বড়লোকের খেলা

ছোটবেলা থেকে আমরা যে শুনে এসেছি ফুটবল হল গরীবলোকের খেলা সেটাকে এখন ছোটবেলার পরিত্যক্ত খেলনাগুলোর মত আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই ভাল। সারা পৃথিবীতেই ফুটবল এখন বড়লোকের খেলা — বড়লোকেরাই দ্যাখে, বড়লোকেরাই খেলে

saltlake

মাসখানেক আগে একদিন একটা ওয়েবসাইটের সাহায্যে হিসাব করে জানলাম আমি একবছরে যা রোজগার করি, প্যারিস সাঁ জা ফুটবল ক্লাবের ব্রাজিলীয় মহাতারকা নেমারের তা রোজগার করতে লাগে ছ ঘন্টার কিছু বেশি। মনে রাখতে হবে, মোদী সরকার যতই নানা ফন্দিফিকিরে আমার হকের টাকা থেকে আমায় বঞ্চিত করুক, আমি ভারতবর্ষের বেশিরভাগ লোকের চেয়ে সচ্ছল অবস্থাতেই আছি। অর্থাৎ আমার পরিবারের কাউকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হয় না, আমার নিজের বাসস্থান আছে, প্রয়োজন পড়লে এবং না পড়লেও জামাকাপড় কেনার সংস্থান আছে, সন্তানকে স্কুলে পড়ানোর জন্যে সরকারী অনুদানের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না, বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে এ রাজ্যের সেরা বেসরকারী চিকিৎসা তাকে দেওয়ার মত আর্থিক সঙ্গতি আছে এবং এতকিছুর পরেও ইচ্ছে হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, দরকার না হলেও বইপত্র কেনা এবং বছরে একবার সপরিবারে বেড়াতে যাওয়ার ক্ষমতা আছে। তা এই আমার বাৎসরিক রোজগারই যদি নেমার মোটে ছ ঘন্টায় আয় করে ফেলেন, তাহলে ভেবে দেখুন ভারতের মত একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশের মহানগরগুলোর বস্তিতে যারা থাকে তাদের জীবনযাত্রার সাথে নেমারের জীবনযাত্রার ফারাক কতটা। একজন বস্তিবাসী যদি পৃথিবী হন, নেমার তাহলে মহাবিশ্ব।
কয়েকমাস আগেই নেমারের প্রাক্তন টিমমেট লায়োনেল মেসি বাল্যবন্ধু আনতোনেলাকে বিয়ে করলেন আর্জেন্টিনায় নিজের যে শহরে জন্ম সেই রোজারিও এক বিলাসবহুল হোটেলে। সংবাদসংস্থাগুলো আকাশ থেকে তোলা একটা ছবি পাঠিয়েছিল হোটেলটার, অনেক কাগজে ছাপাও হয়েছিল। সেই ছবিতে দেখা যায় হোটেলটার ঠিক বাইরেই বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বস্তি। দেখতেই মনে পড়েছিল বিজন ভট্টাচার্য নামে এক পাগলের লেখা ‘নবান্ন’ বলে একটা নাটকের কথা। তার একটা দৃশ্য আমাদের পাঠ্য ছিল কোন এক সুদূর অতীতে। সেই দৃশ্যে এক বড়লোকের বাড়ির বিয়ে হচ্ছে। সেখানকার আসবাবপত্রের গা দিয়ে “আলো চুঁইয়ে পড়ছে” আর বিয়েবাড়ির বাইরে ময়লার ভ্যাটে একদল মানুষ কুকুরের সঙ্গে কামড়াকামড়ি করছে খাবারের জন্যে। আপনি বলবেন মেসি, নেমার তাঁদের জন্মগত প্রতিভা এবং অধ্যবসায়ের জোরে ঐ রোজগারে পৌঁছেছেন। কথাটা মিথ্যে নয়। একইসঙ্গে এটাও মিথ্যে নয় যে অনাহার ছাড়া অত্যাহার থাকতে পারে না।
যাই হোক, সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় ছোটবেলা থেকে আমরা যে শুনে এসেছি ফুটবল হল গরীবলোকের খেলা সেটাকে এখন ছোটবেলার পরিত্যক্ত খেলনাগুলোর মত আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই ভাল। সারা পৃথিবীতেই ফুটবল এখন বড়লোকের খেলা — বড়লোকেরাই দ্যাখে, বড়লোকেরাই খেলে। বিশ্বাস হচ্ছে না? ইন্টারনেটে খুঁজে দেখুন প্রিমিয়ার লিগের খেলাগুলোর টিকিটের দাম নিয়ে কত সমর্থক অসন্তুষ্ট। এন্ড্রু ফ্লিন্টফকে মনে পড়ে? তিনি তো নেহাত গরীব লোক নন, সিপিএম নন, বিজন ভট্টাচার্যের মত পাগলও নন। ইউটিউবে খুঁজে দেখুন, একটা রেডিও স্টেশনে বসে ফ্লিন্টফ প্রশ্ন তুলছেন আর্সেনালের খেলার টিকিটের দাম নিয়ে। বলছেন যে এওয়ে ম্যাচটা আর্সেনাল খেলতে যায় বিলাসবহুল প্লেনে করে, সে ম্যাচটা তো বাসে চড়েও খেলতে যাওয়া যায়। যে সমর্থক কষ্ট করে আয় করা পয়সা খরচ করে টিউবরেলে চড়ে খেলা দেখতে আসেন তিনি কুড়ি মিনিটের ফ্লাইটে যাতে সিনেমা দেখা যায়, ভিডিও গেম খেলা যায়, স্নানবিলাসী হওয়া যায় — তার জন্যে বেশি দামের টিকিট কিনতে বাধ্য হবেন কেন? গানাররা কেন বাসে করে খেলতে গিয়ে টিকিটের দাম কমানোর ব্যবস্থা করবে না?
তা এহেন ফুটবল খেলার ভবিষ্যতের তারকাদের আপনি দেখতে পাবেন আপনার দেশেই। আর কয়েকদিন পরেই আমাদের চিরচেনা (সাংবাদিক বন্ধুদের মুখে শুনছি আর চেনা যাচ্ছে না) সল্টলেক স্টেডিয়ামে তারা দাপিয়ে বেড়াবে। সেই স্টেডিয়ামের আশেপাশে কখনো বস্তি থাকতে দেওয়া যায়! ভাবলেন কী করে? পৃথিবীর সর্বত্রই তো দরিদ্র কুৎসিত, দারিদ্র্য নয়। অতএব বড়লোকেদের মোচ্ছবের জন্যে কিছু গরীবকে তো ঘরছাড়া হতেই হবে। আমাদের দেশটা কত সুজলাং সুফলাং সেটা দেখাতে হবে না দুনিয়াসুদ্ধু লোককে? হীরকরাজার মোচ্ছবের আগে লোকের ভিটেমাটি চাটি করার সেই দৃশ্য মনে নেই?
আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এতবড় খেলাধুলোর আয়োজন মানেই তো এই। ব্রাজিলে যখন ফুটবল বিশ্বকাপ হল তখনো এই একই ঘটনা ঘটেছিল তো। ব্রাজিল তো তবু ফুটবলের পীঠস্থান, আমাদের তো ফুটবলের বিশ্ব মানচিত্রের পিঠে স্থান খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। তবু আমরা এই মহাযজ্ঞ করছি। করার সুযোগ যে পেয়েছি সেও ফুটবল আর গরীবের খেলা নেই বলেই। মাঠের ভেতরে আমরা যা-ই করি না কেন, বাইরে আমাদের মত বড় বাজার আর কোথায় আছে? ফিফা আর তার স্পনসররা সেই বাজারে ব্যবসা করার এমন সুযোগ ছাড়বে কেন? আমাদের আম্বানি ইত্যাদিরাও সেই সুযোগে যারপরনাই কামিয়ে নেবেন না কেন? আর আমাদের শাসকরাই বা দুনিয়াকে দেখানোর এমন সুযোগ ছাড়বেন কেন যে আমাদের দেশে সবার পেটে ভাত না থাক, দারুণ দারুণ সব স্টেডিয়াম আছে, মোচ্ছব করতে আমরা ভারী ওস্তাদ। তাই অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপই শেষ নয়, প্রধানমন্ত্রীর সস্নেহ প্রশ্রয়ে অনূর্ধ্ব-২০ আয়োজন করার আব্দারও করে ফেলেছি আমরা। হরির লুট ভাল জমেছে বুঝলে ফিফা সে আব্দার রক্ষা করতেও পারে। চাই কি, ভবিষ্যতে সিনিয়র বিশ্বকাপও আমরা আয়োজন করতে চাইতে পারি। এক ফুয়েরারের বার্লিন অলিম্পিক দরকার হয়েছিল শক্তি প্রদর্শন করতে, আরেকজনের একটা ফুটবল বিশ্বকাপ তো লাগতেই পারে।
যাও বস্তির ছেলে, যাও। যেখানে পার পালিয়ে যাও, ফুটবল তোমার খেলা নয়। বস্তিতে ন্যাকড়া দিয়ে বল বানিয়ে খেলতে খেলতে ফুটবলের রাজা হয়ে ওঠা দিয়েগো মারাদোনা যখন তোমার শহরের আদরের প্রাক্তন ক্রিকেটারের সাথে বল লাথাবেন, তুমি তখন আসন্ন শীতে কোথায় মাথা গুঁজবে সেটা ভেবো। জগতের আনন্দযজ্ঞে তোমার নিমন্ত্রণ নেই, থাকতে পারে না।

পুনশ্চ: বন্ধুরা আমার ভন্ডামিতে ভুলবেন না যেন। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি এই খেলার বিপক্ষে নই। হতেই পারি না। আগামী একমাস সাজিয়ে গুছিয়ে ফলাও করে এই খেলারই খবর যারা আপনাদের সকালের কাগজে পরিবেশন করবে আমি তাদেরই একজন।