‘রাজ, দিলীপ, দেব: যুগের স্বপ্ন সাফল্য ব্যর্থতার ধারক’

এখনকার অক্ষয় কুমার ইত্যাদিদের ছবি থেকে তো ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের ইতিহাসটাকেই মুছে দেওয়া হয়েছে। কুষ্ঠরোগীর সঙ্গে যেমন এককালে মানুষ অস্পৃশ্যের মত ব্যবহার করত, এখনকার হিন্দি সিনেমা দরিদ্রের প্রতি সেই মনোভাব নিয়েছে।

আজ রাজ কাপুরের জন্মদিন, তাঁর শতবর্ষ হবে ২০২৪ সালে। গত রবিবার শতবর্ষে পড়লেন দিলীপকুমার। দেব আনন্দও শতবর্ষ পূর্ণ করবেন বছর ঘুরলে। স্বাধীনোত্তর ভারতে হিন্দি ছবির বিপুল জনপ্রিয়তার পিছনে এই তিনজনের অবদান অতুলনীয়। আজ আসমুদ্রহিমাচলে বলিউড নামে পরিচিত মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা যেখানে এসে পৌঁছেছে, তাতে ওই ত্রয়ীর কাজকে ফিরে দেখা প্রয়োজন মনে করে নাগরিক ডট নেট সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছিল। তিনি যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর তো দিলেনই, উপরন্তু আলোচনায় এসে পড়লেন উত্তমকুমার, এল দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে। যেমন ঢুকে পড়লেন ইউরি গ্যাগারিন, তেমনি এসে গেল কহো না পেয়ার হ্যায়। নাগরিকের পক্ষ থেকে কথা বলেছেন প্রতীক

রাজ

স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দি সিনেমার যে বিপুল জনপ্রিয়তা, হিন্দিভাষী নন এমন মানুষকেও যেভাবে তা প্রভাবিত করেছে তাতে এই তিনজনেরই তো অনস্বীকার্য প্রভাব। আজকের জনপ্রিয় হিন্দি ছবি যে পথে চলেছে তার সাপেক্ষে ওঁদের কীভাবে দেখেন?

প্রশ্নটা খুব আকর্ষণীয় এবং কিছুটা দূরপ্রসারী। যে মুহূর্তে ভারতীয় চলচ্চিত্রে রাজ কাপুর, দিলীপকুমার এবং দেব আনন্দ প্রবেশ করছেন তখন যে ধরনের সাংস্কৃতিক বাতাবরণ ছিল, একটা সদ্য স্বাধীন দেশে যে ধরনের গঠন প্রক্রিয়া চলছিল এবং আমাদের রাজনীতি যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল, তার সমস্তটাই জনপ্রিয়তার আবরণ সরিয়ে দিলে দিলীপকুমার, দেব আনন্দ এবং রাজ কাপুরের মধ্যে দেখা যায়। একথা অনস্বীকার্য যে পাঁচের দশকে মেলোড্রামার পৃথিবীতে একইসঙ্গে পশ্চিমে দিলীপকুমার, রাজ কাপুর ও দেব আনন্দ; দক্ষিণে শিবাজী গণেশন এবং পূর্বে উত্তমকুমার যে মায়াবী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তার কোনো পুনরাবৃত্তি ভারতীয় সিনেমায় আর হবে না সম্ভবত।

মুম্বাইয়ের ত্রয়ীর মধ্যে দিলীপকুমার অবশ্য একটু আলাদা, কারণ রাজ আর দেব প্রোডাকশন হাউসের মালিক হয়ে উঠেছিলেন। দিলীপকুমারের তেমন কোনো ঠিকানা ছিল না। কিন্তু মোদ্দা ব্যাপারটা এইরকম যে যা ছিল রানীর কণ্ঠহার, মানে ‘কুইন’স গোল্ডেন নেকলেস’, তা ওই সময়ে অস্তমায়ায় করুণ রঙিন; উপনিবেশের স্মৃতি ক্রমশ আবছা হয়ে জেগে উঠছে নির্বাচিত সাধারণতন্ত্র; বিদায় নিচ্ছেন অশোককুমার, বলরাজ সাহনিরা। এই সময়ে তাঁদের নায়কোচিত অবস্থানে এসে পড়লেন দিলীপকুমার; সঙ্গে সঙ্গে রাজ কাপুর আর দেব আনন্দ। কিন্তু ব্যাপারটা যে শুধুই ঘটনা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলেও সে সময় ক্রমশ গ্রাম এসে শহরে ভিড় করছে। নানারকম অবসিত পল্লী শহরের আনাচে কানাচে। তখন আমাদের অজান্তেই জাতি গঠনের রূপকথা নানারকম বাঁক নিচ্ছিল। মনে রাখতে হবে, সত্যজিৎ রায়ের অপূর্ব কুমার রায় যখন কলকাতায় প্রবেশ করে নবীন নাগরিক হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে, প্রায় তখনই শাপমোচন ছবির নায়ক উত্তমকুমার গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসেন। এই স্থানান্তর উপলক্ষে উত্তমকুমার জনসাধারণের মন লুঠ করে নেন।

আপনি বলছেন একই ব্যাপার রাজ কাপুরদের ক্ষেত্রেও হিন্দি ছবিতে ঘটেছিল?

ঠিক তাই। কলকাতার মতই তৎকালীন বম্বে শহরের মধ্যেও এক অলীক গ্রাম তৈরি হয় সিনেমার পর্দায়। উত্তমকুমারের মতই রাজ কাপুর এবং দিলীপকুমার শহুরে লোকগাথার অবিসংবাদী সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন। এই হল মেলোড্রামার আদর্শ মুহূর্ত, যেখানে বুর্জোয়া সভ্যতার ট্র্যাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কিছু বাধ্যতামূলক নৈতিকতা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। বস্তুত দেশভাগ, গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্ব, নগরায়নের দোলাচল কিছু আধিক্য তৈরি করে, অতিশয়োক্তিই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। আমার মতে সেই অতিশয়োক্তির আদর্শ দৃষ্টান্ত দিলীপকুমার।

রাজ কাপুর তাহলে কী? বলা যায় উনি সরকারি সিলমোহর। প্রায় শাস্ত্রানুমোদিত, নেহরু যুগের জাতি গঠনের স্মারক। অন্যদিকে দেব আনন্দ স্বাধীনোত্তর লাগামছাড়া যৌবনের দূত। রাজকে দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে একদিকে যখন সাহিত্যসমর্পিত বাস্তববাদ চলচ্চিত্রের জন্য একটি মানচিত্র তৈরি করতে ব্যস্ত, তখন তিনি মেলোড্রামার আদলে গ্রাম থেকে শহরে আসার অভিজ্ঞতা ও রাষ্ট্রীয় বিধিসমূহ পরীক্ষা করে চলেছেন সেলুলয়েডে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর গণতান্ত্রিক সমাজবাদ ও মিশ্র অর্থনীতির ধারণায় এক ধরনের জাতি গঠনের প্রয়াস মূর্ত হয়ে উঠেছিল। আওয়ারা (১৯৫১), বুট পলিশ (১৯৫৪), শ্রী ৪২০ (১৯৫৫) এবং জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায় (১৯৬০) উত্তর-স্বাধীনতা পর্বে ভারতীয় জনজীবনে আধুনিকতার নিশ্চিত দলিল হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। আরেকটু তলিয়ে ভাবলে, প্রমথেশ বড়ুয়ার অধিকার সেই ১৯৩৯ সালে তথাকথিত অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছিল রাজ কাপুর সেই উত্তরাধিকার কৃতজ্ঞ চিত্তে বহন করে নেন আওয়ারাতে। অথচ তিনিই আবার সামাজিক প্রসঙ্গ আড়াল করে সিক্ত যূথীর গন্ধবেদনে আখ্যানের গহনে চলে যান শ্রী ৪২০ ছবিতে। শাড়ির অন্তরালে একটি ছাতার তলায় নার্গিস ও নিজেকে অমর করে দেন সঙ্গীতের চরণে, ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’ মেলডিতে। নিজেকে জীবনের যাবতীয় বাসনার আড়ালে রেখে জানান, ওই রজনীতে ঝড় বয়ে যাবে রজনীগন্ধা বনে।

ওখান থেকেই তো ওই জুটি অন্য মাত্রা পেল?

হ্যাঁ, এরপর কিংবদন্তী হয়ে গেলেন রাজ-নার্গিস যুগল। রিচার্ড বার্টন-এলিজাবেথ টেলরের সম্পর্ক যদি গবেষণার বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে রুপোলি পর্দায় তার পরিশিষ্টে রাজ কাপুর-নার্গিসের জীবনকথাও নক্ষত্রলোকের জিনিস। বম্বেভিত্তিক হিন্দি ছায়াছবির জগৎ গত শতকের নয়ের দশক থেকে বলিউড নামে চিহ্নিত হয়। সেখানে সবচেয়ে শক্তিশালী কাপুর পরিবারের মধ্যমণি রাজ, যেন রামায়ণে ইক্ষ্বাকু বংশের শ্রীরামচন্দ্র। অবিভক্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পেশোয়ার শহরে তাঁর জন্ম। বাবা পৃথ্বীরাজ জীবিকার কারণে বম্বে শহরে চলে আসেন। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম সারির এই নেতা শুধু যে সপরিবারে ভারতের নানা শহরে আস্তানা গেড়েছিলেন তাই নয়, নিজের সন্তানদের মধ্যেও সংক্রমিত করেছিলেন গরীব ও নিচুতলার মানুষকে খোলা চোখে দেখার ঘরানা। এই সুবাদে কিছুদিন কলকাতাতেও ছিলেন বালক রাজ কাপুর। ছোটবেলা থেকেই যে বাংলা ভাষার উত্তম ব্যবহার জানতেন তার কারণও এই শহরের মায়াবী স্মৃতি।

এই কলকাতার সংযোগটা আরেকটু খুলে বলবেন?

এটা সবিস্তারে বলার মত ব্যাপারই বটে। একটা মজার তথ্য অনেকেই হয়ত জানেন না। রাজের প্রথম ছবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কলকাতা। ছবিটার নাম ইনকিলাব (১৯৩৫)। সেখানে তাঁর আবির্ভাব হয় শিশুশিল্পী হিসাবে। সে ছবির পরিচালক দেবকী বসু আর প্রযোজনা নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর। যদিও ডানা মেলতে রাজ সময় নিয়েছেন আরও অনেকদিন। ইনকিলাবের এক যুগ পরে নীলকমল (১৯৪৭) ছবিতে মধুবালার বিপরীতে নায়ক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। কিন্তু ১৯৪৯ সালের অন্দাজ ছবিতে যে মেলোড্রামার কথা এত করে বলছি তা এক বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়। তবে সেখানেও রাজ আর দিলীপ একত্রে ছিলেন। রাজ প্রথম মেঘমুক্ত হলেন আওয়ারার সাফল্যে। ভারতবর্ষ তো বটেই, তখনকার সোভিয়েত ভূমিও প্লাবিত হয়েছিল আওয়ারা হুঁ গানে। এতটাই যে মানুষের প্রথম মহাকাশ যাত্রায় ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশযানে এই গান গুঁজে দেওয়া হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নে তো রাজ কাপুরের অনেক ছবিই প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। এই প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল তখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, রাজ কাপুরের ছবির যে রাজনীতি সেটাই কি ভারতের মত কমিউনিস্ট রাশিয়াতেও জনপ্রিয় হওয়ার কারণ?

শুধু তা হয়ত নয়। আওয়ারা ছবিতে নারী ও শিশুর সঙ্গে আদালত এবং আইনের যে সংঘর্ষ পরবর্তী বুট পলিশ ছবি (যাকে টাইম ম্যাগাজিন ‘ক্ষুদ্রাকার মহাকাব্য’ বলেছিল) বা শ্রী ৪২০ ছবিতেও দেখা যায়, তা থেকে বোঝা যায় রাজ কাপুর একটি দেশের গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তরের পথে যে উত্থান পতন, যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, যে অশ্বখুরের ধ্বনি, সেগুলোকে এক ধরনের রূপকথার আঙ্গিকে প্রকাশ করছেন। তিনি সমাজের কথা বলছেন, কিন্তু প্রেম আর গান সেখানে যেভাবে জড়িয়ে থাকছে তাতে অনেকসময়েই একরকম ব্যালাডের রূপ নিচ্ছে। যেমন মেরা জুতা হ্যায় জাপানি গানটা একসময় প্রায় জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছিল। তার পিছনে আবার রাজনীতি অন্যতম কারণ, যেহেতু তখন ভারত পঞ্চশীল রাজনীতির চর্চা শুরু করেছিল। সুতরাং রাজ কাপুরের রাজনীতি ব্যালাডের রূপ ধরে পর্দায় আসে বলেই সত্যজিতের অপরাজিত (১৯৫৬) ছবির চেয়ে অনেক বেশি জনচিত্তহারী হতে পেরেছিল সর্বত্রই। মেহবুব খানের মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭) ছবির মতই রাজের জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায় উত্তর ভারতের সম্পন্ন চাষির চোখ দিয়ে ভারতীয় নব্য জীবনগাথা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।

আপনি সম্প্রতি এক জায়গায় বলেছেনদিলীপকুমারের উত্থান নেহরুজাত সমাজতান্ত্রিক যুগের সূচক আর শাহরুখ খানের উত্থান মনমোহনী বাজার অর্থনীতির সূচক। দিলীপকুমার থেকে শাহরুখ অব্দি পৌঁছতে গিয়ে হিন্দি সিনেমা তো ভোল পালটে অনেক বেশি করে উত্তর ভারতীয় এবং অনাবাসী ভারতীয়কেন্দ্রিক হয়ে পড়লযেখানে বাঙালি বা তামিল চরিত্র শুধুমাত্র হাস্যরস উৎপাদন করে। এমনটা তো বরাবর ছিল না। স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনের প্রথম হিট ছবি তো আনন্দ, যেখানে কথকের চরিত্রটাই একজন বাঙালি ডাক্তারের। এই সারা ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার সংস্কৃতি যে হিন্দি ছবিতে আর রইল না, এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?

এখানেই আসতে চাইছিলাম। এই যে আমরা দিলীপকুমারের কথা বলছি। তিনি তো একজন আর্কিটাইপাল বিরহী এবং অতিনাটক তাঁর কাছে শকুন্তলার হাতের আংটির মত। কিন্তু দিলীপকুমার কেন কিংবদন্তী? কারণ নবীন ভারতীয় প্রজাতন্ত্র যে সমস্ত মিথ জনসাধারণের জন্য ছড়িয়েছিল, সেগুলো দিলীপকুমার আশ্চর্যভাবে নিজের শরীরে মুদ্রিত করতে পারতেন। যেমন বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কণ্ঠমাধুর্যে ভেসে যেতে যেতে যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজের সিংহাসন, তা দর্শককুলকে স্বপ্নপুরীতে নিয়ে যায়। সে দ্যাখে সকরুণ দীর্ঘশ্বাসে দিলীপকুমারের যন্ত্রণাতাড়িত মুখ। পাঁচের দশকে দেবদাস হয়ে তিনি মদের পেয়ালায় ঠোঁট ছোঁয়ালে তা একটা আস্ত প্রজন্মের অশ্রুলিপি হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দিলীপকুমার নক্ষত্রলোকে সময়ের আশ্চর্য মুখপাত্র। ধরো আমরা যখন মধুমতী (১৯৫৮) দেখি বা অন্দাজে রাজ কাপুরের বিপরীতে দিলীপকুমারকে দেখি, তখন বুঝি যে এই নায়করা “assure the passage from awe to charm”। কথাটা আমার নয়, রলাঁ বার্থের। কথাটা এঁদের প্রসঙ্গে খাটে। এঁদের সময় সম্পর্কে আগেই যা বললাম – একদিকে যুগ যুগ ধরে জমে থাকা মাটির টান, অন্যদিকে শাসক প্ররোচিত শিল্পসভ্যতার দায়ে বদলে যাওয়ার সমস্ত ক্ষতচিহ্ন উৎকীর্ণ হয়ে আছে নাগরিক সভ্যতার গায়ে। ফলে দিলীপকুমারের সমকালীন যুবসমাজ ফলের বাগিচা এবং লেদ মেশিনের আর্তনাদের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হতে হতে যে উন্মাদনা এবং প্রতিস্থাপনকে খেয়াল করে, তা যদি অপরাজিত বা জলসাঘর (১৯৫৮) চিত্রিত বাস্তবতার ইশতেহারকে পরিহার করে, তবে তাতে এক ধরনের মাত্রাছাড়া ঢেউ থাকবেই। ফলে বলা যেতে পারে দিলীপকুমার, রাজ কাপুর আর দেব আনন্দ ইতিহাসের একরকম সরলীকৃত ব্যাখ্যার মূর্ত রূপ।

এবার শাহরুখের কথা বলি। আমাদের ওই ত্রয়ীর সকলেই, চলতি কথায় যাকে বলে ‘সুদর্শন’। তাঁরা যুবতীদের হৃদয় হরণ করতেন। পুরুষরাও তাঁদের দেখে এক মায়াবী লাবণ্য অনুভব করেন। শাহরুখকে আমরা যখন দেখতে পেলাম ততদিনে কিন্তু আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা অপসৃয়মান, নবীনের সঙ্গে প্রাচীনের দ্বন্দ্বও অনেক বদলে গেছে। নেহরু যুগের অবসানে আমরা বুঝতে পারছি সাবেকি সমাজতন্ত্রের পতাকা পথপ্রান্তে লুটোপুটি খাচ্ছে। এ দেশে যেমন নেহরুর অর্থনীতি বাতিল হয়ে যাচ্ছে, তেমনি বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনও আসন্ন। ফলে শাহরুখ আসেন এক সাধারণ ‘অপর’-এর প্রতিনিধি হয়ে। তিনি আমাদের জয় করলেন কিন্তু কোনো মতাদর্শগত বার্তা দিয়ে নয়, যে বার্তা রাজ বা দিলীপের চরিত্রগুলো দিতে পারত। শাহরুখ এই কারণেই বিশ শতকের শেষ বড় নায়ক হয়ে উঠলেন যে তিনি আর পাঁচজনের মতই এবং তিনি কোনো বৃহত্তর স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নন। ফলে এই শতাব্দীতে পৌঁছে ওম শান্তি ওম (২০০৭) ছবিতে তিনি মুম্বাইয়ের ছবির প্রায় গোটা ইতিহাসটারই নতুন রকম ব্যাখ্যা করে নিজেকে তার কেন্দ্রে স্থাপন করেন, খানিকটা ব্যঙ্গই করেন। অর্থাৎ এখানে কিন্তু তাঁর একটা পাল্টা রাজনীতি উঠে এল।

রাজ কাপুরের একটা দিক নিয়ে আমার কৌতূহল নিরসন করতে চাই। উনি ১৯৫৬ সালে জাগতে রহো ছবিতে অভিনয় করেছেন, যেখানে গ্রামের একজন তৃষ্ণার্ত কৃষক শহরে এসে একটু জল পাচ্ছে না কারোর কাছে, উল্টে চোর সন্দেহে তাড়া খাচ্ছে। এই ছবির পরিচালক শম্ভু মিত্র, অমিত মৈত্র। সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী অর্থাৎ ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সাথে যুক্ত লোকেরা। পরে যখন রাজ কাপুর আর কে ফিল্মসের ব্যানারে নাচে গানে ভরপুর ছবি করছেনতখনো জাগতে রহোর প্রভাব যেন থেকেই যাচ্ছে। সেই কপর্দকশূন্য মানুষযাকে চার্লি চ্যাপলিনের ছবির আলোচনায় আমরা ট্র‍্যাম্প বলিসে জাগতে রহোর আগেই মুক্তি পাওয়া শ্রী ৪২০-এ তো প্রায় চ্যাপলিনের চেহারাতেই ছিল, কিন্তু বহু পরে ১৯৭০ সালে যখন রাজ মেরা নাম জোকার করেন, তখনো সেই ট্র্যাম্পসুলভ একটা চরিত্রই কেন্দ্রে। ১৯৬৬ সালে বাসু ভট্টাচার্য পরিচালিত তিসরি কসম এমনিতে একটা প্রেমের ছবি। কিন্তু সে ছবির রাজ অভিনীত চরিত্র, গাড়োয়ান হীরামন, সেও প্রায় সব হারানো একজন মানুষ। বারবার এইরকম চরিত্র রাজের কাজে ফিরে আসত কি স্রেফ চার্লি চ্যাপলিন তাঁর প্রিয় শিল্পী ছিলেন বলে, নাকি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের কোনো স্থায়ী প্রভাব ওঁর উপর রয়ে গিয়েছিল বলা যায়?

মেরা নাম জোকার, তারপর ববি (১৯৭৩) বা রাম তেরি গঙ্গা ময়লি (১৯৮৫)-র সময়ে রাজ কাপুর এমন এক বাণিজ্যিক সিনেমা উৎপাদন করছেন যেখানে লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মধ্যে প্রথমজনের দিকেই পাল্লা ভারি। মজার কথা, ববির চিত্রনাট্যকারদের একজন, খাজা আহমেদ আব্বাস ছিলেন ১৯৪৬ সালে তৈরি ধরতি কে লাল ছবির পরিচালক। সে ছবির প্রেরণা বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন। অর্থাৎ সেই লোক এই যুগে ববির চিত্রনাট্যকার হয়ে গেছেন। তেমনি রাজ কাপুরও ববিতে আপাতভাবে শ্রেণিবৈষম্যের কথা বলছেন বটে, কিন্তু আসলে রজার ভাদিম যেভাবে ফরাসী নবতরঙ্গে ব্রিজিত বারদোকে ব্যবহার করেন সেইভাবে ডিম্পল কাপাডিয়াকে প্রদর্শনযোগ্য নারীত্বের মডেল হিসাবে ব্যবহার করছেন। একই ঘটনা ঘটাচ্ছেন জিনত অমনকে নিয়ে সত্যম শিবম সুন্দরম (১৯৭৮) আর মন্দাকিনীকে নিয়ে রাম তেরি গঙ্গা রাম তেরি গঙ্গা ময়লি ছবিতে।

তবে তা সত্ত্বেও এটা ঠিকই, তিনি যে গণনাট্য সঙ্ঘের আদর্শ নিয়ে শুরু করেছিলেন, তার ছাপ শেষদিকেও দেখা যায়। মেরা নাম জোকারে এসে তাঁর উপর নব বাস্তববাদের প্রভাব দেখা যায়। ফলে শুধু চ্যাপলিনকে পছন্দ করতেন বলেই যে ট্র্যাম্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কাজে, তা বোধহয় নয়। যদিও রাজের চ্যাপলিন প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু শুধু কাজ নয়, রাজের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে তাকালে প্রশস্তি না করেও বলা যায়, তাঁর মধ্যে সেই গণনাট্য সঙ্ঘের আমলের লোকেদের সারল্য কিছুটা রয়ে গিয়েছিল। যেমন একবার ইরানের এক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক পিএইচডি দিয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি তো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকিনি, এখানে এই কালো পোশাক পরে অধ্যাপকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে কত বড় হয়ে গেছি! অত বড় তারকার এত সরল কথা বলা হয়ত বামপন্থী বাবার প্রভাবই হবে। তাঁর সব ছবিতেই কিন্তু রাজ এক ধরনের সারল্যের প্ররোচনা দিয়েছেন। ফলে মনস্তাত্ত্বিকভাবে একেবারে ছাপোষা ভারতীয়ের সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করতে পারতেন। ববির মত ছবিতেও দারিদ্র্যকে একটু অলঙ্কার পরিয়ে দেওয়া তাঁর স্বধর্মে পর্যবসিত হয়েছিল। আমার ধারণা এটা চ্যাপলিনের প্রভাব নয়, গণনাট্য সঙ্ঘে আদি যুগ কাটানোরই ফল।

এবার একটা প্রশ্ন করব যেটা হয়ত অযৌক্তিক, কিন্তু লোভ সামলাতে পারছি না। রাজ কাপুর, দিলীপকুমারের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ক্রমশ অক্ষয় কুমারের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হয়ে যাওয়া – এর পিছনে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ, তার ফলে মূলধারার শিল্প থেকে গণনাট্য সঙ্ঘের প্রভাব ক্রমে অপসৃত হওয়াকে কতটা দায়ী করা যায়? কারণ প্রভাবটা তো সে আমলে নেহাত কম ছিল না। জাগতে রহো বা বিমল রায়ের দো বিঘা জমিন তো বিষয়বস্তুর দিক থেকেই অন্যরকম, কিন্তু মধুমতীর মত তথাকথিত রোম্যান্টিক ছবির চিত্রনাট্যও তো ঋত্বিক ঘটকের লেখা। সে জিনিস যে বন্ধ হয়ে গেল, তাতে কি বামপন্থীদের একেবারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংযোগ তৈরি করার কাজটার ক্ষতি হল? ঘটনাচক্রে আজ আবার হেমাঙ্গ বিশ্বাসেরও জন্মদিন। যিনি একেবারে সাধারণ মানুষের চেনা আঙ্গিকে বামপন্থী রাজনৈতিক আখ্যান সৃষ্টি করতে পারতেন। যেমন মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য তৈরি করেছিলেন। 

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আধুনিক বলিউডে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের দর্পিত পদক্ষেপ ঘটেছে। সেখানে শুধুই শপিং মল সংস্কৃতি রয়েছে, যেখানে গরীবকেও সাজিয়ে গুছিয়ে দেখানো হয়। সিনেমার এমন হয়ে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে সুনিশ্চিত হয়ে যায় একমেরু পৃথিবীতে। বলিউড তখন আমাদের বোঝাতে শুরু করে যে আমরাই শুধু হলিউডের নকল করি না, ওরাও আমাদের ‘ছম্মা ছম্মা’ গান নেয় (নিকোল কিডম্যান অভিনীত মুলাঁ রুজ ছবিতে)। মানে অর্থনৈতিক উদারীকরণের নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে বলিউড আমাদের সামনে হাজির হয়। এটা ক্ষতি তো বটেই। কিন্তু এতে আমাদের একটা উপকার হয়েছে। সেটা হল এককালে হিন্দি ছবির যেসব বাড়াবাড়ি নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম, যেমন বড়লোকের ছেলের সঙ্গে গরীবের মেয়ের প্রেম বা উল্টোটা, সেগুলোরও যে দরকার ছিল তা আমরা উপলব্ধি করতে পারলাম।

আরও পড়ুন শ্রদ্ধেয়

কেন এরকম বলছেন?

আচ্ছা দিলীপকুমারের শতবর্ষ তো, তাঁর মেলোড্রামার উদাহরণ দিয়েই বলি। তিনি কী আশ্চর্য দক্ষতায় বাঙালি বিরহী দেবদাস আর মোগল যুবরাজ সেলিম – দুটো ভূমিকাই পালন করেছেন। এই দুটো চরিত্রের দূরত্ব কতটা? একবার দিলীপ হালকা মেজাজে বলেছিলেন – ৫০ ফুট। কারণ আসলে আন্ধেরির মোহন স্টুডিওতে এই দুটো ছবির সেট পড়েছিল মুখোমুখি। ফলে দিলীপ মাত্র কয়েক গজ হেঁটে ব্যথিত মাতাল থেকে গর্বোদ্ধত যুবরাজ হয়ে যেতেন। এই যে বিমল রায়ের পরামর্শে দেবদাস চরিত্রটার সঙ্গে হাড়ে মজ্জায় মিশে যাওয়া… কী মর্মান্তিকভাবে বলেছিলেন সেই সংলাপ ‘কৌন কমবখত হ্যায় জো বরদাশ্ৎ করনে কে লিয়ে পীতা হ্যায়?’ এ তো এক অবাস্তব জগৎ তৈরি করছিলেন। মুঘল-এ-আজমে যখন ‘যব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ গানের মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে, তখনো ভারত এক অসম প্রেমকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যা বাস্তবে ঘটে না, ঘটা সম্ভব নয়। বলা চলে এসব গরীবের আকাশকুসুম কল্পনাকে প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু এখন তো ছবি থেকে গরীব উধাও হয়ে গেছে।

এখনকার অক্ষয় কুমার ইত্যাদিদের ছবি থেকে তো ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের ইতিহাসটাকেই মুছে দেওয়া হয়েছে। কুষ্ঠরোগীর সঙ্গে যেমন এককালে মানুষ অস্পৃশ্যের মত ব্যবহার করত, এখনকার হিন্দি সিনেমা দরিদ্রের প্রতি সেই মনোভাব নিয়েছে। ওটাকে ঢেকে দেওয়া হয়। আমেদাবাদে যেমন বিদেশি নেতারা এলে গরীবদের পাড়ার সামনে পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়, অনেকটা সেইরকম। এখন দরিদ্র হওয়া অপরাধ। সেই কহো না পেয়ার হ্যায় (২০০০) আমল থেকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখনকার ছবিতে ভিখারিরাও যেন সাজানো গোছানো, ব্র্যান্ডেড। অথচ শোলে (১৯৭৩) পর্যন্তও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে পর্দায় দেখতে পাওয়া যেত। নিয়মমাফিক মুসলমানের উপস্থিতি, শিখের উপস্থিতি থাকত। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে যে প্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়, প্রায় তারই চেহারা দেখা যেত মুম্বাইয়ের হিন্দি ছবিতে।

আজ তার ঠিক উল্টো ঘটছে, এক ধরনের কেন্দ্রীকরণ চলছে। যেমন বিয়ে – একটা সামাজিক মিলনোৎসব। সেই দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে (১৯৯৫) থেকে পাঞ্জাবি বিয়েই ভারতীয় বিয়ে হয়ে উঠল। ভারতের অন্যান্য প্রান্তে অন্য কোনোরকম বিয়ে হয় কিনা সেকথা আমরা যেন ভুলেই গেছি। হিন্দি ছবি গোটা দেশটার একটা সিন্থেটিক কোডিফিকেশন করেছে। যেন কম্পিউটার, যেখানে ক্লিক করলেই মুশকিল আসান।

সেইজন্যেই বলছি, অল্প বয়সে আমরা তথাকথিত আর্ট সিনেমার পাল্লায় পড়ে রাজ কাপুর, দিলীপকুমার, দেব আনন্দদের নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতাম। আজ মনে হয় তাঁরা একটা যুগের স্বপ্ন, সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে ধারণ করার চেষ্টা তো অন্তত চালিয়েছিলেন। যোগ্যতার আলোচনায় যাবই না, কারণ দিলীপকুমারের মত অভিনয় প্রতিভা, রাজ কাপুরের মত জাদুকর বা দেব আনন্দের মত রোম্যান্টিক অভিনয় করার ক্ষমতাসম্পন্ন নায়ক যে আজকের বলিউডে নেই তা বুঝতে কোনো মেধা লাগে না।

কিন্তু আসল কথা হল তাঁদের নিজের কাজের প্রতি যে বিশ্বাস, যে অধ্যবসায় ছিল সেটাই আজ লুপ্তপ্রায়। বিশেষ করে বাঙালি ছবির সমালোচকরা, যাঁরা জনপ্রিয় সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা একেবারেই অপছন্দ করেন, তাঁদের হিন্দি ছবির ওই ত্রয়ীকে প্রাপ্য সম্মান জানানো দরকার। সেটা করা হয়নি, কারণ মনে করা হত জনপ্রিয় সিনেমার আলোচনায় ঢুকে পড়া উত্তর কলকাতার একটি কুখ্যাত পাড়ায় ঢুকে পড়ার সমান। এই উন্নাসিকতার ফল ভোগ করছে আজকের টলিউড, যেখানে আর অজয় কর বা নির্মল দে-র মত পরিচালক নেই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

জাতীয় সঙ্গীত এবং নেশন: ইরান যা ভাবায়

নেশন যে একটা বানিয়ে তোলা ধারণা – রবীন্দ্রনাথের এই মতের চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হলে। একই কবির একই ভাষায় লেখা দুটো গান গায় দুই আলাদা নেশনের মানুষ।

জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়ার কী কী ফল হতে পারে? ইসলামিক আইনে চালিত, এই মুহূর্তে গনগনে বিদ্রোহের আগুনে ঝলসাতে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে কী হতে পারে জানি না, তবে সাংবিধানিকভাবে এখনো ধর্মনিরপেক্ষ এবং তথাকথিত আধুনিক আইনকানুন মেনে চলা দেশ ভারতে কী হতে পারে তার বেশকিছু দৃষ্টান্ত আছে।

২০১৮ সালের দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন নিজেদের দেশের সবচেয়ে সংস্কৃতিবান এবং প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী বলে দাবি করা কলকাতার বাসিন্দারা স্টার থিয়েটারে ন জন দর্শকের দিকে তেড়ে যান সিনেমা শুরু হওয়ার আগে ‘জনগণমন’ চলার সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে গান না করার অপরাধে। অথচ সে বছরের জানুয়ারিতেই সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টেরই জারি করা সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র বাজানো বাধ্যতামূলক করার আদেশ বাতিল করে দিয়ে বলেছিল, “The interim order passed on November 30, 2016 is modified that playing of national anthem prior to screening of a film is not mandatory or directory”। কিন্তু দেশের অবস্থা তখনই এমন, যে ওই আদেশ পুরোপুরি বাতিল করার সাহস সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরও হয়নি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় সে সময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বটে “should we wear our patriotism on our sleeves”? কিন্তু আদালত এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্কোয়্যার পাস দিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে।

সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর ৯ জানুয়ারি দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া কলকাতার বিভিন্ন সিনেমা হলের মালিকদের মতামত প্রকাশ করেছিল এক প্রতিবেদনে। সেই প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায়, ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাতিরাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যে মনোভাবই থেকে থাকুক, কলকাতার হলমালিকরা ব্যবসার মত জাতীয়তাবাদের প্রতিযোগিতাতেও হারতে রাজি নন।

প্রিয়া সিনেমার মালিক অরিজিৎ দত্ত বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশে আমার এখানে কোনো তফাত হবে না। আমি জাতীয় সঙ্গীতের বদলে বন্দে মাতরম বাজাব। আশা করব দর্শকরা উঠে দাঁড়াবেন। তবে আমি কাউকে জোর করব না।” মিনার, বিজলী, ছবিঘরের মালিক সুরঞ্জন পাল বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্টের নতুন অর্ডার জাতীয় স্তোত্র বাজানো বাধ্যতামূলক নয় বললেও আমি বাজাতেই থাকব। আমি এ-ও আশা করব যে গান চলার সময়ে দর্শকরা উঠে দাঁড়াবেন।” নবীনার মালিক নবীন চৌখানি আবার একটা নতুন কথা বলেছিলেন। “আগের অর্ডারটা বৈষম্যমূলক ছিল। কেবল সিনেমা হলগুলোকে জাতীয় স্তোত্র বাজানোর জন্যে বেছে নেওয়া হল কেন? রেস্তোরাঁ, খেলার মাঠ – এসব জায়গায় তো বাজাতে বলা হয়নি।”

অর্থাৎ দিনের যে কোনো সময়ে যে কোনো উদ্দেশ্যে আপনি যেখানেই যান না কেন, রাষ্ট্রের ইচ্ছা হলেই আপনাকে সাবধান পজিশনে দাঁড় করিয়ে জাতীয় স্তোত্র বাজিয়ে দেওয়া হবে আর আপনাকেও সুবোধ বালক/বালিকা হয়ে গাইতে হবে। এই ব্যবস্থায় বিশেষ কারোর আপত্তি নেই। শুধু তাই নয়, কেউ ভিন্নমত হলে তাকেও মেরে ধরে দাঁড় করিয়ে গাওয়ানোর উদ্যোগ নেবে লোকে।

চেন্নাই, বেঙ্গালুরুতেও সেসময় সিনেমা হলে এ নিয়ে বিস্তর গোলমাল, হাতাহাতি হয়েছিল, গৌহাটিতে হুইলচেয়ারে বসা এক শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকেও জাতীয়তাবাদী দর্শকরা উঠে না দাঁড়ানোর জন্য গালাগালি করেছিলেন। উল্লেখ্য, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার অবমাননা আইনত অপরাধ বলে গণ্য হলেও আইনে কোথাও বলা নেই উঠে না দাঁড়ানো মানে অবমাননা করা। যা-ই হোক, আজও রমরমিয়ে সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র বেজে চলেছে, অধিকাংশ নাগরিক উঠে দাঁড়িয়ে গান গেয়েও থাকেন। ইদানীং অবশ্য যারা উঠে দাঁড়ায় না তাদের দিকে তেড়ে যাওয়ার ঘটনা তত শোনা যায় না। অনেকে ওসব ঝামেলা এড়াতে গান বেজে যাওয়ার পরে হলে ঢোকেন। তার মানে ঝামেলা যে হতে পারে সে আতঙ্ক সফলভাবে সকলের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে। সিনেমা হলে জাতীয়তাবাদ প্রদর্শন কর্তব্য বলে স্বীকৃত হয়েছে। সে কর্তব্য পালন না করলে গারদে পুরে দেওয়ার আইন এখনো পাস হয়নি বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কদিন আগে বলে দিয়েছেন, শুধু বন্দুকধারী নয়, কলমধারী নকশালদেরও সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। তেমন কিছুদিন পরে বলতেই পারেন, শুধু রাজনীতি করা অ্যান্টি-ন্যাশনাল নয়, জাতীয় স্তোত্র না গাওয়া অ্যান্টি-ন্যাশনালদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে। কে না জানে, প্রধানমন্ত্রী যে সে লোক নন? তিনি বিষ্ণুর একাদশ অবতার। অতএব তাঁর কথাই আইন। তিনি বললেই জাতীয় স্তোত্র গাইতে যারা উঠে দাঁড়ায় না তাদের হাজতবাস করানোর জন্য সিনেমা হলে কাতারে কাতারে পুলিস মোতায়েন হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

তবু না মেনে উপায় নেই, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আয়াতোল্লা খোমেইনি হয়ে উঠতে বাকি আছে। অনুসিদ্ধান্ত – ভারতের ইরান হয়ে উঠতে বাকি আছে। তাই ভাবছিলাম, ভারতেই যদি সাধারণ নাগরিক সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র না গাইলে এত কাণ্ড হতে পারে, তাহলে কাতারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে ইরানের যে ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না, তাঁদের কী অবস্থা হবে। ম্যাচের পর সাংবাদিক সম্মেলনে ইরান অধিনায়ক এহসান হজসফি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন কেন তাঁরা জাতীয় সঙ্গীত গাননি। জানিয়েছেন দেশে যা চলছে তা যে ভাল হচ্ছে না তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই এবং তাঁর দল দেশের মানুষের পাশেই আছে। তাদের জন্যেই ভাল খেলার চেষ্টা, গোল করার চেষ্টা।

⚡️ BREAKING: #IRAN FOOTBALL TEAM CAPTAIN DEFIES REGIME, BACKS PROTESTS: “WE HAVE TO ACCEPT THAT CONDITIONS IN OUR COUNTRY ARE NOT RIGHT & OUR PEOPLE ARE NOT HAPPY. THEY SHOULD KNOW THAT WE ARE WITH THEM. AND WE SUPPORT THEM. AND WE SYMPATHIZE WITH THEM REGARDING THE CONDITIONS.” PIC.TWITTER.COM/SX4KENXITZ— Hillel Neuer (@HillelNeuer) November 21, 2022

কী চলছে তাঁর দেশে? কারোর জানতে বাকি নেই। ১৬ সেপ্টেম্বর মাহসা আমীনী রাষ্ট্রের হাতে খুন হওয়ার পর থেকে ইরানের মহিলাদের হিজাববিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। তাঁরা প্রকাশ্যে আসছেন ইসলামিক রাষ্ট্রের হিজাব, বোরখা পরার আইন অমান্য করে। পুড়িয়ে দিচ্ছেন সেসব, চুল কেটে ফেলছেন। মিছিলে মিছিলে ছয়লাপ গোটা দেশ। পাল্লা দিয়ে চলছে সরকারি দমননীতি – মারধোর, হত্যা, পুলিসি হেফাজতে যৌন নির্যাতন। ইরানের পুরুষদের একটা বড় অংশ যে এই আন্দোলনের পাশে এসে গেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল বিশ্বকাপের মঞ্চে ফুটবল দলের প্রতিবাদে।

পৃথিবীর কোথাও কোনো নারী আন্দোলনের পাশে এভাবে পুরুষদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা দাঁড়িয়েছেন কিনা জানি না, নারীবাদ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা বলতে পারবেন। কিন্তু হজসফি ও তাঁর দল একইসঙ্গে অন্য একটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন যা আজকের পৃথিবীতে, ভারতে তো বটেই, প্রাসঙ্গিক। ভারতের জাতীয় স্তোত্রের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ নেশন (বাংলাতেও এই শব্দই লিখেছেন) ব্যাপারটাকেই ভাল চোখে দেখতেন না। স্বাধীন দেশে কী করলে নেশনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় তার কিছু মানদণ্ড আমরা ঠিক করেছি, সব দেশই করে থাকে। তার অন্যতম জাতীয় সঙ্গীত। ইরানের ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না, বললেন দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ দেশ মানে মানুষ, কতকগুলো প্রতীক নয়। তাহলে কি প্রতীকের প্রয়োজন শুধু দেশের উপর নেশনের আধিপত্য বজায় রাখতে?

১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে রবীন্দ্রনাথ ইরানে যান শাসক রেজা শাহ পহলভির আমন্ত্রণে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক হজসফিদের জানার কথা নয়। তবু তাঁদের আচরণে যেন উঠে এসেছে নেশন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথেরই অনাস্থা।

আরও পড়ুন ‘ন্যাশনাল আর্কাইভের অবলুপ্তি দেশটাকে শপিং মল বানানোর চক্রান্ত’

১৯১৬ সালের মে মাস থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল – এই সময়ের মধ্যে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দেন। যেসব কথাবার্তা তিনি বলেন তা জাতীয়তাবাদীদের (বা নেশনবাদীদের) সেদিনও পছন্দ হয়নি, আজও হয় না। যেমন জাপান সম্পর্কে তিনি বলেন “জাপানে দেখেছি গোটা দেশের মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের মস্তিষ্ক এবং স্বাধীনতা সরকারের হাতে খর্ব হতে দিয়েছে। আর সরকার নানারকম শিক্ষার ব্যবস্থার দ্বারা মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের অনুভূতি নির্মাণ করছে, মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিলে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে নজরদারি চালাচ্ছে। এক সংকীর্ণ পথ দিয়ে সত্যের দিকে নয়, মানুষকে সেই দিকে চালিত করছে যেদিকে নিয়ে গেলে মানুষকে একেবারে ভেঙে গড়ে নিজের ইচ্ছানুযায়ী এক সমসত্ত্ব জড়পিণ্ডে পরিণত করা যাবে। মানুষ এই সর্বগ্রাসী মানসিক দাসত্ব সানন্দে এবং সগর্বে মেনে নেয় কারণ তাদের মধ্যে নেশন নামক ক্ষমতার যন্ত্রে পরিণত হওয়ার উত্তেজক অভিলাষ কাজ করে…”। [ভাষান্তর আমার]

(I have seen in Japan the voluntary submission of the whole people to the trimming of their minds and clipping of their freedom by their government, which through various educational agencies regulates their thoughts, manufactures their feelings, becomes suspiciously watchful when they show signs of inclining toward the spiritual, leading them through a narrow path not toward what is true but what is necessary for the complete welding of them into one unform mass according to its own recipe. The people accept this all-pervading mental slavery with cheerfulness and pride because of their nervous desire to turn themselves into a machine of power, called the Nation…)

পড়লে মনে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়েই রবীন্দ্রনাথ ইসলামিক বিপ্লব পরবর্তী ইরানের মত নেশন বা একবিংশ শতাব্দীর বিরাট ডিসটোপিয়াসুলভ নেশনগুলোর চেহারা দেখতে পাচ্ছিলেন, যা তাঁর অন্তত দেড় দশক পরে ইউরোপের টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে দেখে কল্পনা করবেন অলডাস হাক্সলি (Brave New World; প্রকাশকাল ১৯৩২), তিন দশক পরে জর্জ অরওয়েল (1984; প্রকাশকাল ১৯৪৯)।

নেশন যে একটা বানিয়ে তোলা ধারণা – রবীন্দ্রনাথের এই মতের চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হলে। একই কবির একই ভাষায় লেখা দুটো গান গায় দুই আলাদা নেশনের মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে এ জিনিস দেখতে হয়নি। ১৯১৬-১৭ সালের সেই বক্তৃতামালায় ভারত সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “যদিও শৈশবকাল থেকে আমাকে শেখানো হয়েছিল যে নেশনকে পুজো করা প্রায় ঈশ্বরকে এবং মানবতাকে শ্রদ্ধা করার চেয়েও ভাল, আমার মনে হয় আমি সেই শিক্ষার প্রভাব কাটিয়ে উঠেছি। আমার বিশ্বাস আমার দেশের মানুষ তাঁদের সত্যিকারের ভারত লাভ করতে পারবেন সেই শিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করলে, যা শেখায় একটা দেশ মানবতার আদর্শের চেয়ে বড়।”

(Even though from childhood I had been taught that idolatry of the Nation is almost better than reverence for God and humanity, I believe I have outgrown that teaching, and it is my conviction that my countrymen will truly gain their India by fighting against the education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity.) [ভাষান্তর আমার]

রবীন্দ্রনাথ যে লড়াই করতে বলেছিলেন আমরা তাতে ব্যর্থ হওয়ার ফলেই দেশভাগ হয়, উপরন্তু খণ্ডিত ভারতবর্ষ আজও ভাগ হয়ে চলেছে। ইরানের ফুটবল দল নেশন নির্ধারিত প্রতীককে অস্বীকার করে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা যত দিন যাচ্ছে তত নেশনের বশংবদ হয়ে পড়ছেন। আগে সাতে পাঁচে থাকতেন না, ইদানীং সবার আগে রাষ্ট্রের পক্ষ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সোশাল মিডিয়ায়। এসব বললেই একটা কথা বলা হয় – আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের থেকে ওসব আশা করা উচিত নয়, কারণ আমাদের সমাজ ইউরোপ বা আমেরিকার মত গণতান্ত্রিক নয়। আমাদের খেলোয়াড়রা রাজনৈতিক প্রতিবাদ করলে নাকি নানাবিধ চাপের মুখে পড়বেন। ইরানের ফুটবলারদের দেখার পর এ কথায় আর কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই বোধহয়। কারণ আমরা তো ইরানের চেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক দেশ বলেই নিজেদের দাবি করে থাকি। তাহলে তাদের ফুটবলাররা এবং তাঁদের পরিজন যে সংকটের কল্পনায় ম্রিয়মান না হয়ে এমন প্রতিবাদ করেছেন তার চেয়ে বড় কোন বিপদে আমাদের খেলোয়াড়রা পড়তে পারেন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে?

পুনশ্চ: বিশ্বকাপ জ্বরে আমাদের অনেকেরই হয়ত চোখ এড়িয়ে গেছে একটা খবর। বিজেপির আইনজীবী নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় দিল্লি হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করে দাবি করেছেন ‘জনগণমন’ আর ‘বন্দে মাতরম’-কে সমান মর্যাদা দিতে হবে। তার উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, দুটো গান একই স্তরের এবং দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দুটোকেই সমান শ্রদ্ধা জানানো উচিত। উপাধ্যায় নিজের পিটিশনে দাবি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলোকে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুটো গানই প্রত্যেক কাজের দিনে বাজানো নিশ্চিত করতে হবে।

দেশ যত দুর্বল হয় নেশনকে তত শক্তিশালী করার দরকার হয়। যে গানে নেশন কম জনগণমন বেশি, সে গান ঠেকায় পড়ে সহ্য করে নিতে হয়। কিন্তু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে অবশ্যই সেই গান বেশি শ্রেয়, যেখানে মাতৃমূর্তির সাহায্যে জনমনে অভিন্ন নেশন প্রতিভাত হয়। 

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

বল্লভপুরের রূপকথা: খাঁটি বাংলা ছবি

হাস্যরস উৎপাদনের জন্যও ওপরচালাক কথার খেল, এলিটিস্ট বিদ্রূপ অথবা অধুনা জনপ্রিয় খিস্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি।

এক গল্প হাজারবার বললে সে আর এক গল্প থাকে না, পালটে পালটে যায়। মানুষের জীবনের মত। এক চরিত্রের মুখ দিয়ে এই কথাটি পরিচালক ছবির শুরুতেই বলে দিয়েছেন। তাই বাদল সরকারের নাটক দেখা না থাকলেও বল্লভপুরের রূপকথা দেখতে অসুবিধা হয় না। আমরা দুর্ভাগা প্রজন্ম। বাদল সরকারের নামটুকুই শুনেছি, কেউ কেউ তা-ও শুনিনি। আমরা কেবল সত্যজিৎ রায়কে চিনি। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য যথার্থই অনুমান করেছিলেন, হলে ঢুকে আমরা কেউ সঙ্গের দর্শককে জিজ্ঞেস করে ফেলতেই পারি “বাদল সরকারটা আবার কে?” তাই গোড়াতেই সেসব দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রফেসর শঙ্কুর মত দেখতে লোকটি যে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যশিল্পী তা সিনেমা দেখতে গিয়ে জানা হয়ে গেল।

পরিচালকের বুকের পাটা দেখে অবাক হতে হয়। মেগাসিরিয়ালে অভ্যস্ত দর্শককে তিনি একে তো বাদল সরকার চেনাচ্ছেন, তার উপর আবার আখ্যান সম্বন্ধে সচেতন করছেন! মিশকালো অন্ধকারে নৌকো বাইতে বাইতে যে মাঝি আখ্যান সম্পর্কে ওই চিরসত্য উচ্চারণ করছে তার নাম রসিক। অরসিকের কাছে রস নিবেদন করার দুর্ভাগ্য যেন আমার না হয় – বিধাতার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন প্রাচীন কবি। অনির্বাণ সে ঝুঁকি নিয়েছেন। তাঁর এত আয়োজন বৃথা যেত যদি বিদেশি ছবি থেকে বাদল সরকারের হাত ঘুরে তাঁর কাছে আসা আখ্যানটিকে রসোত্তীর্ণ করতে না পারতেন। সে পরীক্ষায় তিনি সফল। তাঁর আখ্যান রসে টইটম্বুর। হলভর্তি দর্শক প্রায়ই হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এ ছবি একটিমাত্র রস পরিবেশন করেনি। এমনকি হাস্যরস উৎপাদনের জন্যও ওপরচালাক কথার খেল (pun), এলিটিস্ট বিদ্রূপ অথবা অধুনা জনপ্রিয় খিস্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি।

ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট অধিনায়কদের একজন, সৌরভ গাঙ্গুলি, একটা কথা খুব বলে থাকেন – একজন অধিনায়ক ততটাই ভাল, যতটা ভাল তাঁর দল। কথাটা চলচ্চিত্র পরিচালকের বেলাতেও বোধহয় খানিকটা খাটে। যে পরিচালকের হাতে বাদল সরকারের লেখা সংলাপ, সত্যম ভট্টাচার্য (ভূপতি), শ্যামল চক্রবর্তী (মনোহর), দেবরাজ ভট্টাচার্যের (সঞ্জীব) মত উৎকৃষ্ট অভিনেতা থাকেন, তাঁকে হাস্যরসের জন্য ইদানীংকালের বাংলা ছবিতে ব্যবহৃত উপরে উল্লিখিত মধ্যমেধার কৌশলগুলোর কাছে হাত পাততে হবেই বা কেন? তবে ক্রিকেট দলের অধিনায়কের একটা সুবিধা থাকে যা পরিচালকের নেই। দলের ব্যর্থতায় নেহাত প্যাঁচে পড়লে অধিনায়ক নির্বাচকদের ঘাড়েও কিছুটা দায় চাপিয়ে দিতে পারেন, পরিচালকের সে উপায় নেই। অনির্বাণ থিয়েটারের অভিনেতাদের নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। ফেল করলে কারোর দিকে আঙুল তোলার উপায় থাকত না। কিন্তু তাঁর নির্বাচিত অভিনেতারা প্রত্যেকেই চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়ের মত খেলেছেন।

অনিবার্যভাবে মনে পড়ে সদ্যপ্রয়াত তরুণ মজুমদারের কথা। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগে অনুপকুমারকে নায়কের চরিত্রে রেখে তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন বাংলা ছবির ইতিহাসে সর্বকালের সেরা হিট ছবিগুলোর অন্যতম – পলাতক (১৯৬৩)। স্রেফ শক্তিশালী চিত্রনাট্য আর অভিনয় দক্ষতা হিট ছবির রসায়ন হতে পারে তার অকাট্য প্রমাণ। অনির্বাণও তারকাবিহীন, এমনকি রুপোলি পর্দার অভিনেতাবিহীন ছবি করেছেন। তরুণের সময়ে তবু টলিউড সংকটাপন্ন ছিল না। এখন কিন্তু স্বাস্থ্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছবি যদি শেষপর্যন্ত বিপুল সংখ্যক দর্শকের আশীর্বাদধন্য হয়, তাহলে কী করলে ছবি হিট হয়, সে প্রশ্ন নতুন করে ভাবতে হবে সকলকেই। শীর্ষ মন্তাজেই ইঙ্গিত রয়েছে – গোয়েন্দা, ভূত, নস্ট্যালজিয়া সবই কপচানো হয়ে গেছে। কোনোটাই বিশেষ কাজ দেয়নি। তরুণ পারতেন রুচিসম্মত অথচ জনপ্রিয় ছবি তৈরি করতে। সে ছবি সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেনের উচ্চতার শিল্প হত না হয়ত। কিন্তু স্রেফ শহুরে ও অনাবাসী বাঙালি দর্শকের জন্য তৈরি চলচ্চিত্রোৎসবমুখী ভানও তাতে থাকত না। একইসঙ্গে গ্রাম ও শহরের দর্শকের মনোরঞ্জন করতে পারে, এমন বাংলা ছবি বিশ-তিরিশ বছর হল তৈরিই হয় না। অভিজ্ঞরা বলেন অমন ছবি নাকি সম্ভবই নয়, কারণ গ্রাম আর শহরের দর্শকের রুচির তফাত বিস্তর। অথচ বিশ্বায়নের যুগে গোটা দুনিয়াটাই গ্লোবাল ভিলেজ – এমনটাই তো জেনে আসছি। বাস্তবিক দার্জিলিং থেকে মেদিনীপুর – সর্বত্রই তো পৌঁছে গেছে ওটিটি। তবু? বল্লভপুরের রূপকথা আখ্যানে এবং উপস্থাপনে গ্রাম, শহরের সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেছে। দেখা যাক তা সফল হয় কিনা।

অভিনয়ের কথা হচ্ছিল। ছবি দাঁড়িয়ে আছে ভূপতি, ছন্দা (সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়), মনোহর আর সঞ্জীবের চরিত্রের উপর ভর দিয়ে। তাঁদের অভিনয় তো নিখুঁত বটেই, ছোটখাটো চরিত্রগুলোতেও এত নির্মেদ অভিনয় আজকাল বাংলা ছবিতে সুলভ নয়। ভূপতির তিন পাওনাদার সাহা (কৃপাবিন্দু চৌধুরী), শ্রীনাথ (সুরজিৎ সরকার) আর পবনের (সুমন্ত রায়) সংলাপ বলার ঢং, হাঁটাচলা, তাকানো – সবকিছুই হাসির উদ্রেক করেছে। অথচ যথেষ্ট অবকাশ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অতি-অভিনয় করেননি। ইংরেজিতে যাকে কমিক টাইমিং বলে তাতে অবশ্য সবার উপরে মনোহর চরিত্রে শ্যামল। গোটা ছবিতে তিনি ভাবলেশহীন মুখে আর সকলকে হাসিয়ে গেলেন।

সত্যম চারশো বছর আগেকার রোম্যান্টিক, কালিদাস আওড়ানো, জমকালো পোশাক পরা রাজপুত্রের চরিত্রে যতটা সাবলীল, ততটাই দেনার দায়ে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা রায়বাড়ির প্রথম গামছা পরে ঘুমনো রাজা হিসাবে। এমনকি শুধু ভূপতির চরিত্রেও তিনি প্রয়োজনমাফিক সপ্রতিভ এবং অপ্রতিভ। কাজটা মোটেই সহজ নয়। বিশেষ করে ব্যোমকেশ আর ফেলুদার চরিত্রের একইরকম অভিনয় দেখে অভ্যস্ত চোখে সত্যমকে দেখে বলতে ইচ্ছে করে “বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে”।

দেবরাজ ভূতের ভয়ে কাবু, মিসেস হালদারের বকুনিতে ক্যাবলা অথচ বন্ধুর প্রতি আনুগত্যে অবিচল চরিত্রে দারুণ বিশ্বাসযোগ্য। অমন অভিনয় করতে পারেন আবার চমৎকার গাইতেও পারেন – এমন শিল্পী কজন পাওয়া যায়?

ওপেন টি বায়োস্কোপ ছবির নেহাত বালিকা সুরঙ্গনা এ ছবিতে গত শতকের ছয়ের দশকের লাবণ্যময়ী বাঙালি মেয়ে ছন্দার চরিত্রে দারুণ মানিয়ে গেছেন। সে শুধু তাঁর সৌন্দর্য, শাড়ি পরার ধরন বা চুল বাঁধার কায়দার জন্যে নয়। যে চোখের ভাষা সেরা সময়ের রোম্যান্টিক বাংলা ছবির নায়িকাদের অব্যর্থ অস্ত্র ছিল, সেই ভাষায় সুরঙ্গনার চোখ বারবার কথা বলেছে। পাশে দাঁড়ানো পুরুষটিকে নিজের ভাললাগা জানানোর জন্য বেশি কিছু নয়, স্রেফ তার মত দেখতে পূর্বপুরুষের পোর্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে “সুপুরুষ” বলে আড়চোখে তাকিয়ে নেওয়ার নৈপুণ্য সুরঙ্গনা চমৎকার রপ্ত করেছেন। বাঙালির প্রেমের অভিজ্ঞান, অন্তত সিনেমার পর্দায়, একসময় ছিল তার সূক্ষ্মতা। নায়িকারা সরাসরি নায়কের দিকে তাকাতেন না বা আগ বাড়িয়ে চুমু খেতেন না বলে যে ন্যাকা ছিলেন তা নয়। পাঁচের দশকেই শাপমোচন ছবিতে অবিবাহিতা সুচিত্রা সেন সটান বাবার সামনে দাদাকে জানিয়ে দিচ্ছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা করতে যান কারণ “তিনি আমার স্বামী”। আবার পথে হল দেরী ছবিতে তাঁর চেয়ে নায়কের দৃষ্টিই লজ্জায় বেশি থরোথরো। সত্যমকে ধমকে দেওয়ার দৃশ্যে সুরঙ্গনাকেও তেমনই দৃঢ়চেতা দেখিয়েছে।

আরও পড়ুন অহৈতুকী পার্টিজানপ্রীতি

বল্লভপুরের রূপকথা ছবিটির এই এক মজা। আপাতদৃষ্টিতে নতুন কিছুই নেই। যা আছে তা হল বাংলা ছবির, বাংলার সংস্কৃতির চিরনতুন কিছু উপাদান যা মানুষের সর্বদা ভাল লাগে। নায়ক, নায়কের অভিভাবকসুলভ বৃদ্ধ চাকর, প্রাণের বন্ধু, নায়িকার শৌখিন এবং আধক্ষ্যাপা বাবা, জাঁদরেল মা, বাবার সঙ্গে রেষারেষি থাকা এক বুড়ো ধনী – এর কোনোটাই কি বাংলা ছবির দর্শকের কাছে নতুন? পরিচালক অনির্বাণ বা অন্যরা প্রচার পর্বে কোথাও বলেননি, অথচ দেখা গেল ছবিটি পিরিয়ড পিসও বটে। মূল নাটকের মত গত শতকের ছয়ের দশকই দেখানো হয়েছে। সেই সময়কার পোশাক-আশাক, কথা বলার ধরন, গাড়ির মডেল সবই নিখুঁত। এমনকি ছবির সঙ্গীত পর্যন্ত বাংলা গানের হারিয়ে যাওয়া মেলডির সন্ধান দেয়। অনির্বাণ, দেবরাজ, শুভদীপের সৃষ্টি ‘সাজো সাজাও এমন করে’ সাহানা বাজপেয়ীর গলায় এমন মধু ঝরায় যে সুরটি ছবি শেষ হওয়ার বহুক্ষণ পরেও কোথা থেকে যেন কানে ভেসে আসে। যন্ত্রসঙ্গীতের ঝমঝম আওয়াজে পূর্ণ খোনা গলার আধুনিক বাংলা সিনেমার গান তো শুনি আর ভুলে যাই প্রায় সহজেই। ছবির আবহসঙ্গীত পর্যন্ত আজকের বলে মনে হয় না, ভয়ের ছবির পরিবেশ সৃষ্টিকারী চেনা শব্দসম্ভারই ফিরে ফিরে আসে। যদিও তাতে ভয়ের পরিবেশ কতটা তৈরি করা গেছে তাতে সন্দেহ আছে। এই এক সমালোচনার জায়গা।

তবে চলচ্চিত্র তো শেষপর্যন্ত চিত্র। মনে রাখার মত কিছু শট না থাকলে চলে না। সেখানে সোনা ফলিয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার। তাঁর তৈরি অন্ধকার ঘুরঘুট্টি বটে, কিন্তু তার মধ্যেও জঙ্গলের প্রত্যেকটি গাছ আলাদা করে দেখা যায়। দিনের বেলার শটগুলোতেও আউটডোর লোকেশনের সৌন্দর্য তাঁর ক্যামেরা চেটেপুটে নিয়েছে। তবে ভোলা যায় না বল্লভপুরের রাজবাড়িতে প্রথম পদক্ষেপের সময়ে সিনেমার পর্দা জুড়ে থাকা অন্ধকারের মধ্যে উদ্ভাসিত ছন্দার মুখের ক্লোজ আপ।

বল্লভপুরের রূপকথা শস্তা নয়, সহজ। চটকদার নয়, রংদার। নতুন নয়, চিরচেনা। পরিচালক অনির্বাণের সবচেয়ে বড় গুণ – তিনি একটি খাঁটি বাংলা ছবি বানিয়েছেন। এখানে বাঙালিকে বাঙালি বলে চেনা যায়। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল হাইরাইজ, হাইওয়ে, স্কচ আর পরকীয়ায় হারিয়ে যায়নি। হৃদয় ঘেঁটে দেখা গেছে কোথায় পাতা শীতলপাটি। ছবির শুরুতে আখ্যান সম্পর্কে যে চিরসত্য মাঝি রসিক তার পীর ঠাকুর্দার উক্তি বলে উল্লেখ করেছে, সেই সত্যই আবার শেষে দোকানদার পবন তার সন্ন্যাসীপ্রতিম ঠাকুর্দার উক্তি বলে ঘোষণা করেছে। অতি সহজে, প্রায় অলক্ষ্যে পরিচালক বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক সমন্বয় দেখিয়ে দিলেন। পুরনো কথাও বারবার বলতে হয়, বলতে বলতে নতুন হয়ে ওঠে। সেই নতুনত্বের খোঁজে বেরিয়েছেন অনির্বাণ। একেবারে শেষে দেখা গেছে তিনি নিজেকে নিয়েও রসিকতা করতে পারেন। এই ক্ষমতা যদি ধরে রাখতে পারেন তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভাল কিছু আশা করা যায়।

নাগরিক ডট নেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

অলক্ষ্মী না হলে বাঁচবে না আমাদের লক্ষ্মী মেয়েরা

পুলিস যেখানে মিটিং করার অনুমতি দেয়নি ঠিক সেখানটাই পার্টিকর্মী, সমর্থকদের দিয়ে ভরিয়ে ফেলে ম্যাটাডোরের উপর দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, মিটিং কোথায় হবে মানুষ ঠিক করবে। পুলিস ঠিক করবে না। এমন দস্যি মেয়েদেরই আমরা লক্ষ্মীছাড়া বলতে অভ্যস্ত।

লক্ষ্মীপুজো কবে? দুর্গাপুজোর পরেই তো? নাকি দিওয়ালি নাগাদ? প্রশ্নটা এই পুজোর মরসুমে রীতিমত ভাবিয়েছে। দিনকাল যেভাবে বদলাচ্ছে। হাফপ্যান্ট পরা বয়স থেকে দেখে আসছি বাঙালি গণেশপুজো করে অক্ষয় তৃতীয়ায়। কিছু দোকান হালখাতা পয়লা বৈশাখে করে না, করে সেইদিন। এখন চুল পাকতে শুরু করার পর দেখছি বাঙালির ঘরে ঘরে, ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে গণেশ চতুর্থীর হিড়িক। দুর্গাপুজোর ঢাকের বাদ্যিও শুরু হয়ে যাচ্ছে অকালবোধনের একমাস আগে। পঞ্চমী তো বটেই, আমাদের আমলে জাঁদরেল বাবা-মায়েরা ষষ্ঠীর দিনও সকালে পড়তে বসাতেন, বিকেল থেকে ছুটি। এখনকার বাবা-মা মহালয়ার দিনই ছেলেমেয়েকে সাজিয়ে গুজিয়ে বাতানুকূল গাড়িতে চাপিয়ে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাচ্ছেন। এতকিছু যখন বদলাচ্ছে, তখন মেঝেতে সারি সারি লক্ষ্মীর পায়ের আলপনা দেওয়ার পুজো ধনতেরাসে বিলীন হতেই পারে। তাই চোখকান খোলা রাখতে হয়। আগে অবশ্য আমাদের বছরে একদিন লক্ষ্মীপুজো করে আশ মিটত না, বাড়িতে লক্ষ্মী মেয়ে তৈরি করার প্রকল্প চলত সারাবছর। শ্বশুরবাড়িতে লক্ষ্মী মেয়েদের চাহিদা এখনো কম নয়, তবে বাবা-মায়েদের কাছে আজকাল অলক্ষ্মী মেয়েদের যথেষ্ট আদর হয়েছে। ছেলের মত বা ছেলের চেয়েও বেশি করে বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে যে অলক্ষ্মীরাই পারে, তার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুতরাং কাল পর্যন্ত যাদের অলক্ষ্মী বলা আমাদের অভ্যাস ছিল, এখন তাদেরই লক্ষ্মী মেয়ে বলে মেনে নেওয়ার দিন। যেমন

মীরাবাঈ চানু, পিভি সিন্ধু, লভলীনা বরগোহাঁই: পিটি ঊষা বা অঞ্জু ববি জর্জ মান্ধাতার আমলের মহিলা নন, কিন্তু কেরিয়ারের সেরা সময়েও তাঁদের যদি বলা হত, আর মাত্র দুই দশকের মধ্যেই কোনো অলিম্পিকে ভারতের জেতা পদকের অর্ধেক জিতবে মেয়েরা, ঊষা আর অঞ্জু নিশ্চয়ই হেসে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু ভারোত্তোলক চানু, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় সিন্ধু আর মুষ্টিযোদ্ধা লভলীনা ঠিক সেটাই করে দেখিয়ে দিয়েছেন গত বছরের টোকিও অলিম্পিকে। একজন পেশি ফুলিয়ে লোহা তোলেন, একজন জনসমক্ষে ছোট ছোট জামাকাপড় পরে লম্ফঝম্প করে ঠাঁই ঠাঁই করে শাটল পেটান। তৃতীয় জন আরও এক কাঠি সরেস – ঘুঁষোঘুঁষি করেন। কী ভীষণ অলক্ষ্মী! আরেকটু হলে মেয়েদের হকি দলও পদক জিতে ফেলছিল। ভারতীয় মেয়েরা এখনো অলিম্পিকে সোনা জেতেননি। অলক্ষ্মীরা এভাবে দলে ভারি হতে থাকলে ২০২৪ সালে প্যারিসে সে অভাবও মিটে যেতে পারে।

দীপ্তি শর্মা, হরমনপ্রীত কৌর: ক্রিকেট খেলার জন্ম বিলেতে আর বিলেতে খেলার দেবভূমি হল লর্ডসের মাঠ। সেই মাঠে সাহেবদের জব্দ করে দিতে পারা কত বড় কাণ্ড তা আজ থেকে কুড়ি বছর আগে জামা খুলে মাথার উপর বনবন করে ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের পুরুষদের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। কদিন আগে সেই লর্ডসেই ইতিহাসে প্রথমবার মেমদের তিনটে একদিনের ম্যাচের তিনটেতেই হারিয়ে দিল ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল। উপরন্তু ইংরেজদের কাটা ঘায়ে ঠান্ডা মাথায় নুন ঘষে দিলেন অফস্পিনার দীপ্তি আর অধিনায়িকা হরমনপ্রীত। ইংল্যান্ড ব্যাটার চার্লি ডিন বারবার আগেভাগেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। দীপ্তি বল করতে গিয়ে বেল ফেলে দিলেন। তৃতীয় আম্পায়ার খতিয়ে দেখে জানালেন এখন যে নিয়ম বলবৎ হয়েছে সে নিয়ম অনুযায়ী চার্লি আউট, ম্যাচ খতম। কিন্তু ব্যাপারটা কেবল ইংরেজ নয়, আরও অনেকেরই হজম হয়নি। সাহেবদের তৈরি খেলা, ফলে তারা দাবি করে আইনটাই শেষ কথা নয়, কেতাও বজায় রাখতে হবে (কেতার গালভরা নাম ‘স্পিরিট অফ ক্রিকেট’)। দীপ্তি যদি কাণ্ডটা করেও থাকেন, হরমনপ্রীতের উচিত ছিল আউটের আবেদন ফিরিয়ে নেওয়া। ক্যাপ্টেন বলে কথা। ম্যাচের শেষে টিভির প্রতিনিধি হরমনপ্রীতকে এ নিয়ে প্রশ্নও করলেন। দেখা গেল হরমনপ্রীত, ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির অপর্ণা সেনের মতই, ‘অত্যন্ত ইমপোলাইট’। বললেন যা করা হয়েছে আইন মেনেই হয়েছে। এরকম হলে আমি আমার বোলারকেই সমর্থন করব। ২৪ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় ইংরেজরা মনে এত ব্যথা পেয়েছে যে পুরুষদের একদিনের দলের অধিনায়ক জস বাটলার হপ্তাখানেক পরেও বলেছেন, আমি হলে কখনো এমন হতে দিতাম না। বিশ্বকাপ ফাইনালে আমার দলের কোনো বোলার এমন করলেও আমি আউট হওয়া ব্যাটারকে ফিরিয়ে আনব।

মীনাক্ষী মুখার্জি: ইনি যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী নন, বিদেশ থেকে ডিগ্রি বা ব্র্যান্ডেড হাতব্যাগ – কোনোটাই নিয়ে আসেননি। রবীন্দ্রসঙ্গীত বা ‘বেলা চাও’ গাইতে পারেন না, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ গানে নাচতেও পারেন না। কলকাতার ভদ্রলোকেদের বাংলায় কথা বলতে পারেন না, চোস্ত ইংরেজি বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। কী পারেন তাহলে? পুলিস লক আপে মার খেয়েও সোজা থাকতে পারেন, যেখানে তাঁর পার্টির তেমন সংগঠন নেই সেখানে দাঁড়িয়েও পুলিসকে ধমকাতে পারেন, জনতাকে উদ্বেল করতে পারেন। পুলিস যেখানে মিটিং করার অনুমতি দেয়নি ঠিক সেখানটাই পার্টিকর্মী, সমর্থকদের দিয়ে ভরিয়ে ফেলে ম্যাটাডোরের উপর দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, মিটিং কোথায় হবে মানুষ ঠিক করবে। পুলিস ঠিক করবে না। এমন দস্যি মেয়েদেরই আমরা লক্ষ্মীছাড়া বলতে অভ্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গের দশ বছর ধরে মিইয়ে থাকা শান্ত বিরোধী রাজনীতিতে অশান্তি হানতে পেরেছেন মীনাক্ষী। মধ্যবিত্তপ্রধান সিপিএমে গরীব ঘর থেকে উঠে আসা এই মেয়ে নূতন যৌবনের দূত। যে পথে এ রাজ্যের বামপন্থীরা আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না বলে মনে হচ্ছিল, সে পথের হদিশ যে পাওয়া গেছে বলে মনে হচ্ছে তাতে রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের অবদান অনেকখানি, কিন্তু মীনাক্ষীর অবদানও কম নয়।

আরও পড়ুন ঝুলন সেরা বাঙালি ক্রিকেটার? মোটেই না

রিয়া কুমারী: প্রচলিত অর্থে লক্ষ্মী মেয়ে বোধহয় বিহারের মহিলা উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারপার্সন হরজোৎ কৌর ভামরা। বহুদূর লেখাপড়া করে আইএএস পরীক্ষায় পাস করে চাকরি পায় যে মেয়ে তাকেই তো লক্ষ্মী মেয়ে বলে। কিন্তু সম্প্রতি বিহার সরকারের উদ্যোগে মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিয়ে এক কর্মশালায় ধরা পড়ে গেছে, যে হরজোৎ মানসিকতায় একজন প্রবল পিতৃতান্ত্রিক পুরুষমানুষ। তাঁকে ধরে ফেলেছেন ১৯ বছর বয়সী ঠোঁটকাটা রিয়া কুমারী, যাঁকে কেউ লক্ষ্মী মেয়ে বলবে না হয়ত। রিয়া জানতে চেয়েছিল সরকার ২০-৩০ টাকায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। হরজোৎ বলেছেন, এরপর তোমরা সরকারের কাছে জিনস চাইবে। তারপর সুন্দর জুতো চাইবে। তারপর কি কন্ডোমও চাইবে? রিয়া তাতে দমে যায়নি। আমলাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, সরকার নির্বাচিত হয় নাগরিকদের ভোটে। নাগরিকদের দাবিদাওয়া থাকতেই পারে।

ভারত রাষ্ট্র যে পথে চলেছে তাতে রিয়া নয়, রাষ্ট্র্বের কাছে হরজোৎই লক্ষ্মী মেয়ে। কিন্তু ভারতীয় মেয়েদের বাঁচতে হলে রিয়ার মত অবাধ্য, অলক্ষ্মী হতে হবে। লক্ষ্মীঠাকুরে যাঁদের বিশ্বাস আছে তাঁরা বরং প্রার্থনা করতে পারেন, এ দেশের মেয়েদের যেন ইরানের মেয়েদের মত লক্ষ্মীছাড়া হয়ে উঠে প্রাণ দিতে না হয়।

সলিল চৌধুরী স্মরণে একটি মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা

গত তিরিশ বছরে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা ক্রমশ যে কোনো উপলক্ষে গোটা দশেক রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাওয়া আর সত্যজিৎ রায়ের গোটা পাঁচেক ছবির চর্বিতচর্বণের কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে। যে ‘কালচার’ নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই, তাতে যে গর্ব করার মত আর কোনো পাত্র-পাত্রী আছেন বা সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা ইত্যাদির আর কোনো ধারা আছে তা টের পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন নয় যে রবীন্দ্রচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বা সত্যজিতের ছবির চর্চা অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে। আসলে ক্রমিক আত্মবিস্মৃতির ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের উইকেট দুটোই এখনো টিকে আছে, বাকিরা জনমন থেকে ক্রমশ কতিপয় রসিকের বৈঠকখানায় অবসৃত হয়েছেন। ওরই মধ্যে সলিল চৌধুরীর অবস্থা কিছুটা ভাল। একসময় পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় গান গেয়ে, আবৃত্তি করে সংস্কৃতি চর্চায় হাতেখড়ি হত বঙ্গসন্তানদের। গত শতকের নয়ের দশক থেকে বুগি উগি সেই সন্ধ্যাগুলোকে স্থানচ্যুত করতে শুরু করে। এখন নানা বয়সের গানের রিয়্যালিটি শোয়ে বিখ্যাত হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাই বাঙালি শিশু, কিশোরদের সংস্কৃতি চর্চার পথ নির্ধারণ করে। সেসব শোয়ে সলিলের গানের বেশ খানিকটা দাম আছে। তার একটা বড় কারণ তিনি একদা হিন্দি সিনেমা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, লতা মঙ্গেশকরের মত শিল্পী তাঁর সুরে, কথায় বাংলা গানও গেয়েছেন। নইলে ওই দামও আজ সলিল পেতেন কিনা সন্দেহ।

ওটুকুর উপর ভরসা করে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন শহরাঞ্চলের প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া করে সপ্তাহের মাঝখানে গোটা সন্ধে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে – এ কথা চট করে বিশ্বাস হতে চায় না। ফলে যখন জানা যায় উত্তরপাড়ার ‘মীড়’ এই কাণ্ডটি ঘটাতে চলেছে ২২ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায়, তখনই চট করে গুগল করে নিতে হয় সেদিন সলিলের জন্মদিন বা মৃত্যুদিন কিনা। শুধু সঙ্গীতচর্চা নয়, যে কোনো চর্চাই যে আসলে ৩৬৫ দিনের কাজ সেকথা আজকাল মনে রাখা শক্ত। গুগল সার্চ যখন জানিয়ে দিল সলিলের মৃত্যুদিন চলে গেছে সপ্তাহ দুয়েক আগেই আর জন্মদিনের মাস দুয়েক দেরি আছে, তখন বোঝা গেল আবেগ কাজে লাগিয়ে নাম কেনা মীড়ের সদস্যদের উদ্দেশ্য নয়। তাঁরা শ্রোতাদের ‘অতল সলিলে’ নিয়ে যেতে চান নিতান্ত সলিল চৌধুরীর গানের টানেই।

গান নির্বাচনেও দেখা গেল পরিশ্রমের ছাপ। মীড়ের কচিকাঁচারা সমবেত সঙ্গীতে ‘শ্রাবণ অঝোর ঝরে’, ‘ঝিলিক ঝিলিক ঝিনুক খুঁজে পেলাম’ ইত্যাদি গানে অন্য স্বাদ এনে দিয়েছে। বাংলা ভাষার এই দুর্দিনেও এক ঝাঁক বাঙালি কিশোর-কিশোরী নিখুঁত উচ্চারণে ‘দুপুরের রৌদ্রের নিঃঝুম শান্তি শান্তি/নীল কপোতাক্ষীর কান্তি’ গাইছে – এই দৃশ্য, এই ধ্বনি মনোমুগ্ধকর। কিন্তু পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী চমকে দিয়েছেন তাঁর ছাত্রীদের গাইতে দেওয়া একক গানের পছন্দে। ১৯৫৬ সালে জাগতে রহো ছবিতে আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘ঠান্ডি ঠান্ডি সাওন কি পুহার’ গানটি আজ কতজনেরই বা পরিচিত? আরও বড় চমক লহনা ভট্টাচার্যের কণ্ঠে সলিল রচিত ও সুরারোপিত ‘সেই মেয়ে’। রবীন্দ্রনাথের ময়নাপাড়ার মেয়ে কৃষ্ণকলিকে শিল্পী সলিলের চোখ দেখেছিল ছেচল্লিশের মন্বন্তরে শীর্ণ বাহু তুলে কলকাতায় যারা ফ্যান ভিক্ষা করত তাদের মধ্যে। সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত সেই গান কৈশোর না পেরনো লহনাকে গাইতে দিয়ে অনুষ্ঠানের নির্দেশক বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কিন্তু লহনা যে অনায়াস দক্ষতায় অত লম্বা এবং দুরূহ গানটি গেয়েছেন তা ঝুঁকি সার্থক করেছে।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে তথাগত ভট্টাচার্য অন্য স্বাদ এনে দিয়েছেন ‘মোর মতন আর দেশপ্রেমিক নাই’, বাড়ি থেকে পালিয়ে ছবির ‘আমি অনেক ঘুরিয়া শ্যাষে আইলাম রে কইলকাত্তা’, গঙ্গা ছবির ‘ইচ্ছা করে পরাণডারে’ ইত্যাদি গানগুলি গেয়ে।

শেষ শিল্পী ছিলেন সৌরভ স্বয়ং। ‘পাগল হাওয়া’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ শিল্পী হিসাবে তাঁর জাত চেনায়। তবে এই সন্ধের পবিত্রতম মুহূর্ত তিনি তৈরি করতে পেরেছেন ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’ গানে। সলিলের মত অত বড় শিল্পীর শিল্পকর্মেও অমন বিশুদ্ধ গানের সংখ্যা হয়ত খুব বেশি নয়। ওই গান গেয়ে আক্ষরিক অর্থে শ্রোতাদের অতল সলিলে নিয়ে যেতে পেরেছেন সৌরভ।

আরও পড়ুন সকল অহঙ্কার হে আমার

অনুষ্ঠানের মেজাজ যে তারে বাঁধা ছিল তাতে ঈষৎ বেসুরো ঠেকেছে ‘শপথ’ কবিতা অবলম্বনে নাচ এবং সমবেত কণ্ঠে ‘পথে এবার নামো সাথী’ গানটি। বিশেষত, গানটি যে সময়ে রচিত তার তুলনায় যুগ এতটাই বদলে গেছে, আমাদের পথে নামার অভ্যাস এতটাই কমে গেছে, নামার উদ্দেশ্যেরও এত তারতম্য ঘটেছে যে গানটি এখন নিজেই নিজের প্যারডি বলে মনে হয় অনেকসময়। দোষটা অবশ্য প্রতিবেদকের সিনিসিজমেরও হতে পারে। বরং অনেক বেশি কালজয়ী ‘রানার’। সৌরভের মত দরাজ গলার কোনো শিল্পীর কণ্ঠে ওই গান হয়ত মধুরতর স্মৃতি হয়ে উঠতে পারত।

সেদিন উত্তরপাড়া গণভবনে তিলধারণের জায়গা ছিল না লিখতে পারলে চমৎকার হত, কিন্তু ঘটনা হল বহু দর্শকের চেয়ে মনোযোগী দর্শক সঙ্গীতানুষ্ঠানের রসগ্রহণের পক্ষে বেশি সুবিধাজনক। সেদিক থেকেও ‘অতল সলিলে’ তৃপ্তিদায়ক। ইদানীং যে কোনো প্রেক্ষাগৃহে মোবাইল ফোনের আওয়াজ শিল্পী এবং অন্য দর্শকদের যতখানি বিরক্তি উদ্রেক করে, এদিন তার অর্ধেকও করেনি।

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত

কতদিন রামের চেয়ে পিছিয়ে থাকবেন কৃষ্ণ?

কোভিডে যখন আমরা ঘরবন্দি, তখন দূরদর্শন তাদের জনপ্রিয় হিন্দি ধারাবাহিকের অনেকগুলোই পুনঃপ্রচার করছিল। বাসু চ্যাটার্জির ব্যোমকেশ বক্সীর প্রায় সবকটা পর্বই ফের গোগ্রাসে গিললাম। বি আর চোপড়ার মহাভারত দেখার তেমন উৎসাহ ছিল না, তবে কিছু পর্ব চোখে পড়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটা ছিল কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম এবং ঝড়ের রাতে বসুদেবের কৃষ্ণকে মাথায় নিয়ে গোকুলযাত্রা। দেখতে দেখতে মনে পড়ল নীতীশ ভরদ্বাজের কথা। দূরদর্শনে সম্প্রচারিত রামানন্দ সাগরের রামায়ণ কীভাবে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে তা নিয়ে বইপত্র লেখা হয়েছে। কিন্তু সেই রামায়ণের রাম অরুণ গোভিলও পাননি, এমন এক সম্মান পেয়েছিলেন চোপড়ার মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রাভিনেতা নীতীশ। তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই জয়ে তাঁর কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয়ই একমাত্র কারণ ছিল না নিশ্চয়ই, কিন্তু ভারতের দর্শক যে অভিনয় আর বাস্তবে প্রায়শই তফাত করতে পারেন না তার অজস্র প্রমাণ আছে। হেমেন গুপ্তের ‘বিয়াল্লিশ’ ছবিতে অত্যাচারী পুলিস অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করার পর বিকাশ রায়ের বাড়িতে ঢিল পড়ার কিংবদন্তিও সে কথাই প্রমাণ করে।

কিন্তু পর্দার কৃষ্ণের রাজনৈতিক লাভ হলেও বিষ্ণুর দুই অবতারের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণই কিন্তু হিন্দুত্ব রাজনীতিতে উপেক্ষিত। রামজন্মভূমি আন্দোলন গোটা ভারতের ইতিহাসই বদলে দিয়েছে। গত কয়েক বছরে রামনবমী হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক বিবৃতির মঞ্চ। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সশস্ত্র মিছিল করবে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু এলাকায় এমন আচরণ করবে যেন বানরসেনার মত তারাও রাবণবধে বেরিয়েছে – এ যেন নিয়ম হয়ে গেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মত বিজেপিবিরোধীরা এর উত্তরে প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্ব করতে নেমে পাল্টা রামনবমী মিছিল, বজরংবলী পুজো ইত্যাদি করবে – এটাই নিয়ম হয়ে গেছে। সেই তুলনায় জন্মাষ্টমী এখনো শান্তিপূর্ণ উৎসব। ‘অ্যাংগ্রি রাম’, ‘অ্যাংগ্রি হনুমান’-এর মত ‘অ্যাংগ্রি কৃষ্ণ’ স্টিকারও দেখা যায় না পথচলতি গাড়ির গায়ে। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আস্ত বক্তৃতা দিয়ে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণের বাঁশরী আর শিখীর পাখা এখনো সুদর্শনকে ঢাকা দিয়ে রেখেছে।

অবশ্য তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কারণ নেই। হিন্দুত্ব প্রকল্পে অযোধ্যার পরে যে কাশী এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরার জায়গা – তা তো হিন্দুত্ববাদীদের স্লোগানেই বলা আছে। গত ১৩ অগাস্ট দিল্লিতে কয়েকজন সাধুসন্ত হিন্দুরাষ্ট্রের ৩২ পাতার খসড়া সংবিধান প্রকাশ করেছেন। তাতে উল্লেখ না থাকলেও, হিন্দুত্বের পিতা সাভারকরের কৃষ্ণ তথা গীতাপ্রীতি মাথায় রাখলে হিন্দুরাষ্ট্রের পতাকায় অশোক চক্রের জায়গা নেবে সুদর্শন চক্র – এমন কল্পনা অন্যায় হবে না।

আরও পড়ুন লাঠালাঠি নয়, গলাগলি

দেবতোষ দাশের বিন্দুবিসর্গ উপন্যাস পড়তে গিয়ে জানলাম, কার্ল মার্কস জগদ্বিখ্যাত দাস কাপিটাল বইতে বিষ্ণুকে উল্লেখ করেছেন পুঁজিবাদী বলে (‘Enough, that the world still jogs on, solely through the self chastisement of this modern penitent, of Vishnu, the capitalist.’)। সে অর্থে বর্তমানে গোটা দুনিয়াটাই বিষ্ণুর দখলে, ভারত তো বটেই। সেই বিষ্ণুর লোকপ্রিয় অবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিকে কি বেশিদিন নরেন্দ্র মোদীরা স্রেফ একটা ছুটির দিন হয়ে থাকতে দেবেন? তুলসীদাসের প্রজারঞ্জক রামকে দিয়ে তাঁদের কাজ চলে না। যশোদার আদরের বালগোপাল বা রাধার প্রেমিক শ্যামকে দিয়ে কি চলবে?

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

আমাদের যখন সবে গোঁফ দাড়ি গজাচ্ছে, তখন ট্রেনের কামরা বা পাবলিক টয়লেটের দেয়ালে সাঁটা কিছু বিজ্ঞাপন নজর কাড়ত। সেখানে লেখা থাকত একটা কথা, যার অর্থ বুঝতে না পেরে আমরা আকাশ-পাতাল ভাবতাম এবং বন্ধু মহলে বিস্তর আলোচনা করতাম। কথাটা হল, কৈশোরের কিছু “কুঅভ্যাস” ছাড়তে না পারলে নাকি বিবাহিত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজেরা কিশোর বলেই ওখানে কোন অভ্যাসের কথা বলা হত তা জানতে আমরা যারপরনাই উদগ্রীব ছিলাম। কথাটা মনে পড়ল সদ্য ওটিটিতে মুক্তি পাওয়া ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দেখে। এই ওয়েব সিরিজের মূলধন হল ফেলুদা আর সত্যজিৎ সম্পর্কে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতা। ও জিনিসটা মানুষ মাত্রেরই থাকে, কিন্তু ওটা এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় কুঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই আমরা চিরকিশোর হয়ে পড়েছি। ফলে পুনরাবৃত্তিই আমাদের শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনুকরণই আমাদের আপ্লুত করছে। গালভরা নাম হয়েছে ‘ট্রিবিউট’। অনীক দত্ত সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁকে ট্রিবিউট দিতে ছবি তৈরি করেছেন। সে ছবির বৈশিষ্ট্য (বিজ্ঞাপন জগতের ভাষায় – ইউনিক সেলিং পয়েন্ট) হল, নামভূমিকায় যিনি আছেন তাঁকে হুবহু সত্যজিতের মত দেখাচ্ছে (অথচ চরিত্রটির নাম সত্যজিৎ নয়), আর পথের পাঁচালীর দৃশ্যগুলোর দারুণ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এতেই আমাদের আবেগে গলা বুজে আসছে। আসল পথের পাঁচালী দেখার উপায় থাকতে অনুকরণ কেন দেখতে যাব, সে প্রশ্ন করলে লোকে তেড়ে আসছে।

ব্যাপারটা শৈল্পিক হোক বা না হোক, স্মৃতিমেদুরতা (বাঙালিরা যাকে বলে নস্ট্যালজিয়া) যে লালমোহন গাঙ্গুলির ভাষায় “সেলিং লাইক হট কচুরিজ”, তাতে সন্দেহ নেই। ফলে সৃজিত মুখার্জিও নস্ট্যালজিয়া বেচতেই নেমেছেন। সিরিজের প্রথম পর্বের শুরুটাই হুবহু অনুকরণ, থুড়ি ট্রিবিউট। সোনার কেল্লা ছবিতে ফেলুদাকে পর্দায় প্রথমবার দেখানোর সময়ে শীর্ষাসনরত পদযুগল দেখানো হয়েছিল, তোপসে দৌড়ে এসে খবর দিয়েছিল মক্কেল এসেছে। এখানে পদযুগল এসেছে কয়েক সেকেন্ড পরে, প্রথমবার দেখানো হয়েছে শীর্ষাসনরত ফেলুদার মুখের ক্লোজ আপ। মুশকিল হল, অনুকরণেরও সক্ষমতা অক্ষমতা আছে। মক্কেল আসার খবর ফেলুদাকে তখুনি জানানোর দরকার পড়ে। জটায়ুর আগমন তো কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয় যে তৎক্ষণাৎ জানাতে হবে। কিন্তু নির্দেশক ওসব ভাবতে যাবেন কেন? দর্শককে নস্ট্যালজিয়ায় জবজবে করে ফেলতে পারাই আসল। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।

নস্ট্যালজিয়া নিশ্ছিদ্র করতে সিরিজটিকে পিরিয়ড পিসে পরিণত করা হয়েছে। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই বোধহয় এমন সিনেমা বোদ্ধা দর্শক পাওয়া যায়, যাঁরা বিশ্বাস করেন ছবি সেপিয়া টোনে রাখলেই পিরিয়ড পিস হয়ে যায়। কারণ ফেলুদারা দার্জিলিংয়ে যে হোটেলে ওঠে, তার বাইরের দেয়াল আধুনিক কায়দার। আশির দশকের ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ট্রিবিউট দিতেই বোধহয় দার্জিলিংয়ের ঠান্ডাতেও এই সিরিজের ফেলুদা টোটা রায়চৌধুরীকে ফিনফিনে পাজামা আর পাঞ্জাবির উপরে স্রেফ একটা চাদর জড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু বাইরে বেরোবার সময়ে তিনি দিব্যি টি-শার্ট পরে ফেলেন। মর্নিং ওয়াকেও চলে যান আধুনিক জামাকাপড় পরে। সেইসব সময়ে আশির দশক বজায় থাকে ফেলুদা আর তোপসের পেতে আঁচড়ানো চুলে। বিরূপাক্ষ মজুমদারের পুত্র সমীরণের সঙ্গে ফেলুদার বাকযুদ্ধ অবশ্য পুরোদস্তুর রেট্রো। ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া প্রভাত রায়ের প্রতিকার ছবির কথা মনে পড়ে যায়। ভয় হয়, চোখা চোখা সংলাপ বলতে বলতে এখুনি চিরঞ্জিত আর ভিক্টর ব্যানার্জির মত টোটা আর সমীরণরূপী সুপ্রভাত দাস মারামারি শুরু করে দেবেন। ট্রিবিউট অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এই সিরিজে ফেলুদার সংলাপ সম্ভবত এমএলএ ফাটাকেষ্ট চরিত্রের অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীকে ট্রিবিউট। নইলে নিজের গায়ের জোর কতটা তা বোঝাতে ফেলুদা বলতে পারেন না “ঘোড়া যেমন চাঁট মেরে মানুষের মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে পারে, ঠিক তেমনই বহু দেশে ঘোড়াকে কেটে তার মাংস রান্না করে খাওয়া হয়।” (তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে “সুস্বাদু। জানেন?”)

দার্জিলিংয়ে ফেলুদার কার্যকলাপ অবশ্য সৌমিত্র বা চিরঞ্জিতের চেয়েও যাঁকে বেশি মনে পড়ায় তিনি অমিতাভ বচ্চন। কারণ এই ফেলুদা চিতাবাঘের চোখে চোখ রাখতে পারেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেই গুনগুন করে গান গাইতে পারেন। সে আবার ইংরেজি গান, যেহেতু তাতে ল্যাভেন্ডার শব্দটা আছে এবং যে ধাক্কা মেরেছিল তার শরীর থেকে ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার পারফিউমের গন্ধ পেয়ে ফেলুদা তাকে চিনতে পেরেছেন। এখানেই শেষ নয়, ফেলুদা আহত, ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের উপর গোটা শরীরের ভার নিতে পারেন। তিনি আরও একটি জিনিস পারেন যা এমনকি আশির দশকের বচ্চনও পারতেন না। তা হল দু হাতে বন্দুক চালানো। সমীরণ মজুমদারের গাড়ির টায়ারে ফেলুদা গুলি করেন বাঁ হাতে, গাড়ি থেকে নেমে আবার বন্দুক তাক করেন ডান হাতে।

ভক্তরা নিশ্চয়ই বলবেন এসব পরিচালকের স্বাধীনতা। ফিল্মের সাহিত্যকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করার দায় নেই। সত্যজিৎ নিজেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প নিয়ে ছবি করার সময়ে চিত্রনাট্যে অনেককিছু বদলে দিয়েছেন। কথাটা ঠিকই। এই স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার সৃজিতবাবু এই সিরিজে করেছেন। যেমন সত্যজিতের গল্পের টফ্রানিল বড়ি হয়ে গেছে ট্রফানিল। কিন্তু সমস্যা হল, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ছদিনে লিখিত এই গল্পে (সূত্র: ফেলুদা সমগ্র ১, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯; আনন্দ) সত্যজিৎ যে টফ্রানিলের কথা লিখেছেন, সামান্য গুগল সার্চই বলে দিচ্ছে ওই ওষুধটি (Tofranil) অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট, যার প্রয়োজনীয়তা বিরূপাক্ষবাবু নিজে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু Trofanil বলে কোনো ওষুধের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এ যুগের সিধুজ্যাঠা গুগল Tromanil Plus বলে একটি ট্যাবলেটের কথা বলছে বটে, কিন্তু সেটিও রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ব্যবহার হয়। তাহলে কি পরিচালক সত্যজিতের উপর কলম চালিয়ে কোনো অদ্যাবধি অনাবিষ্কৃত ওষুধের সন্ধান দিলেন? পিরিয়ড পিসে কি তা করা চলে? প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অবশ্য হতাশ হতে হবে। যেমন বিরূপাক্ষবাবুর বেয়ারা লোকনাথকে খুন করা হয়েছিল গলা কেটে। মৃতদেহের তলপেটের কাছেও কী করে রক্ত লাগল – এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।

গল্পের যে পরিবর্তনটিকে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ বৈপ্লবিক আখ্যা দিচ্ছেন, সেটি চিত্রনাট্যকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে তা-ও যেমন বোঝা গেল না। দার্জিলিং জমজমাট গল্পে বলিউডের নায়িকা সুচন্দ্রার উল্লেখমাত্র আছে। এই সিরিজে কিন্তু তাঁর উপস্থিতি বেশ কয়েকটি দৃশ্যে। শুধু তা-ই নয়, ফিল্মের নায়ক রাজেন রায়না ওরফে বিষ্ণুদাশ বালাপোরিয়ার সঙ্গে তাঁর উদ্দাম প্রেম আছে – একথা একেবারে শুরু থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত দর্শককে (এবং ফেলুদাকে) একটি চুম্বন দৃশ্য উপহার দেওয়া ছাড়া চরিত্রটির আর কোনও ভূমিকা নেই। নায়ক-নায়িকার সম্পর্ক বিরূপাক্ষ মজুমদার হত্যা রহস্যকে নতুন কী দিতে পারল তা বোধহয় জিজ্ঞেস করা উচিত হবে না। কিন্তু সুলভ পর্নোগ্রাফির যুগেও বাঙালি দর্শকের একটি লং শটের চুম্বন দৃশ্যকে বৈপ্লবিক মনে হচ্ছে দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।

একইরকম অবাক করে গল্পের সাধারণ ভদ্রলোক হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়কে ‘অ্যাংগ্রি ওল্ড ম্যান’ গোছের চরিত্রে পরিণত করা। তিনি নাকি বিরূপাক্ষবাবুর উপর নজর রাখার জন্য লোক লাগিয়েছিলেন। কী উদ্দেশ্যে তার ব্যাখ্যা অবশ্য চিত্রনাট্যে নেই। উপরন্তু তিনি বলেন, “ব্লাড প্রেশার আর গেঁটে বাতের সমস্যা না থাকলে” তিনি হয়ত বিরূপাক্ষবাবুকে খুন করার চেষ্টা করতেন। এটাও কি আশির দশকের বচ্চনকে ট্রিবিউট? মানে পিরিয়ড পিস হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হঠাৎ একটিমাত্র দৃশ্যে একটিমাত্র দেয়ালে আখরি রাস্তা-র পোস্টার সাঁটা হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করছি।

আরও পড়ুন ‘অলৌকিক মেগা সিরিয়াল দেখা সমাজের সত্যজিতের ছবি দেখার কোন কারণ নেই, তিনি উপলক্ষ মাত্র’

ট্রিবিউটাভ্যাস চরমে উঠেছে ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে। কদিন পরে কলকাতা মেট্রোর উত্তমকুমার স্টেশনের আশপাশে হাঁটতে গেলে নির্ঘাত কোনো ব্যোমকেশ বা ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে। দেখা যাচ্ছে তাতেও যথেষ্ট ট্রিবিউট হয়নি। তাই সৃজিতবাবুর সিরিজে পুলক ঘোষাল জটায়ুর নারীচরিত্রহীন উপন্যাসের চিত্রনাট্যে নায়িকা আমদানি করার যুক্তি হিসাবে খাড়া করছেন শরদিন্দুর সত্যান্বেষীর বিবাহিত জীবনকে। আবার রহস্যোদ্ঘাটনের দৃশ্যে স্বয়ং ফেলুদা বলছেন চিত্রচোর গল্পের সঙ্গে নাকি বিরূপাক্ষ হত্যার ঘটনার মিল আছে। মিলটি যে কী তা আমার খাটো বুদ্ধিতে ধরা পড়ল না। শরদিন্দুর গল্পের অপরাধী তার পুরনো চেহারাটা গায়েব করার জন্য ছবি চুরি করেছিল। এ গল্পের অপরাধী তো বুঝতেই পারেনি তার একখানা পুরনো চেহারার ছবি রয়েছে নয়নপুর ভিলায়। অবশ্য আমাদের মত দর্শকের বুদ্ধির দৌড় কতটুকু তা নির্দেশক ভালই জানেন। তাই ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যগুলি বার তিনেক করে না দেখিয়ে ক্ষান্ত দেননি। বিরূপাক্ষবাবুর বুকে ছুরি মারার শটটি যে কতবার কতভাবে দেখিয়েছেন তা গুনতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।

নস্ট্যালজিয়া ছাড়া আর যে জিনিসটি এখন সেলিং লাইক হট কচুরিজ, সেটি হল গোয়েন্দা গল্প। এই দুয়ের চাপে এই সিরিজের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছেন। তাঁর নাম অনির্বাণ চক্রবর্তী। সবে গত মাসে মুক্তি পেয়েছে আরেক গোয়েন্দার কীর্তিকলাপ নিয়ে ছবি দ্য একেন। সেই ছবিতে অনির্বাণ নিজেই গোয়েন্দা। এমন একজন গোয়েন্দা যিনি বিলক্ষণ ভাঁড়ামি করেন। বাংলা প্রবাদ বলতে ভুল করেন, হাস্যকর হিন্দি বলেন। দুটি ছবিরই প্রেক্ষাপট দার্জিলিং, লোকেশনেও মিল। অনেক ফ্রেমে মনে হয় একই ছবি দেখছি। কে জানে, হয়ত শুটিংও কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। এই ডামাডোলে অনির্বাণ একেনবাবুই থেকে গেছেন, লালমোহনবাবু হয়ে উঠতে পারেননি। জটায়ু যে ভাঁড় নন তা অভিনেতা বা নির্দেশক কেউই বুঝে উঠতে পারেননি মনে হয়। বিশেষ করে অঘোরচাঁদ বাটলিওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করার সময়ে অনির্বাণ যা করেছেন তা সিনেমা কেন, যাত্রার মঞ্চেও বিসদৃশ লাগে। অবশ্য বিরূপাক্ষ মজুমদারের চরিত্রে বরুণ চন্দ, মহাদেব ভার্মার চরিত্রে সুব্রত দত্ত ইন্সপেক্টর যতীশ সাহার চরিত্রে লোকনাথ দে আর সুচন্দ্রার চরিত্রে মুনমুন রায় ছাড়া এই সিরিজে প্রায় সকলেই বাড়াবাড়ি করেছেন।

ফেলুদার চরিত্রে টোটাকে দিব্যি মানিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চিড়িয়াখানায় চিতাবাঘকে প্রায় কামড়াতে যাওয়া ফেলুদাকে তো মানায় না বটেই, কোনো শিক্ষিত মানুষকেই মানায় না। সোনার কেল্লায় মুকুল ভবানন্দকে দুষ্টু লোক বলে চিনতে পেরেছিল তখন, যখন সে ময়ূরের দিকে গুলি চালায়। জীবজগতের প্রতি এই সংবেদনশীলতা গোটা রায় পরিবারের অভিজ্ঞান। লীলা মজুমদারের ‘কুঁকড়ো’ গল্পেও যার প্রমাণ রয়েছে। ফেলুদাকে হি-ম্যান বানাতে গিয়ে সেই সংবেদনশীলতার জায়গায় আলিপুর চিড়িয়াখানায় যারা বাঘের খাঁচায় ঢুকে তাকে মালা পরাতে গিয়েছিল, তাদের মানসিকতা এনে ফেলা হয়েছে। সন্দীপ রায়ের ফেলুদাও অনেকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারতেন না, কিন্তু নিদেনপক্ষে তাঁর ফেলুদা সলমন খান বা টাইগার শ্রফ মার্কা মোটা দাগের অ্যাকশন হিরো হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন না। সৃজিতের ফেলুদা যদি পেশিবহুল চেহারার, বাঘ সিংহের সাথে লড়াই করা পুরোদস্তুর একটি নতুন চরিত্র হয়ে উঠতেন, তাহলেও কথা ছিল। ভাবা যেত বিবিসির শার্লক সিরিজের মত নতুন কিছু হল। কিন্তু এক পা নস্ট্যালজিয়ার সেপিয়া নৌকায় রেখে অন্য পা হাস্যকর মাচোইজমে রাখা এই টলমলে ট্রিবিউট আপন মনে গাওয়ার মত শীর্ষ সঙ্গীতটি ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র জগৎকে কী দিল?

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের স্তম্ভ নয়, গণতন্ত্রই সংবাদমাধ্যমের স্তম্ভ

গত ২১ মে, ২০২২ (শনিবার) কলকাতার ন্যাশনাল মাইম ইনস্টিটিউটে হাতিবাগান সঙ্ঘারাম নাট্যদলের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রদত্ত সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে এই বক্তৃতা পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রূপে প্রকাশ করা হল। আলোচনার বিষয় ছিল ‘আলো-অন্ধকারে আমাদের সময় – কী করণীয়, কী স্মরণীয়’।

উপস্থিত সকলকে নমস্কার, হাতিবাগান সঙ্ঘারামকে জন্মোৎসবের শুভেচ্ছা। আজকাল ভাল কাজ করতে চায় এমন কোনো সঙ্ঘের সন্ধান পেলে ভারি আরাম হয়। আপনারা আরও অনেকদিন আমাদের মনের আরাম, প্রাণের আরাম দিন, সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণাও দিন – এই কামনা করি।

আমার কাছে যখন আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণ করার প্রস্তাবটা এল, আলোচনার বিষয়টা শুনেই আমার যা মনে পড়ল সেটা বলি। করোনা অতিমারির শুরুর দিক পর্যন্ত আমি একটা খবরের কাগজে সম্পাদনার চাকরি করতাম। ওই চাকরিতে যেমন হয়, অফিস থেকে বেরোতাম মাঝরাত্তির নাগাদ; অফিসের গাড়ি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসত। আমরা রোজ বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের সামনে দিয়ে যেতাম। স্টেডিয়াম সমেত বাইপাসের অনেকটা জায়গায় অত রাতেও আলো চুঁইয়ে পড়ত। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়ে বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকটা প্রথম পড়ি। ওই নাটকের একটা দৃশ্য আমাদের পাঠ্য ছিল। সেই দৃশ্যে একটা বিয়েবাড়ির বর্ণনা আছে। লেখা হয়েছে, সেখানে আলো চুঁইয়ে পড়ছে। যে মাস্টারমশাই পড়িয়েছিলেন, তিনি খুব যত্ন করে আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে কোনো জিনিস চুঁইয়ে পড়ে তখনই, যখন তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়ে যায়। তা ২০১৭ সালে যখন ভারতে অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসেছিল, তখন থেকেই ওই এলাকা চুঁইয়ে পড়া আলোয় ভেসে যাচ্ছে। এখন মহাবিশ্ব তো নিত্যতার সূত্র মেনে চলে, যাকে ইংরেজিতে বলে ল অফ কনজারভেশন। তার মানে পৃথিবীর যেখানেই আলো চুঁইয়ে পড়ে, বুঝতে হবে সেখানেই অন্য কোনো জায়গার আলো এনে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গাটাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অন্ধকারে। আপনার চারপাশে তাকান, দেখবেন এরকম চুঁইয়ে পড়া আলোর জায়গা ২০-২৫ বছর ধরে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা এই আলোর বৃত্তেই থাকি বলে খেয়াল করি না, যে অন্ধকার এলাকাগুলোও বাড়ছে আলোর গতিতে।

সেই কারণেই আমাদের সময়ের আলো, অন্ধকার নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ হচ্ছে। নইলে, শুধু আমাদের সময় কেন, যে কোনো সময়েই তো আলো আর অন্ধকার দুটোই থাকে। কিন্তু আমাদের সময়ে অন্ধকারের গভীরতা আর ব্যাপ্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে অনেক প্রবীণ মানুষেরও অভূতপূর্ব বলে মনে হচ্ছে। এখানে সঞ্জয়দা (সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়) আছেন। পশ্চিমবঙ্গ ১৯৬০, ৭০-এর দশকে যে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে গেছে তাকে ওঁর মত করে কজন জানে? সঞ্জয়দা সে নিয়ে লিখলে বা বললে সেই অন্ধকার একেবারে জ্যান্ত মনে হয়। আর নৃসিংহবাবু (নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী) তো বললেনই, আলো আর অন্ধকার সৃষ্টির সমবয়সী। সুতরাং ইতিহাসে এমন কোনো যুগ ছিল না যা সম্পূর্ণ অন্ধকারমুক্ত। কিন্তু পরিমাণগত এবং গুণগত তফাত ঘটে। বিরাট তফাত। আমাদের সময়ের আলোচনায় যাওয়ার আগে এই কথাগুলো বলে নিতে হল, কারণ জীবনানন্দ দাশের ছিল একজন বনলতা সেন, আর আমরা হলাম অভ্যাসের দাস। আমাদের আছে হাজার হাজার বনলতা সেন। আপনি বর্তমানের কোনো অন্ধকারের দিকে আঙুল দেখালেই তাঁরা জম্বিদের মত দলে দলে তেড়ে আসবেন, বলবেন “এখন প্রতিবাদ করছেন? এতদিন কোথায় ছিলেন?”

মাঠে যেমন বাউন্ডারি না থাকলে খেলা যায় না, তেমনি আলোচনারও সীমা ঠিক করে না নিলে আলোচনা করা যায় না। আমি যেহেতু সাংবাদিকতা করি, তাই মূলত সাংবাদিকতার অন্ধকার নিয়েই আলোচনা করব, প্রসঙ্গক্রমে অন্য অন্ধকারের কথা এসে পড়বে।

আমি যদি আপনাদের জিজ্ঞেস করি, সাংবাদিক শব্দটা শুনলেই প্রথমে কার নাম মনে আসে? কোনো সন্দেহ নেই, অনেকেই বলবেন অর্ণব গোস্বামী। সকলেই যে লোকটাকে পছন্দ করেন বলে বলবেন তা নয়, যাঁরা অপছন্দ করেন তাঁদেরও প্রথমে ওই নামটাই মনে আসবে। লোকটি অন্ধকার এতটাই ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। কেউ কেউ হয়ত একেবারে বিপরীত মেরুর রবীশ কুমারের নাম করবেন। এছাড়া সুমন দে, মৌপিয়া নন্দী, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি নামও উঠে আসতে পারে। পুরনো লোকেরা বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, বরুণ সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, কুলদীপ নায়ার, সি আর ইরানি ইত্যাদি নাম বলবেন। কিন্তু আজকে আমি আপনাদের সামনে একেবারে অন্য কতকগুলো নাম বলব। আজকের ভারতবর্ষে আসল সাংবাদিকতা এঁরাই করছেন। সৈনিকরা নিজের জীবন বাজি রেখে লড়েন, এই সাংবাদিকরা নিজের সর্বস্ব বাজি রেখে খবর তুলে আনছেন।

প্রথম নামটা পবন জয়সোয়াল। উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের এই সাংবাদিক ২০১৯ সালে জনসন্দেশ টাইমস বলে একটা স্থানীয় কাগজে খবর করেন, যে একটা স্কুলে মি ডে মিলে স্রেফ রুটি আর নুন দেওয়া হচ্ছে। সে খবর ক্রমশ সারা দেশে হইচই ফেলে দেয়, যোগী সরকারের মুখ পোড়ে। উত্তরপ্রদেশ পুলিস তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক চক্রান্ত, কর্মরত সরকারি কর্মচারীর কাজে বাধা দেওয়া আর প্রতারণা – এই তিনটে অভিযোগে এফ আই আর দায়ের করে। যথারীতি শেষ অব্দি একটা অভিযোগও প্রমাণ করে উঠতে পারেনি। পবন ক্যান্সারে ভুগছিলেন, চিকিৎসা করার মত যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। গত ১১ এপ্রিল তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ, বিরোধী নেতা অখিলেশ যাদব আর কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে ট্যাগ করে অর্থসাহায্য চেয়ে টুইট করেন। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্যও দিয়ে দেন। ওঁরা কতটা সাহায্য করেছিলেন জানি না, কোনো কোনো সাধারণ মানুষ করেছিলেন। পবন গত ৫ মে মারা গেছেন।

দ্বিতীয় নাম যোগেন্দ্র সিং। তিনি কোনো স্থানীয় কাগজেও কাজ করতেন না, তাঁর ছিল ‘শাহজাহানপুর সমাচার’ নামে একটা ফেসবুক পেজ। ২০১৫ সালের ৩০ মে সেই পেজে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের মন্ত্রী, সমাজবাদী পার্টির রামমূর্তি বর্মা এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে ধর্ষণ করেছেন এবং জোর করে জমি দখল করেছেন – এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়। আপনাদের মধ্যে যারা সোশাল মিডিয়ায় খুব সক্রিয়, তাদের মনে পড়তে পারে একটা ভাইরাল ছবি – শরীরের বেশিরভাগটা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া একটা মানুষ বুকে হেঁটে এগোবার চেষ্টা করছে। সেই মানুষটাই যোগেন্দ্র। কিছু মানবাধিকার সংগঠন ঘটনাটা নিয়ে চেঁচামেচি না করলে পুড়ে মরেও যোগেন্দ্রর ভাইরাল হওয়া হত না। মন্ত্রীমশাই আর কয়েকজন পুলিসকর্মীই যে যোগেন্দ্রকে জীবন্ত দাহ করেছেন সেটাও চাপা পড়ে যেত।

তৃতীয় নাম সিদ্দিক কাপ্পান। এই সাংবাদিক কয়েক বছর হয়ে গেল উত্তরপ্রদেশে হাজতবাস করছেন এমন এক প্রতিবেদনের জন্য, যা তিনি লিখতে পারতেন বলে উত্তরপ্রদেশ সরকারের ধারণা। এতদিন হয়ে গেল তাঁকে জামিন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। কাশ্মীরওয়ালা কাগজের সম্পাদক ফাহাদ শাহ আর ফ্রিলান্স সাংবাদিক সাজ্জাদ গুলের হাজতবাসও বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল। তবে কাশ্মীরের কথায় যাব না, কারণ ওখানকার সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের যত বড় তালিকাই তৈরি করি না কেন, সেটা অসম্পূর্ণ তালিকা হবে। বরং মধ্যপ্রদেশের কথা বলি।

সিধি জেলার সাংবাদিক কণিষ্ক তিওয়ারি। তিনি গিয়েছিলেন নাট্যশিল্পী নীরজ কুন্দেরের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানার বাইরে যে প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছিল তা কভার করতে। পুলিস তাঁকে এবং কয়েকজন প্রতিবাদী থিয়েটার কর্মীকে থানার ভিতর টেনে নিয়ে যায়, ১৮ ঘন্টা মত লকআপে আটকে রাখে। তাঁর অভিযোগ, মারধরও করা হয় এবং জামাকাপড় খুলে ফেলতে বাধ্য করা হয়। শেষের অভিযোগটা যে মিথ্যে নয় তা আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, কারণ শুধু অন্তর্বাস পরিহিত বন্দীরা জড়সড় হয়ে এক পুলিস অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, এ ছবিও ভাইরাল হয়েছিল।

একটা নামও পশ্চিমবঙ্গের নয় দেখে নিশ্চয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন? ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৫০ নম্বরে নেমে যাওয়া এই দেশে আমাদের রাজ্যটাকে আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মত মরুদ্যান আখ্যা দেবেন ভাবছেন কি? তাহলে আরেকটা নাম বলি। বিপ্লব মন্ডল। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজগুলো খুঁজে দেখুন। অধিকাংশ কাগজের প্রথম পাতায় পাবেন এঁর কথা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াকে আঁতুড়েই মুখে ধান পুরে মেরে ফেলার যে চেষ্টা চলছিল সেদিন, তার ছবি তুলে ফেলার অপরাধে রাজনৈতিক গুন্ডারা চিত্রসাংবাদিক বিপ্লবকে মারধোর করে, জামাকাপড় খুলে নেয়, সে ছবি মোবাইলে তোলা হয় এবং হুমকি দেওয়া হয় “ভাইরাল করে দেব কিন্তু।” সৈনিকদের মত ‘জীবন’ বাজি রেখে কাজ করছেন না বলে কেন ‘সর্বস্ব’ বাজি রেখে বললাম বোঝা গেল তো?

এটা কিন্তু এক দিকের অন্ধকার। শুধু এই দিকে অন্ধকার থাকলে উল্টো দিকে আলো দেখা যেত। কিন্তু উল্টো দিকটা কীরকম? বিপ্লবের কথা অধিকাংশ কাগজে বেরিয়েছিল বলেছি, সব কাগজে বলিনি কিন্তু। যে কাগজগুলোতে বেরোয়নি, তার মধ্যে একটা হল সেই কাগজ, যাদের হয়ে উনি সেদিন ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। এটাই আজকের সাংবাদিকতার বাস্তবতা। আমি যখন সাংবাদিকতায় আসি ২০০৫ সালে, তখন একেই পড়তে পড়তে চাকরি পেয়ে গেছি বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করতাম। তার উপর সিনিয়ররা একেকজনকে দেখিয়ে বলতেন “ওই যে অমুকদাকে দেখছিস? ও কর্পোরেশনে ঢুকলে মেয়র পর্যন্ত থরথর করে কাঁপে। কখন কী খবর করে দেবে, মেয়রের চেয়ার নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে।” “তমুক দিদিকে দ্যাখ। পুলিস কমিশনারও ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমতা করে।” আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, ওঁদের মত হতে হবে।

ওই সাংবাদিকদের কি রাবণের মত দশটা মাথা ছিল, নাকি দুটো করে অতিরিক্ত হাত-পা জামাপ্যান্টের ভিতর লুকনো থাকত? তা তো নয়। তাহলে সরকার, সরকারি দল, পুলিস, প্রশাসন, বিরোধী দল – সকলকে চটানোর মত খবর করার সাহস পেতেন কী করে? পেতেন, কারণ জানতেন আমার কাগজ আমার পিছনে আছে। আমার নামে যদি মামলা হয়, কাগজের উকিল বুঝে নেবে। আমাকে যদি গ্রেপ্তার করা হয়, আমার সম্পাদক জামিনের ব্যবস্থা করবেন, পরদিন কাগজে বিরাট করে খবর বেরোবে যে সরকার সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছে। আর রাজনৈতিক গুন্ডারা যদি পেটায়, মিডিয়ার গাড়ি যদি ভাঙচুর হয়, তাহলে শুধু তাঁর কাগজ বা চ্যানেল নয়, গোটা সংবাদমাধ্যম সরকারের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি না, সারা দেশেই এরকম হত। আর এখন? সরকারের বিরুদ্ধে বা কোনো ক্ষমতাশালী, পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে খবর করতে গেলে প্রথমে আপনি আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলবে “চেপে যা বাপু। কী দরকার?” যদি এমন হয় যে আপনার বসটির মেরুদণ্ড এখনো সোজা, তাহলে খবরটা হয়ত হয়ে গেল, কিন্তু পরদিন আপনি আর আপনার বস – দুজনের চাকরি নিয়েই টানাটানি হবে। এভাবে অসংখ্য ভাল সাংবাদিকের চাকরি গেছে গত এক দশকে। সারা দেশেই গেছে। প্রতিদিন যে আরও কত সরকারবিরোধী খবর এবং টাকার কুমিরদের কুকীর্তির খবর বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে বা লঘু করে ফেলা হচ্ছে ভারতবর্ষের নিউজরুমগুলোতে, তার হিসাব করার চেয়ে মাথার চুল গোনা সহজ।

কাদের অঙ্গুলিহেলনে হচ্ছে এরকম? কাগজ এবং চ্যানেলের মালিকদের। কেন তাঁরা এরকম হয়ে গেছেন গত এক দশকে? সবচেয়ে বড় কারণ – বিজ্ঞাপন।

সংবাদমাধ্যম বলতে কাদের বোঝায়? স্বাধীনতার পর থেকে ভারত যে আধা-সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ে চলছিল, তাতে যে দু-একটা শিল্পক্ষেত্রে সরকারি অংশগ্রহণ নগণ্য ছিল তার একটা হল মিডিয়া। গত সহস্রাব্দের প্রায় গোটাটাই মিডিয়া বলতে মোটের উপর প্রিন্ট মিডিয়াকেই বোঝাত, কারণ তার আগে অব্দি তো টিভির খবর মানে কেবল দূরদর্শনের বুলেটিন। কেবল টিভি তো ঘরে ঘরে থাকত না, কারণ সেটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। তা তখনকার খবরের কাগজগুলো ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর থেকে আমাদের কী বুঝিয়েছে? না, ভর্তুকি খুব খারাপ জিনিস। কোনোকিছুতে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের উচিত নয়। সবকিছু খোলা বাজারে ছেড়ে দেওয়া উচিত, সেখান থেকে যার যা কেনার সামর্থ আছে সে সেটা কিনবে, যার সামর্থ নেই সে কিনবে না। অথচ এই যে তিরিশ বছর হয়ে গেল উদারীকরণের, সমস্ত সময়টা জুড়ে খবরের কাগজগুলো কিন্তু নিউজপ্রিন্ট কেনার সময়ে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়ে এসেছে। মানে আপনি সকালবেলা আপনার বাড়ির কাগজটায় ভর্তুকির বিরুদ্ধে একশো যুক্তি পড়ে পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে জমিয়ে তর্ক করে এসেছেন, কাগজের মাধ্যমে জনমত তৈরি হয়েছে, সরকার সেই জনমত শিরোধার্য করে ধীরে ধীরে সবেতেই ভর্তুকি কমিয়ে গেছে। কমাতে কমাতে ২০২২ সালে এসে আপনার রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম হয়ে গেছে হাজার টাকা। এদিকে আপনার কাগজের মালিক কিন্তু সরকারকে একবারও বলেনি, যে আমার নিউজপ্রিন্ট কিনতে ভর্তুকি লাগবে না। শুধু তা-ই নয়, সমস্ত সংবাদমাধ্যম গাছেরও খেয়েছে, তলারও কুড়িয়েছে। মানে কাগজ কেনার সময়ে একবার ভর্তুকি পেল, আবার সেই কাগজে খবর ছেপে যখন বার করবে তখন সরকারি বিজ্ঞাপনও পেল। তাহলে ডাবল সাবসিডি হল? এখানেও শেষ নয়। এর উপর আবার বেসরকারি বিজ্ঞাপন ছেপেছে। এখন তো বিজ্ঞাপন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে আপনি কাগজের প্রথম পাতা খুঁজে পাবেন না। যাঁরা খুব ভোরে ওঠেন তাঁরা শুরুর বিজ্ঞাপনের পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে ঘুমিয়েও পড়তে পারেন।

টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। তারাও অনেক টাকার সরকারি বিজ্ঞাপন পায়, সঙ্গে বেসরকারি বিজ্ঞাপনও চলে। সেটা মেনে নেওয়া যেত, যদি এরা দর্শকদের থেকে টাকা না নিত। ডিটিএইচ যুগের আগে যেমন চ্যানেলগুলো আপনার থেকে টাকা নিতে পারত না। তাহলে আয় করবে কোথা থেকে? সুতরাং বিজ্ঞাপন দরকার ছিল। আমি কূপমণ্ডূক, কিন্তু যাঁরা বিভিন্ন দেশে গেছেন তাঁরা জানেন, সাবস্ক্রিপশন মডেলে টিভি চললে কিন্তু এত বিজ্ঞাপন থাকে না। আমাদের এখানে তো এখন অনুষ্ঠানের মাঝে বা খবরের মাঝে বিজ্ঞাপন হয় না, বিজ্ঞাপনের মাঝে একটুখানি খবর হয়। ক্রিকেট খেলা দেখতে বসলে দেখবেন কোনো কোনো ওভারের একটা-দুটো বল হয়ে যাওয়ার পর বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়। আসলে চ্যানেল মালিক আর বড় কাগজের মালিকদের লোভের কোনো শেষ নেই। “এ জগতে হায় সে-ই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি।”

আরও পড়ুন সত্যান্বেষী পাঠক জাগুন, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবর লিখতে হবে

এই হল বড় কাগজ, বড় মিডিয়ার কাণ্ড। আর ছোট কাগজগুলোকে এই সরকারি বিজ্ঞাপনের জুজু দেখিয়েই যে যেখানে ক্ষমতাসীন সে সেখানে পকেটে পুরে রেখেছে। কারণ কাগজের ব্যবসায় একটা মৌলিক স্ববিরোধ আছে। আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, যে কাগজটা আপনি পাঁচ টাকা দিয়ে কেনেন সেটা তৈরি করতে খরচ হয় ১০-১৫ টাকা। এটা অতিমারীর আগের হিসাব বললাম, এখন হয়ত আরও বেশি। তা এই খরচ পুষিয়ে তারপর লাভ করতে গেলে ছোট কাগজগুলোর পক্ষে সরকারি বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে চলা অসম্ভব। বড় কাগজ বলতে কী বোঝাচ্ছি? পাঁচ লক্ষের বেশি বিক্রি হয় যে কাগজগুলো। আর ছোট কাগজ মানে যারা মেরে কেটে এক-দু লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে বড় কাগজ একটা কি দুটো। সেই কাগজগুলো এত বেসরকারি বিজ্ঞাপন পায়, যে ওই যে বললাম – প্রথম পাতা খুঁজতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। ছোট কাগজ কিন্তু ওসব বিজ্ঞাপন পায় না সাধারণত। কেন পায় না? কারণ সেগুলো কম লোকের হাতে যায়। যিনি বিজ্ঞাপনদাতা, তিনি তো যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে পৌঁছতে চান। ফলে যে কাগজের বিক্রি বেশি সেই কাগজই বেশি বিজ্ঞাপন পায়। মানে তেলা মাথাতেই তেল পড়ে। সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কিন্তু নিয়মটা আলাদা। আপনার কাগজের বিক্রি যা-ই হোক, যদি নামটা ডিএভিপি (মানে ডিরেক্টোরেট অফ অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড ভিজুয়াল পাবলিসিটি)-র খাতায় থাকে, তাহলেই সরকার আপনাকে বিজ্ঞাপন দেবে। সরকার এই নিয়মটাকেই ব্যবহার করে। অমুক প্রতিবেদনে আমার দুর্নীতি দেখিয়েছ? যাও, তোমাকে বিজ্ঞাপন দেব না। তমুক সিদ্ধান্তের নিন্দে করেছ? আজ থেকে তোমার বিজ্ঞাপন বন্ধ।

কতকগুলো টাকার অঙ্ক না বললে আপনাদের বিশ্বাস না-ও হতে পারে যে সরকারি বিজ্ঞাপন এত বড় ব্যাপার। তাই কয়েকটা অঙ্ক বলি। প্রায়ই দেখবেন কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন থাকে। ওরকম একটা বিজ্ঞাপনের দর বড় কাগজগুলোতে উনিশ বিশ। ২০২০ সালে আমি তেমন একটা কাগজেই কাজ করতাম। সেখানে ওই বিজ্ঞাপনের দাম ছিল এক কোটি টাকা। আধ পাতার বিজ্ঞাপন হলে পঞ্চাশ লাখ। এবার মনে করে দেখুন, গত লোকসভা নির্বাচনের সময়ে প্রত্যেক দফায় কতবার আপনার বাড়ির কাগজটার পাতা জুড়ে মোদীজিকে দেখেছেন, তারপর হিসাব করুন কত টাকার বিজ্ঞাপন একেকটা কাগজ বিজেপির থেকে পেয়েছে। এ তো গেল নির্বাচনের সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপনের কথা। ওগুলো তাও কোট আনকোট সরকারি বিজ্ঞাপন নয়। গত এক দশকে সরকারের বিজ্ঞাপন দেওয়ার বহর কীভাবে বেড়েছে তার একটা ধারণা দিই। এগুলো সবই অতিমারীর আগের হিসাব। পরেরগুলো আসতে এখনো সময় লাগবে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে একজন তথ্যের অধিকার আইন (মানে রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট) অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সরকার সংবাদমাধ্যমে কত টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। উত্তরে সরকার জানায় এপ্রিল ২০১৪ থেকে অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত অঙ্কটা ছিল ৩,৭৫৫ কোটি টাকা। ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের ভাগে ১,৬৫৬ কোটি আর ছাপা কাগজে বা পত্রিকায় ১,৬৯৮ কোটি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিল্লি সরকার, মানে আম আদমি পার্টির সরকার। তারা শুধু ২০১৫ সালেই ৫২৬ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল।

তা এতগুলো টাকার বিজ্ঞাপনের মায়া ত্যাগ করে কোন সংবাদমাধ্যম সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন খবর করবে? পশ্চিমবঙ্গের কথা বেশি বলব না। কারণ এখান থেকে আবার বাড়ি ফিরতে হবে তো, বিপ্লব মন্ডল করে দিলে মুশকিল। গতবছর একসঙ্গে চারটে রাজ্য আর একটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, মানে পুদুচেরিতে, ভোট হয়েছিল। তার মধ্যে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় এক নম্বরে ছিল আমাদের রাজ্য। প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা খরচ করেছিল এই রাজ্যের দলগুলো। প্রায় ১ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা খরচ করে শীর্ষে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মত বা তার চেয়েও বেশি করে কীভাবে সোশাল মিডিয়া ভোটারদের প্রভাবিত করে তা নিয়ে একটা আলাদা আলোচনা করা যায়, তার মধ্যে যাচ্ছি না।

বিজ্ঞাপন দিয়ে মিডিয়াকে কিনে নেওয়ার কাজটা কিন্তু শুধু সরকার করে না, কর্পোরেটও করে। আর আমাদের দেশে তো ক্রমশ যাহা কর্পোরেট তাহাই সরকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে কোনো কাগজ যেমন সরকারের সমালোচনার মধ্যে যায় না, চ্যানেলগুলো যেমন দিনরাত প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীদের গুণগান করতে ব্যস্ত থাকে, তেমনি শিল্পপতিদের কুকীর্তিও প্রকাশ করা যায় না। শুধু তা-ই নয়, কাগজের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত কোথাও আপনি কারোর সমালোচনা করতে পারবেন না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এখন তো আইপিএলের দেখাদেখি অনেকগুলো খেলাতেই ওরকম আলো ঝলমলে লিগ হয়। আমার ডিপার্টমেন্টের এক জুনিয়রকে সেরকম একটা লিগ কভার করতে পাঠানো হয়েছিল। সে সেখান থেকে একটা কপি ফাইল করল, যে এখানে বাজনা তো প্রচুর, কিন্তু খাজনা নেই। মানে লোকে সেভাবে খেলা দেখতে আসছে না, গ্যালারি রোজই খালি থাকছে। এই কপি পাতায় বসে যাওয়ার পর ফেলে দিতে হয়েছিল। কারণ আমার কাছে উপরতলা থেকে ফোন এল, ওই লিগ কাগজকে কোটি পাঁচেক দিয়েছে। অতএব তাদের খামতি-টামতি লেখা যাবে না।

মানে বুঝতেই পারছেন, টাকা দিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা যদি রাজনীতিতে একবার চালু হয়ে যায়, তাহলে সব ক্ষেত্রেই সেটা চলে। অগণতান্ত্রিকতা, অসহিষ্ণুতাও তাই এখন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র। শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতা নেত্রী নয়, বিরাট কোহলি পর্যন্ত অপ্রিয় প্রশ্ন শুনলে রেগে যান। আজকাল খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকার নেওয়া মানে হচ্ছে, আগে থাকতে প্রশ্নগুলো দলের মিডিয়া ম্যানেজারের কাছে জমা দিতে হবে। তিনি যে প্রশ্নগুলো করতে অনুমতি দেবেন কেবল সেগুলোই জিজ্ঞেস করা যাবে। মানে ফিক্সড ইন্টারভিউ ব্যাপারটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে।

এই যে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ – এটাই আজকের সাংবাদিকতার অভিনব অন্ধকার। আগে কি এমন হত না, যে কোনো সাংবাদিক কোনো শিল্পপতির থেকে ঘুষ নিয়ে তাঁর সম্পর্কে বা তাঁর ব্যবসা সম্পর্কে ভাল ভাল কথা লিখলেন, বা লেখা উচিত এমন কোনো খবর লিখলেন না? বিলক্ষণ হত। রাজনৈতিক নেতারা, প্রশাসনের মাথারা, মন্ত্রীরা, অভিনেতারা – অনেকেই এ কাজ করাতেন। অনেকসময় ঘুষ দিয়েও করাতে হত না এগুলো, স্রেফ প্রভাব খাটিয়ে বা সাংবাদিকের সাথে খাতিরের জোরে করানো হত। কিন্তু সেগুলো চুপিচুপি করা, কোনো কোনো সাংবাদিক করতেন। কাজটার পেশাগত স্বীকৃতি ছিল না। এখন কিন্তু আর সাংবাদিক একা একা দুর্নীতি করতে পারেন না। এখন তাঁর কাগজ বা তাঁর চ্যানেল সরাসরি নির্দেশ নেয় ক্ষমতাশালীদের কাছ থেকে। দরাদরিও করে। ফলে কোনো সাংবাদিক সৎ সাংবাদিকতা করতে গেলে একলা হয়ে যাবেন। চুপচাপ ঘাড় নীচু করে কর্তৃপক্ষ যা বলছেন তাই করে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অন্যথায় চাকরি চলে যাবে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাণও যেতে পারে।

আর সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে যে একতা ছিল, সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে। আগে একজন সাংবাদিককে কেউ আক্রমণ করলে শুধু তাঁর সংস্থা নয়, সমস্ত সংস্থার সাংবাদিক পাশে দাঁড়াত। কারণ প্রতিযোগিতা ছিল খবর করা নিয়ে, ক্ষমতাশালীর প্রিয়পাত্র হওয়া নিয়ে নয়। এখন সাংবাদিক হয়ে গেছেন গৌণ, খবর করা নিয়ে প্রতিযোগিতাও স্তিমিত। কারণ প্রতিযোগিতাটা এখন সরকার আর বিরাট পুঁজিওলা লোকেদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার। সেই প্রতিযোগিতা তো মিডিয়া হাউসগুলোর মধ্যে, সাংবাদিক সেখানে বোড়ে মাত্র। সাংবাদিককে দরকারই নেই, দরকার ম্যানেজার। সেই কারণে অতিমারীর অজুহাতে গোটা দেশের অসংখ্য বড় কাগজ অনেকগুলো সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে, কাগজ আর চ্যানেলগুলো প্রচুর সাংবাদিক ছাঁটাই করেছে। মালিকদের দরকার বাধ্য লোক। তারা অযোগ্য হলেও কোনো অসুবিধা নেই, বরং সুবিধা। কারণ সাধারণত অযোগ্য লোকের পোষ মানার তাগিদ বেশি হয়। এর মধ্যে যোগ্য লোক যাঁরা টিকে আছেন, তাঁদের নিজেদের যোগ্যতা জোর করে ভুলে টিকে থাকতে হচ্ছে। আপনি হয়ত সকালের কাগজে একগুচ্ছ ভুল দেখে বা টিভির খবরে ভুলভাল, হাস্যকর আলোচনা দেখে মন খারাপ করছেন। ভাবছেন ছি ছি! এই কাগজটা কোথায় ছিল, কোথায় নামল! ভুল করছেন, কোত্থাও নামেনি। আপনি সকালে যেটা হাতে পাচ্ছেন সেটা আসলে একটা রসিদ। কার রসিদ? যে বা যারা নিজের পছন্দের খবর ছাপাতে টাকা দিয়েছে তাদের রসিদ। মানে বিরাট বিরাট স্পনসর এসে পড়ার আগের যুগে পাড়ার দুর্গাপুজোর সুভেনির হত না? সেই জিনিস। আপনি মাস গেলে কাগজওলাকে টাকা দিলেন মানে আসলে কাগজে যারা বিজ্ঞাপন দেয় তাদের আপনি ভর্তুকি দিলেন। টিভির পর্দায় যা দেখছেন তা-ও ইলেকট্রনিক রসিদ। জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, খবর হচ্ছে সেটাই যেটা কেউ একজন চায় না প্রকাশিত হোক। বাকি সব হচ্ছে পাবলিক রিলেশন।

তা পাবলিক রিলেশন তো আর পাবলিকের স্বার্থে করা হয় না। পাবলিককে সম্মোহিত করে রাখার জন্য করা হয়। সেটাই করা হচ্ছে। আপনার দরকার চাকরি, আপনাকে আমি পড়াচ্ছি অমুক নেতার তমুকের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের রসালো কাহিনি। তাঁরা পয়লা বৈশাখে ছাদে নাচ করলেন, গরমের ছুটিতে কাশ্মীর বেড়াতে গেলেন। আপনি দেখছেন সবজি মাছ মাংস সবকিছুর আগুন দাম, ২০১৪ সালে যে দামে দুটো গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যেত এখন সে দামে একটা পাওয়া যাচ্ছে। আমি আপনাকে দেখাচ্ছি কী? না তাজমহল কি আসলে তেজো মহালয় ছিল? কারণ ওটা করার জন্যই আমার কাগজ বা আমার চ্যানেল বিজ্ঞাপন, এবং পেড নিউজ, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ঘুষ, পাচ্ছে। সরকারের অকর্মণ্যতা নিয়ে খবর করতে গেলে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

এর সঙ্গে আরও একটা বিপদ আছে। বিরাট বিপদ। কমলে কামিনী জানেন তো? ওই যে চণ্ডীমঙ্গলে ছিল? একজন মহিলা পদ্মফুলের উপর বসে আস্ত আস্ত হাতি গিলে ফেলছে? ওইভাবে পদ্মফুলের উপর বসে মুকেশ আম্বানি একের পর এক ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে গিলে ফেলছেন। এমন প্রায় কোনো সংবাদমাধ্যমের নাম আপনি ভেবে উঠতে পারবেন না, যেখানে তাঁর অন্তত কিছুটা অংশীদারিত্ব নেই। নিজেদের হাতে তৈরি সিএনএন-আইবিএন ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল রাজদীপ সরদেশাই আর তাঁর স্ত্রী সাগরিকা ঘোষকে। কারণ রাঘব বহলের থেকে ওটা কিনে নিয়েছিল রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। ওই নেটওয়ার্ক এইট্টিন গ্রুপের যত চ্যানেল, যত ওয়েবসাইট সবই এখন মুকেশের সম্পত্তি। তাছাড়াও অজস্র সংবাদমাধ্যমে তিনি নানা মাত্রায় আছেন। এমনকি SEBI (মানে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া)-র রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সম্ভবত এনডিটিভিরও ৫২% শেয়ার এখন মুকেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মহেন্দ্র নাহাতার। ভারতীয় মিডিয়া ইতিমধ্যেই অভিজাততন্ত্রে পরিণত হয়েছে, ক্রমশ আক্ষরিক অর্থে মনোপলির দিকে এগোচ্ছে। এইসব কারণে, লক্ষ করুন, আমি যে অসমসাহসী সাংবাদিকদের নাম করলাম প্রথম দিকে, তাঁরা কেউ আপনাদের জানা কোনো সংবাদমাধ্যমের কর্মী নন। কেউ স্থানীয় কাগজের কর্মচারী, কারোর একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে, কেউ শুধু একটা ফেসবুক পেজ চালান। নির্ভীক সাংবাদিকতা আজকের ভারতে এই মানুষগুলোই করছেন।

কী করে পারছেন? এর উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আজকের আলোচনার বিষয়ের দ্বিতীয় অংশটার উত্তর। কী করণীয়?

এই মুহূর্তে ভারতে সত্যিকারের সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝায়, কয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেটা করার একমাত্র জায়গা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিকল্প সংবাদমাধ্যম (alternative media)। কয়েকটা নাম আমরা সবাই জানি – দ্য ওয়্যারনিউজক্লিকনিউজলন্ড্রিকুইন্ট ইত্যাদি। এরা অনেকেই স্থানীয় স্তরের যে লড়াকু সাংবাদিকরা এতদিন বিভিন্ন বড় সংবাদমাধ্যমে নামমাত্র পারিশ্রমিকে দারুণ কাজ করতেন, তাদের কিছুটা বেশি টাকা দিয়ে খবর কেনে। সরকারবিরোধী, কর্পোরেটবিরোধী খবর এরা করে উঠতে পারে কারণ এই ওয়েবসাইটগুলো চলে মূলত সাবস্ক্রাইবারদের টাকায়, বিজ্ঞাপনের টাকায় নয়। বাংলায় কিন্তু এই ব্যাপারটা এখনো সেভাবে চালু হয়নি। না হওয়ার জন্য আপনি, আমি সবাই খানিকটা দায়ী। হয়নি বলে পশ্চিমবঙ্গে যে নিউজ সাইটগুলো আছে, তার অনেকগুলোই কনটেন্টের দিক থেকে বিকল্প নয়।

আমি শুধু বিজ্ঞাপনের কথা বলেছি, পেড নিউজের মধ্যে ঢুকিনি। কারণ সেটা আবার নিজেই একটা আলাদা বিষয়। এ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথের দারুণ কাজ আছে। এমনিতে আজকাল সংবাদমাধ্যমকে টাকা দিয়ে আপনি করাতে পারবেন না এমন কাজ নেই। ২০১৮ সালে কোবরাপোস্ট একটা স্টিং অপারেশন করেছিল। তাতে কোবরাপোস্টের প্রতিনিধিরা একটা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধি সেজে ভারতের অনেকগুলো বড় বড় মিডিয়া হাউসের কর্তাদের কাছে গিয়েছিলেন। প্রস্তাব ছিল, আমরা টাকা দেব, সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর করতে হবে এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা হয় এমন খবর করতে হবে, নানারকম ইভেন্টের আয়োজন করতে হবে। দুটো মাত্র মিডিয়া হাউস রাজি হয়নি – পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ।

এই অন্ধকারের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কেন নেমে এল এই অন্ধকার? ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার চেয়েও ঘন এই অন্ধকার কেন আটকাতে পারল না সংবাদমাধ্যম? দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান তো শুধু ভারতে হয়নি। পৃথিবীর দুটো প্রাচীন গণতন্ত্র – ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – দু জায়গাতেই ঘোর দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে গত এক দশকে। সেখানে মিডিয়ার এ অবস্থা হয়নি তো।

ইন্টারনেটে ইংল্যান্ডের কাগজগুলো পড়ে দেখুন, রোজ তুলোধোনা করছে বরিস জনসনকে। সরকার তাদের কিচ্ছুটি করতে পারে না। মাসখানেক আগেই দেখলাম আইটিভির একজন সাংবাদিক মুখোমুখি বসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর লাইভ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ভদ্রমহিলার বয়স আমাদের নাভিকা কুমারের মতই হবে। কিন্তু তিনি এমন সব প্রশ্ন করছিলেন, যে জনসনবাবু পালাতে পথ পাচ্ছিলেন না। একবার আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলেন, আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব আমি করছি। মহিলা সটান বলে দিলেন, না, করছেন না। তারপর তথ্যপ্রমাণও দিয়ে দিলেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নিউইয়র্ক টাইমস তাদের ‘ওপিনিয়ন’ নামে যে বিভাগটা আছে তাতে ‘ট্রাম্প’স লাইজ’ শিরোনামে পুরো পাতা জুড়ে একটা লেখা ছেপেছিল। কী ছিল সেই লেখায়? কিচ্ছু না। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যত মিথ্যে কথা বলেছেন তার তালিকা, সঙ্গে সত্যিটা কী – সেইটা। আমরা কি স্বপ্নেও ভাবতে পারি ভারতের কোনো কাগজে ‘মোদী’জ লাইজ’ বলে একটা পাতা বেরোবে? যে দু-একটা কাগজ এখনো ধারাবাহিকভাবে সরকারবিরোধী খবর করে – ধরুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বা বেঙ্গালুরুর ডেকান হেরাল্ড, কি কলকাতার টেলিগ্রাফ – তারাও পেরে উঠবে না। আবার দেখা যায় এরাও নিজের রাজ্যের সরকারের ব্যাপারে অনেকসময় নরম। কারণ সকলেরই ক্ষমতার সীমা আছে। কদিন পরপরই দেখবেন খবর হয় – এনডিটিভির প্রণয় রায়, রাধিকা রায়ের পাসপোর্ট সিজ করা হয়েছে। বা দ্য ওয়্যারের অফিসে ইডির রেড, অথবা নিউজক্লিকের কর্ণধারকে টানা ছ ঘন্টা জেরা। তাছাড়া অবাধ্য সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের নামে কথায় কথায় মানহানির মামলা, থানায় ডেকে পাঠিয়ে হয়রানি – এসব চলতেই থাকে। উপরন্তু যে মানিকজোড় ক্রমশ ভারতের সব শিল্পের দখল নিচ্ছেন, তাঁদের অন্য জোড়টি, গৌতম আদানি, তিনিও মৃদুমন্দ গতিতে মিডিয়া জগতে ঢুকে পড়ছেন। কুইন্টের মাইনরিটি স্টেক কিনেছেন সদ্য। সুতরাং বিকল্প সংবাদমাধ্যমও যে আমাদের সময়ের আলো হয়ে বেশিদিন টিকতে পারবে, এমন ভরসা করা যায় না।

তাহলে কী স্মরণীয়? কী করণীয়?

প্রথমেই আমাদের মধ্যে গেড়ে বসে থাকা একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণাকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। আমরা ছোট থেকে শুনে এসেছি যে আইনসভা (মানে সংসদ, বিধানসভা, বিধান পরিষদ ইত্যাদি), প্রশাসন (মানে পুলিস, আমলা প্রমুখ), বিচারব্যবস্থার (মানে আদালত) পর সংবাদমাধ্যম হল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। খবরের কাগজ হল “people’s Parliament always in session” – এরকমও বলা হয়েছে। এখন বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে, যে এগুলো একদম ভুল। আসলে সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ নয়, গণতন্ত্রই সংবাদমাধ্যমের একমাত্র স্তম্ভ। গণতন্ত্র শক্তিশালী হলে সংবাদমাধ্যম শক্তিশালী হয়, গণতন্ত্র ধসে পড়লে সংবাদমাধ্যমও ধসে পড়ে।

ইংল্যান্ড, আমেরিকার সাংবাদিকরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছেন কারণ বাম, মধ্য, ডান যে-ই ক্ষমতায় আসুক; ওখানকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এত শক্তিশালী, যে একটা স্তরের বেশি বেয়াদপি করা যায় না। আপনার দেশের রাজনীতি নীতিহীনতা, দুর্নীতি আর মানুষ-মারা আদর্শের স্বর্গরাজ্য হয়ে যাবে আর সংবাদমাধ্যম একা কুম্ভ হয়ে গণতন্ত্রের গড় রক্ষা করবে – এ হয় না। আপনার সমাজ সংখ্যালঘুর রক্ত চাইবে আর টিভি চ্যানেলগুলো রেডিও রোয়ান্ডা হয়ে উঠবে না – এ অসম্ভব।

আমেরিকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দেখুন আর ভারতের বিরোধী শক্তিগুলোকে দেখুন। আমেরিকার ডেমোক্র্যাট নেতারা রাহুল গান্ধীর মত ট্রাম্পের সাথে লড়াই করতে করতে আচমকা ইউরোপে ছুটি কাটাতে চলে যেতেন না। ওখানে আমাদের এখানকার মত ঘোষিত মার্কসবাদীদের সংখ্যা এবং শক্তি – দুটোই নগণ্য। কিন্তু ডেমোক্র্যাট দলের বামপন্থী বার্নি স্যান্ডার্স, আলেক্সান্দ্রা ওকাসিও কর্তেজরা যে লড়াই দিয়েছিলেন, এখনো দিচ্ছেন, তার ফলে ট্রাম্পপন্থী লোকেরা তো বটেই, এমনকি ডেমোক্র্যাটদের ভিতরের দক্ষিণপন্থীরাও কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। অসংখ্য দলে বিভক্ত ভারতের বামপন্থীদের তো তার চেয়ে অনেক বেশি জোরদার লড়াই দেওয়ার কথা। কিন্তু পারছেন কই? বুলডোজারের সামনে সিপিএমের বৃন্দা কারাতের সঙ্গে নকশাল নেতা রবি রাইও দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। যেখানে সম্ভব সেখানেই স্বৈরাচারী শাসকের বুলডোজারের সামনে যদি ওঁরা ওইরকম ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারেন, তাহলে কিছুটা লড়াই হতে পারে। কিন্তু এ দেশের কমিউনিস্টদের অনেকটা সময় এবং উদ্যম নষ্ট হয় কে কার চেয়ে বেশি কমিউনিস্ট তার চুলচেরা হিসাব করতে গিয়ে।

আর যে আঞ্চলিক দলগুলো আছে, তাদের মধ্যে লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ছাড়া প্রায় সকলেই কখনো না কখনো বিজেপির সাথে ঘর করেছে, ক্ষমতায় থাকাকালীন চরম দুর্নীতির ইতিহাসও আছে। তাছাড়া তাদের নেতা-নেত্রীদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ্রহ যতখানি, আরএসএসের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে নামার আগ্রহ ততখানি নয়। বরং রামনবমী পালন, মন্দির বানানো, বিভিন্ন পুজোর আয়োজনে বিজেপির চেয়ে বেশি বিজেপি হওয়ার প্রতিযোগিতায় তারা বেশি স্বচ্ছন্দ। সংখ্যালঘুদের ত্রাতার অভিনয় করে ক্ষমতায় এসে দাঙ্গাবাজদের দলের টিকিটে উপনির্বাচনে দাঁড় করাতে তাদের কোথাও বাধে না। ফলে অবাধে মসজিদের কুয়ো থেকে শিবলিঙ্গ উদ্ধার চলছে। গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত আমাদের চোখের সামনে ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। সে ইতিহাস অবশ্য পড়বে না আমাদের ছেলেমেয়েরা। তারা পড়বে হলদিঘাটের যুদ্ধে রাণাপ্রতাপের সেনাবাহিনী আকবরের বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিল। তারা ভগৎ সিং পড়বে না, পড়বে আরএসএসের প্রথম সঙ্ঘচালক কেশব বলিরাম হেড়গেওয়ারের বক্তৃতা।

এমতাবস্থায় সাংবাদিকতার অন্ধকার কাটানো অসম্ভব। সে অন্ধকার কাটবে তখনই, যখন ভারত আবার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ হবে।

কী করে হবে সেটা? মোডাস অপারেন্ডি যদি আমার জানা থাকত, তাহলে আমি আজ এখানে এসে আপনাদের সামনে এতক্ষণ ধরে বক্তৃতা দিতাম না। কাজটা করতে নেমে পড়তাম। কিন্তু আমি জীবনে একদিনও সক্রিয় রাজনীতি করিনি, আর এই কাজটা রাজনীতির লোকেদেরই কাজ। তাঁদেরই করতে হবে। এখানে আমি রাজনীতি বলতে দলীয় রাজনীতির কথা বলছি, সরকার পরিবর্তনের কথা বলছি। কিন্তু আমার ধারণা, যে অন্ধকারে ভারতবর্ষ প্রবেশ করেছে তার থেকে মুক্তি স্রেফ সরকার পরিবর্তন হলেই হবে না। সেই কারণেই আমরা যারা দলীয় রাজনীতির বাইরের লোক, তাদেরও সেতুবন্ধনে কাঠবিড়ালির ভূমিকা নিতে হবে বলে আমার মনে হয়।

তার জন্যে প্রথমেই আমাদের নিজেদের রাজনৈতিক করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক করে তোলা মানে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া নয়। সে কেউ প্রয়োজন বোধ করলে যোগ দিতেই পারেন। কিন্তু যেটা অবশ্যই করা দরকার সেটা হল কাজকর্মে, জীবনচর্যায় রাজনৈতিক হওয়া। এই ব্যাপারটায় অন্তত এই মুহূর্তে ভারতের ফ্যাসিবাদীরা বামপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে।

একটা উদাহরণ দিই, তাহলেই বোঝা যাবে কথাটা। এই কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়া তোলপাড় হয়ে গেল একজন রেডিও জকির একটা মন্তব্য নিয়ে। তা উনি যে চ্যানেলের বিতর্কসভায় গিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন, সেই চ্যানেলটা আমি দেখি না। কারণ ওটা যে খবরের চ্যানেল নয়, ফ্যাসিবাদীদের প্রোপাগান্ডা চ্যানেল সেটা অনেকদিন আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে এবং তারাও এটা গোপন করার চেষ্টা করে না। কিন্তু একটা লেখার জন্য আমার ওই ক্লিপটা, যেখানে ওই ভদ্রমহিলা বিতর্কিত কথাগুলো বলেছেন, সেটা দেখার দরকার পড়েছিল। ওই কয়েক মিনিটের ক্লিপে আমার দুজনকে চোখে পড়ল যাঁরা ঘোষিত ফ্যাসিবিরোধী। একজন নামকরা অধ্যাপক, আরেকজন বিখ্যাত সাহিত্যিক। তা আমি যদি ফ্যাসিবাদীদের প্ল্যাটফর্মকে বয়কট করার মত সামান্য কাজটুকুও করতে না পারি, তাহলে আমি কিসের ফ্যাসিবিরোধী? ওঁরা তো তবু দলীয় রাজনীতির বাইরের লোক। তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম ইত্যাদি যেসব দল ঘোষিত আরএসএস বিরোধী – অবশ্য, তৃণমূল সম্পর্কে না জেনে ওই শব্দটা প্রয়োগ করা হয়ত আমার উচিত হচ্ছে না।। কারণ গত বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভে রাহুল কাঁওয়ালকে বলেছিলেন তাঁর বিজেপিকে নিয়ে সমস্যা, তিনি সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়ছেন না। কারণ তারা ভোটে লড়ে না (এই ভিডিওতে ১৩ মিনিট ১১ সেকেন্ড থেকে)। যা-ই হোক, কথা হচ্ছে বিজেপিবিরোধী দলের প্রতিনিধিরাই বা ওই চ্যানেলে কী প্রত্যাশা নিয়ে যান? কেন বয়কট করতে পারেন না? আমাদের মত সাধারণ মানুষ তো ওঁদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ওঁরা কিন্তু বুঝতেই পারছেন না, যে এই বয়কটটা একটা দরকারি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তই যদি না নেওয়া যায়, তাহলে গণতন্ত্রকে কী করে বাঁচাব আর ফ্যাসিবাদকে কী করে হারাব? লক্ষ করে দেখবেন, কোনো বিজেপি নেতা তো বটেই, দলীয় রাজনীতির বাইরের কোনো দক্ষিণপন্থীও রবীশ কুমারের শোতে যায় না, ওয়্যার বা নিউজক্লিকে লেখে না।

আসলে গত তিরিশ বছরে আমাদের সকলেরই যে সত্তাটা সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সেটা হল ক্রেতা সত্তা। ফলে আমাদের চিন্তাভাবনাও হয়ে গেছে ব্র্যান্ড নির্ভর। কোনটা রাজনীতি আর কোনটা স্রেফ দলাদলি সেটা ভুলে গেছি। আমাদের মধ্যে এক ধরনের অরাজনৈতিক পার্টিজানশিপ তৈরি হয়েছে, যা আসলে হয়ত ব্র্যান্ড নির্ভরতা। আমরা ভাবছি একটা মতাদর্শ মানে একটা ব্র্যান্ড। আর ব্র্যান্ডেড জিনিসের তো একটাই এক্সক্লুসিভ বিক্রেতা থাকে। ফ্যাসিবাদ ব্র্যান্ডের বিক্রেতা হল বিজেপি, মার্কসবাদ ব্র্যান্ডের বিক্রেতা সিপিএম – এরকম আর কি। আমাদের রাজ্যে তো ব্র্যান্ড বুদ্ধ, ব্র্যান্ড মমতা – এই শব্দবন্ধগুলো অনেকদিন ধরেই চালু। এগুলো আমাদের অবচেতনেও কাজ করে। তো ব্র্যান্ড চেনা হয়ে গেলে আমরা কী করছি? কে কোন দলের সমর্থক আর আমি কোন দলের সমর্থক – তা দিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া ঠিক করছি এবং আমার ক্রিয়া বলে আর কিছু থাকছে না।

আপনার সাথে কোনো বিষয়ে আমার তর্ক হলে আমি আপনার যুক্তিগুলো মন দিয়ে শুনছি না, বোঝার চেষ্টা করছি না। যুক্তিগুলো খণ্ডন করে আপনাকে হারানোর চেষ্টা করছি না। আমি চট করে আপনার ফেসবুক প্রোফাইল দেখে জেনে নিচ্ছি কোন বিষয়ে আপনার কী প্রতিক্রিয়া ছিল, তা থেকে ঠিক করে নিচ্ছি আপনি কোন দলের লোক। তারপর আপনি আমার পছন্দের ব্র্যান্ডের লোক হলে আপনি অন্যায় বললেও একমত হয়ে যাচ্ছি, নাহলে ন্যায্য কথা বললেও ঝগড়া করছি। এয়ারটেল ভাল, না ভোডাফোন ভাল? এই নিয়ে যদি দুজন ঝগড়া করে, গালাগালির পর্যায়ে চলে যায়, আপনি দেখে হাসবেন তো? অথচ এটা কিন্তু সেই জিনিসই হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ ঠিক এটাই চায়।

অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ আর বাইরে নেই, আপনার ভেতরে আমার ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। এটাকে বার করতে হলে যেখানে সম্ভব সেখানেই ফ্যাসিবাদীদের সংস্রব ত্যাগ করতে হবে। কোনো ছোঁয়াচে রোগ হলে আমরা সকলের থেকে সরে থাকি দুটো কারণে। এক, যাতে রোগটা আরও ছড়াতে না পারে। দুই, যাতে আমার নিজের সংক্রমণ বেড়ে না যায়। আমাদের মারাত্মক ছোঁয়াচে ঘৃণার রোগ হয়েছে। এই রোগ তাড়াতেও আমাদের আগে ফ্যাসিবাদীদের সঙ্গে সমস্তরকম সম্ভাব্য সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে বলে আমার মনে হয়। কাউকে হয়ত বন্ধু ত্যাগ করতে হবে, কাউকে কোনো আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক তুলে দিতে হবে। কিন্তু কাজটা করতেই হবে। আমরা যে যার মত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলব আর এত বড় বিপদ থেকে দেশটা বেঁচে যাবে, আমরা আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব – এরকম ভাবনা অনৈতিহাসিক।

একবার আমারই কাছাকাছি বয়সের কয়েকজন পুরস্কারপ্রাপ্ত বাঙালি সাহিত্যিকের সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছিল। তাঁরা হিন্দি আগ্রাসন আটকাতে হবে বলে দিনরাত ফেসবুকে পোস্ট করতেন। অথচ নিজেদের ছেলেমেয়েকে বাংলা বই পড়ান না। সেদিনের আড্ডায় বললেনও “বাংলার চেয়ে হিন্দি পড়লে যদি বেশি লাভ হয়, তাহলে সন্তানকে আমি হিন্দিই পড়াব। বাংলা কেন পড়াব?”

এরকম ভণ্ডামি করে কোনোদিন ফ্যাসিবাদীদের হারানো যায়নি। কেবল প্রতিক্রিয়া দিয়ে পৃথিবীর কোনো দেশে গণতন্ত্র রক্ষা হয়নি। ক্রিয়া দরকার। কীরকম ক্রিয়া? আমি ডাক দিলে তো এক হাজার লোক জড়ো হবে না, যে একটা মিছিল কি মিটিং করব? কিন্তু মিছিল, মিটিংয়ে যেতে তো পারব। অন্তত সেটুকু করি। যদি আমি লিখলে পাঁচজন লোক পড়ে, তাহলে একটু লিখি। যদি বললে আপনাদের মত কিছু লোক শোনে, তাহলে একটু বলি। যে কবিকে আমরা ঠাকুর বানিয়ে শিকেয় তুলে ভুলে গেছি এবং যাঁর জন্মদিনে আমরা কোনো কেলেঙ্কারি করতেই বাকি রাখি না, সেই কবি লিখেছিলেন

কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।”

এই মাটির প্রদীপের কাজটা আমরা করতে পারি। ভীষণ ক্লান্তিকর, হতাশায় ডুবিয়ে দেওয়ার মত কাজ কিন্তু। কারণ চারপাশের অন্ধকার এত গাঢ়, রাতটা এত দীর্ঘ যে মাঝে মাঝে মনে হবে একটা অন্ধকার অট্টালিকায় আপনি একা প্রদীপ হয়ে জ্বলছেন। এই হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্যে একটু আশার বাণী আমি শোনাতে পারি আগাথা ক্রিস্টির লেখা থেকে। দ্য পেল হর্স উপন্যাসের এক জায়গায় কয়েকটা চরিত্র ‘ইভিল’-এর ধরন ধারণ নিয়ে আলোচনা করছিল। সেখানে একটা চরিত্র বলে, যে হিটলারের মত লোকেরা ইভিল হলেও নিশ্চয়ই তাদের বিরাট ব্যক্তিত্ব ছিল। পরে যখন অপরাধী ধরা পড়ে, দেখা যায় লোকটা নেহাত ফালতু। তখন এক পুলিস অফিসার বলেন “Evil is not something superhuman, it’s something less than human. Your criminal is someone who wants to be important, but who never will be important, because he’ll always be less than a man.”

সাংবাদিক পরিচয়ে এতগুলো কথা বললাম। ফলে কেউ এই প্রশ্নটা তুলতেই পারেন, যে আমার তো নিরপেক্ষ হওয়ার কথা। আমি পক্ষ নিচ্ছি কেন? সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ হওয়া উচিত, এই ধারণাটাকেও বাতিল করা দরকার। এ দেশে কথাটা খোলাখুলি বলা হয় না এখনো, সবরকম পক্ষপাতদুষ্ট কাজ নিরপেক্ষতার ভান বজায় রেখে করা হয়। কিন্তু সেই ১৯৪২ সালে আমেরিকায় হাচিন্স কমিশন বলে একটা কমিশন তৈরি করা হয়েছিল। তার কাজ ছিল আধুনিক গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নির্ধারণ করা। ১৯৪৭ সালে সেই কমিশন রিপোর্ট দেয়। সেই রিপোর্টে “factually accurate but substantially untrue” প্রতিবেদন লেখার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। কথাটা কেমন পরস্পরবিরোধী মনে হচ্ছে না? ঘটনা হিসাবে নিখুঁত হলে আবার অসত্য হবে কী করে?

২০২০ সালের অগাস্ট মাসে আমেরিকান প্রেস ইনস্টিটিউটের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর টম রোজেনস্টিয়েল ট্রাম্পের আমলে উত্তর-সত্যের (post truth) মোকাবিলা কীভাবে করতে হবে সেটা বলতে গিয়ে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন ধরুন, আমি নিও নাজিদের বলা একগাদা কথা রিপোর্ট করেছি, যেটা ঘটনা হিসাবে নিখুঁত। মানে তারা সত্যিই এই কথাগুলো বলেছে। কিন্তু যা বলেছে, সেগুলো ডাহা মিথ্যে। তার মানে আমি কী করলাম? আমি মিথ্যে কথাগুলোকে নিখুঁতভাবে রিপোর্ট করলাম। আমি যদি রিপোর্টে না বলি যে এগুলো সব মিথ্যে কথা, তাহলে তো সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো হবে না। অথচ সত্য উদ্ঘাটন করাই তো সাংবাদিকের কাজ।

আমি মাস দুয়েক আগে অল্টনিউজের কর্ণধার প্রতীক সিনহার সাক্ষাৎকার নিলাম। উনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, সমাজে ঘৃণার এমন চাষ হয়েছে যে স্রেফ কোনটা ভুয়ো খবর আর সত্যিটা কী, সেটা বলে দিয়ে কাজ মিটছে না। কারণ আমরা ফেক নিউজ থেকে হেট স্পীচের স্তরে পৌঁছে গেছি।

সুতরাং সাংবাদিককে এখন পক্ষ নিতেই হবে। প্রাইম টাইম নিউজে যারা ঘৃণা ছড়ায় তারা মিথ্যার পক্ষ নিয়েছে, আমি সত্যের পক্ষ নিলাম।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

তীব্র মেরুকরণ হওয়া সমাজে ফ্যাক্ট চেকিং যথেষ্ট নয়: প্রতীক

স্কুল স্তর থেকে অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে অল্টনিউজ পশ্চিমবঙ্গে

সম্প্রতি অল্টনিউজের কর্ণধার প্রতীক সিনহা সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা করেছেন, তিনি কলকাতার বাসিন্দা হয়েছেন। অল্টনিউজ এবার পশ্চিমবঙ্গেও কাজ করবে। হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের কারণ কী? এ কি কোনো স্বল্পমেয়াদি সিদ্ধান্ত, নাকি এর পিছনে আছে দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা? নাগরিক ডট নেটের প্রতীককে জানালেন অল্টনিউজের প্রতীক।

নাগরিক: প্রথমেই পশ্চিমবঙ্গে আপনাকে এবং অল্টনিউজকে স্বাগত জানাই। সেইসঙ্গে একটা অনুযোগও করব। আমাদের কিন্তু অল্টনিউজকে গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে বেশি দরকার ছিল। কারণ নির্বাচনের সময়ে ভুয়ো খবরের উপদ্রব বড্ড বেড়ে যায়। তাই আমার প্রথম প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলায় অল্টনিউজকে বিস্তৃত করার সিদ্ধান্তটা এই সময়ে কেন নেওয়া হল?

প্রতীক: আমার মনে হয় আমাদের পশ্চিমবঙ্গে আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা ভুল ধারণা থেকে এই অনুযোগটা তৈরি হয়েছে। দেখুন, ভুয়ো খবরের উপদ্রব দেশের সব ভাষাতেই সমান। অথচ আমরা একটা ক্রাউড ফান্ডেড ছোট স্টার্ট-আপ। সব রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তো আমাদের কলকাতায় আসার কারণ এটা নয় যে পশ্চিমবঙ্গ ভুয়ো খবরের সবচেয়ে বড় টার্গেটগুলোর অন্যতম। আমাদের উদ্দেশ্যটা একটু বিশদে বলি?

 নাগরিক: নিশ্চয়ই…

প্রতীক: অল্টনিউজ চালু হয়েছে পাঁচ বছর হল। যারা এটা চালু করেছিল তারা নানারকম কাজের লোক। আমি যেমন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লোক। আগের পনেরো বছর আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারই ছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে এই কাজটায় এসেছি সামাজিক প্রভাব আছে এমন কিছু করব ভেবে। আমরা যারা অল্টনিউজ শুরু করেছিলাম, সকলেই চাইতাম আমাদের নিজেদের যে পারদর্শিতাগুলো আছে, সেগুলোকে সমাজের কাজে লাগাব। আর আমরা দেখেছিলাম যে ভারতীয় সাংবাদিকতায় ক্রস ডিসিপ্লিন বিশেষজ্ঞ বলে কিছু নেই। মানে ধরুন, যিনি বিজ্ঞান নিয়ে সাংবাদিকতা করেন, তাঁর কিন্তু বিজ্ঞানের ডিগ্রি নেই। বা টেক জার্নালিস্টের প্রযুক্তির ডিগ্রি নেই। আমরা বুঝেছিলাম, আমাদের যার যা টেকনিকাল জ্ঞান, সেগুলো ব্যবহার করে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এমন একটা জিনিস করতে পারি যা সেই সময়ে অন্তত এ দেশে আর কেউ করছিল না। ২০১৭ সালে আমরাই প্রথম এ দেশে মিথ্যা তথ্য চিহ্নিত করার কাজটা শুরু করি। কিন্তু সেটুকুই আমাদের লক্ষ্য ছিল না। আমরা আশা করেছিলাম সামগ্রিকভাবে সমাজে ভুয়ো তথ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারব।

কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, সমস্ত বড় বড় ইস্যুতে ভুয়ো খবর, মিথ্যা তথ্যকে চিহ্নিত করতে এত পরিশ্রম করি আমরা… এখন আরও অনেক সংগঠন করে… তা সত্ত্বেও কিন্তু সমাজে কোনো বদল আসেনি। সমাজ এখনো পাঁচ বছর আগের মতই মিথ্যা তথ্য গিলে চলেছে। বরং প্রতিদিন এগুলো বাড়ছে বললেও ভুল হয় না। তার ফলে সমাজে কী তীব্র মেরুকরণ হয়েছে আমরা দেখতেই পাচ্ছি। গত এক-দেড় বছরে আবার ভুয়ো খবর, মিথ্যা তথ্যের সাথে যুক্ত হয়েছে হেট স্পীচ। এ থেকে প্রমাণ হয়, এতদিন ধরে অসত্য গিলতে গিলতে সমাজ এতটাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে যে হেট স্পীচ হজম করতে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। ছ বছর আগেও যদি হরিদ্বার বা ছত্তিশগড়ের হেট স্পীচের মত ঘটনা ঘটত, অনেক বেশি মানুষ অবাক হতেন বা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।

ফলে আমরা বুঝতে পেরেছি, এই যে একের পর এক আর্টিকেল প্রকাশ করে যাচ্ছি, এটা যথেষ্ট নয়। আরও বেশি কিছু করা দরকার। উন্নততর প্রযুক্তি তো দরকার বটেই, তা নিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, মানুষকে এই ব্যাপারে শিক্ষিত করা বেশি জরুরি। আপনি ইউরোপের দিকে তাকান। বিশেষ করে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্কের মত দেশে ইতিমধ্যেই ভুয়ো খবর চিহ্নিত করা স্কুলের পাঠক্রমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানে ওরা এ সম্বন্ধে মানুষকে ছোট থেকে শিক্ষিত, সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছে; ব্যাপারটাকে স্রেফ সাংবাদিকতার ব্যাপার বলে ভাবছে না। আমরা ওই দিকে এগোতে চাইছি। পশ্চিমবঙ্গে আসার মূল উদ্দেশ্য এই দিকটা নিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি সাংবাদিকসুলভ যে কাজ আমরা পাঁচ বছর ধরে করছি সেটা তো করে যাবই।

নাগরিক: তা এই কাজ শুরু করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ উর্বর জমি বলে মনে হল কেন?

প্রতীক: এই কাজটা আমরা একটা ভৌগোলিক অঞ্চল বেছে নিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমরা দেখতে চাই যে একটা বড় অঞ্চলের মানুষকে ব্যাপকভাবে তথ্যসাক্ষর (information literate) বা মিডিয়াসাক্ষর (media literate) করে তোলা যায় কিনা। তা এটা করতে গেলে এমন একটা রাজ্য দরকার, যেখানকার সরকার আমাদের কাজটাকে সমর্থন না করলেও অন্তত আমাদের বিরোধিতা করবে না। সেদিক থেকে আমাদের তিনটে রাজ্যের কথা মাথায় ছিল — কেরালা, তামিলনাডু আর পশ্চিমবঙ্গ। এই কাজে রাজনৈতিক স্থিরতার গুরুত্বটা আশা করি বুঝতে পারছেন। মানুষকে এই ব্যাপারে শিক্ষিত করে তোলা তো দু-এক দিনের কাজ নয়, রাজনৈতিক বিরোধিতা সামলে দীর্ঘ সময় ধরে এটা করে যাওয়া মুশকিল। তো আমরা শেষমেশ এখানেই করব ঠিক করলাম, তার একটা বড় কারণ এই প্রোজেক্টটার মাথা আমি। আমি বাংলা ভাষাটা অন্তত বলতে পারি; তামিল, মালয়ালম পারি না। দ্বিতীয়ত, পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের, তেমনি আসামের, তেমনই বিহারের। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারের যে বিয়াল্লিশটা করে আসন, সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কেরালায় হয়ত আমাদের কাজের জমি কিছুটা তৈরি ছিল। কারণ ওখানকার সিপিএম সরকার স্কুলের পাঠক্রমে তথ্যসাক্ষরতার কোর্স চালু করবে বলে ঘোষণা করেছে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ অব্দি ভাষা আর রাজনৈতিক গুরুত্ব — এই দুটো কারণেই আমরা পশ্চিমবঙ্গকে বেছে নিলাম বলা যায়।

নাগরিক: এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা হয়েছে কি?

প্রতীক: না, এক্ষুণি সরকারের সাথে আলোচনা করার কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রথমে আমরা নিজেরা একটা কাঠামো দাঁড় করাতে চাই। কিছু এনজিও, প্রাইভেট স্কুল ইত্যাদির সঙ্গে কাজ করে আমরা আগে একটা পাঠক্রম তৈরি করতে চাইছি। সত্যি কথা বলতে, আমাদের এই কাজটা করতে করতেই শিখতে হবে কী করে কী করা যায়। কারণ আমার তো শিক্ষাজগতের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করছি। আমরা আপাতত এক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। আমি নিজে এই কদিন আগেই কিছু ক্লাস ইলেভেন, টুয়েলভের ছেলেমেয়েকে একটা ট্রেনিং কোর্স করালাম।

নাগরিক: ব্যাপারটা কতটা কঠিন হতে পারে বলে মনে হচ্ছে?

প্রতীক: ব্যাপারটা অনেকটাই অন্যরকম। যেমন ধরুন, ছোটদের তথ্য সংগ্রহ করা আর বড়দের তথ্য সংগ্রহ করার ধরনটা কিন্তু আলাদা। ফলে আমাদের এমন একটা পাঠক্রম তৈরি করতে হবে যেটা ছোটদের ভাল লাগবে। বড়দের যদি আমি রাজনৈতিক ভুয়ো খবর নিয়ে বলি, তাঁরা আগ্রহী হবেন। কিন্তু ছোটরা উৎসাহ পাবে না। সুতরাং আমাদের ভাবতে হবে কী করে এমন একটা পাঠক্রম তৈরি করা যায় যা ছোটদের টানতে পারবে, তথ্য সম্পর্কে তাদের আরও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারবে। যেসব দেশ এই কাজটা শুরু করে দিয়েছে তাদের কিছু কিছু পদ্ধতি আমরা নিশ্চয়ই অনুসরণ করতে পারি, কিন্তু বেশিরভাগটাই নিজেদের নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর সাথে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক তফাত বিস্তর। ধরুন ফিনল্যান্ডের সাক্ষরতার হার ৯৫%-এর আশেপাশে। তাদের মত করে এখানকার মানুষকে শেখাতে গেলে তো চলবে না। ফলে আমাদের পথ আমাদেরই আবিষ্কার করতে হবে।

নাগরিক: একটু পরিষ্কার করে নিই, তাহলে আপনারা এখানে মানুষকে তথ্যসাক্ষর করার কাজটা করবেন, কিন্তু অল্টনিউজ হিন্দির মত অল্টনিউজ বাংলা পরিষেবা চালু হচ্ছে না?

প্রতীক: না না, তা নয়। অল্টনিউজ বাংলা চালু হচ্ছে। কারণ এখানে মানুষকে তথ্যসাক্ষর করতে হলে শেখানোর ভাষাটা বাংলা হতেই হবে। একেবারে শিশু শুধু নয়, বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের কথা ভাবুন। আমি যদি তাদের শেখাতে যাই, ওদের মধ্যে যারা ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ নয় তাদের জন্যে বাংলা রিসোর্স লাগবে তো। অল্টনিউজ বাংলাকে দিয়ে সেই কাজটা হবে। মানে অল্টনিউজ বাংলা আমাদের এই বড় কাজটারই একটা অংশ হয়ে উঠবে বলতে পারেন।

নাগরিক: অদূর ভবিষ্যতে অন্য আঞ্চলিক ভাষাতেও এরকম উদ্যোগ নেওয়ার কোনো ভাবনা আছে কি?

প্রতীক: আপাতত নেই। বড়জোর গুজরাটি ভাষায় কাজ করতে পারি, কারণ আমি নিজে গুজরাটি ভাষাটা জানি, আমার অনেক সহকর্মীও গুজরাটি। আমাদের একটা ছোট গুজরাটি পরিষেবা আছেও, যেখানে সামান্য কিছু ভিডিও দেওয়া হয়। খুব বেশি হলে সেটাকে একটা পূর্ণাঙ্গ পরিষেবায় পরিণত করতে পারি। তার কারণ আমাদের মত ছোট স্টার্ট-আপের পক্ষে একেবারে নিশ এরিয়াতে কাজ করাই সম্ভব। যেমন এতদিন আমরা স্রেফ ভুয়ো খবর, মিথ্যা তথ্য নিয়ে কাজ করেছি, অন্য কিছুতে ঢুকিনি। এখন হেট স্পীচ নিয়ে কাজ শুরু করছি। সবে ‘আনহেট’ বলে একটা প্রোজেক্ট ঘোষণা করেছি। আর এই শিক্ষা নিয়ে কাজটা শুরু করছি। নিজেদের এর বেশি ছড়ানোর সামর্থ কোথায়? তাছাড়া দেখুন, আলাদা আলাদা ভাষায় পরিষেবা চালু করে যে অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে খুব বেশি সুবিধা হবে তা নয়। এই যে এতদিন ইংরেজি ভাষায় আমরা কাজ করছি, এতে কজন ইংরেজি জানা লোককে প্রভাবিত করা গেছে? সমাজে মেরুকরণ এত মারাত্মক, যে বিরাট অংশের মানুষকে কিছুই বুঝিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। অতএব আমাদের অন্য রাস্তা নিতে হচ্ছে। আমি জানি না সফল হবে কিনা, কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন যেভাবে আমরা এই সমস্যার সাথে লড়ছি তাতে তেমন সুবিধা হচ্ছে না।

নাগরিক: আচ্ছা, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে? ভুয়ো খবর কি ইংরেজি ভাষায় বেশি তৈরি হয়, নাকি আঞ্চলিক ভাষাগুলোতে?

প্রতীক: সব ভাষাতেই সমানভাবে তৈরি হয় এবং অন্য ভাষায় অনুবাদ হয়ে যায়। মনে রাখবেন, মিথ্যা তথ্য কিন্তু ভুল তথ্য নয়। মানে ওগুলোর জন্ম ভুল করে হয় না, সংগঠিতভাবে তৈরি করা হয়। ফলে বাংলায় তৈরি ভুয়ো খবর মুহূর্তের মধ্যে তেলেঙ্গানায় বা গুজরাটে গিয়ে পৌঁছয়। কোন ভাষায় বেশি মিথ্যা তথ্য উৎপাদন হয় তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়াও অসম্ভব, কারণ কে যে ভুয়ো খবর তৈরি করছে তা কিছুতেই খুঁজে বার করা যায় না। আই টি সেল কি একটা ঘরে বসা কয়েকটা লোক, নাকি সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা কয়েকশো লোক? এর উত্তর কারোর কাছে নেই।

নাগরিক: বিশেষ করে উদারপন্থী বৃত্তের মধ্যে একটা কথা আজকাল খুব বলা হয়। মানুষ তা-ই বিশ্বাস করে যা সে বিশ্বাস করতে চায়। অল্টনিউজ করতে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কি কথাটা ঠিক বলে মনে হয়? যেমন ধরুন, আপনাদের অ্যাপে তো সন্দেহজনক তথ্য আপলোড করে সেটা ভুয়ো কিনা তা জেনে নেওয়ার একটা ব্যবস্থা আছে। সেটা কতজন ব্যবহার করেন?

প্রতীক: ওই ব্যবস্থা তো আছেই। তা বাদে আমাদের একটা হোয়াটস্যাপ নম্বরও আছে। সেখানেও একই কাজ করা যায়। বেশকিছু লোক এগুলো ব্যবহার করেও থাকেন। তবে সব মিলিয়ে সংখ্যাটা আর কত? এই মুহূর্তে ভারতে ৫০০ মিলিয়নের বেশি হোয়াটস্যাপ ব্যবহারকারী আছেন। তার মানে এতগুলো মানুষের কাছে ভুয়ো খবর পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে। অল্টনিউজ মাসে এক মিলিয়ন ইউজার পায়। তো বুঝতেই পারছেন, আমরা একটা ভগ্নাংশের কাছেও পৌঁছতে পারছি না। আমার মনে হয় না ফ্যাক্ট চেকিং সাংবাদিকতা কোনোদিনই এমন জায়গায় পৌঁছবে, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ফ্যাক্ট চেক করবেন। সেই কারণেই আমরা এই রাজ্যে যা করতে এসেছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

নাগরিক: সারা ভারতেই স্বাধীন সাংবাদিকতা যাঁরা করেন, তাঁদের অভিযোগ হল, ক্ষমতাশালীরা এই স্বাধীন সাংবাদিকদের কাজে প্যাঁচে পড়ার সম্ভাবনা আছে দেখলেই কেস ঠুকে দিয়ে কোণঠাসা করেন। আপনাদেরও তো এরকম অভিজ্ঞতা হয়। এই ঝামেলাটা কীভাবে সামলান?

প্রতীক: হ্যাঁ, আমার সহকর্মী এবং অল্টনিউজের কো-ফাউন্ডার মহম্মদ জুবেরের নামেই তো আলাদা আলাদা জায়গায় চারটে এফ আই আর হয়ে বসে আছে। সবকটাই হাস্যকর অভিযোগ। আমাদের বিরুদ্ধে দৈনিক জাগরণ কাগজের একটা মানহানির মামলাও চলছে। লিগাল নোটিস তো আসতেই থাকে। মানে যথেষ্ট হয়রানি চলে। তবে আমরা খুবই সতর্ক হয়ে কাজ করি। প্রত্যেককে বারবার বলা হয়, মাথা গরম থাকার সময়ে কিছু লিখবে না। কোনোকিছু নিয়ে উত্তেজিত থাকলে, রাগ পড়ে যাওয়ার পর লেখো। আমাদের রিপোর্টগুলোতে আমরা প্রসঙ্গ থেকে একেবারেই যেন সরে না যাওয়া হয় সেদিক কড়া নজর রাখি। নির্দিষ্ট করে বলি, আমরা লেখায় অত্যন্ত কম বিশেষণ ব্যবহার করি।

নাগরিক: ক্রাউড-ফান্ডেড ফ্যাক্ট চেকিংয়ের ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ কেমন বলে আপনার মনে হয়? মানে টাকা রোজগার করতে না পারলে তো কাজটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

প্রতীক: এই মুহূর্তে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এই অতিমারী, লকডাউন ইত্যাদিতেও আমাদের মাইনে কমাতে হয়নি। যথেষ্ট মানুষই টাকা দিয়ে পড়ছেন। তবে কমবেশি তো হয়েই থাকে। কয়েকটা ফ্যাক্টরের উপর ব্যাপারটা নির্ভর করে, যেমন অর্থনীতির অবস্থা কেমন? লোকের হাতে কতটা অতিরিক্ত অর্থ আছে? তাছাড়া আমাদের একটা বড় সুবিধা হল আমরা এমন একটা ভাষায় কাজ করি, যে ভাষা ব্যবহারকারীদের মাথাপিছু আয় শুধু আঞ্চলিক ভাষা পড়তে পারেন যাঁরা, সেইরকম মানুষের চেয়ে সাধারণত বেশি হয়। ফলে আমার ধারণা, কেবল আঞ্চলিক ভাষায় এরকম কোনো ওয়েবসাইট চালানো অনেক বেশি কষ্টসাধ্য হবে।

নাগরিক: নাগরিককে সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

প্রতীক: ধন্যবাদ আপনাদেরও।

https://nagorik.net থেকে প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে

লজ্জার ভাগ

ভিখারি দূরে থাক, হকারদের প্রবেশও নিষেধ। কেউ ফাঁকতালে গ্রীষ্মের দুপুরে ঢুকে পড়লে রক্ষীর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।

উসকোখুসকো, পরিচর্যার অভাবে লাল হয়ে যাওয়া দড়ির মত চুল, পরনে রং বোঝা যায় না এমন সালোয়ার কামিজ, কাঁধে একটা কাপড়ের পোঁটলা, সঙ্গে হাড় জিরজিরে ছেঁড়া ফ্রক পরা বছর দশেকের একটি মেয়ে। এভাবে আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন একজন বছর তিরিশের মহিলা। দিন পনেরো আগের কথা। কোনো ভণিতা নেই, দরজা খুলতেই বললেন “বাবু, দুটো কাপড় হবে? আমাদের পরার কাপড় নেই।” বাড়ির দরজায় এসে কেউ সরাসরি হাত পেতে দাঁড়ায়নি অনেককাল। তাই কিছুটা ধাক্কা লেগেছিল। নিজের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে, বউ মেয়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জাই হয়েছিল কিছুটা। গিন্নীর ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু পুরনো জামাকাপড় প্রার্থীর হাতে তুলে দেওয়া গেল। বাচ্চা মেয়েটির চোখ দিয়ে খিদে এমন দৃষ্টিকটুভাবে চেয়ে ছিল, যে তার হাতে দুটো বিস্কুটও দেওয়া গেল। তাতেই বোঝা গেল, এমন নয় যে ওদের বাড়িতে অন্নের তবু সংস্থান আছে, কেবল বস্ত্র ভিক্ষা করতে হচ্ছে। মহিলা বলে বসলেন “বাবু, চাল হবে?” আসলে ইনি ভিক্ষাজীবী নন একেবারেই। বললেন অধুনা প্রায় জঙ্গলে পরিণত হিন্দমোটর কারখানার পরিত্যক্ত কোয়ার্টারগুলোর একটাতে থাকেন। কী কাজ করতেন বললেন না, কিন্তু বললেন কাজ ঘুচে গেছে অতিমারীর কোপে। কাপড় দিয়েছি গোটা কয়েক, মেয়ের হাতে বিস্কুট দিয়েছি না চাইতেই, কিঞ্চিৎ নগদও দিয়েছি। বোধহয় সে জন্যেই ভরসা করে চাল চেয়েছিলেন। কেন কে জানে, ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “হবে না।” একটিও কথা না বাড়িয়ে, পোঁটলার মুখ বেঁধে ফেলে দুজনে বিদায় নিলেন।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার পর মনে হল, ফিরে ডাকি। কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেল। গিন্নী শুনে বললেন “হবে না বললে কেন? চাল তো ছিলই।” ভেবে দেখলাম, চাল আছে। অভাব তো নেই-ই, বরং উদ্বৃত্ত আছে। কিন্তু আমার দেবার মনটাই নেই। নিজের কাছে নানারকম যুক্তি খাড়া করে ফেললাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। যেমন, কাপড় দিলাম, টাকা দিলাম, আবার চালও দেব? বাড়াবাড়ি করা ভাল নয়। যদি চিনে রাখে, নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করে? প্রগতিশীল যুক্তিও খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রের মত লাগিয়ে দিলাম পিছনে — ভিক্ষা দেওয়া ভাল নয়। এর সমর্থনে দু-একজন মহাপুরুষের উক্তিও মনে করার চেষ্টা করলাম, মনে পড়ল না। শেষ পর্যন্ত দুটো কথা স্বীকার না করে উপায় রইল না। প্রথমত, যিনি এসেছিলেন তিনি সারা বছর ধরাচূড়ো পরে ট্রেনে বাসে ভিক্ষা করে নেশার টাকা তুলে বেড়ানোর লোক নন। লজ্জার মাথা খেয়ে মেয়ের হাত ধরে ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যদি বারবার ফিরেও আসেন, তাহলেও আমার যত আছে সবটা ভিক্ষা করে নিয়ে যাওয়ার শক্তি ওঁর নেই।

আসলে সংবেদনশীলতা বোধহয় একটা অভ্যাস। সে অভ্যাস আমার চলে গেছে, তাই কয়েক মিনিটের জন্যও আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে পারি না। ভয় হয়, দুর্বলতম মানুষটিও আমার সব কেড়ে নেবে। অথচ নেওয়ার মত কী-ই বা পড়ে আছে আমাদের? এক সময় কিন্তু ছিল। যখন এ তল্লাটে বাড়ি বাড়ি আসতেন তাঁরা, যাঁদের আমরা সবাই ভিখিরি বলতাম।

ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের যে জায়গাগুলো হুগলী শিল্পাঞ্চলের মধ্যে ধরা হত, তারই একটায় আজন্ম বসবাস করছি। আমার জন্মের আগে বা আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই এ অঞ্চলের বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সমরেশ বসুর গল্প, উপন্যাসে এই অঞ্চলের যে ব্যস্ত শ্রমিক মহল্লার ছবি পাওয়া যায়, সেসব বিরল হয়ে আসতে শুরু করেছে ক্রমশ। র‍্যালিস ইন্ডিয়াকে প্রথম থেকেই পোড়োবাড়ি বলে জেনেছি, রিলাক্সন কারখানায় ধর্মঘট, শ্রমিক-মালিকের টানাপোড়েন চলছে — এসব শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। কিন্তু কৈশোরের শেষ পর্যন্ত হিন্দমোটর আর রিষড়ার অ্যালকালির সাইরেন ভুলতে দেয়নি যে আমরা শিল্পাঞ্চলে বাস করি। পাড়ার কাকু, জেঠু, দাদারা সাইরেন বাজার খানিক আগে-পরে সাইকেল নিয়ে কারখানার দিকে রওনা হতেন বা ফিরতেন। ওসব সকাল-বিকেলের ব্যাপার। দুপুরের নৈঃশব্দ্য, গৃহিণীদের দু দণ্ড বিশ্রামের শান্তি ভঙ্গ হত ভিখারিদের আগমনে।

যাঁরা আসতেন তাঁদের রোজ দেখতে দেখতে মুখ চেনা হয়ে যেত। এক লোলচর্ম বৃদ্ধা আসতেন। পিঠ বেঁকে মাটির সাথে প্রায় সমান্তরাল হয়ে গেছে, দু পা হেঁটেই হাঁপিয়ে পড়েন, টানা কথা বলতেও পারেন না। পয়সা দিলে ক্ষুণ্ণই হতেন। তাঁর দরকার ছিল চাল, ডাল অথবা আলু। তখন ফ্ল্যাটে থাকতাম না। নিজেদের বাড়ি ছিল, সে বাড়ির চাল ছিল টিনের, বৃষ্টি হলে জলও পড়ত। কিন্তু ওই বৃদ্ধাকে মা কখনো বলেননি, চাল হবে না। এ কেবল আমার বাড়ির গল্প নয়। এলাকায় দোতলা বাড়ি তখন গোনা যেত, আর টিভি থাকতে একটা-দুটো বাড়িতে। বৃদ্ধা সব বাড়ি থেকেই কিছু না কিছু পেতেন, ঠা ঠা দুপুরে জিরিয়ে নিতেন কোনো বারান্দায় বসে। হাফপ্যান্টের বয়সে কৌতূহলের সীমা থাকে না। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম “দিদা, তুমি ভিক্ষা করো কেন? তোমার বাড়িতে কেউ নেই?” ছিল, সবই ছিল। স্বামী না থাকলেও ছেলে ছিল, বৌমা ছিল, নাতি-নাতনি ছিল। কিন্তু তারা দেখে না, দু মুঠো খেতেও দেয় না — এমনটাই বলেছিলেন তিনি। দিদার মৃত্যুসংবাদও যথাসময়ে পাওয়া গিয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের পাড়ার লোকেরাই চাঁদা তুলে তাঁর সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল।

এক কাকু ছিল, যে শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভিক্ষা করতে চাইত না। জন্মান্ধ, তার উপর টাকাপয়সার হিসাবও রাখতে পারত না ঠিক করে। তাই তার বাড়ি বাড়ি ধূপ বিক্রি করার ব্যবসা নামেই ব্যবসা। কোনো ক্রেতা তাকে সুযোগ পেয়ে ঠকিয়েছে কিনা জানি না, তবে যে ধূপ সে বিক্রি করতে আসত তার গন্ধ তেমন মনোমুগ্ধকর ছিল না। আদৌ কোনো গন্ধ ছিল কিনা সে-ও তর্কসাধ্য, অর্থাৎ পাইকারি বিক্রেতা তাকে বরাবরই ঠকিয়ে গেছে বলা যায়। সুতরাং কাকুর কোনোমতে গ্রাসাচ্ছাদন আসলে লোকের দয়ার উপরেই নির্ভরশীল ছিল। বয়স একটু বাড়তে মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণও দেখা দিয়েছিল, ফলে দুর্দশার শেষ ছিল না। তবু, কটু কথা শোনালেও, তাকে যৎসামান্য সাহায্য করার লোকের অভাব ছিল না আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর মফস্বলে।

মাঝে মাঝে দেখা মুখও ছিল কয়েকজন। সেই সময়কার আর সব মফস্বল স্টেশনের মত, আমাদের কোন্নগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও ভিখারিদের দেখা পাওয়া যেত। তাছাড়া কালীপুজোর দিন সন্ধেবেলা আমারই বয়সী কিছু শুকনো মুখ ঘুরে বেড়াত। তারা শিশু হলেও আত্মসম্মান যথেষ্ট, তাই কখনো কারোর কাছে বাজি চায়নি। কিন্তু তাদের মুখের অন্ধকার দেখেও নিজের ভাগের আলো থেকে একটুও দেবে না কোন পাষাণ?

আশির দশক পেরিয়ে নব্বইয়ের দশকে এসে কিন্তু অন্য মানুষের দয়ায় বাঁচতে বাধ্য মানুষের সংখ্যা কমে গেল বহুগুণ। এলাকায় বন্ধ কারখানার সংখ্যা বাড়লেও চোখের সামনে দেখতে পেলাম, কিছু না কিছু করছে সকলেই। নিতান্ত ভিক্ষা করে খাওয়ার লোক আমাদের এলাকায় আর নেই দেখে অদ্ভুত স্বস্তিবোধ হত। আজ যৌবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার বৃত্তের সমবয়স্ক এবং বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেদের সাথে কথা বলে দেখি, নিজ নিজ এলাকায় তাঁদের অভিজ্ঞতাও এরকমই। অন্যের অনুগ্রহের ভরসায় জীবনধারণ করার চেয়ে গ্লানিকর কিছু নেই। সে গ্লানি দেখাও গ্লানিকর। তা কাউকে অবসন্ন করে, কাউকে ক্ষিপ্ত করে। ওই গ্লানি থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি বলেই মনে হয়েছিল মাঝের কয়েক বছর।

এখন ভারতের যে প্রান্তের মানুষের সাথেই কথা বলছি, মন খারাপ করা গল্প বলছেন সবাই। আলোকচিত্রীদের ক্যামেরাতেও ধরা পড়ছে মানুষের অসীম দুর্দশার ছবি। পথ দিয়ে চলে যাওয়া দুধের গাড়ি থেকে গড়িয়ে পড়া দুধ রাস্তা থেকে চেটে খাচ্ছেন একজন — এমন ছবিও আমরা দেখে ফেলেছি গত বছর। তার আগেই অবশ্য আমার কল্পনাশক্তিকে অবশ করে দিয়ে হুগলী জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসী এক বন্ধু জানিয়েছে, এক দুপুরে তারা সবে খেয়ে উঠে ঢেঁকুর তুলছে যখন, এক পথিক এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছে “ভাত হবে?” বছর তিরিশেকের ছেলেটি নিজের জন্মস্থানে মানুষকে এভাবে অভুক্ত থাকতে কখনো দেখেনি। ভারতের রাজধানীতে জন্মানো, বেড়ে ওঠা সাংবাদিক বন্ধুও এই দেড় বছরে একাধিকবার বলেছেন, যারা খেটে খেত, তারাও হাত পাততে বাধ্য হচ্ছে।

জানি না, পাঠক, এসব অভিজ্ঞতা কতটা মিলছে আপনাদের অভিজ্ঞতার সাথে। আমাদের নবগ্রাম অনেক বদলে গেছে, আমরা সবাই বদলে গেছি। এখানে এখন অনবরত বাড়ি ভাঙছে, ফ্ল্যাট উঠছে। সেসব ফ্ল্যাটে আমরা সম্ভ্রান্ত লোকেরা থাকি। আমার ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা পেয়েই নিশ্চয়ই দোতলায় উঠে আসতে পেরেছিল ওই তরুণী মা আর তার মেয়ে। হয়ত আর কোনোদিন পারবে না। বহু ফ্ল্যাটে সজাগ রক্ষী আছে এসব বাজে লোককে আটকানোর জন্য। ভিখারি দূরে থাক, হকারদের প্রবেশও নিষেধ। কেউ ফাঁকতালে গ্রীষ্মের দুপুরে ঢুকে পড়লে রক্ষীর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে। আপনি যদি তেমন কোনো ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হন, তাহলে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতা, বমন উদ্রেককারী দৃশ্যের পসরা সাজাবার জন্য। এসব গালগল্প মনে হলে আমিই দায়ী।

আসলে অনুগ্রহ প্রার্থী মানুষ আমাকে বড় লজ্জায় ফেলেন। অতিমারীর সময় হঠাৎ লজ্জায় পড়তে হয়েছে তা নয়। এ লজ্জার শুরু এই সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে। তার আগে নেহাত বালক ছিলাম, লজ্জা ঘৃণা ভয় — সবই কম ছিল। প্রথম লজ্জা পেলাম যখন সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানার শ্রমিকরা আমাদের বাড়িতে পুরুষ-মহিলাদের প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি করতে এলেন। বাবার বয়সী লোক সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালে যে পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করে, সে অনুভূতি সেই প্রথম। আমরা যত বড় হয়েছি, বন্ধ কারখানার সংখ্যা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে মরিয়া শ্রমিকদের যাতায়াত। এক পাড়ায় কতজন এক মাসে কতগুলো ডিওডোর‍্যান্ট কিনতে পারে? উত্তর জেনেও তাঁদের দলে দলে, বারবার আসতে হয়েছে আমাদের দুয়ারে। বিপন্ন মানুষের জন্যে, রোজগারের রাস্তা খোঁজা মানুষের জন্যে এই পৃথিবী কী ভীষণ ছোট! যাঁরা আসেন, তাঁদের কখনো না কখনো ফেরাতেই হয়। মেজাজ ভাল থাকলে নরম সুরে “সেদিন যেটা দিয়ে গেলেন, এখনো ফুরোয়নি যে, কাকু।” তিরিক্ষে হলে “এই তো আপনাদের ফ্যাক্টরিরই একজনের থেকে একটা জিনিস কিনলাম। কজনের থেকে কিনতে হবে রে বাবা?” মাসে মাসে এলে কয়েক জনের মুখ চেনা হয়ে যায়। তখন অনুগ্রহ প্রার্থনা আরও লজ্জায় ফেলে। কেউ কেউ নিজের অবস্থায় এতই লজ্জিত, যে সামান্য নখপালিশ কেনার জন্য হাঁটুর বয়সী গৃহবধূকে বলে ফেলেন “আপনাদের অশেষ দয়া। আপনারা আছেন বলেই আমার মেয়েটা খেতে পরতে পাচ্ছে মা।” আসলে তিনি জানেন এই বেচা কেনা চাহিদা-যোগানের অর্থনৈতিক নীতি অনুযায়ী হচ্ছে না, হচ্ছে অনুগ্রহের ভিত্তিতে।

গত দেড়-দুই দশক ধরে তবু এই ভানটুকু আমাদের আব্রু বজায় রেখেছিল। অতিমারী এসে সেটুকুও বুঝি কেড়ে নিল। ভিখারি হওয়া ছাড়া আর পথ রইল না অনেক মানুষের। নিজেকে এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃশাসনীয় গল্পের নারীদের মত অসহায়, উলঙ্গ মনে হয়। দুঃখ ভাগ করলে কমে জানি, লজ্জা ভাগ করলে কমে কিনা জানি না। তাই খানিক আশায়, প্রিয় পাঠক, এই ঝুঁকি নিলাম।

https://aajkaal.in এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

%d bloggers like this: