বিশ্বসাথে যোগে

এত ভাল লেগেছে কবিতাটা, বলে “যে করে হোক আমায় একটা জাপানী অনুবাদ যোগাড় করে দাও”

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।”

গানটা ছোট থেকেই শুনছি। কতবার কত রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সুরে, বেসুরে; কত লং প্লেয়িং রেকর্ডে, ক্যাসেটে, সিডিতে যে শুনেছি তার হিসাব নেই। বেশিরভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীত যেরকম অন্যমনস্কভাবে শোনে সবাই, সেভাবেও শুনেছি আবার মন দিয়েও শুনে দেখেছি। কোন যোগ স্থাপন করতে পারিনি গানটার সাথে। এভাবেই স্কুল, কলেজ পেরিয়ে গেছি। বাবা-মায়ের ঠ্যালা খেয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অংশগ্রহণ করেছি একটা বয়স পর্যন্ত, তারপর যে বয়সে বাবা-মা আর জোর করতে পারে না সেই বয়স থেকে যতটা পেরেছি পাশ কাটিয়ে গেছি অনুষ্ঠানটাকে।

তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম। একদিন আশুতোষ বিল্ডিং এর ঠিক সামনে অর্ধচন্দ্রাকার জায়গাটায় বসে পা দুলিয়ে অমূল্য আড্ডা দিচ্ছি, আমার সহপাঠী বন্ধু এবং তৎকালীন কমরেড (পরে সহকর্মী) সুদীপ্ত এসে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। কোথায় যেতে হবে না হবে কিচ্ছু বলল না। যদ্দূর মনে পড়ে ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে বেরিয়েই রেলায় ট্যাক্সি ডেকে আমাকে নিয়ে উঠে পড়ল। কোথায় যাওয়ার তাড়া, কিসের তাড়া কিছুই বুঝলাম না। যেতে যেতে শোনা গেল সেটা।

আমরা দুজনে তখনো বিশ্বজুড়ে যৌথ খামারের স্বপ্নটপ্ন দেখি। তা জাপান থেকে এক কমরেড এসেছেন আমাদের এখানকার নির্বাচন কভার করতে। তাঁকে সাহায্য করতে হবে। ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য কমিটি নাকি সাংবাদিকতা বিভাগের কোন ছাত্রকে চেয়েছে সেই কাজে। আর আমার যোগ্যতা সম্পর্কে অকারণ উচ্চ ধারণা পোষণ করা বন্ধুটি অমনি আমার নাম বলে দিয়েছে। বলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি অবশ্য। আমাকে পাকড়াও করে পাড়ি দিয়েছে রাজ্য কমিটির অফিসে। শুনেই আমি ট্যাক্সির দরজা খুলে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলাম আর কি। জাপানীর জ জানি না, সুদীপ্ত আমায় এরকম ফাঁসাচ্ছে! শেষমেশ যে বান্ধবীটির প্রতি অনুরক্ত ছিলাম তার কথা ভেবে টেবে ঝাঁপটা দিলাম না।

জাপানীটি দেখা গেল অতীব ভদ্রলোক এবং সে জাপানী জানা লোক খুঁজছে না, খুঁজছে ইংরিজি এবং বাংলা জানা লোক। তা তার সাথে নির্বাচন কভার করা তো হল। বোধহয় নেহাত খারাপ সাহায্য করিনি। তাই সে পরেও আরেকবার কলকাতায় এসে আমাকেই খুঁজে বার করে কাজকম্ম করেছিল।

এর পরের বছর। ছাত্রজীবন একেবারে শেষ প্রান্তে। ছাত্র ফেডারেশনের সাথে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দিয়েছি, এম এ পাশ করে চাকরিবাকরি পাব কিনা তা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছি। এমন সময় খবর হল উগো শাভেজ কলকাতায় আসবেন। শাভেজ মানে ভেনেজুয়েলার সেই নেতা যিনি প্রায় একটা গোটা মহাদেশকে বিশ্বায়নের চাকার তলা থেকে সরিয়ে এনে অন্যরকমভাবে বাঁচার সাহস দিয়েছেন। শাভেজ মানে যিনি ভোটে জিতে এসে সমাজতান্ত্রিক কর্মকান্ড চালানোর ক্ষমতা ধরেন। শাভেজ মানে যিনি প্রায় কাস্ত্রোর মতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে বহুজাতিকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। সেই শাভেজ আসছেন কলকাতায়। যখন নেলসন ম্যান্ডেলা এসেছিলেন, বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন হাত ধরে। এবারে শোনামাত্র ভাবছি কী করে যাওয়া যায় রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে সেই দিনটায়। ছাত্র ফেডারেশনের সাথে আড়ি করেছি, যৌথ খামারের স্বপ্নের সাথে তো আড়ি করিনি। এত কাছে আসছেন শাভেজ, অন্তত কয়েকশো ফুট দূর থেকে তাঁকে দেখব না!

কোন ব্যবস্থা মাথায় আসার আগেই জাপানী কমরেড জুনিচির ফোন। “আমি কমরেড শাভেজের কলকাতা সফর কভার করতে আসছি। তোমার অন্য কোন কাজ না থাকলে আমাকে একটু সাহায্য করবে?” অন্য কাজ! সব কাজ ফেলে ঐ কাজ করব আমি।

জুনিচির সঙ্গী হওয়ার সুবাদে মঞ্চের একেবারে কাছাকাছি বসার সুযোগ পেয়ে গেলাম। খুব কাছ দিয়ে হেঁটে এসে মঞ্চে উঠলেন শাভেজ। তারপর উদাত্ত গলায় নিজের মাতৃভাষায় বক্তৃতা। স্টেডিয়ামে উপস্থিত বেশিরভাগ লোকের মতই আমিও স্প্যানিশ জানি না। জুনিচিও জানে না। আমার কাজ ছিল ঐ সভার সকলের বক্তৃতার ইংরিজি অনুবাদ লিখে দেওয়া। শাভেজের বক্তৃতা শুনছি আর প্যাডে লিখছি। আসলে তো তাঁর কথা শুনে লিখছি না, লিখছি স্প্যানিশ দূতাবাস আমারই বয়সী যে ছেলেটিকে শাভেজের বক্তৃতা বাংলা করে বলে দেওয়ার জন্যে নিযুক্ত করেছিল তার কথা শুনে। দু এক মিনিটের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে ভাগ্যবানটি স্প্যানিশ যেমনই জানুক, বাংলা মোটেই জানে না। হোঁচট খেতে খেতেও প্রায় মেরে এনেছিল ব্যাপারটা কিন্তু একেবারে গুবলেট হয়ে গেল শাভেজ বক্তৃতার উপসংহারে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা বলতে শুরু করতেই। লাইনদুয়েক বাংলা করতেই গোটা স্টেডিয়াম বুঝে গেল এটা কোন কবিতা। কিন্তু সেই হতভাগা বোধহয় জম্মে কবিতাটা পড়েনি। তাই সে ভ্যাবাচ্যাকা। আরো লাইনতিনেক চলার পর এমনকি শাভেজও বুঝলেন ঠিক বাংলা হচ্ছে না। ভুরু কুঁচকে থেমে গেলেন। অগত্যা মঞ্চে উপবিষ্ট পশ্চিমবাংলার তখনকার মুখ্যমন্ত্রী (তিনিও নাকি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মত কবিতা টবিতা লিখতেন) উঠে এসে সেই বঙ্গ মায়ের স্প্যানিশ সন্তানটিকে সরিয়ে দিয়ে গড়গড় করে বলে দিলেন “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য / উচ্চ যেথা শির…” ইত্যাদি। শাভেজ দেখলাম যারপরনাই খুশি হলেন। দুজনের আলিঙ্গন, স্টেডিয়ামসুদ্ধ লোকের স্লোগান দিয়ে মিটিং শেষ হল।

কথা ছিল বক্তৃতাগুলো আমি পরদিন দুপুরের মধ্যে ইমেল করব জুনিচিকে। তারপর বিকেলে ওর হোটেলে যাব আর কোন সাহায্য লাগলে সেটা করতে। পরদিন হোটেলে পৌঁছতেই ওর প্রথম প্রশ্ন “তুমি এত ভাল কবিতা লিখতে পার?রবীন্দ্রনাথের কবিতাটার কি সুন্দর ইংরিজি করেছ!” লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায় আর কি। ওকে বোঝালাম যে ইংরিজিটা মহাকবি নিজেই করে গেছেন। তাতে ও আরো মুগ্ধ। রবীন্দ্রনাথ নোবেলজয়ী কবি। জাপানেও গেছেন সেকথা ওর জানা। কিন্তু তিনি যে এত ভাল ইংরিজি জানতেন তা ও শোনেনি কখনো। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে রইল।

তারপরেই আমাকে ফেলল মহাবিপদে।

“আচ্ছা এই কবিতাটার জাপানী অনুবাদ পাওয়া যাবে?”

বোঝ! আমি ওকে বললাম যে রবীন্দ্রনাথ জাপানী ভাষা জানতেন বলে আমার জানা নেই। ওদের দেশের কোন কবি যদি করে থাকেন অনুবাদ তো থাকতে পারে কিন্তু সে তো ও-ই ভাল জানবে। জুনিচি নাছোড়বান্দা। এত ভাল লেগেছে কবিতাটা, বলে “যে করে হোক আমায় একটা জাপানী অনুবাদ যোগাড় করে দাও।” দিন দুয়েক সময় চেয়ে নিয়ে কেটে পড়লাম।

অকূলপাথারে পড়লে যা করা আমাদের জাতীয় অভ্যেস সেটাই করলাম। বাবার পরামর্শ চাইলাম। বাবাই বাতলে দিলেন। আমার এক মামা বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ছিলেন। সেই মামীকে ধরলাম। নিপ্পন ভবনের অধিকর্তার ইমেল আইডি যোগাড় হল। তাঁকেই জুনিচির ব্যাপারে জানিয়ে লিখলাম অন্তত বঞ্চিত করে যেন বাঁচিয়ে দেন। ভেবেছিলাম উত্তর টুত্তর পাব না। অবাক কান্ড! চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই উত্তর এল “আপনার অনুরোধ পেয়েছি। মিস্টার জুনিচি কোদামাকে আমরা কবিতাটা পাঠাচ্ছি।”

জুনিচির সেদিনই দিল্লীতে নিজের আস্তানায় ফিরে যাওয়ার কথা। আমি জানালাম কী বার্তা এসেছে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বেচারা একটু ব্যাজার মুখেই ফেরত গেল। বোধহয় ভেবেছিল মারাদোনার মত ডজ করে দিলাম। আমি আবার নিপ্পন ভবনের অধিকর্তা মারাদোনা কিনা তাই ভাবছিলাম। কে আমি অজ্ঞাতকুলশীল কলকাতার উপকণ্ঠের এক ছাত্র? আমার অনুরোধে কেনই বা এসব করতে যাবেন তিনি? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বুঝি ক্ষমতা অসীম। পরদিন বিকেলে দিল্লী থেকে ফোন করল জুনিচি। সে ইমেলে কবিতাটা পেয়েছে। এবং পড়ে আপ্লুত। “এমন আশ্চর্য কবিতা আমি আগে পড়িনি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

রবীন্দ্রনাথকে বললাম, একমাত্র তুমিই পারো। কোথায় সুদূর লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা! সেখানকার বিপ্লবী নেতার বুকে তুফান তোলে তোমার কবিতা আর সেই কবিতা নিজের ভাষায় পড়তে চায় এশিয়ার এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের সাংবাদিক! আব্দারটা করে তোমার দেশের, তোমার ভাষার এক অকিঞ্চিৎকর তরুণের কাছে আর সে আব্দারটা মেটাতে সমর্থ হয় কারণ একটা বিশ্বভারতী রেখে গেছ তুমি!
সেইদিন গানটা কানের ভিতর দিয়ে মরমে পৌঁছল। ফিরে রবীন্দ্রনাথকেই বললাম “নয়কো বনে, নয় বিজনে, / নয়কো আমার আপন মনে — / সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়, সেথায় আপন আমারও।।”