‘রাজ, দিলীপ, দেব: যুগের স্বপ্ন সাফল্য ব্যর্থতার ধারক’

এখনকার অক্ষয় কুমার ইত্যাদিদের ছবি থেকে তো ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের ইতিহাসটাকেই মুছে দেওয়া হয়েছে। কুষ্ঠরোগীর সঙ্গে যেমন এককালে মানুষ অস্পৃশ্যের মত ব্যবহার করত, এখনকার হিন্দি সিনেমা দরিদ্রের প্রতি সেই মনোভাব নিয়েছে।

আজ রাজ কাপুরের জন্মদিন, তাঁর শতবর্ষ হবে ২০২৪ সালে। গত রবিবার শতবর্ষে পড়লেন দিলীপকুমার। দেব আনন্দও শতবর্ষ পূর্ণ করবেন বছর ঘুরলে। স্বাধীনোত্তর ভারতে হিন্দি ছবির বিপুল জনপ্রিয়তার পিছনে এই তিনজনের অবদান অতুলনীয়। আজ আসমুদ্রহিমাচলে বলিউড নামে পরিচিত মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা যেখানে এসে পৌঁছেছে, তাতে ওই ত্রয়ীর কাজকে ফিরে দেখা প্রয়োজন মনে করে নাগরিক ডট নেট সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছিল। তিনি যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর তো দিলেনই, উপরন্তু আলোচনায় এসে পড়লেন উত্তমকুমার, এল দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে। যেমন ঢুকে পড়লেন ইউরি গ্যাগারিন, তেমনি এসে গেল কহো না পেয়ার হ্যায়। নাগরিকের পক্ষ থেকে কথা বলেছেন প্রতীক

রাজ

স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দি সিনেমার যে বিপুল জনপ্রিয়তা, হিন্দিভাষী নন এমন মানুষকেও যেভাবে তা প্রভাবিত করেছে তাতে এই তিনজনেরই তো অনস্বীকার্য প্রভাব। আজকের জনপ্রিয় হিন্দি ছবি যে পথে চলেছে তার সাপেক্ষে ওঁদের কীভাবে দেখেন?

প্রশ্নটা খুব আকর্ষণীয় এবং কিছুটা দূরপ্রসারী। যে মুহূর্তে ভারতীয় চলচ্চিত্রে রাজ কাপুর, দিলীপকুমার এবং দেব আনন্দ প্রবেশ করছেন তখন যে ধরনের সাংস্কৃতিক বাতাবরণ ছিল, একটা সদ্য স্বাধীন দেশে যে ধরনের গঠন প্রক্রিয়া চলছিল এবং আমাদের রাজনীতি যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল, তার সমস্তটাই জনপ্রিয়তার আবরণ সরিয়ে দিলে দিলীপকুমার, দেব আনন্দ এবং রাজ কাপুরের মধ্যে দেখা যায়। একথা অনস্বীকার্য যে পাঁচের দশকে মেলোড্রামার পৃথিবীতে একইসঙ্গে পশ্চিমে দিলীপকুমার, রাজ কাপুর ও দেব আনন্দ; দক্ষিণে শিবাজী গণেশন এবং পূর্বে উত্তমকুমার যে মায়াবী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তার কোনো পুনরাবৃত্তি ভারতীয় সিনেমায় আর হবে না সম্ভবত।

মুম্বাইয়ের ত্রয়ীর মধ্যে দিলীপকুমার অবশ্য একটু আলাদা, কারণ রাজ আর দেব প্রোডাকশন হাউসের মালিক হয়ে উঠেছিলেন। দিলীপকুমারের তেমন কোনো ঠিকানা ছিল না। কিন্তু মোদ্দা ব্যাপারটা এইরকম যে যা ছিল রানীর কণ্ঠহার, মানে ‘কুইন’স গোল্ডেন নেকলেস’, তা ওই সময়ে অস্তমায়ায় করুণ রঙিন; উপনিবেশের স্মৃতি ক্রমশ আবছা হয়ে জেগে উঠছে নির্বাচিত সাধারণতন্ত্র; বিদায় নিচ্ছেন অশোককুমার, বলরাজ সাহনিরা। এই সময়ে তাঁদের নায়কোচিত অবস্থানে এসে পড়লেন দিলীপকুমার; সঙ্গে সঙ্গে রাজ কাপুর আর দেব আনন্দ। কিন্তু ব্যাপারটা যে শুধুই ঘটনা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলেও সে সময় ক্রমশ গ্রাম এসে শহরে ভিড় করছে। নানারকম অবসিত পল্লী শহরের আনাচে কানাচে। তখন আমাদের অজান্তেই জাতি গঠনের রূপকথা নানারকম বাঁক নিচ্ছিল। মনে রাখতে হবে, সত্যজিৎ রায়ের অপূর্ব কুমার রায় যখন কলকাতায় প্রবেশ করে নবীন নাগরিক হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে, প্রায় তখনই শাপমোচন ছবির নায়ক উত্তমকুমার গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসেন। এই স্থানান্তর উপলক্ষে উত্তমকুমার জনসাধারণের মন লুঠ করে নেন।

আপনি বলছেন একই ব্যাপার রাজ কাপুরদের ক্ষেত্রেও হিন্দি ছবিতে ঘটেছিল?

ঠিক তাই। কলকাতার মতই তৎকালীন বম্বে শহরের মধ্যেও এক অলীক গ্রাম তৈরি হয় সিনেমার পর্দায়। উত্তমকুমারের মতই রাজ কাপুর এবং দিলীপকুমার শহুরে লোকগাথার অবিসংবাদী সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন। এই হল মেলোড্রামার আদর্শ মুহূর্ত, যেখানে বুর্জোয়া সভ্যতার ট্র্যাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কিছু বাধ্যতামূলক নৈতিকতা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। বস্তুত দেশভাগ, গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্ব, নগরায়নের দোলাচল কিছু আধিক্য তৈরি করে, অতিশয়োক্তিই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। আমার মতে সেই অতিশয়োক্তির আদর্শ দৃষ্টান্ত দিলীপকুমার।

রাজ কাপুর তাহলে কী? বলা যায় উনি সরকারি সিলমোহর। প্রায় শাস্ত্রানুমোদিত, নেহরু যুগের জাতি গঠনের স্মারক। অন্যদিকে দেব আনন্দ স্বাধীনোত্তর লাগামছাড়া যৌবনের দূত। রাজকে দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে একদিকে যখন সাহিত্যসমর্পিত বাস্তববাদ চলচ্চিত্রের জন্য একটি মানচিত্র তৈরি করতে ব্যস্ত, তখন তিনি মেলোড্রামার আদলে গ্রাম থেকে শহরে আসার অভিজ্ঞতা ও রাষ্ট্রীয় বিধিসমূহ পরীক্ষা করে চলেছেন সেলুলয়েডে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর গণতান্ত্রিক সমাজবাদ ও মিশ্র অর্থনীতির ধারণায় এক ধরনের জাতি গঠনের প্রয়াস মূর্ত হয়ে উঠেছিল। আওয়ারা (১৯৫১), বুট পলিশ (১৯৫৪), শ্রী ৪২০ (১৯৫৫) এবং জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায় (১৯৬০) উত্তর-স্বাধীনতা পর্বে ভারতীয় জনজীবনে আধুনিকতার নিশ্চিত দলিল হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। আরেকটু তলিয়ে ভাবলে, প্রমথেশ বড়ুয়ার অধিকার সেই ১৯৩৯ সালে তথাকথিত অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছিল রাজ কাপুর সেই উত্তরাধিকার কৃতজ্ঞ চিত্তে বহন করে নেন আওয়ারাতে। অথচ তিনিই আবার সামাজিক প্রসঙ্গ আড়াল করে সিক্ত যূথীর গন্ধবেদনে আখ্যানের গহনে চলে যান শ্রী ৪২০ ছবিতে। শাড়ির অন্তরালে একটি ছাতার তলায় নার্গিস ও নিজেকে অমর করে দেন সঙ্গীতের চরণে, ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’ মেলডিতে। নিজেকে জীবনের যাবতীয় বাসনার আড়ালে রেখে জানান, ওই রজনীতে ঝড় বয়ে যাবে রজনীগন্ধা বনে।

ওখান থেকেই তো ওই জুটি অন্য মাত্রা পেল?

হ্যাঁ, এরপর কিংবদন্তী হয়ে গেলেন রাজ-নার্গিস যুগল। রিচার্ড বার্টন-এলিজাবেথ টেলরের সম্পর্ক যদি গবেষণার বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে রুপোলি পর্দায় তার পরিশিষ্টে রাজ কাপুর-নার্গিসের জীবনকথাও নক্ষত্রলোকের জিনিস। বম্বেভিত্তিক হিন্দি ছায়াছবির জগৎ গত শতকের নয়ের দশক থেকে বলিউড নামে চিহ্নিত হয়। সেখানে সবচেয়ে শক্তিশালী কাপুর পরিবারের মধ্যমণি রাজ, যেন রামায়ণে ইক্ষ্বাকু বংশের শ্রীরামচন্দ্র। অবিভক্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পেশোয়ার শহরে তাঁর জন্ম। বাবা পৃথ্বীরাজ জীবিকার কারণে বম্বে শহরে চলে আসেন। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম সারির এই নেতা শুধু যে সপরিবারে ভারতের নানা শহরে আস্তানা গেড়েছিলেন তাই নয়, নিজের সন্তানদের মধ্যেও সংক্রমিত করেছিলেন গরীব ও নিচুতলার মানুষকে খোলা চোখে দেখার ঘরানা। এই সুবাদে কিছুদিন কলকাতাতেও ছিলেন বালক রাজ কাপুর। ছোটবেলা থেকেই যে বাংলা ভাষার উত্তম ব্যবহার জানতেন তার কারণও এই শহরের মায়াবী স্মৃতি।

এই কলকাতার সংযোগটা আরেকটু খুলে বলবেন?

এটা সবিস্তারে বলার মত ব্যাপারই বটে। একটা মজার তথ্য অনেকেই হয়ত জানেন না। রাজের প্রথম ছবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কলকাতা। ছবিটার নাম ইনকিলাব (১৯৩৫)। সেখানে তাঁর আবির্ভাব হয় শিশুশিল্পী হিসাবে। সে ছবির পরিচালক দেবকী বসু আর প্রযোজনা নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর। যদিও ডানা মেলতে রাজ সময় নিয়েছেন আরও অনেকদিন। ইনকিলাবের এক যুগ পরে নীলকমল (১৯৪৭) ছবিতে মধুবালার বিপরীতে নায়ক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। কিন্তু ১৯৪৯ সালের অন্দাজ ছবিতে যে মেলোড্রামার কথা এত করে বলছি তা এক বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়। তবে সেখানেও রাজ আর দিলীপ একত্রে ছিলেন। রাজ প্রথম মেঘমুক্ত হলেন আওয়ারার সাফল্যে। ভারতবর্ষ তো বটেই, তখনকার সোভিয়েত ভূমিও প্লাবিত হয়েছিল আওয়ারা হুঁ গানে। এতটাই যে মানুষের প্রথম মহাকাশ যাত্রায় ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশযানে এই গান গুঁজে দেওয়া হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নে তো রাজ কাপুরের অনেক ছবিই প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। এই প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল তখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, রাজ কাপুরের ছবির যে রাজনীতি সেটাই কি ভারতের মত কমিউনিস্ট রাশিয়াতেও জনপ্রিয় হওয়ার কারণ?

শুধু তা হয়ত নয়। আওয়ারা ছবিতে নারী ও শিশুর সঙ্গে আদালত এবং আইনের যে সংঘর্ষ পরবর্তী বুট পলিশ ছবি (যাকে টাইম ম্যাগাজিন ‘ক্ষুদ্রাকার মহাকাব্য’ বলেছিল) বা শ্রী ৪২০ ছবিতেও দেখা যায়, তা থেকে বোঝা যায় রাজ কাপুর একটি দেশের গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তরের পথে যে উত্থান পতন, যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, যে অশ্বখুরের ধ্বনি, সেগুলোকে এক ধরনের রূপকথার আঙ্গিকে প্রকাশ করছেন। তিনি সমাজের কথা বলছেন, কিন্তু প্রেম আর গান সেখানে যেভাবে জড়িয়ে থাকছে তাতে অনেকসময়েই একরকম ব্যালাডের রূপ নিচ্ছে। যেমন মেরা জুতা হ্যায় জাপানি গানটা একসময় প্রায় জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছিল। তার পিছনে আবার রাজনীতি অন্যতম কারণ, যেহেতু তখন ভারত পঞ্চশীল রাজনীতির চর্চা শুরু করেছিল। সুতরাং রাজ কাপুরের রাজনীতি ব্যালাডের রূপ ধরে পর্দায় আসে বলেই সত্যজিতের অপরাজিত (১৯৫৬) ছবির চেয়ে অনেক বেশি জনচিত্তহারী হতে পেরেছিল সর্বত্রই। মেহবুব খানের মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭) ছবির মতই রাজের জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায় উত্তর ভারতের সম্পন্ন চাষির চোখ দিয়ে ভারতীয় নব্য জীবনগাথা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।

আপনি সম্প্রতি এক জায়গায় বলেছেনদিলীপকুমারের উত্থান নেহরুজাত সমাজতান্ত্রিক যুগের সূচক আর শাহরুখ খানের উত্থান মনমোহনী বাজার অর্থনীতির সূচক। দিলীপকুমার থেকে শাহরুখ অব্দি পৌঁছতে গিয়ে হিন্দি সিনেমা তো ভোল পালটে অনেক বেশি করে উত্তর ভারতীয় এবং অনাবাসী ভারতীয়কেন্দ্রিক হয়ে পড়লযেখানে বাঙালি বা তামিল চরিত্র শুধুমাত্র হাস্যরস উৎপাদন করে। এমনটা তো বরাবর ছিল না। স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনের প্রথম হিট ছবি তো আনন্দ, যেখানে কথকের চরিত্রটাই একজন বাঙালি ডাক্তারের। এই সারা ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার সংস্কৃতি যে হিন্দি ছবিতে আর রইল না, এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?

এখানেই আসতে চাইছিলাম। এই যে আমরা দিলীপকুমারের কথা বলছি। তিনি তো একজন আর্কিটাইপাল বিরহী এবং অতিনাটক তাঁর কাছে শকুন্তলার হাতের আংটির মত। কিন্তু দিলীপকুমার কেন কিংবদন্তী? কারণ নবীন ভারতীয় প্রজাতন্ত্র যে সমস্ত মিথ জনসাধারণের জন্য ছড়িয়েছিল, সেগুলো দিলীপকুমার আশ্চর্যভাবে নিজের শরীরে মুদ্রিত করতে পারতেন। যেমন বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কণ্ঠমাধুর্যে ভেসে যেতে যেতে যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজের সিংহাসন, তা দর্শককুলকে স্বপ্নপুরীতে নিয়ে যায়। সে দ্যাখে সকরুণ দীর্ঘশ্বাসে দিলীপকুমারের যন্ত্রণাতাড়িত মুখ। পাঁচের দশকে দেবদাস হয়ে তিনি মদের পেয়ালায় ঠোঁট ছোঁয়ালে তা একটা আস্ত প্রজন্মের অশ্রুলিপি হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দিলীপকুমার নক্ষত্রলোকে সময়ের আশ্চর্য মুখপাত্র। ধরো আমরা যখন মধুমতী (১৯৫৮) দেখি বা অন্দাজে রাজ কাপুরের বিপরীতে দিলীপকুমারকে দেখি, তখন বুঝি যে এই নায়করা “assure the passage from awe to charm”। কথাটা আমার নয়, রলাঁ বার্থের। কথাটা এঁদের প্রসঙ্গে খাটে। এঁদের সময় সম্পর্কে আগেই যা বললাম – একদিকে যুগ যুগ ধরে জমে থাকা মাটির টান, অন্যদিকে শাসক প্ররোচিত শিল্পসভ্যতার দায়ে বদলে যাওয়ার সমস্ত ক্ষতচিহ্ন উৎকীর্ণ হয়ে আছে নাগরিক সভ্যতার গায়ে। ফলে দিলীপকুমারের সমকালীন যুবসমাজ ফলের বাগিচা এবং লেদ মেশিনের আর্তনাদের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হতে হতে যে উন্মাদনা এবং প্রতিস্থাপনকে খেয়াল করে, তা যদি অপরাজিত বা জলসাঘর (১৯৫৮) চিত্রিত বাস্তবতার ইশতেহারকে পরিহার করে, তবে তাতে এক ধরনের মাত্রাছাড়া ঢেউ থাকবেই। ফলে বলা যেতে পারে দিলীপকুমার, রাজ কাপুর আর দেব আনন্দ ইতিহাসের একরকম সরলীকৃত ব্যাখ্যার মূর্ত রূপ।

এবার শাহরুখের কথা বলি। আমাদের ওই ত্রয়ীর সকলেই, চলতি কথায় যাকে বলে ‘সুদর্শন’। তাঁরা যুবতীদের হৃদয় হরণ করতেন। পুরুষরাও তাঁদের দেখে এক মায়াবী লাবণ্য অনুভব করেন। শাহরুখকে আমরা যখন দেখতে পেলাম ততদিনে কিন্তু আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা অপসৃয়মান, নবীনের সঙ্গে প্রাচীনের দ্বন্দ্বও অনেক বদলে গেছে। নেহরু যুগের অবসানে আমরা বুঝতে পারছি সাবেকি সমাজতন্ত্রের পতাকা পথপ্রান্তে লুটোপুটি খাচ্ছে। এ দেশে যেমন নেহরুর অর্থনীতি বাতিল হয়ে যাচ্ছে, তেমনি বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনও আসন্ন। ফলে শাহরুখ আসেন এক সাধারণ ‘অপর’-এর প্রতিনিধি হয়ে। তিনি আমাদের জয় করলেন কিন্তু কোনো মতাদর্শগত বার্তা দিয়ে নয়, যে বার্তা রাজ বা দিলীপের চরিত্রগুলো দিতে পারত। শাহরুখ এই কারণেই বিশ শতকের শেষ বড় নায়ক হয়ে উঠলেন যে তিনি আর পাঁচজনের মতই এবং তিনি কোনো বৃহত্তর স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নন। ফলে এই শতাব্দীতে পৌঁছে ওম শান্তি ওম (২০০৭) ছবিতে তিনি মুম্বাইয়ের ছবির প্রায় গোটা ইতিহাসটারই নতুন রকম ব্যাখ্যা করে নিজেকে তার কেন্দ্রে স্থাপন করেন, খানিকটা ব্যঙ্গই করেন। অর্থাৎ এখানে কিন্তু তাঁর একটা পাল্টা রাজনীতি উঠে এল।

রাজ কাপুরের একটা দিক নিয়ে আমার কৌতূহল নিরসন করতে চাই। উনি ১৯৫৬ সালে জাগতে রহো ছবিতে অভিনয় করেছেন, যেখানে গ্রামের একজন তৃষ্ণার্ত কৃষক শহরে এসে একটু জল পাচ্ছে না কারোর কাছে, উল্টে চোর সন্দেহে তাড়া খাচ্ছে। এই ছবির পরিচালক শম্ভু মিত্র, অমিত মৈত্র। সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী অর্থাৎ ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সাথে যুক্ত লোকেরা। পরে যখন রাজ কাপুর আর কে ফিল্মসের ব্যানারে নাচে গানে ভরপুর ছবি করছেনতখনো জাগতে রহোর প্রভাব যেন থেকেই যাচ্ছে। সেই কপর্দকশূন্য মানুষযাকে চার্লি চ্যাপলিনের ছবির আলোচনায় আমরা ট্র‍্যাম্প বলিসে জাগতে রহোর আগেই মুক্তি পাওয়া শ্রী ৪২০-এ তো প্রায় চ্যাপলিনের চেহারাতেই ছিল, কিন্তু বহু পরে ১৯৭০ সালে যখন রাজ মেরা নাম জোকার করেন, তখনো সেই ট্র্যাম্পসুলভ একটা চরিত্রই কেন্দ্রে। ১৯৬৬ সালে বাসু ভট্টাচার্য পরিচালিত তিসরি কসম এমনিতে একটা প্রেমের ছবি। কিন্তু সে ছবির রাজ অভিনীত চরিত্র, গাড়োয়ান হীরামন, সেও প্রায় সব হারানো একজন মানুষ। বারবার এইরকম চরিত্র রাজের কাজে ফিরে আসত কি স্রেফ চার্লি চ্যাপলিন তাঁর প্রিয় শিল্পী ছিলেন বলে, নাকি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের কোনো স্থায়ী প্রভাব ওঁর উপর রয়ে গিয়েছিল বলা যায়?

মেরা নাম জোকার, তারপর ববি (১৯৭৩) বা রাম তেরি গঙ্গা ময়লি (১৯৮৫)-র সময়ে রাজ কাপুর এমন এক বাণিজ্যিক সিনেমা উৎপাদন করছেন যেখানে লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মধ্যে প্রথমজনের দিকেই পাল্লা ভারি। মজার কথা, ববির চিত্রনাট্যকারদের একজন, খাজা আহমেদ আব্বাস ছিলেন ১৯৪৬ সালে তৈরি ধরতি কে লাল ছবির পরিচালক। সে ছবির প্রেরণা বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন। অর্থাৎ সেই লোক এই যুগে ববির চিত্রনাট্যকার হয়ে গেছেন। তেমনি রাজ কাপুরও ববিতে আপাতভাবে শ্রেণিবৈষম্যের কথা বলছেন বটে, কিন্তু আসলে রজার ভাদিম যেভাবে ফরাসী নবতরঙ্গে ব্রিজিত বারদোকে ব্যবহার করেন সেইভাবে ডিম্পল কাপাডিয়াকে প্রদর্শনযোগ্য নারীত্বের মডেল হিসাবে ব্যবহার করছেন। একই ঘটনা ঘটাচ্ছেন জিনত অমনকে নিয়ে সত্যম শিবম সুন্দরম (১৯৭৮) আর মন্দাকিনীকে নিয়ে রাম তেরি গঙ্গা রাম তেরি গঙ্গা ময়লি ছবিতে।

তবে তা সত্ত্বেও এটা ঠিকই, তিনি যে গণনাট্য সঙ্ঘের আদর্শ নিয়ে শুরু করেছিলেন, তার ছাপ শেষদিকেও দেখা যায়। মেরা নাম জোকারে এসে তাঁর উপর নব বাস্তববাদের প্রভাব দেখা যায়। ফলে শুধু চ্যাপলিনকে পছন্দ করতেন বলেই যে ট্র্যাম্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কাজে, তা বোধহয় নয়। যদিও রাজের চ্যাপলিন প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু শুধু কাজ নয়, রাজের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে তাকালে প্রশস্তি না করেও বলা যায়, তাঁর মধ্যে সেই গণনাট্য সঙ্ঘের আমলের লোকেদের সারল্য কিছুটা রয়ে গিয়েছিল। যেমন একবার ইরানের এক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক পিএইচডি দিয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি তো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকিনি, এখানে এই কালো পোশাক পরে অধ্যাপকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে কত বড় হয়ে গেছি! অত বড় তারকার এত সরল কথা বলা হয়ত বামপন্থী বাবার প্রভাবই হবে। তাঁর সব ছবিতেই কিন্তু রাজ এক ধরনের সারল্যের প্ররোচনা দিয়েছেন। ফলে মনস্তাত্ত্বিকভাবে একেবারে ছাপোষা ভারতীয়ের সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করতে পারতেন। ববির মত ছবিতেও দারিদ্র্যকে একটু অলঙ্কার পরিয়ে দেওয়া তাঁর স্বধর্মে পর্যবসিত হয়েছিল। আমার ধারণা এটা চ্যাপলিনের প্রভাব নয়, গণনাট্য সঙ্ঘে আদি যুগ কাটানোরই ফল।

এবার একটা প্রশ্ন করব যেটা হয়ত অযৌক্তিক, কিন্তু লোভ সামলাতে পারছি না। রাজ কাপুর, দিলীপকুমারের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ক্রমশ অক্ষয় কুমারের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হয়ে যাওয়া – এর পিছনে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ, তার ফলে মূলধারার শিল্প থেকে গণনাট্য সঙ্ঘের প্রভাব ক্রমে অপসৃত হওয়াকে কতটা দায়ী করা যায়? কারণ প্রভাবটা তো সে আমলে নেহাত কম ছিল না। জাগতে রহো বা বিমল রায়ের দো বিঘা জমিন তো বিষয়বস্তুর দিক থেকেই অন্যরকম, কিন্তু মধুমতীর মত তথাকথিত রোম্যান্টিক ছবির চিত্রনাট্যও তো ঋত্বিক ঘটকের লেখা। সে জিনিস যে বন্ধ হয়ে গেল, তাতে কি বামপন্থীদের একেবারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংযোগ তৈরি করার কাজটার ক্ষতি হল? ঘটনাচক্রে আজ আবার হেমাঙ্গ বিশ্বাসেরও জন্মদিন। যিনি একেবারে সাধারণ মানুষের চেনা আঙ্গিকে বামপন্থী রাজনৈতিক আখ্যান সৃষ্টি করতে পারতেন। যেমন মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য তৈরি করেছিলেন। 

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আধুনিক বলিউডে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের দর্পিত পদক্ষেপ ঘটেছে। সেখানে শুধুই শপিং মল সংস্কৃতি রয়েছে, যেখানে গরীবকেও সাজিয়ে গুছিয়ে দেখানো হয়। সিনেমার এমন হয়ে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে সুনিশ্চিত হয়ে যায় একমেরু পৃথিবীতে। বলিউড তখন আমাদের বোঝাতে শুরু করে যে আমরাই শুধু হলিউডের নকল করি না, ওরাও আমাদের ‘ছম্মা ছম্মা’ গান নেয় (নিকোল কিডম্যান অভিনীত মুলাঁ রুজ ছবিতে)। মানে অর্থনৈতিক উদারীকরণের নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে বলিউড আমাদের সামনে হাজির হয়। এটা ক্ষতি তো বটেই। কিন্তু এতে আমাদের একটা উপকার হয়েছে। সেটা হল এককালে হিন্দি ছবির যেসব বাড়াবাড়ি নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম, যেমন বড়লোকের ছেলের সঙ্গে গরীবের মেয়ের প্রেম বা উল্টোটা, সেগুলোরও যে দরকার ছিল তা আমরা উপলব্ধি করতে পারলাম।

আরও পড়ুন শ্রদ্ধেয়

কেন এরকম বলছেন?

আচ্ছা দিলীপকুমারের শতবর্ষ তো, তাঁর মেলোড্রামার উদাহরণ দিয়েই বলি। তিনি কী আশ্চর্য দক্ষতায় বাঙালি বিরহী দেবদাস আর মোগল যুবরাজ সেলিম – দুটো ভূমিকাই পালন করেছেন। এই দুটো চরিত্রের দূরত্ব কতটা? একবার দিলীপ হালকা মেজাজে বলেছিলেন – ৫০ ফুট। কারণ আসলে আন্ধেরির মোহন স্টুডিওতে এই দুটো ছবির সেট পড়েছিল মুখোমুখি। ফলে দিলীপ মাত্র কয়েক গজ হেঁটে ব্যথিত মাতাল থেকে গর্বোদ্ধত যুবরাজ হয়ে যেতেন। এই যে বিমল রায়ের পরামর্শে দেবদাস চরিত্রটার সঙ্গে হাড়ে মজ্জায় মিশে যাওয়া… কী মর্মান্তিকভাবে বলেছিলেন সেই সংলাপ ‘কৌন কমবখত হ্যায় জো বরদাশ্ৎ করনে কে লিয়ে পীতা হ্যায়?’ এ তো এক অবাস্তব জগৎ তৈরি করছিলেন। মুঘল-এ-আজমে যখন ‘যব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ গানের মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে, তখনো ভারত এক অসম প্রেমকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যা বাস্তবে ঘটে না, ঘটা সম্ভব নয়। বলা চলে এসব গরীবের আকাশকুসুম কল্পনাকে প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু এখন তো ছবি থেকে গরীব উধাও হয়ে গেছে।

এখনকার অক্ষয় কুমার ইত্যাদিদের ছবি থেকে তো ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের ইতিহাসটাকেই মুছে দেওয়া হয়েছে। কুষ্ঠরোগীর সঙ্গে যেমন এককালে মানুষ অস্পৃশ্যের মত ব্যবহার করত, এখনকার হিন্দি সিনেমা দরিদ্রের প্রতি সেই মনোভাব নিয়েছে। ওটাকে ঢেকে দেওয়া হয়। আমেদাবাদে যেমন বিদেশি নেতারা এলে গরীবদের পাড়ার সামনে পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়, অনেকটা সেইরকম। এখন দরিদ্র হওয়া অপরাধ। সেই কহো না পেয়ার হ্যায় (২০০০) আমল থেকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখনকার ছবিতে ভিখারিরাও যেন সাজানো গোছানো, ব্র্যান্ডেড। অথচ শোলে (১৯৭৩) পর্যন্তও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে পর্দায় দেখতে পাওয়া যেত। নিয়মমাফিক মুসলমানের উপস্থিতি, শিখের উপস্থিতি থাকত। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে যে প্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়, প্রায় তারই চেহারা দেখা যেত মুম্বাইয়ের হিন্দি ছবিতে।

আজ তার ঠিক উল্টো ঘটছে, এক ধরনের কেন্দ্রীকরণ চলছে। যেমন বিয়ে – একটা সামাজিক মিলনোৎসব। সেই দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে (১৯৯৫) থেকে পাঞ্জাবি বিয়েই ভারতীয় বিয়ে হয়ে উঠল। ভারতের অন্যান্য প্রান্তে অন্য কোনোরকম বিয়ে হয় কিনা সেকথা আমরা যেন ভুলেই গেছি। হিন্দি ছবি গোটা দেশটার একটা সিন্থেটিক কোডিফিকেশন করেছে। যেন কম্পিউটার, যেখানে ক্লিক করলেই মুশকিল আসান।

সেইজন্যেই বলছি, অল্প বয়সে আমরা তথাকথিত আর্ট সিনেমার পাল্লায় পড়ে রাজ কাপুর, দিলীপকুমার, দেব আনন্দদের নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতাম। আজ মনে হয় তাঁরা একটা যুগের স্বপ্ন, সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে ধারণ করার চেষ্টা তো অন্তত চালিয়েছিলেন। যোগ্যতার আলোচনায় যাবই না, কারণ দিলীপকুমারের মত অভিনয় প্রতিভা, রাজ কাপুরের মত জাদুকর বা দেব আনন্দের মত রোম্যান্টিক অভিনয় করার ক্ষমতাসম্পন্ন নায়ক যে আজকের বলিউডে নেই তা বুঝতে কোনো মেধা লাগে না।

কিন্তু আসল কথা হল তাঁদের নিজের কাজের প্রতি যে বিশ্বাস, যে অধ্যবসায় ছিল সেটাই আজ লুপ্তপ্রায়। বিশেষ করে বাঙালি ছবির সমালোচকরা, যাঁরা জনপ্রিয় সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা একেবারেই অপছন্দ করেন, তাঁদের হিন্দি ছবির ওই ত্রয়ীকে প্রাপ্য সম্মান জানানো দরকার। সেটা করা হয়নি, কারণ মনে করা হত জনপ্রিয় সিনেমার আলোচনায় ঢুকে পড়া উত্তর কলকাতার একটি কুখ্যাত পাড়ায় ঢুকে পড়ার সমান। এই উন্নাসিকতার ফল ভোগ করছে আজকের টলিউড, যেখানে আর অজয় কর বা নির্মল দে-র মত পরিচালক নেই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত