপারে মুখ খোলেন না, স্বর্গের দেবতাদের মত থাকেন। হঠাৎ এই বেলা একযোগে মর্ত্যে অবতরণের দরকার পড়ল কেন?

তথ্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হয় যে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ২০০৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে বলেছিল, ভারতীয় ক্রিকেট দল হল “the official team of BCCI, not the official team of India”. কিন্তু তারপর আরব সাগর দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট রীতিমত কমিশন বসিয়ে বোর্ড ভেঙে দিয়ে অ্যাড হক কমিটি দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট চালিয়েছেন বেশ কিছুদিন। তারপর নতুন বোর্ড গঠন হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে অভূতপূর্ব বদল হয়েছে। রাজনীতিবিদদের ক্রিকেট প্রশাসনে অংশগ্রহণ চিরকাল ছিল। মাধবরাও সিন্ধিয়া, এন কে পি সালভে, শরদ পাওয়ারের মত কংগ্রেস নেতারা বোর্ডের সর্বোচ্চ পদেও থেকেছেন। তা বলে স্টেডিয়ামের বাইরে অরুণ জেটলির মত তাঁদের বিশাল মূর্তি বসানো হয়নি। ক্রিকেটারদের দিয়ে সরকারের প্রচার চালানো হয়নি। এখন নোটবন্দি হতে না হতেই বিরাট কোহলি পণ্ডিতের মত বলে দেন স্বাধীন ভারতে এটাই সবচেয়ে বিপ্লবী পদক্ষেপ। পুলওয়ামা বিস্ফোরণ, যার তদন্তে সরকার আদৌ মাথা ঘামাল না, সেই বিস্ফোরণে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভারতীয় দল খেলতে নামে আর্মি ক্যামোফ্লাজ ক্যাপ পরে। যদি তারপর ভারতীয় ক্রিকেটাররা বা অধিনায়ক বিরাট সরকারকে প্রশ্ন করতেন পুলওয়ামার শহীদদের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী তার তদন্ত হল না কেন? ধৃত দাবিন্দর সিং কেন জামিন পেল? তাহলে তবু ঐ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকে বিশ্বাস করা যেত। যেহেতু তা করা হয়নি, সেহেতু ভারতীয় ক্রিকেট দলকে সরকারী মুখপাত্র ছাড়া কিছু ভাবা শক্ত।

এই দল আর ভারতের কৃষকদের হয়ে খেলে না। প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় গত এক বছরে যারা চাকরি খুইয়েছে, এ দল তাদেরও নয়। কারণ তাদের সম্বন্ধে ক্রিকেটাররা টুইট করেন না। হঠাৎ লকডাউনে কাজ হারিয়ে যে প্রবাসী শ্রমিকরা কয়েকশো মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন, অনাহারে অর্ধাহারে বেঁচেছেন বা মারা গেছেন, তাঁদের নিয়ে টুইট করার সময়ও বাবুদের হয় না। যতই মহম্মদ সিরাজ বাবার মৃত্যু ভুলে থেকে প্রাণপণ বোলিং করে বিদেশের মাঠে জয়ের রাস্তা দেখান, এই দল নিজেকে ভারতের প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি মনে করে কিনা তা-ও সন্দেহজনক। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় নিজেদের ক্রিকেটাররা বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্যের স্বীকার হওয়ার আগে পর্যন্ত এরা #BlackLivesMatter আন্দোলনের প্রতি কোন সমর্থন জানায়নি। জর্জ ফ্লয়েড কাণ্ডের পর শুরু হওয়া ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে খেলোয়াড়রা এক হাঁটু মুড়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার উপরে তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, কিন্তু আই পি এল শুরু হয়েছিল ওসব ছাড়াই। ১৯ সেপ্টেম্বর আরম্ভ হওয়া প্রতিযোগিতায় ২৬ অক্টোবর হার্দিক পান্ডিয়া প্রথম ওভাবে প্রতিবাদ করেন, তাও একক প্রয়াসে। অথচ ভারত সরকারের যে কোন সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে এই ক্রিকেটাররাই এক পায়ে খাড়া। সুতরাং এই ভারতীয় ক্রিকেট দলকে সেই ১৯৯৯-এর মত আমি আর আমার বিজেপি সমর্থক বন্ধু — দুজনেই নিজের দল বলে দাবি করতে পারি না বোধহয়। আমার মত লোকেরা এখন সেই বন্ধুর চোখে তো বটেই, ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের চোখেও দেশদ্রোহী।

আরো দুঃখের কথা, সেদিন যে ক্রিকেটারদের সাফল্যকে নিজেদের সাফল্য বলে আমরা মনে করতাম, যাঁদের ব্যর্থতায় আমরা কান্নায় ভেঙে পড়তাম, তাঁরাও আর আমাদের সকলের নন। বিরাট নাহয় বি সি সি আই-এর চাকুরে, শচীন তো তা নন। অনিল কুম্বলেও নন। তবু তাঁরা বাকি পৃথিবীর নিন্দার হাত থেকে সরকারকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। সে কি এঁরা আম্বানিদের বেতনভুক কর্মচারী বলে? এই দুজনের বিতর্ক এড়িয়ে চলা কিন্তু জগদ্বিখ্যাত। শচীন তো বিতর্ক থেকে এতটাই দূরে থাকতে পছন্দ করতেন যে ম্যাচ ফিক্সিং কাণ্ডে অপরাধীদের শাস্তি হয়ে যাওয়ার পরেও বলেছিলেন তিনি নাকি ঐ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না, কিছুই দ্যাখেননি। হঠাৎ মধ্যবয়সে এসে বিতর্কের ভয় উধাও! আর আমাদের প্রথম যৌবনের বিপ্লবী অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। তিনি এখন শালগ্রাম শিলা। পদ ধরে রাখতে নিজের মেয়েকেও সোশাল মিডিয়া পোস্ট ডিলিট করতে বাধ্য করেন। অসুস্থ শরীরেও গতকাল শচীন, কুম্বলের টুইট রিটুইট করেছেন, কর্তব্যে অবহেলা নেই।

এতদিন জানতাম দুঃসময়ে বন্ধু চেনা যায়। দেখা গেল দুঃসময়ে আইকনও চেনা যায়।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

নিশীথিনী-সম

দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্টিভ ওয়কে টসের জন্য অপেক্ষা করানো সৌরভ ছিলেন অরুণ খুনের তরুণ, মেয়েকে দিয়ে টুইট ডিলিট করানো সৌরভ নেহাতই মধ্যবয়স্ক পিতা।

বাঙালি আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে, আমরা শত বীণা বেণু রবে হইহই করব— এই অভিলাষেই উনবিংশ শতকের নবজাগরণের আলোকপ্রাপ্ত বাঙালির দিন এই একবিংশ শতাব্দীতেও কাটে। শ্রেষ্ঠ আসন কোনটা, তা চিহ্নিত করার ব্যাপারেও আমরা বেশ উদার, মোটেই গোঁড়া নই। আপাতত আমাদের মতে শ্রেষ্ঠ আসন হল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের পদ। কদিন কী হয় কী হয় চলল, আভাস ছিল বাংলার গৌরব সৌরভ নতুন চেয়ারম্যান হবেন। কিন্তু হব হব করেও কিছুতেই হয়ে উঠছে না। ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডের দাদাগিরির চোটে আইসিসি এমন এক কোমরভাঙা সংগঠনে পরিণত যে, নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনের পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে পর্যন্ত বিবাদ বিসম্বাদ। খবরে প্রকাশ, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড চাইছে, আগের মতো দুই-তৃতীয়াংশ ভোটেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হোন। দাদারা বিমুখ, তাঁরা চান সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিয়ম। এ বিবাদ না-মিটলে নতুন চেয়ারম্যানের নির্বাচন হবে না। ফলে, এক্ষুণি বাঙালির শ্রেষ্ঠ আসন লাভ সম্ভব হচ্ছে না।

না-ই বা হল পারে যাওয়া। আইসিসি চেয়ারম্যান না হলে কি সৌরভ গাঙ্গুলি বেহালার বাসিন্দা হয়েই থেকে যাবেন? ভারতীয় ক্রিকেটের মহারাজ থাকবেন না? তা তো নয়। ভারত অধিনায়ক হিসাবে ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁর উজ্জ্বল অবদান মুছে দেওয়ার সাধ্য এমনকী অমিত শাহেরও নেই। টেস্ট ক্রিকেটে না-হলেও, একদিনের ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা দশজন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁকে, স্রেফ পরিসংখ্যানের বিচারেও, না-রেখে উপায় নেই। অতএব উনি অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব ক্রিকেটের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হবেন কিনা, সে আলোচনা এখন থাক। এই লকডাউনারামে (থুড়ি, আনলকারামে) ঠান্ডা মাথায় বরং সৌরভের ‘বিবর্তন’ নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক।

দাদা যা ছিলেন, যা হইয়াছেন

সে এক সৌরভ গাঙ্গুলি ছিলেন। এই সহস্রাব্দের গোড়ায় যখন তাঁকে গড়াপেটা কলঙ্কিত ভারতীয় দলের অধিনায়ক করা হল, ক্রিকেট সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য লিখেছিলেন অধিনায়ক হলে হবে না, সংস্কারক চাই। দাবিটা তখন অনেকেরই বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল, এমনকী ভক্ত বাঙালিদেরও কারও কারও বুক কেঁপেছিল। কুড়ির ঘরে বয়স একটা ছেলের, এমনিতেই তার ঘাড়ে এমন একটা সময়ে অমন গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার ওপর আবার এতটা প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে দেওয়া কি উচিত? অবাঙালিরা গৌতমবাবুর সে লেখা পড়তে পারেনি তাই, পারলে নির্ঘাত বলত ‘আদিখ্যেতা’। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ২০০৫-এ দায়িত্ব চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অধিনায়ক সৌরভ যা যা করেছেন সেগুলো সংস্কারের চেয়েও বেশি। কেবল বিদেশের মাঠে ম্যাচ জেতানো নয়, কেবল লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা খুলে মাথার উপর ঘুরিয়ে ইংরেজ আভিজাত্যের নাকে ঝামা ঘষে দেওয়া নয়, কেবল ভারতকে একগুচ্ছ ম্যাচ উইনার উপহার দেওয়া নয়। তিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের সংস্কৃতিই বদলে দিয়েছিলেন।

পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ বাহান্ন সেকেন্ডের বেশি একসঙ্গে মনে রাখার দরকার নেই— এ কথা ভারতীয় ক্রিকেটে সবাই জানত। কখনও মনসুর আলি খান পতৌদি, কখনও কপিলদেব কিছুটা অন্যরকম করার চেষ্টা করেছেন, দীর্ঘমেয়াদি ফল হয়নি। এ লবি বনাম সে লবির ঝগড়া রমরমিয়ে চলেছে, দলের হারজিতে কিছু এসে যায়নি। প্রত্যেক নির্বাচনী সভার আগে পরে ঢাকঢাক গুড়গুড় না-রেখেই আলোচনা হয়েছে— অমুকের তমুকের কোটায় দলে ঢুকেছে। ওই ছেলেটি অধিনায়কের রাজ্যের খেলোয়াড়, অতএব ওকে না-নিয়ে আর উপায় কী? এইসব দোষ থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রায় কোনও তারকা মুক্ত ছিলেন না। গাভাসকর অধিনায়ক থাকার সময় কপিল একটা টেস্টে ব্যর্থতার পর বাদ গিয়ে অধিনায়ককে দুষেছেন, কপিল অধিনায়ক থাকার সময় আজীবন ওপেনার গাভাসকর চার নম্বরে ব্যাট করার আবদার করেছেন। স্বয়ং শচীন তেন্ডুলকরের দিকেও আঙুল উঠেছে বাল্যবন্ধু বিনোদ কাম্বলিকে ফর্ম না-থাকলেও খেলিয়ে যাওয়ার জন্য। সৌরভের বেলায় হল উলটপুরাণ।

বাংলার সৌরভ জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিতাড়িত পাঞ্জাবের ছেলে হরভজন সিংকে দলের স্ট্রাইক বোলার করে ফেললেন। ভাল করে দাড়িগোঁফ না-ওঠা বরোদার জাহির খান নতুন বল হাতে আগুন ঝরানোর টানা সুযোগ পেলেন। দিল্লির নড়বড়ে ফিটনেসের নওজওয়ান আশিস নেহরা বারবার ফিরে আসার সুযোগ পেলেন। কর্নাটকের জাভাগল শ্রীনাথ অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন, একদিনের ক্রিকেটে তাঁকে কেউ তখন ভরসা করে না। সৌরভ বললেন, ওঁকে ছাড়া বিশ্বকাপের দল হবে না। শ্রীনাথের রাজ্যেরই রাহুল দ্রাবিড়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মন্থর ব্যাটিং করেন, বাদ দিলে প্রাইম টাইম টিভিতে অর্ণব গোস্বামীর মতো চেঁচানোর কেউ ছিল না। সৌরভ তাঁকেও উইকেটরক্ষকের গ্লাভস ধরিয়ে দলে রেখে দিলেন। দিল্লির বীরেন্দ্র সহবাগ মিডল অর্ডারে হঠকারী ব্যাটিং করে, ওকে দিয়ে টেস্ট ক্রিকেট হবে না— সিদ্ধান্ত হয়েই গিয়েছিল। সৌরভ তাঁকে বাদ তো দিলেনই না, ইনিংস শুরু করতে পাঠিয়ে দিলেন। কেবল কোনও মাঝারি মানের বাংলা ক্রিকেটার সৌরভের দলে ঠাঁই পেলেন না।

অর্থাৎ তিনি যোগ্যতা দেখতেন, প্রতিভা দেখতেন, রাজ্য দেখতেন না। এই কারণেই সৌরভ কেবল বাংলার সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হয়ে কেরিয়ার শেষ করেননি, সারা দেশের ক্রিকেটের জনগণমনঅধিনায়ক হয়ে অবসর নিয়েছিলেন। গড়াপেটা কাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ বহু মানুষ সৌরভের দলের জন্য ক্রিকেটের কাছে ফিরে এসেছিলেন। সে কৃতিত্ব তাঁর একার নয় নিশ্চয়ই। তেন্ডুলকর, দ্রাবিড়, কুম্বলে, লক্ষ্মণদের মতো ভদ্রলোক সিনিয়র ক্রিকেটাররা না-থাকলে হয়তো সেই কেলেঙ্কারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হত না। কিন্তু সৌরভই যে তাঁদের মধ্যমণি, সে কথা অনস্বীকার্য।

আর এখন?

সৌরভ যখন বোর্ড সভাপতি হলেন, তখন আমরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সমমর্যাদায় স্থাপন করেছি ঘটনাটাকে। এমন একজন দায়িত্ব নিলেন যিনি খেলোয়াড় জীবনে ভারতীয় ক্রিকেটকে অতল গহ্বর থেকে উদ্ধার করেছিলেন। ক্রিকেটের অচ্ছে দিন তাহলে এসেই পড়ল। কেবল আমাদের মতো অর্বাচীনরা নয়, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা, তাঁদের দ্বারা নিযুক্ত অস্থায়ী কর্তা বিনোদ রাই পর্যন্ত এমনটাই ভেবেছিলেন। দেশের যেমন ‘স্ট্রং লিডার’ দরকার, দেশের ক্রিকেটেরও তো দরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দিল্লির রেসকোর্স রোডের বাসিন্দা কিসে স্ট্রং তা যেমন দুর্বোধ্য, কলকাতার বীরেন রায় রোডের বাসিন্দা কিসে স্ট্রং, দুর্বোধ্য তাও।

বলিউড আর ক্রিকেটের উপাদেয় খিচুড়ি আইপিএল-এ গড়াপেটার ছায়া পড়ল, মহেন্দ্র সিং ধোনি পর্যন্ত বিচারপতির সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। ঘটনার জল গড়াতে গড়াতে সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছল, মহামান্য আদালত দেশের ক্রিকেটের খোলনলচে বদলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। দেখা গিয়েছিল, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। স্বয়ং বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসনকে বাণপ্রস্থে যেতে হল। আমাদের সৌরভ, সুপ্রিম কোর্টের আস্থাভাজন সৌরভ, সিএবি সভাপতি থেকে এক লাফে বিসিসিআই সভাপতি হলেন কাদের সমর্থনে? শ্রীনিবাসনের সমর্থনে। বিতাড়িত শ্রীনিবাসন স্বয়ং ঘোষণা করলেন তাঁর নাম। স্ট্রং লিডার।

ক্রিকেট খেলায় বেনিফিট অফ ডাউট চালু আছে। সবসময় ব্যাটসম্যানকেই তা দেওয়া নিয়ম। বাংলার গৌরবকেও তাই দিতে মন চাইছে নিশ্চয়ই? বোর্ডের অচলাবস্থা কাটাতে তাঁর মতো একজন দিকপাল ক্রিকেটার যদি সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন তাতে ওটুকু দোষ না-ধরাই উচিত, তাই না? কিন্তু কাকে বেনিফিট দেবেন? যিনি নিজের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য একবার বদলানো সংবিধান আবার বদলানোর আবেদন করেছেন?

একজন সৌরভ গাঙ্গুলি ছিলেন। তিনি দারুণ ফর্মে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন বললেন, “এবার আসি।” আমরা সবাই হায় হায় করে উঠেছিলাম। তিনি কিন্তু চিরশত্রু গ্রেগ চ্যাপেলের দাদা ইয়ানের পরামর্শ শিরোধার্য করে চলেই গিয়েছিলেন। ইয়ানের বিখ্যাত মন্তব্য, এমন সময়ে যেতে হয় যখন সবাই জিজ্ঞেস করে “কেন?” “কেন নয়” জিজ্ঞেস করা অবধি অপেক্ষা করা উচিত নয়। আজকের সৌরভ গাঙ্গুলির বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কবিতা পড়ার অভ্যাস হয়েছে কিনা, জানা নেই। হয়তো শক্তি চাটুজ্জের ভক্ত হয়েছেন, ঘুমের মধ্যেও আওড়ান, “যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?” স্ট্রং লিডারের ভাবমূর্তিতে দাগ পড়া অতএব আটকানো যাচ্ছে না।

অবশ্য বয়স বাড়লে কে-ই বা যৌবনের মতো স্ট্রং থাকতে পারেন? রথযাত্রার আদবানি আর মার্গদর্শক আদবানি কি একই লোক? দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্টিভ ওয়কে টসের জন্য অপেক্ষা করানো সৌরভ ছিলেন অরুণ খুনের তরুণ, মেয়েকে দিয়ে টুইট ডিলিট করানো সৌরভ নেহাতই মধ্যবয়স্ক পিতা। তিনি বিধির দর্পহারী হওয়ার স্বপ্নও দেখেন না। ও কথা থাক। খেলার মধ্যে রাজনীতি টেনে আনা বদভ্যাস বলে আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছি অনেককাল হল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই নিজে উদ্যোগ নিয়ে বোর্ড সভাপতি কে হবেন তা নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করুন, যতই তাঁর সুপুত্র বোর্ডের পদাধিকারী হোন, ক্রিকেট একটা খেলা বই তো নয়। সৌরভ গাঙ্গুলির সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি প্রাক্তন ক্রিকেটার, অতএব তিনি ক্রিকেটের জন্য কী করছেন, ক্রিকেটারদের জন্য কী করছেন তা নিয়েই কথা হোক।

কোভিড-১৯ এর জ্বালায় পৃথিবীজুড়ে ক্রিকেট বন্ধ ছিল অনেকদিন, সম্প্রতি আবার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এখনও ইংল্যান্ডের বাইরে শুরু হয়নি, ঘরোয়া ক্রিকেট শ্রীলঙ্কায় শুরু হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডেও কাউন্টি ক্রিকেট চালু হয়েছে আবার। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট এখনও ভোঁ ভাঁ। দেরি করে শুরু হবে বলা হয়েছে। তাও শুধু কুড়ি-বিশের প্রতিযোগিতা সৈয়দ মুস্তাক আলি আর রঞ্জি ট্রফি। বিজয় হাজারে বাদ, দলীপ ট্রফি বাদ, ইরানিও বাদ। বোর্ড সভাপতির অনেক কাজ আছে, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট নিয়ে এর বেশি মাথা ঘামানোর সময় নেই। তিনি ইউএই প্রিমিয়ার লিগ, থুড়ি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের আয়োজন করতে ব্যস্ত। একগাদা দল আর তাদের বিরাট দলবলকে অন্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাচ্ছে, মহিলা ক্রিকেট দলকে ইংল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেল না? এদিকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটাররা তাঁদের প্রাপ্য টাকাপয়সা পাননি বলে অভিযোগ, বিরাট কোহলিদেরও নাকি মাইনে বাকি। সকলে স্ট্রং লিডারের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমার-আপনার অবশ্য সে ভাবনা না-ভাবলেও চলবে। কপাল ভালো থাকলে টিভি খুললেই দেখতে পাবেন, সৌরভ বলছেন জমিয়ে খেলতে। তিনি সফল অধিনায়ক, তাঁর দলের সঙ্গে নিজের দল মেলাতে পারলেই একেবারে এক কোটি টাকা পাওয়া যাবে। সে কালে দাদা গড়াপেটার অন্ধকার থেকে ক্রিকেটকে বের করে এনেছিলেন, এ কালে আমাদের বাজি ধরতে বলছেন। সে কালের বাণী ছিল, “তমসো মা জ্যোতির্গময়”। অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো। এ কাল ভরিল সৌরভে। নিশীথিনী-সম।

আসলে দোষ, সৌরভের নয়। হেরাক্লিটাসের নাম না-শুনে থাকলেও সৌরভ বিলক্ষণ বোঝেন, মানুষ এক নদীতে দুবার ডুব দিতে পারে না। তিনি নদীতে সাঁতরে সাগরের দিকে চলেছেন, আমরা বাঙালিরা নস্টালজিয়ার বদ্ধ জলায় বারবার ডুব দিচ্ছি।

তথ্যসূত্র:

https://4numberplatform.com/ এ প্রকাশিত

টুপির আমি টুপির তুমি?

খেলোয়াড়রা বা দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক চাওয়া পাওয়া, ইতিহাস, ক্ষোভ, রাগ ইত্যাদি খেলার মাঠে প্রকাশ করে শাস্তি না পেলে মাঠে ক্রমশ রাজনীতিই হতে থাকবে, খেলা নয়।

২৬শে নভেম্বর ২০০৮। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা। হতাহতের সংখ্যা, আক্রমণের ব্যাপকতা, দৈর্ঘ্য — যেদিক দিয়েই বিচার করুন। সেই ঘটনার ঠিক দু সপ্তাহ পরে, এগারোই ডিসেম্বর, চেন্নাইয়ের এম এ চিদম্বরম স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের একটি টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়। গোটা ম্যাচে পিঠ দেওয়ালে ঠেকে থাকার পর, চতুর্থ দিন বিকেলে ৬৮ বলে ৮৩ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলে বীরেন্দ্র সেওয়াগ ম্যাচ জেতার পথ খুলে দিয়ে যান। পঞ্চম দিন সকালে ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজন, তখন দেশের নয়নমণি শচীন তেন্ডুলকর অপরাজিত শতরান করে ভারতীয় দলকে জেতান। খেলার পরে তিনি বলেন

What happened in Mumbai was extremely unfortunate and I don’t think by India winning or me scoring a hundred, people who have lost their loved ones will feel any better. It’s a terrible loss for all of them and our hearts are with them, but whatever manner we can contribute to making them feel better we’ll make that effort.

(www.telegraph.co.uk)

শোক প্রকাশে যে পরিমিতি জরুরী, তাঁর কথায় শুধু যে তা ছিল তা-ই নয়, ঐ কথাগুলোর মধ্যে এই উপলব্ধিও রয়েছে যে ক্রিকেট শেষ পর্যন্ত একটা খেলাই, তার বেশি কিছু নয়। কোন জয়, কোন শতরান মানুষের মৃত্যুর ক্ষতি পূরণ করতে পারে না।

মাঝে এগারো বছর কেটে গেছে। “আশাটাও পণ্য এখন বাজার দরে / বিকোতে পারলে টাকা আসবে ঘরে।“ শুধু আশা নয়, শোকও এখন বিক্রয়যোগ্য। দেশপ্রেম তো বটেই।

তাই দেশসুদ্ধ দেশপ্রেমিকরা হাততালি দিলেন, হর্ষিত হলেন এই দেখে যে বিরাট কোহলি তাঁর দলবল নিয়ে ক্রিকেট মাঠে নামলেন সেনাবাহিনীর টুপি পরে, যে টুপিতে আবার বহুজাতিক ব্যবসায়িক সংস্থা নাইকির লোগো। অর্থাৎ ভারতীয় ক্রিকেটাররা পুলওয়ামার শহীদদের, সেনাবাহিনীর জওয়ানদের এত সম্মান করেন যে তাঁদের সম্মান জানানোর জন্যেও একটা দিন সেলসম্যান হওয়া বন্ধ রাখতে পারলেন না। স্পনসরের লোগো লাগানো টুপি যদ্দিন তৈরি হয়নি তদ্দিন ওঁরা শোকপালন স্থগিত রেখেছিলেন। পুলওয়ামায় হামলা হয়েছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। এমন নয় যে তারপর থেকে ভারতীয় দল আর মাঠে নামেনি। অথচ শহীদদের সম্মানে একটা ম্যাচের ফি দিয়ে দেব, জওয়ানদের মত ক্যামোফ্লাজ টুপি পরব — এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ধোনি, কোহলির মত বিরাট দেশপ্রেমিকদের লেগে গেল প্রায় এক মাস। আচ্ছা, সিদ্ধান্তটা এমন হল না কেন যে এই দিনটায় যেহেতু সেনাবাহিনীর টুপি পরছি, সেহেতু আমাদের জামা, জুতো, টুপি, ব্যাট, প্যাড কোত্থাও কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লোগো থাকবে না? যাঁরা জীবন দিলেন তাঁদের জন্যে এটুকু ত্যাগ করতে পারি না, অথচ দেশপ্রেম আমার উপচে পড়ছে? দেশ ভর্তি দেশপ্রেমিক বলিউড তারকা, রাজনীতিবিদ, খোদ প্রধানমন্ত্রী, তাঁর আই টি সেল — সকলে কী করে মেনে নিলেন সেনাবাহিনীর টুপির এই বেসাতি? এরপর তো কোনদিন দেখব তেরঙার মাঝখানে অশোকচক্রের পাশে জিও লোগো। দেশপ্রেমিকরা মেনে নেবেন তো? অবশ্য এতে আপত্তির আছেটাই বা কী? লালকেল্লা তো ইতিমধ্যেই ডালমিয়া রেড ফোর্ট। দেশপ্রেম তো শুধু বিরোধী কণ্ঠ রোধ করার সময়ে পবিত্র, ধরা ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে।

ক্রিকেটাররা নিজেদের এক দিনের বেতন দিয়ে দিলেন জাতীয় নিরাপত্তা তহবিলে। চমৎকার খবর। গত বছর কেরালায় ভয়াবহ বন্যা হল, সচরাচর এত বড় বন্যা হয় না। তখন ক্রিকেটাররা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কদিনের বেতন দিয়েছিলেন মনে করতে পারছি না। আমার মত দেশদ্রোহীরা অবশ্য দেশের ভাল কাজ দেখতে পান না। দেশপ্রেমিকরা কেউ মনে করিয়ে দিলে ভাল হয়। অবশ্য ত্রাণ তহবিলে দান ঠিক ফোটোজিনিক নয়। নিহত জওয়ানদের স্ত্রীরা যা-ই বলুন না কেন, সেনাবাহিনীর নাম করে কিছু করার মধ্যে যে মাচোপনা আছে বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করার মধ্যে তা কোথায়?
তাছাড়া ক্রিকেটারদের মাথায় তুলতে তুলতে আমরা যে কৈলাসে তুলেছি, সেখানে বসে গঞ্জিকা সেবন না করেও তাঁদের মনে হতেই পারে ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, তাঁরাও নেহাত খেলোয়াড় নন। সকলেই সাক্ষাৎ যোদ্ধা একেকজন। বিরাট ভাবতেই পারেন তাঁর ব্যাটটা এক্কেবারে এ কে ৪৭, ধোনির হেলিকপ্টার শটে চাপিয়ে অভিনন্দন বর্তমানকে পাঠানো হলে তিনি পাক সেনার হাতে ধরা পড়তেন না। ভারতীয় দলের ক্রিকেটাররা যে নিজেদের দেবতা গন্ধর্ব বলে মনে করেন তা তো আমরা দেখেছিই কিছুদিন আগে, যখন দুই তরুণ ক্রিকেটার নিজেদের কার্তিক আর কেষ্ট জ্ঞানে টেলিভিশনের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠানে বসে লীলা বর্ণনা করছিলেন। অতএব সেনাবাহিনীর জীবন নিংড়ে নেওয়া ট্রেনিং না নিয়েও, মাসের পর মাস সমস্ত শারীরিক, মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে কাজ না করেও যদি ক্রিকেটাররা মনে করেন তাঁরা আর্মি ক্যাপ পরার যোগ্য, তাঁদের ঠেকাবে কে? “সিয়াচেনে আমাদের জওয়ানরা লড়ছে” বলে যাঁরা সমালোচনার মুখ বন্ধ করেন, নিরীহ লোককে ঠ্যাঙান বা ভোট ভিক্ষা করেন — বিরাটবাহিনীর এই ধ্যাষ্টামোতে তাঁদের আহ্লাদ প্রমাণ করে সত্যিকারের জওয়ানদের প্রতি এঁদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই।

বিরাট কোহলি আজ নিজেকে সৈনিক ভেবে আমোদিত হচ্ছেন, তাঁর ব্যর্থতা এবং তাঁর দলের ব্যর্থতাকে যেদিন দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর পরাজয়ের মতই মরণবাঁচন সমস্যা মনে করবেন, সেদিন কিন্তু হেরে গেলে গালিগালাজ, মারধোর, বাড়িতে ইঁট পড়া — কোনটাকেই অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ খেলা যে শুধু খেলা নয়, ভারতীয় ক্রিকেট দল যে সেনাবাহিনীর মতই দেশরক্ষার কাজে নিযুক্ত সেটা বিরাটরা নিজেরাই তো প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছেন। ইতালিতে বিয়ে করতে যাওয়া যায়, সেই সঙ্কটে ওখানে ক্রিকেট খেলতে চলে গেলে লাভ হবে তো?

এসব কেনা বেচার বাইরেও অবশ্য কালকের দিনটা অন্য এক বিপদের জন্ম দিয়ে গেল। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল ভারতীয় ক্রিকেট সংস্থার কাছে কাঞ্চনমূল্যে আত্মবিক্রীত। তাদের ঠুঁটোপনার কারণেই সম্ভবত খেলার মাঠে সামরিক তথা রাজনৈতিক প্রতীকের প্রবেশ অনুমতি পেয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোন খেলায় এ ঘটনা ঘটতে দেওয়া হবে বলে মনে হয় না। কারণ খেলার মাঠকে রাজনৈতিক, সামরিক বিষয়ে মত প্রকাশের মঞ্চ হয়ে উঠতে দিলে খেলাধুলোর রক্তাক্ত শত্রুতা হয়ে উঠতে বিশেষ সময় লাগবে না।

ফুটবলপ্রেমীদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত ফুটবল বিশ্বকাপে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে গোল করার পর আলবানিয়ার পতাকায় যে দুমুখো ঈগল থাকে সেটার সম্পর্কে ইঙ্গিত করায় ফিফা সুইজারল্যান্ডের গ্রানিত ঝাকা আর ঝেরদান শাকিরিকে জরিমানা দিতে বাধ্য করেছিল। ঐ দুজনের উদ্বাস্তু জীবন, একজনের বাবার পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ায় নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাসের কারণে বিশ্বজুড়ে এই সিদ্ধান্তের জন্যে ফিফা সমালোচিতও হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, খেলোয়াড়রা বা দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক চাওয়া পাওয়া, ইতিহাস, ক্ষোভ, রাগ ইত্যাদি খেলার মাঠে প্রকাশ করে শাস্তি না পেলে মাঠে ক্রমশ রাজনীতিই হতে থাকবে, খেলা নয়। ক্রিকেটে সেই সম্ভাবনা গতকাল তৈরি হয়ে গেল। এরপর ভারত বনাম শ্রীলঙ্কার খেলায় যদি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা রাজীব গান্ধী প্রেরিত শান্তি বাহিনীর হাতে নিহতদের স্মৃতিতে লুঙ্গি ছাপ টুপি পরে খেলতে চায় আই সি সি না বলবে কোন যুক্তিতে? এই কষ্টকল্পনারও প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের খেলায় যদি বাংলাদেশ দল পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গণহত্যায় মৃতদের স্মরণে দেখতে রক্তের ছিটের মত এমন নকশার জার্সি পরতে চায়, আটকানো হবে কোন যুক্তিতে? রাজনীতি খেলার অ্যাজেন্ডা নির্ধারণ করতে শুরু করলে অচিরেই খেলা রাজনীতির অ্যাজেন্ডা নির্ধারণ করবে। সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়। হন্ডুরাস আর এল সালভাদোরের যুদ্ধ লেগেছিল সামান্য একটা ফুটবল ম্যাচ নিয়ে। আমরা আধুনিক রাষ্ট্রের মানুষ নিশ্চয়ই এই ধ্বংসাত্মক ছেলেমানুষীর পুনরাবৃত্তি চাইব না।

শেষে একটা কথা বলার আছে। অনেকেই বলেন, খেলা কি তার পারিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন? খেলাধুলোর ইতিহাসে কখনো কি রাজনীতি ঢুকে পড়েনি? বিশ্বকাপ ফুটবলে আমরা কাকে সমর্থন করছি তার পেছনে কি রাজনীতি থাকে না কখনোই?

সত্যি কথা। খেলা বা খেলোয়াড় তার চারপাশ বাদ দিয়ে নয়। বিশ্বকাপ ফুটবলে আমাদের সমর্থনও প্রায়শই রাজনৈতিক কারণে হয়। খেলাধুলোর ইতিহাসেও বহু রাজনৈতিক ঘটনার পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে।

কিন্তু এই আলোচনায় আমাদের সমর্থনের প্রশ্নটা প্রথমেই বাদ দিতে হবে। কারণ মাঠ থেকে বহু দূরে থাকা সমর্থকের রাজনৈতিক বা সামাজিক পছন্দ অপছন্দ খেলায় প্রভাব ফ্যালে না। যাঁরা মাঠে থাকেন তাঁদের ব্যবহার নিঃসন্দেহে প্রভাব ফ্যালে। সেই কারণেই তাঁদের ব্যবহারেরও নিয়মকানুন আছে। সে নিয়ম ভাঙলে তাঁরা যে ক্লাবকে বা দেশকে সমর্থন করেন তাদের শাস্তি দেওয়ার নিয়মও আছে প্রায় সব খেলাতে। সেই কারণেই চেলসি সমর্থকরা বর্ণবিদ্বেষী গালাগালি দিলে চেলসি পার পায় না।

এবার খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গে আসা যাক। রাজনৈতিক বিবৃতির কতকগুলো অবিস্মরণীয়, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খেলার মাঠে আছে। কিন্তু সেই বিবৃতি এসেছে খেলার মধ্যে দিয়েই, আক্রমণাত্মক সামরিক পোশাকের মধ্যে দিয়ে নয়। আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃষ্টান্তটা দিয়ে শেষ করি।

বার্লিন অলিম্পিক, ১৯৩৬। অ্যাডলফ হিটলার ভেবেছিল আর্য রক্তের বিশুদ্ধতা প্রমাণের সবচেয়ে বড় মঞ্চ তৈরি করবে অলিম্পিকটাকে। অথচ তার নাজি গর্ব গুঁড়িয়ে গিয়েছিল একজন কালো মানুষের পায়ের তলায়। তাঁর নাম জেসি আওয়েন্স। নাজিবাদকে খেলার মাঠে হারিয়ে দিয়েছিল চারটে সোনার মেডেল। মার্কিন সেনাবাহিনীর পোশাক নয়।

ঐ অলিম্পিকেই হকি ফাইনালে হিটলারের জার্মানিকে ভানুমতীর খেল কাকে বলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এক ভারতীয়। তাঁর নাম ধ্যানচাঁদ। পরাধীন দেশের কালো চামড়ার লোকেদের দলের কাছে সেদিন আট গোল খেয়েছিল হিটলারের আর্য রক্তের বীরপুঙ্গবরা। শোনা যায় হিটলার নাকি ধ্যানচাঁদকে জার্মানিতে রেখে দিতে চেয়েছিল৷ হকির জাদুকর পাত্তা দেননি। তাঁর কিন্তু শস্তার জার্সি ছাড়া কিচ্ছু ছিল না।