শারদ উৎসব এসে পড়লেই বাঙালির আনন্দ আর ধরে না। মন্ত্রী সান্ত্রী থেকে শুরু করে আমাদের মত চুনোপুঁটি — সকলেরই নাচতে ইচ্ছে করা স্বাভাবিক। তবে সকলে ক্যামেরার সামনে নাচেন না। সেটা চান না বলে নাকি সুযোগ পান না বলে, সে অন্য কথা। কিন্তু আমাদের মধ্যে যাঁরা বিখ্যাত বা কুখ্যাত, তাঁদের সুযোগের অভাব নেই। অতএব তাঁরা লাইক কুড়োবার এমন মওকা ছাড়বেন কেন? সমস্যা হল, ক্যামেরার সামনে কিছু করছেন মানেই সেটা পাবলিক পারফরম্যান্স। আর তাতে কেবল লাইক নয়, সমালোচনা জোটে; ব্যঙ্গবিদ্রুপও। শোভন চ্যাটার্জি আর বৈশাখী ব্যানার্জির নাচের বেলাতেও তাই হয়েছে। কিন্তু বাঙালি যেহেতু বুদ্ধিজীবীর জাত, সেহেতু নিতান্ত লঘু ঘটনাকেও গুরুত্ব আরোপ করে তর্কের বিষয়বস্তু করে তুলতে না পারলে চলে না। তাই শোভনবাবু, বৈশাখী দেবীকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা অন্যায় — এই সন্দর্ভ তৈরি হয়েছে। রীতিমত প্রবন্ধ লেখালিখি চলছে। যুক্তি মূলত দুটি। ১) দুজন মানুষ একে অপরকে ভালবাসে, একসাথে নাচতে ইচ্ছে হয়েছে বলে নেচেছে। এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার। সমালোচনা মানে অনধিকার চর্চা, ২) ওঁদের অন্য অনেক দিক থেকে সমালোচনা করা যেতে পারে। শারীরিক গঠন নিয়ে বিদ্রুপ করা কুরুচিকর।
প্রথম যুক্তিটির মত কুযুক্তি কমই হয়। বেসুরো গলায় বাথরুমে গান গাওয়া নিশ্চয়ই আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু স্টেজে উঠে গাইলে কোনো শ্রোতা যদি বলেন “গাধার মত গাইছে”, তখন তেড়ে যাওয়া চলে না। শ্রোতারও ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। আসলে প্রথম যুক্তি আসছে দ্বিতীয় যুক্তি থেকে। সেটি নিয়ে কিঞ্চিৎ দীর্ঘতর আলোচনা প্রয়োজন।
নৃত্যশিল্পের অনুপযোগী দুজন মানুষের পাবলিক পারফরম্যান্সের সমালোচনা করলে ফ্যাট শেমিংয়ের ওজর তোলা প্রমাণ করে আমাদের শিল্প বোধ গোল্লায় গিয়েছে। ইংরেজি ভাষায় নৃত্য, গীত, সাহিত্য, চিত্রকলা — সবকিছুকেই discipline বলা হয়। কারণ এসবের চর্চা করতে নিয়মানুবর্তিতা দরকার, অনুশীলন প্রয়োজন। গায়ক/গায়িকা হতে গেলে কেবল রোজ রেওয়াজ করতে হয় না, টক খাওয়ার লোভও ছাড়তে হয়। নৃত্যশিল্পী হতে গেলেও খাওয়া-দাওয়ায় নিজেকেই বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়, জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনতে হয়। এককথায় কিছু ত্যাগস্বীকার করতে হয়। অত কথা আজকাল আমরা বুঝি না। আমরা বুঝি প্রতিভা। অর্থাৎ উদয়শঙ্কর, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার প্রমুখ বোকার হদ্দ ছিলেন। সারাজীবন ভরপেট খেয়ে ভুঁড়ি বাগিয়েও নাচ করতেই পারতেন। স্রেফ প্রতিভা দিয়েই কেল্লা ফতে হয়ে যেত।
আসলে দোষ শোভনবাবু, বৈশাখী দেবীর নয়। বাঙালি মাত্রেই কবি, গায়ক, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী ইত্যাদি হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। ইদানীং তা প্রমাণ করার জন্য রিয়ালিটি শো হয়েছে। ছানাপোনারা লসাগু, গসাগু শেখার আগেই গান গেয়ে স্বনামধন্য বিচারকদের থেকে প্রতিভার স্বীকৃতি পাচ্ছে। আগে বিখ্যাত গায়ক-গায়িকারা বলতেন সঙ্গীত নাকি সারাজীবন শিখতে হয়, আজকাল বছর পঁচিশ বয়সের শিল্পীরাও বিচারক। তার উপর আছে সোশাল মিডিয়া। পাঠ্য বইয়ের বাইরে কবিতা পড়িনি, কিন্তু ফেসবুকে রোজ কবিতা লিখছি, দু হাজার বন্ধুর মধ্যে পাঁচশো জন লাইক দিলেই প্রমাণ হল আমি কবি। বাড়ির শিশুটি সবে দু-একটি কবিতা আবৃত্তি করতে শিখেছে, বাবা-মা খুলে দিলেন ইউটিউব চ্যানেল। এক মাসেই মেয়ে বুঝে গেল সে একজন শিল্পী।
আরও পড়ুন সলিল চৌধুরী স্মরণে একটি মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা
সোশাল মিডিয়ার বাইরেও একটি উপন্যাস লেখার পরেই তরুণ লেখক সম্পর্কে প্রবীণ বলছেন “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেই…”। জনপ্রিয় কবি রাতারাতি সিনেমা পরিচালক হয়ে যাচ্ছেন, পারকাশনিস্ট সিনেমার নায়ক হচ্ছেন, নায়ক গায়ক হচ্ছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথার মাথামুন্ডু খেয়াল না করে কোরাসে গাওয়া হচ্ছে। সাহেবরা বলে discipline, আমাদের জোরালো দাবি জানানো উচিত, শিল্প মানে আসলে go as you like। যে লিখেছে সে আর তার ভক্তরা যাকে কবিতা বলবে, তা-ই কবিতা। অনর্থক কিনা, ছন্দের হদ্দমুদ্দ হয়েছে কিনা তা বিবেচ্যই নয়।
এমতাবস্থায় কপোত-কপোতী মনের আনন্দে নাচবেন, শিল্প সৃষ্টি করবেন, তার আবার সমালোচনা হবে কেন? তাল মিলুক আর না মিলুক, দেখতে যেমনই লাগুক, যারা বলবে ওটা নাচ নয় তারা তালিবান।
উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত
One thought on “বাঙালির চেতনার রঙে শিল্প হল গো অ্যাজ ইউ লাইক”