সত্য; তবু শেষ সত্য নয়

যদি না আসেন তাহলে দেশের শত্রুদের পক্ষে সহজ হবে বলে দেওয়া যে এই আন্দোলনে মুসলমান ছাড়া কারো কিছু এসে যায় না। রেল অবরোধে, উত্তেজনায় সাম্প্রদায়িক হিংসার তকমা সেঁটে দেওয়া জলভাত হয়ে দাঁড়াবে, দাঙ্গা বাধানো সহজ হয়ে যাবে। তাতে শুধু আপনি নয়, ডাহা ফেল করবে ভারতবর্ষ

আসাম জ্বলছে। অসমিয়াদের বক্তব্য ওঁদের ভাষা, সংস্কৃতি সব বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালিরা ধ্বংস করে দিচ্ছে। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে সেই অনসমিয়াদের নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ওঁরা রাস্তায়। যারা নাগরিকত্ব আইনের এই নব কলেবরের বিরুদ্ধে কারণ এতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাদ রাখা হচ্ছে — তারাও ক্রমশ রাস্তায়, ক্রমশ একজোট।

লড়াইটা লম্বা। লড়াইটা কেবল নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে নয়, জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর বিরুদ্ধেও। এবং স্পষ্ট করে বলা যাক, নাগরিকত্ব সংবিধানের কেন্দ্রীয় তালিকার বিষয়। ফলে যে যে রাজ্য সরকার এই আইন প্রয়োগ করব না বলছেন তাঁরা আদর্শগত অবস্থান জানাচ্ছেন মাত্র। তাঁরা কাউকে নাগরিকত্ব দিতে পারেন না, অতএব না দেওয়ারও প্রশ্ন নেই। কিন্তু রাজ্য সরকারগুলো অবশ্যই জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) আটকাতে পারেন। কারণ ব্যবহারিক কারণেই রাজ্য সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কাজটা করা মুশকিল। সত্যিই যদি কোন রাজ্য সরকার অসহযোগ করতে চান তাহলে সেটা NPR থেকেই শুরু করতে হবে। আশাব্যঞ্জক যে বহু মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই বলেছেন NRC করতে দেবেন না। তবে সেই কথাকে কজন কাজে পরিণত করবেন সেটাই আসল কথা।
পরিষ্কার করে এটাও বলা দরকার যে নতুন আইনের বিরোধিতাকে যে হিন্দুবিরোধিতা বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে সেটাও বিশুদ্ধ বদমাইশি। একজন বিরোধীও বলেননি “হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া অন্যায়।” বরং সকলেই বলেছেন “বেছে বেছে মুসলমানদের বাদ দেওয়া অন্যায়।” উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঙালিবিদ্বেষী প্রতিবাদ ছাড়া কোন প্রতিবাদ শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিবাদ নয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে রাজ্যসভায় বললেন এই আইন নিয়ে যারা ইতিমধ্যেই নাগরিক তাদের দুশ্চিন্তা করার কিচ্ছু নেই — সেটা ধূর্ততা। সত্যিই তো। সংশোধিত আইন তো যারা আগে থেকেই নাগরিক তাদের সম্বন্ধে নতুন কিছু বলছে না, বলছে যারা নাগরিক ছিল না তাদের সম্বন্ধে। খবরের কাগজের পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনে যে লেখা হয় চোদ্দ হাজার টাকার জিনিস চোদ্দশো টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, তা যতটা সত্যি, অমিত শাহ যা বলেছেন তাও ততটাই সত্যি। পাতার একেবারে তলায় প্রায় আণুবীক্ষণিক হরফে লেখা থাকে “শর্তাবলী প্রযোজ্য”। ওটা দেখতে না পেয়েছেন কি মরেছেন। এই নাগরিকত্ব আইনের “শর্তাবলী প্রযোজ্য” মানে হল “এরপর নাগরিকপঞ্জী তৈরি করা হবে। তখন বুঝে নেব কে কে কবে কোথা থেকে এসেছ। পছন্দ না হলেই নাগরিকত্ব বাতিল।”

কাদের পছন্দ হবে না তা বুঝতে ফেলুদা বা ব্যোমকেশ হওয়ার দরকার নেই। নতুন নাগরিকত্ব আইনেই বলা আছে। তার পরেও যদি ঘেঁটু ফুলের মত নিষ্পাপ কেউ থেকে থাকেন তার জন্যে অমিত শাহ রাজ্যসভায় পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, আপনাদের দাবীটা কী রে বাপু? দুনিয়ার যেখান থেকে যত মুসলমান আসবে সবাইকে নাগরিকত্ব দিতে হবে নাকি? এর জবাবে বাংলার সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন চমৎকার বক্তৃতা দিলেন, এমনকি আমাদের ঠাকুর মানে রবীন্দ্রনাথ — সেকথাও বললেন। ভাল হত ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় ভারতীয় কারা তার যে সংজ্ঞা আছে সেটাও শুনিয়ে দিলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ অব্দি একটা ভাল বই পড়েননি বলে সারা জীবন অশিক্ষিত হয়ে থাকবেন এ কি ভাল কথা? যাকগে।

কথা হচ্ছে ইতিহাস না পড়লে বা ভুলে মেরে দিলে (আমাদের উচ্চশিক্ষিত লোকেদের অনেকেই যা করেছে বলে আজকাল দেখতে পাচ্ছি) যা হয় সঙ্ঘ পরিবার তথা আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও তা-ই হয়েছে। এত বয়সে ফের ইতিহাস পড়তে যাওয়া কষ্টসাধ্য, তাই ঐ পাতা দুয়েকের কবিতাটার কথা বলছিলাম। পড়লে বোঝা যায় ভারত এমন এক দেশ যেখানে “সবারে হবে মিলিবারে আনতশিরে।” মিলতে হবে, মেলা যাবেও। কিন্তু মাথা নীচু করে সবার সমান হয়ে। আঙুল উঁচিয়ে সবাইকে এক করতে গেলে যা হয়, বিজেপি আমলে তা-ই হচ্ছে।

সবাইকে হিন্দু হতে হবে, সবাইকে হিন্দি বলতে হবে আমাদের হিন্দুস্তানে। এই আর এস এস প্রকল্প লাগু করতে গিয়ে কাশ্মীরকে বন্দুক আর ট্যাঙ্ক দিয়ে শান্ত রাখতে হয়েছে। এখন আবার আসামকে বন্দুক দেখাতে কাশ্মীর থেকে সেনা ডেকে আনতে হচ্ছে। সম্পর্কটা খেয়াল করুন। এক দেশ দুই আইন নাকি অন্যায় — এই যুক্তিতে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হল। এদিকে নতুন নাগরিকত্ব আইনের আওতার বাইরে রাখা হল উত্তর পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য, কিছু অঞ্চলকে। কেন? কারণ ভারতের সব রাজ্যের ইতিহাস এক নয়, আশা আকাঙ্ক্ষা এক নয়। ঐ রাজ্যগুলোর আদি নিবাসীদের দীর্ঘকালীন আশঙ্কা বাইরে থেকে লোক এলে তাঁদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে যাবে, সে তারা যে ধর্মের লোকই হোক। বিজেপি যদি বলে কেউ অন্য দেশ থেকে ঐ রাজ্যগুলোতে এলেই নাগরিকত্ব পাবে, তাহলে যাকে গোদা বাংলায় বলে “এক ঘাও মাটিতে পড়বে না।” কত সেনা আছে তোমার? কোথায় কোথায় দাঁড় করাবে?

এই বাস্তব ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা, মানে যাঁদের আজকাল লম্পট, চামার, মুসলমানদের এজেন্ট, ব্রিটিশ এজেন্ট ইত্যাদি বলা হয়, তাঁরা জানতেন। সেই কারণেই হাতুড়ি পিটিয়ে এক দেশ, এক আইনের নির্বোধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে যাননি। অমিত শক্তিধর শাহকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে বাইরে রাখার জন্যেও সেই লম্পট দুশ্চরিত্র লোকগুলোর তৈরি সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলেরই দোহাই দিতে হয়েছে।

কিন্তু আসামকেও তাহলে ছাড় দেওয়া হল না কেন? হয়েছে। উপজাতি এলাকাগুলোকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, কারণ ষষ্ঠ তফসিল সেই এলাকাগুলোর কথাই বলে। বাকি আসামের জন্যে সরকার অমন ব্যবস্থা করল না কেন? করলেই তো অসমিয়ারা আর আপত্তি করতেন না, তাই না? করতে যে পারল না সেখানেই ভারতবর্ষ নামক সাড়ে বত্রিশ ভাজার মজা। আসামে কোটি খানেক বাঙালি, তার অনেকেই আবার হিন্দু। NRC তে তাদের অনেকেই বাদ পড়েছে। প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গে দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ তাড়া খেয়েছেন, দুষ্টু লোকে বলে চড় থাপ্পড়ও খেয়েছেন। খেতে খেতে নাগরিকত্ব আইনের খুড়োর কল দেখিয়েছেন। এখন যদি অসমিয়া হিন্দুদের না বাঁচান তাহলে পশ্চিমবঙ্গে… ঐ যে… এক ঘা…।

এই গল্পের নীতিবাক্যগুলো কী তাহলে?

১) ভারত এক ধর্মের দেশ নয়, এক ভাষার দেশ নয়, এক আইন সর্বত্র প্রয়োগ করাও যাবে না এখানে। এ এমন এক দেশ যেখানে এক কোণে যে সংখ্যাগুরু, অন্য কোণে সে-ই সংখ্যালঘু।

২) সকলেই যে গেরুয়া দেশপ্রেমিকদের মত নিজের ধর্মীয় পরিচিতিকেই সবচেয়ে উপরে স্থান দেয় তা-ও নয়। অমর্ত্য সেন বলে এক অ্যান্টিন্যাশনাল একটা বইতে লিখেছে একজন মানুষের অনেকগুলো পরিচয় থাকে। এ দেশের বহু লোক বইটা না পড়েও ব্যাপারটা নিজের জীবনে পালন করে। এখানে একটা পরিচিতির উপর ভর দিয়ে ভেদাভেদ তৈরি করতে গেলে অন্য একটা পরিচিতি সব গুবলেট করে দিতে পারে। (উফ! আবার বইয়ের কথা বলে ফেললাম। এত পড়লে মন্ত্রীরা কাজ করবেন কখন?)

যারা মনে করে ভারত সকলের জন্য তাদের বছর আষ্টেক খুব খারাপ কেটেছে। এমন নয় যে তার আগে ভারতে সাম্প্রদায়িক রেষারেষি, হানাহানি ছিল না। কিন্তু সেগুলো ছিল আইনত নিষিদ্ধ, সামাজিকভাবে অস্বীকৃত। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের রমরমায় গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িকতা প্রথমে সামাজিক স্বীকৃতি পেল, তারপর আইনগত বৈধতা পেল। তারপর অর্থনীতি যখন তলানিতে, গণতান্ত্রিক অধিকার যখন ভূলুণ্ঠিত — এরকম একটা সময়ে নাগরিকত্ব আইনের এই সংশোধন সাম্প্রদায়িকতাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিল

সবটাই হতে পারল কারণ আমাদের চারপাশের মানুষেরা হয় পরধর্মবিদ্বেষী, পরজাতিবিদ্বেষী হয়ে উঠলেন, নয় যাবতীয় অন্যায়ের প্রতি উদাসীন হয়ে রইলেন। মৌনং সম্মতি লক্ষণম।

সেদিক থেকে গত কয়েক দিনের ঘটনাবলী কিন্তু নতুন আশার সঞ্চার করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ দ্রুত জড়ো হচ্ছেন, প্রতিবাদ করছেন। দীর্ঘ বিশ তিরিশ বছর ধরে লালিত আন্দোলনবিরোধী, প্রতিবাদবিরোধী সংস্কৃতির জাল ছিঁড়ে এমন মানুষ মিছিলে নেমে পড়ছেন যাঁরা চিরকাল এসবের থেকে সযত্নে দূরে থেকেছেন। তার মানে তাঁরা বিপদটা বুঝছেন। অনেকে নিজে নিজেই বুঝে নিচ্ছেন, কেউ বা সাগ্রহে জেনে নিচ্ছেন। প্রশ্ন করলেই আক্রান্ত হওয়ার কালে দাঁড়িয়ে এ কি কম কথা?

তবে এই আশাবাদে লাগাম পরানো দরকার। গত দুদিনের প্রতিবাদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরই প্রধানত অংশগ্রহণ দেখে অনেকেই নাক সিঁটকোচ্ছেন। “ওটা তো ওদের প্রতিবাদ”। তা বন্দুকের নলের ঠিক সামনে যখন “ওরা” আছে তখন প্রতিবাদ করার তাগিদ “ওদের” থাকবে বই কি। কিন্তু আপনি যদি বুঝে থাকেন বিপদটা কোনখানে, যদি বুঝে থাকেন আসলে CAB, NRC ভারতের বিরুদ্ধেই অন্তর্ঘাত তাহলে আপনিও এসে দাঁড়ান। ভারত তো আপনারও। এবং ভুলেও মনে করবেন না মুসলমান না হলেই আপনি নিরাপদ। আসামের বাঙালি হিন্দুদের দেখে শিখুন। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। আসলে আপনিও হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের উদ্যত থাবার আওতায় থাকা বাঙালি। আর যদি না আসেন তাহলে দেশের শত্রুদের পক্ষে সহজ হবে বলে দেওয়া যে এই আন্দোলনে মুসলমান ছাড়া কারো কিছু এসে যায় না। রেল অবরোধে, উত্তেজনায় সাম্প্রদায়িক হিংসার তকমা সেঁটে দেওয়া জলভাত হয়ে দাঁড়াবে, দাঙ্গা বাধানো সহজ হয়ে যাবে। তাতে শুধু আপনি নয়, ডাহা ফেল করবে ভারতবর্ষ।

আন্দোলনের ফলে রাতারাতি কিন্তু কিছু হবে না। রাত সবে শুরু। আরো গভীর হবে। আন্দোলন জোরদার হলে কাশ্মীর বা আসামের মত বাংলারও কণ্ঠরোধ হতেই পারে। খুব বেশি রাজ্যে প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়লে NRC করতে বদ্ধপরিকর সরকার কতটা দমন পীড়নের পথে যাবে কেউ বলতে পারে না। সরকারের পুলিশ আছে, সেনাবাহিনী আছে, না জানি আরো কত কী আছে! আমরা অবয়বহীন দেড়শো কোটি। আমাদের আমরা ছাড়া আর কিছু নেই। সে নেহাত ফেলে দেওয়ার মত শক্তি নয়, উপস্থিত নানাবিধ বিদ্বেষে শতধাবিভক্ত হলেও।
তাই অন্ধকারের আজকের সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

%d bloggers like this: