হারানের নাতজামাই: স্মৃতিমেদুরতার নাটক

শিউরে ওঠার অনুভূতি কিন্তু হারানের নাতজামাই নাটকের শেষে হল না। যদিও শেষে মঞ্চে নির্মিত হল মাণিক লিখিত পুলিসকে ঘিরে ধরার দৃশ্য, যা দেখে মন্মথর মনে হয় “মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারাণের বাড়ীর লোকের জন্য চারদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে!”

ব্যর্থ বিপ্লব আর বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকার বলতে যা যা পড়ে থাকে তার মধ্যে প্রধান কি মধ্যবিত্ত স্মৃতিমেদুরতা? প্রশ্নটা আমার মত মাঝবয়সীর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ না দেখেছি তেলেঙ্গানার গণসংগ্রামের পার্টিকে, না দেখেছি ১৯৬৪ সালে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আগের পার্টিকে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর দ্বারা সংগঠিত তেভাগা আন্দোলনের মত কোনো বিদ্রোহ আমার জীবনে দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি। নকশাল আন্দোলনের মত কোনো বিপ্লব প্রচেষ্টাও দেখিনি। সবটাই আমার কাছে হয় ইতিহাস, নয় গল্পকথা। তেভাগা আন্দোলন বলতে ছোট থেকে শুনে আসা সলিল চৌধুরীর ‘ঘুমভাঙার গান’ ক্যাসেটটার কথাই প্রথমে মনে পড়ে। সে জিনিসও প্রযুক্তিগত কারণে এখন আর চলে না। মাঝে মাঝে রোদে দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টা করি না তা নয়, কিন্তু ক্যাসেট বাজাতে গেলে যে যন্ত্রটি দরকার তা বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে বহুকাল আগে। ঊর্ধ্বমুখী মধ্যবিত্ত অস্তিত্বে সপ্তাহান্তে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে হারানের নাতজামাই নাটকের মঞ্চায়ন দেখতে যাওয়া তাই অদেখা বিদ্রোহের ওম নেওয়ার চেষ্টা মাত্র।

গত ১৯ মার্চ (রবিবার) মধুসূদন মঞ্চে যাদবপুর রম্যাণীর নাটক দেখতে গিয়েছিলাম ওই ওমটুকু নিতেই। পর্দা ওঠার পরে যখন দেখি মঞ্চসজ্জায় চোখে পড়ার মত জায়গা করে নিয়েছেন চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ হোড় এবং নিভু নিভু আলোয় কৃষকদের বৈঠক চলছে, যা অবধারিতভাবে মনে পড়ায় সোমনাথ হোড়ের আঁকা একটি বিখ্যাত ছবিকে, তখনই আমার অদেখা বিদ্রোহের পরিবেশ তৈরি করতে সফল হয়ে যান মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পকে নাট্যরূপদানকারী অরুণ মুখোপাধ্যায়।

আমাদের যুগের শহুরে মধ্যবিত্ত বামপন্থার সঙ্গে লোকায়ত সংস্কৃতির ব্যবধান দুস্তর। লোকায়ত সংস্কৃতি আর আমরা বিপ্লবী সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি তা বিপ্রতীপ কোণে অবস্থান করে বললেও ভুল হয় না। আমাদের বামপন্থী গান, কবিতা, ছবি – সবকিছুরই মুখ পশ্চিম দিকে ঘোরানো। আমরা যতজন ‘বেলা চাও’ বা ‘জন হেনরি’ শুনেছি, ততজন যে ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য’ শুনিনি তা হলফ করে বলা যায়। এই নাটক দেখলে আঁচ পাওয়া যায়, এমনটি চিরকাল ছিল না। গোটা নাটক জুড়ে উদাত্ত কণ্ঠে গান গেয়ে চরণদাস (অভিজিৎ) চরিত্রটি বিদ্রোহকে কৃষক পরিবারের উঠোনে শক্ত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। গ্রামের যাত্রাদল এবং সে দলের অভিনেতাদের বিদ্রোহের সঙ্গে তলে তলে জড়িয়ে থাকাও বিপ্লবী সংস্কৃতি আর লোকায়ত সংস্কৃতির মেলবন্ধন তুলে ধরেছে। এর তুঙ্গ মুহূর্ত তৈরি হয় যখন হারানের (মাণিকের বানান অনুযায়ী হারাণ) বাড়ির দাওয়ায় কৃষকদের সঙ্গে মিলে চরণদাস শোনায় সদ্য বাঁধা গান ‘ন্যাংটার নেই বাটপাড়ে ভয়’। গানটি বাঁধা হয়েছে রামপ্রসাদী ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না’ গানের সুরে। গোটা নাটকে ওই একটি সময়েই মনে হল প্রেক্ষাগৃহের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি বড় বেশি সক্রিয়। আমার দেশের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবনধারণ করা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আমার অপরিচয়ের পরিমাণ শিরশিরানি ধরিয়ে দিল। কী হতে পারত আর কী হচ্ছে – সেকথা ভেবে বিষণ্ণ লাগল। হয়ত অপ্রাসঙ্গিক, তবু খেয়াল হল, যে মঙ্গলশঙ্খ ছাড়া হিন্দু বাড়ির পুজোআচ্চা চলে না সেই শাঁখ বাজিয়েই এককালে এ দেশে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিদ্রোহীদের সাবধান করে দেওয়া হত – পুলিস আসছে। আজ মন্দিরের মাইক থেকে জানান দেওয়া হয় – অমুক মুসলমানের বাড়ির ফ্রিজে হিন্দুদের পূজনীয় প্রাণির মাংস আছে। চলো বিহিত করে আসি।

মাণিক গল্পের নামে হারাণ চরিত্রটিকে রেখেছিলেন বটে, কিন্তু আখ্যানে সে চরিত্রের ভূমিকা নগণ্য। অরুণবাবুর নাট্যরূপে হারাণের অভিনয় করার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে এবং সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন প্রবীণ অভিনেতা শ্যামল চক্রবর্তী। গল্পের মতই এই নাটকেও অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ময়নার মা। মেক আপের দিক থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাজানো গোছানো মনে হলেও দেবলীনা চক্রবর্তী সব মিলিয়ে মন্দ নন। বিশেষত দারোগা মন্মথর (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়) মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভুবন মণ্ডলকে বাঁচানোর দৃশ্য, যা আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে তিনি চমৎকার। মন্ডলের চরিত্রে চন্দন সেন বা চণ্ডী ঘোষের চরিত্রে মেঘনাদ ভট্টাচার্যের অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাঁদের অভিনয় ক্ষমতা তো প্রমাণিত। তবে মথুর চরিত্রে সৌমিত্র মিত্র অতখানি মাতাল না হলেও হয়ত ক্ষতি ছিল না। হারানের নাতজামাই নাটক দেখতে গিয়ে কেষ্ট মুখার্জিকে মনে পড়া খুব সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।

দর্শককে টিকিটের দাম চুকিয়ে দেওয়ার তাগিদেই কিনা জানি না, এই নাটক হাস্যরস সৃষ্টির দিকে একটু বেশিই নজর দিয়েছে। উপরন্তু চণ্ডী ঘোষ আর সাতকড়ি (সৌমিত্র বসু) কতটা খারাপ লোক তা প্রমাণ করতে গিয়ে যেসব দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে সেগুলি বড় বেশি করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বেশি বয়সে যেসব উচ্চকিত বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেগুলির কথা মনে পড়ায়। কোনো সাহিত্যকর্মের নাট্যরূপ দেওয়ার অভিশাপই এই। যা যা সংযোজিত হল তা আখ্যানে নতুন মাত্রা যোগ করল কিনা সে প্রশ্ন দর্শকের মনে এসেই পড়ে। বাংলার জোতদাররা সব সাধুপুরুষ ছিল এমন দাবি নিশ্চয়ই কেউ করে না, মাণিক তো করতেন না বটেই। কিন্তু এখানে গ্রামের বিধবা হরিমতীর (সুজাতা সরকার) সঙ্গে চণ্ডী ঘোষের যে অবৈধ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে তা বিদ্রোহকে কতখানি ঘনীভূত করেছে তা অন্তত আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

অবশ্য মাণিকের গল্পের মূল সুর বিদ্রোহ হলেও এই নাটক সেখান থেকে বেশ খানিকটা সরে গেছে। ফলে হারানের নাতজামাই জগমোহনের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। মাণিকের জগমোহন ফিটফাট কড়া ধাতের লোক, পেলবতার লেশমাত্র নেই। অরুণবাবুর জগমোহন (শুভঙ্কর মুখার্জ্জী) তোতলা, বাপের সামনে কেঁচো হয়ে থাকে, রামায়ণ পালায় জটায়ুর চরিত্রে অভিনয় করে এবং এতটাই পেলব যে সীতার ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েলি স্বভাবের রসিক (গৌতম সেন) তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনাদায়ী রুপোর গয়নার জন্যে বউকে শ্বশুরবাড়িতে ফেলে রাখা নিয়ে মাণিকের জগমোহনের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে শ্বশুরবাড়ি যায় বউয়ের জন্যে মনটা হু হু করেছে বলে নয়, লোকমুখে বউয়ের ব্যভিচারিণী হওয়ার গল্প শুনে। ময়নাদের গ্রামের বিদ্রোহী মেজাজ যে তাকে আদৌ স্পর্শ করেছে এমন ইঙ্গিত মাণিক প্রায় শেষ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত দেন না। দারোগা মন্মথ ময়নার থুতনিতে হাত দিতে এলে সে যে “লাফিয়ে এসে ময়নাকে আড়াল করে গর্জে ওঠে”, তা কতটা বউয়ের প্রতি প্রেমে আর কতটা অধিকারবোধে সেকথা ভাবার ভার মাণিক পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন মায়ার জঞ্জাল: যে কলকাতা দেখতে পাই না, দেখতে চাই না

অরুণবাবুর জগমোহন কিন্তু ময়নার প্রেমে ডগমগ। এত প্রেম থাকতে সে আগে কেন বউকে নিতে ছুটে আসেনি সাতকড়ির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। এই নাটকে ময়না সত্যিই অন্য কারোর সঙ্গে রাত কাটিয়েছে কিনা সে প্রশ্ন করতে জগমোহন আসেও না, আসে তার বাবা সাতকড়ি। এসে বলে বউকে সে আর ঘরে নেবে না। জগমোহন বরং পরে এসে বাবার সিদ্ধান্ত নস্যাৎ করে এতদিন পরে বউয়ের সঙ্গে প্রেম করতে বসে। মাণিকের গল্পের সুস্পষ্ট রাজনীতি নাটকের এই শেষ দৃশ্যে এসে একেবারে ভেঙে পড়ে। গল্প পড়লে পরিষ্কার হয়, যে কেবল কৃষক নেতা মণ্ডল নয়, একটি গোটা পরিবার বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রামের মানুষের কাছে। জগমোহনও যে শেষপর্যন্ত বিদ্রোহের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, ময়নাকেও স্ত্রী হিসাবে পাশে নিয়েছে – এতগুলো কথা মাণিক বুঝিয়ে দেন একটিমাত্র বাক্যে – “ময়না তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়েই রক্ত মুছিয়ে দিতে আরম্ভ করে জগমোহনের।” শিউরে উঠে পাঠক বুঝতে পারে, জগমোহন মণ্ডল না হলেও, আগের রাতে পুলিসকে ধোঁকা দেওয়ায় যুক্ত না থাকলেও গ্রেপ্তার বরণ করেছে বিদ্রোহের দায় স্বীকার করে। আগের রাতে যে হারানের নাতজামাই ছিল সে বিদ্রোহী, আজ সকালে যে হারানের নাতজামাই সে-ও বিদ্রোহী। এ যেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই অমোঘ পংক্তি “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।”

এই শিউরে ওঠার অনুভূতি কিন্তু হারানের নাতজামাই নাটকের শেষে হল না। যদিও শেষে মঞ্চে নির্মিত হল মাণিক লিখিত পুলিসকে ঘিরে ধরার দৃশ্য, যা দেখে মন্মথর মনে হয় “মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারাণের বাড়ীর লোকের জন্য চারদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে!” কিন্তু তার আগেই অরাজনৈতিক হয়ে গেছে নাটকটি। ফলে জোতদার আর পুলিসকে যখন মঞ্চে ঘিরে ফেলে সশস্ত্র কৃষকরা, আর বেজে ওঠে “হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো”, তখন ছোটবেলা থেকে শুনে আসা গানের স্মৃতিমেদুরতাটুকু নিয়েই বেরিয়ে আসা যায় প্রেক্ষাগৃহ থেকে। তার বেশি কোনো সঞ্চয় থাকে না। সে অবশ্য আমার মুদ্রাদোষও হতে পারে। আমি তো কখনো রক্তে ধান বুনিনি, আমি পঞ্চাশ টাকা কিলো মিনিকিট চালের ভাত খাই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

সলিল চৌধুরী স্মরণে একটি মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা

গত তিরিশ বছরে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা ক্রমশ যে কোনো উপলক্ষে গোটা দশেক রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাওয়া আর সত্যজিৎ রায়ের গোটা পাঁচেক ছবির চর্বিতচর্বণের কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে। যে ‘কালচার’ নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই, তাতে যে গর্ব করার মত আর কোনো পাত্র-পাত্রী আছেন বা সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা ইত্যাদির আর কোনো ধারা আছে তা টের পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন নয় যে রবীন্দ্রচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বা সত্যজিতের ছবির চর্চা অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে। আসলে ক্রমিক আত্মবিস্মৃতির ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের উইকেট দুটোই এখনো টিকে আছে, বাকিরা জনমন থেকে ক্রমশ কতিপয় রসিকের বৈঠকখানায় অবসৃত হয়েছেন। ওরই মধ্যে সলিল চৌধুরীর অবস্থা কিছুটা ভাল। একসময় পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় গান গেয়ে, আবৃত্তি করে সংস্কৃতি চর্চায় হাতেখড়ি হত বঙ্গসন্তানদের। গত শতকের নয়ের দশক থেকে বুগি উগি সেই সন্ধ্যাগুলোকে স্থানচ্যুত করতে শুরু করে। এখন নানা বয়সের গানের রিয়্যালিটি শোয়ে বিখ্যাত হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাই বাঙালি শিশু, কিশোরদের সংস্কৃতি চর্চার পথ নির্ধারণ করে। সেসব শোয়ে সলিলের গানের বেশ খানিকটা দাম আছে। তার একটা বড় কারণ তিনি একদা হিন্দি সিনেমা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, লতা মঙ্গেশকরের মত শিল্পী তাঁর সুরে, কথায় বাংলা গানও গেয়েছেন। নইলে ওই দামও আজ সলিল পেতেন কিনা সন্দেহ।

ওটুকুর উপর ভরসা করে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন শহরাঞ্চলের প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া করে সপ্তাহের মাঝখানে গোটা সন্ধে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে – এ কথা চট করে বিশ্বাস হতে চায় না। ফলে যখন জানা যায় উত্তরপাড়ার ‘মীড়’ এই কাণ্ডটি ঘটাতে চলেছে ২২ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায়, তখনই চট করে গুগল করে নিতে হয় সেদিন সলিলের জন্মদিন বা মৃত্যুদিন কিনা। শুধু সঙ্গীতচর্চা নয়, যে কোনো চর্চাই যে আসলে ৩৬৫ দিনের কাজ সেকথা আজকাল মনে রাখা শক্ত। গুগল সার্চ যখন জানিয়ে দিল সলিলের মৃত্যুদিন চলে গেছে সপ্তাহ দুয়েক আগেই আর জন্মদিনের মাস দুয়েক দেরি আছে, তখন বোঝা গেল আবেগ কাজে লাগিয়ে নাম কেনা মীড়ের সদস্যদের উদ্দেশ্য নয়। তাঁরা শ্রোতাদের ‘অতল সলিলে’ নিয়ে যেতে চান নিতান্ত সলিল চৌধুরীর গানের টানেই।

গান নির্বাচনেও দেখা গেল পরিশ্রমের ছাপ। মীড়ের কচিকাঁচারা সমবেত সঙ্গীতে ‘শ্রাবণ অঝোর ঝরে’, ‘ঝিলিক ঝিলিক ঝিনুক খুঁজে পেলাম’ ইত্যাদি গানে অন্য স্বাদ এনে দিয়েছে। বাংলা ভাষার এই দুর্দিনেও এক ঝাঁক বাঙালি কিশোর-কিশোরী নিখুঁত উচ্চারণে ‘দুপুরের রৌদ্রের নিঃঝুম শান্তি শান্তি/নীল কপোতাক্ষীর কান্তি’ গাইছে – এই দৃশ্য, এই ধ্বনি মনোমুগ্ধকর। কিন্তু পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী চমকে দিয়েছেন তাঁর ছাত্রীদের গাইতে দেওয়া একক গানের পছন্দে। ১৯৫৬ সালে জাগতে রহো ছবিতে আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘ঠান্ডি ঠান্ডি সাওন কি পুহার’ গানটি আজ কতজনেরই বা পরিচিত? আরও বড় চমক লহনা ভট্টাচার্যের কণ্ঠে সলিল রচিত ও সুরারোপিত ‘সেই মেয়ে’। রবীন্দ্রনাথের ময়নাপাড়ার মেয়ে কৃষ্ণকলিকে শিল্পী সলিলের চোখ দেখেছিল ছেচল্লিশের মন্বন্তরে শীর্ণ বাহু তুলে কলকাতায় যারা ফ্যান ভিক্ষা করত তাদের মধ্যে। সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত সেই গান কৈশোর না পেরনো লহনাকে গাইতে দিয়ে অনুষ্ঠানের নির্দেশক বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কিন্তু লহনা যে অনায়াস দক্ষতায় অত লম্বা এবং দুরূহ গানটি গেয়েছেন তা ঝুঁকি সার্থক করেছে।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে তথাগত ভট্টাচার্য অন্য স্বাদ এনে দিয়েছেন ‘মোর মতন আর দেশপ্রেমিক নাই’, বাড়ি থেকে পালিয়ে ছবির ‘আমি অনেক ঘুরিয়া শ্যাষে আইলাম রে কইলকাত্তা’, গঙ্গা ছবির ‘ইচ্ছা করে পরাণডারে’ ইত্যাদি গানগুলি গেয়ে।

শেষ শিল্পী ছিলেন সৌরভ স্বয়ং। ‘পাগল হাওয়া’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ শিল্পী হিসাবে তাঁর জাত চেনায়। তবে এই সন্ধের পবিত্রতম মুহূর্ত তিনি তৈরি করতে পেরেছেন ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’ গানে। সলিলের মত অত বড় শিল্পীর শিল্পকর্মেও অমন বিশুদ্ধ গানের সংখ্যা হয়ত খুব বেশি নয়। ওই গান গেয়ে আক্ষরিক অর্থে শ্রোতাদের অতল সলিলে নিয়ে যেতে পেরেছেন সৌরভ।

আরও পড়ুন সকল অহঙ্কার হে আমার

অনুষ্ঠানের মেজাজ যে তারে বাঁধা ছিল তাতে ঈষৎ বেসুরো ঠেকেছে ‘শপথ’ কবিতা অবলম্বনে নাচ এবং সমবেত কণ্ঠে ‘পথে এবার নামো সাথী’ গানটি। বিশেষত, গানটি যে সময়ে রচিত তার তুলনায় যুগ এতটাই বদলে গেছে, আমাদের পথে নামার অভ্যাস এতটাই কমে গেছে, নামার উদ্দেশ্যেরও এত তারতম্য ঘটেছে যে গানটি এখন নিজেই নিজের প্যারডি বলে মনে হয় অনেকসময়। দোষটা অবশ্য প্রতিবেদকের সিনিসিজমেরও হতে পারে। বরং অনেক বেশি কালজয়ী ‘রানার’। সৌরভের মত দরাজ গলার কোনো শিল্পীর কণ্ঠে ওই গান হয়ত মধুরতর স্মৃতি হয়ে উঠতে পারত।

সেদিন উত্তরপাড়া গণভবনে তিলধারণের জায়গা ছিল না লিখতে পারলে চমৎকার হত, কিন্তু ঘটনা হল বহু দর্শকের চেয়ে মনোযোগী দর্শক সঙ্গীতানুষ্ঠানের রসগ্রহণের পক্ষে বেশি সুবিধাজনক। সেদিক থেকেও ‘অতল সলিলে’ তৃপ্তিদায়ক। ইদানীং যে কোনো প্রেক্ষাগৃহে মোবাইল ফোনের আওয়াজ শিল্পী এবং অন্য দর্শকদের যতখানি বিরক্তি উদ্রেক করে, এদিন তার অর্ধেকও করেনি।

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত

প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের নিভু নিভু আগুন

গত দশ বছরে তৃণমূল নেত্রীর উচ্চারণের ত্রুটি নিয়ে খোদ সূর্যকান্ত মিশ্রের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে কম কটাক্ষ করা হয়নি। ‘টুম্পা’ তেমন উচ্চারণকেই বাম রাজনীতির ভাষা করে দিল।

বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র কয়েক বছর আগে হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক ভরে গিয়েছিল নারী কণ্ঠে গাওয়া ভূপেন হাজারিকা খ্যাত ও গঙ্গা তুমি গানে। সেখানে গায়িকা প্রথমে পল রোবসনের ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ গাইছিলেন। তারপর ঐ গানের অনুসরণে রচিত ‘ও গঙ্গা তুমি’। বলা হচ্ছিল গলাটা কলম্বিয়ান শিল্পী শাকিরার। কয়েক দিন পরে জানা গেল, আসলে ঐ কণ্ঠ পূরবী মুখার্জির। যিনি এক সময়কার পরিচিত শিল্পী, প্রচুর গণসঙ্গীত গেয়েছেন। বাঙালি, বিশেষত বামপন্থী বাঙালি, নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার কত দ্রুত হারিয়ে ফেলছে তা দেখে অবাক লেগেছিল। সেই বিস্মৃতি আরো কুৎসিত চেহারায় প্রতিভাত হয়েছে গত কয়েক দিনে। বামফ্রন্টের ডাকা ব্রিগেড সমাবেশের প্রাক্কালে ঐ সভায় যোগ দেওয়ার আহ্বান হিসাবে মোবাইল থেকে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়েছে জনপ্রিয় গান টুম্পার প্যারডি

কুৎসিত বলায় সিপিএম কর্মীরা রাগ করবেন। কাগজে পড়ছি কেবল শতরূপ ঘোষের মত তরুণ তুর্কিরাই নয়; মহম্মদ সেলিম, শমীক লাহিড়ির মত বর্ষীয়ান নেতারাও “শতফুল বিকশিত হোক”, “বয়সের নিজস্ব ভাষা” প্রভৃতি যুক্তিতে সিপিএম ডিজিটালের সদস্যদের তৈরি এই প্যারডির পক্ষে চেতেশ্বর পূজারার মত ব্যাট করছেন।

বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে অকথা কুকথার বান ডেকেছে। লাইভ টিভিতে বিজেপি আর তৃণমূলের দুই নেতা একে অপরের জন্মদাতাকে পর্যন্ত গালাগালি করেছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেহারা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে এবং তাঁর ভাইপোকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়েছে বিজেপির দিক থেকেও। বামপন্থীরা সঙ্গত কারণেই দুপক্ষেরই সমালোচনা করছিলেন, বলছিলেন সাধারণ মানুষের ইস্যু বাদ দিয়ে কদর্য ভাষায় কুৎসিত রাজনীতি করা হচ্ছে, যা বাংলার সংস্কৃতির পরিপন্থী। সেই আবহে হিন্দি মিশ্রিত, অভিধান বহির্ভূত শব্দ সম্বলিত টুম্পাকে ব্রিগেডে নিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প কোন সংস্কৃতিকে ধারণ করছে কে জানে! ইদানীং কিছু ভোজপুরি গান নানা উপলক্ষে বাজতে শোনা যায়। সেগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য কয়েকটা শব্দ পরে পরেই শিল্পীর কণ্ঠের সাথে এক যান্ত্রিক আওয়াজের ক্যাকোফোনি। মূল ‘টুম্পা’ গানটা সেই ধারা অনুসরণ করেছে, প্যারডিও তাই। বামপন্থীরা যে ইস্যুভিত্তিক বিতর্কের কথা বলছিলেন, এ গানে তা-ই বা কোথায়? কেবল তৃণমূল-বিজেপির ‘সেটিং’-এর কথা রয়েছে, মমতা বা মোদী সরকারের কার্যকলাপের কড়া সমালোচনাও নেই। শুধু বার দুয়েক চাকরির প্রসঙ্গ আছে। অর্থাৎ এই প্যারডি রাজনৈতিক বক্তব্যে দুর্বল এবং আঙ্গিকে অবাঙালি। তবুও ভাইরাল, সুতরাং জনপ্রিয়। এতেই বাম নেতারা উল্লসিত। ভাইরাল মানেই ভোট বলে ভাবছেন হয়ত। ঠিক ভাবছেন কিনা তা সময় বলবে। তবে মজা লাগল অন্য কারণে।

আরও পড়ুন বাঙালির চেতনার রঙে শিল্প হল গো অ্যাজ ইউ লাইক

গত দশ বছরে তৃণমূল নেত্রীর উচ্চারণের ত্রুটি নিয়ে খোদ সূর্যকান্ত মিশ্রের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে কম কটাক্ষ করা হয়নি। ‘টুম্পা’ তেমন উচ্চারণকেই বাম রাজনীতির ভাষা করে দিল। নীচের তলার বাম কর্মীদের আকছার বলতে শোনা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে বাঙালির “কালচারে আলকাতরা মিশে গেছে”। টুম্পার প্রেমে পড়ে এখন দেখছি কালচারের ধারণাটাকেই তাঁরা “এলিটিস্ট” আখ্যা দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর লেখা কবিতা নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করতেন ওঁরা, আর মমতাপ্রেমী বুদ্ধিজীবীরা বলতেন কে কবি কে নয়, তা দাগিয়ে দেওয়া ভদ্রলোকদের এলিটিজম। জীবনানন্দ দাশের ভাষায় এমন অসাহিত্যিক প্রলাপ শুনে শিউরে উঠতাম। এখন ‘টুম্পা’-র পক্ষে দেখছি একইরকম যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। শমীকবাবু বলেছেন “উচ্চাঙ্গসঙ্গীতই যে একমাত্র সংস্কৃতি, সেটা কোথায় সিদ্ধান্ত হল?”

উচ্চাঙ্গসঙ্গীত মনে পড়ল অথচ গণসঙ্গীত মনে পড়ল না! জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক প্রতীক ব্যবহার করে প্রতিবাদী গান বাঁধার কথা বললেই যে কোন ইতিহাস সচেতন কমিউনিস্টের মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য মনে পড়ার কথা। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরকে ব্যঙ্গ করে তৈরি সেই গান মঙ্গলকাব্যের ভাষায় হওয়ায় অক্ষর পরিচয় না থাকা মানুষকেও ছুঁয়ে ফেলত।

আর আজ কমিউনিস্টরা মনে করছেন সাধারণ মানুষের ভাষা মানে কিছু অভিধান বহির্ভূত শব্দ।

অবশ্য হেমাঙ্গ বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরীদের যুগ কবেই চলে গেছে। তখন সম্ভবত সংসদীয় কমিউনিস্টরাও চাইতেন মানুষকে বিকল্প বৈপ্লবিক সংস্কৃতির খোঁজ দিতে। এখন পাবলিক যা খাচ্ছে, সেটাকেই ব্যবহার করে ভোটে জিততে চান।

টুম্পা দীর্ঘজীবী হোক।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: